Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প613 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪.১ আল্লাহ আকবর

    ১৫. ‘তুমি সম্রাট হবে

    তুমি ওগুলো কোথায় পেলে? সেলিম মুরাদকে ক্রুদ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করলো। দুটি কবুতর মুরাদের কোমরবন্ধনী থেকে ঝুলছিলো, সেগুলির গলা রক্তাক্ত। তবে সেলিমের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো মুরাদের হাতে ধরা দ্বিবক্র ধনুক এবং তীর ভরা তূণীরটির দিকে।

    মুরাদ দাঁত বের করে হাসল। আমি এগুলো উঠানে কুরিয়ে পেয়েছি। মনে করেছিলাম এগুলো তোমার আর প্রয়োজন নেই…

    তার মানে তুমি ওগুলো চুরি করেছ।

    মুরাদের মুখের হাসি গায়েব হয়ে গেলো এবং সে কিছুটা আক্রমণাত্বক ভঙ্গিতে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো। যদিও সে এগারো মাসের ছোট কিন্তু তার উচ্চতা সেলিমের তুলনায় প্রায় দুই ইঞ্চি বেশি।

    আমি চোর নই। আমি কীভাবে জানবো তুমি এগুলো এখনোও চাও? আমাদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষা করতে বা অনুশীলন করতে তুমি আর আগের মতো উঠানে আসো না। সব সময় অন্য কোথাও পালিয়ে বেড়াও। দানিয়াল এবং আমি তোমাকে আমাদের সাথে পাই না। বাবা বলেন….

    সেলিম এক পা এগিয়ে এলো। বাবা কি বলেন? সে নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলো এবং তার সংকুচিত হয়ে আসা চোখদুটি সৎ ভাই এর মুখের উপর নিবদ্ধ।

    মুরাদ কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লো। তেমন কিছু না…মানে তুমি একাই বেশিরভাগ সময় কাটাও। বাবা একটু আগে এখানে ছিলেন, আমার তীর ছোঁড়ার অনুশীলন দেখছিলেন। এই ধনুকের সাহায্যে আমি যখন কবুতর গুলিকে মারলাম তখন তিনি বললেন তিনি আমার বয়সে যেমন দক্ষ ছিলেন আমার হাত সেরকমই ভালো। মুরাদের কথায় কিছুটা গর্বের ভাব প্রকাশ পেলো। আমার তীরধনুক আমাকে ফিরিয়ে দাও।

    কেনো দেবো? এখন তুমি এগুলো ফেরত চাচ্ছ কারণ এগুলো আমার পছন্দ হয়েছে এবং এগুলো আমি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারি।

    আমি ওগুলো ফেরত চাই কারণ ওগুলো আমার।

    পারলে নাও। মুরাদের কণ্ঠে প্রতিদ্বন্দ্বীতার সুর প্রকাশ পেলো।

    সেলিম তীব্র ক্রোধ অনুভব করলো এবং সৎ ভাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার আর কোনো প্রণোদনার প্রয়োজন ছিলো না। যদিও মুরাদ তার তুলনায় ভারী কিন্তু সে মুরাদের তুলনায় দ্রুত। নিজের ভরবেগ কাজে লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে সে মুরাদকে মাটিতে পেড়ে ফেললো, তারপর তার পেটের উপর বসে দুই উরু দিয়ে তার পাঁজর চেপে ধরলো। মুরাদ সেলিমের চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু সেলিম সময় মতো পিছনে সরে গেলো এবং এক হাত মুরাদের মুখের উপর রেখে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরলো। তারপর অন্য হাতে তার লম্বা কালো চুলের মুঠি ধরে মাথাটা উঁচু করে পাথুরে মেঝের সঙ্গে ঠুকে দিলো। আঘাতের ভোতা শব্দে সে তৃপ্তিবোধ করলো এবং একই প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তি করার জন্য যখন মাথাটা আবার তুললো তখন মেঝের উপর রক্তের হালকা দাগ দেখতে পেলো।

    যুবরাজ, থামুন! উত্তেজিত কণ্ঠস্বর এবং দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকা পদশব্দের মধ্যেই সেলিম আরেকবার তার ভাইয়ের মাথাটি মেঝের উপর ঠুকলো। এসময় সে অনুভব করলো শক্তহাতে কেউ তাকে মুরাদের পেটের উপর থেকে টেনে তুলছে। উপরে তাকিয়ে দেখলো তিনি মুরাদের একজন শিক্ষক। লোকটি তাকে কিছুটা দূরে সরিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলো। গভীর নিশ্বাস নিতে নিতে সেলিম তার মুখে জমে উঠা ঘাম মুছলো। তখনো মেঝেতে শুয়ে গোঙ্গাতে থাকা মুরাদকে দেখে সে কিছুটা সন্তুষ্টিও বোধ করলো। তার প্রতি উদ্ধত আচরণের উচিত শিক্ষা সে মুরাদকে দিতে পেরেছে।

    এসময় দানিয়াল সেখানে দৌড়ে এলো। সে কিছুটা হতচকিত কিন্তু সেলিমের মনে হলো তার এই ছোট ভাইটি তার প্রতি কিছুটা প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ভালোঁই লড়াই করতে পারে…কিন্তু সে যখন আবার মুরাদের দিকে তাকালো, মুরাদ তখন উঠে বসেছে এবং নিজের রক্তাক্ত মাধায় হাত বুলাচ্ছে। এবারে সেলিমের অনুপ্রেরণায় কিছুটা ভাটা পড়লো এবং তার উচ্ছ্বাস পরিবর্তিত হলো লজ্জায়। এতোটা আক্রমণাত্বক হওয়াটা বোধ হয় তার উচিত হয়নি। সভাবে চিন্তা করলে মুরাদের তার তীরধনুক নেয়াটা তার জন্য ততোটা রাগের কারণ নয়, যদিও সেগুলি তাকে বাবা উপহার হিসেবে দিয়েছেন। তার কষ্টের কারণ, বাবা মুরাদের সঙ্গে তুলনা করে তার সমালোচনা করেন- মুরাদের তীর ছুঁড়ে লক্ষভেদের বিষয়ে তিনি যে প্রশংসা করেছেন সেটাও তার ঈর্ষার কারণ।

    কি হচ্ছে ওখানে? বাবার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে সেলিম চারদিকে তাকাল এবং তার হৃদস্পন্দন দ্রুততর হলো।

    ও আমাকে চোর বলেছে! তারপর আমাকে আক্রমণ করে, মনে হচ্ছিল আমাকে মেরেই ফেলবে, মুরাদ বললো, সে তখন উঠে দাঁড়িয়েছে। আমি কেবল ওর তীর ধনুক ধার নিয়েছিলাম, সেজন্য ও এতোকিছু ঘটালো।

    তুমি ওগুলো চুরি করেছিলে। তারপর আমি ফেরত চাইলে তুমি বলেছো এমনিতে দিবে না, সামর্থ থাকলে আমাকে সেগুলি তোমার কাছ থেকে লড়াই করে নিতে হবে। কিন্তু তুমি ওগুলো তোমার কাছেই রাখতে পারো যদি তোমার প্রয়োজন এতো বেশি হয়।

    তোমরা পরস্পরের ভাই। সেলিম, তুমি বড়, তোমার আরো বেশি বুঝদার হওয়া উচিত। এমন মারামারি করা মোটেই শোভনতা নয়। আকবরের কণ্ঠস্বর কঠোর শোনালো। বাজারের অসভ্য বালকদের মতো ঝগড়া করার জন্য তোমাদের দুজনেরই শাস্তি পাওয়া উচিত। এবারের মতো আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিচ্ছি, কিন্তু আবার এধরনের কিছু ঘটলে আমি আর তোমাদের দয়া দেখাবো না। দেখি, যে তীরধনুকের জন্য এতোকিছু ঘটলো সেগুলি আমাকে দাও।

    মুরাদ তীরধনুক গুলি আকবরের কাছে নিয়ে এলো এবং আকবর সেগুলি খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। আমি এগুলো চিনতে পারছি। আমি তোমাকে এগুলি উপহার দিয়েছিলাম সেলিম, তাই না? আমি তোমাকে বলেছিলাম এগুলো একজন তুর্কী ওস্তাদের হাতে তৈরি করা। সে অত্যন্ত উন্নত মানের সামগ্রী দিয়ে এগুলো বানিয়েছে।

    সেলিম এগুলো উঠানে ফেলে রেখেছিলো…সে এগুলো কখনো ব্যবহার করে না…যদি বৃষ্টি হতো তাহলে নষ্ট হয়ে যেতো। মুরাদের কণ্ঠে অভিযোগের সুর।

    সেলিম থমথমে দৃষ্টিতে সামনে তাকালো। সে কীভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করবে যখন মুরাদের অভিযোগ সত্যি? আসলেই সে বাবার উপহারের প্রতি অবহেলা করেছে।

    আকবর সেলিমের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁকে কিছুটা দ্বিধান্বিত মনে হলো। এগুলো তোমার পছন্দ না হওয়ায় আমার খারাপ লাগছে। আমার নিজের ব্যবহারের জন্য এগুলো এখন থেকে আমার কাছেই থাকবে।

    সেলিম বুঝতে পারছিলো তার বাবা তার মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন, যে কোনো ধরনের ব্যাখ্যা। সে কিছু বলার জন্য তীব্র আকাক্ষা অনুভব করলো কিন্তু তার মুখ ফুটে কোনো কথা বের হলো না। তার পক্ষে সামান্য কাঁধ ঝাঁকানো ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হলো না এবং সে বুঝলো এতে করে অনুশোচনার পরিবর্তে তার স্পর্ধাই প্রকাশ পেলো।

    *

    এক সপ্তাহ পরের ঘটনা। সেলিম ও মুরাদের মধ্যে ঝগড়া হওয়ার পর থেকে যে উদ্বেগ আকবরের মনে চেপে বসেছে তিনি কিছুতেই তা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না। দাবা খেলার শেষে পরাজিত পক্ষ বলে- শাহ মাত, রাজা পরাজিত হয়েছে- এই শব্দগুলি তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তার এমনই অনুভূতি হচ্ছিলো যখন তিনি সেলিমের মুখোমুখী হয়েছিলেন এবং এই অনুভূতি তার কাছে অপরিচিত। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তিনি সর্বদাই বুঝতে পারেন তাকে কি করতে হবে। শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রেও তিনি একই ধরনের নিশ্চয়তা অনুভব করেন। বর্তমানে তার রাজ্যের সীমান্তগুলি নিরাপদ রয়েছে, আইনের শাসন বলবৎ আছে এবং তিনি ধনী গরিব নির্বিশেষে সকল প্রজার সমর্থন ও আস্থা অর্জন করছিলেন। কিন্তু নিজের পারিবারিক বিষয়ে তিনি একই ধরনের নিশ্চয়তা কেনো অনুভব করতে পারছেন না?

    এমন আশা করবেন না যে আপনার পুত্ররা প্রকৃতিগত ভাবেই আপনাকে ভালোবাসবে অথবা তারা এক ভাই অন্য ভাইকে স্বাভাবিক নিয়মে ভালোবাসবে… বহু বছর পূর্বে আকবরকে বলা এই কথা গুলিই ছিলো শেখ সেলিম চিশতির শেষ উপদেশ। তিনটি স্বাস্থ্যবান পুত্রের পিতা হওয়ার আনন্দে তিনি সুফির সতর্কবাণী মন থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। কদাচিৎ মনে এলেও তিনি এর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেননি কারণ তাঁর মনে হয়েছে এই বিচক্ষণ উপদেশ যে কোনো পিতার জন্যই প্রযোজ্য হতে পারে, শুধু তার জন্যই নয়। কিন্তু বর্তমানে সেই কথাগুলি মনে করে ক্রমশ তার অস্বস্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তার এবং সেলিমের মধ্যকার ব্যবধান কি বেড়ে চলেছে? তাদের মধ্যকার বন্ধন যদি সত্যিই দুর্বল হতে থাকে, তাহলে সেলিম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, এবং এই অশুভ পরিণতি প্রতিরোধ করার জন্য তিনি কি করতে পারেন?

    বহুবার তার ইচ্ছা হয়েছে এই দুর্ভাবনাগুলির বিষয়ে তাঁর মা এবং ফুফুর সঙ্গে আলাপ করতে। কিন্তু হেরেমের ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের পর থেকে তিনি নিজের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলতে নিরুৎসাহিত বোধ করেছেন, যেমন ভাবে সেলিম তার সঙ্গে কথা বলতে বাধাগ্রস্ত হয়। এর পরিবর্তে আবুল ফজলের সঙ্গে আলাপ করার চিন্তা তার মনে এসেছে। তার সহজাত উপলব্ধি থেকে আকবরের মনে হয়েছে আবুল ফজল তাকে বুঝতে পারবে, এমনকি কোনো উত্তম পরামর্শও হয়তো দিতে পারবে…

    অবশেষে এক সন্ধ্যাবেলায় মোমর আলো জ্বালা নির্জন উঠানে আকবর আবুল ফজলকে ডেকে পাঠালেন আলোচনা করার জন্য।

    আমি আমার কাগজ-কলম নিয়ে এসেছি জাঁহাপনা, আপনি কি আমাকে কিছু লেখার জন্য ডেকেছেন?

    না…আমি তোমার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলাপ করতে চাই। তোমার সন্তান আছে, তাই না?

    জ্বী জাহাপনা, আমার দুটি পুত্র, একজনের বয়স দশ এবং অন্য জনের বয়স বারো। মনে হলো আবুল ফজল কিছুটা অবাক হয়েছে।

    তুমি যখন তাদের কোনো উপহার দাও কিম্বা প্রশংসা করো তখন তাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়?

    আবুল ফজল কাঁধ ঝাঁকালো। তাদের প্রতিক্রিয়া অন্য যে কোনো বালকের মতোই হয় জাহাপনা। তারা খুশি হয় এবং উত্তেজনা প্রকাশ করে।

    আমার ছোট দুই পুত্র মুরাদ এবং দানিয়েল এর মতোই…

    আর যুবরাজ সেলিম জাহাপনা? সে কি একই আচরণ করে না? আবুল ফজল মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।

    না, তার আচরণ সেরকম নয়। অন্তত আমার সঙ্গে…আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে এবং বিষয়টি মেনে নেয়া আমার জন্য কষ্টকর- আমি অনুভব করছি সেলিম এবং আমার মাঝে একটি অদৃশ্য দেয়াল সৃষ্টি হচ্ছে। আমার বাংলা অভিযানের আগে সেলিম আমার অন্য পুত্রদের মতোই ভোলামেলা এবং স্বাভাবিক ছিলো, বরং আমি বলবো তাদের তুলনায় একটু বেশিই উচ্ছ্বাস প্রবণ ছিলো। কিন্তু বর্তমানে সে একদম চুপচাপ…অসামাজিক এবং সে আমার সঙ্গ এড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে।

    ওর শিক্ষক কি বলেন?

    শিক্ষক বলে সেলিম সব কিছুতেই ভালো করছে। সে সাবলীল ভাবে ফার্সী এবং তুর্কী ভাষা পড়তে পারে। সে তলোয়ার চালনায়ও দক্ষ, গাদাবন্দুক ছুঁড়তে পারে এবং উদ্যাম বেগে টাটুঘোড়া ছুটিয়ে পোলো খেলে। এ সবই সত্যি কারণ আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু আমার অন্য পুত্ররা যখন নিজেদের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আমাকে অবহিত করতে উদগ্রীব হয়ে থাকে, সেলিম কদাচিৎ আমার মুখোমুখী হয়। দুই সপ্তাহ আগে আমি শুধু তাকে নিয়ে বাঘ শিকারে গিয়েছিলাম। আমরা যখন বিশাল জানোয়ারটাকে সেটার লুকানো অবস্থান থেকে তাড়িয়ে বের করে আনি, আমি সেলিমকে বন্দুক ছোঁড়ার সুযোগ দেই। তার ছোঁড়া গুলি বাঘটির গলায় আঘাত করলে সে উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠে। কিন্তু পরে রাজধানীতে ফিরে আসার সময় সে প্রায় কোনো কথাই বলেনি।

    তার বয়স অল্প জাঁহাপনা, মাত্র এগারো। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।

    হয়তো।

    সব পিতাই তাঁদের সন্তানদের নিয়ে দুর্ভাবনা করেন।

    কিন্তু সকল পিতাই তো আর সম্রাট নয়। যদিও আমি এখনো যুবক, শক্তসবল এবং আত্মবিশ্বাসী এবং প্রার্থনা করি ঈশ্বর আমাকে আগামী অনেকগুলি বছর এমন রাখবেন, তবুও অমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোনো পুত্রটিকে আমি আমার উত্তরাধিকারী নির্বাচন করবো। এটা সত্যি যে আমার পুত্ররা এখনো বালক, কিন্তু আমি তো ভুলতে পারি না যে আমার পিতামহ রাজা হয়েছিলেন মাত্র বারো বছর বয়সে। তাঁর শাসন আমলের প্রাথমিক বছর গুলিতে নিজ সাহস এবং ঐকান্তিকতার বলে তিনি পর্যাপ্ত জ্ঞান আহরণ করেছিলেন-পরবর্তীকালে সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি আততায়ীর অতর্কিত আক্রমণ প্রতিহত করেছেন এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিয়েছেন। আমাদের পুত্রদের মধ্যে যে পরবর্তী মোগল সম্রাট হবে তার মাঝে একই নিয়তি অনুসরণ করার যোগ্যতা থাকতে হবে। আমার ইচ্ছা আমার প্রথম পুত্রকে উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচন করা। কিন্তু সেলিম যদি আমার প্রতি বিরুদ্ধাচারণ শুরু করে অথবা তার মাঝে যদি নেতাসুলভ গুণাবলীর অভাব দেখা দেয়, তাহলে কি হবে?

    এবারে আবুল ফজল কোনো কথা বললো না। তারা দুজন নিজেদের চিন্তার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকলো যখন মোমবাতি গুলি একে একে নিঃশেষ হতে লাগলো। আকবর ইশারায় তার পরিচাকদের নতুন বাতি জ্বালতে নিষেধ করলেন। আজ রাতে আলোর পরিবর্তে অন্ধকারেই তিনি অধিক স্বাচ্ছন্দ বোধ করছেন।

    *

    তার শিক্ষকরা যদি জানতে পারেন সে কি করছে তাহলে নিঃসন্দেহে তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবেন, কিন্তু সেলিম তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামালো না। মায়ের সঙ্গে আলাপের সেই অস্বাভাবিক সন্ধ্যাটির পর থেকে সে পূর্বের তুলনায় অধিক চঞ্চলতা এবং অনিশ্চয়তা অনুভব করছে। সে যতোদূর মনে করতে পারে তার মা হীরাবাঈ তার বাবাকে ভালোবাসেন না। ক্রমশ বড় হতে হতে সে বুঝতে শিখেছে যে বাবা এবং মায়ের মধ্যকার বিয়েটি ছিলো নিছক রাজনৈতিক মৈত্রী। কিন্তু আগে কখনোও তার মায়ের ঐ সুগভীর ঘৃণা সম্পর্কে তার ধারণা ছিলো না। বাবার প্রতি এবং মোগলদের প্রতি। দৌড়াতে থাকা সেলিমের আশে পাশে বাদুর পাখা ঝাঁপটে উড়ছে, তবে এই পথের প্রতিটি ইঞ্চি তার চেনা, এমনকি এই ঘোর সন্ধ্যাবেলায়ও তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

    সেলিম কারো নজরে না পড়ে আগ্রাদ্বার দিয়ে প্রসাদ সীমানার বাইরে বেরিয়ে এলো। সে ব্যবসা করতে আসা বণিকদের দলের সঙ্গে মিশে গেছে যারা সূর্যাস্তের পর বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। বণিকের দল সমভূমির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো, সেলিম তাঁদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যদিকের পহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে লাগলো। আরো দশ মিনিট দ্রুত গতিতে ছোটার পর তার মনে হলো সে একটি নিচু বাড়ির আকৃতি দেখতে পেলো। সেলিম থামলো, সে তার কানের উপর হৃদস্পন্দনের আঘাত অনুভব করছে এবং এতো জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে যে তার মনে হলো কিছুটা দূরে অবস্থিত বাড়িটির সামনে জ্বালা ছোট আগুনের সামনে বসে থাকা বৃদ্ধা এবং মেয়েটি যেনো তা শুনতে পাবে। কিন্তু তারা নিজেদের কাজ চালিয়ে গেলো। মেয়েটি একটি সমতল পাথরের উপর ময়দা বেলে রুটি বানিয়ে বৃদ্ধাটির হাতে দিচ্ছে এবং বৃদ্ধাটি সেগুলি ধাতব তাওয়ার উপর সেঁকছে।

    সেলিম শুনতে পেলো বৃদ্ধাটি হতাশাসূচক আর্তনাদ করলো যখন একটি কাঁচা রুটি আগুনে পড়ে গেলো। সে যখন কাছে এগিয়ে গেলো তার নাকে পোড়া ময়দার গন্ধ এলো। দৃশ্যটির সরলতা তাকে সাহসী করে তুলল। কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই সে আজ এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হেরেমের উঠানে পায়চারিরত অবস্থায় মুরাদ এবং দানিয়েল এর সঙ্গে বাবাকে আলাপ করতে এবং হাসতে দেখে তার ভীষণ রাগ হয়। হঠাৎ ওদের কাছে নিজেকে তার বহিরাগত বলে মনে হয়। তার বেঁচে থাকা কি আদৌ অর্থপূর্ণ? এমন প্রশ্ন তার মনে জাগ্রত হতে থাকে। একই সঙ্গে তার মনে এমন আশাও সৃষ্টি হয় যে, একমাত্র সুফি সাধক শেখ সেলিমই তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন। সেলিম জানতো তার জন্ম সম্পর্কে এই সুফি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন এবং তাঁর সম্মানেই ফতেহপুর শিক্রি নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি এখন অত্যন্ত বুড়ো হয়ে গেছেন এবং সম্পূর্ণ অন্ধ। আকবর তাঁকে রাজপ্রাসাদে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু তিনি রাজি হননি।

    সেলিম ইতস্তত পায়ে আগুনের আলোর সীমায় উপস্থিত হলো। মেয়েটি তাকে প্রথমে দেখতে পেলো এবং উঠে দাঁড়ালো। বৃদ্ধাটি ময়েটির দৃষ্টিকে অনুসরণ করে তাকে দেখতে পেলো। তুমি কি চাও?

    আমি জনাব শেখ সেলিম চিশতির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

    আমার ভাই অত্যন্ত দুর্বল- তিনি এতোই দুর্বল যে আগাম বার্তা না দিয়ে আসা দর্শনার্থীর সঙ্গে তিনি এই রাতের বেলা দেখা করতে পারবেন না।

    আমি দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি…. সেলিম আরেকটু এগিয়ে গেলো। তার গলায় পরিহিত মণিমাণিক্যের মালা এবং হাতের আংটি আগুনের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তার দেহের সোনারূপার কারুকাজ করা সবুজ রেশমের পোশাকটিও ঝলমল করছে। বৃদ্ধাটি তার পায়ে পড়া চামড়ার বুটজুতো থেকে গলার হার পর্যন্ত সবকিছু খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো- অবশেষে সে উঠে দাঁড়ালো।

    হালিমা, রুটি সেঁকা শেষ করো। তারপর সে সেলিমকে ইশারা করলো তাকে অনুসরণ করে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার জন্য। বাড়িটির প্রবেশ দ্বারের চৌকাঠ এতো নিচু যে বালক হওয়া সত্ত্বেও সেলিমকে তার মাথা ঝুঁকিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হলো। দুটি তেলের প্রদীপের অস্পষ্ট আলোতে সে দেখতে পেলো ঘরের শেষ প্রান্তের দেয়ালে হেলান দিয়ে কেউ বসে রয়েছে। প্রথমে সেলিমের মনে হলো মোটা গড়নের কেউ, কিন্তু অল্প আলো চোখে সয়ে আসতেই সে বুঝতে পারলো সুফির দেহে মোটা পশমের কম্বল জড়ানো।

    ভাই, তোমার কাছে একজন দর্শনার্থী এসেছে। পোশাক দেখে মনে হচ্ছে আমাদের যুবরাজদের একজন। বৃদ্ধাটির কণ্ঠস্বর অত্যন্ত মোলায়েম শোনালো। তার সঙ্গে কথা বলার শক্তি কি তোমার আছে?

    বৃদ্ধ সুফি মাথা নাড়লেন। তাকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। তাকে বলো আমার কাছে এসে বসতে।

    বৃদ্ধাটি সুফির সামনে বিছান পাটের মাদুরে সেলিমকে বসতে ইঙ্গিত করলো, তারপর বাইরে চলে গেলো।

    আমি জানতাম একদিন তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, সেলিম। তুমি যেখানে বসে আছে, তোমার বাবাও ঠিক একই জায়গায় বসে ছিলেন যখন তিনি বহু বছর আগে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

    আপনি কেমন করে বুঝলেন আমি কে? আমার পরিবর্তে আমার সৎ ভাইদের কেউও তো হতে পারতো, মুরাদ অথবা দানিয়েল…।

    আল্লাহ্ আমার প্রতি অত্যন্ত সদয়। যদিও দৃশ্যমান জগৎ আমি দেখতে পাই না, তিনি আমার হৃদয়ের দৃষ্টিতে অনেক কিছু উন্মোচন করেন। আমি জানতাম তুমিই এসেছে কারণ সম্রাটের পুত্রদের মধ্যে বর্তমানে একমাত্র তোমারই আমার সহায়তা প্রয়োজন।

    হঠাৎ সেলিমের চোখের পাতা কান্নায় ভিজে উঠলো- এটা বেদনার অশ্রু নয়, বরং সে যে এতোদিনে এমন একজনকে পেলো যে তার কথা শুনবে ও বুঝবে এই স্বস্তিবোধের অশ্রু।

    তোমার সমস্যা গুলি আমাকে বলো, সুফি কোমল কণ্ঠে বললেন।

    আমি বুঝতে পারি না আমি কে- ভবিষ্যতে আমার জীবনের উদ্দেশ্য কি হবে। আমি চাই আমার বাবা আমার জন্য গর্ববোধ করুক, কিন্তু আমি বুঝতে পারি না কি করলে তিনি খুশি হবেন…আমি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র। আমারই পরবর্তী মোগল সম্রাট হওয়া উচিত, কিন্তু আমার মনে হয় বাবা সেটা চান না। আমার পরিবর্তে সম্রাট হিসেবে যদি তিনি আমার সৎ ভাইদের কাউকে নির্বাচন করেন তাহলে কি হবে? এবং যদি আমি সম্রাট হইও, এর জন্য আমার মা আমাকে ঘৃণা করবেন। তিনি বলেন মোগলরা একটি অসভ্য জাতি এবং হিন্দুস্তানের উপর তাঁদের কোনো অধিকার নেই। তিনি…

    শেখ সেলিম চিশতি তাঁর মোটা কম্বলের আচ্ছাদন সহ কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকলেন এবং সেলিমের মুখটি তার শুষ্ক বুড়ো হাতে স্পর্শ করলেন। আর বলতে হবে না। তোমার অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি- সেই সঙ্গে তোমার ভয় এবং আশংকা গুলিও। তুমি ভালোবাসা চাও, কিন্তু তোমার আশংকা পিতা বা মাতার মধ্যে একজনকে ভালোবাসলে অপর জনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে…তুমি তোমার সৎ ভাইদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ কারণ তোমার সন্দেহ তারা তোমাকে তোমার পিতার দৃষ্টিতে সর্বদা খাটো করতে সচেষ্ট…এ কারণে তুমি এখন আর তাদের সঙ্গ পছন্দ করো না। তোমার মনে এমন প্রশ্ন জাগে যে তোমার মধ্যে একজন শাসকের গুণাবলী আছে কি না…আমি তোমাকে সরাসরি বলছি যুবরাজ সেলিম: মোগলদের অনেক কঠোর এবং রক্তাক্ত পথ পারি দিতে হয়েছে কিন্তু তারা মহত্বও অর্জন করেছে এবং ভবিষ্যতে তাদের আরো অনেক সাফল্য অর্জন করার আছে। তুমি সেই মহত্বের একজন অংশীদার হবে- তুমি একজন সম্রাটও হবে… সুফি থামলেন এবং সেলিম তার মুখের উপর তার আঙ্গুলের অগ্রভাগের হালকা চাপ অনুভব করলো, যেনো তিনি স্পর্শের মাধ্যমে এমন কিছু খোঁজার চেষ্টা করছেন যা দৃষ্টিহীনতার কারণে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তোমার মধ্যে তোমার পিতার একাগ্রতা এবং সবলতা রয়েছে কিন্তু এখনো তার অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাস তোমার মাঝে তৈরি হয়নি। তাঁকে পর্যবেক্ষণ করবে, লক্ষ্য করবে তিনি কেমন করে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। সেটাই তোমার নিজেকে তৈরি করার উপায় এবং তার অনুমোদন লাভের। কিন্তু তাঁকেও আমি সতর্ক করেছিলাম এবং এখন তোমাকে করছি। কারো প্রতি আস্থা পোষণের আগে বিচক্ষণতার সঙ্গে চিন্তাভাবনা করবে এবং কোনো বিষয়ে বিশ্বাসের উপর নির্ভর করবে না। এমনকি যারা তোমার সঙ্গে রক্তের বন্ধনে যুক্ত তাঁদের ব্যাপারেও সতর্ক থাকবে- তোমার সৎ ভাই অথবা তোমার নিজের অনাগত সন্তানদের প্রতিও। আমি এমনটা বোঝাতে চাচ্ছি না যে সর্বদাই তুমি বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা পরিবেষ্ঠিত থাকবে, কিন্তু তোমাকে সর্বদা মনে রাখতে হবে যে প্রতারণা খুব দ্রুত জন্ম নেয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষা উভয় দিকে ধার বিশিষ্ট তলোয়ারের মতো। এর সাহায্যে মানুষ অনেক মহত্ব অর্জন করতে পারে আবার এর দ্বারা মানুষের হৃদয় কলুষিতও হয়- অন্য যে কোনো মানুষের মতো তোমার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। একদিকে তোমার আশে পাশের সকলের মন্দ অভিপ্রায় যেমন তোমাকে প্রতিরোধ করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি তোমার নিজের মনের দুষ্ট আবেগ সমূহ এবং দুর্বলতা গুলিকেও তোমার দমন করতে হবে। তুমি যদি এতে সফল হও তাহলেই তোমার আকাঙ্ক্ষাগুলি বাস্তবে রূপ নেবে। সুফি সেলিমের মুখ ছেড়ে দিয়ে আবার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলেন।

    সেলিম তার চোখ বন্ধ করলো, তখনই একটি দৃশ্য তার কল্পনার পর্দায় রূপ নিতে আরম্ভ করলো: সে আলোক উজ্জ্বল সিংহাসনে বসে আছে, তার সভাসদ এবং সেনাপতিরা তাকে কুর্ণিশ করছে। সে এমন কিছুই আশা করে পরবর্তী মোগল সম্রাট হতে। তার মা তার মাথায় যে সব সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এই মহিমান্বিত দৃশ্যের প্রভাবে সেগুলি উধাও হয়ে গেলো। সব কিছুর উর্ধ্বে সে একজন মোগল এবং নিজ বংশের গৌরব তাকে রক্ষা করতে হবে। এতোদিন যতো দুর্ভাবনা এবং অনিশ্চয়তা তার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে সেগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে। যদিও এখনো তার বয়স অল্প তবুও তাকে পৌরুষ অর্জন করতে হবে। সুফি ঠিকই বলেছেন। তার পিতার ভালোবাসা এবং আস্থা অর্জন করতে হলে তাকে প্রমাণ করতে হবে যে রাজ্য শাসনের যোগ্যতা তার রয়েছে…

    সুফির লম্বা শ্বাস ফেলার শব্দে সেলিমের চিন্তাগুলি থমকে গেলো। আমার খুব দুর্বল লাগছে। তুমি এখন যাও। আমার বিশ্বাস আমি তোমার মাঝে স্বস্তি এবং আশা সৃষ্টি করতে পেরেছি।

    সেলিম সুফিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার জন্য কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তার আবেগের তীব্রতা তার কণ্ঠরোধ করে রাখলো। আপনি সত্যিই মহান, অবশেষে কোনোক্রমে সে বলতে পারলো। আমি এখন বুঝতে পারছি আমার বাবা আপনাকে এতো সম্মান করেন কেনো।

    আমি একজন তুচ্ছ সাধক যে ঈশ্বর এবং মানুষের কার্যক্রম উপলব্ধি করার অসম্ভব চেষ্টায় নিয়োজিত। নির্জনে শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকতে পারার জন্য আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। কিন্তু তোমার নিয়তি অন্যরকম। তুমি একজন মহান শাসক হবে, কিন্তু তোমার জীবন অথবা গৌরবের প্রতি আমি কখনোই ঈর্ষাবোধ করবো না।

    .

    ১৬. স্বর্গ এবং নরক

    ফতেহপুর শিক্রির আগ্রা দ্বারের কাছে পৌঁছে সেলিম পরিতৃপ্তি অনুভব করলো। আজ সকালের বাজ পাখি উড়ানোর খেলা বেশ চমৎকার ভাবে সম্পন্ন হয়েছে এবং তার পাখিগুলি উত্তম দক্ষতা প্রদর্শন করেছে। ভোরের ফ্যাকাশে আলোয় তারা শিকারের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ঘুঘু বা ইঁদুরের উপর একই রকম নৈপুণ্যে। আরো যেটা তার জন্য সুখবর তা হলো কয়েক সপ্তাহ পর সে তার বাবার সঙ্গে একটি দীর্ঘ শিকার অভিযানে যাবে। আকবরের শিকারের চিতা বাঘ গুলিকে অভিযানের জন্য তৈরি করা হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে থাকবে শত শত খেদাড়ে।

    সেলিম এই কারণে আরো আনন্দিত যে তার বাবা তার অন্য ভাইদের পরিবর্তে তাকে শিকারের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। সেই রাতে শেখ সেলিম চিশতির সঙ্গে দেখা করার পর আট মাস পার হয়ে গেছে। সে সুফির উপদেশ পালনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। যখনই সুযোগ পায় সে পিতার দৈনিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে, আকবরের ভোরে বারান্দায় গিয়ে প্রজাদের দর্শন দান থেকে শুরু করে দৈনিক রাজসভার সাক্ষাৎকার পর্ব পর্যন্ত সব কিছু। রাজসভায় কঠোর নিরাপত্তা বেষ্ঠনীতে অবস্থিত আকবরের সম্মুখে বিভিন্ন অভিযোগ বা আর্জি পেশ করা হয় এবং তিনি সেগুলি বিচার বিবেচনা করে আদেশ বা সমাধান প্রদান করেন। সুফির নির্দেশনা গুলি তার মনে এমন আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করেছে যে, তার এখন মনে হয় যাই ঘটুক না কেনো একদিন এই সব কার্যক্রম সেই পরিচালনা করবে। তার পিতা তার সম্পর্কে কি ভাবতেন সেই বিষয়ে দুশ্চিন্তা না করে সে এখন জনগণের শাসক হিসেবে তার কি দায়িত্ব হতে পারে সে সব বিষয়ে চিন্তা করে। সুফি যেমন অনুমান করেছিলেন তা সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে, তার এই সব কর্মকাণ্ডের ফলে অল্প অল্প করে সে তার পিতার আস্থা অর্জন করতে শুরু করেছে।

    তবে আবুল ফজল সর্বদা বাবার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে না থাকলে ভালো হতো। এক নাগারে সে তার খাতায় হিজিবিজি লিখতে থাকে এবং বাবার কানে কানে ফিসফিস করে। বাবার উপর তার প্রভাব অন্য যে কোনো সময়ের মতোই অত্যন্ত প্রবল। এই আবুল ফজল কখনো কখনো সভা শুরু হওয়ার সময় বাবাকে অনুরোধ করে যাতে সে সেখানে না থাকে। আবুল ফজল যুক্তি প্রদর্শন করে যে, বিষয় বস্তুর গুরুত্ব এমন যে এর সঙ্গে সরাসরি জড়িতদেরই কেবল উপস্থিত থাকা প্রয়োজন। সেলিম আরো সন্দেহ করে আবুল ফজলের প্ররোচনাতেই বাবা তাকে যুদ্ধ বিষয়ক সভায় অংশ নিতে দেন না, এই নিষেধাজ্ঞা তাকে ভীষণ ভাবে হতাশ করে।

    যুবরাজকে নিরাপত্তা প্রদান করো! ঐ লোক গুলিকে গ্রেপ্তার করো। আচমকা সেলিমের দেহরক্ষীদের দলপতির চিৎকারে তার চিন্তা বাধাগ্রস্ত হলো। একই সঙ্গে একটি অপরিচ্ছন্ন বাদামি আলখাল্লা পড়া লোক সেলিমের ঘোড়ার সামনে দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে গেলো এবং ঘোড়াটি আতঙ্কে লাফিয়ে একপাশে সরে গেলো। সেলিম ঘোড়াটিকে শান্ত করার জন্য একহাতে সবলে লাগাম টেনে ধরলো এবং অন্য হাতে খাপ থেকে তলোয়ার বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। ঠিক তার পেছনে সে তার কোর্চির ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি শুনতে পেলো, কোৰ্চিটি উত্তেজিত কণ্ঠে অভিশাপ দিতে দিতে নিজের ঘোড়াটিকে সামলানোর চেষ্টা করছে। পর মুহূর্তে আরেক জন লোক-অদ্ভুত পোশাক পরিহিত এবং তার এক হাতে তলোয়ার এবং অন্য হাতে একটি ছোরা-প্রথম জনকে তাড়া করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেলো, সে কোনো অপরিচিত ভাষায় গর্জন করছে যা সেলিম বুঝতে পারলো না।

    স্পষ্ট বোঝা গেলো প্রথম লোকটির দম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এবং দ্বিতীয় লোকটির সঙ্গে তার দূরত্ব দ্রুত কমে আসছে। প্রথম লোকটি একটি আবর্জনা পূর্ণ সংকীর্ণ গলির মধ্যে অদৃশ্য হলো যার দুপাশে মাটির ইটে তৈরি বাড়ির সারি। ইতোমধ্যে সেলিমের চার জন দেহরক্ষী ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে এবং লোক দুজনকে ধাওয়া করা শুরু করেছে-গলিটি ঘোড়া প্রবেশ করার মতো চওড়া নয়। কয়েক মিনিট পরে সেলিম আরো চিৎকারে চেঁচামেচি শুনতে পেলো। একটু পরে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী লোক দুজনকে গলির মুখে দেখা গেলো, তাদের পেছনে তলোয়ার হাতে সেলিমের দেহরক্ষীরা। যে লোকটি তলোয়ার হাতে ছুটছিলো তাকে নিরস্ত্র করা হয়েছে কিন্তু সে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছিলো। অন্যজনের বাম চোখের উপরের কাটা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। বোঝাই যাচ্ছে রক্ষীরা সময় মতো আক্রমণকারীকে থামাতে পারেনি। তাদেরকে সেলিমের সামনে কয়েক গজ দূরে থামানো হলো। হাঁটুর পেছনে রক্ষীদের তলোয়ারের চ্যাপ্টা অংশের আঘাত পেয়ে তারা উভয়েই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসলো।

    এখন সেলিম তাঁদের অবয়ব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে। যে লোকটি বাদামি আলখাল্লা পড়ে আছে তাকে সে একজন জেসুইট পুরোহিত হিসেবে শনাক্ত করতে পারলো। তার চিকন কব্জিতে পেচানো সুতাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং তার আলখাল্লার নিচ দিয়ে বেরিয়ে থাকা বাদামি রঙের স্যাণ্ডেলটি মোটা তলি বিশিষ্ট, তার পিতার সঙ্গে দেখা করতে আসা জেসুইট পুরোহিতরা এধরনের জুতোই পড়ে। কিন্তু অন্য লোকটির চেহারা বা পোশাক সবকিছুই সেলিমের কাছে বেশ জটিল মনে হলো। সেলিম গাট্টগোট্টা চওড়া কাঁধের অধিকারী লোকটার দিকে তাকালো। সেও একজন বিদেশী সন্দেহ নেই কিন্তু এমন অদ্ভুত বিদেশী সেলিম আগে দেখেনি। তার লম্বা কোকড়া চুল গুলি উজ্জ্বল কমলা রঙের- জাফরানী এবং সোনালী এই দুই এর মাঝামাঝি কোনো রঙ। সে একটি সংক্ষিপ্ত আটসাট চামড়ার জ্যাকেট পড়ে আছে এবং সেটার নিচে ডোরা কাটা ফুলে থাকা পালুন পড়া যেটা মধ্য উরু পর্যন্ত লম্বা এবং বেগুনি রিবন লাগান। অদ্ভুত পালুনটির নিচের অংশ হলুদ রঙের পশমের মোজায় ঢাকা। তার এক পায়ে চোখা অগ্রভাগ বিশিষ্ট কালো চামড়ার জুতো পড়া রয়েছে। অন্য পাটিটি নিশ্চয়ই গলির ভিতর মারপিটের সময় খোয়া গেছে।

    ওদেরকে দাঁড় করাও, সেলিম আদেশ দিলো। রক্ষীরা তাঁদের হুড়ো দিয়ে দুপায়ের উপর খাড়া করানোর পর সেলিম আরো ভালো মতো তাদের চেহারা দেখার জন্য সামনে ঝুঁকলো। জেসুইট পুরোহিতটি গোঁয়ার পর্তুগীজ বাণিজ্য উপনিবেশ থেকে আগত ছয়জন প্রতিনিধির একজন। আকবরের অনুরোধে তারা তাদের ধর্মগ্রন্থ ল্যাটিন ভাষা থেকে ফার্সীতে অনুবাদের কাজে আকবরের অনুবাদকদের সাহায্য করতে এসেছে। লম্বা লিকলিকে বেঢপ আকৃতির লোকটির মুখের এক পাশ দগদগে ব্রনে ভরা। যদিও সে সেলিমের কাছ থেকে প্রায় দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো তবুও তার গায়ের ঘামের তীব্র ঝাঝালো দুর্গন্ধ তার নাকে আসছিলো। সেলিমের কাছে এটা রহস্যময় মনে হলো যে এই বিদেশীরা হাম্মাম খানায় গোসল করে না কেনো? নিজেদের গায়ে খচ্চরের মতো দুর্গন্ধ তারা সহ্য করে কীভাবে?

    অন্য বিদেশীটির ঠোঁটের উপরের অংশ নিখুঁত ভাবে কামান কিন্তু তার থুতনিতে ছাগলের মতো সরু দাড়ি রয়েছে। তার ফ্যাকাশে পাপড়ি বিশিষ্ট চোখগুলি উজ্জ্বল নীল এবং গায়ের চামড়া তার চুলের মতোই লাল এবং তার নাকের অগ্রভাগ আরো বেশি লাল। সে তার পোশাকের ধূলা ঝাড়তে শুরু করলো।

    তোমাদের ঝগড়ার কারণ কি? সেলিম ফার্সীতে জেসুইটটিকে জিজ্ঞাসা করলো, তার মনে হয়েছে সে ফার্সী ভাষা বোঝে এবং বলতে পারে।

    পুরোহিতটি সেলিমের দিকে তাকালো। জাহাপনা, এই লোকটি আমার ধর্মকে অপমান করেছে। সে আমার গুরু পোপকে ব্যাবিলনের লাল বর্ণের বেশ্যা বলে গাল দিয়েছে…সে আরো বলে

    যথেষ্ট হয়েছে। সেলিম বুঝতে পারেনি পুরোহিতটি কি ব্যাপারে কথা বলছে শুধু এতোটুকু ছাড়া যে তাঁদের মধ্যে ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে ঝগড়া হয়েছে।

    ঐ লোকটি কোনো দেশ থেকে এসেছে?

    ইংল্যান্ড থেকে। সে একজন বণিক, বদমাশ কিছু সঙ্গী সহ ফতেহপুর শিক্রিতে নতুন এসেছে।

    তুমি তাকে কি এমন বলেছে যাতে সে এতো ক্রুদ্ধ হয়ে তলোয়ার নিয়ে তোমাকে তাড়া করেছিলো?

    আমি তাকে কেবল একটি সত্যি কথা বলেছি জাঁহাপনা। আমি বলেছি তার দেশের রানী একজন বেজন্মা বেশ্যা যে তার অনুসারীদের সহ নরকে পচবে।

    বণিকটি মাথা নিচু করে তাঁদের কথা শুনছিলো কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো সে একটি বর্ণও বুঝতে পারছে না। সেলিম জানতো ইংল্যান্ড কোথায় অবস্থিত। আবিস্কৃত ভূখণ্ডের এক প্রান্তে অবস্থিত একটি ছোট দ্বীপ যেখানে সব সময় বৃষ্টি হতে থাকে এবং দমকা হাওয়া অবিরাম আঘাত হানতে থাকে। দেশটির শাসক একজন রানী যার চুল এই লোকটির মতোই লাল। সেলিম সেই রানীর ছোট আকারের একটি প্রতিকৃতিও দেখেছে যেটি একজন তুর্কি বণিক দরবারে নিয়ে এসেছিলো। বণিকটি আকবরের দুর্লভ বস্তু প্রীতির কথা জানতো। সে অনেক চড়া দামে কাছিমের খোলের ডিম্বাকৃতির কাঠামোতে বাধাই করা এবং মুক্তার কাজ করা ছবিটি আকবরের কাছে বিক্রি করে। ছবিটিতে রানী একটি ঘিয়া রঙের মেঝে পর্যন্ত লম্বা পোশাক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে মহিলা মনে না হয়ে সেলিমের কাছে একটি পুতুলের মতো লেগেছে।

    এই বণিকটি কি ফার্সী ভাষা বলতে পারে?

    না জাঁহাপনা। এই ইংরেজরা স্কুল এবং অশিক্ষিত লোক। তারা নিজেদের সহজ ভাষা ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় কথা বলতে পারে না এবং বাণিজ্য ও অর্থ উপার্জন ছাড়া অন্য কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করে না।

    ঠিক আছে থামো। আমি তাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। আমার মনে হচ্ছে ওর ভাষা সম্পর্কে তোমার কিছুটা ধারণা রয়েছে, তুমি আমার দোভাষীর ভূমিকা পালন করো। আমি যা বলবো অবিকল তাই বলবে, কোনো রকম পরিবর্তনের চেষ্টা করবে না। জেসুইটটি বিষণ্ণ মুখে মাথা নাড়লো।

    ওকে জিজ্ঞেস করো সে কেনো সম্রাটের রাস্তার উপর লড়াই করেছে।

    পুরোহিতটি ইংরেজটিকে সংক্ষেপে কিছু বললো যা সেলিমের কাছে লাগসই মনে হলো, তবে সেই ভাষার মাঝে সেলিম ফার্সী ভাষার ছন্দময়তা খুঁজে পেলো না। পুরোহিতটি তার প্রতিপক্ষের উত্তর শুনলো এবং সেলিমকে বললো, সে দাবি করছে সে তার রানী, দেশ এবং ধর্মের অপমানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো।

    তাকে বলো আমাদের রাস্তায় কোনো ধরনের ঝগড়া বা লড়াই করা চলবে না এবং সে সৌভাগ্যবান এ কারণে যে তার উশৃঙ্খল আচরণের জন্য আমি তাকে গারদে নিক্ষেপ করছি না বা চাবুক পেটা করছি না। আমি তার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করছি কারণ আমি বুঝতে পারছি উভয় পক্ষেরই দোষ হয়েছে। তাকে আরো বলো সে যেনো রাজসভায় আসে। আমি নিশ্চিত আমার পিতা তাকে তার দেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইবেন। আর তোমাকে বলছি, আমাদের দেশের মাটিতে কাউকে ভবিষ্যতে অপমান করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ এই ইংরেজ লোকটির মতো তুমি নিজেও একজন বিদেশী ভ্রমণকারী।

    *

    আমি আপনাদেরকে আমার ইবাদত খানায় স্বাগত জানাচ্ছি। একজন সম্রাটের প্রধান দায়িত্ব হলো তার রাজ্যের সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং সম্ভব হলে তা সম্প্রসারণ করা যেমনটা আমি করেছি এবং ভবিষ্যতেও করবো। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি একজন মহান শাসকের উচিত মানবীয় জ্ঞান এবং উপলব্ধিরও সম্প্রসারণ করা। আজীবন তার কৌতূহলী থাকা উচিত, প্রশ্ন করা উচিত এবং তার অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে প্রজাদের উন্নয়নের চেষ্টা করা উচিত। এ কারণেই আমি কেবলমাত্র উলামাবৃন্দ এবং মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তিদেরকেই আমন্ত্রণ জানাইনি বরং অন্য ধর্মের প্রতিনিধিদেরও ডেকেছি। সম্মিলিতভাবে আমরা ধর্ম বিষয়ক প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক করবো, সত্য কি এবং মিথ্যা কি তা উদঘাটনের চেষ্টা করবো এবং যে বিষয়গুলি আমাদের সকলের জন্য একই রকম তার তাৎপর্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।

    সেলিম বিশাল সভা কক্ষের পিছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে, সে তার পিতাকে কদাচিৎ এমন জৌলুসপূর্ণ রূপে দেখেছে। আকবর উজ্জ্বল সবুজ রঙের সোনা রূপার কারুকাজ খচিত জোব্বা এবং পালুন পড়ে আছেন, গলায় পান্নার মালা এবং মাথায় সোনা দিয়ে বোনা কাপড়ের পাগড়িতে হীরা ঝিকমিক করছে। এক মানুষ উঁচু সোনার ঝাড়বাতিদান স্থাপিত রয়েছে তার সিংহাসনের দুপাশে মার্বেল পাথরের বেদীর উপর।

    উলামাবৃন্দ কালো পোষাক পরিধান করেছেন- শেখ আহমেদ সকলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আবুল ফজলের বাবা শেখ মোবারক দলের এক পাশে অবস্থান করছেন। জেসুইট পুরোহিতরা তাঁদের চিরাচরিত মোটা বাদামি কাপড়ের আলখাল্লা পড়ে আছে, কোমরে দড়ির কোমরবন্ধনী বাঁধা, গলায় কাঠের ক্রুশ ঝুলছে। সেলিম তাদের মাঝে ফাদার ফ্রান্সিসকো হেনরিকস এবং তার সঙ্গী ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেটকে দেখতে পাচ্ছে যারা পাঁচ বছর আগে এই রাজসভায় প্রথম এসেছিলো এবং তার দেখা প্রথম খ্রিস্টান।

    সেখানে পাঁচ জন হিন্দু পুরোহিতও উপস্থিত রয়েছে। তাদের চেহারায় শান্ত ভাব বিরাজ করছে, পরনে সাদা রঙের নেংটি এবং বাম কাধ তেকে শুরু করে ডান হাতের নিচ দিয়ে ঘুরিয়ে বাঁধা সুতার পৈতা। এদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে জৈনরা যাদের সেলিম পবিত্র মানুষ বলে জানে। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিউপাসক জোরাস্ট্রিয়ানরা, তারা বহু আগে পারস্য থেকে হিন্দুস্তানে এসেছিলো। এই ধর্মের অনুসারীদের কারো মৃত্যু হলে মৃত দেহটিকে নিঃশব্দ মিনার নামক পাহাড়ের চূড়ায় রেখে আসা হয় পাখিদের ঠুকরে খাওয়ার জন্য। সেলিম পাতলা গড়নের লম্বা বুড়ো লোকটিকে চিনতে পারলো যে জোরাস্ট্রিয়ানদের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে একজন ইহুদী পণ্ডিত যে পারস্যের কাসান থেকে অল্প কিছুদিন আগে আকবরের দরবারে এসেছে এবং পাঠাগারে কাজ পেয়েছে। যেহেতু সে কোনো ধর্মযাজক বা পুরোহিত নয় তাই এদের কাছ থেকে বেশ খানিটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো লাল চুল বিশিষ্ট ইংরেজ বণিকটি, তিন মাস আগে শহরের রাস্তায় সেলিম যার মুখোমুখী হয়েছিলো। তার নামটি সেলিমের কাছে ভীষণ অদ্ভুত লেগেছে জন নিউবেরী। তার ঠিক পাশেই তারই মতো বেখাপ্পা পোশাক পরিহিত তার দুজন সঙ্গী দাঁড়িয়ে আছে। এই তিনজন ইংরেজ শহরে একটি বাসস্থান ভাড়া করে অবস্থান করছিলো এবং তারা তাদের রানীর অনুমোদন বিশিষ্ট একটি বাণিজ্যের আবেদন পত্র আকবরের কাছে পেশ করে এর উত্তর লাভের জন্য অপেক্ষায় ছিলো। সেলিম যেমন অনুমান করেছিলো, আকবর তাঁদের বহুদূরবর্তী দেশ সম্পর্কে এবং তাঁদের ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যদিও তারাও খ্রিস্টান তবে তাঁদের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে পর্তুগীজ জেসুইটদের বিশ্বাসের অনেক পার্থক্য রয়েছে।

    বর্তমান পরিবেশ প্রত্যক্ষ করে সেলিমের মন গর্বে ভরে উঠেছে। যদিও তার বাবা কেনো এই ইবাদত খানা নির্মাণ করছেন সে বিষয়ে তাকে তেমন কিছু বলেননি, সে প্রায়ই এর নির্মাণ কাজ দেখার জন্য আসতো। এখন তার বাবার বক্তব্য শুনে সে নির্মাণের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে-তিনি ধর্ম সম্পর্কে তাঁর ক্রমবর্ধমান কৌতূহল পরিতৃপ্ত করতে চান। মোগলদের অসভ্য বলে অবজ্ঞা করে তার মা ভুল করেছেন, সেলিম ভাবলো। জীবনের তাৎপর্য সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা এবং মনের অজানা প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টার তুলনায় উচ্চতর আর কি একজন মানুষ অনুসন্ধান করতে পারে? এই মুহূর্তে উজ্জ্বল পোষাক এবং ঈগলাকৃতির হাতল বিশিষ্ট তলোয়ারে তার পিতাকে কেবল জাগতিক শক্তির মূর্ত প্রকাশ বলেই মনে হচ্ছে না বরং তার মাঝে প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্বও ফুটে উঠেছে। সেলিম নিজে কি কখনোও তার পিতার মতো এমন মহিমান্বিতভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারবে?

    আমি জানতে পেরেছি বহু দূরবর্তী ভূখণ্ডে ধর্মমতের ভিন্নতার কারণে খ্রিস্টানরা পরস্পরকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারছে, আকবর বললেন। আমি ফাদার ফ্রান্সিসকো এবং ফাদার এ্যান্টোনিওর কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চাইছি। আপনারা বলুন যাতে উপস্থিত সকলে এ সম্পর্কে জানতে পারে।

    জেসুইট দুজন পরস্পরের সঙ্গে নিচু কণ্ঠে কিছু বাক্য বিনিময় করলো, তারপর তার লম্বা সঙ্গীর সম্মতি পেয়ে ফাদার ফ্রান্সিসকো বক্তব্য প্রদান করা শুরু করলো। আপনি যা শুনেছেন তা সত্যি জাঁহাপনা, ইউরোপে মানুষের আত্মার মুক্তির যুদ্ধ চলছে। আমরা যারা ক্যাথলিক মতের অনুসারী তাদের বিশ্বাসের উপর এক অশুভ আগ্রাসন শুরু হয়েছে। আমরা একে প্রোটেস্টানিজম নামে ডাকি। এই মতের অনুসারীরা সত্য থেকে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং তারা রোমে অবস্থিত আমাদের ধর্মীয় নেতা পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। পোপ হলেন সেই ব্যক্তি যার অবস্থান আমাদের মতো নিকৃষ্ট পাপী এবং ঈশ্বরের মধ্যবর্তী স্থানে এবং তিনি পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি। প্রোটেস্টেন্টরা আমাদের পবিত্রতম বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর বিরুদ্ধে অশোভন গালাগাল দেয়। তারা পবিত্র বাইবেল এর সম্পূর্ণ বিরোধী নব্য ধর্মতত্ত্ব চর্চা করে এবং দাবি করে ঈশ্বর এবং তাঁদের মাঝখানে কোনো মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন নেই। উত্তম ক্যাথলিক দেশগুলিতে কিছু পবিত্র মানুষ রয়েছে। আমরা তাদের বিচ্যুতি দমনকারী নামে ডাকি- তারা এইসব পথভ্রষ্টদের অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে এবং তারা যখন পথভ্রষ্টদের খুঁজে পায় তখন তাদের ভুল স্বীকার করে ভ্রান্ত মতো পরিত্যাগ করার জন্য বলপূর্বক বাধ্য করে। যারা ভুল স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায় তাদেরকে জীবন্ত অবস্থায় আগুনের মধ্যে প্রেরণ করা হয় অনন্ত নরকদণ্ডের প্রাথমিক স্বাদ প্রদানের জন্য।

    তাদের কি পরিণতি হয় যারা আপনাদের সত্য পথে ফিরে যেতে রাজি হয়? আকবর জিজ্ঞাসা করলো। তিনি একাগ্রচিত্তে জেসুইটদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

    যদি তারা তাদের ভুল স্বীকারও করে তবুও তাদের পার্থিব দেহ আগুনের মাঝে প্রেরণ করা হয় যাতে তাদের আত্মা পাপমুক্ত হতে পারে এবং তারা স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের উপযুক্ত হয়।

    আপনারা মানুষকে তাদের বিশ্বাস পরিবর্তনে কীভাবে প্ররোচিত করেন? যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে, যেমনটা আমরা এখানে করছি?

    পাদরীদ্বয় পরস্পরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো। নিশ্চয়ই আমরা যুক্তির শক্তি ব্যবহার করি দলছুট ভেড়াদের দলে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু পরিতাপের সঙ্গে জানাচ্ছি মাঝে মাঝে আমাদেরকে দৈহিক নির্যাতনও প্রয়োগ করতে হয়।

    আমার অনুবাদকগণ সেই সব নির্যাতনের বিস্তারিত বিবরণ আমাকে শুনিয়েছে- এমন যন্ত্র ব্যবহার করা হয় যা মানুষের দেহ দুদিক থেকে টেনে হাড়ের সংযোগস্থল বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, লোহার ডাণ্ডার আঘাতে মানুষের হাড়ের মজ্জা বের করে ফেলা হয় এবং চোখের উপর চাপ প্রয়োগ করে অক্ষিগোলক ফাটিয়ে দেয়া হয়…

    কখনো কখনো এমন নির্যাতনের প্রয়োজন হয় জাহাপনা। কয়েক ঘন্টার যন্ত্রণা নরকের অনন্ত উত্তপ্ত অগ্নির তুলনায় কিছুই নয়।

    আপনারা পুরুষদের মতো নারী ও শিশুদেরও নির্যাতন করেন?

    শয়তানের ফেলা জাল অনেক বিস্তৃত জাঁহাপনা। মহিলারা বিশেষত দুর্বল বাহন এবং অল্পবয়সে কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে না।

    নির্যাতিতরা সত্যিই অনুতপ্ত হয়েছে সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত হোন কীভাবে? অত্যাচার বন্ধের জন্য তারা তো ভানও করতে পারে।

    বিচ্যুতি দমনকারীরা এ সব বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞ জাঁহাপনা, আপনার অনুসন্ধানকারীদের মতোই। মাত্র গত সপ্তাহেই আমি দেখেছি দুজন সন্দেহভাজন চোরকে হাতের গোড়া পর্যন্ত গরম বালুর মধ্যে পুঁতে তাদের অপকর্মের স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করতে। এই পদ্ধতি এবং আমাদের বিচ্যুতি দমনকারীদের প্রয়োগ করা কৌশলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

    সেখানেই পার্থক্য সূচিত হয় যখন আদৌ কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না তা বিবেচনায় আসে। চোরদের ক্ষেত্রে সন্দেহাতিত ভাবে জানা গেছে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং কি ঘটেছিলো তা বিচারকরা উদঘাটনের চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কোনো ধর্মের কি নিজ বিশ্বাস জোর করে অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার আছে? এই প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের কি ভাবা উচিত নয়? আমার সাম্রাজ্যে আমি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষে মানুষে পার্থক্য করি না। আমার উপদেষ্টাগণ, আমার সেনাপতিগণ এমনকি আমার স্ত্রীগণও সকলে আমার ধর্মের অনুসারী নয়।

    জেসুইটদের চেহারা গম্ভীর দেখালো এবং সেলিম লক্ষ্য করলো শেখ আহমেদ রাগে মাথা নাড়ছেন এবং বিড়বিড় করে তার পাশে দাঁড়ান মাওলানাকে কিছু বলছেন, কিন্তু কেউ সরাসরি কোনো কথা বললো না।

    আসুন আমরা আমাদের অনুসন্ধান আরো বিস্তৃত করি… আকবর বলে চললেন, তাঁর বক্তব্য সকলে গ্রহণ করতে পেরেছে অনুমান করে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। জেসুইটরা তাদের বিশ্বাসের কথা আমাদের বলেছেন, কিন্তু এখন আমরা প্রটেস্টেন্টদের বক্তব্য শ্রবণ করবো যাদেরকে ক্যাথলিকরা এতো ঘৃণা করে…আমি ইংরেজ ভদ্রলোক জন নিউবেরীকে প্রশ্ন করতে চাই। আমার একজন তুর্কি পণ্ডিত তার ভাষা জানে এবং সে দোভাষী হিসেবে কাজ করবে।

    লালচুলো ইংরেজটিকে তুর্কি মোরগের মতো আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে এবং জেসুইটদের মতোই যুদ্ধংদেহী, সেলিমের ভাবলো। সে তখন তুর্কি দোভাষীটিকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলো।

    উপস্থিত সবাইকে তোমার ধর্ম সম্পর্কে বলো জন নিউবেরী, যা তুমি ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে বলেছো।

    ইংরেজ বণিকটি তুর্কিটিকে বিড়বিড় করে কিছু বললো এবং সে কিছুটা ইতস্তত ভাবে তার অনুবাদ শুরু করলো। আমি একজন ইংরেজ এবং একজন প্রটেস্টেন্ট এবং এই উভয় বৈশিষ্টের জন্য গর্বিত।

    তুমি আমাকে বলেছো তোমাদের রানী তোমাদের ধর্মীয় নেতা। বিষয়টি আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করো

    আবারো দোভাষীটির সঙ্গে নিউবেরীর নিচু স্বরে কথোপকথন হলো, কিন্তু এবারে তুর্কিটিকে কিছুটা আত্মবিশ্বাসী মনে হলো।

    আমাদের রানীর পিতা আমাদের প্রয়াত মহান রাজা হেনরী খুব তরুণ বয়সে এক রাজকুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু এই রাজকুমারীটি এর আগে একবার আমাদের রাজার ভাই এর বাগদত্তা হয়েছিলেন। যাই হোক, বছর গড়িয়ে যেতে লাগলো এই রানীটি আমাদের রাজাকে একটি মাত্র কন্যা সন্তান উপহার দিতে পারলো। আমাদের রাজা উপলব্ধি করলেন নিজের ভাই এর সম্ভাব্য স্ত্রীকে বিয়ে করে তিনি ঈশ্বরের দৃষ্টিতে পাপ করেছেন। তিনি রানীকে তালাক দিয়ে নিজের পাপের অনুশোচনা করতে চাইলেন। কিন্তু পোপ- যাকে এই জেসুইটরা এতো শ্রদ্ধা করে- এই তালাকের ব্যাপারে সম্মতি দিলেন না। আমাদের রাজা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, নিজ রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তার পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি পোপের হস্তক্ষেপ মেনে নিবেন না। তিনি নিজেকে ইংল্যান্ডের গির্জার প্রধান হিসেবে ঘোষণা করলেন, রানীকে তালাক দিলেন এবং অন্য এক রমণীকে বিবাহ করলেন যার গর্ভে আমাদের বর্তমান রানী মহান এলিজাবেথ জন্ম নেন।

    তুমি আমাকে বলেছে তোমাদের ধর্ম অনুযায়ী কোনো পুরুষ একটি মাত্র বিয়ে করতে পারে, কিন্তু আমি শুনেছি এই রাজা হেনরী ছয় বার বিয়ে করেছেন। কীভাবে তা সম্ভব হলো? তোমার দেশে কি রাজাদের জন্য ভিন্ন নিয়ম চালু রয়েছে?

    না, জাহাপনা। আমাদের বর্তমান রানীর মা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হোন- এমনও শোনা যায় তিনি একজন ডাইনী ছিলেন এবং তাকে হত্যা করা হয়। রাজা হেনরী আবার বিয়ে করেন কিন্তু এই রানীর সন্তানের বয়স মাত্র দুসপ্তাহ হতেই তিনি মারা যান। রাজা তার চতুর্থ স্ত্রীকেও তালাক দেন যিনি ছিলেন একজন বিদেশী রাজকন্যা- কারণ তিনি রাজার দৃষ্টিকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি। তাঁর পঞ্চম স্ত্রী-তরুণী এবং অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পবিত্র ছিলেন না-ব্যভিচারের অভিযোগে তারও গর্দান কাটা যায়। কিন্তু রাজার ষষ্ঠ স্ত্রী ছিলেন একজন মধ্যম মর্যাদার নারী যিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত রাজার সহধর্মিনীর ভূমিকা পালন করেন।

    তোমাদের রাজার কিছু অসুবিধা দূর হয়ে যেতো যদি তিনি আমাদের মতো একই সঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করতেন। এবং আমার মনে হচ্ছে তার হেরেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল ছিলো… আকবরের কথা শেষ হতেই ইবাদত খানা জুড়ে হাসির হিল্লোল উঠলো। কিন্তু তুর্কি পণ্ডিতটির মুখে আকবরের বক্তব্যের অনুবাদ শুনে ইংরেজ বণিকটি বা জেসুইট পাদ্রীদের কেউ হাসলো না।

    তোমাদের বর্তমান রানী সম্পর্কে বলো জন নিউবেরী। তোমাদের দেশের জনগণ কি একজন নারীর শাসনে সন্তুষ্ট?

    তাকে আমাদের দেশের মানুষ ভালোবাসে কারণ তিনি আমাদেরকে ক্যাথলিকদের হুমকি থেকে রক্ষা করছেন এবং আমাদেরকে স্বাধীন ভাবে জীবন যাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন।

    তাঁর কোনো স্বামী নেই?

    কুমারী থাকতে পেরে তিনি গর্বিত। বহু বিদেশী যুবরাজ তাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছে কিন্তু তিনি বলেন ইংল্যান্ডই তার স্বামী।

    তিনি কি সুন্দরী?

    তিনি সুন্দরের চেয়েও বেশি কিছু- তিনি দ্যুতিময়।

    সেলিম দেখলো ফাদার এ্যান্টোনিও খুব দ্রুত ফাদার ফ্রান্সিসকোর কানে কানে কিছু বললো এবং কয়েক মুহূর্ত পর দ্বিতীয় জন কিছুটা সামনে অগ্রসর হলো। আমি কিছু বলতে চাই জাঁহাপনা, সে তার মোলামেয় দরবারী ফার্সী ভাষায় বললো। এই ইংরেজটি আপনাকে বিভ্রান্ত করছে জাহাপনা। ইংল্যান্ডের বর্তমান রানী তার পিতা রাজা হেনরীর লালসা পূর্ণ অবৈধ মিলনের ফলে জন্মলাভ করেছে এবং তার মাতা ছিলো একজন স্বীকৃত বেশ্যা। এই এলিজাবেথ ইংল্যান্ডের বৈধ শাসক নয়- আইনত সেই দেশ শাসন করার ন্যায্য অধিকারী হলেন স্পেনের ক্যাথলিক রাজা-কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এক জারজ উত্তরসূরি দেশটিকে অনন্ত নরকের দিকে ধাবিত করছে। আমাদের প্রভু রোমের ধর্মীয় অধিশ্বর পোপ ঐ নারীকে বিধর্মী বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তাই তাকে অনন্তকাল নরকের আগুনে পুড়তে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

    তুর্কি দোভাষীটি জন নিউবেরীকে এসব কথা অনুবাদ করে শোনাচ্ছিলো এবং ইংরেজটির লাল মুখমণ্ডল আরো গাঢ় বর্ণ ধারণ করছিলো জেসুইটের বক্তব্য বুঝতে পেরে। কিন্তু সেলিম লক্ষ্য করলো আকবর এসব কথা শুনে ভিষণ বিরক্ত বোধ করছেন। তার বাবা দার্শনিক যুক্তিতর্ক আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করেন কিন্তু কারো নিন্দা বা কুৎসা নয়। তাই হঠাৎ আকবর যখন আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সেলিম অবাক হলো না।

    যথেষ্ট হয়েছে। আমরা অন্য কোনো দিন আবার আলোচনা করবো, আকবর বললেন এবং ইবাদত খানা ত্যাগ করলেন।

    *

    হেমন্তের এক ঝকঝকে দিন। সূর্যের আলো বনের ঘন বিন্যস্ত গাছ পালা, মধ্যে শোধিত হয়ে ভূমিতে সামান্যই পৌঁছাচ্ছে। এর মাঝেই খেদাড়ের তাঁদের ধাতুনির্মিত চাকতির ঘন্টা পিটিয়ে এবং তারস্বরে চিৎকার করে তাদের সম্মুখের পশু গুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। হাতির পিঠে চড়ে তার তিনজন পরিচারক সহ ছন্দোময় গতিতে এগেয়ে যেতে সেলিমের খুব ভালো লাগছিলো। তার কাছ থেকে প্রায় দশ গজ দূরে তার বাবার হাতিটি এগিয়ে চলেছে। হাতিটির নাম লংকা, সেটার পেছনের বাম পায়ে একটি ক্ষত রয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি পুরুষ বাঘ ধারালো নখ দিয়ে সেখানে আঁচড়ে দিয়েছিলো। লংকা আকবরের প্রিয় শিকারের হাতি। আকবর নিজেই হাতিটিকে ধরেছিলেন সেটার জংলী সঙ্গীদের দল থেকে যখন সেটার বয়স অল্প ছিলো, তারপর সেটাকে পোষ মানান।

    সেলিম তার পিতাকে নির্ভিক চিত্তে অন্য হাতিদেরও বশে আনতে দেখেছে। জংলী হাতিকে বশে আনা অত্যন্ত বিপদজনক কাজ, এর জন্য দুই জন লোক লাগে যারা বুনো হাতিটির দুপাশে দুটি পোষা হাতির পিঠে চড়ে অবস্থান করে। সঠিক অবস্থানে থেকে তারা একটি মজবুত দড়ির ফাঁস বুনো হাতিটির গলায় পড়ায় এবং দড়িটির প্রান্ত তাদের নিজেদের হাতির গলায়ও শক্ত করে বাঁধে। তারপর ফাঁসটিকে তারা ক্রমশ টেনে শক্ত করতে থাকে যার ফলে বুনো হাতিটি ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকে এবং নিয়ন্ত্রণে আসে। এভাবে বুনো হাতি বশ মানাতে গিয়ে অনেক লোককে সেলিম মারা যেতে দেখেছে। কারণ বশকারীরা যে কোনো সময় মাটিতে পড়ে যেতে পারে এবং ক্ষিপ্ত হাতির পায়ের নিচে পড়লে কারো বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না। প্রাথমিক বশীকরণের পরেও বহু মাসের প্রশিক্ষণ বাকি থেকে যায়, খাদ্যের প্রলোভন দেখিয়ে হাতিকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার হুকুম তামিল করা শেখাতে হয় এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু লংকা আকবরের সেবা ভালো ভাবেই করছে এবং এর প্রশিক্ষণের পিছনে তিনি যে সময় ব্যয় করেছেন তার প্রতিদান দিচ্ছে।

    তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সেলিমের মুখের কোণা দিয়ে এক ফোঁটা লোনা ঘাম প্রবেশ করলো। সে জিহ্বা দিয়ে তা সরিয়ে দিলো। শীঘ্রই খেদাড়েদের ঘর ছোট হয়ে আসবে যখন শিকার আরম্ভ হবে। কাঁধের উপর দিয়ে পিছন ফিরে সেলিম দেখতে পেলো তার কোৰ্চি একটি ঘোড়ার পিঠে কাছাকাছি রয়েছে এবং তার কালো স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটিকে নিয়ে আসছে। প্রয়োজনে যাতে সে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত অগ্রসর হতে পারে। উত্তেজনায় সেলিমের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে, শিকারের সময় সর্বদাই তার এমন অনুভূতি হয়। সে একজন ভালো লক্ষ্যভেদকারী- বন্দুক এবং তীর ছোঁড়ায় সমান পারদর্শী-এবং সম্ভবত আজো সে তার পিতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। বাবার সঙ্গে লংকার পিঠে ভ্রমণ করতে তার ভালো লাগতো, কিন্তু চিরাচরিত নিয়মে নাদুসনুদুস গড়নের অধিকারী আবুল ফজল তার বাবাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো।

    সামান্য ঈর্ষার যে ছায়া সেলিমের মনের উপর পড়েছিলো তা শীঘ্রই অপসারিত হয়ে গেলো। সে দেখলো তার পিতার হাতিটি বনের অপেক্ষাকৃত ঘন গাছপলার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শেখ সেলিম চিশতির নির্দেশনা মতো তাকে কাজ চালিয়ে যেতে হবে- ধৈর্য ধরে সবকিছু দেখতে হবে, শিখতে হবে এবং তাহলেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। এবং এটি তার জন্য একটি শুভ ঘটনা যে তার বাবা তাকে শিকারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। হঠাৎ সম্মুখ থেকে আসা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে সেলিম চট করে হাত বুলিয়ে তার পিঠে থাকা তীর ধনুক ঠিক আছে কি না দেখে নিলো। এবং তারপর তার গাদাবন্দুকটির মসৃণ নলের উপর হাত বুলালো। হ্যাঁ, সে শিকারের জন্য প্রস্তুত।

    কিন্তু পর মুহূর্তে সেলিম অনুভব করলো সম্মুখের হট্টগোল শিকারের প্রস্তুতির তুলনায় বেশি কিছু এবং তা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই গোলযোগের মাঝে সে কিছু কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলো, সম্রাট অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন! হেকিমকে ডাক! হঠাৎ দ্রুধাবমান ঘোড়ার খুড়ের শব্দ পাওয়া গেলো এবং সেলিম দেখলো আকবরের দুজন দেহরক্ষী তার সামনে দিয়ে পিছন দিকে ছুটে গেলো যে দিকে ষাড়টানা গাড়িতে রাজ হেকিমরা রয়েছেন।

    কি হয়েছে? আমার বাবার কি হয়েছে? সেলিম চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো কিন্তু এই গোলযোগের মাঝে কেউ তার দিকে মনোযোগ দিলো না। উত্তেজিত সেলিম তার হাওদা টপকে হাতির দেহের পাশে বাঁধা চামড়ার ফালি ধরে কিছুটা নেমে মাটির কাছাকাছি পৌঁছে মাটিতে ঝাঁপ দিলো। তারপর কিছু অশ্বারোহী এবং খেদাড়ের পাশ কাটিয়ে দৌড়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। সে দেখতে পেলো তার পিতার হাতি লংকা হাঁটতে ভর দিয়ে বসে আছে এবং সেটার বিশাল অবয়বের পাশে কিছু লোক মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা একটি দেহকে ঘিরে জড়ো হয়ে আছে। বলপূর্বক ভিড় ঠেলে সে অগ্রসর হলো এবং দেখতে পেলো মাটিতে শুয়ে থাকা মানুষটি আকবর। তাঁর দেহ মাঝে মাঝে খিচুনির কারণে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। সেলিম বিস্ফোরিত চোখে দৃশ্যটি অবলোকন করতে লাগলো এবং নিজের অজান্তেই একটি কথা বার বার বলতে লাগলো, দয়া করো আল্লাহ, এখনই নয়। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ভবিষ্যত সংক্রান্ত ভীতির কোনো গুরুত্ব আর তার কাছে রইলো না।

    দিশেহারা সেলিম ভীষণ অস্থির বোধ করছে, উত্তেজনায় কখনো সে প্রচণ্ড জোরে তার জিভ কামড়ে ধরেছিলো বুঝতে পারেনি। জিভ কেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে এবং সে এক দলা রক্তাক্ত থুতু ফেললো। সে অসহায় ভাবে তাকিয়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে কল্পনার চোখে সে দেখতে পাচ্ছে মুরাদ এবং দানিয়েল এর পাশে দাঁড়িয়ে সে পিতার শেষকৃত্যানুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করছে। সে হামিদা এবং গুলবদনের শোকসন্তপ্ত বিলাপ শুনতে পেলো এবং মায়ের মুখে বাঁকা হাসি দেখতে পেলো, যে তার জনগণের শত্রুর মৃত্যুতে আনন্দিত। আবুল ফজল আকবরের জোব্বার বোতাম গুলি খুলে দিচ্ছিলো, তার আঙ্গুল কাঁপছে। সকলে পিছনে সরে দাঁড়ান, জাহাপনাকে মুক্ত বাতাস পেতে দিন… সে বললো। সেই মুহূর্তে একজন দেহরক্ষী তার ঘোড়ার পিঠে করে একজন হেকিমকে নিয়ে সেখানে পৌঁছালো। উপস্থিত জনতার ভিড় দুভাগ হয়ে হেকিমের আসার পথ করে দিলো।

    হেকিম আকবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো এবং আকবরের হাতটি নিজের হাতে নিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করলো। আপনি! কোনো আনুষ্ঠানিক সম্বোধন ছাড়াই সে আবুল ফজলকে লক্ষ্য করে বললো, জাহাপনার পা দুটি স্থির করে ধরুন। এবং আপনি, সে আরেকজন সভাসদকে লক্ষ্য করে বললো, এক টুকরা কাপড় রুমাল যাই পাওয়া যায় ভাঁজ করে সম্রাটের মুখের ভিতর ভরে দিন তা না হলে ওনার জিভে কামড় লাগতে পারে।

    হেকিম, আমি আমার বাবার জন্য কি করতে পারি? সেলিম জিজ্ঞাসা করলো। হেকিম তার দিকে তাকালো। কিছু না, হেকিম সংক্ষেপে বললো এবং আবার আকবরের দিকে ঘুরলো। সেলিম এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীদের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসতে লাগলো। যদি কোনো সাহায্য করতে না পারে তাহলে এখানে থাকার কোনো অর্থ নেই।

    মাত্র আধ ঘন্টা আগে ভোরের যে সূর্য একটি ক্রীড়াপূর্ণ দিনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো বর্তমানে বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া তার আলো নির্দয় এবং নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছে। সেলিম নিচু হয়ে জন্মে থাকা ঝোঁপঝাড়ের মধ্য দিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এগিয়ে চললো। একটি খালি জায়গায় এসে সে থামলো এবং তার ইন্দ্রিয় তাকে সতর্ক করলো গাছের শাখার মধ্য দিয়ে একজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সেটা ছিলো একটি কম বয়সী হরিণ, সেটার শিংগুলি ফ্যাকাশে বাদামি রঙের। ধীরে সেলিম তার পিঠে ঝুলে থাকা ধনুকের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেলো। কি লাভ? ইতোমধ্যে পৃথিবীর বুকে কারণে অকারণে বহু মৃত্যুই তো সংঘটিত হয়ে চলেছে।

    এক মুহূর্ত পর হরিণটি অদৃশ্য হলো। সেলিম ঝোঁপ ঝাড় পেরিয়ে সেটির চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেলো এবং ফিরতি পথ ধরলো। তার পিতার ভাগ্যে যাই ঘটুক না কেনো তাকে এর মুখোমুখী হতে হবে। সে একটি নির্বোধ জানোয়ারের মতো জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে পারবে না এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তার অনুপস্থিতি সকলের নজর কাড়বে। কারণ যুবরাজদের আপন মনে নিরুদ্দেশ হওয়ার রেওয়াজ নেই। কিন্তু ফিরে গিয়ে কি দেখবে সে কথা ভেবে তার মনে কিছুটা ভীতি সৃষ্টি হলো। দূর থেকে সেলিম দেখলো হেকিম দাঁড়িয়ে কিছু বলছেন এবং তাকে ঘিরে থাকা আকবরের সভাসদ এবং শিকার সঙ্গীরা তার বক্তব্য শুনছেন। কিন্তু বাবা কোথায়? সেলিম সবেগে দৌড় দিলো।

    সেলিম ওদের কাছে পৌঁছে আতঙ্কের সঙ্গে চারদিকে তাকাতে লাগলো এবং দেখলো তার বাবা একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন, আবুল ফজল তার মুখে একটি পানির পাত্র ধরে রেখেছে। দেহরক্ষীরা তাকে ঘিরে রেখেছে, সেলিম তাঁদের ব্যুহ ভেদ করে বাবার কাছে ছুটে গেলো। বাবা…. পিতাকে জীবিত অবস্থায় দেখে সে স্বস্তিতে ফোঁপাচ্ছে। আকবরকে সামান্য ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে এবং তার লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে আছে, এছাড়া আর কোনো পরির্তন বোঝা গেলো না।

    দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। আমি দিব্যদৃষ্টিতে কিছু দেখেছি-আল্লাহ্র সঙ্গে আমার সরাসরি যোগাযোগ হয়েছে। তখন আমার সারা দেহ আনন্দে কাঁপছিলো এবং আল্লাহ্ আমাকে জানিয়েছেন আমাকে কি করতে হবে। আমি শিকার স্থগিত করছি এবং এই মুহূর্তে ফতেহপুর শিক্রিতে ফিরে যাবো। সেখানে আমার জনগণের কাছে আমাকে একটি ঘোষণা দিতে হবে। এখন তুমি যাও, আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও।

    সেলিম সরে এলো, তার মনে হলো বাবা তাকে রুঢ়ভাবে উপেক্ষা করেছেন। তার বাবা যদি কোনো ঐশ্বরিক বাণী লাভ করেই থাকেন তাহলে সে বিষয়ে তাকে জানাচ্ছেন না কেনো? তিনি কি তাকে বিশ্বাস করছেন না? পিছন ফিরে সে দেখলো যে মানুষটিকে সে কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুর নিকটবর্তী ভেবেছিলো তিনি আবুল ফজলের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছেন এবং অনুভব করলো এতোক্ষণ সে যে উদ্বেগ বোধ করেছে তা ঘৃণায় রূপান্তরিত হচ্ছে। তার নিজের উপর রাগ হচ্ছিলো কিন্তু আরো বেশি রাগ হচ্ছিলো আকবরের উপর।

    *

    ফতেহপুর শিক্রির এই মহান মসজিদে আমি আপনাদের সবাইকে তলব করেছি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা প্রদান করার জন্য।

    আকবরের পরনে স্বর্ণের সুতায় বোনা পোশাক এবং মাথায় চুনি পাথরের নিচে আটা তিনটি সাদা সারসের পালক বিশিষ্ট পাগড়ি। তিনি উপস্থিত উলামাবৃন্দ, সভাসদ এবং সেনাপতিদের উপর নজর বুলালেন। তাঁদের মধ্যে সেলিমও দাঁড়িয়ে ছিলো, সে জালির আড়ালে অবস্থিত মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের দিকে এক পলক তাকালো। সেখানে হামিদা এবং গুলবদন বসে আছেন এবং আকবরের বক্তব্য শুনছেন। বাবা কি বলতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কে কি তাদের কোনো ধারণা রয়েছে? তার নিজের নেই। আকবর শিকার থেকে ফেরার পর গত তিন দিন ধরে রাজপ্রাসাদ নানা গুজবে ছেয়ে গেছে। সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আকবর নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। তিনি কেবল আবুল ফজলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং দুই বার শেখ মোবারকের সঙ্গে দেখা করেছেন। গুজব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কেউ কেউ দাবি করছে আকবর নিজেকে খ্রিস্টান বলে ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন।

    কয়েক দিন পূর্বে অসীম কল্যাণের প্রতীক ঈশ্বর আমার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং তার ইচ্ছা আমাকে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন তিনি আমাকে এই কারণে নির্বাচন করেছেন যে অন্য পয়গম্বরদের মতো আমিও পড়তে জানি না এবং আমার মন তাঁর নির্ভেজাল বাণী শ্রবণ করার জন্য যথেষ্ট উন্মুক্ত এবং নমনীয়। তিনি আমাকে আরো বলেছেন একজন প্রকৃত শাসকের উচিত ঐশ্বরিক বিধি বিধান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব অন্যদের উপর ন্যস্ত না করে নিজের কাঁধে নেয়া। আজ শুক্রবার, আমাদের সাপ্তাহিক প্রার্থনার দিন। অতীতে আমি একজন ইমামকে দায়িত্ব প্রদান করেছি বেদীতে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় নেতৃত্ব দান করার জন্য এবং খুতবা পাঠ করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে ঈশ্বরের নির্দেশ পালন করার জন্য আপনাদের সামনে উপস্থিত থেকে আমাকেই খুতবা পাঠ করতে হবে।

    উপস্থিত জনতার মুখ থেকে উচ্চারিত বিস্ময়সূচক ধ্বনি এবং কোলাহলের মধ্যে আকবর গোলাপ কাঠের খাড়া সিঁড়ি বেয়ে মার্বেল পাথরের বেদীতে উঠে গেলেন। তারপর তাঁর গভীর ছন্দময় কণ্ঠে খুতবা পাঠ করতে লাগলেন। এক সময় তিনি তার খুতবার চরম পর্যায়ে পৌঁছলেন এবং তাঁর কণ্ঠ থেকে চূড়ান্ত কথাগুলি বের হয়ে এলো, মহামান্য সম্রাটের মঙ্গল হোক! আল্লাহ্ আকবর!

    সেলিম বিস্ময়ে তীব্র ঝাঁকি খেলো। আল্লাহ্ আকবর এর অর্থ আল্লাহ্ মহান, কিন্তু তার পিতার বক্তব্যের এমন অর্থও হয় যে আকবর আল্লাহ্। তার পিতা কি নিজেকে কোনো প্রকারে ঈশ্বর বলে দাবি করছেন? সে তার আশে পাশে উপস্থিত সকলকে বিস্ময়সূচক বাক্য বিনিময় করতে শুনলো। কিন্তু সামনে তাকিয়ে সে দেখতে পেলো তার পিতা শান্ত চিত্তে নিজের অনিশ্চিত বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি সকলকে নীরব হওয়ার জন্য হাত তুলে ইশারা করলেন এবং চারিদিকে নীরবতা নেমে এলো। আমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ধর্ম উপদেষ্টা শেখ মোবারককে একটি দলিল প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছি যাতে আমার সাম্রাজ্যের সকল ওলামাবৃন্দ দস্তখত করবেন। এই দলিলে উল্লেখ থাকবে এখন থেকে ধর্ম সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নের ব্যাখ্যা দানে তারা নয়-বরং আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।

    সেলিম লক্ষ্য করলো শেখ আহমেদ এবং অন্যান্য মাওলানারা অকবরের বক্তব্যের অর্থ-তিনি ঐশ্বরিক বিষয়ে যে কোনো মাওলানার তুলনায় অধিক জ্ঞান ধারণ করেন-এমন উপলব্ধি করে পরস্পরের দিকে আহত দৃষ্টি বিনিময় করলো। ইংল্যান্ডের রাজার মতোই, আকবর এখন কেবল তার রাজ্যের সম্রাটই নন বরং প্রধান ধর্মীয় নেতাও। সেই মুহূর্তে আকবরের মুখে সামান্য হাসি দেখা গেলো এবং সেলিম তার পিতার প্রতি নতুন করে কিছুটা সম অনুভব করলো। সে আরো অনুভব করলো প্রতিদিন সে তার পিতাকে আরেকটু বেশি করে বুঝতে পারছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএম্পায়ার অভ দা মোগল : দি টেনটেড থ্রোন – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার : অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }