মৃত্তিকার মৃত্যু – ৬
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
(১)
‘আমি পল্লব সেন বলছি। শুনলাম আপনার নাকি শরীর ভাল নেই?’ ‘হ্যাঁ, শরীরটা একটু গণ্ডগোল করছিল। হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিল। এখন ভাল আছি। কিন্তু আপনি কী করে জানলেন আমার শরীর খারাপ?
‘আপনাকে ফোন করেছিলাম। আপনার স্ত্রী ফোনটা ধরলেন। বললেন আপনি হাসপাতালে ।
“ওহো। আপনি ফোন করেছিলেন আমি জানতামই না। আমার স্ত্রী আমাকে বলতে ভুলে গেছে। আসলে ওর ওপর দিয়ে এত চাপ গেছে, ভুলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।’
‘ঠিকই তো। তা আপনার কী হয়েছিল?’
‘হার্টের প্রবলেম। দুটো আর্টারিতে ব্লক ছিল। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি হল। দুটো স্টেন্টও বসেছে। এখন বাড়িতে। সুস্থ আছি। গতকাল থেকে অফিসে বেরোনোর পারমিশান পেয়েছি।’
ওরেব্বাবা! এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! আপনাকে তা হলে বরং পরে কখনও ফোন করব। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন এই কামনা করি।’
‘আমি এখন মোটামুটি সুস্থ। আপনি বলুন না কেন ফোন করেছিলেন। ‘বিশেষ কিছু নয়। আমার বাড়িতে এই শুক্রবার একটা গানের বৈঠক অরগানাইজ করেছি। আজকাল তো ভাল শ্রোতা পাওয়া যায় না। সেদিন আপনার সঙ্গে কথা বলে মনে হল আপনি সমঝদার লোক। তা, এই ওস্তাদ পাকিস্তান থেকে আসছেন। দিল্লি আর মুম্বাইতে পাবলিক পারফরমেন্স দেবেন। একটা দিনের জন্যে কলকাতায় আসছেন। এখানে কোনও পাবলিক পারফরমেন্স দিচ্ছেন না। আমি অনেক কষ্টে ওঁকে আমার বাড়িতে গাইতে রাজি করিয়েছি। গুণী মানুষ। টাকা-পয়সার চাহিদা বিশেষ নেই। কিন্তু ভাল শ্রোতা চান। শুনেছেন, কলকাতার মানুষ গান-বাজনার সমঝদার। তাই রাজি হয়ে গেছেন। কিন্তু সেই পুরোনো কলকাতা তো আর নেই। ভাল, সমঝদার শ্রোতা তো হাতে গোনা।’
‘এই পাকিস্তানি ওস্তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কী? কোথায় গান শিখেছেন?’ আদিত্য খানিকটা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল। পাকিস্তানি ওস্তাদদের সবার গান তার ভাল লাগে না। বিশেষ করে যে ঘরানাটা ওখানে সব থেকে বেশি চলে, সেই শাম-চৌরাসি ঘরানার গান আদৌ আদিত্যর কাপ অফ টি নয়।
‘ওস্তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডটাই তো সব থেকে ইন্টারেস্টিং। আপনি জানেন আসাদ আলি খাঁ বলে ফৈয়জ খাঁর এক ভাইপো না ভাগ্নে ছিল যাকে উনি ওঁর সব থেকে সুযোগ্য শিষ্য মনে করতেন? বীণকার আসাদ আলি নয়, ভোকালিস্ট আসাদ আলি। জানেন এর কথা ?
‘ওরকম একজন ছিলেন জানতাম, তবে তেমন ভাল করে জানি না। ওঁর খুব বেশি রেকর্ড তো পাওয়া যায় না। উনি বোধহয় দেশভাগের ঠিক আগে বা ঠিক পরে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। ওঁর একটা বারোঁয়া শুনেছি। আর বোধহয় একটা ছায়া-কেদার। খুবই ভাল। কিন্তু আসাদ আলির তো এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয়।’
‘বাঃ, আপনি তো আসাদ আলির কথা জানেন। খুব বেশি লোক কিন্তু ওঁর কথা জানে না। যিনি আসছেন তিনি আসাদ আলি নন। আসাদ আলির শেষ দিকের শিষ্য। বয়েস বোধহয় ষাটের আশেপাশে। বিশুদ্ধ আগ্রা ঘরানা, যেটা আজকাল খুব বেশি শোনা যায় না। ওঁর কলকাতায় আসার কারণটাও ইন্টারেস্টিং। জানেন তো ফৈয়জ খাঁ সাহেব কলকাতায় আসতেন হিন্দুস্তান কম্পানিতে গান রেকর্ড করার জন্যে। এসে উনি বউবাজারে কম্পানিরই একটা বাড়িতে থাকতেন। এই ওস্তাদ সেই বাড়িটা দেখতে আসছেন। এখান থেকে যাবেন বরোদা। ওখানে ফৈয়জ খাঁ সাহেবের কবর আছে। সেটা দেখে উনি মুম্বাই আর দিল্লিতে গান গেয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন। পাকিস্তানের মিউজিক ক্রিটিকরা এঁর গানের প্রশংশা করতে গিয়ে একেবারে নালে-ঝোলে হয়ে গেছে। সরি, উত্তেজনার বশে মুখ দিয়ে নর্থ-ক্যালকাটার ভাষা বেরিয়ে গেল। আসবেন ওঁর গান শুনতে?’
‘আপনি যা বললেন তারপর তো না যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ক’টা থেকে গান শুরু?
‘সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে। ন’টা অব্দি চলবে। তারপর ডিনার। আমার বাগবাজারের বাড়িতে। ও হ্যাঁ। ওস্তাদের নামটাই তো বলা হয়নি। ওস্তাদের নাম শাহবাজ খান। ‘
দুপুর থেকে বৃষ্টি নামল। খবর হবার মতো বৃষ্টি নয়, মুগ্ধ হয়ে দেখার মতোও নয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি, বর্ষাকালে যেমন সারাদিন ধরে ঝরে যায়। একঘেয়ে, বিরক্তিকর। এই বৈশাখ মাসেই বর্ষা এসে গেল নাকি? আদিত্য আপিসে এসেছিল। অশনি রায়ের কেসটার জন্যে অন্য ছোটখাট কয়েকটা কাজ বাকি পড়েছিল। মূলত কিছু পেপার ওয়ার্ক। আদিত্য ভেবেছিল সারাদিন কাজ করে বিকেলে গান শুনতে যাবে। কেয়া বলেছিল গাড়িটা আদিত্যকে পৌঁছে দিয়ে আসবে। আদিত্য রাজি হয়নি। বাগবাজার যাবার পক্ষে মেট্রোটাই সুবিধেজনক। তাছাড়া একটু হাঁটাও হবে। ডাক্তার আদিত্যকে রোজ হাঁটতে বলেছে। এখন এই বৃষ্টিটাই ঝামেলা বাঁধাল। খুব জোরে পড়ছে না, কিন্তু ভিজিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট।
একটা জিনিস আদিত্যর বেশ অদ্ভুত মনে হচ্ছে। কানু ধরা পড়ার পরে সেই ব্ল্যাকমেলার একেবারে চুপ মেরে গেছে। কানুর কথা যদি সত্যি হতো, অর্থাৎ কানা মুমতাজ যদি এর পেছনে থাকত, তা হলে সে কি আবার চেষ্টা করত না? এমন হতে পারে, যে মেয়েটির ছবি দেখিয়ে ব্ল্যাকমেলের দাবী এসেছে, সে এবং কানু মিলে ব্ল্যাকমেলটা প্ল্যান করেছে। মুমতাজ-টুমতাজ কেউ এর পেছনে নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, এরা ব্ল্যাকমেল করার জন্যে এতদিন অপেক্ষা করল কেন? আরও প্রশ্ন, মুমতাজ বড় মাপের মাফিয়া। সে নিজে দেশে না থাকলেও তার সাগরেদরা চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তারা যদি জানতে পারে নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্যে কানু মিথ্যে করে মুমতাজকে ফাঁসাচ্ছে তা হলে কানুকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। কানু নিজেও সেটা জানে। তা হলে এই ঝুঁকিটা কানু নেবে কেন? ওই মেয়েটিকে খুঁজে বার করতে পারলে অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত। কিন্তু কোথায় সে?
আবার অন্যদিকে রাজারহাটের বাড়িটাতে পুলিশ ওত পেতে বসে আছে। কিন্তু এখন অব্দি কোনও দল বা ব্যক্তি ছবি তোলার সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে এসে পৌঁছয়নি। দীনবন্ধু মাহাতো লোকটা যতটা জানার ভান করছে তার থেকে হয়ত অনেক বেশি জানে। হয়ত সুভদ্রর সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলার পরই তার সন্দেহ হয়েছে। সে দলের লোকদের সাবধান করে দিয়েছে। পুলিশ দীনবন্ধুর মোবাইল ফোনটা বাজেয়াপ্ত করে কল-লিস্ট খুঁটিয়ে দেখছে। তার জায়গা-জমি-বাড়ি-টাকাকড়ি কী আছে সেটাও দেখছে। তাছাড়া এখনও রোজ তার জেরা চলছে। সুভদ্র বলছে, এই ম্যারাথন জেরার চাপে আজ না হোক তো কাল দীনবন্ধু ভেঙে পড়তে বাধ্য। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, এখন অব্দি কোনও দিকেই কোনও দিশা দেখা যাচ্ছে না।
সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল, বৃষ্টি ধরার নামগন্ধ নেই। কেয়া মেসেজ করেছে, যদি গান শুনতে যাও উবার নেবে। কিপটেমি করবে না। আদিত্যর বাড়ি ফিরতে দেরি হবে বলে কেয়াও আজ দু’তিনজন কলিগের সঙ্গে সাউথ সিটিতে শপিং করতে গেছে।
আদিত্যর কোনও ধারণাই ছিল না আজকাল উবার পেতে কতটা দেরি হয়। ফলে যখন সে বাগবাজারে সেন বাড়ির বড় হলঘরটাতে পৌঁছল তখন ওস্তাদ শাহবাজ খানের তানপুরা বাঁধা হয়ে গেছে। তবলিয়া অঙ্কুশ সাহা হারমোনিয়ামের সঙ্গে সুর মিলিয়ে তবলা বাঁধছে। হারমোনিয়াম বাদক শান্তনু ঘোষ প্রবীণ শিল্পী, বহু বড় বড় গায়কের সঙ্গে আদিত্য এঁকে বাজাতে শুনেছে।
মাটিতে শতরঞ্চির ওপর সাদা চাদর পেতে ঢালাও বসার ব্যবস্থা। এক নজর দেখে আদিত্যর মনে হল ঘরে জনা কুড়ির বেশি শ্রোতা হবে না। অনেকটা জায়গা এখনও খালি রয়েছে। আদিত্য একেবারে পেছনে গিয়ে বসল। পল্লব সেন ছাড়াও কয়েকটা চেনা মুখ চোখে পড়ল। তার মধ্যে একজন তারাপদ গাঙ্গুলি, গানের এনসাইক্লোপিডিয়া, আদিত্যর বাবার বিশেষ স্নেহধন্য। তারাপদ কাকা একেবারে সামনে পল্লব সেনের ঠিক পাশে বসেছেন। তারাপদ গাঙ্গুলি বা পল্লব সেন কেউই আদিত্যকে দেখতে পাননি ৷
আদিত্য ভাবল, ভালই হয়েছে। দেখতে পেলে হয়ত সামনে ডাকতেন। সামনে বসতে আদিত্যর সংকোচ হয়, বিশেষ করে এই কারণে যে গানের কোনও কোনও মুহূর্তে তার মুখে ও শরীরে যে স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির জন্ম হয় সেটা সে কাউকে দেখাতে চায় না।
দেখে মনে হয় ওস্তাদজির বয়েস ষাটের নিচেই হবে। শীর্ণ মুখায়বব। মাথার চুল কাঁচাপাকা। পূরবী রাগ দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলেন। আগ্রার স্টাইলে নোম তোম আলাপ করলেন অনেকক্ষণ ধরে। তারপর মধ্যলয়ে ফৈয়জ খাঁর সেই বিখ্যাত গান মথুরা না যাও মোরে কানহে’। আদিত্যর ভালই লাগছিল, বলা যায় বেশ ভাল লাগছিল, তবে নালে-ঝোলে হবার মতো কিছু মনে হল না। পূরবীর পর কেদার এবং সব শেষে কেদারে কোমল নিষাদ লাগিয়ে চাঁদনি কেদার। শেষতম রাগের ঝাঁপতাল বন্দিশটা, জানা গেল, ওস্তাদজির গুরু আসাদ আলি খাঁ সাহেবের। সাড়ে আটটার মধ্যে গান শেষ। পল্লব সেন একটা ঠুংরি শোনার আর্জি জানালেন। ওস্তাদজি সবিনয়ে জানালেন আল্লা নিশ্চয় আর একদিন তাঁকে ঠুংরি শোনানোর সুযোগ করে দেবেন, কিন্তু আজ তাঁকে উঠতেই হবে। কোনও এক জায়গায় নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ।
গান শুনে আদিত্যর ভালই লাগল, কিন্তু মন ভরল না। পল্লব সেনের কথা শুনে সে হয়ত একটু বেশি আশা করে ফেলেছিল। আদিত্য ভাবছিল, আসলে এই ওস্তাদজি, তাঁর দাদা-গুরু ফৈয়জ খাঁকে হুবহু নকল করার চেষ্টা করেন। এঁর গলাটাও অনেকটা অল্প বয়সের ফৈয়জ খাঁর মতো। কিন্তু সমস্যা দুটো। হুবহু ফৈয়জ খাঁকে নকল করলে, তা সে যত ভাল নকলই হোক, কেউ খুব বড় শিল্পী হতে পারবেন না। সত্যিকারের বড় শিল্পী হতে গেলে নিজস্ব একটা রাস্তা, একটা স্টাইল খুঁজে বার করতেই হবে। আর তার থেকেও বড় কথা, ফৈয়জ খাঁর মতো মহান গায়ককে বড়জোর ওপর ওপর নকল করা যায়। কিন্তু তাঁর গলায় সুরের যে সূক্ষ্মতম কারুকাজ, যে ফাইনার নুয়ান্সেস, সেটা অন্য কারও পক্ষে রপ্ত করা অসম্ভব।
পাশের ঘরে নটার সময় ডিনার দেওয়া হবে, এখনও তার মিনিট কুড়ি দেরি আছে। পল্লব সেন ঘোষণা করলেন, কেউ যদি ডিনারের আগে একটা-দুটো ড্রিঙ্ক নিতে ইচ্ছা করেন তাঁদের জন্য পাশের ঘরে একটা ছোট বার আছে। আদিত্যর একটা হুইস্কি খেতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু সে এখনও ডাক্তারের কাছ থেকে মদ্যপানের ছাড়পত্র পায়নি। তাছাড়া তারাপদ গাঙ্গুলির উপস্থিতিতে তার পক্ষে মদ্যপান অসম্ভব। পল্লব সেন আদিত্যকে দেখতে পেয়েছেন।
‘আরে আপনি এসেছেন। আমি তো ভাবলাম আপনি আসতেই পারলেন না।’ পল্লব সেন দূর থেকে গলার স্বর উঁচু করে বললেন।
আদিত্য পায়ে পায়ে পল্লব সেনের দিকে এগিয়ে গেল।
‘কেমন লাগল গান?’ পল্লব সেন সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন।
‘ভাল লাগল। তবে আমি আর একটু ভাল আশা করেছিলাম।’
‘আমি তো বলব এত ভাল আগ্রা ঘরানার গান অনেকদিন শুনিনি। আপনার ভাল লাগল না? ’
‘না, না। ভাল লাগল। খুবই ভাল লাগল। তবে কিনা এই বয়সেও উনি ফৈয়জ খাঁর ছত্রছায়া থেকে বেরোতে পারলেন না। সত্যিকারের বড় শিল্পী হতে গেলে একটা নিজস্ব স্টাইল তো ডেভেলপ করতে হবে।’
‘আমিও তো ঠিক এটাই বলছিলাম। ফৈয়জ খাঁকে যারাই অন্ধভাবে নকল করতে গেছে, প্রত্যেকের সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। ওই জিনিসের নকল হয় না।’ তারাপদ গাঙ্গুলি পেছন থেকে বললেন। আদিত্যকে তিনি তখনও খেয়াল করেননি। তারপর আদিত্যকে দেখতে পেয়ে বললেন, ‘আরে বাবা, আমার কী সৌভাগ্য, কাকে দেখছি! ‘ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘তাই ভাবছি এটা কে? এ তো বেশ গান-টান বোঝে মনে হচ্ছে। অসিতদার ছেলে, গান বুঝবে না?’
আদিত্য লাজুক গলায় বলল, ‘ভাল আছেন তারাপদকাকা?’
‘এই বয়েসে যতটা ভাল থাকা যায় ততটা ভাল আছি। শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সেসব নিয়ে কথা বলতে ভাল লাগে না। তবে বাড়ি থেকে খুব একটা বেরুতে পারি না।’
‘আপনি আদিত্যবাবুকে চেনেন?” পল্লব সেন তারাপদ গাঙ্গুলির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন।
‘চিনি মানে? একে আমি জন্মাতে দেখেছি। এ কার ছেলে জানো? এ হচ্ছে অসিতদার ছেলে।’
‘অসিতদার ছেলে মানে?” পল্লব সেন এখনও আদিত্যর পরিচয়টা ঠিক ধরতে পারছেন না। ‘আমি তো জানি উনি আদিত্য মজুমদার। বেসরকারি গোয়েন্দা এবং একই সঙ্গে গানের সমঝদার।’
‘বেসরকারি গোয়েন্দা!’ তারাপদ গাঙ্গুলি হতভম্ভ। বোঝাই যাচ্ছে, আদিত্যর এই পরিচয়টা তাঁর জানা ছিল না। আদিত্য লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। অসিতবর্ণ মজুমদারের ছেলে বেসরকারি গোয়েন্দা। তারাপদকাকা কী ভাবছেন?
ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করার জন্যে আদিত্য মরিয়া হয়ে বলল, ‘তারাপদকাকা, আপনি তো জানেন বাবা মারা যাবার পর আমাদের অবস্থা কী হয়েছিল। বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেল। আমার লেখাপড়াটাও বন্ধ হয়ে গেল। অনেক কিছু চেষ্টা করলাম, কিছুই হল না। শেষে নেহাতই পেটের দায়ে গোয়েন্দাগিরি ধরেছি। করতে ভাল লাগে না। কাউকে বলতেও ভাল লাগে না। কিন্তু এটাই বাস্তব।’
তারাপদ গাঙ্গুলি চুপ করে আছেন। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। নীরবতা ভেঙে পল্লব সেন বললেন, ‘অসিতদা মানে কি আলিপুরের অসিতবর্ণ মজুমদার ?’
‘তাছাড়া কে?’ তারাপদ গাঙ্গুলি সম্বিত ফিরে পেয়েছেন। ‘এদের বাড়িতে আমি কার গান শুনিনি? নাইনটিন ফরটিজ-এ দু’বার ফৈয়জ খাঁও শুনেছি। আমি অবশ্য তখন খুবই ছোট।’
‘আমার বাবা আপনার বাবার বন্ধু ছিলেন। আপনাদের বাড়ির মজলিসের কথা আমি বাবার মুখে শুনেছি।’ পল্লব সেন আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন।
উর্দিপরা খানসামা দরজায় দেখা দিয়ে বলল, পাশের ঘরে ডিনার তৈরি। তারাপদ গাঙ্গুলি ডিনার খাবেন না। বয়সের কারণে আজকাল বাইরের কোনও খাওয়া তাঁর হজম হয় না। তিনি বিদায় নেওয়ার পর আদিত্য খানিকটা স্বস্তি বোধ করছে।
ব্যুফে। মস্ত টেবিলে অসংখ্য খাদ্যবস্তু সাজানো । দিশি বিদেশির সমাহার। বেশিরভাগ খাদ্যই অবশ্য আদিত্যর চলবে না। আদিত্য ঠিক করল চিকেন রোস্ট এবং বয়েল্ড ভেজটেবলস-এ নিজেকে আটকে রাখবে। শেষে বড়জোর একটা ক্যারামেল পুডিং চলতে পারে।
‘আপনার কাছে একটা আর্জি ছিল।’ ডিনার খেতে খেতে আদিত্য পল্লব সেনকে বলল।
‘বলুন, বলুন।
‘প্রথম যেদিন আপনাকে টেলিফোন করেছিলাম, সেদিন বলেছিলাম আমি একজন সাংবাদিক। বাঙালির ব্যবসা নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি। তাই আপনার সঙ্গে দেখে করতে চাই। আপনি তো জানেন আমি নিজের পরিচয়টা মিথ্যে বলেছিলাম। আজ কিন্তু আর মিথ্যে বলব না। সত্যি কথাটা হল, কিছুদিন আগে স্থানীয় পুলিশ আপনাদের ডিসট্রিবিউশন ম্যানেজার শুভব্রত সাহার মৃতদেহ কৃষ্ণনগরে তার কোয়ার্টার থেকে উদ্ধার করেছে। খবরটা আপনি নিশ্চয় জানেন।’
‘জানি। কিন্তু শুভব্রত সাহা তো আত্মহত্যা করেছে। সে নাকি কম্পানির টাকা চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিল।’
‘কম্পানির থেকে সেটাই বলা হচ্ছে। স্থানীয় পুলিশও তাতে সায় দিচ্ছে। কিন্তু আসল সত্যটা বোধহয় আলাদা। আমরা ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখতে চাই। তার জন্যে কৃষ্ণনগরে আপনাদের ফ্যাকটরিতে যেতে হবে। তদন্ত ছাড়াও কৃষ্ণনগর যাওয়ার আর একটা কারণ নস্টালজিয়া। আসলে সেন বেকারির পাঁউরুটির ব্যাপারে আমার একটা ভীষণ দুর্বলতা আছে। আমাদের বাবুর্চি ছিল নুরুল। সে সেন বেকারির ছাড়া অন্য কারও পাঁউরুটি রান্নাঘরে ঢুকতেই দিত না। তাই আমার সেন বেকারির ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছে করে। ফ্যাকটরিটা দেখতে ইচ্ছে করে। ওখানে একটা ভিজিট অরগানাইজ করা যাবে?’
‘আপনি একাই যাবেন?’
‘না। একা যাব না। এটা একটা ফর্মাল ইনভেস্টিগেশন। আমার সঙ্গে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর যাবে। ব্যবস্থা করতে পারবেন ?’
পল্লব সেন ভাবছেন। কী ভাবছেন আদিত্যর পক্ষে আন্দাজ করা শক্ত। সে পল্লব সেনের মুখের দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পল্লব সেন বললেন, ‘ঠিক আছে। ব্যবস্থা করা যাবে। আপনারা কবে যেতে চান?’
‘ধরুন যদি পরের সপ্তাহে যাই। সকালে যাব। সারাদিন ফ্যাক্টরি দেখব। সন্ধের ট্রেনে চলে আসব। আপনি শুধু একটু বলে দেবেন আমরা যাচ্ছি।’
‘সেটা তো একটা ফোন করে দিলেই হবে। পরের সপ্তাহে কবে যেতে চান?’ ‘সোম বা মঙ্গল? অবশ্য তার আগে সুভদ্র, মানে সেই পুলিশ ইন্সপেক্টার যিনি আমার সঙ্গে যাবেন, তার সঙ্গে একবার কথা বলে নিতে হবে। আপনাকে যদি শনিবার জানিয়ে দিই?’
‘নো প্রবলেম। জানিয়ে দেবেন। আরে মিহির, তুমি কোথায় লুকিয়ে ছিলে? এক্সকিউজ মি।’ পল্লব সেন আদিত্যকে রেখে এগিয়ে গেলেন।
ডিনার শেষ করে আদিত্য এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কথা বলার মতো চেনা তেমন কেউ নেই। একটু দূরে পল্লব সেন কিছু মহিলা পরিবৃত হয়ে রয়েছেন। আদিত্যর মনে হল, এই অবস্থায় ওকে বিব্রত না করে চুপি চুপি কেটে পড়াই ভাল। পরে তো ফোনে কথা হবেই। হলঘরের দরজা দিয়ে বেরোতে যাচ্ছে, নারীকণ্ঠে নিজের নাম শুনে থমকে যেতে হল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কণ্ঠের অধিকারিণী সুন্দরী, ব্যক্তিত্বময়ী, অভিজাত ।
‘আদিত্যবাবু, আপনি ভাল করে খেয়েছেন তো? আমি তো কোনও দিকেই ভাল করে নজর দিতে পারলাম না।’
‘আমি খুব ভাল করে খেয়েছি। আপনি কত দিকে নজর দেবেন?’ আদিত্য লাজুক গলায় জানাল।
“ও হো। আমি তো নিজের পরিচয়টাই এখনও দিইনি। আমি মালবিকা সেন, পল্লবের বৌদি।’
‘পরিচয় দেবার দরকার নেই। আমি আগেই বুঝতে পেরেছি।’আদিত্য সৌজন্যমূলক হাসল ।
‘আমি আপনাদের কথাবার্তা ওভারহিয়ার করছিলাম। পল্লবের মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু আপনাদের বাড়ির কথা আমার স্বামী সৌরভ খুব বলত। ও অনেকবার আমার শ্বশুরমশায়ের সঙ্গে আপনাদের বাড়িতে গান শুনতে গেছে। আজ আর আপনাকে আটকাব না, রাত্তির হয়ে গেছে। পরে একদিন আপনাকে সস্ত্রীক আসতে বলব। তখন অনেক গল্প করা যাবে।’
বাড়ি ফিরতে ফিরতে আদিত্য ভাবছিল মালবিকা সেন জানলেন কী করে সে বিবাহিত? নাকি তার বয়সের যে কোনও পুরুষকে বিবাহিত বলে ধরে নেওয়াটাই স্বাভাবিক?
শনিবারের আগেই আদিত্য পল্লব সেনকে ফোন করল।
‘সুভদ্রর সঙ্গে কথা বলেছি। ও বলছে সোমবারটা ওর একটু কাজ আছে। কিন্তু সপ্তাহের বাকি দিনগুলো ও ফ্রি। সেক্ষেত্রে কি মঙ্গলবার যাওয়া যেতে পারে?’
‘শুনুন। আপনারা মঙ্গলবার যান। সারাদিন ফ্যাক্টরি দেখুন। তারপর রাত্তিরটা কিন্তু ওখানে থেকে যেতে হবে। ফ্যাক্টরির মধ্যে আমার একটা গেস্ট হাউস আছে। আপনারা সেখানে রাত্তিরটা থাকবেন। আমিও রাত্তিরে কোনও একটা সময় ফ্যাকটারিতে পৌঁছে যাব। পরদিন ভোরবেলা আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে মাইল পনের দূরে জলঙ্গী নদীর একটা দ্বীপে আপনাদের নিয়ে যাব। ওখানে অপূর্ব সব পাখি আসে। পাখি-টাখি দেখে আপনারা আমার সঙ্গে কলকাতা ফিরে আসবেন। রাজি তো?’
‘অবশ্যই রাজি। এত চমৎকার প্রস্তাবে কেউ অরাজি হতে পারে? তবে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে। আমি যে একজন গোয়েন্দা আর আমার সঙ্গে যিনি যাচ্ছেন তিনি যে একজন পুলিশ অফিসার এই পরিচয়গুলো প্লিজ কাউকে জানাবেন না। পুলিশ বা গোয়েন্দার কাছে লোকে ওপেন আপ করতে চায় না। নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। সেটা আমাদের কাজের পক্ষে অসুবিধেজনক। আপনি বরং বলতে পারেন আমরা দুজন সাংবাদিক। বাঙালির পুরোনো ব্যবসাগুলো নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি। সেই সূত্রেই সেন বেকারির কারখানাটা দেখতে চাই।’
‘ঠিক আছে তাই বলব। আর কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে আমার ফ্যাক্টরি যাওয়ার ডিরেকশনটা আমি হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি। আপনারা ট্রেনেই যাচ্ছেন তো?’
‘হ্যাঁ। আমরা ট্রেনেই যাব।’
‘ঠিক আছে। তা হলে মঙ্গলবার রাত্তিরে আপনাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। রাত্তিরটা আপনারা আমার সঙ্গে ডিনার করবেন। আমি আমার ফ্যাক্টরিতে সমস্ত দরকারি ইনফরমেশন দিয়ে রাখব।’
(২)
দুটো দিন আদিত্য বাড়িতেই ছিল। সারাদিন ভাবছিল। দ্বিতীয় দিন বিকেলে সুভদ্র এসে হাজির। কেয়া তখনও ফেরেনি।
‘এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম একবার চান্স নিয়ে দেখি, যদি বাড়িতে থাকেন।’ ‘তুমি এসে খুব ভাল করলে। না এলে আমিই ফোন করতাম। সামনের মঙ্গলবার আমরা কৃষ্ণনগর যাচ্ছি সেটা তো আগেই কথা হয়ে গেছে। কিন্তু যাবার আগে দু’একটা কাজ সেরে নেওয়া দরকার। কী কাজ বলছি। দাঁড়াও দু’কাপ চায়ের কথা বলে আসি।’ রান্নার মাসিকে চায়ের ফরমাশ জানিয়ে আদিত্য তার কালো নোটবইটা নিয়ে ফিরে এল। নোটবইএর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা জায়গায় থেমে গিয়ে নিজের মনেই বলল, ‘হ্যাঁ, পাওয়া গেছে।’
সুভদ্র উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
‘দেখো, তুমি মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্রর মার্ডার কেসটার ব্যাপারে আমাকে যা যা বলেছিলে আমি সব নোট করে রেখেছি। নোটে দেখতে পাচ্ছি লেখা আছে, পার্থ মিত্র সেন বেকারির সোল ডিট্রিবিউটার ছিল এবং সেই সুবাদে সেন বেকারির ওই ফ্ল্যাটটাতে থাকত। কিন্তু মৃত্তিকা কী করত সেটা কোথাও লেখা নেই। তুমি এটা বলনি আর আমিও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। মৃত্তিকা মিত্রর ব্যাকগ্রাউন্ডটা জানা জরুরি। জানো তো একটা কথা আছে, খুনিকে ধরতে গেলে যে খুন হয়েছে তার বিষয়ে ভাল করে জানা দরকার। মৃত্তিকা কি কিছু করত, নাকি পিয়োর হোমমেকার ?”
‘এটা আমার বলা উচিত ছিল। কোনও কারণে মিস হয়ে গেছে। মৃত্তিকা মিত্র একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করত। অ্যাকাউন্টস-এর কাজ, মানে কম্পিউটারে হিসেবপত্তর রাখা, ব্যাঙ্কে যাওয়া, কর্তাদের মিটিং-এর আগে হিসেবপত্র তৈরি করা, এইসব।’
‘তুমি এটা জানলে কী করে?’
‘প্রথমে আমিই তো কেসটা ইনভেস্টিগেট করছিলাম। আমি মৃত্তিকা মিত্রর কাজের জায়গায় খোঁজ নিয়েছিলাম।’
‘আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ, তারপর বল।’
‘তারপর আর বলার কিছু নেই। মৃত্তিকা মিত্র সম্বন্ধে এইটুকুই জানতে পেরেছিলাম।’ ‘মৃত্তিকার কম্পানিটার নাম কী ছিল?’
‘নামটা ঠিক মনে নেই। খাতায় লেখা আছে। আমি বাড়ি ফিরে আপনাকে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিচ্ছি। তবে এটা মনে আছে অফিসটা ক্যামাক স্ট্রিটে।’
‘ঠিক আছে। নামটা তুমি পরে মেসেজ করে দিও। এবার বল, যে দু’জনকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে, মানে কানু আর দীনবন্ধু মাহাতো, তাদের কাছ থেকে কি আর কিছু জানা গেল ? ‘
‘নাঃ। বিশেষ কিছুই আর জানা যায়নি।’ সুভদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আমরা ভেবেছিলাম কানুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে এলে তাকে ফলো করে দেখা হবে সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু কানু পোড় খাওয়া ক্রিমিনাল। সে জানে তার কোনও ভিজিটার এলে পুলিশ সেই ভিজিটারকে ফলো করতে পারে। তাই সে কারও সঙ্গে দেখা করছে না। এদিকে কানু কিন্তু বেল চাইছে না। যদি ও বেল চাইত আমরা খুব একটা অপোজ করতাম না। মানে একটা আজেবাজে উকিল দাঁড় করাতাম যাতে ও বেলটা পেয়ে যায়। তারপর বেল নিয়ে ও কোথায় যায় ওকে ফলো করে দেখতাম। কিন্তু ও বেলও চাইছে না। আমরা তো নিজের থেকে ওকে ছেড়ে দিতে পারি না। ছেড়ে দিলে ও যদি বেপাত্তা হয়ে যায় তা হলে কেলেঙ্কারি হবে।’
‘কিন্তু আমি শিয়োর ওর দোসর যে মহিলা রয়েছে বলে আমরা ভাবছি, ও তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করবে। তুমি তো জান, জেল হাজতে টাকা দিলে সবই পাওয়া যায়। হাজতের মধ্যে কিছুক্ষণের জন্যে একটা মোবাইল ফোন পাওয়া খুব শক্ত নয়। খোঁজ নিয়ে দেখ কানু এই রকম কোনও মোবাইল হাতে পেয়েছে কিনা।’
‘পায়নি দাদা। আমরা জানি পায়নি। কারণ ওর ওপর সব সময় কড়া নজর রাখা হয়েছে। ও মোবাইলে ফোন করবে কখন?’
‘শোন । তিনটে কাজ তোমাদের করতে হবে। এক, কানুর ওপর নজরদারিটা শিথিল করতে হবে। দুই, হাজতে তোমাদের একটা লোক ঢোকাতে হবে যে কানুকে তার মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করতে দেবে। তিন, কানু যাকে ফোন করবে তার নম্বরটা ট্রেস করতে হবে। দ্যাখো, কানু ফাঁদে পা দেয় কিনা।’
‘বুঝেছি দাদা। চেষ্টা করে দেখছি।’
‘আচ্ছা, আর আমাদের দীনবন্ধু মাহাতোর কী খবর?’
‘লোকটা অতিশয় ধূর্ত। প্রথম দিন যা বলেছিল সেটাতেই স্টিক করে আছে। খুব অল্প লোকই এতদিন ধরে ইন্টারোগেশনের চাপ নিয়ে তার বয়ানে স্টিক করে থাকতে পারে। একটা ব্যাপার থেকে মনে হচ্ছে লোকটা কিছু একটা লুকোচ্ছে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, দীর্ঘ দিন ধরে একই প্রশ্ন করে গেলে কোনও নির্দোষ লোক ছোটখাট ডিটেলের ব্যাপারে নিজেকে কনট্রাডিক্ট করতে বাধ্য। এই লোকটা কিন্তু একবারের জন্যেও নিজেকে কনট্রাডিক্ট করেনি। তাই মনে হয় ও খুব কনশাসলি মিথ্যে বলছে। যেন একটা পার্ট মুখস্থ করে এসে আওড়ে যাচ্ছে।’
‘আর ওই বাড়িটাতেও নিশ্চয় আর কেউ আসেনি?”
‘নাঃ। কেউ আসেনি। আমরা সারভিলেন্স বজায় রেখেছি। তবে একটা পজিটিভ ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আমাদের অনেক ইনফর্মার আছে তো? ঐ ছবিগুলো দেখে একজন ইনফর্মারকে নাকি কেউ বলেছে সে ওই মেয়েটিকে চেনে। আমি এই লোকটার সঙ্গে এখনও কথা বলতে পারিনি। আমাদের ইনফর্মারকে বলেছি তাকে লালবাজারে আমার কাছে নিয়ে আসতে। আমাদের ইনফর্মার বলেছে কাল দুপুরে লোকটাকে নিয়ে আসবে। আপনি কি তখন থাকতে পারবেন ?
‘নিশ্চয় পারব। অবশ্যই পারব।’
আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে সুভদ্র যখন চলে গেল কেয়া তখনও ফেরেনি। রাত্তিরে সুভদ্রর কাছ থেকে মেসেজ পেল আদিত্য। মৃত্তিকা যে কম্পানিতে কাজ করত তার নাম গ্লোবাল ট্রেডিং কম্পানি ।
যে লোকটা সুভদ্রর উল্টোদিকে বসে আছে তার তামাটে রঙ, পাকানো শরীর, হাড়ালো মুখ, শিরা ওঠা হাত। উচ্চতা বেশি নয়, সাড়ে পাঁচ ফুটের কমই হবে। শরীরটা এক সময় নিয়মে থাকত, এখন পেশিগুলো কিছুটা শিথিল হয়ে গেছে। মুখে অত্যাচারের ছাপ স্পষ্ট। লোকটার বয়েস এবং পেশা কী হতে পারে আদিত্য আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল। আদিত্যর মনে হল, লোকটার বয়েস পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন। পেশায় নাবিক? ট্র্যাপিজের খেলোয়াড়? প্রাক্তন হকি বা ফুটবল প্লেয়ার? লোকটার মধ্যে সম্ভবত একটা বিদেশি রক্তও আছে। আদিত্যর শেষ অনুমানটা যে ঠিক সেটা অচিরেই বোঝা গেল।
‘আপনার নাম?’ সুভদ্র লোকটাকে জিজ্ঞেস করল।
‘সাইমন রবার্ট।’ লোকটার বাংলায় সামান্য টান আছে।
‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান? ‘
‘হ্যাঁ। তবে বর্ন অ্যান্ড এট আপ ইন ক্যালকাটা।’
‘থাকেন কোথায় ?
‘কিডেরপুর। ফ্যানসি মার্কেটের কাছে।’
‘কী করেন?”
‘আগে রেসিং হর্স-এর জকি ছিলাম। এখন অড জবস করি।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ। রেসিং হর্সের জকি। এটা আদিত্যর মাথায় আসেনি। চেহারার সঙ্গে মিলছে। এরা খুব লম্বা হয় না। ওজনটাও কম রাখতে হয়। কিন্তু টাফ, মাসকুলার হতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, জকি জীবন শেষ হবার পর লোকটা শরীরের ওপর নানারকম অত্যাচার করেছে।
‘অড জবস মানে কী ধরনের কাজ?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘টলিগঞ্জে একটা হর্স রাইডিং স্কুল আছে। আই টীচ রাইডিং দেয়ার। ইন দ্য ইভিনিং আই ওয়ার্ক ইন আ নাইট ক্লাব।’
‘হোয়াট সর্ট অফ ওয়ার্ক?’
‘আই ওয়ার্ক অ্যাজ এ সিকিউরিটি গার্ড।’
‘সিকিউরিটি গার্ড না বাউন্সার?’
‘বিট অফ বোথ।’
“এতে চলে যায় ?’
‘ভাল চলে না। দ্যাটস দ্য রিসন আইম হিয়ার। আই এক্সপেক্ট টু গেট সাম মানি ফর দ্য ইনফরমেশন আইম গনা প্রোভাইড।’
‘আপনি বলছেন আপনি ছবির ওই মেয়েটিকে চেনেন। আপনি কী করে মেয়েটির আইডেন্টিটি নিয়ে শিয়োর হচ্ছেন?’ সুভদ্র সরাসরি কাজের কথায় এল।
‘লুক স্যার। দ্য গার্ল ইন দ্য পিকচার ইজ শবনম, হু ওয়াজ কনসিডার্ড টু বি দ্য পর্ন কুইন অফ ক্যালকাটা টেন ইয়ারস ব্যাক।’
‘পর্ন কুইন? শবনম?’ সুভদ্র খবরটা হজম করার চেষ্টা করছে।
‘বাট হাউ ক্যান ইউ বি শিওর ইটস হার?’ আদিত্য এখনও ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।
‘আই অ্যাম শিয়োর বিকজ আই ওয়াজ হার কো অ্যাক্টর ইন আ নাম্বার অফ স্ট্যাগ ফিল্মস, প্রোভাইডেড অফ কোর্স ইউ কল দ্যাট অ্যাক্টিং।’ সাইমন রবার্ট মিটি মিটি হাসছে।
আদিত্যর মনে হল লোকটার নির্লজ্জতার মধ্যে একটা নিরাসক্তি আছে। ঘরে স্তব্ধতা। আদিত্য এবং সুভদ্র দু’জনেই নিজের মতো করে সাইমন রবার্টকে বোঝার চেষ্টা করছে।
কিছুক্ষণ পরে স্তব্ধতা ভেঙে সুভদ্র বলল, “তা হলে আপনি বলতে চাইছেন যে এই মহিলার সঙ্গে আপনি একাধিক পর্ন ফিল্ম-এ কাজ করেছেন এবং তাই আপনি জোর দিয়ে বলতে পারছেন যে এই মহিলার নাম শবনম।’
‘দ্যাটস কারেক্ট। আমি ঠিক এটাই বলতে চাইছি। আমি জানি এটা শবনমের ছবি বিকজ আই নো হার বডি লাইক দ্য ব্যাক অফ মাই হ্যান্ড।’
‘আপনি তো বললেন আপনি ঘোড়দৌড়ের জকি ছিলেন। হঠাৎ এইসব আর্ট-কালচারের লাইনে এলেন কী করে?।’ আদিত্য হালকা গলায় বলল।
‘ইটস আ লঙ স্টোরি। কিন্তু আমাকে বলতে হবে কারণ পুরোটা না বললে আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। আর আমাকে বিশ্বাস না করলে আপনারা আমাকে আমার ইনফরমেশনের জন্যে টাকাও দেবেন না। অ্যান্ড আই রিয়ালি নিড দ্য মানি।’
সাইমন রবার্ট কিছুক্ষণ থেমে দম নিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘দেখুন আমার একটা পুলিস রেকর্ড আছে। তাই কিছু মিথ্যা বললে বা কিছু চেপে গেলে আপনারা ঠিক ধরে ফেলবেন। দেয়ারফোর আই শ্যাল টেল দ্য ট্রুথ অ্যাণ্ড নাথিং বাট দ্য ট্রুথ।
‘আমি প্রায় কুড়ি বছর ধরে ক্যালকাটা রেস কোর্সে জকির কাজ করেছি। ম্যাডরাস, ব্যাঙ্গালোর, পুনে, উটি এইসব জায়গাতেও কাজ করেছি, কিন্তু আই ওয়াজ মেনলি স্টেশনড ইন ক্যালকাটা। অ্যান্ড আই ওয়াজ আ গুড জকি। আই ওয়াজ মেকিং এনাফ মানি ফর আ ডিসেন্ট লিভিং বাট আনফরচুনেটলি অবসেসিভ গ্যাম্বলিং রুইন্ড মি। আমার বাজারে প্রচুর ধার হয়ে গেল। ধার শোধ দিতে গিয়ে আমি ঘুষ নিতে শুরু করলাম। ঘুষ নিয়ে কয়েকটা শিয়োর রেস হেরে গেলাম। এবং ফাইনালি আমি ধরা পড়ে গেলাম। কট রেড হ্যান্ডেড। কয়েক বছরের জেল হয়ে গেল। মোর ইম্পরটেন্ট, মাই কেরিয়ার অ্যাজ আ জকি ওয়াজ ফিনিসড। জেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম সারভাইভাল ওয়াজ ভেরি ডিফিকাল্ট। এই সময় একজন আমাকে ব্লু ফিল্ম-এ নিয়ে আসে।’
যে ইনফর্মার সাইমনকে নিয়ে এসেছিল সে ঘরে ঢুকেছে। এতক্ষণ সে বাইরে বসেছিল।
‘ওর কি অনেক সময় লাগবে? আমি তা হলে এগোচ্ছি। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলে নেব।’ ইনফর্মারটি সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল।
আদিত্য আন্দাজ করল সাইমনকে ধরে আনার জন্য ইনফর্মারটির কিছু অর্থপ্রাপ্তি আশা করছে যেটা নিয়ে সে পরে সুভদ্রর সঙ্গে কথা বলতে চায় ।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তুমি এখন যাও। পরে যোগাযোগ কোরো। আর শোনো, দরজায় নক না করে এইভাবে কখনও আমার ঘরে ঢুকবে না। যাও, এখন যাও।’ সুভদ্র বিরক্তিটা লুকোতে চাইছে না। ‘আপনি বলুন।” শেষের কথাগুলো সাইমনের প্রতি।
‘আই ওয়াজ মরালি ডেড আফটার আই স্টার্টেড মাই নিউ জব। আই ওয়ার্কড লাইক আ ডেড ম্যান। অ্যারাউন্ড দ্যাট টাইম আই হিট দ্য বটল। অদ্ভুত ব্যাপার হল, আই ওয়াজ ভেরি সাকসেসফুল ইন মাই নিউ কেরিয়ার। আই হ্যাড আ গুড ফিজিক অ্যান্ড মোর ইম্পরট্যান্ট, আই হ্যাড অ্যান অফুল লট অফ স্ট্যামিনা হুইচ ইজ এসেনশিয়াল ইন দ্যাট কাইন্ড অফ ট্রেড।’
‘সেই সময় কি আপনার সঙ্গে শবনম বলে মেয়েটির আলাপ হয়?’ আদিত্য কাজের কথায় আসতে চাইছিল। এই লোকটির জীবনকাহিনী শুনতে তার আর ভাল লাগছে না।
‘হ্যাঁ। এই সময়।’
‘এটা কতদিন আগে হবে?’ সুভদ্র আবার ইন্টারোগেশনের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। ‘ধরুন দশ বছর। বাট আই কান্ট বি এক্স্যাক্ট।’
‘এই মেয়েটির বিষয়ে আপনি কতটুকু জেনেছিলেন?’
‘ভেরি লিটল। শি নেভার ওপেনড আপ। নেভার টকড অ্যাবাউট হারসেলফ।
উই হ্যাড আ পিওরলি প্রফেশানাল রিলেশানশিপ।’
“ও কোথায় থাকে, ওর বাড়িতে কে আছে এসব কোনওদিন বলেনি?’
‘না। কিচ্ছু বলেনি। তবে আই হ্যাড আ ফিলিং দ্যাট শি হ্যাড আ স্টেডি বয়ফ্রেন্ড। মাঝে মাঝে ওর বয়ফ্রেন্ডের ফোন আসত।
‘আপনি কতদিন ওই কাজটা করেছিলেন ?”
‘চার বছর। দেন আই লস্ট মাই স্ট্যামিনা অ্যান্ড বিকেম ইউজলেস টু দ্য ইন্ডাসট্রি। ইট ওয়াজ বিকজ অফ এক্সেসিভ ড্রিকিং। আই হ্যাড টু কুইট।’
‘শবনম বলে মেয়েটি কি তখনও ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল?’
‘না, না। আমি ছেড়ে দেবার কিছু দিন আগে ভেরি মিস্টিরিয়াসলি শি জাস্ট ডিস্যাপিয়ার্ড। নো ওয়ান কুড ট্রেস হার। শি জাস্ট ভ্যানিসড।’
‘এটা কত বছর আগে হবে?’
‘লেট মি সি। রাফলি সাত-আট বছর আগে শবনম ডিস্যাপিয়ার্ড। নো ওয়ান হ্যাজ সিন হার ইন আ স্ট্যাগ ফিল্ম এভার সিন্স।’
‘আচ্ছা আপনি কখনও রাজারহাটে কোনও বাড়িতে শুটিং করেছেন?’ আদিত্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করল।
প্রশ্নটা শুনে সাইমন রবার্ট কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “কোথায় কোথায় শুটিং করেছি সেটা নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। এটা প্রোফেশানাল সিকরেট।’
একটু পরে সাইমন রবার্ট যখন বিদায় নিল তখন রোদ্দুর পড়ে এসেছে।
(৩)
কলকাতায় অনেক পুরোনো রাস্তার নতুন নামকরণ হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিন্তু কলকাতাবাসী নতুন নামগুলো মনে রাখেনি। কে আর মনে রেখেছে সাদার্ন অ্যাভিনিউ-এর নাম এখন মেঘনাদ সাহা সরণী, পাম অ্যাভিনিউ-এর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সরণী, পার্ক স্ট্রিটের নাম মাদার টেরেসা সরণী? আবার কিছু কিছু রাস্তা আছে যাদের নতুন নাম জনমানসে চালু হয়ে গেছে। যেমন আপার সারকুলার রোডের বদলে এপিসি রায় রোড এবং লোয়ার সারকুলার রোডের বদলে এজেসি বোস রোড নাম দুটো আজকাল ভালই চলছে। এজেসি বোস রোড থেকে বেরিয়েছে ক্যামাক স্ট্রিট। দু’টি রাস্তার সংযোগস্থলে একটি ফলক রয়েছে যেখানে ক্যামাক স্ট্রিটকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সরণী বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু এই নতুন নামটা আদৌ কি কেউ ব্যবহার করে? কেন একটা রাস্তার ক্ষেত্রে নতুন নামটা বেশ চালু হয়ে গেল কিন্তু তার সংলগ্ন আর একটা রাস্তার ক্ষেত্রে হল না, আদিত্য মনে মনে এই দুরূহ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিল। তাকে যেতে হবে ক্যামাক স্ট্রিটে শ্রীলেখা টাওয়ার বলে একটা বাড়ির পাঁচতলায়, গ্লোবাল ট্রেডিং কম্পানির অফিসে। সঙ্গে সুভদ্রও আছে।
দিন এখন বেশ বড়। ফলে নগরপালের নির্দেশে রাস্তার বাতিস্তম্ভগুলো জ্বলে উঠলেও সূর্যের আলো নিবে আসেনি। ক্যামাক স্ট্রিটের একমুখী ট্র্যাফিক পার্ক স্ট্রিটের দিক থেকে আসছে, ফলে এজেসি বোস রোড দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢোকা যাবে না। এটা যে সুভদ্রর ড্রাইভারের অজানা ছিল তা নয়। কিন্তু এজেসি বোস রোডে আসতেই হতো কারণ সেখানে পুলিশের দপ্তরে সুভদ্রর একটা কাজ ছিল। আদিত্য আর সুভদ্র ঠিক করেছে পুলিশের দপ্তরে গাড়িটা রেখে শ্রীলেখা টাওয়ার অব্দি হেঁটে যাবে।
এজেন্সির মোড় থেকে শ্রীলেখা টাওয়ার মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। বাড়িটা আটতলা। একতলায় গাড়ি রাখার জায়গা, দোতলা থেকে আসল বাড়ি শুরু হয়েছে। লিফটের পাশে নেমপ্লেটগুলো দেখে মনে হল এই বাড়িটাতে পাঁচমেশালি আপিস ছাড়াও কয়েক ঘর গেরস্থ বাস করে।
ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। সুভদ্রর মন খচ খচ করছিল, এত দেরিতে গিয়ে গ্লোবাল ট্রডিং-এর অফিসে কাউকে পাওয়া যাবে তো? আদিত্য তাকে বারবার আশ্বস্ত করেছে, সরকারি দপ্তর হলে কাউকে পাওয়া যেত না। কিন্তু প্রাইভেট কম্পানিরা অত তাড়াতাড়ি কর্মচারিদের ছুটি দেয় না। মালিকও অনেকক্ষণ অফিসে থাকে।
মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে অবশ্য পাওয়া গেল না। তিনি আউট অফ টাউন, কাজে জয়পুর গেছেন। চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার স্বরূপ মহাপাত্র অফিসের চার্জে। অতএব তার সঙ্গেই কথা বলতে হবে। ভদ্রলোক পুলিশ দেখে বেশ ঘাবড়েছেন। ‘কী ব্যাপার বলুন তো? কোনও গণ্ডগোল হয়েছে?’ মহাপাত্র সাহেব চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। মনে হয় ওড়িয়া নন, মেদিনীপুরের বাঙালি। তবে পুলিশ দেখে গলা কাঁপছে।
‘না, না কোনও গণ্ডগোল হয়নি। আপনার টেনশানের কোনও কারণ নেই। আমরা কিছু ইনফরমেশানের জন্যে এসেছি। কী ইনফরমেশান পরে বলছি। তার আগে বলুন আপনি কত বছর কাজ করছেন এখানে?’ সুভদ্র ঠাণ্ডা গলায় বলল।
‘সামনের জুন মাসে কুড়ি বছর পুরো হবে।’
‘তার আগে কোথাও কাজ করতেন?’
‘একটা অডিট ফার্ম-এ আর্টিকল ক্লার্ক ছিলাম। যেটা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হবার জন্য ম্যান্ডেটারি।’
‘এখানে জয়েন করার পর চার্টার্ড পাশ করলেন?’
‘হ্যাঁ। তাও অনেকদিন হয়ে গেল।’
‘অন্য কোথাও যাবার কথা ভাবেননি?’
‘আসলে এটা তো ছোট একটা কম্পানি। আমি এর সবটাই প্রায় জানি। একটা মায়া পড়ে গেছে। ভয় হয়, বড় কম্পানিতে গেলে হয়ত হারিয়ে যাব। কম্পানির মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালাও খুব ভাল মানুষ। এখানে শান্তিতে আছি। সব থেকে বড় কথা, আমার অ্যামবিশানটাই কম।’
‘আমাদের এখানে আসার কারণটা এবার বলি। কয়েক বছর আগে মৃত্তিকা মিত্র এবং তার স্বামী পার্থ মিত্র তাদের ফ্ল্যাটে খুন হন। মৃত্তিকা আপনাদের কম্পানিতে চাকরি করতেন। আমরা মৃত্তিকার সম্বন্ধে একটু খোঁজ-খবর নিতে এসেছি।’
‘কিন্তু মৃত্তিকার ব্যাপারটা তো নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। খুনি ধরাও পড়েছিল। এতদিন পরে আবার কী হল?’
‘যাকে খুনি বলে ধরা হয়েছিল সে হাইকোর্টে বেকসুর খালাস হয়ে গেছে। পুলিশ এবার ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। অর্থাৎ কেসটা রিওপেনড হয়েছে। আমরা তাই আবার নতুন করে এভিডেন্স সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’
স্বরূপ মহাপাত্র চুপ করে আছে। বোধহয় কী বলবে বুঝতে পারছে না। সুভদ্র বলল, ‘আমরা আপনাকে মৃত্তিকা মিত্রকে নিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করব। প্রথম প্রশ্ন, মৃত্তিকা এখানে কী ধরনের কাজ করতেন? ‘
‘অ্যাকাউন্টস-এর কাজ। আমাদের ছোট কম্পানি বলে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই করতে হতো। ভাউচার এনট্রি থেকে ব্যালেন্স শিট বানানো, ব্যাঙ্ক রিকনসিলিয়েশান, সবই অল্পবিস্তর করতে হতো। মৃত্তিকা স্টেটমেন্টগুলো তৈরি করত, আমি পরে সেগুলো চেক করে ভেরিফাই করতাম। তবে একটা ব্যাপার বলতেই হবে। মৃত্তিকার কমপিউটার স্কিলস ছিল অসাধারণ। মূলত ওর কমপিউটার নলেজের ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের অ্যাকাউন্টসটা প্রায় পুরোপুরি কমপিউটারাইজ করে ফেলেছিলাম।’
‘মৃত্তিকা মিত্র কতদিন আপনাদের কম্পানিতে কাজ করেছিল?’
‘খুব বেশি দিন নয়। বছর তিনেক বছর হবে। তার মধ্যেই ও কিন্তু কাজে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল।’
‘ওকে কি কখনও ব্যাঙ্কে যেতে হতো?’
‘হ্যাঁ। মাঝে মাঝে যেতে হতো। আমাদের কয়েকটা ব্যাঙ্ক লোন নেওয়া ছিল। সেগুলোর ব্যাপারে কথা বলতে যেতে হতো।
‘আপনাদের মেন ব্যাঙ্কার কে?’ আদিত্যর প্রশ্ন।
‘আমাদের দুটো বড় লোন আছে। দুটোই স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে। আর পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে একটা ওভারড্রাফট ফেসিলিটি আছে। এই দুটোই মেন ব্যাঙ্ক। এছাড়া আরও কয়েকটা ছোটখাট অ্যাকাউন্ট আছে।’
‘আপনাদের কি সাউথ এশিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কে কোনও অ্যাকাউন্ট আছে? কেন জিজ্ঞেস করছি, বলি। অশনি রায়, যাকে মৃত্তিকার মার্ডার চার্জে ধরা হয়েছিল, এই ব্যাঙ্কটিতে কাজ করতেন। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি, ব্যাঙ্কের কাজের সূত্রে অশনি রায়ের সঙ্গে মৃত্তিকা মিত্রর কখনও আলাপ হয়েছিল কিনা।’ আদিত্য প্রশ্নটা করে স্বরূপ মহাপাত্রর মুখের অভিব্যক্তিটা লক্ষ করছিল। স্বরূপ মহাপাত্র কিছু একটা ভাবছে।
‘আমার যতদূর মনে পড়ছে সাউথ এশিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের সল্ট লেক ব্রাঞ্চে আমাদের একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। কিন্তু সেটা অনেক দিন আগে ক্লোজ করে দেওয়া হয়েছে।’
‘কতদিন আগে অ্যাকাউন্টটা ক্লোজ করা হয়েছে, বলতে পারবেন?’
‘অফ হ্যান্ড পারব না। পুরোনো রেকর্ড দেখে বলতে হবে।’
“ঠিক আছে। আপনাকে দু’দিন পরে ফোন করে জেনে নেব। আচ্ছা, আপনাদের মেন ব্যবসাটা কীসের?”
‘আমরা গারমেন্টস এক্সপোর্ট করি। মেনলি শাড়ি। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে এথনিক শাড়ি প্রোকিওর করে আমরা ইউ এস এ-তে এক্সপোর্ট করি।’
‘আপনাদের গত পাঁচ-দশ বছরের ব্যালেন্স শিট পাওয়া যাবে?’
‘আমাদের ব্যালেন্স শিট? সেটা কেন আপনাদের দরকার হচ্ছে? আমাদের কম্পানি এর মধ্যে আসছে কোথায়? ইন এনি কেস, পুলিশ অথরিটির কাছ থেকে কোনও লিখিত অর্ডার ছাড়া আমি ব্যালেন্স শিট দিতে পারব না। আমাকে মাফ করবেন।’ ‘ঠিক আছে অর্ডার বার করে পাঠিয়ে দেব।’ সুভদ্র চোয়াল শক্ত করে বলল। ‘আচ্ছা, গারমেন্টস এক্সপোর্ট ছাড়া আপনাদের কি আর কোনও ব্যবসা আছে?’ ‘এই কম্পানির নেই। তবে মালিকের অন্য ব্যবসা আছে।’
‘কীসের ব্যবসা?’
‘আমি যতদূর জানি এনটারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে মুকেশজির বেশ কিছু ইনভেস্টমেন্ট আছে। বিশেষ করে বাংলা, ভোজপুরি এবং ওড়িয়া সিনেমায় ওঁর ইনভেস্টমেন্ট সিগনিফিকেন্ট। কিন্তু এর বেশি আমি কিছু জানি না।’
‘ঠিক আছে। এতেই হবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার আর একটা প্রশ্ন ছিল। ব্যক্তিগত প্রশ্ন। আমার এক বোনের বন্ধু এখানে কাজ করে, নাম মিতা অধিকারী বোধহয় কলকাতার বাইরে কোথাও পোস্টেড। ওর ফোন নম্বরটা আমার বোনের কাছে ছিল, কিন্তু কোনও কারণে হারিয়ে গেছে। আপনি কি ফোন নম্বরটা দিতে পারবেন? বোন চাইছিল।’
‘মিতা অধিকারী? সে তো জয়পুরে পোস্টেড। অনেকদিন আসেনি। আমার কাছে তো নম্বরটা নেই, তবে আমাদের পারসোনেল ডিপার্টমেন্টে পেয়ে যাবেন?’
‘মিতা অধিকারী শেষ কবে কলকাতায় এসেছিল?’
‘তা বছর দুয়েক তো হয়ে গেছে।
‘বছর দুয়েক? ঠিক আছে বোনকে বলব।’
পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের গজানন সাঁতরার কাছ থেকে মিতা অধিকারীর ফোন নম্বর পাওয়া গেল। আদিত্যর কাছে মিতা অধিকারীর যে নম্বরটা আছে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা নম্বর।
সাউথ এশিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক একটি বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থা। এদের হেড অফিস ম্যানিলায়। এক সময় এরা ভারতের বাজারটা ধরার জন্য বেশ মরিয়া হয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে একটার পর একটা শাখা খুলে যাচ্ছিল। কয়েক বছর হল এদের ব্যবসা-নীতি বদলেছে। ভারতে এরা এদের রিটেল ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। অনেকগুলো শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলি আছে তাতে মূলত ব্যাক-অফিসের কাজ হয়। যেমন, অন্য কোনও দেশে যে ধারের দরখাস্তগুলি এসেছে সেগুলিকে মূল্যায়ন করা হয়। আন্তর্জাতিক কেনাবেচার ওপরে যে ব্যাঙ্ক গ্যারেন্টি লাগে সেটা তৈরি করা হয় ৷ ম্যানিলা বা সিঙ্গাপুরের তুলনায় ভারতে এখনও শ্রমের দাম অনেক কম। ফলে এইসব কাজ এখানে করিয়ে নেওয়াটা লাভজনক। সল্ট লেকের শাখাটাতেও এখন এইসব কাজ হচ্ছে।
পুলিশ থেকে আসছি বলাতে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার দৃশ্যত অখুশি। মনে হল, পুলিশ আসতে পারে ম্যানেজার জানত। ম্যানেজারের নাম নিমগ্ন দাশগুপ্ত।
‘দেখুন, সম্প্রতি আমাদের ব্রাঞ্চ থেকে অনেকে ছাঁটাই হয়ে গেছে। কেউ কেউ আবার নিজের থেকেই ছেড়ে দিয়েছে। তাই আমরা গ্রসলি আন্ডারস্টাফড। আপনাদের বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।’ নিমগ্ন দাশগুপ্ত বিরক্ত মুখে বলল।
‘আমরা শুধু একটা অ্যাকাউন্ট সম্বন্ধে জানতে চাই। অ্যাকাউন্টটা কবে খোলা হয়েছিল, কবে বন্ধ হয়ে গেল, কীরকম ট্রানজ্যাকশান হতো অ্যাকাউন্টটাতে এইটুকু।’
‘হ্যাঁ, জানি। গ্লোবাল ট্রেডিং-এর অ্যাকাউন্টটা তো?’
‘হ্যাঁ, ওটাই। আপনি কী করে জানলেন?’ সুভদ্র অবাক।
‘আজ সকালে গ্লোবাল ট্রেডিং থেকে ফোন করে জানতে চাইছিল ওরা কবে অ্যাকাউন্টটা বন্ধ করেছিল। ওরা পুরোনো কাগজপত্র কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বলল, পুলিশ নাকি ওই অ্যাকাউন্টটা সম্বন্ধে জানতে চায়। তখনই মনে হচ্ছিল ওই অ্যাকাউন্টটা সম্বন্ধে জানার জন্য আমাদের ব্রাঞ্চেও পুলিশ আসতে পারে।’
‘বেশ। বুঝতে পারলাম। তা আপনারা কি ওই অ্যাকাউন্টটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন?’
‘দেখুন, এটা তো কারেন্টলি চালু অ্যাকাউন্ট নয়। তাই এখনকার কমপিউটারে ট্রানজাকশানগুলো থাকবে না। যে সব অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেছে আমরা সেই সব অ্যাকাউন্টের ট্রানজাকশানগুলো হার্ড ডিস্কে তুলে স্টোররুমে রেখে দিই। সেখানে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে ওটা কোন হার্ড ডিস্কে আছে। কাজটা বেশ লেবোরিয়াস। আর আমাদের স্টাফ শর্টেজ। খুব তাড়াতাড়ি আমরা ওই অ্যাকাউন্টটা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারব না। একটু সময় দিতে হবে। ‘কতটা সময়?’
‘এই ধরুন এক সপ্তাহ। রেকর্ডটা খুঁজে পেয়ে গেলে আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেব।’
‘ঠিক আছে তাই দেবেন।’ সুভদ্র খানিকটা হতাশ গলায় বলল।
‘আচ্ছা, আমি একটা অন্য প্রশ্নে আসছি।’ আদিত্য মৃদু গলায় বলল। ‘অশনি রায়কে কি আপনি চিনতেন? এই ব্রাঞ্চেই কাজ করতেন উনি।’
‘অশনি রায়? মানে যে মার্ডার চার্জে অ্যাকিউসড হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেই অশনি রায়।’
‘তার কথা এতদিন পরে কেন জানতে চাইছেন?’
‘আপনি হয়ত জানেন হাই কোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে অশনি ছাড়া পেয়ে গেছে। পুলিশ সম্ভবত ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। তাই কেসটা রিওপেনড হচ্ছে।’
‘আই সি। তা, গ্লোবাল ট্রেডিং-এর অ্যাকাউন্টটা সম্বন্ধেও কি সেই কানেকশানে জানতে চাইছেন? যদিও ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমি কানেকশানটা ঠিক ধরতে পারছি না ।’
‘আছে একটা কানেকশন। সেটা যথা সময়ে রিভিলড হবে। আপনি এখন অশনি সম্বন্ধে যদি কিছু জানেন সেটা বলুন।’ আদিত্য সাবধানে বলল।
‘দেখুন অশনি আর আমি একই বছর জুনিয়ার ম্যানেজার হিসেবে এই ব্যাঙ্ক জয়েন করি। দু’জনের একই ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড। আমরা দু’জনেই তখন সদ্য বিজনেস স্কুল থেকে বেরিয়েছি। তার আগে দু’জনেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছি। যদিও আলাদা আলাদা জায়গা থেকে। আমাদের প্রথম ট্রেনিং ম্যানিলায় হয়েছিল। ওখানেই অশনির সঙ্গে প্রথম আলাপ এবং কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বেশ বন্ধু হয়ে গেলাম। ট্রেনিং-এর পরে অশনি সল্ট লেকের এই ব্রাঞ্চে পোস্টিং পেল, আর আমি পোস্টিং পেলাম বালিগঞ্জে। অনেক সময় মিটিং থাকলে দু’জনকেই বিবাদী বাগে হেড অফিসে যেতে হতো। তখন দেখা হতো ওর সঙ্গে। তাছাড়া অফিস আওয়ারের পরেও দেখা হতো। রাত্তির অব্দি আড্ডা দিতাম। আমরা কেউই তখনও বিয়ে করিনি। অশনি ওর বাবা-মার সঙ্গে থাকত। ওর একজন স্টেডি গার্ল ফ্রেন্ড ছিল। তার কথা ও খুব বলত। আমি একেবারেই সিঙ্গল। বাবা-মাও মারা গেছে। দাদারা নর্থ বেঙ্গলে থাকে। ইন শর্ট, অশনির কম্পানিটা আমার খুব ভাল লাগত। কয়েকবার আমরা এক সঙ্গে বেড়াতেও গেছি। একবার গোয়া, একবার কেরালা, দু’বার দার্জিলিং।’ নিমগ্ন দাশগুপ্ত পুরোনো দিনের স্মৃতিতে নিমগ্ন হয়ে গেছে।
‘মানুষ হিসেবে অশনিকে আপনার কেমন মনে হয়েছিল? মানে অশনি সম্বন্ধে আপনার বেসিক ইম্প্রেশানটা জানতে চাইছি।’
‘খুব ইমোশানাল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রবল বুদ্ধিমান। ভেরি কুইক থিংকার। তাই ব্যাঙ্কেও খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করছিল। ওর মেন প্রবলেম ছিল ওর গার্লফ্রেন্ড অন্বেষা ৷ আমি তাকে কখনও মিট করিনি, কিন্তু অশনির কাছে যা গল্প শুনতাম তাতে মনে হত মেয়েটি অসম্ভব অ্যামবিশাস এবং ডিমান্ডিং। মেয়েটির জন্য অশনি যা এক্সপেন্সিভ গিফট কিনত, আমি অবাক হয়ে ভাবতাম এত টাকা ও পায় কোথা থেকে? তারপর ভাবতাম, হয়ত বাবার কাছ থেকে পায়। ওর বাবা তো বিখ্যাত ডাক্তার। আমার মনে হতো, এই মেয়েকে বিয়ে করলে অশনি বিপদে পড়বে। মুখে কিছু বলিনি। যাই হোক, খুব কুইক সাকসেশনে অশনির দুটো মিসহ্যাপ হয়ে গেল। ওর মা মারা গেলেন এবং তার কয়েক বছর পরেই অন্বেষা আর একজনকে বিয়ে করে অ্যামেরিকা চলে গেল। মাস তিনেক হি ওয়াজ ইন এ মেস। তারপর ও ধীরে ধীরে রিকভার করছিল। কিন্তু ওই দু’টি দুর্ঘটনার পরে হি ওয়াজ এ চেঞ্জড ম্যান। মানে, ও অনেক বেশি সিনিকাল হয়ে গিয়েছিল।’
‘আচ্ছা অশনি রায়ের যে আরেকটা অ্যাফেয়ার হয়েছিল এটা কি ও আপনাকে গল্প করেছিল?’
‘বলেছিল ওর আরেকটা সম্পর্ক হয়েছে। কিন্তু ডিটেলটা, মানে কার সঙ্গে সম্পর্ক, কীভাবে হলো সেসব কিছু খুলে বলেনি। আমিও কখনও জোর করিনি। ভেবেছিলাম, সময় হলে ও নিজের থেকেই সব বলবে। কিন্তু তার আগেই এই ভয়ানক ঘটনাটা ঘটে গেল।’
‘জেল থেকে বেরোনোর পরে কি অশনি আপনার সঙ্গে দেখা করেছিল?’ ‘না, করেনি। আমি দু’একবার ফোন করে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ও ডিসকারেজ করেছিল। বলেছিল, ও এখনও একটা ট্রমার মধ্যে আছে। একটু স্বাভাবিক হলে দেখা করবে।’
‘আচ্ছা, মৃত্তিকা মিত্র, মানে যিনি খুন হয়েছিলেন, তাকে কি আপনি কখনও আপনাদের ব্যাঙ্কে আসতে দেখেছেন? আসলে, মৃত্তিকা গ্লোবাল ট্রেডিং-এ কাজ করত।’
‘আই সি! এখন আমি কানেকশানটা বুঝতে পারছি। আমি মৃত্তিকা মিত্ৰকে কখনও দেখিনি। দেখার কথাও নয়, কারণ আমি তখন এই ব্রাঞ্চে ছিলাম না।’
‘যারা তখন ছিল তারা কি কেউ বলতে পারবে?’
‘যারা তখন এই ব্রাঞ্চে ছিল তারা কেউই আর নেই। আমাদের হিউজ লে অফ হয়েছে। এখানকার চাকরি ছেড়ে কে কোথায় গেছে বলা শক্ত। হয়ত, দু’একজনকে পাওয়া যেতেও পারে যারা এখনও এই ব্যাঙ্কে কাজ করছে তবে অন্য ব্রাঞ্চে আছে। তেমন কেউ সত্যি আছে কিনা একটু চেষ্টা করলে জানা যাবে। আমাকে একটু সময় দিন।’
সাউথ এশিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আদিত্য সুভদ্রকে বলল, ‘রবিবার উলুবেড়িয়া যাচ্ছি তো? তার আগে আমি দু’দিন বাড়িতে রেস্ট নেব।’
(৪)
গুগল ম্যাপ বলছে কলকাতা থেকে উলুবেড়িয়ার দূরত্ব ৪২.৬ কিমি, গাড়ি করে গেলে পৌঁছতে লাগবে এক ঘন্টা আঠেরো মিনিট। রবিবার বলে আদিত্য ভাবছিল আরও তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যাবে। বস্তুত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো দূরের কথা, উলুবেড়িয়া পৌঁছতে আড়াই ঘন্টারও বেশি সময় লেগে গেল। উলুবেড়িয়া থেকে আর একটু পশ্চিমে গেলে গঙ্গা, উলুবেড়িয়া কালীবাড়ির ঘাট। তার কিছু দক্ষিণে, গঙ্গার ধারে, মাতাজির আশ্রম, আদিত্যদের গন্তব্যস্থল।
আদিত্যর ঘনঘন বাইরে যাওয়া নিয়ে কেয়া খুব চটে ছিল। তাকে এই শর্তে ঠাণ্ডা করা গেছে যে সেও আদিত্যদের সঙ্গে আসবে। সঙ্গে এলে সে আদিত্যর খাওয়া দাওয়া নিয়ে নজরদারি করতে পারবে। তাছাড়া গঙ্গা দেখবে। চাইলে এমনকি আশ্রমের রাধাগোবিন্দের মন্দিরে পুজোও দিতে পারে।
সকাল সাড়ে ছটায় বেরিয়েও তাড়াতাড়ি যে পৌঁছন গেল না তার কারণ একাধিক। প্রথমত, জায়গায় জায়গায় বাজার বসেছিল। এক-একটা বাজার পেরোতে দশ-পনের মিনিট লেগে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় কারণ, মাঝরাস্তায় টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছিল। সেটাকে বদলে স্টেপনি বসাতে আরও মিনিট পনের গেল।
কেয়ার খিদে পেয়েছে। সে ঘোষণা করেছে কিছু না খেয়ে সে এক পাও এগোতে পারবে না। ফলে সুভদ্রর ড্রাইভার আদিত্যদের তিনজনকে একটা কচুরি-সিঙাড়ার দোকানে নামিয়ে দিয়ে জখম টায়ারটা সারাতে গেছে। কোনও সুখাদ্য অবশ্য আদিত্যর কপালে নেই। কেয়া তার জন্যে টিপিন-কেরিয়ারে ওট সেদ্ধ, ডিমসেদ্ধর সাদা অংশ এবং পাকা পেঁপে নিয়ে এসেছে। এইসব স্বাস্থ্যকর খাদ্য খেতে খেতে আদিত্য আড়চোখে দেখছিল কেয়াদের জন্যে আলুর দম সহ দু’টি করে সদ্য ভর্জিত ভীমাকার রাধাবল্লভী টেবিলে হাজির।
আদিত্যকে না দিয়ে রাধাবল্লভী খেতে কেয়ার খারাপ লাগছিল। সে আদিত্যকে বলল, ‘রাগ কোরো না গো। তোমার শরীরটা নিয়ে চিন্তা করি বলেই তো এইসব খেতে দিই না। ডাক্তার আগে বলুক, তখন সব খাবে।’
আদিত্য ভাবল, এমন কোনও ডাক্তার কি আছে যে বলবে রাধাবল্লভী খাও, কিছু হবে না। মুখে বলল, “চিন্তা তো আমার শরীর নিয়ে নয়, তোমাদের শরীর নিয়ে। এই অখাদ্যগুলো কি না খেলেই নয়? তোমরাও তো বাড়ি থেকে ডিমসেদ্ধ আনতে পারতে।’
‘আমি তো আনতে চেয়েছিলাম। সুভদ্র বলল উলুবেড়িয়ার এই দোকানটার রাধাবল্লভী নাকি জগদ্বিখ্যাত। কী সুভদ্র, বলনি?’
‘বলেছিলাম বৌদি। এটাও বলেছিলাম, আমি একা একা খেতে পারব না। দাদা না খেলেও আপনাকে খেতে হবে। তবে আমি বলি কি বৌদি একটা রাধাবল্লভী দাদাকে অ্যালাও করুন। একটা খেলে কী আর এমন ক্ষতি হবে? বরং দাদার মেজাজটা খুশ থাকবে। কথায় কথায় আমাদের বকাবকি করবে না।’
সুভদ্র অনেক পেড়াপেড়ি করার পর কেয়া নিমরাজি হয়েছে। রাধাবল্লভী-আলুর দমে একটা কামড় দিয়েই আদিত্য বুঝল কেন একে জগদ্বিখ্যাত বলা হচ্ছে। সুভদ্রকে আদিত্যর যে ভাল লাগে তার কারণ আছে।
উলুবেড়িয়ার কালীবাড়িটা বেশ ঝকঝকে। দেখে মনে হয় নতুন। পাশে গঙ্গা। ঢেউ তুলে মাঝনদী দিয়ে স্টিমার যাচ্ছে। তার যাওয়ার ধাক্কায় নদীর পাড়ে নোঙর করা নৌকোগুলো লাফিয়ে উঠছে। হাতে কাজ না থাকলে এখানে আর একটু সময় কাটানো যেত। আদিত্যদের আরও দক্ষিণে যেতে হবে।
গঙ্গার ধারে কয়েকটা বেসরকারি পিকনিক স্পট। আজ রবিবার বলে প্রত্যেকটা ভর্তি। পিকনিক স্পটগুলোর বাইরে ঠাণ্ডা মফস্বল রবিবারের সকালে ঝিমোচ্ছে। আরও কিছুটা গিয়ে বড় রাস্তা থেকে বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ছোট একটা রাস্তায় ঢুকতে হল। ছোট রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক গিয়েই মাতাজির আশ্রম, একেবারে গঙ্গার ধারে।
সাদা বাড়ি, সামনে বাঁধানো উঠোন, এক ধারে পাতকুয়ো, পেয়ারা গাছ, নিমগাছ, বট-অশত্থ, তুলসীমঞ্চ। ঠাহর করে দেখলে সাদা বাড়িটার পেছনে তিনটে মন্দির চোখে পড়বে। এক ধারে শিব-দুর্গা, অন্য ধারে দক্ষিণা কালিকা, মধ্যিখানে রাধাগোবিন্দের মন্দির। যদিও রাধাগোবিন্দের মন্দিরটাই আশ্রমের মূল মন্দির তবু, অনায়াসে বলা যায়, এখানে বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে শাক্ত ধর্মের একটা উদার মিশ্রণ ঘটেছে।
এখানে সন্ন্যাসিনীদের বলা হয় তপস্বিনী। আশ্রমে দশ-বারোজন তপস্বিনী বাস করেন। সবার মাথার ওপর আছেন মাতাজি। তিনি এদের সকলের গুরু মা। এঁরা সকলে মিলে আশ্রমের ভেতরে অল্পবয়সী গরিব মেয়েদের জন্যে একটা ইস্কুল চালান।
একই সঙ্গে ইস্কুল সংলগ্ন একটা ঘরে একটু বেশি বয়সের মেয়েদের শেখান হয় হাতের কাজ। তাছাড়া আশ্রমের ভেতরে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় আছে। সেখানে বারোমাস একজন নার্স এবং একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারকে পাওয়া যায়। এর ওপরে সপ্তাহে দু’দিন বাইরে থেকে অ্যালোপাথিক ডাক্তাররা এসে রুগি দেখে যান। আশ্রমের পেছনে একটা বাগান আছে। সেখানে শাক-সব্জি, ফল-পাঁকুড় ফলান হয়। ফলন এতটাই ভাল যে আশ্রমিকদের প্রয়োজন মিটে গিয়েও কিছু উদ্বৃত্ত থাকে। স্থানীয় বাজারে এই উদ্বৃত্ত শাক-সব্জি-ফলের খুব কদর।
এখানে তপস্বিনীদের সংসার-জীবন ভুলে গিয়ে সন্ন্যাস নিতে হয়। তাঁদের তখন নতুন নামকরণ হয় · ভক্তি, মুক্তি, দয়া, মমতা, ক্ষমা ইত্যাদি। নামকরণ করেন স্বয়ং মাতাজী। একবার নামকরণ হয়ে গেলে তপস্বিনী আর তার সংসার জীবনের নাম উচ্চারণ করতে পারেন না। আগের জীবনের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখতে পারেন না। এই একটা ব্যাপারে মাতাজি ভীষণ কড়া। তিনি বলেন, সংসারের সমস্ত বাধা-বন্ধন কাটিয়ে আসতে না পারলে তপস্বিনী হওয়া যায় না। তাই চট করে কাউকে তিনি আশ্রমে তপস্বিনী হিসেবে নিতে চান না। তপস্বিনী হতে গেলে অনেক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে হয়।
মাতাজির দর্শন পাবার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই আশ্রমে আসে। মাতাজি বলেন, কাউকে জাগতিক কিছু পাইয়ে দেবার ক্ষমতা তাঁর নেই। তিনি মানুষকে শুধু শান্তির সন্ধান দিতে পারেন। তিনি বলেন, মানুষের জীবনে দুঃখ-কষ্ট তো কম নেই। একমাত্র ধ্যানের মধ্যে দিয়েই সেই দুঃখ-কষ্টের উপসম হতে পারে। তাই তিনি মানুষকে ধ্যান করতে শেখান।
আশ্রম সম্বন্ধে এইসব খবর যিনি দিচ্ছিলেন তিনি একজন অল্পবয়সী তপস্বিনী, নাম স্নেহ। তার কাছে জানা গেল আশ্রমের জন্য কিছু দরকারি জিনিসপত্র কিনতে করুণাদিদি উলুবেড়িয়া বাজারে গেছে। একটু পরেই চলে আসবে। সুভদ্রর ইনফর্মার আগেই জানিয়েছিল বনানী দাসের আশ্রমিক নাম করুণা।
এখানে এসে প্রথমেই নিজের পরিচয় দিয়ে মাতাজির সঙ্গে দেখা করেছিল সুভদ্র। আদিত্য আর কেয়া তখন রাধাগোবিন্দের মন্দিরে ঢুকেছিল। সুভদ্র মাতাজিকে বলেছিল, একটা পুরোনো খুনের মামলার ব্যাপারে পুলিশ বনানী দাস ওরফে করুণার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ব্যাপারটা কী সেটাও সংক্ষেপে বলেছিল। মাতাজি বললেন তিনি ব্যাপারটা জানেন। করুণা তার কাছে কিছুই লুকোয়নি। এবং পুলিশের কাজে বাধা দিতেও তিনি চান না। পুলিশ নিশ্চয় করুণার সঙ্গে কথা বলতে পারে। তবে আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী তার গার্হস্থ জীবনের কথা করুণা বলতে পারে না। যদি সে সেসব কথা বলতে না চায় তা হলে পুলিশ যেন তাকে জোর না করে। মেয়েটা এক সময় খুব কষ্ট পেয়েছে। সেই কষ্টের দিনগুলো ভুলে গিয়ে এখন সে শান্তিতে আছে। সেই শান্তি যেন তার থেকে কেড়ে নেওয়া না হয়। তারপর স্নেহ বলে মেয়েটিকে তিনি সুভদ্রর সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন যাতে তার কোনও অসুবিধে না হয়। সুভদ্র বলছিল, মাতাজির সঙ্গে কথা বললে সত্যিই শান্তি পাওয়া যায়।
‘মাতাজি কি আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন?’ কেয়া ব্যগ্র হয়ে স্নেহ নামক তরুণী সন্ন্যাসিনীকে জিজ্ঞেস করল।
‘কেন করবেন না? মাতাজি সকলের সঙ্গে দেখা করেন। আপনাদের সঙ্গেও করবেন।’
আদিত্যরা তিনজন স্নেহর সঙ্গে বাগানে বসে কথা বলছিল। একটা নিমগাছের ছায়ায় বাঁধানো বসার জায়গা। সেখানে। সবুজ ঘাসের ওপর কাকেদের মিটিং চলছে। কয়েকটা কাঠবেরালি ব্যস্ত হয়ে একটা বটগাছে ওঠানামা করছে। এখান থেকে গঙ্গার খানিকটা দেখা যায়। বেশ চওড়া নদী। ওপারের বাড়িঘরগুলো খেলনা বাড়ির মতো দেখাচ্ছে। আদিত্য জানে, ওপারে বজবজ ।
‘এখানে এলে মনে হয় সংসারের বাইরে চলে এসেছি। আচ্ছা, আপনাদের এখানে খবর কাগজ আসে?’ কেয়া সরলভাবে বলল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। চারটে খবর কাগজ আসে। দুটো বাংলা, দুটো ইংরেজি। আমাদের তপস্বিনীদের মধ্যে কয়েকজন অবাঙালি।’
‘তাহলে তো আপনারা সংসারের বাইরে নন। তাই না?’
‘বাইরে কেন হব? আমরা মোটেই সংসারের বাইরে নই। তবে গার্হস্থ জীবনের বাইরে। আরে ওই তো করুণাদিদি এসে গেছে। আপনারা বসুন, আমি গিয়ে আপনাদের কথা বলছি।’ আদিত্যদের বসিয়ে রেখে স্নেহ উঠে গেল।
স্নেহ আর করুণা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আদিত্যরা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে তাদের কথোপকথন শোনা যায় না। করুণার হাতে বাজারের থলি, প্লাস্টিকের ব্যাগ। স্নেহর কথা শুনে সে আদিত্যদের দিকে বারবার তাকিয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর করুণা সাদা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। স্নেহ আদিত্যদের দিকে এগিয়ে আসছে।
‘চলুন, আপনাদের ভেতরে বসতে বলেছে। করুণাদিদি জিনিসপত্রগুলো রেখে আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে।’
‘আমি এইসব কথাবার্তার মধ্যে থাকব না। আমি একটু মন্দিরগুলো ঘুরে দেখতে পারি?’ কেয়া বলল ৷
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার সঙ্গে চলুন। আমি সব দেখিয়ে দিচ্ছি।’ কেয়াকে নিয়ে তপস্বিনী স্নেহ অন্য দিকে চলে গেল।
একটা নিরাভরণ ঘরে আদিত্যদের বসানো হয়েছে। চেয়ার-টেবিল-খাট-পালঙ্ক কিছু নেই। মাটিতে মাদুর পেতে বসার ব্যবস্থা। একদিকের দেয়ালে রাধাগোবিন্দের ছবি, যে বিগ্রহ আদিত্য আর কেয়া একটু আগে দেখে এসেছে। উল্টোদিকের দেয়ালে চিত্রহীন একপাতাওলা একটা ক্যালেন্ডার। অন্য দুটো দেয়াল একেবারে ফাঁকা।
‘বলুন, আপনারা কী বলবেন।’ বনানী দাস ওরফে করুণা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে। ‘আপনি আগে বসুন।’ আদিত্য নম্রভাবে বলল।
করুণা একটা চাটাইএর আসনে বসেছে। আদিত্যদের থেকে একটু দূরে। রোগা, তপোক্লিষ্ট শরীর। ভাঙা গাল, উঁচু হনু, উন্নত নাক। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হয় ভেতরের মানুষটা যেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে দূরে কোথাও রয়েছে।
‘আপনারা কেন এসেছেন আমি জানি। মাতাজি আমাকে সব বলেছেন। কিন্তু আমি তো আমার অতীত জীবন নিয়ে কিছু বলতে পারব না। এটা আশ্রমের নিয়ম। মাতাজিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আমি আমার অতীত নিয়ে কথা বলব না, ভাবব না, অতীত জীবনের আত্মীয়-বন্ধু-শত্রু কারও সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না। সেই প্রতিশ্রুতি আমি ভাঙতে পারি না। এর জন্য আপনারা যা শাস্তি আমাকে দিতে চান আমি মাথা পেতে নেব। যদি বলেন, পুলিশের সঙ্গে অসহযোগিতা করার জন্য আমার জেল হবে। আমি তাতেও রাজি। কিন্তু দয়া করে আমাকে প্রতিশ্রুতি ভাঙতে বলবেন না ।’
আদিত্য কী বলবে বুঝতে পারছে না। সুভদ্রও চুপ করে বসে আছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আদিত্য বলল, ‘আচ্ছা দিদি, ধরুন আমরা প্রশ্ন করে গেলাম আর আপনি হ্যাঁ কিংবা না বলে তার উত্তর দিলেন। এটা কী হতে পারে?’
খানিকক্ষণ চিন্তা করে করুণা বলল, “না সেটাও চলবে না। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে আমাকে অতীতের ঘটনাগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। সেটা আমি করতে চাই না।’
অনেক চেষ্টা করেও করুণাকে তার অতীত নিয়ে কথা বলাতে রাজি করা গেল না। হাল ছেড়ে দিয়ে আদিত্য সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল, উঠে পড়া যাক। এখানে থাকলে শুধু সময় নষ্ট।’ তারপর করুণার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘আপনি কিন্তু দিদি নিজের সঙ্গে তঞ্চকতা করছেন। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমাদের সঙ্গে কথা বলার সময় অতীতের বহু ঘটনা আপনার মনে উঁকি দিচ্ছিল। অতীতের ঘটনা মনে আনা যদি পাপ হয় তা হলে সেই পাপ আপনি করে ফেলেছেন।’ করুণা ওরফে বনানী দাস ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এইসব অবস্থায় কী করতে হবে আদিত্য বুঝতে পারে না। সুভদ্রও হতভম্ভ হয়ে বসে আছে।
অনেকক্ষণ পরে করুণা বলল, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি পাপী, ঘোর পাপী। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্য করতে এখানে এসেছি। আমার সমস্ত পাপের কথা মাতাজিকে বলেছি। আর কাউকে বলার প্রয়োজন দেখি না। মাতাজি আমাকে স্বান্ত্বনা দিয়েছেন, অভয় দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন। আমি এখানে এসে শান্তি পেয়েছি। আপনারা কি চান সেই শান্তি নষ্ট হয়ে যাক?’
‘মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরে আপনারা কষ্ট দিচ্ছেন। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি আমার আশ্রম ছেড়ে আপনারা চলে যান। দয়া করে এক্ষুনি চলে যান।’
আদিত্য খেয়াল করেনি কখন মাতাজি নিজে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। তার পেছনে কাঁচুমাচু মুখে কেয়া।
ফেরার পথে অনেকক্ষণ কারও মুখে কথা নেই। গাড়ি পাঁচলা পেরোনোর পর আদিত্য কেয়াকে বলল, ‘মাতাজির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। আমি মাতাজিকে জিজ্ঞেস করলাম আমার দুশ্চিন্তা করার অসুখ। বিশেষ করে স্বামীকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। কী করে মনকে শান্ত রাখব?’
‘উনি ধ্যান করতে শিখিয়ে দিলেন। চোখ বুঝে মনটাকে একেবারে চিন্তামুক্ত করে ফেলতে হবে। এবং ওই অবস্থায় বসে থাকতে হবে। এক দিনে পারব না। তবে বললেন, চেষ্টা করে গেলে আস্তে আস্তে পারব।’
কিছুক্ষণ চলার পরে আদিত্য বলল, ‘কোথাও দাঁড়িয়ে মধ্যাহ্নভোজনটা সেরে নেওয়া দরকার। কলকাতা পৌঁছন অব্দি অপেক্ষা করতে গেলে আমার নাড়ি-ভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে।’
খিদে সকলেরই পেয়েছে, কিন্তু কোন খাদ্যটা আদিত্যর পক্ষে উপযুক্ত হবে এ-নিয়ে আবার একপ্রস্থ অশান্তি। আদিত্য বলছে, যা হোক কিছু খেয়ে নিলেই হয়। একদিন অনিয়ম করলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। কেয়া সে কথা কিছুতেই মানবে না। স্বামী-স্ত্রীর বচসার মধ্যে সুভদ্র ঢোকার সাহস পাচ্ছে না। শেষে রাস্তার ধারে একটা ভাতের হোটেল পাওয়া গেল, বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মেনুতে রুই-কাতলা-পাবদা, চিকেন, মটনের সঙ্গে ‘রুগির ঝোল’ বলে একটা আইটেম রয়েছে। হোটেলের পরিচারককে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, যাদের কিছুই হজম হয় না তাদের জন্যে তেল মশলা ছাড়া রান্না করা ওই বিশেষ পদটি ওই এলাকায় যথেষ্ট জনপ্রিয় । এরপর আর অন্য কোথাও যাবার প্রশ্নই ওঠে না।
খাওয়া শেষ করে সকলে গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। গৌতম ফোন করছে।
‘আরে করেছিস কী তোরা? গোখরোর ল্যাজে পা দিয়েছিস।’
‘কী বলছিস? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।’ আদিত্য সত্যিই কিছু বুঝতে পারছে না।
‘আমি বুঝিয়ে বলছি। ওপরওলার কাছ থেকে কড়া হুকুম এসেছে গ্লোবাল ট্রেডিং এবং সাউথ এশিয়ান কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের কাছ থেকে কোনও কাগজপত্র চাওয়া যাবে না। ওই দুটো জায়গায় কোনও ইনভেস্টিগেশনও করা যাবে না। তোদের নাম করে নির্দেশ এসেছে। তোরা কি ওখানে গিয়েছিলি?’
‘অবশ্যই গিয়েছিলাম। এবং কিছুটা প্রোগেসও করেছি। দুটো জায়গাতেই কিছু কাগজপত্র চেয়েছিলাম। গ্লোবাল ট্রেডিং তো সরাসরি ওদের ব্যালেন্স সিট দিতে অস্বীকার করল। বলল, হায়ার অথরিটির চিঠি লাগবে। আর সাউথ এশিয়ান ব্যাঙ্ক কয়েকটা দিন সময় চাইল। আমরা ভাবছিলাম তোকে দিয়ে বলালে তাড়াতাড়ি কাগজপত্রগুলো পেয়ে যাব।’
‘সে গুড়ে বালি। কিন্তু আমি বোঝার চেষ্টা করছি চাপটা এল কোথা থেকে। সম্ভবত কোনও পলিটিকাল নেতার কাছ থেকে চাপটা এসেছে। আমি ওটাকে রিভার্স করার চেষ্টা করছি। জানি না কতটা পারব। যতদিন না পারি ততদিন ওই দুটো জায়গায় যাস না। আজ রাখি রে।’ মনে হল ওদিক থেকে গৌতম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গাড়িতে উঠে গৌতমের কথাগুলো সুভদ্রকে বলল আদিত্য। সুভদ্রকে রীতিমত হতাশ দেখাচ্ছে।
‘আজ সারাদিনে শেষ পর্যন্ত কী পেলাম দাদা? একে তো বনানী দাস একটা কথাও বলল না। তার ওপর অ্যাডিশানাল কমিশনারের কাছ থেকে এই নির্দেশ। সারা দিন পরিশ্রমের নিট ফল তো শূন্য।”
‘না, না। মোটেই শূন্য নয়। মোটেই শূন্য নয়। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমরা জানতে পেরেছি। প্রথমত, বনানী দাসের সঙ্গে কথা বলে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে অতীতে সে একটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করে ফেলেছিল। কাজটা এতটাই গর্হিত যে এখন সেকথা স্মরণ করলেও সে শিউরে উঠছে। গর্হিত কাজটা কী সেটা এখন আমাদের খুঁজে বার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, গৌতমের ওপরওলার কাছ থেকে যে নির্দেশটা এসেছে তাতে এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে উই আর অ্যাবসোলিউটলি অন দ্য রাইট ট্র্যাক। না হলে এত জরুরি নির্দেশ আসত না। চিন্তা কোরো না। আমাদের তদন্ত ঠিক পথেই চলছে।’