Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প110 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫. পুকুরে ছিপ ফেলা হয়েছে

    ৫

    পুকুরে ছিপ ফেলা হয়েছে।

    আজকের আয়োজন ব্যাপক। দেলোয়ার সকালবেলাতেই পানিতে নেমেছে। মাছের চার দিয়েছে। কচুরিপানা সরিয়ে ছিপ ফেলার জায়গা করেছে। চাচাজী মাছধরা দেখতে আসতে পারেন ভেবে তাঁর জন্যে বেতের চেয়ার এনে রেখেছে। চেয়ারের সামনে চা-কফি রাখার জন্যে টেবিল আনা হয়েছে। আয়োজন দেখে শেফার খুব ভালো লাগছে। সে সকাল থেকেই ভাবছে দেলোয়ার ভাইকে ভালো কোনো উপহার দিতে হবে। সে আজ যেমন খুশি হয়েছে, উপহার পেয়ে দেলোয়ার ভাইও যেন তেমন খুশি হয়। খুশিতে খুশিতে কাটাকাটি।

    মাছের মন্ত্র পড়ে ছিপে ফুঁ দেয়া হল। মন্ত্রটা পড়তে হল শেফাকেই। যে বর্শেল মন্ত্র তাকেই পড়তে হবে। অন্য কেউ পড়লে হবে না। মন্ত্রটা বেশ বড়, শেফা কাগজে লিখে নিয়েছে। কারণ মন্ত্র একবার পড়লেই হবে না। বার বার পড়তে হবে। ফানা নড়লেই মন্ত্র পড়ে পানিতে তিনবার টোকা দিতে হবে। মন্ত্রটা এ রকম,

    (মাছ মন্ত্ৰ)

    আয় জলি বাঁয় জলি
    জলির নামে মন্ত্র বলি।
    হাঁটু পানিতে রক্ষা-কালি।
    রক্ষাকালির নয় দরজা।
    মাছের রাজা জামজা।
    মীর পীরের দোহাই লাগে
    সুতার আগায় মাছ লাগে।

    মাছের মন্ত্র পড়তে শেফার লজ্জা-লজ্জা লাগছে। বড় আপা দেখে ফেললে খুব হাসাহাসি করবে। ভাগ্যিস আপা এখন নেই। শুরুতে একবার এসে আয়োজন দেখে গেছে। আবার হয়তো আসবে। টোপে মাছ ঠোকরাবার সময় না এলেই হয়। আপার সামনে মন্ত্র পড়াই যাবে না। খেপিয়ে মারবে। তাকে দেখলেই সুর করে বলবে, আয় জলি বাঁয় জলি। জলির নামে মন্ত্ৰ বলি …।

    দেলোয়ার পুকুর থেকে উঠে এল। সে শীতে হি হি করে কাঁপছে। সারা শরীর কাদায়-শ্যাওলায় মাখামাখি। মালকোঁচা মেরে লুঙ্গিপরা। পা ভর্তি লোম। দেখতে বিশ্রী লাগছে।

    দেলোয়ার লুঙ্গি ছেড়ে দিল। তার মুখ হাসি-হাসি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে পানিতে নামা খুব আনন্দের ব্যাপার এবং শীতে থরথর করে কাঁপাও আনন্দময়।

    শেফা বলল, দেলোয়ার ভাই, মাছের মন্ত্র কি সত্যি কাজ করে?

    ‘অবশ্যই কাজ করে। আজই প্রমাণ পাবে।’

    ‘মন্ত্র পড়ার সময় যদি কোনো ভুল হয় তখন কী করব?’

    ‘তখন আবার পড়বে।’

    ‘মন্ত্রের ব্যাপারটা বড় আপাকে বলবেন না। বড় আপা শুনলে খুব হাসাহাসি করবে।’

    ‘না কাউকে বলব না।’

    ‘ছিপ ফেলবেন কখন?

    ‘পরে ফেলব। পানিতে ‘লারা’ পড়েছে। পানি ঠাণ্ডা হোক। .

    ‘পানি ঠাণ্ডা হতে কতক্ষণ লাগবে?’

    ‘ঘণ্টা দুই লাগবে। তোমার কাজকর্ম থাকলে সেরে আস।’

    ‘না আমার কোনো কাজ নেই, আমি এখানেই থাকব। ছিপ ফেলার পর থেকে আপনি কিন্তু আমার সঙ্গে থাকবেন। কীভাবে ছিপে হ্যাঁচকা টান দিতে হয় আমি জানি না।’

    ‘কোনো চিন্তা নাই আমি থাকব।’

    ‘দেলোয়ার ভাই আমি আপনাকে একটা গিফট দিতে চাই, কী গিফট দেব বলুনতো। কী আপনার পছন্দ?’

    ‘আমার গিফট লাগবে না।’

    ‘লাগবে। অবশ্যই লাগবে। আপনার সবচে পছন্দের জিনিস কী আমাকে বলবেন। আমার নিজের অনেক জমানো টাকা আছে। ঈদের সময় সালাম করে আমি যত টাকা পাই সব জমিয়ে রাখি।’

    ‘কত টাকা জমেছে?’

    ‘কত জমেছে সেটা বলব না। জমা টাকার পরিমাণ বললে জমা টাকা কমে যায়। টাকার উপর চোখ লাগেতো এইজন্যে কমে যায়।’

    ‘তাহলে বলার দরকার নেই।’

    ‘ঠিক আছে আপনাকে বলে ফেলি। আমার মোট টাকা হল ছয় হাজার সাতশ পঁচিশ।’

    ‘অনেক টাকা।’

    ‘কী গিফট আপনার পছন্দ আমাকে বলবেন—আমি ঢাকায় গিয়েই আপনাকে কিনে পাঠাব। আর মুখে বলতে যদি লজ্জা লাগে তাহলে কাগজে লিখে দেবেন।’

    ‘আচ্ছা।

    ‘আপনিতো দেখি শীতে কাঁপছেন। যান ঘরে গিয়ে কাপড় বদলান। আর শুনুন দেলোয়ার ভাই, আমার জন্যে যে আপনি এত কষ্ট করেছেন For that many thanks. অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

    ‘আগে মাছ ধরা পড়ুক তারপর ধন্যবাদ দিও।’

    ‘মাছ ধরা না পড়লেও ধন্যবাদ।’

    শেফা প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছে। সে নিশ্চিত যে আজ মাছ ধরা পড়বে। সে পুকুরপাড়ে বসে রইল। তার হাতে মন্ত্রলেখা কাগজ। ছিপ ফেলতে দেরি আছে-এর মধ্যে মন্ত্রটা মুখস্থ করে ফেলতে হবে। মাছ যখন টোপ খাবে তখন হৈচৈএর মধ্যে কাগজ বের করে সে হয়তো মন্ত্র পড়তেই ভুলে যাবে। মুখস্থ করে রাখাটা ভালো।

    মীরাকে আসতে দেখে শেফা মন্ত্রের কাগজ হাতে লুকিয়ে ফেলল। কামিজে পকেট থাকলে ভালো হত। কাগজটা কামিজের পকেটে লুকিয়ে ফেলা যেত। এখন রাখতে হচ্ছে হাতে। মেয়েদের ড্রেসে পকেট থাকে না কেন ভেবে তার সামান্য মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সবার কি ধারণা ছেলেদেরই শুধু পকেটে রাখার জিনিস থাকবে, মেয়েদের থাকবে না? মেয়েদের শাড়িতেও আসলে পকেটের সিস্টেম থাকা দরকার।

    মীরা এসে বেতের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, এখনো পুকুরপাড়ে?

    শেফা বলল, হুঁ।

    শেফার একটু মন খারাপ লাগছে কারণ মীরাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। খয়েরি রঙের মতো পচা রঙের একটা শাড়িতে মানুষকে এত সুন্দর লাগে? আপার প্রতি একটু ঈর্ষা ভাব হচ্ছে। এটা খারাপ। নিজের বোনকে ঈর্ষা করতে নেই। শেফার মনে হল তার মনটাই ছোট। বাংলাদেশে তার মতো ছোটমনের মেয়ে বোধ হয় কেউ নেই। যেভাবেই হোক মনটা বড় করতে হবে।

    ‘আপা তোমাকে অপ্সরীর মতো লাগছে।

    ‘কিসের মতো লাগছে?’

    ‘অপ্সরীর মতো।’

    ‘ছিঃ অপ্সরীর মতো লাগবে কেন? অপ্সরী কী তুই জানিস?’

    ‘না। অপ্সরী কী?’

    ‘অপ্সরী হচ্ছে স্বর্গের প্রসটিটিউট। প্রসটিটিউট শব্দের মানে জানিস তো?’

    শেফা লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। প্রসটিটিউট শব্দের মানে সে জানে। বেশ্যা শব্দের মানে জানে। খানকি মাগী শব্দের মানেও জানে। আসলে সে বোধ হয় একটা খারাপ মেয়ে। খারাপ মেয়ে বলেই খারাপ খারাপ শব্দের মানে জানে। অপ্সরী শব্দটা এত খারাপ জানলে সে এই শব্দ কখনোই বলত না। ক্লাসের কত সুন্দরী মেয়েকে সে অপ্সরী বলেছে। ভাগ্যিস ওরাও শব্দটার আসল মানে জানে না। অপ্সরী বলতে ওরা খুশিই হয়েছে।

    মীরা বলল, তুই কি লজ্জা পেয়ে গেলি নাকি?

    শেফা না-সূচক মাথা নাড়ল। যদিও সে খুবই লজ্জা পেয়েছে।

    ‘মাছ মারা কখন শুরু হবে?’

    ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। আজ আমার ছিপে বিশাল একটা মাছ ধরা পড়বে।’

    ‘কে বলেছে? দেলোয়ার সাহেব?’

    ‘কেউ বলেনি আমি জানি।’

    ‘এক হাজার টাকা বাজি তোর ছিপে কোনো মাছ ধরা পড়বে না।’

    ‘কত টাকা বাজি?’

    ‘এক হাজার এক টাকা। যা এক টাকা বাড়িয়ে দিলাম।’

    ‘আচ্ছা যাও বাজি।

    ‘বাজিতে হারলে ক্যাশ দিতে হবে। তোর সঙ্গে ক্যাশ আছে তো?’

    ‘আছে।’

    ‘ভেরি গুড, বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত টাইম। পাঁচটার মধ্যে মাছ ধরা না পড়লে তুই গুণে গুণে এক হাজার এক টাকা দিবি।‘

    ‘আচ্ছা। তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?’

    ‘আমাকে খুশি খুশি লাগছে?’

    ‘হ্যাঁ লাগছে। সুন্দরও লাগছে আবার খুশি খুশিও লাগছে।’

    ‘আমি খুশি এইজন্যেই খুশি খুশি লাগছে। যে খুশি তার চেহারায় আলাদা সৌন্দর্য চলে আসে এইজন্যে সুন্দর লাগছে।

    মীরা উঠে দাঁড়াল। শেফা মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। আপা চলে গেলেই ভালো। সে মন্ত্রটা মুখস্থ করে ফেলতে হবে—

    আয় জলি বাঁয় জলি
    জলির নামে মন্ত্র বলি।

    জলিটা কী? জল? জলের নামে মন্ত্র বলা হচ্ছে? আচ্ছা এই মন্ত্রে যে জায়গায় মাছের কথা বলা হয়েছে সেখানে সে যদি মাছ না বলে ‘কচ্ছপ’ বলে তাহলে কি মাছের বদলে কচ্ছপ ধরা পড়বে? সে যদি বলে,

    মীর পীরের দোহাই লাগে
    সুতার আগায় কচ্ছপ লাগে।।

    দেলোয়ার ভাইকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং একদিন কচ্ছপের নাম বলে মন্ত্রের জোরটা পরীক্ষা করতে হবে।

    .

    আজহার সাহেব তার প্রিয় জায়গায় বসে আছেন। জলপাই গাছের বাঁধানো বেদীতে। একটু আগে কোকিল ডাকছিল। কোকিলের ডাক শুনে তাঁর মনটা খারাপ হয়েছে এই ভেবে যে দুই মেয়ের কেউ তার পাশে নেই। মেয়েরা থাকলে কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতেন। ঢাকা শহরে পাখির ডাক মানে তো কাকের ডাক। কোকিলের ডাক এরা তো বোধহয় শুনেইনি।

    আজহার সাহেব দেখলেন মীরা তাঁর দিকে আসছে। ইস মেয়েটা যদি আর দশ মিনিট আগে আসত। তবে কোকিলটা আশেপাশেই আছে, আবারো নিশ্চয়ই ডাকবে।

    মীরা বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। হাসিমুখে বলল, বাবা এই জায়গাটা কি তোমার খুব পছন্দের?

    আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বলর্লেন, ‘হুঁ। মা তুই দশ মিনিট আগে এলে ভালো হত।’ আজহার সাহেব সাধারণত মেয়েদের তুমি বলেন। তাঁর মন যখন দ্রবীভূত থাকে তখনই শুধু তুই বলেন।

    ‘দশ মিনিট আগে এলে কী হত?’

    ‘কোকিলের ডাক শুনিয়ে দিতাম। ঢাকা শহরে এই জিনিস কোথায় পাবি?’

    ‘কী বলছ তুমি বাবা। সব কোকিল তো ঢাকা শহরে।’

    ‘তার মানে?’

    ‘ঢাকা শহর ভর্তি কাক। কোকিলদের ডিম পাড়তে হয় কাকের বাসায়। কাজেই কোকিলদের ভালো না লাগলেও তারা এখন ঢাকা শহরে বাস করে।

    আজহার সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, তোর কথাতো মা ফেলে দিতে পারছি না।

    ‘ফেলে দিও না, তোমার ব্যাগে ভরে রেখে দাও।’

    মীরা বাবার পাশে বসল। তার মুখ হাসি-হাসি। আজহার সাহেব মেয়েকে এমন হাসিখুশি অবস্থায় কখনো দেখেন নি। তাঁর খুবই ভালো লাগল। মেয়েটা কোনো একটা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, এখন মনে হয় সমস্যাটা কেটে গেছে। প্রথম যৌবনের সমস্যা অবশ্যি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হুট করে সমস্যাগুলি আসে আবার হুট করে চলে যায়।

    ‘মীরা!’

    ‘জ্বি বাবা।’

    ‘আজ মনে হয় তোর মনটা খুব ভালো।’

    ‘আমার মন সব দিনই ভালো থাকে। আমি ভাব করি যে মন খারাপ।’

    ‘কেন?’

    ‘এম্নি।’

    ‘গত কয়েকদিন তোকে দেখে আমি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তোর মা’কে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি মীরার কী হয়েছে।’

    ‘মা কী বলেছে?’

    ‘সে জবাব দেয়নি। পাশ কাটিয়ে গেছে।’

    মীরা হাসতে হাসতে বলল, পাশ কাটানোর ব্যাপারে মা খুব ওস্তাদ।

    আজহার সাহেব সিগারেট ধরালেন। সিগারেট তিনি ছেড়ে দিয়েছেন তবে একটা প্যাকেট সব সময় সঙ্গে রাখেন—হঠাৎ হঠাৎ খুব ইচ্ছা হলে সিগারেট ধরান। এখন খুব ইচ্ছা হচ্ছে। মীরা বলল, বাবা তুমি আমাকে কতটুকু পছন্দ কর?

    আজহার সাহেব বললেন, এটা আবার কেমন প্রশ্ন। পছন্দ কি দাঁড়িপাল্লায় মাপা যায় যে মেপে বলে দিলাম এতটুকু পছন্দ। পছন্দ কোয়ান্টিফাই করা যায় না।

    ‘তারপরও বলা যায়। উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যায়। আচ্ছা তোমার জন্যে ব্যাপারটা সহজ করে দিচ্ছি। তুমি একদিন লোকমুখে জানতে পারলে যে আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি তখন কী করবে?’

    ‘বিশ্বাস করব না। আমি তো আমার মেয়েকে চিনি। মানুষের কথায় আমি বিশ্বাস করব কেন?

    ‘আচ্ছা ধর আমিই তোমাকে বললাম। বললাম যে বাবা আমি ভয়ংকর একটা অন্যায় করেছি। তখন তুমি কী করবে? আমাকে ঘৃণা করবে?

    ‘ঘৃণা করব কেন? পাপকে ঘৃণা করতে হয়, পাপীকে না।’

    ‘এইসব হল বইএর বড় বড় কথা। বইএর কথা পড়তে ভালো লাগে। বইএর বাইরে আর ভালো লাগে না। আমি একটা খুন করে ফেললাম তারপর ও তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না?’

    আজহার সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। দীর্ঘ বক্তৃতার প্রস্তুতি নিয়ে বললেন, সব কিছুই নির্ভর করছে অবস্থার উপর। খুন কেন করলি, কোন্ অবস্থায় করলি তার উপর। নিউ ইংল্যান্ডে একটা খুনের মামলা হয়েছিল। চাক্ষুষ সাক্ষী ছিল তারপরেও খুশি বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। মামলাটা পুরোপুরি আমার মনে নেই। যতটুকু মনে আছে তোকে বলি। ভেরি ইন্টারেস্টিং।

    ‘প্লিজ বাবা মামলার গল্প শুরু করবে না।’

    ‘মামলার গল্প শুনতে ভালো লাগে না?’

    ‘অসহ্য লাগে বাবা। বমি এসে যায়।’

    ‘অসহ্য লাগবে কেন? মানুষের জীবনের বিচিত্র অংশটা ধরা পড়ে কোর্টে। মানুষের চিন্তাভাবনা, কর্মকাণ্ড যে কোন্ পর্যায় যেতে পারে তা… .

    আজহার সাহেব কথা শেষ করতে পারলেন না। কোকিল ডেকে উঠল। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ গলায় বললেন, কোকিলের ডাক শুনলি?

    ‘হ্যাঁ শুনলাম।’

    ‘পাখিদের মধ্যে কোন্ পাখির ডাক তোর সবচে ভালো লাগে?’

    ‘কোনো পাখির ডাকই ভালো লাগে না। পাখিরা ডাকাডাকি করে পাখিদের জন্যে। মানুষের তা ভালো লাগার কোনো কারণ নেই।’

    ‘ঘুঘুর ডাক তোর কাছে ভালো লাগে না?’

    ‘না। তুমি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ কেন? তোমার তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ঘুঘুর ডাক ভালো না-লাগাটা বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ?’

    আজহার সাহেব হেসে ফেললেন। মেয়ে দুটাই দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেল। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। নিজের মেয়ে বলে এখন আর তাদের মনে হয় না। মনে হয় অন্য বাড়ির মেয়ে। বেড়াতে এসেছে। মীরাকে দেখে কে বলবে ঐতো সেদিন তার জন্ম হল। তাঁর তখন কোর্টে কঠিন এক মামলা। মনোয়ারার ব্যথা শুরু হয়েছে—তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এই খবর পেয়েছেন কিন্তু কোর্ট ফেলে হাসপাতালে যেতে পারছেন না। মামলায় কী হচ্ছে না-হচ্ছে সেদিকেও মন দিতে পারছেন না। বিশ্রী অবস্থা। কোর্ট থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চলে গেলেন মেডিকেল কলেজ। মনোয়ারা আছে নয় নম্বর কেবিনে। হাসপাতালে গিয়ে জানা গেল তাদের কোনো নয় নাম্বার কেবিনই নেই। এই নাম্বারে কেবিন নেই শুধু তাই না, মনোয়ারা নামে কোনো পেশেন্টই ভর্তি হয়নি। হাসপাতাল থেকেই বাসায় টেলিফোন করলেন। কেউ টেলিফোন ধরছে না। রিং হচ্ছে, কেউ ধরছে না।

    আজহার সাহেব পুরানো কথা ভেবে আবারো রোমাঞ্চিত হলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরা তোর জন্মের সময়ের ঘটনা মনে আছে? সিরিয়াস কাণ্ড।

    মীরা বলল, প্লিজ বাবা সিরিয়াস কাণ্ডের গল্প এখন শুরু না করলে ভালো হয়। কতবার যে শুনেছি। মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হলি ফ্যামিলিতে, তুমি উপস্থিত হয়েছ ঢাকা মেডিকেলে।

    মীরা উঠে দাঁড়াল। আজহার সাহেব বললেন, উঠছিস কেন বোস না গল্প করি।

    ‘উহুঁ। তোমার ভাবভঙ্গি ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তুমি বাসি গল্প শুরু করবে।’

    ‘তোর মাকে পাঠিয়ে দে।’

    মীরা চলে যাচ্ছে। আজহার সাহেব মমতা নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। পুরানো দিনের কথা মনে হয়ে তাঁর ভালো লাগছে। Old is gold. অতীতের গল্প হিরন্ময়। মনে করলেই ভালো লাগে। তিনি শেষ পর্যন্ত ঠিক হাসপাতালে পৌঁছলেন রাত আটটা বেজে দশ মিনিটে। লজ্জিত ভঙ্গিতে ন’ নম্বর কেবিনে ঢুকলেন। কেন দেরি হল মনোয়ারা বলতে যাবেন তার আগেই তোয়ালে দিয়ে জড়ানো মীরাকে নার্স তাঁর কোলে তুলে দিতে দিতে বলল, আপনার প্রথম সন্তান মেয়ে, আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান। আর দেখুন কী টুকটুকে মেয়ে।

    মেয়ের দিকে তাকিয়ে গভীর আনন্দে আজহার সাহেবের চোখে পানি এসে গেল। খুবই অস্বস্তির ব্যাপার, তাঁর কোলে মেয়ে। দুটা হাতই বন্ধ। এদিকে চোখে পানি। হাত দিয়ে যে চট করে চোখের পানি মুছে ফেলবেন সে উপায় নেই। নার্স তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে।

    .

    মনোয়ারা শোবার ঘরের খাটে বসে আছেন। সারারাত তাঁর একফোঁটা ঘুম হয়নি। ঘুমের চেষ্টাও করেননি। মীরা ঘুমিয়েছে, তিনি তার পাশে জেগে বসেছিলেন। শেষরাতে বিছানা থেকে নামলেন। বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে রইলেন। যখন আকাশে আলোর আভা দেখা গেল তখন তাঁর মনে হল, তিনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। মীরা তাঁর সঙ্গে রসিকতা করেছে। তাঁকে প্রচণ্ড ভয় পাইয়ে মজা দেখেছে। এর বেশি কিছু না। মীরার এই স্বভাব আছে। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় সে স্কুল থেকে টেলিফোন করে কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, মা খুব খারাপ খবর আছে। আমাকে প্রমোশন দেয়নি।

    তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, সেকি!

    ‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম, আমার অঙ্ক আর ইংরেজি পরীক্ষা ভালো হয়নি। এখন দেখলাম দুটাতেই ফেল মার্ক।’

    ‘তুই কী বলছিস!’

    ‘হেডমিসট্রেস আপা তোমাকে আসতে বলেছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। মা তুমি আপাকে রিকোয়েস্ট করে আমাকে নাইনে তোলার ব্যবস্থা কর। একই ক্লাসে দুবছর থাকলে আমি মরে যাব।’

    ‘তুই কি সত্যি ফেল করেছিস?’

    ‘হ্যাঁ সত্যি।’

    মনোয়ারা শুনলেন মীরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তিনি বললেন, তুই কাঁদিস না। আমি এক্ষুনি আসছি।

    তিনি স্কুলে গিয়ে শুনলেন মীরা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে। ক্লাসের মেয়েরা সবাই ধরেছে চাইনিজ খাবার জন্যে। মীরা এইজন্যেই মাকে খবর দিয়ে এনেছে।

    কাল রাতে যে ঘটনার কথা বলল, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে এটাও মীরার বানানো। অবশ্যই বানানো। তিনি শুধু শুধুই এমন দুশ্চিন্তা করছেন।

    মনোয়ারা ফজরের নামাজ পড়লেন। তাঁর মন অনেকখানি শান্ত হল। তিনি আবারো এসে বারান্দায় বসলেন, তখন মনে হল মীরা যা বলছে সবই সত্যি। তার কথার একবর্ণও বানানো না। এই মহাবিপদে তিনি কী করবেন?

    মীরার বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাঁর পরামর্শ চাইবেন? এটা সম্ভব না। ঘটনা শুনে মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে হার্টফেল করে মারা যাবে। তার হার্টের অসুখ আছে। এসকিমা না কী যেন বলে। ডাক্তার সিগারেট খেতে মানা করে দিয়েছে। ফ্যাটি খাবার মানা করেছে। এমন একজন অসুস্থ মানুষকে এতবড় কথা বলা যায় না। যে মেয়েকে নিয়ে তাঁর এত অহংকার সেই অহংকার নষ্ট তিনি করতে পারেন না। ব্যাপারটা তাঁকেই সামাল দিতে হবে। কীভাবে সামাল দেবেন?

    একটাই পথ। ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে। বিয়ে হলে সব ঝামেলা শেষ। মীরার বাবা হুট করে মেয়ের বিয়েতে রাজি হবে না। তাছাড়া ক্লাসফ্রেন্ডের সঙ্গে বিয়ে। ছেলে চাকরি-টাকরি কিছু করে না, ছাত্র। গ্রাম থেকে এসেছে, পারিবারিক অবস্থাও নিশ্চয়ই খারাপ। এটা মনোয়ারা সামাল দিতে পারবেন। তাঁর সেই ক্ষমতা আছে। যেভাবেই হোক সামাল দেবেন। কোনো একটা কৌশল করে করতে হবে। অবশ্যি কৌশলের দরকারও নেই। তিনি যদি কোনো রাতে ঘুমুতে যাবার সময় কাঁদো-কাঁদো গলায় বলেন তুমি কি আমার একটা কথা রাখবে? মানুষটা সঙ্গে সঙ্গে বলবে, অবশ্যই রাখব। তোমার কোনো কথাটা আমি রাখিনি?

    তখন চোখে পানি এনে বলতে হবে, কথাটা কিন্তু অন্যায়। তোমার উপর জোর খাটানো হবে।

    মানুষটা তখন বলবে, কী যন্ত্রণা! কাঁদতে শুরু করলে কেন? কী চাও বল। যা বলবে তাই হবে।

    মীরা বলছে ছেলেটা রাজি না। এটা কোনো ব্যাপার না। ছেলে ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। তিনি ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন। তাকে বুঝাবেন। দরকার হলে ছেলের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলবেন। প্রয়োজনে তাদের পায়ে ধরবেন। তাঁকে তার পারিবারের সম্মান রক্ষা করতে হবে। তাঁর মেয়ের সম্মান রক্ষা করতে হবে।

    মনোয়ারা চেয়ার থেকে উঠে রান্নাঘরে গেলেন। দুকাপ চা বানালেন। মীরার বাবাকে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আজই রাজি করিয়ে ফেলতে হবে, দেরি করা যাবে না।

    আজহার সাহেব ঘুমঘুম চোখে দরজা খুলে স্ত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খুবই খুশি হলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, রাতে একফোঁটা ঘুমাওনি তাই না? চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কী করেছ সারারাত? মেয়ের সঙ্গে গুটুর-গুটুর গল্প?

    মনোয়ারা ক্ষীণস্বরে বললেন, হুঁ।

    ‘তোমরা মা মেয়ে সারারাত হেসে কী গল্প কর? একবার গোপনে তোমাদের কথাবার্তা শুনতে হবে। ওয়াটার গেট টাইপ ব্যবস্থা। হা হা হা।’

    ‘চায়ে চিনি টিনি লাগাবে কি-না দেখ।’

    আজহার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, চিনি টিনি কিছুই লাগবে না। অসাধারণ চা হয়েছে। আচ্ছা বেহেশতে চা পাওয়া যাবে কি-না জানো? বেহেশতে অনেক খাবারদাবারের কথা বলা হয়েছে। চায়ের কথা বলা হয়নি। চা না-পাওয়া গেলে আমার জন্যে সমস্যা।

    মনোয়ারা বললেন, তুমি কি নিশ্চিত তুমি বেহেশতে যাবে?

    আজহার সাহেব বললেন, তোমার কারণে নিশ্চিত। তুমি বেহেশতে যাবে এবং বেহেশতের গেটে দাঁড়িয়ে শক্ত গলায় বলবে আমি মীরার বাবাকে ছাড়া ঢুকব না। কাজেই আমাকে নিয়ে আসা হবে। আমি তোমার সাহায্য নিয়ে বেহেশতে ঢুকব, তারপর কিন্তু আমাকে ছুটি দিতে হবে! সাতটা হুরকে নিয়ে আমার কিছু বিশেষ পরিকল্পনা আছে। হা হা হা।

    মনোয়ারা কিছুই বলতে পারলেন না। দুঃখী দুঃখী চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন।

    .

    বেলা প্রায় এগারোটা। বাড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। মনোয়ারা চুপচাপ বসে আছেন। রাতে লোকজন খেতে আসলে ছোট আয়োজন করতে হবে। তারো আগে সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মীরাকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নেত্রকোনা চলে যাবেন। টেলিফোন করে ছেলেকে এখানে চলে আসতে বলবেন। তারপর তিনি যা বলার বলবেন।

    মনোয়ারা আজহার সাহেবের খোঁজে বাগানে এসেছেন। তিনি যে নেত্রকোনা যাবেন তা বলা দরকার। সাবের ছেলেটাকে এখানে খবর দিয়ে আনবেন সেই ব্যাপারটা সম্পর্কেও ধারণা দিয়ে রাখা দরকার।

    আজহার সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, এসো। তোমার অবস্থাতো দেখি কাহিল। হাঁটতেও পারছ না। একরাত না ঘুমিয়েই এই অবস্থা। চোখের নিচে কালি পড়ে কী হয়েছে।

    মনোয়ারা বললেন, আমি একটু নেত্রকোনা যাব। তোমার গাড়িটা নিচ্ছি।

    আজহার সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, বিশ্রী অভ্যাসটা ছাড় তো। তোমার গাড়ি আবার কী? বল আমাদের গাড়ি। হঠাৎ নেত্রকোনা কেন?

    ‘রাতে তুমি লোকজন দাওয়াত করেছ ওরা খাবে। নিজের হাতে কয়েকটা জিনিস কিনব। ভাবছি খাসির মাংস রান্না করব।’

    ‘চল আমি তোমার সঙ্গে যাই।’

    ‘না তুমি থাকো। তুমি চলে গেলে শেফা একেবারে একা থাকবে। আমি মীরাকে সঙ্গে নিচ্ছি।’

    ‘শেফা একা এটা ঠিক না, দেলোয়ার আছে।’

    ‘কী বল তুমি। দেলোয়ারের হাতে মেয়ে রেখে আমি চলে যাব না-কি? তুমি থাকো।

    ‘আচ্ছা যাও থাকলাম। তোমার অতিরিক্ত প্রটেকটিভ নেচার এই যুগে অচল। প্রটেকটিভ নেচার সামান্য কমাতে হবে। যুগ বদলে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।’

    মনোয়ারা স্বামীর পাশে বসতে বসতে বললেন, মীরার কোনো বন্ধু যদি এখানে বেড়াতে আসে তুমি রাগ করবে? ক্লাসফ্রেন্ড।

    ‘সাবেরের কথা বলছ? লম্বা ছেলেটা!’

    ‘হুঁ। সাবেরের খুব শখ মীরার গ্রামের বাড়ি দেখা। ওর শখ দেখে আমি কথায় কথায় বলে ফেলেছি আমরা গ্রামের বাড়িতে গেলে তোমাকে খবর দেব, চলে এসো।’

    আজহার সাহেব বললেন, ক্লাসফ্রেন্ডদের সঙ্গে মেলামেশা একটা পর্যায় পর্যন্তই ভালো। এর বেশি ভালো না। মীরার কি ইচ্ছা ছেলেটা আসুক?

    ‘ওর ইচ্ছাও নেই অনিচ্ছাও নেই। আমি ভাবছিলাম মীরার কয়েকজন ক্লাসফ্রেন্ড এসে যদি হৈ চৈ করে যায় মীরার ভালো লাগবে।

    ‘কয়েকজন আসবে?’

    ‘সাবের যখন আসতে চেয়েছিল তখন আমি বলেছিলাম তোমরা কয়েক বন্ধু মিলে চলে এসো। মীরার গ্রামের বাড়ি খুব সুন্দর। তোমাদের ভালো লাগবে। ওদের আবার পাখি শিকার খুব শখ।’

    ‘পাখিতো শিকার করতে পারবে না। আইন করে নিষেধ করা আছে। যা হোক, আসুক পাখি দেখিয়ে আনব।’

    ‘তুমি যে গ্রামে স্কুল-টুল দিয়েছ, মীরা বড়গলায় বন্ধুদের সেইসব বলেছে। ওরা দেখতে খুব আগ্রহী।’

    আজহার সাহেব উৎসাহিত গলায় বললেন, আসুক না—অসুবিধা কী? দেলোয়ারকে বল দক্ষিণের দুটা ঘর ঠিকঠাক করে দিতে। একটা কম্বল আছে না? কজন আসবে?

    ‘এখনো জানিনা। নেত্রকোনায় গিয়ে টেলিফোন করব। বেশি না আসাই ভালো। এত বিছানা কোথায়? হয়তো দেখা যাবে সাবের একাই আসবে। ওর আগ্রহই বেশি।’

    ‘আসুক দলবল নিয়েই আসুক। বিছানার ব্যবস্থা করা যাবে। তুমি নেত্রকোনা যখন যাচ্ছ দুটা সিঙ্গেল লেপ নিয়ে এসো।’

    আজহার সাহেব হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো বোধ করলেন। কয়েকজন ছেলে আসবে হৈ চৈ করবে, ভালো তো। ওদের নিয়ে খেজুরের রস খাওয়া যাবে। ক্ষেতে বসে মটরশুঁটি সেদ্ধ খাওয়া হবে। পুকুরে জাল ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। শহরের ছেলে জাল ফেলে মাছ মারা নিশ্চয়ই দেখেনি। তারা নিজেরাই নিশ্চয়ই পুকুরে নেমে যাবে। ছবি তুলতে হবে। প্রচুর ছবি তুলতে হবে।

    ‘মনোয়ারা! তুমি যখন যাচ্ছ দু’টা ফিল্ম নিয়ে এসো। ছেলেরা এলে অনেক ছবি তোলার ব্যাপার আছে।’

    মনোয়ারা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে তাঁর ভালোমানুষ স্বামীর কাছ থেকে বিদেয় নিলেন। এখন কথা বলতে হবে মীরার সঙ্গে। মীরা প্রথমে বেঁকে যাবে। বেঁকে গেলে হবে না।

    .

    মীরা কঠিন গলায় বলল, তুমি সাবেরের সঙ্গে কথা বলতে চাও?

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘কেন?’

    ‘কেন মানে কী? এতবড় একটা ব্যাপার, আমি কথা বলব না?’

    ‘তোমার ব্যাপারতো মা না। আমার ব্যাপার। আমি কথা যা বলার বলেছি। ওর সঙ্গে কথা বলাবলির আর কিছু নেই।

    মনোয়ারা নিজের অজান্তেই মেয়ের গালে প্রচণ্ড চড় বসালেন। মীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলালো। তার চোখে গভীর বিস্ময়। মা তার গায়ে হাত তুলতে পারে এটা সে কখনো ভাবেনি।’

    ‘মা আমাকে মারলে কেন?’

    ‘তুমি এমন কিছু করনি যে তোমার গালে চুমু খেতে হবে।’

    ‘আমাকে মারতে হবে এমন কিছুও আমি করিনি।’

    মনোয়ারা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। মীরা মাকে নিয়ে খাটের উপর পড়ে গেল। খাটের কোনা লেগে মীরার ঠোঁট কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। মীরা হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে আছে। মীরা খুবই অবাক হয়ে বলল, মা তুমি আমাকে মারছ?

    ‘হ্যাঁ মারছি। আমি তোকে খুন করে ফেলব।’

    ‘বেশতো খুন কর। খুন করে ডেডবডি বস্তায় ভরে পুকুরে পানিতে ডুবিয়ে দাও।’

    ‘একটা কথা না। তুই আমার সঙ্গে আয়। এখন থেকে আমি যা বলব তাই করবি।’

    মীরা শোবার ঘর থেকে মা’র পেছনে পেছনে বারান্দায় এল। বারান্দায় দেলোয়ার ভীত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মীরার দিকে একবার তাকিয়েই চট করে চোখ নামিয়ে নিল। মনোয়ারা হিংস্র ভঙ্গিতে বললেন, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কী চাও?

    দেলোয়ার ক্ষীণস্বরে বলল, কিছু চাইনা চাচীজী।

    ‘ড্রাইভারকে বল, আমি নেত্রকোনা যাব।’

    ‘চাচীজী আমি সাথে যাব?’

    ‘হ্যাঁ তুমি সঙ্গে যাবে।’

    দেলোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। বড় আপার ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। খয়েরি শাড়িতে রক্তের দাগ ভরে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। এই তথ্যটা চাচীজীকে জানানো দরকার কিন্তু তার সাহসে কুলাচ্ছে না।

    মনোয়ারা বললেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন? কথা কী বলছি কানে যাচ্ছে না?

    দেলোয়ার ছুটে বের হয়ে গেল।

    মীরা বলল, মা তুমি পাগলের মতো আচরণ করছ। পাগলের মতো আচরণ করতে হলে আমি করব। তুমি করছ কেন? আমি তো স্বাভাবিক আছি।

    ‘তুই স্বাভাবিক আছিস কারণ তুই কী করেছিস বুঝতে পারছিস না। বুঝতে পারলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পড়তি।’

    ‘তুমি কি চাও আমি পুকুরে ঝাঁপ দেই? বল তুমি চাও?’

    ‘গলা উঁচু করে কথা বলবি না। খবরদার গলা উঁচু করবি না। কেউ যেন কিছু না জানে।’

    ‘মা তোমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে।’

    ‘আমার মাথা ঠিক আছে। কতটা ঠিক আছে জানতে চাস? প্রয়োজনে আমি নিজের হাতে ইঁদুর-মারা বিষ গুলে তোকে খাওয়াব। আমার হাত কাঁপবে না। যা ঘরে যা, কাপড় বদলে আয়।’

    মীরা ঘরে ঢুকল। মনোয়ারা মেয়ের পেছনে পেছনে ঢুকলেন। তাঁকে হিংস লাগছে। তাঁর ঠোঁটে ফেনা জমে আছে। মা’র দিকে তাকিয়ে মীরার বুক কাঁপতে লাগল। এই মাকে সে চেনে না। এই মা তাকে সত্যি সত্যি ইঁদুর-মারা বিষ কিনে খাওয়াতে পারে।

    গাড়িতে মনোয়ারা সারাপথ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। তাঁর নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। বমি ভাব হচ্ছে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নেমে তিনি বমি করলেন। সঙ্গে পানি আনা হয়নি। কুলি করা হল না। মুখ ধোয়া হল না।

    দেলোয়ার একবার বলল, চাচীজী দৌড় দিয়া পানি নিয়া আসি।

    মনোয়ারা বললেন, কিচ্ছু আনতে হবে না।

    তিনি রাস্তার পাশের ডোবার কাছে নেমে গেলেন। ডোবার নোংরা পানি মুখে দিলেন। মাথায় দিলেন। ড্রাইভার এবং দেলোয়ার দুজনই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

    দেলোয়ারকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে। মীরাও গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। সে একবার শুধু বলল, মা তোমার শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে? মনোয়ারা মেয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন। কিছু বললেন না। মীরা লক্ষ্য করল তার মা’র চোখ লাল হয়ে আছে। গাড়িতে ওঠার সময় চোখ লাল ছিল না। এখন চোখ লাল।

    গাড়িতে উঠে মনোয়ারা বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। দেলোয়ারের সঙ্গে গল্প শুরু করলেন। নানান ধরনের কথা। এখানকার এম. পি. কেমন এম. পি., রাস্তাঘাটের এই অবস্থা ঠিক করছে না। বর্ষাকালে মাঠগুলি কি পানিতে ডুবে যায়? এখানে হাটবার কবে? পরের হাটে দেলোয়ার যেন খুঁজে দেখে ভেড়া পাওয়া যায় কি-না। তাঁর ছোটবেলা থেকে শখ তিন-চারটা বাচ্চাওয়ালা একটা মা ভেড়ার।

    নেত্রকোনা শহরে পৌঁছেই তিনি দেলোয়ারকে বললেন, বাবা তুমি আমাকে আগে একটা টেলিফোন করার ব্যবস্থা করে দাও। কয়েকটা জরুরি টেলিফোন করব আর এই ফাঁকে তুমি ভালো দেখে দুই কেজি খাশির গোশত কিনবে। সিনা আর রান মিলিয়ে কিনবে। যদি টক দৈ পাওয়া যায় তাহলে এক হাঁড়ি টক দৈ কিনবে। টক দৈ না পাওয়া গেলে এক বোতল ভিনিগার। ভিনিগার কী জানো তো? সিরকা। এর সঙ্গে অবশ্যই তুমি ইঁদুর মারার যে অষুধ আছে র‍্যাটম! র‍্যাটম কিনবে। ইঁদুর মারার অষুধ পাওয়া যায় না?

    দেলোয়ার বলল, জ্বি পাওয়া যায়।

    ‘দু প্যাকেট র‍্যাটম কিনবে। ঘরে খুব ইঁদুরের উপদ্রব। রাতে এরা বড় যন্ত্রণা করে। এক কাজ কর। আমরা গাড়িতে বসছি, তুমি আগে র‍্যাটম নিয়ে এসো তারপর টেলিফোন করতে যাব। ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে যাও। তাকে এককাপ চা খাইয়ে আনো। সারা রাস্তা ঝিমুচ্ছিল।’

    দেলোয়ার ড্রাইভারকে নিয়ে চলে গেল। মনোয়ারা আগের মতো সীটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে পরে আছেন। তাঁর বুকের ব্যথাটা বেড়েছে।

    মীরা মা’র কাণ্ডকারখানা কিছু বুঝতে পারছে না। মা এমন করছে কেন? তাকে কি র‍্যাটম দিয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে? ভয় দেখাবার কিছু কি আর এখন আছে? টেলিফোনে মা কী বলবে তাও সে বুঝতে পারছে না। মা’র যা অবস্থা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে একটা কথাও তো বলতে পারার কথা না। মীরা লক্ষ্য করল তার মা’র চোখ এখন আরো লাল হয়েছে। মনে হচ্ছে তাঁর চোখ উঠেছে। মীরা বলল, মা তুমি আমাকে এখানে আসতে বলছ আমি এসেছি। তুমি টেলিফোন করতে চাচ্ছ, কর। তুমি টেলিফোনে তাকে পাবে না।

    ‘পাব না কেন?’

    ‘এখন প্রায় একটা বাজে। এই সময় সে বাসায় থাকে না। টেলিফোনটা উত্তরার বাসায়।’

    ‘কখন সে বাসায় থাকে, কখন থাকে না—সব তোর মুখস্থ। মীরা শোন তাকে যদি টেলিফোনে না-পাওয়া যায় তাহলে তোকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাব।’

    ‘আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে?’

    ‘হ্যাঁ ঢাকায় যাব। দেলোয়ারকে দিয়ে তোর বাবার কাছে চিঠি লিখে যাব যে আমার হঠাৎ শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার আমাকে এক্ষুনি ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেছে বলে তুই আমাকে নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিস। তোর বাবা দুশ্চিন্তা করবে—করুক দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তার সে দেখেছে কী? দুশ্চিন্তার তো সবে শুরু।

    মা যে এই কাজটা করবে তা মীরা বুঝতে পারছে। মা গাড়ি নিয়ে বের হবার সময়ই তৈরী হয়ে এসেছে।

    মীরা বলল, মা তোমাকে একটা কথা বলি।

    ‘বল্।’

    ‘তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার ভয় লাগছে। তুমি একা টেনশানটা নিতে পারছ না। তুমি এক কাজ কর, বাবাকে সব জানাও। যা করার বাবা করুক।’

    ‘তুই আমাকে উপদেশ দিবি না। তোর উপদেশগুলি তুই নিজের জন্যে জমা করে রাখ। তোর বাবাকে আমি কিছুই জানাব না। তোকে বিষ খাইয়ে যদি মেরেও ফেলতে হয় তাও জানাব না। মরা মেয়ের জন্যে সে কষ্ট পেলে পাবে–তুই যে কাণ্ড করেছিস সেই ঘটনা জানার কষ্ট আমি তাকে দেব না। ‘

    মীরা বলল, মা তোমাকে সরল সাদাসিধা মেয়ে জানতাম। তুমি মোটেই তা না। তুমি ভয়ংকর একটা মানুষ।

    মনোয়ারা শান্ত গলায় বললেন, আমি যে কত ভয়ংকর সেই সম্পর্কে তোর কোনো ধারণাও নেই

    ‘একটা কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ মা। আমি তোমার মেয়ে। আমিও কিন্তু ভয়ংকর। কে জানে হয়তোবা তোমার চেয়েও ভয়ংকর।’

    ড্রাইভার এবং দেলোয়ার ফিরে এসেছে। দেলোয়ারের হাতে কালো পলিথিনের একটা প্যাকেট। মনোয়ারা বললেন, পেয়েছ?

    দেলোয়ার ভীত স্বরে বলল, জ্বি।

    ‘ক’ প্যাকেট এনেছ?’

    ‘চার প্যাকেট। চার প্যাকেট কিনলে পাইকারি রেট দেয়।’

    ‘ভালো করেছ।’

    চাচীজীকে তার খুবই ভয় লাগছে। চাচীজীর উপর জ্বিনের আছর হয়নি তো। হবিব নামে যে জ্বিনটা এ বাড়িতে থাকে সে বড়ই দুষ্ট।

    মনোয়ারা বললেন, মোতালেবকে চা খাইয়েছ?

    দেলোয়ার জবাব দেবার আগেই মোতালেব বলল, জ্বি আম্মা।

    ‘ঘুম কেটেছে?’

    ‘জ্বি।

    ‘মোতালেব শোন। আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। আমাকে ঢাকা যেতে হতে পারে। গাড়ির চাকা টাকা সব ঠিক আছে?’

    ‘স্পেয়ার চাকা লিক আছে।’

    ‘আমরা টেলিফোন করার ফাঁকে গাড়ির যা ঠিকঠাক করার করে নাও।’

    ‘জ্বি আচ্ছা।’

    .

    আই এস ডি লাইন হওয়ায় খুব সুবিধা হয়েছে। তিন বারের চেষ্টাতেই লাইন পাওয়া গেল। টেলিফোন ধরল সাবের। মীরার কথা ঠিক হয়নি। সাবের বাসাতেই ছিল। মীরা টেলিফোন রিসিভার মা’র দিকে বাড়িয়ে দিল। মনোয়ারা সহজ ভঙ্গিতে রিসিভার হাতে নিলেন। মফস্বলের টেলিফোন অফিস কখনো নিরিবিলি থাকে না। এখানেও নেই। ছোট্ট একটা ঘরের একদিকে মীরা এবং মনোয়ারা—অন্যদিকে টেবিল চেয়ার পেতে এক বুড়ো ভদ্রলোক বসে আছেন। মাথা নিচু করে ফাইলে কী সব লিখছেন।

    মীরা নিচু গলায় বলল, মা আমি কি উনাকে কিছুক্ষণের জন্যে অন্য ঘরে যেতে বলব?

    মনোয়ারা বললেন, না কিছু বলতে হবে না।

    ওপাশ থেকে সাবের বলল, হ্যালো হ্যালো। কে কথা বলছেন?

    মনোয়ারা সহজ স্বাভাবিক গলায় বললেন, কে সাবের?

    ‘জ্বি।’

    ‘আমি মীরার মা কথা বলছি।’

    ‘স্লামালিকুম।’

    ‘ওয়ালাইকুম সালাম, তুমি ভালো আছ?’

    ‘জ্বি ভালো।’

    ‘এদিকে মীরার শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে, প্রচণ্ড জ্বর। কথা ছিল নেত্রকোনায় এসে সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। জ্বরের জন্যে আসতে পারেনি বলেই আমি কথা বলছি।’

    ‘জ্বি বলুন।’

    ‘তুমি কি একটু আসতে পারবে?’

    ‘কোথায়?’

    ‘মীরার গ্রামের বাড়ি। বেড়ানোর জন্যে জায়গাটা খুব সুন্দর, তোমার পছন্দ হবে।’

    ‘জ্বি না। ঢাকায় আমার অনেক কাজ।’

    ‘মীরা বলছিল তোমার সঙ্গে তার কিছু জরুরি কথা আছে।’

    ‘ঢাকায় যখন আসবে তখন কথা বলব।’

    ‘মীরাকে দেখে মনে হয় সে কোনো ভয়াবহ সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সমস্যাটা কী তা কি তুমি জানো?’

    ‘আমি জানি না।’

    ‘তুমি জানো না, নাকি জেনেও দায়িত্ব অস্বীকার করতে চাচ্ছ?’

    ‘আপনি কী বলছেন আমি বুঝতেই পারছি না।’

    ‘তুমি বুঝতেই পারছ না?’

    ‘জ্বি না। তা ছাড়া লাইনে ডিস্টার্ব হচ্ছে। কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না।’

    ‘আমি অবশ্য তোমার কথা পরিষ্কার শুনতে পারছি। যাই হোক আমি কিছু কথা তোমাকে বলছি তুমি মন দিয়ে শোন। আমি তোমার জন্যে গাড়ি পাঠাচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে গাড়ি পৌঁছে যাবে।’

    ‘হ্যালো শুনুন। গাড়িটাড়ি পাঠাবেন না। বিকাল সাড়ে তিনটার সময় আমি দেশে চলে যাচ্ছি। আমার মা খুব অসুস্থ। মাকে দেখতে যাব।’

    ‘আমি আমার কথা শেষ করে নেই তারপর তুমি যদি অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে চাও দেখতে যাবে। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়াই তো উচিত। আমি কী বলছি মন দিয়ে শোন। সন্ধ্যার মধ্যে তোমার কাছে গাড়ি যাবে। তুমি গাড়িতে করে চলে এসো। তুমি যদি সঙ্গে কোনো বন্ধু-বান্ধব আনতে চাও তাদেরও নিয়ে এসো…’

    ‘আমি শুধু শুধু বন্ধু-বান্ধব নিয়ে গ্রামে আসব কেন?’

    ‘আমি মনে করছি তোমার এখানে আসা দরকার। এখানে এলে মঙ্গল ছাড়া তোমার কোনো অমঙ্গল হবে না। না এলেই বরং অমঙ্গলের সম্ভাবনা।’

    ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

    ‘শুধু শুধু তোমাকে কেন ভয় দেখাব। যারা ভয় পাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকে তারা সবকিছুতেই ভয় পায়। দড়ি দেখলে ভাবে সাপ। সুতা দেখলে ভাবে সুতা সাপ। তবে বাবা শোন, তোমাকে ভয় দেখাতে চাইলে আমি অবশ্যই ভয় দেখাতে পারি। আমি যদি চাই রাত আটটার মধ্যে তুমি এখানে উপস্থিত থাকবে—তোমাকে থাকতেই হবে। তুমি মীরার সরলতা দেখবে, তার ক্ষমতা দেখবে না, তাতো হবে না।’

    ‘খালাম্মা আপনি রেগে যাচ্ছেন।’

    ‘বাবা আমি রাগছি না। যে মেয়ে সমস্যায় পড়েছে তার মা রাগতে পারেন না। আমি মোটেই রাগছি না। মীরার বাবা যখন সবকিছু শুনবেন তখন তিনি রাগ করবেন। তাঁর রাগ চণ্ডাল রাগ। সেই রাগকে আমি প্রচণ্ড ভয় করি। আমি চাই না তাঁর কানে ব্যাপারটা যাক। তোমার এবং মীরার মঙ্গলের জন্যেই এটা চাই না।’

    ‘আপনার কথাবার্তা শুনে আমি খুবই অবাক হচ্ছি—আসলে আমি কিছুই জানি না।’

    ‘কিছু না জানলে জানবে। জানার জন্যেই আসতে বলছি। এখন আমি তোমার সঙ্গে লাভক্ষতির একটা আলাপ করব। এই আলাপটা মন দিয়ে শোন। লাইনে ডিস্টার্ব হচ্ছে না তো? পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছ?’

    ‘জি পাচ্ছি।’

    ‘আমার দু’টাই মেয়ে। আমাদের যা বিষয়সম্পত্তি আছে সবই এদের। বাংলাদেশের হিসেবে মীরার বাবা শুধু সম্মানিত মানুষই নন, বিত্তবান মানুষও। ঢাকা শহরে কলাবাগানে আমাদের চারতলা একটা বাড়ি আছে। ঐ বাড়ি তুমি ।দেখনি। ভাড়া দেয়া আছে। এ ছাড়াও মীরার বাবা দু’ মেয়ের নামে গুলশানে তিনহাজার স্কয়ার ফিটের দু’টা এপার্টমেন্ট কিনে দিয়েছেন। দু’টি মেয়ের জন্যেই দশ লক্ষ টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা আছে।

    ‘আপনি আমাকে এইসব কেন বলছেন বুঝতে পারছি না।’

    ‘তোমাকে বলছি কারণ মীরা তোমাকে অসম্ভব পছন্দ করে। যদি কোনো কারণে সে তোমাকে হারায় সেটা সে সহ্য করতে পারবে না।’

    ‘আমার হারাবার কথা উঠছে কেন? আমি তাকে বলেছি আমরা দু’জনই এখন ছাত্র। তারপর একটা প্ল্যান করে …’

    ‘আমি সেই সময়টা মীরাকে দিতে পারছি না। মীরার দাদীজানের বয়স আশির উপরে। তিনি গুরুতর অসুস্থ। আমরা মূলত গ্রামে এসেছি তাঁকে দেখতে। তিনি নাতজামাইয়ের মুখ দেখতে চাচ্ছেন।’

    ‘আপনি কি সত্যি সত্যি বিয়ের কথা ভাবছেন?’

    ‘মিথ্যামিথ্যি বিয়ের কথা কেউ ভাবে না। বিয়ের কথা যদি ভাবে, সত্যি বিয়ের কথাই ভাবে। যাই হোক তুমি ভেবো না যে তুমি এখানে আসবে আর জোর করে তোমাকে বিয়ে দেয়া হবে। আমি চাই মীরার দাদীজান তোমাকে দেখুন। তারপর আমরা পারিবারিক ভাবে আলাপ-আলোচনা করব। তোমার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করব।’

    ‘আমার বাবা বেঁচে নেই। আমার গার্জিয়ান হচ্ছেন আমার বড় মামা।’

    ‘আমরা তোমার মার সঙ্গে আলাপ করব, তোমার মামার সঙ্গে আলাপ করব। আমি কথা যা বলার বলে ফেলেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে হবে। অসুস্থ মেয়ে ফেলে এসেছি। তুমি কি আর কিছু জানতে চাও?’

    ‘মীরা আপনাকে কী বলেছে?’

    ‘মীরা আমাকে কিছুই বলেনি। সে অত্যন্ত চাপা-স্বভাবের মেয়ে। তাকে মেরে ফেললেও তার পেট থেকে কোনো কথা বের করা যাবে না। তাকে হঠাৎ দেখছি সে খুব টেনশানে করছে। জানি না কী কারণ তার মাথায় ঢুকে গেছে যে তুমি তাকে ছেড়ে যাচ্ছ। আমার মেয়ের টেনশান আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আমি তোমাকে যা বললাম, মেয়ের টেনশান কমানোর জন্যেই বললাম। আশা করি তুমি আমার উপর রাগ করোনি।’

    ‘জ্বি না রাগ করব কেন? রাগ করার মতো তো আপনি কিছু বলেননি।’

    ‘আচ্ছা বাবা রাখি। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

    ‘আমি আসতে পারব কি পারব না এখনো বলতে পারছি না। মা অসুস্থ তো।

    ‘বুঝতে পারছি। তুমি ভাবো। ভেবেটেবে সিদ্ধান্ত নাও। কোনো সিদ্ধান্তই হুট করে নিতে নেই। সিদ্ধান্ত যত ছোটই হোক তার জন্যে চিন্তার সময় দিতে হয়। রাখি কেমন?’

    ‘খালা স্লামালিকুম।’

    ‘ওয়ালাইকুম সালাম।’

    মীরা এতক্ষণ অবাক হয়ে মা’র দিকে তাকিয়েছিল। এখন সে চোখ নামিয়ে নিল। মনোয়ারা বললেন, খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মা দেখ তো আমার জন্যে একগ্লাস পানি জোগাড় করা যায় কিনা।

    মা’র গলা আগের মতো হয়ে গেছে। এই কণ্ঠস্বর মমতা এবং ভালোবাসায় আর্দ্র। মীরার চোখ ভিজে উঠতে শুরু করেছে। সে বলল, মা তোমার কি জ্বর আসছে। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।

    মনোয়ারা ক্লান্ত গলায় বললেন, বুঝতে পারছি না।

    ‘বুকে ব্যথা হচ্ছে?

    ‘হ্যাঁ।’

    ‘বেশি ব্যথা হচ্ছে?

    ‘না বেশি না। আমি একগ্লাস পানি খাব। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে।

    মীরা পানির সন্ধানে বের হল।

    মনোয়ারা উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখলেন তাঁর মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে এক্ষনি মেঝেতে পড়ে যাবেন। চেয়ারের হাতল ধরে তিনি নিজেকে সামলালেন। তাঁর উচিত বসে পড়া। তিনি বসলেন না, প্রায় টলতে টলতে বের হলেন।

    .

    উত্তেজনায় শেফার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। তার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুণি সে কেঁদে ফেলবে। আসলেই তার কান্না আসছে। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরে সে কান্না থামাচ্ছে। কান্না থামানোর এটা তার পুরানো কৌশল। তার ছিপে মাছ ধরা পড়েছে। এমন সময় মাছটা ধরল যখন আশেপাশে কেউ নেই। অল্পক্ষণ আগেও আজহার সাহেব ছিলেন। তিনি বললেন, মা আমি একটু হেঁটে আসি কেমন? শেফা চাচ্ছিল তার বাবা পাশে থাকে, তারপরেও বলল, আচ্ছা। আজহার সাহেব চলে যাবার পর শেফা হঠাৎ দেখে তার দু’টা ছিপের দু’টা ফাত্নার একটা নেই। সত্যি সত্যি নেই। প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি যে মাছ টেনে ফাত্না পানির নিচে নিয়ে গিয়েছে। সে চিন্তিত মুখে ফাত্না খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন হঠাৎ মনে হল মাছ টোপ গিলেনি তো! কী সর্বনাশ মাছ-মন্ত্র তো পড়া হয়নি।

    সে তিনবার মাছ-মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দিল। আর তখনি শিঁশিশি ধরনের শব্দ হল। মাছ সুতা টানছে। হুইল-বড়শির হুইল ঘুরছে। শেফার বুক ধক করে উঠল। সে ডাকল, বাবা বাবা।

    তখন মনে হল বাবা নেই, একটু আগে উঠে গেছেন। সে কী করবে। বঁড়শি হাতে নিয়ে হ্যাঁচকা টান দেবে? না শুধু বঁড়শি শক্ত করে ধরে বসে থাকবে। বড় মাছ যদি হয় তাকে সুদ্ধ টেনে পানিতে নিয়ে যাবে নাতো?

    শেফা কাঁপতে কাঁপতে বঁড়শি ধরল। আর তখন অন্য ফাত্নাটাও পানিতে ডুবে গেল। শেফা কী করবে। মাছ-মন্ত্র পড়ে পানিতে টোকা দেবে কী করে? তার হাত বন্ধ। মাছ সুতা টানছে। শিশিশি শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মাছটার ভয়ংকর শক্তি। ছিপ ধরে বসে থাকা যাচ্ছে না। রাক্ষুসী মাছ নাতো? মানুষ গিলে খেয়ে ফেলতে পারে এমন কোনো রাক্ষসী মাছ! পুরানো দিঘিতে এ-রকম মাছ থাকতেও তো পারে। পানির অনেক নিচে এরা মাটির মাছ উপর শুয়ে থাকে। এদের একেকটার বয়স দুশ তিনশ বছর। এদের হা প্রকাণ্ড। শরীর লোহার মতো শক্ত। এরা প্রচণ্ড রাগী। বেশিরভাগ সময় এরা ঘুমিয়ে থাকে। যে .তাদের ঘুম ভাঙায় তাকে তারা কিছুতেই ক্ষমা করে না।

    নানান ফন্দি-ফিকির করে এরা তাকে পানিতে নিয়ে যায়। তারপর খুবলে খুবলে চোখ খেয়ে ফেলে। এইসব কথা শেফাকে কেউ বলেনি। তার মনে হচ্ছে।

    হুইলের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে শেফার শরীর কাঁপছে। বুক ধক ধক করছে। আর কিছক্ষণ এ-রকম চললে শেফা মনে হয় টেনশানে মরেই যাবে। এমন অবস্থায় হঠাৎ সুতা টানা বন্ধ হয়ে গেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। পৃথিবী যেন হঠাৎ শব্দহীন হয়ে গেল। আশ্চর্য গাছের পাতাও পড়ছে না।

    এ-রকম কীভাবে হয়। পৃথিবী এমন শব্দহীন হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে। ভৌতিক কিছু।

    শেফা কাঁদো-কাঁদো গলায় ডাকল, বাবা।

    শেফাকে ভীষণ চমকে দিয়ে শেফার ঠিক পেছন থেকে আজহার সাহেব বললেন, কী হয়েছে মা?

    ‘মাছ টোপ খেয়েছে।’

    ‘মাছ টোপ খেয়েছে খুব ভালো কথা। তুই এমন ছটফট করছিস কেন?’

    ‘কেমন জানি লাগছে।’

    ‘কেমন লাগালাগির কিছু নেই। মাছটা এখন খেলিয়ে তুলতে হবে। সুতা ছাড়তে হবে। দেখি ছিপটা আমার হাতে।’

    ‘না তোমার হাতে দেব না। তুমি আমাকে বলে দাও কী করতে হবে। যা করতে বলবে তাই করব। সুতা কীভাবে ছাড়তে হয়?’

    শেফার কথা শেষ হবার আগেই মাছ আবার সুতা টানা শুরু করল এবং প্রথমবারের মতো তাকে দেখাও গেল। সে পানি ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল।

    আজহার সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, একি! এ তো বিরাট মাছ! এই মাছ ধরে রাখা তোর-আমার কর্ম না। এক্ষুনি সুতা ছিঁড়ে ফেলবে।

    শেফা বলল, তুমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না বাবা। আমাকে কী করতে হবে বল।

    ‘কী করতে হবে আমি নিজেওতো জানি না।‘

    শেফা ছিপ ধরে রাখতে পারছে না। মনে হচ্ছে তাকে-সুদ্ধ টেনে পানিতে ফেলে দেবে। আজহার সাহেব মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। উত্তেজনায় তাঁরও শরীর কাঁপছে। তিনি আনন্দিত গলায় বললেন, যেভাবেই হোক মাছটাকে খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে হবে। আরো সুতা ছাড়তে হবে।

    শেফা বলল, আর কীভাবে সুতা ছাড়ব?

    আজহার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আমি নিজেওতো মা তোর মতই আনাড়ি। অবশ্যি আমার নিজেকে ওল্ড ম্যান দ্য সি’র ফিসারম্যানের মতো লাগছে। ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি পড়েছিস?

    ‘এই সময় পড়াশোনার কথা বলবে নাতো বাবা, ভালো লাগছে না।’

    ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা অসাধারণ উপন্যাস।’

    ‘বাবা তুমি সবসময় বিরক্ত কর কেন?’

    ‘নোবেল প্রাইজ পাওয়া উপন্যাস।’

    ‘বাবা প্লিজ।’

    ‘শেফা আমি এক কাজ করি। আমি বরং পুকুরে নেমে পড়ি। আমি দেখেছি ছিপে বড় মাছ ধরা পড়লে একজন পুকুরে নামে।’

    ‘তাহলে তুমি নেমে পড়। কথা বলে সময় নষ্ট করছ কেন?’

    ‘তুই ছিপ শক্ত করে ধরে থাক।’

    ‘আমি ধরে আছি।’

    আজহার সাহেবের গায়ে শীতের কাপড়। কাশ্মিরি কাজ-করা লাল সোয়েটার।

    তিনি সেই কাপড়েই পানিতে নেমে পড়লেন।

    .

    মনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়েছেন। গাড়ির সীটে আধাশোয়া হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর মাথায় সবসময় ঘোমটা দেয়া থাকে, এখন ঘোমটা নেই। শাড়ির আঁচল সরে গেছে। জানালা খানিকটা খোলা। শীতের বাতাসে তাঁর মাথায় কাঁচাপাকা চুল উড়ছে। মীরার মনে হল জানালাটা বন্ধ করা দরকার। মা’র ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। আবার মনে হচ্ছে এই ভালো, বদ্ধ বাতাসে না-থেকে খোলা বাতাসে থাকাই ভালো। ঘুম ভালো হবে। মা’র ঘুম দরকার। আজ রাতেও মা নিশ্চয়ই ঘুমুবে না। সারারাত জেগে থাকবে। এবং তার শরীর ভয়ংকর খারাপ করবে।

    মীরা মা’র একটা ব্যাপারে মুগ্ধ। সে কখনো চিন্তাও করেনি তার মা এই ভঙ্গিতে কথা বলতে পারে এবং এমন গুছিয়ে কথা বলতে পারে। পরিস্থিতি মানুষকে তৈরী করে। কথাটা বোধহয় ঠিক। পরিস্থিতি যখন পাল্টে যায় তখন মানুষ পাল্টে যায়। মুরগি জবে করার দৃশ্য দেখে যে মানুষ ভয়ে ভিরমি খায় সে-ই ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করে। তখন তার হাত কাঁপে না। মানুষ জলের মতো। পাত্রের সঙ্গে সঙ্গে সে তার আকার বদলায়।

    বাড়ির পরিস্থিতি বদলে গেছে, মা বদলে গেছেন। বাবা নতুন পরিস্থিতির খবর জানেনও না। তিনি যখন জানবেন তিনি বদলে যাবেন। শেফা বদলাবে। দেলোয়ার বদলাবে। এখন দেলোয়ার ভীত মুখে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। তার কোলে পানি-ভর্তি জেরিকেন। এক-একবার গাড়ি ঝাঁকুনি খাচ্ছে— জেরিকেনের পানি তার গায়ে পড়ছে। সে নির্বিকার। দেলোয়ার পানি সঙ্গে নিয়েছে যদি যাবার পথেও চাচীজী বমি করেন। পানির অভাবে যেন তাঁর অসুবিধা না হয়। দেলোয়ার একটু পরপর ঘাড় ঘুরিয়ে মনোয়ারাকে দেখছে। মীরার মনে হল দেলোয়ার বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে কী যেন বলছে। জানতে ইচ্ছা করছে। পরিস্থিতি আগের মতো থাকলে সে জিজ্ঞেস করত, দেলোয়ার সাহেব বিড়বিড় করছেন কেন?

    আচ্ছা এই মানুষটাকে সে দেলোয়ার সাহেব ডাকে, না দেলোয়ার ভাই ডাকে? আশ্চর্য, মনে পড়ছে না। তার নিজের মাথাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই মাথা এলোমেলো হতে দেয়া যাবে না। খুব ভয়াবহ সময় তার সামনে। সবচে ভয়ংকর সম্ভবত আজ রাতটাই। এই রাত পার করতে পারলে বাকি জীবন সুখে-দুঃখে কেটে যাবে। আজ রাত তার জন্যে কালরাত। সব মানুষের জীবনে একটা কালরাত থাকে। লখিন্দরকে যে রাতে সাপে কাটল সে রাতটা ছিল বেহুলার কালরাত।

    বেহুলার চেয়ে সে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বেহুলা তার কালরাতের খবর আগেভাগে জানত না। সে জানে। না, ভুল ভাবা হচ্ছে। বেহুলা জানত তার মহাবিপদের কথা। সাপের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সে লোহার বাসর-ঘর করেছিল। তাতে লাভ হয়নি। চুলের মতো কালনাগিনী কোন্ এক ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছিল।

    মীরা তার কালরাতের জন্যে যত প্রস্তুতিই নিক, কোনো এক ফাঁকফোকর দিয়ে কালনাগিনী ঢুকে পড়বে। নিয়তি এড়ানো যাবে না। নিয়তি মেনে নিতে পারলে খুব ভালো হত। সব দায়দায়িত্ব নিয়তির হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ানো যেত। মুশকিল হচ্ছে নিয়তির হাতে মীরা নিজেকে ছাড়তে পারছে না। নিয়তি বেহুলার জন্যে সত্যি, তার জন্যে সত্যি না।

    গাড়ি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে গেল। ঘুম ভেঙে মনোয়ারা অসহায় গলায় বললেন, কী হয়েছেরে মীরা?

    ড্রাইভার বলল, কিছু না আম্মা। চাকা পাংচার। রাস্তা এমন জঘন্য।

    মনোয়ারা বললেন, চাকা বদলাতে কতক্ষণ লাগবে?

    ‘দশ মিনিট।’

    ‘তাড়াতাড়ি বদলাও। আমাদের বাড়িতে রেখে তুমি ঢাকা যাবে।’

    ড্রাইভার জবাব দিল না। সে গাড়ি থেকে নেমে চাকা বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দেলোয়ার তার পাশে। দেলোয়ারের হাতে এখনো পানি-ভর্তি জেরিকেন। সে মনে হয় কোনো অবস্থাতেই এটা হাতছাড়া করবে না।

    মীরা বলল, মা তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে? জানালার কাচ পুরোপুরি উঠিয়ে দেব?

    মনোয়ারা বললেন, আমাকে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই নিজের কথা ভাব।

    মনোয়ারা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মীরা গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল। মীরা নিজেকে নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু ভাবতে চাচ্ছে না। আগেভাগে ভেবে কিছু হবে না। সময় হোক। শুধু একটা ব্যাপার ঠিক রাখতে হবে—কী করবে?

    এটা ঠিক করা আছে। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির কিছু নেই। সাবের নামের মানুষটাকে সে বিয়ে করবে না। এবং…

    নাহ্ এবং কী তা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না। বাবার সঙ্গে মীরার কথা বলা দরকার। বাবাকেও খোলাখুলি সব জানানো দরকার। তিনি মনে কতটা কষ্ট পাবেন বা না পাবেন তা নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবার কিছু নেই। মীরাকে দেখতে হবে তার নিজের জীবন।

    বাবাকে কথাগুলি কীভাবে বলা যায়? কথাগুলি ইংরেজিতে শুরু করা যেতে পারে। ইংরেজিতে বলার একটা সুবিধা হচ্ছে, মনে হয় সে তার নিজের সমস্যার কথা বলছে না। অন্য কারো সমস্যার কথা বলছে।

    বাবা, I want to discuss something with you. Please spare me few minutes.

    না ভালো লাগছে না। কথাগুলি বাংলাতেই বলতে হবে।

    ‘বাবা আমি একটা ভয়ংকর বড় ভুল করেছি। ভুল যখন করেছি তখন আমার কাছে ভুল মনে হয়নি এবং এখনো মনে হচ্ছে না। তবে ভুলতো বটেই। এই ভুলের জন্যে তোমরা আমাকে শাস্তি দিতে চাও দাও। কিন্তু আমার জীবনটা যেহেতু আমার, আমি সেই জীবন কীভাবে যাপন করব তা ঠিকও করব আমি। এই ব্যাপারে তোমরা জোর খাটাতে পারবে না।’

    বাবা তখন নিশ্চয়ই খুবই বিস্মিত হয়ে বলবেন– এ-রকম বক্তৃতার ভাষায় কথা বলছিস কেন রে? ব্যাপারটা কী?

    ব্যাপারটা শোনার পর বাবা কীভাবে রিএক্ট করবেন? আগেভাগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। মা এত কাছের, সেই মা যে এমন করবে তাতো মীরা বুঝতে পারে নি। মীরার আশা ছিল—আর কেউ না হোক, মা অন্তত তার সমস্যা কিছুটা হলেও মীরার মতো করে দেখবে। মা শুধু মা না, একই সঙ্গে মেয়ে। একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের জন্যে কোনোরকম সহানুভুতি বোধ করবে না?

    .

    গাড়ি চলতে শুরু করেছে। মনোয়ারা জেগে উঠেছেন। তাঁর চোখ এখনো লাল। কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছেন বলে লাল ভাব আরো বেড়েছে।

    মীরা বলল, মা তোমার শরীরটা একটু ভালো লাগছে?

    মনোয়ারা জবাব দিলেন না এবং মেয়ের দিকে ফিরলেনও না। তিনি তাকিয়ে আছেন তাঁর ডানদিকে। দৃষ্টি জানালার বাইরে-—ফসল কাটা খোলা প্রান্তর। দেখার কিছু নেই।

    মীরা বলল, মা একটা ক্যাসেট চালালে তোমার কি খুব অসুবিধা হবে?

    মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে বিস্ময়। এমন একটা ভয়ংকর সময়ে মেয়েটা ক্যাসেটে গান দিতে চাচ্ছে? তার মানে কি এই যে ভয়ংকর ব্যাপারটা তার গায়ে লাগছে না! সে কিছু বুঝতেই পারছে না। তাঁর ধারণা ছিল তিনি তাঁর পরিবারের মানুষগুলিকে চেনেন। এখন মনে হচ্ছে চেনেন না।

    ড্রাইভার গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে ক্যাসেট বের করে চালিয়ে দিল। গান হচ্ছে। মীরা চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। মনোয়ারা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে। ফুলের সঙ্গে এই মেয়ের উপমা দেয়া ঠিক হচ্ছে না। আরেকটা ব্যাপারে মনোয়ারা খুব অবাক হচ্ছেন—গান শুনতে তাঁর নিজেরো ভালো লাগছে। শুধু ভালো না, বেশ ভালো লাগছে। তিনি নিজেও চোখ বন্ধ করলেন। গান হচ্ছে। যে গাইছে তার গলাটাও তো খুব মিষ্টি। বন্যা না-কি? মনোয়ারার ইচ্ছা করছে মীরার কাছে নামটা জানতে। তিনি অবশ্যি জানতে চাইলেন না। চোখ বন্ধ করলেন।

    ‘হেথা যে গান গাইতে আসা আমার
    হয়নি সে গান গাওয়া।
    আজো কেবলি সুর সাধা, আমার
    কেবল গাইতে চাওয়া।’

    শেফা ভেবে পাচ্ছে না কেন তার ভাগ্যটা এত খারাপ? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তারচে অনেক খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আছে—তবে শেফার ধারণা বাংলাদেশে তারচে খারাপ ভাগ্যের মেয়ে আর নেই।

    আজ সে এতবড় একটা মাছ ধরে ফেলেছে। আর আজই কি-না বাড়িতে কেউ নেই। সে, বাবা আর দাদীজান। দাদীজানের সকাল থেকে দাঁতব্যথা বলে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তারপরও তিনি এসে দেখেছেন এবং শেফাকে হতভম্ব করে বলেছেন—মাছটা তো খারাপ না।

    এতবড় একটা মাছ দেখে একজন মানুষ কী করে বলে—মাছটাতো খারাপ না। দাদীজান কি আশা করেছিলেন সে ছিপ দিয়ে তিমিমাছের সাইজের একটা কাতল মাছ ধরবে?

    মাছের গায়ে হাত রেখে শেফা বসে আছে। আজহার সাহেব এই অবস্থায় মেয়ের ছবি তুললেন। এটা নিয়ে শেফার মনে অশান্তি। বাবা একেবারেই ছবি তুলতে পারেন না। শাটার টেপার সময় বাবার হাত কাঁপবেই। শুধু যে হাত কাঁপে তাই না, তিনি ফ্রেমও কেটে ফেলেন। ছবি প্রিন্ট হবার পর দেখা যায় মাথা অর্ধেকটা কাটা। কিংবা একটা হাত বাদ পড়েছে। আপা এখন থাকলে কত ভালো হত। সে কখন আসবে কে জানে।

    আজহার সাহেব বললেন, কাদায় পানিতে মাখামাখি হয়ে আছিস। যা গোসল করে কাপড় বদলা।

    শেফা বলল, উহুঁ আপা আসুক তারপর। বাবা তুমি এই মাছটা খাবে তো? ‘খাব না কেন?’

    ‘আমি রান্না করব।’

    ‘তুই কি রান্না করতে পারিস!’

    ‘দাদীজানের কাছে শিখে নেব।’

    ‘ভালো তো। ঠিক আছে তুই রান্না কর। আমি তোকে সাহায্য করব।’

    ‘তোমাকে সাহায্য করতে হবে না। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে আমি যা করব নিজে নিজে করব। মাছ মারলেও একা একা মারব। রান্না করলে ও একা একা রান্না করব।’

    আজহার সাহেব হাসছেন। মেয়েটার অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হচ্ছে তিনি এই গ্রহের সবচে সুখী মানুষ।

    শেফা বলল, বাবা তুমি আমার দিকে তাকিয়ে এমন বিশ্রীভাবে হাসছ কেন? তুমি এখন যাওতো বাবা, আমি কাজ করছি।

    ‘কাজ করছিস কোথায়, তুইতো মাছের গাছে হাত রেখে বসে আছিস।’

    শেফা আসলেই কাজ করছে। মনে মনে ক্লাসের বন্ধুদের কাছে চিঠি লিখছে। তার চারজন অতি প্রিয় বান্ধবী আছে। সবার কাছে আলাদা আলাদা চিঠি যাবে। চিঠির সাথে মাছের একটা করে ছবি দিতে পারলে ভালো হত। সেটা সম্ভব হবে না। ছবি প্রিন্ট করাতে হবে ঢাকায় গিয়ে। তাছাড়া বাবা ছবি যা তুলেছে—হয়তো দেখা যাবে ছবিতে সে আছে, মাছটা নেই।

    “তুই শুনে খুবই মজা পাবি যে আমি আমাদের গ্রামের বাড়ির পুকুরে একটা মাছ ধরে ফেলেছি। মাছটা কত বড় বললে, তুই ভাববি গুল মারছি। বাবাকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে রেখেছি। তোকে ছবি দেখাব। ছবি দেখলেই বুঝবি। প্রথম যখন ছিপে টান পড়ল, আমি ভাবলাম …”

    উহু চিঠিটা ভালো হচ্ছে না। আরো গুছিয়ে আরো সুন্দর করে লিখতে হবে।

    মাছটা ধড়ফড় করছে। মাছটার দিকে তাকিয়ে শেফার এখন কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। আহারে বেচারা! পানির নিচে সে হয়তো ছেলেমেয়ে নিয়ে কত সুখে ছিল। সে কি কোনোদিন ভেবেছিল শেফা নামের একটা মেয়ে তাকে মেরে ফেলবে? মাছটার ঠোঁটে বঁড়শি বিঁধে আছে। ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে। মাছটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিশ্চয়ই তীব্র ঘৃণা নিয়েই তাকাচ্ছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদেবী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }