মৃত্তিকার মৃত্যু – ৫
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
( ১ )
দুপুর সাড়ে বারোটায় আদিত্যর অ্যাঞ্জিওগ্রাফি হল। আজকাল কব্জির ধমনী দিয়ে হার্ট পর্যন্ত একটা ক্যাথেটর ঢুকিয়ে অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করা হয়, আগে নাকি কুঁচকি দিয়ে ঢোকান হত। যাই হোক, পুরো প্রসিডিওরটাই হল লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে, আদিত্যর জ্ঞানে। অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করতে করতে অসীমাভ রায় বলে দিলেন, দুটো মেজর ব্লক আছে, একটা বাঁ দিকে, একটা ডান দিকে। বাঁ দিকেরটা সিরিয়াস, নাইনটি পার সেন্ট ব্লক। দুটো ব্লকেই বেলুন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে স্টেন্ট বসাতে হবে। আদিত্যর যদি আপত্তি না থাকে এই ইন্সারশানেই সেটা করে ফেলা যেতে পারে। তবে আদিত্য তো এই অবস্থায় সই করতে পারবে না, তাই কনসেন্টটা ওর স্ত্রীকেই দিতে হবে।
আদিত্যর আপত্তি করার প্রশ্নই ওঠে না। সে সেই কথা অসীমাভ রায়কে বলল। অসীমাভ রায় আদিত্যর সম্মতির কথাটা কেয়াকে জানিয়ে তার কনসেন্ট আদায় করার জন্য ওটি থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে আদিত্যকে যখন ওটিতে নিয়ে আসা হচ্ছিল তখন ক্ষণিকের জন্য কেয়ার মুখটা দেখতে পেয়েছিল আদিত্য। কেয়াকে চেনাই যাচ্ছে না। ভাল করে চুল আঁচড়ায়নি, শাড়িটাও একেবারে ক্রাশড। তার ওপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে।
আগের রাত্তিরে আদিত্য যখন কেয়াকে তার অসুখের কথা বলল, কেয়া প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি। ভাবছিল আদিত্য মজা করছে। একটু পরে কেয়া বুঝতে পারল আদিত্য মোটেই মজা করছে না। সেই থেকে তার চেহারা, চরিত্র সব কিছু বদলে গেছে। আদিত্য এই প্রথম উপলব্ধি করল কেয়া তার ওপর মানসিক ভাবে কতটা নির্ভর করে। তার নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। কেয়ার কথা না ভেবে সে দিনের পর দিন ধূমপান চালিয়ে গেছে। তার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সত্যিই কোনও ক্ষমা নেই।
আদিত্য কেয়াকে অনেকবার বোঝাতে চেষ্টা করছিল, হার্টের অসুখটা আজকাল কোনও ব্যাপারই নয়। কেয়ার একটাই কথা, ‘তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব ।
ছেলেমানুষি কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু কথাগুলোর পেছনে যে প্রচণ্ড আবেগের ধাক্কাটা আছে, তাকে অবজ্ঞা করা আদিত্যর পক্ষে অসম্ভব।
বেলুন অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হল, বুকের দু’দিকে দুটো স্টেন্ট বসল। পুরোটাই লোকাল দিয়ে, আদিত্যর জ্ঞানে। ভাল মাত্রায় সিডেটিভ দিয়েছিল বলে আদিত্য আচ্ছন্ন হয়ে শুয়েছিল। তার শরীরের ভেতরে কী ঘটছে সেটা একটা মনিটরে পরিষ্কার দেখা গেলেও সে কিছুই দেখছিল না। দেখতে ইচ্ছেও করছিল না। পুরো ব্যাপারটা শেষ হতে কতক্ষণ লাগল আদিত্য ঠিক বলতে পারবে না কারণ সিডেটিভের প্রভাবে তার সময়বোধ লুপ্ত হয়েছিল। বস্তুত, চোখ বুঝে শুয়ে থাকতে থাকতে আদিত্য প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল। শুধু মাঝে মাঝে টের পাচ্ছিল তার শরীরের ভেতরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। তবে জ্বালা-যন্ত্রণা তেমন নেই।
যেহেতু সব কিছুরই শেষ আছে, একটা সময় এই আসুরিক প্রক্রিয়াগুলিও শেষ হল। আধা জাগ্রত অবস্থায় আদিত্য টের পেল তাকে ওটির বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যেতে যেতে কয়েকটা চেনা মুখ তার চোখে পড়ল গৌতম-মালিনী, সুভদ্র মাজি, তাদের নতুন ড্রাইভার মনোজ হালদার। কিন্তু কেয়ার মুখটা দেখতে পাচ্ছিল না বলে আদিত্যর খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপর তার চোখে পড়ল কেয়া নিজের ইস্কুলের কয়েকজন কলিগের সঙ্গে একধারে দাঁড়িয়ে। আদিত্যকে বেরোতে দেখে কেয়া দৌড়ে আসছে।
‘ডাঃ রায় বলেছেন সব কিছু খুব ভাল ভাবে হয়ে গেছে। আর কোনও চিন্তা নেই।’ কেয়ার মুখটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
কেয়ার বোধহয় আরও কিছু বলার ছিল, কিন্তু ততক্ষণে ঠেলাওলা আদিত্যর স্ট্রেচারটা ঠেলতে ঠেলতে দূরে নিয়ে চলে গেছে।
সেই দিনটা আদিত্যর ঘোরের মধ্যেই কাটল। পরের দিন বেলার দিকে তাকে এমন একটা ক্যাবিনে দিল যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তা মানে রাসেল স্ট্রিট। হুস হুস করে গাড়ি যাচ্ছে, ট্যাক্সি যাচ্ছে, মাঝে মাঝে বিরাট ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকছে। একধার দিয়ে স্কুটার, মোটরবাইকও যাচ্ছে। এমনকি দু’একটা সাইকেল। আদিত্য ঘোলাটে চোখে দেখছিল। যেন বাইরের পৃথিবীটা একেবারে অচেনা কোনও জায়গা। অথচ মাত্র দু’দিনই তো হয়েছে সে হাসপাতালে। বাথরুমে যাবার জন্যে উঠতে গিয়ে মাথাটা টলে গেল। সিডেটিভের প্রভাব এখনও যায়নি। আদিত্য খেয়াল করল তার শরীরে কোথাও কোনও ব্যথা নেই। শুধু কব্জিতে, যেখানে ফুটো করে ক্যাথেটার ঢোকানো হয়েছিল, সেখানে ব্যথা, ব্যান্ডেজ। নার্স ইঞ্জেকশান দিতে এসেছে। দুপুরে খাবার পর আদিত্য বেশ কয়েক ঘন্টা ঘুমোল। ঘুম থেকে উঠে চা-বিস্কুট খাচ্ছে, কেয়া ঘরে ঢুকল।
‘শরীর কেমন?’ কেয়াকে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে।
‘অপূর্ব। ফার্স্ট ক্লাশ।’ আদিত্য একগাল হাসল। ‘সেরে উঠেছি। বুকে-টুকে আর কোনও ব্যথা নেই।’
‘দুপুরে খেয়েছিলে ভাল করে?’
‘খেয়েছি। তারপর টানা ঘুমিয়েছি।’
‘কী খেতে দিল?’
‘ভাত, পাতলা মুসুরির ডাল, লাউএর তরকারি, মাছের ঝোল, টক দই। রাত্তিরে চিকেন দেবে বলেছে।’ বলতে বলতে আদিত্য লক্ষ করল কেয়া সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছে। ‘সিঁদুর পরেছ? তুমি তো কখনও সিঁদুর পর না।’ আদিত্য হাত বাড়িয়ে কেয়ার হাতটা ধরল।
‘স্বামীর কল্যাণে পরতে হয়েছে। তোমার এখানে আসার আগে কালীবাড়িও গিয়েছিলাম।’ কেয়া আদিত্যর খুব কাছে চলে এসেছে।
‘কালীঘাটে গিয়েছিলে?’
‘না, না। আমি কালীঘাটের কিছুই চিনি না। ঠনঠনে কালীবাড়ি গিয়েছিলাম। ওটা আমাদের পুরোনো কলেজ পাড়া। তাই চিনি।’
আদিত্য সিঁদুর পরাতেও বিশ্বাস করে না, কালীবাড়ি গিয়ে পুজো দেওয়াতেও নয়। কিন্তু কেয়া তার কল্যাণে সিঁদুর পরেছে, কালীবাড়িতে পুজো দিয়েছে, এটা ভাবলে কেয়ার জন্যে তার মনটা হু হু করে ওঠে।
হঠাৎ অন্য একটা কথা মনে পড়ে যাওয়াতে সে খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল, ‘এখানকার বিলটা কত হবে কিছু আন্দাজ পেয়েছ?’
‘পুরোটা এখনও বলেনি। তবে এদের একটা প্যাকেজ আছে। আমরা সেটার সুবিধে নিতে পারব। আমাকে ডাঃ রায় বললেন, যদি আনফোরসিন কিছু না ঘটে তাহলে তোমাকে পরশুদিন ছেড়ে দেবেন। সেটা ধরে নিয়ে আমি নিচে অ্যাকাউন্টসে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা বলছে, সব মিলিয়ে সাড়ে চার পৌনে পাঁচ লেগে যাবে। এতটা লাগত না। কিন্তু ডাঃ রায়ের ফাঁটা মারাত্মক বেশি। উনি একটা পয়সা ছাড়েননি। সত্যি বলতে কী আমি একটু অবাক হয়ে গেছি। উনি তো তোমার মক্কেল। একটু কনসেশন দিতে পারতেন না?’
‘কেন কনসেশন দেবেন? উনি তো জানেন টাকা দেবে ইনশিয়োরেন্স কম্পানি। বরং কম টাকা নিলেই ব্যাপারটা এমব্যারাসিং হতো। যাই হোক, আমাদের ইনশিয়োরেন্স তো পাঁচ লাখের। তার মধ্যে হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস তোমাদের হেড মিস্ট্রেসের কথা শুনে হেলথ ইনশিয়োরেন্সটা করিয়ে রেখেছিলাম।’ আদিত্য একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
‘তা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবছর এত ক্লেম থাকলে পরের বার প্রিমিয়ম বেশ বেড়ে যাবে। যাই হোক, তুমি কিন্তু ডাঃ রায়ের কাছ থেকে তোমার পুরো ফীটা নিও। এক পয়সাও ছেড় না।’
‘সে দেখা যাবে। গৌতম-মালিনীকে তো দেখলাম। বিমল খবর পেয়েছে?’ ‘বিমল খবর পেয়েছে কিনা জানি না। গৌতম-মালিনী বলেছে কাল আবার আসবে। আজই আসবে ভেবেছিল, কিন্তু গৌতম কী একটা কাজে আটকে পড়েছে। আমাকে ফোন করেছিল।’
‘আমার কোনও ফোন এসেছিল?’ আদিত্যর মোবাইলটা কেয়ার কাছে আছে। ‘দু’একটা আজেবাজে ফোন এসেছিল। ধার নেবে কিনা, ক্রেডিট কার্ড নেবে কিনা, মোবাইলের আরেকটা কানেকশন নেবে কিনা, এইসব। তবে একটু আগে একজন ফোন করেছিল। মহিলা। খুব বিপদের মধ্যে আছে মনে হল। তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছিল। আমি বললাম, উনি হাসপাতালে ভর্তি আছেন। চার-পাঁচ দিন পরে করবেন।’
‘মহিলা? নাম বলেছিল?’ আদিত্যর ভুরু দুটো কুঁচকে গেছে।
‘নাম বলেছিল। কিছু একটা সাহা। অনামিকা? না। না। অনসূয়া? না অনসূয়াও নয়। বোধহয় অনন্যা। হ্যাঁ, ঠিক, ঠিক। অনন্যা সাহা। বলল, তুমি বাঙ্গুরে ওদের বাড়িতে কিছুদিন আগে গিয়েছিলে। মনে করতে পারছ?’
আদিত্য মনে করতে পারছে।
সাতটায় ভিজিটিং আওয়ার শেষ। কেয়া চলে গেল। আদিত্য কাজ না পেয়ে টিভি খুলেছে। বাংলা খবরের চ্যানেল। দশ মিনিটে দশটা খবর দেবে বলছে। সবই জেলার খবর। আদিত্য টিভির দিকে অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে ছিল। অ্যাঙ্কার মেয়েটি ঝড়ের গতিতে পরপর দশটা খবর পড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুরে দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের বোমাবাজিতে সাধারণ মানুষ বাড়ি থেকে বেরতে পারছে না। হুগলির বলাগড়ে পারিবারিক দ্বন্দ্বের ফলে দুই ভাই আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রাজ্যের ন্যায্য দাবিগুলি জানানোর জন্য অর্থমন্ত্রী আজ বিকেলে দিল্লি রওনা হয়েছেন। নদীয়ার ভাণ্ডারখোলা অঞ্চলে, তিনশ’ বারো নম্বর হাইওয়ের ওপর, অভুক্ত কিছু গ্রামবাসী রাতের অন্ধকারে পাঁউরুটি ভর্তি একটা ট্রাক লুঠ করেছে। বাঁকুড়ার একাধিক পঞ্চায়েতে রাজনৈতিক অদলবদলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে চারজন দুষ্কৃতি একটি নাবালিকাকে ধর্ষণ করেছে। শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত ডার্বি ম্যাচে মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের খেলাটি ১-১ গোলে অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয়েছে। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
অ্যাঙ্কার মেয়েটি এত তাড়াতাড়ি কথা বলছে যে আদিত্য খেই হারিয়ে ফেলছে। বিরক্ত হয়ে সে টিভি বন্ধ করে আবার চোখ বুঝল। চোখ বুঝলেও ঘুম আসছে না। কী করে আসবে? দুপুরে যা টানা ঘুমিয়েছে। তবু আদিত্য চোখ বন্ধ করে আছে। তার মনে হচ্ছে ওই খবরগুলোর মধ্যে একটা খবর আছে যেটা তার পক্ষে জরুরি। কিন্তু কোন খবরটা ঠিক মনে করতে পারছে না। হয়ত পরে মনে পড়বে। এখন মনটাকে বিশ্রাম দেওয়া দরকার।
সকাল আটটা থেকে ন’টা একটা ভিজিটিং আওয়ার, আর একটা বিকেল পাঁচটা থেকে সাতটা। তবে কেয়ার কাছে একটা গোলাপী রঙের কার্ড আছে, সেটা দেখালে যখন খুশি তাকে আদিত্যর ঘরে ঢুকতে দেয়। কেয়া সকাল সাড়ে সাতটায় চলে এসেছিল। এখন তার গাড়ি হয়েছে, তাই যাতায়াতে অসুবিধে নেই। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হবার আগেই কেয়া বেরিয়ে গেল। তার ইস্কুলে কী যেন একটা বিশেষ কাজ আছে। বিকেলে আবার আসবে। কেয়া চলে যাবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আদিত্যর মনে হল দরজা দিয়ে একটা মুণ্ডু উঁকি মারছে। বিমল গায়েন।
‘স্যার আপনি এত অসুস্থ অথচ আমাকে একটা খবর পর্যন্ত দেননি। আমি হয়ত তেমন কিছু করতে পারতাম না। কিন্তু ম্যাডামের সঙ্গে থেকে ফাইফরমাস তো খেটে দিতে পারতাম। দৌড়দৌড়ির কাজগুলো তো করে দিতে পারতাম। আপনি কি স্যার আমাকে আপন মনে করেন না?’ বিমলের অভিযোগ আর ফুরোতেই চায় না।
‘শোনো, আমাকে হঠাৎ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। কাউকেই খবর দিতে পারিনি।’ বিমল একটু থামার পর আদিত্য শান্ত গলায় বলল। ‘তুমি জানলে কী করে আমি অসুস্থ?’
‘আমি আজ সকালে আপনাকে ফোন করেছিলাম। একটা খবর দেবার ছিল। তা, ফোনটা ম্যাডাম ধরলেন। তখনই জানতে পারলাম আপনি হাসপাতালে। জানতে পেরে সোজা এখানে চলে এসেছি। নাইট ডিউটি করে এখনও বাড়ি যাইনি। আপনি এখন কেমন আছেন স্যার?’
‘ভাল আছি। বিপদ একটা এসেছিল নিশ্চয়, কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা কেটে গেছে। ডাক্তারবাবুও বললেন খুব অঘটন না ঘটলে আগামীকাল ছেড়ে দেবেন। সপ্তাহ খানেক পরে মনে হয় আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব।’
‘ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে স্যার, তবু বলব, সিগারেটটা এবার ছেড়ে দিন। ওটাই যত নষ্টের গোড়া।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা তো ছেড়েই দিয়েছি। ডাক্তারবাবু বলছিলেন উত্তেজনা, টেনশান এইসব কমাতে হবে। কিন্তু আমার যা কাজ, ওগুলো তো থাকবেই।’
‘কাজ থেকে কিছুদিন ছুটি নিন না স্যার। ক’দিন কাজ না করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’
‘অনেক কাজ বাকি পড়ে আছে গো। অনেক দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছি। দু’চারদিন জিরিয়ে নিয়ে আবার কাজে লেগে পড়তে হবে।’ আদিত্য উদাস গলায় বলল। তারপর গলায় একটু উৎসাহ এনে বলল, ‘কী যেন একটা খবর দেবে বলছিলে?’
‘তেমন কিছু নয় স্যার। পরে বলব। এখন ওসব কথা বললে আপনি আবার ভাবতে বসবেন। সেটা আপনার শরীরের পক্ষে ভাল নয়।’
‘আরে বলই না। কী আর হবে। বড় জোর শুয়ে শুয়ে ভাবব। উঠে তো আর নাচানাচি করছি না।’
হাসপাতালের পোষাক পরে একটা লোক ঘরে ঢুকেছে। ‘চলে যান, এবার চলে যান। ভিজিংটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে।’ বলতে বলতে লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
‘বল। তোমার খবরটা বলে যাও।’ আদিত্য তাগাদা লাগাল। সে জানে বিমলের আনা খবরে সাধারণত পদার্থ থাকে।
‘ঠিক আছে স্যার বলছি। আপনি বলতে বলছেন বলেই বলছি। আমি আপনার কথা ফেলতে পারি না। যাই হোক, আপনার নিশ্চয় মনে আছে কিছুদিন আগে আপনাকে সোমনাথ বাগ বলে একজনের খবর দিয়েছিলাম যে আগে বাঙ্গুর এভিনিউর ওই বাড়িটাতে সিকিউরিটির কাজ করত?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিশ্চয় মনে আছে। তার সঙ্গে তো কথা বললাম এই সেদিন। কী হয়েছে তার?’ আদিত্য কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘কী হয়েছে জানি না। যে খবরটা আপনাকে দিতে চাই সেটা হল, সোমনাথ বাগ তিরুপতি গার্ডস-এর চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। চাকরি ছেড়ে সে কোথায় যে গেছে কেউ বলতে পারছে না।’
‘চিন্তার কথা।’ আদিত্যর কপালে ঈষৎ ভাঁজ পড়েছে। ‘কিন্তু তুমি খবরটা পেলে কোথা থেকে?’
‘আসলে কী হয়েছে স্যার, মা দুর্গা সিকিউরিটিজ বলে আমি যে সিকিউরিটি কম্পানিটাতে কাজ করি সেখানে বাবলু বলে একজন কাজ করত। বাবলু মান্না। আমরা দু’জন একই বাড়িতে ডিউটি করতাম। এক সঙ্গে ডিউটি করতে করতে বাবলু আমার খুব বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। আমরা এক সঙ্গে টিপিন খেতাম, গেট পাহারা দিতাম। দু’একবার এক সঙ্গে সিনেমাও দেখেছি। তা, বাবলু হঠাৎ একদিন কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে চলে গেল। মেদিনীপুরে ওর দেশ। বলল, দেশে একটা মুদির দোকান দেবে। পরের গোলামি করতে আর ভাল লাগছে না।’
‘আরে বাবলু মান্নার কথা কে জানতে চাইছে? বাবলু মান্না নয়, আমি সোমনাথ বাগের কথা জানতে চাইছি। সময় নেই। তাড়াতাড়ি বল। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে। এক্ষুনি ওই লোকটা এসে তোমাকে বার করে দেবে।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি সোমনাথের কথাই বলছি স্যার। কিন্তু তার আগে বাবলুর কথাটা বলতে হবে।’
‘ঠিক আছে তুমি তোমার মত করেই বল।’
‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম, অনেক দিন বাবলুর খবর রাখতাম না। তারপর এই দু’দিন আগে আবার ওর খবর পেলাম। শুনলাম ও কলকাতায় ফিরে এসেছে। দেশে মুদির দোকানটা তেমন চলেনি। আরও শুনলাম, কলকাতায় ফিরে ও তিরুপতি গার্ডস-এ চাকরি নিয়েছে। শুনেই মনে হল আগে জানলে ওর কাছ থেকেই সোমনাথ বাগের খবর নেওয়া যেত। যাই হোক, ওর সঙ্গে দেখা করলাম। অনেক দিন পরে দেখা অনেক কথা জমে ছিল। একথা সেকথার পর জিজ্ঞেস করলাম, সোমনাথ বাগকে চেন? তোমাদের কম্পানিতেই চাকরি করে। বাবলু বলল, কী করে চিনব? সে তো চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। তার জায়গাতেই তো আমি এসেছি। তাকে কখনও চোখেই দেখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, সোমনাথ চাকরি ছেড়ে দিয়ে কোথায় গেছে জান? বাবলু বলল, সেটাই তো অদ্ভুত ব্যাপার। যা শুনলাম, সোমনাথ নাকি হঠাৎ একদিন এসে ম্যানেজারকে বলেছে সে আর চাকরি করবে না। তার যা পাওনা-গণ্ডা আছে সেটা যেন তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই কথা বলে সেই যে সে আপিস থেকে বেরিয়ে গেছে আর তার কোনও খবর কেউ পায়নি।’
‘আরে আপনি এখনও ঘরে রয়েছেন? যান, এবার যান দয়া করে। ভিজিটিং আওয়ার অনেকক্ষণ শেষ হয়ে গেছে।’ ইউনিফর্ম পরা লোকটা আবার ঘরে ঢুকেছে। যতক্ষণ না বিমল ঘর থেকে বেরোচ্ছে, ততক্ষণ সেও ঘর থেকে বেরোবে না ।
‘নাঃ। এবার তুমি যাও। আমি একটু বিশ্রাম করি।’ আদিত্য উদাস হয়ে বাইরে তাকাল। নীল আকাশ। সাদা মেঘ। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। আদিত্য ভাবছে। গভীরভাবে ভাবছে।
(২)
বাড়ি ফেরার তিন ঘন্টার মধ্যে আদিত্য অনন্যা সাহাকে ফোন করল। রেকর্ডেড মেসেজ জানাল নম্বরটা নেটওয়ার্কের বাইরে।
বেলা এগারোটা বেজেছে। কেয়া আজ ইস্কুলে যাবে না। রান্নাঘরে। আদিত্যর জন্য লাঞ্চ বানাচ্ছে। আদিত্য জানলার সামনে দাঁড়াল। সকালের গমগমে বাজার এখন ভেঙে যাবার মুখে। তবু দু’একজন কিছু বিক্রির আশায় এই শেষ বেলায় বেসাতি নিয়ে বসে আছে। পটল, বেগুন, কুমড়ো। কয়েক আঁটি কলমি শাক। কাঁচা লঙ্কা। কর্পোরেশনের জমাদার ঠেলাগাড়িতে ময়লা তুলছে। তার বেলচাতে শব্দ হচ্ছে শপ শপ। আদিত্যর মনে হল যেন বহু যুগ পরে সে এই পরিচিত দৃশ্যগুলো দেখছে। আসলে মাত্রই তিন দিন সে হাসপাতালে ছিল।
অনন্যা সাহার সঙ্গে আবার যোগাযোগের চেষ্টা করল আদিত্য। নম্বরটা এখনও নেটওয়ার্কের বাইরে। ল্যাপটপে উলহাস কাসালকারের দেবগিরি বিলাওল লাগাল। বন্দিশটা গুড়ের মতো মিষ্টি। আদিত্য সব কিছু ভুলে মিনিট পাঁচেক গানের মধ্যে ডুবে ছিল। হঠাৎ টেলিফোন। সুভদ্র মাজি।
‘রাজারহাটের ওই বাড়িটার খবর নিয়েছিলাম দাদা। সাত-আট বছর আগে শান্তি আলয়ের আশেপাশে কোনও বাড়িই ছিল না। গত দু’তিন বছরে ওখানে শান্তি আলয় ছাড়াও কয়েকটা হাইরাইজ হয়েছে।
‘আচ্ছা, রাজারহাটে অন্য কোনও হাইরাইজ কি অশনির ব্যাঙ্ক ফাইন্যান্স করেছিল?’ ‘আপনি একদম ঠিক ধরেছেন দাদা। ওই সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফেটার কাছে অশনি রায়ের ব্যাঙ্ক আর একটা বাড়ি ফাইন্যান্স করেছিল। বাড়িটার নামটা বেশ জমকালো। ওয়াদারিং হাইটস। মানে সেই এমিলি ব্রন্টের উপন্যাস।’
আদিত্য অবাক হল না। সুভদ্র মাজির বিস্তৃত সাহিত্যপাঠের পরিচয় সে আগেও পেয়েছে। মুখে বলল, ‘এই এমিলি ব্রন্টের আশেপাশে আর কোনও বাড়ির সন্ধান পেলে?’
‘সেটাও খোঁজ নিয়েছিলাম। কিছুই নেই। জায়গাটা এখনও ঠিকমতো ডেভেলপই করেনি। তবে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে দু’টো বাড়ি আছে। একটা বছর খানেক পুরোনো। অতএব সেটাকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। অন্যটার বয়েস বছর দশেক। একেবারে মাঠের মাঝখানে দোতলা একটা বাড়ি। নাম রিপোজ। এটা অশনি রায়ের গোপন মিলনকুঞ্জ হওয়া সম্ভব।’
‘তুমি কি এই রিপোজ বাড়িটা দেখতে গিয়েছিলে ?”
‘গিয়েছিলাম। বাড়িটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। আউট হাউসে একজন কেয়ারটেকার বাস করে। সে বলল মালিক দুবাইতে থাকে। বছরে একবার দু’বার আসে। বাকি সময় বাড়িটা বন্ধই থাকে।’
‘এটা তো অশনির ডেসক্রিপশনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।’
‘তা যাচ্ছে। তবে কেয়ারটেকার অশনির ছবি দেখে চিনতে পারছে না। অবশ্য চেনবার কথাও নয়। কেয়ারটেকার বলছে সে তিন সাড়ে-তিন বছর এখানে চাকরি নিয়েছে।’
‘মালিক ছাড়া অন্য কেউ কি এই বাড়িটাতে আসে?”
‘আমি এই প্রশ্নটা অনেকবার করেছিলাম। প্রত্যেকবার একই উত্তর দিচ্ছে। মালিক ছাড়া আর কেউ এখানে আসে না। মালিক যখন আসে তখন বাড়িটা খোলা হয়। অন্য সময় বাড়িটা বন্ধ পড়ে থাকে।’
‘তোমার কি মনে হয় লোকটা সত্যি কথা বলছে?’
‘আমার মনে হচ্ছে না। ওর কথা বলার ধরন থেকে মনে হচ্ছে ও কিছু একটা লুকোবার চেষ্টা করছে। লোকটার তাগড়াই চেহারা কিন্তু মনে হয় খুব চালাক-চতুর নয়। মনের ভাব মুখে প্রকাশ করে ফেলে।’
‘তুমি কি লোকটাকে বলেছ যে তুমি পুলিশ?’
‘পাগল, তাই কখনও বলে? আমি বলেছি এক বন্ধুর খোঁজ করছি। সেই বন্ধু এক সময় এই বাড়িটায় থাকত। এইসব বলে অশনি রায়ের ছবিটা দেখিয়েছি। মনে হল লোকটা বিশ্বাস করে নিয়েছে।’
‘তুমি দুটো কাজ কর। এক, ওই বাড়িটা সার্চ করার জন্যে একটা ওয়ারেন্ট বার কর। আর দুই, খোঁজ নাও বাড়িটা কার নামে রেজিস্টার্ড আছে। আমি তিন-চার দিনের মধ্যে বাড়ি থেকে বেরোবার অনুমতি পাব। তখন দু’জনে মিলে ওই বাড়িটা সার্চ করতে হবে। আমার মন বলছে কিছু একটা পেয়ে যাব।’
কেয়া ঘরে ঢুকেছে। বলল, ‘এবার মোবাইল রাখো। চান করে নাও। লাঞ্চ তৈরি।’ চান করতে করতে আদিত্য বুঝতে পারল হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে সে টিভিতে যে খবরগুলো শুনেছিল তার মধ্যে কোনটা তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং কেন।
দিবানিদ্রার অভ্যাস আদিত্যর কোনও কালেই ছিল না, ইদানীং হাসপাতালে গিয়ে হয়েছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কেয়া আদিত্যর পাশে শুয়ে খবরকাগজ পড়ছিল। একটা খবরকাগজের পাতা খুলে দু’একটা লাইন পড়তে না পড়তেই আদিত্যর চোখ দুটো ঘুমে জড়িয়ে এল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন বেলা পড়ে গেছে। আদিত্য চোখের এক পাশ দিয়ে দেখল খাটের অন্যদিকে কেয়া এক বান্ডিল পরীক্ষার খাতা নিয়ে বসেছে। আদিত্যকে উঠে পড়তে দেখে বলল, ‘চা খাবে?’
‘অবশ্যই খাব। এখন কোনও ওষুধ আছে?’
না, এখন নেই। সন্ধে ছ’টায় একটা আছে। চা কি বিছানায় দেব, নাকি খাবার টেবিলে বসবে?’
‘খাবার টেবিলে দাও।’ বিকেল বেলা কেয়ার সঙ্গে বসে চা খাবার সুযোগ তার রবিবার ছাড়া জোটে না।
আদিত্য বাথরুমে ঢুকল। ঘুম থেকে উঠে তার দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস, তা সে দিন হোক বা রাত্তির।
এক সঙ্গে চা খাবার অছিলায় আদিত্য কেয়ার একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে। একটু একটু করে কেয়ার শরীরের কাছে আসছে। কেয়ার শরীরের উত্তাপ নিতে চাইছে ৷ ‘এখন কিন্তু অনেক দিন ওসব বন্ধ থাকবে।’ কেয়া ধমকের স্বরে বলল। ‘মনে হচ্ছে তোমার মতলব ভাল নয়। ডাক্তারবাবু তোমাকে এখন কোনও রকম উত্তেজনা নিতে বারণ করেছেন।’
‘কত দিন বন্ধ থাকবে?’ আদিত্য বোকা বোকা গলায় বলল।
‘অন্তত তিন মাস। ‘
‘তিন মাস! পাগল! এক মাস। এক মাসই যথেষ্ট।’
হয়ত এটা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ দরাদরি চলত, কিন্তু ইতিমধ্যে আদিত্যর মোবাইলটা বেজে উঠেছে।
মোবাইলটা বাজতেই কেয়া ছোঁ মেরে তুলে নিল। খুব দরকারি ফোন ছাড়া সে আদিত্যকে কথা বলতে দেবে না।
ওদিক থেকে কী বলছে আদিত্য শুনতে পাচ্ছে না, শুধু কেয়া বলছে শুনতে পাচ্ছে।
‘হ্যালো’
‘……’
‘উনি খুব অসুস্থ। সবে হসপিটাল থেকে ফিরেছেন। এখন ওঁর পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়।’
‘……’
‘বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন ওঁর সঙ্গে কথা বলা সত্যিই সম্ভব নয়।’
“………”
‘তুমি অনন্যা সাহার সঙ্গে কথা বলবে? উনি বলছেন খুব বিপদে পড়েছেন। তোমার সঙ্গে কথা বলা ভীষণ দরকার। তুমি যখন হাসপাতালে ছিলে তখনও উনি ফোন করেছিলেন। কথা বলবে?’ কেয়া আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল।
‘অবশ্যই বলব। ফোনটা দাও।’ আদিত্য ব্যগ্র হয়ে ফোনটা ধরে বলল, “হ্যালো’
‘আমি অনন্যা সাহা বলছি। আমাকে চিনতে পারছেন? কিছুদিন আগে আপনি বাঙ্গুরে আমাদের বাড়ি এসেছিলেন। খুব বিপদে পড়ে আপনাকে ফোন করছি।’ ওপার থেকে ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
‘আপনাকে আমার খুব মনে আছে। বলুন কী ব্যাপার।’
‘আমার স্বামী শুভ হঠাৎ মারা গেছে।’ ওপারের কণ্ঠস্বর কান্নায় ভেঙে পড়েছে। ‘মারা গেছে! কী করে?’ আদিত্য হতভম্ব। কী বলবে বুঝতে পারছে না। ওপারে কান্না অব্যাহত।
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কান্না না থামলে কথা বলা মুস্কিল।
‘পুলিশ বলছে শুভ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু স্বাভাবিক, হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ কেন আত্মহত্যা করতে যাবে?’ অনন্যা সাহা এখনও ফোঁপাচ্ছে। ‘আপনি তো গোয়েন্দা। আপনি একটু খোঁজ নিয়ে বলতে পারেন ব্যাপারটা ঠিক কী?’
‘কোথায় ঘটেছে ঘটনাটা? আপনাদের ফ্ল্যাটে?’
‘না, না। আমাদের ফ্ল্যাটে নয়। কৃষ্ণনগরের কাছে শুভদের আপিসের একটা ফ্যাক্টরি আছে। ওখানেই শুভর অফিস এবং কোয়ার্টার। মাসের মধ্যে অন্তত দশ-পনের দিন শুভকে ওখানেই কাটাতে হয়। ওই কোয়ার্টারেই শুভকে পাওয়া গেছে। ও নাকি গলায় গামছা দিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলছিল।’ বলতে বলতে অনন্যা সাহা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।
আদিত্য বলল, ‘আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলা দরকার। টেলিফোনে সব কথা হয় না। স্বাভাবিক অবস্থা হলে আমি আপনার বাড়িতে চলে যেতাম। কিন্তু আমি আজকেই হাসপাতাল থেকে ফিরেছি। ডাক্তার এখনও বাইরে বেরোবার পারমিশান দেয়নি। তাই ভাবছিলাম, আপনি কি আমার বাড়ি আসতে পারবেন? আমার বাড়িটা দেশবন্ধু পার্কের কাছে।’
ওপারে সাড়াশব্দ নেই। অনন্যা সাহা নিশ্চয় ভাবছে কী করবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে বলল, “ঠিক আছে, আমিই আপনার বাড়িতে যাব। তবে আজ আর পারব না। একটু আগে কৃষ্ণনগরের পুলিশ মর্গ থেকে বড়ি ছাড়িয়ে কৃষ্ণনগরেই বডি ক্রিমেট করে ফিরেছি। খুব ক্লান্ত লাগছে। তাছাড়া মেয়েটাও সারাদিন একা ছিল। ওর সঙ্গেও থাকতে হবে। আমি বরং কাল সকালে, মেয়ে স্কুলে বেরিয়ে গেলে, আপনার বাড়ি যাব। আপনার ঠিকানা আর বাড়ির ডিরেকশানটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দিন।’
অনন্যা সাহা ফোন ছেড়ে দেবার পর আদিত্য সুভদ্র মাজির নম্বরটা ডায়াল করল। ‘আর একটা কাজ করে দিতে হবে। শুভব্রত সাহা বলে একজনের বড়ি কৃষ্ণনগরের পুলিশ মর্গে আজ সকাল অব্দি ছিল। পুলিশ বলছে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার কেস। ঠিক কী হয়েছে জানা দরকার। লোকটা সেন বেকারিতে চাকরি করত। মাসের অর্ধেক দিন কৃষ্ণনগরের কাছে সেন বেকারির যে ফ্যাক্টরি আছে তার সংলগ্ন কোয়ার্টারে থাকত। ওখানেই নাকি লোকটা আত্মহত্যা করেছে। একটু খোঁজ নেবে?
আরে, তুমি তো দেখছি আবার রীতিমত কাজ শুরু করে দিলে! ডাক্তার তোমাকে ক’টা দিন রেস্ট নিতে বলেছে তো। মোবাইল রাখো। ওষুধ খেতে হবে।” কেয়া ঘরে ঢুকে চেঁচামিচি শুরু করে দিয়েছে।
সকালে ফোন করে অনন্যা সাহা জানিয়েছিল সাড়ে দশটায় আসবে। এগারোটা বাজতে চলল এখনও তার আসার নামগন্ধ নেই। আদিত্য বসার ঘরে ইজি চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে করতে গান শুনছে। শুদ্ধ সারং। সেই পুরোনো বড়ে গোলাম। আদিত্য ভাবছিল, আহা, এমন করে আর কেউ গাইতে পারল না।
কেয়া আজও ছুটি নিয়েছে। রুগির দেখাশোনা করবে। আদিত্য অনেকবার বলছে তাকে দেখাশনা করার কোনও দরকার নেই, কেয়া কর্ণপাত করেনি। আগামী দু’দিন শনি ও রবিবার, কেয়ার এমনিতেই ছুটি। অতএব এখন আরও তিনদিন আদিত্যকে কেয়ার কড়া নজরদারিতে থাকতে হবে।
এখন কেয়া রান্নাঘরে। রান্নার মাসিকে দেখিয়ে দিচ্ছে কত কম তেল এবং নুন দিয়ে আদিত্যর জন্যে রান্না করতে হবে। হঠাৎ সে ঘরে ঢুকে বলল, “তোমাকে কিন্তু বারোটার সময় লাঞ্চ খেতে হবে। তার মানে সাড়ে এগারোটায় চান করতে যাবে। মহিলা যদি আরও দেরি করে তা হলে কিন্তু আমি তাকে ভাগিয়ে দেব।’
আদিত্য বলতে শুরু করেছিল, ‘কেয়া, অত নির্দয় হয়ো না। ভদ্রমহিলার স্বামী হঠাৎ মারা গেছেন। ওঁর মনের অবস্থাটা ভাব।’ আদিত্যর কথা অর্ধেক শেষ হবার আগেই কেয়া আবার রান্নাঘরে ফিরে গেছে। এঘর থেকে কথা বললে রান্নাঘরে কিছুই শোনা যায় না। আদিত্যর চিন্তা হচ্ছিল, ভদ্রমহিলা আরও দেরি করলে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ না তৈরি হয়।
কার্যত দেখা গেল আদিত্যর দুশ্চিন্তা ভিত্তিহীন। সাড়ে এগারোটা বেজে গেল, বারোটা বেজে গেল, সাড়ে বারোটাও বেজে গেল, অনন্যা সাহার দেখা নেই। শুধু যে দেখা নেই তা নয়, ভদ্রমহিলা একটা ফোন পর্যন্ত করলেন না। আদিত্য ভাবছিল সে নিজেই একটা ফোন করবে। কিন্তু কেয়া তার মোবাইলটা দখল করে রেখেছে। কেয়া বলে দিয়েছে, আগে খাবে তারপর কিছুক্ষণ ঘুমোবে। তারপর ঘুম থেকে উঠে যদি ইচ্ছে করে তাহলে ফোন কোরো। আদিত্য তিনটে অব্দি ঘুমোল। ঘুম থেকে উঠে চা-বিস্কুট খাচ্ছে এমন সময় অনন্যা সাহার ফোন।
‘আমি খুব লজ্জিত সকালে যেতে পারিনি বলে। এমন একটা অবস্থা হল, যাওয়া সম্ভব ছিল না। আপনাকে খুলে বললে বুঝতে পারবেন। চারটের সময় আমার মেয়ে স্কুল থেকে ফিরবে। ওকে খেতে দিয়ে আমি বেরোব। আপনার ওখানে পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাব। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমি সত্যিই খুব অসুবিধের মধ্যে আছি।’
ভদ্রমহিলার গলা শুনে মনে হচ্ছে সত্যিই বিপদে পড়েছেন।
আদিত্য বলল, “ঠিক আছে। তাই আসুন।’
‘সকালে কেন আসতে পারলাম না সেটা আগে বলি।’ অনন্যা সাহাকে দেখে চেনা যায় না। সেই মোটাসোটা, আদুরে, পুতুল-পুতুল ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। চোখের নীচে গভীর কালি। শাড়ি-ব্লাউজে মিল নেই। চুল অবিন্যস্ত। একেবারে ধসে যাওয়া চেহারা ।
‘আপনি চা খাবেন?” কেয়া ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল।
‘না। আমি চা খাই না।’
‘আমি কি একটু চা পেতে পারি?’ আদিত্য উত্তরটা জানত, তবু একটা চান্স নিয়ে দেখল।
‘মোটেই পেতে পার না। তুমি এখন ডাবের জল খাবে।’ কেয়া আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সম্ভবত আদিত্যর জন্যে ডাবের জল আনতে ।
‘আপনি বলুন।’ আদিত্য অনন্যা সাহার দিকে তাকিয়ে বলল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। সকালে আমার মেয়ে স্কুলে বেরিয়ে যাবার পর আমিও বেরোতে যাব এমন সময় শুভর অফিস থেকে দু’জন এসে হাজির। তাদের একজনকে আমি অফিসের অনুষ্ঠানে আগে দেখেছি। দু’একবার কথাও বলেছি। উনি কম্পানির জেনারেল ম্যানেজার, নাম প্রণব মাইতি। উনিই কম্পানিটা চালান। ওঁর ওপরে অবশ্য মালিক পল্লব সেন আছেন, কম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টার। কিন্তু সেটা নামেই। মালিক ব্যবসা-ট্যাবসা কিছু দেখেন না। প্রণব মাইতিই সবটা দেখেন।
‘আর দ্বিতীয় জন?’
‘দ্বিতীয় জনকে আমি আগে কখনও দেখিনি। তবে শুভর কাছে নাম শুনেছি। পরিচয় দিতে চিনতে পারলাম। সম্রাট দত্ত। কম্পানির চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার।’
‘এরা কী বলতে এসেছিলেন?’
“প্রথমে এরা শুভর মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করলেন। তারপর বললেন বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ এর যে ফ্ল্যাটটায় কম্পানি আমাদের থাকতে দিয়েছিল, সেখানে আমার মেয়েকে নিয়ে আমি এখন কিছুদিন থাকতে পারি।’
‘কিছুদিন মানে কতদিন?’
‘ওদের কথায় যা বুঝলাম, বছর খানেক। তার মধ্যে অন্য বাড়ি দেখে উঠে যেতে হবে। তবে কাকুতি-মিনতি করলে হয়ত আরও এক-দু’মাস থাকতে দিতে পারে।’
‘আর কী বলল?’
‘বলল, কম্পানির কাছে শুভর যা পাওনা আছে, প্রভিডেন্ড ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, লিভ এনক্যাশমেন্ট ইত্যাদি, সেগুলো আমি একমাসের মধ্যে পেয়ে যাব। তার ওপর, যেহেতু শুভ চাকরি করতে করতে মারা গেছে, একটা ভাল টাকা কম্পেনসেশন হিসেবে আমাকে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, গ্র্যাজুয়েশন অব্দি আমার মেয়ের সমস্ত খরচ কম্পানি বহন করবে।’
‘এ তো খুব ভাল কথা।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কম্পানির একটা শর্ত আছে। শর্তটা হল শুভর মৃত্যুটা নিয়ে আমি পুলিশের কাছে যেতে পারব না। কোর্টে যাওয়াও চলবে না। মিডিয়ায়, মানে খবর কাগজ বা টেলিভিশনে, কিছু বলাও চলবে না। ওরা বলছে শুভর মৃত্যুটা নিয়ে জল ঘোলা হলে সব থেকে ক্ষতি হবে কম্পানির। ওরা সেটা চায় না।’
‘আপনার স্বামীর মৃত্যু কেন হল সে বিষয়ে কি ওরা কিছু বললেন?”
‘শুধু এইটুকু বললেন যে শুভ সুইসাইডই করেছে। কেন করেছে, সেটা পুলিশ নিশ্চয় খুঁজে বার করবে। তবে আমি যেন আলাদা করে পুলিশের কাছে না যাই । বুঝতেই পারছেন ওরা ছিল বলে আমি আপনাকেও ফোন করে জানাতে পারছিলাম না যে আটকা পড়ে গেছি।’
‘বুঝতে পারছি আপনি কেন ফোন করতে পারেননি। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না কেন ওদের বারণ সত্ত্বেও আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে এলেন।’
‘এলাম কারণ আমি বিশ্বাস করি শুভ আত্মহত্যা করেনি, অন্য কোনও ভাবে মারা গেছে। খুব সম্ভবত তাকে কেউ খুন করেছে। আমার মনে হল, আপনি হয়ত কে শুভকে খুন করেছে সেটা বার করতে পারবেন। খুনিকে শাস্তি দিতে পারবেন।’
‘আমার ওপর আপনার এত আস্থা কেন?’
‘আদিত্যবাবু, আপনার কথা আমি কাগজে পড়েছি। সেদিন আপনি চলে আসার পর বুঝতে পারলাম আপনিই সেই আদিত্য মজুমদার যার কথা আমি কাগজে পড়েছি। মনে হল, আপনি নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। আর তাছাড়া আপনি তো পুলিশ নন, বেসরকারি গোয়েন্দা। কম্পানি আমাকে পুলিশের কাছে যেতে বারণ করেছে, কিন্তু কোনও বেসরকারি গোয়েন্দার কাছে যেতে তো বারণ করেনি।’
‘ঠিক আছে। আপনার কথা মেনে নিলাম। কিন্তু বলুন, আপনার কেন মনে হচ্ছে আপনার স্বামী আত্মহত্যা করেননি?
‘দেখুন, আজ তো শুক্রবার, শুভ গত সোমবার মারা গেছে। সেদিন ভোরের ট্রেন ধরার জন্যে ও যখন বাড়ি থেকে বেরোয় তখন একদম স্বাভাবিক ছিল। তার আগের রাত্তিরে, মানে রবিবার, আমরা প্ল্যান করছিলাম গোয়া বেড়াতে যাব। এরকম একটা লোক কখনও আত্মহত্যা করতে পারে? শুভ শেয়ালদা থেকে সকাল ছ’টা দশের কৃষ্ণনগর লোকাল ধরেছিল। সাড়ে আটটা নাগাদ কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর কথা । পুলিশের ডাক্তার বলছে, শুভ মারা গেছে সোমবার বেলা এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর তিন-চার ঘন্টার মধ্যে কী এমন ঘটল যাতে শুভকে আত্মহত্যা করতে হল ?”
‘আপনি কখন খবরটা জানতে পারলেন?’
‘সোমবার রাত্তির থেকেই শুভর বড়ি কৃষ্ণনগর পুলিশ মর্গে পড়ে রয়েছে। অথচ আমাকে খবরটা দেওয়া হল মঙ্গলবার সন্ধেবেলা। এটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। এতটা সময় ধরে পুলিশ কী করছিল? আমাকে খবর দেবার আগেই পোস্ট মর্টম হয়ে গিয়েছিল। তাতে নাকি আত্মহত্যার ধারণাটাই কনফার্মড হয়েছে।’
‘আচ্ছা, যদি ধরে নিই আপনার স্বামীকে কেউ খুন করেছে, তাহলে মোটিভের প্রশ্ন ওঠে। আপনার স্বামীকে খুন করার মোটিভ কি কারও থাকতে পারে?’
‘আপাতদৃষ্টিতে আমার স্বামীর কোনও শত্রু ছিল না। হাসিখুশি, দিলখোলা মানুষ । সকলেই ওকে পছন্দ করত। তবে আমার ধারণা অফিস নিয়ে ওর বেশ টেনশান ছিল। অনেক রাত্তির ঘুমোতে পারত না। আমি জিজ্ঞেস করলেও বলত না কী হয়েছে। বলত, আপিসের ময়লা বাড়িতে আনার দরকার নেই।’
‘হুঁ। এবার কৃষ্ণনগর যাবার আগে আপনার স্বামী উল্লেখযোগ্য কিছু বলেছিলেন?’ ‘নাঃ, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। ও হ্যাঁ। একটা কথা বলেছিল বটে। শনিবার আমরা একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমার মেয়ে পাশের ঘরে বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীনাথ বহুরূপী’ থেকে প্রশ্ন-উত্তর মুখস্থ করছিল। ওটা ওদের পড়তে হয়। আর আমার মেয়ে চেঁচিয়ে ছাড়া পড়া মুখস্থ করতে পারে না। সে যাই হোক, শুভ হঠাৎ বলল, চারদিকেই ছিনাথ বহুরূপীরা ছড়িয়ে আছে। আমাদের আপিসেও আছে। একটা লোককে ওপর ওপর দেখে যেটা মনে হচ্ছে সে মোটেই সেটা নয়। তাই খুব সাবধানে থাকতে হবে।’
‘এই কথাটার কী মানে হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’
‘আমার মনে হয়েছিল, শুভ বলতে চাইছে, ওর অফিসে কেউ বা কারা সামনা-সামনি ওর বন্ধু সেজে পেছন থেকে ক্ষতি করছে। শুভর যে অল্পদিনের মধ্যে এতটা উন্নতি হয়েছে এটা হয়ত কারও কারও ভাল লাগেনি।
একটু পরে অনন্যা সাহা চলে যাবার পর আদিত্য সুভদ্র মাজির ফোনটা ডায়াল করল।
‘হ্যাঁ দাদা। আপনাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। শুভব্রত সাহার ব্যাপারে কৃষ্ণনগরে ফোন করেছিলাম। ওখানকার পুলিশ বলছে সুইসাইড কেস। লোকটা নাকি কম্পানি থেকে অনেকগুলো টাকা সরিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাই সুইসাইড করেছে। পোস্ট মর্টম রিপোর্টও বলছে মৃত্যুর কারণ গলায় গামছা দিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝোলা।
এর বেশি আর ওখানকার পুলিশ কিছু বলতে পারছে না। হয়ত বলতে চাইছে না। ওপর থেকে যদি চাপ দেওয়া যায় তা হলে হয়ত আরও কিছু জানা যেতে পারে। আপনি একটু অ্যাডিশানাল কমিশানার সাহেবকে বলে দেখুন না।’
সুভদ্রর সঙ্গে কথা বলার পর ফোনটা রেখে আদিত্য গভীরভাবে ভাবছিল। যে লোকটা কম্পানি থেকে টাকা সরিয়ে ধরা পড়েছে তাকে কি কম্পানি নিঃশর্তে সমস্ত পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেবে? তার স্ত্রীকে মোটা টাকা কম্পেনসেশান দেবে? তার মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করবে?
রাত্তিরবেলা আদিত্যর ঘুম আসছিল না। ঘুমের বদলে নানারকম চলমান ছবি মাথার মধ্যে ঘুরছে। কেয়া পাশে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে। আদিত্য বিছানা ছেড়ে উঠে এক গেলাস জল খেল। ঘড়িতে দেখল রাত সাড়ে বারোটা। দূরে এপিসি রোড দিয়ে এখনও লরি যাচ্ছে। আদিত্যদের শোবার ঘর থেকে দেখা যায় না, তবে শব্দ শোনা যায়। কেয়াকে আদর করতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু সেটা এখন সম্ভব নয়। আদিত্য আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করল। আবার সেই চলমান দৃশ্য। সেই লোকটার ছবি ভেসে উঠেছে যাকে ডায়মন্ডহারবারে নদীর ধারে দেখে চেনা মনে হয়েছিল। চকিতে আদিত্যর মনে পড়ে গেল লোকটাকে আগে কোথায় দেখেছে। এতদিন মনে পড়েনি কেন? উত্তেজনায় আদিত্য বিছানায় উঠে বসেছে। কেয়ার ঘুম ভেঙে গেল।
‘কী হল? বসে আছ কেন?’ কেয়ার গলায় উদ্বেগ।
‘ঘুম আসছে না। ‘
‘আমাকে ধরে শোও, ঘুম এসে যাবে। কিন্তু একদম দুষ্টুমি করবে না।’ কেয়া আদিত্যর দিকে পাশ ফিরে শুল।
কেয়ার শরীরের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে আদিত্যর কখন যে ঘুম এসে গেছে সে নিজেই জানে না।
(৩)
এক সপ্তাহ পরে আদিত্য আজ বাইরে বেরোবার অনুমতি পেয়েছে। কেয়া এত সহজে রাজি হতো না, ডাঃ রায়কে দিয়ে বলিয়ে অনেক কষ্টে তাকে রাজি করানো গেছে। তবে ডাঃ রায় বারবার বলে দিয়েছেন, এই প্রবল গ্রীষ্মে আদিত্য যেন এগারোটার পর আর বাইরে না থাকে।
আদিত্য সুভদ্র মাজিকে নিয়ে রাজারহাটের সেই বাড়িটা দেখতে যাচ্ছে। যেখানে সম্ভবত অশনি রায় তার বান্ধবীর সঙ্গে সময় কাটাত। বাড়িটা সার্চ করার জন্য ওয়ারেন্ট সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। ভোর সাড়ে ছ’টায় সুভদ্র এসে আদিত্যকে তুলে নিয়েছে। এমনিতে ভোরে উঠতে আদিত্যর জঘন্য লাগে। কিন্তু আজ এতদিন পরে মুক্তি পেয়েছে বলে এই ভোরটা তার চমৎকার লাগছে।
এত সকালে রাস্তা ফাঁকা। পুলিশের গাড়িটা দেখতে দেখতে সল্ট লেক পৌঁছে গেল। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে একজন কনসটেবল। পিছনের সীটে আদিত্য এবং সুভদ্র। দেখতে দেখতে সল্ট লেক পেরিয়ে রাজারহাটে ঢুকে পড়ল গাড়িটা।
বাড়িটা দোতলা, মাঠের মধ্যিখানে বেমানানভাবে দাঁড়িয়ে। আশেপাশে আর কোনও বাড়ি নেই। দু’একটা জমিতে পাঁচিল দেওয়া আছে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে সেসব জায়গায় বাড়িঘর উঠবে। কিন্তু আপাতত চারদিকটা একেবারে ধু ধু করছে। সুভদ্র খবর নিয়ে জেনেছে সুন্দরলাল সাপ্রু বলে এক ব্যক্তির নামে বাড়িটা রেজিস্টার্ড। সুন্দরলাল দুবাইতে থাকে। এনকেডিএ-কে নিয়মিত ট্যাক্স দেয়। পুলিশের খাতায় নাম নেই। আপাতদৃষ্টিতে গুড সিটিজেন। কিন্তু এই রকম পাণ্ডববর্জিত জায়গায় সে একটা বাড়ি তুলতে গেল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। পুলিশের গাড়ি বাড়িটার সামনে গিয়ে থামল।
গেটের পাশে দেয়ালে পাথরের ফলকে লেখা রিপোজ। হয়ত এক সময় বাড়িটার যত্ন হতো, এখন বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে অনেকদিন রঙ করা হয়নি। গেট দিয়ে আদিত্যরা ভেতরে ঢুকে দেখল সামনে এক ফালি জমি। সেখানে শাক-সব্জির গাছ। লাউমাচা। একটা সারিতে কিছু দিশি ফুল ফুটে রয়েছে। দোতলা ছাপিয়ে উঠে গেছে দুটো বড় আমগাছ। দুটোতেই হাড়ে-মজ্জায় মুকুল ধরেছে। একটা কাঁঠাল গাছও আছে। সেটাতেও বেশ কয়েকটা ছোট-ছোট কাঁঠাল ঝুলছে। অন্য গাছগুলোকে আদিত্য চিনতে পারল না। শাক-সব্জির গাছ আর ফুল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে একটা বাঁধানো রাস্তা বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে ঠেকেছে। সদর দরজাটা বন্ধ। তালা ঝুলছে।
‘এই যে, কেউ আছ নাকি? এই চৌকিদার!’ সুভদ্র হাঁক পাড়ল। কারও সাড়া নেই। কাঁঠাল গাছের নিচে একটা ঘর রয়েছে, সেটাও তালাবন্ধ। এটা নিশ্চয় চৌকিদারের ঘর। লোকটা গেল কোথায়?
‘চৌকিদার ! এই চৌকিদার!’ এবার কনসটেবল গলা তুলেছে। তার গলার আওয়াজে চারদিক কেঁপে গেল। আর সেই আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না যেতে বাড়ির পেছন দিক থেকে একটা ক্ষীণ আওয়াজ শোনা গেল, ‘আসছি, আসছি।’
ড্রাইভার বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আদিত্যরা বাকি তিনজন দ্রুত পায়ে বাড়ির পেছনে গিয়ে দেখল কলতলায় বসে চৌকিদার বাসনপত্র ধুচ্ছে। তিনটে লোক, তার মধ্যে একজন আবার পুলিশের পোষাক পরা, তার দিকে এগিয়ে আসছে দেখে সে বাসনপত্র ফেলে উঠে দাঁড়াল।
“শোনো, সেদিন তোমার সঙ্গে কথা হয়েছিল মনে আছে? তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম এই বাড়িতে কারা আসে, তুমি বললে মালিক ছাড়া আর কেউ আসে না। মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু আপনি কে? আবার কেন এসেছেন? বললাম তো, আপনি যাকে খুঁজছেন তাকে আমি কখনও দেখিনি। সঙ্গে পুলিশ এনেছেন কেন?’
‘সঙ্গে পুলিশ আনব কেন? আমরাই তো পুলিশ। আমরা এই বাড়িটা সার্চ করব। আমাদের সঙ্গে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। তুমি যদি পড়তে পার তা হলে পড়ে দেখ।’ ‘কেন আপনারা সার্চ করবেন? এখানে তো কেউ থাকেই না। মালিক মাঝে মাঝে আসে, তাও বছরে একবার কী দুর্বার। ‘
‘সে তো তুমি বলছ। আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করছি না।’
‘আমি মিথ্যে বলব কেন? মিথ্যে বলে আমার কী লাভ?”
‘কী লাভ সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে। আপাতত তুমি দরজাটা খুলে দাও । তোমার কাছে নিশ্চয় বাড়ির চাবি আছে।’
‘আমার কাছে বাড়ির চাবি নেই।’
‘তোমার কাছে বাড়ির চাবি নেই? ঠিক আছে তোমার ঘরের চাবি তো আছে। তোমার ঘরটা খুলে দাও। আগে তোমার ঘরটা খুঁজে দেখি বাড়ির চাবিটা পাই কিনা ৷ যদি না পাই তা হলে তালা ভাঙতে হবে।’
‘আপনারা কিন্তু জুলুম করছেন স্যার।’
‘জুলুমের এখনই কী দেখলে? পুলিশের কাজে বাধা দিলে আরও জুলুম দেখবে। নাও তাড়াতাড়ি চল।’
‘মালিক আমাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেবে। মালিক বলে দিয়েছিল কাউকে বাড়ির চাবি দেবে না। মালিক জানতে পারলে আমি কী বলব?’
‘বলবে পুলিশ চেয়েছিল তাই দিতে বাধ্য হয়েছি। মালিক ঠিক বুঝতে পারবে। তোমার নামটাই তো জানা হল না। নাম কি?
‘আজ্ঞে দীনবন্ধু। দীনবন্ধু মাহাতো।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘পশ্চিম মেদিনীপুর। ঝাড়গ্রামের কাছে।
সুভদ্র আর দীনবন্ধু চৌকিদার কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিল। কনসটেবলটি তাদের ঠিক পেছন পেছন হাঁটছে। আর সবার পেছনে চারদিকটা দেখতে দেখতে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে আদিত্য।
দীনবন্ধু কোমর থেকে নিজের ঘরের চাবি বার করে দরজা খুলল, ঘরে ঢুকে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা চাবির গোছা নিয়ে বেরিয়ে এল। মনে হচ্ছে, সে এখন পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে চৌকিদার সহ গোটা দলটা বাড়ির ভেতরে।
একতলায় সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা বেশ বড় বসার ঘর। সোফা, কাউচ, টেলিভিশন সব কিছুই প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। বসার ঘরের সংলগ্ন খাবার জায়গা। সেখানেও ডাইনিং টেবিল এবং রেফ্রিজারেটারটা প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। রেফ্রিজারেটরটা অফ করা আছে। এছাড়া একতলায় একটা কিচেন রয়েছে। কিচেনের গ্যাজেটগুলিও অর্থাৎ মাইক্রোওভেন, মিক্সি, টোস্টার, ইলেকট্রিক কেটল ইত্যাদি, যত্ন করে প্লাস্টিক দিয়ে কেউ ঢেকে রেখেছে যাতে অব্যবহারে সেগুলোতে ধুলো না জমে। উনুনের সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডারের যোগাযোগটাও বিচ্ছিন্ন।
দীনবন্ধু আদিত্যদের পেছন পেছন আসছিল। এবার সে বলল, ‘বললাম না স্যার, মালিক ছাড়া এখানে কেউ ঢোকে না। দেখছেন তো, এই জিনিসগুলো ব্যবহার করবেন না বলে মালিক এগুলো চাপা দিয়ে গেছেন।’
‘তুমি কি এই একতলাটা নিয়মিত ঝাড়পোঁচ কর? কোথাও ধুলো-টুলো তো তেমন দেখছি না।’ সুভদ্র রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল।
‘শুধু একতলা কেন স্যার? পুরো বাড়িটাই নিয়মিত ঝাড়পোঁচ করি। ওটাই তো আমার কাজ। মালিক তো আমাকে রোজ বাড়ি পরিষ্কার করতে বলেছে।”
‘বাঃ। তুমি তো দেখছি খুব খাঁটি লোক। অন্য যে কেউ হলে শুধু মালিক আসার আগে বাড়িটা পরিষ্কার করত। অন্য সময় যখন বাড়িটা ফাঁকা থাকছে সে আর বাড়ি পরিষ্কারের ঝামেলায় যেত না।’ আদিত্য এতক্ষণে মুখ খুলেছে।
‘আমি স্যার ওরকম লোক নই। কাজে ফাঁকি দেওয়া কখনও শিখিনি। ‘ ‘বেশ, বেশ। চল এবার দোতলায় কী আছে দেখা যাক।’ দীনবন্ধুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সুভদ্র বলল।
বসার ঘরের একপাশ দিয়ে সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। ওপরে তিনটে শোবার ঘর। তার মধ্যে দুটো ঘর খোলা, একটার গা-তালা চাবি দিয়ে বন্ধ। খোলা ঘরদুটোতে তেমন কিছু দেখার নেই। একতলার মতো এখানেও আসবাব পত্র প্লাস্টিক দিয়ে ঢাকা। যেন কেউ দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকবে না বলে খাট-বিছানা-আলমারি যত্ন করে ঢাকা দিয়ে গেছে। তাহলে কি দীনবন্ধুর কথাটাই মেনে নিতে হবে? মালিক ছাড়া আর কেউ এই বাড়িতে ঢোকে না?
‘ওই বন্ধ ঘরটাতে কী আছে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘আমি বলতে পারব না স্যার। ওই ঘরটার চাবি আমার কাছে নেই। হয়ত ওখানে মালিক কোনও দামী জিনিস রেখে গেছে, তাই আমাকে চাবিটা দিয়ে যায়নি।’
‘ঘরটা খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।’ সুভদ্র পুলিশি গলায় বলল।
‘আমি কী করে ব্যবস্থা করব স্যার? আমার কাছে সত্যিই ওই ঘরটার চাবি নেই।’ দীনবন্ধু কাতর গলায় বলল।
‘তা হলে দরজা ভাঙতে হবে।’ সুভদ্র সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল।
‘স্যার, যদি দরজা ভেঙে দেখেন কিছু নেই তাহলে কেমন করে আমি মালিককে জবাবদিহি করব? পুলিশই বা কী জবাবদিহি করবে? আমি ঠিক বলছি তো স্যার?’ ‘লোকটা কিন্তু খুব একটা ভুল বলছে না।’ আদিত্য সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল। ‘যদি তেমন কিছু পাওয়া না যায়, দরজা ভাঙার দায়টা তোমার ঘাড়ে পুরোপুরি পড়বে। তাই দরজা ভাঙার আগে একটু ভেবে দেখো।’
‘আপনার ইনটিউশান কী বলছে দাদা? ভেতরে কিছু পাওয়া যাবে?’
আমার ইনটুইশান বলছে, যাবে। অবশ্যই যাবে। কিন্তু শুধুমাত্র আমার ইনটুইশানের ওপর নির্ভর করে এগোনো উচিৎ হবে কিনা বুঝতে পারছি না।’
সুভদ্র ভাবছে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, “আমি আপনার ইনটিউশানের ওপর নির্ভর করে রিস্ক নিতে রাজি। বড়জোর তালা ভাঙার দামটা পকেট থেকে দিতে হবে আর ওপরওলার ধ্যাঁতানি খেতে হবে, এই তো? আমি ওটুকু হজম করতে পারব।’ তারপর কনসটেবেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আশুতোষ, তালা ভাঙো।’
তালা ভাঙ্গার কাজটা যতটা সহজ মনে হয়েছিল, কার্যত সেটা হল না। বাইরে গিয়ে ড্রাইভারের কাছ থেকে গাড়ির টুলকিটটা নিয়ে এসেও আশুতোষ বিশেষ সুবিধে করতে পারল না। মিনিট পনের-কুড়ি ধস্তাধস্তি করার পর সে বলল, “পারলুম না স্যার। চাবিওলা ছাড়া এটা খোলা যাবে না।’
‘চাবিওলা এখানে কোথায় পাবে? সেই নাগেরবাজার যেতে হবে। না হলে শ্যামবাজার। তুমি বরং এক কাজ কর। গাড়িটা নিয়ে সেক্টর ফাইভে চলে যাও। ওখানে ইলেক্ট্রনিক কমপ্লেক্স পুলিশ স্টেশনে গিয়ে বাপ্পা সামন্তর খোঁজ করবে। বাপ্পা ওখানে গ্রুপ ডি, কিন্তু তালা খোলায় ওস্তাদ। যে কোনও তালা খুলতে পারে। তুমি এক্ষুনি গিয়ে বাপ্পাকে ধরে নিয়ে এস। ওসিকে আমার নাম করে বলবে আমি বাপ্পাকে ডাকছি। ওকে ওর যন্ত্রপাতিগুলো সঙ্গে আনতে বোলো। ’
আদিত্য ঘড়ি দেখল। পৌনে নটা। এগারোটার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে কেয়া তুলকালাম করবে। আদিত্যর অসুখের পর বাড়িতে যে রাতদিনের মাসি মোতায়েন হয়েছে সে আসলে কেয়ার গুপ্তচর। আদিত্য দেরি করে ফিরলে কেয়ার কাছে ঠিক খবর চলে যাবে। কিন্তু আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই ।
‘এখানে একটা ভাল ক্যাফে আছে। আমি কেয়াকে নিয়ে একবার এসেছিলাম। আশুতোষ চাবিওলা ধরে আনা অব্দি ওখানে বসে কফি খাওয়া যেতে পারে। তুমি কফি খেও আমি চা খাব।’ আদিত্য সুভদ্রকে বলল।
‘আসার সময় দেখলাম তো ক্যাফেটা। বেশ তো, ওখানে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাবে। কিন্তু এতটা তো হেঁটে যাওয়া যাবে না। গাড়ি নিয়ে যে আশুতোষ বেরিয়ে গেল। ওর মোবাইল নম্বর তো জানি না।’
‘বোধহয় এখনও বেরোয়নি। যদি না বেরিয়ে গিয়ে থাকে, ওকে ছাত থেকে ডেকে নিতে পারবেন স্যার।’ দীনবন্ধু তাড়াতাড়ি ছাতের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। আদিত্য আর সুভদ্র ওর পেছন পেছন।
সুভদ্র যখন আশুতোষকে চেঁচিয়ে ডাকছে তখন আদিত্য ছাতের চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। এখানে খুব বেশি লোক আসে না। ধুলো, ময়লা, ইট-পাটকেল জমে আছে। একটা আমগাছের ডাল একদিকের পাঁচিল ছুঁয়েছে। অন্যদিকে একটা চিলেকোঠার ঘর। তালা নেই, শুধু হুড়কো টানা।
আশুতোষকে আটকানো গেছে। গাড়ি আদিত্যদের জন্যে দাঁড়িয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে আদিত্য দীনবন্ধুকে জিজ্ঞেস করল, ‘চিলেকোঠার ঘরটাতে কী আছে?’
‘বাতিল জিনিসপত্তর, রাবিশ, বালির বস্তা এইসব। দরজা খোলাই আছে। ঢুকে দেখতে পারেন। তবে ঘরটা নোংরা হয়ে পড়ে আছে। ওখানে আমার খুব একটা যাওয়া হয় না।’
‘ঠিক আছে। ফিরে এসে দেখব।’
সল্ট অ্যান্ড পেপার ক্যাফের সামনে আদিত্যদের নামিয়ে দিয়ে পুলিশের গাড়িটা চলে গেল। ঠিক হয়েছে, আশুতোষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাপ্পাকে পাকড়াও করে রিপোজ বলে ওই বাড়িটাতে ফিরে আসবে এবং ফেরার পথে আদিত্যদের এই ক্যাফে থেকে তুলে নেবে ।
ক্যাফের মধ্যে ঢুকে আদিত্য লক্ষ করল আগের দিনের থেকে ভিড় অনেক বেশি। জানলার ধারে বসার জায়গাগুলো সব ক’টা ভর্তি। অতি কষ্টে ভেতর দিকে একটা দু’জনের টেবিল ফাঁকা পাওয়া গেল। আদিত্য দেখল কাউন্টারে মালা সরকার বসে আছে। তবে আদিত্যদের খেয়াল করেনি। আদিত্য ভদ্রমহিলার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হাত তুলল। মালা সরকার আদিত্যদের দেখতে পেয়েছে। ওদের টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে।
‘আমার কী সৌভাগ্য। আবার আপনি আমাদের ক্যাফেতে আসবেন আমি ভাবতেই পারিনি।’
‘আপনিই তো বললেন, আপনাদের কাস্টমাররা খুব লয়াল। একবার আসার পর বারবার এখানেই ফিরে আসে। আমিও তাই ফিরে এসেছি।’ আদিত্য চওড়া করে হাসল ।
‘আপনার স্ত্রী এলেন না?’
‘না, আজ আমার বন্ধুর সঙ্গে এসেছি। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি সুভদ্র মাজি, কলকাতা পুলিশের একজন অত্যন্ত দক্ষ অফিসার। আর ইনি মালা সরকার, এই ক্যাফের মালিক।’
সুভদ্রর পরিচয় শুনে মালা সরকারের মুখটা কি গম্ভীর হয়ে গেল? সে হাত তুলে নমস্কার করে বলল, আপনারা আজ এখানে এসে আমার খুব উপকার করলেন। আদিত্যবাবু, আমি আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। একটা বিপদে পড়েছি। আপনার সঙ্গে কি আলাদা করে একটু কথা বলা যাবে? মানে এখানে তো খুব ভীড়। আমার অফিসে আসবেন ?
‘সুভদ্র, তুমি একটু বোসো। আমি এঁর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।’
‘ঠিক আছে দাদা। বেশিক্ষণ নেবেন না। আশুতোষ এক্ষুনি চলে আসবে। আর তার থেকেও বড় কথা আপনাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। না হলে বৌদি আমাকে ছাড়বে না ৷ ‘
সুভদ্রকে একলা বসিয়ে রেখে আদিত্য মালা সরকারের পেছন পেছন ক্যাফের অফিসে ঢুকল। অফিসটা কাউন্টারের পেছনে। অফিস না বলে একটা খুপরি বলাই ভাল। একটা টেবিল আর তার একদিকে একটা এবং অন্য দিকে দুটো চেয়ার রাখতেই ঘরটা ভরে গেছে। যেদিকে একটা চেয়ার আছে মালা সেদিকে বসল, আদিত্য উল্টোদিকে।
‘আমি খুব সংক্ষেপে আমার বিপদের কথাটা বলছি। কয়েকদিন আগে রাত্তির সাড়ে ন’টা নাগাদ আমার ক্যাফেতে দুটো লোক এল। তখন ক্যাফে প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমার ওয়েটার ওদের বলল, এত রাত্তিরে আর নতুন অর্ডার নেওয়া সম্ভব নয়। ওদের মধ্যে একজন, সে-ই মনে হয় দলের পাণ্ডা, বলল, তারা এখানে খেতে আসেনি, এখানকার মালকিনের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। মালকিন কোথায়?
‘আমি ধারে কাছেই ছিলাম, বললাম, কী ব্যাপার? দলের পাণ্ডাটা বলল, আপনার সঙ্গে একটু কনফিডেনশিয়ালি কথা বলতে চাই। লোকটা কিন্তু কোনও অভদ্রতা করছিল না। কিন্তু ওর গলার ঠাণ্ডা ভদ্রতায় একটা ভয় দেখানো ব্যাপার ছিল। আমি বললাম, এখানেই বলুন যা বলার। আমার মাথায় ছিল লোকদুটো আমাকে ফিজিকালি অ্যাসল্ট করতে এলে আমার ওয়েটার এবং কুক আমাকে রক্ষা করবে। পাণ্ডাটা বলল, আপনি নিশ্চয় জানেন অশনি রায়ের কেসটা আবার উঠবে। আমাদের অনুরোধ, এখন অব্দি আপনি যা যা স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তার থেকে এক চুলও ডেভিয়েট করবেন না। বিশেষ করে আপনি যে খুন হওয়া মহিলার ছবি দেখে তাকে আইডেন্টিফাই করেছিলেন, বলেছিলেন এর সঙ্গেই অশনি রায় আপনার ক্যাফেতে আসতেন, সেই স্টেটমেন্ট-এ আপনি স্টিক করে থাকবেন। এটা আমাদের অনুরোধ। কিন্তু অনুরোধ না রাখলে আপনার নিরাপত্তার কোনও দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। বিশেষ করে যেহেতু আপনার ক্যাফেটা একেবারে নির্জন একটা জায়গায়।
‘লোকদুটো এইভাবে আমাকে ভয় দেখিয়ে চলে গেল। আমি অশনিবাবুকে ফোন করলাম। উনি বললেন আপনাকে ফোন করতে। তবে এটাও বললেন যে আপনি অসুস্থ। তাই ফোনটা যেন কয়েকদিন পরে করি। আপনার শরীর এখন কেমন আছে?’
কিছুক্ষণ পরে আদিত্য সুভদ্রর কাছে ফিরে এসে দেখল সে একটা বড় আকারের ক্রোেয়াস-কে বাগে আনার চেষ্টা করছে। পাশে বড় এক কাপ কালো কফি। আদিত্য তার অর্ডারটা কাউন্টারেই বলে এসেছিল। একটু পরে ক্যাফের ইউনিফর্ম পরা ওয়েট্রেস আদিত্যকে একটা ছোট টিপটে দার্জিলিং চা দিয়ে গেল সঙ্গে দুটি কমপ্লিমেন্টারি দিশি বিস্কুট। আদিত্য চায়ে একটা চুমুক দিয়েই বুঝল চা-টা চমৎকার। বাইরে দিঘিটা এখান থেকে একটু একটু দেখা যাচ্ছে। দিঘির ওপরের আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। ক্যাফের উল্টোদিকে একটা বাড়ি উঠছে। রাস্তার ওপরে বালির পাহাড়, তার ওপরে রাস্তার দু’টি নবীন কুকুর অহেতুক আনন্দে উদ্বেল হয়ে লাফালাফি করছে। ক্যাফের ভেতরে ভিড় আরও বেড়েছে। ভিড়ের ভেতরে কে যেন কাকে বলছে, ‘ক্যাফে লাতে এখানকার স্পেশালিটি, ট্রাই করতে পার।’ মহিলা কণ্ঠ। আর ঠিক তখনই সুভদ্রর ফোনটা বেজে উঠল।
এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে যাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে আদিত্য। আশুতোষ বাপ্পাকে নিয়ে ফিরে এল পৌনে এগারোটা নাগাদ। তার পর থেকেই বাপ্পা বন্ধ দরজার তালাটা খোলার চেষ্টা করছে। তালাটা তাঁদোড় বটে। দেখতে দেখতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল, পৌনে বারোটাও বেজে গেল, বাপ্পা সামন্ত তালা খুলতে গিয়ে দরদর করে ঘামছে, তবু তালা খুলছে না।
‘ফরেনের তালা স্যার। এগুলো ভয়ঙ্কর খিটকেল হয়।’ বাপ্পা ম্লান হেসে বলল। ‘তবে আমিও ছাড়ছি না।’
অবশেষে সাড়ে বারোটা নাগাদ বাপ্পার অধ্যাবসায়ের জয় হল। খুলে গেল বন্ধ দরজার তালা। তালা জয় করে বাপ্পার মুখে হাসি আর ধরে না।
ঘরের ভেতরটা পর্দা টানা। অন্ধকার। আশুতোষ পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই ঘর আলোয় ভরে গেছে। ঘরে ধুলো-টুলো কিছু নেই। মনে হয় নিয়মিত ঝাড়-পোঁচ হয়। ঘরের মাঝখানে বেশ বড় একটা খাট, সাদা বিছানা। আর কোথাও কোনও আসবাব নেই। তিনটে দেয়াল জুড়ে মস্ত বড় বড় আয়না। সিলিংটাও একটা আয়না। ঘরের সংলগ্ন একটা অ্যান্টিরুম এবং একটা বাথরুম আছে। অ্যান্টিরুমে একটা ড্রেসিং টেবিল, তার ওপরে কয়েকটা লিপস্টিক, একটা ফেস পাউডারের কৌটো। বাথরুমটা পরিষ্কার ঝকঝক করছে। বেসিনের ওপর আয়না দেওয়া ক্যাবিনেট। আদিত্য ক্যাবিনেট খুলে দেখল তার ভেতরেটা ফাঁকা।
‘এই ঘরটা যে নিয়মিত ব্যবহার হয় সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। না হলে এত পরিষ্কার থাকত না। কিন্তু কী কাজে ঘরটা ব্যবহার হয় সেটা আন্দাজ করতে পারছ ? ‘ আদিত্য সুভদ্রকে জিজ্ঞেস করল।
‘ভাসা ভাসা পারছি দাদা। পুরোটা পারছি না।’ সুভদ্র অপ্রস্তুতভাবে হাসল। ‘চল, ওপরে চিলেকোঠার ঘরটা দেখা যাক। এখানে মনে হচ্ছে না আর কিছু দেখার আছে।’
দীনবন্ধু ঠিকই বলেছিল। চিলেকোঠার ঘরটা জঞ্জালে ঠাসা। কিছু পুরোনো ম্যাগাজিন, একটা বাতিল গদি, ভাঙা চেয়ার গোটা দুয়েক, এক বস্তা বালি, কয়েকটা সুটকেস।
‘সুটকেসগুলোতে কী আছে দেখব নাকি দাদা?’
‘দেখতে পার।’ আদিত্য অন্যমনস্ক ভাবে বলল। সে ছাইগাদার মধ্যে রতনের সন্ধান পেয়েছে।
‘এর মধ্যে শুধু পুরোনো জামাকাপড় রয়েছে।’ সুভদ্র একটা সুটকেস খুলে হতাশ গলায় বলল। ‘আর এই সুটকেসটা তো ফাঁকা।’ সুভদ্র দ্বিতীয় একটা সুটকেসও খুলে ফেলেছে।
আদিত্য শুনছিল না। সে বহু কষ্টে জঞ্জাল পেরিয়ে ঘরের একটা কোণ থেকে একটা ছাতা বার করে আনছিল। ধুলো পড়ে তার রঙটা মলিন হয়ে গেছে, কিন্তু এক ঝলক দেখলে বোঝা যায় এক সময় ছাতাটার রঙ ছিল সাদা। ছাতাটা বন্ধ অবস্থায় ছিল। আদিত্য সেটাকে খুলতে গিয়ে দেখল কয়েকটা শিক একেবারে ভেঙে গেছে। সন্দেহ নেই, সেই কারণেই ছাতাটাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
‘আমার যা দেখার দেখা হয়ে গেছে। আমাকে কিন্তু এবার বাড়ি যেতে হবে।’ আদিত্য চিলেকোঠার ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার হাতে সেই ভাঙা ছাতা । ‘আরও দুটো সুটকেস বাকি আছে, দেখে নিই।’ সুভদ্র আরো একটা সুটকেস খোলার উপক্রম করল।
‘দেখে নাও। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’
একটু পরে সুভদ্র বেরিয়ে এল। ‘নাঃ, সুটকেস গুলোতে কিচ্ছু নেই।’ তারপর আদিত্যর হাতে ছাতাটা দেখে বলল, ‘আপনি ওটা কী নিয়ে এলেন?’
‘দেখতেই তো পাচ্ছ। একটা ভাঙা ছাতা। ‘
‘ওটা দিয়ে কী হবে?’
‘এখন আর কিছু হবে না। ওটা তো ভেঙে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, যখন ওটা আস্ত ছিল তখন কী কাজে লাগত?’
‘এটা তো সাদা ছাতা। ট্র্যাফিক পুলিশ ছাড়া বিশেষ কাউকে সাদা ছাতা ব্যবহার করতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু এটা তো ট্র্যাফিক পুলিশের ছাতা নয়। এটা বেশ সৌখিন একটা ছাতা।
‘এই সাদা ছাতাটা রোদ-বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচানোর জন্যে ব্যবহার হত বলে মনে হয় না। এটা খুব সম্ভবত রিফ্লেকটার হিসেবে ব্যবহার করা হত। যেরকম রিফ্লেকটার স্টিল ফটো বা সিনেমা তোলার কাজে ব্যবহার করা হয়।’ আদিত্য ছাতাটাকে পরীক্ষা করতে করতে বলল।
‘তার মানে নিচের বন্ধ ঘরটা স্টুডিয়ো হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মনে হচ্ছে, নোংরা ছবি বা ব্লু ফিল্ম তোলার স্টুডিও। আয়নাগুলোও একটা অশ্লীল ইংগিত দিচ্ছে।’ আদিত্য ঈষৎ উত্তেজিত গলায় যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল।
‘এই ঘরটাতে ব্লু ফিল্ম তোলা হয়?’ সুভদ্রর গলায় এখনও কিছুটা সংশয় আছে। ‘একদম তাই। আমি প্রায় নিশ্চিত সেটাই হয়। আমি এই ব্যাপারেও নিশ্চিত যে অশনি রায়ের ছবিগুলো এই ঘরের অ্যান্টিরুমটা থেকে তোলা হয়েছিল। বলাই বাহুল্য, অশনি টের পায়নি। খেয়াল করেছ কিনা জানি না, অ্যান্টিরুম আর মূল ঘরটার মধ্যে একটা স্কাইলাইট আছে। ওখানে ক্যামেরা বসালে সিলিংএর আয়নাটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওই আয়না থেকেই তোলা হয়েছিল ছবিগুলো। সেই জন্যে মনে হচ্ছিল অশনি ডান হাতে ঘড়ি পরে আছে। আসলে সে বাঁ হাতেই ঘড়িটা পরেছিল, কিন্তু আয়নাতে সেটা ডান হাত মনে হচ্ছিল। কিন্তু ঘরটা যে এইসব কাজে এখনও নিয়মিত ব্যবহার করা হচ্ছে এটা দীনবন্ধু জানে না?’
‘আমিও তো দাদা এইটাই ভাবছিলাম।’
‘ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখা যাক।’
দীনবন্ধু দোতলায় ছিল। কিন্তু অনেক জেরা করেও ওর কাছ থেকে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। ও বলছে, প্রত্যেক শুক্রবার রাত্তিরে ও বাড়িটা তালা বন্ধ করে দেশে যায়। ফিরতে ফিরতে সোমবার দুপুর হয়ে যায়। কাজে ঢোকার সময়ই ও মালিককে বলে নিয়েছিল প্রত্যেক সপ্তাহে ওকে দেশে যেতে দিতে হবে কারণ দেশের বাড়িতে ওর বউ-বাচ্চা ছাড়াও বুড়ো বাবা-মা আছে। মালিক ওর শর্তে রাজি হয়েছিল। তার মানে হল, মালিক যদি আলাদা করে ওই ঘরটা সমেত পুরো বাড়িটাই প্রত্যেক শনিবার এবং রবিবারের জন্যে কাউকে ভাড়া দেয়, সেটা দীনবন্ধুর টের পাবার কথা নয়।
দীনবন্ধু মাহাতো লোকটা হয় হদ্দ বোকা আর না হয় ভীষণ চালাক কিন্তু বোকা সেজে থাকে। দুটোর মধ্যে কোনটা সেটা বোঝার জন্যে সুভদ্র মাজি দীনবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে চলল।
(৪)
সেদিন দেরি করে বাড়ি ফেরার শাস্তি হিসেবে আদিত্যকে তিন-চারদিন বাড়িতে বন্দী থাকতে হল। তারপর তার মাথায় একটা ফন্দি এল। ডাঃ রায় তাকে নিয়মিত মর্নি ওয়াক করতে বলেছেন এটা কেয়া জানে। অতএব ডাঃ রায়ের কথাটা বলে তার কাছে প্রাতঃভ্রমণের অনুমতি চাওয়া যেতেই পারে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেয়াকে অনুমতি দিতে হয়েছে। তবে শর্ত হল, আদিত্য দেশবন্ধু পার্কের ভেতরেই হাঁটবে, বাইরে কোথাও যাবে না। একটু বাইরে বেরোনোর লোভে আদিত্য আজকাল তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ছে। ক’দিন তাড়াতাড়ি উঠে ভোরের দীনেন্দ্র স্ট্রিট, তাদের পাড়ার পার্ক, প্রাতঃভ্রমণকারী স্বাস্থ্যান্বেষী বৃদ্ধ সবই বেশ আপন লাগছে তার।
ভোরবেলাকার রুটিন ছবিগুলো আদিত্যর মুখস্থ হয়ে গেছে। পার্কের উল্টো ফুটপাতে যে মনিহারি দোকানটা আছে সেটা বেশ ভোর ভোর খুলে যায়। দোকানের মালিক বাবলু, যার ভাল নামটা আদিত্য জানে না, সারা সপ্তাহ দোকানের পেছনেই থাকে। বাবলুর পরিবার থাকে হুগলির কোনও গ্রামে। প্রতি রবিবার দোকান বন্ধ রেখে বাবলু বাড়ি যায়। বাবলুর দোকানে সাবান-টুথপেস্ট-ক্রিম-পাউডার ছাড়াও খাতা-পেন্সিল, পাঁউরুটি-বিস্কুট এমনকি দুধ বা ডিমও পাওয়া যায়। আদিত্য পার্কে চক্কর মারতে মারতে দ্যাখে দুধ নিয়ে মাদার ডেয়ারির গাড়ি এল, সাইকেল ভ্যান
চেপে পাঁউরুটি নিয়ে এল পাঁউরুটিওলা। তার বাক্সে পাঁউরুটি ছাড়াও কেক এবং দিশি বিস্কুট থাকে। তারও কিছু পরে মোটর বাইকের দু’দিকে দুটো লোহার খাঁচায় ডিমের স্তূপ সাজিয়ে ডিমওলা আসে। আদিত্য হাঁটা থামিয়ে অবাক হয়ে দ্যাখে কী অসাধারণ নৈপুণ্য লোকটার। একটাও না ভেঙে দিনের পর দিন দোকানে দোকানে হাজার হাজার ডিম পৌঁছে দিচ্ছে।
হাঁটা সেরে বাড়ি ফেরার পথে আদিত্য ওই দোকানটা থেকে দুধ পাঁউরুটি কেনে। মাঝে মাঝে ডিম। দিশি বিস্কুট। ডাক্তার আদিত্যকে কুসুমটা বাদ দিয়ে ডিম খেতে বলেছে। ডিমের কুসুমগুলো আপাতত ফ্রিজে জমা হচ্ছে। ডিমের কুসুমের সঙ্গে চকলেট মিশিয়ে কেয়া নাকি এক রকম কেক বানাতে শিখেছে। আরও কয়েকটা কুসুম জমা হলে সে বলেছে সেই কেকটা বানাবে। বানিয়ে ইস্কুলে নিয়ে যাবে, আদিত্যকে দেবে না। কারণ ডিমের কুসুম খাওয়া আদিত্যর বারণ। ফলে ওই কেক বানানোর ব্যাপারে আদিত্যর কোনও উৎসাহ নেই। কুসুম ছাড়া ডিম খেতে আদিত্যর অতি জঘন্য লাগে। তার মনে হয়, কুসুম ছাড়া ডিম যেন রাম ছাড়া রামায়ণ।
আজ ডিম পাঁউরুটি কিনতে কিনতে আদিত্যর কী খেয়াল হল, সে বাবলুকে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা আনস্লাইসড পাঁউরুটি রাখেন না?’
‘রাখি তো। ওই যে দেখুন ব্রাউন ব্রেডের নিচে আছে।’
আদিত্য দেখল স্তূপীকৃত ব্রাউন ব্রেডের নিচে দু’টি আনস্লাইসড কোয়ার্টার পাউন্ড রুটি পড়ে আছে। সে বার করে হাত দিয়ে সামান্য টিপে দেখল তেমন নরম নয়। তার মানে বাসি।
‘এগুলোকে তো টাটকা মনে হচ্ছে না।’ আদিত্য আনস্লাইসড রুটি দুটো হাতে নিয়ে বাবলুকে দেখাল।
‘এগুলো পরশুদিনের রুটি। নেবেন না দাদা। আপনি আমার রোজকার খদ্দের। আপনাকে মিথ্যে বললে কাল এসে চেপে ধরবেন। আপনি যদি আনস্লাইসড রুটি চান, আমি কাল সকালে রুটিওলার কাছ থেকে নিয়ে রাখব। আপনি কি হাফ পাউন্ড নেবেন, নাকি কোয়ার্টার পাউন্ড?’
আনস্লাইসড রুটিগুলোর গায়ে কম্পানির নাম লেখা আছে। ডিলিশাস কনফেকশানার। আদিত্য বলল, “আমি একটা হাফ পাউন্ডের লোফ নেব। কোন কম্পানি আনস্লাইসড রুটি ভাল বানাচ্ছে?’
‘আমার দোকানে তো এই ডিলিশাসের রুটিই আসে। খুব যে একটা চলে তা নয়। দু’চারজন অবশ্য নিয়মিত নেয়। তাদের জন্যে সকালে আসা টাটকা রুটি সরিয়ে রাখতে হয়। আপনি যদি নিতে চান আপনার জন্যেও কাল সরিয়ে রাখব।’
‘ঠিক আছে। আধ পাউন্ড রেখে দেবেন। আমি এই সময় এসে নিয়ে যাব।’ ‘আজ কিছু লাগবে না?”
‘বাড়িতে পাঁউরুটি আছে। আপনি শুধু আধ লিটার দুধ দিন।’
‘একটা নতুন বিস্কুট এসেছে। খেয়ে দেখবেন?’
‘নাঃ। আজ থাক। বাড়িতে অনেক বিস্কুট জমে গেছে। আচ্ছা, আমাদের ছোটবেলায় সেন বেকারির আনস্লাইসড রুটি পাওয়া যেত। এখনও পাওয়া যায়?”
‘সেন বেকারি? না দাদা আমি সেন বেকারির পাঁউরুটি আর রাখি না। আগে রাখতাম। এখন ওদের কোয়ালিটি খুব খারাপ হয়ে গেছে। বছর দুয়েক আগে আমার এক কাস্টমার এসে দেখাল, সেন বেকারির একটা আনস্লাইসড কোয়ার্টার পাউন্ড রুটি কাটার পর ভেতর থেকে একটা মরা আরশোলা বেরিয়েছে। ছোট আরশোলা নয়। দেড় ইঞ্চির বড় আরশোলা। কী ঘেন্নার কথা বলুন তো। এরা কীভাবে রুটি বানায় কে জানে? কিছু কমপ্লেন আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ওই আরশোলা বেরোনোর পর থেকে আমি সেন বেকারির রুটি আর রাখি না।’
‘যে আপনাকে রুটি দেয় তাকে বললেন না?’
‘বললাম তো। রুটিওলা বলল, আমি কী করব? আমি কি রুটি বানাই? তোমার নেওয়ার হলে নাও, না হলে নিও না। আসলে রাস্তার চায়ের দোকানগুলোতে সেন বেকারির রুটি এখনও বেশ চলে। কারণ ওদের রুটির দাম অনেকটাই কম। ওইসব দোকানের খদ্দেররা বেশিরভাগই মুটে-মজুর। তাদের কাছে দামটা বড় ব্যাপার, কোয়ালিটি একটু খারাপ হলেও কিছু এসে যায় না। আর ঘুগনিতে একবার ডুবিয়ে নিলে রুটির নিজস্ব স্বাদ আর কী থাকে বলুন?’
বাড়ি ফেরার পথে আদিত্য ভাবছিল বাবলু মুদি একটু বেশি কথা বলে ঠিকই, কিন্তু ওর কথা থেকে অনেক সময় কিছু কাজের খবরও বেরিয়ে আসে। রুটির থেকে দেড় ইঞ্চি আরশোলা বেরোনোর ব্যাপারটা আদিত্যকে চিন্তায় ফেলেছে।
কেয়া ইস্কুলে বেরিয়ে গেলে আদিত্য বুঝতে পারে না একা একা বাড়িতে বসে কী করবে। কিছুক্ষণ অবশ্যই গান শোনা যায়, কিছুক্ষণ ঘুমোনো যায়, স্নানাহারেও কিছুটা সময় ব্যয় করা যায়, কিন্তু এই সব করেও যে সময়টা উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে তাকে কায়দা করা আদিত্যর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আশার কথা এটাই যে এই সপ্তাহটা কোনও ক্রমে কাটিয়ে দিতে পারলে সামনের সোমবার থেকে আদিত্য বাইরে বেরোবার অনুমতি পেয়ে যাচ্ছে।
কেয়া বেরোল সাড়ে দশটা নাগাদ, পৌনে এগারোটা থেকে তার ক্লাশ। আজকাল গাড়ি কেনার ফলে সে বেশ দেরি করে বেরোচ্ছে। কাজের মাসি রান্নাঘরে ছ্যাঁকছোঁক করছে। মনে হয় আদিত্যর মধ্যাহ্নভোজনের প্রস্তুতি চলছে। আদিত্য কিছুক্ষণ খবর কাগজ পড়ল, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অশনি রায়ের কেসটা নিয়ে ভাবল, তারপর যখন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে এবার চান করতে যাবে, তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠেছে।
আদিত্য লক্ষ করেছে কলিং বেল বাজলেই রান্নার মাসি কালা হয়ে যায়, পাছে তাকে হেঁটে গিয়ে সদর দরজাটা খুলতে হয়। অতএব আদিত্যই উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। বিমল। হাতে মিষ্টির বাক্স। আদিত্যকে দেখে চওড়া করে হাসল।
‘নাতি হয়েছে স্যার। তাই খবরটা দিতে নিজেই চলে এলাম।’ বিমলকে ভীষণ খুশি-খুশি দেখাচ্ছিল।
আদিত্য ভাবল, নাতনি হলেও কি বিমলকে এতটা খুশি-খুশি দেখাত? সে মুখে বলল, ‘এস, এস, ভেতরে এস। এত ভাল খবর। বাচ্চা, বাচ্চার মা সব ভাল আছে তো?’
‘ভাল আছে স্যার। সবাই ভাল আছে। আজকেই হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। মানে ওর শ্বশুরবাড়ি কোদালিয়ায় ফিরেছে। আমাদের বাড়িতে তো জায়গা নেই।’
বিমল আদিত্যর পেছন পেছন বসার ঘরে ঢুকে মিষ্টির বাক্সটা টেবিলের ওপর রাখল। আদিত্য তার ইজিচেয়ারে বসে বিমলকে সামনের চেয়ারে বসতে বলল।
‘তোমার বউ কোথায়?’
“ও এখন কিছুদিন মেয়ে এবং নাতির সঙ্গে কোদালিয়ায় থাকবে। মেয়েটার কাঁচা শরীর, বাচ্চাটাও তো একেবারে ছোট। মাকেই তো দেখতে হবে, তাই না স্যার?’
‘সে তো বটেই। তা তুমি খাওয়া দাওয়া করছ কোথায়?’
‘কোথায় আর করব স্যার, ওই রাস্তার হোটেলে। প্রথমে ভেবেছিলাম নিজেই রান্নাবান্না করব। কিন্তু দেখলাম ও আমার দ্বারা হবে না। যেটা রাঁধি সেটা মুখে দেওয়া যায় না।’
‘শোনো, আজ দুপুরে তুমি আমার বাড়িতে খেয়ে যাবে। মানে, আজ দুপুরে আমরা এক সঙ্গে ভাত খাব।’
‘সে কী? না, না। বলা নেই কওয়া নেই এরকম হুট করে চলে এসেছি। আপনার খুব অসুবিধে হবে। তাছাড়া বৌদিও তো বাড়ি নেই। না স্যার আমি একটু পরেই উঠে পড়ব। আপনাকে আর জ্বালাতন করব না।’
‘কিছু জ্বালাতন নয়। আমাদের এখন একজন রান্নার মাসি আছে। সে-ই সব ব্যবস্থা করবে। তোমাকে শুধু কিছুক্ষণ একা একা বসে থাকতে হবে। আমি যতক্ষণ চান করব ততক্ষণ। তুমি একটু বোসো আমি আগে রান্নার মাসিকে বলে আসি।’
একটু গাঁইগুঁই করে বিমল খেতে রাজি হয়ে গেল।
রান্নার মাসি কেয়ার গুপ্তচর হতে পারে, কেউ এলে সদর দরজা খুলে দিতে গড়িমসি করতে পারে, কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে বাড়তি রান্না করতে তার কোনও আপত্তি কোনও দিন কেউ দেখেনি। মাসি জানাল, রেফ্রিজারেটারে যা শাক-সব্জি, মাছ-মাংস আছে তাই দিয়ে বিমলের খুব ভালোই হয়ে যাবে। আদিত্যর জন্যে অবশ্য অন্য ব্যবস্থা। কেয়ার কড়া হুকুম, ট্যালট্যালে চিকেন স্টু, এক কাপ ভাত আর এক বাটি টক দই, এর বাইরে আর কিছু আদিত্যকে দেওয়া যাবে না।
খাওয়া শেষ করে বিমল বলল, “আমি আর বেশিক্ষণ বসব না স্যার। আপনার এখন বিশ্রাম করা দরকার। শুধু একটা খবর দিয়ে চলে যাব।’
আদিত্যরও একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। এই ক’দিনে তার বিলক্ষণ দিবানিদ্রার অভ্যাস হয়েছে। সে একটা হাই অর্ধেক চেপে বলল, ‘কি খবর?’
‘সোমনাথ বাগের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমার যে বন্ধু সোমনাথের জায়গায় চাকরি পেয়েছে তার এক বন্ধু, সে আবার সোমনাথকেও চেনে, সন্ধানটা দিয়েছে।’ ‘কী সন্ধান দিয়েছে?’ আদিত্য খেয়াল করল তার ঘুমটা খানিকটা চলে গেছে। ওই বন্ধুর বন্ধুটার সঙ্গে এসপ্লানেড না কোথায় যেন একটা সোমনাথের দেখা হয়েছিল। সোমনাথ ওকে বলেছে সে দেশে ফিরে গিয়ে একটা মনিহারি দোকান করেছে। খুব ভাল আয় হচ্ছে। দোকান করার টাকা কোথায় পেল, জিজ্ঞেস করতে ও বলেছে এক কাকা ওকে টাকাটা দিয়েছে। আমাদের এরকম কাকা কেন থাকে না স্যার?’
‘ওর দেশ কোথায়?’ আদিত্য ভাবছে।
‘শেয়ালদার মেন লাইনে চাকদা বলে একটা জায়গা আছে স্যার। সেখানে। আমি কি গিয়ে খোঁজ-খবর নেব?’
‘এক্ষুনি দরকার নেই। ‘
‘তা হলে আমাকে এখন কী করতে বলেন?’
‘তোমাকে আপাতত কিচ্ছু করতে হবে না। কোনও দরকার হলে আমি তোমাকে ফোন করব।’
আদিত্য এখনও ভাবছে।
বিমল চলে যাবার পর আদিত্য ঘুমোবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু প্রথম দশ-পনের মিনিট কিছুতেই ঘুম আসছিল না। মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। সবই অশনি রায় সংক্রান্ত। সেন বেকারির ব্যাপারটাও মাথায় ঘুরছে। অশনি রায়ের রহস্যময়ী বান্ধবী, বাঙ্গুর এভিনিউ-এর ফ্ল্যাটে জোড়া খুন, সেন বেকারির পাঁউরুটির ব্যবসা, ড্রাগ অ্যাডিক্ট জয় তরফদারের মৃত্যু, অনন্যা সাহার স্বামী শুভব্রত সাহার আত্মহত্যা সবটাই মনে হচ্ছে এক সুতোয় বাঁধা। সুতোর জোড়গুলো অবশ্য এখনও অনেক জায়গায় বেমজবুত হয়ে আছে। ওগুলো শক্ত করা দরকার। তবু সব মিলিয়ে একটা হালকা ছবি আদিত্য দেখতে পাচ্ছে। ছবিটা ভাবতে ভাবতে আদিত্যর ঘুম এসে গিয়েছিল।
হয়ত মিনিট পঁয়তাল্লিশ ঘুমিয়েছিল আদিত্য, মোবাইল বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। আদিত্য দুপুরে ঘুমোতে যাবার আগে সাধারণত মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে দিয়ে শোয়, কারণ এই সময়টা নানা রকম ফেরিওলা ফোন করে উৎপাত করে। ‘আজ বিমল আসার ফলে মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে দিতে ভুলে গিয়েছিল।
ঘুম চোখে আদিত্য দেখল তার মোবাইলে মিতা অধিকারী নামটা ফুটে উঠেছে। মিতা অধিকারীটা আবার কে? ভাবতে ভাবতে আদিত্য ফোনটা ধরল। ‘আমি মিতা বলছি। মিতা অধিকারী। আপনাকে ওই অশনি রায়ের ব্যাপারটায় ফোন করেছিলাম, মনে আছে?’
আদিত্যর এবার মনে পড়েছে। তার ঘুমটাও কেটে গেছে।
‘মনে আছে। অবশ্যই মনে আছে। কেমন আছেন?’
‘ভাল আছি। কম্পানির কাজে কলকাতায় এসেছিলাম, আজ রাত্তিরে ফিরে যাচ্ছি। এই ক’দিন এত ব্যস্ত ছিলাম যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারলাম না। খুব ইচ্ছে ছিল দেখা করার।’
‘দেখা হতো কিনা জানি না। আমি অসুস্থ হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। তারপর বাড়ি ফিরে গত এক সপ্তাহ বাড়িতে। আমার স্ত্রীর কঠোর নির্দেশে ভিজিটার বন্ধ ৷”
‘সে কী! কী হয়েছিল? সিরিয়াস কিছু?’
‘হৃদয়ঘটিত সমস্যা। ধূমপানের কুফল। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে আপাতত বিপদ এড়ানো গেছে। বুকের দু’দিকে দুটো স্টেন্ট বসেছে। এখন ভালই আছি।’
‘আই অ্যাম ভেরি সরি আদিত্যবাবু। আপনি এরকম অসুস্থ জানলে আমি কিছুতেই ফোন করতাম না। আপনি বিশ্রাম নিন। তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে উঠুন। আজ রাখি?’ আদিত্য খেয়াল করল ‘রাখি’ বলেও মিতা অধিকারী ফোনটা রাখছে না। হয়ত কিছু একটা বলার আছে। সে বলল, ‘আপনি মনে হয় কিছু একটা বলতে ফোন করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ, তা করেছিলাম। কিন্তু আপনার এই শরীরে সেটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।’
‘আপনি বলুন না। আমার শরীর এখন ঠিক আছে।’
‘আসলে আমি ওই মহিলাকে আবার দেখেছি।’
“ওই মহিলা মানে যার সঙ্গে অশনি রায় দারুচিনিতে আসতেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই মহিলাই ।’
‘কোথায় দেখলেন ? ‘
‘আগে যেখানে দেখেছিলাম, সেখানে। আমাদের কম্পানির মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালার ঘরে।’
‘আপনি র্যানডমলি এসে যখন ভদ্রমহিলাকে আপনাদের মালিকের ঘরে দেখছেন তখন ধরে নিতে হবে ওই ভদ্রমহিলা বেশ ঘন ঘন আপনাদের মালিকের ঘরে আসেন।’ ‘আমারও ঠিক এটাই মনে হয়েছে। কিন্তু মালিককে তো সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না উনি কে, তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারিনি।’
‘অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করেননি?’
‘করেছিলাম। গ্লোবাল-এর হেড অফিসে আমার এক বন্ধু কাজ করে, সে আমার সঙ্গে দারুচিনি-তেও কাজ করত, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।’
‘কী জিজ্ঞেস করলেন ? ‘
‘জিজ্ঞেস করলাম, মালিকের চেম্বার থেকে যে মহিলাকে বেরোতে দেখলাম, উনি কে? আগেও অনেকবার ওকে মালিকের চেম্বার থেকে বেরোতে দেখেছি।’
‘আমার বন্ধু বলল, তোর জানার কী দরকার? ওসব বড় ঘরের বড় বড় ব্যাপার। তোর আমার মতো হেঁজিপেঁজি ওসব ব্যাপার যত কম জানে ততই ভাল। তারপর আমার বন্ধু গলা নামিয়ে বলল, শুনলাম, ওই মেয়েটাকে নিয়ে মালিকের সঙ্গে মালিকের বউ-এর নাকি খুব ঝামেলা চলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটার নাম কী? বন্ধু বলল, আমি জানি না। জানার দরকারও নেই। তোর এত কৌতূহল কেন বুঝতে পারছি না।’
“ওই ভদ্রমহিলা কি আপনাদের মালিকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতে আসেন নাকি কোনও কাজে আসেন?’
‘আমি এটা খুব সাবধানে ওখানকার কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেউ কিচ্ছু বলতে পারল না। কাজে এলে নিশ্চয় কেউ না কেউ বলতে পারত। যখন কেউ বলতে পারছে না তখন ধরে নিতে হবে উনি পারসোনাল ভিজিটেই আসেন।
‘আর কিছু জানতে পারলেন?’
‘না, আর কিছু না। মোটামুটি এইটুকুই জেনেছি। ভাবলাম আপনাকে জানিয়ে রাখি। হয়ত আপনার কাজে লাগবে।’
‘ভাল করেছেন। আচ্ছা, আপনার সঙ্গে অশনি রায়ের কি সম্প্রতি দেখা হয়েছে?’ ‘অশনি রায়ের সঙ্গে? কই না তো।’
‘ঠিক আছে। ভাল থাকবেন।’
‘আপনিও ভাল থাকবেন। পরের বার কলকাতায় এলে দেখা করব।’ “নিশ্চয়।’
কেয়া এল ছ’টার একটু পরে। সারা বিকেল আদিত্য এই মুহূর্তটার জন্যে অপেক্ষা করছিল। এবার এক সঙ্গে চা খাবে। কেয়া এসে আদিত্যর কপালে হাত দিয়ে দেখল। যেন আদিত্যর জ্বর হয়েছে। বলল, ‘শরীর কেমন?
‘ভাল। দুপুরে ঘুমিয়েছি। তার আগে বিমল মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। ওর নাতি হয়েছে। বউ মেয়ের কাছে আছে। তাই বিমল হোটেলে খাচ্ছে। ওকে দুপুরে খাইয়ে দিলাম।’
‘ভাল করেছ। কিন্তু ফ্রিজে তো বিশেষ কিছু ছিল না।’
‘যা ছিল তাই দিয়েই বেশ ভাল হয়ে গেছে। কাতলা মাছ ছিল। পালং শাক ছিল। কালকের রান্না করা খানিকটা চিকেনও ছিল। মাসি বড়ি আর মুলো দিয়ে একটা পালং শাকের ঘন্ট যা রেঁধেছিল না!’
‘তুমি খেলে?’
‘একটু খেয়েছি। দেখেই লোভ লেগে গেল। একটু না খেলে বিমলের পেট খারাপ হতো।’
‘তোমার খাওয়া উচিত হয়নি। মাসি রান্না করে ভাল, কিন্তু ভীষণ তেল দেয়। এই লোভেই তুমি গেলে।’
মাসি চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে আদিত্য দেখল সুভদ্র হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করেছে। বনানী দাসের খবর পাওয়া গেছে। উলুবেড়িয়ার কাছে একটা আশ্রমে থাকে ৷ সারাদিন নাকি সাধন-ভজন নিয়েই আছে। আপনি চাইলে একদিন কথা বলে আসা যেতে পারে।