লুব্ধক – ১
১
সাত ঘন্টা, মাত্র সাতটা ঘন্টা আর বাকি আছে৷ সাত ঘন্টা মানে চারশো কুড়িটা মিনিট৷ খুব একটা অভাবনীয় মাপের কিছু নয়৷ মাত্র পঁচিশ হাজার দুশোটা সেকেন্ড৷ সময়-এর এই খণ্ড দৌড়ে পেরিয়ে যেতে একটা ঘুমই যথেষ্ট৷ তবে পুরোটাকে ঘুম বলা যাবে না৷ খুব সামান্য সময়ের জন্যে হলেও দু-একটা স্বপ্ন দেখতে হবেই৷ মোটের ওপর সাত ঘন্টার অপেক্ষা৷ আর ঘুমোতে যে হবেই বা ঘুম যে আসবেই এমন কোনো কথা নেই৷
রিখটার স্কেলে মাপা যায়নি যে ভূমিকম্পটা কত জোরালো ছিল৷ এর থেকে হাস্যকর কথা কী হতে পারে? আসলে এরকম কথা বলার কোনো মানেই হয় না৷ ঘেউ! ঘেউ! চার্লস এফ রিখটার তাঁর স্কেলটি বানিয়েছিলেন এই সেদিন৷ ১৯৩৫ সালে৷ আর ভূমিকম্পটা হয়েছিল ১৭৩৭-এ, মানে তার প্রায় দুশো বছর আগে৷ লোক মারা গিয়েছিল ৩,০০,০০০৷ দিনটা ছিল ১১ অক্টোবর৷ ৫২৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ধরে ১৯৯৫ অবধি যে দুনিয়া কাঁপানো চুয়াল্লিশটি ভূমিকম্পের তালিকা করা হয়েছে তাতে কী অদ্ভুত, তারিখের সঙ্গে মিল দেওয়ার জন্যেই যেন ১১ নম্বরে এই ভূমিকম্পের কথা আছে৷ এই তালিকায় শেষ ভূমিকম্পটি হল ১৯৯৫-এর ১৭ জানুয়ারি, জাপানের কোবেতে, যাতে ৫,২৫০ জন মারা যায়৷ সে যাই হোক, ১১ নম্বর ভূমিকম্প, যাতে তিন লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল সেটা হয়েছিল কলকাতায়৷
তখন নিশ্চয়ই কলকাতায় এত লোক থাকত না৷ এত বাড়ি, সেতু, স্তম্ভ, মিনার, মেট্রো এসব কিছুই ছিল না৷ তাহলেও অত লোক থাকত যে মরেই গেল তিন লক্ষ৷ আর একটা শহরে নিশ্চয়ই শুধু মানুষই থাকে না৷ যেমন এখনকার কলকাতায় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের কথা বাদ দিলেও যে অসংখ্য না-মানুষ প্রাণীদের আমরা দেখতে পাই তারাও নিশ্চয়ই ছিল৷ যেমন কুকুর, গোরু, ছাগল, বেড়াল, কাক, চড়াই, চামচিকে ও আরও কত প্রাণী৷ ভূমিকম্পই হোক, বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনাই হোক বা মহামারি অথবা শান্ত সময়েও কোনো পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ডুবোজাহাজের দুর্ঘটনাই হোক মানুষের বেলায় ঠিক হোক, ভুল হোক, মোটের ওপর একটা হিসেব থাকে৷ প্রাণহানি বললে কী বোঝায়? নিশ্চয়ই মানুষ৷ অনেক সময় বাসের ভেতরে লেখা দেখা যায় সময়ের চেয়ে জীবনের দাম বেশি৷ কার জীবনের দাম বেশি সেটা এর চেয়ে খুলে বলার দরকার হয় না৷ কী বলতে চাওয়া হয়েছে সেটা জানাই থাকে৷ জানা ব্যাপারটা জানানো হল৷ সকলেই জানে কিন্তু বড়ো বড়ো করে লেখাও থাকে৷ কেন এরকম করা হয়? যে সাত ঘন্টা বাকি আছে সে সময়টা না ঘুমিয়ে এরকম একটা প্রশ্ন নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা যায়৷ এর মধ্যে সকলেই একটা কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়া নিস্তব্ধতা সম্বন্ধে এখনও বোধহয় সচেতন হয়নি৷ অথচ একটু খেয়াল করলেই জানা যাবে যে শহর শব্দময় হলেও তার মধ্যে কুকুরের ডাক নেই৷ চাকার শব্দ, পিস্টনের শব্দ, ইঞ্জিনের শব্দ, ফোনের শব্দ, টায়ার বা গ্যাসের সিলিন্ডার ফাটার শব্দ, টেলিভিশনে চেনা চেনা কন্ঠস্বর, চলন্ত গাড়িতে স্টিরিয়ো বাজার শব্দ, ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ, শরীরে শরীর ঘষা ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার রবার রবার শব্দ, দেশলাই কাঠি জ্বলে ওঠার শব্দ, চুল্লির দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ, বঁটি ধোওয়ার শব্দ, খাওয়ার শব্দ, নিঃশব্দ ছাপা শব্দ, শবদেহ নিয়ে যাওয়া জানানোর শব্দ, ট্রামেদের গুমটিতে ফেরার শব্দ, টিউব আলোর তোতলাতে তোতলাতে জেগে ওঠার শব্দ, এক হাতওয়ালা টিউবওয়েলের জল ডাকার শব্দ – সব যেমন থাকে তেমন রয়েছে৷ কিন্তু কোনো কুকুরের ডাক নেই, কোনো গাড়িতে ধাক্কা খাওয়ার পরে তার রেশ রেখে যাওয়া আর্তনাদ নেই, ককিয়ে কান্না নেই৷ কুকুরের কোনো শব্দ নেই৷ কুকুর নেই৷ নাকি আছে অথচ ডাকছে না৷ সাত ঘন্টা সময় হাতে৷ এটা নিয়েও খোঁজ-খবর করা যায়৷ কুকুরগুলো সব কোথায় গেল? ফুলরা কোথায় যায়, ফুলকুড়ানি বালিকারা কোথায় যায়, তারা যে তরুণদের দেখে মুগ্ধ হয় তারা কোথায় যায় এবং তারা যে কবরে যায়, সে কবর আবার ফুলদল হয়ে যায় এসব নিয়ে যে গান বেঁধেছিল সেই বুড়োটা বলতে পারবে? কোথায় গেল কুকুরেরা?
এমনকি হতে পারে যে কুকুরদের ল্যাজে তারাবাজি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল! তাতে মজা পেয়ে তারা আকাশে ছুটে গেছে লাফাতে লাফাতে আর রাতের শূন্যে তাকিয়ে আমরা সেইসব তারাবাজির গমনাগমন বা পুড়ে নিঃশেষ হয়ে ল্যাজ থেকে খসে পড়া অনেকক্ষণ বা অনেক যুগ, অনেক আলোকবর্ষ ধরে জ্বলতে থাকা দেখছি তো দেখছিই৷ আরও সাত ঘন্টা ধরেও দেখে যাওয়া যায়৷
অচেতন করে বেশ ধারালো অস্ত্র বা করাত দিয়ে যদি কুকুর চেরাই করা হয় তাহলে খুব একটা শব্দ হবে কি? করাতকলে দাঁড়িয়ে যারা গাছের গুঁড়ি চেরাই দেখেছে, দেখেছে ঝুরঝুর করে কাঠের গুঁড়োয় মাটি ঢেকে যেতে, তারা কি এত সূক্ষ্ম, এত সম্মোহিত শব্দ শুনতে পাবে? অচৈতন্য কুকুরদের চেরার শব্দ? ফাঁড়ার শব্দ! তারপর আরও সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণের শব্দ৷ এর আগেই তো আকাশগঙ্গার কথা হচ্ছিল যেখানে মহাকাশযানে লাইকাকে পাঠানো হয়েছিল৷ সেখান থেকে আমরা ইথার ও রক্তের গন্ধময় কুকুর ব্যবচ্ছেদের টেবিলে কীভাবে এলাম? কীভাবে এলাম, লাইকা? কীভাবে এলাম স্ত্রেলকা, বেল্কা? কীভাবে?
আমরা বরং এই রক্ত ও ইথারে মাখামাখি টেবিল ছেড়ে আকাশের ফুটো ফুটো তেরপলের নীচেই একটা বিকট দুর্গন্ধময় জায়গায় যেতে পারি, যার নাম, পিঁজরাপোল৷ অভিধানে বলা আছে যে পিঁজরাপোল হল- ‘অকর্মণ্য গোরু, ঘোড়া প্রভৃতির জন্য বৃহৎ পিঞ্জরাকারে ঘেরা স্থান৷’ সেখানে রাতে যায় রাত্রিচর রাক্ষস, চোর, প্যাঁচা বা বেড়াল৷ বৃষ্টি এখানে মৃত কুকুরদের পচাতে ও ফুলিয়ে ওঠাতে সক্রিয় হয়েছে, যেমন হয়েছে রোদ, ভ্যাপসা বাতাস, মাছি, মূষিক ও জীবাণু৷ এখানেই জন্মানো ও এখানেই মরে যাওয়া ওই কুকুর-শাবকটিকে দেখো যার চোখও ফোটেনি৷ এখন সে কিছুটা তুলোটে অবয়ব-এর৷ দেখো যে, পিঁপড়েরা তার চোখের বন্ধ, না ফোটা আস্তরণটি খেয়ে নেওয়ার ফলে তার চোখ খুলেছে৷ বড়োই অকিঞ্চিত্কর ওই ক্ষুদ্র একটি মৃত চোখ, যা ঘোলাটে৷ এইবার দেখো যে, সেই চোখে যার ছায়া পড়েছে, তার নাম মহাকাশ৷ ওই একটি মৃত চোখ বা দর্পণের বিন্দু ধরে রেখেছে ছায়াপথ, দূরে অপসৃয়মান গ্যালাক্সি, ক্রতু, পুলহ, শিশুমার তারামণ্ডল ও কত না ধূমকেতু ও বেকার, নিষ্প্রাণ কৃত্রিম উপগ্রহ৷ আরও আছে৷ কালপুরুষের দক্ষিণ-পূর্বে তাকাও৷ ক্যানিস মেজর বা বৃহৎ কুকুরমণ্ডলের দেখা পাবে৷ এরই মধ্যে দেখো কী সুন্দর ওই আকাশের উজ্জ্বলতম তারাটি৷ ওরই নাম লুব্ধক বা সিরিয়াস৷ যারা নক্ষত্র-চর্চা করে তারা জানে যে ১ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টায় ও ১ নভেম্বর ভোর ৪টে নাগাদ লুব্ধক মধ্যগমন করে৷ তার কী ইচ্ছা তা আরও সাত ঘন্টা পরে জানা যাবে৷ তার নির্দেশ জারি করা হয়ে গেছে৷ যা আর ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না৷ তবে এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷
পিঁজরাপোল একটা নয়৷ এবং একটির ভেতরেই কম করে একশো সতেরোটা কুকুরের শবদেহ গুনে ফেলা যায় যার মধ্যে ওই চক্ষুষ্মান শাবকটিকে না ধরলেও চলবে৷ বিভিন্ন বিচিত্র ভঙ্গিতে তারা পড়ে আছে৷ কারও গলায় ছেঁড়া দড়ি পরানো৷ কেউ বুড়ো৷ কেউ জওয়ান৷ কেউ প্রথমবার মা হতে যাচ্ছিল৷ এখন কৃমির খাদ্য৷ আরও সাত ঘন্টা তাই থাকবে৷ চূড়ান্ত মুহূর্তে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করার আগে কেউ কামড়াতে গিয়েছিল৷ কেউ শেষবার থাবা তুলেছিল৷ কেউ থাবা গুটিয়ে নিয়েছিল৷ কেউ মরে যাওয়ার পরে শান্ত, ঘুমন্ত চেহারা নিয়েছিল৷ পিঁজরাপোল আপাতত ধৃত কুকুরদের মৃত্যুভূমি হয়ে অন্যান্য পিঁজরাপোলের মতোই শবস্তব্ধ হয়ে থাকুক৷ মহাকাশ থেকে দেখলে এই কলকাতাকে একটি অতি নগণ্য তারাপুঞ্জ বলেই মনে হবে৷ অন্তত সাত ঘন্টা দূর থেকে দেখলে তো বটেই৷ অন্ধকারের ধাওয়া খেয়ে কিছু দুর্বল জোনাকি এক জায়গায় জড়ো হয়েছে৷ এই অবশ আলোর ঘেঁষে থাকা দেখতে থাকলে একসময় ঘুম নেমে আসে৷ এবং সেই ঘুম সাত ঘন্টা ধরেও চলতে পারে৷
তবে একটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই৷ একাধিক পিঁজরাপোল ঘুরে ঘুরে সব কটি কুকুরের শবদেহ লক্ষ করলে দেখা যাবে আগে যে বৈচিত্রের কথা বলা হয়েছে তা মোটেও সাধারণ চিত্র নয়৷ অনেক কেন, বেশির ভাগ কুকুরই অসহায়ভাবে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে৷ বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে যে কুকুরদের অসহায়তা শেখানো যায়৷ আমরা শাটলবক্স পরীক্ষার কথা জানতে পারি৷ শাটলবক্স হল একটি দু-ভাগে ভাগ করা বাক্স যার মধ্যে আড়াআড়িভাবে একটি অস্বচ্ছ বাধা বা বিভাজিকা থাকে, যার উচ্চতা, ধরা যাক, এক কুকুর৷ শাটলবক্সের মেঝেটি ধাতব৷ সেখানে তীব্র ইলেকট্রিক শক্ দিলে কুকুরটা লাফায় এবং বাধা টপকে বাক্সের অন্য অংশে চলে আসতে পারে, যেখানে মেঝেতে বিদ্যুৎ থাকে না৷ কিন্তু কুকুরটি যে নিরাপদ অংশে এল সেখানেও বিদ্যুৎ শক্ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে৷ এরকম হলে কুকুরটি দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ এবার অস্বচ্ছ বাধাটি সরিয়ে যদি উঁচু একটা কাচ লাগানো যায় তাহলে দেখা যাবে যে কুকুরটা লাফিয়ে কাচের গায়ে আছড়ে পড়ছে৷ অজান্তে বিষ্ঠা বা মূত্রত্যাগ করা, চেঁচিয়ে বা ককিয়ে ডাকা, কম্পন, বাক্সের গায়ে কামড়ানোর চেষ্টা – এরকম অনেক কিছুই তখন দেখা যাবে৷ কিন্তু দেখা গেছে যে এক-নাগাড়ে দশ-বারো দিন এই পরীক্ষা চালিয়ে গেলে কুকুরটি আর লাফাবার বা পালাবার চেষ্টা করে না৷ এইভাবে তাকে অসহায়তা শেখানো যায়৷ কুকুরেরা এই ভাবেই অসহায়তা শিখে নেয়৷ পরীক্ষার সময় দেখা গেছে যে কুকুরেরা হাল ছেড়ে দেয় এবং চুপটি করে শক্ নেয়৷ এইভাবে কুকুরেরা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং প্রমাণ করেছে যে, অসহায়তা মেনে নেওয়া শিখে ফেলা যায় ও শেখানো যায়৷ কুকুর উপকথায় যেহেতু কুকুরদেরই আনাগোনা বেশি, তাই বলে রাখা দরকার, যে অসহায়তা শেখানোর পরীক্ষায় শুধুমাত্র কুকুরদের ওপরেই পরীক্ষা চালানো হয়নি, অন্যান্য প্রাণীরাও ছিল – যেমন ইঁদুর ও গোল্ডফিশ৷
শাটলবক্স একটা জোটাতে পারলে হাতেনাতেই পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া যেতে পারে যে সত্যিই অসহায়তা শেখানো যায় কি না৷
হাতে তো এখনও সাত ঘন্টা সময় রয়েছে৷ ঘেউ! ঘেউ!