Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রাতের পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প178 Mins Read0
    ⤷

    ১ মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি

    রাতের পাখি – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

    বহুদিন থেকে মৃত্যুর মন্থর পদধ্বনি শোনা যাচ্ছিল দূরবর্তী বলদের গলার ঘণ্টাধ্বনির মতো। যেন নিয়ে যাবার গাড়ি আসছে প্রস্তুত হয়ে, সময় হাতে থাকার অলস মন্থরতায়।

    হঠাৎ হঠাৎ কোনও এক সময় সে ধ্বনি অস্পষ্ট হয়ে গেছে, মনে হয়েছে বুঝি থেমে গেল। হয়তো ও গাড়ি আর আসবে না, ভুল রাস্তায় আসছিল ভেবে ফিরে গেছে। আবার হঠাৎ একদিন শোনা গেছে। সেই আওয়াজ, দ্রুত স্পষ্ট। যেন অনেক ক্ষণের শিথিলতার ক্রটি সামলে নিচ্ছে।

    এরা তখন অনিবার্যের আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠছে, ভয় পেয়েছে, দরজায় মুখ বাড়িয়ে দেখেছে, কিন্তু চাকার ধুলো ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি।…

    ক্রমশ এরা উদ্বিগ্ন হওয়ার অভ্যাসটা ছেড়েছে। রাত্রে উৎকর্ণ হয়ে থাকতে ভুলে গেছে। নিশ্চিন্ত জেনে নিয়েছে সকালে ঘুম ভেঙে উঠে চিরস্থায়ী ওই দৃশ্যটা দেখতে পাবেই। দেখতে পাবে, সামনের ওই ঘরটায় উঁচু পালঙ্কের উপর ফরসা ধবধবে বিছানায় বালিশে কনুই ঠেকিয়ে আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন প্রিয়মাধব। দৃশ্যটা যেন অনন্তকালের পৃথিবীরই একটা অচ্ছেদ্য অংশ।

    প্রিয়মাধব পালঙ্কের উপর আধবসা হয়ে শুয়ে আছেন। প্রিয়মাধবের সেই পালঙ্কের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা ফরসা তোয়ালে ঝোলানো আছে, আর প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল আছে যার উপর থরে থরে সাজানো আছে শিশি বোতল কৌটো। প্রিয়মাধবের খাটের নীচের দিকে একটু তফাতে দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা মাঝারি মাপের জালের আলমারি আছে, তার মাথার উপর প্রিয়মাধবের খাবারের প্লেট, গ্লাস, চামচ, ফিডিংকাপ, জল রাখবার কাঁচের জার সাজানো আছে, আর তার ভিতরে প্রিয়মাধবের মজুত করা খাদ্যবস্তু আছে। জানা কথা, ওটা হাতড়ালে আচার আমসত্ত্ব থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি অন্তত একশো জিনিস মিলতে পারে।

    প্রিয়মাধবের পালঙ্কের ওধারে দুটো জানলার মাঝখানে একটা আলনা আছে, তার গায়ে প্রিয়মাধবের জামা কাপড় গেঞ্জি গোছানো আছে, কোণের কোনাচেগড়ন বুকসেলফটায় কয়েকখানা মোটা-সোটা ভারী বাঁধাই ইংরেজি বই আছে, যার মলাটের নামটা একসময় সোনার জলে লেখা ছিল, এখন বিবর্ণ আর অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

    এ ছাড়াও প্রিয়মাধবের ঘরে একটা ছোট্ট স্টিলের লকার’ আছে, যার চাবিটা এখনও প্রিয়মাধবের আয়ত্তে। আর একটা বেতের চেয়ার আছে, যেটায় তাঁর নার্স বসে। প্রিয়মাধব কত কত কাল যেন মাটিতে পা ঠেকাননি, তবু তাঁর খাটের পায়ের কাছে পাপোশের উপর এক জোড়া চটিজুতো সাজানো আছে।

    প্রিয়মাধবের ঘরের এই দৃশ্যের পরিবর্তন নেই, ঘরের কোনও জিনিস এক ইঞ্চি এদিক-ওদিক করতে দেন না প্রিয়মাধব। শুধু খুব ভোরবেলায় এ-ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালে দেখা যায় ওঁর ওই ওষুধের টেবিলের কাছে একটা টুল পড়েছে। এবং তার উপর বড় একটা এনামেলের গামলা বসানো হয়েছে প্রিয়মাধবের মুখ ধোওয়ার জন্যে।

    নার্স মুখ ধুইয়ে দিয়ে সেটা সরিয়ে নিয়ে যেতে এক মিনিট দেরি করলেই প্রিয়মাধব বিদ্রুপের গলায় বলেন, নার্স, এই দৃশ্যটা কি তোমার খুব সুন্দর বলে মনে হচ্ছে? নার্সের একটা নাম আছে, সেটা এমন কিছু দুরুচ্চাৰ্য নয়। নিজে সে অনেকবার বলেছে, আপনি আমায় নীহার বলেই ডাকবেন। প্রিয়মাধব সে অনুরোধ রাখেননি। ওই বিদ্রুপের ভঙ্গিতেই বলেছেন, চিরকাল তুমি আমার পরিচর্যা করবে এ গ্যারান্টি দাও তো নামটা মুখস্থ করার কষ্ট স্বীকার করি। ছমাস পরে আবার কে আসবে, আবার আমি তার নাম মুখস্থ করতে বসব, ঝুটমুট অত খাটতে পারব না।

    নার্স অবশ্য চিরকালের গ্যারান্টি দেয়নি। অতএব নার্সই বহাল আছে। ছেলের কাছে এ গল্প করে হেসেছেন প্রিয়মাধব। বলেছেন, মেয়েমানুষ জাতটার এই এক দোষ বুঝলি, কিছুতেই কোনও একটা সম্পর্ক না পাতিয়ে স্বস্তি পায় না। যেই আমি নাম ধরে ডাকতে শুরু করব, ও-ও তক্ষুনি মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকতে শুরু করবে নির্ঘাত। কী কাজ বাবা আমার অত ঝামেলায়?

    প্রিয়মাধবের ছেলে অরুণমাধব অবশ্য ওই ডাকটাকে খুব একটা ঝামেলার ব্যাপার বলে ভাবেনি। নীহারের মতো একটি সভ্য-ভব্য ভদ্র মেয়ে যদি প্রিয়মাধবকে মেসোমশাই কি কাকাবাবু ডাকে, সেটা খুব একটা বিরক্তিকর বলেও মনে হয়নি তার। তবু সে বাবার কথার প্রতিবাদ করেনি, শুধু বাবার এও একটা বাতিক ভেবে মৃদু হেসেছিল।

    এ ঘরে, নিজেদের দিকে তারা নীহারকে বাড়ির অতিথির মতোই স্নেহ সম্মান দেয়, তার সঙ্গে ভালভাবে কথা বলে, কিন্তু বাবার ঘরে নীহার সম্পর্কে নির্বিকার থাকতে হয়। অনেক সময় মিথ্যা ধমকের ভানও দেখাতে হয়। হয়তো বলতে হয়, এ কী? বিছানার চাদরটা কি আজ পালটানো হয়নি? ফ্রেশ দেখাচ্ছে না তো? অথবা, কী আশ্চর্য, ফলগুলো অমন খোলা ফেলে রেখেছেন কেন? এই এক গাফিলি আপনাদের!

    এটা নীহারেরই শিক্ষা।

    নীহারই বলে রেখেছে, বকবেন, ওঁর সামনে আমাকে খুব বকবেন। এটা ওঁর ওষুধের কাজ করবে।

    অরুণমাধবের বউ উত্তরা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন বলুন তো?

    তাই হয়।নীহার হেসে বলেছিল, বেশি দিন বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে মানুষের মেজাজ তিক্ত হয়ে ওঠে। আর তার উপরই সব থেকে বেশি রাগ হয়, যে এই অসহায় অবস্থার সাক্ষী। অতএব সবাই মিলে তাকে বকছে গাল দিচ্ছে, এটা দেখতে ভাল লাগে।

    উত্তরা নিশ্বাস ফেলে বলে, কী জানি বাবা!

    নীহার হেসে বলে, আমরা জানি। দেখে দেখে অভ্যাস তো, তা ছাড়া পড়েও তো আছেন কম দিন নয়।

    না, কম দিন নয়।

    উত্তরার বিয়ের পর বছরখানেক মাত্র শ্বশুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে উত্তরা। আবার খুব বেশিরকমই দেখেছে। সেই বয়েসে তখনও যেন ইয়ংম্যান। ছেলের চাইতে এনার্জি বেশি, খাওয়া বেশি, কর্মক্ষমতা বেশি। শাশুড়ি ছিলেন, তাঁর সঙ্গে প্রেমের নিবিড়তাও কম দেখেনি। আদৌ কর্তা-গিন্নির মতো নয়, যেন তরুণ-তরুণী।

    সহসা একদিন অকস্মাৎ ঘটে গেল বিপর্যয়। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন প্রিয়মাধব। দুটো সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে উঠে এসেই পড়লেন অজ্ঞান হয়ে। সহজে ভাঙল না।

    তোলপাড় পড়ে গেল। ডাক্তারে বাড়ি বোঝাই হল, তাঁরা রায় দিলেন, কারণটা রক্তচাপ বৃদ্ধি। তলে তলে কখন শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্ত মস্তিষ্কের কোষে কোষে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, আর নামতে পারেনি। কখন হয়েছে কে জানে সে খবর। প্রিয়মাধব নিজেও তো টের পাননি।

    তদবধি প্রিয়মাধবের ওই পালঙ্কশয্যা।

    ওই এক দৃশ্য।

    শুধু তখন নীহারের জায়গায় ছিলেন শাশুড়ি সুমিতা। স্বামীসেবার এমন গভীর বেদনাময় রূপ কদাচ দেখা যায়। প্রতিটি মুহূর্তের সতর্কতা দিয়ে ঘিরে রাখতেন তিনি স্বামীকে, প্রতিটি পলক ফেলতেন উল্কণ্ঠার দৃষ্টি নিয়ে।

    নিজের নাওয়া খাওয়া ঘুম গেল ভদ্রমহিলার। একটা সেবার যন্ত্রের মতো হয়ে যেতে লাগলেন ক্রমশ।

    অরুণমাধব কত অনুযোগ করেছে, মা, তুমিও কি বিছানায় পড়তে চাও?

    সুমিতা বলেছেন, পড়ে যদি উঠতে না হয় এক্ষুনি পড়তে চাই বাবা!

    তা হলে তো তুমি খুব স্বার্থপর মা! বাবাকে যে এত সেবা করছ সবই ভুয়ো।

    তুই তো আছিস সেবা করতে, বলতেন সুমিতা। আর বলতেন, আর ভুয়ো তো সবই রে, কোনটা ভুয়ো নয়? তুই ঠিকই দেখবি বরং—

    মার উক্তিতে মাঝে মাঝেই এমন দার্শনিক স্পর্শ থাকত। অরুণ আমল দিত না। বলত, তোমার কাছে আমি? যাই বলল মা, নিজেকে এমন অযত্ন করাটা খুব অন্যায় হচ্ছে তোমার। বাবার জন্যেই। নিজেকে খাড়া করে রাখতে হবে তোমায়।

    এ রকম কথায় হঠাৎ হঠাৎ ভারী অদ্ভুতভাবে হাসতেন সুমিতা। বলতেন, তাই তো রেখে এলাম রে এ-যাবৎ।

    অরুণ মার ওই হাসি দেখে অবাক হত।

    অরুণমাধব ভেবে পেত না, এ-যাবৎ খাড়া থাকবার মানেটা কী? বাবাই তো এত বেশি খাড়া ছিলেন যে যুবকপুত্র অরুণই যেন মূল্যহীন হয়ে পড়ত।

    সুমিতা তাঁর ছেলের সাবধানবাণীতে কান দেননি। সুমিতা তিল তিল করে ক্ষয় করেছিলেন নিজেকে। প্রিয়মাধবের অসুখে পড়ার তিন বছরের মাথায় মারা গিয়েছিলেন সুমিতা।

    খুব একটা কিছু অসুখ করল না, বিছানাতেও পড়লেন না বেশি দিন। দিন চার-পাঁচের জ্বরে মারা গেলেন। প্রিয়মাধবের ওঠবার ক্ষমতা ছিল না। প্রিয়মাধব পাথরের মতো বিছানায় পড়ে থাকলেন। পাশের খাট থেকে তাঁর চিরদিনের সঙ্গিনীকে আলতা-সিঁদুর পরিয়ে চিরদিনের মতো নিয়ে যাওয়া হয়।

    উত্তরা তখনও প্রায় নতুন বউ-ই, অত কিছুই জানত না।

    নিরুপায় হয়ে নিজের মাকে আনিয়েছিল শাশুড়ির অসুখের সময় থেকেই। তিনিই আলতা আনালেন, সিঁদুর আনালেন, চওড়া লাল পাড় গরদের শাড়ি আনালেন, আর সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন, দেখুন সবাই, ভাগ্যটা দেখুন। ওই অনড় স্বামীকে রেখে সতীলক্ষ্মী স্বর্গে গেলেন।

    অবশ্য যাদের শোনালেন, প্রায় সকলেই তারা পাড়াপড়শি বন্ধু। আত্মীয় খুব কমই আছে প্রিয়মাধবের, সুমিতার দিকে তো আদৌ ছিলই না। মা নেই বাপ নেই। একটা যমজ বোন ছিল, তাও অল্প বয়েসে বিধবা, সেও কোনকালে মারা গিয়েছিল। সুমিতার কাছেই নাকি মারা গিয়েছিল নমিতা। যমজের হিসেবে এক ঘণ্টার ছোট বোন সুমিতার। প্রিয়মাধব তখন চা বাগানের ম্যানেজার, আসামের এক চা-বাগানে থাকেন।

    সুমিতা বলেছিল, শ্বশুরবাড়িতে নমিতার কষ্টের সীমা নেই। শাশুড়ি অপয়া বলে গঞ্জনা দেয়, আর দেওররা ওর বিষয়-ভাগ ঠকিয়ে নেবার তালে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যন্ত্রণা দেয়। তুমি যদি ওর বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারটা বুঝেপড়ে দেওরদের থেকে আলাদা করে নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চলো, বেঁচে যায় বেচারা। কিছু যদি কমও পায়, তাই পাক। আমাদের তো অভাব নেই?

    প্রিয়মাধব বলেছিলেন, আমরা নিয়ে যেতে চাইলে ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে রাজি হবে কেন?

    সুমিতা রাগ করেছিল।

    বলেছিল, রাজি হবে কি হবে না সে কথাও ভাবতে হবে কেন? আছে কে সেখানে? শশুর না, ভাশুর না, পাজি দুটো দেওর আর নিষ্ঠুর এক শাশুড়ি। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েই চলে আসবে। আমি ছাড়া আপন বলতে ওর কে আছে বলো?

    বাপের বাড়ির দিকে টানের বলতে সুমিতারও তত আর কেউ ছিল না, বোন বলে খুব একটা মায়া ছিল।

    নমিতার দেওররা নমিতাকে বিষয়ের ভাগ দেবার জন্যে উদগ্রীব ছিল না। সামান্য একটা থোক টাকা দিয়ে ওর ভাগটা লিখিয়ে নিয়েছিল। এবং বেপরোয়া গলায় হেসে প্রিয়মাধবকে বলেছিল, নিয়ে যান না মশাই, আমরা তো বেঁচে যাই। রাতদিন আমার বুড়ো মায়ের সঙ্গে অশান্তি করছেন।

    প্রিয়মাধব রেগে বলেছিলেন, অশান্তি করছে নমিতা? অশান্তি করবার মেয়ে ও?

    দেওর আরও অসভ্য হাসি হেসেছিল, দেখবেন গিয়ে কেমন মেয়ে। ঘর করে দেখবেন। ডাইনে-বাঁয়ে চিনির নৈবেদ্য নিয়ে চলেছেন যখন।

    লোকটার ওই দাঁতের উপর একটা ঘুষি বসিয়ে সব কটা দাঁত ভেঙে দেবার ইচ্ছে সংবরণ করে চলে এসেছিলেন প্রিয়মাধব।

    নমিতার যতদিন বিয়ে হয়নি, আর নমিতা যে কদিন সধবা ছিল, প্রিয়মাধব নিজেই এ-ঠাট্টা করতেন। হেসে হেসে বলতেন, তোমরা কদাচ দুজনে একরকম শাড়ি পোয়রা না বাপু! আমি হঠাৎ গুলিয়ে ফেলতে পারি। বলতেন, তোমাদের দুই বোনকে নিয়ে কোথাও যাওয়া আমার বিপদ, লোকে ভাববে ডাইনে-বাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি নিয়ে চলেছে লোকটা, বেড়ে ভাগ্যখানা তো!

    কোথাও যাওয়া ব্যাপারটা সুমিতার সঙ্গেই হত নমিতার, কুমারী থাকতে, বিয়ে হয়েও। নমিতার উকিলবর বেজায় গম্ভীর গম্ভীর ছিল। তা ছাড়া এক ঘণ্টার দিদি হয়েও সুমিতা সত্যিই বড় বোনের মতো স্নেহময়ী ছিল। কোনও আমোদ-আহ্লাদ একা ভোগ করে সুখ পেত না।

    সিনেমা-থিয়েটারে নিয়ে যাবে বলে নিজে গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে নমিতার বরের অনুমতি আদায় করে নমিতাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তখন প্রিয়মাধবের চা বাগানের চাকরিটা হয়নি। কলকাতাতেই কোথায় যেন কাজ করতেন।

    অসম্ভব স্ফুর্তিবাজ, অসম্ভব প্রাণ-চঞ্চল, আর অসম্ভব শক্তিমান প্রিয়মাধব দুই বোনকে একসঙ্গে দুহাতে তুলে ফেলতে পারতেন কোমর ধরে।

    নমিতা হাত পা ছুঁড়ে নেমে পড়ে বলত, দিদি না হয় আপনার বউ, ওকে বাঁদর-নাচ নাচাতে পারেন, আমায় কেন?

    প্রিয়মাধব বলতেন, দিদি বউ, তুমি মউ! জানো না, ফাউয়ের তুল্য মিষ্ট বস্তু নেই? শালি হচ্ছে সেই ফাউ। তায় আবার যমজা।

    কিন্তু নমিতা বিধবা হবার পর সেই চাপল্য সংবরণ করেছিলেন প্রিয়মাধব। দুই বোনের একরকম সাজের প্রশ্নও ওঠেনি। সেই বয়েসেই সব রং মুছেছিল নমিতা, সব বাহুল্য বর্জন করেছিল। চিরকালের বিধবার সাজে সেজেছিল।

    সুমিতা কেঁদে ফেলে বলেছিল, হেমন্তকে তো তুই এত ভালবাসতিস না নমু যে, তার জন্য সর্বত্যাগিণী হবি। আমি তো জানি ওর প্রতি ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না তোর।

    নমিতা হেসে বলেছিল, তার জন্যে সর্বত্যাগিণী হচ্ছি, এমন মিছে কথা তোমাকে কে ভাবতে বলেছে? ত্যাগ করেছি ধিক্কারে। সমাজ যদি ওই সবটা কেড়েই নিচ্ছে, তার থেকে সামান্য একটু হাতে রাখবার জন্যে আবার কাড়াকাড়ি করব কোন ঘেন্নায়? ভাল শাড়ি পরলে তো বলবে অনধিকার চর্চা!

    তোর বয়েসে কে কবে কোথায় থান পরে? ওটা অসহ্য নমু!

    নমিতা বলেছে, আমার আরও অসহ্য দিদি, থানের পাশে পাড়ের এক ফালি ক্যারিকেচার। সেটা আরও করুণ। আরও দৈন্যের।

    হ্যাঁ, দিদিই বলত নমিতা তার একঘণ্টার বড় বোনকে। ছেলেবেলায় তাই শেখানো হয়েছিল ওকে। পিসি বলেছিল, তা হোক, একটুও ছোট বড় তো। ওতেই সম্পর্ক ঠিক করতে হয়।

    মা ছিল না। শৈশবের যা-কিছু শিক্ষাদীক্ষা সবই পিসির কাছে।

    কিন্তু শিক্ষাদীক্ষা কথাটার কি সত্যিই কোনও অর্থ আছে? দুটো সম্পূর্ণ একই বয়েসের মেয়েকে, একই পরিবেশে, একই শিক্ষায় শিক্ষিত করে, একই রকম কি গড়তে পেরেছিল পিসি?

    পারেনি।

    সুমিতার আর নমিতার আকৃতি এক ছিল। প্রকৃতি এক ছিল না। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতি নিয়ে গড়ে উঠেছিল নমিতা, সুমিতার সঙ্গে এক থালায় খেয়ে, এক বিছানায় শুয়ে।

    সুমিতা ছিল প্রত্যেকটি বিষয়ে অপটু, নমিতা সব বিষয়ে পটু।

    সুমিতা মৃদু, নমিতা প্রখরা।

    সুমিতা অবোধ, নমিতা তীক্ষ্ণবুদ্ধি। সুমিতা স্নেহময়ী, নমিতার শরীরে মায়ামমতার বাহুল্য নেই।

    এক ঘণ্টার বড় হয়েও সুমিতা বড়দিদি, এক ঘণ্টার ছোট হয়েও নমিতা ছোট বোন।

    সুমিতা শান্ত স্তিমিত, নমিতা উজ্জ্বল অস্থির। নমিতার দেওর তাই বলেছিল, নিয়ে যান না, আমরা তো তা হলে বাঁচি।

    .

    বিধবা হয়ে নমিতা অনেক শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবু ওর শাশুড়ি ওকে দেখতে দেখতে রাতদিন অশান্তিতে জ্বলেপুড়ে মরত।

    বলত, এই আগুনের খারা চিরদিন বুকে বয়ে মরতে হবে আমাকে।

    নমিতা শুনে হাসত। আর সুমিতা প্রিয়মাধবের কাছে চোখের জল ফেলত।

    এই সময় হঠাৎ প্রিয়মাধবের চা বাগানের কাজটা হল। অভাবিত, অপ্রত্যাশিত। তবু ভাগ্যের এই দানকে সুমিতা প্রসন্নমনে নিতে পারেনি। বলেছিল, আমি অতদূরে চলে গেলে নমুকে ওরা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে।

    অবশেষে ওই প্রস্তাব। নমিতাকে নিয়ে যাবে সুমিতা।

    ওরা রাজি হল।

    নমিতার শাশুড়ি বলল, চোখের আড়ালে গিয়ে যা-খুশি করগে মা, আমার হাড়ে বাতাস লাগুক।

    তা বোনকে কাছে নিয়ে গিয়ে সুমিতারও হাড়ে বাতাস লাগল। সর্বদা নমু নমু করার দুর্ভাবনাটা গেল। স্নেহের বস্তুকে একান্ত কাছে রেখে ঠাণ্ডা হল। তা ছাড়া, ওই জনবিরল চা বাগানে বাঙালি বলতে অনেক দূরের মধ্যে কেউ ছিল না। প্রিয়মাধব তো নতুন দায়িত্বের কাজে মশগুল। কথা বলতে নমিতা, সঙ্গী বলতে নমিতা। কদাচ কখনও দূর থেকে কোনও বাঙালি পরিবার বেড়াতে আসত। বলত, খুব ভাগ্যে বোনটি পেয়েছেন বাবা! সঙ্গী তো বটেই, তা ছাড়া উনিই তো দেখছি সংসার মাথায় করে রেখেছেন।

    নমিতার বৈধব্যটাকে সুমিতার ভাগ্য হিসেবেই গণ্য করত ওরা। বলবার সময় সেটা সামলাতে মনে থাকত না। সুমিতা অপ্রতিভ হত, সুমিতা অন্য কথা পাড়ত।

    তারা চলে গিয়ে আড়ালে বলত, বোনের প্রতি ভাবটা দেখেছ? ঠিক ঝিয়ের মতো। ওকে একটু ভাল বলাটাও সহ্য হয় না। যমজ বোন, তাকে কী সাজিয়ে রেখেছে দেখো? হলই বা বিধবা, এখানে আর কে অত দেখতে আসছে?

    হয়তো বা বলত, কারণটা বুঝছ না? পাছে বরের দৃষ্টিপাত পড়ে যায়। অবশ্য তা নিয়েও হাসাহাসি করত।

    বলত, দৃষ্টিতে তো নতুন কিছু পড়বে না? একই মূর্তি, আলাদা আকর্ষণ আসবার কারণ নেই।

    বলত। বেরিয়ে গেলেই বলত।

    অবশ্য কালেকস্মিনেই আসত তারা। সুমিতা কারও বাড়ি গেলে একাই যেত প্রিয়মাধবের সঙ্গে। নমিতা যেতে চাইত না। বলত, আমার এখন কাজ আছে।সুমিতা বেশি পীড়াপীড়ি করলে বলত, তুই তো আচ্ছা বোকা দিদি, দুজনে গেলে লোকে কী বলবে, ভুলে যাচ্ছিস?

    কী আবার বলবে? নমিতা একটু বাঁকা হাসি হেসে বলত, ডাইনেবাঁয়ে চিনির নৈবিদ্যি!

    যেত না নমিতা, বাড়িতে কাজ নিয়ে থাকত। আর তারপর তো কাজ বেড়েই গেল। ক্রমশই বাড়তে লাগল।

    অরুণমাধব জন্মাল।

    সেই এক আনন্দের দিন গেছে সুমিতার। চা-বাগানের ওই কোয়ার্টার্সের বাইরে যে আর কোনও জগৎ আছে, ভুলেই গেল যেন। দুই মা মিলে একটা শিশুকে নিয়ে রাজ্য রচনা করল একটা।

    অপুট সুমিতা ছেলেকে আদর করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। সুপটু নমিতা তার সব কিছু কাজ করে, শিশুর তো অতএব আঠারো আনা।

    কিন্তু নমিতা?

    নমিতাও কি সুখের সাগরে ভাসত? দিদির ছেলে থেকেই তার সব সম্পূর্ণতা, এই কি ভাবত সে?

    নমিতার কথা বিশেষ জানার উপায় নেই।

    নমিতা তো অরুণের জন্মের কিছু দিন পরেই মারা গেল। মাস আষ্টেকের ছেলে তখন অরুণ, দেশে আসবে সুমিতা ছেলের মুখে ভাত দিতে, হঠাৎ তছনছ হয়ে গেল সব। সুমিতার জীবনের সুর গেল কেটে।

    সেই একই সময়ে প্রিয়মাধবের কোম্পানি আরেক বুনো জায়গায় বদলি করে দিল বড় একটা বাগান কিনে, আর অকস্মাৎ নমিতা মারা গেল একটা পোকার কামড়ের জ্বরে।

    ওই বিষাক্ত পোকা থাকে বাগানের আশেপাশে। অসতর্ক কুলিকামিনদের ছেলেমেয়েরা প্রাণ হারায় মাঝে মাঝে, কিন্তু তাই বলে সুমিতার বোন প্রাণ হারাল? সুমিতা এত অসতর্ক হল?

    হল।

    সুমিতার ভাগ্য সুমিতাকে নিঃস্ব করল। সুমিতার শৈশব কৈশোর বাল্যের একমাত্র সাথী, সুমিতার যৌবনসুখের একমাত্র দর্শক, সুমিতার সংসার-জীবনের একমাত্র অবলম্বন ঝরে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে।

    দেশে এসে ছেলের ভাত দেওয়া আর হল না সুমিতার, চলে গেল সেই বুনো বাগানে। দীর্ঘকাল পড়ে থেকেছে সেখানে, ছেলেকে বোর্ডিং-এ রেখে মানুষ করেছে, তারপর প্রিয়মাধব যখন আরও কিছুদিন এ বাগান সে বাগান করে অবশেষে অবসর নিয়ে দেশে ফিরেছেন, সুমিতা কলকাতায় এসে গুছিয়ে বসেছেন, ছেলের বিয়ে দিয়েছেন।

    কিন্তু সেই বিয়ের পরই আবার ঝপ করে ভেঙে পড়ল তাসের প্রাসাদ।

    প্রিয়মাধব অসুখে পড়লেন।

    নমিতার মৃত্যুর মতোই আচমকা এল এই মৃত্যু।

    তা, মৃত্যু ছাড়া আর কী?

    জীবন থেকে তো নির্বাসন ঘটল প্রিয়মাধবের। যে-জীবনকে আঁকড়ে থেকেছেন প্রিয়মাধব চিরটা দিন।

    চিরদিনই বিষাদকে ভয় প্রিয়মাধবের, শোককে বরদাস্ত করতে পারেন না। নমিতার মৃত্যুর পর তাই প্রিয়মাধব ইচ্ছে করে হইচই করেছেন। ইচ্ছে করে স্ফুর্তি করেছেন, সুমিতাকে কিছুতেই বিষাদে ডুবে থাকতে দেননি। বলেছেন, মৃত্যুর সাধনা করে লাভ কী? জীবনের সাধনা করো।

    .

    সেই প্রিয়মাধব জীবনকে হারালেন। চিরতরে হারালেন।

    সুমিতা যদি নমিতার শাশুড়ির মতো হতেন, নিশ্চয় বউকে অপয়া বলতেন।

    কিন্তু তেমন নন সুমিতা।

    তাই ভাগ্যের এই দুঃসহ নিষ্ঠুরতা মেনে নিয়েছেন। আর কাউকে দায়ী করেননি। জীবনপাত করে সেবা করেছেন স্বামীর। তারপর একদিন আস্তে বিদায় নিয়েছেন।

    তদবধি নার্স।

    নার্স ছাড়া আর কে করবে?

    অরুণমাধবের সাধ্য কী?

    প্রিয়মাধবের খুঁতখুঁতুনির বোঝা পাহাড়ের বোঝাঁ।

    নার্স এল।

    কতজন এল গেল।

    কাউকে বরদাস্ত করতে পারেন না প্রিয়মাধব। প্রতিটি বিষয়ে খুঁত কাটেন, ব্যঙ্গ করেন বিদ্রূপ করেন, আর অরুণমাধব যখন বাবাকে দেখতে এ ঘরে আসে, বলেন, পয়সা কি তোমার এত বেশি হয়েছে অরুণ যে, এই চিড়িয়াখানার মালটিকে মোটা পয়সা দিয়ে পুষছ। ফেলে দেওয়ার মতো পয়সা থাকে, অনাথ-আশ্রমে দান করো না।

    অরুণ লজ্জায় অধোবদন হত, লাল হয়ে বলত, কী বলছেন বাবা?

    প্রিয়মাধব বলতেন, ঠিকই বলছি। এর থেকে একটা বনমানুষ এনে বাপের সেবায় লাগিয়ে দিও, কাজ যেমন চলছে চলে যাবে।

    বনমানুষ!

    এর পর আর কোন মানুষটি থাকবে? পাগলের সেবা করবে বলে তো আসেনি তারা?

    অনেক জনকে বিদায় করে এখন নীহার। নীহার একটু বেশি বুদ্ধিমতী আর বেশি সহিষ্ণু বলে অনেকদিন টিকে আছে। প্রিয়মাধবের কোনও কথাই গায়ে মাখে না সে। এ ঘরে এসে উত্তরাকে বলে, উঁহু, ভয় পাবেন না, আমি নড়ছি না। আপনার শ্বশুরের শ্রাদ্ধের ভোজ খেয়ে তবে যাব।

    আশ্বাস!

    এই আশ্বাসের জোরে অরুণ আর উত্তরা ক্রমশই বাবার জন্যে উৎকণ্ঠিত হওয়া কমিয়ে দিয়েছে। জানে, মিস ঘোষ আছেন।

    নীহারের বয়েস কম, কিন্তু দৃঢ়তা আছে।

    যখন অরুণমাধব রাত্রে একটু সাড়াশব্দ উঠলেই ভয় পেত, মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পেলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত, তখন নীহারই বলত, যান তো, শুতে যান তো! মাথা খারাপ করতে হবে না। আপনারাই যদি জেগে বসে থাকবেন, আমি তবে আছি কী করতে?

    কোনও সময় বা বলত, এত ভয়ই বা কীসের? মা বাপ কি মানুষের চিরদিনের? এই তো মা গেছেন, বেঁচে নেই আপনি?

    শুনে উত্তরা নার্সের ওপর কৃতজ্ঞ হত। যে কথাগুলো নিজে সে বরকে বলতে পারে না, সেটা অপর কেউ বলে দিচ্ছে–এতে অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধ হত।

    নীহারের এই অসীম বিবেচনায় উত্তরা ওকে নার্স বলে দূরে রাখেনি, আত্মীয়ের মতো ভাবে।

    .

    সুমিতা মারা যেতে উত্তরার মা বেয়াইকে ডেকেও বলেছিলেন, দেখুন বেয়াই মশাই, ভাল করে তাকিয়ে দেখুন, আর তো দেখতে পাবেন না। একদিন নিজে হাতে করে মাথায় সিঁদুর ঢেলে দিয়ে আঁচলে আঁচলে বেঁধে এই ঘরে নিয়ে এসেছিলেন, আজ সেই গাঁটছড়া খুলে দিয়ে নতুন সাজে সেজে চলে যাচ্ছেন বেয়ান।

    ভদ্রমহিলার বুকের পাটা যে বিলক্ষণ তা বোঝা গেল। অরুণ চমকে উঠল–এই একটা ঝড় ওঠে বুঝি। এই গ্রাম্যতায় না জানি কী তীব্র ব্যঙ্গ করে উঠবেন বাবা!

    প্রিয়মাধব কিন্তু ঝড় ওঠালেন না, নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বোধ-চৈতন্য কিছু আছে, তা বোধ হল না।

    অরুণমাধবের শাশুড়ি তাঁর বেয়াইয়ের বোধ-চৈতন্য উদ্রেকের উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছু হৃদয় মোচড়ানো কথা বললেন, কাজে লাগল না। প্রিয়মাধব পাথরের মতো শুয়ে রইলেন, সুমিতার দিকে না তাকিয়ে।

    ভদ্রমহিলা এ-ঘরে এসে বললেন, তোর শ্বশুরের ব্রেনটা একেবারে গেছে উত্তরা, নইলে এতকালের সঙ্গী চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে, চোখে এক ফোঁটা জল নেই? এক বিন্দু আকুলতা নেই? পাগলেও এমন শোক বুঝতে পারে।

    উত্তরাও অবাক হচ্ছিল বইকী!

    ও তো ভেবেছিল শ্বশুরকে ধরে রাখা যাবে না, হুড়মুড়িয়ে উঠতে চেষ্টা করে পড়ে প্রাণটা হারাবেন। কিন্তু সে-দৃশ্য দেখল না। প্রিয়মাধব পাথর হয়ে রইলেন। একদণ্ড চোখের আড়াল হলে সুমিতা সুমিতা করে ডাক পাড়তেন। সুমিতা চলে গেলেন, একবারের জন্যে ডাকলেন না প্রিয়মাধব সুমিতা বলে। একবিন্দু জল গড়াল না।

    ব্রেনটা কি তবে হঠাৎ শ পেয়ে অকেজো হয়ে গেল?

    তাই মনে হয়েছিল কদিন।

    যে কদিন অরুণমাধব, উত্তরা আর বাড়ির চাকরটা মিলে এলোমেলো করে সেবা করেছিল, পাথরের মতো পড়ে ছিলেন প্রিয়মাধব।

    কিন্তু নার্স ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যেন ছিটকে উঠলেন, বদলে গেলেন। নাওয়া খাওয়া প্রত্যেকটি ব্যাপারে রসাতল করতে লাগলেন। চামচখানা রাখা, কি তোয়ালেখানা পাট করার অপরিপাট্য নিয়ে অভিযোগের ঝড় তুলতে লাগলেন। আর শুরু করলেন তীব্র তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবচন।

    একদিন তো উত্তরা বলেই ফেলেছিল, তা ঠিক, মার মতন আর কে হবে বাবা? আপনি যদি তেমন আশা করেন ।

    প্রিয়মাধব বলেছিলেন, কথা বলতেও শিখতে হয় বউমা! ওটা শিখতে তোমার বাকি আছে।

    কিন্তু মাঝে মাঝে অবস্থার বদল হয়। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকেন প্রিয়মাধব। মৃত্যুর পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘণ্টা মিনিট মাপা হয়। উত্তরা মুক্তির স্বপ্ন দেখে, অরুণ দিশেহারা হয়।

    বাবা থাকবেন না, এখনও যেন এ কথা ভাবতে পারে না অরুণমাধব। তেরো বছর ধরে প্রায় শিলীভূত হয়ে পড়ে আছেন প্রিয়মাধব–তবুও। অরুণমাধবের চেতনার কাল থেকেই বাবাই তার

    জীবনের হিরো। চা বাগানের সেই প্রাণহীন পরিবেশের মধ্যে বাবাকে মনে হত প্রাণের বন্যা।

    মা ছিলেন একটু মৃদু, একটু চুপচাপ।

    বাবা উত্তাল, অস্থির, দুরন্ত।

    সেই বাবার এই পরিণতি বড় বিচলিত করে রেখেছে অরুণমাধবকে।

    তবু ইদানীং অনিবার্যের নৈবেদ্য হাতে করেই বসে থাকতে হচ্ছে।

    প্রায়ই সেই অনিবার্য জানান দিচ্ছে। প্রায়ই আজকাল সকালে এ ঘরে এদের সঙ্গে চা খেতে বসে নীহার বলে, আজ সকালে আবার এ দৃশ্য দেখাতে পারব আপনাদের, এ আশা করিনিকাল রাত্রে যা অবস্থা!

    অরুণমাধব শিউরে উঠে বলে, সে কী, ডাকেননি কেন আমাদের?

    নীহার বলে, উঁহু! আরও না দেখে

    অরুণ বলে, শেষকালে বাবার যদি কিছু বলতে ইচ্ছে করে!

    এত অগাধ সময় পেয়েও যদি সে ইচ্ছে মিটিয়ে নিতে না পারেন, না-ই পারলেন।

    কথা আর কি! কোন কথা বলবার থাকতে পারে? তবে

    উত্তরা ভাবত ওই লকারটায় না জানি কী আছে! এখনও শ্বশুর যার চাবি আগলাচ্ছেন। ওইটার কথাই হয়তো কিছু বলবেন। হয়তো কোনও দলিলপত্র আছে। হয়তো শাশুড়ির গয়নাগাঁটি আছে। সেইগুলো হাতে তুলে দেবেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। কিন্তু সে অনুষ্ঠানে দরকার কী?…ভাবত উত্তরা, মারা গেলে তো আর চাবি সামলাতে আসবেন না প্রিয়মাধব?…আর সে চাবির ভাগীদারও কেউ নেই একা অরুণ ছাড়া।

    প্রিয়মাধবের মাথার কাছের বাজুতে একখানা পাটকরা তোয়ালে, প্রিয়মাধবের সামনে একটা নিচু গোল টেবিল, যাতে থরে থরে সাজানো আছে শিশি, বোতল, কৌটো।…

    যেন এই দৃশ্যটাই অনিবার্য!

    উত্তরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত ওই দৃশ্যটার উপর। উত্তরা যে তার বরের সঙ্গে একদিনের জন্যে কোথাও বেড়াতে যেতে পারেনি, এ আক্ষেপ করতেও ভুলে যাচ্ছিল ক্রমশ।

    ও জানে ওকে সকালবেলা উঠেই এ ঘরে এসে বলতে হবে, বাবা কেমন আছেন?

    প্রিয়মাধব এক টুকরো বিদ্রুপের হাসি হেসে বলবেন, চমৎকার!

    একটুক্ষণ অপ্রতিভের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সরে আসতে হবে উত্তরাকে! বেশিক্ষণ কাউকে সহ্য করেন না প্রিয়মাধব। বাড়ির লোক কি অন্য আত্মীয় কেউ এসে একটু বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই প্রিয়মাধব বলে ওঠেন, আর কেন? হয়ে গেছে তো চারপেয়ে গোরু দেখা।! টিকিট উসুল হয়ে গেছে। এবার যেতে পারো।

    উত্তরা বলত, আর আমি যাব না ও ঘরে।

    অরুণমাধব বলত, বাবাকে কি এখন পুরো মানুষ ভাবা উচিত উত্তরা?

    উত্তরা রেগে উঠত। বলত, পুরো মানুষের মানমর্যাদা, প্রাপ্য পাওনাটা তো পুরোর উপর আরও বেশি নিচ্ছেন। তাতে তো একতিল ঔদাসীন্য দেখি না!

    তবু আবার দুপুরবেলা উত্তরাকে এ ঘরের দরজায় এসে বলতে হয়, বাবা, তরকারি মুখে ভাল লাগল?

    প্রিয়মাধব বলেন, অপূর্ব! তুমি নিজে বেঁধেছ বুঝি?

    নীহার বলত, আমার কিন্তু ভারী ইন্টারেস্টিং লাগে। এত রোগী দেখেছি, এমন মজার রোগী দেখিনি কখনও।

    আপনার আর মজা লাগবে না কেন?উত্তরা ভারী গলায় বলত, আপনার তো জীবন ফসিলহয়ে যাচ্ছে না আমার মতো? বিয়ে হয়ে পর্যন্ত এই দৃশ্য ২৪৬

    অরুণমাধব ক্ষুব্ধ হত, অরুণমাধব লজ্জিত হত। ক্ষুব্ধ হত স্ত্রীর মনোভাবে, লজ্জিত হত বাবার ব্যবহারে।

    উত্তরার কাছে অরুণমাধবের মুখরক্ষা করতেও যদি বাবা। শুনেছিল মৃত্যু অনিবার্য, প্রিয়মাধবের ব্যাপারে কি তার ব্যতিক্রম হবে?

    .

    আশা ফুরিয়ে গিয়েছিল।

    কিন্তু এল একদিন সেই অনিবার্য!

    এল, কিন্তু ঢাকঢোল বাজিয়ে সমারোহ করে নয়, নিঃশব্দে।

    হয়তো অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে নিয়েছে বলেই এখন স্তব্ধতা পছন্দ করল।

    অনেক রাত্রে নীহার এসে এ ঘরের দরজায় টোকা দিল। বলল, আসুন?

    এ কী সুর!

    এ কী ভঙ্গি।

    অরুণমাধব শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে?

    ঘামছেন!

    উত্তরা মৃতের মতো বলল, পাখা খুলে দেননি?

    নীহার একটু হেসে বলল, দিয়েছি।

    অরুণমাধব ত্রস্ত হয়ে জামা গায়ে দিতে গেল। নীহার বলল, ও কী করছেন?

    ডাক্তারকে বলিগে—

    আর নয়, থাক। ডাক্তার এসে পৌঁছবে না।

    তা হলে?

    আসুন এ-ঘরে।

    অরুণ গেল, উত্তরাও গেল।

    নিঃসন্তান দম্পতি, পিছনের দিকে তাকাতে হয় না।

    প্রিয়মাধব ঘামছিলেন।

    কবিরাজরা নাকি একেই বলেন কালঘাম। তবু প্রিয়মাধবের জ্ঞান চলে যায়নি। প্রিয়মাধব স্পষ্ট করে তাকাতে পারছিলেন না, কিন্তু স্পষ্ট গলায় কথা বলেছিলেন, কোথায় ছিলে তোমরা? সারারাত একলা পড়ে আছি আমি।

    অরুণমাধব ঝুঁকে পড়ে ডেকে বলে ওঠে, বাবা, কী কষ্ট হচ্ছে?

    প্রিয়মাধব বললেন, মরতে পারছি না, এই কষ্ট।

    বাবা, ডাক্তারবাবুকে ডাকব?

    আঃ।

    ধমক দিয়ে উঠলেন প্রিয়মাধব।

    তারপর বলে উঠলেন, অরুণ, আমাকে সে কথা বলতেই হবে। নইলে মরা হবে না।

    উত্তরা এগিয়ে এসে বলল, কোন কথা বাবা?

    প্রিয়মাধব এই মরণকালেও চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, আঃ, তুমি কে বাঁচাল মেয়ে? যাও, যাও এ ঘর থেকে।

    উত্তরা ঠিকরে বেরিয়ে গেল।

    নীহার ওদিক থেকে একটু অনুকম্পার হাসি হাসল।

    প্রিয়মাধব আরও ঘামছিলেন, নীহার মুছিয়ে দিচ্ছিল তোয়ালে দিয়ে। নীহার জানতে পারছিল, এই ফরসা তোয়ালেটা কাল সকালে আর পালঙ্কের বাজুতে পাট করে রাখতে হবে না।

    প্রিয়মাধব বললেন, নার্স, তুমি যাও।

    না, আমি যাব না।

    প্রিয়মাধব তেড়ে উঠলেন, তুমি আমার গোপন কথা শুনবে?

    শুনতেই হবে।

    অরুণ, একে তাড়িয়ে দাও।

    অরুণ মিনতির চোখে তাকাল। নীহার নিচু গলায় বলল, অনেকক্ষণ থেকে ডিলিরিয়াম শুরু হয়ে গেছে। অনেক গোপন কথা বলেছেন আমায়।

    অরুণ স্তিমিত হয়ে গেল।

    প্রিয়মাধবও স্তিমিত হয়ে যাচ্ছেন, তবু শেষ চেষ্টা করলেন প্রিয়মাধব, এই চাবিটা নাও। ওটা খোলো।

    সেই চাবি, যা এতদিন আগলে রেখেছিলেন প্রিয়মাধব।

    অরুণের হাত-পা শিথিল হয়ে যাচ্ছিল, তবু অরুণ খুলল গডরেজের ছোট্ট আলমারিটা। কিছু নেই, শুধু কিছু কাগজ আর একটা মোটা খাতা!

    মূঢ়ের মতো তাকাল।

    প্রিয়মাধব বিছানা হাতড়াচ্ছিলেন, যেন কিছু একটা খুঁজছিলেন।

    অরুণমাধব শুকনো গলায় বলে, বাবা, কী দেব?

    প্রিয়মাধব শুনতে পেলেন না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, তোমার চোখ সরাও। দেয়ালে, ছাতে, জানলায়, দরজায় সব জায়গায় চোখ পেতে রাখবে কেন তুমি? বুঝতে পারো না আমার ভয় করে? কত মায়া ছিল তোমার, এত নিষ্ঠুর হলে কী করে?

    মুমূর্ষ রোগীর প্রলাপের মধ্যে কি কোনও অর্থ থাকে? বাক্যন্ত্রের আর চিন্তার যন্ত্রের মধ্যেকার যোগসূত্র তো ছিন্ন হয়ে গেছে, ভেঙে পড়ে গেছে চলাচলের সেতু। এখন তো শুধু চির-অভ্যস্ত বাকযন্ত্র এলোমেলো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার শেষ শক্তিটুকু।

    অরুণ তবে কেন সেই অর্থহীন প্রলাপের মধ্যে থেকে অর্থ খুঁজতে চাইছে? ও কেন উৎকর্ণ হয়ে ওই কথাগুলোই শুনছে?…প্রিয়মাধবের নখের ডগাগুলো যে অসম্ভব ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, নীহার যে যেখানে যত ভোয়ালে ছিল সব দিয়েও প্রিয়মাধবের ঘাম মুছিয়ে শেষ করতে পারছে না, এ কি প্রিয়মাধবের ছেলের চোখে পড়ছে না?

    তাই অজানিত এক রহস্যলোকের বন্ধ দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সে ওই প্রলাপোক্তির সামনে।

    হয়তো এমনিই হয়।

    একা অরুণমাধবই নয়, মানুষ মাত্রেই রোগীর প্রলাপোক্তির মধ্যে থেকে, মুমূর্যর শেষোক্তির মধ্যে থেকে কোনও এক অজানা রহস্যলোকের চাবি খুঁজতে বসে।

    চিরদিন দরজায় দরজায় পাহারাদার ছিল মোতায়েন, আগলে রাখত রহস্যের কোষাগার, আজ পরিত্যাগ করে চলে গেল তারা ভগ্নদুর্গ। খোলা পড়ে রইল দরজা। কৌতূহলী মানুষেরা তবে উঁকি মেরে দেখতে আসবে না কেন, কী ছিল ওখানে? ঝড়তি-পড়তি যদি কিছু পড়ে থাকে, কুড়িয়ে নিতে পারলে তো বোঝা যাবে, কোন রহস্যপুরীর দরজা আগলে থাকত মজবুত পাহারাদার! অরুণও সব মানুষের মতোই করল।

    কান পাতল ওই স্তিমিত কণ্ঠের অর্থহীন প্রলাপোক্তিতে।

    স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে..ক্রমশ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে সেই অর্থহীন বিড়বিড় করা বকুনি। যেন সরু তারের উপর দিয়ে হাঁটছে, আর বারেবারে পা ফসকে যাচ্ছে। তবু চোখ রাঙাচ্ছ? কতবার বলছি, তোমার ছেলে ভয় পাবে। হ্যাঁ হ্যাঁ–ছেলে।…আঃ, কী নাম তোমার? জানো না? থাক থাক্‌, বলতে হবে না। শুধু শুনে রাখো, সুমিতা তোমার মা নয়!… না-না, ভুল বলছি ছেলে, সুমিতা তোমার মা। বুঝলে? শুনতে পাচ্ছ, সুমিতা তোমার মা, কিন্তু সে তো হারিয়ে গেছে। সেই যখন তুমি একটা খোকা ছিলে, তখন

    আচ্ছা ও তবে কে? যে তোমায় ভাত খাইয়ে দেয়? তোমায় জামা পরিয়ে দেয়? ও কেউ নয়? সুমিতা, ওর বুঝি চোখ নেই? জলভরা, ছলছলে! অরুণের কানটা প্রিয়মাধবের ওষ্ঠ স্পর্শ করছে। অরুণও ঘামছে প্রায় বাবার মতোই। অরুণের বাহ্যজ্ঞান লোপ পেল না কি?

    তাই অরুণ লোকলজ্জা মানছে না। নীহার যে বসে রয়েছে সে কি দেখতে পাচ্ছে না অরুণ? অরুণ শুধু শুনবে বিলীন হয়ে যাওয়া কণ্ঠের শেষ কথা। অস্ফুট শব্দ ফুটতর করতে নাকি যন্ত্র আছে, সে যন্ত্র যদি আগে থেকে এনে রাখত অরুণ?

    এনে রাখেনি।

    তাই অরুণ শুধু একটা স্বরের খসখসানি শুনতে পাচ্ছে। ওর থেকে কি ধরতে পারবে অরুণ প্রিয়মাধব বলছেন, ছেলে, তুমি বুঝতে পারছ না অত চোখ কার? সুমিতার না নমিতার? তবু পারছ না, বোকা, বোকা, ঠকে যাচ্ছে। চিরদিন ধরে শুধু ঠকছে। খুব ঠকিয়েছি তোমায়, দুয়ো, দুয়ো!

    আর শোনা যাচ্ছে না।

    খসখসানিটুকুও থেমে যাচ্ছে যেন। নীহার ধমকে উঠল, আর কী শুনতে চাইছেন অরুণবাবু? কথা তো থেমে গেছে, দেখছেন না রেকর্ডের গায়ে শুধু পিনটা ঘষছে।

    হ্যাঁ, কথা বন্ধ হয়ে যাওয়া রেকর্ডটা এখনও ঘুরছে, পিনটা উঠিয়ে নেবার ওয়াস্তা।

    কিন্তু হঠাৎ কী করে তবে উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রিয়মাধব? পিনটা উঠিয়ে নেবার সময় শেষবারের মতো কি আর্তনাদ করে উঠল রেকর্ডখানা? না কি ভেঙে গেল? নার্স! নার্স! খাতাটা পোড়াচ্ছ না যে? ভেবেছ কী তুমি? মাইনে পাও না?…জানো না আমার ছেলে ভয় পায়..পুড়িয়ে ফেলো নার্স, বলছি পুড়িয়ে ফেলল।

    বাবা! বাবা! ঝাঁপিয়ে পড়ল অরুণমাধব।

    থেমে গেল ভাঙা রেকর্ডের আর্তনাদ।

    ক্রমশ দুরের ঘণ্টা নিকটবর্তী হচ্ছে, গাড়ির চাকার আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে, মনে হচ্ছে সে গাড়ি এবার দরজায় এসে থামবে। আর অন্য পথে ফিরে যাবে না।

    ও কি প্রিয়মাধবের ওই স্বীকৃতিটুকুর জন্যে অপেক্ষা করছিল? অপরাধ কবুল করেছেন প্রিয়মাধব, এইবার নিয়ে যাবে ও?

    .

    মিস ঘোষ! অরুণমাধব গলার স্বরেই যেন হাত চেপে ধরল নীহার ঘোষের, কখন থেকে শুরু হয়েছিল ভুল কথা?

    নীহার সন্তর্পণে হাত ছাড়িয়ে নেবার সুরে বলল, ওই এক ঘুম থেকে ওঠার পর আর কি।

    ঘুমিয়েছিলেন?

    চমৎকার!

    অরুণ রুদ্ধশ্বাসে বলে, তারপর কী হল?

    নীহার হঠাৎ প্রায় হেসে উঠল। কথার সুরে তার আভাস ধরা পড়ল, কিছু মনে করবেন না অরুণবাবু, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে এই পিতৃশোকটা যেন আপনার কাছে বিনা নোটিসে অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো এসেছে।

    কী বলছেন?

    ঘুম ভাঙার মতো বলে অরুণ।

    বলছি, আপনার এই ভেঙে পড়াটা হাস্যকর। আপনার বাবার যা অবস্থা চলছিল, সুসন্তান হিসেবে ঈশ্বরের কাছে আপনার ওঁর মুক্তির জন্যে প্রার্থনা করা উচিত ছিল।

    মিস ঘোষ, বাবা আমার কাছে কী ছিলেন আপনি জানেন না।

    দেখুন, মা-বাবাকে কে না ভালবাসে? সেই ভালবাসার বশেই যথা সময়ে ওঁদের মৃত্যু কাম্য! অনড় অশক্ত হয়ে বেঁচে থাকুন তাঁরা আমার দৃষ্টিসুখের জন্যে, এ তো রীতিমত স্বার্থপরতা!

    আপনার কথা মানছি মিস ঘোষ অরুণ অন্যমনা হয়ে বলে, কিন্তু সেই প্রথম ঘুম ভেঙে কী বলছিলেন উনি শুনতে পেয়েছেন আপনি?

    নীহার উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে, শুনতে হয়তো পেয়েছিলাম, কান দিইনি—

    কান দেননি? উনি কী বললেন কান দেননি?

    উত্তেজিত শোনাল অরুণের গলা। নীহার অনুত্তেজিত, প্রলাপের রোগী কী বলছে না বলছে তাতে কান দিতে গেলে আমাদের চলে না অরুণবাবু!

    আপনার মনে হল সবই প্রলাপ?

    তা ছাড়া আবার কী? সারা দেয়াল উনি চোখ দেখতে পাচ্ছিলেন, দেয়াল ছাত দরজা জানলা, সমস্ত ভরে যাচ্ছিল জোড়া জোড়া চোখে, এ সবেরও তবে মানে আবিষ্কার করুন।

    হয়তো মানে আছে মিস ঘোষ!

    হতাশ গলায় বলে অরুণমাধব।

    .

    সেই ঘরটাতে বসেই কথা বলছে ওরা, যে ঘরে একখানা শূন্য পালঙ্ক পড়ে আছে অদ্ভুত নতুন একটা দৃশ্যের মতো। ওই পালঙ্কে যে তেরো বছর ধরে একটা যন্ত্রণাজর্জর আত্মা খানিকটা জড়মাংসপিণ্ডের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে জীবন্ত পৃথিবীর দিকে, এ কথা কি এখন আর মনে পড়ছে? ওটা যেন শুধু একটা শূন্যতার প্রতীকের মতো পড়ে আছে।

    উত্তরা এ ঘরে আর আসেনি।

    উত্তরা ছত্রিশ ঘন্টা আগের সেই অপমানটায় জ্বলছে, যখন প্রিয়মাধবের সেই অচল দেহটা তার সমস্ত আক্ষেপ আর উত্তেজনা থামিয়ে স্থির হয়ে গেল, যখন সেই তাঁর জর্জরিত আত্মখানি দরজায় এসে থামা গাড়িটায় চড়ে বসে এগিয়ে গেল মেঠোপথ ধরে, তখনও উত্তরা এল না। উত্তরা শুধু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকল।

    অরুণমাধব বলেছে, উত্তরা, তুমি কি পাগল?

    তিলে তিলে পাগল হয়ে উঠেছি হয়তো। প্রতি মুহূর্তে অপমান সহ্য করা শক্ত বইকী! জিনিসটা গুরুপাক।

    কিন্তু এতদিন সহ্য করে এসে, এখন এই শেষকালে যখন অসহ্য হওয়াটা অর্থহীন হয়ে গেল

    উত্তরা গম্ভীরভাবে বলেছে, কার কাছে কোন জিনিসটা কোন অর্থ নিয়ে আসে, সবাই কি বুঝতে পারে? অনেক ভার সইতে সইতে কোনও এক সময় সুতোটা ছিঁড়ে পড়ে।

    অরুণমাধব ভাবল, হয়তো ছিঁড়ে পড়ে ভালই হয়েছে, হয়তো রোগীর প্রলাপের ওই শেষ কথাগুলো উত্তরা বুঝে ফেলত, হয়তো তার মানে আবিষ্কার করতে বসত।

    কিন্তু অরুণ?

    অরুণ কি স্মৃতির সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করবে প্রিয়মাধব ওকে কখন ঠকালেন? তার সমস্তটা জীবন ঠকিয়ে এসেছেন প্রিয়মাধব? না কি মৃত্যুকালে ঠকিয়ে গেলেন? দুয়ো দিয়ে গেলেন?

    সুমিতা যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন কি সুমিতা প্রলাপ বকেছিলেন!

    না, সুমিতার প্রলাপ বকার কোনও কারণ ঘটেনি, সুমিতা সামান্য একটু ইনফ্লুয়েঞ্জায় মারা গিয়েছিলেন।

    সুমিতা মারা যাবার দিন সকালেও অরুণকে ডেকে বলেছিলেন, অরুণ, ওঁর ওষুধটা খাবার সময় হল বোধ হয়।

    বলেছিলেন, বউমাকে বলিস অরুণ, ওঁর স্টুটা নিজে করে দিতে। ব্ৰজেন ঠিকমতো পারবে না। হয়তো ঝাল দিয়ে বসবে।

    প্রতিদিন মাংস খেতেন প্রিয়মাধব, সেই রান্নাটা ছিল সুমিতার হাতে।

    সেই দুপুরেই মারা গেলেন সুমিতা, যেন আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। একটি কথাও বলে গেলেন না কাউকে। আশ্চর্য, কোনও বক্তব্যই কি ছিল না সুমিতার? একমাত্র বক্তব্য, প্রিয়মাধবের ঝোলে যেন ঝাল না পড়ে?

    তবে?

    বক্তব্য কি শুধু নমিতার?

    সুমিতার সেই যমজ বোন নমিতা।

    বিষপোকার কামড় খেয়ে মারা গিয়েছিল যে নমিতা অনেকদিন আগে। অরুণ নামক একটা বোকা শিশু যখন দোলায় শুয়ে চেঁচাত, আর চুষি খেয়ে ভাবত মার স্পর্শ পাচ্ছি, তখন।

    .

    কিন্তু মৃত নমিতা কি উঠে এসেছিল চিতা থেকে? সেই আসামের উপকণ্ঠের কোনও একটা জঙ্গুলে শ্মশানে যে চিতা সাজানো হয়েছিল, সেখান থেকে এখানে চলে এসেছিল নমিতা? প্রিয়মাধবের ঘরে ঢুকে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বালিশের তলা থেকে চাবি বার করে নিয়ে খুলে ফেলেছিল প্রিয়মাধবের মাথার কাছের সেই ছোট্ট আলমারিটা? আর তার মধ্যে রেখে দিয়ে গিয়েছিল তার বক্তব্য! কখন ওই বক্তব্যের খাতাটা ভরাল নমিতা? কখন লিখল পাতার পর পাতা? আশ্চর্য!

    অথচ খাতাটা তো নমিতারই।

    মলাটের পরের পৃষ্ঠাতেই তো পরিষ্কার করে লেখা রয়েছে–নমিতা দেবী।

    কিন্তু নমিতা দেবী কি তাঁর বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন নীহার ঘোষ নামের একটা মাইনে করা নার্সের জন্যে? তাই কি সম্ভব?

    অথচ সে খাতা নীহার ঘোষই পড়ছে রাত জেগে, উপন্যাস পড়ার কৌতূহল নিয়ে।

    তার মানে নীহার ঘোষ চুরি করেছে এ খাতা।

    গোলমালের সময়, যখন ভোলা পড়ে ছিল আলমারিটা। অথচ নীহার এমন খারাপ মেয়ে ছিল না। খাতাটা যদি চুরি করেছে নীহার, ওর মধ্যে থেকে প্রিয়মাধবের স্ত্রীর গয়নাগুলো ও তো চুরি করতে পারত। ওর মধ্যেই তো ছিল একটা খোপে। হয়তো নীহার দেখতে পায়নি সেই গয়না। তাই নিতে পারেনি। তাই শুধু ওই কালো বাঁধাই মোটা খাতাটা টেনে নিয়েছিল খস করে।

    যে খাতা নমিতা দেবীর অনেক রাত্রিজাগরণের ফসল, সে খাতা নীহার ঘোষ পড়ছে রাত জেগে, এর থেকে ভাগ্যের কৌতুক আর কী আছে?

    কিন্তু ভাল মেয়ে নীহার কেন চুরি করল? প্রিয়মাধবের আদেশ পালন করতে ও কি তবে ওটা পুড়িয়ে ফেলতেই নিয়ে রেখেছে? শুধু কৌতূহল সামলাতে পারেনি, ভিতরে কী লেখা আছে ভেবে?

    এই কৌতূহলই নীহারকে যুক্তি দিয়েছে, আমি পড়লে কী? আমার কাছে তো শুধু উপন্যাস? আমার জন্যে তো প্রিয়মাধব নামের ওই নাটকীয় চরিত্রটি নাটকের মতো করে বলে ওঠেনি, খাতাটা পুড়িয়ে ফেলো নার্স। খাতাটা পুড়িয়ে ফেলল।

    .

    দিদি আমার থেকে এক ঘণ্টার বড়—

    নমিতার জীবনের নায়িকা কি দিদি?

    তাই নমিতা দিদি দিয়েই শুরু করেছে তার ডায়েরি:

    দিদি আমার থেকে এক ঘণ্টার বড়, তবু পিসি আমায় দিদি বলতে শিখিয়েছিল।

    আমাদের সেই সিকদার বাগান লেনের বাড়িটার ধারেকাছে যারা থাকত, তারা শুনে হাসত। বলত যমজ ভাইবোনকে দাদা, দিদি বলা শুনিনি কখনও। কে বড় কে ছোট হিসেব থাকে নাকি? ওদের হিসেবে যাই হোক, আমি কিন্তু দিদিকে দিদিই ভেবে এসেছি ছোট থেকে। দিদিও তো ছোট বোন ছাড়া আর কিছু ভাবত না আমায়। দিদি বড়র স্নেহ দিয়ে আগলে রাখত আমায়। বড়র মর্যাদা নিয়ে শান্ত থাকত।

    দিদির সঙ্গে ছেলেবেলায় কখনও ঝগড়া হয়নি আমার। একটা খেলনা একটা পুতুল থাকলে দিদি আমার হাতে তুলে দিত।

    অবিশ্যি খেলনা পুতুল, এইসব রাজকীয় বস্তু ভাগ্যে কবারই বা জুটেছে আমাদের?

    কে আদর করতে এসেছে আমাদের? জন্মকালে মা মরেছে, বাল্যকালে বাপ।

    যমজ দুটো বোন পিসির হাতে মানুষ হয়েছি, নেহাতই ভগবানের জীব এই পরিচয়ে। তবে বাড়িটা ছিল আমাদের নিজেদের, আর বাবার টাকাও ছিল কিছু, তাই পিসেমশাই তাঁর ভাইদের সঙ্গে পৃথক হয়ে শালার বাড়িতে এসে উঠেছিলেন।

    অবশ্য তাঁর এই আসার পিছনে যুক্তি ছিল বইকী! পিসিমা যদি তাঁর ভাইঝি যুগলের তদারকির অজুহাতে ভাইয়ের বাড়িতেই স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন, পিসেমশাই কি বানের জলে ভেসে যাবেন?

    আসল কথা, আমাদের দুর্ভাগ্য পিসিমার সৌভাগ্য ডেকে এনেছিল। শ্বশুর বাড়িতে একখানি মাত্র ঘরে, পাঁচ বউয়ের এক বউ হয়ে শাশুড়ির আওতায় দিন কাটছিল, সে জায়গায় সংসার, স্বাধীনতা, বাপের বাড়ির বাড়িখানা। তার বদলে দুটো পুষ্যি, এই যা। কিন্তু পিসির নিজের তো ছেলেপুলে ছিল না।

    তবু পিসি আমাদের সামনে সক্কলকে বলে বেড়াত, এই-যে, আমার গলায় গেঁথে দিয়ে চলে গেছে। ভাই-ভাজ দুজনে। নিজের সর্বস্ব ভাসিয়ে দিয়ে এসে ওদের নিয়ে পড়ে আছি।

    আমরা বড় হবার পরও বলত।

    পিসির সর্বস্বটা কতটা, সে কথা আমরা বুঝে ফেলার পরও বলতে লজ্জা পেত না।

    অথচ পিসি যদি এত কষ্ট না করত, কত উপকারই করা হত নমিতা সুমিতা নামের দুটো মেয়ের।

    নামকরণের সঙ্গে সঙ্গে, যদি বিলোপ হয়ে যেত নাম দুটো, বেঁচে যেত তারা।

    কিন্তু বাঁচতে পেল না বেচারারা।

    পিসি মরে মরে তাদের মানুষ করতে লাগল।

    তবে পিসিকে আমি দোষ দিতে পারি না।

    পিসি করেছিল বইকী! অনেক কিছুই করেছিল। পিসেমশাই গাফিলি করে বসে থেকেছে বলে পিসি তার সঙ্গে ঝগড়া করে পাড়ার লোককে দিয়ে সুমিতা নমিতাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। পাড়ার লোককে দিয়েই মাস্টার ঠিক করিয়ে দিয়েছে। আর নিজে লেখাপড়া না জানলেও, দুবেলা তদারকি করে পড়তে বসিয়েছে ওদের ছেলেবেলায়। স্কুলের ভাত রাঁধত পিসি, স্কুলে যাবার সময় জবজবে করে তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিত। আবার স্কুল থেকে ফিরলে একগোছা পরোটা আর তরকারি নিয়ে বসে থাকত, আসামাত্রই যাতে তাদের পেটের মধ্যে চালান করে দিতে পারে।

    শুধু যাযা করত, সব বড় বিশদ করে বলত পিসি। বলে বেড়াত। ওই দোষ! ওই দোষেই পিসিকে দেখতে পারত না ওরা।

    অথচ পিসি তার বরের সঙ্গে ঝগড়া করত মেয়ে দুটোকে নিয়ে।

    পিসেমশাই ওদের সুবাদেই ওদের বাড়িতে থাকত, ওদের পয়সাতেই সংসার চালাত, তবু ওদের আপদবালাই ভাবত। ভাবখানা যেন আমাদের যুগল জীবনের মাঝখানে ও দুটো অবান্তর সুখের বিঘ্ন।

    তবু যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল পিসি।

    টেনে তুলেছিল মেয়ে দুটোকে স্কুলের গণ্ডি থেকে, আর দুজনকে দুটো বর জোগাড় করে দেবার জন্যেও উঠেপড়ে লেগেছিল সেই স্কুলের সময় থেকেই।

    তবু ভাইঝিদের ভালবাসা জোটেনি তার কপালে।

    সুমিতা নামের মেয়েটা পিসিকে ভালবাসুক না বাসুক গুরুজন বলে মানত। বড় হয়ে ইস্তক পিসির কাজের সাহায্য করে দিতে আসত, পিসি খেয়েছে না খেয়েছে দেখত, পিসি তোমার কষ্ট হচ্ছে–এ কথা বলে মন জোগাত।

    নমিতা ছিল বিপরীত।

    হ্যাঁ, আমি! আমি আদৌ ওসবের মধ্যে যেতাম না। ঝি না এলে পিসি যদি বাসন মাজতে যেত, দিদি হয়তো ঘরগুলো মুছতে বসত, আমি সে সময় দিদিকে আর পিসিকে দেখিয়ে দেখিয়ে চটের ফুল তুলতাম, শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কবিতার বই খুলে কবিতা পড়তাম।

    আমাদের বাবার অনেক বই ছিল। তার মধ্যে কবিতার বইও অনেক ছিল।

    কান্ত কবির, সত্যেন দত্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের, কুমুদরঞ্জন মল্লিকের, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর, আর সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের অনেক বই ছিল বাবার।

    দিদি কদাচ সে সব বইতে হাত দিত, দিদি স্কুলের পড়ায় প্রাণ ঢালত। যদিও কখনও ছুটির দিনেটিনে একখানা বই টেনে বসত তো সে হয়তো গ্রন্থাবলী। অনেক গ্রন্থাবলী ছিল বাবার আলমারিতে।

    বাবাকে আমার অস্পষ্ট মনে পড়ে।

    যেন একটু বিষণ্ণ বিষণ্ণ, একটু বা গম্ভীর। আমাদের কদাচ কাছে ডাকতেন। এর বেশি নয়। কিন্তু ওই বইগুলির মধ্যে থেকে যেন বাবাকে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করতাম আমি।

    সে আবিষ্কার সত্যের কাছাকাছি পৌঁছত কিনা জানি না, তবে পিসির সঙ্গে যে পিসির ভাইয়ের আকৃতি বা প্রকৃতির মিল ঘটায়নি এটা নিশ্চিত। আকৃতিও কল্পনা করে নিতে হত। কারণ বাবার কোনও ফটো ছিল না। পিসির মুখের আক্ষেপের মধ্যে থেকে শুনেছি, আমাদের মায়ের নাকি খুব ফটো তোলার সাধ ছিল। ভাল একটি ফটো তোলার।

    বিয়ের সময় নাকি ফটো তোলা হয়নি মার।

    কিন্তু হচ্ছে হবে করে সেই ফটো আর ভোলা হয়নি, মরেই গেলেন ভদ্রমহিলা। দু-দুটো মোটাসোটা মেয়ের ভার যদিবা সয়ে ছিলেন, তাদের ধারটা আর সইতে পারলেন না। তাদের পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েই বিদায় নিলেন।

    এরপর যে আর বাবার নিজের ছবি তোলবার বাসনা হবে না, এটা খুবই স্বাভাবিক।

    একবার একজোড়া ন্যাড়া মেয়ের ফটো তুলিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, সেটা মাকড়সার ঝুল চাপা হয়ে ঝুলেই থাকত, সাতজন্মে চুনকাম না করা দেয়ালে। তার আশেপাশে পিসির অবদান কালী, দুর্গা, সত্যনারায়ণ, কমলে কামিনী, আর বস্ত্রহরণ লীলার পট। পিসির ছবির সংগ্রহশালা দেখলে বোঝবার উপায় ছিল না, পিসি শাক্ত কি বৈষ্ণব। কেন জানি না, মা সম্পর্কে কোনও কৌতূহল পোষণ করিনি কখনও। পিসি যদি কখনও একখানা পুরনো চেলি কি রং-জ্বলা সাটিনের জ্যাকেট সামনে এনে বলত, এই দেখ তোদের মার স্মৃতিচিহ্ন, উদাসীন দৃষ্টিতে দেখতাম, নয়তো বা সেকালের জামার কাটছাঁট নিয়ে ঠাট্টা করতাম। কিন্তু বাবার সম্পর্কে কৌতূহল ছিল, জল্পনা কল্পনা ছিল, আর জ্ঞান হয়ে দেখতে পেলাম না বলে আক্ষেপ ছিল।

    ওই আলমারি ভর্তি পুরনো বইয়ের মধ্যে কি বাবার উপস্থিতির সৌরভ ছিল? না কি প্রত্যেকটি বইয়ের গায়ে পরিষ্কার অক্ষরে যে নামটি লেখা ছিল, তাতেই সেই নামীর স্পর্শ ছিল?

    কারণ যাই হোক, বাবাকে নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। দিদি আর আমি।

    আমিই বলতাম, বাবাকে দেখতে কীরকম ছিল বল তো দিদি?

    দিদি ভেবে বলত, পিসির দাদা তো৷ পিসির মতোই হবে।

    ওটা আমার পছন্দ হত না।

    বলতাম, দূর, পিসির মতো হলে তো বিচ্ছিরি।

    এই নমু, ও রকম বলতে নেই রে, বলিস না।

    আমি হেসে ফেলে বলতাম, তবে কি পিসিকে খুব সুন্দরী বলা উচিত?

    দিদি হেসে বলত, অতটা বলছি না তা বলে।

    কিন্তু কতটা যে বলতে চাইত তা দিদিও জানত না। নিজস্ব কোনও ধারণা ছিল না দিদির।

    দিদি শুধু দেখতে চেষ্টা করত কাউকে না আঘাত করা হয়, কাউকে না অসম্মান করা হয়ে যায়। কোথাও না ঔদ্ধত্য প্রকাশ হয়।

    আমি যদি বিশেষ কোনও ইচ্ছে, অভিমত বা ধারণার উপর জোর দিতাম, দিদি ক্ষীণ প্রতিবাদ তুলতে না তুলতেই তাতে সায় দিত।

    তাই দিদি পরক্ষণেই বলত, যা বলেছিস, পিসির মতো ছিল না কখনও। ভাইবোন বলেই যে একরকম দেখতে হবে তার মানে নেই। আমাদের মতো যমজ তো আর নয়!

    এ সব বই, সমস্ত বই বাবা পড়েছিলেন মনে হয় তোর? বলতাম আমি।

    দু-তিনটে আলমারি বই পড়ে ফেলা দিদির কাছে সত্যি সমুদ্র-জল পান করার মতোই, তাই দিদি হেসে ফেলে বলত, ধ্যেৎ।

    আমি বলতাম, আমার কিন্তু স্থির বিশ্বাস, সব পড়েছেন বাবা। নতুন বই কিনে কেউ তুলে রাখতে পারে? একটা করে কিনেছেন, পড়ে তবে আলমারিতে সাজিয়েছেন। এই হচ্ছে ঠিক।

    দিদি বলত, এমনি কিনে রেখে দেওয়া যায় না বুঝি?

    আমি বলতাম, যায়। যাবে না কেন? ভাত বেড়ে নিয়ে বসে না খেয়েও কি থাকা যায় না? তবে থাকে কি কেউ?

    তা পদ্যর বইগুলো কি কেউ পড়ে?

    পড়ে না? আমি হি হি করে হাসতাম।

    পড়ে না তো লেখা হয় কেন?

    আহা, সে তো স্কুলে রেসিটেস্যান করতে কিংবা

    আমার হাসির ঝাপটায় দিদির হাসি বন্ধ হয়ে যেত।

    অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে নিজেও হাসত দিদি।

    কিন্তু এসব কথা আমরা খুব ছেলেবেলাতেই কইতাম। বছর আট কি নয় বড়জোর।

    বড় হয়ে তা বলে দিদি অত বোকা ছিল না।

    নিজস্ব একটা স্বাভাবিক বুদ্ধি দিদির মধ্যে গড়ে উঠেছিল। দিদি বুঝতে পারত কোন কথার কী পরিণাম হতে পারে, কোন মনোভাবটা শুভ, আর কোনটা শুভ নয়। পিসেমশাইকে পর্যন্ত বলতে শুনেছি, সুমিতার মতন মেয়ে হয় না। লক্ষ্মী মেয়ে।

    সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য নমিতা নামের মেয়েটার সমালোচনা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সে সমালোচনা নমিতার অনুকূল নয়।

    কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না নমিতার।

    নমিতা ওই বোকা সুমিতার মতো কেয়ার করত না, কে কী ভাবছে। পিসের মতো একটা গাঁইয়া লোকের, বা পিসির মতো একটা নির্বোধ মেয়েমানুষের নিন্দে সুখ্যাতিতে কিছুই এসে যেত না তার।

    বাবার ওই বইয়ের রাজ্যে ছিল নমিতার আশ্রয়।

    সুমিতা আশ্রয় খুঁজত সংসারের মাপা গণ্ডির মধ্যে।

    আশ্চর্য! মানুষ কত বদলায়!

    কত ওলটপালট হয়ে যায় তার চিন্তাধারা! কী অদ্ভুত সিদ্ধান্তেই না পৌঁছতে পারে সে হঠাৎ। আর কত সহজেই ভেঙে পড়ে তার আশ্রয়!

    ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদশটি উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }