মৃত্তিকার মৃত্যু – ৯
নবম পরিচ্ছেদ
(১)
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে আদিত্যর কান্না পায়। কিন্তু একবার চোখ থেকে ঘুম ঝেড়ে উঠে পড়তে পারলে, মন্দ লাগে না। সুভদ্র আজ ভোর ছ’টায় গাড়ি নিয়ে এসেছিল। এখন তারা দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার হচ্ছে।
গাড়িটা এসইউভি। সামনের সিটে ড্রাইভার ছাড়াও একজন বন্দুকধারী পুলিশ। একেবারে পেছনের সিটে আরও একজন। মাঝখানে দুটো বাকেট সিট। তার একটাতে আদিত্য, আর একটাতে সুভদ্র। তাদের গন্তব্য কোলাঘাটের কাছে বোরোডাঙ্গি গ্রাম।
ব্রিজের ওপর খুব বেশি গাড়ি নেই। নিচে নদীটাও প্রায় ফাঁকা। ভোরের নরম আলোয় চিকচিক করছে। বোয়া ভাসছে একটা দুটো। ব্রিজের মাঝপথে পৌঁছে সামনের সিটের পুলিশটা চোখ বুজে, জোড়হাত করে মা গঙ্গাকে প্রণাম করল। আদিত্যদের গাড়ি ভি আই পি লেন দিয়ে টোল প্লাজা পেরিয়ে যাচ্ছে। ব্রিজ থেকে নেমে আর একটু গিয়ে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে। এত সকালে সেটাও বেশ ফাঁকা। শুধু দু’একটা জায়গায়, যেখানে বাজার বসেছে, সেখানে একটু ভিড়। আকাশের এক কোণে কিছু মেঘ জমা হয়ে ছিল। গাড়ি বম্বে রোডে পড়ার আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ‘শবনম বলে এই মেয়েটাকে ধরতে পারলে আমরা ব্ল্যাকমেলের কেসটাকে সলভ করে ফেলব। হয়ত মৃত্তিকা মিত্রর কেসটা থেকে অশনি রায়কে অব্যাহতি দেবার মতো একটা অবস্থাও তৈরি হতে পারে।’ সুভদ্র প্রায় নিজের মনে স্বগতোক্তি করল। আসলে সে বুঝতে চায় আদিত্য কী ভাবছে।
আদিত্য উত্তর দিচ্ছে না। জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
‘আমি ঠিক বলছি তো, আদিত্যদা?”
‘কিছুটা ঠিক, পুরোটা ঠিক নয়।’ আদিত্য যেন খানিকটা অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলছে। ‘প্রথমত, শবনমকে ধরতে পারলে শুধু হবে না। ছবিগুলোও তার কাছ থেকে উদ্ধার করতে হবে। না হলে শবনম বলতে পারে তার অজান্তে কেউ ছবিগুলো তুলেছে। সে এইসবের সঙ্গে জড়িত নয়। দ্বিতীয়ত, অশনি রায় যদি শবনমকে রূপলেখা বলে আইডেন্টিফাই করেও, এটা তো প্রমাণ হয় না যে অশনি মৃত্তিকাকে খুন করেনি। এমন তো হতেই পারে, অশনি রূপলেখার সঙ্গে প্রেম করত এবং একই সঙ্গে, কোনও একটা কারণে, মৃত্তিকাকে খুন করেছিল?’
‘কিন্তু অশনি তো বলছে সে মৃত্তিকাকে খুব অল্পই চিনত। অশনি কি মিথ্যে বলছে?’ ‘মিথ্যে বলছে না এটাই বা জোর দিয়ে বলি কী করে? অশনি যে ব্যাঙ্কে কাজ করত সেখানে কাজের সূত্রে মাঝে মাঝেই মৃত্তিকাকে যেতে হতো। দু’জন পরস্পরকে চেনার ব্যাপারটা তো অশনিই স্বীকার করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দুজনের মধ্যে কতটা ঘনিষ্ঠতা ছিল? ব্যাঙ্কের একজন এই ব্যাপারে সাক্ষী দিয়েছিল। বলেছিল দু’জনে ঘনিষ্ঠই ছিল। কিন্তু অরুণপ্রকাশের জেরায় তার সাক্ষ্যটা দাঁড়ায়নি। আর একজন সাক্ষী আছে। বাঙ্গুর এভিনিউএর ওই ফ্ল্যাটের তৎকালীন সিকিউরিটি গার্ড। সে বলছে সে বোধহয় মৃত্তিকা এবং অশনিকে পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে এক সঙ্গে দেখেছে। তবে সে খুব নিশ্চিত নয়।’
‘কিন্তু মৃত্তিকাকে খুন করার ব্যাপারে অশনির মোটিভ কী হতে পারে?’ ‘জানি না। ভাবতে হবে।’ আদিত্য মুখে সেই যে কুলুপ আঁটল, কোলাঘাট পৌঁছনো অব্দি সে কুলুপ আর খুলল না।
কোলাঘাট পৌঁছে আদিত্য বলল, ‘কাজে নামার আগে একটু চা-জলখাবার খেয়ে নিলে হতো না? সকালে তো ব্রেকফাস্ট খাওয়া হয়নি।’
পাঞ্জাবি ধারায় আলুর পরোটা এবং চা খেয়ে আদিত্যরা যখন বোরোডাঙ্গি গ্রামের সেই বাগানবাড়ির সামনে পৌঁছল তখনও আটটা বাজেনি। মেন গেট বন্ধ। চারদিকে উঁচু পাঁচিল। দরোয়ানকে দেখা যাচ্ছে না। একজন পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে গেট ধরে ভয়ঙ্কর ঝাঁকানি দিল। লোহার গেট ঝনঝন করে উঠল। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। পুলিশ দেখে উল্টোদিকের চা-ওলা দোকান ফেলে দৌড়ে এসেছে। আদিত্যরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে।
‘এর মধ্যে তো দরোয়ান উঠে দরজার সামনে বসে থাকে। মালিরাও উঠে কাজ শুরু করে দেয়। আজ এদের হলটা কী ?’ দোকানির স্বতঃপ্রণোদিত জিজ্ঞাসা আরও কয়েকবার সজোরে লোহার গেটে ধাক্কা দেওয়া হল। কোনও সাড়া শব্দ নেই ৷
সুভদ্র একজন পুলিশকে বলল, ‘তুমি গেট টপকে ভেতরে ঢুকে দরজা খুলে দাও।’ পুলিশটি তার সহকর্মীর কাছে হাতের অস্ত্রটা গচ্ছিত রেখে প্রায় অনায়াসে গেট টপকে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর আর তার সাড়াশব্দ নেই।
‘অনিল? অনিল? গেলে কোথায়?’ সুভদ্র গলা তুলে ডাকল। বন্ধ গেটের ওদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
মিনিট পাঁচেক পরে, যখন সুভদ্র আর আদিত্য আলোচনা শুরু করেছে প্রথম পুলিশের খোঁজে দ্বিতীয় জনকেও পাঠাবে কিনা, হঠাৎ গেটটা শব্দ করে খুলে গেল। ‘গেটে তালা দেওয়া ছিল স্যার। দরোয়ানের ঘর থেকে চাবি এনে খুললাম। তাই দেরি হয়ে গেল। খোলা গেট দিয়ে অনিল মুখ বাড়িয়েছে।
‘দরোয়ান কী করছে?’ আদিত্য খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। ‘অঘোরে ঘুমোচ্ছে স্যার। মনে হচ্ছে কেউ কড়া ঘুমের ওষুধ স্প্রে করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ও এমন বেভুল হয়ে ঘুমোচ্ছে, মনে হয় খুব সহজে উঠবে না।’ আদিত্যদের দলটা বাগানবাড়ির ভেতরে ঢুকল। বাগানটাই বেশি অংশ জুড়ে রয়েছে, বাড়ির অংশ কম। গেটের পাশেই দরোয়ানের ঘর। দরোয়ান বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে। ‘ভাগ্যিস দরোয়ানের দরজাটা খোলা ছিল। না হলে চাবিটাই পেতাম না।’ অনিল নামক পুলিশটি নিজের মনেই বলল।
লাল, সাদা, হলুদ, ফুলের বাগানটা সত্যিই মনোরম। একদিকে গোলাপ গোলাপী। মাঝখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে রজনীগন্ধা, গাঁদা। অন্যদিকে জুঁই, বেল, আরও দু’একরকমের ফুল। বাগানের এক কোণে আর একটা ঘর, সম্ভবত মালিদের বাসস্থান। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, একটা জানলা খোলা রয়েছে। খোলা জানলা দিয়ে দেখা গেল দুটো মালি মেঝেতে বিছানা পেতে মরিয়া হয়ে ঘুমোচ্ছে।
‘এদেরও মনে হচ্ছে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।’ দ্বিতীয় পুলিশটি বলল। তার নাম আদিত্য এখনও জানে না।
‘আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বাড়ির ভেতরে যাওয়া যাক।’ আদিত্যর গলায় রীতিমত উৎকণ্ঠা।
দোতলা বাড়ির সদর দরজাটা খোলা। একতলায় দুটো ঘর। একটাতে সোফাসেট পাতা। এটাই মনে হচ্ছে বসার ঘর। তার সংলগ্ন ঘরটাতে অব্যবহৃত হরেক রকম জিনিস ডাঁই করা রয়েছে। সাহেবরা যাকে বলে লাম্বার রুম। একতলায় আর কোনও ঘর নেই।
দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা প্রায়ান্ধকার। সম্ভবত জানলাগুলো বন্ধ রয়েছে বলে। নিচের বসার ঘরটার সাইজে ওপরেও একটা বড় ঘর। এক দিকে একটা খাটের ওপর সাদা বিছানা পাতা। কিন্তু এটাকে ঠিক শোবার ঘর বলে মনে হচ্ছে না। সংলগ্ন ঘরটা মনে হয় বেডরুম। ঘরে আলো জ্বলছে।
আদিত্যরা বেডরুমে ঢুকে থমকে দাঁড়াল। মেঝের ওপর এক পুকুর রক্তের মধ্যে একটি মেয়ে পড়ে আছে। তার শরীরটা একটা উলটে পড়া চেয়ারের সঙ্গে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা। যন্ত্রণায় তার মুখ-চোখ বিকৃত। এ যদি শবনম হয়, তা হলে বোঝাই যাচ্ছে শবনম আর বেঁচে নেই।
প্রাথমিক ঝটকাটা কাটিয়ে উঠে সুভদ্র বলল, “আমাকে লালবাজারে ফোন করতে হবে আদিত্যদা। কয়েকটা ফরম্যালিটি আছে। ডাক্তার আসবে, ফটোগ্রাফার আসবে, ফরেন্সিক এক্সপার্ট আসবে। লাশ নিয়ে যাবার জন্যে একটা এম্বুলেন্সও লাগবে। আমি পাশের ঘর থেকে ফোনটা করে আসছি। এ ঘরে সিগনাল পাচ্ছি না।’
সুভদ্র চলে যেতে আদিত্য পুলিশ দু’জনকে বলল, “আপনারা একটু মেন গেটে পাহারা দিন। দেখুন বাইরের কেউ যেন বাড়ির ভেতরে ঢুকতে না পারে।’
পুলিশ দুজন চলে যাবার পর আদিত্য লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। চারদিকে চাপ চাপ রক্ত। এত রক্ত এল কোথা থেকে? সম্ভবত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে এই মহিলার মৃত্যু হয়েছে। গালে, গলায়, ঘাড়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। কিন্তু কোনওটাই খুব গভীর নয়। তা হলে? আদিত্য হঠাৎ লক্ষ করল মৃতার ডান হাতের তিনটে আঙুলের নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই এত রক্তপাত। এবং অতিরিক্ত রক্তপাতের ফলে মৃত্যু। অতিরিক্ত যন্ত্রণার ফলে মরার আগে এই মহিলা অমানুষিক কষ্ট পেয়েছে। এতটা কষ্ট ওকে কেন দেওয়া হল?
আদিত্য মৃতদেহের থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছিল। টের পায়নি কখন সুভদ্র এই ঘরে ফিরে এসেছে।
‘লালবাজার থেকে টিম আসছে। কিন্তু তার আগে লোকাল থানা থেকে হেল্প চলে আসবে। বাইরে মেন গেটের সামনে ভিড় জমতে শুরু করেছে। অনিল আর রাজু ওদিকটা সামলাচ্ছে। বলল, আপনিই ওদের গেটটা সামলাতে বলেছেন। লোকাল হেল্প এবং লালবাজার থেকে লোক যতক্ষণ না আসছে আমাদের এখানে থাকতে হবে।’
‘তুমি লোকাল থানায় বলে একটা অ্যামবুলেন্স-এর ব্যবস্থা কর। দরোয়ান এবং মালিদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।’
‘ঠিক আছে, দেখছি’ বলে সুভদ্র আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
আদিত্য খুব মন দিয়ে একটা কিছু খুঁজছে। সুভদ্র ফিরে এসে বলল, “বিশেষ কিছু খুঁজছেন আদিত্যদা?’
‘হ্যাঁ। এই মহিলা যদি শবনম হয় তা হলে আমার বিশ্বাস এই ঘরের কোথাও একটা লুকোনো ক্যামেরা থাকবে। সেই ক্যামেরাটাই খুঁজছি।’
‘ক্যামেরা?’
‘হ্যাঁ, লুকোনো ক্যামেরা। শবনম যেভাবে অশনির ছবি তুলেছিল তাতে মনে হয় এই ব্যাপারে ওর একটা এক্সপার্টিস ছিল। মানে, কাজটা ও আগেও করেছে। বলাই বাহুল্য ব্ল্যাকমেলিং-এর উদ্দেশ্যে। এই নির্জনে এসে ও কি ওর পুরোনো রোজগারের রাস্তাটা একেবারে ছেড়ে দেবে? বিশেষ করে ওই চা-ওলা বিমলকে বলেছিল, মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে একা একটা লোক আসে। তাই ভাবছিলাম এই ঘরে লুকোনো ক্যামেরা একটা থাকতেও পারে।’
অনেক খুঁজেও লুকোনো ক্যামেরা-ট্যামেরা কিছুই পাওয়া গেল না। ইতিমধ্যে লোকাল পুলিশ এসে গেছে। দরোয়ান এবং মালিদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ওষুধের প্রভাবে তারা এখনও অচৈতন্য হয়ে ঘুমিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ পরে লালবাজারের টিম এসে গেল। এদের মধ্যে পুলিশের ডাক্তারবাবু আদিত্যর চেনা।
মৃত্যুর কারণের ব্যাপারে ডাক্তারবাবু আদিত্যর সন্দেহটা মোটামুটি কনফার্ম করলেন। বললেন, “এটা তো দেখাই যাচ্ছে যে ডান হাতের তিনটে নখ তীক্ষ্ণ কোনও ছুরি দিয়ে উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ওপর ওপর দেখে মনে হচ্ছে এর ফলে যে অমানুষিক যন্ত্রণাটা হয়েছে সেটার কারণে সম্ভবত হার্ট ফেল হয়েছে। আবার অতিরিক্ত রক্তপাতও মৃত্যুর কারণ হতে পারে। পোস্ট মর্টম না করলে নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর কারণটা বোঝা যাবে না।’
‘এত নৃশংসতা একমাত্র কানা মুমতাজের গ্যাং-এর লোকেরাই করতে পারে। নিশ্চয় খবর গেছে ওই ব্ল্যাকমেলের কেসটার সঙ্গে কানু কানা মুমতাজের নাম জড়িয়ে দিয়েছিল।’ সুভদ্র বলল।
আদিত্য উত্তর দিল না। তার চোখ এখনও ঘরের মধ্যে একটা লুকোনো ক্যামেরা খুঁজে যাচ্ছে। ছবি বা আয়না সরিয়ে তো দেখা হল। কোথাও কিছু নেই। পরিষ্কার সাদা দেয়াল, সেখানেও ফুটো-ফাটা নেই। আলমারির দরজাটা খোলা ছিল, ভেতরের ড্রয়ারগুলোও খোলা ছিল। খুনী একটা কিছু খুঁজেছে। হঠাৎ বিছানার ধারে সুইচ বোর্ডটার দিকে আদিত্যর চোখ পড়ল। আলোর সুইচ, এসির সুইচ, দুটো প্লাগ পয়েন্ট। তার মধ্যে একটা প্লাগ পয়েন্ট বেশ বড়। সাধারণত এত বড় প্লাগ পয়েন্ট রান্নাঘরে থাকে। এটা পনের অ্যাম্প-এর প্লাগ গ্রাইন্ডার, মিক্সার, রেফ্রিজারেটার ইত্যাদি যেগুলোতে বেশি ইলেকট্রিসিটি লাগে সেগুলো ব্যবহারের জন্যে। এটা এখানে কেন? প্লাগ পয়েন্টগুলোতে কোনও প্লাগ লাগানো নেই।
‘এই সুইচ বোর্ডটা খোলা যাবে?’ আদিত্য সুভদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল। ‘একটা ছুরি বা স্ক্রু ড্রাইভার জোগাড় করতে পারবে?’ সুভদ্র অনিলকে জিজ্ঞেস করল। ‘এই সুইচ বোর্ডটা খুলে ফেলতে হবে।’
‘দেখছি স্যার।” অনিল তার পকেট থেকে একটা ফোল্ডিং ছুরি বার করে ফেলেছে। সেটা দিয়ে একটু চাড় দিতেই সুইচ বোর্ডটা খুলে এল। কোনও সন্দেহ নেই ভেতরে যে ছোট্ট যন্ত্রটা রয়েছে সেটা একটা ভিডিও ক্যামেরা। ক্যামেরাটা এখনও চলছে। সুইচ বোর্ডের ভেতরে থাকলেও প্লাগের ফুটো দিয়ে বাইরে, ঘরের প্রায় পুরোটা, ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সে ধরা পড়েছে।
‘মনে হচ্ছে খুনের পুরো দৃশ্যটা এই ক্যামেরার মধ্যে ধরা আছে। একটু গবেষণা করলেই বোঝা যাবে ক্যামেরাটা চালু-বন্ধ করে কী করে। সে যাই হোক, খুনির চেহারাটা এবার দেখতে পেয়ে যাবে।’
‘চেহারাটা না হয় দেখতে পেলাম। কিন্তু লোকটাকে কোথায় পাব?’
‘কাজের ধরন দেখে মনে হচ্ছে এটা পেশাদার কোনও খুনির কাজ। দ্যাখো, তোমাদের রেকর্ডে লোকটার হদিশ পাও কিনা। খুনির পরিচয় জানাটা আসল সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হল কে বা কারা খুনিকে নিয়োগ করেছে সেটা বার করা। সেটা জানতে পারলে খুনিকে ধরে ফেলা শক্ত হবে না। আমার একটা অনুমান আছে। তবে এখনই সেটা বলছি না।’
সেদিন বেশ রাত্তিরের দিকে সুভদ্রর ফোন এল। কেয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আদিত্য বসার ঘরে গভীর চিন্তায় মগ্ন।
‘আদিত্যদা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?’
‘না, না, ঘুমোইনি। তবে ঘুমোতে যাবার তোড়জোড় করছিলাম। আজ খুব ভোরে উঠেছিলাম তো। তাই ঘুম পেয়ে গেছে। তুমি বল। মনে হচ্ছে খবর আছে।’
‘হ্যাঁ, কয়েকটা খবর দেবার ছিল। প্রথম খবর, খুন হওয়া মহিলাই শবনম । কানুকে মৃতদেহের ছবি দেখানো হয়েছিল। কানু সেটাকে শবনম বলে আইডেন্টিফাই করেছে। এবং তার পর থেকে কানু একেবারে ভেঙে পড়েছে। দ্বিতীয় খবর, শবনমের ছবি দেখে তাকে রূপলেখা দত্ত বলে অশনি রায় আইডেন্টিফাই করেছে।”
‘বেশ, বেশ। তৃতীয় খবর?’
‘তৃতীয় খবর, ক্যামেরার ছবিগুলো দেখা গেছে। খুনি মুখ ঢেকে ছিল। তবে কয়েকবার তার মুখ থেকে কাপড়টা সরে গিয়েছিল। তখন তার মুখটা দেখতে পেয়েছি। লোকটার নাম বিকাশ, সবাই বলে সাধু বিকাশ। পেশাদার খুনে। পুলিশ অনেক দিন বিকাশকে খুঁজছে। কিছু একটা পাবার জন্যে বিকাশ ওই মহিলার ওপর অকথ্য অত্যাচার করছিল। জিনিসটা একটা খাম। আলমারির ভেতরে একটা চোরা ড্রয়ারে লুকোনো ছিল। ওই মহিলা কষ্ট সহ্য করতে না পেরে লুকোনো জায়গাটা বিকাশকে বলে দিতে বিকাশ খামটা হাতিয়ে নিয়ে চলে গেল। শবনম চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা ছিল। সেই অবস্থায় কাতরাতে কাতরাতে চেয়ার সুদ্ধু মাটিতে পড়ে গেল। ছটফট করতে করতে এক সময় স্থির হয়ে গেল। মনে হচ্ছে, সাধু বিকাশ শবনমকে খুন করতে চায়নি। কেবল ওই খামটা হাতাতে এসেছিল।’
‘এই সাধু বিকাশ কি কানা মুমতাজের দলের লোক?’
‘সেরকম কোনও ইনফরমেশন আমাদের কাছে নেই। সাধু বিকাশ কানা মুমতাজের দলের লোক হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবে আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, মুমতাজের গ্যাংটা প্রায় ভেঙেই গেছে। সেক্ষেত্রে এমন হতে পারে সাধু বিকাশ নিজের থেকেই কাজটা করেছে। হয়ত সে জানত শবনমের কাছে মূল্যবান কিছু আছে যেটা হাতাতে পারলে তার আখেরে লাভ আছে।’
‘তোমরা কি অশনির সঙ্গে শবনমের ছবিগুলো শবনমের বাড়িতে পেয়েছ?’ ‘পাইনি। কোনও ছবিই পাইনি। অশনি বা অন্য কারও সঙ্গে শবনমের কোনও ঘনিষ্ঠ ছবিই আমরা পাইনি। সম্ভবত ছবিগুলোই বিকাশ নিয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের আর একটু ভাল করে খুঁজতে হবে।’
‘ঠিক আছে। এবার আমার কথাটা খুব মন দিয়ে শোনো। বলছিলাম না আমার একটা অনুমান আছে। সেই অনুযায়ী কিছু কিছু জায়গায় পুলিশ পাহারা বসাতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
‘বেশ। আর কিছু?’
‘হ্যাঁ। তোমাকে একদিন কষ্ট করে আবার কৃষ্ণনগর যেতে হবে। ঠিক কৃষ্ণনগর নয়, তার কাছে কৃষ্ণচন্দ্রপুরে, যেখানে সেন বেকারির আর একটা কারখানা ছিল এবং যেখানে রেখা দাস বলে মেয়েটি থাকত। ওখানে গিয়ে তমাল বিশ্বাস যে গল্পটা বলছে সেটা ভেরিফাই করতে হবে। ফিরে এসে আমাকে জানিও কী জানতে পারলে।’ আরও কী কী করতে হবে সে ব্যাপারে এর পরের দশ মিনিট আদিত্য সুভদ্রকে কিছু নির্দেশ দিল।
পরের দিন অনেক বেলা অব্দি ঘুমোল আদিত্য। কেয়া স্কুলে বেরোনোর সময় ওকে ঘুম থেকে তুলে দিতে চেয়েছিল, আদিত্য বলেছে ও আজ বেরোবে না। আদিত্য যখন বিছানা ছেড়ে উঠল তখন দুপুর সাড়ে বারোটা বেজে গেছে। তাও উঠতে ইচ্ছে করছিল না, কেয়া অন লাইনে কিছু একটা অর্ডার দিয়েছিল, সেটার ডেলিভারি এসেছে বলে উঠতেই হল। এই সময় আদিত্যরা কেউ বাড়ি থাকে না। তাই সাধারণত ডেলিভারিগুলো এরা নিচে দরোয়ানের কাছে রেখে যায়। হয়ত নিচে রেখে যাবার আগে একবার দেখে যায় বাড়িতে কেউ আছে কিনা।
আদিত্য প্যাকেটটা খাবার টেবিলে রেখে বাথরুমে ঢুকল। প্যাকেটটাতে কি আছে তার জানার উৎসাহ নেই। সম্ভবত, সাবান বা টুথপেস্ট কিংবা মেঝে পরিষ্কার করার কোনও লিকুইড। চিজ, টমেটো, পারসলি পাতা দিয়ে জম্পেস করে আদিত্য একটা ডবল ডিমের অমলেট বানাল, কেয়া উপস্থিত থাকলে নিশ্চয় দুটো ডিম খেতে দিত না। তারপর টোস্টারে দুটো পাঁউরুটি পুরে কেটলিতে কফির জল গরম করতে দিল। ব্রেকফাস্ট নাকি ব্রাঞ্চ ?
আপাতত আদিত্যর শুধু একটা কাজ বাকি আছে। সেটা দু’একদিন পরে করলেও চলবে। এখন সে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে সুভদ্রর ফোনের জন্য অপেক্ষা করছে। সুভদ্রকে যে কাজগুলো করতে বলেছিল সেগুলো সে করতে পারল কি?
কেয়া ফোন করছে। ‘তোমার শরীর খারাপ নাকি? বিছানা ছেড়ে উঠছিলে না কেন? কী ব্যাপার?’
‘শরীর একদম ঠিক আছে। গতকাল ভাল ঘুম হয়নি তাই ঘুম পাচ্ছিল।’ ‘কিছু খেয়েছ?’
‘অমলেট করে নিলাম একটা। আর টোস্ট।’
‘এতে পেট ভরবে? বাড়িতে আছ যখন একটু ভাত খেলে পারতে। ভাত আর
মাছের ঝোল ফ্রিজে করা আছে। একটু গরম করে নিতে হবে।’
‘ঠিক আছে। জানা রইল। এই তো সবে ঘুম থেকে উঠলাম। ব্রেকফাস্ট খেলাম। এবার চান করতে যাব। চান করে এসে যদি খিদে পায় তখন দেখা যাবে। তুমি কখন ফিরবে?’
‘আজ পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসব। টা টা।’
‘টা টা।’
আদিত্য চান করে উঠে ল্যাপটপ খুলল। মেল চেক করল। কয়েকটা মেলের উত্তর দিল। খবর কাগজ পড়ল। গান শুনল। সুভদ্র ফোন করছে না। আদিত্য সুভদ্রর ফোনের জন্যে অপেক্ষা করে আছে।
কেয়া পাঁচটা বাজার কিছু আগেই ফিরে এল। আদিত্য কেয়ার সঙ্গে চা খেল। গল্প করল। কিন্তু তার মনটা সুভদ্রর ফোনের দিকে পড়ে আছে। দেখতে দেখতে সন্ধে সাতটা বেজে গেল সুভদ্রর ফোন এল না। আটটা বেজে গেল, ন’টা বেজে গেল। আদিত্য ভাবল নিজেই একবার সুভদ্রকে ফোন করবে। তারপর ভাবল থাক। সত্যি কোনও খবর থাকলে ও নিশ্চয় ফোন করত।
পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় সুভদ্রর ফোন। ‘আদিত্যদা খবর আছে। কাল অনেক রাত্তিরে খবরটা পেলাম তাই আর ফোন করিনি। টেলিফোনে সব কথা বলা যাবে না। আমি এই সাড়ে দশটার মধ্যে আপনার বাড়ি চলে আসছি। বেরিয়ে যাবেন না যেন।’
‘আমার সেই ক্রোনোলজি অফ ইভেন্টস-এর কী হল? ওটা তৈরি করতে পারলে?’ সাড়ে দশটা বললেও দশটার আগেই সুভদ্র চলে এসেছে। উত্তেজিত। ঘন্টা খানেক আলোচনা করার পর ঠিক হল আগামীকাল তারা উলুবেড়িয়া যাবে। মাস এবং বছর সহ ঘটনার তালিকা সুভদ্র সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।
(২)
মৃত্তিকা মিত্রর মৃত্যুরহস্য সমাধান হয়ে যাবার পরে যখনই এই কেসটার কথা আদিত্য ভাবত তখনই তার মনে হত বোধহয় আর কোনও কেস-এ এত বেশিদিন ধরে সে ভুল রাস্তায় হাঁটেনি। বস্তুত, ভুল রাস্তাটা থেকে আদিত্য বেরোতেই পারত না, আর না বেরোতে পারলে রহস্যটারও সমাধান করতে পারত না, যদি না নেহাতই দৈবের বশে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা তার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিত। তার মানে তার নিজের কোনও কৃতিত্ব নেই। ভাবনাটা আদিত্যকে মাঝে মাঝে বিব্রত করে। তার থেকেও বড় কথা, তাকে বিনয়ী হতে বাধ্য করে। একটা গভীরতর প্রশ্ন উঠে আসে। আদিত্য ভাবে, ন্যায়বিচার হওয়াটা কি তা হলে নেহাতই কাকতালীয়? ভাগ্য নির্ভর? সে যেহেতু বিধাতার মঙ্গলসাধনে বিশ্বাস করে, তার ভাবতে ভাল লাগে আপতত যেটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে তার পেছনে কোনও শুভশক্তি নিশ্চয় আছে। এসব কথা অবশ্য সে কোনও দিন কাউকে বলেনি। ব্যক্তিগত বিশ্বাস ব্যাপারটা এতটাই পবিত্র যে তার কথা কাউকে বলতে নেই ।
উলুবেড়িয়া ঘুরে আসার পরের তিন-চার দিন আদিত্য শুয়ে-বসে কাটাল। ঘুমিয়ে রইল বেলা আটটা অব্দি, দেরি করে আপিস গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ইন্টারনেটে খবর কাগজ পড়ল। গান শুনল সন্ধে পর্যন্ত। সুভদ্রর দেওয়া ঘটনাক্রমের বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বিবরণটি এইরকমঃ
তারিখসহ কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জী

এর মধ্যে একদিন সুভদ্র ফোন করেছিল।
‘কাল কৃষ্ণচন্দ্রপুর ঘুরে এলাম আদিত্যদা।’
‘কী জানতে পারলে?”
‘তমাল বিশ্বাসের কাহিনিটা সত্যি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।’
‘কেন?’
“ওখানে গিয়ে জানলাম রেখা দাসের চরিত্রটা ভাল ছিল না। স্বামী বেঁচে থাকতেই সে নানা রকম লোকের সঙ্গে লটঘট করত। স্বামী মারা যাবার পর একেবারে মরিয়া হয়ে যায়। পুলিশ রিপোর্ট বলছে মেয়েটা মারা যাবার সময় প্রেগনেন্ট ছিল। তবে সেটা শুভব্রত সাহার দ্বারাই কিনা বলা শক্ত।’
‘মেয়েটা কি সুইসাইডই করেছিল?”
‘সেটাও পরিষ্কার নয়। মেয়েটার পেটে এবং একটা গ্লাসে ঠাণ্ডা পানীয়র সঙ্গে বিষ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেটা সে নিজেই খেয়েছিল না কেউ তাকে খাইয়ে দিয়েছিল সেটা স্পষ্ট নয়।’
মৃত্তিকার মৃত্যুরহস্য নিয়ে অশনি রায় আদিত্যর কাছে এসেছিল চৈত্র মাসের শেষ দিকে। আর এখন ভরা শ্রাবণ। আদিত্যর মনে হচ্ছে এতদিনে সেই রহস্যের সে সমাধান করতে পেরেছে। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি সারাদিন ধরে ঝরছে। গাছের পাতাগুলো সবুজ হয়ে উঠেছে। আদিত্য আমীর খাঁর মিয়া মল্লার শুনছিল। ১৯৫৮ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে গাওয়া। ইউ টিউবে আছে। সেই পুরোনো গান, করিম নাম তেরো। এত শান্তি, এত শান্তি আমীর খাঁর গানে, ঈশ্বরের মঙ্গলসাধনে বিশ্বাস না করে উপায় কী?
চার দিনের দিন খবর এল। আদিত্য এই খবরটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। এর পর গৌতমকে ফোন করে রহস্যের যবনিকা উত্তোলনের ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। খবরটা গৌতম নিশ্চয় আদিত্যর আগেই পেয়ে গেছে।
বিকেলের দিকে গৌতম নিজেই ফোন করেছে।
“তোর লোক কাল রাত্তিরে ধরা পড়েছে।’
‘জানি। সুভদ্র খবর দিয়েছে। তবে ডিটেলটা বলতে পারেনি। কোনও ক্যাজুয়ালটি হয়নি তো?’
‘হয়নি মানে? আমাদের দুজন জখম। একজন কনসটেবল, একজন এ এস আই। দু’জনেরই গুলি লেগেছে। এ এস আই-এর অবস্থা সঙ্কটজনক। তোর লোকটাকে ঠিক শান্তশিষ্ট বলা চলে না।’
‘আমি তো বলেই দিয়েছিলাম লোকটা বিপজ্জনক। যাক গে, ধরা তো পড়েছে। আমি বলছিলাম কী, কাল দুপুরে তোর অফিসে একটা মিটিং অ্যারেঞ্জ করতে পারবি ? যবনিকা উত্তোলনের সময় হয়েছে।’
‘অবশ্যই পারব। কাল আমার কোনও কাজ নেই। বড় কর্তা দিল্লি গেছেন। অতএব যখন তখন ডাক পড়বে না।’
‘সেন বেকারির পল্লব সেন এবং প্রণব মাইতি বেল-এ আছে তো। তাদের নিশ্চয় মাঝে মাঝে থানায় হাজিরা দিতে হয়। কাল দুপুরে ওদের দু’জনকে লালবাজারে উপস্থিত থাকতে বলবি। আর সপুত্র অসীমাভ রায়ও যেন হাজির থাকেন। কানু এবং উকিল সজল নন্দীকেও থাকতে হবে। হয়ত তাদের দিয়ে একটা স্বীকারোক্তি করাতে হতে পারে। আর, লাস্ট বাট নট দ্য লীস্ট, তপস্বিনী করুণা, যাঁর সংসার-জীবনের নাম বনানী দাস, আমাকে কথা দিয়েছেন আসবেন। তিনি সরাসরি আমার বাড়িতে আসবেন, আমি তাঁকে সঙ্গে করে লালবাজার নিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। দুটোর সময় মিটিংটা রাখছি। লাঞ্চের ঠিক পরে। ঘন্টা দুয়েক-এ হয়ে যাবে আশা করি।’
‘মনে হয় হয়ে যাবে। দেখা যাক। ‘
‘আমার বিশ্বাস মৃত্তিকা মিত্র এবং তার স্বামী পার্থ মিত্রর মার্ডার কেসটা আমি সলভ করে ফেলেছি। আমার তদন্ত থেকে যেটা পেয়েছি সেটা আপনাদের বলব । কিন্তু তার আগে বলে নিই এখানে একাধিক কাহিনি জড়িয়ে আছে। সেগুলোও আমাকে বলতে দিতে হবে। একটা, বলাই বাহুল্য, মৃত্তিকা-পার্থর কাহিনি, কিন্তু সেটা ছাড়াও প্রাসঙ্গিকভাবে আরও দুটো গল্প এখানে এসে পড়বে।’ আদিত্য থামল।
ঘরে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও শ্মশানের নীরবতা। চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করল।
‘মাস তিনেক আগে, রোদ্দুরে পুড়ে যাওয়া এক চৈত্র মাসের বিকেলে অশনি রায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্র মামলার আসামী। হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চে বেকসুর খালাস হয়ে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু পুলিশ কেসটা নিয়ে খুব শিগগির ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করবে এমন একটা খবর হাওয়ায় ভাসছে। তাই আমার বন্ধু অ্যাডিশানাল কমিশানার গৌতম দাশগুপ্ত আমার কাছে অশনিকে পাঠিয়েছে। আমি যদি অশনির সপক্ষে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারি, ভবিষ্যতে কেসটা আবার আদালতে উঠলে মামলার সুবিধে হবে। আর আমি যদি সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ মৃত্তিকার আসল খুনিকে ধরে দিতে পারি তাহলে তো কথাই নেই। সেক্ষেত্রে হয়ত পুলিশ কেসটাই আর আদালতে তুলবে না। গৌতমের বিশ্বাস অশনি খুনটা করেনি। পরে সুভদ্র মাজির সঙ্গে কেসটা নিয়ে কথা হল । প্রাথমিক তদন্তটা সে-ই করেছিল। সুভদ্রও বলল তার বিশ্বাস অশনি খুনটা করেনি। বলে রাখি, গৌতম এবং সুভদ্রর বিবেচনার প্রতি আমার গভীর আস্থা।’
গৌতম মুচকি মুচকি হাসছে। সুভদ্রর মুখ গম্ভীর।
‘গৌতমের বিশ্বাসটা ছিল একটা গাট ফিলিং, যদিও তার পেছনে কিছু যুক্তিও ছিল। সুভদ্রও তার বিশ্বাসের সপক্ষে কয়েকটা যুক্তি দিল। গৌতম এবং সুভদ্রর যুক্তিগুলো উড়িয়ে দেবার মতো নয়। এক নম্বর যুক্তি, মৃত্তিকা এবং তার স্বামীর আঘাতের চিহ্নগুলো দেখে মনে হয় খুনগুলো কোনও প্রফেশানাল অ্যাসাসিনের কাজ। দ্বিতীয়ত, একটা সিসি টিভির ফুটেজে দেখা গিয়েছিল খুনের কিছু পরে কেউ একজন বাড়ির পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে। তৃতীয়ত, অশনিকে খুনি প্রমাণ করার ব্যাপারে পুলিশের ওপর একটা অদৃশ্য চাপ ছিল। সেটা আপাতত আসছিল সম্ভবত কোনও রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে। কিন্তু সেই নেতা কার কথায় চাপটা দিচ্ছিলেন সেটা অজানা। চতুর্থত, অরুণকান্তি ব্যানার্জী, যিনি অশনির কেসটা লড়েছিলেন, হঠাৎ রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন। এটা কাকতালীয় নাও হতে পারে। সব মিলিয়ে আমিও প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করে ফেললাম অশনি রায় খুন করেনি।’
কথাগুলো বলে আদিত্য অশনির দিকে তাকাল। সে তার বাবার পাশে বসে মগ্ন হয়ে আদিত্যর কথা শুনছে। আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। পরের কথাগুলোর জন্যে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। জানলায় শ্রাবণ মাসের দুপুর। রোদ্দুর নেই। মেঘে ঢাকা চিৎপুর। একটা ফাঁকা ট্র্যাম ঘন্টি বাজাতে বাজাতে নাখোদা মসজিদের দিকে চলে গেল। ট্র্যামরাস্তার ধারে সামান্য জল জমে আছে। আদিত্যর মনে পড়ে গেল হুতোমের সেই উক্তি, আকাশে মেঘ করলে চিৎপুরে জল জমে ।
আদিত্য আবার বলতে শুরু করেছে।
‘আমি প্রাথমিকভাবে বিশ্বাস করলাম বটে অশনি খুন করেনি, কিন্তু কোথাও একটা খটকা রয়ে গেল। অশনিকে দেখে মনে হল ও পুরোটা সত্যি কথা বলছে না। অর্ধসত্য বলছে। এটা একটা ইনটুইশান, এমন একটা অনুভূতি যেটা চট করে ব্যাখ্যা করা যায় না। অবশ্য এই রকম মনে হবার পেছনে একটা কারণও ছিল। প্রথম দিন থেকেই অশনিকে আমার অতি-নাটকীয় মনে হচ্ছিল। যেন জোর করে অপ্রকৃতিস্থ হবার ভান করছে। হঠাৎ সব ভুলে যাচ্ছে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে ওর হাবভাবটা মনে হচ্ছিল বানানো। কিছু একটা লুকোনোর থাকলে তবেই মানুষ এরকম অভিনয় করে। যাই হোক, ব্যাপারটা আমি তখনকার মতো মনে মনে দূরে সরিয়ে রাখলাম। কারণ আরও প্রাথমিক একটা প্রশ্নের উত্তর আমাকে খুঁজতে হচ্ছিল।
‘প্রশ্নটা এইরকম। যদি পুলিশের গল্পটা ঠিক না হয়, অর্থাৎ যদি ধরে নিই, পার্থ মিত্র তার স্ত্রী মৃত্তিকাকে এবং অশনি রায় তার প্রেমিকার স্বামী পার্থ মিত্রকে খুন করেনি, তাহলে প্রশ্ন হল, আসল খুনি কি দু’জনকেই খুন করতে চেয়েছিল? নাকি দু’জনের মধ্যে একজনকে? আর অন্যজন ওখানে ছিল বলে তাকেও খুন করতে বাধ্য হয়েছিল। মনে হল, দ্বিতীয়টা হবার সম্ভাবনাই বেশি। পার্থ এবং মৃত্তিকার মধ্যে একজনকে খুন করাটাই খুনির মূল উদ্দেশ্য ছিল। কাকে? আমার আরও মনে হল, পার্থকে খুন করাটাই খুনির মূল উদ্দেশ্য ছিল। মৃত্তিকাকে নয়। মৃত্তিকাকে খুন করা হয়েছিল কারণ সে অকুস্থলে উপস্থিত ছিল এবং খুনি কোনও সাক্ষী রাখতে চায়নি। আমার কেন এমন ধারণা হল খুলে বলছি। কিন্তু তার জন্যে আর একটা কাহিনি বলতে হবে।’
আদিত্য চায়ের কাপে চুমুক দিল। আবার বাইরে তাকাল। কিছুক্ষণ চুপ করে রয়েছে । ‘আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আমার পেশেন্টরা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। এরা বহুদিন আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। এদের দিকটা একটু ভেবে দেখুন।’ ডাঃ অসীমাভ রায় খানিকটা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন।
‘ডাঃ রায়, আপনাকে অসুবিধের মধ্যে ফেলে দেবার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’ আদিত্য দু’হাত জড়ো করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করল। ‘কিন্তু আপনিও একটু ভেবে দেখুন, এটা আপনার ছেলের জীবন-মরণের ব্যাপার। কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনার এখানে থাকাটা সত্যিই জরুরি। না হলে আপনাকে আটকাতাম না। আমরা জানি আপনার সময়ের কতটা দাম। কিন্তু আজ প্লিজ আমাদের একটু সময় দিন।’
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ ডাঃ অসীমাভ রায় পকেট থেকে মোবাইল বার করে একটা নম্বর টিপলেন। মনে হয় ওঁর সেক্রেটারির নম্বর। ‘আমার পেশেন্টদের বলে দাও আজ আমার চেম্বারে পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েক দেরি হবে। ওরা একটু ঘুরে আসতে পারেন।’
ডাঃ অসীমাভ রায় মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখার পর আদিত্য আবার শুরু করল।
‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। আমার মনে হল, খুনির মুখ্য ভিকটিম ছিল পার্থ মিত্র। এই রকম মনে হওয়ার পেছনে আর একটা গল্প আছে। অশনি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসার কয়েকদিন পরে একটা রবিবারে আমি অশনির বাবার সঙ্গে ওদের বাড়িতে দেখা করতে গেলাম। সেদিনই বিকেলবেলা আমার স্ত্রী কেয়ার কাছে একটা ফোন এল। ওদের স্কুলের ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট অমলা তরফদারের ছেলে জয় তরফদার ড্রাগ ওভারডোজের ফলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিন্তু পুলিশি ঝামেলার ভয়ে কোনও হাসপাতাল বা নার্সিং হোম তাকে ভর্তি করছে না। আমরা যদি একটু সাহায্য করতে পারি। আমি গিয়ে ছেলেটাকে একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করাতে পারলাম। সে যাত্রা ছেলেটা বেঁচে গেল। শশীধর মিশ্র বলে যে অফিসার কেসটা হ্যান্ডেল করছিলেন তিনি বললেন ইদানীং সারা পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগ পেডলিং-এর সমস্যা হঠাৎ বেড়ে গেছে। এর কিছুদিন পরে আমার বন্ধু গৌতম দাশগুপ্ত আমাকে একই কথা বলল। বলল, পশ্চিমবঙ্গে এখন দুবে বলে কোনও এক ব্যক্তির গ্যাং ড্রাগের বাজারটা দখল করে নিয়েছে। এদের একটা রাইভাল গ্যাং-ও আছে, ইসমাইলের গ্যাং, কিন্তু তারা ফ্রিঞ্জে রয়েছে, মূল বাজারে ঢুকতে পারছে না। ইসমাইল সম্বন্ধে পুলিশ কিছুটা জানলেও দুবে সম্বন্ধে তাদের কোনও ধারণাই নেই। লোকটা সাধারণ মানুষের ভিড়ে মিশে আছে। তাকে কেমন দেখতে, তার কত বয়েস, সবই অজানা। আমি এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়া ড্রাগ পেডলিং-এর ব্যাপারটা ইনভেস্টিগেট করার দায়িত্ব ফর্মালি গ্রহণ করলাম।
‘দুবের গ্যাং-এর মূল অ্যাডভান্টেজ হল ওদের ডিসট্রিবিউশান নেটওয়ার্ক। কী ভাবে ড্রাগটা নেশাখোরদের কাছে পৌঁছচ্ছে, পুলিশ কিছুতেই তার হদিশ পাচ্ছিল না। অমলা তরফফার আমাকে একটা কথা বলেছিল যার তাৎপর্য তখন বুঝতে পারিনি । পরে একটু একটু করে বুঝতে পেরেছিলাম। অমলা তরফদার বলেছিল তার ছেলে জলখাবারে শুধু পাঁউরুটি খায়। মুড়ি, হাতরুটি এসব কিচ্ছু খায় না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম জয় যে পাঁউরুটিটা খায় সেটা সেন বেকারির আনস্লাইসড কোয়ার্টার পাউন্ড লোফ। ওটা আসে জয়দের বাড়ির নিচের চায়ের দোকান থেকে।’
‘আমাদের পাঁউরুটির গল্প শোনাবার জন্যে এখানে এতক্ষণ বসিয়ে রাখা হয়েছে?’ কানু হঠাৎ গর্জন করে উঠেছে।
‘একটু পরেই বুঝতে পারবে কেন তোমাদের এখানে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এখন একদম চুপ করে বোসো। আবার গলার আওয়াজ শুনলে হাতে হাতকড়া লাগিয়ে মুখে সেলোটেপ আটকে বসিয়ে রাখব।’ গৌতম আরও জোরে গর্জন করে উঠল।
কানু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। উকিল সজল নন্দী তাকে হাত ধরে নিরস্ত করল। আদিত্য আবার বলতে শুরু করল।
‘কিছুদিন পরে জয় তরফদার মারা গেল। মৃত্যুর কারণ সেই ড্রাগ ওভারডোজ। প্রশ্ন হল, জয় ড্রাগটা পাচ্ছিল কোথা থেকে? সে তো সারাদিন ঘরে বন্দি হয়ে থাকত। কিন্তু আমরা তার ঘরের দেয়ালে আলগা প্লাস্টার সরিয়ে তার আড়াল থেকে প্লাস্টিকে মোড়া হেরোইনের প্যাকেট পেয়েছি। আর একটা প্রশ্ন, ড্রাগের জন্যে সে পয়সা দিচ্ছিল কী ভাবে? তার নিজের রোজগার তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
‘দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজে পেয়ে গেলাম। এবং তার সূত্র ধরে প্রথম প্রশ্নের উত্তরটাও। অমলা তরফদার ঘুগনি-পাঁউরুটি কেনার টাকা দিত না। সে জানাল, নিচের চায়ের দোকান, যেখান থেকে জয়ের ঘুগনি-পাঁউরুটি আসত, সেখানে বেশ কিছু টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া ছিল। জয়ই এক সময় দিয়েছিল। ঘুগনি-পাঁউরুটির জন্যে কেউ অ্যাডভান্স দেয়? আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম ঘুগনি পাঁউরুটির মধ্যে দিয়ে হেরোইন আসত। কিন্তু ঘুগনির মধ্যে দিয়ে হেরোইন আসা সম্ভব নয়। এইভাবে হেরোইন পাঠাতে হলে অসংখ্য চা-ওলার হাতে হাতে হেরোইন দিয়ে আসতে হবে যাতে তারা সেটা ঘুগনিতে মিশিয়ে বিক্রি করতে পারে। ড্রাগ ডিসট্রিবিউশনের পক্ষে এটা খুবই আনাড়ি একটা উপায়। দুবে গ্যাং-এর দক্ষতার সঙ্গে এটা আদৌ যায় না। তাছাড়া হেরোইন ঘুগনির সঙ্গে মিশলে তার কতটা পোটেন্সি থাকে তা নিয়েও সন্দেহ আছে। সব থেকে বড় কথা, ড্রাগটা যে ছোট ছোট প্লাসটিকের প্যাকেটে ডিসট্রিবিউটেড হয় সেটা আমরা জয় তরফদারের ঘরেই তো দেখতে পেলাম। ঘুগনি বাদ দিলে পড়ে থাকে পাঁউরুটি। বেক করার সময় কোয়ার্টার পাউন্ড আনস্লাইসড লোফের মধ্যে একটা হেরোইনের প্যাকেট ভরে দেওয়া খুবই সহজ কাজ। কিন্তু তার জন্যে সেন বেকারিকেও এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে। তাই না প্রণববাবু?’
প্রণব মাইতি মুখ নিচু করে আছে। পল্লব সেনের মুখ আষাঢ়ের মেঘের মতো কালো।
‘আমার ছেলেবেলায় আমাদের বাড়িতে সেন বেকারির আনস্লাইসড পাঁউরুটি ছাড়া কিছু ঢুকতোই না। আহা, কী স্বাদ ছিল সেই পাউরুটিতে। অথচ আমাদের পাড়ার দোকানদার বাবলু বলল আজকাল সেন বেকারির পাঁউরুটি কেউ কেনেই না। সেন বেকারির পাঁউরুটির থেকে নাকি দেড় ইঞ্চির মরা আরশোলা বেরিয়েছে। আমাদের আপিসের দরোয়ান শ্যামলও বলল পাতাখোর কিংবা মাতাল ছাড়া সেন বেকারির পাঁউরুটি আজকাল আর কেউ খায় না। তার মানে কম্পানিও ভাল চলার কথা নয়। অথচ সেন বেকারির মালিক পল্লব সেনের সঙ্গে আলাপ হবার পর দেখলাম তাঁর জীবনযাত্রায় ঠাটবাটের অভাব নেই। পক্ষী নিরীক্ষণ করে এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শুনে তিনি যথেষ্ট বিলাসিতার মধ্যেই দিন কাটাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, সেন কম্পানির পাঁউরুটি যদি না চলে তা হলে তাঁর বিলাসিতার অর্থটা আসছে কোথা থেকে?’
পল্লব সেন কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন।
গৌতম বলল, “আমরা খবর নিয়ে দেখেছি পল্লব সেন নামেই এম ডি। ব্যবসা চালায় জেনারেল ম্যানেজার প্রণব মাইতি। আমার মনে হয় উনিই আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। তবে আইনের হাত থেকে পল্লব সেনও রেহাই পাবেন না।’ ‘আপনি যে অভিযোগ করলেন সে ব্যাপারে আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ প্রণব মাইতি ঠাণ্ডা গলায় বলল।
‘আছে বৈকি। নিশ্চয় আছে। প্রমাণ ছাড়া এত বড় অভিযোগ করা যায়? আমরা সেন বেকারির কয়েকটা পাঁউরুটি ভর্তি ট্রাক আটক করেছি। দু’ধরনের পাঁউরুটি পাওয়া গেছে। ওপর ওপর দুটোর মধ্যে খুব সূক্ষ্ণ তফাত। দু’ধরনের পাঁউরুটির প্যাকেটেই মাথায় টুপিওলা বেকারের ছবি। কিন্তু একটাতে বেকারের গোঁফ আছে, আর একটাতে নেই। গোঁফওলা বেকারের ছবি দেওয়া পাঁউরুটিগুলোর ভেতরে হেরোইনের প্যাকেট পাওয়া গেছে। এর বেশি প্রমাণ আর কি দরকার আছে?’
প্রণব মাইতি এবং পল্লব সেন দুজনেই চুপ করে রইল।
আদিত্য বলল, “কিছুদিন আগে আপনাদের রাইভাল গ্যাং আপনাদের ফ্যাক্টরির সামনে থেকে একটা ট্রাক লুট করেছিল। সেটা পাঁউরুটির জন্যে নয়, পাঁউরুটির ভেতরের জিনিসটার জন্যে। তাই না?’
প্রণব মাইতি এখনও চুপ। পল্লব সেন বলল, ‘আমি কিন্তু এসব কিছুই জানতাম না।’ তার কথার উত্তর না দিয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করেছে।
‘ড্রাগ পেডলিং-এর ব্যাপারে আমাদের আরও কিছু বলার আছে, কিন্তু আপাতত পার্থ মিত্র, মৃত্তিকা মিত্রর হত্যারহস্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। পার্থ মিত্রর কম্পানি সেন বেকারির হেরোইন পোরা পাঁউরুটি বিভিন্ন জায়গায় ডিস্ট্রিবিউট করত। অর্থাৎ ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে পার্থ মিত্রর কম্পানি আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ছিল। ড্রাগ মাফিয়াদের মধ্যে যথেষ্ট রেশারেশি আছে, তার জেরে মাঝে মধ্যেই লাশ-টাস পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে হল, পার্থ মিত্রর মৃত্যুটা এই রকমই একটা ড্রাগ রিলেটেড মার্ডার। হয়ত ইসমাইলের গ্যাং-এর কেউ পার্থকে মেরেছিল। কিংবা হয়ত পার্থ টাকার লোভে ইসমাইলের কাছে তার দলের কিছু গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছিল। এবং সেটা জানতে পেরে দুবের লোকই পার্থকে মেরে ফেলেছিল। যেটাই হোক, আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম খুনির প্রাইমারি টার্গেট ছিল পার্থ মিত্র। মৃত্তিকার খুনটা ইনসিডেন্টাল, ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া।’
‘কিন্তু তা হলে এর মধ্যে অশনি রায় এল কী করে?’ সুভদ্র খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। একেবারে সঠিক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নেরই এবার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব। কিন্তু তার আগে একটু চা পাওয়া যাবে? গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে।’ আদিত্যর শেষের কথাগুলো গৌতমকে লক্ষ করে।
‘চা আসছে। বলে দিচ্ছি।’ গৌতম তার টেবিল-সংলগ্ন কলিং বেলটা বাজাল।
(৩)
আদিত্য জানলার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিচে, চিৎপুর রোডে, মস্ত ট্র্যাফিক জ্যাম। টিকি খুলে গিয়ে একটা ট্র্যাম রাস্তার মাঝখানে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার পেছনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে লরি-বাস-ঠেলাগাড়ি। এগোনোর উপায় নেই জেনেও কেউ কেউ ক্রমাগত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। কেউ অকারণে চেঁচাচ্ছে। ট্র্যামের কনডাকটার গাড়ি থেকে নেমে ওভারহেড তারের সঙ্গে ট্র্যামের বিচ্ছিন্ন টিকিটার সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। কিছু লোক তাকে উচ্চকণ্ঠে উৎসাহ দিচ্ছে। সব মিলিয়ে তুমুল হট্টগোল। আদিত্য ঘরের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। একেবারে উল্টো ছবি। শান্ততা। কেউ কেউ চাপা গলায় কথা বলছে। বাকিরা চুপ করে আছে। চা এসে গেল।
‘অশনি রায় কীভাবে মৃত্তিকার সঙ্গে যুক্ত হল সেটা জানার আগে বোঝা দরকার সেন বেকারি কী করে হেরোইনের জন্য পেমেন্ট করত।’ আদিত্য চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে আবার শুরু করল। ‘হেরোইনটা সম্ভবত আসত সেন্ট্রাল অ্যামেরিকার কোনও দেশ থেকে। নিউ ইয়র্ক থেকে সেই কনসাইনমেন্টের পেমেন্ট হতো। পেমেন্টের উপায়টা বেশ অভিনব। ড্রাগের টাকা পেমেন্ট করার জন্যে সেন বেকারি শাড়ির ব্যবসায় নেমেছিল। গ্লোবাল ট্রেডিং কম্পানি বলে একটি সংস্থার মাধ্যমে তারা নিউ ইয়র্কে শাড়ি রপ্তানি করত। গ্লোবাল ট্রেডিং অন্য আরও অনেক শহরে শাড়ি রপ্তানি করত বটে কিন্তু সেন বেকারির থেকে কেনা শাড়িগুলো শুধুমাত্র নিউ ইয়র্কের ওই বিশেষ কম্পানিটিকেই বিক্রি করত। এবং লক্ষ্যনীয় হল, বাজারে শাড়ির যা দাম তার অর্ধেকেরও কম দামে নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানিটিকে শাড়িগুলো বিক্রি করা হতো। বাকি টাকাটা নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানি হেরোইনের দাম বাবদ সেনট্রাল অ্যামেরিকায় পাঠিয়ে দিত।
‘হেরোইনটা সম্ভবত ইস্টের সঙ্গে নদীপথে বাংলাদেশ থেকে আসত। একবার আমার স্ত্রীর সঙ্গে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতে গিয়ে শুভব্রত সাহাকে দেখতে পেয়েছিলাম। শুভব্রতর ছবি আমি অনন্যা সাহার ড্রয়িংরুমে একবার মাত্র দেখেছিলাম। তাই ডায়মন্ডহারবারে তাকে দেখে প্রথমটা চিনতে পারিনি। যাই হোক, আমার ধারণা শুভব্রত জানত ইস্টের সঙ্গে সঙ্গে সে সেন বেকারির ফ্যাক্টরিতে হেরোইনও পৌঁছে দিচ্ছে। এটা নিয়ে তার টেনশন ছিল। রাত্তিরে ঘুম হতো না।’
‘এই ট্রানজাকশনের ব্যাপারটা গুলিয়ে যাচ্ছে আদিত্যদা। আর একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ সুভদ্র বলল।
‘একটা উদাহরণ দিয়ে বলছি। ধরো নিউ ইয়র্কে একটা বালুচরী শাড়ির দাম আড়াইশ ডলার। সেন বেকারি সেটা গ্লোবাল ট্রেডিং-এর মাধ্যমে নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানিকে একশ ডলারে বিক্রি করল। অর্থাৎ শাড়ি পেয়ে নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানি গ্লোবাল ট্রেডিংকে দিল একশ ডলার, যার থেকে কুড়ি ডলার কমিশন কেটে নিয়ে গ্লোবাল ট্রেডিং সেন বেকারিকে দিল আশি ডলার। সেন বেকারি নিশ্চয় নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানিটাকে খয়রাতি করবে না। তা হলে প্রশ্ন হল, আড়াইশ ডলারের দেড়শ’ ডলার গেল কোথায়? বস্তুত, নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানি বাকি দেড়শ ডলার পাঠিয়ে দিল সেন্ট্রাল অ্যামেরিকায় হেরোইন প্রস্তুতকারকদের কাছে। তারা তখন দেড়শ’ ডলারের হেরোইন চোরাপথে, বাংলাদেশ থেকে নদীপথে, সেন বেকারির কাছে পৌঁছে দিল।
‘চমৎকার, চমৎকার। তা তুই এই চেনটা ধরলি কী করে?’ গৌতম অভিভূত। ‘এমনিতে ধরতে পারতাম না। গ্লোবাল ট্রেডিং-এর হিসেবপত্র ভাল করে দেখেও ধরতে পারতাম না। তারপর একদিন কেয়ার জন্যে শাড়ি কিনতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম সেন বেকারির থেকে কেনা শাড়িগুলো গ্লোবাল আশ্চর্য কম দামে নিউ ইয়র্কে বিক্রি করছে। অন্য শহরে কিন্তু সেন বেকারির থেকে কেনা শাড়িও বিক্রি করছে না, আবার কম দামও নিচ্ছে না।’
‘আচ্ছা, আদিত্যদা, এই ট্র্যানজ্যাকশনটা নিশ্চয় কোনো ব্যাঙ্ক দিয়ে হতো। তা হলে কেউ এটা লক্ষ করল না কেন ?
‘একদম ঠিক জায়গায় ধরেছ। ব্যাঙ্কের চোখ এড়িয়ে দিনের পর দিন এই আন্ডার-ইনভয়েসিংটা করা সম্ভব নয়। এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে ব্যাঙ্কের কাউকে থাকতেই হবে। অশনি রায়ের ব্যাঙ্কে গ্লোবালের অ্যাকাউন্ট ছিল। এটা তো হতেই পারে, এই ট্র্যানজ্যাকশনটার মধ্যে অশনিও ছিল এবং তার লিঙ্ক ছিল মৃত্তিকা। ভুললে চলবে না, মৃত্তিকা গ্লোবাল ট্রেডিং-এই কাজ করত। ধরা যাক, বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল বলে দুবে পার্থকে খুন করতে চেয়েছিল এবং তার সঙ্গে তার বউকেও, যে কিনা গ্লোবাল ট্রেডিং সংক্রান্ত লেনদেনের ব্যপারটা জানত। কিন্তু অশনিও তো ওই ব্যাপারে খানিকটা ওয়াকিবহাল ছিল। তাকে ছেড়ে রাখা যায় না। তাই তাকে পার্থর খুনে ফাঁসানো হল। খুন দুটো এমনভাবে করা হল যাতে মনে হয় পার্থ রাগের মাথায় মৃত্তিকাকে খুন করেছে এবং পার্থকে খুন করেছে অশনি। এতে অশনিকে জেলে পোরা হল আবার ওই জোড়া খুনের জন্য একটা বলির পাঁঠাও তৈরি হল। দুবে ধরে নিয়েছিল, অশনি কখনই ওই বেআইনি ট্রানজ্যাকশনটার কথা পুলিশের কাছে বলবে না। বললে সে নিজেই আরও ফেঁসে যাবে।’
‘চুপ করুন। এগুলো মিথ্যে কথা। আপনি বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। আমি কোনও দিন কোনও শেডি ডিলের মধ্যে থাকিনি।’ অশনি রায় হঠাৎ প্রতিবাদ করে উঠল।
‘আপনি এসব কী যা তা বলছেন? আমার ছেলে হঠাৎ কেন ওসব করতে যাবে? ওর কি টাকার অভাব?’ অসীমাভ রায়ও রুখে উঠেছেন।
‘আপনারা দয়া করে একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আমার বলা কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। আমি এখন অব্দি একটা সম্ভাবনার কথা বলেছি। এই সম্ভাবনাটা অবশ্যই আর একটু খতিয়ে দেখব। বিশেষ করে যখন আপনারা এত আপত্তি করছেন। কিন্তু তার আগে আমার গল্পটা শেষ করতে দিন। প্লিজ।’
বাবা-ছেলে গুম হয়ে বসে রইল। আদিত্য আবার বলতে শুরু করল।
‘আর একটা গল্প আছে। রূপলেখা দত্তর গল্প। অশনির পুরোনো বান্ধবী তাকে ছেড়ে চলে যাবার পর রূপলেখা দত্ত বলে এক মহিলার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়। মহিলা বলেছিলেন তিনি বিবাহিতা। তবু অশনি মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। অশনির কথা অনুযায়ী, যে রাত্তিরে মৃত্তিকা এবং পার্থ খুন হয়, সেই রাত্তিরে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এর ওই বাড়িটাতে রূপলেখা অশনিকে ডেকেছিল। অশনি জানত ওটাই রূপলেখার বাড়ি। গিয়ে দেখে একটি নারী ও একটি পুরুষ খুন হয়ে পড়ে আছে। অশনির বয়ান অনুযায়ী মেয়েটি তার অল্প চেনা এবং পুরুষটি সম্পূর্ণ অচেনা। ওই খুনের ঘটনার পর থেকে রূপলেখা দত্ত সম্পূর্ণ নিখোঁজ হয়ে যায়।’
আদিত্য খেয়াল করল অশনি এবং তার বাবা খুব মন দিয়ে তার কথা শুনছে। ‘আমরা রূপলেখা দত্তর রহস্য সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করতে পেরেছি। রূপলেখার আসল নাম শবনম। সে একজন দেহোপজীবিনী। দু’-দুবার মামলায় হেরে গিয়ে বনানী দাস মরিয়া হয়ে তাকে নিযুক্ত করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল, শবনম রূপলেখা সেজে অশনির ঘনিষ্ঠ হয়ে কিছু নোংরা ছবি তুলবে যাতে অশনিকে পরিষ্কার দেখা যাবে কিন্তু শবনমকে দেখা যাবে না। পরে এই ছবিগুলো দিয়ে অশনির বাবাকে অপদস্থ করা হবে। ঠিক বলছি তো দিদি?’
শেষের কথাগুলো আদিত্য তপস্বিনী করুণা ওরফে বনানী দাসের উদ্দেশে বলল। তপস্বিনী করুণা এতক্ষণ চুপ করে নতমস্তকে ঘরের এক কোণে বসে ছিল। এবার খুব মৃদুভাবে তার গলার স্বর শোনা গেল।
‘মাতাজি আমাকে মরণ থেকে তুলে এনে নতুন জীবন দিয়েছেন। প্রতিহিংসার আগুন আমাকে পাগল করে দিয়েছিল। আমি আর মানুষ ছিলাম না। সেই অবস্থায় আমাকে ওই উকিলবাবু নরকের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার পাপের সীমা নেই। আমি সব কথা মাতাজিকে বলেছি। উনি বলেছেন, পুলিশের কাছে সব কিছু খুলে বলতে। মাতাজি বলেছেন, পুলিশের কাছে সব কথা খুলে বললে তবেই আমি শান্তি পাব।’ বনানী দাস চুপ করলেন। তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
‘দিদি, আপনাকে যদি দু’একটা প্রশ্ন করি আপনি কি তার উত্তর দেবেন?’ আদিত্য সসম্ভ্রমে জিজ্ঞেস করল।
বনানী দাস আদিত্যর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। নীরবে প্রশ্নের অপেক্ষা করছে।“শবনমের সঙ্গে আপনার কোথায় প্রথম আলাপ?’
‘উকিলবাবুর চেম্বারে। উকিলবাবুই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন।’ ‘উকিলবাবু মানে সজল নন্দী? ওই ওখানে যিনি বসে আছেন?’
বনানী দাস এক ঝলক সজল নন্দীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘শবনমকে ব্যবহার করে অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেল করার প্ল্যানটা কি সজল নন্দীই আপনাকে দেন?
‘শবনমকে নিযুক্ত করার পরিকল্পনাটা উকিলবাবুর। কিন্তু অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেল করার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। আমার উদ্দেশ্য ছিল অসীমাভ রায়কে অপমান করা, হেনস্থা করা, এমন একটা অবস্থা তৈরি করা যাতে অসীমাভ রায় আর লোকসমাজে মুখ দেখাতে না পারে। ভেবেছিলাম, ছবিগুলো হাতে পেলে আমি বিভিন্ন জায়গায় ওগুলো পাঠিয়ে দেব।’
‘ছবিগুলো কি আপনি হাতে পেয়েছিলেন ?
‘হ্যাঁ। পেয়েছিলাম। ছবিগুলো দেখে আমার গা গুলিয়ে উঠেছিল। বুঝতে পারছিলাম ছবি পাঠানোর কাজটা ছবিগুলোর থেকেও নোংরা। তবু ছবিগুলো আমি পাঠাতাম। আমার মধ্যে প্রতিহিংসার আগুন তখনও দাউদাউ করে জ্বলছিল। আমার মধ্যে যা কিছু ভাল ছিল সেই আগুনে পুড়ে গিয়েছিল।
‘কিন্তু ছবিগুলো আপনি পাঠাননি।’
‘না। পাঠাইনি। পাঠানোর আগেই অসীমাভ রায়ের ছেলেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল ৷ খুনের দায়ে তার জেল হল। আমি ভাবলাম অসীমাভ রায় তার কৃতকর্মের সাজা তো পেয়েই গেল। তা হলে আমি আর ওই সব নোংরামির মধ্যে থাকব কেন? এর কিছুদিন পরে মাতাজির দর্শন পাই। উনি আমাকে ওঁর চরণে আশ্রয় দেন। আমি নতুন জীবন পেলাম।’
‘ছবিগুলো কি হল?’
‘ওই নোংরা ছবিগুলো আমি নিজের কাছে রাখতে চাইনি। ওগুলো আমি পুড়িয়ে ফেলেছিলাম।’
‘তার মানে, আপনাকে ছবিগুলো আপনাকে দেবার আগে শবনম ওগুলোর কপি রেখেছিল। বলা তো যায় না, কখন কাজে লেগে যায়। শবনমের মতো মহিলার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। তবে এর পেছনে কানু বা উকিলবাবুর পরামর্শ থাকাটা আশ্চর্য নয়।’
কানু ও সজল নন্দী নিশ্চুপ।
‘আচ্ছা, উকিলবাবুর পাশে যিনি বসে আছেন তাকে আপনি চেনেন?’ আদিত্য সজল নন্দীর পাশে বসে থাকা কানুর দিকে আঙুল দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘না, ওকে আমি চিনি না। তবে মনে হচ্ছে কয়েকবার যেন শবনমের সঙ্গে উকিলবাবুর চেম্বারে দেখেছি।’
‘এসব কিন্তু আপনারা কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না।’ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সজল নন্দী মুখ খুলেছে।
‘সজলবাবু, আমরা কী প্রমাণ করতে পারব আর কী পারব না সে সব পরে দেখা যাবে। আপাতত আপনি চুপ করে বসুন। আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি। ‘আগের কাহিনিতে ফিরে যাচ্ছি। ধরা যাক, অশনি রায় রূপলেখারূপী শবনমের সঙ্গে প্রেম করছে এবং একই সঙ্গে ড্রাগের পেমেন্ট-এর জন্য গ্লোবালকে আনডারইনভয়েসিং-এ সাহায্য করছে। পেশার কারণে মৃত্তিকাকে সে চেনে কিন্তু সম্পর্কটা খুব গভীর কিছু নয়। এই সময় দুবে ঠিক করল পার্থ এবং মৃত্তিকাকে খুন করা হবে এবং সেই খুনের দায়টা চাপানো হবে অশনির ওপর। দুবের লোক অশনিকে ফলো করে জানতে পারল অশনির সঙ্গে একজন মহিলার জোরদার অ্যাফেয়ার চলছে। আরও জানতে পারল, মহিলাটি আসলে একজন বাজারের মেয়ে, তার আসল নাম শবনম।
‘দুরের লোক টাকা দিয়ে শবনমকে বশ করল। শবনম একটা মোবাইলের মাধ্যমে অশনির সঙ্গে যোগাযোগ করত যেটা রূপলেখা দত্তর নামে রেজিস্টার্ড। সেই মোবাইলটাতে শবনম আর অশনির যে ছবিগুলো ছিল সেগুলো শবনম আগেই মুছে দিয়েছিল। কিন্তু অশনির সঙ্গে চ্যাটগুলো মোবাইলে রেখে দিয়েছিল। দুবের নির্দেশে খুনের রাত্তিরে রূপলেখা অশনিকে ফোন করে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এর ওই বাড়িটাতে আসতে বলল। অশনি যখন ওখানে পৌঁছল তখনও খুনি পালাবার সুযোগ পায়নি। সে অশনিকে অজ্ঞান করে ড্রেনপাইপ বেয়ে পালিয়ে গেল। যাবার সময় অশনিকে ফাঁসানোর জন্যে রূপলেখার মোবাইলটা রেখে গেল। মোবাইলটা যেহেতু রূপলেখা দত্তর নামে রেজিস্টার্ড, পুলিশ ধরে নিল মৃত্তিকা মিত্রই রূপলেখা দত্ত নাম নিয়ে অশনির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করেছিল। সেই অবৈধ সম্পর্কের জেরে প্রথমে পার্থ মিত্র তার স্ত্রীকে খুন করে এবং তাই দেখে উত্তেজনার বশে অশনি পার্থ মিত্রকে মেরে ফ্যালে। কিন্তু পুলিশের কেস সাজানোয় কিছু ফাঁক ছিল বলে অশনি ছাড়া পেয়ে যায়।
‘অর্থাৎ আমার এই গল্পটা যদি সত্যি হয় তা হলে অশনি খুন করেনি বটে কিন্তু সে গ্লোবাল ট্রেডিং এবং সেন বেকারির বেআইনি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু পুলিশের কাছে সে সেই কথা স্বীকার করেনি।’
‘আমি আবার প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমি কোনওদিন কোনও বেআইনি লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’ অশনি রায়ের গলাটা এবার ক্লান্ত শোনাল।
‘বললাম তো আমরা আপনার প্রতিবাদটা খতিয়ে দেখব। তার আগে দয়া করে আমাকে শেষ করতে দিন।’ আদিত্যর গলাটাও একটু ক্লান্ত শোনাল ‘কতক্ষণে আপনি শেষ করবেন? আপনি বলে যাচ্ছেন তো বলেই যাচ্ছেন।’ এবার কানু উদ্ধত গলায় বলল।
‘এই এটার মুখে একটা সেলোটেপ আটকে দে তো। এটা বড্ড কথা বলছে।’ গৌতমের গলা পুলিশি কর্কশ।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন কর্তব্যরত কনসটেবল এগিয়ে আসছিল। কানু বিপদ বুঝে দু’হাত জড়ো করে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। এবারের মতো মাফ করে দিন স্যার। আর কথা বলব না।’
গৌতমের ইশারায় কনসটেবল দু’জন পিছিয়ে গেছে। ঘরের আবহাওয়া একটু শান্ত হতে আদিত্য আবার শুরু করল।
‘সেই নোংরা ছবিগুলো, যেগুলো বনানী দাস পুড়িয়ে ফেলেছিল, কিন্তু শবনমের কাছে যেগুলোর কপি ছিল, অশনি রায় জেলে যাবার পর সেগুলো মূল্যহীন হয়ে গিয়েছিল। ওগুলো ব্যবহার করে অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেল করাটা শক্ত ছিল। জেলে যাবার ফলে অশনির সুনাম তো এমনিতেই ধূলিসাৎ, ছবিগুলো বাইরে এলে তার সুনামের আরও কী এমন ক্ষতি হবে? এই অবস্থায় অসীমাভ রায়ও ব্ল্যাকমেলের টাকা দিতে চাইবেন না। পুরো পরিশ্রমটাই বৃথা যাবে। এইসব ভেবে শবনম ছবিগুলো আর ব্যবহার করেনি। তারপর যখন হাই কোর্ট অশনিকে বেকসুর খালাস করে দিল, সে তার পুরোনো সুনামও অনেকটা ফিরে পেল। চাকরিটাও ফিরে পাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিল। তখন শবনম ভাবল ছবিগুলো ব্যবহার করে এখন কিছু পয়সা রোজগার করা যেতে পারে। এই ব্যাপারে তার সঙ্গে ছিল কানু এবং উপদেষ্টা হিসেবে সজল নন্দী। ব্ল্যাকমেলের টাকা আনতে গিয়ে কানু ধরা পড়ল, সজলকেও আমরা পুলিশ কাস্টডিতে নিলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, কানু এবং সজল যখন পুলিশ কাস্টডিতে সেই সময় শবনম খুন হল। যে শবনমকে খুন করল সে ছবিগুলোও নিয়ে গেল। শবনমকে কে খুন করল? এ ব্যাপারে সুভদ্র কিছু বলবে।’
‘আমরা সিসি ক্যামেরায় দেখতে পেয়েছি সাধু বিকাশ বলে একজন পুরোনো ক্রিমিনাল কিছু একটা পাবার জন্য শবনমকে টর্চার করছে। অমানুষিক টর্চারের ফলেই শবনমের মৃত্যু হয়েছিল। আর সম্ভবত শবনমকে টর্চার করা হয়েছিল ওই ছবিগুলোর জন্যেই। এবং যেহেতু অনেক খুঁজেও ছবিগুলো আমরা শবনমের বাড়িতে পাইনি, ধরে নেওয়া যায় ছবিগুলো সাধু বিকাশ নিয়ে গেছে। প্রশ্ন হল, সাধু বিকাশ কি কোনও জায়গা থেকে খবর পেয়ে নিজেই ছবিগুলো হস্তগত করতে গিয়েছিল নাকি কেউ তাকে নিয়োগ করেছিল?’ সুভদ্র থামল।
‘এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়েছি। উত্তরটা পরে বলব। তার আগে মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্রর হত্যারহস্যে ফিরে যাওয়া যাক।’ আদিত্য আবার বলতে শুরু করল। ‘এখন এই রহস্যের দুটো আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা আমরা পেয়েছি। একটা পুলিশের ব্যাখ্যা যেটা বলছে মৃত্তিকাকে খুন করেছে পার্থ এবং পার্থকে অশনি। এই ব্যাখ্যাটায় কিছু মৌলিক গলদ আছে। প্রথম গলদ, দুটো খুনই পেশাদার হাতের কাজ। এত প্রিসিশন অশনির পক্ষে অসম্ভব। দু’নম্বর গলদ, পাঁচিল টপকে যে লোকটা পালাল তার ব্যাপারে পুলিশ কোনও ব্যাখ্যা দিচ্ছে না। তিন নম্বর গলদ, অশনি যদি খুন করে থাকে, তা হলে সে তার হাতের ছাপ সুদ্ধু রিভলভারটা অকুস্থলে ফেলে আসবে কেন। আরও প্রশ্ন আছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, যেটাতে দেখা যাচ্ছে লোকটা পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে, প্রথমে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে কোনও এক যাদুমন্ত্রে ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী সেটা কোর্টে প্রোডিউস করলেন। এটা কী করে হল? অরুণকান্তির দুর্ঘটনাটাও কি কাকতালীয়? কেসটা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে যাবার জন্যে পুলিশের ওপর কোথা থেকে চাপ আসছে? সব মিলিয়ে পুলিশের ব্যাখ্যাটা ধোপে টিকছে না।’
‘তা হলে কি অন্য ব্যাখ্যাটাই ঠিক? মানে তুই যেটা বললি?’ গৌতমকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হল।
‘অন্য ব্যাখ্যাটাতেও অনেকগুলো ফাঁক আছে। সেগুলো এক এক করে বলছি।’ অশনি আর তার বাবার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আদিত্য বলতে শুরু করল।
‘প্রথম ফাঁক, পার্থ মিত্র নিঃসন্দেহে সেন বেকারির ড্রাগ পেডলিং-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু সে তার স্ত্রীকেও এই কাজে যুক্ত করতে চেয়েছিল এটা মনে করার কারণ নেই। কালানুক্রমিক ঘটনাপঞ্জী বলছে গ্লোবাল ট্রেডিং-এর কাজে সে যোগ দিয়েছিল ২০১৫ সালের অক্টোবরে। কিন্তু তার আগে চার বছর আট মাস মৃত্তিকা বেকার হয়ে বাড়িতে বসেছিল। অনেক আগেই পার্থ মৃত্তিকাকে গ্লোবালে একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারত। কিন্তু পার্থ এটা চায়নি। শেষে উপায় না দেখে খানিকটা অনিচ্ছা নিয়েই পার্থ মৃত্তিকাকে গ্লোবাল-এর চাকরিটা পাইয়ে দিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই কাজের সূত্রে গ্লোবালের মালিককে পার্থ মিত্র চিনত। কিন্তু পার্থ চাইত না তার স্ত্রী তার আসল কাজের ব্যাপারটা জানতে পারুক। মৃত্তিকা গ্লোবাল-এ চাকরি করলে যে সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছিল না। তাই মৃত্তিকা বাড়িতে বেকার বসে থাকা সত্ত্বেও পার্থ অনেকদিন মৃত্তিকার গ্লোবাল-এ চাকরি করার ব্যাপারে উৎসাহ দেখায়নি। এর থেকে মনে হয় মৃত্তিকা ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে আদৌ যুক্ত ছিল না।
ঘরের সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে।
‘দ্বিতীয় ফাঁক, মৃত্তিকা যখন গ্লোবালে চাকরি করছে তখন এমন কিছু ঘটেনি যাতে অশনির অনেক টাকার দরকার হবে। টাকার দরকার তার হতে পারত যখন প্রথম বান্ধবী অন্বেষার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ভেঙে যায়নি। অশনি নিজে এবং তার বন্ধু নিমগ্ন দাশগুপ্ত আমাদের বলেছে অন্বেষা ভীষণ ডিমান্ডিং ছিল। কাজেই এই সময় যদি মৃত্তিকার মাধ্যমে অশনি বেআইনি আন্ডার-ইনভয়েসিং অর্থাৎ শাড়ির দাম কমিয়ে দেখানোর কাজে জড়িয়ে পড়ত, সেটা তবু মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু সুভদ্রকে অশনি জানিয়েছে যে অন্বেষার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়েছে ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে, আর আমরা জানি তার একমাস পরে মৃত্তিকা গ্লোবাল-এ যোগ দিয়েছিল। ততদিনে অশনির টাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। সে কেন মৃত্তিকার প্রস্তাবে রাজি হয়ে বিপথে যাবে? মনে রাখতে হবে, অশনির দ্বিতীয় বান্ধবী রূপলেখা তার প্রথম বান্ধবী অন্বেষার মতো ডিমান্ডিং ছিল না। এটা অশনিই আমাকে বলেছে।
‘তৃতীয় ফাঁক, মোবাইলটা কেন কয়েকদিন পরে একটা লুকোনো জায়গা থেকে পাওয়া গেল? কেউ যদি অশনিকে ফাঁসানোর জন্যে মোবাইলটা মৃত্তিকার বাড়িতে ফেলে যায় তা হলে তো সে সেটা প্রকাশ্য জায়গায় ফেলে রাখবে। লুকিয়ে রাখবে কেন?
‘সব থেকে বড় কথা, দুবে যদি সত্যি সত্যি অশনির মুখ বন্ধ করতে চাইত তা হলে সরাসরি তাকে মেরে ফেললেই তো পারত। তাকে বাঁচিয়ে রাখা মানেই রিস্ক, কখন সে পুলিশের কাছে কী বলে ফেলবে কে বলতে পারে? আর দুবে বা তার গ্যাং ইতিমধ্যেই এত মানুষ মেরেছে যে আর একটা মানুষ মারতে তাদের খুব অনীহা হবে বলে মনে হয় না। আরও প্রশ্ন, দুবের লোকজনই যদি সব গন্ডগোলের মূলে থাকে তা হলে ধরে নিতে হবে তারা শবনমকেও খুন করিয়েছে। কিন্তু তারা খামোকা শবনমকে খুন করাতে যাবে কেন? ছবিগুলোই বা নিতে যাবে কেন?
‘সব মিলিয়ে আমার মনে হচ্ছে দ্বিতীয় এই ব্যাখ্যাটাও ধোপে টিকছে না।’ আদিত্য চুপ করল। ঘরে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর সেই নীরবতা ভেঙে গৌতম বলল, ‘যা ব্বাবা। তা হলে আমরা তো সেই ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান।’
(৪)
‘বেশ কিছুদিন কিন্তু আমি ওই দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটাই সত্যি বলে ধরে নিয়ে যে ফাঁকগুলো বললাম সেগুলো ভরাট করার চেষ্টা করছিলাম। বলাই বাহুল্য, ফাঁকগুলো ভরাট করতে পারছিলাম না, কারণ ফাঁকগুলো ভরাট করার নয়। সম্ভবত কোনও কেসেই আমি এতদিন ধরে ভুল রাস্তায় হাঁটিনি। তারপর একেবারে ভাগ্যের বশে এমন একটা ঘটনা ঘটল এবং তার ফলে এমন একটা জিনিস আমি জানতে পারলাম যাতে মৃত্তিকা-পার্থর মৃত্যুরহস্যটা এক মুহূর্তে আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।’ আদিত্য একটু থেমে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল।
‘কী ঘটনা? কী জানতে পারলি?’ গৌতম আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছে না।
‘আমার ভুলটার কথা আগে বলি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম মৃত্তিকা-পার্থর হত্যারহস্যের সঙ্গে দুবে গ্যাং-এর ড্রাগ পেডলিং ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটাই আমার ভুল। সত্যি এটাই যে মৃত্তিকা-পার্থর হত্যারহস্যের সঙ্গে দুবে গ্যাং-এর ড্রাগ পেডলিং-এর কোনও সম্পর্ক নেই। একটা ইনটুইশন আমাকে চালিত করছিল। আমার ইনটুইশন আমাকে বলছিল, অশনি মিথ্যে কথা বলছে। সে আসলে ভাল করেই মৃত্তিকাকে চিনত। মানে যতটা চিনত সে বলছে তার থেকে অনেক বেশি চিনত। এই ইনটুইশনের দ্বারা চালিত হয়ে আমি ড্রাগ পেডলিং-এর সঙ্গে মৃত্তিকা-পার্থর খুনটা জড়িয়ে ফেলেছিলাম। আমার ইনটিউশনটা ভুল ছিল না। কিন্তু সেটার থেকে ঠিক ইঙ্গিতটা আমি নিতে পারিনি।
‘অর্থাৎ অশনি মৃত্তিকাকে ভাল করেই চিনত। অশনি পুলিশকে মিথ্যে বলছিল।’ অশনি রায় কাঠ হয়ে বসে আছে। তার বাবার মুখেও উদ্বেগের চিহ্ন। আদিত্য আবার বলতে শুরু করেছে।
‘আমি ভেবেছিলাম ড্রাগ পেডলিং নিয়ে রেশারেশির জেরে খুনি মূলত পার্থ মিত্রকেই খুন করতে চেয়েছিল। মৃত্তিকা সেখানে উপস্থিত ছিল বলে সেও খুন হয়ে যায়। আসল ঘটনাটা ঠিক উল্টো। খুনি মৃত্তিকাকেই খুন করতে গিয়েছিল। সেই রাত্তিরে পার্থর বাড়িতে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু তার ফ্লাইট ক্যানসেলড হয়ে যাবার ফলে সে বাড়ি ফিরে আসে। এবং মৃত্তিকার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও খুন হয়ে যায়। খুনী সাক্ষী রাখতে চায়নি।’
‘খুনি ওই ফ্ল্যাটে ঢুকল কী করে?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘খুনি সকাল থেকে ওই ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে উঠে ট্যাঙ্কের পাশে লুকিয়ে ছিল। তারপর রাত্তিরে ড্রেন পাইপ বেয়ে মৃত্তিকাদের বারান্দায় নামে এবং বারান্দা থেকে শোবার ঘরে ঢোকে। মৃত্তিকা তখন তার শোবার ঘরেই ছিল। আর তার স্বামী পার্থ ছিল বাথরুমে। খুনির সঙ্গে রিভলভর ছিল, কিন্তু সে সেটা ব্যবহার করতে চায়নি, পাছে শব্দে লোকজন জেগে যায়। খুনি পেশাদার। সে ক্যাবিনেট থেকে একটা ফুলদানি তুলে নিয়ে নিপুণ দক্ষতায় মৃত্তিকার মাথায় মারে এবং মৃত্তিকা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। ঠিক এই সময় শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজা খুলে পার্থ বেরিয়ে আসে। খুনির ধারণা ছিল পার্থ শহরের বাইরে। সে জানত না পার্থর ফ্লাইট ক্যানসেলড হয়ে গেছে। তাই সে কিছুটা চমকে যায় এবং উপায় না দেখে রিভলভর বার করে পার্থকে গুলি করে। আমার বিশ্বাস এর ঠিক পরেই কলিং বেল বেজে ওঠে। কলিং বেল বাজাচ্ছিল অশনি রায়। খুনি তাকে বাড়িতে ঢুকিয়ে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে দেয়। তারপর রিভলভরে অজ্ঞান অশনির হাতের ছাপ তুলে রিভলভরটা মেঝেতে ফেলে রেখে ড্রেন পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পাঁচিল টপকে চম্পট দেয়।’
‘তার মানে অশনি রায় সত্যি কথাই বলেছিল।’ সুভদ্র মন্তব্য করল। ‘পুরোটা নয়। আংশিক সত্যি বলেছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, অশনি কেন অত রাত্তিরে মৃত্তিকা-পার্থর ফ্ল্যাটে গিয়েছিল? আর এখানেই অশনি মিথ্যে বলছে। সত্যিটা হল, অশনি অত রাত্তিরে মৃত্তিকার ফ্ল্যাটে গিয়েছিল কারণ মৃত্তিকা তাকে যেতে বলেছিল।’
‘মৃত্তিকা যেতে বলেছিল!’ গৌতম সত্যিই অবাক।
‘হ্যাঁ, মৃত্তিকাই যেতে বলেছিল।’
‘কেন?’
‘অশনির সঙ্গে তার কিছু কথা ছিল যে কথাগুলো সে স্বামীর উপস্থিতিতেই অশনিকে বলতে চেয়েছিল। এদিকে তার স্বামী পার্থ কাজে ব্যস্ত থাকে। সেন বেকারির হেরোইন ভরা পাঁউরুটি ডিসট্রিবিউট করা কম কাজ তো নয়। কাজেই পার্থকে পাওয়া যায় না। হঠাৎ সেই রাত্তিরে পার্থ মিত্রর ফ্লাইট ক্যানসেলড হল। মৃত্তিকা ভাবল আজ রাত্তিরেই অশনিকে ডেকে কথাটা বলে দিই। এই ভেবে সে অশনিকে ফোন করল। অশনি তখন রূপলেখার সঙ্গে ডিনার সেরে বাড়ি ফিরছিল। মৃত্তিকার ফোন পেয়ে অশনি গাড়ি ঘুরিয়ে বাঙ্গুর অ্যাভিনিউতে এসে পৌঁছল। ততক্ষণে মৃত্তিকা এবং পার্থ খুন হয়ে গেছে। ঠিক বলছি তো অশনিবাবু?’ শেষ কথাগুলো বলাই বাহুল্য অশনির উদ্দেশে।
অশনি নিরুত্তর। অসীমাভ রায় চিন্তায় ডুবে আছে।
‘তুই আর হেঁয়ালি না করে পরিষ্কারভাবে বল কেন মৃত্তিকা অশনি রায়ের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল।’ এবার গৌতমের গলা।
‘বলছি, বলছি। তার আগে বলি ভাগ্যক্রমে কোন ঘটনা আমাকে ঠিক পথে নিয়ে এল। আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে হার্টকেয়ার নার্সিং হোমে একটা বিল মেটাতে গিয়েছিলাম। ওখানে কিছুদিন আগে ডাঃ অসীমাভ রায় আমাকে অ্যাঞ্জিও করে স্টেন্ট বসিয়েছিলেন। সেই সংক্রান্ত বিল। বিল মেটাতে গিয়ে যাজ্ঞসেনী মল্লিক বলে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। যাজ্ঞসেনী হার্টকেয়ার-এর অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। কথায় কথায় যাজ্ঞসেনী বলল, এক সময় মৃত্তিকা মিত্র হার্টকেয়ারের মেডিকাল রেকর্ডস-এর দায়িত্বে ছিল। বলতে গেলে প্রায় বিনা কারণে তার চাকরিটা চলে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে আমি পুরো ছবিটা চোখের সামনে দেখতে পেলাম।’ ‘কী ছবি দেখলেন? কী ছবি?’ অনেকক্ষণ পরে অসীমাভ রায়ের গলা শোনা গেল।
‘ছবিটা আপনার জন্যে খুব গৌরবজনক নয় ডাঃ রায়। আপনি হার্টকেয়ারের আট আনা অংশীদার। নামে ও বেনামে। বাকি অংশীদার আপনার বন্ধু বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জেন ডাঃ সমীরণ সান্যাল। সেটাও নামে এবং বেনামে। এটাই সত্যি যে আপনারা দু’জনে মিলে টাকার লোভে মনোময় দাসকে অপরেশন করার পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। মনোময় দাসের শারীরিক অবস্থা আদৌ অপরেশনের উপযুক্ত ছিল না। সেটা জেনেও যখন আপনারা মনোময় দাসকে অপরেশন করানোর পরামর্শ দিলেন তখন বলা যেতেই পারে আপনারা তাকে টাকার লোভে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিলেন।’
‘আপনি প্রলাপ বকছেন। আমি আপনার নামে মানহানির মামলা করব।’ অসীমাভ রায় গর্জে উঠেছেন।
‘ইচ্ছে হলে নিশ্চয় করবেন। কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ এখনও শেষ হয়নি। বলতে পারেন সবে শুরু হয়েছে। আপনি আগে মন দিয়ে আপনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুনুন। তারপর যা মনে হবে করবেন। বনানী দাস যখন মামলা করল তখন প্রথমেই হার্টকেয়ারের মেডিকাল রেকর্ডস-এর দায়িত্বে থাকা মৃত্তিকা মিত্রকে আপনারা বিনা কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন। আপাতদৃষ্টিতে বিনা কারণে, কিন্তু আসলে খুব জরুরি একটা কারণ ছিল। আপনারা মনোময় দাসের মেডিকাল টেস্টের রিপোর্টগুলো বদলে দিয়েছিলেন। না হলে আপনারা কোর্টে দাঁড়াতে পারতেন না। এখন, মৃত্তিকা মিত্রর মতো কম্পিউটার-দক্ষ কর্মী থাকলে আপনারা এই বদলটা চুপিচুপি করতে পারতেন না। মৃত্তিকা ঠিক ধরে ফেলত। তাই মৃত্তিকাকে আপনারা ছাঁটাই করে দিলেন। বেচারা জানতেও পারল না কেন তার চাকরি গেল। এই ষড়যন্ত্রে আরও কতজন যুক্ত ছিল এবং এই ধরনের কাজ আপনারা আরও কতবার করেছেন, সেসব নিয়ে অবশ্যই তদন্ত হবে। তবে আমার বিশ্বাস এই ধরনের কাণ্ড আপনারা আরও ঘটিয়েছেন। না হলে একজন অপদার্থ কিন্তু বিশ্বস্ত কর্মচারীকে মেডিকাল রেকর্ডের দায়িত্বে বসিয়ে রাখতেন না। যাই হোক, আপাতত মৃত্তিকার সেটা নিয়ে বলি।’
অসীমাভ রায়ের ফরসা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। তিনি কথা বলছেন না। শুধু হাতের মুঠি খুলছেন, বন্ধ করছেন। একটু জিরিয়ে নিয়ে আদিত্য আবার বলতে শুরু করল।
‘চার বছর আট মাস মৃত্তিকা বাড়িতে বেকার হয়ে বসেছিল। তারপর গ্লোবাল ট্রেডিং-এ একটা চাকরি পেল। নিজের দক্ষতা দিয়ে বেশ তাড়াতাড়ি উন্নতি করছিল মৃত্তিকা। তারপর একদিন অশনি রায়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। নেহাতই কাজের সূত্রে পরিচয়। শুরুতে তার থেকে বেশি আর কিছু ছিল না। পরে অশনি এবং মৃত্তিকার মধ্যে খানিকটা ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। আমার অনুমান, প্রথম প্রেমিকার কাছ থেকে দাগা খাওয়ার পর অশনি নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা হারায় এবং প্লেবয়-সুলভ একটা প্রবণতা তার মধ্যে তৈরি হয়। অর্থাৎ মেয়ে দেখলেই তার ফ্লার্ট করতে ইচ্ছে করত। মৃত্তিকার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। অশনির চেহারাটা মেয়ে পটানো তো ছিলই।’ ‘কিন্তু মৃত্তিকা তো বিবাহিত। সে অশনিকে পাত্তা দেবে কেন?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘আমার ধারণা, পার্থ তার স্ত্রীকে খুব বেশি সঙ্গ দিতে পারত না। তাই মৃত্তিকা একাকীত্বে ভুগত। অশনির মতো মার্জিত সুপুরুষের সঙ্গ তার ভালই লাগত। তার বেশি হয়ত আর কিছু নয়।’
‘বেশ। তারপর ? ‘
‘কথায়, কথায় অশনি রায়ের কাছ থেকে মৃত্তিকা প্রথম বনানী দাসের মামলার ব্যাপারটা জানতে পারে। এটাও শোনে যে কোর্টে মেডিকাল রিপোর্ট দিয়ে প্রমাণ করা হয়েছিল মনোময় দাস অপরেশনের জন্যে সম্পূর্ণ উপযুক্ত ছিল। চকিতে তার মনে পড়ে যায় মনোময় দাসের যে রিপোর্টগুলো সে নার্সিং হোমের কম্পিউটারে তুলে রেখেছিল সেগুলো ঠিক এই রকম ছিল না। বুদ্ধিমতী মৃত্তিকা ধীরে ধীরে এটাও বুঝতে পারে কেন তাকে হার্টকেয়ার থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সে একদিন অসীমাভ রায়ের সঙ্গে দেখা করে বলল, সে এতদিনে পুরো ষড়যন্ত্রটা ধরতে পেরেছে। অসীমাভ রায় যদি পাবলিকলি তাঁর দোষ স্বীকার না করেন তাহলে মৃত্তিকা তাঁকে এক্সপোজ করে দেবে। ঠিক এই কথাগুলোই সে বলেছিল কিনা জানি না। তবে এই ধরনের কিছু একটা নিশ্চয় বলেছিল। অসীমাভ রায় মৃত্তিকাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তাঁর চোখে মৃত্তিকার বাঁচার অধিকার আর রইল না।’
‘এসব কথা কি শুধুই আপনার কল্পনাপ্রসূত, নাকি প্রমাণ-টমান কিছু আছে?’ ‘কিছু প্রমাণ জোগাড় না করে কি এত কথা বলছি? প্রমাণের প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে আমার অভিযোগগুলো বলে নিই।
‘অসীমাভ রায়ের কাছ থেকে বিতাড়িত হয়ে মৃত্তিকা ভাবল কোথায় যাবে ? পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ কি তার কথা বিশ্বাস করবে? মনে হয় না। অনেক ভেবেচিন্তে সে ঠিক করল অসীমাভ রায়ের ছেলে অশনিকেই সে সব কথা জানাবে। সেই মতো সে অশনির সঙ্গে যোগাযোগ করল। খানিকটা আভাসও দিল সে কী নিয়ে কথা বলতে চায়। আমার ধারণা অশনি ব্যাপারটা শুনে খুব অবাক হয়নি, কারণ সে তার বাবাকে খানিকটা চিনত। কিন্তু ব্যাপারটা এতটাই সিরিয়াস, বিশেষ করে অসীমাভ রায়ের কাছ থেকে বিতাড়িত হবার পরে, যে মৃত্তিকা তার কথাগুলো একা একা বলতে চায়নি। স্বামীর উপস্থিতিতে বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পার্থকে তো পাওয়াই যায় না। শেষে সেই রাত্তিরে ফ্লাইট বাতিল হয়ে গিয়ে হঠাৎ পার্থ বাড়ি ফিরে আসাতে মৃত্তিকার মনে হল অশনিকে কথাগুলো বলার এটাই উপযুক্ত সময়। সে অশনিকে ফোন করে তার বাড়িতে আসতে বলল। মৃত্তিকার ফোন পাবার পর অশনি তার বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই অসীমাভ রায়ের ভাড়াটে খুনি, পুলিশের খাতায় যার নাম সাধু বিকাশ, মৃত্তিকা এবং পার্থ মিত্রকে খুন করে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, বাবার খুনের দায় নিরপরাধ ছেলের ঘাড়ে এসে পড়ল। এবং অশনি পুলিশের কাছে পুরো সত্যটা বলল না, পাছে তার বাবার আসল চেহারাটা সবার সামনে বেরিয়ে আসে। এর জন্যে অবশ্য তাকে তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে। বাবার পাপে ছেলের শাস্তি। নিরাপরাধ ছেলে শাস্তি পাচ্ছে দেখেও বাবা কিন্তু তার দোষ স্বীকার করল না। অসীমাভ রায় নিজেকে এতটাই ভালবাসে।’ ‘আরও ভেবে দেখুন আদিত্যদা, বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রেমিকাকে, মানে রূপলেখাকে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে এতটুকু ইতস্তত করেনি অশনি। যখন সে পুলিশকে মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে যে রূপলেখা তাকে ওই বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এর বাড়িতে ডেকে এনেছে, তখন তো সে জানতই না যে রূপলেখা একজন ফ্রড।’ সুভদ্র বলল।
‘আসলে কী জান? অশনির সঙ্গে রূপলেখার সম্পর্কটা ছিল মূলত শারীরিক। ওদের মনের যোগ কখনই হয়নি। এটা আমি অশনির সামনেই বলব।’ আদিত্য চিন্তা করার গলায় বলল।
‘আবার বলছি, কোনও প্রমাণ আছে তোমার কাছে, নাকি এমনিই ঝোঁকের মাথায় বকবক করে যাচ্ছ?’ রাগের মাথায় অসীমাভ রায় আদিত্যকে তুমি সম্বোধন করে ফেলেছেন।
‘ঠিক প্রমাণ নেই। তবে একজন সাক্ষী আছে। তাকে আপনার চেম্বারের সামনে থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। তার নাম সাধু বিকাশ। সে স্বীকার করেছে আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সে মৃত্তিকা, পার্থ এবং শবনমকে খুন করেছে। হ্যাঁ, ওই ছবিগুলো হস্তগত করার জন্য আপনিই সাধু বিকাশকে দিয়ে শবনমকেও খুন করান। ছবিগুলো নিয়ে সে যখন আপনার কাছে যাচ্ছিল সেই সময় পুলিশ তাকে ছবিসুদ্ধু গ্রেপ্তার করে। সাধু বিকাশ এখন আমাদের প্রধান সাক্ষী।’
‘আর একজন সাক্ষীও আছে আদিত্যদা। তার কথা ভুলে গেলেন? আপনিই তো তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চেক করতে বললেন।’ সুভদ্র মনে করিয়ে দিল।
‘ও হ্যাঁ, তার কথা ভুলেই যাচ্ছিলাম। সেও তার অপরাধ স্বীকার করেছে। মক্কেলের নাম সোমনাথ বাগ। মৃত্তিকা এবং পার্থ যখন খুন হয় তখন সে বাঙ্গুর এভিনিউ-এর ওই বাড়িটায় সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিল। তাকে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে সাধু বিকাশ খুন হওয়ার দিন সকালবেলা বাড়ির ছাতে উঠে জলের ট্যাঙ্কের পেছনে লুকিয়ে ছিল। যখন সাধু বিকাশ ঢুকছিল তখন কয়েক মিনিটের জন্যে সোমনাথ সিসি ক্যামেরাটা বন্ধ করে দেয়। যে টাকাটা সাধু বিকাশ সোমনাথকে দিয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য অসীমাভ রায়ের। অনেক পরে, যখন আমি সোমনাথকে আবিষ্কার করলাম, তার সঙ্গে কথাবার্তা বললাম, তখন সে বুঝল কেসটা নিয়ে আবার ঘাঁটাঘাটি হচ্ছে। সে ভয় পেয়ে গেল। ঠিক করল, সে চিরতরে উধাও হয়ে যাবে। তিন বছর আগে অসীমাভর কাছ থেকে সে অনেক টাকা পেয়েছিল। সোমনাথ সাবধানী লোক। টাকাটা এতদিন সে খরচ করেনি। ব্যাঙ্কেও রাখেনি। মনে হয়, নগদে কোথাও একটা লুকিয়ে রেখেছিল। এবার ওই টাকা দিয়ে সে দেশে ফিরে গিয়ে একটা দোকান খুলল। সোমনাথ বাগ পুলিশের কাছে তার অপরাধ স্বীকার করেছে।
‘অসীমাভ রায় সোমনাথ বাগের সঙ্গে সরাসরি ডিল করলেন?’ গৌতমের প্রশ্ন। ‘না, না। একেবারেই নয়। অসীমাভ রায় তো দূরের কথা সাধু বিকাশের সঙ্গেও কখনও সোমনাথ বাগ কথাবার্তা বলেনি। সোমনাথ ওদের পরিচয় জানতই না। একজন তৃতীয় ব্যক্তির মাধ্যমে কথাবার্তা হয়েছিল। বস্তুত, সোমনাথ জানত না যার কাছ থেকে সে টাকা নিচ্ছে তার ছেলেই অশনি যে কিনা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এটা সে জানত না বলেই আমাকে বলেছিল অশনি এবং মৃত্তিকাকে সে একসঙ্গে দেখেছে। অর্থাৎ অশনিকে প্রোটেকশন দেবার কথাটা তার মাথায় আসেনি। অশনি আর মৃত্তিকাকে এক সঙ্গে দেখার কথাটা অবশ্য সত্যি।’
‘একটা জিনিস কিন্তু ঠিক বোঝা গেল না। যে সিসি ক্যামেরার ফুটেজটাতে দেখা গেল একটা লোক পাঁচিল টপকে পালাচ্ছে, যেটা প্রথমে পাওয়া যায়নি, পরে ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জী কোর্টে প্রোডিউস করেছিলেন, সেটা কোথায় ছিল?’ গৌতমের প্রশ্ন।
‘এটার একটা উত্তর আমার কাছে আছে। উত্তরটা আমার অনুমান। কিন্তু মনে হয় অনুমানটা খুব ভুল হবে না। আমার অনুমান, সিসি ক্যামেরার ফুটেজটা সোমনাথ বাগ সরিয়ে রেখেছিল যাতে সাধু বিকাশের ওপর কোনও সন্দেহ না পড়ে। ক্যামেরটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়ে যেত। সোমনাথ তার সুযোগ নিয়েছিল। ফুটেজটা নিয়ে সোমনাথ অসীমাভ রায়ের কাছে জমা দিয়েছিল। বলাই বাহুল্য সেই তৃতীয় ব্যক্তিটির মাধ্যমে। ফুটেজটা অসীমাভ রায়ের কাছেই ছিল। পরে যখন অসীমাভ রায় দেখলেন তার নিজের ছেলেই খুনের দায়ে ফেঁসে যাচ্ছে তখন তিনি ফুটেজটা কোথা থেকে পেয়েছেন সে বিষয়ে কিছু একটা গল্প বানিয়ে সেটা ব্যারিস্টার সাহেবের হাতে তুলে দিলেন। আমার অনুমান ঠিক কিনা অসীমাভ রায় বলতে পারবেন।’
অসীমাভ রায় কিছু বললেন না। চুপ করে রইলেন।
‘আমার একটা প্রশ্ন ছিল আদিত্যদা। ব্যারিস্টার অরুণকান্তি ব্যানার্জীর মৃত্যুটা কি নিছকই একটা অ্যাকসিডেন্ট নাকি ওটার পেছনেও কোনও ফাউল প্লে আছে?’ সুভদ্র জিজ্ঞেস করল।
আদিত্য তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অসীমাভ রায়ের দিকে তাকাল। অসীমাভ রায় চোখ নামিয়ে নিয়েছেন।
‘ব্যারিস্টার সাহেবের মৃত্যুটাও নিছক অ্যাকসিডেন্ট নয়। এই অ্যাকসিডেন্টটা ঘটানো হয়েছিল। সাধু বিকাশ ডাক্তারবাবুর নির্দেশে লোক দিয়ে এটা ঘটিয়েছিল। গৌতম বলল একটু অগে সাধু সেকথা স্বীকার করেছে।’
‘ব্যারিস্টার সাহেবকে মারার দরকার হল কেন?’ অবাক হয়ে যাওয়া গলায় অশনি প্রশ্ন করল।
‘যখন শোনা গেল পুলিশ অ্যাপিল করবে, কেসটা আবার ব্যারিস্টার সাহেবের কাছে গেল। কেসটা নিয়ে তাঁর কিছু অস্বস্তি ছিল। এবার তিনি পুরোদমে তদন্ত শুরু করলেন যেটা তিনি আগে সময়ের অভাবে করতে পারেননি। তিনি জানতে পারলেন মৃত্তিকা এক সময় হার্টকেয়ারে কাজ করত। ব্যারিস্টার সাহেবের ঝকঝকে মাথা। অচিরেই তিনি বুঝতে পারলেন মৃত্তিকা মিত্র, পার্থ মিত্রের খুনের পেছনে কে বা কারা আছে। তিনি সরাসরি পুলিশের কাছে যেতে পারতেন। কিন্তু হাজার হলেও অসীমাভ রায় তাঁর পুরোনো বন্ধু। সেই বন্ধুত্বের খাতিরে তিনি বন্ধুকে গিয়ে বললেন তিনি সবটাই বুঝতে পেরেছেন। এবং কেসটা আবার আদালতে উঠলে তিনি আসল সত্যটা প্রকাশ করার জন্যই অশনির হয়ে লড়বেন। অসীমাভ যেন তৈরি থাকে। এর ফলে অসীমাভ রায়ের চোখে ব্যারিস্টার সাহেবেরও বেঁচে থাকার অধিকার রইল না। ঠিক মৃত্তিকারই মতো।’
আদিত্য চুপ করল। সকলেই চুপ করে আছে। হঠাৎ সুভদ্র বলে উঠল, ‘স্যার, আমি মেসেজ পেলাম একটু আগে ডাঃ সন্দীপন সান্যালকেও পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।’ কথাগুলো গৌতমের উদ্দেশে।
‘আমার শরীরটা ভাল লাগছে না। আমি কি আসতে পারি?” বনানী দাস কিঞ্চিত দুর্বল গলায় বললেন।
“নিশ্চয় দিদি। অবশ্যই আপনি আসতে পারেন। একটা বেআইনি কাজ করতে গিয়েও আপনি শেষ পর্যন্ত করেননি। যেহেতু কাজটা আপনি করেননি, পুলিশ ও আপনাকে চার্জ করতে পারবে না। কী রে গৌতম ঠিক বলছি তো?’
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছিস। পুলিশ বনানী দাসের বিরুদ্ধে কোনও চার্জ দেবে না।’
‘তবে দিদি, একটা ব্যাপার আমার কিন্তু খেয়াল করা উচিত ছিল। একজন সাধারণ গৃহবধূ যখন একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজ-সংসার সব ছেড়ে এত তীব্রভাবে লড়াই করেন, তখন এটাই ধরে নেওয়া স্বাভাবিক ছিল যে তাঁর ক্ষোভটা সত্যিকারের। প্রথমেই আমরা ধরে নিলাম স্বামীর শোকে ওই গৃহবধূ পাগল হয়ে গেছেন। সত্যি-মিথ্যের মধ্যে আর তফাৎ করতে পারছেন না। এই ধরে নেওয়াটা আমার বিরাট একটা ভুল ছিল।’
তপস্বিনী করুণার চোখে একটা পুরোনো আগুন দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিবে গেল।
‘আমাদেরও তো এখানে আর কোনও কাজ নেই। আমাদেরই বা এখানে বসিয়ে রেখেছেন কেন?’ তপস্বিনী করুণা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর সজল নন্দী বিরক্ত গলায় বলল।
‘আপনারা তো ব্ল্যাকমেলিং-এর চার্জ থেকে ছাড়া পাচ্ছেন না। সেই আবার গিয়ে লক-আপেই তো ঢুকবেন। এত তাড়া কীসের? তবু যখন জিজ্ঞেস করলেন, জানিয়ে রাখি কেন আপনাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। দেখুন সজলবাবু, উকিল হিসেবে আপনার রেপিউটেশন ভাল ছিল না। নানারকম অনৈতিক এবং বেআইনি কাজের সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন। আপনার ওকালতির লাইসেন্সটা হয়ত অনেক আগেই বাতিল হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ওটা যে শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছিল তার পেছনে পরিষ্কারভাবে অসীমাভ রায়ের হাত ছিল। এইটুকু জানানোর জন্যেই আপনাকে বসিয়ে রেখেছিলাম।’
‘আর আমরা কেন এখনও বসে আছি?’ প্রণব মাইতি উদ্ধত গলায় বললেন। ‘আপনারাও এখনি ছাড়া পাচ্ছেন না। আপনাদের বিরুদ্ধে তো শুধু ইনশিয়োরেন্স ফ্রডের চার্জ নেই, আরও অনেক গুরুতর ড্রাগ ট্র্যাফিকিং-এর চার্জ রয়েছে। সেই চার্জে আপনাদের আবার গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
‘আমাকেও ড্রাগ ট্র্যাফিকিং-এর চার্জে গ্রেপ্তার করা হবে? আমি কিন্তু এসবের বিন্দুবিসর্গ জানতাম না।’ পল্লব সেন অসহায়ভাবে বললেন।
‘হয়ত আপনি সত্যি কথা বলছেন। কিন্তু আপনি দুর্জনের অসদুপায়ে অর্জন করা অর্থ ভোগ করেছেন। এত সহজে আপনি ছাড়া পাবেন না। কিছু শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে। আপনার দাদার মৃত্যুর পর যখন আপনাদের ব্যবসা পুরোপুরি প্রণব মাইতির হাতে চলে গেল আপনার একবারও মনে হল না ব্যবসাটা কীভাবে চলছে? আপনার বিলাসবহুল জীবনযাপনের টাকাটা আসছে কোথা থেকে? পল্লববাবু আপনি তো বোকা লোক নন। আপনি কখনও কখনও নিশ্চয় টের পেয়েছিলেন ব্যবসাটা ঠিক পথে চলছে না। আপনি ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে ছিলেন। কারণ সেটাই আপনার পক্ষে সুবিধেজনক ছিল। পুলিশ আপনাকে সহজে ছাড়বে না, পল্লববাবু।
পল্লব সেন মাথা নিচু করে আছেন।
‘সত্যিটা হল, আপনার ব্যবসাটা যে সৎ পথে চলছে না এটা আপনি জানতেন।
আর জানতেন বলেই আমরা কৃষ্ণনগর যাবার আগে আমাদের আসল পরিচয় আপনি প্রণব মাইতিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। না হলে প্রণব নন্দীর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না আমরা নকল পরিচয় দিচ্ছি। যে প্রণব নন্দী শুভব্রত সাহার ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে গিয়ে এতটাই ঝুলিয়ে দিল, সেই লোকটাই আমাদের দেখা মাত্র বুঝে ফেলল আমরা যা বলছি আসলে আমরা তা নই, এটা বিশ্বাস করা শক্ত। আমি যে আপনাকে বলেছিলাম আমরা ছদ্ম-পরিচয়ে যাব, আসলে সেটা একটা ফাঁদ। আপনি কতটা ইনোসেন্ট সেটা বোঝার জন্য।’
‘কিন্তু একটা সমস্যা তো রয়েই গেল। আমরা তো এখনও জানতে পারলাম না দুবে লোকটা কে?’ সুভদ্র বলল।
‘দুবে কে আমরা জানতে পেরেছি তো। তাকে পুলিশ গ্রেপ্তারও করেছে। তুমিই তো কাল ফোন করে আমাকে খবরটা দিলে।’
‘আমি খবর দিলাম? আপনি শুধু জেনে দিতে বলেছিলেন আপনি যে লোকটাকে অ্যারেস্ট করতে বলেছিলেন পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছে কিনা। আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম, হ্যাঁ, লোকটা অ্যারেস্টেড হয়েছে। আমি সেইটুকুই জানি এর বেশি আর কিচ্ছু জানি না।’
‘গৌতম কিন্তু সব জানে।’ আদিত্য মিটিমিটি হাসছে। ‘দুবে তোমার চেনা লোক, সুভদ্র। লোকটা অত্যন্ত বিপদজনক। গৌতম বলল গ্রেপ্তার হবার আগে ও দুজন পুলিশকে ভাল মতো জখম করেছে। তুমি কি আন্দাজ করতে পারছ লোকটা কে?’
সুভদ্র হতভম্ভ মুখ করে বসে আছে।
‘আচ্ছা প্রণববাবু আপনি তো সেন বেকারির আসল ব্যবসার ব্যাপারটা সবই জানতেন। কী করতে হবে সে ব্যাপারে কি আপনার কাছে ওপর থেকে নির্দেশ আসত?’
প্রণব মাইতি মুখ টিপে বসে আছে।
‘আপনি বলবেন না, তাই না? ঠিক আছে আপনার হয়ে আমি বলে দিচ্ছি। কোনও অদৃশ্য কর্তৃপক্ষের থেকে আপনার কাছে নির্দেশ আসত। কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে। কে নির্দেশ দিচ্ছে আপনি জানতেন না। কিন্তু যে নির্দেশ দিচ্ছে সে আপনার খুঁটিনাটি কাজের খবর রাখত। তার নির্দেশে আপনি শুভব্রত সাহার খুনটা চাপা দেবার চেষ্টা করেছিলেন। তারই নির্দেশে আপনি দু-দু’টো কারখানায় আগুন লাগিয়েছিলেন যাতে কোথাও কোনও হেরোইনের ট্রেস না থাকে। তারই নির্দেশে আপনি গেস্ট হাউসে আগুন লাগিয়েছিলেন যাতে আমরা দু’জন পুড়ে মরে যাই। আপনার পাশে বসেই লোকটা কাজ করত। আপনার ওপর সারাদিন নজর রাখত । কিন্তু আপনি ঘূণাক্ষরেও টের পাননি যে আপনার সেক্রেটারি তমাল বিশ্বাসই আসলে আপনার অদৃশ্য বস ড্রাগ মাফিয়া দুবে।’
ঘরে অখণ্ড নীরবতা। প্রণব মাইতির মুখে যতটা না গ্লানি তার থেকে ঢের বেশি বিস্ময়।
‘শুভব্রত সাহা কেন খুন হয়েছিল জানেন? শুভব্রত তমাল বিশ্বাসের আসল পরিচয়টা কোনও ভাবে জেনে ফেলেছিল। আসলে তমাল বিশ্বাসের একটা অত্যন্ত বিলাসবহুল নাইট-লাইফ ছিল। অত টাকা রোজগার করলে খরচা করতে হবে তো। সেটাই শুভব্রতর চোখে পড়ে গিয়েছিল। কাছেই থাকত বলে হয়ত। আপনার ওপর নির্দেশ এল শুভব্রতর কেসটা ধামাচাপা দিতে। আপনি কাজটা ভাল ভাবে করতে পারলেন না। একদিকে রটিয়ে দিলেন শুভব্রত টাকা চুরি করে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তাই আত্মহত্যা করেছে। অন্য দিকে তার স্ত্রীর মুখ বন্ধ করার জন্যে তাকে কম্পানি থেকে অনেকগুলো টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেললেন। একবারও ভেবে দেখলেন না দুটো পরস্পর বিরোধী। টাকা চুরি করে আত্মহত্যা করলে কোনও কম্পানিই কমপেনসেশন দেয় না। দুবে বুঝতে পারল আমি সন্দেহ করছি। তাই সে অন্য একটা গল্প ফাঁদল। এক পুরুষের জীবনে দুই নারীর সাবেক গল্প। সুভদ্র খোঁজ নিয়ে জানল গল্পটা সত্যি হলেও হতে পারে। দুবে সুভদ্রকে আর আমাকে গেস্ট হাউসে আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। মরে গেলে ল্যাঠা চুকেই যেত। কিন্তু যদি বেঁচে যাই সেই সম্ভাবনাটার কথা ভেবে দুবে আমাদের ওই গল্পটা বলেছিল। তার দুর্ভাগ্য আমরা বেঁচেও গেলাম, গল্পটাও বিশ্বাস করলাম না।’
কিছুক্ষণ পরে যখন গৌতমের ঘরে গৌতম, আদিত্য আর সুভদ্র ছাড়া অন্য সবাই বেরিয়ে গেছে, সুভদ্র বলল, ‘আদিত্যদা আপনি তো সব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে দিলেন, কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এখনও পেলাম না। প্রশ্নটা এতই ডেলিকেট যে বাইরের লোকের সামনে করতেও পারছিলাম না। প্রশ্নটা হল, অশনিকে দোষী প্রতিপন্ন করার জন্য কে পুলিশকে এত চাপ দিচ্ছিল? চাপ যে দিচ্ছিল তাতে সন্দেহ নেই। আমি নিজে সেই চাপ অনুভব করেছি।’
‘হ্যাঁ, চাপ একটা অবশ্যই ছিল এবং আমার ধারণা সেটা আসছিল কোনও পলিটিশিয়ান মারফত দুবের দল-এর কাছ থেকে। সত্যিটা এই যে দুবে ধরে নিয়েছিল পার্থ মিত্রর খুনটা তার রাইভাল গ্যাং ইসমাইলের দলের কাজ। অসীমাভ রায়ের কথাটা তার মাথাতে আসেনি। এখন খুনের তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ যদি জেনে যায় পার্থর সঙ্গে ড্রাগ মাফিয়াদের যোগ আছে এবং সেই ড্রাগ মাফিয়ারা সেন বেকারির মধ্যে দিয়ে অপরেট করে তা হলে দুবের সমূহ বিপদ। তাই সে যতটা পারে কেসটাকে অন্য দিকে অর্থাৎ অশনির বিরুদ্ধে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। একই কারণে তার লোক সল্ট অ্যান্ড পেপার-এর মালকিন মালা সরকারকে ভয় দেখাচ্ছিল। এবং একই কারণে গ্লোবাল ট্রেডিং-এর ব্যালেন্স শিট জোগাড় করাটাও তোমাদের পক্ষে এত শক্ত হয়ে গিয়েছিল।’
‘আচ্ছা এই এত কাণ্ড ঘটে গেল। এর মধ্যে ইসমাইলের দলটা কি একেবারে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসেছিল? তারা কি কিছুই করছিল না?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল। ‘করছিল। তাদের মতো করে করছিল। দুবের দলের একটা পাঁউরুটি ভর্তি ট্রাক তারা একবার লুট করেছিল। বলাই বাহুল্য, পাঁউরুটির মধ্যে হেরোইনের প্যাকেট ভর্তি ছিল। পরে দুবে খুব সাবধান হয়ে গিয়ে পাহারাদার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এছাড়াও তাদের আরও কীর্তি আছে। আমি অচেনা একটা মেয়ের কাছ থেকে একটা ফোন পেলাম। সে বলল তার নাম মিতা অধিকারী। সে গ্লোবাল ট্রেডিং-এ কাজ করে, অশনিকে চেনে, অশনির বান্ধবীকেও দেখেছে। দুজনে একসঙ্গে তাদের দোকানে নাকি শাড়ী কিনতে এসেছিল। মেয়েটা অবশ্য জনত না অশনি রূপলেখাকে কখনও কোনও দামী উপহার দেয়নি। যাই হোক, মেয়েটা বলল, অশনির সেই রহস্যময়ী বান্ধবীকে আজকাল নাকি গ্লোবাল ট্রেডিং-এর মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। মিতা অধিকারী কলকাতায় তাদের একসঙ্গে দেখেছে। আমি গ্লোবাল ট্রেডিং-এ খোঁজ নিয়ে জানলাম মিতা অধিকারী বলে তাদের একজন কর্মচারী আছে বটে কিন্তু সে দু’বছর হল কলকাতায় আসেনি। অর্থাৎ যে মেয়েটা আমাকে ফোন করেছিল সে ভুয়ো। কেন একজন এত কষ্ট করে নাম ভাঁড়িয়ে আমাকে ফোন করবে? এতে তার লাভ কী? একটু ভাবতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। মেয়েটি গ্লোবাল ট্রেডিং-এর দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিল। যেন বলতে চাইছিল গ্লোবাল ট্রেডিং-এর কার্যকলাপগুলো ভাল করে তদন্ত করে দেখা দরকার। ইসমাইলের গ্যাং ছাড়া আর কে এরকম চাইতে পারে? আমি বুঝতে পারলাম ওই মেয়েটি আসলে ইসমাইলের দলের।’
‘একটা জিনিস কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। রূপলেখার মোবাইলটা মৃত্তিকার ফ্ল্যাটে গেল কী করে?’ গৌতম জিজ্ঞেস করল।
‘এটা বেশ শক্ত প্রশ্ন। তবে উত্তরটা সুভদ্র আর আমি তদন্ত করে বার করেছি। এক কথায় উত্তর হল, ওটা খুনের রাত্তিরে মৃত্তিকার ফ্ল্যাটে ছিলই না। ব্যাপারটা এই রকম। খুনের রাত্তিরে অশনির গাড়িটা মৃত্তিকার ফ্ল্যাটের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তার সিসি ক্যামেরায় ওটার ছবি ধরা পড়ে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ অশনির কাছে আসে এবং তার মোবাইলটা কব্জা করে। দেখা যায় ওই মোবাইলটা থেকে অশনি রূপলেখার মোবাইলে বারবার কল করেছে। ইতিমধ্যে কিন্তু দুবে টাকা-পয়সা দিয়ে এবং ভয় দেখিয়ে পুলিশের একটা অংশকে কিনে ফেলেছে। সুভদ্রকে তদন্ত থেকে সরিয়ে নেওয়া হল। তার বদলে এমন কাউকে তদন্তের ভার দেওয়া হল যে দুবের কথা শুনে চলবে।
‘রূপলেখার মোবাইল কিন্তু তখনও খোলা রয়েছে, কারণ সে মৃত্তিকা-পার্থর খুন হওয়ার কথা কাগজে পড়লেও এর সঙ্গে অশনি যে জড়িয়ে পড়েছে সে কথা তখনও জানে না। দুবের কথা শুনে চলা পুলিশ রূপলেখার মোবাইল ট্রেস করে তার বাড়ি পৌঁছে গেল। রূপলেখার মনে পাপ, সে পুলিশ দেখেই পেছনের দরজা দিয়ে পালাল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মোবাইলটা ফেলে গেল। পুলিশ মোবাইলটা নিয়ে এল। পরে দুবের নির্দেশ মতো সেই পুলিশ রূপলেখার মোবাইলটা মৃত্তিকার বাড়িতে লুকিয়ে রেখে আসে এবং কিছুদিন পরে নিজেই খুঁজে বার করে। বলাই বাহুল্য, অশনিকে ভাল মতো ফাঁসানোর জন্যে এটা করা হয়।
‘আরও একটা প্রশ্ন, আদিত্যদা। অসীমাভ রায় যদি সাধু বিকাশকে দিয়েই ছবিগুলো উদ্ধার করবে ঠিক করে থাকে, তা হলে সে ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারে পুলিশের সাহায্য নিতে গেল কেন ?
‘নিতে গেল তার কারণ সে জানত না সাধু বিকাশ কত তাড়াতাড়ি ছবিগুলোর হদিশ করতে পারবে। অথচ খুব তাড়াতাড়ি ব্ল্যাকমেলারকে আটকানো দরকার ছিল। তার জন্য পুলিশের সাহায্য ছাড়া উপায় কী?’
আদিত্য থামল। একটু থেমে বলল, ‘এবার বাড়ি যাই। একে দেরি হল, তার ওপর মোবাইলটাও বন্ধ রেখেছিলাম। কেয়ার কাছে আজ প্রচণ্ড ঝাড় খেতে হবে।’ ‘ঠিক আছে, আয়। আমি যথাস্থানে রিপোর্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি। ড্রাগ-মাফিয়াদের কেসটা সভ্ করার জন্য ওই ট্রাস্টের কাছ থেকে তোর প্রাপ্য টাকাটা খুব শিগগির পেয়ে যাবি। তবে অসীমাভ রায়ের কাছ থেকে তোর পারিশ্রমিকটা বোধহয় মার গেল।’ ‘আমি কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী অশনি রায়কে নির্দোষ প্রমাণ করে দিয়েছি। টাকাটা আমাকে দিয়ে দেওয়া উচিত।’ আদিত্য একটু হেসে হাত নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আদিত্যর এখনও ধূমপানের আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ মেটেনি। বৃষ্টি-বাদলার দিনে কিংবা গুরুভোজনের পর কিংবা গভীরভাবে কিছু চিন্তা করার সময় তার সিগারেট খাবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে ওঠে। কেয়ার কথা ভেবে সে ইচ্ছেটা দমন করে। সে জানে সে ছাড়া সত্যিই কেয়ার আর কেউ নেই। এটা ভাবলে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি তার একটা দায়িত্ব চলে আসে। এমনিতেই তার পেশায় যথেষ্ট শারীরিক ঝুঁকি আছে। সিগারেট খেয়ে সেই ঝুঁকিটা বাড়াবার কোনও মানে হয় না ।
আদিত্যর অবচেতনে ধূমপানের ইচ্ছেটা আরও প্রবলভাবে থেকে গেছে। তার প্রমাণ আদিত্য এখনও মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখে সে সিগারেট খাচ্ছে। স্বপ্নের মধ্যেই সে শিউরে ওঠে। ভাবে, তাহলে তো আমি সিগারেট ছাড়িনি। ওই তো আমি সিগারেট খাচ্ছি। আর সেই গ্লানি বোধে ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে বুঝতে পারে আসলে সে সিগারেট ধরেনি। ওটা স্বপ্ন ছিল।
মৃত্তিকার মৃত্যুরহস্য কী ভাবে উদ্ঘাটিত হল সেই গল্প কেয়াকে শোনানোর পর আদিত্য বলছিল, ‘দ্যাখো, সিগারেট খাওয়ারও কিছু ভাল দিক আছে। আমি যদি সিগারেট না খেতাম তা হলে হার্টকেয়ারে ভর্তি হতে হত না। আর হার্টকেয়ারে ভর্তি হতে না হলে সেখানে বকেয়া বিল মেটাতেও যেতাম না। আর বকেয়া বিল মেটাতে না গেলে যাজ্ঞসেনী মল্লিকের সঙ্গে দেখাই হতো না। আর যাজ্ঞসেনী মল্লিকের সঙ্গে দেখা না হলে মৃত্তিকার মৃত্যুরহস্যও সমাধান করতে পারতাম না।’
‘তুমি কি আবার সিগারেট খাবার ধান্দা করছ নাকি?’ কেয়া সন্দেহের গলায় বলল । ‘আবার যদি সিগারেট ধরো আমি আমাদের স্কুলের বারান্দা থেকে নিচে ঝাঁপ দেব। এটা যেন মনে থাকে।
‘না, না। মজা করছিলাম। সিগারেট না খেতে পারলে এখনও মাঝে মাঝে কষ্ট হয় ঠিকই, কিন্তু তোমাকে কষ্ট দেবার কষ্ট তার থেকে অনেক বেশি।’ আদিত্য নিরীহভাবে হাসল। তারপর কেয়ার হাতে নিজের হাতটা ছোঁয়াল।
না। আদিত্য বাস্তবে আর কোনও দিন সিগারেট খাবে না। শুধু স্বপ্নে দু’একটা খেয়ে ফেলতে পারে। ওটার ওপর তো তার হাত নেই।
সমাপ্ত