মৃত্তিকার মৃত্যু – ১
একটা জলভরা মেঘ খুব ধীরে ধীরে আকাশ পেরোচ্ছিল। এক ঝলক দেখলে মনে হবে সে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবেই তার যাত্রা টের পাওয়া যায়। তার গতি পুব থেকে পশ্চিমে। পুবে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, পশ্চিমে বিবাদী বাগ। মাঝে বিপিনবিহারী গাংগুলি স্ট্রিট, অর্থাৎ বউবাজার। জনাকীর্ণ, কর্মচঞ্চল, কোলাহলময়। বউবাজারের ওপর দিয়ে মেঘটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এত লোক রাস্তায় অথচ মেঘটাকে কেউ খেয়াল করছে না। করতেই পারত। হলুদ রোদ্দুরের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে রাস্তা জুড়ে লম্বা ছায়া ফেলছে মেঘটা। সারা বিকেল আদিত্য মেঘটার ওপর নজর রাখছে।
এখন চৈত্র মাস। ভরা গ্রীষ্ম। দুপুরে শহরটা ঝলসে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে খানিকটা ঠাণ্ডা হয়েছে। শুধু মেঘটার জন্যে নয়। কয়েক বার গঙ্গার দিক থেকে দমকা হাওয়া এসেছিল। হয়ত সন্ধের মুখে দু’এক পশলা বৃষ্টি নামবে। কালবৈশাখী।
আদিত্যর হাতে কাজ নেই। তিন-চার মাস ধরেই নেই। তবু অভ্যাসবশত আপিসে এসে সন্ধে অব্দি বসে থাকে। বই পড়ে। ইন্টারনেটে দেশ-বিদেশের খবর কাগজ। ইউ টিউবে গান। আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে পারলে ভাল হতো। সঙ্গে ছাতা নেই। বৃষ্টি নেমে গেলে ভিজতে হবে। কিন্তু দুপুরবেলা আদিত্যর বন্ধু গৌতম ফোন করেছিল। বলল, একজনকে পাঠাচ্ছি, একটু সাহায্য করিস। আর বিশেষ কিছু বলল না। কাকে পাঠাচ্ছে, কেন পাঠাচ্ছে, যাকে পাঠাচ্ছে সে কখন আসবে, কিছু না। শুধু বলল, মিটিং আছে, পরে কথা হবে। গৌতম এখন লালবাজারের ব্যস্ততম পুলিশ-কর্তাদের একজন। মন্ত্রীদের নেকনজরে।
সেই থেকে আদিত্য ঠায় বসে আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। দু’বার কফি খাওয়া হল। তিনবার সিগারেট। সিগারেটটা কিছুতেই ছাড়া যাচ্ছে না। তবে বাড়িতে সিগারেট খাওয়া বন্ধ। কেয়া ভীষণ রাগারাগি করে। সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই আদিত্য আপিসেই রেখে যায়। বাড়ি ফেরার সময়, ইস্কুলে পড়া বালক ধূমপায়ীদের মতো, চুয়িংগাম চিবিয়ে বাড়িতে ঢোকে।
কালো মেঘ পশ্চিম আকাশটা দখল করে নিয়েছে। ঠাণ্ডা হাওয়ার যাতায়াত বাড়ছে।
আদিত্য আবার কফির জল বসাবে কিনা ভাবছিল, দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। মাস চারেক হল ওটা লাগানো হয়েছে। কেয়া বলে, কলিং বেলটা অপয়া । আপিসের দরজায় ওটা লাগানোর পর থেকে একটা মক্কেলও আসেনি। আজ হয়ত কলিং বেলের সেই দুর্নাম ঘুচবে। আদিত্য দরজা খুলে দেখল, মক্কেল-টক্কেল নয়, বাড়িওলার কর্মচারী বাড়ি ভাড়া নিতে এসেছে। গতকাল আসার কথা ছিল, তাই চেকটা লেখাই রয়েছে। সেটা এনে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় আদিত্য খেয়াল করল কর্মচারীটির পেছনে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বেশ লম্বা, ছিপছিপে, করিডরের আধো-অন্ধকারে মুখটা ভাল করে বোঝা যায় না। তবে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে লোকটা আদিত্যর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
‘কিছু বলবেন?’ কর্মচারী চেক নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর পর আদিত্য লোকটাকে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। বলছি।’ এইটুকু বলেই লোকটা চুপ করে গেল ।
আদিত্য লোকটাকে ভাল করে দেখছে। করিডোরের অন্ধকারটা খানিক চোখ-সওয়া হয়ে এসেছে তার। লোকটাকে দেখে ঠিক স্বাভাবিক মনে হয় না। গালে তিন-চারদিনের না-কামানো দাড়ি, মাথার চুল অবিন্যস্ত, চোখের তারা দুটো ঘন ঘন দিক-বদল করছে। পাগলদের যেমন হয়। অথচ পরনের জামা-প্যান্ট বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, এমন কি দামীও বলা যায়। লোকটা পাগল হলেও ঠিক রাস্তার পাগল নয়।
‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’ আদিত্য আবার জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুঁজছি। আদিত্য মজুমদারকে খুঁজছি।’ লোকটা তাড়াতাড়ি বলে উঠল। যেন তার উপস্থিতির কৈফিয়ত দিচ্ছে। তারপর আদিত্যর দরজায় সাঁটা নেমপ্লেটটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘এটাই তো আদিত্য মজুমদারের অফিস?’
‘আমিই আদিত্য মজুমদার। এটাই আমার অফিস। আপনি ঠিক জায়গায় এসেছেন। ভেতরে আসুন।’ আদিত্য দরজাটা আর একটু খুলে একপাশ হয়ে দাঁড়াল, যাতে লোকটা ঢুকতে পারে।
একটু পরে, যখন লোকটা পিঠ টানটান করে আদিত্যর উল্টোদিকের চেয়ারে এগিয়ে বসেছে, তার পিঠ এবং চেয়ার ঠেসানের মধ্যে অন্তত তিন ইঞ্চির দূরত্ব, একটা বিদ্যুতের সুতো পশ্চিম আকাশটাকে আদ্যোপান্ত চিরে দিয়ে মিলিয়ে গেল। আর তার দু’তিন সেকেন্ড পরে কান ফাটানো মেঘের গর্জন। আকাশের দেবতা বিলক্ষণ চটেছেন। আদিত্য তার চেয়ারে না বসে তাড়াতাড়ি গিয়ে জানলার দুটো পাল্লা বন্ধ করে দিল। মনে হয় এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।
‘বলুন, কী ব্যাপার। আমাকে কেন খুঁজছেন?’ আদিত্য নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল।
‘আমাকে অ্যাডিশানাল কমিশানার গৌতম দাশগুপ্ত সাহেব পাঠিয়েছেন। বললেন, আপনার সঙ্গে দেখা করে আমার সমস্যাটা বলতে। বললেন, আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন ।
আদিত্য উত্তর না দিয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। আরও তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘এক গ্লাশ জল হবে? গলাটা শুকিয়ে গেছে।’ লোকটা কুণ্ঠিত গলায় বলল। আদিত্য বুঝতে পারছে না জল চাওয়া নিয়ে এত কুণ্ঠা কেন। জল এনে দিয়ে সে লোকটাকে বলল, ‘আপনি আপনার সমস্যাটা ভাল করে বলুন। না হলে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারব না।’
‘আমি ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। সব এলোমেলো হয়ে যায়। আচ্ছা ইন্টারনেটে আপনার যে ফোন নম্বরটা দেওয়া আছে সেটা বোধহয় বদলে গেছে। তাই আসার আগে ফোন করতে পারিনি।’ লোকটা আবার চুপ করে গেল। তাকে অসহায় দেখাচ্ছে।
আদিত্য অবশ্যই মোবাইল নম্বরটা বদলেছে। তার মনে পড়ে গেল ইন্টারনেটের কোনও কোনও সাইটে এখনও তার পুরোনো নম্বরটা রয়ে গেছে। সে লজ্জিতভাবে বলল, ‘হ্যাঁ নম্বরটা বদলেছে। কিন্তু কোথাও কোথাও পুরোনো নম্বরটাই রয়ে গেছে। ভেরি সরি।’
লোকটা আর কোনও কথা বলছে না। ঘরে স্তব্ধতা।
‘কফি খাবেন?’ ঘরের আবহাওয়াটা সহজ করার উদ্দেশ্যে আদিত্য বলল। ‘কফি? হ্যাঁ, তা…’ লোকটা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়েছে।
আদিত্য উঠে গিয়ে কফির জল বসাতে বসাতে লোকটাকে দেখছিল। ফরসা রঙ পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ নাক, ভাসা ভাসা চোখ। আদিত্য আন্দাজ করল লোকটার বয়েস বছর চল্লিশ হবে। মনে হয়, এক সময় রীতিমত সুপুরুষ ছিল।
বাইরে কুপকুপে অন্ধকার। চারদিক তোলপাড় করে বৃষ্টি নেমেছে। জানলায় বউবাজার স্ট্রিটের ঝাপসা অবয়ব। আদিত্য তন্ময় হয়ে বৃষ্টি দেখছিল। বৃষ্টি দেখতে দেখতে কিছুক্ষণ ভুলেই গিয়েছিল লোকটা ঘরে রয়েছে। দু’কাপ কফি বানিয়ে ফের নিজের চেয়ারে ফিরে এসে আদিত্য বলল, “আমি বরং আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি উত্তরগুলো থেকে আপনার সমস্যাটা বুঝে নেব।’
লোকটা কিছু বলল না । প্রশ্ন শোনার জন্যে সরাসরি আদিত্যর মুখের দিকে তাকাল ।
‘আপনার নাম কি?’ আদিত্য পেন-নোটবই খুলে জিজ্ঞেস করল।
‘আমার নাম অশনি রায়।’
‘কোথায় থাকেন ?’
‘সাদার্ন অ্যাভিনিউ। সাদার্ন অ্যাভিনিউ আর ল্যান্সডাউন রোডের মোড়ের কাছে। মানে ওই শরৎ বোস রোড, মানে ল্যান্সডাউন রোডটা যেখানে সাদার্ন অ্যাভিনিউতে গিয়ে পড়েছে তার খুব কাছে।’
‘কী করেন?’
প্রশ্নটা শুনে লোকটা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘আগে একটা চাকরি করতাম। এখন কিছু করি না।’
‘কী চাকরি করতেন ?
‘একটা বিদেশি ব্যাঙ্কে চাকরি করতাম।’
‘কলকাতায়?’
‘হ্যাঁ, এই কলকাতাতেই। সল্ট লেকে আমার অফিস ছিল।’
‘চাকরি ছেড়ে দিলেন কেন?’
‘চাকরি করা সম্ভব ছিল না।’
‘কেন সম্ভব ছিল না? দেখুন, সব কথা আমাকে খুলে না বললে আমি আপনাকে কী করে সাহায্য করব?’ শেষের কথাগুলো আদিত্য যথাসম্ভব নরম গলায় বলল। লোকটা আবার অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল, ‘সম্ভব ছিল না কারণ গত তিন বছর আমি জেলে ছিলাম।’
আদিত্য এই উত্তরটার জন্যে মোটেই তৈরি ছিল না। সে খানিকটা থতমত খেয়ে গেছে। খেই হারিয়ে সে কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টির বেগ একই রকম আছে। ঝড়জলের মধ্যে ঘন্টি বাজাতে বাজাতে একটা ট্র্যাম চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর দিকে চলে গেল। দমকা হাওয়ায় জানলার একটা পাল্লা হঠাৎ খুলে গেছে। তবে বৃষ্টির ছাঁট অন্য দিকে বলে ঘরে জল ঢুকছে না। শুধু হাওয়ারা দৌড়ে দৌড়ে এসে টেবিলের কাগজপত্র তছনছ করে দিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য একটা বইএর নিচে আলগা কাগজগুলো চাপা দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। ঠাণ্ডা হাওয়াটা তার ভাল লাগছে। সে জানলাটা বন্ধ করতে চাইছে না।
‘আপনি কেন জেলে ছিলেন? ব্যাঙ্কের টাকাপয়সায় গন্ডগোল হয়েছিল?’ আদিত্য সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল।
‘না, না। ব্যাঙ্কের কোনও ব্যাপার নয়। একটা খুনের দায়ে আমাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। একটা নয়, দুটো খুন হয়েছিল। তার মধ্যে একটা খুন নাকি আমি করেছিলাম। এর সঙ্গে আমার চাকরির কোনও সম্পর্ক ছিল না। আসলে আমি খুন করিনি। আই ক্যান সোয়্যার টু গড় আমি খুন করিনি। অথচ লোয়ার কোর্ট আমাকে দোষী সাব্যস্ত করল। তারপর হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে কেস ওঠার পর আমি বেকসুর খালাস হয়ে গেলাম। তবে শুনতে পাচ্ছি, পুলিশ নাকি খুব শিগগির ডিভিশন বেঞ্চে অ্যাপিল করবে। ইতিমধ্যে কিন্তু আমার তিন বছর জেল খাটা হয়ে গেছে।’ অশনি রায়কে খুব অসহায় দেখাল ৷
আদিত্য রীতিমত বিভ্রান্ত। ‘আপনি খুন করেননি অথচ খুনের দায় আপনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল?’
‘আমি একটি মেয়েকে চিনতাম। তার নাম রূপলেখা। রূপলেখা দত্ত। সে খুন হয়নি। আর একজন খুন হয়েছিল। তার নাম মৃত্তিকা মিত্র। তার সঙ্গে তার স্বামী পার্থ মিত্রও খুন হয়েছিল। স্বামীকে আমি চিনতাম না। এই মৃত্তিকা মিত্রকে খুব সামান্য চিনতাম। ব্যাঙ্কের কাজের সূত্রে দু’একবার কথা হয়েছিল। আমাকে মৃত্তিকা মিত্রর স্বামীর খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল। বলা হল রূপলেখা দত্তর আসল নাম মৃত্তিকা মিত্র।’ অশনি রায়কে এখনও খুব বিপন্ন দেখাচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, লোকটা কী বলতে চাইছে আদিত্য এক বর্ণও বুঝতে পারেনি। শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছে সুসংহত কোনও বর্ণনা দেওয়া অশনি রায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। টুকরো টুকরো করে ব্যাপারটা জানতে হবে। সে বলল, ‘রূপলেখা দত্ত বলে যাকে আপনি চিনতেন তার সঙ্গে আপনার কোথায় আলাপ হয়েছিল?’
‘কোথায়? কেন ব্যাঙ্কে? আমি তখন ক্রেডিট-এর চার্জে ছিলাম। রূপলেখা একটা লোন নিতে চাইছিল। পঞ্চাশ লাখ টাকার ক্যাশ ক্রেডিট। রূপলেখার একটা বিউটি পার্লার ছিল। সেটাকে এক্সটেন্ড করতে চাইছিল। তার জন্যে লোন। ওটার ব্যাপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।’
‘ক্যাশ ক্রেডিট মানে?
‘মানে, পঞ্চাশ লাখের লিমিট। কোনও সময় তার থেকে বেশি ধার নিতে পারবে না। মাঝে মাঝে ধার কিছুটা শোধ করে দিলে পরে আবার সেই অ্যামাউন্টটা ধার নিতে পারবে। কিন্তু টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং লোন কখনই পঞ্চাশ লাখ ক্রস করবে না।’
আদিত্য টের পেল চিন্তা এলোমেলো হয়ে গেলেও অশনি রায় তার পুরোনো পেশার খুঁটিনাটিগুলো ভোলেনি। সে খেই ধরিয়ে দেবার জন্য বলল, ‘তার মানে ওই ক্যাশ ক্রেডিটের ব্যাপারে রূপলেখা দত্ত আপনার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসত।’
“ঠিক তা নয়। লোনটার ব্যাপারে রূপলেখা আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। ওটা নিয়ে ওর সঙ্গে একবার দু’বার কথা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত লোনটা কিন্তু রূপলেখা নেয়নি। আমাকে পরে বলেছিল যে স্পেসটায় ও বিউটি পার্লারটা এক্সটেন্ড করার কথা ভাবছিল, সেই স্পেসটাই পাওয়া যায়নি। জায়গাটার মালিক ওই জায়গাটা কোনও কারণে ভাড়া দিতে চায়নি। তাই রূপলেখাও আর শেষ পর্যন্ত লোনের অ্যাপ্লিকেশনটা করেনি।’
“তার মানে রূপলেখা দত্ত আর আপনাদের ব্যাঙ্কে আসতেন না?’
‘না। লোনই যখন নেবে না, ব্যাঙ্কে আসবে কেন?’
‘তাহলে আপনাদের ঘনিষ্ঠতা হল কী করে? আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে,
রূপলেখা দত্তর সঙ্গে আপনার একটা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।’
‘তা তো অবশ্যই হয়েছিল।’
‘কী করে?’
‘প্রথম দেখা হবার কিছুদিন পরে একদিন খুব বৃষ্টি পড়ছে, রাত্তির প্রায় ন’টা বেজে গেছে, আমি ব্যাঙ্ক থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি, বাড়ি ফিরবো, দেখি রূপলেখা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে। সল্ট লেকে এমনিতেই রাত্তিরের দিকে বাস-ট্যাক্সি কিছু পাওয়া যায় না, তার ওপর বৃষ্টি, আমি রূপলেখাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোথায় যাবে। আমি তাকে রাইড দিতে পারি কিনা।’
অশনি রায়কে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন একটা পুরোনো স্বপ্নের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে।
‘তারপর?’
‘রূপলেখা বলল, তার পার্লারটা আমাদের ব্যাঙ্কের খুব কাছে। এখান থেকে বাড়ি ফিরতে তারও সাড়ে আটটা ন’টা বেজে যায়। কিন্তু তার গাড়িটা ক’দিন হল গ্যারেজে গেছে। তার ওপর এই বৃষ্টি। বলল, একটু এগিয়ে সিটি সেন্টারের দিকে পৌঁছে দিলে সে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাবে। তাকে কোথায় যেতে হবে বলল না।’
‘আপনি রূপলেখা দত্তকে সিটি সেন্টার অব্দি পৌঁছে দিলেন?’
‘না, সিটি সেন্টার অব্দি নয়, বাইপাসে চিংড়িহাটার মোড় অব্দি। সাধারণত সিটি সেন্টারে দু’তিনটে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই রাত্তিরে একটাও ছিল না। অত রাত্তিরে একজন ভদ্রমহিলাকে রাস্তায় ছেড়ে দেব কী করে? বললাম, আপনাকে আমি বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিই? রূপলেখা ইতস্তত করছিল। কিন্তু এদিকে বৃষ্টি ক্রমশ বেড়ে চলেছে, অত বৃষ্টিতে ট্যাক্সি পাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষে বলল, আমাকে বাইপাস অব্দি পৌঁছে দেবেন? ওখান থেকে নিশ্চয় একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাব।’
লোকটা থামল। নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে গেছে। উত্তেজিত। বিড়বিড় করছে। আদিত্য লোকটাকে একটু শান্ত হতে সময় দিল। বাইরে বৃষ্টির বেগ কমে এসেছে। বৈশাখী বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। তবে দমকা হাওয়াটা এখনও রয়েছে।
‘সেই রাত্তিরে যদি আমি রূপলেখাকে সাহায্য করার জন্যে গাড়ি না থামাতাম তা হলে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যেত।’ অশনি রায় আবার নিজের থেকেই কথা বলতে শুরু করেছে। ‘কী করা যাবে? আমার কপাল।’ লোকটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল।
আদিত্য অপেক্ষা করছে, অশনি রায় কখন কথা বলতে শুরু করবে। সে অনেকক্ষণ চুপ করে আছে দেখে আদিত্য বলল, ‘আপনার সঙ্গে রূপলেখা দত্তর আবার কবে যোগাযোগ হল ?’
‘আমি নিজেই পরের দিন যোগাযোগ করলাম। রূপলেখা আমাকে তার ফোন নাম্বারটা দিয়েছিল। আমিও তাকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়েছিলাম। আমি দুপুরে লাঞ্চের আগে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, সে ঠিক আছে কিনা ।
‘মানে, আপনি জানতে চাইলেন ট্যাক্সি তাকে ঠিকঠাক বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল কিনা।’
‘সেটা আপনি ঠিকই বলেছেন। ঠিক না থাকার কোনও কারণ ছিল না। এবং তারই উচিত ছিল আমাকে একটা ফোন করে ধন্যবাদ দেওয়া। ইন ফ্যাক্ট, আমি সারা সকাল রূপলেখার ফোনের জন্যে হন্যে হয়ে অপেক্ষা করছিলাম।’
‘তার কাছ থেকে ফোন না পেয়ে আপনিই তাকে ফোন করলেন?’
‘হ্যাঁ। ফ্যাক্ট ইজ, আই গট গড ড্যাম অ্যাট্র্যাক্টেড টু হার। শি হ্যাড দ্যাট সিডাকটিভ চার্ম হুইচ অ্যাট্রাক্টস মেন। তাছাড়া এর কিছুদিন আগে আমার একটা সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল। আমি মানসিকভাবে ভীষণ ভালনারেবল অবস্থায় ছিলাম।’
অশনি রায় আবার চুপ করে গেল। আদিত্য বলল, “তারপর?’
‘আমি ফোন করতে রূপলেখা অনেকক্ষণ ধরে ক্ষমা চাইল। বলল, তারই ফোন করে ধন্যবাদ দেবার কথা। কিন্তু সারা সকাল এত বেশি ক্লায়েন্টদের প্রেশার ছিল যে মুখ তুলতে পারেনি। তারপর বলল, যদি আমার আপত্তি না থাকে তাহলে আমরা একসঙ্গে লাঞ্চ খেতে পারি। আমি অবভিয়াসলি রাজি হয়ে গেলাম। রূপলেখা বলল, রাজারহাটের অ্যাক্সিস মল ছাড়িয়ে মিনিট দশেক ড্রাইভ করলে রাস্তার বাঁ দিকে একটা ক্যাফে হয়েছে। নাম, সল্ট অ্যান্ড পেপার। ওখানে সে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।’ ‘রাজারহাটের অ্যাক্সিস মল ছাড়িয়ে? সে তো অনেকটা দূরে? অত দূরে কেন?” ‘আমারও এটা মনে হয়েছিল। পরে কারণটা বুঝেছিলাম। রূপলেখা যে আমার সঙ্গে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছে এটা ও কাউকে জানাতে চায়নি। মানে আমাদের দু’জনকে এক সঙ্গে কেউ দেখে ফেলুক এটা ও চায়নি। কারণ ওর একজন স্বামী ছিল। অবশ্য স্বামীর সঙ্গে ওর একেবারেই বনিবনা ছিল না। ওই যে ক্যাফেটার কথা ও বলেছিল সেটা বেশ নির্জন একটা জায়গায় । আমারও ওই জায়গাটা স্যুট করেছিল। আমি তখনও জানতাম রূপলেখা আমাদের একজন ক্লায়েন্ট। একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া অবস্থায় অফিসের কেউ দেখে ফেললে আমার অসুবিধে হতো। বিজনেস লাঞ্চ এক জিনিস। কিন্তু ওটা তো ঠিক বিজনেস লাঞ্চ ছিল না।’
অশনি রায় আবার চুপ করে গেল। দম দেওয়া গ্রামাফোনে দম ফুরিয়ে গেলে যেমন হয়।
খেই ধরিয়ে দেবার জন্য আদিত্য বলল, ‘তারপর? তারপর কী হলো?”
‘এর পরে অনেকবার আমরা ওই ক্যাফেটাতে গিয়েছিলাম। ক্যাফের ভেতরটায় কখনও দু’চারজনের বেশি দেখিনি। সবই কাপল। কেউ কাউকে খেয়াল করছে না। নিজেদের মধ্যেই মশগুল হয়ে আছে। আর আমরা ঠিক করেছিলাম ব্যাঙ্কের ভেতর দেখা হয়ে গেলেও একজন অন্যজনকে না চেনার ভান করব। পরে ব্যাঙ্কে রূপলেখাকে আমি দু’একবার দেখেওছিলাম, কিন্তু কখনও কথা বলিনি।’
‘তারপর?’
‘তারপর ধীরে ধীরে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। আমি রূপলেখার সঙ্গে থাকলে খুব শান্তি পেতাম। শি ওয়াজ সো টিমিড। নেভার ওয়ান্টেড এনিথিং ফ্রম মি। কোনও দিন একটা গিফট পর্যন্ত নেয়নি। বলত, তোমার সঙ্গে থাকাটাই আমার গিট্। আমার আগের বান্ধবীর একেবারে উল্টো। আমার আগের বান্ধবী এক্সপেক্ট করত রোজ আমি ওর জন্যে খুব দামি কোনও উপহার নিয়ে যাব। দামি মানে সত্যিকারের দামি । অল্পসল্প জিনিসে ওর মন উঠত না। সেদিক থেকে রূপলেখা ছিল আ ব্রেথ অফ ফ্রেশ এয়ার।’
রূপলেখা দত্তর বিউটি পার্লারটা কোথায় ছিল?’
‘সল্ট লেকের একটা কোথাও। আমাদের অফিসের কাছে।’
‘আপনি সেখানে কখনও গিয়েছিলেন ?’
‘না। কখনও যাইনি। রূপলেখাই বারণ করেছিল। আমাদের সম্পর্কের কথা ওর পার্লারের কেউ জানুক এটা ও চায়নি।’
অশনি রায় আবার চুপ করে গেছে।
‘তারপর কী হল? আপনি বললেন ধীরে ধীরে আপনাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগল, তাই তো?’ আদিত্য অশনি রায়কে মনে করিয়ে দিতে চাইছে।
‘দেখুন, তিন বছর জেলে থাকার পর আমার কিছু মেন্টাল প্রবলেম হয়েছে। বেশিক্ষণ কনসেনট্রেট করতে পারি না। আমার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এখন সেই যন্ত্রণাটা শুরু হচ্ছে। আমার পক্ষে আর বিশেষ কিছু বলা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলি, আই অ্যাম ইনোসেন্ট। গৌতম দাশগুপ্ত সাহেব বিশ্বাস করেন আই অ্যাম ইনোসেন্ট। তাই উনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আই শ্যাল রিমেন গ্রেটফুল যদি আপনি আমার কেসটা নেন। আপনার যা ফিজ আমরা দেব। আমরা মানে আমার বাবা দেবেন। আমার বাবার নাম আর ফোন নাম্বার আমি লিখে এনেছি।’ অশনি রায় পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর চোখ বুজে টেবিলে মাথা রাখল। একটানা অতগুলো কথা বলে গিয়ে সে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল।
মিনিট পাঁচেক ওইভাবে থাকার পর লোকটা দাঁড়িয়ে উঠে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। একটা কথাও আর বলল না।
আদিত্য কী করবে বুঝতে পারছে না।
(২)
লোকটা চলে যাবার পর মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে রইল আদিত্য। একবার গৌতমের নম্বরটা লাগাল। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। নিশ্চয় সাইলেন্ট মোডে দিয়ে গৌতম দরকারি মিটিং করছে। একটু পরে গৌতম মেসেজ পাঠাল, মিটিং চলছে। রাত্তিরে ফোন করব।
টেবিলের ওপর রাখা চিরকুটটার দিকে আদিত্যর নজর পড়েছে। চিরকুট নয়, একটা ভিজিটিং কার্ড। লেখা রয়েছেঃ ডাঃ অসীমাভ রায়, কনসালটেন্ট কার্ডিওলজিস্ট, এম ডি (ক্যাল), এম আর সি পি (লন্ডন)। কার্ডের ওপরের ডান দিকে দুটো ঠিকানা লেখা। ওপরেরটা চেম্বারের, ঠিকানাটা হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের। তার নিচে শরৎ বোস রোডের বাড়ির ঠিকানা। তারও নিচে ল্যান্ডলাইন এবং মোবাইল নম্বর। আদিত্যর মনে হল, ডাঃ অসীমাভ রায় নামটা সে আগে শুনেছে।
বাইরে এখনও বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। খুব জোরে নয়, তবে ভিজিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। অর্থাৎ এক্ষুনি বেরোনো যাবে না। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আদিত্য ভিজিটিং কার্ডে লেখা মোবাইল নম্বরটা ডায়াল করল। ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। আদিত্য তবু ধরে আছে। ঠিক করেছে, যতক্ষণ না ফোনটা কেটে যাচ্ছে ততক্ষণ ধরে থাকবে। একবারে শেষ মুহূর্তে, সম্ভবত কেটে যাবার ঠিক আগে, একটি মহিলা ফোন ধরলেন। ‘ডক্টর রায়েজ চেমবার। মে আই হেল্প ইউ?’ ইংরেজি উচ্চারণে জড়তা নেই, আবার অনর্থক সাহেবিপনাও নেই।
‘ডক্টর রায়ের সঙ্গে একটু কথা বলা যাবে?’ আদিত্য বাংলাতেই বলল ৷ ‘উনি পেশেন্ট দেখছেন। এখন কথা বলা সম্ভব নয়।’ মহিলার গলাটা খুব একটা উৎসাহব্যাঞ্জক শোনাল না।
আদিত্যর ভয় হল এক্ষুনি বুঝি উনি ফোনটা কেটে দেবেন। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে ফোন করেছিলাম। ব্যাপারটা খুব আরজেন্ট। ওঁর ছেলে সংক্রান্ত।’
ওদিকে কিছুক্ষণ নীরবতা। আদিত্য মনে মনে দেখতে পেল ভদ্রমহিলা ফোনটা হাতে ধরে ভুরু কুঁচকে ভাবছেন। অবশেষে তাঁর সাড়া পাওয়া গেল। ‘একটু ধরুন, আমি দেখছি।’
আদিত্য ফোন ধরে আছে তো ধরেই আছে, ওপারে সাড়াশব্দ নেই। এরা তার কথা ভুলে গেল নাকি? ফোনটা রেখে দিয়ে আবার ফোন করবে? বাইরে বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে। বৃষ্টির জন্যে যারা এতক্ষণ আটকে পড়েছিল, তারা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। লোক থইথই বউবাজার। উল্টোদিকের চায়ের দোকানে আপিস-ফেরত বাবুরা ভিড় করে খাচ্ছে। খোলা জানলা দিয়ে চপ-কাটলেট ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধে আদিত্যর খিদে পেয়ে গেল। এরা কোবরেজিটা বেশ করে। বাড়ির জন্যে দুটো কোবরেজি নিয়ে গেলে কেমন হয়? কেয়া কি খুব রেগে যাবে? ইদানীং কেয়া খুব স্বাস্থ্য-সচেতন হয়েছে।
হঠাৎ ওপার থেকে সাড়া পাওয়া গেল। ‘আমি ডক্টর অসীমাভ রায় বলছি। কী ব্যাপার বলুন?’ রাশভারি গলা। কোবরেজির মধুর চিন্তা থেকে কঠিন বাস্তবে ফিরে আসতে আদিত্যর কয়েক সেকেন্ড সময় লেগে গেল।
‘আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। আমার নাম আদিত্য মজুমদার। আপনার ছেলে অশনি রায় একটু আগে আমার কাছে সাহায্যের জন্যে এসেছিলেন। কিন্তু ওঁর সমস্যাটা কী ভাল করে বলার আগেই উনি খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তারপর হঠাৎ উঠে পড়ে আমার অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে বলে গেলেন আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তাই ফোন করছি।’
‘আপনার কাছে যাবার কথা আমার ছেলে আমাকে বলেছিল। তবে আজকেই চলে যাবে জানতাম না। আপনার নামই তো অ্যাডিশানাল কমিশানার রেকমেন্ড করেছেন?
‘হ্যাঁ, গৌতম দাশগুপ্ত আমার অনেক দিনের বন্ধু।
‘শুধু অ্যাডিশানাল কমিশানার রেকমেন্ড করেছেন বলে নয়। আপনার কথা আমি খবর কাগজে পড়েছি। আপনার এক্সপার্টিজটা আমাদের খুবই দরকার।’
‘কিন্তু তার আগে তো আপনাদের, মানে আপনার ছেলের সমস্যাটা আমাকে জানতে হবে।’
‘দেখুন, এখন তো আমি পেশেন্ট দেখছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। কালও ব্যস্ত থাকব। পরশুদিন রবিবার। রবিবার আমি পেশেন্ট দেখি না। আপনি কি সকালের দিকে আমাদের বাড়িতে একবার আসতে পারবেন? এই ধরুন দশটা নাগাদ। আমার ছেলেও থাকবে।’
‘অবশ্যই যাব।’
‘তা হলে রবিবার দেখা হচ্ছে।’ ডাঃ অসীমাভ রায় হঠাৎ ফোন রেখে দিলেন। কারও কারও কোনও ভনিতা না করে হঠাৎ ফোন রেখে দেওয়া স্বভাব।
গৌতম যখন ফোন করল তখন আদিত্যদের রাত্তিরের খাওয়া হয়ে গেছে। কেয়া শোবার ঘরে আই প্যাড স্ক্রোল করছে। আদিত্য পড়ার ঘরে বসে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখছে অশনি রায় সম্বন্ধে কিছু জানা যায় কিনা।
মাস কয়েক হল কেয়ার একটা আই প্যাড হয়েছে। আদিত্যই দিয়েছে। রাত্তিরে খাবার পর কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেয়া তাতে নানান হাবিজাবি দ্যাখে। ইমেল পড়ে, উত্তর দেয়। রান্নার রেসিপি মুখস্থ করে। ফেসবুকে মন্তব্য করে, লাইক দেয়। কিছু ভিডিও ক্লিপ আসে সেগুলো হাঁ করে দ্যাখে। মাঝে মধ্যে ইউ টিউবে বাংলা সিনেমাও দ্যাখে। এই সময়টা তার নিজের। আদিত্য তখন পড়ার ঘরে বসে গান শোনে, ক্বচিৎ-কদাচিত সিনেমাও দ্যাখে। সবই পুরোনো হলিউড।
‘ঘুমিয়ে পড়েছিলি নাকি?’ গৌতমের গলাটা প্রফুল্লই শোনাল।
‘না, না। এখনই কী ঘুমোবো? সবে তো সাড়ে দশটা।’ আদিত্য দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল।
‘তোকে আজ খুব বোর করেছি। না বলে-কয়ে একটা পাগল-ছাগল লোককে তোর কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আসলে, আমার আজ একদম সময় ছিল না। বসিরহাটের দিকে কাল রাত্তিরে একটা ল অ্যান্ড অর্ডার প্রবলেম হয়েছে। সেটা কমিউনাল ফিউড-এর দিকে চলে যাচ্ছিল। তাই নিয়ে সারাদিন মিটিং। এই একটু আগে ছাড়া পেলাম। এখনও বাড়ি ফিরতে পারিনি। গাড়িতে।’
‘তার মানে তো তুই খুবই টায়ার্ড। তা হলে আজ থাক। কাল সুবিধে মতো আমাকে একটু ব্রিফ করে দিস।’
‘আরে না, না। তত কিছু টায়ার্ড নই। গাড়িতে যেতে যেতে তোকে খানিকটা বলি। পরে আরও ভাল করে কথা হবে। প্রথমে বলি, ওই ছেলেটাকে আর একটু পরে, মানে তোকে ভাল করে ব্রিফ করার পর, তোর কাছে পাঠানো যেত। কিন্তু ওর এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, এক্ষুনি একটা মেন্টাল সাপোর্ট না পেলে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে।’
‘ওকে দেখে তো মনে হলো একটা নার্ভাস ব্রেকডাউন অলরেডি হয়ে গেছে। যাই হোক, তুই বল। খানিকটা অবশ্য ওর কাছে শুনেছি। কিন্তু ও কথা শেষ না করেই হঠাৎ বেরিয়ে গেল। বলল, ওর খুব অসুস্থ লাগছে।’
‘আমি একটুও অবাক হচ্ছি না। আসলে ছেলেটার ওপর একটা মায়া পড়ে গেছে। লোকটা না বলে ছেলেটাই বলছি। বয়েস সদ্য চল্লিশ ছুঁয়েছে। দেখে অবশ্য বেশি মনে হয়।
গৌতম থামল। বোধহয় গুছিয়ে নিচ্ছে। আদিত্য টেলিফোনে ভিজে রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। গৌতম নিশ্চয় এসি না চালিয়ে গাড়ির জানলা খুলে রেখেছে। বৃষ্টি না থাকলেও দক্ষিণের হাওয়াটা এখনও আছে।
‘তিন বছর আগেকার কথা। ভি আই পি বাঙ্গুরের দিকে যে অনেকগুলো ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে তারই একটাতে তখন সদ্য লোক আসতে শুরু করেছে। বেশিরভাগটাই ফাঁকা। এইরকমই সদ্য-সমাপ্ত, আধফাঁকা একটি বহুতলের ফ্ল্যাটে একটা জোড়া খুনের ঘটনা সেই সময় মিডিয়ায় বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিল।’
‘এটা কোন মাস তোর মনে আছে?’
‘মাসটা ঠিক মনে নেই। তবে সময়টা ছিল শীতকাল। হয় ডিসেম্বর, না হয় জানুয়ারি, আর না হয় ফেব্রুয়ারি। আমার এক্সাক্ট ডেট মনে থাকে না। নিশ্চয় শীতকাল ছিল, কারণ সিসি টিভিতে দেখা গিয়েছিল খুনের জায়গা থেকে অশনি রায় একটা মেরুন সোয়েটার পরে বেরিয়ে আসছে। পরে ওই সোয়েটারটা ওর বাড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছিল। ফরেন্সিক পরীক্ষায় সোয়েটারে খুন হওয়া মহিলার রক্তের ছিটেফোঁটারও হদিশ মিলেছিল। তোর কি ঘটনাটার কথা মনে আছে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ঘটনাটার কথা আমার ভালই মনে আছে। আমার যতদূর মনে পড়ছে মাসটা ছিল ফেব্রুয়ারি। আমি তাও ভেরিফাই করে নিলাম। তারপর?’
‘খুনটা হয়েছিল রাত্তির এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে, অন্তত পুলিশের তাই অনুমান। সিসি টিভিতে দেখা গিয়েছিল মেন সাসপেক্ট অশনি রায় রাত্তির পৌনে বারোটা নাগাদ খুন হওয়া দম্পতির ফ্ল্যাট থেকে বেরোচ্ছে। তবে পরদিন সকালের আগে খুনের কথা জানা যায়নি। কাজের মাসি খুনটা আবিষ্কার করেছিল। তার কাছে ফ্ল্যাটের একটা চাবি থাকত, কারণ কর্তা-গিন্নির ঘুম থেকে উঠতে দেরি হত। কাজের মাসি সিকিউরিটিকে খবর দেয় এবং সিকিউরিটি পুলিশকে ফোন করে।
‘স্বামী-স্ত্রী, মানে যারা খুন হয়েছিল, তারা কী করত?’
‘স্বামীর একটা ডিসট্রিবিউশনের ব্যবসা ছিল। বিভিন্ন মনিহারি জিনিস বড় বড় কম্পানির কাছ থেকে নিয়ে শহরের ছোট ছোট মনিহারি দোকানে ডিসট্রিবিউট করত। সাবান, তেল, টুথপেস্ট, কেক-বিস্কুট-পাঁউরুটি, এইসব। ব্যবসাটা খুব একটা চলত বলে মনে হয় না। স্ত্রীও যেন কী একটা করত। ছোটখাট কিছু একটা।’
‘এদের নাম?’
‘স্ত্রীর নাম মৃত্তিকা মিত্র, স্বামী পার্থ মিত্র।’ ‘অশনি রায়ের সঙ্গে এদের কী সম্পর্ক? ‘
‘পার্থ মিত্রর সঙ্গে অশনি রায়ের কোনও সম্পর্ক ছিল না। মৃত্তিকার সঙ্গে ছিল বলে পুলিশের অনুমান। বেশ গভীর সম্পর্কই ছিল। গভীর প্রেমের সম্পর্ক। দু’একজন তার সাক্ষী ছিল। অশনি নিজে অবশ্য বলছে একটি মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সে মৃত্তিকা নয়, অন্য একটি মেয়ে। তার নাম রূপলেখা দত্ত। রূপলেখা কিন্তু খুন হয়নি। খুন হয়েছিল মৃত্তিকা মিত্র। অশনি বলছে সে মৃত্তিকা মিত্রকে খুব সামান্যই চিনত। পুলিশের ধারণা অশনি মিথ্যে কথা বলছে। অশনি বলছে সে কোনও খুন করেনি। যাদের সে চিনতই না বা সামান্য চিনত তাদের খুন করবে কেন? সে ঘটনাচক্রে ওখানে গিয়ে পড়েছিল। প্রাথমিক সাক্ষ্য-প্রমাণ কিন্তু অশনির বিরুদ্ধে যাচ্ছে।’
‘অশনি ওখানে গিয়ে পড়ল কী করে?’
‘ওকে নাকি ওই রূপলেখা বলে মেয়েটি ওখানে আসতে বলেছিল। রূপলেখা নাকি বলেছিল তার স্বামী তার ওপর ভীষণ অত্যাচার করছে। অশনি যেন তাড়াতাড়ি এসে ওকে উদ্ধার করে। এই কথা বলে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এর ওই বাড়িটার ঠিকানা দিয়েছিল। যেহেতু রূপলেখার বাড়িতে অশনি আগে কখনও যায়নি, তাই ও ধরে নিয়েছিল ওটাই রূপলেখার আসল ঠিকানা ‘
‘রূপলেখা কী বলছে?’
‘সেটাই হয়েছে মুস্কিল। ঘটনার পর থেকে রূপলেখার দেখা পাওয়া যায়নি। অতএব অশনি সত্যি বলছে না মিথ্যে বলছে যাচাই করার কোনও উপায় নেই।
‘তাহলে অশনি রায় ছাড়া পেল কী করে?’
‘সঙ্গত প্রশ্ন। মামলা যখন হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে তখন ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী কেসটা টেক-আপ করেন। তিনি কিছু নতুন এভিডেন্স আদালতে পেশ করলেন। তাছাড়া ওঁর নিজের ক্যারিসমা তো ছিলই। সব মিলিয়ে যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে অশনি রায় ছাড়া পেয়ে গেল। কিন্তু সেটা সাময়িক। পুলিশের ওপর হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে অ্যাপিল করার জন্য প্রচণ্ড পলিটিকাল প্রেশার আছে। আমি এখনও ধরতে পারিনি কেন প্রেশারটা আসছে।’
‘আচ্ছা, কিছুদিন আগে কাগজে যেন দেখলাম ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। ঠিক বলছি?’
‘একেবারে ঠিক বলছিস। মাসখানেক আগে সকালে গলফ খেলে উনি ক্লাবের সামনে গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় একটা লরি এসে ওঁকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। লরিটাকে ধরা যায়নি। এর মানে হল, অশনি রায়ের কেসটা ডিভিশন বেঞ্চে উঠলে ওর হয়ে লড়ার কেউ নেই। তাই আমি ওকে তোর কাছে পাঠালাম।’
‘তুই এর মধ্যে জড়িয়ে পড়লি কী করে?’
‘আমি নিজে অশনি রায়কে বেশ কয়েকবার ইন্টারোগেট করেছিলাম। আমার গাট ফিলিং হল, ছেলেটা নির্দোষ। তার ওপর অরুণকান্তি ব্যানার্জীর এই অ্যাক্সিডেন্টটা। এটা কি অ্যাক্সিডেন্ট, নাকি এর পেছনে কোনও ফাউল প্লে আছে? যদি ফাউল প্লে হয় তা হলে এর সঙ্গে অশনি রায়ের কেসটার একটা সম্পর্ক থাকাটা মোটেই আশ্চর্য নয়। তা ছাড়া ডিভিশন বেঞ্চে অ্যাপিল করার জন্যে পুলিশের ওপর এত পলিটিকাল প্রেশার কেন? যেন অদৃশ্য কোনও শক্তি পুলিশকে নির্দেশ দিচ্ছে অশনি রায়কে দোষী প্রমাণ করতেই হবে। এরকম কেন হবে? সব মিলিয়ে মনে হল সেটা তোর কাছে পাঠানো দরকার। বাই দ্য ওয়ে, অশনির বাবা খুব পশারওলা ডাক্তার। তা ছাড়া ওদের পারিবারিক অবস্থাও বেশ ভাল। তোর যা ফি সেটা তুই চেয়ে নিতে একটুও সংকোচ করিস না।’
‘সেটা ঠিক আছে, কিন্তু…।’ আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘অশনির বাবার সঙ্গে সামনের রবিবার দেখা করার কথা। দেখা যাক কী হয়।
‘আমার মনে হচ্ছে, কেসটা তোর পছন্দ হবে। আর হ্যাঁ। কেসটা সম্বন্ধে তোকে সব থেকে ভাল ধারণা দিতে পারবে ইন্সপেক্টার সুভদ্র মাজি। সে তো তোর চেনা লোক। ও-ই তো কেসটা নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করেছিল। ওর সঙ্গে অবশ্যই যোগাযোগ করিস।’
“নিশ্চয় করব। আর কার সঙ্গে কথা বলা উচিত তোর মনে হয়?’
‘সব ডিটেল তোকে সুভদ্র বলে দেবে। শোন, আমার বাড়ি এসে গেছে। পরে কথা হবে। ছেলেটাকে একটু সাহায্য করিস। ছেলেটা ইনোসেন্ট। টা টা।’
এখনও বারোটা বাজেনি। সুভদ্র মাজিকে একটা ফোন করা যেতেই পারে। সৈকত চৌধুরির খুনের মামলায় সুভদ্রর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সেই পরিচয় এখন অনেক গাঢ় হয়েছে। সুভদ্রকে আদিত্যর খুব পছন্দ। এমন ভদ্র, বিনয়ী এবং একই সঙ্গে দক্ষ পুলিশ অফিসার খুব বেশি দেখা যায় না। সব থেকে বড় কথা ওর সততা প্রশ্নাতীত। আজকাল সুভদ্র মাঝে মাঝেই আদিত্যর বাড়িতে আসে। টুকিটাকি পরামর্শ নেয় ৷ কেয়াও সুভদ্রকে বেশ পছন্দ করে।
আদিত্য সুভদ্রর নম্বরটা লাগাল। ফোনটা বিজি। এত রাত্তিরে কার সঙ্গে কথা বলছে?
আদিত্য মোবাইল রেখে অন্যমনস্কভাবে সিগারেট ধরাল। টের পায়নি কখন কেয়া পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আদিত্য ভেবেছিল কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।
‘শুতে যাবে না? এ কী? সিগারেট ধরিয়েছ?’
‘একটা ফোন করে শুতে যাচ্ছি।’ সিগারেট ধরানোর ব্যাপারে কিছু না বলাটাই আদিত্য নিরাপদ মনে করল।
‘তুমি যে বলেছিলে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ? আমাকে মিথ্যে বলেছিলে?” কেয়া তীক্ষ্ণ গলায় বলল ।
‘ওই মাঝে-সাঝে একটা-দুটো। শুধু চিন্তা করার সময়।’
‘এত রাত্তিরে কীসের চিন্তা?’
‘একটা কাজ পেয়েছি। আজই একজন মক্কেল এসেছিল।’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল।
‘কাজ পেয়েছ বলে মনের আনন্দে সিগারেট ধরিয়ে ফেললে?’
ভাগ্যক্রমে ফোনটা বেজে উঠল বলে আদিত্যকে আর এই কঠিন প্রশ্নের উত্তরটা দিতে হল না। ফোনে ইন্সপেক্টার সুভদ্র মাজি।
‘সুভদ্র? এত রাত্তিরে ফোন বিজি ছিল কেন?’ আদিত্য মোবাইল ধরে বলল। ‘অ্যাডিশনাল কমিশানার সাহেব ফোন করেছিলেন। বললেন, আপনি ওই মৃত্তিকা মিত্রর কেসটার ব্যাপারে জানতে চেয়ে ফোন করবেন। আমি যেটুকু জানি আপনাকে যেন সবটা বলি। অ্যাডিশনাল কমিশানার সাহেবের ফোন করার দরকার ছিল না। আপনি জানতে চাইলে আমি এমনিই বলে দিতাম।’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি। ব্যাপারটা আমার খুব ভাল করে জানা দরকার। তুমি নিশ্চয় জান, খুব শিগগির পুলিশ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে অ্যাপিল করবে। তার আগে একটা থরো ইনভেস্টিগেশন দরকার। তুমি কি এখনও সেটার চার্জে আছ?’
‘না, না। অনেক দিন হল কেসটা থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশনটা করেছিলাম। কেস লোয়ার কোর্টে ওঠার সময় থেকেই আমি কেসটার চার্জে নেই।’
‘তোমাকে সরিয়ে দেওয়া হল কেন?’
‘সেটা তো বলতে পারব না। মনে হয়, ওপর থেকে নির্দেশ এসেছিল। অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেব হয়ত বলতে পারবেন।
‘তুমি যতটুকু জান, আমাকে বলবে? অশনি রায় আমার কাছে এসেছিল। আমাকে ওর প্রোটেকশনের জন্যে এনগেজ করেছে। গৌতমও চাইছে ব্যাপারটা আর একটু ইনভেস্টিগেটেড হোক।’
‘আমারও মনে হয় সেটা হওয়া উচিত। আপনি ইনভেস্টিগেট করলে সব থেকে ভাল হবে। আমি যতটা জানি অবশ্যই বলব। তবে দাদা, অত কথা টেলিফোনে হবে না। একদিন আপনাদের বাড়ি গিয়ে সময় নিয়ে বলতে হবে। কবে যাব?’
‘কবে আসবে? দাঁড়াও দেখছি।’ আদিত্য কথা বলতে বলতে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল।’
কেয়া আদিত্যর পেছনে এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল। আদিত্য কিছু বলার আগে বলে উঠল, ‘সুভদ্রকে বল সামনের মঙ্গলবার সকালে আসতে। দুপুরে এখানে খেয়ে নেবে। সেদিন পয়লা বৈশাখ, ও নিশ্চয় ছুটি পেয়ে যাবে।’
পয়লা বৈশাখের নেমন্তন্ন পেয়ে সুভদ্র মাজি বেজায় খুশি।
(৩)
আদিত্য আজ বুদ্ধি করে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে। সঙ্গে ছাতা থাকলে ডবোল লাভ । প্রথমত, আদিত্য লক্ষ করেছে, ছাতা নিয়ে বেরোলে কোনও অলিখিত নিয়মে বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা অনেকটা কমে যায়। দ্বিতীয়ত, নেহাতই যদি বৃষ্টি নেমে যায়, চিন্তার কিছু নেই। ছাতা খুলে রাস্তা দিয়ে অকুতোভয়ে হাঁটো। অবশ্য খুব জোরে বৃষ্টি নামলে ছাতায় কাজ হবে না। তখন কোনও দোকানে বা অন্য কোনও ছাউনির নিচে অপেক্ষা
করতে হবে।
এই সব কটা সম্ভাবনার জন্যেই আদিত্য মনে মনে তৈরি ছিল, কিন্তু যেটা ঘটল তার জন্যে সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না। বৃষ্টি একটা নামল বটে কিন্তু সেটা হালকা বৃষ্টি নয় যে ছাতা খুলে এড়ানো যাবে, আবার ঝমঝমে বৃষ্টিও নয় যে একটা আশ্রয় খুঁজে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে। এই দুই-এর বদলে আকাশ থেকে একটা আশ্চর্য শিলাবৃষ্টি শুরু হল। আদিত্য তখন মেট্রো ধরবে বলে শ্যামবাজারের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
আদিত্যর ছাতার ওপর চড়চড় করে শিল পড়ছে। একবার ভাবল শিলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়েই পা চালিয়ে চলে যায়, অশনি রায়ের বাবা অসীমাভ রায়ের কাছে দশটার মধ্যে পৌঁছতে হবে। তারপর মনে হল, ধুত্তোর, দু’চার মিনিট দেরি হলে কী যায় আসে? রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শিলাবৃষ্টি দেখলে কী এমন ক্ষতি হবে? শিলাবৃষ্টি তো রোজ রোজ হচ্ছে না।
একটা গাড়িবারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আদিত্য এখন শিলাবৃষ্টি দেখছে। চড়বড় করে শিল পড়ছে রাস্তার ওপরে। পড়েই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় এরকম শিলাবৃষ্টি হলে আদিত্য শিল কুড়োতো। কুড়িয়েই মুখে। ঠাণ্ডা বরফের মতো শিল মুখের ভেতর আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেত। এখনও ফুটপাথবাসী শিশুরা মহা আনন্দে শিল কুড়িয়ে যাচ্ছে। মুখে পুরছে। তাদের আনন্দটা, গাড়িবারান্দার নিচে যারা বৃষ্টি থামবার জন্যে অপেক্ষা করছিল, তাদের মধ্যেও সংক্রামক ভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
দূরে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ঘোড়ায় চড়া নেতাজির মূর্তিটাকে বৃষ্টিতে ঝাপসা দেখাচ্ছে। যেন সারা কলকাতা শহরটাই শিলাবৃষ্টির আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে গেছে। গাড়িবারান্দার নিচে চায়ের দোকান। সকলেই চা খাচ্ছে। ভাল ব্যবসা করছে দোকানদার। আদিত্যও এক ভাঁড় চায়ের অর্ডার দিল। সকলেই খুশি-খুশি, যেন সকলের জন্যে আকাশ থেকে অপ্রত্যাশিত একটা উপহার এসেছে। শুধু বিপুল বপু একটা ষাঁড়, যে অন্যদের সঙ্গে গাড়িবারান্দার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল, হঠাৎ জলদগম্ভীর স্বরে একটা হাম্বা ডাক ছেড়ে তার অসুবিধের কথা জানিয়ে রাখল।
এই পড়ে পাওয়া আনন্দটাকে আরও বাড়িয়ে নেবার জন্যে আদিত্য ভাবল একটা সিগারেট ধরাবে। তার সঙ্গে সিগারেট নেই, যে কটা ছিল কাল রাত্তিরে কেয়া সব কটা ফেলে দিয়েছে। অবশ্য গাড়িবারান্দার নিচে সিগারেটের দোকানও আছে। সিগারেট কিনতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কেয়ার মুখটা মনে পড়ে গেল।
কাল রাত্তিরে ঘুমোতে যাবার আগে কেয়া বলেছিল, “তুমি যদি আবার সিগারেট খাও, দেখো আমি ঠিক মরে যাব।’
বলাই বাহুল্য, আদিত্য এসব দিব্যি-টিবিতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু কেয়ার অসহায় মুখটা মনে পড়ে গেল বলে তার আর সিগারেট কেনা হল না ।
এই সব ভাবতে ভাবতে শিলাবৃষ্টি থেমে গেছে। বৃষ্টিও ধরে এসেছে প্রায়। ছাতা খুলে আদিত্য রাস্তায় নামল।
মেট্রো থেকে নেমে আদিত্য ভাবছিল, কোন দিক দিয়ে যাবে? রাসবিহারী অ্যাভিনিউ দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে ডান দিকে বেঁকে যাবে, নাকি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী রোড ধরে দক্ষিণ দিকে খানিকটা এগিয়ে সরাসরি সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে নেবে? দুটো রাস্তাই তার পছন্দ। সে মনে মনে ঠিক করল যাবার সময় রাসবিহারী দিয়ে যাবে, ফেরার সময় সাদার্ন অ্যাভিনিউ।
ডাঃ অসীমাভ রায়ের সঙ্গে আজ সকালেই কথা হয়েছে। উনি বলে দিয়েছেন, সাদার্ন অ্যাভিনিউ-শরৎ বোস রোড মোড়ের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা পেট্রল পাম্প আছে। সেটাকে ডানহাতে রেখে ওই একই ফুটপাথ ধরে মিনিট তিনেক পশ্চিম দিকে এগোলেই তাঁদের দোতলা বাড়ি। সামনে ড্রাইভওয়ে।
এদিকটা মনে হয় তেমন বৃষ্টি হয়নি, রাস্তা প্রায় শুকনো। বৃষ্টি আজকাল খুব ছোট ছোট অঞ্চলে আটকে থাকছে। লেক মার্কেটের কাছে রাস্তায় রবিবারের বাজার। গ্রীষ্মের সবজি শীতের তরি-তরকারিদের হটিয়ে বাজার দখল করে নিয়েছে। ফুলকপি-বাঁধাকপি-পালং প্রায় উধাও, তাদের বদলে কচি পটল, নবীন ভিত্তি, তরুণী ঝিঙে। হলুদ কুমড়োর পাশে লাল টমেটো, সবুজ নিমপাতা। বেশ দেখাচ্ছে। রবিবার সব দোকানপাট বন্ধ। শুধু পাশাপাশি দুটো ওষুধের দোকানে ভিড় উপচে পড়ছে। দেখতে দেখতে আদিত্য দেশপ্রিয় পার্কের মোড়ে পৌঁছে গেল ।
ডানদিকে বাঁক নিয়ে খানিক দূর এগোলেই একটা গলির মোড়ে সেই বিখ্যাত কচুরির দোকান। দূর দূর থেকে বাবুরা গাড়ি চড়ে এখানে কচুরি খেতে আসেন। কচুরি ভাজার গন্ধে হাওয়া ভারি হয়ে আছে। কচুরির পাশে জিলিপি, ছোট ছোট মালপোয়া। খেলে অবধারিত অম্বল। কিন্তু অম্বলের কথা কেউ ভাবছে বলে মনে
হয় না। কচুরির দোকান পেরোতে পেরোতে আদিত্য ভাবছিল এই গলিটার নাম কচুরি সরণি রাখলে ঠিক হতো।
মিনিট দশেক পরে যখন আদিত্য সবে রায় বাড়ির বৈঠকখানায় গিয়ে বসেছে, বসে গৃহস্বামীর অপেক্ষা করছে, তখন ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। সে অবশ্য রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অসীমাভ রায়কে ফোন করে বলে দিয়েছিল তার পৌঁছতে একটু দেরি হবে। তাও এই দেরিটা হল বলে আদিত্যর খারাপ লাগছে।
ঘরটা বেশ বড়। আসবাবগুলো পুরোনো এবং দামী। বনেদি বাড়িতে যেমন হয়। মিনিট পাঁচেক হয়ে গেল গৃহস্বামীর দেখা নেই। গৃহস্বামীর ছেলেটাই বা কোথায় গেল? ইতিমধ্যে উর্দি পরা বেয়ারা এসে চা ও দু’খণ্ড কেক দিয়ে গেছে। চা ও কেক খাওয়া শেষ হয়ে গেল, অসীমাভ রায় বা অশনি রায় কারও দেখা নেই। পৌনে এগারোটা বেজে গেল। এগারোটা। দেয়াল ঘড়ি থেকে একটা কোকিল বেরিয়ে এসে এগারোবার কুহু কুহু করল। তবু বাপ ব্যাটার দেখা নেই। আদিত্য উসখুস করছে। ভাবছে, ঘরের বাইরে বেরিয়ে বেয়ারাটাকে যদি দেখতে পায় জিজ্ঞেস করবে। এই ভেবে সে উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় হনহন করে বছর সত্তরের এক শুভ্রকেশ সুদর্শন বৃদ্ধ ঘরে ঢুকলেন।
‘আপনাকে এতক্ষণ বসিয়ে রাখলাম বলে অত্যন্ত লজ্জিত।’ টেলিফোনের সেই গমগমে গলা। আদিত্য শোনা মাত্রই চিনতে পারল।
‘না, না। আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। আমি বসে বসে চা-কেক খাচ্ছিলাম।’ আদিত্য হাসল।
‘আমার সত্যিই কোনও উপায় ছিল না। হসপিটাল থেকে ফোন এসেছিল। আমার এক পেশেন্টের অবস্থা ক্রিটিকাল। অন্য দিন হলে হসপিটালে চলে যেতাম। কিন্তু আপনাকে বসিয়ে রেখে তো আর যেতে পারি না। প্যারামিটারগুলো শুনে শুনে টেলিফোনে আমার জুনিয়ারকে ইন্সট্রাকশান দিচ্ছিলাম কী করতে হবে। এখন পেশেন্টের অবস্থা একটু স্টেবিলাইজ করেছে।’
আদিত্য আবার হাসল। কী বলবে সে বুঝতে পারছে না।
‘বেয়ারাটাকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছি যাতে আমাদের কথাগুলো সে আড়ি পেতে শুনতে না পারে। আজকাল কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। ও বাড়ি থাকলে ওকে দিয়ে বলে পাঠাতাম আমার আসতে একটু দেরি হবে।’
‘প্লিজ আর বলবেন না। এবার কিন্তু আমি সত্যিই লজ্জা পাচ্ছি। আপনি ভীষণ ব্যস্ত একজন ডাক্তার। এরকম আনসিন এমার্জেন্সি তো আপনার হতেই পারে।’ আদিত্য কুণ্ঠিত ভাবে বলল। তারপর একটু থেমে বলল, “কিন্তু অশনিবাবুকে তো দেখছি না। উনি বাড়ি নেই?’
প্রশ্নটা শুনে ডাঃ অসীমাভ রায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘বাবলু ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন। আদিত্য অসীমাভ রায়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। যেন তার প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তরটা সে এখনও পায়নি।
‘আপনি তো জানেন, বাবলুর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। সে জন্য তাকে ওষুধ খেতে হয়। ফলে সে বেলা বারোটার আগে উঠতে পারে না। আমিও তাকে তুলি না। যত বেশি ঘুমোবে, তত তার নার্ভটা সুদড হবে। তাছাড়া আজ আমি যখন আপনার সঙ্গে কাজের কথাগুলো বলব, তখন বাবলুর না শোনাই ভাল। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলে ওর নার্ভের ক্ষতি হতে পারে। আমাদের কথা শেষ হয়ে গেলে ওকে ডেকে নেব। তার মধ্যে আমার বেয়ারা নাদের আলিও হয়ত ফিরে আসবে। তখন আমরা একটু চা খাব।’
জানলা দিয়ে নিরুত্তেজ রোদ্দুর ঘরে ঢুকেছে। একটা আকাশও দেখা যাচ্ছে, তার এক কোণে কৃষ্ণবর্ণ খণ্ডিত মেঘমালা । হয়ত এদিকটাতেও এবার বৃষ্টি নামবে। আদিত্যর মনে পড়ল এই ঘরে ঢোকার সময় সে তার ছাতাটা বেয়ারার হাতে দিয়েছিল। সে সেটাকে কোথায় রেখেছে কে জানে?
‘কীভাবে শুরু করলে ভাল হবে জানি না। আমি যে সিকোয়েন্সে ব্যাপারগুলো জেনেছি সেভাবেই বলছি। তবে তার আগে আমার ছেলে বাবলু মানে অশনি সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা দরকার।’
অসীমাভ রায় থামলেন। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন। আদিত্যর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। ইচ্ছেটা দমন করে সে পকেট থেকে নোটবই আর পেন বার করল।
‘বাবলু লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। সাংঘাতিক ট্যালেন্টেড হয়ত নয়, কিন্তু পরিশ্রমী, বাবা-মার বাধ্য। আমার খুব ইচ্ছে ছিল বাবলু বড় হয়ে ডাক্তার হোক। ওর মা কিছুতেই সেটা হতে দিল না। ডাক্তার হিসেবে আমার নিজের ব্যস্ততা যত বেড়েছে তত পরিবারকে আমি কম সময় দিতে পেরেছি। সঙ্গত কারণেই এ-নিয়ে আমার স্ত্রীর প্রচণ্ড ক্ষোভ ছিল। তারই জের টেনে ও বলত, বাবলু কিছু কম টাকা রোজকার করলেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু ওর যেন একটা ঠিকঠাক পারিবারিক জীবন থাকে। বাবলু ডাক্তার হলে সেটা সম্ভব হবে না।
‘ডাক্তার হবার বদলে বাবলু ইঞ্জিনিয়র হল। তারপর এম বি এ। বিদেশি ব্যাঙ্কে চাকরি। খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করছিল। তবে ওর মা যে ভেবেছিল বাবলু বাড়িতে অনেকটা সময় দিতে পারবে, সেটা ঘটল না। বিদেশি ব্যাঙ্কের চাকরিতে ভীষণ চাপ । কোনও দিনই রাত্তির দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারত না। এটা নিয়ে ওর মায়ের বেশ দুঃখ ছিল। কিন্তু আমি বোধহয় মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি।’
‘না, না, আপনি যতটা পারেন বলুন। আমার সবটা শোনা দরকার।’ আদিত্য নোটবই থেকে মুখ তুলে বলল।
‘বাবলুর এক বান্ধবী ছিল। বাবলুর সঙ্গে কলেজে পড়ত। আমরা ধরে নিয়েছিলাম ওর সঙ্গে বাবলুর বিয়ে হবে। বাবলুও তাই বলেছিল। আমরা মনে মনে বিয়ের তোড়জোড়ও খানিকটা শুরু করে দিয়েছিলাম। বাবলুর তখন আঠাশ প্লাস বয়েস। সেই সময় আমাদের পরিবারে প্রথম মিসহ্যাপটা ঘটল। বাবলুর মায়ের একটা ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হল। আমি তখন একটা কনফারেন্সে হায়দ্রাবাদে। ফিরে আসার আগেই সব শেষ। নিজের মুখেই বলছি, আমি কলকাতার টপ কার্ডিয়োলজিস্টদের একজন। আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবার জন্য পেশেন্টদের দু’তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। অথচ আমার নিজের স্ত্রী যে এত অসুস্থ সেটাই আমি জানতাম না! জানা উচিত ছিল। নিশ্চয় জানা উচিত ছিল। হার্টের অসুখ তো এক দিনে হয় না। আমি আমার স্ত্রীর প্রতি একদম নজর দিইনি। এটাই সত্য। লজ্জা! লজ্জা!’ অসীমাভ রায়ের গলাটা বুজে এসেছে।
আদিত্য চুপ করে আছে। বলার তো কিছু নেই।
‘বাবলু ওর মায়ের খুব ক্লোজ ছিল। মায়ের ওরকম হঠাৎ করে চলে যাওয়াটা ও একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। প্রথম মাস ছয়েক খেতে পারত না, ঘুমোতে পারত না, অফিসে কাজ করতে পারত না। তারপর মনে হয় একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল। বান্ধবী অন্বেষাকে আঁকড়ে ধরে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। আমি ওকে খুব বেশি সময় দিতে পারতাম না। অন্বেষাই ছিল ওর মেন্টাল সাপোর্ট। মানসিকভাবে বাবলু কোনও দিনই খুব একটা ইনডিপেনডেন্ট ছিল না। ওর মা ওকে ছোটবেলা থেকে ভীষণ প্রোটেক্ট করে রাখত বলে এটা হয়েছিল। আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম অন্বেষাও ওকে ওই প্রোটেকশানটা দেবে। অন্বেষাকে নিয়ে বাবলু হ্যাপি হবে। মায়ের মৃত্যুর জন্যে অবভিয়াসলি ওদের বিয়েটা পিছিয়ে গিয়েছিল। রোজই ভাবতাম, বাবলু বুঝি এবার ওর বিয়ের কথাটা বলবে। কিন্তু দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেল। বাবলু আর বিয়ের কথা বলে না। তারপর আমাদের পরিবারে দ্বিতীয় মিসহ্যাপটা ঘটল।’
অসীমাভ রায় আবার থামলেন। ঘরের বাইরে কোনও শব্দ হচ্ছে কিনা কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, “আপনি একটু বসুন। আমি দেখে আসি বাবলু উঠে পড়ল কিনা।’ তিন-চার বছরের বাচ্চা অসময়ে ঘুম থেকে উঠে পড়লে বাবার যেমন অস্বস্তি হয়, অসীমাভ রায়ের গলাটা সেই রকম শোনাল।
আবার একা ঘরে আদিত্য। বাইরে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠেছে। জানলা দিয়ে ধুলো ঢুকছে। আদিত্যর ফোনটা ভাইব্রেট করছে। কেয়া।
‘কখন আসবে?’
‘এখনও ক্লায়েন্টের বাড়িতে। কথা বলছি।’
‘আজ কাঁকড়া রাঁধছি, মনে আছে তো? দুপুরে এক সঙ্গে খাব।’
‘মনে আছে, মনে আছে। আমি ঠিক চলে আসব। এখন রাখছি।’ আদিত্য মোবাইলটা বন্ধ করে পকেটে রাখল। ডাঃ অসীমাভ রায় ফিরে এসেছেন।
‘আপনি দ্বিতীয় মিসহ্যাপের কথা বলছিলেন।’ আদিত্য খেই ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করল।
‘হ্যাঁ, সেকেণ্ড মিসহ্যাপ। অন্বেষা হঠাৎ জানাল সে বাবলুকে বিয়ে করতে পারবে না। সে আর বাবলু নাকি কমপ্যাটিবল্ নয়। একেবারে বোল্ট ফ্রম দ্য ব্লু। আসল কথা, অন্বেষার অ্যামেরিকায় বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অ্যামেরিকা যাবার সুযোগটা অন্বেষা হাতছাড়া করতে চায়নি। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই অন্বেষা বিয়ে করে অ্যামেরিকা চলে গেল। বাবলু একেবারে ডিভাসটেটেড্।’
‘এই সময় নাগাদই কি অশনিবাবুর সঙ্গে ওই মহিলার আলাপ হয়? অশনিবাবু আমাকে সেই রকমই বলেছিলেন।’ আদিত্য নোট নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, এই সময়ই বাবলুর সঙ্গে ওই মহিলার দেখা হয়। পুরোটাই ওই মহিলার আগে থেকে প্ল্যান করা। কীভাবে সেটা বলছি। তার আগে বলি, ওই মহিলার সঙ্গে বাবলুর একটা সম্পর্ক তৈরি হবার পেছনে আমার একটা পরোক্ষ ভূমিকা আছে। সেটা না বললে মৃত্তিকা মিত্র এবং তার স্বামী খুন হবার ব্যাপারটা ভাল করে বোঝা যাবে না।’
চোখে কৌতূহল নিয়ে আদিত্য মুখ তুলে তাকাল। অসীমাভ রায় চিন্তায় ডুবে আছে। যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে।
‘আমার স্ত্রী চলে যাবার কয়েক বছর আগে মনোময় দাস বলে একজন আমার কাছে চিকিৎসার জন্য এসেছিল। বয়েস তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে, সদ্য বিয়ে করেছে, বাড়ির অবস্থা যেমন ভাল, হার্টের অবস্থা তেমনি খারাপ। আসলে ছোটবেলায় ছেলেটির অনেকবার রিউম্যাটিক ফিভার হয়েছিল। ওদের ব্যবসায়ী পরিবারে কারও ধারণাই ছিল না রিউম্যাটিক ফিভার হার্টের কতটা ক্ষতি করতে পারে। আবার এটাও হতে পারে যে দুর্বল হার্ট নিয়েই মনোময় জন্মেছিল।
‘মনোময়ের বাবা আর কাকা একসঙ্গে ব্যবসা করত। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’জনেই মারা যায়। মনোময় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আর তার কাকার কেবল এক মেয়ে। কিন্তু মনোময়দের পরিবারে মেয়েরা ব্যবসার অংশ পায় না। ফলে মনোময়ের ঘাড়ে পুরো ব্যবসার দায়িত্ব এসে পড়ল। তখন তার বয়েস সদ্য আঠাশ পেরিয়েছে। মনোময়ের মা তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন। বউমার নাম বনানী, সুন্দরী এবং শক্ত চরিত্রের মেয়ে। সে এসে সংসারের হাল ধরল। আমার গল্প এই বনানী দাসকে নিয়ে।
‘আমি টানা দু’তিন বছর মনোময়ের চিকিৎসা করেছিলাম। তাতে যে তার খুব একটা উপকার হয়েছিল বলতে পারি না। মাঝে কয়েক মাসের জন্যে বনানী তার স্বামীকে নিয়ে ভেলোর গেছিল। সেখানেও অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। ফিরে এসে আবার আমার কাছে আরও তিন বছর। ছেলেটা একটু একটু করে মরেই যাচ্ছিল আর স্বামীকে ওই ভাবে একটু একটু করে মরে যেতে দেখে বনানী দাস নিজে একটু একটু করে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। একটা সময় আমার মনে হল, ওপেন হার্ট সার্জারি করলে হয়ত মনোময় আরও কিছু দিন বেঁচে যেতে পারে। আমি বনানীকে সেই কথা বললাম। স্বামীর অপরেশন করাতে বনানী রাজিও হল। অপরেশন করল আমারই বন্ধু সমীরণ, ডাঃ সমীরণ সান্যাল। কিন্তু মনোময় বাঁচল না। আর তারপরই সমস্যা শুরু হল।
‘বনানীর ধারণা হল আমার জন্যেই তার স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে। সার্জারি করার আসলে কোনও দরকার ছিল না। আমি টাকার লোভে সার্জারি করিয়েছি। সার্জারি করার জন্য সমীরণ যে ফি পেয়েছিল, আমি নাকি তার ভাগ পেয়েছি। কিছুদিন আমি ভাল কথায় বনানীকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, ওকে কিছুতেই বোঝানো গেল না। উলটে ও আমাকে সোশাল মিডিয়ায় ইনটিমিডেট করতে শুরু করল। এতে আমার প্রফেশানালি ভীষণ ক্ষতি হচ্ছিল, তবু আমি চুপ করেই ছিলাম। শেষে বনানী আমার নামে কেস করে দিল। লোয়ার কোর্টে কেস দাঁড়াল না, হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চেও না। বনানী বুঝল আইনের পথে ও আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। তাই ও ডিভিশন বেঞ্চে আর অ্যাপিল করল না। কিছুদিন ও আমাকে ভয় দেখিয়ে কয়েকটা চিঠি লিখল। তারপর একেবারে চুপ করে গেল। আমি ভাবলাম সমস্যাটা বোধহয় মিটে গেল।’
‘আদিত্যবাবু কতক্ষণ এসেছেন?”
আদিত্য মুখ ফিরিয়ে দেখল রাত্রিবাসের ওপর ড্রেসিং গাউন চাপানো অশনি রায় দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।
(8)
অশনি রায় তার বাবার পাশে সোফায় এসে বসেছে।
‘নাদের কোথায়? বাড়িতে কোথাও দেখতে পেলাম না। একটু চা খেতাম।’ অশনি রায় তার বাবাকে বলল।
‘নাদেরকে আমি একটা কাজে পাঠিয়েছি। একটু অপেক্ষা কর, ও চলে আসবে।’ অসীমাভ রায় ঈষৎ কুণ্ঠিত ভাবে বললেন ।
‘আমি কফি করছি। আর কেউ কফি খাবে?’ অশনি রায় আলাদা আলাদা করে আদিত্য এবং তার বাবার দিকে তাকাল ।
‘আমি কফি খাব না। নাদের ফিরলে চা খাব।’ অসীমাভ রায় জানালেন।
‘আমিও চা-ই খাব।’ আদিত্য একটু ইতস্তত করে বলল।
‘আমি তাহলে নিজের জন্যে একটু কফি করে আনছি।’
অশনি রায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আদিত্য একটু আশ্চর্য হয়েই লক্ষ করল নিজের বাড়ির পরিবেশে অশনি রায়কে প্রায় স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এটা অবশ্য অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ওঠার ফলও হতে পারে।
‘সমস্যাটা আসলে মিটল না?’ অশনি রায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আদিত্য পুরোনো প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চাইল।
‘মিটল তো না-ই, বরং বহুগুণ ভয়ঙ্করভাবে ফিরে এল। বনানী একটা অন্য নাম নিয়ে বাবলুর সঙ্গে ভাব জমাল। বাবলুর মনটা তখন খুব নরম রয়েছে। তাকে পটানো খুব সোজা।’
‘কী নাম নিয়ে ভাব জমাল? রূপলেখা দত্ত?’
‘হ্যাঁ। রূপলেখা দত্ত। ওই নামে বাবলুদের ব্যাঙ্কে একজন ক্লায়েন্ট ছিল। তাকে আর তার স্বামীকে বনানী নিশ্চয় চিনত। যত দূর জানি, বনানী একবারই ব্যাঙ্কের ভেতরে বাবলুর সঙ্গে দেখা করেছিল। তখন সে তার নাম বলেছিল রূপলেখা দত্ত । বলেছিল, ব্যাঙ্কে তার একটা বড় অ্যাকাউন্ট আছে। এর পরে যতবার সে বাবলুর সঙ্গে দেখা করেছে সব ব্যাঙ্কের বাইরে।’
‘তারপর?’
অসীমাভ রায় আবার শুরু করার আগেই অশনি এক কাপ কফি হাতে ঘরে ফিরে
এসেছে।
‘বাবা নিশ্চয় বলছে বাবার পেশেন্টের স্ত্রী সেই বনানী দাস প্রতিশোধ নেবার জন্যে রূপলেখা সেজে আমার সঙ্গে অ্যাফেয়ার করেছিল। ওটা বাবার পেট থিয়োরি। আমার কিন্তু এটা মনে হয় না।’ অশনি রায় তার বাবার পাশে বসতে বসতে বলল।
‘আগে আপনার বাবার কথাটা শোনা যাক। তারপর আপনার কথাটা শুনব।’ আদিত্য অসীমাভ রায়ের দিকে তাকাল।
‘আমার আর খুব বেশি কিছু বলার নেই। শুধু এইটুকু বলার যে বনানী লোক দিয়ে মৃত্তিকা এবং তার স্বামীকে খুন করিয়েছিল। এবং তারপর ফোন করে বাবলুকে মৃত্তিকার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। বলেছিল ওটা তার বাড়ি। বাবলু ওখানে পৌঁছে দ্যাখে বাড়ির ভেতর একটি পুরুষ এবং একজন মহিলা মরে পড়ে আছে। তাই দেখে বাবলু ভয় পেয়ে পালিয়ে আসে। কিন্তু ইতিমধ্যে সিসি ক্যামেরায় বাবলুর ছবি উঠে গেছে। তাই দেখে পুলিশ বাবলুকে গ্রেপ্তার করল। বনানী জানত সরাসরি আমার কোনও ক্ষতি করার থেকে আমার ছেলের কোনও ক্ষতি করতে পারলে আমি আরও অনেক বেশি কষ্ট পাব।’
‘কিন্তু একজনের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে বনানী দু’জন নিরপরাধ লোককে খুন করল?’
‘ঠিক বলেছেন। আমার মনে হয় বাবার থিয়োরিতে এটাই সব থেকে বড় ফাঁক।’ এবার অশনির গলা ।
‘ফাঁক নেই, কোনও ফাঁক নেই।’ ডাঃ অসীমাভ রায় দৃঢ় গলায় বললেন। ‘বনানী যদি সরাসরি বাবলুর কোনও ক্ষতি করত তাহলে তো ওর ওপরেই সন্দেহ পড়ত। সেটা হোক ও চায়নি।’
‘পুলিশ কি বনানীর খোঁজ করেছিল?’
‘আমি আমার সন্দেহের কথা পুলিশকে বলেছিলাম। তারপর পুলিশ কি করেছিল আমি বলতে পারব না। তবে কোর্টে কখনও পুলিশ বনানীকে সাক্ষী হিসেবে ডাকেনি।’
‘আপনাদের উকিলও ডাকেনি ?”
‘হ্যাঁ, আমার উকিল, ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী বনানীকে ডেকেছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, আমি যেটা বলছি, অরুণ খুনের মোটিভ হিসেবে কোর্টে সেটাই বলেছিল। কোর্ট থেকে সমনও গিয়েছিল বনানীর নামে। কিন্তু বনানীর কোনও হদিশ পাওয়া যায়নি।’
‘বনানীর কোনও পুরোনো ঠিকানা আপনার কাছে আছে?’
‘আট-দশ বছর আগেকার একটা ঠিকানা বোধহয় আছে। একটু খুঁজতে হবে। খুঁজে পেলে আপনাকে মেসেজ করে দিচ্ছি। তবে কোর্ট থেকে যখন সমন গিয়েছিল, এই ঠিকানায় বনানীকে পাওয়া যায়নি।’
‘বনানীর স্বামীর কীসের ব্যবসা ছিল ?’
‘ধর্মতলায় ওদের একটা রঙের দোকান ছিল। দাস অ্যান্ড সনস। অনেক পুরুষের দোকান। তবে মনোময় দাস মারা যাবার পরে দোকানটা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এখন সেখানে একটা টিভির দোকান হয়েছে।’
‘আমার মনে হয় আসল ঘটনাটা একটু আলাদা। আমি আমার কথাগুলো একটু বলব? জানেন তো হঠাৎ হঠাৎ আমার একটা ব্ল্যাক-আউট হয়ে যায়। সেরকম কিছু হবার আগে আমার কথাগুলো বলে নিতে চাই।’ অশনি রায়ের গলাটা ঈষৎ ব্যাকুল শোনাল।
‘বলুন, বলুন। আদিত্য অশনি রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল। সে এখনও নোট নিচ্ছে।
‘দেখুন, ওই মহিলা, আমি তাকে রূপলেখা বলেই রেফার করছি, আমার সঙ্গে অল্প দিনের মধ্যেই বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সেই ঘনিষ্ঠতার বর্ণনা দিয়ে আপনাকে বোর করব না। শুধু দু’একটা কথা বলা জরুরি। বছর তিনেক আমাদের সম্পর্কটা হবার পর ওই খুনের ঘটনাটা ঘটে। আমরা বাইরেই মিট করতাম। রূপলেখা কখনও আমাকে বলেনি তার বাড়ি কোথায়।’
‘তার মানে আপনি ওই ঘটনার আগে রূপলেখা দত্তর ফ্ল্যাটে কখনও যাননি।’ ‘না, যাইনি। অবভিয়াসলি, রূপলেখার স্বামী ওই ফ্ল্যাটেই থাকত। যাব কী করে? অ্যাকচুয়ালি রূপলেখাও চাইত না আমি ওর বাড়ির কাছাকাছি কোথাও যাই। তাই ও কোথায় থাকে আমাকে কখনও জানায়নি। হয়ত ভাবত, ওর বাড়ির কাছাকাছি গেলে পাড়ার লোক আমাদের একসঙ্গে দেখতে পেয়ে যাবে। তাই আমি কখনও রূপলেখাকে বাড়ি পৌঁছে দিইনি। ওর বাড়ির ঠিকানাও নিইনি। বাড়ি ফেরার সময় ওকে একটা উবারে উঠিয়ে দিতাম।’
‘তার মানে, ফ্ল্যাট বাড়িটার সিকিওরিটি বা অন্য কেউ আপনাকে চিনত না?’ ‘পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের সময় একজন দরোয়ান আমাকে আইডেনটিফাই করেছিল। সে বলেছিল ঘটনার দিন রাত্তিরে সে আমাকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে।’ ‘আপনার বাবা বললেন, ঘটনার রাত্রে একটা ফোন পেয়ে আপনি মৃত্তিকা মিত্রর বাড়িতে যান। এটা একটু ডিটেলে বলবেন ? ‘
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই তো ভাল করে বলতে চাই। ঘটনাটা ঘটার কিছু দিন আগে থেকে রূপলেখা বলছিল আমাদের সম্পর্কটার কথা ওর স্বামী জানতে পেরেছে। এটা নিয়ে বাড়িতে খুব অশান্তি চলছে। মাঝে মাঝেই ওর স্বামী ওর গায়ে হাত তুলছে। এই গায়ে হাত তোলা ব্যাপারটা আমার সঙ্গে রূপলেখার আলাপ হবার আগেও ঘটত। অন্য কোনও অছিলায়। হয়ত স্বামীর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যেই রূপলেখা আমার দিকে ঝুঁকেছিল।’
‘এক মিনিট।’ আদিত্য নোট নেওয়া থামিয়ে বলল। ‘আপনি বললেন, রূপলেখা আপনাকে বলেছিল ওর স্বামী আপনাদের সম্পর্কটার কথা জানতে পেরেছে। কী করে জানতে পেরেছে রূপলেখা কিছু বলেছিল?’
‘আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। রূপলেখা বলেছিল, ওর স্বামী ওর মোবাইলে আমাদের হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাটগুলো দেখতে পেয়েছিল। আমাদের একসঙ্গে তোলা কয়েকটা ইনটিমেট সেলফি ছিল, সেগুলোও দেখেছিল।’
‘মোবাইলটা কি পুলিশ উদ্ধার করেছিল?’
‘হ্যাঁ… রূপলেখার ওই মোবাইলটা মৃত্তিকা মিত্রর ফ্ল্যাটের একটা লুকোনো জায়গা থেকে পুলিশ খুঁজে বার করেছিল।’
‘রূপলেখা দত্তর মোবাইল মৃত্তিকা মিত্রর ফ্ল্যাটে গেল কী করে?’
‘জানি না। আমি সত্যিই জানি না। মোবাইলটা খুঁজে পাবার পর পুলিশ বলছে মৃত্তিকাই মোবাইলটা লুকিয়ে রেখেছিল পাছে তার স্বামী টের পায়। পুলিশ আরও বলছে, রূপলেখার মোবাইল মৃত্তিকার ফ্ল্যাটে খুঁজে পাওয়ার মানে মোবাইলটা মৃত্তিকার। সে রূপলেখা দত্তর নামে মোবাইলটা রেজিস্টার করিয়েছিল এবং সেই মোবাইল থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করত। অর্থাৎ রূপলেখা দত্ত নাম নিয়ে মৃত্তিকাই আমার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল যার জেরে তার স্বামীকে আমার হাতে খুন হতে হয়।’
‘রূপলেখার মোবাইলে কি আপনাদের ইনটিমেট ছবিগুলো ছিল?’
‘পুলিশ যখন মোবাইলটা পেয়েছিল তখন তার মধ্যে আমার সঙ্গে রূপলেখার কোনও ছবি ছিল না। কিন্তু হোয়াট্সঅ্যাপ চ্যাটগুলো ছিল। স্বামীর সঙ্গে অশান্তি হবার পর রূপলেখা ছবিগুলো ইরেজ করে দিয়েছিল। চ্যাটগুলো করেনি। আমার পক্ষে সেটা মোস্ট আনফরচুনেট।’
‘ঠিক আছে। তারপর কী হল বলুন।’
‘মোবাইলের কল লিস্ট এবং ওই চ্যাটগুলো দেখে পুলিশ আমাকে অ্যারেস্ট করল। তার আগে আমার গাড়ির নম্বর থেকে পুলিশ আমাকে ট্রেস করেছিল। গাড়িটা অনেকক্ষণ রাস্তায় পার্ক করা ছিল। রাস্তার সিসি ক্যামেরায় সেটার ছবি উঠে গিয়েছিল।’
‘তারপর কী হল?’
‘তারপর আর কী? ওই যে বললাম, পুলিশ ধরে নিল খুন হওয়া মহিলা আমার অতি পরিচিত। যেহেতু মোবাইলে আমাদের ছবিগুলো আর ছিল না আমি কিছুতেই প্রমাণ করতে পারলাম না যে মহিলার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল সে অন্য একজন।’
‘আপনার মোবাইলে ছবি বা চ্যাটগুলো ছিল না?’
‘আমার মোবাইলেও চ্যাটগুলো ছিল। ছবিগুলো ছিল না।’
‘কেন?’
‘রূপলেখার সঙ্গে ওর স্বামীর অশান্তি হবার পর যখন ও ওর মোবাইল থেকে আমাদের ছবিগুলো মুছে ফেলল তার কয়েকদিন পরেই ও ইনসিস্ট করল আমিও যেন আমার মোবাইল থেকে ছবিগুলো মুছে ফেলি। আমি বললাম, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না? ও সরাসরি কিছু বলল না। শুধু বলল এখন ওর যা মনের অবস্থা তাতে ছবিগুলো কোথাও থেকে গেলে ওর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে। তারপর বলল, পুরুষ জাতটাকে ও আর বিশ্বাস করে না। ওর মনে হচ্ছে ছবিগুলো থেকে গেলে ও ভালনারে হয়ে যাবে। সেটা ও চায় না। তারপর ছবিগুলো মুছে দেবার জন্য ও কাকুতি মিনতি করতে লাগল। ও এত জোরাজোরি করল যে শেষ পর্যন্ত আমি ছবিগুলো মুছে দিতে বাধ্য হলাম। এর পরে আমরা আর এক সঙ্গে ছবি তুলিনি।’
‘কিন্তু চ্যাটগুলো মুছে দিতে বলেনি?’
‘না। বলেনি। হয়ত এই কারণে যে চ্যাট থেকে কাউকে সহজে আইডেন্টিফাই করা যায় না।’
‘হুঁ, বুঝলাম ৷ আচ্ছা বলুন, আপনি অত রাত্তিরে বাঙ্গুর এভিনিউএর ওই বাড়িটাতে গিয়ে হাজির হলেন কী করে?’
‘আমি পুরো ঘটনাটা বললে আপনি বুঝতে পারবেন। যে রাত্তিরের কথা সেদিন আপনাকে বলেছিলাম, মানে যে রাত্তিরে আমি প্রথম রূপলেখাকে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিয়েছিলাম বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম, সেটা ছিল জুন মাসের মাঝামাঝি। কলকাতায় সবে মনসুন এসেছে। তাই অত বৃষ্টি। আর ওই ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটেছিল তিন বছর পরে ফেব্রুয়ারিতে। সে বছর হাড়-কাঁপানো শীত পড়েছিল কলকাতায়। ফেব্রুয়ারিতেও বেশ শীত ছিল। আমি আর রূপলেখা রাত্তির সাড়ে দশটা-পৌনে এগারোটা অব্দি এক সঙ্গে কাটিয়েছিলাম। রাজারহাট নিউ টাউনে একটা নির্জন রেস্টোরান্টে ডিনার সেরে আমি রূপলেখাকে একটা উবারে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। ও বলেছিল, ওর স্বামী আউট অফ টাউন, তাই তাড়াতাড়ি ফেরার কোনও চাপ নেই। রাত্তিরে রাস্তা ফাঁকা, রূপলেখাকে নামিয়ে দিয়ে আমি বেশ চটপট বাড়ি ফিরে আসছিলাম। যখন মা ফ্লাইওভারের কাছে পৌঁছেছি, হঠাৎ রূপলেখার ফোন। শি ওয়াজ সবিং। আমাকে বলল, আমার স্বামী আমার ওপর ভীষণ অত্যাচার করছে, তুমি তাড়াতাড়ি এস। তুমি না এলে ও আমাকে মেরেই ফেলবে। আমার ঠিকানাটা লিখে নাও। ঠিকানাটা বলতে বলতে কেউ যেন ফোনটা ওর হাত থেকে কেড়ে নিল। আমি অবশ্য ঠিকানাটা শুনতে পেয়েছিলাম। ভীষণ ওয়ারিড হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আমি রূপলেখার বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।’
‘বেশ, বেশ। আচ্ছা, আমি ইন্টারনেট থেকে জানলাম পুলিশ বলছে সেই রাত্তিরে রূপলেখা দত্তর মোবাইল থেকে আপনার মোবাইলে কোনও ফোন আসেনি। তা হলে ওই এস ও এস কলটা এল কোথা থেকে?’
‘ওটা এসেছিল রূপলেখাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে। রূপলেখাই বলেছিল ও ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করছে। আমি এটা পুলিশকে বলেওছিলাম। পুলিশ নম্বরটা ভেরিফাই করে নিয়েছিল।’
‘কিন্তু আপনার কথা মতো রূপলেখা এবং মৃত্তিকা যদি আলাদা মহিলা হয় তা হলে রূপলেখা মৃত্তিকা মিত্রর বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করল কী করে?’
‘আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। আমার মনে হয়, রূপলেখা তার সঙ্গী বা সঙ্গীদের নিয়ে মৃত্তিকা মিত্রর বাড়ি গিয়েছিল। গিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে খুন করার পর আমাকে বাড়ির ল্যাগুলাইন থেকে ফোনটা করেছিল।’
‘রূপলেখা মৃত্তিকা এবং পার্থ মিত্রকে খুন করবে কেন?
‘এটা আমি বলতে পারব না। শুধু বলতে পারি আমাকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে।’
বাইরে একটা পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
অসীমাভ রায় বললেন, ‘নাদের বোধহয় ফিরে এল। আমি একটু চা করতে বলি। এই গল্পটা আমি এতবার শুনেছি, আর একবার না শুনলেও চলবে।’
অসীমাভ রায় বেরিয়ে যেতেই আদিত্য চাপা গলায় বলল, “একটা প্রশ্ন আপনার বাবার সামনে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছিল। এবার জিজ্ঞেস করছি। আপনার সঙ্গে রূপলেখা দত্তর কি কোনও শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল?’
অশনি রায় মাথা নিচু করে আছে। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, ‘হ্যাঁ হয়েছিল। রাজারহাটের একটা বাড়িতে রূপলেখার সঙ্গে আমি কয়েকবার শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিলাম।’
‘আর একটা প্রশ্ন। মৃত্তিকা মিত্রকে আপনি কতটা চিনতেন?’
‘খুব সামান্য চিনতাম। আমাদের ব্যাঙ্কে ওঁর কম্পানির একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। সেই কারণে আমাদের ব্যাঙ্কে উনি মাঝে মাঝে আসতেন। ফলে মুখ চিনতাম। যতদূর মনে পড়ছে আমাকে উনি কাজের সূত্রে দু’একবার ফোনও করেছিলেন।’
‘ঠিক আছে। তারপর কি হয়েছিল, বলুন।’
‘আমি যখন ঠিকানা খুঁজে রূপলেখার ফ্ল্যাটে পৌঁছলাম তখন রাত্তির এগারোটা বেজে গেছে। বাড়ির মেন গেট বন্ধ। একজন সিকিউরিটি গার্ড গেটের সামনে বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে। লোকটাকে ডেকে তুলতে হল। অত রাত্তিরে আমি ভেতরে যাব শুনে বেশ অবাক হল লোকটা। অনেক চেঁচামিচির পরে গেটটা খুলে দিল। পরে ওই লোকটাই কোর্টে আমাকে আইডেনটিফাই করে। রূপলেখা বলেছিল ওরা টপ ফ্লোরে থাকে। আমি লিফট দিয়ে উঠে রূপলেখাদের ফ্ল্যাটে বেল বাজালাম।
কী করে বুঝলেন ওটা রূপলেখাদের ফ্ল্যাট?’
‘ফ্ল্যাটের দরজায় ফ্ল্যাটের নম্বর লেখা ছিল।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? আমি পৌঁছবার আগেই ফ্ল্যাটের মধ্যে ওই দু’জন খুন হয়ে গিয়েছিল।’
‘বাড়ির দু’জনেই যদি খুন হয়ে থাকে তাহলে দরজা খুলল কে?’
‘একজন লোক দরজা খুলেছিল। আমি ধরে নিয়েছিলাম সে ওই বাড়িতে কাজ করে। মানে, চাকর বা রান্নার ঠাকুর। পরে বুঝেছিলাম আসলে সে একজন ভাড়া করা খুনি। সে-ই খুনটা করেছিল। কিন্তু খুনটা করে তখনও পালিয়ে যেতে পারেনি। লোকটাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেমসাহেব কোথায়? ও বলল, মেমসাহেব আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আপনি সোজা বেডরুমে চলে যান। বলে বেডরুমটা দেখিয়ে দিল। আমি লোকটাকে পাশ কাটিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেডরুমের দিকে এগোতে যাব, লোকটা পেছন দিক থেকে আমার নাকের ওপর একটা রুমাল চেপে ধরল। ক্লোরোফর্ম বা ওই রকম একটা কিছু ছিল রুমালটায়। আমি জ্ঞান হারালাম।’
‘কতক্ষণ আপনার জ্ঞান ছিল না?’
‘কিছুক্ষণ তো হবেই। ধরুন এই আধ ঘন্টা। আমি অবশ্য ঘড়ি দেখিনি। আন্দাজে বলছি।’
‘নিজের থেকেই জ্ঞান ফিরে এল?”
‘হ্যাঁ, নিজের থেকেই জ্ঞান ফিরে এল। জ্ঞান হতে দেখলাম ফ্ল্যাটের ভেতরে মেন দরজাটার সামনে পড়ে আছি। চারদিক অন্ধকার। কেউ নেই। শুধু বেডরুমের আধখোলা দরজা দিয়ে একটা আলো ভেসে আসছে।’
‘বুঝতে পারছি। তা আপনি তারপর কী করলেন?’
‘আমি কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও কোনও রকমে উঠে দাঁড়ালাম।’
আদিত্যর মনে হল অশনি রায়ের দৃষ্টিটা বর্তমান কালে নেই। সেদিনের ঘটনাগুলো যেন সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
‘আমি খানিকটা টলতে টলতে বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম।’ ভূতে পাওয়া মানুষের মতো অশনি রায় বলল।
“গিয়ে কী দেখলেন? ‘
‘দেখলাম দুটো মৃতদেহ। একটা পুরুষের, অন্যটা মহিলার। পুরুষের মৃতদেহটা মেঝেতে, কার্পেটের ওপরে। মহিলার মৃতদেহের আধখানা বিছানায়, আধখানা মাটিতে। চারদিকে থোকা থোকা রক্ত। পরে শুনেছিলাম পুরুষটিকে গুলি করে মারা হয়েছে। পিস্তলটা পাশেই পড়েছিল। কিন্তু মহিলাটিকে গুলি করা হয়নি। তার মাথা ভারি কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।’
অশনি রায় দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। তারপর মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে চেয়ারে হেলান দিল। চোখ বন্ধ। তাকে প্রথম দিনের মতোই অসুস্থ লাগছিল। আদিত্য চুপ করে বসে আছে। মিনিট পাঁচেক পরে ডাঃ অসীমাভ রায় ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে পেছনে চায়ের সরঞ্জাম হাতে নাদের।
অসীমাভ রায় ছেলেকে দেখে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘আবার কী হলো?’ বাবার গলা শুনে অশনি চোখ খুলে বলল, ‘না, না। কিছু হয়নি। আমি একটু ঘরে গিয়ে শুচ্ছি।’
আদিত্যর মনে হল অশনি রায় আজ আর কথা বলবে না।
একটু পরে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আদিত্য অসীমাভ রায়কে বলল, ‘আমাকে আপনি ঠিক কী করতে বলছেন?’
‘আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে আমরা যে রেসপাইটটা পেয়েছি সেটা সাময়িক। সম্ভবত পুলিশ খুব শিগগির ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছে। হাই কোর্টে আমার প্রধান ভরসা ছিল আমার পুরোনো বন্ধু অরুণ, ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী। অরুণ আর আমি এক সঙ্গে বিলেতে ছিলাম। ফ্ল্যাট শেয়ার করেছি। অরুণ আইন পড়ত, আমি ডাক্তারি। সে আর নেই। আমরা কার ওপর ভরসা করব?’
অসীমাভ রায় কিছুক্ষণ থেমে রইলেন। ভাবছেন।
‘আমি চাইছি রূপলেখা দত্ত পরিচয় দিয়ে যে মেয়েটা বাবলুর ঘনিষ্ঠ হয়েছিল, আপনি তাকে খুঁজে বার করুন। তাহলে আমরা ভাল করে লড়তে পারব। অরুণের মতো কাউকে অবশ্য পাব না। তবু ওই মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া গেলে আমাদের সমস্যা অনেক কমে যাবে।’