Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    আনা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি

    August 30, 2025

    আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ১ (অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ)

    August 30, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মিশরের ইতিহাস – আইজাক আসিমভ

    দ্বিজেন্দ্রনাথ বর্মন এক পাতা গল্প265 Mins Read0

    ১০. টলেমীয় মিশর

    ১০. টলেমীয় মিশর

    প্রথম টলেমি

    ক্লিওমেনিসের শাসনামলে মিশরের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল আর আলেক্সান্ডার যখন বিজয়োল্লাসে পারস্যের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন, ঘটনার ডামাডোলে তিনি কিছুটা পেছনে পড়ে গেলেন। এদিকে আলেক্সান্ডার ছোটবড় সব শহর দখল করার পর অবশেষে সমগ্র মিশরের ম্রাটরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন (পারস্যের শেষ ম্রাট তৃতীয় দারায়ুস ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নিজের লোকজনের হাতেই নিহত হন।

    দূরদূরান্তে অভিযান শেষে আলেক্সান্ডার ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বেবিলনে ফিরে এসে নূতন অভিযানের পরিকল্পনা করছিলেন আর তখনই তার মৃত্যু হয়।

    মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল মাত্র তেত্রিশ বছর, এক নব-যুবক, আর তিনি পেছনে কোনো সমর্থ উত্তরাধিকারীও রেখে যেতে পারেননি। তার ছিল এক ঝগড়াটে পারসিক মাতা, এক মানসিক জরাগ্রস্ত সৎভাই, আর এক মরণোত্তর পুত্র। এদের কাউকে হিসাবের মধ্যেই গণ্য করা যায়না।

    প্রবাদ আছে মৃত্যুকালে আলেক্সান্ডারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি কাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করতে চান, শেষ নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে তিনি নাকি বলেছিলেন, “সবচেয়ে শক্তিমানকে।”

    তিনি হয়তো এমনটা নাও বলে থাকতে পারেন, তবে তার জেনারেলরা এমনটা বলেছিলেন বলেই প্রচার করেছিল। তাদের প্রত্যেকেই এক একটা অংশ দখল করে নেয়, আর অন্য অংশগুলি কজা করতে উঠে পরে লেগে যায়। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জেনারেল ছিলেন টলেমী, সেলুকাস আর এন্টিগোনাস। শেষের জনের সহায়ক ছিল তার তদীয় পুত্র ডিমেট্রিয়াস।

    টলেমী (অথবা গ্রিক রূপান্তর টলেমাইয়ুস) ছিলেন একজন মেসিডোনীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির পুত্র, রটনা রয়েছে তিনি ছিলেন ফিলিপের অবৈধ সন্তান, আর সেই সূত্রে আলেক্সান্ডারের সৎ ভাই (হয়তো এটা সঠিক নয়, আর রটনাটি টলেমী নিজেই ছড়িয়েছিলেন তার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করার জন্য)।

    আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর সাথে সাথেই টলেমী মিশরের গভর্নরের পদটি দখল করে নেন আর ক্লিওমেনেসকে মৃত্যুদণ্ড দেন (একজন দক্ষ শাসকের উপযুক্ত পুরস্কার)। টলেমী বেশ সুচিন্তিতভাবেই তার তার রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ করেন। মিশর ছিল এক সমৃদ্ধ দেশ, নীলের নিয়মিত বন্যা আর কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মিশর তৎকালীন বিশ্বের মধ্যে ছিল সবচেয়ে সম্পদশালী দেশ।

    টলেমী বেশ চাতুর্যের সাথে আলেক্সান্ডারের দেহাবশেষ এনে মেম্ফিসে সমাহিত করেন, যেহেতু আলেক্সান্ডারের ভাবমূর্তি তৎকালীন বিশ্বে সবচেয়ে উজ্জ্বল যাতে তার উপর আরোপিত হয়েছিল অর্ধ-দেবত্ব।

    জেনারেলদের মধ্যে টলেমীই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি বুঝতে পেরেছিলেন কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে সমগ্র দেশ শাসনের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তিনি বরং মিশরের শাসক হতে পেরেই সন্তুষ্ট, গোটা সাম্রাজ্য কজা করতে গিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ার কি প্রয়োজন? নীল উপত্যকা আর তার প্রবেশপথ তার আয়ত্তে থাকলেই হলো, যাতে সম্ভাব্য আক্রামকদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়, যাতে উত্তরের সমুদ্রপথে সংযোগ রক্ষা হতে পারে।

    পশ্চিম দিকটাই সহজতর বলে মনে হয়েছিল। টলেমী চেয়েছিলেন শুধু সাইরেনি ও লিবীয় মরুদ্যান তার অধীনতা স্বীকার করুক, যেগুলি পারস্য ও আলেক্সান্ডারের অধীনে ছিল, আর এরা টলেমীর অধীনতা স্বীকারে তেমন ঝামেলা করেনি।

    পূর্ব দিকেও তেমন সমস্যা ছিলনা। ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি সিরিয়ার দিকে একটি অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি বেশ চাতুর্যের সাথে যেরুজালেম আক্রমণ করেন সাবাথ ডে-তে। অতিধার্মিক ইহুদিরা সাবাথ ডে-তে যুদ্ধ করতে রাজি হয়নি, তাই বেশ বিনা বাধাতেই টলেমী যেরুজালেম অধিকার করে নেন।

    সমস্যা দেখা দিয়েছিল উত্তরে। তিনি একটি নৌবহর সাজিয়ে গ্রীসের বিভিন্ন দ্বীপে অভিযান পরিচালনা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সেসব এলাকায় কিছু মিত্র লাভ করা। সেখানে বাধা এল এন্টিগোনাস আর ডিমেট্রিয়াসের তরফ থেকে। আর সেখানে ৩০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পিতা এবং পুত্রের নৌ আক্রমণে টলেমীকে এক চরম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছিল।

    সে সময় এন্টিগোনাসের বয়স ছিল পঁচাত্তর বছর আর এই বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর আগে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়াসে এশিয়ার রাজা উপাধি ধারণ করলেন। টলেমীও এই পরাজয়ের জ্বালা বিনা বাধায় মেনে নিতে রাজি ছিলেননা। তিনিও নিজেকে রাজা বলে ঘোষণা করলেন, এন্টিগোনাস ও ডিমেট্রিয়াসের সম্মিলিত বাহিনীর মিশর আক্রমণ প্রতিহত করলেন, আর তাতে করে তার নূতন উপাধিটির সার্থকতা প্রতিপন্ন হয়ে গেল।

    মিশরের রাজারূপে টলেমী এক বংশধারা প্রতিষ্ঠা করে গেলেন যা পরবর্তী তিন শতাব্দীব্যাপী টিকে ছিল, যেটা পূর্ববর্তী তিন সহস্রাব্দের মধ্যে কোনো রাজবংশই করতে সক্ষম হয়নি। এই রাজবংশকে বলা যেতে পারে মেসিডোনীয় রাজবংশ বা টলেমীর পিতা লাগিডের নামানুসারে লাগিডীয় বংশ বা মিশরীয় রীতি অনুযায়ী একত্রিংশ রাজবংশ।

    সাধারণভাবে এই রাজবংশকে টলেমীয় বংশরূপে উল্লেখ করা হয়, কারণ এই বংশের সব রাজাই এই উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন।

    শুধু টলেমী ও এন্টিগোনাসই একমাত্র জেনারেল ছিলেননা যারা রাজা হয়েছিলেন। সেলুকাস, যিনি বেবিলনিয়ায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তিনিও রাজা উপাধিটি গ্রহণ করেছিলেন। তার বংশধরদের বলা হতো সেলুকীয়, আর পশ্চিম এশিয়ায় তাদের রাজত্বকে বলা হয় সেলুকীয় সাম্রাজ্য।

    উত্তরে মাত্র একবার পরাজিত হওয়ার জন্যই যে প্রথম টলেমী হাত গুটিয়ে নিয়েছিলেন তা নয়। তিনি তার নৌবহরকে পুনরায় সুসজ্জিত করে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকেন। ৩০৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ডিমেট্রিয়াস রোডস দ্বীপ অবরোধ করে বসেন, যেটা টলেমীর পরাজয় সত্ত্বেও মিশরের সাথে তার মিত্রতা বজায় রেখেছিল। রোডসবাসীরা বেশ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, আর টলেমী তাদের সাহায্যার্থে নৌবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। ডিমেট্রিয়াস অবরোধ তুলে নিয়ে পিছু হটে যান। কৃতজ্ঞ রোডসবাসীরা টলেমীকে “সোটার” (ত্রাণকর্তা) উপাধি প্রদান করে।

    আলেক্সান্ডারের পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে একটা প্রথা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, রাজারা একটা চটকদার উপনাম গ্রহণ করত যার মাধ্যমে একে অন্যের থেকে আলাদা করা যায়, আর ইতিহাসে তাদের চেনা যায়। সচরাচর যে রাজা যত কমজোর তার উপনামটা ততই চটকদার হতো। পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় সব রাজাই এমনটা করত, তবে আমি শুধু তাদের সাথেই এটা যুক্ত করতে চাই মিশরের সাথে যাদের সম্পর্ক আছে। তাই প্রথম টলেমীকে বলা যায় প্রথম সোটার।

    যেহেতু সকল জেনারেলদের মধ্যে এন্টিগোনাসই ছিলেন সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, আর আপোসরফায় মোটেই আগ্রহী ছিলেননা, তাই টলেমী, সেলুকাস এবং আরও কিছু জেনারেল তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছিল, আর এই জোটের শর্ত অনুসারে টলেমী ও সেলুকাস তাদের মধ্যে সিরিয়াকে বাটোয়ারা করতে সম্মত হয়েছিল, টলেমীর ভাগে পড়েছিল দক্ষিণার্ধ।

    এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালে টলেমীর ভয় ছিল হয়তো পরাজয় হতে পারে, আর তিনি তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করেছিলেন। ৩০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্য এশিয়া মাইনরের ইপসাসে যখন যুদ্ধের শেষ পর্যায় চলছে সেই পর্যায়ে এন্টিগোনাসই পরাজিত এবং নিহত হলেন, আর তার পুত্র ডিমেট্রিয়াস বিতাড়িত হয়ে সাময়িকভাবে নির্বাসনে চলে গেলেন।

    সেলুকাসের তখন জয়জয়কার। তিনি প্রকৃতপক্ষে আলেক্সান্ডারের অধিকৃত এশীয় অঞ্চলের প্রায় পুরোটাই নিজের অধিকারে নিয়ে নিলেন। তদতিরিক্ত তিনি সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলও দাবি করে বসলেন, কারণ ইপসাসের যুদ্ধের পূর্বে পশ্চাৎমুখীনতার কারণে তিনি এই অঞ্চলের উপর তার অধিকার হারিয়েছিলেন। তবে টলেমী তার অধিকার ছাড়তে রাজি হননি। পরবর্তী এক শতাব্দী যাবৎ দক্ষিণ সিরিয়া ও বিশেষ করে জুডিয়া মিশরের অধিকারে রয়ে যায়। আট শতাব্দী পূর্বে তৃতীয় রামেসেসের পর এটাই মিশরের প্রথম এশীয় সাম্রাজ্য। তবু সিরিয়া প্রায় দেড় শতাব্দীব্যাপী টলেমীয় এবং সেলুকীয়দের মধ্যে বিবাদের বিষয় হয়ে রইল, আর এ নিয়ে অনেকগুলি যুদ্ধ ঘটে যায় যা উভয় বংশেরই ধ্বংসের কারণ।

    টলেমীর সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ তার দীর্ঘ জীবন, যাকে মিশরেরও আশীর্বাদরূপে গণ্য করা যায়, তার নমনীয় এবং ন্যায়পরায়ণ শাসনের কারণে, যে জন্য তার রাজত্বের শেষ অবধি তিনি জনপ্রিয় শাসকের মর্যাদা লাভ করেন, যদিও তিনি ছিলেন একজন বহিরাগত। তিনিই প্রথম মিশরীয় সম্রাট যিনি ধাতব মুদ্রার প্রচলন করেন। মিশরের অর্থনীতির বিকাশ ঘটে। তার রাজত্বের শেষ অর্ধাংশ ছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, তবে তার সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় ছিল অবন্ধুসুলভ সেলুকাসেরও দীর্ঘ জীবন।

    ২৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ প্রায় ৮০ বছর বয়সে টলেমী শারীরিক ও মানসিভাবে সক্ষম আর রইলেন না। তিনি নিজেও অনুধাবন করলেন তার পক্ষে আর রাজকার্য সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এবার তাই তাকে তার উত্তরাধিকারী নিয়ে ভাবতে হবে, এমন একজন যে সেলুকাস ও তার উত্তরাধিকারীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।

    প্রথম টলেমীর অনেক পুত্র ছিল, তার মধ্যে দুজন (আলাদা মায়ের) ছিল গুরুত্বপূর্ণ। উভয়েই টলেমী নাম বহন করত। বয়ঃজ্যেষ্ঠজন টলেমী সেরোনাস বা “বজ্ৰপাণি সেরোনাস” আর কনিষ্ঠজন টলেমী ফিলাডেলফাস। এই নামটি তাকে দেওয়া হয় জীবনের শেষ পর্যায়ে যার কারণ আমরা পরে বুঝতে পারব।

    প্রথমজন ছিলেন প্রকৃত বজ্রবিদ্যুৎ শক্তি, যেদিক দিয়ে যেত সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিত। আর সেই আগুনে নিজেও দগ্ধ হতো। কনিষ্ঠজন ছিলেন তার পিতার মতোই সুবিবেচক, নরমপন্থী। টলেমী বিনা দ্বিধায় সেরোনাসকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন এবং কনিষ্ঠপুত্রকে নিজের কাছে শাসনকার্যের অংশীদার করে রাখেন, এবং ২৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কনিষ্ঠ পুত্রের অনুকূলে সিংহাসন ত্যাগ করেন। দীর্ঘ সফল রাজত্বের অবসানে ২৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

    টলেমী সেরোনাস অবশেষে স্থান পেলেন সেলুকাসের রাজদরবারে, যিনি সানন্দে তাকে গ্রহণ করলেন। এই যুবা পুরুষের মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন মিশরের ভবিষ্যৎ শাসককে, প্রয়োজনে যাকে তিনি হাতিয়াররূপে ব্যবহার করতে পারবেন। সেলুকাস মোটেই টলেমীর মতো ছিলেন না। তার বার্ধক্য তাকে মোটেই সিংহাসন ত্যাগের হাতছানি দেয়নি। ক্ষমতার প্রলোভন তখনও তার মাঝে সক্রিয় আর এজন্য তিনি তখনও সগ্রাম করে চলেছেন একজন সাহসি তরুণের মতো।

    ২৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি শেষ যুদ্ধ জয় করেন আর পরবর্তী এক যুদ্ধে আলেক্সান্ডারের এক বৃদ্ধ সেনাপতিকে পরাজিত ও হত্যা করতে সক্ষম হন। এদিকে প্রথম টলেমীর মৃত্যু হওয়ায় আলেক্সান্ডারের সেনাপতিগণের মধ্যে তিনিই একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, আর এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার (এই বিজয়ের শিখরে আরোহণের সময় তার বয়স ছিল সাতাত্তর বছর)।

    তবে এই উল্লাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার বিজয়ের সুফল উপভোগ করার জন্য তিনি মেসিডোনে গমন করেন, আলেক্সান্ডারের দেশ তার অধিকারে নেওয়ার জন্য। তবে সেলুকাসের আগমনের সাথে সাথেই সেরোনাস তার কার্যক্রম শুরু করে দেন। মিশরের সিংহাসন তার হাতছাড়া হয়ে যায়, তবে কোনো এক জায়গায় তো তাকে থিতু হয়ে বসতে হবে। আপাত অমর সেলুকাসের মৃত্যুর জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা যায়না। তাই ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ছুরিকাঘাতে তাকে ধরাশায়ী করে ব্যাপারটা ফয়সালা করে ফেললেন।

    আলেক্সান্ডারের সেনাপতিদের সর্বশেষ ব্যক্তির জীবনাবসান ঘটল, এবার টলেমী সোটারের দুই পুত্ৰই সিংহাসন দখল করে বসলেন। কনিষ্ঠ হলেন মিশরের আর জ্যেষ্ঠ মেসিডোনের অধীশ্বর। তবে জ্যেষ্ঠ, যিনি হত্যার মাধ্যমে সিংহাসন অধিকার করেছিলেন, তার ভাগ্যে বেশিদিন সিংহাসনে বসে থাকা লিখা ছিলনা। পরের বছরই উত্তরের বর্বরদের দ্বারা মেসিডোন আক্রান্ত হয়, আর ভয়ংকর এক ডামাডোলের মধ্যে সেরোনাস তার প্রাণ হারান।

    .

    আলেক্সান্দ্রিয়া

    প্রথম টলেমী তার রাজ্য শাসন করতেন নূতন রাজধানী আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে, আর পরবর্তী সব টলেমীয়রাই তাই করেছেন। সত্যিকারের মিশর বলতে যা বোঝায় আলেক্সান্দ্রিয়া তার সবকিছুই, বিশেষ করে বহিরাগতদের কাছে। তবে মিশরীয়দের কাছে আলেক্সান্দ্রিয়ার মোটেই কোনো গুরুত্ব ছিলনা। টলেমীয়রা মিশরীয় প্রথা এবং মিশরীয় দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল, আর তাদের প্রার্থনাতেও যোগ দিত, আর সে কারণেই তাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য কোনো বিদ্রোহ ঘটেনি, যেমনটা ঘটেছিল হিক্সস, আসিরীয় এবং পারসিকদের বিরুদ্ধে। তৎসত্ত্বেও মিশরীয়দের মনে হতো আলেক্সান্দ্রিয়া মিশরের মধ্যে অন্য এক দেশ। দেশটা শাসন হচ্ছিল গ্রিক রীতিতে, দেশটি গ্রিক আর ইহুদিতে ভরপুর (ওখানে ইহুদিদের আগমন ঘটে জুডিয়া থেকে যেটা সে সময় মিশরীয় শাসনাধীনে ছিল)।

    হয়তো মিশরীয়দের দিক থেকে দেখতে গেলে এটাও ছিল মঙ্গলজনক। গ্রিকদের রাজধানীতে আটকে রাখতে পারায় সমগ্র মিশর ছিল মিশরীয়দের।

    অনেকে মনে করত, আলেক্সান্দ্রিয়ার এক তৃতীয়াংশ গ্রিক, এক তৃতীয়াংশ ইহুদি আর এক তৃতীয়াংশ মিশরীয়। এর সম্পদ, এর আধুনিকায়ন, বিশ্বজনীয়তার কথা বিবেচনায়, আর অতীতচারিতা থেকে মুক্তির কথা বিবেচনা করে বলা যায় আলেক্সান্দ্রিয়া ছিল সেকালের নিউইয়র্ক।

    প্রথম টলেমী এবং তার পুত্র দ্বিতীয় টলেমী আলেক্সান্দ্রিয়াকে শুধু বৃহৎ, জনবহুল এবং সম্পদশালী করাকেই যথেষ্ট মনে করতেন না। উভয়েই চেষ্টা করেছিলেন একে একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্ররূপে গড়ে তুলতে, আর এ ব্যাপারে তারা সাফল্যও লাভ করেছিলেন (এদিক থেকে প্রথম দুজন টলেমীর মধ্যে কে কতটা এগিয়ে সেটা নির্ণয় করা বেশ কঠিন)।

    প্রথম টলেমী নিজেও একজন লেখক ছিলেন আর তিনি সোজাসাপ্টা গদ্যে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেটের জীবনী লিখেছিলেন। এটা দারুণ আফসোসের ব্যাপার যে এই বিখ্যাত বইটির মূল কপি আমাদের হাতে আসেনি। তবে এর চারশ বছর পরে একজন গ্রিক ঐতিহাসিক আরিয়ান আলেক্সান্ডারের জীবনী লিখতে গিয়ে উল্লেখ করেছিলেন সেটি মূলত প্রথম টলেমীর বইয়ের উপর ভিত্তি করে। আরিয়ানের লেখা আমাদের সময় পর্যন্ত টিকে আছে আর তার মাধ্যমেই পরোক্ষভাবে আমরা প্রথম টলেমীর বই সম্বন্ধে জানতে পারি।

    টলেমী মহান গ্রিক দার্শনিক এরিস্টোটলের লাইব্রেরি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেন, আর তার সংগ্রহ বৃদ্ধি করার সব চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তিনি তার লাইব্রেরি সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত করার জন্য একজন এথেনীয় লাইব্রেরিয়ানকে আমদানি করেছিলেন, যার ফলে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ লাইব্রেরিতে পরিণত হয়। বর্তমান কালের ছাপাখানা আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত পরবর্তী সতেরো শতাব্দীব্যাপী তার সাথে তুলনীয় কোনো লাইব্রেরি গড়ে ওঠেনি।

    লাইব্রেরি সংলগ্ন মিউজের এক মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল, (গ্রিক ভাষায় মৌজিয়ন আর রোমান ভাষায় মিউজিয়াম) যেখানে পণ্ডিতেরা শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে। এথেন্স, যা ছিল তঙ্কালীন বিশ্বে গ্রিক বিদ্যাচর্চার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র, আলেক্সান্দ্রিয়ার কাছে তা ম্লান হয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সেখানে পণ্ডিতেরা সমবেত হতে থাকে (যেখানে অর্থ, সেখানে মেধা পাচার হতে থাকে, এখন যেমন হচ্ছে আমেরিকায়)। এই কেন্দ্রের শীর্ষ সময়ে এখানে ১৪০০ ছাত্রের সমাগম ঘটেছিল, আধুনিক মাপকাঠিতেও বলা যায় এটি ছিল বিশাল এক বিশ্ববিদ্যালয়।

    এই আলেক্সান্দ্রিয়াতেই ইউক্লিড তার জ্যামিতির সূত্র আবিষ্কার করেন, ইরাতোস্থেনিস পৃথিবীর পরিধি নিরুপণ এবং হেরোফাইলাস ও ইসিস্রেতাস শারীরতত্ত্বে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেন আর তেসিবাস আবিষ্কার করেন জলঘড়ি।

    আলেক্সান্দ্রিয়ার বিদ্যাচর্চা মূলত গ্রিক ধাঁচের, তবে এতে মিশরীয় প্রযুক্তির যথেষ্ট অবদান ছিল। তাত্ত্বিক দিক থেকে মিশর গ্রীসের পেছনে থাকলেও, প্রযুক্তির দিক দিয়ে তারা গ্রীসের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিল। বহু শতাব্দীর মমি তৈরির অভিজ্ঞতা তাদের রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

    গ্রিক পণ্ডিতেরা মিশরীয় জ্ঞান আত্মস্থ করার ব্যাপারে মোটেই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। মিশরীয়দের কাছে ইবিসের মুণ্ডযুক্ত দেবতা “থথ” ছিল সকল জ্ঞানের ভাণ্ডার, আর গ্রিকরা তার সাথে নিজেদের দেবতা হার্মিসকে মিলিয়েছিল। তারা বলত হার্মিস ট্রিসমেজিস্ট্রাস (ত্রিগুণাত্মক হার্মিস) আর তার ছত্রছায়ায় যে বিজ্ঞান গড়ে উঠেছিল তাকে বর্তমানে বলা হয় আলকেমি।

    টলেমীয়রা ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে গ্রিক থাকলেও তারা মিশরীয় সংস্কৃতিকে যথেষ্ট আনুকূল্য প্রদান করত। উদাহরণস্বরূপ দ্বিতীয় টলেমী মিশরের ইতিহাস রচনায় মানেথোকে সহায়তা দিয়েছিলেন, আর নীলের এক নৌযাত্রায় সাহচর্য দিয়েছিলেন।

    টলেমীয়রা মিশরীয় ধর্মের প্রতিও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিল। তারা গ্রিক আর মিশরীয় সমন্বয়ে এক নূতন ধর্মের উদ্ভাবনের চেষ্টা করে, যেটা নিজেদের অনুকূলে যায়। যেমন ওরিসিস আর এপিসের সমন্বয়ে গ্রিক দেবতা সেরাপিস, তাকে সম্পৃক্ত করা হয় জিউসের সাথে আর প্রথম টলেমী তার সম্মানার্থে আলেক্সান্দ্রিয়ায় এক সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেন। এটাই সেরাপিওন বা তার রোমান রূপান্তর সেরাপিয়াম।

    মিশরীয় রীতি অনুসারে ফারাওরা যেমন ভ্রাতা-ভগ্নী বিবাহপাশে আবদ্ধ হতো, দ্বিতীয় টলেমী তার অনুসরণ করে নিজের ভগ্নী আর্সিনোয়েকে বিবাহ করেন, ইতিপূর্বে যার বিবাহ হয়েছিল তার সৎ ভাই টলেমী সেরোনাসের সাথে। তাদের বিবাহবন্ধন ছিল অত্যন্ত সুখকর, তবে তারা দুজনেই যৌবনোত্তীর্ণ হওয়ায় তাদের কোনো সন্তান জন্মেনি।

    এমনকি ইহুদিরাও টলেমীয়দের আনুকূল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে টলেমীয়দের প্রারম্ভিককালে তারা ইহুদিদের এক প্রাচীন ইতিহাসের ধারক বাহকরূপে স্বীকৃতি দিয়েছিল, যাদের অধিকারে ছিল অনেক আকর্ষণীয় পবিত্র গ্রন্থ। এই কথা মনে রেখেই প্রথম টলেমী সাবাথ ডে-তে যেরূজালেম আক্রমণ করেন, কারণ তিনি জানতেন ঐদিন তাকে ইহুদিদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হবেনা। টলেমীয়রা ইহুদিদের আজব সব প্রথা পালনের অনুমতি দেয় আর আলেক্সান্দ্রিয়ায় তারা অনেকটাই স্বায়ত্তশাসন উপভোগ করে।

    আলেক্সান্দ্রিয়ার পরিবেশ অভিবাসী ইহুদিদের জন্য এতটাই অনুকূল করে তোলা হয়েছিল যে, ইহুদিরা শীঘ্রই জুডিয়ায় ব্যবহৃত আরামীয় অথবা যে হিব্রম্ন ভাষায়। তাদের ধর্মগ্রন্থ লিখিত তার পরিবর্তে তারা গ্রিক ভাষায় কথা বলতে শুরু করল।

    গ্রিক ভাষায় অনূদিত বাইবেলকে বলা হয় সেয়াজিন্ট, গ্রিক ভাষায় যার অর্থ “সত্তর,” কারণ কথিত আছে যে সত্তরজন পণ্ডিত এই অনুবাদের কাজটি করেছিল।

    ল্যাটিন ভাষায় যে বাইবেলের অনুবাদ হয়েছিল তা এই সেপ্টয়াজিন্টেরই অনুবাদ। কাজেই প্রাথমিক খ্রিস্টীয় যুগে এই সেয়াজিন্টেরই প্রচলন ছিল, সেটা এিকই হোক আর ল্যাটিনই থোক। তাই বলা যায় টলেমীয়দের বাইবেলের অনুবাদ সমগ্র খ্রিস্টীয় জগতে অসাধারণ গুরুত্ব বহন করে।

    দ্বিতীয় টলেমী তার মেসিডোনীয় উত্তরাধিকারের কথাও ভোলেননি। তিনি আলেক্সান্ডারের মরদেহ মেম্ফিস থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় এনে সমাহিত করেন, আর এর উপর সুদৃশ্য এক সমাধিমন্দির নির্মাণ করেন।

    প্রথম ও দ্বিতীয় টলেমী ধন্যবাদাহঁ এজন্য যে তারা আলেক্সান্দ্রিয়াকে বাণিজ্যকেন্দ্ররূপেই নয়, জ্ঞানচর্চার কেন্দ্ররূপেও গড়ে তোলেন। আর এটা টিকে ছিল পরবর্তী প্রায় নয় শতাব্দী যাবৎ।

    .

    ক্ষমতার শীর্ষে টলেমীয়গণ

    দ্বিতীয় টলেমী মিশরের সমৃদ্ধির প্রবাহ ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। নীলের সাথে যে খাল সংযোগ মিশরের অগ্রগতির প্রধান নিয়ামক তার কার্যক্ষমতাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। তিনি খাল কেটে নীলের সাথে লোহিত সাগরের সংযোগ ঘটিয়েছিলেন, তিনি নীলের উজান অঞ্চল আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি লোহিত সাগরের তীরে সেনানিবাস ও শহর স্থাপন করেছিলেন, যাতে আরব উপকূলে ব্যবসাবাণিজ্য নিরাপদ করা যায়।

    তাছাড়া তিনি লেক মোয়েরিস সম্বন্ধে ফারাওদের গৃহিত নীতির সংশোধন করেন। এর পানির উচ্চতা বৃদ্ধির পরিবর্তে তিনি এর পানি সেচে ফেলে খাল খননের দ্বারা নীলের মিঠাপানি সরবরাহ করে আশপাশের এলাকাকে উর্বর কৃষিক্ষেত্রে পরিণত করেন। এর ফলে সেই এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, অনেক শহর গড়ে ওঠে। পরবর্তী চার শতাব্দী যাবৎ এই এলাকাটি মিশরের সবচাইতে সমৃদ্ধ এলাকায় পরিণত হয়।

    ভূমধ্যসাগরে নৌচলাচল নিরাপদ করার জন্য দ্বিতীয় টলেমী আলেক্সান্দ্রিয়ার অদূরে ফারোজ দ্বীপে প্রায় ৮০০ ট্যালেন্ট (আধুনিক মুদ্রায় প্রায় বিশ লাখ ডলার) ব্যয় করে একটি লাইটহাউস নির্মাণ করিয়েছিলেন। প্রাচীন বিশ্বে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় লাইটহাউস। গ্রিকরা অবাক বিস্ময়ে একে বলেছিল বিশ্বের সপ্তমাশ্চর্যের একটি। এর বর্গাকৃতি ভিত্তিভূমির প্রত্যেক পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ ফিট, এর উচ্চতা (বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে ২০০ থেকে ৮০০ ফিট), যার শীর্ষদেশে সবসময় একটা মশাল জ্বলত। সবচেয়ে বড় আকারে নির্মিত হয়েছিল সমুদ্র-দেবতা পোসিডনের মূর্তি। প্রজ্বলিত কাঠের অগ্নিকুন্ড বিশ মাইল দূর থেকে দৃশ্যমান ছিল। এর নির্মাণ কৌশল এখন আর জানা সম্ভব নয়, কারণ এটি নির্মাণের পনেরো শতাব্দী পরে এক প্রবল ভূমিকম্পে এটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়।

    তবে টলেমীয় এবং সেলুকীয়দের মধ্যে বিবাদ চলতে থাকে। প্রথম সেলুকাসের উত্তরাধিকার লাভ করেন তার পুত্র প্রথম এন্টিয়োকাস। আর পুত্রে পুত্রে শত্রুতা কখনোই প্রশমিত হয়নি। ২৭৬ থেকে ২৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ চলে “প্রথম সিরীয় যুদ্ধ” আর এতে জয়যুক্ত হয় মিশর, যাতে করে দ্বিতীয় টলেমী তার অধিকার সম্প্রসারিত করেন ফিনিসিয়া ও এশিয়া মাইনরের অংশ বিশেষের উপর। দ্বিতীয় সিরীয় যুদ্ধ সংঘটিত হয় দ্বিতীয় এন্টিয়োকাস ও তৃতীয় সেলুকীয় রাজার মধ্যে ২৬০ থেকে ২৫৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এটা মিশরীয়দের জন্য তেমন সৌভাগ্যের ছিলনা, আর এতে পূর্ববর্তী কিছু অর্জনও হারাতে হয়েছিল। সম্ভবত বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় টলেমীর সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটি ছিল এমন একটি বিষয় যাকে সে সময় তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা হয়নি। ইতালিতে রোম নামে একটি নগরী ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল, যা উপদ্বীপের অধিকাংশই দখল করে বসেছিল। যে সময় দ্বিতীয় টলেমী মিশরের সিংহাসনে, ততদিনে মধ্য ইতালির অধিকাংশই রোমের অন্তর্গত যা দক্ষিণের গ্রিক নগরসমূহের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

    গ্রিকরা আলেক্সান্দারের দূর সম্পর্কের আত্মীয় পাইরাস নামে একজন মেসিডোনীয় জেনারেলকে তাদের সাহায্যার্থে আহ্বান করেছিল। পাইরাস ছিলেন যুদ্ধের ব্যাপারে অতি-উৎসাহী একজন জেনারেল আর তিনি বেশ আগ্রহভরে এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হস্তিবহরযুক্ত সেনাদল নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন আর দুইবার রোমানদের পরাজিত করেন। রোমানরা অবশ্য মরিয়া হয়ে যুদ্ধে লেগে থাকে আর অবশেষে ২৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পাইরাসকে পরাজিত করে, আর তাকে ইতালি থেকে তাড়িয়ে দেয়। ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ তারা দক্ষিণ ইতালির প্রায় সবগুলি গ্রিক নগর দখল করে নেয়।

    দ্বিতীয় টলেমী গ্রিক সহানুভূতির দ্বারা মোটেই মোহিত হননি। তার মনে হয়েছিল রোমানরা একটি উঠতি জাতি, আর তাই তাদের বিপক্ষে থাকার চাইতে সাথে থাকা অনেক ভালো। তাই তিনি গ্রিকদের সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি করেন, আর সিসিলিকে নিয়ে যখন কার্থেজে রোমানরা এক যুদ্ধে লিপ্ত, তখনও টলেমীয়রা রোমানদের সহায়তা দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এই মৈত্রী মিশরীয়দের এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল যেখান থেকে তারা কখনো সরে আসেনি।

    ২৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্বিতীয় টলেমীর মৃত্যুর পর তৃতীয় টলেমী সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেন। মিশর আবার একজন তেজস্বী বুদ্ধিদীপ্ত শাসক লাভ করল। তিনি সাইরিন পুনর্দখল করেন কিছুদিনের জন্য যা স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিল।

    তবে সেলুকীয়দের সাথে তাদের বিবাদ অবিরাম চলে আসছিল, আর এখন পারিবারিক দ্বন্দ্বে তা আরও ঘনীভূত হলো।

    অবশেষে প্রথম সিরীয় যুদ্ধের সমাপ্তিতে দ্বিতীয় টলেমী তার কন্যা, যুবরাজের ভগ্নী বেরেনিসকে আর এক যুবরাজ, পরবর্তীকালে যিনি দ্বিতীয় এন্টিয়োকাসরূপে সিংহাসন লাভ করেন, তার সাথে বিবাহ দেন।

    দ্বিতীয় টলেমী যে বছর মারা যান সেই একই বছরে সিংহাসনে আরোহণের অনতিবিলম্বে মারা যান দ্বিতীয় এন্টিয়োকাস। কাজেই দ্বিতীয় টলেমী আশা করেছিলেন তার বোনের শিশু সন্তানই চতুর্থ সেলুকীয় রাজারূপে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। তবে দ্বিতীয় এন্টিয়োকাসের পূর্ববর্তী আরও এক স্ত্রী জীবিত ছিলেন। তিনি বেরেনিস ও তার শিশু পুত্রকে হত্যা করান এবং তার নিজের পুত্র দ্বিতীয় সেলুকাস সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    তৃতীয় টলেমীর জন্য যুদ্ধ শুরু করার এটাই পর্যাপ্ত কারণ। তার ভগ্নীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনি সেলুকীয় রাজ্যে অভিযান শুরু করেন, আর এটাই ছিল তৃতীয় সিরীয় যুদ্ধ। তিনি অভিযান চালিয়ে বেবিলন দখল করে নেন। মিশরের সুদীর্ঘ ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই এতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারেনি, বলা যায় এর মাধ্যমে টলেমীয় শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ। হাজার বছর পূর্বে দ্বিতীয় রামেসেসের পর মিশরীয়রা আর কখনোই পৃথিবীতে এত শক্তিধর হতে পারেনি।

    তবে তৃতীয় টলেমী বুঝতে পেরেছিলেন তার অগ্রাভিযানের মধ্যে কিছুটা অবাস্ত বতা ছিল। সাময়িকভাবে যে ভূমি তিনি দখল করেছেন তা চিরকাল দখলে রাখা হয়তো সম্ভব হবেনা। তাই স্বেচ্ছায় সেলুকীয়দের ভূমি তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে পিছু হটে এলেন। শুধু মিশরের নিকটবর্তী কিছু অঞ্চল, যেটুকু লাভজনকভাবে নিজের অধিকারে রাখতে পারবেন, তাই রাখলেন।

    তিনি শুধু সঙ্গে করে নিয়ে এলেন কিছু মূর্তি আর ধর্মীয় উপকরণ ইতিপূর্বে তিন শতাব্দী আগে ক্যাম্বিসেস যেসব মিশর থেকে নিয়ে গিয়েছিল, এবং সেগুলি স্বস্থানে রেখে দিলেন। কৃতজ্ঞ মিশরীয়রা তাকে উপাধি প্রদান করেছিল “ইয়ুর্জেটিস” (মহৎ উপকারী)। আর এভাবেই তৃতীয় টলেমী ইতিহাসে পরিচিত ইয়ুর্জেটিস নামে। সেলুকীয় রাজ্যে টলেমীয় অভিযান নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। তার রানি, সেরেনীয় যুাজ্ঞী বেরেনিস তার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রার্থনা করেন, আর এটা নিশ্চিত করণের জন্য নিজের চুল কেটে দেবতা এফ্রোডাইটের মন্দিরে সমর্পণ করেন। চুলগুলি চুরি হয়ে যায় আর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এক পুরোহিত তাকে বলে, চুলগুলি দেবতা স্বর্গে নিয়ে গেছে, আর কিছু অস্পষ্ট তারকা দেখিয়ে বলে ওগুলিই তার চুল। আজো সেই তারকা মণ্ডলকে বলা হয় “কোমা বেরেনিসেস” বা বেরেনিসের চুল।

    টলেমীর যুদ্ধংদেহী শৌর্যের প্রকাশ আরও একটা দিকে দৃশ্যমান আর তা হলো, তিনি দক্ষিণদিকে অগ্রসর হয়ে নুবিয়ায় প্রবেশ করেন, ইতিপূর্বে যেমনটা ঘটেছিল ফারাওদের সময়ে।

    শান্তির আবহেও তৃতীয় টলেমীর অনীহা ছিলনা। তার পিতা ও পিতামহের মতো তিনিও প্রবল আগ্রহে মিউজিয়ামে সহায়তা দিয়ে যান। তার সময়ে বইয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০,০০০, আর তিনি সকল আগ্রহী আগন্তুককেই বই কপি করে নেওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে সকল টলেমীয় সম্রাটই এমনকি সবচেয়ে নিকৃষ্টজনও শিল্প সংস্কৃতির মহা উৎসাহী ছিলেন।

    তৃতীয় টলেমী ইহুদিদের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন অব্যাহত রাখেন। তিনি তাদের গ্রিকদের সমতুল্য নাগরিক সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। এমনকি সেলুকীয় অভিযান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি যেরুজালেমের মন্দিরে প্রথাসিদ্ধ বলি প্রদান করেন।

    ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় টলেমীর মৃত্যু হয়। পেলুসিয়ামে আলেক্সান্ডারের আগমনের পর থেকে ১১১ বছর ধরে মিশর অত্যন্ত উন্নত সুশাসন লাভ করে। স্বদেশীয় ফারাওদের দীর্ঘ শাসনেও এমন নজির নাই। আলেক্সান্ডার, ক্লিওমেনেস এবং তিনজন টলেমীয় শাসনে মিশর লাভ করেছিল নিরাপত্তা, শান্তি এবং সমৃদ্ধি।

    তবে এই সুদিনে আবার অবক্ষয়ের সূত্রপাত হলো।

    .

    অবক্ষয়ে টলেমীয়গণ

    মহান ইউয়ের্জেতিসের জ্যেষ্ঠপুত্র চতুর্থ টলেমী নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ফিলোপেটার (পিতার স্নেহভাজন) উপাধি গ্রহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করে তার প্রথম কর্তব্য ছিল তার মাতা বেরেনিস এবং ভগ্নীকে হত্যা করা। কাজেই এটা সহজবোধ্য যে তার পিতার উপাধি গ্রহণ ছিল লোক দেখানো মাত্র। হয়তো এমনটা নাও হতে পারে। ঐতিহাসিক দলিলের অনুপস্থিতিতে অনেক সময় কল্পকথাকেই সম্বল করতে হয়। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে চটকদার কথাই টিকে থাকে, সেটা যতই মর্মদ হোক না কেন।

    নূতন টলেমী ছিলেন একজন দুর্বল এবং বিলাসপ্রিয় শাসক। তিনি তার শাসনকার্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তার মন্ত্রী এবং পছন্দের লোকদের উপর এটা ছিল মিশরীয়দের জন্য বিশেষ দুর্ভাগ্যজনক, কারণ সেলুকীয় সাম্রাজ্যে তখন একজন অত্যন্ত ক্ষমতাধর উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসক ক্ষমতাসীন। তৃতীয় এন্টিয়োকাসের কনিষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় সেলুকাস ২২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেলুকীয় সিংহাসনে আরোহণ করেন।

    দ্বিতীয় টলেমীর হাতে তার পিতার পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হয়ে তৃতীয় এন্টিয়োকাস চতুর্থ সিরিয়ার যুদ্ধে মিশরীয় বাহিনীর সম্মুখীন হন। যুদ্ধটা ঠিক এমন সময়ে যখন মহান টলেমী সবেমাত্র মৃত্যুবরণ করেছেন। প্রাথমিকভাবে তৃতীয় এন্টিয়োকাসেরই জয়লাভ হয়, তবে ২১৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মিশর সীমান্তে রাফিয়ার যুদ্ধে স্বয়ং চতুর্থ টলেমীর নেতৃত্বে মূল মিশরীয় বাহিনীর সম্মুখীন হন। উভয় পক্ষেই ছিল হস্তিবহর। এন্টিয়োকাসের এশীয় হস্তি, আর টলেমীর বৃহৎ তবে কম সচল আফ্রিকীয় হস্তি। এটাই একমাত্র যুদ্ধ যেখানে দুই প্রজাতির হস্তি পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল। এশীয় প্রজাতি এখানে বিজয়ী বলে প্রমাণিত হয়েছিল, তৎসত্ত্বেও এশীয় সৈন্যবাহিনী পরাজয় বরণ করে। মিশরীয় বাহিনী চূড়ান্ত বিজয় লাভে সমর্থ হয় যাতে করে মনে হয়েছিল টলেমীয়দের সৌভাগ্য এবার চিরস্থায়ী হবে।

    সেলুকীয় বাহিনীর অগ্রগতির চাপে মিশরীয় সরকার বাধ্য হয়েছিল তাদের সেনাবাহিনীতে দেশীয় লোকদের বেশি করে অন্তর্ভুক্ত করতে। এটা মিশরীয় সরকারের একটি দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপ বলে প্রমাণিত হয়েছিল। টলেমীয় শাসন আর আগের মতো রইল না এবং সশস্ত্র মিশরীয়গণ মাঝে মাঝেই বিদ্রোহ করত যদিও সেটা সাংঘাতিক হয়ে উঠেনি।

    চতুর্থ টলেমী এবং তার মন্ত্রিপরিষদ ঢাকনা বন্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছিল। যতদিন চতুর্থ টলেমী জীবিত ছিলেন, ততদিন মিশর তার নিয়ন্ত্রণে ছিল আর তৃতীয় এন্টিয়োকাস নিজেকে অন্যত্র ব্যস্ত রেখেছিল।

    চতুর্থ টলেমীর একটা অস্বাভাবিক খেয়াল ছিল। তিনি বিশাল বিশাল সামুদ্রিক জাহাজ নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন- যেগুলি এত বড় ছিল যে সেগুলি তেমন ব্যবহার উপযোগী হতে পারেনি, কারণ এগুলি ছিল মহাবিদঘুঁটে এবং সফলভাবে চালনার অনুপযোগী। সবচেয়ে বড় জাহাজটি ছিল ৪২০ ফিট লম্বা এবং ৫৭ ফিট চওড়া। এর ছিল চল্লিশ সারি বৈঠা এবং সে বৈঠা চালানোর জন্য একপাল দাড়ি মাঝি। দেখে মনে হতো এক দৈত্যাকার কেনই। এটা দারুণ দর্শনীয় হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে ছিল বিপজ্জনক।

    চতুর্থ টলেমীর শাসনকাল একটি হতাশাজনক ঘটনার জন্ম দেয় যা গ্রীসের অবক্ষয় ডেকে আনে। মেসিডনে দ্বিতীয় ফিলিপের সময় থেকে উত্তরের রাজ্যগুলি গ্রিক নগরসমূহের উপর আধিপত্য করত। নগরগুলি স্বাতন্ত্রলাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যেই লড়াইয়ে লিপ্ত হয়, যেটা সব সময়ই মেসিডনের পক্ষে গিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ২৩০ অব্দে যখন তৃতীয় টলেমী মিশরের সিংহাসনে আসীন তখন স্পার্টায় ক্ষমতাসীন তৃতীয় ক্লিওমেনিস নগরটিকে পুনর্গঠন করতে চেয়েছিলেন, অর্ধশতাব্দী পূর্বে যা ছিল গ্রীসের প্রধান চালিকা শক্তি। “একিয়েন লীগ” (ম্পার্টার উত্তরের কয়েকটি নগরের সম্মিলন) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তবে তারা ক্লিওমেনিসের দ্বারা পরাজিত হয়ে মেসিডনকে আহ্বান করে, যা ছিল গ্রীসের স্বাধীনতায় শেষ পেরেক। ২২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসিডোনীয়া ক্লিওমেনিস ও তার স্পার্টান বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে। রাজা এবং তার কিছু সহচর পালিয়ে গিয়ে মিশরে আশ্রয় গ্রহণ করে।

    তৃতীয় টলেমী তাদের সাদরে গ্রহণ করেন, সম্ভবত এ কারণে যে তাদের মেসিডনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। চতুর্থ টলেমী সিংহাসনে আরোহণ করে ক্লিওমেনিসকে দেখতে পেলেন এক আপদরূপে এবং তাকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় গৃহবন্দী করে রাখলেন।

    ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কারাবন্দী হয়ে ক্লিওমেনিস যখন হতাশায় ভুগছেন, চতুর্থ টলেমীর আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে অনুপস্থিতিতে তার একটা সুযোগ এসে গেল। তিনি কারাগার ভেঙ্গে বেরিয়ে টলেমীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে উদ্দীপনাময় ভাষণ দিতে শুরু করলেন যেন তারা বিদ্রোহ করে গ্রিক ধারায় স্বাধীন শাসনব্যবস্থা কায়েম করে। তবে মিশরীয়রা অবাক বিস্ময়ে তার ভাষণ শুনল কিন্তু তাদের কাছে এসব কথা অর্থহীন, কারণ স্বাধীনতা বলতে কী বোঝায় তাই তারা জানতনা। যে ক্লিওমেনিসের জন্ম সময়ের পূর্বে, তার বোকামী বুঝতে পেরে নিজেই আত্মঘাতী হলেন।

    ২০৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চতুর্থ টলেমীর মৃত্যু হয় এবং প্রথমবারের মতো টলেমীয়দের একজন প্রাপ্তবয়স্ক উত্তরাধিকারীর অভাব হলো। যে রাজকুমার উত্তরাধিকার লাভ করেন তিনি পাঁচ বছর বয়সী এক বালক পঞ্চম টলেমী। যাকে বলা হয় “টলেমী এপিফেস” অথবা ঈশ্বরের অবতার টলেমী, যদিও এই বালকটি মোটেই সে রকম ছিলেন না। মিশরীয় সরকার প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ল। সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে পড়ে এবং সেই সুযোগে দেশীয়রা বিদ্রোহ করে বসে।

    শুধু এটাই যথেষ্ট নয়, তৃতীয় এন্টিয়োকাস বুঝতে পারলেন এটাই সুযোগ। রাফিয়ার যুদ্ধের পর এতদিন তিনি এশীয় অঞ্চল, যা ইতিপূর্বে পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল সেখানে অভিযান চালিয়ে সময় ক্ষেপণ করেছিলেন, যে অঞ্চল ইতিপূর্বে আলেক্সান্ডার অধিকার করেছিলেন এবং প্রথম সেলুকাস উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন। সাম্প্রতিককালে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তবে বর্তমানে তৃতীয় এন্টিয়োকাস তাদের জোর করে সেখান থেকে বের দেয় এবং তার সম্রাজ্য, অন্তত কাগজে কলমে ছিল বিশাল। তিনি নিজেকে আখ্যায়িত করেছিলেন “এন্টিয়োকাস দ্য গ্রেট” নামে।

    চতুর্থ টলেমীর মৃত্যুর পর যখন তার পঞ্চবর্ষীয় পুত্র নতুন ফারাও রূপে অভিষিক্ত হলেন, তখন সঙ্গে সঙ্গেই এন্টিয়োকাস মেসিডোনীয়ার শাসনকর্তা চতুর্থ ফিলিপের সাথে একটা রফা করলেন। যদি তারা একত্র হয়ে মিশরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন তাহলে সহজেই তা জয় করা যাবে এবং তখন মৃতদেহটি ভাগাভাগি করা যাবে। ফিলিপ সহজেই এই পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হলেন এবং ২০১ খৃঃ পূর্বাব্দে পঞ্চম সিরীয় যুদ্ধ শুরু হল। তবে উভয় রাজাই একটি বিষয় হিসাবের মধ্যে নেননি। সেটি হলো পশ্চিমের দেশ রোম।

    অর্ধশতাব্দী পূর্বে দ্বিতীয় টলেমীর আমলে রোম কার্ধেজের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েন যা মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে দীর্ঘদিন চলতে থাকে। ২১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এক বিশেষ মুহূর্তে যখন কার্থেজীয় জেনারেল হানিবল (যিনি এমন একজন সামরিক নেতা যিনি অর্থের জন্য আলেক্সান্ডারকেও ছাড় দিয়েছিলেন) ইতালিতে অভিযান শুরু করেন এবং তিনটি মহান বিজয় লাভ করেন। মনে হয়েছিল এবার রোমের পতন হবে।

    তবে ২০১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইতিহাসের এক মহান পুনরাবর্তন ঘটে, ঠিক যেমন এন্টিয়োকাস ও ফিলিপ মিশরের বিরুদ্ধে একত্র হয়েছিল। অবশেষে কার্ধেজের পরাজয় ঘটে এবং পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় রোম প্রধান শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। মিশরীয় সরকার তার শত্রুদের মিলিত শক্তির কাছে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে এবং রোমের সাথে তার পূর্বের সন্ধি স্মরণ করে রোমের সাহায্য প্রার্থনা করে।

    এ ব্যাপারে রোম একপায়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মোটের উপর হানিবলের বিজয়ের অন্ধকার দিনগুলিতে মিশরের চতুর্থ টলেমী জাহাজে করে রোমে খাদ্যশস্য পাঠিয়েছিলেন অথচ মেসিডনের পঞ্চম ফিলিপ কার্থেজীয়দের সাথে একটি মৈত্রী চুক্তি করেছিল। রোমের অবশ্য ফিলিপের পূর্ব শত্রুতা ভুলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তাই অবিলম্বে সে মেসিডনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং যখন সে দেখল তাকে রোমের মুখোমুখি হতে হবে তখন পঞ্চম ফিলিপ মিশরকে বিভক্ত করার কাজে লেগে পড়েন।

    তৃতীয় এন্টিয়োকাস মহা উৎসাহে যুদ্ধে অগ্রসর হলেন। তিনি একাই মিশরকে সামলাবেন যখন মেসিডন সামলাবে রোমকে। তিনি যখন একাই মিশরে যাবেন তখন সেটাই হবে তার লভ্যাংশ। রোম নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি এন্টিয়োকাস দ্য গ্রেট নাম ধারণ করে বিশাল এক সাম্রাজ্যের অধীশর হয়ে বসলেন। তিনি পশ্চিমের বর্বরদের নিয়ে আর কেন মাথা ঘামাবেন?

    অতএব তিনি যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন এবং ১৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রকৃতপক্ষেই মিশরীয় বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হলেন। এন্টিয়োকাস অবিলম্বে জুডিয়াসহ সিরিয়াকে তার রাজ্যের সাথে যুক্ত করে নিলেন। এতে করে ১২৫ বছরের নমনীয় টলেমীয় শাসনের জায়গায় এক কঠোর সেলুকীয় শাসন এসে গেল।

    তবে ওদিকে রয়ে গেল নোম। তারা মেসিডনকে পরাজিত করেছিল তবে সেটা খুব সহজসাধ্য ছিল না এবং পঞ্চম ফিলিপ ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে অবসরে চলে গেলেন। মেসিডোনীয়দের রাজত্ব টিকে রইল পশ্চিম এশিয়া মাইনরের ক্ষুদ্র এক অঞ্চলে যারা পূর্ব দিকের সেলুকীয় শক্তির আতঙ্কে থাকত (বিশেষ করে উচ্চাকাতক্ষী তৃতীয় এন্টিয়োকাসের ভয়ে)। তাই অবিলম্বে তারা রোমান আধিপত্যে নিজেদের সমর্পিত করল। সবাই রোমের কাছে আবেদন করতে লাগল এন্টিয়োকাসের বিরুদ্ধে কিছু করার, বিশেষ করে ইতিপূর্বে যারা এশিয়া মাইনরে মিশরের অধিপত্যে ছিল।

    রোমানরা তৃতীয় এন্টিয়োকাসকে আদেশ করলেন এশিয়া মাইনর থেকে চলে যেতে, তবে তৃতীয় এন্টিয়োকাস এতে মোটেই কর্ণপাত করলেন না। কার্থেজীয় জেনারেল হানিবল তার দরবারে নির্বাসিত ছিলেন এবং তিনি এটিয়োকাসকে অনুরোধ করলেন ইতালি অভিযানে তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে। তবে এন্টিয়োকাস অনুভব করলেন যে রোম অধিকারে তাকে তেমন বেগ পেতে হবে না। তিনি একটি সৈন্যবাহিনী নিয়ে গ্রীসের দিকে অগ্রসর হলেন কিন্তু তাতে শুধু সময় নষ্ট হল।

    রোমানরা গ্রীসের দিকে অগ্রসর হয়ে এন্টিয়োকাসকে শক্ত আঘাত হানল। চৈতন্য ফিরে পেয়ে সেলুকীয় রাজা এশিয়া মাইনরে ফিরে এলেন যেখানে রোমান বাহিনী তার উপর আরও শক্ত আঘাত হানল। এতদিনে তৃতীয় এন্টিয়োকাস জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি একটি অসম শান্তি চুক্তি করে এশিয়া মাইনরে ফিরে গেলেন।

    অবশ্য তিনি সিরিয়া ধরে রাখতে সক্ষম হলেন, যা মিশর আর কোনোদিনই ফিরে পায়নি। রোম মিশরের মূল ভূখণ্ড নীল উপত্যকা রক্ষা করতে পেরেছিল। সে মিশরের রাজকীয় অধিকার নিশ্চিত করতে আগ্রহী ছিল না। এতদিন মিশর এশিয়া মাইনরে যা কিছু অধিকার করেছিল তা উপদ্বীপের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়- যাদের সবাই হয়ে পড়ে রোমানদের ক্রীড়নক। নীল উপত্যকার বাইরে টলেমীয় মিশর একমাত্র যে এলাকা নিজেদের অধিকারে রাখতে পেরেছিল তা হল পশ্চিমে সাইরেনাইকা এবং উত্তরে সাইপ্রাস দ্বীপ।

    এ কাজটি সমাপ্ত করার পর রোম পূর্ব সাম্রাজ্য তাদের অধিকারে ছেড়ে দেয় এর ফলে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ববিবাদে নিজেরাই নিঃশেষিত হয়ে যায়।

    ইতিমধ্যে পঞ্চম টলেমী এত বৃদ্ধ হয়ে পড়েন যে, তার পক্ষে শাসন ক্ষমতা ধরে রাখার সামর্থ্য ছিল না। তার বার্ধক্য মহাসমারোহে উদযাপিত হয় এবং তার গৌরবগাথা গ্রিক ও মিশরীয় ভাষায় কৃষ্ণপ্রস্তরে খোদাই করে রাখা হয়। এই লিপি প্রায় দুহাজার বছর পরে উদ্ধার করা হয় যেমনটা করা হয়েছিল রোজেটা পাথরের বেলায় যা মিশরের প্রাচীন ইতিহাস উন্মোচনে সহায়তা করে। শুধু এ কারণেই বলা যায় পঞ্চম টলেমীর জীবন ব্যর্থ ছিল না।

    রোমানদের সাহায্যে বিদেশি আশঙ্কা দূর হওয়ায় যুবক টলেমী অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মনোনিবেশ করেন। ১৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৃতীয় এন্টিয়োকাসের মৃত্যুর পর পঞ্চম টলেমী সিরিয়া পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তবে ১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। সম্ভবত তাকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

    তিনি দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্রকে রেখে যান। জ্যেষ্ঠ ষষ্ঠ টলেমী পরিচিত ছিলেন “ফিলোমেটার বা মাতৃপ্রেমিক” নামে। অথচ তার প্রিয় মাতা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন মিশরকে শান্তিপূর্ণ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মৃত্যুর পর ষষ্ঠ টলেমী যিনি তখনও যথেষ্ট অপ্রাপ্তবয়স্ক তিনি এক অনলবর্ষী মন্ত্রীর প্রভাবাধীন ছিলেন, যিনি সিরিয়া পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখতেন। সেলুকীয়দের সাথে আবার সেই পুরাতন সংগ্রাম শুরু হল।

    তবে ষষ্ঠ টলেমী মোটেই যোদ্ধা ছিলেন না (প্রকৃতপক্ষে সকল টলেমীয়দের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কোমলহৃদয় ও মানবিক)। তার বিরুদ্ধে সেলুকীয় সাম্রাজ্যে ছিল একজন নতুন সম্রাট চতুর্থ এন্টিয়োকাস যিনি তথাকথিত এন্টিয়োকাস দ্য গ্রেটের যুবক পুত্র। চতুর্থ এন্টিয়োকাস প্রকৃতপক্ষে তার অতিমূল্যায়িত পিতার চাইতে অধিকতর সক্ষম ব্যক্তি ছিলেন, তবে তার প্রধান রোগ খামখেয়ালীপনা ও বদমেজাজ।

    মিশরীয়দের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ইঙ্গিত পেয়ে চতুর্থ এন্টিয়োকাস তৎক্ষণাৎ মিশর সীমান্তের দিকে ছুটে যান এবং পেলুসিয়ামের যুদ্ধে মিশরীয়দের পরাস্ত করে আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীর পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং চতুর্থ টলেমীকে বন্দী করেন। হয়তো। তিনি আলেক্সান্দ্রিয়া অধিকার করে নিতেন তবে অনেক দূর রোম থেকেই তিনি ইঙ্গিত পান যে এটা তার জন্য বাড়াবাড়ি হবে।

    যেহেতু ষষ্ঠ টলেমী বন্দী অবস্থায় থেকে ম্রাটের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি, মিশরীয়রা তাই ১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার ছোট ভাই সপ্তম টলেমীকে সম্রাট ঘোষণা করে। এন্টিয়োকাস তৎক্ষনাৎ ষষ্ঠ টলেমীকে মুক্ত করে দেন এবং তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন আর তিনি একটা বেশ রসালো গৃহযুদ্ধের আমেজ অনুভব করেন কিন্তু দুই টলেমী একত্রে রাজ্যশাসনে আপোসরফা করে এন্টিয়োকাসের মতলব ভেস্তে দেয়।

    বিরক্ত হয়ে এন্টিয়োকাস মিশরের দিকে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং আলেক্সান্দ্রিয়া প্রাপ্তির বিনিময়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন। তবে আবার তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এবার রোমান রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্দ্রিয়ার প্রাচীরের কাছে এগিয়ে যান এবং তাকে মিশর থেকে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। রোমের এই ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির আদেশ প্রতিপালন করে তার সমস্ত সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে যাওয়া ছাড়া চতুর্থ এন্টিয়োকাসের গত্যন্তর ছিল না। কাজেই তিনি দ্রুত স্বদেশে ফিরে গেলেন।

    তিনি যাকে পরাজিত করতে পারতেন এমন এক ব্যক্তির আদেশে ফিরে যাওয়ার অপমানে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি যেরুজালেম দখল করে নেন। তিনি ইহুদী মন্দিরকে অপবিত্র করেন এবং যার ফলে ইহুদীদের জাতীয়তাবাদী নেতা ম্যাকাবিসের নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহের মুখোমুখি হন।

    ১৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচ্যদেশে একটি ব্যর্থ অভিযানে চতুর্থ এন্টিয়োকাসের মৃত্যু হয়। এর ফলে এমনকি টলেমীয় মিশরের চাইতেও অধিকতর দ্রুতগতিতে সেলুকীয় সাম্রাজ্যের অধঃপতন শুরু হয়। একের পর এক অন্তর্কলহে দেশটির মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং ইহুদী বিদ্রোহ অধিকতর সুযোগ লাভ করে।

    এক বিশেষ মুহূর্তে শান্তিবাদী ষষ্ঠ টলেমীও গোলমালের সুযোগ নিয়ে সেলুকীয়দের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। তার আশা ছিল পিতার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করা। সেলুকীয় সম্রাটের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল (প্রাচ্য প্রদেশসমূহ) আবার স্থায়ীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সেটুকু কজা করাই ছিল তার অভিপ্রায়। প্রথমত আলেক্সান্ডার ব্যালাস নামে একজন সেলুকীয় দখলদারকে প্রথমে সহায়তা দিয়ে এবং তারপর তাকে উৎখাত করে তিনি সাফল্যলাভের আশা করেছিলেন। তবে সিরিয়ায় তিনি তার ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং সেই আঘাতে ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

    এর ফলে সপ্তম টলেমী একমাত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী রয়ে যান। প্রাচীন ঐতিহাসিকরা সর্বদাই তার কুখ্যাতি করেন। যদিও দাপ্তরিকভাবে প্রপিতামহের মতো তার নাম ছিল ইউয়ার্জেটিস, তবে সর্বজনীনভাবে তিনি পরিচিত ছিলেন ফিজকন (পেটমোটা কারণ তিনি অতি বিলাসিতায় ভীষণ মোটা হয়ে গিয়েছিলেন) নামে। সকল প্রকার বদখেয়াল ও নিষ্ঠুরতার অভিযোগ তার ঝুলিতে জমা পড়েছিল। তবে এটা বলা যাবে না এর কতটা অতিরঞ্জন।

    শিলালিপিতে দেখা যায় তিনি ছিলেন বিদ্যাচর্চার পৃষ্ঠপোষক এবং মিশরীয় মন্দির সংস্কারে এবং জাতীয় সম্পদ উন্নয়নে যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছিলেন। এমনটা হতে পারে যে গ্রিকরা তাকে অপছন্দ করত কারণ তাদের চোখে তিনি ছিলেন স্বদেশীদের অতিশয় প্রশ্রয়দাতা। মিশরীয়রা নয় বরং গ্রিকরাই ছিল এসব ইতিহাসের স্রষ্টা এবং সম্ভবত সপ্তম টলেমী একারণেই এসব মিথ্যা অপবাদের ভাগিদার হয়েছিলেন।

    মিশরীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যেতে শুরু করে ১১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সপ্তম টলেমীর মৃত্যুর পর। তিনি তার একপুত্রকে সাইরেনী ও অপর পুত্রের নামে সাইপ্রাস উইল করে যান এবং খোদ মিশর রয়ে যায় তৃতীয় পুত্র অষ্টম টলেমীর অধিকারে। তৃতীয় জন বিতাড়িত হন নবম টলেমীর দ্বারা আর আলেক্সান্দ্রিয়ার জনগণ নবম টলেমীকে বিতাড়িত করে অষ্টম টলেমীকে ফিরিয়ে আনে।

    এই ধরনের যাওয়া-আসায় মিশরীয়দের জন্য এমন কিছু যায় আসেনি এবং পূর্ব সাম্রাজ্যের অবশিষ্টাংশ তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। শুধু একটি শক্তি গণনার মধ্যে থেকে যায় এবং তা হলো রোম। প্রকৃতপক্ষে এই যুগের একটি ঘটনাকে গুরুত্ব দেওয়া যায়। ৮৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অষ্টম টলেমীর সিংহাসনে আরোহণের পর কোনো এক সময় থিবিস নগর বিদ্রোহ করে বসে। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে টলেমী সেই নগরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। তিন বছর ধরে এটা অবরোধ করে রাখেন এবং অবশেষে একে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন, যে ধ্বংসপ্প থেকে একে আর কখনোই পুনরুদ্ধার করা যায়নি। অবশেষে মধ্যরাজত্ব এবং নব্যরাজত্বের রাজধানীর দু’হাজার বছরের গৌরবগাথার অবসান হল। যে মহান নগর ছিল দ্বিতীয় রামেসেসের অধীনে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী। তবে এর চেয়েও এক হাজার বছরের পুরনো মেক্ষীস নগরী মিশরের শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন হিসেবে আজও টিকে আছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবরিশালের যোগেন মণ্ডল – দেবেশ রায়
    Next Article শুনছ, কোথাও আছো কি কেউ?
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রঙ্কিণীর রাজ্যপাট এবং অন্যান্য – নবনীতা দেবসেন

    August 30, 2025

    আনা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরি

    August 30, 2025

    আগাথা ক্রিস্টি রচনা সমগ্র ১ (অনুবাদ : নচিকেতা ঘোষ)

    August 30, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.