Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মিত্ৰপ্ৰাপ্তি

    Ek Pata Golpo এক পাতা গল্প41 Mins Read0
    পঞ্চতন্ত্র মিত্রভেদ

    হরিণ কচ্ছপ ইঁদুর কাক

    দক্ষিণ ভারতে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। তার কাছেই ছিল এক বিশাল বটগাছ। কত পাখি তার শাখায় বাস করত। তার ফল খেত। কত যে বানর তার ডালে লাফালাফি করত আর পাতা-ফুল-ফল খেত। কত পোকা-মাকড় তার কোটরে বাস করত। আর কত পথিকই না তার ছায়ায় আশ্রয় নিত। তাই তাকে দেখে সবাই বলত―এভাবে যারা পরের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেয়, তারাই পৃথিবীর অলঙ্কার, বাকি সব ভারস্বরূপ।

    সেই বটগাছে থাকত এক কাক। লঘুপতনক। খুব দ্রুত উড়তে পারত। তাই এ নাম। একদিন ভোরবেলা লঘুপতনক যাচ্ছে নগরের দিকে। খাবারের সন্ধানে। হঠাৎ দেখে―যমদূতের মতো নিকষকালো এক ব্যাধ। এক হাতে জাল, অন্য হাতে খাবারের ভাণ্ড। এদিকেই আসছে। ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল! আজ বোধ হয় বটবাসী পক্ষিকুলের শেষ দিন! সে দ্রুত ফিরে এসে পক্ষিদের বলল: ভায়েরা! ঐ শয়তান ব্যাধ আসছে আমাদের ধরতে। ও নিশ্চয়ই জাল পেতে খাবার ছড়াবে। সাবধান! কেউ লোভে পড়ে খেতে যেও না। মারা পড়বে।

    একথা বলতে বলতেই ব্যাধ এসে পড়ল। জাল বিছিয়ে চাল ছড়িয়ে লুকিয়ে রইল। কিন্তু বৃক্ষবাসী কোনো পক্ষিই ধরা দিল না। ব্যাধ হতাশ হয়ে বসে রইল। এমন সময় চিত্রগ্রীব নামে এক কবুতর এল তার দলবল নিয়ে। হাজার কবুতর তার দলে। নিচের দিকে তাকিয়ে নিসিন্দা ফুলের মতো সাদা চাল দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। লঘুপতনকের নিষেধ সত্ত্বেও চাল খেতে নেমে দলসহ আটকা পড়ল। কথায় বলে—লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আসলে, লোভে কারো বুদ্ধিনাশ হলে বিপদ তাকে ছাড়ে না। তাইতো—পরস্ত্রীহরণ দোষ জেনেও রাবণ তা করে সবংশে নিহত হয়েছিল। সোনার হরিণ অসম্ভব জেনেও রাম তা ধরতে গিয়ে সীতাকে হারিয়েছিলেন। পাশাখেলার ভয়াবহ পরিণতি জেনেও যুধিষ্ঠির তা খেলে রাজ্যহারা হয়েছিলেন। তদ্রূপ চিত্রগ্রীবও লোভে পড়ে এখন মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত।

    ব্যাধ তো মহাখুশি! এতগুলো কবুতর! একসঙ্গে! সে লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে এল মারা জন্য। চিত্রগ্রীব দেখল, এভাবে পড়ে থাকলে মরণ নিশ্চিত। বাঁচার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সে পায়রাদের ডেকে বলল: তোমরা ভয় পেওনা, ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবেলা কর। দেখ—

    বিপদে যে ধৈর্য ধরে সে-ই বেঁচে থাকে।
    দুর্বলেরা যখন তখন পড়ে যে বিপাকে।।
    মহতেরা সমান থাকে সুদিনে দুর্দিনে।
    সুর্য যেমন উদয়ে লাল তেমনি অস্তগমনে।।

    তাই, চলো, জালসহ উড়ে আমরা অন্য কোথাও যাই। সেখানে গিয়ে মুক্ত হব। তবে, সাবধান! সবাইকে একসঙ্গে উড়তে হবে। তা না হলে বিপদ! জড়াজড়ি করে সবাই মারা পড়ব। দেখ—সুতা যতই চিকন হোক, অনেকগুলো এক সঙ্গে হলে তা দিয়ে হাতিও বাঁধা যায়।

    চিত্রগ্রীবের কথামতো পায়রাগুলো তা-ই করল। জাল সমেত উড়ে চলল। তা দেখে ব্যাধ পেছন পেছন দৌড়াতে লাগল। প্রথমে একটু হতাশ হলেও পরে এই ভেবে আশ্বস্ত হলো যে—

    পাখিরা সব এক হয়ে মোর
    জাল নিয়ে ঐ যাচ্ছে চলে।
    আর কতক্ষণ? দেখো না ঐ
    ঝগড়া করে পড়ল বলে।।

    ঘটনা দেখে লঘুপতনকের বিস্ময় লাগে। সে আহার ভুলে ‘দেখি না কি হয়’― এই কৌতূহলে পেছনে পেছনে উড়তে লাগল। কিন্তু পায়রাগুলো উড়ছে তো উড়ছেই। থামার কেনো লক্ষণ নেই। অনেক দূরে চলে গেছে। ব্যাধের দৃষ্টির বাইরে। ব্যাধ তাই নিরাশ হয়ে বলল:

    যা হবার নয় তা হয় না কভু
    যা হবার তা এমনিতেই হয়।
    ভাগ্যে যদি না-ই থাকে
    হাতে পেয়েও ফসকে যায়।।
    এমন বস্তু পেতে গিয়ে
    যার যা আছে তা-ও যায়।
    মাংস থাক দূরের কথা
    জালটাও যে গেল, হায়!!

    এই বলে ব্যাধ অতিশয় দুঃখিত মনে ফিরে এল। তা দেখে চিত্রগ্রীব বলল: বন্ধুরা, ও বেটা হার মেনেছে। এবার উত্তর-পূর্ব দিকে চল। সেখানে পাহাড়ের গায়ে আমার এক বন্ধু আছে—হিরণ্যক। দেখি, সে আমাদের জন্য কি করে। কথায় বলে— বিপদেই বন্ধুর পরিচয়।

    চিত্রগ্রীবের নির্দেশে পায়রারা উত্তর-পূর্ব দিকে উড়ে চলল। অনেকটা পথ গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করল। সেখানেই সুড়ঙ্গ করে থাকে হিরণ্যক নামে এক ইঁদুর। হাজারটা প্রবেশপথ তার সুড়ঙ্গের। এ যেন এক শক্তিশালী দুর্গ। এমনই সুরক্ষিত যে, কেউ তাকে ধরতে পারবে না। তা দেখে চিত্রগ্রীব পায়রাদের উদ্দেশ করে বলল: দেখ, মদহীন হাতি, দাঁতহীন সাপ আর দুর্গহীন রাজা এ তিনজনই অরক্ষিত। কারণ, যুদ্ধে সহস্র হাতি আর লক্ষ ঘোড়া যা না করতে পারে, একটি শক্তিশালী দুর্গ তার চেয়ে বেশি করতে পারে। এটা রাজনীতির কথা।

    চিত্রগ্রীব একটি সুড়ঙ্গদ্বারে গিয়ে তারস্বরে ডাক দিয়ে বলল: বন্ধু হিরণ্যক! শিগির এস! মহাসঙ্কট!

    বন্ধুর গলা শুনে হিরণ্যকের যেন আনন্দ আর ধরে না। গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। মনে মনে বলে: বন্ধু-বান্ধব হচ্ছে চোখের উৎসব, দেখলেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। আর যখন-তখন বন্ধুরা বাড়িতে এলে যে-আনন্দ পাওয়া যায়, তা ইন্দ্রপুরীতেও মেলে না।

    এরপর প্রকাশ্যে চিৎকার দিয়ে সে বলল: আসছি!

    বাইরে এসে দেখে দলবলসহ চিত্রগ্রীব জালে আটকা। জিজ্ঞেস করার আগেই চিত্রগ্রীব বলল: দেখ, নিজের পাপ-পুণ্যের ফল মানুষ পায়—যার কাছ থেকে, যে-কারণে, যখন, যেভাবে, যা, যতটা, যেখানে তার পাওয়ার কথা—তার কাছ থেকে, সে-কারণে, তখন, সেভাবে, তা-ই, ততটা, সেখানে এ হলো শাস্ত্রের বিধান। তাই, জিভের লালসা মেটাতে গিয়ে আজ আমাদেরও এই দশা! এবার তুমি দ্রুত আমাদের মুক্ত কর, বন্ধু।

    সব শুনে হিরণ্যক বলল: পাখিদের স্বভাবই এই—শতযোজন দূর থেকে তারা শুধু খাবারটাই দেখে, জালটা আর চোখে পড়ে না। এরপর যখন সে চিত্রগ্রীবের কাছে গিয়ে বাঁধন কাটতে শুরু করবে তখন চিত্রগ্রীব বিনয়ের সঙ্গে বলল: বন্ধু, এমনটি করো না। আগে ওদের মুক্ত কর, তারপর আমাকে।

    হিরণ্যক রাগ করে বলল: কি বলছ তুমি! আগে রাজা, তারপর প্রজা।

    চিত্রগ্রীব: তা নয়, বন্ধু! ওরা সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। ওদের সমস্ত বিশ্বাস আমায় অর্পণ করেছে। বিশ্বাস নষ্ট হলে আর কি থাকে? তাছাড়া, ধর, আমার বাঁধন কাটতে কাটতেই তোমার দাঁত ভেঙ্গে গেল, কিংবা শয়তান ব্যাধটা এসে পড়ল। তখন? তখন আমার নরক ঠেকাবে কে? তাছাড়া দলপতি হিসেবে ওদের দায়-দায়িত্ব তো আমারই। কথায় বলে না—

    প্রজারা সব কষ্টে আছে রাজা আছে সুখে।
    স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নরক কাটবে যে তার দুঃখে।।

    শুনে হিরণ্যক ভীষণ খুশি হয়ে বলল: বন্ধু, রাজধর্ম আমি জানি বৈ-কি! তোমায় একটু পরীক্ষা করছিলাম। ঠিক আছে, আগে ওদেরটাই কাটব, পরে তোমারটা। এভাবে চললে নিশ্চয় তুমি লক্ষ পায়রার রাজা হতে পারবে। শাস্ত্রে আছে না—

    ভৃত্যে দয়া, ধনবণ্টন করেন যিনি সমান।
    সেই মহীপাল শাসন করতে পারেন ত্রিভুবন।।

    এই বলে হিরণ্যক একে একে সকলের বাঁধন কেটে চিত্রগ্রীবকে বলল: বন্ধু, এবার যাও। আবার কখনো বিপদে পড়লে এসো। সকলের পক্ষ থেকে চিত্রগ্রীব তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ির উদ্দেশে উড়াল দিল। নীতিশাস্ত্র যথার্থই বলেছে:

    বন্ধুর সাহায্যে হয় দুঃসাধ্য সাধন।
    অতএব, মিত্র করো নিজের মতন।

    এই সমস্ত ঘটনা লঘুপতনক বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছে। ভাবছে, ওঃ! হিরণ্যকের কি বুদ্ধি! কি সুরক্ষিত তার দুর্গ! বন্ধুর প্রতি তার কি বিশ্বাস-ভক্তি! এ না থাকলে তো পাখিদের নিশ্চিত মরণ ছিল। আমি তো জীবনে কাউকে বিশ্বাসই করতে পারলাম না। যেমন আমার চেহারা, তেমন গলা, আর তেমনই চঞ্চল স্বভাব।

    কিছুক্ষণ ভেবে সে স্থির করল, যেভাবেই হোক, এর সঙ্গে ভাব করতে হবে। তারপর গাছ থেকে নেমে সুড়ঙ্গদ্বারে গিয়ে চিত্রগ্রীবের কণ্ঠে বলল: বন্ধু, আরেকটি বার এসো তো। কথা আছে।

    হিরণ্যক বেরিয়ে এল। কিন্তু, লঘুপতনককে দেখে দ্রুত গর্তে ঢুকে বলল: তোমার এখানে কি চাই? দূর হয়ে যাও এক্ষুণি।

    লঘুপতনক: অমন করছ কেন? আমি তোমাদের সব ঘটনা দেখেছি। তোমার এই বিশাল দুর্গ! তোমাদের গভীর বন্ধুত্ব! কিভাবে তুমি পাখিদের মুক্ত করলে! সব! সব! আমি মুগ্ধ! আমার কোনো বন্ধু নেই। আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। ভবিষ্যতে বিপদে পড়লে তুমি আমায় উদ্ধার করতে পারবে। তুমি না করো না।

    হিরণ্যক: তা কি করে হয়? তুমি হচ্ছ খাদক, আর আমি খাদ্য। এই অসমতে বন্ধুত্ব হয় না। তুমি যাও।

    লঘুপতনক: তুমি যতই বল, আমাকে তোমার বন্ধু করতেই হবে। এই আমি তোমার দরজায় বসলুম। হয় বন্ধুত্ব, না হয় অনশনে মৃত্যু।

    হিরণ্যক: আঃ! মিছিমিছি বিরক্ত করছ কেন! বলেছি না—শত্রুর সঙ্গে কখনো মিত্ৰতা হয় না। শাস্ত্রে আছে—শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা যতই গভীর হোক তা স্থায়ী হয়না, যেমন জল যতই গরম হোক তা আগুনকে নেভাবেই।

    লঘুপতনক: আরে, তোমার সঙ্গে আমার তো কখনো দেখাই হয়নি। তবে আমি তোমার শত্রু হলাম কি করে?

    হিরণ্যক: দেখ, শত্রু দু-রকমের

    জন্মগত ও কারণগত। কারণগত শত্রুতা প্রতিকারে দূর হয়। কিন্তু, জন্মগত শত্রুতা জীবন দিয়ে শোধ করতে হয়। সাপে-নেউলে, জলে—আগুনে, ব্যাধে-হরিণে, সতীনে-সতীনে, দুর্জনে-সুজনে ইত্যাদি হলো জন্মগত শত্রুতা, যেমন তোমাতে-আমাতে। তাই, তুমি ফিরে যাও।

    লঘুপতনক: আরে ধ্যাৎ! কি আজে-বাজে বকছ! শোনো কাজের কথা। এ দুনিয়ায় বন্ধুত্ব হয় কারণে, আবার শত্রুতাও হয় কারণে। তাই এসো, আমরা বন্ধু হয়ে পরস্পরের কাজে লাগি। আরো শোনো—মানুষে মৈত্রী হয় উপকারে, পশু ও পক্ষিতে হয় বিশেষ কারণে, মূর্খদের হয় ভয়ে কিংবা লোভে, আর সজ্জনের হয় কেবল দর্শনে। তুমিও সজ্জন, আমিও সজ্জন। কাজেই আমাদের বন্ধুত্ব তো হয়েই গেছে। সজ্জনের বন্ধুত্ব আখের রসের মতো আগা থেকে গোড়ার দিকে পাকে পাকে বাড়ে। আর দুর্জনের বন্ধুত্ব এর বিপরীত—গোড়া থেকে আগার দিকে পাকে পাকে কমে। কিংবা ধরো, দিনের প্রথমার্ধ ও পরার্ধের ছায়ার মতো। পরার্ধের ছায়া যেমন শূন্য থেকে ক্রমে ক্রমে বাড়ে, সজ্জনের বন্ধুত্বও তেমনি। কিন্তু দুর্জনের বন্ধুত্ব প্রথমার্ধের ছায়ার মতো—শুরুতে ব্যাপক, ক্রমশ কমে। আমি শপথ করে বলছি, তুমি আমায় সজ্জন বলে বিশ্বাস করতে পার।

    হিরণ্যক: দেখ, আমি তোমার এই শপথ-টপথে বিশ্বাস করি না। শাস্ত্রে আছে—শপথ নিয়ে সন্ধি করলেও শত্রুকে বিশ্বাস করবে না, কারণ দেবরাজ শপথ নিয়ে বিশ্বাসের সুযোগেই বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন। শত্রু সূক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে ভেতরে ঢুকে এক সময় ধ্বংস করে দেয়, যেমন বানের জল ছিদ্রপথে প্রবেশ করে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। যে—ব্যক্তি শত্রু কিংবা অসতী স্ত্রীকে বিশ্বাস করে, সে অকালে প্রাণ হারায়। কাজেই নিজের সুখ-সমৃদ্ধিকামী বিচক্ষণ ব্যক্তি দেবগুরু বৃহস্পতিকেও বিশ্বাস করেনা। লঘুপতনক ভাবল: এ তো রাজনীতিতে ভীষণ তুখোড়! এজন্যই তো এর সঙ্গে ভাব করতেই হবে। প্রকাশ্যে বলল: দেখ, পণ্ডিতেরা বলেন সজ্জনদের বন্ধুত্ব হয় সাত কথায় কিংবা সাত পা এক সঙ্গে চললে। তাই তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এবার আমি যা বলি শোনো। তুমি যদি আমায় বিশ্বাস না-ই করতে পার, তাহলে ঠিক আছে, তুমি তোমার দুর্গের মধ্যেই থাক। আমি বাইরে থেকেই তোমার সঙ্গে আলাপ করব।

    হিরণ্যক ভাবল: এ তো খুব বিদগ্ধের মতো কথা বলছে! তা ভাব করিই না। প্রকাশ্যে বলল: তবে তা-ই হোক। কিন্তু, এক শর্ত—তুমি কখনো আমার দুর্গে ঢুকতে পারবে না। শাস্ত্রে আছে— শত্রু প্রথমে ভয়ে ভয়ে রাজ্যে পা দেয়, তারপর অনায়াসে ঢুকে পড়ে—যেমন প্রণয়ীর হাত নারীর শরীর দখল করে।

    লঘুপতনক: তা-ই হবে।

    তারপর তারা দুজনে পরম আনন্দে দিন কাটাতে লাগল। ইঁদুর গর্তে, কাক গাছে। তাতে কি? মনের মিলটাই আসল। তাই হাসি-ঠাট্টা, সুখ-দুঃখের কথা বলে তাদের দিন কাটতে লাগল। লঘুপতনক দূর-দূরান্ত থেকে মাংসের টুকরো, নৈবেদ্যের অবশেষ রান্নাকরা খাবার ইত্যাদি এনে হিরণ্যককে দেয়। হিরণ্যক চাল, ডাল ইত্যাদি যোগাড় করে রাখে। লঘুপতনক এলে দেয়। এভাবে তাদের বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। এক সময় ইঁদুর গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে, আর কাকও গাছ থেকে নেমে আসে। আসলে— গোপন কথা বলা, সুখ-দুঃখের খবর নেয়া, দান করা, দান গ্রহণ করা, খাওয়া এবং খাওয়ানো এই ছয়টি হলো ভালোবাসার লক্ষণ। এ সংসারে ভালোবাসা ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ দানের ব্যাপার থাকে। দেবতারাও দান না পেলে অভীষ্ট বর দেয় না। দুধ ফুরোলে বাছুর মাকে ত্যাগ করে। খাবার দিলে গাভী সব দুধ দিয়ে দেয় মালিককে, বাছুরের কথা ভাবে না। কাজেই আদান-প্রদান হচ্ছে ভালোবাসার প্রধান কারণ। এই আদান-প্রদানের মাধ্যমেই এক সময় কাক ও ইঁদুর জন্মশত্রুতা ভুলে অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হয়। শুধু তা-ই নয়, ইঁদুর কখনো কখনো কাকের পাখার নিচেও পরম নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেয়।

    একদিন কান্নাজড়িত কণ্ঠে লঘুপতনক এসে বলল: ভাই হিরণ্যক, তোমাকে যে আমার ছেড়ে যেতে হবে!

    হিরণ্যক: কেন, কি হয়েছে, ভাই?

    লঘুপতনক: এই দেশটার প্রতি আমার বিরক্তি ধরে গেছে! অন্য কোথাও যেতে হবে!

    হিরণ্যক: খুলে বল না, কি হয়েছে!

    লঘুপতনক: প্রচণ্ড খরায় দেশে আকাল পড়েছে! কোথাও খাবার জুটছে না! পশু-পাখির বরাদ্দ খাবরটুকুও কেউ ছড়িয়ে দিচ্ছে না! উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত কেউ ফেলছে না! ফেলবে কি করে? মানুষই তো না খেয়ে মরছে! দেখার কেউ নেই! রাজার এ ব্যাপারে কোনো উদ্বেগ নেই! মানুষ খাবার না পেয়ে বাড়ি বাড়ি জাল পাতছে। পাখি ধরার জন্য। আমিই তো প্রায় আটকা পড়েছিলাম। বুদ্ধির জোরে বেঁচে গেছি। জালে আটকা পড়ে দলে দলে পাখি মরছে! এ আমি দেখতে পারব না! তাই, এদেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাচ্ছি! হিরণ্যক: তা কোথায় যাবে?

    লঘুপতনক: দাক্ষিণাত্যে এক বিশাল বন আছে। সেখানে।

    হিরণ্যক: কিন্তু, সেখানে তোমাকে কে সমাদর করবে?

    লঘুপতনক: দেখ, রাজত্ব আর বিদ্বত্ত্ব সমান নয়। রাজা শুধু নিজের দেশেই সমাদর পান। কিন্তু, বিদ্বানের সমাদর সর্বত্র। তাছাড়া, ঐ বনের মধ্যে এক গভীর জলাশয় আছে। সেখানে আমার এক কচ্ছপ-বন্ধু থাকে মন্থরক। সে আমাকে মাছটা—কাঁকড়াটা ধরে দেবে। আমি খাব। দিন চলে যাবে।

    কিছুক্ষণ চুপ থেকে হিরণ্যক বলল: বন্ধু, আমাকেও তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও! আমার বড় কষ্ট!

    লঘুপতনক: তোমার আবার কষ্ট কিসের?

    হিরণ্যক: সে অনেক কথা। ওখানে গিয়েই বলব।

    লঘুপতনক: তা-তো বুঝলাম, কিন্তু তুমি যাবে কি করে? আমি তো উড়ে যাব।

    কাতর স্বরে হিরণ্যক বলল: তুমি যদি আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে থাক, তাহলে তোমার পিঠে করে আমায় নিয়ে চল।

    লঘুপতনক মহাখুশিতে ‘কা কা’ রবে বলল: সে তো আমার পরম সৌভাগ্য! তবে আর দেরি কেন? উঠে এসো আমার পিঠে।

    হিরণ্যক লঘুপতনকের পিঠে উঠে শক্ত করে ধরে থাকল। আর লঘুপতনক উড়ে চলল মন্থরকের উদ্দেশে। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। আঁধার নামতে কিছু বাকি। এমন সময় তারা গিয়ে পৌঁছল গন্তব্যে। জলাশয়ের তীরে এক গাছের কোটরে হিরণ্যককে রেখে লঘুপতনক ডাক ছাড়ল: বন্ধু মন্থরক, আমি লঘু। একবার উঠে এসো না, ভাই।

    দীর্ঘদিন পর বন্ধুর ডাক শুনে মন্থরক চমকে উঠল। বিপদ-টিপদ নয় তো! তাড়াতাড়ি উঠে এসে লঘুপতনককে জড়িয়ে ধরে বলল: কেমন আছ, বন্ধু?

    লঘুপতনকও মন্থরককে আলিঙ্গন করে বলল: মনটা বড়ই উতলা ছিল। তোমার স্পর্শে শান্ত হলো। দেখ, লোকে শরীরের দাহ কমাতে কর্পূরমাখা চন্দন মাখে, কিন্তু তোমার মতো বন্ধু থাকলে তার আর চন্দনে কি প্রয়োজন? বন্ধুর আলিঙ্গনই যথেষ্ট।

    এমনি সময় হিরণ্যক কোটর থেকে বেরিয়ে এসে লঘুপতনকের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তা দেখে মন্থরক বলল: ভাই, এ ইঁদুরটি কে? এ তো তোমার খাদ্য?

    লঘুপতনক: না, ভাই। এ এক অসাধারণ গুণী ব্যক্তি। মাথার চুল, বৃষ্টির ধারা কিংবা আকাশের তারা যেমন গোণা যায় না, এর গুণের কথাও তেমনি বলে শেষ করা যায় না। তাই তো, এ-ও তোমার মতো আমার এক পরম বন্ধু। এর বিশাল রাজত্ব আছে। কিন্তু, মনে বড় কষ্ট। তাই সব ছেড়ে চলে এসেছে।

    মন্থরক: কিসের কষ্ট?

    লঘুপতনক: জানতে চেয়েছিলাম। বলল, এখানে এসে বলবে।

    মন্থরক: তা-ই হবে। তবে রাত হয়ে এল। এবার আমি যাই। কাল শুনব। লঘুপতনক ও হিরণ্যক: তথাস্তু।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপঞ্চতন্ত্র মিত্রভেদ
    Next Article দেবদাস

    Related Articles

    Ek Pata Golpo মহালয়া

    মহালয়া: মহিষাসুরমর্দিনী (Mahalaya: Mahishasuramardini)

    September 10, 2025
    Ek Pata Golpo

    গাছের পাতা নীল – আশাপূর্ণা দেবী

    July 7, 2025
    Ek Pata Golpo

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – অম্লান দত্ত

    June 19, 2025
    Ek Pata Golpo

    লিঙ্গপুরাণ – অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    June 3, 2025
    Ek Pata Golpo

    ৪. পড়ন্ত বিকেল

    April 5, 2025
    Ek Pata Golpo ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    পূজারির বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }