Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মিত্তিরবাড়ির গুপ্তধন – অভীক সরকার

    লেখক এক পাতা গল্প170 Mins Read0
    ⤷

    ১. বিজয়া দশমীর রাত

    মিত্তিরবাড়ির গুপ্তধন – অভীক সরকার
    প্রথম প্রকাশ এপ্রিল ২০২১

    .

    আমার পরম সুহৃদ, আত্মার আত্মীয়
    শ্রী রাজা ভট্টাচার্য মশাইকে।

    .

    ভূমিকা

    কিশোরদের জন্য একটি মনকাড়া গোয়েন্দা-অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আমার বহুকালের। সত্যি কথা বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের প্রতি আমার অনুরাগ জন্মানোর প্রধান অনুঘটক ছিলো শৈশব ও শৈশোরে আনন্দমেলা-শুকতারা-কিশোরভারতী আদি বিভিন্ন পূজাবার্ষিকী। পটাশগড়ের জঙ্গলে, জঙ্গলমহলে গোগোল, সোনাঝরা গল্পের ইনকা, বিজয়নগরের হীরে, প্রফেসর শঙ্কু ও স্বর্ণপর্ণী, বাংলাসাহিত্যের মহীরুহদের রচিত এইসব আখ্যান, এসবই আমার অপাপবিদ্ধ শৈশোরের অম্লান স্মৃতি।

    লেখালিখি শুরু করেছি বেশীদিন নয়। তবে শুরুতেই যে কথাটি যথাবিহিত হৃদয়ঙ্গম করেছি সেটি হচ্ছে যে কিশোরপাঠ্য উপন্যাস পড়া যতটা সহজ, লেখা ততটাই কঠিন। ওই জগতটা দেখা সহজ, বোঝা কঠিন। বুকে জড়ানো সহজ, ছুঁয়ে দেখা কঠিন।

    সেই থেকেই বুঝেছি যে শিশুকিশোরসাহিত্যজগতে পা রাখতে গেলে মা সরস্বতীর বিশেষ আশীর্বাদ প্রয়োজন হয়। নচেৎ এই দুনিয়ায় প্রবেশের চাবিকাঠি মেলে না। সেই আশীর্বাদ কেউ কেউ পান। যাঁরা পান তাঁরা ভাগ্যবান।

    তবুও অনেক সাহসে ভর করে লিখে ফেললাম এই ভুতুড়ে মজাদার অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসখানি। বলতে বাধা নেই, এটি লেখার সময় যাঁদের আমি লেখালিখির জগতে ঈশ্বর বলে মনে করি তাঁদের প্রভাব যে পুরোপুরি এড়াতে পেরেছি তা নয়। এমনকি সে চেষ্টাও যে খুব সচেতন ভাবে করেছি তাও নয়। ধরে নিন এই উপন্যাস আমার ফেলে আসা কৈশোরের প্রতি একটুকরো সহর্ষ প্রণতি।

    পরিশেষে বলি যাদের জন্য লেখা, তারা যদি পড়ে খুশি হয়, তবেই আমার এই পরিশ্রম সার্থক বলে মনে করবো।

    অভীক সরকার
    শুভ দোলযাত্রা
    ২৮শে মার্চ। ২০২১ সাল।

    .

    বিজয়া দশমীর রাত, আঠেরোশো নব্বই সাল, ঘুঘুডাঙা।

    গ্রামের শেষে যে বড় বিলটা আছে, তার পাশে একটা অশ্বত্থের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয় যাচ্ছিলেন রতিকান্ত মল্লিক। হুগলি জেলার মশা যে কী ভয়াবহ সে নিয়ে তাঁর বিস্তর ধারণা ছিল, কম দিন হল না এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। তবে অক্টোবরের শীতল মধ্যরাতেও যে এইরকম চড়াইপাখি সাইজের মশা হুল বাগিয়ে তেড়ে আসতে পারে সেটা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল।

    দু-হাতে চট চট করে মশা মারতে মারতে সন্তর্পণে বাইরের দিকে তাকালেন তিনি। শয়তানের বাচ্চা গঙ্গাপদটা কোথায়? এখনই তাঁকে নিতে আসার কথা ছিল তা বাঁদরটার?

    একটু নীচু হয়ে পায়ের কাছে রক্ত চুষতে থাকা একটা মশা মারলেন রতিকান্ত। আফ্রিকা থেকে আফগানিস্তান, তিব্বত থেকে বোর্ণিও, প্রাচ্যদেশের অনেক জায়গাতেই এইরকম টানটান উত্তেজনার রাত কাটিয়েছেন তিনি। এসব তাঁর প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। কিন্তু এরকম অসভ্য রকমের মশার কামড় কখনোই সহ্য করতে হয়নি তাঁকে! বাপরে, এরা মশা না ভিমরুল?

    মশাটা মেরে ফের ঘুঘুডাঙার জমিদার বাড়ির দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। আজ দুর্গাপূজার শেষ দিন। একটু আগেই বিসর্জন হয়েছে। দশদিনের উৎসব শেষে সারা গ্রামের লোকজন আজ রাতে মড়ার মতো ঘুমোবে। আর এই সুযোগটাই চাই রতিকান্ত মল্লিকের।

    রতিকান্ত মল্লিক একজন চোর। তবে যে সে চোর নন তিনি। রতিকান্ত চুরি করেন একমাত্র সেইসব জিনিস যার ঐতিহাসিক বা পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব আছে। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন মন্দির আর বৌদ্ধস্তূপ থেকে যে যে বহুমূল্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি হয়েছে, প্রতিটির পেছনে রতিকান্ত মল্লিকের ধূর্ত বুদ্ধির ছাপ আছে। ইউরোপের বড়লোকদের মধ্যে এখন হিড়িক উঠেছে প্রাচ্যের বিভিন্ন ঐতিহাসিক সামগ্রী কিনে ঘর সাজানোর। শুধু ঘর সাজানো নয়, অনেকে আবার শখের সংগ্রাহকও বটে। তাঁরা চোরাবাজারে এসব কিনে চেনা পরিচিতদের মধ্যে নিজেদের দর বাড়ান। আর এশিয়ার বাজারে তাদের মুশকিল আসান একজনই, দ্য গ্রেট রতিকান্ত মল্লিক।

    পকেট থেকে ঘড়ি বার করে সময় দেখলেন রতিকান্ত। রাত আড়াইটে, চারিদিক নিস্তব্ধ। গঙ্গার দিক থেকে বয়ে আসছে আশ্বিনের ঠান্ডা শীতল হাওয়া। সেই হাওয়ায় বিলের পাশের জঙ্গল থেকে একটানা শনশন শব্দ শোনা যায়। জঙ্গলের বাইরের বাউন্ডারিতে জন্মানো বাঁশ আর অশ্বত্থের মাথাগুলো অল্প অল্প দুলছে। সেদিকে অবশ্য নজর ছিল না তাঁর, তিনি তাকিয়েছিলেন অন্য দিকে।

    ঘুঘুডাঙা গ্রামের প্রধান রাস্তা যেখানে রাজবাড়ির ফটকের রাস্তার সঙ্গে এসে মিশেছে সেখানে একটা অতি প্রাচীন বটগাছ বহুকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রতিকান্ত যেখানে অপেক্ষা করছেন সেখান থেকে সেই মোড়টা দেখা যায়।

    একবার বাঁ-হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা দেখে নিলেন তিনি। ভোর হতে আর বড়জোর দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিট আছে। তার মধ্যে গঙ্গাপদ না এলে মুশকিল। এর পর গ্রামের লোক এক এক করে জাগতে শুরু করবে।

    একটু অস্থির হয়ে উঠলেন রতিকান্ত। দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিট মানে দু-ঘণ্টা উনিশ মিনিট হয়ে ষাট সেকেন্ড, তার একমুহূর্ত বেশি না। চুলচেরা প্ল্যানিং আর যন্ত্রের মতো নিখুঁত এক্সিকিউশন, এর ওপরে ভর করেই আজ অবধি এতগুলো সফল অপারেশন করেছেন তিনি। কোনও দেশের পুলিশের বাবার সাধ্য হয়নি তাঁর টিকি ছোঁয়ার। কিন্তু এই গঙ্গাপদ মনে হচ্ছে এত ট্রেনিং দেওয়ার পরেও ডোবাবে তাঁকে।

    ভাবতে ভাবতেই সেই পুরোনো বটগাছের দিক থেকে রাতের অন্ধকার চিরে দ্রুত কিন্তু চাপা পায়ের শব্দ ভেসে এল রতিকান্ত’র কানে। একজন নয়, অনেকজনের পায়ের শব্দ।

    ঠিক দুটো ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো রতিকান্ত’র কাছে। তাদের মধ্যে একজন বললো, ‘সাহেব, আছো?’

    রতিকান্ত সতর্ক গলায় বললো, ‘আছি, কিন্তু সঙ্গে ও কে?’

    ‘ও এই গাঁয়েরই লোক সাহেব, আমার জিগরি দোস্ত। ওর নাম রামনারায়ণ তিওয়ারি। ওকে বলেছি আমাদের সব কথা।’

    তীব্র ক্রোধে দাঁতে দাঁত ঘষলেন রতিকান্ত। সাধে এই দেশের খোঁচড়গুলোকে বাঁদরের বাচ্চা বলে ডাকেন না তিনি। কথা ছিল যে গঙ্গাপদ আর তিনি, এই দুজনেই যাবেন ঘুঘুডাঙার জমিদারবাড়ির শিবমন্দিরে। এ যে কত বড় ঝুঁকির কাজ সে ব্যাপারে রতিকান্ত বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল আছেন। মন্ত্রগুপ্তি হচ্ছে এসব কাজের প্রধান উপকরণ। ভগবানের অলঙ্কার চুরি করতে এসেছে, এই খবর চাউর হয়ে গেলে রতিকান্ত মল্লিকের পিঠের একটা হাড়ও আস্ত থাকবে না।

    ‘তোমার সঙ্গে তো অন্য কারও আসার কথা ছিল না গঙ্গা,’ ধারালো শোনালো রতিকান্ত’র গলার স্বর, ‘তাহলে তোমার বন্ধুকে এখানে আনার মানে কী?’

    একটু অস্বস্তির হাসি হাসল গঙ্গাপদ, ‘আসলে কী হয়েছে সাহেব, রামুকে না বলেন আমি কোনও কাজ করি না, বুঝলেন। আপনি যখন আমাকে কাজের কথাটা বললেন না, সেটাও না না করে রামুকে বলে ফেলেছি। এখন ও চাইছে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে।’

    ‘তাতে আমার লাভ?’ অন্ধকারে হিসহিসে শোনায় রতিকান্ত’র কণ্ঠস্বর।

    খুকখুক করে হাসে রামনারায়ণ, ‘লাভ আছে সাহেব। নইলে আমি কী আর এমনি এসেছি?’

    ‘বটে? আর তোমার লাভ?’

    ফের সেই খুকখুকে হাসি, ‘গঙ্গাপদকে যা দিচ্ছেন তাই দেবেন সাহেব। রামনারায়ণ তেওয়ারি নিজের ন্যায্য পাওনার থেকে একটা টাকাও বেশি নেয় না, ঘুঘুডাঙার সব্বাই জানে।’

    রতিকান্ত বুঝতে পারলেন এই ছেলে গঙ্গাপদ’র তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। কথাবার্তায় ধূর্তামির ছাপ স্পষ্ট।

    ‘তাহলে বলো রামনারায়ণ, কীভাবে তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো?’

    ‘মিত্তিরদের জমিদাবাড়ির চৌহদ্দিতে কীভাবে ঢুকবেন সেটা ঠিক করেছেন কিছু?’

    ‘কী মনে হয়? আমি আজ পায়চারি করতে করতে ভাবলাম অ্যাদ্দূর চলেই যখন এসেছি তাহলে জিনিসটা চুরি করে নিয়ে গেলে ভালো হয়। তাই না?’

    গম্ভীর হয়ে গেল রামনারায়ণ,’আপনার পরিকল্পনা আমি শুনেছি সাহেব। কিন্তু আমার কাছে তার থেকেও অনেক ভালো রাস্তা আছে। ঝুঁকিও কম, আর ফরাসডাঙ্গায় পৌঁছবেনও অনেক তাড়াতাড়ি।’

    ‘কীরকম?’

    নিজের পরিকল্পনার কথা সবিস্তারে বলতে শুরু করে রামনারায়ণ। স্থির হয়ে শুনতে থাকেন রতিকান্ত।

    আজ থেকে দেড় বছর আগে। লখনৌ। ডিসেম্বর মাস।

    ফয়্যার প্লেসের আগুনটা একটু উসকে দিয়ে রকিং চেয়ারে এসে বসলেন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পরনে দামি সিল্কের গাউন, হাঁটু অবধি ফুল মোজা। ফর্সা রং, কাঁচা পাকা চুল, আর সোনালি রিমের চশমায় ভদ্রলোকের চেহারায় একটা আলাদা আভিজাত্য ফুটে উঠেছে। শুধু চেহারায় কেন, ঘরের সর্বত্র বৈভব আর আভিজাত্যের পরিচয়। মেঝেতে পাতা দামি কার্পেটে, বাহারী ওয়ালপেপারে, দেওয়ালে ঝোলানো দামি পেইন্টিং-এর দিকে তাকালে বোঝা যায় গৃহস্বামীর অর্থও আছে, রুচিও। একদিকের দেওয়াল জুড়ে দামি ওক কাঠের বুককেস। তাতে ঠাসা বইপত্র।

    ঠোঁটে ধরা পাইপটা নিভে গেছিল। তাতে লাইটার জ্বেলে অগ্নিসংযোগ করতে করতে উলটোদিকে বসা লোকটিকে একবার আড়চোখে দেখে নিলেন তিনি। তারপর একবার খাঁকার দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আপনাকে তো চিনলাম না।’

    লোকটি বোধহয় একটু অন্যমনস্ক ছিল। প্রশ্ন শুনে চমকে সামনে তাকাল সে। তারপর খুব মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘সে নিয়ে বিশেষ উতলা হবেন না প্রফেসর গুপ্তা। আমাদের পরস্পরকে চেনার সম্ভাবনা এতটাই কম যে রীতিমতো প্রব্যাবিলিটির অঙ্ক কষে দেখতে হবে। আমাকে না চেনার জন্য আপনার লজ্জিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।’

    ভুরু কুঁচকোলেন গৃহকর্তা। প্রথমে দেখে যতটা বোকাসোকা মনে হয়েছিল, লোকটি হয়তো ততটা নিরীহ নয়। উত্তর দেওয়ার ধরনের মধ্যে একটা শান্ত আত্মবিশ্বাস আছে, যেটা চট করে সাধারণ লোকের মধ্যে আসে না। এবার বুঝলেন তিনি, কেন তাঁর ড্রাইভার কাম কম্বাইন্ড হ্যান্ড লছমন লোকটাকে আটকায়নি।

    পাইপ খেতে খেতে আগত আগন্তুককে একবার আগাপাশতলা দেখে নিলেন কিংস জর্জ কলেজের সদ্য প্রাক্তন অধ্যাপক রামশরণ গুপ্তা। বোঝাই যায় যে লোকটি উত্তর ভারতের লোক নয়। উচ্চারণ শুনে রামশরণ অনুমান করে নিলেন,লোকটি খুব সম্ভবত বাঙালি।

    আরও মনোযোগ সহকারে এই আগন্তুককে লক্ষ্য করা শুরু করলেন প্রফেসর গুপ্তা। লোকটার ব্যবহারে কিন্তু কোথাও কোনও অস্বাচ্ছন্দ্য নেই। পোশাক আশাক দেখে মনে হয় লোকটি স্বচ্ছল না হলেও দরিদ্র নয়। তবে লক্ষ্য করার বিষয় হল লোকটির চোখদুটি, বুদ্ধিতে আর কৌতুকে ঝকঝক করছে। তার ওপর চওড়া কপাল, টিকলো নাক, আর সরু করে কাটা গোঁফ দেখলে বোঝা যায় যে লোকটি খুব সাধারণ ঘরের কেউ না।

    রামশরণ পাইপে একটা টান দিয়ে বলেন, ‘প্রথম আলাপে নিজের পরিচয় দেওয়াটাই ভদ্রতা বলে জানতাম।’

    লোকটি বিনয়ে একেবারে গলে গিয়ে বললো, ‘এই না-চীজের গুস্তাখি মাফ করবেন স্যার। কী আর করা যাবে বলুন, আমি আবার লখনৌভি তেহজিবটা এখনও ঠিক শিখে উঠতে পারিনি। এই বদনসিবের নাম নাম ব্রজনারায়ণ মিত্র।’

    ‘কলকাতার লোক নাকি প্রবাসী বাঙালি?’

    ‘প্রশ্নটা কি খুব বুদ্ধিমানের মতো হল প্রফেসর সাহেব? কলকাতার বাইরে বাকি বেঙ্গলে কি বাঙালি থাকে না? নাকি তারা সবাই প্রবাসী? আপনার মতো বুজুর্গ জানকার লোক যদি ব্যাপারটা খেয়াল না করেন, তবে আমাদের মতো জাহিল, আনপঢ়, বে-ইলম কোথায় যাই বলুন তো?’

    ভুরু কুঁচকোলেন প্রফেসর গুপ্তা’তা মিস্টার মিত্র, হঠাৎ করে আমার বাড়িতে হানা দেওয়ার কোনও কারণ? ভাষা শুনে তো মনে হচ্ছে যে বাঙালি হলেও এদেশে কম দিন হয়নি আছেন। লখনৌভি তেহজিবের কথা যখন উল্লেখ করলেনই, তখন এ শহরের সামাজিক রীতিনীতি আদবকায়দাও আপনার জানা উচিত। আশা করি আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না যে…’

    হাত জোড় করে প্রফেসর গুপ্তাকে থামিয়ে দিলেন ব্রজনারায়ণ মিত্র। বিনয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, ‘আপনার আশীর্বাদে এদেশের আদবকায়দা কিন্তু কিছু কিছু শিখেছি প্রফেসর। আপনাকে খুঁজে বার করতো তো কম ধকল যায়নি আমার, তাও ধরুন প্রায় বছর পাঁচেকের পরিশ্রম। তা এই ক’বছরে প্রবাদপ্রতিম লখনৌভি ভদ্রতার কিছু তো অন্তত শিখব না, তা কি হয়?’

    পাইপে টান দিয়ে আগন্তুকের দিকে চেয়ে থাকেন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ অধ্যাপক। লোকটার এই আপাতকৌতুকতার মধ্যে একটা শীতল ক্রুরতা আছে যেটা তাঁর কাছে একটু অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল।

    ‘ওয়েল মিস্টার মিত্র। আপনি বেঙ্গলর লোক, অনেকদিন ধরে আমাকে খুঁজছেন, টু বি প্রিসাইজ প্রায় বছর পাঁচেক ধরে, এসবই বুঝলাম। এবার আপনার আসার কারণটা একটু জানাবেন দয়া করে? বোঝেনই তো, আমার সময়ের দাম আছে। বেকার গালগল্প করার মতো সময় আমার কাছে একদমই নেই।’

    হেঁ হেঁ করতে করতে আগন্তুক লোকটি বললো, ‘সে তো বটেই, সে তো বটেই। আপনি ব্যস্ত লোক, লখনৌ শহরের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রিয়ও বটে। আপনার কাছে বসে দু-দণ্ড খোশগল্প করতে পারাও যে অনেক পুণ্যের ব্যাপার সেটা কি আর জানি না?’

    ধৈর্যচ্যুতি ঘটল প্রফেসর গুপ্তার, ‘সেক্ষেত্রে আপনার কী বক্তব্য সেটা সাফ সাফ বলে ফেলে কেটে পড়ুন মিস্টার মিত্র। আমার সময়ের দাম আছে।’

    লোকটা কোমরে হাত দিয়ে ধীরেসুস্থে একটা ওয়েবলি স্কট বার করে আনলো। তারপর সেটা সামনের টেবিলে রেখে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললো, ‘দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে নিজের দেশ ছেড়ে গোটা উত্তর ভারত জুড়ে রতিকান্ত মল্লিকের উত্তরাধিকারীদের খুঁজে চলেছি প্রফেসর রামশরণ গুপ্তা। সময়ের দাম আমারও আছে বইকি। রতিকান্ত মল্লিকের সঙ্গে ঘুঘুডাঙার মিত্র পরিবারের একটা পুরোনো হিসেব মেটানো এখনও বাকি, সেটা জানেন তো? সেটা না মিটিয়ে এত সহজে কী করে কেটে পড়ি বলুন দেখি?’

    প্রফেসর গুপ্তার মুখ আরক্তভাব ধারণ করল, ‘ইউ ব্লাডি সোয়াইন। তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? জানো আমি কী করতে পারি?’ বলেই উচ্চৈস্বরে ডেকে ওঠেন তিনি, ‘লছমন, লছমন, কাঁহা মর গ্যায়ে হো? তুম রেহতে হুয়ে ইসবদতমিজ বঙ্গালিকো ঘরমে ঘুসনেকা হিম্মত ক্যায়সে হুয়া?’

    লছমনকে টেনে নিয়ে আসে একটা লোক। তার হাতে ছুরি, লছমনর গলায় ধরা। তার সঙ্গে সঙ্গে ঢোকে আরও দুটো লোক, তাদের হাতে পিস্তল।

    লোকটা এবার সামনে ঝুঁকে আসে, সামান্য লাজুকস্বরে বলে ‘এই বদতমিজ বঙ্গালি আপাতত আপনার পুরো বাড়ির দখল নিয়ে নিয়েছে প্রফেসর গুপ্তা। খাঁটি লখনৌভি বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে রাখি, বিন্দুমাত্র বেচাল কিন্তু বরদাস্ত করা হবে না।’

    নার্ভাস হয়ে পড়েন প্রফেসর গুপ্তা। গোলাগুলি অস্ত্রপাতি দেখলেই নার্ভাস হয়ে পড়েন তিনি। তবু তার মধ্যেই তোতলাতে তোতলাতে বলেন, ‘তু তু তুমি কী ভেবেছ, আমাদের এখানে খুন করে চলে যাবে আর পুলিশ কিছু বুঝবে না?

    লোকটা মিষ্টি হেসে বলে, ‘পুলিশ কী বুঝবে সে কথা পরে ভাববেন প্রফেসর সাহেব। কিন্তু তার আগে আপনি নিজের পরিস্থিতিটা একটু বুঝেশুনে দেখলে ভালো হত না?’

    ‘কী চাই তোমার?’কপালে ঘাম জমতে থাকে প্রফেসর গুপ্তার।

    ‘এই তো, এবার কাজের কথায় এসেছেন।’ লোকটা ভারী খুশি হয়, ‘এবার বলুন দেখি ওই সোনার পাত দুটো কই?

    ‘কোন সোনার পাত?’

    লোকটা এবার ওয়েবলি স্কটটা তুলে নিয়ে প্রফেসর রামশরণ গুপ্তার কপালের মধ্যিখানে ঠেকায়। তার স্বরে এখন পরিহাস বা বিনয়ের বাষ্পমাত্র নেই। কঠিন গলায় বলে, ‘যেটা আপনার পূর্বপুরুষ মিস্টার রতিকান্ত মল্লিক আজ থেকে একশো তিরিশ বছর আগে বেঙ্গল থেকে চুরি করে নিয়ে আসেন। ঘুঘুডাঙার রাজবাড়ির শিবলিঙ্গ থেকে খুলে আনা সোনার ত্রিপুণ্ড্রক।’

    বিজয়া দশমীর রাত, আঠেরোশো নব্বই সাল, ঘুঘুডাঙা।

    তিনজনে যখন পাঁচিল টপকে জমিদারবাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকলেন তখন রাত্রি তিন প্রহর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে দশমীর চাঁদ। সারা রাস্তা নির্জন, এমনকি গ্রামের কুকুরগুলো অবধি কোথায় ঘাপটি মেরেছে কে জানে।

    ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগল রতিকান্ত মল্লিকর। ‘কী ব্যাপার, কুকুরগুলো ডাকছে না কেন?’

    ‘যাতে না ডাকে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর রামনারায়ণের।

    মন্দিরটা জমিদারবাড়ি পিছনবাগে। সেখান অবধি পৌঁছবার একটাই রাস্তা, মূল ফটক দিয়ে ঢুকে দুদিকে দুটো ছোট গলি, যেগুলো জমিদারবাড়ির মূল অংশটাকে বেড় দিয়ে পেছনের বাগানে গিয়ে পড়েছে। রতিকান্ত আর গঙ্গাপদ’র প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিলো সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি মূল ফটক দিয়ে ঢোকা। ফটকের চাবি গঙ্গাপদ’র কাছেই থাকে।

    কিন্তু রামনারায়ণ বিলকুল উলটো পথ ধরল। সে জমিদারবাড়ির বাইরের মেঠো রাস্তা ধরে পৌঁছল একেবারে বাগানের পেছনবাগে। খুঁজেপেতে একটা মস্ত বটগাছের নীচে এসে দাঁড়াল সে। সেই রাস্তার একদিকে জমিদারবাড়ির পাঁচিল, অন্যদিকে মা গঙ্গা। রতিকান্ত যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে ইটের ভাঙাচোরা সিঁড়ি নেমে গেছে গঙ্গার তীর অবধি। ঘাটে একটা ছোট নৌকো বাঁধা, এখান থেকেও সেটা নজর এড়াল না রতিকান্ত’র।

    ‘এখান দিয়ে কেন? আমাদের কথা ছিল না মেইন গেট দিয়ে ঢোকার?’ উষ্মা গোপন রাখেন না রতিকান্ত।

    ‘আগেই বলেছি, পরিকল্পনাটা খুবই বোকার মতো হয়েছিল সাহেব। ধরুন কাজ শেষ হওয়ার আগে কোনওভাবে সবাই টের পেল যে মন্দিরে কেউ ঢুকেছে। তখন পালাতেন কোথা থেকে? সদর দরজাটাই তো সবার আগে বন্ধ হত, তাই না?’

    চুপ করে রইলেন রতিকান্ত, কথাটায় যুক্তি আছে। ততক্ষণে বটগাছের গোড়ার দিকে একটু ঝুঁকে পাঁচিলের খানিকটা অংশ উন্মুক্ত করে রামনারায়ণ। সেখান দিয়ে একটা ফোকর উঁকি দিচ্ছে বটে।

    ‘গ্রামের ছেলেরা দুষ্টুমি করে বাগান থেকে ফলপাকুড় পাড়বে বলে এই ফোকরটা বানিয়েছিল। এর খোঁজ গঙ্গাপদ তো রাখেই না, এমনকি বাগানের মালি রামখিলাওন অবধি রাখে না। আমি কী করে এর খোঁজ পেয়েছি সে প্রশ্ন জিজ্ঞেস না করে আপাতত এর মধ্যে দিয়ে ভিতরে আসুন দেখি। দেখবেন, আওয়াজ যেন না হয়।’

    রতিকান্ত সেই ফোকর দিয়ে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘাটে নৌকোটা বাঁধা আছে দেখেছি। চালাবার লোক আছে তো?’

    রামনারায়ণ বাঁকা হেসে বলল, ‘রামনারায়ণ তেওয়ারি আধা কাজ করে না সাহেব।’

    আজ থেকে দেড় বছর আগে। লখনউ। ডিসেম্বর মাস।

    প্রফেসর গুপ্তা মৃদুস্বরে কথা বলা শুরু করেন। মনে হয় ঘরের মধ্যে জমাট বেঁধে থাকা থমথমে নৈঃশব্দের মধ্যে কে যেন গ্রামোফোনের পিন দিয়ে আঁচড় কেটে চলেছে।

    ‘তুমি যখন ওই সোনার ত্রিপুণ্ড্রকের কথা জেনে গেছ, তখন পুরো ঘটনাটাই জানো নিশ্চয়ই।’

    ‘নট নেসেসারিলি প্রফেসর গুপ্তা’ রিভলভারটা নিজের হাতে ধরে কৌচে বেশ আয়েশ করে বসে লোকটা, ‘চুরি করা অবধি জানি। তারপর বাকিটা জানি না।’

    ‘এ গল্প আমাদের পরিবারে বহুদিন ধরে প্রচলিত, যাকে বলে ফ্যামিলি ফোকলোর বলে, তাই।’

    ঘুঘুডাঙার রাজবাড়ি থেকে প্রাণ হাতে করে পালিয়ে আসার পর রতিকান্ত আর বেঙ্গল প্রভিন্সের ধারে কাছে থাকেননি। সেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন কানপুরে। দেশে ফিরেই কোন যাদুমন্ত্রে বিরাট ধনী হয়ে পড়েন তিনি। বিয়ে করেন এক স্থানীয় জমিদারের কন্যাকে। তিনি ধনী তো ছিলেনই, সেই সঙ্গে তাঁর বংশ মর্যাদাও কম বড় ছিল না। তাই এই বিয়েতে কোনও পক্ষের তরফেই কোনও আপত্তি ওঠেনি। একটা উড়ো খবর অবশ্য কন্যাপক্ষের কানে এসেছিল যে বাংলায় থাকাকালীন নাকি রতিকান্ত কোনও এক বাঙালি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তবে প্রথমত তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, আর দ্বিতীয়ত সে যুগে হিন্দু পুরুষদের পক্ষে একাধিক বিয়েতে কোনও আইনি বাধা ছিল না। ফলে কন্যাপক্ষ এ নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাননি।

    রতিকান্ত আর বিন্দিয়া চৌধুরীর কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁদের একটি মেয়ে জন্মায়, রাগিণী, রাগিণী মল্লিক। ইনি বড় হয়ে বিয়ে করেন ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট রামলখন শ্রীবাস্তবের সঙ্গে সঙ্গে। রাগিণী বিয়ের পর তাঁর পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে একটা ট্রাঙ্কও নিয়ে আসেন তাঁর শ্বশুরবাড়িতে। লেডি রাগিণী ছাড়া সেসব দেখার অধিকার নাকি শ্রীবাস্তব পরিবারের আর কারও ছিল না।

    রামলখন বিয়ের পর সামরিক বাহিনী থেকে ইস্তফা দিয়ে রাগিণীকে নিয়ে পাড়ি দেন শ্রীলঙ্কা। সেখানে চা-এর ব্যবসা করে প্রভূত অর্থোপার্জন করেন। শ্রীলঙ্কায় তাঁদের দুটি পুত্র এবং একটি কন্যা সন্তান জন্মায়। মেয়েটি ছোট, নাম আরতি শ্রীবাস্তব। তিনি পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। ইতিহাস ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়।

    আরতি যখন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ছেন, তখনই বাধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেই সময়েই তিনি পরিচিত হন আরেকজন মেধাবী যুবকের সঙ্গে, রঘুনন্দন গুপ্তা।’

    এই পর্যন্ত বলে মাথা নীচু করে চুপ করে থাকেন প্রফেসর রামশরণ গুপ্তা।

    আগন্তুক বলে, ‘আর আরতির সেই দুই ভাইয়ের নাম হরিশঙ্কর শ্রীবাস্তব আর চন্দ্রভানু শ্রীবাস্তব, দুজনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যান, তাই তো?’

    মাথা নাড়েন প্রফেসর গুপ্তা, ‘ঠিক যেদিন দেশ স্বাধীন হয়, সেদিনই আরতি আর রঘুনন্দনের একটি ছেলে জন্ম নেয়, জানকীবল্লভ গুপ্তা। ইনি ছিলেন আর্কিওলজিস্ট। দেশ বিদেশের বহু পুরাতত্ত্ববিষয়ক অভিযানে ইনি অংশ নিয়েছেন। শেষ বয়সে এসে পদ্মভূষণ খেতাবও পান।

    ‘আরতি শ্রীবাস্তব থেকে বাকি ইতিহাসটা আমি জানি প্রফেসর সাহেব। আপনার বাবা প্রফেসর জানকীবল্লভ গুপ্তা’র খ্যাতির ব্যাপারেও জানি। আপনার পড়াশোনা কলকাতায়, বিয়ে করেছিলেন এক বাঙালি মহিলাকে, একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে, এসবও জানা আছে। শুধু রতিকান্ত থেকে আরতি অবধি পারিবারিক সূত্রটা খুঁজতেই আমার এতগুলো বছর কেটে গেল। সে যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসুন প্রফেসর গুপ্তা। লেডি রাগিণীর সেই ট্রাঙ্কের কী হল?’

    ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লেডি প্রথমবারের জন্য রাগিণী শ্রীবাস্তব-এর ট্রাঙ্ক খোলা হয়। দেখা যায় যে তার মধ্যে প্রচুর প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে। তার মধ্যে কিছু কিছু আর্টের নিদর্শন অত্যন্ত উঁচুদরের। এসবের সঙ্গে রতিকান্ত মল্লিকের একটা ডায়েরিও ছিল। সেই ডায়েরিতে কোন আইটেম কোথাকার, কী তার বিশেষত্ব, কোথা থেকে কীভাবে সংগৃহীত সেসবের বিস্তারিত বিবরণ ছিল।

    ততদিনে রামলখনও মারা গেছেন। মারা গেছেন হরিশঙ্কর আর চন্দ্রভানুও। ফলে এসব এসবের ভার এসে পড়ে আরতিও ওপরেই।

    আরতি ছিলেন ঘোরতর ভাবে একজন আধুনিক মনস্ক মানুষ। তিনি রতিকান্ত’র ডায়েরি পড়ে বুঝতে পারেন এসবই প্রাচ্যের বিভিন্ন সম্পদ, রতিকান্ত চুরি করে এনেছিলেন। যেগুলো রতিকান্ত কোনও কারণে হাতছাড়া করতে চাননি, সেগুলোই ওই ট্রাঙ্কে আছে। তিনি প্রতিটি আইটেম ধরে ধরে দেশের জিনিস দেশের সরকারের হাতে তুলে দেন। একটি জিনিস ছাড়া।’

    আগন্তুক ঝুঁকে আসে, ‘কী সেটা।’

    ‘ঘুঘুডাঙার সেই সোনার ত্রিপুণ্ড্রক। তার ডায়েরি মোতাবেক তার তিনটি অংশ, কিন্তু রতিকান্ত দুটিই আনতে পেরেছিলেন। আরতি ভেবেছিলেন ওটা ফেরত দিতে গেলে এ প্রশ্ন উঠতে পারে যে তৃতীয়টা কোথায়। তাই আর সে নিয়ে এগোননি।’

    লোকটা এবার চওড়া করে হাসে, ‘আপনাদের পারিবারিক ইতিহাস খুবই ইন্টারেস্টিং প্রফেসর গুপ্তা। একজন চুরি করেছেন, আরেকজন ফিরিয়ে দিচ্ছেন। যাই হোক, আলাপ করে ভালো লাগল। এবার ওই দুটো পার্ট দিন দেখি, আরতি ম্যাডামের শেষ ইচ্ছেটা পূর্ণ করে দিয়ে যাই।’

    প্রফেসর গুপ্তা কঠিনভাবে সামনে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘কিন্তু আপনিই যে সেই জমিদারবাড়ির উত্তরাধিকারী তার প্রমাণ কী?’

    বিজয়া দশমীর রাত, আঠারোশ নব্বই সাল, ঘুঘুডাঙা।

    বিশাল শিবলিঙ্গটার দিকে চেয়ে হাঁ হয়ে রইলেন রতিকান্ত।

    মন্দিরের ভিতরে একটা ছোট জানলা, সেটা দরজার উলটোদিকের দেওয়ালে। তার ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু আলো আসছিল তাতে দৃষ্টি পরিষ্কার হওয়া দূরে থাক, বরং অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠছিল। তার মধ্যে উচ্চতায় প্রায় আট থেকে দশ ফুট, কম করে হলেও দু-ফুট ব্যাসার্ধের শিবলিঙ্গটিকে বিশাল এবং ভয়াবহ মনে হচ্ছিল রতিকান্ত’র। ‘পেশা’-র সূত্রে এ দেশের বহু মন্দির ঘুরেছেন তিনি, কিন্তু এরকম বিশাল আকারের শিবলিঙ্গ কমই দেখেছেন।

    অন্ধকারে রামনারায়ণের ফিসফিসানি কানে আসে, ‘দেখেশুনে বাক্যি হরে গেল নাকি সাহেব?’

    শুনে চটপট ধাতস্থ হন রতিকান্ত। অনেক কাজ বাকি, সময় দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। তিনি ফিসফিস করে শুধোন, ‘গঙ্গাপদ, রামনারায়ণ, বাকি ব্যবস্থা কই?’

    বাঁশের তৈরি একটা উঁচু মতো মাচা এনে দিল রামনারায়ণ, আস্তে আস্তে বলল, ‘গঙ্গাপদ দরজা পাহারা দিচ্ছে সাহেব। আপনি যা করার করুন। দেখবেন যেন শব্দ না হয়।’

    মাচাটাকে খুব সন্তর্পণে টেনে এনে, শিবলিঙ্গের যে অংশটাকে গৌরীপট্ট বলে, তার পাশে রেখে মাচাটার ওপর চড়লেন রতিকান্ত। বাঁশের মাচা ক্যাঁচকোঁচ করে উঠলো। রতিকান্ত বুঝলেন যে বস্তুটি খুব একটা মজবুত নয়। তবুও তার মধ্যেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

    সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একবার আড়চোখে দরজার দিকে তাকালেন রতিকান্ত। গঙ্গাপদ’র আবছায়া অবয়বটা দেখা গেল সেখানে। মনে মনে তাকে একটা ধন্যবাদ দিলেন তিনি। ছোঁড়া এমনি কাজেকর্মে ঢ্যাঁড়স হলে কী হবে, তালা খোলায় ওস্তাদ একেবারে। সেই সুনাম শুনেই তো বিস্তর টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে ছেলেটাকে টেনেছিলেন তিনি। তাঁর সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে একটু আগেই। মন্দিরের অত বড় ভারী তালা যে স্রেফ একটা এক আঙুল লম্বা লোহার কাঠি দিয়ে খুলে ফেলা যায়, সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না চৌরশ্রেষ্ঠ রতিকান্ত মল্লিকের।

    এবার সোজা হয়ে সামনে তাকালেন রতিকান্ত। তাঁর সামনে এখন শিবলিঙ্গের মাথার কাছটা। আর সেখানে আনুভূমিকভাবে পরপর সাঁটা আছে তিনটে সোনার পাত। ঘুঘুডাঙার জমিদারবাড়ির বিখ্যাত সোনার ত্রিপুণ্ড্রক। প্রতি পাতের আকার দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি, অর্থাৎ এক ফুট আর উচ্চতায় ছয় ইঞ্চি। আর সেই তিনটে সোনার পাতের গায়ে জমে আছে প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো চন্দনলেপার মোটা পরত।

    ‘রামনারায়ণ, আলো আন।’

    একটা ক্ষীণ আলোর বৃত্ত জ্বলে উঠল মন্দিরের এক কোণে। তারপর রামনারায়ণ একটা ছোট মশাল বাঁশের ডগায় বেঁধে উঁচু করে ধরে তুলে ধরল।

    পকেট থেকে কয়েকটা যন্ত্রপাতি বার করে আনলেন রতিকান্ত। এসব জিনিস সাধারণ বাজারে পাওয়া যায় না। নিজের কাজের জন্য চেনা মিস্ত্রিকে দিয়ে বানিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার মধ্যে থেকে একটা ছেনির মতো জিনিস বার করলেন রতিকান্ত, সেটা দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে শক্ত চন্দনের পুরু স্তর খুঁড়ে খুঁড়ে সাফ করলেন। তারপর পকেটে রাখা একটুকরো পশমের কাপড় গঙ্গাপদকে দিলেন। বললেন মন্দিরের কোণায় রাখা গঙ্গাজলের কলসী থেকে জল নিয়ে ওটা ভিজিয়ে আনতে।

    পাত তিনটের গায়ে ভেজা কাপড় দিয়ে একটু ঘষতেই ভুরুটা কুঁচকে গেল রতিকান্ত’র। সোনার পাতের গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে খোদাই করা ওসব কী?

    ‘আলোটা একটু তুলে ধর তো রামনারায়ণ।’ চাপা উত্তেজনায় আদেশ করলেন রতিকান্ত।

    আলোটা আরেকটু তুলে ধরল রামনারায়ণ, তার সঙ্গে চাপা গলায় বলল, ‘তাড়াতাড়ি করুন সাহেব। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।’

    রতিকান্ত একটু নড়ে উঠতেই মাচাটা ফের আওয়াজ করে উঠল, এবার একটু জোরেই। দাঁত চিপে গঙ্গাপদকে গাল দিলেন রতিকান্ত, ব্যাটাচ্ছেলেকে যদি একটা কাজ দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তালা খুলতে পারা ছাড়া হতচ্ছাড়াটার আর কোনও গুণই নেই। দেখেশুনে তিনি একটা রামছাগলকেই সঙ্গে নিয়েছিলেন বটে।

    মশালের আলোয় সোনার ত্রিপুণ্ড্রক ঝলমল করে উঠল রতিকান্ত’র চোখের সামনে। তার সঙ্গে তার গায়ে আঁকা আঁকিবুঁকিগুলোও।

    এসব কী? আরও ঝুঁকে এলেন রতিকান্ত।

    প্রথম পাতে অজানা ভাষায় কিছু লেখা। অক্ষরগুলো সংস্কৃত নয়, ও ভাষাটা ভালোই জানেন রতিকান্ত। এঅন্য কোনও ভাষা।

    দ্বিতীয় পাতে পরপর চারটে ছবি আঁকা। প্রথম ছবিতে একটা কারুকার্য করা দরজা। দ্বিতীয় ছবিতে সেই দরজার সামনে একটা মস্ত বড় চাবি, তার উচ্চতা প্রায় দরজার সমান। তৃতীয় ছবিতে আবার দরজার জায়গায় চাবির ছবি আঁকা, তার গায়ে দরজার কারুকার্যগুলোই। চতুর্থ ছবিতে একটা ঘড়া, তার গলা জড়িয়ে একটা সাপ।

    তৃতীয় পাতটা ভালোভাবে দেখার আগেই রামনারায়ণ চাপা গলায় বলল, ‘জলদি করুণ সাহেব। এবার কিন্তু সত্যিই দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

    তড়িঘড়ি করে পিঠে আঁটা ঝোলাটা থেকে যন্তরগুলো বার করলেন রতিকান্ত। প্রথম যৌবনে মধ্যভারতের একটা কুখ্যাত ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন তিনি, তাদের ছত্রছায়ায় অনেক কিছুই শিখেছেন। এইসব যন্ত্রপাতিও সেই সময়েরই কালেকশন।

    প্রথম পাতটা উপড়ে আনতে বেশ অসুবিধা হল রতিকান্ত’র। ঘাম ঝরতে লাগল কপাল বেয়ে। এদিকে মশাল উঁচু করে ধরে থাকতে থাকতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে রামনারায়ণের। তার জায়গায় এখন গঙ্গাপদ। সে ভীতস্বরে বলল, ‘আর কিছুক্ষণ পরেই ব্রাহ্মমুহূর্ত শুরু হবে সাহেব। লোকজন জেগে ওঠা শুরু করবে, তাড়াতাড়ি করুন।’

    দ্বিতীয় পাতটা তুলে আনতে আরও কষ্ট করতে হল রতিকান্তকে। এই আশ্বিনের রাতেও রীতিমতো ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেলেন তিনি। কবজি থেকে শুরু করে কাঁধের কাছটা টনটন করতে লাগল। তার মধ্যে বাঁশের মাচার ক্যাঁচক্যাঁচটা বেড়েই চলেছে। ভয় লাগছিল রতিকান্ত’র, যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারেন তিনি।

    প্রথম দুটো পাত খুলে পিঠের সঙ্গে বাঁধা চামড়ার ঝোলায় সাবধানে রাখলেন রতিকান্ত। তারপর মনোনিবেশ করলেন একদম শেষের পাতে।

    বাইরে থেকে রাতচরা পাখির টিরিরিরি আওয়াজ ভেসে আসছিল। এছাড়া চারিদিক শুনশান। গঙ্গার দিক থেকে একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা ভেসে এল মন্দিরের মধ্যে।

    তৃতীয় পাতটা সবে অর্ধেক তুলেছেন, এমন সময় চাপাস্বরে শশশশ করে আওয়াজ করল রামনারায়ণ। রতিকান্ত আর গঙ্গাপদ দুজনেই চমকে তাকালেন ওর দিকে। দাঁতে দাঁত চিপে রামনারায়ণ বলল, ‘আলোটা নীচে কর গঙ্গা। জমিদারবাড়ির কোনও একটা ঘরে কেউ আলো জ্বেলেছে।’

    শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেল রতিকান্ত’র। তিনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। গঙ্গাপদ মশালটা মন্দিরের এক কোণায় নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখল। তার হাত কাঁপছে তখন।

    স্থির চোখে খানিকক্ষণ জমিদারবাড়ির দিকে চেয়ে রইল রামনারায়ণ। তারপর বলল, ‘ওরা বোধহয় কিছু টের পেয়েছে সাহেব। যা করার এক্ষুনি করুন, গতিক ভালো বুঝছি না।’

    আধো অন্ধকারের মধ্যেই তৃতীয় পাতটা খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন রতিকান্ত। উদ্বেগে আর উত্তেজনা তাঁর হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল। এদিকে রামনারায়ণ আরও ঘনঘন বলতে লাগল, ‘তাড়াতাড়ি করুন সাহেব। ওরা বোধহয় কিছু টের পেয়েছে। এক এক করে সব ঘরে আলো জ্বলে উঠছে।’

    তৃতীয় পাতের শেষের অংশটা তুলে ফেলতে ফেলতেই জমিদারবাড়ির দিক থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে, কে ওখানে? বুড়োবাবার মন্দিরে কে ঢুকেছে? ওরে কে কোথায় আছিস, আলো জ্বাল…’

    গঙ্গাপদ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘পালান সাহেব, পালান। ওরা এসে পড়লে পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে না।’

    দাঁতে দাঁত চিপে রতিকান্ত বললেন, ‘আর একটুখানি।’

    রামনারায়ণ এবার উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘সাহেব, এবার বেরোন। জমিদারবাড়িতে আলো জ্বলে উঠেছে। মশাল নিয়ে ওরা এদিকেই আসছে।’

    গঙ্গাপদ লাফ মেরে মন্দিরের বাইরে পড়েই দৌড় দিল। মশাল নিভে যাওয়াতে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। তার মধ্যেই তৃতীয় পাতটা খুলে এল রতিকান্তর হাতে। কিন্তু তিনি ধরার আগেই সেটা ঝনঝন শব্দ করে আছড়ে পড়ল মেঝেতে। শিউরে উঠলেন রতিকান্ত, সর্বনাশ!

    সেই ঝনঝনানির আওয়াজ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল কারা, ‘ওরে চোর ঢুকেছে বুড়োবাবার মন্দিরে, কে কোথায় আছিস, সদর দরজা বন্ধ কর… দেখিস হারামজাদা যেন পালাতে না পারে…’

    মাচা থেকে একলাফে মাটিতে নামলেন রতিকান্ত। তারপর মাটিতে হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলেন তৃতীয় পাতটা। চেঁচিয়ে উঠল রামনারায়ণ, ‘ওটা আমার হাতে সাহেব, আর সময় নষ্ট করবেন না, জলদি পালান।’

    মন্দির থেকে দুজনে বেরিয়ে সোজা দৌড় দিলেন পাঁচিলের ওই ফোকরের দিকে। ততক্ষণে জমিদারবাড়ি মশালের আলোয় আলোকময়। সেই সঙ্গে জেগে উঠেছে গ্রামের লোকজনও। সদর দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের লোকজন হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছে জমিদারবাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে, ছুটে আসছে এদিকেই। চারিদিকে হইচই আর প্রবল হল্লা। তারই মধ্যে দুইজনে ফোকর গলে কাঁচা রাস্তায়। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন রতিকান্ত, ‘গঙ্গাপদ কোথায়?’

    হাঁফাতে হাঁফাতে রামনারায়ণ বলল, ‘ওর চিন্তা ছাড়ুন সাহেব। আগে নিজের চিন্তা করুন।’

    ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নৌকোয় পৌঁছতে যা দেরি। লাফিয়ে নৌকোয় উঠলেন রতিকান্ত। ততক্ষণে মশালের আলো আর লোকজনের হইহল্লা খুঁজে পেয়েছে তাঁদের পালাবার পথ। কে যে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই পথেই পালিয়েছে শয়তানগুলো। খুড়োমশাই, শিগগির এদিকে আসুন। মনে হচ্ছে খুব বেশিদূর যায়নি ওরা।’

    মশালগুলো ঘাটের দিকে ধেয়ে আসতেই নৌকো ছেড়ে দিল। কী যেন একটা মনে পড়ে যেতে চেঁচিয়ে উঠলেন রতিকান্ত, ‘তোমার হাতের ওই সোনার পাতটা দাও রামনারায়ণ।’

    রামনারায়ণ কিছু বলার আগেই মশালগুলো এসে দাঁড়াল ঘাটের মাথায়। তারপর একের পর এক সড়কি ধেয়ে আসতে লাগল নৌকোর দিকে। রামনারায়ণ ঝাঁপ দিল গঙ্গার জলে। লোকজন চিনে ফেলার আগেই তাকে পালাতে হবে তাকে, কেউ দেখতে পেলেই সর্বনাশ।

    নৌকোর পাটাতনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন রতিকান্ত। আফশোসে হাত কামড়াচ্ছিলেন তিনি। ইশ, আর পাঁচটা মিনিট যদি সময় পেতেন। ওই থার্ড পিসটা না পেলে এটা তিনি কোথাও বেচতেও পারবেন না যে!

    * * *

    ‘বেজাবাবু।’

    ‘উঁ।’

    ‘বলি ও বেজাবাবু।’

    ‘বলে ফ্যাল লখাই। কান খোলাই আছে।

    ‘বলি এ কোথায় এনে ফেললেন মশাই? এ যে ধুম অন্ধকার দেখছি।’

    ‘দেখ লখাই, মেলা হাঁউমাউ না করে চেপে বোস দিকিন। এমন একটা ভাব করছিস যেন তুই কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছিস না, আর আমিই প্যাটপ্যাট করে সব দিকে চক্ষু মেলে বসে আছি।’

    ‘সেই থেকে তো চেপে বসেই আছি বেজাবাবু, উঠতে আর দেখলেন কই? বিষ্টুচরণের শাগরেদরা থাবড়ে এমন চেপেচুপে বসিয়ে দিয়ে গেছে যে এখন তুলতে গেলে ক্রেন ছাড়া উপায় কী?’

    ‘তুলতে হবে? এখনও বলছিস তুলতে হবে? মানে ইতিমধ্যেই উঠে যাসনি বলছিস?’

    ‘উঠে যাইনি বলতে? বলি চাদ্দিকে এমন ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, হাত পা কোথায় সেঁধিয়ে আছে কী ঠিক ঠাহর হচ্ছে না, এমন সময় এসব রসিকতা না করলেই নয়?’

    ‘বাহ বাহ, এই তো রসিকতাটা বুঝে গেছিস দেখছি। হাজার হোক গগন মাস্টারের ছাত্তর, একেবারে আবোদা গোঁসাই তো নোস। আট ক্লাস অবধি তো পড়েই ফেলেছিলিস, তাই না রে লখাই?’

    ‘হেঁ হেঁ হেঁ, ওই আর কী, সাড়ে সাত ধরতে পারেন। মানে হাফ ইয়ার্লির পর আরও মাসখানেক ছিলুম কি না। তারপরেই তো মাস্টারমশাই একদিন ডেকে বললেন, ‘ওরে লখাই, মা সরস্বতীকে আর কষ্ট দিস নি বাপ। একে ভদ্রমহিলার বয়েস হয়েছে, হার্টও দুর্বল। তার ওপর তোর হাফ ইয়ার্লির খাতাটা যদি উনি ভুল করে একবার দেখে ফেলেন, তাহলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠছি রে লখাই। তখন কি আর ওঁকে বাঁচানো যাবে রে? বলি উনি মরলে বাকি ছেলেপুলেদের কী হবে সেটা ভেবে দেখেছিস একবার?’

    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, গগনের মুখে সে গল্প শুনেছি। পরীক্ষার খাতায় হুমায়ুনকে হনুমান আর জোয়ান অফ আর্ককে জোয়ানের আরক লিখে এসেছিলিস। আর হাইদাসপিসের যুদ্ধ নিয়ে লিখেছিলিস যে যুদ্ধে হায়দারের পিসে শহীদ হন।’

    ‘আরে সেই শুনেই তো হায়দার স্যার স্কুলের বেঞ্চিটা তুলে এমন তাড়া করলেন যে…যাগ্গে যাক, সে কথা বাদ দিন। ওঠাউঠির কথা কী বলছিলেন যেন?’

    ‘বলি উঠে এসে নিজেকে একটু হালকা হালকা লাগছে না লখাই?’

    ‘হে হে, সে আর বলতে। মনে হচ্ছে বয়েসটা এক ঝটকায় বিশ বচ্ছর কমে গেছে মশাই। এই একবার ইচ্ছে করছে মিত্তিরদের পুকুরে সাঁতার কেটে আসি, আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে পাকড়াশীদের মাঠে গিয়ে একটু ফুটবল পেটাই।’

    ‘উঠে আসার ওইটাই তো সুবিধে লখাই। বডি ফডি এক্কেবারে ঝরঝরে হয়ে যায়। শুধু উঠে কোথায় এসেছি সেটা যদি একটু জানা যেত। আচ্ছা লখাই, জায়গাটা তোর কেমন একটু ছরকুটে লাগছে না রে? কেমন যেন ভিরকুট্টি মেরে আছে না?’

    ‘লাগছেই তো। সেইটাই তো বলার চেষ্টা করছি তখন থেকে।’

    ‘ছোটবেলায় একবার কোন একটা বইতে রৌরব না কুম্ভীপাকের ডেসক্রিপশন পড়েছিলুম, বুঝলি। সেও নাকি ভারী আচাভুয়া জায়গা। সেখানেও নাকি এইরকম চোখের ওপর আলকাতরা লেপা অন্ধকার। হাত পা ঠিক ঠাহর হয় না…’

    ‘দেখুন বেজাবাবু, আপনার কথা শুনে এই পথে পা বাড়িয়েছি, এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। ওই কীসের পাক না রব কীসব নামটাম বললেন, ওখানে আসার কথাটা কিন্তু কড়ারে ছিল না মশাই!’

    ‘আসতে কি আমিই চেয়েছিলাম রে লখাই?’

    ‘আপনার কথাবার্তা কেমন যেন ব্যাঁকাপারা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বেজাবাবু। নাহ, দুটো পয়সার লোভে আপনার সঙ্গে কাজকারবার করাই মহা গোখখুরি হয়েছে দেখছি। আমার টাকাপয়সা মিটিয়ে দিন বেজাবাবু, আমি চলে যাই।’

    ‘হে হে হে… তুই কী আর ফিরে যাওয়ার অবস্থায় আছিস রে লখাই? কী ভাবছিস, এখান থেকে গলায় হ্যালোজেন ল্যাম্প ঝুলিয়ে তুই রাস্তা দেখতে দেখতে পৃথিবীতে ফিরে যাবি, আর তোর ওই অপোগণ্ড ভাইপো তাসা পার্টির ছ্যা র্যাঁ র্যাঁ লাগিয়ে তোকে ঘরে তুলে নেবে?’

    ‘দেখুন বেজাবাবু, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। ভজন মোটেই অপোগণ্ড নয়। শুধু মাথায় একটু বুদ্ধি কম, এই যা। কিন্তু আমাকে যে রাতদুপুর নাগাদ ডেকে আনলেন বিষ্টুচরণের সঙ্গে কীসব হুড়যুদ্ধ করতে হবে বলে, আর আমিও হাতের খেঁটোটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সেটা ভজন দেখেছে। ঘরে না তুলে নেওয়ার কী আছে মশাই? আর তা ছাড়া ও বাড়ি কার, আমার না? আমার বাড়িতে আমাকেই ঢুকতে দেবে না মানে?’

    ‘ওই জন্য বলেছিলাম ওরে লখাই, অত বড় বোমটা মুণ্ডু দিয়ে হেড দিতে যাসনি, ঘিলু চলকে যাবে। বলি অত বড় যে একখান যুদ্দু হল তুই বেড়াল না মুই বেড়াল করে, বিষ্টুচরণের লোকজন ল্যাজা সড়কি রামদা আর হাতবোমা দিয়ে আমাদের সাবড়ে দিল, সেসব কী একেবারেই ভুলে মেরে দিয়েছিস রে লখাই? কিচ্ছুটি মনে নেই?’

    ‘আমি কি বোমাটোমা গুলি-বন্দুকে ভয় টয় পাই নাকি? ছোঃ! লাঠি হাতে দাঁড়ালে লখাই সামন্ত’কে ভয় খায় না, এমন মানুষ এই ঘুঘুডাঙায় আছে নাকি? বলি বিষ্টুচরণ তো আমার কাছে এখনও হাজার দশেক টাকা পায়। তবু তাকে কখনও দেখেছেন আমার সঙ্গে মিঠে কথা ছাড়া গলা উঁচু করে কথা কইতে?’

    ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ। বিষ্টু তো সেদিন সেই শোধটাই তো সেদিন নিয়ে গেল রে লখাই। এবার তোর ভিটেমাটিতে ও যদি ঘুঘু না চড়ায় তো আমার নামে কুকুর পুষিস তুই।’

    ‘ইঃ, অত বড় সাহস হবে নাকি বিষ্টুচরণের? লাঠি মেরে মাথা ফাঁক করে দেব না?’

    ‘হে হে হে। তুই কি ভেবেছিস, বিষ্টু ওর লোকজন নিয়ে তোর ওই ভাঙাচোরা বাড়িটা দখল করতে আসবে? তার আর দরকার হবে না রে লখাই, গিয়ে দেখ, তোর ভাইপো কাল সকালেই সটকে পড়ার প্ল্যান করছে।’

    ‘সটকে পড়বে মানে?’

    ‘মানে তাকে কয়েকদিন ধরেই বিষ্টু ভারী মিঠেকড়া করে ওই দশ হাজার টাকার কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছে কি না। ছোকরা আর চাপটা নিতে পারছে না, বুঝলি। কাল ভোরেই সে বাড়িঘর ছেড়ে লম্বা দেবে বলে ভাবছে।’

    ‘অ্যাঁ? সে কি! ভজনের এত বড় সাহস? হতচ্ছাড়াকে এই জন্যে কোলেপিঠে মানুষ করেছি? দাঁড়ান তো বেজাবাবু, ঝট করে ব্যাটার ঘাড় ধরে দুটো ধোবিপাট মেরে আসি।’

    ‘ওরে লখাই, ওসব মারদাঙ্গার কথা এখন ভুলে যা। বরং পরকালের কথা ভাব। শুনেছি রৌরব আর কুম্ভীপাক, দুটোতেই বড় কষ্ট দেয়। সেখানে কি আর তোর ওই গা জোয়ারি কোনও কাজে লাগবে? আমার তো ঘোর সন্দেহ আছে।’

    ‘এসব কী হচ্ছে বেজাবাবু? জানেন না, আমি ভূতে ভয় পাই? তার ওপর আমাকে এসব অসৈরণ কথাবার্তা বলে প্রাণের ভয় দেখানোটা কি ঠিক হচ্ছে?’

    ‘ওরে লখাই, তোকে এখন আমি প্রাণ, আমজাদ খান, অমরীশ পুরী কারও ভয়ই দেখাচ্ছি না বাপধন আমার। তা ছাড়া কথাটা কি জানিস? ভেবে দেখতে গেলে তোর পক্ষে এখন ভয় পাওয়াটা একদমই ভালো দেখায় না।’

    ‘বেজাবাবু, আপনি কিন্তু ফের ভয় খাইয়ে দিচ্ছেন মাইরি! ও কী, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মনে হচ্ছে?’

    ‘আর দীর্ঘশ্বাস। বিষ্টুচরণের কথায় ভুলে একটা বড় ভুল করে ফেলেছি রে লখাই। এই লাইনে এতদিনের পাকা খেলোয়াড় হয়ে কী করে যে এত বড় ভুলটা করলাম, সে আক্ষেপ আমার আর যাওয়ার নয়।’

    ‘কী কথা বেজাবাবু?’

    ‘বলব রে লখাই। সব খুলে বলতেই হবে তোকে। কারণ ডায়েরিটা যদি ওই বিষ্টুচরণের হাত থেকে বাঁচাতে হয় তবে তোর ওই অপোগণ্ড ভাইপোটাই যা ভরসা।

    ‘দেখুন বেজাবাবু, বার বার ভজনকে অপোগণ্ড বলে খামোখা ইনসালটিং করবেন না কিন্তু। একটু ঠান্ডা বটে, আর মাথাটা একটু নরম মতন হলে কী হবে, অমন হিরের টুকরো ছেলে কিন্তু আশেপাশের সাত গাঁ খুঁজলেও পাবেন না।’

    ‘হলেই ভালো। এখন ডায়েরিটা যদি ঠিকঠাক করে উদ্ধার করে… ও কী লখাই? চাদ্দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে কী দেখছিস অতো?

    ‘ও ও ওরা কারা বেজাবাবু? গাছের ডাল থেকে সারি সারি দেহ ঝুলছে.. কাদের দেহ? আশেপাশেও ছায়ার মতো কারা যেন ঘুরছে… ও কাদের ছায়া বেজাবাবু? ওরা আপনার ওই বিষ্টুচরণের লোক নয় তো?’

    ‘ঠান্ডা হয়ে চেপেচুপে বোস লখাই। এই ডালটার দুপাশে পা ঝুলিয়ে থেবড়ে বোস দিকি। ওরকম শান্তিগোপাল মার্কা গলা কাঁপানোর কিচ্ছু হয়নি। ওরা আমাদের মতোই প্রাক্তন হিউম্যান আর হিউওয়োম্যান বিইং। আচ্ছা ইংরেজিটা কি ঠিক বল্লুম রে লখাই? আমার ইংরেজিটা আবার মাঝেমধ্যেই… ও তুই তো আবার সাড়ে সাত পাশ।’

    ‘ও বেজাবাবু… এসব কী বলছেন মশাই? এসবের মানে কী? তার মানে কী আমরা এখন…’

    ‘হ্যাঁ রে লখাই, তুই যা ভাবছিস ঠিক তাই। আমরা আর বেঁচে নেই। আমরা এখন ভূত।’

    * * *

    আজকাল ঘুঘুডাঙার চণ্ডীমণ্ডপ বসছে সতীশ চাকলাদারের দাঁতের ডাক্তারখানায়। ডাক্তারখানাও নতুন, ডাক্তারবাবু সতীশ চাকলাদারও তাই। ইনি আগে পশ্চিমের কোন শহরে প্র্যাকটিস করতেন, ভাষায় একটা পশ্চিমা টান আছে। পসার মন্দ ছিল না। তবে আজকাল বেশি রুগী সামলাবার ধকল নিতে পারেন না বলে হপ্তা দুয়েক হল দেশে ফিরে এই জয়চণ্ডীতলায় এসে চেম্বার খুলেছেন। এখানেই একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। একাই থাকেন, স্বপাক রান্না করে খান। ফাইফরমাশ খাটার জন্য একটা ছোকরা চাকর রেখেছেন। তা এখানে আসার পর থেকে টুকটাক করে রোগী হচ্ছে মন্দ না।

    সেপ্টেম্বরের শেষ, সবে মহালয়া গেছে। সন্ধের বাতাসে একটু শীত শীত ভাব, তার ওপর একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই রাস্তায় আজ লোকজন নেই বললেই চলে। আড্ডাটা চলছিলো ভূত নিয়ে। বিশু গুছাইত বেশ জাঁক করেই বলছিল, ‘বুঝলেন নগেনদা, ঝট করে ভূতে বিশ্বাস নেই বললেই ভূত জিনিসটা নেই হয়ে যায় না। ভূত জিনিসটা যে খাঁটি সত্যি, তার বিস্তর বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে।’

    বিশু সদ্য পঞ্চায়েত বোর্ডের মেম্বার হয়েছে, এই চত্ত্বরে তার দাপট খুব, চট করে তার কথা কেউ কাটে না। তবে গগন মল্লিকের কথা আলাদা। একে তিনি বিরোধী পার্টির লোক, তার ওপর ঘোরতর নাস্তিক। তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ভূতের নাকি আবার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ, হুঁ! কঙ্কালের নাকি গেঁটেবাত, লুঙ্গির আবার হিপপকেট! বলি গাঁজাটা কী আজকাল একটু বেশিই হচ্ছে হে বিশু?’

    বিশু একটু সিঁটিয়ে গেল। বদমেজাজী বলে ঘুঘুডাঙায় গগন মল্লিকের বিস্তর দুর্নাম আছে। ঘুঘুডাঙার রেসিডেন্ট ধোপা রামভজন গোয়ালার পেয়ারের মুলতানী গাই হচ্ছে রাজলক্ষ্মী। তাকে ঘুঘুডাঙার বাসিন্দা বিহারীদের মেয়ে-বউ’রা একেবারে সাক্ষাৎ ভগবতী জ্ঞানে সেবা করে। পালা করে এসে রাজলক্ষ্মীর পা টিপে দেয়, ক্ষুরে গঙ্গাজল ঢেলে পুজো টুজোও করে যায়। এহেন রাজলক্ষ্মী গেলবার ভোটের আগে গগন মল্লিকের সাধের ভাগলপুরী লুঙ্গি খেয়ে নিয়েছিলো বলে তিনি রাজলক্ষ্মী আর রামভজন দুজনকেই দরজার বাটাম খুলে তাড়া করে স্টেশনের পাশের পচা ডোবাটায় ফেলে দিয়েছিলেন। অবশ্য তারপরেই ভোটে হেরে যান। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র দমেননি তিনি। গগন মল্লিক সৎ একরোখা লোক, কাউকে ডরান না, বুক চিতিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলেন।

    এই এলাকার বাঁধা পুরোহিত হলেন নরহরি চক্কোত্তি। তিনি কানে একটা দেশলাই কাঠি ঢুকিয়ে সুড়সুড়ি দিতে দিতে নিমীলিত নয়নে বললেন ‘ভূতের তুমি কী জানো হে গগন? ওসব দেখার জন্য অন্তর্দৃষ্টি চাই হে, বুঝলে হে, অন্তর্দৃষ্টি। খেচরী মুদ্রায় কুম্ভক সাধন করতে হয়। ইড়া আর পিঙ্গলা দুটোকেই টক করে মূলাধার থেকে সহস্রারে তুলে ফেলো দিকি। তাহলেই দেখবে চোখের সামনে ভূত আর ভগবান দুটোই দিব্যি প্রতীয়মান হচ্ছে।’

    রোষকষায়িত লোচনে খানিকক্ষণ নরহরির দিকে চেয়ে রইলেন গগন মল্লিক। তারপর একটা বিষাক্ত দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘সারাটা জীবন তো অং বং চং করে আর লোকের মাথায় টুপি দিয়ে কাটালে নাড়ু। আমার না হয় পরকালের ভয় নেই, ওসবে বিশ্বাস করি না। বলি তোমার তো অন্তত সে ভয়টা আছে, তিনকাল গিয়ে তো এককালে ঠেকেছে। অন্তত এবার তো শুধরে যাও!’।

    নরহরি একটা উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘একটা পাষণ্ড নাস্তিকের কাছ থেকে পরকালের কথা শুনতে হবে নাকি গগন? তুমি একে নাস্তিক, তার ওপর দেবদ্বিজে মোটে ভক্তি নেই। বলি তোমার জন্য যে রৌরব নরকের আগুনে লোহার কড়া চাপিয়ে পিপে পিপে তেল ঢালা হচ্ছে, সে খবর রাখো?’

    .

    গগন মল্লিক খানিকক্ষণ মুখ ওপরে করে কান ফাটানো শব্দ করে হাসলেন। তারপর একটা হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, ‘ওহে জালিয়াতচন্দ্র, এমন সুখবরটা তোমার কানে পৌঁছে দিলো কে শুনি?’

    নগেন মুহুরি মাঝবয়েসি লোক। জেলাসদরে কাজ করেন, ঠাকুর দেবতায় ভারী ভক্তি। তিনি হাত দুটো মাথায় তুলে প্রণাম ঠুকে ক্ষীণকণ্ঠে বললেন, ‘অমন করে বলতে নেই মল্লিকমশাই। হাজার হোক উনি পুরুত মশাই, ওঁকে অমন করে গালমন্দ করাটা কি ঠিক? তা ছাড়া ভূত ভগবান নিয়ে শেকসপিয়ার কী একটা দামি কথা বলে গেছিলেন বলে শুনিচি না?’

    নরহরি চক্কোত্তি সোজা হয়ে বসে আপাত গম্ভীরমুখে বললেন, ‘খবরটা পাঁচকান করতে চাইনি গগন। কিন্তু ভাবলাম নরকের কথাটা শুনে তোমার মতো অবিবেকী পাষণ্ডের যদি কিছু চৈতন্য হয়। বলি গ্যাঁড়াপোতার সদগুরু আশ্রমে গত পরশু এক মহাপুরুষ এসেছেন, শ্রীশ্রী জগদানন্দস্বামী। নাম শুনেছ? সিদ্ধ পুরুষ হে, সিদ্ধ পুরুষ। খবরটা তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া।’।

    গগন মল্লিক ব্যাঁকা হেসে বললেন, ‘গাঁজাদানন্দস্বামী? ও বিশু, তোমার গাঁজার সাপ্লাই কি এই বাবাজীবনের আশ্রম থেকেই আসে নাকি হে।’

    বিশু শুনেই একটা হেঁচকি তুলল। তারপর ত্রস্ত হয়ে বলল, ‘কার নামে কী বলছেন গগনদা? উনি পরমসিদ্ধ পুরুষ, ত্রিকালদর্শী। আর ব্রহ্মতেজের তো কথাই নেই, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আশেপাশের এলাকার শ্রদ্ধালু লোকজন তো একদম ইয়ে হয়ে আছে।’

    ‘শ্রদ্ধালু? এটা কী ধরনের আলু বিশু? জ্যোতি না চন্দ্রমুখী?’

    ‘হেঁ হেঁ। এই জন্যেই তো দাদা আগের ইলেকশনটা গুবলেট করে বসলেন। বলি এসব করতে করতেই তো আপনারা আজকাল দেশীয় ব্রহ্মতেজালো ইসে গুলোর খোঁজই পাচ্ছেন না দাদা।’

    ‘বটে? তা এই জগদানন্দবাবুর ব্রহ্মতেজের নমুনাটা শুনি একটু।’

    ‘শুনবেন? তবে শুনুন। আমাকে দেখেই তো প্রভু গড়গড় করে আমার ভূত ভবিষ্যৎ সবই বলে দিলেন। স্কুল কলেজ, বিয়ে শাদি, পঞ্চায়েত ইলেকশন, এমনকি পাঁচ বছর বয়সে যে সান্নিপাতিক হয়ে মরতে বসেছিলাম সেটাও।’

    ‘বাহ বাহ। তাহলে তো খুব গুণের লোক বলতে হবে। তা গত হপ্তায় যে ওই পরেশ সাধুখাঁ’র চালকলটা বেনামে কিনলে সেটা বলতে পেরেছেন তো? আর নতুন মোটরসাইকেল কেনার টাকাটা কোথা থেকে পেয়েছো সেটা? তার সুলুক-সন্ধান কিছু দিলেন নাকি?’

    বিশু গুছাইত আরও সেঁটে গেলো দেওয়ালের সঙ্গে। নরহরি চক্কোত্তি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বাপু হে, সবজায়গায় অত হোলসেল অশ্রদ্ধা ভালো না। ওতে পরমাত্মা কুপিত হন, পরকালের পথ রুদ্ধ হয়। তুমি জানো শুধু আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে প্রভুজি দেশের দশের কত কী উপকার করেছেন?’

    গগন মল্লিক একটা ঘোঁৎ করলেন।

    ‘বিশ্বাস হল না তো? তা তোমার মতো পাপীতাপী অবিশ্বাসীর বিশ্বাস হবে কেমন করে? তবে শোনো, যেমন ধরো সেই যে তিরাশিতে সেবার যখন ভারত ওয়ার্ল্ড কাপ জিতেছিল, তার পেছনে কি আমাদের প্রভুজির যোগবিভূতি একেবারে ছিল না ভেবেছ?’

    গগন মল্লিক ভারী নিরীহস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তা তোমার এই বাবাজির বয়েস কত নাড়ু?’

    ‘তা গোটা চল্লিশ তো হবেই।’

    গগন মল্লিক ফের একটা বিষাক্ত হাসি হেসে বললেন, ‘এটা দু-হাজার বিশ সাল নাড়ু। উনিশশো তিরাশি মানে আজ থেকে সাঁইত্রিশ সাল আগের ঘটনা। তোমার গোঁ বাবাজির বয়েস যদি এখন পঞ্চাশ হয়ে থাকে তবে তখন তাঁর বয়েস ছিল তিন। তা ইনি কি একেবারে যোগবিভূতি নিয়েই মাতৃগর্ভ থেকে ল্যান্ড করেছেন?’

    জগদানন্দের অবতারত্ব নিয়ে নরহরি একটা কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই নগেন মুহুরি স্খলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিন্তু চক্কোত্তিদা, ক্রিকেট তো হল গিয়ে সায়েবসুবোদের খেলা। তাতে হুড়যুদ্ধ আছে, কোটপ্যান্ট আছে, হ্যামবেকন আছে, এমনকি ইংরিজি অবধি আছে। সেখানে আমাদের প্রভুজির লীলা কি তেমন ফুটবে?’

    ‘কথাটা ঠিকই বলেছেন মুহুরিমশাই। তবে সেদিন যা ঘটেছিল সে অতি গুহ্য কথা, বুঝলেন কি না।’

    ‘কী কথা নরহরিদা?’ নগেন মুহুরি আরেকটু ঘেঁষে আসেন।

    ‘সেসব কথা কি আর অবিশ্বাসীদের সামনে বলা ঠিক হবে হে নগেন? তারা হয়তো এসবকে ধোঁকা ভাঁওতাবাজি এসব বলে উড়িয়েই দেবে।’ বলে গগন মল্লিকের দিকে একটা বাঁকা চাউনি নিক্ষেপ করেন নরহরি। ইঙ্গিত বুঝে গগন মল্লিক গম্ভীর মুখে একটু সরে বসেন, যদিও কান থাকে এদিকেই।

    এবার বেশ উচ্চৈস্বরে ফিসফিস করে বলতে থাকেন নরহরি, যাতে কথাগুলো গগনের কানে যায় ঠিকই। বিশু আর নগেন মুহুরি আরও কাছে ঘেঁষে বসেন।

    ‘খবরটা কিন্তু আপনারা বাইরে পাঁচকান করবেন না কাইন্ডলি। ব্যাপারটা হচ্ছে এই। তিরাশি’র বিশ্বকাপের ফাইনালের দিন, বুঝলেন কি না, প্রভুজি তাঁর সাধনপীঠের ছাদে উঠেছিলেন অষ্টসিদ্ধি ব্যাপারটা একবার ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য। তেজীয়ান লোক তো কম নন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই অণিমা আর লঘিমা দুটো একসঙ্গে আয়ত্তে চলে এল। আর ব্যস, ভদ্রলোক নিজের অজানতেই হাফ মাইলটাক ওপরে ভেসে উঠলেন।’

    ‘সে কী?’ চাপাগলায় প্রশ্ন করে বিশু গুছাইত। তার স্বরে উত্তেজনার ভাব স্পষ্ট।

    ‘কিন্তু গোলমালটা বাধলো এর পরেই।’

    ‘কীসের গোলমাল দাদা?’ এবার নগেন মুহুরি।

    গগন মল্লিকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলতে থাকেন নরহরি, ‘ঠিক সেই সময়ই সাউথ চায়না সী থেকে হঠাৎ করে একটা দমকা হাওয়া ভেসে আসে, বুইলে। আর ব্যস, গোস্বামী মশাই বসন্তপুর থেকে ধাঁ করে লর্ডসের আকাশে। লঘিমাতে বডি হেবি হালকা হয়ে যায় কী না! তখন ভিভ রিচার্ডস বেধড়ক ঠ্যাঙাচ্ছে আমাদের বোলারদের। এমন সময় প্রভুজি লর্ডসের আকাশে ভেসে এলেন, আর ঠিক তক্ষুণি মদনলালের বলে ভিভ রিচার্ডস দিলো একটা লোপ্পাই ক্যাচ। প্রভুজি তখন মাঠের ওপরেই বায়ুভূত নিরালম্ব হয়ে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। বলটা আকাশে তাঁর বাঁ বগলের কাছে সুড়সুড়ি দিতে তিনি মশাটশা ভেবে, ‘আহ জ্বালাতন করিসনি বাপু’ বলে বলটাকে থাবড়ে দেন। নীচেই উলটোবাগে দৌড়ে আসছিলেন কপিলদেব। তিনি যাকে বলে খেলুড়ে লোক। বলটাকে কপাৎ করে ধরে ফেলতে তাঁর কোনও অসুবিধাই হয়নি। ব্যস, বাকিটা তো জানেনই!’

    ফের আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা পিলে চমকানো হাসি হাসলেন গগন মল্লিক। তারপর বললেন, ‘শোনো ডাক্তার শোনো। আহম্মকদের কাণ্ড শোনো।’

    সতীশ চাকলাদার মৃদু মৃদু হাসছিলেন। তিনি কম কথার মানুষ। দরকার না হলে মুখ খোলেন না। এতক্ষণ ধরে একটা মেডিক্যাল জার্নাল পড়ার চেষ্টা করছিলেন। যদি কান ছিল এদিকেই।

    ‘নরহরিদা, আপনার এই বাবাজি এসেছেন কোথা থেকে?’ এতক্ষণে মুখ খুললেন সতীশ ডাক্তার।

    ‘কে জানে?’ হাত উলটোলেন নরহরি চক্কোত্তি, ‘আমার গুরুভাই হরেন মুখুজ্জেকে তো চেনেন। সে থাকে গ্যাঁড়াপোতাতেই। হপ্তাখানেক আগে হরেন কলকাতা গেসলো তার ভায়রাভাইয়ের বাড়ি, শালির ছেলেকে পুজোর জামাকাপড় দিতে। ফিরতে ফিরতে লেট হয়ে যায়। তারপর লাস্ট ট্রেন ধরে যখন গ্যাঁড়াপোতায় নামে তখন রাত প্রায় বারোটা। নেমে দেখে স্টেশনে গাড়িঘোড়া কিছুই নেই। স্টেশন থেকে তার বাড়ি বেশিদূর নয়। হরেন ভেবেছিল বাকি রাস্তাটা হেঁটেই মেরে দেবে। তা হাঁটতে হাঁটতে ডাইনিজলার মাঠ অবধি এসেছে, দেখে অশথতলার কাছে কে যেন আগুন জ্বেলে বসেছে।’

    ‘রাম রাম রাম… অত রাতে ডাইনিজলা? আপনার গুরুভাইয়ের তো সাহস আছে নরহরিদা।’ নগেন মুহুরী শিহরিত হন।

    ‘সবই গুরুকৃপা হে নগেন, গুরুকৃপা। সে যাই হোক। হরেন গিয়ে দেখে সে এক মহা অসৈরণ ব্যাপার। ওই অত রাতে এক জটাজূটধারী সন্ন্যাসী ধুনি জ্বালিয়ে হোম করছেন। হরেন উপস্থিত হতেই বাজখাঁই গলায় বললেন, ‘এসেছিস? আয় রে পাশবদ্ধজীব, আয়। কালই যোগনিদ্রায় মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বটে। মা বলছিলেন ”ওরে জগা, বহুদিন হল নররক্তের স্বাদ পাইনি। মাঝে তো মুখবদল করতেও তো মন চায়।” ওরে জগন্ময়ীর ইচ্ছে কি মিছে হতে পারে রে পাগলা? এই দেখ, মহাবলি নিজেই পায়ে হেঁটে উপস্থিত। এদিকে তিথিও প্রশস্ত, শুক্লপক্ষের চতুর্থী। জবার মালা, খাঁড়া, রক্তচন্দন সব রেডি। যা বাবা, যা, ঝট করে ওই জলাটায় একটা ডুব দিয়ে তো দেখি, জন্মমৃত্যুর বন্ধন থেকে তোকে আজই উদ্ধার করে দিয়ে যাই।’

    ‘তারপর? হরেন মুখুজ্জে বলি হয়ে গেল?’ বিশু গুছাইত দৃশ্যতই শিহরিত।

    ‘হলে কি আর সে খবরটা পেতে না বিশু?’ খুবই বিরক্ত হলেন নরহরি, ‘হরেন যে বলি হয়েই যেত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কি না যে ধার্মিক মানুষ, পাপাচারী নাস্তিক নয়। ব্যাপারস্যাপার দেখে তার হাত পা কাঁপছে তখন। তার মধ্যেই সাহস করে একেবারে কাটা কলাগাছের মতো বাবা’র পায়ে পড়ে গেল। তার বউ বাচ্চা আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, দু’দুটো এল আই সি পলিসি আছে,বাড়ির হোম লোনের ই এম আই আছে, শ্বশুর চোখ বুজলে মোটা টাকা আছে, সে কিছুতেই বলি হবে না। শেষে বাবা’র দয়া হতে তাকে তুলে ধরে কানের কাছে বগলামন্ত্র পড়ে বলেন, ‘যা রে মায়াবদ্ধ জীব যা। মহামায়া সবার জ্ঞাননেত্রে মশারি টাঙিয়ে রেখেছেন কি না, তাই এ যাত্রা তোর মুক্তির সামনে মা একটা রেলগেট ফেলে দিলেন। যার যা কপাল। মায়ের ইচ্ছেয় তোকে ছেড়ে দিচ্ছি বটে, কিন্তু খবরদার, এদিকে আর আসবিনি। আমি চাই না সংসারী মানুষ এসে আমাকে বিরক্ত করুক।’

    নগেন মুহুরী কপালে যুক্তকর ঠেকালেন, ‘মা মাগো। তোমার ইচ্ছেই পূর্ণ হোক মা।’

    ‘তবে হরেনও কি সোজা মানুষ হে নগেন। সে তো পরের দিন সকাল হতেই লোকজন নিয়ে ডাইনিজলার মাঠে গিয়ে হাজির। বাবাজী তখন প্রাতকৃত্যাদি সেরে হাতমুখ ধুয়ে যোগধ্যানে বসার উদ্যোগ করছিলেন। তিনি তো লোকজন দেখে মহা খাপ্পা, হরেনকে এই মারেন কি সেই মারেন। তারপর লোকজন হাতে পায়ে ধরে ওঁকে সদগুরু আশ্রমে এনে তোলে। বাবাজি আপাতত সেখানেই আছেন বটে, তবে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে বলে রয়ে গেলেন। কালীপুজোর পরেই উনি আর নেই, নর্মদার তীরে ওঁর সাধনভজনের কোটা কমপ্লিট করতে ফিরে যাবেন।’

    ‘তা এত কথা তুমি জানলে কি করে নাড়ু?’ উঁচু গলায় প্রশ্ন করেন গগন মল্লিক।

    ‘বললাম যে, হরেন মুখুজ্জে আমার গুরুভ্রাতা। সে তো প্রভুজিকে আশ্রমে প্রতিষ্ঠা করেই আমার কাছে এসে হাজির। আমি তো শুনেই দৌড়ে গেছি। তোমার মতো পাপীতাপীদের সংসর্গ করি, একটু পুণ্য সঞ্চয় না করলে কী করে চলে বলো? তা গিয়ে ব্যাপার স্যাপার দেখেশুনে তো আমি তো যাকে বলে মোহিত। আমাদের পোস্টমাস্টারকে চেনেন তো? পরেশ সাঁতরা। এককালের নামকরা নাস্তিক, ধম্ম কম্ম অজাত কুজাত এঁটোকাঁটা কিছুই মানতো না। গিয়ে দেখি সে তো দীক্ষা নেবে বলে প্রভুজি’র একেবারে পা জড়িয়ে বসে আছে, ছাড়ার নামই নেই। বুঝলেন ডাক্তারবাবু, অনেক পুণ্য করলে তবেই এমন মহাপুরুষ কালেক্কে দেখা দেন ডাক্তারবাবু। তবে পাপীতাপী নাস্তিকদের অবশ্য এ কথা বিশ্বাস হবে না, সে বলাই বাহুল্য।’

    গগন মল্লিক বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লেন। ‘তোমাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া আর ঘরে বসে তাস খেলে সময় নষ্ট করা একই ব্যাপার। ধুর ধুর। সন্ধেটাই মাটি।’

    নরহরি চক্কোত্তি লাফিয়ে উঠলেন, ‘আরে ও গগন, চললে কোথায়? আমাকে ওই মোড়ের বটগাছটা অন্তত পার করিয়ে তো দাও। সেদিনই দু’দুখানা লোক খুন হয়ে গেল ওখানে…রাতের বেলা…রাম রাম।’

    আড্ডা ভেঙে গেল। ফাঁকা চেম্বারে চিন্তিত মুখে বসে রইলেন সতীশ ডাক্তার। তারপর চেম্বার বন্ধ করে বাড়ির রাস্তা ধরলেন।

    * * *

    ‘তবে যাই বলুন বেজাবাবু, আমার কিন্তু একটু আনন্দই হচ্ছে, বুইলেন।’

    ‘সে তো যেভাবে চনমনে হয়ে উঠেছিস তা দেখেই বুঝতে পারছি লখাই। তা এত আনন্দের কারণটা একটু বুঝিয়ে বলবি নাকি আমাকে?’

    ‘বলছি বেজাবাবু, এবার ইস্কুলে টিস্কুলে আমাদের নিয়ে পড়াশোনা হবে, তাই না?’

    ‘বটে? তা হঠাৎ এরকম মনে হল কেন তোর?’

    ‘আমাদের পাশের পাড়ার বুঁচকি’র এবার এইট কেলাস হল যে! সেদিন শুনলাম ভজনকে বলছিল যে ওদের নাকি এবার ভৌতবিজ্ঞান টিজ্ঞান কীসব পড়াবে। ভৌতবিজ্ঞান মানে তো ভূতেদেরই বিজ্ঞান, নয়?’

    ‘হুঁ।’

    ‘ও কী বেজাবাবু, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নাকি?’

    ‘শ্বাসের আর দোষ কী! আচ্ছা লখাই, মাঝেমধ্যে তোর নিজেকে একটু কেমন কেমন লাগে না?’

    ‘লাগে তো! গগন মাস্টার তো একদিন বলেই ফেলেছিল, ‘ওরে বেজা তোর মতন অদ্ভুত প্রতিভা ভূভারতে নেই। রামভজনের রাজলক্ষ্মীও যদি কোনওদিন ধাতুরূপ শব্দরূপ আওড়াতে থাকে তো আশ্চর্য হব না। কিন্তু তোর মতো প্রতিভাকে লেখাপড়া শেখানো আর মাথা দিয়ে পাথর ভাঙা একই কাজ। কথাটা তো প্রশংসার মতোই মনে হল আমার, ঠিক কি না?’

    ‘সাড়ে সাত? ঠিক বলেছিলি তো লখাই?’

    ‘আহা, ওই আর কী। মানে হাফ ইয়ার্লির পর আরও মাসখানেক ছিলুম কি না। হরেদরে ওই সোয়া সাতই ধরুন না কেন। কিন্তু কথাটা কেমন যেন খোঁটা দেওয়ার মতো শোনাচ্ছে বলুন তো বেজাবাবু?’

    ‘আহা, আবার খোঁটার কথা উঠছে কেন। তুই তো সংসারের খোঁটাখুঁটির বাঁধন ছিঁড়ে একপ্রকার উদ্ধারই হয়ে গেছিস বাপ আমার।’

    ‘দেখুন বেজাবাবু, জানি যে এই ঘুঘুডাঙার দশ মাইল দূর দূর অবধি আপনার মতো পণ্ডিত মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। তাই বলে কি আমাকে এত হেলাচ্ছেদ্দা করাটা ঠিক হচ্ছে?’

    ‘আহা, এই তোর এক দোষ লখাই, বড় চট করে মাথা গরম করে ফেলিস। ওরে তোকে কি সে কথা বলেছি আমি? বলি শাস্ত্রে ব্যজস্তুতি বলে একটা কথা আছে জানিস তো? ওর মানে হচ্ছে নিন্দের ছলে প্রশংসা করা। ধরে নে আমি তো প্রশংসাই করলুম না হয়।’

    ‘তা হঠাৎ করে আমার এত প্রশংসা করার বাই উঠল কেন শুনি?’

    ‘এই দেখ, ছেলে এখনও চটে আছে আমার ওপর। বলি এই বয়সে এত রাগ করলে যে সান্নিপাতিক কি সর্দিগরমি হয়ে একটা কাণ্ড বাধিয়ে ফেলবি দেখছি।’

    ‘হ্যা হ্যা হ্যা। ভূতের আবার সান্নিপাতিক আর সর্দিগরমি। বলি লোকে তো সর্দি হলে খোনা গলায় কথা কয় দেখেছি। তা ভূতের সর্দি হলে কি ভূতে মহালয়ার সকালে রেডিওবাবুর মতো মন্তর আওড়াবে বেজাবাবু?’

    ‘এই তো ফের চনমনে হয়ে উঠেছিস দেখছি। সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার। শোন লখাই, এখন নিজেদের মধ্যে রাগারাগি করে লাভ নেই। নিজেদের গোখখুরির দণ্ড তো দিয়েইছি। কিন্তু তাই বলে যার জন্য এত হুজ্জুত হাঙ্গাম সেইটে কি বিষ্টুচরণের হাতে চলে যেতে দেখবি?’

    ‘আপনার কথা মাঝে মাঝেই কেমন যেন হেঁয়ালি লাগে বেজাবাবু। জিনিসটি যে কী সেটাই তো আজ অবধি খুলে বললেন না। একদিন কী একখান পুরোন ডায়েরি না কী একটা এসে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটাকে যত্ন করে রাখিস লখাই। যদি মাসখানেক গুছিয়ে রাখতে পারিস ম্যালা টাকা পয়সা পাবি।’ আমিও ভাবলুন বেজা মিত্তিরের মতো বড়লোক মানুষ যখন বলেছে লুকিয়ে রাখতে তখন খুব দামি কিছু হবে। সেই ভেবে ঠাকুরের আসনের নীচে পুঁতে রেখেছি। কিন্তু সেই নিয়ে যে এত হ্যাঙ্গাম হবে সে জানব কী করে?’

    ‘হুম। আমার চালে কিছু ভুল ছিল না রে লখাই। তুই মানুষটা সরল আর একটু বোকা হলে কী হবে, সৎ আর একরোখা। তা ছাড়া এককালে তোর সঙ্গে আমাদের ফ্যামিলির একটা রিলেশনও ছিলো, জানিস বোধহয়। ভাবলাম তোর কাছেই বোধহয় ডায়েরি আর ম্যাপটা সুরক্ষিত থাকবে।’

    ‘ওই ম্যাপ? ওতে আবার ম্যাপ পেলেন কই? একদিন তো খুলে দেখলাম, বইটার পাতায় পাতায় অং বং চং করে কীসব লেখা, দেখতে বাংলার মতো কিন্তু বাংলা নয়। একটা পাতায় আবার ঘর দরজা কীসব আঁকা, তার সারা গায়ে চিত্তির বিচিত্তির আলপনা। আরেক পাতায় একটা ঘড়া না কী, তার গলা জড়িয়ে একটা সাপ না কী নেতিয়ে আছে। ঘড়ার মাথায় আবার লাইট মারছে। আমি তো দেখে হেসে মরে যাই। ছোঃ, ওটাকে ম্যাপ বলে? ওফফ ম্যাপ দেখেছিলুম বটে আমাদের ক্লাস সেভেনের ভূগোল বইতে। সে হচ্ছে গিয়ে গাদাগুচ্ছের নদীনালা পাহাড় পর্বত শহর টহরের নাম নিয়ে এক নান্দিভাস্যি কাণ্ড। সেসব কী নাম, এখনও দু-একটা মনে আছে বইকি! নদীর নাম মাসিপিসি, মরুভূমির নাম টাকলা মাকুন্দ, পাহাড়ের নাম আন্দাজ না বরকন্দাজ কী একটা…

    ‘ওই জন্যই তো রে লখাই, এই সরল গাম্বাটপনার জন্যই তো তোকে এত ভালোবাসি।’

    ‘দেখুন বেজাবাবু আপনি কিন্তু ফের খুবই অপমান টপমান করছে। এবার কিন্তু ওসব বেজাস্তুতো না মাসতুতো কী একটা বললেন ওসব বলে পার পাবেন না বলে দিচ্ছি, হ্যুঁ।’

    ‘এই দেখো, ছেলে ফের রাগ করে। ওরে গাম্বাট মানে জানিস? জি ইউ এম গাম মানে হচ্ছে আঠা, আর বি ইউ টি বাট মানে হচ্ছে কিন্তু। অর্থাৎ যার মনের মধ্যে ”কিন্তু’ ব্যাপারটা আঠার মতো লেগে থাকে, তাকেই বলে গাম্বাট।”

    ‘ইয়ে, সেটা কি খুব ভালো কিছু বেজাবাবু?’

    ‘ওরে পাগল এই যে মনের মধ্যে একটা কিন্তু কিন্তু ব্যাপার, এর মানেই হচ্ছে প্রশ্ন। আর কে না জানে প্রশ্নই হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। অর্থাৎ কী তোর মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো বর্ষার জলে কইমাছের মতো খলবল করে উঠছে। এবার খাপলা জাল ফেলে ধরে ফেললেই হাতে গরমাগরম জ্ঞান পেয়ে গেলি। এবার সেটাকে গঙ্গাযমুনা করে খাবি নাকি ফুলকপির ঝোল করে সেটা তোর ব্যাপার।’

    ‘কিন্তু কইমাছে তো বড্ড কাঁটা থাকে বেজাবাবু।’

    ‘এই তো ব্যাপারটা জলবত্তরং ধরে ফেলেছিস। ওরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটা শুনিসনি, কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন ইলিশ তুলিতে?’

    ‘এই বার ব্যাপারটা বেশ খোলসা হল। কিন্তু কিন্তু একটা কথা বলুন বেজাবাবু, আপনার অত পেল্লায় সাইজের প্রাসাদ থাকতে পুরোনো ডায়েরিখানা আমার বাড়িতেই বা রাখতে দিলেন কেন?’

    ‘কারণ আছে রে লখাই। ঘোরতর কারণ আছে। বহুদিনের চেষ্টায় যে ধাঁধার সমাধান করতে পেরেছিলাম, ভেবেছিলাম তার ফসল একাই ভোগ করব। কিন্তু যাকে শত্রু ভেবেছিলাম আর যাকে বন্ধু ভেবেছিলাম তারা যে জায়গা পালটে ফেলবে সেটা আগে থেকে কী করে বুঝব বল?’

    ‘সেই থেকেই কী গণ্ডগোলটা পেকে উঠল বেজাবাবু?’

    ‘সে আর বলতে? ভাগ্যিস ডায়েরিটা তোর কাছে আগে রেখে গেছিলাম। তুই তো জানিসই লখাই, তালা আর চাবি একজায়গায় রাখতে নেই, তাতে চোরের সুবিধে হয়।’

    ‘সে কী আর বুঝিনি বেজাবাবু? আন্দাজ করেছি অনেকটাই। কিন্তু তাতে করে কি আর এই হাঙ্গাম হুজ্জোত থেকে আমি বা আপনি রক্ষা পেলুম?’

    ‘সেটা তোর দোষ নয় রে লখাই। পুরোটাই আমার নির্বুদ্ধিতা। ওই যে বললাম, শত্তুর চিনতে ভুল করেছি। তারই দণ্ডভোগ করছি এখন।’।

    ‘তা এখন কী করণীয় বেজাবাবু?’

    ‘ওই ডায়েরিটা যেন তেন প্রকারেণ রক্ষা করতে হবে রে লখাই।’

    ‘কিন্তু কী করে? এই তো বললেন ভজন নাকি ভিটে ছেড়ে পালাবার মনস্থ করছে। তা ও যদি বাড়ি ছেড়ে লম্বা দিয়েই থাকে থাকলে কীসের কী রক্ষা করা।’

    ‘সেটাই তো চিন্তার রে লখাই। আগে তোর ভাইপোর ওই বাড়ি ছেড়ে পালানোটা আটকাতে হবে। তারপর ম্যাপটা উদ্ধার করতে হবে। তারপর ওকে দিয়েই বাকি কাজ সমাধা করতে হবে।’

    ‘বাকি কাজ বলতে?’

    ‘যে কাজের জন্য আমি ঘর ছেড়ে পাগলের মতো কানপুর দিল্লি আর লখনউ শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি পাঁচটা বছর।’

    ‘কী কাজ বেজাবাবু? একটু খোলসা করে না বললে শরীরে মনে তেমন উৎসাহ পাচ্ছি না যে।’

    ‘সে তো তোকে এখন বলতেই হবে রে লখাই। এ ছাড়া আর উপায় নেই। বলি আমাদের জমিদারবাড়ির গুমঘরের কথা শুনেছিস তো।’

    ‘তা শুনিনি বললে নেহাত অধর্ম হবে বেজাবাবু, হাজার হোক এত পুরুষের সম্পর্ক। কিন্তু সেসব তো সবই গল্পকথা। শুনেছি আজ অবধি অনেক চেষ্টাচরিত্তির করেও কেউই ওই গুমঘরের খোঁজ পায়নি। কিন্তু তার সঙ্গে ওই ডায়েরির কী যোগাযোগ বেজাবাবু?’

    ‘যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ রে লখাই, খুবই ঘনিষ্ঠ। যদি ওই ছবিটা ভালো করে দেখতিস, তাহলে বুঝতে পারতিস যে ওটা ঘড়া নয়, একটা কলসীর ছবি। আর তার গলা জড়িয়ে যে সাপের ছবিটা আছে ওটা যখ।’

    ‘য য য যখ? আমি কি ঠিক শুনলাম বেজাবাবু?’

    ‘একদম ঠিক শুনেছিস লখাই। আর ঘড়ার মুখে যে লাইট মারার কথা বলছিলিস ওটা টর্চের লাইট নয়, ধন-রত্নের আভা।’

    ‘তা তা তার মানে কী বেজাবাবু?”

    ‘তার মানে যেটা তোকে রাখতে দিয়েছিলাম ওটা যে সে ডায়েরি নয়রে লখাই। ওটা একটা গুপ্তধন খুঁজে পাওয়ার নকশা, আমাদের পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত সম্পদ। বহুকষ্টে ওই ডায়েরির সঙ্কেত উদ্ধার করে গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছিলাম। আর সেই গুপ্তধন রাখা আছে আমাদের ওই গুমঘরেই।’

    * * *

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্ধকারের গল্প – অভীক সরকার
    Next Article চক্রসম্বরের পুঁথি – অভীক সরকার

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }