রাজকন্যের সন্ধানে – ৩০
৩০
নয়া দিল্লি।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর আবাসন।
সকাল সাড়ে সাতটা।
র’চিফের গাড়ি ঢুকল।
মন্ত্রী চিন্তিত মুখে বসে ছিলেন।
চিফ মন্ত্রীর ঘরে ঢুকতেই মন্ত্রী বললেন, “কী আপডেট?”
চিফ বললেন, “কোন আপডেট নেই”।
মন্ত্রী বললেন, “আরে আমি তো সেটাই জানতে চাইছি। কেন আপডেট নেই? গিলগিট থেকে কী আপডেট আছে?”
চিফ বললেন, “ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ইসলামাবাদে যার সঙ্গে এই মিশনটা নিয়ে যোগাযোগ করছিলাম, তার ফোনও পাওয়া যায় নি। আমেরিকান সাংবাদিক খুনের জন্য তার উপরে নজর পড়েছে আই এস আই এর”।
মন্ত্রী ভ্রূ কুঁচকালেন, “মানেটা কী? আমেরিকান সাংবাদিক খুনে জড়িত ইনফরমারের সঙ্গে আমরা কাজ করছি নাকি?”
চিফ মাথা নাড়লেন, “না না। তা নয়। যে হোটেলে ওই সাংবাদিক ছিল, সেই হোটেলে আমাদের ইনফরমার কাজ করে। ওই দিন ছেলেটা কাজে যায় নি অন্য কোন কারণে। এরা ভাবছে ও কোন ভাবে জড়িত, তাই হি ইজ আন্ডার দেয়ার র্যাডার”।
মন্ত্রী বললেন, “ওহ। তাহলে ঠিক আছে। শোন তুমি, এই মুহূর্তে মিশন অ্যাবর্ট করতে হবে। প্রাইম মিনিস্টার আমার কাছ থেকে শোনার পর থেকেই ভীষণ চিন্তিত হয়ে আছেন। ওর কথা অনুযায়ী এই ব্যাপারে আমাদের জড়িয়ে যাওয়া খুব বাজে ব্যাপার হবে। যদি তোমার লোক ধরা পড়ে, তাহলে পাকিস্তান এটা নিয়ে বড় ইস্যু করে দেবে। যদি কোনভাবে যোগাযোগ হয় তবে ওকে বলে দাও দেশে ফিরে আসতে। আর যদি সব করিডর বন্ধ থাকে, তাহলে যতদিন বন্ধ থাকবে, ততদিন পাকিস্তানেই থাকতে বলে দাও”।
চিফ হতভম্ব হয়ে বললেন, “কিন্তু এই মিশনের অনুমতি তো আপনিই দিয়েছিলেন”।
মন্ত্রী বললেন, “আমি পি এমের সঙ্গে কোন আলোচনা না করেই দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই মিশনটা করতে পারলে আমাদের লাভ হবে। কিন্তু তোমার লোক যদি ধরা পড়ে যায় তাহলে পুরো নাক কাটা যাবে”।
চিফ মাথা নাড়লেন, “আমি এখন এই ব্যাপারে কিছু করতে পারব না স্যার। আমিও জানি না আমার লোক এখন কোথায়, কী অবস্থায় আছে”।
মন্ত্রী বললেন, “পি এম আমার উপর ভীষণ রেগে গেছেন। বার বার বলে যাচ্ছেন কেন আমি কোন রকম আলোচনা না করে তোমাকে এগিয়ে যাওয়ার পারমিশন দিলাম। এখন পিছনোর উপায়ও নেই। ঠিক আছে, একটা কাজ করা যাক। আমাদের লোক যখনই তোমাকে জানাবে তার একজ্যাক্ট পজিশন কী, তুমি তাকে বলে দিও দেশে ফিরে আসতে। বাকি কী করতে হবে তুমি জানো, আলাদা করে বলছি না”।
চিফ বললেন, “ইফ এনি চান্স মেয়েটাকে আমরা নিয়ে আসতে পারি?”
মন্ত্রী বললেন, “আমরা মেয়েটাকে নিয়ে কী করব? পাকিস্তান যদি বলে বসে ওদের দেশের ব্যাপারে আমরা হস্তক্ষেপ করেছি?”
চিফ বললেন, “আমি যতদূর জানি স্যার, গিলগিট আমাদের দেশেরই অংশ। আমাদের দেশের ম্যাপ এখনো তাই বলে। তাহলে এখানে পাকিস্তানের কথা কেন আমাদের মানতে হবে?”
মন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। বললেন, “গুড পয়েন্ট। কাল রাত থেকে আমি ঘুমোতে পারি নি জানো”।
চিফ বললেন, “আপনি ভাববেন না স্যার। আমাদের বেস্ট এজেন্ট এখন এই মিশনে আছে। এই অপারেশন সাক্সেসফুল হবেই”।
মন্ত্রী বললেন, “কিপ মি আপডেটেড। আমি দেখছি পি এমকে কীভাবে বোঝাতে পারি”।
চিফ উঠলেন। মন্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে ফোন বের করে বেশ কয়েকটা নাম্বারে ফোন করলেন। সব নাম্বার সুইচড অফ বলছে। একবার ভাবলেন ইসলামাবাদে হাই কমিশনারকে ফোন করবেন। পরক্ষণেই প্ল্যান ক্যান্সেল করলেন। ঠিক কী অবস্থায় এই মুহূর্তে সৈকত আছে, না জেনে কিছু করা যাবে না।
তার অফিসে পৌঁছলেন চিফ। কন্ট্রোল রুমে পৌঁছলেন। তাকে দেখে বাকি অফিসারেরা উঠে দাঁড়ালেন।
চিফ বললেন, “কোন ফোন এসেছে?”
উত্তর এল, “নেগেটিভ স্যার”।
চিফ বললেন, “এক্সিট করিডর কী কী অ্যাক্টিভ আছে এখন খোঁজ নাও”।
“ওকে স্যার”।
চিফ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ইলিয়াস খানের ফোন পাওয়া গেলে কিছুটা চিন্তামুক্তি হত। সেটাও পাওয়া যাচ্ছে না…
৩১
দাসুতে পৌঁছে গাড়ি গ্রামের ভিতর নিয়ে গেল খালেদ।
ভোরের দিকে একটা পরিত্যক্ত মসজিদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে গাড়ি রেখে তারা মসজিদে আশ্রয় নিল।
দাসু সিন্ধু উপত্যকায় অবস্থিত। এখানেও শীত প্রবল। মেঝেতে চাদর পেতে ফাজিয়াকে বসানো হয়েছে। ফাজিয়া গুটিশুটি মেরে বসে রইল।
সৈকত বলল, “এবার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিতে হবে। চিরুণি তল্লাশি শুরু হবে। আমাদের লোকেশন পেতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না”।
সৈকত ফাজিয়ার দিকে তাকাল। ফাজিয়া গুটিশুটি মেরে বসে আছে। এই মেয়েটার কত বয়েস হবে? এর মধ্যে ইয়াসিরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত ওরা। আরও কত শত মেয়েদের মতের অমতে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। একবারও জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনটুকু বোধ করে না এরা। কাবুল কান্দাহারে তালিবানরা ফিরছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে বিয়ে দেবে, রাজি না হলে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হবে। সময় এগনোর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের তো মুছে যাবার কথা ছিল। তা আর হল কোথায়?
সে বলল, “ফাজিয়া কী চাও? আমার সঙ্গে ইন্ডিয়া যাবে?”
ফাজিয়া বলল, “যাব। আমি পাকিস্তানে থাকতে চাই না। পাকিস্তান আমার দেশ না”।
ইফতিকার বলল, “কিন্তু বেটি, আমাদের সঙ্গে থাকলে তুমি নিরাপদ থাকবে”।
ফাজিয়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “এ দেশে আমরা কেউ নিরাপদ নই”।
ইফতিকার সৈকতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “ঠিক আছে। এবার প্ল্যান বলুন”।
সৈকত বলল, “লাইন অফ কন্ট্রোলের দিকে এগোতে হবে। খালেদ রাস্তা চিনতে পারবে?”
খালেদ বলল, “চিনব। কিন্তু আপনি এল ও সির কাছে পৌঁছলেও ইন্ডিয়া কী করে ঢুকবেন?”
সৈকত হামিদকে বলল, “ইলিয়াস খানের ফোন এখন পাওয়া যাচ্ছে?”
হামিদ মাথা নাড়ল, “নাহ”।
সৈকত বলল, “ঠিক আছে। এখন আমার লাইন অফ কন্ট্রোলের দিকে রওনা দেব। সময় খুবই কম। খালেদ একটু বিশ্রাম করুক, অনেকটা ড্রাইভ করেছে”।
ইফতিকার বিদ্রুপের গলায় বলল, “এত সোজা হবে বুঝি সবটা”?
সৈকত বলল, “আপনি কী চাইছেন?”
ইফতিকার বলল, “আমরা কয়েক দিন আন্ডারগ্রাউন্ড থাকি। কয়েকদিন পর এমনিতেই সব ঠান্ডা হয়ে যাবে”।
সৈকত বলল, “এ দেশ কোন দিন ঠান্ডা হবে বলে আপনার মনে হয়? একটা না একটা সমস্যা আসতেই থাকবে। আপনি, খালেদ কিংবা হামিদ কাজ বন্ধ করে এত বছর আত্মগোপন করে থাকলে কারো কোন সন্দেহ হবে না বলছেন?”
ইফতিকার চুপ করে গেল।
খালেদ সৈকতের দিকে তাকাল, “আমি আপনার সঙ্গে আছি। ইফতিকার চাচা চাইলে ইসলামাবাদ ফিরে যেতে পারেন। আমি আপনাকে আর ফাজিয়াকে নিয়ে লাইন অফ কন্ট্রোল নিয়ে যাব”।
ইফতিকার বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল, “ওভাবে হবে না। অত সহজে পাকিস্তান আর্মি আর ইয়াসির হুসেন সব কিছু ছেড়ে দেবে না। আমাকে তোমাদের দরকার পড়বে। ঠিক আছে, ফাজিয়া বেটি যখন এদেশে থাকতে রাজি নয়, তাহলে আমরা ওকে ইন্ডিয়ায় পাঠানোর জন্য সব রকম চেষ্টা করব। আমাদের মেয়ের গায়ে যেন কোন দাগ না পড়ে”।
সৈকত বলল, “পড়বে না। আমি আছি তো”।
একগাদা আখরোট, কাজু বের করল হামিদ। সবাইকে দেওয়া হল। খালেদের ফোন বাজল। খালেদ ফোন ধরল, একটু কথা বলেই ফোনটা সৈকতের হাতে দিল।
সৈকত ধরল, “হ্যাঁ”।
“আমি ইলিয়াস বলছি”।
সৈকত সোজা হয়ে বসল, “বলুন”।
“চিড়িয়ারা আমাকে সন্দেহ করছে। আমি যদিও কোন সাংবাদিককে মারি নি। তবুও করছে। আমাকে আমার পুরনো আস্তানা ছাড়তে হয়েছে। আমি তেহেরান পালাচ্ছি। এখন থেকে যা করবে তোমাকেই করতে হবে। ওপারের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই। সব লাইন ওরা ট্যাপ করছে। যা করবে, সাবধানে করবে। ভাল থেকো”।
ফোনটা কেটে গেল।
সৈকত হতভম্ব হয়ে ফোনটা খালেদের হাতে দিয়ে বলল, “সিমটা ফেলে দাও। আর কোন সিম আছে?”
খালেদ বলল, “আছে”।
সৈকত বলল, “আপাতত ফোনে কোন সিম লাগানোর দরকার নেই। দাসু আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। খালেদ, চল, বেরোই”।
খালেদ উঠে পড়ল, “চলুন”।
৩২
সকাল দশটা। ইসলামাবাদ হাইওয়ের পাশে আই এস আই চিফ রফিক আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন।
টহলদারি দল আলীর মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে। আহমেদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ফোন করতে ভয় পাচ্ছেন।
মাথা কাজ করছে না। আলীর মত একজন অফিসারের আচমকা মৃত্যু আই এস আইএর কাছে বিরাট আঘাত।
অনেকক্ষণ ধরে পায়চারি করছিলেন। স্থানীয় টহলদারি দলের অফিসার এসে সেলাম জানিয়ে বলল, “জনাব, আমরা কি বডি পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাব?”
আহমেদ রাগী গলায় বললেন, “আমি কি বারণ করেছি? এত দেরী করছেন কেন? যান! আর কী পোস্টমর্টেম করবেন? গুলি লেগে মারা গেছে এটা বোঝার জন্য পোস্টমর্টেম করার কিছু নেই। আলীর ফ্যামিলিকে বডি পাঠানো হোক”।
“জি জনাব”।
অফিসার চলে গেল।
আহমেদ মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ পায়চারি করে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে ফোনটা করেই ফেললেন। ওপ্রান্ত থেকে ফোন ধরলেন মন্ত্রী, “হ্যাঁ, বলুন”।
“জনাব, আলী ইজ নো মোর। কাল রাতে একটা ইনভেস্টিগেশনে গিয়ে সাসপেক্টকে একা তুলে জেরা করতে গিয়ে…”
“হোয়াট? এসব কী চাইল্ডিশ ব্যাপারস্যাপার? কী বলছেন আপনি?”
“জি জনাব। আলী কী করে এই ভুলটা করল বুঝতে পারি নি। তবে ড্যানিয়েল মার্ডারে আলীর সন্দেহ ঠিক বলেই মনে হচ্ছে। র্যাডিসনে যে লোকটি কাজ করত, মানে যার পিছু নিয়েছিল আলী, এ খুন তারই করা। আমরা অলরেডি ওর ঘর সার্চ করেছি স্যার। এখনো সন্দেহজনক কিছু পাই নি, তবে পেলে অবশ্যই আপনাকে ইনফর্ম করছি”।
“ইনফর্ম করার কিছু নেই আহমেদ, উই ডোন্ট হ্যাভ এনি টাইম। আমেরিকান মিডিয়া আমাদের পিছনে পাগলা কুকুরের মত লেগে গেছে। মিডিয়ায় দিয়ে দিন ড্যানিয়েল খুনে এই ইলিয়াস খানের হাত আছে। আমেরিকান মিডিয়াতেও দিয়ে দিন। যে যেভাবে পারে গল্প দিয়ে যাক। আমি এখনো গিলগিটে আছি। এখানেও হালত খুব বিগড়ে আছে। পরে কথা বলছি”।
ফোন কেটে গেল।
আই এস আই চিফ তার সেক্রেটারিকে ডেকে সব নির্দেশ দিলেন। অস্থির হয়ে আরো কিছুক্ষণ রাস্তার উপর হাটাহাটি করে গাড়িতে উঠে বসলেন। একদিকে বিদেশী ডেলিগেশন আসার কথা, অন্যদিকে লস্কর, হিজবুল মাথায় চেপে বসে আছে, আর সব কিছুর পরে আলীর পাকামির জন্য আর কী কী উটকো বিপদ আসতে পারে তার কোন আন্দাজ করা যাচ্ছে না। অফিসে ফোন করে ইলিয়াস খান সম্পর্কিত সব তথ্য বের করতে বলে দিলেন। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, এই ইলিয়াস খান মোটেও সুবিধার লোক নয়। আলী একে ফাঁকায় তুলে এনে জেরা করতে চেয়েছিল, এ আলীকে মেরে পালিয়েছে। লুক আউট নোটিস জারি করতে বলে দিলেন। থানায় থানায় ইলিয়াস খানের ছবি পাঠাতে বললেন।
র্যাডিসনে ফোন করে জানা গেল ইলিয়াস বেশ ভাল স্টাফ। কোন সমস্যা নেই। আলীর একটা বদদোষ ছিল ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন ওর অবজারভেশনগুলো তাকে রিপোর্ট করত না। কোথাও লিখেও রাখে নি। ভীষণ ওভারকনফিডেন্ট ছেলে ছিল। কাউকে বিশেষ বিশ্বাসও করত না।
এর ফলে যেটা হল, ইলিয়াসের সম্পর্কে জানতে আহমেদকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।
ইলিয়াসের বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল।
রফিক আহমেদ গাড়ি থেকে নেমে ইলিয়াসের বাড়িতে ঢুকলেন। পুলিশ আর তাদের লোক ভর্তি হয়ে আছে। আশে পাশের বাড়ি থেকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। স্থানীয় থানার অফিসার এসে স্যালুট দিয়ে জানাল প্রতিবেশীরা জানিয়েছে ইলিয়াস ভাল মানুষ। কখনো কারো সাতে পাঁচে থাকে না।
রফিক পোড় খাওয়া অফিসার। কারো উপর ভরসা না করে নিজেই ইলিয়াসের বাড়ির চিরুণি তল্লাশি শুরু করলেন।
ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, বাথরুম, বেডরুম সব স্বাভাবিক।
রফিক বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে দেওয়াল চেক করতে শুরু করলেন। সব ঘরের দেওয়ালই ঠিক আছে। কোথাও কোন সমস্যা নেই।
ইলিয়াস খানের আলমারী ভাঙা হয়েছে। কিচ্ছু পাওয়া যায় নি।
পাকিস্তানী পাসপোর্ট আছে, এই বাড়ির ঠিকানাতেই। সব কিছু নিখুঁত। পারফেক্ট। এটাই যেন বেশি সন্দেহ তৈরী করছে। বেশ কিছুক্ষণ সব দেখে শুনে রফিক হাল ছেড়ে দিয়ে বসলেন।
আলী কী কী জেনেছিল এর ব্যাপারে?
৩৩
গিলগিট বিমানবন্দরে এনাসহ বাকি তিনজন বিদেশী সাংবাদিকের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আল জাজিরার সাংবাদিক হায়াতের পাশে এনার সিট পড়েছে।
হায়াত এনার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আপনি খুব সাহসী। আলাপ করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু সময়ের অভাবে হয়ে ওঠে নি”।
এনা ম্লান হাসল। বিমান টেক অফ করতে এনা বলল, “ওরা কি শিয়াদের বাড়ি ভাংচুর করছে এখানে?”
হায়াত বলল, “বলতে পারব না”।
এনা বলল, “বলতে চাইছেন না, তাই তো?”
হায়াত চোখ দিয়ে ইশারা করল। বিমানে পাকিস্তান আর্মির কয়েকজনও আছেন।
এনা তার ফোন বের করে নোট প্যাডে লিখল, “এখানে শিয়াদের উপর অত্যাচার হচ্ছে?”
হায়াত লিখল, “শিয়ারা এখানে অত্যাচারিত হয়েই আছে। ঘটনাটার পর সেটা বাড়বে। এছাড়া আর কিছু না”।
এনা বুঝল। এবারের সফরটা যত দিন যাচ্ছে অভিশপ্ত হয়ে উঠছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাকিস্তানী আর্মি তাদের গিলগিট থেকে বের হবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। এর মানে দাঁড়ায় এরপরে স্থানীয় মানুষদের উপর এমন কোন অস্ত্র প্রয়োগ হবে যেটা মিডিয়াকে তারা দেখাতে চায় না।
এত সুন্দর একটা জায়গা, অথচ সব কিছুতে কত আড়াল! এনার ইচ্ছা ছিল ইয়াসির হুসেনের ইন্টারভিউ নেওয়ার, অনুমতিই পাওয়া গেল না। মেয়েটা নিজে পালিয়েছে, নাকি কিডন্যাপ হয়েছে, কেউই কোন ক্লু বের করতে পারে নি।
কোন সংগঠন দায় স্বীকারও করে নি বা কোন বিবৃতি দেয় নি।
গিলগিট বাল্টিস্তান এমনিতেই ভীষণ বিতর্কিত জায়গা। পাকিস্তানি আর্মির আগ্রাসনের ফলে এই অঞ্চল ভারতের হাত থেকে বেরিয়ে যায় অনেক আগেই। তার পর থেকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শিয়ারা অত্যাচারিত হতে শুরু করে।
ইসলামাবাদে ফিরেই এনার দেশে ফেরার ফ্লাইট। দেশে ফেরার আগে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকছে? ফাজিয়া মেয়েটাই বা কোথায় গেল? অনার কিলিং হল না তো?
এনা চমকে উঠল। হায়াতকে দেখিয়ে স্ক্রিণে সেটা লিখল।
হায়াত লিখল, “এ দেশে সব কিছু হওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে হলে বডি পাওয়া যেত। এটুকুই আশা”।
এনা সিটে হেলান দিল। বেশি ভাবলে শরীর খারাপ লাগে। তার আশা ছিল ড্যানিয়েল কিডন্যাপ হলেও ঠিক ফিরে আসবে। সে ভাবছিল কীভাবে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে এভাবে কোন রকম চিন্তা না করে মেরে ফেলতে পারে?
হায়াত কয়েক মিনিট ধরে সামনের সিটে বসা এক সেনাকে দেখছিল। খানিকক্ষণ পরে উশখুশ করে উঠল। বাথরুম থেকে ফিরে রুমাল বের করে ঘাম মুছল।
এনা লিখল, “কী হয়েছে? এনিথিং সিরিয়াস? ঘামছেন কেন?”
হায়াত লিখল, “আমার সন্দেহ হচ্ছে পাকিস্তানী আর্মির ছদ্মবেশে এই প্লেনে একজন লস্কর নেতা যাচ্ছে”।
এনা চমকে উঠে লিখল, “হোয়াট???”
হায়াত লিখল, “ফিফথ রো-র কোণার জনকে দেখুন। ওর চেহারা একজনের সঙ্গে মিলছে”।
এনা লিখল, “কে?”
হায়াত লিখল, “রুমান আলি। লস্কর ই তৈবা”।
এনা চমকে উঠল। ড্যানিয়েলের খুনি আর সে একই ফ্লাইটে যাচ্ছে। সে লিখল, “প্লিজ কনফার্ম হিজ আইডেন্টিটি। প্লিজ”।
হায়াত চারপাশে তাকিয়ে লিখল, “অসম্ভব। এরা তাহলে মেরে ফেলবে আমাদের। প্লিজ কিপ কোয়াইট”।
এনা ফোন রেখে দু হাতে মুখ ঢাকল। লোকটাকে এতক্ষণ সে দেখে নি। উঁচু হয়ে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আবার বসল।
হায়াত তাকে ইশারায় শান্ত হতে বলল।
বাকি রাস্তাটা এনা ছটফট করতে লাগল কিন্তু কিছুই করতে পারল না।
বিমান ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে পৌঁছতে তাদের নামতে দেওয়া হল না। এনা চেষ্টা করতে গেল, আর্মির লোকজন তাকে আটকে দিল। প্লেন ফাঁকা হয়ে গেলে তাদের নামানো হল।
এনা হায়াতকে বলল, “ও কোথায় গেল?”
হায়াত হতাশ চোখে চারদিক দেখে বলল, “আর কি রাখে? এতক্ষণে সরিয়ে ফেলা হয়েছে”।
এনা বলল, “এই দেশে সব সম্ভব, তাই না?”
হায়াত হাসল, “হ্যাঁ”।
৩৪
রাত দুটো। অ্যাবোটাবাদ থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে খালেদকে দাঁড় করাল সৈকত।
বলল, “আপনারা আমাকে আর ফাজিয়াকে অ্যাবোটাবাদে রেখে ফিরে চলে যেতে পারেন। বাকিটা আমি দেখে নেব”।
ইফতিকার রেগে গেল, “আমার তো বিরাট কোন কাজ পড়ে নেই। আমি কেন ফাজিয়াকে আপনার হাতে ছেড়ে দেব? ও আমাদের মেয়ে। ওর দায়িত্ব আমাদেরও।”
সৈকত ঠান্ডা গলায় বলল, “এত বড় দল ঘুরে বেড়ালে খুব স্বাভাবিকভাবেই আর্মির চোখে পড়বে। এখান থেকে লাইন অফ কন্ট্রোল অবধি যত কম মানুষ থাকা যায়, তত ভাল”।
ইফতিকার বলল, “আর আপনি যদি গদ্দারি করেন?”
সৈকত বলল, “গদ্দারি আপনার দেশের লোক করেছে আপনাদের উপরে। আমি শেষ চেষ্টা করছি এটুকুই। বাকিটা আপনাদের উপরওয়ালা জানেন”।
ইফতিকার মাথায় হাত দিলেন।
খালেদ বলল, “আমাদেরও পাকিস্তানেই থাকতে হবে চাচা। বেশিদিন লা পতা থাকলে আমাদের উপরেও নজর পড়তে পারে, সেটা ভেবে দেখবেন”।
ইফতিকার গাড়ির দরজা খুলে নামলেন। চিন্তিত মুখে খাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ালেন। সৈকত গাড়ি থেকে নেমে ইফতিকারের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাকে ভরসা করতে হবে আপনাকে”।
ইফতিকার বলল, “ফাজিয়াকে আপনার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকবেন? এক ঘরে থাকবেন? কী করে এটা আমি মেনে নেব? আপনি আমাদের মেয়েকে সহি সালামাত না রাখেন যদি”।
সৈকত বলল, “যুদ্ধের সময় এবং প্রাণ বাঁচানোর সময় জাত, ধর্ম বিসর্জন দিতে হয় জনাব। ইয়াসির হুসেন ফাজিয়াকে খুঁজে পেলে কি বাঁচিয়ে রাখবে? ওদের নাকের সামনে থেকে মেয়েটাকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি আমরা। এখনও যদি গোঁড়ামি রক্ষা করে চলেন, তাহলে আপনাদের সবার জীবন বিপন্ন হয়ে যাবে”।
ফাজিয়া ঘুমাচ্ছিল। ইফতিকার গাড়িতে গিয়ে ফাজিয়াকে ডেকে বলল, “বেটিজান, তোমাকে উনি ভারতে নিয়ে যাবেন, তুমি প্রস্তুত তো?”
ফাজিয়া ঘাড় নাড়ল, “জি চাচাজান”।
খালেদ সৈকতকে বলল, “আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। আমি জানি, আপনি ঠিক ফাজিয়াকে নিয়ে ইন্ডিয়াতে পৌঁছতে পারবেন। ওর সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারবেন”।
হামিদ ইফতিকারকে বলল, “সামসের শাহের হোটেলে ওদের রেখে যাবো। সামসের শাহ বেঁচে থাকতে পাকিস্তানী আর্মি ওদের কিছু করতে পারবে না”।
ইফতিকার বললেন, “তাই হোক”।
সবাই গাড়িতে উঠলে তারা অ্যাবোটাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। অ্যাবোটাবাদ বড় শহর। পাকিস্তানের পক্ষে লজ্জারও বটে। ওসামা বিন লাদেনকে এই শহর থেকেই খুঁজে পেয়েছিল আমেরিকানরা।
সামসের শাহ ইফতিকারের বয়সী।
ছোট একটা হোটেল। সামসের রিসেপশনে শুয়ে ছিল।
ইফতিকার তাকে ঘুম থেকে তুলে আলাদা করে কথা বলল।
সৈকত হামিদ আর খালেদকে জড়িয়ে ধরে বলল, “খুদা হাফিজ মিয়াঁ। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে”।
হামিদ বলল, “আপনি খুব বাহাদুর মানুষ বন্ধু। আপনার সাহস দেখে আমি মুগ্ধ। যদি কোন দিন এই সমস্ত বর্ডার হারিয়ে যেত, আমি সবার আগে ইন্ডিয়ায় গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব”।
সৈকত হাসল, “চিন্তা নেই। আমি পাকিস্তানে এলে ঠিক তোমাদের খুঁজে নেব”।
ফাজিয়া আর সৈকতকে নামিয়ে দিয়ে ইফতিকাররা গাড়ি করে বেরিয়ে গেল।
একটা ছোট ঘর বরাদ্দ হয়েছে তাদের দুজনের জন্য।
সৈকত বলল, “তুমি নিশ্চয়ই ক্লান্ত। এখনই ঘুমোতে চাও?”
ফাজিয়া বলল, “কেন বলুন তো?”
সৈকত বলল, “আমাদের এখনই এই হোটেল ছাড়তে হবে”।
ফাজিয়া অবাক হল, “কেন?”
সৈকত বলল, “দেখো তোমার সব কেনর উত্তর দিতে হলে রাত পেরিয়ে যাবে। চুপচাপ আমার সঙ্গে চলুন”।
সৈকত ঘর থেকে বেরোল। তার পিছন পিছন ফাজিয়া।
রিসেপশনে সামসের শাহ আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।
সৈকত ফাজিয়াকে নিয়ে চুপ চাপ হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকল।
ফাজিয়া বলল, “এত রাতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি কেন আমরা”?
সৈকত ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, “কোন প্রশ্ন না”।
কুড়ি মিনিট হাঁটার পর বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছল তারা। সৈকত বলল, “এখানেই রাত কাটাবো আমরা”।
ফাজিয়া বলল, “ঘুম পেয়েছে তো”!
সৈকত বলল, “ওয়েটিং রুমের এই ভাঙা চেয়ারেই ঘুমোন আপাতত”।
ফাজিয়া চেয়ারে বসে পড়ে বলল, “এখন মনে হচ্ছে ইফতিকার চাচার সঙ্গে গেলেই হত। আপনি কিছুই বলছেন না”।
সৈকত হাসল, “যত কম বলব, তত ভাল থাকবেন”।