Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মিসমিদের কবচ – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প60 Mins Read0

    ১. শ্যামপুর গ্রাম

    মিসমিদের কবচ – কিশোর উপন্যাস – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    শ্যামপুর গ্রামে সেদিন নন্দোৎসব।

    শ্যামপুরের পাশের গ্রামে আমার মাতুলালয়। চৌধুরী-বাড়ির উৎসবে আমার মামার বাড়ির সকলের সঙ্গে আমারও নিমন্ত্রণ ছিলসুতরাং সেখানে গেলাম।

    গ্রামের ভদ্রলোকেরা একটা শতরঞ্জি পেতে বৈঠকখানায় বসে আসর জমিয়েচেন। আমার বড়ো মামা বিদেশে থাকেন, সম্প্রতি ছুটি নিয়ে দেশে এসেচেনসবাই মিলে তাঁকে অভ্যর্থনা করলে।

    এই যে আশুবাবু, সব ভালো তো? নমস্কার!

    নমস্কার। একরকম চলে যাচ্ছেআপনাদের সব ভালো?

    ভালো আর কই? জ্বরজাড়ি সব। ম্যালেরিয়ার সময় এখন, বুঝতেই পারছেন।

    আপানার সঙ্গে এটি কে?

    আমার ভাগনে, সুশীল। আজই এসেচেনিয়ে এলাম তাই।

    বেশ করেচেন, বেশ করেছেন, আনবেনই তো। কী করেন বাবাজি?

    এখানে আমি মামাকে চোখ টেপবার সুবিধে না পেয়ে তাঁর কনিষ্ঠাঙ্গুলি টিপে দিলাম।

    মামা বললেনঅফিসে চাকরি করে কলকাতায়।

    বেশ, বেশ। এসো বাবাজি, বোসো এসে এদিকে।

    মামার আঙুল টিপবার কারণটা বলি। আমি কলকাতার বিখ্যাত প্রাইভেট-ডিটেকটিভ নিবারণ সোমের অধীনে শিক্ষানবিশি করি। কথাটা প্রকাশ করবার ইচ্ছা ছিল না আমার।

    নন্দোৎসব এবং আনুষঙ্গিক ভোজনপর্ব শেষ হল। আমরা বিদায় নেবার জোগাড় করচি, এমন সময় গ্রামের জনৈক প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমার মামাকে ডেকে বললেন–কাল আপনাদের পুকুরে মাছ ধরতে যাবার ইচ্ছে আছে, সুবিধে হবে কী?

    বিলক্ষণ! খুব সুবিধে হবে! আসুন না গাঙ্গুলিমশায়, আমার ওখানেই তাহলে দুপুরে আহারাদি করবেন কিন্তু।

    না না, তা আবার কেন? আপনার পুকুরে মাছ ধরতে দিচ্ছেন এই কত, আবার খেয়ে বিব্রত করতে যাব কেন?

    তাহলে মাছ ধরাও হবে না বলে দিচ্চি। মাছ ধরতে যাবেন কেবল এই এক শর্তে।

    গাঙ্গুলিমশায় হেসে রাজি হয়ে গেলেন।

    পরদিন সকালের দিকে হরিশ গাঙ্গুলিমশায় মামার বাড়িতে এলেন। পল্লিগ্রামের পাকা ঘুঘু মাছ-ধরায়, সঙ্গে ছ-গাছা ছোটো-বড়ো ছিপ, দু-খানা হুইল লাগানোবাকি সব বিনা হুইলের, টিনে ময়দার চার, কেঁচো, পিঁপড়ের ডিম, তামাক খাওয়ার সরঞ্জাম, আরও কত কী।

    মামাকে হেসে বললেন–এলাম বড়োবাবু, আপনাকে বিরক্ত করতে। একটা লোক দিয়ে গোটাকতক কঞ্চি কাটিয়ে যদি দেন–কেঁচোর চার লাগাতে হবে।

    মামা জিজ্ঞেস করলেন–এখন বসবেন, না, ওবেলা?

    না, এবেলা বসা হবে না। মাছ চারে লাগাতে দু-ঘণ্টা দেরি হবে। ততক্ষণ খাওয়া-দাওয়া সেরে নেওয়া যায়। একটু সকাল-সকাল যদি আহারের ব্যবস্থা …

    হ্যাঁ হ্যাঁ, সব হয়ে গেছে। আমিও জানি, আপনি এসেই খেতে বসবার জন্যে তাগাদা দেবেন। মাছ যারা ধরে, তাদের কাছে খাওয়া-টাওয়া কিছুই নয় খুব জানি। আর ঘণ্টা খানেক পরেই জায়গা করে দেব খাওয়ার।

    যথাসময়ে হরিশ গাঙ্গুলি খেতে বসলেন এবং একা প্রায় তিনজনের উপযুক্ত খাদ্য উদরসাৎ করলেন।

    আমি কলকাতার ছেলে, দেখে তো অবাক।

    আমার মামা জিজ্ঞেস করলেনগাঙ্গুলিমশায়, আর একটু পায়েস?

    তা একটুখানি না হয়… ওসব তো খেতে পাইনে! একা হাত পুড়িয়ে বেঁধে খাই। বাড়িতে মেয়েমানুষ নেই, বউমারা থাকেন বিদেশে আমার ছেলের কাছে। কে ওসব করে দেবে?

    গাঙ্গুলিমশায় কি একাই থাকেন? একাই থাকি বই কী। ছেলেরা কলকাতায় চাকরি করে, আমার শহরে থাকা পোষায় না। তা ছাড়া কিছু নগদ লেন-দেনের কারবারও করি, প্রায় তিনহাজার টাকার ওপর। টাকায় দু আনা মাসে সুদ। আপনার কাছে আর লুকিয়ে কী করব? কাজেই বাড়ি না থাকলে চলে কই? লোকে প্রায়ই আসচে টাকা দিতে-নিতে।

    গাঙ্গুলিমশায় এই কথাগুলি যেন বেশ একটু গর্বের সঙ্গে বললেন।

    আমি পল্লিগ্রাম সম্বন্ধে তত অভিজ্ঞ না হলেও আমার মনে কেমন একটা অস্বস্তির ভাব দেখা দিলে। টাকাকড়ির কথা এ ভাবে লোকজনের কাছে বলে লাভ কী! বলা নিরাপদও নয়শোভনতা ও রুচির কথা যদি বাদই দিই।

    গাঙ্গুলিমশায়কে আমার বেশ লাগল।

    মাছ ধরতে ধরতে আমার সঙ্গে তিনি অনেক গল্প করলেন।

    … থাকেন তিনি খুব সামান্য ভাবে–কোনো আড়ম্বর নেই–খাওয়া-দাওয়া বিষয়েই কোনো ঝট নেই তাঁর। …এই ধরনের অনেক কথাই হল।

    মাছ তিনি ধরলেন বড়ো বড়ো দুটো। ছোটো গোটা-চার-পাঁচ। আমার মামাকে অর্ধেকগুলি দিতে চাইলেন, মামা নিতে চাইলেন না। বললেন–কেন গাঙ্গুলিমশায়? পুকুরে মাছ ধরতে এসেছেন, তার খাজনা নাকি?

    গাঙ্গুলিমশায় জিব কেটে বললেনআরে রামো! তাই বলে কী বলচি? রাখুন অন্তত গোটা দুই!

    না গাঙ্গুলিমশায়, মাপ করবেন, তা নিতে পারব না। ও নেওয়ার নিয়ম নেই আমাদের।

    .

    অগত্যা গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলেন। আমায় বলে গেলেনতুমি বাবাজি একদিন আমার ওখানে যেও একটা ছুটিতে। তোমার সঙ্গে আলাপ করে বড়ো আনন্দ হল আজ।

    কে জানত যে তাঁর বাড়িতে আমাকে অল্পদিনের মধ্যেই যেতে হবে; তবে সম্পূর্ণ অন্য কারণেঅন্য উদ্দেশ্যে।

    গাঙ্গুলিমশায়ের সঙ্গে খোশগল্প করার জন্যে নয়।

    .

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    গাঙ্গুলিমশায় চলে গেলে আমি মামাকে বললাম–আপনি মাছ নিলেন না কেন? উনি দুঃখিত হলেন নিশ্চয়।

    মামা হেসে বললেন–তুমি জান না, নিলেই দুঃখিত হতেন–উনি বড়ো কৃপণ।

    তা কথার ভাবে বুঝেচি।

    কী করে বুঝলে?

    অন্য কিছু নয় বউ-ছেলেরা কলকাতায় থাকে, উনি থাকেন দেশের বাড়িতে। একটা চাকর কী রাঁধুনি রাখেন না, হাত পুড়িয়ে এ-বয়সে বেঁধে খেতে হয় তাও স্বীকার। অথচ হাতে দু পয়সা বেশ আছে।

    আর কিছু লক্ষ করলে?

    বড়ো গল্প বলা স্বভাব! আমার ধারণা, একটু বাড়িয়েও বলেন।

    ঠিক ধরেচ। মাছ নিইনি তার আর-একটি কারণ, উনি মাছ দিয়ে গেলে সব জায়গায় সে গল্প করে বেড়াবেন, আর লোকে ভাববে আমরা কি চামারপুকুরে মাছ ধরেছে বলে ওঁর কাছ থেকে মাছ নিইচি।

    না মামা, এটি আপনার ভুল। একথা ভাববার কারণ কী লোকদের? তা কখনো কেউ ভাবে?

    তা যাই হোক, মোটের উপর আমি ওঠা পছন্দ করি নে।

    উনি একটা বড়ো ভুল করেন মামাবাবু। টাকার কথা অমন বলে বেড়ান কেন?

    ওটা ওঁর স্বভাব। সর্বত্র ওই করবেন। যেখানে বসবেন, সেখানেই টাকার গল্প। করেও আজ আসছেন বহুদিন। দেখাতে চান, হাতে দু-পয়সা আছে।

    আমার মনে হয় ও-স্বভাবটা ভালো নয়বিশেষ করে এইসব পাড়াগাঁয়ে। একদিন আপনি একটু সাবধান করে দেবেন না?

    সে হবে না। তুমি ওঁকে জান না। বড্ড একগুঁয়ে। কথা তো শুনবেনই নাআরও ভাববেন, নিশ্চয়ই আমার কোনো মতলব আছে।

    আমি সেদিন কলকাতায় চলে এলাম বিকেলের ট্রেনে। আমার ওপরওয়ালা নিবারণবাবু লিখেছেন, খুব শিগগির আমায় একবার এলাহাবাদে যেতে হবে বিশেষ একটা জরুরি কাজে। অফিসে যেতেই খবর পেলাম, তিনি আর-একটা কাজে দু-দিনের জন্য পাটনা গিয়েচেন চলেআমার এলাহাবাদ যাবার খরচের টাকা ও একখানা চিঠি রেখে গিয়েছেন তাঁর টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে।

    আমার কাছে তাঁর ড্রয়ারের চাবি থাকে। ড্রয়ার খুলে চিঠিখানা পড়ে দেখলাম, বিশেষ কোনো গুরুতর কাজ নয়এলাহাবাদ গভর্নমেন্ট থাম্ব-ইমপ্রেশন-বুরোতে যেতে হবে, কয়েকটি দাগি বদমাইশের বুড়ো-আঙুলের ছাপের একটা ফোটো নিতে।

    মি. সোম বুড়ো-আঙুলের ছাপ সম্বন্ধে একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।

    এলাহাবাদের কাজ শেষ করতে আমার লাগল মাত্র একদিন, আট-দশদিন রয়ে গেলাম তবুও।

    সেদিন সকালবেলা হঠাৎ মি. সোমের এক টেলিগ্রাম পেলাম। একটা জরুরি কাজের জন্য আমায় সেইদিনই কলকাতায় ফিরতে লিখেছেন। আমি যেন এলাহাবাদে দেরি না করি।

    .

    ভোরে হাওড়ায় ট্রেন এসে দাঁড়াতেই দেখি, মি. সোম প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম, কারণ, এরকম কখনো উনি আসেন না।

    আমার বললেনসুশীল, তুমি আজই মামার বাড়ি যাও। তোমার মামা কাল দু-খানা আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করেছেন তোমায় সেখানে যাবার জন্যে।

    আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম–মামার বাড়ি কারো অসুখ। সবাই ভালো আছে তো?

    সেসব নয় বলেই মনে হল। টেলিগ্রামের মধ্যে কারো অসুখের উল্লেখ নেই।

    কোনো লোক আসেনি সেখান থেকে?

    না। আমি তার করে দিয়েছি, তুমি এলাহাবাদে গিয়েচ। আজই তোমার ফিরবার তারিখ তাও জানিয়ে দিয়েছি।

    আমি বাসায় না গিয়ে সোজা শেয়ালদা স্টেশনে চলে এলাম মামার বাড়ি যাবার জন্যে।

    মি. সোম আমার সঙ্গে এলেন শেয়ালদা পর্যন্তবার বার করে বলে দিলেন, কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটলে তাঁকে যেন খবর দিইতিনি খুব উদবিগ্ন হয়ে রইলেন।

    মামার বাড়ি পা দিতেই বড়ো মামা বললেন–এসেছিস সুশীল? যাক, বড্ড ভাবছিলাম?

    কী ব্যাপার মামাবাবু? সবাই ভালো তো?

    এখানকার কিছু ব্যাপার নয়। শ্যামপুরের হরিশ গাঙ্গুলিমশায় খুন হয়েছেন। সেখানে এখুনি যেতে হবে।

    আমি ভীত ও বিস্মিত হয়ে বললাম–গাঙ্গুলিমশায়। সেদিন যিনি মাছ ধরে গেলেন! খুন হয়েচেন?

    হ্যাঁ, চলো একেবার সেখানে। শিগগির স্নানাহার করে নাও। কারণ, সারাদিনই হয়তো কাটবে সেখানে।

    বেলা দুটোর সময় শ্যামপুরে এসে পৌঁছোলাম। ছোট্ট গ্রাম। কখনো সেখানে কারো একটা ঘটি চুরি হয়নি–সেখানে খুন হয়ে গিয়েছে, সুতরাং গ্রামের লোকে দস্তুরমতো ভয় পেয়ে গেছে। গ্রামের মাঝখানে বারোয়ারি-পূজা-মন্ডপে জড়ো হয়ে সেই কথারই আলোচনা করছে সবাই।

    আমার মামা এখানে এর পূর্বে অনেকবার এসেছিলেন এই ঘটনা উপলক্ষ্যে, তা সকলের কথাবার্তা থেকে বোঝা গেল। আমার কথা বিশেষ কেউ জিগ্যেস করলে না বা আমার সম্বন্ধে কেউ কোনো আগ্রহও দেখালে না। কেউ জানে না, আমি প্রাইভেট-ডিটেকটিভ মি. সোমের শিক্ষানবিশ ছাত্ৰএসব অজ পাড়াগাঁয়ে ওঁর নামই কেউ শোনেনিআমাকে সেখানে কে চিনবে?

    মামা জিগ্যেস করলেন–লাশ নিয়ে গিয়েছে?

    ওরা বললেআজ সকালে নিয়ে গেল। পুলিশ এসেছিল।

    আমি ওদের বললামব্যাপার কীভাবে ঘটল? আজ হল শনিবার। কবে তিনি খুন হয়েছেন।

    গ্রামের লোকে যেরকম বললে তাতে মনে হল, সে-কথা কেউ জানে না। নানা লোক নানা কথা বলতে লাগল। পুলিসের কাছেও এরা এইরকমই বলে ব্যাপারটাকে রীতিমতো গোলমেলে করে তুলেছে।

    আমি আড়ালে মামাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললাম–আপনি কী মনে করে এখানে এনেচেন আমায়?

    মামা বললেন–তুমি সব ব্যাপার শুনে নাও, চলো, অনেক কথা আছে। এই খুনের রহস্য তোমায় আবিষ্কার করতে হবেতবে বুঝব মি. সোমের কাছে তোমায় শিক্ষানবিশ করতে দিয়ে আমি ভুল করিনি। এখানে কেউ জানে না তুমি কী কাজ করোসে তোমার একটা সুবিধে।

    সুবিধেও বটে, আবার অসুবিধেও বটে।

    কেন?

    বাইরের বাজে লোককে কেউ আগ্রহ করে কিছু বলবে না। গোলমাল একটু থামলে একজন ভালো লোককে বেছে নিয়ে সব ঘটনা খুঁটিয়ে জানতে হবে। গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে কোথায়?

    সে লাশের সঙ্গে মহকুমায় গিয়েছে। সেখানে লাশ কাটাকুটি করবে ডাক্তারে, তারপর দাহকার্য করে ফিরবে।

    লাশ দেখলে বড় সুবিধে হত। সেটা আর হল না

    সেইজন্যেই তো বলছি, তুমি কেমন কাজ শিখেচ, এটা তোমার পরীক্ষা। এতে যদি পাস করো তবে বুঝব তুমি মি. সোমের উপযুক্ত ছাত্র। নয়তো তোমাকে আমি আর ওখানে রাখব না–এ আমার এক-কথা জেনো।

    .

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    তারপর গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি গেলাম।

    গিয়ে দেখি, যেখানটাতে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি–তার দু-দিকে ঘন-জঙ্গল। একদিকে দূরে একটা গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা, একদিকে একটি হচ্ছে বাড়ি।

    আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের কথা জিগ্যেস করে জানলাম, সে এখনও মহকুমা থেকে ফেরেনি। তবে একটি প্রৌঢ়ার সঙ্গে দেখা হল–শুনলাম তিনি গাঙ্গুলিমশায়ের আত্মীয়া।

    তাঁকে জিগ্যেস করলামগাঙ্গুলিমশায়কে শেষ দেখেছিলেন কবে?

    বুধবার।

    কখন?

    বিকেল পাঁচটার সময়।

    কীভাবে দেখেছিলেন?

    সেদিন হাটবার ছিল–উনি হাটে যাবার আগে আমার কাছে পয়সা চেয়েছিলেন।

    কীসের পয়সা?

    সুদের পয়সা। আমি ওঁর কাছে দুটো টাকা ধার নিয়েছিলাম ও-মাসে।

    আপনার পর আর কেউ দেখেছিল?

    গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির ঠিক পশ্চিমগায়ে যে বাড়ি, সেদিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে প্রৌঢ়া বললেন–ওই বাড়ির রায়-পিসি আমার পরও তাঁকে দেখেছিলেন?

    আমি বৃদ্ধা রায়-পিসির বাড়ি গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতেই বৃদ্ধা আমায় আশীর্বাদ করে একখানা পিঁড়ি বার করে দিয়ে বললেন–বোসো বাবা।

    আমি সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম–আপনি একা থাকেন নাকি এ বাড়িতে।

    হ্যাঁ বাবা। আমার তো কেউ নেই–মেয়ে-জামাই আছে, তারা দেখাশুনো করে।

    মেয়ে-জামাই এখানে থাকেন?

    এখানেও থাকে, আবার তাদের দেশ এই এখান থেকে চার ক্রোশ দূর সাধুহাটি গাঁয়ে, সেখানেও থাকে।–

    গাঙ্গুলিমশায়কে আপনি বুধবারে কখন দেখেন?

    রাত্তিরে যখন উনি হাট থেকে ফিরলেন–তখন আমি বাইরের রোয়াকে বসে জপ করছিলাম। তারপর আর চোখে না দেখলেও ওঁর গলার আওয়াজ শুনেচি রাত দশটা পর্যন্তউনি ওঁর রান্নাঘরে রাঁধছিলেন আলো জ্বেলে, আমি যখন শুতে যাই তখন পর্যন্ত।

    তখন রাত কত হবে?

    তা কী বাবা জানি? আমরা পাড়াগাঁয়ের লোক–ঘড়ি তো নেই বাড়িতে। তবে তখন ফরিদপুরের গাড়ি চলে গিয়েছে। আমরা শব্দ শুনে বুঝি কখন কোন গাড়ি এল-গেল।

    একা থাকতেন, আর রাত পর্যন্ত রান্না করছিলেন–এত কী রান্না?

    সেদিন মাংস এনেছিলেন হাট থেকে। মাংস সেদ্ধ হতে দেরি হচ্ছিল।

    আপনি কী করে জানলেন?

    পরে আমরা জেনেছিলাম। হাটে যারা ওঁর সঙ্গে একসঙ্গে মাংস কিনেছিল–তারা বলেছিল। তা ছাড়া যখন রান্নাঘর খোলা হলবাবাগো!

    বলে বৃদ্ধা যেন সে দৃশ্যের বীভৎসতা মনের পটে আবার দেখতে পেয়ে শিউরে উঠে কথা বন্ধ করলেন। সঙ্গে যে প্রৌঢ়া আত্মীয়টি ছিলেন গাঙ্গুলিমশায়ের, তিনিও বললেনও বাবা, সে রান্নাঘরের কথা মনে হলে এখনও গা ডোল দেয়!

    আমি আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠলামকেন? কেন?কী ছিল রান্নাঘরে?

    বৃদ্ধা বললেন–থালার চারদিকে ভাত ছড়ানোমাংসের ছিবড়ে আর হাড়গোড় ছড়ানো।

    বাটিতে তখনও মাংস আর ঝোল রয়েছে–ঘরের মেঝেতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন–তিনি খেতে বসেছিলেন এবং তাঁর খাওয়া শেষ হবার আগেই যারা তাঁকে খুন করে তারা এসে পড়ে।

    প্রৌঢ়াও বললেন–হ্যাঁ বাবা, এ সবাই দেখেচে। পুলিশও এসে রান্নাঘর দেখে গিয়েছে। সকলেরই মনে হল, ব্রাহ্মণের খাওয়া শেষ হবার আগেই খুনেরা এসে তার ওপর পড়ে।

    আচ্ছা বেশ, এ গেল বুধবার রাতের ব্যাপার। সেদিনই হাট ছিল তো?

    হ্যাঁ বাবা, তার পরদিন সকালে উঠে আমরা দেখলাম, ওঁর ঘরের দরজা বাইরের দিকে তালা-চাবি দেওয়া। প্রথম সকলেই ভাবলে উনি কোথাও কাজে গিয়েচেন, ফিরে এসে রান্নাবান্না করবেন। কিন্তু যখন বিকেল হয়ে গেল, ফিরলেন না–তখন আমরা ভাবলাম, উনি ওঁর ছেলেদের কাছে কলকাতায় গেছেন।

    তারপর?

    বিষ্যুদবার গেল, শুক্রবার গেল, শুক্রবার বিকেলের দিকে বন্ধ-ঘরের মধ্যে থেকে কীসের দুর্গন্ধ বেরোতে লাগলতাও সবাই ভাবলে, ভাদ্রমাস, গাঙ্গুলিমশায় হয়তো তাল কুড়িয়ে ঘরের মধ্যে রেখে গিয়েছিলেন তাই পচে অমন গন্ধ বেরোচ্ছে।

    শনিবার আপনারা কোন সময় টের পেলেন যে, তিনি খুন হয়েছেন?

    শনিবারে আমি গিয়ে গ্রামের ভদ্রলোকদের কাছে সব বললাম। অনেকেই জানত না যে, গাঙ্গুলিমশায়কে এ ক-দিন গাঁয়ে দেখা যায়নি। তখন সকলেই এল। গন্ধ তখন খুব বেড়েছে! পচা তালের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে না!

    কী করলেন আপনারা?

    তখন সকলে জানলা খোলবার চেষ্টা করলে, কিন্তু সব জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। দোর ভাঙাই সাব্যস্ত হল। পরের ঘরের দোর ভেঙে ঢোকা ঠিক নয়–এরপর যদি তা নিয়ে কোনো কথা ওঠে। তখন চৌকিদার আর দফাদার ডেকে এনে তাদের সামনে দোর ভাঙা হল।

    কী দেখা গেল?

    দেখা গেল, তিনি ঘরের মধ্যে মরে পড়ে আছেন! মাথায় ভারি জিনিস দিয়ে মারার দাগ। মেজে খুঁড়ে রাশীকৃত মাটি বার করা, ঘরের বাক্স-প্যাঁটরা সব ভাঙা, ডালা খোলা–সব তচনচ করেচে জিনিসপত্র। … তারপর ওঁর ছেলেদের টেলিগ্রাম করা হল।

    এ ছাড়া আর কিছু আপনারা জানেন না?

    না বাবা, আর আমরা কিছু জানি নে।

    গাঙ্গুলিমশায়ের প্রতিবেশিনী সেই বৃদ্ধাকে জিগ্যেস করলামরাত্রে কোনোরকম শব্দ শুনেছিলেন? গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ি থেকে?

    কিছু না। অনেক রাত্তিরে আমি যখন শুতে যাই–তখনও ওঁর রান্নাঘরে আলো জ্বলতে দেখেছি। আমি ভাবলাম, গাঙ্গুলিমশায় আজ এখনও দেখি রান্না করছেন!

    কেন, এ-রকম ভাবলেন কেন?

    এত রাত পর্যন্ত তো উনি রান্নাঘরে থাকেন না; সকাল রাত্তিরেই খেয়ে শুয়ে পড়েন। বিশেষ করে সেদিন গিয়েছে ঘোর অন্ধকার রাত্তির–অমাবস্যা, তার ওপর টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়েছিল সন্ধ্যে থেকেই।

    তখন তো আর আপনি জানতেন না যে, উনি হাট থেকে মাংস কিনে এনেছেন?

    না, এমন কিছুই জানি নে। … হ্যাঁ বাবা, … যখন এত করে জিগ্যেস করচ, তখন একটা কথা আমার এখন মনে হচ্ছে–

    কী, কী, বলুন?

    উনি ভাত খাওয়ার পরে রোজ রাত্তিরে কুকুর ডেকে এঁটো পাতা, কী পাতের ভাত তাদের দিতেন, রোজ রোজ ওঁর গলার ডাক শোনা যেত। সেদিন আমি আর তা শুনিনি।

    ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো।

    না বাবা, বুড়ো-মানুষ ঘুম সহজে আসে না। চুপ করে শুয়ে থাকি বিছানায়। সেদিন আর ওঁর কুকুরকে ডাক দেওয়ার আওয়াজ আমার কানেই যায়নি।

    ভালো করে জেরা করার ফল অনেক সময় বড়ো চমৎকার হয়। মি. সোম প্রায়ই বলেন –লোককে বারবার করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। যা হয়তো তার মনে নেই, বা, খুঁটিনাটির ওপর সে তত জোর দেয়নি তোমার জেরায় তা তারও মনে পড়বে। সত্য বার হয়ে আসে অনেক সময় ভালো জেরার গুণে।

    .

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    সেদিনই আমার সঙ্গে গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে শ্রীগোপালের দেখা হল। সে তার পিতার দাহকার্য শেষ করে ফিরে আসছে কাছাগলায়।

    আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিজের প্রকৃত পরিচয় দিলাম। শ্রীগোপালের চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়তে লাগল। সে আমাকে সবরকমের সাহায্য করবে প্রতিশ্রুতি দিলে।

    আমি বললাম, কারো ওপর আপনার সন্দেহ হয়?

    কার কথা বলব বলুন। বাবার একটা দোষ ছিল, টাকার কথা জাহির করে বেড়াতেন সবার কাছে। কত জায়গায় এসব কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে কে এ-কাজ করলে কী করে বলি?

    আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করব–কিছু মনে করবেন না। আপনার বাবার কত টাকা ছিল জানেন?

    বাবা কখনো আমাদের বলতেন না। তবে, আন্দাজ, দু-হাজারের বেশি নগদ টাকা ছিল না।

    সে টাকা কোথায় থাকত?

    সেটা জানতাম। ঘরের মেঝেতে বাবা পুঁতে রাখতেন–কতবার বলেছি, টাকা ব্যাংকে রাখুন। সেকেলে লোক, ব্যাংক বুঝতেন না।

    গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর পর বাড়ি এসে আপনি মেজে খুঁড়ে কিছু পেয়েছিলেন?

    মেঝে তো খুঁড়ে রেখেছিল যারা খুন করেছে তারাই। আমি এক পয়সাও পাইনি–তবে একটা কথা বলি–দু-হাজার টাকার সব টাকাই তো মেঝেতে পোঁতা ছিল না–বাবা টাকা ধার দিতেন কিনা! কিছু টাকা লোকজনকে ধার দেওয়া ছিল।

    কত টাকা আন্দাজ?

    সেদিক থেকেও মজা শুনুন, বাবার খাতাপত্র সব ওই সঙ্গে চুরি হয়ে গিয়েছে। খাতা না দেখলে বলা যাবে না কত টাকা ধার দেওয়া ছিল।

    খাতাপত্র নিজেই লিখতেন?

    তার মধ্যে গোলমাল আছে। আগে নিজেই লিখতেন, ইদানীং চোখে দেখতে পেতেন না বলে এক-ওকে ধরে লিখিয়ে নিতেন।

    কাকে-কাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন জানেন?

    বেশিরভাগ লেখাতেন সদগোপ-বাড়ির ননী ঘোষকে দিয়ে। সে জমিদারি-সেরেস্তায় কাজ করে–তার হাতের লেখাও ভালো। বাবার কথা সে খুব শুনত।

    ননী ঘোষের বয়েস কত?

    ত্রিশ-বত্রিশ হবে।

    ননী ঘোষ লোক কেমন? তার ওপর সন্দেহ হয়।

    মুশকিল হয়েছে, বাবা তো একজনকে দিয়ে লেখাতেন না! যখন যাকে পেতেন, তখন তাকেই ধরে লিখিয়ে নিতেন যে! স্কুলের ছেলে গণেশ বলে আছে, ওই মুখুজ্যে বাড়ি থেকে পড়ে–তাকেও দেখি একদিন ডেকে এনেছেন। শুধু ননী ঘোষের ওপর সন্দেহ করে কী করব?

    আর কাকে দেখেছেন?

    আর মনে হচ্ছে না।

    আপনি হিসেবের খাতা দেখে বলে দিতে পারেন, কোন হাতের লেখা কার?

    ননীর হাতের লেখা আমি চিনি। তার হাতের লেখা বলতে পারি–কিন্তু সে খাতাই বা কোথায়? খুনেরা সে খাতা তো নিয়ে গিয়েছে!

    কাকে বেশি টাকা ধার দেওয়া ছিল, জানেন?

    কাউকে বেশি টাকা দিতেন না বাবা। দশ, পাঁচ, কুড়ি–বড়োজোর ত্রিশের বেশি টাকা একজনকেও তিনি দিতেন না।

    .

    শ্যামপুরের জমিদারবাড়ি সেবেলা খাওয়া-দাওয়া করলাম।

    একটি বড়ো চত্বর, তার চারিধারে নারিকেল গাছের সারি, জামরুল গাছ, বোম্বাই-আমের গাছ, আতা গাছ। বেশ ছায়াভরা উপবন যেন, ডিটেকটিভগিরি করে হয়তো ভবিষ্যতে খাব–তা বলে প্রকৃতির শোভা যখন মন হরণ করে–এমন মেঘমেদুর বর্ষা-দিনে গাছপালার শ্যামশোভা উপভোগ করতে ছাড়ি কেন?

    বসলুম এসে চত্বরের একপাশে নির্জন গাছের তলায়।

    বসে বসে ভাবতে লাগলুম।

    … কী করা যায় এখন? মামা বড়ো কঠিন পরীক্ষা আমার সামনে এনে ফেলেছেন?

    মি. সোমের উপযুক্ত ছাত্র কিনা আমি, এবার তা প্রমাণ করার দিন এসেছে।

    কিন্তু বসে বসে মি. সোমের কাছে যতগুলি প্রণালী শিখেচি খুনের কিনারা করবার– সবগুলি পাশ্চাত্য-বৈজ্ঞানিক-প্রণালী–স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভের প্রণালী। এখানে তার কোনোটিই খাটবে না। আঙুলের ছাপ নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করা হয়নি– সাত-আটদিন পরে এখন জিনিসপত্রের গায়ে খুনির আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

    পায়ের দাগ সম্বন্ধেও ঠিক সেই কথা।

    খুন হবার পর এত লোক গাঙ্গুলিমশায়ের ঘরে ঢুকেচে–তাদের সকলের পায়ের দাগের সঙ্গে খুনির পায়ের দাগ একাকার হয়ে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। গ্রামের কৌতূহলী লোকেরা আমায় কী বিপদেই ফেলেচে! তারা জানে না, একজন শিক্ষানবিশ-ডিটেকটিভের কী সর্বনাশ তারা করেচে!

    আর একটা ব্যাপার, খুনটা টাটকা নয়, সাতদিন আগে খুন হয়ে লাশ পর্যন্ত দাহ শেষ সব ফিনিশ– গোলমাল চুকে গিয়েছে।

    চোখে দেখিনি পর্যন্ত সেটা–অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন-টিহ্নগুলি দেখলেও তো যা হয় একটি ধারণা করা যেত। এ একেবারে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া! ভীষণ সমস্যা।

    মি. সোমকে কী একখানা চিঠি লিখে তাঁর পরামর্শ চেয়ে পাঠাব? এমন অবস্থায় পড়লে তিনি নিজে কী করতেন জানাতে বলব?

    কিন্তু তাও তো উচিত নয়।

    মামা যখন বলেছেন, এটা যদি আমার পরীক্ষা হয়, তবে পরীক্ষার হলে যেমন ছেলেরা কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করে নেয় না–আমায় তাই করতে হবে।

    যদি এর কিনারা করতে পারি, তবে মামা বলেছেন, আমাকে এ-লাইনে রাখবেন–নয়ত মি. সোমের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেবেন, নিয়ে হয়তো কোনো আর্টিস্টের কাছে রেখে ছবি আঁকতে শেখাবেন বা বড়ো দরজির কাছে রেখে শার্ট তৈরি, পাঞ্জাবি তৈরি শেখাবেন।

    তবে শিক্ষানবিশের প্রথম পরীক্ষা-হিসেবে পরীক্ষা যে বেশ কঠিন, এতে কোনো ভুল নেই।…

    বসে-বসে আরও অনেক কথা ভাবলুম।

    …হিসেবের খাতা যে লিখত, সে নিশ্চয়ই জানত ঘরে কত টাকা মজুত, বাইরে কত টাকা ছড়ানো। তার পক্ষে জিনিসটা জানা যত সহজ, অপরের পক্ষে তত সহজ নয়।

    এ-বিষয়েও একটা গোলমাল আছে। গাঙ্গুলিমশায় টাকার গর্ব মুখে করে বেড়াতেন যেখানে-সেখানে। কত লোক শুনেচে-কত লোক হয়তো জানত।

    একটা কথা আমার হঠাৎ মনে এল।

    কিন্তু, কাকে কথাটা জিজ্ঞেস করি?

    ননী ঘোষের বাড়ি গিয়ে ননী ঘোষের সঙ্গে দেখা করা একবার বিশেষ দরকার। তাকেই একথা জিগ্যেস করতে হবে। সে নাও বলতে পারে অবশ্য–তবুও একবার জিজ্ঞেস করতে দোষ নেই।…

    ননী ঘোষ বাড়িতেই ছিল। আমায় সে চেনে না, একটু তাচ্ছিল্য ও ব্যস্ততার সঙ্গে বললে –কী দরকার বাবু? বাড়ি কোথায় আপনার?

    আমি বললাম–তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে। ঠিক উত্তর দাও। মিথ্যে বললে বিপদে পড়ে যাবে।

    ননীর মুখ শুকিয়ে গেল। দেখলাম সে ভয় পেয়েছে। বুঝেছে যে, আমি গাঙ্গুলিমশায়ের খুন সম্পর্কে তদন্ত করতে এসেছি–নিশ্চয়ই পুলিসের সাদা পোশাক-পরা ডিটেকটিভ।

    সে এবার বিনয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বললে–বাবু, যা জিগ্যেস করেন, করুন।

    গাঙ্গুলিমশায়ের খাতা তুমি লিখতে?

    ননী ইতস্তত করে বললে–তা ইয়ে–আমিও লিখিচি দু-একদিন–আর ওই গণেশ বলে একটা স্কুলের ছেলে আছে, তাকে দিয়েও–

    আমি ধমক দিয়ে বললাম–স্কুলের ছেলের কথা হচ্ছে না–তুমি লিখতে কিনা?

    ননী ভয়ে ভয়ে বললে–আজ্ঞে, তা লেখতাম।

    কতদিন লিখচ? মিথ্যে কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে। ঠিক বলবে।

    প্রায়ই লেখতাম। দু-বছর ধরে লিখচি।

    আর কে লিখত?

    এই যে স্কুলের ছেলে গণেশ—

    তার কথা ছেড়ে দাও, তার বয়েস কত?

    পনেরো-ষোলো হবে।

    আর কে লিখত?

    আর, সরফরাজ তরফদার লিখত, সে এখন—

    সরফরাজ তরফদারের বয়েস কত? কী করত?

    সে এখন মারা গিয়েছে।

    বাদ দাও সে-কথা। কতদিন মারা গিয়েছে?

    দু-বছর হবে।

    এইবার একটা কথা জিগ্যেস করি–গাঙ্গুলিমশায়ের কত টাকা বাইরে ছিল জান?

    প্রায় দু-হাজার টাকা।

    মিথ্যে বোলো না। খাতা পুলিসের হাতে পড়েছে–মিথ্যে বললে মারা যাবে।

    না বাবু, মিথ্যে বলিনি। দু-হাজার হবে।

    ঘরে মজুত কত ছিল?

    তা জানিনে!

    আবার বাজে কথা? ঠিক বলো।

    বাবু, আমায় মেরেই ফেলুন আর যাই করুন–মজুত টাকা কত তা আমি কী করে বলব? গাঙ্গুলিমশায় আমায় সে টাকা দেখায়নি তো? খাতায় মজুত-তবিল লেখা থাকত না।

    একটা আন্দাজ তো আচে? আন্দাজ কী ছিল বলে তোমার মনে হয়?

    আন্দাজ আর সাত-আট-শো টাকা।

    কী করে আন্দাজ করলে?

    ওঁর মুখের কথা থেকে তাই আন্দাজ হত।

    গাঙ্গুলিমশায়ের মৃত্যুর কতদিন আগে তুমি শেষ খাতা লিখেছিলে?

    প্রায় দু-মাস আগে। দু-মাসের মধ্যে আমি খাতা লিখিনি–আপনার পায়ে হাত দিয়ে বলচি। তা ছাড়া খাতা বেরোলে হাতের লেখা দেখেই তা আপনি বুঝবেন।

    কোনো মোটা টাকা কি তাঁর মরণের আগে কোনো খাতকে শোধ করেছিল বলে তুমি মনে করো?

    না বাবু! ঊর্ধ্বসংখ্যা ত্রিশ টাকার বেশি তিনি কাউকে ধার দিতেন না, সেটা খুব ভালো করেই জানি। মোটা টাকা মানে, দু-শো-এক-শো টাকা কাউকে তিনি কখনো দেননি।

    এমন তো হতে পারে, পাঁচজন খাতকে ত্রিশ টাকা করে শোধ দিয়ে গেল একদিনে? দেড় শো টাকা হল?

    তা হতে পারে বাবু, কিন্তু তা সম্ভব নয়। একদিনে পাঁচজন খাতকে টাকা শোধ দেবে না। আর একটা কথা বাবু। চাষি-খাতক সব–ভাদ্রমাসে ধান হবার সময় নয়–এখন যে চাষি প্রজারা টাকা শোধ দিয়ে যাবে, তা মনে হয় না। ওরা শোধ দেয় পৌষ মাসে–আবার ধার নেয় ধান-পাট বুনবার সময়ে চৈত্র-বৈশাখ মাসে। এ-সময় লেন-দেন বন্ধ থাকে।

    .

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    কোনো কিছু সন্ধান পাওয়া গেল না ননীর কাছে। তবুও আমার সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে গেল না। ননী হয় সম্পূর্ণ নির্দোষ, নয়তো সে অত্যন্ত ধূর্ত। মি. সোম একটা কথা সবসময়ে বলেন, বাইরের চেহারা বা কথাবার্তা দ্বারা কখনো মানুষের আসল রূপ জানবার চেষ্টা কোরো না করলেই ঠকতে হবে। ভীষণ চেহারার লোকের মধ্যে অনেক সময় সাধুপুরুষ বাস করে– আবার অত্যন্ত সুশ্রী ভদ্রবেশী লোকের মধ্যে সমাজের কণ্টকস্বরূপ দানব-প্রকৃতির বদমাইশ বাস করে। এ আমি যে কতবার দেখেচি।

    ননীর বাড়ি থেকে ফিরে এসে গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়ির পেছনটা একবার ভালো করে দেখবার জন্যে গেলাম।

    গাঙ্গুলিমশায়ের বাড়িতে একখানা মাত্র খড়ের ঘর। তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট রান্নাঘর। রান্নাঘরের দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে যাওয়া যায়। এসব আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

    তাকে বললাম–আপনার পিতার হত্যাকারীকে যদি খুঁজে বার করতে পারি, আপনি খুব খুশি হবেন?

    সে প্রায় কেঁদে ফেলে বললে–খুশি কী, আপনাকে পাঁচ-শো টাকা দেব।

    টাকা দিতে হবে না। আমায় সাহায্য করুন। আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারি নে।

    নিশ্চয় করব। বলুন কী করতে হবে?

    আমার সঙ্গে সঙ্গে আসুন আপাতত। তারপর বলব যখন যা করতে হবে। আচ্ছা, চলুন তো বাড়ির পিছন দিকটা একবার দেখি?

    বড় জঙ্গল, যাবেন ওদিকে?

    জঙ্গল দেখলে তো আমাদের চলবে না–চলুন দেখি।

    সত্যই ঘন আগাছার জঙ্গল আর বড়ো বড়ো বন্যগাছের ভিড় বাড়ির পেছনেই। পাড়াগাঁয়ে যেমন হয়ে থাকে–বিশেষ করে এই শ্যামপুরে জঙ্গল একটু বেশি। বড়ো বড়ো ভিটে লোকশূন্য ও জঙ্গলাবৃত হয়ে পড়ে আছে বহুকাল থেকে। ম্যালেরিয়ার উৎপাতে দেশ উৎসন্ন গিয়েছিল বিশ-ত্রিশ বছর আগে। এখন পাড়ায় পাড়ায় নলকূপ হয়েছে জেলাবোর্ডের অনুগ্রহে, ম্যালেরিয়াও অনেক কমেছে–কিন্তু লোক আর ফিরে আসেনি।

    জঙ্গলের মধ্যে বর্ষার দিনে মশার কামড় খেয়ে হাত-পা ফুলে উঠল। আমি প্রত্যেক স্থান তন্নতন্ন করে দেখলাম। সাত-আটদিনের পূর্বের ঘটনা, পায়ের চিহ্ন যদি কোথাও থাকতে পারে–তবে এখানেই তা থাকা সম্ভব।

    কিন্তু জায়গাটা দেখে হতাশ হতে হল।

    জমিটা মুথে-ঘাসে ঢাকা–বর্ষায় সে ঘাস বেড়ে হাতখানেক লম্বা হয়েছে। তার ওপর পায়ের দাগ থাকা সম্ভবপর নয়।

    আমার মনে হল, খুনি রাত্রে এসেছিল ঠিক এই পথে। সামনের পথ লোকালয়ের মধ্যে দিয়ে–কখনই সে-পথে আসতে সাহস করেনি।

    অনেকক্ষণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেও সন্দেহজনক কোনো জিনিস চোখে পড়ল না– কেবল এক জায়গায় একটা শেওড়াগাছের ডাল ভাঙা অবস্থায় দেখে আমি গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলেকে বললাম–এই ডালটা ভেঙে কে দাঁতন করেছিল, আপনি?

    গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলে আশ্চর্য হয়ে বললে–না, আমি এ-জঙ্গলে দাঁতন-কাঠি ভাঙতে আসব কেন?

    তাই জিগ্যেস করচি।

    আপনি কী করে জানলেন, ডাল ভেঙে কেউ দাঁতন করেছে?

    ভালো করে চেয়ে দেখুন। একরকম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুচড়ে ভেঙেচে ডালটা–তা ছাড়া এতগুলি শ্যাওড়াডালের মধ্যে একটিমাত্র ডাল ভাঙা। মানুষের হাতে ভাঙা বেশ বোঝা যাচ্চে। দাঁতনকাঠি সংগ্রহ ছাড়া অন্য কী উদ্দেশ্যে এভাবে একটি ডাল কেউ ভাঙতে পারে?

    আপনার দেখবার চোখ তো অদ্ভুত! আমার তো মশাই চোখেই পড়ত না!

    আচ্ছা, দেখে বলুন তো, কত দিন আগে এ-ডালটা ভাঙা হয়েছে?

    অনেক দিন আগে।

    খুব বেশি দিন আগে না। মোচড়ানো-অংশের গোড়াটা দেখে মনে হয়, ছ-সাতদিন আগে। এর চেয়েও নিখুঁতভাবে বলা যায়। ওই অংশের সেলুলোজ অণুবীক্ষণ দিয়ে পরীক্ষা করলে ধরা পড়বে। আমি এই গাছের ভাঙা-ডালটা কেটে নিয়ে যাব, একটা দা আনুন তো দয়া করে?

    গাঙ্গুলিমশায়ের ছেলের মুখ দেখে বুঝলাম সে বেশ একটু অবাক হয়েছে। ভাঙাদাঁতনকাঠি নিয়ে আমার এত মাথাব্যথার কারণ কী বুঝতে পারছে না।

    সে পিছন ফিরে দা আনতে যেতে উদ্যত হলকিন্তু দু-চার পা গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে ঘাসের মধ্যে থেকে কী একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে বললে–এটা কী?

    আমি তার হাত থেকে জিনিসটা নিয়ে দেখলাম, সেটা একটা কাঠের ছোট্ট গোলাকৃতি পাত। ভালো করে আলোয় নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখলাম, পাতের গায়ে একটা খোদাই কাজ। একটা ফুল, ফুলটার নীচে একটি শেয়ালের মতো জানোয়ার।

    শ্রীগোপাল বললে–এটা কী বলুন তো?

    আমি বুঝতে পারলাম না, কী জিনিস এটা হতে পারে তাও আন্দাজ করতে পারলাম না। জিনিসটা হাতে নিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। যাবার আগে শেওড়াগাছের ভাঙা ডালের গোড়াটা কেটে নিয়ে এলাম।

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসুন্দরবনে সাত বৎসর – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article মরণের ডঙ্কা বাজে – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }