Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এক পাতা গল্প332 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩. আতর আলী

    অধ্যায় ১১

    আতর আলী হা করে চেয়ে আছে মাটির দিকে। গর্ত বলে কিছু নেই সেখানে! অথচ একটু আগেই এখান দিয়ে যাবার সময় বেচারা সাংবাদিক সদ্য খোরা কবরে পড়ে নাস্তানাবুদ হয়েছিলো।

    চারপাশে তাকিয়ে হাটু গেড়ে বসে পড়লো সে। ফালুর সদ্য খোরা ‘অ্যাডভান্স’ কবরটি সুন্দর করে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এমনভাবে সেটা করা হয়েছে যেনো সহজে বোঝা না যায়, কিন্তু আতরের চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ছে কবর ভরাট করার লক্ষণগুলো। আলগা মাটি ফেলে ভরাট করার চিহ্ন এখনও রয়ে গেছে। ফালু চেষ্টা করেছে এই কবরটা খোরার কোনো চিহ্ন যেনো না থাকে। কিন্তু কেন?

    উঠে দাঁড়ালো আতর।

    ফালুকে সে এতোদিন নিতান্তই তারছেঁড়া পোলা হিসেবে দেখে এসেছে। ওর ব্যাপারে তার শ্যেনদৃষ্টি কখনওই পড়ে নি। এখন মনে হচ্ছে। ছেলেটা বোবা-ডাকাইত! ভালোমানুষের ছদ্মবেশে অগোচরে কিছু একটা করছে, আর সেটা সাংঘাতিক কিছুই হবে। ওর নিশ্চয় বিরাট কোনো গোমড় আছে। ঐসব গ্রামবাসীর জন্য তার করুণা হলো যারা মনে করে ফালু একজন কামেল লোক, স্বয়ং আজরাইলের সঙ্গে তার খাতির রয়েছে, জান কবচের খবর আগেভাগে টের পেয়ে যায় সে, তাই সুন্দরপুরে কেউ মারা যাবার আগেই কবর খুরে রাখে। আজও তাই করেছিলো, তারপর তমিজের বাপও পা পিছলে গুয়ের গাড়ায় পড়ে মরলো, সবই ঠিক আছে কিনতু বুড়োর লাশ দাফন করার আগে কবরটা কেন ভরাট করে ফেলা হলো? তাহলে ফালুর ‘অ্যাডভান্স’ কবর খোরার উদ্দেশ্যটা কি ছিলো?

    এইসব প্রশ্ন মাথায় নিয়েই আতর আলী আবারো চলে এলো গেরিখোদকের ঝুপড়ি ঘরের সামনে। এবার আর কোনো হাঁক-ডাক দিলো না, দরজা দিয়েও চেষ্টা করলো না, সোজা চলে গেলো ঘরের বামদিকে। ওখানে একটা টিউবওয়েল আর ধোয়া-মোছার জন্য পাকা-জায়গা আছে। টিউবওয়েলের দিকে মুখ করে আছে ঝুপড়ি ঘরের একটি জানালা। ওটা বন্ধ থাকলেও কপাট দুটো ধাক্কা মারতেই খুলে গেলো। জানালায় কোনো শিক দেয়া নেই। অনায়াসেই ঘরের ভেতরেকে যেতে পারলো সে।

    ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকার চোখে সয়ে যেতে একটু সময় নিলো। পকেটে একটা মোবাইলফোন আছে যার ডিসপ্লে কাজ করে না। অগত্যা দেয়াশলাইর কাঠি জ্বালালো আতর।

    আমকাঠের একটা চৌকি, কাপড় রাখার আলনা, এককোণে পানি রাখার মাটির কলস, কিছু হাড়ি-পাতিল আর কোদাল, শাবল, টুকরি দেখতে পেলো।

    আরেকটা কাঠি জ্বালিয়ে ঘরটায় শকুনি নজরে দেখে নিলো সে। একজন নিঃসঙ্গ গোরখোদকের ঝুপড়িঘর যেরকম থাকার কথা তার চেয়ে বেশি কিছু নেই। কিন্তু পুলিশের সাথে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে সে, তার নাকে অন্য কিছুর গন্ধ খুব দ্রুতই ধরা পড়ে। উপুড় হয়ে চৌকিটার নীচে দেয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠির আলোয় দেখলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারেও জিনিসটা চিনতে পেরে ইনফর্মারের শরীরে কাটা দিয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে। একটা ময়লা চাদরে কিছু মুড়িয়ে রেখেছে কিন্তু ফাঁক-ফোকড় দিয়ে মানুষের শরীরের হাঁড় বের হয়ে আছে!

    কঙ্কাল!?

    একটু ভয় পেলেও বুকে সাহস নিয়ে কাপড়টা খুলে দেখার চেষ্টা করলো। লাশের আর অবশিষ্ট কিছুই নেই আছে শুধু হাঁডগোড। তাতে লেগে আছে পচা মাংসের অবশিষ্ট। কাদামাটিও হতে পারে, তবে অন্ধকারে দেয়াশলাইর কাঠির আলোয় নিশ্চিত হতে পারলো না। কাপড়টা সরিয়ে আরেকটু দেখতে যাবে অমনি ঝুপড়ি ঘরের বাইরে কারোর পায়ের শব্দ শুনে চমকে উঠলো সে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের জ্বলন্ত কাঠিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো।

    ফালু?

    পায়ের শব্দটা এখন ঝুপরি ঘরের দরজার খুব কাছে চলে এসেছে। আতর কিছু বুঝে ওঠার আগেই দরজার ফাঁক-ফোকর দিয়ে টর্চের আলো এসে পড়লো ঘরের ভেতরে। নিমেষে তার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেলো।

    *

    ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটি পুরনো দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছফা। এ মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটিই তার বেলায় বেশি প্রযোজ্য। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। অন্য অনেকের মতো সে কুসংস্কারগ্রস্ত নয়, ভুত-প্রেত, জিন-পরীতেও তার বিশ্বাস নেই। একজন যক্তিবাদী মানুষ হিসেবে সে জানে জগতে যুক্তির বাইরে কিছুই নেই; কিছু ঘটেও না। তার অভিজ্ঞতা বলে, সমস্ত রহস্য আর অব্যাখ্যাত ব্যাপারগুলো আসলে সাময়িক বিভ্রম। অজ্ঞানতা। এক সময় রহস্য ভেদ করে ঠিকই সত্য জানা যায়।

    দু-চোখ কুচকে সামনের দেয়ালের দিকে ভালো করে তাকালো। এখান দিয়ে অবশ্যই কোনো প্রবেশপথ আছে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগের ঘটনা, তার স্পষ্ট মনে আছে ঐ মহিলা ইটবিছানো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সামান্যতম ডানে-বামে নয়, একেবারে সোজা।

    মাথার উপরে ঘন ডালপালা থাকার কারণে চাঁদের আলো বাঁধা পড়েছে, ফলে জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, স্পষ্ট করে কিছু দেখার উপায় নেই। তবে ইটবিছানো পথটি যে দেয়ালের দিকেই চলে গেছে সেটা বুঝতে পারলো। মুশকান জুবেরির মতো তার হাতে টর্চলাইট থাকলে বুঝতে পারতো সামনে আসলে কি আছে।

    সামনের দিকে একটু এগিয়ে অন্ধের মতো দেয়ালটা হাতরাতে চাইলে কিনতু নাগাল পেলো না। আরেকটু সামনে বাড়লো, এবারও তার হাত দেয়ালটা স্পর্শ করলো না। বিস্ময়ে থমকে দাঁড়ালো ছফা। টের পেলো নিঃশ্বাস বেড়ে গেছে। ইটবিছানো পথের উপরে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। মোবাইলফোন বের করে ডিসপ্লের আলো জ্বালাতে পারছে না নিজের উপস্থিতি চাউর হবার ভয়ে। তাই অন্ধকারে চোখ সয়ে আসার জন্য একটু অপেক্ষা করলো, আর সেটা হতেই ধরতে পারলো দৃষ্টি বিভ্রমের কারণটা।

    জমিদার বাড়ির পুবদিকে জোড়পুকুর অবস্থিত। মূল বাড়ি থেকে পুকুরটা আলাদা করা হয়েছে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর দুটো দেয়াল দিয়ে। দেয়াল দুটো একই রেখায় অবস্থিত নয়। দক্ষিণ দিক থেকে যে দেয়ালটা এসে মিলেছে ইটবিছানো পথের কাছে, তার থেকে ছয়-সাত ফিট পরে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় দেয়ালটি। ওটা চলে গেছে উত্তর দিকে। দুটো দেয়ালের মাঝে যে ফাঁক সেটাই কাজ করে খোলা প্রবেশদ্বার হিসেবে। কোনো দরজা না থাকলেও অন্দরবাড়ির মহিলাদের স্নান করার দৃশ্য এই প্রবেশদ্বারের সামনে। দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। জোড়পুকরে যেতে হলে দটো দেয়ালের মাঝখানে ছোট্ট একটা গলি দিয়ে যেতে হবে। এর ফলে রাতের অন্ধকারে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে। পুরনো দিনের এই স্থাপত্য-কৌশলে মুগ্ধ হলো ছফা। এই সহজ সরল টেকনিকটা মঞ্চে রাখা বিশাল আকারের হাতি ভ্যানিশ করার জাদুতে ব্যবহার করে থাকে জাদুকরেরা।

    ছোট্ট গলিটিতে ঢুকে পড়তেই বেশ কিছুটা দূরে উজ্জ্বল আলোর উৎস চোখে পড়লো তার। জোড়পুকুরটার শান বাঁধানো ঘাটের আগে বেশ কিছুটা খালি জায়গা আছে, সেখানে উজ্জ্বল আলোর একটি বাতি জ্বলছে। চিনতে পারলো সে। দেখতে অনেকটা বড়সর হারিকেনের মতো হলেও এর আলো বেশ উজ্জ্বল। ছোটোবেলায় তারা এটাকে গ্যাস-বাতিও বলতো। এক সময় গ্রামে-গঞ্জে বেশ জনপ্রিয় ছিলো এটা। জিনিসটার নাম অনেক চেষ্টা করে মনে করতে পারলো না নুরে ছফা। যাহোক, তার দৃষ্টি আটকে রইলো একজন বলশালী আর মাঝারিগগাছের যুবকের দিকে, তারা দু-জন দাঁড়িয়ে আছে একটা গর্তের পাশে। মুশকান জুবেরি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে কী যেনো বলছে। হাতের টর্চটা দিয়ে কিছু একটা দেখাচ্ছে গর্তের নীচে। গর্তের পাশেই আলগা মাটির স্তূপ, একটা কোদাল, বেলচা আর ভাঁজ করা চটের ছালা পড়ে আছে। গতটা আকারে কবরের চেয়ে সামান্য বড় হবে।

    ছফা টের পেলো তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। হৃদস্পন্দন থমকে আছে যেনো। দেয়ালের প্যাসেজটার পাশেই বড় একটা গাছের নীচে তিন-চার ফুট উঁচু ঘন ঝোপের আড়ালে মূর্তির মতো বসে রইলো সে। উজ্জ্বল আলোয় পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে খালি গায়ের গোরখোদক ফালু ময়লা জিন্স প্যান্ট হাটু পর্যন্ত গুটিয়ে রেখেছে। তার সারা শরীর আর মুখ ঘেমে একাকার। হাপাচ্ছে সে। কবর খুরে পরিশ্রান্ত এখন। কপালের ঘাম হাত দিয়ে কেঁচে ফেললো একবার। নিজের খোরা গর্তের তাকিয়ে কী যেনো দেখছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝারিগোছের যুবকের দৃষ্টিও সেদিকে। তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সম্ভবত এটাই বোবা দারোয়ান। মুশকান জুবেরি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কী যেনো বললো তাকে। সঙ্গে সঙ্গে গোরখোদক ছেলেটাকে নিয়ে চটের ছালাটা মেলে ধরলো সে, দু-দিকে দুটো প্রান্ত ধরে উপুড় হয়ে গর্তের নীচে বিছিয়ে দিলো ওটা।

    টর্চটা বন্ধ করে গভীর মনোযোগের সাথে গর্তের নীচে তাকিয়ে আছে। মুশকান জুবেরি। অবশেষে সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কিছু একটা ইশারা করতেই ফালু আর ইয়াকুব কোদাল-বেলচা নিয়ে গর্তের মধ্যে আলগা মাটি ফেলতে শুরু করে দিলো।

    নুরে ছফা টের পেলো তার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে। মুশকান জুবেরি কী করছে! কাউকে কবর দিচ্ছে!? একজন নয় নিশ্চয়।

    সর্বনাশ!

    স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গোরখোদক ফালু এসব কাজে খুব দক্ষ। যন্ত্রের মতো দ্রুত হাত চালিয়ে আলগা মাটিগুলো কোদালে করে নিয়ে ফেলে দিচ্ছে গর্তের মধ্যে। বোবা দারোয়ান অবশ্য ধীরগতিতে মাটি ফেলে যাচ্ছে।

    মুশকান জুবেরি এখন বাগানের আশেপাশে তাকাচ্ছে। আকাশের দিকেও এক পলক তাকালো। বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করে রেখেছে। তার ডানহাতে টর্চটা। গায়ে জড়ানো শাল থুতনি পর্যন্ত ঢেকে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গর্ত ভরাট করার কাজে সন্তুষ্ট।

    ঝোপের আড়াল থেকে গর্তের নীচে কি আছে ছফার পক্ষে সেটা দেখা সম্ভব হচ্ছে না, তবে সে জানে একটা জিনিসই থাকতে পারে ওখানে, আর এটা ভাবতেই তার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। মনে হলো এরকম গভীর রাতে নির্জন এই বাড়িতে ঢোকাটা ঠিক হয় নি। কতো বড় বিপদ তার জন্যে অপেক্ষা করছে কে জানে। এরা যদি টের পেয়ে যায় তাহলে কি হবে ভাবতেই তার হাত-পা অসাড় হয়ে গেলো। বোবা দারোয়ান, গোরখোদক ফালু আর মুশকান জুবেরিকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না।

    নিজেকে খুব সাহসী মনে করলেও এই প্রথম ছফা টের পেলো সে। দারুণভাবেই ভড়কে গেছে। এখন যদি ঐ গোরখোদক আর দারোয়ান ছেলেটা তার দিকে তেড়ে আসে তাহলে ঝোপের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াবার মতো শক্তি থাকবে কিনা সন্দেহ। পা দুটো খুব ভারি অনুভূত হচ্ছে। তার কাছে, বুকে চলছে হাতুড়িপেটা। গভীর করে দম নিলো সে। শ্বাসপ্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো।

    মুশকান জুবেরি বুকের কাছে হাত রেখেই দাঁড়িয়ে আছে, তার দৃষ্টি গর্তে মাটি ফেলার দিকে নেই, আশেপাশের অন্ধকারে চোখ বুলাচ্ছে। ছফা বুঝতে পারলো মহিলার মধ্যে এক ধরণের ভৌতিক সৌন্দর্য আছে। উজ্জ্বল গ্যাস বাতির আলোয় তার চোখ দুটো কেমন জানি দেখাচ্ছে তবে আতর আলীর বর্ণনামতো সেই চোখ মোটেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে না। ইনফর্মার সম্ভবত ভয় পেয়ে দৃষ্টি বিভ্রমের শিকার হয়েছিলো।

    গর্তটা প্রায় ভরাট হয়ে উঠেছে। ফালুর শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ছটলেও বিরাহীনভাবেই সে মাটি ফেলে যাচ্ছে কোদাল দিয়ে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে পারছে না বোবা ইয়াকুব।

    ছফা দেখতে পেলো মুশকান জুবেরি তার মুখটা সামান্য উঁচু করে গভীর করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

    বাতাসের গন্ধ নিচ্ছে?!

    হঠাৎ করে ছফার বুকের রক্ত আরেকবারের জন্য হিম হয়ে গেলো। ঝোপের আড়ালে মূর্তির মতো বসে রইলো সে। আতরের বলা গল্পটা মনে পড়ে গেলো। সঙ্গোপনে প্রার্থনা করলো এটা যেনো তার বেলায় না ঘটে। এই মুহূর্তে মুশকান জুবেরি যদি তার দিকে তাকায় সে স্থির থাকতে পারবে না। তার দু-চোখ কুচকে গেলো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মিসেস জুবেরির নাসারন্ধ্র ফীত হয়ে আছে। মহিলা আলতো করে দুচোখ বন্ধ করে ফেললো কয়েক মুহূর্তের জন্য, যেনো শিকারীপশু শিকারের গন্ধ পাচ্ছে। তারপরই ছফার হৃদপিণ্ডে কাঁপন ধরিয়ে ঘাড়টা না ঘুরিয়েই আড়চোখে ঝোপের দিকে তাকালো সে। তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে? মহিলার মুখে বাঁকাহাসিও ফুটে উঠলো এ সময়।

    ঝোপের পেছনে হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলো নুরে ছফা। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না মুশকান জুবেরি কী করে বুঝে গেলো সে এখানে আছে।

    শুধু এটুকুই। আড়চোখে তাকানো, মুখে বাঁকাহাসি, আর কিছু করলো না রহস্যময়ী নারী। আতরের সাথেও মহিলা ঠিক এরকমই করেছিলো।

    কিন্তু তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে আচমকাই বোবা দারোয়ানকে হাত তুলে মাটি ফেলার কাজ থামানোর নির্দেশ দিলো মুশকান, তারপর হাতের টর্চটা তুলে ঝোপের দিকে দেখিয়ে দিতেই ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে বেলচা রেখে ছুটে আসতে লাগলো ঝোপের দিকে।

    ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলো ছফা। বুঝতে পারছে না কী করবে!

    .

    অধ্যায় ১২

    লুঙ্গির প্রান্ত দুটো দু-হাতে ধরে হাটুর উপরে তুলে রীতিমতো দৌড়াচ্ছে আতর।

    ফালুর ঘরে যেভাবে ঢুকেছিলো ঠিক সেভাবেই জানালা দিয়ে বেরিয়ে টিউবওয়েলের পাশ দিয়ে সোজা চলে যায় কবরস্তানের দক্ষিণ দিকে। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে পালাতে পারেনি। একটা পুরনো কবরের উপর পা পড়তেই মাটি দেবে হূমুরিয়ে পড়ে যায় সে।

    “ওই? কে? কে?”

    তার পড়ে যাবার শব্দ শুনে ঝুপরি ঘরের দরজার কাছ থেকে বাজখাই কণ্ঠটা বলে উঠেছিলো। টর্চের আলোও ফেলেছিলো শব্দটার উৎস আন্দাজ করে। আতর আর উঠে দাঁড়ায় নি। চুপচাপ কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করে যাতে ফালু মনে করে শিয়াল কিংবা বাঘডাস হবে হয়তো। কে না জানে, গ্রামের কবরস্তানে এদের নিত্য আনাগোনা। কবর খুরে পচা গলা লাশ খেতে এদের জুরি নেই।

    আতরের ধোঁকায় কাজ হয়। গোরখোদক আর উচ্চবাচ্য না করে কয়েক মুহূর্ত পরই একটা বড়সর মাটির চাকা ছুঁড়ে মারে শব্দের উৎসের দিকে। ঢিলটা পড়ে আতরের খুব কাছেই। হারামজাদার নিশানা বলতে হবে। একটুর জনো ওটা গায়ে লাগে নি। টর্চের আলোটা সরে যেতেই শুনতে পায় বিড়বিড় করে কেউ কিছু বলছে। তবে শেয়াল আর বাঘডাশের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দেয়া গালিগালাজগুলো আতরকে স্বস্তি এনে দেয়।

    গালাগালি থেমে যেতেই আস্তে করে উঠে দাঁড়ায় সে, অন্ধকারে পা টিপে টিপে কবরগুলো এড়িয়ে দক্ষিণ দিকে নেমে পড়ে। ওই জায়গাটা একটু নীচ, ঝোঁপঝাঁড় আর ডোবায় ভরতি। উপায়ন্ত না দেখে লুঙ্গিটা হাটুর উপরে তুলে কাদা-পানিতে নেমে পড়ে সে। কবরস্তান থেকে একটু দূরে, বিস্তৃর্ণ ক্ষেতের কাছে আসতেই জোরে জোরে দৌড়াতে শুরু করে।

    মহাসড়কে আসতেই দম ফুরিয়ে গেলো আতরের। পথের পাশে থেমে একটু জিরিয়ে নিলো। পায়ে কাদা লেগে থাকার কারণে এখনও লুঙ্গিটা হাটুর উপরেই তুলে রেখেছে। অনেকক্ষণ বিরতি দিয়ে একটা-দুটা বাস-ট্রাক চলে গেলেও মহাসড়কে রিক্সার কোনো বিকার দেখা পেলো না। রাতের এ সময় টাউনেই রিক্সা পাওয়া কঠিন, এই সড়কে সারারাত বসে থাকলেও পাবে না। একটু সামনে এগিয়ে সড়কের পাশে ডোবা থেকে পা দুটো ধুয়ে নিলো, তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলো সে।

    সড়কের একপাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আতরের মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো। ফালুর ঘরে চৌকির নীচে চাদরে মোড়া জিনিসটা কি সত্যি সত্যি লাশের কঙ্কাল ছিলো, নাকি এটা তার মনের ভুল? না। সে নিশ্চিত, ওটা মানুষের কঙ্কালই ছিলো। কথা হলো, ঐ হারামজাদা নিজের ঘরের খাটের নীচে লাশের হাডিউগুডিট রেখে দিয়েছে কেন?

    আতরের মাথা আর কাজ করে না। এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই। এমনকি আন্দাজ করতে গিয়েও হিমশিম খেলো।

    *

    পালিয়ে যাবার তাড়না বোধ করলেও ছফা কিছু করার আগেই দেখতে পেলো বোবা দারোয়ান তার ডানদিক দিয়ে চলে গেলো সরু প্যাসেজটার দিকে। সে মোটেও তার দিকে ছুটে আসছিলো না। ভাগ্য ভালো, ঝোপের আড়াল থেকে উঠে দৌড় দেবার আগেই বুঝতে পেরেছিলো এটা।

    বোবা ভেতরের বাড়িতে চলে যাবার পর হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। তবে নিশ্চিত হতে পারছে না, মুশকান জুবেরি কি আসলেই ঝোপের আড়ালে তার উপস্থিতি টের পেয়ে গেছে কিনা। যদি টের পেয়ে থাকে তাহলে এমন আচরণ করছে কেন? তবে এটাও ঠিক, আতর আলীর উপস্থিতি জেনে যাবার পরও মহিলা ঠিক এমনটাই করেছিলো, কোনো রকম চিৎকার-চেঁচামেচি করে নি।

    এবার তাকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে মুশকান জুবেরি টর্চলাইটটা জ্বালিয়ে তার দিকে আলো ফেললো।

    ঠিক তার উপরে নয়, তার থেকে একটু দূরে, ডানে-বামে! ঝোপের আড়াল থেকে ছফা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মহিলার ঠোঁটে মুচকি হাসি। গোরখোদক ফালু গর্তটা প্রায় ভরে ফেলছে মাটি দিয়ে। দৃশ্যটা সে দেখতে পেয়ে একটু থেমে তাকালো ঝোপের দিকে। কিছু বললো মুশকান জুবেরিকে। মহিলা মুচকি হাসি দিয়ে মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো। তবে কী বলছে সেটা তা দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না।

    কয়েক মুহূর্ত ভেবে ছফা আর কোনো ঝুঁকি নিলো না। বসা অবস্থায়ই আস্তে করে একটু পিছিয়ে গেলো, তবে তীক্ষ্ণণ নজর রাখলো মুশকান জুবেরির দিকে। এভাবে আরেকটু পেছনে সরে গিয়ে উপড় হয়ে থেকেই ঘুরে আস্তে আস্তে প্যাসেজটায় ঢুকে পড়লো, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়িটার পেছন দিককার আঙিনার কাছে কাছে চলে গেলো। সে। মাত্র কয়েক গজ সামনে এগোতেই চমকে গেলো। অল্পের জন্যে মুখ দিয়ে অস্ফুট একটি আর্তনাদ বেরিয়ে যাচ্ছিলো প্রায়। কয়েক মুহূর্ত জমে রইলো বরফের মতো।

    তার সামনে, মাত্র দশ গজ দূরে পাকা আঙিনার উপরে এক তরুণী। বসে আছে। তার পাশে পিতলের থালা, তাতে কিছু খাবার আর পানিপাত্র। মৃদু চাঁদের আলোতেও চকচক করছে ও দুটো। মেয়েটা বিন্দুমাত্র না চমকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে!

    ছফা ভড়কে গিয়ে আস্তে করে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। মেয়েটা অন্ধকারে তাকে চিনতে পারছে না, কিন্তু বোঝার চেষ্টা করছে। এক পা দু পা করে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো সে। ভালো করেই জানে এরপর কি হবে। মুশকান জুবেরি যেটা করে নি এই মেয়ে সেটাই করবে-তারস্বরে চিৎকার দিয়ে ‘চোর চোর’ বলে চেঁচিয়ে উঠবে এখনই।

    কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটা কিছুই করলো না। গাছের আড়াল থেকে আস্তে করে উঁকি মেরে দেখলো ছফা। দৃশ্যটা তাকে বিস্মিত করলো আরেকবার : আঙিনায় বসে থাকা তরুণী আপন মনে মাথার চুলে বিলি কাটছে আর গুনগুন করে কোনো লোকজ গান গাইছে! যেনো একটু আগে সে কিছুই দেখে নি!

    গাছের আড়ালে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সে। টের পেলো তার গা কাটা দিয়ে উঠেছে। চোখের সামনে ভুত দেখলেও এতোটা ভয় পেতো কিনা সন্দেহ।

    এই বাড়িতে কী হচ্ছে এসব? এরা সবাই এমন কেন?!

    তার এই ভাবনাটা বাধাগ্রস্ত হলো কারোর পায়ের শব্দে। চমকে পেছনে। ফিরে তাকালো সে। দুই দেয়ালের মধ্যে যে প্যাসেজটা আছে সেখান দিয়ে টর্চের আলোকরশ্মির আভা দেখতে পেলো। মুশকান জুবেরি আসছে!

    কয়েক মুহূর্ত পরই ধীরপায়ে মিসেস জুবেরি বেরিয়ে এলো প্যাসেজটা দিয়ে। ডানে-বামে কোথাও না তাকিয়ে সোজা চলে গেলো বাড়ির দিকে। আঙিনায় উঠেই ঐ মেয়েটাকে কিছু বললো কিনতু সেটা বোঝা গেলো না। মেয়েটা খাবারের থালা আর পানিপাত্র রেখেই চুপচাপ উঠে মুশকান জুবেরির সাথে সাথে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।

    ঝোপের পেছনেই বসে রইলো ছফা। গোরখোদক ফালু এখনও পুকুরপাড়ে আছে সম্ভবত সেও চলে আসরে এক্ষুণি।

    তাই হলো। দুই-তিন মিনিট পরই ওখানে আলোর বন্যা বইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো একজন। ফালুর একহাতে সেই গ্যাস-বাতি, অন্যহাতে গামছা, ওটা দিয়ে মুখে-গলায় ঘাম মুছতে মুছতে জমিদার বাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন তার গায়ে একটা শার্ট চাপানো। সম্ভবত ওটা খুলেই মাটি খোরা

    আর ভরাটের কাজ করেছিলো, কাজ শেষে আবার পরে নিয়েছে।

    ফালু ঝোপটা অতিক্রম করতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো ছফা। এখন জোর পুকুরটার পাশ দিয়ে এ বাড়ির বাইরে যাবার চেষ্টা করবে সে। তার ধারণা। ওদিক দিয়ে অবশ্যই বের হবার কোনো রাস্তা আছে। হয়তো তাকে আবারো দেয়াল টপকাতে হবে।

    হাইজ্যাক-বাতিটা আঙিনায় রেখে খাবারের থালার পাশে বসে হাতের গামছা দিয়ে মুখ আর গলা মুছতে লাগলো ফালু। পিতলের পানিপাত্রটা যেই হাতে তুলে নিয়েছে গোরখোদক অমনি লাফ দিয়ে উঠলো ছফা। তার ঘাড়ের উপরে কিছু একটা পড়তেই শিরশির করে জ্যাকেটের কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না গোরখোদক সঙ্গে সঙ্গে পাত্রটা রেখে ঝোপের দিকে তাকালো। তার চোখেমুখে বিস্ময়। গ্যাস-বাতি হাতে নিয়ে মুখের কাছে তুলে ধরলো সে।

    ছফা লাফ দিয়ে উঠে তার শরীরটা মুচড়িয়ে ছোট্ট প্রাণীটার হাত থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করলো কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারলো একটা বড়সড় প্রাণী তাকিয়ে আছে তার দিকে! গ্যাস-বাতির উজ্জ্বল আলোয় চোখ কুচকে ফেললো সে।

    “ওই! ওই! ওইহানে কে রে?” চিৎকার দিয়ে বলেই গোরখোদক ফালু গ্যাস-বাতিটা হাতে নিয়ে তেড়ে আসতে লাগলো তার দিকে।

    ইতরপ্রাণীর হাত থেকে রেহাই পাবার চেষ্টা আপাতত বাদ দিয়ে। দেয়ালের প্যাসেজটার দিকে প্রাণপণে ছুটে গেলো ছফা। সে জানে মারাত্মক বিপদে পড়ে গেছে। তার পেছনে ধেয়ে আসছে এমন একজন গোরখোদক যে আজরাইলের মৃত্যুর পরোয়ানার খবর আগেভাগেই টের পেয়ে যায়। কিন্তু এ মুহূর্তে নুরে ছফার কাছে মনে হচ্ছে, লোকটা স্বয়ং মৃত্যুদূত।

    .

    অধ্যায় ১৩

    এতোটা পথ হেঁটে এসে অনেকটাই ক্লান্ত আতর আলী। তার মাথায় কিছুই টুকছে না। হোটেল সানমুনের ম্যানেজারের কথা শুনে তার দিকে সন্দেহের চোখে চেয়ে আছে। ঐ সাংবাদিক নাকি অনেক আগেই হোটেল থেকে বের হয়ে গেছে, আর ফিরে আসে নি। ম্যানেজার অবশ্য জানে না ভদ্রলোক একজন সাংবাদিক।

    ঘন্টাখানেক আগে সে নিজে একটা ভ্যানে তুলে দিয়েছে লোকটাকে, তাহলে আবার কোথায় গেলো? এতো রাতে সুন্দরপুরে একা একা ঘুরে বেড়াবে না, এখানকার কাউকে চেনেও না ঐ সাংবাদিক। তাছাড়া রাতের এ সময়ে রিক্সা পাওয়াও মুশকিলের ব্যাপার। কিন্তু ম্যানেজার যখন জানালো, শহরের ঐ ভদ্রলোক তার বাইসাইকেলটা নিয়ে গেছে তখন চিন্তায় পড়ে গেলো। সাইকেল নিয়ে যাবে কোথায়? কী এমন জরুরি কাজ পড়লো যে হঠাৎ করে এতো রাতেই বেরিয়ে পড়তে হলো?

    কয়েক ঘণ্টা ধরে তার মাথায় একের পর এক প্রশ্ন এসে ভীড় করছে, জট পাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোনোটারই জবাব পাচ্ছে না। ভেবেছিলো ফালুর ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়ে সাংবাদিককে চমকে দেবে। সে যে আসলেই একজন ইনফর্মার সেটা বুঝতে পারবে নুরে ছফা। সুন্দরপুরের সব খবর তার কাছে আছে-এমন বদ্ধমূল ধারণাটি মারাত্মক হোঁচট খেয়েছে ঐ ডাইনি আর ফালুর কারণে। হারানো গৌরব ফিরে পাবার জন্য ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে।

    ম্যানেজারের দিকে তাকালো। তার উপস্থিতি মোটেও পছন্দ করছে না। লোকটা, তবে সাহস করে সেটা প্রকাশও করতে পারছে না। অবাক হলো না আতর। সুন্দরপুরের অনেক মানুষই তার সাথে এমন করে। ম্যানেজারের ডেস্কের সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়লো সে। ঠিক করলো ঐ সাংবাদিকের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করবে।

    “ইয়ে মানে,” কাচুমাচু হয়ে বললো ম্যানেজার, “সারাদিন ডিউটি কইরা এক্কেবারে টায়ার্ড হয়া গেছি…একটু ঘুমাইতাম…”

    “ঘুমান…সমস্যা কি,” নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো ইনফর্মার। এক পায়ের উপর আরেক পা তলে আরাম করে বসলো এবার।

    “না, মানে…এইটা তো শহরের হোটেল না..সারারাইত খোলা রাখি …বারোটার দিকে বন্ধ কইরা দেই..”

    ম্যানেজারের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে ডেস্কের পেছনে দেয়াল ঘড়িটা দেখে নিলো। “বারোটা তো অহনও বাজে নাই, আপনের বারোটা বাজুক, আমি চইলা যামু।”

    আতরের দ্ব্যর্থবোধক কথায় ঢোক গিললো ম্যানেজার। এই হারামজাদা মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তার বারোটা বাজাতে এসেছে। আর কিছু না বলে চুপ মেরে গেলো সে।

    লোকটার দিকে চকিতে চেয়ে মুচকি হাসলো ইনফর্মার। সুরত আলী তার হোটেলটাকে বেশ্যাপাড়া বানিয়ে রেখেছে, রাত গম্ভীর হলেই শুরু হয় মজমা। এই ম্যানেজার যতো গোবেচারা চেহারা করেই রাখুক না কেন সে জানে, লোকটা গভীর জলের মাছ, ডুবে ডুবে জল খায়।

    “ব্যবসা কিমুন চলতাছে?”

    ম্যানেজার নীচু হয়ে কী যেনো করছিলো, আতরের প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে তাকালো। “এই তো…তেমন একটা ভাল না।”

    বাঁকাহাসি দিলো সে। “কন কি, ফেরিঘাটের খানকিপট্টিটা তো তুইলা দিছে. অহন তো আপনাগো বিজনেস ভালা থাকনের কথা?”

    বিব্রত ভঙ্গি করলো লোকটা। “এইটা খুবই ছোটো টাউন, এইখানে ব্যবসা-বাণিজ্য সব সময়ই মন্দা থাকে।”

    “হূনেন, আপনেরে একটা বুদ্ধি দেই, একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বললো সে, “খানকিপাড়ার ভুসগি-মাগিগুলারে বাদ দিয়া নতুন কিছু নিয়া আসেন।”

    ম্যানেজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার দিকে চেয়ে রইলো।

    “আগের মতো তো আর যাত্রাপালা হয় না…যাত্রাপালার মাইয়াগুলা কাম কাইজও পায় না…ওগোরে হোটেলে তুলেন…পিপড়ার মতো কাস্টমার আইবো।”

    ম্যানেজার কিছু বলতে যাবে অমনি পুলিশের একটা জিপ এসে থামলো হোটেলের সামনে। আতর আর ম্যানেজার দু-জনেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।

    জিপ থেকে নামলো সাদাপোশাকের এক মাঝবয়সী লোক।

    “ওসিসাব?!” বিস্মিত ইনফর্মার দাঁড়িয়ে পড়লো, ম্যানেজারের দিকে তাকালো সে। লোকটা আবারো বিব্রত ভঙ্গি করছে। “আপনে আগে কইবেন নাওসিসাব আইবো?” এ মুহূর্তে এরকম জায়গায় সুন্দরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতার মুখোমুখি হতে চাইছে না। এমনিতেই এখন ওসির সুনজরে নেই, তার উপরে এরকম জায়গায় দেখা হয়ে গেলে লোকটা যতো না লজ্জায় পড়বে তারচেয়ে বেশি রেগে যাবে তার উপর।

    “না, মানে–”।

    হাত তুলে ম্যানেজারকে থামিয়ে দিলো সে। লোকটা এখন ডেস্ক ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। “ওসিসাব কি দোতলায় যাইবো?”

    “হ।”

    আতর আর দেরি না করে গজরাতে গজরাতে সোজা চলে গেলো নীচতলার টয়লেট রুমের দিকে।

    *

    জোড়-পুকুরের অপর পাড়ে উঁচু ঢিবির নীচে লুকিয়ে আছে ছফা। তার সারা শরীর চুলকাচ্ছে। ঘাড় থেকে পিঠ পর্যন্ত চুলকানির চোটে পুড়ে যাচ্ছে যেনো। সম্ভবত ঝোঁপে থাকা কোনো ছ্যাঙ্গা’ কিংবা ঐ জাতীয় কীট তার ঘাড় দিয়ে পিঠে ঢুকে পড়েছে। তুচ্ছ কীটটা এখনও তার পিঠের কোথাও লেগে আছে, তবে ছফা হাত ব্যবহার করে জ্যাকেটের উপর দিয়ে এমনভাবে ওটাকে পিষে ফেলেছে যে, ভর্তা না-হয়ে যায়-ই না। প্রাণীটা মরে গেলেও তার বিষ ঠিকই ছড়িয়ে দিয়েছে। ছফার ইচ্ছে করছে জ্যাকেট আর শার্টটা খুলে সামনের পুকুরের পানিতে নেমে গোসল করতে কিন্তু এ মুহূর্তে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

    ঢিবির তালুতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে, তার নজর পুকুরের ওপাড়ে। গ্যাস-বাতির আলোয় দেখতে পাচ্ছে জোড়পুকুরটা আসলে দুটো পুকুর নয়, বরং ডিম্বাকৃতির বড় একটি পুকুর, তবে নারী-পুরুষের ঘাট দুটোর মাঝখানে মোটা দেয়াল চলে গেছে পানির মধ্য দিয়ে বেশ কিছুদুর। ফলে ঘাটে গোসল করতে আসা নারী-পুরুষের মধ্যে এক ধররেণর আড়াল তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ছফার কাছে মনে হলো পুরুষ ঘাটটা ভেঙেচুরে আছে। এটা হয়তো খুব একটা ব্যবহৃত হয় না এখন।

    একটু আগে যেখানে মাটিচাপা দেয়া হয়েছে সেখানে গোরখোদক ফালু হাতের বাতিটা উপরের দিকে তুলে ধরে আশেপাশে তাকাচ্ছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে তাকে। ছফা যেখানে লুকিয়ে আছে দুর থেকে সেখানেও দেখার চেষ্টা করছে, তবে গোরখোদক পা বাড়াচ্ছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করছে তার অবস্থান।

    এমন সময় বোবা দারোয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো সেখানে। গোরখোদকের সাথে হাত নেড়ে ইশারায় কথা বললো সে। ঘটনা কি জানতে চাইছে। পুকুরের অপরপাড়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখালো ফালু।

    ছফা বুঝতে পারছে তাকে এখন সটকে পড়তে হবে, তবে অপেক্ষা করলো ওই দু-জন এরপর কি করে সেটা দেখার জন্য। ওরা এদিকটায় আসতে নিলেই সে দৌড় দেবে। কিন্তু দৌড়ে যাবে কোথায়? ঘন অন্ধকারেও বুঝতে পারছে পুকুরের পুবদিকে সামান্য একটু নীচু জায়গার পরই বড়সড় জলাশয় আছে। সম্ভবত পানির ঠাঁই বেশি হবে না। সাঁতার দিতে গেলেও সেটা হবে বোকার মতো কাজ। আর পানির ঠাই কম হলে তো মহাবিপদ। এরকম জলাশয় দিয়ে দৌড়ে কতোটুকুই বা যেতে পারবে? দুই দু জন তাগড়া যুবক ঠিকই ধরে ফেলবে তাকে।

    পুকুরের ওপাড়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে যাওয়া দুই যুবকের দিকে চেয়ে রইলো সে। চকিতে বামদিকে তাকালো। চাঁদের মিয়মান আলোয় দেখতে পেলো, পুকুরের দক্ষিণ দিকে ঝোঁপঝাঁড়ের আধিক্য বেশি। বড় বড় গাছও রয়েছে প্রচুর। সম্ভবত ওখান দিয়ে এগিয়ে গেলেই এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে।

    ঠিক এ-সময় পুকুরপাড়ে টর্চ হাতে চলে এলো মুশকান জুবেরি। তাকে দেখে বোবা দারোয়ান আর গোরখোদক ছেলেটা এগিয়ে গেলো। দূর থেকে ওদের কোনো কথাই বুঝতে পারছে না ছফা, এমনকি শরীরি ভাষাটাও পড়তে হিমশিম খাচ্ছে। তবে, ফালু আর দারোয়ান কেন তাকে ধরার জন্য এদিকটায় এসে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটা তার মাথায় ঢুকছে না। ছফাকে আরো বেশি বিস্মিত করে দিয়ে বোবা আর গোরখোদক চুপচাপ ভেতরের বাড়িতে চলে গেলো!

    মুশকান জুবেরি টর্চ হাতে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার স্থিরদৃষ্টি ঠিক সেখানে নিবদ্ধ যেখানে ছফা লুকিয়ে আছে। তারপরই ঘুরে চলে গেলো মহিলা।

    বলতে গেলে পাঁচ মিনিটের মতো বিবশ হয়ে রইলো সে। মুশকান জুবেরিসহ এই জমিদার বাড়ির কারোর আচরণ বোধগম্য হচ্ছে না তার কাছে। এরা কি স্বাভাবিক মানুষ?

    ওরা বাড়ির ভেতরে চলে যাবার পর সুনসান নীরবতা নেমে এলো জোড়পুকুর পাড়ে। যেভাবে ছিলো সেভাবেই পড়ে রইলো সে। যেনো ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তাকে যে এখন পিতৃপ্রদত্ত জীবনটা নিয়ে এখান থেকে পালাতে হবে সে-খেয়াল নেই। তার ঘোর কাটলো অদভুত এক শব্দে। চমকে পেছন ফিরে তাকালো। পেছনের জলাভূমিতে কিছু একটা নড়ছে।

    মাছ? সম্ভবত।

    মুশকান জুবেরি যে বিভিন্ন ধরণের কৃষিজ ফলনের সাথে জড়িত এটা সে জানে। ক্ষেতে শাক-সবজি, ফলমূল আর পুকুরে মাছ চাষ করে। এমন কি, নিজের বাগানের একপাশে ঔষধি গাছের সংগ্রহও রয়েছে তার। বিপুল জমির প্রায় সবটাই কাজে লাগিয়েছে মহিলা।

    কিন্তু তার পেছনে যে প্রাকৃতিক জলাশয়টি আছে ওখানে নিশ্চয় মাছ চাষ করা হয় না। ওরকম মুক্ত জলাশয়ে মাছচাষ করবে কোন বোকা! সে যতোটুক বুঝতে পারছে, পুকুরেই মাছচাষ করা হয়। তাহলে জলাশয়ে ওগুলো কি?

    ছফা আস্তে করে তালু দিয়ে নীচে নেমে এলো। পুকুরের পেছন দিকটা বিস্তৃর্ণ নীচু জলাশয় চলে গেছে পুবদিকে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় ভালো করে তাকিয়ে দেখলো তার থেকে দশ-বারো হাত দূরে জলাশয়টি প্রায় পাঁচফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে পুকুরপাড় থেকে আলাদা করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে প্রথম দেখায় ওটা চোখে পড়ে নি।

    সেই কাঁটাতারের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলো সে। পানির মধ্যে যে জিনিসটা নড়াচড়া করছে সেটা যেনো উঠে আসছে কাঁটাতারের দিকে। একটু কুঁজো হয়ে ভালো করে দেখলো, সঙ্গে সঙ্গে ভিরমি খেলল সে। এগুলো কী?

    .

    অধ্যায় ১৪

    সুরত আলীর ‘ফাইভ-স্টার হোটেলের টয়লেটে কয়েক মিনিট থেকেই আতরের বমি হবার জোগার হলো। এই হোটেলের নীচতলাটি একদম সস্তা কাস্টমারদের জন্য, ফলে এখানকার সব কিছুই জঘন্য। মশার উপদ্রব যেমন তেমনি টয়লেটের দুরাবস্থা। সুরত আলীর ভাবসাব অনেকটা এমন এসব না পোষালে একটু বেশি টাকা খরচ করে দোতলায় থাকো, কে মানা করেছে?

    সস্তার তিন অবস্থা। সুয়ারেজ লাইন জ্যাম হয়ে আছে। হাগা-মুতা সব জমে আছে প্যানে। তার উপরে তিন-চারটা ব্যবহৃত কনডম ভাসছে।

    ওয়াক! নাক চেপে কয়েক মিনিট পার করে দিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। এই সানমুনে আর থাকা যাবে না। এমন কি এর বাইরেও নয়। ওসিসাব একটু ফুর্তি করতে এসেছে। তার ত্রি-সীমানায় থাকার ইচ্ছে নেই আতরের।

    হাতে ঘড়ি নেই বলে হোটেল থেকে বের হবার সময় ম্যানেজারের ডেস্কের পেছনে দেয়াল ঘড়িটা দেখে নিলো। রাত ১২টা বাজতে বেশি বাকি নেই, অথচ সাংবাদিক এখনও হোটেলে ফিরে আসে নি। তার কাছে ব্যাপারটা মোটেও ভালো ঠেকছে না। মনের একটা অংশ বলছে, এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামিয়ে কী লাভ? ঐ সাংবাদিককে মাত্র দু-দিন ধরে চেনে। এরকম একজনের জন্য এতো দুশ্চিন্তা করার কী আছে। আবার অন্য অংশটা খারাপ কিছুর আশংকা করে কিছুটা উতলা হয়ে উঠছে।

    নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়াটা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না, এখান থেকে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের পথ কিন্তু সেখানে গিয়ে কী করবে? কে আছে তার জন্য? একা মানুষ। রাতের বেলায় ঘরে ঢুকলেই মনে হয় সে দুনিয়াতে সবচেয়ে একলা। সারাদিন এটা-ওটা করে নিজের একাকীত্ব ভুলে থাকা যায় কিন্তু রাত খুবই নির্মম। তাকে সারারাত নিধুম রেখে জানিয়ে দেয়। আদতে সে বড় একা।

    এমনিতেও সে রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ায়, যতোটুকু সম্ভব নিজের ঘরে ফিরে যাওয়াটা এড়াতে চায়। থানার সাথে ঝামেলা না-হলে রাত দুটা-তিনটা পর্যন্ত পুলিশদের সাথেই কাটিয়ে দিতো। মুরগি ধরা আর ডিম বের করার কাজে পার করে দিতো সারাটা রাত। মুরগি ধরার কাজ না থাকলে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতো। জুনিয়র এসআই, কনস্টেবলদের সাথে ভাং খাওয়া, বাংলা মদে চুর হওয়া, কখনও কখনও ফেরিঘাটের বেশ্যাপাড়ায় ঢুঁ মারা-সবই করতো। ভালো গাঁজা আর মদ পেলে পুরুষ মানুষের জন্য রাত কাবার করাটা কী আর এমন কঠিন কাজ। তবে আতর একটা জিনিস কখনও খায় না ফেন্সিডিল। হতে পারে সে খুবই নগন্য মানুষ, তাই বলে কাশির সিরাপ খেয়ে নেশা করবে!

    এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো সে। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলো পেছন থেকে কেউ তার নাম ধরে ডাকছে।

    “অ্যাতো রাইতে কই যাও?” ফিরে তাকাতেই রহমান মিয়া বললো তাকে।

    “তুমি এতো রাইতে কইথেইকা আইলা?” একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আতর। রহমান মিয়া সাধারণত রাত দশটার পরই তার চায়ের দোকান বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় এগারোটা পর্যন্তও খোলা রাখে, কিনতু কখনও বারোটা পর্যন্ত নয়।

    “গেছিলাম একটু পুবপাড়ায়। তমিজের বাপটা আৎখা মইরা গেছে…হে আবার আমার জ্যাঠার সমন্ধি হয়।”

    “ও,” আর কিছু বললো না আতর। এটা সে মাস্টারের বাড়ি থেকে ফেরার পথেই জেনেছিলো।

    “শহরের মানুষটারে দেখলাম কানা-রাইতে সাইকেল নিয়া বাইর হইছে…এখন আবার তুমি এতো রাইতে ঘুরাফিরা করতাছো…ঘটনা কি?”

    সাইকেলের কথা বলাতে আতর ভুরু কুচকে ফেললো। “সাইকেল নিয়া কারে দ্যাখছো?”

    “এই তো, এটটু আগে তোমার ঐ শহরের লোকটারে সাইকেল চালায়। যাইতে দেখলাম…পরথমে তো চিনবারই পারি নাই…পরে মুখটা দেইখা চিনবার পারলাম।”

    ইনফর্মারের মনে আর কোনো সন্দেহ রইলো না, রহমান মিয়া নুরে ছফারে দেখেছে।

    “আমি দোকান বন কইরা তমিজের বাপের খবরটা দিতে গেছিলাম মোখলেস আর বেপারিরে…ওগোরে খবর দিয়া ফিরা আহনের সময় দেখলাম ঐ লোক সাইকেল চালায়া যাইতাছে।”

    “কই যাইতাছিলো?”

    “জোড়পুকুরের দিকে যাইতে দেখলাম।”

    নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো আতর। জোরপুকুর মানে জমিদার বাড়ি। ঐ সাংবাদিক তাহলে মুশকান জুবেরির বাড়িতে গেছে! কিন্তু কিভাবে যাবে? সে নিশ্চয় গেটের কাছে গিয়ে বলবে না, আমি একজন সাংবাদিক, মুশকান জুবেরির সাথে দেখা করতে চাই? যদি সেটা করার চিন্তাও করে এতো রাতে নিশ্চয় করাবে না?

    “কি ভাবতাছো?”

    রহমান মিয়ার প্রশ্নে মাথা দোলালো সে। “না, কিছু না।”

    “বাড়িতে যাওনের আগে আরো কিছু আত্মীয়-স্বজনরে খবরটা দিয়া যাই…মরার খবর যতো বেশি মানুষরে জানান যায় ততো বেশি নেকি, বুঝলা?”

    মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনফর্মার। “যাও, তাইলে নেকি কামাও গিয়া।”

    রহমান মিয়া আর কোনো কথা না বলে চলে গেলো।

    ফাঁকা রাস্তায় ঘোরের মধ্যে হাঁটতে লাগলো আতর। তাহলে এ কারণেই হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছে সাংবাদিক। এটা আরো আগেই তার বোঝা উচিত ছিলো। ঐ লোক একটা কাজেই সুন্দরপুরে এসেছে-মুশকান জুবেরির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়া। সুতরাং সে যদি কোনো কারণে কোথাও গিয়ে থাকে তবে সেটা ঐ মহিলার ব্যাপারেই হবে।

    আর কিছু না ভেবে হাটার গতি বাড়িয়ে দিলো সে। শীতের রাত যতো বাড়ে ততোই বাড়ে কুয়াশার তেজ। রাতের এ সময়টাতে ভারি কুয়াশা পড়ছে। আতরের গায়ে পাতলা একটা সোয়েটার। দুই হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা পাবার চেষ্টা করলো। পায়ের স্যান্ডেল ভেদ করে শীতের হিমবাতাস ঢুকে পড়ছে, তার চেয়ে বেশি ঢুকে পড়ছে লুঙ্গি দিয়ে।

    দ্রুতগতিতে হেঁটে কয়েক মিনিটের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সামনে চলে এলো। হোটেলটা বন্ধ থাকলেও জ্বলজ্বলে সাইনে বিরাট আর ভারিক্কি নামটা নির্জন মহাসড়কের পাশে প্রকটভাবে ফুটে উঠছে বার বার। সেদিকে তাচ্ছিল্যভরে চেয়ে একদলা থুতু ফেললো আতর। রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে মহাসড়ক থেকে নেমে গেলো ছোট্ট রাস্তায়। এই রাস্তাটা চলে গেছে। জমিদার বাড়ির দিকে। তার আশংকা সাংবাদিক ঐ ডাইনির বাড়িতে গিয়ে বিপদে পড়েছে। ফালুর ঘরে যা দেখেছে তা তো মামুলি কিছু নয়। এরকম একটা ছেলে, যে কিনা কবর থেকে লাশ তুলে নিজের ঘরের খাটের নীচে রেখে দেয়, তার সাথে মুশকান জুবেরির যে সম্পর্কই থাকুক সেটা নিশ্চয় ভালো কিছু নয়।

    আতরের আরো মনে হলো, জমিদার বাড়িতে তার ঢোকার কাহিনীটা বলার পরই হয়তো সাংবাদিক এরকম সাহস দেখানোর কথা চিন্তা করেছে। গোরখোদক ফালু কেন ঐ মহিলার বাড়িতে ঢুকলো সেটা হয়তো খতিয়ে দেখার জন্য তার মতোই দেয়াল টপকে ঢুকে পড়েছে জমিদার বাড়িতে। কিন্তু শহরের লোকটার কোনো ধারণাই নেই ঐ ডাইনি কতোটা ভয়ঙ্কর।

    জমিদার বাড়ির সামনে এসে দর থেকে মেইনগেটের দিকে তাকালো। সে জানে না বোবা দারোয়ান গেটের পেছনে আছে কিনা। দেয়াল টপকে জমিদার বাড়ির ভেতরে ঢোকার কোনো ইচ্ছে তার নেই। সে শুধু দেখতে চায় ভেতরের অবস্থাটা। দেয়াল বেয়ে উঠে বাড়ির ভেতরটা দেখবে বলে বামদিকের সীমানা প্রাচীর ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলো। এর আগে যেখান দিয়ে উঠেছিলো সেখানে আসতেই কিছু একটা চোখে পড়লো তার। আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে কিন্তু বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না জিনিসটা কি।

    সানমুনের ম্যানেজারের সাইকেলটা সীমানাপ্রাচীরে হেলান দিয়ে রাখা আছে। এরকম জায়গায় সাইকেলটা রাখার একটাই মানে ঐ সাংবাদিক ঠিক এখান দিয়েই দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

    হালার সাম্বাদিক করছেটা কি!

    *

    বিস্ময়লাগা ভয়ের সথে ছফা দেখতে পাচ্ছে কুৎসিত কিছু প্রাণী কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে ছিপছিপে পানিতে নড়াচড়া করছে। প্রাণীগুলোর আকার বেশি বড় নয়। সম্ভবত শিশু অবস্থায় আছে এখন। কিন্তু ওদের মা-বাবারা নিশ্চয় জলাশয়ের মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে!

    ছফার মাথায় ঢুকছে না, এসব ভয়ঙ্কর প্রাণী এখানে কেন। এদের তো এখানে থাকার কথা নয়। সেও গ্রামের ছেলে, পনেরো-ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামেই থেকেছে। এসএসসি পাস করে ঢাকা শহরে চলে গেলেও গ্রামের সাথে তার সম্পর্ক এখনও অটুট, সুযোগ পেলেই গ্রামে চলে যায়, নদীতে পুকুরে সাঁতার কাটে। কই, কখনও তো এরকম জিনিস দেখে নি।

    আতর বলেছিলো মুশকান জুবেরি মাছ চাষ করে, শাক-সবজি আবাদ করে, এমনকি গরুর খামারও দিয়েছে কিন্তু এই জিনিসের কথা বলে নি! আবারো বুঝতে পারলো, ইনফর্মার কতোটা অজ্ঞ এই রহস্যময়ী মহিলার ব্যাপারে। এর কারণটাও সে ধরতে পারলো-মুশকান জুবেরির সাথে এখানকার সব হোমরাচোমরাদের খাতির-মহিলার ব্যাপারে নাক গলানোর সাহস কেউ রাখে না। আতর আলী ভেবে দেখেছে, এসব ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই, বরং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। এখন কিছু টাকা কামাই করার ধান্দা পেয়েছে বলে তাকে সাহায্য করছে মহিলার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে।

    মাত্র দশ-বারো গজ দূরে কুৎসিত প্রাণীগুলো ছিপছিপে পানিতে দাপাদাপি করলেও ছফা ওগুলোকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে না, তার কারণ কাঁটাতারের বেড়ার জন্য ওরা তার কাছে ঘেষতে পারবে না। তবে তার ভয় হচ্ছে অন্য কারণে–এখান থেকে বের হবার রাস্তাটা কোথায় বুঝতে পারছে। না।

    ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ হেলে পড়েছে আকাশে। চারপাশে আবারো নজর দিলো সে। তার ধারণা, মহাসড়কটি এই বাড়ির দক্ষিণ দিকে। সড়ক আর বাড়ির মাঝখানে বিস্তৃর্ণ ক্ষেতসহ কিছু নীচু জমি আছে। বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের দক্ষিণ দিকেও জলাশয় দেখেছে সে। পুবদিকের জলাশয়ের সাথে দক্ষিণ দিকের জলাশয়ের সংযোগ আছে কি? সে নিশ্চত হতে পারছে না। নিশ্চিত জানা থাকলে ওদিক দিয়েই বের হবার চেষ্টা করতো। তার কেনজানি মনে হচ্ছে জমিদার বাড়িটার তিন-দিক দিয়েই অশ্বখুড়াকৃতির জলাশয় ঘিরে রেখেছে-অনেকটা প্রাচীনকালের দূর্গের মতো। দিল্লির লালকেল্লার তিন দিকেও এরকম পরিখা খনন করা আছে। মুঘল জমানায় ওইসব পরিখাতুল্য জলাশয়ে দানবাকৃতির কুমীর ঘুরে বেড়াতো–একটা প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বর্ম!

    জমিদার অলোক বসুর বাড়িটিও ঠিক সেভাবে নিরাপদ করে রাখা। হয়েছে। তবে ছফার বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা জমিদার অলোকনাথ কিংবা তার বাপ-দাদাদের কাজ। তার দৃঢ় বিশ্বাস, রহস্যময়ী মুশকান জুবেরি বাড়ির তিনদিকে ঘিরে থাকা জলাশয়ে কুমীর চাষ শুরু করেছে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা গড়ে তোলার জন্য। হয়তো বাড়িটার চারপাশে নীচু ভূমি কিংবা জলাশয় ছিলো আগে থেকেই, মহিলা ওটার সদ্ব্যবহার করেছে মাত্র।

    ভালো করে তাকালো চারপাশে। পশ্চিমদিক বাদে জোড়পুকুরের তিনদিকই উঁচু ঢিবি দিয়ে ঘেরা। গ্রামের ছেলে হিসেবে ছফা জানে এটা করা হয় বন্যার হাত থেকে পুকুরকে রক্ষা করার জন্য। বিশেষ করে নীচু জমি, যেগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যায় সেখানকার পুকুরের চারপাশ এভাবে উঁচু টিবি দিয়ে সুরক্ষিত করা হয়। জমিদার বাড়িটি বেশ উঁচুতে বানানো হয়েছে বলে জোড়পুকুরের পশ্চিম দিকটায় টিবি দেবার দরকার পড়ে নি।

    পুকুর পাড়ের তিনদিকই সারি সারি নারকেল, সুপারিসহ আরো অসংখ্য গাছে ঘেরা। ছফা পুকুরপাড়ের ঢালের নীচ দিয়ে এগোতে লাগলো। তার বামদিকে সমান্তরালে কাঁটাতারের বেড়া চলে গেছে, ওপাশের প্রাণীগুলো এখনও দাপাদাপি করছে অল্পপানিতে। পুকুরের দক্ষিণ দিকটা ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ। ঝোপের সংখ্যাও বেশি। দেখে মনে হচ্ছে এই অংশটা পরিত্যক্ত কোনো জায়গা। অন্ধকারে দেখতে পেলো কালচে একটা টিবি পুকুরপাড় থেকে দক্ষিণ দিকে হেলে আছে। খুব কাছে যেতেই চোখে পড়লো গাছগাছালির ফাঁকে ভগ্নপ্রায় একটা দালান। ভালো করে তাকালো সে। বুঝতে পারলো একটা পুরনো মন্দির।

    এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো। এরকম জমিদার অবশ্যই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে মন্দির বানাবে। এরাও তাই করেছে। তবে দীর্ঘদিন অযত্নে থেকে মন্দিরটা এখন ভগ্নসতুপ ছাড়া আর কিছু না। সেই ভগ্নসতুপের চারপাশে বেড়ে উঠেছে আগাছা, ঝোঁপঝাঁড়, এমনকি বড় বড় গাছ-গাছালি। যুদ্ধের পর জমিদারের সব সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাওয়ার কারণে মন্দিরটা আর ব্যবহার করা হয় নি সম্ভবত। আর মুশকান জুবেরি কয়েক বছর আগে বাড়িটা রেস্টোরেশন করলেও মন্দিরের কিছু করে নি। যে মন্দিরে নিয়মিত প্রার্থনা করা হবে না সেটা অচিরেই বেহাল দশায় পরিণত হবে।

    ভগ্নস্তূপটার সামনে শুধু ঝোঁপ-ঝাঁড়ই গজায় নি, বড় বড় গাছপালা জন্মে প্রায় ঢেকে রেখেছে স্থাপনাটি। মাথার উপরে ঝুঁকে আসা গাছের ডালপালা আর ঝোঁপ-ঝাঁড় সরিয়ে ভগ্নপ্রায় মন্দিরের ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। সাপখোরের ভয় করছে না শীতকাল বলে। এ-সময়ে ওইসব জঘন্য আর বিপজ্জনক প্রাণীরা শীতনিদ্রায় থাকে।

    একটা শিবমন্দির। আকারে বেশ ছোটো। ফলার মতো তীক্ষ্ণ চূড়াটা ভেঙে যাওয়ায় চেনা যাচ্ছে না। ভেতরের ছোটো কক্ষটি আগাছা আর মাটিতে পরিপূর্ণ। স্থাপনাটির একপাশ দিয়ে সাবধানে পা ফেলে ফেলে ছফা চলে এলো বিপরীত দিকে। হতাশ হয়ে দেখতে পেলো এটাই আসলে মন্দিরের সম্মুখভাগ, আর তার সামনে জলাশয়। নীচু এই জলাশয় চলে গেছে ডানে-বামে আর সামনের দিকে। মন্দিরের সামনের দিকে জলাশয়টি কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে না পুকুরের পুবদিকের জলাশয়ের সাথে এটা মিশে গেছে কিনা।

    খুট করে শব্দ হতেই চমকে উঠলো সে। ঐ কুমীরের বাচ্চাগুলো না তো?! জলাশয়টি যদি বিচ্ছিন্ন না থাকে তাহলে কুমীরগুলো এখানেও চলে আসতে পারে যেকোনো সময়!

    দ্রুত ভাঙামন্দির থেকে বের হবার জন্য যে-ই না ঘুরে দাঁড়িয়েছে অমনি ছফার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।

    সামনের ঝোপের মধ্য থেকে একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ চেয়ে আছে তার দিকে!

    .

    অধ্যায় ১৫

    আতর আলী সাইকেলের সিটের উপর থেকে নেমে পড়েছে দ্রুত। এখন দেয়ালের নীচে বসে আছে ঘাপটি মেরে।

    একটু আগে দেয়ালের উপর দিয়ে দেখছিলো বাড়িটা কেমন সুনশান। মানুষজন আছে বলে মনে হয় না, কারো কেনো সাড়াশব্দ নেই, শুধু দোতলার একটা ঘর থেকে মৃদু লালচে আলো দেখা যাচ্ছে। তবে দারোয়ান। ইয়াকুবকে গেটের কাছে না দেখে সে বুঝে গেছিলো ঐ বোবা নিশ্চয় লীলাখেলায় মশগুল। তার তো গেটের পাশেই থাকার কথা। রাতের এ সময় ওখানে না থাকার একটাই মানে-কাজের মেয়েটাকে নিয়ে ওসব শুরু করে দিয়েছে। দৃশ্যটা কল্পনা করে সুড়সুড়ি পেলো না আতর, বরং ঈর্ষায় আক্রান্ত হলো!

    দেয়াল টপকানোর কথা ভাবলেও দ্বিধায় পড়ে গেছিলো। স্বল্পপরিচিত কারোর জন্য এতোবড় ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানেই হয় না। নুরে ছফা নামের সাংবাদিক তার কাছ থেকে সব শোনার পরও জেনেশুনে ঐ বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। তার যদি কিছু হয় সেজন্যে নিজেই দায়ি হবে। লোকটার কি হয়েছে সে-সম্পর্কে অবশ্য বিন্দুমাত্র ধারণাও করতে পারছে না আতর, তবে খারাপ কিছু হয়েছে বলেই মনে করে সে, তা না-হলে অনেক আগেই ঐ বাড়ি থেকে

    বের হয়ে আসতো।

    সাইকেলের সিটের উপর দাঁড়িয়ে যখন এসব ভাবছিলো তখনই দেখতে পায় দারোয়ান ছেলেটা বাড়ির পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে, আর তার পেছনে ঐ গোরখোদক।

    ফালু!

    সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলের উপর থেকে নেমে দেয়ালের পাশে চুপচাপ বসে পড়ে সে। এই বাড়িতে এতোক্ষণ ধরে হারামজাদা কী করছে! তারচেয়েও বড় কথা, ফালু যদি এখানে এই বেটির বাড়িতে থেকে থাকে তাহলে কবরস্তানে তাকে কে ধাওয়া করলো?!

    সত্যি বলতে আতর একটু ভয়ই পেয়ে গেলো। ভুত-প্রেতের ব্যাপারে তার বিশ্বাস একটু অদ্ভুত রকমের-থাকলেও থাকবার পারে! জমিদার বাড়ির গেট খোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। তার মনে হচ্ছে ফালু বুঝি এখনই চলে আসবে এখানে। সে যে এখানে লুকিয়ে আছে সেটা কেউ জানে না, তারপরও মনের মধ্যে এই ভয়টা কাজ করছে।

    ঢোক গিললো ইনফর্মার। ফালুর ভারি পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। সে কি এখানেই আসছে?!

    আস্তে আস্তে ভারি পায়ের শব্দটা মিইয়ে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার পকেটে ফোন আছে, পাঁচ-ছয় টাকার মতো ব্যালান্সও আছে তাতে কিন্তু সাংবাদিককে ফোন দিতে পারছে না। ওসির হাতে চরথাপ্পড় খাবার সময় ফোনটা তার হাতে ছিলো, ছিটকে মাটিতে পড়ে ডিসপ্লেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র ইনকামিং ফোন রিসিভ করতে পারে। টাউনের এক মোবাইল মেকানিককে দেখিয়েছিলো, দুমুখ ছেলেটা বলেছে, টাকা খরচ করে এই সস্তা ফোন ঠিক না-করিয়ে নতুন আরেকটা কিনলেই ভালো হয়। কিন্তু নতুন ফোন কিনতে যে টাকা লাগবে সে-টাকা কই? থানায় যেতে পারে না বলে ইনকাম অনেক কমে গেছে, নইলে এই কানা-ফোন নিয়ে কে ঘুরে বেড়ায়!

    কী করবে বুঝতে না পেরে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে রইলো আতর। গাঁজার নেশা পুরোপুরি কেটে গেছে, আরেকটা স্টিক আছে পকেটে, ওটা ধরাবে কিনা বুঝতে পারলো না, এমন কি এখান থেকে ফিরে যাবার সিদ্ধান্তটাও নিতে পারছে না সে। সাংবাদিক যদি ডাইনির বাড়িতে ঢুকে কোনো বিপদে পড়ে থাকে তাহলে তার কীই বা করার আছে, শুধু শুধু বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করা ছাড়া?

    অবশেষে ঠিক করলো টাউনে ফিরে যাবে। এখানে সাইকেলটা এভাবে পড়ে থাকলে চোর-বাটপারের খপ্পরে পড়ে যেতে পারে, তারচেয়ে ভালো হবে ওটা নিয়েই ফিরে যাওয়া, তাহলে টাউনে যেমন হেঁটে যেতে হবে না তেমনি বেচারা ম্যানেজারেরও একটা সম্পত্তি রক্ষা পাবে।

    সাইকেলের হ্যান্ডেলটা যে-ই না ধরতে যাবে অমনি একটা কথা মনে পড়ে গেলো তার। সাইকেলটা রেখে পকেটে হাত ঢোকালো সে।

    *

    ছফা প্রথমে ভেবেছিলো ইনফর্মার আতর যে-রকম জ্বলজ্বলে চোখ দেখেছিলো এই বাড়িতে ঢু মেরে সেও বুঝি ঠিক একই জিনিসের দেখা পেতে যাচ্ছে অবশেষে। কিন্তু না, তাকে কয়েক সেকেন্ডের দমবন্ধ করা উত্তেজনা থেকে মুক্তি দিলো চোখ দুটোর মালিক নিজেই!

    লেজ গুটিয়ে হারামজাদা পালিয়ে গেলো।

    হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। সম্ভবত একটা শেয়াল ভগ্নপ্রায় মন্দিরে বাসা বেঁধেছে।

    পুকুর পাড়ে চলে এলো আবার। এখান থেকে বের হওয়াটা তার জন্য যে খুব কঠিন তা নয়। পকেটে মোবাইলফোন আছে, বেশি সমস্যা হলে বাধ্য হয়ে ওটাই ব্যবহার করতে হবে কিন্তু তাতে করে…

    ছফার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। এখানে ঢোকার আগেই রিংটোন অফ করে ভাইব্রেট মোড়ে দিয়ে রেখেছিলো। মন্দির থেকে একটু সরে নীচু হয়ে বসে পড়লো সে, পুকুরের ওপাড় থেকে কেউ যেনো তাকে দেখতে না পায় সেজন্যে।

    ডিসপ্লেতে কলার-আইডি দেখে বিষম খেলো।

    আতর আলী??

    এতো রাতে সে কেন ফোন দেবে? তার নাম্বারই বা পেলো কোত্থেকে? যতোদূর মনে পড়ে, ইনফর্মারকে সে তার ফোন-নাম্বার দেয় নি। দ্রুত কলটা রিসিভ করতেই কণ্ঠটা ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো :

    “আপনে কই? ঠিক আছেন তো?”

    “আপনি…আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”

    “তার আগে কন, আপনে কি ঐ বেটির বাড়িতে হান্দাইছেন নি?”

    ছফা খুবই অবাক হলো। “আ-আপনি কি করে জানলেন আমি…মানে, আমি ঐ-”

    “আপনের কি মাথা খারাপ হয়া গেছে!” ছফাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো ইনফর্মার, “আমি কেমনে জানলাম হেইটা জরুরি না…আগে কন, এহন কই আছেন? ঠিকঠাক আছেন তো?”

    কথাটা বলার আগে ঢোক গিলে নিলো সে। “আ-আমি তো…জোড়পুকুর পাড়ে…মানে, জমিদার বাড়ির ভেতরে আটকা পড়ে গেছি।”

    “কি??” বিস্মিত আতর বলে উঠলো। “ওরা আপনেরে আটকায়া রাখছে!?”

    “আরে না..ধরা পড়ি নি..আমি পুকুরপাড়ে ঢুকে পড়েছি…এখন বের হতে পারছি না।”

    “আপনেরে ওরা কেউ দেহে নাই? কেউ কিছু টের পায় নাই?!” ইনফর্মার খুবই অবাক।

    গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। “অনেক ঘটনা আছে। সবই বলবো, তবে এখন না। আগে আমাকে এখান থেকে বের হতে হবে। এবার বলেন এখান থেকে কিভাবে বের হবো?”

    “আমার ফোনে টাকা নাই….আপনে ফোন দেন। ওপাশ থেকে বললো। আতর।

    “ঠিক আছে, দিচ্ছি,” কলটা কেটে দিয়ে ইনফর্মারের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং হতেই রিসিভ করলো সে।

    “..আপনে তো ঢুকছেন দেয়াল টপকাইয়া…সাইকেলের উপর উইঠা..না?”

    “হুম।” এবার বিস্মিত হলো ছফা। এই লোক এটাও জানে? কিভাবে?

    “এহন তো ঐখান দিয়া বাইর হইতে পারবেন না। ফালু হারামজাদা একটু আগে বাইর হয়া গেছে…বোবারে দেখলাম গেটে আইসা বইছে।”

    “আপনি কিভাবে দেখলেন?” ছফার কণ্ঠে বিস্ময় সরছেই না।

    “আমি এহন ঐ সাইকেলের সামনেই আছি। এটুটু আগে দেওয়ালের উপর দিয়া বাড়ির ভিতরটা দেখছি।”

    “বলেন কি?” কথাটা শুনে ছফা নতুন করে মনোবল ফিরে পেলো।

    আতর চুপ মেরে রইলো কয়েক মুহূর্ত।

    “হ্যালো?”

    “আছি তো..ক?”

    “এই বাড়ির অন্য কোনো দিক দিয়ে বের হবার রাস্তা নেই?”“

    “উমম,” আতর মনে করার চেষ্টা করলো। বর্তমানে জমিদার বাড়ির ভেতরে কোথায় কি আছে সে জানে না। সেই ছোটোবেলায় যখন বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিলো তখন তারা বন্ধুরা মিলে মাঝেমধ্যে চোর-পলান্তি খেলতো। সেই স্মৃতি থেকে যতোটুকু জানে, বাড়ির ভেতরে জোড়পুকুর আর তার তিনদিকেই রয়েছে জলাশয়। বাইরে থেকে এখনও সেটা বোঝা যায়। তবে আগের মতো গেটটা খোলা থাকে না। কোনো ভাঙা দেয়ালও নেই যে ওখান দিয়ে বের হওয়া যাবে। মহিলা এই বাড়িটাকে শুধু মেরামতই করে নি, একেবারে দূর্গের মতো বানিয়ে ফেলেছে। “আপনে সাঁতার জানেন?” কয়েক মুহূর্ত পর জিজ্ঞেস করলো সে। “জানি..কেন?”

    “পুকরের দক্ষিণ দিকে যে ডোবাটা আছে ওইটা সাঁতরাইয়া পার হইতে পারবেন না? পানি কইলাম খুব বেশি নাই…কচুরিপানা দিয়া ভইরা আছে।”

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। ইনফর্মকে কিভাবে খুলে বলে ঐ ডোবাতে ভয়ঙ্কর সব প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে। “ওখান দিয়ে সাঁতরে যাওয়া যাবে না। অন্য কোনো উপায় আছে কিনা বলেন।”

    “ক্যান? ওইখান দিয়া সমস্যা কি?”

    “অনেক সমস্যা আছে..ওখান দিয়ে আমি কেন, কেউই সাঁতরে পার হতে পারবে না।”

    “কন কি?” বোঝাই যাচ্ছে ইনফর্মার অবাক হয়েছে কথাটা শুনে।

    “আর কোনো উপায় নেই?”

    “এটটু খাড়ান!” ফিসফিসিয়ে বললো আতর।

    “কি হয়েছে?” চাপাকণ্ঠেই জানতে চাইলো ছফা।

    “একটা গাড়ি আইসা থামছে গেটের সামনে!”

    “কি?!” আৎকে উঠলো ছফা। পুলিশ নাকি? হতে পারে। মহিলা নিজে কিছু না করে পুলিশ ডেকে এনেছে। এজন্যেই কি তাকে বাড়ির মধ্যে পেয়েও কিছু করে নি মুশকান জুবেরি?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
    Next Article অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    Related Articles

    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেমেসিস (বেগ-বাস্টার্ড – ১) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কন্ট্রাক্ট (বেগ-বাস্টার্ড ২) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    নেক্সাস (বেগ-বাস্টার্ড ৩) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    কনফেশন (বেগ-বাস্টার্ড ৪) – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

    November 15, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }