Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌকিক এবং অলৌকিক গল্প – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প238 Mins Read0

    পুরোনো কলকাতার একটি বাড়িতে

    পুরোনো কলকাতার একটি বাড়িতে

    অনেকদিন আগে এই গল্পটা শুনেছিলাম৷ কে বলেছিল, ঠিক কবে বলেছিল, সেসব ভুলে গেলেও, গল্পটা কিন্তু মনে আছে৷ প্রথম যখন শুনি আমার সেই বয়সের শিরদাঁড়ায় শিহরন খেলে গিয়েছিল৷

    আজকালকার পাঠকদের কেমন লাগে, দেখাই যাক৷ গল্পটা এইরকম৷

    বিকেল তখন ফুরিয়ে এসেছে, কাটোয়া লোকাল হাওড়া স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামল৷ ট্রেনের মাঝামাঝি একটা কম্পার্টমেন্ট থেকে নেমে এল রাজেন৷ তার এক হাতে টিনের সুটকেস, আরেক হাতে মোটা কাপড়ের ব্যাগ৷ অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে লম্বা প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেটে কালো কোট পরা রেলবাবুদের হাতে টিকিট জমা দিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে চলে এল সে৷

    একে-ওকে জিজ্ঞেস করে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ ধরে যে বাসগুলো শ্যামবাজারের দিকে যায় তার একটায় উঠে পড়ল রাজেন৷

    তিন বছরও পুরো হয়নি, দেশ স্বাধীন হয়েছে৷ কলকাতায় এখনকার মতো এত লোকজন ছিল না, যানবাহনও অনেক কম৷ রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নেই৷ মানুষের ভিড়ও তেমন চোখে পড়ে না৷

    বাসটা হাওড়া ব্রিজ পেরিয়ে বড়বাজারে চলে এল৷

    রাজেনের বয়স বাইশ-তেইশ৷ তাদের বাড়ি কাটোয়ার সিদ্ধেশ্বরীতলায়, গঙ্গার কাছাকাছি৷ তার পরনে ধুতি আর ঢোলা ফুলশার্ট৷ পায়ে বাটা কোম্পানির পুরু চপ্পল৷ সেই সময় এখনকার মতো এত প্যান্ট-শার্টের চল ছিল না৷

    রাজেন এই প্রথম কলকাতায় এল না৷ তবে উত্তর কলকাতায় তার কখনও আসা হয়নি৷ শ্যামবাজার, শোভাবাজার, ফড়েপুকুর এইসব নাম তার শোনা৷ এই এলাকাগুলো কেমন, তার ধারণা নেই৷ এই বিশাল শহরে আগে বেশ কয়েকবার যে রাজেন এসেছে, দক্ষিণ কলকাতার শেষ প্রান্তে বেহালা শখের বাজারে তার নমিতা পিসির বাড়িতে উঠেছে৷ নমিতা পিসি তার বাবার আপন বোন নয়৷ দূর সম্পর্কের খুড়তুতো বোন হলেও নমিতা পিসি এবং তার স্বামী রাজেনের পীতাম্বর পিসে খুবই ভালোমানুষ৷ যখনই সে বেহালা শখের বাজারে আসে, পিসিরা কী আদর-যত্নটাই না করে৷ যতবারই এসেছে নমিতা পিসিরা সহজে তাকে ছাড়েনি৷ কম করে আট- দশদিন তাদের কাছে কাটাতেই হয়েছে রাজেনকে৷

    এবার নমিতা পিসিরা নেই৷ বাড়িতে তালা লাগিয়ে কাশী-মথুরা-বৃন্দাবনে তীর্থ করতে গেছে৷ একমাসের আগে ফিরবে না৷ তাই রাজেনের শোভাবাজারের কাছাকাছি অবিনাশকাকুদের বাড়িতে দিন সাতেক থাকা ছাড়া উপায় নেই৷

    অবিনাশ দত্ত রাজেনের বাবার বন্ধু৷ কলকাতার একটা বিদেশি স্টিভেডর কোম্পানির অফিসে দু’জনে সহকর্মী ছিল৷ বাবার বন্ধু, সেই সুবাদে কাকা৷ বাবা এবং অবিনাশকাকু বছর তিনেক হল রিটায়ার করেছে৷

    রাজেনের বাবা বাসুদেব নিয়োগী পঁয়ত্রিশটা বছর কলকাতার মেসে থেকেই চাকরি করেছে৷ ছুটিছাটায় কাটোয়ায় যেত৷ অবসরের পর কলকাতার মেস-টেস ছেড়ে বাসুদেব নিয়োগী পাকাপাকিভাবে কাটোয়াতেই থাকছে৷ এখন খুবই অসুস্থ, বাড়ি থেকে বেরুনো একরকম বন্ধ৷ একমাত্র অবিনাশ দত্ত ছাড়া অফিসের পুরোনো কলিগদের সঙ্গে তার যোগাযোগও নেই বললেই হয়৷

    রাজেন দু’বছর হল বি-কমটা পাশ করেছে৷ কিন্তু চাকরি-টাকরি এখনও কিছুই জোটেনি৷ নানা অফিসে দরখাস্তর পর দরখাস্ত পাঠানোই সার৷

    রাজেনের একটা কাজ দরকার৷ কেননা বাবা অসুস্থ৷ তার তিন-চারটে ছোট ছোট ভাইবোন৷ সংসারের সব দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে৷ হঠাৎই এই মাসে কয়েকটা অফিসে ইন্টারভিউ দেবার জন্য তাকে ডেকেছে৷ দু-একদিন গ্যাপ দিয়ে দিয়ে অফিসগুলোতে দৌড়তে হবে৷ কাটোয়া থেকে দু-একদিন পর পর এসে ইন্টারভিউ দেওয়াটা খুবই কষ্টকর৷ ট্রেন জার্নির ধকলের কথা বাদ দিলেও হুট করে গিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে গিয়ে বসলেই তো হল না৷ তার আগে বই-টই ঘাঁটতে হয়, মনকে তৈরি করে নিতে হয়৷ ট্রেনেই যদি সময় কেটে যায়, প্রিপারেশনটা কী করে হবে? তাই অন্তত দিনদশেক রাজেনের কলকাতায় থাকা দরকার৷ কিন্তু নমিতা পিসিরা ছাড়া এই শহরে তাদের অন্য কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই৷ সে থাকবে কোথায়?

    নিরুপায় হয়েই অফিসের পুরোনো সহকর্মীকে চিঠি লিখেছিল বাসুদেব নিয়োগী৷ অবিনাশ দত্ত চিঠি পেয়েই উত্তর দিয়েছে৷ রাজেন তাদের বাড়িতে ক’টা দিন থাকবে, এতে সে আর তার স্ত্রী বন্দনা খুবই খুশি৷ অবিলম্বে যেন রাজেনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে একটাই কথা৷ রাজেনকে সাবধানে থাকতে হবে এবং বাড়ির ভেতর অবিনাশ আর বন্দনা যেভাবে বলবে, তাকে সেভাবেই চলতে হবে৷

    বাড়ির ভেতর অবিনাশদের কথামতো চলতে হবে, সেটা না হয় ঠিক আছে৷ কিন্তু সাবধানতা কী কারণে? একটু খটকা দেখা দিলেও তেমন আমল দেয়নি বাসুদেবরা৷ তাই ব্যাগ-সুটকেস গুছিয়ে কাটোয়া লোকালে উঠে পড়েছিল রাজেন৷

    বাসটা বড়বাজার, চিৎপুর-টিটপুর ছাড়িয়ে কংক্রিটে-বাঁধানো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে ঢুকে স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছিল৷

    দেশ স্বাধীন হলেও ব্রিটিশ শিল্পপতিরা সবাই তখনও কলকাতা ছেড়ে ব্রিটেনে ফিরে যায়নি৷ সাহেব মালিকরা বা তাদের অফিসাররা ইন্টারভিউতে কী কী প্রশ্ন করতে পারে তাই নিয়ে রীতিমতো চিন্তা হচ্ছিল রাজেনের৷ অবশ্য দেশি কয়েকটা কোম্পানিও তাকে ডেকেছে৷

    বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করলেও তখন স্কুলে-কলেজে ইংরেজির ওপর জোর দেওয়া হত৷ ইংরেজিটা মোটামুটি ভালোই জানে রাজেন৷ গুছিয়ে লিখতেও পারে৷ কিন্তু বলার অভ্যাস নেই৷ কিন্তু ইন্টারভিউতে একটুও হোঁচট না খেয়ে ঝরঝরে সাবলীল ইংরেজিতে জবাব দিতে হবে৷ দুশ্চিন্তাটা সেখানে৷ কিছু করার নেই৷ ইন্টারভিউ দিতেই হবে৷

    সে কোথায় যাবে, বাসে উঠেই অবাঙালি কন্ডাক্টরকে জানিয়ে দিয়ে রাজেন বলেছিল, তাকে যেন সেখানে নামিয়ে দেয়৷

    কন্ডাক্টরটি তা মনে করে রেখেছিল৷ বিডন স্ট্রিট পেরুবার পর সে রাজেনের সিটের কাছে চলে এল৷—‘বাবুজি—’

    রাজেন অন্যমনস্ক ছিল৷ ডাকটা কানে যেতে একটু চমকে তাকাল৷

    কন্ডাক্টর বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে বলল, ‘আপনার ইস্টপ (স্টপ) এসে গেছে৷ উতার যাইয়ে (নামুন)—’

    সুটকেস আর ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে নেমে পড়ল রাজেন৷ অবিনাশ দত্ত চিঠিতে জানিয়ে দিয়েছিল বিডন স্ট্রিট পেরুবার পর বাঁ-দিকে তিনটে লেন পেছনে ফেলে চার নম্বর সরু রাস্তাটা হল রাধানাথ মল্লিক লেন৷ সেখানেই তারা থাকে৷ বাড়ির নম্বর তেরো৷

    সন্ধে নেমে গিয়েছিল৷ রাস্তায় রাস্তায় কর্পোরেশনের আলো জ্বলে উঠেছে৷ দু-ধারের বড় বড় বিল্ডিং আর ছোট-বড় নানা ধরনের দোকান এবং শো-রুম-গুলোতেও অজস্র আলো৷

    কলকাতার এই এলাকাটা রাজেনের পুরোপুরি অচেনা৷ চারপাশের বিশাল বিশাল বাড়িগুলোর চেহারা দেখে মনে হয় বহুকালের পুরোনো৷ কী একটা বইয়ে সে পড়েছে, এই অংশটাই আদি কলকাতা৷ অবশ্য সে শুনেছে নমিতা পিসিরা যেখানে থাকে সেই বেহালা শখের বাজারও প্রাচীন কলকাতা৷

    শহরের পুরাতত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় এটা নয়৷ তেরো নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনটা তাকে খুঁজে বের করতে হবে৷

    একটা ওষুধের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, একটু এগিয়ে বাঁ-ধারে যে গলিটা পাওয়া যাবে সেটাই রাধানাথ মল্লিক লেন৷ রাজেন পা চালিয়ে সেই গলিটায় ঢুকে পড়ল৷

    সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর গায়ে এরকম একটা গলি থাকতে পারে ভাবা যায় না৷ বড় রাস্তার বহুতল সব ইমারত আর আলোর ঝলকানি কিছুই এখানে নেই৷ রাধানাথ মল্লিক লেনটা যেন ছাপ্পান্ন পাকের গলি৷ কয়েক পা হাঁটলেই একটা করে বাঁক৷ প্রায় তিন বছর হল ইংরেজ রাজত্বের অবসান হয়েছে৷ কিন্তু এই গলিতে অনেকটা দূরে দূরে লাগানো গ্যাসবাতিগুলো এখনও থেকে গেছে৷

    সরু রাস্তাটার দু-ধারে নোনা-ধরা, গায়ে গায়ে ঠেকানো একতলা, দোতলা, তেতলা, আদ্যিকালের সব বাড়ি৷ ফাঁকে ফাঁকে টালি বা টিনের চালের ছোট ছোট কয়েকটা বস্তি৷ এসবের মধ্যেই কালীমন্দির, শনিমন্দির, শিবমন্দির৷ কেরোসিনের ডিবে ঝুলিয়ে তেলেভাজার দোকান, কবিরাজখানা, মুদিখানা, পান-বিড়ির দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি৷

    এখানকার বাড়িগুলো থেকে অবশ্য ইলেকট্রিকের আলো বেরিয়ে এসেছে৷ কিন্তু সেগুলো খুবই ম্যাড়মেড়ে৷ গ্যাসবাতি, কেরোসিনের ডিবে, ইলেকট্রিক আলো— সবই আছে কিন্তু চারপাশ কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা৷ রাস্তা দিয়ে লোকজন চলছে ঠিকই কিন্তু সব ছায়ামূর্তি৷ জোব চার্নক কি তিনশো বছর আগে এখানকার বাড়িগুলোর ভিত গেঁথেছিলেন?

    রাজেন চলেছে তো চলেছেই৷ এই গলিতে তেরো নম্বর বাড়িটার কথা যাকেই জিজ্ঞেস করছে তারই এক জবাব—আরেকটু এগিয়ে যান৷ এগুতে এগুতে কোথায় গিয়ে পৌঁছোবে সে?

    মাথায় গোঁ চেপে গেল রাজেনের৷ সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর মুখ থেকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট হাঁটছে সে৷ দেখা যাক আরও কতক্ষণ লাগে? এক ঘণ্টা, দু’ঘণ্টা যাই লাগুক সে ছাড়ছে না৷ বাড়িটা খুঁজে তাকে বের করতেই হবে৷

    কিন্তু না, আর বেশিক্ষণ তাকে হাঁটতে হল না, বাঁদিকে একটা চিঁড়েমুড়ি, চিঁড়ের মোয়া, খইয়ের মোয়া, বাদামভাজা, ছোলাভাজা, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি নানা জিনিসের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল রাজেন৷ তেরো নম্বর বাড়ির কথা বলতেই দোকানদার চমকে উঠে অদ্ভুত চোখে তাকাল৷ তার চোখেমুখে শুধু চমকই নয়, ভয়ও যেন ফুটে উঠেছে৷

    রাজেন অবাক৷ সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দোকানদার ঢোক গিলে বলল, ‘বাবু, আপনি ঠিক তেরো নম্বর বাড়িতেই যেতে চান?’

    রাজেন হতভম্ব৷ বলে কী লোকটা? একটু সামলে নিয়ে বলল, ‘তাই তো বললাম৷’

    এবার দোকানদারের গোলাকার মুখে খাবি খাওয়ার মতো ভঙ্গি ফুটে উঠেছে৷ তারই মধ্যে কিছুটা সামলে নিল সে৷—‘ও, আচ্ছা৷ আমার দোকানের গা ঘেঁষে যে বাড়িটা সেটাই তেরো নম্বর৷’

    ‘ঠিক আছে—’ কয়েক পা এগুতেই রাজেনের চোখে পড়ল আধাআধি খোলা সদর দরজার ডানপাশের পাল্লায় কালো ধ্যাবড়া হরফে লেখা ১৩৷

    যাক, শেষমেশ পাওয়া গেল৷ দরজাটা পুরোপুরি খুলে ঢুকতে যাবে, কী ভেবে চিঁড়েমুড়ির দোকানের দিকে তাকাল রাজেন৷ দোকানদার কচ্ছপের মতো গলাটা অনেকখানি বাড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে৷ চোখে সেই অদ্ভুত ভয় ভয় দৃষ্টি৷ চোখাচোখি হতেই গলাটা টেনে নিল৷

    রাজেন ভেতরে ঢুকতে গিয়ে ঢুকল না৷ দোকানদারের চোখে এত ভয়, এত চমক কেন? সে কি কিছু বলতে চায়? কী বলবে? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না৷ একটু দোনোমনো করে ঢুকেই পড়ল সে৷

    দরজা পেরুলেই দু-ধারে প্রায় পঁচিশ- ছাব্বিশ ফিট উঁচু, প্রায় তিরিশ ইঞ্চি পুরু, আদ্যিকালের নোনা-ধরা দেওয়াল৷ মাঝখান দিয়ে পাঁচ-ছ’ফিট চওড়া রাস্তা৷ অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো৷

    কারওকেই দেখা যাচ্ছে না৷ হঠাৎ রাজেনের মনে হল, অবিনাশকাকা কি আসল ঠিকানাটা লিখতে গিয়ে ভুল করে ফেলেছে? বাড়ির নম্বর হয়তো পনেরো৷ কুড়ি, বাইশ, চব্বিশ বা অন্য কিছুও হতে পারে৷ কিন্তু তাই বা কী করে হয়৷ অবিনাশকাকা ভুল ঠিকানা দিয়ে তাকে নাজেহাল করবে কেন? না, আরেকটু এগিয়েই দেখা যাক৷

    সামনের দিকে পনেরো-কুড়ি ফিট যেতেই চোখে পড়ল সুড়ঙ্গের মতো প্যাসেজটা ডান দিকে সামান্য বাঁক নিয়ে সোজা চলে গেছে৷

    বাঁকের মুখে আসতেই চোখে পড়ল, খানিকটা দূরে শান-বাঁধানো চাতালের ওধারে একটা মস্ত সেকেলে তিনতলা বাড়ি৷ রাজেন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে সোজাসুজি একতলার দু’টো ঘরে কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে৷ চাতালের ডানপাশেরও দু-তিনটে ঘরে ম্যাড়মেড়ে আলো৷ চাতালের দু’পাশ থেকেই মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে৷

    না, এটা জনশূন্য ভূতুড়ে বাড়ি নয়৷ এখন মনে হচ্ছে, অবিনাশকাকা সঠিক ঠিকানাই দিয়েছে৷ চিঠিতে জানিয়েছিল তারা তেরো নম্বরের দোতলায় থাকে৷

    মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকাল রাজেন৷ দোতলাতেও আলো জ্বলছে৷ সে পা বাড়াতে যাবে, হঠাৎ আরও উঁচু থেকে খস খস আওয়াজের মতো কিছু কানে এল৷ রাজেনের চোখ তেতলার দিকে চলে গেল৷ তেতলাটা অন্ধকার৷ কেউ থাকে বলে মনে হয় না৷ তারও ওপরে ছাদের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে অনেকটা ঝুঁকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে৷ আবছা আবছা অন্ধকারেও মনে হল কোনও মহিলা৷ বয়স বেশি হবে না, তিরিশের নীচেই৷ পরনে শাড়ি, কপাল অবধি ঘোমটা টানা৷ সে রাজেনের দিকে তাকিয়ে আছে৷ প্রায় চল্লিশ ফিট নীচে থেকেও বোঝা যাচ্ছে তার চোখ দুটো যেন জ্বলছে৷ মুখে অদ্ভুত মিষ্টি কিন্তু হিংস্র হাসি৷

    তেতলায় মনে হচ্ছে কেউ থাকে না৷ তা হলে প্রাচীন দুর্গের মতো এই বাড়ির ছাদ থেকে শরীরটাকে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে অর্ধেকটা ঝুঁকিয়ে কে এই মেয়েটি, আর তাকে এভাবে দেখছেই বা কেন? তার হাসিটা কী মারাত্মক!

    রাজেন ভীতু নয়৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তার সারা শরীর ভয়ে হিম হয়ে গেল৷ হূদপিণ্ডটা এত জোরে জোরে লাফাচ্ছে যে তার শব্দ শুনতে পাচ্ছে রাজেন৷ সে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না৷ মাথা নামিয়ে নিল৷ এত ভয় জীবনে কখনও পায়নি৷ সামলে নিতে অনেকটা সময় লাগল৷ তারপর বাঁধানো চাতালটায় চলে এল৷ সেখানে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগল, ‘অবিনাশকাকা, বন্দনা কাকিমা—’

    দোতলার বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে অবিনাশ দত্ত বলল, ‘তুই এসে গেছিস৷ আয় আয়, আরেকটু এগুলেই বাঁ পাশে সিঁড়ি৷’

    চাতাল পেরুতে পেরুতে নিজের অজান্তেই যেন দাঁড়িয়ে পড়ে ছাদের দিকে তাকাল রাজেন৷ আশ্চর্য, সেই তরুণী বউটি নেই, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে উধাও হয়ে গেছে৷ বেশ ধন্দে পড়ে গেল সে৷ সত্যিই কি বউটি ছিল, নাকি তার চোখের ভ্রম?

    কিন্তু বউটাকে স্পষ্ট দেখেছে রাজেন৷ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তার তাকানো, মধুর এবং হিংস্র হাসি তার শরীরে হিমের স্রোত বইয়ে দিয়েছিল৷ সেটা ভ্রম হয় কী করে? এখনও তো বুকের ভেতরটা লাফিয়ে চলেছে৷ এই আছে, এই নেই, কে সেই বউটা?

    অবিনাশ দত্ত বলল, ‘কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লি যে?’

    ধন্দটা এখনও কাটেনি রাজেনের৷ থেমে থেমে বলল, ‘না না, থামব কেন? যাব, যাব—’

    ছেলেটাকে একটু যেন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে৷ দু-এক লহমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাজেনের পা থেকে মাথা অবধি লক্ষ করে অবিনাশ দত্ত বলল, ‘তুই ওখানেই থাক৷ আমি আসছি—৷’ একটু পরেই সে নেমে এল৷—‘চল৷ তোর সুটকেসটা আমাকে দে৷ অনেকক্ষণ বয়ে বেড়িয়েছিস৷ নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে—’

    ‘না না, ওটা এমন কিছু ভারী নয়—’

    অবিনাশ দত্ত কোনও কথা শুনল না, সুটকেসটা একরকম জোর করেই টেনে নিল৷

    সিঁড়িতে আলো জ্বলছিল৷ দু’জনে ওপরে উঠে এল৷ দোতলায় আসতেই চোখে পড়ল সিঁড়ির বাইরে খানিকটা বাঁধানো চাতাল মতো জায়গা৷ সেটার বাঁ দিকের শেষ মাথা দিয়ে তেতলায় ওঠার সিঁড়ি৷ সিঁড়ির মুখে দরজা৷ সেটা তালাবন্ধ৷ আর একতলা থেকে দোতলায় উঠলেই চাতালের ডানপাশে একটা ঘর৷ ওটা কীসের ঘর বোঝা যাচ্ছে না৷

    তেতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে যেমন দরজা আছে, একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখেও তেমনি একটা দরজা৷

    অবিনাশ দত্ত ডাকলেন, ‘বন্দনা, তাড়াতাড়ি এসো৷ রাজেন এসে গেছে৷’

    দোতলার ছোট চাতালটার সামনের দিকে দু-আড়াই ফিট উঁচু, বেশ বড় একটা বারান্দা৷ সেখানে জোরালো আলো জ্বলছিল৷ বারান্দার তিন দিক ঘিরে কয়েকটা ঘর৷

    একটা ঘর থেকে বন্দনা বেরিয়ে এল৷ রাজেনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘এসো বাবা, এসো—’

    অবিনাশ দত্ত বলল, ‘তুমি ওকে বসার ঘরে নিয়ে যাও৷—রাজেন তোর সুটকেসটা আমার কাছে থাক৷ সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়ে আসছি—’

    এর মধ্যেই রাজেন বুঝে গেছে হাজার বললেও অবিনাশকাকা সুটকেসটা ছাড়বে না৷ সেটা না হয় ঠিক আছে৷ কিন্তু রাজেনের মনে একটা খটকা বা প্রশ্ন দেখা দিল৷ এখনও তেমন রাত হয়নি, খুব বেশি হলে সাতটা কি সওয়া সাতটা৷ তেতলার সিঁড়ির দরজায় আগেই তালা লাগানো আছে, দোতলার সিঁড়ির দরজাতেও সন্ধেবেলায় কেন তালা ঝোলানো হচ্ছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷

    বন্দনা কাকিমা বলল, ‘এসো— এসো—’

    চাতাল থেকে বারান্দায় উঠে এল তারা৷ বারান্দার সোজাসুজি পর পর তিনটে ঘর৷ বন্দনা কাকিমা রাজেনকে মাঝখানের মাঝারি মাপের ঘরে নিয়ে এল৷ গোটাতিনেক সোফা, চার-পাঁচটা গদি-আঁটা বেতের চেয়ার, একটা সেন্টার টেবিল আর একদিকের দেওয়াল ঘেঁষা একটা কাঠের আলমারিতে কিছু বই৷ এই বসার ঘরের আসবাবগুলোর কোনওটাই দামি নয়, সস্তার জিনিস৷

    বন্দনা কাকিমা বলল, ‘বোসো বাবা, বোসো—’

    হাতের ব্যাগটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে একটা সোফায় বসে পড়ল রাজেন৷

    অবিনাশকাকা সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে এসে রাজেনের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল৷

    রাজেনের মনে পড়ে গেল, দোতলায় উঠে আসার পর প্রথম জরুরি কাজটাই করা হয়নি৷ বন্দনা কাকিমা একধারে দাঁড়িয়ে ছিল৷ ব্যস্তভাবে উঠে গিয়ে তাকে প্রণাম করল, তারপর অবিনাশকাকাকে৷ দু’জনেই তার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘থাক—থাক—’

    প্রণাম-পর্ব সারা হলে ফিরে এসে সোফায় বসেই ক্ষিপ্র হাতে ব্যাগটা খুলে বড় একটা প্যাকেট বের করে বন্দনাকে দিতে দিতে বলল, ‘এটা নিন কাকিমা—’

    বন্দনা জিজ্ঞেস করল, ‘কী আছে এতে?’

    ‘বাবা একটু মিষ্টি পাঠিয়েছে৷ কাকা তো কাটোয়ার ক্ষীরের পান্তুয়া খুব ভালোবাসে—’

    অবিনাশ দত্ত প্রায় লাফিয়ে উঠল, ‘কাটোয়ার ক্ষীরের পান্তুয়া—একেবারে স্বর্গীয় ব্যাপার৷ ন’বছর আগে তোদের বাড়িতে যখন লাস্ট গেছি, খেয়েছিলাম৷ এখনও জিভে লেগে আছে৷’

    বন্দনা ধমক দিল, ‘থামো তো৷ মিষ্টির নাম শুনলে জিভ লক লক করে৷—রাজু, সেই কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে৷ ট্রেনে- বাসে অনেক ধকল গেছে৷ এখন একটু জিরিয়ে নাও৷ তারপর হাত-মুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছাড়ো৷’ বলে কিছু খেয়াল হতে অবিনাশের দিকে তাকাল৷—‘তুমি রাজুকে ওর বেডরুম আর আমাদের বাথরুমটা দেখিয়ে দিও৷ আমি এখন যাই—’

    ‘যাবে মানে? ছেলেটা এল, ওর জন্যে জলখাবার-টাবার—’

    ‘আমার কি সে হুঁশটা নেই? রাজু কখন এসে পৌঁছুবে তা তো বুঝতে পারছিলাম না৷ আগে থেকে লুচি ভেজে রাখলে চামড়া হয়ে যেত—’

    ‘তাই তো—’

    বন্দনা কাকিমা চলে গেল৷

    অবিনাশ দত্ত রাজেনের দিকে তাকাল৷—‘হ্যাঁ রে রাজু, বাড়ি চিনে এখানে আসতে অসুবিধা হয়নি তো?’

    রাজেন বলল, ‘না না, কীভাবে আসতে হবে, চিঠিতে সব জানিয়ে দিয়েছিলেন৷ শুধু—’

    ‘শুধু কী?’

    ‘রাধানাথ মল্লিক লেনে ঢোকার পর, মানে গলিটা সাপের মতো এঁকেবেঁকে—’

    রাজেনকে থামিয়ে দিয়ে অবিনাশ দত্ত বলল, ‘পুরোনো পাড়া তো, একে মোড়ের পর মোড়, তার ওপর গ্যাসবাতি, ম্যাড়মেড়ে ইলেকট্রিকের আলো, হ্যারিকেন—তাই একটু ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগে৷ যুদ্ধের আমল থেকে সাড়ে চোদ্দো টাকা ভাড়ায় পুরো দোতলাটা নিয়ে আছি৷ সন্ধের পর একটু ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগে৷ এত কম টাকায় এতগুলো ঘরওলা বাড়ি কলকাতায় এখন আর কোথাও পাওয়া যায় নাকি?’

    দু’বার ভূতুড়ে শব্দটা কানে ঢুকতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল রাজেন৷ অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকা মুড়িমুড়কি দোকানের সেই লোকটা আর তেতলার ছাদ থেকে ঝুঁকে পড়া বউটির চকিতের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা পাশাপাশি মনে পড়ে গেল৷

    অবিনাশ দত্ত লক্ষ করছিল৷ জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, কী ভাবছিস?’

    ‘না, কিছু না—’ একটু চমকে উঠে হাসল রাজেন, ‘আচ্ছা অবিনাশকাকা—’

    ‘বল—’

    ‘এ বাড়িতে ঢোকার সময় তেতলাটা অন্ধকার মনে হল৷ ওখানে কেউ থাকে না?’

    ‘না তো৷ ওটা বাড়িওয়ালার অংশ৷ বর্ধমানে তার তেলকল, চালকল, এই সব আছে৷ চার-পাঁচ মাস পর একবার এসে কয়েকদিন থেকে চলে যায়৷ বাকি সময়টা তালা-দেওয়া থাকে৷’

    ‘ওই জন্যেই বুঝি তেতলার সিঁড়ির মুখে তালা?’

    ‘হ্যাঁ৷’

    ‘তেতলার ছাদে কেউ থাকে না?’

    অবিনাশ দত্ত হকচকিয়ে গেল৷ পরমুহূর্তেই তার চোখের তারা দুটো একেবারে স্থির৷ স্বাভাবিক হতে খানিকটা সময় লাগল তার৷ হেসে হেসে বলল, ‘তুই তো একটা অদ্ভুত ছেলে৷ তেতলার সিঁড়ির মুখে তালা, ছাদের মুখে তালা৷ ন্যাড়া ছাদে কেউ থাকতে পারে?’

    একতলার চাতাল থেকে পলকের জন্য দেখার পরও মনে হয়েছিল চোখের ভ্রম৷ অবিনাশকাকা কেউ থাকে না বলার পর এখন তা অবিশ্বাস করার মতো কারণ থাকতে পারে না, কিন্তু কেমন যেন একটা খিঁচ থেকে যাচ্ছে—’

    অবিনাশ তাড়া দিল, ‘তোর কাকিমার লুচিভাজা বোধহয় শেষ হয়ে এল৷ এখানে এসে আমাদের বসে থাকতে দেখলে বকুনি লাগাবে৷ ওঠ, ওঠ, আগে তোকে তোর ঘরে নিয়ে যাই—’ রাজেনের সুটকেসটা তুলে নিয়ে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে৷

    রাজেন তার ব্যাগটা হাতে ঝুলিয়ে অবিনাশকাকার পিছু পিছু চলেছে৷ তার মনে হল, ছাদের ব্যাপারটা এড়ানোর জন্যে অবিনাশকাকা বড় বেশি তাড়াহুড়ো করে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ ভুলও হতে পারে৷

    বাইরে থেকে বারান্দায় উঠলে সোজাসুজি তিনটে ঘর৷ বারান্দার ডানপাশে এবং বাঁ-পাশে আরও দুটো ঘর রয়েছে৷ রাজেনের চোখে পড়ল ডানপাশের ঘরটায় আলো জ্বলছে৷ সেখান থেকে ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ আসছে৷ ওখানে পেছন ফিরে কোনাকুনি বসে কিছু করছে বন্দনা কাকিমা৷ নিশ্চয়ই ওটা রান্নাঘর৷

    অবিনাশ দত্ত রাজেনকে নিয়ে বারান্দার বাঁ-পাশের ঘরটার সামনে চলে এল৷ দরজার পাল্লা দুটো ভেজানো৷

    ‘একটু দাঁড়া—’ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বেলে অবিনাশকাকা ডাকল, ‘এবার আয়—’

    ঘরটা আলোয় ভরে গেছে৷ ভেতরে যেতেই চোখে পড়ল, একধারে সিঙ্গল-বেড খাটে পরিপাটি করে বিছানা পাতা৷ তা ছাড়া একটা আলমারি, লেখার জন্য চেয়ার-টেবিল ছাড়াও, একটা নীচু ছোট টেবিলে জলের বড় জগ, কাচের গ্লাস, সাবান, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, এমনি টুকিটাকি আরও কিছু জিনিস৷

    অবিনাশ দত্ত বলল, ‘এটা তোর ঘর৷ আলমারিতে সব জিনিসপত্র রাখবি৷ ওই হল পড়ার টেবিল৷ এখন আর বসতে হবে না৷ তা হ্যাঁ রে, ঘরে পরার মতো জামা- কাপড়, তোয়ালে এনেছিস? নাকি—’

    ব্যস্তভাবে রাজেন বলল, ‘সব এনেছি৷’ হাতের ব্যাগটা খুলে পাজামা, হাফশার্ট আর নতুন গামছা বের করল রাজেন৷

    ‘গুড৷ ওগুলো তো নিবিই, ও হ্যাঁ, সাবানটাও নে—’

    অবিনাশ দত্ত’র কথামতো পাজামা গামছা-টামছা গুছিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে চানঘরের কাছে চলে এল রাজেন৷

    একতলা থেকে দোতলায় উঠে এলে সিঁড়ির মুখের দরজাটার পাশের ঘরটাই হল চানঘর বা বাথরুম৷ সেটার দরজার মাথায় শেকল তোলা৷ সেটা নামিয়ে দরজা খুলে দিল অবিনাশকাকা৷ বলল, ‘ভেতরে যা৷ ডানদিকের দেওয়ালে সুইচ আছে৷ টিপলেই আলো৷ যা যা—’

    ঢুকে পড়ল রাজেন৷ আলো জ্বালতেই দেখা গেল জলে ভর্তি বিরাট চৌবাচ্চা, পায়খানা, বালতি, মগ, সব মজুদ৷ একধারে একটা লম্বা দড়ি টাঙানো৷ সেটার ওপর পাজামা-টাজামা ঝুলিয়ে দিল৷ গায়ে সারাদিনের ধুলো-ধোঁয়া লাগানো চটকানো- মটকানো ধুতি, শার্ট রয়েছে৷ সে ঠিক করে ফেলল, এগুলো নিজেই কেচে ফেলবে৷

    দরজা খোলা রয়েছে৷ বাইরে থেকে লক্ষ রাখছিল অবিনাশ দত্ত৷ বলল, ‘গায়ের কাপড়-টাপড় একধারে রেখে দে৷ কাল কাজের মেয়ে এসে কেচে দেবে৷ দরজা বন্ধ করে হাত-পা মুখ-টুখ ধুয়ে নে৷ বেরুবার সময় আলো নিভিয়ে দিবি৷ আমি বারান্দায় বসে থাকব৷’

    বারান্দায় কেন বসে থাকবে অবিনাশকাকা? একটু খটকা লাগল রাজেনের৷ কিন্তু না, সারাদিনের প্রচণ্ড ধকলের পর সমস্ত শরীর এলিয়ে আসছে৷ এখন এ নিয়ে ভাবার মতো এনার্জি তার আর নেই৷ চটপট হাত, মুখ-টুখ ধুয়ে পোশাক পালটে আলো নিভিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে৷

    চানঘরের দরজায় শেকল লাগাতে লাগাতে আচমকা খসখসে আওয়াজ কানে এল৷ চমকে উঠল রাজেন৷ এ বাড়িতে ঢোকার পর ছাদের দিক থেকে অবিকল এইরকম শব্দ তার কানে এসেছিল৷ ওপর দিকে মুখ তুলতে সেই বউটিকে দেখতে পেয়েছিল সে৷

    আওয়াজটা থামছে না৷ দিশেহারার মতো এধারে-ওধারে তাকাতে তাকাতে চোখ দু’টো দোতলার সিঁড়ির মুখের দরজার দিকে চলে গেল৷ একটু আগেই অবিনাশ- কাকা ওটার কড়ায় তালা লাগিয়ে দিয়েছিল৷ আওয়াজটা একটু স্পষ্ট হল৷— ‘ভয় পাচ্ছ!’ তারপরেই রিনরিনে হাসি৷

    গায়ের লোমগুলো মুহূর্তে খাড়া হয়ে গেল রজেনের৷ শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে কনকনে বরফের স্রোত যেন বইতে লাগল৷ আশপাশে কেউ নেই৷ সে বুঝতে পারছে তালাবন্ধ সিঁড়ির দরজাটার ওধার থেকেই হাসি-টাসির আওয়াজটা আসছে৷ কে? কে হতে পারে?

    অবিনাশকাকা বলল, ‘কী রে, দাঁড়িয়ে পড়লি যে? চলে আয়—’

    সারা শরীর ভারী হয়ে গেছে রাজেনের৷ সে যে বারান্দার দিকে পা ফেলবে, সেই শক্তিটুকুও যেন আর নেই৷ প্রচণ্ড ভয়ে সে সিঁটিয়ে গেছে৷

    অবিনাশের দৃষ্টিটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল৷ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে কী ভেবে উঠে পড়ল সে৷ দু’চার পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘শরীর খারাপ লাগছে?’

    অবিনাশকাকা কাছাকাছি চলে আসায় ভয়টা অল্প হলেও কেটে গেল; কিছুটা সাহসও ফিরে এসেছে৷

    রাজেন বলল, ‘হ্যাঁ, মানে—’ হাসি- টাসির কথাটা জানাল না৷

    ‘সারাদিন অনেক ছোটাছুটি গেছে৷ শরীর তো ছেড়ে দেবেই৷ আয়—’

    বারান্দার দিকে পা বাড়াতে গিয়ে মাথা কাত করে সেই দরজাটার দিকে তাকাল রাজেন৷

    অবিনাশ জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখছিস রে? কেউ কি ওখানে আছে?’

    ‘না না, কেউ না—’ এ বাড়িতে ঢোকার পর নীচের চাতাল থেকে চকিতের জন্য ছাদে যাকে দেখেছিল, পরে মনে হয়েছে সেটা তার চোখের ভ্রম হতে পারে৷ এখনও এই হাসি, কথা বলা ভ্রমই হবে হয়তো৷ আজ এসব কী হচ্ছে তার? সে অসীম সাহসী নয় ঠিকই, ভীরুও তো নয়৷ তাকে সাত সাতটা অফিসে বিরাট বিরাট কোম্পানির বাঘা বাঘা সব অফিসারদের সামনে গিয়ে ইন্টারভিউ দিতে হবে৷ এর ওপরেই তাদের পরিবারের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে৷ একটা চাকরি তার চাইই চাই৷ কে হাসল, কে ফিসফিস করে কথা বলল, এসব আজেবাজে, উটকো ব্যাপার মাথা থেকে বের করে দেওয়া দরকার৷ এখন যা ভাবাভাবি সব ইন্টারভিউ নিয়ে৷

    অবিনাশকাকা বলল, ‘চল, তোর ঘরে আগে যাওয়া যাক৷ চুল-টুল আঁচড়ে তুই আমার সঙ্গে বসার ঘরে যাবি৷’

    খুব অবাকই হল রাজেন৷ যতক্ষণ সে চানঘরে ছিল, অবিনাশকাকা বারান্দায় বসে কি তাকে পাহারা দিয়েছে? এখন আবার সঙ্গে যেতে চাইছে৷ কিছুই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷

    রাজেন আপত্তি করল না৷ চুল-টুল আঁচড়ানো হলে অবিনাশকাকা তাকে সঙ্গে করে বসার ঘরে ফিরে এল৷ রান্নাঘর থেকে বন্দনা কাকিমা তাদের দেখতে পেয়েছিল৷ বলল, ‘লুচিভাজা হয়ে গেছে৷ আমি আসছি—’

    দু’টো বড় প্লেট বোঝাই করে লুচি, বেগুনভাজা, আলুভাজা, আর মিষ্টি নিয়ে এসে টেবিলে রেখে দু’গ্লাস জল আর নিজের জন্য ছোট একটা প্লেটে দু’খানা লুচি আর কয়েক টুকরো আলুভাজা নিয়ে ফিরে এল৷ একটা সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘নাও শুরু কর—’

    রাজেন বলল, ‘আমি এত খেতে পারি না৷’

    ‘এত আবার কোথায়? আটটাও বাজেনি৷ রাতের খাওয়া খেতে খেতে এগারোটা, সাড়ে এগারোটা৷ খাও, খাও—’

    ‘এখন খেলে আবার রাত্তিরে—’

    ‘কাকা-কাকিমার কাছে এসেছ, লজ্জা কীসের? এই বয়েসের ছেলে, এখনই তো খাবে৷ প্লেটে হাত দাও—’ হেসে হেসে হালকা ধমকের সুরে বন্দনা বলল৷

    রাজেনও একটু হেসে লুচি ছিঁড়ে মুখে পুরল৷ খেতে খেতে গল্পও হচ্ছে, সেই সঙ্গে কাজের কথাও৷ বিশেষ করে যে কারণে রাজেনের কলকাতায় আসা সেই ইন্টারভিউ নিয়ে জানতে চাইছে অবিনাশকাকারা৷ কবে কোন অফিসে ক’টার সময় ইন্টারভিউ, সব জানতে চাইল তারা৷

    সব শুনে অবিনাশকাকা জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাংক, রেল আর অন্য সব কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে গেলে কী ধরনের প্রশ্ন করতে পারে, সেগুলোর কী উত্তর হয়, এইসব প্রশ্নোত্তর সাজিয়ে অনেক বই বাজারে বেরিয়েছে৷ সেসব দেখেছিস?’

    ‘হ্যাঁ কাকা৷ ওইরকম চারটে বই কিনে দু’মাস ধরে পড়ছি৷ সঙ্গে করে নিয়েও এসেছি৷’

    ‘গুড৷ আজ থাক৷ কাল থেকে ফের বার বার পড়ে ঝালিয়ে নিস৷’

    কথায় কথায় রাত বাড়তে থাকে৷ হঠাৎ রন্টুর কথা মনে পড়ল রাজেনের৷ অবিনাশকাকার ছেলে রন্টু, যার অন্য একটা নামও আছে—দীপক৷ বেশ কয়েকবার সে অবিনাশকাকার সঙ্গে কাটোয়ায় তাদের বাড়িতে গেছে৷ বলল, ‘রন্টুকে তো দেখছি না—’

    ‘ও, তোকে বলতে ভুলে গেছি, তিনমাস হল আসানসোলে চাকরি পেয়েছে রন্টু৷ ও সেখানেই থাকে৷ সপ্তাহে শনি-রবি দু’দিন ছুটি৷ শুক্রবার অফিসের ডিউটি শেষ হলে সন্ধের ট্রেনে কলকাতায় আসে৷ আমাদের কাছে দু’দিন কাটিয়ে সোমবার ভোরের ট্রেনে ফিরে যায়৷ তবে এই উইকে আসবে না৷ অফিসে কী একটা জরুরি কাজে ওকে আসানসোলে থেকে যেতে হবে৷’

    রাত এগারোটা বাজলে রাতের খাওয়া শেষ হলে অবিনাশ দত্ত রাজেনকে নিয়ে তার ঘরে এল৷ বলল, ‘জল-টল সব আছে৷ যদি কলঘরে যেতে হয়, আমাদের ডাকবি৷ হুট করে একা একা চলে যাস না৷ মনে থাকবে?’

    ‘থাকবে৷’ রাজেন ঘাড় কাত করল৷

    ‘এবার আমি যাব৷ তুই ভেতর থেকে ভালো করে দরজায় হুড়কো লাগিয়ে, লাইট নিবিয়ে শুয়ে পড়৷ ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, এই ঘরের ডান দিকের দেওয়ালে একটা জানলা আছে৷ আমি সেটা আগেই বন্ধ করে রেখেছি৷ জানলার বাইরে একটা সরু গলি৷ রাত্তিরে যদি ওদিক থেকে কারও গলার আওয়াজ বা হাসির শব্দ শুনতে পাস, কান দিবি না৷’

    বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল রাজেনের৷ এই তো সন্ধেবেলা সে যখন কলঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, দোতলার সিঁড়ির মুখের বন্ধ দরজাটার ওধার থেকে গলার স্বর আর রিনরিনে হাসির আওয়াজ কানে এসেছিল৷ অবিনাশকাকা কি এই কথাই বলছে? উৎকণ্ঠায় তার গলা শুকিয়ে গেছে৷ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কার গলার স্বর? কে হাসবে?’

    ‘কতরকম পাজি লোক আছে৷ রাত বাড়লে হইচই করতে করতে তারা ওই গলিটা দিয়ে যায়৷ যতসব বজ্জাতের ধাড়ি৷ রাত্তিরে ওই জানলাটা কিছুতেই খুলবি না৷ আর দাঁড়িয়ে থাকিস না৷ শুতে যা—’

    অবিনাশকাকা চলে গেছে৷ আলো নিবিয়ে, দরজায় হুড়কো লাগিয়ে শুয়ে পড়েছে রাজেন৷ ঘরের ভেতরটা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে৷

    আশপাশের কোনও বাড়ি থেকে বারোবার ঘণ্টা পেটানোর মতো জোরালো আওয়াজ করে একটা ঘড়ি জানিয়ে দিল এখন রাত বারোটা৷ রাধানাথ মল্লিক লেন নিঝুম হয়ে গেছে৷ কোথাও এতটুকু শব্দ নেই৷ কিন্তু ঘুম আসছে না রাজেনের৷ আজ সন্ধের মুখে আদ্যিকালের কলকাতার এই এলাকায় পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটেছে বার বার চোখের সামনে তা ফুটে উঠছে৷ মুড়ি-মুড়কির দোকানের সেই লোকটা, ছাদের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বউটা যার মুখে মধুর কিন্তু হিংস্র হাসি, কলঘরের পাশে দোতলার সিঁড়ির মুখের বন্ধ দরজার ওধার থেকে কোনও তরুণীর ডাক, রিনরিনে হাসি, সব কেমন যেন অস্বাভাবিক৷ অদ্ভুত, ভয়ংকর এক রহস্যে ঘেরা৷ তা ছাড়া অবিনাশকাকার ব্যাপার-স্যাপার কি আদৌ স্বাভাবিক? সারাক্ষণ সে যেন তাকে পাহারা দিয়ে চলেছে৷ চানঘরে যখন রাজেন ঢুকল—সে বারান্দায় বসে বসে নজর রাখছিল৷ রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর এই ঘরে এসে নানাভাবে সাবধান করে গেছে৷ রাত্তিরে ডানদিকের জানলা খোলা যাবে না৷ হুট করে একা কলঘরে যাওয়া চলবে না৷ যাওয়ার আগে অবিনাশকাকাদের ডেকে তুলতে হবে৷ খুব সম্ভব সে যতক্ষণ কলঘরে থাকবে, অবিনাশকাকারা বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে৷ সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, এ ঘরের বন্ধ জানলার বাইরের গলিটা থেকে রাত্তিরে কেউ কথা-টথা বললে বা হেসে উঠলে সেসবে কান দিতে বারণ করা হয়েছে৷ তখন খেয়াল হয়নি, আচমকা এখন মনে হল, কলঘরের পাশের বন্ধ দরজার ওধার থেকে যে রিনরিনে গলায় হেসেছিল, তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, সে-ই কি বন্ধ জানলার ওপাশ থেকে তাকে ডাকাডাকি করবে, তেমনি রিনরিন করে হেসে উঠবে?

    না না, এসব ভাবনাকে আশকারা দেবে না রাজেন৷ দেবে না বললেই হল৷ টের পাওয়া যাচ্ছে, বুকের ভেতর হূদপিণ্ডটা সমানে লাফাচ্ছে৷ সারা গায়ে বিন বিন করে ঘাম বেরুচ্ছে৷

    রাজেন এরই মধ্যে জোর করে চোখ বুজে ঘুমোতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু ঘুমবো বললেই ঘুমনো যায়?

    কাছাকাছি সেই বাড়ির ঘড়িটা তীব্র আওয়াজ করে কিছুক্ষণ পর পর জানিয়ে দিল এই একটা বাজল, এই দু’টো বাজল৷ কিন্তু না, জানলার বাইরে থেকে কারও গলার স্বর বা হাসির শব্দ শোনা গেল না৷

    যে ভয়টা বুকের ওপর চেপে বসেছিল, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে৷ সহজভাবে সে এবার শ্বাস টানতে পারল৷ দু’চোখ আস্তে আস্তে জুড়ে এল তার৷

    পরদিন কাদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল রাজেনের৷ ধড়মড় করে উঠে পড়ল সে৷ প্রথমটা বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে৷ তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলল৷ বারান্দায় অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমা৷ দু’জনের চোখেমুখে উদ্বেগের ছাপ৷ অবিনাশকাকা বলল, ‘কত বেলা হয়েছে জানিস? সাড়ে ন’টা৷ তোর কাকিমার আর আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল৷ ভাবছিলাম কী হল ছেলেটার? এত বেলা অব্দি ঘুমোবার তো কথা নয়৷ যাক, এখন নিশ্চিন্ত৷ চট করে মুখ-টুখ ধুয়ে নে৷ কলঘরটা তো চিনিস৷ তোর কাকিমা জলখাবার তৈরি করে রেখেছে৷ যা যা—’

    অবিনাশকাকারা চলে গেল৷

    বাসি পোশাক ছাড়তে হবে৷ ঘরে পরার মতো সাদা পাজামা, হাফশার্ট, গামছা, ব্রাশ আর টুথপেস্ট নিয়ে কলঘরে চলে এল রাজেন৷

    ছাদের দিক থেকে কোনাকুনি ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে৷ এখন তো রাত নয়, তাই বোধহয় অবিনাশকাকাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখা গেল না৷ বারান্দা থেকে নেমে কলঘরের দিকে যেতে চোখে পড়ল, দোতলার সিঁড়ির দরজাটা হাট করে খোলা৷

    মুখ-টুখ ধুয়ে পোশাক বদলে বাসি কাপড়-চোপড় কলঘরে রেখে বেরিয়ে এল সে৷ বসার ঘর থেকে অবিনাশকাকা তাকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘গামছা-টামছা রেখে এখানে আয়৷ দেরি করবি না—’

    ‘আচ্ছা—’ একটু পরেই চলে এল রাজেন৷

    অবিনাশকাকা গলার স্বর উঁচুতে তুলে বলল, ‘বন্দনা, রাজু এসে গেছে—’

    রান্নাঘর থেকে বন্দনা কাকিমার গলা ভেসে এল৷—‘দেখেছি৷ দু’মিনিট—’

    দু’মিনিটও লাগল না প্লেটে প্লেটে খাবারদাবার সাজিয়ে বন্দনা কাকিমা চলে এল৷

    কাল জলখাবারে ছিল লুচি, আজ পরোটা, আলুর দম, মিষ্টি৷

    কালই রাজেন বুঝতে পেরেছে অবিনাশকাকাদের বসার ঘরটা খাওয়ার ঘরও৷

    খেতে খেতে কথাও হচ্ছে৷ অবিনাশকাকা জিজ্ঞেস করল, ‘তোর ফার্স্ট ইন্টারভিউটা কবে?’

    ‘পরশু—’

    ‘ব্যাংকে, না রেলে?’

    ‘একটা ওষুধ কোম্পানির হেড অফিসে৷’

    ‘সেটা কোথায়?’

    ‘ডালহৌসির ক্লাইভ স্ট্রিটে৷ রাইটার্স বিল্ডিংয়ের কাছে—’

    ‘আমি তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব৷’

    ‘না না, আমি একাই যেতে পারব৷ গেল বছর ক্লাইভ স্ট্রিটেরই অন্য একটা অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম৷ জায়গাটা চিনি—’

    ‘ঠিক আছে৷ এখন জলখাবার খেয়ে ইন্টারভিউর জন্যে যে নোট-বইগুলো এনেছিস, ভালো করে দেখে নিবি৷’

    ‘হ্যাঁ৷’ আস্তে মাথা নাড়ল রাজেন৷

    একটু চুপচাপ৷

    তারপর অবিনাশ দত্ত দোনোমনো করে বলল, ‘হ্যাঁ রে রাজু, কাল রাত্তিরে ভয়-টয় পাসনি তো?’

    ‘ভয় পাব! কেন?’

    ‘না মানে, নতুন জায়গায় একা একা শুয়েছিস৷ পাশের গলির দিক থেকে কোনও গোলমাল-টোলমাল, হাসি-টাসি—’

    কাল সন্ধেবেলায় কলঘরের পাশে দোতলার সিঁড়ির দরজার ওধার থেকে খসখসে গলার স্বর আর রিনরিনে হাসির আওয়াজ কানে এসেছিল রাজেনের৷ কিন্তু একবারই৷ অবিনাশকাকা বেশ কয়েকবার ওই হাসি-টাসির কথা কাল বলেছে৷ আজও আবার বলল৷

    রাজেন জিজ্ঞেস করল, ‘এরকম কেউ একজন হাসে, কথা বলে, আপনি তাকে জানেন নাকি?’

    থতমত খেয়ে অবিনাশকাকা বলল, ‘আমি, আমি কী করে জানব? আমাদের এই এলাকাটা তো কলকাতার সবচেয়ে পুরোনো পাড়া৷ এখানে সব কিছুই হতে পারে৷ তাই সাবধানে থাকতে হয়৷’

    শুধু ওই হাসি আর গলার স্বরটা ছাড়া অন্য কী শোনা যেতে পারে বা ঘটতে পারে সেসব নিয়ে একটি শব্দও অবিনাশকাকা উচ্চারণ করে না৷ এই একটা ব্যাপারই তার মাথায় চেপে বসে আছে৷

    রহস্যটা কী হতে পারে? না, এ নিয়ে আর কিছু জানতে চাইল না রাজেন৷

    খাওয়া হয়ে গিয়েছিল৷ রাজেন উঠে পড়ল৷—‘যাই, নোট-বইগুলো দেখে নিই গে—’

    অবিনাশকাকা বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, যা৷ দিনের বেলা তোর ঘরের জানলাটা খুলে রাখতে পারিস—’

    রাজেন চলে গেল৷ নিজের ঘরে এসে জানলাটা প্রথমেই খুলে দিল৷ অবিনাশকাকা যা বলেছিল ঠিক তাই৷ সরু, নোংরা একটা গলি৷ তার ওধারে নোনা-ধরা, রং-চটা আশি-নব্বই বছরের সেকেলে সব বাড়ি৷ বেশির ভাগেরই পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে৷ নীচে বেশ লোকজন দেখা যাচ্ছে৷

    পড়ার টেবিলটা জানলার ধার ঘেঁষে৷ বই-টই নিয়ে রাজেন সেখানে বসে পড়ল৷

    চোখের পলকে দু’টো দিন কেটে গেল৷ হিংস্র-মধুর হাসি যার মুখে সেই বউটিকে আর দেখা যায়নি৷ দরজা বা জানলার আড়াল থেকে তার খসখসে গলা বা হাসির আওয়াজও কানে আসেনি৷ মনটা বেশ হালকা হয়ে গেছে৷

    এই দু’দিনে ভয় বা আতঙ্কটা পুরোপুরি কেটে গেছে রাজেনের৷ ছাদে যে বউটিকে দেখেছিল বা অশরীরী কারও হাসির বা গলার স্বর শুনেছিল সেসব যে তার চোখের আর কানের ভ্রম, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই৷

    কিন্তু মনে হয় অবিনাশকাকার অটুট বিশ্বাস, এই বাড়িতে কেউ একজন আছে যে ওইভাবে হাসে, কথা বলে এবং চকিতের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়৷ তার একমাত্র মন্ত্র ‘সাবধানের মার নেই’৷ দিনের বেলা রাজেনকে চোখে চোখে না রাখলেও চলে, কিন্তু সন্ধেটি যেই নামল পাহারাদারি শুরু হয়ে গেল৷ নিজে এসে রাজেনের ঘরের জানলা বন্ধ করে দেবে৷ রাজেন যখন চানঘরে যাবে, সে চেয়ার এনে বারান্দায় বসে পড়বে৷ দু’দিন কেটে যাবার পর এখন একটু মজাই লাগছে রাজেনের৷ অবিনাশকাকা যা করছে সেটা বাড়াবাড়িই৷

    আজ রাজেন প্রথম ইন্টারভিউটা দিতে যাবে৷ তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমার৷ কাল রাত্তিরেই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিল তারা৷

    সাড়ে সাতটায় রাজেনের ঘুম ভাঙিয়ে দিল অবিনাশকাকা৷—‘যা, তাড়াতাড়ি চান করে নে৷’

    চান সারা হলে পোশাক পালটে, মোটামুটি ফিটফাট হয়ে নিল৷ এর মধ্যেই বন্দনা কাকিমার রান্নাবান্না শেষ৷

    খাওয়াদাওয়া চুকলে অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমাকে প্রণাম করে রাজেন বলল, ‘যাচ্ছি—’

    ‘আয়৷ ইন্টারভিউতে খুব ভেবেচিন্তে উত্তর দিবি৷ একদম ঘাবড়াবি না৷’

    দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বন্দনা কাকিমার গলা কানে এল৷— ‘দুর্গা, দুর্গা—’

    সেই যে দু’দিন আগে সে এসে দোতলায় উঠেছিল তারপর আর নীচে নামা হয়নি৷ সেদিন সন্ধের আবছা অন্ধকারে একতলায় যে দু’টো ভাড়াটে ফ্যামিলি থাকে তাদের কারওকে স্পষ্ট দেখা যায়নি৷ আজ কিন্তু দেখা গেল৷ সবাই চোখ গোলাকার করে তাকে লক্ষ করছে৷

    সে কি দেখার মতো বস্তু? ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে রাজেনের৷ লম্বা লম্বা পা ফেলে একতলার চাতালটা পেরিয়ে সুড়ঙ্গের মতো গলিটায় চলে এল সে৷ নিজের অজান্তেই ঘুরে দাঁড়াল৷ টের পেল চুম্বকের মতো তেতলার ছাদটা তার চোখ দু’টোকে টানছে৷ সেদিকে তাকাতে সেই বউটিকে, যার মুখে হিংস্র মধুর হাসি, দেখা গেল৷ ছাদের রেলিং ধরে সে ঝুঁকে নেই৷ রেলিং থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকে হাতছানি দিচ্ছে৷

    কালই সে ভেবেছিল এমন কেউ নেই, সবই চোখের ভুল, এসব অবিনাশকাকার বাড়াবাড়ি৷ কিন্তু আজ প্রকাশ্য দিবালোকে ঝকঝকে রোদে প্রাচীন কলকাতা যখন ভেসে যাচ্ছে সেইসময় সে দেখা দিল৷ তার মানে—আছে, আছে, আছে—

    বুকের ভেতরে দু’দিন আগের মতোই হিমের স্রোত বয়ে গেল৷ ছাদের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না রাজেন৷ কয়েক মুহূর্ত মাত্র৷ তার পরেই ছাদের সেই হাড়-হিম-করা রহস্যময়ী অদৃশ্য হয়ে গেল৷

    তারপর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, খেয়াল নেই রাজেনের৷ শরীরটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে৷ ঘোরের মতো কিছু একটা তার ওপর চেপে বসেছে৷ মেসমেরাইজ অর্থাৎ সম্মোহন করলে কি এরকম হয়?

    একসময় রাজেনের মনে পড়ল, আজ তার প্রথম ইন্টারভিউ৷ ঘোরটা একরকম জোর করেই কাটিয়ে নিতে চাইল সে৷ ভারী শরীরটা টানতে টানতে সুড়ঙ্গ পেরিয়ে রাধানাথ মল্লিক লেন নামের ছাপ্পান্ন পাকের গলিতে চলে এল৷ সেখান থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে এসে বাস ধরল৷

    ক্লাইভ স্ট্রিটে যখন রাজেন পৌঁছল, এগারোটা বাজতে বেশি বাকি নেই৷ পাগলের মতো ছোটাছুটি করে ক্লাইভ স্ট্রিটে আলফ্রেড অ্যান্ড নিকলসন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির হেড অফিসটাও খুঁজে বের করা গেল৷ ইন্টারভিউতে বসার সুযোগও পেল রাজেন৷ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সে পৌঁছোতে পেরেছে৷

    যাঁরা ইন্টারভিউ নিয়েছেন তাঁদের দু’জন পাক্কা ইংরেজ, দু’জন বাঙালি৷ প্রশ্নগুলো চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছিল৷ সবই ইংরেজিতে৷ ঘোরটা অনেকখানি কাটলেও পুরোটা নয়৷ যা যা মুখে এসেছে এলোপাতাড়ি বলে গেছে সে৷ এই চাকরিটার আশা নেই বলেই মনে হয়৷

    ইন্টারভিউর পর অনেকটা সময় ডালহৌসির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল রাজেন৷ বিকেল যখন ফুরিয়ে আসছে, সন্ধে নামে নামে, সেইসময় রাধানাথ মল্লিক লেনে ফিরে এল সে৷

    ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় কোনও দিকে তাকায়নি রাজেন৷ অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে দৌড়তে দৌড়তে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউর দিকে চলে গিয়েছিল৷ এখন, এই সন্ধের মুখে তেরো নম্বর বাড়িটায় ঢুকতে গিয়ে চোখে পড়ল মুড়িচিঁড়ের দোকানের সেই লোকটা গলা বাড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে৷ তার চোখে অসীম কৌতূহল, সেই সঙ্গে কেমন একটা ভয় ভয় ভাব৷

    কী ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল রাজেন৷ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি কিছু বলবেন?’

    দোকানদার থতমত খেয়ে গেল৷—‘না, বাবু, এই—’

    ‘এই কী?’

    ঢোঁক গিলল লোকটা৷—‘আপনাকে আগে কক্ষনো দেখিনি৷’

    রাজেন বলল, ‘দেখার কথা নয়৷ আমি এখানে নতুন এসেছি৷’

    ‘তেরো নম্বর বাড়িটায় কদ্দিন থাকবেন?’

    সে কোথায়, কতদিন থাকবে তাই নিয়ে লোকটার এত কৌতূহল কেন? সেই সঙ্গে বেশ উদ্বেগও৷ রাজেন জিজ্ঞেস করল, ‘কেন বলুন তো?’

    লোকটা হকচকিয়ে গেল৷—‘না, ও কিছু না৷ শুনেছি তেরো নম্বর বাড়িটা আশি-নববুই বছরের পুরোনো৷ কলকাতায় এই ধরনের বাড়িতে কত কিছুই তো হয়৷ তাই আর কি—’

    রাজেনের মনে পড়ে গেল, অবিনাশকাকাও ওই বাড়িটা সম্পর্কে এইরকম কিছু বলেছে৷ তেরো নম্বরের গা ঘেঁষে যার দোকান সেও কি আর ওই বাড়িটার রহস্য জানে না? যে অশরীরী মাঝে মাঝে দর্শন দিয়ে হিংস্র মধুর হেসে হাতছানি দেয়, খসখসে গলায় কথা বলে তার খবরও কি দোকানদারটা রাখে না? রাখাটাই স্বাভাবিক৷

    লোকটাকে বেশ ভালোই মনে হচ্ছে৷ রাজেন আঁচ করে নিল তার কোনওরকম ক্ষতি হয়, দোকানদার তা চায় না৷ স্পষ্ট করে না হলেও সে যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে তেরো নম্বর বাড়িটায় তার থাকা ঠিক হবে না৷

    সে ঠিক করে ফেলল, আর দাঁড়াবে না৷ তেরো নম্বরের দিকে পা বাড়াতে যাবে দোকানদার ডাকল, ‘বাবু যাবেন না৷’

    ‘কিছু বলবেন?’ রাজেন তার দিকে তাকাল৷

    ‘হ্যাঁ—’ দোকানদার মাথা নাড়ল৷— ‘আরেকটু এগিয়ে আসুন৷’

    রাজেন অবাক হল৷—‘কেন বলুন তো?’

    ‘যা বলছি তাই করুন৷’

    কী ভেবে এগিয়েই গেল রাজেন৷ দোকানদার চকিতে এধার-ওধার দেখে নিল৷ না, ধারে-কাছে কেউ নেই৷ সে একটা নীচু টুলের ওপর বসে ছিল৷ ঝুঁকে রাজেনের কানের কাছে মুখটা এনে খুব চাপা গলায় বলল, ‘বাবু, আপনাকে আগেও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছি, তেরো নম্বরটায় থাকা ঠিক হবে না৷ যত শিগগির পারেন চলে যান৷ আপনি কিন্তু আমার কথা শুনছেন না৷’

    ‘ওই বাড়িটায় থাকলে কোনও বিপদ- টিপদ হতে পারে?’

    ‘পারে বাবু৷’

    ‘কী বিপদ?’

    ‘ও বাড়িটায় আগে নতুন যারা এসেছে তাদের ভেতর তিনজন খুন হয়ে গেছে৷’

    বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল রাজেনের৷ মিয়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কে খুন করেছে? কেন?’

    ‘সে আমি বলতে পারব না৷ মাফ করবেন৷’

    একটু দূরে পায়ের শব্দ শোনা গেল৷ তড়িদগতিতে মুখ সরিয়ে নিয়ে টুলের ওপর সোজা হয়ে বসল দোকানদার৷— ‘লোক আসছে৷ আর দাঁড়াবেন না৷ চলে যান, চলে যান৷ আর যা শুনলেন, কারওকে কিন্তু বলবেন না৷’

    খুনের কথাটা শোনার পর থেকে মাথা ঝিমঝিম করছে রাজেনের৷ তেরো নম্বর বাড়ির পুরোনো বাসিন্দাদের কোনও ভয় নেই৷ নতুন কেউ এলে তাদের কারও কারও খুন হয়ে যাবার সম্ভাবনা যথেষ্ট৷ রহস্যটা কী? না, ঠিকমতো গুছিয়ে ভাবা যাচ্ছে না৷ সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে৷ অন্যমনস্কের মতো এলোমেলো পা ফেলে সে তেরো নম্বর বাড়িটায় ঢুকে গেল৷ সুড়ঙ্গের মতো সরু গলিটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে এসে হঠাৎ নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ সঙ্গে সঙ্গে তার দুই চোখ তেতলার ছাদের দিকে চলে গেল৷

    কিন্তু না, প্রথম দিন যে বউটিকে ছাদে দেখেছিল, যার মুখে ছিল হিংস্র অথচ মধুর হাসি, সে এখন নেই৷ যাক স্বস্তি৷ জোরে শ্বাস টেনে রাজেন এগিয়ে গেল৷

    প্রাচীন কলকাতার এই ঘিঞ্জি এলাকায় সূর্য পশ্চিমদিকে খানিকটা নেমে গেলে তেরো নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনে একফোঁটা রোদ ঢোকে না৷ ভেতরটা এর মধ্যেই কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা৷ মিনিট দশেকও লাগবে না, তার মধ্যে ঝপ করে অন্ধকার নেমে যাবে৷

    একতলার চাতাল পেরিয়ে ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলোর কাছে চলে এল রাজেন৷ চারটে, সাড়ে-চারটে বাজলেই সিঁড়ির গায়ে আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়৷ আজও তার হেরফের হয়নি৷

    রাজেন সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এল৷ অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমা বাইরের বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে গল্প করছিল৷

    ‘আমরা তোর কথাই ভাবছিলাম৷ সেই কখন বেরিয়েছিস৷ এত দেরি হল? খুব চিন্তা হচ্ছিল রে—’ বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল অবিনাশকাকা৷ বন্দনা কাকিমাও৷

    রাজেন উত্তর দেবার আগেই অবিনাশকাকা ফের বলল, ‘ডালহৌসি তো এখান থেকে খুব দূরে নয়৷ বাসে আসতে কতক্ষণ আর লাগে৷ ঠিক আছে, জামাকাপড় পালটে, হাতমুখ ধুয়ে বসার ঘরে চলে আয়৷ চা খেতে খেতে তখন ভালো করে কথা হবে৷’

    মিনিট পনেরো বাদে বসার ঘরে চলে এল রাজেন৷ অবিনাশকাকা একাই বসে ছিল৷ বলল, ‘বসে পড়৷ তোর কাকিমা চা’টা করতে গেছে৷ রাঙা আলুর পুলি আর সিঙাড়াও বানিয়ে রেখেছে৷ বোস—’

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চা এবং সিঙাড়া- টিঙাড়া নিয়ে চলে এল বন্দনা কাকিমা৷

    খেতে খেতে অবিনাশকাকা জানতে চাইল, ‘তোর ইন্টারভিউ কেমন হল এবার বল—’

    একটু চুপ করে থেকে রাজেন বলল, ‘খুব একটা ভালো হয়নি কাকা—’

    ‘কেন রে? তুই তো বেশ তৈরি হয়েই গিয়েছিলি৷ খুব খারাপ হবে কেন?’ একটু চিন্তিতই দেখাল অবিনাশ দত্তকে৷

    রাজেন বলল, ‘ইন্টারভিউ যারা নিয়েছে তাদের মধ্যে খাঁটি সাহেবও ছিল৷ তারা গাঁক গাঁক করে কী জিজ্ঞেস করছিল বুঝতে পারছিলাম না৷’

    ‘ঘাবড়ে না গিয়ে স্মার্টলি জবাব দিয়েছিস তো?’

    ‘স্মার্টলি কিনা বলতে পারব না৷ তবে আন্দাজে আন্দাজে ওদের কোশ্চেনগুলো যা বুঝেছি উত্তর দিয়েছি৷ আমার ইংরেজি তো, নিশ্চয়ই অনেক ভুলভাল থেকে গেছে৷’

    কিছুক্ষণ চুপচাপ৷

    অন্যমনস্কের মতো কথা বলছিল রাজেন৷ অন্যমনস্কের মতোই খাচ্ছিল৷ মুড়ি-মুড়কির দোকানের সেই লোকটার কথাগুলো বার বার ঘুরে ঘুরে তার মনে পড়ে যাচ্ছে৷ আশি-নব্বই বছর আগের ঝরঝরে পলেস্তারা-খসা সাবেক বিল্ডিংটায় নতুন যারা আসে তাদের অনেকেই নাকি খুন হয়ে গেছে৷ নতুন লোক এলে খুন হবে কেন? কারণটাই বা কী? এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি৷ লোকটা তাকে দু-একদিনের ভেতর তেরো নম্বর বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে বলেছে৷ তাকে কি খুন করা হবে? সেই ইঙ্গিতটাই কি দোকানদারটা দিয়েছে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না৷

    হঠাৎ রাজেনের মনে হল, মুড়ি- মুড়কিওয়ালা তাকে ভয় দেখাতে এসব বলেছে৷ পরক্ষণে ভাবল, যাকে মাত্র দু-তিনদিন রাস্তায় দেখেছে, পুরোপুরি অচেনা, কেন তাকে ভয় দেখাবে?

    ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে চাইলেও পারা গেল না৷ সেই বউটি, যার মুখে হিংস্র মধুর হাসি, চোখের সামনে ভেসে উঠল৷

    চকিতে রাজেনের মনে হল, মুড়ি-মুড়কির দোকানদার কি ইঙ্গিতে এর কথাই জানাতে চেয়েছে! সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল৷ একটা ফাঁকা ছাদের রেলিং ধরে ক্কচিৎ কখনও দেখা দিয়ে সে কোথায় মিলিয়ে যায়, কে জানে৷ সে কি তার ক্ষতি করবে? কেন করবে?

    অবিনাশ দত্ত তাকে লক্ষ করছিল৷ জিজ্ঞেস করল, ‘কী ভাবছিস রে অত?’

    রাজেন চমকে উঠল, ‘না, কিছু না তো—’ বলেই মনে হল, দোকানদারের মুখে এ বাড়িতে খুনের যে ঘটনাগুলোর কথা শুনেছে, অবিনাশকাকাকে জিজ্ঞেস করে কি জেনে নেবে, এই সব ঘটনা কি সত্যি৷ সঙ্গে সঙ্গেই চিন্তাটা খারিজ করে দিল৷ মনের ভেতরটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে রইল৷ একটা অদ্ভুত রহস্য যেন মাথার ওপর ঠেসে বসে আছে৷ কখনও ভয়ে সিঁটিয়ে যায় সে, কখনও আজগুবি বলে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে৷

    রাজেনের মনে কী ধরনের তোলপাড় চলছে, বাইরে থেকে আন্দাজ করার উপায় নেই৷ অবিনাশের মনে হল, ইন্টারভিউ খারাপ হওয়ার জন্য রাজেন মুষড়ে পড়েছে৷ তাকে চনমনে করে তোলার জন্য বলল, ‘মন খারাপ করিস না৷ একটু ভুল-টুল ইংরেজি হলেও সব প্রশ্নের যখন চটপট জবাব দিয়েছিস, আমার মনে হয় চাকরি হয়ে যাবে৷’

    রাজেন চুপ করে রইল৷

    অবিনাশ দত্ত এবার বলল, ‘ধরা যাক, চাকরিটা হল না৷ তাতে অত ভেঙে পড়ার কারণ নেই৷ তোর আরও কয়েকটা ইন্টারভিউ তো রয়েছে৷ ক’টা যেন?’

    আনমনা রাজেন বলল, ‘আরও ছ’টা—’

    ‘চিন্তা করিস না, এতগুলো ইন্টারভিউ যখন বাকি, একটা না একটা চাকরি হয়ে যাবে৷’

    রাজেন উত্তর দিল না৷

    আরও দু’দিন কেটে গেল৷ এর মধ্যে ইন্টারভিউ ছিল না৷ রাজেন বাড়ি থেকে বেরোয়নি৷ চান-টান করতে বাথরুমে গেছে ঠিকই, সেই বউটিকে দেখা তো যায়ইনি, এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যাতে ভয়ে শিউরে উঠতে হয়৷ যে আতঙ্কটা রাজেনের মাথায় চেপে বসেছিল সেটা আর নেই৷

    দু’দিন পর আজ যে ইন্টারভিউ দু’টো রয়েছে তার একটা বেলা দু’টোয়, আরেকটা সাড়ে তিনটেয়৷ কোনওটাই ডালহৌসিতে নয়, অনেকটা দূরে৷ একটা পার্ক স্ট্রিটের শেষ মাথায়, অন্যটা থিয়েটার রোডে৷

    দু’টো ইন্টারভিউর পর বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেল৷ আগের দিন সন্ধের মুখে মুখে সে ফিরেছে৷ আজ সন্ধে পার হয়ে গেল৷

    গ্যাসবাতির টিমটিমে আলোয় রাধানাথ মল্লিক লেনের আঁকাবাঁকা ভূতুড়ে গলিটা দিয়ে তেরো নম্বর বাড়িটায় ঢোকার আগে মুড়ি-মুড়কির দোকান থেকে সেই লোকটা সেদিনের মতোই ডাকল, ‘বাবু—’

    চমকে উঠল রাজেন৷ তার আর তেরো নম্বরে ঢোকা হল না৷

    দোকানদার গলা বাড়িয়ে বলল, ‘মাঝখানে দু’দিন আপনাকে দেখিনি৷ কোত্থেকে এলেন?’

    রাজেন বলল, ‘একটা কাজে বেরিয়েছিলাম৷ এখন ফিরছি৷ কেন বলুন তো—’

    ‘আপনাকে সেদিন সাবধান করে দিয়েছিলাম৷ তারপরও দু’দিন এখানে ছিলেন?’

    ‘ছিলাম—’

    রাজেন যে তার সতর্কবাণী শোনার পরও দু’টো দিন তেরো নম্বরে কাটিয়ে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে, স্বচক্ষে তাকে দেখেও দোকানদারের বিশ্বাস হচ্ছিল না৷ খুব সম্ভব সে যে বেঁচে আছে লোকটা তাতে খুশি হতে পারেনি৷

    রাজেন জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কি আর কিছু বলার আছে?’

    ঢোঁক গিলে দোকানদার বলল, ‘আছে৷ আপনি পারলে আজই, নইলে কাল সকালে উঠেই চলে যাবেন৷’

    ‘এই দোকানের সামনে দিয়ে গেলেই আপনি ডেকে ডেকে ভয় দেখান৷ মতলবটা কী?’

    ‘কোনও বদ মতলব নেই বাবু৷ কেন বুঝতে পারছেন না আমি আপনার ভালো চাই৷ চলে যান বাবু, চলে যান—’

    চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে রাজেনের৷ ‘ধ্যাত—’ বলেই সে তেরো নম্বর বাড়ির দিকে পা বাড়ায়!

    পেছন থেকে দোকানদারের করুণ, ভয়ার্ত গলা ভেসে আসে৷—‘আমার কথাটা ফেলবেন না বাবু৷ তেরো নম্বরটা ছাড়লে আপনার মঙ্গল হবে৷’

    কে কার কথা শোনে৷ রাজেন বাড়ির ভেতর ঢুকে সুড়ঙ্গের মতো সরু গলিটা দিয়ে খানিকটা এগিয়ে অন্য দিনের মতো ছাদের দিকে তাকাল৷ না, কেউ নেই৷ ছাদটা যতদূর দেখা যায়, একেবারে ফাঁকা৷ দোকানদারের ওপর রাগে মাথা গরম হয়ে উঠল তার৷ লোকটা তার গায়ে যেন জোঁকের মতো লেগে আছে৷ বলেছে সে তার ভালো চায়, বিন্দুমাত্র খারাপ অভিসন্ধি নেই৷ নেই বললেই হল! নিশ্চয়ই আছে৷ রাজেন ঠিক করে ফেলল, এরপর যদি ডাকাডাকি করে, এমন ধাতানি দেবে যে তাকে দেখলে টুঁ শব্দটিও করতে সাহস পাবে না৷

    ছাদের দিকে তাকিয়ে ছিল রাজেন৷ মাথা নামিয়ে চাতাল পেরিয়ে সিঁড়ির দিকে চলে গেল৷

    পার্ক স্ট্রিট আর থিয়েটার রোডে ইন্টারভিউ দেবার পর তিনদিনের গ্যাপ৷ তারপর শেষ দুটো ইন্টারভিউ হয়ে গেলে সে কাটোয়া ফিরে যাবে৷

    এই তিনটে দিন বাড়ি থেকে রাজেনকে বেরুতে হবে না৷ সে শেষ ইন্টারভিউ দু’টোর জন্য বইটই ঘেঁটে প্রস্তুতি চালাতে লাগল৷ ফাঁকে ফাঁকে বসার ঘরে গিয়ে অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে আসা, স্নান-খাওয়া ছাড়া নিজের ঘরেই সে বেশির ভাগ সময়টা থাকে৷

    প্রথম দু’টো দিন ভালোই কাটল৷ সেই বউটিকে আর দেখা যায়নি৷ কাটোয়া থেকে যেদিন তেরো নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনের এই বাড়িটায় এল সেদিন থেকে একটা আতঙ্ক তার ওপর মাঝেমাঝেই চেপে বসেছিল, আবার মিলিয়েও গেছে৷ এখন মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তার কারণ নেই৷ আর একটা দিন অর্থাৎ তৃতীয় দিনটা ভালোয় ভালোয় কেটে গেলে শেষ দু’টো ইন্টারভিউ দিয়ে সে আর তেরো নম্বরে ফিরবে না; সোজা হাওড়ায় গিয়ে কাটোয়ার ট্রেন ধরবে৷

    তৃতীয় দিনটা আগের দু’দিনের মতোই শুরু হল৷ সকালে উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে বসার ঘরে গিয়ে অবিনাশকাকাদের সঙ্গে চা-জলখাবার খাওয়া, একটু-আধটু গল্প, তারপর নিজের ঘরে গিয়ে বইপত্র নিয়ে বসা, দুপুরে বাথরুমে গিয়ে স্নান, খাওয়া সেরে ঘণ্টাতিনেক ঘুম, তারপর বিকেলের চা খেতে খেতে অবিনাশকাকাদের সঙ্গে সময় কাটানো, তারপর ঘরে এসে বই নাড়াচাড়া, রাত দশটায় খাওয়াদাওয়া সেরে ফের নিজের ঘরে৷

    অবিনাশকাকা শোওয়ার আগে রাজেনের ঘরের সামনে এসে অন্যদিনের মতো আজও বলে গেল, ‘বেশি রাতে যদি বাথরুমে যেতে হয় আমাকে আর কাকিমাকে ডাকবি৷ একা একা হুট করে চলে যাস না, কেমন?’

    আস্তে মাথা নেড়েছে রাজেন৷ রাজি হলেও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, সে আসার পর থেকে এ বাড়িতে হাড়-হিম-করা কোনও ঘটনাই যখন ঘটেনি, মাঝরাতে দু’জন বয়স্ক মানুষকে ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না৷ রাত দেড়টা-দু’টোয় যদি বাথরুমে যাবার দরকার হয় তখন দেখা যাবে৷

    অবিনাশকাকা চলে গেলে রাজেন দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল৷ এখানে আসার পর প্রথম কয়েক দিন আতঙ্কে সে কুঁকড়ে ছিল কিন্তু এখন আর কোনও চাপ নেই৷ শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দু’চোখ জুড়ে এল৷

    রাজেনের অনেকদিনের অভ্যাস মাঝরাতে একবার সে বাথরুমে যাবেই৷ এই বয়সেও সেটা থেকে গেছে৷

    আজও রাত একটা কি দেড়টায় বিছানা থেকে উঠে পড়ল রাজেন৷ চোখে ঘুম লেগে রয়েছে৷ তারই মধ্যে সে ঘরের দরজা খুলে বাথরুমে চলে গেল৷ মিনিট তিনেক পর সে যখন সেখান থেকে বেরুল, বাঁ পাশের সিঁড়ির দরজার দিক থেকে হালকা একটা শব্দ আবছাভাবে কানে এল৷

    কীসের আওয়াজ? ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বরফের স্রোত বইতে লাগল রাজেনের৷ চোখ থেকে ঘুম উধাও৷ তালাবন্ধ সিঁড়ির দরজার পাল্লা ভেদ করে সেই বউটি, যার মুখে হিংস্র মধুর হাসি, বেরিয়ে এল৷ দরজার পাল্লা আর তালা যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেল৷

    বউটা রাজেনের কাছে এসে তার পিঠে হাত রাখল৷ কনকনে ঠান্ডা হাত৷ সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল রাজেনের৷

    বউটা বলল, ‘চল, তোমার জন্যে অনেকক্ষণ দরজার ওধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ চল, চল—’

    রাজেন কিছু বলতে চাইল কিন্তু গলার ভেতর থেকে একটি শব্দও বেরুল না৷

    বউটির হাত রাজেনের পিঠের ওপর পড়ে আছে৷ সে আস্তে রাজেনকে সামনের দিকে ঠেলে দিল৷

    রাজেনের ভাবনাচিন্তা কিছুই কাজ করছে না৷ সারা শরীর অসাড়৷ তবু সে এগিয়ে গেল৷ চকিতে আবছাভাবে মনে হল, দোতলায় সিঁড়ির দরজা তো তালা দিয়ে আটকানো৷ তা হলে পাল্লা ভেদ করে বউটা কী করে বেরিয়ে এল! ভাবতেই শরীরে অসাড় ভাবটা অনেক বেড়ে গেল৷ আর শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত আরও কনকনে হয়ে উঠল৷

    বউটা তাকে তেতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে নিয়ে এসেছে৷ কী আশ্চর্য, এখানকার দরজাটা খোলা৷ আবছাভাবে মনে হল, তেতলায় ওঠার সিঁড়ির দরজাটা তো সবসময় তালাবন্ধ থাকে৷ কে এটা খুলল?

    বউটি বলল, ‘আমি দরজা-জানলা বন্ধ থাকলেও তার ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারি৷ তুমি তো এখন পারবে না, পরে অবিশ্যি পারবে৷ তোমার জন্যে দরজাটা খুলে রেখেছি৷’

    বলে কী বউটা, সে নাকি পরে বন্ধ দরজা-জানলা দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে৷ মানে কী এসব কথার? মাথার ভেতরটা পুরোপুরি গুলিয়ে গেল রাজেনের৷

    ‘দাঁড়িয়ে থেকো না৷ চল—চল—’ বউটি একরকম তাড়াই দিচ্ছে৷

    এখান থেকে অবিনাশকাকা আর বন্দনা কাকিমার শোওয়ার ঘরটা দেখতে পাচ্ছে৷ চিৎকার করে তাদের ডাকতে চেষ্টা করল কিন্তু তার গলা থেকে কোনও শব্দ বেরুল না৷

    বউটি রাজেনের পিঠে ফের চাপ দিল৷ রাজেন এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি বাইতে শুরু করল৷ বউটির হাত তার পিঠ থেকে এক মুহূর্তের জন্য সরেনি৷ রাজেনের মনে হচ্ছে নিজের ইচ্ছায় কোনও কিছু করার ক্ষমতা তার আর নেই, কোনও অলৌকিক শক্তি তাকে টেনে নিয়ে চলেছে৷ সেটা রুখে দেবার ক্ষমতা তার নেই৷

    তেতলায় উঠতেই বাঁ পাশে সারি সারি ঘর, বারান্দা, রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি৷ সব বন্ধ৷ সমস্ত ফ্লোরটা জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷

    অবিনাশকাকার মুখে শুনেছে, বাড়িওয়ালা পুরো তেতলাটায় তালা লাগিয়ে বর্ধমান না কোথায় যেন তাদের দেশের বাড়িতে থাকে৷

    তেতলা পেরিয়ে বউটি রাজেনকে ছাদের দরজার কাছে নিয়ে এল৷ এই দরজাটাও হাট করে খোলা৷

    বউটি বলল, ‘চল—’

    ছাদে যেতেই চোখে পড়ল চাঁদের আলোয় চারিদিক ভেসে যাচ্ছে৷

    বউটি এবার বলল, ‘আগে তোমাকে একটা জিনিস দেখাই৷ তারপর একটা গল্প বলব৷ এসো—’

    রাজেন উত্তর দিল না৷ আচ্ছন্নের মতো বউটির পাশাপাশি হাঁটতে লাগল৷

    ছাদের ডানদিকে একটা জায়গায় এসে বউটি বলল, ‘চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে, তখন ইংরেজ রাজত্ব চলছে৷ এখানে তিন কামরার একটা ফ্ল্যাট ছিল৷ আমরা সেখানে থাকতাম৷ দেখ, দেখ, চিনতে পারছ কি?’

    কী বলছে বউটা! অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও রাজেন অবাক হয়ে গেল৷ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে এখানে কী ছিল, সে জানবে কেমন করে? রাজেন চুপ করে রইল৷

    ‘চিনতে পারছ না তো৷ গল্পটা শুনলেই পারবে৷ ওদিকটায় চল—’ একটু দূরে তাকে নিয়ে গেল বউটি৷ এখানে ইট দিয়ে বানানো আড়াই-তিন ফিট উঁচু, তিন-চার ফিট চওড়া, বারো-চোদ্দো ফিট লম্বা একটা আধাখেঁচড়া টাইপের দেওয়াল৷ সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল সে৷—‘বোসো—’

    রাজেন বসে পড়ল৷ তার গা ঘেঁষে বসল বউটি৷ রাজেনের মনে হল তার শরীরটা আরও ভারী হয়ে গেছে৷ শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে৷

    বউটি বলল, ‘এই যেখানে বসেছ সেটা ছিল আমার শোওয়ার ঘরের একটা দেওয়াল৷ পুরো ফ্ল্যাটটা ভাঙা হলেও এই দেওয়ালের নীচের দিকটা কেন রেখে দেওয়া হয়েছে, বাড়িওয়ালাই জানে৷ সে যাক গে, আমার বসার একটা জায়গা পাওয়া গেছে৷ তোমাকেও বসতে দিতে পারলাম৷ হাজার হোক তুমি আমার অতিথি৷ নীচে ধুলোবালির ওপর তো বসানো যায় না৷’

    রাজেন এবারও চুপ৷

    ‘তুমি তো কাল এ বাড়ি থেকে পালাবার তাল করেছিলে, তাই না?’ বউটির চোখের দৃষ্টি তীব্র হয়ে উঠেছে৷ মুখের হাসিটি আরও মিষ্টি এবং আরও হিংস্র৷

    ওই যে যারা মানুষের মুখ দেখে তার মনের কথা মুহূর্তে পড়ে নিতে পারে, বউটি বোধহয় তাদেরই একজন৷ চমকে ওঠার মতো শক্তিটাও রাজেনের মধ্যে আর নেই৷ তার গলা দিয়ে জড়ানো জড়ানো গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল৷

    ‘কী ভেবেছিলে, আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাবে? কাজটা অত সোজা নয়৷ আমার এ বাড়ির কাজ একরকম শেষ হয়ে গেছে৷ শুধু তুমিই বাকি ছিলে৷ তোমার জন্যে বছরের পর বছর এখানে পড়ে আছি—’ বউটি বলতে লাগল, ‘এখন গল্পটা শুরু করা যাক৷’

    কেন তার জন্য বউটি এই বাড়িতে বছরের পর বছর পড়ে আছে, কিছুই মাথায় ঢুকছে না রাজেনের৷ ঘোলাটে চোখে সে তার দিকে তাকাতে লাগল৷ কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না৷ তার মাথা ঝুলে পড়ছে৷

    ‘এই ছাদের ওপর তিন কামরার একটা ফ্ল্যাট ছিল, আর আমরা যে এখানে থাকতাম, তোমাকে আগেই বলেছি—’ বউটি গল্প শুরু করে দিয়েছে, ‘আমাদের ফ্যামিলি খুব বড়োও ছিল না, ছোটোও না৷ সব মিলিয়ে আমরা পাঁচজন৷ আমার বুড়ো শ্বশুর, আমার স্বামী, দুই দেওর আর আমি৷ দেওরদের তখনও বিয়ে-টিয়ে হয়নি৷ আমাদের শ্যামবাজার আর বউবাজারে জামাকাপড়, রেডিমেড পোশাক আর আসবাবের বিরাট বিজনেস ছিল৷ বাড়িতে সবসময় তিন-চার লাখ নগদ টাকা থাকত৷ দিনগুলো খুব আনন্দে আর সুখেই কাটছিল৷ কিন্তু একদিন মাঝরাতে পাশের গলিতে ঢুকে মোটা মোটা যে তিনটে পাইপ দিয়ে বর্ষার জল বেরিয়ে যায় সেগুলো বেয়ে চারজনের একটা ডাকাতের দল ছাদে উঠে এসেছিল৷ তারা কীভাবে খবর পেয়েছিল সেদিন আমাদের ফ্ল্যাটে সাড়ে তিন লাখ টাকা ছিল৷ সেই দলটায় ছিলিস তুই—’ এতক্ষণ ‘তুমি’-‘টুমি’ করে বলছিল বউটি; এবার শুরু হল ‘তুই’ দিয়ে৷

    কোনওরকমে নুয়ে-পড়া মাথাটা তুলল রাজেন৷ এমন অদ্ভুত কথা আগে কখনও শোনেনি সে৷ কীভাবে যেন একটু শক্তি আর সাহস জড়ো করে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ‘আমি!’

    ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই—’

    ‘কিন্তু—’

    ‘কীসের কিন্তু?’

    ‘চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছর আগে আমি কী করে ডাকাতি করতে আসব! এখন আমার বয়েস মোটে বাইশ৷ অত দিন আমি কোথায় ছিলাম!’

    ‘তোর আগের জন্মের কথা বলছি৷ তোর নাম তখন ছিল বিনোদ৷ ঢাকুরিয়া রেল স্টেশনের ওধারে অক্ষয় দত্ত লেনে ছিল তোদের বাড়ি৷ পুলিশ পরে জানতে পেরেছে৷ এই জন্মে আর আগের জন্মের বাড়িতে যাওয়ার সময় পাবি না৷’

    রাজেন তাকিয়ে রইল৷

    বউটি বলল, ‘তোরা আমাদের সেই সাড়ে তিন লাখ টাকা কেড়ে নিয়েছিলি৷ আমরা পাঁচজন ঠেকাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছোরা আর পিস্তল চালিয়ে আমাদের পাঁচজনকে শেষ করে দিয়েছিলি৷ পরে পুলিশ তাদের ঠিকানাগুলো শুধু জানতে পারে৷’

    উত্তর নেই৷

    ‘খুন হয়ে যাবার পর কিছুদিন আমি হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াই৷ তারপর থেকে এই বাড়িতে এসে আছি৷ আমাদের ফ্যামিলির বাকি চারজন কোথায়, জানি না৷ তবে আমাদের সাবাড় করার পর তোরা নানা রোগে মরে গেছিলি৷ মরার দশ-বারো বছর পর ফের তোদের জন্ম হয়েছে৷ আগের জন্মের সব কথা আমার মনে আছে৷ ভালো বাংলায় কী যেন বলে, ও হ্যাঁ, জাতিস্মর৷ আমি ঠিক তাই৷ ভাবতাম খুন করে পার পেয়ে যাবি তা কিছুতেই হতে দেব না৷ তোদের গত জন্মে শাস্তি দিতে পারিনি, এই জন্মে কিছুতেই ছাড়াছাড়ি নেই৷ আমার মনে হয়েছিল, তোরা একদিন না একদিন এই তেরো নম্বর বাড়িতে আসবি৷ তিনজন আগেই এসেছিল, তাদের আমি যমের দোরে পাঠিয়েছি৷ এবার তোর পালা—’

    হঠাৎ বউটির চেহারা আগাগোড়া পালটে গেল৷ দু’চোখ থেকে আগুন ঠিকরোচ্ছে, হাসিটা আর নেই৷ ওপরের পাটির দু’পাশের দু’টো আর নীচের পাটির দু’টো দাঁত লম্বা আর চোখা হয়ে উঠল৷ রাজেন কিছু বোঝার আগেই বউটি আরও এগিয়ে এসে তার দাঁতগুলো গলায় বসিয়ে দিয়ে চাপ দিতে লাগল৷

    পুরোপুরি বেহুঁশ হবার আগে রাজেন টের পেল তার বুকের ওপর গল গল করে স্রোতের মতো কী যেন নামছে৷ আবছাভাবে একটা চিৎকার শুনতে পেল সে৷ সেই সঙ্গে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি ভেঙে কাদের উঠে আসার আওয়াজ৷

    তিন দিন বাদে পুরোপুরি জ্ঞান ফেরার পর রাজেন দেখতে পেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে৷ তাকে ঘিরে অবিনাশকাকা, বন্দনা কাকিমা৷ খবর পেয়ে কাটোয়া থেকে তার বাবা-মা চলে এসেছে৷

    অবিনাশকাকা জানিয়েছে, সেদিন অনেক রাত্তিরে একতলার ভাড়াটেদের কেউ কোনও দরকারে বাইরে বেরিয়েছিল৷ হঠাৎ ছাদে সেই বউটির সঙ্গে রাজেনকে দেখে চেঁচিয়ে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়ে ছাদে চলে আসে৷ রক্তের সমুদ্রে তখন পড়ে আছে রাজেন৷ বউটিকে তখন দেখা যায়নি৷

    সেই রাতেই রাজেনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়৷ একতলার ভাড়াটেটি না দেখলে তাকে বাঁচানো যেত না৷

    *

    এই ঘটনাটি ঘটে যাবার চল্লিশ বছর পর গল্পটা শুনেছিলাম৷ আরও আরও শুনেছি, ঘটনার পর সুস্থ হয়ে উঠেছিল রাজেন, একটা চাকরিও পেয়েছিল কিন্তু বেশিদিন বাঁচেনি৷

    তেরো নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনের সেই বাড়িটা আর নেই৷ সেটা ভেঙে বিরাট এক হাইরাইজ তোলা হয়েছে৷

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়
    Next Article সিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.