মৃত্তিকার মৃত্যু – ৪
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
(১)
সকাল থেকে মাথার ভেতর ভৈরবী ঘুরছে। নিশ্চয় সেদিন রসলুন বাই শোনার ফল। আদিত্য কফির কাপ টেবিলে রেখে ল্যাপটপে বিসমিল্লার ভৈরবী লাগাল । বিসমিল্লা খান সুর লাগানোর মিনিট খানেকের মধ্যে আদিত্যর চোখে জল। তিন-চার মিনিটের মাথায় চোখের জল গালে নেমেছে। কেয়া দেখতে পেলে লজ্জার ব্যাপার হতো। ভাগ্যিস কেয়া এখনও ওঠেনি। আদিত্য ভাবছে, এত সুর পেল কোথায় লোকটা ? ভাবছে, এত দুঃখ কোথায় জমা হয়ে ছিল? আরও ভাবছে, বিয়ের দিন সকালে সানাইতে ভৈরবী বাজায় কেন? দুঃখ কীসের? নিশ্চয় মেয়ে বাপের বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে, সেই দুঃখ। বাবুল মোরা নৈহারে ছুটো হি যায়, ভৈরবীর সেই গানটা যেমন। তারপর কী আশ্চর্য সানাই যখন দ্রুত গতে পৌঁছোয়, বিসমিল্লা যেমন এইমাত্র পৌঁছলেন, ততক্ষণে মেজাজ পালটে গেছে। এবার আনন্দের সুর। নতুন জীবনের আনন্দ? আদিত্যর অন্তত এইরকম করে ভাবতে ভাল লাগে। পণ্ডিতেরা কেমন করে
ভাবে কে জানে ?
আটটা নাগাদ কেয়া উঠে ঘুম চোখে চায়ের জল বসাল। আদিত্য ততক্ষণে চান-টান করে বেরোবার জন্যে তৈরি।
‘এত সকালে কোথায় যাচ্ছ? ব্রেকফাস্ট খাবে না?’ কেয়া একটু অবাক হয়েছে। আদিত্য এত সকালে সচরাচর বেরোয় না।
‘যাচ্ছি অমলা তরফদারের বাড়ি। লোকাল পুলিশের সঙ্গে। সুভদ্রও যাচ্ছে। জয় তরফদারের ঘরটা ভাল করে দেখতে হবে। কীভাবে ড্রাগটা ড্রাগ-ইউজারের কাছে পৌঁছচ্ছে পুলিশ কিছুতেই বুঝতে পারছে না। শুধু জয় তরফদারের ক্ষেত্রে নয়, আরও অনেকগুলো ক্ষেত্রে।
‘কখন ফিরবে?’
‘বলা মুস্কিল কখন ফিরব। বেশি দেরি হয়ে গেলে সোজা আপিসে চলে যাব। তুমি চিন্তা কোরো না ।’
‘ব্রেকফাস্ট খাবে কোথায়? একটু বোসো। আমি ওটস আর ডিমসেদ্ধ করে দিচ্ছি। দু’মিনিটে হয়ে যাবে।’
দু’মিনিটে হয়ত হবে না। কিন্তু কুড়ি মিনিট লাগলেও কেয়া একবার যখন বলেছে তখন ব্রেকফাস্ট না খাইয়ে ছাড়বে না। ভালই হল। বাড়িতে ব্রেকফাস্ট খেয়ে না বেরোলে বাইরে সিঙাড়া-কচুরি খেতে হতো। ওগুলো আজকাল আর সহ্য হচ্ছে না। হাতে কিছুটা সময় আছে। সুভদ্র মাজি আধঘন্টার আগে আসছে না। আদিত্য ইউ টিউবে আর একটা গান লাগাল। সামন্ত সারং। সত্তর দশকের শেষ দিকে নিভৃতিবুয়া সরনায়েকের গাওয়া।
ওয়েস্ট রেঞ্জ রাস্তাটা বেকবাগান অঞ্চলে। দৈর্ঘ্য বেশি নয়। তার মধ্যেই নানা ধর্মের বাস। খ্রীস্টান, মুসলমান, হিন্দু। দু’এক ঘর শিখও আছে। ধর্মবৈচিত্র্যের মতো শ্রেণিবৈচিত্র্যও চোখে পড়ার মতো। পুরোনো মোটর গ্যারেজের গা ঘেঁসে নতুন গাড়ির শো রুম। হাল ফ্যাশানের অভ্রভেদী, তার পাশে ষাট-সত্তর বছরের ভেঙে-পড়া এজমালি বাসাবাড়ি। অমলা তরফদারের বাস এইরকমই একটা এজমালি বাড়ির তিনতলায় ৷
বাড়ির সামনে কয়েকজন যুবক গুলতানি করছে। দোরগোড়ায় পুলিশের জিপ দাঁড়াতে দেখেও এদের তেমন হেলদোল দেখা গেল না। হাবভাব দেখে মনে হয় এখানে মাঝে মাঝেই পুলিশ আসে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই নোংরা একসার সিঁড়ি পাঁচতলা অব্দি উঠে গেছে। সিঁড়ির দেয়ালে পলেস্তারা খসে গিয়েছে, কোণে মাকড়সার জাল। প্রত্যেক তলায় অন্তত চারটে পাঁচটা করে পরিবারের বাস। বারোয়ারি বারান্দা। বারান্দায় বালতি, ঝ্যাঁটা, জুতোর র্যাক। জামাকাপড় শুকোচ্ছে। জরাজীর্ণ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দম্পতী রঙ-চটা বেতের চেয়ারে বসে খবর কাগজ পড়ছে। তার পাশে মাঝবয়সী মুসলমান গৃহবধূ মেঝেতে সেমাই শুকোতে দিচ্ছে। পুলিশ দেখে সকলেই একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার নিজেদের কাজে মন দিল।
‘একটা ভাল ব্যাপার দাদা, পুলিশ নিয়ে এদের কোনও কৌতুহল নেই। না হলে ক্রাউড সামলাতেই অর্ধেক এনার্জি চলে যেত।’ সুভদ্র সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বলল।
আদিত্য অন্য কথা ভাবছিল। বলল, ‘আচ্ছা, সেদিন আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসে তুমি যে বললে কী একটা ব্যাপারে আমার সাহায্য চাও, ব্যাপারটা পরে খুলে বলবে, সেটা কি এই ড্রাগ পেডলিং-এর ব্যাপার? যেটার কথা গৌতম বলল?’
—হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেটাই। দাশগুপ্ত সাহেব আমাকে এক্সক্লুসিভলি এই কাজটার ভার দিয়েছেন। অন্য সব কাজ থেকে আমি কিছুদিনের জন্য রেহাই পেয়েছি। কাজটার ভার দিয়ে দাশগুপ্ত সাহেব বলেছিলেন উনি চেষ্টা করছেন আপনাকেও যাতে এই ব্যাপারটায় ইনভলভ করা যায়। আপনাকে দাশগুপ্ত সাহেব তো কেসটা নিয়ে মোটামুটি ব্রিফ করে দিয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ব্যাপারটা মোটামুটি জেনেছি। আরও কিছু জানার থাকলে পরে তোমার কাছ থেকে জেনে নেব।’
কথা বলতে বলতে আদিত্যরা দু’জন তিনতলায় পৌঁছে গিয়েছিল। অমলা তরফদারের বাসা চিনতে অসুবিধে হল না। সদর দরজার সামনে করেয়া থানার মেজবাবু শশীধর মিশ্র দুজন কনসটেবল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যদের দেখে এগিয়ে এসে বলল, ‘বড়বাবু একটা কাজে আটকে পড়েছেন। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। বললেন, সেদিন যখন এই ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল, আপনিই তো কেসটা ইনভেসটিগেট করেছিলেন। আপনি ব্যাপারটা জানেন। আপনিই যান।’
আদিত্য বুঝতে পারল না বড়বাবুর কাজ আছে বলে শশীধরকে পাঠানো হল, নাকি শশীধর ব্যাপারটা খানিকটা জানে বলে।
সদর দরজাটা ভেজানো ছিল। দরজা ঠেলে প্রথমে শশীধর ভেতরে ঢুকল, পেছন পেছন আদিত্য এবং সুভদ্র মাজি। কনসটেবল দু’জন বাইরে পাহারায় রয়েছে।
সামনের ঘরে দু’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বসে আছে। একজন চেয়ারে, একজন তত্তোপোষের ওপর। চোখের দৃষ্টিতে সাড় নেই। পুলিশ দেখে দু’জনেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। এরাই মনে হয় অমলা তরফদারের শ্বশুর-শাশুড়ি। ভেতরের একটা ঘর থেকে অমলা তরফদার বেরিয়ে এসেছে।
‘ও বৌমা আমাদের খেতে দিলে না? সকাল থেকে চা-টাও তো দিলে না। সেই কখন থেকে মুখ ধুয়ে বসে আছি।’ বুদ্ধের গলায় অসহায়তা ঝরে পড়ছে। গতকাল বাড়িতে যে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে সেটা এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কতটা বুঝতে পারছে সন্দেহ।
‘আপনারা ভেতরে আসুন। আমার ছেলের ঘরটা দেখবেন তো?’ অমলা তরফদারকে দেখে মনে হয় যেন একটা মরা মানুষ কথা বলছে।
ঘরটা তালাবন্ধ। শশীধর পকেট থেকে চাবি বার করে তালা খুলল। ঘর বলা শক্ত। ছ’ফুট বাই ছ’ফুটের একটা কুঠুরি। একটা তক্তাপোষ ঘরের চোদ্দ আনা দখল করে আছে। বাকি দু’আনায় টেবিল-চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা প্লেটে খাবারের ভুক্তাবশেষ। একটা আধখাওয়া পাঁউরুটি, খানিকটা ঘুগনি। একটা কাপের অর্ধেক ভর্তি চা। চায়ের ওপর সর পড়েছে। টেবিলের পেছন দিকে দেয়ালে হেলান দিয়ে দু’চারটে ইস্কুল-পাঠ্য বই সাজানো রয়েছে। জয় তরফদার যখন পড়াশোনা করত তখনকার স্মৃতি। চেয়ারে আধময়লা জামা-প্যান্ট, গেঞ্জি-জাঙিয়া, বেশ ময়লা একটা রুমাল। একটা ছোট কাঁচি। একটা খুব ছোট চিমটে। চেয়ারটা বসার কাজে ব্যবহার হতো বলে মনে হয় না।
তত্তোপোষের পেছনে দেয়ালটার রঙ উঠে গেছে। আদিত্য আন্দাজ করল জয় তরফদার, চেয়ারে না বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে তত্তোপোষে বসত। মেসে থাকার সময় এই অভ্যাসটা আদিত্যরও ছিল।
‘খাবার এবং চা ফরেনসিকে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন।’ সুভদ্র শশীধরকে বলল।
‘স্যার।’ শশীধর সসম্ভ্রমে বলল।
ঘরের সংলগ্ন একটা পায়রার খোপের মতো ছোট বাথরুম। নোংরা। অতিশয় দুর্গন্ধযুক্ত। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে আদিত্য তার মধ্যে ঢুকল। পেছন পেছন সুভদ্ৰ।
শশীধর বাইরে। সে মনে হয় আগেই একবার ভেতরটা দেখে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে বাথরুমটা থেকে বেরিয়ে এল আদিত্য। সঙ্গে সুভদ্র। বাথরুমে দরকারি কিছু নেই।
ঘরে ছোট একটা জানলা আছে। সেটা খোলা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে পাশের বাড়ির খানিকটা দেখা যায়। আদিত্য জানলা দিয়ে উঁকি মারল। একটা খাবার টেবিল দেখা যাচ্ছে। এক বৃদ্ধ টেবিলে বসে আছে। চা খাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই। এক বৃদ্ধা ঘরে ঢুকল। ম্যাক্সি পরা। মাথা প্রায় সাদা। টেবিলের ওপর কিছু একটা রাখল। মনে হচ্ছে হালুয়া জাতীয় কিছু। নিশ্চয় বৃদ্ধের প্রাতরাশ। আদিত্য জানলা থেকে সরে এল। একজন মানুষের দৈনন্দিন খাওয়ার ব্যাপারটা এতটাই ব্যক্তিগত যে সেখানে উঁকি মারতে ইচ্ছে করে না ৷
‘কনসটেবল দু’জনকে ডাকুন। ঘরটা ভাল করে সার্চ করতে হবে।’ আদিত্য শুনতে পেল সুভদ্র শশীধরকে নির্দেশ দিচ্ছে।
কনসটেবল দু’জন ঘরে আসার পর সুভদ্র তাদের বলল, “খুব ভাল করে ঘরটা খুঁজে দেখুন কোথাও ড্রাগ পাওয়া যায় কিনা। শশীবাবু আপনিও ওদের একটু হেল্প করুন। আমিও করছি।’
এর পরের পনের কুড়ি মিনিট ঘর তোলপাড় করে খোঁজাখুঁজি চলল। তত্তোপোষের তোষক উলটে দেখা হল, টেবিলের বইপত্র সরিয়ে দেখা হল, টেবিল সরিয়ে দেখা হল, তক্তোপোষ সরিয়ে দেখা হল, চেয়ারের জিনিসপত্র নামিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। কোথাও ড্রাগের চিহ্ন নেই। সৌভাগ্যক্রমে ঘরটা ছোট। খুব বেশি খোঁজার জায়গা নেই ।
পুরো ব্যাপারটায় আদিত্য নীরব দর্শক।
পুলিশের দল যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছে, দেয়ালের একটা ফাটলের দিকে আঙুল দেখিয়ে সুভদ্র হঠাৎ বলে উঠল, “ওই ফাটলটার ভেতরে দেখ তো, কিছু পাও কিনা।’
একজন কনসটেবল ফাটলটার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। ফাটলটা এতই ছোট যে একটা আঙুলও ঢোকে না।
আদিত্য বলল, ‘চেয়ারের ওপর যে চিমটেটা ছিল ওটা ব্যবহার করে দেখতে পারেন।’
চিমটেটা ভেতরে ঢোকাতেই তার মুখে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের প্যাকেট উঠে এল। চিনে দোকান থেকে খাবার আনলে যেরকম প্যাকেটে ভিনিগারে ভেজানো লঙ্কার কুচি দেয়, সেরকম প্যাকেট। সাইজে আর একটু বড়। প্যাকেটের মুখটা সযত্নে কাঁচি দিয়ে কাটা হয়েছে। তারপর একটা রবার ব্যান্ড জড়িয়ে প্যাকেটের কাটা মুখটা বন্ধ করা রয়েছে। কারণ প্যাকেটের ভেতরে বেশ কিছুটা সাদা গুঁড়ো এখনও অবশিষ্ট আছে।
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সুভদ্র বলল, ‘হেরোইন। আমি এটা পরীক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছি।
মনে হচ্ছে যেটা আমরা খুঁজছিলাম সেটা পাওয়া গেছে।’
‘আসল প্রশ্নটার কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না। এই বস্তুটা এখানে এল কী করে? অমলা তরফদার তো পুলিশের কাছে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন বাইরের কেউ এই ঘরে ঢুকতো না। আর তিনি যখন স্কুলে যেতেন, জয়কে ঘরে খাবার দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চলে যেতেন। তিনি বলেছিলেন না, জয় হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর থেকে এই ব্যবস্থাই চলছিল?’ আদিত্য নিজের মনে বিড়বিড় করছে।
‘হয়ত জিনিসটা আগে থেকেই এই ফাটলের মধ্যে মজুত করা ছিল।’ সুভদ্র বলল। ‘হতে পারে। হতেও পারে।’ আদিত্যর গলা শুনে মনে হল সে এখনও অনিশ্চয়তায় ভুগছে।
‘আপনার অন্য কিছু মনে হচ্ছে?” সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘দু’একটা ব্যাপারে বেশ খটকা লাগছে।’ আদিত্য অন্যমনস্ক গলায় বলল। ‘দ্যাখো, সপ্তাহ খানেক আগে জয় তরফদার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিল। তারপর থেকে সে এখানেই ছিল। ধরা যাক, এর মধ্যে বাইরে থেকে কোনও সাপ্লাই আসেনি। অর্থাৎ জয় হাসপাতালে যাবার আগে থেকেই প্যাকেটা ওখানে রাখা ছিল। প্যাকেটটার দিকে যদি তুমি তাকাও তাহলে বুঝবে ওটা প্রায় ভর্তি রয়েছে। অর্থাৎ ওটার থেকে একবারের বেশি শট নেওয়া হয়নি। কিন্তু তাহলে এটাও ধরে নিতে হবে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর কয়েকদিন জয় তরফদার ড্রাগ নেওয়া থেকে বিরত ছিল। হয়ত সে তার নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। তারপর শেষে আর থাকতে না পেরে সে লুকোনো জায়গা থেকে প্যাকেটটা বার করে ড্রাগটা নিয়ে ফেলে এবং অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তুমি মোটামুটি এটাই বলতে চাইছ তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। মোটামুটি এটাই।’
‘এই রকম ঘটা অসম্ভব আমি বলছি না। কিন্তু আগের বার যেদিন জয় তরফদার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল তার পরের দিন আমি শশীধরের সঙ্গে এই বাড়িতে এসে জয়ের ঘরটা খুব ভাল করে সার্চ করেছিলাম। তত্তোপোষের তোষকের তলা থেকে এই রকম একটা রবার ব্যান্ড জড়ানো মুখ-খোলা হেরোইনের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি সেই সময় ওই ফাটলের মধ্যে কোনও ড্রাগের প্যাকেট লুকোনো ছিল না। তাহলে প্যাকেটটা ওখানে এল কী করে ? নিশ্চয় অমলা তরফদার ওখানে প্যাকেটটা লুকিয়ে রাখেনি?’
সুভদ্র মাজিকে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ দেখাচ্ছিল। আদিত্য শশীধরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পাশের বাড়িতে যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকেন তাদের সঙ্গে কথা বলব। আপনি একটু দেখবেন?
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। একবার অবশ্য আমি কথা বলেছি।’
পাশের বাড়ির সদর দরজায় দুটো নাম লেখা। জন শান্তনু গোমস, মার্গারেট মৃদুলা গোমস। খ্রিষ্টান পরিবার সন্দেহ নেই। কিন্তু বাঙালি কি? শশীধরকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত, কিন্তু তার দরকার হল না। জিজ্ঞেস করার আগেই অমলা তরফদারের জানলা দিয়ে দেখা সেই পাকা মাথার বৃদ্ধা দরজা খুলে দিয়েছেন। শশীধরকে দেখে তার ভুরু ঈষৎ কুঞ্চিত।
পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘আর একবার আসতে হল ম্যাডাম। লালবাজার থেকে এঁরা এসেছেন। একবার আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে চান।’
‘আমাদের যা বলার তো বলেই দিয়েছি। আমার স্বামীর শরীরটাও ভাল নেই।’ বৃদ্ধা গলার বিরক্তিটা ঢাকার চেষ্টা করলেন না।
‘আমরা খুব অল্প সময় নেব ম্যাডাম। আমি কথা দিচ্ছি, দশ মিনিটের বেশি আপনাদের বিরক্ত করব না।’ আদিত্য ক্ষমা চাওয়ার গলায় বলল।
সেই বৃদ্ধ এখনও খাবার টেবিলেই বসে আছেন। সামনে খোলা খবরের কাগজ। কাছে একটা সোফায় সুভদ্র আর আদিত্য গিয়ে বসে পড়ল। শশীধর দাঁড়িয়ে আছে। মৃদুলা গোমেস খাবার টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন ।
‘জয় তরফদারকে তো আপনারা বড় হতে দেখেছেন, তাই না?’ আদিত্য আলগোছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
কেউ উত্তর দিচ্ছেন না। হয়ত একজন ভাবছেন অন্যজন উত্তরটা দেবেন। ‘জয়কে কি আপনারা ছোট থেকেই চিনতেন?’ আদিত্য আর একবার প্রশ্নটা করল। এবার সরাসরি মৃদুলাকে।
‘ক্লাশ সিক্স-সেভেন অব্দি বলতে গেলে জয় আমাদের বাড়িতেই থাকত। ওর বাবা খুব অল্প বয়সে মারা যায়। ছেলে মারা যাবার পরে জয়ের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। মাথাও ভাল কাজ করত না। জয়ের মা তো সেই সকালে স্কুলে বেরিয়ে যেত। স্কুলের পর আর একটা চাকরি করে বেশ রাত্তিরে ফিরত। জয়কে কে দেখবে? জয় স্কুলের পর আমাদের বাড়িতেই চলে আসত। রাত্তির অব্দি থাকত।’
‘আমার বড় ছেলে প্যাট্রিক কুড়ি বছর আগে ক্যানাডা চলে গেছে। ছোট ছেলে বেঞ্জামিন অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিল। তারপর সেও ফ্যামিলি নিয়ে নিউজিল্যান্ড চলে গেল।’ শান্তনু গোমেস এতক্ষণে মুখ খুলেছেন। ‘আমরা ভীষণ একা হয়ে গেলাম। এই সময় জয় আমাদের বাড়িতে অনেকক্ষণ থাকতে শুরু করে। আমাদের খুব ভাল লাগত। ভীষণ ভাল লাগত। জয়কে আমরা যত ভালবাসতাম আমাদের নিজের নাতি-নাতনিদেরও ততটা বাসি না। জয় চলে যেতে আমরা শ্যাটার্ড হয়ে গেছি।’
‘জয় যে বদলে গেল, খারাপ সঙ্গে পড়ল, এটা কবে থেকে?’ সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘জয় যখন নাইন-এ পড়ে তখন আমরা প্রায় এক বছর দেশে ছিলাম না। রিটায়ার করার পর দুই ছেলের কাছে ছ’মাস করে কাটিয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি জয় একেবারে বদলে গেছে। স্বভাবটা রুক্ষ হয়ে গেছে। ডাকলেও আসতে চায় না। চেহারাটাও খারাপ হয়ে গেছে। এ যেন অন্য কোনও জয়। মনে হয়, আমরা যখন ছিলাম না, তখন জয়কে দেখার কেউ ছিল না। ওর নিজের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা তো ভেজিটেবল হয়ে গেছিল। অমলাও বাড়ি থাকত না। জয় কুসঙ্গে পড়ল। ওই তখন থেকেই মনে হয় ও ড্রাগ নেওয়া শুরু করে।’ শান্তনু গোমেস থামলেন।
‘আগে ছেলেটা খেতে কী ভালবাসত। কত কী রান্না করে ওকে খাওয়াতাম। ইদানীং ডাকলেও আসত না। জানলা দিয়ে দেখতাম দুপুরবেলা ঘরে বসে রোজ একই খাবার খেয়ে যাচ্ছে। সেই পাঁউরুটি আর ঘুগনি। তাও বাড়িতে বানানো নয়। নিচের দোকান থেকে আনা। বাড়িতে রান্নার লোক নেই, অমলাও সকাল-সকাল বেরিয়ে যায়, কে রান্না করবে? একটা সময় ছেলেটা পাঁউরুটি খেতেই চাইত না। এখন দেখি রোজই ওই অখাদ্য খেয়ে যাচ্ছে। দেখে বুকটা ফেটে যায়। রাত্তিরে অবশ্য অমলা রান্না করে।’ মৃদুলা গোমেসের স্বরে কান্না রয়েছে।
‘আচ্ছা, আপনারা তো জানলা দিয়ে সারাদিনই জয়কে দেখতে পেতেন, ও কখন ড্রাগ নিচ্ছে বা ড্রাগটা আসছে কোথা থেকে, সেসব বুঝতে পারতেন?’
‘না, কিছুই বুঝতাম না। দেখুন, সারাক্ষণ তো আর আমরা ওর ওপর নজর রাখতাম না। কোনও এক ফাঁকে আমাদের চোখ এড়িয়ে ড্রাগ নেওয়া শক্ত ছিল না। বিশেষ করে দুপুরে বা রাত্তিরে আমরা যখন ঘুমোচ্ছি। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, ড্রাগটা ও পেত কী করে? ওর মা তো ওর ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে রাখত।’ মৃদুলা বললেন।
‘ওকে খাবার দিত কে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সকালে স্কুলে যাবার আগে অমলা ওকে ব্রেকফাস্ট দিয়ে যেত। রাত্তিরে ফিরে এসে ডিনার দিত।’
‘আর দুপুরবেলা?’
‘আমি যতদূর জানি, নিচের একটা চায়ের দোকান থেকে রুটি-ঘুগনি আসত । একটা ছেলে এসে ওটা দিয়ে যেত। পরে কাজের মাসি জয়ের ঘরের তালা খুলে খাবারটা ওর ঘরে পৌঁছে দিত। জয়ের ঠাকুর্দা-ঠাকুমা দুপুরে মুড়ি খেত।
‘কাজের মাসির বা ওই চায়ের দোকানের ছেলেটার হাত দিয়ে কি ড্রাগটা জয়ের কাছে পৌঁছনো সম্ভব ? ‘
‘চায়ের দোকানের ছেলেটার কথা জানি না। কিন্তু নিরুপমা বলে ওই কাজের মাসি আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে অনেকদিন কাজ করছে। অমলাদের বাড়িতেই বোধহয় ওর পনের-কুড়ি বছর হয়ে গেল। ও এরকম কাজ করবে বলে মনে হয় না।’
শান্তনু গোমেসের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আদিত্য শশীধরকে জিজ্ঞেস করল, ‘চায়ের দোকানে খোঁজ নিয়েছিলেন? যেখান থেকে রুটি-ঘুগনি আসত?’
‘খোঁজ নিয়েছি স্যার। রাস্তার চায়ের দোকান। ঘুগনি পাঁউরুটি, মাখন টোস্ট, ডিম-রুটি, দিশি কম্পানির কেক আর কয়েক রকম দিশি বিস্কুট। এর বাইরে আর কিছু পাওয়া যায় না। তবে কাছেই একটা ফ্যাক্টারি আছে বলে দোকানটায় বেশ বিক্রি । এখান থেকে মাসিক ব্যবস্থায় জয় তরফদাদের জন্যে পাঁউরুটি ঘুগনি আসত। তেল ঝাল ছাড়া। এর বেশি আর কিছু জানা যাচ্ছে না।’
(২)
সন্ধের মুখে ঝড় এল। আদিত্য তখনও আপিসে। ভাবছিল এবার বেরোবে, ঝড় উঠতে দেখে ঠিক করল আরও কিছুক্ষণ আপিসে থেকে যাবে। কফির জল বসাল। সিগারেট ধরাল। জানলার শার্শিতে ঝড়ের শব্দ। নিচে বউবাজার স্ট্রিট উত্তাল হয়ে উঠেছে। দমকা হাওয়া বর্ষশেষের আবর্জনা, কাগজ, প্লাস্টিক, ঝরা পাতা, উড়িয়ে বিবাদী বাগের দিক থেকে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একটা বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং ঝড়ে শব্দ করে কাঁপছে। একটা জারুল গাছ এত দুলছে যে ভয় হয় এই বুঝি উপড়ে পড়বে। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। হঠাৎ টেলিফোন।
‘আমি ডাঃ অসীমাভ রায় বলছি। অশনি রায়ের বাবা। আপনি কি আজ একটু রাত্তিরের দিকে, মানে এই সাড়ে আটটা ন’টার পরে, আমার চেম্বারে একবার আসতে পারবেন? ন’টার পরে এলেই ভাল হয়। আমার ততক্ষণে রুগি দেখা শেষ হয়ে যাবে।’ অসীমাভ রায়ের গলাটা থমথমে। মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে।
‘কী হল? কোনও সমস্যা হয়েছে?’ আদিত্য প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিজ্ঞেস করল। “হ্যাঁ, সমস্যা একটা হয়েছে। কিন্তু ফোনে সেটা বলা যাবে না। তাই আপনাকে আসতে বলছি। ব্যাপারটা বাবলুও জানে না। এক্ষুনি জানাতেও চাই না। তাই চেম্বারে আসতে বললাম। আসতে পারবেন তো?’
‘ঠিক আছে। চলে আসছি।’ আদিত্য ফোন রেখে দিল।
আদিত্য ঘড়িতে দেখল মাত্র ছ’টা দশ। এখান থেকে হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট যেতে বড় জোর আধঘন্টা। বাকি সময়টা কাটাবে কী করে? কেয়া আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে বলেছিল। ফিরে আদিত্যকে নিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে যাবে। সেই ড্রাইভার যার নাম আদিত্য জানত গোপু, কিন্তু আসলে নাকি সৌমিত্র। কেয়াই কথা বলবে, কিন্তু তার মতে একজন পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকা দরকার। কেন দরকার, আদিত্য অবশ্য জানে না। যাই হোক সে কেয়ার সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছিল। এখন যেতে পারবে না বললে কেয়া বেজায় চটবে।
পরশু কেয়ার নতুন গাড়ি আসছে। তার আগে ড্রাইভার ঠিক করা খুবই দরকার ছিল। গত কুড়ি-পঁচিশ বছর আদিত্য গাড়ি চালায়নি। এতদিন পরে গাড়ি চালাতে একটু ভয়-ভয় করবে। বিশেষ করে নতুন গাড়ি। একটু ধাক্কা লেগে গেলে, দাগ হয়ে গেলে, মন খারাপ। শো-রুম থেকে গাড়িটা অবশ্য কম্পানির লোক পৌঁছে দেবে। কিন্তু তারপর? যেখানে গাড়িটা রাখা হবে সেখানে ঘেঁষ ঘেঁষ করে অনেকগুলো গাড়ি থাকে। প্র্যাকটিস না থাকলে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে অন্য গাড়ির সঙ্গে লেগে যেতে পারে। অর্থাৎ পার্ক করার জন্যেও ড্রাইভার দরকার। আদিত্য কেয়ার ফোনটা লাগাল।
‘সে কী! যেতে পারবে না!’ কেয়া প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছে। ‘তাহলে কী হবে? আমার তো পরশুদিনই ড্রাইভার দরকার।’
‘আমি সত্যিই আজ পারছি না গো। খুব দরকারি একটা কাজ এসে গেছে। ফিরতে দশটা সাড়ে দশটা হয়ে যাবে। সত্যিই আমার কোনও উপায় নেই।’
‘কিন্তু আমার ড্রাইভারের কী হবে?”
‘তুমি গোপুর ফোন নম্বরটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দাও, আমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি।’
‘টেলিফোনে যদি কাজ হতো তাহলে তোমাকে যেতে বলতাম না। এসব কাজ টেলিফোনে হয় না।’
‘গোপু কি তোমার গাড়ি চালাতে রাজি হয়েছে?’
‘পুরো রাজি হয়নি। বলা যায় নিমরাজি হয়েছে। বাকিটা ওর সঙ্গে কথা বলে বোঝাতে হবে। তাই আমি ওর সঙ্গে সামনা-সামনি কথা বলতে চেয়েছিলাম।’ ‘গোপু ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও ড্রাইভার নেই? গোপুকেই ধরে আছ কেন?’ ‘আমি তো আর কাউকে চিনি না। তোমার চেনা থাকলে একটা ড্রাইভার জোগাড় করে দাও না।’
‘ঠিক আছে। দেখছি। তুমি গোপুর নম্বরটা পাঠিয়ে দাও।’
কেয়া কী বুঝেছিল কে জানে, গোপুর সঙ্গে কথা বলে আদিত্যর মনে হল কেয়ার ডিউটি করতে তার খুব একটা উৎসাহ নেই। এখন যেখানে সে ভাড়া গাড়ি চালায় সেখানে কাজের চাপ খুব বেশি, কিন্তু টাকাটাও অনেক বেশি। অত টাকা কেয়া দিতে পারবে না। গোপুর বয়েস কম, তার খাটতে আপত্তি নেই, যদি টাকাটা বেশি হয়। সব মিলিয়ে আদিত্যর মনে হল গোপুর সঙ্গে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ।
আসল কথাটা হল, ড্রাইভারের ব্যাপারটা কেয়া অনেকদিন ধরেই বলে যাচ্ছে, কিন্তু আদিত্য তেমন কান দেয়নি। কিন্তু এখন একেবারে শিয়রে সংক্রান্তি। কিছু একটা না করতে পারলে কেয়া ছাড়বে না। আদিত্য দেখল হাতে খানিকটা সময় আছে। সাড়ে আটটা নাগাদ বেরোলেও অনায়াসে ন’টার মধ্যে হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিট পৌঁছে যাওয়া যাবে। হাতের সময়টা অনায়াসে ড্রাইভার খোঁজার কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। অনেক ভেবেচিন্তে আদিত্য গৌতমকে ফোন করল।
‘একটা অন্য দরকারে ফোন করছি। একটা ড্রাইভার দিতে পারিস। কেয়া গাড়ি কিনছে। পরশু ডেলিভারি দেবে।’
‘ড্রাইভার? দাঁড়া, তোকে একটা ফোন নম্বর দিচ্ছি। অন্তু গাংগুলির ফোন নম্বর। উনি আমাদের লালবাজারে ভাড়া গাড়ি সাপ্লাই করেন। ওর হাতে ড্রাইভার থাকতে পারে। তোর তদন্ত কেমন এগোচ্ছে?’
‘কোন তদন্ত? ড্রাগ পেডলিং নাকি অশনি রায়ের কেস?’
‘দুটোই। কিছু এগোতে পারলি?’
‘তেমন এগোতে পারিনি। একটা ভাসা ভাসা ধারণা হয়েছে। আর ক’টা দিন যাক। তারপর তোর সঙ্গে বসব।”
অন্তু গাংগুলির সহায়তায় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই একটি ড্রাইভার পাওয়া গেল। নাম মনোজ হালদার। বয়স্ক মানুষ। এক সময় পুলিশের ভাড়া গাড়ি চালাতেন। এখন খুব ভারি ডিউটি আর করতে চান না। কেয়ার পক্ষে আদর্শ। মাইনেও ঠিক হয়ে গেল।
কেয়াকে ফোন করে খবরটা দিতে কিন্তু তাকে খুব একটা খুশি মনে হল না। তার মাথায় তখনও গোপু ড্রাইভার ঘুরছে। কেয়ার ধারণা গোপুকে আর একটু জোর করলে সে রাজি হয়ে যেত। আদিত্য ততটা চেষ্টা করেনি। আদিত্য আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দিল। হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটে ডাঃ অসীমাভ রায়ের চেম্বারের দিকে এবার রওয়ানা দিতে হবে।
আদিত্য যখন অসীমাভ রায়ের চেম্বারে পৌঁছল তখনও ন’টা বাজতে কয়েক মিনিট দেরি আছে। রিসেপশানের মেয়েটিকে নিজের নাম বলতে সে আদিত্যকে বসতে বলল। বলল, পেশেন্ট দেখা শেষ হয়ে গেলে ডাঃ রায় আপনাকে ডেকে নেবেন । আদিত্য দেখল ঘরে জনা তিনেক চিকিৎসার্থী তখনও অপেক্ষা করছে।
শেষ রুগিটি যখন চেম্বারে ঢুকছে তখন সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। সে চেম্বার থেকে বেরোল পৌনে দশটা নাগাদ, তার পেছন পেছন ডাঃ অসীমাভ রায়।
‘আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখার জন্য ক্ষমা চাইছি। আসলে এরা প্রত্যেকেই অনেকদিন আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন। এদের তো ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। আসুন।’
‘আমি কি স্যার মেন দরজা বন্ধ করে দেব?’ রিসেপশনের মেয়েটি বলল। ‘ও হ্যাঁ। তুমি মেন দরজা বন্ধ করে দরোয়ানের কাছে চাবি দিয়ে চলে যাও। আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব। আসুন আদিত্যবাবু।’ অসীমাভ রায়কে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। হয়ত সারাদিনের ক্লান্তি। হয়ত অন্য কিছু।
কেয়া ফোন করছে।
‘কখন আসবে? খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
‘ক্লায়েন্টের সঙ্গে আছি। আমার একটু দেরি হবে। তুমি খেয়ে নাও।’ আদিত্য অসীমাভ রায়ের পেছন পেছন তার চেম্বারে ঢুকল।
বেশ পরিপাটি করে সাজানো চেম্বার। একদিকে অসীমাভ রায়ের বসার টেবিল। অন্যদিকে ছোট একটা বেড যেখানে রুগিদের শুইয়ে পরীক্ষা করা যায়। পেছনে আলো দেওয়া এক্সরে দেখার একটা চৌকো ফ্রেম। অসীমাভ রায় নিজের চেয়ারে বসে উল্টো দিকে আদিত্যকে বসতে বললেন।
‘একটা ক্রাইসিস হয়েছে। বেশ বড়-সড় ক্রাইসিস। কীভাবে আপনাকে বলব বুঝতে পারছি না।’ অসীমাভ রায় কিছুক্ষণ ডানহাতের আঙুল দিয়ে কপাল ঢেকে চোখ বন্ধ করে রইলেন। যেন ভয়ানক কিছু বলার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করছেন।
আদিত্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে।
‘আজ সকালে আমি এই খামটা পেয়েছি। কেউ একজন এসে আমার রিসেপশনে দিয়ে গেছে।’ অসীমাভ রায় ড্রয়ার থেকে একটা সাদা খাম বার করলেন। খামের ওপর অসীমাভ রায়ের নাম ছাড়াও বড় বড় করে লেখা Urgent and Confidential |
‘খামের ভেতর একটা চিঠি আছে। আর কয়েকটা ছবি। আমার ছেলে বাবলুর কয়েকটা ছবি। একজন মহিলার সঙ্গে। অত্যন্ত কমপ্রমাইজড অবস্থায়। মহিলার মুখটা ব্লার্ড। বাবলুর মুখটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।’ অসীমাভ রায় খামটা আদিত্যর দিকে এগিয়ে দিলেন।
আদিত্য এক ঝলক ছবিগুলো দেখে খামের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে পর্নোগ্রাফির দোকানে যেমন ছবি পাওয়া যায় সেরকম কিছু ছবি। আদিত্য খামের চিঠিটা বার করল। ইংরেজিতে লেখা চিঠি। বাংলা তর্জমা করলে এইরকম দাঁড়ায়।
আমার মাঝে-মাঝেই টাকার দরকার হয়। কখনও কম, কখনও বেশি। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন। যদি না করেন, আপনার ছেলের এই সুন্দর মুহূর্তের ছবিগুলো আমি এমন এমন জায়গায় পাঠিয়ে দেব যেখানে তাদের খুব কদর হবে। এই মুহূর্তে আমার মাত্র ১০ লাখ টাকা দরকার। এটা আপনার কাছে অতি সামান্য টাকা। আমি আপনাকে জানিয়ে দেব কোথায় এবং কী ভাবে টাকাটা দিতে হবে । ধরে নিচ্ছি, পুলিশে খবর দেবার বোকামি করবেন না।
টাইপ করা চিঠি। ওয়ার্ড সফটওয়্যারের টাইমস নিউ রোমান হরফ। যে কোনও ল্যাপটপ অথবা ডেস্কটপ-এ থাকে। অর্থাৎ হরফ দেখে পত্রলেখকের পরিচয় জানার কোনও উপায় নেই।
‘কে এই চিঠিটা পাঠাতে পারে? আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘সত্যি বলতে কি আমার কোনও ধারণাই নেই কে চিঠিটা পাঠিয়েছে। আই হ্যাভ নো ক্লু।’
‘আপনি সেই যে এক মহিলার কথা বলেছিলেন? যার স্বামী আপনার পেশেন্ট ছিলেন, মারা গিয়েছেন। ভদ্রমহিলার ধারণা আপনিই ওর স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। মনে আছে?’
‘খুব মনে আছে। বনানী দাস। স্বামী মনোময় দাস।’ অসীমাভ রায় খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। ভাবছেন। তারপর বললেন, ‘বনানী দাস নানাভাবে আমাকে হ্যারাস করেছিল। আমার নামে মামলা করেছিল। সোশাল মিডিয়ায় আমার নামে কুৎসা করেছিল। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, আমার মনে হয় না ও এতটা নিচে নামতে পারে।’
‘কিন্তু আপনিই তো বলেছিলেন আপনার ধারণা বনানীই মৃত্তিকা সেজে অশনিবাবুকে সিডিউস করেছিলেন। পরে আসল মৃত্তিকাকে খুন করে বা করিয়ে তিনি খুনের দায়টা অশনিবাবুর ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। বলেছিলেন তো?’
‘বলেছিলাম। এবং যেটা বলেছিলাম সেটা আমি এখনও বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি যে বনানী দাস আমাকে হার্ট করার জন্য নানারকম জঘন্য কাজ করলেও কখনও টাকা চেয়ে ব্ল্যাকমেল করবে না। ইট্স বিয়ন্ড হার ডিগনিটি। আমি বোধহয় ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলাম না।’
পারলেন কি পারলেন না তার মধ্যে না গিয়ে আদিত্য হঠাৎ সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ওই ছবিগুলোতে যে মহিলাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি কি বনানী দাস হতে পারেন?’
‘না, না। সেটা একেবারেই সম্ভব নয়। একে তো ওই ছবির মহিলার গায়ের রঙ একটু চাপা আর বনানী দাস রীতিমত ফর্সা। তাছাড়া ছবির মহিলার গড়নও বনানী দাসের তুলনায় অনেক লম্বা। কিন্তু সব থেকে বড় কথা, এই রকম কাজ করার প্রবৃত্তি বনানী দাসের হবে না। বনানীর যতই দোষ থাকুক শি ওয়াজ নট আ হোর।’
‘অন্য একটা প্রশ্ন। এই ছবিগুলো কাকে কাকে পাঠালে আপনাদের ক্ষতি হবে?’ ‘দেখুন, হাইকোর্ট বাবলুকে নির্দোষ বলার পর এখন কিন্তু বাবলুর ওপর আর কোনও চার্জ নেই। তাই বাবলু ওর পুরোনো চাকরিটা ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। কথাবার্তাও খানিকটা এগিয়েছে। ওর বস ওকে নিতে ইন্টারেস্টেড। বাবলু ওয়াজ আ গুড ব্যাঙ্কার, ইউ নো। এই অবস্থায় বাবলুর বসের কাছে ওই ছবিগুলো যদি কেউ পাঠিয়ে দেয় তাহলে ওর চাকরিটা হবে কিনা সন্দেহ। এটা তো একটা বড় ক্ষতি। তাছাড়া আমাদের পরিবার খুব পুরোনো এবং কনজারভেটিভ। আমার কাকা-কাকিমা, দাদা-বৌদি সকলেই জীবিত। তাঁরা বাবলুকে খুব ভালবাসেন। তাঁদের হাতে এই ছবিগুলো গেলে কী যে হবে আমি ভেবেই শিউরে উঠছি। ছবিগুলো ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বা তাদের ছেলেমেয়েদের হাতে পৌঁছলে আমাদের সামাজিকভবে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। কোথাও আর মুখ দেখাতে পারব না।’
আদিত্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। অসীমাভ রায়ও কথা বলছেন না। চিন্তায় ডুবে আছেন। কিছু পরে স্তব্ধতা ভেঙে আদিত্য বলল, ‘অশনিবাবুকে কিন্তু ব্যাপারটা জানাতেই হবে। কোন সিচুয়েশনে ছবিগুলো তোলা হয়েছিল সেটা একমাত্র উনিই বলতে পারবেন। সেটা কিন্তু আমাদের জানা দরকার।’
‘আমি বাবা হয়ে এই ছবিগুলো নিয়ে বাবলুর সঙ্গে কী ভাবে কথা বলব ?’ ‘আপনি না বলতে পারলে আমাকে বলতে হবে। আপনি আমাকে ছবিগুলো দিন আমি অশনিবাবুর সঙ্গে কালকেই কথা বলে নেব।’
‘আমার এখন তাহলে কী করণীয়?’
‘আপনি ব্যাঙ্ক থেকে দশ লাখ টাকা তুলে রাখুন। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব টাকাটা যাতে ব্ল্যাকমেলারকে দিতে না হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্ল্যাকমেলারটি বা তার কোনও অনুচর আপনার ওপর নজর রাখছে। বিশেষ করে সে জানতে চাইবে আপনি ব্যাঙ্ক থেকে কোনও মোটা টাকা তুললেন কিনা। যদি সে দ্যাখে আপনি টাকা তুললেন তাহলে সে খানিকটা নিশ্চিন্ত হবে। আমরা তাকে নিশ্চিন্ত রাখতে চাই। তাহলে সে কিছুটা অফ গার্ড হয়ে যাবে। এর বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া আর আপনার কিছু করার নেই। ব্ল্যাকমেলার তো বলেছে টাকা নেবার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তাকে যোগাযোগ করতে দিন।’
‘পুলিশকে কি আমি ব্যাপারটা জানাব?’
‘আপনাকে কিচ্ছু জানাতে হবে না। যা জানাবার আমিই জানাব। আর শুনুন। আমি আগে এখান থেকে বেরিয়ে যাই। আপনি দশ মিনিট পরে বেরোবেন। হয়ত লোকটা নজর রাখছে। আমাদের সে এক সঙ্গে দেখুক আমি চাই না। ঠিক আছে আমি চলি। ব্ল্যাকমেলার যোগাযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবেন। গুড নাইট।’
‘আচ্ছা, একটা কাজ করবেন?’ আদিত্য দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে এসেছে। ‘আমাকে একটা প্রেস্ক্রিপশন লিখে দেবেন? আমি ওটা নিয়ে কোনও ওষুধের দোকানে ঢুকব। যদি কেউ আমার ওপর নজর রাখে সে ধরে নেবে আমি আজ রাত্তিরের শেষ পেশেন্ট।’
অসীমাভ রায় প্রথমে ব্যাপারটা ধরতে পারছিলেন না। পরে বুঝতে পেরে একটু হেসে বললেন, ‘দেখি আপনার প্রেশারটা। ওষুধ দেবার আগে রুগিকে একবার অন্তত দেখে নেওয়া ভাল।’
প্রেশার চেক করতে গিয়ে অসীমাভ রায়ের মুখটা ক্রমশ গম্ভীর হচ্ছিল। প্রেশার চেক করার পর আদিত্যকে বললেন, ‘একটু এগিয়ে আসুন। বুকটা একবার দেখি। স্টেথো দিয়ে আদিত্যর বুকটা পরীক্ষা করতে করতে অসীমাভ রায় বললেন, ‘আপনি কি স্মোক করেন ?
‘হ্যাঁ, মানে ওই খারাপ অভ্যাসটা এখনও ছাড়তে পারিনি।’ আদিত্য ঢোঁক গিলে বলল।
‘আপনার বুক বা পিঠ অঞ্চলে কখনও ব্যথা হয়? ধরুন কিছুক্ষণ হাঁটার পর কিংবা সিঁড়ি ভাঙার পর?’
‘হ্যাঁ হয়।’ আদিত্যর আপিসটা দোতলায় হলেও পুরোনো দিনের বাড়ি বলে সিঁড়িগুলো খুব খাড়া খাড়া। আজকাল দোতলায় আপিসে পৌঁছে আদিত্যর বুকে বেশ ব্যথা হয়। চেয়ারে দু’তিন মিনিট বসে থাকলে আস্তে আস্তে ব্যথাটা চলে যায়। কথাটা কেয়াকে বলা হয়নি। কিন্তু আদিত্যর মনে হল অসীমাভ রায়কে জানানো দরকার।
‘আদিত্যবাবু আপনাকে ক্লিনিকালি দেখে আমার মনে হচ্ছে আপনার আনস্টেবল অ্যাঞ্জাইনা। ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ সিরিয়াস। আপনার ব্লাড প্রেশারও বেশি। বিশেষ করে নিচেরটা প্রায় একশ’। আপনি আর একটা সিগারেটও খাবেন না। খেলে সিমপ্লি হার্ট অ্যাটাক ডেকে আনবেন। আর কালই একটা ট্রেডমিল আর একটা ইকো কার্ডিওগ্রাম করান। আর কয়েকটা ব্লাড-ওয়ার্ক। আমি সব লিখে দিচ্ছি। এই রাস্তার মোড়ে কেয়ার বলে একটা ডাওগনস্টিক সেন্টার আছে, ডক্টর চৌহান ওখানকার চিফ রেডিওলজিস্ট। আমার বন্ধু। খুব ডিপেন্ডেবল। ওঁর কাছে করাবেন। তাছাড়া দুটো ওষুধ লিখে দিচ্ছি। আজ রাত্তির থেকে শুরু করে দিন। দিনে দু’বার। আফটার ব্রেকফাস্ট এবং আফটার ডিনার। ব্যাপারটা প্লিজ সিরিয়াসলি নেবেন। আপনার হার্টের আর্টারিতে মনে হচ্ছে ব্লক আছে। ট্রেডমিল এবং ইকোর রেজাল্টগুলো পেলে খানিকটা বোঝা যাবে। দরকার পড়লে একটা অ্যাঞ্জিওগ্রামও করতে হবে। আপনার বয়েস এখন কত?’
ডাঃ অসীমাভ রায়ের ডাক্তার সত্তা তার আর সব সত্তাকে ছাপিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরে, আদিত্য যখন অসীমাভ রায়ের চেম্বারের উল্টোদিকে একটা ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনছে তখন সে খেয়াল করল একটা আধময়লা জামা পরা লোক তার প্রায় গায়ের ওপর এসে তার প্রেসক্রিপশনটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। যেন ওটাকে পড়বার চেষ্টা করছে। অথচ দোকানে তেমন ভিড় নেই।
আধময়লা জামা পরা লোকটাকে শুনিয়ে আদিত্য দোকানের লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, কেয়ার ডায়োগনস্টিক সেন্টারটা কোথায়? ডাক্তারবাবু ওখান থেকে আমাকে এই টেস্টগুলো করাতে বলেছেন।’
“ওই তো বেরিয়ে ডানদিকে। রাস্তার মোড়ে। এখন বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকাল ন’টার মধ্যে খালি পেটে এসে আপনাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে। যদি কালকেই টেস্টগুলো করাতে চান।’
আদিত্য লক্ষ করল আধময়লা জামা পরা লোকটা এক পাতা জেলুসিল কিনে দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
মাথায় এক রাশ চিন্তা নিয়ে আদিত্য রবীন্দ্র সদন মেট্রো স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগাল।
(৩)
লাল টুকটুকে মারুতি ওয়্যাগন আর। একবার দেখলেই ভাল লেগে যাবে। তার ওপর নতুন ড্রাইভার মনোজ হালদার লোকটিকেও আদিত্যর পছন্দ হয়ে গেল। ষাটের ধারে-কাছে বয়েস। লম্বা গড়ন। চোখে চশমা। খুব কম কথা বলে। কেষ্টপুরে বাড়ি, আদিত্যদের বাসস্থান থেকে খুব দূরে নয়। কখনও-সখনও রাত্তির হয়ে গেলে বাড়ি ফিরতে অসুবিধে হবে না।
যেদিন গাড়ি এল তার পরের দিন কেয়া ছুটি নিয়েছে। আদিত্যকেও অফিস যেতে দেয়নি। দু’জনে মিলে সকাল-সকাল নতুন গাড়ি নিয়ে ডায়মন্ডহারবারের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছে। বেহালা পার হয়ে ঠাকুরপুকুর পৌঁছতে ঘন্টা খানেক লেগে গেল। এই সময় জ্যাম থাকার কথা নয়, কিন্তু ডায়মন্ডহারবার রোডের কিছু কিছু অংশে এখনও মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে। গাড়ি জোকা ছাড়াতে না ছাড়াতে হাওয়ারা দৌড়ে এল। আদিত্যর বেশ ভাল লাগছে।
‘জানলাটা বন্ধ কর। চুল উড়ে যাচ্ছে।’ আদিত্যর মতামতের তোয়াক্কা না করে কেয়া এবার ড্রাইভারের উদ্দেশে বলল, ‘মনোজবাবু, জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে এসি চালিয়ে দিন।’
প্রাকৃতিক হাওয়া আদিত্যর কপালে নেই। তবে দৃশ্য তো আছে।
ধানখেত। আলের রাস্তা এঁকেবেঁকে মাঠের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে একটা একলা দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে থেমে গেছে। দূর থেকে পাম্প চলার শব্দ ভেসে আসছে। উপুড়-চুপুড় সবজি নিয়ে রিক্সাভ্যান মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় এক্ষুনি রওনা দেবে। মনোজ হালদারের গাড়ি চালানোর হাতটা বেশ পাকা। জোরে চালালেও মনে হয় না বেপরোয়া চালাচ্ছে।
আমতলার হাটের কাছে পৌঁছে গাড়ির গতি আবার খুব কমে এল। আজ হাটবার। রাস্তার দু’ধারে সারি সারি দোকান বসে গেছে। প্লাস্টিকের বালতি-মগ, জামাকাপড়, মোবাইল কভার, চামড়ার বেল্ট, চটের ব্যাগ। তার পাশে মুরগির দোকান, কচি পাঁঠার দোকান। একটা লোক সাইকেল রিক্সায় দু’তিনটে পেল্লায় বস্তা চাপিয়ে কোথায় যেন চলেছে। বস্তাগুলো রিক্সার প্রায় সব জায়গা নিয়ে নিয়েছে। লোকটার নিজের বসার জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। হাট দেখতে আদিত্যর খুব ভাল লাগে। তাই গাড়ির গতি কমে এলেও তার খারাপ লাগছে না। তাছাড়া তাদের তো কোথাও তাড়াতাড়ি পৌঁছবার নেই। কেয়ার দিকে তাকিয়ে আদিত্য দেখল কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমতলা পেরোতে প্রায় কুড়ি মিনিট লেগে গেল। পেরোতে না পেরোতেই আদিত্যর মোবাইলটা বেজে উঠল। ডাঃ অসীমাভ রায়। মোবাইল বাজার শব্দে কেয়ার ঘুম ভেঙে গেছে।
‘আপনার রিপোর্টগুলো এইমাত্র হাতে এল। ভারত চৌহান পাঠিয়ে দিয়েছে। রিপোর্টগুলো ভাল নয়। বিশেষ করে ট্রেডমিল রিপোর্টে বেশ ইররেগুলারিটি আছে। আপনাকে একটা অ্যাঞ্জিওগ্রাম করাতে হবে। তার জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। আমার ধারণা আপনার আর্টারিতে মালটিপল ব্লক আছে। অ্যাঞ্জিও করলে দেখা যাবে কোথায় ব্লক, ক’টা ব্লক। তখন ঠিক করতে হবে বাইপাস দরকার নাকি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি।
যাই হোক আপনি একদম দেরি করবেন না। সম্ভব হলে আজ-কালের মধ্যেই কোথাও ভর্তি হয়ে যান। আর আমাকে দিয়ে যদি অ্যাঞ্জিও করাতে চান তাহলে রাসেল স্ট্রিটে হার্টকেয়ার বলে যে নার্সিং হোমটা আছে সেখানে ভর্তি হতে হবে। কী ঠিক করলেন, আজ রাত্তিরের মধ্যে জানাবেন।’ আদিত্য কাল চুপিচুপি গিয়ে টেস্টগুলো করে এসেছিল। শরীর খারাপের ব্যাপারে কেয়াকে এখনও কিছু বলা হয়নি। এখন অসীমাভ রায়কে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে কেয়া টের পেয়ে যাবে। টের পেয়ে গেলে ডায়মন্ডহারবার যাত্রাটাই মাটি। হয়ত এখান থেকেই ফিরে যেতে চাইবে।
‘ঠিক আছে। জানাব।’ আদিত্য সংক্ষেপে বলল। ‘আপনার ওদিককার খবর কী? টাকা চেয়ে কোনও চিঠিপত্র এসেছে?’
‘এখনও আসেনি। এলেই জানাব। তবে আপনার যা শরীরের অবস্থা! এই শরীরে আপনি কতটা কী করতে পারবেন বুঝতে পারছি না। অথচ পুলিশের কাছেও যেতে পারছি না।’ ডাঃ অসীমাভ রায়ের গলাটা চিন্তান্বিত শোনাল।
‘দেখাই যাক না কী হয়। আগে থেকে চিন্তা করে লাভ নেই। আপনি টাকাটা তুলে রেখেছেন?’
‘হ্যাঁ। কাল তুলেছি।’
‘ঠিক আছে। দেখা যাক কী হয়।’
আদিত্য ফোন রেখে দিল।
‘কে ফোন করেছিল?’ কেয়া কি কিছু আঁচ করেছে?
‘অশনি রায়ের বাবা, ডাঃ অসীমাভ রায়।’
“কেন ফোন করেছে?’
‘ওর ছেলের কিছু আপত্তিকর ছবি তুলে সেই ছবি দেখিয়ে কেউ ডাক্তারবাবুকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে।’
‘সে কী? কীরকম আপত্তিকর ছবি?’
‘কোনও মহিলার সঙ্গে পর্নোগ্রাফিক ছবি। ‘
“ওরে বাবা। ছেলেটা তো তাহলে ভাল নয়।’
‘সেটা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। কেউ ওকে ফাঁসাতেও পারে।’
‘ও।’ ব্যাপারটায় কেয়ার উৎসাহ চলে গেছে। সে আবার চোখ বুজিয়েছে। গাড়ি এখন ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বেশ জোরে যাচ্ছে। দু’দিকে আবার ধানখেত।
সরিষার মোড়ে পৌঁছে কেয়া বলল, ‘গাড়ি থামিয়ে একটু ব্রেকফাস্ট খেলে হতো না? এখানে কয়েকটা চমৎকার সিঙাড়া-জিলিপির দোকান আছে। স্কুল থেকে পিকনিক করতে এসে একবার খেয়েছিলাম।’
সিঙাড়া-জিলিপির ব্যাপারে আদিত্য একপায়ে খাড়া।
মোড় থেকে একটা রাস্তা রায়চকের দিকে চলে গেছে। ডায়মন্ডহারবার রোড ধরে আর একটু এগোলেই পাশাপাশি দুটো মিষ্টির দোকান। সামনেই গরম গরম সিঙাড়া ভাজছে। শুধু একটা অভাব। জিলিপি নেই। তার বদলে রসগোল্লা। কলকাতার অভিজাত দোকানে যেমন স্পঞ্জ রসগোল্লা পাওয়া যায় তেমন নয়। এটা খাঁটি মফস্বলের বাঙালি রসগোল্লা। খানিকটা ক্ষীরমোহনের মতন। এক একটা প্রায় টেনিস বলের আকারের। সলিড ছানা। সিঙাড়ার মতো রসগোল্লাটাও গরম ছিল। মনে হয় একটু আগে কড়া থেকে নামিয়েছে।
আদিত্য ভাবছিল কখন কেয়াকে তার শরীর খারাপের কথাটা বলবে? নিজের শরীর নিয়ে আদিত্য একেবারেই ভাবে না। কিন্তু কেয়াকে নিয়ে তার খুব চিন্তা। কেয়া যদি জানতে পারে আদিত্যকে খুব শিগগির হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, সে কীভাবে ব্যাপারটা নেবে? আদিত্য ছাড়া কেয়ার আর কেউ নেই, এটা আদিত্য জানে। তাই আদিত্যর ব্যাপারে কেয়া সর্বদা দুশ্চিন্তায় ভোগে। তাছাড়া তাকে যদি হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, অসীমাভ রায়ের কেসটার কী হবে?
চা এসেছে। চায়ের গেলাশে চুমুক দিয়ে আদিত্য সুভদ্র মাজির নম্বরটা লাগাল। ‘দাদা, একটু ঝামেলার মধ্যে আছি। মিনিট পনের পরে করছি। ওদিক থেকে উত্তর এল।
‘আমিই করব। এই ধর ঘন্টা দুয়েক বাদে? ঠিক আছে?’
‘একদম ঠিক আছে।’
‘উঠবে?’ কেয়া আদিত্যর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘রায়চক যাবে নাকি? শুনেছি ওখানে নদীর ধারটা ইনটারেস্টিং।’ আদিত্য রায়চক যাবার রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে বলল ।
‘রায়চক?’ কেয়া ভাবছে। ‘নাঃ থাক। আজ ডায়মন্ডহারবার মন করে বেরিয়েছি। ডায়মন্ডহারবারেই যাই। পরে একদিন বরং রায়চক যাওয়া যাবে।’
ড্রাইভার মনোজ হালদার কিছুক্ষণ আগেই খাওয়া শেষ করে গাড়িতে গিয়ে বসেছে। অনেক বছর আগে আদিত্য একবার ডায়মন্ডহারবারে এসেছিল। তখন সেখানে মোটামুটি ভদ্র, থাকার উপযোগী হোটেল বলতে ছিল সরকারি যাত্রীনিবাস সাগরিকা। এখন আর একটু বিলাসবহুল দু’একটা হোটেল হয়েছে। তার একটা গঙ্গার পাড় ঘেঁষে। সেখানে পৌঁছে জানা গেল তাদের সব ঘর ভর্তি। শুধু মূল হোটেল থেকে একটু বিচ্ছিন্ন একটা কটেজ খালি আছে যেটা একেবারে নদীর ওপরে। তাও শুধু আজ রাত্তিরের জন্যে কটেজটা খালি আছে। কাল বেলা বারোটায় অন্য লোক এসে যাবে। কটেজটার ভাড়া অন্য ঘরগুলোর তুলনায় অনেকটাই বেশি।
ভাড়ার অঙ্কটা শুনে আদিত্য ইতস্তত করছিল, কেয়া সেদিকে না তাকিয়ে রিসেপশানের মেয়েটিকে বলল, “আমরা কটেজটাই নেব। এক রাত্তিরের জন্যেই নেব।’
ড্রাইভারদের থাকার জন্য এই হোটেলে আলাদা ব্যবস্থা আছে।
কটেজটা নির্জন। একটা বসার ঘর আছে। তার সংলগ্ন শোবার ঘর। বসার ঘরে চা-কফি বানিয়ে নেবার ব্যবস্থা। ছোট একটা ফ্রিজ। খাবার টেবিল। টেবিলের ওপর ফ্রুট বাসকেট। শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দা। কাঁচ দিয়ে ঢাকা। নদীটা গায়ের ওপর এসে পড়েছে। আদিত্য বারান্দা থেকে তন্ময় হয়ে নদী দেখছিল।
‘একটু কফি করবে নাকি?’ কেয়া ঘরের ভেতর থেকে বলল। আদিত্য লক্ষ করল কেয়া স্নানঘর থেকে মুখ-চোখে জল দিয়ে বেরিয়েছে।
‘এখন কফি খাবে? তাহলে লাঞ্চ খাবে কখন?’ আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। বারোটা বাজে।
‘ঠিক আছে। তাহলে লাঞ্চের পরেই না হয় কফি খাব। কিন্তু লাঞ্চটা কোথায় খাচ্ছি? রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে দিই?’
“আরে, রাত্তিরের ডিনারটা তো ঘরে বসেই খেতে হবে। তখন আর বাইরে যেতে ইচ্ছে করবে না। এখন চল না বাইরেটা একটু এক্সপ্লোর করে দেখি। এক সময় সাগরিকা বলে ওই সরকারি হোটেলটায় খুব টাটকা মাছ পাওয়া যেত। গিয়ে দেখি না। হয়ত এখনও পাওয়া যেতে পারে।’
আদিত্যর অনুমান ভুল নয়। সাগরিকা হোটেলের ডাইনিং রুমে খোঁজ নিয়ে জানা গেল নদীর মোহানায় সদ্য ধরা পমফ্রেট এবং লোকাল পুকুরের টাটকা পারশে দুই-ই পাওয়া যাবে।
ডাইনিং হলটা বেশ বড়। তবে সপ্তাহের মাঝখানে একেবারেই ভিড় নেই। আদিত্যরা ছাড়া আর একটা পরিবার জানলার ধারে বসে খাবারের অপেক্ষা করছে। বাবা, মা, দুই ছেলে। আদিত্যর মনে হল তারা একটু আগে আগে এসে পড়েছে। রান্না এখনও পুরো হয়নি।
কেয়া বলল, ‘একটা জলের বোতল দিতে বল না। গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।’
গলা শুকিয়ে যাওয়াটা আশ্চর্য নয়। রোদ্দুরের যা তেজ। যে লোকটি খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল তাকে কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না। জলের বোতলের কথাটা কাকে বলা যায়? হঠাৎ আদিত্যর চোখে পড়ল হোটেলের বাইরে, নদীর ধারের বাঁধানো জায়গাটায় ডাব বিক্রি হচ্ছে।
‘ডাব খাবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল। ‘বাইরে বিক্রি হচ্ছে।’
‘খাওয়ালে নিশ্চয় খাব। দূরে যেতে হবে?’
‘না, না। এই সামনেই। তুমি বোসো আমি দুটো ডাব নিয়ে আসছি।’ ‘তাড়াতাড়ি এস।’
ডাবওলার সামনে তিনটে লোক ডাব কিনবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকগুলোর মুখ দেখা যাচ্ছে না। ডাবওলা একটা ডাব কেটে তিনজনের একজনকে দিল। তারপর আর একজনকে। শেষ লোকটা ডাব নেবার আগে পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। নিশ্চয় পয়সা বার করবে। একটা লরি হর্ন দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলে গেল। হর্নের শব্দ শুনে শেষ লোকটা পেছন ফিরে লরির দিকে তাকিয়েছে। আদিত্য তার মুখটা দেখতে পাচ্ছে। রোগা, ফর্সা মুখ। খুব বেশি বয়েস নয়। বড় জোর বছর চল্লিশ। লোকটা আদিত্যর দিকে একবার তাকাল যেমন করে মানুষ অপরিচিতদের দিকে তাকায়। কিন্তু আদিত্যর মনে হচ্ছে লোকটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে। কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না।
দুটো ডাব হাতে নিয়ে সাগরিকা হোটেলে ঢোকার আগে আদিত্য একবার পেছন ফিরে দেখল। লোক তিনটে রোদ্দুরের মধ্যে নদীর দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
আদিত্যরা যখন কটেজে ফিরে এল তখন দক্ষিণ দিকের আকাশে অল্প মেঘ জমেছে। কেয়া বাইরের পোষাক ছেড়ে বাড়ির পোষাক পরে দাঁত ব্রাশ করার জন্য বাথরুমে ঢুকল। আদিত্যও বাইরের পোষাক পালটে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিয়েছে। গুরুভোজনের পর তার খুব সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে শরীর খারাপের কথাটা কেয়াকে এখনও বলা হয়নি।
কেয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় শুয়েছে।
‘এখানে এস। আমার পাশে শোও।’ কেয়া আদুরে গলায় বলল। ‘আমাকে ধর।’ কেয়াকে এত প্রগল্ভ হতে আদিত্য খুব বেশি দেখেনি। বেড়াতে এসে কেয়ার চরিত্রটা পালটে গেছে।
আধঘন্টা পরে আদিত্য কাঁচে-ঢাকা বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারে গিয়ে বসল। কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। কেয়াকে আদর করার ধকলে আদিত্যর বুকের বাঁদিকটা ব্যথা করছিল। কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতে ব্যথাটা চলে গেল। দক্ষিণের আকাশটা এখন অনেকটাই মেঘাবৃত। অনেক দূর দিয়ে একটা স্টিমার যাচ্ছে। দুটো গাধাবোট নদীর ধারে নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝনদীতে কয়েকজন ধীবর নৌকো ভাসিয়েছে। দক্ষিণ সাগর থেকে হাওয়া আসছে। একটু একটু করে নদীর ঢেউগুলো অশান্ত হচ্ছে। দেখতে দেখতে দক্ষিণ দিগন্তের শেট রঙটা সারা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল।
আদিত্যর হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুভদ্র মাজিকে ফোন করার কথা ছিল। করা হয়নি।
‘সুভদ্র, এখন কথা বলা যাবে?’ আদিত্য নম্বরটা লাগিয়ে বলল।
‘নিশ্চয় দাদা। বলুন।’
‘একটা ব্যাপার হয়েছে। তোমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি ঘটনাটা সংক্ষেপে বলছি। অশনি রায়ের বাবা অসীমাভ রায়কে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। অশনির সঙ্গে এক মহিলার কিছু পর্নোগ্রাফিক ছবি অসীমাভ রায়ের কাছে পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এক্ষুনি দশ লাখ টাকা না দিলে ছবিগুলো বিভিন্ন সেনসিটিভ যায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
‘আমাকে কী করতে বলছেন?’
‘তোমার দুটো কাজ। প্রথমত, ছবিগুলো ফরেনসিকে পাঠিয়ে যাচাই করতে হবে ওগুলো আসল না ফেক। তুমি তো জান, এর বড় তার মুণ্ডু জুড়ে দিয়ে আজকাল নানা রকম ছবি তৈরি করা যায়। সেরকম কিছু হয়েছে কিনা প্রথমে বুঝতে হবে।’
‘ছবিগুলো আমি পাচ্ছি কোথায়?’
‘ওগুলো তোমার অফিসের ঠিকানায় আমি কুরিয়ার করে দিয়েছি। আজ বিকেলের মধ্যে পেয়ে যাবে। ওসব ছবি আমার কাছে আছে দেখলে কেয়া ডিভোর্স করে দেবে। তাই প্রথম সুযোগেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ আদিত্য হাসল।
‘ঠিক আছে। আমি ছবিগুলো জেনুইন কিনা ভেরিফাই করে নেব। আর দ্বিতীয় কাজ?’
‘অবশ্য ছবিগুলো আমারও কাজে লাগতে পারে ভেবে মোবাইলে ফটো তুলে রেখে দিয়েছি। কেয়া যদি দেখতে পায় তোমাকে সাক্ষী মানব।’ আদিত্য আবার হাসল।
‘ঘাবড়াবেন না দাদা, আমি আছি। দ্বিতীয় কাজটা কী বলুন।’
‘দ্বিতীয় কাজটা আর একটু জটিল। বনানী দাস বলে একজন মহিলার খোঁজ করতে হবে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে অসীমাভ রায়ের পুরোনো শত্রুতা। বনানীর স্বামী মনোময় দাস অসীমাভ রায়ের চিকিৎসায় মারা গেছিল। বনানীর ধারণা অসীমাভ রায়ই তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। সেই থেকে শত্রুতা। আমার ধারণা বনানী এই ব্ল্যাকমেলিং-এর পেছনে থাকতে পারে। যদিও অসীমাভ রায়ের সেটা মনে হয় না। যাই হোক, বনানী দাসের সঙ্গে কথা বলা দরকার।’
‘বনানী দাসের কোনও ঠিকানা জানা আছে?’
‘সেটাই তো মুস্কিল। একটা আট-দশ বছরের পুরোনো ঠিকানা আছে, কিন্তু সেখানে বনানী দাস থাকে না। অশনি রায়ের মামলাটা যখন হাইকোর্টে চলছিল তখন কোর্ট থেকে বনানী দাশের নামে সমন গিয়েছিল। কিন্তু বনানী দাসকে পাওয়া যায়নি । বনানীর স্বামীর একটা রঙের দোকান ছিল ধর্মতলায়। দাস অ্যান্ড কম্পানি। কিন্তু সেটাও এখন আর নেই।
পুরোনো ঠিকানাটা আপনার কাছে আছে? ওখান থেকেই খোঁজটা শুরু করতে হবে।’
‘একদম ঠিক। পুরোনো ঠিকানাটা আমি তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি।’ ‘ব্ল্যাকমেল-এর ব্যাপারটা কী করবেন? অসীমাভ রায় কী টাকাটা দেবেন বলছেন?’ ‘টাকাটা কবে, কোথায়, কীভাবে দিতে হবে এসব জানিয়ে আগে চিঠি আসুক। চিঠি এলে তখন ঠিক করা যাবে। এরকম চিঠি যদি আসে আমি তোমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানাব।’
‘অশনি রায় কী বলছে? সে কি কখনও ওই রকম অবস্থায় কোনও মহিলার সঙ্গে সময় কাটিয়েছিল?’
‘অশনি রায় এখনও ব্যাপারটা জানে না। তার বাবা এ-ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলতে সংকোচ বোধ করছে। আমি তার সঙ্গে কথা বলব।’
সুভদ্র মাজির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আদিত্য দেখেছিল বৃষ্টি এসে গেছে।
ফোন রেখে দিয়ে সে নদীর দিকে চেয়েছিল। নদীর ওপর মুষলধারে বৃষ্টি, সে কী অপরূপ দৃশ্য। নৌকোগুলো নদীতে আর নেই, পারে এসে নোঙর করেছে। শুধু একটা নৌকো এখনও নোঙর করতে পারেনি, ঢেউয়ের ধাক্কায় টলতে টলতে পারের দিকে আসার চেষ্টা করছে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে আদিত্য আবার মোবাইলটা তুলে নিল। অসীমাভ রায়কে একটা ফোন করতে হবে।
‘একটা ছোট প্রশ্ন ছিল তাই আবার বিরক্ত করতে হচ্ছে।’
‘ঠিক আছে। বলুন।’
‘বনানী দাস কি কোর্টে গিয়ে আপনার কাছে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিল?’ ‘একটু হোল্ড করুন। আমি পাশের ঘরে গিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলছি।’ আদিত্য আন্দাজ করল অসীমাভ রায়ের কাছে রুগি আছে।
‘বিরাট কমপেনসেশন চেয়েছিল। বেশ কয়েক কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কিছুই পায়নি। কারণ কোনওভাবেই আমার নেগলিজেন্স বা কোনও ম্যালাফাইড ইনটেনশন প্রমাণ করা যায়নি।’
‘আচ্ছা, এমন কি হতে পারে ওই কমপেনসেশনের টাকাটা বনানী ব্ল্যাকমেল করে তুলতে চায়?’
‘ঠিক বলতে পারব না। আমি এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি।’
‘ব্ল্যাকমেলারের কাছ থেকে আর কোনও চিঠি পেলেন?’
‘এখন অব্দি পাইনি। আপনি কবে ভর্তি হচ্ছেন?’
‘আমাকে এক সপ্তাহ সময় দিন। না হলে আপনার কেসটা একেবারে ঘেঁটে যাবে। প্লিজ।’
‘দেখুন, ডাক্তার হিসেবে আমি বলব আপনার কালই ভর্তি হওয়া উচিত। আনস্টেবল অ্যাঞ্জাইনা কিন্তু একেবারে সময় দেয় না।’
‘অন্তত তিন দিন সময় দিন। আমি তার মধ্যেই একটু গুছিয়ে নিতে পারব।’ —ঠিক আছে। আজ বুধবার। আপনি আগামী রবিবার সকালে হার্টকেয়ারে ভর্তি হচ্ছেন। আমি বলে রাখব।’
‘তাই হবে। সেটাই ঠিক রইল।’
মোবাইল রেখে আদিত্য ঘড়ি দেখল। মাত্র সোয়া চারটে। অঝোরে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। আকাশ মেঘে ঢাকা বলে এর মধ্যেই দিনের আলো নিবে এসেছে। শেষ নৌকোটাও তীরে এসে পৌঁছল। নদীতে আর কোনও নৌকো নেই। হঠাৎ আদিত্য দেখতে পেল নদীর ধারে দু’তিনটে টর্চের আলো মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে। মনে হয় মোবাইলের টর্চ। যে নৌকোটা একটু আগে পারে এসে ভিড়ল তার কাছে তিনটে লোক ঘোরাফেরা করছে। এই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ওরা কী করছে? এত দূর থেকে ওদের ভাল দেখা যাচ্ছে না। তবু আদিত্যর মনে হল এরা সেই তিনটে লোক যারা দুপুরবেলা সাগরিকা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ডাব খাচ্ছিল। লোকগুলো আদিত্যদের কটেজের দিকেই এগিয়ে আসছে। পাকা রাস্তায় উঠতে চায় নিশ্চয়। আরও খানিকটা এগিয়ে আসার পর তিনজনকেই পরিষ্কার দেখা গেল। আদিত্য নিশ্চিত, এর সেই তিনজনই বটে। দুটো লোক হাতে দুটো মাঝারি সাইজের বাক্স বহন করে নিয়ে আসছে। তৃতীয়জন, যাকে আদিত্যর চেনা মনে হয়েছিল, খালি হাতে পেছন পেছন আসছে। আর চারদিকে নজর রাখছে। আদিত্য আবার ভাল করে এই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে দেখল। আদিত্য নিশ্চিত সে একে আগে কোথাও দেখেছে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করে এবারেও মনে পড়ল না লোকটাকে কোথায় দেখেছে। আদিত্যদের কটেজে পৌঁছনোর আগেই লোকগুলো পাকা রাস্তার দিকে বেঁকে গেল।
‘চা করবে নাকি?’ ঘরের ভেতর থেকে কেয়ার গলা। কেয়ার ঘুম ভেঙে গেছে।
(৪)
অশনি রায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে। চার-পাঁচ মিনিট হয়ে গেল। খুব ছোটবেলায় আদিত্য একবার বাবার সঙ্গে হ্যামলেট দেখতে গিয়েছিল। বাংলায় হ্যামলেট। সম্ভবত কোনও গ্রুপ থিয়েটার অ্যাকাডেমিতে নাটকটা মঞ্চস্থ করেছিল। কোন দল আদিত্যর মনে নেই। নাটকটারও বিশেষ কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে হ্যামলেটকে যখন প্রথম দেখাচ্ছে তখন বেশ কিছু সময় ধরে হ্যামলেটের কোনও ডায়লগ ছিল না। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রক্ষীদের কথা শুনছিল যারা রাত্তিরে দুর্গ পাহারা দিতে গিয়ে তার বাবার প্রেতাত্মাকে দেখেছে। অশনি রায়কে দেখে ছোটবেলার সেই হ্যামলেটের কথা মনে পড়ে গেল। অশনি কি লজ্জা পেয়েছে? নাকি লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করছে? মানসিকভাবে যারা স্থিতিশীল নয় তাদের কি এইরকম নাটকীয় প্রতিক্রিয়া হয়?
একটু আগে আদিত্য অশনি রায়কে ছবিগুলো দেখিয়েছে। ছবিগুলো দিয়ে তার বাবাকে যে কেউ ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে সেকথাও জানিয়েছে। তার পর থেকে অশনির এই অবস্থা ।
আদিত্য জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। বেলা এগারোটার ব্যস্ত কলকাতা। বাসে ভীড়। মানুষ ভীড় করে রাস্তা পার হচ্ছে। একটি যুবক বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ে একটা ধাবমান ট্র্যামে উঠে পড়ল। সে উঠতে পারবে কিনা তাই নিয়ে আদিত্যও দু’এক মিনিটের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। নিজের দলের স্ট্রাইকার বল নিয়ে বিপক্ষ দলের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়লে যেমন উৎকণ্ঠা হয়। আদিত্য মনে মনে ছেলেটিকে সমর্থন করছিল আর চলমান ট্র্যামটাকে বিপক্ষ দল মনে করছিল। ছেলেটি ট্র্যামে উঠে পড়ার পর আদিত্য আবার তার অফিসের ভেতরের বাস্তবতায় ফিরে এল। অশনি রায় এখনও দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে আছে।
‘অশনিবাবু, আমি বুঝতে পারছি এই ব্যাপারটা আপনাকে কতটা বিচলিত করেছে।’
আদিত্য দু’পা হেঁটে গিয়ে অশনির পিঠে হাত রাখল। ‘কিন্তু আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই। একদিকে তো এই ব্ল্যাকমেলার যে কোনও সময় টাকা চাইতে পারে। অন্যদিকে, হয়ত আপনার বাবা আপনাকে বলেছেন, আমি কয়েকদিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছি। তার মানে বেশ কিছুদিন অকেজো হয়ে যাব। তাই এখন চেষ্টা করছি, যতটা কাজ এগিয়ে রাখা যায়। আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। আপনি যদি একটু কষ্ট করে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন, আমার কাজের খুব সুবিধে হয়।’
দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। সম্ভবত শ্যামল। চা এনেছে। আদিত্য গলা চড়িয়ে বলল, ‘ভেতরে এস। খোলা আছে।
শ্যামল কেটলি থেকে আদিত্যর ফ্লাস্কে চা ঢেলে দিয়ে চলে গেল। শ্যামলের পায়ের শব্দ পেয়ে অশনি মুখ তুলে তাকিয়েছে। শ্যামল চলে যাবার পর আদিত্য দুটো কাপে চা ঢালল। একটা কাপ অশনির সামনে রেখে অন্য কাপটা হাতে নিয়ে উল্টোদিকে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। একটু কড়া গলায় বলল, ‘এবার আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন।’
‘বলুন, কী জিজ্ঞেস করবেন।’ অশনির গলায় একরাশ ক্লান্তি রয়েছে।
‘প্রথম প্রশ্ন, আপনার সঙ্গে যে মহিলার ছবি পাঠানো হয়েছে সেই মহিলা কি রূপলেখা দত্ত হতে পারেন?’
প্রশ্নটা শুনে অশনি খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর গলা নামিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘ছবির ওই মহিলা রূপলেখা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।’
‘আপনার কথা যদি সত্যি বলে ধরে নিই তাহলে অন্তত তিনটে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয়।’ আদিত্য গলায় পেশাদারি গাম্ভীর্য এনে বলল। ‘প্রথম সিদ্ধান্ত, ছবিগুলো জাল নয়। অর্থাৎ একটা মুখের সঙ্গে অন্য কারও শরীর জুড়ে দিয়ে তৈরি হয়নি। মানে, মুখ এবং শরীর দুটোই আপনার। ছবিগুলো জাল কিনা দেখার জন্যে অবশ্য ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে।’
‘দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত?’ অশনি কিছুটা অসহিষ্ণু গলায় প্রশ্ন করল।
‘দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত, আপনার সঙ্গে রূপলেখার শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল। ঠিক বলছি তো?’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলছেন। আমি তো আগেই সে কথা স্বীকার করেছি।— অশনি মৃদু গলায় বলল।
‘হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের এখন ডিটেলগুলো জানা দরকার। কোথায়? কখন? কত ফ্রিকোয়েন্টলি?’
‘আমাদের আলাপ হবার মাস তিনেক পর থেকে রাজারহাটের একটা বাড়িতে আমরা নিয়মিত মিলিত হতাম।’
‘বাড়িটার সন্ধান পেলেন কী করে?’
‘আমি পাইনি। রূপলেখাই আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, বাড়িটা ওর এক বন্ধুর। সেই বন্ধু স্বামীর সঙ্গে দুবাইএ থাকে। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য চাবিটা রূপলেখাকে দিয়ে গেছে।’
‘বাড়িটার এক্স্যাক্ট লোকেশানটা আমার জানা দরকার। ঠিকানাটা জানতে পারলে আরও ভাল হয়।’
‘ঠিকানা তো জানি না। আর এক্স্যাক্ট লোকেশানটাও এতদিন পরে ভুলে গেছি। অ্যাক্সিস মল-এ পৌঁছে মূল রাস্তা থেকে বাঁদিকে টার্ন নিতে হতো। তারপর রাইট টার্ন নিয়ে আবার বোধহয় লেফট টার্ন। আবার রাইট। বেশ কমপ্লিকেটেড। এতদিন পরে মনে রাখা সম্ভব নয়।
‘আচ্ছা, আপনারা যখন ওই বাড়িটাতে নিয়মিত যেতেন, তখন ওখানকার কোনও সিকিউরিটি বা দরোয়ান নিশ্চয় আপনাদের মনে রেখেছিল?’
‘হ্যাঁ সেটা অসম্ভব নয়। যতদূর মনে পড়ে গেটে একটা দারোয়ান থাকত। সে হয়ত আমাদের মনে রেখেছিল।’
‘তাই যদি হয়, আপনার মামলা চলার সময় লোকটাকে খুঁজে বার করেননি কেন? লোকটা হয়ত আপনার হয়ে সাক্ষী দিতে পারত। বলতে পারত, যে মহিলা খুন হয়েছেন তাঁর সঙ্গে আপনার কোনও সম্পর্ক নেই।’
অশনি চুপ করে আছে। উত্তর খুঁজছে। শেষে বলল, ‘আমার বাবার কথা ভেবে লোকটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করিনি। একজন বিবাহিত মহিলার সঙ্গে আমি নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছি জানতে পারলে বাবা ভীষণ দুঃখ পেত। বাবাকে দুঃখ দিতে চাইনি। বাবা ভীষণ কনজারভেটিভ।’
‘কিন্তু মামলা চলার সময় আপনার সঙ্গে একজন বিবাহিত মহিলার সম্পর্কের কথাটা তো আপনার বাবা তো জানতেই পারলেন। সেক্ষেত্রে আর একটু জানাতে কী ক্ষতি ছিল?’
‘বাবা জানতেন আমার সঙ্গে রূপলেখার একটা প্লেটনিক সম্পর্ক ছিল। তার বেশি আর কিছু নয়।’
‘আচ্ছা আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন ছবির এই মহিলাই আপনার পরিচিত রূপলেখা দত্ত?’
অশনি কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলল, ‘রূপলেখার বুকের বাঁদিকে একটা বড় কালো তিল ছিল।’
আদিত্য ভাবনায় ডুবে আছে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অশনি রায় জিজ্ঞেস করল, “আর তৃতীয় সিদ্ধান্ত?’
‘হ্যাঁ। তৃতীয় সিদ্ধান্ত হল, যে মহিলা রূপলেখা দত্ত নাম নিয়ে আপনার সঙ্গে ভাব করেছিল, তার অভিপ্রায় বা চরিত্র কোনওটাই ভাল ছিল না। নাহলে এই ছবিগুলো সে তোলাবে কেন? তোলাবার প্রবৃত্তি হবে কেন? তার সাহায্য ছাড়া ছবিগুলো তোলা সম্ভব হতো না। অর্থাৎ ছবিগুলো যে তোলা হচ্ছে সেটা সে জানত। ফ্ল্যাটের চাবি তো তার কাছেই থাকত। সে নিশ্চয় আগে থেকে ওই ফ্ল্যাটে একজন ফটোগ্রাফারকে ঢুকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কথা হচ্ছে, এতদিন পরে সে ছবিগুলো দেখিয়ে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে কেন? কেন সে ছ’বছর আগে এই চেষ্টাটা করেনি?’
আদিত্য আবার ভাবনায় ডুবে গেছে। তাকে বেশ কিছুক্ষণ নির্বাক দেখে অশনি রায় বলল, ‘আজ তাহলে উঠি? আমার শরীরটা বিশেষ ভাল লাগছে না।’
‘উঠবেন? ঠিক আছে, উঠুন।’ আদিত্য অন্যমনস্কভাবে বলল। তারপর অশনি রায়কে উঠে পড়তে দেখে আদিত্য আবার বলল, ‘আচ্ছা, আপনি যে দুপুরবেলা রূপলেখা দত্তর সঙ্গে দেখা করতেন, আপনি অফিস থেকে বেরতেন কী ভাবে? বেসরকারি অফিসে ওইভাবে নিয়মিত বেরোনো যায় নাকি?’
‘আমি ইন্সপেকশনে যাচ্ছি বলে বেরোতাম।’ অশনি রায় আবার বসে পড়েছে। ‘যে বাড়িটাতে আমরা দেখা করতাম তার কাছেই একটা রিয়াল এস্টেট প্রজেক্ট চলছিল। আমাদের ব্যাঙ্ক ওটা ফাইনান্স করেছিল। ওখানে ইন্সপেকশনে যেতে হতো। ফেরার পথে ওই বাড়িটাতে যেতাম। ওখানে রূপলেখা আমার জন্য অপেক্ষা করত।’
‘যে প্রজেক্টটা আপনি ইন্সপেকশন করতে যেতেন সেটা কোথায়?
‘আমার খুব ভাল মনে নেই। জানেন তো গত তিন বছরে আমার মাথার ভেতরটা ওলোটপালোট হয়ে গেছে। যতদূর মনে পড়ছে, অ্যাক্সিস মল থেকে ডান দিকে বেঁকে মিনিট পঁচিশ যেতে হতো। বাড়িটার নাম বোধহয় শান্তি আলয় বা শান্তি নিকেতন বা ওই ধরনের একটা কিছু। একুশতলা বাড়ি। এতদিনে নিশ্চয় কমপ্লিট হয়ে গেছে।’ ‘আর যে বাড়িটাতে আপনি রূপলেখা দত্তর সঙ্গে দেখা করতে যেতেন সেটা কত তলা?’
‘যত দূর মনে পড়ছে দোতলা। তিনতলাও হতে পারে।’ অশনির গলায় অস্বস্তি। অশনি কি কিছু লুকোবার চেষ্টা করছে?
বিকেলের দিকে অসীমাভ রায়ের ফোন এল।
‘ব্ল্যাকমেলার আবার যোগাযোগ করেছিল। এবার কুরিয়ারে চিঠি পাঠিয়েছে। লিখেছে, আজ রাত্তির এগারোটার সময় লেক কালীবাড়ির উল্টো ফুটপাথে যে ভ্যাট মানে ময়লা ফেলার জায়গাটা আছে সেখানে দু’হাজার টাকার নোটের পাঁচটা বাণ্ডিল, এক-একটা বাণ্ডিলে দু’লাখ টাকা করে, মোট দশ লাখ টাকা একটা মুখ বন্ধ গারবেজ ব্যাগে ভরে ফেলে আসতে হবে। মুখটা বন্ধ করতে হবে সাদা ফিতে জড়িয়ে, যাতে অনেক ব্যাগের মধ্যে এই ব্যাগটাকে আলাদা করে চেনা যায়। পুলিশে খবর দিলে পরের দিনই ওই ছবিগুলো নানা জায়গায় পৌঁছে যাবে। বলুন কী করব।’
“টাকাটা তৈরি রাখুন। আমি একটু খোঁজ-খবর নিয়ে বলছি কী করতে হবে।’ আদিত্য ফোন কেটে দিয়ে সুভদ্র মাজির নম্বরটা লাগাল।
‘আজ সন্ধে বেলা ফ্রি আছ?’
‘সাড়ে পাঁচটা অব্দি লালবাজারে একটা মিটিং আছে দাদা। খুব বেশি হলে ছ’টা অব্দি চলবে। তারপর ফ্রি।’
‘নো প্রবলেম। আমার কাজটা রাত্তিরে। অবশ্য তার আগে কিছু তোড়জোড় করতে হবে। এটা সেই ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারটা। সেই যে তোমাকে ছবি পাঠালাম, মনে আছে?’ ‘খুব মনে আছে। আমি ছবিগুলো ফরেনসিকে পাঠিয়েছিলাম। ওরা বলছে ছবিগুলো জেনুইন।’
‘তুমি নিজে ছবিগুলো ভাল করে দেখেছ?’
‘ওরকম নোংরা ছবি আর কী দেখব দাদা?’ সুভদ্র মনে হয় লজ্জা পেয়েছে। ‘নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে দেখবে। প্রফেশানালের দৃষ্টিতে দেখবে। সেরকম ভাবে দেখেছ কি?’
‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনি কী বলতে চাইছেন।’
‘বলতে চাইছি, তুমি যদি ভাল করে ছবিগুলো দেখতে, তাহলে একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করতে। দেখতে, ছবিতে অশনি রায় ডান হাতে ঘড়ি পরে আছে। কিন্তু অশনি তো ডান হাতে ঘড়ি পরে না। তোমার-আমার মতই বাঁ হাতে পরে। তা হলে ওই সময় সে ডান হাতে ঘড়ি পরল কেন?’
‘জানি না, দাদা। ভাবতে হবে।’
‘যাই হোক, ছবির অন্যতম চরিত্র অশনি রায় কনফার্ম করেছে যে ছবিগুলো আসল ৷ অতএব ছবিগুলোর জেনুইননেস নিয়ে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু আপাতত সমস্যাটা অন্য। ব্ল্যাকমেলার পত্র দিয়ে জানিয়েছে যে আজ রাত্তির এগারোটায় লেক কালীবাড়ির উল্টো ফুটপাতে দশ লাখ টাকা রেখে না এলে সে সব কিছু ফাঁস করে দেবে। এই ব্ল্যাকমেলারটিকে ধরার ব্যাপারে তোমার এবং তোমার দু’চারজন কনস্টেবলের সাহায্য চাই।’
‘নো প্রবলেম দাদা ৷ আপনি শুধু বলে দেবেন কী করতে হবে। আমি ফোর্স জোগাড় করে রাখব।’
‘আর একটা ব্যাপার। রাজারহাটে অ্যাক্সিস মলের কাছে শান্তি আলয় বলে একটা একুশতলা হাইরাইজ উঠেছে। অশনি রায়ের ব্যাঙ্ক প্রজেক্টটা ফাইন্যান্স করেছিল। খোঁজ নিতে পারবে আট-নয় বছর আগে এই শান্তি আলয়ের আশেপাশে বাড়ি কী কী ছিল? আমার ধারণা সাত-আট বছর আগে ওই অঞ্চলে খুব বেশি বাড়ি হয়নি। তোমাকে খুব একটা খুঁজতে হবে না। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। তুমি আরও খোঁজ নিও অশনি রায়ের ব্যাঙ্ক সম্প্রতিকালে রাজারহাট অঞ্চলে আর কী কী হাউসিং প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করেছিল। বিশেষ করে দেখবে রবীন্দ্র তীর্থ পেরিয়ে খানিকটা এগোলে বাঁ দিকের একটা রাস্তায় সল্ট অ্যান্ড পেপার বলে একটা ক্যাফে আছে। খোঁজ নিও ওই অঞ্চলে অশনি রায়ের ব্যাঙ্ক কোনও রিয়াল এস্টেট প্রজেক্ট ফাইন্যান্স করেছিল কিনা।’
‘এটা কি নতুন কোনও কেস?’
‘আরে না, না। এই ব্ল্যাকমেলিং-এর কেসটায় ওই বাড়িটার একটা ভূমিকা আছে। আজ রাত্তিরে তোমার সঙ্গে দেখা হলে সব খুলে বলব।’
লেক কালীবাড়ি শনিবার বাদ দিয়ে অন্যান্য দিন রাত ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়। শনিবার খোলা থাকে রাত্তির সাড়ে বারোটা অব্দি। আজ বুধবার। তাই মন্দির ন’টায় বন্ধ হয়ে গেছে। মন্দির বন্ধ হবার আধঘন্টার মধ্যে অঞ্চলটা ফাঁকা। আরও ঘন্টাখানেক পরে যখন সুভদ্রকে নিয়ে আদিত্য লেক কালী মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছল তখন দু’দিকের ফুটপাত রীতিমত শুনশান। শুধু মাঝে মাঝে নিস্তব্ধতা ভেঙে রাস্তা দিয়ে দু’একটা গাড়ি যাচ্ছে।
আদিত্যদের গাড়িটা জায়গা নিয়েছে লেক ভিউ রোডে একটা উঁচু বাড়ির পার্কিং লটে। ব্যবস্থাটা সুভদ্র আগেই করে রেখেছিল। এখান থেকে কালীবাড়ির উল্টো ফুটপাতের ভ্যাটটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো কালো কালো গারবেজ ব্যাগ পড়ে রয়েছে। আশে পাশের হাইরাইজ গুলোর জঞ্জাল। মনে হয় কাল ভোরে কর্পোরেশনের গাড়ি এসে ময়লা নিয়ে যাবে। সম্ভবত আদিত্যদের মতো আরও কেউ ভ্যাটের দিকে নজর রাখছে।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখা গেল গোলপার্কের দিক থেকে একটা আকাশী নীল হন্ডা অ্যাকর্ড সাদার্ন অ্যাভিনিউ ধরে এগিয়ে আসছে। ভ্যাটের সামনে এসে গাড়িটা থেমে গেল। পেছনের দরজা দিয়ে অসীমাভ রায় বেরোলেন। হাতে একটা কালো গারবেজ ব্যাগ। এদিক-ওদিক তাকিয়ে গারবেজ ব্যাগটা অসীমাভ রায় ভ্যাটের মধ্যে ছুঁড়ে দিলেন। অনেকগুলো ব্যাগের মধ্যে অসীমাভ রায়ের ব্যাগটা মিশে গেল। অসীমাভ রায় গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।
এর পরের পঞ্চাশ মিনিট তেমন কিছু ঘটল না। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ক্রমশ কমতে লাগল। কয়েকটা কুকুর খাদ্যের সন্ধানে আঁস্তাকুড়ে ঢুকে পড়ল। তাদের মধ্যে বোধহয় বেপাড়ার দু’একজনও ঢুকে পড়েছিল। ফলে রাত্রির স্তব্ধতা খানখান করে মিনিট দশেক কুকুরদের ঝগড়াঝাঁটি চলল। কিছু মশা আদিত্যদের গাড়ির জানলা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। তারা মনের সুখে আদিত্যদের কামড়ে যাচ্ছিল। অন্ধকারে মশাদের দেখা যাচ্ছিল না, ফলে মারাও যাচ্ছিল না।
আদিত্যর ঝিমুনি আসছিল। হঠাৎ দেখল কালীবাড়ির দিক থেকে রাস্তা পার হয়ে একটা পাগল বা ভিখিরি আঁস্তাকুড়ের দিকে এগোচ্ছে। আদিত্য তার পাশে বসা সুভদ্রকে চাপা গলায় বলল, “এই মনে হচ্ছে আমাদের লোক।’
লোকটা আঁস্তাকুড়ের ভিতরে ঢুকে কিছু একটা খুঁজছে। অসীমাভ রায়কে বলা ছিল সে যেন এমন ভাবে গারবেজ ব্যাগটা ভ্যাটের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে যাতে ওটা খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লেগে যায়। ওই সময়ের মধ্যে লুকোনো জায়গা থেকে পুলিশরা লোকটার কাছে চলে আসতে পারবে ।
ঠিক ব্যাগটা খুঁজে পেতে লোকটার মিনিট তিন-চার লেগে গেল। ব্যাগটা হাতে নিয়ে সে রেলিং টপকে রবীন্দ্র সরোবরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। সুভদ্র চাপা গলায় বলল, ‘চিন্তা নেই দাদা। ওদিকেও আমাদের লোক আছে।’
আদিত্যরা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। লোকটা মাঠ পেরিয়ে ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাবের দিকে এগোচ্ছে। আদিত্যরা দ্রুত রাস্তা পার হল। অন্ধকারে একটা কালো কোয়ালিস দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা গাড়ির কাছে পৌঁছে ব্যাগটা জানলা দিয়ে ভেতরে চালান করে দিল। আর ওমনি যেন মাটি ফুঁড়ে চারটে পুলিশ গাড়ির সামনে এসে হাজির। পুলিশ দেখেই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে দিয়েছে। যে দু’জন পুলিশ গাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল তারা ভয় পেয়ে সরে গেল। নাহলে গাড়িটা তাদের ধাক্কা দিয়ে চলে যেত। কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না। একটা পুলিশের ভ্যান গাড়ির রাস্তাটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছে।
যে লোকটা আঁস্তাকুড় থেকে টাকার ব্যাগটা তুলে এনেছিল সে চুনোপুঁটি। যে তাকে নিয়োগ করেছিল সে গাড়ির ভেতরে বসে ছিল। পুরোনো পাপী। পুলিশের খাতায় নাম আছে। একাধিক নাম। শ্রীকৃষ্ণ, কানু, অসগর। কিন্তু থার্ড ডিগ্রি করেও তার কাছ থেকে জানা গেল না ছবিগুলো সে কোথায় পেয়েছে। সে বলছে, ছবি-টবির কথা সে কিছুই জানে না। তার কাজ ছিল টাকাটা নিয়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেওয়া।
‘কোথায় পৌঁছে দেবার কথা ছিল?’ সুভদ্র স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করেছিল। ‘কোথাও না। এখন টাকাটা আমার কাছেই রেখে দেবার কথা ছিল। পরে আমার কাছ থেকে কেউ এসে টাকাটা নিয়ে যেত। কবে আসবে কিছু বলেনি।’
‘কে এসে টাকা নিয়ে যেত?’
‘আমাকে যে কাজটা করতে বলেছিল, তার লোক।’
‘কে তোমাকে কাজটা করতে বলেছিল?’
‘আমি তাকে চিনি না। টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা হয়েছিল।’
আবার কিছু থার্ড ডিগ্রি প্রয়োগ করা হল। উত্তর মেলে না। কিছু পরে আবার থার্ড ডিগ্রি। আদিত্যর অসুস্থ লাগছিল। বেশ কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর কানু জানাল কানা মুমতাজ বলে একজন কুখ্যাত অপরাধী এই ব্ল্যাকমেলিং-এর পেছনে আছে। সে-ই কানুকে নিয়োগ করেছে। টাকাটা মুমতাজের হাতে নিরাপদে তুলে দিতে পারলে কানু পাবে এক লাখ। বাকিটা কানা মুমতাজ। অন্তত কানু তাই বলছে।
বেশ কিছুদিন হল মুমতাজকে পুলিশ খুঁজছে। সে দেশে আছে নাকি বিদেশ থেকে ব্যবসা চালাচ্ছে সেটাও পুলিশ জানে না। মুমতাজের মূল ব্যবসা মধুকুঞ্জ এবং ব্রথেল চালানো। কলকাতায় তার অনেকগুলো ব্রথেল আছে। তাছাড়া মেয়ে পাচারের ব্যবসার সঙ্গেও মুমতাজ জড়িত। মূলত মিডল ইস্টে সে মেয়ে সাপ্লাই করে। কিন্তু কানুর কথা যদি সত্যিও হয়, কানা মুমতাজ কোথা থেকে এই ছবিগুলো পেল সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
বেশ কয়েকবার থার্ড ডিগ্রির পরে কানু যখন ধুঁকছে, যখন নতুন আর কোনও তথ্য পাবার কোনও আশাই নেই, তখন আদিত্য সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি এবার বাড়ি যাব। কাল খুব ভোরে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।’
সুভদ্র এত অবাক হয়ে গেছে যে কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।
রাস্তায় এসে আদিত্যর মনে পড়ল তার হাসপাতালে ভর্তি হবার ব্যাপারটা কেয়াকেও বলা হয়নি। বললে অবশ্য কেয়া তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিত না।