Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প239 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    রুদ্র – ১৫

    ১৫

    রাত প্রায় দশটা। অফিস থেকে সোজা ইকবাল মাহমুদের বাসায় চলে এল রুদ্র। তিনিও মাত্রই বাসায় ফিরেছেন। রুদ্রকে বসিয়ে ভেতরে গিয়েছিলেন ফ্রেশ হতে। জলদি গোসল সেরে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে রুদ্রের সামনে এসে বড্ড আয়েশে আসন পেতে সোফায় বসলেন তিনি

    — “তোমাকে বললাম রাতের খাবারটা চলো একসঙ্গে খাই। শুনলে না। তুমি কখনোই আমার এখানে খাওয়া দাওয়া করতে চাও না।”

    — “কারো বাসায় খেতে ভালো লাগে না আসলে!”

    — “কেন যে লাগে না! আচ্ছা ফিরলে কবে তুমি? ঘুরাফেরা কেমন কাটলো?”

    — “ফিরেছি গতকাল। ঘুরাফেরা দারুণ কেটেছে।”

    — “সব ঠিক আছে তো, তাই না?”

    — “এই সময় হঠাৎ করে চলে এলাম তাই জিজ্ঞেস করছেন?”

    — “তুমি অগ্রীম খবর না দিয়ে কখনো আসো না।”

    — “হ্যাঁ, একটা জরুরি কাজেই এসেছি।”

    — “বলো?”

    — “আমার মায়ের অবস্থা তো জানেনই। মা ছাড়া আপাতত আমার সবচেয়ে কাছের মুরুব্বি আপনিই আছেন যাকে আমি আমার ব্যক্তিগত কোনোকিছুর দায়িত্ব দিতে পারি।”

    — “অবশ্যই পারো।”

    — “আপনি পরশু আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন।’

    এক মুহূর্ত রুদ্রের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলেন ইকবাল মাহমুদ। সঙ্গে চেহারায় তার আনন্দ ছটা।

    স্নেহভরে জানতে চাইলেন,

    — “বিয়ে করবে তুমি! ইচ্ছে হলো তবে নতুন কাউকে জীবনে আনার? প্রেম ভালোবাসা চলছিল নাকি বাবা?”

    — “হ্যাঁ হলো আরকি! প্রেম-ট্রেম না। শুভর প্রতিবেশী। দেখেছি, ভালো লেগেছে। মনে হলো, ওকেই লাগবে আমার। অন্য কাউকে না।”

    — “ওকেই পাবে। তোমার কাছে কে না মেয়ে দেবে? বিরোধী দলের কারো মেয়ে হলে আবার আলাদা হিসেব।”

    বলে নিজেই হাসতে লাগলেন ইকবাল মাহমুদ। মুচকি হেসে রুদ্রও তার হাসিতে তাল মেলালো।

    — “মেয়ের পরিবার এসব রাজনীতি থেকে দূরে। খুবই সাধারণ সাদামাটা পরিবার।”

    — “মেয়ে কী করে? মেয়ের বাবা কী করে?”

    সুরভীকে নিয়ে গল্প করছে রুদ্র। খুব মনোযোগে তার কথা শুনছেন ইকবাল মাহমুদ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুভ দেখতে থাকলো রুদ্রকে। সুরভীকে নিয়ে বলতে গিয়ে চোখের চাহনি বলার ধরণটাই বদলে গেছে তার। যেন তার সব মনোযোগ, সমস্ত খুশির মূলবিন্দু এখন শুধুই সুরভী।

    হাসলো শুভ। রাজনীতির কিংবা ব্যবসায়ের মাঠে রুদ্রের দৌড় খুব কাছ থেকে দেখেছে সে। একচ্ছত্র নায়কের মতো মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়িয়েছে সবসময়। হোক তা বিরোধীদলের সরকার আমল কিংবা নিজ দলীয়। কোনোকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। এবার নাহয় প্রেমিক রুদ্রকে দেখার সুযোগ হবে! দেখা যাক এই মামলায় কতখানি দাপুটে হয় সে।

    ১৬

    — “ছয় বছরের সম্পর্ক আমাদের! এভাবে ভেঙে দিবে তুমি?”

    — “আমি পারবো না তোমাকে বিয়ে করতে। আমার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। সেগুলো পালন করা আমার কাছে বেশি জরুরি।”

    — “আমি কোনো আর্থিক চাপ তোমাকে দেবো না, তুমি জানো সেটা।”

    — “তবুও! একজন মেয়ের দায়িত্ব নেয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার।”

    — “এমন তো কথা ছিল না আসিফ! সবকিছু ঠিক ছিল আমাদের। হঠাৎ কেন এমন করছো তুমি?”

    — “আমি দ্বিধায় ছিলাম।”

    — “কিসের দ্বিধা! এই কয়দিনে বলোনি তুমি একবারও।”

    — “ছিলাম। বলা হয়নি তোমাকে।”

    — “এখন বললে তো হবে না। তুমি…” সুরভীর কথা কাটলো আসিফ।

    — “হোক বা না হোক, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। আবেগের বশে ভুল কিছু করতে চাই না। এই মুহূর্তে এই বিয়েটা আমার ফ্যামিলি মানবে না। তাদের ছেড়ে আমি

    কোথাও যেতে পারবো না। বাবা অসুস্থ। আমি চাই না এই মুহূর্তে বাবার উপর কোনো মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে।

    — “আসিফ! কী বলছো, বুঝতে পারছো?”

    — “বুঝেই বলছি। ভালো ঘরে বিয়ে হবে তোমার। এসব আবেগ মুছে যেতে সময় লাগবে না।”

    — “এত সহজ?”

    — “সহজ ভাবলেই সহজ।”

    — “তোমার কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভুলেই গেছ!”

    — “মনে রাখার মতো পরিস্থিতি নেই সুরভী। এরচেয়ে বেশি আর কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমি কাল অন্য শহরে চলে যাচ্ছি। নতুন চাকরি হয়েছে আমার। তুমি আর আমার জন্য অপেক্ষা করো না। মা-বাবা যেখানে চাইছে সেখানেই বিয়ে করে নিও।”

    রেগে গেল সুরভী। এতক্ষণ কাঁদছিল ও। হঠাৎ কান্না থেমে গেল ওর। চাপা স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

    — “পাঁচ বছর! গুনে গুনে পাঁচ বছর তোমাকে আমি দিয়েছি। তোমার সব সমস্যা শুনেছি, জেনেছি। কখনো কোনোকিছুর আবদার করিনি। গিফট, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এসব কিছু চাইনি আমি। তোমার ফ্যামিলি ক্রাইসিসে যতটা সম্ভব হেল্প করেছি আমি। কেন করেছি এতসব? ভালোবাসি বলেই তো! এত বছর পর সমস্ত ভালোবাসা, এফোর্টের বিনিময়ে একটা সংসার চাইছি আর তুমি কিনা এই শেষ মুহূর্তে এসে সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছো? আসিফ লাস্ট টাইম আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, আমাকে ছেড়ে যাবার কারণ কি এটাই? নাকি অন্য কোনো সমস্যা যা তুমি আমাকে বলতে চাইছো না?”

    — “আমার ফ্যামিলি প্রবলেমটা কি তোমার প্রবলেম মনে হচ্ছে না?” ধমকে উঠলো আসিফ।

    নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে সুরভীর।

    ‘আসিইইইফ’ বলেই আবারও কেঁদে উঠলো ও। আরো রূঢ় হলো তার প্রেমিক। প্রেমিকার কান্না, আবেগ কিংবা অনুরোধ কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। চোখের সামনে তার পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর নতুন জীবনের ঝকমকে স্বপ্নের সামনে সুরভীকে একটা আস্ত দেয়াল ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না সে। মেজাজ চড়ছে ভীষণ। কোন কুক্ষণে এই মেয়েটার সঙ্গে ভাব ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েছিল, কে জানে! এতদিন জ্বালিয়েছে জ্ঞান দিয়ে, আর এখন তো তার ভবিষ্যৎটাই নষ্ট করে দিতে চাইছে! ভবিষ্যৎ তো পরের ব্যাপার। এই জীবনটা বাঁচানো যাবে কি না তা-ই ঠিক নেই। কখন এসে গুম করে দেয়! অধৈর্য্য লাগলো আসিফের। কঠিন স্বরে স্পষ্ট করে সুরভীকে সে জানিয়ে দিলো,

    — “তোমাকে আর বলার কিছুই নেই। শুধু এতটুকুই বলি, মাফ করো আমাকে। আমি এই সম্পর্কটা টেনে নিতে মোটেও ইচ্ছুক নই। আমার সঙ্গে তোমার নাম জড়িয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করো না প্লিজ! রাখছি।”

    হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে বসে রইলো সুরভী। মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। আসিফের বলা প্রতিটা কথা মেলানোর চেষ্টা করছে ও। এই তো সন্ধ্যেবেলায়ও কথা হলো। কাল কিছু জামা, দু’টো চেইন আর পাঁচ জোড়া ছোট কানের দুল ব্যাগে ভরে আসিফের কাছে রেখে আসার কথা হলো। বাকি গয়না আর জামা কাপড় বাসা ছেড়ে পালানোর দিন সঙ্গে নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল। এই চার পাঁচঘন্টায় কী হয়ে গেল! হঠাৎ ধাক্কায় মাথার বাম পাশে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে সুরভীর। আসিফের নাম্বারে আবার ডায়াল করলো ও। এভাবে আসিফ ওকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। কোনোভাবেই না!

    *****

    রাত দুইটা। রুদ্র বসে আছে বারান্দায়, সঙ্গে আছে শুভও। একটু পর পর কানে ফোন নিয়ে অস্থির পায়ে সুরভীর পায়চারী দেখছে বারান্দায়। আসিফকেই কল করছে হয়তো! এতক্ষণে ঘটা করে বিচ্ছেদ করে নিয়েছে আসিফ। তাই সুরভীর এই অস্থিরতা, ঠিক বুঝে নিলো রুদ্র। আচ্ছা, ও কি কাঁদছে? হঠাৎ এক আশংকায় বুকের মধ্যে ভয় হলো রুদ্রের। নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা নিয়ে কথা বলছিল শুভ। সেদিকে এতক্ষন মনোযোগ থাকলেও, কয়েক সেকেন্ড ধরে মনোযোগটা আর রইলো না শুভর প্রতি, আশংকাতে আটকে গেল।

    শুভর কথার মাঝে রুদ্র বলে উঠলো,

    — “শুভ একটা ভুল হয়ে গেছে বোধহয়!”

    শুভ অবাক স্বরে জানতে চাইলো,

    — “ভুল! কী ভুল?”

    — “সুরভী কতটা স্ট্রং তা তো আমরা জানি না। আসিফকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।”

    রুদ্রের সন্দেহ বুঝে নিলো শুভ। অমূলক কিছু না। রুদ্র অস্থির হয়ে উঠছে সে কথাও তার কণ্ঠেই বুঝা যাচ্ছে।

    — “আসিফকে কল করে বলবো সুরভীর সঙ্গে কথা বলতে?”

    দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ালো রুদ্র।

    — “কোনোভাবেই না! যা গেছে, গেছেই। ওটার ছায়াও আর আমি দেখতে চাচ্ছি না।”

    শুভর সন্দেহ হলেও রুদ্রকে আশ্বস্ত করতে চাইলো সে।

    — “কান্নাকাটি করবে। খুব জোর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে একটু অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু সুইসাইড এটেম্পট নেবে না। এত ছোটও না, বড় হয়েছে তো! এতবড় ভুল ডিসিশন নেয়ার আগে ভাববে অন্তত একবার।”

    — “কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সেটা বুঝার মতো সেন্স ওর আছে বলে মনে হয় তোমার? থাকলে ওরকম একটা ফালতু ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতো না।”

    — “পালিয়ে যাওয়া আর সুইসাইড ডিসিশনের মাঝে তফাৎ আছে না!”

    — “রিস্ক নেয়া যাবে না কোনোভাবেই।”

    — “তাহলে?”

    — “বারান্দায় যতক্ষণ আছে, থাকুক। আমার চোখের সামনে আছে। রাতে ওর বারান্দার দরজা খোলাই থাকে। যদি দরজা, জানালা লক করে দেয় সোজা ওর বাসায় চলে যাবো।”

    — “সিন ক্রিয়েট হবে!”

    — “হু কেয়ারস! সুরভীর লাইফ রিস্কের ব্যাপার। ওসব ঝামেলা টামেলা গুনবো আমি?”

    মাথা দুলিয়ে সায় দিলো শুভ। নিজের কথায় মনে মনে হাসলো সে। রোজ রোজ শ’খানেক ঝামেলা করা মানুষটা কিনা বলছে, সিন ক্রিয়েট হবে!

    রাত বাড়ছে। কিছুক্ষন আগেই গাড়ি গ্যারেজ থেকে বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে এসেছে শুভ। সুরভীর ঘরের বাতি জ্বালানো। কাঁদছে ও। দূর থেকে টিস্যুতে ওর নাক মোছা, চোখ মোছা দেখেই আন্দাজ করে নিলো রুদ্র আর শুভ। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। চুপচাপ বসে সুরভীকে দেখছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দৃষ্টি সীমানায় দেখা যায় এভাবেই থাকবে তারা। অপেক্ষা করছে সুরভী না দরজা আটকে দেয়! আটকে দেয়া মাত্রই দু’জনে মিলে সরাসরি ওর রুমে গিয়ে, ওকে বের করে সোজা হসপিটাল চলে যাবে। এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না। মেজবাহ আর সুমনকে বলা আছে, ঝামেলা হওয়া মাত্র যেন স্থানীয় পুলিশকে কল করে সামলে নেয়া হয়। রুদ্রকে খেয়াল করছে শুভ। যতবার সুরভী ঘরে যাচ্ছে ততবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে, যেন এখনই ছুটবে সে ঐ বাসায়। রুদ্রকে এতখানি অস্থির শেষ কবে দেখেছিল মনে পড়ছে না শুভর। আদৌ কখনো দেখেছিল কী! নির্বাচন, খুন, দাঙ্গা, রাজনীতি-ব্যবসায়ের মারপ্যাঁচসহ কত জটিল সব পরিস্থিতি সমাধান করে ফেললো আজ পর্যন্ত! অথচ আজ কিনা এই মেয়েটা তাকে আতংক দিয়ে শেষ করে ফেলছে! যার সঙ্গে আজ পর্যন্ত কথা হয়নি, যার ভালোবাসা কিংবা একটু চাহনীও এখন পর্যন্ত ভাগ্যে জোটেনি তার জন্য এত টান! যেদিন থেকে এই মেয়েটাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করবে, আপন করে নিবে, কী হবে তখন? এই মায়া-টান কিংবা তার পাগলামি কোথায় গিয়ে ঠেকবে? কোন কপালের জোরে এমন পাগল জুটলো সুরভীর, কে জানে!

    ১৭

    ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটু ভেঙে ফ্লোরে বসে আছে ইমরান। অমন দাপুটে বাবার ছেলের এমন ভীতু চেহারা দেখে হাসি পেয়ে গেল জামিলের। সারা দেশের জেলায় জেলায় ঘুরে, মঞ্চে উঠে, মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাদেক খান যেভাবে হুংকার ছেড়ে বিরোধীদলের নেতাদের হুমকি ধমকি দেন, ছেলেটাকেও যদি তেমনি করে একটুখানি তেজ দেখানো শেখাতেন আরকি!

    রুদ্র ঠিকই বলেছিল- এই ফুলবাবুটার জন্য একজন লোকই যথেষ্ট। কপাল বরাবর পিস্তল ঠেকালেই কাজ হয়ে যেত। খামোখা পাঁচজনের দলসহ এসে হাজির হয়েছে ওর বাসায়। এতটা সময় ওর পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখেছে জামিল। সুন্দর, সাজানো গোছানো। এই বাসায় একা ব্যাচেলর একটা ছেলে থাকে, তা দেখে বোঝার উপায় নেই। ঘুরতে ঘুরতে ইমরানের মুখোমুখি এসে বসলো জামিল। তখনও অস্ত্রধারী বাকি চারজন ঘিরে রেখেছে ওকে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল ইমরানের। ওর চুলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিচ্ছে জামিল।

    — “তখন বললাম না একটা বিশেষ কাজে এসেছি?”

    উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালো ইমরান।

    নিজের মোবাইলে ভিডিও অন করে ইমরানের হাতে দিলো জামিল। ক্রমশ চোখ বড় হচ্ছে তার। কখন, কীভাবে ধারণ করা হলো এই ভিডিও? কী চায় এরা?

    টাকা? কত টাকা? জামিলের সামনে বসে প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো নগ্ন মুহূর্ত দেখার রুচি হলো না ইমরানের। ভিডিও অফ করে দ্রুত এর বিনিময় মূল্য জানতে চাইলো সে,

    — “কত চান?”

    হাসলো জামিল। তখনও ইমরানের চুল হাতড়ে চলছে সে। দারুণ সুন্দর ঝলমলে চুল ছেলেটার। মেয়েদের মাথায়ও অমন চুল দেখা যায় না। ভালো লাগছে চুলগুলো গুছিয়ে দিতে। সোফার উপর পড়ে ছিল একটা রাউন্ড ব্যান্ড। যত্ন করে ইমরানের সামনের চুলগুলো ব্যান্ডে আটকে দিয়ে জামিল বললো,

    — “সবকিছুর বিনিময় কি টাকা দিয়ে হয়? টাকা ছাড়াও কত কী আছে বিনিময় করার মতো!”

    — “কী চান?”

    — “ভিডিয়ো।’

    — “মানে?”

    — “একটু আগে যে ভিডিয়োটা দেখলে সেটা লিক হলে কী হবে, জানো তো? বাবার রেপুটেশন উড়ে যাবে একদম। বাবা তোমাকে ভীষণ আদর করে, তার মানে এই না তার মান-সম্মান পুরো দেশবাসির সামনে ধ্বংস করে দেয়ার পরও তোমাকে ভালোবাসবে। দেশের মানুষের মন-মানসিকতা কেমন, তা জানা আছে নিশ্চয়ই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের ন্যাংটা ভিডিয়ো পেয়ে কেমন আনন্দ উল্লাস যে করবে তা টের পাচ্ছো তো? লোকের অমন নোংরা উল্লাসের খোড়াক হতে চাও?”

    গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ইমরানের। প্রেমিকার সঙ্গে নগ্ন মিলনে আগ্রহ আর অভিজ্ঞতা আছে, তবে তা বহুনারী নয়। কিংবা খোলামেলাও নয়। এই জীবনে মাত্র দু’জন নারীর সংস্পর্শেই গিয়েছে সে। নিজের ব্যক্তিগত জীবন সে এতটাই গোপন রাখতে পছন্দ করে যে, বন্ধুমহলেও সে কথা অজানা। আর আজ কিনা অতি স্পর্শকাতর মুহূর্তটাই পুরো দেশবাসীর সামনে খোলাসা হয়ে যাওয়ার হুমকি মিলছে! কান্না চেপে বসছে খুব।

    অসহায় ভঙ্গিতে সে বললো,

    — “কী চান, বলুন না?”

    — “বলছি। তার আগে শুনে নাও এই ভিডিয়ো ভাইরাল হবার পর আর কী হতে পারে? তোমার সঙ্গে যে আছে সে আজগরের মেয়ে। আজগর কেমন অমানুষ, তা একটু হলেও জানো নিশ্চয়ই?”

    — “কিন্তু আমি অদিতিকে ফোর্স করিনি। ইট ওয়াজ মিউচুয়াল!”

    — “সে খবর তুমি আমি জানি, অদিতি জানে। আজগরও জানবে তবে প্রমাণ করবে অন্য কিছু। নিজের মেয়ের দিকে আঙুল তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ কাউকে ও দিবে না। এসব মামলায় বরাবর ছেলেরা ফাঁসে, সেটা মিউচুয়াল সেক্স হোক কিংবা রেইপ। লোকের কানে আসা মানে ছেলেটাই কিছু করেছে। আজগর সেটার পুরো ফায়দা নেবে। মানে যতটা তুমি ভাবছো তার চেয়ে আরো বেশি বাজেভাবে তুমি ফাঁসতে যাচ্ছো।”

    জামিলের বলা কথাগুলো স্পষ্ট দৃশ্য হয়ে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো ইমরানের। আসন্ন বিপদের কথা ভেবে লজ্জা আর ভয়ে কেঁদেই দিলো সে। এক সেকেন্ড দেরী না করে ফটাফট পাঁচ ছয়টা টিস্যু একটানে বক্স থেকে বের করে নিলো জামিল। আলগোছে ইমরানের চোখের কোণ মুছতে মুছতে রুদ্রের তরফ থেকে আসা প্রস্তাব রাখলো সে।

    — “আহা! এখনই কেন কান্নাকাটি? সমাধান আছে তো!”

    — “কী?”

    — “অদিতির ভিডিয়ো।”

    জামিলের প্রস্তাব ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ইমরান। কান্না থামিয়ে সে জানতে চাইলো,

    — “মানে?”

    *****

    ভোর হয়ে গেছে। পাড়ার মসজিদে মসজিদে ফজরের আজান চলছে। সুরভীর ঘরে ওর মাকে দেখা যাচ্ছে। এতটা সময়ে যেহেতু কিছু করেনি, আর করার সম্ভাবনাও আপাতত নেই। শুভকে ঘুমুতে পাঠিয়েছে আরো দেড়ঘন্টা আগেই। এবার তারও একটুখানি ঘুমানো উচিত। আজ বিকেলে প্রস্তাব নিয়ে যাবে হবু শ্বশুরবাড়ি। না, ঘুমিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া চেহারা নিয়ে যাওয়া চলবে না! একটু হলেও ঘুম প্রয়োজন। বারান্দা ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে করছিল না রুদ্রের। সুরভীটা তো ঘুমুবে না! তবুও উঠে এল সে।

    বিছানায় গা এলাতেই কল এল জামিলের।

    — “হ্যাঁ বলো?”

    — “ডান।”

    — “ঝামেলা করেনি তো?”

    — “ভয়েই শেষ!”

    — “বলেছিলাম না?”

    — “এতটাও হবে তা বুঝিনি।”

    — “কাজ হবে কবে নাগাদ?”

    — “পরশু ওদের মিট করার কথা, সেদিনই।”

    — “আজ কালের মধ্যে করা যায় কিনা দেখো না! যত দ্রুত হবে তত ভালো।’

    — “আচ্ছা দেখছি তাহলে কথা বলে।”

    ১৮

    আজ বিকেলে সুরভীর বাসায় যাবে রুদ্র। সব আয়োজন তার শেষ। আসিফকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল তাদের সঙ্গেও আলাপ শেষ। শুভকে নিয়ে আজ সকালেই গয়না, শাড়ী আর দুই লাগেজ ভর্তি সুরভীর জন্য বিয়ের উপহার কিনেছে সে নিজেই। এখন পর্যন্ত বডিগার্ড দু’জন, শুভ, সে নিজে, ইকবাল মাহমুদ আর ধর্মমন্ত্রী শাহীন আহমেদ ছাড়া আর কেউ জানে না এ ব্যাপারে। যত ঘটা, যত লোকজন জানানো, তত ঝামেলা। সুরভীর আর তার মাঝে একটা সূক্ষ্ম কাঁটাও সে আপাতত দেখতে রাজি না। তবে মাকে ছাড়া এই বিয়ে অসম্ভব! তাই তো কেনাকাটা শেষে সোজা চলে এল মায়ের কাছে।

    দুপুরবেলার খাওয়া চলছে মায়ের। অস্থির হয়ে একবার সে মায়ের পাশের চেয়ারে বসছে তো আবার উঠে মায়ের আশপাশ দিয়ে হাঁটছে। ছেলেকে লক্ষ্য করছেন ফেরদৌসী। এতটা অস্থির তার ছেলে না। ভীষণ স্থির হয়েছে বাবা যাওয়ার পর থেকে। চোখ কিংবা চেহারা কিছুই দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনে কী চলছে? একদম না! সেই ছেলেটাকে আজ এত অস্থির দেখাচ্ছে, কিছু তো একটা ঘটেছেই! তাকে সার্বক্ষনিক দেখাশোনা করা নাজনীনকে ইশারা করলেন তিনি।

    আপত্তি করলো নাজনীন,

    — “জি না। খাবার শেষ করতেই হবে খালামনি।”

    অন্য ঘোরে ছিল রুদ্র। নাজনীনের কথা শুনে মায়ের দিকে তাকালো সে।

    — “খাওয়াটা শেষ করো আম্মু।”

    — “খাবার আমি যখন তখন খেতেই পারবো, আগে তোর কথা শুনি। চল, আমার ঘরে চল।”

    — “বলবো তো, আগে তুমি খাও।”

    — “বলছি তো আমি আর খাবো না। তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। তোর কথা না শুনে আমিও শান্তি পাবো না।”

    মায়ের সঙ্গে আর জোর করলো না রুদ্র। সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগছে। যত সময় ঘনিয়ে আসছে তত অস্থিরতা বাড়ছে। জলদি করে মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে তৈরী হতে হবে। ইকবাল মাহমুদ চলে আসবেন চারটা নাগাদ। এখান থেকে একসঙ্গে রওয়ানা হবে সবাই। সময় হাতে খুব একটা নেইও!

    নাজনীনকে অবলম্বন করে নিজের ঘরে এলেন ফেরদৌসী। পেছন পেছন এল রুদ্র। ফেরদৌসীকে বিছানায় বসিয়েই বেরিয়ে গেল নাজনীন। রুদ্র গুটিগুটি পায়ে মায়ের পায়ের কাছে, ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। নিজের মাথার উপর মায়ের হাতটা রেখে বললো,

    — “আম্মু আমি একাই খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”

    চিন্তা হলো ফেরদৌসীর। এমন অদ্ভুত কায়দায় কথা বলছে কেন ছেলেটা? ছেলের গালে কপালে হাত বুলাতে লাগলেন তিনি

    — “কী হয়েছে বাবা? কোথায় ছিলি তুই? ফিরে এসেই কেন এমন করছিস?”

    — “আমি বিয়ে করবো আম্মু। আজই।”

    স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন নাজনীন। খুশি হবেন না কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। মায়ের চেহারা ঠিক পড়তে পারলো রুদ্র।

    আবারও তার হাতটা মাথার উপর টেনে নিয়ে বললো,

    — “ব্যাপারটা শকিং, আমি জানি। আগে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু, ঐ তো…। ধুর! আমি কথা গুছাতে পারছি না। আমার সব এলোমেলো লাগছে।”

    — “এলোমেলোই বল, আমি বুঝে নিবো।”

    — “অনেক ঝামেলা ছিল, ওগুলো সুরাহা করতে হয়েছে।”

    — “কী ঝামেলা?”

    — “বকা দিও না প্লিজ!”

    — “কবে বকেছি তোকে?”

    — “ওর নাম সুরভী। শুভর এলাকায় থাকে। দেখেছি, ভালো লেগেছে। ওকেই লাগবে আমার। লাগবে মানে লাগবেই। ওকে ছাড়া চলবে না আম্মু। আমার পুরো মাথাটা এই মেয়ে দখল করে ফেলেছে। নিজেকে এডিক্টেড মনে হয়। দিনভরে ওকে দেখলেও বোধহয় আমার তৃষ্ণা মিটবে না!”

    ছেলের কথায় সজোরে হেসে উঠলেন ফেরদৌসী। সেই ছোট্টবেলাতেও এমন পাগলামি করতে দেখেননি ছেলেকে।

    ছেলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে তিনি বললেন,

    — “যা কাঠখোট্টা একটা মুখ করে বেড়াস সারাদিন! আমি তো ভেবেছিলাম তোর মন থেকে হাসি, মায়া, প্রেম, টান সব মুছে গেছে! এখন তো দেখছি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম-ট্রেম সবই চলছে।”

    — “প্রেম! কিসের প্রেম?”

    — “না?”

    — “না তো!”

    — “তাহলে এই হুটহাট বিয়ের কারণ? আর তুই না বললি দেখেছিস, ভালো লেগেছে?”

    — “ভালো লাগা, ভালোবাসা সব শুধু আমার দিক থেকে। সুরভী আমাকে চেনেও না। আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে এক শব্দের কথাও ওর হয়নি।”

    — “কী বলছিস রুদ্র!”

    — “ওকে এক প্রকার ধরে-বেঁধে বিয়ে করবো আম্মু।”

    — “কেন? কার মেয়ে ও? বিরোধী দলের কেউ?”

    — “না। খুব সাদাসিধে ঘরের মেয়ে। ওর অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক ছিল। নেক্সট উইক ওর বিয়ে। আমি পাত্রপক্ষকে হুমকি ধমকি দিয়ে বিয়ে ক্যান্সেল করেছি।” চোখ রাঙিয়ে কপট রাগ দেখালেন ফেরদৌসী।

    — “এই বুড়ো বয়সে এসব ছেলেমানুষী কেন রুদ্র? একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিবি তুই?”

    — “তুমি বুঝতে পারছো না! ওকে আমার লাগবেই। আজ যাবো। ওর বাবা যদি বিয়ে দিতে রাজি না হয়, তাহলে ওকে তুলে আনবো।”

    — “এতসব বাড়াবাড়ি কেন রে বাবা?”

    — “বাড়াবাড়িই! ওকে চোখ বুজে অনুভব করলেই আমার সমস্ত স্ট্রেস, খারাপ লাগা মুছে যায়। আমার অমিমাংসিত সব সমস্যার সমাধান হতে থাকে। আমি কতগুলো বছর ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছি আম্মু। কোথাও আমার শান্তি নেই। তুমি বুঝো না? আমি আমার শান্তি খুঁজে পেয়েছি আম্মু। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে হলেও আমি ওকে চাই।”

    ছেলের আকুতিতে বুকে কাঁপন ধরলো মায়ের। চোখের কোণে পানি জমলো একটু করে। সত্যিই তো! শেষ কবে ছেলেটাকে স্বস্তিতে দেখেছেন, প্রাণখুলে হাসতে দেখেছেন মনে পড়ছে না তার। ছেলে যদি নিজের সুখ খুঁজে পায় তবে তিনিও মনে প্রাণে চান সেই সুখ তার ছেলের হোক। হোক তা সমস্ত কিছুর বিনিময়ে কিংবা জোর করে ছিনিয়ে। রুদ্রের থুতনিতে আলতো করে আদর করে দিলেন ফেরদৌসী।

    — “আচ্ছা নিয়ে আয় বউ। কিন্তু তুই এত অস্থির হয়ে আছিস কেন?”

    — “সুরভীর বাবা এই বিয়েতে আপত্তি করার সম্ভাবনা প্রবল।”

    — “কেন? নিজের পরিচয় দিবি তুই। তোর পরিচয় জানার পর কে না রাজি হবে মেয়ে দিতে?”

    — “সঙ্গে ইকবাল আংকেলকে নিচ্ছি। শাহীন ভাইও যাবে। মুরুব্বি কাউকে তো লাগবে।”

    — “স্বয়ং পি এম যেখানে প্রস্তাব নিয়ে যাবে সেখানে আপত্তি কে করবে রুদ্র?”

    — “ওরা খুব সাধারণ পরিবার। ঝুট ঝামেলায় নেই। আমাদের জীবনের আগা গোড়াই ঝামেলা। যতটুকু জেনেছি সেই ক্যালকুলেশনে মনে হচ্ছে ওর বাবা আপত্তি করবে। আপত্তি শুনতে আমার একদম ভালো লাগবে না আম্মু। মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে আমার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো কি না তখন তা-ও জানি না। সব মিলিয়ে কেমন যেন লাগছে আমার। স্থির হয়ে আপাতত কিছু ভাবতে পারছি না।”

    — “সব ভালো হবে। ইকবাল ভাই বুদ্ধিমান মানুষ। তুইও তো আর গাধা না। উনার চেয়ে তুই আরও বুদ্ধিমান। পরিস্থিতি সামলাতে জানিস। এটাও পারবি আপোষে সেড়ে নিতে।”

    — “হুম।”

    — “কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করেছি।”

    — “কেন?”

    — “ইকবাল ভাই, শাহীন তোর বিয়ের ঘটনা আগে থেকে জানে। অথচ আমাকে কিনা জানালি সবার শেষে!”

    অপরাধী ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো রুদ্র।

    — “সিচুয়েশনটা ঠিক বুঝাতে পারছি না। সব ঝামেলা মিটলোই গতকাল। আমি…”

    রুদ্রের কথা ফুরাবার আগেই হাসলেন ফেরদৌসী।

    — “আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুই তোর সুখের চাবি খুঁজে নিয়েছিস, তাতেই আমার শান্তি।”

    মলিন হাসলো রুদ্র। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বললো,

    — “ওকে তুমি বরণ করবে না আম্মু?”

    — “আমার ছেলের বউ আমি বরণ করবো না? নতুন গয়না পরিয়ে বরণ করবো! এদিকটা তোর ভাবতে হবে না। বউ ঘরে আসবে, আমি আমার মতো ঠিক আয়োজন করে নেবো।”

    — “উঠি আমি তাহলে। গোসল করে রেডি হবো।”

    — “কী পরবি?”

    — “নরমাল গেটআপ, শার্ট-প্যান্ট।”

    — “পাঞ্জাবি পর।”

    — “ইচ্ছে করছে না।”

    — “এটা কেমন কথা!”

    — “এটাই তো শেষ না আম্মু, হবে তো আয়োজন। সুরভী আসুক। আমার সঙ্গে, এই বাড়িতে ওকে এডজাস্ট হতে দাও। তারপর সব হবে।”

    ১৯

    সুরভীকে সেই ভোর থেকে দেখছে ওর মা। ওর ঘরের আলমারীতে জরুরি কিছু কাগজ ছিল, সেগুলোই আনতে গিয়েছিলেন। তখন সজাগ ছিল সুরভী। পুরো রাত না ঘুমিয়ে, কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিল ওর। ছেলেমেয়েকে বকাঝকা করা কিংবা তাদের মন খারাপের মুহূর্তে আরো মানসিক চাপ সৃষ্টি করা কখনোই সুরভীর মা মিতার মাঝে ছিল না। আজও নেই। সামনের সপ্তাহে মেয়ের বিয়ে। জানা মতে মেয়ের কখনো কারো সঙ্গে প্রেম ছিল না। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে এসে সেই বিশ্বাসটুকু আর নেই মিতার। আজ ভোরের কথা কিংবা সারাদিনে মেয়ের মানসিক অবস্থায় তিনি ঠিক আন্দাজ করে নিয়েছেন সুরভী কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে। কিন্তু ও কাউকে কেন কিছু বলেনি? এই মুহূর্তে এসে বিয়ে ভাঙার কথা বললেই তো আর ভেঙে ফেলা যাবে না। মেয়ের দুশ্চিন্তায় আধমরা লাগছে মিতার। ভয়ে স্বামীকেও কিছুই এখন পর্যন্ত জানাননি তিনি। বড় ছেলেকে কল করেছিলেন এই ব্যাপারে কথা বলবেন বলে, রিসিভ করেনি সে। কলব্যাকও করেনি। মাহিনের সঙ্গে কথা না বলে সুরভী কিংবা তার স্বামী কারো সঙ্গেই আপাতত তিনি কিছু বলতে চাইছেন না।

    আসরের নামাজ শেষে, নামাজের বিছানায় বসেই মেয়েকে নিয়ে এলোমেলো খেয়ালে ডুবে ছিলেন মিতা। বাসার সামনে হৈ-চৈ, ২-৩ টা গাড়ির একত্রে বেজে উঠা সাইরেনের শব্দে কৌতূহলী হলেন তিনি। নামাজের বিছানাটা উঠিয়ে রেখে, জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন আট দশটা গাড়ি এক সিরিয়ালে এসে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী আর ধর্মমন্ত্রী। তাদেরকে কড়া পাহাড়ায় ঘিরে রেখেছে কয়েকজন। একটু দূরেই আরেক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো একটা পরিচিত মুখ। টিভিতে মিতা তাকে দেখেছেন কয়েকবার, কিন্তু তার পরিচয় জানেন না মিতা। তবে উনারা এখানে কেন? কই সারাদিনে তো কারো কাছে শোনেনি এই এলাকায় কোথাও সভা হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই আরো চমকে উঠলেন তিনি। সবাই তারই বিল্ডিংয়ে ঢুকছে! কার বাসায় এসেছেন উনারা? এবারে তার বাড়াবাড়ি রকমের কৌতূহল হলো। দরজা খুলে সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে নিচে চেয়ে রইলেন তিনি, কার বাসায় তারা এসেছে সে কথা জানতে। ক্রমশ সবাইকে উপরে উঠতে দেখে নিজের ঘরে দরজার আড়ালে দাঁড়ালেন তিনি। উপরতলায় যাবে হয়তো! অথচ একটু বাদেই তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়ে তারই বাসার বেল বাজালো অস্ত্রধারী একজন। কেমন ভয় ধরে যাচ্ছে মিতার! দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে, ঠিক পেছনেই ধর্মমন্ত্রী। দু’জনেই দুই সেকেন্ড আগে পরে সালাম দিলেন মিতাকে। কন্ঠে জড়তা নিয়ে সালামের উত্তর করলেন মিতা। তার ফ্যাকাশে মুখটা দেখেই মনের ভেতরের কৌতূহল, সংশয়, ভয় সব বুঝে নিলেন ইকবাল মাহমুদ। মুখে তখনও তার হাসি লেগে আছে।

    ভীষণ বিনয়ে তিনি অনুমতি চাইলেন মিতার কাছে,

    — “আপা, ভেতরে আসি?”

    নিজের নির্বুদ্ধি আচরণে লজ্জায় পড়ে গেলেন মিতা। তড়িৎ গতিতে দরজা ছেড়ে তিনি বললেন,

    — “আসুন, আসুন! আমিও কেমন বোকার মতো দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছি।” ধর্মমন্ত্রীর পরই সেই পরিচিত মুখের ছেলেটা তার সামনে এল। পা ছুঁয়ে সালাম করবে বলে নিচু হতেই লজ্জা, দ্বিধায় সরে পড়লেন মিতা।

    — “কী করছো বাবা! সালাম কেন?”

    রুদ্র সেখানেই বসে রইলো। চোখ তুলে মুচকি হেসে তাকালো মিতার দিকে। শুভ এগিয়ে এসে বললো,

    — “তাতে কি আন্টি? আপনি মুরুব্বি, পা ছুঁয়ে সালাম করাই যায়। আসুন না? সামনে আসুন।”

    ভেতর থেকে রুদ্রকে মিতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখে মাথা দুলিয়ে হাসলেন শাহীন আহমেদ।

    ইকবাল মাহমুদের কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,

    — “দেখছেন অবস্থা? পুরো মন্ত্রীসভাকে দৌড়ের উপর রাখে যে ছেলেকে আজ পর্যন্ত কাউকে সালাম পর্যন্ত দিতে শুনিনি, সেই ছেলে কিনা পায়ে ধরে সালাম করছে!”

    — “প্রতিটা মানুষ কোথাও না কোথাও আটকায়। কোনোদিন মাথা না নোয়ানো মানুষটাও কোনো একজনের হাঁটুর কাছে ঠিকই মাথা নত করে। সবখানে দাপিয়ে বেড়ানো রুদ্র, এই ছোট্ট একটা এলাকায় বেড়ে উঠা খুব সাদাসিধে, চাকচিক্যহীন একটা মেয়ের কাছে আটকে গেছে। ওর জন্য রুদ্র সব করবে। প্রয়োজনে মাথা নোয়াবে, প্রয়োজনে মাথা কেটে আলাদাও করবে।”

    ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সুরভী। এই প্রথম রুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ পড়েছে ওর। অনুভূতির দোটানায় ভুগতে লাগলো রুদ্র। একদিকে প্রথম চোখে চোখ পড়ার সুখ অন্যদিকে সুরভীর বিধ্বস্ত চেহারায় মন খারাপ হওয়া। তবুও যেন সুখের পাল্লাটাই বেশি ভারী। এই তো আর কিছুক্ষণ বাদেই সুরভীকে নিজের করে নেবে সে। একান্তই নিজের। তারপর থেকে সুরভীর সবকিছু তার দায়িত্বে। এইসব মন খারাপ, কষ্ট, চোখের পানি কিছুই আর ছুঁতে পারবে না ওকে। সব মুছে দেবে সে। আগলে রাখবে সুরভীকে সবসময়, সারাজীবন!

    কী করবেন, কী করবেন না ভেবে যখন মিতা দিশেহারা হচ্ছিলেন তখন সুরভীকে সামনে পেয়ে যেন একটুখানি দিশা পেলেন তিনি। মেয়েকে ইশারা করলেন জলদি করে একটুখানি চা-নাস্তার আয়োজন করতে। মায়ের ইশারায় মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে আবারও রুদ্র আর শুভকে, বাইরে দাঁড়ানো বডিগার্ডদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো সুরভী। কারা এরা? কেন এসেছে?

    নামাজ শেষে বাসায় ফিরলেন শরীফ সাহেব। বাসার নিচ থেকে শুনে এসেছেন তার বিল্ডিংয়ে মন্ত্রীরা এসেছে। দরজার সামনে এসে দেখলেন মন্ত্রীরা তার ঘরেই এসেছে। বোকা বোকা হাসিতে ঘরে ঢুকেই সালাম দিলেন আগত মেহমানদের। ইকবাল মাহমুদ, শাহীন আহমেদ স্বেচ্ছায় উঠে এসে হাত মেলালেন তার সঙ্গে। মিতার একটুখানি সাহস হলো স্বামীকে পেয়ে। নয়তো এতটা সময় ধরে নিজের ঘরে নিজেকেই কেমন মেহমানের মতো লাগছিল। রুদ্রের পাশের খালি সোফাটায় গিয়ে বসলেন শরীফ সাহেব।

    অন্য প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি কথা শুরু করলেন শামীম আহমেদ।

    — “আপনারা হয়তো ভাবছেন, হঠাৎ আমরা এতগুলো মানুষ আপনার বাসায় কী কারণে এলাম!”

    — “একটু তো অবাক হয়েছিই। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের ঘরে স্বয়ং মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী চলে আসবে, তা তো ভাবিনি কখনো।”

    — “ভাই, আমরা এসেছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

    মিতা সঙ্গে সঙ্গে তাকালেন রুদ্রের দিকে। ঘটনা তবে এই! সেজন্যই ছেলেটা পা ধরে সালাম করলো? শরীফ সাহেব তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না প্রস্তাব আসলে কার জন্য? তার বড় ছেলের নাকি সুরভীর?

    — “কার বিয়ের ব্যাপারে বলছেন?”

    — “আপনার সুরভীর সঙ্গে ওর।”

    চোখের ইশারায় রুদ্রকে দেখালেন শামীম আহমেদ।

    — “ও রুদ্র। আশরাফ মির্জার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?”

    — “জি।”

    — “আশরাফ ভাইয়ের একমাত্র ছেলে ও। বর্তমানে আশরাফ মির্জার পুরো ব্যবসা ও দেখছে। দলের উপদেষ্টাদের মাঝে একজন ও। সর্বকনিষ্ঠ বটে, তবে বুদ্ধির জোর আমাদের সবার চেয়ে একটু বেশিই! যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান বলতে আমরা যা বুঝি আরকি।”

    মুচকি হাসলেন শরীফ সাহেব। বিনয়ের সঙ্গে জানালেন,

    — “আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সামনের শুক্রবার বিয়ে।”

    ইকবাল মাহমুদ বললেন,

    — “জানি। আমরা জেনেই এসেছি। আপনাদের সম্পর্কে প্রতিটা খবর আমাদের কাছে আছে।”

    — “জানেন যেহেতু তাহলে আমি আর কী নতুন করে বলবো?”

    — “বলার আছে অবশ্যই। বিয়ে ঠিক হয়েছে, হয়ে তো আর যায়নি। মেয়ের জন্য এত ভালো ঘর, এত ভালো ছেলে পেয়েছেন একটু তো বিবেচনা করবেন অবশ্যই।”

    — “কিছু মনে করবেন না। এখানে বিবেচনা করার কিছু নেই। আমি ঐ পক্ষকে কথা দিয়ে ফেলেছি। এই মুহূর্তে যত ভালো প্রস্তাবই আসুক না কেন সেদিকে আমি নজর দিতে পারবো না।”

    স্বামীর সঙ্গে মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন মিতা। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইকবাল মাহমুদের দিকে। শামীম আহমেদ ইশারায় শান্ত হতে বললো তাকে। বারবার তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছে, মাথা গরম করা চলবে না। ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে, তবুও ছেলেটা রেগে যাচ্ছে!

    মাথা নিচু করে ফেললো রুদ্র। মাথায় সত্যিই রক্ত চড়ে যাচ্ছে। জানা ছিল, সুরভীর বাবা-মা রাজি হবে না। মানসিক প্রস্তুতিও ছিল তার। তবুও মেজাজ সামলে রাখা যাচ্ছে না!

    ইকবাল মাহমুদ উঠে এসে শরীফ সাহেবের পাশে বসলেন। তার হাতের মাঝে শরীফ সাহেবের হাত চেপে বললেন,

    — “দেখুন, রুদ্রের বাবা নেই। ওর বাবার জায়গায় আমি এসেছি। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে, আপনার মেয়ে রাণী হয়ে থাকবে রুদ্রের কাছে।”

    — “ভাই এভাবে বলবেন না দয়া করে! কথার একটা মূল্য তো আছে, তাই না? যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছি তার চেয়ে ধনী . প্রভাবশালী পরিবার পেয়েছি বলে বিয়ে ভেঙে দিবো? এই অনৈতিকতা আমাকে দিয়ে হবে না।”

    শুভকে ইশারা করলো রুদ্র। তার কিছুক্ষণ বাদেই পাত্রপক্ষ থেকে কল এল শরীফ সাহেবের ফোনে। তিনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাফ জানানো হলো, এই বিয়েটা হচ্ছে না। পাত্রের পছন্দ আছে নিজস্ব, ওখানেই বিয়েটা করবে সে। শরীফ সাহেব কথা বাড়াতে চেয়েও পারলেন না। মুখের উপর কল কেটে দিলো পাত্রপক্ষ। ঘটনার আকস্মিকতায় খেই হারালেন তিনি। মনে তীব্র সন্দেহ কড়া নাড়লো তার, এই বিয়ে ভাঙার পেছনে এদের হাত নেই তো?

    ইকবাল মাহমুদ আবার বলতে লাগলেন,

    — “দেখুন ঝামেলা কিন্তু মিটে গেছে। এবার আপনি আমাদের প্রস্তাবটা বিবেচনা করতেই পারেন।”

    নিজেকে এক প্রকার জোর করেই সামলে নিলেন শরীফ সাহেব। ঘরে চলমান পরিস্থিতি সামলাতে হবে।

    — “পারি, তবে করবো না। দেখুন, আমি খুব সাধারণ মানুষ। ছেলেমেয়েগুলোকে বড় করেছি সাধারণভাবেই। এই বাড়িটা করেছি বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর ব্যাংক লোন নিয়ে। সম্পত্তি বলতে এই একটা বাড়ি আর কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স আছে আমার। এর বাইরে আর কিছুই নেই। আশরাফ মির্জাকে আমি চিনি তবে তার সম্পর্কে জানি না। তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে পুরো জ্ঞান না থাকলেও আন্দাজ ঠিক করতে পারি। এতবড় বাড়িতে আমি আমার মেয়ে বিয়ে দেবো না।”

    এবারে মুখ খুললো রুদ্র। যথাসম্ভব নিচুস্বরে বললো,

    — “প্রপার্টির সঙ্গে বিয়ে না দেয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না, আংকেল!”

    — “দেখো বাবা, দু’পক্ষ সমান হওয়া জরুরি। তোমার সঙ্গে আমার একেবারেই পাহাড় জমিন অবস্থা। আমার মেয়ে কিংবা আমরা সেই পাহাড় বেয়ে এই সম্পর্কটা ঠিকঠাক ব্যালেন্স করতে পারবো না।”

    শামীম আহমেদ বললেন,

    — “কিছু ব্যালেন্স করতে হবে না আপনাকে। কোনো দাবি-দাওয়া নেই আমাদের। আমরা শুধু মেয়ে নিবো, ব্যস! একটা সুতাও মেয়ের সঙ্গে দিতে হবে না।”

    — “আমার যা সাধ্য তা আমি আমার মেয়েকে দিবোই। আর সাধ্যের ভেতরেই

    থাকবো। সাধ্যের বাইরে কোনো সম্পর্কে আমি যেতে চাচ্ছি না। এই সম্পর্কটা আমরা সত্যিই সামলাতে পারবো না!”

    রুদ্র আবারও বলে উঠলো,

    — “এখানে সামলানোর কিছু নেই আংকেল। আমি নিজে এসেছি প্রস্তাব নিয়ে। সুরভীকে ভালো লেগেছে বলেই এসেছি। ওকে ছাড়া কিছু চাই না আমি। রইলো কথা ব্যালেন্স করার, কেন করা যাবে না? আমি আপনাদের ছেলের মতোই থাকবো।”

    রুদ্রের সঙ্গে আর কথা বাড়ালো না শরীফ সাহেব। ইকবাল মাহমুদের দিকে ফিরে আরো বিনয়ী হয়ে বললেন,

    — “রাগ করবেন না প্লিজ! রাজনীতি থেকে আমি দূরে থাকতে পছন্দ করি। সহজ সাদামাটা জীবন পছন্দ আমার। ছেলেমেয়েগুলোকে অমন ঘরেই দেবো। রুদ্রকে চিনি আমি। টুকটাক খবর ওকে নিয়েও লোকমুখে চর্চা হয়, পত্রিকায় ছাপা হয়। কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যা তা আমি জানি না। যাচাই করার প্রয়োজন মনে হয়নি কখনো। কিন্তু ওর কাছে মেয়ে বিয়ে দেবার প্রশ্ন এলে তখন সেসব খবর আমার ভাবতেই হবে। আমি বলছি না যা শুনেছি, পড়েছি সব সত্য। মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে আমি কোনো রিস্ক নিবো না। আমি কোনো পলিটিশিয়ানের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবো না।”

    রুদ্রের দিকে একবার তাকালেন ইকবাল মাহমুদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এভাবে হাতে ধরে মেয়ে চাইছে, এই লোকের জায়গায় অন্য কেউ হলে নাচতে নাচতে মেয়ে দিয়ে দিতো। কিন্তু এই লোকটা রাজি হচ্ছে না। হবেও না, সে কথা বুঝে গিয়েছেন ইকবাল মাহমুদ। হাসলেন তিনি। তবে কন্ঠে সেই বিনয়টা আর ধরে রাখলেন না। শরীফ সাহেবের হাতের উল্টোপিঠে, হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ইকবাল মাহমুদ বললেন,

    — “সামান্য দু’টো খবরে রুদ্রকে মাপা অসম্ভব! ওর সঙ্গে চলাফেরা করেও ঠিকঠাক ওকে বুঝা দায় এমন গোলকধাঁধা ও। রুদ্র সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই শরীফ ভাই!”

    — “আপনার কথার সুরে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।”

    ঠিক তখনই চা-নাস্তার ট্রে হাতে ঘরে এলো সুরভী। শুভ দ্রুত ওর হাত থেকে ট্রে নিতে চাইলে সুরভী আপত্তি করলো,

    — “না! আপনি কেন? আমি সার্ভ করছি।’

    শুভকে ইশারায় থামিয়ে দিলো রুদ্র।

    সুরভীকে সে বললো,

    — “টে টা রাখো টেবিলের উপর।”

    — “না, আমি দিচ্ছি সবাইকে।”

    সুরভীর হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলের একপাশে রাখলো রুদ্র। ওর হাত টেনে শরীফ সাহেবের পাশে বসিয়ে, নিজে বসলো টেবিলের উপর। এরপর বললো,

    — “আপনার কেন মনে হলো ও আমার কাছে ভালো থাকবে না?”

    — “আমি বলিনি ও তোমার কাছে ভালো থাকবে না। কিন্তু আমার নিজস্ব পছন্দ- অপছন্দ বলতে কিছু আছে।”

    — “সরাসরি হয়তো বলেননি কিন্তু কথার ইঙ্গিত সম্পূর্ণটা সেদিকেই যাচ্ছে। আমার চেয়ে বেশি ভালো কে রাখবে ওকে? এত খেয়াল কে রাখবে ওর? আপনি ওর বাবা। আপনি নিজেও ওর এতটা খেয়াল কখনো রাখেননি যতটা আমি রাখবো।”

    ভ্রু কুঁচকালেন শরীফ সাহেব। একজন বাবার যত্নে আঙুল তুলছে এই ছেলেটা!

    শরীফ সাহেব কিছু বলার আগেই রুদ্র বললো,

    — “ভ্রু কুঁচকানোর আগে একটা কথার জবাব দিন আমাকে, আপনার মেয়ে মুখটা আজ সারাদিনে দেখেছেন একবার? ও ঘুমায়নি সারারাত তা খেয়াল করেছেন?”

    মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন শরীফ সাহেব। সত্যিই অসুস্থ লাগছে ওকে! খেয়ালই করা হয়নি সারাদিন।

    — “আপনার মেয়ের এমন আরো বহু খোঁজ আমার জানা, যা আপনি জানেন না। ওকে ভালো লেগেছে, জীবনসঙ্গী করতে চাই, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটুকু ওর দখলে দিতে চাই; তাই ওর খেয়াল রাখি, চোখে চোখে রাখি। চাইলে আপনার মেয়েকে কবেই ধরে নিয়ে যেতে পারতাম। কারো কিছুই করার সাধ্য ছিল না। কিন্তু আমি নেইনি। আপনার সঙ্গে ঝামেলা করার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি ওর বাবা। একটাই মেয়ে আপনার, আমি চাইনি আপনার মেয়ের বিয়ে আপনার অনুপস্থিতিতে হোক। আমি আপনাকে সম্মান দিতে চেয়েছি, আপনি সম্মান নিতে না চাইলে আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। ওকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। দেখি আমাকে কে আটকায়?”

    ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো মিতার। ছুটে এসে মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। অসহায় চোখে ইকবাল মাহমুদের দিকে তাকালেন শরীফ সাহব। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আড়চোখে রুদ্রকে দেখছে সুরভী। আসিফের ধাক্কাটা এখনো কাটেনি। তাই এসব হুমকি-ধমকি, বিয়ের আলাপ মাথায় ঠিকঠাক খেলছে না। মা- বাবার মতো নিজেকে অসহায়ও লাগছে না। কিন্তু কে ইনি? কবে থেকে ওর পেছনে পড়ে আছে? চোখে পড়েনি তো কখনো?

    শরীফ সাহেবের কাঁধ চাপড়ালেন ইকবাল মাহমুদ।

    — “নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন। এত ভালো ঘর, বর মেয়ের জন্য কোথাও পাবেন না আপনি।”

    — “এভাবে আমার মেয়েটাকে জোর করে নিতে চাইবেন, তাই বলে?”

    — “জোর তো প্রথমে ও করতে চায়নি। আপোষেই সমাধান চেয়েছিল। আপনাকে আমি হুমকি দিচ্ছি না, জাস্ট রিয়েল ফ্যাক্ট এক্সপ্লেইন করছি। মেয়ে যদি আপনি ওর কাছে না দেন, মেয়েকে আর কোথাও দিতে পারবেন না। ও সত্যিই মেয়ে বাসা থেকে নিয়ে যাবে। আমি বলবো জীবনে কোনো পূণ্য করেছেন বলেই মেয়ের এমন ভাগ্য উপরওয়ালা নিজে সাজিয়ে দিয়েছে। আপনার মেয়েকে মাথায় করে রাখবে ও।”

    — “আংকেল. আমি আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবো না। বেরিয়ে আসার সময় মাকে বলেছি বউ আনতে যাচ্ছি। আমি বউ নিয়েই মায়ের কাছে ফিরবো। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন মেয়েকে নিজে আমার হাতে তুলে দেবেন নাকি আমি ওকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেবো?”

    নিজেকে টালমাটাল লাগছে সুরভীর। আসিফের চলে যাওয়া, হুট করে এই লোকটার উড়ে এসে জোর-জবরদস্তি, সবকিছু মাথার উপর গেলেও জোর করে পুরো মুহূর্তটা একবার মাথায় আঁটতে চাইলো ও।

    শান্ত-দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো,

    — “আপনার কেন মনে হলো আপনি আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইলেই আপনাকে আমি বিয়ে করবো?”

    সুরভীর কথায় মাথা নিচু করে হাসলো রুদ্র। প্রথমবারের মতো সুরভী তাকে কিছু বলছে। বলছে না ঠিক, প্রতিবাদ করছে। এটাও ভালো! ঘরের বউরা কখনো স্বামীর কথায় গলা মেলায় নাকি! ওরা উল্টো বলবে, চলবে, প্রতিবাদ করবে এই-ই

    তো ঘটে আসছে যুগ যুগ ধরে।

    — “আপনি হাসছেন কেন?”

    — “বিয়ে করতে চাও না আমাকে?”

    — “না! চিনি না, জানি না আপনাকে কেন বিয়ে করবো? তার উপর আমার ঘরে ঢুকে আমার বাবার সঙ্গে এভাবে বেয়াদবি করছেন! আপনাকে আমি বিয়ে করবোটা কেন, সেটা বলুন?”

    — “বাবার কথা এত ভাবো তুমি?”

    — “অবশ্যই ভাবি।”

    সুরভীকে একটানে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে নিলো রুদ্র।

    আর্তনাদ করে উঠলেন মিতা,

    — “আমার মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

    ভয়ে গলা ধরে এলো শরীফ সাহেবেরও।

    — “ক্ষমতার বলে এভাবে অন্যায় করবেন আমাদের উপর?”

    ইকবাল মাহমুদের বিরক্তি ধরে এল। কন্ঠের সেই নমনীয়তা হারালেন তিনি। ভ্রু জোঁড়া কুঁচকে এল তার।

    — “কেন এভাবে কান্নাকাটি করছেন? আমরা কি একাত্তরের হানাদার বাহিনী যে ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে সম্ভ্রম নষ্ট করবো? এসেছি একটা পবিত্ৰ কাজে। কী চমৎকার একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি! কোথায় রাজি হবেন, খুশি হবেন… তা না করে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কান্নাকাটি জুড়ে দিচ্ছেন। এসবের কোনো অর্থ হয়? নেহাৎ এটা রুদ্রের প্রসঙ্গ, নয়তো আপনি এভাবে বারণ করার পর আমি আর এক

    সেকেন্ডও এখানে বসতাম না। আত্মসম্মান আছে আমার, আর আমাদের ছেলেও কোটিতে একটা! এই ছেলের জন্য মেয়ের অভাব নাকি!”

    — “তাই বলে এভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে?”

    — “রুদ্রের ক্ষমতা আছে, তাই হুমকি দেয়। আপনার থাকলে আপনিও দিতেন।”

    সুরভীর ঘরে ওকে নিয়ে মুখোমুখি বসলো রুদ্র। নিচু স্বরে বললো,

    — “কার জন্য বিয়েটা করতে চাও না? আসিফ?”

    গতরাতের জট বুঝি এবারে খুললো। আসিফের হঠাৎ সরে যাবার কারণ কি এই লোকটা? ইনি কিছু করেছে আসিফকে? খাট থেকে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো সুরভী। রুদ্রের উপর চড়াও হলো ও।

    — “আপনি কী করেছেন আসিফকে?”

    সুরভীকে একটানে আবার খাটে বসালো রুদ্র। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

    — “চিৎকার করার আগে এটা দেখে নাও।”

    গতরাতের পুরো মুহূর্তটা ভিডিয়ো করেছিল শিশির, আসিফের অজান্তে। নিঃশব্দে সুরভী কাঁদছে। দুই গাল গড়িয়ে পানি ঝরছে ওর চোখ থেকে। চোখ জোড়ায় কাউকে হারাবার ব্যথা আর দেখছে না রুদ্র। এই কান্না কারো প্রতি কষ্টের কান্না না। এই কান্না প্রতারিত হয়ে নিজের জন্য মায়া হওয়ার কান্না। প্রতারকের প্রতি রাগে অন্ধ হবার কান্না।

    রুদ্রের ইচ্ছে করছে সুরভীর চোখজোড়া মুছে দিতে। সুরভীর চোখে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিলো রুদ্র। কাঁদুক। এই মুহূর্তটায় কারো সহানুভূতি ছাড়া একাই কষ্টের সঙ্গে লড়াই করুক। একা লড়াই না করলে অপরপক্ষের প্রতি ঘৃণাটা ঠিক জমে না!

    ভিডিয়ো শেষে মোবাইলটা রুদ্রকে ফিরিয়ে দিলো সুরভী। মাথা নিচু করে কাঁদছে ও। রুদ্র দেখছে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসা, নখ দিয়ে নিজের হাত খামচে ধরা। নিজের পক্ষে এবারে একটুখানি সাফাই গাইতে শুরু করলো রুদ্র।

    — “না জেনেই এভাবে ব্লেইম করা উচিত না। ছেলেটা তোমাকে এতগুলো বছর ধরে ইউজ করছিল জাস্ট। আর তুমি কিনা ওর জন্য মা-বাবা সব ফেলে চলে যেতে চেয়েছিলে! আবার সেই তুমিই তখন আমাকে শাসিয়ে বলছিলে, তোমার বাবাকে আমি অসম্মান করছি, তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? বাবাকে নিয়ে তুমি কখনোই এত ভাবো না সুরভী! যদি ভাবতে, এভাবে বিয়ের আগ মুহূর্তে তুমি বাসা থেকে গয়না নিয়ে পালাবার ডিসিশন নিতে পারতে না।”

    সুরভী ডুকরে কেঁদে উঠলো। হয়তো অপরাধবোধে! ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো রুদ্র।

    — “চোখটা মোছো। তোমার কান্নাকাটি দেখতে আমার ভালো লাগে না।”

    উত্তর করলো না সুরভী। রুদ্রর কথা কানে স্পষ্ট পৌঁছালোও না। আসিফ এখনও মাথায় ঘুরছে। যে মানুষটা তাকে ভালোবাসে না তার জন্য সব ছেড়ে যেতে চাইছিল ও! আসিফ শুধু এতগুলো বছর টাকার জন্য ওর কাছে এত অপ্রেম নিয়ে পড়ে রইলো? আর সেই টাকার কাছেই কিনা ওর পাঁচটা বছরের সমস্ত আবেগ, ভালোবাসা, সময় বেচে দিয়ে এভাবে হারিয়ে গেল! এত নিষ্ঠুর, বিবেকহীন লোকও হয় এই পৃথিবীতে? মুহূর্তেই ঘেন্না ধরে এল সুরভীর। সমস্ত আবেগ সবটাই বুঝি ফুরিয়ে গেছে। আসিফের নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা কোনো মায়া, ভালোবাসা কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না সুরভী।

    — “আমাকে বিয়ে করতে তোমার এখন আর কোনো আপত্তি নেই আশা করি!” রুদ্রের কথায় নিজ ভাবনায় ছেদ পড়লো সুরভীর। সামনের লোকটাকেও তার বিবেকহীনই লাগছে। নয়তো এমন মুহূর্তে একজন মানুষকে কেউ বিয়ের কথা কী করে বলতে পারে? মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করবে না? নাকি সেই বোধটুকুই পৃথিবী থেকে চিরতরে উঠে যাচ্ছে? কান্না জড়ানো দৃঢ় স্বরে সুরভী অমত জানালো, – “আমি কোথাও বিয়ে করবো না।”

    — “কেন? এখনও সমস্যা কী তোমার?”

    — “আপনি কি ইমোশনলেস? সমস্যা কোথায় বুঝতে পারছেন না আপনি? একটা মানুষ এভাবে আমাকে ঠকিয়ে চলে গেল আর আমি তক্ষুনি আপনাকে নাচতে নাচতে বিয়ে করে নেবো?”

    — “জানি তোমার খারাপ লাগছে। তুমি এই বিয়েতে রাজি না হলে আমারও খারাপ লাগবে।”

    ছলছল স্থির চোখে রুদ্রের দিকে চেয়ে রইলো ও। আবদারের একটা সীমা থাকা উচিত! সুরভীর আরো খানিকটা কাছে এগিয়ে বসলো রুদ্র।

    — “আসিফের কাছে তুমি একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলে, ভালোবাসা চেয়েছিলে। সব মেয়েই চায় অমনটা। আমি দেবো তোমাকে। ভালোবাসা, যত্ন, সংসার, সোশ্যাল স্ট্যাটাস সব! আমার ঘরে রাজত্ব করবে তুমি। আমার উপর কেউ কথা বলার সাহস করে না সুরভী। তোমাকে আমি সেই অধিকারটা দিতে চাইছি। নিবে না তুমি?”

    — “আমি এই মুহূর্তে কাউকে বিয়ে করার অবস্থায় নেই। বুঝতে কেন পারছেন না?”

    — “পারছি তো! তোমার কষ্ট হচ্ছে সে কথা আমি বুঝবো না? কিন্তু এই বিয়েটা খুব জরুরি। হতেই হবে। আজই। তোমার সঙ্গে আমার নাম জুড়ে দেবার আগ পর্যন্ত আমি কোনো কিছুতে শান্তি পাবো না। এত এত দায়িত্ব আমার, আমি শান্তিতে না থাকলে সেসব পালন করবে কে? তুমি শুধু কবুল বলো সুরভী। তুমিটাকে আমাকে দিয়ে দাও, আমি সব সামলে নেবো। তোমার মন খারাপ, অস্থিরতা সব!”

    কী বলবে ভেবে পেলো না সুরভী। সম্পূর্ণ অচেনা অদেখা কোনো মানুষ এভাবে উড়ে এসে জোর করে বিয়ের বায়না করলে তাকে কী করে ফেরাতে হয়, ঠিক কোন কথাটা বলে তাকে থামানো যায়, তা জানা নেই সুরভীর। সুরভীর হাত আলতো করে চেপে ধরলো রুদ্র।

    — “তুমি কী চাও শুধু বলো আমাকে? সব করবো আমি তোমার জন্য।”

    সুরভী এখনও চুপ। ওর চোখে স্পষ্ট বারণ। ও রাজি না এই সম্বন্ধে। কোনোভাবেই না। রুদ্রের আর ধৈর্য হলো না। শীতল চোখে সুরভীর দিকে তাকালো সে।

    ভীষণ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

    — “তুমি যদি আমার হও, আমার এই মাথাটা তোমার সামনে নুইয়ে দেবো। এবার তুমি হাত বুলাও, চুমু খাও, চড়ে বসো কিংবা চিবিয়ে খাও তোমার ইচ্ছে। আমি সব হাসতে হাসতে মেনে নেবো। তবে যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, তোমাদের মাথায় আমি চড়ে বসবো। রুদ্রের কারো মাথায় চড়ে বসার পরিণাম ভালো হয় না সুরভী। সহ্য করতে পারবে না। মৃত্যু যন্ত্রণাও এরচেয়ে সহজ মনে হবে। আমার এত চাওয়ার মানুষটাকে এভাবে কষ্ট দিতে আমারও ভালো লাগবে না। রাজি হও, নয়তো আরো অনেক উপায় আছে তোমাকে রাজি করানোর।”

    — “থ্রেট করছেন?”

    — “উহুঁ! যা কিছু হবে তা-ই বলছি।”

    — “আমি আপনাকে চিনি পর্যন্ত না!”

    — “রাস্তা থেকে উঠে আসা কোনো ছেলে আমি না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?”

    — “রাস্তা থেকে উঠে আসুন কিংবা প্রাসাদ থেকে নেমে আসুন, আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা একই থাকবে

    — “কেমন? খারাপ?”

    — “ভালো ধারণা হবার মতো কিছু কি করছেন আপনি? চিনি না জানি না হুট করে ঘরে ঢুকে বিয়ের জন্য জোর করছেন। সঙ্গে মন্ত্রী, একগাদা বডিগার্ড, পুলিশ নিয়ে এসেছেন। কোনো সন্ত্রাসী আর আপনার মাঝে খুব একটা তফাৎ আমি দেখছি না! সব কিছুতেই জোর চলে না। বিয়ে একটা মনের ব্যাপার। হতেই পারে আপনার অনেক ক্ষমতা, টাকা, আপনি সুন্দর, শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেক উঁচু। কিন্তু তবুও সেখানে ইচ্ছে কিংবা সম্মতির ব্যাপারটা আসেই। হয়তো আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অনেকেই ইচ্ছুক কিন্তু আমার ফ্যামিলি কিংবা আমি আমরা কেউই ইন্টারেস্টেড না।”

    সুরভীর বলা প্রতিটা কথা গায়ে বিধলেও ভালো লাগা, ওকে পাবার আকাঙ্ক্ষা যেন আরো তীব্র হলো। অন্য দশটা মেয়ের মতো টাকা, ক্ষমতার মোহে ডুবে গিয়ে জীবনসঙ্গী হবার মানসিকতা এই মেয়েটা রাখে না। ওর কাছে ব্যক্তি, তার মানসিকতা, অনুরাগ মূখ্য। এমন একজনই তো চেয়েছিল সে বহুবছর আগে যখন প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি এই মনে ছিল। চমৎকার একটা জীবনসঙ্গীকে সাথে নিয়ে দূরে কোথাও ঘর বাঁধার স্বপ্ন এই দু’চোখে ছিল। দাদী প্রায়ই একটা কথা বলতেন, “উপরওয়ালা যখন দেয়, ঝুলি ভরে দেয়”। তবে কি উপরওয়ালা এবার সুরভীকে দিয়ে তার সুখের ঝুলি পূর্ণ করবেন?

    আরেকটুখানি কঠিন হলো রুদ্র। দুইহাতের মাঝে সুরভীর হাতটা নিয়ে শক্ত করে চেপে বললো,

    — “এই যে হাত ধরে রেখেছি, কারো সাধ্য নেই আমার হাত থেকে তোমার হাতটা ছাড়িয়ে নেবার। তোমাকে আমার লাগবেই। এবার তোমার এই বিয়েতে মত থাকুক কিংবা না থাকুক।”

    রাগে কান্না পেলো সুরভীর। হচ্ছেটা কী এসব? প্রথমে আসিফ, তারপর এই লোকটা। একই সঙ্গে এতসব ঝামেলা হবার খুব প্রয়োজন ছিল কি? ছলছল চোখে, কান্না চাপা স্বরে সুরভী বললো,

    — “কী সুখ পাবেন আপনি আমার কাছে? এভাবে আমাকে জোর করলে না আমি ভালো থাকবো, না আপনাকে ভালো রাখতে পারবো।”

    — “দেখা যাক! এখন চলো আমার সঙ্গে। মা-বাবার সামনে গিয়ে বলবে এই বিয়েতে তুমি রাজি।”

    — “আমি রাজি না!”

    আর বাক্যব্যয়ের রুচি হলো না রুদ্রের। গলা উঁচালো সে,

    — “শুভ!”

    রুদ্রের চিৎকার এই ঘর অব্দি এল। শুভ ছুটলো পাশের ঘরে। শরীফ সাহেবের হাত চেপে ধরলেন মিতা। ভীতি, শঙ্কা আরো চেপে ধরলো যেন দু’জনকে। বিড়বিড়

    করলেন ইকবাল মাহমুদ, “শুধু শুধু পাগল ক্ষেপাচ্ছে”।

    শাহীন আহমেদ নিজে সোফা ছেড়ে উঠে এসে শরীফ সাহেবের পাশে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে নিচু স্বরে বললেন,

    — “আপনি কেন এমন গো ধরে আছেন বুঝতে পারছি না আমি। সম্বন্ধটা তো ভালো। মেনে নিয়ে দেখুন একবার। না মানলেই রাজ্যের সমস্যা আপনার ঘাড়ের উপর ভেঙে পড়বে। কেন বুঝতে চাইছেন না?”

    দিশেহারা লাগছে শরীফ সাহেবের। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। মেয়ে নিয়ে এতবড় বিপদে পড়বেন তা দুঃস্বপ্নেও আসেনি কোনোদিন।

    সুরভীর ঘরে এল শুভ। রুদ্রের পাশে দাঁড়াতেই সে বললো,

    — “মাহিনের ওখানে লোক পৌঁছেছে?”

    — “জি।”

    — “ওকে…”

    মাহিনের নাম শোনা মাত্র বুকের ভেতর মোচড় কাটলো সুরভীর। রুদ্রের কথা কাটলো ও।

    — “ভাইয়াকে কী করবেন আপনি?”

    — “একটু পরই খবর পাবে ওকে কী করেছি।”

    — “আমার জন্য ওর ক্ষতি কেন করবেন?”

    — “কারণ ও তোমার ভাই।”

    অসহায় চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো সুরভী। দু-চোখ বেয়ে পানি ঝরছে ওর। আর একবিন্দু মানসিক চাপ নেবার ক্ষমতা ওর নেই। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। নিজ হাতে ওর চোখজোড়া আলতো করে মুছে দিয়ে রুদ্র বললো,

    — “সিচুয়েশন তুমিই জটিল করছো। একটা মানুষ তোমাকে এত করে চাইছে, সে নিশ্চয়ই তোমাকে খারাপ রাখবে না। এতটুকু বোঝার মতো বয়স তোমার হয়েছে সুরভী! আমার লোক দাঁড়িয়ে আছে। বলো, তুমি কি এখনই কবুল বলবে নাকি আমি রাফ ডিসিশনে যাবো?”

    আর এক মুহূর্ত সময় নিলো না সুরভী। কোন দূরদেশে ভাইটা একা পড়ে আছে। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই ওখানে। ওর বিপদে কে দেখবে ওকে? ভাবতেই মাথা ঘুরতে লাগলো ওর। রুদ্রের চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,

    — “আমি রাজি।”

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম
    Next Article পৃথিবীর পথে – ম্যাক্সিম গোর্কি (অনুবাদ : খায়রুল আলম মনি)

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Our Picks

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }