Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প277 Mins Read0

    লজ্জা (০৮) অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার পর

    ৮ক.

    উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার পর সারা ভারত জুড়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল তার মাত্রা কমে আসছে। ধীরে ধীরে। ভারতে মৃতের সংখ্যা এর মধ্যে আঠারশ ছাড়িয়ে গেছে। কানপুর ও ভূপালে এখনও সংঘর্ষ চলছে। প্রতিরোধ করতে গুজরাট, কণাটক, কেরালা, অন্ধ্রপ্রদেশ, আসাম, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গের রাস্তায় সেনাবাহিনী নেমেছে। তারা টহল দিচ্ছে। ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলগুলোর দরজায় তালা পড়েছে।

    শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য ঢাকায় সর্বদলীয় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল হচ্ছে, তাতে কী। এদিকে শদ্ভূ-গোলকপুরের ত্ৰিশজন হিন্দু মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে, চঞ্চলী, সন্ধ্যা, মণি..। মারা গেছে নিকুঞ্জ দত্ত। ভয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে এক বৃদ্ধা, ভগবতী। গোলকপুরে দিনের বেলায়ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মুসলমানের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া মেয়েরাও ধর্ষিতা হয়েছে। দাসের হাট বাজারের নাটু হালদারের চৌদ্দশ মণ সুপারির আড়ত ছাই হয়ে গেছে। ভোলা শহরের মন্দির ভাঙচুরের সময় পুলিশ, ম্যাজিষ্ট্রেট, ডি সি নীরবে: দাঁড়িয়ে ছিল। জুয়েলারিগুলো প্রকাশ্যে লুট হয়েছে। হিন্দু ধােপাবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। মানিকগঞ্জ শহরের লক্ষ্মী মণ্ডপ, সার্বজনীন শিববাড়ি, দাশেরা, কালিখলা, স্বর্ণকার পট্টি, গদাধর পালের বেভারেজ ও সিগারেটের বড় মজুত দোকান ভাঙচুর করা হয়। তিন ট্রাক ভর্তি লোক ত্বরা, বানিয়াজুরি, পুকুরিয়া, উথলি, মহাদেবপুর, জোকা, শিবালয় থানায় হামলা চালায়। শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বেতিলা গ্রামে হিন্দুদের ঘর লুট করা হয়। পোড়ানো হয়। বেতিলার শত বছরের পুরনো নাটমন্দিরে হামলালানো হয়। গড়পাড়ায় জীবন সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার তিনটে গোয়াল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, কয়েকশ মণ ধানও পুড়ে গেছে। ঘিওর থানার তেরাষ্ট্ৰীবাজারের হিন্দুদের দোকান, গাণ্ডভুবি, বানিয়াজুরি, সেনপাড়ার হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনপাড়ায় এক হিন্দু গৃহবধূকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। পিরোজপুরের কালীবাড়ি দেবার্চনা কমিটির কালী মন্দির, মনসা মন্দির, দুর্গা মন্দির, শীতল মন্দির শিব মন্দির, নারায়ণ মন্দির, পিরোজপুর মদনমোহন বিগ্রহের মন্দির, আখড়াবাড়ি, রায়েক্লাঠি কালীবাড়ির মন্দির, কৃষ্ণনগর রাইরাসরাজ সেবাশ্রম, ডুমুরতলা শ্ৰীশুরু সংঘের আশ্রম মন্দির, দক্ষিণ ডুমুরতলার সুরেশ সাহার বাড়ির কালী মন্দির, ডুমুরতলার নরেন সাহা বাড়ির মনসা মন্দির, রমেশ সাহার বাড়ির মনসা মন্দির ও বসতবাড়ি, ডুমুরতলা বারোর কালী মন্দির, সুচরণ মণ্ডল, গৌরাঙ্গ হালদার, হরেন্দ্রনাথ সাহা, নরেন্দ্রনাথ সাহার বাড়িল্লমন্দির, ডুমুরতলা হাই স্কুলের পাশে কালী মন্দির, রানীপুর পঞ্চদেবীর মন্দির, হুলারাহাট সার্বজনীন দুৰ্গ মন্দির ও কার্তিক দাসের কাঠের দোকান, কলাখালি সনাতন আশ্ৰৱল কালী মন্দির, জুজখোলা গৌরগোবিন্দ সেবাশ্রম, হরিসভার সনাতন ধর্মমন্দির, রনজিৎ শীলের বাড়ির কালী মন্দির, জুজখোলা বারোয়ারি পূজামণ্ডপ, গাবতলা স্কুলের পাশে সার্বজনীন দুর্গা মন্দির, কৃষ্ণনগর বিপিন হালদারের বাড়ির মন্দির, নামাজপুর সার্বজনীন কালী মন্দির, কালিকাঠি বিশ্বাস বাড়ির মন্দির ও মঠ, লাইরি কালী মন্দির, স্বরূপঠি থানার ইন্দের হাট সার্বজনীন মন্দির, ইন্দের হাট কানাই বিশ্বাসের বাড়ির দুর্গ মন্দিরবানকুল সাহার সিনেমা হল, অমল গুহর বাড়ির দুর্গ মন্দির, হেমন্ত শীলের বাড়ির মন্দির, মঠবাড়িয়া থানার যাদব দাসের বাড়ির কালী মন্দির জ্বালানো হয়। সৈয়দপুর মিস্ত্রী পাড়ায় শিব মন্দিরও ভাঙা হয়। নড়াইল জেলার রতডাঙ্গা গ্রামে সাৰ্বজনীন মন্দির, বারোর ঘোনা সার্বজনীন মন্দির, কুডুলিয়ার সার্বজনীন শ্মশানঘাট, নিখিল চন্দ্ৰ দে’র পারিবারিক মন্দির, কালীপদ হাজরার পারিবারিক মন্দির, শিবুপ্রসাদ পালের পারিবারিক মন্দির, বাদন গ্রামের দুলাল চন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ির মন্দির, কৃষ্ণচন্দ্র লস্করের বাড়ির মন্দির, তালতলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের বৈদ্যনাথ সাহা, সুকুমার বিশ্বাস, পাগলা বিশ্বালে পারিবারিক মন্দির, পঙ্কবিলা গ্রামের সার্বজনীন মন্দির ও লোহাগড়া থানার দৌলতপুর পূর্বপাড়া নারায়ণ জিউ মন্দির ভেঙেচুরে তছনছ করা হয়। খুলনায় দশটি মন্দিল্লী ভেঙেছে। পাইকপাড়ার রাডুলি, সোবনাদাশ। আর বাকা গ্রামে চার-পাঁচটি মন্দির ভাঙচুহু কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট করা হয়। রূপসা থানার তালিমপুর এলাকায় দুটো মন্দির-ভেঙে দেওয়া হয়। পাশের হিন্দু বাড়িগুলো লুট করা হয়। দীঘলিয়া আর সেন✉ট এলাকায় আটই ডিসেম্বর রাতে তিনটি মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেনীর সহদেবপুর গ্রামে একদল মিছিলকারী তেরোটি বাড়িতে হামলা চালায়। ছাগল-ইয়ার জয়পুর গ্রামে হামলা হওয়ায় বিশজন আহত হয়েছে। লাঙ্গলবোয়া গ্রাম থেকে মোয়াজেম হোসেনের নেতৃত্বে দুশ লোক গোবিন্দপ্ৰসাদ রায়ের বাড়িতে হামলা চালাম্বী কমল বিশ্বাস নামে একজন গুরুতর আহত হয়। সম্ভবত মারা যাবে।

    বিরূপাক্ষ, নয়ন, দেবব্রত, সুরঞ্জনের সামনে বসে গলগল করে ভাঙচুরের বমি করে। সুরঞ্জন চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটি কথাও সে এতগুলো ভাঙনের গল্প শুনবার পরও উচ্চারণ করে না। এরা কেউ জানে না কেবল ভোলা চট্টগ্রাম পিরোজপুর সিলেট কুমিল্লার হিন্দু বাড়ি লুট হয়নি, টিকাটুলির এই বাড়ি থেকে লুট হয়ে গেছে মায়া নামের একটি চমৎকার মেয়ে, মেয়েমানুষ তো অনেকটা সম্পদের মত, তাই সোনাদানা ধনসম্পদের মত মায়াকেও তুলে নিয়ে গেছে ওরা।

    –কি ব্যাপার সুরঞ্জন কথা বলছি না কেন? হয়েছে কি তোমার? দেবব্রত প্রশ্ন করে।

    –মদ খেতে চাই। পেট ভরে মদ খাওয়া যায় না আজ?

    –মদ খাবে?

    –হ্যাঁ খাব ৷

    — টাকা আছে আমার পকেটে, কেউ গিয়ে এক বোতল হুইস্কি নিয়ে এস।

    –বাড়িতে বসে খাবে? তোমার বাবা মা?

    –গুল্লি মারো বাবা মা। আমি খেতে চাইছি, খাব। বিরূ যাও, সাকুরা পিয়সি কোনও একটাতে পাবে।

    –কিন্তু সুরঞ্জনদা…

    –এত হেসিটেট করো না তো, যাও।

    ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

    –কাঁদে কে? মাসিমা? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে।

    –হিন্দু হয়েছে যখন, না কেঁদে উপায় আছে?

    চুপ হয়ে যায় তিন যুবক। হিন্দু তো ওরাও, ওরাও অনুভব করে মাসিমাকে কাঁদতে হয় কেন। প্রত্যেকের বুকের মধ্য থেকে বোবা কান্না ঠেলে ওঠে। বিরূপাক্ষ টাকা নিয়ে দ্রুত চলে যায়, ফেন চলে গেলেই সে সকল বেদনা থেকে মুক্তি পাবে। যেমন সুরঞ্জন মুক্তি পেতে চাইছে মদ খেয়ে।

    বিরূপাক্ষ চলে যেতেই সুরঞ্জন প্রশ্ন করে–আচ্ছা দেবব্রত, মসজিদ পোড়ানো যায় না?

    –মসজিদ? তোমার কি মাথা-ট্যাথা খারাপ হয়ে গেছে?

    —চল আজ রাতে ‘তারা মসজিদ’ পুড়িয়ে ফেলি। দেবব্রত বিস্মিত চোখে একবার সুরঞ্জনের দিকে, একবার নয়নের দিকে তাকায়।

    —আমরা দু কোটি হিন্দু আছি, চাইলে বায়তুল মোকাররমটাকেও তো পুড়িয়ে ফেলতে পারি।

    —তুমি তো কখনও নিজেকে হিন্দু বলনি। আজ বলছ কেন?

    –মানুষ বলতাম তো, মানবতাবাদী বলতাম। আমাকে মুসলমানেরা মানুষ থাকতে দেয়নি। হিন্দু বানিয়েছে।

    –তুমি খুব বদলে যােচ্ছ সুরঞ্জন।

    –সে আমার দোষ নয়।

    –মসজিদ ভেঙে আমাদের কি লাভ? আমরা কি আর মন্দির ফিরে পাব? দেবব্রত চেয়ারের ভাঙা হাতলে নখ ঘষতে ঘষতে বলে।

    –না পাই, তবু আমরাও যে ভাঙতে পারি। আমাদেরও যে রাগ আছে তা একবার জানানো উচিত নয়? বাবরি মসজিদ সাঁড়ে চারশ বছরের পুরনো মসজিদ ছিল। চৈতন্যদেবের বাড়িও তো পাঁচশ বছরের পুরনো ছিল। চার-পাঁচশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য কি এ দেশে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না? আমার সোবহানবাগ মসজিদটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। গুলশান এক নম্বরের মসজিদটা সৌদি আরবের টাকায় করা। চল ওটা দখল করে মন্দির বানিয়ে ফেলি।

    –কী বলছি তুমি সুরঞ্জন? পাগলই হয়েছ বটে। তুমি না। আগে বলতে ‘মন্দির ও মসজিদের জায়গায় দিঘি কেটে নধর পতিহাঁস ছেড়ে দেব?

    –কেবল কি তাই বলতাম, বলতাম,  গুঁড়ো হয়ে যাক ধর্মের দালানকোঠা, পুড়ে যাক অন্ধাগুনে মন্দির মসজিদ গুরুদয়ারা গির্জার ইট, আর সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর সুগন্ধ ছড়িয়ে বড় হোক মনোলোভা ফুলের বাগান, বড় হোক শিশুর ইস্কুল, পাঠাগার। মানুষের কল্যাণের জন্য এখন প্রার্থনালয় হোক হাসপাতাল, এতিমখানা, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়। এখন প্রার্থনালয় হোক শিল্পকলা একাডেমি, কলামন্দির, বিজ্ঞান গবেষণাগার, এখন প্রার্থনালয় হোক ভোরের কিরণময় সোনালি ধানের ক্ষেত, খোলা মাঠ, নদী, উতল সমুদ্র। ধর্মের অপর নাম আজ থেকে মনুষ্যত্ব হোক।

    –সেদিন দেবেশ রায়ের একটি লেখা পড়লাম। লিখেছেন বড়ে গোলাম তাঁর সুরমণ্ডল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নেচে নেচে গাইছেন, হরি ওম তৎসৎ, হরি ওম তৎসৎ। আজও বড়ে গোলাম সেই একই গান গেয়ে চলেছেন। কিন্তু যারা বাবরি মসজিদকে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে সেখানে রামলালার মূর্তি বসিয়ে পালিয়ে আসে, সেই হিন্দু এ গান শুনতে পায় না। এ গান আদভানি, অশোক সিঙ্ঘলরা শুনতে পায় না। এ গান রাস্ট্রীয় সেবক সংঘ বা বজরং দল শুনতে পায় না। বড়ে গোলাম আলি মুসলমান ছিলো। অথচ তাঁর গলায় এই হরি ওম তৎসৎ সেইসব মুসলমানরাও শুনতে পায় না। স্বামীনে করে মসজিদ ধ্বংসের একমাত্র প্রতিবিধান হতে পারে মন্দির ধ্বংস করে।

    —সুতরাং বলতে চাইছ মন্দির ধ্বংসের কারণে মন্দির ধ্বংস করা ঠিক নয়। তুমি আমার বাবার মত আদর্শবাদের কথা বলছি। আই হেট হিম। আই হেট দ্যাট ওলন্ড হেগার।

    সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে শোয়া থেকে একলাফে উঠে দাঁড়ায়।

    –শান্ত হও সুরঞ্জন। শান্ত হও। তুমি যা বলছ এগুলো কোনও সমাধান নয়।

    –আমি এভাবেই সমাধান চাই। আমার হাতেও আমি রামদা কিরিচ পিস্তল চাই। মোটামোটা লাঠি চাই। ওরা পুরনো ঢাকার এক মন্দিরে পেচ্ছাব করে এসেছিল না? আমি পেচ্ছাব করতে চাই ওদের মসজিদে।

    –ওহ সুরঞ্জন। তুমি কম্যুনাল হয়ে যাচ্ছ।

    — হ্যাঁ আমি কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি। কম্যুনাল হচ্ছি।

    সুব্ৰত সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নানা কাজে একসঙ্গে থেকেছে দুজন। সে অবাক হয় রঞ্জনের আচরণে। মদ খেতে চাইছে। নিজের মুখে বলছে কম্যুনাল হচ্ছে। বাবাকে পর্যন্ত গাল দিচ্ছে।

     

    ৮খ.

    ‘দাঙ্গা তো বন্যা নয় যে, জল থেকে তুলে আনলেই বিপদ কাটল, তারপর চিড়েমুড়ি গাড় করতে পারলেই আপাতত ঝামেলা মিটল। দাঙ্গা তো আগুন লাগা নয় যে, জল ঢলে নিভিয়ে দিলেই পরিত্রাণ জুটবে। দাঙ্গায় মানুষ তার মনুষ্যত্ব স্থগিত রাখে। দাসী মানুষের মনের বিষ বেরিয়ে আসে। দাঙ্গা কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, কোনও দুৰ্ঘটনা নয়। দাঙ্গা মনুষ্যত্বের বিকার।’ সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিরণময়ী ঘরের কোণে তাঁর ভগবানের কাছে কপাল ঠুকে রাখেন। মাটির ঠাকুরটি নেই। ভেঙে ফেলেছে সেদিন। রাধাকৃষ্ণের একটি ছবি ছিল কোথাও। সেটি সামনে নিয়ে কপাল ঠোঁকেন কিরণময়ী। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলেন। সুধাময় তাঁর চলৎশক্তিহীন শরীর নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাকেন। রাধা বা কৃষ্ণের কি কোনও ক্ষমতা আছে মায়াকে ফিরিয়ে দেবার! এই যে ছবি, এ তো কেবল ছবি। কেবল গল্প। এরা কি করে মায়াকে কঠোর কঠিন নিষ্ঠুর মৌলবাদের কবল থেকে উদ্ধার করবে? এই দেশের নাগরিক হয়েও, ভাষা আন্দোলন করেও, যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের খেদিয়ে দেশ স্বাধীন করেও এই দেশে তাঁর নিরাপত্তা জোটে না। আর কোথাকার কোন রাধা কৃষ্ণ তাঁকে বলা নেই কওয়া নেই নিরাপত্তা দেবে! এদের আর খেয়ে-দোয়ে কাজ নেই। জন্ম থেকে চেনা পড়শিই তোমার বাড়ি দখল করে নিচ্ছে, তোমার পাশের বাড়ির দেশি ভাইয়েরা তোমার মেয়েকে অপহরণ করে নিচ্ছে। আর সেখানে তোমার দুৰ্গতি দূর করতে ননীচোর আসবে! আয়ান ঘোষের স্ত্রী আসবে! দুৰ্গতি যদি দূর করতে হয় সবাই মিলে এক জাতি হবার জন্য যারা যুদ্ধ করেছিল, তারাই করবে।

    সুধাময় করুন ক্লান্ত স্বরে কিরণময়ীকে ডাকেন–কিরণ কিরণ।

    কিরণময়ী রোবটের মত কাছে দাঁড়াতেই তিনি বলেন—সুরঞ্জন মায়াকে আজ খুঁজতে যায়নি?

    –জানি না।

    —হায়দার নাকি লোক দিয়ে খোঁজাচ্ছে। ও কি এসেছিল?

    –না।

    –তবে কি মায়াকে পাওয়া যাচ্ছে না?

    –জানি না।

    —আমার পাশে একটু বসবে কিরণ?

    কিরণময়ী জড়বস্তুর মত থপ করে বসেন ৷ বসেই থাকেন। না হাত বাড়ান। তাঁর অচেতন হাত পায়ে, না একবার তোকান অসুস্থ স্বামীর দিকে। ওঘরে হইচই চিৎকারের শব্দ। সুধাময় বলেন-সুরঞ্জন এত চেঁচাচ্ছে কেন? ও হায়দারের খোঁজে যায়নি? আমি নিজেই তো যেতে পারতাম। এই অসুখটা কেন আমার হতে গেল! আমি সুস্থ থাকলে মায়াকে কেউ ষ্টুতে পারত? পিটিয়ে লাশ বানিয়ে দিতাম না! সুস্থ থাকলে যে করেই হোক মায়াকে আমি খুঁজে আনতাম…সুধাময় একই উঠতে চান। উঠতে গিয়ে আবারই চিৎ হয়ে পড়ে যান বিছানায়। কিরণময়ী তাঁকে ধরে ওঠান না। স্থির তাকিয়ে থাকেন বন্ধ দরজার দিকে। কখন শব্দ হয়। কখন ফেরে মায়া।

    —একবার ডাকো তোমার সুযোগ্য পুত্ৰধনকে। স্কাউন্ড্রেল কোথাকার। বোন নেই। আর বাড়িতে সে মদের আসর বসিয়েছে ৷ হৈ-হাল্লা করছে। ছিঃ ছিঃ।

    কিরণময়ী সুরঞ্জনকে না ডাকতে যান, না। সুধাময়কে শাস্ত হতে বলেন, তিনি স্থির তাকিয়ে থাকেন দরজায়। ঘরের কোণে রাধাকৃষ্ণের ছবি বসিয়েছেন। তিনি এখন আর স্বামী বা পুত্রের নিষেধ মেনে নাস্তিকতার চাচা করতে রাজি নন। এই মুহুর্তে কোনও মানুষ সহায় নয়, যদি একবার ভগবান সহায় হন।

    সুধাময় একবার দাঁড়াতে চান। একবার জেনাথন সুইফটের মত বলতে চান পরস্পরকে ঘৃণা করবার ধর্ম আমাদের অনেক আছে, কিন্তু পরস্পরকে ভালবাসার ধর্ম নেই। মানুষের ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে আছে ধর্মীয় কলহে, যুদ্ধে, জেহাদে। ছেচল্লিশে শ্লোগান দিতেন সুধাময়রা ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’। এরকম শ্লোগান আজও হয়। এই শ্লোগান এতকাল ধরে দিতে হয় কেন? এই উপমহাদেশে এই শ্লোগান স্পষ্ট বছর কত শতাব্দী ধরে দিতে হবে। এখনও প্রয়োজন ফুরোয়নি আহ্বানের! এই শ্লোগান শ্লোগানে বোধবুদ্ধিহীন মানুষ কি জাগে আদৌ? মানুষ যদি ভেতরে অসাম্প্রদায়িক না হয়, তবে এই শ্লোগান দিয়ে আর যাই ঘুচুক, সাম্প্রদায়িকতা ঘুচবে না।

     

    ৮গ.

    হায়দারের বাড়ি ঘুরে এসেছে সুরঞ্জন। সে নেই। ভোলা গেছে। ভোলায় হিন্দুর দুর্দশা দেখতে গেছে। নিশ্চয়ই ফিরে এসে আহা উহু করবে। দশ জায়গায় বক্তৃতা করবে। লোকে বাহবা দেবে। বলবে—আওয়ামি লিগের কর্মীরা বড় দরদী। বড় অসাম্প্রদায়িক। সুতরাং হিন্দুর ভোটগুলো আর যায় কই! তার পাশের বাড়ির মায়ার প্রতি মায়া নেই। সে গেছে দূরের মায়াদের দেখতে।

    ছিপি খুলে গলায় ঢকচক করে কিছু ঢেলে নেয় সুরঞ্জন। অন্যদের তেমন আগ্রহ নেই খেতে। তবু সঙ্গ দিতে জল মিশিয়ে মুখে দেয়। খালি পেটে মদ পড়লে কেমন গুলিয়ে ওঠে সব।

    –বিকেলবেলাটা আমার খুব ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছে হত। মায়ারও ঘুরে বেড়াবার খুব শখ। একদিন শালবন বিহার নিয়ে যাব।

    –জানুয়ারির দু তারিখ থেকে ওলামা মাশায়েখদের লং মার্চ। বিরূপাক্ষ বলে।

    –কিসের লং মার্চ?

    –তারা হেঁটে হেঁটে ভারত যাবে বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের জন্য।

    –হিন্দুদের নেবে লং মার্চে? নিলে আমিও যাব। তোমরা যাবে কেউ? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

    সকলে নীরব। এ ওর মুখ চায়।

    দেবব্রত খানিকটা ধমকের সুরেই বলে—তুমি এত হিন্দু মুসলমান হিন্দু মুসলমান করছ কেন? তোমার হিন্দুত্বটা বেশি বেড়ে গেছে।

    –আচ্ছা দেবু, ছেলেদের সারকামশিসন করা না থাকলে বোঝা যায় সে হিন্দু। কিন্তু মেয়েদের হিন্দুত্ব বোঝার উপায় কি বল তো! ধর মায়া। মায়াকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় রাস্তায়। ধর ওর মুখ বাঁধা হাত পা বাঁধা। ও যে হিন্দু বুঝবে কি করে? ওর তো মুসলমানদের মতই দেখতে নাক চোখ মুখ, হাত পা মাথা।

    সুরঞ্জনের কথায় কোনও উত্তর না দিয়ে দেবব্রত বলে–জিয়াউর রহমানের সময় ফারাক্কার জলের জন্য রাজনৈতিক লং মার্চ হয়েছিল সীমান্ত পর্যন্ত। খালেদা জিয়ার আমলে তিরানব্বই সালে শুরু হবে বাবরি মসজিদ তৈরির জন্য সাম্প্রদায়িক লং মার্চের মধ্য দিয়ে। ফারাক্কার লং মার্চও যেমন জলের জন্য হয়নি, বাবরি মসজিদের লং মার্চও বাবরি মসজিদের পুননির্মাণের জন্য হবে না। আসলে বাবরি মসজিদ নিয়ে বাড়াবাড়ির উদ্দেশ্য রাজনৈতিকে সাম্প্রদায়িকতার পাওয়ার হাউজে পরিণত করা আর গোলাম আজম-বিরোধী আন্দোলন থেকে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে দেওয়া। এ সময় সরকারের এয়ার টাইট নীরবতাটাও লক্ষ করবার মত। এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, অথচ সরকার বলেই চলেছে, এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি আছে।

    এ সময় পুলক ঢেকে ঘরে। বলে-কি ব্যাপার দরজা খোলা রেখে বসে আছ?

    —দরজা খোলা, মদ খাচ্ছি, চিৎকার করছি। ভয়ের কি আছে, মরে গেলে মরে যাব। তুমি বেরোলে যে বাইরে!

    —পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত। তাই বেরোতে সাহস পেলাম।

    –আবার অশান্ত হলে দরজায় খিল এটে বসবে, তাই না? সুরঞ্জন শব্দ করে হেসে ওঠে।

    পুলক অবাক হয় সুরঞ্জনের মদ্যপান দেখে। সে ভয়ে ভয়ে স্কুটারে গা লুকিয়ে এসেছে। দেশের পরিস্থিতি কী ভয়াবহ। আর সুরঞ্জনের মত রাজনীতি সচেতন ছেলে ঘরে বসে হাসছে, মদ খাচ্ছে। এই দৃশ্যটি সে কল্পনা করতে পারে না। সুরঞ্জন হঠাৎ এমন বদলে গেল কেন?

    সুরঞ্জন গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলে–গোলাম আজম গোলাম আজম গোলাম আজম। গোলাম আজম দিয়ে আমার কি? আমার.কী লাভ গোলাম আজমের শাস্তি হলে? তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আমি কোনও উৎসাহ পাই না। মায়ার আবার ঘৃণায় গা রি রি করে। নাম শুনলে বমি করে। মুক্তিযুদ্ধে আমার দুই জ্ঞাতি কাকা আর তিন মামাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি বুঝি না বাবাকে কেন বাঁচিয়ে দিয়েছিল ওরা। সম্ভবত স্বাধীনতার মজা ভোগ করতে। এখন ভোগ করছে না? বউ ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বাধীনতার রোদ পোহাচ্ছে না ডক্টর সুধাময় দত্ত?

    মেঝোয় পা ছড়িয়ে বসেছে সুরঞ্জন। পুলকও বসে। ধুলো ভরা ঘর, ভাঙা চেয়ার। বইপত্র ছড়ানো। সারা ঘরে সিগারেটের ছাই। ঘরের কোণে একটি আলমারি, ভাঙা। সুরঞ্জনের যে মেজাজ, মদ খেয়ে খেয়ে বোধহয় ভেঙেছে সব। বাড়ি এত নিঝুম, আর কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

    —একরাম হোসেন ভোলায় গিয়েছিল। ফিরে বলল ভোলার পুলিশ, প্রশাসন, বি এন পি-র লোক বলছে ভোলার ঘটনা নাকি বাবরি মসজিদ ভাঙার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, মানে স্পনটেনিয়াস ব্যাপার, এগুলো নাকি লুটেরাদের কাজ, আর কিছু নয়। হিন্দু উচ্ছেদ অভিযানের ফলে গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। বাতাসে পোড়া গন্ধ শুধু। খড়ের গাদা, গোলাঘর কিছু বাদ যায়নি। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সব। ঘরের কাপড়চোপড়, জুতো, কাঁথা-বালিশ থেকে শুরু তেলের শিশি, এমন কি ঘরের ঝাড়ু পর্যন্ত লুট করে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে ধানক্ষেত, নারকেলের বাগান, ছেলেদের পরনের লুঙ্গিও জোর করে খুলে নিয়েছে। মেয়েদের যাকে পেয়েছে ধর্ষণ করেছে, শাড়ি অলঙ্কার জোর করে খুলে নিয়েছে। ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিল হিন্দুল্লা। শম্ভুপুর খাসেরহাট স্কুলের টিচার নিকুঞ্জ দত্তকে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় টাকার জন্য মারধোর করে। নিকুঞ্জ দত্ত সম্ভবত মারা যাকেন। ভোলায় শ্লোগান দিয়েছে, হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, বাংলা ছেড়ে ভারত যাও। হিন্দুদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে কবে যাবি, ‘কোিট গরুকে দিয়ে খাওয়াব। বিত্তবান হিন্দুদের অবস্থাও একই রকম। তাদেরও কিছু নেই, পুড়ে ছাই সব। তারা এখন নারকেলের মালায় জল খাচ্ছে, কলাপাতায় ভাত খাচ্ছে তাও সাহায্যের চাল। দিনে একবার শাকপাতা, কচুঘেঁচু রান্না করে খাচ্ছে। স্বামী সামনে স্ত্রী, বাবার সামনে মেয়েকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে। মা আর মেয়েয়েকে একই সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। অনেকে খোলাখুলি বলছে–ভিক্ষে করব, তবু এখানে আর না।’ সাহায্য নিয়ে যারা যাচ্ছে, তাদের কেউ কেউ মুখ ফুটেই বলে—’সাহায্য লাগবে না। আমাদের পার করে দিন, আমরা চলে যাই।’ শম্ভুপুর গোলপুরে হামলা করেছে এম এ বাছেত আর সিরাজ পাটোয়ারি, এরা আগে শিবিরের নেতা ছিল এখন বি এন পি করে। লর্ড হার্ডিঞ্জের একটি হিন্দু বাড়িও নাকি নেই যে পোড়া হয়নি। প্রিয়ালালবাবু ছিলেন ফ্রিডম ফাইটার। তাঁর বাড়িতেও অত্যাচার হয়। তাঁদের গ্রামে হামলা করেছে আওয়ামি লিগ নেতা আবদুল কাদের চেয়ারম্যান, বেলায়েত হোসেন। বাবুল দাসের তিনটি পাওয়ার টিলার পুড়ে গেছে। একরাম তাঁর ভবিষ্যৎ কি জানতে চাইলে নাকি কান্নায় ভেঙে পড়েন, বলেন, সময় পেলে চলে যাব। পুলক হয়ত বলতেই থাকত। সুরঞ্জন তাকে ধমকে থামায়। বলে—শাট আপ। আর একটিও কথা না। আর একটি কথা বল তো চাবকাবো তোমাকে।

    পুলক প্রথম ঘাবড়ে যায় সুরঞ্জনের ধমকে। সে বুঝে পায় না সুরঞ্জন এমন অস্বাভাবিক আচরন করছে কেন। মদের ঝোঁকে? হতে পারে। দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে সে শুকনো ঠোঁটে হাসে।

    অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না। সুরঞ্জনের গ্লাস দ্রুত শেষ হতে থাকে। সে মদে অভ্যস্ত নয়। হঠাৎ হঠাৎ কারও বাড়ির আসরে পান করে। তাও অল্প। আজ তার ইচ্ছে করছে কয়েক বোতল এক ঢেকে খেয়ে ফেলতে। পুলককে থামিয়ে দেবার পর হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবেশ। স্তব্ধতার মধ্য থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে সুরঞ্জন। পুলকের কাঁধে মাথা রেখে চিৎকার করে কাঁদে। পুলিকের কাঁধ থেকে ওর মাথা গড়িয়ে মেঝেয় নামে। টিমটিমে আলো জ্বলছে ঘরে, মদের গন্ধ, আর বুক-ফাটা সুরঞ্জনের কান্না শুনে ঘরের হতবাক মানুষগুলো আরও কাঠ হয়ে থাকে আশঙ্কায়। পরনে ওর গত রাতের পরা শার্ট প্যান্ট, আর পাল্টানো হয়নি। স্নান নেই, খাওয়া নেই। ধুলোভরা শরীর। ওই ধুলোর শরীরে আরও ধূলোয় গড়াতে গড়াতে সুরঞ্জন বলে—মায়াকে ওরা কাল রাতে ধরে নিয়ে গেছে।

    —কি বললে? চমকে ফেরে সুরঞ্জনের দিকে পুলক। একই সঙ্গে দেবব্রত, নয়ন, বিরূপাক্ষ।

    রঞ্জনের গায়ে তখনও কান্নার দমক। মদ মদের মত পড়ে থাকে। গ্লাস উল্টে থাকে। না খাওয়া গ্লাসের মদগুলো গড়িয়ে পড়ে মেঝোয়। মায়া নেই–এই শব্দদ্বয়ের কাছে আর সব তুচ্ছ হয়ে যায়। কেউ কোনও কথা খুঁজে পায় না। এর তো এরকম কোনও সান্ত্বনা নেই যে অসুখ হয়েছে, ভেবো না সেরে যাবে।

    ঘর যখন স্তব্ধতার জলে নিমজ্জিত তখন বেলাল ঢোকে। ঘরে। সে ঘরের পরিবেশটি লক্ষ করে। সুরঞ্জনের মেঝোয় পড়ে থাকা শরীরটি ছুঁয়ে বলে—সুরঞ্জন, মায়াকে নাকি ধরে নিয়া গেছে?

    সুরঞ্জন মুখ তোলে না।

    —জি ডি এন্ট্রি করা হয়েছে?

    সুরঞ্জন তবুও মুখ তোলে না। বেলাল আর সবার দিকে তাকিয়ে উত্তরের আশা করে। কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানে না ইঙ্গিতে জানায়।

    —কোনও খোঁজখবর করেছি, কারা নিয়েছে?

    সুরঞ্জন এবারও মুখ তোলে না। বেলাল বিছানায় বসে। সিগারেট ধরায়। বলে—কি যে শুরু হয়েছে চারদিকে। গুণ্ডা বদমাশরা ভাল একটা সুযোগ পেয়েছে। ওদিকে ইন্ডিয়ায় তো ‘আমাদের’ সমানে মারছে।

    —আপনাদের মানে? বিরূপাক্ষ জিজ্ঞেস করে।

    —মুসলমানদের। বি জে পি তো কচু-কাঁটা করছে।

    –ও।

    –ওদিককার খবর শুনে এদেরও মাথার ঠিক নেই। দোষ কাকে দেব। ওখানে ‘আমরা’ মরছি। এখানে ‘তোমরা’। কী দরকার ছিল মসজিদটাি ভাঙার। এত বছরের পুরনো মসজিদ। মহাকাব্যের চরিত্র রামের আঁতুড় ঘর খুঁজতে মসজিদ খুঁড়ছে ইন্ডিয়ানরা। কদিন পর বলবে তাজমহলে হনুমানের জন্ম হয়েছিল, সুতরাং তাজমহল ভাঙো। ব্যস ভেঙে ফেলবে। ভারতে নাকি সেকুলারিজমের চর্চা হয়! মায়াকে আজ ধরে নিচ্ছে কেন? মূল নায়ক তো আদভানি, যোশী। মেটিয়াবুরুজের অবস্থা শুনেছি ভয়াবহ।

    সুরঞ্জন বেওয়ারিশ লাশের মত পড়ে থাকে মেঝেয়। ওঘর থেকে কিরণময়ীর কান্নার শব্দ, সুধাময়ের অস্ফুট গোঙানো বেলালের দুঃখকে ম্লান করে দেয়।

    —মায়া নিশ্চয় ফিরে আসবে। ওরা তো আর জলজ্যান্তু মেয়েটিকে খেয়ে ফেলবে না। ককিমাকে বল ধৈর্য ধরতে। আর তুমিই বা মেয়েমানুষের মত এমন কাঁদাছ কেন? কেঁদে সমস্যার সমাধান হবে? আর আপনারাই বা বসে আছেন কেন?’ মেয়েটা গেল কই খোঁজখবর তো করতে পারেন।

    বিরূপাক্ষ বলে–আমরা তো এইমাত্রই খবরটা জানলাম। কাউকে ধরে নিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়? আর কোথায় বা খুঁজব।

    —নিশ্চয় গাঁজা হেরোইন খায়, পাড়ারই হবে। চোখ পড়েছে মেয়ের দিকে। তাই চান্স পেয়েছে, ধরে নিয়ে গেছে। ভাল লোকেরা এসব করে? আজকালকার উঠতি ছেলেপেলেরা কী সব যাচ্ছেতাই কাণ্ড করছে। মূল কারণ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বুঝলেন?

    বিরূপাক্ষ মাথা নীচু করে। এদের কারও সঙ্গে বেলালের আলাপ নেই। বেলাল উত্তেজিত, পকেট থেকে বেনসন আর লাইটার বের করে। সিগারেটটি হাতেই থাকে তার ৷ বলে—মদ কোনও সমাধান হল? আপনারাই বলুন, মদ কোনও সমাধান? এ দেশে কখনও বড় কোনও দাঙ্গা হয়েছে? এসব তো দাঙ্গা নয়। মিষ্টি খাবার লোভে ছেলেরা মিষ্টির দোকান লুট করে। ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার নাকি ছয় হাজার দাঙ্গা হয়েছে। হাজার হাজার মুসলমান মারা গেছে। এখানে কটা হিন্দু মারা গেছে? প্রতিটি হিন্দু এলাকায় ট্রাক ভর্তি পুলিশ দেওয়া হয়েছে।

    কেউ কোনও কথা বলে না। সুরঞ্জনও না। সুরঞ্জনের কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তার ঘুম পায় খুব। বেলাল সিগারেটটি ধরায় না। কাছেই কোথাও তার কাজ আছে বলে চলে যায়। এক এক করে অন্যরাও চলে যায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন
    Next Article দাবিদার – তারক রায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.