Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মেঘমল্লার

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প30 Mins Read0

    মেঘমল্লার

    দশপারমিতার মন্দিরে সেদিন যখন সাপুড়ের খেলা দেখবার জন্য অনেক মেয়ে-পুরুষ মন্দির প্রাঙ্গণে একত্র হয়েছিল, তারই মধ্যে প্রদ্যুম্ন প্রথমে লোকটিকে দেখে।

    সেদিন ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি। চারিপাশের গ্রাম থেকে মেয়েরা এসেছিল দশপারমিতার পূজা দিতে। সেই উপলক্ষ্যে অনেক সাপুড়ে-গায়ক-বাজিকর মন্দিরে একত্র হয়েছিল; অনেক মালাকার নানা রকমের সুন্দর সুন্দর ফুলের গহনা গড়ে মেয়েদের কাছে বেচবার জন্য এনেছিল। একজন শ্রেষ্ঠী মগধ থেকে দামি রেশমি শাড়ি এনেছিল বেচবার জন্য। তারই দোকানে ছিল সেদিন মেয়েদের খুব ভিড়। প্রদ্যুম্ন শুনেছিল, জ্যৈষ্ঠ-সংক্রান্তির উৎসব উপলক্ষ্যে পারমিতার মন্দিরে একজন বিখ্যাত গায়ক ও বীণ-বাজিয়ে আসবেন। সে মন্দিরে গিয়েছিল তাঁরই সন্ধানে। সমস্ত দিন ধরে খুঁজেও কিন্তু প্রদ্যুম্ন তাঁকে ভিড়ের মধ্যে থেকে বার করতে পারেনি।

    সন্ধ্যার কিছু পূর্বে মন্দিরের উঠোনে একজন সাপুড়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সাপের খেলা দেখাতে আরম্ভ করলে, আর তারই চারিধারে অনেকগুলি কৌতুকপ্রিয়া মেয়ে জমে গেল। ক্রমে সেখানে খুবই ভিড় হয়ে উঠল। প্রদ্যুম্নও সেখানে দাঁড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু তার মন সাপখেলার দিকে আদৌ ছিল না। সে ভিড়ের মধ্যের প্রত্যেক পুরুষমানুষকে মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করছিল, যদি চেহারায় ও হাবভাবে বীণ-বাজিয়ে ধরা পড়েন। অনেকক্ষণ ধরে দেখবার পর তার চোখে পড়ল একজন প্রৌঢ় ভিড়ের মধ্যে তার দিকেই চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর পরনে অতিমলিন ও জীর্ণ পরিচ্ছদ। কী জানি কেন প্রদ্যুম্নের মনে হল, এই সেই গায়ক। প্রদ্যুম্ন লোক ঠেলে তাঁর কাছে যাবার উদ্যোগ করতে তিনি হাত উঁচু করে প্রদ্যুম্নকে ভিড়ের বাইরে যেতে ইঙ্গিত করলেন।

    বাইরে আসতে প্রৌঢ় তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— আমি অবন্তীর গাইয়ে সুরদাস, তুমি আমাকে খুঁজছিলে, না?

    প্রদ্যুম্ন একটু আশ্চর্য হল। তার মনের কথা ইনি জানলেন কী করে?

    প্রদ্যুম্ন সসম্ভ্রমে জানালে, হ্যাঁ, সে তাঁকেই খুঁজছিল বটে।

    প্রৌঢ় বললেন— তুমি আমার অপরিচিত নও। তোমার পিতার সঙ্গে একসময় আমার যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। আমি কাশী গেলেই তোমার পিতার সঙ্গে দেখা না-করে আসতাম না। তোমাকে ছেলেবেলায় দেখেছি, তোমার বয়স তখন খুব কম।

    —আপনি এখানে এসে কোথায় আছেন?

    —নদীর ধারে একটা ভাঙা মন্দির আছে, জানো?

    —হ্যাঁ জানি। ওখানে একজন সন্ন্যাসী পূর্বে থাকতেন না?

    —তিনি এখনও ওখানেই আছেন। তুমি যেকোনো একদিন গিয়ে ওখানে আমার সঙ্গে দেখা করো। তুমি এখানে কোথায় থাকো?

    —এখানকার বিহারে পড়ি, তিন বছর আছি। আপনি মন্দিরে কতদিন থাকবেন?

    —সে তোমাকে বলব। তুমি এরই মধ্যে একদিন যেও।

    প্রদ্যুম্ন প্রণাম করে বিদায় নিল।

    .

    সন্ধ্যা তখনও হয়নি; মন্দিরটা যে ছোটো পাহাড়ের উপর ছিল, তারই দু-পাশের ঢালু রাস্তা বেয়ে মেয়েরা উৎসব থেকে বাড়ি ফিরছিল। প্রদ্যুম্নের চোখ যেন কার সন্ধানে একবার মেয়েদের ভিড়ের মধ্যে ইতস্তত ধাবিত হল, পরেই সে আবার তাদের পিছনে ফেলে দ্রুতপদে নামতে লাগল। আচার্য শীলব্রত অত্যন্ত কড়া মেজাজের মানুষ, একেই তিনি প্রদ্যুম্নের মধ্যে অন্যান্য ছাত্রদের চেয়ে বেশি চঞ্চলতা ও কৌতুকপ্রিয়তা লক্ষ করে তাকে একটু বেশি শাসনের মধ্যে রাখতে চেষ্টা করেন; তার উপরে সে রাত করে বিহারে ফিরলে কি আর রক্ষা থাকবে?

    বাঁক ফিরতেই বাঁ-পাশের পাহাড়ের আড়ালটা সরে গেল। সেখানে সেদিকটা ছিল খোলা। প্রদ্যুম্ন দেখলে দূরে নদীর ধারে মন্দিরটার চূড়া দেখা যাচ্ছে। চূড়ার মাথার উপরকার ছায়াচ্ছন্ন আকাশ বেয়ে ঝাপসা ঝাপসা পাখির দল ডানা মেলে বাসায় ফিরছিল। আরও দূরে একখানা সাদা মেঘের প্রান্ত পশ্চিম দিকের পড়ন্ত রোদে সিঁদুরের মতো রাঙা হয়ে আসছিল, চারিধারে তার শীতোজ্জ্বল মেঘের কাঁচুলি হালকা করে টানা।

    হঠাৎ পিছন থেকে প্রদ্যুম্নের কাপড় ধরে কে ঈষৎ টানলে।

    প্রদ্যুম্ন পিছন ফিরে চাইতেই যে কাপড় ধরে টেনেছিল তার চোখে কৌতুকের বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে কিশোরী, তার দোলনচাঁপা রঙের ছিপছিপে দেহটি বেড়ে নীল শাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরা। নতুন কেনা একছড়া ফুলের মালা তার খোঁপাটিতে জড়ানো।

    প্রদ্যুম্ন বিস্ময়ের সুরে বলে উঠল— কখন তুমি এসেছিলে, সুনন্দা! আমি তোমাকে এত খুঁজলাম, কই দেখতে পেলাম না তো?

    প্রথমটা কিশোরীর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল, তারপরে সে একটু অভিমানের সুরে বললে— আমাকেই খুঁজতে যেন এখানে এসেছিলে আর কী! যত রাজ্যের সাপুড়ে আর বাজিকরদের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘুরছিলে, সে আর আমি দেখিনি!

    —সত্যি বলছি সুনন্দা, তোমাকে খুঁজেছি। নামবার সময় খুঁজেছি, এর আগেও খুঁজেছি; তুমি কাদের সঙ্গে এলে?

    এমন সময় দেখা গেল একদল মেয়ে পাহাড়ের উপর থেকে সেই পথে নেমে আসছে। সুনন্দার সেদিকে চোখ পড়তেই সে তখনি হঠাৎ প্রদ্যুম্নকে পিছনে ফেলে দ্রুতপদে নামতে লাগল।

    পিছনেই একদল অপরিচিতা মেয়ে, এ অবস্থায় আর সুনন্দার অনুসরণ করা সংগত হবে না ভেবে সে প্রথমটা খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর হতাশা মেশানো ক্রোধে ঘাড় উঁচু করে সে সদর্পে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে লাগল।

    সন্ধ্যার ঈষৎ অন্ধকার কখন মিলিয়ে গিয়েছে, অন্ধকারটাই তরল থেকে তরলতর হতে হতে হঠাৎ কখন জ্যোৎস্নায় পরিণত হয়েছে— অন্যমনস্ক প্রদ্যুম্ন তা মোটেই লক্ষ করেনি। যখন তার চমক ভাঙল, তখন পূর্ণিমার শুভ্রোজ্জ্বল জ্যোৎস্না পথঘাট ধুইয়ে দিচ্ছিল। দূর-মাঠের গাছপালা জ্যোৎস্নায় ঝাপসা দেখাচ্ছিল। পড়াশুনো তার হয় কী করে? আচার্য পূর্ণবর্ধন ত্রিপিটকের পাঠ অনায়াত্ত দেখে তাকে ভর্ৎসনা করলেই বা কী করা যাবে? এরকম রাত্রে যে যুগে-যুগের বিরহীদের মনোবেদনা তার প্রাণের মধ্যে জমে ওঠে, তার অবাধ্য মন যে এইসব পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নারাত্রে মহাকোটঠি বিহারের পাষাণ অলিন্দে মানসসুন্দরীদের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়, এর জন্য সেই কী দায়ী!

    দশপারমিতার মন্দিরে সন্ধ্যারতির ঘণ্টার ধ্বনি তখনও মিলিয়ে যায়নি। দূরে নদীর বাঁকের ভাঙা মন্দিরে ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠল। উৎসব-প্রত্যাগত নর-নারীর দল জ্যোৎস্নাভরা মাঠের মধ্যে ক্রমে বহুদূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রদ্যুম্নের গতি আরও দ্রুত হল।

    পথের পাশে একটা গাছ। গাছের নিকট যেতে প্রদ্যুম্নের মনে হল গাছের আড়ালে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর একটু এগিয়ে গাছের পাশে যেতেই তার অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠের হালকা মিষ্টি হাসির ঢেউয়ে সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল;দেখলে গাছতলায় সুনন্দা দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চিকচিকে জ্যোৎস্নার আলো পড়ে তার সর্বাঙ্গে আলো-আঁধারের জাল বুনেছে। প্রদ্যুম্ন চাইতেই সুনন্দা ঘাড় দুলিয়ে বলে উঠল— আর একটু হলেই বেশ হত! গাছের তলা দিয়ে চলে যেতে অথচ আমায় দেখতে পেতে না!

    সুনন্দাকে দেখে প্রদ্যুম্ন মনে মনে ভারি খুশি হল, মুখে বললে— না, তা আর দেখব কেন? ভারি ব্যাপারটা হয়েছে গাছতলায় লুকিয়ে! আর না দেখতে পেলেই বা কী? আমি তোমার ওপর ভারি রাগ করেছি, সুনন্দা, সত্যি বলছি।

    সুনন্দা বললে— দোষ করবেন নিজে, আবার রাগও করবেন নিজে! সেদিন কি কথা বলেছিলেন মনে আছে? তা না, যত রাজ্যের সাপুড়ে আর বাজিকর, মাগো! ওদের কাছে যাও কী করে? এমন ময়লা কাপড় পরে! আমি ওদের ত্রিসীমানায় যাইনে।

    প্রদ্যুম্ন বললে— তুমি বড়োমানুষের মেয়ে, তোমার কথাই আলাদা; কিন্তু কথাটা কী ছিল বলছিলে?

    সুনন্দা বললে— যাও! আর মিথ্যে ভানে দরকার নেই। কী কথা মনে করে দেখো। সেই সেদিন বললে না?

    প্রদ্যুম্ন একটুখানি ভেবে বলে উঠল— বুঝতে পেরেছি, সেই বাঁশি?

    সুনন্দা অভিমানের সুরে বললে— ভেবে দেখো বলেছিলে কি না। আমি দুপুর বেলা থেকে মন্দিরে এসে বসে আছি! একে তো এলেন বেলা করে, তার ওপর— যাও!

    প্রদ্যুম্ন এবার হেসে উঠল। বললে— আচ্ছা সুনন্দা, যদি তুমি আমায় দেখতেই পেয়েছিল, তো আমায় ডাকবে না কেন?

    সুনন্দা বললে— আমি কি একা ছিলাম? দুপুর বেলায় আমি একা এসেছিলাম বটে, কিন্তু তখন তো আর তুমি আসনি? তারপর আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা সব যে এল। কী করে ডাকব?

    প্রদ্যুম্ন বললে— আচ্ছা ধরে নিলাম আমার দোষ হয়েছে, তবে তুমি যে বার বার সাপুড়ে আর বাজিকরদের কথা বলছ সুনন্দা; সাপুড়ে আর বাজিকরদের আমি খুঁজিনি। শুনেছিলাম অবন্তী থেকে একজন বড়ো বীণ-বাজিয়ে আসবেন! তুমি তো জানো, আমার অনেক দিন থেকে বীণ শেখবার বড়ো ইচ্ছা। তাই তাঁর সন্ধানে ঘুরছিলাম, তাঁর দেখাও পেয়েছি। তিনি এখনকার নদীর ধারের দেউলে থাকেন। ভালো কথা, তোমার বাবা কোথায়?

    সুনন্দা বললে— বাবা তিন-চার দিন হল কৌশাম্বী গিয়েছেন মহারাজের ডাকে। প্রদ্যুম্ন হঠাৎ খুব উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠল, বললে— ওহো তাই! নইলে আমি ভাবছি এত রাত পর্যন্ত সুনন্দা কি—

    সুনন্দা তাড়াতাড়ি প্রদ্যুম্নের মুখে নিজের হাত দু-টি চাপা দিয়ে লজ্জিত মুখে বললে— চুপ চুপ, তোমার কি এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই? এখুনি যে আরতি দেখে সব লোক ফিরবে!

    প্রদ্যুম্ন হাসি থামিয়ে বললে— এবার কিন্তু তোমার বাবা এলে বলে দেবো নিশ্চয়। সুনন্দা রাগের সুরে বললে— দিও বলে। এমনি আমি মন্দিরে আরতি পর্যন্ত থাকি, তিনি জানেন। প্রদ্যুম্ন সুনন্দার সুগঠিত পুষ্পপেলব দক্ষিণ বাহুটি নিজের হাতের মধ্যে বেষ্টন করে নিলে, তারপর বললে— আচ্ছা থাক, বলে দেবো না। চলো সুনন্দা, তোমায় বাঁশি শোনাই, আমার সঙ্গেই আছে। সত্যি বলছি, তোমায় শোনাবার জন্যেই এনেছিলাম। তবে ওঁকে খুঁজছিলাম বীণাটা ভালো করে শিখব বলে।

    নদীর ধারে এসে কিন্তু প্রদ্যুম্ন বড়ো নিরুৎসাহ হয়ে পড়ল। সে বাঁশি বাজালে বটে, কিন্তু সে যেন ভাসা-ভাসা। সুরের সঙ্গে তাতে তার প্রাণের কোনো যোগ রইল না। তারা দু-জনে নির্জনে আরও কতবার বসেছে, প্রদ্যুম্নের বাঁশি শুনতে সুনন্দা ভালোবাসত বলে প্রদ্যুম্ন যখনই বিহার থেকে বাইরে আসত, বাঁশিটি সঙ্গে আনত। প্রদ্যুম্নের বাঁশির অলস স্বপ্নময় সুরের মধ্যেদিয়ে কতদিন উভয়ের অজ্ঞাতে রোদভরা মধ্যাহ্ন গিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে, কিন্তু দু-জনে এক হলে প্রদ্যুম্নের এরকম নিরুৎসাহ ভাব তো সুনন্দা আর কখনো লক্ষ করেনি!

    কী জানি কেন প্রদ্যুম্নের বার বার মনে আসছিল সেই জীর্ণ পরিচ্ছদপরা অদ্ভুতদর্শন গায়ক সুরদাসের কথা। তাদের বিহারের কলাবিৎ ভিক্ষু বসুব্রতের আঁকা জরার চিত্রের মতোই লোকটা কেমন কুশ্রী, লোলচর্ম-শীর্ণদর্শন! পুরাতন পুথির ভুর্জপত্রের মতো ওর পরিচ্ছদের কেমন একটা অপ্রীতিকর মেটে লাল রং!

    .

    তার পরদিন সকালে প্রদ্যুম্ন নদীর ধারের ভাঙা মন্দিরে গেল। সেটার দেবমূর্তি বহুদিন অন্তর্হিত। সমস্ত গায়ে বড়ো বড়ো ফাটল, সাপখোপের বাস। নিকটবর্তী গ্রামবাসীরা সেদিকে বড়ো একটা কেউ আসত না। একজন আজীবক সন্ন্যাসী আজ প্রায় সাত-আট মাস হল সেখানে বাস করছেন। তাঁরই দু-চারজন অনুগত ভক্ত মাঝে মাঝে আসত-যেত বলে মন্দিরের পথ আজকাল অপেক্ষাকৃত ভালো আছে।

    অর্ধ-অন্ধকার মন্দিরের মধ্যে প্রদ্যুম্নের সঙ্গে সুরদাসের সাক্ষাৎ হল। সুরদাস প্রদ্যুম্নকে দেখে খুব আনন্দ প্রকাশ করলেন, তারপর বললেন— চল, বাইরে গিয়ে বসি, এখানে বড়ো অন্ধকার।

    বাইরে গিয়ে সুরদাস আলোতে প্রদ্যুম্নের মুখ ভালো করে দেখলেন, তারপর যেন আপন মনে বলতে লাগলেন— হবে, তোমার দ্বারাই হবে! আমি তা জানতাম।

    প্রদ্যুম্ন সুরদাসের মূর্তি দূর থেকে দেখে যে অস্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছিল, তাঁর নিকটে এসে কিন্তু প্রদ্যুম্নের সে ভাব কেটে গেল। সে লক্ষ করলে সুরদাসের মুখশ্রী একটু কুদর্শন হলেও প্রতিভাব্যঞ্জক।

    সুরদাস বললেন— আমি ভাবছিলাম তুমি আজ আসবে। হ্যাঁ, তোমার পিতা তো একজন প্রসিদ্ধ গায়ক ছিলেন, তুমি নিজে কিছু শিখেছ?

    প্রদ্যুম্ন লজ্জিত মুখে উত্তর দিলেন— একটু-আধটু বাঁশি বাজাতে পারি।

    সুরদাস উৎসাহের সুরে বললেন— পারা তো উচিত। তোমার বাবাকে জানত না এমন লোক এদেশে খুব কম আছে। প্রতি উৎসবেই কৌশাম্বী থেকে তোমার বাবার নিমন্ত্রণ পত্র আসত। হ্যাঁ, আমি শুনেছি তুমি নাকি বাঁশিতে বেশ মেঘমল্লার আলাপ করতে পার!

    প্রদ্যুম্ন বিনীতভাবে উত্তর দিল— বিশেষ যে কিছু জানি তা নয়, যা মনে আসে তাই বাজাই; তবে মেঘমল্লার মাঝে মাঝে বাজিয়েছি।

    সুরদাস বললেন— কই দেখি তুমি কেমন শিখেছ?

    বাঁশি সব সময়েই প্রদ্যুম্নের কাছে থাকত। কখন কোন সময় সুনন্দার সঙ্গে দেখা হয়ে পড়ে বলা যায় না।

    প্রদ্যুম্ন বাঁশি বাজাতে লাগল। তার পিতা তাকে বাল্যকালে যত্ন করে রাগ-রাগিণী শেখাতেন। তা ছাড়া সংগীতে প্রদ্যুম্নের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতাও ছিল। তার আলাপ অতিমধুর হল। লতাপাতা ফুলফলের মাঝখান বেয়ে উদার নীল আকাশ আর জ্যোৎস্না রাতের মর্ম ফেটে যে রসধারা বিশ্বে সবসময় ঝরে পড়ছে, তার বাঁশির গানে সে রস যেন মূর্ত হয়ে উঠল। সুরদাস বোধ হয় এতটা আশা করেননি। তিনি প্রদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করে বললেন— ইন্দ্রদ্যুম্নের ছেলে যে এমন হবে, সেটা বেশি কথা নয়। বুঝতে পেরেছি, তুমিই পারবে, এ আমি আগেও জানতাম।

    নিজের প্রশংসাবাদে প্রদ্যুম্নের তরুণ সুন্দর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।

    অন্যান্য দু-এক কথার পর, প্রদ্যুম্ন বিদায় নিতে উদ্যত হলে, সুরদাস তাকে বললেন— শোনো প্রদ্যুম্ন, একটা গোপনীয় কথা তোমার সঙ্গে আছে। তোমাকে একথা বলব বলে পূর্বেও আমি তোমার খোঁজ করেছিলাম; তোমাকে পেয়ে খুব ভালোই হয়েছে। কথাটা তোমাকে বলি, কিন্তু তার আগে তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, একথা তুমি কারুর কাছে প্রকাশ করবে না।

    প্রদ্যুম্ন অত্যন্ত বিস্মিত হল। এই প্রৌঢ়ের সঙ্গে তার মোটে একদিনের আলাপ, এমন কী গোপনীয় কথা ইনি তাকে বলবেন?

    সে বললে— কী কথা না-শুনে কী করে—

    সুরদাস বললেন— তুমি ভেবো না, কোনো অনিষ্টকর ব্যাপার হলে আমি তোমাকে বলতাম না।

    কী কথা জানবার জন্যে প্রদ্যুম্নের অত্যন্ত কৌতূহলও হল, সে প্রতিজ্ঞা করলে সুরদাসের কথা কারও কাছে প্রকাশ করবে না।

    সুরদাস গলার স্বর নামিয়ে বলতে লাগলেন— নদীর ওই বড়ো বাঁকে যে-ঢিপিটা আছে জানো? তার সামনেই বড়ো মাঠ। ওই ঢিবিটায় বহু প্রাচীনকালে সরস্বতীদেবীর মন্দির ছিল; শুনেছি এদেশের যত বড়ো বড়ো গায়ক ছিলেন, শিক্ষা শেষ করে সকলেই আগে ওই মন্দিরে এসে দেবীর পূজা দিয়ে তুষ্ট না-করে ব্যাবসা আরম্ভ করতেন না। সে অনেক দিনের কথা। তারপর মন্দির ভেঙেচুরে ওই দাঁড়িয়েছে। ওই ঢিপিতে বসে আষাঢ়ি পূর্ণিমার রাতে মেঘমল্লার নিখুঁতভাবে আলাপ করলে সরস্বতীদেবী স্বয়ং গায়কের কাছে আবির্ভূতা হন। এ সংবাদ এদেশে কেউ জানে না। আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র এই তিন মাসের তিন পূর্ণিমায় প্রতি বার যদি তাঁকে আনতে পারা যায়, তবে তাঁর বরে গায়ক সংগীতে সিদ্ধ হয়। তাঁর বরে সংগীত সংক্রান্ত কোনো বিষয় তখন গায়কের কাছে অজ্ঞাত থাকে না। তবে একটা কথা আছে, যে-গায়ক বর প্রার্থনা করবে সে অবিবাহিত হওয়া চাই। তাই আমি বলছিলাম, সামনের পূর্ণিমায় তুমি আর আমি এই বিষয়টা চেষ্টা করে দেখব, তুমি কী বল?

    সুরদাসের কথা শুনে প্রদ্যুম্ন অবাক হয়ে গেল। তা কী করে হয়? আচার্য বসুব্রত কলাবিদ্যা সম্বন্ধে উপদেশ দিতে দিতে অনেকে বার যে বলেছেন, কলা-অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর যে মূর্তি হিন্দুরা কল্পনা করেন, সেটা নিছক কল্পনাই; তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। সত্য সত্য তাঁকে দেখতে পাওয়া— এ কী সম্ভব?

    প্রদ্যুম্ন চুপ করে রইল।

    সুরদাস একটু ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলেন— এতে কি তোমার অমত আছে?

    প্রদ্যুম্ন বললে— সে জন্যে না। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, এটা কী করে সম্ভব যে—

    সুরদাস বললেন— সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। এর সত্যতা তুমি নিজের চোখে দেখো। তোমার অমত না-থাকলে আমি সামনের পূর্ণিমায় সব ব্যবস্থা করে রাখি।

    সুরদাসের কথার পর থেকেই প্রদ্যুম্ন অত্যন্ত বিস্ময়ে কৌতূহলে কেমন একরকম হয়ে গিয়েছিল। সে ঘাড় নেড়ে বললে— আচ্ছা রাখবেন, আমি আসব।

    সুরদাস বললেন— বেশ, বড়ো আনন্দিত হলাম। তুমি মাঝে মাঝে একবার করে এখানে এসো, তোমাকেও তৈরি হতে হলে দু-একটা কাজ করতে হবে, সে বলে দেবো।

    প্রদ্যুম্ন আর একবার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়বার পর সুরদাসের কাছে বিদায় চাইলে। তারপর সে চিন্তিতভাবে বিহারের পথ ধরল।

    তার মনে হচ্ছিল— দেবী সরস্বতী স্বয়ং! শ্বেতপদ্মের মতো নাকি রংটি তাঁর, না-জানি কত সুন্দর তাঁর মুখশ্রী! আচার্য বসুব্রত বলেন বটে…

    .

    ভদ্রাবতী নদীর ধারে শাল-পিয়াল-তমাল বনে সেবার ঘনঘোর বর্ষা নামল। সারা আকাশ জুড়ে কোন বিরহিণী পুরসুন্দরীর অযত্নবিন্যস্ত মেঘবরণ চুলের রাশ এলিয়ে দেওয়া। প্রাবৃটরজনীর ঘনান্ধকার তার প্রিয়হীন প্রাণের নিবিড় নির্জনতা, দূর বনের ঝোড়ো হাওয়ায় তার আকুল দীর্ঘশ্বাস, তারই প্রতীক্ষাশ্রান্ত আঁখি দু-টির অশ্রুভারে ঝরঝর অবিশ্রান্ত বারিবর্ষণ, মেঘমেদুর আকাশের বুকে বিদ্যুৎচমক তার হতাশ প্রাণে ক্ষণিক আশার মেঘদূত!

    আষাঢ়ি পূর্ণিমার রাতে প্রদ্যুম্ন সুরদাসের সঙ্গে নদীর ঘাটে গেল। তারা যখন সেখানে পৌঁছল, তখন মেঘ নেমে সমস্ত আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, চারিদিক তরল অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।

    প্রদ্যুম্ন সুরদাসের কথামতো নদী থেকে স্নান করে এসে বস্ত্র পরিবর্তন করলে। সঙ্গীর ক্রিয়াকলাপে প্রদ্যুম্ন বুঝতে পারলে তিনি একজন তান্ত্রিক। তাদের বিহারে একজন ভিক্ষুক ছিলেন, তিনি যোগাচার্য পদ্মসম্ভবের শিষ্য। সেই ভিক্ষুর কাছে তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের কথা কিছু কিছু সে শুনেছিল। সুরদাস অনেকগুলো রক্তজবার মালা সঙ্গে করে এনেছিলেন, তারমধ্যে কতকগুলো তিনি নিজে পরলেন, কতকগুলো প্রদ্যুম্নকে পরতে বললেন। ছোটো মড়ার মাথার খুলিতে তেল সলতে দিয়ে প্রদীপ জ্বাললেন। তাঁর পূজার আয়োজনে সাহায্য করতে করতে প্রদ্যুম্ন হাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় দেখবার জন্যে তার মনে এত কৌতূহল হচ্ছিল যে অন্ধকার রাতে একজন প্রায় অপরিচিত তান্ত্রিকের সঙ্গে একা থাকবার ভয়ের দিকটা তার একেবারেই চোখে পড়ল না। অনেক রাত্রে হোম শেষ হল।

    সুরদাস বললেন— প্রদ্যুম্ন, তুমি এবার তোমার কাজ আরম্ভ করো, আমার কাজ শেষ হয়েছে। খুব সাবধান, তোমার কৃতিত্বের ওপর এর সাফল্য নির্ভর করছে।

    তাঁর চোখের কেমন একটা ক্ষুধিত দৃষ্টি যেন প্রদ্যুম্নের ভালো লাগল না। কিন্তু তবু সে বসে একমনে বাঁশিতে মেঘমল্লার আলাপ আরম্ভ করলে।

    তখন আকাশ-বাতাস নীরব। অন্ধকারে সামনের মাঠটায় কিছু দেখবার উপায় নেই। শালবনের ডালপালায় বাতাস লেগে একরকম অস্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। বড়ো মাঠের পারে শালবনের কাছে দিকচক্রবালের ধারে নৈশপ্রকৃতি পৃথিবীর বুকের অন্ধকার পুষ্পশয্যায় তার অঞ্চল বিছিয়েছে। শুধু বিশ্রাম ছিল না ভদ্রাবতীর, সে কোন অনন্তের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেবার আকুল আগ্রহে একটানা বয়ে চলেছে, মৃদু গুঞ্জনে আনন্দ-সংগীত গাইতে গাইতে, কূলে তাল দিতে দিতে। হঠাৎ সামনের মাঠটা থেকে সমস্ত অন্ধকার কেটে গিয়ে সারা মাঠটা তরল আলোকে প্লাবিত হয়ে গেল। প্রদ্যুম্ন সবিস্ময়ে দেখলে— মাঠের মাঝখানে শত পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো অপরূপ আলোর মণ্ডলে কে এল জ্যোৎস্নাবারী অনিন্দ্যসুন্দরী মহিমাময়ী তরুণী! তার নিবিড় কৃষ্ণ কেশরাজি অযত্নবিন্যস্তভাবে তাঁর অপূর্ব গ্রীবাদেশের পাশ দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর আয়ত নয়নের দীর্ঘ কৃষ্ণপক্ষ কোনো স্বর্গীয় শিল্পীর তুলি দিয়ে আঁকা। তাঁর তুষারধবল বাহুবল্লি দিব্য পুষ্পাভরণে মণ্ডিত। তাঁর ক্ষীণকটি নীল বসনের মধ্যে অর্ধলুক্কায়িত মণিমেখলায় দীপ্তিমান। তাঁর রক্তকমলের মতো পা দু-টিকে বুক পেতে নেবার জন্যে মাটিতে বাসন্তী পুষ্পের দল ফুটে উঠেছে। হ্যাঁ, এই তো দেবী বাণী! এঁর বীণার মঙ্গলঝঙ্কারে দেশে দেশে শিল্পীদের সৌন্দর্যতৃষ্ণা সৃষ্টিমুখী হয়ে উঠেছে। এঁর আশীর্বাদে দিকে দিকে সত্যের প্রাণপ্রতিষ্ঠা হচ্ছে; এঁরই প্রাণের ভাণ্ডারে বিশ্বের সৌন্দর্যভাণ্ডার নিত্য অফুরন্ত রয়েছে। শাশ্বত এঁর মহিমা, অক্ষয় এঁর দান— চিরনতুন এঁর বাণী।

    প্রদ্যুম্ন চেয়ে থাকতে থাকতে দেবীর মূর্তি অল্পে অল্পে মিলিয়ে গেল। জ্যোৎস্না আবার ম্লান হয়ে পড়ল, বাতাস আবার নিস্তেজ হয়ে বইতে লাগল।

    অনেকক্ষণ প্রদ্যুম্নের কেমন একটা মোহের ভাব দূর হল না। সে যা দেখলে— এ স্বপ্ন না-সত্যি? অবশেষে সুরদাসের কথায় তার চমক ভাঙল। সুরদাস বললেন— আমার এখনও কাজ আছে, তুমি ইচ্ছা করলে যেতে পারো— কেমন; আমার কথা মিথ্যা নয় দেখলে তো?

    সুরদাসের কথা কেমন অসংলগ্ন বোধ হতে লাগল, তাঁর মুখের দিকে চেয়ে প্রদ্যুম্ন দেখলে, তাঁর চোখ দুটো যেন অর্ধ-অন্ধকারের মধ্যে জ্বল-জ্বল করছে।

    তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে যখন বিহারের দিকে রওনা হল, পূর্ণিমার চাঁদকে তখন মেঘে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। একটু একটু জ্যোৎস্না যা আছে, তা কেমন হলদে রঙের; গ্রহণের সময় জ্যোৎস্নার এরকম রং সে কয়েক বার দেখেছে।

    মাঠ খুব বড়ো, পার হতে অনেকটা সময় লাগল। তারপর মাঠ ছাড়িয়ে বড়ো বনটা আরম্ভ হল। খুব ঘনবন, শাল-দেবদারু গাছের ডালপালা নিবিড় হয়ে জড়াজড়ি করে আছে, মধ্যে অন্ধকারও খুব। পাছে রাত ভোর হয়ে যায়, এই ভয়ে সে খুব দ্রুতপদে যাচ্ছিল। যেতে যেতে তার চোখে পড়ল বনের মধ্যে একস্থান দিয়ে যেন খানিকটা আলো বেরুচ্ছে। প্রথম সে ভাবলে, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়ে থাকবে, কিন্তু ভালো করে লক্ষ করে দেখে সে বুঝলে যে, সে আলো জ্যোৎস্নার আলোর মতন নয়, কৌতূহল অত্যন্ত হওয়াতে পথ ছেড়ে সে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল। যে পিপ্পল গাছের সারির ফাঁক দিয়ে আলো আসছিল, তার কাছে গিয়ে গাছের গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে প্রদ্যুম্ন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    একী! এঁকেই তো সে এইমাত্র মাঠের মধ্যে দেখেছে, এই সেই অপরূপ সুন্দরী নারী তো!

    অদ্ভুত! যাঁকে সে এইমাত্র মাঠের মধ্যে দেখেছে, সেই অপরূপ দ্যুতিশালিনী নারী বনের মধ্যে চারিধারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জোনাকি পোকার হুল থেকে যেমন আলো বার হয়, তাঁর সমস্ত অঙ্গ দিয়ে তেমনি একরকম স্নিগ্ধোজ্জ্বল আলো বেরুচ্ছে, অনেকদূর পর্যন্ত বন সে আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে; আর একটু নিকটে গিয়ে সে লক্ষ করলে, তাঁর আয়ত চক্ষু দু-টি অর্ধনিমীলিত, যেন কেমন নেশার ঘোরে তিনি চারিপাশে হাতড়ে পার হবার পথ খুঁজে বেড়াছেন, কিন্তু তা না-পেয়ে পিপ্পল গাছগুলোর চারিধারে চক্রাকারে ঘুরছেন। তাঁর মুখশ্রী অত্যন্ত বিপন্নের মতো।

    প্রদ্যুম্নের হঠাৎ বড়ো ভয় হল। সে ভাবলে মাঠে সরস্বতীদেবীর দর্শন থেকে আর এ-পর্যন্ত ঘটনাটা আগাগোড়া ভৌতিক, এই নিশীথ রাত্রে শালের বনে নইলে এ কী কাণ্ড!

    সে আর সেখানে মোটেই দাঁড়াল না। বন থেকে বার হয়ে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে যখন সে বিহারের উদ্যানে এসে পৌঁছল, ম্লান চাঁদ তখন কুমারশ্রেণির পাহাড়ের পিছনে অস্ত যাচ্ছে।

    ভোর রাত্রে শয্যায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে স্বপ্ন দেখলে— ভদ্রাবতীর গভীর কালো জলের তলায় রাতের অন্ধকারে কে এক দেবী পথ হারিয়ে ফেলেছেন; তিনি যতই ওপরে ওঠবার চেষ্টা করছেন, জলের ঢেউ তাঁকে ততই বাধা দিচ্ছে, নদীর জলে তাঁর অঙ্গের জ্যোতি ততই নিবে আসছে, অন্ধকার ততই তাঁর চারিপাশে গাঢ় হয়ে আসছে। নদীর মাছগুলো তাঁর কোমল পা দু-খানি ঠুকরে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে; ব্যথিতদেহা, বিপন্না, বেপথুমতী দেবীর দুঃখ দেখে একটা বড়ো মাছ দাঁত বার করে হিংস্র হাসি হাসছে, মাছটার মুখ গায়ক সুরদাসের মতো।

    প্রদ্যুম্ন ভোরে উঠেই আচার্য পূর্ণবর্ধনের কাছে গিয়ে সুরদাসের সঙ্গে প্রথম দেখার দিন থেকে গত রাত্রি পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপার খুলে বললে। আচার্য পূর্ণবর্ধন বৌদ্ধদর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। মঠের ভিক্ষুদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও বিজ্ঞ, এজন্য সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করত। তিনি সব শুনে বিস্মিত হলেন, সঙ্গেসঙ্গে তাঁর চোখের দৃষ্টি শঙ্কাকুল হয়ে উঠল। জিজ্ঞাসা করলেন— একথা আগে জানাওনি কেন?

    —তিনি নিষেধ করেছিলেন। আমি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞা—

    —বুঝেছি। তবে এখন বলতে এসেছ কেন?

    —এখন আমার মনে হচ্ছে, আমি কার যেন কী অনিষ্ট করেছি।

    পূর্ণবর্ধন একটুখানি কী ভাবলেন, তারপর বললেন— এইরকম একটা কিছু ঘটবে তা আমি জানতাম। পদ্মসম্ভব আর তার কতকগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীন তান্ত্রিক শিষ্য দেশের ধর্মকর্ম লোপ করতে বসেছে। স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা না-করতে পারে এমন কোনো কাজই নেই; আর আমি বেশ দেখছি প্রদ্যুম্ন যে, তোমার এই অবাধ্যতা ও অযথা কৌতুকপ্রিয়তাই তোমার সর্বনাশের মূল হবে। তুমি কাল রাত্রে অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছ, তুমি দেবী সরস্বতীকে বন্দিনি করবার সহায়তা করেছ।

    এবার প্রদ্যুম্নের বিস্মিত হবার পালা। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বার হল না। পূর্ণবর্ধন বললেন— এই সব কুসংসর্গ থেকে দূরে রাখবার জন্যেই আমি বিহারের কোনো ছাত্রকে বিহারের বাইরে যাবার অনুমতি দিইনে, কিন্তু যাক, তুমি ছেলেমানুষ, তোমারই বা দোষ কী। আচ্ছা, এই সুরদাসকে দেখতে কীরকম বলো দেখি?

    প্রদ্যুম্ন সুরদাসের আকৃতি বর্ণনা করলে।

    পূর্ণবর্ধন বললে— আমি জানি। তুমি যাকে সুরদাস বলছ, তার নাম সুরদাস নয় বা তার বাড়ি অবন্তীতেও নয়। সে হচ্ছে প্রসিদ্ধ কাপালিক গুণাঢ্য। কার্যসিদ্ধির জন্য তোমার কাছে মিথ্যা নাম বলেছে—

    প্রদ্যুম্ন অধীরভাবে বলে উঠল, কিন্তু আপনি যে বলেছেন—

    পূর্ণবর্ধন বললেন— সে ইতিহাস বলছি শোনো। নদীর ধারে যে সরস্বতী মন্দিরের ভগ্নস্তূপ আছে, ওটা হিন্দুদের একটা অত্যন্ত বিখ্যাত তীর্থস্থান। প্রায় দু-শত বৎসর পূর্বে একজন তরুণ গায়ক ওখানে থাকত। তখন মন্দিরের খুব সমৃদ্ধির অবস্থা ছিল না। কিন্তু প্রবাদ এই যে, সেই গায়কটি মেঘমল্লারে এমন সিদ্ধ ছিল যে, আষাঢ়ি-পূর্ণিমার রাতে তার আলাপে মুগ্ধা হয়ে দেবী সরস্বতী স্বয়ং তার কাছে আবির্ভূতা হতেন। সেই থেকে ওই মন্দির এক প্রসিদ্ধ তীর্থস্থান হয়ে ওঠে। সে গায়ক মারা যাওয়ার পরেও কিন্তু পূর্ণিমার রাতে সিদ্ধ গায়ক মল্লার আলাপ করলেই দেবী যেন কোন টানে তার কাছে এসে পড়েন। এই গুণাঢ্য একবার অবন্তীর প্রসিদ্ধ গায়ক সুরদাসের সঙ্গে ওই ঢিপিতে উপস্থিত ছিল। সুরদাস মেঘমল্লার-সিদ্ধ ছিলেন। তাঁর গানে নাকি সরস্বতীদেবী তাঁর সম্মুখে আবির্ভূতা হয়ে তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বলেন। সুরদাস প্রার্থনা করেন, তিনি যেন দেশের সংগীতজ্ঞ ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন প্রাপ্ত হন। সরস্বতীদেবী তাঁকে সেই বরই দেন। তারপর দেবী যখন গুণাঢ্যকে বর প্রার্থনার কথা বলেন, তখন সে দেবীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকেই প্রর্থনা করে বসে। সরস্বতীদেবী বলেছিলেন, তাঁকে পাওয়া নির্গুণের কাজ নয়; সে নামে গুণাঢ্য হলেও কার্যত তার এমন কোনো কলাতেই নিপুণতা নেই যে তাঁকে পেতে পারে, অনেক জীবন ধরে সাধনার প্রয়োজন। সরস্বতীদেবী অন্তর্হিত হওয়ার পর মুর্খ গুণাঢ্যের মোহ আরও বেড়ে যায়, আর সেই সঙ্গে সঙ্গে দেবীর ওপর তাঁর অত্যন্ত রাগ হয়। সে তন্ত্রোক্ত মন্ত্রবলে দেবীকে বন্দিনি করবার জন্যে উপযুক্ত তান্ত্রিক গুরু খুঁজতে থাকে। আমি জানি সে এক সন্ন্যাসীর কাছে তন্ত্রশাস্ত্রের উপদেশ নিত। সন্ন্যাসী কিছুদিন পরে তার তন্ত্রসাধনার হীন উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাকে দূর করে দেন। এসব কথা এদেশের সকল প্রাচীন লোকই জানেন। তারপর আমি অনেকদিন গুণাঢ্যের আর কোনো সংবাদ জানতাম না। ভেবেছিলাম সে এদেশ থেকে চলে গিয়েছে। কিন্তু এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাল রাত্রে সে কৃতকার্য হয়েছে বোধ হয়। এতদিন ওই উদ্দেশ্যেই সে কোথাও তন্ত্রসাধনা করছিল। যাক তুমি এখনি গিয়ে সন্ধান করো মন্দিরে সে আছে কি না, থাকে যদি আমায় সংবাদ দিও।

    প্রদ্যুম্ন সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। সে ছুটে গিয়ে বিহারের উদ্যানে পড়ল। তখন রোদ বেশ ফুটে উঠেছে, বিহারের পাঠার্থীদের সমবেত কণ্ঠের স্তোত্রগান তার কানে আসছিল।

    যে ধম্মা হেতূপ পভবা

    তেসং হেতুং তথাগতো আহ

    তেসঞ্চ যে নিরোধো

    এবংবাদী মহাসমনো…

    যেতে যেতে সে দেখলে উদ্যানের এক প্রান্তে একটা বড়ো আমগাছের ছায়ায় চিত্রকর ভিক্ষু বসুব্রত হরিণচর্মের আসনে বসে বোধ হয় কী আঁকছেন, কিন্তু তাঁর মুখে অতৃপ্তি ও অসাফল্যের একটা চিহ্ন আঁকা।

    প্রদ্যুম্ন যা ভেবেছিল তাই ঘটল। মন্দিরে গিয়ে সে দেখলে— সেখানে কেউ নেই; গুণাঢ্য তো নেই, সেই আজীবক সন্ন্যাসী পর্যন্ত নেই। দু-একটা যবাগু পানের ঘট, আগুন জ্বালবার জন্যে সংগৃহীত কিছু শুকনো কাঠ মন্দিরের মধ্যে এদিক-ওদিক ছড়ানো পড়ে আছে।

    সেইদিন গভীর রাত্রে প্রদ্যুম্ন কাউকে কিছু না-বলে চুপি চুপি বিহার পরিত্যাগ করলে।

    তারপর এক বৎসর কেটে গিয়েছে।

    বিহার পরিত্যাগ করবার পর প্রদ্যুম্ন একবার কেবল সুনন্দার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছিল, সে বিশেষ কোনো কাজে বিদেশে যাচ্ছে, শীঘ্রই ফিরে আসবে। এই এক বৎসর সে কাঞ্চী, উত্তর কোশল ও মগধের সমস্ত স্থান খুঁজেছে, কোথাও গুণাঢ্যের সন্ধান পায়নি। তবে বেড়াতে বেড়াতে কতকগুলি কৌতূহলজনক কথা তার কানে গিয়েছে।

    মগধের প্রসিদ্ধ ভাস্কর মিহিরগুপ্ত রাজার আদেশমতো ভগবান তথাগতের মূর্তি তৈরি করতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। এক বৎসর পরিশ্রম করে তিনি যে মূর্তি গড়ে তুলেছেন, তার মুখশ্রী এমন রূঢ় ও ভাববিহীন হয়েছে যে, তা বুদ্ধের মূর্তি কী মগধের দুর্দান্ত দস্যু দমনকের মূর্তি; তা সে দেশের লোক ঠিক বুঝতে পারছে না।

    তক্ষশীলার বিখ্যাত দার্শনিক পণ্ডিত যমুনাচার্য মীমাংসাদর্শনের ভাষ্য প্রণয়ন করতে নিযুক্ত ছিলেন। হঠাৎ তাঁর নাকি এমন দুর্দশা ঘটেছে যে, তিনি আর সূত্রের অর্থ করে উঠতে না-পেরে আবার বৈদিক ব্যাকরণের সুবন্ত-প্রকরণ থেকে পড়তে আরম্ভ করেছেন।

    মহাকোটঠি বিহারের চিত্রবিদ্যা শিক্ষক ভিক্ষু বসুব্রত ‘বুদ্ধ ও সুজাতা’ নামক তাঁর চিত্রখানা বৎসরবিধি চেষ্টা করেও মনের মতো করে এঁকে উঠতে না-পেরে বিরক্ত হয়ে ওদিক একেবারে ছেড়ে দিয়ে সম্প্রতি নাকি শাকুনশাস্ত্রের চর্চায় অত্যন্ত উৎসাহ দেখাচ্ছেন।

    একদিন প্রদ্যুম্ন সন্ধান পেলে ঊরুবিল্ব গ্রামের কাছে একটা নির্জন স্থানে একজন গো-চিকিৎসক এসে বাস করছেন। তাঁর চেহারার বর্ণনার সঙ্গে সুরদাসের আকৃতির অনেকটা মিল ছিল। তখনি সে গ্রামে গিয়ে অনেককে জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু গো-চিকিৎসকের সন্ধান কেউ দিতে পারলে না।

    সেদিন ঘুরতে ঘুরতে অবসন্ন অবস্থায় ঊরুবিল্ব গ্রামের প্রান্তের একটা বড়ো বটগাছের ছায়ায় সে বসেছে। সন্ধ্যা তখনও নামেনি, ঝিরঝিরে বাতাসে গাছের পাতাগুলো নাচছে। পাশে মাঠে পাকা শস্যের শিষগুলো সোনার মতো চিকমিক করছে, একটু দূরে একটা ডোবার মতো জলাশয়ে বিস্তর কুমুদ ফুল ফুটে আছে, অনেক বন্যহংস তার জলে খেলা করছে।

    সামনে একটু দূরে একটা ছোটো পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে একটা ঝরনা। পাহাড়ের নীচে এক জায়গায় ঝরনার জল খানিকটা আটকে গিয়ে ওই ডোবার মতো জলাশয়টা তৈরি করেছে। প্রদ্যুম্নের হঠাৎ চোখ পড়ল, পাহাড়ের গা বেয়ে ধাপে ধাপে ঘটকক্ষে এক স্ত্রীলোক নেমে আসছেন।

    দেখে তার মনে কেমন সন্দেহ হওয়াতে সে এগিয়ে গেল। ডোবার একদিকের উঁচু পাড়ে গিয়ে দেখেই তার মাথাটা যেন ঘুরে উঠল— এই তো! এই তো তিনি! ভদ্রাবতীর তীরে শালবনে ইনিই তো পথ হারিয়ে ঘুরছিলেন, মাঠের মধ্যে জ্যোৎস্নারাতে এঁকেই তো সে দেখেছিল; তবে তাঁর অঙ্গের সে জ্যোতির এককণাও আর নেই, পরনে অতিমলিন এক বস্ত্র। কিন্তু সেই চোখ, সেই সুন্দর গঠন।

    দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে তার আর কোনো সন্দেহ রইল না যে, এই তিনি। তার মনের মধ্যে গোলমাল বেধে গেল। সে উত্তেজনার মাথায় বিহার ছেড়ে সুরদাসের খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল বটে, কিন্তু দেখা পেলে কী করবে তা সে ভাবেনি। কাজেই সে একরকম লুকিয়েই সেখান থেকে চলে এল।

    রোজ রোজ সন্ধ্যায় প্রদ্যুম্ন এসে বটগাছটার তলায় বসে। রোজ সন্ধ্যার আগে দেবী পাহাড়ের গায়ের পথ বেয়ে নেমে আসেন, আবার সন্ধ্যার সময় ঘটকক্ষে ধাপে ধাপে উঠে চলে যান— সে রোজ বসে দেখে।

    এইরকম কিছুদিন কেটে গেল। একদিন প্রদ্যুম্ন মাঠের গাছতলায় চুপ করে বসে আছে, সেইসময় দেবী জলাশয়ে নামলেন। সেও কী ভেবে ডোবার এদিকের পাহাড়ের দিকে দাঁড়াল, দেখলে— দেবী ঘট নামিয়ে রেখে কুমুদ ফুল সংগ্রহে বড়ো ব্যস্ত। একটা বড়ো ফুল জলাশয়ের এপারের দিকে এগিয়ে বেশি জলে ফুটেছিল, তিনি সেটা সংগ্রহের জন্য খানিকটা বৃথা চেষ্টা করবার পর চোখ তুলে অপর পাড়ে প্রদ্যুম্নকে দেখতে পেয়ে হঠাৎ একটু অপ্রতিভের হাসি হাসলেন, তারপর হাসিমুখে তার দিকে চেয়ে বললেন— ফুলটা আমায় তুলে দেবে?

    —দেবো যদি আপনি এক কাজ করেন।

    —কী বলো?

    —আমায় কিছু খেতে দেবেন? আমি সমস্ত দিন কিছু খাইনি।

    দেবীর মুখে ব্যথার চিহ্ন দেখা দিল। বললেন— আহা! তা এতক্ষণ বলোনি কেন?— এপারে এসো, থাকগে ফুল।

    প্রদ্যুম্ন জলে নেমে ফুলটা সংগ্রহ করে ওপারে গেল।

    দেবী বললেন— তুমি মাঠের মাঝের ওই বড়ো গাছটির তলায় রোজ বসে থাকো, না?

    প্রদ্যুম্ন তাঁর হাতে ফুলটা দিয়ে বললে— হ্যাঁ, আমিও দেখি আপনি সন্ধ্যার সময় রোজই জল নিতে আসেন।

    দেবী হাসিমুখে বললেন— ওই পাহাড়ের ওপরই আমার ঘর, এসো তুমি আমার সঙ্গে, তোমার খেতে দিইগে।

    হঠাৎ দেবী কেমন একপ্রকার বিহ্বল চোখে চারিদিকে চাইলেন। তারপর পাহাড়ের গায়ে কাটা ধাপ বেয়ে উঠতে লাগলেন, প্রদ্যুম্ন পিছনে পিছনে চলল। পাহাড়ের উপরে উঠে গিয়ে একটু দূরে বুনো বাঁশঝাড়ের আড়ালে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা ছোটো কুটির। দেবী বন্ধ দুয়ার খুলে ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রদ্যুম্নকে বললেন— এসো।

    প্রদ্যুম্ন দেখলে কুটিরে কেউ নেই, জিজ্ঞাসা করলে— আপনি কি এখানে একা থাকেন?

    দেবী বললেন— না। এক সন্ন্যাসী আমায় এখানে সঙ্গে করে এনেছেন। তিনি কী করেন জানিনে, কিন্তু মাঝে মাঝে এখান থেকে চলে যান; পাঁচ-ছ-দিন পরে আসেন। তুমি এখানে বসো।

    দেবী মাটির ঘট পূর্ণ করে তাকে যবাগু পান করতে দিলেন, স্বাদ অমৃতের মতো, এমন সুস্বাদু যবাগু সে পূর্বে কখনো পান করেনি।

    প্রদ্যুম্নের মনে হল, যদি আচার্য পূর্ণবর্ধনের কথা সত্য হয়, আর যদি সে স্বচক্ষে যা দেখেছে তা ইন্দ্রজাল না-হয়, তবে এই তো দেবী সরস্বতী তার সামনে। তার জানবার কৌতূহল হল, ইনি নিজের সম্বন্ধে কী বলেন!

    সে জিজ্ঞাসা করলে— আপনারা এর আগে কোথায় ছিলেন? আপনার দেশ কোথা?

    দেবী কাঠের বড়ো পাত্রে সযত্নে সুপ ও অন্ন পরিবেশনে ব্যস্ত ছিলেন, প্রশ্ন শুনে বিস্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি প্রদ্যুম্নের দিকে চেয়ে বললেন— আমার কথা বলছ? আমার দেশ কোথায় জানিনে। আমি নাকি বিদিশার পথের ধারে এক ভাঙা মন্দিরে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম, সন্ন্যাসী আমায় এখানে উঠিয়ে এনেছেন! সেই থেকে এখানেই আছি; তার আগে কোথায় ছিলাম তা আমার মনে পড়ে না।

    তিনি অন্যমনস্কভাবে বাইরে সাঁঝের রক্তিম আকাশে যেখানে ঊরুবিল্ব গ্রামের প্রান্তরে বনরেখার মাথায় সূর্য হেলে পড়েছে, সেই দিকে চেয়ে রইলেন। চেয়ে চেয়ে কী মনে আনবার চেষ্টা করলেন, বোধ হয় মনে এল না। হঠাৎ কী ভেবে তাঁর পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ দু-টি বেয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল।

    তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছে তিনি প্রদ্যুম্নের সামনে অন্নে-পূর্ণ কাঠের থালা রাখলেন। বললেন— খাবার জিনিস কিছুই নেই। তুমি রাত্রে এখানে থাকো, আমি পদ্মের বীজ শুকিয়ে রেখেছি, তাই দিয়ে রাত্রে পায়েস তৈরি করে খেতে দেব। সকালে যেও।

    প্রদ্যুম্নের চোখে জল আসছিল।— ওগো বিশ্বের আত্মবিস্মৃতা সৌন্দর্যলক্ষ্মী! বিদিশার মহারাজের আর মহাশ্রেষ্ঠীর সমবেত রত্নভাণ্ডার তোমার পায়ের এক কণা ধুলোরও যোগ্য নয়, সে দেশের পথের ধুলো এমন কী পুণ্য করেছে মা, যে তুমি সেখানে পড়ে থাকতে যাবে?

    খাওয়া শেষ হলে প্রদ্যুম্ন বিদায় চাইলে।

    দেবীর চোখে হতাশার দৃষ্টি ফুটে উঠল, বললেন— থাকো-না কেন রাত্রে! রাত্রে পায়েস রেঁধে দেবো।

    প্রদ্যুম্ন জিজ্ঞাসা করলে— আপনার এখানে একা রাত্রে থাকতে ভয় করে না?

    —খুব ভয় করে। ওই বেতের বনে অন্ধকারে কী যেন নড়ে, ভয়ে আমি দোর খুলতে পারিনে। ঘুম হয় না, সমস্ত রাত বসেই থাকি।

    প্রদ্যুম্নের হাসি পেল, ভাবলে রাত্রে একা থাকতে ভয় করে বলে পায়েসের লোভ দেখিয়ে দেবী তাকে সঙ্গে রাখতে চান। সে বললে— আচ্ছা রাত্রে থাকব।

    দেবীর মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হল।

    সমস্ত রাত সে কুটিরের বাইরে খোলা হাওয়ায় বসে কাটালে। দেবীও কাছে বসে রইলেন। বললেন— এমন জ্যোৎস্না, আমি কিন্তু ভয়ে বাইরে আসতে পারিনে, ঘরের মধ্যে বসে রাত কাটাই।

    দেবীর ব্যাপার দেখে প্রদ্যুম্ন অবাক হয়ে গিয়েছিল। হলেই বা মন্ত্রশক্তি, এতটা আত্মবিস্মৃত হওয়া, এ যে তার কল্পনার বাইরের জিনিস।

    নানা গল্পে সমস্ত রাত কাটল, ভোর হতে সে বিদায় চাইলে।

    দেবী বলে দিলেন— সন্ন্যাসী এলে একদিন আবার এসো।

    .

    সেই দিন থেকে প্রতি রাত্রে সে দেবীর অলক্ষিতে পাহাড়ের নীচে বসে কুটিরের দিকে চেয়ে পাহারা রাখত। তার তরুণ বীর হৃদয় এক ভীরু নারীকে একা বনের মধ্যে ফেলে রাখার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তুলছিল।

    দশ-পনেরো দিন কেটে গেল।

    এক-একদিন প্রদ্যুম্ন শুনত, দেবী অনেক রাত্রে একা গান গাইছেন। সে গান পৃথিবীর মানুষের গান নয়, সে গান প্রাণধারার আদিম ঝরনার গান, সৃষ্টিমুখী নীহারিকাদের গান, অনন্ত আকাশে দিকহারা কোনো পথিক তারার গান।

    একদিন দুপুর বেলা কে তাকে বললে— তুমি যে গো-বৈদ্যের কথা বলেছিলে, তাকে এইমাত্র দেখে এলাম, পথের ধারে পুকুরে সে স্নান করছে।

    শুনে ছুটতে ছুটতে সে গিয়ে পুকুরের ধারে উপস্থিত হল। দেখলে সত্যই গুণাঢ্য, পুকুরের ধারে বস্ত্রাদির পুঁটলি নামিয়ে রেখে পুকুরে স্নান করতে নেমেছেন। সে অপেক্ষা করতে লাগল।

    একটু পরে গুণাঢ্য বস্ত্র পরিবর্তন করে উপরে উঠে প্রদ্যুম্নকে দেখে কেমন যেন অবাক হয়ে গেলেন। বললেন— তুমি এখানে?

    প্রদ্যুম্ন বললে— আমি কেন তা বুঝতে পারেননি?

    গুণাঢ্য বললেন— তুমি এখন বলছ বলে নয় প্রদ্যুম্ন, আমি এ-কাজ করবার পর যথেষ্ট অনুতপ্ত আছি। প্রতি রাত্রে ভয়ানক স্বপ্ন দেখি, কারা যেন বলছে— তুই যে কাজ করেছিস, এর শাস্তি অনন্ত নরক। আমি এইজন্যেই আজ এক পক্ষের ওপর আমার গুরু সেই আজীবক সন্ন্যাসীর কাছে গিয়েছিলাম। তাঁরই কাছে এ বশীকরণ মন্ত্র আমি শিক্ষা করি। এর এমনি শক্তি যে মনে করলে আমি যাকে ইচ্ছে বাঁধতে পারি, কিন্তু আনতে পারিনে। মন্ত্রের বন্ধনশক্তি থাকলেও আকর্ষণী শক্তি নেই। এইজন্যে আমি তোমাকে সঙ্গে নিয়েছিলুম। আমি নিজে সংগীতের কিছুই জানিনে যে তা নয়, কিন্তু আমি জানতাম যে তুমি মেঘমল্লারে সিদ্ধ, তোমার গানে দেবী ওখানে আসবেনই; এলে তারপর মন্ত্রে বাঁধব। এর আগে আমার বিশ্বাসই ছিল না যে, এমন একটা ব্যাপার হওয়া সম্ভব। অনেকটা মন্ত্রের গুণ পরীক্ষা করবার কৌতূহলেই আমি এ-কাজ করি।

    প্রদ্যুম্ন বললে— এখন?

    গুণাঢ্য বললেন— এখন আমার গুরুর কাছ থেকেই আসছি। তিনি সব শুনে একটা মন্ত্র শিক্ষা দিয়েছেন, এটা পূর্ব মন্ত্রের বিরোধী শক্তিসম্পন্ন। সেই মন্ত্রপূত জল দেবীর গায়ে ছড়িয়ে দিলে তিনি আবার মুক্ত হবেন বটে, কিন্তু তার কোনো উপায় নেই।

    প্রদ্যুম্ন জিজ্ঞাসা করলে— উপায় নেই কেন?

    —যে ছিটিয়ে দেবে, সে চিরকালের জন্য পাষাণ হয়ে যাবে। আমার পক্ষে দু-দিকেই যখন সমান, তখন তাঁকে বন্দিনি রাখাই আমার ভালো। রাগ কোরো না প্রদ্যুম্ন, ভেবে দেখো, মৃত্যুর পর হয়তো পরজগৎ আছে; কিন্তু পাষাণ হওয়ার পর? তা আমি পারব না।

    আত্মবিস্মৃতা বন্দিনি দেবীর চোখ দু-টির করুণ অসহায় দৃষ্টি প্রদ্যুম্নের মনে এল। যদি তা না-হয়, তা হলে তাঁকে যে চিরদিন বন্দিনি থাকতে হবে!

    যুগে যুগে যে উদার উচ্চ প্রেরণা আগে এসে তরুণদের নির্মল প্রাণে পৌঁছয়, আজও প্রদ্যুম্নের প্রাণের বেলায় তার ঢেউ এসে লাগল। সে ভাবলে, একটা জীবন তুচ্ছ। তাঁর রাঙা পা দু-খানিতে একটা কাঁটা ফুটলে তা তুলে দেবার জন্যে আমি শতবার জীবন দিতে প্রস্তুত।

    হঠাৎ গুণাঢ্যের দিকে চেয়ে সে বললে— চলুন, আপনার সঙ্গে যাবো, আমায় সে মন্ত্রপূত জল দেবেন।

    গুণাঢ্য বিস্ময়ে প্রদ্যুম্নের দিকে চেয়ে বললেন— বেশ করে ভেবে দেখো। এ ছেলেখেলা নয়। এ কাজ—

    প্রদ্যুম্ন বললে— চলুন আপনি।

    তারা যখন কুটিরের নিকটবর্তী হল তখন গুণাঢ্য বললেন— প্রদ্যুম্ন, আর একবার ভালো করে ভেবে দেখো, কোনো মিথ্যা আশায় ভুলো না। এ থেকে তোমায় উদ্ধার করবার ক্ষমতা কারুর হবে না— দেবীরও না। মন্ত্রবলে তোমার প্রাণশক্তি চিরকালের জন্য জড় হয়ে যাবে; বেশ বুঝে দেখো। মন্ত্রশক্তি নির্মম অমোঘ, কাউকে রেহাই হবে না।

    প্রদ্যুম্ন বললে— আপনি কি ভাবেন আমি কিছু গ্রাহ্য করি?— কিছু না, চলুন।

    কুটিরে তারা যখন গিয়ে উপস্থিত হল, তখন রোদ বেশ পড়ে এসেছে। দেবী কুটিরের বাইরে ঘাসের উপর অন্যমনস্কভাবে চুপ করে বসে ছিলেন। প্রদ্যুম্নকে আসতে দেখে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। হাসিমুখে বললেন— এসো এসো! আমি তোমার কথা প্রায়ই ভাবি। তোমায় সেদিন কিছু খেতে দিতে না-পেরে আমার মন খুব খারাপ হয়েছিল। এখন তুমি এখানে কিছুদিন থাকো।

    তিনি দু-জনকে খেতে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে কুটিরের মধ্যে চলে গেলেন।

    প্রদ্যুম্ন বললে— কই আমায় মন্ত্রপূত জল দিন তবে?

    গুণাঢ্য বললেন— সত্যিই তাহলে তুমি এতে প্রস্তুত?

    প্রদ্যুম্ন বললে— আমায় আর কিছু বলবেন না, জল দিন।

    দেবী কুটিরের মধ্যে আহারের স্থান করে দু-জনকে খেতে দিলেন। আহারাদি যখন শেষ হল, তখন সন্ধ্যার আর বেশি দেরি নেই। বেতবনে ছায়া নেমে আসছে, রাঙা সূর্য আবার ঊরুবিল্ব গ্রামের উপর ঝুলে পড়েছে।

    গোধূলির আলোয় দেবীর মুখপদ্মে অপরূপ শ্রী ফুটে উঠল।

    তারপর তিনি ঘটকক্ষে প্রতিদিনের মতো নীচের ঝরনায় জল আনতে নেমে গেলেন।

    গুণাঢ্য বললেন— আমি এখান থেকে আগে চলে যাই, তারপর এই ঘটপূর্ণ জল দেবীর গায়ে ছিটিয়ে দিও।

    তাঁর চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হল। আবেগভরে তিনি প্রদ্যুম্নকে আলিঙ্গন করে বললেন— আমি কাপুরুষ, আমার সে সাহস নেই, নইলে—

    তিনি কুটিরের মধ্যে তাঁর দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে নিলেন। তারপর সরু পথ বেয়ে বেতবনের ধার দিয়ে পাহাড়ের অপর পারে চলে গেলেন। তারই নীচে একটু দূরে মগধ থেকে বিদিশা যাওয়ার রাজবর্ত্ম।

    প্রদ্যুম্ন চারিদিকে চেয়ে বসে বসে ভাবলে, ওই নীল আকাশের তলে বিশ বৎসর আগে সে মায়ের কোলে জন্মেছিল, তার সে মা বারাণসীতে তাদের গৃহটিতে বসে বাতায়ন পথে সন্ধ্যার আকাশের দিকে চেয়ে হয়তো প্রবাসী পুত্রের কথাই ভাবছেন। মায়ের মুখখানি একবারটি শেষবারের জন্যে দেখতে তার প্রাণ আকুল হয়ে উঠল। ওই পূর্ব আকাশের নবমীর চাঁদ কেমন উজ্জ্বল হয়েছে! মগধ যাবার রাজপথে গাছের সারির মাথায় একটা তারা ফুটে উঠল। বেতবনের বেতডাঁটাগুলো তরল অন্ধকারে আর ভালো দেখা যায় না।

    প্রদ্যুম্নের চোখ হঠাৎ অশ্রুপূর্ণ হল।

    সেই সময়ে সে দেখলে— দেবী জল নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছেন। মন্ত্রপূত জলপূর্ণ ঘট সে মাটিতে নামিয়ে রেখেছিল; দেবীকে আসতে দেখে সে তা হাতে তুলে নিলে।

    দেবী কুটিরের সামনে এলেন, তাঁর হাতে অনেকগুলো আধ-ফোঁটা কুমুদ ফুল।

    দেবী জিজ্ঞাসা করলেন— সন্ন্যাসী কোথায়?

    প্রদ্যুম্ন বললে— তিনি আবার কোথায় চলে গেলেন। আজ আর আসবেন না।

    তারপর সে গিয়ে দেবীর পায়ের ধুলো নিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললে— মা, না-জেনে তোমার ওপর অত্যন্ত অন্যায় আমি করেছিলাম, আজ তারই শাস্তি আমাকে নিতে হবে। কিন্তু আমি তার জন্যে এতটুকু দুঃখিত নই। যতক্ষণ জ্ঞান লুপ্ত না-হয়ে যায়, ততক্ষণ এই ভেবে আমার সুখ যে, বিশ্বের সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে অন্যায় বাঁধন থেকে মুক্ত করার অধিকার আমি পেয়েছি।

    দেবী বিস্মিত দৃষ্টিতে প্রদ্যুম্নের দিকে চেয়ে রইলেন।

    প্রদ্যুম্ন বললে— শুনুন, আপনি বেশ করে মনে করে দেখুন দেখি, আপনি কোথা থেকে এসেছিলেন?

    দেবী বললেন— কেন, আমি তো বিদিশার পথের ধারে—

    প্রদ্যুম্ন এক অঞ্জলি জল তাঁর সর্বাঙ্গে ছিটিয়ে দিলে।

    সদ্যোনিদ্রোত্থিতার মতো দেবী যেন চমকে উঠলেন।

    প্রদ্যুম্ন দৃঢ়হস্তে আর এক অঞ্জলি জল দেবীর সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিলে। নিমেষের জন্যে তার চোখের সামনে বাতাসে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের স্নিগ্ধ প্রসন্ন হিল্লোল বয়ে গেল। তার সারা দেহ-মন আনন্দে শিউরে উঠল; সঙ্গেসঙ্গে তার মনে এল— বারাণসীতে তাদের গৃহ সন্ধ্যার-আকাশে-বদ্ধ আঁখি বাতায়নপথবর্তিনী তার মা!

    .

    কুমারশ্রেণির বিহারে আচার্য শীলব্রতের কাছে একটি মেয়ে অল্পবয়সে দীক্ষা গ্রহণ করে। তার নাম সুনন্দা, সে হিরণ্যনগরের ধনবান শ্রেষ্ঠি সামন্তদাসের মেয়ে। পিতামাতার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও মেয়েটি নাকি বিবাহ করতে সম্মত হয়নি। অত্যন্ত তরুণ বয়সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করায় সে বিহারের সকলের শ্রদ্ধার পাত্রী হয়ে উঠেছিল। সেখানে কিন্তু কারও সঙ্গে সে তেমন মিশত না, সর্বদাই নিজের কাজে সময় কাটাত আর সর্বদাই কেমন অন্যমনস্ক থাকত।

    জ্যোৎস্নারাত্রে বিহারের নির্জন পাষাণ অলিন্দে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে আপন মনে প্রায়ই কী ভাবত! মাঠের জ্যোৎস্নাজাল কাটিয়ে অনেক রাতে কাউকে বিহারের দিকে আসতে দেখলে সে একদৃষ্টে সেদিকে চেয়ে থাকত, যেন কতদিন আগে তার যে প্রিয় আবার আসবে বলে চলে গিয়েছিল, তারই আসবার দিন গুণে গুণে এ শান্ত-শান্ত ধীর পথ চাওয়া। প্রতি সকালে সে কার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে রইত, সকাল কেটে গেলে ভাবত বিকালে আসবে, বিকাল কেটে গেলে ভাবত সন্ধ্যায় আসবে— দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এরকম কত সকাল-সন্ধ্যা কেটে গেল; কেউ এল না। তবু মেয়েটি ভাবত, আসবে… আসবে, কাল আসবে… পাতার শব্দে চমকে উঠে চেয়ে দেখত— এতদিনে বুঝি এল!

    এক-এক রাত্রে সে বড়ো অদ্ভুত স্বপ্ন দেখত। কোথাকার যেন কোন এক পাহাড়ের ঘন বেতের জঙ্গল আর বাঁশের বনের মধ্যে লুকোনো এক অর্ধভগ্ন পাষাণমূর্তি। নিঝুম রাতে সে পাহাড়ের বেতগাছ হাওয়ায় দুলছে, বাঁশবনে সিরসির শব্দ হচ্ছে, দীর্ঘ দীর্ঘ বেতডাঁটার ছায়ায় পাষাণমূর্তিটার মুখ ঢাকা পড়ে গেছে। সে অন্ধকার অর্ধরাত্রে জনহীন পাহাড়টার বাঁশগুলোর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে কেবল বাজছে মেঘমল্লার!…

    ভোরে উঠে রাতের স্বপ্ন ভেবে আশ্চর্য হয়ে যেত— কোথায় পাহাড়, কোথায় বেতবন, কার ভাঙা মূর্তি, কীসের এসব অর্থহীন দুঃস্বপ্ন!

    পৌষ ১৩৩১, প্রবাসী

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমায়া
    Next Article মেডেল

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    জুয়াড়ির বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    অন্ধের বউ

    March 27, 2025
    ছোটগল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    সর্ববিদ্যাবিশারদের বউ

    March 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }