Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প613 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৬.১ পৃথিবীর অধীশ্বর

    ২৭. একটি পাটের থলে

    আমি এখন নিশ্চিত ভাবে জানি বাবা আমাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ প্রদান করবেন না। যদিও তিনি আমার পিতামহ এবং প্রপিতামহের মতোই আমার অর্ধেক বয়সে সম্রাট হয়েছিলেন। কোমরের খাপ থেকে নিজের আনুষ্ঠানিক খঞ্জরটি বের করে নিয়ে সেলিম ডিভানের গোলপি রেশমের আচ্ছাদনের উপর আঘাত করলো। বিকেলের উষ্ণ আবহাওয়ায় সে লাহোরের দুর্গপ্রাসাদের একটি কক্ষে সময় কাটাচ্ছে। খঞ্জরটির ফলা ভোতা, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটি কোমল রেশম ভেদ করে তুলার আস্তরণের মধ্যে ঢুকে গেলো। আমি দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করলোম, কিন্তু কি লাভ হলো? কিছুই না! কোনো সেনাপতির পদ পেলাম না, কোনো প্রশাসকের পদ পেলাম না, কোনো সম্ভাবনাও সৃষ্টি হলো না। এমন কি একটি সান্ত্বনা বাক্যও নয়। আমি এখন কি করবো? সেলিম সুলায়মান বেগের কাছে জানতে চাইলো, সে পাশাপাশি স্থাপিত আরেকটি গদি-আঁটা আসনে আধ-শোয়া হয়ে আছে। তার এক হাতে একটি আমের রসের পানপাত্র ধরা রয়েছে। আমি ঠিক বলতে পারবো না, সুলায়মান বেগ চিন্তিত কণ্ঠে বললো। তারপর আমের রসে একটি চুমুক দিয়ে আবার বললো, কিন্তু আমি যতদূর জানি তা হলো উত্তরাধিকার লাভ করার ক্ষেত্রে সময় এবং ধৈর্যই মূল চাবিকাঠি।

    যদিও বাবার বয়স এখন পঞ্চাশের শেষের দিকে, তাঁর স্বাস্থ্য এখন আগের চাইতেও ভালো। তোমার ইঙ্গিত তাঁর জন্য প্রযোজ্য নয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি অমর কি না-যে ভাবে তিনি তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছেন এবং উত্তরাধিকারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাথা ঘামাচ্ছেন না তাতে মনে হয় তিনি নিজের মরণশীলতায় বিশ্বাস করেন না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁর এমন আত্মবিশ্বাসই আরো দৃঢ় হয়েছে যে তিনি সব কিছু সকলের চেয়ে ভালো বোঝেন। সেলিম আবার ডিভানে আঘাত করলো, এবার আরো জোরে, ধূলো এবং তুলার আঁশ ছিটকে বের হলো।

    যদিও শীঘই তোমার বাবার স্বর্গে বিশ্রামে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তোমার সৎ ভাইদের অবস্থা এর বিপরীত যারা উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। তারা উভয়েই মদের কাছে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছে। তাদের এই আচরণ যদি অব্যাহত থাকে তাহলে খুব শীঘ্রই তারা পৃথিবীর বুকে বিচরণ করার অধিকার হারাবে।

    দশ দিন আগে মুরাদ এবং দানিয়েলের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো তা মনে পড়তে সেলিম আপন মনে হাসলো। কোনো রকম পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আকবর তার তিন পুত্রকে রাজ প্রাসাদের সম্মুখে অবস্থিত কুচকাওয়াজের মাঠে ভোর বেলা ডেকে পাঠান। রবি নদীর উপর তখনো সাদা কুয়াশা জমে ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে তার আগের সন্ধ্যা বেলায় সেলিম হেকিমের নির্দেশ পালন করে মদ বা ওপিয়াম স্পর্শ করেনি। বরং হেরেমে গিয়ে যোধ বাঈ এর সঙ্গে প্রণয়লীলায় লিপ্ত হয়েছিলো। ফলে তার মন ছিলো ফুরফুরে এবং শরীর ছিলো সতেজ যখন সে কুচকাওয়াজের মাঠে উপস্থিত হয়।

    তারা তিন জন মাঠে উপস্থিত হতেই পরিষ্কার বোঝা গেলো মুরাদ বা দানিয়েল কেউই সেলিমের মতো পূর্বের সন্ধ্যায় সংযম পালন করেনি। মুরাদ যখন উঁচু পাথুরে দ্বারের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করলো দেখা গেলো তার একজন পরিচারক তখনো তার কোমর বন্ধনী বাঁধার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মুরাদের চৌকো চোয়াল বিব্রতকর ভাবে ঝুলে ছিলো। দানিয়েল প্রবেশ করলো মাতালের টলমল করতে থাকা পদক্ষেপে। তার মাথাটি অস্বাভাবিক রকম স্থির ছিলো এবং চোখ দুটি ছিলো রক্তাভ। আকবরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় সে একাধিক বার হোঁচট খেলো।

    আকবর তাঁদের তিন জনকে আদেশ দিলেন ঘোড়ার পিঠে চড়ার জন্য। তারা যখন ঘোড়ার পিঠে উঠার চেষ্টা করলো, মুরাদের ঢিলা কোমর বন্ধনী ছুটে গেলো এবং তাতে তার পা পেচিয়ে সে হোঁচট খেলো এবং মাটিতে উপুর হয়ে পড়ে গেলো। পরিচারকদের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত সে ঘোড়ায় চড়তে পারলো এবং কিছু দূর অগ্রসরও হলো কিন্তু মাত্র একশ গজ পার হওয়ার পর পিছলে ঘোড়ার পিঠ থেকে নিচে পড়ে গেলো।

    দানিয়েল তার তুলনায় কিছুটা ভালো পারদর্শীতা দেখালো। সে সফল ভাবে ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারলো এবং সামনের দিকে অগ্রসরও হলো। কিন্তু যেই তার বর্শার অগ্রভাগে তরমুজ গাঁথার জন্য সামান্য নিচু হলো ওমনি ধপাস করে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেলো। কোনো রকমে উঠে দাঁড়িয়ে সে অনর্গল বমি করা শুরু করলো।

    সেলিম সব কিছুই ভালো ভাবে সম্পন্ন করলো। নিপুন দক্ষতায় বর্শা দিয়ে তরমুজ বিদ্ধ করলো সে। তবে তার পিতার বক্তব্যে স্পষ্ট কোনো প্রশংসা প্রকাশ পেলো না। এই প্রথম বারের মতো দেখতে পাচ্ছি তুমি মদ্যপান করোনি সেলিম। তবে মনে রেখো তোমাদের পরীক্ষা নেয়ার এটাই শেষ নয়। তুমি এখন যেতে পার। সেলিম মাঠ ত্যাগ করার পর শুনেছিলো তার পিতা তার সৎ ভাইদের তাদের কক্ষে অবরুদ্ধ রাখার ব্যবস্থা করেছেন চৌদ্দ দিনের জন্য। এবং আদেশ দিয়েছেন কেউ যেনো তাঁদের মদ সরবরাহ না করে। এই সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও তিনি তাঁদের প্রতি নজর রাখতে বলেছেন যাতে তারা কোনো প্রকার নেশা করতে না পারে।

    অবশ্য তারা কয়েক দিনের মধ্যে বন্দীদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর আর নেশাপানি করবে না, কি বলো সুলায়মান বেগ?।

    আমার এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে। আমি শুনেছি তাদের কিছু অনুগামী গোপনে তাদের কাছে মদ সরবরাহ করছে। গুজব কোনো যাচ্ছে মুরাদের স্কুল পরিচারক গরুর অন্ত্রের(নাড়িভূড়ি) মধ্যে মদ ভরে সেটা নিজের তলপেটে পেচিয়ে তার কাছে পাচার করছে। আর দানিয়েল একজন রক্ষীকে ঘুষ দিয়ে গাদা বন্দুকের বন্ধ নলে মদ ভরে তার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছে।

    পরের গুজবটি সত্যি হতে পারে না। এমন স্পষ্ট অবাধ্যতা জানাজানি হলে ঐ রক্ষীকে আমার বাবা হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে হত্যা করবেন।

    অর্থের জন্য মানুষ বিস্ময়কর সব ঝুঁকি নিতে পারে, তবে এটা হয়তো একটি ভিত্তিহীন গুজবই। কিন্তু সেটা সকলের মুখে মুখে ফিরছে।

    হয়তো তোমার কথাই ঠিক, উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমার সম্ভাইরা আমার প্রতিদ্বন্দ্বি নয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে আমার ক্ষমতা প্রাপ্তির কোনো সম্ভাবনা রয়েছে জীবনের বর্তমান পর্যায়ে যা আমার ন্যায্য পাওনা। আমি আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আরো অনেক সমৃদ্ধি বয়ে আনতে পারি যদি বাবা আমাকে কোনো সুযোগ দেন।

    কেমনরকম সমৃদ্ধি? উদাহরণ দাও দেখি।

    যেমন প্রথমে আমি কিছু দুর্নীতিপরায়ণ চাটুকার উপদেষ্টাকে তাঁর কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দেবো-শুরু করবো আবুল ফজলকে দিয়ে।

    কিন্তু তুমি ভালো করেই জানো তোমার বাবা তাদের পদচ্যুতি সমর্থন করবেন না। তাছাড়া তাঁর প্রশাসন এবং উপদেষ্টাদের সমালোচনা করার আগে তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমি নিজে একজন দক্ষ প্রশাসক। কিন্তু সেটা আমি কীভাবে প্রমাণ করবো যেখানে বাবা আমাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করছেন না? সেলিম আবার তার খঞ্জরটি ডিভানে বিদ্ধ করলো এবং তার চোখ ঝলসে উঠলো। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবার অনুমতি ছাড়াই কোনো প্রদেশের শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই নিজের সামর্থ প্রমাণ করার জন্য!

    কিন্তু সেটা তো বিদ্রোহ বলে বিবেচিত হবে।

    তুমি একে যা ইচ্ছা বলতে পারো- কিন্তু আমি বলবো সেটা হবে আমার একটি সাহসি উদ্যোগ।

    এটা তোমার আন্তরিক ইচ্ছা, তাই না? সুলায়মান বেগ আস্তে করে বললো।

    হ্যাঁ, সেলিম উত্তর দিলো এবং সরাসরি তার বন্ধুর চোখের দিকে তাকালো।

    বেশ কিছুদিন ধরে রাতের বেলা নিজের মাদকাসক্তির প্রতি সংযম ধারণ করে আমি এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করছি। তোমার এতে আহত হওয়ার কিছু নেই পূর্বাঞ্চলে আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যম মর্যাদার তরুণ সেনাপতিদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধু রয়েছে। তারাও তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রভাব পছন্দ করছে না এবং আমার মতোই ক্ষমতা এবং দায়িত্ব পেতে চায়।

    এটা সত্যি, আমি জানি। আমার কানেও এ ধরনের অসন্তোষের গুজব এসেছে, সুলায়মান বেগ বললো। তরুণ সেনাকর্তাদের অনেকেই নিজেদেরকে পদোন্নতি এবং পুরষ্কারের উপযুক্ত বলে দাবি করছে।

    আমার মনে হচ্ছে তুমিও উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে আমি অলীক কল্পনা করছি না। তুমি কি আমার সঙ্গে যোগ দিতে প্রস্তুত?

    তোমার বোঝা উচিত ছিলো আমি তোমাকে সমর্থন করবো। আমরা পরস্পর সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। অন্য কারো চেয়ে আমি তোমার প্রতিই বেশি বিশ্বস্ত। কথাগুলি বলে সুলায়মান বেগ কয়েক মুহূর্ত গভীর ভাবে চিন্তা করলো। এখন তাকে সেলিমের মতোই গম্ভীর এবং একাগ্র মনে হচ্ছে, তারপর সে বললো, এই উদ্যোগের ফলে হয়তো তুমি তোমার পিতার মনোযোগ এবং শ্রদ্ধা অর্জন করতে সফল হবে। তুমি যদি এ ব্যাপারে কাজ শুরু করো তোমার প্রথম পদক্ষেপ কি হবে?

    আমার প্রথম পদক্ষেপ হবে পূর্বাঞ্চলের ঐসব তরুণ সেনা কর্তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া। তবে বাবার অনুমতি ব্যতীত আমার পক্ষে ঐ অঞ্চলে যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তোমার পক্ষে সম্ভব…।

    ঠিক আছে, আমি যাব- বাংলার প্রশাসক মহলে এখনো আমার কিছু আত্মীয় স্বজন রয়েছে। আমি তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কেউ সন্দেহ করবে না।

    আমার উপর আস্থা পোষণ করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। কথাগুলি বলার সময় নিজের কণ্ঠস্বরে সেলিম কিছুটা বিস্মিত হলো। সে তার কণ্ঠে এক অভিনব কর্তৃত্বের আভাস পেলো যা তার পিতার অনুরূপ। এখন সে তার কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ, অন্তত তার অনিশ্চিত অপেক্ষার দিনগুলি ফুরিয়েছে। ফলাফল যাই হোক না কেনো সে এখন আর নিজেকে যথেষ্ট সাহসি না হওয়ার জন্য তিরস্কার করতে পারবে না।

    *

    তিন মাস পরের ঘটনা। সেলিম শিবিরের কেন্দ্রে অবস্থিত তার বিশাল তাবুর সম্মুখের চাদোয়ার নিচ থেকে সামনের দিকে তাকালো। চম্বল নদীর উপর সূর্য অস্ত যাচ্ছে। বাঘ শিকারের অজুহাতে ছয় সপ্তাহ আগে সে রাজধানী ত্যাগ করেছে। বিগত কয়েক দিন ধরে অস্থির চিত্তে সে দিগন্ত পর্যবেক্ষণ করেছে তার শিবিরের দিকে অগ্রসরমান একদল অশ্বারোহীর দেখা পাওয়ার জন্য, আশা করছে সুলায়মান বেগ পূর্বাঞ্চলে তার গোপন দায়িত্ব পালন শেষে শীঘ্রই ফিরে আসবে। কিন্তু তার মনের অন্য একটি অংশ আশঙ্কা করছে হয়তো তার শিবিরের দিকে অগ্রসরমান অশ্বারোহীর দল আবুল ফজলের পাঠানো হতে পারে যারা তাকে গ্রেপ্তার করতে আসবে তার গোপন ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে।

    সেই দিন দুপুরে একদল অশ্বারোহী সত্যিই এসেছিলো। তারা যখন আরেকটু কাছে চলে এলো, সেলিমের মনে হলো এতো ছোট দল তাকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঠানো হতে পারে না। সেলিম অবশেষে সম্পূর্ণ দুশ্চিন্তামুক্ত হলো যখন দেখতে পেলো সেটা সুলায়মান বেগেরই দল। যাইহোক, ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত সুলায়মান বেগ সেলিমকে তার অভিযানের দুই একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য সম্পর্কে অবহিত করে আশ্বস্ত করলো এবং কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার অনুমতি চাইলো। তারা আরো সিদ্ধান্ত নিলো এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ। করবে নৈশ ভোজের সময়।

    সেলিম তার কপালের উপর হাত রেখে অস্তরত সূর্যরশ্মি থেকে চোখ আড়াল করে দেখলো সুলায়মান বেগ তার দিকে এগিয়ে আসছে। দুই বন্ধু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় করলো, তারপর পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে তাবুর ভিতর প্রবেশ করলো। তাবুর কেন্দ্রস্থলের অবস্থিত একটি নিচু টেবিলে নৈশভোজের আয়োজন সাজানো রয়েছে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে তন্দুরী মুরগী এবং ভেড়া; কাশ্মীরি কায়দায় দৈ ও হালকা মশলা দিয়ে রান্না করা শুকনো ফল; গুজরাটি কায়দায় তৈরি ঝাল শজি এবং চম্বল নদীর মাছ। রসালো ঝোলে নান রুটি ভিজিয়ে তারা ভোজন পর্ব শুরু করলো এবং সেলিম তার পরিচারকদের তাবুর বাইরে যেতে আদেশ দিয়ে আলাপ আরম্ভ করলো।

    বল সুলায়মান, পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলির কতোজন সেনা কর্তাকে আমরা দলে পাবো?

    প্রায় দুই হাজারের মতো। প্রতিটি নতুন যোগদানকারী অন্যদের দলে টেনেছে যাদের আমাদের উদ্দেশ্যকে সমর্থন করার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যেমন অনুমান করেছিলাম তাদের বেশিরভাগই আমাদের মতো তরুণ। দায়িত্ব লাভের বিষয়ে তারা সকলেই উগ্রীব সেই সঙ্গে পুরষ্কার লাভের জন্যেও তোমার পক্ষ থেকে আমি যার প্রতিশ্রুতি তাদের দিয়েছি। কিন্তু কিছু বয়স্ক সেনাকর্তাও আমাদের দলে যোগ দিতে আগ্রহী। তারা তাদের পদোন্নতির বিষয়ে অসন্তুষ্ট অথবা পুরানো শত্রুদের প্রতি তোমার পিতার সহনশীলতায় ক্ষুব্ধ। তাছাড়া কিছু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীও রয়েছে।

    তাদের অধীনে সর্বমোট কতোজন সৈন্য রয়েছে?

    প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো।

    বাবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই সংখ্যা যথেষ্ট, কি বলো?

    অনেকে এ কারণে আমাদের দলে যোগ দেয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে যে উদ্যোগটা তুমি নিয়েছে। বিষয়টি সম্পূর্ণ বিদ্রোহের পর্যায়ে পড়বে না যেহেতু বাইরের কেউ তোমার পিতাকে সিংহাসন থেকে উৎখাতের পরিকল্পনা করেনি। তারা একথা ভেবে আরো আশ্বস্ত হয়েছে যে কোনো এক পর্যায়ে তুমি আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাবে।

    তাহলে তাদের এমন ধারণা অব্যাহতই থাকবে, কি বলো?

    তার মানে? তুমি কি তোমার পিতার সঙ্গে সমঝোতা করবে না?

    না…মানে…নিশ্চয়ই করবো। তবে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা না করে তার আগেই তাকে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করতে পারবো।

    এমন চিন্তার লাগাম টেনে ধরো সেলিম। তোমার বাবার প্রত্যক্ষ অধীনে অবস্থিত সেনাবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী। তোমার তেজস্বিতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায় তোমার সম্ভাব্য গুরুত্ব প্রদর্শনের জন্য যতোটা সমর্থন প্রয়োজন আমরা কেবল তারই সংস্থান করতে পেরেছি। কিন্তু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার মতো সামর্থ আমাদের নেই। তুমি যদি সেই চেষ্টা করো তাহলে অনেকেই আমাদের উপর থেকে তাদের সমর্থন সরিয়ে নেবে।

    অধিকাংশ মানুষ আমার পিতাকে ভালোবাসে, আমি সেটা জানি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি তাঁর প্রজাদের সুখ দুঃখের ব্যাপারে যতোটা সচেতন, তার নিজের পরিবারের ব্যাপারে ততোটা নন। তুমি আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি অবশ্যই তার সঙ্গে সমঝোতা করবো। আমি কেবল আমাদের সামর্থের সব দিক বিবেচনায় আনতে চেয়েছি।

    আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ কখনো নেবো? বেশি দেরি করা উচিত হবে না। সবখানে আবুল ফজলের গুপ্তচর ছড়িয়ে রয়েছে। সূক্ষ্ম পন্থায় মানুষের গোপন তথ্য উদ্ঘাটন করা এবং মানুষের অনুগত্য পরিবর্তন করার কাজে সে অত্যন্ত পারদর্শী।

    আবুল ফজলের ব্যাপারে আমাকে ভাবতে দাও। যতোযাই হোক, সে একজন মানুষ বৈ অন্য কিছু নয়। কিন্তু আমিও কালক্ষেপন করবো না। ইতোমধ্যেই আমি আগ্রা এবং দিল্লীতে আমার প্রতি বিশ্বস্ত লোকদের কাছে বার্তা পাঠিয়েছি যাতে তারা এক মাসের মধ্যে আমার সঙ্গে এখানে যোগ দেয়। তোমার সঙ্গে আরো বিস্তারিত পরিকল্পনার পর এবং তোমার বিশ্রাম নেয়া শেষ হলে তুমি পূর্বাঞ্চলে ফিরে গিয়ে আমাদের সমর্থক বাহিনী সংগঠন করা আরম্ভ করবে। এদিকে আমার বাহিনী একত্রিত হওয়ার পর আমি তাদের নিয়ে তোমার সঙ্গে এলাহাবাদে মিলিত হবো। গঙ্গা এবং যমুনা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত এলাহাবাদ সবদিক থেকে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যদি আমরা আমাদের প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করি তাহলে বাবা আমাদেরকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারবেন না।

    *

    সেলিম হাত তুলে তার সেনাবাহিনীকে থামার ইঙ্গিত করলো। এলাহাবাদের প্রশাসক নাসের হামিদের কাছে সে যে দূত পাঠিয়েছিলো তাকে ফিরে আসতে দেখা যাচ্ছে। তারা যেখানে রয়েছে সেখান থেকে এলাহাবাদ মাত্র চার মাইল দূরে অবস্থিত এবং শহরের গম্বুজ ও মিনারগুলি এখান থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। তরুণ দূতটি যখন সেলিমের সম্মুখে উপস্থিত হলো তখন তার মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো। জাঁহাপনা, নাসের হামিদ তার শহরে আপনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

    সেলিমের কাঁধ দুটি শিথিল হলো, গত কয়েক সপ্তাহরে মধ্যে এই প্রথম সে কিছুটা স্বস্তি বোধ করা শুরু করলো। নাসের হামিদ তার বহু পুরানো বন্ধু এবং তার সঙ্গে গোপন চিঠি বিনিময় কালে সে জানায় সেলিমের কাছে এলাহাবাদকে সমর্পণ করতে সে প্রস্তুত রয়েছে। যাইহোক, শহরে প্রবেশের সময় সেলিম কিছুটা উৎকণ্ঠা অনুভব করলো। তার মনে হলো সবকিছু খুব বেশি মসৃণভাবে সম্পন্ন হচ্ছে। সুলায়মান বেগ চলে যাওয়ার পর সফল ভাবে লাহোর এবং আগ্রার তরুণ সেনাকর্তাগণ তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সাত সপ্তাহ আগে, আবুল ফজলের সঙ্গে আলাপরত অবস্থায়, আকবর তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের আরেকটি শিকার অভিযানের জন্য রাজধানীর বাইরে থাকার আবেদনে সম্মতি প্রদান করেন। তার পরের দিন সেলিম তার একদল অনুসারীকে নিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের অভিযানে বেরিয়ে পড়ে (সে নিজে বিষয়টিকে এভাবেই দেখে), যদিও অন্যরা একে বিদ্রোহ বলে আখ্যা দেবে।

    সম্মুখে অগ্রসর হতে হতে সেলিমের মনে হলো সেই সময় পরিস্থিতি কেমন দাঁড়াবে যখন পুনরায় সে আকবরের মুখোমুখী হবে। তার বিরূপ কর্মকাণ্ডে আকবরের যে প্রতিক্রিয়া হবে তার থেকেও গুরুতর বিষয় হলো সে তার স্ত্রী ও পুত্রদের সঙ্গে আনতে পারেনি। অবশ্য তার পরিকল্পনার বিষয়ে স্ত্রীদের অবহিত করার মতো আস্থা তার তাঁদের উপর নেই। তাছাড়া হেরেমের পরিবেশে কোনো গুঢ় তত্ত্ব গোপন রাখাও প্রায় অসম্ভব। তার পুত্ররা তাদের পিতামহের সঙ্গে যতো সময় কাটায় তাতে রাজপ্রাসাদে তাদের অনুপস্থিতি অস্বাভাবিক দেখাবে এবং বিষয়টি উপেক্ষিতও থাকবে না। অবশ্য তার সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে এই জন্য যে রাজধানী ত্যাগ করার সময় সে তার পিতামহীকে কিছু বলে আসতে পারেনি, কাবুল থেকে তার প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে যাকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। বাবার সঙ্গে তার সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘটনা তাকে আহত করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি উভয়কেই অত্যন্ত ভালোবাসেন এবং উভয়ের ব্যাপারেই শঙ্কিত হবেন। এই বিরোধীতা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে কি না এমন দুশ্চিন্তাও তাকে পেয়ে বসবে। তবে এই মুহূর্তে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সেলিমের তথ্য সংগ্রহকারীরা জানিয়েছে কেউ তাঁদের পশ্চাধাবন করেনি। একবার অবশ্য তার বাবার নিয়মিত টহলদানকরী একদল অশ্বারোহী সামনে পড়ে গিয়েছিল। তারা অনেক দূরে থাকতেই সেলিম দিক পরিবর্তন করে তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে গেছে। সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে সেলিমের সৈন্যদল ভারী হয়েছে এবং তাদের নেতৃত্ব দানের স্বাধীনতা সে উপভোগ করতে আরম্ভ করেছে যাতে আকবরের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তবে সে বুঝতে পারছে এই পরিস্থিতি চীরস্থায়ী হবে না, কিন্তু তার জন্য অনুকূল হয় এমন ফলাফল এই অবস্থা থেকে সৃষ্টি করতে হবে।

    সুলায়মান বেগ খবর পাঠিয়েছে সে বাংলা থেকে তার সৈন্যদল নিয়ে এলাহাবাদের পৌঁছাবে দুই সপ্তাহ পরে। তার দুধভাই এর তার সঙ্গে পুনরায় যোগ দেয়ার বিষয়ে সে অত্যন্ত উদ্গ্রীব হয়ে আছে। সেটা কেবল এই জন্য নয় যে, সে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিতে আসছে। বরং তার বন্ধুত্ব, তার সুচিন্তিত উপদেশ এবং তার নিঃশর্ত বিশ্বস্তও এই আকাঙ্ক্ষার পিছনে কার্যকর। কিন্তু এই মুহূর্তে এলাহাবাদের প্রবেশের ক্ষণটিকে তার যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক করে তুলতে হবে। শহরের নাগরিকদের মাঝে তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম জাগিয়ে তুলতে হবে, সেই সঙ্গে নিজের লোকদের আত্মবিশ্বাসও বৃদ্ধি করতে হবে।

    আমাদের পতাকা গুলি মেলে উত্তোলন করো, ঘোড়ার জিনের উপর আরো সোজা হয়ে বসে সেলিম আদেশ দিলো। অশ্বারোহী শিঙ্গা বাদক এবং হাতির পিঠে থাকা ঢোল বাদকদের সামনের দিকে অবস্থান নিতে বললো। সকল সৈন্যকে সঠিক ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে কুচকাওয়াজ করার নির্দেশ প্রদান করো। তারপর শিঙ্গার সাথে ঢাক বাজানো শুরু করতে বলল, এলাহাবাদের প্রবেশদ্বার আর বেশি দূরে নয়।

    তিন মাস পরের ঘটনা। সেলিম এবং সুলায়মান বেগ এলাহাবাদের দূর্গপ্রাচীরের উপরে দাঁড়িয়ে নিচের কুচকাওয়াজের মাঠে সেলিমের অশ্বারোহী বাহিনীর অনুশীলন দেখছিলো। এ সময় একজন পরিচারক তাদের কাছে উপস্থিত হলো। জাহাপনা, অর্চার বুন্দেলা রাজা বীর সিং এর দূত এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। কাছাকাছি অবস্থিত যমুনা নদীর তীরে সেনাবুর লম্বা সারি দেখা যাচ্ছে, সেখানে সেলিমের অনুগত প্রায় পঞ্চাশ হাজার সৈন্য রয়েছে। পূর্বে যা অনুমান করা হয়েছিলো তার তুলনায় এই সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ।

    আমি এখনই ওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবো। তাকে এখানে নিয়ে এসো।

    পাঁচ মিনিট পর একজন লম্বা হালকা পাতলা গড়নের লোক পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে সেখানে উপস্থিত হলো। সে দুকানে বড় বড় চক্রাকার সোনার বলয়(রিং) পড়ে আছে। দীর্ঘ ভ্রমণের ফলে তার পোশাক ধূলিমলিন। তার এক হাতে একটি পাটের থলে ধরা রয়েছে যাকে ঘিরে কিছু মাছি ভন ভন করছে। সেলিমের কাছ থেকে বারো ফুট দূরে থাকতে লোকটি থামলো এবং উবু হয়ে পাটের থলেটি মেঝেতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

    রাজার কাছ থেকে আমার জন্য কি সংবাদ এনেছো?

    দূতটি বিস্তৃত হাসি দিলো, ঝাকড়া কালো গোঁফের নিচে তার অসমান ময়লা দাঁত গুলি স্পষ্ট দেখা গেলো। আমি যে সংবাদ এনেছি তা শোনার পর আপনি অতিব আনন্দিত হয়ে উঠবেন জাহাপনা।

    দেরি কোরনা, বলো।

    রাজা বীর সিং আপনার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছেন। কথা বলার সময় লোকটি পাটের থলেটি মেঝে থেকে তুললো এবং সেটার মুখে শক্ত করে বাঁধা দড়িটি খুলতে শুরু করলো। থলেটি ভোলা হতেই একটা আশটে মিষ্টি গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো। সে থলেটির ভিতরে হাত ঢুকিয়ে চুল ধরে পচনরত একটি মানুষের মাথা বের করে আনলো। যদিও মস্তকটিতে লেগে থাকা মাংস পচে কিছুটা শুকিয়ে গেছে, বেগুনি বর্ণ ধারণ করা ঠোঁটটি ফাঁক হয়ে আছে এবং মুখের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমাট বেঁধে আছে তবুও আবুল ফজলকে চিনতে সেলিমের অসুবিধা হলো না। দৃশ্যটি দেখে সুলায়মান বেগের মুখটি ফ্যাকাশে এবং বেদনার্ত হয়ে উঠলো। সে পেট চেপে ধরে বমি করার জন্য ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো।

    কিন্তু সেলিম একটুও বিচলিত হলো না, শান্ত কণ্ঠে সে বলে উঠলো, রাজা খুব ভালোভাবে আমার আদেশ পালন করেছে। তোমাদের দুজনকেই আমি প্রতিশ্রুতির তুলনায় দ্বিগুণ পুরষ্কার প্রদান করবো। তারপর সে সুলায়মান বেগের দিকে ফিরলো। পূর্বে আমি তোমাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানাইনি তোমার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। যদি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হত তাহলে তুমি কিছু না জানার অজুহাতে যে কোনো রকম দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকতে। আবুল ফজলকে হত্যা করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিলো। সে আমার এক নম্বর শত্রু ছিলো। সেলিম দূতটির দিকে ফিরলো। ওকে হত্যা করার বিস্তারিত কাহিনী আমাকে বল।

    আপনি রাজাকে জানিয়েছিলেন যে আবুল ফজল দাক্ষিণাত্যের সীমান্তে যুদ্ধরত রাজকীয় বাহিনীর পরিদর্শন শেষে আগ্রা ফেরার পথে ওনার এলাকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হবে। আমাদের পাহাড় বেষ্ঠিত রাজ্য অতিক্রম করার জন্য মাত্র দুটি পথ রয়েছে এবং রাজা উভয় পথেই গুপ্ত আক্রমণের জন্য লোক নিয়োজিত করেন। এক মাস আগে তিনি খবর পান আবুল ফজল পশ্চিমের পথটির দিকে পঞ্চাশ জনের একটি দল নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমাদের লোকেরা তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম- শেষ বিকেলের দিকে তাঁদের উপর হামলা চালায় যখন তারা সংকীর্ণ একটি গিরিপথ অতিক্রম করছিলো। প্রথমে আমাদের বন্দুকধারীরা রাস্তার উপরের ঢালে অবস্থিত বড় বড় পাথরের চাঁই এর আড়াল থেকে তাদের উপর গুলি বর্ষণ করে। কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই আবুল ফজলের দেহরক্ষীরা গুলি বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু আবুল ফজল এবং তার ডজনখানেক সঙ্গী অক্ষত অবস্থায় ঘোড়া থেকে নেমে রাস্তার পার্শ্ববর্তী পাথর এবং ঝোঁপ ঝাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়। আমাদের সৈন্যরা তাঁদের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পাথর এবং ঝোঁপের আড়াল থেকে অব্যর্থ লক্ষ্যে গুলি চালিয়ে আবুল ফজলের লোকেরা তাদের অনেককে আহত করতে সক্ষম হয়। তাঁদের মধ্যে আমার আপন ভাইও ছিলো। তার মুখে গুলি লাগে যার ফলে তার অধিকাংশ দাঁত এবং চোয়ালের অংশ বিশেষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সে এখনোও বেঁচে আছে কিন্তু কথা বলতে পারে না এবং ঠিকমতো খেতে পারে না। তার যন্ত্রণার অবশান হওয়ার জন্য আমি কামনা করছি যেনো অতি শীঘ্রই তার মৃত্যু হয়।

    দূতটি থামলো, এক মুহূর্তের জন্য তার চেহারায় বিষাদের ছায়া দেখা গেলো, তারপর সে আবার শুরু করলো, এক সময় আবুল ফজলকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়। তারপর রাজা সাদা পতাকা হাতে তার কাছে একজন দূত পাঠান বার্তা দিয়ে। দূতটি আবুল ফজলকে জানায় যদি সে আত্মসমর্পণ করে তাহলে রাজা তার সঙ্গীদের মুক্তি দেবেন। এর কয়েক মিনিট পরে আবুল ফজল পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং তার তলোয়ারটি ফেলে দিয়ে রাজার মুখোমুখী হয়। যখন সে কথা বলে উঠে তার চেহারা তখন ভাবলেশহীন ছিলো। আমি তোমার মতো একজন অপরিচ্ছন্ন মাছি বসা পাহাড়ি গোত্রপতির ভয়ে ভীত হয়ে পালানোর চেষ্টা করবো না। তুমি আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করো কিন্তু স্মরণ রেখো আমি কার অধীনে দায়িত্ব পালন করছি।

    আবুল ফজলের ঘৃণাপূর্ণ বক্তব্যে রাজা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন এবং কোমর থেকে নিজের খাঁজ কাটা খঞ্জরটি বের করে তার স্থূল গলায় বসিয়ে দেন। অবশ্য আবুল ফজল কোনো প্রকার বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। আমি বহু লোককে হত্যা করতে দেখেছি কিন্তু আবুল ফজলের গলা থেকে যতো রক্ত বেরিয়েছে তেমনটা কখনোও দেখিনি। তারপর রাজা অবুল ফজলের সকল সঙ্গীকে হত্যা করার আদেশ দেন। হত্যার পর তাদের দেহ মাটির অনেক গভীরে পুতে ফেলা হয়।

    রাজা যে তার সঙ্গীদের হত্যা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তা রক্ষা করলো না কেনো? সুলায়মান বেগ জিজ্ঞাসা করলো।

    রাজা জানতেন ম্রাট আবুল ফজলকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। তার সঙ্গীদের বাঁচতে দিলে তারা সম্রাটের কাছে সব কথা ফাঁস করে দিতো। ফলে রাজার জীবন বিপন্ন হতো। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি।

    এটা প্রয়োজন ছিলো সুলায়মান, সেলিম বললো। কোনো কাজ সুচারু ভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমাদেরকে মাঝে মাঝে নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নিতে হয়। আমি কামনা করি আবুল ফজলের সাহসি সঙ্গীদের আত্মা স্বর্গে স্থান পাক। তাদের একমাত্র অপরাধ ছিলো তারা একটি দুষ্ট লোকের অনুগত্য করেছে। আবুল ফজল বিরতিহীন ভাবে বাবার কানে আমার নামে বিষ ঢেলেছে। তাকে আমার মাতলামি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়ে অবহিত করেছে। নিজের লোকদের নিয়োগ দানের জন্য সুপারিশ করেছে আমাকে বা আমার বন্ধুদের উপেক্ষা করে। এমনকি আমার দাদীও আমাকে তার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন এই বলে যে সে আমার প্রতি সদয় নয়। আমি তাকে ঘৃণা করতাম।

    তার প্রতি আবুল ফজলের আচরণের স্মৃতি একে একে স্মরণে আসতে থাকায় সেলিম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে সে ছিন্ন মস্তকটিকে প্রচণ্ড এক লাথি হাঁকলো এবং সেটা দুর্গ পরিখার মধ্যে জমে থাকা ময়লার মধ্যে গিয়ে পড়লো। ওর মিথ্যাবাদী চাটুকারী জিহ্বা কুকুরের খাদ্যে পরিণত হোক এবং ওর সদা প্রশ্নবোধক চোখ গুলি কাকেরা খুটে খাক।

    সেইদিন সন্ধ্যার সময় দুর্গে সেলিমের কক্ষে সেলিম ও সুলায়মান বেগ বিশ্রাম করছিলো। যদিও সেলিম ওপিয়ামের নেশা পরিত্যাগ করেছে কিন্তু সে আবার। সুরাপান আরম্ভ করেছে। মদের স্বাদ তার ভালোলাগে এবং সে নিজেকে এই বলে বর্তমানে প্রবোধ দিচ্ছে যে মদের দাস হওয়ার তুলনায় এর প্রভু হওয়ার। মতো যথেষ্ট মনোবল এখন তার আছে। একজন পরিচারক তাদের একটি পূর্ণ। বোতল দিয়ে চলে যাওয়ার পর সুলায়মান বেগ জিজ্ঞাসা করলো, তোমার বাবা যে আবুল ফজলের হত্যার প্রতিশোধ নেবেন সে বিষয়ে তোমার মনে কোনো ভয় নেই? তুমি তাকে খেপিয়ে তোলার ব্যবস্থা করেছো যখন জানো তিনি ইচ্ছা করলেই আমাদের বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারেন।

    আমি জানি তার সেনাবাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী এবং বিশ্বস্ত কিন্তু এখনোও পর্যন্ত তিনি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেননি। তিনি আমার বিদ্রোহকে উপক্ষো করেছেন এবং আমাকে একজন অকৃতজ্ঞ সন্তান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে যে কেউ আমার সঙ্গে যোগ দেবে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার হুমকিও প্রদান করেননি। এর পরিবর্তে তিনি তার প্রধান সেনাবাহিনীকে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত করেছেন। আমি মনে করি না এখন তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টে আমার উপর আক্রমণ চালানে।

    কেনো? আবুল ফজল তো একাধারে তাঁর বন্ধু এবং উপদেষ্টা ছিলো।

    কিন্তু আমি তাঁর আপন পুত্র। তিনি জানেন তাঁকে তাঁর সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে। এক বছর আগে মুরাদের মৃত্যু হয়েছে এবং তার নাতিদের বয়স এখনোও অনেক কম। তিনি অবশ্যই বুঝতে পেরেছেন সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে উত্তরাধিকারী হিসেবে মাতাল দানিয়েল অথবা। আমি এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে। আমার ব্যাপারে তাঁর মনে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু এর কোনো বিকল্প উপায়ও তার সামনে নেই। তাছাড়া আবুল ফজলকে হত্যা করে আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে আমি আমার অপ্রশমণযোগ্য শত্রুকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে পারি যেভাবে বাবা নিজে হিমু, আদম খান এবং অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের দমন করেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি আর আমাকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। এই মুহূর্তে তিনি তার সেনাবাহিনীকে দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহ দমনের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে আমার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর পরিবর্তে আমার সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করবেন।

    আমাদের সকলের স্বার্থেই আমি প্রার্থনা করছি সম্রাটের মানসিকতা সম্পর্কে তোমার অনুমান সঠিক হোক।

    *

    সেলিম খবর পেলো তার পিতামহীর কাফেলা এলাহাবাদ থেকে মাত্র দুই মাইল দূরে রয়েছে। সে ব্যাপক উৎকণ্ঠা নিয়ে হামিদার পৌঁছানোর অপেক্ষা করছে। কয়েক ঘন্টার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ঘুমের পর, ভোর থেকে সে তার কক্ষে পায়চারী করছে। উত্তেজনা দমন করার জন্য ওপিয়াম বা সুরা পান করা থেকেও অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রেখেছে। রাজধানী ত্যাগ করার পর দীর্ঘদিন সে দাদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ বঞ্চিত রয়েছে। নিজের স্ত্রী বা নিজ মায়ের তুলনায় হামিদার প্রতি সে অনেক বেশি ভালোবাসা অনুভব করে। কিন্তু তিনি কি বুঝতে পারবেন কেনো সে তার বাবার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করেছে? তিনি কি তাঁর নিজের উদ্যোগেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন নাকি বাবা তাকে পাঠিয়েছেন? এটা নিশ্চিত যে তিনি বাবার কাছ থেকে কোনো বার্তা বয়ে আনবেন, কিন্তু সেটা কি হবে? আবুল ফজলের মৃত্যুর বিষয়ে বাবার কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে ব্যাপারে সে যথেষ্ট অনিশ্চিত যদিও সুলায়মান বেগের কাছে অন্যরকম মনোভাব প্রকাশ করেছে। তবে শীঘই সব কিছু তার কাছে পরিষ্কার হবে। সেলিম দুর্গের সম্মুখের রৌদ্রজ্জ্বল উঠানে টাঙ্গানো সবুজ চাঁদোয়ার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলো। সমগ্র উঠানে সেলিমের নির্দেশে গোলাপের পাপড়ি ছিটানো হয়েছে। অল্প সময় পরে হামিদার কাফেলার অগ্রবর্তী ঘোড়সওয়ারদের দুর্গের প্রবেশ দ্বারে উপস্থিত হতে দেখা গেলো। তারপর শিঙ্গার আর্তনাদ এবং ঢাকের গুরুগম্ভীর বাজনার সঙ্গে হামিদাকে বহনকারী বিশাল আকৃতির হাতিটি ধীরে দুর্গ চত্বরে প্রবেশ করলো। সোনার কারুকাজ এবং রত্নখচিত হাওদাটি ঘিয়া বর্ণের পাতলা পর্দা দিয়ে আড়াল করা হয়েছে রোদ এবং লোকচক্ষুর কাছ থেকে আরোহীদের আচ্ছাদিত রাখার জন্য।

    যেই মাত্র মাহুত হাতিটিকে হাঁটার উপর বসালো তখনই সেলিম সকল পুরুষ পরিচারক এবং রক্ষীদের ঐ স্থান ত্যাগ করতে আদেশ দিলো। সেলিম হাওদার পাশে স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চটির উপর উঠে পর্দা সরালো। হাওদার ভিতরের অল্প আলো তার চোখে সয়ে আসতেই সে তার দাদীর পরিচিত অবয়বটি দেখতে পেলো। তাঁর বিপরীত দিকে বসে আছে জোবায়দা যাকে সেলিম কাশ্মীরের পাহাড়ি খাদ থকে উদ্ধার করেছিলো। সেলিম ঝুঁকে হামিদার কপালে চুমু খেলো। এলাহাবাদে আমার দুর্গে তোমাকে স্বাগত জানাচ্ছি দাদীমা, সেলিম বলে উঠলো এবং অনুভব করলো কেমন কৃত্রিম, বিব্রতকর এবং অনুষ্ঠানিক শোনলো তার কণ্ঠস্বর।

    আমি এখানে আসতে পেরে আনন্দিত। তুমি তোমার উপযুক্ত স্থান এবং পরিবারের কাছ থেকে বহু দিন ধরে দূরে রয়েছে। তারপর সেলিমের আড়ষ্ট মুখভাব লক্ষ্য করে হামিদা বললেন, আমরা সে বিষয়ে পরে কথা বলবো, এখন আমাকে এবং জোবায়দাকে হাওদা থেকে নামতে সাহায্য করো।

    সেইদিন সূর্যাস্তের সময় সেলিম দুর্গের মহিলাদের আবাসস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো যেখানে সবচেয়ে উত্তম কক্ষের একটিতে তার দাদীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেটা দুর্গের সবচেয়ে উঁচুতলার কক্ষ যেখান থেকে গঙ্গা নদী নজরে পড়ে। মহিলা কক্ষের দিকে প্রসারিত্ব শীতল আধার সিঁড়িধাপের কাছে পৌঁছে সেলিম তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো। দাদীকে আবার দেখার জন্য এবং তার বয়ে আনা বর্তা শ্রবণ করার জন্য সে উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছে। কক্ষের রেশমী পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে সে দেখতে পেলো হামিদা জাঁকজমকহীন কিন্তু পরিপাটি বেগুনি বর্ণের পোশাক পড়ে একটি নিচু চেয়ারে বসে আছেন এবং জোবায়দা তার চুলের গোছা ঠিকঠাক করে দিচ্ছে। সেলিমকে দেখে তিনি জোবায়দাকে প্রস্থান করতে বললেন।

    ঐ টুলটির উপর বসো সেলিম যাতে আমি তোমাকে ভালোভাবে দেখতে পাই, হামিদা বললেন। সেলিম বসল যদিও তার অস্থির মন চাচ্ছিলো ঘরময় পায়চারি করতে। কোনো রকম ভূমিকা না করে হামিদা কথা বলা শুরু করলেন, তার কণ্ঠস্বর আগের মতোই নরম এবং কর্তৃত্বপূর্ণ।

    সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তোমার সেনাশক্তি প্রদর্শন এখনই বন্ধ করা প্রয়োজন। তোমাকে তোমর বাবার সঙ্গে সৃষ্টি হওয়া বিরোধ মিটিয়ে ফেলে আমাদের প্রকৃত শত্রুদের মোকাবেলায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।

    আমাদের পরিবারের জন্য হুমকি সৃষ্টি করা কখনোই আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। আমি আমাদের বংশানুক্রমকে শ্রদ্ধা করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষের কীর্তি সমূহের প্রতিও আমার ব্যাপক সমবোধ রয়েছে। আমিও চাই আমাদের ম্রাজ্যের আরো সমৃদ্ধি হোক। কিন্তু বাবা এতোদিন যাবত রাষ্ট্রীয় কাজে আমার অবদান রাখার ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেছেন। আমার সকল কর্মকাণ্ডকে তিনি তাঁর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রতি হুমকি স্বরূপ মনে করেন।

    তার এমন মনোভাবের স্বপক্ষে কি যথেষ্ট যুক্তি নেই যখন তুমি তার প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রিয় বন্ধুকে হত্যা করিয়েছো?

    আমি…

    অস্বীকার করো না, সেলিম। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কে কখনোই কপটতা স্থান পায়নি।

    আবুল ফজল তার প্রভাব এবং ক্ষমতার প্রতি আমাকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতো। তার কপটতা এবং দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে আমাকে যন্ত্রণাবিদ্ধ করে আসছে। তার মৃত্যুর ফলে রাজসভা এখন থেকে আবার নতুন নিয়মে চালিত হবে।

    তোমার সঙ্গে তোমার পিতার সম্পর্কও হয়তো নতুন দিকে মোড় নেবে। কিন্তু তোমার মাঝে কি সেই বিবেচনা শক্তি রয়েছে যার দ্বারা তুমি তোমার পিতার অবস্থানে অধিষ্ঠিত হয়ে উপলব্ধি করতে পারবে যে আবুল ফজলের মৃত্যু তাকে কি পরিমাণ কষ্ট দিয়েছে? বেশি ভাবার দরকার নেই। আমিই তোমাকে পরিস্থিতিটি বুঝিয়ে দিচ্ছি। চিন্তা করো তখন তোমার কেমন লাগবে যদি তোমার বাবা সুলায়মান বেগকে হত্যা করান। তার নিজের দুধভাই এবং দুধমা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পর থেকে সে আর কাউকে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারেনি। সেই একই কারণে হয়তো সে তোমাকে বা তোমার সভাইদের সত্যিকার কোনো ক্ষমতা প্রদান করতে কুণ্ঠিত হয়েছে। যাইহোক, এক সময় সে আবুল ফজলের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে আরম্ভ করেছিলো। ভেবে দেখো বিষয়টি কেমন দাঁড়ালো যখন সে জানতে পারলো যে ছেলেকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি তারই নির্দেশে তার বন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আবুল ফজলের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে সে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে প্রায় পড়ে যেতে নিয়েছিলো। পরিচারকদের কাঁধে ভর দিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় সে তার শয়ন কক্ষে পৌঁছায়। সেখানে সে একনাগারে দুই দিন একা অবস্থান করে। এই দুদিন সে কারো সঙ্গে দেখা করেনি এবং কোনো খাবার গ্রহণ করেনি। তারপর যখন সে পুনরায় সভায় উপস্থিত হয় তার চোখ দুটি ছিলো রক্তাভ এবং মুখে দুদিনের না কামান খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সে অবুল ফজলের মৃত্যুর জন্য এক সপ্তাহ শোক পালনের ঘোষণা দেয়। তারপর সে সরাসরি তোমার মায়ের কাছে গিয়ে তোমার মতো অকৃতজ্ঞ সন্তানকে জন্ম দেয়ার জন্য তাকে তিরস্কার করতে থাকে। তোমার মা তার স্বামীকে জবাব দেয় যে সে এই কারণে খুশি যে তুমি তোমার বাবার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো আত্মবিশ্বাসের অধিকারী হয়েছে।

    নিজের বাবা মায়ের মুখোমুখী অবস্থান নেয়ার ঘটনাটি কল্পনা করে সেলিম হাসলো।

    তোমার বাবার শোক আনন্দে হাসার মতো কোনো ঘটনা নয়। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করলোম তখন সে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে আমাকে বলে, আমি জানি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সেলিমের হাত রয়েছে। আমি বাবা হিসেবে এমন কি অন্যায় করেছি যার কারণে সে আমাকে এমন প্রতিদান দিলো? আমার প্রজা এবং সভাসদগণ আমাকে সম্মান করে এবং ভালোবাসে। আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র কেনো তা পারে না? আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে তুমি এখনোও তরুণ এবং এ কারণেই তুমি তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি অনেক বেশি উচ্ছ্বাস প্রবণ। এবং তোমার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে। আমি তাকে আরো স্মরণ করিয়ে দেই যে তার নিজের পিতা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে তার সঙ্গে তার ব্যক্তিত্বের সংঘাত হয়নি। তাছাড়া সম্রাট হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে সে তার নিজের অভিভাবকের প্রতিও অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছিলো। সে প্রথমে অনিচ্ছুক ভাবে আমার কথা স্বীকার করে নেয়। যাইহোক, পরবর্তী দিন গুলিতে আরো বিস্তারিত আলোচনার পর আমি তার কাছে আবেদন করি যাতে সে তার সর্বজনবিদিত মহানুভবতা এবং বিচক্ষণতা বলে তোমাকে ক্ষমা করে দেয়। তারপর সে আমার সঙ্গে এই মর্মে একমত পোষণ করে যে আমি তোমার কাছে এসে তোমাদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে তোমাকে রাজি করাবো।

    তুমি মিমাংসার উদ্যোগ নিয়ে আমার কাছে আসায় আমি সত্যিই অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। কিন্তু বাবার স্বভাবে কি সত্যিই এমন পরিবর্তন এসেছে যার ফলে তিনি আমাকে সেই ক্ষমতা প্রদান করবেন যা আমি কামনা করি? তিনি কি সেই পুরুষ বাঘের মতো নয় যে তার নিজের সাবককে খেয়ে ফেলে যে তার কর্তৃত্বের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে?

    আর তোমার স্বভাব কেমন সেলিম? তুমি নিজে একগুঁয়ে এবং বোকার মতো আচরণ করোনি? তোমার বাবার রক্ষিতা আনারকলির সঙ্গে প্রণয়ে লিপ্ত হয়ে তুমিও তো তরুণ পশুর মতো আচরণ করেছিলে।

    স্বীকার করছি আমি তখন পরিণতির কথা চিন্তা না করে বোকার মতো কাজ করেছি। যৌনলিপ্সা আমাকে গ্রাস করেছিলো। আমি মানছি সেটা আমার ভুল ছিলো। আমার লালসার কারণে আনারকলিকে জীবন দিতে হয়েছে এবং হ্যাঁ, ঐ ঘটনার জন্য বাবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটা স্বাভাবিক ছিলো।

    বাস্তব পরিস্থিতি তোমার এই স্বীকারোক্তির তুলনায় অনেক গভীর। তোমার পিতা একজন মহান ব্যক্তি, সে তার পূর্বপুরুষ চেঙ্গিসখান এবং তৈমুরের মতোই শক্তিশালী যোদ্ধা কিন্তু তাঁদের তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল এবং বিচক্ষণ শাসক। মহান ব্যক্তিদের সন্তানরা এবং পিতামাতারা তাদের অন্যদের তুলনায় ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে। যাইহোক, তোমার পিতা হিসেবে, একজন ব্যক্তি হিসেবে বা একজন সম্রাট হিসেবে তাকে তোমার যে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত ছিলো তা তুমি করোনি। তার অবস্থানগত মর্যাদাকে তুমি ক্ষুণ্ণ করেছে। তোমার পিতা যদি ততোটা ক্ষমাশীল না হতো কিম্বা অল্পবয়সী পুত্রের ভ্রান্তি মূলক লালসা উপলব্ধি না করতে পারতো তাহলে আনারকলির মতো তোমাকেও মৃত্যুবরণ করতে হতো।

    আমি সেটা জানি এবং আমি সে জন্য কৃতজ্ঞও। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বাবা আমাকে সমস্ত সভার সম্মুখে লজ্জা দিয়েছেন, আমার সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করেছেন।

    অসংযমী আচরণ করে তুমি তাকে বিভিন্ন সময় কষ্ট দিয়েছে। কেবল নারীঘটিত বিষয়েই তুমি অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করোনি। তোমার সৎভাইদের মতোই মাতাল অবস্থায় তুমি সভায় প্রবেশ করেছে বহুবার। তোমার বাবা একজন অহংকারী মানুষ এবং নিজের রাজকীয় মর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তোমার বেসামাল আচরণ সমগ্র সভার সম্মুখে তাকেও লজ্জায় ফেলেছে।

    কিন্তু আমি তো আমার বদঅভ্যাস গুলি ত্যাগ করার চেষ্টা করেছি যা মুরাদ বা দানিয়েল করেনি।

    সেজন্য তোমার বাবা তোমার প্রতি প্রশংসাও জ্ঞাপন করেছে।

    সত্যিই কি তাই? আর আবুল ফজলের পরিণতির ব্যাপারে তার মনোভাব কি?

    তোমার বাবা মনে করে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধুকে হত্যা করে তুমি তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছে। তবে এ ব্যাপারেও সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে রক্তের সম্পর্ককে সে তার বন্ধুত্বের তুলনায় বেশি মর্যাদা প্রদান করবে এবং আমার বিশ্বাস সে সেই চেষ্টা করবে। এটাও নিশ্চিত যে এ ছাড়া তার আর বিকল্প কোনো পথ নেই। মুরাদের মৃত্যু হয়েছে এবং দানিয়েল সর্বক্ষণ মদের মধ্যে নিমজ্জিত থাকে। এই অবস্থায় তুমি এবং উপযুক্ত সময়ে তোমার পুত্ররাই আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যৎ হবে।

    সেলিমের সমস্ত দেহে একটি স্বস্তির ঢেউ বয়ে গেলো। তার বাবা সম্পর্কে তার বিচার বিশ্লেষণের সমর্থন মিললো দাদীর কাছে। শেষ পর্যন্ত তিনি তাহলে উপলব্ধি করলেন যে আমাকে তার প্রয়োজন?

    হ্যাঁ, তবে তোমাকেও উপলব্ধি করতে হবে যে তোমার তাকে আরো বেশি প্রয়োজন। ইচ্ছা করলে তোমার এই ক্ষুদ্র বিদ্রোহ সে নিমিষেই ধূলিসাৎ করতে পারতো। এমনকি সে যদি তোমাকে প্রকাশ্যে ত্যাজ্যপুত্র বলে ঘোষণা করতো তাহলেও তোমার পক্ষে কর্তৃত্ব বজায় রাখা সম্ভব হতো না এবং তোমার অনুসারীরা তোমাকে ত্যাগ করা শুরু করতো। তুমি সেটা বুঝে, না কি বুঝো না?

    সেলিম কিছু বললো না। তবে সে মনে মনে স্বীকার করলো তার দাদী ঠিকই বলেছেন। তার বর্তমান অবস্থান ততোটা দৃঢ় নয় যতোটা সে প্রদর্শন করছে। তার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আকবরের উপর চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা স্থবির হয়ে পড়েছে। এলাহাবাদের কোষাগার দ্রুত খালি হয়ে পড়ছে। সৈন্যদের ধরে রাখার জন্য অতি শীঘ্র আরো অর্থের প্রয়োজন। সে দীর্ঘদিন যাবত রাজধানী এবং সভাসদদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। তাঁদের অনেকেরই আনুকূল্য অর্জন করা প্রয়োজন হবে যদি সে তার পিতার উত্তরাধিকারী হয়। তার পুত্রদের সঙ্গেও তার দেখা হওয়া প্রয়োজন, এতোদিন ধরে হয়তো তারা তাদের দাদার কাছে তার বিদ্রোহ সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছে। আর বাস্তবতা হলো সে এবং তার পিতা উভয়েই কিছু কিছু ভুল করেছে। কিন্তু তা সরাসরি স্বীকার করতে তার অহমিকায় বাঁধলো। পরিশেষে সে কেবল বললো, আমি বুঝি।

    তাহলে মিমাংসার ব্যাপারে তোমার সম্মতি রয়েছে?

    হ্যা…তবে আমার একটি শর্ত আছে। বিরোধ মিটিয়ে ফেলার প্রক্রিয়ায় আমাকে ছোট করা চলবে না।

    তোমাকে ছোট করা হবে না বা কোনো প্রকার অপমানজনক পরিস্থিতিতেও ফেলা হবে না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি। তোমার বাবা দরবারে আনুষ্ঠানিক ভাবে তোমাদের মধ্যকার বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টি সমাধা করার দায়িত্ব আমাকে প্রদান করেছে।

    তাহলে আমি খুশি।

    *

    যখন শিঙ্গা বাজানো হবে তখন তুমি ডান দিকের দরজা দিয়ে দরবার কক্ষে প্রবেশ করবে, হামিদা বললেন। এলাহাবাদ এবং আগ্রার মাঝে দূরত্ব একদিনের। আজই সেলিম হামিদার সঙ্গে আগ্রায় পৌঁছেছে যাকে অল্পদিন। আগে পুনরায় আকবর তার রাজধানী বানিয়েছেন। সেলিম আগ্রা শহরের সীমায় শিবির স্থাপন করার পর হামিদা একা অগ্রার দুর্গে গমন করেছিলেন আকবরকে অবহিত করতে যে সেলিম তার সঙ্গে আপোষ করতে সম্মত হয়েছে।

    দাদীমা, তুমি নিশ্চিত যে সকলে তোমার নির্দেশ অনুযায়ী আচরণ করবে?

    হ্যাঁ। যেমনটা আমি নিশ্চিত তোমার ব্যাপারে। আর দেরি করা যাবে না, তুমি তৈরি থাকো। আমাকে জালির পিছনে আমার নিজের অবস্থানে যেতে হবে। সেলিমকে একটি চূড়ান্ত নিশ্চয়তার হাসি প্রদান করে এবং তার কাঁধে মৃদু চাপড় মেরে হামিদা কক্ষ ত্যাগ করলো। শিঙ্গা বেজে উঠার আগে আয়ানায় নিজের চেহারাটি একবার দেখে নেয়ার জন্য এবং রেশমের কোমরবন্ধনীটির বাঁধন ঠিকঠাক করার জন্য সেলিম সামান্য সময় পেলো। ধুকপুক করতে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে, সে উঁচু দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, দুজন দ্বাররক্ষী যার কপাট গুলি তার সম্মুখে মেলে ধরল। দরবার কক্ষে প্রবেশ করে সেলিম দেখতে পেলো তার বাবা সেই উঁচু পিঠ ওয়ালা সোনায়োড়া সিংহাসনটিতে বসে আছেন এবং তাঁকে ঘিরে তার সভাসদগণ দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর পরনে টকটকে লাল বর্ণের সোনা রূপার কারুকার্যখচিত রেশমি পোশাক, কোমরে সাদা কোমরবন্ধনী এবং মথায় আনুষ্ঠানিক সাদা পাগড়ি যাতে চারটি বড় আকারের পদ্মরাগমণির সাহায্যে দুটি ময়ূরের পালক আটকান। সেলিমের পিতামহের তলোয়ার আলমগীর তার পাশে। সেলিম আরেকটু কাছে এগিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলো তার বাবা তাঁদের পূর্বপুরুষ তৈমুরের দন্তবিদির্ণ বাঘের মাথা বিশিষ্ট আংটি পড়ে আছেন। যখন সেলিম তার বাবার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মানসূচক কুর্ণিশ করতে গেলো, হঠাৎ আকবর সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং সেলিমকে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এলেন। কয়েক মুহূর্ত তাকে ধরে থাকার পর তাকে ছেড়ে দিয়ে আকবর উপস্থিত সভাসদদের দিকে ফিরলেন।

    আমি তোমাদের এই সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এটা প্রত্যক্ষ করার জন্য যে আমার সঙ্গে আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রের বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। অতীতে আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সকল মতভেদ বিস্মৃত হয়েছে। সকলে প্রত্যক্ষ করো, আমি আমার আনুষ্ঠানিক পাগড়িটি আমার পুত্রের মাথায় পড়িয়ে দিচ্ছি। আমাদের পুনর্মিলনের স্মারক স্বরূপ। আজ থেকে যে কেউ আমাদের যে কোনো একজনের বিরুদ্ধাচারণ করবে আমরা উভয়েই তাকে শত্রু বলে বিবেচনা করবো। কথা বলতে বলতে আকবর নিজের মাথা থেকে পাগড়িটি খুলে সেলিমের মাথায় পড়িয়ে দিলেন।

    সেলিমের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি সর্বদা আমি আপনাকে সম্মান করবো এবং আজ থেকে আপনার প্রতিটি আদেশ আমার শিরোধার্য হবে।

    যাইহোক, পনেরো মিনিট পর সেলিম যখন দরবার কক্ষ ত্যাগ করছিলো তখন তার মাঝে সৃষ্টি হওয়া প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলো। বাবার তাকে জড়িয়ে ধরার বিষয়টি কি অন্তঃসারশূন্য অভিনয়ের চেয়ে বেশি কিছু? বাবার কণ্ঠে কি কোনো আন্তরিকতা ছিলো যখন তিনি তার অন্তবর্তীকালীন দায়িত্ব সমূহ বর্ণনা করছিলেন। সেগুলির কোনোটিই তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নয়। তিনি কি সত্যিই এতো সহজে তার সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিলেন?

    .

    ২৮. পিতা এবং পুত্র

    আরো জোরে খোসরু। তুমি ওকে পরাজিত করতে পারবে, আগ্রাদুর্গের সম্মুখে অবস্থিত কুচকাওয়াজের মাঠের পশে দাঁড়ানো সেলিম চিৎকার করে উঠলো। তার জ্যেষ্ঠপুত্র, ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন টাটুঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে শক্ত মাটিতে গাথা বর্শার মধ্য দিয়ে একে বেকে ছুটছে। সে শংকর ঘোড়ার পিঠে আসিন আরেকটি তরুণের ঠিক পেছনে রয়েছে যে তার বাম পাশে সমান্তরাল ভাবে গাথা আরেক সারি বর্শার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা দুজন তৃতীয় আরেকজন তরুণের তুলনায় এগিয়ে আছে যে খোসরুর ডান পাশে রয়েছে। তৃতীয় তরুণটি অবশ্য ইতোমধ্যে একজোড়া বর্শা অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং নিজ ঘোড়াটিকে সেগুলির মধ্য দিয়ে পুনরায় চালিত করার চেষ্টা করছে। এক মিনিট পর সমাপ্তি লাইন অতিক্রম করার সময় খোসরু তার ঘোড়াটির ঘাড় কিছুটা সামনে অগ্রসর রাখতে সক্ষম হলো। ঘোড়াটির মাথা তখন নিচু হয়ে ছিলো এবং সেটার শ্বাস ফেলার ধাক্কায় ধূলো উড়ছিলো।

    সেলিম যখন রাজধানী ছেড়ে এলাহাবাদ সহ অন্যান্য জায়গায় দুই বছর পার করেছে সেই সময়ের মধ্যে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটি কতোই না বদলে গেছে। সে যখন রাজধানী ত্যাগ করে খোসরু তখনো বালক। কিন্তু বর্তমানে সে সতেরো বছর বয়সী একজন তরুণ। নিজ পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় খোসরু বা পারভেজকে সঙ্গে নিতে না পারার জন্য তার এখন আফসোস হচ্ছে। ছোট্ট খুররমকে সাথে নেয়া আরো বেশি কঠিন হতো যে এখন তেরো বছরে পদার্পণ করেছে। জন্মের পর থেকে অধিকাংশ দিনই সে তার দাদার সংগে কাটিয়েছে এবং সাধারণত রাত্রে দাদার কক্ষেই ঘুমাতো। এমনকি এখনোও তারা দুজন দশ গজ দূরে একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। উভয়েই খোসরুকে লক্ষ্য করে জোরালো হাততালি প্রদান করছে যে ঘোড়া থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে আকবরের দিকে এগিয়ে আসছে। আকবরের হাতে একটি রত্নখচিত হাতল বিশিষ্ট অশ্বচালনার চাবুক দেখা যাচ্ছে যেটা তাঁর জ্যেষ্ঠ নাতির বিজয়ের পুরষ্কার।

    দৃশ্যটি পারিবারিক সম্প্রীতির কততইনা মনোহর চিত্র, সেলিম ভাবলো। সে অনেক দীর্ঘ সময় গোটা পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। দ্রুত হেঁটে সেলিম তার বাবার কাছে পৌঁছালো, তখন আকবরের বাড়িয়ে ধরা হাত থেকে খোসরু তার পুরস্কার গ্রহণ করছে। খুব ভালো খেলা দেখিয়েছো খোসরু। আমি তোমার বয়সে ঘোড়া চালনায় যতোটা পারদর্শী ছিলাম তুমিও সেই দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছে। আমি প্রার্থনা করি তোমার এই দক্ষতা বজায় থাকুক এবং তোমার অর্জিত অন্যান্য সূক্ষ গুণাবলী গুলিও, যে বিষয়ে তোমার শিক্ষকগণ আমাকে অবহিত করেছে। কোনো দুর্বলতা সৃষ্টিকারী নেশা, বদঅভ্যাস বা লালসার প্রভাবে তোমার গুণগুলি নষ্ট হতে দিও না, আমাদের পরিবারের কিছু সদস্য যেমনটা করেছে, আকবর বললেন।

    আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি দাদা আমি তেমন কিছু করবো না, খোসরু উত্তর দিলো, সরাসরি তার দাদার দিকে তাকিয়ে। সেলিম অনুভব করলো তার বয়স যখন খোসরুর সমান ছিলো তখন সে আকবরের কাছ থেকে এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেনি।

    তুমি খুব ভালো ঘোড়া চালাও খোসরু। আমিও তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, সেলিম এই প্রথম মুখ খুললো।

    ধন্যবাদ বাবা। আমি সেই সময়টিতেই ঘোড়া চালনায় এতো দক্ষ হয়ে উঠেছি যখন তুমি রাজধানীতে ছিলে না।

    খোসরু আর খুররম, তোমরা দুজন কি আমার সঙ্গে আমার যুদ্ধহাতিগুলি পরিদর্শন করতে যাবে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন। আমার কিছু চমৎকার জানোয়ার আছে। খোসরু, আমি জানি তুমি নিজে বাচ্চা হাতিদের একটি আকর্ষণীয় আস্তাবল গড়ে তুলেছে। আমার মাহুতদের প্রশিক্ষণ কৌশল দেখে তুমি অনেক কিছু শিখতে পারবে।

    সেলিমের উভয় পুত্ৰই উৎসাহের সঙ্গে মাথা নাড়লো এবং দাদাকে অনুসরণ করে তার হাতিশালের দিকে অগ্রসর হলো। অবুঝ মানসিকতায় সেলিমের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করলো, বাবা তোমার হাতিগুলির তুলনায় আমার সংগ্রহের হাতিগুলি অনেক উন্নত মানের। কিন্তু সে কিছুই বললো না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো তার তিনজন অতিঘনিষ্ট পুরুষ আত্মীয় তার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তার বাবা ইচ্ছাকৃত ভাবে তাকে সঙ্গে যাবার প্রস্তাব করলেন না। কিন্তু বাবা যে তাকে উপেক্ষা করলেন সেটা কি তার পুত্রদ্বয় বিশেষ করে খোসরু উপলব্ধি করতে পেরেছে?

    *

    দুই মাস পরের ঘটনা। সেলিম এবং সুলায়মান বেগ, দুজনে সেলিমের কক্ষে রয়েছে। সেলিম সুলায়মান বেগেকে লক্ষ্য করে প্রায় চিৎকার করে উঠলো, কি বললে? তুমি ভুল শোননি তো?

    মোটেই না। কুচকাওয়াজের মাঠে অনুশীলন শেষে সেনাপতিরা যে নির্দিষ্ট হাম্মাম খানায় গোসল করে আমি সেখানে ছিলাম। গোসল শেষে আমি যখন পার্শ্ববর্তী কক্ষে পোশাক পড়ছিলাম তখন দুজন সেনাকর্তা হাম্মামে প্রবেশ করে। আমি তাদের দেখতে পাইনি এবং তারাও আমার উপস্থিতি টের পায়নি। গোসলের পানি পড়ার শব্দের মধ্যেও আমি তাদের আলাপ পরিষ্কার শুনতে পাই। প্রথম জন জিজ্ঞাসা করছিলো, তুমি কি এটা শুনেছ যে সম্রাটের কিছু সভাসদ সেলিম বা দানিয়েলের পরিবর্তে খোসরুকে তার উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতে অনুরোধ করেছে? এবং দ্বিতীয় জন উত্তর দেয়, না এমন কিছু আমি শুনিনি, কিন্তু আমি প্রস্তাবটির তাৎপর্য বুঝতে পারছি। দানিয়েল একজন অকর্মণ্য মাতাল এবং সেলিমের মাঝে আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তির অভাব রয়েছে যার ফলে সে যে কোনো মুহূর্তে তার পুরানো অভ্যাসে ফিরে যেতে পারে।

    সেলিমের চেহারা ক্রোধে আড়ষ্ট হয়ে উঠলো তবে মুখে সে কিছু বললো না। সুলায়মান বেগ বলে চললো, এবার প্রথম জন আবার কথা বললো। সত্যিই তাই। তবে পরিস্থিতি যেদিকেই গড়াক না কেনো সেলিমকে তার অস্থাভাজন লোকদেরকে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী পদগুলিতে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এক্ষেত্রে তার বিশ্বাসঘাতকতা মূলক বিদ্রোহে যারা তাকে অনুসরণ করেছিলো তাদেরকেই তার নির্বাচন করতে হবে। আমাদেরকে নয় যারা তার বাবার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছি। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো যদি আবুল ফজলের পরিণতি আমাকে বরণ করতে না হয়। প্রথম জনের এই বক্তব্যের পরপরই আরো কিছু সেনাকর্তা হাম্মাম খানায় প্রবেশ করে এবং ঐ দুজনের কথোপকথন বন্ধ হয়ে যায়।

    সেলিম চেষ্টা সত্ত্বেও কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারলো না, এ সময়টি তার ব্যয় হলো নিজের আবেগের মাঝে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। এলাহাবাদের অবস্থান করার সময় সবচেয়ে গুরুতর যে আশঙ্কা তার মনে সৃষ্টি হয়েছিলো তা হলো আকবর হয়তো তার নাতিদের একজনকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করবেন, কিন্তু এই চিন্তা খুররমকে ঘিরে কেন্দ্রীভূত ছিলো যেহেতু তাঁকেই তিনি অধিক স্নেহ করেন। অন্যদিকে খুররমের অল্পবয়স বিবেচনা করে তার সেই চিন্তা খারিজও হয়ে যায়। কিন্তু খোসরুকে মনোনীত করার বিষয়টি বর্তমানে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। সে যথেষ্ট বড় হয়েছে এবং রাজধানীতে ফিরে আসার পর সেলিম লক্ষ্য করেছে খোসরুর আশেপাশে বেশ কিছু সহযোগিও জুটে গেছে যারা তার থেকে বয়সে সামান্য বড়। অবশেষে সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, বিশ্বাসঘাতক নির্বোধেরা যে এমন সম্ভাবনার কথা আলোচনা করছে তা কি তুমি এবারই প্রথম শুনলে?

    এমন সরাসরি ভাবে এবারই প্রথম। আবার যখন কথা বলা শুরু করলো তখন মনে হলো সুলায়মান বেগ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছে, কিন্তু তুমি যদি ক্ষমতা লাভ করো তাহলে তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে অনেকে আশঙ্কা করছে এটা আমি শুনেছি। তোমার এবং তোমার বাবার মাঝে যে ফাটল তৈরি হয়েছে সকলে তার দৈর্ঘপ্রস্থ পরিমাপ করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক এবং কীভাবে তা জোড়া লাগবে সেটাও তাঁদের ভাবনার বিষয়। এর উপর ভিত্তি করেই তারা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা স্থির করতে চায়।

    আমি এই সব জল্পনাকল্পনাকে শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে দিতে চাই না, সেলিম ক্রুদ্ধভাবে চিৎকার করে উঠলো এবং তার পাশের নিচু টেবিলের উপর রাখা একটি রত্নখচিত থালা প্রচণ্ড জোরে দেয়ালের দিকে ছুঁড়ে মারলো।

    শান্ত হও, সুলায়মান বেগ বললো। নিজেদের কিসে মঙ্গল হবে তা নিয়ে মানুষ চিন্তাভাবনা করবেই, এটাই মানুষের স্বাভাব। তোমার পক্ষে তাতে বাধা দেয়া সম্ভব নয়। তবে তোমাকেও তোমার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তোমার সৎগুণাবলী এবং যোগ্যতা সম্পর্কে আরো বেশি মানুষের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে হবে।

    হয়তো তোমার কথাই ঠিক, সেলিম বললো, তার ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব, আমিতো অনেক দিন রাজসভা থেকে বিচ্ছিন্ন। ছিলাম?

    সকলের মনে এই ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করো যে তুমি তাদের অতীতের ভুল ত্রুটি ভুলে যেতে প্রস্তুত।

    এর জন্য যদি আমি আমার বাবার কিছু উপদেষ্টার পুত্রদের আমার নিজের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেই তাহলে কাজ হতে পারে, কি বলো?

    সেটা করলে আমাদের দলে গুপ্তচর ঢুকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং বিরোধও সৃষ্টি হতে পারে।

    তা হয়তো ঠিক, কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে আমাদের লুকানোর কিছু নেই। এলাহাবাদ থেকে ফিরে আসার পর আমি তেমন কিছু কি করেছি? ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করা ছাড়া এবং বাবার প্রতিটি তুচ্ছ আদেশ উৎসাহের সঙ্গে পালন করা ছাড়া আমিতো আর কিছু করিনি। আমি আমার আবেগকে রুদ্ধ করে রেখেছি। দুই একটা ক্ষোভের কথা কেবল তোমার কাছে প্রকাশ করেছি যেমন বাবা এখনোও আমাকে তেমন কোনো ক্ষমতা দিচ্ছেন না বা সেনাবাহিনীর কোনো উচ্চ পদ প্রদান করছেন না।

    তোমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরো অধিক নিশ্চিত হওয়ার আগে বৃহৎ সেনাবাহিনীর দায় দায়িত্ব তোমাকে প্রদান না করার জন্য তোমার বাবাকে ক্ষমা করা যায়।

    তার পক্ষে এমন আচরণ করাই স্বাভাবিক, আমি বুঝতে পারছি, সেলিম উত্তর দিলো, রাগ সরে গিয়ে এখন তার চেহারায় অস্পষ্ট হাসি ফুটে উঠেছে। তারপর ভ্রূজোড়া সামান্য কুচকে সে জিজ্ঞাসা করলো, তুমি নিশ্চয়ই মনে করো না বাবা আমাকে বঞ্চিত করে আমার পুত্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন?

    সত্যি কথা বলতে কি, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই…যদিও বর্তমানে তাঁর বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, তবুও এখনো তিনি একজন চতুর এবং জটিল মানুষই রয়ে গেছেন। এখন তিনি নিজের মনোভাব গোপন রেখে তার আশেপাশের মানুষদের উদ্দেশ্য এবং উদ্বেগ আঁচ করতে পারেন। সম্ভবত ইচ্ছা করেই তিনি খোসরুকে সামান্য মৌন সমর্থন প্রদান করছেন এটা ভেবে যে তুমি সেটা বুঝতে পারবে। তিনি হয়তো আশা করছেন এর ফলে তোমার উপর চাপ সৃষ্টি হবে এবং তুমি পরিশীলিত জীবন যাপনের ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হয়ে উঠবে।

    এ ধরনের ঠাণ্ডা ষড়যন্ত্র করাই তার স্বভাব, সেলিম আবার চিৎকার করে উঠলো। তিনি এখনোও আমার অনুভূতির প্রতি উদাসীন। খোসরু যখন জানতে পারবে তাকে উত্তরাধিকার প্রদানের বিষয়ে প্রস্তাব উঠেছে তখন তার মনে অবাস্তব আকাক্ষা সৃষ্টি হবে।

    তাহলে তুমি এখন কি করবে?

    বাইরে বাইরে আমি এমন ভাব দেখাবো যে আমি এই সব গুজবে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছি না এবং দায়িত্বশীল সন্তানের মতো আচরণ করবো। কিন্তু গোপনে আমি আরো বেশি লোককে আমার দলে টানার চেষ্টা করবো এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে আমি ক্ষমতায় গেলে তাঁদের ব্যাপক ভাবে পুরস্কৃত করবো। সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করবো যাতে প্রয়োজন দেখা দিলে পর্যাপ্ত সংখ্যক সেনাকর্তা এবং সশস্ত্র সৈন্য আমার স্বপক্ষে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য প্রয়োজন। তুমি আমার তুলনায় অনেক খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারো।

    আপনি আমার সাহায্য পাবেন জাঁহাপনা।

    এদিকে আমি চেষ্টা চালাবো খোসরুর মানসিকতা এবং আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে ধারণা পেতে…

    *

    সেলিম সময় নষ্ট না করে একদিন পরেই খোসরুর সঙ্গে নিজের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলো। তীর ছোঁড়ার অনুশীলনের স্থানে পিতাপুত্র মিলিত হলো। তুমি আজ আমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আমি খুব খুশি হয়েছি, ধনুকে তীর পড়াতে পড়াতে সেলিম মন্তব্য করলো। তারপর খড়ের মনুষ্য আকৃতির লক্ষ্যবস্তুর দিকে সতর্কভাবে তাক করে তীর ছুড়লো। তীরটি লক্ষ্যবস্তুর বুকে বিদ্ধ হলো।

    ভালো লক্ষ্যভেদ করেছো বাবা, খোসরু বললো, তারপর নিজের ধনুকে তীর পড়িয়ে ছুড়লো। খোসরুর তীরটি সেলিমের তীরটি থেকে এক ইঞ্চি দূরে বিদ্ধ হলো। তারপর ধনুক নামিয়ে মন্তব্য করলো, তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে আমারও ভালো লাগে।

    খুব ভালো। আমরা দীর্ঘ দিন পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি। আমি চাই না তুমি এমন ভাবো যে এলাহাবাদে এতোগুলি মাস অতিবাহিত করার সময় তোমার কথা আমার স্মরণ ছিলো না।

    আমি এমনটা ভাবিনি।

    আমি যা করেছি তা সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য এবং তোমাদের জন্য করেছি।

    খোসরু একটি হতাশ হাসি প্রদান করলো। কিন্তু বর্তমানে সাম্রাজ্য শাসন করছেন আমার দাদা। আল্লাহর কৃপায় তিনি স্বর্গে গমন করে তার পুরষ্কার প্রাপ্তির আগে আরো দীর্ঘ সময় এভাবে শাসন করুন আমি এই কামনা করি। এই সময়ের মধ্যে আমাদের কার ভাগ্যে কি ঘটবে তা কে বলতে পারে। তুমি কি বোঝাতে চাইছো? সেলিম জিজ্ঞাসা করলো, তার গলার স্বর তীক্ষ্ম। শোনালো। সেই সঙ্গে ধনুক তুলে আবার সে তীর ছুড়লো।

    আমি কেবল বোঝাতে চেয়েছি দাদার শাসনামলের বাকি সময়টায় কি ঘটবে তা আমাদের পক্ষে আগে থেকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা সকলেই মরণশীল। আমরা যদি বেঁচেও থাকি সময় আমাদেরকে ঠিকই বদলে দেবে এবং আমাদের সম্পর্কে অন্যদের ধারণাও পাল্টাবে। এবার খোসরু তীর ছুড়লো। তার ছোঁড়া তীরটি সেলিমের শেষের তীরটিকে দুভাগ করে খড়ের মানুষের দেহে ঢুকে গেলো। বিষয়টি কি কোনো দৈবদুর্ঘটনা নাকি কোনো অশুভ সংকেত? সেলিম ভাবলো। নিজে থেকেই তার মনে পড়ে গেলো সেই সুফি সাধকের সতর্কবাণী, তার পুত্রদের ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা। ধনুকে আরেকটি তীর পড়িয়ে সে ছুড়লো যেটা খড়ের মানুষের গলায় বিদ্ধ হলো। তোমার কথা ঠিক, আমাদের জীবন ঐশ্বরিক নির্দেশনায় চালিত হয়। কিন্তু আমাদেরকে প্রাকৃতিক নিয়মও মেনে চলতে হয় যেখানে পুত্ররা পিতার মৃত্যুর পর নিজেদের দায়িত্ব ও পদমর্যাদা অধিকার করে সামনের দিকে অগ্রসর হয়। আমরা কেউই এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটুক তা আশা করি না।

    খোসরু এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো, তারপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো, আমিও চাই সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে চলুক। আমি এটাও বিশ্বাস করি যে আমরা সকলে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল।

    তাদের তীর ধনুকের অনুশীলন অব্যাহত থাকলো, পিতা পুত্র নিজেদের বক্তব্যকে সংঘর্ষের দিকে গড়াতে না দিয়ে রাজপ্রাসাদের দৈনন্দিন বিষয়াদির দিকে তাদের আলাপকে কেন্দ্রীভূত করলো। যাইহোক, অনুশীলন শেষে সেলিম যখন তার তীরধনুক গোলাপকাঠের বাক্সে ভরতে লাগলো এবং খোসরু উঠান পার হয়ে তার দাদার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য হাতিশালের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো, তখন সেলিম অনুভব করলো তার তেজস্বী জ্যেষ্ঠ পুত্রের মাঝে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুন ইতোমধ্যেই প্রজ্জলিত হয়ে গেছে, তাতে তার পিতার কোনো ভূমিকা থাকুক বা না থাকুক। এখন তাকে একাধারে তার সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে এবং শত্রুদের প্রশমিত করতে হবে। সব কিছুর উপরে তার বাবাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এর জন্য নিজের সত্যিকার ইচ্ছা গুলিকে দমন করতে হলেও কিছু যায় আসে না। সেটা তার জন্য কিছুটা কষ্টকর হবে কিন্তু বিনিময়ে যে সিংহাসন সে। লাভ করবে তার তুলনায় এই কষ্ট খুবই তুচ্ছ।

    *

    সেলিম এবং আকবর উভয়ের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাঁদের সম্মুখে মৃতদেহের খাঁটিয়াটি আগ্রাদুর্গের পাশ্ববর্তী একটি দ্বার দিয়ে বয়ে নিয়ে একটি ফুলে ঢাকা সাধারণ শবযানের উপর স্থাপন করা হলো। তারপর শবানটিকে ঠেলে নৌকায় উঠান হলো। যমুনা নদী পথে মৃতদেহটি দিল্লীতে নিয়ে হুমায়ূনের পাশে দাফন করা হবে। হামিদার মৃত্যু শোক যেভাবে পিতাপুত্রকে একত্রিত করেছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারলে স্বয়ং হামিদা অত্যন্ত আনন্দিত হতেন। তিনি খুব কোমল ভাবে তার আটাত্তর বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে শায়িত হয়েছেন মাত্র কয়েক দিন অসুস্থ থাকার পর। প্রথমে যা সামান্য কাশি দিয়ে শুরু হয়েছিলো তাই শেষ পর্যন্ত মারাত্মক কিছুতে পরিবর্তিত হয়।

    সেলিম এবং আকবর হামিদার নিচু বিছানার দুপাশে বসেছিলো যখন তিনি তাদের কাছ থেকে বিদায় নেন। বুকে জমে উঠা কফের কারণে তিনি ফিসফিস করে বলছিলেন তারা যেনো পরস্পরকে ভালোবাসে যেমনটা তিনি তাদেরকে বেসেছেন। তার জন্য না হলেও সাম্রাজ্যের স্বার্থে যেনো তারা তার শেষ ইচ্ছাটি রক্ষা করে সেই অনুরোধও তিনি করেন। হামিদার অনুরোধে আকবর এবং সেলিম তার দুর্বল দেহেরে উপর দিয়ে নিজেদের হাত প্রসারিত করে পরস্পকে ধরে তাঁর আদেশ পালনের ব্যাপারে সম্মত হয়। এর কয়েক মিনিট পরেই জানালা দিয়ে পৌঁছানো কোমল জ্যোছনার আলোতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর শেষ কথা গুলি ছিলো, তারাদের মধ্য দিয়ে স্বর্গে তোমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য আমি আসছি হুমায়ুন।

    নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যুদ্ধ করতে করতে সেলিম অনুমান করার চেষ্টা করলো তার বাবার মনের অবস্থা এখন কেমন। কয়েক মাস আগে দাদী গুলবদনের মৃত্যু হয়েছে আর এখন হামিদাও চলে গেলেন। বাবা কি এখন তাঁর নিজের মরণশীলতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছেন? তিনিই এখন তাঁর পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য- অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই তিনি পরিবার প্রধানের ভূমিকা পালন করে আসছেন। তিনি আজ তাঁর সেই মাকে হারালেন যিনি তাঁকে শৈশবের নানা প্রতিকূলতা এবং মৃত্যু ঝুঁকি থেকে রক্ষা করেছিলেন। আকবরের প্রতি হামিদার ভালোবাসা ছিলো নিঃস্বার্থ যেমনটা সেলিমের প্রতিও। সেই জন্য সেলিম তাঁর অভাব তীব্র ভাবে অনুভব করবে।

    কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং অসময়ে বুড়িয়ে যাওয়া দানিয়েলের দিকে তাকালো সেলিম। সে তার পিতার আরেক পাশে রয়েছে। এখনোও টিকে থাকা তার একমাত্র সম্ভাইটি এক ঘন্টা আগে রাজধানীতে এসে পৌঁছেছে। আকবরের নির্দেশে ফতেহপুর শিক্রির কাছে অবস্থিত একটি বিচ্ছিন্ন রাজপ্রাসাদ বর্তমানে তার আবাস। তার সমস্ত দেহ থর থর করে কাঁপছে। সেলিম অনুমান করলো এই কম্পন হয় অতিরিক্ত মদ্য পানের জন্য অথবা মদের অভাবে সৃষ্টি হচ্ছে। তবে অবশ্যই তা শোকের জন্য নয়। তারপর সেলিম তার নিজের তিন পুত্র খোসরু, পারভেজ এবং খুররম এর দিকে তাকালো যারা দানিয়েলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তারা সম্ভবত তার নিজের বা আকবরের মতো শোকাহত হয়নি। কারণ তারা তার মতো দীর্ঘসময় ধরে হামিদার আদরস্নেহ পায়নি এবং তার মতো তাঁকে চিনতেও পারেনি।

    হামিদা তাকে বুঝতেন। তার মদ্যপান, ওপিয়াম সেবন, তার কামনাবাসনা কিছুই তার অজানা ছিলো না। শুধু তাই নয় তার অল্পতেই রেগে উঠা, তার ধৈর্যহীনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত প্রতিশোধ পরায়ণতা বিশেষ করে আবুল ফজলের ব্যাপারে প্রভৃতি কিছুই তার অজানা ছিলো না। যাইহোক, এই সব দুর্বলতা সত্ত্বেও তিনি তার উপর আস্থা হারাননি। সেলিম আকবরের অশ্রুভেজা মুখের দিকে তাকালো এবং নিজের অজান্তেই তাঁর কোনোই স্পষ্ট করলো তাঁর শোকের সমব্যথি হিসেবে। অত্যন্ত ধীর এবং শোকাবহ লয়ে ঢাক পেটানো শুরু হলো যখন হামিদাকে বহনকারী খাঁটিয়াটি নৌকায় তোলা হলো। প্রিয় মাকে শেষ বিদায় জানানোর বেদনাবিধূরক্ষণে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রকে তার বাহু আকড়ে ধরে থাকার সুযোগ দিলেন।

    *

    সুলায়মান বেগ, তোমার হাত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। কি ব্যাপার? সেলিম বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো সুলায়মান বেগ তার কক্ষে প্রবেশ করতেই।

    উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সামান্য কথা কাটাকাটির পরিণতি, তেমন গুরুতর কিছু নয়।

    কাছে এসো, আমাকে দেখতে দাও। হেকিমকে ডাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করো?

    আছে বোধহয়, গেলোই করার দরকার হতে পারে। সুলায়মান বেগ তার বাহুটি সেলিমের সামনে ধরলো এবং সেলিম তার জোব্বা ছিঁড়ে বাধা পউিটা সাবধানে খুলে ক্ষতটা উন্মুক্ত করলো। কনুই এর উপর তিন ইঞ্চি লম্বা জায়গা ধারাল ফলার আঘাতে চিড়ে গেছে। সেলিম যখন তার গলায় বাধা রুমালটি খুলে ক্ষতের উপর জমে থাকা রক্ত মুছলো দেখা গেলো সামান্য চর্বি এবং মাংসপেশি উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে তবে ক্ষতটি হাড় পর্যন্ত গভীর নয়।

    ক্ষতটি পরিষ্কার, বেশি গভীর নয় কিন্তু হেকিমের সাহায্য দরকার হবে। অনেক রক্ত বেরুচ্ছে। হাতটি মাথার উপর উঁচু করে ধরো যাতে কম রক্ত বের হয়, আমি আবার পট্টি বেধে দিচ্ছি। সুলায়মান বেগের হাতে নিজের রুমাল প্যাচাতে প্যাচাতে সেলিম উচ্চ স্বরে তার একজন পরিচারককে ডাকলো হেকিমকে খবর দেয়ার জন্য। তারপর অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে সুলায়মান বেগকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো, কি হয়েছে আমাকে সব খুলে বলো। উত্তরাধিকার সম্পর্কিত তর্ক বলতে তুমি কি বুঝিয়েছো?

    প্রাসাদের উঠানে আড্ডারত খোসরুর একদল তরুণ অনুগামীর পাশ দিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। সে সময় তাঁদের একজন আমি যাতে শুনতে পাই তেমন উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, ঐ যে আমাদের সুলায়মান বেগ যাচ্ছে। আমার ওর জন্য করুণা হয়। সে সিংহাসনের ভুল উত্তরাধিকারীকে সমর্থন করছে। খোসরুর বিদ্রোহী বাবার পরিবর্তে খোসরু যখন সিংহাসনে বসবে তখন ওর ভাগ্যে জুটবে কাঁচকলা। হয়তো তখন আমাদের একজন তাকে আমাদের খেদমতগার বানাবো কিম্বা বাবুর্চি। সে নিশ্চয়ই সুরা পরিবেশনের ব্যাপারে অনেক অভিজ্ঞ কারণ সেলিমের জন্য তাকে অনেক ঢালতে হয়েছে।

    আমি বুঝতে পারছিলাম আমাকে উত্তেজিত করার জন্যই ওরা এমন বিদ্রূপ করছে কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। আমি ঘুরে দলটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, যে মন্তব্যটি করেছিলো তার গলা আকড়ে ধরে তাকে পার্শ্ববর্তী থামের সঙ্গে চেপে ধরে বললোম তার বক্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করতে। সে অস্পষ্ট স্বরে বললো আমাদের প্রজন্মের সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। সম্রাটের মৃত্যুর পর আমাদেরকে কেউ পাত্তা দিবে না। তখন ওদের মতো তরুণরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হবে।

    তখন আমি তার গলাটা আরো জোরে চেপে ধরে বললোম যদি সাহস থাকে তাহলে আবার আমাকে তার খেদমতগার হওয়ার প্রস্তাব দিতে। সে কিছু বললো না। আমি আরো বেশি জোরে চাপ দিলাম। তার চেহারা তখন বেগুনি বর্ণ ধারণ করতে লাগলো এবং তার চোখ দুটি কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। আর এক মিনিট ওভাবে চেপে ধরে থাকলে ও মারা যেতো। হঠাৎ আমার বাহুতে তীক্ষ্ম হুল ফোঁটার মতো ব্যথা অনুভূত হলো। দেখলাম দলের অন্যদের তুলনায় সাহসী একটি তরুণ তার বন্ধুকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য আমার হাতে খঞ্জর দিয়ে পোচ মেরেছে। এক মুহূর্তের জন্য আক্রমণকারীর সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো, আমরা উভয়েই ঘটে গেলো সেই সম্পর্কে শঙ্কিত এবং সে বিষয়েও যা ঘটতে পারতো…তারপর খোসরুর পাজী সমর্থক গুলি সেখান থেকে দৌড়ে পালালো সেই সঙ্গে তাদের বাঁচাল সঙ্গীটিকেও টেনে নিয়ে গেলো যে তখনো শ্বাস কষ্টে ভুগছে। তার গলার ব্যথা সারতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে এবং এরপর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি বিরুপ মন্তব্য করার আগে সে দুবার চিন্তা করবে।

    আমি হলে তোমার মতো এতো ধৈর্যশীল আচরণ করতে পারতাম না, সেলিম বললো। খোসরুর অনুসারীদের সাহস দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের অহমিকা এবং উদ্ধত আচরণ সীমা অতিক্রম করে গেছে। তারা এখন প্রকাশ্যে খোসরুর গুণাবলী সমূহ এবং তাঁর শাসন করার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রচারণা চালাচ্ছে। দানিয়েলের মৃত্যুর পর এখন যখন আমি বাবার একমাত্র উত্তরসূরি বলে বিবেচিত হচ্ছি তখন এক প্রজন্ম উপেক্ষা করে আমার নিজ পুত্রকে সিংহাসনের দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে। কতো বড় সাহস যে তারা তোমাকে আক্রমণ পর্যন্ত করেছে। পরিস্থিতি দেখে আমার মনে হচ্ছে তারা নিজেদের সামর্থ যাচাই করার চেষ্টা করেছে অথবা আমাকে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রলুব্ধ করতে চাইছে যাতে করে আমি বাবার বিরাগভাজন হই।

    স্বয়ং সম্রাট তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেনো?

    ঠিক জানি না। দাদী এবং দানিয়েলের মৃত্যুর পর থেকে মনে হচ্ছে খুব দ্রুত তাঁর বয়স বেড়ে চলেছে। হঠাৎ করে এখন তাকে সত্যি সত্যিই বাষট্টি বছর বয়সের বুড়োর মতো লাগে এবং তার পাকস্থলীর সমস্যাটি এখন ঘন ঘন তাকে আক্রমণ করছে। বর্তমানে তার সবচেয়ে বেশি মনোযোগ খুররমের দিকে। তিনি তার সামর্থ এবং গুণাবলীগুলি যাচাই করতেই বেশি ব্যস্ত। যেভাবে তিনি তাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তেমনটা নিজের ছেলেদের বা তার অন্যান্য নাতিদের কখনোও দেননি।

    মাঝে মাঝে আমার মনে হয় তিনি ইচ্ছা করে খোসরু এবং তার অনুসারীদের তাদের সামর্থ জাহির করার সুযোগ দিচ্ছেন এটা দেখার জন্য যে তারা আমাদের বিপরীতে কতোটা জনসমর্থন লাভ করতে পারে।

    হয়তো তাই। তবে এ ব্যাপারে আমি খুশি যে আবুল ফজলের সুপারিশে পদন্নোতি পাওয়া কিছু বয়স্ক সভাসদ খোসরুর দলের উদ্ধত আচরণে বিরক্ত হয়ে আমার প্রতি তাদের সমর্থন প্রদান করছে। হয়তো, আমি যতোটা মনে করি বাবা তার তুলনায় অনেক বেশি বিচক্ষণ এবং সবদিক বিবেচনা করেই তিনি তার উত্তরাধিকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।

    আমি তোমার সঙ্গে একমত। যদিও ম্রাট শারীরিক ভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন কিন্তু তার বিচারবুদ্ধিকে ছোট করে দেখা উচিত নয়।

    *

    কি ব্যাপার খুররম? নিজের সর্বকনিষ্ঠ পুত্রকে উঠান পার হয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে সেলিম বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, সে এবং সুলায়মান বেগ তখন দাবা খেলছিলো।

    দাদা তোমার এবং খোসরুর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধহাতি দুটির লড়াই দেখতে চান। তিনি মনে করেন এ ধরনের লড়াই তার সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভে সহায়ক হবে।

    সেলিম এবং সুলায়মান বেগ পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কখনো? আজ বিকেলে, পরিবেশ যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। দাদা আরো বলেছেন দুর্গের সামনে যমুনার তীরে লড়াইটির আয়োজন করতে যাতে তিনি ঝরোকা বারান্দায় বসে তা দেখতে পান।

    তোমার দাদাকে গিয়ে বলল আমি তার প্রস্তাবে অত্যন্ত খুশি হয়েছি এবং আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় হাতি পৃথ্বী কম্পককে লড়াই এ নামাবো।

    ঠিক আছে বাবা।

    তোমার ভাই এর সঙ্গে কি তোমার কথা হয়েছে?

    আজকে দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসে খোসই এই লড়াই এর আবেদন উত্থাপন করে। অল্পদিন আগে বাংলা থেকে আমদানী করা দামোদর নামের তার একটি দৈত্যাকার হাতি সম্পর্কে সে খুব প্রশংসা করছিলো। সে বলেছে দামোদর কখনোও লড়াই এ পরাজিত হয়নি।

    লড়াইটা তাহলে ভালোই জমবে। কারণ পৃথ্বী কম্পকও আগে কখনোও পরাজিত হয়নি। সেলিম তার পুত্রের দিকে তাকিয়ে হাসলো, কিন্তু যেই খুররম প্রস্থান করলো ওমনি তার হাসি অপসারিত হলো। খোসরু উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই লড়াই এর ফন্দি এটেছে, আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। সে সমগ্র রাজসভার সম্মুখে আমাকে পরাজিত করতে চায়।

    হয়তো তাই। কিন্তু সে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছে যে তার হাতি তোমার হাতিকে পরাজিত করতে পারবে?

    তার অহংকারই তার মনে এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে। অবশ্য যদি তার জয় নাও হয় সে সকলের সামনে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সক্ষম হলো যে তার এবং আমার মর্যাদা সমান এবং আমরা উভয়েই সম্রাটের আনুকূল্য প্রার্থী। অন্য যে কারো চেয়ে তুমি বিষয়টা বেশি বুঝো কারণ তুমি সেই ক্ষতটি বহন করছে। বিজয়কে সে মনে করবে তার প্রতি পূর্বাভাষ বা দৈবইঙ্গিত স্বরূপ।

    তাহলে এখন তুমি কি করবে?

    যথাসাধ্য চেষ্টা করবো যাতে আমার হাতিটি জয়ী হয়। আমার সবচেয়ে দক্ষ মাহুত সূরজ এবং বাসুকে খবর দাও। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য আমাদের হাতে এখনোও কয়েক ঘন্টা সময় আছে।

    *

    হাতি লড়াই এর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো এবং সময় যতোই কাছিয়ে আসতে লাগলো উৎসুক জনতা আগ্রাদুর্গের সম্মুখবর্তী উত্তপ্ত নদীপারে ভিড় জমাতে লাগলো। লড়াই এর জন্য দুইশ ফুট লম্বা এবং পঞ্চাশ ফুট চওড়া জয়গার চারদিক মাটি ভর্তি বস্তা ফেলে একজন মানুষের কাঁধ সমান উঁচু করা হয়েছে। ঘেরের পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে হাতিদের প্রবেশের জন্য ফাঁক রাখা হয়েছে। ঘেরের মধ্যখানে আড়াআড়ি ভাবে ছয়ফুট উঁচু আরেকটি মাটির বাধ দিয়ে ঘেরটিকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়েছে।

    ঝরোকা বারান্দায় নিচু সিংহাসনে বসে থাকা আকবরের পিছনে সেলিম, খোসরু এবং খুররম দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকবরের গায়ে কারুকাজ করা সূক্ষ্ম কাশ্মীরি পশমের শাল জড়ানো রয়েছে। নিচে উপস্থিত জনতার দিকে তাকিয়ে সেলিম লক্ষ্য করলো বেগুনি জোব্বা এবং রুপার সুতায় বোনা বস্ত্রের পাগড়ি পড়ে খোসরুর সমর্থকরা সেখানে হাজির হয়েছে। লাল এবং সোনালী পোষাক পরিহিত তার নিজের সমর্থকদেরও সেখানে দেখতে পেলো যাদের মধ্যে জাহেদ বাট রয়েছে যে তার দেহরক্ষীদের অধিনায়ক। সেলিম নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে এক পলক তাকালো। খোসরুকে বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে এবং সে আকবরকে কিছু বলতেই তিনি হেসে উঠলেন।

    সম্রাট তার হাত উঁচু করলেন এবং তার সংকেত পেয়ে দুর্গপ্রাচীরের উপর দাঁড়িয়ে থাকা শিঙ্গা বাদক তার ছয়ফুট লম্বা ব্রোঞ্জের শিঙ্গাটি ঠোঁটে লাগিয়ে তিনটি সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ তুললো। এটা হাতিমহল থেকে হাতি গুলিকে লড়াই এর স্থানের দিকে নিয়ে আসার সংকেত। নাকাড়ার (এক জাতীয় ঢোল) তালে তালে প্রথমে পনেরো ফুট উঁচু দামোদর লড়াই এর ঘেরের দিকে এগিয়ে গেলো। তার গায়ে বেগুনি মখমলের আচ্ছাদন যাতে রুপালী পাড় লাগানো রয়েছে। তার বিশাল পা গুলিতে ঢিলা করে রুপার শিকল লাগানো রয়েছে যাতে হঠাৎ করে দৌড়দিতে না পারে। সেটার মাহুত ঘাড়ের উপর বসে আছে, তার হাতে হাতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করার বাকানো ধাতব দণ্ড। দ্বিতীয় একজন মাহুত প্রথম জনের পিছনে বসে আছে। প্রথম জন যদি আহত হয় বা পড়ে যায় তাহলে সে হাতিটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য দামোদরের কপাল এবং চোখের উপর উজ্জ্বল ইস্পাতের পাত পড়ানো হয়েছে। যেটা তার গুঁড়ের অর্ধেক পর্যন্ত বিস্তৃত। সেটার দাঁত গুলি সোনালী রঙ করা হয়েছে অগ্রভাগের কিছু অংশ ছাড়া। দুর্গ থেকে বেরিয়ে দামোদর যখন রাজকীয় ভঙ্গীতে লড়াই এর ঘেরের দিকে এগিয়ে গেলো খোসরুর সমর্থকরা সমস্বরে চিৎকার করে তাঁদের সমর্থন জানালো।

    ঘাড় ফিরিয়ে সেলিম তার নিজের হাতিটির দিকে তাকালো- যোধ বাই এর বাবা হাতিটি তাকে উপহার দিয়েছেন। পৃথ্বী কম্পক ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। তার ঘাড়ের উপর সূরজ এর পিছনে বাসু বসে আছে। এই হাতিটির উচ্চতা খোসরুরটির তুলনায় প্রায় এক ফুট কম কিন্তু সেটার রুপালী রঙ করা দাঁত গুলি দামোদরের তুলনায় বড় এবং বেশি বাঁকানো। রাজপুতগণ তাদের হাতিগুলিকে উত্তম প্রশিক্ষণ প্রদান করে এবং পৃথ্বী কম্পক বহুবার নিজের নির্ভীকতা প্রমাণ করেছে।

    যেই মুহূর্তে দামোদর এবং পৃথ্বী কম্পক ঘেরের মধ্যে তাদের স্ব স্ব স্থানে প্রবেশ করলো তখনই প্রবেশের ফাঁক গুলি মাটির বস্তা ফেলে বন্ধ করে দেয়া হলো। ওদিকে উভয় হাতির আচ্ছাদন সরিয়ে ফেলা হলো এবং সেগুলি পরস্পরকে লক্ষ্য করে ক্রুদ্ধ ভাবে শুর বাজাতে লাগলো এবং মাথা দোলাতে লাগলো। সেলিমের হৃদস্পন্দর দ্রুততর হলো। সে খোসরুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সেও ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে কারণ তার বুক ঘন ঘন উঠা নামা করছে। নিজ পুত্র সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ কি ভুল? সত্যিই কি তার পিতার বিনোদনের জন্য এই লড়াই এর আয়োজন করা হয়েছে? কিন্তু যখন দেখলো আবার খোসর সামনে ঝুঁকে আকবরের কানে কানে ফিসফিস করছে, তখন সেলিম নিশ্চিত হলো যে তার পুত্রের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ সঠিক।

    কয়েক জন তরুণ হাতি গুলির পায়ের নিচে ঢুকে শিকল গুলি খুলে নিচ্ছিলো। শিকল উন্মুক্তকারীরা লড়াই এর মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই খোসরুর হাতিটিকে মাঠের মধ্যবর্তী বাধের দিকে ছুটতে দেখে দর্শকরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল। দামোদর বাধের কাছে পৌঁছে উচ্চস্বরে শুর বাজিয়ে পিছনের পায়ে ভর দিয়ে সামনের পা দুটি উপরে তুললো তারপর বাধটি ভেঙে ফেলার জন্য সেটার উপর সজোরে পা দুটি নমিয়ে আনলো। তারপর কিছুটা পিছিয়ে এসে পুনরায় অগ্রসর হওয়ার উদ্যোগ নিলো। ওদিকে বাধের অন্য পাশে অবস্থিত পৃথ্বী কম্পক সূরজ এর কোমল টোকার ইঙ্গিতে ধীরে বাধের কাছ থেকে পিছাতে লাগলো। সেলিম দেখলো খোসরু দাঁত বের করে হাসছে যখন দামোদর পুনরায় বাধটি ভাঙার চেষ্টায় এগিয়ে গেলো।

    কয়েক মুহূর্ত পর ঘাড়ের উপর শক্তভাবে এঁটে থাকা আরোহীদের নিয়ে ক্রোধে ফুঁসতে থাকা দামোদর তার বিশাল থামের মতো পায়ের আঘাতে বাধের অবশিষ্টাংশ ভেঙে ফেললো। তারপর মাঠের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পৃথ্বী কম্পককে আক্রমণ করতে এগিয়ে গেলো, তার পদাঘাতে চারদিকে মাটি বালু ছিটকে পড়তে লাগলো। সূরজ পৃথ্বী কম্পককে তখনো স্থির রেখেছে, সেলিম এবং সে মিলে এমন পরিকল্পনাই করেছিলো যে প্রতিপক্ষকে প্রথমে তারা দ্রুত আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করবে। হাতির লড়াই এর বিষয়ে আগে থেকে কিছুই অনুমান করা যায় না তবে এটা একটি উত্তম কৌশল, সেলিম মনে মনে নিজেকে বললো। খোসরুর হাতির তুলনায় পৃথ্বী কম্পক ছোট তবে তার চলার গতি সেটার তুলনায় বেশি ক্ষিপ্র।

    যখন দামোদর গুঁড় উঁচিয়ে দাঁতগুলিকে সমান্তরাল রেখে ভয়ংকর মৃত্যু দূতের মতো এগিয়ে এলো সেলিমের মনে হলো হয়তো সূরজ বেশি দেরি করে ফেলছে। কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে যখন মনে হলো দামোদর তাদের উপর আঘাত হানবে সূরজ চিৎকার করে নির্দেশ প্রদান করলো এবং পৃথ্বী কম্পকের ডান কাঁধে ধাতব দণ্ড দিয়ে টোকা দিলো। নির্দেশনা পেয়ে পৃথ্বী কম্পক দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে দামোদরের আক্রমণ এড়ালো। একই সঙ্গে মাথা হেলিয়ে তার ঘষে ধারালো করা দাঁত দিয়ে অগ্রসরমান দামোদরের দেহের বাম পাশে গুঁতো দিলো। সঙ্গে সঙ্গে দামোদরের দেহে সৃষ্টি হওয়া ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগলো। যেই দামোদর থমকে গেলো এবং শুর বাজিয়ে আর্তনাদ করতে লাগলো সূরজ তাকে ধাওয়া করলো। ঘেরে প্রবেশের পথ আটকানো মাটির বস্তার কাছে তারা দামোদরের নাগাল পেলো। দামোদরের মাহুত তখন চেষ্টা করছে তার আহত এবং ভীত হাতিটিকে শান্ত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য এবং সে কোনো রকমে তাকে ঘুরিয়ে পৃথ্বী কম্পকের মুখোমুখী করতে পারলো।

    তাঁদের মাহুতদের তাগিদে এবং উল্লাসিত জনতার চিৎকারের প্রভাবে হাতি দুটি কয়েক বার পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো এবং আবার সজোরে মাটির উপর পা নামিয়ে আনলো। উভয়েই চেষ্টা করলো পরস্পরকে দাঁত বিদ্ধ করতে। কয়েক মুহূর্ত পর পৃথ্বী কম্পক সফল হলো দামোদরের ইস্পাতের আবরণের নিচের অংশের শুড় দাঁতের আঘাতে চিড়ে ফেলতে। তারপর, দামোদর যেই টলমল পায়ে পিছু হটলো, পৃথ্বী কম্পক এগিয়ে গিয়ে একটি দাঁত সেটার ডান কাঁধের গভীরে ঢুকিয়ে দিলো। খোসরুকে আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছিলো না। পৃথ্বী কম্পকের জয় আর বেশি দূরে নয়, সেলিম ভাবলো। কিন্তু উন্মত্ত হাতি দুটি আবার যখন পরস্পরের কাছাকাছি হলো, দামোদরের মাহুত তার ধাতব দণ্ডটি হাতে সামনের দিকে ঝুঁকলো। তাকে দেখে মনে হলো সে নিজের হাতিটিকে আঘাত করতে উদ্যত হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ দামোদরের ঘাড়ে পেচিয়ে বাধা একটি চামড়ার ফালি আকড়ে ধরে সামনের দিকে হেলে পড়লো এবং তড়িৎ গতিতে হাতের দণ্ডটির বাঁকা অংশটি সূরজের এক পায়ে আটকে সজোরে টান দিলো। ভারসাম্য হারিয়ে সূরজ এক মুহূর্ত টলমল করলো, তারপর পৃথী কম্পকের ঘাড়ের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেলো। সেলিম যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান থেকে বুঝতে পারলো না সূরজের পরিণতি কি হলো কিন্তু উপস্থিত জনতা সমস্বরে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালো।

    লড়াই বন্ধ করতে বলো! আকবর আদেশ দিলেন।

    কয়েক মুহূর্ত পর লড়াই এর ব্যবস্থাপনার নিয়োজিত লোকেরা ঘেরের মধ্যে জ্বলন্ত পটকা নিক্ষেপ করতে লাগলো হাতি দুটির মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য এবং তাদের পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। পটকার ঠাস ঠাস প্রচণ্ড শব্দ এবং ধোঁয়া দামোদরের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হলো না, সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তার ঘাড়ের উপর তখনো আকড়ে থাকা আরোহীদের নিয়েই প্রচণ্ড বেগে ধাক্কা মেরে ঘেরের দেয়াল ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ সরতে না পারা তিন জন দর্শক তার পায়ের নিচে পিষ্ট হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলো। আর আতঙ্কিত দামোদর নদীর পার দিয়ে ছুটতে লাগলো এবং ভীত দর্শকরা তার গতিপথ থেকে এদিক ওদিক ছুটে পালাতে লাগলো। তারপর সে নদীতে নেমে গিয়ে প্রায় মাঝ নদী বরাবর অগ্রসর হয়ে থমকে দাঁড়ালো এবং তার রক্তে নদীর পানি রক্তিম বর্ণ ধারণ করতে লাগলো।

    ওদিকে ঘেরের ভিতর বাসু পৃথ্বী কম্পকের ঘাড়ের উপর দিয়ে ছেড়ে অগ্রসর হয়ে সূরজের বসার স্থানটি দখল করলো এবং পটকার শব্দ এবং দর্শকদের চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেও হাতিটিকে শান্ত করতে সক্ষম হলো এবং সেটার চোখ দুটি একটি পট্টি দিয়ে ঢেকে দিলো। ঘেরের মধ্যবর্তী স্থানে তখন সূরজের পদদলিত দেহটি একটি রক্তাক্ত মাংস পিণ্ডের মতো পড়ে রয়েছে। সেলিম তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের দিকে ফিরে চিৎকার করে বলে উঠলো, তোমার মাহুত বুঝতে পেরেছিলো যে আমার হাতিটি জয়ী হতে যাচ্ছে তাই সে অসৎপন্থা অবলম্বন করে আমার মাহুতকে ফেলে দিয়ে একটি সাহসী লোকের অনর্থক মৃত্যু ঘটালো।

    যা ঘটলো তা একটি দুর্ঘটনা। সেলিমের চোখের দিকে না তাকিয়ে খোসরু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো, তার মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে উঠেছে।

    তুমি ভালো করেই জানো তুমি মিথ্যা কথা বলছে। যেহেতু তোমার হাতি লড়াই এর ঘের ছেড়ে দৌড়ে পালিয়েছে তাই আমার মৃত মাহুতের নামে আমি বিজয় দাবি করছি।

    কারো হাতি জয়ী হয়নি, লড়াই অমিমাংসিত ভাবে শেষ হয়েছে। দাদা, আপনার কি মতো… খোসরু আকবরের কাছে সমাধান চাইলো কিন্তু সম্রাটকে অন্যমনষ্ক মনে হলো। তিনি তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং বারান্দার রেলিং ধরে একাগ্রচিত্তে নিচের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন, দুজন পরিচারক তাঁকে দুদিক থেকে ধরে রেখেছে। আকবর এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছেন বোঝার জন্য সেলিমও এগিয়ে গেলো। দর্শকরা ঠেলাঠেলি করে সূরজের দেহাবশেষ দেখার চেষ্টা করছে পরিচারকরা যা একত্রে জড়ো করে খাঁটিয়ায় তুলে মাঠ থেকে বের করে নিচ্ছে। কিন্তু তখনই ক্রুদ্ধ হৈ-চৈ শোনা গেলো এবং সেলিম দেখলো তার এবং খোসরুর সমর্থকদের মধ্যে মারপিট শুরু হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে সে দেখতে পেলো খোসরুর একজন পরিচারক কোমরে গোজা ছোরা টেনে বের করে তার একজন ভূতের মুখে পোচ মারলো। দেখতে দেখতে আরো বেশি লোক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো।

    সেলিম! খোসরু! তোমাদের লোকেরা আমার সামনে এমন বিশ্রী ভাবে ঝগড়া মারামারি করার সাহস পেলো কীভাবে! তাঁদের উপর তোমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? তোমাদের দুজনেরই লজ্জা হওয়া উচিত। আকবর ক্রোধে থর থর করে কাঁপছেন। খুররম, মনে হচ্ছে একমাত্র তোমার উপরই আমি আস্থা রাখতে পারি। এক্ষুনি আমার রক্ষীদের অধিনায়কের কাছে যাও এবং তাকে আদেশ দাও এই গোলযোগ বন্ধ করতে। আর একজন লোক যদি অস্ত্র তোলে তাকে গ্রেপ্তার করে চাবুক পেটা করতে বলো।

    জ্বী দাদা, আমি যাচ্ছি, কথা গুলি বলে খুররম দৌড়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

    আর তোমরা, সেলিম এবং খোসরু, আমার সামনে থেকে দূর হও। তোমাদের দুজনের ব্যাপারেই আমি হতাশ হয়েছি।

    খোসরু তখনই প্রস্থান করলো কিন্তু সেলিম ইতস্তত করতে লাগলো। তার আত্মপক্ষ সমর্থন করতে ইচ্ছা হলো, কিন্তু তাতে কি কোনো লাভ হবে? সে যাই বলুক না কেনো বাবার মনোভাব তাতে পরিবর্তিত হবে না। সে পিছন ফিরে এক পলক আকবরের দিকে তাকালো। কিন্তু আকবরের থমথমে চেহারায় তাকে সেখানে থাকতে বলার কোনো আভাস পাওয়া গেলো না- সেলিম ধীর পদক্ষেপে বারান্দা ত্যাগ করলো। শুধু সেই নয়, খোসরুও আকবরের অসন্তুষ্টির কিছুটা ভাগ পেয়েছে, একথা ভেবে সেলিম কিছুটা সান্ত্বনা পেলো। কিন্তু তারপর আরেকটি ভাবনা তার মনে আঘাত করলো। খুররমকে লক্ষ্য করে বাবা যে মন্তব্য করলেন সেটার তাৎপর্য কি? মনে হচ্ছে একমাত্র তোমার উপরই আমি আস্থা রাখতে পারি…। তারা দুজন যখন আবার একত্রে সময় কাটাবে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তখন খুররমকে বাবা আজকের ঘটনাবলী সম্পর্কে কি বলবেন? এই যে, সেলিম এবং খোসরুর মধ্যকার নগ্ন বিরোধীতা দেখে তিনি মনে করছেন তাঁদের কেউই সাম্রাজ্য শাসন করার উপযুক্ত নয়?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএম্পায়ার অভ দা মোগল : দি টেনটেড থ্রোন – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }