Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মৃত্যুক্ষুধা – কাজী নজরুল ইসলাম

    কাজী নজরুল ইসলাম এক পাতা গল্প154 Mins Read0

    মৃত্যুক্ষুধা – ১১

    মৃত্যুক্ষুধা – ১১

    “ঝড় আসে নিমেষের ভুলে।”

    জীবনের কোন পথ দিয়ে কখন বিপর্যয় আসে, মুহূর্তের জন্যে – নিমেষে সব ওলট-পালট করে দিয়ে যায় –বন্ধনের দড়াদড়ি কখন যায় টুটে, –কেউ জানে না।

    ‍এক দিঘি ফোটা পদ্মবনের উপর দিয়ে – ঝড় নয় – শুধু একটা ঘূর্ণি হাওয়ার চলে-যাওয়া দেখেছিলাম। সেই অসহায় পদ্ম-দিঘির ,স্মৃতি আজও ভুলিনি। হয়তো কখনও ভুলবও না। জলের ঢেউ তার তেমনই রইল – কিন্তু পদ্মবন গেল আগাগোড়া ওলট-পালট হয়ে! কোথায় গেল রাঙা শতদলের সে শোভা, কোথায় উড়ে গেল তার পাশের মরাল-মরালী! শুধু কাঁটা-ভরা মৃণাল আর পদ্মের ছিন্নপত্র। ছিন্নদল পদ্মের পাপড়িতে দিঘির মুখ আর দেখাই যায় না।

    ও যেন মূর্ছিতা ত্রস্তকুন্তলা বিস্রস্ত-বসনা অভিমানিনী! ওকে কে যেন দু পায়ে দলে পিষে চলে গেছে।

    নিমেষের ঝড়।…

    ঘরে কাঁদে মেজোবউ, বাইরে কাঁদে কুর্শি। একজন ঘৃণায়, রাগে –আর একজন অভিমানে, বেদনার অসহায় পীড়নে।

    প্যাঁকালে কোথায় চলে গেছে।

    মেজোবউ রাগে নিজের হাত নিজে কামড়ে মরে নিষ্ফল আক্রোশে। এই আবার পুরুষ, বেটাচেলে! এত বড়ো মিথ্যার ভরকে সে উপেক্ষা করে চলতে পারল না! যে মিথ্যা-কলঙ্কের ঢিল লোকে তাদের ছুঁড়ে মারলে, সেই ঢিল কুড়িয়ে সে তাদের ছুঁড়ে মারতে পারলে না। অন্তত অবহেলায় হাসি হেসে বুক চিতিয়ে তাদেরই সামনে দিয়ে পথ চলতে পারল না। শেষে কিনা পালিয়ে গেল! হার মেনে! কাপুরুষ! মেজোবউ ভাবে, আর কী একটা সংকল্প করে। অমন সুন্দর মুখ পাথরের মূর্তির মতো কঠিন হয়ে ওঠে।

    পুরুষ যেখানে হার পালিয়ে গেল, সেইখানে দাঁড়িয়ে সে যুদ্ধ করবে তবু হটবে না।

    শাশুড়ি কাঁদে, বড়োবউ হা-হুতাশ করে, ছেলেমেয়েরা রোজ সাঁঝে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। এমনই সন্ধে হব-হব সময় সে আসত ওই শিশুগুলির জন্যে একটা-না একটা কিছু নিয়ে!’ কোনোদিন ‘লেবেঞ্জুস’কোনদিন বা বোয়াল মাছ।

    মেজোবউয়ের আনমনা ছেলেটি আকাশের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। তারপর আপন মনেই বলে, “তোমায় কিছু আনতে হবে না ছোটো কাকা, তুমি অমনি এসো।” মাকে বলে, “আচ্ছা মা, ছোটো-চা বুঝি বা-জানের কাছে চলে গিয়েছে? উখেনে থেকে বুঝি আর ছেড়ে দেয় না?”

    মা ছেলেকে বুক চেপে ধরে। বলে, “বালাই! ষাট! উখেনে যাবে কেন? হুই রানাঘাট চলে গেছে টাকা রোজগার করতে।”

    শিশু থামে না। বলে, “রানাঘাট বুঝি বা-জান যেখেনে থাকে, তার চেয়েও দূর? না মা?”

    মা ছেলেকে ধুলোয় বসিয়ে দিয়ে উঠে যায়।

    মসজিদে সন্ধ্যার আজানের শব্দ কান্নার মতো এসে কানে বাজে। ও যেন কেবলই স্মরণ করিয়ে দেয় – বেলা শেষ হয়ে এল, আর সময় নাই!..পথ-মঞ্জিলের যাত্রী সশঙ্কিত হয়ে ওঠে!

    সন্ধ্যার নামাজ-যেন মৃত দিবসের জানাজা সামনে রেখে তার আত্মার শেষ কল্যাণ-কামনা!

    মেজো’বউ পাগলের মতো ছুটে গিয়ে মসজিদের সিঁড়ির ওপর –‘সেজদা’তো নয় –উপুড় হয়ে পড়ে মাথা কুটতে থাকে। চোখের জলে সিঁড়ির ধুলো পঙ্কিল হয়ে ওঠে –তার ললাটে তারই ছাপ এঁকে দেয়।

    কী প্রার্থনা করে সে-ই জানে। ভিতর থেকে মউলবি সাহেবের ‘তকবির’ধ্বনি ভেসে আসে, ‘আল্লাহো আকবর!’মেজোবউ সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, ‘আল্লাহো আকবর!’কান্নায় গলার কাছে আটকে যায় স্বর।

    ‍তারপর ঘরে এসে সব ছেলেমেয়েদের চুমু খায়, আদর করে – অভিভূতের মতো। নিবিড় সান্ত্বনায় বুক ভরে ওঠে। মন কেবলই বলে, এবার আল্লা মুখ তুলে চাইবেন।

    শাশুড়িকে ডেকে বলে, “মা আমি কাল থেকে নামাজ পড়ব।”

    শাশুড়ি খুশি হয়ে বলে, “লক্ষ্মী মা আমার, পড়বি তো? আর কেউ নয় মা, শুধু তুই যদি খোদার কাছে হাত পেতে চাস খোদা আমাদের এই দুখ্যু রাখবে না – আমার প্যাঁকালে ফিরে আসবে। কই, এতদিন তো পড়ছি নামাজ, এত ডাকলাম, সে শুনল কই মা! কিন্তু তুই ডাকলে শুনবে!”

    মেজবউ খুশি হয়ে গান করে – অস্ফুট স্বরে।

    শাশুড়ি ক্ষুণ্ণ হয়ে বলে, “মা, তুই ওই গান ছেড়ে দে দিকিন! ওতে আল্লা ব্যাজার হন। গান করলে ‘গুনা’হয়, শুনিসনি সেদিন মউলবি সায়েবের কাছ থেকে?”

    মেজোবউ হেসে বলে, “কিন্তু আমি যে ওতে খুশি হই মা। আমি খুশি হলে কি তিনি খুশি হন না? আচ্ছা মা, তুমি মউলবি সায়েবকে জিজ্ঞেস কর তো, গান করে তাঁকে ডাকলে, তাঁর কাছে কাঁদলে কি তিনি তা শোনেন না?

    বড়োবউ মুখ গম্ভীর করে বলে, “কোরান পড়ে না ডাকলে আল্লা কি শোনে রে মেজোবউ?”

    মেজোবউ হেসে ফেলে। তারপর আপন মনে আবার গুন গুন করে গান ধরে।

    প্যাঁকালে যেদিন গভীর রাত্তিরে কাউকে কিছু না বলে চলে যায় –সেদিন বিকেল পর্যন্তও সে জানত না যে চলে যাবে।

    সন্ধ্যায় সে ফিরছিল কাজ করে। সারাদিনের ক্লান্ত চরণ তার কখন যে তাকে টেনে কুর্শির বাড়ির সামনে নিয়ে এসেছিল, তা সে নিজেই বুঝতে পারেনি। হঠাৎ কার কণ্ঠস্বরে সে সচকিত হয়ে দেখলে বেড়ার ওধারে কুর্শি, এধারে রোতো কামার। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল পাশের আমগাছটার আড়ালে। রোতোর কী একটা কথার উত্তরে কুর্শি কচার একটা ছোট্ট কচি শাখা ভেঙে রোতোকে ছুঁড়ে মারলে, রোতোও হেসে হাতের একটা পান ছুঁড়ে মারলে কুর্শির বুক লক্ষ করে।

    রোতোর হাত-যশ আছে বলতে হবে। পানটা কুর্শির বুকেই গিয়ে পড়ল। কুর্শি নিমেষে সেটাকে লুফে নিয়ে মুখ পুরে দিলে।

    কিন্তু এরই মধ্যে চক্ষের পলকে কী যেন বিপর্যয় হয়ে গেল।

    হঠাৎ কোত্থেকে একটা কন্নিক এসে লাগল কুর্শির বাম কানের ওপরে, ঠিক কপালের পাশে। কুর্শি ‘মাগো’বলে মাটিতে পড়ল। ফিনিক দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

    এর পর রোতোর আর কোনো উদ্দেশ পাওয়া গেল না।

    কুর্শি তখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। প্যাঁকালে কুর্শিকে পাথালি কোলে করে –যেমন করে বর তার রাঙা নববধূকে বাসি-বিয়ের দিন একঘর হতে আর এক ঘরে নিয়ে যায় তেমনই করে – বুকে জড়িয়ে তাদের বারান্দায় নিয়ে এল। বাড়ির সকলে তখন বেরিয়ে গেছে কোথায় যেন।

    বহুক্ষণ শুশ্রূষার পর কুর্শি চোখ মেলে চাইল। চেয়েই প্যাঁকালেকে দেখে আবার চক্ষু বুঁজে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেঁদে উঠল, ‘মাগো!’

    প্যাঁকালে তার কোল থেকে কুর্শির মাথাটা একটা বালিশের ওপর রেখে উঠতে উঠতে বলল, “তোর বাবাকে বলিস আমি মেরেছি তোকে!” বলেই বেরিয়ে গেল–কুর্শির ক্ষীণ কণ্ঠস্বর তার পশ্চাতে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে মিলিয়ে গেল।

    পরের দিন ঘুম হতে উঠেই কুর্শি শুনলে, প্যাঁকালে চলে গেছে – ওদের বাড়িতে মরাকান্না পড়ে গেছে! শুনেই সে আবার মূর্ছিতা হয়ে পড়ল!

    কোথায় কী করে লাগল হাজার চেষ্টা করেও কুর্শির বাবা-মা জানতে পারলে না। কুর্শি কিছু বলে না, কেবল কাঁদে আর মূর্ছা যায়। কিন্তু সেরে উঠতে তার খুব বেশি দিন লাগল না।

    মাথার আঘাত তার যত শুকাতে লাগল, ততই তার মনে হতে লাগল, যেন ওই কন্নিকের ঘা বুকে গিয়ে বেজেছে। সে রোজ দিন গোনে আর ভাবে, আজ সে আসবেই। তার গা ছুঁয়ে দিব্যি করল যে দুদিন আগে রাগের মাথায় সে চলেই যদি যায়, তাহলেও তার ফিরতে দেরি হবে না। এ অহংকার তার আছে। আর রোতোর কথা? অমন বাজে ইয়ার্কি জোয়ান বয়সের ছেলে-মেয়ের দেখাশুনা হলেই দুটো হয়। আ মরণ! এ মিনসেকে বুঝি সে ভালোবাসতে গেল?

    তারপরেই লুটিয়ে পড়ে কাঁদে! বলে, “ফিরে আয় তুই, ফিরে আয়! তোরই দিব্যি করে বলছি, ওর সঙ্গে দুটো ইয়ার্কি দেওয়া ছাড়া আর কোনো সম্বন্ধ নাই আমার! ওকে আমি এতটুকুও ভালোবাসিনে!” আরও কত কী! ছেলেমানুষের মতো যা মুখে আসে, তাই বলে যায় আর কাঁদে।

    কিন্তু বেশি দিন এমন করে যায় না। ফুল ফোটে, শুকায়, ঝরে পড়ে। হৃদয়ও ফোটে, শুকায়, তারপর দলিত হয় তারই পায়ে –যাকে সে কোনো দিনই চায়নি।

    একমাস – দুমাস –তিন মাস যায়, প্যাঁকালে আর আসে না। তবে, খবর পাওয়া গেছে যে, সে কোলকাতায় কাজ করছে – রাজমিস্ত্রিরই কাজ। দুবার টাকাও পাঠিয়েছে বাড়িতে।

    কুর্শি একদিন মরিয়া হয়ে প্যাঁকালের বড়ো-ভাবিকে জিজ্ঞেস করল – সে কখন আসবে এবং চিঠিপত্র দেয় কি-না। বড়োবউ মুখ বেঁকিয়ে বললে, “কে জানে কখন আসবে!” কিন্তু এ খবরটা জানা গেল যে, চিঠিপত্তর মাঝে মাঝে দেয় বাড়িতে।

    কুর্শি আর শুনতে পারল না, মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগল।

    কিন্তু কীসের জন্য তার এত ক্ষোভ, তা সে নিজেই বুঝে না। কেবল অসহায়ের মতো ছটফট করে মরে। চিঠি সে যে কেমন করে দেবে তাকে তা সে নিজেই ভেবে উঠতে পারে না। তবু রোজ মনে করে, বুঝি তার নামে আজ চিঠি আসবে। ক্রিশ্চান মেয়ে সে, মোটামুটি লেখাপড়া জানে, একটা চিঠিও হাতে কোনরকমে লিখতে পারে। মাঝে মাঝে কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসেও লিখতে। কিন্তু লিখেই তার সমস্ত মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে, মন যেন কেন বিষিয়ে ওঠে নিবিড় অভিমানে। লেখা কাগজ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে!

    মাঝে মাঝে ভাবে, খুব কঠিন হয়ে থাকলে বুঝি সে না এসে পারবে না। তারপর দুদিন তিনদিন মুখ ভার করে থাকে, রাস্তায় বেরোয়, গোলপুকুরে নাইতে যায় মুখ ভার করেই–সেখানে তিনটে বেজে যায়, কেউ আসে না। প্যাঁকালেদের ঘরের সামনে দিয়ে আসে যায়, এখন আর কেউ ফিরেও দেখে না। শুধু মেজোবউ তাকে দেখতে পেলে মুখ টিপে হাসে আর গান করে। কুর্শির শরীর-মন যেন রি-রি-রি-রি করতে থাকে রাগে।

    এতদিন তার সয়েছিল এই ভেবে যে, হাজার হোক সে-ই তো অপরাধী। অমন করে পর-পুরুষের সঙ্গে আলাপ করতে দেখলে কার না রাগ হয়! ভাবতেই জিভ কেটে লজ্জায় সে যেন মরে যায়! সেও তো পর-পুরুষ! রোতো যেমন সেও তো তেমনই! বিয়ে তাদের হয়নি, হতেও পারে না। তবু, মন তার এমনই অবুঝ যে, সে কেবলই কীসব অসম্ভব দাবি করে বসে তারই ওপর –বাইরের দিক থেকে যার ওপর কোনো দাবিই সে করতে পারে না।

    কিন্তু যত বড়োই অপরাধ সে করুক, তারই গা ছুঁয়ে তো সে দিব্যি করে বলেছিল যে, তাকে না বলে সে কোথাও যাবে না। সে না-হয় কিছু না-ই হল, মজিদের দিকে মুখ করে দিব্যি করেছিল! এত বড়ো কী অপরাধ করেছে সে যে, প্যাঁকালে মজিদেরও অপমান করতে সাহস করে সেই অপরাধের জ্বালায়!

    মন তার বেদনায় নিষ্ফল ক্রন্দনে ফেনিয়ে ওঠে। যত মন জ্বালা করে, তত বুক ব্যথা করে। সে বুঝি আর পারে না! রবিবার গির্জায় গিয়ে কাতরস্বরে প্রার্থনা করে, “জিশু, তুমি আমায় খুব বড়ো একটা অসুখ দাও, যেন শুনে সে ছুটে আসতে রাস্তা পায় না।”

    শুকিয়ে সে যেতে লাগল দিন দিন, কিন্তু বড়ো কিছু অসুখও হল না। প্যাঁকালেওএল না! কুর্শি এইবার যেন মরিয়া হয়ে উঠল। এইবার সে-যা হোক একটা কিছু করবে। এইবার সে দেখিয়ে দেবে যে, খেরেস্তান হলেও সে মানুষ। তাকে ছুঁয়ে দিব্যি করে যে সেই দিব্যির অপমান করে, তাকে সেও অপমান করতে জানে!

    সে ইচ্ছা করেই রোতো কামারের দোকানের সামনে দিয়ে একটু বেশি করে যাওয়া আসা করতে লাগল। সেই দুর্ঘটনার পর থেকে রোতো কিন্তু অতিমাত্রায় কাজের লোক হয়ে উঠেছে। এখন দিনরাত দোকানে বসে লোহা পেটে আর হাপর ঠেলে। কুর্শিকে দেখলে সে যেন এতটুকু হয়ে যায় – লজ্জায়, ভয়ে। কীসের এত লজ্জা, এত ভয় ওইটুকু মেয়েকে সে খুব ভালো করে যে বোঝে, তা নয়। কী যেন মস্ত বড়ো অপরাধের বোঝা জোর করে তার মাথাটা ধরে নিচু করে দেয়। কুর্শি তার পাশ দিয়ে হাঁটে, আর অমনি সে প্রাণপণ জোরে হাপর ঠেলতে থাকে। যেন সমস্ত বিশ্বটাকে সে-ই চালাচ্ছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে জলন্ত লোহাটাকে নেহাই-এর ওপর রেখে পটতে থাকে। আগুনের ফুলকিতে তার মুখ আর দেখা যায় না।

    সেদিন হঠাৎ কুর্শি তার একেবারেই চোখের সামনে এসে পড়ল। সে কিন্তু হেসে উঠল, “আ মর ড্যাকরা! যেন চেনেনই না আমায়! তোর হল কী বল তো!”

    রোতো ঘেমে উঠে ভীত চোখের দৃষ্টিতে চারিদিকে চায়, তারপর আস্তে আস্তে বলে, “না ভাই, আর কাজ নেই। সেদিনের কথা মনে পড়লে আমার বুক আজও দুরুদুরু করে ওঠে!…শালা ডাকাত!..সে আবার আসছে কখন?”

    কুর্শি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, “আর সে আসছে না। এলে টের পাইবে দেব মজাটা এইবার!”

    রোতো কিন্তু কথা খুঁজে পায় না। আমতা আমতা করে বলে, “আমি ইচ্ছে করলে শালাকে সেদিন গুঁড়িয়ে দিতে পারতুম, শুধু তোর জন্যেই দিইনি।”

    কুর্শি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে, “মাইরি বলছিস, তুই তাকে মারতে পারবি এবার এলে? ওই কচার বেড়ায় ধারে -– যেখেনে সে আমায় কন্নিক ছুঁড়ে মেরেছিল, ওইখেনে ওকে মেরে শুইয়ে দিতে পারবি?” উত্তেজনায় তার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোয় না। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে।

    তার আন্দোলিত বুকের পানে তাকিয়ে রোতের রক্ত গরম হয়ে ওঠে। সে হঠাৎ কুর্শি হাত চেপে ধরে এসে। বলে, “এই তোকে ছুঁয়ে বলে রাখলাম কুর্শি, ওকে যদি ওইখেনে মেরে শুইয়ে না দিই, তবে আমি বাপের বেটা নই! একবার এলে হল শালা!”

    কুর্শি ঝাঁকানি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, “মর হতচ্ছাড়া! বড়ো যে আস্পর্ধা তোর দেখছি! আমার হাত ধরেন এসে! একবার মেরেই দেখিস, পিঠের ওপর খ্যাংরার বাড়ি কেমন মিষ্টি লাগে!” সে আর বলতে পারে না; কান্নায় তার বুক যেন ভেঙে যায়! তারপর, দৌড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে।

    সন্ধ্যা নেমে আসে – তাদের গির্জার কালো পোশাক-পরা মিসবাবাদের মতো!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleব্যথার দান – কাজী নজরুল ইসলাম
    Next Article বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    Related Articles

    কাজী নজরুল ইসলাম

    অগ্নিবীণা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    চক্রবাক – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    ভাঙার গান – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    বাঁধনহারা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    দোলনচাঁপা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    কাজী নজরুল ইসলাম

    সন্ধ্যা – কাজী নজরুল ইসলাম

    July 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.