Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প110 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. আজহার সাহেব রোদের আশায়

    ২

    আজহার সাহেব রোদের আশায় বারান্দায় বসে আছেন। রোদ উঠছে না। ঘন হয়ে কুয়াশা পড়েছে। এমন ঘন যে দশহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। তাঁর ইচ্ছা মেয়েদের নিয়ে বাগানে বসে খেজুরের রস খাবেন। নিজের গাছের রস। কলসি ভর্তি রস দেলোয়ার নামিয়ে এনেছে। সেই রস কাপড়ের ছাঁকনিতে ছাঁকা হচ্ছে। রসের মিষ্টি গন্ধটাও মনে হয় শীত বাড়িয়ে দিচ্ছে। গন্ধের সঙ্গে কি শীতের সম্পর্ক আছে? রঙের সঙ্গে যে সম্পর্ক আছে তা তিনি জানেন। কিছু রঙকে বলাই হয় উষ্ণ রঙ, ওয়ার্ম কালার—যেমন লাল, হলুদ। কিছু রঙ আবার ঠাণ্ডা রঙ —যেমন নীল।

    মনোয়ারা চায়ের মগ নিয়ে বারান্দায় এলেন। আজহার সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কই শেফা আর মীরাকে বলেছ?

    মনোয়ারা কুণ্ঠিত গলায় বললেন, ওরা আসবে না।

    ‘আসবে না কেন? বাগানে বসে খেজুরের রস খাবে কত ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। টাটকা রস। ঢাকায় এই জিনিস পাবে কোথায়?’

    ‘মীরা শুয়ে আছে। ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না।’

    ‘সবসময় এক অজুহাত দিও না। শরীর ভালো যাচ্ছে না মানে কী? এমন একটা ভাব সে ধরে আছে যেন তাকে আন্দামান দ্বীপে এনে ফেলা হয়েছে।’

    মনোয়ারা বললেন, ওরা ওদের মতো করে থাকুক। চল আমরা দুজন বাগানে যাই। যাবে? দাঁড়াও আমি একটা চাদর নিয়ে আসি।

    আজহার সাহেব হ্যাঁ না কিছু বললেন না। তাঁর মনটাই খারাপ হয়ে গেল। তিনি ভেবে রেখেছেন রস খাবার পর মেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বের হবেন। উত্তর বন্ধে মটরশুঁটির ক্ষেতের দিকে যাবেন। দেলোয়ার সঙ্গে যাবে। দেলোয়ারের সঙ্গে থাকবে কেরোসিনের চুলা এবং পানি গরম করার পাত্র। মটরশুঁটির ক্ষেতে বসে মটরশুঁটি সিদ্ধ ক্বা হবে। তারপর খোসা ছাড়িয়ে মটরশুঁটি খাওয়া।

    আজহার সাহেবের দাদা মুনশি হেলালউদ্দিন এই বাগান করেছিলেন। মুনশি হেলালউদ্দিন মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। এক রাতে স্বপ্নে তিনি কয়েকটা রোগের ঔষধ পেয়ে যান। শিক্ষার পাশে-পাশে লোকজনদের অষুধ দেয়া শুরু করেন। কামেলা রোগের অষুধ এবং সূতিকার অষুধ। তাঁর যখন খুব নাম-ডাক হল, দূরের গ্রাম থেকে বোতল নিয়ে অষুধের জন্য লোকজন আসতে শুরু করল, তখন তিনি হঠাৎ চিকিৎসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁকে নাকি অষুধ না-দিতে স্বপ্নে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অষুধ নিতে এসে লোকজন ফেরত যেতে শুরু করল। এতে তাঁর নাম আরো ছড়িয়ে পড়ল। লোকজনের ভিড় বেড়ে গেল। তার কিছুদিন পর গ্রামে গুজব ছড়িয়ে পড়ল মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি পেয়েছেন। `শুধু যে পীরাতি পেয়েছেন তাই না, তাঁর পোষা দুটা জ্বীনও আছে। রাতে দরজা বন্ধ করে তিনি জ্বীনদের সঙ্গে কথা বলেন। জ্বীনদের সঙ্গে জিকির করতে বসেন। নতুন পীর সাহেবের কাছ থেকে তাবিজ এবং পানিপড়া নেবার জন্যে দলে দলে লোক আসতে লাগল। তিনি পানিপড়া এবং তাবিজ দিতে শুরু করলেন। অবিবাহিত মেয়েদের দিতেন সূতাপড়া। কালো রঙের সূতায় ফুঁ দিয়ে দিতেন। সেই সূতা খোঁপায় চুলের সঙ্গে বেঁধে রাখতে হত। সূতা বাঁধার দশদিনের ভেতর বিয়ের সম্বন্ধ আসত। নিয়ম হচ্ছে প্রথম যে-সম্বন্ধ আসবে সেখানেই মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। খোঁপায় সূতা বাঁধা অবস্থায় আসা সম্বন্ধ ফিরিয়ে দেয়া যাবে না।

    মুনশি হেলালউদ্দিন পীরাতি করে অনেক টাকাপয়সা জমিজমা করেছিলেন। তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে পাকা বাড়ি তোলেন। বাড়ির নাম হয়ে যায় পীরবাড়ি।

    হেলালউদ্দিন সাহেবের শেষ জীবন সুখের হয়নি। মাথাখারাপের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। রাতে বা দিনে কখনোই ঘুমাতে পারতেন না। শেষ রাতের দিকে কিছুক্ষণের জন্যে ঝিমুনি আসত, তিনি চোখ বন্ধ করেই সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠতেন। সবার ধারণা তাঁর পোষা দুটা জ্বীন বিগড়ে গিয়েছিল। তারাই তাঁকে যন্ত্রণা করত। জ্বীন দুটার একটার নাম হবিব আর একটার নাম জাবির। দুজনের বয়সই চারশ’র উপর। দুটাই অবিবাহিত। এদের বাড়ি কোহকাফ নগরে। এদের মধ্যে একজন জ্বীন (হবিব) আগে হিন্দু ছিলেন পরে মুসলমান হয়েছেন।

    লোকশ্রুতি হল মুনশি হেলালউদ্দিন মৃত্যুর সময় ইচ্ছা করে জ্বীন দুটাকে আজাদ করে যাননি। তারা পীরবাড়িতেই আটকা পড়ে আছে। আমৃত্যু তাই থাকবে। গ্রামের অনেক লোক পীরবাড়ির ছাদে দুটা আগুনের হলকাকে নাচানাচি করতে দেখেছে। কেউ কেউ এখনো দেখে।

    মনোয়ারা এবং আজহার সাহেব খেজুরের রসের গ্লাস হাতে নিয়ে মুনশি হেলালউদ্দিন সাহেবের শখের বাগানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আম-কাঁঠালের বাগান, মাঝখানে কয়েকটা জলপাই গাছ আছে। জলপাই গাছের জায়গাটা আসলেই সুন্দর। জলপাই গাছের শুকনো পাতার রঙ গাঢ় লাল। শুকনো পাতা পড়ে গাছের নিচটা এমন হয়েছে যে মনে হয় কেউ লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। দু বছর আগে সবচে বড় জলপাই গাছের গুঁড়ি আজহার সাহেব বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। এখন তিনি সেই বাঁধানো গাছের নিচে বসে আছেন।

    মনোয়ারা বললেন, প্রায় দশ বছর পর খেজুরের রস খাচ্ছি।

    আজহার সাহেব বললেন, খেতে কেমন লাগছে?

    মনোয়ারা মুগ্ধ গলায় বললেন, ভালো। খুবই ভালো। বলতে বলতে আগ্রহ নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলেন। আসলে তাঁর মোটেই ভালো লাগছে না। কেমন বমি চলে আসছে, গন্ধটাও খারাপ– কেমন পচা-পাতা পচা-পাতা গন্ধ।

    স্বামীকে খুশি করার জন্যে রস খেয়ে মুগ্ধ হবার অভিনয় তাঁকে করতে হচ্ছে। একজন আদর্শ মহিলাকে অভিনয় করায় অত্যন্ত পারদর্শী হতে হয়। তাদের জীবনের একটা বড় অংশ কাটে আনন্দিত এবং মুগ্ধ হবার অভিনয় করে।

    শুকনো পাতা মাড়িয়ে দেলোয়ার আসছে। দেলোয়ারের গায়ে মাপে বড় হলুদ রঙের একটা কোট। কোটটা আজ সকালেই মনোয়ারা দেলোয়ারকে দিয়েছেন। আজহার সাহেবের কোট। পুরানো হলেও এখনো ভালো। দেলোয়ারের হাতে কেরোসিনের চুলা, এলুমিনিয়ামের একটা কড়াই। মটরশুঁটি সিদ্ধ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে সে এসেছে।

    ‘চাচাজী চলেন যাই।’

    আজহার সাহেব বললেন, দেলোয়ার থাক বাদ দাও।

    মনোয়ারা বললেন, বাদ থাকবে কেন? চল আমরা দুজন যাই।

    ‘মেয়েরাই ব্যাপারটা এনজয় করত, ওরা যখন যেতে চাচ্ছে না তখন থাক। দেলোয়ার তুমি চলে যাও।’

    দেলোয়ার চলে গেল। চাচাজীর সামনে থেকে যে সে সরে পরার সুযোগ পেয়েছে তাতেই সে খুশি। আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মা নাস্তা বানাচ্ছেন, তুমি মাকে সাহায্য কর। আর আমার জন্যে এখানে চা পাঠিয়ে দিও।

    ‘রোদ ওঠেনি। তুমি কুয়াশার মধ্যে একা বসে থাকবে? ঠাণ্ডা লাগবে তো। ঘরে চলে এসো।’

    ‘কুয়াশা থাকবে না, রোদ উঠবে।’

    মনোয়ারা চলে গেলেন। বাগানে একা-একা হাঁটতে আজহার সাহেবের খারাপই লাগছে। মটরশুঁটি খাবার আইডিয়াটা ভালো ছিল। মেয়েরা রাজি হল না। মেয়েরা অনেক দূরে সরে গেছে। গ্রামের মধ্যে বন্ধুবান্ধব নেই, টেলিফোন নেই, টিভি নেই, মিউজিক সিস্টেম বা শপিং নেই, কাজেই তিনি ধারণা করেছিলেন তারা কাছাকাছি আসবে। বাধ্য হয়েই বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। তিনি তাদের সঙ্গে নানান গল্প-গুজব করবেন। ওরা কী ধরনের গল্প পছন্দ করে তা তিনি জানেন না। মামলার কিছু ইন্টারেস্টিং গল্প আছে, সেইসব গল্প করা যেতে পারে। স্টেট ভার্সেস শিউলি রানীর মামলাটা তাদের পছন্দ হবার কথা। এই মামলাটায় কিছু অস্বাভাবিক এবং নোংরা ব্যাপার আছে। এই ব্যাপারগুলি বাদ দিয়ে বলতে হবে। মামলার যেদিন রায় হয় তার আগের দিন শিউলি রানী হঠাৎ ঘোষণা দিল সে আসলে নারী না, পুরুষ এবং বিজ্ঞ আদালতকে বলল তাকে ডাক্তারি পরীক্ষা করানোর জন্য। আদালত স্তম্ভিত। কারণ শিউলি রানী বিবাহিতা, তার দুটা ছেলে আছে। স্বামী জীবিত… . এই গল্প এদের পছন্দ না হয়েই পারে না।

    চায়ের কাপ হাতে শেফা আসছে। এক হাতে চায়ের কাপ অন্য হাতের পিরিচে দুটা ভাপা পিঠা। মেয়েকে দেখে আজহার সাহেবের মনখারাপ ভাবটা দূর হয়ে গেল। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, গুড মর্নিং মা। শেফা বলল, গুড মর্নিং। তোমার জন্যে চা আর পিঠা নিয়ে এসেছি।

    ‘খুব ভালো করেছিস।’

    ‘চা মনে হয় আনতে আনতে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। তোমাদের গ্রামে এত শীত কেন বাবা?’

    ‘তোমাদের গ্রাম বলছিস কেন? এটাতো তোরও গ্রাম। তোর গ্রাম কি আলাদা? মীরার ঘুম ভাঙে নি?’

    ‘ভেঙেছে। চা খেয়ে আবার লেপের ভেতর ঢুকে গেছে। আপা বলেছে রোদ না উঠলে সে লেপ থেকে বের হবে না।’

    ‘তোর রাতে ঘুম কেমন হয়েছে?’

    ‘ঘুম ভালো হয়েছে। তবে ঘুমুতে গেছি অনেক রাতে।’

    ‘কেন?’

    ‘কাল শোয়া নিয়ে খুব সমস্যা হয়েছে। প্রথমে গেলাম আপার সঙ্গে ঘুমানোর জন্যে। আপা রাজি হল না। তারপর একা-একা ঘুমুতে গেলাম। প্ৰায় ঘুম চলে এসেছে তখন দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে দেখি দাদীমা, উনি না-কি আমার সঙ্গে ঘুমুবেন। দাদীমা অনেক রাত জেগে গল্প করলেন।’

    ‘তাহলে তো ভালোই মজা হয়েছে।’

    ‘খুবই মজা হয়েছে বাবা।’

    শেফার আসলে কোনোই মজা হয় নি। দাদীমা রাতে একফোঁটা ঘুমায়নি, সারাক্ষণ কথা বলেছে। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেছেন যে শেফা হতভম্ব। যেমন হঠাৎ শেফার বুকে হাত দিয়ে বলেছেন—‘কিরে বেটি দুধ এত ছোট ক্যান?’ শেফা প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, দাদীমা যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বললেন-—

    হরিণ সুন্দর চোখে
    নারী সুন্দর বুকে।

    শেফা বলল, দাদীমা গায়ে হাত দিও না। কাতুকুতু লাগে। তিনি কুটকুট করে হাসতে হাসতে বললেন, জামাটা খোল্‌ বুক কেমন দেখি।

    কী আশ্চর্য কথা। এইসব তো আর কাউকে বলা যায় না। বলা ঠিকও হবে না। দাদীমা কিছু উদ্ভট কাণ্ডকারখানা করলেও মানুষটা খুবই ভালো। শেফার তাকে মোটামুটি পছন্দ হয়েছে।

    ‘দাদীমার সঙ্গে কী গল্প হল রে শেফা?’

    ‘অনেক গল্প হয়েছে। বেশির ভাগ গল্পই দাদাজানকে নিয়ে। দাদাজান নাকি তারজন্যে একেবারে পাগল ছিল। তিনি চোখের আড়াল হলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করতেন। বাইরের লোকজন এসেছে দাদাজানের সঙ্গে কথা বলতে, তখনো নাকি দাদীজানকে খুব কাছেই পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এমন জায়গায় দাঁড়াতে হত যেন পর্দার নিচে দিয়ে দাদাজান তাঁর পা দেখতে পান কিন্তু বাইরের লোকজন কিছু দেখতে পায় না। বাবা এইসব কি সত্যি?

    ‘হুঁ সত্যি। বাবা স্ত্রৈণ প্রকৃতির ছিলেন। আমার মা অত্যন্ত ভাগ্যবতী।’

    ‘এইরকম ভাগ্যবতী হলে আমি বিষ খেয়ে মরে যাব। একটা পুরুষ সারাক্ষণ চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে ভাবতে তো কুৎসিত লাগছে। ছিঃ।’

    আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। শেফার কথাবার্তা তাঁর ভালো লাগছে। মেয়েটা তো বেশ মজা করে কথা বলে।

    ‘বাবা!’

    ‘উঁ।’

    ‘দাদাজান নাকি মৃত্যুর আগে-আগে ঘোষণা করেছিলেন এই পুকুরের মাছ তার বংশধরেরা কেউ খেতে পারবে না। তাদের জন্যে পুকুরের মাছ নিষিদ্ধ।’

    ‘তা বলেছিলেন।’

    ‘কেন বলেছিলেন?’

    ‘তাতো মা জানি না। বাবা মারা যাবার সময় আমি গ্রামে ছিলাম না। আমি থাকলে জিজ্ঞেস করতাম।’

    ‘তুমি এই পুকুরের মাছ খাও না?’

    ‘আমি কি এখানে থাকি যে মাছ খাব?’

    ‘মাছ যদি মারা হয় তুমি খাবে?

    ‘কী দরকার? একজন মানুষ মৃত্যুর আগে একটা কথা বলে গেছে। কথাটা মানতে অসুবিধা কী?’

    ‘আমি ঠিক করেছি বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরব। তারপর নিজেই মাছ রান্না করব। সবাইকে খাওয়াব। তোমাকেও খাওয়াব।’

    আজহার সাহেব হাসলেন। রোদ উঠেছে। আশ্চর্য ব্যাপার, রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে গেছে। চারদিক ঝকঝক করছে। কুয়াশায় ভেজা গাছের পাতায় আলোর ঝলমলানি।

    আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, শেফা যা মীরাকে ডেকে নিয়ে আয়। রোদ উঠেছে। তোদের দুই বোনকে আমি অদ্ভুত একটা কাহিনী বলব— স্টেট ভার্সাস শেফালি রানীর বিখ্যাত মামলা। ইংরেজের আমলের মামলা। কোলকাতা হাইকোর্ট থেকে শেষপর্যন্ত প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গিয়েছিল। যেমন সেনসেশনাল মামলা, তেমনি সেনসেশনাল রায়। যা মীরাকে ডাক।

    ‘ডেকে লাভ হবে না বাবা। আপা আসবে না।’

    ‘আসবে না কেন? ‘

    ‘আসবে না কারণ তার আসলে খুব মন খারাপ।’

    ‘কেন?’

    ‘যেদিন আমরা এখানে আসব, তার আগের দিন সাবের ভাইয়ের সঙ্গে আপার খুব ঝগড়া হয়েছে।’

    ‘সাবের ভাই মানে কি লম্বা ছেলেটা?’

    ‘হ্যাঁ। আমি ডাকি লম্বু ভাইয়া। আপা তাতে রাগ করে।’

    ‘সাবের ছেলেটার সঙ্গে মীরার ঝগড়া হয়েছে? তোকে বলেছে?’

    ‘তুমি পাগল হয়েছ বাবা? আপা আমাকে কিছু বলবে? টেলিফোনে ঝগড়া হল তো, আমি আড়াল থেকে শুনলাম। টেলিফোন শেষ করে দরজা বন্ধ করে আপার যে কী কান্না। হাউ মাউ করে কেঁদেছে।

    ‘তোর মা জানে?’

    ‘মা ভাব করে সে কিছুই জানে না। আসলে সবই জানে।’

    ‘আমাকে তো কিছু বলে নি।’

    ‘তোমাকে কেন বলবে?’

    ‘আমাকে বলবে না কেন? আমি কি বাইরের কেউ যে আমাকে কিছু বলা যাবে না?’

    তুমি ঘরের হলেও তুমি হচ্ছ পুরুষমানুষ। পুরুষমানুষকে সবকিছু বলা যায় না।’

    ‘ঝগড়া হয়েছে ভালো কথা। এই বয়সে ক্লাস-ফ্রেন্ডদের মধ্যে ঝগড়া হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই বলে দরজা বন্ধ করে কাঁদতে হবে?’

    ‘কাঁদতে হলে তো দরজা বন্ধ করেই কাঁদতে হবে। দরজা খোলা রেখে কে কাঁদবে? বাবা আমি যাচ্ছি।’

    ‘বোস আরেকটু। স্টেট ভার্সেস শেফালি রানীর গল্পটা শুনবি?’

    ‘না। মামলা মোকদ্দমার গল্প শুনতে আমার ভালো লাগে না বাবা।’

    ‘না-শুনেই কীভাবে বুঝলি ভালো লাগে না?‘

    ‘না-শুনেই আমি বুঝতে পারছি—খুবই বোরিং গল্প। তোমার বেশিরভাগ গল্পই বোরিং, মামলার গল্প আরো বেশি বোরিং। বাবা আমি যাচ্ছি।’

    আজহার সাহেব চুপচাপ বসে রইলেন। কিছুক্ষণ আগে রোদ উঠেছে, এরমধ্যেই রোদ কেমন কড়া হয়ে গেছে। সুঁচের মতো গায়ে রোদ বিঁধে যাচ্ছে।

    মীরা বারান্দায়। রোদে পা মেলে সে মোড়ায় বসে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। চোখের নিচে কালি পড়েছে। মুখ শুকনো লাগছে। তারপরও মনোয়ারা বারান্দায় এসে মীরাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কী সুন্দরই না মেয়েটাকে লাগছে! ইন্দ্রাণীর মতো লাগছে। এই মেয়েটা তার বাবার মতো সুন্দর হয়েছে। শেফা বেচারি তার বাবার কিছুই পায়নি। কেমন ভোঁতা নাক মুখ। গায়ের রঙটা পেলেও তো কাজ হত। মীরা মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, মা তুমি এই ভয়ংকর কাণ্ডটা কী করে করলে?

    মনোয়ারা বিস্মিত হয়ে বলল, আমি কী করেছি?

    ‘দেলোয়ার নামের লোকটাকে সঙ সাজানোর বুদ্ধি তোমাকে কে দিল? লুঙ্গির উপর হলুদ একটা কোট পরে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাকে যে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে সে বুঝতেও পারছে না। মনে হচ্ছে মহাখুশি।

    ‘গ্রামের মানুষ অল্পতেই খুশি হয়।’

    ‘মা প্লিজ লোকটাকে বলো সে হয় কোট খুলে ফেলুক, কিংবা লুঙ্গির বদলে

    প্যান্ট পরুক। প্যান্ট না থাকলে বাবার একটা প্যান্ট দাও। ক্লাউন যখন সাজবে পুরোপুরি সাজুক।’

    ‘হাতমুখ ধুয়েছিস? নাশতা দেব?’

    ‘কী নাশতা?’

    ‘ভাপা পিঠা।’

    ‘ভাপা পিঠা খাব না। পরোটা ভেজে দিতে বল।’

    ‘পরোটা ভেজে দিচ্ছি। একটা পিঠা খেয়ে দেখ, খেতে ভালো হয়েছে। ‘যত ভালোই হোক খাব না। মিষ্টি-কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। ‘

    মনোয়ারা চলে যাচ্ছিলেন। মীরা বলল, মা আরেকটা জরুরি কথা শুনে যাও।

    ‘কী কথা?’

    ‘আমি নেত্রকোনা যাব। গাড়িটা নিয়ে যাব। দেলোয়ারকে বল সে যেন আমার সঙ্গে যায়।’

    ‘নেত্রকোনা কীজন্যে?’

    ‘আমার কাজ আছে।’

    ‘ঢাকায় টেলিফোন করবি?’

    ‘হুঁ। আমাকে টেলিফোন করতেই হবে।’

    ‘তোর বাবা রাগ করবে।’

    ‘রাগ করলে তুমি রাগ সামলাবে। আমাকে যেতেই হবে মা।’

    ‘তোর সমস্যাটা কী?

    ‘আমার সমস্যা ভয়াবহ।’

    ‘ভয়াবহ মানে কী? আমাকে বলা যায়?’

    ‘আজ যদি টেলিফোনে সাবেরকে পাই তাহলে তোমাকে সমস্যাটা বলব।’ মনোয়ারা বললেন, মীরা তুই এক কাজ কর। তোর বাবা বাগানে আছে। তার কাছে গিয়ে বোস। আমি তোর নাশতা সেখানে দিচ্ছি।

    ‘কেন?’

    ‘বেচারি একা বসে আছে। তুই পাশে গিয়ে বসলে খুশি হবে। তখন তোর নেত্রকোনা যাওয়া সহজ হবে। তোর বাবা রাগ করবে না।’

    মীরা গম্ভীর হয়ে বলল, মা তুমি সবকিছু নিয়ে কৌশল কর, প্যাঁচ খেলো, এইটাই আমার খারাপ লাগে। তোমার মাথার মধ্যে সবসময় কৌশল খেলা করে। তুমি সহজ সাধারণভাবে কিছু করতে পার না কেন?

    ‘সংসার ঠিকঠাক রাখতে হলে কৌশল লাগেরে মা। এখন বুঝবি না—আরো বয়স হোক তখন বুঝবি।’

    ‘বয়স আমার কম হয় নি—একুশ।’

    ‘একুশ একটা বয়স হল?’

    মীরা বাগানের দিকে রওনা হল। তার মেজাজ খারাপ। মা’র ওপর রাগ লাগছে। তার নেত্রকোনা যাবার মতো সাধারণ একটা ব্যাপারেও মা একটু প্যাঁচ খেলবে।

    আজহার সাহেব তাঁর বড় মেয়েকে দেখে এত খুশি হলেন যে তাঁর প্রায় চোখে পানি এসে যাবার মতো ব্যাপার হল। তিনি উজ্জ্বল গলায় বললেন, কেমন চনমনে রোদ উঠেছে দেখেছিস মা?

    মীরা বলল, হ্যাঁ। এখনতো রীতিমতো গরম লাগছে। সকালে দেখলাম কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না। আর এখন রোদ ঝাঁ-ঝাঁ করছে। বাবা শোনো, আমি একটু নেত্রকোনা যাব। আমাকে ঢাকায় টেলিফোন করতে হবে। গাড়িটা নিয়ে চলে যাই? দেলোয়ার সঙ্গে থাকবে, বাবা আমি কি যাব?

    আজহার সাহেব বললেন, যা। রাস্তা খানিকটা ভাঙা আছে, সাবধানে চালাবি। আরেকটা কথা, দেলোয়ার বয়সে তোর চে বড়। দেলোয়ার না বলে দেলোয়ার ভাই বল্। খুশি হবে। নাশতা করেছিস?

    ‘না। মা এখানে নাশতা নিয়ে আসবে।’

    ‘ভেরি গুড। খোলামেলা জায়গায় বসে নাশতা খাবার মজাই অন্যরকম।’

    ‘নাশতার প্লেটে পাখি ইয়ে না করে দিলেই হল।’

    আজহার সাহেব হো হো করে হেসে ফেললেন। তাঁর হাসি আর থামছেই না। মীরা ভেবে পাচ্ছে না সে এমন কী কথা বলেছে যে বাবার হাসি থামছে না।

    মনোয়ারা নাশতা নিয়ে এলেন। তিনি আজহার সাহেবের জন্যে আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছেন।

    আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মনোয়ারা বললেন, এই শোনো মীরার ঢাকায় একটা টেলিফোন করা দরকার। ওদের পরীক্ষা নিয়ে কি জানি ঝামেলা আছে। সেই সম্পর্কে খোঁজ নেয়া। দেলোয়ারকে বলে দেই সঙ্গে যাক। নেত্রকোনা থেকে আমারো দু-একটা জিনিস আনানো দরকার। মীরা গেলে আমার জন্যেও ভালো। মীরা দেখেশুনে আনতে পারবে।

    মীরার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। মা অকারণে এত কাঁদুনি গাইছে কেন?

    .

    শেফা খুব আয়োজন করেই মাছ মারতে বসেছে। পুকুরপাড়ে তার জন্যে বড় একটা শীতলপাটি বিছানো হয়েছে। শেফা যে জায়গায় বসেছে সেখানে রোদ আসে বলে বাঁশের মাথায় ছাতা বাঁধা হয়েছে। তার হাতে দুটা বঁড়শি আছে। এর মধ্যে একটা আবার হুইল বঁড়শি। হুইল বঁড়শি কী করে টানতে হয় শেফা জানে না। সাধারণ বঁড়শি টানার নিয়মও জানে না। শুধু এইটুকু জানে ফাত্না পানির নিচে তলিয়ে গেলে হ্যাঁচকা টান দিতে হয়। শেফা ঠিক করে রেখেছে যদি হুইলের বঁড়শির ফাত্না ডুবে যায় তাহলে সে বাবা বলে বিকট চিৎকার দেবে। বাকি যা করার বাবা করবেন। দেলোয়ার ভাই থাকলে হত, তিনি মীরা আপার সঙ্গে নেত্রকোনা গিয়েছেন। শেফার তাদের সঙ্গে যাবার ইচ্ছা করছিল। ইচ্ছাটা সে প্রকাশ করেনি, কারণ ইচ্ছে করলে লাভ নেই। মীরা আপা তাকে নেবে না।

    আজহার সাহেব মেয়ের বড়শি ফেলা দেখতে এলেন। তাঁর খুবই মজা লাগছে। বোঝা যাচ্ছে তাঁর ছোট মেয়েটা গ্রাম পছন্দ করতে শুরু করেছে। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছেন মেয়েটার ছিপে একটা মাছ ধরুক। ধরবে বলে মনে হয় না, প্রাচীন পুকুরের বুড়ো মাছগুলি ধুরন্ধর প্রকৃতির হয়—এরা সহজে ধরা দেয় না। তিনি খুশি-খুশি গলায় বললেন, তোর পাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে তোর কি খুব অসুবিধা হবে?

    শেফা বলল, অসুবিধা হবে না। শুধু নাক ডাকতে পারবে না। তোমার নাক ডাকার শব্দে মাছ পালিয়ে যেতে পারে।

    ‘নাক ডাকব না, শুধু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকব। মাছ ধরার একটা মন্ত্র আছে— মাঝে মাঝে মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিতে হয়।’

    ‘মন্ত্রটা কী?’

    ‘আমি ভুলে গেছি। দেলোয়ার জানতে পারে। ওকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিস।

    আজহার সাহেব নিজেই বালিশ নিয়ে এলেন। বালিশে মাথা রেখে মেয়ের পাশে শুয়ে পড়লেন।

    তাঁর হাতে কয়েকটা পেপারব্যাক। ছুটি কাটাবার সময় তিনি সঙ্গে বেশকিছু বই নিয়ে আসেন। ভাবেন ছুটির মধ্যে আরাম করে বই পড়া যাবে। কখনোই পড়া হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার হল যখন ব্যস্ততা থাকে চরমে তখনই বই পড়া হয়। অবসর সময় কখনোই পড়া হয় না। বই পড়তে গেলেই হাই উঠে ঘুম পায়। এখনো তাই হচ্ছে—হাই উঠছে। চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। চেষ্টা করেও খোলা রাখা যাচ্ছে না। আজহার সাহেব বইয়ের লেখার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারছেন না।

    বইটা খুবই হাসির হবার কথা, একটুও হাসি আসছে না—

    “There Were Four of us Gorge, and William Samuel Harris, and Myself, and montmoremcy. We were sitting in my room, smoking, and talking about how bad we were bad from a medical point of view I mean, of course.. …”

    আজহার সাহেব হাই তুলতে তুলতে ভাবছেন—বাক্যগুলি এত লম্বা কেন? বাক্যের শেষের দিকে এলে শুরুটা মনে থাকে না। লোকজন হাসবে কখন?

    .

    দেলোয়ারের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করেছে। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে মীরা! বাচ্চা একটা মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে, কোনোরকম ভুল করছে না। গাড়ি চালাতে চালাতে আবার তার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, প্রয়োজনমতো হর্ন দিচ্ছে—কী আশ্চর্য! শুধু যে দেলোয়ার বিস্মিত হচ্ছে তা না, যে দেখছে সে-ই অভিভূত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। বিড়বিড় করে কী সব বলছে।

    ‘দেলোয়ার সাহেব।’

    ‘জ্বি।‘

    ‘লোকজন কী অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে—লক্ষ্য করেছেন?’

    ‘জ্বি।’

    ‘একটা শিম্পাঞ্জি গাড়ি চালিয়ে গেলে লোকজন যেভাবে তাকে দেখত—আমাকে সেইভাবেই দেখছে। নিজেকে শিম্পাঞ্জি শিম্পাঞ্জি মনে হচ্ছে। আর আপনাকে মনে হচ্ছে শিম্পাঞ্জি ট্রেইনার। ট্রেইনার শব্দের মানে জানেন তো?’

    ‘জ্বি জানি, শিক্ষক।’

    ‘সরি, ট্রেইনার শব্দের মানে তো আপনি জানবেনই। আপনি যে বি. এ. পাশ এই তথ্য মনে থাকে না। বি. এ.-তে আপনার রেজাল্ট কী ছিল?’

    ‘থার্ড ক্লাস।’

    ‘থার্ড ক্লাসের জন্যেই বোধহয় কোথাও কোনো চাকরিটাকরি পাচ্ছেন না, তাই না?’

    ‘জ্বি না। চেষ্টা করি নাই।’

    ‘চেষ্টা করেননি কেন?

    ‘যা আছি তো ভালোই আছি। মাস শেষে চাচাজী এক হাজার টাকা দেন। আমি একা মানুষ। আমি চলে গেলে চাচাজীর বিষয়সম্পত্তি দেখবে কে। বিশ্বাসী মানুষ পাওয়া যায় না।’

    ‘আপনি কি খুব বিশ্বাসী মানুষ?’

    ‘জ্বি।‘

    ‘আপনি বাবার বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছেন?’ দেলোয়ার উত্তর দিল না। এই মেয়েটা কথাবার্তা কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মেয়েটা অসম্ভব বুদ্ধিমতী। এই ধরনের বুদ্ধিমতী মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা সাবধানে বলতে হয়।

    ‘দেলোয়ার সাহেব। ‘

    ‘জ্বি।’

    ‘নেত্রকোনায় কি রেডিমেড প্যান্টের দোকান আছে?’

    ‘জ্বি আছে।

    ‘আপনি দয়া করে নেত্রকোনায় পৌঁছেই একটা প্যান্ট কিনে নেবেন।’

    ‘সঙ্গে টাকা আনি নাই।‘

    ‘টাকা আমি দেব। আপনি লুঙ্গিটার উপর কোট পরেছেন, আপনাকে সার্কাসের ক্লাউনের মতো লাগছে।’

    ‘আপামণি লুঙ্গি বদলায়ে পায়জামা পরেছি। চাচিজী লুঙ্গি বদলাতে বললেন, এইজন্যে বদলেছি। আপনি বোধহয় লক্ষ্য করেন নাই।’

    ‘পায়জামার উপর কোট আরো জঘন্য। আপনি অবশ্যই একটা রেডিমেড প্যান্ট কিনবেন এবং শুনুন, একজোড়া জুতাও কিনবেন। আমি টাকা দেব।’

    ‘জ্বি আচ্ছা।’

    ‘আমার কথায় আশা করি কষ্ট পাচ্ছেন না?’

    ‘জ্বি না।’

    ‘আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—বাবার ঘরবাড়ি বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনাই আপনার জীবনের ব্রত?’

    ‘চাচাজীর জন্যে কিছু করতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার।’

    ‘কেন? বাবা বড় মানুষ বলে? সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বলে? লোকজনের কাছে বলতে পারবেন— আমি একজন বিচারপতির বিষয় দেখাশোনা করি—এই কারণে?’

    ‘জ্বি না। উনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন।’

    ‘অত্যধিক স্নেহ করলেও তার মধ্যে বাবার স্বার্থ আছে। আপনাকে তাঁর দরকার। আপনি না থাকলে তাঁর গ্রামের এই বিরাট বিষয়সম্পত্তি বারো ভূতে লুটে খেত।’

    দেলোয়ারের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই মেয়ে তার বাবাকে এমন ছোট করে দেখছে কেন? আজহার সাহেব কেমন মানুষ সেটাতো এই মেয়েটারই সবচেয়ে বেশি জানার কথা। এই মানুষটা তাঁর গ্রামের জন্যে কী করেনি? মেয়েদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে, ছেলেদের স্কুল বানিয়ে দিয়েছে। নিজের খরচে রাস্তা ঠিক করে দিয়েছে। ডিপ টিউবওয়েল কিনে দিয়েছে। গ্রামের যে-কোনো মানুষ বিপদে পড়ে তার কাছে গিয়ে কখনো খালিহাতে ফেরেনি I

    ‘দেলোয়ার সাহেব।’

    ‘জ্বি।’

    ‘আপনি কি আমার কথায় মন খারাপ করেছেন?’

    ‘জ্বি করেছি। চাচাজীকে আমি অনেক বড় চোখে দেখি।’

    ‘কিন্তু আমি কি কথাগুলি ভুল বলেছি? আপনাকে বাবা যে স্নেহ করেন সেই স্নেহ কি স্বার্থজড়িত স্নেহ না?’

    ‘জ্বি না। আমার একবার খুব অসুখ হয়েছিল। খারাপ ধরনের জন্ডিস। আমাকে নেত্রকোনা সদর হাসপাতালে ভর্তি করল। জীবনের আশা ছেড়েই দিলাম। তখন স্যার খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে নেত্রকোনা হাসপাতালে আমাকে দেখতে এলেন। আমার অবস্থা দেখে মনে খুবই কষ্ট পেলেন।’

    ‘কী করে বুঝলেন—মনে কষ্ট পেয়েছেন?’

    ‘চাচাজীর চোখে সঙ্গে সঙ্গে পানি এসে গেল। চোখের পানি মুছে বললেন—দেলোয়ার তোর এ কী অবস্থা। চাচাজী কখনো আমাকে তুই বলেন না। সব সময় তুমি বলেন। সেদিনই প্রথম তুই বললেন।’

    ‘আপনি কী করলেন?’

    ‘আমি চাচাজীরে বললাম, চাচাজী আপনি যদি আমার কপালে হাত রেখে আল্লাহপাকের কাছে একটু দোয়া করেন, আমি ভালো হয়ে যাব।’

    ‘বাবা তাই করলেন?’

    ‘জ্বি, তিনি কপালে হাত রেখে দোয়া করলেন। সন্ধ্যাবেলা দোয়া করলেন—এশার ওয়াক্ত থেকে শরীর ভালো হতে শুরু করল। রুচি চলে গিয়েছিল, যা খেতাম বমি করে দিতাম। রুচি ফিরে এল। রাতে নার্সকে বললাম—সিস্টার হিদল ভর্তা দিয়ে একটু ভাত খেতে ইচ্ছা করছে।’

    ‘কী ভর্তা?’

    ‘হিদল ভর্তা। হিদল হল পুঁটিমাছের একরকম শুঁটকি, অনেকে বলে চেপা শুঁটকি।

    ‘হিদল ভর্তা দিয়ে ভাত খেলেন?’

    ‘জ্বি। ভরপেট ভাত খেলাম। পরদিন সকালে শরীর সুস্থ। সুস্থ হবে জানা কথা। পীর বংশের মানুষ। পীরাতি চাচাজীর মধ্যেও আছে। চাচাজী নিজে তা জানেন না।

    ‘আমিওতো পীর বংশের বড় মেয়ে—আমার মধ্যে নাই?’

    ‘জ্বি আপনি আপনার মধ্যে আছে।’

    ‘কী করে বুঝলেন?

    ‘বোঝা যায়।’

    .

    টেলিফোন-পর্ব শেষ করে ফেরার পথে মীরা খুব হাসিখুশি রইল। মজার মজার গল্প করতে লাগল। কিন্তু দেলোয়ারের মনে হল—মেয়েটার মন খুবই খারাপ হয়েছে। অতিরিক্ত হাসিখুশির ভাব যতই দেখাক না কেন মেয়েটা খুবই কষ্ট পাচ্ছে।

    ‘দেলোয়ার সাহেব।’

    ‘জ্বি।’

    ‘প্যান্ট এবং জুতাজোড়া আপনার পছন্দ হয়েছে তো?’

    ‘জ্বি হয়েছে।’

    ‘মানুষ হিসেবেও আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। এখন যদি আপনি লুঙ্গির উপর কোট পরে ঘুরেন আপনাকে আগের মতো খারাপ লাগবে না।‘

    দেলোয়ার হঠাৎ বলে ফেলল, আপামণি আপনার মনটা কি খারাপ? মীরা বলল, হ্যাঁ আমার মনটা খুব খারাপ। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে। আমি কাঁদতে পারছি না।

    দেলোয়ার লক্ষ্য করল মীরার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেছে। চোখের পানি টপ টপ করে পড়ছে গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে। দেলোয়ার সঙ্গে সঙ্গে খতমে ইউনুছ পড়া শুরু করল। এই দোয়া এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বার পড়ে আল্লাহপাকের কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। সে খতম শেষ করে আল্লাহপাককে বলবে—মেয়েটার মনটা তুমি ভালো করে দাও আল্লাহ্। তুমি গাফুরুর রাহিম, তোমার রহমতের কোনো শেষ নাই। তোমার রহমতের দরিয়া থেকে একফোঁটা রহমত মেয়েটাকে তুমি দাও। এতে তোমার রহমতের দরিয়ার কোনো ক্ষতি হবে না।

    মীরা বলল, দেলোয়ার সাহেব। আমি কাঁদছি আমার দুঃখে, আপনার চোখে পানি কেন?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }