Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    যখন পুলিস ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

    ধীরাজ ভট্টাচার্য এক পাতা গল্প244 Mins Read0

    ৫. চৈত্র-সংক্রান্তি

    সকালে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম। চৈত্র-সংক্রান্তির আর মাত্র দু’দিন বাকি। রমেশ জানিয়ে গেল থানা-ঘরে মহেন্দ্রবাবু ডাকছেন। ভাবলাম এতো সকালে মহেন্দ্রবাবু থানা ঘরে? আওলিং-এর মতো আর একটা কেস এসে গেল নাকি? আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে থানায় ঢুকে দেখি খাকি হাফ প্যান্ট, সাদা টুইলের হাফ শার্ট, পায়ে খাকি মোজা ও সাদা ক্যাম্বিসের জুতো পরে খাকি সোলার হ্যাটটা টেবিলের উপর রেখে আমারই বয়সী একটি লোক মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে গল্প করছে।

    মহেন্দ্রবাবু বললেন,-এসস, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন ‘নীলা’র আবগারি সাব-ইন্সপেক্টর আবদুল মজিদ সাহেব, আর এই হচ্ছে ধীরাজ যার কথা আপনাকে এতোক্ষণ ধরে বলছিলাম।

    কিছু বলবার আগেই দেখি হাসিমুখে উঠে দাঁড়িয়েছেন মজিদ সাহেব। তারপর আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন আমিও এখানে একেবারে নতুন ধীরাজবাবু। আজ সপ্তাহখানেক হলো ‘নীলা’য় এসেছি। না বুঝি এদের কথাবার্তা না বুঝি কাজকর্ম। কি বিপদেই যে পড়েছি ভাই।

    চমৎকার লাগলে মজিদ সাহেবকে। বহুদিন এমন দিলখোলা শিক্ষিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপের সৌভাগ্য হয়নি। বললাম বসুন! এদিকে বেড়াতে এসেছেন বুঝি?

    উত্তরটা দিলেন মহেন্দ্রবাবু। বললেন–না। উনি একটা কেসের জন্য বাধ্য হয়ে এখানে এসেছেন। তুমি হয়তো জানো না আবগারি কোনো কেসে সার্চ করতে হলে সঙ্গে একজন থানা অফিসার দরকার। থানা অফিসার সঙ্গে না নিয়ে আবগারি পুলিসের সার্চ করবার ক্ষমতা নেই। নীলা থেকে বারো চৌদ্দ মাইল দূরে সমুদ্রের ধারে মরিআলা গ্রামে শুধু মুসলমানের বাস। ঐ গ্রামেরই একজন মুসলমান বকশিসের লোভে নীলায় আবগারি আপিসে খবর দিয়েছে যে, গ্রামের সবাই সমুদ্রের জল জ্বাল দিয়ে লবণ তৈরি করে হাটবারে নীলায় এসে বিক্রি করে যায়। বহুদিন ধরে এটা চলছে, প্রথমে আবগারি পুলিস বিশ্বাস করতে চায়নি। লোকটা কান্নাকাটি অনুনয় বিনয় শেষ পর্যন্ত আল্লার নামে শপথ করে বললে যে, সে যা বলছে সবই সত্যি। এমন কি সে নিজে সঙ্গে গিয়ে হাতেনাতে ধরিয়ে দিতেও প্রস্তুত। অগত্যা আবগারিকে কেসটা টেক-আপ করতেই হলো।

    চারদিক চেয়ে মজিদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি একই এসেছেন?

    হেসে জবাব দিলেন মজিদ সাহেব–না, গাঁয়ের সেই বিভীষণটিই আমাকে পথ চিনিয়ে এনেছে। গরজটা যেন তারই সব চাইতে বেশি। দেখবেন জীবটিকে? ঐ যে, বারান্দায় বসে আছে। একথা বলেই তিনি হাঁক দিলেন–বাচ্চা।

    দেখলাম তিরিশ বছর বয়েসের একটি রোগ মুসলমান ঘরে ঢুকে সেলাম করে হাত জোড় করে দাঁড়ালো। কি জানি কেন এক নজর দেখেই মনটা ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় ভরে গেল।

    মজিদ সাহেব মহেন্দ্রবাবুকে বললেন–আপনিই সব জিজ্ঞাসা করুন। আমি ওর কথা একদম বুঝতে পারি না।

    মগী আর চট্টগ্রাম বাংলায় মেশানো এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি ভাষায় কি সব জিজ্ঞাসা করলেন মহেন্দ্রবাবু, লোকটাও চটপট জবাব দিয়ে গেল। কথা শেষে আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মজিদ সাহেব-বুঝলেন কিছু? মাথা নেড়ে জানালাম না।

    শিশুর মতো খিল খিল করে হেসে উঠে মজিদ সাহেব বললেন–আমিও না।

    মহেন্দ্রবাবু বললেন,-তাহলে মজিদ সাহেব ঐ কথাই রইলো আপনি দুপুরে আমার বা ধীরাজের ওখানে খাওয়া দাওয়া করে নিন তারপর বেলা দুটোর স্টীমারে রওনা হলে বেলা চারটের মধ্যে নীলায় অনায়াসে পৌঁছতে পারবেন। তুমিও তৈরি হয়ে নাও ধীরাজ। মজিদ সাহেবের সঙ্গে যাবে।

    হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায়। বললাম–আমি?’

    মহেন্দ্রবাবু বললেন–হ্যাঁ। এতোক্ষণ শুনলে কি হবে? থানা থেকে একজনকে সঙ্গে না নিলে ওঁর যাওয়া না যাওয়া সমান হবে। নীলা থেকে মাত্র দশ বারো মাইলের পথ। দু’দিনের মধ্যে কাজ সেরে অনায়াসে ফিরে আসতে পারবে।

    পাংশুমুখে টেবিলের একটা কোণ নখ দিয়ে খুড়তে লাগলাম।

    আমার হঠাৎ এরকম ভাবান্তরে মজিদ সাহেব বেশ বিস্মিত হয়েছেন বুঝলাম। বললেন–এখান থেকে দু’দিনের জন্য বাইরে গেলে আপনার খুব ক্ষতি হবে কী ধীরাজবাবু?

    কী উত্তর দেবো। শুধু মজিদ সাহেবের দিকে একবার চেয়ে মুখ নিচু করে বসে রইলাম।

    মহেন্দ্রবাবু বললেন–ছাই ক্ষতি হবে। শোনো ধীরাজ, ছেলেমানুষী করো না। লবণ চুরির ব্যাপারটা যা শুনলাম তাতে কেসটা ভালো বলেই মনে হলো। ধরতে পারলে কনভিকশান হবেই। ভালো রিওয়ার্ড পাবে তা ছাড়া সার্ভিস বুকে একটা লাল কালির আঁচড়ও পড়বে। এতদিন ধরে আই. বি’তে চাকরি করেছে সার্ভিস বই তো শুনতে পাই ব্ল্যাঙ্ক, ব্ল্যাঙ্ক। মজিদ সাহেবের দিকে চেয়ে হেসে উঠলেন মহেন্দ্রবাবু। কিন্তু মজিদ সাহেব হাসলেন না। আমার দিকে চেয়ে বসে আছেন। এবার বেশ একটু উষ্ম প্রকাশ করেই বললেন মহেন্দ্রবাবু–যতো সব ছেলেমানুষী। ওরা মনে করে আমি কিছুই খবর রাখিনে। জানেন মজিদ সাহেব? ধীরাজের প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ সকাল-বিকেল বারান্দায় বসে মগ মেয়েদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকা। তা থাকে। কিন্তু সরকারের কাজের ক্ষতি করে ওসব ছেলেখেলার আমি প্রশ্রয় দিতে পারি না। যাও, খেয়ে দেয়ে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নাও।

    গম্ভীরভাবে কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন মহেন্দ্রবাবু। টেবিলের দু’পাশে চুপ করে বসে রইলাম আমি আর মজিদ সাহেব। একটু পরে দেখি চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। একখানা হাত আস্তে আস্তে আমার কাঁধের উপর রেখে জিজ্ঞাসা করলেন–যদি আপত্তি না থাকে। ব্যাপারটা আমায় বলবেন?

    মাত্র কয়েক মিনিটের পরিচয়, তবুও মনে হলো একে আমি, বিশ্বাস করতে পারি। অন্ততঃ এই মানুষটি ব্যাপারটা ছেলেখেলা বলে উড়িয়ে দেবে না। একে একে সব বলে গেলাম–মাথিনের কথা, চৈত্র-সংক্রান্তির দিনটির কথা, সবই আমি তাঁর কাছে স্বীকার করলাম। শুনে খানিকক্ষণ গুম হয়ে রইলেন মজিদ সাহেব। তারপর বললেন–আপনার অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি ধীরাজবাবু। কিন্তু আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? মাত্র দশ-বারো মাইল পথ। আমি কথা দিচ্ছি, আজ রাত্রেই আমরা নীলা থেকে রওনা হয়ে পড়বে এবং কালকের মধ্যেই কাজ শেষ করে রাত্রে নয় তত বড় জোর পরশু সকালের মধ্যে আপনি নিশ্চয় এখানে ফিরে আসতে পারবেন।

    খানিকটা ভরসা পেলাম, মজিদ সাহেবকে নিয়ে কোয়ার্টার্সে চলে এলাম। এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল।

    .

    খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোতে আমাদের একটা বেজে গেল। ঠিক দুটোয় স্টীমার। থানা ছেড়ে একটু এগোতেই দেখি ম্লান মুখে একটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হরকি। একটু থেমে বললাম–মানুষের পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে পরশুর মধ্যে আমি ফিরবোই। যদি না পারি মাথিনকে সব বুঝিয়ে বলিস, যেন আমায় ভুল না বোঝে। কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলো হরকি।

    ছোট্ট স্টীমার। নাফ নদীর মাঝখান দিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে। রেলিঙ ধরে টেকনাফের দিকে চেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনের অবস্থা বুঝে মজিদ সাহেবও কথাবার্তা বলবার চেষ্টা করলেন না। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম।

    নীলায় পৌঁছবার আগে তিনটে জায়গায় স্টীমার থামে। প্রথমটার নাম মনে নেই। পরেরটা উখিয়া তারপরে মংডু সব শেষে নীলা। ওখান থেকে খানিকটা দূরে পড়ে কুতুবদিয়া থানা। টেকনাফে শুনেছিলাম যে, উখিয়া আর কুতুবদিয়া এই দুটো ছোটো জায়গায় বড় বড় নাম করা রাজবন্দীদের অন্তরীণ করে রাখা হত। পরবর্তী জীবনে শুনেছিলাম যে, স্বৰ্গত মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে এই কুতুবদিয়া থানার এলাকাতেই বহু দিন রাজবন্দীরূপে আটক থাকতে হয়েছিল।

    বেলা চারটের কিছু আগেই নীলায় পৌঁছে গেলাম। স্থানীয় লোকে নীলাকে ছোটোখাটো একটা গঞ্জ বা শহর বলতো। থানা, আবগারি পুলিসের আপিস বাজার সব মিলিয়ে ছোট্ট হলেও জায়গাটা বেশ কর্মব্যস্ত চঞ্চল। আবগারি আপিসেই উঠলাম। সেখানে এসে দেখি দশ-বারোজন মগ ও মুসলমান কনস্টেবল যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। মজিদ সাহেবের মতো আমারও পরনে খাকি হাফ প্যান্ট, হাফ সার্ট, পায়ে মোজা ও সাদা কেডস, মাথায় খাকি সোলার হ্যাট। শুধু থানা থেকে একটা পাতলা স্টিক যোগাড় করে নিলাম। শুনলাম ‘আমাদের বেরোতে হবে রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে ন’টা সাড়ে নটায়। আবগারি একজন বাঙালী কর্মচারীর কাছে শুনলাম দিনে বা বিকেলে মরিআলা বা আশেপাশের গ্রামের বহু লোক নীলায় কেনা বেচা করতে আসে। তাদের কেউ যদি আমাদের দেখতে পায় বা আমাদের উদ্দেশ্য জানতে পারে তা হলে সব পণ্ড হবে, রাতারাতি লবণ সরিয়ে ফেলবে। সেই জন্যে রাতের আঁধারে চিটাগং হিলস্-এর মধ্যে দিয়ে আমাদের গোপনে যেতে হবে।

    হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে পাংশু মুখে মজিদ সাহেব ছুটে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলেন, চমকে মুখের দিকে চাইলাম। দেখি চোখ দুটো ছল ছল করছে। সবিস্ময়ে বললাম–ব্যাপার কি মজিদ সাহেব? প্রথমটা কোনো জবাব না দিয়ে আস্তে আস্তে আমার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় বললেন–আমায় আপনি ক্ষমা করুন ধীরাজবাবু।

    হাসবো না কাদবব? হেসেই বললাম–টেকনাফে আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এমন কোনো অপরাধ আপনি করেছেন বলে তো মনে পড়ে না যার জন্যে হাত ধরে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে।

    হঠাৎ রেগে উঠলেন মজিদ সাহেব। যতো সব জোচ্চোর মিথ্যেবাদীর দল, এরা জীবনে ভুলেও সত্যিকথা বলে না।

    জোচ্চোর ও মিথ্যেবাদী দলের সঙ্গে আমার বা মজিদ সাহেবের কী ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকতে পারে ভেবে যখন কোনো কূল কিনারা পাচ্ছি না তখন রূঢ় সত্য দিনের আলোর মতোই চোখের সামনে পরিষ্কার ফুটে উঠলো। স্তম্ভিত ও হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। মজিদ সাহেব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন-কেমন জলের মতো আমায় বুঝিয়ে দিলে দশ বারো মাইল পথ, একদিনের মধ্যেই কাজ শেষ করে চলে আসতে পারবেন। এখন শুনছি এই নীলার আবগারি আপিস থেকে মরিআলা ষাট মাইলেরও বেশি পথ। তার মানে চাররাত্রি অবিশ্রাম হাঁটলে তবে আমরা পঞ্চম দিনে মরিআলায় পেঁছিবে, কী ভয়ানক! এমন জানলে আমি চাকরি ছেড়ে দিতাম সেও ভি আচ্ছা, তবু কখনই এই অসভ্য জংলি মুলুকে প্রাণ দিতে আসতাম না।

    কোনো জবাব দিলাম না, দেবার ক্ষমতাও ছিল না। আমি যেন সমস্ত অনুভূতির বাইরে এক নতুন জগতে চলে গিয়েছি। কতোক্ষণ এইভাবে ছিলাম মনে নেই, বাহ্য জগতে ফিরে এলাম মজিদ সাহেবের পরের কথায়। বললেন–যা থাকে কপালে আপনি ফিরে যান ধীরাজবাবু। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু আল্লার নামে শপথ করে বলছি আমি কিছুই জানতাম না। ওরা বেশ জানতো সত্যি কথা বললে আপনি বা আমি কেউই এ এক্সপিডিশনে আসতাম না।

    আমি শুধু ভাবছিলাম মহেন্দ্রবাবুর কথা। বহুদিন এ অঞ্চলে আছেন, তিনি তো সবই জানতেন। তবে?

    রুদ্ধ আক্রোশে মজিদ সাহেব বলেই চললেন–রাত্তিরটা খাওয়া দাওয়া করে এখানে থেকে কাল সকালেই আপনি টেকনাফ ফিরে যান। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন পেটের অসুখ করেছিল। আমিও তাই বলবো, তারপর যা হয় হবে। চিটাগং হেড আপিস থেকে আমাকে কি বলে এখানে পাঠিয়েছে জানেন? আমাকে বললে–মজিদ সাহেব, আপনি নতুন কলকাতা থেকে আসছেন। কাজকর্ম কিছুই জানেন না। এখানে থাকলে চান্স পেতে অনেক দেরি হবে। তার চেয়ে আপনি নীলায় চলে যান, মরি আলার কেসটা শেষ করতে পারলেই মোটা রিওয়ার্ড পাবেন আর সার্ভিস বুকেও ভালো রিমার্ক হবে। এখন বুঝতে পারছি এতো সব পাকা ঝানু লোক থাকতে আমায় রিওয়ার্ড পাওয়ার জন্যে ওদের এতো মাথা ব্যথা কেন হয়েছিল। মিথ্যেবাদী শয়তানের দল।

    এতো দুঃখের মধ্যেও মনে মনে হাসলাম। ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি-মজিদ সাহেব চট্টগ্রামে আপনার মিসেস মুলাও বলে কোনো ইংরেজ মহিলার সঙ্গে হঠাৎ আলাপের সৌভাগ্য হয়েছিল কি? অতি কষ্টে লোভ সংবরণ করলাম। জোর করে সব চিন্তা ভাবনা মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে ডান হাতখানা মজিদ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম–তা হয় না মজিদ সাহেব। এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়া কখনও উচিত নয়। তাছাড়া এতো বড় একটা মিথ্যার মধ্যে দিয়েই তো আপনার মতো একজন সত্যিকার বন্ধু পেলাম–সেটা কি কম লাভ? চলুন যা থাকে কপালে। মরি বাঁচি একসঙ্গেই দু’জনে মরিআলায় যাবে।

    পরম আগ্রহে দু’হাত দিয়ে আমার হাতখানা চেপে ধরে আনন্দোজ্জল চোখে শুধু মুখের পানে চেয়ে রইলেন মজিদ সাহেব।

    .

    সেদিন খাওয়া-দাওয়া সেরে দশজন কনস্টেবল ও পথ-প্রদর্শক বাচ্চাকে নিয়ে যখন আমরা আবগারি আপিস থেকে বেরোলাম, মজিদ সাহেবের হাতঘড়িতে তখন রাত দশটা বেজে গিয়েছে। নীলা থেকে বেরিয়ে বরাবর পশ্চিম মুখো হাঁটতে শুরু করলাম। সবার আগে চলেছে বাচ্চা, তার পিছনে গল্পগুজব করতে করতে চলেছে দশটি কনস্টেবল। প্রত্যেকের হাতে প্রকাণ্ড একখানা ধারালো দা’ আর মশাল, মশালগুলো জ্বালা হবে চিটাগং হিলস-এ ঢোকবার আগে। সবার পিছনে পাশাপাশি নিঃশব্দে চললাম আমি আর মজিদ সাহেব। প্রায় ঘণ্টাখানেক এইভাবে হেঁটে পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছলাম। সমতল জমি শেষ হয়ে গেল। এখান থেকে শুধু এই বিরাট চিটাগং হিলস্-এর বুকের মাঝখান দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। আগে পাহাড় শুনলেই ভাবতাম সে শুধু পাথরেরই স্তূপ, এই প্রথম বিশাল চিটাগং হিলস্ দেখে সে ধারণা বদলে গেল। সমস্ত পাহাড়টাই মাটির, এক টুকরো পাথরও তার মধ্যে নেই। প্রকাণ্ড বড় বড় শাল, সেগুন, দেবদারু আর অসংখ্য নাম-না-জানা গাছ মাটির পাহাড়কে ঢেকে ফেলে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করতে আকাশে মাথা তুলেছে। দিনেই ঢুকতে ভয় করে, রাত্রে তো কথাই নেই। সমতল থেকে মাটি কেটে কেটে সিঁড়ির ধাপের মতো পথ উপরে উঠে গিয়েছে, অপরিসর সরু সেই পথ ধরে দু’জন পাশাপাশি যেতে পারে না। ঐ সিঁড়ি বা পথ বেয়েই আমাদের উপরে উঠতে হবে। চট্টগ্রামের একটি বাঙালী কনস্টেবল পঞ্চু দাস মজিদ সাহেবকে আস্তে আস্তে কি জিজ্ঞাসা করলে। আমার দিকে ফিরে মজিদ সাহেব বললেন–ওরা জানতে চাইছে আর একটু বিশ্রাম নেবেন, এখনই রওনা হবেন।

    নীলা থেকে বেরিয়ে এই প্রথম আমাদের মধ্যে কথা হলো। বললাম–না না, বিশ্রামের দরকার নেই। চলুন রওনা হয়ে পড়ি।

    .

    মশালগুলো সব জ্বেলে নেওয়া হলো। মশালের লাল আলোর আভায় ওদের হাতে প্রকাণ্ড দা’গুলো চক চক করে উঠলো। সবার আগে মশাল হাতে চলেছে পথ-প্রদর্শক বিভীষণ বাচ্চা, তারপর একে একে দশজন কনস্টেবল, এদের পর আমি ও সবশেষে রাইফেল কাঁধে মজিদ সাহেব। রাইফেলটা প্রথমে নজরে পড়েনি একজন কনস্টেবলের কাছে ছিল। পাহাড়ে উঠবার আগে মজিদ সাহেব তা নিজের কাঁধেই নিয়ে নিলেন। অভোগুলো মশাল আর দা’-এর চেয়ে ঐ একটা রাইফেলই দুর্গম পথের ভীষণতা যেন আরো শতগুণ বাড়িয়ে দিলো। নিঃশব্দে খাড়া মাটির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। একটার পর একটা সিঁড়ি অতিক্রম করছি আর মনে হচ্ছে এ পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায়!

    আধ ঘন্টা এইভাবে অবিশ্রাম উঠবার পর যখন পা দুটো একেবারে ধরে এসেছে তখন সিঁড়িও শেষ হলো। সবাই হাঁপাচ্ছে। কনস্টেবলের দল সরু পথের উপর বসে পড়লো। আমি আর মজিদ সাহেব লজ্জায় আর ওদের সঙ্গে কলাম না। মজিদ সাহেব রাইফেলটার উপর ভর দিয়ে গড়ালেন আর আমি হাতের ছড়িটায় উপর যতটুকু ভার দেওয়া সম্ভব দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলাম। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বার করে মজিদ সাহেবকে একটা দিয়ে নিজে একটা ধরালাম। এই বিশ্রামের অবসরে মজিদ সাহেবের পরিচয় যা পেলাম তা এই বাবা রিটায়ার্ড সাবজজ। বছর খানেক হলো বড় ভাই ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছেন। মজিদ সাহেবও স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে ভালোভাবে বি-এ. পাশ করে এম-এ. পড়বার জন্য অ্যাডমিশনও নিয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ বাবা হার্টফেল করে মারা গেলেন। ছোট বোন রাবেয়া বোর্ডিং-এ থেকে আই-এ, পড়তো সেও এসে পড়লো। মা অনেক ছোটবেলা মারা গিয়েছিলেন, তাকে ভালো করে মনে পড়ে না মজিদ সাহেবের। বাবাই সে অভাব পূর্ণ করেছিলেন এতদিন। ভাই-বোনে পরামর্শ করে ঠিক হলো বাড়িটা সম্পূর্ণ ভাড়া দেওয়া হবে। সেই ভাড়া থেকে দাদার বিলেত পড়ার খরচ পাঠিয়ে আর রাবেয়ার বোর্ডিং-এর খরচ দিয়ে যদি কিছু বাঁচে ভালোই, নইলে মজিদ সাহেব চাকরির টাকা থেকে বাকিটা দিয়ে দেবেন। বাবারই এক বন্ধুর চেষ্টায় ও তদ্বিরে মজিদ সাহেব আবগারি সাব-ইন্সপেক্টারের পোস্ট পেয়ে গেলেন। পরের ঘটনাগুলো সবই জানা।

    হাঁটা শুরু হলো। গাছ আর মাটি কেটে কেটে তৈরি করা পথ। খুব বেশি হয় তো হাতখানেক চওড়া, দু’জনে পাশাপাশি যাওয়া চলে না। পথের দুপাশে গভীর খাত, উপর থেকে চাইলে তলা দেখা যায় না, মাথা ঝিম ঝিম করে। একটি লম্বা লাইন করে সবাই চলেছি। কনস্টেবলরা বাঁ হাতে দা’খানাকে শক্ত করে ধরে ডান হাত উঁচু করে মশালগুলো নিয়ে গুনগুন করে কি যেন বলছে আর পথ চলছে। প্রথমে একজন সুর করে কি বলে পরে সবাই এক সঙ্গে তার প্রতিধ্বনি করে। শুনতে মন্দ লাগে না। কেউ না বলে দিলেও একটু পরে বুঝতে পারলাম ওরা গান ধরেছে। আমাদের দেশে যেমন পাল্কি-বেয়ারারা গান করে, দিনমজুর কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে করতে গায়, এও সে ধরনের গান। তফাত শুধু স্থান আর কালের। আমাদের দেশের মজুররা গান গায় পরিশ্রম খানিকটা লাঘব করার জন্য। কিন্তু এরা? শুধুই কি পরিশ্রম দূর করার জন্য না এর সঙ্গে খানিকটা প্রচ্ছন্ন ভয়ও মেশানো রয়েছে? মনে মনে আলোচনা করতে করতে বেশ কিছুদূর এগিয়েছি হঠাৎ খেয়াল হতেই দেখি গান থেমে গিয়েছে আর আমরাও থেমে গিয়েছি। দলের সবচেয়ে বিজ্ঞ মগ ইশারা করে সবাইকে চুপ করতে বলে দিলে। কাঠের পুতুলের মতো সেই সরু রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি–এক মিনিট, দু মিনিট, তিন মিনিট। হঠাৎ মজিদ সাহেবকে জড়িয়ে ধরলাম। বুকের ভিতরটা ঢিব ঢিব করতে লাগলো। স্পষ্ট শুনতে পেলাম কাছে খুব কাছে রুদ্ধ আক্রোশে ফুলে উঠে ডাকছে একটা বাঘ। প্রথমটা আস্তে তারপর ক্রমশঃ বাড়তে লাগলো গর্জন। হঠাৎ একেবারে কাছে শুনলাম আর একটা বিকট আওয়াজ। সঙ্গে সঙ্গে দা’গুলো মাটিতে রেখে মগ কনস্টেবলের দল এক হাতে মশালটা উঁচু করে নাড়ছে অপর হাতের আঙুলগুলো মুড়ে মুখের কাছে এনে সবাই এক সঙ্গে এক বিকট বীভৎস আওয়াজ করতে শুরু করেছে। থেকে থেকে দমকা আওয়াজ করে, আবার থামে, আবার শুরু হয়। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চললে আওয়াজের মহড়া। তারপর হঠাৎ থেমে সবাই উৎকর্ণ হয়ে রইলো। এবার বেশ বুঝতে পারলাম বাঘের ডাক ক্রমেই দূর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম ব্যাঘ্র মহাশয় গতিক সুবিধা নয় বুঝতে পেরে ‘যঃ পলায়তি নীতি অবলম্বন করেছেন। ততোক্ষণে খাকি হাফ প্যান্ট, শার্ট সবই ঘামে ভিজে সপসপ করছে, মজিদ সাহেবের অবস্থাও তাই। নীরবে পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম–কথা বলার দরকার হলো না। আবার চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়ে দেখি মাটিকাটা পথ আবার নিচুতে নামতে শুরু করেছে। নামবার সময় বেশ আরাম লাগে। একটু গিয়ে আবার উপরে ওঠার পালা শুরু। মুশকিল হয় সেই সময়, পা দুটো আর উঠতে চায় না।

    শুধু দেখলাম আমাদের সঙ্গী মগেরা বেশ উৎসাহের সঙ্গেই চলেছে। এ-কষ্টকে ওরা কষ্ট বলেই গ্রাহ করছে না। এইভাবে দু’তিনবার ওঠা-নামা করে মজিদ সাহেবকে বললাম–এবার উঠে বেশ একটু বিশ্রাম না করে আমি আর হাঁটতে পারবে না মজিদ সাহেব।

    মজিদ সাহেব বললেন–আপনি বাঁচালেন, আমি লজ্জায় বলতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা আপনার চেয়েও শোচনীয়।

    একটু পরেই উপরে উঠে খানিকটা সমতল পথ পাওয়া গেল। চওড়ায় কয়েক ইঞ্চি বেশি। যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। দ্বিতীয়বার আর বলতে হলো না, উপরে উঠেই মজিদ সাহেব বাঙালী কনস্টেবল পঞ্চু দাসকে ডেকে আমাদের অভিপ্রায় জানিয়ে দিলেন। পঙ্গু তখনই মগী ভাষাতে তা সবাইকে বলে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে মশালগুলো পথের দুধারে পুতে রেখে দা’ হাতে সবাই কুপ ঝাঁপ করে পথের উপর লাইন করে বসে পড়লো। তারপর ফতুয়ার পকেট থেকে চুরুট বার করে মশালের আলোতে ধরিয়ে দিব্যি আরামে টানতে শুরু করে দিলে। শুধু বিভীষণ বাচ্চা একটা প্রেতের মতো কেরোসিনের টিন নিয়ে ঘুরে ঘুরে নিবুনিবু মশালগুলোতে তেল দিতে লাগলো।

    একটু দূরেই আমি আর মজিদ সাহেব বসলাম। পকেট থেকে সিগারেট বার করতে গিয়ে সভয়ে চিৎকার করে ওঠে দাঁড়ালাম। মজিদ সাহেব ব্যাপার কি জিজ্ঞেস করতেই হাত দিয়ে আমার ও মজিদ সাহেবের মধ্যেকার পথটা দেখিয়ে দিলাম। পঞ্চু মশাল নিয়ে ছুটে এল। দেখলাম এক ঝুড়ি গোবরের মতো পদার্থ, একেবারে টাটকা। আর তা থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছে। মুখ দেখে বুঝলাম মজিদ সাহেবও বেশ ভড়কে গিয়েছেন। বয়স্ক সর্দার মগ পঞ্চকে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়ালো, তারপর নিচু হয়ে বুকে ব্যাপারটা দেখে নিয়ে মগী ভাষাতে সঙ্গীদের উদ্দেশ করে কি একটা বলে হাসিতে আটখানা হয়ে ভেঙে পড়লো। মনে মনে অপ্রস্তুত হলেও মুখে তা প্রকাশ না করেই বেশ একটু ঝাঁজের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম–ব্যাপার কি পঞ্চু।

    বেশ সহজভাবেই পঞ্চু জবাব দিলে, আমরা এখানে আসবার মিনিট খানেক আগে দল-ছাড়া একটা বুনো হাতি এ-পথ দিয়ে গিয়েছে আর অকাট্য প্রমাণ রেখে গিয়েছে ঐ টাটকা মল যা থেকে ধোয়া বার হচ্ছে।

    লজ্জা পেলাম। ভাবলাম অতোটা ভড়কে না গেলেও পারতাম। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে সিগারেট বার করে মজিদ সাহেবকে দিয়ে নিজে ধরালাম। এরই মধ্যে পঞ্চু কোন ফাঁকে একটা মশাল আমাদের পাশে পুতে রেখে গিয়েছে আর সঙ্গী মগের দল এমন কি বাচ্চা পর্যন্ত পরম কৌতুকে আমাদের দিকে চেয়ে চুরুট টানতে টানতে কি বলাবলি করছে। মনে মনে খোলদা আনা বিশ্রামের ইচ্ছা থাকলেও উঠে দাঁড়ালাম। অদ্ভুত লোক এই মজিদ সাহেব। কিছু বলবার দরকার হলো না, আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে পঞ্চকে ডেকে অর্ডার দিলেন–রাত দুটো বেজে গিয়েছে, আর বসলে চলবে না। মশালটা নিয়ে যাও আর ওদের সবাইকে বলে দাও সকাল পাঁচটার আগেই আমাদের একটা নিরাপদ জায়গায় পেঁছিতে হবে।

    আবার শুরু হলো হাঁটা।

    গম্ভীর নিস্তব্ধ রাত্রির বুকের উপর দিয়ে এক ভয়াবহ অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে অভিযান। কেউ জানে না এর শেয় কোথায়। হেঁটেই চলেছি, মাঝে মাঝে মশালের আলো কমে যায় আর ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে রাতের ভয়াবহ রূপ শতগুণ বেড়ে ওঠে। একটু থেমে তেল দিয়ে আবার ওগুলোকে সতেজ করে নিয়ে যাত্রা শুরু হয়। হঠাৎ একটা অস্ফুট আওয়াজ করে সামনের কনস্টেবলের দল দাঁড়িয়ে পড়ে। আমি আর মজিদ সাহেব বাঘ সিংহ বা হাতির ডাকের প্রত্যাশায় উৎকর্ণ হয়ে থাকি। কিছুই শুনতে না পেয়ে নিরাশ হই, কনস্টেবল পঞ্চু দাস উঁচু গলায় বলে–ও কিছু নয় বাবু। একটা গোনর খাদের এপাশ থেকে ওপাশে যাচ্ছিলো। কনস্টেবল খাই চুং তাকে দা দিয়ে টুকরো টুকরো করে কেটে খাদে ফেলে দিয়েছে।

    আবার চলা শুরু হয়। একটু পরে শুনি কনস্টেবলরা গুন গুন করে কোরাস শুরু করে দিয়েছে। ভাবলাম বাঘ আর হাতির রাজ্য ছেড়ে এবার বোধ হয় সাপের জমিদারীতে ঢুকলাম। মশালের অস্পষ্ট আলোয় চোখ বড়ো করে সামনে মাটির দিকে চেয়ে পথ চলি। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে চলার পর সমতল ছেড়ে আবার নিচে নামতে শুরু করলাম, নামছি তো নামছিই। হঠাৎ মনে হলো আর তেমন গরম লাগছে না। কোথা থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে যেন সর্বাজ জুড়িয়ে দিতে লাগলো। মজিদ সাহেবও দেখলাম একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেলে চার দিক চাইতে চাইতে নামছেন। খানিকক্ষণ বাদে নামা শেষ হলো, বুঝতে পারলাম ঠাণ্ডা হাওয়ার উৎস কোথায়। মনে হলো চিটাগং হিলস-এর এইখানটাই সবচেয়ে নিচু। মাটি ভিজে সঁতসেঁতে। কিছুদূরে একটা ছোট্ট খাল, চওড়া ছ’ সাত হাতের বেশি হবে না, রাস্তার উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে বয়ে গিয়েছে। ঐ খালটি পার হয়ে আমাদের যেতে হবে। দেখি কেরোসিনের টিন থেকে খানিকটা করে তেল নিয়ে মগেরা পায়ে হাঁটু পর্যন্ত মাখছে। হাত-পায়ের ব্যথা মারতে কেরোসিন তেলের যে কোনো বিশেষ ক্ষমতা আছে আগে জানা ছিল না। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। সামনে জল দেখে তৃষ্ণা আরও বেড়ে গেল। মজিদ সাহেবকে চুপি চুপি বললাম–চলুন আঁজলা করে খানিকটা জল খেয়েনি। দ্বিরুক্তি না করে মজিদ সাহেব আমার সঙ্গ নিলেন। মশালের আলোয় ছোট্ট খালটার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্বচ্ছ পরিষ্কার জল, নিচের মাটি পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। অনুমানে মনে হলো বড় জোর হাঁটু পর্যন্ত গভীর। দু’জনে পাশাপাশি বসে আস্তে আস্তে জলে হাত বাড়াতে যাচ্ছি হঠাৎ দু-তিনজন মগ কনস্টেবল পিছন দিক থেকে আমাদের দুজনকে ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে পিছনে নিয়ে যেতে লাগলো আর ভয়ে কুকুতে চোখ কপালে তুলে চিৎকার করে বলতে লাগলো–রি মি হিন্দুরি মি হিন্দু। চোখের নিমেষে ব্যাপারটা ঘটে গেল। খালের ধার থেকে বেশ কিছুদূরে আমাদের দুজনকে এনে যখন ছেড়ে দিলে, তখন প্রথমটা রাগে বিস্ময়ে কোনো কথাই মুখ দিয়ে বেরুলো না, একটু পরেই মজিদ সাহেব চিৎকার করে উঠলেন–পঞ্চু! এ সবের মানে কি? কি ভেবেছে ওরা? মুখখানা কাচুমাচু করে হাত দুটো কচলাতে কচলাতে পঞ্চু কাছে এসে বললে–হুজুর ওরা ঠিকই করেছে। এ খালের জল দেখতে পরিষ্কার হলেও পাহাড়ী জোকে ভর্তি। এমনিতে নজরে পড়ে না, কিন্তু হাত জলে ডুবিয়েছেন কি ছেকে ধরেছে। অনেক কষ্টে যদিও সেগুলো ছাড়িয়ে ফেলতে পারলেন, কিন্তু পরে সে জায়গায় ঘা হয়ে যাবে এবং বিষাক্ত ঘা। এরা বলে সে যা সহজে সারে না। তাই ওরা চিৎকার করে বলছিল যে, জল খাবেন না, জল ভালো না। দেখছেন না ওরা পায়ে হাঁটু পর্যন্ত কেরোসিন তেল লাগিয়ে নিচ্ছে। তেলের গন্ধ পেলে জোক কাছেই ঘেঁষবে না।

    কেরোসিন তেলের মাহাত্ম্য এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম। অকারণ ক্রোধে উত্তেজিত হওয়ার জন্য মনে মনে লজ্জা পেলাম। জলের বর্ণনা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পিপাসা দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। এখন শুধু একমাত্র চিন্তা হলো হেঁটে ঐ খাল আমরা কি করে পার হবে। শেষ পর্যন্ত জুতো মোজা খুলে আমাদেরও কি সর্বাঙ্গে কেয়োসিন তেল মালিশ করতে হবে? মজিদ সাহেবের দিকে তাকালাম। বুঝলাম তাঁরও ঐ এক দুশ্চিন্তা। একটু ইতস্তত করে বললাম–তাহলে পঞ্চু, আমরা জুতো মোজা খুলতে লাগি, তুমি একটু কেরোসিন তেল এনে দাও।

    হেসে জবাব দিলে পঞ্চু–না হুজুর। আপনাদের ওসব কিছুই করার দরকার হবে না। আমরাই কোলে করে আপনাদের পার করে দেবে।

    তাই হলো। আমাদের দুজনকে দুটি মগ গলার নিচে এক হাত আর হাঁটুর নিচে এক হাত দিয়ে অনায়াসে কোলে করে খালের অপর পারে পৌঁছে দিলে।

    খাল পার হবার পর্ব শেষ হলে আবার সদলবলে হাঁটতে শুরু করলাম। এবার দেখলাম পথটা একটু চওড়া। আমি আর মজিদ সাহেব পাশাপাশি সিগারেট খেতে খেতে চললাম।

    মজিদ সাহেবের ঘড়িতে দেখলাম রাত চারটে বাজে। আর একটা ঘন্টা কোনো রকমে কাটিয়ে দিতে পারলেই বিশ্রাম। মজিদ সাহেবকে বললাম–অনেকক্ষণ ধরে ভূতের বোঝা বইছেন, আমায় খানিকটা অংশ দিন। রাইফেলটা মজিদ সাহেবের কাছ থেকে নিজের কাঁধে তুলে নিলুম। একটা অদ্ভুত মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। রাইফেল, বন্দুক, রিভলবার, ছোরা, দুরি, দা’–যে কোনো অস্ত্র বা মারাত্মক হাতিয়ারের একটা সাইকোলজিক্যাল এফেক্ট আছে, ব্যবহার করি না করি হাতে এলেই একটা সিকিউরিটি ভাব আসে। খানিকটা সাহস যেন ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসে। জিজ্ঞাসা করলাম-আচ্ছা মজিদ সাহেব, রাইফেল রিভলবার কখনও ছুঁড়েছেন?

    মজিদ সাহেব হেসে জবাব দিলেন–ট্রেনিং-এ পরীক্ষা পাশ করার প্রয়োজন ছাড়া এক দিনও না। তবে এবার হয় তো প্রয়োজন হবে। প্রথমদিনেই যা সব নমুনা পেলাম।

    হঠাৎ দেখি কিছু আগে আমাদের সঙ্গীর দল থেমে দাঁড়িয়ে মশালের আলোয় নিচু হয়ে কি দেখছে আর উত্তেজিতভাবে কি সব বলাবলি করছে। দু-তিনজন দেখলাম মশালটা উঁচু করে ডান দিকের ঘন জঙ্গলটার ভিতরে কি দেখবার চেষ্টা করছে। ব্যাপার কি? অজ্ঞাতে বাঁ হাত দিয়ে রাইফেলটা শক্ত করে ধরে এক পা, এক পা করে এগোতে লাগলাম। কাছে গিয়ে দেখি একটা রক্তাক্ত বাছুরের আধখানা দেহ। স্পষ্ট বোঝা গেল কোনো বাঘ বা নেকড়ে সবে ব্রেকফার্স্ট-এ বসেছিল। আমাদের হঠাৎ আগমনে বিরক্ত হয়েই বোধ হয় ডান দিকের ঘন জঙ্গলটার মধ্যে আত্মগোপন করে রয়েছে। দেখলাম বাছুরটার মুখ আর সামনের পা দুটো নেই। শুধু পিছনের দুটো পা আর ল্যাজটা অবশিষ্ট আছে। সরু একটা টাটকা রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়েছে পাশের খাদে। রাইফেলটা কাঁধ থেকে খুলে নিয়ে দু হাতে বেশ শক্ত করে ধরে ঐ জঙ্গলটার দিকে তাক করে গুলী ছুঁড়তে যাবে এমন সময় সঙ্গী মগী কনস্টেবলের দল আর্তনাদ করে উঠলো।

    পঞ্চু বললে–অমন কাজও করবেন না বাবু! এমনিতে ও কিছুই বলবে না। কিন্তু খুচিয়ে ঘা করলে এখান থেকে কেউ প্রাণ নিয়ে যেতে পারবে না।

    রাইফেল ছোঁড়ার এমন একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে না পেরে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলাম। কাঁধে না ঝুলিয়ে রাইফেলটা হাতে নিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম। মগের দল ততক্ষণে মশাল নিভিয়ে ফেলেছে। চেয়ে দেখি ঘন পাতার আবরণ ভেদ করেও পুবের আকাশ দেখা যাচ্ছে আর একটা ঝিরঝির হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। কানে ভেসে এল অগণিত ঘুম-ভাঙা পাখির কলরব। বুঝলাম ভোর হয়ে এল। চিটাগং হিলস-এর গভীর অরণ্যে এই ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যেও অদ্ভুত ভালো লেগেছিল সেদিনের প্রভাত। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মিনিট পাঁচেক হাঁটবার পর সামনে কিছু দূরে অস্পষ্ট আলোয় দেখি মাঝারি একখানা ক্যাংঘর। ঘর? এই গভীর অরণ্যে মানুষের বসতি? নিজের চোখকে বিশ্বাস হলো না। বললাম–দেখুন তো মজিদ সাহেব, দূরে ওটা ঘর বলে মনে হচ্ছে না? মজিদ সাহেবও আমার মতোই অবাক হয়ে গিয়েছেন। একটু ইতস্তত করে বললেন–হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো ধীরাজবাবু, এ যে আরব্য উপন্যাসকেও ছাড়িয়ে গেল। দেখি সামনে কনস্টেবলদেরও দৃষ্টি এড়ায়নি। ওরাও ঘরখানা দেখতে পেয়েছে। তবে আমাদের মতো মোটেই তারা অবাক হয়নি বরং খুশি মনে ঐ দিকেই এগিয়ে চলেছে। আরও কাছে এসে পড়লাম। সেই চিরাচরিত ফরমুলার ক্যাংঘর, লম্বা শাল গাছের খুটি, মাটি থেকে আট দশ হাত উঁচু পুরু তক্তার মেজে, তক্তার বেড়া, একটা জানলাও চোখে পড়লো। তার উপর, ওঃ বাবা, গোলপাতা বা নারকেল পাতা নয়, একেবারে করোগেটেড টিনের চাল! বেশ স্পষ্ট দেখতে পেলাম এবার, মেজের তক্তা দু’তিন হাত বারান্দার মতো ঘরের চারপাশে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আর তারই একপাশে বসে দাঁতন করছে কে? পরক্ষণেই দেহে যতটুকু শক্তি অবশিষ্ট ছিল সবটুকু দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম–সুধীর!

    আমার হঠাৎ-চিৎকারে সঙ্গীরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে একবার আমার দিকে একবার ঐ রহস্যময় লোকটির দিকে তাকাতে লাগলো। দেখলাম লোকটি তক্তার উপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। চোখে মুখে বিস্ময়। নিমেষে বিস্ময় কেটে গিয়ে আনন্দে উল্লাসে তার সমস্ত মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তারপর ঐ আট-দশ হাত উঁচু তার উপর থেকে অত্যন্ত বেড়ালের মতো এক লাফে আমাদের সামনে এসে পড়লো।

    চোখের পলক ফেলবার আগেই দেখি সে রাইফেল সুদ্ধ, আমাকে জড়িয়ে ধরে মাটি থেকে শূন্যে উঠিয়ে নিয়েছে আর বলছে–ধীরাজ। আমার যে এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। চিটাগং-এর এই গভীর জঙ্গলে তুই?

    কথা কইবার ক্ষমতা ছিল না। এইবার মনে হলো যে সত্যিই আমি পরিশ্রান্ত আর এক পাও হাঁটবার ক্ষমতা নেই। বললাম–পরে সব বলবো, শুধু তুই কোলে করে আমাকে ঐ তক্তার এক পাশে একটু শুইয়ে দে ভাই। কোনো কথা না বলে সুধীর আমাকে কোলে করেই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। হঠাৎ চোখ পড়লো মজিদ সাহেবের উপর। তিনি আমাদের দিকে চেয়ে অপরাধীর মতো একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। নিজের স্বার্থপরতায় ভীষণ রাগ হলো নিজের উপর। বললাম–সুধীর, আমাকে নামিয়ে দাও। দু’তিনটে সিঁড়ি লাফিয়ে পার হয়ে মজিদ সাহেবের কাছে গিয়ে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম–আমার মতো জানোয়ারকে ক্ষমা না করাই উচিত। কিন্তু অল্প কয়দিনের পরিচয়ে যেটুকু চিনেছি তাতেই সাহস পেয়ে বলছি। নিজের দুঃখ-কষ্টটাকেই আমি বড় করে দেখেছি। আর ভাষা যোগালো না। সত্যিই কেঁদে ফেললাম। সুধীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল দেখিনি। হঠাৎ আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে বললে–এসব মান-অভিমানের পালা খাওয়া-দাওয়া করে জিরিয়ে নিয়ে তারপর হবে। এখন চলল। জুতো মোজা খুলে লুঙ্গি পড়ে শুয়ে পড়বে চলল।

    সে আদেশ অবহেলা করবার সাহস বা ইচ্ছা ছিল না। কোনো রকমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ঘরে গিয়ে জুতো মোজাটা খুলে ঝুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। চোখ মেলতে পারছিলাম না, কথা জড়িয়ে আসছিল, তবু জোর করে বললাম–মজিদ সাহেব, আলাপ করিয়ে দিই, সুধীর দত্ত হচ্ছে আমার টেকনাফের এক রাতের অতিথি। তিনজন ফরেস্টার বন্ধুর একজন। তারপর জ্ঞান হারালাম না ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারবো না।

    ***

    ঘুম ভাঙলো বেলা দুটো আড়াইটের সময়। ঘুম ভাঙলো বললে মিথ্যে বলা হবে, ঘুম ভাঙালো। সুধীর আর তার আর্দালি বিছানা থেকে একরকম টেনে হিঁচড়ে উঠিয়ে খসিয়ে দিলো, তাতেও যখন ঘুম ভাঙলো না-তখন দুজনে মিলে আমাকে ঝাঁকাতে শুরু করে দিলে। কিছুক্ষণ বাদে চোখ মেলে চাইলাম।

    সুধীর বললে–শুধু ঘুমুলেই চলবে? খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না?

    ম্লান হেসে জবাব দিলামনা, শুধু ঘুমুলেই চলবে।

    মজিদ সাহেবের ঘুম ভেঙে গিয়েছে আমার আগেই। দু’জনে উঠে এসে কাঠের বারান্দায় দাঁড়ালাম। সেখানে দু’ বালতি জল, সাবান ভোয়ালে সব হাজির। কোনো রকমে হাত মুখ মাথা ধুয়ে গাটা মুছে কাক-স্নান সেরে নিলাম। পাশেই দেখি ঐ দু’হাত আড়াই হাত চওড়া বারান্দায় আমাদের সঙ্গীরা দিব্যি আরামে গাদাগাদি করে ঘুমুচ্ছে।

    সুধীর বললে–ওরা বুদ্ধিমান, আগেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছে।

    এইবার মনে হলো সত্যিই খিদে পেয়েছে। ঘরে এসে দেখি এরই মধ্যে কখন সুধীরের আর্দালি দু’ থালা ভাত, ডাল, আলুভাতে, খানিকটা করে গাওয়া ঘি আর বড়ো দুটো বাটিতে মুরগীর ঝোল সাজিয়ে বসে আছে।

    সুধীরকে বললাম–মুরগীটা ছেড়েই দিলাম কিন্তু এই সীতার বনবাসে মুগের ডাল, আলু, গাওয়া ঘি এসব যোগাড় করলে কি করে?

    হেসে সুধীর বললে–খুব সোজা! নীলার হাট থেকে আমার লোক এগুলো নিয়ে আসে তাতে সাত আট দিন চলে যায়। আবার পরের সপ্তাহে দরকারী সব কিছু নিয়ে আসে। আর মুরগীর জন্য তো ভাবনাই নেই। একটা বন্দুক নিয়ে বেরোলে মিনিট পনেরোর মধ্যে দু তিনটে বুনো মুরগী অনায়াসে যোগাড় হয়ে যায়।

    পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম এবং খেতে খেতে সুধীরকে আমাদের লাঞ্ছনার কথা সব বললাম। শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইলো সুধীর, তারপর বললে–তোদের একেবারে বোকা বানিয়েছে। মরিআলায় মুন তৈরি হয় সত্যি, কিন্তু ওরা বড্ডো গরীব। এই মুন বেচে দু’চার পয়সা যা পায় তাই দিয়ে কোনো মতে সংসার চালায়। আমার যতদূর মনে হয় অন্ততঃ কুড়ি বছরের মধ্যে মরিআলায় কোনো অফিসার ইন্সপেকশনে আসেনি। মজিদ সাহেবের দিকে তাকালাম। উত্তরে শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। মুখার্জি আর দাসের খবর জিজ্ঞাসা করলাম।

    সুধীর বললে–এখন কাঠ কাটার সিজন, এ সময় এলাকা ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় নেই। আমি মুখার্জিকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছি, কাল ভোরে তোমরা ওর বাংলোয় গিয়ে তৈরি ভাত পাবে।

    কথায় কথায় খেয়ে উঠতে বেলা চারটে বেজে গেল। সুধীর বললে–একটু ঘুমিয়ে নাও। আবার সারা রাত ঐ জঙ্গলের বুকের উপর দিয়ে ওঠা-নামা করতে হবে।

    খুব যুক্তিপূর্ণ কথা, মজিদ সাহেবের দিকে চেয়ে দেখি তার অবস্থা ‘ক্যাবলা ভাত খাবি? না হাত ধুয়ে বসে আছি’র মতন। নিদ্রা দেবী হাত বাড়িয়েই ছিলেন, দু’জনে শোবার সঙ্গে সঙ্গেই কোলে টেনে নিলেন।

    .

    ঘুম ভাঙলো যখন তখন রাত আটটা বেজে গিয়েছে। ঘরে একটা হ্যারিকেনের আলো মিট মিট করে জ্বলছে আর বাইরের বারান্দায় আমাদের সঙ্গীরা কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। বুঝলাম যাত্রার সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করে বসে পড়লাম। ব্যথায় পা দুটো টন টন করছে, শিরাগুলো দড়ার মতো ফুলে উঠেছে। সুধীর বারান্দায় ছিল, ছুটে কাছে এল। পায়ের অবস্থা দেখে বললো যে, অনেকক্ষণ একভাবে শুয়ে থাকার জন্য হয়েছে, একটু মাসাজ করে দিলে এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে। পাশে চেয়ে দেখি মজিদ সাহেব এরই মধ্যে কখন উঠে নিঃশব্দে জুতো মোজা পরতে শুরু করে দিয়েছেন। পাঁচ মিনিট বাদে ব্যথা অনেকটা কমে গেল। জুতো মোজা পরতে যাচ্ছি এমন সময় সুধীরের আর্দালি দুটো থালায় গরম লুচি আলুভাজা আর খানিকটা করে মুরগীর মাংস নিয়ে হাজির। খিদে ছিল না বললে মিথ্যা বলা হবে তবুও মৌখিক ভদ্রতা করলাম–এ সব আবার কেন, এই তো চারটের সময় খেয়ে উঠেছি।

    হেসে ফেললে সুধীর। বললে–আর পেটে খিদে মুখে লাজ করে কাজ নেই। খেয়ে নাও, মাইল পাঁচেক হাঁটলেই দেখবে আবার খিদে পেয়েছে।

    আড়ম্বরহীন বিদায়ের পালা শেষ হতে দেরি হলো না। সুধীর একটা টর্চ ও বন্দুক নিয়ে আমাদের খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেল। যাবার সময় বারবার আমাকে ও মজিদ সাহেবকে অনুরোধ করলে যেন ফেরার সময় তার বাংলো হয়ে যাই।

    মজিদ সাহেব হেসে জবাব দিলেন–এটা কিন্তু একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে সুধীরবাবু। মনে মনে বেশ জানেন যে, আপনার অতিথি না হয়ে আমাদের যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

    বেশ একটা হাল্কা হাসিখুশির মধ্যে দিয়েই যাত্রা শুরু করলাম। রাত তখন নটা। মাইল খানেক পথ বেশ আরামেই হেঁটে এলাম, পথও অপেক্ষাকৃত চওড়া, আশেপাশে জঙ্গলও ততো গভীর নয়। হঠাৎ পট পরিবর্তন হলো। দু’পাশে ঘন গভীর জঙ্গল তার মধ্যে দিয়ে মাটি কেটে ছোট সরু পথ একটু একটু করে উপরে উঠে গিয়েছে। একটা সরু লাইন করে পর পর সবাই চলেছি। আগের মতো বাচ্চা সবার সামনে তার পর সব কনস্টেবলেরা। সবার শেষে আছি মজিদ সাহেব ও আমি। আমাদের সঙ্গী মগদের মধ্যে সব চেয়ে কম বয়সের একটি ছেলে ছিল। তার আসল নাম জানিনে, সবাই জংলি বলেই তাকে ডাকতো। বয়েস আঠারো উনিশের বেশি হবে না, চমৎকার স্বাস্থ্যবান নিটোল চেহারা। মাথায় একরাশ কেঁকড়া বাবরি চুল লাল একটা রুমাল দিয়ে বাঁধা। নীলা থেকে লক্ষ্য করছি সব সময় ছেলেটা কেমন মনমরা হয়ে আছে। ভেবেছিলাম শরীর ভালো নেই নয় তো পারিবারিক কোনো অশান্তির জন্য মন খারাপ। হঠাৎ শুনি জংলি চিৎকার করে মগী ভাষায় গান গাইতে শুরু করেছে। ব্যাপার কী? মজিদ সাহেবও বেশ অবাক হয়েছেন। সঙ্গী মগেরা গা টেপাটিপি করে হাসহাসি শুরু করেছে, জংলির সেদিকে ক্ৰক্ষেপ নেই–ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃকপাত। জংলিকে উপলক্ষ্য করে অনেকখানি পথ বিনা ক্লেশে হেঁটে মেরে দিলাম। মজিদ সাহেবকে বললাম–এই মগ জাতটাকে কিছুতেই চিনে উঠতে পারলাম না।

    মজিদ সাহেব বললেন–আমি মাত্র কয়েকদিন হলো এসেছি। আপনি তবু খানিক চেনার সুযোগ পেয়েছেন।

    মশালে তেল দিতে হবে, সবাই একটু দাঁড়ালাম। এই অবসরে পঞ্চুকে ডেকে বললাম–জংলির কি হয়েছে বলো তো? প্রথমটা পঞ্চু প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। মজিদ সাহেব ও আমি পীড়াপীড়ি করাতে যা বললো তা হচ্ছে এই-সংসারে জংলি এক বুড়ো মা ছাড়া আর কেউ নেই। তিন তিনটে জোয়ান ভাই চিটাগং-এর জঙ্গলে কাজ করতে গিয়ে সাপ আর বাঘের হাতে প্রাণ দিয়েছে। বুড়ো মা তাই অনেক কান্নাকাটি করে অফিসারদের হাতে পায়ে ধরে জংলিকে কনস্টেবলের কাজে ঢুকিয়েছে-জঙ্গলের কাজে সে জংলিকে কিছুতেই যেতে দেবে না। আর এই চৈত্র-সংক্রান্তির দিন ওদেরই প্রতিবেশী একটি মেয়ের সঙ্গে জংলির বিয়ের কথাটা পাকাপাকি হবার কথা ছিল। ওদের ধারণা ঐ শুভ দিনটিতে যদি না হয় বা কোনো বাধা পড়ে তাহলে বুঝতে হবে ভগবান তথাগতের ইচ্ছা নয় যে, বিয়ে হয়। হঠাৎ এরকম দু দুটো বাধা পেয়ে বেচারি একেবাবে মুষড়ে পড়েছে। আর বুড়ী মা? আসবার সময় তার কী কান্না!

    যে ব্যথা জোর করে এ দু’দিন ভুলে ছিলাম পঞ্চু সেইটেই সবার সামনে নির্মমভাবে প্রকাশ করে দিলো। মাথিনের চিন্তা আবার দ্বিগুণভাবে সমস্ত মনটাকে অধিকার করে বসলো। স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠলো দুটো জলভরা চোখ, রাজ্যের মিনতি জড়ো করে কি যেন আমায় বলতে চায়।

    পঞ্চু দাস বললে–এমনিতে জংলি খুব ফুর্তিবাজ ছেলে। সব সময় হাসি খুশি, গল্পে গানে আবগারি আপিস সরগরম করে রাখতে। কাল বিকেল থেকে ওর মুখে আর কথা নেই, কারও সঙ্গে একটা কথাও বলেনি। খায়নি ভালো করে, আমরা জোর করে একটু যা খাইয়েছি। তাই এতোক্ষণ বাদে ও যখন হঠাৎ গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলো আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

    ভাবলাম ওর মনটা অনেকখানি হাল্কা হয়ে যাবে। নতুন চোখে চাইলাম জংলির দিকে। সে তখন উদাস দৃষ্টি মেলে দূরের রহস্যময় অন্ধকারের দিকে চেয়ে হয় তো তার প্রিয়তমার মুখখানাই দেখছে।

    হঠাৎ মজিদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনি কুসংস্কার মানেন?

    একটু অবাক হয়ে সাহেব বললেন–মানে?

    বললাম–এই ধরুন যেমন মগদের কুসংস্কার হচ্ছে চৈত্র-সংক্রান্তির দিন বাগদান না হলে বা তাতে বাধা পড়লে আর বিয়ে হয় না?

    হো হো করে হেসে উঠলেন মজিদ সাহেব। নাঃ, আপনি যে এতো ছেলেমানুষ তা জানা ছিল না। শিক্ষা বা সভ্যতার আলো যারা এতোটুকুও পেয়েছে তারা কখনো এসব অন্ধ সংস্কার মানে না–মানতে পারে না।

    এমন একটা কিছু সান্ত্বনা পেলাম না মজিদ সাহেবের কথায় আর এ নিয়ে তর্ক করতেও প্রবৃত্তি হলো না। তাই চুপ করেই রইলাম।

    পঞ্চু বললে–হুজুর এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে, হুকুম করেন তো চলতে শুরু করি।

    আবার সেই অফুরন্ত পথে একঘেয়ে চলা শুরু হলো। কতোক্ষণ এইভাবে নিঃশব্দে চলেছি খেয়াল নেই। বৈচিত্র্যহীন একইভাবে ওঠা-নামা আর চলা। হঠাৎ দেখি আমাদের অগ্রগামী মগ সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। শুনলাম এইবার উঠতে হবে পাহাড়ের সব চেয়ে উঁচুতে। সেখানে পথ অসম্ভব সরু, দু’পাশে গভীর খাদ। অন্যমনস্ক হয়ে পা একটু ফস্কালে আর রক্ষে নেই। আর এই পথ বেয়ে চলতে হবে তিন মাইলের উপর। আমাদের অরণ্যযাত্রার এইটেই হলো সবচেয়ে ভয়াবহ ও কষ্টকর পথ। মজিদ সাহেব পকেট থেকে সিগারেট বার করে একটা আমাকে দিলেন। ইচ্ছে ছিল না তবুও নিলাম। একটু পরে উপরে ওঠা শুরু হলো। সেই মাটি কেটে তৈরি সিঁড়ি। ব্যতিক্রম হলে অন্যান্য পাহাড়ে উঠবায় সময় খানিকটা চালু সিঁড়ি থাকে–এটা একদম খাড়া। খানিক উঠে পাড়িয়ে হাঁপাই, মগদের থামতে বলি, আবার উঠতে থাকি। এইভাবে মাঝে মাঝে থেমে যখন শেষ ধাপে পৌঁছলাম তখন আমি আর মজিদ সাহেব আধময়া। ঝুপ করে বলে পড়লাম উপরের অপেক্ষাকৃত একটু চওড়া, পথের ধারে। আমাদের দেখাদেখি সঙ্গীরাও বসে পড়েছে পথের উপরেই। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট বেশ বুঝতে পেরেছিল যে, সিঁড়ির সব কটা ধাপ পেরিয়ে উপরে উঠে বসতেই হবে তাই এখানটা অপেক্ষাকৃত চওড়া। জিরিয়ে একটু দম নিয়ে মজিদ সাহেব বললেন–পথের নমুনা দেখে কি মনে হয় জানেন ধীরাজবাবু? যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল, সে পথ দিয়ে ফিরলো নাকো তারা।

    ম্লান হেসে জবাব দিলাম–ফিরবার আশা আপনি রাখেন তাহলে? আমার তো মনে হয় এ অগস্ত্যের যাত্রা। এ যাত্রায় কেউ ফেরে না।

    দূরে গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে এল একটা গরুর অন্তিম আর্তনাদ, সেই সঙ্গে বাঘের হিংস্র হুঙ্কার। বোধ হয় মিনিট খানেক চলেছিল এই খাদ্য খাদকের লড়াই তারপর সব নিস্তব্ধ। বুঝলাম বেচারা গরুর গো-জন্মের যবনিকা এইখানে পড়লো। চিন্তার মোড় ঘুরে গেল। ভাবছিলাম মানুষের জীবনে কতো রঙ কতো বৈচিত্র্য। এই অনিশ্চিত জীবনকে কেন্দ্র করে কতো আশা ভালোবাসা স্বপ্নের সৌধ রচনা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো জাদিমুরা মন্দিরের পাদদেশে সমতল ভূমিটা। কোথায় সেই শান্ত মৌন স্তব্ধতা! যৌবনের কলহাস্য গানে আজ এর আকাশ বাতাস মুখরিত। মনে পড়লো আজ চৈত্র-সংক্রান্তির উৎসব। সকাল থেকে রঙ বেরঙের নতুন পোষাক পরে নতুন জীবন-পথে প্রথম পা বাড়াবার উৎসাহে পাহাড়ের আঁকা বাঁকা মাটির সিঁড়ি বেয়ে ভগবান বুদ্ধের আশীর্বাদ নিতে চলেছে দলে দলে সুন্দর অসুন্দর মগ ছেলে মেয়ের দল। আজ শুধু যৌবনের সমারোহ। জরা বার্ধক্যের স্থান এখানে নেই। হরকির কিনে আনা নতুন রেশমী সুজি ফতুয়া পরে মাথায় বাবরি চুলের মাঝখানে রঙিন রুমাল বেঁধে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মাঝে দাঁড়িয়ে আছি মন্দিরে ওঠবার সিঁড়ির এক পাশে মাথিনের প্রতীক্ষায়। ফ্রমে বেলা বাড়ে–নতুন জীবনের স্পন্দনও দ্রুততর হয়। মাথিনের তবু দেখা নেই। যৌবনে উচ্ছল অগণিত পূজারিণীর দল মনোমতে সঙ্গী নিয়ে ওপরে উঠছে। খানিক বাদে হাসিমুখে আবার নেমে আসছে। আমি শুধু সঙ্গীহীন একা। মাঝপথে হতাশার চড়ায় আটকে মাথিনের অপেক্ষায় পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দুশ্চিন্তায় মন অস্থির হয়ে ওঠে। তবে কি মাথিনের বাবা শেষ পর্যন্ত মত পরিবর্তন করলো। না সবটাই আগাগোড়া হরকির ধাপ্পাবাজি? আবার চিন্তায় বাধা পড়লো। সঙ্গী মগের দল একসঙ্গে চিৎকার করে উঠে হাতের মশালগুলো উঁচু করে ধরে ডানদিকের খাদের পাশে ঝুঁকে পড়ে ডাকলো–জংলি। অন্যমনস্ক হয়ে সরু পথ বেয়ে চলতে চলতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে গিয়েছে জংলি ডানদিকের অতলস্পশী খাদের মধ্যে। কান খাড়া করে সবাই শুনলাম তখনও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে জংলি। ছোটোখাটো গাছপালা যা পাচ্ছে একান্ত নির্ভরে আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আবার সেগুলো উপড়ে নিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বুকফাটা একটা আর্তনাদ নিকট থেকে ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগলো—মা–আম্মা…মা–আম্মা…

    নিরুপায় অনাথের অন্তিমের ডাকের মতো। সঙ্গী মগেরা চিৎকার করে ডাকে–জংলি! সে ডাক তার কানে পৌঁছয় কিনা জানি না কিন্তু সে সাড়া দেয় না। শুধু বুকফাটা আর্তনাদের সুরে বলে চলে-মা-আম্মা…। শেষ মুহূর্তে মৃত্যু স্থির নিশ্চয় জেনেও জংলি ভগবান বুদ্ধের নাম করলো না। তার আশৈশবের প্রণয়ী প্রিয়তমার নাম ধরেও একবার ডাকলো না। শুধু বৃদ্ধা স্থবির মায়ের চিন্তাই তাকে ব্যাকুল করে তুললো। মনে হলো আমি যেন সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছি, একেবারে সব অনুভূতির বাইরে। উৎকর্ণ হয়ে বসে আছি, আর কিছুই শোনা গেল না। শুধু মৃত্যুগর জংলির ডাকটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে লাগলো-মা আম্মা–মা–আম্মা। মজিদ সাহেবের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক বেশ বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

    রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন–জলজ্যান্ত ছেলেটা এক মিনিটেই শেষ?

    বললাম–আর সেই বুড়ী মা’র কথাটা ভাবুন তো? তিন তিনটে জোয়ান ছেলেকে এই রাক্ষুসী জঙ্গল হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়েছে। বুড়ী জংলিকে কিছুতেই আসতে দিতে চায়নি।

    চেয়ে দেখি সঙ্গী মগেরা যাবার জন্য তৈরি হয়ে আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আর সত্যিই তো জংলির মতো একটা নগণ্য ছেলের জন্য আর কতো সময় নষ্ট করা যায় আর লাভই বা কি! আবার হাঁটতে শুরু করি। সারা পথ শুধু সঙ্গে সঙ্গে চললো জংলির ঐ মা, আম্মা ডাক। যতো দূরে চলে যাই একটু দাঁড়িয়ে ডানদিকের খাদের কাছে কান পাতলেই যেন স্পষ্ট শুনতে পাই দূর দূরান্তর থেকে জংলি আকুলভাবে তার বৃদ্ধা মাকে ডাকছে–মা—আম্মা–

    হেঁটেই চলেছি। বিরাম বিশ্রামহীন একঘেঁয়ে হাঁটা। মাঝে মাঝে দূর থেকে বাঘের ডাক ভেসে আসে। মাথার উপর আকাশচুম্বী শাল বা দেবদারু গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে প্যাঁচা বা ঐ জাতীয় পাখি বিশ্রী কর্কশ কণ্ঠে দু-একবার ডেকে বুঝি বা অমঙ্গলের আভাস দেয়, গ্রাহ্য করি না। জংলি যাবার সময় একটা মস্ত উপকার করে গিয়েছে। আমাদের সমস্ত ভয় ভাবনা দুশ্চিন্তাগুলো ও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছে। মনে পড়লো দম দেওয়া একরকম পুতুলের কথা। রং বেরঙের পোশাক পরা, হাতে বন্দুক, মাথায় লোহার টুপি, একটা সৈন্যের পিছন দিকে একটা ছোট্ট দম দেওয়ার চাবি ফিট করা। বেশ কিছুক্ষণ দম দিয়ে ঘরের সিমেন্টের মেজেয় ছেড়ে দিলে যেমন সমান তালে পা ফেলে টলতে টলতে বন্দুক উঁচিয়ে হেঁটে যায়, আমাদের অবস্থাও হুবহু তাই। কতোক্ষণ এইভাবে হাঁটছি খেয়াল নেই। মজিদ সাহেবের হাতঘড়িতে ক’টা বাজলো জানতেও ইচ্ছা করছে না আজ। শুধু হাঁটছি। হঠাৎ দেখি আমাদের সঙ্গীরা বাড়িয়ে পড়েছে। মজিদ সাহেবের কাছে শুনলাম এইবার আমাদের সাঁকো পার হতে হবে। সাঁকো? জলের চিহ্নমাত্র নেই; মাটির পাহাড়ে সাঁকো? শুনলাম যে কারণেই হোক খানিকটা মাটি ধসে গিয়েছে সেই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে আমাদের সরে ঘন নীলমণি। সরু পথটিকে। দেখলাম পাশাপাশি দুখানা বাঁশ দিয়ে পারাপারের সেতু ৰা সাঁকো তৈরি হয়েছে। পাশ দিয়ে একখানা বাঁশ বাঁধা, বুঝলাম ঐখানি ধরে বৈতরণী পার হতে হবে। সঙ্গী মগেরা অনায়াসে পার হয়ে গেল। গোল বাঁধলে মজিদ সাহেবকে নিয়ে। রাইফেলটাকে লাঠির মতো ধরে পা ঘষে ঘষে দু তিন পা এগিয়ে মজিদ সাহেব টলোমলো করতে লাগলেন। তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে নামিয়ে নিলাম। তারপর অনেক গবেষণার পর ঠিক হলে আমরা দুজনে একসঙ্গে পার হবে, যা থাকে কপালে। ডান হাতে ঐ সরু বাঁশটি আর বাঁ হাতে রাইফেলের ডগাটি ধরে আমার দিকে ফিরে সঁড়ালেন মজিদ সাহেব আর আমি মজিদ সাহেবের দিকে ফিরে বাঁ হাতে বাঁশটি আর ডান হাতে রাইফেলের তলাটি ধরে এগোতে লাগলাম আস্তে আস্তে পা ঘষে ঘষে। আমি সামনে একটু একটু করে এগোচ্ছি আর পা ঘষে ঘষে একটু একটু করে পিছু হটছেন মজিদ সাহেব। পরস্পরের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে পার হওয়ার উদ্দেশ্য হলো–দু’পাশের গভীর খাদের দিকে নজর দেবার অবসর পাব না। দু’জনেই মনে মনে স্থির জানতাম যে, যদি ভুলেও পাশের খাদে চোখ পড়ে তাহলে পতন অনিবার্য। এইভাবে ঐ আট হাত চওড়া বৈতরণী প্রায় চল্লিশ মিনিটে পার হয়ে যখন ওপারে পৌঁছলাম তখন ঘামে আমাদের সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছে। ওদিকে মুখে একটা চুরুট গুঁজে সঙ্গী মগেরা পরম কৌতুকে আমাদের এই পার হওয়ার প্রহসনটা উপভোগ করছে।

    মজিদ সাহেব বললেন–বসুন, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক।

    বললাম–ক’টা বেজেছে দেখুন তো।

    হাতঘড়ি দেখে মজিদ সাহেব বললে–তিনটে বেজে গিয়েছে।

    বসে বিশ্রাম নেবার ষোলো আনা ইচ্ছা থাকলেও বললাম–এমনিতেই সাঁকো পার হতে আমাদের অনেকখানি সময় নষ্ট হয়েছে। তার উপর এখন আবার বিশ্রাম করতে গেলে সকালে মুখার্জির বাংলোয় পৌঁছনো সম্ভব হবে না।

    খুব ছোট বেলায় ঠাকুরমা’র কাছে শোনা বিস্মৃতপ্রায় একটি প্রবাদ বাক্য হঠাৎ মনে পড়লো। মজিদ সাহেবকে বললাম–

    দাঁড়ালে পোয়া, বসলে ক্রোশ,
    পথ বলেন–বাপুহে আমার কি দোষ?

    শুনে মজিদ সাহেব হেসে জবাব দিলেন–খুব সত্যি কথা। এখন এই আধমরা অবস্থায় বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলে পথ দ্বিগুণ বলে মনে হবে।

    চলতে শুরু করলাম। পথ অপেক্ষাকৃত চওড়া ও ঢালু। পাশাপাশি দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে পথ চলেছি। হঠাৎ বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম বাবা মা ছোট ভাইবোনেরা সবাই এখন নিশ্চিন্ত আরামে বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছে, আর আমি? রুদ্ধ অভিমানে চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছতে যাচ্ছি–বিভীষণ বাচ্চা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। আবার কী হলো? অবাক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলাম আবার কি কেউ খাদে পড়ে গেল? না। সবাই তো দাঁড়িয়ে আছে। মজিদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে লাভ নেই, কেননা ‘দাদা কানা ছোটভাই চোখে দেখে না’র মতো তিনি। আমার চেয়ে আনাড়ি। পঞ্চুকে জিজ্ঞাসা করলাম। পঞ্চুর কথা শুনে ভয়ে আমার আর মজিদ সাহেবের হাত-পা পেটের ভিতর ঢুকে যায় আর কি। শুনলাম একপাল বুনো হাতি এই পথ বেয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এখন উপায়? একমাত্র উপায় রাইফেলের কঁকা আওয়াজ করা আর মশাল নেড়ে মুখে অদ্ভুত শব্দ করা। তাতে যদি ভয় পেয়ে হাতির দল মত ও পথ পরিবর্তন করে তাহলে রক্ষে নইলে ঝুপ ঝপ করে খাদের দু’পাশে গড়িয়ে পড়া ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। অগত্যা তাই করতে হলো। রাইফেলটা মজিদ সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে আকাশের দিকে লক্ষ্য করে ফায়ার করলাম গুড়ম-গুড়ম। নিস্তব্ধ জঙ্গলে প্রতিধ্বনি খানিকক্ষণ চলল গুড়ুম গুড়ম। আবার লোড করে ফায়ার করি। ততোক্ষণে আমাদের সঙ্গীদের একজন সব কটা মশাল একসঙ্গে জড়ো করে মাথার ওপর তুলে নাড়ছে আর সবাই দু’হাত মুখে দিয়ে এক অদ্ভুত আওয়াজ করতে শুরু করে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে মানুষে আর হাতিতে বুদ্ধির যুদ্ধ চললো। সবশেষে জয় হলো মানুষের। দেখলাম ঐ বিরাট দেহের তুলনায় বুদ্ধিটা ভগবান হাতিকে একটু কমই দিয়েছে। মুষ্টিমেয় কটা মানুষের ধোঁকাবাজিতে ভুলে ভয় পেয়ে হাতির দল সুড়সুড় করে দু’ পাশের খাদে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    কারো সম্মতির অপেক্ষা না করেই ঝুপ করে পথের উপর বসে পড়ে বললাম–পথ দ্বিগুণ হোক বা তিন গুণ হোক, বেশ খানিকক্ষণ না জিরিয়ে এক পাও নড়বে না। মৌন সম্মতি দিয়ে পাশে বসে মজিদ সাহেব সিগারেট ধরালেন–আমাকেও একটা দিলেন।

    ***

    জঙ্গলের অসংখ্য জানা অজানা পাখি বিচিত্র কলরবে আমাদের অভ্যর্থনা জানালে। ঘন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পুবের আকাশ দেখতে না পেলেও বুঝলাম ভোর হয়েছে। ক্লান্ত অবশ পা দুটো টেনে টেনে হেঁটেই চলেছি, মুখার্জির বাংলোর তবু দেখা নেই। মজিদ সাহেবকে বললাম–এবার শুধু বসে বিশ্রাম নেওয়া নয়, একেবারে শুয়ে পড়তে হবে, আর পারছি না। উত্তরে মজিদ সাহেব কি বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় কানে ভেসে এল বন্দুকের আওয়াজ। ঘুমভাঙা পাখির দল আর্তনাদ করে বাসা ছেড়ে দূর দূরান্তরে উড়ে চলে গেল। আমরা তবুও হাঁটছি, মনে হলো পা দুটো আর আমাদের বশে নেই। ইচ্ছে করলেও থামতে পারবো না। আবার শোনা গেল বন্দুকের আওয়াজ, একটু কাছে। চলা থামিয়ে মজিদ সাহেব কান খাড়া করে দূরাগত বন্দুকের ধ্বনি শুনলেন, তারপর অতিকষ্টে ঐ সাড়ে সাত সের ওজনের রাইফেলটা আকাশের দিকে তুলে ফায়ার করলেন, সারা জঙ্গল কেঁপে উঠলো। একটুখানি চুপচাপ তারপর মনে হলো কারা যেন কথা কইতে কইতে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে। কিছু দূরে দেখা গেল একটা টর্চ ও হ্যারিকেন। ভয়ে নয়, বিস্ময়ে স্থাণুর মতো শুধু চেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে এসে দাঁড়ালো বন্দুক হাতে মুখার্জি আর টর্চ ও হ্যারিকেন হাতে তার দুই আর্দালি। আর কিছু মনে নেই।

    .

    চোখ মেলে দেখি মুখার্জির কাঠের ঘরে ক্যাম্প খাটের উপর নরম বিছনায় একটা লুঙ্গি পরে শুয়ে আছি। ভোরের ঘটনা সব মনে পড়ে গেল। ক্লান্তি ও অবসাদে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে ওরা ধরাধরি করে নিয়ে এসে জামা জুতো খুলে শুইয়ে দিয়েছে। ঘাড় ফেরাতে কষ্ট হচ্ছিলো তবুও জোর করে ঘরের চারপাশে তাকালাম। দেখলাম পশ্চিমদিকে আর একটা ক্যাম্প খাটে লুঙ্গি পরে মজিদ সাহেব দিব্বি আরামে নাক ডাকাচ্ছেন। সর্বাঙ্গ, ব্যথায় টন টন করছিল তবুও জোর করে উঠে বসলাম। সামনে কাঠের টেবিলটার উপর মজিদ সাহেবের হাতঘড়িটা রয়েছে, একটু ঝুঁকে দেখলাম বেলা ঠিক বারোটা। আস্তে আস্তে টেবিলটা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে এক পা দু পা করে বাইরে বারান্দায় এসে কাঠের রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়ালাম। নিচের উঠোনে তখন মাটি খুড়ে গর্ত করে এক অদ্ভুত উনুন তৈরি করে আমাদের সঙ্গীরা প্রকাণ্ড এক ডেকচি মুরগীর মাংস চাপাবার উৎসাহে মেতে উঠেছে। ক্লান্তি বা অবসাদের চিহ্ন ওদের চোখে মুখে কোথাও নেই। উঠোনের উত্তর দিকে রান্নাঘর। আমায় বারান্দায় দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো মুখার্জি। কিছু বলবার আগেই ম্লান হেসে বললাম–ভাবছে, এই অযোগ্য অপদার্থকে পুলিস ডিপার্টমেন্ট কি দেখে নিয়েছিল, না?

    মুখার্জি বললে–না। ভাবছি সামান্য একটু পরিচয়ের সূত্র ধরে মানুষ মানুষের কতো কাজেই না লাগে। মাত্র এক রাত্রের পরিচয় টেকনাফ থানায়। আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি তোমাকে এই গভীর জঙ্গলে অতিথি পাবো।

    চুপ করে রইলাম। মুখার্জি বললে–দত্ত যখন খবর পাঠালে আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি, ভাবলাম ঠাট্টা করেছে। গভীর রাতে হঠাৎ শুনলাম রাইফেলের আওয়াজ, একটা দুটো নয় অনেকগুলো। ভাবলাম নিশ্চয়ই তোমরা কোনো বিপদে পড়েছো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দু’জন আর্দালি সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

    রান্নাঘরের ভিতর থেকে ভক্তিমধুর কণ্ঠে কে যেন গেয়ে উঠলো–

    শিবে, আর কতদিন এ দীনে ঘুরাবে।।
    বিষয় বাসনা, নানা লেনা-দেন এইভাবে
    আর কতদিন এ দীনে ঘুরাবে।।

    চমৎকার গলা। মুখার্জির দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইতেই বললে –ও আমাদের অনন্ত। আমার আর্দালি। বাড়ি ন’দে জেলার কোনো গ্রামে। তিন কুলে কেউ নেই, দিব্বি আছে। ওর গানে স্থান কাল পাত্রের দরকার নেই। ভাব এলেই গান। একদিন দেখি মুরগী রান্না করতে করতে ও কেন গেয়ে কেঁদে ভাসাচ্ছে।

    অনন্ত আবার গেয়ে উঠলো–

    দারা সুত অবিরত, দাও আনো করে রব
    রবি মৃত নিয়ত ভাবে কবে হবে শব,
    আমার কি হবে মা ব্ৰহ্মময়ী,
    গতি নেই মা তোমা বই
    দীন অনন্ত দাসে ঐ চরণে রাখিতে হবে
    ভবে, আর কতদিন এ দীনে ঘুরাবে।

    মিশমিশে কালো আধবয়সী একটি মোটা সোটা লোক বাইরে এসে পঁড়ালো। মুখে সদা-প্রসন্ন হাসি সবসময় লেগেই আছে। পরিচয়ের দরকার হলো না, বুঝলাম এই-ই অনন্ত।

    মুখার্জি বললে–অনন্ত, তোমার গান ধীরাজবাবুর খুব ভালো লেগেছে।

    আভূমি নত হয়ে করজোড়ে নমস্কার করে কাছে এসে দাঁড়ালো অনন্ত। বললাম–চমৎকার গলা তোমার। কতোদিন গানের চর্চা করছো?

    অনন্ত বললে–ছেলেবেলা থেকে যাত্রার দলে গান গাইতাম। বেশ নামও মায়ের আশীর্বাদে হয়েছিল। কিন্তু বরাতে সইলো মা বাবু।

    জিজ্ঞাসা করলাম–কেন?

    এ প্রশ্নের জবাব সঙ্গে সঙ্গে অনন্ত দিলো না। ওর মুখে চোখে তখন একটা বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে। উদাস দৃষ্টিটা দূরে বনের উপর নিবদ্ধ রেখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর ম্লান হেসে বললেআর একঘেয়ে দুঃখের কাহিনী কি আপনাকে ভালো লাগবে? বাবু সব জানেন।

    পাশে চেয়ে দেখি মুখার্জি নেই। কোন কে ঘরে গিয়ে মজিদ সাহেবের সঙ্গে দিব্বি গল্প জুড়ে দিয়েছে।

    অনন্ত বললে–আমি যাই বাবু। ভাত চড়িয়ে এসেছি, হয় তো বা ধরে গেল।

    অনন্তর মতো সদানন্দময় লোকের জীবনে কী এমন ব্যথা লুকিয়ে থাকতে পারে যার জন্যে লোকালয় ছেড়ে এই গভীর জঙ্গলে ও বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে বসেছে। তারই সম্ভক অসম্ভব নানা কল্পনা করতে করতে ঘরে ঢুকলাম।

    মজিদ সাহেবের দেওয়া সিগারেটটায় কষে একটা টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুখার্জি বললে–চমৎকার লোক তোমার এই বন্ধু মজিদ সাহেব। এরকম সঙ্গী পেলে আমি নরকে যেতেও প্রস্তুত।

    হেসে বললাম–নরকের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই কিন্তু তোমাদের মরিআলার মহিমা মর্মে মর্মে গাঁথা আছে। নরক তার কাছে স্বর্গ।

    মজিদ সাহেব ও মুখার্জি একসঙ্গে হেসে উঠলেন। মুখার্জি বললে–মাভৈঃ ধীরাজ। তোমরা নরকের দ্বারদেশে উপস্থিত।

    হকচকিয়ে গেলাম। বললাম–মানে?

    নাটকীয় ভঙ্গিতে মুখার্জি বললে–মানে তোমাদের দুঃখনিশার অবসান কাল সকালেই হবে। দু’ রাত্রি হেঁটে তোমরা বারো আনা পথ মেরে দিয়েছো, মাত্র চার আনা বাকি। অর্থাৎ এখান থেকে মরিআলা দশ বারো মাইলের মধ্যে অর্থাৎ কিনা টেনেটুনে তিন ঘণ্টার জানি।

    ইচ্ছে হচ্ছিলো মুখার্জিকে জড়িয়ে ধরে নাচি। বললাম–আজ যে খবর শোনালি আমি রাজা হলে অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যা দিতাম তোকে।

    এই অরণ্যযাত্রায় আর একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা লাভ করলাম। শহরে-সমাজে ফর্মালিটি বা ভদ্রতার যে মুখোশ পরে আমরা বসে থাকি, শহর থেকে দূরে, সে গভীর অরণ্যই হোক বা অকূল সমুদ্রের বুকেই হোক, বিপদে পড়লে আপনা হতেই সে আবরণ খসে পড়ে যায়, জানতেও পারা যায় না। টেকনাফে একদিনের পরিচয়ে যাদের ‘আপনি’ ‘আজ্ঞে’ ছাড়া চেষ্টা করেও অন্য কিছু বলতে পারিনি–সুদুরে এই বিপদ-সঙ্কুল অরণ্যে কেমন অনায়াসে প্রথম দর্শনেই তাদের ‘তুই’ ‘তুমি’ বলে ফেললাম; যেন বহুদিনের পরিচিত অন্তরঙ্গ বন্ধু।

    খাটের উপর বসে টেবিল থেকে মুখার্জির একটা সিগারেট ধরালাম। মুখার্জি উঠে এসে পাশে বসে বললে–তখন তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবার পর এখানে আসতে আসতে পথে মজিদ সাহেবের কাছে তোমার সব কথাই শুনলাম। ক্ষতি হয় তো কিছুটা হয়েছে কিন্তু লাভটাও কম হয়নি তোমার।

    একটু অবাক হয়ে বললাম–লাভ?

    -হ্যাঁ লাভ। মাথিনকে দু’দিন বাদেও তুমি পাবে। কিন্তু ইতিমধ্যে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে তার দামও কম নয় ভাই।

    প্রসঙ্গ চাপা দেবার জন্য বললাম–আচ্ছা মুখার্জি, দাসের সঙ্গে তো দেখা হলো না? শুনেছিলাম পথে তার বাংলোও পড়বে।

    মুখার্জি বললে–তার বাংলো তোমরা অনেক আগেই ছেড়ে এসেছে। সবচেয়ে খাড়াই ও উঁচু পাহাড় থেকে নেমে দু’দিকে দুটো পথ গিয়েছে। বাঁদিকটা দিয়ে একটু গেলেই দাসের বাংলো পড়ে। তোমর অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, ডানদিকের পথ দিয়ে সোজা চলে এসেছে এই গরীবের কুঁড়ে ঘরে! যা হোক দাসকে খবর পাঠিয়েছি হয় তো দুপুরের মধেই এসে পড়বে।

    জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, তোমার অনন্তর ব্যাপারটা কি বলো তো? বললে–বাবু সব জানেন।

    কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলো মুখার্জি। তারপর বললে সত্যিই ওর জন্যে দুঃখ হয়। লেখাপড়া কিছু শেখেনি। ছেলেবেলায় গলা খুব ভালো ছিল বলে যাত্রার দলে গান গেয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। দেশে জমি জমা যা ছিল তাতে চাকুরি না করলেও ওর বেশ চলে যেতে। বাপ মা ছিল না, সংসারে দূর সম্পর্কের এক বিধবা দিদিই ছিল ওর একমাত্র অবলম্বন। সেই দিদিই একরকম জোর করে অনন্তর বিয়ে দিলো। সুন্দরী বউ, মহানন্দে সংসার পাতলো অনন্ত। বছর তিনেকের মধ্যে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে হলো। বিধবা দিদিও চোখ বুজলেন। এইবার, মুশকিল হলো অনন্তর। যাত্রার নেশা আফিং-এর নেশার মতো ওকে পেয়ে বসেছিল। দিদি থাকতে দলের সঙ্গে ভিন্ গাঁ-এ পালা গাইতে গিয়ে তিন চারদিন কাটিয়ে আসতো। কিন্তু এখন? মহা সমস্যায় পড়লো অনন্ত। মীমাংসা হতেও দেরি হলো না। একে সংসারের অভিজ্ঞতা কম তার উপর ভালো মানুষ। সবার উপরে সুন্দরী অল্প শিক্ষিতা বউ। পরোপকারী হৃদয়বান ঠাকুরপো’র দল হুমড়ি খেয়ে পড়লো অনন্তর উপকার করতে। ঠিক হলো বেশি দিনের জন্য বাইরে গেলে ওরাই স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে দেখাশুনা করবে। ছ’মাস বেশ নির্বিঘ্নে কাটলো। একটা বড় বায়না হওয়ায় দলের সঙ্গে সাত-আট দিনের জন্যে মফস্বলের কোন শহরে আসতে হলো অনন্তকে। ফিরে গিয়ে দেখে শরচ্চন্দ্রের চরিত্রহীন না পড়েও কিরন্ময়ীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে ওর বউ ওরই মধ্যে সব চাইতে কম বয়সী একটি বেকার ঠাকুরপো’কে নিয়ে। ছেলেমেয়ে দুটি সঙ্গে নেয়নি। পরদিন সকালে তাদের কান্না শুনে প্রতিবেশী কেষ্ট বৈরাগীর বউ এসে বাড়ি নিয়ে গিয়েছে। সব শুনে গুম হয়ে বসে রইলো অনন্ত। পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই সান্ত্বনা দিতে এল এবং এ অবস্থায় অচিরেই অনন্তর আর একটি বিয়ে করা বিশেষ দরকার এ কথাটাও বার বার বোঝতে কসুর করলো না। কিন্তু অনন্ত শুধু মাথা নাড়ে। যখন কোনো যুক্তিতেই কেউ অনন্তকে টলাতে পারলো না তখন কেষ্ট বৈরাগীর বউ ছোট ছেলে মেয়েটিকে এনে অনন্তর কোলে বসিয়ে দিয়ে বললে–এদের মুখ চেয়েও অন্তত তোমার বিয়ে করা দরকার। এই দুধের বাছাদের মানুষ করবার জন্য এ ছাড়া অন্য পথই বা কি আছে! অগত্যা দশচক্রে ভগবান ভূত-এর মতো অনন্তকে নীরব সম্মতি দিতেই হলো। উৎসাহী প্রতিবেশীর দল কোমর বেঁধে লেগে গেল অনন্তর ভাঙা ঘর জোড়া লাগাবার মহান ব্রতে। আগেই বলেছি অনন্তর অবস্থা মোটামুটি ভালোই। বছরের খাবার ধান ক্ষেত থেকেই পাওয়া যায় তাছাড়া জমি জমাও আছে। সুন্দরী বয়স্কা পাত্রীর অভাব হলো না। বিয়ের দিন বাকি, গ্রামে কলেয়া দেখা দিলো। দু’দিনের মধ্যে কয়েক ঘণ্টার আগু পিছুতে অনন্তর ছেলে মেয়ে অনন্তপথে, যাত্রা করলো। শেষ বন্ধনটুকুও ছিন্ন হয়ে গেল। এক মাসের মধ্যে বাড়ি, ঘর, জমি জমা বেচে সমস্ত টাকা গাঁয়ের ভাঙা কালী মন্দির সংস্কারের জন্য দান করে একদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলে অনন্ত গা ছেড়ে চলে গেল।

    মুখার্জি চুপ করলো। মজিদ সাহেব ও আমি রুদ্ধ নিঃশাসে বসে আছি। একটা সিগারেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ নিঃশব্দে ধুমপান করলো মুখার্জি তারপরে কোনো দিকে না চেয়ে বলতে লাগলো পরের ইতিহাস খুব জটিল নয়। হঠাৎ একদিন চিটাগং শহরে অনন্তর সঙ্গে আমার দেখা। কেঁদে পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললো আমায় যে কোনো একটা চাকরি দিয়ে আপনার সঙ্গে নিয়ে চলুন বাবু। বললাম–আমি বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই, হাতি, বাঘ, সাপ এরাই আমার প্রতিবেশী। সেখানে তুমি? বাধা দিয়ে বলে উঠলো–তারা মানুষের চেয়ে অনেক ভালো বাবু। হিংসে করলে তবে অনিষ্ট করে। আর মানুষ ওদের চেয়েও হিংস্র। কিছু না করলেও সর্বনাশ করে বসে। বললাম–কিন্তু তুমি বিয়ে করেছে, তোমার স্ত্রী ছেলে মেয়ে, তাঁদের কে দেখবে? উত্তর না দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে অনন্ত। সেইদিনই ওর গাঁয়ের একজন লোকের মুখে সব শুনলাম। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চাকরি বিশেষ করে আর্দালির কাজ যোগাড় করতে কষ্ট হয় না। সহজেই ওর কাজ হয়ে গেল। সেই থেকে ও আমার কাছেই আছে।

    আবার চুপ করলে মুখার্জি। ভাবলাম কাহিনী শেষ হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে চেয়ে মুখার্জি বললে–ভাবছে, সামান্য একটা আর্দালি-তার জীবনের খুঁটিনাটি এতো কথা আমি জানলাম কি করে? অনন্ত আমারই গাঁয়ের লোক-–আর…। গলাটা ধরে এল মুখার্জির। কেসে গলা পরিষ্কার করে আমাদের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালো মুখার্জি। তারপর বললে–আর যে ছেলেটি ওর সুন্দরী স্ত্রীকে কুলের বার করে নিয়ে গিয়েছিল সে আমারই গুণধর ছোট ভাই। হতভাগা বছরখানেক হলো টি. বি-তে মারা গিয়েছে। অনন্তর স্ত্রী এখন চিটাগং-এ রেয়াজুদ্দিন গলিতে মালতী নাম নিয়ে পতিতাবৃত্তি করছে।

    খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম থেকে উঠলাম বিকেল পাঁচটায়। শুনলাম, দাস আসতে পারেনি। লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছে, গাছ কাটতে গিয়ে তার একজন মজুর প্রকাণ্ড শাল গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছে। সেই হাঙ্গামায় খুব ব্যস্ত। মুখার্জিকে বার বার করে বলে পাঠিয়েছে, ফেরবার পথে আমরা যেন অতি অবশ্য ওর বাংলো হয়ে যাই। সন্ধ্যার আগে দেখি, আমাদের সঙ্গীরা রান্না চাপিয়ে দিয়েছে। মুখার্জি বললে–তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না। রাত্রে খেয়ে দেয়ে তোফ দু’ তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও। তারপর রাত্রি বানোটা একটায় যাত্রা করো। হেসেখেলে ভোরের আগে মরিআলায় পৌঁছে যাবে।

    তাই ঠিক হলো। রাত আটটায় খেয়ে নিয়ে আবার ঘুম দিলাম। ঠিক বারোটায় মুখার্জি ডেকে দিলে। উঠে প্রস্তুত হয়ে মশাল জ্বেলে রওনা হলাম যখন তখন একটা বাজে। মুখার্জি বলে দিলে যে, পথে আর বিশেষ কষ্ট হবে না, পথও চওড়া। আর এবার থেকে শুধু নিচের দিকেই নামতে হবে বেশি। কাজেই খাড়া উপর দিকে ওঠার হাত থেকে এবার খানিকটা রেহাই পাবে। অনেক বারণ করা সত্ত্বেও মুখার্জি খানিকটা পথ বন্দুক ও টর্চ নিয়ে এগিয়ে দিয়ে গেল। অনন্তকে আসবার সময় দেখতে পেলাম না–ভাবলাম বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। মিনিট তিনেক হাঁটার পর পথ যেখানটায় ডানদিকে মোড় নিয়েছে, সেইখানে মুখার্জিকে বিদায় দিলাম।

    প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গিয়েছে। নিঃশব্দে শুধু হেঁটেই চলেছি, হঠাৎ নিস্তব্ধ রাতের মৌনতা ভেঙে কানে ভেসে এল অনন্ত দাসের অপূর্ব দরদী গলার গান।

    ‘আমি কি তোর কেহ নই তারা?
    (তবে) মা মা বলিয়া কেন হই মা সারা।’

    আমার মনের কথার প্রতিধ্বনি করে মজিদ সাহেব বললেন–দাঁড়ান ধীরাজবাবু। গানটা শুনি। সঙ্গীদেরও থামতে বলে দিলাম। শুনলাম, তারামায়ের উদ্দেশ্যে অভিমান-ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অনন্ত রাস আকুল হয়ে কাঁদছে :

    ‘দিবস রজনী ডাকি মা মা বলে,
    মা তুমি একবার চাও না আমায় ভুলে।
    আর কি হবে তারা ডাকলে মা মা বলে
    দিন তো আমার মাগো হলো সারা।
    আমি কি তোর কেহ নই তারা।’

    গান শেষ হয়ে গেল। খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর ভারী মন নিয়ে আস্তে আস্তে মরিআলার পথে পা বাড়ালাম।

    ***

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleটোটেম ও টাবু – সিগমুন্ড ফ্রয়েড (ভাষান্তর : ধনপতি বাগ)
    Next Article যখন নায়ক ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

    Related Articles

    ধীরাজ ভট্টাচার্য

    যখন নায়ক ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

    August 30, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণের নবনীতা – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    ভ্রমণ সমগ্র ১ – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.