Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রহস্য সমগ্র – অজেয় রায়

    লেখক এক পাতা গল্প543 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মঙের চুনি

    লীর দোকানে ঢুকে মঙ এক কোণে দাঁড়াল। আর একজন খদ্দের ছিল। ছোকরা কর্মচারীটি তাকে জিনিস দিয়ে বিদায় করে মঙের দিকে ফিরল।— ‘কী চাই?’

    —‘চাল।’

    ছোকরাটি চাল দেওয়ার বদলে মঙকে একবার তির্যক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে সোজা মালিক লীর কাছে হাজির হল। লী টেবিলে খাতার ওপর হিসেব করছিল। কর্মচারীটি তাকে কী জানি বলতে মুখ তুলে মঙকে দেখল। তারপর হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠল— ‘কী ব্যাপার মঙ? আবার কী চাই! পয়সা আছে?’

    মঙ কাঁচুমাচু ভাবে বলল, ‘না পয়সা আনিনি। লিখে রাখো। পরে সব শোধ করে দেব।’

    —‘উঁহু, আর ধার হবে না। এক সপ্তাহ ধারে ধারে চলছে। তোমার মতো খদ্দেরের সঙ্গে বেশিদিন কারবার করলে বাপু আমার ব্যাবসা লাটে উঠবে। ব্যাবসা করতে এসেছি আমি। দানছত্র তো খুলিনি। নেহাত পুরোনো খদ্দের বলে অ্যাদ্দিন চুপ করে ছিলাম।’

    মঙ অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। আস্তে আস্তে বলল— ‘তোমার ধার আমি কবে শোধ করিনি, লী?’

    —‘হুঁ— তা করেছ। তবে এবার আর আশা দেখছি না।’ লী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। গোদা গোদা হাত দুটো টেবিলের উপর রেখে বেলুনের মতো ফুলো মুখটা সামনে বাড়িয়ে খুব মিহি সুরে বললে, ‘বুঝলে বুড়ো, একটা ভালো পরামর্শ দিচ্ছি শোনো। কেন মিছামিছি সময় নষ্ট করছ? তোমার বরাতে আর পাথর-টাথর নেই। তাই বলি এবার দেশে ফিরে যাও। কাজকম্ম করো। বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে নিজে মরছ। অন্যদেরও জ্বালাচ্ছ। গত দুবছর ধরে তো দেখছি। হ্যাঁ, যাবার আগে আমার ধারটারগুলো শোধ করে যেয়ো কিন্তু।’

    মঙ কোনো উত্তর না দিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। লীয়ের তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ তাকে যেন ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। ক্ষোভে দুঃখে সে দিশেহারা বোধ করছিল। বয়স ও দারিদ্র্যে জীর্ণ তার শরীর ধনুকের মতো নুইয়ে পড়েছিল। তার শীর্ণ তোবড়ানো মুখে অজস্র ভাঁজ। এলোমেলো ভাবে পা ফেলে মঙ ভাবতে ভাবতে পথ চলল।

    আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে সে প্রথম এই অঞ্চলে এসেছিল। এই রত্নের দেশে। সত্যি, এমন দুরবস্থা তার কখনও হয়নি। খারাপ সময় আগেও অনেকবার এসেছে। কয়েকমাস যাবৎ কিছু পায়নি। কিন্তু তারপর আবার সৌভাগ্যের মুখ দেখেছে। কয়েকটি দামী পাথর পেয়ে গেছে। কিন্তু এবার যেন ভাগ্যদেবী আর মুখ তুলে চাইছেনই না। গত দু’বছরে যে কটা পাথর পেয়েছে তা অতি খেলো। বিক্রি করে কয়েকমাসের রসদ কেনার পয়সাও জোটেনি। মাঝে মাঝে পাথর খোঁজা বন্ধ করতে হয়েছে। এই গ্রামের কাছাকাছি কোথাও গিয়ে গায়ে গতরে খেটে তিল তিল করে পয়সা জমিয়ে, আবার ফিরে এসে কাজে নেমেছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই পয়সা শেষ হয়ে গেছে। ভাগ্য ফেরেনি। ফের অভাব দেখা দিয়েছে। ধার জমেছে।

    শুধু লী কেন? কিছুদিন হল অনেকেই তাকে দেখলে ঠাট্টা করছে। গায়ে পড়ে উপদেশ দিচ্ছে। ‘যাও হে বুড়ো, এবার ফিরে যাও। কোনোদিন রাস্তায় পড়ে বেঘোরে মরবে। খালি পেটে পাথর ভাঙা কি এই বয়েসে পোষায়!’

    গ্রামের প্রায় সীমানায় কোম্পানির আমলে তৈরি ভাঙাচোরা দোতালা পাকা বাড়িটায় ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা। কোম্পানির বাড়িটা ছাড়িয়ে কিছু দূরে মঙের ছোট্ট কুটির। একটি মাত্র ঘর। বাঁশের দেয়ালের ওপর খড় ছাওয়া। মঙের মতো তার বাসস্থানটিরও চরম দুরবস্থা। এবার বর্ষা বুঝি কাটে না!

    কুটিরের সামনে বেদির মতো পাথরটায় বসে পড়ল মঙ। ক্লান্ত পা দুটোকে ছড়াল। পরনের প্যান্টটার সর্বাঙ্গে তালি মারা। শার্টটা ঘাড়ের কাছে ফেঁসে গেছে। দুটোই চিরকুটে ময়লা। এক টুকরো সাবান পেলে কেচে পরিষ্কার করে নেওয়া যেত। কিন্তু সাবান কেনার পয়সা কই? পেটের ভাত জোটে না তো সাবান!

    হ্যাঁ, লোকেরা ঠিকই বলে, তাকে নেশায় ধরেছে। রত্নের নেশা। চল্লিশ বছর আগে যখন বর্মা-রুবি মাইনস্-এ কাজ করতে আসে তখন কি মঙ জানত উত্তর বর্মার মগোক প্রদেশে এই বনজঙ্গল পাহাড় রাজ্যে ঘুরে ঘুরে তার বাকি জীবনটা কেটে যাবে! তার দেশ এখান থেকে প্রায় দেড়শো মাইল দূরে। সেখানে তার নিজের বাড়ি আছে। বাড়ি যেত বছরে অন্তত একবার। এখন পাঁচ বছর যায়নি। খালি হাতে ফিরতে তার লজ্জা করে।

    পাথরের রহস্য জানতে তার কম দিন লাগেনি, একটু একটু করে জেনেছে। ক্রমে নেশা ধরেছে। বর্মা-রুবি মাইনস্-এ কাজ করার সময় সে প্রথম পাথর চিনতে শুরু করে। জানে, এই দেশের মাটির তলায় আছে মণিমাণিক্যের ভাণ্ডার। নানান জাতের মূল্যবান কোরাণ্ডাম পাথর। চুনি, নীলা, চন্দ্রকান্তমণি। মাটি খুঁড়ে পাথর ভেঙে বের কর। আর চিনতে শেখ পাথরের জাত। কোনটা দামী কোনটা খেলো।

    কোম্পানিতে সে ছিল মজুর। মাটি পাথর কাটার কাজ। রত্নপাথর ঘাঁটাঘাঁটির তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু আর পাঁচজনের মতো সেও কাজের ফাঁকে কিছু কিছু করে পাথরের জাত বিচারের বিদ্যে রপ্ত করেছিল। বছর দশেক পরে কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেল। অনেক কর্মচারী কিন্তু গেল না। লাইসেন্স নিয়ে নিজেরাই প্রসপেকটিং শুরু করে দিল। মঙও থেকে গেল। তখন থেকে তার ভাগ্যের ওঠানামার ইতিহাসের শুরু।

    মঙ মাথা নেড়ে বিড় বিড় করতে লাগল। ‘পেয়েছি, অনেকবার পেয়েছি। রাখতে পারিনি টাকা।

    মঙ চিরকাল বেহিসেবি। উড়নচণ্ডী যখনই দামি পাথর বেচে মোটা টাকা হাতে পেয়েছে দুহাতে উড়িয়েছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে দেদার ফুর্তি করেছে। ব্যাস দুদিনে ফতুর, আবার যে কে সেই পাথর ফাটানো। প্রাণান্ত পরিশ্রম করা।

    উদাস চোখে গ্রামের ঘরবাড়ির দিকে চেয়ে মঙ ভাবতে লাগল। এক সময় কী জমজমাটই না ছিল এই গ্রাম। পুরনো দিনের সেই ছবি মঙের মনে ভাসে। বড়ো বড়ো বাড়ি। সুন্দর দোকানপাট। কত লোকজনের আনাগোনা। ইরাবতী নদীর কূলে ঘাটে সর্বদা নৌকোর ভিড়। লঞ্চও বাঁধা থাকত দু-একটা। বর্মা-রুবি মাইনস্-এর দিন শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অনেককাল বাড়বাড়ন্ত ছিল এই গ্রাম। তারপর ক্রমে অবস্থা খারাপ হতে থাকল। কেবল এই গ্রাম নয়। এই অঞ্চলের আরও অনেক গ্রাম যারা রত্নপাথরের খনিগুলির দৌলতে ফেঁপে উঠেছিল সবারই ভাগ্যরবি যেন অস্ত গেল।

    মাটির তলায় লুকোনো মণিমাণিক্যের ভাণ্ডার যেন ফুরিয়ে গেল। দামি পাথর আর তেমন পাওয়া যায় না। খাটুনি পোষায় না। বেশির ভাগ অনুসন্ধানকারী চলে গেল। শুধু মঙের মতো কয়েকজন মাটি কামড়ে পড়ে রইল। রক্তে যাদের নেশা লেগেছে। রত্নপাথর খোঁজার সর্বনাশা নেশা।

    পুরোনো লোক, মঙের বন্ধুবান্ধবেরা আজ কেউ নেই। তবে এখনও প্রতিবছর কিছু কিছু নতুন লোক আসে এ অঞ্চলে। কয়েক বছর খোঁজে। কেউ কিছু কিছু পায়। কেউ কিছুই পায় না। তারপর তারা চলে যায়। বেশিদিন থাকে না কেউ!

    মঙ ভাবে, আর না। এবার ফিরে যাই। দেশে তার দুমুঠো ভাতের অভাব হবে না। কিন্তু হতাশ মনে পরাজিত হয়ে ফিরতে তার আঁতে লাগে। যদি তেমনি কিছু পাই তো ফিরব, নইলে নয়।

    মঙ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। রোদ বেশ চড়া হয়ে উঠেছে। পাথর তাতছে। ঘরে ঢুকে সে কৌটো, হাঁড়িকুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখল চারমুঠো চাল অবশিষ্ট আছে আর এক ফালি কুমড়ো। অর্থাৎ মাত্র একবেলার আহার। থাক, এখন রান্না করব না, রাতে খাব। আসছে দিনের ভাবনা মঙের মাথায় আসে না। যা হয় হবে। শুধু লী কেন, অন্য কোনো লোক তাকে আর ধার দেবে না। অনেকের কাছেই তার প্রচুর ধার জমেছে। শেষ ভরসা ছিল লী, তাও গেল। বাধ্য হয়ে আবার হয়তো তাকে মজুরি খাটতে হবে। কিন্তু বুড়ো বয়সে হাড়ভাঙা খাটুনি আর শরীরে সয় না।

    খাবার চিন্তায় লীর ঠাট্টা মনে পড়ল। তার কাছে কটা টাকাই বা ধার? অথচ মঙের কৃপায় তার কম লাভ হয়নি এতদিনে। বোকা মঙকে অনেকে ঠকিয়েছে। তার অংশীদাররা। দোকানদাররা। যখন সে পাথর ভালো চিনত না, দাম জানত না, অংশীদাররা প্রায়ই ভালো ভালো পাথরগুলো ঠকিয়ে নিয়েছে। ওই লী কতবার দামী পাথর নামমাত্র দামে কিনেছে তার কাছ থেকে। আবার টাকা হাতে পেয়ে ওই লীর দোকানেই সে ফুর্তি করেছে। জিনিস কিনেছে।

    মাসের শেষে মোটা বিল দিয়েছে লী। একবার চোখ বুলিয়েও দেখেনি হিসেবটা। তৎক্ষণাৎ মিটিয়ে দিয়েছে সব পাওনাগণ্ডা। বন্ধুরা বলেছে ও বেটা জোচ্চোর। ঠকায়। মঙ কিন্তু কখনো লীকে কিছু বলেনি। আর আজ সেই লী কী অপমানটাই-না করল! এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই লোকটার।

    মঙ উঠে দাঁড়াল। খনি খোঁড়ার দরকারি যন্ত্রপাতি ভরা থলিটা কাঁধে নিয়ে সে কুটিরের বাইরে বেরুল।

    গ্রামের সীমানা ছাড়িয়ে মাইল খানেক দূরে পাহাড় জঙ্গলের শুরু। বনের কাছে এক গভীর গর্ত। খনির খাদান এখন ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা। বড়ো বড়ো গাছ গজিয়েছে চারপাশে। প্রচুর রুবি ও নীলা পাওয়া গেছিল এই খাদে। মঙ বনের ভিতর ঢুকল। বনের মধ্যেও এমনি অনেক পরিত্যক্ত খনি ছড়িয়ে আছে। এক জায়গায় সে দেখল কয়েকজন লোক একটা খাদে কাজ করছে। এরা বছরখানেক হল খাদানটা খুঁড়ছে। কিছু কিছু পাথরও পেয়েছে। তবে রুবি কম, বেশির ভাগই নীলা।

    এ-রকম দলবেঁধে কাজ করলে অনেক সুবিধে। কিন্তু মঙের দুর্ভাগ্য কেউ তাকে এখন অংশীদার নিতে চায় না। পয়সা নেই, বুড়ো। কাজেই মঙকে একা একাই কাজ করতে হয়।

    তবে একা কাজ করার চেয়ে ইদানীং তাকে সবচেয়ে মুশকিলে ফেলেছে তার চোখ। তার দৃষ্টিশক্তি বেশ কমে গেছে। পাথর বাছতে অসুবিধা হয়। হয়তো বাজে পাথরের সঙ্গে দু-একটা ভালো দামি পাথরও ফেলে দেয়। কিন্তু শহরের ডাক্তারকে চোখ দেখানো বা চশমা নেবার ক্ষমতা তার নেই। তাই খুব ধীরে সাবধানে পাথর পরীক্ষা করে।

    কাছে কোনো বড়ো পাহাড় নেই। নীচু পাহাড় বা টিলা। পাহাড়ের গায়ে ও উপত্যকায় নানারকম গাছগাছড়া। লম্বা লম্বা সেগুন গাছ। ঘন বাঁশের ঝাড় আর কাঁটা ঝোপই বেশি। শক্ত মাটির তলায় চুনাপাথরের স্তর। কোথাও বা কালচে কঠিন গ্রানিটের ঢিপি।

    মঙ একটা পুরোনো খাদের পাশে থামল। কিছুদিন ধরে সে এই খাদানটার মধ্যে খুঁজছে। খাদানটা ভালো করে খোঁড়া হয়নি। যারা এখানে আগে কাজ করেছিল কোনো কারণে অনুসন্ধান শেষ না করেই চলে গেছিল। ঝোপ ও লতায় অনেকটা ঢেকে গেছে গর্ত।

    খাদের দেয়ালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে মঙ সাবধানে নীচে নামল। প্রায় তিরিশ ফুট গভীর খাদ। এক জায়গায় অনেকগুলো বড়ো বড়ো পাথরের চাঙড় ছড়ানো। এগুলো ভাঙতে হবে। ওপর থেকে এক ফালি রোদ এসে পড়ছে। তবে আলো বেশিক্ষণ থাকবে না। মঙ তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করে দিল।

    খস্ খস্ করে একটা আওয়াজ হতেই মঙ সতর্ক হল। কীসের শব্দ? শেয়াল, বুনো কুকুর না সাপ? ক্ষীণ দৃষ্টি যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে ওপরে চাইল। চারপাশে দেখল। একটা ছোটো পাথরের টুকরো হাতে তুলে নিল। দরকার হলে ছুড়বে।

    নাঃ, শব্দটা থেমে গেছে। পাথরটা ফেলে দিতে গিয়ে সে চমকে উঠল। পাথরের গায়ে সন্তর্পণে আঙুল বোলাল। একটা ছোট্ট নুড়ি। পাথরের গায়ে আটকে রয়েছে। তার চোখ দুটি মাঝে মাঝে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও তার অভিজ্ঞ আঙুলের স্পর্শ কখনো ভুল করে না। সাধারণ নুড়ি নয়, কেমন মসৃণ। নিশ্চয় দামি পাথর। তাড়াতাড়ি সে হাতুড়ি ঠুকে পাথর ভেঙে নুড়িটা বের করল।

    সুপুরির মতো ছোট্ট গোল নুড়ি। হুঁ, রঙটা যেন লালচে! একটু ঘষে পরিষ্কার করে সে ভালো করে দেখল। বাঃ, গাঢ় লাল রঙ যেন ফুটে বেরচ্ছে। রোদের আলোয় সে নুড়িটা পরীক্ষা করল। উত্তেজনায় ধক ধক করে উঠল তার হৃৎপিণ্ড। হ্যাঁ, যা ভেবেছে ঠিক। টুকটুকে লাল স্বচ্ছ পাথর। পায়রার রক্তের মতো গাঢ় লাল রঙা চুনি। যাকে বলে পিজিয়ন ব্লাড রেড রুবি। পৃথিবীর সেরা মণি। হীরের চেয়েও দামি। অতি দুর্লভ বস্তু। মনে হচ্ছে পাথরটির ঘনত্বও নিখুঁত। এখন অবশ্য তেমন উজ্জ্বল দেখাচ্ছে না। কিন্তু মঙ জানে কেটে পালিশ করলে এই পাথরের টুকরোটি অঙ্গারের মতো জ্বলবে। আলো পড়লে ঝিলিক দেবে।

    এই রক্তরঙা চুনি কেবল উত্তরবর্মার মগোক অঞ্চলে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় না। তাও আজকাল অতি দুষ্প্রাপ্য। সৌখিন ধনীর জগতে একটি পিজিয়ন ব্লাড রেড রুবির জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। অস্বাভাবিক দর ওঠে। ডান হাতের তেলোয় রাখা চুনিটি দেখতে দেখতে মঙের সারা শরীর কাঁপতে থাকে। দরদর করে ঘাম ঝরে। যেন বিশ্বাস হয় না ব্যাপারটা। বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে চুনিটা। না, কোনো ভুল নেই।

    কত ওজন হবে? মঙ আন্দাজ করল প্রায় কুড়ি ক্যারেট। সময় নষ্ট না করে সে চুনি পকেটে পুরে যন্ত্রপাতি থলিতে ভরে গ্রামের পথে রওনা দিল। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলল।

    মঙ সোজা বা-থিনের দোকানে এসে ঢুকল। লীর মতো বা-থিনেরও হরেকরকম ব্যাবসা। মশলাপাতি, মণিহারি জিনিস সাজানো রয়েছে দোকানে। সঙ্গে লাগোয়া একটি ঘরে পান-ভোজনের ব্যবস্থাও আছে। তাছাড়া লীর মতো বা-থিনও মণিরত্ন কেনাবেচা করে। গটগট করে এসে বা-থিনের সামনে টেবিলের ওপর চুনিটি রেখে মঙ বলল— ‘ওজন করো।’

    পাথরটি দেখে বা-থিন চমকে উঠল।

    খপ করে তুলে নিয়ে আইগ্লাস বের করে চোখে লাগিয়ে গভীর মনোযোগে পরীক্ষা করল। উত্তেজনায় তার মুখ লাল হয়ে উঠল। একটু ইতস্তত করে সে যেন অভ্যাসবশেই বলতে যায়— উঁহু, তেমন ভালো জাতের বলে মনে হচ্ছে না তো। কমদামি মাল।

    কিন্তু মঙের ভাবলেশহীন মুখ দেখে সে নিজেকে সামলে নিল। মঙের মতো ঝানু পাথর খুঁজিয়েকে এসব ভাঁওতায় ভোলানো যায় না বা-থিন জানত। বরং সে হাত বাড়িয়ে মঙের হাত চেপে ধরে বলল— ‘অভিনন্দন মঙ। খুব ভালো জিনিস পেয়েছ। খাঁটি মাল।’

    মঙ আবার নিস্পৃহ স্বরে বলে, ‘ওজন করো।’

    —‘হ্যাঁ হ্যাঁ করছি।’ বা-থিন চটপট দাঁড়িপাল্লা বের করে।

    হুঁ, যা ভেবেছিল ঠিক। ‘একুশ ক্যারেট।’

    —‘দাম কত?’ মঙ একই সুরে বলল।

    বা-থিন কাগজ কলম বের করে নানারকম অঙ্ক কষতে লাগল। কিন্তু মঙ ততক্ষণে মনে মনে একটা হিসেব কষে ফেলেছে।

    —‘পনেরো হাজার টাকা।’ বা-থিন বলল।

    মঙ হাত বাড়াল। ‘পাথর দাও।’

    —‘সে কী।’ বা-থিন আঁৎকে ওঠে।— ‘ভাবছ বুঝি ঠকাচ্ছি। বেশ আরও দুহাজার দিচ্ছি।’

    —‘না। পাথর দাও। এখন বিক্রি করব না।’

    —‘বেশ বেশ তাড়াহুড়োর কী আছে। পাথর দিচ্ছি। তা দুদণ্ড বসো তো। ওরে কে আছিস। দুটো মাংসের চপ নিয়ে আয়, আর চর্বির বড়া। গরম গরম আনবি।’

    মঙ নির্বিকার ভাবে চা ও চপ খেল। তারপর চুনি পকেটে পুরে বেরিয়ে এল। বা-থিন পিছন পিছন আসে।— ‘দেখো মঙ আমি তোমার কদ্দিনকার খদ্দের। কখনো ঠকিয়েছি তোমায়? জানি তুমি অন্য দোকানে যাবে দর যাচাই করতে। বেশ, অন্যরা যা বলে আমিও ঠিক তত দিতে রাজি। মনে রেখো কথাটা।’

    লী হঠাৎ মাথা তুলে টেবিলের সামনে মঙকে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখে ভ্রূ কোঁচকাল। প্রায় মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল— আবার কী? বললাম তো ধারটার হবে না। কিন্তু মঙের হাবভাব দেখে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মঙ গম্ভীরভাবে চুনি বের করে টেবিলে রাখল— ‘ওজন করো। কত দাম হবে।’

    পাক্কা জহুরি লী পাথরটি এক নজরে দেখেই চিনতে পারল। একটু পরীক্ষা করেই কোনো সন্দেহ রইল না তার। উত্তেজনায় তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল— ‘অ্যাঁ, আজই পেলে বুঝি এটা?’

    —‘হুঁ।’ মঙের সংক্ষিপ্ত জবাব।

    অনুশোচনায় লীর নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। ওঃ, এই লোকটাকে সে আজ সকালে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন? যদি মঙ প্রতিশোধ নেয়? যদি তাকে এই চুনি বিক্রি করতে না চায়? ইস, বহুদিন এমন ভালো লাভের সুযোগ আসে নি তার ভাগ্যে। এই রক্তরঙা চুনি বিদেশি ধনীর কাছে বিক্রি করে মোটা দাঁও মারা যাবে।

    লী তৎপর হয়ে উঠল। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে ছোকরা কর্মচারীটির উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ল— ‘এই ব্যাটা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? ভদ্রলোককে বসার টুল দে। আর দেখ কী কী খাবার পাওয়া যায়। যা যা টাটকা পাবি আনবি।’

    তারপর বলল, ‘হেঁ হেঁ বুঝলে মঙ। তোমার সৌভাগ্য উপলক্ষে একটু খাওয়াদাওয়া না করলে কি চলে?’ লী দাঁত বের করে হাসতে লাগল।

    মঙ প্লেটভর্তি খাবারের সদ্‌গতি করতে করতে বলল, ‘কই, ওজন করলে না? দামটা হিসেব করো।’

    —‘হ্যাঁ করছি। তাড়া কীসের! আগে খাও।’

    —‘সতেরো হাজার টাকা।’ দামটা বলে ফেলে লী আড়চোখে মঙকে লক্ষ্য করে। উঁহু, মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি দামটা। তাড়াতাড়ি বলল— ‘আচ্ছা, আঠারো হাজার দেব। কী, চলবে?’

    মঙ মুখ মুছতে মুছতে হাত বাড়ায়— ‘আমার পাথর দাও।’

    লী শশব্যস্ত হয়ে বলে, ‘কী! পোষাল না? বেশ আর এক হাজার দিচ্ছি— উনিশ। এর বেশি কেউ দেবে না। তুমি যাচাই করতে পার। আরে! তোমায় কি আমি ঠকাব? আমাদের কি কেবল লাভ-লোকসানের সম্পর্ক। অ্যাঁ? তুমিই বলো?’

    মঙ মাথা নাড়ল।— ‘পাথর দাও, এখন বেচব না।’

    লী হতাশ ভাবে বলল, ‘বেশ, আর এক হাজার দিচ্ছি। এবার খুশি?’

    মঙ কথা না বাড়িয়ে চুনি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

    লী হাত কচলাতে কচলাতে রাস্তার মোড় অবধি সঙ্গে সঙ্গে চলে। মনে করিয়ে দেয় তাদের কত দিনের বন্ধুত্ব। কতদিনের কারবার। ‘হ্যাঁ, সকালের ব্যাপারটা— ভাই রাগ কোরো না। মাথার ঠিক ছিল না আমার। একটা মোটা লোকসানের খবর পেলাম আজ সকালেই। সর্বনাশ হয়ে গেছে ব্যাবসার। নইলে কি ওই সামান্য কটা টাকার জন্যে তোমায় তাগাদা দি? অ্যাদ্দিন তো দেখছ আমায়। তুমিই বলো।’

    মঙ উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল।

    গ্রামের পথে যার সঙ্গে মঙের দেখা হয় সেই সেধে সেধে কথা বলে। যারা এতদিন, ‘কী হে বুড়ো’ ইত্যাদি ভাষায় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কথা বলেছে, তারাই ‘আজ্ঞে মশাই’ বলে সম্বোধন করতে লাগল। মুখে তাদের সমীহ। প্রথমটা মঙ অবাক হয়ে গেলেও একটুক্ষণ পরে রহস্যটা ধরতে পারল।— অর্থাৎ খবরটা রটে গেছে।

    মঙ তার কুটিরের ভিতর ঢুকে স্থির হয়ে বসল। হুম, এখন কী করা যায়? নাঃ খিদে নেই। লী ও বা-থিনের কল্যাণে পেট ভর্তি। ঘুম পাচ্ছে। সারাদিনের খাটুনি ও উত্তেজনায় শরীর অবসাদে জড়িয়ে আসছে। কিন্তু এই নির্জন ভাঙা ঘরে ঘুমনো কি ঠিক হবে? এখানে দুষ্টু লোকের অভাব নেই। সে বৃদ্ধ, দুর্বল। কেউ যদি জোর করে চুনিটা কেড়ে নেয় বা ঘুমের মধ্যে চুরি করে? এ চুনি সে এখানে বিক্রি করবে না। মান্দালয় শহরে নিয়ে যাবে। সেখানকার জহুরিদের সঙ্গে দরদস্তুর করলে তার দৃঢ় বিশ্বাস আরও কয়েক হাজার টাকা বেশি পাওয়া যাবে।

    ভেবেচিন্তে মঙ কুটির ছেড়ে বেরিয়ে জঙ্গলের পথে হাঁটা দিল।

    মঙ কোথায় আত্মগোপন করেছিল, কোথায় সে ঘুমিয়েছিল কেউ জানে না কিন্তু ঘণ্টা তিনেক পরে সে যখন গ্রামে আবির্ভূত হল তাকে দেখে সবাই হতভম্ব

    উশকোখুশকো চেহারা। চোখ লাল। পাগলের মতো চেঁচাচ্ছে এবং হাতে একটা মস্ত ধারালো কাটারি।

    কী ব্যাপার! ব্যাপারটা অচিরেই জানা গেল। মঙ জঙ্গলের ভিতর ঘুমিয়েছিল। সেই সময় কেউ নাকি তার চুনি চুরি করেছে।

    মঙ উন্মাদের মতো পথে পথে ছুটে বেড়াতে লাগল। যাকে দেখে তার দিকেই ভয়ংকর ভাবে কাটারি তুলে তেড়ে যায়।

    —‘বলো, কে চুরি করেছে আমার পাথর? নিশ্চয় জান। বুঝেছি ষড়যন্ত্র। বেশ, আমিও দেখে নেব কেমন সে আমার হকের ধন হজম করে। ঠিক খুঁজে বের করব এই শয়তানকে। আমি তাকে খুন করব।’

    গ্রামের লোক মঙের সেই বিভীষণ মূর্তি দেখে যে যার ঘরে ঢুকে দোর দিল। চুনির শোকে বুড়োর মাথার ঠিক নেই। কী জানি কী করে বসে।

    মঙকে ছুটে আসতে দেখে লী ঝটপট দোকানের ঝাঁপ ফেলে ভিতরে বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। মঙ বাইরে থেকে তারস্বরে চেঁচাল, ‘বুঝেছি, এ তোর কীর্তি লী। ভালোয় ভালোয় পাথর বের করে দে, নইলে এর শোধ আমি তুলব।’

    লী কোনো সাড়াশব্দ দিল না।

    সেখান থেকে মঙ ছুটল বা-থিনের উদ্দেশে।

    বা-থিন অবশ্য আগে থেকেই খবর পেয়ে দোকান বন্ধ করে সরে পড়েছিল!

    মঙ অনেকক্ষণ এইভাবে চেঁচামেচি ও আস্ফালন করে তার কুটিরে ফিরে গেল। তার চুনির কিন্তু কোনো হদিস মিলল না।

    গ্রামে তো বেজায় হুলুস্থুল। কে চুরি করল মঙের চুনি?

    একদল বলল, ‘এ নির্ঘাত বেঁটে চ্যাং-এর কীর্তি।’ লোকটা দাগী চোর এবং অনেকে তাকে মঙের পিছন পিছন যেতে দেখেছে। আর-এক দলের রায়, ‘এটি ফুজির হাতসাফাই। বিকেলবেলা ও বনে ঢুকেছিল কী করতে?’

    ফুজি ও চ্যাং দুজনেই গুজব কানে যাওয়া মাত্র দৃঢ়ভাবে সব অভিযোগ অস্বীকার করল। তাছাড়া তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণও কিছু নেই। হাতেনাতে কেউ ধরেনি। মঙও বলতে পারছে না কে নিয়েছে।

    লী ও বা-থিনের মতো ব্যবসায়ীরা দারুণ ঘাবড়ে গেল। ছি ছি কী কাণ্ড! এরকম চুরি-চামারি হলে ব্যাবসা চলে কীভাবে! যে চুরি করেছে, সে তো পাথরটা নিয়ে সটকাবে এবং অন্য কোথাও বেচবে। এতে এই পাথর কেনাবেচা করে তারা যে লাভটুকু করত সেটি মাঠে মারা গেল।

    লী বেঁটে চ্যাং-এর এক সাকরেদকে পাকড়ে মিষ্টি মিষ্টি করে শোনাল।— ‘দেখো ভাই, কেউ যদি একখানা ভালো চুনি বিক্রি করতে চায় তো আমার কাছে পাঠিয়ো! উচিত দাম দেব! হ্যাঁ, পাথর সে কোত্থেকে পেয়েছে! কেমন করে? এসব নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র মাথাই ঘামাব না! আর কথা দিচ্ছি যেই বিক্রি করুক-না-কেন, তার নাম ধাম আমি গোপন রাখব।’

    ইতিমধ্যে বা-থিনও একই বার্তা প্রচার করেছিল!

    .

    মঙ সে রাতে কেমন করে কাটালে কেউ খোঁজ করেনি। খোঁজ করার সাহসও ছিল না কারো। যাহোক পরদিন সকালে তাঁকে দেখা গেল নদীর ঘাটে বসে আছে।

    সেদিন মান্দালয়গামী স্টিমার আসার দিন। ইরাবতী নদীপথে যাত্রী ও মালপত্র নিয়ে স্টিমার আসা-যাওয়া করে। তবে রোজ নয় কয়েকদিন অন্তর অন্তর। স্টিমার গ্রামের ঘাটে থামে। এখান থেকে তাড়াতাড়ি শহরে যাওয়ার বা আসার এই একমাত্র উপায়। নইলে নৌকোয় বা ডাঙাপথে অনেক বেশি সময় লাগে।

    স্টিমার এল। মঙ ছাড়াও ঘাটে আর কয়েকজন যাত্রী ছিল। সবাই উঠল। গ্রামের লোক কৌতূহলী হয়ে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল— ‘মঙ, কোথায় চললে?’

    অনেকক্ষণ পরে মঙ চিৎকার করে উত্তর দিল— ‘থানায়।’

    এখান থেকে ঘণ্টাখানেক স্টিমারে গেলে থানা। ওই থানার দারোগার উপর এ অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভার।

    ডেকের এককোণে মঙ কাঠের মতো খাড়া হয়ে বসে রইল। তার তীব্র উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি জলের দিকে নিবদ্ধ। যাত্রী ও মাল্লারা ফিসফিসিয়ে তার দুর্ভাগ্য নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। কেউ অবশ্য তার কাছে ঘেঁষল না। এমনকী তার কাছে স্টিমারের টিকিট অবধি চাইতে গেল না কেউ।

    থানার ঘাটে স্টিমার ভিড়তেই মঙ লাফ দিয়ে ডাঙায় নামল। সারেংকে আদেশ দিল— ‘খবরদার, কাউকে নামতে দেবে না। আমি পুলিশ ডাকছি। তল্লাশি হবে।’

    থানার দারোগা মঙের নালিশ শুনে বলল, ‘তাই তো, খুবই দুঃখের ব্যাপার। তোমার এত বড়ো লোকসান হল। নাঃ, ওই গ্রামের বদমাসগুলো বড়ো জ্বালাচ্ছে। একবার আচ্ছা করে কড়কে না দিলে দেখছি চলছে না। তবে এখন লঞ্চে তল্লাশি করে কি ফল হবে না। যে চুরি করেছে সে কি আর এই স্টিমারে চলেছে? মনে হয়, সে আপাতত গ্রামেই আছে। পরে সুযোগ বুঝে পালাবে। আমি বরং গ্রামে সেপাই পাঠাচ্ছি। কিন্তু চুনি ফিরে পাওয়ার আশা কম। কে নিয়েছে যখন দেখতে পাওনি। মঙ নাছোড়বান্দা। নিশ্চয় ওই গ্রাম থেকে যারা আসছে তাদের মধ্যে কেউ চুরি করেছে আমার চুনি। তাদেরই কারো কাছে আছে। তাড়াতাড়ি শহরে চলেছে বিক্রি করতে।’

    অগত্যা বাধ্য হয়ে দারোগা উঠল। নইলে যে বুড়ো নড়বে না।

    মঙের সঙ্গে আরও আটজন লোক ওই গ্রামের ঘাট থেকে স্টিমারে উঠেছিল। তাদের জামাকাপড় জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেও হারানো চুনির পাত্তা পাওয়া গেল না। বিরক্ত দারোগা সেপাইদের নিয়ে ফিরে গেল।

    যাবার আগে দারোগা মঙকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখন কী করবে?’ ‘জানি না’– মঙ উত্তর দিল।

    —‘এই স্টিমারেই যাবে?’

    —‘হ্যাঁ।’

    থানার এক সিপাই ছুটি নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিল ওই স্টিমারে। দারোগা তাকে ডেকে বলল।— ‘লোকটার ওপর একটু নজর রেখো হে। শেষে আত্মহত্যা না করে বসে। তাহলে আরও ভোগাবে আমায়।’

    মঙ ডেকে কোণে গিয়ে বসেছে। তার মাথা সামনে ঝুঁকে পড়েছে। ডান হাতের তালু মুখের ওপর চাপা। সমস্ত ভঙ্গিতে চরম হতাশা ও রিক্ততার ভাব। মঙের অবস্থা দেখে অন্যদের দুঃখ হচ্ছিল। তবে তার গ্রামের সঙ্গী কজন বেজায় চটেছে। তারা দূর থেকে মুণ্ডপাত করছিল বুড়োর। মঙের অবশ্য কোনো খেয়াল নেই। নিজের চিন্তায় ডুবে আছে।

    মান্দালয়ে স্টিমার থামতে মঙ নামল। সিপাইটি দারোগার কথামতো কিছুক্ষণ মঙকে চোখে চোখে রেখেছিল। কিন্তু জাহাজঘাটায় ভিড়ের মধ্যে হুস্ করে মঙ কোথায় যে হারিয়ে গেল! সিপাইটির তাড়া ছিল। একটা ক্ষ্যাপা বুড়োর পিছনে বাজে সময় নষ্ট না করে সে ছুটল শ্বশুরবাড়ি যাবার নৌকো ধরতে।

    আরও দুদিন পরে।

    দুপুরবেলা এক নির্জন মাঠের ধারে মঙ বাস থেকে নামল। একজন লোক সেই বাসে উঠবে বলে দাঁড়িয়েছিল। মঙকে দেখে চেঁচিয়ে বলল— ‘আরে মঙ যে, অনেক কাল পর। থাকবে তো কিছুদিন?’

    —‘হ্যাঁ ভাই, এবার দেশেই থাকব ঠিক করেছি। আর ফিরব না।’ মঙ হাসিমুখে উত্তর দিল।

    —‘বেশ বেশ। পরে দেখা হবে, গল্প হবে।’ বলতে বলতে লোকটি চলন্ত বাসে উঠে পড়ল। মঙ একা একা দাঁড়িয়ে রইল।

    দূরের মাঠের ওপারে গাছপালা ঘেরা তার নিজের গ্রামটির দিকে তাকিয়ে মঙ একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে বের করল একটি থলি। থলিটা টিপেটুপে দেখল। আঃ, নোটে ঠাসা। কড়কড়ে পঁচিশ হাজার টাকা। মান্দালয়ে চুনি বিক্রি করে পেয়েছে।

    —‘একটু হিসেব করে চললে এখন বাকি জীবনটা পায়ের ওপর পা তুলে আরামে কাটাব।’ মঙ নিজের মনে বলল। ‘মঙ বোকা, চিরকাল কেবল ঠকেই এসেছে। তাই না? এখন কেমন? চোর-ডাকাতকে ফাঁকি দিলাম এবং অতগুলো পাওনাদারকে বেবাক কলা দেখালাম। কাউকে একটি পয়সা ধার শোধ করতে হল না।’

    দারোগাকে মঙ নিছক মিছে কথা বলেনি। স্টিমারে ওই গ্রামের যাত্রীদেরই কারো কাছে ছিল তার চুনি। তবে লোকটি যে স্বয়ং মঙ তা কে ভাববে!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleথানা থেকে আসছি – অজিত গঙ্গোপাধ্যায়
    Next Article গল্পসংগ্রহ – অজেয় রায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }