Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লজ্জা – তসলিমা নাসরিন

    তসলিমা নাসরিন এক পাতা গল্প277 Mins Read0

    লজ্জা (০২) সুরঞ্জনের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি

    ০২ক .

    সুরঞ্জনের বন্ধুদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। অবশ্য ওদের মুসলমান বলাওঁ ঠিক নয়। ওরা ধর্মন্টর্ম তেমন মানে না। আর মানলেও সুরঞ্জনকে কাছের মানুষ ভাবতে ওরা কোনও দ্বিধা করেনি। কামাল তো গত বছর বাড়িসুদ্ধ নিয়ে গেল নিজের বাড়িতে। পুলক, কাজল, অসীম, জয়দেবও সুরঞ্জনের বন্ধু কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বেশি কামাল, হায়দার, বেলাল বা রবিউলের সঙ্গে। সুরঞ্জনের যে কোনও বিপদে কাজল অসীমের চেয়ে কাছে এসেছে হায়দার কামাল বেলালই। সুধাময়কে একবার সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি করবার প্রয়োজন পড়েছিল, রাত দেড়টা বাজে তখন। হরিপদ ডাক্তার বললেন, ‘মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান, এক্ষুনি হাসপাতালে নাও।‘ সুরঞ্জন কাজলকে খবরটি জানালে কাজল হাই তুলে বলল, ‘এত রাতে কি করে শিফট করবে, সকাল হোক, একটা ব্যবস্থা করা যাবে।‘  অথচ খবরটি জানবার পরই গাড়ি নিয়ে ছুটে এল বেলাল। নিজে দৌড়াদৌড়ি করে ভর্তি করাল, বারবার সুধাময়কে বলল, ‘কাকাবাবু, আপনি একটুও দুশ্চিন্তা করবেন না, আমাকে আপনি নিজের ছেলেই মনে করবেন।’ সুরঞ্জনের মন ভরে গেছে দেখে। যতদিন হাসপাতালে ছিলেন সুধাময়, বেলাল খোঁজ নিয়েছে, চেনা ডাত্মারদের বলে এসেছে কেয়ার নিতে, সময় পেলেই দেখতে গিয়েছে, হাসপাতালে যাওয়া আশর জন্য গাড়ি দিয়েছে। কে করে এত? পয়সা তো কাজলেরও আছে, সে কি এমন হৃদঙ্গবন হতে পারে সুরঞ্জনের জন্য? চিকিৎসার খরচ প্রায় পুরোটাই দিয়েছে। রবিউল। একদিন টিকাটুলির বাড়িতে হঠাৎ উপস্থিত রবিউল, বলল, ‘তোর বাবা নাকি হাসপাতালে?’ সুরঞ্জন হ্যাঁ না কিছু বলবার আগেই টেবিলের ওপর একটি খাম রেখে রবিটল বলল, ‘এত পর ভাবিস না বন্ধুদের।’ বলে যেমন দমকা এসেছিল, দমকা চলেণ্ড গেল। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে পাঁচ হাজার টাকা। কেবল সাহায্য করে বলে নয়, ওদের সঙ্গে মনে ও মননেও বড় মেলে তার। রবিউল কামাল হায়দারকে যত আপন করে পেয়েছে সুরঞ্জন, অসীম কাজল জয়দেবকে ততটা পায়নি। শুধু তা-ই নয় পারভিনকে সে যতন্ত্র ভালবেসেছিল, সুরঞ্জনের বিশ্বাস হয় না কোনও অর্চনা, দীপ্তি, গীতা বা সুনন্দাকে সে ততটা ভালবাসতে পারবে।

    সম্প্রদায়ের ভেদ সুরঞ্জন নিজে কখনও করতে শেখেনি। ছোটবেলায় সে জানোতই না যে সে হিন্দু। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে পড়ে, খ্রি-ফোরে হবে হয়ত, খালেদ নামের এক ছাত্রের সঙ্গে ক্লাসের পড়া নিয়ে তার খুব তর্ক হচ্ছিল। তর্ক একসময় তুঙ্গে উঠলে খালেদ তাকে গাল দেয়। কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, হারামজাদা এমন গাল। উল্টে সুরঞ্জনও খালেদকে গাল ফিরিয়ে দিচ্ছিল। খালেদ বলে ‘কুকুরের বাচ্চা, সুরঞ্জনও বলে ‘তুই কুকুরের বাচ্চা’। ‘ খালেদ বলে ‘হিন্দু।’ সুরঞ্জন পাল্ট বলে ‘তুই হিন্দু ৷ ‘ সে ভেবেছিল কুকুরের বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চার মত হিন্দুও এক ধরনের গাল। সে অনেককাল ভেবেছিল হিন্দু বোধহয় তুচ্ছাৰ্থে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত কোনও শব্দ। পরে আরও বড় হয়ে সুরঞ্জন বুঝেছে হিন্দু একটি সম্প্রদায়ের নাম এবং সে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। আরও পরে তার যে বোধ জন্ম নিয়েছে তা হল সে আসলে মানব সম্প্রদায়ের মানুষ এবং সে জাতিতে বাঙালি। কোনও ধর্ম এই জাতিকে তৈরি করেনি। বাঙালিকে সে অসাম্প্রদায়িক এবং সমাজয়বাদী জাতি হিসেবেই মানতে চায়। বাঙালি শব্দটি একটি বিভাজন বিরোধী শব্দ এর কথা সে বিশ্বাস করে। কিন্তু স্বধৰ্মীয় বিদেশিকে আপনি এবং অন্য ধমাবলম্বীকে পরজাতি বলে বাঙালি বারবারই মনে করছে, এই বিভ্ৰান্তিকর ধারণা, বোধ, বিশ্বাস বাঙালিকে হিন্দু মুসলমানে বিভক্ত করেছে।

    আজি ডিসেম্বরের আট তারিখ। সারাদেশে হরতাল। হরতাল ডেকেছে৷ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মাঝখান থেকে জামাতে ইসলামি জানায় তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছে। হরতাল হচ্ছে, সুরঞ্জন আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়ে, একবার ঘুরে আসা যাক। প্রিয় শহরটির মুখ দেখে না। সে আজ দু দিন। ওঘরে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন। কিরণময়ী। সুধাময়ের মনে কোনও শঙ্কা আছে কি না। সুরঞ্জন ঠিক বুঝতে পাত্রে না। বাড়িতে এবার সে জানিয়ে দিয়েছে কোথাও যাবে না লুকোতে। মরলে মরে যাবে। মুসলমানেরা যদি বাড়ির সবাইকে কেটে রেখে চলে যায়, যাবে। তৰু বাড়ি থেকে এক পা-ও নড়বে না। সুরঞ্জন। মায়া নিজ দায়িত্বে গেছে, যাক। বাঁচবার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে মুসলমানের ঘরে সে আশ্রয় নিয়েছে। দুই-একজন পারুল রিফাতের ছাতার তলে সে প্রাণ বাঁচাতে চাইছে। বেচারা মায়া।

    দুদিন টানা শুয়ে থেকে সুরঞ্জন যখন বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়, দেখে কিরণময়ী চমকে উঠে বলেন–কোথায় যাচ্ছিস?

    —দেখি শহরের অবস্থা কী। হরতাল কেমন হচ্ছে দেখে আসি।

    —বাইরে যাস নে সুরো। কী হয় বলা যায় না।

    —যা হয় হবে। মরতে তো একদিন হবেই। আর এত ভয় পেও না তো। তোমাদের ভয় দেখলে আমার রাগ ধরে। চুলে সিঁথি কাটতে কাটতে সুরঞ্জন বলে।

    কিরণময়ী কেঁপে ওঠেন। তিনি ছুটে এসে সুরঞ্জনের হাত থেকে চিরুনি কেড়ে নেন। –কথা শোন সুরঞ্জন। একটু সাবধান হ। হরতালের মধ্যেই শুনছি দোকান ভাঙছে, মন্দির পোড়াচ্ছে। ঘরে বসে থাক। শহরের অবস্থা দেখার কোনও দরকার নেই।

    সুরঞ্জন চিরকালের অবাধ্য ছেলে। সে কিরণময়ীর কথা মানবে কেন? বাধা ডিঙিয়ে চলে যায় সে। বাইরের ঘরে সুধাময় একা বসেছিলেন। তিনিও অবাক তাকিয়ে থাকেন। ছেলের চলে যাওয়ার দিকে। ঘরের বাইরে বেরোতেই বিকেলের স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে খাঁ খাঁ নির্জনতা আর ভূতুড়ে স্তব্ধতা তার গায়ে বেঁধে। একটু কি ভয় ভয় লাগে তার!! লাগেই মনে হয়। তবু সুরঞ্জন ভেবেছে যখন আজ সে শহর ঘুরবে, ঘুরবেই। এবার তাদের নিতে বা দেখতে কেউ আসেনি। না বেলাল, কামাল, না কেউ। ওরা এলেও সুরঞ্জন যেত না, যাবে কেন? ক’দিন পর পরই হামলা হবে। আর তল্পিতল্পা সহ ছোটাছুটি, ছিঃ! নেহাত গর্দভ ছিল বলে গত বছর গিয়েছিল কামালের বাড়িতে। এবার এলে দিব্যি সে বলে বসন্ত ‘তোমরা মারবেও আবার দয়াও করবে, এ কেমন কথা। তার চেয়ে সকলে মিলে একটি কাজ কর। যত হিন্দু আছে দেশে, ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে গুলি করে মারো। মরে গেলে তোমাদের ঝামেলা চুকবে। মারতেও হবে না, আবার কায়দা করে বাঁচাতেও হবে না।’ সুরঞ্জন রাস্তায় উঠতেই একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, চেচিয়ে ওঠে ‘ধর ধর, হিন্দু ধর বলে। এই ছেলেগুলো পাড়ারই। বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে সাত বছর এদের দেখছে সে। সুরঞ্জন চেনেও দু-একজনকে। আলম নামের ছেলেটি প্রায়ই আসে। চাঁদা চাইতে। পাড়ায় একটি ক্লাব আছে। এদের। ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় সুরঞ্জন গানও গায়। কিছু ছেলেকে ডি এল রায় আর হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান শেখাবে ভেবেছিল সে। এরা প্রায়ই দাদা এটা করে দিন ওটা শিখিয়ে দিন বলে কাজে-অকাজে বাড়িতে ভিড় করে। এদেরই পাড়ার লোক বলে সুধাময় ফ্রি চিকিৎসা করছেন দীর্ঘদিন। আর এরাই ওই যে হিন্দু যায়, হিন্দু ধর’ বলে সুরঞ্জনকে ধরে পেটাবার ইঙ্গিত করে। সুরঞ্জন উল্টো পথে দ্রুত হেঁটে যায়, ভয়ে নয়, লজ্জায়; পাড়ার এই চেনা ছেলেগুলো তাকে ধরে পেটাবে ভাবলে নিজেরই লজ্জা হয়। নিজে মারি খাচ্ছে সে কারণে নয়, লজ্জা যারা পেটাবে তাদের জন্যই। লজ্জা বুঝি অত্যাচারিতের জন্য হয়, লজ্জা তো হয় অত্যাচারীর জন্য, দুৰ্বত্তের জন্য।

    সুরঞ্জন হাঁটতে হাঁটতে শাপলা চত্বরের কাছে এসে থামে। থমথমে চারদিক। কোথাও কোথাও মানুষের জটিল। রাস্তায় ইটের টুকরো, পোড়া কাঠ, ভাঙা কাচ ছড়ানো, বোঝা হ্যায় এইমাত্র ভীষণ এক তাণ্ডব ঘটে গেছে। দু-একজন যুবক এদিক-ওদিক দৌড়োচ্ছে। কিছু নেড়ি কুকুর মধ্য রাস্তা বরাবর ছুটছে। টিংটিং বেল বাজিয়ে সামান্য কটি রিক্সা চলে যাচ্ছে ডানে বাঁয়ে। সে কিছু বুঝতে পারছে না কোথায় কী ঘটেছে। কুকুরগুলোর কীের্ণ ভয় নেই। জাতের ভয় নেই। তারা যে দৌড়োচ্ছে, সুরঞ্জন অনুমান করে খালি রাষ্ট্ৰী পাওয়ার আনন্দেই দৌড়োচ্ছে। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে দৌড়োতে। মতিঝিলের ব্যস্ত রাস্তা এতদিনে খালি পেয়ে সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে ছোটবেলার মত জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল শোিণত, অথবা খড়ির স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট। এরকম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখে পড়ে বাঁকে একটি ঘর পোড়া। সাইনবোর্ড দরজা জানোলা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটি ইপিন এয়ারলাইনসেক্স অফিস। কিছু লোক পােড়া অফিসটি দেখছে দাঁড়িয়ে, হাসছে। সুরঙ্গসুন্দর দিকে কেউ কি লুকুঁচকে তাকায়, সন্দেহ হয়। দ্রুত হাঁটে সে সামনের দিকে, ফে এইসব ঘরবাড়ি পুড়ে যাক, তার কী? সামনে সে দেখতে যাচ্ছে আর কী কী পুড়েছে, আৰু কি পোড়া পেট্রোলের মত পােড়া ইট কাঠের ভ্রাণ নিতে অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে। হবে হয়?। হাঁটতে হাঁটতে সে সি পি বি অফিসের সামনে দেখে মানুষের ভিড়। রাস্তায় ইট পাটকলের ছড়াছড়ি। ফুটপাতে বই-এর দোকান ছিল। সূরঞ্জন এই ফুটপাত থেকে প্রচুর বই কনেছে। আধাপোড়া একটি বই সুরঞ্জনের পায়ে ঠেকে, ম্যাক্সিম গোর্কির মা। মুহূর্তে মনে হয়। সে পাভেল ভলািসভ। আর সে তার মায়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে পায়ের নীচে পিন্ধই। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে সুরঞ্জনের। থমকে দাঁড়িয়ে থাকে পোড়া বইটির সামল। চারদিকে জটলা, ফিসফিস কথা, চরম উত্তেজনা পুরো এলাকায়। কী হয়েছে, কী হবে এসব নিয়ে কথা বলছে সবাই। সি পি বি অফিসটি পোড়া। কমিউনিস্টরা তাদের স্ত্র্যাটেজি চেঞ্জ করে আল্লাহ খোদার নাম নিচ্ছে, তারপরও রেহাই পেল না। আগুন থেকে? কমরেড ফরহাদ মারা গেলে বড় জানাজা হল, মিলাদও হল, তারপরও সাম্প্রদায়িকতার আগুন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস পোড়ায়! পোড়া অফিস্টর দিকে নির্বক তাকিয়ে থাকে সুরঞ্জন। হঠাৎ সামনে পড়ে কায়সার। উড়েইগড়া চুল। শেভ না করা গাল, রক্তাভ কনজাংটিভা, কণ্ঠে উদ্বেগ তার, বলে—তুমি বেরিয়েছ কেন?

    —আমার কি বেরোতে মানা? সুরঞ্জন পাল্টা প্রশ্ন করে।

    —মানা নেই। তবু জানোয়ারগুলোকে তো বিশ্বাস নেই। এরা যে এত ধর্ম ধর্ম করে, আসলে কি কোনও ধর্ম মানে, বল?? জামাত শিবির যুব কমান্ডের সন্ত্রাসীরা গতকাল দুপুরে এসব করেছে। পার্টি অফিস, ফুটপাতের বইয়ের দোকান, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের অফিস পুড়িয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো তাকে তক্কে থাকে কোথাও একটা ইস্যু তাদের ফেভারে নিয়ে চিৎকার করতে। যেন তাদের উঁচু গলাটা সবাই শোনে।

    পাশাপাশি তোপখানার দিকে হাঁটতে থাকে দুজন। সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে—আর কোথায় কোথায় আগুন ধারালো ওরা?

    –চট্টগ্রামের তুলসীধাম, পঞ্চাননধাম, কৈবল্যধাম মন্দির ভেঙে গুড়ো করে দিয়েছে। মালিপাড়ী, শ্মশান মন্দির, কোরবানিগঞ্জ, কালীবাড়ি, চট্টেশ্বরী, বিষ্ণুমন্দির, হাজারিলেন, ফকিরগািড়া এলাকার সব মন্দির লুটপাট করে আগুন জেলে দিয়েছে। অবশ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিলও বেরিয়েছে।

    সুরঞ্জন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কায়সার ডান হাতে এলেচুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে—কাল শুধু মন্দির নয় মাঝিরঘাট জেলেপাড়ায় আগুন জ্বেলে দিয়েছে। অন্তত পঞ্চাশটি ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

    —আর? সুরঞ্জন নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

    —জয়দেবপুরের মাধব মন্দির আর দুর্গ মন্দিরে হামলা হয়েছে। শেরপুরের কৃষি সেন্টারে অন্নপূর্ণ মন্দির, শেরিঘাট আশ্রমের কালী মন্দির ধ্বংস করে দিয়েছে। ফরিদপুরে রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরগুলো লুট হয়েছে। মহারাজা আর তার ছাত্ররা সিরিয়াসলি ইনজিউরড।

    —আর? সুরঞ্জনের উদাসীন স্বর।

    -নরসিংদিতে চালাকচড় আর মনোহরাদির বাড়ি আর মন্দিরগুলো ভেঙে ফেলেছে। নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ থানার মর্যাপাড়া বাজারের মন্দির ধ্বংস করেছে। কুমিল্লার পুরনো অভয় আশ্রমটি জ্বলিয়ে দিয়েছে। আর নোয়াখালিতেও জঘন্য সব কাণ্ড করেছে।

    —কি রকম?

    —সুধারাম থানার অধর চাঁদ আশ্রম আর সাতটা হিন্দুর বাড়ি জ্বলিয়ে দিয়েছে। গঙ্গাপুর গ্রামে যত হিন্দু বাড়ি ছিল, প্রথম লুট করেছে, পরে পুড়িয়ে দিয়েছে। সোনাপুরের শিব-কালী মন্দির আর বিনোদপুর আখড়া ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনির কালীমন্দির, দুৰ্গাপুরের দুৰ্গর্বিাড়ি মন্দির, কুতুবপুর আর গোপালপুরের মন্দির ভেঙেছে। ডাঃ পি কে সিংহের ওষুধের ফ্যাক্টরি, আখন্দ আশ্রম, ছয়আনি এলাকার মন্দিরগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। চৌমুহনি বাবুপুর, তেতুইয়া, মেহদিপুর, রাজগঞ্জ বাজার, টঙ্গিরপাড়, কাজিরহাট, রসুলপুর, জমিদারহাট, পোতাবাড়ির দশটি মন্দির আর আঠারোটি হিন্দু বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। একটি দোকান, একটি গাড়ি, একটি মহিলাও পুড়েছে। ভাবর্দির সতেরোটি বাড়ির মধ্যে তেরোটি বাড়িই পুড়ে গেছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়ির মেয়েরা নিৰ্য্যতিত হয়েছে। বিপ্লব ভৌমিক স্টেবডি। গতকাল বিরাহিমপুরের সবকটি বাড়ি এবং মন্দির আক্রান্ত হয়েছে। জগন্নাথ মন্দির, চরহাজারি গ্রামের তিনটি দোকান, ক্লাব লুট করেছে, ভেঙেছে। চরপার্বতী গ্রামের দুটো বাড়ি, দাসের হাটের একটি বাড়ি, চরকুকরি আর মুছাপুরের দুটো মন্দির, জয়কালী মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। পিরোজপুরের প্রতিটি মানুষ মার খেয়েছে, প্রতিটি বাড়ি লুট হয়েছে, বাড়িগুলো শেষে পোড়ানোও হয়েছে।

    –ও।

    সুরঞ্জন আর কোনও শব্দ উচ্চারণ করতে চায় না। ছোটবেলার মত রাস্তার যে কোনও ইট বা পাথরের টুকরো পায়ে ছুড়ে ছুড়ে হাঁটতে ইচ্ছে করে তার। কায়সার আরও কী কী সব বলে, আরও মন্দির পোড়ানো, আরও বাড়িঘর লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। সুরঞ্জন সব শোনেও না। তার শুনতে ইচ্ছেও করে না। প্রেস ক্লাবের সামনে দুজনই দাঁড়ায়। সাংবাদিকদের জটলা, গুঞ্জন দু চোখ ভরে দেখে সে। শোনেও কিছু। কেউ বলছে-ভারতে এ পর্যন্ত দুশর ওপর লোক দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। আহত কয়েক হাজার। আর এস এস, শিবসেনাসহ মৌলবাদী দলগুলো নিষিদ্ধ, লোকসভায় বিরোধী নেতার পদ থেকে আদভানি পদত্যাগ করেছে। কেউ বলছে-চট্টগ্রামে, নন্দনকানন তুলসীধামের এক সেবক দীপক ঘোষ পালিয়ে যাবার সময় জামাতিরা তাকে ধরে জ্বলিয়ে দেবার চেষ্টা করে। পাশে কয়েকজন দারোয়ান ছিল, ওরা দীপককে মুসলমান পরিচয় দিলে জামাতিরা দীপককে মারধোর করে ছেড়ে দেয়।

    সুরঞ্জনকে পরিচিত যারাই দেখে চমকে ওঠে। বলে—কী ব্যাপার তুমি বাইরে বেরিয়েছ যে! বিপদ হতে পারে। বাড়ি চলে যাও।

    সুরঞ্জন কোনও উত্তর করে না। বড় অপ্রতিভা লাগে নিজেকে। তার নাম সুরঞ্জন দত্ত বলে তাকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে। আর কায়সার, লতিফ, বেলাল, শাহীন এরা বাইরে বেরোবে, কোথায় কী হচ্ছে। এ নিয়ে আলোচনা করবে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মিছিলও করবে। কিন্তু সুরঞ্জনকে বলবে বাড়ি চলে যাও, এ কেমন কথা? সুরঞ্জন কি ওদের মতই বিবেকবান, মুক্তবুদ্ধির, যুক্তিবাদী মনের মানুষ নয়? দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে উদাসীন, সিগারেটের দোকান থেকে এক কাঠি বাংলা ফাইভ কেনে, আগুনমুখো দড়ি থেকে সিগারেট ধরায়। নিজেকে বড় বিচ্ছিন্ন বোধ করে সুরঞ্জন। এত লোক চারদিকে, অনেকেই চেনা, কেউ কেউ ঘনিষ্ঠও, তবু এক লাগে তাঁর। যেন এই যে এত মানুষ হাঁটছে, কথা বলছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা আর সেইসূত্রে এ দেশের মন্দির ভাঙা নিয়ে উত্তপ্ত কথাবাত চলছে, এসব সুরঞ্জনের বিষয় নয়। সে মিশে যেতে চাইলেও পারছে না। কোথায় যেন একটা বাধা অনুভব করছে সে। সুরঞ্জন বুঝতে পারছে তাকে সকলেই আড়াল করছে, করুণা করছে, তাকে দলে টানছে না। সুরঞ্জন গাল ভরে ধোঁয়া নিয়ে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে দেয়। চারদিকে উত্তেজনা আর সে তার অলস শরীরের ভার দেওয়ালে ছেড়ে দেয়। অনেকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে সুরঞ্জনকে। বিস্মিত হয়। কারণ একটি ‘হিন্দু ও আজ ঘরের বার হয়নি। ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়েছে সব। আর সুরঞ্জনের সাহস বা স্পধর্ম দেখে লোকে অবাক হবেই বা না কেন!

    কায়সার একটি দলে ভিড়ে যায়। মিছিলের প্রস্তুতি চলছে। সাংবাদিকরা কাঁধে ঝোলা বা ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করছে। এদের মধ্যে লুৎফরকে দেখেও সুরঞ্জন ডাকে না। ও একসময় নিজেই এগিয়ে আসে। চোখ কপালে তুলে বলে-দাদা, আপনি এখানে কেন?

    —কেন থাকতে নেই?

    লুৎফরের চোখে মুখে চরম উৎকণ্ঠা। জিজ্ঞেস করে–বাড়িতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

    লুৎফরের কথায় এবং বলবার ভঙ্গিতে এক ধরনের অভিভাবকত্ব আছে। সুরঞ্জন টের পায়। এই ছেলেটি মুখচোরা স্বভাবের ছিল। তার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও কথা বলেনি এমনই বিনত, লাজুক, ভদ্র। ছেলেটিকে সুরঞ্জনই ‘একতা’ পত্রিকার সম্পাদককে বলে-কয়ে চাকরি নিয়ে দিয়েছিল। লুৎফর একটি বেনসন ধরায়। সুরঞ্জনের খুব কাছে সরে এসে বলে—সুরঞ্জনদা, অসুবিধে হয়েছে কোনও?

    সুরঞ্জন হেসে জিজ্ঞেস করে–কি অসুবিধে?

    লুৎফর একটু অপ্রস্তুত হয়। বলে—কী আর বলব দাদা। দেশের যা অবস্থা…

    সুরঞ্জন তার সিগারেটটির ফিল্টারটুকু নীচে ফেলে পায়ে পিষতে থাকে। লুৎফর তার সঙ্গে সব সময় নীচু কণ্ঠে কথা বলত, আজি কণ্ঠটা তার উঁচুই মনে হয়। ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়ে, কপাল কুঁচকে তাকায় তার দিকে, বলে—দাদা, আজ বরং আপনি অন্য কোথাও থাকুন। বাড়িতে থাকাটা ঠিক হবে না। আচ্ছা আশেপাশের কোনও মুসলমানের বাড়িতে অন্তত দুটো রাতে থাকার ব্যবস্থা করা যায় না?

    সুরঞ্জনের কণ্ঠে নির্লিপ্তি। সে দোকানের আগুনমুখে দড়িটির দিকে তাকিয়ে বলে—না।

    —না? লুৎফর চিন্তিত হয়। ওর ভাববার ভঙ্গিতেও অভিভাবকত্ব টের পায় সুরঞ্জন। সে বুঝে যায়, যে কেউই এখন এ ধরনের অভিভাবকত্ব দেখাবে। না চাইতেই আগ বাড়িয়ে উপদেশ দেবে। বাড়িতে থাকা ঠিক নয়, লুকিয়ে থাকে। ক’দিন বাড়ি থেকে বেরিও না। নাম পরিচয় বলো না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে না হয় বেরোও, এসব। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে আরও একটি সিগারেট ধরাতে। কিন্তু লুৎফরের গুরুগম্ভীর উপদেশ তার ইচ্ছেটিকে নষ্ট করে দেয়। শীত নেমেছে বেশ। সে হাতদুটো ভাঁজ করে -বুকের ওপর রেখে গাছের পাতার সবুজ-গাঢ় সবুজ রং দেখে। শীতকালটা সে সব সময়ই বেশ উপভোগ করে। সকালে গরম ভাপাপিঠে, রাতে গায়ের ওপর রোদে দেওয়া লেপ, মায়ের মুখে ভূতের গল্প-ভাবতেই এক ধরনের রোমাঞ্চ হয় সুরঞ্জনের। লুৎফরের সামনে –দাঁড়িয়ে একটি ঝোলা কাঁধের দাড়িঅলা যুবক নাগাড়ে বলে যায়-ঢাকেশ্বরী মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, মহাপ্রকাশ মঠ, নারিন্দা গৌড়ীয় মঠ, ভোলাগিরি আশ্রমে মিছিল করে গিয়ে লোকেরা ইট মারছে, লুট করছে। স্বামীবাগ আশ্রম লুট হয়েছে। শনির আখড়ার পচিশটি বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে দিয়েছে। শনির মন্দির, দুর্গ মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নারিন্দার ঋষিপাড়া আর দয়াগঞ্জের জেলেপাড়াও রক্ষা পায়নি। ফার্মগেট, পল্টন ও নবাবপুরে মরণচাঁদের মিষ্টির দোকান, টিকাটুলির দেশবন্ধু মিষ্টির দোকান লুট করেছে, ভেঙেছে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ঠাঁটারি বাজারের মন্দিরে আগুন লাগিয়েছে।

    লুৎফর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—আহা।

    সুরঞ্জন লুৎফরের দীর্ঘশ্বাসটি কান পেতে শোনে। সে ভেবে পায় না সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, মিছিলে যোগ দেবে, নাকি দূরে কোথাও চলে যাবে। আত্মীয়হীন বন্ধুহীন কোনও ঝাড় জঙ্গলে একা বসে থাকবে। ঝোলা কাঁধের যুবকটি সরে গিয়ে অন্য আডায় মিশে যায়। লুৎফরও চলে যাবার পাঁয়তারা করে। কারণ সুরঞ্জনের ভাবলেশহীন মুখ আতাকে স্বস্তি দিচ্ছে না মোটে।

    চাপা উত্তেজনা চারদিকে। সুরঞ্জনের ইচ্ছে করে দলের সঙ্গে মিশে যেতে। তার ইচ্ছে করে কোথায় কোথায় মন্দির ভাঙল, পুড়ল, কোথায় ঘরবাড়ি দোকান লুট হল এসব খবরে সেও অংশ নিক। সেও স্বতঃস্ফূর্ত বলুক—‘এই ধর্মবাদীদের চাবকে সোজা করা দরকার। <এই মুখোশধারী ধার্মিকেরা আসলে সবচেয়ে বড় প্রতারক।’ কিন্তু পারছে কই। তার —দিকে আড়াচোখে যারাই তাকাচ্ছে সকলের চোখ থেকেই করুণা ঝরছে, যেন তার এখানে শুথিাকা নিরাপদ নয়, যেন সে ঠিক এখানে দাঁড়াবার, ওদের মত উত্তেজিত হবার, ওদের সঙ্গে -মিছিল করবার যোগ্য লোক নয়। সে এতদিন ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে —মঞ্চে বা আড্ডায় তুখােড় তুখোড় কথা বলেছে, অথচ আজ তাকে একটি অদৃশ্য শক্তি বোবা করে রাখছে। কেউ বলছেও না, সুরঞ্জন কিছু বল, কিছু কর, রুখে দাঁড়াও।

    কায়সার জটলা ভেঙে সামনে আসে। ফিসফিস করে বলে, ‘বায়তুল মোকাররমে বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে মিটিং হবে, লোক জমছে, তুমি বাড়ি চলে যাও।‘

    —তুমি যাবে না? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।

    কায়সার বলে—আরে না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল করতে হবে না!

    কায়সারের পেছন লিটন আর মাহতাব বলে দুজন ছেলে ছিল। ওরাও বলে—আসলে আপনার ভালর জন্যই বলছি। শুনেছি জলখাবারও নাকি পুড়িয়ে দিয়েছে। আশেপাশেই ঘটছে ঘটনাগুলো। আপনাকে চিনতে পারলে কী হবে বলুন তো। ওরা হাতে ছুরি, লাঠি, রামদা নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরছে।

    কায়সার একটি রিক্সা ডাকে। রিক্সায় সুরঞ্জনকে তুলে দেবে সে। লুৎফর এগিয়ে এসে তার হাত ধরে টান দেয়, বলে–আসুন তো দাদা। সোজা বাড়ি যান। এ সময় কেন যে বাইরে বেরোলেন আপনি।

    সুরঞ্জনকে বাড়ি পাঠানোর জন্য অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাকে চেনে না। এমন দু-একজন ছুটে এসে জানতে চায় হয়েছে কী। ওরা বুঝিয়ে বলে ও হিন্দু, ওর এখানে থাকাটা ঠিক নয়। সকলে মাথা নেড়ে সায় দেয়, হ্যাঁ চলে যাওয়াই উচিত। কিন্তু সে তো ঘরে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে আসেনি। ওরা তার পিঠ আলতো খুঁয়ে, হাত টেনে রিক্সায় ওঠাতে যাবে আর তখনই সুরঞ্জন হাত ছাড়িয়ে নেয়। সে তার হাতখানা একটু হেঁচকাটানেই ছাড়ায়।

     

    ২খ.

    সুখময় সটান শুয়ে থাকতে চান, পারেন না। অস্থির লাগে। সুরঞ্জন আবার এ সময় বাইরে বেরিয়েছে। ও বেরোবার পর টুকটুক শব্দ হয় দরজায়। সুধাময় লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়েন। সূরঞ্জনই ফিরে এল। কিনা। না সুরো নয়, এসেছেন আখতারুজ্জামান। এ পাড়ায় বাড়ি তাঁর। রিটায়ার্ড অধ্যাপক। বয়স ষাটের ওপর। ঘরে ঢুকেই ছিটিকিনি আটকে দিলেন নিজ হাতে। ‘কী কিছু হয়নি তো?’ আখতারুজ্জামান প্রশ্ন করলেন চাঁপা স্বরে। ‘কইনা তো কি হবে? সুধাময় ঘরের বিছানা টেবিল বইপত্রর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়েন। আখতারুজ্জামান নিজেই চেয়ার টেনে বসেন। সারভাইক্যাল স্পনডিলাইটিসের রোগী। ঘাড় সোজা রেখে চোখের মণি নেড়ে বলেন-বাবরি মসজিদের অবস্থা তো জানেন? কিছু নেই। আর। ছিঃ ছিঃ।

    一হুঁ।

    —কিছু বলছেন না যে। সাপোর্ট করছেন?

    –সাপোর্ট করব কেন?

    —তবে যে বলছেন না কিছু?

    —খারাপ লোক খারাপ কাজ করেছে। দুঃখ করা ছাড়া আর কী বা করার আছে?

    -একটি সেকুলার রাষ্ট্রে যদি এই অবস্থা হয়। ছিঃ ছিঃ। সমস্ত রাষ্ট্ৰীয় পরিস্থিতি, সমস্ত রাজনৈতিক ঘোষণা, সুপ্রিম কোর্ট-লোকসভা-পর্টি, গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য-সবই আসলে ফাঁকা আওয়াজ। যাই বলুন সুধাবাবু, ভারতে যত দাঙ্গা হয়েছে, এ দেশে তুলনায় কিন্তু কিছুই হয়নি।

    –হুঁ। চৌষট্টির পর নব্বই–এই প্রথম বড় দাঙ্গা হল।

    —চৌষট্টি না বলে পঞ্চাশ বলাই ভাল। পঞ্চাশের পরে চৌষট্টিতে দাঙ্গা যা হয়েছিল, সবচেয়ে বড় দিক ছিল সাম্প্রদায়িকতার স্পনটেনিয়াস প্রতিরোধ, যেদিন দাঙ্গা শুরু হয়, সেদিনই মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরি আর আবদুস সালামের উদ্যোগে প্রতিটি পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যানার হেডিং ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। প্রতিবেশী এক হিন্দু পরিবারকে রক্ষা করতে যেয়ে পঞ্চান্ন বছর বয়সের আমীর হোসেন চৌধুরি প্রাণ দিলেন। আহা।

    সুধাময়ের বুকের ব্যথাটি বাড়ে। তিনি চৌকিতে গা এলিয়ে দেন। এক কাপ গরম চা খেতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু চা-টা দেবে কে? সুরঞ্জনের জন্য কিরণময়ী দুশ্চিন্তা করছেন। একা একা বাইরে গেল, গোলই যদি হায়দারের সঙ্গে গেলেই পারত। কিরণময়ীর দুশ্চিন্তাটি সুধাময়ের মধ্যেও সংক্রামিত হয়। সুরঞ্জনের আবেগ বরাবরই ঘন, তাকে ঘরে আটকে রাখা যায় না, সুধাময় তা জানেনও, তবু দুশ্চিন্তা তো এমন নয় যে তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা যায়। তিনি সেটিকে বুকের মধ্যে পুষে আখতারুজ্জামানের প্রসঙ্গে ফেরেন—শান্তিই নাকি সকল ধর্মের মূল গন্তব্য অথচ সেই ধর্মকে নিয়ে কত অশান্তি, কত রক্তপাত, মানুষের কত লাঞ্ছনা হতে পারে এই শতাব্দীর শেষে এসে তাও দেখতে হল। ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে মানুষ এবং মনুষ্যত্বকে যেভাবে গুড়িয়ে ফেলা যায় তেমন আর কোনও কিছু দিয়েই সম্ভব হয় না।

    আখতারুজ্জামান বলেন–হুঁ।

    কিরণময়ী দু কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢোকেন। ‘কী, ব্যথাটা তোমার বাড়ল নাকি? ঘুমের ওষুধটা না হয় খেয়ে নাও’ বলে দুজনের সামনে কাপদুটো রেখে তিনি চৌকিতে বসেন। আখতারুজ্জামান বলেন-বৌদি তো বোধহয় শাঁখা সিঁদুর পরেন না, তাই না?

    কিরণময়ী চোখ নামিয়ে বলেন–পঁচাত্তরের পর থেকে পরি না।

    — বাঁচা গেল। তবুও সাবধানে থাকবেন। সাবধানের মার নেই।

    কিরণময়ী স্নান হাসেন। সুধাময়ের ঠোঁটেও এই হাসিটি সংক্রামিত হয়। আখতারুজ্জামান চায়ে দ্রুত চুমুক দেন। সুধাময়ের বুকের ব্যথা কমে না। তিনি বলেন–আমিও তো ধুতি ছেড়েছি সেই কবে। ফর দা সেক অফ ডিয়ার লাইফ, মাই ফ্রেন্ড।

    আখতারুজ্জামান চায়ের কাপটি নামিয়ে রেখে বলেন–চলি, ওদিকে বিনোদবাবুকে একবার দেখে যাব ভাবছি।

    সুধাময় টান টান শুয়ে থাকেন। চা জুড়িয়ে পড়ে থাকে। শিয়রের কাছের টেবিলে। কিরণময়ী দরজার খিল এটে বসে থাকেন। বাতির উল্টোদিকে বসা, মুখে তাঁর ছায়া পড়েছে, একসময় চমৎকার কীর্তন গাইতেন কিরণময়ী। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা পুলিশ অফিসারের মেয়ে কিরণময়ী। ষোল বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। সুধাময় বলতেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত গাঁও কিরণ। ওস্তাদ রেখে দিই।’ মিথুন দে-র কাছে ক’বছর শিখেওছিলেন। গান গাওয়ার ডাকও পড়ত। ময়মনসিংহের নানা অনুষ্ঠানে। সুধাময়ের মনে পড়ে টাউন হলে একবার গান গাইতে গিয়েছিলেন কিরণময়ী। তখন সুরঞ্জনের বয়স তিন কী চার বছর। শহরে গানের শিল্পী হাতে গোনা ক’জনই ছিলেন। সমীর চন্দ্ৰ দে গেয়ে যাবার পর কিরণময়ী এলেন। সুধাময় সামনের সারিতে বসে রীতিমত ঘামছিলেন, কী জানি কেমন গান, কিরণময়ী গাইলেন—’আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর।’ অডিয়েন্স চিৎকার করে উঠল, ওয়ান মাের ওয়ান মোর। এরপর ধরেছিলেন–‘ভুবনেশ্বর হে, মোচন কর বন্ধন সব মোচন করা হে। প্ৰভু মোচন কর ভয়, সব দৈন্য করাহ লয়, নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কর নিঃসংশয়।’ এত দরদ দিয়ে গাইছিলেন যে শুনে সুধাময়ের মত নাস্তিক মানুষের চোখেও জল চলে এসেছিল। দেশ স্বাধীনের পর বাইরে গান গাইতে যেতে চাইতেন না কিরণময়ী। উদিীচীর অনুষ্ঠানে সুমিতা নাহা গাইবে, মিতালি মুখার্জি গাইবে, সুরঞ্জন মায়ের কাছে আবদার করত তুমিও গাইবে চল। কিরণময়ী হাসতেন ‘রেওয়াজ করি না, এখন কী আর আগের মত গলা আছে!’ সুধাময় বলতেন—যাও না অসুবিধে কী। আগে গাইতে, লোকে তো চেনেও অনেকে। হাততালিও তো পেয়েছ একসময়।‘

    —হুঁ পেয়েছি। যারা তালি দিত, তারাই বলত হিন্দু মেয়েদের লজ্জা শরম নেই বলেই তাঁরা গান শেখে, পরপুরুষের সামনে গা দেখিয়ে গান গায়।

    —মুসলমান মেয়েরা বুঝি গান গায় না? সুধাময় সামাল দিতেন।

    —সে তো এখন গায়। আগে যখন গাইত না তখন টিপ্পনিগুলো তো আমাদের শুনতে হত। এত ভাল গাইতেন মিনতিদি, একপাল ছেলে একদিন ধরল তাঁকে, তিনি নাকি মুসলমান বাড়ির মেয়েদের গান শেখাবার তাল করছেন।

    —গান শেখানো তো ভাল জিনিস। সুধাময় বলেছিলেন।

    –ছেলেরা বলল মুসলমান মেয়েদের গান গাওয়া ঠিক নয়। গান গাওয়া খারাপ, গান গাইলে তারা নষ্ট হয়ে যাবে।

    –ও।

    কিরণময়ীও আর তেমন মন দেননি। গানে। মিথুন দে মাঝে মাঝেই বলতেন, তোর গলাটা ভাল ছিল কিরণ, ছেড়েই দিলি গানটা।

    কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন—দাদা, ভাল লাগে না কিছু। মনে হয় কী হবে গেয়ে। এইসব নাচ গান তো মানুষ পছন্দ করে না। খারাপ বলে।

    ছাড়তে ছাড়তে ছাড়াই হয়ে গেল। গান। সুধাময় জোর করেননি যে তোমার গাইতে হকেই। তবে মাঝে মধ্যে অনুযোগ করতেন, ‘বাইরে না গাঁও, ঘরে তো গাইতে পারে।’ ঘরে কী আর গাওয়া হয়। রাত গভীর হয়ে এলে ঘুম আসছে না। এমন অস্থির সময়ে দুজন ইন্সে উঠতেন। ব্ৰহ্মপুত্রের জন্য, ব্ৰহ্মপুত্রের কাছে ফেলে আসা বাড়িটির জন্য দুজনেরই মন কাঁদত। দূর নক্ষত্রের দিকে দুজনেই নিবাক তাকিয়ে থাকতেন। কিরণময়ী গুন গুন করতেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা বলব। কী রে হয়, শুনে সুধাময় যে এত শক্ত মনের *মানুষ, তাঁরও কেমন কেমন জানি লাগত। তাঁরও ফিরে পেতে ইচ্ছে করত। শৈশব কৈশোরের খেলার মাঠ, ইস্কুলের আঙিনা, ভরা নদী, নদীতীরের ঘন বনের ভেতর-পথ ধরে ব’ন পীরের দিকে যাওয়া। এত যে কঠিন হৃদয়ের মানুষ সুখময়, সুধাময়ই রাতে রাতে কিরণময়ীকে দু হাতে বুকে জাপটে ধরে কেঁদে উঠতেন। সুধাময়ের কষ্ট্রের কোনও গণ্ডি নেই। একাত্তরে জগন্ময় ঘোষাল, প্রফুল্প সরকার, নিতাই সেন প্রায় চোখের সামনে খুন হলেন। ক্যাম্পে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলত, পরদিন ট্রাক ভরে ফেলে আসত বধ্যভূমিতে। হিন্দু পেলেই পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে আসত, বুটের লাথি, বেয়নেটের খোঁচা, চোখ উপড়ে নেওয়া, পিঠের হাড় ভেঙে দেওয়া এসব যখন করত মনে হত বুঝি ছেড়ে দেবে, শেষ পর্যন্ত কিন্তু মেরে ফেলত। অনেক মুসলমানকে পিটিয়ে ছেড়ে দিতে দেখেছে সুধাময়, হিন্দুকে ছাড়তে দেখেনি। মেথরূপট্টির কুয়ো ভর্তি হিন্দু আর মুসলমানের লাশ গাদাগাদি করে ফেলে রাখা ছিল, মাজেদ, রহিম, ইক্লিস-এর আত্মীয়রা, দেশ স্বাধীনের পর কুয়োর ভেতর থেকে যেদিন হাজার হাজার হাড় ওঠানো হল, ওই হাড়ের ওপর পড়ে চিৎকার করে কেঁদেছিল, কোন হাড় মাজেদের, কোন হাড় অনিলের কে বুঝবে? সুধাময়ের ভাঙা পা, পাঁজরের ভাঙা তিনটে হাড় জোড়া নিয়েছিল, কাটা পেনিসের ঘা-ও শুকিয়ে এসেছিল, কিন্তু বুকের ক্ষত শুকোয়নি, চোখের জলও শুকোয়নি। বেঁচে যাওয়া খুব কি বড় কিছু? শরীরে বেঁচে গিয়ে সুধাময়ের কিন্তু মনে হয়নি ক্যাম্প থেকে ফিরে খুব বেঁচে গিয়েছিলেন। ফুলপুরের অর্জুনখিলা গ্রামে আবদুস সালাম নাম নিয়ে তিনি দীর্ঘ সাত মাস কাটিয়েছিলেন একটি বাঁশের বেড়ার ঘরে, সুরঞ্জনকে ডাকতে হত সাবের বলে, কিরণময়ীকে যখন একঘর লোক ফাতেমা বলে ডাকত, সুধাময়ের লজ্জা করত শুনতে, পাঁজরের ভাঙা হাড় বুকে যত খোঁচা দিত, তার চেয়ে ফাতেমা নামের খোঁচা বুকে বাজত বেশি। ডিসেম্বরে যখন মুক্তিযোদ্ধারা ফুলপুরে নেমে এল, সারা গ্রাম ‘জয় বাংলা’ বলে আনন্দে নেচে উঠল, পুরো সাত মাস না ডাকতে পারা প্রিয় নামটি সেদিন প্ৰাণ ভরে ডেকেছিলেন সুধাময়—কিরণ, কিরণ, কিরুণাময়ী। বুকে জমিয়ে রাখা তাঁর কােষ্ট্রর আগুনগুলো সব নিভে গেল। এই-ই সুধাময়ের জয় বাংলা। কিরণময়ীকে গলা ছেড়ে হাজার মানুষের সামনে কিরণময়ী ডাকবার স্বাধীনতাকেই তিনি ‘জয় বাংলা’ বলে জানেন।

    হঠাৎ কড়া নড়বার বিশ্ৰী শব্দ শুনে দুজনে চমকে ওঠেন। এসেছেন। হরিপদ, হরিপদ ভট্টাচার্য। জিভের তলে নিফিকার্ড ট্যাবলেট দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকবার পর ব্যথাটি সামান্য কমে সুধাময়ের। হরিপদ ঘরের লোকের মতই। হরিপদকে দেখে সুধাময় উঠে বসেন। ‘কী আপনার অসুখ করল নাকি? খুব পেইল লাগছে!’

    —হ্যাঁ হরিপদ। কদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভাল যাচ্ছে না। প্রেসারটাও দেখা হয় না।

    –আগে জানলে আমি বি পি মেশিনটা নিয়ে আসতে পারতাম।

    কিরণময়ী বলেন–সুরঞ্জনটা এ সময় বাইরে বেরোল, বুঝুন অবস্থা। আর আপনিই বা এলেন কি করে?

    –শর্টকাট মেরেছি। বড় রাস্তা দিয়ে আসিনি।

    অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না, হরিপদ গায়ের চাদরটি গা থেকে খুলে নিয়ে বলেন-চাকায় আজ বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিবাদ হচ্ছে, আবার শান্তি মিছিলেও বেরিয়েছে, রাজনৈতিক দল আর বিভিন্ন সংগঠন সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখবার আহ্বান জানিয়েছে, মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংযত ও সহিষ্ণু থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, শেখ হাসিনাও বলেছেন, যে কোনও মূল্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি বজায় রাখুন। ভারতে দাঙ্গায় দুশ তেইশজন নিহত, চল্লিশটি শহরে কার্ফ, সাম্প্রদায়িক দলগুলো নিষিদ্ধ, নরসীমা রাও বাবরি মসজিদ নতুন করে তৈরি করবে। কথা দিয়েছেন।

    এটুকু বলে হরিপদ গভীর মুখে বসে থাকেন। বলেন—কিছু ঠিক করেছেন? এখানেই থাকবেন? থাকাটা উচিত হবে বলে মনে হয় না। আমি তো ভেবেছিলাম শ্বশুরবাড়ি চলে যাব। মানিকগঞ্জে বাড়ি। তো আজ সন্ধ্যায় আমার বড় শ্যালক এসে বলল মানিকগঞ্জ শহরে আর ঘিওর থানায় প্রায় একশ বাড়ি লুট করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পাঁচিশটি মন্দির ভেঙে আগুন জ্বালিয়েছে। বাকবুড়ি বলে একটি গ্রাম আছে, ওই গ্রামের হিন্দু বাড়িগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। দেবেন শোরের মেয়ে সরস্বতীকে মাঝরাতে আট-দশজন ছেলে বাড়ি থেকে সোজা উঠিয়ে নিয়ে রেপ করে।

    —বালছ কী! সুধাময় আর্তনাদ করে ওঠেন।

    –আপনার মেয়েটি কোথায়?

    —মায়া গেছে ওর বান্ধবীর বাড়িতে।

    –মুসলমানের বাড়ি তো!

    –হ্যাঁ।

    –তা হলে ঠিক আছে। হরিপদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।

    কিরণময়ীরও স্বস্তি হয়। সুধাময় চশমার কাচ মুছতে মুছতে বলেন–আসলে এদিকটাতেই যত দাঙ্গা-হাঙ্গামা ময়মনসিংহে তেমন দাঙ্গা হতে দেখিনি কিন্তু। আচ্ছা, আমাদের ময়মনসিংহে কিছু হয়েছে বলে শুনেছ নাকি হরিপদ?

    –শুনলাম গত রাতে ফুলপুর থানার বাথুয়াদি গ্রামে দুটো মন্দির, একটা পূজা মণ্ডপ, আর ত্রিশালে একটি কালীমন্দির ভেঙে ফেলেছে।

    —শহরে তো কিছু হয়নি নিশ্চয়ই। দেশের উত্তর দিকটায়। এসব আসলে কমই হয়। আমাদের ওদিকে, কী বল কিরণময়ী, মন্দির পোড়াবার ঘটনা কিছু শুনেছ নাকি কখনও!

    –নৰ্থ ব্ৰুক হল রোডের সার্বজনীন পূজা অফিস, জমিদার বাড়ি কালী প্রতিমা, মন্দির সবই ধ্বংস করে ফেলেছে। আজ শান্তিনগরে জলখাবার মিষ্টির দোকান, শতরূপা স্টোর লুট করে ভেঙে পুড়িয়েও দিয়েছে। কুষ্টিয়ায় ছটা মন্দির গতকাল গভীর রাতে জামাত শিবিরের লোকেরা ভেঙে ফেলেছে। তারপর ধরুন চিটাগাং, সিলেট, ভোলা, শেরপুর, কক্সবাজার, নোয়াখালির কথা যা শুনেছি, আমার তো ভয় হচ্ছে খুব।

    —কিসের ভয়? সুধাময় প্রশ্ন করেন।

    –এক্সোডাস।

    –আরো না। এদেশে ওইভাবে দাঙ্গা বাধবে না।

    –নব্বই-এর কথা ভুলে গেলেন দাদা। নাকি তা তেমন গুরুতর বলে মনে হয়নি আপনার?

    –ও তো এরশাদ সরকারের সাজানো ঘটনা ছিল।

    —কি যে বলছেন দাদা। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবটি দেখলেই তো পারেন। এবারের এক্সোডাস ভয়ঙ্করই হবে। সাজানো ঘটনায় মানুষ দেশের মাটি ছেড়ে এভাবে চলে যায় না। দেশের মাটি তো আর ফুলের টবের মাটি নয়। জল সার দিলাম। আর কদিন পর পর পাল্টালাম। দাদা, ভয় হয় খুব। এক ছেলে কলকাতায় পড়ালেখা করে। দু মেয়ে আছে। এখানে। মেয়েরা বড় হয়েছে, রাতে ঘুমোতে পারি না। ভাবছি চলেই যাব।

    সুখময় আঁতকে ওঠেন। এক ঝটিকায় চশমাটি খুলে নিয়ে বলেন–পাগল হয়েছ তুমি হরিপদ? এমন অলক্ষুণে কথা উচ্চারণও কোরো না।

    –এ কথাই তো বলবেন যে এখানে আমার প্র্যাকটিস ভাল। ভাল টাকা পয়সা কামাচ্ছি। নিজের বাড়ি আছে। তাই না?

    —না হরিপদ। সে কারণে নয়। সুযোগ-সুবিধে আছে বলেই যে তোমার যাবার কথা ওঠে না তা নয়। সুযোগ-সুবিধে না থাকলেই বা যাবার প্রশ্ন উঠবে কেন? এ তোমার দেশ নয়? আমি তো রিটায়ার্ড লোক। আয় রোজগার নেই। ছেলেটা কোনও চাকরি-বাকরি করে না। রোগী দেখার টাকায় সংসারটা চলে। দিন দিন রোগী কমছে। আমি কি তাই বলে চলে যাব?. দেশ ছেড়ে চলে যায় যারা, তারা কি মানুষ? যা কিছুই হোক যত দাঙ্গাই ঘটুক, বাঙালি তো আর অসভের জাত নয়। একটু-আধটু কোলাহল হচ্ছে, থেমে যাবে। পাশাপাশি দুটো দেশ, এক দেশের আগুন আরেক দেশে তো একটু-আধটু ছিটকে আসবেই। মাইন্ড ইট হরিপদ, চৌষট্টির দাঙ্গ বাঙালি মুসলমান বাঁধায়নি, বাঁধিয়েছিল বিহারীরা।

    হরিপদ গায়ের চাদরে নাক মুখ ভাল করে ঢেকে নিয়ে বলেন—এই যে চাদরের তলে মুখখানা লুকিয়ে বেরোচ্ছি, সে কিন্তু বিহারীদের ভয়ে নয় দাদা, আপনার বাঙালি ভাইদের ভয়েই।

    হরিপদ আলগোছে দরজা খুলে বেরিয়ে পা টিপে টিপে বাঁয়ের গলিতে অদৃশ্য হয়ে যান। কিরণময়ী দরজা দু আঙুল ফাঁক করে সুরঞ্জনের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠেন। খানিক পর পরই মিছিল যাচ্ছে ‘নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর’ শ্লোগান দিয়ে। তাদের ভাষ্য, ভারত সরকারকে যে করেই হোক বাবরি মসজিদ গড়ে দিতে হবে, নইলে রক্ষা নেই।

    সুরঞ্জন বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে। টলতে টলতে ফেরে। কিরণময়ীকে জানিয়ে দেয় তার খিদে নেই, রাতে সে ভাত-টাত খাবে না।

     

    ২গ.

    বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে সুরঞ্জন। তার ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ অস্থিরতায় তার সারারাত কাটে। যেহেতু ঘুম আসেই না সে এক পা এক পা করে অতীতে ফেরে। এই রাষ্ট্রের চারটি মূল নীতি ছিল—জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। বাহান্নার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘকালের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও তার চূড়ান্ত পৰ্য্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক ও ধমন্ধি শক্তি পরাস্ত হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সংবিধানের চরিত্র পরিবর্তন করবার পর মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যাখ্যাত ও পরাজিত সেই সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি পুনবাসিত হয়। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবার অপকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করবার পর সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা খুব বেশি বেড়ে যায়।

    কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার সবাহন গ্রামে উনিশ শ উনআশি সনের আটই ফেব্রুয়ারি ভোরে হিন্দু ঋষি সম্প্রদায়ের ওপর আশেপাশের গ্রামের প্রায় চারশ লোক অতর্কিতে আক্রমণ চালায়, তারা চিৎকার করে ঘোষণা করে, ‘সরকার দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ঘোষণা করেছে। তাই ইসলামি দেশে থাকতে হলে তোদের সবাইকে মুসলমান হতে হবে। মুসলমান না হলে এ দেশ থেকে তোদের পালিয়ে যেতে হবে ৷ ‘ এই লোকগুলো ঋষি সম্প্রদায়ের প্রতিটি বাড়ি লুট করে, আগুন জ্বলিয়ে দেয়, মন্দির ধূলিসাৎ করে, অনেককে ধরে নিয়ে যায়, যাদের এখনও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করা হয়। এই হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় এখনও অনেকে আছেন।

    নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার আবীরদিয়া গ্রামের নৃপেন্দ্ৰ কুমার সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী অনিমা সেনগুপ্তাকে একজন এডভোকেটের বাড়িতে আটকে রেখে সোয়া আট বিঘা জমি জোর করে রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়েছে। উনিশ শ উনআশি সনের সাতাশে মার্চ তারিখে অনিমা নরসিংদী পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন যে, আসামীরা তাঁকে ভয় দেখায়, এলাকার লোকও ভয়ে কিছু বলতে পারে না। এরপর অনিমাকে চার দিন হাজতে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।

    সে বছর সাতশে মে তারিখে পিরোজপুর জেলার কাউখালি উপজেলার বউলাকান্দা গ্রামে দশ-বারো জন সশস্ত্ৰ লোক হালদার বাড়িতে হামলা করে। ওরা বাড়ির জিনিসপত্র লুট করে, মন্দির ভেঙে সোল্লাশে শ্লোগান দিয়েছে, ‘মালাউন নিধন কর, মন্দির ভেঙে মসজিদ কর।’ ওরা হিন্দুদের শিগরি দেশ ত্যাগের জন্যও বলে যায়।

    চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার গশ্চি গ্রামের বৈদ্যবাড়িতে মে মাসের নয় তারিখে দিনে-দুপুরে বোমা ফাটিয়ে, বাড়ি জ্বলিয়ে, গুলি করে প্রায় এক-দেড়শ জন মুসলমান তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে।

    ষোলই জুন পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর গ্রামে দশ-বারো জন পুলিশ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, নগেন্দ্ৰ মণ্ডল, অমূল্য মণ্ডল, সুবোধ মণ্ডল, সুধীর মণ্ডল, হীরেন্দ্ৰ নাথ মণ্ডল, জহর। দেউরি সহ পনেরো-ষোলজন হিন্দুকে আটক করে এবং গৌরাঙ্গ মণ্ডলের বাড়ির উঠোনে এনে মারধোর শুরু করে। গৌরাঙ্গ মণ্ডলের স্ত্রী বেণু বাধা দিতে গেলে পুলিশেরা তাকে একটি ঘরে ধরে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। অন্য মহিলারা বাধা দিতে গেলে তাদেরও লাঞ্ছিত করা হয়। সনাতন মণ্ডলের কন্যা রীণাকেও জোর করে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এই ঘটনার পর রাণাকে অপহরণ করা হয়। আজও রাণার কোনও খোঁজ নেই।

    আঠারোই জুন তারিখে রাত এগারেটার দিকে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার চাঁদকাঠি গ্রামে তিনজন পুলিশ ও স্থানীয় চৌকিদার কিছু সশস্ত্ৰ লোক সহ তল্লাশি চালায়। তল্লাশি চালাবার সময় তারা হিন্দুদের দেশ ত্যাগ করতে বলে। সর্বহারী পার্টির সদস্য বলে অভিযোগ করে তারা দুলাল কৃষ্ণ মণ্ডল সহ চার-পাঁচজন হিন্দুকে আটক করে থানায় নিয়ে অকথ্য নিযাতন চালায়। পরে আট-দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এই এলাকার অনেক হিন্দু দেশ ত্যাগ করেছে। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার গাজীর হাট ইউনিয়নের বারোটি গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দুর ওপর শুরু হয়েছে। অকথ্য নিযাতন। নিবাচনে হেরে গিয়ে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী মোল্লা জামালউদ্দিন ভাড়াটে লোক লাগিয়ে হিন্দুদের চাষাবাদে বাধা দিচ্ছে, মাঠের ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে, গরু ছাগল নিয়ে যাচ্ছে, দোকানপাট লুট করছে।

    বরিশাল জেলার দুর্গাপুর গ্রামে অর্পিত সম্পত্তির অন্যায় ভাবে লিজ গ্রহণ ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে মামলার কারণে অষ্ট আশি সনের দশই ডিসেম্বর আবদুস সোবহান ভূঁইয়া ও ইউ পি সদস্য গোলাম হোসেন অস্ত্রশস্ত্র ও দলবল নিয়ে রাজেন্দ্রনাথ দাসের বাড়িতে চড়াও হয়। তারা রাজেন্দ্রনাথের বাড়িতে খুন করবার হুমকি দেখিয়ে বাড়ির সোনাদানী লুট করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ মূর্তিও নিয়ে গেছে, যারা দিতে চায়নি, তাদের ইচ্ছেমত পেটানো হয়েছে। যাওয়ার আগে ওরা রাজেন্দ্রনাথ দাসকে সপরিবারে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দিয়ে যায়।

    অষ্ট আশির ছাব্বিশে আগস্ট সকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় তািলবুনিয়া গ্রামে কিছু মৌলবাদীর প্ররোচনায় অশীতিপর বৃদ্ধ লক্ষ্মণ চন্দ্ৰ পালের বাড়িতে ঢুকে বৃদ্ধের নাতি বিকাশ চন্দ্ৰ পালকে পুলিশের খুব পেটায়, লক্ষ্মণ চন্দ্রের বড় ছেলে পুলিন বিহারী পাল ও মেজ ছেলে রবীন্দ্রনাথ পালকেও মারধোর করে। পুলিনের বউ পুলিশের কাজে বাধা দিতে গেলে পুলিশ তাকেও বেদম পেটায়। পুলিশ এরপর পুলিন, রবীন্দ্রনাথ আর বিকাশকে বেঁধে থানায় নিয়ে যায়, সেখানে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে হাজতে পাঠিয়ে দেয়। তাদের জামিন দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার কিছু আগে শোলাকুড়া গ্রামের আবদুল হাকিম মোল্লা লক্ষ্মণ চন্দ্রের ভাইয়ের মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের পিটিয়েছিল। এই অপরাধে দীর্ঘকাল জেলবাস হয় হাকিম মােল্লার। জেল থেকে ফিরে তালবুনিয়া গ্রামের সিরাজ মল্লিক, হারুণ মল্লিক ও আবদুল জব্বার কাজিকে নিয়ে প্রতিশোধ নেয় পুলিশ দিয়ে লক্ষ্মণচন্দ্রের পরিবারের সদস্যদের এ ধরনের শাস্তি দিয়ে। এই ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতায় এলাকার অনেক হিন্দুই দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    গোপালগঞ্জ, কোটালিপাড়া, মকসুদপুর সহ পুরো গোপালগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের বাড়িতে চুরি, ডাকাতি, লুট, জালিয়াতি, অবৈধভাবে বাড়ি দখল, মিথ্যা মামলা, নারী ধর্ষণ, মন্দির ভেঙে আগুন লাগিয়ে দেওয়া তো আছেই, সঙ্গে পুলিশি নিযাতনও আছে। কোটালিপাড়া উপজেলার চেয়ারম্যান মন্টু কাজির পোষা গুণ্ডাবাহিনী কুশলা ইউনিয়নের মান্দ্রা লাখিরপাড় গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে হামলা চালায়, হিন্দু মেয়েদের নিযতন করে, এরা মাদারবাড়ি, আদায়, দামি জিনিসপত্র লুট করে স্ট্যাম্পে সই নিচ্ছে। এখানকার অনেক হিন্দুই ভয়ে দেশ ত্যাগ করেছে। মাষ্ট্ৰ কাজি কোটালিপাড়া সোনালি ব্যাঙ্কের মিসেস ভৌমিককে ধরে এনে পাশবিক নিযাতন চালিয়েছে। কান্দি গ্রামের মমতা, মধু সহ অনেককে চাকরি দেওয়ার লোভ দেখিয়ে উপজেলা কার্যালয়ে আটকে রেখে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।

    বাগেরহাটের চিতলমারি উপজেলার গরীবপুর গ্রামের অনিলচন্দ্রের বাড়িতে অষ্ট আশির তেসরা জুলাই গভীর রাতে পুলিশ ঢেকে। অনিলচন্দ্র বাড়িতে ছিলেন না, পুলিশ তাঁর বউ আর বাচ্চাকে বেদম পেটায়, ওই রাতে গ্রামের স্কুলমাস্টার অমূল্যবাবুর বাড়িতেও পুলিশ লুটপাট করে। চার তারিখে সুড়িগতি গ্রামের ক্ষিতীশ মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালায় পুলিশ। বাড়িতে কোনও পুরুষ না পেয়ে ক্ষিতীশ মণ্ডলের স্ত্রী কন্যার ওপর পাশবিক নিযাতন চালায়। পাঁচ তারিখে একই গ্রামের শ্যামল বিশ্বাসের বাড়িতে পুলিশি হামলা চলে। শ্যামলবাবুকে না পেয়ে পুলিশ তাঁর মেয়েকে ধর্ষণ করে, এবং ঘরের মূল্যবান জিনিস লুট করে নিয়ে যায়। এসব ঘটনার কয়েকদিন পর চিতলমারি গ্রামের নীরদ বিহারী রায়ের বাড়িতে এক সমাজবিরোধী লোক জোর করে বসবাস শুরু করে দিয়েছে। প্রশাসনকে জানিয়ে কোনও কাজ হয়নি। কালাশিরা গ্রামের একজন হিন্দুকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে ইউ পি সদস্য মনসুর মল্লিক। সেখানে জোর করে বসবাস শুরু করেছে। নিরাশ্রয় হিন্দু এখন পথে পথে ঘোরে।

    গোপালগঞ্জের শিক্ষা কর্মকতা জহুরসাহেব হিন্দু মহিলাদের চাকরির লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ করেছেন। ডেমাকৈর গ্রামের বিশ্বাস।বাড়ির দুজন মহিলা এভাবে ধর্ষিতা হয়েছে। এই লোক হিন্দু শিক্ষক-শিক্ষিকদের বদলির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন।

    গোপালগঞ্জের আলতি গ্রামের জগদীশ হালদারের বাড়িতে পুলিশ ও এলাকার সশস্ত্র যুবকেরা একযোগে হামলা চালায়। গোটা বাড়ি তছনছ করা হয়, পরিবারের সদস্যদের মারধোর করা হয় এবং লুটপাট চালানো হয়। ওরা যাবার সময় সবাইকে মেরে ফেলবার হুমকি দিয়ে যায়। ওই বছরের বারেই আগস্ট গ্রামের আরও কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে পুলিশসহ সশস্ত্র যুবকেরা হামলা চালায় এবং কয়েকটি মন্দির ভেঙে ফেলে। আশুতোষ রায়, সুকুমার রায়, মনোরঞ্জন রায়, অঞ্জলি রায়, সুনীতি রায়, বেলা বিশ্বাস তাদের হাতে নিগৃহীত হন। ওরা যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে যায় যে এ দেশে কোনও মন্দির থাকতে পারবে না।

    গোপালগঞ্জ জেলার মকসুদপুর উপজেলার উজানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খায়ের মোল্লার মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে মৌলবাদীরা ও পুলিশ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার চালায়। পুলিশ বাসুদেবপুর গ্রামের শিবুর স্ত্রী ও মহাটলি গ্রামের কুমারী অঞ্জলি বিশ্বাসকে ধর্ষণ করে। শিমুলপুর গ্রাম থেকে বারোজনকে সর্বহারা দলের সমর্থক অভিযোগে গ্রেফতার করে প্রচণ্ড নিযাতন চালানো হয়। এরং বড় অঙ্কের টাকা দেবার পর এদের ছাড়া হয়।

    বিশে জুন তারিখে পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি উপজেলার বাস্তুকাঠি গ্রামে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। বাস্তুকাঠি নদীর দুই তীরে পুলিশ হিন্দু সম্প্রদায়ের জমির ফসল। তছনছ করে দেয়। মাঠে যারা কাজ করছিল তাদের আটক করে এবং প্রচুর টাকার বিনিময়ে ছাড়ে। এই গ্রামেই এগারোই জুন উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সেবিকা মিনতি রানী তার বৌদি ও ভাইকে নিয়ে বান্ধবী ছবি রানীর সঙ্গে দেখা করতে আদমকাঠি যাওয়ার পথে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে তাদের আটক করা হয় এবং নিযািতনের হুমকি দেওয়া হয়। পরে এক হাজার টাকা আদায় করে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। স্বরূপকাঠির পূর্বজলা বাড়ি গ্রামে সুধাংশু কুমার হালদারের মেয়ে চৌদ্দ বছর বয়সের শিউলিকে মামার বাড়ি যাবার পথে রুস্তম আলি নামের এক লোক ধর্ষণ করে। রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে শিউলি। সুধাংশু হালদার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কাছে এ ঘটনার বিচার চাইলে তাকে বলা হয়, ‘এসব সহ্য করতে না পারলে দেশ ত্যাগ করতে হবে। ‘

    উনআশি সাতই এপ্রিল তারিখে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ বাজারে ডাঃ শচীন্দ্ৰ কুমার সাহার বসতবাড়ির কাছে মসজিদ নিমণিকে কেন্দ্র করে মসজিদ কমিটির লোকেরা হামলা চালায়, তারা ডাঃ সাহার বাড়ির দরজা জানোলা ভেঙে ফেলে, লুটপাট করে এবং বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারা সংলগ্ন মন্দির ভেঙে ধূলিসাৎ করে দেয়। প্রায় দুঘণ্টা ধরে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে এগারো লাখ টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। ঘটনার সময় ডাঃ সাহার ছেলে কোনও রকমে পালিয়ে গিয়ে থানায় খবর দিলে পুলিশ কর্মকতা পুলিশ ফোর্স নিয়ে গেলে আসামী আলতাফ হোসেন মণ্ডলের নেতৃত্বে অন্যান্য আসামীরা লাঠিসোটা, লোহার রড, ইট পাটকেল নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, এতে ক’জন পুলিশ কর্মকতা আহতও হয়। পরে শিবগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা বাদী হয়ে আলতাফ হোসেন মণ্ডল সহ পয়ষট্টি জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন, তাদের আটকও করা হয়। কিন্তু উর্ধর্বতন মহলের নির্দেশে আসামীরা ছাড়া পেয়েছে। ডাঃ সাহার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এতে গোটা এলাকার হিন্দুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, এলাকা ছেড়ে যাবার চিন্তা ভাবনাও করছে।

    ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙা উপজেলার টিকিরাপাড়া গ্রামে উনআশি সালের মে মাসের তিন ও চার তারিখে হিন্দুদের ওপর নিযাতন চালানো হয়, এলাকার হিন্দুরা প্রাণভয়ে নিজের বসতভিটে ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।

    মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের রাহাতপুর গ্রামের অধিবাসী হরেন বিশ্বাসের স্ত্রী, নাবালিকা মেয়ে এবং তার ছেলের বউকে একই এলাকার প্রভাবশালী নজীর মৃধা ধর্ষণ করেছে। এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের হলে নজীর নায়েব এবং তার সাঙ্গাপাঙ্গদের অত্যাচারে হরেন বিশ্বাস তার পরিবার পরিজনসহ দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে।

    উনিশে ও বিশে মে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার দেবগ্রামের পুলিশ বঙ্গভূমি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকবার অভিযোগে ওই গ্রামের অনিল কুমার বাগচী, সুশীল কুমার পাণ্ডে, মাখন লাল গাঙ্গুলিকে আটক করে, এবং প্রচুর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। ঝালকাঠি জেলার ঝালকাঠি উপজেলার মিরাকাঠি গ্রামের অপ্রকৃতিস্থ রমেশ চন্দ্ৰ ওঝাকে জোর করে ধমন্তিরিত করা হয়। রমেশ চন্দ্রের স্ত্রী মিনতি রানী ও তার বড় ভাই নীরদ ওঝাকে ধমন্তিরিত করবার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। মিনতি রানী এ ব্যাপারে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিকে জানালে তাকে বরং উল্টে পাশবিক নিযািতনের হুমকি দেওয়া হয়। মিনতি রানী এখন প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

    গোপালগঞ্জের কচুয়া উপজেলার জোবাই গ্রামের সুধীর বৈদ্যের স্ত্রীকে সুলতান নামের একজন চাকুরিচ্যুত পুলিশ ধর্ষণ করে। লোকলজ্জায় তিনি আত্মগোপন করেছেন। সুধীর বৈদ্যকে প্ৰাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। একই গ্রামের উপেন্দ্র মালোর একটি গরু জবাই করে খেয়ে ফেলা হয়, উপেন্দ্র প্রশাসনের কাছে বিচার চেয়ে বরং লাঞ্ছিত। হয়েছেন।

    গোপালগঞ্জের বীেলতলি ইউনিয়নের বৌলতলি গ্রামের কার্তিক রায় নিজের জমির ধান রক্ষা করতে গিয়ে পাড়ার মুসলমানদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। স্ত্রী রেণুকাকে এই নিৰ্মম হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলতে বাধ্য করা হয়েছে।

    কুমিল্লা জেলার লাকসাম উপজেলার দক্ষিণ চাঁদপুরের প্রেমানন্দ শীলের নাইনে পড়া মেয়ে মঞ্জুরানী শীলকে অষ্ট আশির চার ডিসেম্বর তারিখে রাত আটটার দিকে আবদুর রহিম তার শিষ্যদের নিয়ে অপহরণ করে। পরদিন সকালে লাকসাম থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মঞ্জু রানীর এখনও কোনও খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। অপহরণকারীদের লোকেরা প্রেমানন্দ শীল ও তার পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। এই এলাকার হিন্দু অভিভাবকেরা মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর সাহস পাচ্ছে না।

    পাঁচিশে এপ্রিল তারিখে বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার গুটিয়া গ্রামে পুলিশ কীর্তনরত অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ষোলজনকে গ্রেফতার করে। এরা ছিল দিনমজুর। পানের বরজে কাজ করত।

    রাষ্ট্রধর্ম বিল পাশ হবার পর যশোর জেলার অভয় নগর উপজেলার সিদ্ধিরপাশা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশ হাজার টাকা বিঘার জমি সাত-আট হাজারে বিক্রি করে ভারত চলে যাচ্ছিল, কারন ওখানের কিছু লোক বলছিল হিন্দুদের সম্পত্তি আর বিক্রি করা যাবে না। গ্রামের মাধব নন্দী হিন্দুদের বোঝাতে চেষ্টা করেন এদের কথায় জমি বিক্রি করা ঠিক নয়। এর কয়েক দিন পর মাধব নদীর বাড়িতে গভীর রাতে বারো-চৌদ্দজন লোক দা বল্লম নিয়ে হামলা চালায় আর সাত মাসের গর্ভবতী মাধব নন্দীর পুত্রবধু ও যুবতী কন্যাকে ধর্ষণ করে।

    কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার দেবেন বিশ্বাস পনেরো মে তারিখে কারও গুলিতে নিহত হন। মামলা দায়ের করা হলেও এ পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি।

    অষ্ট আশি সালের বারোই ও ষোলই আগস্ট পুলিশ সশস্ত্র যুবকদের নিয়ে বাগেরহাট জেলার চিতলমারি উপজেলার গরীবপুর গ্রামে হামলা চালায়। তারা মন্দিরের দেবমূর্তি ভেঙে ফেলে, নারীদের ধর্ষণ করে। বিশ-একুশজনকে ধরে বেদম মারের পর টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। নারায়ণ বৈরাগী, সুশান্ত ঢালী, অনুকুল বাড়ৈ, রঞ্জন ঢালী, জগদীশ বৈরাগী অনেকদিন পর্যন্ত হাজতে ছিলেন। চরবালিয়াড়ি গ্রামেও একই রকম হামলা চালালো হয়, পনেরো-ষোলজনকে আটক করে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। হিজলা ও বড়বাড়িয়া গ্রামেও আট-নজনকে আটকে রেখে নিৰ্য্যতন করা হয়, পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

    সাতক্ষীরার তালা উপজেলার পারকুমির গ্রামের রবীন্দ্রনাথ ঘোষের কিশোরী মেয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছন্দাকে গ্রামের স্কুল শিক্ষক ধর্ষণ করেছে। উনআশির ষোলই মে তারিখে ঘটনাটি ঘটে। সেদিন রাতে ছন্দা ঘুমিয়েছিল বাড়ির বারান্দায় পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে। গভীর রাতে তার স্কুল শিক্ষক নাছিমউদ্দিন কিছু লোক নিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে যায় ছন্দাকে। তারপর পাশের একটি বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরদিন সকগলৈ ছন্দোকে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়, তাকে সাতক্ষীরা হাসপাতালে পাঠানো হয়। তালা থানায় মামলা দায়ের করলেও অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়নি।

    গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গোহালা গ্রামের উজ্জ্বলা রানীকে তার বাবার সম্পত্তি দখলকারী পাঁচজন লোক ধর্ষণ করে। উজ্জ্বলা রানীর অভিভাবকেরা মুকসুদপুর থালায় এ ব্যাপারে জানাতে গেলে থানা কর্তৃপক্ষ কোনও এফ আই আর গ্রহণ করেনি।

    পজিরপুর, গৌরনদী সহ সর্বহারা পার্টির সদস্যদের গ্রেফতারের নামে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন চালানো হয়। আর গ্রেফতারের পর উৎকোচের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে ওই এলাকার অনেক হিন্দু পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আগৈলঝরা উপেজলার কাশীনাথ হালনার পুলিশের নির্তিনের শিকার হয়ে প্রার মরা হয়ে পড়ে পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলায় দীঘ ইউনিয়নের নাওটানা গ্রামের কেশব সাধু তাঁর একমাত্র পুত্রকে সর্বহারা পার্টির সঙ্গে জড়িত থাকবার মিথ্যে অভিযোগে পুলিশ এমন পেটায় যে দেখে তিনি হার্টফেইল করেন।

    নরসিংদী জেলার রায়পুর উপজেলার চরমধুয়া ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামে শাহাবুদ্দিন ও আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে সত্তর-আশিজনের একটি দল সূত্ৰধর পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা চালায়, লুটপাট করে। বিশটি পরিবারের প্রায় দেড়শ সদস্য গ্রাম ছেড়ে উদ্বাস্তুর জীবন কাটাচ্ছে।

    নেত্রকোণা জেলার মদন উপজেলার জাহাঙ্গীরপুর গ্রামে ষোলই মে তারিখে মৌলবাদী একটি দল সংখ্যালঘু নেতা বিনয় বৈশ্যের বাড়িতে হামলা চালায়। বিনয়বাবুর পরিবারের সদস্যদের ছত্রিশ ঘণ্টা আটকে রেখে লোকেরা লুটপাট করে। থানায় খবর দেওয়া হলে পুলিশ এসে উল্টে বিনয়বাবুর দুই ছেলেকেই ধরে নিয়ে যায়। অবশ্য পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

    বাকেরগঞ্জ চাঁদপুর ইউনিয়নের দুৰ্গপুর গ্রামে দশই ডিসেম্বর তারিখে স্থানীয় ইউ পি সদস্য গোলাম হোসেন পিন্টুর নেতৃত্বে প্রায় একশ মত লোক রাজেন্দ্ৰ চন্দ্র দাসের বাড়িতে হামলা চালায়, লুটপাট করে, বাড়ির লোকদের মারধোর করে, শেষে বাড়িতে লাগিয়ে দেয়। কোতয়ালি থানায় রাজেন্দ্ৰ চন্দ্রের পক্ষ থেকে মামলা করা হলে এরা আবার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পরিবারের সদস্যর প্রাণনাশের হুমকি দেয়। উপজেলায় মামলা করা হলে পুলিশ নীরব থাকে।

    নোয়াখালি জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার মিরওয়ারিশপুর গ্রামের দীনেশ চন্দ্ৰ দাস-এর সম্পত্তি কিছু লোক জোর করে ভোগ দখল করছে।

    সুরঞ্জনের ঘুম আসে না। একতা পত্রিকায় দু বছর কাজ করেছিল সুরঞ্জন। অষ্ট আশি উনশির দিকে। রিপোটিং-এর কাজ করতে হত তার, সারাদেশ দৌড়োতে হত। এইসব নিপীড়নের সংবাদ তার ঝোলা বোঝাই হয়ে থাকত। কিছু ছাপা হত, কিছু হত না। সম্পাদক বলতেন, ‘বুঝলে হে সুরঞ্জন, এসব হচ্ছে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার।, দরিদ্রের ওপর ধনীর অত্যাচার। তুমি যদি ধনী হও, তুমি হিন্দু কী মুসলমান সেটা ফ্যাক্টর নয়, পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার তো এরকমই নিয়ম। দেখা গিয়ে দরিদ্র মুসলমানদের একই অবস্থা। ধনীরা, সে হিন্দু হোক মুসলমান হোক, দরিদ্রকে শোষণ করছে।‘

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন
    Next Article দাবিদার – তারক রায়

    Related Articles

    তসলিমা নাসরিন

    আমার মেয়েবেলা – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    উতল হাওয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    দ্বিখণ্ডিত – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    কিছুক্ষণ থাকো – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভালোবাসো? ছাই বাসো! – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    তসলিমা নাসরিন

    ভ্রমর কইও গিয়া – তসলিমা নাসরিন

    August 21, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    সমগ্র কিশোর সাহিত্য – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    ছোটগল্প – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025

    টেনিদা সমগ্র – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

    September 2, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.