Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুদ্র – খাদিজা মিম

    খাদিজা মিম এক পাতা গল্প239 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    রুদ্র – ২০

    ২০

    ছোট ভাই-বোনদের উপস্থিতিতে আজ সন্ধ্যার পর মেয়ে বিয়ে দিলেন শরীফ সাহেব। কোনো আয়োজন নেই, খুশি নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়েটা এমন কুৎসিত কায়দায় হলো সে কথা যতবার মনে পড়ছে, ততবার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এমন মানুষের নজরে তার মেয়েটা পড়লো কেমন করে! সোফায় গা এলিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। পাশ থেকে ছোট ভাই, বোনজামাই কী কী যেন বলছে তাকে! কানে কিছুই পৌঁছাচ্ছে না। কানে বাজছে শুধু রুদ্রের হুমকি, চোখে ভাসছে মেয়ের কান্না। তার স্ত্রী নিচুস্বরে বিলাপ করে কাঁদছে। ছোটবোন, ভাইয়ের বউ ভাতিজিরা মিলে তাকে শান্ত করতে চাইছে। মুহূর্তে বেড়ে যাওয়া হাই প্রেশার, তেঁতুল গোলানো পানি খাইয়ে আর মাথার তালু তেল পানিতে ভিজিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কোনোকিছুতেই স্থির হতে পারছেন না তিনি। এভাবে বলে কয়ে ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে কে যায়!

    মোবাইল বাজছে শরীফ সাহেবের। ঘোলা চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলেন মাহিনের নাম। রিসিভ করেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি,

    — “বাবা! আমার সুরভী …”

    মির্জামহলে সানাই বাজছে। বাড়ির মূল ফটকে চেয়ারে বসে আছেন ফেরদৌসী মির্জা। বিয়েটা ভীষণ অনাড়ম্বর হয়েছে সে কথা জানেন তিনি। তবে ছেলের বউ কোনো আয়োজন ছাড়াই শ্বশুরবাড়ি প্রথম পা রাখবে, তা কিছুতেই হওয়া চলবে না। বিকেলে ছেলে বেরিয়ে যাবার পর তক্ষুনি বাড়ির কর্মচারীদের ডেকে তিনি সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার আদেশ মতে পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে, রুদ্রের ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, সানাই আর ঢাকের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বউ বরণের জন্য বংশ পরম্পরায় পাওয়া হারটার সঙ্গে কিনে আনিয়েছেন আরো একসেট গয়না। বাড়ির রান্নাঘরে এখনো চলছে নতুন বউ আগমন উপলক্ষ্যে বাহারী রান্না। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তার সবসময়ের সঙ্গী নাজনীন, ছোট ভাইয়ের বউ আর ছোট বোন। তাদের কেউ ধরে রেখেছে শরবত- মিষ্টির ট্রে, একজনের হাতে গয়নার বাক্স, অন্যজনের হাতে ফুল।

    গাড়ি বাড়ির সামনে এসেছে মিনিট পাঁচেক হলো। এখনও বর-বউ কেউ গাড়ি থেকে নামছে না। কেন যে নামছে না, কে জানে! সুরভীকে একনজর দেখবেন বলে অস্থির লাগছে ফেরদৌসীর। তার অস্থিরতা টের পেয়ে নাজনীন এগিয়ে যেতে চাইলো গাড়ির দিকে। তখুনি থেমে গেল সে। বউ নামছে!

    ফেরদৌসীর মুখ থেকে হাসি সরছেই না। এই তো তার একমাত্র ছেলের বউ! এই বাড়ির নতুন কর্ত্রী। তার ছেলের বহু শখের মানুষটা! যার মাঝে তার ছেলে সুখের চাবি পেল তাকে তিনি মাথায় করে রাখবেন।

    সুরভী কাছে এসে সালাম করে উঠে দাঁড়াতেই ওর মুখটা দেখলেন ফেরদৌসী। মুখে কোনো সাজ নেই। কেঁদে চোখ-নাক ফুলিয়ে রেখেছে। একটুখানি হাসি মিলিয়ে গেল তার। মেয়েটার বড্ড মন খারাপ! ওর জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটা আরো অনেক সুন্দর হতে পারতো। ছেলেটা যে কেন অমন অদ্ভুত আচরণ করলো কে জানে! তবে ছেলে সব সামলে নেবে, সে বিশ্বাস আছে তার। তাই আর মাথা ঘামালেন না তিনি। গায়ের হালকা গয়না, গাঢ় বেগুনী কাঞ্জিভারামে ভারী মিষ্টি লাগছে ওকে।

    সুরভীর গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে ফেরদৌসী ভাই-বউ, বোনকে বললেন,

    — “দেখো তো কেমন বাচ্চা একটা বউ নিয়ে এসেছে রুদ্র! এত এত দায়িত্ব কেমন করে ওরে ঘাড়ে চাপাবো আমি? আমার তো ইচ্ছে হবে ওকে দুই বেণী করে দিয়ে কোলে বসিয়ে রাখি।”

    ফেরদৌসীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো সবাই। সুরভীর পেছন থেকে সামনে সরে এল রুদ্র। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো সে। ছেলের চোখে মুখে খুশির ছটা দেখতে পাচ্ছেন তিনি। অদ্ভুত এক সুখময় স্থিরতা খেলা করছে তার মাঝে। ছেলেকে কবে এমন খুশি দেখেছিলেন, সুখী হতে দেখেছিলেন মনে নেই ফেরদৌসীর। ছেলের এই মুখটা দেখার জন্যই তো এতগুলো বছর কাতর হয়ে ছিলেন তিনি।

    সুরভীর মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে, ওর মাথায় দু-হাত চেপে ছলছল চোখে দোয়া করলেন তিনি,

    — “তুমি সুখে থাকো। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার হোক। দুঃখ কোনোদিন তোমাকে স্পর্শ না করুক। ভালো থাকো মেয়ে তুমি।”

    শাশুড়ির কান্না জড়ানো কন্ঠে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো সুরভী। ছেলের বিয়েতে মায়েরা কাঁদে? জানা ছিল না তো! সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। রুদ্র কে, সে কথা জানা নেই সুরভীর। তবে আন্দাজ করাই যাচ্ছে নাগালের বাইরের একজন মানুষ সে। চাইলে দেশের সেরা সুন্দরী, বনেদী ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতেই পারতো। ধরে ধরে ওকেই কেন? তাও এমন বাজে কায়দায়! এমন ঘরে বিয়ে দেবার স্বপ্ন তো মনে হয় কোনোদিন মা বাবাও দেখেনি! কেন ঘটছে এসব? রুদ্রের রাজনৈতিক কোনো চালের অংশ কি এই বিয়েটা?

    *****

    মায়ের কথামত আজ নতুন বউকে ভীষণ যত্নে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে রুদ্র। প্রতিবার সুরভীর মুখে খাবার তুলে দেবার সময় তার মনে হয়েছে, ও আমার বড্ড আদরের কেউ, যার যত্নে কোনো হেলা চলবে না! খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন মামী খালা আর কাজিনরা তার পেছন পেছন আসছিল নতুন বউকে বাসর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলে, তখনই সুরভীর হাত কাঁপতে শুরু করলো। সবার চোখ এড়ালেও, রুদ্রের চোখ এড়ালো না। তাদের বাসর নিয়ে দুষ্ট খুনসুটিতে মেতে উঠা ভাই-বোনদের চোখ রাঙিয়ে তক্ষুনি থামিয়ে দিলো সে।

    সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

    — “এত ঘটা করে ঘর অব্দি যাওয়ার কিছু নেই। এটা ওর ঘর। ও একাই যেতে পারবে। ঘরে চলো সুরভী।”

    রুদ্রের কন্ঠের কঠোরতা বড্ড কানে লাগলো সুরভীর। লোকটা কি এভাবেই কথা বলে সবার সঙ্গে? ভাই-বোনদেরও কেমন চোখ রাঙালো! সবাই তার এক চোখের ইশারায় চুপ হয়ে গেল, মুরুব্বিরা থেমে গেল। বিয়ের সময়ও বারবার করে ঐ দু’জন সতর্ক করছিল, ঝামেলা করলেই বিপদে পড়বেন। সবাই উনাকে এত ভয় পায় কেন?

    রুদ্রকে ঘিরে ভাবতে ভাবতে তার পেছন পেছন তারই ঘরে যাচ্ছে সুরভী। এতটা সময়ে নিজের নতুন ঘরটা দেখা হয়নি। বরণ করে শাশুড়ির ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন। এক পা দুই পা করে নিজের ঘরে যত এগোচ্ছে তত ভয় চেপে ধরছে ওকে। হাতের কাঁপুনিটা থামছেই না!

    ঘরে ঢুকে, দরজার পাশে মাথা নিচু করে সুরভী দাঁড়িয়ে রইলো। ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ মাতোয়ারা। চোখ তুলে এখনো দেখা হয়নি এই ঘর আজ কী কী ফুলে সেজেছে? সামনেই রুদ্র দাঁড়িয়ে। অস্বস্তি আর ভয়ে একটুখানি নড়াচড়াও করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সুরভীকে দেখলো রুদ্র। সে চাইছিল সুরভী চোখ তুলে তাকাক। অন্তত একবারের জন্য হলেও তাকাক। অথচ ও তাকাচ্ছে না কিছুতেই! এগিয়ে এসে সুরভীর হাত টেনে খাটে বসালো সে। ওর কাঁপতে থাকা হাতজোড়া, নিজের দু’হাতের মুঠোবন্দি করে চেপে ধরলো রুদ্র। এই বুঝি লোকটা স্বামীর অধিকার চাইলো বলে! সেই আতংকে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো মুহূর্তেই! জোর করে বিয়ে পর্যন্ত নাহয় সহ্য করা গেছে, তাই বলে এই অপরিচিত লোকটার সঙ্গে বাসর! এতখানিও মেনে নেয়া সম্ভব না। সহ্যসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে এবার। ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো সুরভী।

    এক মুহূর্ত সময় নিলো না রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে সুরভীর হাত ছেড়ে খানিকটা দূরে সরে বসলো।

    কন্ঠ নামিয়ে সুরভীকে বললো,

    — “তুমি যা ভাবছো এমন কিছু হবে না সুরভী। এসব বাসর, ফুল-টুল এগুলো আম্মুর করা। ভেবেছে, ছেলে বিয়ে করেছে, বাসর ঘর সাজাতেই হবে। আম্মু এতসব বুঝেনি। বিয়ে জোর করে করেছি কিন্তু তোমার আমার অন্তরঙ্গতা তোমার অনুমতি ছাড়া হবে না। আমি খারাপ। সত্যিই আমি খারাপ। তবে জোর করে একটা মেয়েকে বিছানায় টানবো এতটাও খারাপ আমি না। হোক সে বাইরের কেউ কিংবা আমার বিয়ে করা বউ। কন্সেন্ট ম্যাটারস! বিয়েটাও জোর করতাম না, কিন্তু তোমাকে যে আমার চাই! তুমি ছাড়া আমাকে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। সবকিছু কেমন থেমে গিয়েছিল আমার। আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার মাথা খেয়ে বসেছিল তোমার দুশ্চিন্তা যদি তোমাকে আমার করে না পাই! বিয়ে করেছি, তুমি এখন আমার। ব্যস! এটুকুতেই আমার শান্তি। এবার যখন ইচ্ছে হবে তখন আমায় ভালোবেসো। যখন ইচ্ছে হবে আমার কাছে এসো। আমি কখনো তোমার কাছে ভালোবাসা কিংবা ইন্টিমেসি কিছুই চাইবো না। তবে শুধু বলবো, আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না। তোমার মনে যদি কখনো কাউকে রাখতে চাও সেই মানুষটা যেন শুধু আমি হই। আমার যখন ভীষণ অস্থির লাগবে, কোথাও শান্তি খুঁজে পাবো না, তখন আমার পাশে বসে আমাকে একটু সময় দিও। তুমি আমার হয়ে আছো, আমার আশপাশে আছো এতেই আমার সুখ।

    সুরভীর হাত আর কাঁপছে না। ভয়, অস্বস্তি কিছুই লাগছে না। মনে শুধু একটা অনুভূতিই উপস্থিত আছে, বিস্ময়! এই মানুষটার মুখে এই কথাগুলো বড্ড বেমানান লাগছে না? বিকেলে যতটা কঠোর রূপ দেখেছিল, কোথায় গেল সেই রূপ? এতটা কোমল স্বরে কথা বলতেও জানেন তিনি? ভালোবাসা কিংবা সঙ্গমের মতো তীব্র আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে ধৈর্য্য রাখতে জানেন তিনি?

    বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুদ্র।

    লম্বা দেহখানি সুরভীর সামনে সামান্য নুইয়ে বললো,

    — “জরুরি কাজ আছে, বেরোবো এখন। ফিরতে হয়তো দুইটা কিংবা তিনটা বাজবে। তুমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আরেকটা কথা, আমি সোফায় ঘুমাতে পারি না। ফ্লোরেও ঘুমাবো না। খাটেই ঘুমাবো। অবশ্যই দূরত্ব বজায় রাখবো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে পাশে আমাকে দেখে ঘাবড়ে যেও না।”

    বলেই একগাল হাসলো রুদ্র। বেরিয়ে যাবার আগে আলতো করো সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে গেল।

    রুদ্র চলে গেছে। এখনও দরজায় চেয়ে আছে সুরভী। একটা মানুষের মাঝে এত রহস্য কেন থাকবে?

    ২১

    ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। রাতের খাবার শেষে, সিগারেট হাতে মাত্রই জানালার ধারে এসে বসতে যাচ্ছিলেন আজগর, তখনই দেখলেন বাড়ির বাইরে রুদ্রের গাড়ি ভেতরে ঢুকবে বলে অপেক্ষা করছে। এত রাতে এখানে এসেছে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কারণ তো অবশ্যই আছে। আদনান সম্পর্কিত কিছু? ঐ ছোকড়াকে তো বউসহ কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছে! লুকিয়ে রেখে আর কতদিন? তাছাড়া এ তো সবে শুরু। সামনে আরো কত কী দেখতে হবে দলকে, সে কথা রুদ্র বেশ জানে। কূল-কিনারা করতে পারছে না হয়তো, তাই বুঝি এই রাতে

    একটা সুরাহা করতে। ভাবতে ভাবতে একাই হাসলেন আজগর, দুইদিনের বাচ্চা এসেছে কিনা তার সঙ্গে লড়তে!

    সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বড্ড আয়েশে উপর থেকে নেমে লিভিং রুমে এলেন তিনি। ততক্ষণে এখানে এসে গেছে রুদ্র আর শুভ। প্রশস্ত হাসিতে জানতে চাইলেন,

    — “কী ব্যাপার! এতরাতে আমার বাড়ি?”

    — “খুব জরুরি কথা আছে আংকেল।” বিষন্ন মুখ করলো রুদ্র, যেন তার ঘোর বিপদ!

    রুদ্রের বিষণ্ন চেহারায় খুশি হতে পারলেন না আজগর। পাহাড় সমান সমস্যা মাথায় ভেঙে পড়লেও চেহারায় সে কথা প্রকাশ করার ছেলে রুদ্র না। মাটিতে একেবারে পিঠ মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সিংহের মতো গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ ও। নিশ্চিত কোনো ফন্দি করে এসেছে! মুখের হাসিটা আর টিকলো না আজগরের। না চাইতেও চোখেমুখে চিন্তার ছাপ একটু হলেও প্রকাশ পাচ্ছে।

    মনে মনে হাসলো শুভ। ভ্রু যুগলের মাঝে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে বললো,

    — “আহা আংকেল! এখনই চিন্তায় পড়ে যাচ্ছেন! আগে পুরো ঘটনা তো শুনুন। এই সমস্যার সমাধান শুধু আপনার কাছেই আছে। আপনাকেই মাথা ঠান্ডা রেখে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

    এগিয়ে এসে আজগরের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো রুদ্র।

    — “উপরে চলুন আংকেল। আপনার শোবার ঘরে। স্পর্শকাতর বিষয়! যেখানে সেখানে আলোচনা করা চলবে না।”

    — “এত হেঁয়ালী করছো কেন? এখানে বলে দিলেই পারো।”

    — “আপনার ঘরের ইজ্জতের ব্যাপার! আমি আপনাকে অপছন্দ করি তা ঠিক। কিন্তু আপনার ইজ্জতের বারোটা বাজাতে আমি একদম চাই না। মিনিমাম মোরালিটি আছে তো আমার!”

    — “নতুন করে খেলা সাজালে নাকি, বাবা?”

    — “খেলা সাজিয়েই টিকে থাকতে হয়। নয়তো রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা যায় নাকি? বাঁচতে দেবেন আপনারা?”

    রুদ্রের সঙ্গে চলতে চলতে মনে মনে বিভিন্ন দিক থেকে হিসেব কষছেন আজগর কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে? কেউ কি গাদ্দারী করলো? মতিকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না সেভাবে। ও কি ভেতরের খবর পাচার করে রুদ্রকে সুযোগ করে দিলো? কিন্তু কী? নীরবে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বয়স বাড়ছে। হুটহাট এমন চাপ মাথায় চড়লে তৎক্ষনাৎ নিজেকে স্বাভাবিক রাখা একটু মুশকিল আজকাল। তবুও যথাসাধ্য নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন আজগর। মরণ সামনে এলেও নিজের দুর্বলতা, ভয় কিচ্ছু বুঝতে দেয়া চলবে না!

    আজগরের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো রুদ্র। বাইরে শুভ দাঁড়িয়ে, ভেতরে আনেনি তাকে। মোবাইল ফোনটা আজগরের হাতে ধরিয়ে তার মুখোমুখি বসলো রুদ্র।

    — “হার্ট মি! হার্ট মি!”

    বাহারী অন্তর্বাস পরে অদিতি দুই পা ফাঁক করে শুয়ে আছে। খাটের সঙ্গে ওর দু’হাত হ্যান্ডকাফে আটকানো। চোখজোড়া লাল কাপড়ে বাঁধা। হেরোইন সেবনকারীরা একটুখানি হেরোইনের জন্য যতটা অস্থির হয়ে উঠে, অদিতি ঠিক তেমন করছে। ঠোঁট কামড়াচ্ছে, গাঢ় নিঃশ্বাসে বুক উঠানামা করছে। একটা পুরুষালী হাত ওর নগ্ন পেট ছুঁয়ে দিতেই ভিডিয়ো অফ হলো।

    অক্টোবরের শেষ সময় চলছে। গরম খুব একটা নেই। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তবুও ঘামছেন আজগর। মাথার টাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার। মোবাইল স্ক্রিনে মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আজগরের। অদিতিকে কী করেছে এরা? মেয়েটা ব্যথা পাবার জন্য এভাবে মরিয়া কেন হয়ে উঠেছে? কোথায় আছে তার মেয়ে? কে ওর গায়ে হাত দিলো? মেয়ের দুশ্চিন্তায় সমস্ত প্রশ্ন গলা পর্যন্তই আটকে রইলো। রুদ্রকে আর জিজ্ঞেস করা হলো না। মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না তার। হা করে শ্বাস নিচ্ছে সে। তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো রুদ্র।

    — “এই বয়সে এভাবে প্যানিক করলে বিপদ। মরে যাবেন তো!”

    — “অদিতিকে কী করেছো তুমি?”

    — “আমি কিছু করিনি। আমার লোকেরা ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে গাড়িতে তুলে নিয়ে ড্রাগ দিয়েছে ওকে। আপনার মেয়ে এখন পুরুষ শরীরের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছে। একটু পর পর চিৎকার করছে, হার্ট মি! হার্ট মি! প্লিজ স্যাটিসফাই মাই থার্স্ট! আরো কী কী সব উগ্র কথাবার্তা! উফ বাবা!”

    ঘটনার আকস্মিকতায় সমস্ত কথা, মানসিক জোর হারালেন আজগর। পৃথিবীতে এই একজনই তো আছে যার কাছে আজগর আটকায়, যাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। আজ কিনা তার রাজনীতির চালের বলি তার সন্তানকে হতে হচ্ছে? তাও এভাবে! অসহায় চোখে আজগর চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে।

    ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। আজগরের ক্লিন শেইভড তেলতেলে গালে হাত বুলিয়ে বললো,

    — “এখনই এমন লুক দিচ্ছেন? সামনে আরো কী সব যে ঘটবে সেসব সামলাবেন কেমন করে? কী সব বলতে কী কী হবে লেট মি এক্সপ্লেইন। বিদেশ বিভূঁইয়ে নানা ঢঙে নারী পুরুষের মিলন হয়। আপনার মেয়ের এই ভিডিয়ো ভাইরাল হবার পর লোকে জানবে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর মেয়ে অদিতি বিদেশ গিয়ে ওসবই এক্সপেরিমেন্ট করছে। ঘূণাক্ষরেও কেউ জানবে না ওকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে। আর হ্যাঁ, আপনি বাবা তাই গায়ে কাপড় চোপড় কিছু রাখা হয়েছে। দেশের লোক যখন দেখবে একটা সুতাও থাকবে না কিন্তু!”

    রুদ্রের কলার চেপে ধরলো আজগর। কথা বলতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। গুছিয়ে কিচ্ছু বলতে পারছে না! নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করছে না রুদ্র। বসেই রইলো সে আজগরের মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে। এই চাহনী মানুষের না, সাক্ষাৎ অসুরের। যে সমস্ত কিছু মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে জানে। ওর চোখে তাকিয়ে ভীতি গাঢ় হলো আজগরের। ধীরে ধীরে কলার থেকে হাত নেমে আসছিল তার। তখনই তার হাত শক্ত মুঠোয় পুরলো রুদ্র।

    — “পাড়া দেয়ার আগে বুঝে নিতে হয় লেজটা কার? ছাগলের নাকি সাপের? সাপের লেজে পা রাখার পরিণাম ভালো হয় না। এতদিন রাজনীতি করে এতটুকু মাথায় ঢুকলো না? আমি ইকবাল না, আমি রুদ্র। আশরাফের ছেলে আমি। বাবার মাঝে মনুষ্যত্ব যা-ও ছিল, আমার সেটাও নেই। পিষে এমনভাবে মাটির সঙ্গে মেশাবো না, দুনিয়ায় আজগর নামের কেউ ছিল সেটাই লোকে ভুলে যাবে।”

    — “অদিতি কি সেইফ আছে?”

    — “আছে।”

    — “কী চাও?”

    — “এভিডেন্স। যা কিছু আছে দলের, সব চাই।”

    নিজের ল্যাপটপ, আর আলমারী খুলে বেশ কিছু ফাইল সব রুদ্রের হাতে তুলে দিলেন আজগর।

    — “যা কিছু আমার কাছে প্রমাণ ছিল, সব এতে দিয়ে দিয়েছি।”

    — “আর আপনার মগজ, যেটাতে সব ঘটনা কপি করা আছে। সেটা কী করবো?”

    — “মেরে ফেলতে চাও?”

    — “না না! কথায় কথায় লোক ধরে মেরে ফেললে চলবে নাকি! আপনি একটু দুষ্টুমি করবেন, আমি একটু করবো এভাবেই বেঁচে থাকবো আমরা। শুধু খেয়াল রাখবেন দুষ্টুমি যেন বেশি না হয়ে যায়! এই তো। আপনি একদিকে মুখ খুলবেন অন্যদিকে আপনার মেয়ে হাওয়া হয়ে যাবে, এবার যতই পাহারা বসান না কেন!”

    ল্যাপটপ আর ফাইলগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো রুদ্র। দরজায় গিয়ে আবার পিছু ফিরলো সে।

    — “দ্বন্দ্ব আমাদের মাঝে ছিল। আমাদের পরিবারের মেয়েদের মাঝে টেনে এনে কাজটা ঠিক করেননি। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ আপনি। রাজনীতি আপনাদের দেখেই আমরা শিখি। নোংরামি শেখালে নোংরামিই করবো। সীমা ছাড়াতে শেখালে সীমাই ছাড়াবো। এবং সেটা আপনার চেয়ে দ্বিগুন হবে।”

    ঘর থেকে বেরিয়ে এল রুদ্র। পেছন পেছন যাচ্ছে শুভ। তার ফোন থেকে কল গেল লন্ডন, জামিলের কাছে। একবাক্যে শুভ কথা সারলো,

    — “অদিতিকে ছেড়ে দাও।”

    *****

    গাড়িতে চড়ে বসা মাত্রই কল এল আদনানের।

    — “কেমন আছেন ভাইয়া?”

    এপাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই রুদ্র আন্দাজ করে নিলো সোমা-আদনানের সম্পর্ক থেকে অস্থিরতা বিদায় নিয়ে শিথিলতা এসেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুদ্র। আদনানকে ঘিরে পুরো ব্যাপারটা এ ক’টাদিন গলার কাঁটা হয়ে ছিল যেন! আদনানের জবাব না দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলো সে,

    — “তোমার খবর বলো? সোমাকে মানানো গেল?”

    — “সে কথা বলার জন্যই কল করলাম। সবকিছু ফিক্স হয়ে গেছে। আপনি যেভাবে বলেছেন এক্সাক্ট সেটাই করেছি।”

    — “দেখলে? সময় কিন্তু বেশি লাগেনি। ভালোবাসে বলেই তোমার কথা মেনে নিয়েছে। যত্নে রেখো ওকে। ওর প্রাপ্য সম্মানটুকু ওকে বুঝিয়ে দিও।”

    — “আর ভুল হবে না। আমার মন্ত্রীত্ব বাতিল হওয়া, মিডিয়া জনগনের প্রেশার এসব হয়তো আমি সামলে নিতে পারতাম, কিন্তু সোমা আমাকে ফেলে চলে গেলে সত্যিই মেনে নিতে পারতাম না! আপনি আপন বড় ভাইয়ের মতো ঐ কঠিন মুহূর্তটায় সাপোর্ট করেছেন। থ্যাংকস ফর এভ্রিথিং ভাইয়া!”

    — “এবার ধুমধাম করে বউ ঘরে তোলো।”

    — “অবশ্যই তুলবো। কিন্তু নেক্সট প্ল্যান কী?”

    — “থাকো ওখানে আরো তিন-চারদিন। তারপর ঢাকায় ফেরো, তখন কথা হবে। এখন শুধু সোমাকে সময় দাও।”

    আরো কিছু কথোপকথন শেষে ফোন রাখলো রুদ্র। পাশেই শুভ কথা বলছে ফোনে। হুম হ্যাঁ তে পুরো ফোনালাপ সীমাবদ্ধ তার। আদনানের সঙ্গে কথা চলাকালীন সময় থেকেই খেয়াল করছে রুদ্র। নতুন কোনো খবর হাত লেগেছে হয়তো!

    খানিকসময় বাদে কল কাটার পরই রুদ্রকে শুভ বললো,

    — “ভালো খবর আছে।”

    — “কী?”

    — “মতির প্রেমিকা প্রেগন্যান্ট।”

    — “মডেলটা?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “বাহ্! চাচা হবো।”

    — “তার আগেই লাশ বানিয়ে দেয়ার সুপারিশ চলে এসেছে।”

    — “কাকে দিলো?”

    — “ফয়েজকে।”

    — “সবচেয়ে কনফিডেন্সিয়াল লোক তো ও-ই আছে। কিন্তু খবর লিক হলো কেমন

    করে? ও তো মুখ খোলার মানুষ না!”

    — “কাহিনিতে টুইস্ট আছে। ফয়েজের মেয়ে-টেয়ের নেশা আছে, তা তো জানেনই। তো যে পাড়ায় যায় সেখানে এক মেয়েকে ওর মনে ধরেছে। খুচরো ইমোশন না, সত্যিই ভালোবাসে মেয়েটাকে। জান-প্রাণ দিয়ে দেবে অবস্থা। সেই মেয়ের সামনে ফোনে কথা হয়েছিল মতির সঙ্গে। সেভাবে ঘটনা আমাদের নন্দীর কানে চলে এসেছে।”

    — “ওটারও তো ওদিকে যাওয়ার নেশা আছে।’

    — “হ্যাঁ!”

    — “সব কথা সবার সামনে বলতে হয় না, এই জ্ঞানটুকু না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। ঝামেলা একটা হবেই। ফয়েজ এক্সপার্ট। ক্ষুরধার বুদ্ধি ওর। মুহূর্তে প্ল্যান ছাড়া পারফেক্ট মার্ডার, কিডন্যাপিংয়ে ও মাস্টার। অথচ দেখো, এই বেসিক সেন্সটা ও রাখে না।”

    — “ভালোবেসে অন্ধ হয়ে গেছে।” ফিক করে হেসে ফেললো শুভ।

    মুচকি হাসলো রুদ্র। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বললো,

    — “তবে লাভটা আমাদেরই হলো। এত পারফেক্টলি সব কিছু ঘটে যাচ্ছে আজ! একদিনে চারটা প্রবলেম সলভড হলো আমার। আমার বিয়ের দিনটা অসাধারণ যাচ্ছে!”

    — “তাহলে মতির বিষয়টা কী করবো?”

    — “একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে তো জেনেশুনে আর মরতে দিবো না। তবে ওকে নিয়ে একটুখানি রাজনীতি করাই যায়!”

    রুদ্রের ইশারা ঠিক বুঝে নিলো শুভ। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো সে।

    — “অর্ডার কবে?”

    — “আটদিন পর।”

    — “কাল বিস্তারিত আলাপ করবো। আজ আর এসব ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না। অসম্ভব ভালো মেজাজে আছি।”

    — “একটা হিসেব ঠিক ধরতে পারলাম না!”

    — “কোনটা?”

    — “অদিতির ভিডিয়োটা ওর অজান্তে ওরই প্রেমিক করেছে। তখনও অদিতিকে কিডন্যাপ করা হয়নি, ড্রাগ দেয়া তো পরের হিসেব। যা ঘটেছে সব ওর ইচ্ছেতে, তাহলে কেন ওর বাবাকে মিথ্যা বললেন?”

    — “মেয়েকে রেইপ করা হচ্ছে আর মেয়ে স্বেচ্ছায় কোনো ছেলের সঙ্গে সেক্স করছে দু’টোর মাঝে তফাৎ আছে তো! মেয়ে আনন্দে আছে সেটা আজগরকে খুব একটা পীড়া দেবে না। হয়তো সাময়িক রাগ হবে, আবার নাও হতে পারে। মেয়ে দেশের বাইরে কী করছে সে সম্পর্কে একেবারে কিছু অজানা তো ওর নেই। ওর মেয়ের ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেবো ঐ হুমকিটা খুব একটা কাজে নাও আসতে পারতো। তবে মেয়ে রেইপ হবে সেটা সব বাবার জন্য সীমাহীন পীড়ার। ডোজ যেহেতু দেবোই, ভালো করেই দেবো।”

    — “অদিতি আজ সেন্সলেস ছিল। যদি ওর বাবা কিছু জিজ্ঞেসও করে, কিছুই গুছিয়ে বলতে পারবে না।”

    — “হ্যাঁ। সব পার্ফেক্টলি হয়েছে এটাই শান্তি। আজগর মনে হয় না আর বাড়াবাড়ির দুঃসাহস দেখাবে। অদিতিকে নিয়ে কোনো রিস্ক ও নেবে না। মতিকেও সাইজ করে দেবো। জেল থেকে বের হওয়ার আর চান্স নেই। রইলো বাকি হাবিব, দু’জনের এই হাল দেখার পর মনে হয় না ও আর কিছু করার সাহস করবে।”

    — “সেটা দেখা যাবে নাহয়!”

    — “গাড়ির এসিটা বন্ধ করে, জানালাগুলো খুলে দাও। গায়ে একটু বাতাস লাগাই।” জানালার কাচ নামিয়ে দিলো শুভ। রাস্তা প্রায় শূণ্য। বাইরে ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগছে। মাথা হেলিয়ে বাইরে চেয়ে আছে রুদ্র। গুনগুন করে গাইছে সে। গানের কথা বুঝার চেষ্টা করছে শুভ। শুনেছিল কোনো একসময় এই মানুষটা গানকে ঘিরে নিজের জগত তৈরী করতে চেয়েছিল। বিধিবাম, সে জগত আর তৈরী হয়নি। গান এখন আর রুদ্রের কন্ঠে বাজে না। খুব সম্ভবত তিন বছর পর আজ রুদ্রকে গুনগুন করতে শুনলো শুভ।

    — “রাস্তায় কোথাও চাপ নানরুটির দোকান খোলা পেলে গাড়ি দাঁড় করাও। খেতে ইচ্ছে করছে।”

    — “ভাবী ঘরে একা। ফিরবেন না?”

    — “শি নিডস স্পেস। খুব জোর জবরদস্তি করলাম, মানসিকভাবে ভীষণ এলোমেলো আর অস্থির হয়ে আছে। একা থাকুক কিছুক্ষণ। হিসেব নিকেশ করে পুরো ঘটনাটার সঙ্গে খাপ খাওয়াক।”

    ২২

    পরশু রাতে ঘুম হয়নি গোটা রাত। সেই সঙ্গে গতকালের ধকল মিলিয়ে ক্লান্তি চরমে ঠেকেছিল সুরভীর। রাতে কাপড় বদলে বিছানায় শুতেই দুনিয়া ভেঙে ঘুম নেমে এল চোখে। তারপর রাত সাড়ে তিনটায় রুদ্রের এই ঘরে আসা, ওর পাশে শোয়া, কপালে আলতো চুমু কিছুই টের পেল না সুরভী। সকালে বেলা গড়িয়ে যখন প্রায় নয়টা তখন কপালের উপর কারো স্পর্শে ঘুম ভাঙলো সুরভীর। পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখলো রুদ্র ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো ও। তাড়াহুড়ো করে বুক থেকে সরে যাওয়া ওড়নাটা খুঁজতে লাগলো। হাসি পেল রুদ্রের। নিজের মনেই বলে উঠলো, স্বপ্নে যা ভেলকি দেখিয়েছো না সোনা! এখন আর গায়ে ওড়না না জড়ালেও চলবে।

    সুরভীর পায়ের কাছ থেকে ওড়না নিয়ে নিজেই সুরভীর গায়ে পেঁচিয়ে দিলো রুদ্র। অবুঝের মতো মুখ করে তার দিকে চেয়ে রইলো সুরভী। লোকটা সত্যিই কাছে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। চাহনীতে কোনোভাবেই কাম প্রকাশ পাচ্ছে না। যথাসাধ্য দূরত্ব বজায় রেখে যত্নের ভাষা প্রকাশ করছে, আগলে রাখতে চাইছে। তবে গতকাল এমন কেন করলো?

    — “তোমার আজ ইম্পরট্যান্ট কোনো ক্লাস আছে? ভার্সিটিতে যেতে চাও?”

    — “না।”

    — “সিওর?”

    — “হ্যাঁ।”

    — “আমি অফিসের জন্য বেরোবো, ভাবলাম তুমি ভার্সিটিতে গেলে তোমাকে ড্রপ করে যাবো।”

    — “ওহ!”

    — “আম্মু তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ফ্রেশ হয়ে দেখা করো আম্মুর সঙ্গে।”

    — “আমি উঠতে খুব দেরী করে ফেললাম বোধহয়!”

    — “এসব কোনো ব্যাপারই না! যেভাবে ভালো লাগে, থাকো। আম্মু কিংবা আমি আমরা কখনোই তোমার ভালো লাগা, স্বাধীনতায় নাক গলাবো না। শুধু আমার গতকালের রিকুয়েষ্টটা মনে রেখো। তাহলেই হবে।”

    কিছু বললো না সুরভী। মাথা নিচু করে রুদ্রের কথা শুনলো শুধু। বিছানা ছেড়ে উঠে যাবার সময় চুলগুলো উঁচু খোপায় বাঁধতে লাগলো ও। রুদ্রের চোখ পড়লো ওর ঘাড়ে। ধীরে ধীরে চুল সরে গিয়ে হলদে ফর্সা বর্ণের ত্বকটা স্পষ্ট হচ্ছে। মোহনীয় ভীষণ! দেখলে ছুঁয়ে দেয়ার লোভ হবে এমন। রুদ্রেরও হচ্ছে কিন্তু সে ছোঁবে না। সুরভী একটুখানি সহজ হবার আগ পর্যন্ত ওর কাছে যাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা সে করবে না।

    চোখ ফিরিয়ে নিলো রুদ্র। সুরভীকে ডাকলো পেছন থেকে,

    — “শোনো?”

    — “জি?”

    — “তোমার মা-বাবা, চাচা, ফুফুদের আম্মু কল করে দাওয়াত করেছে। আজ বিকেলে আসবেন উনারা। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। এখানে চা নাস্তা করবেন, সঙ্গে ডিনারটাও। আম্মু দেখছেন পুরো আয়োজনটা, তবুও তোমার যদি মনে হয় মেন্যুতে কোনো চেঞ্জ আনতে হবে বা কিছু এড করতে হবে তুমি আম্মুকে বলো। হেসিটেশনের কিছু নেই। আর যদি বেশিই অস্বস্তি হয় আম্মুকে বলতে, তাহলে আমাকে বলো।

    চোখ চকচকে হয়ে উঠলো সুরভীর।

    — “আম্মু-আব্বু আসছে!”

    — “হ্যাঁ। মেয়ের কোথায় বিয়ে হলো দেখবেন না উনারা? তাই আম্মু দাওয়াত করলো।”

    — “কথা হয়ে গেছে সব? কই আম্মু তো আমাকে কিছু জানালো না!”

    — “কল করেছিল একঘন্টা আগে। তুমি ঘুমুচ্ছিলে, তাই কলটা আমি রিসিভ করেছি।”

    — “ওহ!”

    — “ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ওয়েট করছি। নাস্তা করে আমাকে অফিসে যেতে হবে।”

    — “আপনি খেয়ে নিন। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।’

    ভ্রু কুঁচকালো রুদ্র।

    — “কেন?”

    রুদ্রের অসন্তোষ চোখে পড়লো সুরভীর। এই মানুষটার উপর থেকে ভয় এখনো কাটেনি। তার অসন্তোষ সুরভীর আতংক বাড়ালো। সুরভীর চোখে স্পষ্ট সে খবর রুদ্র পড়তে পারছে। মুচকি হেসে এগিয়ে এল সে।

    — “আমাকে ভয় কেন পাচ্ছো?”

    কিছু বললো না সুরভী। ওর কানের পাশে চুল গুঁজে দিলো রুদ্র।

    — “গতকালের ঘটনা ধরে রেখো না সুরভী। গতকালের পর তোমার আমার একটা সম্পর্ক হয়েছে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তুমি কি বুঝতে পারছো না একদম? আমি তো বলেছি এই মাথাটা তোমার সামনে নুইয়ে দেবো। সত্যিই দেবো। মাত্রই এলে। সময় যাক। সব সহজ হবে। বুঝে নেবে। তুমি একটু স্বাভাবিক হও প্লিজ। আমার রাগ, ধমকে কিংবা বিরক্তিতে এভাবে ঘাবড়ে গেলে হবে না তো! আরো দ্বিগুন রাগ, বিরক্তি নিয়ে আমার উপর চড়াও হতে হবে, নয়তো তোমার সঙ্গে সংসার করে সুখ পাবো না আমি।”

    ঠোঁট চেপে হাসলো সুরভী। কিছু না বলেই চলে গেল ওয়াশরুমে। এই ঘরে সবকিছু ওর জন্য গোছানো আছে। ব্রাশ থেকে শুরু করে, তোয়ালে, পরনের জামা, কসমেটিকস সবকিছু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে রুদ্রকে নিয়ে, নতুন এই জীবন নিয়ে ভাবতে লাগলো সুরভী। রুদ্র লোকটাকে ধাঁধার চেয়েও জটিল লাগছে। দেখতে লোকটা ভারী সুদর্শন। শ্যামলা বর্ণের, উঁচু সুঠাম গড়নের সে। কথা বলার সময় ঠোঁটের চেয়ে চোখ কথা বলে বেশি। যার চোখ এতটা অভিব্যক্তিপূর্ণ, তার চোখই তো সবার নজর আগে কেড়ে নেবে। পুরো মানুষটাকে যদি বাহ্যিকভাবে বিবেচনা করা হয়, যে কেউ তার চোখ আর চুলের প্রশংসায় মুখর হবেই। এমন সুদর্শন পুরুষটা হুট করে কোথা থেকে এসে তাকে ধরে নিয়ে এল, রাজকীয় এক জীবন তাকে দিলো। কিন্তু কেন? কোনো কিছুরই হিসেব মিলছে না সুরভীর। একদম না! ঘোরই কাটছে না! ওদিকে শুধু ব্যক্তি রুদ্রকে নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। ভয় যদিও কাটছে না, তবে সহজ লাগছে আগের চেয়ে। কথার ভঙ্গি, চাহনী ধীরে ধীরে সহজ করে নিচ্ছে পরিস্থিতি, মনের অবস্থা।

    ২৩

    অফিসে নিজের রুমে কাজ সারছিল রুদ্র। শুভ হঠাৎ বাইরে থেকে ছুটে এসে টিভি অন করলো। ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে টিভিস্ক্রিনে তাকালো রুদ্র। ব্রেকিং নিউজে আজগরের স্ট্রোকের খবর জানানো হচ্ছে, সঙ্গে রিপিট টেলিকাস্ট চলছে হসপিটালে আজগরকে ঢুকানোর দৃশ্য।

    আবার কাজে মন দিলো রুদ্র।

    টিভি অফ করে তার মুখোমুখি বসলো শুভ।

    — “একেবারে মরার ঘাটে পৌঁছে গেছে দেখছি।”

    — “দুর্বল রগে চেপে ধরলে লোকে অমন মরার ঘাটেই পৌঁছায়। জ্ঞান ফিরলে একটা ফ্লাওয়ার বুকে পাঠিয়ে দিও।”

    মাথা দুলিয়ে হাসলো শুভ। গম্ভীর মুহূর্তে সূক্ষ্ম তামাশা করা রুদ্রের পুরোনো অভ্যেস। হসপিটালের বেডে পাঠিয়েও শান্তি হলো না। এবার তাকে সেখানে খোঁচানোর কথাও ভাবছে! সম্ভব হলে হয়তো মরে যাবার পর কবরে গিয়েও খোঁচাতো।

    — “রাতে কিন্তু আমার ওখানে খাবে। সঙ্গে তিথিকেও নিয়ে এসো।”

    — “রাতের বেলা ওকে বের হতে দেবে না একা।”

    — “এখনও বাসার লোকেরা তোমার কথা জানে না কেন? জানাতে বলো।”

    — “রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই মেয়ে দেবে না। সরকারী চাকরি করে, ডিসেন্ট ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দেবে।”

    — “বাবা-মায়েরা আর সরকারী চাকরির গন্ডি থেকে বেরোতে পারলো না!”

    — “ওর পড়া শেষ হোক। দেখি কী হয়!”

    — “তাহলে অন্য একদিন নিয়ে এসো সময় করে। সুরভীর সঙ্গে পরিচয় করাবে না! আম্মুও জিজ্ঞেস করছিল কয়েকদিন আগে তিথির কথা।”

    — “ওর পরীক্ষা চলছে। শেষ হোক নিয়ে আসবো একদিন।”

    *****

    শাশুড়ির ঘরে বসে আছে সুরভী। আলমারী থেকে একটা চেইন বের করে সুরভীর পাশে এসে বসলেন তিনি

    — “লকটা খোলো তো!”

    দ্রুত চেইন হাতে নিয়ে লকটা সুরভী খুলে দিলো। ম্লান হাসলেন ফেরদৌসী। – “ডান হাতটা ঠিকঠাক নাড়াতে পারি না। এই হাতে কাজ করা একটু মুশকিল! আগের মতো আর নেই আমি। পঙ্গু হয়ে এমন দিন কাটাচ্ছি বহুদিন।” মায়া হলো সুরভীর। এসেছে পর থেকে দেখছে সার্বক্ষণিক একজন মহিলা নির্ভর উনার জীবনযাপন। তার সাহায্যে দিব্যি চলে যাচ্ছে সবকিছু। তবুও তো, পরনির্ভরশীল জীবনে সুখ কোথায়? অচল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে আর কতটুকু ভালো থাকা যায়?

    সুরভীর গলায় চেইনটা পরিয়ে দিলেন ফেরদৌসী।

    — “লকটা লাগাও তো মামণি!”

    সুরভীর গলা হাতড়ে দেখছেন ফেরদৌসী।

    — “ভীষণ মানিয়েছে।”

    সুরভী প্রত্যুত্তর করলো না। লাজুক হাসলো শুধু।

    — “আমার সবকিছু তোমারই সুরভী। তবুও এটা আমি নিজ হাতে পরালাম কেন জানো? এটা আমার কাছে খুব স্পেশাল। বিয়ের রাতে তোমার শ্বশুর আমাকে এটা পরিয়ে দিয়েছিল। আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম গিফট এটা।”

    — “আমাকে দিয়ে দিলেন!”

    — “তুমিও আমার কাছে বিশেষ একজন। আমার রুদ্র খুব আশা নিয়ে তোমাকে বউ করেছে। রুদ্রের সুখ যার কাছে, সে আমার কাছে শিরোমণি। তোমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর এটা আমি আর পরিনি। তুলে রেখেছিলাম। আজ থেকে এটা তুমি যত্নে রেখো, তোমার কাছে।”

    — “আপনি ভালোবেসে আপনার এত ভালোবাসার জিনিসটা আমাকে দিলেন, আমি এটা খুব যত্নে রাখবো সবসময়।”

    — “আমার ছেলেটাকেও দেখে রেখো। যত্নে রেখো। ও মানুষটা খুব ভালো। রাজনীতি করে, হয়তো ওর অনেক অনেক খারাপ দিক তোমার চোখে পড়বে। সেসব দেখে তুমি রুদ্রকে ভুল বুঝো না যেন! ও তোমাকে ভীষণ ভালো রাখবে, দেখে নিও তুমি।”

    কথা বলছে না সুরভী। মাথা নিচু করে বসে আছে।

    তার মাথায় হাত বুলালেন ফেরদৌসী।

    — “এভাবে তোমার বিয়েটা তুমি এখনও মেনে নিতে পারছো না এটাই স্বাভাবিক। তবে বলবো, রুদ্রকে একটু সুযোগ দাও। মনের দরজাটা বন্ধ করে রেখো না। দেখবে, সব সহজ হবে। তোমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে।”

    — “গল্প করছো তোমরা?” দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে রুদ্র।

    হাসলেন ফেরদৌসী।

    — “ভেতরে আয়?”

    — “নাহ্। গল্প করো তোমরা। আমি ফ্রেশ হতে যাই।”

    রুদ্র যেতেই ফেরদৌসী, সুরভীকে বললো,

    — “আচ্ছা, তুমি গিয়েছিলে রান্নাঘরে? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

    — “আমি আবার কেন দেখতে যাবো? আপনি বলেছেন যেহেতু, সবকিছু পারফেক্টই হবে।”

    — “তাই বলে তুমি একবার চেক করবে না?”

    — “না! আমি কেন?”

    — “আমি কেন মানে? তুমি কি গেস্ট? তুমি এই বাড়ির মালকিন। তোমার বাবার বাড়ির মানুষ আসছে তোমার বাড়িতে। এসব তদারকী তোমাকেই করতে হবে। অসুস্থ শাশুড়ি তোমার, এতকিছু দেখে রাখার জো আর নেই। বউকে খাটে বসিয়ে আস্তে ধীরে দায়িত্ব ছাড়বো ঐ অবস্থাও নেই। খুব জোর কাল পর্যন্ত আমি এসব দেখবো। পরশু থেকে চাবি বুঝিয়ে দেবো। ব্যস, আমি এবার শান্তি।”

    — “আমি এতকিছু কিভাবে কী করবো?”

    — “আমাকেও এভাবে দায়িত্ব ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তোমার চেয়েও বয়সে ছোট ছিলাম, করতে করতে শিখে গেছি। তোমারও হয়ে যাবে।”

    — “যদি ভুল করি?”

    — “ভুল করলে করবে। তোমার হাজবেন্ড আর শাশুড়ি তো জাদরেল না যে ভুল করলেই কথা শোনাবে। রিল্যাক্সে সব করবে তুমি। ভুল হলে তা থেকে শিখবে।”

    অসহায় ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি দিলো সুরভী। এতবড় বাড়ি, এত এত কর্মচারী এসবকিছু কিভাবে সামলাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ও। তার উপর এই বাড়িটাই তো ঠিকমতো দেখা হলো না। কোন কর্মচারীর কী দায়িত্ব, সেটাও ওর জানা নেই। এই ঘরের মানুষ কী খায়, কী খায় না, পছন্দ-অপছন্দ কিচ্ছু জানা নেই ওর। মনে হচ্ছে যেন মাঝ সমুদ্রে পড়ে গেছে ও!

    সুরভীর চিন্তা দেখে হাসলেন ফেরদৌসী।

    — “চিন্তায় মরে যাবার কিছু নেই, রিল্যাক্স থাকো। আছি তো। সব সহজ করে দেবো তোমার জন্য। এবার ঘরে যাও, সন্ধ্যা হতে সময় বেশি নেই। তোমার মা বাবা চলে আসবে কিছুক্ষণ পরই। সুন্দর একটা শাড়ী পরো, কানে গলায় গোল্ড পরো, একটু সাজো। দুঃখী দুঃখী মুখ করে থেকো না। তোমার মা-বাবা বড্ড দুশ্চিন্তায় আছে তোমাকে নিয়ে। তুমি সেজেগুজে আছো, হাসিখুশি ঘুরছো দেখতে পেলে তোমার মায়ের মনটা একটুখানি শান্ত হবে।”

    ২৪

    রুদ্রের শ্বশুরবাড়ির লোক এসেছে আজ। আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখেননি ফেরদৌসী। সেই সঙ্গে আপ্রাণ অমায়িক আচরণ তো তার আছেই। দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনিই মেয়েপক্ষ। ফুল দিয়ে বরণ করেছেন তিনি বেয়াই বাড়ির লোকদের। টেবিল বাহারী নাস্তায় ভরপুর করে রেখেছেন। এত খাবার দেখেই পেট ভরে গেছে মিতার। মেয়ে নিয়ে গুরুতর দুশ্চিন্তায় গতকাল থেকে তার খাওয়া বন্ধ। মেয়েকে বাহ্যিকভাবে ভালো দেখালেও আদৌ মেয়েটা ভালো আছে কি না সে খবর ওর মুখ থেকে না জানার আগ অব্দি শান্তি পাবেন না তিনি। রুদ্র সবাইকে নিয়ে গেছে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে। মিতা যাননি। অস্থির হয়ে তিনি সুযোগ খুঁজছেন মেয়ের সঙ্গে একটু আলাদা বসে কথা বলবেন বলে। ফেরদৌসী গল্পের ফাঁকে বুঝলেন মায়ের অস্থিরতাটুকু। কাজের বাহানায় বসার ঘর ছাড়লেন তিনি। যাবার আগে সুরভীকে বললেন,

    — “মাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। বেয়াইন একটু আরাম করে বসুক। তোমার ঘরটাও দেখুক।”

    ফেরদৌসী চোখের আড়াল হওয়া মাত্র মেয়ের হাত চেপে ধরলেন মিতা,

    — “জলদি চল, কথা আছে তোর সঙ্গে।”

    ভাই-বোনরা, তাদের পরিবারেরা হতবাক হয়ে পুরো বাড়ি দেখছে। বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে বাচ্চারা ছুটছে। সেসবে বিন্দুমাত্র মন নেই শরীফ সাহেবের। তার সমস্ত নজর আটকে আছে রুদ্রে। তার চলন-বলনে বড় সূক্ষ্ম নজরদারি করছেন তিনি। ওর পরিবার বলতে শুধু মা। মা-ছেলে বাদে এই ঘরে আর কোনো সদস্য নেই। বাকি যারা আছে সব কর্মচারী। আত্মীয়স্বজনও হয়তো তেমন নেই। থাকলেও হয়তো যোগাযোগ নেই। বলা চলে মা-ছেলের বেশ একাকিত্মের জীবনযাপন। মায়ের আচরণ ভীষণ অমায়িক আর মিশুক প্রকৃতির। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়ে ধরে এনেছে তার ছেলে, এই নিয়ে ন্যূনতম আক্ষেপ, ক্ষোভ কিংবা অসন্তোষ কিছু দেখা যায়নি তার মাঝে। আচরণ মুগ্ধ হওয়ার মতো বটে। তার কাছে সুরভী নিরাপদ। কিন্তু যার সঙ্গে বিয়ে হলো সে? কানকথায় রুদ্রের নামে পথে-ঘাটে, চায়ের দোকানে মাঝেমধ্যে চর্চা শুনেছেন আগে। প্রচন্ড তুখোড় সে। মন্ত্রী আমলারা তাকে দশবার সালাম ঠুকে। গতকাল যে রূপ সে দেখালো তাতে কোনোভাবেই ওকে ভালো বলা চলে না। কিন্তু আজ যাকে দেখছেন সে ভীষণ ভদ্র। এখানে এসে এমন আচরণ পাবেন, তা একদম আশা করেননি। এই ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারছেন না শরীফ সাহেব। খুবই সাধারণ পরিবারের সাদাসিধা একটা মেয়েকে কেন এমন একজন ছেলে এভাবে ঝামেলা ফ্যাসাদ করে একবেলার মধ্যে বিয়ে করলো, এর পেছনে কারণ কী, তাও ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। শার্টের হাতায় টান লাগলো তার। ঘাড় ফেরাতেই তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠলো ছোটবোন আফসানা।

    — “তোমার মেয়ের কী কপাল দেখছো! রাজঘরে বিয়ে হয়েছে ওর। এমন বাড়ি, এমন পাত্রের চিন্তা আমরা কল্পনায়ও আনার দুঃসাহস করি না ভাইয়া। অযথা চিন্তায় মরছিলে তুমি।”

    বোনের কথায় মত-অমত কিছুই করলেন না শরীফ সাহেব। চুপচাপ শুনলেন শুধু। তার দুশ্চিন্তা বুঝার মতো অবস্থায় কেউ নেই। মেয়েটা তার। বাইরের যে চাকচিক্য দেখে সবাই মুগ্ধ হচ্ছে, সেই চাকচিক্য দেখে তার আতংক আরো বাড়ছে। হিসেব আরো গরমিল লাগছে। এখানে, এইবাড়িতে সুরভীর বিয়ে কী করে সম্ভব?

    মেয়ের ঘরে ঢুকেই তার হাতে ধরে কেঁদে ফেললেন মিতা।

    — “তুই ঠিক আছিস তো মা?”

    মায়ের কান্নায় চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি সুরভীও। মেয়ের চোখে পানি দেখে মিতা আঁতকে উঠলেন,

    — “তোকে কী করেছে ছেলেটা?”

    — “না, না! আমাকে কী করবে?”

    — “কাঁদছিস যে!”

    — “তুমি কাঁদছো তাই।”

    — “ঠিক করে বল না মা! ভয় পাচ্ছিস? ভয়ে সত্যি লুকাচ্ছিস না তো?”

    — “সত্যি বলছি আম্মু! সবকিছু ঠিক আছে। বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ঠিক।”

    — “কেমন?”

    — “সবকিছু এত পারফেক্ট! এত পারফেক্ট কিছু হয় না আম্মু।”

    — “খুলে বল তো?”

    উঠে গিয়ে আলমারী খুললো সুরভী।

    — “দেখো কান্ড! আলমারী ভর্তি শাড়ী, কুর্তী, লেগিংস, কামিজ। ওয়েস্টার্নও আছে। ড্রেসিং টেবিলটা দেখো একটু! ফ্রেঞ্চ পারফিউম, জাপান থেকে আনা সব স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট, মেকআপ আইটেমগুলো লন্ডনের। ওয়াশরুমেও একই অবস্থা। এক্সপেন্সিভ সব জিনিসে ঘর ভরিয়ে রেখেছে। এই যে দেখো আমার গলায়, এই সেটটা গতকাল আমার শাশুড়ি বরণ করার সময় আমাকে পরিয়ে দিলো।”

    — “বিয়ের সময়ও তো ভারী একসেট দিলো তোকে।”

    — “হ্যাঁ। সেটাই বলছি। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবকিছু।”

    — “আর রুদ্র?”

    — “একদম অন্য মানুষ। সফট টোনে কথা বলছে, আমার মেন্টাল স্টেট, ইমোশন বুঝে কথা বলছে, মিশছে।”

    — “কাছে আসার ব্যাপারটা?”

    — “একদম না। আমাকে বলেছে তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কাছে যাবো না।”

    ভ্রু কুঁচকালেন মিতা,

    — “সত্যিই?”

    — “অবাক করা বিষয় না, বলো?”

    — “তোকে যেভাবে গতকাল তুলে আনলো, এই কথা কাউকে বললে কে বিশ্বাস করবে?”

    — “আমারও বিশ্বাস হয়নি।

    — “ওর আর বউ-টউ নেই তো, তাই না?”

    হেসে ফেললো সুরভী।

    — “না আম্মু, এখনো চোখে পড়েনি।”

    — “হাসবি না। চিন্তায় পুরো রাত আমি ঘুমাইনি জানিস!”

    — “জানি।”

    — “পুরো রাত নামাজ পড়েছি আর দোয়া করেছি। কী যে অসহায় লাগছিল নিজেকে! তোর সঙ্গে এই ছেলেটা কী করছে, কোনো টর্চার করছে নাকি, এসব! তার উপর বারবার শুধু মনে হচ্ছিল ওর তো বউ-বাচ্চাও থাকতে পারে। থাকে তো এমন নেতা-টেতাদের। থাকে না বল?”

    — “এখন পর্যন্ত যতটুকু জানি, একমাত্র বউ আমিই। আর কেউ নেই।”

    — “তার উপর সকালে কল করলাম, তোর বর রিসিভ করলো। আমার দুশ্চিন্তা

    আরো বাড়লো। ভেবেছি ও ইচ্ছে করে তোর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিলো না।

    যদি ওর বিপক্ষে আমাকে কিছু বলে দিস, তাই।”

    — “সব ঠিকঠাক আছে।”

    — “ঠিকই বলেছিস। প্রয়োজনের চেয়ে সবকিছু একটু বেশিই ঠিক মনে হচ্ছে।”

    — “সেজন্যই আমার হিসেব, ঘোর কিচ্ছু কাটছে না।”

    — “সময় লাগবে এই ঘটনা থেকে বেরোতে। তবে বিয়ে তো বিয়েই। যেভাবেই হোক, হলো তো। রুদ্র তোর বর, এটা তোর শ্বশুরবাড়ি এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তোরও ধীরে ধীরে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে।”

    — “দায়িত্বের কথা বলছিলেন আমার শাশুড়ি।”

    — “এতবড় ঘর, এত চাকরবাকর, ভিন্ন জীবনধারা, এদের দায়িত্বই বা পালন করবি কেমন করে? তুই এমন জীবনযাপনে তো অভ্যস্ত না। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে প্রশংসা না কুড়াতে পারলে মায়েদের লজ্জার সীমা থাকে না। তুই কিভাবে যে কী করবি! ধুর ছাই! দুশ্চিন্তার পর দুশ্চিন্তা!”

    *****

    ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হচ্ছে। একটু পরই খেতে বসার ডাক আসবে, তারপর খেয়ে দেয়ে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। তার আগেই কথা সারতে চাইলেন শরীফ সাহেব। নতুন বেয়াইন আর মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

    — “বিয়ের পরদিন মেয়েকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার নিয়ম। আমরা সুরভীকে আজ সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।”

    ফেরদৌসী কিছু বলার আগেই রুদ্র বাঁধ সাধলো।

    — “ও আপাতত কোথাও যাবে না। থাকুক কিছুদিন, তারপর নিয়ে যাবেন।”

    বলেই সুরভীর দিকে তাকালো রুদ্র। এতটা সময় সুরভী চেয়ে ছিল রুদ্রের দিকেই।

    চোখে চোখ পড়া মাত্র চোখ নামিয়ে নিলো সুরভী।

    মেয়ে জামাই কর্তৃক এমন প্রত্যাখ্যানে অপমানিত বোধ করলেন শরীফ সাহেব। চেহারায় তা স্পষ্ট হতে দেননি। দ্বিতীয়বার কিছু বলতেও আত্নসম্মানে টান লাগছিল খুব। উনি কিছু বলার আগেই মিতা অনুরোধ করলেন,

    — “এটা তো নিয়ম বাবা! হঠাৎ করে চলে এল, ওর মনও বসছে না হয়তো

    এখানে। দুদিন বাসায় থেকে এলে আমাদেরও ভালো লাগতো।”

    মিতার সঙ্গে তাল মেলালেন ফেরদৌসী।

    — “ঠিকই তো! তুই বারণ কেন করছিস বুঝলাম না!”

    — “ও অবশ্যই যাবে। ওর বাবার বাড়িতে ও যাবে না? কিন্তু আপাতত না। থাকুক আরো কিছুদিন। আমি নিজে গিয়ে রেখে আসবো ওকে। টেবিলে খাবার রেডি। চলুন আপনারা।”

    আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না রুদ্র। গোমড়া মুখে নতুন জামাইর আবদার মেনে নিলো শরীফ-মিতা দম্পতি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম
    Next Article পৃথিবীর পথে – ম্যাক্সিম গোর্কি (অনুবাদ : খায়রুল আলম মনি)

    Related Articles

    খাদিজা মিম

    বাতাসে গুনগুন – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    খাদিজা মিম

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

    August 6, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Our Picks

    কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025

    অপেক্ষবাদের অ, আ, ক, খ – বারট্রান্ড রাসেল

    October 29, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }