মৃত্তিকার মৃত্যু – ৭
সপ্তম পরিচ্ছেদ
(১)
পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আদিত্যর খুব বেশি যাওয়া হয়নি। ছোটবেলায় যখন তাদের অবস্থা ভাল ছিল তখন ছুটি-ছাটায় বাবার সঙ্গে প্রত্যেক বছর মধুপুর যাওয়া হতো। গিয়ে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ দিন থাকা হতো। শুধু মধুপুর, আর কোথাও নয়। মধুপুরে তাদের একটা মস্ত বাড়ি ছিল। আরও ছোটবেলায় একবার পুরী যাওয়া হয়েছিল। বিয়ের পর কেয়াকে নিয়ে আরও একবার। এছাড়া গোয়েন্দাগিরির কাজে দু’বার দিল্লি গেছে, একবার মুম্বাই। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আদিত্যর ভ্রমণবৃত্তান্ত এইটুকুই। বিয়ের পর সেইভাবে হানিমুনে যাওয়া হয়ে ওঠেনি এখনও।
আসল কথা হল, খুব দূরে কোথাও যেতে আদিত্যর ভাল লাগে না। সেদিক থেকে সে ঘরকুনো খাঁটি কলকাতার ঘটি। তবে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে ঘুরতে আদিত্যর ভালই লাগে। আদিত্য ভাবে, দূরে কোথাও যাবার আগে নিজের জায়গাটা ভাল করে দেখা দরকার। কত জায়গার নাম সে ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে–বালুরঘাট, শান্তিপুর, ঝাড়গ্রাম—কিছুই তো দেখা হয়নি। অবসর সময়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপ দেখা আদিত্যর নেশা। এইভাবেই জলঙ্গী নদীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল।
জলঙ্গী। জলই যার অঙ্গ। কী সুন্দর নাম। ও’মেলি সাহেবের বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার-এ আদিত্য দেখেছিল দেড়শ-দু’শো বছর আগেও বাংলাদেশে কত জীবন্ত নদী ছিল। তারা এখন চিরকালের জন্যে হারিয়ে গেছে। জলঙ্গী নদী ঠিক সে রকম না হলেও এখন তার কিছু অংশ রীতিমত শীর্ণ। তবে আদিত্য ছবিতে দেখেছে কৃষ্ণনগর-নবদ্বীপ-মায়াপুর অঞ্চলে, যেখানে নদীটা ভাগীরথীতে এসে পড়েছে সেখানে, তার ব্যাপ্তি আছে। জলঙ্গী নদী দেখা হবে বলে তাই আদিত্য কিঞ্চিৎ উত্তেজিত।
সকাল দশটা আঠাশে শেয়ালদা থেকে লালগোলা ছাড়ে, কৃষ্ণনগর সিটি পৌঁছোয় বেলা সাড়ে বারোটায়। সে ট্রেনটা ধরলে রাত্তিরের ঘুমটা ভাল হত, কিন্তু সাড়ে বারোটায় কৃষ্ণনগর পৌঁছলে কাজের দেরি হয়ে যাবে। অগত্যা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে কোনও রকমে এসে আদিত্যরা শেয়ালদা স্টেশন থেকে ভোর ছটা পঞ্চাশের হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস ধরেছে। সুভদ্রর অবশ্য ভোরে ওঠা অভ্যাস, তাই তার ভোরের ট্রেন ধরতে কোনও অসুবিধে নেই। ট্রেনে উঠে আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছিল। কৃষ্ণনগর যাওয়ার পথটা প্রায় কিছুই দেখা হল না।
হাজারদুয়ারি বেশ দেরি করে কৃষ্ণনগর সিটি পৌঁছেচে। পৌঁছনোর কথা আটটা পঞ্চাশে, যখন পৌঁছল তখন সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। আদিত্য ভেবেছিল তারা পৌঁছতে পৌঁছতে এই প্রাচীন শহরে বিপুল কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু কলকাতায় যেমন নাভিঃশ্বাস ওঠা ব্যস্ততা, এখানে ইস্টিশনের বাইরে এসে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। দু’চারটে টোটো যাত্রীর আশায় অপেক্ষা করছে। একটা জলখাবারের দোকান মনে হল সদ্য খুলেছে। দোকানের বাইরে বড় উনুনে লুচি ভাজা হচ্ছে। খদ্দের তেমন নেই। অনতিদূরে সাত-আটটা শালিক রাস্তার ওপর বসে ঝগড়া করছে।
শহরের উত্তরপ্রান্তে জলঙ্গী নদীর ধারে ঘুর্নি পুতুলপট্টি। কেষ্টনগরের মাটির পুতুল তৈরির জায়গা। ঘুর্ণি পেরিয়ে ৩১২ নম্বর হাইওয়ে ধরে আরও খানিক গেলে ভাণ্ডারখোলা। ভাণ্ডারখোলা থেকে আরও এক কিলোমিটার দূরে হাইওয়ের ওপরেই সেন বেকারির কারখানা। কৃষ্ণনগর স্টেশনের দিক থেকে এলে কারখানাটা বাঁ দিকে পড়বে। পল্লব সেন এই রকমই বলে দিয়েছেন।
আদিত্যরা একটা গাড়ি ভাড়া করতে চাইছিল, কিন্তু স্টেশনের বাইরে ভাড়া করার মতো কোনও গাড়ি চোখে পড়ল না। টোটোওলা বলল, সাড়ে বারোটা নাগাদ লালগোলা ঢোকার সময় দু’একটা ভাড়ার গাড়ি চলে আসতে পারে। আদিত্যরা অতক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না। তাই টোটোওলাকেই জিজ্ঞেস করতে হল, ভাণ্ডারখোলা পেরিয়ে সেন বেকারির যে রুটি-কারখানা আছে সেখানে সে যাবে কিনা। কারখানাটা টোটোওলার চেনা। সে বলল, ওখানে গেলে ফাঁকা ফিরতে হবে। তাই দু’পিঠের ভাড়া লাগবে। আদিত্যরা তাতেই রাজি।
টোটোওলার বয়েস বছর পঁচিশ, নাম শম্ভু। বাড়ি ভাণ্ডারখোলা থেকে আরও খানিকটা দূরে পূর্বপণ্ডিতপুর বলে একটা যায়গায়। রুটি কারখানার সামনে দিয়ে তাকে দু’বেলা যাতায়াত করতে হয়।
শম্ভু বলল, ‘আমাকে দশ মিনিট সময় দিতে হবে। চা-জলখাবার খেয়ে নেব।’ সুভদ্র বলল, ‘আদিত্যদা, আমরাও স্টেশন থেকে কিছু খেয়ে নিই। এর পর আবার কখন খাবার জুটবে জানি না। কিন্তু আপনার তো এই বাজারের লুচি-তরকারি চলবে না। কিছু ফল-টল দেখব ?”
খাবার ব্যাপারে আদিত্য রাজি। অত ভোরে কিছুই খেয়ে বেরোন হয়নি। আসার পথে ট্রেনে ঘন্টাখানেক ঘুমোনোর পর বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সে লুচির কড়ার দিকে কিছুক্ষণ সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য কেয়া কাল রাত্তিরে টিফিন গুছিয়ে দিয়েছে। সম্ভবত চিকেন স্যান্ডউইচ। সুভদ্র এবং শম্ভু-ড্রাইভার যখন গরম গরম লুচি-তরকারি খাচ্ছিল তখন তাদের পাশে বেঞ্চিতে বসে টিপিন বাক্স খুলে শুকনো স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে আদিত্য ভাবছিল, যার যা কপাল ।
শম্ভু বলেছিল আধঘন্টায় পৌঁছে দেবে। খাওয়া-দাওয়ার পর সেই যে সে বাথরুম থেকে আসছি বলে উধাও হয়ে গেল আর তার দেখা নেই। আদিত্যরা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে।
সুভদ্র বলল, ‘আদিত্যদা, শুভব্রত সাহার ব্যাপারটা নিয়ে একবার লোকাল থানায় খোঁজ নিলে হতো না?’
‘হাতে সময় থাকলে একবার খোঁজ নিতে পার। তবে আমার মনে হয় না খুব একটা লাভ হবে।’
‘কেন বলছেন লাভ হবে না?’
‘দ্যাখো, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে যে শুভব্রতর মৃত্যুটা আত্মহত্যা নয়। শুভব্রত যদি কম্পানির টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে লজ্জায়, অনুশোচনায় আত্মহত্যা করত তাহলে নিশ্চয় কম্পানি তার স্ত্রীকে অত দরাজ হাতে কমপেনসেট করত না। আমার বিশ্বাস, সেন বেকারির কোনও একটা দু’নম্বরি ব্যবসা আছে। সেই ব্যবসাটার সঙ্গে শুভব্রত সাহার মৃত্যুটা জড়িত। দু’নম্বরি ব্যবসা গোপন রাখার জন্য সেন বেকারি স্থানীয় পুলিশকে নিয়মিত টাকা দেয়। তাই শুভব্রত সাহার ব্যাপারটায় স্থানীয় পুলিশ মুখ বন্ধ রেখেছে। আমরা গেলে পুলিশ মুখ খুলবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং মাঝখান থেকে যারা দু’নম্বরি ব্যবসাটা করছে তারা সাবধান হয়ে যাবে।’ ‘আপনি কী করে শিয়োর হচ্ছেন সেন বেকারির দু’নম্বরি ব্যবসা আছে?’ ‘একটু ভেবে দ্যাখো, সেন বেকারির পাঁউরুটি আর তেমন চলে না। আমার পাড়ার দোকানদার বলল কিছুদিন আগে তার এক খদ্দের দেখিয়েছে সেন বেকারির পাঁউরুটির ভেতরে একটা আস্ত মরা আরশোলা রয়েছে। যদি এটা সত্যি হয়, মিথ্যে হবার কোনও কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি না, তাহলে ধরে নিতে হবে সেন বেকারি আর মন দিয়ে পাঁউরুটি বানাচ্ছে না। তা হলে তারা কী করছে? পল্লব সেনের লাইফস্টাইল দেখে মনে হয় না তার কোনও অর্থকষ্ট আছে। তার বাবুয়ানির টাকাটা আসছে কোথা থেকে?’
‘আপনি কি এই সব কারণেই সেন বেকারির কারখানা দেখতে এলেন?’
‘অবশ্যই। আসলে দুটো সম্ভাবনা আমার মাথায় ঘুরছে। একটু অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে, কিন্তু একেবারে ভিত্তিহীন নয়। প্রথম সম্ভাবনা, মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্রর খুনের সঙ্গে সেন বেকারির একটা যোগ আছে। ঠিক কী যোগ এখনও বুঝতে পারিনি, কিন্তু সেন বেকারির বাড়িতে সেন বেকারির সোল ডিসট্রিবিউটার তার পত্নী সহ খুন হল অথচ সেন বেকারি এই খুনের সঙ্গে জড়িত নয় এটা কি হতে পারে? তাছাড়া, অশনি রায়ের বিরুদ্ধে পুলিশ যে কেসটা সাজিয়েছে সেটাতে বিস্তর ফাঁক আছে । অশনি রায় বন্দুক চালিয়ে একজনকে খুন করবে এটা ভাবতে আমার অসুবিধে হচ্ছে। তবে অশনি রায়ও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। ওই ছবিগুলো তার প্রমাণ। হয়ত আরও কিছু আছে। সোমনাথ বাগ বলে যে লোকটি বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এর ওই ফ্ল্যাটে খুনের সময় সিকিউরিটির কাজ করত সে আমাকে বলল সে নাকি একদিন মৃত্তিকা মিত্রর সঙ্গে অশনিকে দেখেছে। কথাটা যদি সত্যি হয় তা হলে অশনি আগে থেকেই মৃত্তিকাকে চিনত…। আরে, ওই তো শম্ভু ড্রাইভার আসছে। পরে কথা বলব।’
‘কী ব্যাপার? এত দেরি কেন?’ সুভদ্র তার বিরক্তিটা চেপে রাখতে চাইছে না। ‘ভেরি সরি দাদা। খুব দেরি করিয়ে দিলাম আপনাদের। আসলে কী জানেন? এই সময় আমি কয়েকটা বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার ডিউটি করি। চারজন কেজির বাচ্চা, মর্নিং স্কুল থেকে ফেরে। সেটার একটা ব্যবস্থা না করে তো আপনাদের নিয়ে যেতে পারি না। অনেক কষ্টে একজনকে রাজি করিয়েছি। সে বলেছে বাচ্চাগুলোকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। এবার চলুন।’
রাস্তাঘাট ফাঁকা। টোটো বেশ জোরে চলছে। আদিত্যর মনে হল দশ কিলোমিটার যেতে আধঘন্টা নাও লাগতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের অন্য অনেক মফস্বল শহরে যেমন বাড়িগুলো একে অপরের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, এখানে তেমন নয়। দুটো বাড়ির মধ্যে ফাঁকা মাঠ। ছেলেরা ফুটবল খেলছে। আকাশে মেঘ রয়েছে বলে রোদ্দুরের চোখ-শাসানি নেই। ভ্রমণের আদর্শ দিন।
‘এখানে সরভাজা-সরপুরিয়ার ভাল দোকান কোনটা?” সুভদ্র শম্ভু ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল। ‘কলকাতায় ফেরার সময় কিছু নিয়ে যেতে হবে।’
‘দাদা, এখানে সব থেকে পুরোনো দোকান হল অধর চন্দ্র দাস। একশ কুড়ি বছরের পুরোনো দোকান। ওটাই সব থেকে ভাল। লোকে বলে, ওরাই নাকি প্রথম মাথা খাটিয়ে সরভাজা-সরপুরিয়া বানিয়েছিল। তার আগে ওসব মিষ্টি ছিলই না।’
‘ঠিক আছে। কলকাতা ফেরার আগে ওখান থেকেই নিয়ে যাব। আদিত্যদা নেবেন নাকি? সরভাজা-সরপুরিয়া ?’
‘নিতে তো হবেই। কেয়া বারবার বলে দিয়েছে। ওই অধরের দোকানের কথাই বলেছে। কেয়াদের বাড়ি বহরমপুর, কিন্তু কেষ্টনগরে ওদের অনেক আত্মীয়স্বজন থাকে। তাই কেয়া অধর দাসের দোকানের কথা খুব ভাল করেই জানে।’
বাইরে বাড়িঘর। ধানজমি। ইরিগেশনের খালে মেঘে ঢাকা আকাশের ছায়া পড়েছে। আবার বাড়ি, লোহা-লক্কড়ের দোকান, টিভির দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, সাইকেল সারাই-এর দোকান। খেলার মাঠ। আমবাগান। পেট্রলপাম্প। একটা কালভার্ট, নিচে কালো জলে কচুরিপানা। ঠাণ্ডা মফস্বল।
‘নদীটা কত দূরে?” আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘কোন নদী?’
‘জলঙ্গী নদী। এখান থেকে কত দূর?’
‘খুব দূরে নয়। তবে আমরা নদীর পাশ দিয়ে যাচ্ছি না।’
শম্ভু হঠাৎ গাড়িটা রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে থামিয়ে দিল। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বলল, ‘একটা ফোন করে আসছি দাদা।’ বলে একটা বাড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেল।
একটু পরে শম্ভু ফিরে আসতেই সুভদ্র কড়া গলায় বলল, ‘অ্যাই, তোমার ব্যাপারটা কী? হঠাৎ হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে যাচ্ছ?’
‘একটা ফোন করতে গিয়েছিলাম দাদা। ওই যে আমার বন্ধুটা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আসবে বলেছিল, ফোন করে খবর নিচ্ছিলাম ও গিয়েছিল কিনা।’
“তা ফোনটা তো গাড়িতে বসেই করতে পারতে।’ সুভদ্র তীক্ষ্ণ গলায় বলল। ‘আসলে কী, হাইওয়ে থেকে আমার মোবাইলে ভাল সিগনাল আসে না।’ শম্ভু আর কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে দিল। আদিত্যর মনে হল শম্ভু সত্যি কথা বলছে না।
সেন বেকারির কারখানাটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একটা পুরোনো বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসস্তূপ। ইঁট বেরিয়ে যাওয়া দেয়াল, ইঁটের ভেতর থেকে দু’একটা বট-অশথ মাথা তুলেছে। শম্ভু ড্রাইভারের টোটো আদিত্যদের কারখানার গেটে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
গেটে চারজন কোমরে পিস্তল বাঁধা দরোয়ান। নিশ্চয় তাদের জানা ছিল আদিত্যরা আসবে, একজন ইন্টারকম তুলে বলল, ‘কলকাতা থেকে বাবুরা এসে গেছেন।’ তারপর আদিত্যদের দিকে ফিরে বলল, ‘আপনারা স্যার এই বাঁধানো রাস্তাটা ধরে সোজা চলে যান। রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা একতলা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন তো? ওটা কারখানার আপিস। ওখানে রিসেপশানে গিয়ে আপনাদের নাম বললেই হবে।’
ধ্বংসস্তূপ-মার্কা বাড়িটার পাশে আধুনিক একতলা বাড়িটা আদিত্য প্রথমে খেয়াল করেনি। যখন খেয়াল করল, দেখতে পেল একতলা বাড়িটার পেছন থেকে আর একটা দোতলা বাড়ি উঁকি মারছে যেটা আরও আধুনিক। আদিত্য আন্দাজ করল ওটাই পল্লব সেনের বাংলো।
কারখানাটা তেমন বড় না হলেও তার পাঁচিল-ঘেরা চৌহদ্দিটা বিশাল। বেশিরভাগটাই ঝোপ-জঙ্গল হয়ে রয়েছে। হয়ত কর্তা ইচ্ছে করেই জঙ্গল পরিষ্কার করাননি যাতে পাখিরা আসতে পারে। জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা গোডাউন রয়েছে। সম্ভবত কাঁচা মাল মজুত করার জন্যে। গেট থেকে কারখানার অফিসে পৌঁছতে প্রায় পাঁচ মিনিট লেগে গেল।
রিসেপশনের বিষণ্ণ মেয়েটি আদিত্যদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। বলল, “আপনারাই সাপ্তাহিক ব্যবসা-বাণিজ্য ম্যাগাজিন থেকে এসেছেন? আমাদের এম ডি স্যার মেসেজ পাঠিয়ে বলেছেন আপনাদের কারখানাটা ঘুরে দেখাতে। আমরা তার ব্যবস্থাও করেছি।
কিন্তু তার আগে আপনারা স্নান করে লাঞ্চ খেয়ে নিন। একটু বিশ্রামও করে নিতে পারেন। সেই ভোরবেলা নিশ্চয় কলকাতা থেকে বেরিয়েছেন।’
আদিত্য ঠিকই আন্দাজ করেছিল। আপিসবাড়ির পেছন দিকের দোতলা ইমারতটাই পল্লব সেনের বাংলো এবং কম্পানির গেস্ট হাউস। আদিত্য দূর থেকে বুঝতে পারেনি, বাড়ি আসলে একটা নয়, দুটো। গায়ে গায়ে লেগে আছে বলে দূর থেকে একটা দেখায়। বাঁদিকের বাড়িটা পল্লব সেনের বাংলো, ডানদিকেরটা গেস্ট হাউস। দুটোই আধুনিক, ঝাঁ-চকচকে। আদিত্য অবাক হয়ে ভাবছিল, কারখানার যখন এই হতদরিদ্র অবস্থা তখন গেস্ট হাউস এত চকচকে কেন?
‘গেস্ট হাউসে অনেক লোক আসে?’ ঘণ্টা খানেক পরে দুপুরের খাবার খেতে খেতে আদিত্য আর সুভদ্র গেস্ট হাউসের বেয়ারার সঙ্গে গল্প করছিল। বেয়ারাটি জানাল তার নাম কালীকিঙ্কর। সবাই কালী বলে ডাকে। বেশি কথা বলা অভ্যাস। তাতে অবশ্য আদিত্যদের সুবিধে হয়েছে।
‘এই গরমকালে গেস্ট হাউস ফাঁকাই থাকে। খুব মাঝে মাঝে, হয়ত দশ-পনের দিন পরে কেউ এল। কিন্তু শীতকালের দু’তিন মাস গেস্ট হাউস প্রায় ভর্তি থাকে।’ কালী গেলাশে জল ঢালতে ঢালতে জানাল।
দ্বিপ্রাহরিক খাদ্যতালিকাটি ছিমছাম। ভাত, মুসুরির ডাল, বেগুনভাজা, সর্ষে বাটা দিয়ে মাঝারি আকারের টাটকা এবং অতীব সুস্বাদু পাবদা মাছ দু’টি করে, কাঁচা আমের টক।
‘কারা আসে এখানে?’ সুভদ্র খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল।
‘ছোট সাহেবের কিছু বন্ধু পাখি দেখতে আসে। প্রত্যেক বছরই আসে। কাছেই জলঙ্গী নদীর ধারে একটা জঙ্গল আছে। সেখানে হেন পাখি নেই দেখা যায় না।’
‘ব্যবসার কাজে কেউ আসে না?’ আদিত্যর প্রশ্ন।
‘হয়ত আসে ৷ আমরা তো সাহেব সকলকে চিনি না। ম্যানেজারবাবু বলতে পারবে । তবে শীতকালে কিছু সাহেব-মেমও আসে।’
‘সাহেব-মেম? পাখি দেখতে আসে?’
‘পাখি দেখতে আসে কিনা জানি না। তবে আসে। একজন আছে বয়স্ক সাহেব । সে তার মেমকে নিয়ে আসে। আবার কয়েকজন অল্পবয়সী সাহেব-মেমও আসে। অল্পবয়সীগুলো আমাদের দিশি রান্না খুব ভালবেসে খায়। বুড়ো সাহেব-মেম আমাদের মতো খায় না। তাদের জন্যে চিকেন স্টু, পুডিং এইসব রান্না হয়। আমাদের বাবুর্চি রামলাল বড় সাহেবের বাবার আমলের লোক। সে ওইসব রান্না খুব ভাল পারে।’ ‘তোমাদের তো তাহলে দারুণ ব্যাপার। সাহেব-মেম, স্টু-পুডিং…’ আদিত্য ভাতের সঙ্গে ভাল মাখতে মাখতে বলল ।
কালী বেয়ারা কী বুঝল কে জানে। তবে ঘাড় নাড়ল। বলল, ‘হ্যাঁ সাহেব। শীতকালে এখানে একেবারে উৎসব লেগে যায়। তারপর একটু থেমে বলল, ‘রাত্তিরে আপনারা কী খাবেন? ভাত না রুটি?’
‘আমি রুটি খাব।’ আদিত্য জানাল।
‘আমি ভাত। রাত্তিরে কী খাওয়াচ্ছ?’ সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘রাত্তিরে মাটন হচ্ছে। মুসুরির ডাল, বেগুন ভাজা। কুচো চিংড়ি দিয়ে এঁচোড়। আর কাতলা মাছ। শেষে সরভাজা।’
‘বাঃ। বেশ, বেশ। এ তো এলাহি ব্যবস্থা। তা তোমাদের ছোট সাহেবও কি এখানে খান? নাকি তার বাংলোতে রান্নার ব্যবস্থা আছে?’ মেনু শুনে সুভদ্রকে খুশি মনে হচ্ছে।
‘কম দিনের জন্যে এলে এখানেই খান। যখন বেশি দিনের জন্যে আসেন তখন কলকাতা থেকে ঠাকুর নিয়ে আসেন। বাবুর্চি রামলালও তখন মাঝে মাঝে বাংলোতে গিয়ে রান্না করে। আজ রাত্তিরে এখানে আপনাদের সঙ্গে খাবেন। বুঝতে পেরেছেন তো আমরা এই সাহেবকে ছোট সাহেব বলি? বড় সাহেব ছিলেন ওর দাদা।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। তাই তো বলা উচিত। তা বড় সাহেবের স্ত্রী মানে ছোট সাহেবের বৌদিও কি এখানে আসেন ?’
‘খুব কম আসেন। হয়ত দু’বছরে একবার। কিংবা আরও কম। যখন বড় সাহেব বেঁচে ছিলেন তখন খুব আসতেন।’
‘আচ্ছা, একটা কথা বল তো। তোমাদের এই পাঁউরুটি কারখানায় এত পাহারা কেন? এখানে ঢোকার সময় দেখলাম চারজন সিকিউরিটি গার্ড কোমরে বন্দুক বেঁধে পাহারা দিচ্ছে। কী এমন আছে এখানে যে এরকম কড়া পাহারা দিতে হবে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
কালীকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। খানিকটা চিন্তা করে সে বলল, ‘আগে এতটা ছিল না জানেন। মালিক শাড়ির ব্যবসা শুরু করার পর থেকে দেখছি সিকিউরিটি খুব বেড়েছে। ওই গোডাউনগুলোতে মনে হয় কোটি কোটি টাকার শাড়ি মজুত থাকে।’ ‘শাড়ির ব্যবসা? সেন বেকারি শাড়িরও ব্যবসা করে নাকি?’ আদিত্য সত্যিই অবাক হয়েছে।
‘পাঁউরুটির ব্যবসা তো তেমন চলে না। শুনতে পাই, মালিক তাই শাড়ির ব্যবসা ধরেছে। শান্তিপুর থেকে ট্রাক ভর্তি শাড়ি আসে। সেসব নাকি অ্যামেরিকায় বিক্রি হয়। আমাদের অবশ্য সবই শোনা কথা। অনেক টাকার মাল গোডাউনে থাকে। তাই সিকিউরিটি। তাছাড়া কিছুদিন আগে কারখানা থেকে এক ট্রাক পাঁউরুটি বেরোচ্ছিল। কারখানার গেটের সামনে সেটা লুট হয়ে গেল। সেরকম যাতে আর না হয় সেজন্যেও হয়ত সিকিউরিটি বাড়িয়েছে……। আপনারা কি খাওয়া হয়ে গেলেই বেরুবেন? রিসেপশন থেকে জিজ্ঞেস করছিল।’
‘আমরা ঘন্টাখানেক বিশ্রাম করে তারপর বেরোব।’
(২ )
‘আমার নাম তমাল বিশ্বাস। আমি জেনারেল ম্যানেজার প্রণব মাইতি সাহেবের পি এস, মানে পারসোনাল সেক্রেটারি। স্যার জরুরি কাজে কলকাতা গেছেন। ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। আপনারা কারখানা দেখবেন তো? স্যার বলে গেছেন আপনাদের সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখাতে। অবশ্য দেখার খুব বেশি কিছু নেই।” লোকটাকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে।
তমাল বিশ্বাসের বয়েস মনে হয় চল্লিশের কাছাকাছি। রোগা শরীর। উচ্চতা পাঁচ ফুট তিন-চার ইঞ্চির বেশি হবে না। নাকের ওপর কালো ফ্রেমের চশমা-জোড়া হয়ত মুখমণ্ডলকে খানিকটা বাড়তি গাম্ভীর্য দেবার উদ্দেশ্যে বসানো হয়েছিল। ব্যক্তিত্ব দেবার বদলে সেটা চেহারাকে আরও নিরীহ, আরও গুরুত্বহীন করে তুলেছে।
‘আমরা তৈরি। এখনই যেতে পারি।’ আদিত্য বলল।
‘ঠিক আছে। এখনই চলুন। কারখানা পাঁচটা অব্দি খোলা। তার মানে আমাদের হাতে ঘন্টাখানেক সময় আছে।’
তমাল বিশ্বাস আগে আগে চলল। পেছনে আদিত্য এবং সুভদ্র। আদিত্যদের পাশাপাশি হাঁটার মতো আত্মবিশ্বাস বোধহয় তার নেই।
‘এই কারখানাটা কতদিনের পুরোনো?” সুভদ্র হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল। ‘নাইনটিন থার্টি এইটে এই কারখানাটা তৈরি হয়েছিল। বড় সাহেবের ঠাকুরদাদার আমলে। আগে এদের কারখানা ছিল খিদিরপুরে। কিন্তু সেখানে জায়গার অভাব বলে এখানে অনেকটা জমি কেনা হল। তার খানিকটা নিয়ে কারখানা হল। বাকি জমিটার জন্যে অন্য সব প্ল্যান ছিল। কিন্তু কোনওটাই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।’ কথা বলতে বলতে তমাল বিশ্বাস আদিত্যদের পাশে চলে এসেছে।
‘আপনার এখানে অনেকদিন হয়ে গেছে মনে হয়। কারখানার ইতিহাস যখন এতটা জানেন।’ আদিত্য হালকাভাবে বলল।
‘আমার এখানে কিন্তু খুব বেশিদিন হয়নি। পাঁচ বছরও পুরো হয়নি। সাড়ে চার বছরের একটু বেশি হয়েছে। আসলে কী জানেন, যে কোনও জায়গার ইতিহাসটা জানতে আমার খুব ইচ্ছে করে। বিশেষ করে যেখানে চাকরি করছি, তার ইতিহাসটা।’ তমাল বিশ্বাস লাজুকভাবে হাসল।
‘আপনি কি ইতিহাসের ছাত্র?’
‘না, ফর্মালি কখনও ইতিহাস পড়িনি। বি কম পাশ করেছিলাম। তারপর কম্পিউটারে একটা ডিপ্লোমা। ইতিহাস পড়লে তো চাকরি পাওয়া যায় না। তাই বাড়ি থেকে পড়ায়নি।’
আদিত্য টের পেল তমাল বিশ্বাস একটু একটু করে সহজ হচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “আপনার বাড়ি কি এদিকে?” ‘আমার বাড়ি চুঁচুড়ায়। ওখানেই জন্ম, পড়াশোনা। এখানে চাকরি পাবার আগে নর্থ বেঙ্গলের একটা চা বাগানে চাকরি করতাম। বাড়ি থেকে অত দূরে থাকতে মন টিকত না। তারপর এই চাকরিটা পেয়ে গেলাম।’
‘এখন বাড়ি থেকে যাতায়াত করেন?’
‘প্রথম কয়েক মাস করেছিলাম। খুব ধকল পড়ে যায়। জিএম সাহেব অনেক সময় সকাল সকাল ডেকে পাঠান। আবার কখনও কখনও রাত অব্দি কাজ করতে হয়। সাহেবকে বলতে উনি কারখানার চৌহদ্দির মধ্যেই একটা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করে দিলেন। কোয়ার্টার মানে একটা ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম। আমি একা মানুষ কোনও অসুবিধে হয় না।’
আদিত্য ভাবছিল তমাল বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করবে তার চুঁচুড়ার বাড়িতে কারা আছে। কিন্তু তার আগেই কারখানার দরজা এসে গেল।
পাঁউরুটির কারখানায় দেখার বিশেষ কিছু নেই। অন্তত সেন বেকারির কারখানায় নেই। কারখানাটা পুরোনো, প্রায় প্রাগৈতিহাসিক। দেয়ালে-কড়িকাঠে কালো আস্তরণ পড়েছে। সন্দেহ নেই বহুদিনের ধোঁয়া-ধুলো-ময়লা জমে এমন হয়েছে। কারখানার ভেতরটা প্রায়ান্ধকার। অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বেলে কুড়ি-পঁচিশজন কাজ করছে। এই রকম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রুটি তৈরি হলে রুটির ভেতর দু’একটা আরশোলা থেকে যাওয়াটা আশ্চর্য নয়। আদিত্য ভাবছিল, সরকারের খাদ্য দপ্তর এখানে ইন্সপেকশান করে না? তাদের তো কিছু ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি আছে। এই কারখানা সেসব মেনে চলে বলে তো মনে হয় না ।
রুটি বানানোর প্রক্রিয়াটা সাদামাটা। অন্তত সেন বেকারির কারখানায়। একটা প্রাগৈতিহাসিক যন্ত্রে ময়দার সঙ্গে জল, তেল, দুধ এবং ইস্ট মেশানো হচ্ছে। যন্ত্র সেইসব উপকরণগুলিকে প্রবল শব্দ সহযোগে মন্থন করে দৈত্যাকার একটা ময়দার লেচি বানাচ্ছে। সেই লেচিগুলোকে বিভিন্ন সাইজে ছোট ছোট করে কেটে রাখছে কয়েকটি লোক। অন্য কিছু লোক সেই ছোট লেচিগুলোকে এক পাউন্ড, হাফ পাউন্ড, কোয়ার্টার পাউন্ড ইত্যাদি মাপের আলাদা আলাদা বাক্সে ভরে বেক করার চুল্লিতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। চুল্লি থেকে পাঁউরুটি হয়ে বেরোনোর পর আর একদল লোক সেই পাঁউরুটিগুলিকে তাদের আয়তন অনুযায়ী বিভিন্ন সাইজের কাগজ দিয়ে প্যাকিং করছে। কাগজে মোড়া গরম পাঁউরুটি স্তূপীকৃত হয়ে জমা হচ্ছে একটা পেল্লায় ট্রেতে।
আদিত্যর মনে হল, এই কারখানায় আরও কিছুটা যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব ছিল। হয়ত অর্থনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয়ও ছিল। সে তমাল বিশ্বাসকে শুনিয়ে সুভদ্রকে বলল, ‘দ্যাখো, এই জন্যে বাঙালির ব্যবসা চলে না। ব্যবসা চালাতে গেলে তো কিছুটা পয়সা ঢেলে প্রোডাকশান প্রোসেসটাকে মর্ডানাইজ করতে হবে। এখানকার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সেই ১৯৩৮-এর পর টেকনলজির আর কোনও উন্নতি হয়নি। এই ব্যাপারটা কিন্তু তুমি তোমার রিপোর্টে নিশ্চয় লিখো।’
তমাল বিশ্বাস উসখুস করছে। মনে হচ্ছে সে কিছু একটা বলতে চায়।
আদিত্য বলল, ‘তমালবাবু কিছু বলবেন?’
‘আমার কিছু বলা শোভা পায় না, বিশেষ করে আপনাদের মতো সাংবাদিকদের সামনে। আপনারা নিশ্চয় অনেক দেখেছেন, অনেক পড়েছেন। তাই আপনাদের মতের মূল্য তো দিতেই হবে। তবে যদি অনুমতি দেন তা হলে একটা কথা বলতে পারি।’
‘বলুন, বলুন। আমরা তো শুনতেই এসেছি। আমরা সবার কথা শুনতে চাই।’
সুভদ্র তমাল বিশ্বাসকে ভরসা দিল।
‘আমি সামান্য মানুষ, হয়ত ভুল বলছি। ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে তবু বলছি, কারখানাটা যদি আরও যন্ত্রনির্ভর হয়ে যেত, সেটা হতেই পারত যেমন আধুনিক রুটি কারখানাগুলো হয়েছে, তা হলে কিন্তু এতগুলো লোক এখানে চাকরি পেত না। পঁচিশটার বদলে পাঁচটা লোক আর কিছু যন্ত্র দিয়ে কাজটা হয়ে যেত। আমরা সেন সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ যে তিনি সেটা হতে দেননি।’
আদিত্য ভাবছিল। আপাতদৃষ্টিতে তমাল বিশ্বাসের কথার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলে যুক্তির ফাঁকটা ধরা যায়। তবে সেটা ধরতে আদিত্যর কয়েক মিনিট লেগে গেল ৷
স্তূপীকৃত পাঁউরুটির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু তমালবাবু, এভাবে কি ভেবে দেখা যায় না? কারখানাটা আধুনিক হলে, আপনাদের পাঁউরুটির মান বাড়ত, বাজারে আপনাদের বিক্রিও বাড়ত। তখন কারখানাটাকে আরও বড় করা যেত। ফলে আরও লোক এখানে কাজ পেত।’
তমাল বিশ্বাসকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। সে আদিত্যর কথার মর্মার্থটা ঠিক ধরতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তাই বুঝতে পারছে না কী উত্তর দেবে। তার ভাগ্য ভাল। উত্তর দেবার বিড়ম্বনা থেকে তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে একজন উর্দি পরা লোক এসে বলল, “জিএম সাহেব এসে গেছেন। এই বাবুদের তার ঘরে ডাকছেন।’
আপিসবাড়ির দোতলায় জিএম সাহেবের কামরা। তমাল বিশ্বাস আদিত্যদের সেখানে পৌঁছে দিল। আদিত্যর মনে হল, কারখানা দেখার এখানেই ইতি।
জিএম সাহেবের কামরার বাইরে একজন উর্দি পরা বেয়ারা বসে আছে। তমাল তাকে গিয়ে আদিত্যদের আগমন সংবাদ জানাল। বেয়ারা আদিত্যদের ভেতরে যেতে বলছে।
‘বিশ্বাসবাবু আপনি একটু থাকুন। কেটে পড়বেন না। সাহেব ডাকতে পারে।’ বোঝাই যাচ্ছে তমাল বিশ্বাসকে বেয়ারাও খুব একটা পাত্তা দেয় না। কিম্বা হয়ত জিএম-র খাস বেয়ারা বলে এই লোকটির একটু বেশি দাপট।
‘না, না। কেটে পড়ব কেন? আমি এখানেই বসছি।’ তমাল বিশ্বাস বেয়ারার টুলের পাশে আর একটা টুলের ওপর বসল। তারপর আদিত্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনারা ভেতরে যান। স্যার আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। আমি এখানেই থাকছি। কিছু দরকার হলে স্যার আমাকে ডেকে নেবেন।’
জিএম প্রণব মাইতির ঘরটা বড়, হয়ত এক সময় সাজানো-গোছানোও ছিল, এখন অযত্নে মলিন হয়ে গেছে। দেয়ালগুলো রঙচটা, দেখে মনে হয় অনেক দিন মিস্তিরির হাত পড়েনি। টেবিলের একপাশে ডাঁই করা ফাইলের ওপর সাতপুরু ধুলো। যে কারখানাটা একটু আগে আদিত্যরা দেখে এল, ঘরটা মোটের ওপর তার চেহারা এবং মেজাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
প্রণব মাইতির বয়েস পঁয়ষট্টি তো হবেই, সত্তর হওয়াটাও আশ্চর্য নয়। পক্ককেশ, দড়ি-পাকানো হাত, গাল তোবড়ানো, কিন্তু চোখের দৃষ্টি সতর্ক, ঈষৎ ধূর্ত।
‘আসুন, আসুন, বসুন। ছোটবাবু বলে দিয়েছেন যতক্ষণ না উনি আসছেন, আমি যেন আপনাদের দেখাশোনা করি। কিন্তু সকালটা থাকতে পারলাম না। একটা বিশেষ কাজে কলকাতা যেতে হল। গেস্ট হাউসে আপনাদের কোনও অসুবিধে হয়নি তো?’
‘না, না। কোনও অসুবিধে হয়নি। খাসা গেস্ট হাউস। খাসা রান্না। আমরা খুব ভাল আছি।’ সুভদ্র দরাজ গলায় সার্টিফিকেট দিল।
‘তাছাড়া আপনার পি এস তমালবাবু খুব যত্ন করে আমাদের কারখানাটা ঘুরিয়ে দেখালেন।’ আদিত্যর সংযোজন। ‘আমাদের তো কারখানা দেখতেই আসা।’
“আপনারা কোন খবরের কাগজে কাজ করেন?’
‘খবর কাগজ নয়। একটা বাংলা ম্যাগাজিন। ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। নামও ব্যবসা-বাণিজ্য। ইংরেজিতে এরকম ম্যাগাজিন অনেক আছে। বাংলায় আমরাই একমাত্র।’
ব্যবসা-বাণিজ্য বলে সত্যিই একটা ম্যাগাজিন আছে। আদিত্যর এক বন্ধুর বন্ধু সেখানে কাজ করে। তার কাছ থেকে আদিত্য ওই ম্যাগাজিনটা সম্বন্ধে কিছু কিছু জেনে এসেছে।
‘সেন বেকারি নিয়ে আপনাদের হঠাৎ উৎসাহ হল কেন? সেন বেকারির ব্যবসা তো আর আগের মতো নেই।’ প্রণব মাইতি বেল বাজালেন। বাইরে অপেক্ষমাণ বেয়ারাটি ঘরে ঢোকার পর তাকে বললেন, ‘তমালকে বল চায়ের ব্যবস্থা করতে।’
বেয়ারা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর প্রণব মাইতি বললেন, ‘হ্যাঁ, যেটা জিজ্ঞেস করছিলাম। আমাদের নিয়ে হঠাৎ আপনাদের এত উৎসাহ কেন? সেন বেকারির সেই পুরোনো নামডাক তো আর নেই।’
‘আসলে আমার এই নবীন বন্ধুটি এই কিছুদিন আগে ব্যবসা-বাণিজ্য ম্যাগাজিনে অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে ঢুকেছে। ওকে আমাদের সম্পাদক বাঙালির পড়ন্ত ব্যবসাগুলো নিয়ে একটা লেখা তৈরি করতে বলেছেন। মানে যে ব্যবসাগুলো আগে ভাল চলত, এখন আর তেমন চলে না, সেগুলো নিয়ে। আমি ওকে একটু সাহায্য করছি।’ আদিত্য হাসবার চেষ্টা করল।
‘আপনাদের সম্পাদকের নাম কী?’ প্রণব মাইতি বুলেটের মত প্রশ্ন করল। ‘সুমিত সেনশর্মা।’ ভাগ্যক্রমে উত্তরটা আদিত্যর জানা ছিল।
“আর আপনাদের নাম?’
‘আমি রবি মজুমদার আর ইনি আমার বন্ধু মলয় শূর।’ আদিত্য দু’হাত জড়ো করে নমস্কার জানাল। তার দেখাদেখি সুভদ্ৰও ।
‘আপনাদের কোনও ভিজিটিং কার্ড আছে?’
‘না। মলয় তো সদ্য চাকরিতে জয়েন করেছে, ও এখনও ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। আর আমার ভিজিটিং কার্ডটা আমি আনতে ভুলে গেছি।’ আদিত্য মুখটাকে কাঁচুমাচু করার চেষ্টা করল।
‘ভিজিটিং কার্ড আনেননি? ঠিক আছে, আপনার প্রেস কার্ডটা সঙ্গে আছে নিশ্চয় । সেটা দেখান।’
আদিত্য চুপ করে আছে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রণব মাইতি আরও কড়া গলায় বললেন, “কিছু একটা আইডেন্টিটি কার্ড আছে কি আপনাদের সঙ্গে? আধার কার্ড? ড্রাইভিং লাইসেন্স? আমি বুঝব কী করে আপনারা ফ্রড নন? ‘
আদিত্য তবু চুপ করে আছে। সুভদ্র আপাদমস্তক বিভ্রান্ত। বোধহয় ভাবছে, আদিত্যদা এরকম কাঁচা একটা কাজ করল কী করে? একবারও ভেবে দেখল না এখানে আইডেন্টিটি কার্ড চাইতে পারে?
আদিত্যদের এখনও চুপ করে থাকতে দেখে প্রণব মাইতি এবার গলা খানিকটা নামিয়ে বললেন, ‘ছোটবাবু বলেছেন আপনাদের দেখাশোনা করতে। কিন্তু ছোটবাবু কি জানেন আপনারা ফ্রড? আসলে ছোটবাবু মানুষটা পাখি দেখা আর গান-বাজনার বাইরে কিছুই জানেন না। চারদিকের পৃথিবীটা সম্বন্ধে ওঁর ধারণা নেই বললেই চলে। ওঁকে ঠকানো খুব সহজ। তাই আমাকে এক্সট্রা কেয়ারফুল থাকতে হয়। আপনারা কী মতলবে এখানে এসেছেন জানি না। জানতে চাইও না। শুধু একটা কথা বলছি। এই মুহূর্তে আপনারা কারখানা ছেড়ে চলে যান। না হলে আমি সিকিউরিটি ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আপনাদের বার করে দেব।’
‘আমাদের আসল পরিচয়টা না জেনে আশা করি ওরকম বোকামি আপনি করবেন না।’ আদিত্য এতক্ষণে মুখ খুলেছে। তার গলায় কর্তৃত্বের ছাপ। ‘ইনি সুভদ্র মাজি। কলকাতা পুলিশ থেকে এসেছেন। আপনাদের ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার শুভব্রত সাহার মৃত্যুর তদন্ত করতে। আমি আদিত্য মজুমদার, বেসরকারি গোয়েন্দা, পুলিশকে সাহায্য করছি। ভেবেছিলাম সাংবাদিক পরিচয়ে এলে আমাদের কাজের সুবিধে হবে। তা, আপনি যখন আমাদের আসল পরিচয়টা জেনেই ফেললেন তখন আর তঞ্চকতার প্রয়োজন নেই। সরাসরি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। অবশ্য তার আগে আপনি সুভদ্র মাজির পরিচয়পত্রটা একবার দেখে নিতে পারেন। চাইলে আমার প্রাইভেট ডিটেকটিভের লাইসেন্সটাও। সুভদ্র, তোমার অফিশিয়াল আইডেন্টিটি কার্ডটা একে একবার দেখাবে ? ‘
ঘরে অস্বস্তিকর নীরবতা। তার মধ্যেই তমাল বিশ্বাস একজন বেয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকেছে। বেয়ারাটির হাতে চায়ের ট্রে।
‘তমাল, এই দু’জন ভদ্রলোক, যাদের তুমি একটু আগে কারখানাটা ঘুরে ঘুরে দেখালে, আসলে সাংবাদিক নন। ইনি সুভদ্র মাজি, কলকাতা পুলিশ। আর ইনি আদিত্য মজুমদার, বেসরকারি গোয়েন্দা। এরা শুভব্রত সাহার মৃত্যুর ব্যাপারে তদন্ত করতে চান।’
‘কলকাতা পুলিশ থেকে এসেছেন? শুভব্রত সাহার মৃত্যুর ব্যাপারটা তদন্ত করতে চান?’ তমাল বিশ্বাসকে বিপন্ন দেখাচ্ছে। ‘আমাকে কী করতে বলছেন স্যার?’
‘আপাতত কিছুই করতে বলছি না। আমিই এদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। তবে পরে তোমাকেও এরা কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন। তাই আগে থেকে বলে রাখলাম। আচ্ছা, কাল ভোরবেলা তো এদের নিয়ে ছোটবাবুর পাখি দেখতে যাবার কথা । তোমাকে ব্যবস্থা করে রাখতে বলেছিলাম। ব্যবস্থা হয়েছে?”
‘হ্যাঁ স্যার। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।’
‘ব্যবস্থাটা করে রাখ। এদের আসল পরিচয়টা জানতে পারলে ছোটবাবু এদের নিয়ে পাখি দেখতে যাবেন কিনা জানি না। তবু ব্যবস্থাটা করা থাক। ঠিক আছে। তুমি এখন আসতে পার। বাইরেই থাক। দরকার হলে ডাকব।’
তমাল বিশ্বাস বেরিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এল। বলল, ‘পরিমলকে ব্যবস্থাটা করতে বলেছিলাম স্যার। ও নিশ্চয় সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। তবু আমি একবার ওর সঙ্গে কথা বলে দেখে নিচ্ছি। ওর তো মোবাইল নেই। সামনা সামনি কথা বলতে হবে। আপনি নিশ্চিন্তে এদের সঙ্গে কথা বলুন স্যার। আমি এদিকটা দেখছি।’ তমাল বিশ্বাস আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তমাল বেরিয়ে যাবার পর প্রণব মাইতি শান্তভাবে বললেন, ‘চা খান। ‘
তারপর একটু থেমে বললেন, ‘আপনাদের কিন্তু ছদ্ম-পরিচয়ের দরকার ছিল না। এখানে আমরা সকলেই ল-অ্যাবাইডিং সিটিজেন। পুলিশ এসে কিছু জিজ্ঞেস করলে আমরা যেটুকু জানি এমনিতেই বলে দিতাম।’
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য জিজ্ঞেস করল, ‘শুভব্রত সাহা আপনাদের এখানে কত দিন কাজ করেছেন?’
‘ঠিক কত দিন বলতে পারব না, ফাইল দেখে বলতে হবে। তবে বছর বারো তো হবেই। হয়ত আর একটু বেশি।’
‘উনি কী কাজ করতেন?’
‘শুভব্রত সাহা অ্যাকাউন্টস অফিসার হয়ে ঢুকেছিল। ছেলেটা বেশ চটপটে, চালাক-চতুর। তাই দেখে পরে ওকে ডিসট্রিবিউশন ম্যানেজার করে দেওয়া হয়।’
‘কত দিন পরে?’
‘এটাও ফাইল না দেখে একেবারে সঠিক বলতে পারব না। আমার যত দূর মনে পড়ছে, শুভব্রতর যখন প্রোমোশন হল তখন ওর আট-ন’বছর চাকরি হয়ে গেছে।’
‘তার মানে তিন-চার বছর উনি ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার ছিলেন?’
‘মোটামুটি ওইরকমই হবে।’
‘আচ্ছা, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, এর আগে আপনাদের ডিসট্রিবিউশনটা দেখত যে কম্পানি তার মালিক পার্থ মিত্র খুন হয়েছিলেন?”
‘হ্যাঁ…… মনে আছে।’ প্রণব মাইতিকে দেখে মনে হল অস্বস্তিতে পড়েছেন। ‘উনি খুন হওয়ার পরেই কি শুভব্রতবাবু ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজার হলেন?’ ‘হ্যাঁ। আমরা ঠিক করলাম বাইরের কম্পানিকে দিয়ে আর ডিসট্রিবিউশনটা করাব না। নিজেরাই নিজেদের মাল ডিসট্রিবিউট করব। সেই অনুযায়ী ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজারের পদটা তৈরি হল। জেলায় জেলায় বিক্রির জন্য এজেন্ট নিয়োগ করা হল।’
‘আচ্ছা, শুভব্রত সাহা কত টাকা মাইনে পেতেন?’
‘এটাও অফহ্যান্ড বলতে পারব না। খুব বেশি নয়। আমাদের দিশি কম্পানি তো। খুব বেশি আমরা দিতে পারি না। এই ধরুন মাসে ফিফটি থাউসেন্ড মতো পেতেন।’ ‘এই টাকাটা আপনারা ওর স্ত্রীকে দিয়ে যাবেন? শুভব্রত কম্পানির টাকা সরিয়েছে এটা জেনেও?’
‘দেখুন, এটা আমার ডিসিশন নয়, ছোটবাবুর ডিসিশন। ছোটবাবুর দয়ার শরীর তাঁর মনে হল শুভব্রতর পরিবার না খেয়ে মরবে।’
‘শুভব্রত চোর এটা আপনাদের কেন মনে হল?
“কিছু দিন ধরেই সন্দেহ হচ্ছিল। বিক্রি থেকে যতটা ক্যাশ-ফ্লো হবার কথা তার থেকে কম টাকা কম্পানির অ্যাকাউন্টে ঢুকছিল। এই ব্যাপারটা শুভব্রতর আনডারে। শুভব্রত যে অ্যাকাউন্টগুলো হ্যান্ডেল করে সেগুলো চেক করে দেখলাম। চুরিটা খুব সহজেই ধরা পড়ে গেল।’
আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ভাবছে। সুভদ্র সাংবাদিক সাজতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার পর থেকে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে আর মুখই খুলছে না। অবশেষে আদিত্যই আবার মুখ খুলল ।
‘অন্য একটা প্রশ্ন করছি। আপনারা র-মেটিরিয়াল কোথা থেকে কেনেন?’ ‘ময়দা আসে ইউপি থেকে আর দুধটা লোকালি প্রোকিওর করা হয়। ইস্ট আসে বাংলাদেশ থেকে। ‘
‘বাংলাদেশ থেকে ইস্ট? কেন? আমাদের দেশে ইস্ট পাওয়া যায় না?’
‘আসলে, মুসলিমদের রুটি-কেক বানানোর একটা পুরোনো ট্র্যাডিশন আছে। সেই ট্র্যাডিশন মেনে বহুবছর ধরে ঢাকা থেকে আমাদের ইস্টের সাপ্লাই আসছে। এটা স্পেশাল এক ধরনের ইস্ট। অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না।’
‘কীভাবে আসে? বাই রোড?’
‘আগে তাই আসত। বাহাত্তর সাল থেকে ভারত-বাংলাদেশ রিভার ট্রেড রুট খুলে গেছে। নদীপথে কিছু রুট আছে, যেগুলোকে বলা হয় প্রোটোকল রুট। সেই রকম একটা রুট দিয়ে আমাদের ইস্ট আসে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর-বরিশাল হয়ে সোজা নামখানা। সেখান থেকে ডায়মন্ডহারবার। আমরা মালটা ডায়মন্ডহারবার থেকে কালেক্ট করে নিই।’
‘আচ্ছা, কিছুদিন আগে আপনাদের গেটের কাছ থেকে আপনাদেরই একটা পাঁউরুটি-ভর্তি ট্রাক লুট হয়েছিল না?’
‘হ্যাঁ, সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। এত কষ্ট করে কেন পাঁউরুটির ট্রাক লুট করল কে জানে। হয়ত কিছু স্টারভিং ভিলেজার কাজটা করেছে। যাই হোক তার পর থেকে আমরা সিকিউরিটি অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছি।’
‘আর একটা প্রশ্ন। আমরা শুনলাম সেন বেকারি সম্প্রতি শাড়ি এক্সপোর্ট-এর ব্যবসায় ঢুকেছে। এটা কি ঠিক?’
‘হ্যাঁ ঠিক। বলতে পারেন খানিকটা বাধ্য হয়েই আমাদের অন্য ব্যবসায় যেতে হয়েছে। আমাদের পুরোনো মার্কেটটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। বাজারে ভীষণ কম্পিটিশন। নতুন নতুন কম্পানি নতুন নতুন প্রডাক্ট নিয়ে আসছে। টিকে থাকতে গেলে পুরো প্রোডাকশনটা ঢেলে সাজাতে হবে। তার জন্যে অনেক ইনভেস্টমেন্ট দরকার। সে টাকা আমাদের নেই। আমি ভেবে দেখলাম, তার থেকে সহজ অন্য কোনও ব্যবসায় যাওয়া। কাছেই শান্তিপুর, তাঁতিদের জায়গা। সেখান থেকে শাড়ি কিনে অ্যামেরিকায় এক্সপোর্ট করার সম্ভাবনাটা তখনই মাথায় এল।’
‘কিন্তু এক্সপোর্ট করার জন্য তো বিদেশে একটা নেটওয়ার্ক দরকার। সেটা কীভাবে তৈরি করলেন?’
‘আমাদের নিজস্ব কোনও নেটওয়ার্ক নেই। শুধু একটা বিজনেস পার্টনার আছে। আমরা শাড়ি প্রোকিওর করে তাদের দিয়ে দিই। তারা তাদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেই শাড়ি অ্যামেরিকায় বিক্রি করে।’
‘আপনাদের বিজনেস পার্টনারের নাম কী?’
‘গ্লোবাল ট্রেডিং এজেন্সি। খুব বড় কম্পানি। গারমেন্ট এক্সপোর্টের বিশাল বিজনেস এদের।’
জানলা দিয়ে আদিত্য বাইরে তাকাল। সন্ধে নামছে। দূরে কোনও মন্দিরে সন্ধ্যারতি হচ্ছে মনে হয়। ঘন্টার শব্দ ভেসে আসছে। দমকা হাওয়া। গাছের মাথাগুলো প্রবলভাবে দুলছে।
(৩)
প্রণব মাইতির আপিস থেকে বেরিয়ে আদিত্য বুঝতে পারছিল না এবার কোথায় যাবে। সুভদ্র এখনও গুম মেরে আছে। আকাশের মতিগতি ভাল নয়। দুটো লম্বা লম্বা গাছের ফাঁক দিয়ে যে এক টুকরো আকাশ দেখা যাচ্ছে সেটা কালো মেঘে থমথম করছে।
‘গেস্ট হাউসে ফিরে গিয়ে পল্লব সেনের জন্যে অপেক্ষা করা যাক, কী বল?’ আদিত্য সুভদ্রকে জিজ্ঞেস করল।
সুভদ্র উত্তর দেবার আগেই দু’জনে দেখতে পেল মেন গেটের রাস্তা দিয়ে তমাল বিশ্বাস দ্রুতপায়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
‘আপনাদের কথা হয়ে গেল?’ তমাল বিশ্বাস সামান্য হাঁপাচ্ছে। ‘স্যার বলেছিলেন আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে। ভেরি সরি, আমি একটু বাড়ি গিয়েছিলাম। স্যারের চেম্বার থেকে আপনারা অনেকক্ষণ বেরিয়ে এসেছেন?’
‘না, না। এই তো বেরোলাম। ভাবছিলাম গেস্ট হাউসে ফিরে যাই। পল্লব সেন এখনও আসেননি বোধহয়?’ আদিত্য ঘড়ি দেখল।
‘না। ছোট সাহেব এখনও আসেননি। আসলে, আমাদের কম্পানির মালিককে সকলে ছোট সাহেব বলে। সকলের দেখাদেখি আমিও তাই বলি।’ তমাল বিশ্বাস লাজুকভাবে হাসল ।
‘আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হতো। আপনার সময় হবে?’ ‘আমার সময়? কী যে বলেন। অবশ্যই হবে। স্যার তো আপনাদের সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে থাকতে বলেছেন।’
‘তা হলে গেস্ট হাউসেই ফিরে যাওয়া যাক। ওখানে বসে কথা বলা যাবে।’ ‘সেটাই ভাল হবে । ওরা হয়ত একটু চায়েরও ব্যবস্থা করতে পারে।’ সুভদ্র এতক্ষণে কথা বলেছে।
ওরা তিনজন গেস্ট হাউস পৌঁছনোর আগেই ঝড় উঠল। গাছের ডালগুলো যেভাবে দুলছে, ভয় লাগে গাছগুলো বুঝি এখনি উপড়ে পড়বে। একটু দূরে গোডাউনের প্লাস্টিকের শেডগুলো প্রবল হাওয়ায় শব্দ করেই চলেছে। বৃষ্টি নামল। প্রথমে দু’এক ফোঁটা, তারপর ঝমঝম করে। ভাগ্যক্রমে ততক্ষণে তিনজন গেস্ট হাউসে ঢুকে গেছে।
‘শুভব্রত সাহা, আপনাদের ডিসট্রিবিউশন ম্যানেজার, যিনি কিছুদিন আগে মারা গেছেন, আপনি কি তাকে চিনতেন?’ মিনিট কুড়ি পরে আদিত্য চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘শুভব্রত সাহা? …হ্যাঁ চিনতাম।’ তমাল বিশ্বাসকে আড়ষ্ট দেখাল, তার বস প্রণব মাইতিকে যেমন দেখিয়েছিল। ‘কতটা চিনতেন?’
‘সাহা সাহেব তো ম্যানেজার র্যাঙ্কের, আর আমি সাধারণ অ্যাসিস্টেন্ট। একটা দূরত্ব তো থাকবেই। তবে সাহা সাহেব হাসিখুশি, দিলখোলা মানুষ ছিলেন। অফিসে সবার সঙ্গে সমানভাবে মিশতেন। তার মধ্যেই, আমার মনে হয় আমাকে একটু বেশি পছন্দ করতেন।’
‘কেন? আপনাকে আলাদা করে বেশি পছন্দ করতেন কেন?’ সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘আসলে, সাহা সাহেবের কোয়ার্টারটা আমার কোয়ার্টারের পাশেই ছিল। সাহা সাহেবের মস্ত বড় কোয়ার্টার। অত বড় কোয়ার্টারে উনি একাই তো থাকতেন। ওর ফ্যামেলি কালেভদ্রে আসত। তা, একা থাকতে থাকতে মানুষের তো একটু অন্য মানুষের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে করতেই পারে। সেরকম ইচ্ছে সাহা সাহেবের মাঝে মাঝে হতো। তখন আমাকে ডেকে নিতেন। ওঁর রাধুনি একটা ছিল। কিন্তু তার রান্না খেতে খেতে সাহা সাহেবের অরুচি হত। তখন আমার ডাক পড়ত।’
‘আপনি শুভব্রত সাহার বাড়ি গিয়ে রান্না করে দিয়ে আসতেন ? ‘
‘হ্যাঁ। বিশেষ করে বিরিয়ানি বা মাংস খাবার ইচ্ছে হলে সাহা সাহেব আমাকে ডাকতেন। রান্নার মাসি ওসব রাঁধতে পারত না।’
‘বাঃ। আপনার এত গুণ দেখে বোঝা যায় না।’ আদিত্য হালকা গলায় বলল। তমাল বিশ্বাস চুপ করে আছে। বুঝতে পারছে না আদিত্য ঠাট্টা করছে, নাকি প্রশংসা করছে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আদিত্য বলল, ‘মারা যাওয়ার আগে শুভব্রত সাহার ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করেছিলেন?
তমাল বিশ্বাস চুপ করেই আছে। এখন মনে হচ্ছে সে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। তার ভেতরে যেন একটা যুদ্ধ চলছে। সুভদ্র কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। আদিত্য ইশারায় তাকে চুপ করতে বলল। তমাল বিশ্বাস নিজেই ঠিক করুক সে কিছু বলবে কিনা, আর বললে কতটা বলবে।
‘আমরা কি অন্য কোথাও গিয়ে কথা বলতে পারি?’ তমাল বিশ্বাস অবশেষে মুখ খুলেছে। ‘এই জায়গাটা কথা বলার পক্ষে ভাল নয়।’
বাইরে রীতিমত বৃষ্টি পড়ছে। এই অবস্থায় গেস্ট হাউস থেকে বেরোনো মুস্কিল। ‘আপনাদের কারও ঘরে গিয়ে কথা বলা যাবে?’ তমাল বিশ্বাস নিচু গলায় বলল। আদিত্য ইতস্তত করছে। তার ঘরটা ভীষণ অগোছাল হয়ে আছে। দুপুরে খাবার পর কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নিয়েছিল। এলোমেলো চাদর, বালিশ না গুছিয়েই বেরিয়ে পড়েছে। চেয়ার এবং টেবিল দখল করে আছে ছাড়া জামাকাপড়। ওই রকম একটা ঘরে বাইরের কাউকে নিয়ে যেতে সংকোচ হয়।
‘আমার ঘরে যাওয়া যেতে পারে।’ আদিত্যকে আশ্বস্ত করে সুভদ্র বলল। সুভদ্র সত্যিই গোছানো স্বভাবের। তার ঘরে ঢুকে আদিত্য দেখল, পরিপাটি বিছানা, জামাপ্যান্ট ক্লজেটে, ব্যাগটা যত্ন করে টেবিলের তলায় রাখা। ঘরে একটা আরাম কেদারা, একটা চেয়ার। আদিত্য আরাম কেদারায় বসল, তমাল চেয়ারে। সুভদ্র খাটে, বালিশে ঠেশ দিয়ে আরাম করে বসল। তমাল বিশ্বাসকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে।
‘বলুন এবার, কী বলবেন।’ সুভদ্রর গলাটা খানিক অধৈর্য শোনাল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। একটু আগে জিজ্ঞেস করলেন না মারা যাবার আগে সাহা সাহেবের মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখেছিলাম কিনা? মারা যাবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সাহা সাহেবের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছিল। ওঁর বাড়ির পাশেই আমার বাড়ি বলে ঘটনাটা আমি খুব কাছ থেকে ঘটতে দেখেছিলাম।’
‘ঘটনা? কী ঘটনা?’ সুভদ্রকে ঈষৎ উত্তেজিত শোনাল।
‘দেখুন, আমি যেটা বলব সেটা কম্পানির বিরুদ্ধে যেতে পারে। তাই অনুরোধ করছি, দয়া করে কাউকে বলবেন না যে এই কথাগুলো আমি বলেছি। সত্যি বলতে কি, আমি এখনও বুঝতে পারছি না কথাগুলো আমার বলা উচিত কিনা।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন এখানে যে কথাগুলো আপনি বলবেন সেটা আপনার কম্পানির কেউ জানতে পারবে না।’ আদিত্য অভয় দিল।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তমাল শুরু করল।
‘আমি যে ঘটনাটার কথা বলব সেটার সূত্রপাত বেশ কিছু দিন আগে। আমি তখন সবে কম্পানি জয়েন করেছি। এখান থেকে কিছু দূরে জলঙ্গীর ধারে কৃষ্ণচন্দ্রপুর বলে একটা জায়গা আছে। ওখানে সেন বেকারির আর একটা কারখানা ছিল। সেখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। শর্ট-সার্কিট হয়ে সেই কারখানায় আগুন লেগে যায়। একজন মারা যায়। কারখানাটাও সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। দোষটা কিন্তু কম্পানির। পুরোনো ওভেনগুলো অনেকদিন আগেই বাতিল করে দেওয়া উচিত ছিল। ইলেকট্রিকের তারগুলোও বদলানো উচিত ছিল। কর্তাদের গাফিলতিতে সেসব হয়নি। কিন্তু তার থেকেও খারাপ ব্যাপার হল পুরো দোষটা চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই কর্মচারিটির ওপর আগুন লাগার ফলে যার মৃত্যু হয়েছিল।’
‘ইনশিয়োরেন্স ছিল?’
‘একদম ঠিক জায়গায় ধরেছেন। ইনশিয়োরেন্স অবশ্যই ছিল, এবং ইনশিয়োরেন্স কম্পানি যদি প্রমাণ করতে পারত ঘটনাটা কম্পানির নেগলিজেন্স-এর ফলে ঘটেছে তা হলে তারা এক পয়সাও দিত না। তাই ব্যাপারটা এমনভাবে সাজানো হল যাতে মনে হয় ওই কর্মচারিটির অসাবধানতায় দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। আসল কথাটা হল, যেহেতু পুরো দোষটা ওই কর্মচারিটির ঘাড়ে চাপানো হল, তাই তার পরিবার খুব অল্প ক্ষতিপূরণ পেল। জিএম সাহেবের ধারণা হল ওই কর্মচারিটিকে বেশি কমপেনসেশন দিলে ইনশিওরেন্স কম্পানি ধরে নেবে আসল দোষটা সেন বেকারির। ইনশিয়োরেন্স-এর পুরো টাকাটা কম্পানি নিয়ে নিল। এবং বলতে খারাপ লাগে, এই জঘন্য প্ল্যানের পুরোটাই বেরিয়েছিল আমাদের জিএম প্রণব মাইতির মাথা থেকে। ওরকম খারাপ মানুষ আমি আর দেখিনি। ‘
‘কিন্তু এর মধ্যে শুভব্রত আসছে কী করে?” সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
‘বলছি কী করে আসছে। ধীরে ধীরে সব বলছি। তার আগে বলি, যে কর্মচারিটি কম্পানির দোষে মারা গেল, কিন্তু ক্ষতিপূরণ প্রায় পেলই না, তার নাম বিশ্বজিৎ দাস। বিএ পাশ ছেলে, চাকরি পায়নি তাই রুটির কারখানায় কাজ নিয়েছিল। ঠিক শ্রমিকের কাজ নয়, সুভারভাইজারের কাজ। রাত্তিরে যখন কারখানার শিফট শেষ হয়ে যায় তখন বিশ্বজিতের রোজকার কাজ ছিল সব কিছু একবার দেখে নিয়ে দরোয়ানকে কারখানা বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দেওয়া। সেই রাত্তিরে যখন সে সব কিছু ঠিক আছে কিনা দেখবার জন্যে কারখানায় ঢোকে তখনই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল।’ ‘এই বিশ্বজিৎ দাসের সঙ্গে কি আপনার আলাপ ছিল?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল। ‘খুব বেশি আলাপ ছিল না। মুখ চিনতাম।’
‘ঠিক আছে। তারপর বলুন।’
‘মারা যাবার কিছুদিন আগে বিশ্বজিৎ বিয়ে করেছিল। তার বউ রেখা গরিব ঘরের মেয়ে, বাবা-মা কেউ নেই, বিয়ের আগে দাদা-বউদির সংসারে থাকত। বিশ্বজিৎ মারা যেতে রেখা অকূলপাথারে পড়ল। দাদা-বৌদির সংসারে ফিরে যাবার উপায় নেই । এদিকে বিশ্বজিৎও বিশেষ কিছু টাকা-পয়সা রেখে যেতে পারেনি। কম্পানিও তেমন কোনও ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। এই সময় সে মাঝে মাঝেই জিএম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসত। অফিস থেকে যদি আরও কিছু টাকা-পয়সা পাওয়া যায় তার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করত। জিএম সাহেব তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বসিয়ে রাখতেন । সারাদিন বসিয়ে রেখেও অনেক সময় দেখা করতেন না। ব্যাপারটা আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার ভীষণ খারাপ লাগত। কিন্তু আমি তো একেবারেই চুনোপুঁটি। প্রণব মাইতি স্যার যেখানে বলে দিয়েছেন টাকা দেবেন না সেখানে আমি কী করতে পারি?’
‘আপনাদের ছোটবাবু ব্যাপারটা জানতেন না?’
‘ঘটনাটা ঘটার সময় ছোটবাবু দেশে ছিলেন না। পাখি দেখতে নরওয়ে না ফিনল্যান্ড কোথায় যেন গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পরে জিএম সাহেব তাঁকে বললেন কৃষ্ণচন্দ্রপুরের কারখানা আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ইনশিয়োরেন্স কম্পানির কাছে ক্লেম সাবমিট করা হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে ভাল টাকাই পাওয়া যাবে। আমার মনে হয়, একটা লোক যে কারখানার মধ্যে পুড়ে মারা গেছে সেটা ছোটবাবুকে জানানোই হয়নি।’
‘তারপর?’
‘তারপর এক সময় ইনশিয়োরেন্স-এর টাকাটা পাওয়া গেল। ছোটবাবু তাতেই খুশি। আর কিছু উনি জানতে চাননি। খুশি হয়ে উনি আবার কোথাও পাখি দেখতে চলে গেলেন।’
“আর রেখা দাস ?
‘হ্যাঁ, সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। এই সময় রেখা দাসের সঙ্গে শুভব্রত সাহা স্যারের দেখা হয়। প্রণব মাইতি স্যারের কাছে সুবিধে করতে না পেরে রেখা দাস সাহা সাহেবকে গিয়ে ধরেছিল। সাহা সাহেব আমাদের জিএম-এর মতো অমানুষ নন। তাছাড়া পুরো ব্যাপারটা জানতেন বলে উনি রেখা দাসের প্রতি বেশ সিমপ্যাথেটিক ছিলেন। কিন্তু ওঁর পক্ষেও চট করে কিছু করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু রেখা দাস, ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ভেসে ওঠার চেষ্টা করে, তেমনি করে সাহা সাহেবকে আঁকড়ে ধরল। কারখানা ছুটি হবার পরে আমি মাঝে মাঝেই ওকে সাহা সাহেবের কোয়ার্টারে আসতে দেখতাম। জিএম সাহেব আমাদের সকলের বস, কম্পানিটা উনিই চালান। ওঁকে টপকে রেখা দাসের জন্যে কম্পানির তরফ থেকে কিছু করা সাহা সাহেবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু রেখা দাসকে যে উনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন এটা সাহা সাহেব নিজেই আমাকে বলেছিলেন।’
‘রেখা দাসের বাড়ি কোথায়?’
‘ওই কৃষ্ণচন্দ্রপুর অঞ্চলেই, যেখানে কারখানাটা ছিল। ওখানে বিশ্বজিৎ দাসের পৈতৃক একটা ছোট বাড়ি আছে। সেখান থেকেই রেখা দাস সাহা সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে আসত । এইভাবে রোজ আসতে আসতে রেখা দাসের সঙ্গে সাহা সাহেবের একটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হল। আমার চোখের সামনেই ব্যাপারটা ধীরে ধীরে ঘটে গেল । আমি জানতাম সাহা সাহেবের বউ-মেয়ে আছে। তাদের এখানে দু’একবার আসতেও দেখেছি। তাই ব্যাপারটা আমার ভাল লাগেনি। বিশ্বজিৎ দাসের পরিবারকে কম্পানির ফাঁকি দেওয়াটা যেমন ভাল লাগেনি, তেমনই বউ-বাচ্চা থাকতে একটা সদ্য বিধবা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক পাতানোটাও খারাপ লেগেছিল। আর মেয়েটাই বা কী রকম? এত তাড়াতাড়ি স্বামীকে ভুলে গেল? যাই হোক, আমি অতি সামান্য অফিস অ্যাসিস্টেন্ট, আমি আর কী বলব? তাই চুপ করেই ছিলাম। কিন্তু টের পেতাম ব্যাপারটা একটা খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে।’
‘খারাপ দিক? মানে আপনি কি বলতে চাইছেন শুভব্রত সাহার মৃত্যুর সঙ্গে এই ব্যাপারটার যোগ আছে?’
‘আমার তো তাই মনে হয়। এটা ছাড়া আমি তো কোনওভাবেই সাহা সাহেবের আত্মহত্যাটার ব্যাখ্যা পাচ্ছি না।’
‘আপনি নিশ্চিত শুভব্রত সাহা আত্মহত্যাই করেছেন?’ সুভদ্র তীক্ষ্ণ গলায় বলল। ‘কেন? সকলে তো তাই বলছে। পুলিশও শুনলাম তাই বলছে। এটা কি অন্য কিছু হতে পারে?’ তমাল বিশ্বাসের গলাটা বিভ্রান্ত শোনাল।
“না, না। আত্মহত্যাই হবে। আপনি বলুন কী বলছিলেন। আদিত্য তমাল বিশ্বাসকে ভরসা দিল।
‘যেটা বলতে চাইছিলাম সেই খবরটা শুনলে আপনারা আঁতকে উঠবেন। খবরটা হল, সাহা সাহেব মারা যাবার সপ্তাহ খানেক আগে রেখা দাসের বাড়িতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। রেখা দাস বিষ খেয়েছিল। পুলিশ এটাকেও আত্মহত্যাই বলছে। আরও শুনলাম, রেখা দাস নাকি অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সত্যিই ছিল কিনা জানি না, লোকে বলছে ছিল। এসব পাড়াগাঁয়ে অবশ্য লোকে নানা গুজব রটায়। তবে রেখা দাসের সঙ্গে যে শুভব্রত সাহার কোনও যোগ থাকতে পারে এটা কেউ জানে না। আমি জানি কারণ ব্যাপারটা আমি চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। জানাজানির যেটুকু সম্ভাবনা ছিল সেটাও খুব কৌশলে কম্পানি চেপে দিয়েছে। আমাদের এই ছোট্ট জায়গায় সেন বেকারির এখনও বেশ দাপট আছে। আসলে জিএম সাহেব ভয় পাচ্ছেন, পুলিশ যদি জানতে পারে শুভব্রত সাহার আত্মহত্যার কারণ রেখা দাসের আত্মহত্যা, তা হলে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়বে। বিশ্বজিৎ দাসের মৃত্যুর আসল কারণটা জানাজানি হয়ে যাবে। ইনশিয়োরেন্স কম্পানিও তাদের টাকা ফেরত চেয়ে মামলা করতে পারে।’ ঘরে স্তব্ধতা। আদিত্য এবং সুভদ্র দু’জনেই নিজেদের মতো করে নতুন খবরগুলো হজম করার চেষ্টা করছে। সুভদ্রই আগে কথা বলল।
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, শুভব্রত সাহা এবং রেখা দাসের মধ্যে একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল যার জেরে রেখা দাস প্রেগনেন্ট হয়ে যায় এবং হয়ত শুভব্রতকে বলে তাকে বিয়ে করতে হবে। শুভব্রত রাজি হয় না, কারণ তার বউ-মেয়ে আছে। তার ফলে রেখা দাস আত্মহত্যা করে। রেখা দাসের আত্মহত্যার খবর পেয়ে শুভব্রত সাহার মনে তীব্র অনুশোচনা হয় এবং সেই অনুশোচনার কারণে কিছুদিন বাদে সেও আত্মহত্যা করে। এটাই বলছেন তো আপনি?’
‘হ্যাঁ, মোটামুটি এটাই বলছি।’
এবার আদিত্য মুখ খুলল।
‘আচ্ছা, আপনি এত কথা আমাদের কেন বলছেন বলুন তো? এসব বলে আপনার কী লাভ? বরং ক্ষতির একটা সম্ভবনা আছে। যদি সত্যিই ওই আগুন লাগার ঘটনাটা নিয়ে কম্পানি কোনও বিপদে পড়ে তা হলে তো আপনারও ক্ষতি। কম্পানির যা অবস্থা তাতে হঠাৎ বড় কোনও বিপদ এলে কম্পানি উঠেও যেতে পারে। তা হলে তো আপনারও চাকরি চলে যাবে।’
‘আপনি ভীষণ সঙ্গত একটা প্রশ্ন করেছেন। আমি খুব সৎভাবে আপনার প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি। দেখুন যেটা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি সেটা পুলিশকে জানানোর একটা প্রবণতা সব নাগরিকেরই থাকে। আমারও আছে। তবে এখানকার পুলিশকে এসব জানিয়ে খুব একটা লাভ নেই। তাই আপনাদের পেয়ে আমার কথাগুলো বললাম। এটা একটা কারণ, কিন্তু আমার কথাগুলো বলার আসল কারণ এটা নয় । আসল কথাটা হল, আমি এই কম্পানিতে খুব অপমানে আছি। এবং অপমানের মূল কারণ আমাদের জিএম প্রণব মাইতি। কারণে অকারণে লোকটা আমাকে অপমান করে। কম্পানিতে হয়ত আরও অনেকে এরকম আছে। কিন্তু আমার মতো এতটা অপমান আর কাউকে সহ্য করতে হয় না যেহেতু তাদের সারাক্ষণ জিএম-এর সামনে থাকতে হয় না। আমি অন্য একটা চাকরি পেয়ে গেছি। এই কম্পানি ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু কম্পানি ছেড়ে চলে যাবার আগে আমি চাই ওই লোকটার যেন একটা শাস্তি হয়। অন্তত ওর খারাপ কাজগুলোর কথা যেন সবাই জানতে পারে। বলতে পারেন প্রতিশোধ।’
তমাল বিশ্বাস হাঁপাচ্ছে। মনে হয় তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে পকেট থেকে একটা ইনহেলার বার করে দুটো পাফ নিল।
‘আপনার কি অ্যাজমা আছে?’ সুভদ্র ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। তমাল বিশ্বাস কথা বলতে পারছে না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। আদিত্য ইশারায় সুভদ্রকে অপেক্ষা করতে বলছে।
একটু পরে তমাল বিশ্বাস নিজে থেকেই বলল, ‘উত্তেজনা হলে অ্যাজমাটা বাড়ে। এখন অনেকটা ঠিক হয়ে গেছি।’
‘আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে। এখন উত্তর দিতে পারবেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘পারব, বলুন।’
‘সেন বেকারির কৃষ্ণচন্দ্রপুরের কারখানাটায় এখন কী হয়?”
‘কিছুই হয় না। ওটা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।’
‘অন্য একটা প্রশ্ন। আপনাদের জিএম বলছেন, শুভব্রত কম্পানির টাকা চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাই লজ্জায়, অপমানে সুইসাইড করে। আপনার কি মনে হয় শুভব্রত সাহা অসৎ ছিল?’
‘দেখুন, ওপর ওপর দেখে কাউকেই তো ঠিক বোঝা যায় না। তবু বলব, সাহা সাহেবকে আমার কোনও দিনই অসৎ মনে হয়নি। তাছাড়া উনি খুব সাধারণভাবে থাকতেন। আমি যতদূর জানি, একটা ফ্ল্যাটও কিনতে পারেননি। কলকাতায় ওর পরিবার কম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকত ।
‘আচ্ছা, একটা কথা বলুন। আপনাদের জিএম সাহেব একদিকে বলছেন শুভব্রত সাহা চোর। আবার অন্যদিকে কম্পানি ওর স্ত্রীকে বিপুল অর্থ সাহায্য করবে বলেছে। শর্ত, ওর স্ত্রী পুলিশ বা সাংবাদিকদের কাছে যেতে পারবে না। এই দুটো কি কনট্রাডিকটরি হয়ে গেল না?’
তমাল বিশ্বাস ভাবছে। অনেকক্ষণ ধরে ভাবছে। শেষে বলল, “আমার সন্দেহটাই তা হলে ঠিক। কম্পানির পুরোনো দোষ ঢাকবার জন্যে শুভব্রত সাহাকে চোর সাজানো হচ্ছে। এই প্রণব মাইতি লোকটা যে কতটা নিচে নামতে পারে এটা তার আর একটা প্রমাণ ।’
বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে।
(৪)
তমাল বিশ্বাস চলে যাবার পরে আদিত্য তার নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল। ঘরের আলো নিবিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। জানলা দিয়ে হঠাৎ বাইরে তাকালে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ধীরে ধীরে একটা-দুটো গাছের অবয়ব ফুটে উঠবে। তাদের ডালপালাগুলো দমকা হাওয়ায় উথাল-পাথাল করছে। বৃষ্টির বেগ কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে।
কেউ দরজায় খট খট করছে। দুপুরের সেই কালী বেয়ারা।
‘আপনার ঘরে আলো নেই স্যার?’
‘আছে তো। আলোটা আমি ইচ্ছে করেই নিবিয়ে রেখেছি। ওই তো ফ্যান চলছে।’ ‘আসলে গেস্ট হাউসের সামনে একটা ইলেকট্রিকের পোস্ট পড়ে গিয়ে এক দিকের আলোগুলো জ্বলছে না। দেখছেন না, গেস্ট হাউসের সামনের রাস্তাটা একেবারে অন্ধকার। আপনাদের ফ্লোরে তা হলে আলো আছে।’
কালী বেয়ারা চলে যাচ্ছিল। আদিত্য গলা তুলে বলল, “তোমাদের ছোট সাহেব কি এসে গেছেন?’
‘এখনও আসেননি মনে হয়। এলে দেখতে পেতাম। এই রাস্তা দিয়েই তো সাহেবকে বাংলোতে যেতে হয়। যা বৃষ্টি। সাহেব হয়ত পথে কোথাও আটকে পড়েছেন।’
আদিত্য ঘড়ি দেখল। আটটা বাজে। ‘এক কাপ চা পাওয়া যাবে?’ “নিশ্চয় স্যার। আপনার সঙ্গে যিনি আছেন উনিও খাবেন তো?” ‘মনে হয় খাবেন। জিজ্ঞেস করে নাও না। উনি ওঁর ঘরে আছেন।’ কালী বেয়ারা চা দিয়ে যাবার পর আদিত্য আরও কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে রইল। বাইরে বৃষ্টি আর হাওয়ার তাণ্ডব চলছে। বড় বড় গাছগুলো হাওয়ার দাপটে মাটিতে শুয়ে পড়তে পড়তে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। বলা শক্ত তারা কতক্ষণ হাওয়ার এই প্রবল দাপট সইতে পারবে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই চারটে ট্রাক কারখানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আদিত্যর জানলা থেকে খুব ভাল দেখা যাচ্ছে না, তবে মনে হচ্ছে ট্রাকে রুটি উঠছে। আদিত্য আন্দাজ করল, পাঁউরুটি এসেনশিয়াল গুড। কাল সকালের মধ্যে বিভিন্ন রিটেল আউটলেটে পৌঁছে দিতেই হবে। তাই ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে পাঁউরুটি ট্রাকে উঠছে। তবে আদিত্যর মনে পড়ে, ছোটবেলায় খুব ঝড়-বৃষ্টির দিনে বাড়িতে ফ্রেশ পাঁউরুটি আসত না। নুরুল বাবুর্চির মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। এখন নিশ্চয় দিনকাল বদলেছে।
ন’টা নাগাদ আদিত্যর ফোনটা বেজে উঠল। পল্লব সেন।
‘এন এইচ থার্টিফোর-এ গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। মানে এখন যেটার নাম হয়েছে এন এইচ টুএলভ।’ পল্লব সেনের গলাটা বিপন্ন শোনাচ্ছে।
“সে কী! কী করে হল?’ আদিত্যর উৎকণ্ঠাটা বানানো নয়।
‘নামেই ন্যাশানাল হাইওয়ে। রাস্তার জায়গায় জায়গায় একেবারে পুকুরের মতো গর্ত। তার ওপর এই জঘন্য ওয়েদার। একটা বিশাল গর্তে পড়ে গাড়ির অ্যাক্সেল ভেঙে গেছে।’
‘আপনি এখন ঠিক কোথায় রয়েছেন? ‘
‘কৃষ্ণনগর থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। এটা আন্দাজে বলছি। বেশিও হতে পারে। দু’দিকে জমাট অন্ধকার। মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। অনেক দূরে একটা দুটো আলো দেখতে পাচ্ছি। হয়ত ওখানে কোনও লোকালয় আছে। আমাদের ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজারকে ফোন করেছি। ও একটা গাড়ি পাঠাবার চেষ্টা করছে। মুস্কিল হচ্ছে এত রাত্তিরে ড্রাইভাররা সবাই বাড়ি চলে গেছে। ওরা কোনও ড্রাইভারকে বাড়ি থেকে ধরে আনতে চেষ্টা করছে। এদিকে আমার গাড়ির ড্রাইভার ছাতা নিয়ে ওই দূরে আলোর দিকে হাঁটা দিয়েছে। যদি একটা মেকানিক পাওয়া যায়। সম্ভাবনা অবশ্য খুবই ক্ষীণ। আমি গাড়ির কাঁচ তুলে ভেতরে বসে আছি।’
“ও আচ্ছা। এবারে বুঝলাম আপনার দিক থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোনও শব্দ কেন পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘শুনুন, আমি বেশিক্ষণ কথা বলব না। মোবাইলে খুব বেশি চার্জ নেই। আমি বলছি, আমার তো কৃষ্ণনগর পৌঁছনোর কোনও ঠিক নেই। আপনারা ডিনার করে শুয়ে পড়ুন। হোপফুলি কাল সকালে দেখা হবে। তবে এই ওয়েদার চলতে থাকলে পাখি দেখতে যাবার প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে মনে হচ্ছে।’
‘আরে না, না। পাখি দেখা নিয়ে ভাববেন না। আপনার এখানে তাড়াতাড়ি চলে আসাটাই এখন প্রায়োরিটি।’
আদিত্য মোবাইল রেখে উঠে দাঁড়াল। আলো জ্বালল। বাইরে বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণ নেই। সুভদ্রর ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিল। তারা দু’জন যখন প্রায় নীরবে ডিনার সারছে তখনও সমানে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল। ডিনার শেষ করে সুভদ্র নিজের ঘরের সামনে পৌঁছে চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘গুড নাইট আদিত্যদা। কাল সকালে দেখা হবে।’
‘ঘরের ভেতরে চল, কথা আছে।’ আদিত্য চাপা গলায় বলল।
সুভদ্র কিছুটা অবাক হয়েছে। ‘কী ব্যাপার? কিছু হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি। তবে আমার মন বলছে আজ রাত্তিরে কিছু একটা হবে। কী হবে খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু আন্দাজটা ভুল হতে পারে তাই এক্ষুনি কিছু বলব না।’
আদিত্য ঘরে ঢুকে ধীরে সুস্থে একটা চেয়ারে বসল। সুভদ্র খাটের ওপর বসে আদিত্যর পরবর্তী কথাগুলো শোনার জন্য তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘একটা কাজ করতে হবে। এই বৃষ্টির মধ্যে কাজটা সহজ হবে না।’ ‘কী কাজ?’
‘গেস্ট হাউসের বিছানার আরাম থেকে বেরিয়ে এই ঝড়বৃষ্টির রাত্তিরে আমাদের এমন একটা জায়গায় লুকিয়ে থাকতে হবে যেখান থেকে ফ্যাক্টরি, গোডাউন এবং গেস্ট হাউসটা দেখা যায়। আমার ধারণা আজ রাত্তিরে এই জায়গাগুলোর কোনও একটাতে কিছু একটা ঘটবে।’
না ।
‘এখন আমাদের বেরোতে হবে?’ সুভদ্র নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে
‘শুধু বেরতে হবে তাই নয়, সারারাত বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নজর রাখতে হবে এই কারখানায় কোথায় কী ঘটছে। তাছাড়া গেস্ট হাউস থেকে বেরোনোর সময় লুকিয়ে বেরোতে হবে, যাতে আমাদের কেউ দেখে না ফ্যালে।’
‘কখন বেরোব?’
‘আর ধর ঘন্টা খানেক ঘন্টা দেড়েক পরে। গেস্ট হাউসের চৌকিদারটা তার ঘরে ঢুকে গেলে। আসার সময় উঁকি মেরে দেখলাম এখনও লোকটা টুল পেতে মেন গেটের সামনে বসে আছে। আশা করি সারা রাত্তির বসে থাকবে না।
আদিত্যর আশা পূর্ণ হল না। বারোটা বাজতে যখন আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি, তখনও উঁকি মেরে দেখা গেল গেস্ট হাউসের সদর দরজার সামনে লোকটা গ্যাঁট হয়ে বসে আছে।
‘মনে হচ্ছে আমাদের ওপর নজরদারি করার জন্যই ওকে ওখানে বসানো হয়েছে।’ আদিত্য ফিসফিস করে বলল। ‘আমাদের অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তার আগে আমাদের বিছানা দুটো পাশবালিশ দিয়ে সাজিয়ে রাখা যাক। যাতে দূর থেকে দেখলে মনে হয় আমরা ঘুমোচ্ছি।’
দোতলার বারান্দার শেষ প্রান্তে একটা গরাদহীন জানলা। পাশ দিয়ে একটা ড্রেনপাইপ নেমে গেছে।
‘এই এসকেপ রুটটা আমি আগেই দেখে রেখেছিলাম। বৃষ্টির জলে পাইপটা একটু স্লিপারি হয়ে আছে। এখান থেকে বেরোনোটা একটু অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয়, উই ক্যান ম্যানেজ।’
জানলা দিয়ে বেরোনোর আগে আদিত্য পল্লব সেন-এর নম্বরটা ডায়াল করল। মোবাইল সুইচড অফ। সম্ভবত চার্জ কম আছে বলে মোবাইলটা পল্লব সেন বন্ধ রেখেছেন।
আদিত্য আগে নামতে শুরু করল, একেবারে শেষ দিকে এসে অত্যন্ত আনাড়িভাবে হাত স্লিপ করে চিৎ হয়ে মাটিতে এসে পড়ল। ভাগ্যক্রমে ততক্ষণে সে মাটিতে প্রায় নেমেই এসেছিল। তাই শরীরে তেমন চোট লাগেনি। শুধু শ্যাওলা আর ড্রেনপাইপের গায়ে জমে থাকা ময়লায় শার্টের সামনেটা একেবারে নোংরা হয়ে গেছে। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ার ফলে শার্টের পেছন দিকটাও। সুভদ্র কিন্তু অনেক স্মার্টভাবে নামল। জামা-প্যান্টে দাগটুকু লাগল না। পকেট থেকে রুমাল বার করে নোংরা হাত দুটো মুছে নিল শুধু। বোঝাই যায় সে আদিত্যর থেকে অনেক বেশি ফিট। আদিত্য ভাবছিল, কেয়া থাকলে তাকে কিছুতেই এইভাবে নামতে দিত না। বিশেষ করে বুকে স্টেন্ট
বসার পর।
‘একটু ঘুরে যেতে হবে। চৌকিদারটা গেস্ট হাউসের সামনের দিকটায় নজর রাখছে।’ আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
ঝোপ-জঙ্গলের আড়াল দিয়ে তারা দু’জন কারখানার ঠিক উল্টোদিকে একটা পরিত্যক্ত শেড-এর সামনে এসে দাঁড়াল। এক সময় হয়ত এই জায়গাটাও কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হত, এখন দেখে মনে হয় বহুদিন অব্যবহৃত পড়ে আছে। জায়গাটায় সাপখোপের ভয় থাকাটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে এই ঘোর বৃষ্টিতে যখন সাপেদের গর্তগুলোয় জল ঢুকে গেছে। পুরো অঞ্চলটা এমনিতে কুপকুপে অন্ধকার । আদিত্যদের দুজনের দুটো মোবাইলের টর্চ-এর সাহায্যে একটা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গা পাওয়া গেল, যার মাথার ওপর একটা শেড আছে। ওরা ঠিক করল ওখানেই অপেক্ষা করবে কারণ ওখানে দাঁড়ালে ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে কারখানা, গেস্ট হাউস এবং পল্লব সেনের বাংলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অথচ অন্ধকার এবং ঝোপের আড়াল রয়েছে বলে আদিত্যদের কেউ চট করে দেখতে পাবে না। তাছাড়া মাথার ওপর ছাউনিটাও দরকার কারণ বৃষ্টি এখনও সমানে হয়ে যাচ্ছে। অসুবিধের দিক হল, এখানে বসবার কোনও জায়গা নেই আর জায়গাটায় সাপ-খোপের ভয় ছাড়াও প্রচণ্ড মশার উৎপাত ।
রাত্তির বারোটা পঞ্চাশ অব্দি মশা তাড়িয়ে কেটে গেল। আদিত্য বা সুভদ্র দু’জনেই মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রেখেছে এবং কেউই মোবাইল খুলতে পারছে না, পাছে মোবাইলের আলো কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাত্তির একটা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেল। গাছের পাতা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরছে। একটা বিদ্যুতের খুঁটি হাওয়ার আঘাতে উপড়ে গিয়ে বিপজ্জনকভাবে মাটি ছুঁয়ে আছে। তার সঙ্গে সংলগ্ন বিদ্যুতের তারটাও মাঝে মাঝে মাটি ছুঁয়ে ফেলছে। তারটা যখনই মাটি ছুঁচ্ছে, তার থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে।
সুভদ্র উসখুস করছে। আদিত্য চিন্তামগ্ন। ‘ভাবছি, পল্লব সেন এখনও কেন এসে পৌঁছতে পারলেন না।’ আদিত্য চিন্তিত গলায় বলল।
উত্তরে সুভদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার কথা শুরু হবার আগেই একটা গাড়ি, মাঝারি সাইজের একটা সিডান, কারখানার সামনে এসে থেমেছে। এত দূর থেকে তার রঙটা সাদাই মনে হচ্ছে। তবে রঙটা গ্রে, অফ হোয়াইট বা খুব হালকা নীলও হতে পারে। গাড়িটা কারখানার সামনে থেমেই রয়েছে। কিন্তু গাড়ি থেকে কেউ এখনও বেরোয়নি।
হঠাৎ জেনারেল ম্যানেজার প্রণব মাইতি কারখানার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। সঙ্গে দু’জন সিকিউরিটি, প্রত্যেকের হাতে একটা করে সুটকেস। মনে হয় সুটকেসগুলোর ওজন আছে, কারণ সুটকেসের ভারে দু’জন সিকিউরিটিই ঈষৎ নুয়ে পড়েছে। গাড়ির ড্রাইভারের সিট থেকে একজন নেমে ডিকি খুলে দিল। সুটকেস দুটো গাড়ির ডিকিতে রাখা হল। ডিকি বন্ধ হল। প্রণব মাইতি পুরো ব্যাপারটা দেখভাল করছে। সে গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু একটা বলল। ড্রাইভার গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিল। গেট খোলার শব্দ। গাড়িটা ধীরে ধীরে কারখানার চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মাইতি তার লোকজন নিয়ে আবার কারখানার ভেতর ঢুকে গেল। আদিত্য মোবাইল বার করে খুব দ্রুত কাউকে মেসেজ করছে।
আবার দীর্ঘ স্তব্ধতা। শুধু গাছের পাতা থেকে বৃষ্টির জল ঝরে পড়ার শব্দ। দূরে শেয়াল ডাকছে। আদিত্যদের সামনে ঘাসের ওপর দিয়ে সড়সড় করে কিছু একটা চলে গেল। সাপ? নাকি মেঠো ইঁদুর? রাত্তির পৌনে দুটো নাগাদ গেট খোলার শব্দ। একটা কালো এসইউভি ধীরে ধীরে এসে গেস্ট হাউস পেরিয়ে পল্লব সেনের বাংলোর সামনে থামল। ড্রাইভার তার আসন থেকে নেমে পিছনের সিটের দরজা খুলে দিতে যিনি টলতে টলতে নেমে বাংলোর মধ্যে ঢুকে গেলেন তিনি পল্লব সেন ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।
‘যাক, ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত বাড়ি ফিরলেন।’ সুভদ্র না বলে পারল না। মিনিট পনের পরে কালি বেয়ারা খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে গেস্ট হাউস থেকে বাংলোয় ঢুকল।
‘পল্লব সেনের ডিনার। অতক্ষণ মাঠের মধ্যে বসে থেকে ভদ্রলোকের নিশ্চয় খুব খিদে পেয়ে গেছে।’ বলতে বলতে আদিত্য লক্ষ করল জিএম প্রণব মাইতি সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে আসছেন। সাঙ্গোপাঙ্গরা গেটে ডিউটি করতে চলে গেল। জিএম সাহেব নিজের বাংলোর দিকে পা বাড়ালেন।
আরও একটু পরে কালী বেয়ারা খালি বাসনপত্র নিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরে গেল। সুভদ্র বলল, ‘আমরা আর কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাব, আদিত্যদা?”
আদিত্য বলল, ‘আর একটু দেখি। মন বলছে, আরও কিছু ঘটবে।’
উত্তরে সুভদ্র একটা লম্বা হাই তুলল। মশার উৎপাত না থাকলে সে বোধহয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ত। অন্তত পরের এক ঘন্টা আদিত্যর ভবিষ্যৎবাণী মেলার কোনও লক্ষণই দেখা গেল না। ঘটনা বলতে মাঝে মিনিট পনের বৃষ্টি হয়েছিল, এখন তাও সম্পূর্ণ থেমে গেছে। ঝিঁঝি ডাকছে। রাত জাগা একটা পেঁচাও কোথাও একটা ডেকে উঠল। বাংলোতে যে দু’একটা আলো জ্বলছিল, সেগুলোও অনেকক্ষণ হল নিবে গেছে। শুধু উপড়ে যাওয়া বিদ্যুতের খুঁটিটার সংলগ্ন তার থেকে এখনও মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঠিকরোচ্ছে।
সুভদ্র বলল, ‘আর পারছি না, আদিত্যদা। আমি এবার ঘুমোতে যাচ্ছি। গেস্ট হাউসের সদর দরজা দিয়েই ঢুকব তো?’
‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। ওদিকে তাকাও। দ্যাখো কী হচ্ছে।’ আদিত্য কারখানার দিকে সুভদ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
তিনটে লোক কারখানার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকের হাতে কিছু একটা রয়েছে। কী রয়েছে এত দূর থেকে আন্দাজ করা শক্ত। দু’জন কারখানার মধ্যে ঢুকে গেল। তৃতীয়জন গেস্ট হাউসের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে। গেস্ট হাউসের চৌকিদারকে কী একটা বলে এই তৃতীয় লোকটা গেস্ট হাউসের ভেতরে ঢুকে গেল। আদিত্য আর সুভদ্র একাগ্রভাবে দেখছে।
মিনিট পাঁচেক পরে ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে একটা হলুদ আলোর আভা দেখা গেল। তার কয়েক মিনিট পরে গেস্ট হাউসের দোতলা থেকেও।
‘কারখানায় আগুন লেগেছে আদিত্যদা।’ সুভদ্র চাপা গলায় বলল।
‘আগুন নিজের থেকে লাগেনি, লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ আদিত্য কথাগুলো বলে নিজের মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করল। উল্টোদিক থেকে সাড়া পাবার পর, আদিত্য বলল, ‘মাই অ্যাপ্রিহেনশন ইজ কারেক্ট। ফ্যাক্টরি ইজ অন ফায়ার। আ কেস ‘অফ আরসন আই থিঙ্ক।’ আদিত্য ফোনটা কেটে দিয়ে মোবাইলটা পকেটে পুরে রাখল ।
সুভদ্র কিছুটা হতভম্ভ। বলল, ‘আমরা এখন কী করব আদিত্যদা ?’
‘কিচ্ছু করব না। এখানেই অপেক্ষা করব। নদীয়ার এস পিকে আগুনের কথাটা জানিয়ে দিলাম। এক্ষুনি পুলিশ এবং দমকল এসে যাবে। ওরা এসে যা করার করবে।’
আগুনের লেলিহান শিখা গেস্ট হাউসের দোতলাটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। কালী বেয়ারা আর চৌকিদার বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
‘কেন গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলাম বুঝতে পেরেছ?’ ‘বুঝেছি আদিত্যদা। আপনার জন্যে আজকে প্রাণটা বাঁচল।’
কালী বেয়ারা পল্লব সেনের বাংলোতে ঢুকে গেল। বোধহয় মালিককে খবর দিতে যাচ্ছে। দু’জন সিকিউরিটিকে সঙ্গে নিয়ে জিএম প্রণব মাইতি ছুটতে ছুটতে কারখানার দিকে আসছে। তারা কারখানার কাছাকাছি পৌঁছনোর আগেই সাইরেনের শব্দ শোনা গেল। দমকল এসে পড়েছে। দুটো দমকলের এঞ্জিন কারখানার চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। পেছনে পুলিশ ভান। সব শেষে এস পি সাহেবের গাড়ি।
আদিত্য বলল, “চল এস পি সাহেবকে রিপোর্ট করে আসি।’
দমকল বাহিনী কাজে নেমে পড়েছে। পল্লব সেন, প্রণব মাইতির সঙ্গে কারখানার আরও অনেক কর্মচারি কারখানার বাইরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরা সকলেই মনে হয় কারখানার কাছাকাছি থাকে। ভিড়ের মধ্যে তমাল বিশ্বাসের মুখটাও কয়েকবার আদিত্যর চোখে পড়ল। কারখানার চারদিকে পুলিশের ঘেরাটোপ, কাউকেই কারখানার খুব কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না ।
‘আপনারা গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন দেখে খুব স্বস্তি পেলাম। কী কান্ড বলুন তো? আপনাদের নেমন্তন্ন করে ডেকে আনার পর একটা অঘটন ঘটে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না।’ পল্লব সেনের গলাটা আন্তরিকই শোনাল।
‘কী করে আগুন লাগল কিছু বোঝা গেছে স্যার?” একটি কর্মচারি জিজ্ঞেস করল। ‘এখনও ভাল করে বোঝা যায়নি। তবে কেউ কেউ বলছে শর্ট সার্কিট। একটা ইলেকট্রিকের পোস্ট ঝড়ে পড়ে গিয়েছিল, সেখান থেকেই মনে হচ্ছে আগুনটা লেগেছে।
প্রায় দেড় ঘন্টার চেষ্টায় কারখানার আগুন খানিকটা আয়ত্তে এল। কারখানাটা খানিকটা বাঁচানো গেলেও, গেস্ট হাউসের দুটো তলা একেবারে পুড়ে গেছে। অনেকগুলো গ্যাস সিলিন্ডার রাখা ছিল ওখানে। সেগুলো সশব্দে ফেটে গিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছিল। তবে কোনও হতাহতের খবর নেই, এটুকুই সান্ত্বনা।
কাজ শেষ করে দমকলের ইঞ্জিন দু’টো ফিরে গেল। পুলিশ বাহিনী এখনও কারখানা এবং গেস্ট হাউস ঘিরে রেখেছে। এস পি দীপক কুমার এগিয়ে এসেছেন। তার সঙ্গে পল্লব সেন এবং প্রণব মাইতি।
‘আপনারা দয়া করে বাড়ি ফিরে যান। পুলিশকে কাজ করতে দিন।’ এস পি সাহেব জনতার উদ্দেশে বললেন। তিনি বেশ ভালই বাংলা বলেন। কিন্তু কেউ তার কথা শুনে নড়ল বলে মনে হল না।
‘আপনারা দয়া করে চলে যান। এখানে অকারণে ভীড় বাড়াবেন না। পুলিশকে কাজ করতে দিন।’ এস পি সাহেব গলা তুলে আবার বললেন। তারপর গলা নামিয়ে পল্লব সেন এবং প্রণব মাইতিকে বললেন, ‘আপনারা দু’জন থাকুন। আপনাদের সঙ্গে কথা কাছে।
দু’একজন যাবার উদ্যোগ করলেও বেশিরভাগ এখনও অনড়।
‘এদের হটাও এখান থেকে।’ এস পি সাহেব হুকুম দিলেন।
কয়েকজন কনস্টেবল লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতেই কৌতূহলী জনতা ছত্রভঙ্গ। এস পি সাহেব পল্লব সেন এবং প্রণব মাইতির দিকে তাকিয়ে বললেন,“আপনাদের বিরুদ্ধে আরসেন-এর কমপ্লেন আছে। আপনারাই আপনাদের কারখানায় আগুন লাগিয়েছেন।’
‘আমরা কেন আমাদের কারখানায় আগুন লাগাব?’ জিএম প্রণব মাইতি যেন আকাশ থেকে পড়েছেন। পল্লব সেন হতভম্ভ, বাকরুদ্ধ।
‘ইনশিয়োরেন্স ক্লেম করার জন্য আগুন লাগিয়েছেন। আপনাদের কারখানা তো খুব একটা চলে না। ইনশিয়োরেন্সের টাকা পাওয়া গেলে তো লাভ। এই রকম আগুন কিছুদিন আগে আপনাদের আরেকটা কারখানায় লেগেছিল না?
‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’ পল্লব সেন এতক্ষণে কথা বলতে পেরেছেন। ‘আমার সঙ্গে চলুন, সব বুঝিয়ে দেব। আর আদিত্যসাব আপনারা দু’জনেও চলুন। আপনারা তো আই উইটনেস।’