Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর

    কাজী মায়মুর হোসেন এক পাতা গল্প222 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    নরকের শহর – ১৫

    পনেরো

    অফিসের রেজিস্ট্রি খাতা থেকে চোখ তুলে ছোটভাইকে দেখল এলিসা রসি। ‘তুমি আসলে কী করতে চাও, অ্যালডি?’

    ‘এসব পুড়িয়ে দেবে? ভাবছ, তাতে আর কোন প্রমাণ থাকবে না?’ বলল অ্যালডো রসি।

    ‘তুমি হলে কী করতে?’ ভাইয়ের দিকে তাকাল এলিসা।

    বোনের কথায় ইতস্তত করছে অ্যালডো।

    ছোটভাইয়ের সুদর্শন চেহারা ফ্যাকাসে হতে দেখে একটু নরম হলো এলিসা রসি। বাবার কথা মনে পড়ল তার। প্রায় বাবার মতই দেখতে হয়েছে অ্যালডি। অবশ্য ওদের বাবার মত করে দলে শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি সে। অ্যাড্রিয়ানোর মত হিংস্র আর আক্রমণাত্মকও নয়। আর সেজন্যেই প্রতিটি পদে ওকে আগলে রাখতে হয় এলিসার।

    ‘তুমি ভাবছ এ-বাড়িতে পুলিশ রেইড করবে?’ জানতে চাইল অ্যালডি।

    ‘ঝুঁকি নেব কেন?’ সোজাসাপ্টা জবাব দিল এলিসা। ‘পুলিশের কথা ভাবছি না। আমাদের আসল শত্রু হচ্ছে সেই হারামজাদা মাসুদ রানা।’

    ‘মাসুদ রানা?’ হাসল অ্যালডো। ‘তার কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলছে শিকাগোর সবাই!’

    ছোটভাইকে একবার গরম চোখে দেখে নিয়ে বলল এলিসা রসি, ‘কখনও কখনও মনে হয় কোথায় আছে তোমার মগজ-মাথায়, নাকি পোঁদের ভেতরে! আগেই তো বলেছি আজ সন্ধ্যার পর এখানে রেইড দিয়েছে সে। আর তখন তুমি বাড়িতে থাকলে খুন হতে লোকটার হাতে।’

    বড়বোনের ধমকে মেঝেতে চোখ নামাল অ্যালডো রসি। নিচু স্বরে বলল, ‘আমি দুঃখিত। আমার উচিত ছিল বাড়ির সিকিউরিটি দশগুণ বাড়িয়ে দেয়া।’

    ‘এরপর কী ঘটেছে ইয়ট ক্লাবে?’ বলল এলিসা। ‘ওখানেও হামলা করেছিল মাসুদ রানা, তা-ই না?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘এ-বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পর ওখানে যায় সে। কিন্তু সেটা করল কেন? কারণ তুমি নিজেই এখানে সূত্র রেখে গেছ। যদিও ইয়টে তোমাকে খুঁজে পায়নি সে।’

    ‘এলিসা, তুমি তো জানো আমি কোথায় ছিলাম।’

    মাথা দোলাল এলিসা। ‘তুমি মেরিনায় ফাঁদ পেতেছিলে। জানতে এ-বাড়ি থেকে তথ্য পেয়ে ওখানে যাবে সে। আর এ-ও জানতে, আমি আছি পিট ব্ল্যাকের সঙ্গে। অথচ সিকিউরিটি বাড়ানোর জন্যে কিছুই করোনি।’

    আবারও মেঝে দেখল অ্যালডো রসি। ‘আমি আসলে ভাল করেই জানতাম তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। বিপদ হলে হবে কুত্তার বাচ্চা মাসুদ রানার।’

    ‘পিট ব্ল্যাক মার খেয়ে ঘাবড়ে গেছে।

    বাঁকা হাসল অ্যালডো। ‘কুত্তাটার মার খাওয়া জরুরি ছিল। মাসুদ রানা না মারলেও আমি ওকে ধরে পেটাতাম।’

    ভাইয়ের কণ্ঠে ঈর্ষা আছে কি না বুঝতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড নিল এলিসা রসি। না, তেমন কিছু নেই। নরম সুরে বলল, ‘দেখো, অ্যালডি, আমরা নানাধরনের ঝামেলায় পড়ে গেছি। এখন যদি সতর্ক না হই, আমাদের দলের ওপরে কুঠারের কোপ নামাবে মাসুদ রানা।’

    ‘আর সেজন্যেই তো উধাও করে দিচ্ছ সব প্রমাণ। অবশ্য কথা হচ্ছে… আজ রাতের শিপমেন্টের কী হবে?’

    ‘নিয়ম অনুযায়ী ঠিক সময়ে মাল পাচার হবে,’ সহজ সুরে বলল এলিসা। ‘এরই ভেতরে আমার সঙ্গে কথা বলেছে জন ওয়েস্টন। জায়গামত পৌঁছে গেছে শিপমেন্ট। যদিও আমার মনে হচ্ছে, আপাতত এ-ধরনের অপারেশন বন্ধ রাখা উচিত । অন্তত মাসুদ রানা এই শহর থেকে বিদায় না নেয়া পর্যন্ত।

    চুপ করে মাথা দোলাল অ্যালডো রসি। কী যেন ভাবছে। একটু পর বলল, ‘যা খুশি করতে শুরু করেছে লোকটা। তবে সময়মত তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। হেলথ সেন্টারে নিজের ভিযিটিং কার্ড রেখে গেছে। তাতে আমার ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। প্রথম সুযোগে আমার লোক খতম করে দেবে তাকে।’

    ‘আমি তার চোখে চোখ রেখে দেখেছি, অ্যালডি,’ বলল এলিসা রসি। ‘বুঝতে দেরি হয়নি যে আমাদেরকে লড়তে হবে হিমালয়ের মত বড় কিছুর বিরুদ্ধে। মাসুদ রানার ব্যাপারে আরও খোঁজ নিয়েছি-তার সঙ্গে যারা লড়তে গেছে, কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তোমার উচিত হবে না তার মুখোমুখি হওয়া।’

    ‘আমার লোক তাকে দুনিয়াছাড়া করবে,’ রাগের ছাপ পড়ল অ্যালডোর মুখে। ‘তুমি আমাকে কী মনে করো, এলিস? আমি কি রাস্তার মস্তানের মত তার সঙ্গে গোলাগুলি করব?’

    ‘না, তা তুমি করবে না। কথাগুলো বলেছি, যাতে তুমি সতর্ক হও।’

    ডেস্কের ওপরে ধুম করে ঘুষি মারল মাফিয়া ডন। ‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ? আমি কি কিছুই করব না?’

    ছোটভাইয়ের দিকে চেয়ে হাসল এলিসা। অ্যালডির মতই একই প্রশ্ন করেছে সিনেটর পিটার। হোটেলে নাকি তাকে কোণঠাসা করেছিল মাসুদ রানা। পরে ফোন এল জন ওয়েস্টনের কাছ থেকে। চিন্তিত কণ্ঠে লোকটা জানাল, এবার দেরি না করে শেষ করতে হবে রাশ স্ট্রিটের কাজটা।

    সবাই এখন চেয়ে আছে এলিসার মুখের দিকে।

    ক্যান্সার আক্রান্ত অ্যাড্রিয়ানোর মুখের দিকে এভাবেই চেয়ে থাকত দলের সদস্যরা। গুরুতর রোগ নিয়েও অন্যান্য মাফিয়া দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত অ্যাড্রিয়ানো রসি। ভয় লাগিয়ে দিত সবার বুকে। অবশ্য বুঝে গিয়েছিল যে আর বেশি দিন নেই সে। বেশিরভাগ সময় পাগলের মত চেঁচাত তীব্র ব্যথায়। তারই ফাঁকে মেয়েকে শেখাত, কীভাবে আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মাফিয়া সদস্যদেরকে। আর সে- সময়ে সাইনবোর্ড হিসেবে অ্যালডোকে ব্যবহার করবে এলিসা।

    কীভাবে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, সেটা বাবার কাছ থেকে শিখে নিয়েছে সে। এরপরের ইতিহাস শুধু উন্নতির সোপানে ওঠার। এমনকী সিনেট থেকে তদন্ত করার সময়েও অন্যান্য মাফিয়া দলের হাত থেকে ওরা কেড়ে নিয়েছে লাভজনক সব ব্যবসা।

    গতকাল পর্যন্ত তাদের প্রতিটি ব্যবসা ছিল এলিসার নিয়ন্ত্রণের ভেতরে। কিন্তু তারপর আজ সন্ধ্যায় হেলথ সেন্টারে হামলা করল মাসুদ রানা। নিজের বেডরুমে একটা প্যাডে ইয়ট ক্লাবের ঠিকানা লিখে রেখে তার সঙ্গে টক্কর দিতে চাইল বোকা অ্যালডি। এ-কাজে বড়বোনের অনুমতি নেয়নি সে। ক্রমেই হয়ে উঠছে বিদ্রোহী। ভাবছে নিজেই চালাতে পারবে পারিবারিক বিশাল সাম্রাজ্য। অথচ সত্যি কথা হচ্ছে, মাত্র কয়েক দিন অ্যালডির হাতে সব ছেড়ে দিলে, হেগেমুতে সব মাখিয়ে নেবে সে। অবশ্য সেটা হতে দেবে না এলিসা।

    অন্তর থেকে বড়বোনকে ভালবাসে অ্যালডি। শ্রদ্ধা করে। এলিসা নরম সুরে বুঝিয়ে বললে, তার সময় লাগে না যুক্তি বুঝে নিতে। ‘ঠিক আছে, তো এবার শোনো আমরা কী করব,’ ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল এলিসা রসি।

    তার চোখে চেয়ে রইল অ্যালডো। সে যে আপত্তি তুলবে, বুঝে গেছে এলিসা। দু’পা সামনে বেড়ে দু’হাত রাখল অ্যালডির দু’কাঁধে। সরাসরি তাকাল ভাইয়ের চোখে। ‘আগের প্ল্যান অনুযায়ী রওনা হবে আজকের শিপমেন্ট। তবে এরপর আমরা নষ্ট করব প্রতিটা প্রমাণ। ডুব দেব কিছু দিনের জন্যে।’

    ‘কিন্তু…’

    ডানহাতের তর্জনী আলতো করে ভাইয়ের ঠোঁটে রাখল এলিসা। মাথা নেড়ে বলল, ‘আপত্তি কোরো না। আমি জানি কাজটা লাভজনক। তবে আপাতত আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রমাণ ধ্বংস করে দিতে হবে। পরে অন্যান্য ব্যবসা থেকে এরচেয়ে ঢের বেশি মুনাফা তুলে নেব। আগে শিকাগো থেকে বিদায় হোক মাসুদ রানা। একটু আগেই তো তোমাকে বলেছি, কিছু দিনের জন্যে আড়ালে চলে যাচ্ছি আমরা।’

    ‘কী ধরনের প্রমাণ আমরা নষ্ট করব?’

    ‘যেমন ধরো, বাচ্চাদের অপহরণ করতে যাদের ব্যবহার করি, তাদের কাউকে কাউকে বিদায় করব দুনিয়া থেকে।’

    ‘যেমন জন ওয়েস্টন?’

    ‘ব্ল্যাকের কথাও ভুলো না,’ দ্বিধাহীনভাবে বলল এলিসা। কী করবে আগেই ভেবেছে। মাসুদ রানার সামনে কাপুরুষের মত ভেঙে পড়ার পর কোনভাবেই রেহাই দেয়া যাবে না নীল ছবির পরিচালককে।

    ‘আর রানার কী হবে?’ জানতে চাইল অ্যালডো রসি।

    ‘তার খোঁজে শিকাগোয় চিরুনি চালাবে পুলিশের লোক আর আমাদের ছেলেরা। তাকে পেলে সঙ্গে সঙ্গে খুন করবে। এদিকে আমাদের দু’জনকে পাহারা দেবে দলের ত্রিশজন গানম্যান। মাসুদ রানা জানে না, কোথা থেকে রওনা হবে বাচ্চাদের শিপমেন্ট। আজ রাতে একটু পর ওখানে যাব আমরা।’ ছোটভাইয়ের গালে হাত বোলাল এলিসা। ‘ভয় নেই, অ্যালডি। ওই লোক টোকাও দিতে পারবে না তোমার গায়ে।’

    আশা করি সব বুঝেশুনে কাজে নেমেছ।’

    এক পা বেড়ে ভাইয়ের মাথা নিজের কাঁধে নিল এলিসা। হাত বুলিয়ে দিল তার মাথা-ঘাড়ে। ভাল করেই জানে, এবার ওর সব কথা শুনবে ভাই। আধঘণ্টা আগে ফোন করে তাকে বাড়িতে ফিরতে বলেছে সে। তারপর তার নাম ভাঙিয়ে খুনিদের নির্দেশ দিয়েছে, অপ্রয়োজনীয় লোকগুলো যেন বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।

    ষোলো

    শিকাগোর দক্ষিণে মধ্যবিত্তদের এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দ্য ফাদার’স অর্ফানেজ। প্রায় বিনা পয়সায় সরকারের কাছ থেকে লিয নেয়া হয়েছে গোটা একটা ব্লক। কম্পাউণ্ডের সামনে দীর্ঘ ‘এল’ শেপের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং। পেছনে চারটে ডরমিটরি। এ-ছাড়া পেছনে আছে জিমনেশিয়াম আর শিশুদের খেলার মাঠ।

    এতিমখানার সাংগঠনিক দালানের উল্টোদিকে চওড়া রাস্তা। সেখানে লিউনার গাড়িটা রেখে চারপাশ দেখে নিল রানা। ওর মনে হলো না রাতের এ-সময়ে জেগে আছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা।

    একতলা দালান ছাড়া অন্য কোথাও বাতি নেই। সামনের রিসেপশনের দুটো জানালা দিয়ে আসছে বৈদ্যুতিক আলো। পাহারা দেয়ার জন্যে ওখানে বোধহয় জেগে আছে এক বা একাধিক গার্ড। এ-ছাড়া দালানের অন্যদিকের এক জানালা ভেদ করে ঘাসে এসে পড়েছে সাদা নিয়ন বাতির আলো।

    রানার পাশের সিটে বসে সরাসরি নিয়ন বাতির জানালার দিকে চেয়ে আছে লিউনা। নিচু গলায় বলল, ‘বেশিরভাগ সময় অনেক রাত পর্যন্ত জাগে ওয়েস্টন। ওটাই তার অফিস।’

    ‘তা হলে হয়তো আমাদের কপাল ভাল,’ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। ‘তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমার ফিরতে বেশিক্ষণ লাগবে না।’

    স্কার্টের পকেট থেকে কী যেন নিয়ে রানার নাকের কাছে ধরল লিউনা। ‘এই যে চাবি। অন্য এক দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। আমার মনে হয় না নিজের এলাকায় বেআইনি কিছু করবে ওয়েস্টন। যত বড় অপরাধী হোক, সে চাইবে না এতিমখানা চালাবার আইনি বৈধতা হারিয়ে ফেলতে।’

    মনে মনে কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল রানা।

    লিউনা বুদ্ধিমতী। নিজের কাজে নিবেদিতা

    ‘তুমি ঠিকই বলেছ,’ বলল রানা। ‘বেশ, এবারের মত আমার সঙ্গে এসো। তবে, প্লিয, খুব সতর্ক থাকবে।’

    ‘প্লিয’ কথাটা শুনে আস্তে করে রানার হাত ধরল লিউনা। দু’জনের কেউ স্বীকার করবে না, তবে এই স্পর্শের কারণে বিদ্যুতের মত এক তরঙ্গ যেন বয়ে গেছে ওদের দেহে।

    ‘তুমিও সাবধানে থেকো, রানা,’ ফিসফিস করল লিউনা। ‘অসহায় শিশুরা জানে না, তবে তোমাকে ওদের খুব দরকার। আমারও প্রয়োজন তোমাকে।’

    আস্তে করে হাত সরিয়ে নিল লিউনা। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। বেশিক্ষণ লাগল না ছায়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে দালানের দূরের এক দরজার সামনে গিয়ে থামতে আলোকিত রিসেপশনের দরজার উল্টোদিকে এই দরজা।

    হোলস্টার থেকে বেরেটা বের করেছে রানা। সতর্ক চোখে দেখল চারপাশে। কোথাও কোনকিছু নড়ছে না। ওর মনে হলো না কোন গার্ড হঠাৎ করে এসে হামলে পড়বে ওদের ওপরে। নিজের কাছে রয়ে যাওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুলল লিউনা। চট্ করে উঁকি দিল করিডরে। আশপাশে কোন গার্ড নেই। হাতের ইশারা করল রানাকে। ফিসফিস করে বলল, ‘এদিকে কেউ নেই।’

    মেয়েটার পিছু নিয়ে দালানে ঢুকল রানা। কোন আওয়াজ না করে আটকে দিল দরজা। এই করিডর সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে দালানের সামনে রিসেপশন রুমের কাছে। করিডরের দু’দিকে একের পর এক কবাট বন্ধ দরজা।

    করিডর ধরে এগোল রানা ও লিউনা। রিসেপশন রুম থেকে করিডরের মেঝেতে এসে পড়েছে আলো। বোধহয় জেগে আছে নাইট গার্ড। মৃদু শব্দে মিউযিক শুনছে কেউ।

    করিডরের শেষমাথায় পৌঁছে বামে বাঁক নিল রানা ও লিউনা। নতুন এই করিডরের মাঝে চওড়া এক দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে এল সাদা আলোর রেখা। নিঃশব্দে ওদিকে আঙুল তুলে দেখাল লিউনা। ওটাই ওয়েস্টনের অফিস।

    দরজার সামনে গিয়ে থামল রানা। দেহের পাশে ঝুলিয়ে রেখেছে বেরেটা। বামহাতে আস্তে করে মোচড় দিল দরজার গোল নব-এ। ওটা লক করা নয়। নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে অফিসে ঢুকল রানা। পেছনেই লিউনা।

    অলাভজনক দাতব্য সংগঠনে যা হয়, অফিসে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। ধাতব ভারী ডেস্ক, খটখটে কয়েকটা চেয়ার আর স্টিলের দুটো কেবিনেট। ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসে ব্রিফকেসে কয়েকটা ফাইল ভরছে জন ওয়েস্টন। মুখ তুলে সরাসরি তাকাল রানা ও লিউনার দিকে। পিস্তল হাতে অচেনা যুবককে দেখে বিস্ফারিত হলো তার দু’চোখ। এরই ভেতরে চিনে গেছে লিউনাকে।

    ‘এসবের মানে কী?’ রাগী গলায় বলল সে। ‘মিস গার্ডনার, তুমি কিন্তু এরই ভেতরে অনেক ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ। দয়াবশত তোমাকে তুলে দিইনি পুলিশের হাতে।’ এবার রানাকে চিনল সে। এতই চমকে গেছে যে ফ্যাকাসে হলো তার চেহারা।

    ‘তুমি ভাল করেই জানো আমি কে,’ নিচু গলায় বলল রানা।

    ওর পাশ থেকে বলল লিউনা, ‘মাসুদ রানাকে দেখলে যে-কেউ দ্বিতীয়বার মনে রাখবে, তা-ই না, মিস্টার ওয়েস্টন? এই ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?’

    নার্ভাস হয়ে ঢোক গিলল লোকটা। ‘জানি না তুমি আসলে কী বলছ। কখনও দেখিনি এই লোককে। তবে তোমরা এখান থেকে বিদায় না হলে পুলিশ ডাকব। তারা এসে গ্রেফতার করবে তোমাদেরকে।’

    ‘বাজে কথা বাদ দাও, ওয়েস্টন,’ বলল রানা। ‘আমরা জানি, ডে-কেয়ার সেন্টার আর এতিমখানা থেকে শিশুদের চুরি করো তুমি। ওদেরকে তুলে দাও রসিদের হাতে। তারা তৈরি করে শিশু পর্নোগ্রাফি। লাখ লাখ ডলারে ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি হয় অসহায় শিশুরা। এ-ছাড়া আরও কী করো, সেটা এবার খুলে বলবে তুমি।’

    একবার রানা আরেকবার লিউনাকে দেখছে ওয়েস্টন। বারকয়েক ঢোক গিলল। কথা বলতে বড় করে হাঁ মেলল। তার বিকৃত চেহারা দেখে রানা বুঝে গেল, খুব ভয় পেয়েছে লোকটা। অবশ্য ওয়েস্টন কিছু বলার আগেই করিডরে ওরা শুনতে পেল পায়ের আওয়াজ। ঝট করে ঘুরে তাকাল রানা। চমকে উঠে ডেস্কের আরেক দিকে সরে গেছে লিউনা

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ওয়েস্টন। একহাতে তার কাঁধ ধরে ডেস্কের পেছনের চেয়ারে তাকে ঠেলে ফেলল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘একদম নড়বে না!’ ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকাল ও। ওভারকোটের পকেটে ঢুকে গেছে বেরেটা। ‘এটা মাথায় রেখো, তুমি খুন হলেও আমার কিছুই যায় আসে না।’

    পদশব্দের মালিক হয়তো ঢুকবে না অফিসে। এদিকটা ঘুরে দেখে যাচ্ছে গার্ড। যদিও রানার মন বলছে, সামনে বড় ধরনের বিপদ!

    ডেস্কের একদিকে ও, অন্যদিকে লিউনা। চেয়ারে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে ওয়েস্টন। হঠাৎ করে অফিসের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে এসে পড়ল ছোট একটা জিনিস। করিডর থেকে দীর্ঘ দুটো হাত এসে টেনে আটকে দিল দরজা। লোকটার ছুটন্ত পদশব্দ করিডরে তৈরি করল প্রতিধ্বনি।

    ডেস্কের ওপরে এসে পড়েছে মাঝারি আকারের কামরাঙ্গার মত আকৃতির গ্রেনেড। আরেক ড্রপ দিয়ে চলে গেল ঘরের কোণে। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আবার ফিরল দরজার দিকে।

    রানা বুঝে গেছে ওটা ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড!

    ওটা কী সেটা বুঝে গেছে ওয়েস্টন। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দরজা লক্ষ্য করে ছুট দিল সে। এদিকে ডানহাত বাড়িয়ে খপ করে লিউনার জ্যাকেটের কলার ধরল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে ওকে নিয়ে এল ডেস্কের এপাশে। মেঝেতে ফেলে দিয়ে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে দিল লিউনাকে।

    পরের সেকেণ্ডে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড।

    প্রচণ্ড শকওয়েভে চমকে গেল রানা। খটাখট শব্দে ডেস্কে এসে লাগল অজস্র শ্যাপনেল। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা তুলে এদিকে-ওদিকে তাকাল ও। ঝনঝন করছে ওর দু’কান। ভারী লোহার ডেস্কের দিকে চেয়ে বুঝে গেল, স্রেফ কপালের জোরে আজ বেঁচে গেছে ওরা। মৃত্যুবাহী শ্যাপনেল ভেদ করেনি ডেস্কের পুরু লোহার পাত। রানার ওজন গা থেকে সরাতে চাইছে লিউনা। ঘরে ভাসমান প্লাস্টারের মিহি ধুলোয় কাশতে শুরু করেছে মেয়েটা।

    উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের কিনারা একহাতে ধরল রানা। মুচড়ে ভেতরের দিকে চলে গেছে লোহার টেবিলের সামনের দিক। কেউ বুঝবে না ওটা একসময়ে ছিল কোন ডেস্ক। কপাল ভাল, মেঝের সঙ্গে বল্টু দিয়ে আটকানো ছিল, নইলে উল্টে পড়ে চ্যাপ্টা করে দিত ওদেরকে।

    কপাল মন্দ ওয়েস্টনের। চার হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে দরজার কাছে। অসংখ্য শ্যাপনেলের আঘাতে কিমা হয়ে গেছে তার দেহ। যে-কারও বুঝতে কষ্ট হবে, মাংস-চর্বি-রক্ত আর হাড়ের স্তূপটা একসময় একজন মানুষ ছিল।

    প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজের পর চারপাশে নেমে এসেছে থমথমে নীরবতা। সেটা ভেঙে গেল শিশুদের হৈ- চৈয়ে।

    হড়হড় করে বমির আওয়াজ পেল রানা।

    উঠে দাঁড়িয়ে ওয়েস্টনের বীভৎস বিকৃত দেহের ওপরে চোখ পড়েছে লিউনার। এখন আবর্জনা ভরা রক্তাক্ত মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছে বমি করে। হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ ধরল রানা। আশা করছে কেটে যাবে বেচারির শক। জরুরি সুরে বলল ও, ‘লিউনা, ডন রসির মৃত্যু-তালিকায় ছিল ওয়েস্টন। এবার এসো, দেরি না করে এখান থেকে চলে যেতে হবে!’

    ধীরে ধীরে মাথা দোলাল লিউনা। ওয়েস্টনের লাশ থেকে চোখ তুলে তাকাল রানার দিকে। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। কাঁধ থেকে রানার হাত সরিয়ে দিয়ে ছুট দিল দরজার দিকে। ‘বাচ্চারা! ওদেরকে বাঁচাতে হবে!’

    এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল লিউনা।

    ঘরে বিস্ফোরিত হয়েছে শক্তিশালী বোমা। মেঝেতে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। লিউনা যে শকের ভেতরে আছে, সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। আগেও বহু মানুষের ভেতরে এমন প্রতিক্রিয়া দেখেছে রানা।

    ঘরে কয়েক সেকেণ্ড চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিউনার খোঁজে করিডরে বেরোল ও। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর ডানকানের পাশ দিয়ে গেল একটা বুলেট। বেরেটা হাতে থমকে দাঁড়াল রানা। করিডরের শেষমাথায় পিস্তল হাতে এক লোক। এক পা সামনে বাড়ল সে। একই সময়ে তাকে লক্ষ্য করে পর পর দু’বার গুলি পাঠাল রানা।

    সরাসরি লোকটার বুকে বিঁধেছে বেরেটার দুই বুলেট। কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকাল আততায়ী। পরক্ষণে পিছলে মেঝেতে নেমে এল তার লাশ।

    চারপাশে তাকাল রানা।

    কোথাও নেই লিউনা!

    বোমা বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দে ভীষণ ভয় পেয়েছে শিশুরা। হৈ-চৈ করছে রিসেপশন রুমে। বড়দের কারও কথায় ওখানে জড় হয়েছে ওরা। দালানের বাইরে অটোমেটিক অস্ত্রের গুলির আওয়াজ। রিসেপশনে না ঢুকে একছুটে পাশের সেই দরজার কাছে চলে এল রানা। কবাট খুলে বেরোল রাতের আঁধারে। মাত্র কয়েক ফুট দূরে দেখতে পেল এক লোককে। এতিমখানার সরু রাস্তার ধারে পড়ে আছে সে। ছটফট করছে তীব্র ব্যথায়। একবার চারপাশ দেখে নিয়ে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা। জরুরি সুরে বলল, ‘গুলি কোথায় লেগেছে?’

    লোকটার গলায় স্টেথোস্কোপ। পরনে সাদা অ্যাপ্রন। রানা বুঝে গেল, ইনিই এতিমখানার নিয়মিত ডাক্তার।

    কালো ওভারকোট পরনে কঠোর চেহারার যুবককে দেখে ঘাবড়ে গেছে সে। যুবকের হাতে আবার পিস্তল!

    ‘মাফ করুন… বাচ্চাদের কোন ক্ষতি করবেন না! ওদের তো কোন দোষ নেই!’ কাতর সুরে অনুরোধ করল ডাক্তার।

    ‘আমি ওদের ক্ষতি করতে আসিনি,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘আপনার কোথায় গুলি লেগেছে?’

    দাঁতে দাঁত চেপে বামপা দেখাল ডাক্তার। তার ঊরু বেয়ে দরদর করে ঝরছে রক্ত। ‘খুব ব্যথা! বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে বেরোতেই গুলি করল একজন। হাতে ছিল সাবমেশিন গান।’ আস্তে করে রানার বাহু ধরল সে। ‘আপনি কি তাদেরকে ঠেকাতে এসেছেন?’

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘তো, স্যর, দেরি করবেন না! আমার কথা ভাববেন না! ওরা কয়েকটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গেছে!’

    তার কথায় উপলব্ধি করল রানা, ওয়েস্টনের এতিমখানা বা ডে-কেয়ার সেন্টারের বেশিরভাগ কর্মচারী নিরপরাধ। লিউনার কথা মনে পড়ল ওর। একটু পর হাজির হবে পুলিশ, তার আগেই ওকে নিয়ে সরে যেতে হবে।

    মাত্র কয়েক মিনিট আগে এতিমখানা থেকে শিশুদের চুরি করেছে একদল বদমাশ। নিশ্চয়ই এরই ভেতরে বেশি দূরে যেতে পারেনি। ডাক্তারকে বলল ও, ‘ঠিক আছে, একটু পর সাহায্য পৌঁছুবে। আমি দেখছি কিডন্যাপারদের ধরতে পারি কি না।’ উঠে দালানের সামনের দিকে চলল রানা। ভাবছে, যে-কোন সময় দেখবে এতিমখানার কোন কর্মকর্তার লাশ।

    রাস্তার দিক থেকে কোন গুলি এল না। দালানের কোনা ঘুরে রিসেপশনের কাছে ফিরল রানা। ঘরের ভেতরে আছে এতিমখানার আয়ারা ও কেয়ারটেকার। শিশুদের আগলে রেখেছে তারা। অবশ্য কৌতূহলী হয়ে রিসেপশনের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সোনালি চুলের পিচ্চি এক মেয়ে। বয়স বড়জোর পাঁচ বছর। পরনে গেঞ্জি ও পায়জামা। হাতে তুবড়ে যাওয়া পুতুল। রিসেপশনে বড়দের কেউ খেয়াল করেনি অন্যদের সঙ্গে নেই পিচ্চি। রাস্তার দিকে চেয়ে আছে ও।

    রানা গিয়ে সামনে থামলেই চকচকে চোখে ওকে দেখল মেয়েটা। নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘আঙ্কেল, তুমি কি মিস লিউনার সঙ্গে এসেছ?’

    হাঁটু গেড়ে পিচ্চির মুখোমুখি হলো রানা। ‘তুমি কি মিস লিউনাকে দেখেছ?’

    ঘন ঘন মাথা দোলাল পিচ্চি। ‘আণ্টি যতবার এসেছেন, সবসময় আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন। কিন্তু আজকে রাতে আর খেললেন না। তাঁকে তো খেলতেই দিল না ওরা!’ বড় করে শ্বাস নিল রানা। ‘ওরা আন্টিকে কোথায় নিল?’

    ‘দূরে কোথাও। ওরা ভাল না।’ রাস্তার দিকে তাকাল পিচ্চি। ‘আণ্টি ফিরলে খেলতে পারতাম। আন্টিকে আমার খুব ভাল লাগে। তুমিও কি খারাপ লোকগুলোর একজন?’

    মাথা নাড়ল রানা। ‘না তো, আমি বোধহয় অতটা খারাপ নই। তুমি আবার আমাকে ভয় পেয়ো না।’ পিচ্চির বাহু নরম হাতে ধরে রিসেপশন রুমের দরজার দিকে চলল রানা কবাটের সামনে থেমে বলল, ‘তুমি এখন ভেতরে চলে যাও। আজকে আর বেরিয়ো না।’

    ‘ঠিক আছে, আঙ্কেল।’ মাথা দুলিয়ে রাজি হলো পিচ্চি।

    ঘুরে লন মাড়িয়ে লিউনার করোলার দিকে ছুটল রানা। গাড়িতে উঠে দেখল এখনও রিসেপশন থেকে বেরোয়নি কেউ। আবছাভাবে শুনল শিশুদের কণ্ঠস্বর। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে ওয়েস্টনের অফিসের ভাঙা জানালা দিয়ে ভকভক করে বেরোচ্ছে সাদা মিহি ধুলো।

    তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ভাবল, এমন কোন সূত্র নেই যে বুঝব অপহৃত শিশু বা লিউনাকে কোথায় নিয়ে গেছে মাফিয়ার গুণ্ডারা।

    পিচ্চি যেদিকে চেয়ে ছিল, সেদিকে তাকাল রানা। কী গাড়িতে করে এসেছে কিডন্যাপাররা, জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিত, রসি পরিবারের হাতে বন্দি হয়েছে লিউনা। ওয়েস্টন খুন হওয়ার পেছনে আছে অ্যালডো রসি বা তার বড়বোন এলিসা রসি। নিজেদের সব অপরাধ আড়াল করতে গিয়ে সব ধরনের সূত্র নষ্ট করছে তারা, যাতে তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে রানা।

    আরও অনেক জটিল হয়ে গেছে পরিস্থিতি।

    অপহৃত শিশুদের লুকিয়ে রাখবে রসিরা, তারপর আজ রাতেই হয়তো পাচার করে দেবে। খুন হওয়ায় ওয়েস্টনকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। রয়ে গেল রসি পরিবার আর তাদের গুণ্ডারা। আরও আছে সিনেটর পিটার আর নীল ছবির পরিচালক ব্ল্যাক। হয়তো সার্জেন্ট এবার্টনের সঙ্গে আবার দেখা হবে ওর। এদিকে যেভাবে হোক খুঁজে নিতে হবে লিউনাকে।

    এতিমখানা পেছনে ফেলে ঝোড়ো বেগে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে পরের কাজগুলো।

    সতেরো

    ম্যাসেজ পার্লারের চারতলায় নিজের অফিসে বসে আছে রুবা। শুকিয়ে গেছে গলা। ধড়ফড় করছে বুক। বুঝে গেল যে কয়েক ঢোক উইস্কি এখন না নিলেই নয়।

    সন্ধ্যার পর এখানে হামলা করেছে মাসুদ রানা। সে চলে যাওয়ার পর ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে কার্পেট থেকে তোলা হয়েছে ভাঙা কাঁচ। নিচতলা আর ওপরে রক্ত মুছিয়ে ভালভাবে চারপাশ পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছে রুবা।

    এখন ফোলা থুতনি ও চোয়ালের টনটনে ব্যথায় ওর মনে হচ্ছে, আলগোছে মরে গেলেই বুঝি ভাল ছিল! তোয়ালের ভাঁজে বরফের খণ্ড রেখে শীতল সেঁক দিতে দিতে ভাবল: খুব জোরে ঘুষি মেরেছে মাসুদ রানা। অমানুষটা আস্ত একটা চামার, নইলে কোন যুবতী মেয়ের গায়ে হাত তোলে কেউ!

    চেয়ার ছেড়ে র‍্যাকের কাছে গেল রুবা। ওখানে আছে গাজর, টমেটো আর আপেলের জুসের ক্যান। নিচের তাকে এক সারিতে মদের বোতল। মদ আসলে বিষ, ওসব খেলে শরীরের ক্ষতি হয়, তাই পারতপক্ষে ছুঁয়েও দেখে না রুবা। কিন্তু এখন ব্যথা কমাতে হলে ওটাই গিলতে হবে। তা ছাড়া, ওটা কাজে লাগবে পরাজয়ের গ্লানি সামাল দেয়ার জন্যে।

    যতবার চোখ বুজছে রুবা, দেখতে পাচ্ছে গুলি করে সিম্পসনের মগজ উড়িয়ে দিচ্ছে মাসুদ রানা!

    গ্লাসে টমেটোর জুস ঢেলে ওটার ভেতরে তিন পেগ উইস্কি মেশাল রুবা। ঢকঢক করে গিলল তরলটুকু। গলা পুড়িয়ে মদ নেমে যেতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল ওর বুক ও পেট। হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁট মুছতে গিয়ে দেখল, আবারও দরজায় এসে থেমেছে অলক্ষুণে সেই মাসুদ রানা!

    বিপদের মাত্রা বুঝে বুক কেঁপে গেল রুবার। ডেস্কের ড্রয়ারের ভেতরে একটা বাটন টিপে দিলে অ্যালার্ম বাজবে সিম্পসনের বার-এ। ওকে বাঁচাতে ছুটে আসবে দু’জন বারটেণ্ডার। অন্তত এতকাল তা-ই হয়েছে। কিন্তু আজকের পর বদলে গেছে সব।

    দরজায় ভীষণ গম্ভীর চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। চোখে শীতল দৃষ্টি। পিস্তল বের না করলেও ওভারকোটের পকেটের কাছে ঝুলছে হাত। যখন-তখন বের করবে অস্ত্র।

    এখন এমন কেউ নেই যে সাহায্য করবে রুবাকে। সিম্পসন খুন হওয়ায় বার বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশের লোক। ঘাড় ধরে বিদায় করেছে বারটেণ্ডারদেরকে।

    নিজেকে মনে মনে বলল রুবা: ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ কোরো না!

    ‘আবার কী চাও?’ কড়া গলায় বলল রুবা, ‘তোমার কারণে সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার!’

    ‘পিট ব্ল্যাক এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

    ব্যথা-ভরা চোয়াল ও থুতনি ডলল রুবা। ‘তুমি জাহান্নামে যাও!’

    ‘আমি ওকে বাঁচাতে এসেছি,’ বলল রানা।

    ‘হ্যাঁ। তুমিও বললে আর আমিও বিশ্বাস করলাম!’

    ‘জন ওয়েস্টন নামের কাউকে চিনতে?’

    দু’সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল রুবা। ‘তার কথা আগে শুনলেই বা কী? তুমি এখান থেকে বিদায় হও! যে জাহান্নাম থেকে এসেছ, সেখানে ফেরত যাও!’

    ‘যেখান থেকে এসেছি, এখন আর সেখানে যেতে পারব না,’ বলল রানা। ‘রুবা, ওয়েস্টন কিন্তু আমার হাতে খুন হয়নি। কাজটা করেছে অন্য কেউ।’

    আরও তিক্ত হলো রুবার মন। ‘বিদায় হও আমার অফিস থেকে! দেখো, ব্ল্যাক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না! শুধু এটা বলতে পারি, সে এখানে নেই। কোথায় যাবে সেটাও জানতে চাইনি। গায়ে পড়ে কিছু জানতে চাওয়া আমার অভ্যেস নয়।

    ‘কতক্ষণ আগে সে চলে গেছে?’

    ‘বেশিক্ষণ হবে না।’

    ‘মিথ্যা বললে, রুবা।’ মাথা নাড়ল রানা। ‘বিপদ হলেই সবসময় সিম্পসন আর তোমার কাছে আসে। এখন তুমি ছাড়া আর কারও কাছে গিয়ে লুকাতে পারবে না। ওকে খুন করার জন্যে খুঁজছে রসির লোকেরা।’

    ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জহুরীর চোখে দেখছে রানা।

    মনে আতঙ্ক নিয়ে নিজেকে বলল রুবা: এ বোধহয় সবই জানে!

    ‘রসিরা কেন ওকে খুন করাবে?’ জানতে চাইল রুবা। ‘রসিরা যখন জানবে যে ব্ল্যাককে লুকিয়ে রেখেছ, তখন দেরি করবে না তোমাকে খুন করতে, বলল গম্ভীর রানা। ‘আবর্জনা পরিষ্কার করছে ওরা। একঘণ্টা আগে খুন হয়েছে ওয়েস্টন। তাদের পরের টার্গেট পিট ব্ল্যাক।

    পর্দা দেয়া এক ক্লসিট থেকে বেরিয়ে ধুপধাপ আওয়াজে ঘরের আরেক দরজার দিকে ছুটল এক লোক। এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল ক্লসিটের পর্দার ওদিকে।

    ঘরে ঢুকে রুবাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের গতি তুলল রানা। ব্ল্যাক ওদিকের দরজার কাছে যাওয়ার আগেই চেপে ধরল তার দু’কাঁধ। একটানে ঘুরিয়ে নিল তাকে। পরক্ষণে কনুইয়ের ভাঁজে আটকে ফেলল নীল ছবির পরিচালকের ঘাড়। ‘যাও কই, ডিরেক্টর সাহেব?’

    দু’হাতে কিল মেরে রানার হাত ছোটাতে চাইল ব্ল্যাক। জবাবে তার ঘাড়ে চাপ বাড়াল রানা। যে ধমনি মগজে পৌঁছে দেয় রক্ত ও অক্সিজেন, আটকে দিয়েছে ওটা। ফলে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে নেতিয়ে পড়ল ব্ল্যাক।

    ‘এই তো, লক্ষ্মী ছেলে,’ তার কানের কাছে বলল রানা। ‘সহজ হয়ে দাঁড়াও। আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাই না।’ ঘাড়ের চাপ কমাল ও। চাইলে এখন কথা বলতে পারবে ব্লু ফিল্মের ডিরেক্টর। রুবার ওপরে এক চোখ রেখেছে রানা।

    তোয়ালে মোড়া বরফ থুতনি ও চোয়ালে ডলছে যুবতী। কৌতূহলী চোখে দেখছে ব্ল্যাক আর রানাকে।

    ঘাড়ের ব্যথা কমতেই বড় করে শ্বাস নিল ব্ল্যাক। ‘ক্- ক্… কী চান আপনি?’

    ঘাড় ছেড়ে এক পা পিছিয়ে গেল রানা। ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল ব্ল্যাক। ঘড়ঘড় আওয়াজে গলার ভেতরে ঢুকছে বাতাস।

    ‘তুমি এখানে ফিরলে কেন?’ জানতে চাইল রানা।

    ‘আপনি কি খুন করবেন আমাকে? আগেই বলেছি, আমার কোন দোষ নেই। বাচ্চাদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না!’

    ‘জানতে চাইছি এখানে এসেছিলে কেন?’

    ‘না ফিরে উপায় ছিল না। এখানে রেখে গেছি আমার সব টাকা আর বেশিরভাগ ফিল্মের মাস্টার কপি। মিস্টার রানা, আপনার বলা সব কথাই তো শুনেছি। কারা যেন খুন করেছে ওয়েস্টনকে। এবার খুন করবে আমাকে। তাই চাইছি পালিয়ে যেতে। আর কখনও এই শহরে ফিরব না।’

    ‘এ-শহরে রয়ে গেলে সত্যিই খুন হবে,’ বলল রানা। ‘চলে যেতে পার, তবে তার আগে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।’

    ‘বেশ,’ হতাশ সুরে বলল ব্ল্যাক। ‘দয়া করে বেশিক্ষণ আটকে রাখবেন না, নইলে কুকুরের মত গুলি করে আমাকে খুন করবে রসির খুনিরা। আমি মরতে চাই না। ওদের হাঁড়ির খবর না জানলেই বোধহয় ভাল ছিল।’

    ‘হাঁড়ির খবরটা আসলে কী?’

    তিক্ত হাসল ব্ল্যাক। ‘রসিদের মাফিয়া দলের মত আরও যে-ক’টা দল আছে, সবাই জড়িত কালোবাজার, পতিতালয়, জুয়া আর ড্রাগসের কারবারে। ভাল নয় কেউ। কিন্তু তারা আবার রসিদের মত অতটা খারাপ নয়।’ কথা শেষ করে ঢোক গিলল ব্ল্যাক।

    ‘তুমি বোধহয় বলতে চাইছ, শিশুদের কিডন্যাপ করা বা ওদেরকে পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহার করার মত চরম অপরাধ করে না অন্যরা,’ বলল রানা।

    বড় করে ঢোক গিলল ব্ল্যাক। কথা বলতে গিয়ে বিকৃত হলো চেহারা। ‘ঠিকই ধরেছেন। অ্যালডো রসি নিজে শিশু পর্নোগ্রাফিতে অভিনয় করে। ধরে এনে অন্যসব শহরে জোগান দেয় ওদেরকে। একবার রাতের মদের আসরে মাতাল হয়ে আমাকে সব বলে দিয়েছিল তার হিসাব-রক্ষক লেস্টার। তবে শপথ করে বলতে পারি, আমি কখনও অত নোংরামিতে নামিনি! এমনকী আমার সিনেমায় কোনদিন বাচ্চাদের কোন দৃশ্যও রাখিনি।’

    ‘শিশুদের কিডন্যাপ করার পর তাদেরকে কী করা হয়?’ জানতে চাইল রানা।

    ওর চোখ থেকে আগুন ঝরতে দেখে এক পা পেছাল ব্ল্যাক। আরও পেছাত, কিন্তু পেছনে বন্ধ দরজা। ‘আমি শুধু এটুকু জানি, প্রতিবছর চারবার শিকাগো থেকে ওদেরকে কিডন্যাপ করে রসিরা। এরপর কোথায় পাচার করে তা জানি না।’

    নরকের এই শহরে স্বর্গের দেবশিশুরা চরম লাঞ্ছিত, ভাবল রানা। ব্ল্যাকের কাছে জিজ্ঞেস করল, ‘আগে যখন দেখা হলো, সে-সময়ে এই কথা বলোনি কেন?’

    ‘কারণ… তখন এলিসা আর তার গুণ্ডাদেরকে আপনার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি,’ স্বীকার করল ব্ল্যাক।

    বাবার মাফিয়া দলের যোগ্য নেত্রী এলিসা, ভাবল রানা। শিশু অপহরণের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তার সঙ্গে আঁতাত আছে সিনেটর পিটারের। মহিলার নির্দেশেই বোধহয় খুন হয়েছে জন ওয়েস্টন।

    ‘পরের শিপমেন্ট কখন হবে বা কোথায় যাচ্ছে, তোমাকে কিছু বলেছে মিস রসি?’

    ‘এজন্যেই তো ওরা এত নার্ভাস,’ বলল ব্ল্যাক। রানাকে খুশি করতে চাইছে। ‘এখন ছেঁড়া সুতো গিঁঠ দিচ্ছে। আজ রাতেই অন্তত বিশটা বাচ্চা পাচার হবে।’

    ব্ল্যাক এমন কিছুই বলবে, ভেবেছিল রানা। কঠোর চোখে তাকে দেখল ও। ‘তা হলে আজ রাতে?’

    ‘এলিসা রসি সেটাই বলেছে।’

    অর্থাৎ আজই শিকাগো থেকে সরিয়ে নেবে অপহৃত শিশুদেরকে। নিশ্চয়ই গোপন কোথাও রাখা হয়েছে ওদেরকে। আর সেখানেই লিউনাকে রেখেছে অ্যালডো আর তার বড়বোন এলিসা

    যেহেতু কোটি টাকার শিপমেন্ট, কাজেই দু’ভাই-বোনের অন্তত একজন থাকবে তদারকিতে। শিশুদের রওনা করিয়ে দেয়ার আগে হয়তো লিউনাকে জেরা করবে সে। মাফিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ মানেই দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করা। তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করবে লিউনা, বারবার ভাববে মারা গেলে বেঁচে যেত। ভয়ঙ্কর কষ্ট দিয়ে তিলতিল করে ওকে খুন করবে দানবেরা।

    ঠিক কোথা থেকে রওনা হবে ওরা?’ জানতে চাইল রানা।

    ঘন ঘন মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘জানি না। তবে এটা বলতে পারি, কার কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন।

    ‘সে কে?’

    ‘আর কে, সিনেটর পিটার। সবই জানে সে।’ লোকটার ব্যাপারে কথা বলার সময় অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে ব্ল্যাকের গলায়। ‘চিরকাল ধরেই বিকৃত মনের মানুষ সে। এলিসা আমাকে বলেছে, ক’দিন পর পর তারা বাচ্চাদেরকে চালান দেয় সিনেটরের কাছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় সেসব শিশুর লাশ।’

    অর্থাৎ চরম অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে আছে সিনেটর! ‘সে আসলেই সত্যিকারের পিশাচ,’ বলল ব্ল্যাক। ভয়ে মৃদু কাঁপছে তার দেহ।

    মাথা দোলাল রানা। হিমশীতল গলায় ব্ল্যাককে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার এ-শহর ছেড়ে পালিয়ে যাও। আর সেটা করবে আমি মনোভাব পাল্টে নেয়ার আগেই।’

    ভয়-ভরা মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ল পিট ব্ল্যাকের। রানাকে দৌড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল করিডরে। পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতেই ঘুরে আগুনের মত লাল চুলের যুবতীর দিকে তাকাল রানা।

    রুবার পরনে এখনও সংক্ষিপ্ত পোশাক। হাতের তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরেছে ফোলা থুতনি আর চোয়াল। ‘আজ রাতে এখানে আর কোন বিপদ হবে না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতাম শিকাগো থেকে।’

    ‘আমিও একই কথা ভেবেছি,’ অন্তর থেকে বলল যুবতী।

    ‘যাওয়ার আগে ভুলেও কাউকে কিছু বলতে যেয়ো না।’

    ‘তা তো বটেই,’ মাথা দোলাল রুবা।

    পিছিয়ে গিয়ে অফিসের দরজা পেরিয়ে করিডরে এল রানা। ঘুরে দ্রুত পায়ে চলল সিঁড়ির দিকে।

    চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল রুবা। চেয়ে আছে খোলা দরজার দিকে। বড় করে শ্বাস ফেলে ঘুরে চলে গেল ডেস্কের পেছনে। ডানের ড্রয়ার খুলে হাতে নিল ভারী একটা বোতল। সোনার মত চকচকে ওটার ভেতরের তরল। গাজর বা টমেটো জুসের সঙ্গে উইস্কি খেয়ে মুখের ব্যথা যায়নি। বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে গিলল বারো বছর ম্যাচিউর করা শিভাস রিগাল। ভাবছে, বহু বছর ছিলাম এ-শহরে। এখন সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। এ-জীবনে হয়তো অন্য কোথাও এত আরামে থাকতে পারব না। তবে অন্তত বেঁচে তো থাকব!

    মন স্থির করার জন্যে চেয়ারে বসে থাকল রুবা।

    .

    একেকবারে তিনধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল রানা। দালানের সরু এক দরজা দিয়ে বেরোল পাশের গলিতে। রাস্তার কাছে যেতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে থরথর করে কাঁপল মাটি। বিকট আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই রাশ স্ট্রিটে বেরোল ও। রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর রাস্তায় গাড়ির জ্যাম নেই।

    সিম্পসনের বার আর রুবার ম্যাসেজ পার্লারের দু’বাড়ি দূরে ব্ল্যাকের জিপ দেখতে পেল রানা। ওটা দেখেই বুঝেছিল লোকটা আছে রুবার অফিস বা বেডরুমে। এখন দাউদাউ করে জ্বলছে জিপ। ওটা চেটে আকাশে উঠছে লাল আগুনের জিভ। জিপটাকে ঘিরে জড় হয়েছে কিছু মানুষ। প্রচণ্ড তাপ থেকে বাঁচতে মুখের সামনে রেখেছে দু’হাত। কারও সাধ্য নেই যে আর এক পা এগোবে।

    মুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভেতরে ড্রাইভিং সিটে ঝুঁকে বসে আছে পুড়ে যাওয়া পিট ব্ল্যাক।

    সত্যি ভীষণ কালো।

    কী ঘটে গেছে সেটা বুঝতে সময় লাগেনি রানার।

    ব্ল্যাক আবারও রুবার ম্যাসেজ পার্লারে ফিরতেই তার গাড়ির ইগনিশনের তারে বোমা রেখে গেছে রসিদের গুণ্ডারা। এতকাল যে কালসাপের মুখে দুধ-কলা জুগিয়ে দিয়েছে ব্ল্যাক, শেষমেশ ওটারই ছোবলে খতম হয়ে গেছে।

    আরেকবার পোড়া লাশটা দেখে নিয়ে লিউনার গাড়িটার দিকে চলল রানা।

    আঠারো

    বড় রাস্তায় আর নদীতে গোলাগুলি করে উধাও হয়েছে মাসুদ রানা, আনমনে ভাবছে সার্জেন্ট শ্যন সিমন্স। শুধু তা-ই নয়, গোটা শহর জুড়ে লাশের পর লাশ ফেলেছে লোকটা। অথচ তাকে যে ধরা যাবে, তেমনটাও মনে হচ্ছে না।

    মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে সিমন্সের গলা। মনে মনে নিজেকে বলল, আরও সতর্ক থাকতে হলে লাগবে আরও কয়েক কাপ কফি।

    অর্গানাইড্ ক্রাইম ইউনিটের স্কোয়াড রুমে সার্জেন্ট এবার্টনের ডেস্কের উল্টোদিকের ডেস্কে বসে আছে সে। একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে রওনা হলো কফি মেকারের দিকে। ডেস্ক থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে বাটন টিপছে এবার্টন। দূর থেকে তাকে দেখল সার্জেন্ট সিমন্স। ভাবল, একই ফোন-নাম্বারে কল দিচ্ছে? কী যেন কুরে কুরে খাচ্ছে ওর পার্টনারের মন!

    কিন্তু বিষয়টা আসলে কী?

    সারারাত ফোনে কথা বললেও জানার উপায় নেই কার সঙ্গে আলাপ করছে এবার্টন, যদি না সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় তাকে। গত কয়েক বছরে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে বাঁধন তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যক্তিগত বিষয়েও তো জিজ্ঞেস করতে পারে সিমন্স!

    কিছুক্ষণ আগে জন ওয়েস্টনের একটি এতিমখানা থেকে হেডকোয়ার্টারে ফিরেছে ওরা। ওখানে ছিল ভীষণ ভয় পাওয়া কিছু ছোট ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে ছোট্ট এক মেয়ে বলেছে, সে দেখেছে মাসুদ রানাকে। নিখুঁত ছিল পিচ্চির বর্ণনা। একই কথা বলেছে এতিমখানার আহত ডাক্তার।

    ‘ছায়ার মত এল,’ বলেছে ডাক্তার। ‘তার নাম তা হলে মাসুদ রানা? আমার অবশ্য মনে হয়নি সে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা করে গেছে। তা ছাড়া, তাকে আমার হিংস্র মানুষ বলেও মনে হয়নি।’

    এতিমখানায় শিশুদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি এবার্টন, মনে আছে সিমন্সের। বাইরে দাঁড়িয়ে চুষে খেয়েছে একের পর এক অ্যান্টাসিড। কী যেন ভাবছিল। হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসার পরেও বুজে রেখেছে মুখ।

    কড়া কফিতে চুমুক দিল সিমন্স। ভাবছে, এবার সময় হয়েছে সব জেনে নেয়ার। কাপের শেষটুকু কফি গিলে স্টাইরোফোমের কাপ ওয়েস্ট-বাস্কেটে ফেলে সোজা এবার্টনের ডেস্কের দিকে চলল সে।

    তাকে আসতে দেখে ফোনের কল কেটে মুখ তুলে তাকাল এবার্টন।

    কার সঙ্গে কথা বলছে সেটা গোপন করছে সার্জেন্ট, ভাবল সিমন্স। কথাটা চিন্তা করে রেগে গেল। সোজা গিয়ে থামল পার্টনারের ডেস্কের সামনে। ঝুঁকে দু’হাত রাখল ডেস্কের কাঁচের ওপরে। কড়া গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় এবার আপনার মুখ খোলার সময় হয়েছে।’

    সিমন্সের দিকে তাকাল এবার্টন। ‘কী বিষয়ে?’

    ‘কোন কিছু গোপন করবেন না, এবার্টন। কোন না কোন ঝামেলায় পড়েছেন আপনি। আর সেটা কী ধরনের, তা জানতে চাইছি।’

    ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘তুমি আসলে আমাকে ভুল ভাবছ, সিমন্স।

    ‘তা হলে ভাঙিয়ে দিন আমার ভুল। বলুন, আসলে কী হয়েছে। আপনি আমার পার্টনার। মৃত্যু-ঝুঁকি নেয়ার সময় আপনার ওপরে নির্ভর করতে হয় আমাকে। কাজেই আপনার মনে কী চলছে, সেটা আমার জানা থাকা দরকার।’

    কড়া চোখে তার দিকে তাকাল এবার্টন। ‘তুমি কি ভাবছ অনেকের মত ঘুষ খেয়ে পচে গেছি আমি?’

    ‘আমি সেটা বলিনি, পার্টনার,’ দ্রুত জবাব দিল সিমন্স। ‘কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টা ধরে খুব অস্বাভাবিক লাগছে আপনার আচরণ। গোপনে ফোন করছেন রহস্যজনক কাউকে। আপনি যেন নিজের ভেতরে নেই। কিন্তু সেটা কেন?’

    ‘তোমার তো জানা আছে, সবসময় বিশ্বাস করতে হয় পার্টনারকে,’ অভিযোগ আর দুঃখ প্রকাশ পেল এবার্টনের কণ্ঠে। ‘আপাতত শুধু মনে রেখো, কোন অন্যায় করছি না।’

    ‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই, এবার্টন। কিন্তু সেটা করা কঠিন করে তুলেছেন আপনি। এদিকে শহর তোলপাড় করছে মাসুদ রানা। তার ওপরে…

    বিরক্ত চেহারায় চেয়ার ছেড়ে ডেস্কের ওপরে দু’হাত রাখল এবার্টন। ঝুঁকে এল সিমন্সের দিকে। এখন দু’জনের নাকের মাঝে দূরত্ব মাত্র দু’ইঞ্চি।

    ‘দেখো, সিমন্স, এমনিতেই একটু পর তোমাকে সব খুলে বলতাম। কিন্তু তার আগেই আমাকে সন্দেহ করলে তুমি।’

    ‘যদি সন্দেহ করে থাকি, তো সে দায় কি আসলে আমার?’

    ‘আমি যা করছি, তার পেছনে উপযুক্ত কারণ আছে। আর সেটা তোমাকে বলতে কোন আপত্তিও নেই।

    ‘তা হলে বলুন। আমি শুনছি।’

    ওদের দু’জনের গলা চড়ে গেছে দেখে কৌতূহলী চোখে এদিকে চেয়ে আছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কয়েকজন অফিসার। ডেস্ক থেকে পিছিয়ে দাঁড়াল এবার্টন ও সিমন্স। নিচু গলায় বলল সিনিয়র সার্জেন্ট, ‘তুমি তা হলে সব জানতে চাও, তা-ই না? তা হলে আমার সঙ্গে এসো!’

    ‘কোথায়?’

    ‘ক্যাপ্টেনের অফিসে।’

    চোখ বিস্ফারিত হলো সিমন্সের। ‘ক্যাপ্টেনের অফিসে?’

    ‘হ্যাঁ, সময় হয়েছে তাঁকে বলার।’ ঘুরে স্কোয়াড রুমের অন্যদিকে ক্যাপ্টেনের অফিস লক্ষ্য করে এগোল এবার্টন। কয়েক সেকেণ্ড দ্বিধা করে তার পিছু নিল সিমন্স।

    কৌতূহলী চোখে ওদের দেখছে কয়েকজন অফিসার। ক্যাপ্টেনের অফিসের ঘষা কাঁচের দরজায় টোকা দিল এবার্টন। ওদিক থেকে এল ঘড়ঘড়ে গলা: ‘কাম ইন, প্লিয!’

    সিমন্সকে একবার দেখে নিয়ে নব ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেনের অফিসে ঢুকল এবার্টন। তার পিছু নিল সিমন্স।

    কাগজের স্তূপের ওদিকে কী যেন পড়ছেন ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড। বুলডগের মত মুখটা তুলে ভুরু কুঁচকে এবার্টনের দিকে তাকালেন তিনি। ‘বলো কী চাও, এবার্টন? আমি কিন্তু এখন খুব ব্যস্ত। নষ্ট করার মত সময় নেই।

    ‘এসেছি মাফিয়াদের বিষয়ে কথা বলতে,’ জানাল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘এ-ব্যাপারে জরুরি কিছু তথ্য আপনার জানা থাকা দরকার।’

    উনিশ

    ট্রাক কোম্পানির ডিরেক্টরের অফিসঘরে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে রাতের আঁধারে চেয়ে আছে অ্যালডো রসি।

    ‘জানালার সামনে থাকা বুদ্ধির কাজ নয়, অ্যালডি,’ নরম সুরে বলল এলিসা রসি। ‘তুমি জানো না কোথায় লুকিয়ে আছে স্নাইপার।

    বড়বোনের কথা শুনেও জানালা থেকে সরল না অ্যালডো রসি। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা পরিবেশ। শহরের বাইরে সাধারণ সব শিপিং বিযনেসের মতই এই ট্রাক কোম্পানি। গভীর রাতে অফিসের কর্মচারীরা কেউ উপস্থিত নেই। বৈদ্যুতিক বাতির আবছা আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে ট্রেইলার ট্রাক আর লোডিং ইকুইপমেন্ট। চারপাশে আলোর চেয়ে ছায়া বেশি।

    ‘তুমি রানার কথা ভাবছ,’ নিচু গলায় বলল অ্যালডো।

    ‘ঠিকই ধরেছ,’ বলল এলিসা। ‘কেউ জানে না অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছে কি না। হয়তো ঠিক এখন সাইটের ভেতর দিয়ে দেখছে তোমার মাথা। চাই না তোমার মগজ নিয়ে পেছনের দেয়ালে লাগুক বুলেট। সাবধান হও, অ্যালডি।’

    তিক্ত হলো অ্যালডোর চেহারা। ‘জানতাম না যে আমার জন্যে এত বেশি ভাবো তুমি।

    কড়া চোখে ছোটভাইকে দেখল এলিসা রসি। আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল।

    আপাতত কিছু দিন শিশুদের শিপমেন্ট নেই। সেজন্যে মনে মনে খুশি এলিসা। এই ব্যবসাটা খুবই লাভজনক। রসি পরিবারের অন্যান্য ব্যবসার মতই এই ধরনের শিপমেন্টের সময় নিজে উপস্থিত থাকে সে। কিন্তু মাসুদ রানার কারণে এখন একদম বদলে গেছে পরিস্থিতি।

    বাইরে শক্তিশালী এক ট্রাক্টর রিগের সঙ্গে দীর্ঘ ট্রেইলার জুড়ছে নাইট শিফটের ফোরম্যান। একটু পর ট্রেইলারে তোলা হবে অপহৃত শিশুদেরকে। ওদেরকে এখন পাহারা দিচ্ছে রসিদের সৈন্যরা। গোটা কম্পাউণ্ডের চারদিকে কাঁটাতার বেড়ার কাছে টহল দিচ্ছে দলের আরও বেশ কয়েকজন।

    একবার হাতঘড়ি দেখে নিল এলিসা রসি

    এখন বাজে রাত পৌনে বারোটা।

    কাজে পিছিয়ে নেই ওরা। মাঝরাতে বাচ্চাদেরকে পেটে নিয়ে রওনা হবে ট্রাক্টর ট্রেইলার।

    ‘আজকের রাত পেরোলে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না, ‘ মন্তব্য করল এলিসা রসি।

    ঘুরে ওকে দেখল অ্যালডো রসি। ‘আমি এত নিশ্চিত নই। তখনও শিকাগোতে রয়ে যাবে রানা।

    পার্স খুলে ওটার ভেতর থেকে রুপার কেস নিল এলিসা। ঢাকনি খুলে দু’আঙুলে ধরে তুলল একটা সিগারেট। ঠোঁটে ওটা ঝুলিয়ে নিতেই লাইটার বাড়িয়ে সিগারেটে আগুন জ্বেলে দিল অ্যালডো রসি।

    ‘তার হাতে আমাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই,’ বলল এলিসা। ‘ভাবছে তার ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্মচারীদেরকে আমরা খুন করেছি। সে যা খুশি ভাবলে ভাবুক। আগামী বেশকিছু দিনের জন্যে ডুব দেব আমরা। চিরকাল তো আর শিকাগোতে থাকতে পারবে না লোকটা। আমার কথা বুঝতে পেরেছ? জরুরি কাজ পড়লে আগে বা পরে চলে যেতে হবে তাকে।’

    ‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক। তবে আমাকে খুন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে সে। তাকে শেষ করার জন্যে গোটা শহরে ছড়িয়ে রেখেছ আমাদের লোক। তার ওপরে তাকে খুঁজছে শিকাগো পুলিশ। এসব দিকেই চোখ আছে তোমার। দেখা যাক, শেষমেশ ধরা পড়ে কি না সে।’

    ‘ওয়েস্টন আর ব্ল্যাক আর নেই,’ আবেগহীন স্বরে বলল এলিসা রসি। ‘সিনেটর পিটারও জানে, মুখ খুললে খুন হবে। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাদেরকে সাহায্য করবে সে। একই কাজ করবে ওয়াশিংটনের কুকুরগুলো।’

    নিজের সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা শলাকা নিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বেলে নিল অ্যালডো। ছাতের দিকে একরাশ ধোঁয়া ছুঁড়ে বলল, ‘মাসুদ রানাকে সামলাতে পারব, কারণ আমাদের আছে আর্থিক সক্ষমতা আর রাজনৈতিক শক্তি।’

    ‘আরও বড় কথা হাতের মুঠোয় আছে লিউনা গার্ডনার, ‘ বলল এলিসা রসি। ‘মনে হয় না মাসুদ রানা চাইবে মেয়েটা খুন হোক। কাজেই আমাদেরকে ঘাঁটাতে চাইবে না সে। দেখা যাক, এবার কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।’

    অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ভারী চোয়ালের এক লোক। মাথায় উল্টো করে পরেছে বেসবল ক্যাপ। ‘আমাদের ট্রাক রওনার জন্যে তৈরি, মিস্টার রসি।’

    ‘গুড,’ খুশি হলো অ্যালডো। ‘সময়ও তো ঘনিয়ে এল।’

    ‘অন্য কোন কাজ আছে, যা করে দিতে পারি, স্যর?’

    ‘না, লাগবে না। অবশ্য এটা দেখবে যেন ট্রেইলারে সবাই ওঠার পর সঠিক সময়ে রওনা হয় ট্রাক্টর।’

    ক্যাপের বিল স্পর্শ করে মাথা দোলাল ফোরম্যান। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ওয়্যারহাউসের দিকে।

    একেও বাঁচতে দেব না, ভাবছে এলিসা। এই লোক ওদের সৈনিক নয়। মাঝে মাঝে বেআইনি কাজে তাকে ডেকে নিতে হয়। যেমন আজকের রাতে।

    ডেস্কের কাছ থেকে সরে গেল এলিসা। তার পরনে খুব নরম কাপড়ের গাঢ় নীল দামি ড্রেস। ওটার ওপরে পরেছে ফারের হাজার ডলারের জ্যাকেট। ফলে তাকে মনে হচ্ছে আরও সুদর্শনা। গলা ও কবজিতে ঝিলিক দিচ্ছে হীরার অলঙ্কার। হাতের গ্লাভ্স্‌ খুলতেই ঝিকিয়ে উঠল অনামিকায় দুর্মূল্য হীরা খচিত আঙটি। ‘অ্যালডি, চলো, ওদেরকে গিয়ে বিদায় দিই,’ সহজ সুরে বলল সে। ‘ওরা রওনা হওয়ার আগে আরেকবার কথা বলতে হবে মিস গার্ডনারের সঙ্গে।’

    ‘আমার মনে হয় না সে কিছু বলবে,’ বলল অ্যালডো।

    তার কথায় হাসল এলিসা। ‘হয়তো বহু কিছুই বলবে। এসো।’

    ছোটভাই অফিসের দরজা খুলে দিতেই বাইরের ঠাণ্ডায় বেরিয়ে এল এলিসা। তার আগে আগে হাঁটতে লাগল অ্যালডো রসি। অফিসের সামনের অ্যাসফল্টের রাস্তা পার করে চলে এল ওয়্যারহাউসের দরজার কাছে। উত্তর থেকে হু- হু করে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া। ওয়্যারহাউসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালডো রসির এক সৈনিক, হাতে উযি সাবমেশিন গান। মাফিয়া ডনকে দেখে এক পা পিছিয়ে মৃদু মাথা দোলাল সে।

    ভাইকে ওয়্যারহাউসে আগে ঢুকতে দিল এলিসা, তারপর পিছু নিল। সৈনিক দেখল মাফিয়া ডনের পেছনে হাঁটছে তার বড়বোন। তার জানা নেই, দলের সবার সামনে গুরুত্বের সঙ্গে প্রতি পদে ভাইকে এগিয়ে রাখে নিষ্ঠুর এই মহিলা।

    শিশুদের পাহারায় যারা আছে, তাদের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে অ্যালডো রসি। দলের লোকগুলো কয়েক গজ দূরে থাকতেই তাদের উদ্দেশে বলল, ‘সব ঠিক আছে তো?’

    ‘জী, ডন, কোথাও কোন সমস্যা নেই,’ বলল কিডন্যাপার দলের নেতা। কনুইয়ের ভাঁজে শটগান। ‘বাচ্চারা কোন ঝামেলা করেনি।’

    ওয়্যারহাউসের একদিকের দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত ত্রিশজন ছেলেমেয়ে। ওরা এতই ছোট, কোন গোলমাল করবে, সেই সাধ্য নেই। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কনকনে শীতে কাঁপছে ওরা। যদিও ঘটনা তেমন নয়। সবার পরনে পুরু জ্যাকেট। বয়সে কেউ পাঁচ বছরের বেশি নয়। ওরা অসুস্থ হলে রসিদের বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা যাবে, তাই কেউ যেন অসুস্থ না হয়, তাই ওদেরকে করানো হয়েছে ডাক্তারি প্রতিটি পরীক্ষা

    কাঁদতে শুরু করলে দু’একটা চড় দেয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতি করা হয়নি ওদের। বেচারাদের চোখে অসহায় দৃষ্টি। বুঝতে পারছে যে আর কখনও ফিরতে পারবে না বাবা-মার কাছে। জানা নেই লোকগুলো এবার কোথায় ধরে নিয়ে যাবে।

    এটা আসলে ভাল দিক যে আগেই মন ভেঙে গেছে ওদের, ভাবল এলিসা। জেদ করা বাচ্চা পছন্দ করে না খদ্দেরেরা। তারা ইচ্ছেমত যা কিছু করবে, আর সেটাই মেনে নেবে বাচ্চারা, নইলে বাঁচবে কী করে!

    ‘গুলিয়ান বলেছে ট্রাক তৈরি হয়ে গেছে,’ শটগান হাতে কঠোর চেহারার লোকটাকে বলল অ্যালডো। ‘তা হলে তাকে বলো লোডিং ডকের কাছে ট্রাক্টর নিয়ে আসুক।’

    ‘আপনি যা বলেন, ডন।’

    ওয়্যারহাউস পাহারা দিচ্ছে একডযন সৈনিক। তাদের কারও কারও চোখ ওর ওপরে, টের পেল এলিসা। তবে ওরা কেউ বলছে না যে সে এখানে কেন। মাঝে মাঝে দলের দু’চারজন নিজেদের ভেতরে আলাপ করে, বড়বোনকে কেন প্রতিটা কাজে রাখেন মাফিয়া ডন রসি। যদিও ডালপালা ছড়াতে পারেনি কথাগুলো।

    এসব ফুট সোলজার কী ভাবছে, তাতে কিছুই যায় আসে না এলিসার। দরকার হলে ওয়েস্টন বা ব্ল্যাকের মত করেই এদেরকেও খরচের খাতায় তুলে দেবে সে।

    ‘ওই মেয়ে কোথায়?’ অপহরণকারী দলের নেতার কাছে জানতে চাইল অ্যালডো। ‘আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

    ঘাড় কাত করে শিশুরা যেখানে আছে, তার উল্টোদিকে ছোট এক অফিস দেখাল লোকটা। ‘হাত-পা বেঁধে টয়লেটে ফেলে রেখেছি।

    ‘নিয়ে এসো ওকে।’

    ‘জী, মিস্টার রসি।’

    কিছুক্ষণ পর গুণ্ডাদের একজন দুর্গন্ধময় টয়লেট থেকে বের করল লিউনাকে। ডানহাত এত জোরে চেপে ধরেছে, ব্যথায় কুঁচকে গেছে ওর মুখ। অ্যালডো আর এলিসা রসির সামনে ওকে হাজির করল গুণ্ডা।

    কঠোর আচরণ করা হয়েছে লিউনার প্রতি। আর সেটা দেখে খুশি হয়ে গেল এলিসা। কয়েক জায়গায় ব্লাউস ছিঁড়ে গেছে মেয়েটার। লাল হয়ে আছে ডান গাল। খুব জোরে ওখানে চড় দেয়া হয়েছিল। ঠোঁটের কোণে শুকিয়ে গেছে কয়েক ফোঁটা রক্ত। অভিযোগের দৃষ্টিতে দুই ভাই-বোনকে দেখছে লিউনা। রাগী কণ্ঠে বলল, ‘তোমরা আমার কী করবে সেটা তোয়াক্কা করি না। ভাল চাইলে বাচ্চাদের ছেড়ে দাও!’

    জবাবে হাসল এলিসা। নরম সুরে বলল, ‘প্রিয় লিউনা, তুমি বোধহয় এরই ভেতরে জেনেছ, জরুরি তথ্য পাব বলে তোমাকে এখনও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা মাথায় রেখো। আর বাচ্চাদের ব্যাপারে? সেটা তো অন্য হিসেব।’

    মনের ভেতরে মৃত্যু-ভয় কাজ করলেও খেপে আছে লিউনা। কড়া চোখে দেখল অ্যালডো রসিকে। ভুলে গেছে ওর হাত মুচড়ে ধরে রেখেছে মাফিয়ার গুণ্ডা।

    ‘তোমরা আসলে পাগল হয়ে গেছ! হয়তো খুন করবে আমাকে, কিন্তু ঠেকাতে পারবে না মাসুদ রানাকে! সে খুঁজে নেবে তোমাদেরকে! আর তখন একজনও বাঁচতে পারবে না!’

    ডানহাতে কষে লিউনার মুখে চড় দিল অ্যালডো। মাথা ঘুরে মেঝেতে বসে পড়ল মেয়েটা। শক্ত হাতে ওর বাহু ধরে রেখেছে মাফিয়ার গুণ্ডা। পরক্ষণে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করাল ওকে।

    ‘রানার ব্যাপারে আর একটা কথাও নয়!’ ধমকের সুরে বলল অ্যালডো রসি। ‘কুকুরটা এই ওয়্যারহাউসের ধারে কাছে এলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবে! তবে সে এটা জানে না যে কোথায় আছি আমরা।’

    একটুকরো হাসি ফুটল লিউনার মুখে। নিচু গলায় বলল, ‘তোমরা আসলে জানতে চাও এ-জায়গা কীভাবে চিনবে রানা। তো শোনো, কীভাবে চিনবে সেটা জানি না, তবে ঠিক সময়ে এখানে হাজির হবে সে।’

    সামনে বেড়ে ওর মুখোমুখি হলো এলিসা রসি। গ্লাভ্স্ পরা হাতে স্পর্শ করল লিউনার ডানগাল। বলল, ‘অ্যালডোর সঙ্গে সাবধানে কথা বলবে। ভুলো না যে আমি তার বড়বোন।

    ‘সত্যিই দুঃখিত,’ বলল লিউনা। ‘আমার ভুল হয়েছে। ‘এই তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ,’ বলল এলিসা। তার মুখে একরাশ থুতু ছুঁড়ল লিউনা। ‘আমার উচিত তোমাদেরকে বলা: তোমরা আসলে জন্মেছ সত্যিকারের কোন হারামি কুত্তীর পেটে!

    দু’পা পিছিয়ে পার্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে মুখ মুছল এলিসা। বড় করে শ্বাস নিল। ‘লিউনা, তুমি দেখি ভদ্রতা বলতে কিছুই শেখোনি! তাই বাধ্য হয়ে সামান্য শিক্ষা দেব।’

    ‘কঠিন কোন শিক্ষা,’ তাল দিয়ে বলল অ্যালডো রসি। লিউনার হাত ধরে রাখা লোকটার দিকে ইশারা করল সে।

    শটগান কনুইয়ের ভাঁজ থেকে নিয়ে ওটার কুঁদো দড়াম করে লিউনার পিঠে নামাল মাফিয়াসো।

    প্রচণ্ড ব্যথায় ধুপ করে সিমেন্টের মেঝেতে পড়ল লিউনা ওর কনুই ছেড়ে দিয়েছে লোকটা।

    সবই দেখছে শিশুরা। লিউনার করুণ পরিণতি দেখে কেঁদে ফেলল কেউ কেউ। বদ্ধ ঘরে তৈরি হলো ক্রন্দনের অদ্ভুত এক ভৌতিক আওয়াজ। অনেকে ওরা চেনে আণ্টিকে। তাকে এত ব্যথা পেতে দেখে ঘাবড়ে গেছে ওরা।

    হাত তুলে গুণ্ডাটাকে আর না মারতে ইশারা করল অ্যালডো রসি। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, ‘আগে শেষ হোক ব্যবসার কাজ, তারপর দেখব ওকে নিয়ে কী করা যায়।’ সামনে বেড়ে লিউনার থুতনি ধরল সে। মুখটা টান দিয়ে ওপরে তুলে সরাসরি তাকাল ওর চোখে।

    ‘কুত্তীর বাচ্চা!’ রাগী গলায় বলল লিউনা।

    ‘আমার কাজ শেষ হলে বুঝবে যে তুমি আর মানুষ নও, ‘ সরীসৃপের মত হিসহিস করল অ্যালডো রসি। ‘বারবার মাফ চাইবে যেন তোমাকে মেরে ফেলা হয়।’

    লিউনা কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে এল ইঞ্জিনের ভারী আওয়াজ। রেইলে ক্রিচক্রিচ শব্দে সরে যাচ্ছে লোডিং ডোরের দরজা। পিছিয়ে এসে ওয়্যারহাউসের ভেতরে লোডিং ডকে এসে থামল বড় এক ট্রাক। লোডিং ডকে উঠল ট্রাকিং কোম্পানির ফোরম্যান। গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমরা মাল তুলতে তৈরি, মিস্টার রসি!’

    লিউনার প্রতি মনোযোগ হারাল অ্যালডো। চট্ করে তাকাল বড়বোনের দিকে।

    জবাবে মৃদু মাথা দোলাল এলিসা।

    ‘তো ওদের ভরো ভেতরে। পরে দেখব হারামজাদীর তেজ কীভাবে কমাতে হবে,’ বলল অ্যালডো।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article মাসুদ রানা ৪৭০ – কালবেলা

    Related Articles

    কাজী মায়মুর হোসেন

    অদৃশ্য ঘাতক – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৬৮ – স্বর্ণলিপ্সা

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    ধাওয়া – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মৃত্যু উপত্যকা – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    খুনে ক্যানিয়ন – কাজী মায়মুর হোসেন

    July 25, 2025
    কাজী মায়মুর হোসেন

    মাসুদ রানা ৪৪৮ – মৃত্যুঘণ্টা

    July 25, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }