Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রাজু ও আগুনালির ভূত – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প172 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫. পঞ্চম দিন

    ৫. পঞ্চম দিন

    ঘুম থেকে উঠে রাজু তার বিছানায় সোজা হয়ে বসে। রাত্রে ঘুম আসতে দেরি হয়েছে, কিন্তু সকালে ঘুম ভেঙেছে বেশ তাড়াতাড়ি।

    বালিশে হেলান দিয়ে বসে সে গতরাতের ব্যাপারটা আবার চিন্তা করতে বসে, কিছুক্ষণের তা মুখ দেখে মনে হতে থাকে তার বুঝি পেটব্যথা করছে।

    আগুনালির ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল রাজু পাথরের মূর্তির মতো চুপচাপ বসে আছে, সে আগে কখনও তাকে এভাবে দেখেনি। ভয়ে ভয়ে ডাকল, “রাজু”

    রাজু যখন গভীর চিন্তায় ডুবে থাকে তখন কেউ সহজে ডেকে তার সাড়া পায়। কিন্তু এবারে রাজু সাথে সাথে মাথা ঘুরিয়ে আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”

    আগুনালি থতমত খেয়ে বলল, “কিসের কী মন হয়?”

    “কালকে রাত্রে যে আমরা ভূত দেখেছিলাম”

    “কী হয়েছে সেই ভূতের?”

    “আসলে সেটা ভূত ছিল না।”

    আগুনালি এবারে একটু রেগে গেল। রেগে গিয়ে বলল, “কী ছিল তা হলে?”

    “আমার মনে হয় এই বাসটায় কোনো মানুষ আছে।”

    “মানুষ?”

    “হ্যাঁ। একজন মেয়েমানুষ। সত্যিকারের মেয়েমানুষ।”

    আগুনালি অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর যখন বলার চেষ্টা করল তখন কোনো কথা বের না হয়ে সে তোতলাতে শুরু করল, বলল, “তো-তো-তা-তোমার মা-মাথা খারাপ হয়েছে? ওখানে মা-মা-মা মানুষ আছে?”

    “নিশ্চয়ই আছে। না হলে কাল রাতে আমরা চিৎকার শুনলাম কিসের? সত্যি সত্যি তো আর ভূত আসতে পারে না!”

    আগুনালির মুখ রাগে থমথম করতে থাকে। সে হাতড়ে হাতড়ে বালিশের নিচে থেকে ম্যাচটা বের করে একটা কাঠি বের করে বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরে ফস করে জ্বালিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেয়, আগুনটা না নেভা পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে তুমি তোমার টাকা ফেরত চাও?”

    রাজু এবারে হেসে ফেলল। বলল, “আমি সেটা বলিনি। তোমার টাকা তুমি রাখো। আমি বলছি, যদি মনে কর সত্যিই ওই বাসায় কোনো মেয়েমানুষ আছে, কেউ তাকে ধরে আটকে রেখেছে, তা হলে আমাদের কি কিছু করা উচিত না?”

    “কী করা উচিত?”

    “তার কথা পুলিশকে গিয়ে বলা।”

    আগুনালি এবারে মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, “তুমি ভেবেছ পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করবে? কোনোদিন বিশ্বাস করবে না।”

    “সেটা পরে দেখা যাবে। আমাদের কথা বিশ্বাস না করলে আজগর মামাকে নিয়ে যাব।”

    “পরে পুলিশ যদি গিয়ে দেখে আসলেই কেউ নেই, শুধু ভূত?”

    রাজু মাথা চুলকে বলল, “আমার মনে হয় দিনের বেলা গিয়ে আমাদের জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।”

    আগুনালি কোনো কথা না বলে রাজুর দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল।

    “দেখেশুনে যদি মনে হয় মানুষ আছে তা হলে পুলিশকে বললেই হবে।”

    আগুনালি আরেকটা ম্যাচের কাঠি বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “যদি ওইখানে কোনো বদমাইশ মানুষ অন্য মানুষকে ধরে আটকে রেখে থাকে তা হলে সে তোমাকে কি কোলে তুলে আদর করবে?”

    “না, তা করবে না। তাই কাজটা হবে লুকিয়ে।”

    “পরিষ্কার দিনের বেলা সেটা তুমি কীভাবে করবে?”

    রাজু আবার মাথা চুলকে বলল, “প্রথমে শুধু বাইরে থেকে দেখব। মামার বাইনোকুলারটা নিয়ে যাবে, সেটা দিয়ে দূর থেকে খুব পরিষ্কার দেখা যাবে।”

    আগুনালি কোনো কথা না বলে আরেকটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে ছুঁড়ে দিল। রাজু হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে বলল, “আমার কী মনে হয় জান?”

    “কী?”

    “আমাদের এখনই গিয়ে জায়গাটা ভালো করে দেখা উচিত।”

    “এখনই?”

    “হ্যাঁ। যদি সত্যি কেউ কাউকে আটকে রেখে থাকে তা হলে যত দেরি হবে ততই তো বিপদ বাড়তে থাকবে।”

    আগুনালি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “সত্যি যদি কেউ কাউকে আটকে রেখে থাকে তা হলে অনেকদিন থেকে আটকে রেখেছে, আরও দুই-এক ঘণ্টা দেরি হলে কোনো অসুবিধে হবে না।”

    রাজু বলল, “তা ঠিক। তা ছাড়া সাগর ঘুম থেকে না ওঠা পর্যন্ত আমরা তো যেতেও পারব না।

    রাজু একটু অস্থিরভাবে ঘরের এক পাশ থেকে অন্য পাশে হেঁটে এসে বলল, “সাগরটা যা ঘুমাতে পারে, ওকে ঠেলে না তুললে কোনোদিন ঘুম থেকে উঠবে না!”

    আগুনালি বলল, “আহা, ছোট মানুষ। ঘুমাক।” যতক্ষণ ঘুমাচ্ছে ততক্ষণে আমরা নাস্তা তৈরি করে ফেলি।”

    আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “খাঁটি কথা! কী আছে নাস্তা তৈরি করার?”

    রাজু মাথা চুলকে বলল, “মুড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। মনে হয় একটা-দুটা ডিম থাকতে পারে। কয়টা বিচিকলাও আছে মনে হয়।”

    নাস্তার বর্ণনা শুনে আগুনালি মোটেও দমে গেল না, হাতে কিল দিয়ে বলল, “ডিম আর মুড়িভাজি ফাস্ট ক্লাস নাস্তা! সাথে চা। সকালবেলা কড়া এক কাপ চা না খেলে শরীরটাতে জুত হয় না! চুলাটা কোন দিকে?”

    সকালের উঠে চুলা জ্বালিয়ে রান্নাবান্না শুরু করার রাজুর কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল আগুনালির আনন্দই হচ্ছে আগুনে। একটু পরেই দেখা গেল চুলায় দাউ দাউ করে বিশাল একটা আগুন জ্বলছে এবং তার সামনে আগুনালি মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আগুনটা খানিকক্ষণ উপভোগ করে চুলার মাঝে কড়াই চাপিয়ে তেল ঢেলে তেলটা গরম হওয়ার পর তার মাঝে পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিয়ে খানিকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে সে ডিমগুলি ভেঙে ছেড়ে দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। আগুন নিয়ে আগুনালির কোনো ভয় নেই, তাই তার কাজকর্ম খুব ঝটপটে, মনে হয় সাংঘাতিক একজন বাবুর্চি। তারপর কড়াই ভরে মুড়িগুলি ভাজা করে আগুনালি সেটা চুলা থেকে নামিয়ে নিয়ে কেতলি চাপিয়ে দেয়। আগুনের আঁচে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সেটা তার ভালোই লাগছে। কেতলির পানি ফুটে উঠলে সেখানে চায়ের পাতা দিয়ে বলল, “নাস্তা রেডি, সাগরকে ডেকে তোলো।”

    সাগরকে সকালবেলা ঘুম থেকে ডেকে তোলা খুব সহজ কাজ নয়, কিন্তু আজকে ব্যাপারটা খুব কঠিন হল না। সে চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “আজগর মামা কি এসেছেন?”

    “না।”

    “তা হলে চান মিয়া?”

    “না।”

    “তা হলে নাস্তা তৈরি করছে কে?”

    “আগুনালি।”

    “আগুনালির নাম শুনেই সে গুটিগুটি বিছানা থেকে নেমে হাতমুখ ধুয়ে আসে।

    আগুনালির তৈরি ডিম এবং মুড়িভাজাটা খেতে খুব ভালো হলেও চা-টা মুখে দেওয়া গেল না। দুধ নেই বলে সেটা কালো এবং তিতকুটে। সাগর মুখে দিয়ে বলল, “ইয়াক থুঃ!”

    আগুনালি উষ্ণ স্বরে বলল, “কী হয়েছে? লিকার চা খাও নাই কোনোদিন?”

    রাজু বলল, “এটা মোটেও লিকার চা না। এটা ইঁদুর মারার বিষ। এক কাপ খেলে পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিদ্র হয়ে যাবে।”

    রাজুর কথাটা ভুল প্রমাণ করার জন্যেই মনে হয় আগুনালি কুচকুচে কালো বিষের মতো চা-টা এক ঢোকে শেষ করে দিল। শুধু তা-ই না, ঠোঁটে চেটে বলল, “ফাস্ট ক্লাস!”

    রাজু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো, এখন যাই।”

    সাগর জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? মাকড়শা-কন্যা দেখতে?”

    “না, নাহার মঞ্জিলে।”

    “সেখানে কেন? দিনের বেলা তো আর সেখানে ভূত থাকবে না।”

    “না।” রাজু একটু ইতস্তত করে বলল, “আসলে আমার মনে হয় ঐ নাহার মঞ্জিলে একটা মেয়েকে দুষ্টু মানুষেরা বেঁধে রেখেছে।”

    সাগরের চোখ বড় বড় হয়ে গেল সাথে সাথে। একবার রাজুর দিকে, আরেকবার আগুনালির দিকে তাকাল সে সত্যি কথা বলছে, নাকি তার সাথে ঠাট্টা করছে বোঝার জন্য। রাজী গম্ভীর মুখ করে বলল, “আমরা এখনও জানি না সেটা সত্যি কি না। কিন্তু যদি সত্যি হয় তা হলে আমাদের পুলিশকে বলতে হবে।”

    সাগরের চোখ হঠাৎ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, সে একবার ঢোক গিয়ে বলল, “ভাইয়া, চলো মামার বন্দুকটা নিয়ে যাই–বন্দুক দেখলে সব দুষ্টু মানুষ সারেন্ডার করে ফেলবে–”

    রাজু হাসি চেপে বলল, “প্রথমেই বন্দুক নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই। আগে জায়গাটা দেখে আসি।”

    সাগর সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চলো যাই।”

    একটু পরে দেখা গেল তিন সদস্যের এই দলটি রাস্তা ধরে হাঁটছে। সবার সামনে সাগর–তার হাতে একটা লম্বা লাঠি। সবার পিছনে রাজু তার গলা থেকে বাইনোকুলারটা ঝুলছে, তার মুখ গভীর চিন্তাগ্রস্থ–দেখে মনে হচ্ছে বুঝি পেটব্যথা করছে। মাঝখানে আগুনালি, এক হাতে সে একটার পর একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে যাচ্ছে। নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে রাজু দাঁড়িয়ে গেল। আগুনালি কাছে এসে বলল, “কী হয়েছে?”

    “আমাদের ওই বাসাটার কাছে লুকিয়ে যেতে হবে।”

    “কেন?”

    “বাসায় যদি সত্যি সত্যি থাকে তা হলে আমাদের দেখে সাবধান হয়ে যাবে।”

    আগুনালি কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, “চলো তা হলে এই জঙ্গলে ঢুকে যাই, জঙ্গল দিয়ে জঙ্গল দিয়ে চলে যাব।”

    সাগর ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “এই জঙ্গলে বাঘ-ভালুক নেই তো?”

    আগুনালি কিছু বলার আগেই রাজু বলল, “না সাগর, তোকে আমি কতবার বলেছি এইসব জঙ্গলে বাঘ-ভালুক থাকে না।”

    আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “আর থাকলেই ক্ষতি কী? তোমার হাতে ঐ বড় লাঠিটা দিয়ে দড়াম করে মাথায় মাঝে একটা বসিয়ে দিও, বাঘ ভালুক বাপ বাপ করে পালাবে।”

    সাগরকে নিয়ে কেউ ঠাট্টা করলে সে খুব রেগে যায়, এবারেও সে রেগে গেল, কিন্তু রেগে গিয়েও সে কিছু বলল না। সত্যি সত্যি যদি দুষ্টু মানুষেরা একজনকে আটকে রেখে থাকে, তা হলে তাকে উদ্ধার করার জন্য মনে হয় ঠাট্টা তামাশা একটু সহ্য করতে হবে।

    নাহার মঞ্জিলের কাছাকাছি এসে রাজুর বেশ আশাভঙ্গ হল, সত্যি সত্যি এটা পোড়াবাড়ি, পুরো বাড়িটা মনে হচ্ছে ধসে পড়ছে। দেয়াল ভেঙে পড়ে আছে, ইট-পাথরের স্থূপ, পোড়া দরজা-জানালা, দীর্ঘদিন অব্যবহারে সারা বাসায় স্থানে স্থানে গাছগাছড়া উঠে এসেছে। রং-উঠা বিবর্ণ ভয়ংকর একটা ধ্বংসস্তূপ। এরকম বাসায় কোনো মানুষ থাকবে কিংবা কেউ জোর করে কাউকে আটকে রাখবে বলে মনে হয় না। তবুও সে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে আজগর মামার বাইনোকুলারটা দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে, কিন্তু পুরো বাসায় যে কোনো জনমানুষের চিহ্ন খুঁজে পেল না। রাজুর সাথে সাথে আগুনালিও দেখল, সাগরও দেখল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।

    এক পাশ থেকে কিছু না দেখে তারা সাবধানে বাসার অন্যপাশে গিয়ে আবার বাসাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, সেখানেও কোনো মানুষের চিহ্ন নেই। এতক্ষণে সাগর আর আগুনালি এই ভাঙা বিধ্বস্ত বাসার মানুষ খোঁজাখুঁজি করায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। সাগর বিরক্ত হয়ে একটা গাছের গোড়ায় বসে একটু পরে পরে বলতে লাগল, “চলো মাকড়শা-কন্যা দেখতে যাই।”

    সাগরের মাথায় কিছু-একটা ঢুকে গেলে খুব বিপদ, তখন সে ভাঙা রেকর্ডের মতো একটা জিনিস বারবার বলতে থাকে। রাজুর ধৈর্য ছুটে যাবার মতো অবস্থা হল। সাগরের এই ঘ্যানঘ্যান থেকে দূরে সরার জন্যে এবং একই সাথে একটু ওপর থেকে দেখার জন্যে সে সাবধানে একটা গাছ বেয়ে ওপরে উঠবে বলে ঠিক করল। আগুনালিকে কথাটা বলতেই সে ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি আগে গাছে উঠেছ?”

    “বেশি উঠিনি, কিন্তু উঠেছি।”

    “জুতা জোড়া খুলে যাও।”

    রাজু জুতা জোড়া খুলে গাছে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। নিচে ডালপালা বেশি নেই, তাই আগুনালি তাকে ঠেলেঠুলে একটু ওপরে তুলে দেয়, বাকি অংশটুকু তখন মোটামুটি সহজ হয়ে গেল। গাছ বেয়ে বেয়ে অনেকটুকু ওপরে উঠে সে আবার নাহার মঞ্জিলের দিকে তাকাল। নিচে থেকে একেবারে বোঝা যায় না, কিন্তু ওপরে বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে এবং এই ঘরগুলো বেশি ভেঙেচুরে যায়নি। সে তীক্ষ্ণ চোখে ঘরগুলোর দিকে তাকাল, একটা জানালা দিয়ে মনে হল ভিতরে দেখা যাচ্ছে এবং হঠাৎ মনে হল ভিতরে কিছু-একটা নড়ছে। সে তাড়াতাড়ি বাইনোকুলারটি চোখে লাগিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বাইনোকুলার ফোকাস করতেই জানালাটি ওর একেবারে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অবাক হয়ে দেখে সত্যি জানালা দিয়ে ভিতরে কিছু-একটা দেখা যাচ্ছে, আবছা মনে হচ্ছে। একজন মানুষ নড়ছে।

    রাজুর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সে চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখতে পেল ঘরের ভিতরে থেকে মানুষটি জানালার কাছে এসে জানালার শিক ধরে বাইরে তাকাল, রাজু প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিক তার বয়সী একটা মেয়ে জানালার শিক ধরে তার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। রাজু তাড়াতাড়ি তার চোখ থেকে বাইনোকুলারটি নামিয়ে নেয়। না, মেয়েটি কাছে নয়, বহুদূরে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এইদিকে তাকিয়ে আছে সত্যি, কিন্তু তাকে দেখছে না।

    আগুনালি নিচে থেকে চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করল, “কী হল, কাউকে দেখলে?”

    রাজু আবার চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ দেখেছি।”

    “সত্যি? কে?’

    “দাঁড়াও বলছি–”রাজু আবার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আবিষ্কার করল মেয়েটির মাঝে একধরনের অস্বাভাবিক সৌন্দর্য আছে যেরকম আগে কখনও তার চোখে পড়েনি। এত সুন্দর মানুষের চেহারা কেমন করে হয়? রাজুর মনে হতে থাকে মেয়েটি বুঝি মানুষ নয়, বুঝি কোনা অশরীরী প্রাণী। বুঝি আকাশের পরী।

    মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার বুকের মাঝে একটা ভয়ংকর কষ্ট হতে শুরু করে। কেউ তাকে বলে দেয়নি, কিন্তু তবু সে বুঝতে পারে এই মেয়েটি খুব দুঃখি মেয়ে। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়েও মেয়েটির মতো দুঃখি মেয়ে সারা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। রাজু রুদ্ধ নিঃশ্বাসে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল, আর ঠিক তখন মেয়েটি দুই হাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে নেয়, তারপর জানালার শিকে মাথা লাগিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটি কি কাঁদছে?

    আগুনালি নিচে থেকে বলল, “কী হল?”

    রাজু চাপাস্বরে বলল, দাঁড়াও বলছি।”

    আবার সে মেয়েটির দিকে তাকাল, দুই হাত থেকে মুখটি তুলে সে আবার তাকাল রাজুর দিকে। রাজু তাড়াতাড়ি বাইনোকুলার সরিয়ে নেয় চোখ থাকে। না, মেয়েটি তাকে দেখেনি, এদিকে তাকিয়ে আছে সত্যি, কিন্তু তাকে দেখছে না। রাজু আবার চোখে বাইনোকুলার তুলে নেয় মেয়েটি জানালার শিকে মুখ লাগিয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে ঘুরে ঘরের ভিতরের দিকে চলে গেল। যাওয়ার ভঙ্গিটি এত দুঃখের যে হঠাৎ রাজু মনে হল সে তার বুঝি বুক ভেঙে যাবে।

    নিচে থেকে আগুনালি আবার বলল, “কী হল? কথা বল না কেন?”

    রাজু বলল, “বলছি দাঁড়াও।” বাইনোকুলারটা গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিচে নেমে আসে। আগুনালি আর সাগর ঘিরে দাঁড়াল রাজুকে। সাগর অধৈর্য গলায় বলল, কী দেখেছ ভাইয়া?”

    একটা মেয়ে।”

    “সত্যি?”

    “সত্যি।”

    “কী করছে মেয়েটা?”

    “কাঁদছে। মনে হয় মেয়েটাকে কেউ আটকে রেখেছে।”

    আগুনালি খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কত বড় মেয়েটা?”

    “আমাদের বয়সী। এত সুন্দর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।”

    আগুনালি হাত বাড়িয়ে বলল, “আমাকে দুরবিনটা দাও, দেখে আসি।”

    রাজু গলা থেকে খুলে বাইনোকুলারটা আগুনালির হাতে দিয়ে বলল, “ভিতরের দিকে চলে গেছে এখন, জানি না তুমি দেখতে পারবে কি না।”

    আগুনালি গাছ বেয়ে বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, “দেখি চেষ্টা করে।”

    সাগর ওপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমিও দেখব, আমিও দেখব।”

    রাজু নিচু গলায় বলল, “গাছের উপরে না উঠলে তুই দেখতে পারবি না।”

    “আমি গাছে উঠব।”

    “তুই নাগাল পাবি না, অনেক উঁচু গাছ।”

    সাগর কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই গাছের উপর থেকে আগুনালি বলল, “কোন জানালাটা রাজু?”

    “বাম দিকের জানালা।”

    আগুনালি বাইনোকুলার চোখে তাকিয়ে থাকে। রাজু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “দেখেছ?”

    “ভিতরে কিছু-একটা নড়ছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।”

    “ঐটাই মেয়েটা।”

    আগুনালি আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করল, কিন্তু মেয়েটি আর জানালার কাছে এল না। সে হয়তো আরও অপেক্ষা করত, কিন্তু রাজু নিচে থেকে ডেকে বলল, “আগুনালি, নিচে নেমে আসো।”

    “কে?”

    “কী করা যায় ঠিক করতে হবে না?

    আগুনালি তখন গাছ ধরে ধরে নিচে নেমে এল। গাছ থেকে একটা বিষপিঁপড়া আগুনালির শরীরে উঠে গিয়ে গলা বেয়ে নেমে যাচ্ছিল, সেটাকে দুই আঙুল পিষে ফেলতে ফেলতে বলল, “এখন কী করবে?”

    “পুলিশ খবর দিতে হবে।”

    “পুলিশ! আগুনালি কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “পুলিশ কোনোদিন তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।”

    “কেন বিশ্বাস করবে না?”

    “ছোটদের কথা বড়রা বিশ্বাস করে না। বড় একজনকে নিয়ে যেতে হবে।”

    রাজু মাথা চুলকে বলল, “কিন্তু বড় মানুষ কোথায় পাব? চলো আমরা নিজেরাই গিয়ে চেষ্টা করি।”

    আগুনালি মাথা নাড়ল, বলল, “না, কাজ হবে না। আর মনে কর পুলিশ তোমার কথা বিশ্বাস করে এসে দেখল মেয়েটা আসলে এখানে থাকে।”

    “এখানে থাকে?”

    ”থাকতেও তো পারে। গরিব মানুষ থাকার জায়গা নেই–এখানে উঠেছে।”

    রাজু মাথা নাড়ল, “না, মেয়েটাকে দেখে গরিব মানুষের মেয়ে মনে হল না। একেবারে পরীর মতো চেহারা।”

    আগুনালি রেগে গিয়ে বলল, “আমি অনেক গরিব মানুষের মেয়ে দেখেছি, তাদের পরীর মতো চেহারা। আমার আপন ফুপাতো বোন–”

    রাজু বাধা দিয়ে বলল, “আমি সেকথা বলছি না। দেখে মনে হয় না গরিব মানুষের মেয়ে থাকতে এসেছে। দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জোর করে আটকে রেখেছে–”

    আগুনালি পা দিয়ে মাটি খুঁটতে খুঁটতে বলল, “কী প্রমাণ আছে?”

    রাজু রেগে গিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সত্যিই তো, কী প্রমাণ আছে? খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চিন্তা করে রাজু অন্যমনস্কভাবে বলল, “আমাদের একটু খোঁজখবর নিতে হবে।”

    “হ্যাঁ,” আগুনালি মাথা নেড়ে বলল, “সত্যি সত্যি যদি পুলিশের কাছে যাবে, তা হলে আগে খোঁজখবর নিয়ে একেবারে পাকা খবর জানতে হবে।”

    “কিন্তু কীভাবে খবর নেবে?”

    সাগর এতক্ষণ দুজনের কথাবার্তা শুনছিল, কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছিল না, দুজন থামতেই সে বলল, “মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেই হয়!”

    দুজনে সাগরের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল, রাজু মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে জিজ্ঞেস করবি মেয়েটাকে? টেলিফোনে?”

    সাগরকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, মাথা চুলকে বলল, “দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করা যায় না?”

    “আর তোর চিৎকার শুনে যখন সবাই লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসবে?”

    “আস্তে আস্তে চিৎকার করবে।” আগুনালি হেসে ফেলে বলল, “আস্তে আস্তে মানুষ কেমন করে চিৎকার

    করে?”

    সাগরকে আবার খুব বিভ্রান্ত দেখা গেল।

    রাজু খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমাদের বাসার দরজায় গিয়ে খোঁজ নিতে হবে।”

    সাগর চোখ বড় বড় করে বলল, “যদি লাঠি নিয়ে আসে?”

    “খুব কায়দা করে খোঁজ নিতে হবে যেন বুঝতে না পারে। গিয়ে ভান করব রাস্তা হারিয়ে এসে গেছি।”

    “না–” আগুনালি মাথা নাড়ল, “রাস্তা হারিয়ে কেউ এখানে আসতে পারে।”

    “তা হলে কী করা যায়?”

    আগুনালি পকেট থেকে ম্যাচ বের করে ফস করে একটা কাঠি জ্বালিয়ে বলল, “আমি চেষ্টা করতে পারি।”

    “কী চেষ্টা করবে?”

    খালিগায়ে একটা গোরু নিয়ে ভিতরে ঢুকে যাই যেন ঘাস খাওয়াতে এনেছি তা হলে কেউ সন্দেহ করবে না।”

    “গোরু? গোরু কোথায় পাবে?”

    “আশেপাশে কত গোরু চরে বেড়ায়, একটা খুঁজে বের করে নেব।”

    রাজু আগুনালির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, একটি গরু নিয়ে কোথাও ঢুকে যাওয়া কত সহজ তার কোনো ধারণা নেই। কিন্তু মনে হল বুদ্ধিটা খারাপ না। সে মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, তা হলে যাও। আমরা রাস্তায় অপেক্ষা করব।”

    খানিকক্ষণ পর দেখা গেল আগুনালি খালিগায়ে একটা লাল রঙের ছোটখাটো গোরু নিয়ে পুরোপুরি রাখাল ছেলের মতো উদাস-উদাস মুখ করে নাহার মঞ্জিলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেখে কে বলবে এটি তার গোরু নয় কিংবা সে খাঁটি রাখাল নয়!

    রাজু সাগরকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। হেঁটে হেঁটে তারা এক মাথায় চলে যায়, সেখানে একটা ছোট সাঁকো রয়েছে। সাঁকোর উপরে দাঁড়িয়ে তারা নিচের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোট ছোট কচুরিপানা ভেসে ভেসে যাচ্ছে। সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে তারা সেগুলির উপর থুতু ফেলার চেষ্টা করে। কাজটি যত সোজা মনে হয় তত নয়। অনেকক্ষণ সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে থেকে তারা আবার রাস্তা ধরে নাহার মঞ্জিলের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। রাস্তায় একজন চাষি ধরনের বুড়ো মানুষকে খুব উদ্বিগ্ন মুখে হেঁটে যেতে দেখল, দেখে মনে হয় কিছু একটা হারিয়ে গেছে। ঠিক ঐ সময় রাস্তার অন্য পাশে আগুনালিকে দেখা গেল, সে জঙ্গল থেকে বের হয়ে হনহন করে হেঁটে আসছে। উদ্বিগ্ন মুখের বুড়ো মানুষটা আগুনালিকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “একটা লাল গাই দেখেছ এইদিকে?”

    আগুনালি থতমত খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ ঐ তো ওখানে ঘাস খাচ্ছে।”

    উদ্বিগ্ন বুড়োর মুখে স্বস্তি ফিরে আসে, সাথে সাথে সে গোরুটাকে উদ্ধার করার জন্যে তাড়াতাড়ি হেঁটে যেতে থাকে। আগুনালি নিজেই যে গোরুটাকে ওখানে নিয়ে গেছে জানতে পারলে মনে হয় বড় ঝামেলা ঘটে যেত।

    রাজু সাগরকে নিয়ে প্রায় ছুটে গেল আগুনালির কাছে। আগুনালি তার শার্টটা পরতে পরতে বলল, “ব্যাপার কেরাসিন!”

    “কেন, কী হয়েছে?”

    “ভিতরে অন্য লোকও আছে।”

    “অন্য লোক? কয়জন? কীরকম লোক?”

    আগুনালি শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে মাটিতে পিচিক করে থুতু ফেলে বলল,”বলছি শোনো।”

    আগুনালি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে না–যেটা আগে বলার কথা সেটা পরে বলে এবং সেটা পরে বলার কথা সেটা আগে বলে ফেলে। যে-কথাটা বলার কোনো প্রয়োজন নেই সেটা অনেক সময় লাগিয়ে বর্ণনা করে। যেমন গোরুটা কী ধরনের ঘাস খেতে পছন্দ করে এবং কেমন করে ঘাস খায় সেটা কয়েকবার বলে ফেলল। তাকে নানাভাবে প্রশ্ন করে শেষ পর্যন্ত রাজু যে-জিনিসটা বুঝতে পারল সেটা এরকম : আগুনালি গোরুটা নিয়ে হেঁটে হেঁটে নাহার মঞ্জিলের ভাঙা দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ভিতরে ঢুকে গিয়ে সামনের ফাঁকা জায়গাতে ঘাস খাওয়াতে খাওয়াতে বাসাটা ভালো করে লক্ষ করছিল। তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই সেটা প্রমাণ করার জন্যে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাসার দরজায় বসে পড়ল, তখন একটা লোক বের হয়ে তাকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বলল। লোকটাকে দেখে মনে হল বাসার দারোয়ান। আগুনালি তখন খুব অবাক হবার ভান করে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, এই বাসায় সে কেমন করে থাকে, কারণ রাত হলেই এখানে ভূত আসে। লোকটা বলল, জিন-ভূত কোনোকিছুই সে ভয় পায় না। আগুনালি তখন জানতে চাইল সে এই বাসায় জিন-ভূত কোনোকিছু দেখেছে কি না, কারণ লোজন বলে রাত হলে নাকি এই বাসা থেকে মেয়েলোকের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়।

    মেয়েলোকের গলার আওয়াজের কথা শুনে লোকটা কেমন যেন ঘাবড়ে গেল, তখন সে জানতে চাইল লোকজন আর কী কী কথা বলে। আগুনালি তখন বানিয়ে বানিয়ে আরও কিছু কথা বলল যেন লোকটা কোনোকিছু সন্দেহ না করে। লোকটা কথাবার্তা বেশি বলতে চায় না, তবু খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেসব কথা বের করেছে তার থেকে মনে হল কাশেম আলি চৌধুরীর ছেলে হাসান আলি চৌধুরী তাদের বাড়িটা ঠিক করার চিন্তাভাবনা করছে, তাই আপাতত এই মানুষটা পাহারা দেয়ার জন্যে এই বাসায় উঠে এসেছে। মানুষটা বলল, এই বাসায় সে একাই থাকে–আর কেউ থাকে না, যেটা পুরোপুরি মিথ্যা কথা।

    রাজু জিজ্ঞেস করল, “কাশেম আলি চৌধুরীর ছেলে কী করে?”

    “জানি না।”

    “বয়স কত?”

    “তাও জানি না।”

    তারা যে-রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল রাস্তাটা মোটামুটি নির্জন, বেশি মানুষের চলাচল নেই। হঠাৎ দেখা গেল, দূর থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে, আগুনালি মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখে কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রাজু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

    “দারোয়ান।”

    “নাহার মঞ্জিলের দারোয়ান?”

    “হ্যাঁ, আমাকে এখন তোমাদের সাথে দেখে ফেলেছে, কিছু একটানা সন্দেহ। করে ফেলে!”

    মানুষটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে, কিছু করার উপায় নেই। তিনজন কিছুই হয়নি এরকম একটা ভাব করে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যেতে থাকে। মানুষটা সরু চোখে তাদের দেখল, এবং হঠাৎ আগুনালিকে চিনতে পেরে কেমন যেন চমকে উঠল। তাকে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই তারা তাড়াতাড়ি হেঁটে সরে গেল। মানুষটা হেঁটে যেতে যেতে একটু পরে পরে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না।

    আগুনালি মাথা চুলকে বলল, “দারোয়ানটা আমাকে চিনে ফেলেছে। ঝামেলা হয়ে গেল।”

    রাজু চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ল। সাগর বলল, “এখন বাসায় কোনো দারোয়ান নেই, গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলতে চাও?”

    রাজু চমকে উঠে সাগরের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “সাগর ঠিক বলেছে। এই সুযোগ!”

    আগুনালি ইতস্তত করে বলল, “কী জিজ্ঞেস করবে মেয়েটাকে?”

    “জিজ্ঞেস করব কেন আটকে রেখেছে, কে আটকে রেখেছে–এইসব।”

    “সত্যি?”

    “সত্যি না তো মিথ্যা? চলো তাড়াতাড়ি যাই।”

    সাগর জিজ্ঞেস করল, “আমরা সবাই যাব?”

    “না। একজন যাব, অন্য দুইজন বাইরে থাকবে, হঠাৎ যদি দারোয়ানটা এসে যায় তা হলে যেন সাবধান করা যায়।”

    সাগর বলল, “আমি যাব, ঠিক আছে?”

    রাজু মাথা নাড়ল, “না সাগর, তুই বেশি ছোট। গিয়ে ঠিক করে কথা বলতে পারবি না।”

    “কে বলেছে পারব না?” সাগর রেগে উঠে বলল, “একশোবার পারব!”

    “ঠিক আছে, পারবি। কিন্তু তুই তো ছোট, মেয়েটা মনে করবে তোর সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই। ছোটদের কেউ বেশি পাত্তা দেয় না। ভিতরে গেলে যাব আমি নাহয় আগুনালি।”

    আগুনালি বলল, “তুমিই যাও–আমি মেয়েদের সাথে ভালো করে কথা বলতে পারি না।”

    রাজু একটু অবাক হয়ে আগুনালির দিকে তাকাল, কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে, আমিই যাব। তাড়াতাড়ি চলো।”

    রাজু আগুনালি আর সাগরকে বাসার কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে রেখে বলল, হঠাৎ করে যদি দারোয়ানটা এসে যায় তা হলে যেন তাকে সাবধান করে দেয়। দারোয়ানটার মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কেমন করে সাবধান করা যায় সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ আলোচনা করে ঠিক করা হল, আগুনালি কোনো কথা না বলে মুখে আঙুল দিয়ে শিষ দেবে–দারোয়ানটা অনেক দূরে থাকতেই যদি শিষ দেওয়া হয় সে হয়তো সন্দেহ করবে না। অনেক দূরে থাকতেই তাকে দেখার জন্যে সাগর রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, দূর থেকে দারোয়ানটা দেখে ফেললে সাগর ছুটে এসে আগুনালিকে বলবে, আগুনালি তখন রাজুকে বিপদ-সংকেত দেবে।

    মোটামুটি সব প্রস্তুতি নিয়ে রাজু সাবধানে নাহার মঞ্জিলে ঢোকে। বাইরে দরজা নেই, একসময়ে ছিল, পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। ভিতরে নানারকম জঞ্জাল, সবকিছু পার হয়ে সে বড় একটা ঘরে হাজির হল। এই ঘরটির এক কোণায় খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে বিছানাপত্র গোটানো আছে। দারোয়ান মানুষটি নিশ্চয়ই রাত্রিবেলা এখানে ঘুমায়। রাজু সাবধানে চারিদিকে তাকিয়ে আরেকটু এগিয়ে যায়। সামনে আরেকটি ঘর, সেখানে থেকে একটা সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। মেয়েটাকে দোতলায় কোনো ঘরে আটকে রাখা আছে, কাজেই রাজু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে।

    সিঁড়িটা জরাজীর্ণ, একসময় নিশ্চয়ই রেলিং ছিল, এখন ভেঙেচুরে গেছে। রাজু সাবধানে দেয়াল ধরে উপরে উঠে যায়। দোতলায় বেশ অনেকগুলি ঘর, বেশির ভাগই ধসে পড়ে যাচ্ছে, শুধু একটি ঘরে নতুন কাঠের শক্ত দরজা লাগানো হয়েছে, সেই দরজায় একটা তালা ঝুলছে। এই ঘরটাতে নিশ্চয়ই মেয়েটিকে আটক রেখেছে, গাছের উপরে উঠে এইদিকেই সে বাইনোকুলার দিয়ে দেখেছিল। রাজু পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তালাটা হাত দিয়ে দেখে, আজগর মামার বাসাতেও ঠিক এরকম তালা। হঠাৎ আর একটা কথা মনে হল, এমন কি হতে পারে–আজগর মামার বাসায় তালার যে-চাবি রয়েছে সেটা দিয়ে এই তালাটা খোলা যাবে? তালাগুলি দেখতে একই রকম, চাবিগুলিও যদি মিলে যায়? রাজুর পকেটেই মামার বাসার তালার চাবিগুলি রয়েছে–সে সাবধানে পকেট থেকে চাবির রিং বের করে সবরকম দোয়া-দরুদ পড়ে তালাটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু তালাটা খুলল না।

    রাজু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এক মুহূর্ত চিন্তা করল, সে কি দরজায় শব্দ করে এখান থেকে মেয়েটার সাথে কথা বলবে? কিন্তু সামনাসামনি একজন আরেকজনকে না দেখে কথা বলাটা রাজুর বেশি পছন্দ হল না। সে হেঁটে পাশের ঘরটিতে গেল, দরজার-জানালা ভেঙে পড়ে আছে, ভিতরে নানারকম জঞ্জাল। সে জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিল, কার্নিস ধরে হেঁটে পাশের ঘরের জানালার সামনে যাওয়া যেতে পারে, পা পিছলে গেলে নিচে পড়ে যাবে, কিন্তু শুধুশুধু তো আর কারও পা পিছলে যেতে পারে না। রাজু কার্নিসে নামার আগে একটু এদিক সেদিক দেখে এল, হঠাৎ করে যদি আগুনালির শিষ শোনা যায় তা হলে ছুটে পালাতে হবে। সামনের দরজা দিয়ে পালানোর সুযোগ হবে না, অন্য কোন দিকে দিয়ে যাওয়া যেতে পারে ভালো করে দেখে রাখল। পুরো বাসটাই একটা ধ্বংসস্তূপের মতো, কাজেই অনেক দিক দিয়ে পালানোর সুযোগ রয়েছে। ইচ্ছে করলে এই কার্নিস ধরে সামনে গিয়েই একটা ভাঙা দেয়াল ধরে নেমে যাওয়া যাবে। জায়গাটা ভালো করে পরীক্ষা করে সে সাবধানে কার্নিস ধরে হাঁটতে থাকে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই জানালা, সে কাছে যেতেই দেখল মেয়েটি

    জানালার শিক ধরে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার, মেয়েটার চোখে একটুকু বিস্ময় নেই, অত্যন্ত শান্ত চোখে সে রাজুর দিকে তাকিয়ে আছে। বাইনোকুলারে মেয়েটাকে যেটুকু সুন্দর মনে হয়েছিল সামনাসামনি সে তার থেকে অনেক বেশি সুন্দর। হঠাৎ দেখল কেমন যেন নিঃশ্বাস আটকে আসে।

    রাজু একটু হকচকিয়ে গেল, তারপর সে এমন একটা ভান করল যেন কার্নিস ধরে হেঁটে হেঁটে এসে তালা দিয়ে আটকে-রাখা একটা মেয়ের সাথে দেখা করা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। সে একটু হাসিহাসি মুখ করে বলল, “আমি রাজু। তোমার নাম কী?”

    মেয়েটা এমনভাবে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল যে তার মনে হল সে তার কথা শুনতে পায়নি। রাজু আবার কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, তখন মেয়েটা বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ, রাজু?”

    “আমি–আমি–মানে আমি দেখতে এসেছি তোমার কোনো বিপদ হয়েছে কি না।”

    “আমার যদি বিপদ হয় তুমি কী করবে?” রাজু একটু থতমত খেয়ে বলল, “তোমাকে সাহায্য করব।”

    “সত্যি?”

    “সত্যি।”

    “আমাকে ছুঁয়ে বলো–” বলে মেয়েটি জানালা দিয়ে তার হাত বাড়িয়ে দিল।

    রাজু কী করবে বুঝতে না পেরে মেয়েটার হাত ছুঁয়ে বলল, “আমি তোমাকে সাহায্য করব।”

    এই প্রথমবার মেয়েটা একটু হাসল, এত সুন্দর মেয়েটা হাসলে আরও অনেক সুন্দর লাগার কথা, কিন্তু মেয়েটির হাসিটি ঠিক স্বাভাবিক ছিল না। হঠাৎ করে রাজুর কেন জানি ভয় করতে থাকে। মেয়েটা তার মুখে হাসিটা ধরে রেখে বলল, “তুমি আমাকে একটা ব্লেড কিনে এনে দেবে?”

    “ব্লেড!” রাজু হতবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “ব্লেড?”

    “হ্যাঁ, আমার কাছে কোনো পয়সা নেই, থাকলে তোমাকে দিতাম। তুমি নিজের পয়সা দিয়ে কিনে আনবে। ঠিক আছে?”

    রাজু কয়েক মুহূর্তে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে ভয়ে ভয়ে বলল, “তুমি ব্লেড দিয়ে কী করবে?”

    মেয়েটা তার হাতের কবজির কাছের অংশটায় আরেক হাত দিয়ে পোঁচ দেওয়ার মতো করে দেখিয়ে বলল, “এইখানে যে-রগটা আছে সেটা কেটে ফেলব।”

    এত সহজ স্বরে কেউ যে-রকম একটা কথা বলতে পারে নিজের কানে না শুনলে রাজু কখনও বিশ্বাস করত না। সে হঠাৎ করে শিউরে ওটে, একধরনের আতঙ্ক এসে তার উপর ভর করে। সে মেয়েটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তখনও সে কথাটা বিশ্বাস করতে পারছে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি এরকম বলছ কেন?”

    মেয়েটা কোনো কথা না বলে আবার হাসল, আর সে-হাসি দেখে রাজু আবার শিউরে উঠল, কোনোমতে বলল, “তুমি বলো তোমার কী হয়েছে, তোমার কী বিপদ? আমরা তোমাকে সাহায্য করব।”

    মেয়েটা মাথা নাড়ল, “আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না।”

    “কেন এরকম বলছ? তোমাকে কে আটকে রেখেছে? তুমি আমাকে বলল আমি পুলিশকে গিয়ে বলব।”

    “পুলিশকে বলবে?”

    “হ্যাঁ। পুলিশ যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে আমি বড় একজন মানুষকে নিয়ে যাব, পুলিশ তখন বিশ্বাস করবে। কে তোমাকে এখানে আটকে রেখেছে?”

    মেয়েটা কোনো কথা না বলে বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। রাগ অভিমান দুঃখ হতাশা সবকিছু মিলিয়ে সেটি ভয়ংকর একধরনের দৃষ্টি। রাজু আবার জিজ্ঞেস করল, “কে?”

    মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার বাবা।”

    রাজু বিস্ফারিত চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাবা?”

    “হ্যাঁ।”

    “তোমার নিজের বাবা?”

    মেয়েটা মাথা নাড়ল। রাজু খানিকক্ষণ হতবুদ্ধির মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারল না–একজন বাবা তার মেয়েকে কেন ধসে যাওয়া একটা বাড়িতে তালা মেরে বন্ধ করে রাখবে! সে মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বাবা কেন তোমাকে আটকে রেখেছে? তোমার মা কোথায়? তোমার মা কেন কিছু বলে না?”

    “আমার মা জানে না আমি কোথায়। বাবা আমাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। জোর করে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে। মেয়েটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার মা নিশ্চয়ই এতদিনে পাগল হয়ে গেছে।”

    “তোমার বাবা কেন তোমাকে ধরে এনেছে?”

    “আমার দাদা ছিল বড় রাজাকার। আমার বাবাও সেরকম। আবার বাবা মনে করে মেয়েদের সবসময় ঘরের ভিতরে থাকতে হয়। তাদের পড়াশোনা করতে হয় না। তাদের যদি বাইরে বের হতে হয়, তা হলে বোরখা পরে মুখ ঢেকে বাইরে যেতে হয়, নাহয় সেইসব মেয়ে দোজখে যায়। আবার বাবা আমাকে মনে হয় খুব ভালোবাসে–একেবারে চায় না আমি দোজখে যাই।”

    মেয়েটা হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। রাজু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কি সত্যিই বলছে, নাকি ঠাট্টা করছে?

    “আমার বাবা আমার মাকে দুচোখে দেখতে পারে না। মাকে এত ঘেন্না করে যে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না। তাই বাবা ঠিক করেছে আমার মাকে শাস্তি দেবে এত কঠিন শাস্তি যেন মা জীবনেও সেই শাস্তির কথা ভুলতে না পারে।”

    “কী শাস্তি? তোমাকে মেরে ফেলবে?”

    “ধুর! সেটা কি বড় শাস্তি হল?”

    “তা হলে?”

    “আমার বাবা আমার জন্য বিয়ে ঠিক করেছে। এইখানে কোনো গ্রামে থাকে অনেক বড় মোল্লা। আগের কয়েকটি বউ আছে। তার সাথে আমার বিয়ে দেবে–”

    “বিয়ে! তোমার! তোমার?” মেয়েটা মাথা নাড়ল। রাজু হতভম্বের মতো বলল, “তুমি তো এত ছোট!”

    “যত ছোট হয় তত ভালো। তা হলে তাদের মনটাকে তাদের জামাইরা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে বদলে দিতে পারে। এই মোল্লার বাড়িতে খুব কঠিন পর্দা, আমি কোনোদিন সেখান থেকে বের হতে পারব না। আমার মা কোনোদিন জানতেও পারবে না আমি কোথায়। আমাকে খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে যাবে, আর আমার বাবা খুশিতে হা হা করে হাসবে।” মেয়েটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার বাবা আসলে একটা পিশাচ। আমার দাদাও পিশাচ ছিল, “আমার বাবাও পিশাচ। আমরা পিশাচের বংশ।”

    রাজু ছটফট করে উঠে বলল, “কিন্তু পুলিশকে বললে পুলিশ এসে তোমাকে উদ্ধার করবে। তোমার মতো ছোট একটা মেয়েকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না। কোনোদিনও পারবে না।”

    “তোমাকে বলেছি না আমার দাদা যেরকম রাজাকার ছিল আমার বাবাও সেরকম রাজাকার? মিডল ইস্ট থেকে বাবার কাছে বস্তা বস্তা টাকা আসে আর আমার বাবা সেই টাকা থেকে বস্তা বস্তা টাকা পুলিশকে দেয়। পুলিশ কখনও বাবাকে কিছু করবে না। কোনো বাবা যদি নিজের মেয়েকে তার সাথে রাখে সেটা কি দোষের কিছু?”

    রাজু কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছু-একটা বলতে গিয়ে আবার সে থেমে গেল।

    মেয়েটা রাজুর চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলল, “কয়দিন থেকে আমার খুব মন-খারাপ ছিল। আজকে সকালে আমার হাত থেকে একটা গ্লাস পড়ে ভেঙে গেল, ভাঙা কাঁচ দেখে আমার হঠাৎ মনে হল, আরে, আমি কেন মন-খারাপ করছি! কাঁচ দিয়ে ঘ্যাঁচ করে হাতের একটা রগ কেটে দেব। কাত করে রাখলে কালির বোতল থেকে যেরকম সব কালি বের হয়ে যায় সেরকম আমার শরীরের সব রক্ত বের হয়ে যাবে। আমার বাবা তার জামাইকে নিয়ে এসে দেখবে তার মেয়ে মরে পড়ে আছে। ভেবেছিল মেয়েকে জোর করে বেহেশতে পাঠাবে, কিন্তু পারবে না, দেখবে মেয়ে দোজখে চলে গেছে। তুমি জান কেউ আত্মহত্যা করলে সে দোজখে যায়?”

    রাজু আর সহ্য করতে পারল না, জানালার শিক ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তুমি চুপ করো, এভাবে কথা বোলো না।”

    “কেন বলব না? সেই থেকে আমার এত আনন্দ হচ্ছে যে, আমি আর হাসি থামাতে পারছি না। নিচের টুকরোটি দিয়ে একটু কেটে দেখেছি, এই দ্যাখো”

    মেয়েটা তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সত্যি সত্যি কবজির কাছে খানিকটা কাটা, রক্ত জমে আছে। মেয়েটা খুশি-খুশি গলায় বলল, “বাবা ভেবেছিল সে মাকে শিক্ষা দেবে–উলটো আমি বাবাকে শিক্ষা দিয়ে দেব!”

    মেয়েটা হঠাৎ অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “শুধু একটা সমস্যা। কাঁচের টুকরো দিয়ে কাটতে খুব ব্যথা লাগে, ব্লেড হলে কী সুন্দর একবারে ঘ্যাঁচ করে কেটে দেওয়া যাবে–তুমি দেবে তো আমাকে একটা ব্লেড এনে? বলে দেবে।

    “না–” রাজু মাথা নাড়ল, “আমি তোমাকে ব্লেড এনে দেব না। আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাব।”

    মেয়েটা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে রাজুর দিকে তাকিয়ে রইল আর হঠাৎ মেয়েটির অপূর্ব সুন্দর দুটি চোখ গভীর বিষাদে ভরে গেল। রাজু দেখল মেয়েটির চোখ হঠাৎ পানিতে ভরে উঠেছে আর সেটা দেখে রাজুর বুকের ভিতরে হঠাৎ এত কষ্ট হতে থাকে যে সেটা বলার মতো নয়। সে জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “তুমি মন-খারাপ কোরো না।

    আমি তোমাকে যেভাবে পারি এখান থেকে নিয়ে যাব। খোদার কসম বলছি!”

    মেয়েটা ফিসফিস করে বলল, “তুমি পারবে না রাজু। কিন্তু তুমি যে বলেছ সেটা শুনেই আমার এত ভালো লাগছে! আমার চারপাশে এখন শুধু খারাপ মানুষ–এত খারাপ যে তুমি চিন্তা করতে পারবে না। তোমাকে যদি ধরতে পারে তা হলে আমার যত বড় বিপদ তোমার তার থেকে আরও বড় বিপদ হয়ে যাবে।”

    “হোক। আমি ভয় পাই না। তুমিও ভয় পেয়ো না। যেভাবে হোক আমরা তোমাকে বাঁচাব-”

    ঠিক এরকম সময় হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ শুনতে পেল। রাজু বাইরে তাকায়, দেয়ালের পাশে আগুনালি দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিছু-একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে। রাজু সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়াল, মেয়েটিকে বলল, “আমাকে এখনই যেতে হবে, “কেউ-একজন আসছে।”

    মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, “যাও। তাড়াতাড়ি যাও।”

    রাজু এক পা গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল, “তোমার নাম কী?”

    “আমার মা আমাকে ডাকে শাওন। আমার বাবা ডাকে ফারজানা।”

    “আমি তোমাকে তা হলে শাওন ডাকব।”

    “ঠিক আছে।”

    রাজু একটু হাসার ভঙ্গি করে দ্রুত কার্নিস বেয়ে ছুটে যেতে থাকে।

    .

    কিছুক্ষণের মাঝেই আগুনালি আর সাগরকে নিয়ে রাজু যখন জঙ্গলের মাঝে লুকিয়ে যাবার জন্যে ছুটে যাচ্ছিল, ঠিক তখন একটা মাইক্রোবাস নাহার মঞ্জিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। মাইক্রোবাসের দরজা খুলে একটা দীর্ঘকায় মানুষ নামল। মানুষটির চেহারা সুন্দর, ফরসা মুখে কালো চাপদাড়ি। চেহারায়, দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একধরনের আভিজাত্যের চিহ্ন রয়েছে, দেখে একধরনের সম্ভ্রম জেগে ওঠে।

    জঙ্গলে গাছের ফাঁক দিয়ে মানুষটিকে দেখে রাজুর ভিতরে অবশ্য কোনো সমবোধ জেগে উঠল না, মানুষটি শাওনের বাবা, কেউ তাকে বলে দেয়নি, কিন্তু তবুও তার বুঝতে কোনো অসুবিধে হল না।

    শাওনের বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত না ভিতরে ঢুকে গেল ততক্ষণ রাজু, সাগর আর আগুনালি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। একেবারে ভিতরে ঢুকে যাবার পর তিনজন চুপিচুপি গাছের আড়ালে আড়ালে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। হেঁটে হেঁটে বেশ অনেক দূর সরে যাবার পর রাজু তার মুখ খুলল।

    রাজুর মুখে পুরো ঘটনাটা শুনে আগুনালি চুপ মেরে যায়, এরকম একটা ব্যাপার যে ঘটতে পারে সে বিশ্বাস পর্যন্ত করতে পারছিল না। শাওনের দুঃখে সাগরের চোখে একেবারে পানি এসে যায়, সে সাবধানে চোখ মুছে বলল, “আমরা এখন কী করব ভাইয়া?”

    “শাওনকে উদ্ধার করতে হবে।”

    “কেমন করে উদ্ধার করবে?”

    রাজু মাথা চুলকে বলল, “এখনও ঠিক করিনি। চল বাসায় গিয়ে দেখি মামা এসেছে কি-না। মামা চলে এলে সবচেয়ে ভালো হয়, তা হলে মামা কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারবে।”

    বাসায় এসে দেখল মামা তখনও আসেননি, বারান্দায় টিফিন-ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে হোটেলের ছেলেটা বসে আছে। খাবার দেখে হঠাৎ তিনজনের একসাথে খিদে লেগে গেল। রাজু চাবি বের করে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তালাটা টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ তার একটা জিনিস মনে হয়েছে, মানুষ কোনো ঘরের তালা খুলে সবসময় তালাটা কি ভিতরে নিয়ে আসে? তা-ই যদি হয় তা হলে সে একটা জিনিস করতে পারে শাওনকে এই তালাটা দিতে পারে, যখন তার বাবা তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তালাটা কোথাও রাখবে, শাওন কোনোভাবে তালাটা পালটে দেবে। তার বাবা কিছু জানবে না, আবার তাকে যখন তালা মেরে রেখে যাবে তখন এই তালাটা দিয়ে তালা মেরে যাবে। যখন আবার বাসায় কেউ থাকবে না রাজুরা গিয়ে তালা খুলে শাওনকে বের করে নিয়ে আসবে।

    পুরো ব্যাপারটা রাজু চিন্তা করে দেখে, যদি শাওন তালাটা পালটে দিতে পারে তা হলে বুদ্ধিটা কাজ করে করার কোনো কারণ নেই। সে ঘুরে আগুনালির দিকে তাকাল। আগুনালির জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

    “শাওনকে এই তালাটা দিতে হবে।”

    “কেন?”

    রাজু তখন পুরো বুদ্ধিটা খুলে বলল, “শুনে আগুনালি মাথা নেড়ে বলল, “ফাস্ট ক্লাস বুদ্ধি, ফাস্ট ক্লাস!”

    রাজু তখনও নাক-মুখ কুঁচকে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। যদি এই বুদ্ধিটা কাজ না করে তা হলে অন্য বুদ্ধি খুঁজে বের করতে হবে।

    টিফিন-ক্যারিয়ার হতে ছেলেটা টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপরে রেখে দেয়। রাজু রান্নাঘরে গিয় কিছু থালাবাসন নিয়ে এসে খেতে বসে।

    খাবারে এখনও অনেক ঝাল–মাছের টুকরো, আলু ডালে ধুয়ে নিতে হল। খেতে খেতে একটু পরেপরেই রাজুর শাওনের কথা মনে পড়ল। বেচারি একা একা ঐ বাসাটায় আটকা পড়ে আছে কে জানে তাকে ঠিক করে খেতে দিচ্ছে কি

    দুপুরে খাবারের পর রোজ তাদের একটু আলসেমি লাগে, সোফায় কিংবা বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আজ অবিশ্যি সেরকম কিছুই হল না, তারা তিনজনই এত উত্তেজিত হয়েছিল যে, একবারও বিশ্রাম করার কথা মনে পড়ল না। বাইরের বারান্দায় তিনজন হাঁটাহাঁটি করতে করতে কীভাবে শাওনকে ছুটিয়ে আনা যায় সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা সোজা নয়, বড় কোনো মানুষের সাহায্য না নিয়ে কীভাবে এটা করা যায় সেটা ভেবে তারা কোনো কূলকিনারা পেল না। সাগর একটু পরে-পরে বলতে লাগল মামার বন্দুকটা নিয়ে গিয়ে গুলি করে শাওনের বাবার বারোটা বাজিয়ে দিতে–সেটা বলা খুব সহজ, কিন্তু বন্দুক দিয়ে সত্যি সত্যি কি আর কাউকে গুলি করা যায়? আজগর মামা সাগরকে যে খেলনা-পিস্তলটা দিয়েছেন সেটা বরং আরও ভালো অস্ত্র, সেটা দিয়ে ভয় দেখানো সোজা। সত্যি সত্যি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে আগুনালি তার আগুনি পাখুনি নিয়ে আসতে পারে, মুখের উপর আগুনের হলকা ছুঁড়ে দিলে মানুষ সাধারণত বাপ-বাপ করে পালায়।

    কী করা যায় সেটা নিয়ে রাজু, আগুনালি আর সাগর আরও ভাবনাচিন্তা করতে লাগল। ঠিক হল বিকেলবেলায় দিকে তারা বের হবে। তার আগে আগুনালি বাড়ি যাবে তার নানারকম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসতে। কিছু নতুন জিনিস তৈরি করার জন্যে কিছু কেনাকাটা আছে, সেজন্যে রাজু তাকে বেশকিছু টাকা ধরিয়ে দিল। আগুনালি ঠিক নিতে চাচ্ছিল না, কিন্তু এখন এসব ব্যাপার নিয়ে আর দ্ৰতা করার সময় নেই।

    সারা দুপুর রাজু বারান্দায় বসে বসে চিন্তা করে কাটাল। যেভাবেই সে চিন্তা করে, কোথাও কোনো কূলকিনারা পায় না। রাজু প্রথমবার আজগর মামার অভাব সত্যিকারভাবে অনুভব করে। যদি এখন আজগর মামা থাকতেন কী সহজেই-না পুরো সমস্যাটার সমাধান করে দিতে পারতেন, তাদের কিছুই চিন্তা করতে হত না। কিন্তু এখন তাদের কিছুই করার নেই–নিজেরা নিজেরা গিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করতেই হবে। যদি ধরা পড়ে যায় তখন কী হবে? শাওন বলেছে তার বাবা নাকি ভয়ংকর মানুষ রাজাকাররা সবসময় ভয়ংকর হয়। একাত্তর সালে সব প্রফেসর ডাক্তারদের নিয়ে ধরে ধরে মেরে ফেলেছিল। যারা প্রফেসর ডাক্তারদের মেরে ফেলতে পারে তারা হয়তো বাচ্চা ছেলেদেরও মেরে ফেলতে পারে। যদি তাদের ধরে ফেলে তখন কী হবে? সাগরকে যদি ধরে ফেলে? রাজু হঠাৎ শিউরে উঠল।

    .

    বিকেলবেলা আগুনালি এসে দেখে রাজু বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ করে বসে আছে। সে রাজুকে খুব বেশি বার গভীরভাবে চিন্তা করতে দেখেনি, তাই তার মুখ দেখে ঘাবড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজু, তোমার শরীর খারাপ করেছে?”

    রাজু চমকে উঠে আগুনালিকে দেখে বলল, “না! শরীর খারাপ হবে কেন?”

    “মুখ দেখে মনে হল–

    সাগর কাছে দাঁড়িয়েছিল। সে মুখ বাঁকা করে বলল, “ভাইয়া সবসময় মুখ এরকম করে রাখে।”

    রাজু রেগে কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল–এখন এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে রাগারাগি করার সময় নেই। সে আগুনালির দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের তালাটা নিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

    “কীভাবে ঢুকবে? দারোয়ানটা যদি থাকে?”

    “কোনোভাবে দারোয়ানটাকে দরজা থেকে সরাতে হবে।”

    “কীভাবে সরাব?”

    ”তুমি তোমার আগুন দিয়ে কিছু-একটা কায়দা-কানুন করতে পারবে না?”

    আগুনালি এক মুহূর্ত চিন্তা করে দাঁত বের করে হেসে বলল, “একশো বার। এমন কায়দা করব দারোয়ানের বারোটা বেজে যাবে!”

    সাগর চোখ বড় বড় করে বলল, “কী করবে তুমি?”

    “চলো, দেখবে সময় হলে।”

    তিনজনের ছোট দলটা আবার রওনা দেয় নাহার মঞ্জিলের দিকে। আগুনালির হাতে একটা বাজারের ব্যাগ, তার মাঝে আগুন লাগানোর নানা ধরনের জিনিসপত্র, কখন কোনটা কাজে লাগবে জানা নেই, তাই পুরো ব্যাগটাই সাথে নিয়েছে। রাজুর পকেটে বাসার তালাটা। মামার আলমারির তালাটা বাসার দরজায় লাগিয়ে এসেছে। তালাটা ছোট, মামার বাসায় চোর-ডাকাত এলে মনে হয় ধমক দিয়েই এ-তালাটা খুলে ফেলতে পারবে, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই।

    তিনজন হেঁটে হেঁটে যখন নাহার মঞ্জিলের কাছে এসে পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যে হয়-হয় করছে। আগুনালি তার ব্যাগটা একটা গাছের গোড়ায় রেখে সেখান থেকে কিছু ন্যাকড়া বের করে একটা লাঠির আগায় প্যাঁচাতে থাকে। তারপর সেটার মাঝে কয়েক ধরনের তেল ঢালে, কোনটা কেরোসিন কোনটা পেট্রোল কোনটা তাৰ্পিন–কোনটা দিয়ে কী হবে সেটা শুধুমাত্র আগুনালিই জানে। তারপর ছোট ছোট বোতলে নানারকম জিনিসপত্র ঢেলে ন্যাকড়া ঢুকিয়ে একধরনের বোমার মতো তৈরি করল। সাথে তার বিখ্যাত আগুনি পাখুনি এবং অনেকগুলি ম্যাচ নিয়ে রওনা হল। ঠিক করা হল আগুনালি দারোয়ানকে বাসার বড় দরজা থেকে সরিয়ে নেয়ামাত্রই রাজু হুট করে ভিতরে ঢুকে পড়বে। সাগরও গোঁ ধরল সে রাজুর সাথে ভিতরে যাবে, তাকে অনেক কষ্টে শান্ত করা হল, বলা হল শাওনকে উদ্ধার করে আনার পর তার ওপর ভার দেওয়া হবে শাওনকে চোখে-চোখে রাখার। রাজু আর আগুনালি এমন একটা ভাব করল যে, সেই ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সাগরের মতো একজন মানুষ ছাড়া সেই কাজটা করা সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত সাগর রাজি হল।

    আগুনালি তার জিনিসপত্র নিয়ে সাবধানে নাহোর মঞ্জিরের দিকে হাঁটতে থাকে, বাসার সামনে মাইক্রোবাসটা নেই, তার মানে শাওনের বাবা আবার চলে গেছে। এখন হয়তো শুধু দারোয়ানটাই আছে বাসার সামনে। ব্যাপারটা তা হলে সহজই হওয়ার কথা।

    আগুনালি গিয়ে বন্ধ দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে থাকে, প্রায় সাথে সাথেই দারোয়ানটা বের হয়ে আসে। আগুনালিকে দেখে মানুষটা খেঁকিয়ে উঠল। আগুনালি অবিশ্যি মোটেও ঘাবড়ে গেল না, গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “দুপুরে আমি একটা গোরু এনেছিলাম, সেটা দেখেছেন?”

    আগুনালির কথা শুনে মানুষটা যত রাগ হল তার থেকে অবাক হল আরও বেশি। আগুনালিকে ধরে প্রায় মার দেয়-দেয় অবস্থা–হাত তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “তোর গোরু আমি কোলে তুলে রেখেছি? বাসার ভিতরে মানুষ গোরু খোঁজ করে শুনেছিস কোনোদিন?”

    আগুনালি উদাস গলায় বলল, “ভাঙা বাড়ি, কোনো ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেছে কি-না কে জানে!”

    মানুষটা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ আগুনালি জিজ্ঞেস করল, “ম্যাচ আছে?”

    “ম্যাচ? ম্যাচ দিয়ে কী করবি?

    “কাজ ছিল–বলে আগুনালি নিজের পকেটে ম্যাচ খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ করে ম্যাচটা পেয়ে যায়। সে ভিতর থেকে একটা কাঠি বের করে এক হাতেই কাঠিটা ফস করে জ্বালিয়ে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়–কাঠিটা যখন নিচের দিকে নেমে আসছে সে তার হাতের মশালটা এগিয়ে দেয় সাথে সাথে দপ করে মশালটা জ্বলে ওঠে। মশালটা সে কী দিয়ে তৈরি করেছিল কে জানে, কিন্তু সেটা একটা ছোট বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে বিশাল একটা আগুনের কুণ্ডলী তৈরি করে দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। দারোয়ান মানুষটা ভয়ে চিৎকার করে পিছনে সরে গেল সাথে সাথে।

    আগুনালি ইচ্ছে করে সেই বিশাল আগুনটি লোকটির নাকের ডগার কাছে ধরে রাখে, মানুষটা কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?

    “আগুন জ্বালালাম।”

    “কেন আগুন জ্বালচ্ছিস এখানে?”

    “অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে–তাছাড়া গোরুটা কোথায় গেল, অন্ধকারে রাস্তা-না হারিয়ে ফেলে!”

    মানুষটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “দূর হ এখান থেকে! দূর হ! পাগলা কোথাকার–”

    আগুনালি দারোয়ানটার গালিগালাজে কান দিল না, খুব ধীরেসুস্থে নিচে নেমে এসে অল্প কিছু দূর গিয়ে মাটিতে মশালটা গেঁথে দিয়ে পকেট থেকে তার বোমাটা বের করে সলতের মতো জায়গাতে আগুন লাগিয়ে সে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয়। খানিকটা উপরে উঠে সেটা নিচে শব্দ করে পড়তেই দপ করে বেশ খানিকটা জায়গায় দাউদাউ করে আগুন লেগে যায়।

    দারোয়ানটা এবারে বাসা থেকে নেমে আগুনালির দিকে চিৎকার করতে করতে তেড়ে গেল, “কী হচ্ছে, কী হচ্ছে এখানে?”

    আগুনালি তার আগুনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “আগুন! আগুন আমার বড় ভালো লাগে!”

    মানুষটা দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “তোর আগুন আমি বের করছি, ব্যাটা পাগল কোথাকার”

    আগুনালি মশালটা হাতে তুলে নিতেই মানুষটা দাঁড়িয়ে গেল, যে অবলীলায় এত বড় বিশাল একটা আগুন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাকে একটু ভয় পেতে হয়।

    রাজু দরজার দিকে তাকাল, মানুষটি দরজা থেকে নেমে নিচে চলে গেছে, তার দৃষ্টি এখন আগুনালির দিকে। এই সুযোগ যে শুট করে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। আগে একবার এসেছে, তাই কোনদিকে যেতে হবে জানে। আবছা অন্ধকার সিঁড়ি ধরে সে উপরে উঠতে উঠতে শুনতে পেল বাইরে বাসার দারোয়ানটা মুখ-খারাপ করে আগুনালিকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।

    দোতলায় একটু হেঁটেই শাওনের ঘরটা পাওয়া গেল। এখনও দরজায় তালা ঝুলছে। রাজু পকেট থেকে তালাটা বের করে মিলিয়ে দেখল। দেখতে হুবহু একরকম। দরজায় টোকা দেবে কি না ভাবল একবার, কিন্তু না দেওয়াই স্থির করে আগের বারের মতো কার্নিস ধরে হেঁটে যেতে শুরু করে। দিনের বেলায় যে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল সেটা বন্ধ। রাজু জানালায় টোকা দিয়ে নিচু গলায় ডাকল, “শাওন!”

    প্রায় সাথে সাথেই শাওন জানালা খুলে দেয়। আবছা আলোয় তাকে অন্য জগতের একজন মানুষের মতো মনে হচ্ছে। জানালার শিক ধরে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “তুমি আবার এসেছ?”

    “হ্যাঁ শাওন। আমি একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে এসেছি। বাইরে দারোয়ানকে আমার বন্ধু ব্যস্ত রেখেছে। সময় বেশি নেই।”

    “কী জিজ্ঞেস করবে?”

    “তোমার ঘরে যখন কেউ ঢোকে তখন বাইরের তালাটা কোথায় রাখে?”

    “খেয়াল করে দেখিনি। শাওন খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “দাঁড়াও মনে পড়েছে, মনে হয় এনে টেবিলের উপরের রাখে–একবার দেখেছিলাম।”

    “গুড! রাজু পকেট থেকে তালাটা বের করে শাওনের হাতে দিয়ে বলল, “এই তালাটা তোমার কাছে রাখো। পরের বার যখন কেউ তালা খুলে ভিতরে ঢুকবে তখন এই তালাটা পালটে দেবে যে মানুষটা বুঝতে না পারে। আমরা এসে তখন এই তালা খুলে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব। পারবে?”

    “জানি না।”

    “তোমাকে পারতেই হবে।”

    শাওন একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “দেখি পারি কি না।”

    “তোমার ঘরের ভিতরে কখন মানুষ আসে?”

    “এই তো একটু পরে খাবার আনবে। তারপর যখন আরও অনেক রাত হয় তখন একবার বের হতে দেয়–আমি তখন ছাদে একা একা হাঁটি।”

    রাজু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমরা দেখেছি।”

    “দেখেছ?”

    “হ্যাঁ তাই তো আমরা জানলাম তুমি এখানে আছ। প্রথমে অবিশ্য ভেবেছিলাম তুমি ভূত।”

    “ভূত?”

    শাওনা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে। রাজু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, এরকম ভাবে থেকেও একজন মানুষ এত সুন্দর করে হাসতে পারে!

    “তুমি যখন ছাদে হাঁট তুমি একা থাক?”

    “হ্যাঁ, কিন্তু সিঁড়িতে দারোয়ান বসে থাকে। আমার বাবা আসে কখনও কখনও।”

    “রাত্রিবেলা তুমি ঘরে বাতি জ্বালাও না?”

    “মাঝে মাঝে একটা হারিকেন দেয়, কিন্তু তখন জানালা বন্ধ রাখতে হয়, যেন বাইরে থেকে কেউ দেখতে না পারে।”

    রাজু কোনো কথা বলল না, একজন মানুষকে অন্য মানুষ কীভাবে এত কষ্ট দিতে পারে? বাইরে দারোয়ান কী করছে কে জানে, কিন্তু এখন বের হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। রাজু নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, “শাওন, এখন যেতে হবে। তালাটা রেখো ঠিক করে। তুমি তালাটা পালটাতে পেরেছ কিনা সেটা বুঝব কেমন করে?”

    “তোমাকে আবার আসতে হবে।”

    “ঠিক আছে, আসব। যাই এখন।”

    “সাবধানে থেকো।”

    রাজু আবার কার্নিস বেয়ে হেঁটে এসে জানালা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল, তারপর পা টিপে টিপে সিঁড়ি ধরে নিচে নামতে থাকে। বাইরে আগুনালি বেশ কয়েকটা আগুন তৈরি করে হাতে মশাল নিয়ে তার সামনে লাফালাফি করছে, আর দারোয়ানটা তাকে ধরার চেষ্টা করছে। অন্য যে-কোনো সময় এরকম একটা দৃশ্য দেখলে হাসিতে তার পেট ফেটে যেত, কিন্তু এখন সবকিছু নিয়ে এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে হাসাহাসির অবস্থা নেই। রাজু খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতেই আগুনালি তার লাফঝাঁপ বন্ধ করে দিল, তাকে নিশ্চয়ই বের হতে দেখেছে। আগুনালি বলল, “যাই আমার গোরু খুঁজে দেখি। ভেবেছিলাম এখানে একটা আগুন করব, কিন্তু করতে দিলেন না।”

    “ভাগ ব্যাটা পাগলা–”

    “পাগল-ফাগল বলবেন না। বেশি ভালো হবে না কিন্তু–”

    “কেন, কী করবি?”

    এই আগুনটা মুখের মাঝে ঠেসে ধরব, একেবারে জন্মের মতো মুখপোড়া বান্দর হয়ে যাবেন।”

    “কী বললি?”

    “বিশ্বাস হচ্ছে না? আসেন কাছে–” বলে আগুনালি লোকটার দিতে এগুতে থাকে–লোকটা কী করবে বুঝতে না পেরে পিছিয়ে আসে। আগুনালি হঠাৎ মশালটা মানুষটির দিকে ছুঁড়ে দিল, লাফিয়ে সরে যেতে গিয়ে মানুষটা খুব খারাপভাবে আছাড় খেয়ে পড়ল, আর সেই ফাঁকে আগুনালি এক দৌড়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

    রাজু আর সাগর একটা গাছের নিচে অপেক্ষা করছিল, আগুনালি ছুটে এসে তাদের সাথে যোগ দেয়। তাদের একটু ভয় হচ্ছিল যে, মানুষটা বুঝি আগুনালির পিছুপিছু ছুটে আসবে। কিন্তু ছুটে এল না, বেকায়দা আছাড় খেয়ে পড়ে খুব খারাপভাবে ব্যথা পেয়েছে। বাসার সামনে আগুনগুলি কোনোভাবে নিভিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থেকে আগুনালি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ফাস্ট ক্লাস! তারপর রাজুর দিকে তাকিয়ে বলল, সবকিছু ঠিক ঠিক হয়েছে?”

    “তা হয়েছে, কিন্তু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”

    “কী ঝামেলা?”

    “আমাকে আবার ঢুকতে হবে।”

    “কেন?”

    “যদি তালাটা বদলাতে পারে তা হলে খুলে শাওনকে বের করতে হবে না?”

    “কিন্তু ঝামেলাটা কী?”

    “শাওন বলেছে এই একটু পরেই নাকি দারোয়ান খাবার নিয়ে যাবে, তখনই যদি তালাটা বদলে দেয় তা হলে তো আমার ভিতরেই থাকা উচিত ছিল। শুধু শুধু বের হলাম। একবারে দুজনে মিলে বের হয়ে আসতে পারতাম।”

    আগুনালি দাঁত বের করে হেসে বলল, “সেটা কোনো সমস্যা না, তুমি যতবার চাইবে ততবার আমি দারোয়ানকে দরজা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাব। আমার উপর কী রকম রেগেছে দেখেছ? এখন আমাকে দেখলেই আমার পিছনে পিছনে ছুটে আসবে।”

    “যদি ধরে ফেলে?”

    “কোনোদিন ধরতে পারবে না। দশ পা দৌড় দিলেই ব্যাটার দম ফুরিয়ে যাবে। শুধু যদি ধরে ফলে, আমার কাছে আছে আগুন পাখুনি। এমন একটা দাগা দিয়ে দেব যে ব্যাটা জন্মের মতো সিধে হয়ে যাবে।”

    রাজু গাছের আড়াল থেকে বাসার ভিতরে উঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল, “সবচেয়ে ভালো হয় যদি কোনোরকম হৈচৈ না করে ঢোকা যায়। বারবার কিছু একটা হৈচৈ করলে সন্দেহ করা শুরু করতে পারে।”

    “তা হলে কীভাবে ঢুকবে?”

    “যখন মনে কর দারোয়ানটা উপরে শাওনের ঘরে খাবার নিয়ে যাবে তখন যদি আমি চুপিচুপি ঢুকে গিয়ে পাশের ঘরে লুকিয়ে থাকি?”

    সাগর ভয়ে-পাওয়া গলায় বলল, “যদি দেখে ফেলে?”

    “দেখবে কেন? দেখবে না। আমি লুকিয়ে থাকব। তবু যদি দেখে ফেলে তা হলে দৌড় দেব। যদি ধরে ফেলে তা হলে আগুনালি তার আগুন পাখুনি নিয়ে আসবে বাঁচানোর জন্য। কী বল?”

    আগুনালি মাথা নাড়ল, একবার দারোয়ান মানুষটিকে ঘোল খাইয়ে তার সাহস অনেক বেড়ে গেছে–সে এখন কোনোকিছুতেই আর ভয় পায় না। রাজুকে বলল, “তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি লোকটা কী করছে, যদি দেখি খাবার নিয়ে ওপরে যাচ্ছে তা হলে ইঙ্গিত করব, তুমি তখন চলে এসো।”

    রাজু বলল, “তোমার জানালার কাছে যেতে হবে না, এখান থেকেই দেখা যাবে, আমাদের কাছে বাইনোকুলার আছে না?”

    “তাই তো! মনেই থাকে না আমার।”

    রাজু চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ঘরের ভিতরে উঁকি দেয়, প্রথমে মনে হয় বেশি অন্ধকার, কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দারোয়ানটা স্পষ্ট হয়ে যায়, উবু হয়ে বসে বসে কিছু-একটা করছে। দারোয়ানটা উঠে দাঁড়াল, হাতে একটা ট্রে-তার মাঝে পানির গ্লাস, একটা প্লেট-তার মাঝে ভাত, সাথে একটা ছোট বাটি। দেখে খুব একটা আহামরি খাবার বলে মনে হচ্ছে না। দারোয়ানটা ট্রে হাতে নিয়ে ভিতরের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।

    রাজু সাথে সাথে বাইনোকুলারটা আগুনালির হাতে দিয়ে বলল, “এক্ষুনি খাবার নিয়ে যাচ্ছে।”

    “সত্যি?”

    “হ্যাঁ, তাকিয়ে দ্যাখো।”

    আগুনালি বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে কিছু দেখতে পেল না। মানুষটা হেঁটে হেঁটে চোখের আড়ালে চলে গেছে। রাজু মাথা নেড়ে বলল, “আমি দেখেছি, ভিতরে গেছে।”

    “তা হলে দেরি কোরো না, এক্ষুনি যাও। জানালা দিয়ে উঠতে পারবে তো?”মনে হয় পারব।”

    “ভিতরে ঢুকে প্রথমে দরজাটা খুলে দেবে। চোরেরা যখন কোনো বাড়িতে চুরি করতে যায় তখন ভিতরে ঢুকে প্রথমেই পালিয়ে যাবার রাস্তাটা ঠিক করে।”

    “আমি কি চুরি করতে যাচ্ছি?”

    “চুরির মতোই। যাও।”

    রাজু অন্ধকার গুঁড়ি মেরে বাসাটার দিকে ছুটে যেতে থাকে। জানালা গলে ভিতরে ঢুকতে বেশি অসুবিধে হল না, তবে দরজাটা খুলতে খুব কষ্ট হল। ছিটকিনিটা ওপরে এবং খুব শক্ত করে লাগানো ছিল। যখন সেটা ভোলার চেষ্টা করছিল তখন শুধু মনে হচ্ছিল হঠাৎ বুঝি দারোয়ানটা এসে যাবে। রাজুর কপাল ভালো দারোয়ানটা এল না। শেষ পর্যন্ত ছিটকিনিটা খুলে পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে এসে শাওনের পাশের ঘর লুকিয়ে গেল। শাওনের সাথে দারোয়ানটা কথা বলছে, তবে ঠিক কী নিয়ে কথা হচ্ছে কিছু বোঝা গেল না। শাওন মনে হল রেগেমেগে কিছু-একটা বলল, দারোয়ানটাও তার উপর কিছু একটা বলল, তারপর মনে হল শাওন আরও রেগে গেল। তারপর অনেকক্ষণ কোনো কথা নেই। কে জানে এখন হয়তো শাওন খাচ্ছে কিংবা মনের দুঃখে কাঁদছে। আসলে কী হচ্ছে বোঝার কোনো উপায় নেই এবং রাজুরও চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। রাজু তাই চুপচাপ বসে রইল। মশাদের মনে হয় রাজুকে পেয়ে খুব আনন্দ হল, পিনপিন করে তারা রাজুকে এসে ছেকে ধরল। শুধু মেয়ে-মশারা কামড়ায়, যদি ছেলে-মশারাও কামড়ানো শুরু করত তা হলে তো বিপদ ছিল। রাজু মশাকে থাবা দিয়ে মারতেও পারছিল না, নিঃশব্দে যে-কয়টাকে তাড়ানো যায়। সে-কয়টাকে তাড়িয়ে কোনোমতে বসে থাকে। মশারা মনে হয় আস্তে আস্তে টের পেয়ে গেল রাজু কাউকে থাবা মারবে না এবং তাদের সাহস আস্তে আস্তে বেড়ে যেতে থাকে–একটা দুইটা মশা নাকের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করল, অনেক কষ্ট করে তখন রাজুকে তার হাঁচি সামলে রাখতে হল।

    এভাবে কতক্ষণ সে বসেছিল তার খেয়াল নেই। সময়টা হয়তো খুব বেশি নয়, টেনেটুনে আধা ঘণ্টাও হবে না, কিন্তু তার মনে হল বুঝি অনন্ত কাল। শেষ পর্যন্ত পাশের ঘর থেকে দারোয়ানটা বের হয়ে দরজায় আবার তালা মেরে থালাবাসন নিয়ে নিচে নেমে গেল।

    রাজু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে পা টিপে টিপে তার লুকানো জায়গা থেকে বের হয়ে আসে। খুব সাবধানে সে শাওনের ঘরের সামনে দাঁড়াল, কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, নিচে থেকে দারোয়ানটা আবার উপরে উঠে আসছে কি না। মানুষটা মনে হয় নিচেই আছে, থালাবাসন ধোয়াধুয়ি করছে। রাজু পকেট থেকে চাবি বের করে তালায় গালাল, তার বুক ধুকধুক করছে, কে জানে শাওন তালাটা পালটাতে পেরেছে কি না!

    চাবিটা ঘোরাতে তালাটা টুক করে খুলে গেল। রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে খুব সাবধানে দরজার কড়াটা সরিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। ঠিক দরজার সামনে বড় বড় চোখে শাওন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে সত্যিই রাজু দরজা খুলে ঢুকেছে। শাওন কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, রাজু তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল। পা টিপে, টিপে সামনে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল, “চলো যাই।”

    শাওন ফিসফিস করে বলল, “কেমন করে যাব?”

    “বাইরে গিয়ে ঠিক করব। চলো।”

    শাওন দুই পায়ে এক জোড়া স্যান্ডেল পরে নিয়ে বলল, “চলো।”

    ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাজু দেখল একটা টেবিলের উপরে এক কাঁদি কলা। কলাগুলি দেখে হঠাৎ সে বুঝতে পারল তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। সে কলার কাঁদিটা হাতে তুলে নেয়। শাওন অবাক হয়ে বলল, “তোমার খিদে পেয়েছে?”

    রাজু একটু লজ্জা পেয়ে গেল, বলল, “এই একটু।”

    “তুমি দাঁড়াও, আমার কাছে বিস্কুটও আছে।”

    “বিস্কুট লাগবে না।”

    শাওন তবু কথা শুনল না, যে-কোনো মুহূর্তে দারোয়ান ওপরে চলে আসতে পারে জেনেও সে তার বিছানার ওপর থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এল। রাজু খুব সাবধানে দরজার পাল্লাটা একটু ফাঁক করে দেয়, তার ভিতর দিয়ে প্রথমে রাজু এবং রাজুর পিছনে পিছনে শাওন বের হয়ে এল। রাজু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করল তালাটা লাগাবে না খোলা রাখবে, মনে হল লাগিয়ে রাখাই ভালো–ভিতরে নেই সেটা জানতে না হলে সময় লাগবে বেশি। সে তালাটা লাগিয়ে দিল।

    ঘর থেকে বের হয়েছে সত্যি, কিন্তু বাসা থেকে এখনও বের হয়নি। সেটা ঠিক কীভাবে করবে সে এখনও জানে না। আগুনালি যতক্ষণ পর্যন্ত একটা কায়দা-কানুন করে দারোয়ানকে দরজা থেকে না সরাচ্ছে, মনে হয় কিছু করার নেই। রাজু ফিসফিস করে বলল, “এই দিকে চলল, এখন লুকিয়ে থাকতে হবে।”

    শাওন ফিসফিস করে বলল, “আমরা বের হব কেমন করে?”

    এখনও ঠিক করিনি। রাজুও গলা নামিয়ে বলল, “বাইরে আমার বন্ধু আছে, সে ব্যবস্থা করবে।”

    “এখন কী করব?”

    “ভিতরে লুকিয়ে থাকতে হবে।”

    “কোথায় লুকাবে?”

    “চলো ঐ পাশে যাই।”

    রাজু শাওনকে নিয়ে বাসার অন্য পাশে চলে এল। একটা ভাঙা দেয়ালের পাশে দুজন গুঁড়ি মেরে বসে। এখান থেকে বাইরে দেখা যায়, আগুনালি সাগরকে নিয়ে সে জায়গায় অপেক্ষা করছে সেই জায়গাটাও মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। যখন সে তার আগুন নিয়ে কিছু একটা কায়দা-কানুন শুরু করবে এখান থেকে সেটা খুব সহজে দেখা যাবে।

    শাওন গলা নামিয়ে বলল, “তোমার কী মনে হয়? আমরা বের হতে পারব?”

    রাজুর বুক ভয়ে ধুকধুক করছে কিন্তু সে সেটা বুঝতে দিল না গলায় জোর এনে বলল, ‘একশো বার।”

    “যদি না পারি?”

    “না পারার কী আছে! সবচেয়ে কঠিন কাজটাই তো হয়ে গেছে!”

    “কোনটা?”

    “তোমার ঘরের তালা খুলে বের করে আনা।”

    “তা ঠিক।”

    রাজু অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে কলার কাঁদিটা বের করে একটা কলা ছিলে খেতে খেতে বলল, “তুমি খাবে একটা?”

    “না। আমি কলা দুচোখে দেখতে পারি না।”

    “তা হলে বিস্কুট খাও।”

    “না, আমার খিদে নেই।”

    রাজু অন্ধকার বসে বসে বিস্কুট আর কলা খেতে থাকে তার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে এরকম অবস্থায় বসে বসে খাচ্ছে! মানুষ ভয় পেলে মনে হয় খিদে পায় বেশি।

    কয়েকটা কলা খেয়ে হঠাৎ রাজু উঠে দাঁড়াল। শাওন জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাও?”

    “এই কলার ছিলকেগুলি ফেলে আসি।”

    “কোথায় ফেলবে?”

    “তোমার জানালার নিচে কার্নিস। তোমার তালা খুলতে না পেরে দারোয়ান নিশ্চয়ই দেখার জন্যে কার্নিস ধরে জানালার দিকে যাবে। যখন জানালার কাছে যাবে তখন ধুড়ম করে আছাড় খেয়ে পড়বে।”

    “সর্বনাশ! উপর থেকে পড়ে যদি মরে যায়?”

    “মরবে না, বেশি উঁচু তো নয়। ব্যথা পাবে। পাওয়া দরকার।”

    রাজু পা টিপে টিপে শাওনের ঘরে গিয়ে জানালা দিয়ে মাথা বের করে কার্নিসে কলার ছিলকেগুলি ছুঁড়ে ফেলল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। হঠাৎ সেখানে এক ঝলক আলো এস পড়ল, আলোটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্যে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই হঠাৎ করে একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেল। সর্বনাশ! নিশ্চয়ই শাওনের বাবা এসেছে।

    রাজু প্রায় ছুটে শাওনের কাছে ফিরে এল, শাওন উঁকি দিকে বাইরে দেখার চেষ্টা করছে। রাজুকে দেখে গলা নামিয়ে বলল, “আমার বাবা এসেছে। এখন কী হবে?”

    রাজু নিজের ভয় লুকিয়ে রেখে বলল, “কী হবে, কিছু হবে না।”

    দুজনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। মাইক্রোবাসটা বাসার সামনে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ড্রাইভার নেমে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। গাড়ির ভিতর থেকে শাওনের বাবা বের হয়ে এল। বাইরে সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। গাড়ির শব্দ শুনে দারোয়ানটাও বের হয়ে এল, মাথা নিচু করে লম্বা সালাম দিল, দু-একটা ছোট কথাবার্তাও বলল, কিন্তু ওপর থেকে ঠিক বোঝা গেল না, শুধুমাত্র ফারজানা নামটা কয়েকবার শোনা গেল। রাজুর হঠাৎ মনে পড়ল শাওনের বাবা তাকে ফারজানা বলে ডাকে।

    শাওনের বাবা ড্রাইভারকে দু-একটা কথা বলে ভিতরে ঢোকে এবং প্রায় সাথে সাথেই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই শাওনের ঘরের সামনে এসে হাজির হবে–তারপর কী হবে? রাজুর বুকের ধুকধুকানি হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সে ঢোক গিলে শাওনের দিকে তাকাল। অন্ধকারে বোঝ যাচ্ছে না, কিন্তু শাওনের মুখও নিশ্চয়ই ফ্যাকাশে হয়ে আছে। শাওনকে না পেয়ে যদি এই বাসায় তাকে খুঁজতে থাকে তারা কতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে?

    রাজু আর শাওন শুনতে পেল শাওনের বাবা আর দারোয়ান ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছে। দারোয়ান নিশ্চয়ই চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করে হঠাৎ আবিষ্কার করেছে তালাটা খুলতে পারছে না। শাওনের বাবা বিরক্ত হয়ে বলল, “কী হল?”

    দারোয়ানটা খুব অবাক হলে বলল, “তালাটা খোলা যাচ্ছে না।”

    “খোলা যাচ্ছে না মানে? ঠিক চাবি ঢুকিয়েছিস?”

    “জি, ঠিকটাই ঢুকিয়েছি, এই দেখেন।”

    “দেখি, আমার কাছে দে।”

    এবারে নিশ্চয়ই শাওনের বাবা খুলতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সেও খুলতে পারছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হঠাৎ মানুষটা রেগে উঠে বলল, “ব্যাটা উলুক, তুই নিশ্চয়ই ভুল চাবি ঢুকিয়ে তালাটা নষ্ট করেছিস।”

    “না হুজুর, আমি ভুল চাবি ঢুকাই নাই–”

    “চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা! বেতমিজ!”

    গালি খেয়ে দারোয়ান মানুষটা একেবারে চুপ করে গেল, আর কোনো কথা বলল না। শাওনের বাবা এবারে শাওনকে ডাকল, “ফারজানা!”

    শাওন হঠাৎ চমকে উঠে রাজুর হাত চেপে ধরল। রাজু ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেয়ো না।”

    শাওনের বাবা আবার গলা উঁচিয়ে ডাকল, “ফারজানা! দু-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে এবারে ক্রুদ্ধ স্বরে চিৎকার করে উঠল, “ফা-র-জা-না!”

    শাওন আবার চমকে উঠে রাজুকে শক্ত করে ধরে রাখল। মেয়েটা কী অসম্ভব ভয় পায় তার বাবাকে! রাজু আবার ফিসফিস করে বলল, “কোনো ভয় নেই শাওন, কোনো ভয় নেই–”

    শাওনের বাবা এবার প্রচণ্ড জোরে দরজায় লাথি দিয়ে বলল, “কথা বল ফারজানা ফারজানা কোনো কথা বলল না এবং হঠাৎ করে দারোয়ানটির দুর্বল গলা স্বর শোনা গেল, বলল, “হুজুর একটা কথা–”

    “কী কথা?”

    “আপা একটা কথা বলেছিলেন–“

    ”কী কথা?”

    “বলেছিলেন গলায় দড়ি দেবেন–”

    “কখন বলেছে?”

    “এই তো মাঝে মাঝেই বলেছেন।”

    শাওনের আব্বা কয়েক মুহূর্তে কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী বলছিস তুই? সুইসাইড করেছে?”

    “করতেও তো পারে! খুব মনের কষ্টে ছিলেন—”

    দরজায় প্রচণ্ড জোরে লাথির শব্দ শোনা গেল। শাওনের আব্বা গলা উঁচিয়ে বলল, “ভাঙ দরজাটা। তাড়াতাড়ি।

    রাজু হঠাৎ বুঝতে পারে তার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বেশি ভয় পেলে ব্যাপারটা কেন হয় কে জানে? এ-যাত্রা বেঁচে গেলে আজগর মামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

    রাজু শাওনের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “যখন দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে যাবে তখন আমরা এখান থেকে বের হয়ে দৌড় দেব।”

    “দেখে ফেলবে না?”

    “দেখলে দেখবে, কিছু করার নেই।”

    রাজু আর শাওন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থেকে শুনতে পায় শাওনের বাবা আর দারোয়ান দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকবার দরজার লাথি দিতেই তাদের বুক কেঁপে উঠছিল। দরজাটা নিশ্চয়ই শক্ত, কারণ অনেক চেষ্টা করেও সেটা ভাঙতে পারল না। দারোয়ানটা বলল, “দরজা খুব শক্ত স্যার। গর্জন কাঠ দিয়ে বানিয়েছে, দুই পাল্লা দিয়েছে–একটা খন্তা হলে সুবিধে হত।”

    “কথা না বলে একটা খন্তা নিয়ে আয়-না কেন?”

    “এই বাসায় তো নাই হুজুর।”

    “নাই? অন্যকিছু নাই?”

    “জি না।”

    “ড্রাইভারকে গিয়ে বল একটা খন্তা আনতে।”

    “জি হজুর।” দারোয়ান চলে যেতে যেতে ফিরে এসে বলল, “জানালা দিয়ে একবার দেখলে হয় না স্যার?”

    “জানালা দিয়ে?”

    “জি।”

    “কেমন করে দেখবি?”

    “এই পাশের ঘর থেকে কার্নিস ধরে যদি যাই।”

    “যেতে পারবি?” দারোয়ানটা বলল, পারব হুজুর।”

    “যা তা হলে।”

    দারোয়ানটা নিশ্চয়ই কার্নিসের ওপর দিয়ে হাঁটা শুরু করেছে। কলার ছিলকেগুলি আছে, সত্যি কি কাজে লাগবে এখন? রাজু নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে এবং হঠাৎ একটা বিকট আর্তনাদ, তারপর ধপাস করে কোনো মানুষের পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল। রাজু হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড!”

    শাওনের বাবা ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”

    বাইরে নিচে থেকে দারোয়ানটির কাতর গলায় স্বর শোনা গেল, কিছু একটা বলছে, এখান থেকে ঠিক শোনা যাচ্ছে না। শাওনের বাবা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “আহাম্মক কোথাকার! এখন মাজা ভেঙে আমাকে ঝামেলায় ফেলবি?”

    রাজু আর শাওন কান পেতে থাকে, শাওনের বাবা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে, নিশ্চয়ই পিছনে গিয়ে দারোয়ানটাকে দেখতে তার কী অবস্থা। ড্রাইভারও নিশ্চয়ই যাবে–এই সুযোগ!”

    রাজু শাওনকে বলল, “চলো যাই।”

    “এখন?”

    “হ্যাঁ, যদি দেখে ফেলে ভয় পেয়ো না–চোখ বন্ধ করে দৌড়াবে। জঙ্গলে আমার জন্যে আগুনালি অপেক্ষা করছে–দরকার হলে ফাঁইট দেবে।”

    শাওন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে অপেক্ষা করছে?”

    “আমার বন্ধু আগুনালি। একটু পরেই দেখবে। চলো যাই।”

    “চলো।”

    কয়েক মুহূর্ত পরে দেখা গেল রাজু আর শাওন দরজা খুলে ছুটতে ছুটতে জঙ্গলের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

    শাওনের নিশ্চয়ই দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, জঙ্গলের আড়ারে গিয়ে সে রাজুকে ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “ওফ, মারা যাচ্ছি একেবারে!”

    রাজু খুশিতে হেসে ফেলে বলল, “না শাওন, তুমি আর মারা যাবে না। তোমাকে আমরা উদ্ধার করে এনেছি।”

    রাজুর কথা শেষ না হতেই হঠাৎ করে আগুনালি আর সাগর হাজির হল। শাওন ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “কে? কে তোমরা?”

    রাজু বলল, “ভয় নেই শাওন। এই হচ্ছে আগুনালি আর এই ছোটজন সাগর, আমার ভাই।”

    সাগর বলল, “ভাইয়া বলেছে তুমি নাকি দেখতে খুব সুন্দর। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।”

    রাজু লজ্জা পেয়ে বলল, “চুপ কর গাধা!”

    সাগর বলল, “তুমি বলনি? একশোবার বলেছ–”

    আগুনালি রাজুকে উদ্ধার করল। বলল, “এখানে দেরি করে লাভ নেই, তাড়াতাড়ি চললা বাসাই যাই। যদি দেখে ফেলে বিপদ হবে।”

    “হ্যাঁ, চলো যাই। রাজু মাথা নাড়ল, “চলো। যেতে যেতে তোমাদের বলি কী হয়েছে?”

    আগুনালি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ও! যা ভয় পেয়েছিলাম সে আর বলার মতো না! কাল সকালেই একটা মুরগি ছদকা দিতে হবে।”

    সাগর জিজ্ঞেস করল, “মুরগি ছদকা দিলে কী হয়?”

    “বিপদ কেটে যায়।”

    ১৬৯

    “বিপদ তো এখন কেটে গেছে, এখন তা হলে কেন দেবে?”

    রাজু বলল, “চুপ কর তো সাগর, খালি ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না।”

    অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সাগর সত্যি চুপ করে গেল।

    কিছুক্ষণ পর দেখা গেল দুটি কিশোর আর একটি শিশু অপূর্ব সুন্দরী একটা কিশোরীকে নিয়ে চাঁদের আলোতে হেঁটে যাচ্ছে। যেতে যেতে নিচু গলায় কথা বলছে রাজু। হঠাৎ করে তার মনে হচ্ছে সে বুঝি আর ছোট নেই, সে বুঝি অনেক বড় হয়ে গেছে। বুকের ভিতরে হঠাৎ সে আশ্চর্য একধরনের অনুভূতি অনুভব করতে থাকে, যার সাথে তার আগে কখনও পরিচয় হয়নি। চাঁদের আলোয় সে একটু পরেপরে শাওনের মুখের দিকে তাকায় আর সাথে সাথে আবার তার বুকের ভিতরে কেমন যেন করতে থাকে।

    একটি মানুষ দেখতে এত সুন্দর কেমন করে হতে পারে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরাতুলের রাত রাতুলের দিন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article বুবুনের বাবা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }