Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প613 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫.২ ডালিমের প্রস্ফুটন

    ২৩. ডালিমের প্রস্ফুটন

    নওরোজের অষ্টম দিন, সবে মাত্র সূর্যাস্ত হয়েছে। মেষ রাশিতে সূর্যের আবির্ভাবের এই ক্ষণে নববর্ষের উৎসব উদযাপন করা হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজপ্রাসাদের উঠানে আবার ভোজ সভা আরম্ভ হবে। ভৃত্য এবং পরিচারকরা নিচু টেবিল গুলির চারদিকে বসার গদি এবং প্রজ্জলিত মোমবাতি স্থাপনে ব্যস্ত। সন্ধ্যার অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেলিম উপযুক্ত সাজসজ্জা পরিধান করে নিরুৎসাহী দৃষ্টিতে আয়োজন প্রত্যক্ষ করছে। নওরোজের উৎসব একটি পারসিক প্রথা যা আকবর হিন্দুস্তানে প্রচলন করেছেন। সম্রাটের জন্মদিনের উৎসবের পরে এটাই সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং দৃষ্টিনন্দন অনুষ্ঠান, যার প্রতিটি পর্ব আকবর স্বয়ং পরিকল্পনা এবং প্রত্যক্ষ করেন।

    প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় উটের দৌড়, হাতির লড়াই, নাচ-গান, আতশবাজী নিক্ষেপ এবং দৈহিক কসরত, আকবরের অনুগত সেনাপতি ও সভাসদদের রাশি রাশি অর্থ প্রদান এবং নতুন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান। বিগত রাত গুলিতে মহামান্য সম্রাট বিভিন্ন উচ্চপদস্থ অনুগামীর অতিথি হয়েছেন। কিন্তু আজ রাতের ভোজ উৎসব সম্রাটের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছে তাঁর বিশেষ আস্থাভাজনদের সম্মানে যা নিশ্চিত ভাবেই অন্য সব আয়োজনকে অতিক্রম করবে। অতিথিগণ চুনি ও পান্না খচিত জেডপাথরের পাত্র থেকে পান করবেন। সেলিম একটি বালুপাথর নির্মিত স্তম্ভের পাশে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে সৌভাগ্যবান আস্থাভাজনদের কেউ কেউ উপস্থিত হওয়া শুরু করেছে। তাঁদের চকচকে দৃষ্টি মহামূল্যবান পানপাত্রগুলির উপর নিবদ্ধ, সন্দেহ নেই মনে মনে হিসাব করছে উৎসব শেষে সেগুলি তাদেরকে উপহার স্বরূপ প্রদান করা হবে কি না। উঠানের কেন্দ্রবিন্দুতে সোনার কাপড়ে ঢাকা মঞ্চটি সবুজ মখমল এবং মুক্তার ঝালর বিশিষ্ট শামিয়ানার নিচে স্থাপিত হয়েছে। মঞ্চের নিচু সিংহাসনটিতে আকবর আসন গ্রহণ করবেন।

    নওরোজ উৎসবের সময় বাবুর্চিদের বিশ্রামের সময় থাকে না। তারা ভোর বেলা থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মুরগী ও অন্যান্য সুস্বাদু পাখি এবং আস্ত ভেড়া ধাতব শলাকায় গেথে অগুনের উপর ঝলসানো হচ্ছে, তাতে যোগ করা হয়েছে জাফরান, লবঙ্গের নির্যাস, জিরা, ঘি এবং আরো বহু প্রকার মসলা। বাবুর্চিরা যখন শলাকাগুলি ঘুরাচ্ছে তখন মাংস ও মসলার মিশ্র উপাদেয় এবং রসনারোচক ঘ্রাণে চারদিকের বাতাস ভরে উঠছে। অল্প সময় পরেই তিনটি শিঙ্গার সম্মিলিত ধ্বনি মহামান্য সম্রাটের আগমন বার্তা জানান দিলো। সেলিম দূর থেকে পিতার জাঁকজমকপূর্ণ আগমন প্রত্যক্ষ করতে লাগলো। আকবর এগিয়ে যাওয়ার সময় উপস্থিত অতিথিগণ তাঁকে ঝুঁকে সম্মান প্রদর্শন করছে, অনেকটা পাহাড়ের ঢালে জন্মে থাকা কাশ্মীরি ফুলগাছের বাতাসে নুয়ে পড়ার মতো। স্বয়ং তৈমুরকেও হয়তো কখনো এমন অভিজাত প্রেক্ষাপটে দেখা যায়নি। ব্যাপক বিস্তৃত সাম্রাজ্যের মহামান্য সম্রাট তার চোখ ধাঁধানো মহিমা নিয়ে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। মঞ্চের নিচে আকবরের সিংহাসনের ডান দিকে যে টেবিলটি পাতা হয়েছে সেটা সেলিম এবং দানিয়েলের জন্য। এর বরাবর বাম দিকে পাতা টেবিলটিতে বসবে আবুল ফজল এবং তার পিতা আব্দুল রহমান।

    নিজের পিতাকে আসন গ্রহণ করতে দেখে সেলিম অতিথিদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেলো দানিয়েলের পাশে নিজ আসনে বসার জন্য। ছোট করে মাথা ঝাঁকিয়ে আকবর তার উপস্থিতিকে স্বীকৃতি দিলেন এবং তারপর তাঁর খাদ্যপরীক্ষকের দ্বারা সদ্য তাঁর সামনে রেখে যাওয়া খাবারের থালার দিকে দৃষ্টি দিলেন। সবসময় যেমনটা করেন তেমনি ভাবে আকবর পরিমিত আহার করলেন। সেলিম প্রায়ই শ্রবণ করে তাঁর বাবা, নরম এবং মোটা হয়ে যাওয়ার জন্য নিজ সেনাপতিদের সমালোচনা করছেন। ঐ রকম ভুড়ি নিয়ে তুমি কখনোই আমার দাদার সঙ্গে হিন্দুস্তান অভিযানের সময় ঘোড়া ছুটাতে পারতে না, তবে গোত্রপতিরা হয়তো তোমাকে একজন উত্তম ভাঁড় হিসেবে নিয়োগ দিত, অধুনা এভাবে তিনি তাঁর এক স্কুল তাজিক সেনাকর্তাকে তিরস্কার করেন যে তার তুলনায় কমপক্ষে পনেরো বছরের ছোট। যদিও আকবরের মুখে তখন হাসি ছিলো, কিন্তু সেলিম তাকে যতোটা জানে তাতে সে বুঝতে পারছিলো তিনি ঠাট্টা করেননি। এবং এর অল্প কয়েক দিন পরেই সেই সেনাকর্তাটিকে বাংলার কোনো এক সেনা শিবিরে বদলি করা হয় সম্ভবত সেখানকার জলাভূমি এবং মশা পরিবেষ্টিত পরিবেশে ঘর্মাক্ত হয়ে তার ভুড়িটি হ্রাস পাবে।

    মাঝে মাঝে আকবরের অনুশীলন করা সেলিম দেখে। তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করা বা আক্রমণ প্রতিহত করা, প্রিয় সাদা পপলার কাঠে তৈরি ধনুকের ছিলা টেনে কবুতকে তীর বিদ্ধ করা, কুস্তি খেলা প্রভৃতি ক্রিড়ায় তিনি এখনো তার অর্ধেক বয়সের যোদ্ধাদের কুপোকাত করতে পারেন। সেলিম দানিয়েলকে এক পলক দেখলো, তার রক্তিম ও ঘর্মাক্ত মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে সে সংযমী অবস্থায় ভোজসভায় আগমন করেনি। এছাড়াও তার প্রসারিত চোখের মণি এবং মুখের বোকা হাসি এটাও স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে যে সে ওপিয়ামও সেবন করেছে। দানিয়েল তার তুলনায় অত্যন্ত দুর্বল, সেলিম ভাবলো। কিন্তু সে যখন দেখলো তার ভাই কম্পিত হাতে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও নিজের পানপাত্রটি স্থিরভাবে ধরে রাখতে পারছে না তখন সে তার প্রতি করুণা অনুভব করলো। নেশাদ্রব্যের প্রলোভন সম্পর্কে সেলিমেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাঝে মাঝে হতাশার বশবর্তী হয়ে সেও অতিরিক্ত মদ্যপান করেছে; গাঁজা, ভাং বা ওপিয়ামের সাহায্যে নিজের স্বপ্নপূরণ না হওয়ার কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটা কদাচিৎ। সে নিজের দেহ এবং মনকে সর্বদা ধারালো রাখার চেষ্টা করেছে এই ভেবে যে যদি হঠাৎ তার পিতা তাকে সেনাপতি বা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেন।

    তবে বিলাসিতা এবং উপভোগ ব্যতীত দানিয়েলের মনে অন্য কোনো ভাবনা নেই। অন্যদিকে মালওয়া এবং গুজরাট থেকে সেলিমের কানে যে তথ্য এসেছে তা হলো মুরাদের মদ্যপানের প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পদটি সেলিম আকাঙ্ক্ষা করেছিলো সেটা এতো অনায়াসে লাভ করা সত্ত্বেও মুরাদ আকবরকে সন্তুষ্ট করার সব সুযোগ হেলায় নষ্ট করছে। সেলিম এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে প্রাদেশিক প্রশাসকের পদটির জন্য সেই অধিক উপযুক্ত ছিলো। কিন্তু তার পিতা এবং আবুল ফজল তাকে এভাবে বঞ্চিত করলো কেনো? সে তার সৎভাইদের তুলনায় অনেক বেশি সক্ষম পুরুষ এবং তার বাবার মতোই সাহসী। কিন্তু আকবর তাকে মূল্যায়ন করতে চাচ্ছেন না কেনো?

    ভোজসভার অগ্রগতির মধ্যে বার বার সেলিমের ক্ষুব্ধ দৃষ্টি আকবরের ঝলমলে অবয়বের উপর নিবদ্ধ হচ্ছিলো। গোয়ালিয়রের খ্যাতিমান বাজিয়েরা তাদের বাঁশিতে এবং তার বিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্রে নরম মোহনীয় সুর মুছনা সৃষ্টি করছে। কয়েক মিনিট পর পর কোর্চিরা সম্রাটকে নওরোজের উপহার দিতে ইচ্ছুক সভাসদদের পথ দেখিয়ে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছে, বেয়ারাগণ বারকোশে সাজিয়ে আরো খাদ্যদ্রব্য নিয়ে এসে টেবিলে পরিবেশন করছে। সেলিম মেঘ মুক্ত জ্যোৎস্না ঝরা রাতের আকাশের দিকে তাকালো। কখনো কখনো এ ধরনের ভোজসভাগুলি ভোর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সে মনে মনে ভাবলো কতো তাড়াতাড়ি সে এই কোলাহল থেকে সরে পড়তে পারবে।

    বাজিয়েরা তাদের বাজনা থামিয়ে বাদ্যযন্ত্রগুলি একপাশে নামিয়ে রেখে নুয়ে পড়ে আকবরকে কুর্ণিশ করলো। নিশ্চয়ই অন্য কোনো বিনোদনের সময় উপস্থিত হয়েছে, সেলিম ভাবলো। সেটা আগুনখেকো বা দড়িবাওয়া বাজিকরদের কসরৎ হতে পারে কিম্বা একই খাঁচায় ছেড়ে দেয়া বন্যপ্রাণী যুগলের লড়াই।

    আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং সঙ্গে সঙ্গে উঠানটিতে নৈশব্দ নেমে এলো। আজকের রাত আমাদের নওরোজ উৎসবের শীর্ষ ক্ষণ। যদিও ইতোমধ্যে আমরা বহু রত্ন ও মণিমাণিক্যের উপহার আদান প্রদান করা সম্পন্ন করেছি, আমার কাছে একটি অমূল্য রত্ন রয়েছে যা অল্প সময়ের জন্য আমি আপনাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। দুই মাস আগে তুরস্কের সুলতান আমাকে বিরল সৌন্দর্য এবং দক্ষতার অধিকারী একজন ইটালীয় নর্তকী পাঠিয়েছেন। ইটালী দেশটি আমাদের দেশ থেকে বহু দূরে অবস্থিত। আমি মেয়েটির নাম দিয়েছি আনারকলি যার অর্থ ডালিমের প্রস্ফুটন। আকবর তাঁর পাশে দাঁড়ানো পরিচারকটিকে আদেশ দিলেন, আনারকলিকে হাজির হতে বলো।

    এমন কি আকবর যখন তার আসনে বসে পড়েছেন, তখনো নৈশব্দ বজায় রইলো, অতিথিরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তাদের সকলের দৃষ্টি কৌতূহলে উজ্জ্বল। সেলিমের মাঝেও ঔৎসুক্য দানা বেধে উঠলো এবং সে আরো কিছুক্ষণ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। ইতোপূর্বে সে কেবল ইউরোপীয় রমনীদের অঙ্কিত চিত্র দেখেছে, পরিব্রাজকগণ সেগুলি তার বাবাকে উপহার হিসেবে দিয়েছে। অবশ্য সে জেসুইটদের মুখে ইটালীর কথা শুনেছে, তাঁদের কেউ কেউ সেখানে জন্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু সে দেশের বিলাস-ব্যসন কিম্বা নারীদের সম্পর্কে গোঁড়া ক্যাথলিক বিশ্বাসের অনুসারী জেসুইটরা তাকে কিছুই বলেনি।

    সেলিম তার বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো তিনি মুখে সন্তুষ্টি এবং আত্মতৃপ্তির সূক্ষ্মহাসি নিয়ে উপস্থিত অতিথিদের জল্পনা-কল্পনার মৃদু গুঞ্জন শ্রবণ করছেন। ওদিকে পরিচারকগণ আগেই সমগ্র উঠান জুড়ে বিছানো পশমের সূক্ষ্ম গালিচার উপর নতুন করে পারসিক শতরঞ্জি বিছাতে ব্যস্ত। শতরঞ্জি বিছানোর কাজ শেষ হতেই অন্য ভৃত্যরা রাজকীয় আগরবাতিদান নিয়ে সারা উঠানময় ছুটোছুটি করে এক স্বপ্নীল সুগন্ধী ধূম্রজাল সৃষ্টি করলো যার মধ্য দিয়ে সেলিম আকবরকে স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলো না। হঠাৎ আকবরের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে আরেক দল পরিচারক এগিয়ে এসে উঠানে প্রজ্জ্বলিত সকল মোমবাতি নিভিয়ে দিলো। হালকা সুগন্ধে আচ্ছাদিত অন্ধকারে কেউ টু শব্দ করছে না। তারপর, পূর্বের আকস্মিকতাতেই মোমবাতিগুলি আবার প্রজ্জ্বলিত করা হলো এবং উঠানের কেন্দ্রে ফিকে হয়ে আসা ধোঁয়ার মাঝে আনারকলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। একটি অর্ধস্বচ্ছ ওড়নায় তার দেহ কোমরের নিচ পর্যন্ত আচ্ছাদিত যা তার পূর্ণস্তন যুগল এবং সমৃদ্ধ নিতম্বকে আড়াল করার পরিবর্তে আরো দর্শনীয় করে তুলেছে। তার ঋজু মস্তকে একটি মুক্তাখচিত বৃত্তাকার সোনার অলঙ্কার শোভা পাচ্ছে যা ওড়নাটিকে আটকে রেখেছে।

    নর্তকীটি তার দুবাহু উপরে তুললো এবং সমগ্র দেহ দোলাতে আরম্ভ করলো। তার দেহের সর্পিল গতির সঙ্গে কোনো বাদ্যযন্ত্রের সহযোগীতা নেই। কেবল দুহাতের কব্জিতে পড়া ভারি চুড়িগুলির সংঘর্ষে সৃষ্ট মূৰ্ছনা এবং নুপুরের কিন্নরই তার সঙ্গী। তার নড়াচড়া আরো মুক্ত এবং বুনো রূপ ধারণ করতে লাগলো। তার মস্তক এক অপরিচিত শৈল্পীক ভঙ্গীমায় এদিক ওদিক কাত হতে লাগলো এবং এক সময় সে ঘুরতে শুরু করলো; স্তনযুগল প্রকম্পিত হচ্ছে, নগ্ন পা দুটি তীব্র বেগে শতরঞ্জিতে আঘাত করছে। সেলিম অন্য অতিথিদের মতোই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। প্রথমে তার বিপরীত দিকে বসে থাকা একজন তারপর আরেকজন, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে আঘাত করে তাল দিতে শুরু করলো। টেবিল চাপড়ানোর শব্দ আরো ব্যাপকতা লাভ করলো যখন আনারকলি আরো দ্রুতবেগে ঘুরতে লাগলো, তার দুবাহু দুদিকে প্রসারিত। তারপর একটি চিৎকারের সঙ্গে সে তার ওড়নাটি খুলে ছুঁড়ে ফেললো।

    সেই মুহূর্তে সম্মিলিত শ্বাস টানার শব্দ পাওয়া গেলো। সেটা কেবল তার নিখুঁত গড়নের আকর্ষণীয় দেহের জন্যেই নয় যা এই মুহূর্তে প্রায় নগ্ন। বর্তমানে তার দেহে অবশিষ্ট রয়েছে আটসাট রত্নখচিত একটি কাঁচুলি ও প্রায় স্বচ্ছ মসলিনের পাজামা। দর্শকদের শ্বাস টানার আরেকটি উপলক্ষ্য তার চুল। চুলগুলি ফ্যাকাশে সোনালী বর্ণের এবং কোমর পর্যন্ত লম্বিত। চুল গুলি একরাশ সোনালী উজ্জ্বলতা নিয়ে চার দিকে উড়তে লাগলো যখন তার ঘুর্ণন অব্যাহত থাকলো। হঠাৎ নাটকীয় ভাবে মেয়েটি থেমে গেলো। তার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি লেগে রয়েছে, যে উত্তেজনা তার নৃত্যকলা দর্শকদের মাঝে সৃষ্টি করছে সে বিষয়ে সে সম্পূর্ণ অবহিত। তারপর মেয়েটি মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়ে ধীরে আকবরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো এবং দুবার মাথা ঝাঁকালো। এর ফলে প্রথমে তার ভুবন ভুলানো চুলের গুচ্ছ তার দেহের সম্মুখে আছড়ে পড়ে তার বক্ষযুগল আবৃত করলো এবং পুনরায় পিছনে পিঠের উপর ছড়িয়ে পড়লো। তারপর সে সম্রাটের দিকে দুবাহু প্রসারিত করে পিছন দিকে ঝুঁকতে লাগলো, এতে তার নমনীয় মেরুদণ্ড ধনুকের মতো পিছন দিকে বেঁকে গেলো এবং এক সময় তার মাথাটি শতরঞ্জি স্পর্শ করলো।

    মোমবাতির প্রকম্পিত আলোতেও আনারকলির দৈহিক বৈশিষ্টগুলি স্পষ্ট ভাবে প্রত্যক্ষ করার মতো নিকটে সেলিম অবস্থান করছিলো। তার মুখমণ্ডল ডিম্বাকৃতি এবং থুতনিতে চিড় রয়েছে, নাকটি ছোট কিন্তু খাড়া। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় তার চোখ দুটি, যেমনটা সেলিম আগে কখনোও দেখেনি। সেগুলি গাঢ় নীল এবং বেগুনির মধ্যবর্তী কোনো রঙ সম্বলিত। মেয়েটির উপর পতিত তার পিতার অনুরাগী এবং পরিতৃপ্ত দৃষ্টিবাণও সেলিমের চোখ এড়ালো না। সেলিমের নিজ হৃৎপিণ্ডটি প্রচণ্ড গতিতে ধুকপুক করছে এবং তার মুখের ভিতরটা শুকিয়ে গেছে। আনারকলিকে তার পেতেই হবে, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই…

    *

    এতে অনেক ঝুঁকি রয়েছে জাহাপনা…আনারকলি বর্তমানে আপনার পিতার সবচেয়ে প্রিয় রক্ষিতা। জানাজানি হয়ে গেলে তাকে এবং আমাকে হাতির পায়ের নিচে মৃত্যুবরণ করতে হবে অথবা এর চেয়েও খারাপ কিছু ঘটতে পারে। গত সাত বছর ধরে আমি হেরেমের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত আছি, এর আগে আমাকে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়নি। হেরেমের খাজানসারা, ছোটখাট গড়নের পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা নাক বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধা, তার চেহারায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। সেলিম লক্ষ্য করলো তার কমে আসা পাকা চুলের নিচে কপালের ডান পাশের একটি শিরার সংকোচন সম্প্রসারণ ঘটছে। কিন্তু একই সঙ্গে তাকে কিছুটা প্রলুব্ধও মনে হলো।

    এর জন্য উপযুক্ত মূল্য দিতে আমি প্রস্তুত। তুমি যা চাইবে তাই দেবো। সেলিম তার জোব্বার ভিতর হাত ঢুকিয়ে তার গলায় চামড়ার সরু ফালির সাহায্যে ঝুলিয়ে রাখা একটি রেশমের থলে বের করে আনলো। থলেটির মুখ আলগা করে সে সেটার ভিতর থেকে একটি পদ্মরাগমণি(রুবি) বের করে আনলো এবং তার পাশের হস্তি-আস্তাবলের দেয়ালের ফোঁকরে রাখা তেলের প্রদীপটির আলোতে সেটিকে উঁচু করে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে অকর্তিত রত্নটির উজ্জ্বল দ্যুতি বিচ্ছুরিত হলো। এটি আমার অধিকারে থাকা সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন- এর মূল্য এক হাজার সোনার মোহর। আমার নির্দেশ মতো কাজ করলে এটি তোমার হবে। তুমি এবং তোমার পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে ধনী থাকবে।

    কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব জাঁহাপনা? খাজানসারার চোখ দুটি রত্নটির দিকে চুম্বকের মতো আকৃষ্ট হয়ে আছে, সে চোখ সরাতে পারছে না। সম্রাট ব্যতীত আর কারো হেরেমে প্রবেশের অনুমতি নেই।

    তুমি বাবার হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক এবং সব সময় সেখানে যাওয়া আসা করো। তুমি তোমার একজন পরিচারিকার ছদ্মবেশে আনারকলিকে লুকিয়ে বের করে আনতে পার। রক্ষীরা তোমাকে সন্দেহ করবে না।

    আমি ঠিক নিশ্চিত নই জাহাপনা… খাজানসারা করুণ স্বরে বললো। সম্রাট তাকে সবসময় ডেকে পাঠান…।

    আজ থেকে তিন দিন পর আমার বাবা একটি দীর্ঘ শিকার অভিযানে যাবেন। তিনি রওনা হওয়ার পর ঐ দিন রাতে তুমি আনারকলিকে আমার কাছে নিয়ে এসো, তাহলে এই পদ্মরাগমণিটি তোমার হবে। সেলিম উত্তরের জন্য অপেক্ষা করার সময় রত্নটি সামান্য ঘুরালো এবং সেটির মধ্যভাগ আগুনের মতো আলোক বিচ্ছুরণ করলো। খাজানসারা তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো, কিন্তু তারপর মনে হলো সে তার মনস্থির করে ফেলেছে। ঠিক আছে, আমি আপনার কথা মতোই কাজ করবো। নিজের কালো শালটি দিয়ে মাথা ঢেকে দ্রুত সে হাতিশালের পেছনে অবস্থিত নির্জন জায়গাটি ত্যাগ করলো এবং অন্ধকারে হারিয়ে গেলো।

    *

    আকবরের শিকারে যাত্রার পূর্বের দিনগুলি সেলিমের জন্য খুব ধীরে কাটতে লাগলো। আনারকলি ব্যতীত অন্য কোনো চিন্তা তার মাথায় খেলছে না সেই নীলচে বেগুনি চোখ, সেই সোনালী চুল। মেয়েটি নিজেই একটি রত্নের মতো, কিন্তু তা নরম জীবন্ত রক্তমাংসে গড়া, কঠিন পাথরে নয়। সেলিমের মনে হচ্ছিলো আকবর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারেন, কিন্তু তৃতীয় দিন ভোর বেলায় সিংহদ্বারকে প্রকম্পিত করা ঢাকের শব্দের সঙ্গে আকবর আবুল ফজল এবং আরো কয়েক জন ঘনিষ্ট সফর সঙ্গী নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। আকবর তিন সপ্তাহ ব্যাপী সফরে থাকার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে তার পিছু পিছু যে শোভাযাত্রাটি অগ্রসর হলো তাতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে পঞ্চাশটি ষাড় টানা গাড়ি যাতে রয়েছে। তাবু, রান্নার তৈজসপত্র, পরিধেয় পোশাকের বাক্স, তীর-ধনুক এবং গাদাবন্দুক। সেই সঙ্গে রয়েছে রক্ষীদল, শিকারী ও খেদাড়ে। তারা অগ্রসর হওয়ার সময় যে সাদা ধূলার মেঘ সৃষ্টি হলো তা মিছিলটি শহর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলো।

    সেই রাতে সেলিম তার ব্যক্তিগত কক্ষে অপেক্ষা করছিলো। কক্ষের ভিতরে সূর্যাস্তের পর পরিচারকরা যে মোমবাতি জ্বালিয়ে গেছে সেগুলি জ্বলতে জ্বলতে অর্ধেক আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে সমগ্র প্রাসাদ জুড়ে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অবশেষে মধ্যরাত অতিক্রান্ত হওয়ার এক ঘন্টা পরে সে তার কক্ষের দরজায় হালকা টোকা পড়ার শব্দ পেলো।

    জাহাপনা। সে সেলিমের একজন দ্বাররক্ষী, তার সারা মুখে নিদ্রাচ্ছন্নতা বিরাজ করছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই মাত্র তাকে কেউ ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। আপনার কাছে দুজন মহিলা এসেছেন। সেলিম তার রক্ষীদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলো যে বাজার থেকে তার কাছে একটি মেয়ে আসবে। এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে, ফলে রক্ষীরা বিষয়টি আলাদা দৃষ্টিতে দেখছে না।

    ওদের ভিতরে পাঠাও।

    কয়েক মুহূর্ত পর, আপাদমস্তক আচ্ছাদনে ঢাকা দুজন নারী কক্ষের ভিতর হাজির হলো। কক্ষে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে খাজানসারা তার মুখের নেকাব সরিয়ে ফেললো এবং সেলিম সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা একটি মুখ দেখতে পেলো। সব কিছু আশানুরূপ ভাবেই ঘটেছে জাহাপনা, কেউ আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি।

    তুমি চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। এখন যেতে পারো এবং ভোর হওয়ার একঘন্টা আগে আবার এখানে হাজির হবে।

    আমার পুরষ্কার জাঁহাপনা…

    সেলিমের দৃষ্টি আনাকলির নিশ্চল অবয়বের দিকে নিবদ্ধ, সে একটানে তার গলায় ঝোলান পদ্মরাগমণির থলেটি বের করলো। এই নাও।

    খাজানসারার দ্রুত পদক্ষেপে প্রস্থান করার বিষয়টি সেলিম লক্ষ্য করলো না। আনারকলির পরনের আলখাল্লাটি তার দেহের তুলনায় লম্বা, তাই সেটার শেষপ্রান্ত ধূলায় আবৃত হয়ে আছে। খাজানসারার দক্ষতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কে সন্দেহ করবে এমন সস্তা পোষাকের অভ্যন্তরে তার পিতার সবচেয়ে প্রিয় রক্ষিতাটি আত্মগোপন করে আছে?

    আপনি আমাকে তলব করেছেন, জাঁহাপনা? আনারকলি ছন্দহীন এবং বেখাপ্পা ফার্সি ভাষায় কথাগুলি বললো, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর নিচু এবং মোলায়েম শোনালো।

    আমাকে তোমার চুলগুলি দেখাও।

    আনারকলি ধীরে তার মস্তক আবৃত করা ওড়নাটি খুলে মাটিতে ফেলে দিলো। তার সোনালী চুলগুলি কালো রঙের একটি আটসাট টুপির ভিতর লুকানো রয়েছে। তার চোখ জোড়া, যেগুলিকে মোমের হালকা আলোতেও নীলকান্তমণির রঙ বিশিষ্ট বলে বোঝা গেলো, সেগুলিকে অলংকৃত করা পাপড়ি গুলি কাজলের পরশ বুলিয়ে কালো করা হয়েছে এবং সেগুলি নির্ভেজাল কৌতূহল নিয়ে সেলিমের চোখের দিকে চেয়ে রয়েছে। সেলিমের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সে তার টুপিটি খুললো এবং তার চুলের গোছা, পাকা শস্যের উপর চাঁদের আলো পড়ে যেমন ফ্যাকাশে সোনালী দেখায়, সেই রূপ ধারণ করে তার কাঁধের উপর ছড়িয়ে পড়লো। তার ঠোঁটে ফুটে উঠা রহস্যময় মৃদুহাসি সেলিমের উপলব্ধিতে সেই বার্তা প্রেরণ করলো, যেমনটা নওরোজের উৎসবের নাচ শেষে করেছিলো- পুরুষ মানুষকে আচ্ছন্ন করা নিজ সম্মোহন ক্ষমতা সম্পর্কে সে ওয়াকিফহাল।

    তোমার নাচ দেখার পর থেকে তুমি ছাড়া আর কোনো চিন্তাই আমার মাথায় খেলছে না। সেদিন থেকেই আমি তোমাকে কামনা করছি।

    আপনার বাবা যদি জানতে পারেন তাহলে তিনি আমার উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হবেন।

    আমি তাকে বলবো তুমি নির্দোষ- সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। তবে তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে আমি তোমাকে জোর করবো না…

    আপনার আকুলতা আমাকে তৃপ্ত করেছে। আমার অবস্থানে থাকা কোনো নারী কি একজন যুবরাজকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে?

    সেলিমের কাছ থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আনারকলি নিজেকে বিবস্ত্র করতে লাগলো। সে তার কুৎসিত পোশাকের আবরণ ছেড়ে এমন ভাবে বেরিয়ে এলো যেনো একটি সুন্দর সাপ পুরানো খোলস ছেড়ে নবরূপ ধারণ করেছে। তার শরীরের মোহনীয় ত্বক থেকে মুক্তার মতো নরম দীপ্তি ঝড়ছে এবং তার নীল শিরা উপশিরা বিশিষ্ট পূর্ণ স্তনযুগলের শীর্ষে অবস্থিত বোটাটি উজ্জ্বল গোলাপি বর্ণের, সেগুলি সামান্য দুলতে থাকলো যখন সে সেলিমের দিকে এগিয়ে এলো। আনারকলি সেলিমের একটি হাত নিজ হাতে নিয়ে সেটাকে তার চিকন এবং রেশমের মতো মসৃণ কোমরে ছোঁয়ালো। তারপর, নিজ দেহকে সেলিমের দেহের উপর সজোরে চেপে ধরলো, সেলিম তার রেশমের জোব্বার উপর দিয়ে তার বোঁটা দ্বয়ের স্পর্শ অনুভব করতে পারলো। এবারে সেলিমের হাতটি সে নিজের সমৃদ্ধ নিতম্বে নামিয়ে আনলো। তার তৃক, সেলিম যেমনটা অনুমান করেছিলো হুবহু তেমনই-উষ্ণ এবং নমনীয়। এক অনিয়ন্ত্রণযোগ্য পৌরুষেয় শিহরণ সেলিমের শরীরে বয়ে গেলো এবং সে আনারকলির কাছ থেকে একটু পিছিয়ে গিয়ে সজোরে টান মেরে নিজের পোশাক খুলতে আরম্ভ করলো, তার অস্থিরতার কারণে নমনীয় বস্ত্রটি ছিঁড়ে যেতে লাগলো।

    আপনি আপনার পিতার মতোই যোদ্ধাসুলভ দেহের অধিকরী এবং তার মতোই দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠেন…

    আনারকলির বক্তব্য সেলিম শুনতে পেলো বলে মনে হলো না। ঐ মহিমাময় অবয়বের মাঝে নিজেকে সমাহিত করা ছাড়া তার মাথায় আর কোনো চিন্তা কাজ করছে না। আনারকলিকে টেনে নিয়ে সে একটি ডিভানে শোয়ালো এবং লাথি মেরে অসুবিধা জনক গদিগুলিকে সরিয়ে দিলো। তারপর তার সোনালী চুলগুলো দুহাতে আকড়ে ধরে প্রথমে তার ঠোঁটে চুমু খেলো এবং সেখান থেকে গিরিপথের মধ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হলো। আনারকলির কাধ থেকে শুরু করে সুগোল উরু পর্যন্ত প্রসারিত নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব সেলিমকে অবাক করলো। সেলিমের অস্থিরতা উপলব্ধি করে ইতোমধ্যেই সে তার উরু দুটি দুপাশে প্রসারিত করেছে এবং তার কোমল দেহটি ঘামে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। জাহাপনা, আনারকলি ফিসফিস করে বললো, এখনই…আমি তৈরি… সেলিম যখন মেয়েটির দেহের মধ্যে প্রবেশ করলো এবং তার উত্থান-পতন শুরু হলো, সে এক অভিনব বিজয়োল্লাস অনুভব করলো- তবে এই অনুভূতি কেবল অসামান্য সুন্দরী এক নারীর সঙ্গে মিলনের কারণেই তার মাঝে সৃষ্টি হয়নি। এর আরেকটি কারণ সে তার পিতার অধিকৃত একটি নারীকে সম্ভোগ করতে পেরেছে।

    *

    সেলিমের ঘুম আসছে না। রাতটি তার কাছে অসহ্য একঘেয়ে এবং গুমোট লাগছে। তার বিছানার উপর নড়তে থাকা টানাপাখাঁটি কক্ষের উষ্ণতাকে একটুও কাবু করতে পারছে না। কিন্তু সেলিম বুঝতে পারছিলো গরম জনিত অসুবিধা নয় বরং আনারকলিকে আবার কাছে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই তার নিদ্রা কেড়ে নিয়েছে। খাজানসারা তার পিতা লাহোরে ফিরে আসার ঠিক আগে পর পর দুরাত আনারকলিকে তার কাছে নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু তারপর থেকে সে আর তার দেখা পায়নি।

    আনারকলি তাকে এতো আকৃষ্ট করে কেনো? এই প্রশ্নের উত্তরটি উদঘাটন করা সেলিমের জন্য বেশ কঠিন, কিন্তু সে অনুভব করে কারণটি আনারকলির সৌন্দর্যের চেও বেশি কিছু, সে তার পিতার রক্ষিতা এই বাস্তবতার চেয়েও গভীর, তবে এ দুটি উপাদান সুস্বাদু মসলার মতো তার কামনাকে উপাদেয় করে তোলে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এক ধরনের সজীবতা, তেজস্বিতা এবং আত্মনির্ভরশীলতা মেয়েটির মধ্যে উপস্থিত, হয়তো জীবনে নানা বিরূপ অভিজ্ঞতা এবং ঝড়ঝাপটা সহ্য করার ফলেই এই বৈশিষ্টগুলি তার মাঝে সৃষ্টি হয়েছে। আনারকলি তার ঘটনাবহুল জীবনের গল্প সেলিমকে শুনিয়েছে। সে খুব অল্প বয়সে তার সওদাগর পিতার সঙ্গে উত্তর আফ্রিকার উপকূল থেকে জাহাজে করে সমুদ্রযাত্রা করে। জলদস্যুরা তাদের জাহাজটি আক্রমণ করে এবং তার বাবাকে গলা কেটে হত্যা করে। তারপর তারা তাকে বন্দী করে নিয়ে যায় এবং ইস্তাম্বুলের ক্রীতদাস কেনাবেচার বাজারে একজন তুর্কি পতিতালয় মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। পতিতালয় মালিকটি তাকে পুরুষের মনোরঞ্জন শিল্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করে। তবে সে তার কুমারীত্ব রক্ষার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে এবং একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করে দেয় যখন তার বয়স পনেরো। এই লোকটি তাকে আবার তুরস্কের সুলতানের কাছে উপহার স্বরূপ প্রদান করে। সেটা বর্তমান সময় থেকে চার বছর আগের ঘটনা।

    যখন সেলিম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো এখনোও সে তার নিজের দেশের কথা ভাবে কি না, আনারকলি কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলো। আমার মনে হয় অনেক কাল পেরিয়ে গেছে। আমার অসহায় বাবার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা মনে পড়লে আমি মাঝে মাঝে কাদি। কিন্তু আমার বাবা যদি আমাকে নিয়ে ভেনিসে পৌঁছাতে পারতেন তাহলে আমার ভাগ্যে কি ঘটতো কে জানে। হয়তো বাবার পছন্দের কোনো ধনী ব্যক্তির সঙ্গে আমার ভালোবাসাহীন বিয়ে হতো। বাবা পূর্বেই এমন পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। কিন্তু এখানেতো আমি বিলাসবহুল জীবন যাপন করছি। বর্তমানে আমার কাছে এমন সব রত্ন রয়েছে যা দেখে ভেনিসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও বিস্মিত হবে। এক মুহূর্তের জন্য তার মুখটি ছায়া আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু তারপর সে সেলিমের দিকে তাকিয়ে হেসেছিলো। এবং এই মুহূর্তে আমি স্ট্যালিয়নের মতো সবল এক তরুণ যুবরাজের শয্যাসঙ্গিনী-আমার মন খারাপ হবে কেনো?

    এমন মসৃণ প্রশংসা বাক্য খুব সহজেই আনারকলির মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, সেলিমের মনে হলো, নিদ্রা এখনো তার চোখে ধরা দিচ্ছে না। মিলনের সময় সে সেলিমের পৌরুষ এবং তাকে তার প্রদান করা সুখানুভূতি নিয়ে চাটুকারিতা করে, বলে সেই তার শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। তবে সেলিম জানে তার এসব বক্তব্য মেকী হতে বাধ্য এবং তার প্রতি আনারকলির সত্যিকার কোনো আকর্ষণ নেই, কিন্তু এই বাস্তবতা আনারকলির প্রতি তার আকর্ষণে একটুও ঘাটতি সৃষ্টি করে না। মেয়েটি তার জীবনে এমন প্রশিক্ষণই পেয়েছে এবং এর সাহায্যেই সে পৃথিবীতে টিকে আছে। এই মুহূর্তে সে হয়তো আকবরের কানে ফিসফিস করে একই বুলি আওড়াচ্ছে।

    সেলিম উঠে বসলো। সে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। সে আবার আনারকলির সঙ্গে মিলিত হবে। কোনো উপায় নিশ্চয়ই রয়েছে এবং সেটা তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

    রবি নদীর তীরে একটি ঝোঁপঝাড়ে আচ্ছাদিত বালুপাথরের ভগ্ন্যুপ রয়েছে, যেখানে এক সময় খেলাধূলা হতো। জায়গাটির দূরত্ব প্রাসাদ থেকে মাত্র আধ মাইল। পাখি শিকার করতে গিয়ে আমি মাঝে মাঝে ওখানে বিশ্রাম করি। এই দেখো… সেলিম এক টুকরো কাগজের উপর কাঠকয়লা দিয়ে একটি মানচিত্র অংকন করলো। আজ রাতে আনারকলিকে ওখানে নিয়ে আসবে যখন আমার বাবা ওলামা পরিষদের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত থাকবেন। নিশ্চয়ই তিনি তার মাওলানাদের সম্মুখে নাচার জন্য তাকে ডাকবেন না।

    আপনি সাক্ষাৎটি অবশ্যই সংক্ষিপ্ত করবেন। সম্রাটের উপস্থিতিতে আনারকলি হেরেম থেকে দীর্ঘক্ষণ অনুপস্থিত থাকতে পারবে না। এবং, জাঁহাপনা…এটাই শেষ বার। আমার পক্ষে আর এতো ঝুঁকি সামলানো সম্ভব নয়…বিষয়টি আমাদের সকলের জন্যই অত্যন্ত বিপদজনক। দুর্ভাবনায় খাজানসারার চোখা নাকটি প্রায় প্রকম্পিত হচ্ছিলো।

    সেলিম সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে ভবিষ্যতে তাকে আরো অভিসার করতে হবে। সে আকবরের চোখে ধূলো দেবার নতুন নতুন বুদ্ধি উদ্ভাবন করবে। এটা নাও। কিন্তু মনে রেখো, ব্যর্থ হলে চলবে না। সেলিম খাজানসারার হাতে মোহর ভর্তি একটি থলে চালান করলো। আমি তোমাদের অপেক্ষায় থাকবো।

    সেই রাতে, নদীতীরের কোমল ছায়ার মধ্য দিয়ে নল-খাগড়ার জঙ্গল এবং অন্যান্য ঝোঁপঝাড় পেরিয়ে সেলিম ভগ্নপটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। জায়গাটি এক সময় নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর ছিলো। বর্তমানে সেখানে সরু সরু স্তম্ভ এবং ভগ্নগম্বুজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেলিম একটি তেলের প্রদীপ জ্বাললো, আবছা আলোতে উল্টে পড়ে থাকা একটি প্রস্তর মূর্তি তার নজরে পড়লো। সেটি সম্ভবত কোনো হিন্দু দেবী বা নর্তকীর মূর্তি, অলংকার ব্যতীত সেটার দেহে আর কোনো আচ্ছাদন নেই, আকর্ষণীয় হাত পা গুলিতে কোনো উচ্ছল নৃত্যের মুদ্রা বিধৃত হয়ে রয়েছে। সেটা দেখে তার আনারকলির ছিপছিপে গড়নের পূর্ণ শরীরের কথা মনে পড়ে গেলো এবং সে যতরকম দেহভঙ্গীমা করতে পারে। সেলিমের হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হলো।

    সেলিম একটি স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো এবং রবি নদীর কলধ্বনি শ্রবণ করতে লাগলো। কোনো ছোট আকারের প্রাণী সম্ভবত ইঁদুর- তার সবুট পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে পালালো এবং সে ঘাড়ের উন্মুক্ত অংশে হুল ফুটানো একটি মশাকে চাপড় মারলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো চাঁদ উঠেছে। প্রায় পূর্ণ চাঁদ, সতেজ কমলা রঙের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সময় বয়ে যাচ্ছিল। সেলিম কান খাড়া করলো, এই ভেবে যে হয়তো নদীর পার থেকে কোমল পদক্ষেপের আওয়াজ শুনতে পাবে। কিন্তু তেমন কিছু শোনা গেলো না। কিছু ঘটেছে কি? খাজানসারা কি ভীত হয়ে তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে? আরো কিছুক্ষণ সে অপেক্ষা করবে, সেলিম ভাবলো। সেলিম একই জায়গায় বসে রইলো, সে রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছে এবং সেই মুহূর্তটিকে কল্পনায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। যখন আবার সে আনারকলির সমৃদ্ধ গিরিখাদের মাঝে নিজের মুখটি সমাহিত করবে। খাজানসারা যদি আজ রাতে আনারকলিকে তার কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে মতো পরিবর্তন করে থাকে সেলিম জানে সে আবার তাকে রাজি করাতে পারবে…

    হঠাৎ খানিকটা দূরে ঘন ঝোঁপের মাঝে টিমটিমে আলো দেখা গেলো হয়তো মশাল-সেলিমের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। খাজানসারা অসতর্ক আচরণ করছে- পথ দেখে অগ্রসর হওয়ার মতো যথেষ্ট চাঁদের আলো চারদিক পাবিত করে রেখেছে। সম্ভবত আগে কখনো এদিকে আসেনি বলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে এমনটা করছে। সেলিম উঠে দাঁড়ালো এবং আরো ভালো করে আলোর দিকে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিল তাঁদের কাছে এগিয়ে যাওয়ার। কিন্তু যেই মাত্র সে স্তম্ভের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে ঝোঁপ ঝাড় পেরিয়ে অগ্রসর হতে নিলো, দেখলো একাধিক মশালের আলো তার দিকে ধেয়ে আসছে। একই সঙ্গে সে একাধিক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ শুনলো এবং নল-খাগড়ার জঙ্গল পেরিয়ে কিছু রক্ষী তার দিকে এগিয়ে এলো।

    কি হচ্ছে এসব? তার সঙ্গে কি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে…? সেলিম তার কোমরে গোজা ছোরাটির দিকে হাত বাড়ালো এবং ঘুরে অন্ধকারে আত্মগোপন করার প্রস্তুতি নিলো, কিন্তু দেখলো একটি পরিচিত অবয়ব তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

    জাহাপনা, আপনার পিতা আপনাকে এই মুহূর্তে প্রাসাদে ফিরতে বলেছেন। আবুল ফজলের ছোট আকারের চোখ দুটি তার পাশে এই মাত্র উপস্থিত হওয়া একজন রক্ষীর মশালের আলোতে ফোয়ারার মতো উজ্জ্বল দেখালো।

    বজ্রাহত সেলিম নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এখন আর আবুল ফজল তার অনুভূতি গোপন করার চেষ্টা করছে না এবং সেলিম আগে কখনোও তার মাঝে এমন স্পষ্ট বিজয়োল্লাস দেখতে পায়নি। সে তার প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশের ভাষা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু আবুল ফজলই আবার কথা বলে উঠলো।

    জাহাপনা, আমাকে বলা সেই কথা গুলি কি আপনার মনে আছে? আপনি বলেছিলেন আপনি জানেন আমার আসল রূপ কি, এবং যে দিন আপনার বাবা তা বুঝতে পারবেন আপনি সেই দিনের অপেক্ষাতেই থাকবেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কথা গুলিকে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলো, তাই না? আপনার পিতা বুঝতে পেরেছেন আপনার আসল রূপ কি…

    *

    বেশ্যাটাকে এখানে হাজির করো। আকবর তার সিংহাসনে উত্তেজিত ভঙ্গিমায় বসে আছেন, তার পরনের গাঢ় লাল বর্ণের আলখাল্লাটিকে কালচে দেখাচ্ছে। তিনি যখন উপস্থিত সভাসদদের দিকে দৃষ্টি হানলেন মনে হলো তিনি মুখোশ পড়ে আছেন। সিংহাসনবেদীর নিচে খালি মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিমের উপস্থিতি তিনি আমলে নিচ্ছেন না। তার পরনে এখনো নিশি অভিসারের পোশাকপরিচ্ছদ।

    বাবা, আমি কিছু বলতে চাই…

    কোনো সাহসে তুমি আমাকে বাবা বলে সম্বোধন করছো যখন তোমার আচরণের মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কের প্রতি ঘৃণা ব্যতীত আর কিছুই প্রকাশ পায়নি। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, তা না হলে আমি তোমাকে নিশ্চুপ করানোর ব্যবস্থা করবো। আকবর পুঞ্জিভূত প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কয়েক মিনিট পর দরবারের পার্শ্ববর্তী একটি দরজা দিয়ে আনারকলিকে নিয়ে আসা হলো, পেছন থেকে দুজন স্কুল গড়নের মহিলা হেরেম রক্ষী তার পিঠে ধাক্কা দিচ্ছিলো। তার দুহাত একত্রে বাধা এবং সোনালী চুলগুলি উস্কোখুস্কো হয়ে কাঁধের উপর ছড়িয়ে আছে। তার সাদা মুখের এখানে সেখানে চোখের জলের সঙ্গে কাজল লেপ্টে গিয়ে কালো দাগ সৃষ্টি করেছে। সেলিম দেখতে পাচ্ছিলো আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তায় মেয়েটি প্রচণ্ড ভাবে থরথর করে কাঁপছে। ধীরে অগ্রসর হয়ে সে আকবরের সামনে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে আছড়ে পড়লো।

    তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে প্রিয় রক্ষিতা। তুমি যতোটুকু আশা করেছো তার তুলনায় অনেক বেশি ঐশ্বর্য আমি তোমাকে প্রদান করেছি। কিন্তু তারপরেও তুমি তোমার সম্রাটের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং এই বদমাশটি যে নিজেকে আমার সন্তান বলে দাবি করছে তার লালসার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে। এর শাস্তি হতে পারে একটাই-মৃত্যুদণ্ড।

    আনারকলির চেহারাটি প্রচণ্ড ভীতি এবং আতঙ্কে দুমড়ে মুচড়ে গেলো। একটি বিক্ষুব্ধ থরকম্প তার সমগ্র দেহে আক্ষেপ সৃষ্টি করলো যখন সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। একজন মহিলা রক্ষী তাকে ধাক্কা মেরে বসিয়ে দিয়ে হাতে থাকা লাঠি দিয়ে নির্দয় ভাবে তার নিতম্বে খোঁচা মারলো।

    দয়া করুন জাঁহাপনা…

    আমার কান তোমার আর্জির প্রতি বধির। তোমাকে কীভাবে শাস্তি দেয়া হবে তা আমি নির্ধারণ করে ফেলেছি। তোমাকে প্রাসাদের কয়েদখানার ক্ষুদ্র একটি প্রকোষ্ঠে ঢুকিয়ে ইটের দেয়াল তুলে সেটি রুদ্ধ করে দেয়া হবে। যখন মিনিট গড়িয়ে ঘন্টা এবং ঘন্টা গড়িয়ে দিন অতিক্রন্ত হয়ে তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে তখন তুমি তোমার অপরাধ সম্পর্কে গভীর ভাবে ভাবার সুযোগ পাবে।

    না! দোষ আমি করেছি, ওর কোনো অপরাধ নেই। আমি ওকে কামনা করেছি এবং খাজানসারাকে ঘুষ প্রদান করেছি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য, সেলিম চিৎকার করে বলে উঠলো।

    আমি সব কিছু জানি, আকবর বললেন, অবশেষে এখন তিনি সেলিমের দিকে তাকালেন। তোমার কি মনে হয়, তোমার ঘৃণ্য অপকর্ম সম্পর্কে আমি জানলাম কীভাবে? খাজানসারা নিজেই আজ সন্ধ্যায় আবুল ফজলের কাছে গিয়ে সব কিছু স্বীকার করেছে। আমি তাকে দয়া প্রদর্শন করেছি….অত্যন্ত দ্রুত তার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটি রাজকীয় হেরেমের সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে যাকে রক্ষা করার জন্য তুমি সাফাই গাইছো। এটা ওর সৌভাগ্য যে আমি জ্যান্ত ওর ছাল ছাড়িয়ে সেই চামড়া প্রসাদ দ্বারে ঝুলিয়ে রাখার আদেশ দেইনি। আকবর রক্ষীদের দলপতির দিকে তাকালেন। ওকে নিয়ে যাও।

    দুই জন রক্ষী দুদিক থেকে আনারকলিকে ধরলো, আর্তচিৎকারের সঙ্গে সে মেঝের শতরঞ্জি আকড়ে ধরে থাকতে চাইলো, আশা করছে কোনো অলৌকিক উপায়ে সেখানে স্থির থেকে নিজের ভয়াবহ পরিণতি বিলম্বিত করতে পারবে। সেলিম সেদিক থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, যে অপার সৌন্দর্য তাকে সীমাহীন ভাবে প্রলুব্ধ করেছিলো তার এই করুণ দশা সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তার কামনার কারণেই এই বিরল বৈশিষ্টের অধিকারী মেয়েটির অকালমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। তাকে রক্ষা করার জন্য তার কিছুই করার বা বলার সামর্থ নেই, এই বোধ সেলিমকে আচ্ছন্ন করলো। কেবল আনারকলির চিৎকার এবং আহাজারি যখন অপসৃত হলো এবং দরবারের দরজাটি বন্ধ করা হলো তখনই সে আবার তার পিতার দিকে তাকালো। তাকে কতোই না নিষ্ঠুর দেখাচ্ছে, কতো ব্যাপক ক্ষমতা নিয়ে ঐ চাকচিক্যপূর্ণ সিংহাসনে বসে আছেন। তিনি তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের ভাগ্যে কি নির্ধারণ করে রেখেছেন? তিনি কি তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেবেন? কয়েক মুহূর্তের জন্য সেলিম তার গলায় শীতল ইস্পাতের ফলার স্পর্শ কল্পনা করতে পারলো। ভুল ত্রুটি সত্ত্বেও নিজ বাবাকে তার সর্বদা সম্মানিত এবং ন্যায় বিচারক বলে মনে হতো। কিন্তু আনারকলির প্রতি তাঁর প্রতিশোধমূলক আক্রোশ সেই অনুভূতিকে নড়িয়ে দিয়েছে।

    সেলিম, তুমি নিজেই স্বীকার করেছে এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের পেছনে তোমার ভূমিকাই প্রধান। একটু থেমে আকবর আবার শুরু করলেন, এমন পুত্রের প্রতি আমি কীভাবে পুনরায় বিশ্বাস স্থাপন করবো যে এমন কুৎসিৎ ভাবে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? তোমার জীবন আমার কাছে এবং মোগল রাজবংশের কাছে মূল্যহীন।

    সেলিম অনুভব করলো তার গলার মাংসপেশি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যদি তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয় তাহলে সে কোনো ধরনের ভীতি প্রকাশ করতে চায় না, তাই সে বাবার চোখে চোখ রেখে তাকালো।

    তুমি এখনোও তরুণ এবং তুমি মূল্যায়ন না করলেও আমি আমাদের মধ্যকার রক্তের বন্ধনকে কিছুটা মূল্যায়ন করি। তাছাড়া আমার নিজের মা তোমার জীবনের জন্য আমার কাছে আরজি পেশ করেছেন, তাই আমি তোমাকে ক্ষমা প্রদর্শন করবো। আগামীকাল সকালে রাজকীয় পরিদর্শন কাজ সম্পাদন করার জন্য তুমি কাবুলের পথে রওনা হবে এবং সেখানেই অবস্থান করবে যতোদিন পর্যন্ত না আমি তোমাকে পুনরায় ডেকে পাঠাই। তোমার স্ত্রীগণ এবং তোমার সন্তানেরা এখানেই অবস্থান করবে। এখন আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও তা না হলে আমার সিদ্ধান্ত পাল্টে যেতে পারে।

    আপনি আমার প্রতি ঈর্ষা পরায়ণ কারণ আমি তরুণ এবং আপনি ক্রমশ বার্ধক্যে উপনীত হচ্ছেন। আপনি মনে মনে জানেন যে আপনি অমর নন এবং এই জন্য ভীত যে আপনার রক্ষিতার মতো একদিন আমি আপনার সিংহাসনও অধিকার করবো, কথা গুলি সেলিম চিৎকার করে বলতে চাইলো, কিন্তু তাতে কি লাভ? ঘুরে দাঁড়িয়ে শতরঞ্জির উপর দিয়ে হেঁটে সে দরবার কক্ষ ত্যাগ করার জন্য অগ্রসর হলো, যেখানে এখনো আনারকলিকে ছেচড়ে নিয়ে যাওয়ার দাগ দেখা যাচ্ছে। এখানেই কি তার সকল উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমাহিত হলো?

    .

    ২৪. ইন্দুজ নদী

    তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। সেলিম তার বিশাল আকারের তাবুর ভেতরের বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার গায়ে সূক্ষ্ম সুতির চাদর এবং আরামদায়ক কাশ্মীরি কম্বল। বৃষ্টির ছাট তাবুর উপর আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ আগে লাহোর ত্যাগ করার পর থেকেই রাতে তার নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম হচ্ছে না। বার বার আনারকলির মোহনীয় মুখটি তার কল্পনার দৃশ্যপটে ফিরে আসছে যা একাধারে উষ্ণ, জৈবনিক এবং সতেজতা সম্পন্ন। কিন্তু বাস্তবতা হলো এতোদিনে সে নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। সেলিম দেখতে পাচ্ছে আনারকলির মুখটি ক্রমশ আঁটো হচ্ছে, ত্বক কুঁচকে গিয়ে মাথার খুলি উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে এবং একসময় গুড়ো গুড়ো হয়ে ধূলায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নীল চোখ দুটি অক্ষত থেকে তাকে ভর্ৎসনা করছে এক মুহূর্তের জন্য, তারপর সেগুলোও আধারে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

    সেলিম অকস্মাৎ ঝাঁকি খেয়ে কম্বল খামচে ধরে বিছানায় উঠে বসলো। আনারকলির করুণ পরিণতির জন্য সৃষ্ট অপরাধ বোধ তার বুকের উপর ভারী পাথরের মতো চেপে বসে আছে। দুঃসহ বেদনা যুক্ত বহু নিদ্রাহীন রাত কাটিয়ে তার মাঝে এই উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে যে মেয়েটি তার জন্য একটি উন্মাদনা সৃষ্টিকারী খেলনা ছিলো এবং নিজ অংঙ্কারকে তৃপ্ত করতে সে তাকে আকবরের কাছ থেকে চুরি করার চেষ্টা করেছিলো। সে যদি সত্যিই আনারকলিকে ভালোবাসতো তাহলে নিজের কর্মকাণ্ডকে নিজের কাছে তার আরো কম ঘৃণ্য বলে মনে হতো তার। সে এমন লোভী এবং অসতর্কভাবে আনারকলিকে হস্তগত করার চেষ্টা করেছে যেনো সে কোনো গাছের পাকা আম বা থালায় সাজানো লোভনীয় মিষ্টান্ন ভক্ষণ করতে চেয়েছে। তবে এই দীর্ঘ অস্থির দিন গুলির মাঝেও কিছুটা স্বস্তির বাতাস তার মনে প্রবাহিত হয়েছে। লাহোর থেকে যাত্রা করার তিন দিন পর দাদী হামিদার কাছ থেকে একটি বার্তা তার কাছে এসেছে যেটা থেকে সে জানতে পেরেছে আনারকলিকে দীর্ঘ মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। তার বুদ্ধিমতি দাদীমা লিখেছেন সেলিমের আকুল আবেদন অনুযায়ী কোনো উপায়ে একটি বিষ ভরা ছোট শিশি তিনি গোপনে আনারকলির কাছে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। সেলিম আশা করছে খবরটি সত্যি হোক এবং এটা যাতে তার দাদীর নিছক সান্ত্বনা বাক্য না হয়।

    ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটি সম্পর্কিত অপরাধবোধ এবং এর পরিণতি বিষয়ক চিন্তা তার মনকে আরেকবার আন্দোলিত করলো। ঘটনার অমোঘ পরিণতিতে সে এখন তার পরিবার পরিজন এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী থেকে শত শত মাইল দূরে নির্বাসিত হয়েছে। তাকে যেতে হবে খাইবার গিরিপথ পেরিয়ে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ প্রান্তে। তার লালসাপূর্ণ আচরণের সাহায্যে আকবরকে বিক্ষুব্ধ করে সে কেবল আনারকলির মৃত্যুই ঘটায়নি। বরং শেখ সেলিম চিশতি তার সম্পর্কে যে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে একদিন সে সম্রাট হবে সেই সম্ভাবনাকেও পদদলিত করেছে। তার সকল আশা আকাঙ্ক্ষা নিশ্চিত ভাবেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এখন তার সৎ ভাইরা তার অপকর্মের অজুহাতকে কাজে লাগিয়ে সিংহাসনের প্রতি নিজেদের দাবি আরো জোরালো ভাবে উত্থাপন করতে পারবে। এবং এখন হঠাৎ যদি আকবরের মৃত্যু হয় তাহলে কি হবে? তার কাছে সেই মৃত্যু সংবাদ পৌঁছানোর আগেই আবুল ফজল এবং তার ঘনিষ্ট অনুগামীরা পরবর্তী উত্তরাধিকারী নির্বাচন করে ফেলবে।

    গর্জনরত দমকা হাওয়া যখন তার তাবুর ভারী তিরপলকে বারংবার আঘাত করে দাবিয়ে দিচ্ছে তখন সেলিম নিজের হতাশা ব্যঞ্জক চিন্তা গুলি থৈকে মনকে অন্য দিকে ফিরাতে চাইলো। সে তার সম্মুখের ভ্রমণ কৌশল নিয়ে ভাবতে শুরু করলো। গতকাল সে এবং তার সঙ্গে থাকা সাড়ে তিনশো সৈন্যের দলটি ইন্দুজ নদীর প্রবল ঘূর্ণিযুক্ত ঠাণ্ডা জল পেরিয়েছে। একটি অল্প বয়সী হাতি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে যখন সেটিকে বহনকারী ভেলাটি মাঝ নদীতে আরেকটি ভেলার সঙ্গে ধাক্কা খায়। হাতিটি নদীতে গড়িয়ে পড়ে এবং প্রবল স্রোতের তোড়ে ভেসে যায়। সেটার পিঠে রান্নার মূল্যবান তৈজসপত্রের বোঝা ছিলো। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাকি দলটি নিরাপদে নদীটির উত্তর পারে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। শেষ ভেলাটি পার হয়ে মাল খালাস করার সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিলো। ইতোমধ্যেই বাতাসের তাড়নায় বৃষ্টিসমৃদ্ধ কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছিলো। কর্দমাক্ত নদীতীরের ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা বেলাভূমিতে সেলিম তখন হুকুম দেয় দ্রুত শিবির প্রস্তুত করার জন্য। নদী অতিক্রম করতে যথেষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এবং সৈন্যরা বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই জন্য আজ সে তাদের একটু বেশি সময় ঘুমানোর সুযোগ দেবে। তারপর নির্বাসনের গন্ত ব্যের দিকে আবার অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করবে। তাদের সম্মুখে রয়েছে পেশোয়ার এবং তারপর খাইবার গিরিসংকটের প্রবেশ পথ। এই ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে সেলিম ধারণা পেয়েছে তার দাদীমার বলা গল্প থেকে এবং সেইসব সেনাপতিদের কাছ থেকে যারা এই অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেছে।

    সেলিমের চোখের পাতা ভারি হয়ে এলো, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে নিলো একটি চিৎকারের শব্দ শুনে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠলো। সেটা কি কোনো বুনো প্রাণী যে অন্য কোনো শিকারী জানোয়ারের ধারালো দাঁতের কবলে আটকা পড়ে মরণ চিৎকার দিলো, নাকি কোনো মানুষ? কয়েক মুহূর্ত পর আরেকটি চিৎকার এবং তাকে অনুসরণ করে উচ্চ কণ্ঠের আদেশ অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হও সকল সন্দেহ দূর করে দিলো। তার শিবির আক্রান্ত হয়েছে। সে বিদ্যুৎ বেগে বিছানার পাশে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কোনো রকমে সে তার বাইরের পোশাকের নুন্যতম অংশগুলি পড়ে নিলো এবং বিদায় উপহার হিসেবে হামিদার পক্ষ থেকে পাওয়া দুদিকে ছোট ছোট সোনার জিহ্বার নকশা বিশিষ্ট পারসিক তলোয়ারটি হাতে নিলো। তাবু থেকে বেরিয়ে সে দেখতে পেলো তার কিছু দেহরক্ষী অন্ধকারের দিকে উত্তেজিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যরা এক জায়গায় ভিড় করে মাটিতে পড়ে থাকা তাঁদের দুজন সাথীর উপর ঝুঁকে আছে, তাদের হাতে ধরা মশালের আগুন বৃষ্টি এবং দমকা বাতাসে কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। আহত হয়ে পড়ে থাকা একজন তার পেটে গেঁথে থাকা তীরটি চেপে ধরে ব্যথায় আর্তচিৎকার করছে। অন্যজন নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।

    মশাল গুলি নিভিয়ে ফেলো, সেলিম চিৎকার করে বললো। ওগুলো জ্বেলে রাখলে তোমরা সহজ নিশানায় পরিণত হবে এবং নিজেদের দৃষ্টিকে অন্ধকারের সঙ্গে অভ্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করো।

    কিন্তু নির্দেশটি পালিত হওয়ার আগেই তৃতীয় আরেকজন রক্ষী পিঠে তীর বিদ্ধ হলো এবং সে হুমড়ি খেয়ে কাদার উপর পড়ে গেলো। মশালগুলি কাদাপানিতে গুঁজে দ্রুত নিভিয়ে ফেলা হলো।

    জাহেদ বাট এবং সুলায়মান বেগ কোথায়?

    আমি এখানে জাহাপনা, জাহেদ বাট চেঁচিয়ে উত্তর দিলো, সে সেলিমের রক্ষীদের অধিনায়ক।

    আমি এখানে আছি, সুলায়মান বেগের আওয়াজ শোনা গেলো, পাশের একটি তাবু থেকে তলোয়ার ঝোলানো কোমর বন্ধনী বাঁধতে বাঁধতে মাথা ঝুঁকিয়ে সে বেরিয়ে এলো। ওদিকে সাধারণ সৈন্যরা এ সময় কাদা পানির মধ্যে এদিক ওদিক ছোটা ছুটি করছে এবং সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছে, তবে সকলের হাতে কোনো না কোনো অস্ত্র রয়েছে।

    কারা আমাদের আক্রমণ করলো? তীরগুলি কোনো দিক থেকে আসছে? সেলিম জানতে চাইলো।

    তীরগুলি পূর্ব দিকের নদীতীর থেকে আসছে, কিন্তু শত্রুকে চেনার কোন উপায় নেই এবং তাদের শক্তি সম্পর্কে ধারণা করাও অসম্ভব। আমি ইতোমধ্যেই সেদিকে কিছু রক্ষীকে তদন্ত করতে পাঠিয়েছি যারা আপনার তাবুর পাহারায় ছিলো… জাহেদ বাট বললো, কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই পর পর দুই ঝাঁক তীর শিবিরের কেন্দ্রস্থল লক্ষ্য করে ছুটে এলো ঘোর অন্ধকার এবং বৃষ্টির মধ্য দিয়ে। জাহেদ বাটের বক্তব্যের বিরোধীতা করতেই যেনো কিছু তীর পশ্চিম দিক থেকে এবং কিছু উত্তর দিক থেকে ধেয়ে এলো। আরেকজন সৈন্য পড়ে গেলো, তীরটি তার বাম উরুর পিছনে বিঁধেছে। এটা সম্ভবত ঝড়ে বক মড়ার মতো ঘটনা ঘটলো। চারদিকের ঘন অন্ধকার, বৃষ্টি এবং দমকা হাওয়ার মধ্যে সঠিক লক্ষ্য ভেদ করা অসম্ভব।

    সেলিমের মনে বহু প্রশ্ন এক সঙ্গে জেগে উঠলো। অজানা অদেখা শত্রুরা তার শিবির ঘিরে ফেলতে চেষ্টা করছে। কেনো? তারা যদি সাধারণ ডাকাত হতো তাহলে তারা নিশ্চয়ই প্রথমে মালামাল বহনকারী গাড়ি গুলিতে হামলা চালাত এবং মালামাল ও বিশ্রামরত ছোঁড়া গুলি নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করতো। এই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু কি সে নিজে? সেলিমের সমগ্র দেহ প্রকম্পিত হলো। এমন কিছু কি ঘটা অসম্ভব যে, আবুল ফজল তার বাবার সম্মতি নিয়ে বা তার অজান্তে এক দল আততায়ী পাঠিয়েছে তার দুর্ঘটনাসুলভ মৃত্যুর পরোয়ানা দিয়ে? এ ধরনের ঘটনা আকবরের শাসনের প্রথম দিকে বৈরাম খানের ভাগ্যে তো ঘটেছিলো।

    বর্তমান পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো এখন তার লোকেরা তার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে এবং তাদেরকে নিরাশ করা চলবে না। দ্রুত চিন্তা করে সেলিম আদেশ দিলো, আমরা সকলে কাছাকাছি থেকে একটি বেষ্টনী তৈরি করে শত্রুদের দিকে এগিয়ে যাবো এবং অগ্রসর হওয়ার সময়ে কিছুটা দূরে আমাদের যেসব রক্ষী পাহারায় ছিলো তাদের কেউ যদি এখনোও বেঁচে থাকে তাহলে তাদের সঙ্গেও দেখা হবে। আমাদের পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে চলবে না, তাই সকলের দায়িত্ব থাকবে তার ডান পাশে অবস্থিত সঙ্গীর দিকে খেয়াল রাখা। আমি নিজে মাঝা মাঝি জায়গায় থাকবো যেখান থেকে অগ্রসর হলে মালপত্র এবং বিশ্রামরত ছোঁড়াগুলির দেখা পাওয়া যাবে। সুলায়মান তুমি পূর্ব অংশের নেতৃত্ব দিবে এবং আপনি জাহেদ বাট, পশ্চিম দিকের। সকলে যথাসম্ভব নিঃশব্দে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করবে।

    দ্রুত সেলিমের লোকজন পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে মোটামুটি সারিবদ্ধভাবে একটি বেষ্টনী তৈরি করলো এবং সম্মুখে অগ্রসর হতে লাগলো, তাঁদের সকলের হাতে উদ্যত অস্ত্র। সারির দুই প্রান্ত কিছুটা দ্রুত নদীতীরের দিকে এগিয়ে গেলো, কিন্তু মধ্য অংশটি, যেখানটা সেলিমের নেতৃত্বে অগ্রসর হচ্ছিলো তাদের গতি অত্যন্ত ধীর এবং তারা হামাগুড়ি দিয়ে পিছলে কিছুটা উঁচু ঢাল বিশিষ্ট কর্দমাক্ত নদীপারে উপস্থিত হলো। এ সময় সেলিমের পায়ের সঙ্গে নরম কিছুর সংঘর্ষ হলো- এটা তার একজন রক্ষীর দেহ, সেটা হাত পা ছড়িয়ে উপুর হয়ে পড়ে আছে। সেলিম হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো। তার এই পতনই তার জীবন রক্ষা করলো, কারণ যখন সে আবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো এক ঝাঁক তীর তার মাথার দুই ফুট উপর দিয়ে ছুটে গেলো এবং যে দুজন লোক তার দুপাশে ছিলো তারা তীর বিদ্ধ হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।

    সেলিম চিৎকার করে উঠলো, সকলে নদীপারের আড়ালে আশ্রয় নাও। কিন্তু পারের নিচ থেকে ভেসে আসা রণহুঙ্কারের উচ্চ শব্দে তার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে গেলো। অতর্কিত ভাবে আত্মগোপনে থাকা হামলাকারীরা এখন একত্রে তার সৈন্যদের বেষ্টনী বরাবর এগিয়ে আসছে। একজন দৈত্যাকৃতি শত্রু হাতে উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে সেলিমের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সেলিম তার তলোয়ারের আঘাত প্রতিহত করলো এবং তার তলোয়ার ধরা হাতটি আকড়ে ধরে টান দিলো। ফলে তারা দুজনে নদীর ঢালু পার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়লো। গড়াতে গড়াতে দুজনে সমতল জায়গায় গিয়ে স্থির হলো। গড়ানোর সময় দৈত্যটির তলোয়ারটি খোয়া গেছে, এখন সে তার বিশাল আকৃতির থাবার মধ্যে সেলিমের গলাটি আকড়ে ধরার চেষ্টা করলো। ওদিকে সেলিম তার পারসিক তলোয়ারটি আবার সুবিধা জনক মুষ্টিতে ধরতে পেরেছে। তবে ততোক্ষণে দৈত্যটির বিশাল আঙ্গুল গুলি তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। কিন্তু সেলিমের তলোয়ার তার কোমর ভেদ করে গভীরে ঢুকে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সেলিম অনুভব করলো উষ্ণ রক্ত শত্রুটির ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসছে এবং তার কণ্ঠনালী চেপে ধরা আঙ্গুল গুলি শিথিল হয়ে পড়েছে। দ্রুত দশাসই ওজনের শরীরটিকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে সেলিম উঠে দাঁড়ালো এবং গলা ডলতে ডলতে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।

    তার আশেপাশে ভয়ঙ্কর লড়াই চলছে। উপরের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো কিছুটা বামে কর্দমাক্ত পারের উপর দাঁড়িয়ে থাকা লম্বা একটি লোক স্পষ্টতই শত্রু পক্ষের কোনো সেনাপতি হবে- হাতে থাকা তলোয়ারটি নাড়িয়ে নিজের দলের লোকদেরকে মোগল সেনাদের আক্রমণ করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেলিম তার কোমর বন্ধনীতে গুঁজে রাখা একটি খাজকাটা ছুঁড়ে মারার ছোরা টেনে বের করলো, তারপর সতর্কভাবে লক্ষ্যস্থির করে লোকটির দিকে ছুঁড়ে মারলো। যোদ্ধাটি শেষ মুহূর্তে খেয়াল করলো ছোরাটি তার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে, একপাশে সরে সে সেটাকে লক্ষ্যচ্যুত করতে চাইলো। তবে পুরোপুরি এড়াতে পারলো না, ছোরাটি তার বাম বাহুর উপরের অংশের মাংস কেটে বেরিয়ে গেলো। নির্ভিক চিত্তে, সে সেলিমের দিকে ধেয়ে এলো, তারপর সেলিমকে লক্ষ্য করে তার তলোয়ার চালালো। তলোয়ারটির অগ্রভাগ সেলিমের মুখের সামনে দিয়ে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেলো, কারণ সে খানিকটা পিছনে হেলে পড়েছিলো। গতি জড়তার কারণে আক্রমণকারীটি আরেকটু সামনে এগিয়ে এলো, সেই মুহূর্তে সেলিম তার ডান পাটি এগিয়ে দিলো তাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার জন্য এবং তাতে কাজ হলো। লোকটি হাত পা ছড়িয়ে মাটির উপর আছড়ে পড়লো। সেলিম তার পারসিক তলোয়ারটির বাট দুহাতে শক্ত করে ধরে লোকটির ঘাড় বরাবর সজোরে কোপ মারলো এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মৃত্যু হলো।

    মুচড়ে তলোয়ারটি বের করে আনার সময় লোকটির মাথা ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সেলিম তার নিজের ছুঁড়ে মারার ছোরাটির শূন্যতা পূরণ করার জন্য লোকটির বাঁকা আকৃতির তলোয়ারটি এক হাতে তুলে নিলো। তারপর, দুহাতে দুটি অস্ত্র নিয়ে সে সেদিকে এগিয়ে গেলো যেখানে তার একজন রাজপুত দেহরক্ষী দুজন আক্রমণকারীকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে এবং তখন উষা লগ্নের হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। নিজের পারসিক তলোয়ারটিকে বর্শার মতো করে সামনের দিকে বাড়িয়ে ধরে ছুটে গিয়ে সে একজন আক্রমণকারীরে নিতম্বের মাংসল অংশে সেটি ঢুকিয়ে দিলো। আহত লোকটি ঘুরে লক্ষ্য নির্ধারণ না করেই সেলিমের দিকে তার ছুরি চালালো। এতে সেলিমের জোব্বার ডান বাহুর হাতা ছিঁড়ে বাহুর অগ্রভাগে ছুরিটির আচড় লাগলো। সেলিম পাল্টা তার বাম হাতে থাকা বাকা তলোয়ারটি দিয়ে আঘাত করলো। যদিও বাম হাতে ধরা অনভ্যস্ত অস্ত্রের দুর্বল আঘাত, তবুও অস্ত্রটির ভারসাম্য ভালো এবং ফলাটিও খুব ধারালো। সেটা লোকটির দেহের একপাশ গভীরভাবে কর্তন করলো এবং সে মাটিতে পড়ে গেলো। তার চুড়ান্ত ব্যবস্থা রাজপুতটি করবে, ইতোমধ্যেই সে অন্য শত্ৰুটিকে পরাজিত করেছে।

    এ সময় বহু আক্রমণকারী রণে ভঙ্গ দিয়ে ঘুরে পলায়ন করতে শুরু করেছে এবং সেলিম যখন হামাগুড়ি দিয়ে কর্দমাক্ত নদীপারের উপরে উঠলো দেখতে পেলো কিছু শত্রু পক্ষের লোক একশো গজ দূরে সারিবদ্ধ ভাবে বেঁধে রাখা মোগলদের ঘোড়া গুলির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইতোমধ্যেই কিছু লোক মরিয়া ভাবে দড়ি কেটে ঘোড়াগুলির পিঠে চড়ে দ্রুত সরে পড়ার চেষ্টা করছে।

    সকলে আমাকে অনুসরণ করো! ঘোড়া গুলির কাছ থেকে শত্রুদের সরিয়ে দিতে হবে যাতে তারা পালাতে ব্যর্থ হয়, পারের উপর থেকে পিছলে : নামতে নামতে সেলিম চিৎকার করে আদেশ দিলো। জল কাদা পেরিয়ে সে ঘোড়া গুলির দিকে দৌড়াতে লাগলো।

    সেলিমকে এগিয়ে আসতে দেখে, বেগুনি পাগড়ি পরিহিত বেটে গড়নের গাট্টাগোট্টা একটি লোক, যে ইতোমধ্যেই একটি সাদাকালো রঙের ঘোড়ার গলার বাঁধন কাটা শেষ করে মরিয়া হয়ে সেটার সামনের পায়ের বাধনও কাটার চেষ্টা করছিলো সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁধে ঝোলান দ্বিবক্র ধনুকটি হাতে নিয়ে তাতে তীর পড়িয়ে সেলিমকে লক্ষ্য করে ছুড়লো। কয়েক ইঞ্চির জন্য তীরটি সেলিমকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। অস্থিরভাবে কম্পিত আঙ্গুলে সে আরেকটি তীর ধনুকে পড়ালো, সেলিম তখন প্রায় তার কাছে পৌঁছে গেছে, কিন্তু সেলিম তাকে ধরতে পারার আগেই সে তার হাতের ধনুকটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে একটি ঘোড়ার পেটের আড়ালে মাথা নিচু করলো। সেলিম তাকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো কিন্তু বিফল হলো।

    শরগোল এবং চিৎকারের কারণে আতঙ্কিত হয়ে ঘোড়াটি ছেড়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। হঠাৎ সেটার সামনের পায়ের অর্ধেক কর্তিত বাঁধন ছিঁড়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটি উন্মত্তের মতো সামনের পা দুটি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। সেটার একটি পায়ের লাথি বেগুনি পাগড়ির লোকটির পেটে আঘাত করলো এবং সে সামনে দিকে কুজো হয়ে মাথার পেছনে ঘোড়াটির আরেকটি লাথি খেলো। লোকটির পাগড়ি মাথা থেকে ছিটকে পড়ে গেলো, তার খুলি ফেটে গেলো এবং সে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লো। সেলিম দ্রুত এক পলক তাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলো লোকটির পক্ষে আর হুমকি সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। সাদাকালো ঘোড়াটির ছুঁড়তে থাকা পয়ের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সেলিম সেটার গলার দড়ি ধরে ফেলতে সক্ষম হলো। একহাতে দড়ি টেনে সেটার আন্দোলনরত মাথাটিকে স্থির করার চেষ্টার পাশাপাশি সে অন্য হাতে সেটার ঘাড়ের উপর চাপড় মারতে লাগলো এবং মোলায়েম কণ্ঠে সেটার সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। ঘোড়াটি দ্রুত শান্ত হয়ে এলো। এই সব কিছু ঘটলো মাত্র দুই এক মিনিটের মধ্যে এবং সেলিম ঘোড়াটির পিঠে চড়ে বসলো।

    হাত, হাঁটু এবং পায়ের সম্মিলিত নির্দেশনার সাহায্যে সেলিম ঘোড়াটিকে চালিত করতে লাগলো এবং সম্মুখে অগ্রসর হওয়া শত্রুদের ধাওয়া করতে লাগলো যারা তারই মতো জিন বিহীন ঘোড়া ছোটাচ্ছে। প্রতিপক্ষের যোদ্ধারা তিন মাইল দূরবর্তী ছোট ছোট পর্বত সারির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে সেলিমের ডজন খানিক দেহরক্ষী তার সঙ্গে যোগ দিলো। প্রথম দিকে শত্রুপক্ষের ঘোড়সওয়ারদের সঙ্গে সেলিমের দলের দূরত্ব কমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। কিন্তু একটু পড়ে শত্রু ঘোড়সওয়ারদের একজন ক্ষুদ্র একটি জলপ্রবাহ লাফিয়ে পেরুনোর পর তার ঘোড়াটি কিছুটা পিছলে গেলো। যেহেতু তার কোনো লাগাম বা জিন ছিলোনা তাই সে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে পড়ে গেলো এবং পিচ্ছল মাটিতে গড়াতে লাগলো। তার পড়ে যাওয়া খেয়াল করে অগ্রবর্তী দলটি যাদের সংখ্যা আট নয় জন হবে, থমকে গেলো এবং তাঁদের দলপতি বলে যাকে মনে হলো সে আদেশ দিলো ঘোড়া গুলির মুখ ঘুরিয়ে ফিরে এসে তাদের সাথীকে উদ্ধার করার জন্য যাতে ধাওয়ারত সেলিম ও তার দলের হাতে সে না পড়ে।

    দলপতিটি তলোয়ার হাতে নিয়ে তার বাদামি রঙের ঘোড়াটিকে সেলিমের দিকে ছোটালো। যখন তারা পরস্পরের কাছাকাছি হলো তখন উভয়েই একে অন্যকে লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো। উভয়েই ব্যর্থ হলো এবং মরিয়া হয়ে আবার পরস্পরকে আক্রমণ করার জন্য বড় আকারের বৃত্ত রচনা করে পরস্পরের দিকে ধেয়ে এলো। এবারে যখন তারা কাছাকাছি হলো সেলিম তার ঘোড়ার পিঠ থেকে প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাকে সহ মাটিতে আছড়ে পড়তে সক্ষম হলো। মাটির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় তাদের উভয়ের তলোয়ারই হাত থেকে ছুটে গেলো। সেলিমের জিহ্বায় কামড় পড়ায় সে মুখের মধ্যে রক্তের স্বাদ পেলো।

    যাইহোক, তারা উভয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালো এবং পরস্পরকে জাপটে ধরে কুস্তি লড়তে লাগলো। তারা যখন আগুপিছু করছে তখন অচেনা শত্রুটি তার কোমর বন্ধনী থেকে একটি ছোট ছোরা বের করতে চেষ্টা করলো। সেই মুহূর্তে সেলিম তার মাথা দিয়ে লোকটির মুখের উপর তীব্র গুঁতো দিলো। লোকটির নাকটি মট করে ভেঙে গেলো এবং সে টলমল পায়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। লোকটি তখনো বিমূঢ় অবস্থায় রয়েছে, সেলিম তার ছোরা ধরা হাতটি ধরে মোচর দিলো এবং ছোরাটি তার হাত থেকে পড়ে গেলো। তারপর তার রক্তাক্ত মুখে সজোরে দুটি ঘুষি মারলো। এর ফলে তার ঠোঁট ফেটে দুভাগ হয়ে গেলো এবং একটি দাঁত ভেঙে গেলো। এবারে সেলিম তার উরু এবং পেটের সংযোগ স্থলে সবুট লাথি হাকালো। তীব্র লাথি খেয়ে যেই সে ভাজ হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকলো সেলিম তার দুই মুষ্টি একত্রিত করে তার ঘাড়ের উপর আঘাত করলো ফলে সে মাটিতে আছড়ে পড়লো। আশে পাশে নজর বুলিয়ে সেলিম দ্রুত তার পারসিক তলোয়ারটি খুঁজে পেলো এবং সেটি তার যন্ত্রণাকাতর প্রতিপক্ষের গলায় ঠেকিয়ে ধরলো। ইতোমধ্যেই অধিকাংশ শত্রু যোদ্ধা হয় ধরাশায়ী হয়েছে নয়তো আত্মসমর্পণ করেছে। সেলিম তার প্রতিপক্ষের রক্তাক্ত মুখ পর্যবেক্ষণ করে এতোটুকু বুঝতে পারলো যে সে একজন তরুণ। তুমি কে এবং কেনো তুমি আমার শিবির আক্রমণ করেছো?

    আমার নাম হাসান, আমি গালদিদ এর রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র, তরুণটি উত্তর দিলো, সেই সঙ্গে থুতুর সঙ্গে মুখের ভেতর থেকে ভাঙা দাঁতের ভগ্নাংশ বের করলো। আমি তোমার শিবির আক্রমণ করেছি কারণ আমি অনুমান করেছিলাম নিশ্চিত ভাবেই তোমার শিবিরে কোনো উচ্চপদস্থ মোগল রয়েছে এবং তাকে জিম্মি করা আমার উদ্দেশ্য ছিলো।

    কেনো?

    তার বিনিময়ে আমার বাবাকে মুক্ত করার জন্য যে মুরজাদ এর দূর্গে মোগলদের হাতে বন্দী রয়েছে।

    তার অপরাধ কি?।

    তার অপরাধ তিনি সিকান্দার শাহ্ এর প্রতি অনুগত যিনি হিন্দুস্তানের সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী ছিলেন। মোগলদের হাতে সিকান্দার শাহ্ এর মৃত্যুর পর আমার পিতা মোগল শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানান… নিজের রক্তাক্ত নাক মুখ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছার জন্য হাসান একটু থামলো তারপর আবার বলা শুরু করলো, তিনি পাহাড়ী অঞ্চলে পালিয়ে যান এবং যাযাবর জীবন যাপন শুরু করেন। কয়েক দশক ধরে তিনি এভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হোন। কিন্তু ছয় সপ্তাহ আগে তিনি এই অঞ্চলের একজন মোগল সেনাপতির পরিকল্পিত ফাঁদে আটকা পড়ে বন্দী হোন।

    তুমি নিজে বুঝতে পারোনি যে তোমার বাবার এই বিরোধীতা অর্থহীন?

    আমি বুঝেছি এবং তাকে এ কথা বলেওছি, কিন্তু তিনি তো আমার বাবা। তিনি যতো বড় ভুলই করুন না কেনো আমি আমার জন্মের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকা আমার নৈতিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব বোধের কারণেই তাকে উদ্ধার করার জন্য আমি সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়েছি।

    ছেলেটি সত্যি কথাই বলছে জাঁহাপনা, জাহেদ বাট বললো, সে একটু আগে সেলিমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এই অঞ্চলে আমার অনেক আত্মীয় স্বজন রয়েছে এবং ছেলেটির পরিবার এই এলাকায় সুপরিচিত।

    জাহাপনা?

    হাসানের চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠলো। আপনি কে?

    তোমার ভীষণ অবাক লাগছে তাই না? আমি সেলিম, সম্রাট আকবরের জ্যেষ্ঠ পুত্র।

    কথাগুলি শোনা মাত্র হাসানের মধ্যে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে সে দশ ফুট দূরে পড়ে থাকা তার ছোরাটি হস্তগত করতে চাইলো। কিন্তু অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করার আগেই, সেলিম তার ধারালো পারসিক তলোয়ারটির অগ্রভাগ হাসানের পাঁজরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হাসান, একজন অনুগত সন্তান, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো। অথচ পিতার প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শনের জন্য সে নিজে নির্বাসনের পথে যাত্রা করেছে, সেলিম মনে মনে ভাবলো।

    *

    তুষারপাত হচ্ছে। যদিও এটা অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে, কাবুলের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের গিরিপথ অঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা আগেই শীতকাল শুরু হয়ে গেছে। শীঘ্রই তুষারের কারণে হিন্দুস্তানে ফেরত যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়বে, সেলিম ভাবলো, যদিও ইতোমধ্যে তার পিতার তার প্রতি সদয় হওয়ার কোনো কারণ নেই। ইন্দুজ নদীর তীরে লড়াই এর সময় আহত এক আফগানী সৈন্য গতকাল সন্ধ্যায় তার ভেঙে যাওয়া বাম পায়ে হিম-দংশনের শিকার হয়েছে। লোকটির বাড়ি কাবুলে এবং সে বোকার মতো পেশওয়ারে আরোগ্য লাভের জন্য না থেকে নিজের জন্মস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি আরম্ভ করে। যাইহোক, সে হেকিমকে অনুরোধ করে পুরোনো আফগান পদ্ধতিতে তার হিম-দংশিত পায়ে পশুর উষ্ণ বিষ্ঠা লেপন করে পট্টি বেধে দেয়ার জন্য। সেলিম এবং হেকিমকে অবাক করে দিয়ে পদ্ধতিটি ভালোই কাজ করছে। কয়েক ঘন্টা পরে দেখা গেলো পায়ের শ্বেত ভাব অনেকটা কমে গিয়ে ক্ষতের স্বাভাবিক রঙ ফিরে আসছে।

    সেলিমের পান্না-সবুজ মুখাবরণ সরে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তুষার মিশ্রিত বাতাসের ঝাপটা লাগলো। গায়ে পুরু ভেড়ার চামড়ার জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও সে দেহের অভ্যন্তরে তীব্র কাপুনি অনুভব করলো। সুলায়মান বেগের বনেদি কায়দার গোঁফের নিচে ঠোঁট দুটিকে নীলচে দেখাচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সে গোফ রাখা শুরু করেছে এবং সেগুলির জন্য সে ভীষণ গর্বও বোধ করে। বর্তমানে ভারী তুষারপাত হচ্ছে এবং সেগুলি তাদের চারপাশে ঢিবির মতো জমে উঠছে। বরফ আবৃত মাটিতে সামনের পা দুটি পিছলে গিয়ে সেলিমের ধূসর ঘোড়াটির মাথা নিচু হয়ে গেলো এবং সে নিজে পিঠ থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। জিনের পিছনের দিকে কাত হয়ে সে জোরে লাগাম টেনে ধরলো এবং ক্লান্ত জানোয়ারটি নিজেকে সামলে নিল। ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে থেকে যে শব্দ ভেসে এলো সেলিমের কাছে তাকে মনে হলো ঘোড়ার খুরের পদাঘাতের শব্দ।

    সকলে থামো। আমি কিছু শুনেছি। জাহেদ বাট, কিছু লোক নিয়ে সম্মুখে এগিয়ে গিয়ে তদন্ত করে আসুন, সেলিম চিৎকার করে রক্ষীদের অধিনায়ককে আদেশ দিলো। বাকিদের মালপত্রের গাড়ি গুলির চারপাশে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে আদেশ দিন।

    কারা হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? সুলায়মান বেগ জিজ্ঞাসা করলো।

    সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই, কিন্তু আমাদের ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না।

    জাহেদ বাট যখন অর্ধবল্পিত গতিতে ঘোড়া নিয়ে তুষারের পর্দার আড়ালে হরিয়ে গেলো, সেলিম ভ্রুকুটি করলো। আইনকানুন বর্জিত বহু চোর ডাকাতে এই গিরিপথ গুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তারাও বর্তমানে সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়া পাঁচশো উত্তমভাবে সশস্ত্র যোদ্ধা সম্বলিত মোগল বাহিনীকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করবে। পেশোয়ারের আশে পাশে অবস্থিত গোত্রগুলি থেকে এই অতিরিক্ত যোদ্ধাদের নিয়োগ করা হয়েছে। লড়াই করাই এই গোত্রগুলির সদস্যদের প্রধান পেশা। তারা সকলে বিশেষ ভাবে ঠাণ্ডা সহ্য করার সামর্থ সম্পন্ন ভাবে জন্ম দেয়া লোমশ টাট্ট ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আছে। বর্শার পাশাপাশি তাঁদের ঘোড়ার জিনের পাশে চামড়ার খাপে ভরা রয়েছে লম্বা নল বিশিষ্ট গাদাবন্দুক। সেলিম তার নিজের অস্ত্রগুলি পরখ করে নিলো। তার কোমরের খাপে রয়েছে পারসিক তলোয়ারটি। এছাড়াও কোমর বন্ধনীতে আরো গোজা রয়েছে একটি সাধারণ ছোরা এবং একটি ছুঁড়ে মারার ছোরা। তার জিনের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে দুই দিকে ফলা বিশিষ্ট যুদ্ধকুঠার। একজন কোৰ্চি(ব্যক্তিগত সেবক) সেলিমের গাদাবন্দুক এবং তীর-ধনুক বহর করছে। তবে বর্তমানের দৃষ্টিশক্তি রুদ্ধ করে দেয়া তুষারপাতের মাঝে বন্দুক বা তীর কোনোটাই তেমন কাজে আসবে না কারণ ঝাপসা দৃশ্যপটে দূরবর্তী লক্ষ্য স্থির করাই কঠিন।

    বায়ুপ্রবাহ আরো তীব্রতর হয়ে উঠছে, প্রচণ্ড শো শো শব্দে তা সরু গিরিপথ বেয়ে তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছে। শীতে কম্পমান সেলিমের ঘোড়াটি অস্বস্তিতে হ্রেষাধ্বনি তুলছে এবং সেটা মাথা নিচু করে সুলায়মান বেগের ঘোড়াটির গায়ের সঙ্গে ঘেঁষতে চাইলো। সেলিম জোরে লাগাম টেনে ধরলো। সামনে যদি কোনো বিপদ থেকে থাকে সেটা মোকাবেলা করার জন্য আগেই প্রস্তুত থাকতে হবে- ইন্দুজ নদীর তীরেও তার প্রস্তুত থাকা উচিত ছিলো….উৎকণ্ঠিত সময় বয়ে চলেছে এবং সেলিম তীক্ষ্মদৃষ্টিতে শ্বেত তুষার আবরণের দিকে তাকিয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। তারপর বায়ুপ্রবাহের উচ্চ শব্দের মাঝে তার মনে হলো সে হালকা ভাবে তিনবার সংক্ষিপ্ত শিঙ্গা ধ্বনি শুনতে পেলো- সব কিছু ঠিক আছে এই মর্মের ইঙ্গিত হিসেবে তা আগেই নির্ধারণ করা ছিলো। দুই এক মিনিট পরে আরো কাছে এবং স্পষ্টভাবে সে একই রকম শিঙ্গা ধ্বনি শুনতে পেলো এবং একটু পরে তার সৈন্যরা তুষারের পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। তারা আরো কাছে এগিয়ে আসার পর সেলিম দেখতে পেলো আরো একডজন নতুন সদস্য তার লোকদের কাছ থেকে অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছে।

    জাহাপনা। জাহেদ বাট সেলিমের দিকে এগিয়ে এলো। দাড়ি সহ তার সমস্ত অবয়ব তুষারাচ্ছন্ন। কাবুলের প্রশাসক সাইফ খান, একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন আপনাকে যাত্রাপথের বাকি অংশের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

    সেলিমের এতোক্ষণ টানটান হয়ে থাকা কাঁধ দুটি শিথিল হয়ে এলো। তার দীর্ঘ নির্বাসন যাত্রা শীঘ্রই সমাপ্ত হতে যাচ্ছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএম্পায়ার অভ দা মোগল : দি টেনটেড থ্রোন – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }