রাজকন্যের সন্ধানে – ২০
২০
সকাল ছ’টায় দাসু থেকে বেরোল তারা। দাসু ছাড়তেই খারাপ রাস্তার মুখোমুখি হতে হল তাদের। সৈকত বলল, “এই রাস্তাটা কবে ঠিক হবে?”
খালেদ বলল, “খুদা জানে”।
এ রাস্তায় পিচ বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। একদিকে ধুলো আর পাথরের পাহাড়, অন্যদিকে খাদ। রাস্তা কোথাও কোথাও সরু হয়ে এসেছে। খালেদ বলল, “রাস্তার হাল আরেকটু ভাল হলে আরো ভোরে বেরোতে হত। এ রাস্তার কাজ যে কবে শেষ হবে, জানি না”।
সৈকত গাড়িতে উঠে এনার্জি সেভিং মোডে চলে গেছিল। সে চোখ বুজেই বলল, “এই জন্য গিলগিটে যেতে হলে সবাই হাওয়াই জাহাজ ইউজ করে। এই রাস্তায় জীবনটাই তো জি বাংলা হয়ে যাবে”।
হামিদ বলল, “জি বাংলা কী?”
সৈকত হেসে ফেলল, “ও বাংলা টিভি চ্যানেল”।
হামিদ বলল, “তুমি বাংলাদেশী?”
সৈকত বলল, “না। ইন্ডিয়ান। বাংলা ভাষায় কথা বললেই বাংলাদেশী হয়ে যায় না। পূর্ব ভারতের একটা বড় অংশ বাংলা ভাষায় কথা বলে”।
হামিদ মাথা নাড়ল, “তা ঠিক। পাকিস্তানীদের একমাত্র এই বাঙালিরাই হাল খারাপ করে দিয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তানের”।
ইফতিকার বলল, “যত দিন যাবে প্রতিটা প্রভিন্স পাকিস্তান থেকে বেরোতে চাইবে। দেশে খাবার নেই, এদিকে কাশ্মীর চাই”।
সৈকত বলল, “সব দেশেই এমন প্রভিন্স থাকে যারা গভর্নমেন্টের থেকে অন্য প্রভিন্সদের মত সমান ট্রিটমেন্ট পায় না। ক্ষোভ থাকবেই। গভর্নমেন্ট তখনই ভাল হয় যখন সে দেশের প্রতিটা মানুষকে সমান চোখে দেখতে পারবে”।
ইফতিকার বলল, “পাকিস্তানি হুকুমত চাইলেও সমান চোখে দেখতে পারবে না। এত আর্মস ঢুকে গেছে, এতগুলো অর্গানাইজেশন এখানে অ্যাক্টিভ হয়ে গেছে, মানুষ বুঝে গেছে, এ দেশে থেকে কিছু হবে না”।
হামিদ বলল, “সেটা গিলগিটের রাজকন্যা বুঝল না কেন? আপনাদের উচিত ছিল অনেক আগে ওকে তেহেরানে পাঠিয়ে দেওয়া”।
ইফতিকার বলল, “কিছু করার ছিল না। ফাজিয়ার আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানী আর্মি ওদের গৃহবন্দী করে রেখেছিল। এখানে কোন আইনের শাসন নেই। যে বন্দুক হাতে নতুন আইন ঘোষণা করবে, আরেকজন শক্তিশালী কেউ আসার আগে সেটাই আইন হয়ে যাবে”।
সৈকত বলল, “ইন্ডিয়া জয়েন করে যাও। আমাদের ম্যাপে তো গিলগিট বাল্টিস্তান হিন্দুস্তানেই পড়ে”।
ইফতিকার বলল, “কাশ্মীর আজাদি চায়। পাকিস্তানী কাশ্মীর, হিন্দুস্তানী কাশ্মীর। সব কিছু থেকে আজাদি চায়। তারা মানবাধিকার চায়, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার হক চায়, কে দেবে সেটা?”
সৈকত বলল, “কূটনৈতিক ভাবে সেটা সম্ভব মিয়াঁ?”
ইফতিকার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “সম্ভব না বলেই আমাদের আর কোন দেশ থাকবে না এরপরে। হিন্দুস্তানী কাশ্মীরিরা তাদের দেশেই অ্যান্টিন্যাশনাল হয়ে বাঁচবে, পাকিস্তানী কাশ্মীররা মরে গিয়ে বেঁচে থাকবে জিহাদীদের খপ্পরে। এটা কোন জীবন?”
গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। বিরাট জ্যাম। সৈকত বলল, “কী হল?”
খালেদ বলল, “ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটাচ্ছে সম্ভবত। নয়ত অন্য কিছু হয়েছে। যাব?”
ইফতিকার সতর্ক গলায় বলল, “কোন দরকার নেই। গাড়িতে বসে থাকো”।
হামিদের ফোন বাজছিল। হামিদ কিছুক্ষণ কথা বলে বলল, “ইলিয়াস খানকে আই এস আই তুলে নিয়ে গেছিল। অফিসারের নাম বলল আলী। ছেড়েছে, তবে ইলিয়াস মিয়াঁর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখা যাবে না। আই এস আই র্যাডারে চলে এসেছে। ওই সাংবাদিক কিডন্যাপিঙের ব্যাপারে”।
খালেদ বলল, “আলী খুব টাফ অফিসার। দেখলে বোঝা যায় না। আমাকে বালুচিস্তানে অনেকদিন পিছু করেছিল। খুব ভাগ্য ভাল ছিল ধরা পড়ি নি”।
খুব জোরে শব্দ হল। প্রথমে একটা। তারপরে বেশ কয়েকটা।
ইফতিকার বলল, “এগুলো কি ডিনামাইটের শব্দ?”
হামিদ সোজা হয়ে বসল, “না, এটা ডিনামাইট না। এটা বুলেটের শব্দ”।
ইফতিকার বারণ করার আগেই খালেদ গাড়ি থেকে নেমে দেখতে গেল। ইফতিকার রাগী গলায় বলল, “একী? হামিদ, খালেদকে ফোন কর”।
হামিদ কয়েকবার ফোনে চেষ্টা করে বলল, “নট রিচেবল বলছে”।
সারে সারে ট্রাক আর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
খালেদ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “পাঁচ ছশো মিটার আগে গ্যাং ওয়ার চলছে। দু চারটে লাশ পড়বে। চিন্তা নেই, ঠিক হয়ে যাবে”।
ইফতিকার “ও” বলে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
এরকম ঘটনা এই জায়গার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হয়ে গেছে। কেউই আর বিশেষ উদ্বিগ্ন হল না।
২১
খালা বার বার তার ঘরে আসছে। ফাজিয়ার বিরক্ত লাগছে। দরজা বন্ধ করলে বাইরে থেকে বার বার ধাক্কা দিচ্ছে খালা।
রাত নেমেছে গিলগিটে। এই রাতেই তাদের বাড়িতে এলাকার বিদ্রোহীরা আসত। কীভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তান সরকারকে গিলগিটবাসীদের দাবিদাওয়া পেশ করা যাবে সে সম্পর্কে আলাপ হত। ফাজিয়ারও ইচ্ছে হত সব আলোচনায় থাকতে, আব্বু বারণ করত। কতরকম লোক আসত।
সাড়ে ন’টার দিকে খালা এল। বিরক্ত মুখে বলল, “রহমত বলে কে একজন দেখা করতে এসেছে। আমি বলেছি তুমি দেখা করবে না। বলছে তোমাকে বলতে। কী বলব?”
ফাজিয়া বিছানা থেকে উঠল। বলল, “যাচ্ছি”।
খালা সন্দিগ্ধ গলায় বলল, “কে ইনি?”
ফাজিয়া বলল, “বাবার বন্ধু। মুজফফরাবাদে থাকেন। দেখা করতে এসেছেন বোধহয়”।
খালা বলল, “এত রাতে কেন এসেছে? আর্মির চরেরা ঘুরঘুর করছে সর্বক্ষণ”।
ফাজিয়া বলল, “ওকে কেউ কিছু বলবে না। ভয় নেই”।
খালা বলল, “কেন? কে উনি?”
ফাজিয়া বলল, “উনি ভাল পোস্টে আছেন। সবাই চেনে ওকে”।
খালা আর কিছু বলল না।
রহমত চিন্তান্বিত হয়ে বসে ছিলেন। ফাজিয়া ঘরে ঢুকে তাকে সালাম দিল, “কখন এসেছেন চাচা?”
রহমত বললেন, “আমি আমার বাড়ি এসেই ছুটে এলাম। ওখানে তো কোন খবরই পাচ্ছিলাম না। তিন দিন আগে জানতে পেরেছি। তুমি এই বিয়েটা মেনে নিলে কেন?”
ফাজিয়া বলল, “আমি মানার কে? যারা ঠিক করার, তারা ঠিক করে আমাকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে”।
রহমত রেগে গেলেন, “আজমত একটা মানুষই না। ও এই সিদ্ধান্ত আমাকে না জানিয়ে নিয়েছে”।
ফাজিয়া মাথা নিচু করল।
রহমত বলল, “তুমি কী চাও?”
ফাজিয়া বলল, “আপনি যা চান। আব্বু যা চাইত। আজাদি”।
ফাজিয়ার দুটো চোখ জ্বলে উঠল।
রহমত মাথায় হাত দিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, “গোটা পাকিস্তানে তোমাদের বিয়ের খবর রটে গেছে। বিয়ের দিন পাকিস্তান আর্মির প্রায় সব মাথা গিলগিটে আসবে। তুমি…”
খালা ঘরে ঢুকল। রহমত কথা ঘুরিয়ে দিলেন, “ইসলামাবাদে ছেলের বাড়ি, তাই তো?”
ফাজিয়া মাথা নাড়ল।
খালা ফাজিয়ার দিকে তাকাল, “অনেক রাত হল”।
রহমত ফাজিয়ার দিকে তাকালেন।
ফাজিয়া বলল, “আমার খালা”।
খালা বলল, “আজমত সাহেব আমাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়েছেন। এই বাড়িতে কে যায় আসে সে ব্যাপারে ওকে জানাতে হবে। আপনি কী করবেন, আপনি ঠিক করুন”।
রহমত বিদ্রুপের চোখে ফাজিয়ার খালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা? আজমতের এখন এত ক্ষমতা হয়েছে?”
ফাজিয়া বিরক্ত মুখে বলল, “আহ খালা, তোমাকে বললাম তো রহমত চাচাকে নিয়ে কারো কোন সমস্যা হবে না”।
অপমানে ফাজিয়ার খালার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছিল। বলল, “আমার উপরে শাদী অবধি অনেক দায়িত্ব আছে”।
রহমত বললেন, “কাপুরুষের মত পাকিস্তানী আর্মির গোলামি করার জন্য আপনাকে বেছে নিয়েছে বুঝি আজমত? কীরকম দায়িত্ব প্রত্যাশা করে তারা? গুপ্তচরবৃত্তি করা?”
খালা বলল, “আপনি এখন যেতে পারেন”।
রহমত উঠলেন, ফাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের বাড়ি অনাকাঙ্খিত মানুষে ভরে গেছে ফাজিয়া। যে বাড়িতে একসময় বীরেরা থাকত, সেখানে এখন কাপুরুষেরা চর রেখে দিয়েছে। তোমার যা দরকার হবে, আমাকে খবর পাঠাবে, আমি চলে আসব। আর আপনি…”
রহমত ফাজিয়ার খালার দিকে তাকালেন, “আপনি ওর অভিভাবক এখন। কী করছেন? মেয়েকে বাঁচানোর জায়গায় কতগুলো শয়তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আপনার লজ্জা লাগে না?”
খালা চেঁচিয়ে বলল, “বেরিয়ে যান এখান থেকে”।
রহমত রক্তচক্ষুতে ফাজিয়ার খালার দিকে তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ফাজিয়া বলল, “তোমাকে আমি বলেছিলাম রহমতচাচাকে কেউ কিছু বলবে না। তবু তুমি ওর সঙ্গে এরকম করলে কেন?”
খালা বলল, “উনি তোমার কানে মন্ত্র দিতে এসেছিলেন। আজাদী মানে কী? তুমি একা আজাদ হবে? আর বাকিরা?”
ফাজিয়া কঠিন গলায় বলল, “বাকিদের জন্য আমায় কেন ভুগতে হবে? বলি হতেই বা হবে কেন? তাছাড়া তুমি আমাদের কথা লুকিয়ে শুনছিলেই বা কেন? তোমাকে আজমত চাচা দায়িত্ব দিলেও আমার আব্বু তো কোন দায়িত্ব দিয়ে যান নি। তোমার এত বড় সাহস হল কেন?”
খালা বলল, “আমি আজমতকে জানাবো এখানে তুমি তোমার ইচ্ছেমত কাজ করছো। আজমত ঠিক শাস্তি দেবে তোমাকে”।
ফাজিয়া বলল, “এই বাড়িটা আজমতের নয়। আমার বাবার। তোমার যদি খুব অসুবিধা হয়, তবে এই বাড়িতে তুমি না থাকলেও হবে”।
খালা বলল, “তোমার খুব সাহস হয়েছে ফাজিয়া। আমার সঙ্গে এভাবে মুখে মুখে তর্ক করছো”।
ফাজিয়া খালার কথার উত্তর না দিয়ে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। খালা বার বার দরজায় ধাক্কা মারলেও আর দরজা খুলল না।
রাত বাড়লে তার জানলায় তিনটে টোকা পড়ল।
ফাজিয়া জানলা খুলল। অন্ধকার ফুঁড়ে এক লোক এসে তার হাতে একটা চিরকুট দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
চিরকুটে লেখা, “আজাদি আসছে। তৈরী থাকো। ইনশাল্লাহ”।
২২
ড্যানিয়েলের হাত বেঁধে তাকে একটা ট্রাকের পিছনে বসানো হয়েছে। গাড়ি ভর্তি বাক্স। তার সঙ্গে দুজন সশস্ত্র যুবক উঠেছে। গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে জানা যাচ্ছে না, তবে ড্যানিয়েল বুঝতে পারছে শহরের দিকে কোথাও যাচ্ছে না তারা। গাড়ি ঝাঁকুনি খাচ্ছে। রাস্তা ভীষণ খারাপ। গাড়ির গতিও বেশি না।
তাকে সিডেটিভ দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল অনেকক্ষণ। গাড়িতে বসানোর স্মৃতি তার হারিয়েছে।
সে দুজন যুবকের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
দুজন পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বেশ খানিকক্ষণ হেসে নিল। একজন বলল, “সেসব জেনে কী করবে?”
ড্যানিয়েল চুপ করে গেল। তার অভিজ্ঞতা বলছে এই ধরণের ধর্মান্ধ এবং ব্রেইন ওয়াশড লোকেদের সঙ্গে কথা বলে আখেরে কোন লাভ হয় না। এদের মাথা এরা ধর্মগুরুদের কাছে বন্ধক রেখে দেয়। একইসঙ্গে জিহাদের নামে যে কোন জায়গায় সুইসাইড মিশনে যেতে এরা একবারও ভাবে না।
গভীর রাতের দিকে ট্রাক দাঁড়াল। দুজন তাকে ঠেলতে ঠেলতে ট্রাক থেকে নামাল। ড্যানিয়েলের রীতিমত শীত লাগছিল। একটা বড় ঘরে তাকে নিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসানো হল। কিছুক্ষণ পরে একজন সুপুরুষ পাঠান এসে তাকে ব্রিটিশ অ্যাক্সেন্টে বলল, “কোন সমস্যা হয় নি তো?”
ড্যানিয়েল বলল, “হাত বেঁধে নিয়ে এলে সমস্যা হবারই কথা আমার মনে হয়”।
পাঠান বলল, “আমি রুমান আলি। আমার নাম শুনেছেন আশা করি”।
ড্যানিয়েল বলল, “লস্কর? আমি এখন খাইবার পাখতুনওয়ালাতে?”
রুমান হাসল, “হ্যাঁ”।
ড্যানিয়েল বলল, “আমি যতদূর শুনেছি আপনি অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করে সিরিয়ায় আইসিস জয়েন করেছিলেন। তারপরে ওখান থেকে হঠাৎই আপনার মনে হল আগে নিজের দেশের সেবা করা উচিত। পাকিস্তানে এসে লস্করে জয়েন করেন। তাই তো?”
রুমান বিস্মিত হয়ে বলল, “মারহাবা! আপনি খুব ভাল একজন জার্নালিস্ট। আমার সম্পর্কে এতকিছু বহির্বিশ্ব জানে ভাবলেই ভাল লাগছে। আল্লাহকে অনেক অনেক শুক্রিয়া”।
ড্যানিয়েল বলল, “আপনি শিক্ষিত মানুষ হয়ে এটুকু বুঝতে পারছেন না, একজন জার্নালিস্টকে এভাবে আটকে রাখার কোন মানেই হয় না?”
রুমান হাসল। বলল, “আমার ভাই নাসির আমাদের মুভমেন্টে বিন্দুমাত্র যুক্ত নয়। সে ইউ এস এর সিটিজেনশিপও পেয়েছে। তবু যতবার সে ও দেশে ঢুকতে যায়, তাকে আলাদা করে পরীক্ষা করা হয়। শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি পরীক্ষা করা হয়। আপনাদের দেশের মানুষ এতো শিক্ষিত, তারা জানে না, মুসলমান মাত্রেই টেরোরিস্ট হয় না? খুব বড় বড় কথা বলা হয়। আমেরিকা সবার, এখানে সবার সমান অধিকার আছে। কোথায় আছে? কিচ্ছু নেই। আমাদের ভাইদের প্রতিটা মুভমেন্ট নজরে রাখা হয়। তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়”।
ড্যানিয়েল বলল, “ও দেশে এর প্রতিবাদও করি আমরাই। ঠিক আছে, আমি এই নিয়ে কোন তর্ক করতে চাই না, আমাকে আপনি বলুন আমাকে নিয়ে আপনাদের কী প্ল্যান আছে?”
রুমান চেয়ার নিয়ে বসে বলল, “আপনি খুব ইম্পরট্যান্ট মানুষ। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সরকার শুধুমাত্র আপনার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমী দুনিয়া থেকেও আপনাকে রিলিজ করার জন্য প্রচুর প্রেশার আসছে”।
ড্যানিয়েল বলল, “সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? আমি যোদ্ধা নই, সংবাদদাতা মাত্র। আমার কোথাও কোন ভূমিকা নেই”।
রুমান হাসল, “কাম অন ড্যানিয়েল। আমি ইউকেতে পাঁচ বছর ছিলাম। আমি খুব ভাল করে জানি তোমরা একইসঙ্গে দুটো কাজ কর। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের মত দেশে চলে আসো, একই সঙ্গে গুপ্তচরবৃত্তিও কর। এগুলো ওপেন সিক্রেট। কেন লুকোতে হয় তোমায়?”
ড্যানিয়েল বলল, “কী চাইছো তুমি?”
রুমান বলল, “কথা ছিল এখানের সেফ হাউজে তোমাকে রাখা হবে। তুমি আসার কিছুক্ষণ আগেই মৌলানা নির্দেশ পাঠালেন তোমার শবদেহ সসম্মানে আমেরিকান কনস্যুলেটে পাঠাতে হবে। আপাতত সেটার ভিডিও করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে”।
ড্যানিয়েল বিস্ফারিত চোখে রুমানের দিকে তাকাল।
কিছুক্ষণের মধ্যে ঘরে ক্যামেরা সহ সব কিছুর ব্যবস্থা হয়ে গেল।
ড্যানিয়েলের মুখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সে ছটফট করছে।
ছেলেদুটো ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরা অন করল।
রুমান হাতে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে ড্যানিয়েলকে মেঝেতে বসিয়ে ড্যানিয়েলের গলা ছুরি দিয়ে কাটতে শুরু করল।
ড্যানিয়েল ছটফট করছে। রুমান শান্ত সহাস্য মুখে ড্যানিয়েলের ধড় থেকে মাথাটা কেটে ফেলে দিল।
#
পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিটিং করছিলেন। তার ফোনে ভিডিওটা গেল।
মিটিং এর মাঝে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন।
২৩
চিলাস পৌঁছতে বিকেল হল। পাহাড়ের গায়ে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে তারা আশ্রয় নিল।
খালেদ বলল, “ঘন্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে রওনা হচ্ছি”।
রাস্তা ফাঁকা হতে ঘন্টাখানেক লেগে গেছিল।
গোলাগুলির পর এত তাড়াতাড়ি সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল, বাইরে থেকে কেউ এলে অবাক হয়ে যেত।
ইফতিকার তার ব্যাগ পারমিটগুলো বের করে আরেকবার দেখে নিয়ে বলল, “গোটা রাস্তায় আমাদের কেউ কিচ্ছু জিজ্ঞেস করে নি। গিলগিটে ঢোকার মুখে করবে। এবার আমাদের প্ল্যান ঠিক করতে হবে। আমার মনে হয় আপনার গিলগিটে ঢোকাটা নিরাপদ হবে না। আপনি চেকপোস্টের আগে কোন সেফ হাউসে অপেক্ষা করতে পারেন”।
ইফতিকার সৈকতের দিকে তাকাল।সৈকত বলল, “আমি কমে যাওয়া মানে দলের একজন কমে যাওয়া। সেটা অ্যাফোর্ড করা যাবে?”
হামিদ বলল, “আমরা এক্সপোজ হয়ে গেলে কোন পাকিস্তানী আর্মিই আমাদের বাঁচাতে আসবে না। উনি অতিথি। ওর বেঁচে থাকাটা জরুরি”।
সৈকত হাসল, “আমি কেন অতিথি হয়ে যাব? ভারতবর্ষের ম্যাপে গিলগিট বাল্টিস্তান এখনো আমাদের দেশেই পড়ে। গিলগিটে আমি কেন অতিথি হলাম মিয়াঁ?”
হামিদ বলল, “তাহলে আপনি কী চান বলুন?”
সৈকত বলল, “আমি বাইরে অপেক্ষা করতে পারব না। আমিও যাব। আমাকে যেতেই হবে”।
ইফতিকার বলল, “ঠিক আছে”।
সৈকত বলল, “আমি তুরতুক একজিট পয়েন্ট ব্যবহার করব”।
ইফতিকার গম্ভীর হয়ে গেল।
সৈকত বলল, “কী হল?”
ইফতিকার বলল, “এটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব”।
সৈকত বলল, “ঠিক আছে। তাই হোক। যা আপনি বলবেন। আপনি এখন আমার গাইড”।
ইফতিকার হাসল। খালেদ বলল, “রওনা হওয়া যাক। আমার এখানে বসে থাকতেও টেনশন হচ্ছে”।
ইফতিকার বলল, “তুমি শিওর? পারবে এখনোই বেরোতে?”
খালেদ বলল, “হ্যাঁ। গিলগিটে বেশি রাতে পৌঁছনোর থেকে এখন বেরোলে আগে পৌঁছনো যাবে। রাত আটটার মধ্যে পৌঁছে যাব ইনশাল্লাহ”।
তারা বেরোল। গাড়িতে উঠে সৈকত বলল, “এই ঐতিহাসিক বিয়ের রাজপুত্তুরটির কিন্তু এটা প্রথম বিয়ে না। আমি গিলগিটে যখন ছিলাম, জনাব ইয়াসিরকে তার বিবি নিয়ে ঘুরতে দেখেছি। তারপরে কি তালাক হয়ে গেছিল?”
হামিদ বলল, “তালাক না, ইয়াসিরের বিবি আত্মহত্যা করেছিল। বেশিরভাগেরই ধারণা ওটা আত্মহত্যা না, খুন”।
সৈকত বলল, “বাহ। চমৎকৃত হলাম। পাত্রটি তো অসাধারণ। সুকুমার রায় পেলে আরেকটা কবিতা লিখতেন”।
হামিদ বলল, “সুকুমার রায় কে?”
সৈকত বলল, “আমাদের বাংলার এক বিখ্যাত মানুষ। সত্যজিৎ রায়ের নাম শুনেছো?”
হামিদের মুখে হাসি ফুটল, “হ্যাঁ। দ্য ফেমাস ডিরেক্টর”।
সৈকত বলল, “একদম। সুকুমার রায় তার আব্বাজান ছিলেন। দাঁড়াও তোমাকে কবিতাটা বুঝিয়ে বলি”।
সৈকত “সৎপাত্র” কবিতাটা বাকি তিনজনকে পুস্তুতে তর্জমা করে বলল। সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ইফতিকার বলল, “গিলগিটের মানুষদের রক্তটাই নষ্ট হয়ে গেছে। নইলে ইয়াসিরের মত লোকের সঙ্গে বিয়ে সমর্থন করে”?
চিলাসের পর থেকে গিলগিটে রাস্তা খানিকটা ভাল হয়েছে। তবে রাস্তায় প্রবল ধুলো। এখানেও পাহাড় ভেঙে রাস্তার কাজ চলছে। কয়েকটা চীনা ট্যুরিস্টের গাড়ি চোখে পড়ল।
ইফতিকার বলল, “চীন এখন পাকিস্তানের কাছে জামাই আদর পাচ্ছে”।
সৈকত বলল, “শাহী শাদিতে চৈনিক দস্যুরা থাকবে না?”
ইফতিকার বলল, “থাকতেই পারে। চীন সেনাদের সঙ্গে অনেক পাকিস্তানী সেনা কর্তার দহরম মহরম আছে। ওরা আসবে”।
সৈকত বলল, “মেলা বসছে তার মানে। একদিকে পশ্চিমী জার্নালিস্ট, অন্যদিকে চীনের সেনা কর্তা। উফ, এই মন্ডপ থেকে বউ নিয়ে পালানোর মজাই আলাদা হবে”।
ইফতিকার বলল, “আমাদের হাতে আর একটা দিন সময় আছে। পরশু থেকে সব রিচুয়ালস শুরু হবে”।
সৈকত বলল, “বিয়ের রীতি নিয়ে কী জানা গেছে? সুন্নী বিয়ের থেকে শিয়া বিয়েতে অনেক বেশি সময় লাগে। ইয়াসির কোন মতে বিয়ে করবে?”
ইফতিকার বলল, “বিয়ে থেকে শুরু করে সবটাই ওদের মত করেই হবে”।
গাড়ি শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। পাকিস্তানী আর্মিরা গাড়ি চেক করছে। ইফতিকার বলল, “এত আগে?”
খালেদ বলল, “হতেই পারে”।
ইফতিকারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। পারমিট বের করে হাতে রাখল।
২৪
“কোথায় যাবে?”
তাদের গাড়ির কাছে এসে এক সশস্ত্র পাকিস্তানী সেনা খালেদকে জিজ্ঞেস করল।
খালেদ বলল, “গিলগিট যাচ্ছি জনাব”।
দশ বারোজন সেনা টহল দিচ্ছে রাস্তায়। প্রতিটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রশ্নোত্তর করছে।
তাদের গাড়ি আটক করা সেনা বলল, “পারমিট দেখি”।
খালেদ পারমিট দিল।
সেনা বলল, “গাড়ি থেকে নেমে যাও”।
হামিদ বলল, “কী হল জনাব?”
সেনা জোরে ধমক দিল, “যা বলছি কর। ড্রাইভার নাম”।
ইফতিকার নিচু গলায় বলল, “খালেদ বসে না থেকে নেমে যাও”।
খালেদ নামল। সেনা টর্চ জ্বালিয়ে পারমিট দেখছিল।
কয়েক সেকেন্ড পর খালেদকে দূরে নিয়ে গিয়ে প্রশ্নোত্তর শুরু করল।
হামিদ বলল, “বাস্টার্ডস। কী করব ইফতি ভাই?”
ইফতি বলল, “বসে থাকো”।
হঠাৎ গাড়ির দরজা খুলে গেল।
ইফতিকার অবাক হয়ে দেখল সৈকত কোন একজন সেনাকে ডেকে আলাপ শুরু করেছে। খানিকক্ষণ পরে সেই সেনা সৈকতকে সিগারেট দিল। সৈকতের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতেই সে সেনা খালেদকে ডেকে নিয়ে যাওয়া সেনাকে ডেকে বলল, “ছেড়ে দাও ওকে। আমার বন্ধু”।
খালেদ ঘর্মাক্ত অবস্থায় গাড়িতে এসে বসল। সৈকত সেই সেনাকে কিছু একটা বলে গাড়িতে উঠে হাসতে হাসতে খালেদকে বলল “গাড়ি টানো”।
খালেদ গাড়ি স্টার্ট দিল।
ইফতিকার বলল, “এটা কী হল?”
সৈকত বলল, “কিছুই হল না। আমি না গেলে খালেদকে গুলি করে খাদে ফেলে দিত! সব গাড়ি আটকানোর অর্ডার আছে। ভাগ্যিস ওয়াসিম ছিল!”
হামিদ বলল, “আপনার বন্ধু?”
সৈকত বলল, “হ্যাঁ বন্ধুই তো। কত বন্ধু বানানো আছে পাকিস্তানে। কখন কে কাজে লেগে যায়, কে জানে”!
হামিদ বলল, “আপনার উপর নির্দেশ ছিল এখানে কোন পরিচিতর সঙ্গে দেখা না করার জন্য”।
খালেদ বলল, “তো উনি কী করতেন? ওরা আরেকটু হলেই পারমিটের ব্যাপারে ইসলামাবাদে ফোন করত। একটা মাছি গলতে পারছে না”।
সৈকত চোখ বন্ধ করল, “একটা মাছিও এখন গিলগিটে পাক সেনার অনুমতি ছাড়া ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না। ওয়াসিমের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝলাম, গিলগিটে এখন তারার মেলা বসছে। সব আসছে”।
ইফতিকার বলল, “আপনি ওয়াসিমকে কী করে চিনলেন?”
সৈকত হাসল, “ভাববেন না। আমি ডাবল এজেন্ট নই। এদেশে কম ঘুরি নি এক কালে। গিলগিটে যখন ছিলাম, ওয়াসিম চেকপোস্টে ডিউটি করত। প্রথম জয়েন করেছে। লাহোরে বাড়ি। প্রায়ই হা হুতাশ করত বাড়ির জন্য। আমাদের সবারই তো বাড়ি আছে, তাই না জনাব?”
হামিদ বলল, “আমার ধারণা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও আপনার আলাপ আছে। যেভাবে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন!”
সৈকত মিটিমিটি হাসতে হাসতে বলল, “আমি কিছু জানি না, কিছু বুঝি না। তবে এটুকু বুঝি, সব দেশের মানুষই স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরতে চায়, কিন্তু পারে না। সিস্টেম তাদের সেখানে ফিরতে দেয় না”।
ইফতিকার মাথা নিচু করল। গিলগিটের চেকপোস্টের কাছে গাড়ি এসে দাঁড়াল। পাঁচটা গাড়ির লাইন হয়েছে। শেষ গাড়ি তাদের। প্রবল শৈত্যপ্রবাহ হচ্ছে। তাপমাত্রা মাইনাসের নিচে চলে গেছে।
ইফতিকার ক্লান্ত গলায় বলল, “কতদিন পর নিজের মাটিতে ফিরলাম। অথচ সেখানে ঢুকতে গেলেও কত কাগজ দেখাতে হচ্ছে!”
সৈকত গাড়ির ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ চোখে চেকপোস্টের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ছাড়ল, “আজ আশা করছি কোন অসুবিধা হবে না। ইউসুফকে দেখতে পাচ্ছি। ইউসুফ আলি, এও লাহোরেই থাকে। এর বাবার একটা পা অ্যাক্সিডেন্টে বাদ পড়েছিল। ছোট ভাই পেশোয়ারে ব্যবসা করে। মা খুব ভাল গোস্ত বানান। ইউসুফের বউ ইসলামাবাদের মেয়ে। ইউসুফ বিয়ের পর বউয়ের কাছে থাকতে পারত না বলে কাঁদত বলে ওকে খুব বুলি করত ওর কলিগরা”।
হামিদ হাঁ করে সৈকতের দিকে তাকিয়ে ইফতিকারকে বলল, “এবার বুঝলাম এঁকে কেন পাঠানো হয়েছে। এ দেখি আমাদের থেকেও পাকিস্তানকে বেশি করে চেনে”।
ইফতিকার বলল, “তবু আপনি আর পরিচয় দেবেন না। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে সমস্যা হতে পারে”।
সৈকত সিটে হেলান দিল নিশ্চিন্তে, “খালেদ, তুমি শুধু হাসি মুখ করে রেখো। টেনশন দেখিও না। তুমি ছড়ালে আমি সামলাবো। কোন চিন্তা নেই”।
খালেদ বলল, “আমি আর চিন্তা করছি না। আপনি যা খেলা দেখাচ্ছেন”।
সৈকত গম্ভীর হয়ে গেল, “অপারেশন আজ রাতেই করতে হবে। রাজকন্যেকে আজকেই তুলব। কালকের অপেক্ষায় থাকলে হবে না”।
ইফতিকার চমকে সৈকতের দিকে তাকাল।