Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মৃণালিনী – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প137 Mins Read0

    মৃণালিনী – ০১

    প্রথম খণ্ড
    প্রথম পরিচ্ছেদ : আচার্য

    একদিন প্রয়াগতীর্থে, গঙ্গাযমুনা-সঙ্গমে, অপূর্ব প্রাবৃট্র‍দিনান্তশোভা প্রকটিত হইতেছিল। প্রাবৃট্।‍কাল, কিন্তু মেঘ নাই, অথবা যে মেঘ আছে, তাহা স্বর্ণময় তরঙ্গমালাবৎ পশ্চিম গগনে বিরাজ করিতেছিল। সূর্যদেব অস্তে গমন করিয়াছিলেন। বর্ষার জলসঞ্চারে গঙ্গা যমুনা উভয়েই সম্পূর্ণশরীরা, যৌবনের পরিপূর্ণতায় উন্মদিনী, যেন দুই ভগিনী ক্রীড়াচ্ছলে পরস্পরে আলিঙ্গন করিতেছিল। চঞ্চল বসনাগ্রভাগবৎ পবনতাড়িত হইয়া কূলে প্রতিঘাত করিতেছিল।
    একখানি ক্ষুদ্র তরণীতে দুই জন মাত্র নাবিক। তরণী অসঙ্গত সাহসে সেই দুর্দমনীয় যমুনার স্রোতোবেগে আরোহণ করিয়া, প্রয়াগের ঘাটে আসিয়া লাগিল। একজন নৌকায় রহিল, একজন তীরে নামিল। যে নামিল, তাহার নবীন যৌবন, উন্নত বলিষ্ঠ দেহ, যোদ্ধৃবেশ। মস্তকে উষ্ণীষ, অঙ্গে কবচ, করে ধনুর্বাণ, পৃষ্ঠে তূণীর, চরণে অনুপদীনা। এই বীরাকার পুরুষ পরম সুন্দর! ঘাটের উপরে, সংসারবিরাগী পূণ্যপ্রয়াসীদিগের কতকগুলি আশ্রম আছে। তন্মধ্যে একটি ক্ষুদ্র কুটীরে এই যুবা প্রবেশ করিলেন।
    কুটীরমধ্যে এক ব্রাহ্মণ কুশাসনে উপবেশন করিয়া জপে নিযুক্ত ছিলেন; ব্রাহ্মণ অতি দীর্ঘাকার পুরুষ; শরীর শুষ্ক; আয়ত মুখমণ্ডলে শ্বেতশ্মশ্রু বিরাজিত; ললাট ও বিরলকেশ তালুদেশে অল্পমাত্র বিভূতিশোভা। ব্রাহ্মণের কান্তি গম্ভীর এবং কটাক্ষ কঠিন; দেখিলে তাঁহাকে নির্দয় বা অভক্তিভাজন বলিয়া বোধ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, অথচ শঙ্কা হইত। আগন্তুককে দেখিবামাত্র তাঁহার সে পুরুষভাব যেন দূর হইল, মুখের গাম্ভীর্যমধ্যে প্রসাদের সঞ্চার হইল। আগন্তুক, ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইলেন। ব্রাহ্মণ আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন, “বৎস হেমচন্দ্র, আমি অনেক দিবসাবধি তোমার প্রতীক্ষা করিতেছি |”
    হেমচন্দ্র বিনীতভাবে কহিলেন, “অপরাধ গ্রহণ করিবেন না, দিল্লীতে কার্য হয় নাই। পরন্তু যবন আমার পশ্চাদগামী হইয়াছিল; এই জন্য কিছু সতর্ক হইয়া আসিতে হইয়াছিল। তদ্ধেতু বিলম্ব হইয়াছে |”
    ব্রাহ্মণ কহিলেন, “দিল্লীর সংবাদ আমি সকল শুনিয়াছি। বখ্ই‍তিয়ার খিলিজিকে হাতীতে মারিত, ভালই হইত, দেবতার শত্রু পশুহস্তে নিপাত হইত। তুমি কেন তার প্রাণ বাঁচাইতে গেলে!”
    হে। তাহাকে স্বহস্তে যুদ্ধে মারিব বলিয়া। সে আমার পিতৃশত্রু, আমার পিতার রাজ্যচোর। আমারই সে বধ্য।
    ব্রা। তবে তাহার উপর যে হাতী রাগিয়া আক্রমণ করিয়াছিল, তুমি বখ্ে‍তিয়ারকে না মারিয়া সে হাতীকে মারিলে কেন?
    হে। আমি কি চোরের মত বিনা যুদ্ধে শত্রু মারিব? আমি মগধবিজেতাকে যুদ্ধে জয় করিয়া পিতার রাজ্য উদ্ধার করিব। নহিলে আমার মগধ-রাজপুত্র নামে কলঙ্ক।
    ব্রাহ্মণ কিঞ্চিৎ পরুষভাবে কহিলেন, “এ সকল ঘটনা ত অনেক দিন হইয়া গিয়াছে, ইহার পূর্বে তোমার এখানে আসার সম্ভাবনা ছিল। তুমি কেন বিলম্ব করিলে? তুমি মথুরায় গিয়াছিলে?”
    হেমচন্দ্র অধোবদন হইলেন। ব্রাহ্মণ কহিলেন, “বুঝিলাম তুমি মথুরায় গিয়াছিলে, আমার নিষেধ গ্রাহ্য কর নাই। যাহাকে দেখিতে মথুরায় গিয়াছিলে, তাহার কি সাক্ষাৎ পাইয়াছ?”
    এবার হেমচন্দ্র রুক্ষভাবে কহিলেন, “সাক্ষাৎ যে পাইলাম না, সে আপনারই দয়া। মৃণালিনীকে আপনি কোথায় পাঠাইয়াছেন?”
    মাধবাচার্য কহিলেন, “আমি যে কোথায় পাঠাইয়াছি, তাহা তুমি কি প্রকারে সিদ্ধান্ত করিলে?”
    হে। মাধবাচার্য ভিন্ন এ মন্ত্রণা কাহার? আমি মৃণালিনীর ধাত্রীর মুখে শুনিলাম যে, মৃণালিনী আমার আঙ্গটি দেখিয়া কোথায় গিয়াছে, আর তাহার উদ্দেশ নাই। আমার আঙ্গটি আপনি পাথেয় জন্য চাহিয়া লইয়াছিলেন। আঙ্গটির পরিবর্তে অন্য রত্ন দিতে চাহিয়াছিলাম; কিন্তু আপনি লন নাই। তখনই আমি সন্দিহান হইয়াছিলাম, কিন্তু আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই, এ জন্যই বিনা বিবাদে আঙ্গটি দিয়াছিলাম। কিন্তু আমার সে অসতর্কতার আপনিই সমুচিত প্রতিফল দিয়াছেন।
    মাধবাচার্য কহিলেন, “যদি তাহাই হয়, আমার উপর রাগ করিও না। তুমি দেবকার্য না সাধিলে কে সাধিবে? তুমি যবনকে না তাড়াইলে কে তাড়াইবে? যবননিপাত তোমার একমাত্র ধ্যানস্বরূপ হওয়া উচিত। এখন মৃণালিনী তোমার মন অধিকার করিবে কেন? একবার তুমি মৃণালিনীর আশায় মথুরায় বসিয়া ছিলে বলিয়া তোমার বাপের রাজ্য হারাইয়াছ; যবনাগমনকালে হেমচন্দ্র যদি মথুরায় না থাকিয়া মগধে থাকিত, তবে মগধজয় কেন হইবে? আবার কি সেই মৃণালিনী-পাশে বদ্ধ হইয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিবে? মাধবাচার্যের জীবন থাকিতে তাহা হইবে না। সুতরাং যেখানে থাকিলে তুমি মৃণালিনীকে পাইবে না, আমি তাহাকে সেইখানে রাখিয়াছি |”
    হে। আপনার দেবকার্য আপনি উদ্ধার করুন; আমি এই পর্যন্ত।
    মা। তোমার দুর্বুদ্ধি ঘটিয়াছে। এই কি তোমার দেবভক্তি? ভাল, তাহাই না হউক; দেবতারা আত্মকর্ম সাধন জন্য তোমার ন্যায় মনুষ্যের সাহায্যের অপেক্ষা করেন না। কিন্তু তুমি কাপুরুষ যদি না হও, তবে তুমি কি প্রকারে শত্রুশাসন হইতে অবসর পাইতে চাও? এই কি তোমার বীরগর্ব? এই কি তোমার শিক্ষা? রাজবংশে জন্মিয়া কি প্রকারে আপনার রাজ্যোদ্ধারে বিমুখ হইতে চাহিতেছ?
    হে। রাজ্য-শিক্ষা-গর্ব অতল জলে ডুবিয়া যাউক।
    মা। নরাধম! তোমার জননী কেন তোমায় দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করিয়া যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছিল? কেনই বা দ্বাদশ বর্ষ দেবারাধনা ত্যাগ করিয়া এ পাষণ্ডকে সকল বিদ্যা শিখাইলাম?
    মাধবাচার্য অনেকক্ষণ নীরবে করলগ্নকপোল হইয়া রহিলেন। ক্রমে হেমচন্দ্রের অনিন্দ্য গৌর মুখকান্তি মধ্যাহ্ন-মরীচি-বিশোষিত স্থলপদ্মবৎ আরক্তবর্ণ হইয়া আসিতেছিল। কিন্তু গর্ভাগ্নিগিরি-শিখর-তুল্য, তিনি স্থির ভাবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। পরিশেষে মাধবাচার্য কহিলেন, “হেমচন্দ্র, ধৈর্যাবলম্বন কর। মৃণালিনী কোথায়, তাহা বলিব- মৃণালিনীর সহিত তোমার বিবাহ দেওয়াইব। কিন্তু এক্ষণে আমার পরামর্শের অনুবর্তী হও, আগে আপনার কাজ সাধন কর |”
    হেমচন্দ্র কহিলেন, “মৃণালিনী কোথায় না বলিলে, আমি যবনবধের জন্য অস্ত্র স্পর্শ করিব না |”
    মাধবাচার্য কহিলেন, “আর যদি মৃণালিনী মরিয়া থাকে?”
    হেমচন্দ্রের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি কহিলেন, “তবে সে আপনারই কাজ |”
    মাধবাচার্য কহিলেন, “আমি স্বীকার করিতেছি, আমিই দেবকার্যের কণ্টককে বিনষ্ট করিয়াছি।”
    হেমচন্দ্রের মুখকান্তি বর্ষণোন্মুখ মেঘবৎ হইল। ত্রস্তহস্তে ধনুকে শরসংযোগ করিয়া কহিলেন, “যে মৃণালিনীর বধকর্তা, সে আমার বধ্য। এই শরে গুরুহত্যা ব্রহ্মহত্যা উভয় দুষ্ক্রিয়া সাধন করিব |”
    মাধবাচার্য হাস্য করিলেন, কহিলেন, “গুরুহত্যায় ব্রাহ্মহত্যায় তোমার যত আমোদ, স্ত্রীহত্যায় আমার তত নহে। এক্ষণে তোমাকে পাতকের ভাগী হইতে হইবে না। মৃণালিনী জীবিতা আছে। পার, তাহার সন্ধান করিয়া সাক্ষাৎ কর। এক্ষণে আমার আশ্রম হইতে স্থানান্তরে যাও। আশ্রম কলুষিত করিও না; অপাত্রে আমি কোন ভার দিই না |” এই বলিয়া মাধবাচার্য পূর্ববৎ জপে নিযুক্ত হইলেন।
    হেমচন্দ্র আশ্রম হইতে নির্গত হইলেন। ঘাটে আসিয়া ক্ষুদ্র তরণী আরোহণ করিলেন। যে দ্বিতীয় ব্যক্তি নৌকায় ছিল, তাহাকে বলিলেন, “দিগ্বিজয়! নৌকো ছাড়িয়া দাও |”
    দিগ্বিজয় বলিল, “কোথায় যাইব?” হেমচন্দ্র বলিলেন, “যেখানে ইচ্ছা- যমালয় |”
    দিগ্বিজয় প্রভুর স্বভাব বুঝিত। অস্ফুটস্বরে কহিল, “সেটা অল্প পথ |” এই বলিয়া সে তরণী ছাড়িয়া দিয়া স্রোতের প্রতিকূলে বাহিতে লাগিল।
    হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া শেষে কহিলেন, “দূর হউক! ফিরিয়া চল |”
    দিগ্বিজয় নৌকা ফিরাইয়া পুনরপি প্রয়াগের ঘাটে উপনীত হইল। হেমচন্দ্র লম্ফে তীরে অবতরণ করিয়া পুনর্বার মাধবাচার্যের আশ্রমে গেলেন।
    তাঁহাকে দেখিয়া মাধবাচার্য কহিলেন, “পুনর্বার কেন আসিয়াছ?”
    হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি যাহা বলিবেন, তাহাই স্বীকার করিব। মৃণালিনী কোথায় আছে আজ্ঞা করুন |”
    মা। তুমি সত্যবাদী-আমার আজ্ঞাপালন করিতে স্বীকার করিলে, ইহাতেই আমি সন্তুষ্ট হইলাম। গৌড়নগরে এক শিষ্যের বাটীতে মৃণালিনীকে রাখিয়াছি। তোমাকেও সেই প্রদেশে যাইতে হইবে। কিন্তু তুমি তাহার সাক্ষাৎ পাইবে না। শিষ্যের প্রতি আমার বিশেষ আজ্ঞা আছে যে, যতদিন মৃণালিনী তাঁহার গৃহে থাকিবে, ততদিন সে পুরুষান্তরের সাক্ষাৎ না পায়।
    হে। সাক্ষাৎ না পাই, যাহা বলিলেন, ইহাতেই আমি চরিতার্থ হইলাম। এক্ষণে কি কার্য করিতে হইবে অনুমতি করুন।
    মা। তুমি দিল্লী গিয়া যবনের মন্ত্রণা কি জানিয়া আসিয়াছ?
    হে। যবনেরা বঙ্গবিজয়ের উদ্যোগ করিতেছে। অতি ত্বরায় বখ্স‍তিয়ার খিলিজি সেনা লইয়া, গৌড়ে যাত্রা করিবে।
    মাধবাচার্যের মুখ হর্ষপ্রফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন, “এতদিনে বিধাতা বুঝি এ দেশের প্রতি সদয় হইলেন |”
    হেমচন্দ্র একতানমনে মাধবাচার্যের প্রতি চাহিয়া তাঁহার কথার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। মাধবাচার্য বলিতে লাগিলেন, “কয় মাস পর্যন্ত আমি কেবল নিযুক্ত আছি, গণনায় যাহা ভবিষ্যৎ বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে, তাহা ফলিবার উপক্রম হইয়াছে |”
    হে। কি প্রকার?
    মা। গণিয়া দেখিলাম যে, যবনসাম্রাজ্য-ধ্বংস বঙ্গরাজ্য হইতে আরম্ভ হইবে।
    হে। তাহা হইতে পারে। কিন্তু কতকালেই বা তাহা হইবে? আর কাহা কর্তৃক?
    মা। তাহাও গণিয়া স্থির করিয়াছি। যখন পশ্চিমদেশীয় বণিক বঙ্গরাজ্যে অস্ত্রধারণ করিবে, তখন যবনরাজ্য উৎসন্ন হইবেক।
    হে। তবে আমার জয়লাভের কোথা সম্ভাবনা? আমি ত বণিক নহি।
    মা। তুমিই বণিক। মথুরায় যখন তুমি মৃণালিনীর প্রয়াসে দীর্ঘকাল বাস করিয়াছিলে, তখন তুমি কি ছলনা করিয়া তথায় বাস করিতে?
    হে। আমি তখন বণিক বলিয়া মথুরায় পরিচিত ছিলাম বটে।
    মা। সুতরাং তুমিই পশ্চিমদেশীয় বণিক। গৌড়রাজ্যে গিয়া তুমি অস্ত্রধারণ করিলেই যবননিপাত হইবে। তুমি আমার নিকট প্রতিশ্রুত হও যে, কাল প্রাতেই গৌড়ে যাত্রা করিবে। যে পর্যন্ত সেখানে না যবনের সহিত যুদ্ধ কর, সে পর্যন্ত মৃণালিনীর সহিত সাক্ষাৎ করিবে না।
    হেমচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “তাহাই স্বীকার করিলাম। কিন্তু একা যুদ্ধ করিয়া কি করিব?”
    মা। গৌড়েশ্বরের সেনা আছে।
    হে। থাকিতে পারে-সে বিষয়েও কতক সন্দেহ; কিন্তু যদি থাকে, তবে তাহারা আমার অধীন হইবে কেন?
    মা। তুমি আগে যাও। নবদ্বীপে আমার সহিত সাক্ষাৎ হইবে। সেইখানেই গিয়া ইহার বিহিত উদ্যোগ করা যাইবে। গৌড়েশ্বরের নিকট আমি পরিচিত আছি।
    “যে আজ্ঞা” বলিয়া হেমচন্দ্র প্রণাম করিয়া বিদায় হইলেন। যতক্ষণ তাঁহার বীরমূর্তি নয়নগোচর হইতে লাগিল, আচার্য ততক্ষণ তৎপ্রতি অনিমেষলোচনে চাহিয়া রহিলেন। আর যখন হেমচন্দ্র অদৃশ্য হইলেন, মাধবাচার্য মনে মনে বলিতে লাগিলেন, “যাও, বৎস! প্রতি পদে বিজয় লাভ কর। যদি ব্রাহ্মণবংশে আমার জন্ম হয়, তবে তোমার পদে কুশাঙ্কুরও বিঁধিবে না। মৃণালিনী! মৃণালিনী পাখী আমি তোমারই জন্যে পিঞ্জরে বাঁধিয়া রাখিয়াছি। কিন্তু কি জানি, পাছে তুমি তাহার কলধ্বনিতে মুগ্ধ হইয়া বড় কাজ ভুলিয়া যাও, এইজন্য তোমার পরমমঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ব্রাহ্মণ তোমাকে কিছু দিনের জন্য মন:পীড়া দিতেছে |”

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পিঞ্জরের বিহঙ্গী

    লক্ষ্মণাবতী-নিবাসী হৃষীকেশ সম্পন্ন বা দরিদ্র ব্রাহ্মণ নহেন। তাঁহার বাসগৃহের বিলক্ষণ সৌষ্ঠব ছিল। তাঁহার অন্ত:পুরমধ্যে যথায় দুইটি তরুণী কক্ষপ্রাচীরে আলেখ্য লিখিতেছিলেন, তথায় পাঠক মহাশয়কে দাঁড়াইতে হইবে। উভয় রমণীই আত্মকর্মে সবিশেষ মনোভিনিবেশ করিয়াছিলেন, কিন্তু তন্নিবন্ধন পরস্পরের সহিত কথোপকথনের কোন বিঘ্ন জন্মিতেছিল না। সেই কথোপথনের মধ্যভাগ হইতে পাঠক মহাশয়কে শুনাইতে আরম্ভ করিব।
    এক যুবতী অপরকে কহিলেন, “কেন, মৃণালিনি, কথার উত্তর দিস না কেন? আমি সেই রাজপুত্রটির কথা শুনিতে ভালবাসি |”
    “সই মণিমালিনী! তোমার সুখের কথা বল, আমি আনন্দে শুনিব |”
    মণিমালিনী কহিল, “আমার সুখের কথা শুনিতে শুনিতে আমিই জ্বালাতন হইয়াছি, তোমাকে কি শুনাইব?”
    মৃ। তুমি শোন কার কাছে- তোমার স্বামীর কাছে?
    ম। নহিলে আর কারও কাছে বড় শুনিতে পাই না। এই পদ্মটি কেমন আঁকিলাম দেখ দেখি?
    মৃ। ভাল হইয়াও হয় নাই। জল হইতে পদ্ম অনেক ঊর্ধ্বে আছে, কিন্তু সরোবরে সেরূপ থাকে না; পদ্মের বোঁটা জলে লাগিয়া থাকে, চিত্রেও সেইরূপ হইবে। আর কয়েকটি পদ্মপত্র আঁক; নহিলে পদ্মের শোভা স্পষ্ট হয় না। আরও, পার যদি, উহার নিকট একটি রাজহাঁস আঁকিয়া দাও।
    ম। হাঁস এখানে কি করিবে?
    মৃ। তোমার স্বামীর মত পদ্মের কাছে সুখের কথা কহিবে।
    ম। (হাসিয়া) দুই জনেই সুকণ্ঠ বটে। কিন্তু হাঁস লিখিব না। আমি সুখের কথা শুনিয়া শুনিয়া জ্বালাতন হইয়াছি।
    মৃ। তবে একটি খঞ্জন আঁক।
    ম। খঞ্জন আঁকিব না। খঞ্জন পাখা বাহির করিয়া উড়িয়া যাইবে। এ ত মৃণালিনী নহে যে, স্নেহ-শিকলে বাঁধিয়া রাখিব।
    মৃ। খঞ্জন যদি এমনই দুষ্ট হয়, তবে মৃণালিনীকে যেমন পিঞ্জরে পুরিয়াছ, খঞ্জনকেও সেইরূপ করিও।
    ম। আমরা মৃণালিনীকে পিঞ্জরে পুরি নাই- সে আপনি আসিয়া পিঞ্জরে ঢুকিয়াছে।
    মৃ। সে মাধবাচার্যের গুণ।
    ম। সখি, তুমি কতবার বলিয়াছ যে, মাধবাচার্যের সেই নিষ্ঠুর কাজের কথা সবিশেষ বলিবে। কিন্তু কই, আজও বলিলে না। কেন তুমি মাধবাচার্যের কথায় পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া আসিলে?
    মৃ। মাধবাচার্যের কথায় আসি নাই। মাধবাচার্যকে আমি চিনিতাম না। আমি ইচ্ছাপূর্বকও এখানে আসি নাই। একদিন সন্ধ্যার পর, আমার দাসী আমাকে এই আঙ্গটি দিল; এবং বলিল যে, যিনি এই আঙ্গটি দিয়াছেন, তিনি ফুলবাগানে অপেক্ষা করিতেছেন। আমি দেখিলাম যে, উহা হেমচন্দ্রের সঙ্কেতের আঙ্গটি। তাঁহার সাক্ষাতের অভিলাষ থাকিলে তিনি এই আঙ্গটি পাঠাইয়া দিতেন। আমাদিগের বাটীর পিছনেই বাগান ছিল। যমুনা হইতে শীতল বাতাস সেই বাগানে নাচিয়া বেড়াইত। তথায় তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইত।
    মণিমালিনী কহিলেন, “ঐ কথাটি মনে পড়িলেও আমার বড় অসুখ হয়। তুমি কুমারী হইয়া কি প্রকারে পুরুষের সহিত গোপনে প্রণয় করিতে?”
    মৃ। অসুখ কেন সখি- তিনি আমার স্বামী। তিনি ভিন্ন অন্য কেহ কখন আমার স্বামী হইবে না।
    ম। কিন্তু এ পর্যন্ত ত তিনি স্বামী হয়েন নাই। রাগ করিও না সখি! তোমাকে ভগিনীর ন্যায় ভালবাসি; এই জন্য বলিতেছি।
    মৃণালিনী অধোবদনে রহিলেন। ক্ষণেক পরে চক্ষুর জল মুছিলেন। কহিলেন, “মণিমালিনী! এ বিদেশে আমার আত্মীয় কেহ নাই। আমাকে ভাল কথা বলে, এমন কেহ নাই। যাহারা আমাকে ভালবাসিত, তাহাদিগের সহিত যে, আর কখনও সাক্ষাৎ হইবে, সে ভরসাও করি না। কেবলমাত্র তুমি আমার সখী- তুমি আমাকে ভাল না বাসিলে কে আর ভালবাসিবে?”
    ম। আমি তোমাকে ভালবাসিব, বাসিয়াও থাকি, কিন্তু যখন ঐ কথাটি মনে পড়ে, তখন মনে করি-
    মৃণালিনী পুনশ্চ নীরবে রোদন করিলেন। কহিলেন, “সখি, তোমার মুখে এ কথা আমার সহ্য হয় না। যদি তুমি আমার নিকটে শপথ কর যে, যাহা বলিব, তাহা এ সংসারে কাহারও নিকটে ব্যক্ত করিবে না, তবে তোমার নিকট সকল কথা প্রকাশ করিয়া বলিতে পারি। তাহা হইলে তুমি আমাকে ভালবাসিবে |”
    ম। আমি শপথ করিতেছি।
    মৃ। তোমার চুলে দেবতার ফুল আছে। তাহা ছুঁয়ে শপথ কর।
    মণিমালিনী তাই করিলেন।
    তখন মৃণালিনী মণিমালিনীর কানে যাহা কহিলেন, তাহার এক্ষণে বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। শ্রবণে মণিমালিনীর পরম প্রীতি প্রকাশ করিলেন। গোপন কথা সমাপ্ত হইল।
    মণিমালিনী কহিলেন, “তাহার পর, মাধবাচার্যের সঙ্গে তুমি কি প্রকারে আসিলে? সে বৃত্তান্ত বলিতেছিলে বল |”
    মৃণালিনী কহিলেন, “আমি হেমচন্দ্রের আঙ্গটি দেখিয়া তাঁকে দেখিবার ভরসায় বাগানে আসিলে দূতী কহিল যে, রাজপুত্র নৌকায় আছেন, নৌকা তীরে লাগিয়া রহিয়াছে। আমি অনেক দিন রাজপুত্রকে দেখি নাই। বড় ব্যগ্র হইয়াছিলাম, তাই বিবেচনাশূন্য হইলাম। তীরে আসিয়া দেখিলাম যে, যথার্থই একখানি নৌকা লাগিয়া রহিয়াছে। তাহার বাহিরে এক জন পুরুষ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, মনে করিলাম যে, রাজপুত্র দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমি নৌকার নিকট আসিলাম। নৌকার উপর যিনি দাঁড়াইয়া ছিলেন, তিনি আমার হাত ধরিয়া নৌকায় উঠাইলেন। অমনি নাবিকেরা নৌকা খুলিয়া দিল। কিন্তু আমি স্পর্শেই বুঝিলাম যে, এ ব্যক্তি হেমচন্দ্র নহে |”
    ম। আর অমনি তুমি চীৎকার করিলে?
    মৃ। চীৎকার করি নাই। একবার ইচ্ছা করিয়াছিল বটে, কিন্তু চীৎকার আসিল না।
    ম। আমি হইলে জলে ঝাঁপ দিতাম।
    মৃ। হেমচন্দ্রকে না দেখিয়া কেন মরিব?
    ম। তার পর কি হইল?
    মৃ। প্রথমেই সে ব্যক্তি আমাকে “মা” বলিয়া বলিল, “আমি তোমাকে মাতৃ-সম্বোধন করিতেছি-আমি তোমার পুত্র, কোন আশঙ্কা করিও না। আমার নাম মাধবাচার্য, আমি হেমচন্দ্রের গুরু। কেবল হেমচন্দ্রের গুরু এমত নহি; ভারতবর্ষের রাজগণের মধ্যে অনেকের সহিত আমার সেই সম্বন্ধ। আমি এখন কোন দৈবকার্যে নিযুক্ত আছি, তাহাতে হেমচন্দ্র আমার প্রধান সহায়; তুমি তাহার প্রধান বিঘ্ন |”
    আমি বলিলাম, “আমি বিঘ্ন?” মাধবাচার্য কহিলেন, “তুমিই বিঘ্ন। যবনদিগের জয় করা, হিন্দুরাজ্যের পুনরুদ্ধার করা, সুসাধ্য কর্ম নহে; হেমচন্দ্র ব্যতীত কাহারও সাধ্য নহে; হেমচন্দ্রও অনন্যমনা না হইলে তাঁর দ্বারাও এ কাজ সিদ্ধ হইবে না। যতদিন তোমার সাক্ষাৎলাভ সুলভ থাকিবে, ততদিন হেমচন্দ্রের তুমি ভিন্ন অন্য ব্রত নাই-সুতরাং যবন মারে কে?” আমি কহিলাম, “বুঝিলাম, প্রথমে আমাকে না মারিলে যবন মারা হইবে না। আপনার শিষ্য কি আপনার দ্বারা আঙ্গটি পাঠাইয়া দিয়া আমাকে মারিতে আজ্ঞা করিয়াছেন?”
    ম। এত কথা বুড়াকে বলিলে কি প্রকারে?
    মৃ। আমার বড় রাগ হইয়াছিল, বুড়ার কথায় আমার হাড় জ্বলিয়া গিয়াছিল, আর বিপৎকালে লজ্জা কি? মাধবাচার্য আমাকে মুখরা মনে করিলেন, মৃদু হাসিলেন, কহিলেন, “আমি যে তোমাকে এইরূপে হস্তগত করিব, তাহা হেমচন্দ্র জানেন না |”
    আমি মনে মনে কহিলাম, তবে যাঁহার জন্য এ জীবন রাখিয়াছি, তাঁহার অনুমতি ব্যতীত সে জীবন ত্যাগ করিব না। মাধবাচার্য বলিতে লাগিলেন, “তোমাকে প্রাণত্যাগ করিতে হইবে না-কেবল আপাতত: হেমচন্দ্রকে ত্যাগ করিতে হইবে। ইহাতে তাঁহার পরম মঙ্গল। যাহাতে তিনি রাজ্যেশ্বর হইয়া তোমাকে রাজমহিষী করিতে পারেন, তাহা কি তোমার কর্তব্য নহে?” আমি কহিলাম, “আমার সহিত সাক্ষাৎ যদি তাঁহার অনুচিত হয়, তবে তিনি কদাচ আমার সহিত আর সাক্ষাৎ করিবেন না |” মাধবাচার্য বলিলেন, “বালকে ভাবিয়া থাকে, বালক ও বুড়া উভয়ের বিবেচনাশক্তি তুল্য; কিন্তু তাহা নহে। হেমচন্দ্রের অপেক্ষা আমাদিগের পরিণামদর্শিতা যে বেশী, তাহাতে সন্দেহ করিও না। আর তুমি সম্মত হও বা না হও, যাহা সঙ্কল্প করিয়াছি, তাহা করিব। আমি তোমাকে দেশান্তরে লইয়া যাইব। গৌড় দেশে অতি শান্তস্বভাব এক ব্রাহ্মণের বাটীতে তোমাকে রাখিয়া আসিব। তিনি তোমাকে আনিয়া আপন কন্যার ন্যায় যত্ন করিবেন। এক বৎসর পরে আমি তোমার পিতার নিকট তোমাকে আনিয়া দিব। তিনি তোমাকে আনিয়া দিব। আর সে সময়ে হেমচন্দ্র এক বৎসর পরে আমি তোমার পিতার নিকট তোমাকে আনিয়া দিব। আর সে সময়ে হেমচন্দ্র যে অবস্থায় থাকুন, তোমার সঙ্গে তাঁহার বিবাহ দেওয়াইব, ইহা সত্য করিলাম |” এই কথাতেই হউক, আর অগত্যাই হউক, আমি নিস্তব্ধ হইলাম। তাহার পর এইখানে আসিয়াছি। ও কি ও সই?

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ : ভিখারিণী

    সখীদ্বয় এই সকল কথাবার্তা কহিতেছিলেন, এমন সময়ে কোমলকণ্ঠনি:সৃত মধুর সঙ্গীত তাঁহাদিগের কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করিল।
    “মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি,
    শ্যামবিলাসিনি-রে!”
    মৃণালিনী কহিলেন, “সই, কোথায় গান করিতেছে?”
    মণিমালিনী কহিলেন, “বাহির বাড়ীতে গায়িতেছে!”
    গায়ক গায়িতে লাগিল।
    “কহ লো নাগরি, গেহ পরিহরি,
    কাহে বিবাসিনী-রে |”
    মৃ। সখি! কে গায়িতেছে জান?
    ম। কোন ভিখারিণী হইবে।
    আবার গীত-
    “বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন,
    কাঁহে তু তেয়াগী-রে;
    দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর,
    ফিরে তুয়া লাগি-রে |”
    মৃণালিনী বেগের সহিত কহিলেন, “সই! সই! উহাকে বাটীর ভিতর ডাকিয়া আন |”
    মণিমালিনী গায়িকাকে ডাকিতে গেলেন। ততক্ষণ সে গায়িতে লাগিল-
    “বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে,
    বহুত পিয়াসা-রে।
    চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী,
    না মিটল আশা-রে।
    সা নিশা-সমরি___”
    এমন সময়ে মণিমালিনী উহাকে ডাকিয়া বাটীর ভিতর আনিলেন।
    সে অন্ত:পুরে আসিয়া পূর্ববৎ গায়িতে লাগিল-
    “সা নিশা সমরি, কহ লো সুন্দরি,
    কাহা মিলে দেখা-রে।
    শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী,
    বনে বনে একা-রে |”
    মৃণালিনী তাহাকে কহিলেন, “তোমার দিব্য গলা, তুমি গীতটি আবার গাও |”

    গায়িকার বয়স ষোল বৎসর। ষোড়শী, খর্বাকৃতা এবং কৃষ্ণাঙ্গী। সে প্রকৃত কৃষ্ণবর্ণা। তাই বলিয়া তাহার গায়ে ভ্রমর আসিলে যে দেখা যাইত না, অথবা কালি মাখিলে জল মাখিয়াছে বোধ হইত, কিংবা জল মাখিলে কালি বোধ হইত, এমন নহে। যেরূপ কৃষ্ণবর্ণ আপনার ঘরে থাকিলে শ্যামবর্ণ বলি, পরের ঘরে হইলে পাতুরে কালো বলি, ইহার সেইরূপ কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু বর্ণ যেমন হউক না কেন, ভিখারিণী কুরূপা নহে। তাহার অঙ্গ পরিষ্কার, সুমার্জিত, চাকচিক্যবিশিষ্ট; মুখখানি প্রফুল্ল, চক্ষু দুটি বড়, চঞ্চল, হাস্যময়; লোচনতারা নিবিড়কৃষ্ণ, একটি তারার পার্শ্বে একটি তিল। ওষ্ঠাধর ক্ষুদ্র, রক্তপ্রভ, তদন্তরে অতি পরিষ্কার অমলশ্বেত, কুন্দকলিকাসন্নিভ দুই শ্রেণী দন্ত। কেশগুলি সূক্ষ্ম, গ্রীবার উপরে মোহিনী কবরী, তাহাতে যূথিকার মালা বেষ্টিত। যৌবনসঞ্চারে শরীরের গঠন সুন্দর হইয়াছিল, যেন কৃষ্ণপ্রস্তরে কোন শিল্পকার পুত্তল খোদিত করিয়াছিল। পরিচ্ছদ অতি সামান্য, কিন্তু পরিষ্কার- ধূলিকর্দমপরিপূর্ণ নহে। অঙ্গ একেবারে নিরাভরণ নহে, অথচ অলঙ্কারগুলি ভিখারীর যোগ্য বটে। প্রকোষ্ঠে পিত্তলের বলয়, গলায় কাষ্ঠের মালা, নাসিকায় ক্ষুদ্র তিলক, ভ্রূমধ্যে ক্ষুদ্র একটি চন্দনের টিপ। সে আজ্ঞামত পূর্ববৎ গায়িতে লাগিল-
    “মথুরাবাসিনি, মধুরহাসিনি, শ্যামবিলাসিনি-রে।
    কহ লো নাগরি, গেহ পরিহরি, কাহে বিবাসিনী-রে ||
    বৃন্দাবনধন, গোপিনীমোহন, কাঁহে তু তেয়াগী-রে |
    দেশ দেশ পর, সো শ্যামসুন্দর, ফিরে তুয়া লাগি-রে ||
    বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে, বহুত পিয়াসা-রে |
    চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা-রে ||
    সা নিশা সমরি, কহ লো সুন্দরী, কাঁহা মিলে দেখা-রে |
    শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী, বনে বনে একা-রে ||”
    গীত সমাপ্ত হইলে মৃণালিনী কহিলেন, “তুমি সুন্দর গাও। সই মণিমালিনী, ইহাকে কিছু দিলে ভাল হয়। একে কিছু দাও না?”
    মণিমালিনী পুরস্কার আনিতে গেলেন, ইত্যবসরে মৃণালিনী বালিকাকে নিকটে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “শুন ভিখারিণি! তোমার নাম কি?”
    ভি। আমার নাম গিরিজায়া।
    মৃ। তোমার বাড়ী কোথায়?
    গি। এই নগরেই থাকি।
    মৃ। তুমি কি গীত গাইয়া দিনপাত কর?
    গি। আর কিছুই ত জানি না।
    মৃ। তুমি গীত সকল কোথায় পাও?
    গি। যেখানে যা পাই তাই শিখি।
    মৃ। এ গীতটি কোথায় শিখিলে?
    গি। একটি বেণে আমাকে শিখাইয়াছে।
    মৃ। সে বেণে কোথায় থাকে?
    গি। এই নগরেই আছে।
    মৃণালিনীর মুখ হর্ষোৎফুল্ল হইল- প্রাত:সূর্যকরস্পর্শে যেন পদ্ম ফুটিয়া উঠিল। কহিলেন, “বেণেতে বাণিজ্য করে- সে বণিক কিসের বাণিজ্য করে?”
    গি। সবার যে ব্যবসা, তারও সেই ব্যবসা।
    মৃ। সে কিসের ব্যবসা?
    গি। কথার ব্যবসা।
    মৃ। এ নূতন ব্যবসা বটে। তাহাতে লাভালাভ কিরূপ?
    গি। ইহাতে লাভের অংশ ভালবাসা, অলাভ কোন্দল।
    মৃ। তুমিও ব্যবসায়ী বটে। ইহার মহাজন কে?
    গি। যে মহাজন।
    মৃ। তুমি ইহার কি?
    গি। নগ্দাই মুটে।
    মৃ। ভাল তোমার বোঝা নামাও। সামগ্রী কি আছে দেখি।
    গি। এ সামগ্রী দেখে না; শুনে।
    মৃ। ভাল-শুনি।
    গিরিজায়া গায়িতে লাগিল-
    “যমুনার জলে মোর, কি নিধি মিলিল।
    ঝাঁপ দিয়া পশি জলে,       যতনে তুলিয়া গলে,
    পরেছিনু কুতূহলে, যে রতনে।
    নিদ্রার আবেশে মোর       গৃহেতে পলিশ চোর,
    কণ্ঠের কাটিল ডোর মণি হরে নিল |”
    মৃণালিনী, বাষ্পপীড়িতলোচনে, গদ্গদস্বরে, অথচ হাসিয়া কহিলেন, “এ কোন্ চোরের কথা?”
    গি। বেণে বলেছেন, চুরির ধন লইয়াই তাঁহার ব্যাপার।
    মৃ। তাঁহাকে বলিও যে, চোরা ব্যাপারে সাধু লোকের প্রাণ বাঁচে না।
    গি। বুঝি ব্যাপারিরও নয়।
    মৃ। কেন, ব্যাপারির কি?
    গিরিজায়া গায়িল-
    “ঘাট বাট তট মাঠ ফিরি ফিরনু বহু দেশ |
    কাঁহা মেরে কান্ত বরণ, কাঁহা রাজবেশ ||
    হিয়া পর রোপনু পঙ্কজ, কৈনু যতন ভারি |
    সোহি পঙ্কজ কাঁহা মোর, কাঁহা মৃণাল হামারি ||”
    মৃণালিনী সস্নেহে কোমল স্বরে কহিলেন, “মৃণাল কোথায়? আমি সন্ধান বলিয়া দিতে পারি, তাহা মনে রাখিতে পারিবে?”
    গি। পারিব- কোথায় বল।
    মৃণালিনী বলিলেন,
    “কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে |
    জলে তারে ডুবাইল পীড়িয়া মরমে ||
    রাজহংস দেখি এক নয়নরঞ্জন |
    চরণ বেড়িয়া তারে, করিল বন্ধন ||
    বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন |
    হৃদয়কমলে মোর, তোমার আসন ||
    আসিয়া বসিল হংস হৃদয়কমলে |
    কাঁপিল কণ্টক সহ মৃণালিনী জলে ||
    হেনকালে কাল মেঘ উঠিল আকাশে |
    উড়িল মরালরাজ, মানস বিলাসে ||
    ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম তার বেগভরে |
    ডুবিল অতল জলে, মৃণালিনী মরে ||
    কেমন গিরিজায়া, গীত শিখিতে পারিবে?
    গি। তা পারিব। চক্ষের জলটুকু শুদ্ধ কি শিখিব?
    মৃ। না। এ ব্যবসায়ে আমার লাভের মধ্যে ঐটুকু।
    মৃণালিনী গিরিজায়াকে এই কবিতাগুলি অভ্যাস করাইতেছিলেন, এমন সময়ে মণিমালিনীর পদধ্বনি শুনিতে পাইলেন। মণিমালিনী তাঁহার স্নেহশালিনী সখী- সকলই জানিয়াছিলেন। তথাপি মণিমালিনী পিতৃপ্রতিজ্ঞাভঙ্গের সহায়তা করিবে, এরূপ তাঁহার বিশ্বাস জন্মিল না। অতএব তিনি এ সকল কথা সখীর নিকট গোপনে যত্নবতী হইয়া গিরিজায়াকে কহিলেন, “আজি আর কাজ নাই; বেণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিও। তোমার বোঝা কাল আবার আনিও। যদি কিনিবার কোন সামগ্রী থাকে, তবে আমি কিনিব |”
    গিরিজায়া বিদায় হইল। মৃণালিনী যে তাহাকে পারিতোষিক দিবার অভিপ্রায় করিয়াছিলেন, তাহা ভুলিয়া গিয়াছিলেন। গিরিজায়া কতিপয় পদ গমন করিলে মণিমালিনী কিছু চাউল, একছড়া কলা, একখানি পুরাতন বস্ত্র, আর কিছু কড়ি আনিয়া গিরিজায়াকে দিলেন। আর মৃণালিনীও একখানি পুরাতন বস্ত্র দিতে গেলেন। দিবার সময়ে উহার কানে কানে কহিলেন, “আমার ধৈর্য হইতেছে না, কালি পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে পারিব না; তুমি আজ রাত্রে প্রহরেকের সময় আসিয়া এই গৃহের উত্তরদিকে প্রাচীনমূলে অবস্থিতি করিও; তথায় আমার সাক্ষাৎ পাইবে। তোমার বণিক যদি আসেন সঙ্গে আনিও |”
    গিরিজায়া কহিল, “বুঝিয়াছি, আমি নিশ্চিত আসিব |”
    মৃণালিনী মণিমালিনীর নিকট প্রত্যাগত্যা হইলে মণিমালিনী কহিলেন, “সই, ভিখারিণীকে কাণে কাণে কি বলিতেছিলে?”
    মৃণালিনী কহিলেন,
    “কি বলিব সই-
    সই মনের কথা সই, সই মনের কথা সই-
    কাণে কাণে কি কথাটি বলে দিলি ওই ||
    সই ফিরে ক’না সই, সই ফিরে ক’না সই |
    সই কথা কোস কথা কব, নইলে কারো নই |”
    মণিমালিনী হাসিয়া কহিলেন, “হলি কি লো সই?”
    মৃণালিনী কহিলেন, “তোমারই সই |”

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ : দূতী

    লক্ষ্মণাবতী নগরীর প্রদেশান্তরে সর্বধন বণিকের বাটীতে হেমচন্দ্র অবস্থিতি করিতেছিলেন। বণিকের গৃহদ্বারে এক অশোকবৃক্ষ বিরাজ করিতেছিল; অপরাহ্নে তাহার তলে উপবেশন করিয়া, একটি কুসুমিত অশোকশাখা নিষ্প্রয়োজনে হেমচন্দ্র ছুরিকা দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিতেছিলেন, এবং মুহুর্মুহু: পথপ্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন, যেন কাহারও প্রতীক্ষা করিতেছেন। যাহার প্রতীক্ষা করিতেছিলেন, সে আসিল না। ভৃত্য দিগ্বিজয় আসিল, হেমচন্দ্র দিগ্বিজয়কে কহিলেন, “দিগ্বিজয়, ভিখারিণী আজি এখনও আসিল না। আমি বড় ব্যস্ত হইয়াছি। তুমি একবার তাহার সন্ধানে যাও |”
    “যে আজ্ঞে” বলিয়া দিগ্বিজয় গিরিজায়ার সন্ধানে চলিল। নগরীর রাজপথে গিরিজায়ার সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল।
    গিরিজায়া বলিল, “কেও দিব্বিজয়?” দিগ্বিজয় রাগ করিয়া কহিল, “আমার নাম দিগ্বিজয় |”
    গি। ভাল দিগ্বিজয়- আজি কোন্ দিক জয় করিতে চলিয়াছ?
    দি। তোমার দিক।
    গি। আমি কি একটা দিক? তোমার দিগ্বিদিগ্জ্ঞা ন নাই।
    দি। কেমন করিয়া থাকিবে- তুমি যে অন্ধকার। এখন চল, প্রভু তোমাকে ডাকিয়াছেন।
    গি। কেন?
    দি। তোমার সঙ্গে বুঝি আমার বিবাহ দিবেন।
    গি। কেন তোমার কি মুখ-অগ্নি করিবার আর লোক জুটিল না।
    দি। না। সে কাজ তোমাকেই করিতে হইবে। এখন চল।
    গি। পরের জন্যেই মলেম। তবে চল।
    এই বলিয়া গিরিজায়া দিগ্বিজয়ের সঙ্গে চলিলেন। দিগ্বিজয় অশোকতলস্থ হেমচন্দ্রকে দেখাইয়া দিয়া অন্যত্র গমন করিল। হেমচন্দ্র অন্যমনে মৃদু মৃদু গাইতেছিলেন,
    “বিকচ নলিনে, যমুনা-পুলিনে, বহুত পিয়াসা রে___”
    গিরিজায়া পশ্চাৎ হইতে গায়িল-
    “চন্দ্রমাশালিনী, যা মধুযামিনী, না মিটল আশা রে |”
    গিরিজায়াকে দেখিয়া হেমচন্দ্রের মুখ প্রফুল্ল হইল। কহিলেন, “কে গিরিজায়া! আশা কি মিটল?”
    গি। কার আশা? আপনার না আমার?
    হে। আমার আশা। তাহা হইলেই তোমার মিটিবে।
    গি। আপনার আশা কি প্রকারে মিটিবে? লোকে বলে রাজা রাজ্ড়া র আশা কিছুতেই মিটে না।
    হে। আমার অতি সামান্য আশা।
    গি। যদি কখন মৃণালিনীর সাক্ষাৎ পাই, তবে এ কথা তাঁহার নিকট বলিব।
    হেমচন্দ্র বিষণ্ণ হইলেন। কহিলেন, “তবে কি আজিও মৃণালিনীর সন্ধান পাও নাই? আজি কোন্ পাড়ায় গীত গাইতে গিয়াছিলে?”
    গি। অনেক পাড়ায়-সে পরিচয় আপনার নিকট নিত্য নিত্য কি দিব? অন্য কথা বলুন।
    হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “বুঝিলাম বিধাতা বিমুখ। ভাল পুনর্বার কালি সন্ধানে যাইবে |”
    গিরিজায়া তখন প্রণাম করিয়া কপট বিদায়ের উদ্যোগ করিল। গমনকালে হেমচন্দ্র তাহাকে কহিলেন, “গিরিজায়া, তুমি হাসিতেছ না, কিন্তু তোমার চক্ষু হাসিতেছে। আজি কি তোমার গান শুনিয়া কেহ কিছু বলিয়াছে?”
    গি। কে কি বলিবে? এক মাগী তাড়া করিয়া মারিতে আসিয়াছিল- বলে মথুরাবাসিনীর জন্যে শ্যামসুন্দরের ত মাথাব্যথা পড়িয়াছে।
    হেমচন্দ্র দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া অস্ফুটস্বরে, যেন আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন “এত যত্নেও যদি সন্ধান না পাইলাম, তবে আর বৃথা আশা- কেন মিছা কালক্ষেপ করিয়া আত্মকর্ম নষ্ট করি; গিরিজায়ে, কালি তোমাদিগের নগর হইতে বিদায় হইব |”
    “তথাস্তু” বলিয়া গিরিজায়া মৃদু মৃদু গান করিতে লাগিল,-
    “শুনি যাওয়ে চলি, বাজয়ি মুরলী, বনে বনে একা রে |”
    হেমচন্দ্র কহিলেন, “ও গান এই পর্যন্ত। অন্য গীত গাও |”
    গিরিজায়া গায়িল,
    “যে ফুল ফুটিত সখি, গৃহতরুশাখে,
    কেন রে পবনা, উড়ালি তাকে |”
    হেমচন্দ্র কহিলেন, “পবনে যে ফুল উড়ে, তাহার জন্য দু:খ কি? ভাল গীত গাও |”
    গিরিজায়া গায়িল,
    “কণ্টকে গঠিল, বিধি, মৃণাল অধমে।
    জলে তারে ডুবাইল পীড়িয়া মরমে ||”
    হে। কি, কি? মৃণাল কি?
    গি।
    কণ্টকে গঠিল বিধি, মৃণাল অধমে।
    জলে তারে ডুবাইল, পীড়িয়া মরমে ||
    রাজহংস দেখি এক নয়নরঞ্জন।
    চরণ বেড়িয়া তারে করিল বন্ধন ||
    না- অন্য গান গাই।
    হে। না- না -না- এই গান- এই গান গাও। তুমি রাক্ষসী।
    গি।
    বলে হংসরাজ কোথা করিবে গমন।
    হৃদয়কমলে দিব তোমার আসন ||
    আসিয়া বসিল হংস হৃদয়কমলে।
    কাঁপিল কণ্টকসহ মৃণালিনী জলে ||
    হে। গিরিজায়া! গিরি- এ গীত তোমাকে কে শিখাইল?
    গি। (সহাস্যে)
    হেন কালে কালমেঘ উঠিল আকাশে।
    উড়িল মরালরাজ মানস বিলাসে।
    ভাঙ্গিল হৃদয়পদ্ম তার বেগভরে।
    ডুবিয়া অতল জলে মৃণালিনী মরে ||
    হেমচন্দ্র বাষ্পাকুললোচনে গদ্গদস্বরে গিরিজায়াকে কহিলেন, “এ আমারই মৃণালিনী। তুমি তাহাকে কোথায় দেখিলে?
    গি।
    দেখিলাম সরোবরে, কাঁপিছে পবনভরে,
    মৃণাল উপরে মৃণালিনী।
    হে। এখন রূপক রাখ, আমার কথার উত্তর দাও- কোথায় মৃণালিনী?
    গি। এই নগরে।
    হেমচন্দ্র রুষ্টভাবে কহিলেন, “তা ত আমি অনেক দিন জানি। এ নগরে কোন্ স্থানে?”
    গি। হৃষীকেশ শর্মার বাড়ী।
    হে। কি পাপ! সে কথা আমিই তোমাকে বলিয়া দিয়াছিলাম। এতদিন ত তাহার সন্ধান করিতে পার নাই, এখন কি সন্ধান করিয়াছ?
    গি। সন্ধান করিয়াছি।
    হেমচন্দ্র দুই বিন্দু- দুই বিন্দু মাত্র অশ্রুমোচন করিলেন। পুনরপি কহিলেন, “সে এখান হইতে কত দূর?
    গি। অনেক দূর।
    হে। এখান হইতে কোন্ দিকে যাইতে হয়?
    গি। এখান হইতে দক্ষিণ, তার পর পূর্ব, তার পর উত্তর, তার পর পশ্চিম-
    হেমচন্দ্র হস্ত মুষ্টিবদ্ধ করিলেন। কহিলেন, “এ সময়ে তামাসা রাখ-নহিলে মাথা ভাঙ্গিয়া ফেলিব |”
    গি। শান্ত হউন। পথ বলিয়া দিলে কি আপনি চিনিতে পারিবেন? যদি তা না পারিবেন, তবে জিজ্ঞাসার প্রয়োজন? আজ্ঞা করিলে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইব।
    মেঘমুক্ত সূর্যের ন্যায় হেমচন্দ্রের মুখ প্রফুল্ল হইল। তিনি কহিলেন, “তোমার সর্বকামনা সিদ্ধ হউক-মৃণালিনী কি বলিল?”
    গি। তা ত বলিয়াছি-
    “ডুবিয়া অতল জলে মৃণালিনী মরে |”
    হে। মৃণালিনী কেমন আছে?
    গি। দেখিলাম শরীরে কোন পীড়া নাই।
    হে। সুখে আছে কি ক্লেশে আছে- কি বুঝিলে?
    গি। শরীরে গহনা, পরণে ভাল কাপড়- হৃষীকেশ ব্রাহ্মণের কন্যা সই।
    হে। তুমি অধ:পাতে যাও; মনের কথা কিছু বুঝিলে?
    গি। বর্ষাকালের পদ্মের মত; মুখখানি কেবল জলে ভাসিতেছে।
    হে। পরগৃহে কি ভাবে আছে?
    গি। এই অশোক ফুলের স্তবকের মত। আপনার গৌরবে আপনি নম্র।
    হে। গিরিজায়া! তুমি বয়সে বালিকা মাত্র। তোমার ন্যায় বালিকা আর দেখি নাই।
    গি। মাথা ভাঙ্গিবার উপযুক্ত পাত্রও এমন আর দেখেন নাই।
    হে। সে অপরাধ লইও না, মৃণালিনী আর কি বলিল?
    গি। যো দিন জানকী-
    হে। আবার?
    গি। যো দিন জানকী, রঘুবীর নিরখি-
    হেমচন্দ্র গিরিজায়ার কেশাকর্ষণ করিলেন। তখন সে কহিল, “ছাড়! ছাড়! বলি! বলি!”
    “বল” বলিয়া হেমচন্দ্র কেশ ত্যাগ করিলেন।
    তখন গিরিজায়া আদ্যোপান্ত মৃণালিনীর সহিত কথোকথন বিবৃত করিল। পরে কহিল, “মহাশয়, আপনি যদি মৃণালিনীকে দেখিতে চান, তবে আমার সঙ্গে এক প্রহর রাত্রে যাত্রা করিবেন |”
    গিরিজায়ার কথা সমাপ্ত হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ নি:শব্দে অশোকতলে পাদচরণ করিতে লাগিলেন। বহুক্ষণ পরে কিছুমাত্র না বলিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। এবং তথা হইতে একখানি পত্র আনিয়া গিরিজায়ার হস্তে দিলেন, এবং কহিলেন, “মৃণালিনীর সহিত সাক্ষাতে আমার এক্ষণে অধিকার নাই। তুমি রাত্রে কথামত তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে এবং এই পত্র তাঁহাকে দিবে। কহিবে, দেবতা প্রসন্ন হইলে অবশ্য শীঘ্র বৎসরেক মধ্যে সাক্ষাৎ হইবে। মৃণালিনী কি বলেন, আজ রাত্রেই আমাকে বলিয়া যাইও |”
    গিরিজায়া বিদায় হইলে, হেমচন্দ্র অনেকক্ষণ চিন্তিতান্ত:করণে অশোকবৃক্ষতলে তৃণশয্যায় শয়ন করিয়া রহিলেন। ভুজোপরি মস্তক রক্ষা করিয়া, পৃথিবীর দিকে মুখ রাখিয়া, শয়ান রহিলেন। কিয়ৎকাল পরে, সহসা তাঁহার পৃষ্ঠদেশে কঠিন করস্পর্শ হইল। মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, সম্মুখে মাধবাচার্য।
    মাধবাচার্য কহিলেন, “বৎস! গাত্রোত্থান কর। আমি তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি- সন্তুষ্টও হইয়াছি। তুমি আমাকে দেখিয়া বিস্মিতের ন্যায় কেন চাহিয়া রহিয়াছ?”
    হেমচন্দ্র কহিলেন, “আপনি এখানে কোথা হইতে আসিলেন?”
    মাধবাচার্য এ কথায় কোন উত্তর না দিয়া কহিতে লাগিলেন, “তুমি এ পর্যন্ত নবদ্বীপে না গিয়া পথে বিলম্ব করিতেছ- ইহাতে তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট হইয়াছি। আর তুমি যে মৃণালিনীর সন্ধান পাইয়াও আত্মসত্য প্রতিপালনের জন্য তাঁহার সাক্ষাতের সুযোগ উপেক্ষা করিলে, এজন্য তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়াছি। তোমাকে কোন তিরস্কার করিব না। কিন্তু এখানে তোমার আর বিলম্ব করা হইবে না। মৃণালিনীর প্রত্যুত্তরের প্রতীক্ষা করা হইবে না। বেগবান হৃদয়কে বিশ্বাস নাই। আমি আজি নবদ্বীপে যাত্রা করিব। তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে -নৌকা প্রস্তুত আছে। অস্ত্রশস্ত্রাদি গৃহমধ্য হইতে লইয়া আইস। আমার সঙ্গে চল |”
    হেমচন্দ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “হানি নাই-আমি আশা ভরসা বিসর্জন করিয়াছি। চলুন। কিন্তু আপনি- কামচর না অন্তর্যামী?”
    এই বলিয়া হেমচন্দ্র গৃহমধ্যে পুন:প্রবেশ পূর্বক বণিকের নিকট বিদায় গ্রহণ করিলেন। এবং আপনার সম্পত্তি এক জন বাহকের স্কন্ধে দিয়া আচার্যের অনুবর্তী হইলেন।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ : লুব্ধ

    মৃণালিনী বা গিরিজায়া এতন্মধ্যে কেহই আত্মপ্রতিশ্রুতি বিস্মৃতা হইলেন না। উভয়ে প্রহরেক রাত্রিতে হৃষীকেশের গৃহপার্শ্বে সংমিলিত হইলেন। মৃণালিনী গিরিজাকে দেখিবামাত্র কহিলেন, “কই, হেমচন্দ্র কোথায়?”
    গিরিজায়া কহিল, “তিনি আইসেন নাই |”
    “আইসেন নাই!” এই কথাটি মৃণালিনীর অন্তস্তল হইতে ধ্বনিত হইল। ক্ষণেক উভয়ে নীরব। তৎপরে মৃণালিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন আসিলেন না?”
    গি। তাহা আমি জানি না। এই পত্র দিয়াছেন।
    এই বলিয়া গিরিজায়া তাঁহার হস্তে পত্র দিল। মৃণালিনী কহিলেন, “কি প্রকারেই বা পড়ি। গৃহে গিয়া প্রদীপ জ্বালিয়া পড়িলে মণিমালিনী উঠিবে |”
    গিরিজায়া কহিল, “অধীরা হইও না। আমি প্রদীপ, তেল, চক্ ‍মকি, সোলা সকলই আনিয়া রাখিয়াছি। এখনই আলো করিতেছি |”
    গিরিজায়া শীঘ্রহস্তে অগ্নি উৎপাদন করিয়া প্রদীপ জ্বালিত করিল। অগ্নুৎপাদনশব্দ একজন গৃহবাসীর কর্ণে প্রবেশ করিল। দীপালোক সে দেখিতে পাইল।
    গিরিজায়া দীপ জ্বালিত করিলে মৃণালিনী নিম্মলিখিত মত মনে মনে পাঠ করিলেন।
    “মৃণালিনী! কি বলিয়া আমি তোমাকে পত্র লিখিব? তুমি আমার জন্য দেশত্যাগিনী হইয়া পরগৃহে কষ্টে কালাতিপাত করিতেছ। যদি দৈবানুগ্রহে তোমার সন্ধান পাইয়াছি, তথাপি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম না। তুমি ইহাতে আমাকে অপ্রণয়ী মনে করিবে- অথবা অন্যা হইলে মনে করিত- তুমি করিবে না। আমি কোন বিশেষ ব্রতে নিযুক্ত আছি- যদি তৎপ্রতি অবহেলা করি, তবে আমি কুলাঙ্গার। তৎসাধন জন্য আমি গুরুর নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছি যে, তোমার সহিত এ স্থানে সাক্ষাৎ করিব না। আমি নিশ্চিত জানি যে, আমি যে তোমার জন্য সত্যভঙ্গ করিব, তোমারও এমন সাধ নহে। অতএব এক বৎসর কোন ক্রমে দিন যাপন কর। পরে ঈশ্বর প্রসন্ন হয়েন, তবে অচিরাৎ তোমাকে রাজপুরবধূ করিয়া আত্মসুখ সম্পূর্ণ করিব। এই অল্পবয়স্কা প্রগল্ভনবুদ্ধি বালিকাহস্তে উত্তর প্রেরণ করিও |”
    মৃণালিনী পত্র পড়িয়া গিরিজায়াকে কহিলেন, “গিরিজায়া! আমার পাতা লেখনী কিছুই নাই যে উত্তর লিখি। তুমি মুখে আমার প্রত্যুত্তর লইয়া যাও। তুমি বিশ্বাসী, পুরস্কার স্বরূপ আমার অঙ্গের অলঙ্কার দিতেছি |”
    গিরিজা কহিল, “উত্তর কাহার নিকট লইয়া যাইব? তিনি আমাকে পত্র দিয়া বিদায় করিবার সময় বলিয়া দিয়াছিলেন যে, ‘আজ রাত্রেই আমাকে প্রত্যুত্তর আনিয়া দিও |’ আমিও স্বীকার করিয়াছিলাম। আসিবার সময় মনে করিলাম, হয়ত তোমার নিকট লিখিবার সামগ্রী কিছুই নাই; এজন্য সে সকল যোটপাট করিয়া আনিবার জন্য তাহার উদ্দেশে গেলাম। তাঁহার সাক্ষাৎ পাইলাম না। শুনিলাম তিনি সন্ধ্যাকালে নবদ্বীপ যাত্রা করিয়াছেন |”
    মৃ। নবদ্বীপ?
    গি। নবদ্বীপ।
    মৃ। সন্ধ্যাকালেই?
    গি। সন্ধ্যাকালেই। শুনিলাম তাঁহার গুরু আসিয়া তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছেন।
    মৃ। মাধবাচার্য। মাধবাচার্যই আমার কাল।
    পরে অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া মৃণালিনী কহিলেন, “গিরিজায়া তুমি বিদায় হও। আর আমি ঘরের বাহিরে থাকিব না |”
    গিরিজায়া কহিল, “আমি চলিলাম |” এই বলিয়া গিরিজায়া বিদায় হইল। তাহার মৃদু মৃদু গীতধ্বনি শুনিতে শুনিতে মৃণালিনী গৃহমধ্যে পুন:প্রবেশ করিলেন।
    মৃণালিনী বাটীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া যেমন দ্বার রুদ্ধ করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, অমনি পশ্চাৎ হইতে কে আসিয়া তাঁহার হাত ধরিল। মৃণালিনী চমকিয়া উঠিলেন। হস্তরোধকারী কহিল, “তবে সাধ্বি! এইবার জালে পড়িয়াছ। অনুগৃহীত ব্যক্তিটা কে শুনিতে পাই না?”
    মৃণালিনী তখন ক্রোধে কম্পিতা হইয়া কহিলেন, “ব্যোমকেশ! ব্রাহ্মকুলে পাষণ্ড! হাত ছাড় |”
    ব্যোমকেশ হৃষীকেশের পুত্র। এ ব্যক্তি ঘোর মূর্খ এবং দুশ্চরিত্র। সে মৃণালিনীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হইয়াছিল, এবং স্বাভিলাষ পূরণের অন্য কোন সম্ভাবনা নাই জানিয়া বলপ্রকাশে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছিল। কিন্তু মৃণালিনী মণিমালিনীর সঙ্গ প্রায় ত্যাগ করিতেন না, এ জন্য ব্যোমকেশ এ পর্যন্ত অবসর প্রাপ্ত হয় নাই।
    মৃণালিনীর ভর্ৎসনায় ব্যোমকেশ কহিল, “কেন হাত ছাড়িব? হাতছাড়া কি করতে আছে? ছাড়াছাড়িতে কাজ কি ভাই? একটা মনের দু:খ বলি, আমি কি মনুষ্য নই? যদি একের মনোরঞ্জন করিয়াছ, তবে অপরের পার না?”
    মৃ। কুলাঙ্গার! যদি না ছাড়িবে, তবে এখনই ডাকিয়া গৃহস্থ সকলকে উঠাইব।
    ব্যো। উঠাও। আমি কহিব অভিসারিকাকে ধরিয়াছি।
    মৃ। তবে অধ:পাতে যাও। এই বলিয়া মৃণালিনী সবলে হস্তমোচন জন্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। ব্যোমকেশ কহিল, “অধীর হইও না। আমার মনোরথ পূর্ণ হইলেই আমি তোমায় ত্যাগ করিব। এখন তোমার সেই ভগিনী মণিমালিনী কোথায়?”
    মৃ। আমি তোমার ভগিনী।
    ব্যো। তুমি আমার সম্বন্ধীর ভগিনী- আমার ব্রাহ্মণীর ভেয়ের ভগিনী- আমার প্রাণাধিকা
    রাধিকা! সর্বার্থসাধিকা!
    এই বলিয়া ব্যোমকেশ মৃণালিনীকে হস্তদ্বারা আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিল। যখন মাধবাচার্য তাঁহাকে হরণ করিয়াছিল, তখন মৃণালিনী স্ত্রীস্বভাবসুলভ চীৎকারে রতি দেখান নাই, এখনও শব্দ করিলেন না।
    কিন্তু মৃণালিনী আর সহ্য করিতে পারিলেন না। মনে মনে লক্ষ ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিয়া সবলে ব্যোমকেশকে পদাঘাত করিলেন। ব্যোমকেশ লাথি খাইয়া বলিল, “ভাল ভাল, ধন্য হইলাম! ও চরণস্পর্শে মোক্ষপদ পাইব। সুন্দরি! তুমি আমার দ্রৌপদী- আমি তোমার জয়দ্রথ |”
    পশ্চাৎ হইতে কে বলিল, “আর আমি তোমার অর্জুন |”
    অকস্মাৎ ব্যোমকেশ কাতরস্বরে বিকট চীৎকার করিয়া উঠিল, “রাক্ষসি! তোর দন্তে কি বিষ আছে?” এই বলিয়া ব্যোমকেশ মৃণালিনীর হস্ত ত্যাগ করিয়া আপন পৃষ্ঠে হস্তমার্জন করিতে লাগিল। স্পর্শানুভবে জানিল যে পৃষ্ঠ দিয়া দরদরিত রুধির পড়িতেছে।
    মৃণালিনী মুক্তাহস্তা হইয়াও পলাইলেন না। তিনিও প্রথমে ব্যোমকেশের ন্যায় বিস্মিতা হইয়াছিলেন, কেন না তিনি ত ব্যোমকেশকে দংশন করেন নাই। ভল্লুকোচিত কার্য তাঁহার করণীয় নহে। কিন্তু তখনই নক্ষত্রালোকে খর্বাকৃতা বালিকামূর্তি সম্মুখ হইতে অপসৃতা হইতেছে দেখিতে পাইলেন। গিরিজায়া তাঁহার বসনাকর্ষণ করিয়া মৃদুস্বরে, “পলাইয়া আইস” বলিয়া স্বয়ং পলায়ন করিল।
    পলায়ন মৃণালিনীর স্বভাবসঙ্গত নহে। তিনি পলায়ন করিলেন না। ব্যোমকেশ প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আর্তনাদ করিতেছে এবং কাতরোক্তি করিতেছে দেখিয়া, তিনি গজেন্দ্রমনে নিজ শয়নাগার অভিমুখে চলিলেন। কিন্তু তৎকালে ব্যোমকেশের আর্তনাদে গৃহস্থ সকলেই জাগরিত হইয়াছিল। সম্মুখে হৃষীকেশ পুত্রকে শশব্যস্ত দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে? কেন ষাঁড়ের মত চীৎকার করিতেছ?”
    ব্যোমকেশ কহিল, “মৃণালিনী অভিসারে গমন করিয়াছিল, আমি তাহাকে ধৃত করিয়াছি বলিয়া সে আমার পৃষ্ঠে দংশন করিয়াছে |”
    হৃষীকেশ পুত্রের কুরীতি কিছুই জানিতেন না। মৃণালিনীকে প্রাঙ্গণ হইতে উঠিতে দেখিয়া এ কথায় তাঁহার বিশ্বাস হইল। তৎকালে তিনি মৃণালিনীকে কিছুই বলিলেন না। নি:শব্দে গজগামিনীর পশ্চাৎ তাঁহার শয়নাগারে আসিলেন।

    ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : হৃষীকেশ
    মৃণালিনীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার শয়নাগারে আসিয়া হৃষীকেশ কহিলেন, “মৃণালিনী! তোমার এ কি চরিত্র?”
    মৃ। আমার কি চরিত্র?
    হৃ। তুমি কার মেয়ে, কি চরিত্র কিছুই জানি না, গুরুর অনুরোধে আমি তোমাকে গৃহে স্থান দিয়াছি। তুমি আমার মেয়ে মণিমালিনীর সঙ্গে এক বিছানায় শোও- তোমার কুলটাবৃত্তি কেন?
    মৃ। আমার কুলটাবৃত্তি যে বলে সে মিথ্যাবাদী।
    হৃষীকেশের ক্রোধে অধর কম্পিত হইল। কহিলেন, “কি পাপীয়সি! আমার অন্নে উদর পূরাবি, আর আমাকে দুর্বাক্য বলিবি? তুই আমার গৃহ হইতে দূর হ। না হয় মাধবাচার্য রাগ করিবেন, তা বলিয়া এমন কালসাপ ঘরে রাখিতে পারিব না |”
    মৃ। যে আজ্ঞা- কালি প্রাতে আর আমাকে দেখিতে পাইবেন না।
    হৃষীকেশের বোধ ছিল যে, যে কালে তাঁহার গৃহবহিষ্কৃত হইলেই মৃণালিনী আশ্রয়হীনা হয়, সেকালে এমন উত্তর তাহার পক্ষে সম্ভব নহে। কিন্তু মৃণালিনী নিরাশ্রয়ের আশঙ্কায় কিছুমাত্র ভীতা নহেন দেখিয়া মনে করিলেন যে, তিনি জারগৃহে স্থান পাইবার ভরসাতেই এরূপ উত্তর করিলেন। ইহাতে হৃষীকেশের কোপ আরও বৃদ্ধি হইল। তিনি অধিকতর বেগে কহিলেন, “কালি প্রাতে! আজই দূর হও |”
    মৃ। যে আজ্ঞা। আমি সখী মণিমালিনীর নিকট বিদায় হইয়া আজিই দূর হইতেছি। এই বলিয়া মৃণালিনী গাত্রোত্থান করিলেন।
    হৃষীকেশ কহিলেন, “মণিমালিনীর সহিত কুলটার আলাপ কি?”
    এবার মৃণালিনীর চক্ষে জল আসিল। কহিলেন, “তাহাই হইবে। আমি কিছুই লইয়া আসিয়া নাই; কিছুই লইয়া যাইব না। একবসনে চলিলাম। আপনাকে প্রণাম হই |”
    এই বলিয়া দ্বিতীয় বাক্যব্যয় ব্যতীত মৃণালিনী শয়নাগার হইতে বহিষ্কৃতা হইয়া চলিলেন।
    যেমন অন্যান্য গৃহবাসীরা ব্যোমকেশের আর্তনাদে শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিয়াছিলেন, মণিমালিনীও তদ্রূপ উঠিয়াছিলেন। মৃণালিনীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার পিতা শয্যাগৃহ পর্যন্ত আসিলেন দেখিয়া তিনি এই অবসরে ভ্রাতার সহিত কথোকথন করিতেছিলেন; এবং ভ্রাতার দুশ্চরিত্র বুঝিতে পারিয়া ভর্ৎসনা করিতেছিলেন। যখন তিনি ভর্ৎসনা সমাপন করিয়া প্রত্যাগমন করেন, তখন প্রাঙ্গণভূমে, দ্রুতপাদবিক্ষেপিণী মৃণালিনীর সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “সই, অমন করিয়া এত রাত্রে কোথায় যাইতেছ?”
    মৃণালিনী কহিলেন, “সখি, মণিমালিনী, তুমি চিরায়ুষ্মতী হও। আমার সহিত আলাপ করিও না-তোমার বাপ মানা করেছেন |”
    ম। সে কি মৃণালিনী! তুমি কাঁদিতেছ কেন? সর্বনাশ! বাবা কি বলিতে না জানি কি বলিয়াছেন! সখি, ফের। রাগ করিও না।
    মণিমালিনী মৃণালিনীকে ফিরাইতে পারিলেন না। পর্বতসানুবাহী শিলাখণ্ডের ন্যায় অভিমানিনী সাধ্বী চলিয়া গেলেন। তখন অতি ব্যস্তে মণিমালিনী পিতৃসন্নিধানে আসিলেন। মৃণালিনীও গৃহের বাহিরে আসিলেন।
    বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, পূর্বসঙ্কেত স্থানে গিরিজায়া দাঁড়াইয়া আছে। মৃণালিনী তাহাকে দেখিয়া কহিলেন, “তুমি এখনও দাঁড়াইয়া আছ?”
    গি। আমি যে তোমাকে পলাইতে বলিয়া আসিলাম। তুমি আইস না আইস-দেখিয়া যাইবার জন্য দাঁড়াইয়া আছি।
    মৃ। তুমি কি ব্রাহ্মণকে দংশন করিয়াছিলে?
    গি। তা ক্ষতি কি? বামুন বৈ ত গরু নয়?
    মৃ। কিন্তু তুমি যে গান করিতে করিতে চলিয়া গেলে শুনিলাম?
    গি। তার পর তোমাদের কথাবার্তার শব্দ শুনিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলাম। দেখে মনে হলো, মিন্‌সে আমাকে একদিন “কালা পিঁপ্ ‍ড়ে” বলে ঠাট্টা করেছিল। সে দিন হুল ফুটানটা বাকি ছিল। সুযোগ পেয়ে বামুনের, ঋণ শোধ দিলাম। এখন তুমি কোথা যাইবে?
    মৃ। তোমার ঘরদ্বার আছে?
    গি। আছে। পাতার কুঁড়ে।
    মৃ। সেখানে আর কে থাকে?
    গি। এক বুড়ী মাত্র। তাহাকে আয়ি বলি।
    মৃ। চল তোমার ঘরে যাব।
    গি। চল। তাই ভাবিতেছিলাম।
    এই বলিয়া দুই জনে চলিল। যাইতে যাইতে গিরিজায়া কহিল, “কিন্তু সে ত কুঁড়ে। সেখানে কয় দিন থাকিবে?”
    মৃ। কালি প্রাতে অন্যত্র যাইব।
    গি। কোথা? মথুরায়?
    মৃ। মথুরায় আমার আর স্থান নাই।
    গি। তবে কোথায়?
    মৃ। যমালয়।
    এই কথার পর দুইজনে ক্ষণেক কাল চুপ করিয়া রহিল। তারপর মৃণালিনী বলিল, “এ কথা কি তোমার বিশ্বাস হয়?”
    গি। বিশ্বাস হইবে না কেন? কিন্তু সে স্থান ত আছেই, যখন ইচ্ছা তখনই যাইতে পারিবে। এখন কেন আর এক স্থানে যাও না?
    মৃ। কোথা?
    গি। নবদ্বীপ।
    মৃ। গিরিজায়া, তুমি ভিখারিণী বেশে কোন মায়াবিনী। তোমার নিকট কোন কথা গোপন করিব না। বিশেষ তুমি হিতৈষী। নবদ্বীপেই যাইব স্থির করিয়াছি।
    গি। একা যাইবে?
    মৃ। সঙ্গী কোথায় পাইব?
    গি। (গায়িতে গায়িতে)
    “মেঘ দরশনে হায়, চাতকিনী ধায় রে।
    সঙ্গে যাবি কে কে তোরা আয় আয় আয় রে ||
    মেঘেতে বিজলি হাসি, আমি বড় ভালবাসি,
    যে যাবি সে যাবি তোরা, গিরিজায়া যায় রে ||”
    মৃ। এ কি রহস্য, গিরিজায়া?
    গি। আমি যাব।
    মৃ। সত্য সত্যই?
    গি। সত্য সত্যই যাব।
    মৃ। কেন যাবে?
    গি। আমার সর্বত্র সমান। রাজধানীতে ভিক্ষা বিস্তর।

    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকপালকুণ্ডলা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article বিষবৃক্ষ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    যুগলাঙ্গুরীয় – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (চলিত ভাষায়)

    May 7, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }