৩৫
ভোর সাড়ে ছ’টা। অ্যাবোটাবাদের পাকিস্তানী আর্মি বেস পেরোল বাসটা।
ফাজিয়াকে বোরখা পরে বাসে বসিয়েছে সৈকত। সে নিজে ছদ্মবেশ নিয়েছে।
পাহাড়ি রাস্তা। ভোরবেলা বলে রাস্তা ফাঁকা।
ফাজিয়ার রাতে ঠিক করে ঘুম হয় নি। পথশ্রমের ধকলে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বাসে উঠে শুয়ে পড়েছে সে।
সৈকত বাসে উঠে যাত্রীদের একবার মেপে নিয়েছে। সন্দেহজনক কিছু পায় নি।
অ্যাবোটাবাদ ছোট শহর। পেরোতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না।
মাটির প্রকৃতি পাথুরে। রাস্তা পাকা। খুব বেশি খারাপ না।
ফাজিয়া বাস স্ট্যান্ডে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে তারা কোথায় যাবে। সৈকত বলে নি। বলেছে যত কম জানবে, ততো ভাল।
এসি বাস। এমনিতেই বাইরে ঠান্ডা। তার উপরে এসি চলছে। যাত্রীদের কম্বল দেওয়া হয়েছে। ফাজিয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
সৈকত চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করল। ঘুম এলো না। ঘুমোনো সম্ভবও না। মস্তিষ্ক প্রতি মুহূর্তে অজস্র সম্ভাবনা খুঁজে চলেছে ফাজিয়াকে নিয়ে নিরাপদে বর্ডার পার হবার ব্যাপারে।
সকাল আটটা নাগাদ রাস্তার ধারের একটা হোটেলে বাস দাঁড়াল। সৈকত ফাজিয়াকে জিজ্ঞেস করল নামবে নাকি। ফাজিয়া ঘুমের ঘোরে উত্তর দিল সে নামবে না।
সৈকত নেমে শুকনো কিছু খাবার নিয়ে এল, সঙ্গে একটা চকলেট।
ফাজিয়া চকলেট দেখে তাকে “শুক্রিয়া” বলল, তাকেও খানিকটা দিল।
তাদের পাশের এক বয়স্ক যাত্রী দেখে সৈকতকে জিজ্ঞেস করল, “জনাব, নব বিবাহিত মনে হচ্ছে?”
সৈকত হাসল, “জি জনাব”।
আশে পাশের সবাই “শুভান আল্লাহ” বলল। সৈকত তাদের ধন্যবাদ দিল।
বাস চলা শুরু হতেই সৈকত বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করা শুরু করল।
কিছুক্ষণ পরে পাহাড়ি রাস্তা শেষ হয়ে আট লেনের সমতল রাস্তায় বাস বেশ দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করল।
ফাজিয়া ফিসফিস করে বলল, “এই বাসটা লাহোর যাচ্ছে। আমরা লাহোরেই যাব?”
সৈকত বলল, “হ্যাঁ”।
ফাজিয়া বলল, “এটা আগে বললে কী হত?”
সৈকত বলল, “পরে বলব”।
লাহোর বাস স্ট্যান্ডে তারা সকাল এগারোটার মধ্যে পৌঁছে গেল।
সৈকত অটো নিল।
লাহোরের তারিক গার্ডেন অঞ্চলে একটা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে সৈকত অটো ছেড়ে দিল।
ষোল তলার বিল্ডিং। লিফটে তিন তলায় উঠে একটা ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াল তারা। সৈকত পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজা খুলে বলল, “চলে এসো”।
ফাজিয়া অবাক গলায় বলল, “এটা কার বাড়ি?”
সৈকত দরজা বন্ধ করে বলল, “বাড়ি না। ফ্ল্যাট বলে। হবে কারো একজনের”।
ফাজিয়া বিস্মিত হয়ে বলল, “মানে? কার না কার ফ্ল্যাটে চলে এলাম?”
সৈকত এবারেও ফাজিয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “তুমি টিভি দেখো বা যা খুশি করতে পারো। আমি স্নান করি। শেষ কবে ঠিক ঠাক স্নান করেছিলাম ভুলে গেছি। টেবিলের উপর একটা পেপার দেখা যাচ্ছে। সেটাও পড়তে পারো। আমি স্নান করে এসে কী করব জানাচ্ছি”।
ফাজিয়া এবার রেগে গেল, “অনেকক্ষণ থেকে আপনি নিজের মত করে আমাকে চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাকে এভাবে অন্ধকারে রেখে লাভ কী হচ্ছে?”
সৈকত থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “যাতে ধরা পড়লে তোমার উপর নির্যাতন করলেও তুমি কিছু বলার না থাকে। আমার অভ্যাস আছে। তোমার নেই। বোঝাতে পারলাম?”
ফাজিয়া মাথায় হাত দিয়ে বলল, “হায় আল্লাহ। ধরা পড়ব?”
সৈকত বলল, “হাই চান্স আছে। এত প্রশ্ন করলে ধরা পড়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়”।
ফাজিয়া ফ্ল্যাটটা দেখছিল। মুগ্ধ গলায় বলল, “কী সুন্দর ফ্ল্যাটটা। এখানেই আমি থেকে যেতে পারি না? নাহ পারি না। আমাদের তো স্বাধীন চিন্তা করার অধিকার নেই। আমি জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াই?”
সৈকত বলল, “দাঁড়াও”।
ফাজিয়া জানলা দিয়ে মুগ্ধ চোখে বাইরের শহরটাকে দেখতে লাগল। বলল, “সারাক্ষণ ঘরে থাকতাম। কোথাও বেরোতে গেলে কতজনের থেকে অনুমতি নিতে হত। শুধু লাহোর কেন, আমার গোটা পাকিস্তান দেখার ইচ্ছা ছিল। বিয়ে করতে হবে, আমাদের লোকেদের বাঁচাতে হবে, সব দায় যেন আমার। শ্বাস নিতে হবে, তাও অন্যের অনুমতি নিয়ে”।
সৈকত বলল, “এখান থেকে অমৃতসর মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার ফাজিয়া। মাঝে ওয়াঘা বর্ডার আছে। এই বর্ডারটা পেরোতে পারলে তুমি যত খুশি স্বাধীনভাবে শ্বাস নিও”।
ফাজিয়া দু চোখ ভরে জানলা দিয়ে লাহোর দেখতে থাকল।
৩৬
ইসলামাবাদের পথে গাড়ি চলছে। কারাকোরাম হাইওয়েতে উঠেছে গাড়ি। খালেদ বড় বড় হাই তুলছে। ইফতিকার বিষন্ন মুখে বসে আছে। হামিদ বলল, “কী হয়েছে চাচা? চিন্তা হচ্ছে?”
ইফতিকার গম্ভীর গলায় বলল, “চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। একজন বিদেশীর হাতে আমাদের মেয়েকে তুলে দেওয়াটা একবারেই ঠিক হয় নি”।
খালেদ বলল, “এখন ভেবো না কিছু। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি রোজকার জীবনে ফিরে যেতে হবে। নইলে আমাদের উপরে নজর পড়বে”।
ইফতিকার বলল, “হু”।
হামিদ বলল, “বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে চাচা। আর কোন দিন কি যেতে পারবো আবার?”
ইফতিকার হামিদের হাত ধরল, “নিশ্চয়ই পারব। ভাবিস না”।
খালেদ বলল, “আমরাও তেহেরান পালিয়ে যাই চাচা। এভাবে নিজের মুলকে পরের মত বাস করা আর হয়ে উঠছে না। মসজিদে গেলেও ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, এই বুঝি উগ্রপন্থীরা আমাদের মসজিদ বোম মেরে উড়িয়ে দেবে। ইরান অনেক শান্ত জায়গা। আমরা যেতে পারি না চাচা”?
ইফতিকার বলল, “আমাদের মেয়ে সহি সালামাত পৌছোক। তারপরে আমরা নিজেদের চিন্তা করব”।
খালেদ ঘাড় নাড়ল, “জি চাচা। তবে আমি আর এই দেশে থাকতে চাই না। আমরাও যাতে পালাতে পারি, এবার সেই চেষ্টা শুরু করুন চাচা। আমি তো ড্রাইভার। ওখানেও ঠিক কাজ জুটিয়ে নেব। কেমন নসীব আমার, ঠিক যেদিন ভেবেছিলাম বালোচিস্তান দিয়ে পালাব, সেদিনই ওখানে বিপ্লবীরা দাঙ্গা শুরু করে দিল”।
ইফতিকার বলল, “আফগানিস্তান হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই?”
খালেদ বলল, “ক্ষেপেছো চাচা? তাহলে হয় তালেবান, নয় আমেরিকান সেনার হাতে মারা পড়ব। থাক চাচা, আমরা আরো ভাবি। টাকা জমাই, একদিন না একদিন উপায় হবেই”।
খানিকটা যেতেই রাস্তায় গাড়ির লম্বা লাইন। ইফতিকার বিরক্ত গলায় বলল, “আবার চেকিং শুরু হয়েছে নিশ্চয়ই। খালেদ কাগজপত্র বের করে রাখ”।
খালেদ বলল, “সব কাগজ পত্র ঠিক আছে। তাছাড়া ফাজিয়াও আমাদের সঙ্গে নেই। আমার মনে হয় না খুব বেশি ঝামেলা হবে আর”।
চেকিং না। রাস্তায় জ্যাম ছিল। ঘন্টা তিনেক পরে ছাড়ল।
ইসলামাবাদে ফিরতে রাত হয়ে গেল তাদের। খালেদ ইফতিকার আর হামিদকে তাদের ডেরায় নামিয়ে গাড়ি রাখতে গেল।
হামিদ সেক্টর থ্রিতে একটা বাড়িতে একা থাকে।
ঘরে ঢুকে সে বেশ কিছুক্ষণ ফাজিয়ার জন্য প্রার্থনা করল।
স্নান সেরে খেতে বেরোল হজরত আলি চকে। একটা ছোট দোকানে তার খাওয়ার ব্যবস্থা করা আছে।
তাকে দেখে দোকানদার নওয়াজ হাসল, “জনাব, দেখছিলাম না তোমায়, কোথায় গেছিলে?”
হামিদ বলল, “ব্যবসার কাজে গেছিলাম। সব ভাল তো?”
নওয়াজ ঘাড় নাড়ল।
হামিদ টেবিলে খেতে বসেছে রুটি আর গোস্তের অর্ডার দিয়ে। হঠাৎ দোকানের ভেতর দুজন সেনা এসে ঢুকে হামিদের দুপাশে দুজন বসল।
হামিদ বলল, “কী ব্যাপার জনাব, একটু সরে বসা হোক”।
একটা রিভলভারের নল হামিদের পেটে খোঁচা মারল। একজন জওয়ান বলল, “চল। ওঠ। জাহান্নামে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করবি”।
হামিদ বিস্মিত হবার ভান করে বলল, “আমি কী করেছি”?
সেনারা হামিদকে মারতে মারতে দোকান থেকে বের করে গাড়িতে তুলল।
তাতেও নিস্তার নেই। ক্রমাগত হামিদকে আঘাত করতে শুরু করল তারা। নওয়াজসহ এলাকার সবাই দেখল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। হামিদের হয়ে কেউ কথা বললে তার দশাও হামিদের মতই করে দেবে এরা।
হামিদের মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি একটা বড় বিল্ডিং এর কাছে এসে দাঁড়াল। হামিদকে নামিয়ে একটা ছোট ঘরে টেবিলে বসিয়ে রাখা হল।
আধ ঘন্টা বাদে একজন অফিসার এসে তার সামনে বসে বলল, “তুই শেষ চারদিন নামাজ পড়তে যাস নি মসজিদে। তোদের শিয়া মসজিদ না? এবার বল, কোথায় গেছিলি তুই?”
হামিদ বলল, “আমি কিছু করি নি জনাব। আপনাদের কোন ভুল হচ্ছে”।
অফিসার এগিয়ে এসে সজোরে ঘুষি মারল হামিদের চোখে। বলল, “আই এস আইকে বুরবাক মনে হয় তোদের? তোরা আলীকেও মেরেছিস। তোদের কপালে দুঃখ আছে”।
হামিদ ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। বলল, “জনাব, আমি এই নামে কাউকে চিনি না”।
“ওকে চিনিস? দেখ ভাল করে”।
ইফতিকারকে অর্ধ মৃত অবস্থায় নিয়ে প্রবেশ করল একজন সেনা। হামিদ বিস্ফারিত চোখে ইফতিকারের দিকে তাকিয়ে রইল।
৩৭
সন্ধ্যে নেমেছে।
ফাজিয়া টিভি দেখছিল।
সৈকত বাথরুমের ভিতর থেকে সম্পূর্ণ নতুন বেশে বেরিয়ে এল। তার গোঁফ নেই, হালকা দাড়ি। মাথায় ফেজটুপি। ফাজিয়া বলল, “আমরা কোথাও যাচ্ছি?”
সৈকত বলল, “তুমি না। আমি বেরোচ্ছি। কেউ নক করলে দরজা খুলবে না। ঠিক আছে?”
ফাজিয়া সভয়ে বলল, “আমি একা থাকতে পারবো? যদি কেউ আসে?”
সৈকত বলল, “আমি তাড়াতাড়ি চলে আসবো। তোমার বেরনো একেবারেই নিরাপদ না। অপেক্ষা কর”।
ফাজিয়া বলল, “আপনি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যান”।
সৈকত একটু থমকে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে”।
ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে তালা দিয়ে সৈকত নিচে নেমে এসে অনেকটা রাস্তা হেঁটে একটা ছোট মোবাইলের দোকানে ঢুকল। একটা বাচ্চা ছেলে বসে আছে। সৈকত বলল, “জনাব শাহ জালাল ভাল আছে?”
ছেলেটা সৈকতের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্টুডিওতে আছে”।
দোকানের পিছনে একটা ছোট স্টুডিও। বিভিন্ন বলিউড হিরো হিরোইনের ছবি।
সৈকত দোকানের দরজায় টোকা দিল।
ভিতর থেকে আওয়াজ এল, “এখন না পরে। স্টুডিও বন্ধ এখন”।
সৈকত বলল, “জনাবকে শাহরুখ খানের সঙ্গে একদিন দেখা করাবোই। কথা দিয়েছি যখন, দেখা হবেই”।
দরজা খুলে গেল।
সৈকত স্টুডিওতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল, “সিকিওর লাইন চাই ইদ্রিশ মিয়াঁ। এখনই”।
ইদ্রিশ মিয়াঁ মাথা নাড়ল, “সম্ভব না। সিকিওর বলে এখন কিছু নেই। তুমি কবে এলে?”
সৈকত বলল, “সিকিওর বলে কিছু নেই মানে?”
ইদ্রিশ কম্পিউটারে কারো একটা পাসপোর্ট সাইজ ফটো ঠিক করছিল। বলল, “লাহোরে এসেছো, ঘুরে বেড়াও, কাবাব খাও, তারপর যেখানে যাবার চলে যাও। এখান থেকে ভুলেও ও পারে কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা কোর না”।
সৈকত বলল, “খুব কঠিন ব্যাপার মিয়াঁ?”
ইদ্রিশ বলল, “হ্যাঁ। খুব কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া তোমার কোন ব্যাপারে আমাকে আর জড়িও না। এর আগে তোমার সঙ্গে করাচী গিয়ে খুব ফাঁসা ফেঁসেছিলাম”।
সৈকত বলল, “ঘটনা হল, ব্যাপারটা যতই কঠিন হোক, আমায় শুধু ওপারে খবর পাঠাতে হবে তাই না, নিজেকেও ওয়াঘা হয়ে ইন্ডিয়া ঢুকতে হবে”।
ইদ্রিশ হাসতে শুরু করল, “পাগল হয়ে গেছো”।
সৈকতও হাসল, “পাগল হই নি”।
ইদ্রিশ বলল, “হাকিম পাড়ায় চলে যাও। আই এস ডি বুথ আছে। ধরা পড়লে আমি জানি না। এখান থেকে কোন রকম যোগাযোগ করা মানে এই জায়গা কমপ্রোমাইজড হয়ে যাবে”।
সৈকত উঠল, “ঠিক আছে মিয়াঁ। বেঁচে থাকলে দেখা হবে”।
ইদ্রিশ বলল, “খামোখা মরতে যাবো কেন? তুমিই বা মরবে কেন? আবার দেখা হবে”।
সৈকত বলল, “যা তোমার ইচ্ছা”।
স্টুডিও থেকে বেরিয়ে সৈকত সন্তর্পণে চারদিক দেখে বেরোল। বাজারের মধ্যে ভীষণ ভিড়। একটা ছোট আই এস ডি বুথ। কয়েক সেকেন্ড সৈকত বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মত পরিবর্তন করে ফ্ল্যাটে ফিরে এল। দরজা খুলে দেখল ফাজিয়া কাঁটা হয়ে বসে আছে। তাকে দেখে স্থির হল।
সৈকত দরজা বন্ধ করে বলল, “চলে এসেছি। এবার রাজকন্যা নিশ্চিন্ত”।
ফাজিয়া বলল, “আমি কোন রাজকন্যা নই। আমি শুধু একটা মেয়ে। খুব ভীতু একজন মেয়ে”।
সৈকত হাসল। মেঝেতে বসল।
বলল, “কাল ভোরে এই ডেরাটাও ছাড়তে হবে। হয়ত আমরা বাঁচব, হয়ত বাঁচব না। ও পারে যোগাযোগ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে ফাজিয়া। তুমি সিদ্ধান্ত জানাও। তুমি যদি চাও, তোমাকে আমি ইসলামাবাদে রেখে আসতে পারি। তোমার চেনা শোনা মানুষজন আছেন ওখানে। ওখানে তুমি ভাল থাকবে। এই সুইসাইডাল মিশনে তুমি না থাকতে চাইলে থেকো না”।
ফাজিয়া বলল, “আপনি ইন্ডিয়ার কোন শহরে থাকেন”?
সৈকত বলল, “কলকাতা”।
ফাজিয়া বলল, “পাকিস্তানে অনেক অঞ্চল আছে, যেখানে বিয়ের পর মেয়েদের সিধা করতে বেত মারা হয়। লাথি মারা হয় বুট পরে। আপনি সেই কলকাতার মানুষ এত দূর থেকে এসেছেন আমাকে বাঁচানোর জন্য। আপনি আমাকে একটা অপশন দিলেন ইসলামাবাদে থেকে যাওয়ার জন্য। কী করব থেকে? সেনাবাহিনী আমায় না পেলেও যদি নিজেদের মধ্যেও আমার বিয়ে হয়, সারাজীবন লাঞ্চনা গঞ্জনার জীবন কাটাতে হবে। এদেশে আমি থাকতে চাই না। মরে গেলেও চাই না। নিজেদের সুখের জন্য এরা আমাকে ওই জানোয়ারটার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল। আপনি একটা কাজ করুন। আপনি বরং একটা রিভলভার সঙ্গে রাখবেন। কখনো ধরা পড়ার সময় এলে আমাকে গুলি করে দেবেন। পারবেন না?”
সৈকত চুপ করে রইল। উত্তর দিল না।
৩৮
তিনটে শরীর রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে।
রুবায়াৎ খান সিগারেট ধরিয়ে ফোন করল আই এস আই চিফকে।
আহমেদ ফোন ধরে বললেন, “বল”।
“জনাব, এই অপারেশনে বাজ ছিল”।
ও প্রান্তে কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তারপর আহমেদ বলল, “কোথায় আছে সে? আবার পালিয়েছে?”
রুবায়াৎ বলল, “অ্যাবোটাবাদে আছে জনাব। এটুকুই বের করতে পেরেছি। তার আগে তিনটেই মরে গেল। এবার লাশগুলো কী করব জানাবেন”।
আহমেদ বললেন, “মেরে দিলে?”
রুবায়াৎ বলল, “থার্ড ডিগ্রি ছাড়া কিছুই বেরোচ্ছিল না জনাব। শেষে একটার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে মারার পর বুড়োটা বলল”।
আহমেদ বললেন, “ঠিক আছে। লাশ যার যার মহল্লায় ফেলে দিয়ে এসো। আমি অ্যাবোটাবাদে কনট্যাক্ট করছি”।
“জি জনাব”।
রফিক আহমেদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং করে বেরোচ্ছিলেন। ফাজিয়ার নিখোঁজ হবার ফাইল নিয়ে বেশি নাড়া ঘাঁটা করার ইচ্ছে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর নেই সেটা বোঝা গেছে। তবে বাজের কথা শুনে আহমেদ গাড়িতে উঠেই অ্যাবোটাবাদে আমানুলকে ফোন করলেন। প্রথম দুবার ফোন রিং হয়ে গেল। তৃতীয়বারে পাওয়া গেল।
আমানুল ফোন ধরে সালাম জানাল।
আহমেদ বললেন, “কী করছো আমানুল? ঘুমোচ্ছিলে?”
আমানুল বলল, “টয়লেট গেছিলাম জনাব”।
আহমেদ বললেন, “যেখানে যাবে ফোন নিয়ে যাবে। বার বার বলেছি”।
আমানুল বলল, “জি জনাব”।
আহমেদ বললেন, “বাজ অ্যাবোটাবাদে আছে আমানুল। ক’টা হোটেল আছে তোমাদের ওখানে?”
আমানুল বলল, “সাতটা জনাব”।
আহমেদ বললেন, “বাজের ডিটেলস পাঠাচ্ছি। যেভাবে হোক দু ঘন্টার মধ্যে খুঁজে বার কর। ওকে ধরতে পারলে যে ইনাম চাইবে, তাই পাবে”।
আমানুল উশখুশ করে বলল, “জি জনাব আমার খুব ব্যাঙ্কক যাওয়ার ইচ্ছা ছিল”।
আহমেদ গালাগাল করতে যাচ্ছিলেন। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে বললেন, “ডিটেলস চেক করে খবর দাও। কাল সকালের মধ্যে বাজকে ইসলামাবাদে চাই আমি”।
আমানুল বলল, “জি জনাব”।
ফোন রেখে অ্যাবোটাবাদের পাক আর্মি বেসে ফোন করলেন আহমেদ। আমানুলের উপর সম্পূর্ণ ভরসা করা যায় না। বাজকে হাতে পাওয়ার এত বড় সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না।
ও প্রান্তে ফোন রিসিভ হতেই আহমেদ সব রকম নির্দেশ দিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
ফোন বাজছিল।
আহমেদ দেখলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ফোন করছে। তাড়াতাড়ি ধরলেন, “জি জনাব”।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থমথমে গলায় বললেন, “তোমার ইস্তফা আমাকে পাঠিয়ে দাও আহমেদ। এই মুহূর্তেঁ তোমাকে আমি বরখাস্ত করলাম”।
আহমেদ অবাক হলেন, “কেন জনাব? কী হয়েছে?”
মন্ত্রী রাগী গলায় বললেন, “এখনো জানো না? তোমার ইন্টেলিজেন্স, তোমার টিম, তোমার যা যা আছে, সব আরব সাগরে বিসর্জন দিয়ে এসো ইউ ইডিয়ট। ফোন চেক কর। পেয়ে যাবে কী হয়েছে”।
ফোন কেটে গেল।
আহমেদ কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে বসে ফোন খুললেন। একটা ভিডিও এসেছে।
ভিডিওটা ওপেন করলেন আহমেদ।
“পাকিস্তানের জনগণকে আমার শুভেচ্ছা জানাই। এই ভিডিওটা সবাই যখন দেখবেন, আমি জানি না আমি কোথায় থাকব। তবে এটা বলার প্রয়োজন আছে, বিশ্বের প্রতিটা মানুষের জানার প্রয়োজন আছে গিলগিট বাল্টিস্তানে পাকিস্তান আমাদের মানুষদের কীভাবে রেখেছে।
গিলগিট বাল্টিস্তানে পাকিস্তানী সেনা আছে ঠিকই, কিন্তু তার থেকেও বেশি করে আছে ওখানে অসংখ্য টেররিস্ট গ্রুপের ক্যাম্প। আমরা যারা ওখানকার আদি অধিবাসী, এরা তাদের মানুষ বলেই মনে করে না। আমাদের কোন রকম স্বাধীনতা নেই। মেয়েদের কখনো জোর করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বিয়ে করার জন্য, কখনো বা সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে জোর করে ধর্ষণ করে। আমাদের না আছে মানবাধিকার, না আছে কোন বিচার। আমার বাবাকে এই পাক সেনাবাহিনীই খুন করেছিল। শুধু তাই না, আমাদের উপত্যকার কত সংসারকে যে এরা শেষ করে দিয়েছে, তার হিসাব পাওয়া যাবে না।
আমার বিয়েটাও সম্পূর্ণ আমার অমতে করার ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তান সরকার। জোর করে বন্দুকের নলের সামনে আমাকে ছেড়ে রেখে ওরা বলতে বাধ্য করেছিল আমি এই বিয়েতে খুশি। সত্যি ঘটনাটা হল, দিনের পর দিন পাকিস্তানী সেনার অত্যাচারে আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছিল।
আমি কিছুতেই এই বিয়ে করতে চাই নি। একজন খুনী লোককে বিয়ে করার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না।
এই দেশকে আমরা ভালবাসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পাকিস্তান সেনা এবং তার সহযোগী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কেউ সেটা হতে দেয় নি।
আমি বাকি পৃথিবীর কাছে দাবি জানাই আমাদের স্বাধীনতার। আমরা মুক্তি চাই এই অত্যাচারী পাকিস্তানী সরকারের হাত থেকে। গিলগিট বাল্টিস্তানের প্রতিটা শিশু পড়াশুনো করুক। তাদের হাতে একে ফরটি সেভেনের পরিবর্তে বই আসুক। যারা ভাবেন আফগানিস্তানের থেকে আমরা ভাল আছি, তারা ভুল জানেন। পাকিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চলে মেয়েদের এভাবেই রাখা হয়। তারা সন্তান তৈরীর যন্ত্র মাত্র। তাদের না আছে নিজস্ব কোন বক্তব্য, না আছে শিক্ষিত হবার অধিকার। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাদের ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী তৈরী করে। এই পাকিস্তান আমাদের দেশ নয়। গিলগিট বাল্টিস্তান স্বাধীন হোক। খুদা হাফিজ”।
ফাজিয়া!
কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে বসে থেকে আহমেদ ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে গাড়ি থেকে নামলেন।
প্রবল রাগে চিৎকার করে উঠলেন। আশে পাশের গাড়ি থেকে তাকে লোকজন কৌতুকভরে দেখতে লাগল।
#
আধঘন্টা পরে অ্যাবোটাবাদের এক ল্যাম্পপোস্টে হোটেল মালিক সামশের শাহের মৃতদেহ পাওয়া গেল। তার গায়ে তারই রক্ত দিয়ে লেখা হল “গদ্দার”।
৩৯
।।একদিন পরের কথা।।
বালুচিস্তান – জাহেদান সীমান্ত।
কিছুক্ষণ আগে একটা বাস এসে সীমান্তবর্তী বাস স্টপেজে দাঁড়াল।
একটা বড় পরিবার ইরানে যাচ্ছে। পাকিস্তান আর্মির অফিসার ব্যাজার মুখে দায় সারার মত করে সবার পাসপোর্ট দেখে বলল, “এরা আর ফিরবে না। সব পালাচ্ছে। যাও মিয়াঁ, পারলে আমিও চলে যেতাম”।
পরিবারের সব থেকে বৃদ্ধ মানুষটি মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম করে বললেন, “ওই সীমানায় সব মিটে গেলেই ভাল হয়, ইনশাল্লাহ”। দায়সারা ভাবে সিকিউরিটি চেকিং হল। পাকিস্তানী সেনা খুব ভাল করে জানে, তাদের তরফ থেকে যাই হয়ে যাক, ইরানের সেনাবাহিনী এদের যেভাবে চেক করবে, তাতে একটা পাকিস্তান থেকে একটা সূচও বিনা বাধায় ইরানে ঢুকতে পারবে না।
ব্যাগপত্র নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই পাকিস্তান ছাড়ল পরিবারটি।
তাদের চলে যাওয়া দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অফিসার আজাদ আফ্রিদি বলল, “বেঁচে গেল”।
পরিবারের প্রত্যেক সদস্য হেঁটে নো ম্যানস ল্যান্ড পার হয়ে ইরানে প্রবেশ করল।
জাভিদ দাঁড়িয়ে ছিল।
বয়স্ক মানুষটিকে হাত ধরে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে নিয়ে গেল।
ইরান সীমান্তের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মিনিট সাতেক পরে পাকিস্তানী ক্যাম্পে ফোন এল।
আজাদ ধরল, “হ্যালো”।
“আমি আই এস আই চিফ রফিক আহমেদ বলছি”।
“জি জনাব”।
“একটা দশ জনের ফ্যামিলি ইরান যাবার জন্য আপনাদের সীমান্তে পৌঁছবে। দেখা মাত্র আটক করবে। দে আর নট পাকিস্তানী। অ্যারেস্ট করে ইসলামাবাদে পাঠাবে। ইটস অ্যান অর্ডার”।
“জি জনাব এই কিছুক্ষণ আগেই ওরা জাহেদানে এন্ট্রি নিল”।
“হোয়াট! ফাক! এক্ষুণি ইরানের ইমিগ্রেশনে ফোন কর। বল ওদের কাগজ ঠিক নেই। আটকে রাখতে হবে”।
“সম্ভব না জনাব। একবার ওরা ওদিকে চলে গেলে জাহেদান বেস ক্যাম্প থেকে কেউ আর হেল্প করে না”।
“হোয়াট দ্য ফাক ইউ ইডিয়ট! কী করছিলে তোমরা? চেক কর নি ভাল করে? কী করেছো জানো তুমি?”
“সরি জনাব”।
“জনাব মাই ফুট। গো টু হেল”।
ফোন কেটে গেল।
আজাদ কাঁধ ঝাঁকাল।
জাহেদানের ইমিগ্রেশন কাউন্টারের ওয়াশ রুম থেকে বৃদ্ধ মানুষের পরিবর্তে বেরোল র এজেন্ট সৈকত ওরফে বাজ।
জাভিদ অপেক্ষা করছিল। সৈকতকে দেখে জড়িয়ে ধরল।
বলল, “ইন্ডিয়া পাকিস্তান বর্ডারের প্রতিটা পাকিস্তানী সেনা আপনার অপেক্ষা করছিল। আপনি জাহেদান থেকেই এক্সিট নেবেন, ওরা ভাবতেই পারে নি”।
ইমিগ্রেশন অফিসার অফিস থেকে বেরিয়ে জাভিদকে কানে কানে বলল, “আপনার অতিথিদের নিয়ে বর্ডার থেকে বেরিয়ে যান। পাকিস্তান থেকে ফোন আসা শুরু হয়ে গেছে”।
লাহোর থেকে আসা পরিবারটিকে বিদায় দিল সৈকত। ফাজিয়াকে নিয়ে জাভিদের গাড়িতে উঠল।
বেশ খানিকটা পথ গিয়ে জাভেদ এক রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে খাবার আনতে গেল।
ফাজিয়া চুপ করে বসে ছিল।
সৈকত বলল, “কী হল? এবার তো নিশ্চিন্ত? দুঃস্বপ্নের দেশটা ছাড়তে পারলে অবশেষে? আর অফকোর্স, তুমি এখন বিখ্যাত। পৃথিবীর সর্বত্র তোমায় নিয়ে ব্রেকিং নিউজ চলছে। তোমার ভিডিওটা সবাই দেখছে। আর চিন্তা নেই”।
ফাজিয়া জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল, “এখন আমার বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে”।
সৈকত বলল, “স্বাভাবিক। মেয়েদের মন। পানাগড় হোক বা পাকিস্তান, সব একই হবে। এত কনফিউশন রাখো কোথায় বল তো?”
ফাজিয়া রাগী গলায় বলল, “আপনি থামুন। পালিয়ে যাবেন তো আবার! কী লাভ হবে? এখানেও তো ঘুরে ফিরে সেই গোলামীর জীবনই তো কাটাতে হবে আমায়”।
সৈকত বলল, “তুমি কী চাও?”
ফাজিয়া বলল, “কলকাতা যাব। গোটা বাসে আপনি কলকাতার মিষ্টির কথা বলে গেছেন। আপনি খাওয়াবেন। আমি কিছু জানি না। জাভিদ চাচা কিছুতেই আর আমাকে আপনার সঙ্গে ছাড়বে না। কিন্তু আমি এখানে থাকলে ঠিক আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। আমাকে কলকাতা নিয়ে চলুন”।
সৈকত হেসে ফেলল।
ফাজিয়া রেগে গেল, “হাসছেন কেন?”
সৈকত বলল, “তথাস্তু”।
ফাজিয়া বলল, “মানে?”
সৈকত বলল, “তবে তাই হোক”।
ফাজিয়া বোরখা তুলে সৈকতকে চুমু খেল।
সৈকত বলল, “আহ… গিলগিট বাল্টিস্তানের মিষ্টি তো দেখছি কলকাতার মিষ্টির থেকেও বেশি সুস্বাদু!”
ফাজিয়া ফিক করে হেসে ফেলল…
(শেষ)