Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লোহার গরাদের ছায়া

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প157 Mins Read0
    ⤶

    ৪. দিনের আলো

    দিনের আলো কি এসবের হিসেব রাখে?

    দিনের আলোয় কি হৃদয়ের গভীর গোপনতল থেকে উঠে আসে এইসব সূক্ষ্ম কোমল অনুভূতিরা?

    দিনটা আবার দেখা দেয় রুক্ষ মূর্তিতে, অনুতাপটা হাস্যকর বাহুল্য লাগে, পৃথিবীকে হিংস্র প্রতিপক্ষ বলে মনে হয়।…

    তাই প্রতিটি মুহূর্তেই জেগে ওঠে অসহিষ্ণুতা, আর বিদ্বেষ, প্রতিটি অণুপরমাণুতে জন্ম নেয় সন্দেহ আর অভিযোগ।

    অভিমানের খোলসটা বেশি কঠিন হলেই বুঝি এমন হয়।

    কেউ কারও মনের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। দূরত্বের প্রাচীর বেড়েই চলেছে।

    অথচ একদা এদের মধ্যেকার দরজাগুলো সবই ভোলা ছিল। সেই খোলা দরজাগুলো আড়াল করে। দিয়েছে একটা উঁচু প্রাচীর।

    পাথরে তৈরি, অনেক উঁচু।

    .

    তবু একেবারেই কি সহজ কথা হয় না? হয়। তাও হয়। সবসময়ই হয়।

    অপর্ণা বলেন, ঝাল ঝাল তরকারি অত ভালবাসতিস, এখন আর ঝাল মুখে করতে পারিস না কেন বল তো?…বলেন, ডাক্তারবাবু যেসব ওষুধপত্তর টনিকফনিক লিখে দিয়ে গেলেন, সেগুলো খাচ্ছিস, না ফেলে দিচ্ছিস বাবা? শরীর তো মোটে সারছে না। আবার কখনও কখনও ডেকে ডেকে হেসে হেসে বলেন, অ নীলু শোন শোন, তোর পাকা ছেলের কথা শোন, বলে কিনা, বাবা বিথিলী, বাবা তোলে নেয় না।

    এই পাকা কথাটি যে তিনি নিজেই শিখিয়েছেন নাতিকে, সেটা অবশ্য চেপে যান।

    নাতিকে বাপের অনুগত করার জন্যে অনেক চেষ্টা করছেন অপর্ণা, সফল হচ্ছেন না। দু পক্ষেই অসহযোগ।

    ছেলেকে বাপের কোলে চাপাতে গেলেই ছেলে পরিত্রাহি চেঁচায়, আর বাপ অসম্ভব বলে দুম করে নামিয়ে দেয়।

    অপর্ণা বলেন, জন্মকাল থেকে তো দেখতে পায়নি, চিনতে দেরি হবে। তুই বাপু একটু ঘুষটুষ দিবি। টফি লজেঞ্চুষ হাতে নিয়ে ডাকবি।

    এমনি কথার কথা!

    এ কথা কোনও ভাবনাপ্রসূত নয়।

    তেমনি রমলার কথাটাও হয়তো ওই রকমই কথার কথা, কোনও অভিসন্ধিমূলক নয়, তবু রমলা যখন আলগা গলায় হেসে বলে উঠল, হ্যাঁ রে খোকন, তোর বাবা ও সব দেবার মধ্যে নেই, নেবার মধ্যে আছে–তখন সুনীলের রগের শির ফুলে উঠল। সুনীল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে রমলার দিকে তাকিয়ে বলল, যাক, স্বরূপটা তা হলে চিনে ফেলেছ?

    রমলা ভয়ের ভান করে বলে, ওমা তুমি রাগ করলে নাকি ভাই? আমি তো ঠাট্টা করে বললাম।

    ঠাট্টা কেন? ঠিক কথাই বলেছ। সর্বদা যে কথা মনে আসছে সেটাই বলে ফেলেছ।

    সুনীল উঠে যায় সেখান থেকে।

    অপর্ণা বিরক্তভাবে বলেন, তোমারও বড়বউমা আজকাল মুখ বড় আলগা হয়ে গেছে।

    বলেই ফেললেন, কারণ অপর্ণা তাঁর বড় ছেলের কথার মধ্যেও মাঝে মাঝেই সন্দেহের সুর শুনতে পান। বড়বউয়ের কথাতেও তাই। তবে রমলা যা কিছু বলে হেসে গা পাতলা করে।

    কিন্তু বলে তো নেয়।

    অপর্ণাই কি তাঁর ছোটছেলের ব্যবহারে তেমন সুখী? যে ছেলেটাকে কিছুদিন আগে চোখের জলে বিদায় দিয়েছেন, আর প্রতিদিন দিন গুনেছেন তার আসার দিনের আশায়, সেই ছেলেটা কি আর ফিরে এল?

    ভেবেছিলেন, তাঁর নীলু এসে দাঁড়ালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, অথচ তার এসে যাওয়াটা কতদিন হয়ে গেল, কিছুই ঠিক হচ্ছে না।

    কোনও কিছুই ঠিক হল না।

    সেই প্রতীক্ষার দিনেও বরং ওই দিন গোনার আনন্দটা ছিল। সারা সংসারটাই যেন ওই সব ঠিক হয়ে যাবার ব্যাকুল বাসনাকে মনের মধ্যে লালন করেছে নিশ্চিত বিশ্বাস দিয়ে।

    যখন সেই আসার দিনটি এগিয়ে এসেছে তখন সারা সংসারে সাড়া পড়ে গেছে। অপর্ণা বাড়ির প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা পরিষ্কার করিয়েছেন, সাজিয়েছেন আর সবাইকে শাসন করেছেন, মনে রাখিস ছোড়দাদাবাবু আসছে। ও এতটুকু নোংরা অগোছাল দেখতে পারে না।

    কিন্তু এখন?

    এখন যেন সব শাসন ভেস্তে গেছে, সব আয়োজন বৃথা হয়ে ব্যঙ্গ হাসি হাসছে।

    ছোড়দাদাবাবু সম্পর্কে কাউকে সমীহ শিহরিত করবার আর ক্ষমতা নেই অপর্ণার। অপর্ণা বুঝে ফেলেছেন ওই ব্যর্থতা বাড়ির দীনতমদেরও চোখে পড়েছে।

    আর অপর্ণা?

    অপর্ণাও বুঝে ফেলেছেন, তাঁর আয়োজন তাঁর ছোটছেলেকে প্রফুল্ল করার বদলে ক্ষুব্ধ করেছে। হয়তো বা ঈর্ষান্বিতও। একদিন হাসির ছলে এ কথাও বলেছে সে,তোমাদের ভগবান যে কেন মানুষকে মরার পর আর একবারের জন্যেও পৃথিবীটায় ঘুরে যাবার ব্যবস্থা রাখেননি, তার মানে বুঝেছি।…মরে যাবার পর যদি মানুষ একবার ফিরে এসে দেখতে পায়, আমার বিহনে কারুর কিছু বন্ধ যায়নি, পৃথিবী যেমন চলছিল চলছে, তা হলে তার মরার ওপর খাঁড়ার ঘা না কি তাই হত তো?

    অপর্ণা কি আর এ কথার মানে বুঝতে পারেননি? তবু মায়ের পক্ষে সব কিছুই সোজা। অপর্ণা বলছেন, কী যে বলিস, মাথা মুণ্ডু বুঝি না বাবা।

    রমলাও বলেছিল, সত্যি হঠাৎ এ কথার মানে? বুঝে বলেছিল, কি না বুঝে, কে জানে।

    কিন্তু নিজের ব্যাপারে রমলা অবোধও নয়, হেসে গা পাতলাও করে না।

    শাশুড়ির বিরক্তি মন্তব্যর সঙ্গে সঙ্গেই রমলা বলল, আমার নতুন করে কিছুই হয়নি মা, আপনাদেরই হয়েছে। সেই যে আপনিই বলেন না, পড়ল কথা সভার মাঝে, যার কথা তার প্রাণ বাজে। এ যেন তাই হল। ঠাকুরপোর সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা কবে না করি? তবে আর করব না।

    অপর্ণার তখন মনে হয়, কথাটা সত্যি, রমলার কথাবার্তা তো চিরদিনই এই রকম।…

    তারপর খুব গভীরে এই কথাটি ভাবেন, আমার ছেলেটা যেন কেমন চোয়াড়ে হয়ে গেছে। চোখের চাউনি সুষ্ঠু বদলে গেছে যেন।

    .

    ভবানীবাবুর কাছে গিয়ে প্রায় কেঁদে পড়েন অপর্ণা, দিনের পর দিন যাচ্ছে, ছেলেটা বাড়ি বসে বসে মন মেজাজ খারাপ করছে, ওর কথা তুমি কিছু ভাববে না?

    ভবানীবাবু উদাস ভাবে বলেন, ভাবি না, কে বললে?

    চমৎকার। শুধু ভাবলেই হবে? কিছু করতে হবে না?

    আমি কী করব?

    তুমি করবে না তো কী আমি করব?

    কারুরই কিছু করবার নেই।

    .

    অপর্ণা খুব রেগে যান, ভবানীবাবু যে চিরদিনই এইভাবে গা ঝাড়া দিয়ে কথা বলে দায়িত্ব এড়াতে চান, সে অভিযোগ করেন, এবং তীব্র ভাবে বলেন, ওর জন্যে কখনও কোনও দিন ভাবতে হয়েছিল তোমায়? নিজের গুণে টকাটক পাশ করেছে, চাকরি পেয়েছে, ভগবানের খেলায় আজ ওর এই অবস্থা।

    ভবানীবাবু তেমনি উদাস ভাবে বলেন, এসব কথা তো অবিরতই ভাবছি।

    শুধু ভাবলে তো হবে না। তোমার জানা চেনা ঢের বড় বড় লোক আছে। তাদের বলোগে ওর একটা চাকরি করে দিতে।

    ভবানীবাবু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বললেন, গিয়ে বলব? আর যদি তারা জিজ্ঞেস করে আপনার কোন ছেলের কথা বলছেন? যে ছেলেটি এতদিন জেলে ছিল? ছাড়া পেয়েছে বুঝি?

    অপর্ণা আরও রেগে বলেন, তা তুমি তাদের বোঝাবে না, বিনি দোষে শাস্তি হয়েছিল ওর।

    ভবানীবাবু আবারও তেমনি ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, ও কথা তো খুনির বাপও বলে।

    দরজার কাছে একটা ছায়া পড়ছিল, পড়তে আসছিল, সেটা সরে যায়, এঁরা লক্ষ করেন না।

    .

    চন্দ্রার ভয় ছিল সুনীল এলে তার মা বাপ দাদারা খুব টানাটানি করবেন তাকে নিয়ে। রোজ রোজ নেমন্তন্ন করবেন, রোজ রোজ গাড়ি পাঠাবেন, সুনীল হয়তো সে নেমন্তন্ন আগের মতো হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করবে না, চন্দ্রার প্রাণ যাবে দোটানায়, কিন্তু চার ভয়কে অমূলক করে দিয়েছেন ওঁরা।

    ওঁরা বলতে হয় বলা গোছর সেই যে প্রথম দিন বলেছিলেন, সেই পর্যন্তই।

    ওঁরা কেবল টেলিফোনে চন্দ্রাকে উপদেশ দেন, দিনরাত বাড়ি বসে থাকে এটা তো ঠিক নয়। নিয়ে নিয়ে বেরোবি। শ্বশুরের একখানা গাড়ি তো আছে? ছেলের জন্যে দেবেন না? ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বি। বন্ধুবান্ধবের বাড়ি গেলি, নয়তো থিয়েটারে সিনেমায়, খেলার মাঠে নিয়ে গেলি মাঝে মাঝে, বা এখানে চলে এলি–

    চন্দ্রা মাকে বাবাকে বলে, বলি তো কত, বেরোতেই চায় না।

    আর বউদিদের কাছে হলে হেসে হেসে বলে, ওর আর আদায় নেই বুঝলে? পেঁচা হয়ে গেছে। ভাবছি আবার ওকে সেখানেই পাঠিয়ে দিই।

    তবু চেষ্টা করে বইকী!

    কেঁদেকেটে হাতেপায়ে পড়ে অবশ্য নয় (তেমন করতে পারলে কেমন হত, কে জানে।) সহজ সাধারণ ভাবে বলে, অনেকদিন তো সিনেমায় টিনেমায় যাওয়া হয়নি, গ্লোবে একটা ভাল ছবি এসেছে, যাবে তো বলল, টিকিটটা কেটে আনি ফেরার সময়।

    সুনীল বিদ্রুপে মুখ কুঁচকে বলে, শুনে বেশ আমোদ লাগছে কিন্তু। গিন্নি অফিস ফেরত টিকিট কেটে আনবেন, আর আমি তাঁর আঁচল ধরে-বাঃ! ভেরি ইন্টারেস্টিং।

    মন থেকে বিষ তুলে তুলে, সব কিছু বিকৃত করে দেখোনা বুঝলে? সহজ হবার চেষ্টা করো।

    মাস্টার মশাইয়ের কথা মনে রাখবার চেষ্টা করব।

    যাবে না তা হলে?

    নাঃ।

    চন্দ্রা নরম হবারই চেষ্টা করে, আগে তো কলকাতায় এলেই ইংরেজি ছবি দেখতে ছুটতে, আমিই বরং তোমার জ্বালায় একটু বাংলা ছবি দেখতে পেতাম না।

    সে জ্বালা তো দূর হয়েছিল, আশা করি প্রাণভরে বাংলা হিন্দি সব দেখে নিয়েছ।

    চন্দ্রা মান খুইয়ে বলে না তুমি যতদিন ছিলে না, এসব কিছুই করিনি আমি

    অথচ এই মানটুকু না খোয়ানোর কোনও মানে হয় না। খোয়ালেই হয়তো মঙ্গল ছিল।

    কিন্তু মঙ্গলটা কে চায়?

    লড়াইয়ে জেতাটাই কাম্য।

    তাই চন্দ্রা অবলীলায় বলে, যতই দেখে থাকি, ফুরিয়ে তো যাবে না? দুটো টিকিট তা হলে কেটে আনছি?

    তোমার জন্যে আনতে পারো, আমি যাচ্ছি না।

    আমি একা যাব?

    এ প্রশ্নে সুনীলের চোয়াড়ে মুখটা ব্যঙ্গে আরও কুৎসিত হয়ে উঠল।

    সুনীল বলল, আহা একাই বা যাবে কেন? বিনে খরচে টিকিট আর এমন একটি সঙ্গিনী, কে না লুফে নেবে?

    চন্দ্রা আর কথা বলে না।

    ইতর কথার উত্তরে তো ইতর কথাই বলতে হবে? যা থেকে সংঘর্ষ উঠবে লজ্জাহীন, সভ্যতাহীন।

    অথচ সুনীল নামের ওই ইতর হয়ে যাওয়া লোকটা অবচেতনে বোধহয় বড় একটা সংঘর্ষই চায়। চন্দ্রার ওই নিরুত্তাপ অনুত্তেজিত পাথরের দেয়ালে ঘেরা মনটাকে টেনে বার করে এনে দেখতে চায়, কী আছে সেখানে। যা ছিল তা আছে কিনা।

    তাই বুঝি ইচ্ছে করে ইতরতা দেখায়।

    যেন ওটাই সেই পাথরের দেয়ালটা ভেঙে ফেলার অস্ত্র।

    কিন্তু হয় না। পাথরে চিড় খায় না।

    চন্দ্রা একবারও ফেটে পড়ে না।

    চন্দ্রা ওই কুৎসিত আঘাতে আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

    তবু চন্দ্রার মস্ত সুবিধে বেশ কয়েক ঘণ্টার জন্যে বাড়ির বাইরে থাকা।

    কিন্তু আবার এক এক সময় সে যেন নরম হয়ে আসে বইকী! যখনই সুনীলের থেকে দূরে থাকে, তখনই সুনীলের বর্তমানের চেহারাটা যেন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে যায়, চকিতে চকিতে ঝিলিক দিয়ে ওঠে সেই তার আগের মূর্তিটা।

    সেই ঝকঝকে মুখ, চকচকে চোখ, টগবগে কথা, সবটা মিলিয়ে খানিকটা আলোয় গড়া একটা অপরিসীম আনন্দের স্বাদ!

    তখন নিজেকে ভারী নিষ্ঠুর মনে হয় চন্দ্রার। মনে হয় হৃদয়হীন। সংকল্প করে সহানুভূতি দিয়ে মমতা দিয়ে ওকে আবার সেই আলোর জগতে ফিরিয়ে আনবে।

    ও তো সিনেমা থিয়েটারে যেতে চায় না, তবে কি মন্দির-টন্দিরে গেলে ভাল লাগবে, বলা যায় না, ওর স্বভাবের তো অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, এটাও হতে পারে।

    লোকটা যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন তার মুখটা দেখলে যেন মমতায় প্রাণটা উদ্বেল হয়ে ওঠে, হয়তো আস্তে ওর গায়ের ঢাকাটা ঠিক করে দেয়, সাবধানে মাথার নীচে বালিশটা সোজা করে দেয়। ভাবে কতদিনের কত ক্লান্তি জমানো রয়েছে ওর মধ্যে। ঘুমোক, ঘুমোক।

    কিন্তু কি একটা ছুটির দিনে চন্দ্রা সক্কালবেলা বলতে গেলে উষা ভোরে হালকা গলায় হইচই করে বলে উঠল, এই, এই, শিগগির উঠে পড়ো তো, দারুণ একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে–ওঠো ওঠো, আর ঘুমোতে হবে না।

    সুনীল চোখ খুলে তাকাল।

    আর মুখের খুব কাছাকাছি ওর মুখটা দেখে, হাতটা বাড়িয়ে টেনে ওকে কাছে এনে ফেলল।

    এ ভঙ্গি সুনীলের নতুন নয়।

    ছুটির সকালে এটাই ছিল সুনীলের পরিচিত খেলা।

    কিন্তু সেই বাহুবেষ্টনের মধ্যে কি সাঁড়াশির মতো এমন একটা লৌহ কঠিন চাপ ছিল? ছিল এমন একটা তীব্র ভঙ্গি? এ যেন সুনীল তার আততায়ীর গলা টিপে ধরছে।

    তবু চন্দ্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে হাঁপিয়ে উঠে হেসেই বলে, আরে দূর আমি কোথায় প্ল্যান করছি ঝপ করে স্নান-টান সেরে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ে বেলুড়ে দক্ষিণেশ্বরে চলে যাই, সকালটা ভাল ভাবে কাটিয়ে আসি, আর তোমার এখন এই সব অভদ্রতা?

    সুনীলের বাহুবন্ধন হঠাৎ শিথিল হয়ে যায়, তীক্ষ্ণ গলায় বলে, হঠাৎ বেলুড় দক্ষিণেশ্বর কেন? এই পরম পাপীটার পাপ স্খলন করতে?

    চন্দ্রার চোখে জল আসে।

    চন্দ্রা তার বিধ্বস্ত শরীরটাকে সামলে নেয়। মুখে আসছিল, তা সেটাও মিথ্যে কি! জেলখানার ভাত আর তার কদর্য পরিবেশ তোমাকে পাপের স্পর্শ দিয়েছে বইকী! তা নইলে তোমার এমন নীচ নোংরা মন হয়ে যায়?

    কিন্তু আজ চন্দ্রা সংকল্পে স্থির, কিছুতেই বিচলিত হবে না। তাই শান্ত গলায় বলে, ও সব জায়গায় কি কেবল পাপ স্খলন করতেই যায় লোকে? এমনি বেড়াতে যায় না? তোমার বাবাও তো আগে কত সময় যেতেন।

    বাবার নাম উল্লেখেই বোধহয় সুনীল আর কোনও মন্তব্য না করে বেজার গলায় বলে, বেড়াতে যাবার মুড থাকলে লোকে বেড়াতে যায়। আমার আপাতত সেটা নেই।

    তথাপি চন্দ্রা মিনতির গলায় বলে, সেটা তোমার না বেরিয়ে বেরিয়ে হয়েছে। বেরিয়ে পড়ে দেখো না। দেখবে খুব ভাল লাগবে। আমি তো ঠিক করছিলাম, প্রথমে বেলুড়ে গিয়ে, তারপর খেয়া নৌকোয় চেপে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে হাজির হওয়া। ওঠো না গো। সত্যি ছুটির দিনটা শুধু বাড়ি বসে খরচ করতে মন যায় না।

    সাধারণ কথা, সরলভাবেই বলা।

    সুনীল তথাপি নরম হয় না, চোখের উপর একটা হাত আড় করে চাপা দিয়ে শুয়ে থেকেই বলে, যাদের কাছে ছুটিটা দুর্লভ বস্তু, তাদের কথা আলাদা, যার অনন্ত ছুটি তার ওসব শৌখিন ইচ্ছে জাগে না।

    এবার চন্দ্রা ধৈর্যচ্যুত হয়। তীক্ষ্ণ স্বরে বলে, তার মানে তুমি কিছুতেই সভ্য হবে না, সুন্দর হবে না, নিজেকে অন্ধকারের গহ্বর থেকে উদ্ধার করবে না, কেমন? একবারও ভাবতে ইচ্ছে হয় না, আমি স্বাভাবিক হই, আমি সুস্থ হই, আমি আমার বাড়ির লোককে শান্তি দিই।

    এ কথার পর সুনীল ঝপ করে উঠে পড়ে। খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে তীব্র ব্যঙ্গের গলায় বলে, এইবার আসল কথায় এসো। বাড়ির লোককে শাস্তি দেওয়া দরকার। ঠিক! আমার জন্যে যে সবাই অশান্তি ভোগ করছে, সেটা টের পাচ্ছি। ঠিক আছে, শিগগিরই এর একটা ব্যবস্থা করছি।

    চন্দ্রা বসে পড়ে রুদ্ধ স্বরে বলে, কী ব্যবস্থা করবে? নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, না গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলবে?

    বলেই স্তব্ধ হয়ে যায় চন্দ্রা।

    এ তার কী হয়!

    যে কথা এক মুহূর্ত আগেও বলব বলে ভাবেনি, সেটাই বলা হয়ে যায় কী করে? এত রূঢ় এত কঠিন কথা বলতে পারল চন্দ্রা?

    হয়তো বড় বেশি নরম হতে এসেছিল বলেই আঘাত খেয়ে এমন কথা বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। যেন প্রণাম করতে এসে পদাঘাত খেতে হয়েছে চন্দ্রাকে, তাই এমন বৈকল্য।

    কিন্তু

    সুনীল কি অনুভব করবে সেটা?

    তাই ছেড়ে দেবে?

    নাঃ ছেড়ে দেবার কথাই ওঠে না।

    সঙ্গে সঙ্গেই সুনীল বলে ওঠে, আমার অবশ্য ওই শেষেরটাই পছন্দ, তবে তাতে হয়তো আবার বাড়ির লোককে অন্য অসুবিধেয় পড়তে হতে পারে

    অতএব?

    অতএব না শোনা পর্যন্ত বুঝি স্বস্তি হচ্ছে না? তা হলে শুনেই রাখো, বাড়ির লোকের চক্ষুশূল হয়ে থাকব না বেশিদিন। কেটেই পড়ব কোনও সময়।

    চন্দ্রার গলাটা আরও বুজে আসে। চন্দ্রার কথা বলতে খুব কষ্ট হয়, তবু চন্দ্র বলে, চমৎকার। মা বাপের একেবারে আদর্শ সন্তান! লোকে যাকে বলে থাকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

    আদর্শ?

    সুনীলের মুখ ব্যঙ্গে কুঁচকে আসে। চোর জোচ্চোর জেলখাটা ছেলে সম্পর্কে হঠাৎ এ কথাটা উঠছে কোথা থেকে?

    চন্দ্রা আর কোনও কথা বলে না।

    চন্দ্রা তার বিশাল দুটি চোখ তুলে একবার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে, ওই বিদ্রূপ মাখানো মুখের দিকে।

    তারপর আস্তে স্নানের ঘরে ঢুকে যায় নিজের সরঞ্জাম নিয়ে।

    অনেক আশা আর অনেক যত্ন দিয়ে গড়া একটা ক্ষণ এই ভাবেই ব্যর্থ হয়।

    বারেবারেই এভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।

    চন্দ্রা খুঁজে খুঁজে বেড়ায় কোথায় গানের জলসা হচ্ছে, কোথায় আধুনিক নাটকের অভিনয় হচ্ছে। কিনে আনে টিকিট, জোগাড় করে কার্ড, কিন্তু শেষ পরিণাম সেই কথার লড়াই।

    চন্দ্রার সব অনুরোধ, উপরোধ, মিনতি, নম্রতা সুনীলের ঔদাসীন্যের বর্মে ঠেকে ছিটকে পড়ে। কিন্তু একচুল এদিক ওদিক হয় না। যাওয়াটা হয় না।

    ক্রমশ আর ব্যঙ্গ বিদ্রূপও নয়, সম্পূর্ণ নির্বেদ ভাব।

    আমার ভাল লাগে না।

    এই হল যুক্তি।

    চন্দ্রা বারেবারে প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনও অনুরোধ করতে যাবে না, তথাপি হঠাৎ আবার কোনওদিন প্রত্যাশার পাত্রখানি বাড়িয়ে ধরে। বলে ওঠে, তোমায় কিছু বললেই তো আগেই না করে উঠবে, তবু বলছি–রবীন্দ্র সরোবরে একটা প্রদর্শনী খুলেছে, চলো না দেখে আসা যাক।

    সুনীল বলে, আমার যেতে ইচ্ছে নেই।

    চন্দ্রা বলে, অবনমহলে একটা পাপেট শো দিচ্ছে চলো না বাচ্চা কটাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনি।

    আগে অবশ্য বাচ্চা রমলার ছেলেটা মেয়েটাকেই বোঝাতো, কিন্তু চন্দ্রার ভাষা শুনে মনে হয়, নিজেরটাকেও জুড়ে দিচ্ছে ওদের সঙ্গে।

    হয়তো বা সেটাই আসল উদ্দেশ্য। পরবর্তী উদ্দেশ্য সুনীলকে বাইরে বার করা।

    কিন্তু চন্দ্রার অভিসন্ধি ব্যর্থ করে দিয়ে সুনীল বলে, আমার পয়সা নেই।

    ঈস! কী যে যা তা বলো। ছোট বাচ্চাদের ব্যাপার। আর তুমি ওই সব কথা বলছ? পয়সার জন্যে কী হচ্ছে? টিকিট তো আমি নিয়েই এসেছি।

    তাই নাকি, তার মানে, যা করবার তা হয়েই গেছে। অনুরোধ করতে আসাটা একটা শো।

    বিদ্যুৎহত না কী বলে, চন্দ্রার প্রায় সেই দশাই ঘটে। চন্দ্রা কঠিন গলা চাপবার চেষ্টা না করেই বলে, যাক ধরেই ফেললে। তা ঠিক শোই। তবে নাচের পুতুলের সুতোটা কারও হাতে নেই এই যা! যে যার নিজের তালে নাচছে।

    সুনীল ঘর ছেড়ে চলে যায়।

    অতএব চন্দ্রার চেষ্টাগুলো কোনও কাজে লাগে না।

    চন্দ্রা ক্রমশ হাল ছেড়ে দেয়।

    চন্দ্রা তখন মনে মনে ভাবে, ভাগ্যিস চাকরিটা ছিল। তবু এই একটা জায়গায় ভাগ্য আমায় দয়া করেছে।

    অথচ ওর ওই ভাগ্যটাই বাড়ির সকলের চক্ষুশূল।

    অপর্ণা ভাবেন, বউ অমন ধিঙ্গি হয়ে বেরিয়ে না গেলে, সারাক্ষণ কাছে কাছে থাকলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যেত।

    অপর্ণার বড় ছেলে চাপা বিরক্তিতে বলে, লোকে বলবে স্বামীর রোজগার গেছে, তাই ওঁকে বাধ্য হয়ে চাকরি করতে হচ্ছে। বাবার সেই মনগড়া যুক্তি, চাকরিটা তাঁর ছোটবউমার নিঃসঙ্গতার ওষুধ এ কথাটা আর খাটছে না।

    এমনকী একদিন সুনীল তেড়ে এসে বাবাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েও ছাড়ল। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের গলায় প্রশ্ন করল, ভবানী রায় নামের বিচক্ষণ ব্যক্তিটি তো তাঁর পুত্রবধূর নিঃসঙ্গতার দুঃখে বিগলিত হয়েছিলেন, কিন্তু এখন? এখন তাঁর আপন পুত্রের দিকটা তাকিয়ে দেখেছেন? যে মানুষটা এই দীর্ঘ আড়াইটি বছর নিঃসঙ্গতার শিকার হয়ে পড়েছিল, এখনও তার দিনগুলো কেমন করে কাটছে তা ভেবে দেখেন?

    ভবানী রায় বললেন, আমি তো ওকে বলি বাইরে-টাইরে বেরোতে, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে–

    সেটা ওর পক্ষে কত শক্ত তা ভেবে দেখেছেন?

    শক্ত বলে ঠেলে রাখলে দেয়ালটা ক্রমে হিমালয় হয়ে ওঠে সুশীল। ছোটবউমা সারাদিন ওকে ঘরে আগলে বসে থাকলেই ওর মনের অসুস্থতা ঘুচবে, এ বিশ্বাস আমার নেই। ওর জোর করেও বাইরে বেরনো দরকার। শুনছে কই? প্রথম এসে যাও বা সহজ ছিল, ক্রমশই তার থেকে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনের স্বাস্থ্য একেবারে নষ্ট করে ফেলছে।

    সুশীল খুব রেগে গেল।

    বলল, আপনি তো চিরকালই আপনার ছোটবউমার পক্ষে। ওঁর কোনও দোষই দেখতে পান না। এটা কি ভেবে দেখবার কথা নয়, নিজের ভুলেই থোক বা যে কারণেই হোক, একজন পুরুষমানুষ যদি তার ভাগ্য হারিয়ে, কর্মজীবন হারিয়ে, বেকার হয়ে বসে থেকে দেখে তার স্ত্রী দিব্যি সাজগোজ করে অফিস যাচ্ছে, তার মনের অবস্থা কেমন হচ্ছে?

    আমার বিবেচনায় এটাতেই তার নিরুদ্যম মনে উদ্যম জাগবার কথা সুশীল। তোমার কি ধারণা, নীলু চিরদিন এই ভাবেই থাকবে?

    থাকবে নয় বাবা, থাকতে বাধ্য হবে। চুরির দায়ে জেলখাটা আসামিকে কে চাকরি দেবে?

    ব্যবসাট্যবসা কিছু করতে পারে।

    সেই বুদ্ধি ওর?

    বুদ্ধিকে তো সৃজন করতে হয় সুশীল। ভাগ্যচক্রে একবার ভাগ্য হারালে, বরাবরের জন্যে নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষের কথা নয়।

    সুশীল বিদ্রুপের গলায় বলে, কী জানি! চিরদিনই তো শুনে এসেছি আপনার বড় ছেলেটা অসার অপদার্থ, ছোট ছেলেই সারালো পদার্থবান।

    সেদিন ভবানী রায় চট করে বলে ফেলেছিলেন, তোর কাছে মাথাধরার কোনও ওষুধ আছে?

    মাথাধরার!

    হ্যাঁ অনেকক্ষণ থেকে খুব মাথা ধরেছে।

    এর মানে, আর কথা বলতে নারাজ তিনি।

    অতএব দেখা যাচ্ছে একমাত্র ভবানীবাবুই চন্দ্রার কোনও দোষ দেখতে পান না। অথচ–দোষের শেষ নেই তার।

    যার বাপের টাকায় ছাতা ধরছে, আর বাপ সেই টাকায় মেয়ের মাথায় ছাতা ধরবার জন্যে ব্যগ্র হয়ে বসে আছে; সেই বাপের স্নেহকে সে দুপায়ে মাড়িয়ে ফেলে দিচ্ছে। অথচ আগে বাপের বাড়ি বলতে প্রাণ ছিল। ভাগ্য যখন মন্দ হয়, তখন বুদ্ধির ঘরেও শনি ঢোকে।

    নইলে ওই সুশীলের কাছেই তো চন্দ্রার দাদা বলেছে, কত টাকা মাইনে পায় চন্দ্রা? ওকে বলবেন, যা পায় তার ডবল টাকা, বাবা ওকে হাতখরচ বলে দিতে প্রস্তুত।

    এই অফারও ছেড়েছে চন্দ্রা।

    দুর্মতি ছাড়া আর কী?

    .

    সুনীলের এখন দৈনিক জীবনযাত্রার পদ্ধতি হয়েছে চন্দ্রা যতক্ষণ ঘরে থাকে, বেরোবার তোড়জোড় করে, ততক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকা। চন্দ্রা ভাত খেতে নেমে গেলে সুনীল বিছানা ছেড়ে ওঠে।

    চন্দ্রা তো আর ওর সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করেনি? চন্দ্রা ডাকাডাকি করে, এতে যে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাবে তা বোঝায় (তাই বলে কি আর সেই আগের মতো ছুটির দিনে বেলা অবধি শুয়ে থাকলে যা করত তাই করে? কানে জল দিয়ে, পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে বিছানা থেকে তুলে তবে ছাড়ে?) যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে। কিন্তু বুঝছে কে?

    চন্দ্রা একটা বুদ্ধি করতে চেষ্টা করে।

    ছেলেটাকে ঠেকিয়ে দিয়ে বলে, বাবাকে তোল।

    কিন্তু সুবিধে করতে পারে না।

    যে ছেলে রাতদিন বকবকিয়ে বেড়াচ্ছে আজকাল, বাড়ির প্রতিটি সদস্য যার কথার মধ্যে অগাধ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে পুলকিত হচ্ছে, সেই ছেলেই নিজের বাপের কাছে প্রায় বোবা।

    মায়ের হুকুম তামিল করতে দুএকবার হয়তো বলে, বাবা ওতো!

    বাবা আঃ! বলে এক ধমক দেয়, সে বেচারা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এবং দিদাকে গিয়ে লাগায়, বাবা বতেতে।

    অপর্ণা এতে অবাক হন, আহত হন।

    এমন সোনার চাঁদ ছেলে, পথের শত্রু যার দিকে ফিরে তাকায়, নীলু তার দিকে ফিরে তাকায় না, কাছে গেলে বকে!

    কারণ কী? কী এর রহস্য?

    ছোট ছেলেপুলে দেখতে পারত না সুনীল এমন তো নয়। কী ভালবাসত দাদার ছেলেমেয়েদের, তাদের বাচ্চাবেলায়।

    রহস্য আর কিছুই নয়, দুর্ভাগ্যের তাড়নায় মনের সুকুমার বৃত্তিগুলো শুকিয়ে গেছে।

    হতভাগা ছেলে বোঝে না–অপর্ণা মনে মনে বলেন, শিশুই সকল দুঃখের ওষুধ।

    এক-একদিন রাগও করেন, ছেলেটাকে অমন ঠেলে সরিয়ে দিস কেন রে?

    সুনীল অবলীলায় বলে, কী জানি ওকে দেখলেই আমার রাগ আসে।

    অপর্ণা নিজ স্বভাব অনুযায়ী হৃদয়ভার বেড়ে উঠলেই স্বামীর কাছে গিয়ে আছড়ে পড়েন, নীলু এমন করে কেন বলো তো?

    ভবানীবাবু বলেন, কেমন?

    আহা দেখতে পাও না? খোকাকে দেখলে নাকি ওর রাগ আসে। মানে পাই না এর।

    মানেটা ভবানীবাবু আবিষ্কার করলেন।

    বললেন, ব্যাপারটা মেয়েলি, অথবা গ্রাম্যতা, তবে মানুষ যখন দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়ে, তখন এসব কুসংস্কার এসে জোটে। খোকার জন্মের সূচনামাত্রই ওর দুর্ভাগ্যের শুরু, ওর জীবনটা ভেঙেচুরে গেল, হয়তো সেই ভেবেই–মানে তোমরা যাকে অপয়া টপয়া বলল আর কি।

    অপর্ণা স্বীকার করলেন, যুক্তিটা ঠিক।

    তাঁর নিজের যে কেন এটা মাথায় আসেনি, ভেবে বিস্মিত হলেন।

    তারপর বললেন, যাঠ! ষাঠ!

    .

    কিন্তু ভবানীবাবুর ব্যাখ্যাই কি ঠিক?

    তা হলে সুনীল কেন বসে বসে অতীতের ক্যালেন্ডার খুলে দেখে?

    সুনীলের বিপর্যস্ত হবার তারিখের সঙ্গে খোকনের জন্মতারিখ মিলোয় বারবার হিসেব করে, বারবার গুলিয়ে ফেলে।

    শুধু সেটা কেউ টের পায় না।

    সবাই ভাবে ওর দেহের স্বাস্থ্য তো বেশ ফিরছে, মনের স্বাস্থ্যই ফিরছে না কেন?

    এ নিয়ে চন্দ্রা একদিন ভবানীবাবুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

    বাবা আপনার ছোট ছেলের কোনও বাল্যবন্ধুটন্ধু নেই? খুব গরিব-টরিব? মানে জীবনে ফেলিওর!

    ভবানীবাবু প্রশ্ন শুনে একটু হাসলেন।

    বললেন, জীবনে ফেলিওর,গরিব-টরিবকে চোখের সামনে তো দেখা যায় না মা, তাদের তা হলে খুঁজে বার করতে হয়। তারা তো চোখের আড়ালেই থাকে।

    চন্দ্রা বসে পড়ে বলল, তবে তাই খুঁজুন বাবা! ভেবেচিন্তে দেখছি। ওর মানসিক স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনবার এটাই ওষুধ।

    ভবানীবাবু বললেন, তোমার প্রেসক্রিপশনটা হয়তো ঠিকই। কিন্তু ওষুধটা বোধহয় দুষ্প্রাপ্য।

    তবু পেতে চেষ্টা করলেন।

    ভবানীবাবু ছেলেকে বললেন, হ্যাঁরে তোর পিন্টুকে মনে পড়ে? ছেলেবেলায় খেলত তোর সঙ্গে।

    সুনীল বলল, হ্যাঁ মনে পড়বে না কেন? রাজমিস্ত্রির ভাইপো! কেন?

    না, এমনি বলছিলাম। রাস্তায় দেখা হল কাল। অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, দুঃখ করছিল—

    ওই পর্যন্তই।

    সুনীল বিন্দুমাত্রও উৎসাহ প্রকাশ করল না, বরং অবজ্ঞাই প্রকাশ করল। বাল্যবন্ধুর অবস্থা খারাপ কি ভাল, ওতে কিছুই এসে যায় না তার।

    অতএব ঔষধ প্রয়োগ হল না।

    অতএব অসুস্থ মন নিয়েই পড়ে থাকে সুনীল, আর চন্দ্রাকে তীর বেঁধে। যেন এটাই এখন তার জীবনের লক্ষ্য।

    চন্দ্রারও পণ বিঁধেছে, সেটা টের পেতে দেবে না।

    কিন্তু পণ রাখতে পারা কি সোজা?

    সত্যি তো আর চন্দ্রা তার মনের চামড়াটা কুমিরের চামড়া করে তুলতে পারেনি?

    সুনীল যে অকারণেই তীর বেঁধে।

    অথবা হয়তো অকারণেও নয়, চন্দ্রার হিসেবের ভুলেই। চন্দ্রা যদি একবারও সেই তীর খেয়ে আর্তনাদ করে উঠত, যদি তার ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয়টাকে একবারও উদ্ঘাটিত করে বসত, তা হলে হয়তো ব্যাধ তাঁর তুণের তীর সংবরণ করত। হয়তো অনুভব করতে পারত তার নিষ্ঠুরতার ওজনটা কতখানি।

    চন্দ্রা এই হিসেবটা করে না কোনওদিন।

    চন্দ্রা আর্তনাদ করে না, রক্তাক্ত হৃদয়টা দেখায় না।

    অতএব সুনীলকে নতুন নতুন তীর খুঁজতে হয়। না হলে হয়তো চন্দ্রা যখন অফিস থেকে ফিরে বাড়ির বেশবাসে, নির্মল মূর্তিটি হয়ে বসে জিজ্ঞেস করল, আর এক কাপ চা খাবে? আমার জন্যে জল চড়িয়েছে দেখলাম–তখন ফস করে এ কথা বলার কী দরকার ছিল সুনীলের। তোমার নিত্য নতুন সাজের বাহার দেখে অফিসে হাসে না?

    চন্দ্রা এখন আর কোনও কথাতেই চমকায় না, নীতিগত ভাবেই চমকায় না, তাই অম্লান মুখে বলে, কেন? হাসবে কেন? সকলেই জানে আমার দেদার শাড়ি আছে।

    সুনীল বিস্বাদ গলায় বলে, শাড়ি অবশ্যই আছে, কিন্তু রোজ রোজ বাহারি শাড়ি পরার মুখটা কি আছে?

    চন্দ্রা সুনীলের ওই পেশি পেশি হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে স্থির চোখে একটু তাকিয়ে বলে, মুখ না। থাকবার কী আছে? আমি কি বিধবা?

    চন্দ্রা চমকায় না, সুনীল চমকাল।

    মুহূর্তের জন্যই অবশ্য।

    পরক্ষণেই বলে উঠল, বিধবা তো তবু ভাল, তার দুঃখই আছে, লজ্জা নেই। কিন্তু তোমার?

    আমারও লজ্জা নেই–বলল চন্দ্রা, আমি জানি আমি যা ছিলাম আমি তাই আছি।

    ওঃ তার মানে এই হতভাগাটার সঙ্গে সম্পর্কটুকুও অস্বীকার করছ?

    তার মানেই যদি তাই হয়, তো হোক।

    যদি টদি নয়, যা সত্যি তা বোঝা শক্ত নয়।

    চন্দ্রার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

    তোমার মতন ছোটলোকের পক্ষে কোনও কিছুই বোঝা শক্ত নয়।

    ছোটলোক। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

    কিন্তু এটা কি নতুন?

    চন্দ্রা কি তাদের সেই ত্রিবেণীর কোয়ার্টার্সে যখন-তখন বলত না, তোমার মতন ছোটলোক যদি আর দুটো দেখেছি।

    বলত।

    সুনীল একটু বেশি আদর করে ফেললেও বলে বসত।

    অভ্যস্ত মুদ্রাদোষ।

    কিন্তু সেই বলা আর এই বলা?

    সুনীল গুম হয়ে গেল।

    বলল, তা বটে! আমি যে নিজে কী, মনে থাকে না সেটা।

    .

    ব্যস দুচারদিনের মতো বাক্যালাপ বন্ধ হয়ে যায়।

    চন্দ্রাও বলতে আসে না, এতে বাবুর এত রাগের কী হল? আমি তো অমন বলিই চিরকাল।

    অথবা সুনীলও বলতে আসে না, রাগলে তোমায় দারুণ দেখায়, তাই রাগাবার তালে ঘুরি।

    যেমন বলত আগে।

    হয়তো ভিতরে ভিতরে এই বলার ইচ্ছেটা আছড়ায়। কিন্তু সে ইচ্ছে অনভ্যাসে বোবা হয়ে থাকে।

    এগিয়ে আসবার ক্ষমতা আর কারুরই নেই।

    .

    তবু কোনও এক সময় কথার সেই বন্ধ দরজা আস্তে আস্তে খুলে যায়। হয়তো সামান্য কোনও উপলক্ষে। হয়তো চন্দ্রাই এসে বলে, মা তোমায় খুঁজছিলেন–

    অথবা হয়তো সুনীলই বলে, বাবার শুনলাম খুব মাথা ধরেছে, এখানে কোথায় যেন নোভালজিন ছিল দেখেছিলাম–

    আস্তে আস্তে আবার কথা।

    সাধারণ কথা।

    বাসের ভিড়ের কথা, বাজারের দরের কথা, কিংবা বর্তমান রাজনীতির দুর্নীতির কথা।

    মাঝে মাঝে হেসেও ওঠে বইকী চন্দ্রা!

    বলে, একবার স্বরাজ এসে দেশের সব দুঃখ ঘুচিয়েছিল, এবার সাম্য এসে শেষ দুঃখ ঘোচাবে।

    তবু এরই মাঝখানে হয়তো সুনীল নামের হতভাগা লোকটা বলে ওঠে, আজকাল আর বাপের বাড়িমুখো হতে দেখি না যে? বড়লোক বাবার আদরের রস শুকিয়ে গেছে? না কি দাগী আসামির বউয়ের মুখ দেখেন না আর তাঁরা?

    হ্যাঁ এই রকম ভাষাতেই কথা বলতে শিখেছে এখন সুনীল।

    মাত্র কিছুকাল আগেও যেটা ভাবা যেত না।

    চন্দ্রাও অবশ্য সমান সমান উত্তর দেয়, কিন্তু চন্দ্রার ভাষা তো তার আভিজাত্য হারায়নি। তাই চন্দ্রা বলে, খুবই স্বাভাবিক। মেয়ের মুখ দেখতে হলেই তো জামাইয়ের মুখ দেখার প্রশ্ন উঠবে।

    অপর্ণা মাঝে মাঝে হইচই করার চেষ্টা করেন, নতুন কোনও রান্না বা খাবার তৈরি করে নাতিনাতনি সমেত দুই ছেলে দুই বউকে ডেকে একসঙ্গে খাওয়াতে বসানোর সাধ প্রকাশ করেন, কিন্তু শেষ অবধি সেটা ধাষ্টামোয় পরিণত হয়ে যায়।

    ছোট ছেলে যদি বা খেতে নামে, হয়তো বড় ছেলে কাজের অজুহাতে নামে না। অথবা বড়বউয়ের ঠিক সেই মহামুহূর্তেই দারুণ মাথা ধরে।

    রমলার অবশ্য বরাবরই শরীর খারাপ নামক বিলাসিতাটা ছিল, কিন্তু তার জন্যে কোনও আমোদ আহ্লাদের ভাগ থেকে বঞ্চিত হতে দেখা যেত না তাকে। জীবনলীলার ষোলো আনা রস উপভোগ করে নিয়ে উদ্বৃত্ত সময়টুকুকে রাখত শরীর খারাপের জন্যে।

    কিন্তু এখন ভঙ্গি বদলেছে।

    এখন ওই রমলা নামের মহিলাটি হঠাৎ হঠাৎ চিরপরিচিত খোলস ছেড়ে, নতুন নতুন খোলস আঁটছেন, সংসার সদস্যরা সহসা চিনে উঠতে পারছে না।

    শুধু হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাচ্ছে তাদের রমলা আর কথায় কথায় হেসে গা পাতলা করে না, রমলা আর সবাইয়ের সব কথায় ফোড়ন কাটে না। রমলা আর শাশুড়ির সুচক্ষে পড়ার জন্যে অকারণ রান্না ভাঁড়ার ঘরে ঘুরঘুর করে না।

    ছেলেমেয়েদের স্কুল আর স্কুলের পড়া। এই দুটোকে দারুণ সিরিয়াস করে তুলে রমলা, নিজেকেই স্রেফ উপর তলায় তুলে ফেলেছে।

    বিস্ময়ের বিষয় এই পুরনো দাসী রাঁধুনীর সঙ্গে যেন হঠাৎ আঁতাত বেড়ে গেছে রমলার, আগে যাদের নাকি দুচক্ষের বিষ দেখত। এবং যখন তখন কথার ছলে জানিয়ে রাখত রমলার হাতে যদি কোনওদিন এ সংসার পড়ে, রমলার সর্বপ্রথম কাজ হবে ওদের বিদায় করা।

    তারা এসব শুনেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা কানে তুলো আর পিঠে কুলো দিয়েই থেকেছে। কারণ এখন তারা বড় বউদিদি বলতে অজ্ঞান হচ্ছে। এবং মায়ের দোষেই যে ছোট বউ অমন বিটকেল হয়ে উঠেছে।

    তা এসব কথা ফিসফিসিয়ে চলে, বাড়ি নিস্তব্ধ।

    সদা সর্বদাই বাড়ি নিথর।

    রমলার কলকল্লোল নেই, বাচ্চাদের হুটোপাটি নেই, অতএব বাড়ি যেন শ্মশানের শান্তি নিয়ে বিরাজমান।

    ভবানীবাবু তো এমনিতেই চিরকাল প্রায় নির্বাকের ভূমিকাতেই ছিলেন, সেটা আরও একটু স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

    অপর্ণাও ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন যেন।

    সংসার সুদ্ধু লোকের যেন এই কমাসেই বয়েসটা কয়েক বছর বেড়ে গেছে।

    তবু অপর্ণাই একদিন কথাটা তুললেন।

    বললেন, বাপ কাছে ছিল না বলে থোকার অন্নপ্রাশন হয়নি, খোকার এবারের জন্মদিনে একটু ঘটাপটা করা হোক।

    ভবানীবাবু বললেন, বেশ তো।

    অপর্ণা মান খুইয়ে রমলাকে পরামর্শে নিতে গেলেন, কার্ড ছাপিয়ে বেশ ভাল করেই হোক কাজটা, কী বলো বড় বউমা?

    আগে হলে নিশ্চয়ই বড় বউমা সর্বশরীরে আহ্লাদের হিল্লোল তুলে বলে উঠতেন, ওমা! কী মজাই হবে তা হলে। সত্যি মাঝে মাঝে ঘটাপটা না করলে যেন সংসারটা ঝিমিয়ে পড়ে। আমি কিন্তু মা গাড়িটা নিয়ে নেমন্তন্ন করতে বেরবো-

    বলতো! নির্ঘাতই বলত।

    কিন্তু এখন মেজাজের পালা বদল হয়েছে, তাই রমলা মুখে নির্লিপ্তির চাদর টেনে বলে, আমি আর কী বলব, আপনার যা ইচ্ছে তা করবেন।

    কিন্তু অপর্ণার মেজাজ এত বদলায়নি যে রেগে উঠবেন না, উঠবেনই। উঠলেনও।

    বললেন, তা বলবেই নাই বা কেন? ছেলের ভাতে ঘটা হয়নি, সে কথা তুমি জানো না?

    রমলা আরও উদাসীন মুখে বলে, জানব না কেন? কিন্তু কেন হয়নি সেটাই জানতাম না। আমার তো বরং মনে হয়েছিল, লোকে বলবে ছেলেটা কী দুর্ভাগ্য, জ্যাঠা ঠাকুর্দা সবাই থাকতেও, বাপ কাছে নেই বলে অন্নপ্রাশনটুকুও হল না। বাপ রইল জেলে, ছেলে জন্মাল লুকিয়ে, এটাই আমার আশ্চর্য লেগেছিল।

    অপর্ণা রমলার কথার সুরটা ধরতে পারেন না।

    অপর্ণা থতমত খেয়ে বলেন, তুমি কী বলতে চাও বলল তো বউমা?

    রমলা অবাক গলায় উত্তর দেয়, ওমা, বলতে আবার কী চাইব! আমার শুধু মনে হয়েছিল, ঠাকুরপো আসামাত্রই একটা ঘটাপটা করা উচিত ছিল।

    অপর্ণা বলে ওঠেন, সে কথা কি বলিনি আমি? তাতে তোমার ঠাকুরপো কী বলেছিল, মনে নেই?

    রমলা অমায়িক মুখে বলে, কী জানি মা, কে কখন কোন কথা বলছে, সব কি কানে আসে?না কানে এলেই মনে থাকে?

    অপর্ণা ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, কানে কেন আসবে না বড় বউমা, তোমার সামনেই বলেছিল। মনে নেই তাই বলল। বলেনি যে, ছেলে ফাস্ট হয়ে পাশ করার উপলক্ষে লোক খাইয়েছ, সেটাই হাসির কথা, কিন্তু দোহাই তোমার মা, ছেলে জেল থেকে বেড়িয়ে এল বলে লোক ডেকে খাওয়াতে বোসো না, লোকে গায়ে ধুলো দেবে। মনে নেই?

    রমলা বলে, বললেন তাই মনে পড়ল। তবে খোকার উপলক্ষে ঘটা করলে লোকে গায়ে ধুলো দিত না মা।

    অপর্ণা বেঁজে উঠে বলেন, তা তখন কেন সেই পরামর্শই দাওনি বাছা।

    ওমা! আমি দেব পরামর্শ?

    রমলা অনেকদিন পরে হেসে গা পাতলা করে। আমি আবার একটা মনিষ্যি! আমার পরামর্শ নিচ্ছেই বা কে! নিলে আজ সংসারের এমন হাল হত না।

    চলে যায়।

    অপর্ণাকে প্রায় ধুলোয় বসিয়ে দিয়ে।

    তবু অপর্ণা বসে পড়েন না।

    অপর্ণা এবার স্বয়ং ছোট বউমাকেই কাণ্ডারী করেন।

    এবার আর পরামর্শের দিক দিয়ে যান না, বেশ ডাঁটের সঙ্গে বলেন, একটা কাগজ পেন্সিল নিয়ে বোসো তো ছোট বউমা, যেমন যেমন বলি, ফর্দ লিখে নাও।

    চন্দ্রা প্রশ্ন করে না, কীসের ফর্দ। চন্দ্রা কাগজ পেন্সিল নিয়ে এসে দাঁড়ায়।

    অপর্ণাকে আবারও মান খোওয়াতে হয়। অপর্ণা নিজ ইচ্ছা ব্যক্ত করেন, খুব সহজ ভাবের। অভিনয়ে।

    খোকন সোনার মুখে ভাতের সময় তো গণ্ডগোল গেল। ওর এবারের জন্মদিনে কিছু লোকজন ডাকব বাড়িতে, নামগুলো লিখে নাও-তো বউমা।

    প্রশ্ন নয়, পরামর্শ নয়, নির্দেশ।

    অতএব প্রতিবাদের প্রশ্ন নেই।

    তা চন্দ্রার মুখচ্ছবিতে প্রতিবাদ ফোটেও না, বরং যেন আবেগ আহ্লাদের ভাবই ফুটে ওঠে।

    শুধু বলে বুড়োধাড়ি ছেলের জন্যে এখন আবার এত!

    তারপর একটা কাগজ কলম নিয়ে বসে বলে, কই বলুন কী লিখতে হবে?

    অপর্ণা এখন উদার চরিতানাম, তাই দরাজ গলায় বলেন, সর্বপ্রথম তোমার বাপের বাড়ির নাম লেখো।

    চন্দ্রা একটু থমকে বলে, কেন?

    কেন কি ছোট বউমা? ছেলের সব কাজে মামার বাড়িরই হচ্ছে অগ্রাসন। তোমার বাপের বাড়ির দিকে সবাইয়ের নাম লেখো। মামার বাড়ি মাসির বাড়ি পিসির বাড়ি, তারপর এদিকে চলে আসা হবে।

    অনেকদিন পরে চন্দ্রার মুখে পুরনো কালের মতো কৌতুকের হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসিমাখা মুখে বলে, ব্যাপার কী বলুন তো? এইসঙ্গে কি নাতির বিয়েটাও লাগিয়ে দিতে চান নাকি? কনে সন্ধানে আছে?

    কী মধুর এই সহজ সরল কৌতুকের হাসি। কী সুন্দর এই পারিবারিক সুখের ছবি।

    অপর্ণা হেসে উঠে বলেন, কনের আবার সন্ধান করতে যাব কী জন্যে গো? তোমার ছেলের কি বুড়ি কনে পছন্দ হবে না?

    চন্দ্রার হঠাৎ মনে হল, ইচ্ছে করলেই তো মানুষ এই সহজ জীবনের মধ্যে নিমগ্ন থাকতে পারে।

    অথচ আমরা ইচ্ছে করে জটিলতার জাল রচনা করে সেই জালে আটকা পড়ে ছটফট করে মরি, ইচ্ছে করে ঘূর্ণির সৃষ্টি করে তার মধ্যে আবর্তিত হতে থাকি।

    .

    অপর্ণার নির্দেশে এবং নির্বেদে বিরাট একটি তালিকা প্রস্তুত করে ফেলে চন্দ্রা হেসে বলে, বেশ একখানা পাগলের কাণ্ড করা হল, এবার ছাঁটাইয়ের কাঁচি নিয়ে বসুন।

    অপর্ণা বলেন, ইস! কাঁচি অমনি চালালেই হল। সব থাকবে।

    থাকুক।

    বলে চন্দ্রা কাগজখানা অপর্ণার কাছে রেখে দিয়ে হাসি হাসি মুখে উঠে যায় উপর তলায়।

    গিয়ে দেখল সুনীল যথারীতি বিছানায় লম্বা হয়ে সকালের পড়া কাগজখানাই আবার উলটোচ্ছে। আসল কথা শুধু শুয়ে থাকাটা অস্বস্তির, অথচ ঘুরে বেড়িয়ে কিছু করতেও যেন আড়ষ্ট লাগে। নিজেকে অন্যের চোখ থেকে আড়ালে রাখতে পারলেই যেন স্বস্তি পায় সুনীল।

    চন্দ্রা ঘরে ঢুকেই কাগজখানা ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে সরিয়ে রেখে হাসি হাসি মুখে বলে, ওঠো! আর কুড়োমি করে পড়ে থাকলে চলবে না। কোমর বাঁধতে হবে। মা নাতির বিয়ের ঘটা লাগাচ্ছেন।

    সুনীল উঠে বসে সবিস্ময়ে বলে, কার বিয়ের ঘটা লাগাচ্ছেন।

    আর বোলো না।

    চন্দ্রা তেমনি হালকা গলায় বলে, খোকনের ভাতে ঘটা হয়নি, এই আক্ষেপে মা এখন ওর এবারের জন্মদিনে নারদের নেমন্তন্ন করবেন ঠিক করে ফেলেছেন। এতক্ষণ তার লিস্ট তৈরি হচ্ছিল।

    সুনীলের মুখের রেখায় মুহূর্তে কুটিলতার ছাপ পড়ে।

    আবার শুয়ে পড়ে বলে, তা ঘটাটাই বা হয়নি কেন?

    হয়নি কেন? বাঃ! চমৎকার। ঘটার অবস্থা ছিল?

    দুরাবস্থাই বা কিসের? ফর শো? তাই বুঝি ওটাকে খোকা খোকাই করা হয়, নাম হয়নি!

    ওটা।

    থেমে গেল সুর, ছিঁড়ে গেল বীণার তার, রক্তের প্রতিটি কণিকায় জ্বলে উঠল আগুন।

    খাটের ধারে বসে ছিল, দাঁড়িয়ে উঠে তীব্র গলায় বলে উঠল চন্দ্রা, তোমার কথাবার্তাগুলো স্রেফ বস্তির মতো হয়ে গেছে।

    কী? কী বললে?

    যা বললাম ঠিকই, চন্দ্রা উত্তেজিত হয়ে বলে, নিজের ছেলেমেয়ের সম্বন্ধে ওভাবে ওটা বলে কথা বলা বস্তির লোকেরই অভ্যাস।

    ওঃ নিজের ছেলে!

    সুনীল কুটিল হাসি হেসে বলে, আমার তো ওটাকে নিজের ছেলে বলে মনেই হয় না।

    এ কথা সুনীল আগে মায়ের কাছেও বলেছে। কিন্তু যে অসঙ্গত কথা মায়ের কাছে বলে পার পাওয়া যায়, স্ত্রীর কাছে কি তা যায়?

    চন্দ্রাও তীক্ষ্ণ তীব্র প্রশ্ন করল, কী বললে?

    কী আবার বলব। যা সত্যি কথা তাই বললাম। মনে হয় না। হিসেবেও তো পাই না—

    হিসেবে পাও না?

    না। আর ওর মুখটা ঠিক তোমাদের নিউ আলিপুরের ড্রাইভারটার মতো দেখতে লাগে।

    .

    চন্দ্রা একটা কাণ্ড করে বসল।

    চন্দ্রা হাতের কাছ থেকে একটা ভারী বই ছুঁড়ে মারল সুনীলকে।

    চন্দ্রার সারা শরীরের রক্ত মুখে উঠে এল। চন্দ্রা চাপা গর্জনে বলল, ইতর ছোটলোক। বর্বর শয়তান।… কে তুমি? সুনীল রায়? ভবানী রায়ের ছেলে সুনীল রায়? হু, সুনীল রায় অনেকদিন মরেছে। তুমি হচ্ছ। তার প্রেতাত্মা! তার মূর্তিটা ধরে ঠকাতে এসেছ আমাদের। তুমি যাও যাও। তোমাকে আর সহ্য করতে পারছি না আমি। ওঃ না তুমিই বা যাবে কেন? বাড়ি তোমার বাবার, আমিই চলে যাব।

    সুনীল যখন বলে উঠল, হিসেবে পাই না–তখন সুনীলের মধ্যে একটা হিংস্র উল্লাস উথলে উঠল। যেন কোনও প্রতিপক্ষকে একটা মুখের মতো জবাব দিতে পেরেছে।

    কিন্তু যে মুহূর্তে ও বলে ফেলল, ওর মুখটা ঠিক তোমাদের নিউ আলিপুরের ড্রাইভারটার মতো দেখতে লাগে– সেই মুহূর্তেই পা থেকে মাথা অবধি যেন প্রবল একটা বিদ্যুতের ঝাঁকুনি খেল সে। এ কী করে বসল সে? এ কী কথা বলে বসল সুনীল রায় নামের একটা ভদ্র বাড়ির ছেলে।

    কই, এক মুহূর্ত আগেও তো এই অশ্লীল অসভ্য কথাটা তার মনের কোনওখানে ছিল না। এ কথা বলতে গেল কেন সুনীল? কোন শয়তান তার মধ্যে ভর করে হঠাৎ হঠাৎ যা তা কথা বলিয়ে নেয়।

    সুনীল একটা অসহায়তা অনুভব করল, সুনীলের মনে হল কোনও একটা অদৃশ্য পৈশাচিক শক্তি সুনীলকে ঘাড় ধরে একটা অন্ধকার পথে চালিয়ে নিয়ে চলেছে।

    সুনীল সেই অসহায় ক্ষণে চন্দ্রার খেপে যাওয়া মুখ দেখতে পেল।..

    ভয় পেল সুনীল।

    দারুণ ভয় পেল।

    সেই সঙ্গে আঘাত এল ওই ভারী বইটার। রগের কাছে এসে লেগেছিল বইটা, সুনীল যেন এতে বেঁচে গেল। সুনীল রগটা চেপে ধরে মুখ ঝুঁকিয়ে বসল, কিন্তু চন্দ্রা আর সে দিকে তাকাবে না! চন্দ্রা চলে যাবে।

    চন্দ্রা ঝড়ের মূর্তিতে আলমারিটা হ্যাঁচ করে টেনে কয়েকটা শাড়ি টেনে নিল, যে শাড়িগুলো চন্দ্রার নিজের উপার্জনের টাকায় কেনা। সামান্য মূল্যের আটপৌরে শাড়ি। সুনীল কেবলই দামি শাড়ির আর সাজসজ্জার কথা উল্লেখ করে বলে, সস্তা ধরনের কয়েকটা শাড়ি কিনেছিল চন্দ্রা।

    চন্দ্রা তারপর ঘর তছনছ করে খোকার অবশ্য প্রয়োজনীয় কতকগুলো জিনিস আর জামা জুতো তোয়ালে টেনে টেনে একটা সুটকেসে ভরে নিল, চন্দ্রা সেই সুটকেসটা নিজে হাতে বয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

    এই দণ্ডে কোথাও চলে যেতে হবে।

    যে কোনওখানে। আর এক মিনিটও এই সর্বগ্রাসী আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না চন্দ্রা। চলে যাবে যে দিকে থোক।

    শুধু নিউ আলিপুরের দিকে নয়।

    সেখানেও আগুন।

    সেখানে হিংস্র শ্বাপদসংকুল অরণ্য।

    .

    সুনীল জানে না সে এখন কী করবে। চন্দ্রার হাতের এই আঘাতটা ভয়ংকর হয়ে উঠে সুনীলকে সংজ্ঞাশূন্য করে ফেলল না কেন? সুনীল তা হলে একেবারে নিশ্চিন্ত হয়ে বাঁচত!

    কিন্তু ভাগ্য এত দয়ালুনয় যে, সামান্য একখানা বইয়ের ধাক্কায় সুনীলের এত বড় সমস্যাটা সমাধান করে ফেলবে বইটা ভারী বলে।

    সুনীলের হঠাৎ লাগার ঝিম ঝিমটা বরং কমেই যায়। তবু সুনীল উঠতে পারে না। সুনীলের চোখের সামনে একটা লাল টকটকে মুখ সর্বনাশের সংকেত নিয়ে আন্দোলিত হতে থাকে।

    সেই সর্বনাশের সংকেত ভবানী রায়ও দেখতে পেলেন।…যখন চন্দ্রা তার ছেলেটাকে দুহাতে চেপে ভবানীবাবুর চোখের সামনে তুলে ধরে স্থির গলায় প্রশ্ন করল, বাবা। দেখুন তো এর মুখটা! আমাদের নিউ আলিপুরের ড্রাইভারের মতো দেখতে লাগছে? দেখুন, খুব ভাল করে দেখুন।

    নিউ আলিপুরের ড্রাইভারের মতো!

    ভবানীবাবু কয়েক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ওই প্রশ্নকারিণীর মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে কোনও ভাবের প্রকাশ নেই, শুধু একটা বর্ণহীন শূন্যতা।

    চন্দ্রা চোখ ফেরাচ্ছে না, চন্দ্রা যেন তার প্রশ্নটা পুঁতে দিয়ে তার প্রতিক্রিয়াটা দেখার জন্যে অপেক্ষা করছে।

    .

    একটু পরে দেখা গেল সে প্রতিক্রিয়া।

    ভবানীবাবুর ভাঙা গলার হাহাকার শোনা গেল, ও তা হলে পাগলই হয়ে গেল ছোট বউমা?

    চন্দ্রা ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে ভবানীবাবুরই চৌকির একধারে বসে পড়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বলে ওঠে, হয়তো তাই! কিন্তু বাবা, পাগলের হাতের বন্দুকের গুলিতে মানুষ খুন হয় না? পাগলে ছুঁড়েছে বলে পাথরের চাঁই তার কাজ করে না?

    কান্নায় ভেঙে পড়া এই কণ্ঠস্বরকে সহজের কোঠায় আনতে সময় লাগে, সেই সময়ের ব্যবধানে চন্দ্রা মুখ তুলে আস্তে বলে, আমায় আপনি ক্ষমা করুন বাবা, আমায় ছেড়ে দিন, আমায় চলে যেতে দিন।

    চলে যেতে দেব!

    প্রশ্ন নয়, অভিযোগ নয়, শুধু কয়েকটা শব্দ উচ্চারিত হল একটা স্খলিত কণ্ঠ থেকে।

    চন্দ্রার মাথাটা নিচু করা ছিল, এখন আবার মুখটা তুলল চন্দ্রা, বলল, আপনি বলছেন থাকতে?

    ভবানীবাবু আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, না! সে কথা বলার ধৃষ্টতা আর নেই আমার ছোট বউমা।

    অতএব এ বাড়ির ছোট বউমা এ বাড়ি থেকে বিদায় নিচ্ছে। সে চলে যাবে।

    সুনীল রায় থাকবে, কারণ এ বাড়িটা তার বাবার বাড়ি।

    কিন্তু চন্দ্রা?

    তা ওরই কি বাবার বাড়ি নেই? এ বাড়ির থেকে আরও অনেক বড় অনেক সুন্দর বাড়িই আছে।

    অপর্ণা কেঁদেকেটে বললেন, এখন কি ওর মাথার ঠিক আছে? কী বলতে কী বলছে, এই দুঃসময়ে তুমি ওকে ফেলে বাপের বাড়ি চলে যাবে?

    চন্দ্রা বলল, বাপের বাড়ি তো যাচ্ছি না।

    যাচ্ছ না? তবে?

    একজন বন্ধুর বাড়ির একতলায় একটা ঘর পেয়েছি, খোকার আর আমার বেশ কুলিয়ে যাবে।

    অপর্ণা কপালে করাঘাত করে বলেন, এ আমার কী হরিষে বিষাদ, চারদিকে এই জ্বাজ্বল্যমান সংসার, আত্মকুটুম্ব, আমি কোথায় ঘটা করতে বসছি, আর তুমি বন্ধুর বাড়ির একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে ছেলে নিয়ে একা থাকতে যাবে? স্বেচ্ছাচারের একটা সীমা নেই?

    চন্দ্রা বলল, আমায় মাপ করুন।

    সুশীল ভাশুর হয়েও মধ্যস্থতা করতে এল। বলল, ঘরের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি কার না হয়? তাই বলে কে ঘর ছাড়ে? চিরকালই তোমার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি চন্দ্রা।

    তা হলে তো জানেনই আমায়।

    জানেন বললেই চলে না। বেশ নিজে যাচ্ছ যাও, ছেলে নিয়ে যাওয়া চলবে না। এ বংশের ছেলে ওভাবে যেখানে সেখানে ।

    চন্দ্রা স্থির গলায় বলল, ও এ বংশের ছেলে কিনা সেটাই তো এখনও স্থির হয়নি।

    তার মানে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে।

    সুশীল লজ্জায় ধিক্কারে আগুন হয়ে চলে গেল।

    তবু রমলা বলতে এসেছিল, আমি ঠাকুরপোর হয়ে তোর হাত ধরে ক্ষমা চাইছি চন্দ্রা—

    চন্দ্রা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এ সময় তো আপনার ভাঁড়ার ঘরে অনেক কাজ থাকে দিদি? বাজে কাজে সময় নষ্ট করতে এসেছেন কেন?

    ভবানীবাবু শান্ত গলায় বললেন, জানি তুমি হার মানবে না, তবু যদি কখনও কিছু দরকার পড়ে—

    ভবানীবাবুর যে বার্ধক্য ধরেছে তা ওঁর উচ্চারণ শুনলেই বোঝা যায়। গলা সব সময়ই কাঁপে।

    আর এ বাড়ির ছোট ছেলে?

    এ নাটকে যে আসল আসামি?

    সে কি কিছুই বলেনি?

    না, সে কিছু বলেনি, এ কথা বললে অন্যায় অবিচার করা হবে তার উপর।

    সে অনেক ক্ষমা চেয়েছিল, অনেকবার নিজের দোষ স্বীকার করেছিল, নিজেকে বর্বর বলেছিল, অমানুষ বলেছিল, আর সত্যিই যে সুনীল রায় নামের মানুষটার মৃত্যু ঘটেছে, এ তার প্রেতাত্মা, এমন কথাও ঘোষণা করেছিল। তবু চন্দ্রা চলেই গেল।

    চন্দ্রা বলল, হয়তো আমি থেকে গেলাম, কিন্তু থেকে গেলে, দুজনে একই বাড়িতে থেকে যাব এই পর্যন্ত! কী লাভ তাতে? আমাদের জীবন থেকে একটা লোহার গরাদের ছায়া কি মুছে ফেলতে পারব?

    সুনীল এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকাল। চন্দ্রার চোখের দৃষ্টি শূন্য, চন্দ্রার মুখের রং রোদ লাগা কচি কলাপাতার মতো। চার শিথিল হাত দুটো দুপাশে ঝুলে পড়েছে।

    চন্দ্রার কোলের সামনে ছেলেটা দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ির একটা কোণ মুঠি পাকিয়ে। ঠিক যেমন দাঁড়িয়ে থাকত রমলার ছেলে শঙ্খ তার এই রকম শৈশবকালে।

    সুনীল ধমকের অভিনয় করত, ছাড় ছাড় বলছি মায়ের আঁচল। মায়ের আঁচল ধরা খোকা হবি নাকি?

    ছেলেটা আরও শক্ত করে মুঠোটা বাগিয়ে ধরত। বাদ-প্রতিবাদ নয়, নীরব জেদের মূর্তি।

    অপর্ণা বলতেন, ঠাকুর্দার মতন চেহারা, ঠাকুর্দার মতন জেদ। মুখে কথাটি নেই, জেদটি ষোলো আনা বসানো ঠাকুর্দা।

    সুনীল হঠাৎ সেই জেদি ছেলেটার চেহারার সঙ্গে এই ছেলেটার একটা আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখতে পেল। সুনীল ওই ছেলেটার ঝকঝকে চোখ দুটোর মধ্যে আর দুটো ঝকঝকে চোখের আভাস দেখতে পেল, অপর্ণার ঘরের দেরাজের উপর রাখা একটা গোল ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকা একটা মুখ! ছবিটা পুরনো হয়ে গেছে, তবু চোখ দুটো ঔজ্জ্বল্য হারায়নি। এই ছেলেটা সেই চোখ দুটো চুরি করল কখন?

    তার মানে সুনীল এই ছেলেটাকে এমন স্পষ্ট করে দেখেনি কোনওদিন। এমন খোলা চোখে তাকিয়ে।

    সুনীলের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।… সুনীল এখন পাতাল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে।

    সুনীল বুঝি তলিয়ে যাবার ভয়েই ট্যাক্সির দরজাটা শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় বোবা গলায় বলে, আমি যদি সে ছায়া মুছে ফেলি?

    চন্দ্রা আস্তে বলে, অপেক্ষায় থাকব।

    যদি তোমার বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়াই, ঢুকতে দেবে তো চন্দ্রা?

    চন্দ্রা চোখ তুলে বলল, আমি তো কোনওদিন আমার ঘরের দরজা বন্ধ করিনি। শুধু জানোই তো চিরদিন ধুলো মাখা পায়ে ঘরে ঢোকা আমি সহ্য করতে পারি না।

    সরে গেছেন অপর্ণা, সরে গেছেন ভবানীবাবু,… ছেলেটা গাড়িতে ওঠবার জন্যে ছটফট করছে, ট্যাক্সি ড্রাইভারও অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করছে, চন্দ্রা বলল, গাড়িটা অস্থির হচ্ছে, যাচ্ছি।

    উঠে পড়ল!

    ছেলেটাকে তো আগেই উঠিয়ে দিয়েছে।

    গাড়ি ছেড়ে দিল।

    সুনীলের চোখ থেকে তবু গাড়ির ছায়াটা মুছে যাচ্ছে না।

    ছায়া জিনিসটা কি তা হলে সত্যিই অনড় অচল?..না কি কালের হাত কোথাও বসে অপেক্ষা করে অলক্ষ্যে ধীরে ধীরে রবার ঘষে ঘষে ছায়াটা মুছে ফেলবার জন্যে।

    ⤶
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসেই রাত্রি এই দিন
    Next Article এই তো সেদিন

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }