Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    রূপকথা নয়!

    উপন্যাস ছোটগল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক পাতা গল্প34 Mins Read0

    রূপকথা নয়!

    প্রচণ্ড শীতের রাত। জামাকাপড় ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। পরমাসুন্দরী এক তরুণী দৃঢ়, দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে নির্জন এক বাড়ির কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিলো এক যুবক এবং চোখের সামনে সুন্দরী তরুণীকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই দরজা বন্ধ করে দিলো। মেয়েটি রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে বলল, “দয়া করে আমাকে আপনার বাড়িতে ঢুকতে দিন। আমি সফরে বেরিয়েছি। ভেবেছিলাম রাত নামার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারব। কিন্তু রাত হয়ে গেছে অথচ আমি এখনো মাঝপথে, আমি জানি না আমি কোথায় এসে পড়েছি। এ এলাকার কাউকেই আমি চিনি না। আপনি যদি আমাকে আপনার বাড়িতে আশ্রয় না দেন, আমি ভয় পাচ্ছি, বাইরে থাকলে আমার সাথে। খারাপ কিছু ঘটতে পারে।” “আশেপাশে আরও অনেক বাড়িঘর আছে… আপনি দয়া করে সেগুলোর কোনো একটাতে যান, ইন শা আল্লাহ তারা আপনাকে সাহায্য করবে।” যুবকটি উত্তর দিলো। মেয়েটি চলে গেল। আসলে চলে যাওয়ার ভান করল। হাড় কাঁপানো শীতের রাতে মেয়েটির নির্জন ওই বাড়ির কড়া নাড়, সফরের কথা বলে আশ্রয় প্রার্থনা করা সবই জঘন্য এক প্ল্যানের অংশ। প্ল্যানটা বুঝতে হলে আমাদের পেছনের ঘটনাগুলোও জানতে হবে। এ যুবক ছিল আল্লাহ্ এক তাকওয়াবান বান্দা। সারাদিন রোযা রাখত আর সারা রাত নফল সালাতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দিত। সব। ধরনের হারাম থেকে নিজেকে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখত। তার পাড়া-প্রতিবেশীরা খুব একটা সুবিধের ছিল না। হারাম-হালালের কোনো তোয়াক্কা করত না। আড্ডাবাজি, গীবত, পরচর্চা, পরনিন্দা করেই তাদের দিন কাটত। যুবক, পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা মেলামেশা করত না। অধিকাংশ সময়ই সে তার নিজের বাড়িতে বসে আল্লাহর ইবাদাত করত। পাড়া-প্রতিবেশীরা এতে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে গেল। তারা সব সময় এই যুবকের সমালোচনা করত, “দেখ না, এ ব্যাটার ভাব দেখ! আমাদের পাত্তাই দেয় না, আমরা কি মানুষ না? সারাদিন ঘরে বসে বসে তসবিহ টেপে, আমাদের সঙ্গে কোনো মেলামেশাই করে না। চল ব্যাটাকে জন্মের মতো সাধুগিরির শিক্ষা দেই।”

    সবাই মিলে এই যুবকের পদস্খলনের ষড়যন্ত্র করল। সুবহান আল্লাহ! শয়তান সব সময় মানুষকে সরাসরি আক্রমণ করে না। সে মাঝে মাঝে মানুষদের মধ্যেই এমন একটা দল তৈরি করে, যারা অন্য মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। যুবকের প্রতিবেশীরা গরু খোঁজার মতো করে আশেপাশের এলাকা চষে ফেলল রুপসী, লাস্যময়ী মেয়ের খোঁজে। তারা এমন এক তরুণীর সন্ধান পেল, যে ছিল ওই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী। লোকগুলো ওই মেয়েকে প্রস্তাব দিলো, “আমরা চাই, তুমি অমুক এলাকার ওই যুবককে তোমার রূপের ফাঁদে ফেলবে এবং তার পদস্খলন ঘটাবে… তার সাথে যিনা করবে।” “হায় আল্লাহ্! আমি একজন মেয়ে, এমন কাজ আমি কীভাবে করব?” “তুমি আমাদের এ কাজটা করে দাও। বিনিময়ে তুমি যা পাবে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। তোমাকে ওজন করে তোমার ওজনের সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি স্বর্ণ তোমাকে দেয়া হবে। রাজি?” মেয়েটি কিছুক্ষণ চিন্তা করল। বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করল বলা যায়। সে ছিল খুবই গরিব। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এক ধাক্কায় এত সম্পদ। করলামই না হয় এ একটা খারাপ কাজ। একবারই তো! নিজেকে বোঝাল সে। “ঠিক আছে। এত করেই বলছ যখন। আমি রাজি।” …যুবকের কথা শুনে মেয়েটি চলে যাবার ভান করল। কিছুক্ষণ পরে সে আবারও দরজায় কড়া নাড়ল। “আমি পাশের বাড়িগুলোতে গিয়েছিলাম কিন্তু তারা কেউ বাড়িতে নেই। বাইরে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার ভীষণ ভয় করছে, আপনি আমাকে আপনার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দিলে আমি হয়তো ঠান্ডায় মরে যাব! দয়া করে দরজা খুলুন” অনুনয় ঝরে পড়ল মেয়েটির কণ্ঠে। “পাহাড়ের নিচের দিকে আরেকটু নেমে গেলে ওখানে আরও কিছু বাড়ি পাবেন। ইন শা আল্লাহ্ তারা আপনাকে তাদের সাথে থাকতে দেবেন। আমার বাড়িতে শুধু আমি, আর কেউ নেই। আমাদের দুজনের একসাথে থাকা ঠিক হবে না।” যুবকের সরল স্বীকারোক্তি। মেয়েটি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও ফিরে এল। দরজায় কড়া নাড়ল। আবারও যুবক দরজা খুলল এবং মেয়েটিকে দেখতে পেল। মেয়েটি বলল, “আল্লাহর শপথ! আপনি যদি আমাকে ভেতরে আসার অনুমতি না দেন এবং কোনো পুরুষ যদি আমার সম্ভ্রম ছিনিয়ে নেয়, তবে আল্লাহর শপথ! শেষ বিচারের দিন আমি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে বলব যে, আপনিই হলেন সেই ব্যক্তি যার কারণে এসব ঘটেছে। আপনার কারণেই আমি ধর্ষিত হয়েছি।”

    যুবকটি যখন আল্লাহর নাম শুনল তখন তাঁর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল, কেননা যখন মুমিনগণের সামনে আল্লাহর নাম স্মরণ করা হয়, তাদের অন্তর কেঁপে ওঠে। যুবক দরজা খুলে সরে দাঁড়াল।

    “আসন, আপনি এ ঘরে রাতটা কাটিয়ে দিন, আমি পাশের ঘরেই থাকছি। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না এবং ফজরের ওয়াক্ত হওয়ামাত্রই আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।” এতটুকু বলেই যুবক পাশের ঘরে চলে গেল। কুরআন তিলাওয়াত শুরু করার আগে সশব্দে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করতে ভুল করল না। যুবকের প্রতিবেশীরা আশেপাশেই ওঁত পেতে ছিল। মেয়েটি বাড়িতে ঢোকার পর ওরা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল–”ব্যাটার সাধুগিরি একটু পরেই খতম হয়ে যাবে।” আরও কিছুক্ষণ তীদের এভাবে বসে থাকার ইচ্ছা। তারপর, একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে যুবকের বাড়িতে হামলা চালিয়ে যুবক এবং মেয়েটিকে হাতেনাতে ধরার প্ল্যান। যুবকটি নিবিষ্ট মনে কুরআন তিলাওয়াত করছিল। হঠাৎ মেয়েটির ঘর থেকে রক্ত হিম করা একটা চিৎকার ভেসে এল। হাতে একটা বাতি নিয়ে যুবক হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। চোখের সামনের দৃশ্য তাকে স্রেফ স্ট্যাচু বানিয়ে দিলো। মেয়েটি শুয়ে আছে বিছানায়। গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। দুচোখে তীব্র কামনা। যুবক জীবনে প্রথমবারের মতো এমন কিছু দেখল, যা সে এর আগে কখনো দেখেনি। সে ভেতরে ভেতরে এমন কিছু অনুভূতির অস্তিত্ব টের পেতে শুরু করল, যা ইতিপূর্বে কখনো অনুভব করেনি। তার মন তাকে এমন কিছু করতে বলল, যা আগে কখনো বলেনি। তাদের অঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি এখন তার সামনে। হাতছানি দিয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে নিষিদ্ধ জগতে হারিয়ে যাওয়ার! কী করবে সে? টগবগে একজন যুবক এই পরিস্থিতিতে কী করে? এলাকাবাসী আগেই বাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল। এবার ওরা তাদের বৃত্ত ছোট করে এনে বাড়ির প্রাচীরের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আর মিনিট দুয়েক পরেই দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকবে ওরা। যুবকটি ওই মেয়ের ঘরে ঢোকার পর মেয়েটির চিৎকার বন্ধ। হয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য নেমে এল রাজ্যের নীরবতা। দূরে একটা নিশাচর পাখি একগাছ থেকে অন্য গাছের উদ্দেশে উড়াল দিলো। গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়ল একদলা তুষার। হঠাৎ যুবকের বাড়ি থেকে রক্ত হিম করা চিৎকার ভেসে এল, আবার। মেয়েটির গলা। সে চিৎকার করছে। করছে তো করছেই, থামার কোনো নামগন্ধ নেই।

    এলাকাবাসী আর একমুহূর্ত দেরি না করে দরজায় হামলে পড়ল। তারপর মেয়ে। এবং যুবক দুজনকেই আবিষ্কার করল একই ঘরের মেঝেতে! মেয়েটি তার রূপের ফাঁদে ঠিকই গেঁথে ফেলেছিল যুবকটিকে। মেয়েটির আহ্বানে সাড়া দিতে যুবকটি এক পা দুই পা করে এগোচ্ছিল তার দিকে। কিন্তু এই নাজুক মুহূর্তেও যুবকটি তাঁর রবের কথা, রবের শাস্তির কথা ভুলে যায়নি। মেয়েটির দিকে একটি করে ধাপ আগানোর পর সে তার হাত বাতির আগুনের ওপর ধরছিল এবং নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, “মনে রাখিস, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার এই আগুনের চেয়েও বেশি উত্তপ্ত”। তীব্র বেদনায় সে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ছিল। আবারও সে উঠে দাঁড়াচ্ছিল। মেয়েটির দিকে আরেক কদম এগিয়ে যাচ্ছিল… আর যখনই সে মেয়েটির দিকে আগানো শুরু করছিল তখনই সে নিজের হাতকে আগুনে ঠেলে দিয়ে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, “মনে রাখিস, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার আগুনের চেয়েও বেশি তীব্র”। এ অবিশ্বাস্য দৃশ্য মেয়েটি সহ্য করতে পারছিল না। তার প্রথম চিৎকার ছিল পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু পরের বার তা ছিল অনুশোচনার, ভয়ের। মেয়েটিকে সেই ঘর হতে সরিয়ে নেয়ার পর যুবক অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে প্রত্যাবর্তন করল আল্লাহ্র (4) নিকট–”ইয়া আল্লাহ্! আমি যে গুনাহ করেছি তার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন”। কী ছিল সেই গুনাহ? কী করেছিল সে? সে তো যিনা করা থেকে বিরত ছিল, সে ওই এলাকার সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ের কাছে যাওয়া থেকে বিরত ছিল, সে কি আদৌ কোনো গুনাহ করেছিল! অথচ সে বলল, হে আল্লাহ! মেয়েটির দিকে বাড়ানো আমার সেই পদক্ষেপগুলোর জন্য আমাকে ক্ষমা করুন।

    এই ঘটনা শোনার পর আমি কিছুক্ষণ নিশ্চপ বসে ছিলাম। একবার নিজেকে কল্পনা করুন ওই যুবকের জায়গায়। আপনার তরুণ শরীর, আপনার টগবগে রক্ত, রাতের নিকষ কালো চাদরের আড়ালে এক সুন্দরী স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছে আপনার কাছে। কোথাও কেউ নেই। কাকপক্ষীও টের পাবে না কিছুই, এমন সময় আপনি কী করবেন? কী করাটা স্বাভাবিক? আনন্দে হার্ট এটাক করলেও অবাক হবার কিছু নেই। বাসা খালি পেলে বা একা রুম পেলে আমাদের মাথায় কী চিন্তা ঘোরাফেরা করে?

    পর্ন দেখার বা হস্তমৈথুন করার এই তো সুযোগ! তাই না? লেটস বি অনেস্ট। বাসায় কেউ ছিল না বা রুম ফাঁকা ছিল আর এমন অবস্থায় আমরা পর্ন ভিডিও দেখিনি, হস্তমৈথুন করিনি বা কোনো মেয়েকে নিয়ে সেক্স ফ্যান্টাসিতে ডুবে যাইনি এমন কবার হয়েছে? একবারও কি হয়নি? বুকে হাত রেখে সত্যি কথা বলার সাহসটা কি হবে আমাদের? সুবহান আল্লাহ্! এই ছেলের ঈমানের শেকড় কী গভীর মাটিতে প্রোথিত। গভীর রাতে অপরূপা যুবতী নিষিদ্ধ প্রেমের যে ঝড় তুলেছিল তাতেও বিন্দুমাত্র টলেনি তাঁর ঈমান, যে সুযোগ পেলে বহু পুরুষ বর্তে যেত, যে সুযোগের কথা ভেবে কত তরুণ অস্থিরতায় ভোগে, সেই সুযোগ পাওয়ায় পরেও তী ছুঁড়ে ফেলে দিতে এতটুকু দ্বিধায় ভোগেনি। হায়! আমাদের ঈমান কত ঠুনকো! একাকী রুমে এক অবাস্তব জগতের ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না এমন পর্নস্টাররা আমাদের চিন্তায় আসামাত্র আমাদের ঈমান হাওয়া হয়ে যায়। নেটে লগইন করে পর্ন দেখতে, হস্তমৈথুন করতে আমাদের বিন্দুমাত্র দেরি হয় না। পার্কের চিপায়, রিকশার হুডের নিচে, বাসের পেছনের সিটে, লিফটে–আমরা নির্জনতা খুঁজি, লোকাল বাসের ভিড়ে, কনসার্টে আমরা সুযোগ খুঁজি। সারাদিন “জাস্ট ফ্রেন্ড-জাস্ট ফ্রেন্ড”, “ভাইবোন” খেলা খেলে, গভীর রাতে বাথরুমে নিজেদের ঠান্ডা করি। পাপ করতে করতে আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে, পাপকে আমরা আর পাপ মনে করি না। হস্তমৈথুন করার পর বা পর্ন দেখার পর আমাদের খারাপ লাগে না। এটা এমন কোনো ব্যাপারই না আমাদের কাছে। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ যুবকও তো আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ ছিল। তারও তো আমাদের মতোই একটা হৃদয় ছিল, সে হৃদয়ে কামনা-বাসনা ছিল, ছিল নারীর প্রতি দুর্বোধ্য আকর্ষণ। কিন্তু সেই কামনা-বাসনার কাছে সে মাথানত করেনি। এও আল্লাহর বান্দা, আমরাও আল্লাহর বান্দা, কিন্তু ওর সঙ্গে আমাদের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। হাশরের ময়দানে আল্লাহর আরশের ছায়ায় বসে ও যখন কাউসারের পানীয় পান করবে, তখন হয়তো রাতের আঁধারে করা পাপের কারণে আমাদের অপমানিত হতে হবে।

    এক শায়খের মুখে এক ছেলের কথা শুনেছিলাম, যে প্রতিদিন ১২,০০০ এরও বেশি বার আল্লাহকে স্মরণ করত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কেন তুমি এত বার আল্লাহকে স্মরণ করো? সে উত্তর দিলো, “যেন আমি আবু হুরাইরাহকে হারাতে পারি। আবু হুরাইরাহর চেয়ে বেশি আল্লাহকে স্মরণ করতে পারি।” আসুন না, আমরাও প্রতিযোগিতায় নামি ওই ছেলের সাথে। সে যদি ডানাকাটা পরীকে উপেক্ষা করতে পারে, তাহলে কেন আমরা সামান্য পর্ন ভিডিও দেখা ছাড়তে পারব না হস্তমৈথুন বন্ধ করতে পারব না?

    রূপকথা নয়

    নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে বসে আছি দার্জিলিং মেল ধরব বলে। ট্রেনটা প্রায় দু-ঘণ্টা লেট, তার ওপর আবার শোনা যাচ্ছে যে কোথায় যেন লাইনের গণ্ডগোল হয়েছে, আজ আর ট্রেন যাবে কি না সন্দেহ। সেজন্য মেজাজটা খিচড়ে আছে। দার্জিলিং মেল না গেলে আজ রাতে আর কলকাতায় ফেরার কোনও উপায় নেই।

    একজন ফেরিওয়ালা অনেকক্ষণ থেকেই বিরক্ত করছিল আমাকে। তার গলায় একটা ট্রে ঝোলানো, তাতে অনেকগুলো কলম, লাইটার, সরু টর্চ, চাবির রিং ইত্যাদি সব টুকিটাকি জিনিস। এর কোনওটাই আমার দরকার নেই। সময় কাটাবার জন্য যারা পাশের লোকের সঙ্গে আলাপ জমায় কিংবা হকারদের ডেকে এমনিই জিনিসপত্র দরদাম করে, আমি সেই দলে পড়ি না। আমার একা চুপ করে বসে থেকেই বেশ ভালো সময় কেটে যায়।

    হকারটি চতুর্থবার এসে আমার সামনে দাঁড়াতেই আমি তাকে এবার ধমক দিতে গেলুম। তার আগেই সে গলার স্বর পালটে বলল, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা জিগ্যেস করব? আপনার নাম কী সুনীল?

    আমি রুক্ষভাবে বললাম, আমি সুনীল কিংবা অমল বা কমল বা বিমল, যা-ই হই না কেন, তাতে কী আসে যায়? আমি তোমার কোনও কিছু কিনব না। এ কথা আমি তোমায়–

    বলতে-বলতে আমি হঠাৎ থেমে গেলুম। আমার মাথার মধ্যে যেন একটা বিদ্যুৎ ঝলক খেলে। গেল। আগে ভালো করে তাকিয়ে দেখিনি, এর মুখ তো আমার চেনা লাগছে। আগে কোথায়। দেখেছি!

    সে এবার বলল, আমায় চিনতে পারছ না তো? চেনবার কথাও নয়, অনেক দিনের ব্যাপার–

    আমি সবিস্ময়ে বললুম, কান্তি?

    সে এবারে খানিকটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল, চিনতে পেরেছ তাহলে? আমিও তোমায় প্রথমে চিনতে পারিনি, কিন্তু তোমার ওই যে একটু পাশের দিকে মুখটা ফিরিয়ে তাকানোর ভঙ্গি, সেটাতেই বুঝলুম।

    আমি লাফিয়ে উঠে ওর হাত ধরে এনে বেঞ্চিতে বসিয়ে দিয়ে বললুম, কী রে, কান্তি, তুই এখানে কী করছিস? রেল স্টেশনে কলম বিক্রি করছিস কেন, ছদ্মবেশ ধরেছিস নাকি?

    কান্তি বলল, কী যে বলো! এটাই তো আমার জীবিকা।

    পকেট থেকে একটা টিনের কৌটো বার করে খুলল কান্তি। তার মধ্যে কয়েকটা বিড়ি রয়েছে। কৌটোটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল, তুমি কি বিড়ি-সিগারেট খাও নাকি?

    আমি সিগারেট টানি, বিড়ি খাওয়ার সুযোগ হয় না। আমার পকেটে সিগারেটের প্যাকেট আছে, একবার ভাবলুম, সেটা বার করে কান্তিকে সিগারেট দিই। পরক্ষণেই মত বদলে তার কৌটো থেকে একটা বিড়ি তুলেম নিলাম। কান্তির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলুম। প্রায় তিরিশ বছর বাদে দেখা। আমরা দুজনেই অনেক বদলে গেছি। কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের কখনও ভোলা যায় না। তাহলে কি কিশোর বয়েসের মুখের আদল সারা জীবনেই থেকে যায় মানুষের?

    প্ল্যাটফর্মে হকারের বেশে বাল্যবন্ধুকে দেখলে চমকে উঠতেই হয়। আমার কাছে রয়েছে ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। যদিও নিজের পয়সায় কাটিনি, কোম্পানির পয়সা। ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রীদের সঙ্গে কোনও হকারের বন্ধুত্ব থাকার কথা নয়, এটাই আমাদের এই সমাজের ব্যবস্থা। কিন্তু স্কুলে পড়বার সময় কান্তি আর আমি ছিলুম অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু!

    কান্তিকে দেখে আমার একটা পুরোনো অভিমান মনে পড়ে গেল। তিরিশ বছর আগেকার সেই অভিমান, তাও বুকের মধ্যে যে এখনও রয়ে গেছে, তা আমি নিজেই জানতুম না।

    আমি জিগ্যেস করলুম, তুই আমার চিঠি লিখিসনি কেন?

    কান্তি বলল, চিঠি? তোমাকে আমি কোথায় চিঠি লিখব? তুমি এখন কোথায় থাকো, তাও তো জানি না—তুমি কি এখন নর্থবেঙ্গলে চাকরি করছ নাকি?

    আমার মনে আছে, কান্তির মনে নেই। চিঠি লেখার কথা ছিল সেই তিরিশ বছর আগে।

    না, নর্থবেঙ্গলে চাকরি করি না। শিলিগুড়িতে এসেছিলুম একটা কাজে। এখানে কতদিন আছিস।

    এইতো মোটে দু-বছর। আগে কুচবিহারে ছিলাম!

    তুই…মানে, সেই যে চলে গেলি, তারপর আর লেখাপড়া করিসনি?

    কান্তি অদ্ভুতভাবে হেসে বলল, আর হল না ভাই। অনেক ইচ্ছে ছিল, কিছুতেই হল না।

    আমি একটুক্ষণ চুপ করে রইলাম।

    ক্লাস টু থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমি কান্তির সঙ্গে এক স্কুলে পড়েছি। তারপর হঠাৎ কান্তির জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটল, যা অনেকটা রূপকথার মতন।

    এই যে আমি এখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে বসে আছি, আমার পরনে কর্ডের প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট, পকেটে তিন চারশো টাকা, আমার সুটকেসটাও বেশদামি। আর কান্তি পরে আছে। একটা আধময়লা ধুতি আর নীল রঙের শার্ট, পায়ে রবারের চটি, মুখে একটা তেলতেলে দৈন্যের ছাপ। যেন আমাদের দুজনের ভূমিকাটাই উলটে গেছে।

    কান্তিদের বাড়ি ছিল মোহনবাগান লেনে। দোতলা বেশ ছড়ানোছিটানো বাড়ি। সামনে একটা ছোট বাগান। দোতলায় মস্ত বড় ঢাকা বারান্দায় ছিল টেবিল টেনিস বোর্ড। কান্তির বাবা ছিলেন একটা ছোটখাটো কারখানার মালিক। আজকালকার বিচারে খুব বড়লোক বলা যায় না। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার। কিন্তু আমার মনে হত, কান্তিদের বাড়িটা যেন রাজবাড়ির মতন!

    আমি ইস্কুল মাস্টারের ছেলে, থাকতুম একটা ভাড়া বাড়ির একতলায় দুখানা স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘরে, সারা বছরে দু-তিনটে মাত্র জামা পেতুম। আমাদের জলখাবার ছিল রুটি আর গুড়, কোনওদিন হাতে একটা পয়সা পাইনি।

    কিন্তু কান্তিদের বাড়িতে গেলেই ওরা খাওয়াতো লুচি, ফুলকপির তরকারি আর রসগোল্লা। কান্তির যে কতরকম জামা ছিল তার ঠিক নেই! ঘুড়ি ওড়াবার সিজনে কান্তি যখন তখন পকেট থেকে। পাঁচটাকা বার করে ওদের বাড়ির চাকরকে হুকুম দিত, যা, এক ডজন দেড়ে চাঁদিয়াল নিয়ে আয়!

    ক্লাস সিক্স থেকে কান্তি ছিল আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আর সেকেন্ড নয় দিলীপ। আমি অবশ্য পড়াশুনোয় তেমন ভালো ছাত্র ছিলুম না। আমি মোটামুটি পাশ করে যেতুম। একবার হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় দিলীপ ফার্স্ট হয়ে যায়। সেই থেকে কান্তির সঙ্গে দিলীপের একটা রেষারেষি শুরু হল। ক্লাসের ছাত্ররাও দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল। আমি কেন যে কান্তির দলে চলে গিয়েছিলুম, তা আর আজ মনে নেই।

    আমার মা আমায় বলতেন, তুই যে কান্তির সঙ্গে এত মিসিস, তোর লজ্জা করে না? দ্যাখ তো কান্তি কত ভালো রেজাল্ট করে, আর তুই পারিস না?

    কান্তিকে অবশ্য বাড়িতে দুজন মাস্টারমশাই এসে পড়িয়ে যেতেন। আমি পড়তুম নিজেই। মাঝে-মাঝে ছুটির দিনে বাবা আমাকে পড়াবার নাম করে খুব বকুনি দিতেন।

    বিকেলবেলা আমার খেলার কোনও জায়গা ছিল না। সামনের গলিতেই ডাংগুলি কিংবা দাড়িয়াবান্দা খেলতুম মাঝে-মাঝে। কান্তির সঙ্গে বেশি ভাব হওয়ার পর ওদের বাড়িতে গিয়ে টেবিল টেনিস খেলা শিখতুম।

    দু-তিনদিন বিকেলে কান্তিদের বাড়িতে না গেলেই কান্তি ওদের বাড়ির দারোয়ানকে পাঠিয়ে আমায় ডেকে নিয়ে যেত। সেই বয়সেই আমার লজ্জা করত মাঝে-মাঝে। কান্তিদের বাড়িতে গেলেই কত কিছু খাবার দেয় আমাকে। অথচ কান্তি কোনওদিন আমাদের বাড়িতে আসে না। এলেও সদর দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকে। আমাদের যে কোনও বসবার ঘর নেই।

    কান্তির ছিল পাঁচ ভাই-বোন। সবচেয়ে বড় কান্তি, তারপর তিন বোন, সব শেষে আবার এক ভাই। সেই ভাইটার বয়েস ছিল তখন মোটে দু-তিন বছর। কান্তির পরের বোন শান্তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব ছিল।

    কান্তিরা বাবা কারখানা নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকতেন যে তাঁকে দেখেছি খুব কম। একটু গম্ভীর মতন লোক ছিলেন তিনি, ছোটদের সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না। পরে আমার আপশোশ হয়েছিল, কেন আমি কান্তির বাবাকে ভালো করে লক্ষ্য করিনি। সেই বয়েস থেকেই মানুষের চরিত্র স্টাডি করার দিকে আমার দিকে ঝোঁক ছিল।

    কান্তির মা প্রায়ই অসুখে ভুগতেন। যখন ভালো থাকতেন, তখন তাকে বেশ হাসিখুশি মনে হত। কোনওদিন আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি যে উনি কান্তির নিজের মানন, দ্বিতীয় মা। কান্তির এক মামাকে ওদের বাড়িতে দেখতুম প্রায়ই, তিনি এসে সব ব্যাপারে খুব সর্দারি করতেন।

    এক রবিবার দুপুরে কান্তির বাবা ভাত খাওয়ার পর জলের গেলাসটা তাঁর হাত থেকে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর তিনি ঢলে পড়লেন টেবিলের ওপর। তাঁর আর জল খাওয়া হল না, সেই মুহূর্তে তার প্রাণ বেরিয়ে গেছে শরীর থেকে।

    সেই বয়েসে মৃত্যু ব্যাপারটা আমাদের মনে তেমন দাগ কাটে না। কান্তির বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আর কয়েকদিন ওদের বাড়িতে যাইনি। ন্যাড়ামাথায় কান্তি যেদিন স্কুলে এল, ওকে দেখে কীরকম অদ্ভুত লেগেছিল। আগে ওর মুখখানা মনে হত গোল, চুল কেটে ফেলার পর সেই মুখটাই যেন হয়ে গেছে লম্বাটে।

    ন্যাড়া অবস্থায় মাত্র ছ-সাতদিন স্কুলে এসেছিল কান্তি। তারপর হঠাৎ ডুব। এর একমাস বাদেই আমাদের পরীক্ষা। আমরা ব্যস্ত ছিলুম, তবু আমি একদিন গেলুম কান্তির খোঁজ নিতে।

    গিয়ে দারুণ অবাক হতে হল। বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড়। ভেতরে ভীষণ চ্যাঁচামেচি হচ্ছে। বাগানের গেট বন্ধ। কান্তির মামার গলাই শুনতে পাচ্ছি বেশি।

    ভিড়ের লোকজনেরা বলল, ও-বাড়িতে নাকি কয়েকদিন ধরেই খুব মারামারি হচ্ছে, আজ কার

    যেন মাথা ফেটে গেছে। আমি ভিড় ঠেলে গেটের কাছে পৌঁছে গেলুম। দারোয়ান আমায় চেনে। কিন্তু সে আমায় ভেতরে ঢুকতে দিল না! রুক্ষভাবে বলল, এখন যাও, এখন যাও! ঝঞ্চাট কোরো না!

    তক্ষুনি সেখানে হাজির হল দুজন পুলিশ। আমরা সেই সময় পুলিশ দেখলেই দূরে সরে থাকতুম। তাই বাড়ি চলে এলুম।

    মোহনবাগান লেনেই থাকত আমাদের ক্লাসের আর একটি ছেলে অসীম। সে একদিন বলল, কান্তিরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ওদের আর ওখানে থাকতে দেবে না।

    আমি ভাবলুম, বাড়িটা তো কান্তিদেরই। সেখানে ওদের কে থাকতে দেবে না? কান্তিরা তো আমাদের মতন ভাড়া বাড়িতে থাকে না!

    কান্তির সঙ্গে বেশ কয়েকদিন দেখা না হওয়ায় আমার মন কেমন করছিল। সেদিনই বুঝতে পারলুম কান্তির সঙ্গে আমার কতখানি বন্ধুত্ব। কান্তির কয়েকখানা গল্পের বই রয়ে গেছে আমার কাছে, সেগুলোও ফেরত দেওয়া হয়নি।

    সেদিনই স্কুলের ছুটির পর অসীমের সঙ্গে গেলুম মোহনবাগান লেনে। কান্তিদের বাড়ির সামনে। দুটো ঠেলাগাড়ি দাঁড়িয়ে, তাতে মালপত্র তোলা হচ্ছে।

    অসীম বলল, আমি ঠিক বলেছি কি না! কান্তিরা আজই চলে যাচ্ছে।

    একটু বাদেই দেখতে পেলুম কান্তিকে। তার ন্যাড়া মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা।

    আমাদের দেখে কান্তি কেমন শুকনো ভাবে চেয়ে রইল, কোনও কথা বলল না। আমি আর অসীম এগিয়ে গিয়ে বললুম, তোর কী হয়েছে রে কান্তি?

    কান্তি বলল, আমরা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। রানাঘাটে আমাদের মামা-বাড়ি, সেখানে থাকব।

    তোর মাথা ফাটল কী করে রে, কান্তি?

    বড় মামা আমাকে একটা ধাক্কা দিয়েছিল, আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছি। বেশি লাগেনি। আমার নন্তু মামাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

    কেন রে?

    নন্তু মামা বড় মামাকে মেরেছে। ছুরি দিয়ে ঘাড়ে মেরেছে। বড় মামা একটুর জন্য বেঁচে গেছে।

    বেশি কথা বলার সুযোগ পাওয়া গেল না। দুজন অচেনা লোক ভেতর থেকে বিছানাপত্র এনে ছুড়ে-ছুড়ে ফেলে যেতে লাগল ঠেলাগাড়ির ওপরে। একটু বাদেই তারা বলল, আর কিছু নেই, এবারে যাও!

    কান্তির তিন বোনকে নিয়ে বাগানের এক পাশেদাঁড়িয়েছিলেন একজন বুড়োমতন লোক। ইনি কান্তির রতন মামা। ইনিই কান্তিদের নিয়ে যাচ্ছেন রানাঘাটে। শান্তা ফুলে-ফুলে কাঁদছে। একবারও তাকাচ্ছে না আমার দিকে।

    শান্তার ওই কান্না দেখে আমারও কান্না পেয়ে গেল।

    এই কদিনের মধ্যেই কান্তি যেন আমাদের চেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে। কান্তি কিন্তু একটুও কাঁদছে না। সে তার বোনদের ডেকে এনে ঠেলাগাড়ির ওপর বসাল। তারপর নিজেও আর একটা ঠেলায় মালপত্রের ওপর চেপে বসল।

    কান্তির বাবার মোটরগাড়িটা গ্যারেজে রয়েছে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ওই গাড়িতে দু-একবার চেপেছি। কান্তি সেই গাড়িতে না গিয়ে ঠেলাগাড়ি চেপে কেন মামা বাড়ি যাচ্ছে, তা বুঝতে পারলুম না।

    ঠেলাগাড়ি চলতে শুরু করার পর কান্তি আমার দিকে চেয়ে বলল, সুনীল, তোকে চিঠি লিখব আমি। উত্তর দিস কিন্তু!

    শান্তা একবার জল ভরা চোখে তাকাল আমার দিকে, তারপরই মুখ নামিয়ে নিল।

    আমি আর অসীম ঠেলাগাড়ি দুটোর পেছনে পেছনে দৌড়ে গেলুম খানিকটা। তারপরেই সেটা বড় রাস্তায় বেঁকে গেল।

    তারপর থেকে আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করছি কান্তির চিঠির জন্য। পিওন পাড়ায় এলেই ছুটে যেতুম। বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরেই খুলে দেখতুম ডাক বাক্স! কিন্তু প্রত্যেকদিন আমায় নিরাশ হতে হত।

    স্কুলে পড়ার সময় আমার পেন ফ্রেন্ডশিপের অভ্যেস ছিল। আমি জাপান, নাইজিরিয়া, ইজিপ্ট এইসব জায়গায় ছেলেমেয়েদের ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে চিঠি লিখতুম, তারাও আমাকে উত্তর দিত। কিন্তু আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু দূরে চলে গিয়ে আমার চিঠি লিখল না? কান্তি ওর মামা বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে যায়নি, তাই আমিও নিজে থেকে চিঠি লিখতে পারিনি।

    সেবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় দিলীপ খুব অনায়াসে ফার্স্ট হয়ে গেল। আমাদের ক্লাস টিচার। বলেছিলেন, কান্তি পরীক্ষা দেয়নি বটে, কিন্তু ও যদি ফিরে আসে, ওকে ক্লাস টেনে প্রমোশান দিয়ে দেওয়া হবে।

    কিন্তু কান্তি আর এল না।

    একটু-একটু করে কান্তিদের বাড়ির ব্যাপারটা নানা লোকের মুখে শুনেছিলুম। তখন সবটা ভালো বুঝতে পারিনি, পরে বুঝেছি।

    কান্তির মা মারা গিয়েছিলেন অনেকদিন আগে। কান্তির দ্বিতীয় মায়ের নিজের ছেলে একটিই, সে হল কান্তির ছোট ভাই বাবলু। কান্তির বাবা তাঁর সব সম্পত্তি গোপনে উইল করে দিয়েছিলেন শুধু বাবলুর নামে। এ যেন ঠিক রামায়ণের মতন গল্প। কৈকেয়ীর কথা শুনে রাজা দশরথ ভরতকে দিলেন রাজ্য আর রামকে বনে পাঠালেন।

    কান্তি যাঁকে বড় মামা বলত, তিনি কান্তির ওই দ্বিতীয় মায়ের ভাই। কান্তির নিজের মামাদের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের অবস্থাও ভালো নয়। কান্তির বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে। তারা এসে উপস্থিত। তারপর তাঁরা যখন শুনলেন যে তাঁদের ভাগ্নে-ভাগ্নীরা বিষয়-সম্পত্তি থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হয়েছে তখন তাঁরা রেগে আগুন। লেগে গেল দুই পক্ষের মামাদের ঝগড়া। দ্বিতীয় মায়ের ভাই যে বড়মামা, তিনিই সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন, ও-বাড়ির সিন্দুকের চাবিও তাঁর কাছে। কান্তির ছোট মামাটি আবার রগচটা ধরনের, রানাঘাটের দিকে তাকে অনেকে গুণ্ডা হিসেবে ভয় পায়। সে রেগে গিয়ে বড়মামাকে ছুরি মারতে গেল, সেই অপরাধে তার তিন বছর কারাদণ্ড হয়ে গেল। আর এইসব কারণে বড়মামা কান্তি আর তার বোনদের একেবারে বিদায় করে দিলেন বাড়ি থেকে।

    কান্তির নিজের মামারা সম্পত্তির ভাগ নেওয়ার জন্য মামলা লড়েছিল। কিন্তু এইসব মামলা চলাতে গেলে টাকার জোর লাগে। কান্তির নিজের মামাদের অবস্থা ভালো নয়, দু-বছর কেস চালাবার পর তাঁরা হাল ছেড়ে দিলেন। কেন কান্তি আমাকে চিঠি লিখল না? কলকাতা ছেড়ে গিয়ে ওর কি আর কখনও মন পড়েনি আমাদের কথা? কান্তিরা গরিব হয়ে গিয়ছিল ঠিকই, তা বলে কি একটা চিঠি লেখার পয়সাও ছিল না?

    ছেলেবেলায় ভাবতুম, রানাঘাট বুঝি কত দূরে! কিন্তু পরে তো বুঝেছি! কান্তি কি রানাঘাট থেকে আর কখনও কলকাতায় আসেনি, তবু আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি কেন?

    নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে এতকাল পরে কান্তিকে এই অবস্থায় দেখে যেন সেই কারণটা খানিকটা অনুমান করতে পারলুম। আমরা যেরকম স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে এসেছি, সেইরকম মনে মনে আমি ধরেছিলুম, কান্তিও নিশ্চয়ই রানাঘাটে আবার স্কুলে ভরতি হয়েছে, সেখান থেকে পাশ করে মফস্বলেরই কোনও কলেজে পড়েছে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা এগিয়ে গেছি, কান্তি সেই ক্লাস নাইনেই রয়ে গেছে।

    আজ যে কান্তি আমার সামনে বসে আছে, তার চেহারায় বেশ একটা প্রৌঢ়ত্বের ছাপ পড়ে গেছে। অথচ তাকে দেখে আমার শুধু মনে পড়ছে সেই ক্লাস নাইনের ছেলেটির কথা। মাঝখানের অংশটা জোড়া না লাগলে আমি এখনকার কান্তিকে চিনতে পারব না।

    কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমি জিগ্যেস করলুম, সেই যে তোরা রানাঘাটে চলে গেলি, তারপর কী হল রে? তুই আর পড়াশুনো করিসনি?

    কান্তি সংক্ষিপ্ত ভাবে বলল :নাঃ! লেখাপড়া আর হল না।

    আমার বেশ রাগ হয়ে গেল। কান্তির মতন একটা ব্রিলিয়ান্ট ছেলের জীবনটা এইভাবে নষ্ট হয়ে গেল? হঠাৎ গরিব হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু গরিবরাও কি এদেশে লেখাপড়া করে না? কান্তি নিজেই বা এটা বোঝেনি কেন?

    আমি বললুম, তোর রানাঘাটের মামারা কী রে? তোকে একটা স্কুলে ভরতি করে দিতে পারেনি?

    কান্তি বলল, ভরতি হয়েছিলুম একটা স্কুলে, নিজেরই চেষ্টায়। কিন্তু তিন-চার মাসের বেশি পড়তে পারিনি সেখানে। বেঁচে থাকাটাই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমরা চার ভাইবোন। রানাঘাটে মামারবাড়িতে গিয়ে ওদের গলগ্রহ হয়ে পড়লুম। পাঁচুমামার অবস্থা ভালো ছিল না। রানাঘাটে একটা ছোট দোকান ছিল মোটে। আমার বাবার সঙ্গে আমার এই মামাদের সম্পর্ক ভালো ছিল না। আমার মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর পাঁচুমামাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্কও। রাখেননি! বাবা মারা যাওয়ার পর পাঁচুমামারা ভাবল, এবার তো আমিই সব সম্পত্তি পাব, তাতে ওঁদেরও সুবিধে হবে। কিন্তু হয়ে গেল তার উলটো। আমার মামি সবচেয়ে বেশি রেগে গিয়েছিল। কথায় কথায় আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিত। একসময় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে রানাঘাটে আমাদের ভাই-বোনদের সবাইকে ভিক্ষে করার উপক্রম হয়েছিল।

    কুচবিহারে আমার এক পিসিমা থাকতেন। রানাঘাটে অসহ্য হওয়ার পর চলে এলাম কুচবিহারে পিসিমার কাছে। সেখানেও প্রায় সেই একই অবস্থা। চারটে উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়ের ভার কে নিতে চায় বল। পিসিমা মানুষ ভালো ছিল, কিন্তু পিসেমশাই ছিলেন যেমন কৃপণ, তেমনি লোভী। তিনি কিছুদিন চেষ্টা করলেন আমাদের সম্পত্তি উদ্ধার করবার জন্য, কিন্তু বড়মামার সঙ্গে পেরে উঠলেন না। তখন পিসেমশাই বললেন, তোমাদের দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। তোমাকে আমি একটা কাজ জুটিয়ে দিচ্ছি, তোমরা আলাদা সংসার করো। পিসিমাও মারা গেলেন এর মধ্যে, সুতরাং বলার কিছুরইল না। মোনলা বছর বয়েসে আমি চাকরিতে ঢুকলাম, আর ভাড়া নিলাম একখানা খোলার ঘর।

    কী চাকরি নিলি?

    একটা মুদির দোকান জিনিস বিক্রি করা। মাইনে একশো টাকা। সেই টাকায় কখনও চলে? ঘাড়ের ওপর তিন-তিনটে বোন, তাদের লজ্জা নিবারণের তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমার বোনদের তোর মনে আছে? শান্তা, মণিকা, বীথিকা?

    শান্তাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে, ফরসা, পাতলা চেহারা। শান্তার সঙ্গে আমার বিশেষ একটা সম্পর্ক ছিল। ঠিক প্রেম নয়, সেই বয়েসে প্রেমের জন্মও হয় না, এক ধরনের ভালো লাগা। শান্তাকে দেখলেই ভালো লাগত। মণিকা আর বীথিকা বেশ ছোট ছিল, ওদের কথা ভালো করে মনে পড়ে না।

    কান্তি বলল, বোনদেরও লেখাপড়া শেখাতে পারলুম না। শান্তা বাড়িতে বসে ঠোঙা তৈরি করত, মণি আর বীথি সাহায্য করত তাকে।

    আমি দৃশ্যটা কল্পনা করেও শিউরে উঠলুম। বড়লোকের বাড়ির শৌখিন মেয়ে ছিল শান্তা আর বোনেরা, কত রকম রঙিন পোশাক পরত, ওরা রাস্তার সাধারণ আইসক্রিমওয়ালার কাছ থেকে আইসক্রিম খেত না, ওদের জন্য পার্ক স্ট্রিট থেকে আইসক্রিম আনানো হত। সেই ফুটফুটে সুন্দর তিনটি মেয়ে একটা বস্তির ঘরে বসে ঠোঙা বানাচ্ছে!

    তারপর কুচবিহার ছাড়লি কেন?

    বছরচারেক ওখানে কষ্টেসৃষ্টে চালিয়ে দিলুম। দু-বেলা খেতে পেতুম না। তবু সেইভাবেই চলে। যাচ্ছিল। যে মুদির দোকানে আমি কাজ করতুম, তার মালিক ভালোই বাসত আমাকে। তুমি তো জানো সুনীল, আমি অঙ্কে বেশ ভালোই ছিলুম, তাই হিসেব-টিসেব করে দিতে পারতুম। তাড়াতাড়ি। সেই দোকানে আরও দুজন কর্মচারী ছিল। আমি একটু মালিকের নেক নজরে পড়ায় তারা আমার ওপরে চটে গেল। তা ছাড়া, আমি ঠিকঠাক হিসেব করতুম বলে ওদের অসুবিধে হচ্ছিল বেশ। তখন ওরা একদিন আমার নামে চুরির অপবাদ চাপিয়ে দিল।

    চুরি?

    হ্যাঁ, চুরি। মারতে-মারতে আমায় তাড়িয়ে দিল সেই দোকান থেকে। তবে ভাই সত্যি কথা বলতে, আমি চুরি করতাম ঠিকই। মাঝে-মাঝেই চাল, ডাল, চিনি সরাতুম একটু আধটু। কী। করব, খিদের জ্বালা বড় জ্বালা। তখন ধর্ম মাথায় ওঠে। সেই দোকানের অন্য কর্মচারীরাও চুরি করত, কিন্তু তারা গায়ের জ্বালায় একদিন আমায় হাতে-নাতে ধরিয়ে দিল। দোকানের মালিক। মারতে-মারতে আমার মুখ দিয়ে রক্ত বার করে দিয়েছিল।

    তারপর?

    একবার চোর অপবাদ চেপে গেলে আর কোথাও চাকরি পাওয়া যায় না। পিসেমশাই তখনও বেঁচে ছিলেন, তাঁর কাছে গিয়ে ধর্না দিলুম। তিনি বললে, হারামজাদা, তোকে জুতোপেটা করব। চুরি করে আবার আমার কাছে মুখ দেখাতে এসেছিস? শহরে আমার পর্যন্ত বদনাম হয়ে গেল! ফের যদি কোথাও গিয়ে আমার পরিচয় দিয়েছিস–

    আমি কান্তির মুখের দিকে আবার ভালো করে তাকালুম। সত্যিই আমার ছেলেবেলার বন্ধু কান্তি আমার পাশে বসে আছে, সে এইসব কথা বলে যাচ্ছে। ঠিক যেন গল্পের মতন। আগেকার দিনে এরকম অনেক গল্প লেখা হত, বিষয় সম্পত্তির গণ্ডগোলে একজন হঠাৎ গরিব হয়ে গেল, তারপর কত কষ্ট, কত অত্যাচার সহ্য করা ইত্যাদি। আমাদের জীবনে এসব কখনও ঘটে না, এইসব লোকজনদের যে আমি কখনও দেখব তা ভাবিনি। কিন্তু এই তো একটা জলজ্যান্ত সত্য ঘটনা একজন আমার পাশে বসেই বলে যাচ্ছে।

    গল্পের একটা টান আছে। সেই জন্যেই এর পরের অংশটুকু আমার জানা দরকার।

    আমি জিগ্যেস করলুম, এর পর তোরা কুচবিহার ছেড়ে চলে এলি?

    কুচবিহার ছেড়ে যাব কোথায়? রেল স্টেশনে এসে কুলিগিরি করতে লাগলুম। মোটে একটাকা দু টাকা পাই। কোনও মতেই তাতে চলে না। চোর বদনাম রটে গেছে বলে কেউ চাকরিও দেবে না। সেই সময় মরীয়া হয়ে একদিন মাকে একটা চিঠি লিখলুম।

    মানে বাবলুর মাকে?

    হ্যাঁ। তাকে তো আমরা নিজের মায়ের মতনই দেখেছি। মার কাছে অনুনয়-বিনয় করে লিখলুম, মা, আমরা বিষয়-সম্পত্তির ভাগ চাই না, কিছু চাই না। শুধু আমাদের কলকাতার বাড়িতে ভাই বোনেদের একটু থাকতে দাও, দুটো খেতে পরতে দাও! আমি কলকাতায় একটা কিছু কাজ জোটাতে পারলেই বাড়ি ছেড়ে আবার চলে যাব।

    সে চিঠির কোনও উত্তর আসেনি নিশ্চয়ই?

    না!

    খুব স্বাভাবিক। সম্পত্তি নিয়ে মামলা চলার পর কি কেউ বিরুদ্ধ পক্ষকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়? আসলে ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসাই তোদের ভুল হয়েছিল। রাইট অব পজেশান বলে একটা কথা আছে না? তোর রানাঘাটের মামারা ছিল গাধা, এই জিনিসটা বোঝেনি?

    অত ছোট বয়েসে তো আমি এসব কিছু বুঝতাম না ভাই! তা ছাড়া ওই যে রানাঘাটের সেই গুণ্ডা মামাটা বাবলুর বড়মামাকে ছুরি মারল, তাতেই সব বরবাদ হয়ে গেল। তবু, আমি যখন বাবলুর মাকে চিঠি লিখেছিলুম, তখন অনেক আশা করেছিলুম যে আমাদের খাওয়া-পরার এত কষ্ট হচ্ছে শুনলে তিনি নিশ্চয়ই কিছু সাহায্য করবেন। হয়তো সে চিঠি বড়মামার হাতে পড়েছিল, মাকে দেখায়নি।

    আমি যতদূর শুনেছিলুম, তোরা চলে আসার বছরচারেক পরেই বাবলুর মা মারা যান। উনি তো প্রায়ই অসুখে ভুগতেন!

    সেই জন্যই! নইলে মা জানতে পারলে কিছু-না-কিছু সাহায্য করতেনই।

    তারপর কী হল?

    শান্তা তো এর মধ্যে বেশ বড় হয়ে উঠেছে, সতেরো বছর বয়েস, চেহারাও তো ভালোই। শান্তাকে একজন লোকের পছন্দ হয়ে গেল, সে শান্তাকে বিয়ে করতে চাইল। এক হিসেবে সেটা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। উঠতি বয়েসের মেয়েদের নিয়ে অনেক বিপদ। আমাদের কোনও সহায়সম্বল নেই, একটা খোলার ঘরের মধ্যে তিন-তিনটে মেয়েকে নিয়ে আমি থাকি, কখন কী হয় বলা যায় না। এই লোকটা তো বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। শুধু দোষের মধ্যে এই লোকটা একটা কশাই।

    কশাই মানে?

    মাদারিহাটে ওর একটা মাংসের দোকান আছে। নিজের হাতে মাংস কাটে না বটে, কিন্তু দোকানে

    সে-ই ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে। একজন কশাই-এর সঙ্গে বোনের বিয়ে দেওয়া যায় কি না, সে পরামর্শ নিতে আবার গিয়েছিলুম পিসেমশাই-এর কাছে। তিনি বললেন, যা ইচ্ছে করো, কিন্তু কুচবিহারে থাকতে পারবে না। চলে এলাম মাদারিহাটে।

    সেই কশাই-এর সঙ্গে শান্তার বিয়ে হল? শান্তা রাজি হল?

    রাজি-অরাজির কী আছে? তখন আমরা খেতে পাই না, এমন অবস্থা। সেই লোকটির বউ মারা গেছে কিছুদিন আগে, দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে আছে, বিয়ে করা তাড়াতাড়ি দরকার। আমরা আর। বেশি চিন্তা করার সুযোগ পেলাম না, তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলাম শান্তার!

    তুই আর তোর বাকি দুবোন ওদের বাড়িতেই রয়ে গেলি?

    প্রথম একবছর ছিলাম। এতদিনের মধ্যে সেই একটা বছরই বেশ ভালো ছিলাম বলতে পারো। শান্তার স্বামীর নাম দুলাল নস্কর। মানুষটা এমনিতে খারাপ না, শুধু একটাই যা দোষ। দুলাল প্রথম-প্রথম আমাকে বেশ খাতির করত। আমাকে সে পাঁচশো টাকা দিয়ে বলল, তুমি নিজে ব্যাবসা করো। চা-বাগানে মুরগি চালান দেওয়ার কাজ নিতে পারো। আমি কাজটা বেশশিখে যাচ্ছিলুম, মনে হয়েছিল, কিছুদিনের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যেতে পারব। দুলালের পাঁচশো টাকা শোধ দিয়ে আমার হাতেও কিছু জমেছিল, কিন্তু এত সুখ আমার কপালে সইল না। আমার ভাগ্যটাই যে খারাপ। এরপর যা হল, সেটা ভাই তোমাকে বলতে আমার লজ্জা করছে।

    তাহলে থাক।

    স্টেশনে লোকজন ছুটোছুটি করছে, মাইকে কী যেন ঘোষণা করল। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করলুম। ট্রেনের কী হল খবর নিতে হয়। ট্রেন যদি নাই যায়, রাত্তিরের জন্য একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

    কান্তি বলল, দার্জিলিং মেল আজ আর যাবে না মনে হচ্ছে। লোকেরা টিকিটের টাকা রিফান্ড নিতে যাচ্ছে। এমন এখানে মাঝে-মাঝে হয়।

    আমি তাহলে কী করব? আমাকেও টিকিটের টাকা রিফান্ড নিতে হবে? কালকের রিজার্ভেশান পাব কী করে?

    সে তুমি চিন্তা কোরো না। আমি ব্যবস্থা করে দেব। এটুকু আমি পারি। কেরানিবাবুরা আমায় চেনেন। তুমি বসো, এখন ভিড় হবে, একটু ফাঁকা হলে যাওয়া যাবে এখন।

    এবারে আমি একটা সিগারেট দিলুম কান্তিকে। সেটা জ্বালিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে সব কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এসব কথা আর কাকেই বা বলব। তোমাকে যে-কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলুম, এখন ভেবে দেখলুম, তাতেই বা লজ্জার কী আছে। ঘটনা যখন ঘটেই গেছে, তখন আর জানাতে লজ্জা কী! শান্তার স্বামী ওই যে দুলাল নস্কর, সে এমনিতে খারাপ লোক নয়, কিন্তু তার একটা দোষই বড় মারাত্মক। মাদারিহাটে সে তার বাড়িতেই আমাদের খাওয়া-থাকা দিচ্ছিল, ভালো মনেই দিত, কিন্তু তার আসল মতলবটা বুঝিনি প্রথমে। মণি আর বীথিও তো বড় হচ্ছে। দুলাল শান্তাকে বিয়ে করল তো বটেই, সেইসঙ্গে সে মণি আর বীথিকেও নিজের ভোগে লাগাতে চাইত। মণিকেই সে বিরক্ত করত বেশি। প্রথম-প্রথম ভাবতুম, এমনিই বুঝি ঠাট্টা ইয়ার্কি। তারপর মণি একসময় পোয়াতি হয়ে গেল, তার তখন মোটে সতেরো বছর বয়েস।

    তোর তখন বয়েস কত রে, কান্তি?

    কত আর হবে, কুড়ি-একুশ। দুলাল একটা হোমরাচোমরা লোক, মাদারিহাটে তার অনেক ক্ষমতা, আমি কী করে পারব তার সঙ্গে? শান্তা কান্নাকাটি করে, মণি কান্নাকাটি করে, তাই দেখে আমিও কাঁদি। দুই বোনেই একসঙ্গে পোয়াতি।

    সেই ছিপছিপে ফরসা কিশোরী মেয়ে শান্তা, সে একজন কশাইয়ের বউ। এই দৃশ্য আমি কল্পনাই করতে পারলুম না। শান্তার সেই অল্পবয়েসি সরল মুখখানাই আমার মনে পড়ে।

    কান্তি বলল, এর মধ্যে মণি আবার একটা কাণ্ড করল। হঠাৎ সে এক রাত্তিরে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল। সেই যে গেল তো গেলই, আর কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে আত্মহত্যা করেছে না নিরুদ্দেশে গেছে তা আজও আমি জানি না! তবে এইটুকু বুঝেছি, মণি আমাদের নিষ্কৃতি দিয়ে গেছে। ওর জন্য যাতে আমাদের বিপদ না বেড়ে যায়, তাই সে নিজেই আত্মত্যাগ করল। অতটুকু মেয়ে, সে যে কতখানি দুঃখ নিয়ে চলে গেছে–

    বলতে-বলতে গলা ধরে গেল কান্তির। তারপর একটু সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল, তোমার টিকিটটার ব্যবস্থা করা যাক।

    কিন্তু তখনও গল্পটার কিছুটা বাকি আছে। মণি চলে যাওয়ার পর ওরা কি মাদারিহাটে শান্তার স্বামীর বাড়িতে থেকে গেল?

    কান্তি বলল, না, তা কি আর থাকা সম্ভব? হাতে তখন আমার মুরগি বেচা শতিনেক টাকা ছিল।

    একদিন রাত্তিরে আমি শান্তাকে চুপি চুপি বললুম, দ্যাখ শান্তা, আমাদের যা হওয়ার তা তো হবেই আমাদের জন্য কোনও চিন্তা করিসনি। তোর পেটে সন্তান এসেছে, তুই তোর স্বামীর সঙ্গে কোনওরকমে মানিয়ে চলিস। আমি পুরুষমানুষ, আমার কোনও রকমে চলে যাবে, আর আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন বীথিকে দেখব। শান্তা একথা শুনেও মানতে চায়নি। কেঁদে-কেঁদে আমার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়েছিল, তবু বীথি আর আমি জোর করেই চলে এলুম।

    ওখান থেকে কোথায় গেলি?

    গেলুম দিনহাটা। নর্থ বেঙ্গলটা মোটামুটি চিনে গেছি তো। দিনহাটায় এসে মুরগির ব্যাবসাই শুরু করেছিলুম। তাও বেশিদিন চালাতে পারলুম না। কী যেন একটা অসুখে একবার পটাপট আমার মুরগিগুলো সবকটা মরে গেল দু-দিনের মধ্যে। দিনহাটা জায়গাটাই ছিল অপয়া, সেখানে আমি আর বীথি দুজনেই অসুখে পড়েছিলুম। তারপর থেকে এই এখানেই আছি। বীথি আর বিয়ে করল না, আমার সঙ্গেই থেকে গেল। একবার পক্স হয়ে বীথির সারা মুখে দাগ হয়ে গেছে, তাতে ভালোই হয়েছে, লোভী লোকেরা আর ওকে বিরক্ত করে না। আমি ভাই বিয়ে করেছি এর মধ্যে। দুটি ছেলেমেয়েও হয়েছে। বাড়িতে দুটো সেলাই মেশিন আছে, বীথি আর আমার বউ কন্ট্রাক্টে জামাকাপড় সেলাই করে, আর আমি এই করি, মোটামুটি এখন চলে যায়। বলতে পারো, ভালোই আছি।

    শান্তার খবর রাখো না?

    নাঃ! ওদিকে আর ঘেঁষিইনি। একদিন এই স্টেশনে দুলাল নস্করকে দেখেছিলুম দূর থেকে, কিন্তু সামনে গিয়ে কথা বলিনি। ওকে দেখেই আমার মণির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, আর তাতেই। লোকটার ওপর এত ঘৃণা হল যে কথা বলতে ইচ্ছে করল না! দুলাল নস্কর এখন বেশ বুড়ো হয়ে গেছে, গায়ে আর সেরকম জোর নেই। সঙ্গে দেখলুম একটা বাচ্চা ছেলে, মুখের আদল দেখে শান্তার ছেলে বলে মনে হল। চল, চল, আর দেরি করা যায় না!

    এরপর কান্তি আমার টিকিটটা নিয়ে ঢুকে গেল একটা ঘরের মধ্যে, খানিক বাদে বেরিয়ে এসে বলল, নাও, তোমার কালকের রিজার্ভেশান হয়ে গেছে। সহজে কি দিতে চায়।

    স্টেশনের বাইরে একটা মাত্র ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। নিউ জলপাইগুড়িতে সেরকম হোটেল ফোটেল নেই রাত কাটাবার জন্য আমাকে যেতে হবে শিলিগুড়ি। ট্যাক্সিটা চলে গেলে মুশকিল।

    সেদিকে এগোতে-এগোতে কান্তি বলল, এতক্ষণ শুধু নিজের কথাই বললুম, তোমার কথা কিছু জিগ্যেস করা হয়নি। তুমি এখন বড় চাকরি করছ নিশ্চয়ই। ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট। কোথায় আছ তুমি?

    আমি একটু হেসে বললুম, একটা খবরের কাগজে চাকরি করি। এমন কিছু বড় চাকরি নয়। দেখছ না ট্রেনে করে যাচ্ছি। যারা বড় চাকরি করে, তারা প্লেনে যাতায়াত করে।

    তোমার বাবা, আমাদের কালীবাবু স্যার কেমন আছেন?

    বাবা বেঁচে নেই।

    তোমার বাবার কোনও সম্পত্তি ছিল না, তাই তুমি সুখে আছ!

    ট্যাক্সিটায় দরদাম হয়ে যাওয়ার পর কান্তি বলল, ভাই সুনীল, তোমাকে একটা রাত অযথা এখানে থেকে যেতে হচ্ছে, শুধু-শুধু হোটেল ভাড়া দেবে। আমার উচিত ছিল তোমাকে আমার। বাড়িতে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু ভাই বিশ্বাস করো, তোমাকে রাখার মতন জায়গা আমাদের বাড়িতে। নেই। অতি ছোট-ছোট দু-খানি ঘর, তার মধ্যে আবার শেলাই-এর মেশিন, আমার দুটো ছেলেমেয়ে—

    আমি বললুম, হোটেলের খরচ আমাদের কোম্পানি দেবে। সেজন্য ভেব না। কাল বরং একটু তাড়াতাড়ি এসে তোমার বাড়িটা একবার দেখে আসব। তোমার বউ দেখাবে না?

    ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেওয়ার পর আমি জানলা দিয়ে হাতছানি দিয়ে কান্তিকে বিদায় জানালুম। গাড়িটা একটু দূরে যাওয়ার পর আমার মনে হল, এইভাবে রেলের প্ল্যাটফর্মে হকার-বেশি কান্তির সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হত। ক্লাস নাইনের কান্তিই আমার প্রিয়। তখন কান্তি আর আমি পরস্পরকে তুই-তুই করতুম। এখন আমি কান্তিকে তুই বললেও ও আমাকে আগাগোড়া তুমি বলে গেল।

    আমি যে বই-টই লিখি, কাগজপত্তরে প্রায়ই আমার নাম বেরোয়, কান্তি তার কিছুই খবর রাখে না। তবুও কান্তি আমাকে সমীহ করছিল কেন?

    দুই

    এর দু-বছর পরের কথা। এক রবিবার সকালে আমি বাড়ি থেকে বেরুতে যাচ্ছি, এমনসময় একটা নতুন ঝকঝকে গাড়ি আমাদের বাড়ির দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। সিল্কের সাফারি সুট পরা একজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে বলল, সুনীল, কোথায় চললি? তোর কাছেই এসেছি—

    আবার একটা দারুণ চমক। কান্তি!

    নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে সেই যে মলিন বয়াটে চেহারা দেখেছিলুম, সে কান্তি তো এ নয়। এ যে আর-একজন মানুষ। চেহারা সুন্দর হয়ে গেছে, মুখে একটা আত্মতৃপ্তির ভাব। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে দেখে যতটা অবাক হয়েছিলুম এবারে অবাক হলুম তার চেয়ে আরও বেশি। এও যে দেখছি রূপকথার মতন।

    কান্তি এক মুখ হেসে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ওঠ রে গাড়িতে ওঠ, তোকে এক জায়গায় যেতে হবে। পথে সব বলছি।

    গাড়িতে উঠে পড়লুম, ঘোর-লাগা মানুষের মতন। কান্তি বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই নে! সেই যে তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার ঠিক দশ মাসের মধ্যেই ব্যাপারটা ঘটে গেল। আমার কপালে একটা পাথর চাপা ছিল বুঝলি, সেই পাথরটা সরে যেতেই সুখের মুখ দেখলুম। তুই কি গুপ্তধন পেয়েছিস নাকি রে কান্তি?

    ঠিক তাই। এ-যুগের গুপ্তধন। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যায়। এবারে বুঝেছিস?

    লটারি? কোথাকার?

    রাজস্থানের!

    অ্যাঁ? ফার্স্ট প্রাইজ? সে তো অনেক টাকা। ছত্রিশ লাখ। ইনকাম ট্যাক্স কেটে-কুটে তেইশ লাখ দিয়েছে। তাই বামন্দ কী, বল? হাঃহাঃহাঃ!

    কান্তি যেমন উদারভাবে হাসল, সেরকম ভাবে হাসবার ক্ষমতা নেই আমার। তেইশ লাখ টাকা যারা হঠাৎ পায়, তারাই শুধু ওরকম ভাবে হাসতে পারে।

    তুই বিশ্বাস কর, সুনীল, আমি আগে কোনওদিন লটারির টিকিট কাটিনি। দুটো টাকা দিয়ে টিকিট কাটার ক্ষমতাই আমার ছিল না। এবারে হল কি, আমাদের নিউ জলপাইগুড়িতে যে টিকিটের এজেন্ট ছিল, তার অসুখ হয়ে গেল। তার কাছে জমে আছে অনেক টিকিট। আমাকে সে বলল, তুই তো ট্রেনে কলম বেচিস, তার সঙ্গে কখানা টিকিটিও বিক্রি কর না। তাই শুরু করলুম। রাজস্থানের লটারির টিকিট নিয়েছিলুম কুড়িখানা, তার মধ্যে উনিশখানা বিক্রি হয়েছিল, একখানা বাকি ছিল। সেই টিকিটটাতেই ফার্স্ট প্রাইজ উঠল!

    আমার চোখ দুটো বিস্ফারিত হতে দেখে কান্তি আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, তুই যদি কোনও গল্পে এইরকম কথা লিখিস, তাহলে, পাঠকরা ভাববে গাঁজাখুরি। ভাববে না তাই? কিন্তু জীবনে। এরকম কিছু অসম্ভব ব্যাপারও সম্ভব হয়।

    সত্যি খুব খুশি হয়েছি রে, কান্তি! তুই জীবনে অকারণে অযথা অনেক কষ্ট পেয়েছিস! টাকাটা নিয়ে কী করবি? ব্যাবসা-ট্যাবসা?

    মাথা খারাপ! পনেরো লাখ টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিয়েছি। তার থেকে যা সুদ পাব, তাতেই রাজার হালে আমার বাকি জীবনটা চলে যাবে। বাকি টাকাটা দিয়ে কয়েকটা কাজ করব। সেই জন্যই তো তোকে নিয়ে যাচ্ছি।

    তুই এখন কোথায় থাকছিস? কলকাতায়?

    তোকে আসল কথাটাই এখনও বলা হয়নি।

    কী রে?

    আগে বলব না। চল, দেখে একেবারে চমকে যাবি।

    তুই আমার ঠিকানা জানলি কোথা থেকে?

    তোর এক প্রকাশককে ফোন করলুম। কলকাতায় এসেছি এক মাস আগেই, নানান কাজে তোর সঙ্গে আগে যোগাযোগ করতে পারিনি। কান্তির ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে নর্থ ক্যালকাটার দিকে। কান্তি কোনও নির্দেশ দিচ্ছে না। কোথায় যেতে হবে, ড্রাইভার তা জানে। কান্তির বুক পকেটে তিনটে কলম। হাতের ঘড়িটাও খুব নতুন ধরনের।

    আমি কান্তির মুখের দিকে তাকাতেই কান্তি হেসে ফেলে বলল, আমি আর চেপে রাখতে পারছি না রে! নাঃ, বলেই ফেলি! কোথায় যাচ্ছি জানিস? মোহনবাগান লেনে। আমি আমার বাবার বাড়িটা কিনে নিয়েছি।

    তাই নাকি?

    টাকাটা পেয়েই প্রথমে আমার এই ইচ্ছেটাই মনে এসেছিল। বাড়িটা কিনতে খুব একটা অসুবিধে হল না। বড়মামা বুড়ো হয়ে গেছেন, সেই তেজ নেই। বাবলুটাও বেশি লেখাপড়া শেখেনি। জীবনে বিশেষ কিছু করতে পারেনি। কারখানাটা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি গিয়ে বললুম, আমি আবার মামলা-মোকদ্দমা করে তোমাদের নাস্তানাবুদ করে দিতে পারি। এখন আমার টাকার জোর আছে। সেসব দিকে আমি যেতে চাই না। এই বাড়ির এখন যা বাজারদর, তার চেয়ে আমি দশ হাজার টাকা বেশি দেব, আমাকে বিক্রি করে দাও। এক কথায় রাজি হয়ে গেল। দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গেছে, আজ এখানে গৃহপ্রবেশ।

    কত বছর বাদে রে, কান্তি? কত বছর বাদে তুই আবার নিজেদের বাড়িতে গিয়ে থাকবি?

    ঠিক বত্রিশ বছর। তবে শুধু গৃহপ্রবেশই হবে। ও বাড়িতে আমি থাকব না। আমি প্ল্যান করে ফেলেছি, ও-বাড়িতে আমি একটা অনাথ আশ্রম বানাব। চিফ মিনিস্টার এসে উদ্বোধন করবেন। যে বাড়ি থেকে আমরা ভাই-বোনেরা একদিন কাঁদতে-কাঁদতে বেরিয়ে গেছিলুম, এখন থেকে সে বাড়িতে থাকবে নিরাশ্রয় ছেলেমেয়েরা। বাবলুকেও আমি তাড়িয়ে দিইনি। আমি বলেছি, সে ইচ্ছে করলে দু-খানা ঘর নিয়ে থাকতে পারে। ইচ্ছে করলে সে এই অনাথ আশ্রমের দেখাশুনোর ভার নিতে পারে। ঠিক করিনি রে সুনীল?

    এর থেকে আর ভালো কিছু হতে পারে না।

    শুধু দুটো দুঃখ রয়ে গেল! লেখাপড়া শিখতে পারিনি, তোদের চেয়ে কত মুখ হয়ে রইলুম। এ বয়েসে কি আর নতুন করে শুরু করতে পারব?

    কেন পারবি না? যে-কোনও বয়েসেই লেখাপড়া শুরু করা যায়। তোর তো ডিগ্রি দরকার নেই, নিজে নিজে পড়বি!

    কী জানি পারব কি না! আর-একটা দুঃখ এই যে, শান্তাকে আনিয়েছি, বীথি আর আমার বউ ছেলেমেয়েও এসেছে, শুধু মণিকাকেই পেলুম না। সে কোথায় হারিয়ে গেল!

    গাড়িটা এসে থামল কান্তিদের সেই পুরোনো বাড়ির সামনে। আমি বহুদিন এ পাড়ায় আসিনি। পাড়াটা প্রায় একইরকম আছে। কান্তিদের বাড়িটা নতুন রং করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। গেটের সামনে দুটো কলা গাছ আর ফুলের মালা। মাইকে শানাই বাজছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কয়েকটি কিশোরকিশোরী। ঠিক যেন বত্রিশ বছর আগের মতন। কান্তি আর তার বোনদের বদলে এখন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ওদের ছেলেমেয়েরা।

    গেট পেরিয়ে আমরা বাগানটার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগলুম।

    কান্তি বলল, বাগানটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আবার গাছ পুঁততে হবে। আশ্রমের ছেলেমেয়েরা সেই গাছের যত্ন করবে। বীথি বলেছে, সে-ও এই আশ্রমেই থাকবে। ওই দ্যাখ ওপরের বারান্দায় বীথি দাঁড়িয়ে আছে, চিনতে পারিস?

    ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এক মহিলা চেয়ে আছে আমাদের। দিকে। বেশ বয়স্কা মনে হয়। বীথিকে যখন আমি দেখি, তখন তার বয়স ছিল সাত-আট বছর, তাকে আমি চিনব কী করে এত বছর বাদে।

    বীথি লাজুকভাবে হেসে বলল, কেমন আছ, সুনীলদা! এই দিদি, দ্যাখ-দ্যাখ, সুনীলদা এসেছে–

    এবারে বীথি পাশে এসে দাঁড়াল শান্তা। বয়েসের দাগ পড়লেও শান্তার মুখখানা প্রায় আগের মতনই আছে। তার স্বামী একজন নষ্ট চরিত্র কশাই হলেও সে শান্তার মুখের সারল্যটা নষ্ট করতে পারেনি।

    শান্তা আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলল না। তারপর মুখটা ওপরে তুলতেই তার মুখে এক অদ্ভুত হাসি-কান্না ফুটে উঠল। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, দাদা, গেটের কাছে…কে এসেছে দেখো। আমি আর কান্তি দুজনেই পেছন ফিরে তাকালুম।

    গেটের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। খুব রোগা, ময়লা শাড়ি-পা, অনেকটা পাগলিনীর মতন চেহারা। গেটের লোহায় সে আদর করে হাত বুলোচ্ছে।

    কান্তি অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, মণিকা!

    তারপরই সে দৌড়ল!

    এই পর্যন্তই থাক। পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে এই কাহিনির দ্বিতীয় অংশটা রূপকথাও নয়, বাস্তবও নয়। এটা একটা স্বপ্ন। দার্জিলিং মেলে ফেরার সময় আমি এই স্বপ্নটা দেখেছিলাম। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে কান্তি এখনও কলম-টর্চ লাইট ইত্যাদি বিক্রি করে কি না জানি না।

    অনেকদিন ওদিকে যাইনি। আশা করি, ওর জীবনে আর কোনও বিপদ ঘটেনি।

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরহস্য কাহিনী নয়
    Next Article রূপকথার রাজারানি

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী ছোটগল্প

    আসল বেনারসী ল্যাংড়া

    April 5, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }