Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প110 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. মীরা না-ফেরা পর্যন্ত

    ৩

    মীরা না-ফেরা পর্যন্ত মনোয়ারা চাপা উদ্বেগ নিয়ে ছিলেন। মেয়েরা বড় হবার পর এই সমস্যা তাঁর হয়েছে। ঘরের বাইরে যাওয়া মানেই উদ্বেগ। মনোয়ারার এই উদ্বেগ নানান ভাবে প্রকাশিত হয়— তাঁর মাথায় যন্ত্রণা হয়, কোনো কাজে মন রাখতে পারেন না। ইদানীং আরেকটি উপসর্গ যুক্ত হয়েছে—শ্বাস কষ্ট। বড় বড় করে নিশ্বাস নিলেও বুক ভরে না। মনে হয় ফুসফুসের একটা বড় অংশে বাতাস পৌঁছাতে পারছে না। ফাঁকা হয়ে আছে। মনোয়ারার ধারণা মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে যাবার পর তাঁর এই সমস্যা থাকবে না। তিনি আরাম করে বাকি জীবন নিশ্বাস নিতে পারবেন।

    নেত্রকোনা থেকে ফেরার পর মেয়েকে দেখে তাঁর ভালো লাগল। বেশ হাসি খুশি মেয়ে। কয়েকদিন ধরে মীরার মুখে যে অন্ধকার ভাব ছিল তা নেই। বরং খানিকটা ঝলমলে ভাব চলে এসেছে। অবশ্যি এটা অভিনয়ও হতে পারে। তাঁর বড় মেয়ে অভিনয় ভালো জানে। ছোটটা একেবারেই জানে না।

    মনোয়ারা মীরাকে বললেন, কোনো সমস্যা হয়েছিল?

    মীরা হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কোনো সমস্যা হয়নি।

    ‘মেয়েমানুষ গাড়ি চালাচ্ছে এটা দেখে লোকজন মজা পায়নি?’

    ‘খুব মজা পেয়েছে।’

    ‘ঢাকায় লাইন পেতে সমস্যা হয়নিতো?’

    ‘উহুঁ! প্রথম রিঙেই সাবের টেলিফোন ধরল এবং আমার গলা চিনতে পারল না। বলল আপনি কে বলছেন?’

    ‘তাহলে সাবের সঙ্গে কথা হয়েছে?’

    ‘হয়েছে।’

    ‘ও ভালো আছে তো?’

    ‘ভালোই আছে তবে ওর মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। গলা কেমন যেন ভারী ভারী শুনাল। কিংবা উল্টোটাও হতে পারে। হয়তো আমার গলা শুনেই সে তার নিজের গলা ভারী করে ফেলল।’

    মীরা হাসছে, মনোয়ারা চলে যাচ্ছেন। মনোয়ারার মুখেও হাসি।

    মীরা ভাবছে, একটা পরিবারে মায়ের ভূমিকা খুবই অদ্ভুত। পরিবারের যে—কোনো সদস্য যখন হাসে, মা’কে হাসতে হয়। পরিবারের যে-কোনো সদস্য যখন দুঃখিত হয়, মাকে দুঃখিত হতে হয়। এটা হল পরিবারের দাবি। পরিবার এমন অন্যায় দাবি মা ছাড়া অন্য কারো ওপর করে না।

    মীরা ডাকল, মা শুনে যাওতো।

    মনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেন। সাবেরের সঙ্গে মীরার সমস্যাটা কী? কীভাবে তা মিটমাট হল এটা জানা মনোয়ারার খুব শখ। তিনি নিজ থেকে জিজ্ঞেস করতে পারছেন না। এখন মনে হচ্ছে মীরাই বলবে।

    ‘মা শোনো তোমাকে খুব জরুরি একটা কথা বলব। ভংয়কর জরুরি।’

    ‘চল বাগানে যাই। ‘

    ‘বাগানে যেতে পারব না। এখানেই বলি। কথাটা হচ্ছে—আমি জানতে পেলাম দাদীজান নাকি আজ রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবে। এটা যেন না ঘটে তুমি দেখবে।

    ‘এটা তোর জরুরি কথা?

    ‘হ্যাঁ এটা আমার জরুরি কথা। দাদীজান কাল রাতে ঘুমিয়েছেন শেফার সঙ্গে এবং তাকে নাকি বলেছেন—তিনি এক রাতে শেফার সঙ্গে ঘুমাবেন, আর এক রাতে আমার সঙ্গে ঘুমাবেন। এইভাবে চলতে থাকবে এটা শোনার পর থেকে আমার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।’

    ‘হাতপা ঠাণ্ডা হবার কী আছে? দাদী নাতনির সঙ্গে ঘুমবে না!’

    ‘না ঘুমবে না। অবশ্যই আমার সঙ্গে না। একটা লেপের নিচে আমি আর দাদীজান। উনার হাড্ডি-হাড্ডি পা উনি আমার গায়ে তুলে দেবেন। তাঁর শরীর থেকে আসবে শুকনা গোবরের গন্ধ। অসহ্য। মা তুমি যেভাবেই হোক আমাকে বাঁচাও।’

    মনোয়ারা চিন্তিত মুখে বললেন, উনি তোর সঙ্গে ঘুমুতে চাইলে আমি না করব কীভাবে?

    ‘এইসব প্যাচাল বুদ্ধি তোমার খুব ভালো আছে। তুমি একটা বুদ্ধি বের কর। বিনিময়ে আমি তোমার সব কথা শুনব। তুমি যদি বল আমাকে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করতে হবে তাতেও রাজি আছি।

    মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বললেন, ফাজলামি ধরনের কথা বলিস না। বাবার সঙ্গে গল্প করবি না তো কার সঙ্গে গল্প করবি?

    মীরা হাসতে হাসতে বলল, মা তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে প্রথম দশজন সেরা বিরক্তিকর গল্প-কথকদের মধ্যে বাবা আছেন? হি হি হি।

    .

    সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আজহার সাহেব তাঁর মেয়েদের সঙ্গে গল্প করছেন। মনোয়ারা চা নিয়ে ঢুকলেন। মীরা তাঁর মাকে চোখে-চোখে বলল, মা আমাদের বাঁচাও। মনোয়ারা হাসলেন এবং তিনিও গল্প শুনতে বসলেন। ঢাকায় থাকার সময় সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করা প্রায় কখনোই হয় না। শেফা বসবে টিভির সামনে, এক্স ফাইল বা কিছু দেখবে। মীরা থাকবে তার ঘরে, তার দরজা থাকবে বন্ধ। বন্ধ-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে সিডির গানের শব্দ ভেঙে ভেঙে আসবে। তার দরজায় ধাক্কা দিলে সে বিরক্ত গলায় বলবে, পরে আসো তো মা। এখন দরজা খুলতে পারব না।

    আজহার সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত গলায় বললেন, শীতের সন্ধ্যায় আনন্দময় ব্যাপার হচ্ছে গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিলাক্স করা। শীত যত বেশি পড়বে রিলাক্সেশন তত বেশি হবে। বরফের দেশে কী হয় দেখ। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। ঘরের ভেতরে ফায়ার-প্লেসে কাঠ পুড়ছে। কাঠের গনগনে আগুন। সেই আগুনের পাশে গোটা পরিবার জড়ো হয়েছে। আগুন তাপাতে তাপাতে কফি খাচ্ছে।

    শেফা বলল, কফি খাচ্ছে না বাবা, মদ খাচ্ছে।

    আজহার সাহেব বললেন, এটা মা তুমি একটা ভুল কথা বললে। ইংরেজি ছবি দেখে-দেখে তোমার এই ধারণা হয়েছে। আসলে ওরা মদ্যপান কম করে। বরং আমি দেখি বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে এটা অনেক বেশি। অর্থবিত্তের প্রমাণ হিসেবে মদ্যপানকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মদ্যপান হয়ে দাঁড়িয়েছে স্ট্যাটাসের অংশ।

    শেফা গম্ভীর হয়ে বলল, বাবা তোমায় সাধারণ কথাও বক্তৃতার মতো কেন? মনোয়ারা হেসে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাসি বন্ধ করে বললেন, এই শোনো তুমি একটা মজার গল্প আমাদের শুনাও তো।

    ‘মজার গল্প?’

    ‘হ্যাঁ মজার গল্প। তোমার মেয়েদের ধারণা তুমি মজার গল্প জানো না।’

    ‘মজার গল্প মানে কি স্ট্র্যাঞ্জ গল্প?—আচ্ছা শোনো নেদারল্যান্ডের এবোরজিনদের একটা অদ্ভুত কাস্টমের কথা বলি। নেদারল্যান্ডের এক প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠী আছে, তাদের অদ্ভুত সামাজিক কিছু নিয়মকানুন আছে। তাদের মধ্যে একদল আছে যাদের বলা হয় Sin eater. সিন ইটার মানে হল পাপ-খাদক। তারা অন্য মানুষদের পাপ খেয়ে ফেলে।’

    মনোয়ারা বললেন, ও মাগো। কী বলছ তুমি! পাপ খাবে কীভাবে?

    মনোয়ারার এত বিস্মিত হবার কারণ নেই। তিনি এই গল্প এর আগে তিনবার শুনেছেন। তিনি বিস্মিত হচ্ছেন গল্প জমিয়ে দেবার জন্যে।

    আজহার সাহেব বললেন, মনে কর কেউ মারা গেল। তখন করা হয় কি, মৃত ব্যক্তিকে নগ্ন করে মাটিতে শুইয়ে রাখা হবে। তার শরীরে নানান খাদ্যদ্রব্য সাজিয়ে রাখা হবে। তারপর খবর দেয়া হতে Sin eaterদের। Sin eaterরা আসবে, তারা চেটেপুটে মৃতদেহের উপর থেকে খাবারদাবারগুলি খেয়ে ফেলবে। বিশ্বাস করা হয় যে তারা খাবারদাবারের সঙ্গে মৃতব্যক্তির সব পাপও খেয়ে ফেলবে। মৃত ব্যক্তি হয়ে যাবে পুরোপুরি নিষ্পাপ এবং সে সরাসরি স্বর্গে চলে যাবে। আর Sin eaterরা যাবে অনন্ত নরকে।

    শেফা এবং মীরার ভেতর গল্প শুনে কোনো ভাবান্তর হল না, কিন্তু মনোয়ারা চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। ঘেন্না-মেশানো গলায় বললেন—তওবা আসাতাগফিরুল্লা, বলে কী?

    আজহার সাহেব উৎসাহিত হয়ে দ্বিতীয় গল্প শুরু করতে যাবেন, তখন দেলোয়ার ঢুকে খবর দিল স্থানীয় স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে এসেছেন। আজহার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন। স্কুলের মাস্টাররা প্রতিদিন সন্ধ্যাতেই এ-বাড়িতে আসছেন। মুগ্ধ হয়ে আজহার সাহেবের গল্প শুনছেন। আজহার সাহেব তাদের সঙ্গে অত্যন্ত আনন্দময় কিছু সময় কাটাচ্ছেন।

    আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে খুশি-খুশি গলায় বললেন, মনোয়ারা বাইরে চা-টা পাঠাবার ব্যবস্থা কর। আর শোনো এদের একবেলা আমি খাওয়াতে চাই। পোলাও টোলাও কর। বেচারারা এই শীতের রাতে দূর দূর থেকে আসে। এত রাতে না-খেয়ে ফেরত যায়। খারাপ লাগে।

    মনোয়ারা বললেন, তারা আসে তোমার গল্প শুনতে। গল্প শুনতে পাচ্ছে এতেই তারা খুশি।

    ‘তা ঠিক। তবুও এক রাতে ভালো করে এদের খাওয়াব। আগামীকাল রাতে খেতে বলি কেমন?’

    ‘আচ্ছা বলো।’

    ‘গরুর মাংস দিয়ে তুমি যে একটা প্রিপারেশন কর—মঙ্গোলিয়ান বিফ, ঐটা করতে পার কিনা দেখ তো। এরা গ্রামে পড়ে আছে, নতুন কিছু খেতে পারলে খুশি হবে।’

    ‘দেখি পারি কি না।’

    আজহার সাহেব চলে যেতেই মীরা বলল, মা, তুমি কি দাদীজানকে সামলেছ? আশা করি তিনি আমার সঙ্গে ঘুমুতে আসবেন না। উনাকে বলে দিয়েছ তো মা।’

    ‘এখনো কিছু বলি নাই। কীভাবে বলব সেটাই বুঝতে পারছি না।’

    ‘তোমাকে একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দেই?’

    ‘দে’

    ‘আজ রাতে তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে আস। তাছাড়া এম্নিতেই আমার শরীরটাও ভালো লাগছে না। জ্বর-জ্বর লাগছে। আমার তোমার সঙ্গে ঘুমুতে ইচ্ছা করছে। তুমি আমার সঙ্গে ঘুমুতে এলে দাদীজান বাধ্য হয়ে শেফার সঙ্গে ঘুমুবেন। প্রবলেম সলভড।’

    শেফা বলল, আজ রাতের প্রবলেম নাহয় সলভড হল, কাল কী করবে? মা কি রোজ তোমার সঙ্গে ঘুমুবে?

    মীরা বলল, কালকেরটা কাল দেখা যাবে। আগে বর্তমানের সমস্যা মিটুক। ভবিষ্যতের সমস্যা ভবিষ্যতে মেটানো হবে। We Live in Present, we do not live in future. তোর মাছ মারা কেমন হয়েছে?

    ‘ভালো হয়নি।’

    ‘শখ মিটছে কি-না বল্। শখ মিটলেই হল।’

    ‘মাছ মারতেই পারলাম না, শখ মিটবে কীভাবে?’

    ‘কাল আবার বসছিস?’

    ‘হুঁ। তুমি কি আমার সঙ্গে বসবে আপা?’

    ‘না।’

    ‘প্লিজ আপা তুমি বোস, তোমার তো ভাগ্য ভালো। আমার ধারণা তুমি থাকলেই মাছ ধরা পড়বে।’

    ‘আমার ভাগ্য ভালো?’

    ‘অবশ্যই ভালো। মা, আপার ভাগ্য ভালো না?’

    মনোয়ারা হাসিমুখে বললেন, দুজনের ভাগ্যই ভালো।

    শেফা বলল, জন্মের সময় আল্লাহ যদি রিপোর্ট-কার্ডের মতো একটা কার্ডে আমাদের ভাগ্য লিখে দিয়ে দিত তাহলে খুব ভালো হত। রিপোর্ট-কার্ড দেখে আমরা আগেভাগে সব জানতাম।

    মনোয়ারা বললেন, তুই এমন মজা করে কথা বলা কোত্থেকে শিখেছিস?

    শেফা বলল, বাবার কাছ থেকে শিখেছি মা। বাবার কাছ থেকে শিখেছি কীভাবে গল্প করলে গল্পগুলি বোরিং হয়। আমি গল্প করার সময় সেইটা বাদ দিয়ে গল্প করি।

    মীরা হেসে ফেলল। মনোয়ারা হাসতে শুরু করলেন। শুধু শেফা গম্ভীর হয়ে রইল। গম্ভীর হয়ে থাকলেও তার খুব মজা লাগছে। দরজায় দেলোয়ারকে দেখা গেল। তাকে দেখাই যাচ্ছে না। নতুন প্যান্ট, জুতা, তার ওপর হলুদ কোট।

    শেফা ফিসফিস করে বলল, ও মাই গড। দেলোয়ার ভাইকে কীরকম সঙের মতো লাগছে দেখেছ মা? মনে হচ্ছে না সার্কাসের জোকার, এক্ষুনি ডিগবাজি—খেয়ে কোনো খেলা দেখাবে?

    মনোয়ারা বললেন, চুপ কর।

    ‘উনাকে আগের মতো লুঙ্গি গেঞ্জি পরে থাকতে বলি মা?’

    মনোয়ারা কিছু বলার আগেই দেলোয়ার বলল, ছোট আপা শুনে যান। শেফা উঠে গেল। দেলোয়ার বলল, ভালো খবর আছে আপা। টিভি জোগাড় হয়েছে।

    ‘টিভি দিয়ে লাভ কী হবে, কারেন্ট নেই। রাত এগারোটার পর কারেন্ট এলে টিভি কী দেখব?’

    ‘ব্যাটারি এনেছি। গাড়ির ব্যাটারিতে চলবে।’

    ‘একসেলেন্ট। আমার ঘরে ফিট করে দিন।’

    ‘আমি তো ফিট করা জানি না। মিস্ত্রি নিয়ে আসছি।’

    ‘নিয়ে এসেছেন তো সময় নষ্ট করছেন কেন? লাগিয়ে দিন।’

    ‘চাচাজী রাগ করবেন নাতো?’

    ‘কী অদ্ভুত কথা! বাবা রাগ করবে কেন? ঢাকায় কি আমি টিভি দেখি না? সারাক্ষণই দেখি।’

    ‘তবু চাচাজীর একটা অনুমতি

    ‘আচ্ছা যান অনুমতি আমি নিয়ে নেব।’

    শেফা অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছে। টিভির অন্য কোনো প্রোগ্রাম না দেখলেও এক্স ফাইল না-দেখলে শেফার চলে না। আজ এক্স ফাইল আছে। দেলোয়ার ভাইকে সন্ধ্যাবেলা শুধু জিজ্ঞেস করেছিল—আশেপাশের কোনো বাড়ি আছে যাদের টিভি আছে? আমাকে এক্স ফাইল দেখতে হবে। দেলোয়ার ভাই টিভিই জোগাড় করে ফেলেছে। মানুষটা কাজের আছে। শুধু একটু জোকার টাইপ।

    ‘দেলোয়ার ভাই।’

    ‘জ্বি।’

    ‘কোট প্যান্ট পরে আপনার কেমন লাগছে?’

    ‘জ্বি ভালো লাগছে। একটু লজ্জা-লজ্জা লাগছে।’

    ‘লজ্জা-লজ্জা লাগছে তাহলে পরে আছেন কেন?’

    ‘জুতা আর প্যান্ট বড় আপা কিনে দিয়েছেন। না পরলে মনে কষ্ট পাবেন।’

    ‘উনি মোটেই কষ্ট পাবেন না। আপনার যদি লজ্জা-লজ্জা লাগে আপনি খুলে ফেলুন।’

    ‘বড় আপার মনটা কি এখন ভালো?’

    ‘খুবই ভালো। মন খারাপ হবে কেন? দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করছেন কেন? এক্স ফাইল শুরু হয়ে যাবে তো।’

    দেলোয়ার কাঁচুমাচু মুখে বলল, চাচাজীর কাছ থেকে যদি অনুমতিটা নিয়ে দেন। টিভি দেখে হঠাৎ যদি রেগে যান।

    ‘আচ্ছা আমি এক্ষুনি অনুমতি এনে দিচ্ছি। আপনি মিস্ত্রি নিয়ে আমার ঘরে চলে যান। এমন জায়গায় টিভি ফিট করবেন যেন আমি বিছানায় শুয়ে-শুয়ে দেখতে পারি।’

    ‘জ্বি আচ্ছা।’

    শেফা বসার ঘরের দিকে যাচ্ছে।

    সে ঘরে ঢুকল না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আজহার সাহেব গল্প করছেন, সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে। আজহার সাহেবের সেই পুরানো গল্প। নেদারল্যান্ডের সিন ইটারদের কাণ্ডকারখানা।

    হেডমাস্টার সাহেব বললেন, স্যার কী বললেন? নগ্ন শরীরে খাদ্যবস্তু সাজিয়ে রাখে?

    ‘জ্বি।’

    ‘শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়?’

    ‘সবার জন্যই একই অবস্থা।’

    ‘হেডমাস্টার সাহেব শিউরে উঠলেন। অতিথিরা কিছুক্ষণ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার বললেন, অতি বর্বর জাতি।

    আজহার সাহেব বললেন, প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে এইজাতীয় অনেক বিচিত্র বিশ্বাস প্রচলিত। আফ্রিকার রেইন ফরেস্টে এই প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী আছে তারা তাদের মৃত আত্মীয়স্বজন কবর দেয় না বা দাহ করে না। খেয়ে ফেলে।’

    ‘কী বললেন স্যার, খেয়ে ফেলে?’

    ‘হ্যাঁ খেয়ে ফেলে। তারা বিশ্বাস করে এতে মৃত আত্মার সদগতি হয়।’

    ‘আমরা তো স্যার সেই তুলনায় ভালো আছি।’

    ‘হ্যাঁ আমরা ভালোই আছি। আমাদের সভ্যতা তো অতি প্রাচীন। তার পরেও সতীদাহের মতো কুৎসিত প্রথা ছিল। ছিল না? ওরা যা করছে মৃত মানুষদের নিয়ে করছে আর আমরা জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরে ফেলছি।’

    এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব মুগ্ধ গলায় বললেন, স্যার আপনি এত বিষয় জানেন, এত সুন্দর করে গল্প করেন এটা একটা অবিশ্বাস্য বিষয়। আপনার গল্প শোনা ভাগ্যের ব্যাপার। সন্ধ্যার পর আর ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। স্যার হয়তো খুবই বিরক্ত হন।

    ‘বিরক্ত হব কেন?’

    ‘স্যার বিরক্ত হন আর নাই হন আমরা না-এসে পারব না।’

    ‘অবশ্যই আসবেন। ভালো কথা, আগামীকাল রাতে আপনারা আমার সাথে চারটে ডালভাত খাবেন।’

    ‘ছিঃ ছিঃ স্যার কী বলেন! আপনি আমাদের মেহমান। কোথায় আমরা খাওয়াব তা না …।’

    ‘কী আশ্চর্য, আমি এই গ্রামের ছেলে না? আপনারা চারটা ডালভাত অবশ্যই খাবেন।’

    শেফা এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। আড়াল থেকে এদের কথাবার্তা শুনতে তার খুব মজা লাগছে। তার বাবার মহাবিরক্তকর গল্পগুলিও যে লোকজন এত আগ্রহ করে শুনতে চায় এটা শেফার ধারণারও বাইরে ছিল। গ্রামের এই মানুষগুলো কি বোকা নাকি?

    আসলে এক ভদ্রলোক আজ দেরি করে এসেছেন। তিনি কবিরাজ শশাঙ্ক কালো। তাঁর নেত্রকোনায় দোকান আছে। দোকান এখন ছেলে দেখাশোনা করে। তিনি বাড়িতে থাকেন। খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে তিনি ঢুকলেন এবং হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে রাগী-রাগী গলায় বললেন, হেডমাস্টার সাহেব কাজটা আপনি কী করলেন? আমাকে না নিয়ে চলে আসলেন। আমি কাল বলেছিলাম না, আসার সময় আমাকে নিয়ে আসবেন। আমি সন্ধ্যা থেকে কাপড় পরে বসা।

    হেডমাস্টার সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, একদম ভুলে গেছি।

    ‘তাতো ভুলে যাবেনই। দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করে উল্টা আমি আপনার খোঁজে গিয়ে শুনি আপনি সন্ধ্যার সময় চলে গেছেন।

    ‘আসছি বেশিক্ষণ হয়নি, এইতো কিছুক্ষণ। আমার কথা বিশ্বাস না হয় স্যারকে জিজ্ঞেস করেন।’

    আজহার সাহেব হাস্যমুখে দুই বন্ধুর ঝগড়া সামাল দেন। তাঁকে আবারো পাপ ভক্ষকদের গল্প নতুন করে শুরু করতে হয়। যারা গল্পটা আগে শুনেছেন তারাও সমান আগ্রহ নিয়ে দ্বিতীয়বার গল্পটি শুনেন। হেডমাস্টার সাহেব আগেরবার গল্পের ঠিক যে-জায়গায় বলেছিলেন ‘শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়?’—এবারো ঠিক সেই জায়গায় আঁৎকে উঠে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার শবদেহ যদি স্ত্রীলোকের হয়? তখনো কি এই অবস্থা।’ যেন তিনিও এই প্রথমবারের মতো গল্পটা শুনছেন।

    শেফা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, আড়ালে দাঁড়িয়ে বাবার গল্প শুনতে তার ভালো লাগছে। এখন তার ধারণা হয়েছে যে তারা আগ্রহ নিয়ে বাবার গল্প শোনে না বলেই বাবার গল্পগুলি তত ভালো হয় না। এরা আগ্রহ নিয়ে শুনছে বলে ভালো হচ্ছে।

    আজহার সাহেব হঠাৎ গল্প থামিয়ে বললেন, দরজার পাশে কে?

    শেফা বলল, বাবা আমি।

    ‘কী করছ মা?’

    ‘বাবা তোমার গল্প শুনছি।’

    হেডমাস্টার সাহেব অত্যন্ত সাধু ভাষায় বললেন, মা এইসব গল্প তোমার শোনার উপযুক্ত নয়। গল্পগুলি পরিণত মানসিকতার মানুষদের জন্যে। মা তুমি চলে যাও। যদি সম্ভব হয় চাচাদের জন্যে একটু চা পাঠাও।

    আজহার সাহেব বললেন, কফি খাবেন না-কি?

    ‘কফির ব্যবস্থা আছে?’

    ‘জ্বি আছে।’

    ‘তাহলে স্যার একটু বড়লোকি জিনিস খেয়ে দেখি।’

    শেফা কফির কথা বলতে চলে গেল। এ্যাসিসটেন্ট হেডমাস্টার সাহেব বললেন, স্যারের দুটা মেয়েই অত্যন্ত ভালো। ভালো হবে জানা কথা। যেমন গাছ তেমন তার ফল।

    আজহার সাহেব বললেন, সামান্য ভুল করলেন মাস্টার সাহেব। খুব ভালো গাছের ফল হয় না। যেমন ধরুন সেগুন গাছ, শাল গাছ…।

    উপস্থিত শ্রোতারা আজহার সাহেবের জ্ঞানের কথায় আবারো অত্যন্ত চমৎকৃত হন। আজহার সাহেব পাপ-ভক্ষকদের গল্পের শেষাংশ শুরু করলেন—শ্রোতারা তাঁর দিকে ঝুঁকে এল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }