Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রত্নদীপ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

    প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এক পাতা গল্প285 Mins Read0

    রত্নদীপ – ৩য় খণ্ড

    তৃতীয় খণ্ড

    ০১. দুই কথা

    খুস্রুপুরে রাখালের কর্মের শেষদিন ক্রমে উপস্থিত হইল। ভৃত্য ও পাঁচকের বেতনাদি শোধ করিয়া, বাজারের দেনা মিটাইয়া, জিনিসপত্র বাধিয়া বন্ধুবান্ধবের নিকট বিদায় গ্রহণ করিয়া রাখাল পশ্চিমের গাড়ীতে আরোহণ করিল।

    গাড়ীর কাছে দাঁড়াইয়া স্টেশনমাষ্টারবাবু ছল–ছল নেত্রে কহিলেন, বাড়ী যাবার সময় এই পথে যাবেন ত? যাবার সময় নেমে, খাওয়া–দাওয়া করে যাবেন।

    রাখাল বলিল, যদি বেঁচে থাকি।

    গাড়ী ছাড়িয়া দিল।

    জানালার কাছে বসিয়া রাখাল মনে মনে বলিল, যদি বেঁচে থাকি, তবেই দেখাশুনো করে যাব। কিন্তু বেঁচে থাকলে ত? রাখাল ভট্টচায্যির জীবন আর কতক্ষণ? এই কয়েকটা ষ্টেশনে চেনাশুনো লোক আছে–দেখা হবে–দেখা হলেই তারা আমায় রাখাল বলে ডাকবে। মোগলসরাই পৰ্য্যন্ত–তার পর আর কেউ চেনা লোক নেই। মোগলসরাই পার হলেই, আমার পুনর্জন্ম–আমি আর তখন ময়নামতী গ্রামের হতভাগ্য রাখাল ভট্টচায্যি নই–আমি ভবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়–নদীয়া জেলায় বাশুলিপাড়া গ্রামের প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার–বছরে লক্ষ টাকা আয়। এ পৃথিবী থেকে রাখাল ভটচায্যির নাম, আর এই কয়েক ঘণ্টা পরেই লোপ পাবে।

    গাড়ী চলিতে লাগিল। প্যাসেঞ্জার গাড়ী–প্রত্যেক ষ্টেশনেই থামিয়া থামিয়া যাইতেছে। প্রায় প্রত্যেক ষ্টেশনেই রাখালের পরিচিত লোক–স্টেশনমাষ্টার, ছোটবাবু, তারবাবু প্রভৃতি আসিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল–রাখালবাবু, কি হয়েছিল বলুন ত? –রাখালবাবু যে–আহা চাকরিটি গেল!–আমরা শুনে বড়ই দুঃখিত হয়েছি–তা যাক, সব লাইনে একখানা করে দরখাস্ত করে দিগে–আবার চাকরী হবে–ইত্যাদি। আবার, কোন কোনও ষ্টেশনের লোক রাখালের পদচ্যুতির কথা শুনে নাই–তাহারা। আসিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল–কিহে রাখাল, কোথায় চলেছ? –বদলি হলে নাকি? ছুটি নিয়েছ? –ইত্যাদি। প্রকৃত কথা শুনিয়া তাহারা বলিতে লাগিল–আঁ! চাকরি গেছে? বল কি? আমরা কিছুই শুনিনি। আহাহা, বড়ই দুঃখের বিষয়। রেলের চাকরি পদ্মপত্রের জল–এই আছে এই নেই। –ইত্যাদি।

    গাড়ী ছাড়িলে রাখাল মনে মনে হাসে এবং তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে নানাবিধ জল্পনাকল্পনা করিতে থাকে। কাশী যাইবে বলিয়া সে বাহির হইয়াছিল–কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া, প্রথমে এলাহাবাদ যাওয়াই স্থির করিল। মোগলসরাই ষ্টেশনে গাড়ী থামিলে, জিনিষপত্র একজন সহযাত্রীর জিম্মায় রাখিয়া গিয়া সে কাশীর পাসখানি স্টেশনমাষ্টারকে দিল এবং এলাহাবাদের টিকিট কিনিয়া আনিল।

    পরদিন প্রাতে এলাহাবাদ পৌঁছিয়া রাখাল নিকটস্থ ধৰ্ম্মশালায় গিয়া বাসা লইল। স্টেশন হইতে একপাল পাণ্ডা তাহার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিল, রাখাল ক্রমাগত তাহাদিগকে বলিতে লাগিল–সে তীর্থ করিতে আসে নাই, সহর দেখিতে আসিয়াছে, পাণ্ডার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। তথাপি তাহারা নাছোড়বান্দা। অনেক কষ্টে রাখাল তাহাদিগকে তাড়াইল, কেবল এক ব্যক্তি কিছুতেই গেল না। সে বলিল, আমার নাম, এক কথাওয়ালা ঠাকুর–আমার এক কথা। বঙ্গদেশে জিলায় জিলায় সকলেই আমার নাম জানে, এই দেখুন বাবু আমার সাটিফিটিক আছে। –বলিয়া একখানি বাঙ্গালায় মুদ্রিত বিজ্ঞাপন রাখালের হস্তে দিল। তাহা পাঠ করিয়া রাখাল জানিল, এক–কথাওয়ালা ঠাকুরটি কলিযুগের দ্বিতীয় যুধিষ্ঠির বিশেষ–ভারতে তাহার তুলনা নাই। যে কোনও স্থান হইতে তাহাকে টেলিগ্রাম করিতে হইলে, এক–কথাওয়ালা এলাহাবাদ, লিখিলেই যথেষ্ট–টেলিগ্রাম ঠিক পৌঁছিবে। অধিকাংশ লোক বিজ্ঞাপনে এই কথা পড়িয়া ভাবে, এক–কথাওয়ালা ঠাকুরটি সাধারণ লোক নহে–সে সরকারের জানিত ব্যক্তি পাণ্ডাগগনের ধ্রুবতারা। কিন্তু রাখালের কাছে চালাকি ব্যর্থ হইলে; কারণ সে জানে, ষান্মাসিক পাঁচ টাকা ফি দিলেই তারঘরে সাঙ্কেতিক ঠিকানা রেজেষ্টারি হইয়া থাকে। এই সমস্ত পাঠ করিয়াও রাখালের যখন মন ভিজিল না, তখন পাণ্ডা ঠাকুর বলিতে লাগিল, বাবু আপনি হিন্দু আদমি–হিন্দু ধরম হয়ে, প্রয়াগে শুধু সহর দেখে চলে যাবেন, এও কি একটা কথা হল? শাস্ত্রে আছে

    প্রয়াগে মুড়ায়ে মাথা
    মরগে পাপী যেথা সেথা।

    এখান থেকে যদি মাথাটি মুড়ায়ে যান, তা হলে আর কোন ভাবনা রইল না। যেখানেই মৃত্যু হোক, আপনার বৈকুণ্ঠবাস হবে। দেশে হোক, বিদেশে হোক, বনে–জঙ্গলে পাহাড়ে

    রাখাল হাসিয়া বাধা দিয়া বলিল, গো ভাগাড়ে।

    ঠাকুর বলিল, হ্যাঁ–আবৎ। যদি গোভাগাড়েও আপনার মৃত্যু হয়–তা হলেও বৈকুণ্ঠবাস হবে। শাস্ত্রে আছে–শাস্ত্রের কথা কি মিথ্যা হয় বাবু? গাড়ী ডেকে আনি, আপনি বেণীঘাটে চলুন, যা কিছু কিরিয়া করম আমি সব আপনাকে করিয়ে দিব–আপনার সওয়া পাঁচ টাকা খরচ হবে। বস্–এক কথা–পাঁচ টাকা চারি আনা। যদি আপনার কাছে আমি পাঁচ টাকা সওয়া চারি আনা চাই, আপনি আমায় বলবেন, তুমি এক–কথাওয়ালা ঠাকুর নও, তুমি দুই–কথাওয়ালা ঠাকুর আর আমার দুই কাণ ধরে আমার দুই গালে দুই চড় মারবেন।

    ভাবিয়া চিন্তিয়া রাখাল বলিল, আচ্ছা, তবে গাড়ী ডাক।

    গাড়ী আসিলে, একটা কুঠুরিতে নিজের জিনিষপত্র বন্ধ করিয়া রাখাল বেণীঘাটে যাত্রা করিল। পথে প্রয়াগ–মাহাত্ম এবং নিজের মাহাত্ম সম্বন্ধে ঠাকুর অনেক বক্তৃতাই করিল, কিন্তু সে সকল কথায় রাখাল বড় কাণ দিল না। সে ভাবিতেছিল, মাথাটি মুড়াইয়া আসিয়া কল্যই গৈরিকবস্ত্র ধারণ করিতে হইবে–তাহা হইলে, হঠাৎ কোন পরিচিত লোকের সহিত সাক্ষাৎ হইলেও সহজে সে আমায় চিনিতে পারিবে না।

    স্নান ও তর্পণাদিতে সওয়া পাঁচ টাকার স্থানে রাখালের ছয়–সাত টাকা ব্যয় হইয়া গেল। ধৰ্ম্মশালায় ফিরিয়া এক–কথাওয়ালা ঠাকুর বলিল, আমায় দক্ষিণা কি দিবেন এবার দিন।

    রাখাল বলিল, বলেছিলে সওয়া পাঁচ টাকার এক পয়সা বেশী লাগবে না। তার জায়গায় প্রায় সাত টাকা লাগিয়ে দিলে–আবার দক্ষিণা চাচ্ছ? –তোমার এক–কথা কোথায় গেল?

    ঠাকুর বিনীত হাস্য করিয়া বলিল, মনে ত করি যে এক–কথাই ঠিক রাখি, কিন্তু পেট যে মানে না বাবু। পোড়া পেটের দায়ে দুই কথা হয়ে যায়।

    রাখাল মনে মনে বলিল, বন্ধু–পৃথিবীতে তুমিই একা নও। পেটের জন্য অনেকেরই দুই–কথা হইয়া যায়। তখন সে হাসিয়া, দুইটি টাকা বাহির করিয়া ঠাকুরের হাতে দিল। ঠাকুর হাসিমুখে বিদায় হইল।

    সারারাত রেলের কষ্ট, আবার প্রভাত হইতে বেলা একটা অবধি ঘোরাঘুরি–রাখাল বড় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ধর্মশালায় একজন ভৃত্যকে ডাকিয়া কিছু খাবার আনাইয়া, তাহাই খাইয়া রাখাল শয়ন করিল।

    বিকালে নিদ্রাভঙ্গ হইলে রাখাল উঠিয়া গাড়ী আনাইয়া বাজারে গেল। ধুতির জন্য রেলির একটা বোয়া থান, দুইটি পাগড়ির উপযুক্ত মলমল, গোটা চারি আংরাখা এবং দুইটা আলখাল্লার উপযুক্ত লংক্লথ, দুখানা ভাল বিলাতী কম্বল এবং একখানি সাদা আলোয়ান ক্রয় করিল। আংরাখা ও আলখাল্লার জন্য দর্জিকে মাপ দিয়া, বাকী জিনিষপত্র লইয়া ধৰ্ম্মশালায় ফিরিয়া আসিল। তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে।

    পরদিন প্রাতে উঠিয়া মুখাদি প্রক্ষালনের পর ভৃত্য রামভরোসাকে ডাকিয়া রাখাল বলিল, হারে, এখানে গেরিমাটি পাওয়া যায়?

    যায়।

    পয়সা দিতেছি, গেরিমাটি কিনিয়া আমার এই নূতন কাপড়–চোপড়গুলা রাঙাইয়া দিতে পারিস?

    পারি। কেন বাবু?

    আমি আর সাদা কাপড় পরিব না, আমি সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসী হইব।

    এ কথায় রামভরোসা বিস্মিত হইয়া, ফ্যাল ফ্যাল্ করিয়া রাখালের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। গতকল্য হইতেই সে লক্ষ্য করিতেছে, এ বাবুটির খরচপত্র বশিস্ প্রভৃতি বেশ স্বচ্ছলতার পরিচায়ক। রামভরোসা জানে, যে খাইতে পায় না সেই সন্ন্যাসী হয়, সন্ন্যাসী হইলে ভিক্ষায় প্রাচুৰ্য্য ঘটিয়া থাকে। তবে এ বাবু কি দুঃখে সন্ন্যাসী হইবেন? ইহাই সে মনে ভাবিতে লাগিল।

    তাহাকে নীরব দেখিয়া রাখাল বলিল, কয় পয়সার গেরিমাটিতে হইবে বল্ দেখি? –বলিয়া একটি আধুলি ফেলিয়া দিল।

    রামভরোসা করুণস্বরে বলিল, বাবু আপনি সংসার ছাড়িয়া বাবাজী হইবেন–আপনার লেড়কা–বালার কি হইবে?

    একটু মৃদু হাসিয়া রাখাল বলিল, আমার লেড়কা লেড়কি কিছুই নাই।

    আপনার বিবি?

    বিবিও নাই।

    মা বাবা?

    মরেছে।

    ভাই বোন?

    কেউ নাই। আমি সন্ন্যাসী হইয়া তীর্থে তীর্থে ঘুরিয়া বেড়াইব, আর ভগবানের নাম করিব।

    এই কথা শুনিয়া রামভরোসার মনটি যেন কতকটা সান্ত্বনালাভ করিল। বলিল–সে ত ভাল কথা বাবু। কিন্তু গেরিমাটি গুলিয়া রঙ করিলে ত ঠিক হইবে না। রামরজে ভাল হইবে।

    রামরজ কি?

    সে এক রকম গুঁড়া, বেনের দোকানে পাওয়া যায়। সেই রঙ ভাল হইবে–গেরুয়া রঙই হইবে, তার সঙ্গে একটু হলুদের আভা। তাহাই আনিয়া আপনার কাপড় আলোয়ান সব রঙ করিয়া দিব। –বলিয়া আধুলিটি তুলিয়া লইল।

    রাখাল বলিল, বেশ। তাহা হইলে আজ এগুলা রাঙাইয়া দে। বেশী করিয়া রঙ লইয়া আসিস। আজ সন্ধ্যাবেলা দর্জি গোটাকতক আংরাখা, আলখাল্লা দিয়া যাইবে, কাল সেগুলা রঙ করিতে হইবে। আর দেখ, একটা রসুয়ে বামুন ঠিক করিয়া দিতে পারিস? পরশু একবেলা, কাল দুবেলা ভাতের মুখ দেখিতে পাই নাই। আজ দুইটি ডাল ভাত খাইব।

    এলাহাবাদে দুইদিন যাপন করিয়া, নব–রঞ্জিত বস্ত্রাদিতে ভূষিত হইয়া রাখাল কাশী যাত্ৰা করিল। পুরাতন বস্ত্র ও বিছানাদি কতক রামভরোসা পাইল, বাকী ধৰ্ম্মশালার অন্যান্য ভৃত্যগণ ভাগ করিয়া লইল।

    ০২. রাখালের পত্র

    কাশীতে নামিলে আর কোনও পাণ্ডা রাখালকে বিরক্ত করিল না। তাহার মুণ্ডিত মস্তক ও গৈরিক বাস দেখিয়া অনেকেই তাহাকে প্রণাম করিতে লাগিল।

    গাড়ী ভাড়া করিয়া রাখাল দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়া উপস্থিত হইল। সে জানিত, কাছাকাছি অনেক যাত্রীওয়ালার বাটী আছে। একটা যাত্রী–বাড়ী অন্বেষণ করিয়া লইয়া, সে সেইখানেই একটা ঘর ভাড়া করিল।

    রাখালের ইচ্ছা, এখন মাসদুই কাশীধামেই সে অবস্থিতি করে। এখানে থাকিয়া, নূতন জীবনের জন্য তাহাকে প্রস্তুত হইতে হইবে। আমি ষোল বৎসর সন্ন্যাসী ছিলাম–বলিলেই ত হয় না, সন্ন্যাসীদিগের জীবনসম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতালাভ অত্যাবশ্যক। নহিলে জেরায় ধরা পড়িয়া যাইতে কতক্ষণ? সন্ন্যাসীদের সঙ্গে একটু মেলামেশা করিয়া, তাহাদের ধরণধারণ বোলচালগুলা আয়ত্ব করিয়া লইতে হইবে; একটু পড়াশুনাও আবশ্যক। এ উদ্দেশ্যসিদ্ধির পক্ষে কাশী ভিন্ন এমন সুযোগ আর কোথায়?

    যাত্রী–বাড়ীতে দুইদিন থাকিয়া রাখাল দেখিল, সেখানে বড় গোলমাল, সৰ্ব্বদাই নূতন নূতন লোক যাওয়া আসা করিতেছে। পাকাদিরও অত্যন্ত অসুবিধা। তাই সে একটি স্বতন্ত্র বাসা অন্বেষণ করিতে লাগিল। মান সরোবরে, কানাই সা মুদীর একটি বাড়ী মাসিক দশ টাকায় ভাড়া করিয়া নিজের জিনিষপত্র সেখানে লইয়া গেল। চাকর ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করিয়া সেই বাড়ীতে বাস করিতে লাগিল।

    এখন রাখালের একমাত্র কায হইল, প্রভাত হইতে বেলা এগারটা পর্যন্ত এবং বিকাল হইতে এক প্রহর রাত্রি পর্যন্ত দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়া সাধু সন্ন্যাসীদের কাছে। বসিয়া থাকা। মাঝে মাঝে বাসায় ডাকিয়া আনিয়া, উত্তমোত্তম ভোজ্য পেয় দিয়া তাহাদের সন্তোষবিধানও করিতে লাগিল। কেহ নাম জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, শ্রীভবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। বাড়ী কোথা এবং অন্য পরিচয়াদি জিজ্ঞাসা করিলে নিরুত্তর থাকিত। গিরি সন্ন্যাসীদের সহিতই রাখাল বেশী করিয়া মিশিত। –তাহাদের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইত, তাহাদের সম্প্রদায়ের বিশেষ বিবরণ সকল সংগ্রহ করিত–তাহাদের পাঠ্য পুস্তকাদি চাহিয়া লইয়া বা কিনিয়া সৰ্ব্বদা পাঠ করিত। প্রতি রাত্রে আহারাদির পর নিয়মিত ভাবে ভবেন্দ্রের আত্মজীবন চরিতখানি পাঠ করিত–বারম্বার পড়িতে পড়িতে তাহার সকল কথাই প্রায় মুখস্থ হইয়া গেল।

    এইরূপে মাসাধিক কাল অতিবাহিত হইল। রাখালের নেড়া মাথায় চুল গজাইল, গোঁফদাড়িও দেখা দিল। রাখাল, ভাবিল, বাশুলিপাড়ায় গিয়া একবার সব দেখিয়া শুনিয়া আসা আবশ্যক। সেখানকার পথ ঘাট, বিশেষ বিশেষ লোকের নাম ও গৃহাদি, পার্শ্ববর্তী গ্রাম সকলের নাম ও গ্রামস্থ ব্যক্তিগণের কিঞ্চিৎ পরিচয় জানিয়া শুনিয়া না আসিলে, হঠাৎ ধরা পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। রাখাল ভাবিতে লাগিল, না গেলে উপায় নাই, কিন্তু কি বেশে যাওয়া যায়? –এ সন্ন্যাসীর বেশ ত নহেই–কারণ এই বেশেই সেখানে ভবেন্দ্ররূপে অবতীর্ণ হইতে হইবে। গৃহস্থবেশেও নহে, কারণ সে সহর নহে পল্লীগ্রাম, সকলেই পরস্পরকে চেনে, একজন নূতন লোক হঠাৎ গিয়া উপস্থিত হইলে, সকলেই জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিবে। পথে একজন মুসলমান ফকিরকে ভিক্ষা করিতে দেখিয়া, হঠাৎ রাখালের মনে হইল, এই ছদ্মবেশে যাওয়াই সৰ্ব্বপেক্ষা নিরাপদ।

    এই ভাবিয়া সে মুসলমানী চাপকান ফরমাস দিল, নাগরা জুতা কিনিল, টুপী কিনিল, কেবল বাকী রহিল একছড়া স্ফটিকের মালা, কীর্তা (কর) এবং বাঁকা জড়ি লাঠি। এগুলি বাজারে কিনিতে পাওয়া গেল না। কিন্তু কড়িতে বাঘের দুগ্ধ মিলে–মালা–করঙ্ক–লাঠির কথা কি! একজন মুসলমান ফকিরকে বাসায় ডাকিয়া আনিয়া টাকা দিয়া রাখাল জিনিষগুলি সংগ্রহ করিয়া লইল। সেইদিন সন্ধ্যার পর, ফকিরের বেশ ধারণ করিয়া পথে বাহির হইল। তাহার চাকর বামুন এ নূতন বেশ দেখিয়া অবাক হইয়া গেল। পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল, এ সন্ন্যাসীও নয়, ফকিরও নয়–নিশ্চয়ই কলিকাতার খৌফিয়া পুলিস, কোনও খুনের আসামীর সন্ধানে আসিয়াছে।

    চাপকান টুপী জুতার নূতনত্ব ধূলায় আবৃত হইলে, বাড়ীতে তালা বন্ধ করিয়া রাখাল বাশুলিপাড়ায় গমন করিল। সেখানে পৌঁছিয়া পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। কেহ দুই এক পয়সা ভিক্ষা দিলে, মোটা গলায়আল্লা আবাদ্ রাখে বলিয়া হাত তুলিয়া আশীৰ্বাদ করিত। বাশুলিপাড়া এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া যাহা কিছু দ্রষ্টব্য, জ্ঞাতব্য সমস্তই দেখিল, জানিয়া লইল। দেওয়ানজি ও পুরাতন কৰ্মচারী ভৃত্য প্রভৃতি, যাহাদের নাম ও উল্লেখ ভবেন্দ্রের আত্মজীবনীতে পাঠ করিয়াছিল, সকলকে চিনিয়া রাখিল। সপ্তাহকাল এইরূপে অতিবাহিত করিয়া রাখাল কাশীতে ফিরিয়া আসিল। ফকিরের বেশবাস, একটা ফকিরকে ডাকিয়া আনিয়া দান করিয়া দিল।

    বৈশাখের শেষ সপ্তাহ–কাশীতে বেশ গরম পড়িয়া গিয়াছে। আহারাদির পর অনেকরাত্রি অবধি রাখাল খোলা ছাদে শুইয়া নানা কথা ভাবে। বাশুলিপাড়ায় কবে যাওয়া যায়? আর বিলম্ব করিয়াই ফল কি? একেবারে হঠাৎ গিয়া পড়িবে, না প্রথমে পত্র লিখিবে? –কিন্তু পত্র লেখায় একটা বিপদ আছে। পত্র পাইয়া, তাহাদের মনে নিশ্চয়ই সন্দেহ উপস্থিত হইবে, এ ব্যক্তি সত্যই ভবেন্দ্র না জাল। দীনবন্ধু মিত্রের নবীন–তপস্বিনী নাটকের কথা, বর্ধমানের প্রতাপচাঁদের মোকদ্দমার কথা মনে মনে পৰ্যালোচনা করিতে লাগিল। পত্র লিখিলে, একটা ঠিকানা ত দিতেই হইবে। তাহারা কেহ যদি চুপে চুপে কাশীতে আসিয়া সন্ধান লয়? তাহার অপেক্ষা পত্র না লেখাই ভাল–একবারে গিয়া পড়িবে। বলিবে–আমি এসেছি।

    এইরূপ সাত পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে আরও কয়েকদিন গেল। রাখালের মনে আশঙ্কা হইতে লাগিল, বিনা সংবাদে হঠাৎ গিয়া পড়িলে তাহারা প্রথম হইতেই সন্দেহপরায়ন হইয়া তাহাকে কঠোর পরীক্ষায় ফেলিবে। তাহার অপেক্ষা যদি সে এরূপ একখানি চিঠি লিখিয়া পাঠায়, যে চিঠি কেবল আসল ভবেন্দ্ৰই লিখিতে পারিত, –এত বৎসর পরে যদি কেহ জাল ভবেন্দ্র সাজিয়া যায়, তবে যে কথা তাহার জানিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই, তাহা হইলে তাহাদের বিশ্বাস জন্মিতে পারে পত্রলেখক প্রকৃতই ভবেন্দ্র। তবে চিঠি রওনা হইবার দুই একদিন পরেই সে স্বয়ং যাত্রা করিবে, যাহাতে পত্র পাইয়া এখানে আসিয়া তাহারা কেহ কোনও প্রকার অনুসন্ধান করিবার অবসরমাত্র না পায়।

    এইরূপ স্থির করিয়া রাখাল চিঠি লিখিতে বসিল। অনেকগুলা চিঠি লিখিয়া ছিঁড়িয়া ফেলিল। ভবেন্দ্রের জীবনচরিত লইয়া আবার আগাগোড়া পড়িতে আরম্ভ করিল। দিনদুই পরে, নিম্নলিখিত মুসাবিদাটি দাঁড়াইল

    ওঁ নমঃ শিবায়
    কাশীধাম
    ২৬শে বৈশাখ প
    রম পূজনীয় শ্রীযুক্ত পিতাঠাকুর মহাশয়
    শ্রীচরণকমলেষু।
    প্রণাম শতকোটি নিবেদনমেতৎ
    বাবা, আজ সুদীর্ঘকাল পরে আপনার অযোগ্য অধম সন্তান স্বীয় জীবনব্যাপী সমস্ত অপরাধ ও দুষ্কৃতের জন্য অনুতপ্ত হইয়া আপনার পদপ্রান্তে উপস্থিত হইল। আজ ষোল বৎসর আমি গৃহত্যাগ করিয়াছি, এই ষোল বৎসরের মধ্যে একটা সংবাদ পর্যন্ত আপনাকে দিই নাই। আমি যে জীবিত আছি, এমন ভরসাও হয়ত এতদিন আপনারা পরিত্যাগ করিয়াছেন। আমার তুল্য পাষণ্ড আর ভূভারতে নাই। যখন প্রথম বাহির হইয়াছিলাম, তখন এলাহাবাদে অবস্থানকালীন বঙ্গবাসীতে আপনার প্রদত্ত বিজ্ঞাপনও দেখিয়াছিলাম; কিন্তু পাছে কোনও বাঙ্গালী সে বিজ্ঞাপন পাঠ করিয়া এবং আমাকে দেখিয়া সন্দেহবশতঃ আপনাকে সংবাদ দেয়, এই জন্য সেইদিনই তথা হইতে পলায়ন করি। যেখানে বাঙ্গালী নাই এমন স্থানে থাকিতে আরম্ভ করি। ক্রমে কনখলে বাসকালীন তিনতারিয়া মঠের মোহান্ত বেলপৎ গিরি মহারাজের কৃপাদৃষ্টি লাভ করি। তিনি আমার মাথা মুড়াইয়া আমায় নিজ চেলা করিয়া লন। তাহার স্বর্গলাভ হইলে আমিই তাহার গদি প্রাপ্ত হই এবং এতদিন সেই স্থলেই অবস্থান করিতেছিলাম। কিন্তু ইদানীং সে জীবনের প্রতি মনে বড় ধিক্কার জন্মিতেছিল। প্রায় দুই বৎসর হইতেই বাড়ী ফিরিব ফিরিব ভাবিতেছিলাম, কিন্তু মতিস্থির হইতেছিল না। দুইমাস পূর্বে একদিন রাত্রে স্বপ্ন দেখিলাম। আমি গৃহত্যাগ করিবার অব্যবহিত পূৰ্ব্বে চক্ষু উঠার জন্য আপনি যে প্রকার ঠুলি চশমা পরিয়া থাকিতেন, সেই প্রকার চশমা পরিয়া, এবং সেইরূপ হলুদে ছোপান রুমাল হাতে করিয়া যেন আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং স্নেহকরুণস্বরে আমকে বলিলেন, পটলা বাড়ী যাবি আয়। –নিদ্রাভঙ্গে আপনার সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আমি কাঁদিতে লাগিলাম এবং পরদিনই মঠ পরিত্যাগ করিলাম। কয়েকটি তীর্থে ঘুরিয়া অবশেষে কাশীধামে আসিয়াছি। ইচ্ছা ছিল পুরী ও সেতুবন্ধ দর্শন করিয়া জ্যৈষ্ঠের শেষে বাড়ী যাইব–কিন্তু আমার মন অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়াছে। আগামী দ্বাদশীর দিন যাত্রা করিয়া ত্রয়োদশীর দিন বাশুলিপাড়া পৌঁছিব।
    আপনি আমার শতকোটি প্রণাম জানিবেন এবং মাতাঠাকুরাণীকে জানাইবেন। দেবেন ভায়াকে আমার আশীৰ্বাদ জানাইবেন। আর আর সকলকে আমার যথাযোগ্য প্রণাম ও আশীৰ্বাদ জানাইবেন।
    আপনার অধম সন্তান
    শ্রীভবেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়

    মুসাবিদাটি বারম্বার পাঠ করিয়া, কাট–কুট করিয়া অবশেষে রাখাল চিঠির কাগজে নকল করিয়া ফেলিল। নকল হইলে নিয়ে এই পুনশ্চটি যুড়িয়া দিল–

    পুঃ–এখানে আসিয়া বাঁশফটকায় আমাদের পাণ্ডা কাশীনাথ মিশ্র ঠাকুরের খোঁজ করিয়াছিলাম। অনুসন্ধানে জানিলাম দুই বৎসর পূর্বে তাহার কাশীপ্রাপ্তি হইয়াছে।
    সেবক শ্রীভবেন্দ্র

    পত্র বন্ধ করিয়া, খামে ঠিকানা লিখিয়া রাখাল স্বহস্তে সেখানি ডাকবাক্সে ফেলিয়া দিল। এ পত্র পৌঁছিবার সংবাদ পাঠকগণ পূৰ্বেই পাইয়াছেন।

    ০৩. বিষম সমস্যা

    অপরাহ্ন–কাল। কাছারিবাড়ীর একটি কক্ষে টেবিলের উপর স্তূপীকৃত কাগজ ও বহি লইয়া, দেওয়ান রঘুনাথ মজুদার মহাশয় বসিয়া হিসাবপত্র পরীক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহার বামপার্শ্বে, তাঁহার চেয়ারখানি হইতে অল্প ব্যবধান, জাজিমে মোড়া একখানি তক্তপোষের উপর রামহরি ভট্টাচার্য্য, বিশ্বেশ্বর মিত্র ও হরিদাস গোস্বামী, পাড়ার এই তিনজন নিষ্কর্মা ব্যক্তি বসিয়া গুণ গুণ স্বরে গল্প করিতেছিলেন। ভট্টাচাৰ্য মহাশয় ও মিত্ৰজার হস্তে এক একটি কলিকাশূন্য হুঁকা–অল্পক্ষণ পূৰ্বেই ভৃত্য ঢালিয়া সাজিবার জন্য কলিকাটি লইয়া গিয়াছে। দেওয়ানজি কাৰ্য্যও করিতেছেন–আবার মাঝে মাঝে ইহাদের কথাবার্তায় যোগও দিতেছেন। ভিত্তিগাত্রে একটি বড় গোলাকার ঘড়ি টিকটিক করিতেছে।

    আগন্তুক তিনজনের মধ্যে ভট্টাচাৰ্য মহাশয়ই বয়োজ্যেষ্ঠ। তিনি বলিলেন, আর শুনেছেন দেওয়ানজি? কলকাতায় নাকি একরকম গাড়ী এসেছে, তাতে ঘোড়ার দরকার হয় না। কল টিপে দিলেই আপনিই রাস্তা দিয়ে গড়গড়িয়ে চলে যায়।

    এ কথা শুনিয়া মিত্ৰজা বলিয়া উঠিলেন, আঁ? বলেন কি? রাস্তায় কলের গাড়ী?

    ভট্টাচার্য্য বলিলেন, হ্যা গো! রাস্তায় নয় ত কি বৈঠকখানায়?

    গোস্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, হ্যা দেওয়ানজি, সত্যি নাকি? –গোস্বামীই এই দলের সৰ্ব্বকনিষ্ঠ।

    দেওয়ানজি বলিলেন, হ্যাঁ, ঠিক কথা। বছরখানেক হল এসেছে, বরং তার উপর। তাকে মোটর গাড়ী বলে।

    মিত্রজা বলিলেন, কই, আমি ত পূজোর সময় কলকাতা গিয়েছিলাম, সে রকম ত কিছু দেখিনি!–আপনি দেখেছেন নাকি?

    না, খবরে কাগজে পড়েছি। এখনও বেশী আসেনি, দশ বিশখানা এসেছে।

    মিত্রজা বলিলেন, গেল, এবার ঘোড়ার অন্ন গেল!

    দেওয়ানজি হাসিয়া বলিলেন, ঘোড়ার অন্ন যেতে এখনও অনেক দেরী আছে, মোটর গাড়ীর বিস্তর দাম।

    গোস্বামী ঔৎসুক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, কত দাম হবে দেওয়ানজি?

    মাসদুই হবে কৃষ্ণনগরে এক মাড়োয়ারী মহাজনের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কলকাতায় তাদের বেশ বড় কারবার। সাত হাজার টাকা দিয়ে তারা বিলেত থেকে একখানি আনিয়াছে বললে। তাও সেখানি ছোট–বড়গুলির দাম আরও বেশী।

    মিত্রজা বলিলেন, ইংরেজ কলে কলে দেশটা ছেয়ে ফেললে। ঘোড়ার অন্ন উঠতে দেরী আছে বলছেন, বড় বেশী দেরী নেই। ও কল–টলগুলো নতুন নতুন যখন ওঠে তখনই বেশী দাম হয়–ক্রমে সস্তা হয়ে যায়। নাঃ–ঘোড়ার আর ভদ্রস্থতা নেই।

    ভট্টাচাৰ্য্য বলিলেন, শুধু ঘোড়ার বলছ কেন? কোচম্যানের অন্ন গেল, সহিসের অন্ন গেল। কল হয়ে দেশের যে কত লোকের অন্ন গেল, তার আর সংখ্যা নেই। –বলিয়া ভট্টাচাৰ্য মহাশয় হতাশভাবে মাথাটি নাড়িতে লাগিলেন।

    এমন সময় ভৃত্য জ্বলন্ত কলিকাতে ফুঁ দিতে দিতে প্রবেশ করিল। ভট্টাচাৰ্য সেইটি লইয়া, নিজের হুঁকার উপর বসাইয়া দুই চারি টান দিলেন। শেষে হুঁকাটি গোস্বামীর হাতে দিয়া বলিলেন–খাও হরিদাস–ধরাও।

    দেওয়ানজি আবার হিসাবের খাতায় মন দিবার আয়োজন করিতেছিলেন, এমন সময় ডাকপিয়ন নিধিরাম সাধুখা প্রবেশ করিয়া বলিল, প্রণাম হই বাবু! হস্তস্থিত একগোছা পত্র হইতে বাছিয়া খানকতক দেওয়ানজির সম্মুখে রাখিল, তারপর ব্যাগ খুলিতে খুলিতে বলিল, কর্তা মহাশয়ের নামে একখানা রেজিষ্ট্রারি আছে।

    দেওয়ানজি বলিলেন, কর্তার নামে?

    আজ্ঞে হ্যাঁ। –বলিয়া পিয়ন শিলমোহর করা একখানি চিঠি বাহির করিয়া টেবিলের উপর রাখিল।

    দেওয়ানজি সেখানি তুলিয়া বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, কে লিখলে? আজ দুবৎসর কৰ্ত্তার স্বর্গবাস হয়েছে, এতদিন পরে তাঁর নামে চিঠি কে লিখলে?

    গোস্বামী বলিলেন, ছাপ দেখুন না–কোথা থেকে আসছে।

    দেওয়ানজি ছাপ পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, বেনারস সিটি। ওঃ–বুঝেছি। কাশীতে আমাদের যে পাণ্ডাঠাকুর আছেন, তাঁরই চিঠি বোধ হয়। তিনি কখন কখনও কর্তাকে চিঠি লিখতেন বটে। বোধ হয় কিছু সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। আচ্ছা পিয়ন আমি সই করে নিচ্ছি। –বলিয়া পীতবর্ণ রসিদ কাগজখানিতে দেওয়ানজি স্বাক্ষর করিয়া দিলেন। পিয়ন ব্যাগ বন্ধ করিয়া প্রণামান্তে প্রস্থান করিল।

    দেওয়ানজি অন্য পত্রগুলি একে একে খুলিয়া পাঠ করিলেন। দুই একখানিতে সংক্ষিপ্ত হুকুম লিখিয়া সেরেস্তায় পাঠাইয়া দিলেন। সৰ্বশেষে রেজিষ্টারি পত্রখানি খুলিলেন।

    প্রথম দুই ছত্র পড়িয়াই দেওয়ানজি ক্ষিপ্রহস্তে পৃষ্ঠা উল্টাইয়া লেখকের নাম দেখিলেন–সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, এ কি!–তাঁহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল হাত পা কাঁপিতে লাগিল।

    গোস্বামী ও মিত্ৰজা সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন, কি হয়েছে?

    ভট্টাচাৰ্য বলিলেন, কোনও মন্দ খবর নয় ত?

    দেওয়ানজি ইতিমধ্যে কতকটা আত্মসম্বরণ করিয়া লইয়াছিলেন। কোনও উত্তর না দিয়া আপন মনে পত্রখানি পাঠ করিতে লাগিলেন। তিনজনেই অদম্য কৌতূহলে তাহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন। ইঁহারা দেখিলেন, পত্র পাঠ করিতে করিতে দেওয়ানজির ঘন ঘন ভাবান্তর উপস্থিত হইতেছে। একবার আনন্দে তাঁহার মুখ উৎফুল্ল হইয়া উঠে, পরক্ষণেই একটা বিষম সংশয়ে জ্বযুগল কুঞ্চিত হইয়া যায়, তারপর ক্রোধে তাঁহার ওষ্ঠযুগল কম্পিত হইতে থাকে–আবার সে ভাব তিরোহিত হইয়া চক্ষুযুগল হর্ষোজ্জ্বল হইয়া উঠে, পরমুহূর্তেই তাহা স্নানভাব ধারণ করে। পত্রখানি শেষ পর্যন্ত পড়িয়া, আবার দেওয়ানজি প্রথম হইতে পড়িতে আরম্ভ করিলেন। এবার, প্রথমবারের মত অত বেশী সময় লাগিল না। পাঠশেষে পত্রখানি দেরাজের মধ্যে রাখিয়া চাবি বন্ধ করিলেন। একটি দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া একদৃষ্টে বাহিরের ফটকের পানে চাহিয়া রহিলেন।

    ইঁহারা তিনজনে পরস্পরের মুখাবলোকন করিতে লাগিলেন। শেষে মিত্রজা গলা ঝাড়িয়া বলিলেন, পাণ্ডার চিঠি নাকি?

    না। –বলিয়া দেওয়ানজি উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

    ভট্টাচাৰ্য মহাশয় বলিলেন, চললেন কোথায়?

    দেওয়ানজি ক্ষীণস্বরে বলিলেন, কায আছে। আজ একাদশী না?

    ভট্টাচাৰ্য্য বলিলেন, হ্যাঁ। আচ্ছা, আমরাও তা হলে উঠি। –বলিয়া তিনি হুঁকায় খুব তাড়াতাড়ি গোটাকতক টান দিয়া লইলেন।

    মিত্রজা ও গোস্বামী ইতিমধ্যে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এস। –বলিয়া ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

    ফটকের নিকট গিয়া তিনজনেই অনুচ্চস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

    মিত্রজা বলিলেন, কোনও একটা গুরুতর ঘটনা ঘটে থাকবে। ভট্টচায্যি মশাই, আপনি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলেন না কেন?

    দরকার? –এস এস এখানে দাঁড়িয়ে থেক না। –বলিয়া ভট্টাচাৰ্য অগ্রসর হইলেন। দুইধারে জঙ্গল, মধ্যে অপ্রশস্ত পথ বাহিয়া তিনজনে চলিলেন।

    মিত্ৰজা বলিলেন, ব্যাপারখানা কি, কিছুই বোঝা গেল না।

    গোস্বামী এদিক ওদিক চহিয়া অনুচ্চস্বরে বলিলেন, আমি কিন্তু একটা অনুমান করেছি।

    মিত্রজা দাঁড়াইয়া বলিলেন, কি, কি হে?

    ভট্টাচাৰ্য্য বলিলেন, আবার দাঁড়ালে কেন? চলতে চলতে কি কথা কওয়া যায় না?

    আবার সকলে চলিতে আরম্ভ করিলেন।

    গোস্বামী বলিলেন, চিঠিখানার একটা জায়গা আমি পড়তে পেরেছি। এক জায়গায় লেখা রয়েছে–নিদ্রাভঙ্গে আপনার সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আমি কাঁদিতে লাগিলাম। এইটুকু খালি পড়তে পেরেছি।

    ভট্টাচাৰ্য বলিলেন, হাঃ–বকো কেন? অতদূর থেকে তুমি পড়তে পেরেছ!

    গোস্বামী বলিলেন, হ্যা ভট্টাচায্যি মশায়, আমি স্পষ্ট পড়েছি–নিদ্রাভঙ্গে আপনার সেই মূৰ্ত্তি স্মরণ করিয়া–।

    ভট্টাচাৰ্য্য বলিলেন, জ্বালাও কেন? আমরা কেউ দেখতে পেলাম না, তুমি অমনি দেখতে পেলে! কত বয়স হয়েছে?

    গোস্বামী বলিলেন, উনচল্লিশ। এখনও চশমা নিতে হয়নি।

    হ্যাঃ–ঊনচল্লিশ! আমারই প্রায় পঞ্চাশের ধাক্কা, তোমার এখনও ঊনচল্লিশ!–বলিয়া ভট্টাচাৰ্য মহাশয় মোড় ফিরিয়া নিজ বাটীর পথ ধরিলেন।

    কিয়দ্দূর গিয়া, মিত্রজা দাঁড়াইলেন। বলিলেন–বটে!–এমন ব্যাপার? ঘুম ভাঙ্গিয়া আপনার মূর্তি স্মরণ করিয়া–এ ত বাবা জমিদারী চিঠি নয়! বলিয়া দন্তে উষ্ঠ দংশন করিয়া বক্রভাবে মাথা নাড়িতে লাগিলেন।

    গোস্বামী বলিলেন, আমার ত মনে হয়, বুঝলেন–ঐ দেওয়ানজি, যতই সাধুতার ভাণ করুন–ভিতরে ভিতরে–বলিয়া তিনি চারিদিকে সাবধানে দৃষ্টিপাত করিলেন। শেষে মিত্রজার কাণের কাছে মুখ রাখিয়া ফিস্ ফিস্ করিয়া কি বলিলেন। পরে আবার স্বাভাবিক স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার কি বোধ হয়?

    মিত্রজা বলিলেন, আমার বোধ হয় নিশ্চয়ই তাই।

    উভয়ে উভয়ের মুখাবলোকন করিয়া কিঞ্চিৎ হাসিয়া, আবার পথ অতিক্রম করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ চলিবার পর, হঠাৎ মিত্রজা থামিয়া বলিলেন, ওহে–তা নয়।

    গোস্বামীও দাঁড়াইয়া বলিলেন, কি নয়?

    তুমি যা বলেছ তা নয়। ও চিঠি ত মোটে দেওয়ানজির নামেই নয়। শুনলে –কৰ্ত্তার নামের চিঠি যে।

    হ্যা হ্যাঁ–তাও ত বটে! তাও ত বটে!–বলিয়া গোস্বামী মুখখানি বিষণ্ণ করিয়া রহিলেন।

    মিত্রজা চিন্তান্বিত হইয়া বলিলেন, উঁহু!–কিছুই বোঝা গেল না!

    গোস্বামীও বলিলেন, নাঃ–কিছুই বোঝা গেল না। –তখন দুইজনে হতাশভাবে আবার পথ চলিতে লাগিলেন।

    এদিকে দেওয়ানজি, অন্তঃপুরে যাইবেন বলিয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া আবার উপবেশন করিলেন। করতলে মস্তক রাখিয়া, গভীরতর চিন্তায় মগ্ন হইলেন। মনে মনে বলিতে লাগিলেন, এখন কি করা যায়? খবরটা বাড়ীতে দিই, কি না দিই? এ লোক সত্যি ভবেন্দ্র, না জুয়াচোর, তারই বা ঠিক কি? এখন খবরটি দিলে, আনন্দে ওঁরা আত্মহারা হবেন। তারপর, পরশু সে এসে পৌঁছলে, যদি তাকে জাল বলে বোঝা যায়, তখন একেবারে মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়াবে যে! আহা ওঁদের পক্ষে সেটা বড়ই নিষ্ঠুর শাস্তি হবে। তারচেয়ে বরঞ্চ এখন চুপ করে থাকি। আসুক, তাকে দেখি না! অবশ্য, আজ ষোল বছর দেখিনি, সেই মানুষ কিনা মুখ দেখে চেনা শক্ত। যদি জাল হয়, কথায় বার্তায় নিশ্চয়ই ধরা পড়ে যাবে। তখন বেশ উত্তম মধ্যম ঘা কতক দিয়ে, পুলিশে দিলেই হবে। আর যদি সে বাস্তবিকই ভবেন্দ্র বলে বোঝা যায়–তার বাড়া আনন্দ কি? কিন্তু সে কি সম্ভব?

    দেওয়ানজি তখন ধীরে ধীরে দেরাজ খুলিয়া, পত্রখানি বাহির করিলেন। আবার সেখানি বিশেষ মনোযোগ সহকারে পাঠ করিলেন। পাঠান্তে, ভাবিতে লাগিলেন, জাল হবে কি? এত সব খুঁটিনাটি কথা, এত বছরের পর অন্য কেউ জানবে কি করে? –আহা, যদি এ বাস্তবিকই ভবেন্দ্ৰ হয়, কি সুখই হয় তা হলে!

    ঘড়িতে তখন পৌনে ছয়টা। চিঠিখানি আবার দেরাজে বন্ধ করিয়া দেওয়ানজি উঠিয়া দাঁড়াইলেন। কক্ষের মধ্যেই ধীরে ধীরে পদচারণা করিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে জানালার কাছে গিয়া একবার দণ্ডায়মান হন, আকাশের দিকে চাহিয়া থাকেন, আবার পদচারণা আরম্ভ করেন। এইরূপে ক্রমে ছয়টা বাজিল।

    ক্রমে তাহার মনে এই কথাগুলির উদয় হইল–যদি পরশু দেখা যায় সে প্রকৃতই ভবেন্দ্র, তাহলে বাড়ীতে ওঁরা মনে করবেন, আমি কোন দুরভিসন্ধিবশতঃ এমন ভাল সংবাদটা দুদিন চেপে রেখেছিলাম। ওঁদের মনে হয়ত সন্দেহ হবে, ভবেন্দ্র ফিরে আসছে এ সংবাদে আমি খুসী নই; জমিদারীর সর্বময় কৰ্ত্তা ছিলাম, সে ক্ষমতাটুকু আমার লোপ পাবে, তাই বুঝি আমার বুকটা চড় চড় করে উঠেছে। আমি যে ভাল ভেবেই কথাটা এখন অপ্রকাশ রাখতে চাচ্ছি–ওঁরা কি তখন তা বিশ্বাস করবেন? –বড় মুস্কিলেই পড়া গেল। এ যে বিষম সমস্যা দেখছি। কি করি? আজ আবার একাদশী–সারাদিন ওঁরা দুজনে উপবাসী রয়েছেন। দুৰ্বল শরীরে, এ আনন্দের বেগ কি সহ্য করতে পারবেন? যদি কোনও দুর্ঘটনা হয়? –এখন থাক্‌, কাল ওঁরা জল–টল খেলে পর না হয় বলা কওয়া যাবে!

    সূর্যাস্তের অধিক বিলম্ব নাই। আর কিয়ৎক্ষণ পদচারণা করিয়া দেওয়ানজি আপন মনে বলিলেন, নাঃ সে কোনও কাযের কথা নয়। এত বড় সংবাদটা, এক রাত্রির জন্যেও গোপন রাখবার কোনও অধিকার আমার নেই। যাই–রাণীমাকে বলিগে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ সাবধানও করে দেব, এখন থেকে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া গেল এমন স্থির না করে বসেন। বড়লোকের বিষয় সম্পত্তির লোভে, জুয়াচোরেরা এ রকম মাঝে মাঝে করে থাকে, তার দৃষ্টান্ত দেব। এ প্রকৃত ভবেন্দ্র নয়, জালমানুষ, এইটেই বরং এখন ধরে নেওয়া ভাল, সেটা বেশ করে বুঝিয়ে বলব!

    রাণীমাকে পত্র পাঠ করিয়া শুনাইবামাত্র, হাসিয়া কাঁদিয়া তিনি উন্মত্তবৎ হইয়া উঠিলেন। দেওয়ানজি তাঁহাকে সংশয়মূলক দুই চারি কথা বলিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাহাতে তিনি কর্ণপাত মাত্র করিলেন না। উদ্দাম স্রোতের মুখে অসহায় তৃণগুচ্ছের ন্যায় তাহার কথাগুলি কোথায় ভাসিয়া গেল! আনন্দের উচ্ছ্বাসে সমস্ত অন্তঃপুর যেন টলমল করিতে লাগিল। একজন ঠাকুরঘরে গিয়া ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি আরম্ভ করিয়া দিল, সে শব্দ বাগানে বউরাণী শুনিয়া কি করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই আমরা প্রকাশ করিয়াছি।

    ০৪. দেওয়ানজির কার্যতৎপরতা

    সেদিন সারারাত্রি দেওয়ানজির ভাল নিদ্রা হইল না। এই ঘটনার পরিণাম যে কি হইবে, ভাবিয়া তিনি কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না।

    পরদিন প্রত্যুষ হইতেই তাঁহার গৃহে লোক–সমাগম আরম্ভ হইল। কথাটা চারিদিকে রাষ্ট্র হইয়া গিয়াছিল। সকলেই তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, গুজবটা সত্য কি না। দেওয়ানজি গম্ভীর ভাবে বলিলেন, সত্য কি মিথ্যা দুদিন বাদে সবাই জানতে পারবে। অবশেষে লোকের প্রশ্নে প্রশ্নে তিক্ত–বিরক্ত হইয়া তিনি গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন–ভৃত্যকে আজ্ঞা দিলেন–কেহ আসিলে বলিস এখন সাক্ষাৎ হইবে না।

    গৃহের স্নানাদি সমাপন করিয়া, বেলা আটটার পর দেওয়ানজি কাছারিতে উপস্থিত হইলেন। অন্তঃপুরে লোক পাঠাইয়া সংবাদ লইলেন, রাণীমার পূজা–আহ্নিক শেষ হইয়াছে, এবার তিনি জলযোগে বসিবেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া দেওয়ানজি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। পূৰ্ব্বে রাণীমা দেওয়ানজির সহিত সাক্ষাৎভাবে কথাবার্তা কহিতেন না। স্বর্গীয় কৰ্ত্তা মহাশয়ের দেহান্তের দুইমাস পূৰ্ব্বে যখন তাঁহার পীড়া সাংঘাতিক ভাব ধারণ করে, তখন হইতেই এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিতে থাকে।

    বসিবার কক্ষে দেওয়ানজি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর, রাণীমা প্রবেশ করিলেন। দেওয়ানজি দেখিলেন, তাঁহার মুখে গত দিবসের সে আনন্দজ্যোতি এখন আর নাই, বরং একটা নৈরাশ্যের ভাব সেস্থানে অধিকার করিয়াছে। উঠিয়া দাঁড়াইয়া, প্রণাম করিয়া বলিলেন–বউঠাকরুণ, জল খাওয়া হয়েছে?

    হ্যাঁ–খেয়েছি। –বলিয়া তিনি উপবেশন করিলেন। তাঁহার চক্ষুযুগল আনত।

    রাণীমা যদি কথা উত্থাপন করেন, এই আশায় দেওয়ানজি কয়েক মুহূর্ত প্রতীক্ষা করিলেন। তাঁহাকে নীরব দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–বউরাণী কেমন আছেন?

    ভাল আছেন।

    রাত্রে ফিট টিট হইনি ত?

    না।

    আবার উভয়ে কিয়ৎক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিলেন। তখন দেওয়ানজি স্থির করিলেন, সংশয়ের কথা উল্লেখ করি–যাহা মনে করিতে হয় করিবেন। যে আসিবে, তাহাকে ভবেন্দ্ৰ বলিয়া এখন গ্রহণ করিয়া, পরে যদি কোনও গোলমাল উপস্থিত হয়, তাহা হইলে এ নির্মল কূলে চিরদিনের জন্যে দুরপনেয় কলঙ্ক রহিয়া যাইবে। এ কথা আমি এখন না। বলিলে আর কে বলিবে, আর কাহার সাধ্য আছে? উঁহারাও এখন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য।

    যদি বলি, তবে আমার বড় অধৰ্ম হয়। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া দেওয়ানজি কথাটা পাড়িলেন। বলিলেন–বউঠাকরুণ, একটা বিষয়–কাল আপনাকে বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু সে সময় কথাটা হল না–আপনি যদি দুঃখিত না হন ত বলি।

    কি কথা?

    আপনি আমার উপর বিরক্ত হবেন না! কথাটা না বললে আমার কর্তব্যহানি হয়, তাই বলতে হচ্ছে।

    রাণীমা বলিলেন, কি কথা তুমি বলতে চাও, তা আমি বুঝেছি ঠাকুরপো। আমারও মনে সে কথা উদয় হয়েছিল। কাল সারারাত্রি ঘুমোয়নি–কেবল আকাশ–পাতাল ভেবেছি। আমার মনটা খুবই উতলা হয়েছিল–তবে ভোর রাত্রে বউমার কাছে একটা কথা শুনলাম, তাই কতকটা আশ্বাস পেয়েছি।

    দেওয়ানজি অত্যন্ত উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, বউরাণী কি বলেছেন?

    রাণীমা তখন, বউরাণীর নিকট তাঁহার গতপূৰ্ব্ব রজনীর স্বপ্ন–দর্শন বৃত্তান্ত যাহা শ্রবণ করিয়াছিলেন, তাহা বিবৃত করিলেন।

    শুনিয়া, দেওয়ানজি গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, ঐটুকুর উপর নির্ভর করে নিশ্চিন্ত থাকা যায় না ত!

    রাণীমা বলিলেন, তা ত বটেই। কিন্তু কি করা যায়? কিছু অনুসন্ধান করতে পারলে ভাল হত, কিন্তু তার সময়ই বা কই? তিনতারিয়া মঠ কোথায় জান?

    না। তবে পশ্চিমে গিয়ে অনুসন্ধান করে বের করা যায়।

    সে ত অনেক সময় লাগবে। ইতিমধ্যে কি হবে? সে, মনে কর, কাল ত্রয়োদশীর দিন এসে পৌঁছবে। তখন তাকে বলতে পারব না–তোমার প্রতি আমাদের সন্দেহ–আমরা এখন অনুসন্ধান করছি–তুমি ততদিন বাইরের ঘরে বসে থাক–চারটি চারটি খেতে পাবে এখন। যদি সে প্রকৃতই ভবেন্দ্ৰ হয়–তা হলে, হয় ত অভিমান করে তখনি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে। সে কি রকম অভিমানী, জান ত ঠাকুরপো?

    হ্যাঁ–তা ত জানি। যদি দুদিন আগেও সংবাদ পেতাম–তা হলেও অন্ততঃ কাশীতে গিয়ে কতকটা অনুসন্ধান করতে পারতাম।

    কখন সে কাশী থেকে রওনা হয়েছে?

    আজই রওনা হবার কথা চিঠিতে লেখা রয়েছে। বোধ হয় বৈকালের গাড়ীতে সেখানে ছেড়ে, কাল সকালে হাওড়ায় এসে পৌঁছবে।

    তুমি যদি আজ রওনা হয়ে কলকাতায় যাও, তাকে যদি কোনও রকমে চিনতে পার, কোনও অছিলায় তার সঙ্গ নিতে পার, তা হলে হয়ত কথায় বার্তায় কতকটা সত্যনির্ণয় হয়।

    দেওয়ানজি এ কথা শুনিয়া তেমন উৎসাহ প্রকাশ করিলেন না। বলিলেন, অত লোকের মধ্যে কি তাকে খুঁজে বের করতে পারব?

    তাহার পর, দুইজনে অনেক্ষণ ধরিয়া এ বিষয়ের আলোচনা হইল। রাণীমা বলিলেন, যদি সে জুয়াচোর হত–তা হলে, পুরোণো এত সব কথা জানতে পারত কি? ছেলেবেলায় তার নাম যে পটলা ছিল, জানবে কি করে? –আর সে সময় কৰ্ত্তার চোখ উঠেছিল–তিনি বাস্তবিকই হলুদে ছোপান রুমাল হাতে করে, চোখে ঠুলি চশমা পরে বেড়াতেন–তোমার মনে আছে ত?

    দেওয়ানজি বলিলেন, খুব মনে আছে। ভবেনকে যখন খুঁজে পাওয়া গেল না–একদিন, দুদিন কেটে গেল–কেঁদে কেঁদে তার অসুখ বেড়ে গিয়েছিল। কাছারীবাড়ীর বারান্দায় বসে চক্ষুর যন্ত্রণায় তিনি আঃ–উঃ করছিলেন, আমি কাছে গিয়ে বললাম–দাদা, কেঁদে কেঁদে কি চক্ষু দুটি খোয়াবেন? একথা শুনে তিনি বললেন–ভাই, আমার চক্ষুর আলোই যখন চলে গেল, তখন এ চক্ষুতে আর প্রয়োজন কি? –বলে বেশী কাঁদতে লাগলেন। –বলিতে বলিতে দেওয়ানজির চক্ষুও সজল হইয়া উঠিল–রাণীমাও কাঁদিতে লাগিলেন।

    তাহার পর, বঙ্গবাসীতে বিজ্ঞাপনের কথা, কাশীর পাণ্ডাঠাকুরের কথা প্রভৃতিও উঠিল।

    রাণীমা বলিলেন, ভগবানের উপর নির্ভর করে থাকা যাক। যদি সত্যি সে ভবেন্দ্র হয়, তা হলে কোন না কোন উপায়ে তিনি ধরিয়ে দেবেনই। নইলে যে আমাদের সৰ্ব্বনাশ হবে! তাঁর ধর্মরাজ্যে এত বড় অধৰ্ম্ম তিনি কি হতে দেবেন? –তা, তুমি আর দেরী করো না। সকালে সকালে স্নানাহার সেরে বেরিয়ে পড়।

    দেওয়ানজি তখন রাণীমাকে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিলেন। পরদিন বেলা দশটার সময়, রাণীমার নামে দেওয়ানজির নিকট হইতে একখানি টেলিগ্রাম আসিল। তাহাতে লেখা আছে–

    কলিকাতা।
    ভবেন্দ্রবাবুকে সঙ্গে লইয়া বেলা তিনটার গাড়ীতে পৌঁছিব। ষ্টেশনে যানাদির বন্দোবস্ত রাখিবেন। কোনও চিন্তা নাই–ভগবান দয়া করিয়াছেন।
    রঘুনাথ মজুমদার

    এই তার পাইয়া, রাণীমার চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া আবার ধারা বহিল।

    লোকজন, পাইক বরকন্দাজ, পাল্কী বেহারা প্রভৃতি বেলা বারোটার সময় স্টেশন অভিমুখে রওনা হইল।

    কাছারির আমলারা সকলেই আজ ছুটী পাইয়াছে। গ্রামের লোক, সকলেই আনন্দিত–কেহ কেহ স্টেশন অবধি ধাওয়া করিয়াছে। অনেকে পরামর্শ করিতেছে, সময়মত তাহারা গ্রামের বাহিরে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকিবে–তাহাদের জমিদারকে অভ্যর্থনা করিয়া, বাদ্যভাণ্ডের সহিত গৃহে লইয়া আসিবে।

    রাণীমা আজ আনন্দের প্রতিমূর্তি। অন্যান্য অন্তঃপুরিকাগণ, ক্ষণে ক্ষণে কলহাস্যে গৃহখানি ভরিয়া ফেলিতেছে। দাসদাসীগণ নব বস্ত্র পরিধান করিয়া ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।

    সুরবালার মুখে আজ অনেক দিন পরে লোকে হাসি দেখিল। কনক বুঝিল তাহার চাকরিটি গিয়াছে, এ সংবাদ পাইলেই তাহার দাদা তাহাকে লইতে আসিবে–তথাপি সেও আজ প্রাণ খুলিয়া এ উৎসবে যোগদান করিয়াছে। তাহার বুকের ভিতর গানের পর গান গুঞ্জরিয়া উঠিতেছে–কিন্তু গাহিবার উপায় নাই। তাই সে ছট–ফট করিয়া বেড়াইতেছে।

    আর, অভাগিনী বউরাণী? অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাহাকে আজ বহুমূল্য বসন ভুষণে সজ্জিত হইতে হইয়াছে। সুরবালা একটি নিভৃত কক্ষে বসিয়া, বহু যত্নে গন্ধতৈল সহযোগে তাঁহার বেণী রচনা করিয়া দিতেছে! কক্ষান্তরে কয়েকজন নবীনা বসিয়া, রাশি রাশি ফুল লইয়া মালা গাঁথিতে ব্যস্ত।

    সূর্যাস্তের অল্পক্ষণ পরেই, গ্রামপ্রান্ত হইতে বাদ্যধ্বনি শ্রুতিগোচর হইল।

    অল্পক্ষণ পরেই হুম হুম্ করিয়া একখানি পাল্কী কাছারীবাড়ীর সম্মুখে আসিয়া থামিল। পাল্কী হইতে দেওয়ানজি নামিয়া তাড়াতাড়ি অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। রাণীমা, অন্যান্য কয়েকজন রমণী সহ দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া ছিলেন।

    দেওয়ানজি হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিলেন, ভবেনের পাল্কী, লোকজন সব সিদ্ধেশ্বরীতলায়। ভবেন মার পূজো দিচ্ছে। পাঁচখানা গ্রামের লোক সেখানে একত্র হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি আপনাকে খবর দিতে এগিয়ে এলাম।

    রাণীমা কাঁদিতে কাঁদিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, কতক্ষণে সে আসবে ঠাকুরপো?

    দেরি নেই, এল বলে।

    চক্ষু মুছিয়া রাণীমা কাতরস্বরে বলিলেন, কি করে তার দেখা পেলে? কোনও ভয়। নেই ত?

    দেওয়ানজি বলিলেন, না বউঠাকরুণ, কোনও ভয় নেই। আপনার ভবেনই বটে। কাশীর গাড়ীর অপেক্ষায় আমি হাওড়া স্টেশনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চিনে যে বের করতে পারব, এমন কোনও আশাই ছিল না। গাড়ী এল–হাজার লোক গাড়ী থেকে নেমে পড়ল। আমি মনে মনে ইষ্টনাম জপ করছি, আর সকলের মুখের দিকে চেয়ে দেখছি। এমন সময় গেরুয়া কাপড় পরা একজন যুবাপুরুষ, আমার কাছ দিয়ে যেতে যেতে, আমার মুখপানে চেয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। জিজ্ঞাসা করলে, আপনার নিবাস কোথা? আমি বললাম বাশুলিপাড়া। শুনে আমার মুখের দিকে খানিকক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল–তার পরে বললে, দেওয়ান কাকা? –আমি বললাম, তুমি কি ভবেন? –বলেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সেও যত কাঁদে, আমিও তত কাঁদি।

    রাণীমা কিয়ৎক্ষণ ধরিয়া কাঁদিলেন। তাহার পর কতকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া বলিলেন, এখনও গেরুয়া ছাড়েনি?

    সে অন্য কাপড় পাবে কোথা? এখানে এলেই তাকে গেরুয়া ছাড়িয়ে নেব। বাদ্যভাণ্ড ক্রমে নিকট হইতে নিকটতর হইতে লাগিল। ক্রমে লোকজনের হৈ হৈ শব্দ আরও স্পষ্ট হইয়া আসিল। ক্রমে সেই জনসঙ্ঘ কাছারীর সম্মুখে উপনীত হইল।

    দেওয়ানজি বাহির হইয়া হাঁকিলেন, লোকজন–তফাৎ। পাল্কী অন্দরের দরজায় এনে লাগাও।

    পাইক বরকন্দাজগণ হাঁকিতে লাগিল, তফাৎ–তফাৎ–পাল্কী আন।

    পাল্কী আসিয়া অন্তঃপুর দ্বারের বাহিরে লাগিল। রাখাল, নামিয়া দাঁড়াইল।

    রাণীমা, পাগলিনীর মত ছুটিয়া গিয়া বাবা–এলি–বলিয়া তাহাকে বক্ষে বাঁধিয়া ফেলিলেন। অন্তঃপুর হইতে গভীর হুলুধ্বনি ও প্রবল শঙ্খনাদ উত্থিত হইয়া দিঙ্মণ্ডল প্রকম্পিত করিতে লাগিল।

    ০৫. লোকে কি বলিল?

    রাণীমা নিজপুত্রজ্ঞানে, একরকম বুকে করিয়াই রাখালকে অন্তঃপুরমধ্যে লইয়া গেলেন।

    কাছারীবাড়ীর বিস্তৃত প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। পাল্কীর সঙ্গে সঙ্গে যাহারা আসিয়াছিল, তাহারা ছাড়া ক্রমে ক্রমে আরও লোক আসিয়া জমিতে লাগিল। সকলেরই মুখে একটা তীব্র কৌতূহল। যাহারা পরে আসিয়াছে, তাহারা পূৰ্বাগতগণকে বাবু সম্বন্ধে নানাবিধ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল।

    যে কয়েকজন ভদ্রলোক মাতব্বর ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, দেওয়ানজি তাহাদের আহ্বান করিয়া, বৈঠকখানার মধ্যে আনিয়া বসাইলেন। আমাদের পূৰ্ব্বপরিচিত ভট্টাচাৰ্য মহাশয়, বিশ্বেশ্বরবাবু ও হরিদাস গোস্বামীও তাহার মধ্যে ছিলেন।

    ভৃত্য তামাক দিয়া গেল। উপস্থিত ভদ্রলোকগণের প্রশ্নে, হাওড়া স্টেশনে সাক্ষাৎ হইতে আরম্ভ করিয়া সকল সংবাদ দেওয়ানজি বিবৃত করিতে লাগিলেন। পিতৃবিয়োগ ও ভ্রাতৃবিয়োগ সংবাদে বাবু কিরূপ অস্থির ও শোকাকুল হইয়া পড়িয়াছেন, কত কষ্টে কত প্রবোধ বাক্যে দেওয়ানজি তাহাকে কথঞ্চিৎ শান্ত করেন, সে সব কথা বলিলেন। শেষে জিজ্ঞাসা করিলেন–আচ্ছা ভট্টাচায্যি মশায়, এখন বাপের মৃত্যুসংবাদ শুনলে ত স্নানে শুদ্ধি? শোনাবার পর কলকাতাতেই ওঁকে আমি গঙ্গাস্নান করিয়ে এনেছি।

    ভট্টাচাৰ্য্য বলিলেন, দুবৎসর হয়েছে কি?

    না, এই কটা দিন বাকী আছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্থীতে দুবৎসর পূর্ণ হবে।

    ভট্টাচাৰ্য বলিলেন, তা হলে ত সদ্যঃশৌচ নয়। অন্য কোনও সপিণ্ড হলে তা হত–এ যে মহাগুরু! একরাত্রি অশৌচ হবে। কাল সকালে গঙ্গাস্নান করে শুদ্ধ হবেন।

    দেওয়ানজি বলিলেন, বটে? তবে ত ভুল হয়ে গেছে। বাবুকে সেটা জানাতে হবে।

    এই সময় অন্তঃপুর হইতে এক ব্যক্তি আসিয়া বলিল, দেওয়ানজি, বেহারারা রাণীমার কাছে বখশিসের জন্যে দরবার করেছে। তিনি হুকুম দিয়েছেন, প্রত্যেক বেহারাকে এক একটা করে গিনি আর এক–এক থান কাপড় দিতে।

    দেওয়ানজি উঠিয়া গেলেন। লোহার সিন্দুক খুলিয়া, বারোটা গিনি লইয়া বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলেন। কাহার বারোজনকে ডাকিয়া, রাণীমার হুকুম শুনাইয়া বলিলেন, কাপড় ত এখন কেনা নেই, সে কাল পাবি। এখন এই নে, এক একটা করে গিনি।

    এই দৃশ্য দেখিয়া সমবেত প্রজাবর্গ আনন্দে চঞ্চল হইয়া উঠিল। স্থানে স্থানে চুপি চুপি লোকে বলাবলি করিতে লাগিল, রাণীমা, বাবুকে নিজের ছেলে বলে নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন, নইলে গিনি বখশিসের হুকুম দিতেন না।

    দেওয়ানজি ফিরিয়া আসিয়া ভদ্রমণ্ডলীর মধ্যে আবার বসিলেন। ক্রমে দুই এক কথায়, পত্রের কথা উঠিল। দেওয়ানজি বলিলেন, সে রেজেষ্টারি চিঠি যখন এল, তখন ভট্টাচায্যি মশাই, মিত্তিরজা, গোঁসাই–সকলে আমার অপিসে ত বসে।

    একজন কৌতূহল দমনে অসমর্থ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, সে চিঠিতে কি লেখা ছিল?

    দেওয়ানজি বলিলেন, আজকে এসে পৌঁছবেন লেখা ছিল। কোথা গেল চিঠিখানা–পকেটেই ত রেখেছিলাম। হ্যাঁ এই যে। –বলিয়া পত্রখানি বাহির করিয়া পড়িতে চেষ্টা করিলেন। তখন দিবালোকে অত্যন্ত ম্লান হইয়া আসিয়াছিল। বলিলেন–চশমাখানা কাছে নেই–তুমি পড় গোঁসাই। হেঁকে হেঁকে পড়।

    অত্যন্ত আগ্রহে পত্রখানি লইয়া হরিদাস পড়িয়া সকলকে শুনাইতে আরম্ভ করিল। বলা বাহুল্য, কেবলমাত্র ইহাদের কৌতূহল নিবৃত্তিই দেওয়ানজির উদ্দেশ্য নহে। বাবুর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে যাহাতে তাঁহারা নিঃসন্দেহ হইতে পারেন পত্রোক্ত কথাগুলি ক্রমে মুখে মুখে গ্রামময় প্রচারিত হইয়া যায়, ইহাই তাঁহার আন্তরিক ভাব।

    এই সময়ে একজন আসিয়া বলিল, দেওয়ানজি, রাণীমা আপনাকে ভিতরে ডাকছেন।

    দুই তিনজনে লোকটিকে জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কি করছেন হে?

    সে বলিল, হাত পা ধুয়ে উপরে গেছেন।

    বাবু কি এখন বাইরে আসবেন?

    কি জানি!–বলিয়া লোকটি প্রস্থান করিল।

    দেওয়ানজি বলিলেন, আমি হলে অন্দরে যাই–আপনারা কি বসবেন?

    কেহ কেহ বলিল, বাবু কি এখন বাইরে আসবেন? –যদি আসেন তা হলে বসি।

    দেওয়ানজি বলিলেন, শ্রান্ত হয়ে এসেছেন, এখন বোধ হয় বেরুবেন না। কাল আপনারা এলে নিশ্চয়ই দেখা হবে।

    বিশ্বেশ্বরবাবু বলিলেন, তা হলে আমরা এখন উঠি; সন্ধ্যা হল। আপনি আমাদের নাম করে বরং তাঁকে বলবেন, আমরা দেখা করবার জন্যে বসে ছিলাম।

    হ্যাঁ, তা বলব বইকি। –বলিয়া দেওয়ানজি প্রস্থান করিলেন।

    ভদ্রলোকগণও উঠিলেন। প্রাঙ্গণে নামিয়া দেখিলেন অন্তঃপুর হইতে আগত একজন। ভৃত্যকে কয়েকজন ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ভৃত্য বলিতেছে–রাণীমা বললেন–বাবা, এলি, যদি দুটো বছর আগে আসতিস–তা হলে কত্তা মনের সুখে স্বর্গে যেতে পারতেন। রাণীমাও যত কাঁদছেন বাবুও তত কাঁদছেন।

    ইহাদের প্রস্থান করিতে দেখিয়া, প্রাঙ্গণস্থিত জনতাও ভাঙ্গিতে আরম্ভ করিল। ক্ষুদ্র বৃহৎ দল বাঁধিয়া, সারাপথ সকলে তর্কবিতর্ক করিতে করিতে চলিল। যে সকল দোকানে বা বৈঠকখানায় বা চণ্ডীমণ্ডপে সন্ধ্যার পর পাঁচজনের আড্ডা জমিয়া থাকে, সেই সকল স্থানে আজ লোক গিগিস করিতেছে। সৰ্ব্বস্থানেই তর্কের বিষয় একটি মাত্র–যিনি আসিয়াছেন তিনি বাস্তবিক বাবু কিনা। তবে তর্কটা অধিকাংশ স্থলেই কাঁচাচুল–ওয়ালা ব্যক্তিগণের মধ্যে আবদ্ধ। ইহাদের অনেকেই বলিতেছে বাবু নয়, প্রবঞ্চক; আবার কেহ কেহ এ মতের খণ্ডন করিতে চেষ্টা করিতেছে। যাহাদের চুল পাকিয়াছে, তাহারা হাঁ না কোন কথাই বলিতেছে না। যাহাদের চুল ও গোফ দুই পাকিয়াছে, তাহারা অনেকেই। বলিতেছেন–নিশ্চয় ভবেন্দ্রবাবু। জুয়াচোরের কি সাধ্যি যে দেওয়ানজির চোখে, রাণীমার চোখে ধুলা দেয়?

    বিশ্বেশ্বর মিত্রের বৈঠকখানাটিও পাড়ার একটি প্রসিদ্ধ আড্ডা। আঁট দশজন লোক তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিয়াছিল। তাহাদিগকে বসাইয়া মিত্রজা বাড়ীর ভিতর গিয়া জলযোগে মন দিলেন।

    প্রায় আধঘণ্টা পরে বাহিরে আসিয়া, বৈঠকখানার বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়াইয়া শুনিলেন সুরেশ গাঙ্গুলী (চুল গোফ দুই পাকা) বলিতেছেন, আচ্ছা উনি যদি ভবেন্দ্রবাবুই না হবেন, তা হলে হাওড়া স্টেশনে, হাজার লোকের মধ্যে দেওয়ানজিকে চিনে ফেললেন কি করে?

    হরিদাস গোস্বামী হাত নাড়িয়া, উত্তেজিত স্বরে বলিতেছে, মশাই এইটে আর বুঝতে পারছেন না? যে লোক, এতটা বিষয় সম্পত্তি হাতাবার লোভে কারসাজি করে এসছে, সে আর একটু গোড়া বেঁধে আসে না? আগে থেকে চিনে ঠিকঠাক করে রেখেছে।

    বৃদ্ধ গাঙ্গুলী বলিলেন, আচ্ছা তা হলে ষোল বচ্ছর আগে কর্তার চোখ–ওঠা আর হলদে রুমালের কথা জানলে কি করে? চিঠি ত তুমি নিজেই পড়লে!

    গোস্বামী বলিল, কি করে জানলে জিজ্ঞাসা করছেন? জানবার শত শত উপায় রয়েছে। এই দেওয়ানজি কত জায়গায় যাচ্ছেন–কৃষ্ণনগর যাচ্ছেন–কলকাতায় যাচ্ছেন। কত লোকের সঙ্গে মিশছেন কত গল্প করছেন। কোথাও ঐ কথা গল্প করে থাকবেন। জুয়াচোর সেই কথাটি এখন নিজের কায়ে লাগিয়ে দিলে। নইলে চিঠিতে ওকথা লিখবে কেন? ঐ রকম কথাবার্তা চিঠিতে থাকলেই হঠাৎ লোকের বিশ্বাস হবে, এইটি ভেবে চিন্তে বুঝে সুঝে লেখা।

    গাঙ্গুলী বলিলেন, যাই বল, আমার ত খুব বিশ্বাস উনি ভবেন্দ্রবাবু।

    গোস্বামী বলিল, কলকাতার পাকা জুয়াচোর।

    বিশ্বেশ্বর বারান্দায় দাঁড়াইয়া এই সকল কথা শুনিতেছিলেন। ঘরের মধ্যে প্রবেশ না করিয়া, অন্তঃপুরে ফিরিয়া গেলেন এবং পুত্রকে পাঠাইয়া হরিদাস গোস্বামীকে ডাকাইয়া আনিলেন।

    হরিদাস আসিলে তাহাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, বলি হ্যাঁ হে–এতখানি বয়স হল, বুড়ো মিনসে হলে, এখনও কি তোমার জ্ঞানকাণ্ড কিছুই হল না?

    হরিদাস ভাবিয়া আসিয়াছিল, বোধ হয় বাড়ীতে জলযোগের কোনও নূতন আহাৰ্য্য আজ প্রস্তুত হইয়াছে, তাই ডাক পড়িয়াছে–কারণ মাঝে মাঝে এইরূপ হইয়া থাকে। সুতরাং মিত্রজার মুখভঙ্গি দেখিয়া সে একটু হতভম্ব হইয়া পড়িল। শঙ্কিতস্বরে জিজ্ঞাসা করিল–কেন কি হয়েছে?

    মিত্রজা বলিলেন, বুদ্ধিমান! সকলের মাঝখানে তুমি জুয়াচোর জুয়াচোর করছ কেন? যাদের লোক, তারা ওকে ভবেন্দ্র বলেই স্বীকার করে নিয়েছে দেখছ। দেওয়ানজির বিশ্বাস হয়েছে, রাণীমার বিশ্বাস হয়েছে। তুমি জুয়াচোর জুয়াচোর কর কোন্ সাহসে হে?

    গোস্বামী বলিল, তা, আমার যদি জুয়াচোর বলেই ধারণা হয় আমি বলব না?

    বিশ্বেশ্বর মুখ খিঁচাইয়া বলিলেন, বলতে হয় তুমি নিজের বাড়ীতে বসে বলগে যাও। আমার বৈঠকখানায় বসে বলতে পাবে না।

    গোস্বামী এবার একটু দমিয়া গেল। বিশ্বেশ্বরের রাগের কারণটা অনুধাবন করিতে পারিল। স্বর নামাইয়া বলিল–তা, যদি বারণ কর, বলব না।

    বিশ্বেশ্বর এবার অপেক্ষাকৃত কোমলভাবে বলিলেন, আসলই হোক আর নকলই হোক–ও আজ লাখ টাকা মুনাফার সম্পত্তির মালিক গ্রামের জমিদার। তুমি যে ওকে জুয়াচোর জুয়াচোর বলছ, এ কথা কি ওর কানে উঠবে না? উঠলে, তোমাকে কি আর এ গ্রামে বাস করতে দেবে? ঐ গাঙ্গুলীটি ত একটি গেজেট বিশেষ–কালই গিয়ে লাগাবে। তখন?

    গোস্বামীর একটু ভয় হইল। বলিল–তাই ত!–বলিয়া অধোবদনে দাঁড়াইয়া রহিল!

    বিশ্বেশ্বর বলিয়া যাইতে লাগিলেন, যদি বাস্তবিক জুয়াখোর হয়, তাহলে সাংঘাতিক হবে। এখন যারা যারা ওকে নকল বলে সন্দেহ করবে, ও তাদের বিষম শত্রু বলে গণ্য করবে। ও কি তাদের সহজে ছাড়বে?

    গোস্বামী বলিল, সে ত ঠিক কথা। .তবে? তোমার এত তর্কাতর্কির দরকারটা কি শুনি? তুমি ত ওর ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিজের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিচ্ছ না! সত্যি হোক আর জাল হোক সে রাণীমা বুঝবে, বউরাণী বুঝবে। তোমার আমার মাথাব্যথা কিসের? খাও দাও কাসি বাজাও–পরের কথায় থাকতে আছে? –এখন যাও বাইরে বসগে। আমি একটু পরে আসছি।

    গোস্বামী মাথা গুঁজিয়া প্রস্থান করিল। পাঁচ মিনিট পরে বিশ্বেশ্বরও বাহির হইয়া আসিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, পাড়ার সুবল মুখুয্যে আসিয়া বলিল, ওহে শুনেছ? ।

    সকলে উৎসুক হইয়া বলিল, কি? কি?

    আমার মা বৈকালে বাবুদের বাড়ী গিয়েছিলেন। তিনি এসে দু–একটা খবর বললেন, তাতে স্পষ্টই বোধ হচ্ছে যিনি এসেছেন তিনি আসল ভবেন্দ্রবাবুই বটে।

    সকলে অতিমাত্র উৎসুক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি রকম? কি রকম?

    সুবল মুখুয্যে তখন জাকিয়া বসিয়া বলিল, শোন তবে বলি! ভবেন্দ্রবাবু পাল্কী থেকে নামলেই, রাণীমা ত বুকে করে তাকে অন্দরে নিয়ে গেলেন। সে ত তোমরা দেখেই এসেছ। বারান্দায় পা ধোবার জল–টল ছিল, জলচৌকি পাতা ছিল। বাবু পা ধোবার জন্যে সেই চৌকিতে বসলেন। রামা খানসামা তোয়ালে কাঁধে করে এসে দাঁড়াল, বাবুকে প্রণাম করলে। বাবু তার মুখপানে চেয়ে বললেন–রামা না? রামা অমনি ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল।

    বিশ্বেশ্বরবাবু বলিলেন, বটে!–তা হলে ত ভবেন্দ্র বাবুই–কোন সন্দেহ নেই। পুরানো চাকর কিনা, দেখেই চিনে ফেলেছেন?

    দুই তিনজন বলিয়া উঠিল, তার পর? তার পর?

    মুখুয্যে বলিল, তাই দেখে নাকি রাণীমা বলেছেন–দেখলি রামা, তুই যে বলেছিলি, এতদিন পরে বাবু কি করে আমায় চিনতে পারবেন? দেখলি? দেখু! তুই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলি, তোকে আর চিনতে পারবে না? বাবু তাই শুনে বললেন–চিহ্ন করে রেখে গেছি, চিনতে পারবো না? রাণীমা জিজ্ঞাসা করলেন, কি চিহ্ন? বাবু বললেন, রামাকেই জিজ্ঞাসা কর না মা। রামা ডানদিকের কপালে হাত দিতে লাগল। বাবু বললেন, যে বছর আমার পৈতে হয়, একদিন বিকালে আমি আর ঘোষেদের ছেলে নবীন, পেঁয়াজের ফুলুরি কিনে আনিয়ে ইস্কুলের পুকুরের ধারে চুপিচুপি বসে খাচ্ছিলাম। রামা কি করতে সেদিকে গিয়েছিল, তাই দেখতে পায়। দেখেই বললে–আঁ দাদাবাবু–একেবারে খৃষ্টান হয়ে গেলে? বলে দিচ্ছি গিয়ে কৰ্ত্তাকে। এই শুনে, রেগে একটি ইট মেরেছিলাম ঘুড়ে, ওর ডানদিকের কপাল কেটে ঝর ঝর করে রক্ত পড়তে লাগল। ও ত বাপ বলে সেইখানে বসে পড়ল। আমি আর নবীন দুজনে গিয়ে, ওকে তুলে এনে, জলের ধারে বসিয়ে সেই রক্ত ধুইয়ে দিই, জামা ছিঁড়ে জলপটি বেঁধে দিই, তবে ও সুস্থ হয়!–রাণীমা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে; একদিন রামা মাথায় পটি বেঁধে এসেছিল। কিন্তু আমাকে ত বলেছিল, জামরুল পাড়তে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে মাথা কেটে গেছে। রামা বললেহ্যাঁ মা, আমি তাই বলেছিলাম।

    বৈঠকখানাশুদ্ধ লোক মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া এই কাহিনী শুনিতেছিল। দুই মিনিট কাল সকলে নিস্তব্ধ থাকিয়া আবার কথাবার্তা আরম্ভ করিল। কেহ বলিল, আর কোন সন্দেহই রইল না। কেহ বলিল, আমি ত গোড়াগুড়িই তাই বলছি!

    গাঙ্গুলী মহাশয় হরিদাসের প্রতি চাহিয়া শ্লেষের সহিত বলিলেন, কি হে গোঁসাই–কথা কচ্চ না যে?

    হরিদাস বলিল, না গাঙ্গুলী মশায়–আমারই ভুল হয়েছিল–স্বীকার করছি। আপনারা হলেন বহুদর্শী লোক–কত দেখেছেন, কত শুনেছেন, যা বলেছিলেন–অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।

    মিত্রজা বলিলেন, পরামর্শ নিতে হলে, পাঁচখানা গ্রামের লোক ঐ গাঙ্গুলী মশায়ের কাছেই যায়! কেন যায়? তোমার কাছে ত আসে না। আমার কাছে ত আসে না। ওঁর কাছে কেন যায়?

    এ প্রশ্নের উত্তর কেহ দিল না, কেবল গাঙ্গুলী মহাশয় প্রসন্নভাবে শিরশ্চালনা করিতে লাগিলেন। অতঃপর ভবেন্দ্রকে কবে কে কোথায় কি করিতে দেখিয়াছিল, কি বলিতে শুনিয়াছিল, নিজ নিজ স্মৃতিসাগর মন্থন করিয়া একে একে তাহাই উত্তোলন করিতে লাগিল। ক্রমে রাত্রি প্রায় এক প্রহর হইল। তখন একে একে সকলে উঠিয়া গৃহাভিমুখী হইল।

    পথে আজ এখনও বহুলোক যাতায়াত করিতেছে। স্থানে স্থানে এক এক দল স্ত্রীলোকও দেখা যাইতে লাগিল। ইঁহারা সকলেই গিন্নীবান্নী–শ্রেণীভুক্তা–বাবুদের অন্তঃপুর হইতে প্রত্যাবর্তন করিতেছেন।

    গোস্বামী গৃহে গিয়া আহারে বসিল। তাহার সহধর্মিণী অনতিদূরে বসিয়া পাখা লইয়া তাহাকে বাতাস করিতে করিতে বলিলেন, বাবুদের বাড়ী থেকে তোমায় নেমন্তন্ন করতে এসেছিল যে।

    কেন, কিসের নেমন্তন্ন?

    বাবুদের বাড়ী কাল সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হবে। বাড়ীশুদ্ধ সবাইকার নেমন্তন্ন।

    গোস্বামী ঘাড় হেঁট করিয়া বলিল, সত্যনারায়ণ মাথায় থাকুন আমাদের যাওয়া হবে না।

    স্ত্রী বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন?

    গোস্বামী এদিক ওদিক চাহিয়া, নিমস্বরে বলিল, কোথাকার এক জোচ্চোর এসেছে। ভবেন্দ্র সেজে–কি জাত তার ঠিকানা নেই–তার বাড়ীতে খেয়ে কি জাতটি খোয়াব?

    গৃহিণী বলিল, জোচ্চোর কি গো–সবাই ত বলছে যে আসল! গোস্বামী বিরক্তির স্বরে বলিল, বেশ ত গো–আসল বলেই তোমার বিশ্বাস হয়–তুমি যেও। বউরাণীর পাতের প্রসাদ পেয়ে এস। সাবিত্রীব্রত করার ফল হবে!

    কেন বউরাণী কি সাবিত্রী নন? –সাবিত্রীরই সমান। নইলে ষোল বছরের নিরুদ্দেশ স্বামীকে কে কবে ফিরে পায়?

    গোস্বামী বলিল, হ্যাঁ–আজ থেকেই তিনি সাবিত্রীর আসনটা পেলেন বটে। সত্যবানটি যুটেছে ভাল!

    গৃহিনী বলিলেন, কি তোমার যে সন্দিগ্ধ মন! এখন ছমাস ত ওঁর সঙ্গে বউরাণীর মোটেই দেখা হবে না।

    কেন? দেখা হবে না।

    শোননি?

    না। ব্যাপার কি?

    গৃহিনী বলিতে লাগিলেন–ও বাড়ীর মেজখুড়ী এই কতক্ষণ হল বাবুদের বাড়ী থেকে ফিরলেন কিনা। তিনি বললেন বৈঠকখানায় উপরতলার ঘরে ভবেন্দ্রবাবুর বিছানা হচ্ছে। বাবু নাকি একটা কি ব্রত নিয়েছেন–সাত বছর সে ব্রত করতে হয়, তার সাড়ে ছবছর হয়ে গেছে–আর ছমাস হলেই উদ্যাপন হয়। সেই ব্রত উদযাপন না হওয়া পর্যন্ত উনি সন্ন্যাসীর মত থাকবেন। রাণীমা নাকি অনেক আপত্তি অনেক কাঁদাকাটা করেছিলেন–বলেছিলেন ষোল বছর ধরে কত যাগযজ্ঞ তপস্যা করেছ ত, একটা ব্রত না হয় পণ্ডই হয়ে যাক–তোমার গেরুয়া কাপড় আমি আর দেখতে পারব না। তাতে বাবু নাকি বলেছেন–মা, এই ব্রতটি পূর্ণ হলে–আমার একশো কুড়ি বছর পরমায়ু হবে–এতদিন কষ্ট করে শেষে ছমাসের জন্যে সেটি খোয়াব? –তাই শুনে রাণীমা রাজি হয়েছেন। গেরুয়া পরে থাকবেন–হবিষ্যি করবেন–স্ত্রী ছোঁবেন না।

    হরিদাস গোস্বামী আর কোনও মতামত প্রকাশ করিল না। নীরবে আহার শেষ করিয়া উঠিল। মনে মনে বলিতে লাগিল, সত্যিই কি তবে ভবেন্দ্র না কি? –কে জানে। –কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

    ০৬. রাখাল নূতন জিনিস দেখিল

    আহারাদির পর রাখাল রাণীমার নিকট বিদায় লইতে গেল। বলিল–মা–তবে এখন যাই, শুইগে।

    রাণীমা বলিলেন, বাবা একটা কথা বলি, শুনবে?

    কি মা?

    বউমার সঙ্গে একবার দেখাটি কর। দেখা করতে কি কোনও দোষ আছে?

    রাখাল একটু বিপন্ন হইল। সে ব্রত ধারণের অছিলা করিয়াছিল, তাহার কারণ আর কিছুই নহে–বউরাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পিছাইয়া দেওয়া। এই স্থানটিতে তাহার মনে একটু সঙ্কোচ ছিল। যখন ভবেন্দ্র সাজিয়াছে, তখন সৰ্বাংশে ভবেন্দ্র ত হইতেই হইবে–তথাপি কিছুদিন যাউক না। শীতকালের দিন, স্নান করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া গিয়াও, জলের ধারে বসিয়া লোকে যেমন একটু বিলম্ব করে রাখালের মনোভাবও তদ্রুপ।

    তাহাকে নীরব দেখিয়া রাণীমা বলিলেন, মা আমার সতী লক্ষ্মী–ওঁর মুখ দেখে আমার বুক ফেটে যায়। তুমি যদি ওঁর সঙ্গে দেখাটি না কর, তা হলে সেটা ওঁর লাগবে। বুঝতে পারছ না বাবা?

    রাখাল বলিল, ব্ৰতটা যতদিন উদ্যাপন না হচ্ছে–সেটা কি উচিত হয় মা!

    না বাবা–কোন দোষ হবে না। তুমি ত বলেছ স্ত্রীকে ছুতে বারণ। তা নাইবা ছুঁলে–তিনি দূরে থাকবেন এখন। মুখের কথা কইতে আর কি দোষ?

    তাঁহার আগ্রহ দেখিয়া রাখাল সম্মত হইল। বউরাণীকে দেখিবার জন্য তাহার মনে যে একটু কৌতূহল না ছিল এমন নহে।

    রাণীমা বলিলেন, তবে এইখানেই তাঁকে ডেকে দিই। –বলিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন।

    এই কক্ষখানি রাখালের ব্যবহারের জন্য আজই সজ্জিত হইয়াছে। বউরাণীর বসিবার কক্ষ হইতে কতক আসবাব, ছবি, পুস্তক প্রভৃতি আসিয়াছে।

    রাণীমা চলিয়া গেলে, বাতিগুলা রাখাল বেশী উজ্জ্বল করিয়া দিল। অল্পক্ষণ পরে রেশমী বস্ত্রের একটা খস্ খস্ শব্দ এবং অলঙ্কারের মৃদুশিঞ্জন শুনিয়া দ্বারপানে চাহিয়া দেখিল–অৰ্দ্ধাবগুণ্ঠনে একটি সুন্দরী যুবতীমূর্তি প্রবেশ করিতেছে। দ্বারদেশে অতিক্রম করিয়া তিনি থামিলেন–অবনত মুখে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

    রাখাল চেয়ারে বসিয়াছিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–এস।

    বউরাণী মৃদু মৃদু পদে অগ্রসর হইয়া আসিলেন। রাখালের সম্মুখীন হইয়া, গলদেশে অঞ্চলগ্র বেষ্টনান্তর নতজানু হইবার উপক্রম করিলেন।

    রাখাল বুঝিল, তিনি প্রণাম করিতে উদ্যত হইয়াছেন। ব্যস্ত হইয়া বলিল, না না–প্রণাম কোরো না। এখনও আমার অশৌচ রয়েছে।

    বউরাণী মুহূর্তকাল দ্বিধা করিলেন। তাঁহার ইচ্ছা হইল বলেন, আমার কাছে তুমি কোনও অবস্থাতেই অশুচি নও। –কিন্তু সে কথা উচ্চারণ করিতে পারিলেন না। রাখালের পানে দৃষ্টিপাত করিয়া কেবলমাত্র বলিলেন–তা হোক। –বলিয়া প্রণতা হইলেন।

    রাখাল তাহার কণ্ঠস্বর শুনিল, অশ্রুজল–পবিত্র চক্ষু দুইটি দেখিল–তাহার মস্তকের কেশ হইতে পদনখাগ্র অবধি যেন একটা বিদ্যুতের তরঙ্গ বহিয়া গেল।

    বউরাণী উঠিয়া দাঁড়াইলেন।

    সম্মুখস্থিত সোফাটি নির্দেশ করিয়া রাখাল বলিল, বস। –বলিয়া সে নিজের চেয়ারখানিতে বসিল।

    বউরাণী উপবেশন করিলে রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, কেমন আছ?

    মৃদুস্বরে উত্তর হইল, ভাল।

    প্রায় দুই মিনিট কাল উভয়ে নিস্তব্ধ। অসহ্য হইয়া উঠিলে রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে তোমার মনে পড়ে?

    বউরাণী অবনতমুখেই বলিলেন, পড়ে।

    আবার দুইজনে নীরব। নিস্তব্ধ রজনী–ভিতরে বাহিরে কোথাও শব্দ মাত্র নাই। এমন সময় ঘড়িটা মুখর হইয়া উঠিল–ঠং ঠং করিয়া এগারোটা বাজিল।

    ঘড়ির শব্দ থামিলে রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, সব শুনেছ ত? বউরাণী পূৰ্ব্ববৎ উত্তর করিল, শুনেছি।

    এখন ছমাস আমায় এইভাবে থাকতে হবে। –কণ্ঠস্বর একটু নৈরাশ্যব্যঞ্জক করিয়াই রাখাল কথাগুলি বলিল।

    বউরাণীর ওষ্ঠযুগল ঈষৎ স্পন্দিত হইল–যেন তিনি কি বলিবেন বলিবেন। কিন্তু কোনও কথা উচ্চারিত হইল না। অঞ্চলের একটি প্রান্ত বামহস্তে ধারণ করিয়া, নতনেত্রে রেশমের ফুলগুলির পরীক্ষায় মনোনিবেশ করিলেন।

    রাখাল বলিল, তুমি দুঃখিত হবে না?

    এইবার বউরাণী মুখ তুলিলেন। ঈষৎ হাসিয়া রাখালের পানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–কেন?

    বউরাণীর চক্ষুযুগল এই দ্বিতীয়বার রাখালের উপর স্থাপিত হইল। সেবার দেখিয়াছিল অশ্রুবাষ্পে পবিত্র–এবার দেখিল হাস্যবিভায় সমুজ্জ্বল। রাখালের মাথা ঘুরিতে লাগিল। তাহাকে নীরব দেখিয়া বউরাণী ধীরে ধীরে কোমল কণ্ঠে বলিলেন, তোমাকে দিনান্তে যদি একটিবার দেখতে পাই, তা হলে দুঃখিত হব না।

    রাখাল দেখিল বউরাণীর মুখখানি স্নেহে সরলতায় পবিত্রতায় যেন ঝলমল করিতেছে। রমণীর মুখে এমন দিব্য জ্যোতিঃ সে পূৰ্বে ত কখনও দেখে নাই। স্ত্রীলোকের মধ্যে এতটা কোমলতা এতখানি স্নেহভক্তি তাহার পক্ষে একেবারেই নূতন।

    এইবার কোন্ কথা বলা যায়, রাখাল ব্যাকুল হইয়া তাহাই চিন্তা করিতে ছিল, কিন্তু একটি কথাও যোগাইল না। তাহার মনে হইতে লাগিল, এখন ছুটি পাইলে বাঁচে, কিন্তু ইহাকে বিদায় দিবার জন্যও যে কথা আবশ্যক। এমন সময় বউরাণী মৃদু স্বরে বলিলেন, তোমাকে ভারি শ্রান্ত দেখাচ্ছে, অনেক রাত হয়েছে–শোওগে যাও।

    রাখাল বাঁচিল। বলিল–হ্যা এখন উঠি। কাল আবার দেখা হবে।

    বৈঠকখানা বাড়ীতে দ্বিতলস্থ নিভৃত কক্ষে সুকোমল শয্যায় শয়ন করিয়া, অনেকক্ষণ রাখালের নিদ্রা আসিল না। কেবল বউরাণীর মুখখানি সে মনে মনে ধ্যান করিতে লাগিল।

    ০৭. নানা কথা

    রাখালের যখন নিদ্রাভঙ্গ হইল, তখন রৌদ্র উঠিয়াছে। তিনদিকের ভিত্তিগাত্রে দুইটি করিয়া ছয়টি বড় বড় জানালা–সকলগুলিই খোলা। বিছানায় পড়িয়া, জানালাপথে বাহিরের দিকে সে চাহিয়া রহিল। আম, কাঁঠাল, জামরুল প্রভৃতি ফলের অনেকগুলি গাছ দেখা যাইতেছে। আমগাছের শাখায় শাখায় ছোট বড় মাঝারি অজস্র আম ঝুলিতেছে–অধিকাংশই এখনও সবুজ–তবে এক একটায় রঙও ধরিয়াছে। জামগাছগুলিও সবুজ, লাল, কালো–সকল রঙের ফলে ভারাক্রান্ত। বাগানের এই গাছগুলি রাখাল দেখিতে লাগিল–আর ভাবিতে লাগিল–এ সমস্তই আমার–সমস্তই আমার!

    যে কক্ষখানিতে রাখাল শয়ন করিয়াছে–গতরাত্রে সেখানি ভাল করিয়া সে দেখে নাই। এখন দেখিতে লাগিল, মহার্ঘ গৃহসজ্জায় সেখানি সজ্জিত। কিয়দ্দূরে একটি বড় গোলাকার টেবিল রহিয়াছে, তাহার উপরিভাগ মর্মরমণ্ডিত, মধ্যস্থল হইতে কারুকার্যময় একটি মোটা পায়া নামিয়াছে, তাহার পর তিনটি শাখায় বিভক্ত হইয়া কক্ষতল স্পর্শ করিয়াছে। জিনিষটি মেহগনি কাঠের বলিয়াই বোধ হয়। দুইদিকের দেওয়ালে দুইটি করিয়া চারিটি দেওয়ালগিরি–ফ্রেমগুলি রৌপ্যনির্মিত। কড়িকাঠ হইতে সবুজ রেশমের রজ্জুতে বিলম্বিত একটি প্রকাণ্ড ঝাড়ও রহিয়াছে, সেটি এখন ঘেরাটোপে আবৃত। দুইটি জানালার মধ্যস্থিত ভিত্তিভাগে একখানি বৃহৎ দর্পণ–তাহাতে পালঙ্কসুদ্ধ নিজের সম্পূর্ণ অবয়ব রাখাল প্রতিবিম্বিত দেখিল। ইহার ফ্রেমটিও রৌপ্যখচিত বহুমূল্য। কয়েকখানি ছবি এখানে ওখানে টাঙ্গানো রহিয়াছে–এগুলি সবই বিলাতী। আসবাবগুলি রাখাল দেখিতে লাগিল–আর মনে মনে ভাবিতে লাগিল, এ সমস্তই আমার–সমস্তই আমার!

    শয্যা হইতে নামিয়া দ্বার মোচন করিবামাত্র, দুইজন খানসামা উঠিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে প্রণাম করিল। একজন সঙ্গে করিয়া রাখালকে মুখাদি প্রক্ষালনের স্থানে লইয়া গেল, অপর জন শয্যাগ্রহ পাহারা দিবার নিমিত্ত রহিল।

    কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া রাখাল দেখিল, দেওয়ানজি অপেক্ষা করিতেছেন। তিনি বলিলেন, বাবা চল, গঙ্গাস্নান করবে। নাপিত এসেছে–খেউরী হয়ে নাও।

    খানসামা বাহিরের বারান্দায় একখানা চেয়ার দিল–রাখাল বসিয়া নরসুন্দরের হস্তে আত্মসমর্পণ করিল।

    স্নান করিয়া ফিরিতে আটটা বাজিল। রাখালকে অন্তঃপুরের মধ্যে রাখিয়া দেওয়ানজি কাছারিবাড়ী যাইতে উদ্যত হইলেন।

    রাখাল বলিল, কাকা, যান কোথা? এখানেই পূজো আহ্নিক করে একটু জল মুখে দিন।

    দেওয়ানজি বলিলেন, না বাবা, আমার আবার নানা রকম হাঙ্গামা আছে। আমি বাড়ী গিয়েই আহ্নিক করব। আমি ততক্ষণ বাইরে বসিগে, তুমি একটু জল খেয়ে এস।

    রাখাল বলিল, না, তা হলে আপনি বাইরে এখন অপেক্ষা করবেন না–একবারে বাড়ী যান–জলটল খেয়ে আসবেন। দুপুরবেলা আজ এইখানেই আপনাকে খেতে হবে কাকা।

    আচ্ছা–খাব এখন। –বলিয়া দেওয়ানজি প্রস্থান করিলেন।

    রাখাল পূজার ঘরে গিয়া, তাহার জন্য নির্দিষ্ট আসনখানিতে বসিল। রাণীমা নিকটে বসিয়া চন্দন ঘষিতেছিলেন।

    ইহাকে এখানে উপস্থিত দেখিয়া রাখাল মহা বিপদে পড়িল। ব্রাহ্মণের ছেলে, গায়ত্রীটা ভুলে নাই–মুখস্থই আছে–কিন্তু সন্ধ্যার মন্ত্র একবর্ণও তাহার মনে নাই। যখন উপনয়ন হইয়াছিল, তখন এক বৎসর কাল নিয়মিতভাবেই সে সন্ধ্যাৰ্চনা করিয়াছিল বটে কিন্তু তাহার পর আর সে চর্চা রাখে নাই। কখন জল লইয়া মাথায় ছিটাইতে হয়, কখন নাক টিপিতে হয়, কখন চোখ বুজিয়া ধ্যানস্থ হইতে হয়, কখন পৈতা দুই হাতে তুলিয়া ধরিতে হয়–এ সকল কিছুই ত তাহার স্মরণ নাই। রাণীমার সম্মুখে সন্ধ্যা করিবার ভান করিলে, তিনি তখনই হয়ত ফাঁকি ধরিয়া ফেলিবেন। তাই রাখাল আসনে বসিয়া, অঙ্গুলিতে পৈতা জড়াইয়া, একশত আটবার গায়ত্রী মন্ত্র মাত্র জপ করিয়া উঠিবার উপক্রম করিল।

    রাণীমা বলিলেন, হয়েছে বাবা?

    হ্যা মা, হয়েছে। আমাদের খালি শিবগায়ত্রী কিনা।

    তবে এস, একটু জল খাবে এস।

    জলযোগান্তে রাখাল সেই বসিবার কক্ষখানিতে গিয়া ধুমপান আরম্ভ করিল। মনে তাহার আশা ছিল, হয়ত বউরাণীর দেখা পাইবে। সেইজন্য মাঝে মাঝে উৎসুক নয়নে সে দ্বারের দিকে চাহিতেছিল। কিন্তু বউরাণী আসিলেন না। –আসিল একজন ভৃত্য। আসিয়া বলিল–হুজুর বৈঠকখানায় দেওয়ানজি আপনাকে বলে পাঠালেন, বাইরে অনেক লোকজন হুজুরের সঙ্গে দেখা করবে বলে এসেছে, একবার গেলে ভাল হত।

    রাখাল গম্ভীরভাবে বলিল, আচ্ছা–বলগে একটু পরে আসছি।

    আজ অনেকে দেখা সাক্ষাৎ করিতে আসিবে, রাখাল পূৰ্বেই তাহা অনুমান করিয়াছিল। কিরূপ আচরণ করিবে তাহাও ভাবিয়া চিন্তিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছিল। এইটি তাহার পক্ষে ভীষণ পরীক্ষা–এইখানেই প্রবল আশঙ্কা। গ্রামস্থ যাহারা সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছে–তাহাদের মধ্যে এমন কেহ কেহ থাকিতে পারে যাহাদের সহিত ভবেন্দ্র বিশেষ পরিচিত ছিল, অথচ আত্মজীবনীতে সে লোক সম্বন্ধে বিশেষ কিছু সে লিপিবদ্ধ করে নাই।

    কপাল ঠুকিয়া, বাহিরে গিয়া সমবেত ব্যক্তিগণের মধ্যে রাখাল উপবেশন করিল। অত্যন্ত সাবধানে কথাবার্তা আরম্ভ করিল। দেওয়ানজি মাঝে মাঝে দুই একজনের পরিচয় বলিতে লাগিলেন। জীবনচরিত হইতে যেখানে যেটুকু সাহায্য পাইল, তাহার সদ্ব্যবহার করিতে রাখাল ভুলিল না। সৌভাগ্যবশতঃ স্থানীয় মাইনর স্কুলের হেডমাষ্টার মহাশয়ও আসিয়াছিলেন–তিনি নূতন লোক। কথাবার্তাটা তাঁহারই সহিত রাখাল বেশী বেশী চালাইল। স্কুলের অবস্থা এখন কিরূপ, কতকগুলি ছাত্র, কোন্ জাতীয় ছাত্র অধিক, বাৎসরিক ফলাফল কিরূপ হইয়াছিল–ইত্যাদি ইত্যাদি সংবাদ অতি আগ্রহের সহিত রাখাল সংগ্রহ করিতে লাগিল। শীঘ্রই একদিন গিয়া স্কুল পরিদর্শন করিয়া আসিবে প্রতিশ্রুত হইল। এইরূপে অর্ধঘণ্টা কাটিল। বেলা অধিক হয় দেখিলে ভদ্রলোকগণ একে একে গাত্রোত্থান করিলেন–রাখালও হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল।

    সকলে উঠিয়া গেলে দেওয়ানজি বলিলেন, বাবা, কৰ্ত্তামশাই আজ দুবছর হল গত হয়েছেন–এ দুবছর যা কিছু করেছি আমিই করেছি। –দেখবার শোনবার লোক ত কেউ ছিল না। আমি বুড়ো মানুষ, কি জানি যদি কিছু ভুল চুকই হয়ে থাকে, এ দুবছরের কাগজপত্রগুলো তুমি একবার দেখে শুনে নিলে ভাল হত।

    রাখাল বলিল, কাকা, আপনার কাগজপত্র আমি আর কি দেখব? আমি কিই বা জানি–কিই বা বুঝি? আপনি যা করেছেন তাই এতদিন হয়ে এসেছে; আর, আপনি যা করবেন এখনও তাই হবে।

    দেওয়ানজি বলিলেন, আমি–করছিই ত–আজ ত্রিশ বছর ধরে করছি। তুমি যে বছর হও, সেই বছরই দাদা আমায় দেওয়ানী পদে পাকা করে দেন। তবে, আমার ভুলচুক যদি কিছু হয়ে থাকে, তুমি হিসাবপত্রগুলো পরীক্ষা করলে হয়ত ধরা যেত।

    রাখাল হাসিয়া বলিল, কাকা, আমাকে আপনি হিসাবপত্রে যতটা পণ্ডিত মনে করেছেন, আমি তা নই। আর হতামই যদি? তাহলে বা কি? ভুলচুকের কথা বলছেন, যদি কিছু ভুলচুক হয়েই থাকে ত হয়েছে। সে ভুল আপনার চক্ষু যদি এড়িয়ে গিয়ে থাকে, ধরা পড়ে ত একদিন আপনার চোখেই ধরা পড়বে।

    দেওয়ানজি বলিলেন, আর বাবা, চোখের তেজ কি চিরদিন মানুষের সমান থাকে? এদিকে ষাট বছর বয়স হল যে! তুমি একবার দেখেশুনে নিলে আমার মনটা নিশ্চিত হত। টাকা জিনিষটে বড় ভাল নয় বাবা।

    রাখাল বলিল, ভাল ত নয়ই। সেইজন্যেই ত সরে পড়েছিলাম। কিন্তু থাকতে পারলাম কই? আপনাদের যে ভুলতে পারলাম না। তা কাকা, ধরা যখন দিয়েছি–হাতে পায়ে রূপোর শিকল পরতেই হবে–দুদিন যাক না!

    মুখে রাখাল এই কথা বলিল বটে–কিন্তু বিষয় সম্পত্তি, বিশেষ নগদ টাকা কি পরিমাণ মজুত আছে, জানিবার জন্য মনটা তাহার ধড়ফড় করিতেছিল।

    দেওয়ানজি বলিলেন, তা দুদিন যাক–আজই যে কাগজপত্র দেখাতে আরম্ভ করছি তা নয়। কৰ্ত্তার বার্ষিক শ্রাদ্ধটা হয়ে যাক। তারপর প্রথম কায, কালেক্টারিতে নাম খারিজের জন্যে আর জজসাহেবের কাছে সার্টিফিকেটের জন্যে দরখাস্ত দেওয়া। কোম্পানির কাগজ যা আছে তার জন্যে কোনও ভাবনা নেই, তাতে কর্তা মহাশয়ের সই করা আছে। কেবল বোধ হয় বেঙ্গল ব্যাঙ্কে যে টাকাটা জমা আছে, সেটা সার্টিফিকেট না হলে তোমার নামে জমা হবে না।

    রাখাল যথাসাধ্য নির্লিপ্তভাব অবলম্বন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, বেঙ্গল ব্যাঙ্কে কত আছে?

    দেওয়ানজি বলিলেন, পঞ্চাশ হাজারের উপর।

    আর কোম্পানির কাগজ?

    ছয় লক্ষ আন্দাজ।

    সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা!–শুনিয়া, মাসিক পঁচিশ টাকা বেতনের ভূতপূৰ্ব্ব এই রেলওয়ে কেরাণীটীর মাথা ঘুরিয়া গেল। সে মনে মনে বলিতে লাগিল, সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা! সাড়ে ছয় লক্ষ টাকা!

    রাখাল মনে মনে ভাবিতে লাগিল, এই নগদ টাকাটা আমার হস্তগত হইলেই–আর আমি কিছু চাহি না। জমিদারী কাৰ্য্য বিশেষ জটিল ও পরিশ্রমসাধ্য। কে ভূতের বেগার খাঁটিয়া মরে। তাই সে নিম্নস্বরে বলিল, কাকা, যদিও আমি গৃহস্থাশ্রমে ফিরে এসেছি বটে, তবু বিষয়কৰ্ম্ম করা আমার যে বড় রুচিকর হবে, তা নয়। যে সময়টা বিষয়কৰ্ম্ম দেখতে আমার যাবে, সে সময়টা আমি পূজো আহ্নিক শাস্ত্রপাঠ তীর্থভ্রমণ করতে পেলে বেশী সুখে থাকব।

    দেওয়ানজি বলিলেন, সে কি বাবা? তা বললে কি চলে? তোমার বিষয় তুমি না দেখলে কি হয়? আমি বুড়ো হয়েছি, আমি আর কদিন? তুমি ফিরে এলে, এ সময় যদি দাদা বেঁচে থাকতেন, তা হলে তোমায় সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখিয়ে দিয়ে, আমরা দুই বুড়োতে গিয়ে কাশীবাস করতাম। –এই সময় দেওয়ানজির কথাগুলি যেন ভারি ভারি হইয়া আসিল, কণ্ঠস্বরটা একটু কাঁপিতে লাগিল। তিনি বলিলেন, কিন্তু তা ত হল না, আমি একলা পড়ে গেলাম।

    দেওয়ানজির ভাবান্তর দর্শনে রাখালও মুখখানি যথাসাধ্য বিষণ্ণ করিয়া রহিল। অধোবদনে কিয়ৎক্ষণ নীরবে অতিবাহিত করিয়া বলিল–কাকা আপনি ধৰ্মকৰ্ম্ম করবেন, পরকালের কায করবেন, তাতে আমি বাধা দেব, এমন পাষণ্ড আমি নই। তবে এইমাত্র বলছিলাম, আমারও প্রাণের টানটা ঐ দিকেই–টাকাকড়ি বিষয় সম্পত্তির দিকে নয়।

    দেওয়ানজি বলিলেন, বেশ ত বাবা–তোমার যখন সে বয়স হবে, তখন তুমিও তাই করবে বই কি। এখন সংসারধর্ম কর; ঈশ্বর যদি দুচারটি ছেলে–পিলে দেন, তাদের মানুষ কর; তারপর তারা উপযুক্ত হলে–তখন তুমিও নিজের পরকালের কায কোরো–সে ত ভাল কথাই।

    ঈশ্বর যদি দুই চারিটি ছেলেপিলে দেন–এই কথা শুনিয়া, গত রজনীতে দৃষ্ট বউরাণীর সেই হাসি ও অশ্রুপূর্ণ মুখখানি রাখালের মনে পড়িয়া গেল। তাহাকে দ্বিতীয়বার দেখিবার আশা করিয়া রাখাল অন্তঃপুরে অপেক্ষা করিয়া ছিল–কিন্তু সে আশায় বঞ্চিত হইয়াছে। আহারের পর হয়ত সেই মুখখানি আবার দেখিতে পাইবে–এই নূতন আশাটুকু তাহার মনের মধ্যে আন্দোলিত হইতে লাগিল।

    কিয়ৎক্ষণ পরে ভৃত্য আসিয়া জানাইল, আহারের স্থান হইয়াছে। তখন দেওয়ানজিকে সঙ্গে করিয়া রাখাল অন্তঃপুর মধ্যে প্রবেশ করিল।

    ০৮. কলিকাতা যাইবার পরামর্শ

    আহারান্তে দেওয়ানজিকে লইয়া রাখাল তাহার নিজের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ খানিতে গিয়া বসিল। রামা খানসামা আলবোলাতে সুগন্ধি তামাকু সাজিয়া দিয়া গেল। একখানি আরামকেদারায় হেলিয়া বসিয়া দেওয়ানজি ধুমপান করিতে লাগিলেন, রাখাল একটি সোফা অধিকার করিয়া তাহার সহিত বাক্যালাপে প্রবৃত্ত হইল। পাশে একটি তেপায়া টেবিলের উপর রূপার ডিবায় গোটাকতক পাণ–কথা কহিতে কহিতে মাঝে মাঝে এক একটা লইয়া রাখাল মুখে দিতেছে।

    জমিদারী সংক্রান্ত কথাবার্তাই বেশীর ভাগ হইল। দেওয়ানজি বলিলেন, কৃষ্ণনগরে গিয়া নামখারিজ প্রভৃতির জন্য দরখাস্তের পর, কালেক্টর সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করা আবশ্যক।

    রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, কি পোষাকে যাব?

    দেওয়ানজি বলিল আমিও তাই ভাবছি। –গেরুয়া পোষাকে যেন কেমন কেমন মনে হয়।

    রাখাল বলিল, যখন মঠে ছিলাম তখন সাহেব–সুবোর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করিতে হলে, গেরুয়া পোষাকেই যেতাম। তবে, তখন ছিলাম মোহান্ত–মানিয়ে যেত।

    কি কি পরতে?

    গেরুয়া ধুতির উপর গেরুয়া মেরজাই, তার উপর গেরুয়া রেশমী আলখাল্লা–মাথায় গেরুয়া পাগড়ী, পায়ে গেরুয়া রঙের মোজা। জুতাটা কেবল গেরুয়া নয়–বাদামী।

    সে সব আলখাল্লা–টালখাল্লা এনেছ?

    না।

    তা হলে না হয় কলকাতা থেকে ফরমাস দিয়ে তৈরি করিয়ে নাও। কিছু আসবাবপত্রও ত কেনার দরকার।

    রাখাল বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। কলকাতায় একবার যাওয়া দরকার। তবিলে কত টাকা আছে? একখানা মোটর কারও কিনে আনবার ইচ্ছে আছে।

    দেওয়ানজি বলিলেন, মোটর কার? সে ত অনেক দাম!

    দেওয়ানজির স্বর শুনিয়া রাখাল বুঝিল, ইনি বাধা দিবার চেষ্টায় আছেন। তাই একটু কৌশল করিয়া বলিল, আজ্ঞে না, বেশী দামের এখন কিনব না; আরএ সব পাড়াগেঁয়ে রাস্তায় পনেরো বিশ হাজারের মোটর নষ্ট হয়ে যাবে। আপাততঃ সাত আট হাজার টাকায় একখানি কিনে আনব।

    দেওয়ানজি বলিলেন, তা, ও টাকা মজুদী তবিল থেকেই হতে পারবে। কবে যাবে বল, আমিও কাম কৰ্ম্মের সেই রকম বন্দোবস্ত করি। হাতে দু একটি জরুরি কায আছে সেগুলো সেরে ফেলি।

    রাখাল ভাবিল–এ আবার কি কথা? –উনি আমার সঙ্গে যাইতে চাহেন নাকি? আরে সর্বনাশ, সে ত হইবে না! কলিকাতায় কত পরিচিত লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইতে পারে; কেহ যদি হঠাৎ দেখিয়া, কি হে রাখাল বলিয়া সব মাটি করিয়া দেয়? তাই সে বলিল–কবে যাব এখনও স্থির করিনি। হয়ত কালই যেতে পারি। তাহার মনের আশা, হয়ত অত শীঘ্র হাতের কায সারিয়া, কলিকাতায় যাইতে দেওয়ানজি অক্ষম হইতে পারেন।

    দেওয়ানজি বলিলেন, কাল যদি যাত্রা কর, তা হলে আমার বিশেষ অসুবিধে হবে; ফিরে এসে সে কাযগুলোতে হাত দিলেও চলবে। পাঁচ সাত দিনের বেশী বিলম্ব হবে কি?

    রাখাল একটু চিন্তা করিবার ভাণ করিল। শেষে বলিল–হ্যাঁ–একটু বিলম্ব হবে বইকি। দশ বারোদিন লেগে যেতে পারে। কৃষ্ণাচতুর্থীর দিন বাবার বাৎসরিক শ্রাদ্ধ, সে সব যোগাড়যন্ত্র করতে হবে ত? আপনি অতদিন ধরে এখানে না থাকলে চলবে কি?

    দেওয়ানজি বুঝিতে পারিলেন, তাহাকে সঙ্গে লইতে বাবু অনিচ্ছুক। মনে মনে একটু বিস্মিত হইলেন। রাখাল নিজেকে অতীব সদাচার–পরায়ণ ব্রহ্মচারী বলিয়া পরিচয় দিয়াছে, তাই দেওয়ানজি রাখালের আপত্তিটুকুর কারণ নির্ণয়ে অসমর্থ হইলেন। কিন্তু কি করিবেন উপায় নাই। অদ্য প্রাতেই রাণীমা তাঁহাকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিয়াছিলেন–বলিয়াছেন, একটা বিষয়ে খুব লক্ষ্য রাখতে হবে–এখন দিনকতক ভবেনকে একলা কোথাও যেতে দেওয়া হবে না। যদি কৃষ্ণনগর কি কলকাতা কি আর কোথাও যেতে চায়–বরাবর তুমি সঙ্গে সঙ্গে থেকো ঠাকুরপো। মনের গতি কখন কি রকম দাঁড়ায় তা ত বলা যায় না। আবার না পালায়! সুতরাং দেওয়ানজিকেও কৌশল অবলম্বন করিতে হইল। তিনি বলিলেন, ভালকথা মনে করে দিয়েছ। কৃষ্ণচতুর্থীর দিন শ্রাদ্ধ–ওটা আমার মনেই ছিল না। যোগাড়যন্ত্র যা কিছু, সে ত কলকাতা থেকেই অধিকাংশ করে নিয়ে আসতে হবে। ঘি, ময়দা, চিনি, মশলাপাতি–সবই ত কলকাতায়। কাযের দুই একদিন আগে হাজার পাঁচেক বোম্বাই আম, হাজার দশেক লিচু, গোলাপজাম অন্যান্য ফল–ফুলরি এসব কিনে পাঠাবার জন্যে কোনও লোককে ভার দিয়ে আসতে হবে। ভিয়েন করবার জন্যে লুচি ভাজার জন্যে জনকতক বামুন এখন থেকে বন্দোবস্ত না করে এলে সময় মত পাওয়া যাবে না।

    রাখাল বলিল, লুচি ভাজবার জন্যে বামুন আনতে হবে কলকাতা থেকে? কেন, এখানে লোক পাওয়া যাবে না? ছেলেবেলায় ত দেখেছি, কায কৰ্ম্ম হলে গ্রামের লোকেই এসে লুচি ভাজত।

    দেওয়ানজি বলিলেন, বাবা, সে কথা আর বল কেন? ষোল বছর আগে যা দেখে গেছ, এখন কি আর তাই আছে? তখন প্রত্যেক পাড়াতেই দুচারজন উৎসাহী পরোপকারী ব্রাহ্মণ ভদ্রসন্তান পাওয়া যেত, কোথাও কাযকৰ্ম্ম হলে তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কোমর বেঁধে লেগে যেত। আগে তারা মনে করত, আমি তৈরী করব, আমার হাতে পাঁচজন ভাল ব্রাহ্মণে খাবে–সে ত আমার সৌভাগ্য। এখন ভাবে কি? আমি কি রসুয়ে বামুন? –এখন এ রকম কাযকে তারা অপমানজনক মনে করে।

    রাখাল ভাবিল, দেওয়ানজি ত কলিকাতায় সঙ্গে না গিয়া ছাড়িবে না দেখিতেছি!–যাহা হউক, সে পরের কথা পরে দেখা যাইবে। এতক্ষণ বউরাণীর আহারাদি হইয়া গিয়া থাকিবে–ইনি এখন গাত্রোত্থান করিলে সে বেচারি আসিতে পারে। তাই অল্পক্ষণ নীরব থাকিয়া রাখাল মুখের কাছে হাত আড়াল দিয়া ক্ষুদ্র একটি হাই তুলিল।

    দেওয়ানজি ইহা লক্ষ্য করিলেন। বলিলেন–এখন তা হলে উঠি, তুমি একটু বিশ্রাম কর। এইখানেই বিছানা করে দিতে বলব কি?

    রাখাল বলিল, আচ্ছা বলুন।

    রামা–ও রামা। –বলিতে বলিতে দেওয়ানজি উঠিয়া গেলেন।

    ০৯. ভুলো না

    রাখালের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হইল। কিয়ৎক্ষণ পরেই আনমিতনয়না সলজ্জবদনা বউরাণী আসিয়া প্রবেশ করিলেন। তাঁহার পরিধানে একখানি জরিপাড় শাদা শাড়ী, গায়ে একটি হাফহাতা জ্যাকেট। হাতে চারিগাছি করিয়া আটগাছি তারা–প্যাটার্ণ সোণার চুড়ী, পায়ে দুগাছি অমৃতী–পাকের জলতরঙ্গ মল–আর কোনও অলঙ্কার নাই।

    বউরাণীকে দেখিয়া রাখাল একটু থতমত হইয়া বলিল, কোথায় যাচ্ছ?

    বউরাণী বিস্ময়ের সহিত বলিলেন, কই কোথাও যাইনি ত।

    রাখাল একটু অপ্রতিভ হইয়া বলিল, না, তা নয়। এতক্ষণ কোথা ছিলে, তাই জিজ্ঞাসা করছি।

    ঠাকুরঘরে ছিলাম। –বলিয়া বউরাণী নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

    রাখাল বলিল, বস।

    বউরাণী সলজ্জভাবে উন্মুক্ত দ্বারের পানে চাহিলেন। রাখাল তাহার মনের ভাব বুঝিয়া, উঠিয়া গিয়া পর্দাটি টানিয়া দিল। ফিরিয়া আসিয়া, একখানি চেয়ারে বসিয়া, সোফাটি নির্দেশ করিয়া বলিল–বস।

    বউরাণী উপবেশন করিয়া, নিজের একখানি হাত অন্য হাতে ধরিয়া অবনত বদনে বলিলেন, তুমি নাকি কলকাতায় যাবে?

    রাখাল বলিল, হ্যা তাই ত মনে করছি।

    একটু নীরব থাকিয়া বউরাণী বলিলেন, এখনি কেন যাবে? –তাহার কণ্ঠস্বর কাতরতাসূচক।

    রাখাল অপরাধীর মত বলিল, কতকগুলো কাযকৰ্ম্ম রয়েছে কিনা।

    এবার বউরাণী মুখ তুলিলেন। ছলছল নেত্রযুগল রাখালের পানে স্থাপন করিয়া বলিলেন–মা কাঁদছেন যে!

    রাখাল উৎকণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, মা কাঁদছেন? কেন?

    বউরাণী বলিলেন, তুমি এখনি কেন যাবে? দেওয়ানকাকা ত যাচ্ছেন। তোমার যা যা জিনিসপত্তর দরকার, তাকে লিখে দিও, তিনি কিনে আনবেন।

    রাখাল ধীরে ধীরে বলিল, কতকগুলো কাপড়–চোপড় তৈরি করাতে হবে কিনা। নিজে–না গেলে।

    বউরাণী বলিলেন, কাপড়–চোপড়ের জন্যে তোমার যাবার দরকার কি? দেওয়ানকাকা কলকাতার সবচেয়ে বড় দোকান থেকে, তাদের দর্জিকে খরচ দিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসবেন–অনেক রকম কাপড়ের নমুনা নিয়ে আসবেন–তুমি এইখানে বসেই কাপড় পছন্দ করে দর্জিকে মাপ দিও।

    রাখাল ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিল, আচ্ছা–তাই হবে। মা যদি দুঃখিত হন, আমি এখন যাব না। –বলিয়া রাখাল একটা পাণ লইয়া মুখে দিল। ডিবাটি বউরাণীর দিকে সরাইয়া বলিল–পাণ খাও।

    বউরাণী ধীরে ধীরে তাহার কম্পিত হস্তখানি বাড়াইয়া একটি পাণ লইলেন। সেটি হাতেই ধরিয়া রহিলেন–খাইলেন না।

    রাখাল জিজ্ঞাসা করিল, তোমার খাওয়া হয়েছে? মার খাওয়া হয়েছে?

    না। আমরা খেতে যাচ্ছিলাম। দেওয়ানকাকার কাছে তোমার কলকাতা যাবার কথা শুনে, মা কাঁদতে লাগলেন।

    রাখাল ঈষৎ হাসিয়া বলিল, তোমায় বুঝি তাই মা পাঠিয়ে দিলেন?

    বউরাণী শিরশ্চালনা করিয়া সঙ্কেতে জানাইলেন–হাঁ।

    রাখাল বলিল, না হলে তুমি এখন আসতে না বোধ হয়–বলিয়া মৃদু হাস্য করিতে লাগিল।

    বউরাণী কোনও উত্তর করিলেন না। তাঁহার অধরপ্রান্তে একটুমাত্র সলজ্জ হাসি দেখা দিল।

    এমন সময় রামা খানসামা বাহির হইতে বলিল, বউরাণী, বাবুর বিছানা কোন্ ঘরে হবে?

    আচ্ছা, আমি আসছি। –বলিয়া বউরাণী রাখালকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মার ঘরে তোমার বিছানা করে দিতে বলব? না, এইখানে শোবে?

    রাখাল বলিল, এইখানে পোব।

    এ ঘরে পালঙ্কাদি কিছুই ছিল না।

    বউরাণী দ্বারের কাছে গিয়া বলিলেন, রামচরণ, এই ঘরেই বাবু শোবেন। একখানা নেওয়ারের খাট আনিয়ে, বিছানা করে দাও।

    রামা চলিয়া গেল। বউরাণী ফিরিয়া আসিয়া আবার সোফায় উপবেশন করিলেন। দুই এক কথার পর রাখাল বলিল, আবার কখন তোমার দেখা পাব?

    কেন?

    কথাটি উচ্চারণ করিবার সময় বউরাণীর ঠোঁট দুখানি যেন ঈষৎ ফুলিয়া উঠিল। এটুকু রাখালের চক্ষু এড়াইল না। সে বলিল, তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে, তাই।

    বউরাণী আবার ঠোঁট ফুলাইয়া একটু হাসির সহিত বলিলেন, ইস্।

    কেন, বিশ্বাস হল না?

    বউরাণী ঘাড় নাড়িয়া জানাইলেন–না।

    অবিশ্বাসের কারণটা কি শুনি?

    বউরাণী কথা কহেন না। রাখাল তখন পীড়াপীড়ি করিতে লাগিল। শেষে তিনি বলিলেন–আমাকে ছেড়ে তুমি ত কলকাতায় চলে যাচ্ছিলে!

    রাখাল বলিল, দুদিনের জন্যে যাচ্ছিলাম বই ত নয়

    তবু ত যাচ্ছিলে!

    রামা বাহির হইতে বলিল, বউরাণী, খাটবিছানা এনেছি।

    রাখাল বলিল, যাও, তুমি খেতে বসগে–বেলা অনেক হল। আমি ঘণ্টাদুই ঘুমিয়ে তারপর উঠব। ততক্ষণ রোদ্দুরটাও পড়ে আসবে। তুমি এসে অন্দরের বাগানে আমায় বেড়াতে নিয়ে যাবে?

    বাগানে বেড়াতে যাবে?

    তুমি এস, দুজনে যাব।

    বউরাণীর মুখখানি লজ্জায় রাঙা হইয়া উঠিল। বলিলেন–দুজনে একসঙ্গে?

    তবে? আমি আগে যাব, তুমি পরে আসবে?

    না–ছি!

    রাখাল দুঃখিত হইয়া বলিল, তুমি যাবে না? –তা হলে আমি গিয়ে কি করব?

    বউরাণী বলিলেন, না, তুমি যেও। আমি আগে থাকতেই সেখানে থাকব এখন।

    নিশ্চয়?

    নিশ্চয়।

    বেশ–ভুলো না।

    তুমি ভুলো না। –বলিয়া বউরাণী মৃদুহাস্য করিয়া প্রস্থান করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন ঝির সহিত রামা খানসামা প্রবেশ করিয়া বাবুর জন্য শয্যা–রচনায় প্রবৃত্ত হইল।

    ১০. সুরবালার গুপ্তকথা

    বিকালে রাখালের সহিত বাগানে বউরাণীর সাক্ষাৎ হইল বটে, কিন্তু সে কেবল পাঁচ মিনিটের জন্য। রাখাল বউরাণীকে খুঁজিয়া বাহির করিলে পর তিনি লজ্জায় নিতান্তই জড়সড় হইয়া পড়িলেন। পাছে কোনও দিক হইতে কেহ আসিয়া পড়ে এই আশঙ্কায় তাহার নয়ন চঞ্চল ও মন ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। অবস্থা বুঝিয়া রাখাল তাঁহাকে মুক্তি দিল, তিনি গাছের আড়াল দিয়া পলায়ন করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। রাখাল বাগানের শোভা দেখিতে দেখিতে পদচারণা করিতে লাগিল।

    সন্ধ্যার অনতিপূৰ্বে অন্তঃপুরের পশ্চাদ্দ্বার হইতে, কনকলতা ও সুরবালা বাহির হইয়া গঙ্গার ঘাট অভিমুখে চলিল। কনক প্রথম প্রথম যখন আসিয়াছিল, তখন সে সুরবালার তত্ত্ব বড় লইত না। সুরবালা তখন নিজের দুঃখভারে বড়ই কাতর ও ম্রিয়মান, কনকও বউরাণীর মন যোগাইবার জন্য অতিমাত্র ব্যস্ত। কিন্তু যখন হইতে বউরাণী কনকের প্রতি অপ্রসন্ন হইতে আরম্ভ করিয়াছেন, তখন হইতে অল্পে অল্পে কনকও সুরবালার প্রতি আকৃষ্ট হইতেছে। এ কয়দিন ত কনক কিংবা সুরবালা বউরাণীর সঙ্গ অতি অল্পক্ষণই পাইয়াছে–সুতরাং উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা একটু বৃদ্ধি পাইয়াছে। কনক বড় বুদ্ধিমতী–সে বেশ বুঝিতে পারিয়াছে, সুরবালার জীবন কোনও একটি গূঢ় রহস্যের যবনিকায় আচ্ছন্ন–সে রহস্যটি যে কি, তাহা ভেদ করিতে এ কয়দিন বিশেষ চেষ্টা করিয়াও সে কৃতকার্য হয় নাই।

    সূৰ্য্য তখন অস্ত গিয়াছেন। গঙ্গার শীতল জলরাশিতে অবগাহন করিয়া, যুবতী দুইজন তীরে উঠিল। সোপানের উপর বসিয়া, গাত্রমার্জনাদিতে মনোনিবেশ করিল।

    সুরবালা বলিল, বউরাণী খুব খুসী হয়েছেন, না?

    কনক বলিল, অমন জিনিষটি পেলে কে না খুসী হয়, তুমি হও না?

    কথাটা শুনিয়া সুরবালার ভাল লাগি না। তাহার যুগ ঈসৎ কুঞ্চিত হইয়া উঠিল। কনক গুন্ গুন্ স্বরে গাহিল–

    আজু রজনি হাম ভাগে পোহায়লুঁ,
    পেখলুঁ পিয়া–মুখ–চন্দা।
    জীবন যৌবন সফল করি মানলুঁ…

    আচ্ছা ভাই, বাবুর এ কি রকম আক্কেল? যদি ব্রতই ছিল, এখন ছমাস যদি এত নিয়মই রাখতে হবে, তবে তাড়াতাড়ি আসা কেন? না হয় ছমাস পরেই আসতেন। অন্যায় নয়?

    সুরবালা বলিল, কেন, অন্যায় আর কি? বুড়ো মা বাড়ীতে রয়েছেন, ছমাসের মধ্যে তিনি যদি মরে যান, তা হলে ত ছেলেটির মুখখানি আর দেখতে পেতেন না।

    মায়ের কথা ভেবে আমি বলিনি। বউরাণীর কথা ভেবেই বলছিলাম।

    সুরবালা বলিল, ছমাস আগে বাড়ী এলেন, বউরাণীর পক্ষেও ভাল নয়? স্বামীসেবা করতে পাওয়া, স্বামীকে দেখতে পাওয়া, এই কি স্ত্রীলোকের পক্ষে কম সৌভাগ্য? ।

    কনক বলিল, নাও নাও, আর ভটচায্যিগিরি ফলাতে হবে না। আচ্ছা ভাই ও যদি ভবেন্দ্র না হয়, অন্য কেউ হয়?

    সুরবালা একথা শুনিয়া শিহরিয়া উঠিল! বলিল–সৰ্ব্বনাশ!–অমন কথা বোল না। উনি ভবেন্দ্রবাবু না হলে বাড়ীর লোকে কি এতক্ষণ সন্দেহ করত না?

    কনক বলিল, এ রকম হয় কিন্তু। কেউ অনেক দিন থেকে নিরুদ্দেশ আছে, হয়ত মরে গিয়েছে, কোনও জুয়াচোর বিষয় সম্পত্তির লোভে সেই লোক সেজে এসেছে। একবার কমলা থিয়েটারে এই রকম একখানা নাটকে আমি–এই রকম একখানা নাটক আমি দেখেছিলাম।

    কেউ প্রথমে চিনতে পারেনি?

    কেউ না।

    ঘরে স্ত্রী ছিল?

    ছিল বইকি। যুবতী স্ত্রী।

    যে এসেছিল, তার এ রকম কোনও ব্রত–ট্রত ছিল?

    না তা ছিল না।

    সুরবালা হাসিয়া বলিল, ইনি যদি জুয়াচোর হতেন, তা হলে এঁরও কোন ব্রত থাকত না।

    কনক বলিল, ইনি জুয়াচোর নন সে প্রমাণ এতে মোটেই হচ্ছে না। বরং যদি ইনি জুয়াচোর হন তবে এই প্রমাণ হচ্চে, নাটকের সেই জুয়াচোর অপেক্ষা বাস্তব জীবনের এ জুয়াচোরটি বেশী বুদ্ধিমান।

    সুরবালা বলিল, ছি! ও কথা মনেও আনতে নেই। বউরাণী আমাদের সতীলক্ষ্মী। ভগবান কি এমন নিষ্ঠুর হতে পারেন?

    গাত্র মার্জনা সমাপনান্তে শুষ্কবস্ত্রাদি পরিধান করিয়া উভয়ে সোপান আরোহণ করিল। মৃদুস্বরে কথাবার্তা কহিতে কহিতে, বাগান অতিক্রম করিয়া দুইজনে অন্তঃপুর অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিল। কনকলতা পশ্চাতে সুরবালা, অগ্রগামিনী।

    কিয়দুরে আসিয়া, উদ্যানপথের একটা বৃক্ষবহুল অংশের বাহির হইবামাত্র সুরবালা স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল। কনক অগ্রসর হইয়া দেখিল, অল্পদূরে রাখাল দাঁড়াইয়া। সেই ইহাদিগকে দেখিবামাত্র, ফিরিয়া, বিপরীত দিকে পদচালনা করিল।

    কনক দেখিল, সুরবালার মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিয়াছে। তাহার হাত পা কাঁপিতেছে। কনকের পানে চাহিয়া রুদ্ধশ্বাসে সে জিজ্ঞাসা করিল–উনি কে?

    সুরবালার ভাবভঙ্গি দেখিয়া কনক কিছু বিস্ময় বোধ করিল; বলিল–কে আবার? বাবু।

    সুরবালা বলিল? বাবু–কোন্ বাবু?

    ভবেন্দ্রবাবু!–কিংবা যিনি ভবেন্দ্রবাবু সেজে এসেছেন, তিনি। –বলিয়া কনক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুরবালার মুখের পানে চাহিয়া রহিল।

    সুরবালা বলিল, যিনি ভবেন্দ্রবাবু সেজেছেন? সেজেছেন নাকি?

    কনকলতার মনের সন্দেহটি প্রায় নিশ্চয়তার কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিল। উত্তর করিল–সেজেছেন কি না আমি জানি? তুমি জান আর উনি জানেন!

    সুরবালা স্বপ্নবিষ্টের ন্যায় কনকের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। কয়েক মুহূর্ত পরে বলিল–বুঝতে পারলাম না। তুমি কি বলছ!

    কনক হাসিয়া বলিল, না এমন কিছু বলিনি–বলছি যে আজ মাসের কদিন হল? –চল চল, এখানে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?

    অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া উভয়ে নিজ নিজ নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করিল। কনকলতা একাকিনী বসিয়া আকাশ পাতাল অনেক চিন্তা করিতে লাগিল। কিন্তু অদ্যকার এই ঘটনাটির একটা নিশ্চিত মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিল না। ইহারা দুইজনে ষড়যন্ত্র করিয়া আসে নাই, তাহা কনকের ধারণা হইল। অথচ ইহারা পরস্পরের যে পরিচিত, সে বিষয়েও কোন সংশয় রহিল না। তবে লোকটা জুয়াচোর–অথবা বাস্তবিক ভবেন্দ্র, মোহান্ত অবস্থায় সুরবালার সহিত পরিচিত ছিল, তাহা কনক কিছুই নির্ণয় করিতে পারিল না।

    রাত্রি নয়টার সময় রাখাল খাইতে বসিয়াছে। বড় গ্রীষ্ম বলিয়া খোলা ছাদে আহারের স্থান হইয়াছে। সম্মুখে একটা বড় ল্যাম্প জ্বলিতেছে। কিয়দ্দূরে একটি অন্ধকার কক্ষে জানালার কাছে দাঁড়াইয়া সুরবালা একদৃষ্টে রাখালের পানে চাহিয়া ছিল। এমন সময় হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে কনক আসিয়া তাহার চক্ষু টিপিয়া ধরিল।

    সুরবালা বলিল, কনক দিদি!

    কনক বলিল, দিদি! দিদি!–আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড় নাকি যে আমায় দিদি বলছ?

    সুরবালা অধীর হইয়া, নড়িয়া চড়িয়া বলিল, চোখ ছাড় চোখ ছাড়।

    চোখ ছাড়ব না। ভদ্রলোকের ছেলে খেতে বসেছে, অমন করে দৃষ্টি দিচ্ছ কেন? আহা, বেচারির বদহজম হবে।

    সুরবালা বিরক্ত হইয়া বলিল, চোখ ছাড় না। কি করছ–-আঃ–

    কনক চোখ ছাড়িয়া বলিল, দেখ–দেখ–প্রাণ ভরে দেখ। যার সঙ্গে যার ভাব, মুখ দেখলেও লাভ! কোথায় আলাপ হয়েছিল?

    সুরবালা বলিল, আলাপ?

    হ্যাঁ–আলাপ–পরিচয়–বন্ধুত্ব কোথায় হয়েছিল?

    কে বললে?

    উনি নিজেই বলেছেন।

    কার কাছে?

    বউরাণীর কাছে।

    সুরবালা সবিস্ময়ে বলিল, কি বলেছেন বউরাণীকে?

    বলেছেন–আমি ঐ স্ত্রীলোকটিকে এক সময় চিনতাম।

    দৃঢ়স্বরে সুরবালা বলিল, বউরাণীকে ও কথা বলেছেন? কখনো নয়।

    কনক বলিল, তবে–আসল কথা খুলেই বল না ভাই!

    সুরবালা কিছু না বলিয়া, ক্ষিপ্রচরণে সেস্থান হইতে প্রস্থান করিল। নিজের শয্যাকক্ষে গিয়া, বিছানায় পড়িয়া, বালিসে মুখ গুঁজিয়া কাঁদিতে লাগিল।

    সেদিন রাত্রে জলযোগের পর, অনেক রাত্রি অবধি কনকলতার বদ্ধ জানালার ফাঁক দিয়া আলোক বাহির হইয়াছিল। বিছানায় বসিয়া সোণার হরিণকে সে একখানি সুদীর্ঘ পত্র লিখিয়া, রাত্রি প্রায় একটার সময় বাতি নিভাইল।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমহাপ্রস্থানের পথে – প্রবোধকুমার সান্যাল
    Next Article গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.