Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রাধার চোখে আগুন – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প219 Mins Read0
    ⤷

    ১. দোতলার বাসিন্দা

    পাশের বাড়ির দোতলার বাসিন্দাটির জন্য মন খারাপ হয়ে গেল। এ-দিনের বাড়িঅলা এমন চট করে ভাড়াটে তুলতে পারে এ বড় দেখা যায় না। আজ সাত আট বছর পাশাপাশি আছি। খুব একটা হৃদ্যতা না থাক মোটামুটি সদ্ভাব ছিল। বাড়ির মেয়েদের সঙ্গেই ভাবসাব বেশি ছিল, পাশাপাশি বারান্দায় বা রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা হলে সবিনয়ে কুশল প্রশ্ন করতেন। তেমন দরকার হলে বয়োজ্যষ্ঠ হিসেবে পরামর্শ নিতে আসতেন।

    কোর্ট-কাচারি নয়, তিন মাসের মৌখিক নোটিসে এমন দোতলা খানা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শুনে অবাকই হয়েছিলাম। সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণে ওই দোতলার ফ্ল্যাটে এক-আধবার গেছি। মস্ত বড় দুখানা শোবার ঘর, অ্যাটাচড বাথ, সামনে বড়সড় ডাইনিং কাম সিটিং স্পেস। সংসার একটু বড় হবার দরুন হোক বা কিছুটা রুচির অভাবের কারণে হোক শেষেরটার মালপত্র বোঝাই গুদামঘরের হাল। সুন্দর বড়সড় কিচেন কাম স্টোর রুমেরও একই দৃশ্য। এক কথায় ভদ্রলোকের প্রয়োজন অনুযায়ী দোতলার এই পরিসরটুকু আদৌ যথেষ্ট ছিল না।

    তবু ভদ্রলোক বেশ সুখেই বসবাস করছিলেন। নিজেই আফসোস করে বলেছিলেন, জলের দরের ভাড়ায় এখানে ছিলেন, তিন মাইল দূরে এর চারগুণ ভাড়ায় যে ফ্ল্যাটে যাচ্ছেন সেটা জানো ছোট তো বটেই, এই ফ্ল্যাটের সঙ্গে তার কোনো তুলনাই হয় না।

    আমার স্বাভাবিক প্রশ্ন তাহলে তিনি এত সহজে এই ফ্ল্যাট ছেড়ে যেতে রাজি হলেন কেন?

    কারণ যা শুনলাম সেটুকু একেবারে পাশের পড়শী হিসেবে আমারও খুব ৰাঞ্ছিত মনে হল না। এ বাড়ি যার তিনি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার র‍্যাঙ্কের লোক। জাঁদরেল অফিসার এবং রাশভারী মানুষ। সদ্য রিটায়ার করেছেন। তিন মাসের মধ্যে সরকারি ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। অতএব রিটায়ারমেন্টের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও তাঁর ভাড়াটেকে নোটিশ দিয়েছেন তিন মাসের মধ্যে দোতলার এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে হবে। ভদ্রলোক ওই পুলিশ অফিসারের বোনের দেওর, সেই সুবাদেই এত সস্তায় এই ফ্ল্যাটখানা সহজে পেয়ে গেছলেন তিনি। এত বছর ধরে আছেন, এক পয়সা ভাড়া বাড়ানোর তাগিদও কখনো আসেনি। একেবারে এই বাড়ি ছাড়ার নোটিস। ভদ্রলোকের বউদি অর্থাৎ পুলিশ অফিসারের সেই বোনও আর বেঁচে নেই যে তাঁর শরণাপন্ন হবেন। অতএব বাড়ির মালিকের কাছেই ছুটে গেছিলেন। একটাই আরজি, দু’বছর আগে একতলায় যে মাদ্রাজী ভাড়াটে এসেছেন তাকে তোলা হোক, একতলার এখন যা ভাড়া তিনি তাই দেবেন এবং একতলার ফ্ল্যাটে নেমে যাবেন।

    বাড়ির পুলিশ অফিসার মালিক এটুকু শুনেই নাকি বিরক্ত, বলেছেন, সেটা করতে হলে কেসের ব্যাপারে দাঁড়াবে, তাছাড়া এক তলার ফ্ল্যাটে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাত্র ফ্যামিলি, তিনি নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চান–ওই ফ্যামিলি চলে গেলে একতলাও আর ভাড়া দেবেন না। অনুনয়ের জবাবে তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, আমার দরকারে ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবে এই কড়ারে তুমি ঢুকেছিলে, এখন সেই মতো ব্যবস্থা করো।

    একে আত্মীয়, আর এই রকম কথাই হয়েছিল বটে। অনেকে ফ্ল্যাট আঁকড়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু ভদ্রলোক আর ঝামেলার মধ্যে যেতে চান না। সদ্য রিটায়ারড, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার, তাঁর প্রতিপত্তি কম হবার কথা নয়। ফ্ল্যাট ছেড়েই দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর ক্ষোভটুকু স্পষ্ট। বলেছেন তাঁর দোতলার দখল চাই, আর আমাকে একতলাটা দেবেন না, এটাই কথা–তাঁর তো দোতলায় ওঠার সিঁড়িও আলাদা, আমার বড় ফ্যামিলিতে তাঁর কি অসুবিধে হত বলুন তো? তাছাড়া নিজের বউ নেই, এক ছেলে তার বউ নিয়ে কোম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটে থাকে, আর এক মেয়ে, তার বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেছে, দুজনেই তারা বাপকে মাথায় করে রাখার জন্য তৈরি তবু আমাকে উচ্ছেদ করে তার এখানেই এসে ওঠা চাই–থাকার মধ্যে সঙ্গে থাকবে পুরনো একজন কমবাইনড হ্যান্ড আর বড়জোর একটা চাকর।

    ভদ্রলোকের এই ক্ষোভ আমার মনে অবশ্য দাগ কাটেনি। রাশ ভারী মানুষ, নিজের সঙ্গতি থাকলে অবসর নিয়েই ছেলে বা মেয়ের আশ্রিত হতে যাবেন কেন? ঘরে স্ত্রী না থাকার অভাবটা কত বড় এ-ও তাঁরই সমস্যা। কি লোক কেমন লোক কিছুই জানি না, পাশাপাশি বাড়ির দোতলার দুই সামনের বারান্দার মধ্যে বড়জোর সাত গজ ফারাক। দুবাড়ির মহিলারা তো যে যার বারান্দায় দাঁড়িয়েই কথাবার্তা চালান। সকালে বিকেলে এই সামনের বারান্দায় আমার অনেকক্ষণ পায়চারি করা অভ্যেস। লাগোয়া বারান্দায় চলতে ফিতে একজন দাপটের রিটায়ারড পুলিশ অফিসারের মুখ দেখতে হবে এটা পছন্দ না হওয়া নিজেরই মনের প্রসারতার অভাব হয়তো। আমাদের দেশের পুলিশদের আপনার জন ভাবাটা নীতির কথা আর কেতাবি কথা। কিন্তু কতজনে তা ভাবেন সে প্রসঙ্গ থাক।

    একজন বড় ফ্যামিলি নিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেলেন দেখলাম। আর একজনের আসার তোড়জোড়ও দেখছি। দোতলার ফ্ল্যাটের সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মনে হল ভাড়াটে কনট্রাক্টর আর মিস্ত্রীই যা করার করছে। মাঝে মাঝে গাড়ি হাঁকিয়ে দু’জোড়া অল্প বয়সী দম্পতীকে তদারকে আসতে দেখি। মনে হয় তারা রিটায়ার পুলিশ অফিসারের ছেলে-ছেলের বউ আর মেয়ে-জামাই হবে। আর একটি মাঝবয়সী লোককেও দেখি মাঝে মাঝে। সে ঠিক চাকর পর্যায়ের না, আবার ঠিক বাবুমানুষও না। দুইয়ের মাঝামাঝি গোছের একজন।

    সংস্কার কেবল দোতলার ফ্ল্যাটেরই হল। আর রং যখন হল গোটা বাড়িটাতেই রঙের পালিশ পড়বে জানা কথা।

    প্রথমে একটা লরি এলো, তাতে মালপত্র খুব বেশি নয়। চকচকে বড় খাটের খোলা পার্টস, জাজিম তোষক বালিশ ইত্যাদি ফ্রিজ, সুন্দর সোফাসেট, টিভি সেট, কাচ বসানো স্টিলের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আলনা খোলা ডাইনিং টেবিল কাটলারি ইত্যাদি। আমার ধারণা এর আটগুণ মাল অন্তত ওই দোতলা থেকে বেরিয়েছে, আর সে মাল একটা লরিতে কুলোয়নি, এই মাল দেখে অন্তত মনে হল যিনি আসছেন তিনি ছিমছাম থাকতে ভালবাসেন, গৃহিণী শূন্য সংসারে এটাই স্বাভাবিক। লরিতে মালের সঙ্গে এলো সেই মাঝবয়সী না-বাবু না-চাকর গাছের লোকটি।

    সেটা ছিল এক শুক্রবারের সকাল। ভাবলাম দুপুর বা বিকেলের মধ্যে বাড়ির মালিকের শুভাগমন হবে। কিন্তু রাতের মধ্যেও তাঁকে বা অন্য কোনো লোককে দোতলার ফ্ল্যাটে দেখা গেল না।

    পরদিন শনিবার। সপ্তাহের এই দিনটিতে বাঙালিকে গৃহপ্রবেশ বা বাড়ি-বদল করতে কমই দেখা যায়। সকাল আটটা নাগাদ আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে। পর পর তিনখানা গাড়ি পাশের বাড়ির ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার মধ্যে সামনের আর পিছনের চকচকে ফিয়েট গাড়ি দুটো আমার আগেই দেখা। সেলফড্রিভন, পাশে যার-যার স্ত্রী–যাদের এক-জোড়া মেয়ে-জামাই অন্য জোড়া ছেলে-ছেলের বউ হবে বলে বিশ্বাস। মাঝের ডাভ-গ্রেরঙের চকচকে অ্যামবাসাডারখানাও সেলফড্রিভন। চালকের আসন থেকে যিনি নামলেন সকলেরই অনুমান তিনিই ছোট্ট এই নতুন রং-পালিশ করা বাড়ির মালিক হবেন। সকলের অনুমান বলতে আশপাশের প্রত্যেক বাড়িরই একতলা দোতলায় দুই একজন করে নবাগত পড়শীর মুখখানা দেখার আগ্রহে দাঁড়িয়ে গেছল। পাড়ার সকলের সঙ্গেই সকলের মৌখিক ভাব-সাব, তার মধ্যে রিটায়ার করলেও পদস্থ পুলিশ অফিসারের ছাপ থাকায় এই একজন পাড়াগোত্ৰীয় হবেন না, সকলেরই হয়তো এই ধারণা। তাই প্রথম দর্শনে চোখে মেপে নেওয়ার আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন, পাশে সেই না-বাবু না-চাকর মানুষটি।

    ভদ্রলোক সৌম্যদর্শন এবং ভারিক্কি চালের মানুষই বটে। পাকা হাতে ফুটপাথ-ঘেঁষে গাড়ি থামিয়ে নামলেন। পরনে পাট ভাঙা সাদা পাজামা, গায়ে নেটের গেঞ্জির ওপর দুধ-সাদা ফিনফিনে বুক-খোলা পাঞ্জাবি, বোতামের জায়গায় সোনার চেনে আটকানো সোনার বোতাম, ডান হাতের এক আঙুলে বড়সড় একটা হীরের আঙটিই হবে, অন্য হাতের রিস্টওয়াচ আর ব্যাণ্ড দুইই স্টেনলেস স্টিলের। পায়ে হরিণের চামড়ার শৌখিন চপ্পল। গায়ের রং মোটামুটি ফর্সা, পরিমিত লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চুল ছোট করে ছাঁটলে ব্যক্তিত্বের ছাপ বাড়ে এমন একটা ধারণা পুলিশ অফিসারদের আছে কিনা জানি না। তবে এঁকে ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক দেখাচ্ছে সন্দেহ নেই।

    গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট চোখে নিজের বাড়ি খানা দেখলেন। ততক্ষণে সামনে-পিছনে দুই ফিয়াটের দু-জোড়া দম্পতীও তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেখামাত্র কোন্ জোড়া ছেলে-ছেলের বউ আর কোন্ জোড়া মেয়ে-জামাই সেটা এক নজরেই বোঝা গেল। ভাইবোনের মুখের আদল বাপের সঙ্গে মেলে। ভদ্রলোক প্রসন্ন মুখেই ফ্ল্যাট বা বাড়ি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করলেন বোধহয়, কারণ বাকি চারজনকেই হৃষ্টমুখে মাথা নাড়তে দেখা গেল। নিজের বাড়ি পর্যবেক্ষণের পর ভদ্রলোক পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে চাক্ষুষ বিবেচনার আশাতেই সম্ভবত একবার চারদিকে ঘুরে দেখলেন। আমার সঙ্গে এবং অনেকের সঙ্গেই চোখাচোখি হল বটে, কিন্তু সেটা বিচ্ছিন্ন-ভাবে কারো সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়।

    গ্যারাজের পাশের সিঁড়ি ধরে একে একে সকলে চোখের আড়াল হলেন। সকলের কি ধারণা হল সেটা একজনের অভিব্যক্তি থেকেই আঁচ করা যেতে পারে। রাস্তার উল্টো দিকে আমার মুখোমুখি বাড়ির দোতলার সমবয়সী ভদ্রলোকটি ব্যঙ্গোচ্ছল মুখে দুদিকে দুই বাহু প্রসারিত করলেন। অর্থাৎ নাগালের বাইরে একজন মস্ত মানুষ এলেন। গাড়ি তিনটেই হয়তো এরকম মূল্যায়নের কারণ। নিজের গাড়ি, ছেলের গাড়ি আবার মেয়ের গাড়ি। পুলিশ অফিসারের এমন সৌভাগ্য সকলে সাদা চোখে দেখে না। আমার কেবল মনে হল একজন অভিজাত পুরুষ একেবারে কাঁধ-ঘেঁষে কায়েম হয়ে বসলেন। তা বসুন। আমার আর কি যায় আসে। আগের বাসিন্দাকে নিয়েও আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল না, এর বেলায় হয়তো সেটুকু আরো কমবে।

    দিন-পনেরো যেতে এটুকু বোঝা গেল নবাগত পড়শীটি যতই রাশভারী পুলিশ অফিসার হয়ে থাকুন, নিজেকে খুব জাহির করার লোক নন। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। সন্ধ্যার দিকে কেবল দু’জোড়া মুখই আসতে যেতে দেখি। মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউ। না-বাবু না-চাকর লোকটি কমবাইণ্ড হ্যাণ্ড। তাকে হাট-বাজার করতে দেখি, আবার গাড়ি চালাতেও দেখি। কোথাও যাবার দরকার না থাকলেও রোজই সে-গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে, স্টার্ট দেয়, দু-চার মিনিট চালিয়ে আবার গ্যারাজ করে। একটা অল্পবয়সী চাকর আছে, বাড়ির কাজের সঙ্গে গাড়ি ধোয়া মোছাও তার ডিউটির মধ্যে পড়ে হয়তো। কিন্তু তাদের প্রভু অর্থাৎ আমার কাঁধ-ছোঁয়া পড়শীটির অস্তিত্ব প্রায় চক্ষু-কর্ণের অগোচর।

    গত পনেরো দিনের মধ্যে বড় জোর পাঁচ-সাতবার তাঁকে বারান্দায় দেখেছি। দুই-একবার হাঁটেন, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে খানিক রাস্তা দেখেন, ভিতরে চলে যান। ইদানীং আমিও সকালে বেরুতে পারছি না। শারীরিক অসুস্থতাই বড় কারণ, তার ওপর লেখার চাপ। সকালে বিকেলে বারান্দাতেই খানিক পায়চারি করি। তখন চোখাচোখি হয়। তিনিও নিস্পৃহ, আমিও। খবরের কাগজ এলে বারান্দায় পাতা ইজিচেয়ারে বসেই অনেকক্ষণ ধরে পড়েন। তখন মুখ দেখা যায় না। দিন সাত-আট বাদে একদিনই কেবল দু-চারটে কথা হয়েছিল। সকালে তিনি তাঁর ছোট্ট বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। আমার দোতলার বারান্দা তাঁর ডবল হবে। নিজের অগোচরে আমি হয়তো একটু জোরেই হাঁটছিলাম। একবার দুই বারান্দা-প্রান্তে মুখোমুখি হতে মৃদু হেসে পরিচিত জনের মতোই বললেন, আপনি তো ভালই মর্নিংওয়াক সেরে নিচ্ছেন দেখছি–

    গলা সেই প্রথম শুনলাম। বেশ ভারী পুষ্ট কণ্ঠস্বর। আমি সৌজন্যের দায়ে একটু হেসে দাঁড়িয়ে গেলাম।

    –লেক তো কাছেই, লেকে যান না কেন?

    সবিনয়ে জবাব দিলাম সেটাই অভ্যাস, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাই বাদ পড়ছে।

    বললেন, আমারও সেই অবস্থা, এখানে আসার আগেই ছকে রেখেছিলাম রোজ সকালে লেকে হাঁটব, আসতে না আসতে কি-রকম একটা গলার ট্রাবল শুরু হয়ে গেল।

    ব্যস আর কোনো কথা নয়, তাঁর কাগজ এলো, সেটা নিয়ে তিনি ইজিচেয়ারে বসে গেলেন।

    এধরনের আলাপের মধ্যেও একটু আভিজাত্যের গন্ধ পেলাম। কোনো কারণ নেই, তবু মনে হল দু-হাত কপালে তোলার প্রাথমিক সৌজন্যও বাতিল করে তিনি যেন দুটো কথা বলে আমাকে একটু অনুগ্রহ করলেন।

    এ-রকম ভাবার একটু কারণও ছিল। রাস্তার উল্টোদিকে মুখোমুখি বাড়ির সমবয়সী ভদ্রলোকটি মাঝে মাঝে গল্প করতে আসেন। নিন্দে না করেও বলা যায় বয়েস অনুযায়ী ভদ্রলোক একটু বেশি রসিক এবং প্রতুলভাষী। নাম অমর গাঙ্গুলী, কাজের সময় এসে বসলে তাঁকে বিদায় করতে বেগ পেতে হয়। দিন তিনেক আগে এসেই তিনি জিগ্যেস করেছিলেন, কি মশাই জাঁদরেল পুলিশ অফিসারের ঘর থেকে সন্ধ্যার পর বেশ হুইস্কির গন্ধটগ্ধ পাচ্ছেন তো?

    -না তো–কেন?

    -সে কি মশাই, সকালেই চলে আর রাতে চলে না? লেখক হয়েও আপনি এমন বে-রসিক।

    তারপরেই এ উচ্ছলতার কারণ ব্যক্ত করলেন। রাস্তার কোণের দত্ত বাড়ির কন্ট্রাক্টর দত্ত সহ দুদিন আগে সকাল দশটায় কর্তব্যের খাতিরে নতুন পড়শীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় করতে এসেছিলেন (আমরা জানি বিনা স্বার্থে এটুকু তিনি করেন না), তা আপনার নতুন নেকসট ডোর নেবার ঘোষ সাহেব (ঘোষ যে এই প্রথম শুনলাম) তখন গরম জলে ব্রাণ্ডি মিশিয়ে সিপ করছিলেন, দত্ত সাহেবকে জানালেন গলার ট্রাবলের জন্য খাচ্ছেন, আর এ-ও জানিয়ে দিলেন বেশি কথা বলা ডাক্তারের বারণ। সাদা কথায় দু-পাঁচ কথার পরেই বিদায় করলেন, বুঝতে পারছেন?

    বুঝেও আমি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করিনি বা কথা বাড়াইনি।

    এই কারণেই হয়তো ঘোষ সাহেবের ও-ভাবে যেচে কথা বলার মধ্যে আমি অনুগ্রহের আভাস আবিষ্কার করেছিলাম।

    কিন্তু পরের সন্ধ্যায় একটা ব্যাপার দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। আমি সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। নিজের বারান্দায় ঘোষ সাহেবও। আমাদের ঠাকুর ঘরে নারায়ণের সন্ধ্যারতি শুরু হল। শঙ্খ কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠল। এটা নৈমিত্তিক ব্যাপার ও-বারান্দায় ঘোষ সাহেবের মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু রাস্তার আলোয় তাঁর অবয়ব ঠিকই দেখা যাচ্ছে। দেখলাম তাঁর হাত দুটি যুক্ত হয়ে কপালে উঠল। তারপর যতক্ষণ এদিকে শয়ন আরতি চলল, (কম করে সাত আট মিনিট হবে) ততক্ষণ এই দুই হাত কপালে যুক্ত হয়েই রইলো।

    অভ্যাসে হাত আমাদেরও কপালে ওঠে, সেটা পাঁচ-সাত সেকেন্ডের জন্য। এতক্ষণ ধরে এই নিবিষ্ট প্রণাম বা শরণ দেখব এ আমার কাছে কেন যেন প্রত্যাশিত ছিল না। বড় পুলিশ অফিসার ছিলেন বলেই এই প্রণাম দেখে যা প্রথমে মনে এলো সেটাকে সুস্থ চিন্তা বলা যাবে না। সে কথা থাক।

    সন্ধ্যা থেকে রাত ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় আমার এই সামনের বারান্দায় বসে বা পায়চারি করে কাটে। ভক্তির ব্যাপারটা আরো দুই-একদিন লক্ষ্য করলাম। ও-সময়ে সব-দিন অবশ্য ভদ্রলোক বারান্দায় থাকেন না। সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আমি রেলিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে। ফুটপাথ ঘেঁষে ঘোষ সাহেবের অ্যামবাসাডার গাড়িটা থামলো। না-বাবু না-চাকর লোকটি চালকের আসনে। সে নেমে এসে পিছনের দরজা খুলে দিতে আটপৌরে বেশ-বাসের একটি রমণী গাড়ি থেকে নামল। খুবই সাধারণ বেশ। গায়ে কোনো গয়না নেই। মাথায় ছোট ঘোমটা। সন্ধ্যায় না হোক দিনের আলোয় বেশ টান ধরেছে। কপালে সিঁথিতে সিঁদুর আছে কি নেই ঠাওর হল না। পায়ে রাবারের চপ্পল। গাড়ি থেকে না নামলে বাড়ির কাজ-করা ভদ্রগোছের মেয়েও ভাবা যেত। যতটুকু নজরে এলো, কালোর ওপর বেশ সুশ্রী আর স্বাস্থ্যের অধিকারিণী মনে হল। লম্বা গড়ন। বয়েস বছর আঠাশ-তিরিশ হতে পারে।

    দিন কুড়ির মধ্যে মেয়ে আর পুত্রবধুকে অনেক বারই দেখেছি। একে আর কোনদিন দেখিনি।

    সামনে তাকিয়ে দেখি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে অমর গাঙ্গুলীও ঝুঁকে আগ্রহ সহকারে লক্ষ্য করছেন। রমণীটি চোখের আড়াল হতে আমার সঙ্গে চোখাচোখি। মাথা ওপর দিকে উঁচিয়ে ইশারায় যে প্রশ্ন ছুড়লেন, তার একটাই অর্থ, কে হতে পারে?

    ঠোঁট উল্টে ভিতরে চলে এলাম। এ ধরনের কৌতূহল কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। আত্মীয় পরিজন কেউ হতে পারে, ছেলে বা মেয়ের বাড়ির কেউ হতে পারে। এমন কি সদ্য নিযুক্ত কোনো রাঁধুনী-টাঁধুনি হতে পারে যে বাড়ি চেনে না বলে গাড়ি করে নিয়ে আসা হল।

    আধ-ঘণ্টাখানেক বাদে মনে হল ওই দোতলার ফ্ল্যাট থেকে গানের গলা কানে আসছে। পায়ে পায়ে কোণের ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ালাম। সামনের ঘর নয়। রাস্তার দিকের ঘর থেকেই গান ভেসে আসছে। মেয়ের গলা যখন, যে খানিক আগে এলো সে ছাড়া আর কে হতে পারে। বাজনা-টাজনা নেই, খালি গলার গান। গানের কথা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না, তবে গলা চড়লে ভক্তিমূলকই মনে হচ্ছে। দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার মতো খুব উঁচুদরেরও মনে হল না আমার। তবে গলাটি বেশ নিটোল মিষ্টি। ভাবের আবেগও একটু আধটু আঁচ করা যাচ্ছিল।

    ঠায় দাঁড়িয়ে শুনিনি, খান তিন-চার গান হল বোধহয়। মাঝে মাঝে সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছিলাম। ভদ্রলোকের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, গ্যারাজ করা হয়নি। গান শেষ হবার পনেরো বিশ মিনিট বাদে মেয়েটিকে আবার গাড়িতে এসে উঠতে দেখলাম। ভদ্রলোক তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন।

    এবারে আমার কৌতূহল একেবারে হয়নি বললে সত্যের অপলাপ হবে। কিন্তু সেটা অস্বাস্থ্যকর বা অশোভন কিছু নয়। কৌতূহল একটু ভদ্রলোকটিকে নিয়েই। ওই ফ্ল্যাটের আগের বাসিন্দাটি বলে গেছলেন, যিনি আসছেন তিনি রাশভারী মানুষ, জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন, নিরিবিলি-নির্ঝঞ্ঝাটে থাকতে চান বলেই দূর সম্পর্কের বড় সংসারের আত্মীয়টির নিচের তলাতেও ঠাঁই হয়নি। সবই মিলছে।–সকালে গরম জলের সঙ্গে ব্রাণ্ডি চলে, পাড়ার কেউ সৌজন্যে আলাপ করতে এলে দু’কথায় তাকে বিদায় করে দেওয়া হয়–আবার রাতে এ-বাড়িতে যতক্ষণ ঠাকুরের শয়ন আরতি চলে ততক্ষণ ভদ্রলোকের প্রণামের জোড়হাত কপাল থেকে নেমে আসে না, একলা বাড়িতে এই বয়সের একটা মেয়ে এসে তাঁকে গান (যদিও ভক্তিমূলক) শুনিয়ে যায়, তাকে গাড়ি করে নিয়ে আসা হয়, পৌঁছে দেওয়া হয়–এরকম মানুষ সম্পর্কে লেখকের কৌতূহল তার পেশার অঙ্গ।

    আরো দিন তিন-চার বাদে অন্তরঙ্গ আলাপের অভিনব সূত্রপাত ঘটল। দোতলার কোণের ঘরে বসে আমি লিখি। সামনের দরজার পর্দা তখন তোলাই থাকে। কারণ লিখতে লিখতে মুখ তুললে আকাশের অনেকটা দেখা যায়। সেটা ভালো লাগে। আবার ওদিকে ফালি বারান্দার এ-মাথায় কেউ এসে দাঁড়ালে এ-ঘর তখন বে-আবরু। ঘরের সবটাই দেখা যায়। কিন্তু সে-রকম ইচ্ছে না থাকলে কেউ আর এখানে এসে দাঁড়াবে কেন? তাই আমার লেখার ব্যাঘাত বড় একটা ঘটে না। সেদিন নিবিষ্ট মনেই লিখছিলাম। হঠাৎ মুখ তুলে দেখি ও-দিকের রাশভারি পুলিশ অফিসারটি তাঁর বারান্দার কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এই ঘরের দিকেই চেয়ে আছেন। চোখাচোখি হতে সামান্য অপ্রস্তুত। হাসি-হাসি মুখ করে ডান হাত তুলে সামনের দিকে একটু নাড়লেন, অর্থাৎ, ডিসটার্ব করে ফেললাম, বসুন বসুন, উঠতে হবে না। তাড়াতাড়ি সরে গেলেন।

    কলম রেখে আমি উঠতেই যাচ্ছিলাম বটে।

    সেই সন্ধ্যার খানিক আগে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই উনি আমার দিকে এগিয়ে এলেন। মনে হল আমার দেখা পাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমিও এগোলাম।

    -ফ্রি আছেন? একটু আসব?

    ব্যস্ত হয়ে বললাম, আসুন আসুন

    –আপনি হার্ট পেশেন্ট শুনেছি, আপনি নিচে না নেমে আমি ওপরে উঠলে অসুবিধে হবে না তো?

    -কিছু না, আসুন।

    আমি সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালাম। প্রায় এক মাস বাদে এই আলাপের আগ্রহ, আবার আমি হার্ট পেশেন্ট এও শুনেছেন।

    নিচে পায়ের শব্দ শুনে আমি দু-ধাপ নেমে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানালাম, আসুন–

    বেশ বলিষ্ঠ পদক্ষেপে উঠে আসতে আসতে বললেন, একটু বাদেই হয়ত লিখতে বসবেন, এসে ডিসটার্ব করলাম না তো?

    হেসে বললাম, খুব চাপ না থাকলে রাতে আমি লিখি না– কিন্তু আমি লিখি, আমি হার্ট পেশেন্ট, এসব খবর আপনাকে কানে কে দিলে?

    আমার লেখার ঘরে তাঁকে এনে বসালাম। একটু জোরেই হেসে তিনি আমার কথার জবাব দিলেন, আরে মশাই আর বলবেন না, আপনার জন্য কাল রাতে আমার মেয়ে আর বউমার কাছে বেইজ্জত হয়ে গেছি। আমি হলাম গিয়ে চোর-ডাকাত ঠেঙানো আর মিনিস্টার সেক্রেটারি ওপরওয়ালাকে তেল-দেওয়া পুলিশ–আমার নাকের ডগায় কে গুণী লোক বাস করছেন না করছেন পরিচয় জানলেও তাঁর মর্ম বুঝব কি করে বলুন তো? গত রাতে মেয়ে হুকুম করে গেছে, তুমি কালই অবশ্য গিয়ে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করবে, পরে আমরাও যাব।

    ভদ্রলোকের মধ্যে নিজের অপরাধ স্বীকার আর স্তুতি-বচনের সহজ সরলতাটুকু ভালো লাগল। হেসে বললাম, আপনি সত্যিকারের ব্যস্ত মানুষ, আমার মতো লেখক চেনার প্রত্যাশা নিজেরও নেই– আপনার বে-ইজ্জত হবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু আপনার মেয়ে আমার ইজ্জত প্রাপ্য থেকেও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাকে আর আপনার বউমাকে আমার ধন্যবাদ জানাবেন।

    মুখখানা একটু গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন।–উঁহু, এতগুলো ভালো-ভালো কথা তো আমার মনে থাকবে না।

    এরপর হাসিমুখে যেটুকু সমাচার শোনালেন তার সার, এর মধ্যে সামনের দোতলার অমর গাঙ্গুলী আর তার পাশের বাড়ির একতলা দোতলার দুই ভদ্রলোক একসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গেছলেন। কথায় কথায় পড়শীদের প্রসঙ্গ উঠেছে, আমার নাম পরিচয় আর হার্টের কথাও অমর গাঙ্গুলী বলেছেন। তিনি শুনে গেছেন এই পর্যন্ত, কারো সম্পর্কেই তেমন আগ্রহ ছিল না। গেল রাতে মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউ এসেছিল। কথায় কথায় মেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল পাশের বাড়িতে কে থাকে। জবাবে তিনি বলেছিলেন ওমুক নামের একজন লেখক থাকে শুনেছি। শুনেই তারা যেমন অবাক তেমনি খুশি। তারপর মেয়ের ওই অনুযোগ, চোর-ডাকাত আর ওপরওয়ালা ছাড়া দুনিয়ার আর কাউকে তুমি চিনলেই না। ওদের হুকুম কালকের মধ্যে এসে যেন আলাপ করে নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নেন।

    লজ্জা পাচ্ছিলাম। কিন্তু ভালও লাগছিল। লেখক মানেই এ ধরনের পুরস্কারের আশা তার রক্তের মধ্যে। এরপর নিজের পরিচয় দিলেন। এবং আমার প্রশ্নে প্রশ্নে সেটুকু বিস্তৃত হল। নাম অংশুমান ঘোষ, তাঁর বাবা দিল্লি পুলিশের বড় চাকুরে ছিলেন, একমাত্র ছেলেকে আই-পি-এস পরীক্ষায় বসিয়েছিলেন। সেই পরীক্ষার জোরে তিনি লাস্ট হয়েছিলেন কি দুই একজনের আগে ছিলেন সেটা জানা যায়নি। নিজের শরীর স্বাস্থ্যের গুণে কনস্টেবলের চাকরি একটা হতে পারত, বাবার সুপারিশের জোরে কলকাতায় পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকরি জীবন শুরু। তাঁর পিতৃদেবের বিবেচনায় পুলিশের চাকরিই সর্বোত্তম, পরে সুযোগ সুবিধে মতো ছেলেকে দিল্লিতে টেনে নিতে পারবেন এমন আশা হয়তো মনে ছিল। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তার ওপরে তিনটি বোন। বাবা তাদের প্রত্যেককে বেশ বড় ঘরে বিয়ে দিতে পেরে নিশ্চিন্ত। তাঁর একমাত্র দুশ্চিন্তা ছিল এই অপদার্থ ছেলের জন্য। অতএব তাঁর এই বাড়ি আর সঞ্চিত বিত্তের বেশির ভাগই ছেলের ভাগ্যে এসেছে। শেষবয়সে বাবার কলকাতায় এসে বসবাসের ইচ্ছে ছিল বলেই এই বাড়ি। কিন্তু কেবল গৃহ-প্রবেশই করেছিলেন, বাস করার সময় মেলেনি। ছেলের চাকরির সময় বাড়িটা বারো না চৌদ্দ বছরের লিজ দেওয়া ছিল। লিজ খালাস হবার পরেও এখানে বাসের সুযোগ হয়নি, কারণ তখন বেশির ভাগ সময়ই তিনি বাইরে পোস্টেড। মাঝবয়েস পর্যন্ত তো ওসি’ গিরিই করেছেন, কোয়াটার্স-এ থেকেছেন। তারপর তাঁকে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে টেনে নেওয়া হয়েছিল, যখন যেখানে ছিলেন ভালো আস্তানাই জুটেছে। শেষের বছর দুই-আড়াই আরো একটু উচ্চ পদস্থ হতে পেরেছিলেন, রিটায়ারমেন্টের পরে তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের ভাড়াটেকে বুকে দাগা দিয়ে এই ফ্ল্যাট থেকে তুলে নিজে এই প্রথম পৈতৃক বাড়িতে স্থিতি লাভ করেছেন। বছর পাঁচ-সাত হল স্ত্রী মারা গেছেন। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। জামাই মস্ত বড় কোম্পানির বড় দরের এনজিনিয়ার, ছেলেও এনজিনিয়ার, জামাই-ই তাকে নিজের কোম্পানিতে টেনেছে এবং পদস্থ করেছে।

    ভদ্রলোকের কথাবার্তা গম্ভীর গোছের, কিন্তু বেশ সরস।

    হেসে বললাম, ছেলে জামাই দুজনেই এনজিনিয়ার, আপনার তাহলে পুলিশের চাকরির ওপর তেমন টান নেই?

    -–কি যে বলেন, এদেশের মানুষ পুলিশকে কি চোখে দেখে আমার জানতে বাকি! আমার নিজের বিয়ের ব্যাপারে মশাই বাবা মায়ের পছন্দের তিন-তিনটি মেয়ের বাপ ছেলের পুলিশে চাকরি শুনে পিছু হটে গেছল। পুলিশের মেয়ে শুনে আমার এই জামাইয়ের বাপও পিছু হঠার মতলবে ছিল, মেয়েটাকে দেখে জামাই বাছাধন একটু মজে না গেলে এ-বিয়ে হত কিনা সন্দেহ।

    আমি হেসে উঠেছিলাম। তিনিও হেসেই বললেন, সত্যি যা তা সত্যি, আর ছেলের বিয়েও কি পুলিশ বাপ দেখে হয়েছে–হয়েছে তার বিদ্যের ছাপ আর বড় কোম্পানির ভালো চাকরি দেখে। বউমাকে একদিন সে-কথা বলতে সে তো লজ্জায় বাঁচে না।

    যতটুকু দেখেছি ভদ্রলোকের বউমাটি বেশ সুশ্রী, আর মেয়েটিকে সুন্দরীই বলা চলে। চাকরি ক্ষেত্রে আমি মোটামুটি পদস্থ সাংবাদিক ছিলাম, সেই সুবাদে কিছু পুলিশ অফিসারের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও আছে। তাঁদের বিনয় এবং শিষ্টাচার নিয়ে কটাক্ষপাত করছি না, কিন্তু ভদ্রলোকের অন্তরঙ্গ হবার মতো একটু বিশেষ গুণ আছে। এখন অন্তত একে রাশভারী বা জাঁদরেল পুলিস অফিসার বলে মনে হচ্ছে না। হতে পারে কর্মক্ষেত্রে তাই ছিলেন, কিন্তু ভিতর সরস না হলে প্রথম আলাপে সৌজন্যের পালিশই বেশি চোখে পড়ত।

    গল্প থামিয়ে জিগ্যেস করলাম, চা হবে কি কফি আগে বলুন?

    –দুটোর একটা হবেই? তাহলে চা-ই বলুন, আর সেটা আসার আগে আপনার এই পর্দাটা ফেলে দিন, আমার বারান্দা থেকে হীরু ব্যাটার বাবার চোখে না পড়ে। হাসছেন।

    -হীরু কে?

    হীরু হল হীরেন্দ্রচন্দ্র দাস, ছেলেবেলায় ছিল চাকর, প্রমোশন পেতে পেতে রান্নার ঠাকুর হয়েছে, বাজার সরকার হয়েছে, ড্রাইভার হয়েছে, আর হালে মেয়ের আস্কারা পেয়ে এখন আমার গার্জেন হয়ে বসছে–দিনে কত পেয়ালা চা খাই মেয়ের কাছে রিপোর্ট করে।

    বুঝলাম এ সেই না-বাবু না-চাকর গোছের লোকটি। জিগ্যেস করলাম, খুব বেশি খান নাকি?

    কোথায় বেশি, দিনে রাতে পাঁচ-ছ কাপ–তবে ইদানীং গলার ট্রাবলের অজুহাতে একটু বেশি হয়ে যাচ্ছিল–

    চা বলে এলাম। প্রথম বাক্যালাপে গলার ট্রাবলের দরুন লেকে বেড়াতে যেতে পারছেন না বলেছিলেন মনে পড়ল। আর সামনের বাড়ির অমর গাঙ্গুলীর ভাষায় সেই অজুহাতে সকালেই গরম জল সহযোগে ব্রাণ্ডি চলছিল–এ নাকি কোণের বাড়ির কনট্রাক্টর দত্ত সাহেব স্বচক্ষে দেখে গেছেন। জিগ্যেস করলাম, আপনার গলার কি ট্রাবল?

    -কে জানে, গলার স্বর মাঝে মাঝে কেমন ফ্যাসফেসে হয়ে যায়, আর ভিতরে কি-রকম চাপ চাপ লাগে–মেয়ে শুনে থ্রোট স্পেশালিস্টের কাছে টেনে নিয়ে গেল, তিনি দেখেশুনে বললেন কিছুই না, ফ্রিজের জল বা ঠাণ্ডা জিনিস কম খাবেন। একটু যত্নটত্ন করলে অবশ্য কমে যায়, তা আমি যত্নটা বেশির ভাগ চায়ের ওপর দিয়েই চালাচ্ছি।

    চা বিস্কুট আসতে বিস্কুটের প্লেট সরিয়ে দিয়ে শুধু চায়ের পেয়ালাই টেনে নিলেন। প্রথম চুমুকের পরেই খুশির মন্তব্য, খাসা চা–আমার লুকিয়ে চা খাবার একটা জায়গা হল।

    আমি হেসেই বললাম, খুব আনন্দের কথা, কিন্তু আপনার মেয়ের বেশি শত্রু হয়ে উঠতে আমি রাজি নই–

    চা খেতে খেতে মাথা নাড়লেন, যা বলেছেন, যত বয়েস হচ্ছে মেয়েটার চোখে আমি ততো যেন খোকা হয়ে যাচ্ছি। আমার পেয়ালা অর্ধেক খালি হবার আগেই তাঁর পেয়ালা শেষ। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, যাক, এতক্ষণ তো কেবল নিজের কথাই হল, এবারে আপনার কথা শোনান, নইলে মেয়ে আর বউমাকে কি বলব?

    কিছুই বলতে হবে না, কেবল তারা এলে একদিন এখানে পাঠিয়ে দেবেন, বলবেন খুব খুশি হব।

    –বাঃ, আমার দায়িত্ব শেষ।–তা আপনি হার্ট পেশেন্ট বলতে কি–বয়েস তো তেমন বেশি মনে হয় না?

    –বছর পাঁচেক আগে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, তারপর থেকে একটু আধটু ধকল পোহাতে হচ্ছে। জবাব সেরে বললাম, আপনি সবে রিটায়ার করলেন, আপনার চোখেও বয়েস বেশি মনে হয় না?

    হাসতে লাগলেন।–এই তো আবার জোচ্চুরি কবুল করিয়ে ছাড়লেন, তবে অপরাধটা আমার নয়, আমার পিতৃদেবের, য়ুনিভার্সিটির সার্টিফিকেটে বয়েস তিন বছর কমানো ছিল, অন্য দিকে কর্তারা এক বছর এক্সটেনশনে রেখেছিলেন, তাহলে আসল বয়েস আমার বাষট্টি পেরিয়ে গেল।

    বললাম, তবু আমার থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে আছেন।

    -বলেন কি! দেখে তো মনে হয় না, কি আর করা যাবে, সিনিয়রিটি মেনে নিলাম। এবারে লেখার কথা শুনি, আপনার অনেক গল্প নাকি সিনেমা হয়েছে নাটক হয়েছে, তার মানে আপনি কেবল উপন্যাস আর গল্প লেখেন?

    -অনেকটা তাই বলতে পারেন।

    বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন।-আমার গল্প উপন্যাস পড়ার দৌড় শরৎবাবু পর্যন্ত। একবার বঙ্কিম ধরেছিলাম, বড় বড় শব্দ আর তার অলংকার ডিঙোতে পারলাম না–রবীন্দ্রনাথও চেষ্টা করেছিলাম, চোখ ঢোকে তো মন ঢোকে না, লজ্জার কথা আর বলবেন না।

    বলার মধ্যে এতটুকু দম্ভ নেই বলেই ভালো লাগছে।

    –এবারে আমার আর একটু আরজি আছে।

    আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির জবাবে বলেন, বাড়ির কারো যদি অসুবিধে না হয় আপনাদের পুজোর ঘরখানা একবার দেখব।

    চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম, অসুবিধের কি আছে, আসুন–

    তিনিও উঠলেন। রোজ রাতে কাঁসর ঘন্টা শঙ্খ বাজে, ভারি ভালো লাগে–আপনাদের গৃহ দেবতা হলেন…?

    –নৃ-সিংহ নারায়ণ, তিনশ’ বছরের বিগ্রহ, দেশের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন, শুনেছি এককালে স্বপ্নাদিষ্ট মানুষ অনেক দূর থেকে পুজো দিতে আসত–পার্টিশনের গুঁতোয় দেবতাটিকেও ভিটে ছাড়া হতে হয়েছে। ঠাকুরঘরের দিকে যেতে যেতে হেসে জানান দিলাম, আমাদের দারুণ কিছু ভক্তি-নিষ্ঠা আছে ভাববেন না যেন–বাবা মায়ের আমলে যা চলত এখনো সেটা চলে আসছে।

    ছোট্ট মন্তব্য, তাই বা কম কি।

    পুজোর ঘরের দু-হাত দূরে পায়ের শৌখিন চপ্পল খুললেন। সামনেই কল দেখে হাত ধুলেন, পায়ে জল দিলেন। তারপর দু-হাত যুক্ত করে পুজোর ঘরে ঢুকলেন। ভেবেছিলাম নারায়ণের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত দেখব, জোড় হাতে দাঁড়িয়ে খানিক দেখলেন, মনে হল প্রণামটুকু চোখেই সেরে নিলেন। তারপর এদিকে বড় কালীর পটের দিকে চোখ গেল। কাছে এগিয়ে এলেন, নিরীক্ষণ করে দেখলেন, মনে হল নারায়ণের থেকেও কালীর প্রতিই তাঁর আগ্রহ বেশি। এখানেও যুক্ত হাত আর চোখে প্রণাম। ভারি গলার স্বর খুব মৃদু, বললেন, যেমন সুন্দর তেমনি স্নিগ্ধ, এমনটি সচরাচর চোখে পড়ে না, কোথায় পেলেন?

    –ঠিক বলতে পারব না, মায়ের কালী, পঁয়ষট্টি বছর মা পুজো করে গেছেন, সেই পুজোই চলছে।

    ফিরলেন। মুখখানা ভাব-গম্ভীর। চোখে দূরের তন্ময়তা। এই ভাবান্তরের সঙ্গে চাকরিগত কোনো পাপবোধ জমা দেওয়ার যোগ আছে আজ অন্তত তা মনে হল না।

    আলাপ এরপর মন-খোলা হৃদ্যতার দিকে এগিয়েছে। মানুষটা বাইরে যত রাশভারী গম্ভীর, ভিতরে আদৌ তা নন। তাঁর চাকরির আমলের দাপটের খবর রাখি না, কিন্তু এখনকার গাম্ভীর্যটুকু নিজেকে আড়াল করার আবরণের মতো মনে হয়।

    তিন চার দিনের মধ্যেই এক সন্ধ্যায় তার মেয়ে-জামাই ছেলে ছেলের বউ এসে হাজির। মেয়ে বলল, আসার পাসপোর্ট পেয়ে সকলেই এসে গেলাম।

    শিক্ষার সহজাত বিনয়ের মাধুর্য দেখলাম আবার বেশ সপ্রতিভ হাসি খুশিও। ছেলে দুটোর বড় চাকরির দেমাক নেই, মেয়ে দুটিও নিরহঙ্কার। ছেলে-ছেলের বউয়ের নাম অমিতাভ আর ঊর্মিলা, মেয়ে জামাইয়ের নাম শমী আর দেবব্রত। মেয়ের দুটি ছেলে, বয়েস এগার আর আট। ছেলের একটি মেয়ে, বয়েস সাত। আমি এদের চারজনকে অনেকবারই আসতে যেতে দেখেছি, এদের ছেলেমেয়েদের দেখিনি। শুনলাম, নাতি-নাতনীরা প্রত্যেক রবিবার সকালে দাদুর কাছে আসে আর বিকেলে ফেরে। সেই দিন আবার সকালে আমার ঘরে জোর আড্ডা বসে, আর দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত কনট্রাক্ট ব্রিজ চলে। তাই চোখে পড়েনি।

    মেয়ে শমী আর বউ ঊর্মিলার যেটুকু উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করলাম তা কেবল সাহিত্য নিয়ে। এই কোণের ঘরে বসে লিখি শুনে আগ্রহ সহকারে চারদিক দেখে নিল। উঠে কাচের আলমারির বইগুলোও দেখল। তারপর প্রশ্ন, কখন লিখি, কতক্ষণ লিখি, কিভাবে প্লট সংগ্রহ করি ইত্যাদি। ঊর্মিলা বলেই ফেলল, সামনা সামনি একজন সাহিত্যিককে আমি এই প্রথম দেখলাম।

    আমি যোগ করলাম, এবং খুব হতাশ হলে।

    হাসি ছাড়া এর আর কি জবাব। ছেলে আর জামাইয়ের দিকে ফিরে বললাম, বড় কোম্পানির বড় এনজিনিয়ার–তোমরাও কি সাহিত্য রসিক নাকি?

    সে হেসে সত্যি জবাবই দিল, ছাত্র জীবনে পড়তাম, এখন আর খুব সময় পাই না।

    তার স্ত্রী অর্থাৎ মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে কটাক্ষপাত। মন্তব্য, এখন ওরা কেবল নাটক বা সিনেমা দেখে আপনার সাহিত্য বিচার করে।

    আহত গোছের মুখ করে বললাম, সেটা কি সুবিচার হল?

    বছর বত্রিশ হবে মেয়েটির বয়েস, কিন্তু বেশ প্রাণোচ্ছল। বলল, সেটা বোঝে কে। একটা বইয়ের নাম করে বিচারের সরস নমুনা দিল।–বই পড়ে সিনেমাটা আমার ভালো লাগেনি, ওরও না, তাই বইটা লাইব্রেরি থেকে আনিয়ে ওকে পড়তে দিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে ও আপনার নায়কের তড়িঘড়ি অমন বাড়িটা করে ফেলার ব্যাপারে খুঁত ধরল, বলল, টেকনিকাল ভুল আছে।

    এদের দেখে সত্যি ভালো লেগেছে আর অংশুমান ঘোষ ভদ্রলোকটিকে ভাগ্যবান মনে হয়েছে। যাবার আগে মেয়ে মিনতি করে বলল, আপনি খুব ব্যস্ত জানি, তবু বাবার দিকে একটু চোখ রাখবেন, আপনাকে বাবার খুব ভালো লেগেছে আর আমরাও একজন নামকরা জেঠু পেয়ে গেলাম–বাবা বরাবরই একটু একলা, কিন্তু মা চলে যাবার পর থেকে একেবারে নিঃসঙ্গ, মন খুলে কারো সঙ্গে মিশতেই চান না– আপনি বেড়াতে-টেড়াতে বেরুলে একটু যদি ডেকে নেন খুব ভালো হয়। গলা নিয়ে এখন আবার অসুখ-অসুখ বাতিক হয়েছে, আমি ডাক্তার দেখিয়েছি– কিছুই না।

    এরপর একদা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার অংশুমান ঘোষের সঙ্গে যত মিশেছি, আমার মনে হয়েছে এ-রকম আরো বিশ-পঁচিশজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে যদি ঘনিষ্ঠ হতে পারতাম, দেশের পুলিশ সম্পর্কেই আমার ধারণা বদলে যেত। সকালে বা বিকেলে আমাকে বারান্দায় ঘুরতে দেখলেই সাদর আহ্বান জানান, হাত খালি নাকি, আসুন না একটু গল্প করি। হয়তো এর দু-আড়াই ঘন্টা আগে দুজনে লেক থেকে মনিংওয়াক সেরে ফিরেছি। যাই। তাঁর সঙ্গ শুধু ভালো লাগে না, এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করি। আগের ভাড়াটের সাত-আট বছরের আমলে বিশেষ কোনো আমন্ত্রণে দুই একবার এসেছি। সামনের এতবড় ডাইনিং-কাম-সিটিং স্পেস মাল আর আসবাবপত্রে এমন বোঝাই থাকত যে পাঁচ মিনিটে হাঁপ ধরে যেত। ছাদে খেতে ওঠার জন্য অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য থাকত না। কিন্তু এখন দোতলায় এসে দাঁড়ালে মনেই হবে না এ সেই একই মস্ত হলঘর। সামনের আধখানাটায় শৌখিন গালচের ওপর দুটো তকতকে সোফা আর একটা সেটি পাতা, মাঝে সুন্দর সেন্টার টেবিল। সোফা সেটির কাঁধ-জোড়া রং-মেলানো চারটে টারকিশ তোয়ালে পাতা। হল-এর মাঝখান দিয়ে দু-মাথা জোড়া সুন্দর পর্দার পার্টিশন। বেশির ভাগ সময় ওটা গোটানোই থাকে। হল-এর ও-মাথায় সুন্দর ডাইনিং টেবিলের চারদিকে ম্যাচ-করা ছ’টা চেয়ার পাল। দুদিকের দেয়ালে একটা করে বড় অয়েল পেন্টিং। তার দুদিকে দুটো করে সাজের বাতির ছোট দেয়াল ঝাড়। দেখলেই বোঝা যায় ওগুলো এ রাজ্যের নয়, বাইরের জিনিস। টিভি এমন জায়গায় পাতা যে বসার জায়গা থেকে আবার খাবার জায়গা থেকেও দেখা যায়। এসে দাঁড়ালে পরিচ্ছন্ন রুচির প্রশংসা করতেই হয়। প্রথম দিন এসে আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল, বাঃ!

    খুশি হয়ে অংশুমান বলেছিলেন, এতে আমার কোনো কেরামতি নেই মশাই, আমি ঠাসাঠাসি জিনিস পছন্দ করি না জেনে এই হলঘর আর ঘর দুটো সাজানো নিয়ে আমার মেয়ে বউমা আর হীরু মাথা ঘামিয়েছে। সব ঠিক করে আমাকে যখন বলেছে, রেডি, চলো– আমি কষ্ট করে এসে হাজির।

    বাইরে নয়, প্রথম দিনই আমাকে নিজের শোবার ঘরে এনে বসিয়েছেন। বলেছেন, অন্তরঙ্গ হতে হলে অন্দরে আসতে হয়, চলে আসুন। শোবার ঘর দুটো রীতিমতো বড় আগেই বাড়ির মেয়েদের মুখে শোনা ছিল। দেখেও খুব ভালো লাগল। এতবড় ঘরখানার বৈশিষ্ট্য সবরকমের বাহুল্য বর্জন। দেয়াল ঘেঁষে খাট পাতা, শৌখিন বেডকভারে ঢাকা। রাস্তার দিকের দরজার পাশে একটা গদি-মোড়া ইজিচেয়ার। খাটের উল্টো দিকের দেয়ালে কালীর মস্ত একখানা বাঁধানো ছবি। তার নিচে দেয়ালে কাঠের তাক ফিট করা। তাতে হাতে-কাজ করা সুন্দর সরু রঙিন কাপড়ের ঢাকনা বিছানো। তাকের দুদিকে দুটো ধূপদানীতে তিনটে করে চন্দন ধূপকাঠি জ্বলছে। মাঝখানে স্টিলের রেকাবিতে কিছু পাঁচমিশেলি ফুল। ফোটোতে একশ আট জবার টাটকা মালা। পরে লক্ষ্য করেছি হীরুর ভোরের বাজারের সঙ্গে এরকম একটা করে জবার মালা রোজই আসে। পাশে আর একটা ছোট্ট দেয়াল-তাকে কিছু বই। কি কি বই দেখলাম। স্বামী বিবেকানন্দর কর্মযোগ, গান্ধীজীর ট্রুথ ইজ গড, সংস্কৃত-বাংলা গীতা একখানা, পাশে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের থিইজম অফ ভগবদগীতা, তার পাশে নিবেদিতার কালী, দি মাদার। শেষে পাঁচ খণ্ডের একসেট কথামৃত।

    মন্তব্য করেছিলাম, শাক্ত-বৈষ্ণবের সহাবস্থান ঘটিয়েছেন দেখছি।

    চার কোণে চারটে শান্তিনিকেতনী মোড়া। মেয়ে-জামাই আর ছেলে-ছেলের বউয়ের বসার জন্য ওগুলোর ঘরে ঠাঁই হয়েছে বোধহয়। ব্যস, এতবড় ঘরে আর কিছুই নেই। একটা আয়নাও না। মাঝের খোলা দরজা দিয়ে ও-ঘরে স্টিলের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আলনা ইত্যাদি সাজানো দেখা গেল। আমাকে খাটে বসতে দিয়ে নিজে ইজিচেয়ারটা টেনে বসেছেন। এর পরেও যত বার এসেছি, আমি খাটে উনি ইজিচেয়ারে।

    প্রথম দিনে দু-দশ কথার পর আমি ইচ্ছে করেই ভক্তি প্রসঙ্গে এসে গেছলাম। জিগ্যেস করেছিলাম, ভক্ত পুলিশ অফিসার আপনি আর ক’জন দেখেছেন?

    চোখ গোল করে আমার দিকে চেয়েছিলেন একটু।–আর ক’জন মানে? আমাকে আপনি ভক্ত ধরে নিয়েছেন?

    -নন?

    হাসতে লাগলেন।-না মশাই না, ভক্তের বিশ্বাস সম্বল, আমার সেই ঝুলিতে হাজার ফুটো, আমার থেকে হীরু ব্যাটা খাঁটি ভক্ত, তিরিশ বছর বয়সে ওর বউ মরে গেল, ছেলেপুলেও হয়নি, আমার স্ত্রী ঝোলাঝুলি করল আবার বিয়ে কর, ব্যাটা হাত জোড় করে বলে কি জানেন, সব মেয়েকেই ওর এখন মা ভাবতে ইচ্ছে করে, বিয়ে থা আর ওর দ্বারা হবে না। একজন আমাকে বলল, ঘরে দক্ষিণা কালী রাখো, ধূপ ধুনো ফুল জল দাও–ব্যস বাজার ঢুঁড়ে ও এই ছবি এনে এখানে টাঙিয়ে দিলে, রোজ মালা পরিয়ে ফুলজল ধূপধুনো দেওয়া এখন ওর ডিউটির মধ্যে–আমি বাধা দিইনে বলে আমার যেটুকু পুণ্যি।

    এ নিয়ে আমি আর তর্কে এগোলাম না। রাশভারী মনিবের অনুমোদন ভিন্ন তার শোবার ঘরে এ-ছবি টাঙিয়ে রোজ ধূপধুনো দেওয়া আর একশ আট জবার মালা পরানো কারো পক্ষেই সম্ভব হত না। হেসে আঙুল তুলে তাকের বই ক’টা দেখালাম।–ওগুলোও হীরই পড়ে বোধ হয়?

    আবার হেসে উঠেছেন। তারপর মনে হল তিনি যেন চোখের সামনে কিছু দেখছেন। মৃদু হেসে বললেন, ব্যাপার কি জানেন, মাঝবয়েস পর্যন্ত মনেপ্রাণে আমি পুলিশই ছিলাম, অনেক নিষ্ঠুর কাজ কত অনায়াসে না করেছি।–যে সময়ের কথা বলছি, তখন কর্তাদের অবিবেচনাতেও আমার মন মেজাজ খারাপ, প্রমোশন ডিউ অথচ বছরের পর বছর একটা অজ-জায়গায় পড়ে আছি–সেই সময় একটা ঘটনা আর বিশ্বাসের এক আশ্চর্য নজির দেখে আমার ভিতরে কিরকম নাড়াচাড়া পড়ে গেল।…বুঝলেন, তার পর থেকেই মনে একটা জিজ্ঞাসার উৎপাত শুরু হল। যত ভাবি ততো অথৈ জলে। ওই বইটইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি, যারা লিখেছেন তারা তো আর ফেলনা কেউ নন, পড়ে বুঝতে চেষ্টা করি, ভালোও লাগে অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু নিজের পায়ের তলায় সেই বিশ্বাসের জমির কোনো হদিসই নেই।…তবে একটু লাভ হয়েছে বলতে পারেন, অন্ধ ভক্তি বিশ্বাস বা আবেগে কাউকে কোথাও মাথা খুড়তে দেখলেও এখন বিজ্ঞের মতো হাসতে পারি না বা অশ্রদ্ধা করতে পারি না।

    কান পেতে শুনেছিলাম। কিন্তু লেখকের নাকে রসদের গন্ধ। জিগ্যেস করলাম, যে ঘটনা আর বিশ্বাসের নজির দেখে আপনার এই পরিবর্তন, সেটা কি?

    বিমনা ছিলেন, প্রশ্ন শুনে নিজের মধ্যে ফিরলেন আর আঁতকে উঠলেন।–কি সর্বনাশ! আপনার মতলবখানা কি মশাই? এ নিয়ে কলম ধরলে তো গেছি! দাস ফার অ্যাণ্ড নো ফারদার–ওরে হীরু, আর একটু চা-টা দিবি, না কি? মিটিমিটি হেসে মন্তব্য করলেন, পুলিশ অফিসার চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরেও তার এক্সহিউমড হবার ভয় থাকে– বুঝলেন।

    অর্থাৎ কবর খুঁড়ে মৃতদেহ টেনে তুলে আবার তত্ত্ব-তল্লাশী চলতে পারে।

    এড়িয়ে গেলেও আমার মনের তলায় কৌতূহলের আঁচড় পড়ে থাকল।

    .

    পরের চার মাসের মধ্যে সেই রমণীটিকে আরো পাঁচ ছ’বার দেখলাম। সেই সাদাসিধে বেশবাসের কালো অথচ সুশ্রী দেখতে একজনকে। আমার অনুমানে বয়েস যার আঠাশ তিরিশের মধ্যে। দীর্ঘাঙ্গী, সুঠাম স্বাস্থ্য। হীরু দাস তাকে শেষ বিকেলে বা সন্ধ্যার মুখে কর্তার গাড়ি করে নিয়ে আসে, আবার এক-দেড় ঘণ্টা বাদে গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে আসে। তাকে নিয়ে আসা, বাড়ির দরজায় গাড়ি থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে এসে দরজা খুলে দেওয়া, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে সিঁড়ির দরজা দিয়ে ঢোকা–এটুকু তৎপরতার মধ্যেও হীরু দাসের চোখে-মুখে বেশ একটু শ্ৰদ্ধার ভাব লক্ষ্য করেছি। সে এলে তাকে এদিকের ঘরে নিশ্চয় বসানো হয় না, তাহলে আমার কোণের ঘর থেকে স্পষ্টই টের পেতাম। ওখান থেকে কেউ জোরে কথা বললেই আমার ঘর থেকে কিছু কিছু শোনা যায়। হলঘরের বসার জায়গায় বসানো হলে সেখান থেকে গানের গলা আর একটু স্পষ্ট ভেসে আসার কথা। আমার ধারণা রমণীটিকে হীরু মালিকের শোবার ঘরে নিয়েই তোলা হয়। কিন্তু খটকা বাধে অন্য কারণে। আমার সামনের বারান্দায় দাঁড়ালে ভদ্রলোকের শোবার ঘর তো এক সারিতেই পড়ে। সেখান থেকে গান তো আরো স্পষ্ট শুনতে পাওয়ার কথা। ঘরের দরজা-টরজা বন্ধ করলে যেমন অস্পষ্ট কিছু কিছু কানে আসে, তেমনি শুনি। তাও গলা চড়ালে। আবার, এলে যে গান হয়ই তা-ও না। পরের পাঁচ ছ’মাসের মধ্যে দিন তিনেক মাত্র গান হচ্ছে বোঝা গেছে। গান হলে কিছু তো কানে আসবেই। ঘন্টা সোয়া ঘণ্টা বাদে তাকে আবার গাড়িতে গিয়ে উঠতে দেখি। গাড়ি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত অংশুমান ঘোষকে দোতলার রেলিংএ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। হীরু দাস পৌঁছে দেয় কিন্তু ফেরে কখন তা এখন পর্যন্ত টের পেলাম না।

    গাড়িটা চলে গেলে ভদ্রলোক এক-আধ দিন ঘুরে আমাকেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। মুখ ভালো না দেখা গেলেও রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথাবার্তা হয় না এমন নয়। কিন্তু ওই রমণীকে নিয়ে গাড়িটা চলে গেলেই তিনি সোজা নিজের ঘরে ঢুকে যান।

    এক-আধদিন হয়তো বাদ পড়ে, নইলে রোজই ইদানীং একসঙ্গে লেকে মর্নিংওয়াকে যাই, একসঙ্গে ফিরি। আকাশের অবস্থা সুবিধে না বুঝলে তিনি গাড়ি বার করে আমাকে ডেকে নেন, এর ওপর আমি লিখছি না টের পেলে সকালেও ডাক পড়ে, বিকেলে বা সন্ধ্যার দিকে তো মাঝে মাঝেই পড়ে। সকালে গেলে হীরুর হাতের তৈরি গরম সিঙ্গাড়া বা গরম কচুরি জোটে, বিকেলে বা সন্ধ্যায় এক-এক দিন মাংস পরোটাও এসে যায়। খাওয়ার গল্প থেকে তখন অনেক গল্প অনেক কথা হয়। তার চাকরি জীবনের অনেক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনি। তাই থেকে লেখার খোরাক জোটে। জিজ্ঞেস করি –লিখতে পারি না কপিরাইট সিলড? তিনি হেসে মাথা নাড়েন, বলেন সচ্ছন্দে–তবে আমাকে আড়ালে রেখে মশাই।

    এ পর্যন্ত তাঁর মাল-মশলার নির্ভরে দুটো ছোট গল্প ছাপা হয়েছে। দেখে এবং পড়ে তিনি ছেলেমানুষের মত খুশি। দুবারই বলেছেন, এ থেকে এমন জিনিসও তৈরি হয় মশাই–অ্যাঁ?

    কিন্তু যে রমণীটিকে নিয়ে আমার কৌতূহল দানা বেঁধে উঠছে তার সম্পর্কে নিজে থেকে ভদ্রলোক একটি কথাও বলেন না। হীরু দাস যাকে গাড়ি করে নিয়ে আসে আর গাড়ি করে পৌঁছে দেয়। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে গেলে ভদ্রলোক নিজের বিগত স্ত্রীর গল্প করেন, ছেলে-ছেলের বউ বা মেয়ে-জামাই কবে কি কাণ্ড করে বসেছিল সেই গল্প করেন, চাকরি জীবনের কোলিগ আর উপর ওয়ালাদের নিয়ে কত মজার কথাই সিরিয়াস মুখ করে বলেন, তাঁর মেয়ে শমী তো আমার ওপর দারুণ খুশি–তার বাবা মন খুলে গল্প করার মতো একজন মানুষ পেয়েছেন এ নাকি নিজেই মেয়েকে বলেছেন। কিন্তু ওই একটি বিশেষ রমণীর সম্পর্কে ভদ্রলোক এ যাবত একটি কথাও তোলেননি। গাড়ি করে তাকে নিয়ে আসা হয় আর পৌঁছে দেওয়া হয় একারণেই বিশেষ বলছি। হতে পারে বলার মতো কেউ নয়, কিন্তু এমন যদি হয় ইচ্ছে করেই বলেন না তাহলে আমার কৌতূহল অশোভন গোছের হয়ে দাঁড়াবে।

    তবু এক একবার মনে হয়েছে জিগ্যেস করে বসি। পারিনি অন্য কারণে। এই একই ব্যাপারে পড়শীদেরও কৌতূহল আমাকে একটু দুর্বল করেছে, সংযমীও করেছে। কেউ চোখ বুজে বসে থাকে না, আর রমণীঘটিত বাতাসের আমেজ সব বয়েসেরই মানুষের গায়ে লাগে বোধহয়। মাসে একবার দুবার ওই রমণীটিকে এই পুলিশ অফিসারের বাড়ি আসতে যেতে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই দেখে। যতটুকু সম্ভব লক্ষ্য করে মনে হয়। বিশেষ করে অমর গাঙ্গুলী, আর তার পাশের বাড়ির একতলা দোতলার ভটচায মশাই আর রায়মশাই। মানুষটাকে তাদের দাম্ভিক ভাবাই স্বাভাবিক, কারণ সৌজন্যের দায়েও ভদ্রলোক কারো বাড়িতে পাল্টা দর্শন দিতে যাননি। ব্যতিক্রম কেবল আমি, মুখে সরাসরি না বললেও এটা কারো খুব পছন্দ হয়নি। যাতায়াত করতে দেখেন, একসঙ্গে মর্নিংওয়াক থেকে ফিরতে দেখেন, এমন কি তার মেয়ে-বউয়েরও আমার বাড়িতে আনাগোনা দেখেন। এই সরাসরি না হোক মুখোমুখি বাড়ির দোতলার অমর গাঙ্গুলী ঠেস দিতে ছাড়েন না। সেদিন সন্ধ্যায় আমার এই কোণের ঘরে এসে জাঁকিয়ে বসেছিলেন। প্রথমেই চড়া অভিযোগ, সকাল-সন্ধ্যা আর যে আপনার দেখাই মেলে না, অবসর সময়ের সবটুকুই যে পুলিশ সাহেব নেবারটির দখলে দেখছি!

    ছেঁড়া কাপড়ে তাপ্পি লাগানোর মতো করে জবাব দিয়েছি, নিজের স্বার্থে আমি বরং তাঁর অবসরের খানিকটা কাড়তে চেষ্টা করি।

    –কি রকম? উৎসুক।–লেখার খোরাক-টোরাক পান নাকি?

    –তাছাড়া আর কি, ভদ্রলোকের অনেক অভিজ্ঞতা, খোরাক পেয়ে এরই মধ্যে দুই একটা লেখা ভালো উতরেছে।

    জলে বাস করে কুমীরের লেজের ঝাপটা কে না এড়াতে চায়। আমার স্বার্থের এ-দিকটা অমর গাঙ্গুলীর মাথায়ই আসেনি সেটা পরের কথায় বোঝা গেল।–তাই বলুন, আমরা আরো অবাক হচ্ছিলাম পাড়াসুদ্ধ, লোকের মধ্যে কেবল আপনার সঙ্গেই পুলিশ সাহেবের এত ভাব-সাব কেন! উল্টে আপনার ওপরই একটু অভিমান হচ্ছিল, একবারই সেই কার্টসি ভিজিট দিয়ে গিয়ে তার পাশের বাড়ির মানুষটি যে নামী লেখক সে সুখ্যাতি আমরাই করে এসেছিলাম– তার পরেই দেখি কিনা আমে-দুধে মিশে গেল আর আঁঠি, মানে আমরাই বাদ!

    আমরা বলতে উনি একা নন। কার্টসি ভিজিট দিতে গেছলেন সঙ্গে আরো দুজন। ওঁর পাশের বাড়ির দোতলার রায়মশাই আর একতলার ভটচায মশাই। পুলিশ সাহেবের এই অবহেলা তাদের চিনচিন করে লাগে এবং আলোচনা হয় বোঝা গেল। প্রসঙ্গ বিরক্তিকর। জবাবে শুধু হাসি।

    -তা এই স্বার্থ তো আপনার পেশার অঙ্গ, কিন্তু সাহেবের তো এখন পুলিশের মেজাজ দেখি–আপনার কাছে মুখ খোলেন?

    -খোলাতে পারলে খোলেন।

    –লেখকদেরই ভাগ্য মশাই–তা আপনাকে বলার স্বার্থ কি, ওঁকে গল্পের হিরো-টিরো বানাচ্ছেন নাকি?

    এবার হাসি মুখেই সুর পাল্টালাম।–আপনি, গল্পের অ-আ জানেন না বোঝেন না পড়েন না–কি পেলে আমি কি বানাই আপনাকে কি করে বোঝাই বলুন তো?

    নির্বোধ আদৌ নন। হেসে সামলে নিলেন।–তা যা বলেছেন, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ–আর আপনার এত নাম-যশ কি এমনি এমনি। সঙ্গে সঙ্গে আবার উৎসুক এবং গলা খাটো।–আচ্ছা ও-বাড়ির মেয়ে-বউয়ের সঙ্গেও তো আপনার আলাপ-সালাপ হয়েছে, তারা নিজেদের গাড়িতে আসে যায়–কিন্তু বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে পুলিশ সাহেবের গাড়িতে একটি মেয়ে আসে আর সন্ধ্যের পর ওই গাড়িতেই ফেরে–ভটচায মশাই আর রায়মশাইও দেখেছেন– কে বলুন তো মেয়েটি?

    জানি না।

    সন্দিগ্ধ দু-চোখ আমার মুখের ওপব থমকালে–আপনি তাকে দেখেননি?

    –দেখেছি।

    –আমরাও দেখেছি, তবে ও-ফুটে গাড়ি থেকে নেমে ভিতরে চলে যায়, আর সন্ধ্যার পর ফেরে তাই ঠিক দেখতেও পাই না, বুঝতেও পারি না

    প্রতিবেশীদের আগ্রহ কোন্ পর্যন্ত চলেছে জানার ইচ্ছেয় সাদা মুখ করেই জিগ্যেস করলাম, কি দেখতে বা বুঝতে চান?

    -ইয়ে মানে যতটুকু দেখেছি তাতে আত্মীয় বা বড়ঘরের মেয়ে মনে হয় না–অথচ গাড়ি করে নিয়ে আসা হয় দিয়ে আসা হয–তাই ভাবছিলাম কে হতে পারে। আপনার কি ধারণা?

    –আমি এ নিয়ে ভাবিও না, কোনো ধারণাও নেই। তবে মেয়েটি ভদ্রলোকের নিজের মেয়ের থেকেও বয়সে ছোট হবে বলে মনে হয়– সে এলে ভক্তিমূলক গান-টান কানে আসে–

    অমর গাঙ্গুলী নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। মেজাজ চড়লে তাঁর কথাবার্তা বরাবরই একটু বেপরোয়া ধরনের। প্রসঙ্গ ধামাচাপা দেবার চেষ্টা ভাবলেন। জেরার সুরেই জিগ্যেস করলেন, পুলিশ সাহেবের ছেলে-ছেলের বৌ বা মেয়ে-জামাই থাকতে মেয়েটিকে কখনো আসতে-যেতে দেখেছেন?

    একটু ভেবে জবাব দিলাম, ঠিক মনে পড়ছে না, বোধহয় না–

    –বোধহয় না, দেখেননি। সাহিত্যিক হয়ে আপনি বয়েসের সার্টিফিকেট দাখিল করবেন ভাবিনি–এবার বলুন, ভক্তিমূলক গান শুনতে হলে মেয়েটিকে শোবার ঘরে এনে বসিয়ে পর্দা থাকা সত্ত্বেও সামনের দিকের দরজা বন্ধ করার দরকার হয়? ভক্তিমূলক গান যদি একটু-আধটু আমাদেরও কানে আসে তাতে আপত্তির কোনো কারণ থাকতে পারে?

    আমার কান গরম। প্রথমে ইচ্ছে করল ভদ্রলোককে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলি। কিন্তু নিজের স্বভাবে এটুকু জোরের অভাব। তাছাড়া থমকাতেও হল একটু।–গানের সময় সামনের দরজা বন্ধ না করা হলে বারান্দায় দাঁড়িয়েও আমি স্পষ্ট শুনতে পাই না কেন? এই লোকের সামনে বসে চিন্তার জট ছাড়াতে চেষ্টা করে লাভ নেই।

    খানিক বাদে ভদ্রলোক বিজয়ী বীরের মতোই উঠে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, পাড়ায় পাঁচ রকম কথা ওঠে, আপনার ও বাড়িতে যাতায়াত আছে তাই আপনাকে বলা– যাক, আপনি এ সবের সাতে পাঁচে নেই যখন যেতে দিন।

    এই ক’মাসের মধ্যে অংশুমান ঘোষের দোতলার শোবার ঘরে আমি কতোবার গিয়ে বসেছি এখন আর হিসেব নেই। বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না, যতক্ষণ থাকি যতক্ষণ বসি, একটা শুচিতার স্পর্শ আমায় ঘিরে থাকে। ধূপধুনো একশ-আট জবার মালা গলায় কালীর ছবি বা ওই ক’টা বইপত্র দেখে নয়। এ-সবই আমার নিজের বাড়িতেও আছে, আর পূজা-পার্বণের অনুষ্ঠানও ঢের বেশিই হয়। কিন্তু এরকম একটা শুচিতার অনুভূতি ঠিক মনে আসে না। অমর গাঙ্গুলীর মুখে ও-রকম শোনার পরেও ওই ঘরে কোনোরকম ব্যভিচার কল্পনা ন্যক্কারজনক মনে হয়। এরপর থেকে ওই মেয়েটির সম্পর্কে আমার নিজের কৌতূহল একেবারে ধামাচাপা। অংশুমান ঘোষ আমার সঙ্গে যতই অন্তরঙ্গভাবে মিশুন, মানুষটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ধরেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক সময় মনে হয়েছে ভদ্রলোক মুখের দিকে চেয়ে মনের অনেকখানি দেখতে পান। ও-প্রসঙ্গ তুলে কোন বিপাকে পড়ব কে জানে, তার থেকে মুখ সেলাই করে থাকাই ভালো।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমেয়েদের ব্রতকথা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article সাত পাকে বাঁধা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }