Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    মেঘের ওপর বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প77 Mins Read0
    ⤷

    ১. আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি

    আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি—এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হয়, মারা গেছি। মৃত অবস্থা থেকে অলৌকিকভাবে যারা বেঁচে ওঠে, তাদের মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়। এর নাম এনডিই (নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স)। বাংলায় মৃত্যু-অভিজ্ঞতা। তারা সবাই দেখে, লম্বা এক সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় চোখধাঁধানো আলো। এই আলোর চুম্বকের মতো আকর্ষণী ক্ষমতা। কঠিন আকর্ষণে অন্ধের মতো আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

    আমি কোনো সুড়ঙ্গ দেখছি না। সুড়ঙ্গের মাথায় আলোও না। তবে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। জীবিত অবস্থায় কোনো মানুষেরই (আয়নার সামনে ছাড়া) নিজেকে দেখার উপায় নেই। আমি যেহেতু নিজেকে দেখছি, কাজেই ধরে নিতে পারি, আমি মারা গেছি। নিজেকে দেখে আমার মায়া লাগছে। হাসপাতালের কেবিনে ডান দিকে পাশ ফিরে আমি শুয়ে আছি। নাকে অক্সিজেনের নল। বাঁ হাতে ক্যানোলা লাগানো। ক্যানোলা দিয়ে রক্তের শিরায় স্যালাইন যাচ্ছে। স্যালাইনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক। নাভির নিচে একটা ফুটো করা হয়েছে। কেন করেছে, কে জানে।

    মোবাইল ফোনের শব্দ হচ্ছে। আমি যেদিক ফিরে শুয়ে আছি, শব্দটা আসছে তার উল্টো দিক থেকে। রুবিনার মোবাইল ফোন। আমি মাথা না ঘুরিয়েই রুবিনাকে দেখলাম। রোগীর অ্যাটেনডেন্টের ডিভানে সে শুয়ে আছে। ডিভানটা ছোট। তার একটা পা বিছানার বাইরে। অন্য পা গোটানো। বেচারি বালিশ ছাড়া ঘুমাচ্ছে।

    রুবিনা ঘুমের মধ্যেই বলল, কে?

    ওপাশ থেকে বলল, আমি জুঁই। ভাইয়া কেমন আছে?

    ভালো আছে। তোমার ভাইয়া ভালো।

    ভাইয়া কি ঘুমাচ্ছে?

    ঘুমাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। রাখি, কেমন? আই লাভ ইউ।

    রুবিনা টেলিফোন হাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে বলল, প্রতিবার রাত তিনটায় টেলিফোন। দিনে কী করিস? ফাক ইউ বিচ!

    রুবিনার টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে কয়েকটা জিনিস স্পষ্ট হলো। মৃত মানুষ টেলিফোনের ওপাশ থেকে যে কথা বলে, তার কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। কেউ মনে মনে কোনো কথা বললে তা-ও শুনতে পায়। এ জন্যই ‘ফাক ইউ বিচ’ এত পরিষ্কার শুনেছি।

    এত রাতে জুঁই নামের কে টেলিফোন করল? চিনতে পারছি না তো!

    নতুন পরিবেশে নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছি। জীবিত অবস্থায় আমার চারপাশের পৃথিবী যেমন ছিল, এখন তেমন নেই। কিছু গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আলো অনেক কোমল হয়ে গেছে। লেন্সে হালকা জেলি লাগিয়ে ছবি তুললে ছবি যেমন কোমল দেখায়, তেমন। রুবিনা যে ডিভানে শুয়ে আছে, তার কিনারা কোমল। ইংরেজিতে সহজ করে বলি—নো শার্প এজেস।

    টুপ করে শব্দ হলো। রুবিনার হাতে ধরা মোবাইল ফোন মেঝেতে পড়ে গেছে। যেখানে পড়েছে, তার কাছেই রাশি বিচারের একটা বই। বইয়ের নাম সাল সাইন লেখিকা লিন্ডা গুডম্যান। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পা দুলিয়ে দুলিয়ে রুবিনা এই বই পড়ছিল এবং বলছিল, আশ্চর্য, সব মিলে যাচ্ছে। কী লিখেছে পড়ে শোনাব?

    আমি বললাম, না।

    আমার বুকে তখন প্রচণ্ড চাপ। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। দুটা কান বন্ধ। প্লেন অনেক ওপরে উঠলে কান যেমন বন্ধ হয়, তেমন। আমি ঘন ঘন সেঁক গিলে কানের তবদা ভাব কাটানোর চেষ্টা করছি, এই সময় রাশিফলের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না।

    আমার না’ কোনো কাজে দিল না। রুবিনা পড়তে শুরু করল, ‘লিব্রানস লাভ পিপল, বাট দে হেইট লার্জ ক্রাউড়। এই শুনছ?

    শুনছি।

    আমরা মানুষ পছন্দ করলেও জনতা পছন্দ করি না। আরও শোনো, লিব্রা ইজ অল লাভ অ্যান্ড বিউটি অ্যান্ড সুইটনেস অ্যান্ড লাইট। পড়তে পড়তে রুবিনা সিগারেট ধরাল। এমনিতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, তার ওপর সিগারেটের কটু গন্ধ। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, সিগারেট ফেলো।

    রুবিনা বলল, দুটা টান দিয়ে ফেলে দেব।

    টয়লেটে চলে যাও, টয়লেটে দরজা বন্ধ করে সিগারেট টানো।

    রুবিনা বই হাতে টয়লেটে ঢুকে গেল। আমি বললাম, দরজাটা বন্ধ করো, প্লিজ।

    রুবিনা বলল, পারব না।

    কিছুক্ষণ পর তার হাসির শব্দ শুনলাম। রাশিফলের বইয়ে এমন কী লেখা থাকতে পারে যে সে খিলখিল শব্দ করে হাসছে! টয়লেট থেকে সিগারেটের দুর্গন্ধ আসছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিনাইলের গন্ধ। টয়লেটের বেসিনের একটা কল নষ্ট, সারাক্ষণ টিপটিপ করে পানি পড়ে। পানি পড়ার শব্দটা আগে কঠিনভাবে কানে লাগত। মনে হতো, নখ দিয়ে কেউ ব্ল্যাকবোর্ডে আঁচড়াচ্ছে।

    এখন অবস্থা ভিন্ন। বেসিনের কল দিয়ে পানি পড়ছে, আমি তার শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা আমাকে পীড়িত করছে না, বরং শুনতে ভালো লাগছে। যেন পানির ফোঁটা পড়ার শব্দটায় লুকানো গল্প আছে। গল্পটা কী ভাবতেই মনে পড়ল। গল্পটার নাম ‘ফুড়ুৎ’। পানির ফোঁটা পড়ছে আর ফুড়ুৎ শব্দ হচ্ছে। খুব ছোটবেলায় বাবা গল্প করছেন, আমি তার সামনে দুই হাঁটু গেড়ে কুকুরের মতো বসে আছি। মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছি–

    এক দেশে ছিল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি পাখি। পাখির যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে রাজা বললেন, ‘সব পাখি জালে বন্দী করো। প্রকাণ্ড জাল বানাও।’ রাজার হুকুমে প্রকাণ্ড জাল বানানো হলো। জাল দিয়ে সব পাখি আটকে ফেলা হলো। জালের এক কোনায় একটা ছিদ্র ছিল, এটা কেউ লক্ষ করেনি। ছিদ্র দিয়ে একটা হলুদ পাখি ফুড়ুৎ করে বের হয়ে গেল।

    এই বলে বাবা গল্প থামাতেই আমি বললাম, তারপর?

    বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

    আমি বললাম, ফুড়ুৎ কী?

    বাবা বললেন, ফুড়ুৎ করে আরেকটা পাখি চলে গেছে।

    আমি বললাম, তারপর?

    বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

    তারপর কী?

    ফুড়ৎ।

    আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, তারপর?

    বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

    আমি বললাম, সবগুলো পাখি কখন বের হবে?

    বাবা বললেন, যেদিন তুই মারা যাবি, সেদিন। তার আগে না।

    আমি মারা গেছি।

    বাবার কথানুসারে সব পাখি জাল থেকে বের হয়েছে। তবে তাদের ফুড়ুৎ করে ওড়ার শব্দ রেখে গেছে। টয়লেটের কল ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করেই যাচ্ছে। শব্দটা মিষ্টি লাগছে। গাছের পাতা থেকে শিশির পড়ার মতো। আলো যেমন কোমল হয়ে গেছে, শব্দও কোমল হয়েছে। যত সময় যাবে, ততই মনে হয় কোমল হবে।

    আলো ও শব্দ—দুটোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। মৃত মানুষের ইন্দ্রিয় কোথায়? আলো কীভাবে দেখছি? শব্দই বা কীভাবে শুনছি? আমার আলাদা অস্তিত্বও নেই। আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছি না। জীবিত অবস্থায় ভূত-প্রেতের ছবি রুবিনার সঙ্গে দেখেছি। হরর ছবি তার খুব পছন্দ। দ্য হুইপ অ্যান্ড দ্য ফ্লেশ, ওমেন, ফ্রাইডে দ্য থারটিনথ—এসব ছবিতে ভূত-প্রেতের আলাদা অস্তিত্ব আছে। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে। তাদের গায়ে কাপড় থাকে। নগ্ন ভূত-পেত্নী কখনো দেখিনি।

    এখন বুঝতে পারছি, এই অংশগুলো ঠিক না। যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তার জামাকাপড় পরারও কিছু নেই।

    পাশের বিছানায় খচমচ শব্দ হচ্ছে। রুবিনা উঠে বসেছে। চোখ ডলছে। মেঝেতে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনসেট উঠিয়ে নিয়ে হাই তুলে কী যেন দেখল। সময় দেখল। বড় করে হাই তুলে ঘুমাতে গিয়েও গেল না; টয়লেটের দিকে রওনা হলো। হাতে সিগারেটের প্যাকেট।

    সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। প্রথমবার যেমন তীব্র লেগেছিল, এখন তেমন লাগছে না; বরং ভালো লাগছে। রুবিনা নিজের মনে কথা বলছে। তার একা একা কথা বলার বাতিক আছে। সে বলছে, গাধাটার কানে মলা দেওয়া দরকার। গাধার বাচ্চা গাধা। চৌদ্দগুষ্টি গাধা।

    রুবিনা বিশেষ কাউকে গাধা বলছে, নাকি নিজের মনে এমনি কথা বলছে? এখন বুঝতে পারছি, রুবিনা গাধা বলছে কাদেরকে। কাদের আমাদের বাসার কেয়ারটেকার। সে সম্ভবত চোর, তবে গাধা না। গাধারা চোর হতে পারে না।

    মৃত মানুষ অন্যের মনের কথা ধরতে পারবে, এটা জানা ছিল না। টেলিপ্যাথি নিয়ে অনেক কথা হয়। আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে তো টেলিপ্যাথি নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে। গবেষণার ফলাফল শূন্য। তারা বলতে বাধ্য হয়েছে মানুষের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই। এখন বুঝতে পারছি, টেলিপ্যাথি মৃত্যুর পরের ব্যাপার।

    দরজা খুলে একজন নার্স ঢুকেছে। সে চোখমুখ কুঁচকে বলল, কে সিগারেট খাচ্ছে?

    বাথরুম থেকে রুবিনা বলল, আমি খাচ্ছি।

    কেবিনে সিগারেট খেতে পারবেন না।

    কেবিনে তো খাচ্ছি না। টয়লেটে খাচ্ছি।

    টয়লেটেও খেতে পারবেন না। সিগারেট খেতে হলে হসপিটালের বাইরে গিয়ে খেতে হবে।

    রুবিনা বলল, রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশে আমি হাসপাতালের বাইরে কোথায় যাব! গুন্ডারা ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যদি রেপ করে, তখন উপায় কী হবে?

    এই নার্স আজই প্রথম ডিউটিতে এসেছে, রুবিনার কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। নার্স খানিকটা হকচকিয়ে গেল। আমি লাইটার জ্বালানোর শব্দ শুনলাম। পর পর দুটা সিগারেট রুবিনা খায় না। দ্বিতীয় সিগারেট সে ধরাল নার্সকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। রুবিনা গলা উঁচিয়ে বলল, সিস্টার, এক কাজ করুন, আমার বিরুদ্ধে একটা কমপ্লেইন করে দিন।

    নার্স মুখ শক্ত করে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। ক্যানোলা দেখল, স্যালাইনের টিউব নেড়েচেড়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করল, ম্যাডাম, রোগী মনে হয় মারা গেছে।

    রুবিনা এই আর্তচিঙ্কারের কোনো জবাব দিল না। নার্স আবার বলল, ম্যাডাম, আসুন। রোগী মনে হয় মারা গেছে।

    রুবিনা বলল, মনে হয় মনে হয় বলছেন কেন? ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে আনুন। ডাক্তার দেখে বলুক।

    নার্স দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। টয়লেট থেকে রুবিনা বলল, ক্যালাস লেডি! দরজা-জানালা ভেঙে ফেলছে।

    আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আমার অবস্থা এখন সবাই জানবে। অন্য রকম উত্তেজনা, অন্য রকম কর্মকাণ্ড শুরু হবে।

    রুবিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে মনে মনে অনেকবার বলা একটি বাক্য আবারও বললাম, একজন তরুণী এত সুন্দর হয় কীভাবে!

    এই অতি রূপবতীর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেন বড় মামা হাবিবুর রহমান। মগবাজারে তার একটা ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির সঙ্গে মোবাইল ফোনের ব্যবসা। এই ফার্মেসিতে রুবিনা এক সন্ধ্যাবেলায় এসে বলল, কুড়িটা কড়া ঘুমের ওষুধ দিন তো।

    বড় মামা বললেন, এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করবেন?

    রুবিনা বলল, সুইসাইড করব। কুড়িটায় হবে না?

    এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিতে পারব না।

    একটা দিতে পারবেন? একটা দিন। কুড়িটা ফার্মেসিতে যাব, সবার কাছ থেকে একটা করে কিনব। পরিশ্রম বেশি হবে, কী আর করা? ওয়ার্ক ফর ডেথ। কাজের বিনিময়ে মৃত্যু। আপনি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন? নাকি একটা ঘুমের ওষুধও বিক্রি করবেন না।

    বড় মামা একটা ট্যাবলেট দিলেন। রুবিনা ট্যাবলেট মুখে দিয়ে তার সামনেই পানি ছাড়া গিলে ফেলল। ট্যাবলেটের দাম দিয়ে গেল না। রুবিনা পরদিন নিজ থেকেই এল ট্যাবলেটের দাম দিতে।

    বড় মামা যেকোনো মানুষের সঙ্গে অতিদ্রুত ঘনিষ্ঠতা করতে পারেন। রুবিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে তাঁর মোটেই সময় লাগল না। মাঝেমধ্যেই

    সে মামার ফার্মেসিতে সানগ্লাসে চোখ ঢেকে বসে থাকত।

    আমার সঙ্গে রুবিনার মামার ফার্মেসিতেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতে বুকে ধাক্কার মতো লাগল। কাউন্টারের পেছনে হলুদ পরি বসে আছে। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রুবিনা বলল, কী লাগবে, বলুন? তার প্রশ্নে আমার থতোমতো ভাব কাটল না, বরং আরও বাড়ল। আমি গেছি মামার খোঁজে। মামা ফার্মেসিতে নেই। এই হলুদ পরিকে কী বলব? বড় মামার খোঁজে এসেছি? বড় মামা বললে কি এই মেয়েটি চিনবে? নাকি বড় মামার নাম বলব? আমার মাথার ভেতর এতই জট পাকিয়ে গেছে যে কিছুতেই বড় মামার নাম মনে করতে পারলাম না।

    রুবিনা বলল, কোনো কাজ ছাড়া ফার্মেসির সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। এই বলে রুবিনা হাই তুলল। হাই তুললে পৃথিবীর সব মানুষকেই কুৎসিত দেখায়। এই মেয়েটির বেলায় মনে হলো, তার হাই তোলাও একটি নান্দনিক দৃশ্য।

    এই হলুদ পরির সঙ্গে বড় মামা আমার বিয়ের ব্যবস্থা কীভাবে করলেন, সেটা ভালোমতো জানি না। বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগোনোর পর রুবিনার সঙ্গে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। রুবিনা স্যুপে চুমুক দিয়ে ঠোট বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ স্যুপের বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্যুপে তেলাপোকার গন্ধ পাচ্ছেন?

    আমি বললাম, না।

    চট করে না বলে ফেললেন? তেলাপোকার গায়ের গন্ধ কেমন, সেটা জানেন?

    না।

    রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি সত্যি সত্যি আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, তাহলে তেলাপোকা ধরে তার গায়ের গন্ধ আপনাকে শোকাব।

    আচ্ছা।

    আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অনেকের সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা হয়েছে। কয়েকবার এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ে হয়নি। আমিও তাদের আংটি ফেরত দিইনি। এখন যে আংটি পরে আছি, সেটা এনগেজমেন্টের আংটি। আংটির পাথরটা হীরার। কত বড় হীরা, দেখেছেন?

    হুঁ।

    আসল হীরা না। নকল হীরা। আমেরিকান ডায়মন্ড। আশ্চর্য, আপনি তো দেখি তেলাপোকার গন্ধওয়ালা স্যুপ খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। আরেক বাটি খাবেন? আমারটা খেয়ে ফেলুন।

    না।

    খাবেন না কেন? আমি মুখ দিয়েছি সেই জন্য? আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আমার শরীরের জীবাণু আপনার শরীরে ঢুকে যাবে?

    আমি চুপ করে রইলাম। রুবিনা বলল, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যখন গ্রহণ করে, তার জীবাণুসহই গ্রহণ করে। আমাকে বিয়ে করতে চাইলে, আমাকে জীবাণুসহই গ্রহণ করতে হবে। রাজি আছেন?

    হ্যাঁ, রাজি আছি।

    তাহলে আমার মুখ দেওয়া স্যুপটা খেয়ে ফেলুন। পুরোটা খেতে হবে না। কয়েক চামচ খেলেই হবে।

    আমি স্যুপের চামচে মুখ দিলাম। হঠাৎ রুবিনার দিকে চোখ পড়তেই দেখি, সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমরা সাধারণত একজন আরেকজনের দিকে তাকাই না।

    এই মুহূর্তে রুবিনা আমার সামনে। তার চোখে সেই পুরোনো অদ্ভুত দৃষ্টি। কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা বিস্ময়, অনেকখানি বেদনা। রুবিনা আমার কপালে হাত রাখল। সেই হাত শীতল, না উষ্ণ—বুঝতে পারলাম না। মৃত মানুষের হয়তো বা স্পর্শানুভূতি নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। মৃত মানুষ যদি দেখতে পারে, যদি শুনতে পারে, তাহলে স্পর্শানুভূতি তার কেন থাকবে না? আমি তো গন্ধও পাচ্ছি। কপালের ওপর রাখা তার হাত থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।

    রুবিনা বিড়বিড় করে বলল, গাধী নার্স। বলে কী, মনে হয় মারা গেছে। মানুষটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এই নার্সটাকে কাপড় খুলে পাছায় লাথি দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া দরকার।

    রুবিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই নার্স ডাক্তার নিয়ে ঢুকল। ডাক্তার আমার নাড়ি ধরল। তাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। সে চোখের পাতা খুলে চোখের মণিতে টর্চ ফেলল। চোখে টর্চ ধরলে আমরা আলো ছাড়া কিছুই দেখি না। কিন্তু আমার দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। নার্সের ভীত মুখ দেখছি, রুবিনার কৌতূহলী মুখ দেখছি, ডাক্তারের নির্বিকার মুখ দেখছি।

    ডাক্তার আমার বিছানার পাশে বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে আবার রেখে দিল। খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গি করে বলল, ম্যাডাম, পেশেন্ট মারা গেছে।

    ডাক্তার মনে হয় রুবিনার কাছ থেকে আর্তচিৎকার আশা করেছিল। সে রকম কিছু না দেখে ডাক্তার বিস্মিত।

    রুবিনা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল, আমাকে সিগারেট ধরাতে হবে।

    ডাক্তার বলল, ধরান, সিগারেট ধরান। অসুবিধা নেই।

    রুবিনা বলল, ওর চোখের পাতাটা বন্ধ করে দিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

    নার্স চোখের পাতা বন্ধ করল না, তবে চাদর দিয়ে আমাকে পুরোপুরি ঢেকে দিল। এতে আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। সবকিছু আগের মতোই দেখছি। এর অর্থ, আমি দেখার জন্য আমার শরীর ব্যবহার করছি না। রুবিনা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে বলল, টাইম কত দেখুন তো ডাক্তার সাহেব? কখন মারা গেছে, সবাই জানতে চাইবে।

    তিনটা ছয়চল্লিশ মিনিট।

    রুবিনা বলল, কতক্ষণ আগে মারা গেছে বলে আপনার ধারণা?

    ডাক্তার বলল, বেশি আগে না। অল্প আগে।

    রুবিনা বলল, এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে, সে চাদর সরিয়ে উঠে বসে পানি খেতে চাইবে?

    ডাক্তার-নার্স মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। রুবিনা বলল, আপনারা চলে যান, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

    ডাক্তার বলল, ডেডবডি সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।

    রুবিনা বলল, না।

    নার্স বলল, আমরা চলে গেলে আপনি ভয় পাবেন।

    রুবিনা বলল, ভয় পাব কেন? জীবিত মানুষকে ভয় পাওয়ার ব্যাপার আছে। মৃত মানুষকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে যদি জেগে উঠে বলে, এক গ্লাস পানি খাব, আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বলব—ঠান্ডা পানি দেব, না নরমাল?

    ডাক্তার বলল, আপনার আত্মীয়স্বজন কাউকে খবর দেব?

    রুবিনা বলল, খবর আমিই দেব। আপনারা ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করুন।

    ডাক্তার ও নার্স চলে যাওয়ার পর পর রুবিনা আমার মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিল। পানির বোতল থেকে পানি খেল। বিরক্ত গলায় বলল, এখনো স্যালাইন যাচ্ছে। এইসব খুলে নাই কেন! গাধা নার্স, গাধা ডাক্তার!

    রুবিনা মোবাইল নিয়ে তার বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসেছে। তার হাতে সিগারেটের প্যাকেট। নতুন একটা স্টিক আঙুলের পাশে ধরা। এখনো জ্বালানো হয়নি।

    হ্যালো। কাদের কাদের? আমার গলা শুনে বুঝতে পারছ না, আমি কে? খামাখা কে কে করছ। তোমার মোবাইলে তো আমার নাম ওঠার কথা। নাম উঠেছে কিনা দেখো।

    ম্যাডাম, উঠেছে।

    আমি দুজনের কথাবার্তাই পরিষ্কার শুনছি। কাদেরের গলা শুনে মনে হচ্ছে, তার ঘুম এখনো কাটেনি।

    কাদের, মন দিয়ে শুনছ?

    জি, ম্যাডাম।

    তোমার স্যার মারা গেছেন।

    কী সর্বনাশ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। কখন মারা গেছেন?

    কখন মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট না। মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট। তুমি গাড়ি পাঠাও, আমি বাসায় ফিরব। হট শাওয়ার নেব।

    সবাইকে খবর দিব, ম্যাডাম?

    এত রাতে কাউকে খবর দেওয়ার কিছু নেই। সবাই ঘুমাচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটার পর খবর দেওয়া শুরু করবে।

    জি, আচ্ছা, ম্যাডাম।

    সবাই বাসায় আসার জন্য ব্যস্ত হবে। তাদের বলবে, ডেডবড়ি বাসায় নেই।

    হাসপাতালে আছে বলব?

    না। বলবে কবর হবে তোমার স্যারের বাবার কবরের পাশে। ডেডবড়ি নিয়ে গাড়ি রওনা হয়ে গেছে।

    অনেকেই যেতে চাইবে।

    যারা যেতে চাইবে, তারা নিজ ব্যবস্থায় যাবে। বুঝেছ?

    পলিন আপুকে কি খবর দেব?

    পলিন ঘুমাচ্ছে না?

    জি।

    পলিন খুব স্বাভাবিক মেয়ে না, এটা তুমি জানো।

    ঘুম ভাঙিয়ে তাকে দুঃসংবাদ দেওয়ার কী আছে? এ রকম একটা খবর শুনলে সে কী করবে, সেটা তুমিও জানেন না, আমিও জানি না। সকাল নয়টার সময় তুমি রবিকে টেলিফোন করবে। সে নয়টার আগে ওঠে না। ডেডবডি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া, দাফনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। আমি এখন আমার মোবাইল অফ করে দিচ্ছি। ড্রাইভার এখনই পাঠাও।

    জি, ম্যাডাম।

    কাঁদছ নাকি? কাঁদার কিছু নাই। জন্মালে মরতে হয়। তুমি মরবে, আমি মরব। তোমার পুরা গোষ্ঠী মরবে, আমার পুরা গোষ্ঠী মরবে। ঠিক না?

    জি, ম্যাডাম।

    আমার শোবার ঘরের এসি ছেড়ে ঘরটা ঠান্ডা করে রাখো। বাসায় ফিরে আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব।

    জি, ম্যাডাম।

    .

    রুবিনা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কাপড় বদলাচ্ছে। আমি একজন মৃত মানুষ, তার পরেও আতঙ্কে অস্থির। দরজা লক করা না। যেকোনো সময় যে-কেউ কেবিনে ঢুকতে পারে। আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম, চোখ বন্ধ করা গেল না। সব আমার চোখের সামনেই ঘটছে। জীবিত অবস্থায় কোনো কিছু দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করতাম, এখন তা সম্ভব না? সবকিছুই আমাকে দেখতে হবে?

    কেবিনের দরজা খুলে নার্স ঢুকল। বাঁচা গেছে, এর মধ্যে রুবিনার কাপড় বদলানো হয়ে গেছে। ড্রেস বদলানোর কাজটা সে অত্যন্ত দ্রুত করতে পারে।

    নার্স বলল, ম্যাডাম আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

    হুঁ।

    ডেডবডি নিয়ে যাবেন না?

    রুবিনা বলল, না। আপনারা রেখে দিন।

    নার্স হতাশ চোখে তাকাচ্ছে। তাকে হতাশ অবস্থায় রেখে রুবিনা বের হয়ে গেল। আমার বলতে ইচ্ছা করছে, সিস্টার! আমার স্ত্রীর ব্যবহারে আপনি মন খারাপ করবেন না। সে এ রকমই। ডেডবডি সে ফেলে রেখে যাবে না। যথাসময়ে নিয়ে যাবে। সে বাসায় যাচ্ছে। হট শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ এসি রুমে বিশ্রাম করবে। তারপর সব ব্যবস্থা হবে।

    আমি বলতে চাচ্ছি, কিন্তু বলতে পারছি না। এটা তো ঠিক না। আমাকে কথা শোনার শক্তি দেওয়া হয়েছে, কথা বলার শক্তি কেন দেওয়া হবে না?

    কেবিনে আরও দুজন ঢুকেছে। এরা ওয়ার্ডবয় বা এ রকম কিছু। হাতের ক্যানোলা থেকে নল সরিয়ে, বেড টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নিচ্ছে, কে জানে। আমি হঠাৎ অস্থির বোধ করলাম, বেডের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কি যাব? না কি আমাকে এ ঘরেই থাকতে হবে। আমার আলাদা কোনো শরীর থাকলে, হাত-পা থাকলে আমার ডেডবড়ি যেখানে যাচ্ছে, সেখানে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম। আমার তো শরীর নেই। যা আছে তা খুব সম্ভব চেতনা। চেতনা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে? নাকি আমার চেতনা এই ঘরেই সীমাবদ্ধ। এখানে যা হবে, শুধু তা-ই আমি জানব। বাইরের কিছু জানব না, এটা তো ঠিক না! ভেরি আনফেয়ার।

    যা ভয় করেছিলাম তা-ই, আমি কেবিন-ঘরে আটকা পড়ে আছি। ওয়ার্ডবয় দুজন ঘর পরিষ্কার করছে। মপ দিয়ে মুছছে। ঘরে স্প্রে করছে। বাথরুম ধুচ্ছে। মৃত্যু কি অশুচি বিষয়? যেখানে কেউ মারা যায়, সেই জায়গা কি অশুচি হয়ে যায়?

    ওয়ার্ডবয় দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। দুজনের গলাই চনমনে। কথা বলেও আনন্দ পাচ্ছে। কথার বিষয়বস্তু হলো, তাদের স্যারের এক ভিডিও মোবাইলে ছাড়া হয়েছে। ভিডিওটা খুব স্পষ্ট নয়, তবে তাদের স্যারকে বোঝা যায়। কিন্তু মেয়েটাকে চেনা যায় না। নার্সের পোশাক পরা মেয়ে। একবারও তার চেহারা দেখা যায়নি।

    একজন বলল, ভিডিও ঠিকমতো করতে পারে নাই। প্রথমেই দুজনের চেহারা দেখানো উচিত ছিল। বাকিটা পরে দেখালে চলত।

    দ্বিতীয়জন বলল, ক্যামেরাও ঠিকমতো ধরতে পারে নাই। হাত কাঁপছে।

    মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কানছে। কী জন্য, এটা তো বুঝলাম না। প্রথমে তো হাসিখুশি ছিল।

    হাসিখুশি বুঝলা কেমনে, মুখ তো দেখ নাই?

    হাসির শব্দ শুনলাম না?

    মনে হয় প্রথমেও কানছে। মুখ না দেখা গেলে হাসির শব্দ, কান্দনের শব্দ সব এক রকম।

    এটা কী বললা?

    হ্যাঁ। একবার আমার পুলার কান্দন শুইনা দৌড়ে গিয়া দেখি, সে হাসতেছে।

    জটিল কথা বলো তো। হাসি আর কান্দনের শব্দ একই।

    তারা মূল আলোচনা থেকে সরে গেছে। হাসি-কান্নার শব্দ অ্যানালাইসিস হচ্ছে।

    আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি তাদের স্যারের ভিডিও দেখার জন্য আগ্রহ বোধ করছি। ভিডিও দেখে মেয়েটা হাসছে না কাঁদছে, সেটা জানার চেষ্টা। মৃত্যুর পরও কি যৌনচেতনা থেকে যায়? নিশ্চয়ই থাকে। না থাকলে নোংরা ভিডিও দেখার ইচ্ছে হতো না। কোনো যুক্তিতেই মৃত্যুর পরের যৌনচেতনার বিষয়টা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। পুরুষ যুবতী তরুণীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে, তার কারণ প্রকৃতি চায় মানবজাতির অস্তিত্ব টিকে থাকুক, তারা বংশবিস্তার করুক।

    একজন মৃত পুরুষ কোনো মৃত তরুণীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করবে না। কারণ, তাদের বংশবিস্তারের কিছু নেই। শরীরই নেই, বংশবিস্তার অনেক পরের ব্যাপার।

    ওয়ার্ডবয় দুজন চলে গেছে। আমি কেবিনঘরে আটকা পড়ে আছি। আমার শরীর কোথায় জানি না। রুবিনা কোথায় কী করছে, তা-ও জানি না।

    মৃত্যুর পর অতি অচেনা এক জগতে আমি ঢুকে পড়েছি। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। বিদেশেও বাড়িঘর আছে, মানুষ আছে; কিন্তু সবই কিছুটা আলাদা। ওদের ভাষা আলাদা, নিয়মনীতি আলাদা। রাস্তাঘাট সবই অচেনা।

    বিদেশ ভ্রমণে একজন গাইড খুব প্রয়োজন। যে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। রাস্তাঘাট চেনাবে। দর্শনীয় জায়গা দেখাবে। পরকালেও আমাদের একজন গাইড দরকার। আমি তো জানতাম, মৃত্যুর সময় মৃত আত্মীয়স্বজনেরা চারদিকে ভিড় করে। তাদের প্রধান চেষ্টা অপরিচিত ভুবনে মৃতের যাত্রা সহজ করে দেওয়া।

    আমার সবচেয়ে ছোট ফুফু ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তীব্র ব্যথায় দিনরাত পশুর মতো গোঙাতেন। ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধপত্র তাঁর জন্য কাজ করছিল না। তার কষ্ট বর্ণনার অতীত। মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক আগে হঠাৎ তার সব ব্যথাবেদনা চলে গেল। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আমি আর বড় মামা তখন তাঁর ঘরে। ফুফু বড় মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই আমাকে ছেড়ে গিয়েছে, কেউ আমার ঘরে উঁকিও দেয় না। শুধু আপনি দিনের পর দিন আসছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছেন, আমার কষ্ট দেখে চোখের পানি ফেলেছেন। আপনার সঙ্গে এই পাগলটা আসছে। পাগলা দৌড় দিয়ে যা, আমার জন্য একটা ললি আইসক্রিম কিনে আন। লাল রঙের আনবি। (ছোট ফুফু আমাকে সব সময় পাগলা ডাকতেন।)।

    লাল রঙের ললি আইসক্রিম কিনে এসে দেখি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষভর্তি ঘর। কে একজন উঁচু স্বরে কালেমা পড়ছেন। ছোট ফুফু বাম কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তিনি চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক দেখছেন। হঠাৎ বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মতো করে বললেন, আম্মাজি আসছেন। আম্মাজি আমারে নিতে আসছেন।

    কালেমা পাঠ বন্ধ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি ফুফুর দিকে। ফুফু একদিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, আম্মাজি, একা আসছেন? আর কেউ আসে নাই?

    ফুফুর মৃত আম্মাজি হয়তো জবাব দিলেন, আমরা সেই জবাব শুনতে পারলাম না। ফুফু বললেন, হ্যাঁ, এখন সবাইরে দেখতেছি। হ্যাঁ আম্মাজি, তাদের সালাম দিতে ভুলে গেছি। আসসালামু আলাইকুম।

    হঠাৎ ফুফু আতঙ্কিত গলায় বললেন, আম্মাজি, এই মেয়েটা কে? আমার ভয় লাগতেছে, আমার ভয় লাগতেছে। এটা কে?

    বড় মামা বললেন, জোবেদারে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে শুয়ায়ে দাও।

    সবাই কালেমা পাঠ করো, বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।

    .

    ছোট ফুফুকে নিতে সবাই এসেছিল। তাঁর অপরিচিত একজন মহিলাও এসেছিলেন। আমাকে নিতে কেউ আসেনি। মৃতকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য মনে হয় কেউ আসে না। সবটাই অসুস্থ মানুষের কল্পনা। আমি কেবিনের মেঝেতে তিনটা তেলাপোকা ছাড়া কিছু দেখছি না। একটার গায়ের রং কুৎসিত সাদা। রুবিনা এই তেলাপোকাটা দেখলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ত। তার মতে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত, সবচেয়ে নোংরা, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম তেলাপোকা।

    রুবিনার ধারণা, মৃত্যুর পর সে অবশ্যই দোজখে যাবে। তার দোজখে কোনো আগুন থাকবে না। অসংখ্য তেলাপোকা কিলবিল করবে। কিছু তেলাপোকা থাকবে সাদা রঙের। এই তেলাপোকারা তার গা বেয়ে উঠতে থাকবে।

    আমি মেঝের তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দেখি বারান্দায় চলে এসেছি। লম্বা বারান্দা চোখের সামনে ভাসছে। কেবিন থেকে কী করে বারান্দায় চলে এসেছি, তা জানি না।

    বারান্দা ফাঁকা। ওয়াকিটকি হাতে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখছি। ইনি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পুলিশ অফিসার কথা বলছেন আমাকে নিয়ে।

    ডেডবডি রিলেটিভদের হাতে ট্রান্সফার করা হয়নি তো?

    এখনো না।

    ডেথ রিপোর্টে আপনারা কী লিখছেন?

    ডেড রিপোর্ট এখনো তৈরি হয়নি।

    আমি ডেথ রিপোর্টের কপি নিয়ে যাব। ডেডবডির সুরতহাল হবে। আমরা সাসপেক্ট করছি ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে।

    বলেন কী? সাসপেক্ট কে?

    এখনো জানি না। তদন্ত হচ্ছে।

    পুলিশ অফিসার আমার কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। কেবিন নম্বর ৩২১। দরজায় আমার নাম লেখা, ড. ইফতেখারুল ইসলাম।

    মৃত মানুষেরা নিঃশ্বাস ফেলে না। কারণ, বাতাস থেকে তাদের অক্সিজেন নেওয়ার কিছু নেই। তার পরও নিজের নামের দিকে তাকিয়ে আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলার মতো করলাম। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। আমি এই পৃথিবীতে ছিলাম, এখন নেই। হাসপাতালের কেবিনের দরজায় নামটা শুধু ঝুলছে।

    পৃথিবীতে আমি ঝামেলামুক্ত ছিলাম। মৃত্যুর পর নানা ঝামেলায় জড়াচ্ছি। এখন জানছি, কেউ আমাকে খুন করেছে। সুরতহাল হবে। একজন ডাক্তার নাকে রুমাল চেপে আমার নগ্ন শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ডোম কাটাকাটি করবে। পাকস্থলীর খাদ্য কৌটায় বের করে পরীক্ষার জন্য পাঠাবে।

    পত্রিকার নিশ্চয়ই নিউজ হবে। পত্রিকাওয়ালারা এই ধরনের খবরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন খবরের ফলোআপ ছাপা হয়। পাঁচ থেকে ছয় দিনের মাথায় খবর ছাপা বন্ধ। সবাই সবকিছু ভুলে যায়।

    পুলিশ অফিসার কেবিনের দরজা খুলে ঘরে উঁকি দিলেন। চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ঘরে সিগারেটের গন্ধ। সিগারেট কে খেত?

    পেশেন্টের স্ত্রী। তাকে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছিল। মহিলা উগ্র স্বভাবের, কারও কথাই শোনেন না।

    তিনি কোথায়?

    বলতে পারছি না। ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছেন।

    তার নম্বর কি আছে? আমি কথা বলব।

    ডেস্কে নিশ্চয়ই আছে। আসুন, নম্বর বের করে দিচ্ছি।

    আমি এই কেবিনে আছি। আপনি টেলিফোন নম্বরটা নিয়ে আসুন। আমাকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দেওয়া কি সম্ভব হবে?

    আমি কোনো পুলিশ অফিসারকে কাছ থেকে দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও পুলিশ সার্ভিসে কেউ নেই। রুবিনার এক চাচাতো ভাই আছে, পুলিশের এআইজি। একবারই তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আধা ঘন্টার মতো ছিলেন, সেই আধা ঘণ্টা তিনি ক্রমাগত মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। এত বিরক্ত মুখে আমি কাউকে কথা বলতে দেখিনি।

    এই পুলিশ অফিসারকেও মনে হলো বিরক্ত। শুধু বিরক্ত না, অধৈর্য। প্রথমে ডিভানের ওপর বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিভান ছেড়ে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিল। সেখান থেকে ফিরে এসে রোগীর বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ওষুধের বোতল হাতে নিয়ে শুকতে লাগল।

    জিনিস শুকার বাতিক তার মধ্যে প্রবল বলে মনে হচ্ছে। সে সবকিছুই শুকছে। ক্লমেট খুলে সে রুবিনার কিছু পোশাক ঝুলন্ত পেল। পোশাকগুলো শুকল। রোগীর ওষুধের টেবিলের ড্রয়ার অনেক টানাটানি করে খুলল। সেখানে রুবিনার সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার। সে সিগারেটের প্যাকেট শুকল। প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করে সিগারেট শুকল। লাইটারটা কয়েকবার জ্বালিয়ে-নিভিয়ে লাইটার শুকল।

    অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন পিএইচডি করি, তখন লস্কনামের একটা টিভি সিরিয়াল দেখতাম। কলম্বো হলো সিরিয়ালের নায়ক। সে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে। পিটার ফক নামের একজন অভিনেতা কলম্বো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অসাধারণ অভিনয়। তারও শুকার বাতিক ছিল। তদন্ত করতে গিয়ে যা দেখতেন, তা-ই কতেন। বেশির ভাগ সময় জিভে লাগিয়েও দেখতেন। একটা দৃশ্যে তিনি সাসপেক্টের বাড়িতে গিয়ে সেন্টের একটা শিশি পেলেন। যথারীতি শুকে দেখলেন। জিভে খানিকটা লাগিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের জামায় খানিকটা স্প্রে করলেন। শেষ পর্যন্ত এই সেন্টের শিশি আসামিকে ধরতে ভূমিকা রাখল।

    বিদেশে পড়াশোনার জটিল সময়টায় কলঙ্কেসিরিয়াল আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। দেহধারী মানুষের অনেক আনন্দের ব্যবস্থাই পৃথিবীতে আছে। নাটক-সিনেমা-বই-গান-চিত্রকলা-সংগীত-পরকালে এমন ব্যবস্থা কি আছে? বা আসলেই কি আছে? আনন্দ এবং উত্তেজনায় অধীর হয়ে কলম্বোর মতো কোনো সিরিয়াল দেখার ব্যবস্থা কি আছে? মৃতদের সিনেমা দেখার জন্য ছবিঘর আছে? লাইব্রেরি আছে?

    .

    কফি নিয়ে একজন ওয়ার্ডবয় ঢুকেছে। তার হাতে একটুকরা কাগজ। মনে হয় রুবিনার টেলিফোন নম্বর। পুলিশ অফিসার কফির মগ হাতে নিলেন। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। তিনি কফিতে চুমুক দিয়ে নানাভাবে গন্ধ শুকলেন। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গন্ধ পছন্দ হয়নি। তিনি মগ নামিয়ে রেখে টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটি হাতে নিলেন। নাকের সামনে ধরে কাগজেরও গন্ধ নিলেন। আমি আনন্দিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুবিনার মিষ্টি গলা শুনতে পাব। মৃত্যুর পরও এই সুবিধাটা হয়েছে—কেউ টেলিফোন করলে দুদিকের কথাই শোনা যায়।

    মিসেস রুবিনা কথা বলছেন?

    ইয়েস।

    কেমন আছেন, ম্যাডাম?

    ভালো। হু আর ইউ?

    আমার নাম খলিল। খলিলুর রহমান। আমি ইফতেখার স্যারের ডাইরেক্ট ছাত্র। স্যারকে খুব ভালোমতো চিনতাম।

    আপনার স্যারকে চিনতেন, ভালো করতেন। এখন আমি ব্যস্ত, টেলিফোন রাখছি।

    প্লিজ, ম্যাডাম, প্লিজ। ছাত্রাবস্থায় খুব বিপদে পড়ে আমি স্যারের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার করেছিলাম। টাকাটা ফেরত দেওয়া হয় নাই। আপনার কাছে ফেরত দিতে চাচ্ছি।

    ফেরত দিতে হবে না। ওকে বাই।

    খট শব্দ হলো। রুবিনা টেলিফোন রেখে দিয়েছে। পুলিশ অফিসার খলিল এবার কফির কাপে চুমুক দিল। তিনবার চুমুক, প্রতিবারই তার চোখমুখ কুঁচকে গেল। সে আবারও টেলিফোন করল। আমার ধারণা ছিল, রুবিনা টেলিফোন ধরবে না। টেলিফোন ধরল।

    ম্যাডাম, আমি খলিল বলছি। ইফতেখার স্যারের ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট।

    একটু আগে কথা হয়েছে। আবার কেন টেলিফোন করলেন? স্টুপিড!

    ম্যাডাম, রাগ করবেন না। আমার সঙ্গে আপনার কথা বলতেই হবে। আপনার অন্য বিকল্প নাই।

    কথা বলতেই হবে কেন?

    স্যারের মৃত্যুতে একটি অপঘাত মামলা হতে যাচ্ছে। একটা টেলিফোনে পুলিশকে তার মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

    কে হত্যা করেছে?

    এখনো জানি না। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে তদন্ত করে বের করার।

    তদন্ত করুন। আমাকে বিরক্ত করছেন কেন! হাজব্যান্ড মারা গেছে, আমি আপসেট।

    ম্যাডাম, আপনাকে তেমন আপসেট মনে হচ্ছে না।

    আপসেট দেখাতে হলে আমাকে কী করতে হবে? ভেউ ভেউ করে কাঁদতে হবে?

    অতি প্রিয়জনের মৃত্যুতে সবাই দুঃখিত হয়, চোখের পানি ফেলে। কেউ বেশি, কেউ কম। তবে কেউই ডেডবডি হাসপাতালে ফেলে বাড়িতে চলে যায় না।

    আপনার কি ধারণা, আমি খুন করে ডেডবডি ফেলে বাসায় লুকিয়ে আছি?

    ম্যাডাম, আমার সে রকম ধারণা নয়।

    তাহলে টেলিফোন রাখুন, আমাকে বিরক্ত করবেন না।

    আচ্ছা ম্যাডাম, টেলিফোন রাখলাম। শোকের সময় বিরক্ত করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

    খলিল টেলিফোন রেখে আবারও ঠান্ডা কফিতে গুনে গুনে তিনবার চুমুক দিল। তার তিনবার কফির কাপে চুমুক দেওয়া দেখেই বুঝেছি যে আবারও টেলিফোন করবে। কলম্বোর সঙ্গে এই পুলিশ অফিসারের মিল আছে। কলম্বো সাসপেক্টকে অতি বিনীতভাবে বিরক্ত করত। একই প্রশ্ন তিন-চারবার করে লজ্জায় নত হয়ে বলত, ছিঃ ছিঃ, এই প্রশ্ন তো আপনাকে আগেও করেছি। আবার করলাম। আমার আসলে মাথার ঠিক নাই।

    হ্যালো, ম্যাডাম, আমি খলিল।

    আপনি তো বলেছেন আর বিরক্ত করবেন না। কেন টেলিফোন করলেন?

    ছোট একটা প্রশ্ন ছিল, ম্যাডাম। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে আর করব না। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট খারাপ হলে প্রশ্ন করব।

    ময়নাতদন্ত মানে?

    সুরতহাল হলো ময়নাতদন্ত। ইংরেজিতে বলে পোস্টমর্টেম। স্যারের ভিসেরা পরীক্ষা করা হবে।

    সেটা কখন করা হবে?

    আজ দিনের মধ্যেই করা হবে। সেটা কখন, তা তো জানি না। ডাক্তাররা করবেন। এখন ম্যাডাম আপনার প্রশ্নটা কি করব?

    হ্যাঁ, করুন এবং আমাকে দয়া করে মুক্তি দিন।

    ম্যাডাম, কেবিনে ওষুধপত্র যেখানে রাখা হয়, সেখানে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর একটা লাইটার পেয়েছি। সিগারেটের প্যাকেটটা কি আপনার?

    হ্যাঁ, আমার।

    আর লাইটার? লাইটারটাও কি আপনার?

    সিগারেটের প্যাকেট যার লাইটার তারই থাকবে, এটাই তো লজিক্যাল।

    ম্যাডাম, অনেক সময় লাইটার অন্যের কাছ থেকে ধার করা হয়।

    লাইটারে কি কোনো সমস্যা?

    লাইটারে কোনো সমস্যা নয়। সিগারেটের প্যাকেটে সমস্যা।

    কী সমস্যা?

    আপনার সিগারেটের প্যাকেটে সাতটা সিগারেট ছিল।

    এতে কোনো সমস্যা? এমন কোনো আইন কি আছে যে বেজোড় সংখ্যার সিগারেট থাকতে পারবে না, কিংবা প্রাইম নম্বর সংখ্যার সিগারেট থাকতে পারবে না?

    ম্যাডাম, এমন কোনো আইন নাই। তবে সাতটা সিগারেটের মধ্যে তিনটা আলাদা। তিনটা সিগারেটের ভেতর গাঁজা ভরা।

    বুঝলাম।

    গাঁজা ভরা সিগারেট আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেন, এটা আমার জানা দরকার।

    আপনি খাবেন? তিনটা গাঁজার সিগারেট নিয়ে যান।

    ম্যাডাম, আমাকে নিয়ে রসিকতা করার প্রয়োজন নাই। আমি তেমন রসিক মানুষও নই। গাঁজার সিগারেট আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেন, তা আমার জানা প্রয়োজন এই জন্য যে আপনি মাদকের কোন চক্রটির সঙ্গে যুক্ত, তা জানা। গাঁজা ছাড়া অন্য কোনো ড্রাগ কি নেন? ইয়াবা, স্পিড, হেরোইন।

    আমি নিজে থেকে আপনাকে কিছুই বলব না। ইউ স্টুপিড! ফাইন্ড ইট আউট।

    রুবিনা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে। খলিল ঠান্ডা কফির কাপ আবার হাতে নিয়েছে। এবার চুমুক দিল দুবার। এর অর্থ হয়তো রুবিনাকে সে আর টেলিফোন করবে না। খলিলকে আনন্দিত মনে হচ্ছে এবং সে বড় কোনো আনন্দের জন্য অপেক্ষা করছে। বড় আনন্দটা কী হতে পারে?

    হঠাৎ করেই তার বড় আনন্দ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। সে কী ভাবছে, বুঝতে পারছি। তার পরিকল্পনা বুঝতে পারছি। তার মাথার ভেতর বৈদ্যুতিক ঝড় হচ্ছে। মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে সীমাহীন সংখ্যার ইলেকট্রন অন্য অংশে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। অতি ক্ষুদ্র সব। বৈদ্যুতিক বিভব তৈরি হচ্ছে। ক্ষুদ্র কিন্তু স্পষ্ট। এর অর্থ কী, তা বুঝতে পারছি। ইলেকট্রনের অ্যান্টিমেটরে পজিট্রন তৈরি হচ্ছে, নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক প্রচুর অক্সিজেন গ্রহণ করে তা জানতাম, সেখানে সামান্য পরিমাণে ওজন (O3) তৈরি হয়, তা জানতাম না।

    খলিল কী ভাবছে, তা এখন আমার কাছে স্পষ্ট। বড় যে আনন্দের জন্য সে অপেক্ষা করছে, সেই আনন্দ মৃত্যুবিষয়ক। হত্যাকারীকে সে ফাঁসিতে ঝুলাবে, এই আনন্দ।

    এর আগে সে আটটা খুনের মামলা তদন্ত করেছে। এই আটজনের মধ্যে সাতজনের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। পাঁচজনের ফাঁসি হয়ে গেছে। দুজনের এখনো হয়নি। তারা ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। যে একজনের ফাঁসির হুকুম হয়নি, সে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। তার নাম জিলানি।

    খলিল নিশ্চিত, জিলানি জোড়া খুনের হোতা। প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে। এই ভয়ংকর অপরাধী আবারও খুন করবে। খলিল তাকে লক্ষ রাখছে। সে আবারও ধরা খাবে। ফাঁসির হাত থেকে জিলানির মুক্তি নেই।

    আমার মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে সে যে আজই তদন্তে নেমেছে, তা নয়। চার দিন আগেই তদন্তে নেমেছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে লক্ষ রাখছে। খোঁজখবর শুরু করেছে। তার চোখ আনন্দে চকচক করছে, আরও একজনকে সে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবে। সেই আরেকজনের নাম রুবিনা।

    খলিলের মাথার ভেতর ফাঁসির দৃশ্য। রুবিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। জল্লাদ রুবিনার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। রুবিনা বলছে, ‘না, না, না।’ ফাঁসির দৃশ্য দেখার জন্য উপস্থিত জেলার সাহেব হাতের রুমাল ফেলে দিলেন। এটাই সিগন্যাল। রুবিনা ফাঁসিতে ঝুলছে। তার আলতাপরা ফর্সা পা দুলছে।

    আশ্চর্য, এখন খলিলের মাথায় কবিতা ঘুরছে। ইংরেজি কবিতা নয়, বাংলা কবিতা। ‘আট বছর আগের একদিন’। প্রথম থেকে নয়, হঠাৎ একেকটা লাইন।

    ‘কোনোদিন জাগিবে না আর!’

    সে এই কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা করছে। অনুবাদ পছন্দমতো হচ্ছে না বলে সে নিজের ওপর রেগে যাচ্ছে। কোনোদিন জাগিবে না আর’—শি উইল নেভার ওয়েক আপ। লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার’—‘নাও শি ইজ স্লিপিং অন দ্য মর্গ টেব্‌ন্।’

    খলিল আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না। জুঁই নামের যে মেয়েটা রাত তিনটায় টেলিফোন করেছিল, তাকে চিনতে পারিনি। জীবিত অবস্থার কিছু স্মৃতি কি নষ্ট হয়ে গেছে?

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকালো যাদুকর – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article নীল হাতী – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }