Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রঙ্কিনীদেবীর খড়গ

    বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভৌতিক গল্প এক পাতা গল্প9 Mins Read0

    রঙ্কিনীদেবীর খড়গ

    জীবনে অনেক জিনিস ঘটে, যাহার কোনো যুক্তিসংগত কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তাহাকে আমরা অতিপ্রাকৃত বলিয়া অভিহিত করি। জানি না, হয়তো খুঁজিতে জানিলে তাহাদের সহজ ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কারণ বাহির করা যায়। মানুষের বিচার-বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতালব্ধ কারণগুলি ছাড়া অন্য কারণ হয়তো আমাদের থাকিতে পারে; ইহা লইয়া তর্ক উঠাইব না। শুধু এইটুকু বলিব, সেরূপ কারণ যদিও থাকে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দ্বারা তাহা আবিষ্কার হওয়া সম্ভব নয় বলিয়াই তাহাদিগকে অতিপ্রাকৃত বলা হয়।

    আমার জীবনে এক বার এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছিল, যাহার যুক্তিযুক্ত কারণ তখন বা আজ কোনোদিনই খুঁজিয়া পাই নাই। পাঠকের কাছে তাই সেটি বর্ণনা করিয়াই আমি খালাস, তাঁহারা যদি সে-রহস্যের কোনো স্বাভাবিক সমাধান নির্দেশ করিতে পারেন, যথেষ্ট আনন্দ লাভ করিব।

    ঘটনাটি এবার বলি—

    কয়েক বছর আগেকার কথা। মানভূম জেলার চেরো নামক গ্রামের মাইনর স্কুলে তখন মাস্টারি করি।

    প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া রাখি, চেরো গ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য এমনতর যে, এখানে কিছুদিন বসবাস করিলে বাংলাদেশের একঘেয়ে সমতল ভূমির কোনো পল্লি আর চোখে ভালো লাগে না। একটি অনুচ্চ পাহাড়ের ঢালু সানুদেশ জুড়িয়া লম্বালম্বিভাবে সারা গ্রামের বাড়িগুলি অবস্থিত। সর্বশেষ বাড়িগুলির খিড়কি দরজা খুলিলেই দেখা যায় পাহাড়ের উপরকার শাল, মহুয়া, কুর্চি, বিল্ববৃক্ষের পাতলা জঙ্গল, একটা সুবৃহৎ বটগাছ ও তাহার তলায় বাঁধানো-বেদি, ছোটো-বড়ো শিলাখণ্ড ও ভেলা-কাঁটার ঝোপ।

    আমি যখন প্রথম ও-গ্রামে গেলাম, তখন একদিন পাহাড়ের মাথায় বেড়াইতে উঠিয়া এক জায়গায় শালবনের মধ্যে একটি পাথরের ভাঙা মন্দির দেখিতে পাইলাম।

    সঙ্গে ছিল আমার দু-টি উপরের ক্লাসের ছাত্র, তাহারা মানভূমের বাঙালি। একটা কথা— চেরো গ্রামের বেশিরভাগ অধিবাসী মাদ্রাজি, যদিও তাহারা বেশ বাংলা বলিতে পারে। অনেকে বাংলা আচার-ব্যবহারও অবলম্বন করিয়াছে। কী করিয়া মানভূম জেলার মাঝখানে এতগুলি মাদ্রাজি অধিবাসী আসিয়া বসবাস করিল, তাহার ইতিহাস আমি বলিতে পারি না।

    মন্দিরটি কালো পাথরের এবং একটু অদ্ভুত গঠনের। অনেকটা যেন চাঁচড়া রাজবাড়ির দশমহাবিদ্যার মন্দিরের মতো ধরনটা। এ-অঞ্চলে এরূপ গঠনের মন্দির আমার চোখে পড়ে নাই। তা ছাড়া মন্দিরটি সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত ও বিগ্রহশূন্য। দক্ষিণের দেওয়ালের পাথরের চাঁই কিয়দংশ ধসিয়া পড়িয়াছে, দরজা নাই, শুধু আছে পাথরের চৌকাঠ। মন্দিরেরর মধ্যেও চারিপাশে বনতুলসীর ঘন জঙ্গল— সান্ধ্য আকাশের পটভূমিতে সেই পাথরের বিগ্রহহীন ভাঙা মন্দির আমার মনে কেমন এক অনুভূতির সঞ্চার করিল। আশ্চর্যের বিষয়, অনুভূতিটা ভয়ের। ভাঙা মন্দির দেখিয়া মনে ভয় কেন হইল— এ-কথা তারপর বাড়ি ফিরিয়া অবাক হইয়া ভাবিয়াছি। তবুও অগ্রসর হইয়া যাইতেছিলাম মন্দিরটি ভালো করিয়া দেখিতে, একজন ছাত্র বাধা দিয়া বলিল— যাবেন না স্যার ওদিকে।

    —কেন?

    —জায়গাটা ভালো নয়। সাপের ভয় আছে সন্ধে বেলা। তা ছাড়া লোকে বলে অনেকরকম ভয়-ভীতি আছে, মানে অমঙ্গলের ভয়। কেউ ওদিকে যায় না।

    —ওটা কী মন্দির?

    —ওটা রঙ্কিনীদেবীর মন্দির, স্যার। কিন্তু আমাদের গাঁয়ের বুড়ো লোকেরাও কোনোদিন ওখানে পুজো হতে দেখিনি, মূর্তিও নেই বহুকাল। ওইরকম জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদার আমলেরও আগে।…চলুন স্যার, নামি।

    ছেলেটা যেন একটু বেশি তাড়াতাড়ি করিতে লাগল নামিবার জন্য।

    রঙ্কিনীদেবী বা তাঁহার মন্দির সম্বন্ধে দু-একজন বৃদ্ধ লোককে ইহার পর প্রশ্নও করিয়াছিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় লক্ষ করিয়াছি, তাহারা কথাটা এড়াইয়া যাইতে চায় যেন; আমার মনে হইয়াছে রঙ্কিনীদেবী সংক্রান্ত কথাবার্তা বলিতে তাহারা ভয় পায়।

    আমিও আর সে-বিষয়ে কাহাকেও কিছু জিজ্ঞাসা করা ছাড়িয়া দিলাম। বছর খানেক কাটিয়া গেল।

    স্কুলে ছেলে কম, কাজকর্ম খুব হালকা, অবসর সময়ে এ-গ্রামে ও-গ্রামে বেড়াইয়া এ-অঞ্চলে প্রাচীন পট, পুথি, ঘট ইত্যাদি সংগ্রহ করিতে লাগিলাম। এ বাতিক আমার অনেক দিন হইতেই আছে। নূতন জায়গায় আসিয়া বাতিকটা বাড়িয়া গেল।

    .

    চেরো গ্রাম হইতে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে জয়চণ্ডী পাহাড়। এখানে খাড়া উঁচু একটা অদ্ভুত গঠনের পাহাড়ের মাথায় জয়চণ্ডী ঠাকুরের মন্দির আছে। পৌষ মাসে বড়ো মেলা বসে। বি এন আর লাইনের একটা ছোটো স্টেশনও আছে এখানে।

    এই পাহাড়ের কাছে একটা ক্ষুদ্র বস্তিতে কয়েক ঘর মানভূম প্রবাসী ওড়িয়া ব্রাহ্মণের বাস। ইহাদের মধ্যে চন্দ্রমোহন পাণ্ডা নামে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সঙ্গে আমার খুব আলাপ হইয়া গেল। তিনি বাঁকা-বাঁকা মানভূমের বাংলায় আমার সঙ্গে অনেক রকমের গল্প করিতেন। পট-পুথি সংগ্রহের অবকাশে আমি জয়চণ্ডীতলা গ্রামে চন্দ্রমোহন পাণ্ডার নিকট বসিয়া তাঁহার মুখে এদেশের কথা শুনিতাম। চন্দ্রপাণ্ডা আবার স্থানীয় ডাকঘরের পোস্টমাস্টারও। এ-দেশে প্রচলিত কতরকম আজগুবি ধরনের সাপের, ভূতের, ডাকাতের ও বাঘের (বিশেষ করিয়া বাঘের, কারণ বাঘের উপদ্রব এখানে খুব বেশি) গল্প যে বৃদ্ধ চন্দ্রপাণ্ডার মুখে শুনিয়াছি, এবং এইসব গল্প শুনিবার লোভে কত আষাঢ়ের ঘন বর্ষার দিনে বৃদ্ধ পোস্টমাস্টারের বাড়িতে গিয়া যে হানা দিয়াছি, তাহার হিসাব দিতে পারিব না।

    মানভূমের এইসব অরণ্য অঞ্চল সভ্য জগতের কেন্দ্র হইতে দূরে অবস্থিত। এখানকার জীবনযাত্রাও একটু স্বতন্ত্র ধরনের। যতই অদ্ভুত ধরনের গল্প হউক, জয়চণ্ডী পাহাড়ের ছায়ায় শালবনবেষ্টিত ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বৃদ্ধ চন্দ্রপাণ্ডার বাঁকা-বাঁকা মানভূমের বাংলায় সেগুলি শুনিবার সময় মনে হইত— এদেশে এরূপ ঘটিবে ইহা আর বিচিত্র কী! কলিকাতা তথা বালিগঞ্জের কথা তো ইহা নয়!

    কথায় কথায় চন্দ্রপাণ্ডা একদিন বলিলেন— চেরো পাহাড়ের রঙ্কিনীদেবীর মন্দির দেখেছেন?

    আমি একটু আশ্চর্য হইয়া বৃদ্ধের মুখের দিকে চাহিলাম। রঙ্কিনীদেবী সম্বন্ধে এ-পর্যন্ত আমি আর কোনো কথা কাহারও মুখে শুনি নাই, সেদিন সন্ধ্যায় আমার ছাত্রটির নিকট যাহা সামান্য কিছু শুনিয়াছিলাম, তাহা ছাড়া।

    বলিলাম— মন্দির দেখেছি, কিন্তু রঙ্কিনীদেবীর কথা জানবার জন্যে যাকেই জিজ্ঞেস করেছি, সে-ই চুপ করে গিয়েছে কিংবা অন্য কথা পেড়েছে।

    চন্দ্রপাণ্ডা বললেন— রঙ্কিনীদেবীর নামে সবাই ভয় পায়।

    —কেন বলুন তো?

    —মানভূম জেলায় আগে অসভ্য বুনো জাত বাস করত। তাদেরই দেবতা উনি। ইদানীং হিন্দুরা এসে যখন বাস করলে, উনি হিন্দুদেরও ঠাকুর হয়ে গেলেন। তখন তাদের মধ্যে কেউ মন্দির করে দিলে। কিন্তু রঙ্কিনীদেবী হিন্দু দেব-দেবীর মতো নয়। অসভ্য বন্য জাতির ঠাকুর। আগে ওই মন্দিরে নরবলি হত— ষাট বছর আগেও রঙ্কিনী মন্দিরে নরবলি হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করে, রঙ্কিনীদেবী অসন্তুষ্ট হলে রক্ষা নেই; অপমৃত্যু আর অমঙ্গল আসবে তাহলে। এরকম অনেকবার হয়েছে নাকি। একটা প্রবাদ আছে এ-অঞ্চলে, দেশে মড়ক হবার আগে রঙ্কিনীদেবীর হাতের খাঁড়া রক্তমাখা দেখা যেত। আমি যখন প্রথম এদেশে আসি, সে আজ চল্লিশ বছর আগেকার কথা, তখন প্রাচীন লোকদের মুখে একথা শুনেছিলাম।

    —রঙ্কিনীদেবীর বিগ্রহ দেখেছিলেন মন্দিরে?

    —না, আমি এসে পর্যন্ত ওই ভাঙা মন্দিরই দেখছি। এখান থেকে কারা বিগ্রহটি নিয়ে যায়, অন্য কোনো দেশে। রঙ্কিনীদেবীর এসব কথা আমি শুনতাম ওই মন্দিরের সেবাইত এক বৃদ্ধের মুখে। তাঁর বাড়ি ছিল এই চেরো গ্রামেই। আমি প্রথম যখন এদেশে আসি, তখন তাঁর বাড়ি অনেকবার গিয়েছি। দেবীর খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার কথাও তাঁর মুখে শুনি। এখন তাঁদের বংশে আর কেউ নেই। তারপর চেরো গ্রামেই আর বহুদিন যাইনি; বয়স হয়েছে, বড়ো বেশি কোথাও বেরোইনে।

    —বিগ্রহের মূর্তি কী?

    —শুনেছিলাম কালীমূর্তি। আগে নাকি হাতে সত্যিকার নরমুণ্ড থাকত অসভ্যদের আমলে। কত নরবলি হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। এখনও মন্দিরের পেছনে জঙ্গলের মধ্যে একটা ঢিবি আছে, খুঁড়লে নরমুণ্ড পাওয়া যায়।

    সাধে এ-দেশের লোক ভয় পায়! শুনিয়া সন্ধ্যার পরে জয়চণ্ডীতলা হইতে ফিরিবার পথে আমারই গা ছম-ছম করিতে লাগিল।

    .

    আরও বছর-দুই সুখে-দুঃখে কাটিল। জায়গাটা আমার এত ভালো লাগিয়াছিল যে হয়তো সেখানে আরও অনেক দিন থাকিয়া যাইতাম; কিন্তু স্কুল লইয়াই বাঙালিদের সঙ্গে মাদ্রাজিদের বিবাদ বাধিল। মাদ্রাজিরা স্কুলের জন্য বেশি টাকাকড়ি দিত, তাহারা দাবি করতে লাগল কমিটিতে তাদের লোক বেশি থাকিবে, ইংরাজির মাস্টার একজন মাদ্রাজি রাখিতেই হইবে, ইত্যাদি। আমি ইংরাজি পড়াইতাম, মাঝে হইতে আমার চাকুরিই রাখা দায় হইয়া উঠিল। এই সময়ে আমাদের দেশে একটা হাই স্কুল হইয়াছিল, পূর্বে একবার তাহারা আমাকে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল, ম্যালেরিয়ার ভয়ে যাইতে চাহি নাই। এখন বেগতিক বুঝিয়া দেশে চিঠি লিখিলাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত এসব কারণে চেরো গ্রামের মাস্টারি আমায় ছাড়িতে হয় নাই। কীসের জন্য ছাড়িয়া দিলাম পরে সে কথা বলিব।

    এমন সময় একদিন চন্দ্রপাণ্ডা চেরো গ্রামে কী কার্য উপলক্ষ্যে আসিলেন। আমি তাঁহাকে অনুরোধ করিলাম, আমার বাসায় একটু চা খাইতে হইবে। তাঁহার গোরুর গাড়িসমেত তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া বাসা বাড়িতে আনিলাম।

    বৃদ্ধ ইতিপূর্বে কখনো আমার বাসায় আসেন নাই। বাড়িতে ঢুকিয়াই চারিদিকে চাহিয়া বিস্ময়ের সুরে বলিলেন— এই বাড়িতে থাকেন আপনি?

    বলিলাম— আজ্ঞে হ্যাঁ, ছোট্ট গাঁ, বাড়ি তো পাওয়া যায় না; আগে স্কুলের একটা ঘরে থাকতাম। বছর খানেক হল স্কুলের সেক্রেটারি রঘুনাথন এটা ঠিক করে দিয়েছেন।

    পুরোনো আমলের পাথরের গাঁথুনির বাড়ি। বেশ বড়ো বড়ো তিনটি কামরা, একদিকে একটা যাতায়াতের বারান্দা। জবরদস্ত গড়ন, যেন খিলজিদের আমলের দুর্গ কী জেলখানা; হাজার ভূমিকম্পেও এ বাড়ির একটু চুন-বালি খসাইতে পারিবে না। বৃদ্ধ বসিয়া আবার বাড়িটার চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। ভাবিলাম বাড়িটার গড়ন তাঁহার ভালো লাগিয়াছে। বলিলাম— সেকালের গড়ন, খুব টনকো, আগাগোড়া পাথরের…

    চন্দ্রপাণ্ডা বললেন— না সেজন্য নয়। আমি এই বাড়িতে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যথেষ্ট যাতায়াত করতাম। এই বাড়িই হল রঙ্কিনীদেবীর সেবাইত বংশের। ওদের বংশে এখন আর কেউ নেই। আপনি যে এ বাড়িতে আছেন তা জানতাম না। তা বেশ বেশ। অনেক দিন পরে বাড়িতে ঢুকলাম কিনা, তাই বড়ো অদ্ভুত লাগছে। তখন বয়েস ছিল ত্রিশ, এখন প্রায় ষাট। তারপর অন্যান্য কথা আসিয়া পড়িল। চা পান করিয়া বৃদ্ধ গোরুর গাড়িতে গিয়া উঠিলেন।

    আরও বছর খানেক কাটিয়াছে। দেশের স্কুলে চাকুরির আশ্বাস পাইলেও আমি যাই নাই। কারণ এখানকার বাঙালি-মাদ্রাজি সমস্যা একরূপ মিটিয়া আসিয়াছে। আপাতত আমার চাকুরিটা বজায় রহিল বলিয়াই তো মনে হয়।

    চৈত্র মাসের শেষ।

    পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরবর্তী এক গ্রামে আমারই এক ছাত্রের বাড়িতে অন্নপূর্ণা পূজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম। মধ্যে রবিবার পড়াতে শনিবার গোরুর গাড়ি করিয়া রওনা হই, রবিবার ও সোমবার থাকিয়া মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বাসায় আসিয়া পৌঁছিলাম।

    বলা আবশ্যক, বাসায় আমি একাই থাকি। স্কুলের চাকর রাখোহরিকে আমি সঙ্গে করিয়া লইয়া গিয়াছিলাম। বাহিরের দরজার তালা খুলিয়াই রাখোহরি বলিয়া উঠিল— এঃ! এ কীসের রক্ত! দেখুন—

    প্রায় চমকিয়া উঠিলাম!

    তাই বটে! বাহিরের দরজার চৌকাঠের ঠিক ভিতর দিক হইতেই রক্তের ধারা উঠান বাহিয়া যেন চলিয়াছে। একটানা ধারা নয়, ফোঁটা-ফোঁটা রক্তের একটা অবিচ্ছিন্ন সারি। একেবারে টাটকা রক্ত— এইমাত্র সদ্য কাহারও মুণ্ড কাটিয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছে।

    আমি তো অবাক! কীসের রক্তের ধারা এ! কোথা হইতে-বা আসিল? আজ দু-দিন তো বাসা বন্ধ ছিল। বাড়ির ভিতরের উঠানে রক্তের দাগ আসে কোথা হইতে? তাহার উপর সদ্য তাজা রক্ত!

    অবশ্য কুকুর, বিড়াল ও ইঁদুরের কথা মনে পড়িল। এ ক্ষেত্রে পড়াই স্বাভাবিক। চাকরকে বলিলাম— দেখ তো রে, রক্তটা কোন দিকে যাচ্ছে; এ সেই হুলো বেড়ালটার কাজ।

    রক্তের ধারা গিয়াছে দেখা গেল সিঁড়ির নীচে চোরকুঠরির দিকে। ছোট্ট ঘর, ভীষণ অন্ধকার এবং যত রাজ্যের ভাঙাচোরা পুরোনো মালে ভরতি বলিয়া আমি কোনোদিন চোরকুঠুরি খুলি নাই। চোরকুঠুরির দরজা পার হইয়া বন্ধ ঘরের মধ্যে ধারাটার গতি দেখিয়া ব্যাপার কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কতকাল ধরিয়া ঘরটা তালাবন্ধ, যদি বিড়ালের ব্যাপারই হয়, বিড়াল ঢুকিতেও তো ছিদ্রপথ দরকার হয়।

    চোরকুঠুরির তালা লোহার শিকের চাড় দিয়ে খোলা হইল। আলো জ্বালিয়া দেখা গেল ঘরটায় পুরোনো, ভাঙা, তোবড়ানো টিনের বাক্স, পুরোনো ছেঁড়া গদি, খাটের পায়া, মরিচা-ধরা সড়কি, ভাঙা টিন, শাবল প্রভৃতি ঠাসবোঝাই। ঘরের মেঝেতে সোজা রক্তের দাগ এক কোণের দিকে গিয়াছে। রাখোহরি খুঁজিতে খুঁজিতে হঠাৎ চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল— একী বাবু! এদিকে কী করে এমনধারা রক্ত লাগল!

    তারপর সে কী-একটা জিনিস হাতে তুলিয়া ধরিয়া বলিল— দেখুন কাণ্ডটা বাবু!

    জিনিসটাকে হাতে লইয়া সে বাহিরে আসিতে তাহার হাতের দিকে চাহিয়া আমি চমকিয়া উঠিলাম।

    একখানা মরিচা-ধরা হাতলবিহীন ভাঙা খাঁড়া বা রামদা— আগার দিকটা চওড়া ও বাঁকানো, বড়ো চওড়া ফলাটা তাহার রক্তে টকটকে রাঙা। একটু একটু রক্ত নয়, ফলাতে আগাগোড়া রক্ত মাখানো। মনে হয় যেন খাঁড়াখানা হইতে এমনি টপ-টপ করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িবে।

    সেই মুহূর্তে একসঙ্গে আমার অনেক কথা মনে হইল। দুই বৎসর পূর্বে চন্দ্রপাণ্ডার মুখে শোনা সেই গল্প। রঙ্কিনীদেবীর সেবাইত বংশের ভদ্রাসন বাড়ি এটা। পুরোনো জিনিসের গুদাম এই চোরকুঠুরিতে রঙ্কিনীদেবীর হাতের খাঁড়াখানা তাহারাই রাখিয়া ছিল হয়তো। মড়কের আগে বিগ্রহের খাঁড়া রক্তমাখা হওয়ার প্রবাদ।…

    আমার মাথা ঘুরিয়া উঠিল।

    .

    মড়ক কোথায় ভাবিতে পারিতাম, যদি সময় পাইতাম সন্দেহ করিবার। কিন্তু তাহা পাই নাই। পরদিন সন্ধ্যার সময় চেরো গ্রামে প্রথম কলেরা রোগের খবর পাওয়া গেল। তিনদিনের মধ্যে রোগ ছড়াইয়া মড়ক দেখা দিল। প্রথমে চেরো, তারপর পাশের গ্রাম কাজরা। ক্রমে জয়চণ্ডীতলা পর্যন্ত মড়ক বিস্তৃত হইল। লোক মরিয়া ধূলধাবাড় হইতে লাগিল। চেরো গ্রামের মাদ্রাজি বংশ প্রায় কাবার হইবার জোগাড় হইল।

    মড়কের জন্য স্কুল বন্ধ হইয়া গেল। আমি দেশে পলাইয়া আসিলাম, তারপর আর কখনো চেরোতে যাই নাই। গ্রীষ্মের বন্ধের পূর্বেই দেশের স্কুলের চাকুরিটা পাইয়াছিলাম।

    সেই হইতে রঙ্কিনীদেবীকে মনে মনে ভক্তি করি। তিনি অমঙ্গলের পূর্বাভাস দিয়া সকলকে সতর্ক করিয়া দেন মাত্র। মূর্খ জনসাধারণ তাঁহাকেই অমঙ্গলের কারণ ভাবিয়া ভুল বোঝে।

    আশ্বিন ১৩৪৭, মৌচাক

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমেডেল
    Next Article রহস্য

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    অসাধারণ | Ashadharon

    April 3, 2025
    ধীরেন্দ্রলাল ধর ভৌতিক গল্প

    তান্ত্রিক

    March 13, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    পথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    February 27, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }