Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প613 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৫.৩ কাবুলের কোষাধ্যক্ষ

    ২৫. কাবুলের কোষাধ্যক্ষ

    নগর রক্ষাকারী দুর্গের বিশাল দেয়ালটি-যা বেশিরভাগ জায়গায় কমপক্ষে দশ ফুট পুরু-শীতকালীন ঝড়ঝঞ্ঝার বিরুদ্ধে কাবুল শহরটির জন্য উত্তম প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করছে। দুই দিন আগে সেলিমের কাবুলে পৌঁছানোর পর থেকে ঝড়ো আবহাওয়ার খুব একটা উন্নতি হয়নি। সেলিম যে বড় আকারের দরবার হলটিতে বর্তমানে রয়েছে সেটার মধ্যস্থলে অবস্থিত অগ্নিকুণ্ডে খঞ্জক কাঠ পোড়ার ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে এবং থেকে থেকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠছে। আগুনের তাপ থাকা সত্ত্বেও সেলিম হাড় পর্যন্ত শীতল কম্পন অনুভব করছে। সে আগুনের আরেকটু কাছে গিয়ে নিজের হাত দুটি গরম করতে করতে সাইফ খানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো, যে একটু আগে তার পরিচারকদের নির্দেশনা প্রদান করতে গেছে।

    পরিচারকরা যখন অগ্নিকুণ্ডটির মধ্যে আরো কাঠ দিলো, সেলিম পাশ ফিরে লম্বা কক্ষটির শেষ প্রান্তের নিচু মঞ্চের উপর অবস্থিত সিংহাসনটির দিকে তাকাল। সেটার লাল মখমলের গদিটি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এবং সোনা মোড়ানো পায়া গুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। লাহোর বা ফতেহপুর শিক্রির রাজপ্রাসাদ গুলিতে এমন মলিন সিংহাসন থাকার কথা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু সেলিম সিংহাসনটির দিকে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। এই সিংহাসনটিতেই তার প্রপিতামহ, ভবিষ্যত মোগল সাম্রাজ্যের মূল জনক বাবর কাবুলের রাজা হিসেবে আসন গ্রহণ করতেন এবং রাজ্য পরিচালনা করতেন। সম্ভবত এই আসনটিতে বসেই তিনি তাঁর হিন্দুস্তান অভিযানের সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন। কক্ষের অমসৃণ পাথুরে দেয়ালের উঁচুতে অবস্থিত ধারকগুলিতে স্থাপিত মশালের কম্পিত আলোতে সেলিম তার কল্পনার দৃশ্যপটে যেনো বাবরকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো তিনি গর্বিত ভঙ্গীতে কোমর বন্ধনীতে যুক্ত আলমগীর সহ সিংহাসনে বসে আছেন। যেভাবে বাবর এতো দূরে অবস্থিত কাবুল থেকে নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার জন্য হিন্দুস্তান অভিযানে অগ্রসর হয়েছিলেন ঠিক অনুরূপভাবে তার প্রপৌত্রের পক্ষেও কি শেখ সেলিম চিশতির ভবিষ্যতবাণী বাস্তবায়ন করার জন্য একই রকম অভিযান করা সম্ভব নয়? সেলিম নিজেকে সান্ত্বনা দিলো। তুষারপাত কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী এলাকার বাগানে অবস্থিত বাবরের সমাধি দর্শন করবে…।

    বাবর যে কঠিন রুক্ষ পরিবেশে থেকে হিন্দুস্তান জয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন তার তুলনায় বাহারী অংকরণ এবং বিলাসিতায় পরিপূর্ণ হিন্দুস্ত নের মোগল রাজপ্রাসাদ গুলির বালুপাথরের কারুকাজ, সুগন্ধী জলের ফোয়ারা এবং জাকজমকপূর্ণ উৎসব আয়োজনের বৈপরীত্য দুই স্থানের বিশাল দূরত্বের চেয়েও বেশি কিছুর জন্য পৃথক। অবশ্য কাবুলের দুর্গপ্রাসাদটি শহর থেকে অনেক উপরে একটি শৈলান্তরীপের উপর নির্মাণ করা হয়েছিলো রুচিবানদের প্রশংসা অর্জনের জন্য নয়। এটি নির্মাণ করা হয়েছিলো এই অঞ্চলের বেপরোয়া গোত্র গুলির মাঝে ত্রাস সৃষ্টির জন্য এবং এই এলাকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বাণিজ্য পথ গুলি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। বড় বড় বাণিজ্য কাফেলা যার মাধ্যমে সারা বছর ধরে মণিমাণিক্য থেকে শুরু করে চিনি, বস্ত্র, মসলা সহ আরো বহু কিছু পরিবাহিত হয় সেগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের উপরই কাবুলের উপার্জন নির্ভরশীল এবং এজন্য সেগুলির নিরাপত্তা বিধান করাও কাবুলের প্রশাসকের দায়িত্ব। এমনকি বর্তমানে কাবুল থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব মোগল কোষাগারের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। মাফ করবেন জাহাপনা, আপনাকে একা রেখে যাওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। সাইফ খান তার জেল্লাদার শিয়ালের চামড়ার আস্তরণ বিশিষ্ট আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় পুনরায় আবির্ভূত হলো। সে একজন মজবুত গড়নের সদয় চেহারার মধ্যবয়সী লোক, যদিও তার বাম গালে একটি সাদা বর্ণের লম্বা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে এবং তার বাম কানের স্থলে অসমতল গোলাপি মাংস ব্যতীত আর কিছু নেই। এসব ক্ষত দেখে অনুমান করা যায় সে একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, তবে সেলিম জানতো না সে বহু বছর ধরে মোগল সম্রাটের পক্ষে সীমান্তবর্তী এলাকায় কৃতিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়েছে এবং এর পুরস্কার স্বরূপ আকবর তাকে কাবুলের প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার অন্যান্য সভাসদদের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।

    নিশ্চয়ই।

    সাইফ খান ফিসফিস করে তার পরিচারককে কিছু বললেন এবং সে দরবারে প্রবেশের দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটি খুললো। তারপর ছয়জন মন্ত্রীকে পথ দেখিয়ে কাছে নিয়ে এলো। প্রশাসক একে একে সকলকে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন-ইনি আমার অশ্বসংগ্রাহক, ইনি রসদ সংগ্রাহক, ইনি সেনাপতি… প্রত্যেকে সেলিমকে কুর্ণিশ করতে লাগলো, সেলিম কেবল ভদ্রতা বশত তাদের পর্যবেক্ষণ করলো। কিন্তু এরপর সাইফ খান এমন একজনের নাম উচ্চারণ করলো যার প্রতি সেলিম বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তাকালো। ইনি গিয়াস বেগ, কাবুলের কোষাধ্যক্ষ। গিয়াস বেগ…নামটি আগে যেনো কোথায় সে শুনেছে? সেলিম কুর্ণিশরত লম্বা আড়ষ্ট লোকটিকে ভালো মতো লক্ষ্য করলো। লোকটি যখন আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো সেলিম তার সূক্ষ্ম চোয়াল বিশিষ্ট মুখটি চিনতে পারলো- সর্বশেষ তাকে যখন দেখেছে সে তুলনায় তার মুখটি অনেক কম অনাহারগ্রস্ত মনে হলো কিন্তু এখনোও সে রোগাই আছে। সেলিমের কল্পনার দৃষ্টিতে সময় পিছিয়ে গেলো। সে সেই বালকটিতে পরিণত হলো, যে ফতেহপুর শিক্রির দরবার কক্ষে আকবরের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা গিয়াস বেগের বক্তব্য শ্রবণ করছে।

    আমার মনে আছে সেই ঘটনাটির কথা যখন আপনি ফতেহপুর শিক্রিতে এসেছিলেন, গিয়াস বেগ।

    জেনে আমি সম্মানিত বোধ করছি জাহাপনা।

    আপনার পরিবার কেমন আছে?

    তারা সকলে সুস্থ সবল রয়েছে জাঁহাপনা। কাবুলের পাহাড়ী আবহাওয়া তাদের জন্য সহায়ক হয়েছে।

    আর আপনার কন্যাটি? সেলিম মেয়েটির নামটি স্মরণ করার জন্য যুদ্ধ করতে লাগলো। মেহেরুন্নেসা, এটাই ওর নাম তাই না?

    জ্বী, জাঁহাপনা। মেহেরুন্নেসা, নারীদের মধ্যস্থিত সূর্য। সেও ভালো আছে।

    স্পষ্টতই আপনি এখানে ভালোই গুছিয়ে নিয়েছেন। আমার পিতা আপনাকে কাবুলে পাঠিয়েছিলেন একজন সহকারী হিসাবরক্ষক হিসেবে কিন্তু বর্তমানে আপনি একজন পূর্ণ কোষাধ্যক্ষ, সেলিম বললো, এবং একটু ইতস্তত করে আবার শুরু করলো: বাবা আমাকে কাবুলে পাঠিয়েছেন এর শাসন ব্যবস্থা পরিদর্শন করার জন্য এবং এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে এখান থেকে অর্জিত রাজস্ব রাজকীয় কোষাগারে ঠিক মতো পাঠানো হচ্ছে কি না।

    আমি আমার জীবন বাজি রেখে বলতে পারি একটি মুদ্রাও অপচয় হচ্ছে না।

    শুনে খুশি হলাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি আপনার হিসাব বহি গুলি পর্যকেক্ষণ করতে চাই।

    নিশ্চয়ই জাহাপনা। আমি হিসাব বহিগুলি এখানে নিয়ে আসতে পারি, অথবা যদি আপনার মর্জি হয় তাহলে ঝড়ের প্রকোপ কমে আসার পর আপনি এই গরীবের গৃহ দর্শন করেও সেগুলি যাচাই করতে পারেন।

    ঠিক আছে, আমি যাবো।

    সেলিম এবং কাবুলের প্রশাসককে রেখে বাকিরা যখন প্রস্থান করলো, সেলিম কিছুক্ষণ অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইলো। গিয়াস বেগ সম্পর্কে তার মনে কিছুটা কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে, প্রথম বার তাকে ফতেহপুর শিক্রিতে দেখার সময় যেমনটা হয়েছিলো। যেমন সহজ ভাবে তার মুখ থেকে মসৃণ বাক্যগুলি বেরিয়ে আসছিলো তা যে কোনো সভাসদের জন্যেই মানানসই। তথাপি, সে যখন গিয়াস বেগকে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলো তখন তার চেহারা কেমন হয়েছিলো সেটা সেলিমের দৃষ্টি এড়ায়নি। পারসিকটিকে তার আত্মসম্মানবোধের ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন মনে হয়েছে।

    জীবনের বৈচিত্রময় ধরণ সম্পর্কে তার দাদী তাকে কিছু কথা বলেছিলেন এবং সেটা বিশেষভাবে গিয়াস বেগ সম্পর্কে, কথাগুলি সেলিমের মনে পড়লো। তিনি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন এই পারসিকটি একদিন হয়তো মোগল সাম্রাজ্যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কেমন ভূমিকা? ভালো না মন্দ? পাশে তাকিয়ে সেলিম দেখতে পেলো সাইফ খান তাকে এতোক্ষণ কৌতূহল নিয়ে লক্ষ্য করছিলো। সে কি ভাবছে? এই যে, সম্রাটের বিপথগামী পুত্র কাবুলে প্রেরিত হয়েছে তার অপকর্মের শাস্তিস্বরূপ? সাইফ খানের জানার কথা যে সেলিমের পরিদর্শকের ভূমিকা নেহায়েত একটি অজুহাত এবং তাকে রাজধানী ত্যাগ করতে হয়েছে অত্যন্ত লজ্জাজনক ভাবে। গুজব অত্যন্ত দ্রুত অগ্রসর হয়, এমন কি আবুল ফজল যদি তাকে এই বিষয়ে কোনো চিঠি নাও লিখে থাকে (তবে সেলিম নিশ্চিত যে আবুল ফজল সাইফ খানকে চিঠি লিখেছে), হয়তো এমন নির্দেশনাও প্রদান করেছে যে সেলিমের আচরণ সম্পর্কে তর। আবুল ফজলকে অবহিত করতে হবে। নিজের মনের বিভ্রান্তি গোপন করতে সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, আমাকে গিয়াস বেগ সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন। তিনি কি সত্যিই তেমন দক্ষ এবং সৎ কোষাধ্যক্ষ যেমনটা তিনি দাবি করেন?

    কাবুলে মহামান্য সম্রাটের তার তুলনায় উত্তম সেবক আর কেউ নেই। তিনি কাফেলা, শহর এবং গ্রামগুলি থেকে কর আদায়ের পদ্ধতির উন্নতি সাধন করেছেন। গত পাঁচ বছর ধরে আমি কবুলের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এ সময়ের মধ্যে তিনি রাজস্ব আয় অর্ধেকের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি করেছেন।

    বহু বছর আগে আকবরের সামনে বক্তব্য প্রদানের সময় গিয়াস বেগ যতোটা নির্ভেজাল ছিলো আজো হয়তো তেমনই রয়েছে, সেলিম ভাবলো। সে আরো উপলব্ধি করলো সাইফ খান তার আচরণ সম্পর্কে কোনো বিবরণী আবুল ফজলকে পাঠালো কিনা অথবা সে সাইফ খান সম্পর্কে কোনো প্রতিবেদন তৈরি করলো কি না এ সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা অর্থহীন। তাকে একজন বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন পরিদর্শকের মতো কাবুলের রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে পিতার প্রতিনিধি হিসেবে। কেবলমাত্র এ কাজে সফল হলেই তার পক্ষে পুনরায় আকবরের নেকদৃষ্টি লাভের সম্ভাবনা রয়েছে।

    *

    তুষারপাত বন্ধ হয়েছে এবং দূর্গপ্রাচীরের উপর জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। সম্মুখে অগ্রদূত ঘোরসওয়ার এবং পিছনে জাহেদ বাট ও অন্যান্য দেহরক্ষীদের নিয়ে সেলিম ঘোড়ার পিঠে আসিন হয়ে দূর্গপরিখার উপর পাতা কাঠের ঢালু পাটাতন দিয়ে নেমে এলো। নিচের শহরে অবস্থিত গিয়াস বেগের বাড়িতে যাওয়ার জন্য সে সুলায়মান বেগকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। কিন্তু তার দুধভাই হাসতে হাসতে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে হিসাবনিকাষের ক্ষেত্রে তার তেমন মাথা নেই। ঠাণ্ডা বাতাসের ধাক্কায় শীতের ফ্যাকাশে নীল আকাশে ছোট ছোট তুলট মেঘ উড়ে চলেছে যখন সেলিম শহর প্রাচীরের সম্মুখে উপস্থিত হলো। প্রাচীরের ভেতরে অবস্থিত সরাইখানা গুলি থেকে রান্নার ধোয়া উঠছে যেখানে মুষ্টিমেয় কষ্টসহিষ্ণু ভ্রমণকারী যাত্রাবিরতি করছে। কিন্তু যখন শীতকাল শেষ হবে এবং সবগুলি গিরিপথ চলাচলের উপযুক্ত হবে তখন কাবুল লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠবে। তখন রাস্তা দিয়ে হাটলে কেউ হয়তো বিশ বা ত্রিশ ধরনের ভাষা শুনতে পাবে। সাইফ খান সেলিমকে এমনটাই বলেছে। সাইফ খান সেলিমের সঙ্গী হওয়ার জন্যে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো। অবশ্য কাবুলে এসে সেলিম যেখানেই যেতে চেয়েছে সেখানেই সে তার সঙ্গে যেতে চেয়েছে। কিন্তু সেলিম সাইফ খানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠে। সে কি তার উপর নজরদারী করার চেষ্টা করছে? সে যাই হোক, সেলিম প্রদেশিক প্রশাসকের ক্লান্তিকর সঙ্গ, একই গল্পের পুনরাবৃত্তি এবং স্থূল কৌতুকের বিষয়ে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলো। সে তাই সিদ্ধান্ত নেয় গিয়াস বেগের সঙ্গে দেখা করার সময় তাকে সঙ্গে নেবে না।

    গিয়াস বেগের বাড়িটি বড় আকারের একটি দোতলা ভবন যা গাছে ঢাকা একটি চত্বরের একপাশ জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। কোষাধ্যক্ষ, সবুজ রেশমের পাগড়ি পড়ে এবং দুপাশে সারিবদ্ধ পরিচারক নিয়ে বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছিলো সেলিমকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। সেলিম দেখতে পেলো যেখানে সে ঘোড়া থেকে নামবে সেখান থেকে শুরু করে বাড়ির চেস্টনাট(এক ধরনের বাদাম গাছের কাঠ) কাঠের পালিশ করা সিঁড়ি পর্যন্ত বরফ গলা ভূমির উপর লম্বা বেগুনি রঙের মখমল বিছানো হয়েছে।

    জাহাপনা, আমার গৃহে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। গিয়াস বেগ একজন সহিসকে হাতের ইশারায় সরিয়ে দিয়ে নিজেই সেলিমের ঘোড়ার রেকাবটি শক্ত করে ধরলো যখন সে নামলো। দয়া করে আমার সঙ্গে আসুন।

    সেলিম তার দেহরক্ষী এবং অন্য সৈন্যদের ইশারায় বাইরে থাকতে বলে গিয়াস বেগকে অনুসরণ করলো এবং বাড়ির প্রবেশ দ্বারের ভেতরে অবস্থিত উঠান পেরিয়ে একটি বড় আকারের বিলাসবহুল আসবাবপত্রে সজ্জিত কক্ষে উপস্থিত হলো। কক্ষের মধ্যে দুটি ধাতব ঝুড়ির মধ্যে কয়লা ধিক ধিক করে জ্বলে কক্ষটিকে উষ্ণ রেখেছে। কক্ষের দেয়াল গুলিতে ঘিয়া রঙের বাহারী কারুকাজ করা পর্দ ঝুলছে এবং দেয়ালের কাছাকাছি জায়গায় নীলা বর্ণের মখমলের বালিস ও কোলবালিস পরিপাটি করে সাজান। মেঝেতে বিছান সমৃদ্ধ বর্ণে বর্ণিল শতরঞ্জি যথেষ্ট পুরু এবং নমনীয়, এগুলো কাবুল দূর্গের তুলনায় নিঃসন্দেহে উন্নত এবং ব্যয়বহুল-বাস্তবে লাহোরের প্রসাদ ছাড়ার পর থেকে এর থেকে উত্তম কিছু সেলিম দেখেনি।

    আপনি অত্যন্ত সৌখিন জীবনযাপন করেন, সেলিম মন্তব্য করলো। গিয়াস বেগের বাড়ির চমৎকারিত্ব আবারো তার মনে সন্দেহ প্রজ্জ্বলিত করেছে। সাইফ খানের ভাষ্য অনুযায়ী সে যদি শ্রেষ্ঠ কর আদায়কারী হয়ও, সে কি কিছু মাখন তার নিজের জন্যেও সরিয়ে রাখছে?

    আমার গৃহ আপনার পছন্দ হয়েছে জেনে আমি আনন্দিত। পারস্যে আমার বাড়ি যেমন ছিলো তেমনি ভাবেই আমি সবকিছু সাজানোর চেষ্টা করেছি। নানা গড়নের কারুকাজ এবং নকশা করা টালী সহ অনেক কিছু আমদানী করেছি। বহু বাণিজ্য কাফেলা কবুলের উপর দিয়ে চলাচল করে, তাদের কাছে একজন মানুষ যে কোনো ভোগ্যপণ্য পেতে পারে। দয়া করে সামান্য জলখাবার গ্রহণ করুন। কাবুলে যে আঙ্গুর জন্মায় তা থেকে উত্তম মানের সুরা প্রস্তুত হয়- একেবারে গজনীল বিখ্যাত সুরার অনুরূপ। অথবা আপনি গোলাপের নির্যাস দিয়ে তৈরি শরবতও পান করতে পারেন। আমার স্ত্রী তার নিজের বাগানে উৎপাদিত গোলাপ থেকে এই শরবত তৈরি করে।

    শরবতই দিন।

    একজন পরিচারক সেলিমের সামনে রূপার পানি ভর্তি বাটি ধরলো হাত ধোয়ার জন্য এবং তারপর তাকে একটি সুগন্ধযুক্ত তোয়ালে দিলো হাত মোছার জন্য। অন্য আরেক জন পরিচারক একটি রূপার পান পাত্রে শরবত ঢেলে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। সেলিম পাত্রটি নিয়ে শরবতে চুমুক দিলো। গিয়াস বেগ ঠিকই বলেছে। শরবতের স্বাদ ও গন্ধ একদম গোলাপ ফুলের মতোই।

    আমি হিসাব বহি গুলি আপনার পর্যবেক্ষণের জন্য প্রস্তুত রেখেছি জাহাপনা। আপনি কোনো হিসাব আগে দেখতে চান? কাফেলা কর নাকি গ্রামীণ রাজস্ব?

    একটু পরে হিসাব দেখবো, সেলিম বললো, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আলাপচারিতার মাধ্যমে গিয়াস বেগের ভেতর থেকে কোনো বোস তথ্য বের করে আনার। প্রথমে এখানে আপনার জীবনযাপন ধরণ সম্পর্কে কিছু বলুন। এ বিষয়ে আমি জানতে আগ্রহী।

    কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে জাহাপনা?

    আপনি একজন শিক্ষিত এবং সংস্কৃতিবান লোক। আপনি কাবুলের মতো জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিলেন কীভাবে? এখানকার বিবাদমান গোত্রগুলি, তাঁদের আমরণ ঝগড়া লড়াই এবং লোভী সওদাগরদের মাঝে আপনি কীভাবে পরিতৃপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন?

    একজন মানুষ তার মনকে স্থির করতে পারলে যে কোনো ক্ষেত্রেই পরিতৃপ্তি লাভ করতে পারে। এবং স্মরণ করুন জাঁহাপনা, এমন দুর্গম অঞ্চলে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমার কৃতজ্ঞ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যখন আপনার পিতা আমাকে সপরিবারে এখানে পাঠালেন তখন তিনি আমাকে চরম দারিদ্র থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং ভালোভাবে বেঁচে থাকার আশা প্রদান করেছিলেন। এই অঞ্চলটি ইসফাহান বা লাহোরের মতো নয়, কিন্তু আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি, আমার দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করার চেষ্টা করেছি এবং তার পরিণতিতে আমার জীবনে সমৃদ্ধি এসেছে। মহামান্য সম্রাট তার সেবকদের উত্তম পারিশ্রমিক প্রদান করেন। ইতোমধ্যে আমি যতো সম্পদ অর্জন করেছি তার সাহায্যে আমি অনায়াসে পারস্যে ফিরে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারি। কিন্তু আমি আপনার পিতার একজন বিশ্বস্ত ভৃত্য এবং আমি এখানেই থাকতে চাই যতোদিন পর্যন্ত আমর পক্ষে তাকে উত্তম সেবা প্রদান করা সম্ভব। হয়তো একদিন তিনি আমার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে আমাকে দিল্লী বা আগ্রার মতো সমৃদ্ধ কোনো নগরীতে নিয়োগ প্রদান করবেন।

    গিয়াস বেগের চিন্তা ভাবনা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত, সেলিম ভাবলো। কিন্তু যদি তিনি আপনাকে সেরকম কোনো নিয়োগ না দেন? সেলিম জিজ্ঞাসা করলো।

    আমি আমার বর্তমান পদ নিয়ে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত রয়েছি জাঁহাপনা। যখন কোনো মানুষ দেখতে পায় মৃত্যু তাকে এবং তার পরিবারকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে এবং এর থেকে পরিত্রাণ পায় তখন সে তার যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা অনুভব করে এবং যা সে অর্জন করতে পারবে না তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে না। এটা আমাদের সকলের জন্যই একটি উত্তম শিক্ষণীয় বিষয় জাঁহাপনা, আমাদের জীবনের গন্তব্য যাই হোক না কেনো।

    সেলিম সামান্য চমকে উঠলো। গিয়াস বেগ কি তার অবস্থা সম্পর্কে পরোক্ষ ইঙ্গিত প্রদান করলো? অবশ্য সে অত্যন্ত সম্মানের সাথে কথা গুলি বলেছে। যাই হোক, সে নিজে এতো ধৈর্যশীল এবং দার্শনিক হতে পারবে না। যখনই কোনো রাজকীয় বার্তাবাহক কাবুল দুর্গের প্রবেশ দ্বার অতিক্রম করেছে, তার মনে হয়েছে এই হয়তো তার পিতা তাকে রাজধানীতে ডেকে পাঠিয়ে বার্তা প্রেরণ করেছেন, কিন্তু অদ্যাবধি আকবর তাকে একটি বাক্যও প্রেরণ করেননি। বরং তার কাছে যে প্রশাসনিক চিঠি গুলি এসেছে তার সবগুলিই আবুল ফজলের লেখা এবং যথারীতি সেগুলি নানা অপ্রাসংঙ্গিক প্রশ্নে জর্জরিত, যেমন কাবুলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বর্তমানে কেমন বা কান্দাহারে যাওয়ার রাস্তাটির বর্তমান অবস্থা কি, ইত্যাদি।

    দয়া করে এখান থেকে একটি মিষ্টান্ন চেখে দেখুন। অতিথিদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা পারস্যের রেওয়াজ। আমার স্ত্রী নিজ হাতে এগুলো কাঠবাদাম ও মধু দিয়ে তৈরি করেছে।

    আপনার স্ত্রী কি একটাই?

    সে আমার দেহের একটি অঙ্গের মতো। ওকে ছাড়া আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই।

    আপনি একজন সৌভাগ্যবান পুরুষ। খুব কম মানুষই এমন কথা বলতে পারে, সেলিম বললো, গিয়াস বেগের বক্তব্য তাকে তার দাদা এবং দাদীর সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিলো। আপনার স্ত্রীর পারস্যে ফিরে যাওয়ার জন্য মন খারাপ হয় না?

    আমাদের বর্তমান অবস্থানে সে আমার মতোই পরিতৃপ্ত, আল্লাহ আমাদের যথেষ্ট আশীর্বাদ প্রদান করেছেন।

    সেলিম কোষাধ্যক্ষের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার আত্মমর্যাদা বোধ এবং সহিষ্ণুতা তাকে অভিভূত করেছে। সে মনে মনে ভাবলো তার যে কোনো স্ত্রীর সঙ্গে তার বন্ধন এরকম বলিষ্ঠ হলে ভালো হতো। কিন্তু এ সময় তার মনে পড়লো সে এখানে এসেছে গিয়াস বেগের কাছ থেকে রাজস্বের হিসাব নিকাষ সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য, তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার জন্য নয়। আপনার হিসাব বহি গুলি নিয়ে আসুন গিয়াস বেগ এবং সেগুলি আমার কাছে ব্যাখ্যা করুন। সাইফ খান আমাকে বলেছে আপনি কর আদায় পদ্ধতিতে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছেন…

    *

    রাতের উষ্ণ বাতাস ঘুঁটেপোড়া, মসলা এবং রুটি সেঁকার তীব্র ঘ্রাণে পূর্ণ হয়ে রয়েছে। কাবুলের নাগরিকরা তাদের সান্ধ্যভোজের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বাড়ির সমতল ছাদ গুলিতে। সেলিম শহরের রাস্তা দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে অগ্রসর হচ্ছে। সদ্য আরম্ভ হওয়া বসন্তের বিগত সপ্তাহ। গুলিতে সে এতো বার গিয়াস বেগের বাড়িতে যাওয়া আসা করেছে যে তার ধূসর রঙের স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটি এখন হয়তো চোখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে পৌঁছাতে পারবে। তুমি ঐ বুড়োটির সঙ্গে কি এতো আলাপ করো? তুমি তার সঙ্গে এতো সময় কাটাও যা আমি আমার নিজের বাবার সঙ্গে কখনো কাটাইনি, সুলায়মান বেগ সেই দিন আরো আগে এমন মন্তব্য করেছিলো, যেমনটা সে আগেও কয়েকবার করেছে। এ ঘটনা তাকে ভীষণ অবাক করেছে। যে সেলিম কাবুলের আশেপাশের জঙ্গলে বুনো গাধা শিকার বা পাহাড়ে বাজপাখি উড়ানোর বদলে গিয়াস বেগের সঙ্গই বেশি পছন্দ করছে।

    বিষয়টি সেলিম নিজেও ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারছে না। গিয়াস বেগের মাঝে সে একটি সংস্কৃতিবান, সভ্য ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। তিনি একজন বুদ্ধিমান এবং আধ্যাত্মিক গভীরতা সম্পন্ন মানুষ যে তার মতোই সীমাবদ্ধতা ও অপূর্ণতা অনুভব করে। কিন্তু সেলিমের মতো অতৃপ্তিবোধ তার মাঝে নেই। বর্তমানে সেলিমের গিয়াস বেগের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য তার দক্ষতা এবং সততা যাচাই এর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যেই কোষাধ্যক্ষ তার হিসাবের স্পষ্টতা এবং নির্ভুলতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। এবং এটাও পরিষ্কার ভাবে বোঝা গেছে যে তার বিলাস বহুল জীবন যাপন ব্যয় তার পদাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্ত বেতনেই মিটানো সম্ভব হচ্ছে। তাছাড়া তিনি ব্যক্তিগত টুকটাক ব্যবসা করেও ভালোই রোজগার করেন। সেলিম আরো আবিষ্কার করেছে তাদের দুজনের মধ্যে বয়সের ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও শিল্পকলা এবং প্রাকৃতিক অনেক বিষয়ে তাদের আগ্রহের মিল রয়েছে।

    আজকের রাতটি অবশ্য কিছুটা ভিন্ন তাৎপর্য বিশিষ্ট। আজ প্রথম বারের মতো গিয়াস বেগ তাকে দাওয়াত করেছে তার সঙ্গে সান্ধ্যভভাজে অংশ নেয়ার জন্য। সেলিম দূর থেকে কোষাধ্যক্ষের বাড়িটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো সেটি আলো ঝলমল করছে। লাল, সবুজ, নীল এবং হলুদ বর্ণের কাঁচের চিমনি যুক্ত লণ্ঠন বাড়িটির সম্মুখের বিভিন্ন গাছের ডাল থেকে ঝুলছে। বাড়িটির প্রবেশ পথের উভয় দিকে চারফুট উঁচু ঝাড়বাতিদান স্থাপন করা হয়েছে যাতে বহু সংখ্যক মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে। রত্নখচিত আগরবাতি দানে স্থাপিত সুগন্ধী রজন মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে।

    যথারীতি গিয়াস বেগ তাকে অভ্যর্থনা জানাতে বাইরে অপেক্ষা করছিলো। যে কোনো সময়ের তুলনায় আজ তার পোশাক পরিচ্ছদ আরো বেশি জাঁকজমকপূর্ণ।

    তার রেশমের আলখাল্লাটি ফুল এবং প্রজাপতির নকশা করা এবং তার কোমরে সোনার শিকলে বাঁধা রয়েছে হাতির দাঁতের হাতল বিশিষ্ট খঞ্জর যার খাপটি প্রবাল এবং টারকোয়াজ এর সমন্বয়ে তৈরি। তার মাথায় রয়েছে একটি লম্বা আকারের মখমলের টুপি। এমন টুপি সেলিম পারস্য থেকে আকবরের রাজসভায় আগত শাহ্ এর প্রতিনিধিদের মাথায় দেখেছে।

    স্বাগতম জাহাপনা। দয়া করে আমার সঙ্গে ভোজনের স্থানে চলুন। সেলিম গিয়াস বেগকে অনুসরণ করে উঠান পার হলো যার দেয়াল ঘিয়া রঙ এবং মৌভি ফুলের আদলে নকশা করা হয়েছে। সেখান থেকে একটি করিডোর হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের আরেকটি উঠানে উপস্থিত হলো। উঠানটি জুড়ে গালিচা বিছান হয়েছে। এক পাশের দেয়াল থেকে রেশমের শামিয়ানা টাঙানো হয়েছে এবং তার নিচে স্বল্প উচ্চতার ডিভানে একাধিক ছোট ছোট বালিশ সাজানো রয়েছে। সেলিম ডিভানটিতে আসন গ্রহণ করতেই গিয়াস বেগ হাত তালি দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একাধিক পরিচারক এগিয়ে এলো, তাঁদের একজন সেলিমের হাত ধোয়ার পানি নিয়ে এসেছে এবং অন্যরা ডিভানের সম্মুখের নিচু টেবিলটিতে দামেস্কের চাদর বিছিয়ে তার উপর গোলাপের শুকনো পাপড়ি ছড়িয়ে দিলো।

    আমি আমার জন্মস্থানের ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করিয়েছি। আশা করি আপনি সেগুলি উপভোগ করে তৃপ্ত হবেন, গিয়াস বেগ বললো।

    সেলিমের জীবনে যতো রকম খাবার আস্বাদন করেছে গিয়াস বেগের পরিবেশিত কিছু কিছু পারসিক খাবার তার তুলনায় অনেক বেশি সুস্বাদু মনে হলো তার কাছে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে বেদানার আখনিতে (সস) রান্না করা ফিজন্ট পাখির মাংস; খুবানি এবং পেস্তাবাদাম ঠাসা ভেড়ার রোস্ট; লম্বা সুগন্ধি জাফরান, ডালিমের উজ্জ্বল দানা, কিসমিস এবং বিভিন্ন সুস্বাদু বাদাম যুক্ত পোলাও; সেদ্ধ করা বেগুন এবং মটরসুটির ঘন ঝোলে ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য পাতলা মচমচে রুটি প্রভৃতি। গিয়াস বেগের পরিচারকরা সেলিমের পানপাত্রটি কাবুলের খাজা খোয়ান সাইদ অঞ্চলের উৎকৃষ্ট সুরায় সর্বক্ষণ ভরপুর রাখলো।

    সেলিম লক্ষ্য করলো কোষাধ্যক্ষ নিজে পান আহারের ক্ষেত্রে মিতভোজী এবং সেলিমের ঘন ঘন প্রশংসা বাক্যগুলি মেনে নেওয়া ছাড়া তেমন কোনো কথাও সে বললো না। কিন্তু যখন প্রধান ভোজের তৈজসপত্র সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুর, রূপার আস্তর যুক্ত কাঠবাদাম এবং রসাল তরমুজ পরিবেশন করা হলো, তখন গিয়াস বেগ বললো, জাঁহাপনা, আমি আপনার কাছে একটি উপকার প্রার্থনা করতে চাই। যদি সম্মতি দেন, আমার স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

    নিশ্চয়ই, সেলিম উত্তর দিলো, সে অনুভব করলো এটা তাদের বন্ধুত্বের প্রতি ব্যাপক সম্মান যোজক একটি প্রস্তাব। রীতি অনুযায়ী কেবল পুরুষ আত্মীয়রাই গৃহের মহিলাদের মুখদর্শন করতে পারে। সেলিম ভাবছে তাদের আসনের বিপরীতে অবস্থিত দেয়ালের উপরের দিকে আচ্ছাদিত কাঠের ঝালরের পিছন থেকে গিয়াস বেগের স্ত্রী এবং কন্যা তাঁদের এতোক্ষণ লক্ষ্য করছিলো কি না।

    আপনি অত্যন্ত সদয় জাহাপনা। গিয়াস বেগ তার একজন পরিচারককে ফিসফিস করে কিছু বললো এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রস্থান করলো। কয়েক মিনিট পর, একটি লম্বা এবং হালকা পাতলা গড়নের অবয়ব উঠানটিতে উপস্থিত হলো। তার মুখমণ্ডল নেকাবে ঢাকা, কিন্তু সেই বস্ত্রখণ্ডের উপরে অবস্থিত নিখুঁত চোখ দুটি সেলিম দেখতে পেলো এবং চওড়া মসৃণ কপালটিও। নিশ্চিতভাবেই তার বয়স গিয়াস বেগের তুলনায় কম। মহিলাটি তার ডান হাতে বুক স্পর্শ করে সেলিমকে সংক্ষিপ্ত কুর্ণিশ করলো এবং তখন গিয়াস বেগ বললো, জাহাপনা এটি আমার স্ত্রী, আসমত।

    আপনার আতিথেয়তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আসমত। আমি কাবুলে আসার পর এর থেকে উত্তম খাবারের স্বাদ আর পাইনি।

    আপনি আমাদের ব্যাপকভাবে সম্মানিত করেছেন জাঁহাপনা। বহু বছর আগে আপনার পিতা মহামান্য সম্রাট আমাদের পরিবারকে দারিদ্র থেকে রক্ষা করেছিলেন কিম্বা তার থেকেও খারাপ কিছু থেকে। আপনাদের প্রতি আমাদের ঋণের অতি ক্ষুদ্রতম পরিমাণ আজ পূরণ করতে পেরে আমি তৃপ্ত। সে তার স্বামীর মতোই সম্ভ্রান্ত পারসিক ভাষায় কথা গুলি বললো এবং তার কণ্ঠস্বর একাধারে সুরেলা এবং নিচু।

    আমার পিতা আপনার স্বামীকে নিয়োগ প্রদান করে একজন উত্তম এবং বিশ্বস্ত সেবক লাভ করেছেন। আমাদের কাছে আপনাদের কোনো ঋণ নেই।

    আসমত তার স্বামীর দিকে এক পলক তাকালো। জাঁহাপনা, আপনার। কাছে আমাদের আরেকটি আর্জি রয়েছে। যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমাদের কন্যা মেহেরুন্নেসা আপনাকে তার নাচ দেখাবে। তার শিক্ষকগণ, যারা তাকে পারসিক ঢঙে নাচ শিখিয়েছে, তারা বলে সে নৃত্যকলায় ততোটা অদক্ষ নয়।

    অবশ্যই তার নাচ দেখবো আমি। সেলিম গদিতে হেলান দিয়ে বসলো এবং গাঢ় লাল বর্ণের সুরায় ছোট করে চুমুক দিলো। সেই মেয়েটিকে দেখার জন্য তার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে, যাকে একটি গাছের খোদলে রেখে চলে যাওয়া হয়েছিলো বুনো পশুর খাদ্য হওয়ার জন্য।

    তিনজন বাজিয়ে হাজির হলো-দুইজন ঢুলি এবং একজন বংশীবাদক। ঢুলিগণ আসন গ্রহণ করেই তাদের বাদ্যযন্ত্রে শক্তিশালী বোল তুললো এবং বাঁশিওয়ালা তার মোহন বাঁশিতে অসাড়তা সৃষ্টিকারী এক রহস্যময় সুর সৃষ্টি করলো। তারপর বাজিয়েদের বাজানার সঙ্গে সমন্বিত তালে একাধিক ঘন্টার টুং টাং শব্দ এগিয়ে এলো যখন মেহেরুন্নেসা উঠানটিতে দৌড়ে আবির্ভূত হলো। সে তার মায়ের মতোই নেকাব পড়ে আছে কিন্তু নেকাবের উপরের অংশে উন্মুক্ত চোখ দুটি আসমতের মতোই দ্যুতিময় এবং বড় বড়। সে মাছরাঙার পালকের মতো নীল বর্ণের রেশমের ঢিলা আলখাল্লা পড়ে আছে। সে যখন তার হাত দুটি উপরে তুলে ঘোরা শুরু করলো তখন সেলিম তার দুহাতে দুটি সোনালি চাকতি দেখতে পেলো যার মাঝে ছোট ছোট রূপালী ঘন্টা যুক্ত রয়েছে।

    যে সর্বশেষ নারীটির সেলিমের সাম্মুখে নেচেছিলো সেই আনারকলি সেলিমের মনের পর্দায় ক্ষণিকের জন্য ভেসে উঠলো, সেই সঙ্গে তাকে ঘিরে যে অনুশোচনা এবং লজ্জা তাকে গ্রাস করেছিলো তার স্মৃতিও। তবে মেহেরুন্নেসা যে ঢঙে নাচছে সেলিম তা হিন্দুস্তানে কখনো দেখেনি। তার নাচের ভঙ্গীমা গুলি কোমল, ধীর এবং সুনিয়ন্ত্রিত। তার হালকা-পাতলা বাহু এবং আঙ্গুল গুলির মুদ্রা, তার মাথার নড়াচড়া, তার শরীরের রাজকীয় দোলা এবং বাজনার তালে তালে তার মেহেদী চর্চিত পায়ের উত্থান-পতন সবকিছু মিলে এক সম্মোহনী আবেশ তৈরি করছিলো। এ সময় বাজনার শব্দ বাড়ার সাথে সাথে সেলিম সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। মেহেরুন্নেসা তার মাথাটি পেছনের দিকে এমন ভাবে হেলিয়ে দিলো যেনো নাচের আনন্দে সে উচ্ছ্বসিত এবং তখনই হঠাৎ করে বাজনা বন্ধ হয়ে গেলো, আর মেহেরুন্নেসা শোভনীয় ভাবে সেলিমের পদযুগলের সম্মুখে হাঁটু গেড়ে নিচু হলো।

    পারস্যে বসন্ত বরণের উৎসবের সময় এই নাচটি দেখতে শাহ্ খুব পছন্দ করেন, গিয়াস বেগ বললো, তার মুখমণ্ডলে কোমল গর্ব ফুটে উঠেছে।

    তোমার পিতার সঙ্গে আমি একমত, সত্যিই তোমার নাচের দক্ষতা অসাধারণ। দয়া করে উঠে দাঁড়াও।

    মেহেরুন্নেসা বিনয়ী ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ালো, কিন্তু যেই সে তার কপালের উপর এসে পড়া একগুচ্ছ উজ্জ্বল কালো চুল সরাতে গেলো অমনি তার নেকাবের এক পাশ ছুটে গিয়ে তার মুখমণ্ডল উন্মোচিত হয়ে পড়লো। তার নাকটি ছোট এবং খাড়া এবং তার চিবুকটি কোমল বাক বিশিষ্ট। এক মুহূর্তের জন্য সে সরাসরি সেলিমের চোখের দিকে তাকালো, তারপর দ্রুত নেকাবটি বেঁধে নিলো।

    *

    তুমি তাকে খুব অল্প সময়ের জন্য দেখেছো।

    সেটাই যথেষ্ট ছিলো সুলায়মান বেগ।

    হয়তো সেটা এ কারণে যে তুমি অনেক দিন যাবৎ নারী সংসর্গ থেকে বঞ্চিত রয়েছ।

    সেলিম কিছুটা ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে সুলামান বেগের দিকে তাকালো। এটা সত্যি যে লাহোরে তার স্ত্রীগণ এবং হেরেম ছেড়ে আসার পর থেকে সে আর কোনো রমনীর সান্নিধ্যে যায়নি। আনারকলির সোনালী চুল এবং আকর্ষণীয় দেহের সৌন্দর্য এবং তা ধ্বংস করার স্মৃতি তার কামনাকে রহিত করেছে এটাও সত্যি, কিন্তু তার কামনা বাসনা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়নি এবং মেহেরুন্নেসার প্রতি তার আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়ার কারণও সেটা নয়।

    তুমি কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, যে অজানা কারণে তুমি তার পিতাকে পছন্দ করো সেই একই কারণে তার প্রতি তোমার দুর্বলতা সৃষ্টি হয়নি? তোমার হয়তো মনে হচ্ছে তার মনটি তার পিতার মতোই হবে এবং অবশ্যই তার দেহটি নারীসুলভ বৈশিষ্টে পরিপূর্ণ। সুলায়মান বেগ হাসলো এবং দাঁতের ফাঁকে একটি আখরোট ভাঙলো, সে সেলিমের কক্ষের জানালার ফোকরে বসে আছে যেখান থেকে দুর্গের আঙ্গিনা দেখা যায়। সত্যি করে বলতো তার মধ্যে তুমি কি বিশেষত্ব দেখেছো?

    তার সবকিছুই বৈশিষ্ট মণ্ডিত। তার নড়াচড়া, তার বিনয় সবকিছু। তাকে আমার কাছে একজন রানীর মতো মনে হয়েছে।

    তার স্তনগুলি বড় বড় ছিলো?

    সে বাজারের বেশ্যা নয়।

    তাহলে আমি আমার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করছি কারণ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তোমার বক্তব্য অনুযায়ী একজন নেকাব পড়া মেয়ে তোমার সামনে অল্প সময় নেচেছে, আর তাতেই হঠাৎ তোমার নেংটিতে আগুন জ্বলে উঠলো…

    আমি তার মুখ দেখেছি। সুলায়মান, তাকে দেখে আমার দাদা এবং দাদীর মধ্যকার ভালোবাসা পূর্ণ সম্পর্কের কথা মনে পড়ে গেছে। তাকে আমি আমার মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছি না।

    তুমি তো বলছিলে সে নেকাব পড়া ছিলো।

    এক মুহূর্তের জন্য তার নেকাব খুলে গিয়েছিলো।

    মেয়েটি অত্যন্ত চালাক।

    তুমি কি বলতে চাও?

    সে ছোট একজন কর্মকর্তার কন্যা যে তোমার রাজ্যর শেষ প্রান্তের এক দুর্গম অঞ্চলে বাস করছে। সুলায়মান বেগ একটি শক্ত আখরোট থু করে মেঝেতে ফেললো, কিন্তু সেলিম বুঝতে পারে প্রকৃতপক্ষে সে কাবুলকেই থুতু দিতে চায়। এই শহর সুলায়মান বেগের কাছে একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর। হিন্দুস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য সে অস্থির হয়ে উঠেছে। সে তোমার নজরে পড়ার চেষ্টা করেছে। এখানে বসে পচার চেয়ে রাজকীয় রক্ষিতা হওয়া অনেক আকর্ষণীয় বিষয়।

    হয়তো সুলায়মান বেগের কথাই সত্যি, সেলিম ভাবলো। তার মনের পর্দায় মেহেরুন্নেসার নেকাব খুলে যাওয়ার দৃশ্যটি ভেসে উঠলো। সেটা কি ইচ্ছাকৃত ছিলো? এবং সে কি সেটা পুনরায় বেধে নেয়ার আগে কিছু সময় দেরি করেছে যাতে সেলিম তার মুখটি ভালোমতো দেখতে পায়? যদি তাই হয় তাহলে সেটা ভালোই হয়েছে। এর অর্থ সেও সেলিমের প্রতি আগ্রহী। সেলিম উঠে দাঁড়ালো। আমি তাকে তুচ্ছ একজন রক্ষিতা হিসেবে আশা করি না। আমি তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে কামনা করি।

    *

    তখন সন্ধ্যা নামছে, একজন পরিচারক এসে সেলিমকে খবর দিলো যে গিয়াস বেগ দুর্গে এসে পৌঁছেছে। যেই মুহূর্তে পারসিকটিকে তার কক্ষে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা হলো, সেলিম উদগ্রীব ভাবে তাকে বললো, গিয়াস বেগ, আমি আপনার যুবরাজ হিসেবে এখানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাইনি, বরং আমি আশা করছি আমি আপনার ভবিষ্যত জামাতা হতে পারবো। আমি আপনার কন্যাকে বিয়ে করতে চাই। মেহেরুন্নেসাকে আমার কাছে সোপর্দ করুন, আমি তাকে আমার স্ত্রীদের মধ্যে প্রধান করবো এবং আমার হৃদয়েও। গিয়াস বেগ ভ্রুকুটি করলো। তার চেহারায় হাসি ফুটে উঠার বদলে বিরক্তির ভাব প্রকাশ পেলো, যা সেলিম আশা করেনি।

    কি হলো গিয়াস বেগ?

    জাঁহাপনা, আপনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা অসম্ভব।

    ঠিক বুঝলাম না…আমি ভেবেছিলাম আমার প্রস্তাবটি আপনি সাদরে গ্রহণ করবেন।

    তা ঠিক আছে জাঁহাপনা। এটা একটা বৃহৎ সম্মানজনক বিষয়, যা আমি কল্পনাও করিনি। কিন্তু এ প্রস্তাব গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

    কেনো? কি করছে তা না ভেবেই সেলিম এগিয়ে গিয়ে গিয়াস বেগের কনুই এর উপরের অংশ দুহাতে চেপে ধরলো।

    আমার মেয়ের বাগদান হয়ে গেছে।

    কার সঙ্গে?

    আপনার পিতার একজন সেনাপতির সঙ্গে যে বাংলায় দায়িত্ব পালন করছে। তার নাম শের আফগান। একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে আমি এ সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারি না। আমি সত্যিই দুঃখিত জাঁহাপনা।

    .

    ২৬. বিস্মৃতি

    জাঁহাপনা, লাহোর থেকে আপনার জন্য একটি চিঠি এসেছে। সেলিমের কোর্চি তার হাতে একটি চামড়ার তৈরি সবুজ ঝুলি দিলো যার মুখ রাজকীয় সীলগালা করা। ঝুলির ভিতর সেলিম একটি চার ভাঁজ করা পুরু কাগজের টুকরো পেলো এবং সেটা খুলে আবুল ফজলের হস্তাক্ষর দেখতে পেলো লাইনের পর লাইন অনেক কিছু লেখা। যথারীতি একগাদা অসার অলংকরণমূলক বক্তব্যের পর একদম শেষের দিকে সেলিম চিঠিটির সারবস্তু খুঁজে পেলো : অতুলনীয় ক্ষমাশীলতার অধিকারী মহামান্য সম্রাট তাঁর সীমাহীন উদারতার বশবর্তী হয়ে অবিলম্বে আপনাকে লাহোরে ফিরে আসতে বলেছেন নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য। তিনি আপনাকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যেও আমাকে আদেশ করেছেন যে তিনি আশা করেন এখন থেকে আপনি ন্যায়ের পথে চলবেন এবং একজন দায়িত্বশীল পুত্রের মতো আচরণ করবেন। তিনি আরো আশা করেন ভবিষ্যতে আপনি অতীতের মতো বিপথগামী হয়ে তাঁর জন্য সীমাহীন মর্মপীড়া এবং হতাশা জনক পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি করবেন না।

    সেলিম চিঠিটি সুলায়মান বেগের হাতে দিলো, সেটা পড়ে তার মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আমি আশঙ্কা করেছিলাম আরো বহু বছর হয়তো আমাদেরকে এখানে আটকে থাকতে হবে।

    যথারীতি চিঠিটির ঢং এমনকি সীলমোহরও আবুল ফজলের, আমার পিতার নয়। যাইহোক, মাত্র আট মাস পড়ে আমাকে ডেকে পাঠানো হবে এমনটা আমি আশা করিনি। আমি সত্যিই অবাক হয়েছি।

    তোমার আরো বেশি আনন্দিত হওয়া উচিত। নাকি তুমি এখনো ঐ পারসিক মেয়েটির ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছো? যখন তুমি তোমার স্ত্রীগণ এবং হেরেমের সান্নিধ্যে ফিরে যাবে তখন তুমি উপলব্ধি করবে এই মেয়েটি তোমার জন্য কাবুলের একঘেয়ে জীবনে একটি ক্ষণস্থায়ী চমক ছাড়া আর কিছু ছিলো না।

    সেলিম বিবেচনা করতে লাগলো এ বিষয়ে তার সত্যিকার অনুভূতিটি কি। গিয়াস বেগের সঙ্গে তার সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব কাবুলে তার সময় যাপনকে অনেকটা সহনীয় করে তুলেছিলো। আর মেহেরুন্নেসাকে দেখার পর থেকে তাকে ঘিরে তার চিন্তা রাজধানীতে ফিরে যাওয়ার চিন্তার তুলনায় কম উৎসাহব্যঞ্জক ছিলো না। কিন্তু গিয়াস বেগ তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর থেকে তাদের ঘনিষ্টতায় ফাটল ধরেছে। সেলিমের পারসিকটির বাড়ি বেড়াতে যাওয়া অনেক কমে গেছে এবং মেহেরুন্নেসার সঙ্গেও তার আর দেখা হয়নি। তবে সেলিম জানতে পেরেছে শের আফগানের সঙ্গে তার বিয়ে আগামী বছরের আগে হবে না। হয়তো লাহোরে ফিরে গিয়ে সে তার পিতার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে গিয়াস বেগের মতো পরিবর্তন করতে পারবে। মেহেরুন্নেসার সঙ্গে শের আফগানের সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য সম্রাট নিজে যদি আদেশ দেন তাহলে গিয়াস বেগের পক্ষে তা পালন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই….

    *

    কাবুল থেকে গিরিপথ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ইন্দুজ এবং পাঞ্জাবের অন্যান্য খরস্রোতা নদী পেরিয়ে হিন্দুস্তানে ফিরে আসার দীর্ঘ যাত্রাটি অত্যন্ত দ্রুত এবং ভালোভাবেই সম্পন্ন হলো। সেলিমের লাহোরে পৌঁছাতে মাত্র ছয় সপ্তাহ সময় লাগলো। যাইহোক, দীর্ঘ আট মাসের নির্বাসন শেষে প্রথম বারের মতো সে যখন আকবরের কক্ষে এককী তার মুখোমুখী হলো, সেলিমের দেহ ভবিষ্যৎ বিষয়ে উৎকণ্ঠা এবং নতুন আশার মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় প্রকম্পিত হতে লাগলো।

    তুমি নিরাপদে কাবুল থেকে ফিরে আসতে পেরেছো দেখে আমি খুশি। আকবরই প্রথম কথা বললেন এবং তার মুখ ভাবলেশহীন। আমি এই জন্য দুঃখিত যে অত্যন্ত ক্রুদ্ধভাবে তোমাকে আমি নির্বাসনে পাঠিয়েছিলাম। তবে তোমাকে নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি প্রদান ছাড়া আর কোনো উপায়ও তখন তুমি আমার জন্য রাখনি। আমি আশা করছি নির্বাসনের সময়টিতে তুমি নিজের কৃতকর্ম সম্পর্কে ভাবার যথেষ্ট সময় পেয়েছে এবং একজন পিতার প্রতি তার সন্তানের দায়িত্ব কি হতে পারে সে বিষয়ে তোমার মনস্থির করতে পেরেছে। ভবিষ্যতে অতীতের নির্বুদ্ধিতা এবং অশোভন আচরণ থেকে বিরত থাকবে তোমার কাছ থেকে আমি সেটাই আশা করি।

    কিন্তু একজন পিতার তার সন্তানের প্রতি যে দায়িত্ব পালন করা উচিত তার কি হবে, সেলিম মনে মনে ভাবলো, কিন্তু মুখে বললো, আমি বুঝতে পেরেছি তোমার প্রতি আমার আচরণ কেমন হওয়া উচিত এবং আমার দোষত্রুটি ক্ষমা করে আমাকে আবার রাজধানীতে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।

    তোমার অপরাধ অনেক ভয়ঙ্কর মাত্রার ছিলো। তাই আমার ইচ্ছা ছিলো তোমাকে আরো দীর্ঘ সময় কাবুলে রাখার। কিন্তু তোমার দাদীর অনুরোধে আমি তোমাকে এতো তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে এনেছি। আকবরের কণ্ঠস্বর এখনো আড়ষ্ট শোনালো।

    বাবা, আবুল ফজলের চিঠিতে উল্লেখ ছিলো তুমি আমার জন্য নতুন দায়িত্ব ঠিক করে রেখেছো। আমি তোমার সেবা করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছি…আমি…

    সবই উপযুক্ত সময়ে হবে, আকবর সেলিমকে থামিয়ে দিয়ে বললেন। কাবুল সফরের পরীক্ষায় তুমি ভালোভাবেই উত্তীর্ণ হয়েছে। আবুল ফজল আমাকে বলেছে তোমার পাঠানো প্রতিবেদন গুলি যথেষ্ট পূর্ণাঙ্গ ছিলো এবং সাইফ খান নিশ্চিত করেছে সেখানে তুমি ভালো আচরণ করেছে। কিন্তু আমি এখনো এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেইনি যে আগামীতে তোমাকে কি দায়িত্ব প্রদান করবো।

    তাহলে সাইফ খান সত্যিই তার উপর গোয়েন্দাগিরি করেছে। সেলিম হাল ছাড়লো না, কোনো প্রাদেশিক প্রশাসকের দায়িত্বও তো আমাকে দিতে পারো, যেমনটা মুরাদ কে দিয়েছো?

    অস্থির হওয়ার কিছু নেই। আমি দেখতে চাই তুমি তোমার ভালো আচরণ বজায় রাখছে কি না। সময় হলে আমি তোমাকে জানাবো তোমার দায়িত্ব কি হবে।

    সেলিম চেষ্টা করলো তার হতাশার ভাব প্রকাশ না করতে, কিন্তু সে বুঝতে পারছিলো নৈরাশ্য তার চেহারায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সে আশা করেছিলো ফিরে আশার পর তার এবং তার পিতার সম্পর্কের মাঝে নতুন কোনো অগ্রগতি সূচিত হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাকে আবারো ক্লান্তি কর ধৈর্যশীলতা অবলম্বন করতে হবে। তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদানের জন্য দাদীর প্রভাব কাজে লাগানো গেলে ভালো হতো যেমনটা তিনি তার ফিরে আসার ক্ষেত্রে খাঁটিয়েছেন। যাইহোক, এ ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হলেও আরেকটি বিষয়ে সে আকবরকে অনুরোধ করতে পারে যে ব্যাপারে দেরি করা উচিত হবে না। প্রসংঙ্গটি এখনই তার উত্থাপন করা দরকার।

    বাবা, আমি কি তোমার কাছে একটি উপকার চাইতে পারি?

    কি ব্যাপারে? আকবরকে সত্যিই বেশ অবাক মনে হলো।

    আমি আরেকটি স্ত্রী গ্রহণ করতে চাই।

    কে সে? এখন আকবরকে দেখে মনে হলো তিনি সম্পূর্ণভাবে আশ্চার্যান্বিত।

    সে গিয়াস বেগের কন্যা, যে কাবুলে তোমার কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছে, সেলিম বললো এবং আকবর কোনো উত্তর দিতে পারার আগেই বলে উঠলো, কিন্তু একটি সমস্যাও রয়েছে। মেয়েটির সঙ্গে বাংলায় নিযুক্ত তোমার এক সেনাপতির বাগদান হয়ে গেছে যার নাম শের আফগান। গিয়াস বেগ মনে করেন এই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়া তার জন্য অসম্মানজনক হবে। কিন্তু তুমি যদি এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করো তাহলে গিয়াস বেগ এবং শের আফগান তোমার আদেশ মেনে নিতে বাধ্য হবে এবং…।

    যথেষ্ট হয়েছে! আমি ভেবেছিলাম নির্বাসনে থেকে তোমার মধ্যে কিছুটা শুভ বুদ্ধির উদ্রেক হয়েছে, কিন্তু আমার ধারণা ভুল। এটাই অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার যে তুমি একটি অখ্যাত পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছো-এই সম্পর্ক আমাদের সাম্রাজ্যের কোনো উপকারে আসবে না। কিন্তু তার চেয়েও দুষ্ট চিন্তা এই যে তুমি তোমার ক্ষণস্থায়ী মোহ চরিতার্থ করার জন্য আমার প্রজাদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করার কথা বলছো।

    এটা কোনো মোহ নয়। তার নাম মেহেরুন্নেসা। আমি আমার মন থেকে কিছুতেই তাকে সরাতে পারছি না।

    তোমাকে এই চিন্তা বাদ দিতে হবে। আমি আমার একজন সাহসী যোদ্ধা এবং বিশ্বস্ত সেবকের বিবাহ পরিকল্পনা বানচাল করতে পারবো না তোমার চির-অতৃপ্ত লালসা পূরণ করার জন্য।

    এটা আমার লালসা নয়…

    তাই নাকি? আমি তো দেখতে পাচ্ছি অন্যের নারীকে অন্যায় ভাবে হস্তগত করার বিষয়টি তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আকবরের কণ্ঠস্বর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ মনে হলো। সেলিম আনারকলিকে সংযুক্ত করে তার পিতার ইঙ্গিতপূর্ণ তিরস্কার হজম করলো। এই মুহূর্তে আত্মপক্ষ সমর্থণ করার জন্য সে আর কিই বা বলতে পারে?

    কয়েক মুহূর্তের কষ্টকর বিরতির পর আকবর ক্লান্তভাবে বললেন, তুমি এখন আমার সামনে থেকে বিদায় হও। তোমার প্রস্তাবে আমি অত্যন্ত বিরক্ত এবং হতাশ হয়েছি। আমি আশা করেছিলাম আমাদের পুনর্মিলন যথেষ্ট আনন্দদায়ক হবে, কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি তুমি তোমার বদভ্যাস গুলিকে এখনোও পরাজিত করতে পারোনি। তোমাকে সংযম চর্চা করতে হবে। কতো অল্প বয়স, তা সত্ত্বেও তোমার পুত্র খুররম ভালো মন্দের পার্থক্য তোমার তুলনায় বেশি বুঝতে পারে।

    সেলিম যখন দ্রুত পায়ে তার পিতার কক্ষ ত্যাগ করছিলো ক্ষোভ এবং কষ্টের অশ্রুতে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে উঠছিলো। আকবর তাকে কখনোও বুঝতে চেষ্টা করেননি এবং ভবিষ্যতেও বুঝতে পারবেন বলে মনে হয় না। তবে তার পিতার কথা গুলি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচন করা ছিলো যা তাকে নির্মম ভাবে ক্ষতবিক্ষত করেছে। খুররমের উদাহরণ টেনে তিনি কি ইঙ্গিত দিলেন? যে তার নিজ সন্তান শাসক হিসেবে তার চেয়েও বেশি উপযুক্ত? বোধ হয় না…খুররমের জন্ম যতোই তাৎপর্য ঘেরা ক্ষণে হয়ে থাকুক না কেনো সে বর্তমানে একটি অকালপক্ক শিশু ছাড়া আর কিছু নয়।

    *

    সেলিম রঙচঙে কাঠের বাক্সটি খুললো, সেটা থেকে একটি কাঁচের বয়াম বের করে আলোর বিপরীতে উঁচু করে ধরলো, তার হাত স্থির নয়। ভালো। বয়ামটির মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক ওপিয়ামের গুলি রয়েছে যা দিয়ে তার সকাল পর্যন্ত চলবে। বয়ামটির রূপার ঢাকনা খুলে, সেলিম ওপিয়ামের দুটি গুলি পান পাত্রের মধ্যে ফেললো তারপর সেখানে কিছু গোলাপজল ঢাললো। ওপিয়াম গুলিকে তরলের মধ্যে ধীরে মিশে যেতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। দুই একটি অবাধ্য কণা ছাড়া সবটাই গোলাপ জলে মিশে গেলো। সেলিম তার তর্জনী দিয়ে পানপাত্রটির তরলে নাড়া দিলো তারপর সেটি ঠোঁটে ছোঁয়াল। কয়েক মিনিট পর যখন সে অনুভব করলো ওপিয়াম তার শরীরে চমৎকার কাজ শুরু করেছে তখন সে আরেকটি পানপাত্র থেকে কয়েক ঢোক আঙ্গুর দিয়ে তৈরি কড়া স্বাদের লাল বর্ণের সুরা পান করলো যা সে সারাদিন ধরে পান করছিলো।

    এখন তার আরো বেশি চমৎকার লাগছে। সেলিম রেশমের চাদরে ঢাকা মাদুরের উপর শরীর এলিয়ে দিলো। সে তার কক্ষের ঝুল বারান্দার রেলিং এর কাছে শুয়ে আছে। নিচের পাথুরে চত্বর থেকে ভেসে আসা মানুষের গলার স্বর এবং ঘোড়ার খুরের শব্দ মনে হলো বহু দূর থেকে আসছে। সে তার চোখ দুটি বন্ধ করলো এবং এক অসীম তৃপ্তিকর অসাড়তার কাছে। নিজেকে সমর্পণ করলো যা বিগত সপ্তাহ গুলিতে তার সুখের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সেলিম যখনই পিতার কাছে তার নিয়োগ দানের বিষয়ে আবেদন করেছে তখনই তিনি তার ঠাণ্ডা বাকচাতুরীর সাহায্যে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর বিরুদ্ধে অতিব কার্যকরী প্রতিষেধক তার এই বর্তমান মাদকাসক্তি। তাছাড়া নিজ সন্তানদের আচরণের আলগা ভাব ভুলে থাকার জন্যেও এই নেশা জরুরি। তার দীর্ঘ অনুপস্থিতির সময়ে তাঁদের ব্যবহার অনেক পাল্টে গেছে। যদিও তাঁদের কথাবার্তা অনেক ভদ্র তবুও তাতে সে কোনো আন্তরিকতা বা উষ্ণতা খুঁজে পায়নি।

    মা হীরাবাঈ বা দাদী হামিদার কাছ থেকেও সে কোনো গঠনমূলক আশ্বাস লাভ করেনি। মা কেবল বাবার প্রতি তার ঘৃণাই প্রকাশ করেছেন যা সাধারণ ভাবে সমগ্র মোগল সম্প্রদায়ের উপরই বর্তায়। আর হামিদার কণ্ঠস্বরে যতোই সহমর্মিতা এবং স্নেহ প্রকাশ পাক না কেনো তিনি সান্ত্বনা প্রদান এবং ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ ব্যতীত আর কিছুই সেলিমকে দিতে পারেননি। এছাড়া তিনি আনারকলির সঙ্গে তার প্রণয় আকবরকে কতোটা আহত করেছে সে বিষয়টিও বহুবার পুনরাবৃত্তি করেছেন। এ সংক্রন্ত গুজব জনগণের মাঝে আকবরের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী অস্তিত্বকে খর্ব করেছে। তাছাড়া নির্বাসন থেকে সেলিমকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আকবরকে রাজি করাতে গিয়েও তাকে অনেক নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে নিজের ছেলের কাছে। তাই বর্তমানে তার পক্ষে ছেলের কাছে আর কোনো সুপারিশ করা সম্ভব নয়।

    ওপিয়াম এবং সুরার সম্মিলিত প্রভাব সেলিমের শরীর ও মনকে শিথিল করে তুলেছে। তার বেদনাদায়ক চিন্তাগুলি এখন ভোতা হয়ে গেছে, নৈরাশ্যজনক অভিজ্ঞতার স্মৃতি গুলির উপর মোলায়েম প্রলেপ পড়েছে এবং সে এমন সব জায়গায় বিচরণ করছে যেখানে কোনো কিছুই আর তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সেলিম অনুভব করলো তার খোলা বুকের উপর দিয়ে একটি পোকা হাঁটছে, কিন্তু সেটাকে সরিয়ে দিতে হলে যে উদ্যোগ তাকে নিতে হবে তা ব্যাপক কষ্টসাধ্য বলে তার কাছে মনে হলো। বেঁচে থাকো, ছোট্ট প্রাণী, তুমি যে গোত্রেরই হও না কেনো, সে মনে মনে কথা গুলি আওড়ালো এবং কোমল ভাবে হাসলো। তারপর একটু নড়ে চড়ে শুলো। নরম উষ্ণ রেশমের চাদরটিকে তার অবিশ্বাস্য রকম আরামদায়ক মনে হলো-যেনো কোনো নারীর নরম ত্বক। হয়তো কিছুক্ষণ পরে সে হেরেমে যাবে এবং মান বাঈ বা যোধ বাঈ এর সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত হবে। তবে সেটাও এখন তার কাছে ব্যাপক কষ্টকর উদ্যোগ বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য সে ফিরে আসার পর তারাও তাকে তেমন উন্মুক্ত হৃদয়ে গ্রহণ করেনি। সেই মুহূর্তে তার আরো খেয়াল হলো বেশ কয়েক দিন যাবৎ সে তার স্ত্রী বা সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। কেনো করবে, যখন এখানে শুয়ে থাকাই এতো আশ্চর্যজনক ভাবে তৃপ্তিকর? এক মুহূর্তের জন্য মেহেরুন্নেসার আকর্ষণীয় মুখটি তার কল্পনার পর্দায় ভেসে উঠলো। হয়তো সুলায়মান বেগের কথাই ঠিক, সে আরেকজন নারী ছাড়া বিশেষ কিছু নয়…

    তারপরও একজন সঙ্গী কাছে থাকলে ভালো হতো, যে তাকে এই মুহূর্তে আবৃত করতে থাকা ছায়া ঘন এবং উজ্জ্বল গোধূলী লগ্নে সঙ্গ দিতো। সুলায়মান বেগ গোঁয়ারের মতো তার প্রতিটি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এমনকি যখন সে একটি বা দুটি ওপিয়ামের গুলি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা আরম্ভ করেছিলো তখনো তার দুধভাইকে প্রলুব্ধ করা যায়নি। উল্টো সে তাকে নেশা করতে নিষেধ করেছে…হয়তো তার উচিত ছিলো তার সভাইদের আমন্ত্রণ জানানো, মুরাদ বা দানিয়েলকে। মুরাদ এক মাস আগে লাহোরে ফিরে এসেছে। একজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গিরদারের প্রতিনিধিকে অসম্মান প্রদর্শনের অভিযোগে চাবুকপেটা করার জন্য আকবর তাকে প্রশাসকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

    মুরাদ হয়তো কোনো দোষ করেনি, সেলিমের মনে হলো, যদিও জানা গেছে চাবুক মারার আদেশ প্রদানের সময় সে মাতাল ছিলো। বাস্তবতা হলো পুত্রদের কাছ থেকে আকবরের আকাক্ষা সীমাহীন যা পূরণ করা তাদের পক্ষে হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। তাকে বা দানিয়েলকে মুরাদের স্থলাভিষিক্ত না করে আকবর যথারীতি চাটুকার আবুল ফজলের এক ভ্রাতুস্পুত্রকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় আরেকটি পোকা-এটাকে আগের তুলনায় একটু বড়ই মনে হলো-সেলিমের বাহুর উপর দিয়ে এখন হাটছে। এবার আর সে অনিহার আবেশে নিষ্ক্রিয় থাকলো এবং পোকাটিকে পিষে মারলো, অনুভব করলো সেটার আঁশালো শরীরর থেকে পিচ্ছিল পদার্থ বেরিয়ে এলো। পোকাটির জায়গায় আবুল ফজল হলে ভালো হতো। তার স্থূল শরীর থেকে কি পরিমাণ চর্বি নিংড়ে বার করা যাবে? সেলিমের চোখ জোড়া আবার বন্ধ হয়ে এলো এবং সে তার মনকে পরম স্বর্গসুখের মাঝে হারিয়ে যেতে দিলো।

    হঠাৎ চমকে জেগে উঠে সেলিম দেখতে পেলো আধার আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে রয়েছে। তার মাথার দুপাশের শিরা ধড়াস ধড়াস করছে, মুখের ভিতরটা এতো শুকিয়ে গেছে যে মনে হলো জিহ্বাটি মুখের তালুর সঙ্গে আটকে গেছে। এক হাতে পাথরের রেলিং আকড়ে ধরে সে নিজেকে অনেক কষ্টে দাঁড় করালো। তার পা দুটি, বস্তুত সারা শরীর, থরথর করে কাঁপছে। এখনতো শীত লাগার কথা নয়! সবে মাত্র মে মাস চলছে, কদিন পড়ে বর্ষা আরম্ভ হবে- বছরের এই সময়টা সবচেয়ে গরম থাকে। এমন শীতল অনুভূতি তার আগেও হয়েছে এবং তার জানা আছে কীভাবে এর সমাধান করতে হবে। তার পর্যাপ্ত পরিমাণ ওপিয়াম সেবন করা হয়নি। সেলিম হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো, তারপর একটি মাত্র বাতি জ্বলতে থাকা ছায়া ঢাকা বারান্দা হামাগুড়ি দিয়ে পেরিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে ওপিয়ামের বাক্সটি অন্ধের মতো হাতড়ে খুঁজতে লাগলো। বাক্সটা কোথায় গেলো? তার মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। বাক্সটি খুঁজে না পেলে তার অবস্থা কি দাঁড়াবে? এই মুহূর্তে তাকে কিছু ওপিয়াম সেবন করতে হবে। তখন তার মনে পড়লো তার সেবায় একাধিক পরিচারক নিযুক্ত রয়েছে…তারা সংখ্যায় দশ জন। সে চিৎকার করে ডাক দিলে বাইরের করিডোর থেকে তারা ছুটে আসবে। না তার প্রয়োজন নেই…বাক্সটি পাওয়া গেছে।

    বাক্সটি খুলে সে কাঁচের বয়ামটি আবার বের করে আনলো এবং অবশিষ্ট ওপিয়ামের গুলি হা করে মুখে ঢাললো। সেলিম গিলতে চেষ্টা করলো কিন্তু সেগুলি তার শুষ্ক গলায় আটকে গেলো- ভুলে সে সেগুলো গোলাপ জলে গুলিয়ে নেয়নি। তার দম আটকে গেছে এবং সেগুলি মাথা ঝাঁকিয়ে থু দিয়ে বের করার চেষ্টা করলো, কিন্তু তা সম্ভব হলো না। শ্বাস নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে সে গোলাপ জলের জগটির জন্য হাতড়াতে লাগলো, যে কোনো তরল পদার্থ হলেই চলবে। যেই মুহূর্তে তার মনে হলো সে জ্ঞান হারাবে, তার হাতে পানির জগের ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ লাগলো। দ্রুত ধরতে গিয়ে সেটা উল্টে পড়ে গেলো। সামনে ঝুঁকে লোভীর মতো সে সেটাকে সোজা করলো এবং বেঁচে যাওয়া পানিটুকু গলায় ঢালল। হ্যাঁ, গুলি গুলো গেলো গেছে। একধরনের কর্কশ অসঙ্গতিপূর্ণ ঘাস ঘাস শব্দ তার কানে বাজতে লাগলো, কয়েক মুহূর্ত পরে সে উপলব্ধি করলো সেটা তার নিজেরই শ্বাস নেয়ার শব্দ।

    হামাগুড়ি দিয়ে সে আবার তার পুরানো জায়গায় ফিরে গেলো তারপর চাদরের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে দুবাহু বুকের উপর ভাঁজ করে হাতের পাঞ্জা দুটি দুই বগলে ঢুকালো। নিজেকে উষ্ণ রাখার আর কোনো উপায় এই মুহূর্তে তার জানা নেই। কিন্তু তাতে কাজ হলো না, শরীরের কম্পন বন্ধ হলো না। একটু পড়ে সে বুঝতে পারলো কেনো সে কাঁপছে- সেটা শীতের জন্য নয় বরং ভীতির জন্য। অদ্ভুত চেহারার ভয়ঙ্কর সব জীব তার চারপাশের আধারে বিচরণ করছে। এদের আগ্রাসন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে…কোনো রকমে সেলিম নিজেকে তার হাঁটুর উপর খাড়া করলো কিন্তু তারপর হঠাৎ তার চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো….

    সেলিম…সেলিম… কেউ তার মুখ একটি ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছিলো কিন্তু সে মোচড় দিয়ে সরে গেলো। এটা কি সেই আধারের জীবদের কেউ? নড়োনা সেলিম। আমি সুলায়মান বেগ… সেলিম অনুভব করলো কেউ শক্ত হাতে তাকে চেপে ধরেছে এবং আবার তার মুখ ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিচ্ছে। অনেক কষ্টে সে তার চোখের পাতা খুললো এবং বিরক্তিকর সূর্যালোক চোখে আঘাত করতেই গুঙিয়ে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

    এটা পান করো! কেউ এখন অত্যন্ত কোমল ভাবে জোর খাঁটিয়ে তার চোয়াল ফাঁক করলো এবং সে তার নিচের ঠোঁটে বৃত্তাকার কিছুর ধাতব স্পর্শ পেলো। তারপর তার মাথাটি কাত করা হলো এবং তার গলা বেয়ে তীব্র গতিতে জল নামতে লাগলো। সেলিমের মনে হলো সে ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু মেঝেতে একটি ধাতব পান পাত্র আছড়ে পড়ার শব্দ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্মম গলাধকরণ অব্যাহত থাকলো।

    সেলিম আবার তার চোখ খুললো, এবার সে তার চোখ দুটি অব্যাহত ভাবে খোলা রাখতে পারলো এবং দেখতে পেলো তার উপর সুলায়মান বেগের মুখটি ঝুঁকে রয়েছে। সে আর কখনোও তার দুধভাইকে এতোটা বিচলিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখেনি। সেলিম উঠে বসলো এবং কিছু বলতে চাইলে কিন্তু তার স্বরযন্ত্র তার ইচ্ছার প্রতি অনুকূল সাড়া দিলো না। সে তার ঠোঁট দুটি নড়াতে পারলো না। সে আবার চেষ্টা করলো এবং এবার কিছুটা সফল হলো, সে বলতে পারলো আমার মনে হচ্ছে এবং তারপরই তার মুখ থেকে হঠাৎ তীব্র বেগে এক প্রকার তিতো আঠাল তরল ছিটকে বের হলো। কিছুটা লজ্জিত ভাবে সে তার বন্ধুর দিক থেকে মুখটা একপাশে সরিয়ে নিয়ে মেঝের উপর ওয়াক থু ওয়াক থু করতে লাগলো যতোক্ষণ পর্যন্ত না সবটুকু আঠালো পদার্থ বেরিয়ে এলো এবং বুকে এমন যন্ত্রণা অনুভব করলো যেনো তার পাঁজর ভেঙে গেছে। আমি দুঃখিত…

    তুমি ক্ষমা চাইছো কেনো? এই জন্য যে তুমি অসুস্থ, নাকি এ কারণে যে তুমি নিজেকে প্রায় মেরে ফেলেছিলে?

    মানে…আমার কি হয়েছে…তুমি কি বলছো এসব? আমিতো কেবল সামান্য ওপিয়াম সেবন করেছি…

    ঠিক কতোটা ওপিয়াম খেয়েছো তুমি?

    ঠিক বলতে পারবো না…

    সেই সঙ্গে সুরাও পান করেছো?

    সেলিম মাথা ঝাঁকালো। সে তার একটি হাত দিয়ে কপালের ডান পাশ স্পর্শ করে অনুভব করলো জায়গাটা রক্ত জমাট বেধে চটচটে হয়ে আছে।

    পাথরের রেলিং এর সঙ্গে তোমার মাথা বাড়ি খেয়েছে। এই যে দেখো, যেখানে বাড়ি খেয়েছে সেখানে তোমার রক্ত লেগে আছে, সুলায়মান বেগ বললো।

    সেলিম তার ঢিপ ঢিপ করতে থাকা মাথাটা ধীরে নাড়লো। আঘাত লাগার বিষয়ে আমার কিছু মনে নেই…শুধু মনে আছে আরো ওপিয়াম খুঁজছিলাম কিন্তু পাচ্ছিলাম না…তারপর গলা আটকে দম বন্ধ হয়ে এলো…

    দরজার বাইরে থেকে তোমার কোৰ্চি পতনের শব্দ শুনতে পায়। তুমি তাকে তোমার কক্ষে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে তাই সে আমার কাছে যায়। আমি এসে তোমাকে বারান্দায় উপুর হয়ে পড়ে থাকতে দেখি, তোমার সারা শরীর তখন কাঁপছিলো এবং কাঁপাল ফেটে রক্ত পড়ছিলো। আমি তোমাকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দেই এবং কপালের রক্তক্ষরণ বন্ধ করি। সেলিম, তোমার ভাগ্য ভালো যে…

    সেলিম সুলায়মান বেগের দিকে তাকিয়ে আছে এবং তার বক্তব্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে সে আবার অসুস্থ বোধ করতে শুরু করলো।

    আমি তোমাকে কতোদিন ধরে সতর্ক করার চেষ্টা করছি। তুমি তোমার সৎ ভাইদের অবস্থা দেখে কিছু শিখতে পারোনি? তাঁদের চেয়েও দ্রুত তোমার অবনতি হয়েছে। তোমার এই আচরণ অযৌক্তিক। তাছাড়া ইদানিং তোমার মেজাজও হঠাৎ করে খারাপ হয়ে যায় এবং তুমি হিংস্র হয়ে উঠো। কয়েক দিন আগে আমি দেখেছি তেমন কোনো কারণ ছাড়াই তুমি খোসরুর উপর কেমন চিৎকার করে মেজাজ করছিলে এবং সে তোমার দিকে কীভাবে তাকিয়ে ছিলো তাও লক্ষ্য করেছি। তুমি তোমার আপন জনদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছ। সুলায়মান বেগকে বেশ ক্রুদ্ধ মনে হলো।

    সেলিম চুপ করে রইলো, গলা বেয়ে উঠে আসতে চাওয়া তিক্ত পদার্থকে চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সে।

    কেনো সেলিম? কেনো তুমি এসব করছো?

    কথাটা কি এমন হওয়া উচিত নয় যে, কেনো করবো না? অবশেষে সেলিম উত্তর দিলো। ওপিয়াম এবং সুরা অন্তত আমাকে কিছুটা হলেও সুখ দিতে পারে। আমি গতরাতে কেবল এর পরিমাণের ব্যাপারে সামান্য ভুল করেছিলাম। ভবিষ্যতে আমি এ বিষয়ে সতর্ক থাকবো।

    তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাওনি। তুমি নিজেকে ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছো কেনো?

    আমার বাবার আমার প্রতি কোনো দৃষ্টি নেই। আমার জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। মুরাদ এবং দানিয়েলই সঠিক উপায় অবলম্বন করেছে। নিজে ফুর্তিতে ব্যস্ত থেকে বাকি সব কিছু ভুলে যাওয়াই কি আমার উচিত নয়?

    বাকি সব কিছু বলতে তুমি কি বোঝাচ্ছো? তোমার স্বাস্থ্য, তোমার পুত্ররা এবং তোমার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ এই সব কিছুর গুরুত্ব এক সময় তোমার কাছে ছিলো। আজ তার কি হলো? তোমার কণ্ঠ থেকে এখন আসলে সুরা এবং ওপিয়ামের বক্তব্য বের হচ্ছে, এটা তুমি নও। ওগুলোকে সাহস করে পরিত্যাগ করো এবং তারপর দেখার চেষ্টা করো তোমার সত্যিকার অনুভূতি কি।

    সেলিম সুলায়মান বেগের রক্তিম হয়ে উঠা চেহারা খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো। আমি তোমাকে হতাশ করেছি, আমি জানি। আমি আমার বাবাকেও হতাশ করেছি। আমি দুঃখিত।

    দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই বরং এ ব্যাপারে কিছু করার চেষ্টা করো। এটা একটি ভালো বিষয় যে তোমার বাবা এই মুহূর্তে দিল্লী এবং আগ্রা পরিদর্শনে গিয়েছেন এবং তোমার এই অবস্থা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। উনি লাহোরে ফিরে আসার আগে তোমার হাতে চার সপ্তাহ সময় রয়েছে। নিজেকে সুস্থ করে তোলার জন্য এই সময়টি কাজে লাগাও। তোমার ধারণা তোমার বাবা তোমাকে তুচ্ছজ্ঞান করেন তাহলে, এই ক্ষেত্রে তাঁর জন্য আরো অধিক সুযোগ সৃষ্টি করো না।

    তুমি একজন ভালো বন্ধু সুলায়মান বেগ…আমি জানি তুমি আমার ভালো চাও কিন্তু তুমি জানো না আমার কষ্ট কতো তীব্র। আমার তারুণ্য বয়ে যাচ্ছে। আমার শক্তিসামর্থ এবং আমার প্রতিভা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে…

    নিজেরও উপর আস্থা হারিও না। তুমি আমাকে প্রায়ই বলতে শেখ সেলিম চিশতি তোমাকে কি বলেছিলেন—এই যে তোমার জীবন সহজ হবে না…এও বলেছেন তিনি তোমাকে ঈর্ষা করেন না…তুমি একদিন সম্রাট হবে এবং তোমার সব স্বপ্ন একসময় পূরণ হবে। এসব কথা তোমার ভুলে যাওয়া উচিত নয়। উনি একজন বিজ্ঞ লোক ছিলেন। কিন্তু তোমার বর্তমান কর্মকাণ্ড তার স্মৃতির প্রতি অসম্মান জনক।

    তার দুধভাই যা বললো সেলিম তার উত্তর দেয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলো না। তুমি ঠিকই বলেছে। অবশেষে সে বললো। নিজের হীনমন্যতার আক্রমণে নিজেকে ধ্বংস হতে দেবো না আমি। আমি ওপিয়াম এবং সুরার নেশা ত্যাগ করবো, অন্তত কিছু দিনের জন্য, কিন্তু সেজন্য তোমার সাহায্য প্রয়োজন হবে…

    নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সাহায্য করবো। এখন প্রথমে যা করতে হবে তা হলো একজন হেকিমকে দিয়ে তোমাকে পরীক্ষা করাতে হবে। ইতোমধ্যেই আমি একজনকে ডেকেছি-সে গোপনীয়তা রক্ষা করার মতো মানুষ। বাইরে অপেক্ষা করছে।

    তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলে যে তুমি আমাকে রাজি করাতে পারবে…

    না, তবে আমি আশা করেছিলাম তুমি আমার কথা শুনবে।

    আধ ঘন্টা ধরে হেকিম সেলিমকে পরীক্ষা করলো। তার চোখ দেখলো, জিভের রং পরীক্ষা করলো, চ্যাপ্টা ফলা বিশিষ্ট ধাতব পাত দিয়ে ঘষে জিভ পরিষ্কার করলো, নাড়ি পরীক্ষা করলো এবং পেটের বিভিন্ন অংশ টিপেটুপে দেখলো। পরীক্ষা করার সময় হেকিম মুখে বিশেষ কিছু বললো না কিন্তু অত্যন্ত মনোযোগর সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলো।

    জাহাপনা, নিজের যন্ত্রপাতির ব্যাগটি বন্ধ করতে করতে হেকিম বললো, আমি আপনার কাছে সত্য গোপন করবো না। আপনি বলেছেন আপনি গত রাতে খুব বেশি পরিমাণ ওপিয়াম গ্রহণ করেছেন। আপনার প্রসারিত হয়ে যাওয়া চোখের মণি দেখেই আমি তা অনুমান করতে পেরেছি। কিন্তু আমি আরো বুঝতে পেরেছি আপনি অতিমাত্রায় মদ্যপানও করেছেন। আপনাকে কড়া মদ এবং ওপিয়াম উভয়ই ত্যাগ করতে হবে। তা না হলে আপনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আপনার মৃত্যুও হতে পারে। এখনো আপনার হাত কাঁপছে।

    না তো, এই দেখুন! সেলিম তার হাত দুটি হেকিমের সামনে মেলে ধরলো। সে তাকে দেখাতে চাইলো তার বক্তব্য ভুল। কিন্তু চিকিৎসক ঠিক কথাই বলেছে। তার ডান হাতটি বাম হাতের তুলনায় বেশি কাঁপছে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করলো সেগুলিকে স্থির করতে, কিন্তু কিছুতেই সেগুলি তার নিয়ন্ত্রণে এলো না।

    হতাশ হবেন না জাহাপনা। উপযুক্ত সময়ে আপনার চিকিৎসা শুরু হয়েছে এবং আপনার শরীর এখনো তরুণ এবং বলিষ্ঠ। কিন্তু আপনাকে আমার কথা মতো চলতে হবে। আপনি কি নিজেকে আমার হাতে সোপর্দ করতে রাজি আছেন?

    আমার সুস্থ হতে কতো দিন সময় লাগবে?

    সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে জাহাপনা।

    নভেম্বরের এক সকালে ফ্যাকাশে সূর্যালোকের নিচে সেলিম এবং সুলায়মান বেগ রবি নদীর পার দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের অনুসরণ করছে শিকারের সহকারীরা, সকলের মধ্যে উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে উত্তম শিকারের চিন্তায়। হঠাৎ একটি কাদাখোঁচা পাখি(স্নাইপ) নদীপারের উঁচু ঝোঁপ থেকে উড়ে বেরিয়ে এলো। সেলিম তার রেকাবে দাঁড়িয়ে তূণীর থেকে তীর নিয়ে ধনুকে পড়িয়ে পাখিটিকে লক্ষ্য করে ছুড়লো। বর্তমানে সে তার হাতের স্থিরতা ফিরে পেয়েছে এবং পাখিটি তীরবিদ্ধ হয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে ডানা ঝাপটাতে লাগলো। সেই রাতে অতিরিক্ত নেশা করে জ্ঞান হারানোর ঘটনার পর ছয় মাস অতিবাহিত হয়েছে। এই ছয় মাস অত্যন্ত বিড়ম্বনার সঙ্গে কেটেছে। এ সময়ের মধ্যে একাধিক বার মনের দৃঢ়তা দুর্বল হয়ে অপিয়াম এবং সুরার দ্বৈত নেশায় ফিরে গিয়েছে সে। কিন্তু সেগুলি ত্যাগ করার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছিলো। এখনো মাঝে মাঝে তার পদস্খলন ঘটে, বিশেষ করে যখন আকবর তার প্রতি অবজ্ঞা বা বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন। কিন্তু বর্তমানে সেলিম তার ধনুকটি পিঠে ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে প্রতিজ্ঞা করলো সে আগামীতে আর নিজের দৃঢ়তা হারাবে না, ভবিষ্যৎ তার জন্য যাই ধারণ করুক, যতো রকম পরাজয় বা হাতাশারই সে সম্মুখীন হোক।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএম্পায়ার অভ দা মোগল : দি টেনটেড থ্রোন – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }