Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রামায়ণের উৎস কৃষি – জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

    জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প204 Mins Read0

    ০৯. কুশ বংশ – নবম প্রকরণ

    ০৯. কুশ বংশ – নবম প্রকরণ

    যেহেতু ‘রামায়ণ’ কৃষিবিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী, এজন্য সৃষ্টির তথা উদ্ভিদের আবির্ভাবের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি অবশ্যকর্তব্য হল প্রাকৃতিক পরিবেশে সহজাত ভাবে যে শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদজগতের আবির্ভাব ঘটেছিল তাকেও ব্যক্ত করা। কৃষিবিজ্ঞান প্রধানতঃ শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদ সংশ্লিষ্ট। সেকারণে সৃষ্টির বিবর্তনের ক্রম অনুসারে বর্ণনা না দিয়ে ইক্ষ্বাকু বংশে উদ্ভিদজগতের প্রাথমিক পাঁচটি ধাপ সৃষ্টির ইংগিত দেওয়া হয়েছে মাত্র। কুশ বংশে মূলতঃ তৃণগোষ্ঠীর শস্যজাতীয় প্রজাতির পরিচয় রয়েছে। অবশ্য কুশ অর্থে জল এবং কুশ অর্থে যোক্তন, এই দুই অর্থ ধরে স্বতন্ত্র ব্যাখ্যাও করা যায়।

    রাম ও লক্ষণের সহায়তায় বিশ্বামিত্র সিদ্ধাশ্রমে সিদ্ধিলাভ করার পর তাঁদের নিয়ে জনক রাজার যজ্ঞে ধনু দেখতে যাওয়ার পথে একদিন তারা সকলে শোণা নদীর তীরে রাত্রিবাস করেন। সমৃদ্ধ বনে শোভিত সেই দেশ সম্পর্কে রাম কৌতুহল প্রকাশ করলে বিশ্বামিত্র কুশ বংশের বিবরণ শোনালেন।

    “সুব্রতানুষ্ঠায়ী, মহাতপস্বী, মহাত্মা, সজ্জনপূজক কুশ নামক জনৈক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্ৰহ্মতনয় ছিলেন। তিনি সদৃশী কুলীন বৈদর্ভীতে কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূর্তরজস্ ও বসু নামক চারিটি পুত্র উৎপাদন করেন ।” ক্ষত্রধর্মের বৃদ্ধিকারণাভিলাষে কুশ মহোৎসাহসম্পন্ন পুত্রগণকে প্রজাপালন করার নির্দেশ দিলেন। সেইমত কুশাম্ব কৌশাম্বী, কুশনাভ মহোদয়, অমূর্তরজস ধর্মারণ্য এবং বসু গিরিব্রজ নামে উত্তম নগর স্থাপন করলেন। গিরিব্রজ বসু কর্তৃক স্থাপিত সেকারণ অপর নাম ‘বসুমতী’; চারিদিকে যে পাঁচটি পর্বত আছে তাদের মধ্যদেশ দিয়ে রমণীয় মালার মত অবস্থিত হয়ে শোণা নদী মগধ দেশে প্রবাহিত হচ্ছে, সে কারণে নদীটির অন্য নাম ‘মাগধী’।(১)

    কুশনাভ ঘৃতাচীনাম্নী অপ্‌সরাতে একশত পরম রূপগুণ সম্পন্ন কন্যা উৎপাদন করেন। সেই কন্যারা যৌবনশালিনী হলে তারা একদিন বাগানে নাচগান করছিল। সর্বাত্মা বায়ু তাদের সকলকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলে তারা অসম্মত হয়, কেননা তার স্বয়ম্বর না হয়ে জনকের নির্বাচিত ব্যক্তিকে পতিত্বে বরণ করতে চায়। একথা শুনে বায়ু সাতিশয় ক্ৰোধ-প্রযুক্ত হয়ে তাদের দেহে প্রবেশ করে সমস্ত অবয়ব ভগ্ন করে ফেললে কন্যাগণ ঐ অবস্থার বিষয় কুশনাভকে জানালে পিতা কন্যাগণকে সৎপাত্রে দানের নিমিত্ত মন্ত্রীগণের সঙ্গে মন্ত্রণা করলেন। সেই সময় ঊর্ধ্বরেতা, শুদ্ধাচারী, দ্যুতিশালী মহৰ্ষি চুলী ব্রহ্মবিষয়ক চিত্তৈকাগ্রতারূপ তপস্যা করছিলেন এবং সোমদা নামে ঊর্মিলানন্দিনী গন্ধর্বী তাঁর সেবায় নিযুক্ত ছিল। কালক্ৰমে সোমদার সেবায় তুষ্ট হয়ে চুলী বর দিতে চাইলে সোমদা বলল যে তার পতি নাই বা সে কাহারও স্ত্রী নয়। তথাপি সে ব্রাহ্মনিয়মে মহর্ষি সদৃশ একটি পুত্ৰ কামনা করলে চুলী প্রার্থনা মত “ব্রহ্মদত্ত” নামে তপঃসমন্বিত একটি পুত্র সোমদাকে দান করলেন।

    ব্ৰহ্মদত্ত কাম্পিলী নামক পুরীতে বাস করছিল। কুশনাভ তার কন্যাগণকে ব্ৰহ্মদত্তর হাতে সমর্পণ করলেন। ব্রহ্মদত্ত সেই কন্যাগণের পাণিসম্পর্শ করা মাত্র তারা সকলকে বিকুব্জা, বিগতজ্বরা ও পরমশোভাসম্পন্ন হল। এবার কুশানভ পুত্র লাভার্থে পুত্রেষ্ঠিযজ্ঞ করলে পিতা কুশের বরে গাধি নামে এক পুত্র উৎপন্ন হয়। এই গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র, কুশ বংশে জন্ম বলে “কৌশিক” নামে বিখ্যাত। এই প্রসঙ্গে বিশ্বামিত্র তাঁর পুত্রগণের কোন উল্লেখ করেননি। বিশ্বামিত্রর ভগিনী ঋচিকপত্নী সত্যবতী, হিমালয় হতে উদ্ভূত নদী বিশেষ ‘কৌশিকী’ নামে বিখ্যাতা। বিশ্বামিত্র এই ভগিনীর নিকট বাস করেন; কেবলমাত্র নিয়মবশতঃ সিদ্ধাশ্রমে এসে রামের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ করেন।(২)

     

    একটা বিশাল অনিলপুঞ্জ হতে পৃথিবী গ্রহের যেমন সৃষ্টি, তেমনি উদ্ভিদজগতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্লোরোফিলের সহযোগিতায় সহজাত ‘কুশ’ নামক তৃণের আবির্ভাব। সেই কুশের পরবর্তী কালে বিভিন্ন পর্যায়ে রূপান্তর। প্রাকৃতিক পরিবেশে যত ধরণের উদ্ভিদ দেখা যায় তার মধ্যে তৃণ জাতীয় সকলের বৃদ্ধ-প্রপিতামহ হল কুশ। মনে হয়, এই কারণে হিন্দুধর্মে সকল যজ্ঞ হোম শ্রাদ্ধকৃত্য ইত্যাদিতে কুশের বিশেষ ভূমিকা স্থির করা হয়েছে। এই সকল ক্রিয়াকাণ্ডে কুশকে ব্রাহ্মণ হিসাবে গণ্য করা হয়।

    শৈবাল, ছত্রাক, মস্, ফার্ণ, ব্যক্তবীজি (অনাবৃত-বীজ) এবং গুপ্ত-বীজি (আবৃত-বীজ) উদ্ভিদের পরিচয় ইক্ষ্বাকু বংশে পাওয়া গিয়েছে। ভাবতে বিস্ময় জাগে—এদের মধ্যে এবং এদের সৃষ্ট নানা প্রজাতির মধ্যে সংযোগ ঘটে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদের যে আবির্ভাব ঘটেছে—একথা প্রাচীন ঋষিগণ চিন্তা করেছেন।

    আদিম পৃথিবীতে যখন কীটপতঙ্গ সৃষ্টি হয়নি, তখন অনুঘটক বা যোগাযোগের মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল বায়ু ও জলস্রোত এবং লতা ও বল্লী। কীটপতঙ্গ, বায়ু, জল ইত্যাদির দ্বারা মূলতঃ কুসুম রেণুর চলাচল হয়, অর্থাৎ, পুংরেণুর সঙ্গে স্ত্রীরেণুর মিলন ঘটে, যা শুধু মাত্র অনাবৃত-বীজ ও আবৃত-বীজ উদ্ভিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু লতা বা বল্লী যখন যোগাযোগকারীর ভূমিকা গ্রহণ করে তখন উভয়ের দেহরসের মিশ্রণের দরূণ নতুন প্রজাতি এবং নতুন ধরণের উদ্ভিদ সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। ধরা যাক একটি ফার্ণ জাতীয় গাছ যার পাতার নীচের দিকে ক্যাপসূলের মধ্যে অনাবৃত অবস্থায় প্রজনন রস জমা আছে, তার সঙ্গে যদি স্বর্ণলতা জাতীয় লতা যার শুধু মাত্র রজুর মত দেহ এবং অনাবৃত রস নিষ্কাষণ কেন্দ্র আছে, এই দুই জাতের উদ্ভিদের পরম্পর বাহ্যিক মিলন হলে ভিতরে ভিতরে উভয়ের দেহরসের মিশ্রণও ঘটবে। পরিবেশ, তাপ ইত্যাদি কারণে সেই মিশ্রিত রস উভয়ের দেহে সঞ্চালিত হয়ে নতুন ধরণের লতা এবং ফার্ণ সৃষ্টি করা ছাড়াও তৃতীয় আরেকটি বর্ণসংকর উদ্ভিদের আবির্ভাব সম্ভব করে তুলবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে এমনি করেই উদ্ভিদজগতের ক্রমবিবর্তনে পুনরায় আরও পাঁচটি পর্যায়ের বিভাজন ঘটেছে। যথা, বৃক্ষ, তৃণ, গুল্ম, বল্লী এবং লতা। যে শস্যজাতীয় উদ্ভিদ মানুষের আহারের জোগান দেয় এবং যার উৎপাদিক শক্তি বাড়ানোর জন্য কৃষিবিজ্ঞান, সেই উদ্ভিদের উদ্ভব হয়েছে কুশ এবং দর্ভ জাতীয় তৃণের মিথুনে বর্ণসংকর সৃষ্ট হওয়ার ফলে। কুশ এবং বৈদর্ভীর যোগাযোগে উৎপন্ন হয় কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূৰ্তরজস্ এবং বসু।

    কুশ অর্থ জল, তৃণ বিশেষ (Poa Cynosuroides) যোক্ত্র, মত্ত, অঙ্কুশ। কু (পৃথিবী)—শী (শয়ন করা) + ড (কর্তৃ সংজ্ঞার্থে); অথবা, কুশ্‌ (যোগ করা) + অ (কর্তৃ- অচ্‌), যে পরস্পর যোগ করিয়ে দেয়।

    কুশ চার প্রকার। (১) যাজ্ঞিক,–দর্ভভেদ, রক্তখদির, পলাশ, অশ্বত্থ। (২) হ্রস্বগর্ভ,–হ্রস্ব (খর্ব, কৃধু, অর্ভক, দভ্র), গর্ভ (ভ্রূণ, শিশু, অগ্নি, কুক্ষি); অর্থাৎ আকারে ছোট এবং অন্তরে অগ্নি বা তেজ রয়েছে। (৩) বর্হিঃ,— অগ্নি, দীপ্তি, গ্রন্থিপর্ণ বৃক্ষ (গ্রন্থি আছে পর্ণে বা পত্রে যার)। (৪) কুতুপ,— চর্মনির্মিতাল্পস্নেহপাত্র। কুতুপ=কুতপ অর্থ দৌহিত্র, সূর্য, অগ্নি, তিল। কু (ঈষৎ) হয়েছে তপ (সূর্যতাপ) যাহাতে। অর্থাৎ, তৈলপ্রদায়ী উদ্ভিদ।

    বৈদর্ভী অর্থ বিদর্ভ কন্যা। বি (বিশেষ, সম্যকৃ, ভিন্ন) দর্ভ (তৃণ, কুশ); বিশেষ ধরণের তৃণ; উলপতৃণ, কাশ। অথবা, ভিন্ন ধরণের তৃণ।

    দর্ভ ছয় প্রকার। কাশ, তীক্ষ্ণ, (কুশ), রোমশ (দু্র্বা), মৌঞ্জ (শরগাছ), বল্বজ (উলুখড়) এবং শাদ্বল (শ্যামক ঘাস)।

    কুশ জাতীয় উদ্ভিদের সঙ্গে বিশেষ ধরণের দর্ভ জাতীয় উদ্ভিদের মিথুন হয়ে চারপুত্র অর্থাৎ বর্ণসংকর চার প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল। কুশও তৃণ, দর্ভও তৃণ; কিন্তু তাদের মধ্যে প্রকার ভেদ আছে। যেমন তৃণগোষ্ঠীতে যারা পড়ে; ঘাস, খড়, গন্ধতৃণ, বংশ, কুশ, নল, শরগাছ, মুথাতৃণ মুঞ্জ, দর্ভ, মেথী, চণক ইত্যাদি।

    কুশের চারপুত্র কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূর্তরজস্ এবং বসু যাদের পর্যায়ক্রমে কুতুপ, বর্হি, যাজ্ঞিক এবং হ্রস্বগর্ভ হিসাবে গণ্য করা যায়।

    কুতুপ বা কুশাম্ব,—কুশ (জল) + অম্ব; আহবান, গমন, পিতা, শব্দ; অর্থাৎ, জলময় কোষ-সমন্বিত উদ্ভিদ।

    বর্হি বা কুশনাভ,–কুশ (যোক্ত্রি) নাভি (কেন্দ্র)তে যার, অর্থাৎ তন্তুসমন্বিত উদ্ভিদ। অথবা, কুশ (জল) নাভি (কেন্দ্র) অর্থাৎ কেন্দ্রবিন্দুতে জল যে উদ্ভিদের।

    যাজ্ঞিক বা অমূর্তরজস্—অমূর্ত (আকাশ, বায়ু, মৃতিহীন) রজস্ (বর্ণান্তরপ্রাপক) অর্থাৎ রঞ্জকগুণ বিশিষ্ট উদ্ভিদ (খদির, পলাশ ইত্যাদি)।

    হ্রস্বগর্ভ বা বসু—বসু অর্থ ধন, অগ্নি, সূর্য, কুবের ইত্যাদি। অর্থাৎ, যে উদ্ভিদের অন্তরে সুপ্ত অবস্থায় অগ্নি আছে, যথা অরণীবৃক্ষ। সাধারণভাবে বলা যায়, যে উদ্ভিদ হতে মূল্যবান কাঠ এবং সেইসঙ্গে ফলও পাওয়া যায়, জ্বালানীও হয়।

    বসুর নগর গিরিব্রজ, অপর নাম বসুমতী।

    অর্থাৎ, পৃথিবীর স্থলভাগ এই জাতীয় উদ্ভিদে শোভিত হয়েছিল; গাছের দ্বারা পরিত্যক্ত অক্সিজেন বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রার সমতা রক্ষা করে পৃথিবীকে জীবধাত্রী করে তুলেছিল। এই কারণে এই জাতীয় উদ্ভিদের নাম বসু এবং এই প্রাণদায়ী উদ্ভিদে সমৃদ্ধ বলে পৃথিবীর নাম বসুমতী। চারিদিকের পাঁচটি পর্বত অর্থে পঞ্চভূত (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, বোম) যার সমন্বয়ে সকল বস্তু সৃজন অথবা স্থূলভাবে বলা যায় পাঁচটি মৌলিক পদার্থের (নাইট্রোজেন, সালফার, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও ক্যালসিয়াম) যোগাযোগে উদ্ভিদের পুষ্টি ও বৃদ্ধি। উল্লেখিত পদার্থ ছাড়াও উদ্ভিদ ক্লোরোফিল দ্বারা কার্বন ও অক্সিজেন বায়ুমণ্ডল হতে গ্রহণ করে। এছাড়া হাইড্রোজেন প্রভৃতি আরও কতকগুলি পদার্থ উদ্ভিদ জল হতে শিকড় মারফৎ আহরণ করে। জল সহায়ক হিসাবে থাকে।

    ‘মাগধী’ শব্দটি মগধ শব্দ হতে এসেছে, যার অর্থ স্তুতি, বন্দনা। জলের সহায়তাকে স্তুতি ধরা হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের চারিপাশের পরিচিত সকল উদ্ভিদ মূলতঃ কুশ এবং বৈদর্ভীর সম্মেলনে উত্তত হয়েছে। শস্যজাতীয় তৃণের পূর্বপুরুষ হিসাবে বিশেষভাবে বেছে নেওয়া হয় কুশনাভকে।

    কাহিনীর পরের অংশে কুশনাভ ও ঘৃতাচীর মিলনে শত কন্যার জন্ম।

    কন্যা শব্দ কন্‌(দীপ্তি, কান্তি, গতি, প্রীত হওয়া), ধাতু নিষ্পন্ন। কন্যা অর্থে কুমারী নারী, ঔষধিবিশেষ, ঘৃতকুমারী। ঘৃতাচী অন্সর ও গন্ধর্বী। মধ্যরাত্রির একটি যামকে বলা হয় ঘৃতাচী। তন্তু-সমন্বিত-উদ্ভিদ (কুশনাভ) এর উপর সৌররশ্মি চাঁদে প্রতিফলিত হওয়ায় যে বিশেষ শক্তি সৃষ্টি হয় তার প্রতিক্রিয়া এবং গন্ধশক্তির মিশ্রণ দরুণ নতুন পর্যায়ের উদ্ভিদের আবির্ভাব। এই পর্যায়ে শর, বেত, কলা গাছ ইত্যাদি ধরা যেতে পারে।

    ‘একশত’ শব্দে বহুত্ব বুঝানো হয়েছে মাত্র। বায়ু কর্তৃক কন্যাগণের দুরাবস্থা বলতে এই জাতীয় উদ্ভিদগুলি ঝড়ে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থাৎ ভঙ্গুরধর্মী।

    এই জাতের রূপান্তর ঘটে ‘ব্রহ্মদত্ত’র সম্পর্কে এসে। ব্ৰহ্মদত্তর স্বতন্ত্র কাহিনী। চুলীর স্পর্শে সোমদার গভে ব্রহ্মদত্তর জন্ম।

    চুলী= কেশী = শিখা, টিকী = বহুল কেশযুক্ত = বিষ্ণু, সিংহ। কেশী অর্থ অজলো মাশুঁয়া-শিম্বী, অগ্রপর্নী, আলকুশী। চুলী শব্দে শুঁয়ো আছে এমন জাতীয় উদ্ভিদ বুঝিয়েছে।

    সোমদা = সোম (অমৃত) দা (প্রদায়িনী, রক্ষণকী)। যা অমৃত দান করে বা অমৃত রক্ষা করে।

    সোমদা ঊর্মিলানন্দিনী। ভাবার্থে লতা ধরা যায়। গন্ধর্বী (গন্ধশক্তিযুক্তা) সোমদ পতিহীনা অর্থে সহজাত লতা, বর্ণসংকর নয়। স্থূলভাবে বলা যায় চুলীর স্পর্শে সোমদা লতা হতে যে উদ্ভিদ জন্ম নিল তার গায়ে কাঁটা বা শুঁয়ো আছে। অর্থাৎ, শুঁয়ো-সমন্বিত উদ্ভিদের সঙ্গে সহজাত গন্ধতৃণ জাতীয় উদ্ভিদের মিলনে সৃষ্ট বর্ণসংকর উদ্ভিদের নামকরণ করা হয়েছে ব্রহ্মদত্ত।

    এই সংকর জাতের উদ্ভিদের সংস্পর্শে আসে কুশনাভ কন্যারা। ফলে কন্যাদের দেহশ্ৰী সুগঠিত হয়। এই পর্যায়ে খেজুর, বেত, তাল, বাঁশ, নারিকেল গাছ প্রভৃতি ধরা যায়। এগুলি আগের মত সহজ ভঙ্গুর নয়। লক্ষণীয় যে এগুলি আগের পর্যায় হতে শুধু শক্তই নয়, কাঁটা-সমম্বিত। বাঁশের কঞ্চি এবং নারিকেলের পাতার বৈশিষ্ট্য কাঁটার মত।

    কুশনাভর এবার পুত্র প্রাপ্তি, নাম—গাধি। কিন্তু কার গর্ভজাত সে কথার উল্লেখ নাই। গা (গতি, স্তুতি) ধি (ধারণ, দান, প্রানন্‌—সন্তোষ সম্পাদন)।

    গাধ (প্রতিষ্ঠা, লিন্স, রচনা, গ্রন্থ) + ই কর্তৃ।

    গাধির আরেক নাম ‘কুশিক’, যার অর্থ অশ্বকৰ্ণ বৃক্ষ, শাল গাছ, বয়রা গাছ, বিভীতক গাছ (বহেড়া)। অশ্বকৰ্ণ অর্থ শস্য সম্বরণ। শস্য (ফলের শাঁস, বৃক্ষাদির ফলপুষ্প) সম্বরণ (আবরণ)। শাল অর্থ শক্তবৃক্ষ বা মুড়াগাছ, অর্থাৎ গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। সুতরাং গাধি গুল্ম বা গুচ্ছ জাতীয় উদ্ভিদ, যার ফল ও পুষ্প হয় এবং ফলের মধ্যে আবরণযুক্ত বীজ থাকে। কুশিক শব্দের অর্থ লাঙ্গলের ফাল।

    লক্ষণীয় যে গাধির মধ্যে পিতামহী বৈদর্ভীর গুল্মধর্ম বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে, বিজ্ঞান-ভাষায় উত্তরাধিকার সূত্র।

    কুশনাভর পুত্রেষ্ঠী-যাগকালে ব্রহ্মনন্দন কুশ বলেছিল যে গাধি নামক এই পুত্র দ্বারা লোকে চিরস্থায়িনী কীর্তি লাভ হবে। অর্থাৎ গাধি পর্যায়ে শস্যপ্রদায়ী গুচ্ছ-উদ্ভিদের আবির্ভাব। গাধির মাতার কোন উল্লেখ না থাকায় মনে হয় সৌরশক্তির বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়ার দরুণ কুশ হতে সহজাতভাবে গাধির অর্থাৎ শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদের আবির্ভাব ঘটেছিল। বর্তমান বিজ্ঞান অনুসারে গাধিকে ধান্যগোরের (ফ্যামিলি গ্রামিনিঈ— (Family Gramineae) অন্তর্গত একবীজপত্রী, বর্ষজীবি, বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ বলা যায়। সুতরাং সহজাত বনজ আদিমতম তণ্ডুল-শস্য-প্রদায়ী উদ্ভিদের নাম গাধি।

    গাধির পুত্র বিশ্বামিত্র। ইনি কৌশিক নামে বিখ্যাত। সাধারণতঃ জ্যেষ্ঠ ভগিনী সত্যবতীর কাছে থাকেন, নিয়মবশতঃ তাকে পরিত্যাগ করে সিদ্ধাশ্রমে এসে রামের প্রভাবে সিদ্ধ হয়ে থাকেন। গাধিপত্নী বা বিশ্বামিত্রর মায়ের কোন উল্লেখ নাই।

    কৌশিক অর্থাৎ লাঙ্গলের ফাল দ্বারা উৎপাদিত ফসলকে কৌশিক শব্দ দ্বারা ইংগিত করা যায়।

    কৌশিক অর্থ ইন্দ্র, গুগ্‌গুল, উলুক, ব্যালগ্রহী, নকুল, কোষজ্ঞ, কোষকার, শৃঙ্গাররস, অশ্বকৰ্ণ বৃক্ষ।

    উলুক পুংলিঙ্গএ অর্থ পেচক। কিন্তু ক্লীবলিঙ্গ ধরলে তৃণ বিশেষ; উলুখড়, সূচ্যগ্র, স্থূলক, দর্ভ, ঘুনাখ্য, খরচ্ছদ, উলপ, উলুপ।

    উলুপ (পুং, ক্লী) গুল্মিনী। শাখাপত্র প্রচয়যুক্ত লতা।

    কুশিক (গাধি) এবং কৌশিক (বিশ্বামিত্র) উভয় শব্দের অর্থ অশ্বকর্ণ বৃক্ষ। সুতরাং কৌশিক অর্থে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ ইংগিত করছে।

    বিশ্বামিত্র,—বিশ্বা (অতিবিষা, শতাবরী, পিপ্পলী) মিত্র হয়েছে যার সহায়তায়।

    অতিবিষা অর্থ অরুণা, শৃঙ্গী, শ্বেতা, শ্বেতকন্দ, ভূঙ্গী, শ্যামকন্দ, মাদ্রী, শ্বেতবচা, অমৃতা।

    অরুণ অর্থ শ্যামা, মজ্ঞিষ্ঠা, ত্রিবৃতা, গুজ্ঞ।

    শতাবরী অর্থ শতমুখী, শটী। শ্বেত। অর্থ শ্বেতদুর্বা।

    ত্রিবৃত = ত্রিবৃৎ (মজ্ঞিষ্ঠা লতা বিশেষ)।

    পিপ্পলী অর্থ পিপুল (কটু বীজ, তিক্ত তণ্ডুল)।

    তণ্ডুলা = ততুল = বিড়ঙ্গ। তিক্ত তণ্ডুলী= তেত চাউল।

    কটু বীজা, – কটু (তিক্ত) বীজ (অংকুর, মজ্জা) যার।

    বিশ্বামিত্র শব্দটি নিয়ে এত বিশ্লেষণের মূল কারণ কুশ বংশের এই শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিটিকে চেনা। ফলে এঁর সঙ্গে রামের যোগাযোগ ঘটা এবং এই যোগাযোগে রামসীতার বিবাহ ঘটার হেতু সহজবোধ্য হবে। রামায়ণ যদি কৃষিবিজ্ঞান হয় তাহলে রাম এবং বিশ্বামিত্র উভয়ে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত।

    ‘বিশ্বামিত্র’ শব্দটির নানা অর্থভেদ করে যা দাঁড়ায় তার সারকথা গুচ্ছধর্মী উলুখড়-জাতীয় তণ্ডুলপ্রদায়ী উদ্ভিদ বিশেষ।

    এখন এটিকে সহজেই চেনা যায় ধান্যগাছ হিসাবে। ধান্য অর্থ সতুঁষ তণ্ডুল।

    তণ্ডুল বা চাউলের আবরক তুঁষ, এই আবরকের পরিচয় গাধি পর্যায়ে পাওয়া গিয়েছে। অবশ্য তণ্ডুল শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। খাদ্যশস্য মাত্রই তণ্ডুল। বর্তমানের অনেক শস্যসজী (আলু, টমাটো ইত্যাদি) প্রাথমিক অবস্থায় তিক্ত অথবা বিষাক্ত ছিল, পরিচর্যার দরুণ খাদ্যে উন্নীত হয়েছে। ধানের বীজ বা চাউলও আদিম অবস্থায় কটু ছিল মনে করি। কারণ দেখা গিয়েছে একটু অবস্থার হেরফের ঘটলে চাউল তেত হয় অর্থাৎ কটু প্রবণতা চাউলের আছে।

    এখানে ধান্যের একটু পরিচয় দিলে মনে করি ভাল হয়। ধান্য মূলতঃ তিন রকম।

    (১) শালিধান্য – হৈমন্তিক ধান্য, আমন ধান।

    (২) ষষ্টিক ধান্য—গ্রীষ্মকালীন ধান্য, বোরো ধান।

    (৩) ব্রীহি ধান্য–বর্ষাকালীন ধান্য, আউস ধান।

    এছাড়া আরও দুটি ভেদ আছে, (ক) কাঙ্গনী ধান্য—শ্যামা, চীনা, কট ও কোদো ভেদে চার রকম এবং (খ) শুক ধান্য—শুঙ্গযুক্ত ধান্য, শিম্বী ধান্য।

    ধান্য জাতীয় শস্য যথা যব, গম, মুগ, মাষ, মসুর, কলাই, ছোলা প্রভৃতি। সুতরাং কুশবংশ কাহিনী মারফৎ আদিম ধান্য বা তণ্ডুল জাতীয় উদ্ভিদের আবির্ভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।

    বিশ্বামিত্রর ভগিনী সত্যবতী (কৌশিকী) স্বামী ঋচিকের সঙ্গে হিমালয়ের পাদদেশে থাকেন। বিশ্বামিত্রর মূল আস্তানা সেখানে। নিয়মমাফিক সিদ্ধাশ্রমে এসে রামের প্রভাবে সিদ্ধ হন। বক্তব্যটি লক্ষণীয়।

    ধানগাছ ফসল দিয়ে মরে যায়। আবার যথাসময়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুসারে অর্থাৎ বর্ষায় বুনতে হয় অথবা গজিয়ে ওঠে। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় বিশ্বামিত্র সিদ্ধাশ্রমে রামের প্রভাবে সিদ্ধিলাভ করেন অর্থাৎ, আগামী বৎসরের বর্ষার উৎস হিসাবে উত্তরায়ণাদি। আবার নিয়মবশতঃ পরবর্তী বর্যার আগে সিদ্ধাশ্রমে আসেন তপস্যা করতে। কৃষিবিজ্ঞানীর মতে ভারত, চীন, জাপান ও জাভায় প্রথম ধান উৎপন্ন হয়। এই প্রসঙ্গে বলা যায় প্রাচীন ভারতে হিমালয়ের যে অংশকে মুজ্ঞমান পর্বত বলা হত, হয়ত সেখানেই প্রথম সহজাত ধানের উদ্ভব।

    বিশ্বামিত্রর ভগিনী সত্যবতী ঋচিকের পত্নী। ঋচিককে ভৃগু ও ভৃগুপুত্র দুইই বলা হয়েছে। ঋচিক বা ভৃগু অর্থে পর্বতের সানুদেশ। মনে হয় বিশ্বামিত্র ও সত্যবতী শব্দ দুটিতে যথাক্রমে ধান ও গম নির্দেশ করা হচ্ছে। ধান ও গম সমগোত্রীয়। গমের আদি জন্মস্থান পাঞ্জাব, হিমালয় পর্বতের সানুদেশ৷ অথবা, দুই মরশুমের দুই প্রকার ধানের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। এই বক্তব্য মেঘদেবতা রামের স্বরূপ প্রতিষ্ঠা করে।

    ভারতীয় কৃষি আজও মৌসুমী বায়ু নির্ভরশীল। এ কারণেই রামকে (মেঘদেবতা) না হলে বিশ্বামিত্র (শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদ -এর সিদ্ধিলাভ (ফসল) সম্ভব হয় না।

    কুশ বংশে বিশ্বামিত্রর পরে তার পুত্রদের কোনই ভূমিকা নাই। বিশ্বামিত্রকে ধান্যগোত্রের, বিশেষভাবে ধানগাছ হিসাবে ব্যক্ত করার পিছনে বড় যুক্তি হল তার রাম তথা মেঘদেবতার সঙ্গে সম্পর্ক।

    পৃথিবীর মৌসুমী অঞ্চলের প্রধান কৃষিজাত ফসল ধান। ভারতবর্ষে সকল ফসলের মধ্যে ধানের উৎপাদন সবচেয়ে বেশী। মনে হয়, প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ধান চাষ কালক্ৰমে গঙ্গা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত এলাকায় প্রাধান্যলাভ করেছিল।

     

    এই বিশ্লেষণ আপাতদৃটিতে কষ্টকল্পনা মনে হতে পারে। কিন্তু রামায়ণের কৃষিবিজ্ঞান-ভিত্তিক সত্তাকে মানতে হলে সৃষ্টি-রহস্য প্রসঙ্গে শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদের আবির্ভাবের বিবরণ অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। রামায়ণের অন্যান্য কাণ্ডে এবং বিভিন্ন সর্গে এমন ধরণের ইংগিত পাওয়া যায় না। উপরন্তু ইক্ষ্বাকুবংশ ও জনকবংশের যোগসূত্রকারী কুশবংশের অবশ্যই এই ধরণের তাৎপর্য থাকা সম্ভব। প্রায় দুই হাজার বছর আগের রহস্যধৰ্মী কাব্যের রহস্য উদ্‌ঘাটন প্রসঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে কষ্টকল্পনা মনে হতে পারে।

    যাইহোক কুশ বংশের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যাও অনুধাবন করা যেতে পারে।

     

    রাম লক্ষ্মণকে নিয়ে মিথিলার পথে শোণা নদীতীরে রাত্রিবাসকালে বিশ্বামিত্র স্বয়ং কুশ বংশের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে বংশের প্রতিষ্ঠাতা কুশ অর্থে তৃণ ধরে বিভিন্ন তৃণ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ে জীবের বিশেষতঃ মানুষের খাদ্যোপযোগী তণ্ডুল অর্থাৎ শস্যপ্রদায়ী উদ্ভিদের আবির্ভাবের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে।

    এছাড়াও রামায়ণে আরেকটি ক্ষেত্রে কুশ বংশের উল্লেখ আছে। রাম ও লক্ষ্মণসহ বিশ্বামিত্র জনকের যজ্ঞভূমিতে উপনীত হলে পুরোহিত শতানন্দ রামকে বিশ্বামিত্রর অতীত ইতিহাস শোনান।

    “রাম! ইহার পূর্বপুরুষ ধৰ্মজ্ঞ, কৃতবিদ্য, প্রজাহিতনিরত, প্রজাপতিনন্দন কুশ নামে রাজা ছিলেন; তাহার পুত্র বলবান সুধামিক কুশনাভ, এবং তাহার পুত্র গাধি নামে বিখ্যাত হন। এই মহামুনি অতিতেজস্বী বিশ্বামিত্র, সেই গাধির পুত্র। ইনি রাজা হইয়া বহুসহস্রবর্ষ পৃথিবী পালন করত রাজ্য ভোগ করিয়াছিলেন ।”(৩)

    লক্ষণীয় যে এখানে কুশের অন্য পুত্রদের এবং বিশ্বামিত্রর ভগিনী কৌশিকী ও তার পুত্ৰগণের কোন উল্লেখ নাই। অবশ্য পরবর্তীকালে শুনঃশেফ কাহিনী প্রসঙ্গে বিশ্বামিত্রর পুত্ৰগণের উল্লেখ রামায়ণে আছে। এক পুত্রের নাম মধুষ্যন্দ। রামায়ণে এদের ভূমিকা এতই নগণ্য যে কুশবংশ বিশ্লেষণে কোন স্থান দেওয়া যায় না।(৪) সুতরাং কুশবংশের মূল ধারাতে মাত্র চারজন উল্লেখযোগ্য। ব্রহ্মসম্ভূত কুশ স্বয়ং, কুশনাভ, গাধি এবং বিশ্বামিত্র। এদের স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দেওয়া হল।

     

    কুশ অর্থ জল। আদিম পৃথিবীতে জল সহজাতভাবে আবিভূত, একারণে কুশ স্বয়ং ব্রহ্মসম্ভূতা। জলের এক নাম জীবন। প্রাণিজগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় জলের উপর নির্ভরশীল। কৃষিকাজে জলের ভূমিকা অপরিহার্য। মেঘদৈবত রামের বহির্প্রকাশ বারিধারা দ্বারা পরিপুষ্ট হয়ে বসুন্ধরা-কন্যা সীতা ফসল উৎপাদন করে কৃষিশ্রী রূপে সার্থকতা লাভ করেন।

    জলের তিনটি পর্যায়; অনিল, তরল ও কঠিন। জড় পৃথিবীতে জলের আবির্ভাবের পরই শুরু হয়েছিল প্রাণের স্পন্দন। পৃথিবীর উদ্ধাকাশে জলকণা বিদ্যমান। ভূ-পৃষ্ঠের তলদেশেও রয়েছে জলের উৎস। ভূ-পৃষ্ঠের তিন-চতুর্থাংশে সমুদ্র বিশাল জলরাশি ধারণ করে আছে। অপরদিকে ধরিত্রীর উত্তরাংশে, ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে হিমালয় পর্বতমালায় কঠিন হিমবাহর রাজত্ব। ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়ার তারতম্য অনুসারে সেই কঠিনীভূত হিমবাহ হতে বহু জলধারা নির্গত হয়ে উচ্চাবচ এলাকা পেরিয়ে সমতল ভূমিতে সকল ঋতুতে নদনদী রূপে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও ঋতু-চক্রের আবর্তনে বৰ্ষাঋতুতে মেঘ সমাগমে বারিবর্ষণের দরুণ সেই সময়কাল কৃষিকাজের প্রকৃষ্ট সময়। তখন বায়ুমণ্ডলে জলকণা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি ভূতলের জলস্তর উৰ্দ্ধমুখী হয়ে ভূ-পৃষ্ঠের জলধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং জল মূলতঃ তিনভাবে অবস্থান করে সৃষ্টি রক্ষা করছে।

    কুশের পুত্র কুশনাভ ৷ কুশ (জল) নাভিতে (কেন্দ্রে) যার অথবা নাভি শব্দের অর্থ সন্নদ্ধ (ব্যাপৃত, সজ্জিত) ধরে বলা যায় জলময়। সুতরাং কুশনাভ শব্দে রূপকে জলের দ্বিতীয় অবস্থান অর্থাৎ হিমবাহ, মহাসমুদ্র, ভূতলস্থ জলধারা এমন কি বহত নদনদীর ইংগিত গ্রহণ করতে পারি।

    এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে কুশনাভ পিতার নির্দেশমত ‘মহোদয়’ নামক নগর স্থাপন করেছিলেন। যেহেতু কাহিনীতে কুশনাভকে নরদেহী হিসাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে, সেকারণে ‘মহোদয়’ শব্দটির পুংলিংগে অর্থ হয় অভুদয়, আধিপত্য, কান্যকুজ দেশ ইত্যাদি। হিমবাহ এবং মহাসমুদ্র উভয়ে পৃথিবীর আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে জীবজগতের হিতসাধন করছে; অর্থাৎ জলের একটি পর্যায় ব৷ স্বরূপের প্রাণিজগতের উপর আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে।

    অপরদিকে, কান্যকুজ বা কন্যাকুজ এবং কাশস্থল শব্দের তাৎপর্য কুশনাভর শত কন্যার কাহিনীতে রূপকে বিবৃত হয়েছে। যেখানে কাশ অর্থাৎ জল বা তৃণ আছে সেই স্থানকে কুশস্থল বলা যায়। জল যেখানে সহজলভ্য, কৃষিকাজ সেখানে প্রসার লাভ করে।

    কুশনাভ ‘কুশিক’ নামেও পরিচিত। কুশিক, কাশী + ক (কন্‌) স্বার্থে; অর্থ ফাল। সুতরাং এই শব্দের ভিত্তিতে জলনির্ভরশীল সহজাত এবং কৃষিজাত ফসল প্রাপ্তির ইংগিত গ্রহণ করা যায়।

    ‘কুশনাভ’ শব্দটির মাধ্যমে যে নৈসর্গিক তথ্য রহস্যে ব্যক্ত করা হয়েছে সেই রহস্যের অন্তঃস্থলে উপনীত হয়ে মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে না পারলে পরবর্তী দুটি চরিত্র তথা পর্যায় সহজবোধ্য হবে না। কারণ কেবলমাত্র হিমবাহ, মহাসমুদ্র ও নদ-নদীর জলধারার উপর নির্ভর করে পৃথিবীর বুকে কৃষিভিত্তিক মানবসমাজ গড়ে ওঠা সম্ভব হত না। ঋতুচক্লের আবর্তনে বর্ষাঋতুর ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রধান।

    কুশনাভর পরে গাধি।

    গাধ্‌ (প্রতিষ্ঠা, স্থিতি) ধাতু নিষ্পন্ন ‘গাধি’ শব্দের অর্থ ধরা যায় স্থিতিশীল বা প্রতিষ্ঠাবান। গাধ্‌ শব্দের অর্থ অবস্থানযোগ্য স্থান।(৫)

    কৃষিবিজ্ঞান অনুসরণে বলা যায় কে প্রতিষ্ঠালাভ করছে অথবা অবস্থানযোগ্য স্থান কোথায়?

    আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে যেমন বসন্ত ঋতু, তেমনি জীবনধারণের জন্য বৰ্ষাঋতু অপরিহার্য। রবিপথের দক্ষিণায়নাদিতে বর্ষারম্ভ। অতএব জলের মেঘ পর্যায়কে গাধি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে ভারতীয় প্রাচীন গ্রন্থাদিতে মেঘের বিভিন্ন স্বরূপ ও নামের বর্ণনা আছে।(৬)

    বর্ষা ঋতুতে যে মেঘ জলধারা উজার করে সৃষ্টি রক্ষার ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেই মেঘের উদ্ভব ঘটে সূর্যর উত্তরায়ণ কালে। ইতিপূর্বে ‘রামজন্মকথা’ প্রকরণে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে রামায়ণের কালে উত্তরাষাঢ়া (যার বৈদিক নাম বিশ্ব) নক্ষত্রে সূর্যর (মিত্র) অবস্থানকালে উত্তরায়ণাদি হত। এই সূত্র হতেই জলের শেষ পর্যায়কে বিশ্বামিত্র নাম দেওয়া হয়েছে।

    অতএব কুশবংশের চারটি পুরুষ তথা পর্যায় বৰ্ষাঋতুতে বসুন্ধরাকন্যা সীতার (কর্ষিত জমির) সঙ্গে সূর্যবংশীয় রামের (বর্ষণ দেবতার) সংযোগ সাধন করছে।

    ——————-

    (৬) “বৃহৎ সংহিতায় অনেক প্রকার মেঘের বর্ণনা আছে। মৎস্যপুরাণেও কয়েক প্রকারের আছে। লিঙ্গপুরাণ (৫৪ অঃ) মতে “চরাচর দক্ষ হইলে পৃথিবীর ধুম স্বরূপ হইয়া যাহা বায়ু কর্তৃক ঊর্ধ্বে নীত হয়, তাহাই অভ্র। এজন্য ধুম অগ্নি ও বায়ুর সংযোগে অভ্রের উৎপত্তি বলা যায়।” বলা বাহুল্য ইহা আধুনিক বিজ্ঞান সম্মতও বটে। যে মেঘ হইতে মেহন (বর্ষণ) হয়, তাহার নাম মেঘ। জীমূত মেঘ ধরাপৃষ্ঠ হইতে অৰ্দ্ধ ক্রোশ উর্ধ্বে থাকে। জীবক মেঘ ক্ষীণ, বিদ্যুৎধবনি শূন্ত। মেঘসমূহ যোজন মাত্র উর্ধ্বে থাকিলে বহু জল বর্ষণ হয়। ইত্যাদি।

    বায়ুপুরাণ (৫১ অঃ) অভ্রাদির লক্ষণ অন্য প্রকার দিয়েছেন। যথা, অত্র হইতে জল ভ্রষ্ট নয় না বলিয়া অভ্র; মেঘ হইতে মেহন হয় বলিয়া নাম মেঘ।

    উৎপত্তি ভেদে মেঘ ত্রিবিধ। এক প্রকার মেঘে—জীমূত—শীত দুর্দিন বাত হয়, উছ

    মহিষ, বরাহ মত্ত মাতঙ্গ রূপ ধারণ করে, উহা বিদ্যুৎ গুণবিহীন জলধারাবিলম্বী নিঃশব্দ, ঘন, মহাকায়, বায়ুর বশানুগ, ক্রোশ কিংবা অৰ্দ্ধ ক্রোশ হইতে বর্ষণ করে, পৰ্ব্বতের

    অগ্র ও নিতম্বে বর্ষণ করে। জীমূত মেঘের সময়ে বলাকার গর্ভ হয়। (২) জীবক মেঘ (বায়ুপুরাণে পুনৰ্ব্বার জীমূত নামে লিখিত) বিদ্যুৎগুণযুক্ত, শব্দযুক্ত, উহা হইতে বর্ষণ হয়, তাহাতে বৃক্ষাদির উদগমে ভূমি পুনর্যৌবন প্রাপ্ত হয়, যোজন বা সাৰ্দ্ধযোজন বা অৰ্দ্ধ যোজন হইতে বর্ষণ করে (৩) (ক) পুস্কর (খ) আবৰ্ত্তক। ইহাদিগের জন্ম পক্ষ হইতে, যে পক্ষ পূৰ্ব্বে পৰ্ব্বতের ছিল, এবং যাহাকে ইন্দ্র ছিন্ন করেন। ইহার কামগ, ও বৃহৎ। (গ) সম্বৰ্ত্ত নানাকার ধারণ করে মহাঘোরতর কল্পান্ত বৃষ্টির স্রষ্ট।

    পর্জন্য ও দিগ্‌গজেরা হেমন্তকালে শীত আনয়ন করে, এবং সৰ্ব্ব শস্য বিবৃদ্ধি নিমিত্ত তুষার বৃষ্টি করে। (বায়ুপুরাণ পশ্চিমদেশে রচিত?) ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পরিবহ। তাহা আকাশ গোচর দিব্য অতিজল স্বর্গপথে স্থিত গঙ্গাকে ধারণ করিয়াছে।” —শ্ৰীযোগেশচন্দ্র রায় প্রণীত “আমাদের জ্যোতিষ ও জ্যোতিষী”, পৃষ্ঠা ৩৫১ (পাদটীকা)।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleশুনছ, কোথাও আছো কি কেউ?
    Next Article জিম করবেট অমনিবাস (অখণ্ড) – মহাশ্বেতা দেবী সম্পাদিত
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    বাঙালনামা – তপন রায়চৌধুরী

    August 20, 2025

    রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনী – তপন বাগচী

    August 20, 2025

    রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস – শ্রী কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ প্রণীত

    August 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.