এক চোর,পাঁচ ডাকাত
এক চোর,পাঁচ ডাকাত
মহেশপুর আদ্যিকালের এক পুরোনো শহর। এর পাশ দিয়ে গঙ্গা বয়ে গেছে।
শহরটার বয়স নাকি কলকাতার থেকেও বেশি। সেকেলে, নোনা—ধরা বাড়িঘর, জিলিপির প্যাঁচের মতো সরু সরু গলি, এসব দেখলে তাই মনে হয়। এখানে কয়েক পা হাঁটলেই একটা করে মন্দির। কোনওটা রাধাকৃষ্ণের, কোনওটা রক্ষাকালীর, কোনওটা বা মা শীতলার। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত হল মহেশ্বরের মন্দির। সেখানে রয়েছে তিন ফুট উঁচু খাঁটি সোনার নটরাজ মূর্তি যার ত্রিনয়নে তিনটে বড় বড় হিরে। শোনা যায়, চার—পাঁচশো বছর আগে এই শহরের যখন জন্ম হয় তখন থেকেই এই মূর্তি আর মন্দিরটা আছে। খুব সম্ভব মহেশ্বরের নামেই শহরটার নাম মহেশপুর।
এই ধরনের এত প্রাচীন নটরাজ মূর্তি সারা দেশে আর একটাও নেই। কেউ বলে ওটার দাম নাকি তিরিশ লাখ টাকা, কেউ বলে চল্লিশ লাখ। যে যাই বলুক, টাকা দিয়ে এর দাম ঠিক করা যায় না। মূর্তিটা ভারতবর্ষের এক অমূল্য সম্পদ। ওটা দেখার জন্য দেশ—বিদেশ থেকে প্রচুর লোক আসে।
মহেশ্বর মন্দির আর সোনার নটরাজের জন্য মহেশপুরের বাসিন্দাদের দারুণ গর্ব। মন্দির আর মূর্তিটা না থাকলে কেই বা এই ভাঙাচোরা, নোংরা শহরে আসত, কেই বা একে চিনত!
আজকাল একদল অত্যন্ত লোভী বদমাশ দেশের পুরোনো মূল্যবান সব জিনিস, যেমন দেবদেবীর মূর্তি, পুথি, দু’হাজার বছর আগের কোনও শিলালিপি চুরি করে বিদেশে বেচে দিচ্ছে। তাই গভর্নমেন্ট থেকে মহেশপুরের নটরাজ মূর্তির জন্য দুজন বন্দুকওয়ালা পাহারাদারের ব্যবস্থা করেছে। তারা মন্দিরেই থাকে আর পালা করে চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি দেয়। আগে অনেক রাত পর্যন্ত মন্দিরের গেট খোলা থাকত, এখন সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সবে নভেম্বরের শুরু। এর মধ্যেই সন্ধে হতে না হতে মহেশপুরে কুয়াশা নামতে শুরু করেছে। বাতাসে ঠান্ডার আমেজ। শীত পড়তে আর বেশি দেরি নেই।
কিছুক্ষণ আগে গঙ্গার ওপারে সূর্য ডুবে গেছে। কুয়াশা আর অন্ধকারে মিশে চারদিক এখন ঝাপসা। মিউনিসিপ্যালিটির আলো জ্বলে উঠেছে ঠিকই কিন্তু সেগুলোর তেজ এতই কম যে বিশ ফুট দূরের কোনও কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না।
অন্যদিনের মতো আজও দক্ষিণ দিকের রাস্তাটা ধরে মহেশ্বর মন্দিরের দিকে আসছিল ফটিক। রোজ সূর্যাস্তের পর সে এখানে নটরাজ মূর্তিকে প্রণাম করতে আসে। এটা যেন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে।
ফটিকের বয়স চব্বিশ—পঁচিশ। বেজায় ঢ্যাঙা, কালো এবং রোগা। বোতলের মতো লম্বা মুখ। ভাঙা গালে খাপচা খাপচা দাড়ি। চোখ একেবারে গোল। দাঁতগুলো এবড়ো—খেবড়ো এবং পোকায়—কাটা। বেঢপ কান দুটো খাড়া খাড়া। মাথার ডান দিকে সিঁথি। পরনে চাপা কালো পাজামার ওপর কালো হাফ শার্ট। তার যে ধরনের কাজকর্ম তাতে এই রংটা খুব দরকারি, অন্ধকারে সহজে চোখে পড়বে না।
আসলে ফটিক মহেশপুরের সবচেয়ে নাম—করা ছিঁচকে চোর। দামি দামি সোনার গয়না, ঘড়ি বা জামাকাপড়—এত উঁচুর দিকে তার নজর নেই। দু’চারটে ঘটিবাটি সরাতে পারলেই সে খুশি। নটরাজের ওপর তার অসীম ভক্তি। ফটিকের ধারণা, মূর্তিকে প্রণাম করে কাজে বেরুলে খালি হাতে ফিরতে হবে না। তবে নটরাজ সব দিন সদয় হন না। মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে ফটিককে বেদম ঠেঙানি খেতে হয়। মহেশপুরের প্রতিটি মানুষ তাকে চেনে। লোভ কম আর দামি জিনিসে হাত দেয় না বলে মারধর করেই গেরস্থরা ছেড়ে দেয়। তবে যারা বদরাগি তারা কিন্তু পেটানোর পরও থানায় দিয়ে আসে। থানার লোকেরাও ফটিককে বহুকাল দেখে আসছে, বিশেষ করে ওসি ধনঞ্জয় চাকলাদার। তিনি ওকে হাজতে পোরেন না, বারকতক কান ধরে ওঠ—বোস করিয়ে থানা থেকে বার করে দেন।
দূর থেকে ফটিকের চোখে পড়েছিল, মন্দিরে আজ ভিড়টিড় কম। জনকয়েক সামনের সিঁড়িতে বসে আছে, কেউ কেউ চত্বরের ভেতর দাঁড়িয়ে গল্প করছে। দু’জন আমর্ড গার্ডকে সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল।
ফটিক যখন মন্দিরের অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে, সেই সময় পর পর চার—পাঁচটা বন্দুকের গুলির আওয়াজ কানে এল। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। এদিক—সেদিক তাকাতেই দেখতে পেল, মন্দিরের দুই পাহারাদার গড়াতে গড়াতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। রক্তে তাদের জামা ভিজে যাচ্ছে। যে ক’জন বসে বা দাঁড়িয়ে—টাড়িয়ে ছিল, তারা চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল। আর কোত্থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে এল পাঁচটা মুখোশ—আঁটা লোক, তাদের মাথায় লাল ফেট্টি, হাতে বন্দুক। গুলিগুলো যে ওরাই করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছে।
মোট কুড়িটা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে মন্দিরে ঢোকার বিশাল দরজা। সেটার সামনে অবশ্য কোলাপসিবল গেট রয়েছে। এখনও সাতটা বাজেনি। তাই গেট বা দরজা বন্ধ করা হয়নি।
এদিকে তিনটে লোককে নীচে পাহারায় রেখে বিদুৎগতিতে সিঁড়ি টপকে ওপরে উঠে মন্দিরের ভেতর ঢুকে গেল দুটো লোক।
আতঙ্কে চোখের তারা দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে ফটিকের। মাথাটা ভীষণ ঝিমঝিম করছিল। তবু তারই মধ্যে সে বুঝতে পারছিল এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হবে না। খুনিগুলোর চোখে পড়লে একটা গুলি তার বুক এফোঁড়—ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাবে। একবার ভাবল, পেছন ফিরে দৌড় লাগায়। কিন্তু প্রচণ্ড কৌতূহল তাকে পালাতে দিল না। রাস্তার পাশে অনেকগুলো তালগাছ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একলাফে সে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে মুখটা সামান্য বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
কতক্ষণ কেটেছে, খেয়াল নেই ফটিকের। একসময় দেখতে পেল মন্দিরের ভেতর থেকে সেই দুই বন্দুকওলা নটরাজ মূর্তিটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসছে। আর এখানকার পুরোহিত মাঝবয়সি জগদীশ ভট্টাচার্য পাগলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, ‘মূর্তি নিয়ো না, মূর্তি নিয়ো না। তোমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে একটা লুটেরা জগদীশের মাথায় বন্দুকের কুঁদো দিয়ে গায়ের জোরে ঘা মারল। তক্ষুনি ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল আর জগদীশ একধারে ছিটকে পড়ে চেঁচাতে লাগলেন, ‘ডাকুরা মূর্তি নিয়ে যাচ্ছে। ধর—ধর—’
পাঁচ বন্দুকবাজ তাঁর দিকে ফিরেও তাকাল না। মন্দিরের পেছনে প্রচুর ঝোপঝাড়। ওরা দৌড়ে সেদিকে চলে গেল।
সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে মিনিট পাঁচেকও লাগেনি। ভয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল ফটিক। চোখের সামনে এমন খুনখারাপি কখনও দেখেনি সে। আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে অবশ্য বেশিক্ষণ লাগল না। প্রথমেই তার মনে হল যে নটরাজ মূর্তি মহেশপুরের মানুষদের প্রাণ, খুনিদের সেটা কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না। ওদের হাতে বন্দুক আছে। কাজেই ঠান্ডা মাথায় ওদের পিছু নিতে হবে। আগে জানতে হবে ওরা কোথায় গিয়ে ওঠে। তারপর বুদ্ধি খাটিয়ে মূর্তিটা উদ্ধার করতে হবে।
মাথার ভেতরে এই সব ভাবনাচিন্তা নিয়ে ফটিক মন্দিরের পেছন দিকে দৌড় লাগাল। এখান থেকে অনেকটা জায়গা ঘন আগাছা আর নানা ধরনের গাছপালায় বোঝাই। সেসব পেরুলে লাইন দিয়ে গোটা পঞ্চাশেক বিশাল বিশাল ধানচালের গুদাম। সেগুলোর বেশ কয়েকটায় কিছু নেই, একেবারে ফাঁকা। ভাঙাচোরা কিছু দোতলা—তিনতলা বাড়িও আছে। ওগুলোতে লোকজন থাকে না।
গুদাম—টুদাম এবং পোড়ো বাড়িগুলোর পর গঙ্গা।
এই শহরেই জন্ম ফটিকের। জীবনের পঁচিশটা বছর এখানেই চুরিচামারি করে কাটিয়ে দিয়েছে সে। মহেশপুরের প্রতিটি অঞ্চলের অন্ধিসন্ধি তার মুখস্থ।
ফটিক চারদিকে তাকাতে তাকাতে চলেছে। কিন্তু অন্ধকারে আর কুয়াশায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। খুনিগুলো কোথায় উধাও হয়েছে কে জানে। তবে কি ওদের ধরা যাবে না?
দমবন্ধ করে চুপিসারে অনেকটা যাওয়ার পর হঠাৎ পায়ের শব্দ কানে এল। তারপরই ছায়ামূর্তির মতো পাঁচ বন্দুকওলাকে দেখতে পেল ফটিক। ওদের ওপর নজর রেখে গাছপালার আড়ালে আড়ালে সে এগুতে লাগল।
নদীর ধারের গুদামগুলো সন্ধের আগে আগে বন্ধ হয়ে যায়। তাই এদিক ভীষণ নির্জন। কোথাও আলোর চিহ্নমাত্র নেই। গঙ্গায় এখন বোধহয় জোয়ার চলছে। তার কলকলানি ছাড়া কোথাও এতটুকু আওয়াজ নেই।
লুটেরারা গুদামের লাইন পেরিয়ে গঙ্গার ধারে চলে এসেছিল। এতক্ষণ গাছপালা আর গুদামের আড়াল ছিল কিন্তু নদীর পাড়টা ফাঁকা। হুট করে ফটিক বেরিয়ে ওদের নজরে পড়ে যেতে পারে। একটা গুদামের পাশে নিজেকে লুকিয়ে রেখে ওদের খানিকটা এগিয়ে যেতে দিল। তার মতলব অনেকটা দূরে থেকে সে পিছু নেবে।
কিন্তু লুটোররা ক্রমশ অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ফটিক বেরিয়ে এসে নদীর পাড় ধরে এগুতে লাগল। কিন্তু একসময় ওদের আর দেখতে পেল না।
ডাকুরা কোথায় যেতে পারে? নদীটা তীক্ষ্ন চোখে লক্ষ করল ফটিক কিন্তু নৌকো—টৌকো দেখা যাচ্ছে না। তার মানে গঙ্গা পেরিয়ে ওরা ওপারে পালায়নি। নিশ্চয়ই এখানে কোথাও আছে।
ফটিক যতটা পারল, খোঁজাখুঁজি করল কিন্তু সে ছাড়া কেউ কোথাও নেই। বন্দুকওয়ালারা বেমালুম যেন উবে গেছে।
কুয়াশা এবং অন্ধকার আরও ঘন হচ্ছে। বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে গায়ের চামড়ায় যেন কেটে কেটে যাচ্ছে। যত কষ্টই হোক, ফটিক ঠিক করে ফেলল, গঙ্গার ধার থেকে যাবে না, লোকগুলোকে যেভাবে পারে খুঁজে বার করবে।
যতদূর পর্যন্ত ওদের দেখা গিয়েছিল তারপরও প্রচুর গুদাম এবং পোড়ো বাড়ি রয়েছে। ফটিক প্রতিটি বাড়ি বা গুদামের সামনের দিক, পেছনের দিক এবং দু’পাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। গুদামগুলোর সামনের দিকে ভারী ভারী তালা ঝুলছে। পেছনে বা পাশে ঢোকার কোনও দরজা নেই। জানালা যদিও আছে, সেগুলো ভেতর থেকে বন্ধ। তবে পোড়ো বাড়িগুলোর বেশির ভাগই চারদিক হা—হা করে খোলা। জানালা—দরজা ভেঙেচুরে গেছে। ফটিকের মনে হল, এই সব বাড়ির কোনো একটায় নিশ্চয়ই ঢুকে আছে। কিন্তু কোন বাড়িটায়?
এতক্ষণ ছোটাছুটি খোঁজাখুঁজি করে হয়রান হয়ে পড়েছিল ফটিক। খানিকক্ষণ বসে জিরিয়ে নিল। তারপর যে বাড়িগুলো বাকি ছিল সেদিকে এগিয়ে গেল। কয়েক পা সবে গেছে, হঠাৎ তার চোখে পড়ল, একেবারে শেষ বাড়িটার তেতলার একটা ঘরের জানালা দিয়ে সরু আলোর একটা রেখা বেরিয়ে আসছে। অন্য লোকের হয়তো নজরে পড়বে না কিন্তু তার চোখের জোর প্রচণ্ড। অন্ধকারেও সে অনেক কিছু দেখতে পায়।
ফটিকের বুকের ভেতরটা প্রবলবেগে লাফাতে লাগল। সে যা ভেবেছিল তাই। আছে, আছে, আছে, ডাকুরা ভেগে যায়নি। ওদের কীভাবে ফাঁদে ফেলা যায়, এখন সেটাই ভেবে বার করতে হবে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করল ফটিক কিন্তু কোনও ফন্দিই মাথায় এল না। একসময় সে ঠিক করল, আপাতত দেখতে হবে বন্দুকওয়ালা কী করছে, নটরাজ মূর্তিটা কোথায় রেখেছে।
নদীর ধারেও গুদাম এবং বাড়িগুলোর গা ঘেঁষে প্রচুর ডালপালাওলা, বিরাট বিরাট গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে। ফটিক দারুণ গাছ বাইতে পারে, ইচ্ছা হলে চোখের পলকে মগডালে উঠে যায়।
শেষ বাড়িটার সবচেয়ে কাছে যে মস্ত রেনট্রিটা রয়েছে সেখানে এসে গিরগিটির মতো তরতর করে বেয়ে ওপরে উঠে পড়ে ফটিক। গাছটার একটা মোটা ডাল যে ঘরে আলো জ্বলছে সেটার জানালা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ডালটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বুক টেনে টেনে সেখানে চলে যায় সে।
ঘরটার এদিকের জানালার একটা পাল্লা ভাঙা। তার ফাঁক দিয়ে ফটিক দেখতে পেল, ঘরের মেঝেতে একটা মোমাবতি জ্বলছে। পাঁচ ডাকাত সেটা ঘিরে গোল হয়ে বসে নটরাজ মূর্তিটা ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে দেখতে দেখতে কথা বলছিল। ডাকুদের একজনের পাকানো গোঁফ, একজনের ঘাড় পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল, একজনের গালে কাটা দাগ, একজন বেঢপ লম্বা, আরেকজনের নিরেট মুগুরের মতো চেহারা। তাদের বন্দুকগুলো দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করানো রয়েছে।
একটা ডাকু বলল, ‘মন্দিরের পাহারাদার দুটো বোধহয় খতম হয়ে গেছে।’
গোঁফওয়ালা বলল, ‘খতম না হলে নটরাজ মূর্তিটা কি তুলে আনা যেত?’
ঝাঁকড়া চুলের লোকটা বলল, ‘ঠিক বলেছিস। পুরুতটা যেভাবে আমার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, বন্দুকের বাঁট দিয়ে মাথা না ফাটালে ছাড়ত না।’
গাল—কাটা লোকটা খুব সম্ভব ওই দলটার নেতা। বয়সও তার অন্যদের থেকে বেশি। হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘কাজের কথাটা শোন। দু’দুটো মার্ডার হয়ে গেছে। পুলিশ পাগলা কুকুরের মতো আমাদের খোঁজ করবে। হইচই যদ্দিন চলবে, এখান থেকে বেরোনো যাবে না। নিশ্চয়ই ওরা নৌকোঘাটা কি রেলস্টেশনে লোক রাখবে। আমরা গেলে ধরা পড়ে যেতে পারি।’
গোঁফওলা বলল, ‘কদ্দিন এখানে লুকিয়ে থাকতে চাও?’
‘পাঁচ—সাত দিন তো বটেই।’
‘তদ্দিন কি আমেরিকান সাহেবটা আমাদের জন্যে কলকাতার হোটেলে পড়ে থাকবে?’
‘থাকবে, থাকবে। এমন একটা নটরাজ মূর্তির জন্যে সাত দিন কেন, সাত বছর থেকে যাবে।’
ঝাঁকড়া চুলওলা বলল, ‘পঞ্চাশ লাখের কমে কিন্তু বেচব না।’
গাল—কাটা বলল, ‘আগে কলকাতায় তো ফিরি। তারপর দেখা যাবে পঞ্চাশ না ষাট, কত আদায় করতে পারি।’
ওদের কথাবার্তা থেকে ফটিক আরও জানতে পারল, চার—পাঁচ দিন আগে কলকাতা থেকে এসে ওরা এই ভূতুড়ে পোড়ো বাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। রোজ দু’তিন বার মন্দিরে গিয়ে দেখে আসত, কখন কীভাবে হানা দিলে কম ঝুঁকিতে মূর্তিটা ছিনিয়ে আনা যাবে। নিখুঁত ছক তৈরি করে আজ তারা মন্দিরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এত বড় একটা কাজে দু’একটা খুন—টুন কোনও ব্যাপারই নয়।
নটরাজ মূর্তিটা কলকাতায় নিয়ে ওরা কোনও এক আমেরিকান সাহেবের কাছে বেচে দেবার মতলব করেছে। কিন্তু ওটা কিছুতেই মহেশপুরের বাইরে যেতে দেবে না ফটিক। ডাকুরা কয়েকদিন এখানে থেকে যাচ্ছে। ফটিকের পক্ষে আপাতাত এতে খানিকটা সুবিধাই হবে। মূর্তি উদ্ধারের কোনও একটা ফন্দি ভেবে বার করার সময় পাওয়া যাবে।
ডাকাতেরা যখন থেকেই যাচ্ছে তখন আর ঠান্ডায় গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলে থাকার দরকার নেই। এখন দিনের বেলা নদীর ধারে ঘুরে ঘুরে আর রাত্তিরে গাছে উঠে ওদের ওপর নজর রাখবে সে।
গাছ থেকে নীচে নামতে নামতে ফটিক সেই গোঁফওয়ালাটার গলা শুনতে পেল, ‘যা শুকনো খাবার—টাবার নিয়ে এসেছিলাম তাতে বড়োজোর আর দু’দিন চলবে। তোমার কথামতো যদি পাঁচ—ছদিন থাকতে হয়, খাবার ফুরোলে কী খাব?’
গাল—কাটা বলল, ‘আগে ফুরোক। তারপর দেখা যাবে।’
ফটিকের মা—বাবা, ভাই—বোন, কেউ নেই। পৃথিবীতে সে একেবারে একা। ঠাকুরদার তৈরি টিনের চালের একটা হেলে—পড়া ঘর আছে তার। গাছ থেকে নেমে সে ভাবল, হোটেলে খেয়ে সেখানে গিয়ে শুয়ে পড়বে। আজ সন্ধের পর থেকে তার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে।
কিন্তু নদীর পাড় থেকে শহরে ঢুকতেই ফটিক টের পেল, চারদিকে হুলুস্থুল চলছে। প্রতিটি রাস্তার মোড় পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। ওসির জিপ সাইরেন বাজাতে বাজাতে এধারে—ওধারে ছোটাছুটি করছে। যেদিকে তাকানো যায় মানুষের জটলা। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। খুন আর মুর্তি চুরি নিয়ে তারা চাপা গলায় কথা বলছিল।
ফটিক কাউকে কিছু জানাল না, এমনকি পুলিশকেও না। চুপচাপ একটা সস্তা হোটেলে রুটি—তরকারি খেয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
পরদিন থেকে নজরদারি শুরু হল। ফটিক সকালে উঠে চান করে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে চা—পাউরুটি খেয়ে গঙ্গার ধারে চলে আসে। ততক্ষণে গুদামগুলো খুলে যায়। প্রচুর লোকজন আসতে থাকে। দিনের বেলা জায়গাটা মানুষের ভিড়ে একেবারে সরগরম।
গুদামগুলোর সামনে দিয়ে ফটিক সারাদিন ঘোরাঘুরি করে ঠিকই, কিন্তু তার নজর সারাক্ষণ শেষ মাথার সেই তিনতলা পোড়ো বাড়িটা। কিন্তু পাঁচ ডাকাতের একজনকেও ভাঙা জানালার পাশে দেখা যায় না। পাছে কারও চোখে পড়ে যায় তাই খুব সম্ভব এধারেই আসে না তারা।
সারাদিন নদীর পাড়ে কাটিয়ে সন্ধেবেলায় শহরে গিয়ে খেয়ে এসে সেই রেনট্রির ডালে উঠে ডাকাতদের কথাবার্তা শোনে ফটিক। না, কলকাতায় পালিয়ে যাবার ভাবনা এই মুহূর্তে তাদের নেই। তবে খাবার শেষ হয়ে এসেছে, সেই নিয়ে ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছে। কেউ বাইরে গিয়ে যে কিছু কিনে আনবে, ধরা পড়ার ভয়ে তা—ও পারছে না।
দু’দিন কেটে যাবার পরও পুলিশ যখন খুনি আর মূর্তিটার কোনও হদিশ পেল না তখন গভর্নমেন্ট থেকে ঘোষণা করা হল, যে বা যারা মূর্তি উদ্ধার করতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।
পুরস্কারের খবরটা শুনে চোখ দুটো চকচক করে উঠল ফটিকের। পঞ্চাশ হাজার যে কত টাকা, সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই নেই। ডাকাতগুলো প্রায় হাতের মুঠোয়, মাথা থেকে ফন্দিটা বেরুলেই ওদের ধরে ফেলা যাবে। আর তারপরেই নগদ এতগুলো টাকা। জীবনে আর ঘটি—বাটি চুরি করতে হবে না। পায়ের ওপর পা তুলে রাজার মতো দিন কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে থানায় গিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝে আসা দরকার।
ভাবামাত্র ফটিক মহেশপুর থানায় গিয়ে হাজির। ওসি ধনঞ্জয় চাকলাদার তখন তাঁর নিজের কামরায় সাব—ইন্সপেক্টর, জুনিয়র অফিসর আর কনস্টেবলদের সমানে ধমকাচ্ছিলেন, ‘কটা ডাকাত দুটো পাহারাদারকে খুন করল, পুরুতকে জখম করল, সোনার নটরাজ নিয়ে গায়েব হল। আর তিনদিনেও তাদের পাত্তা করতে পারলে না। এদিকে এস পি থেকে শুরু করে সব ওপরওলা অনবরত ধাতিয়ে যাচ্ছে। যত সব অকর্মার ধাড়ি। তোমাদের জন্যে আমার মানসম্মান সব গেল।’
ধনঞ্জয়ের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। দারুণ মজবুত চেহারা, চৌকো মুখ, ভারী চোয়াল, হাইট ছ’ফিটের ওপর। জাঁদরেল অফিসার হিসেবে তাঁর খুব সুনাম। যখনই যে থানায় গেছেন, চোর—ডাকাতদের ঢিট করে ছেড়েছেন। তাঁরই এলাকায় এত বড় দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটল, অথচ তিনদিনেও কিছুই করা গেল না, এতে মাথাটা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম সব বন্ধ হয়ে গেছে। এমন বেইজ্জত জীবনে কখনো হননি।
প্রায় চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ধনঞ্জয় ফের হুমকে উঠলেন, ‘আর দু’দিন সময় দেবো। তার ভেতর যেভাবে পারো—’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই দেখতে পেলেন, দরজার ওধারে ফটিক দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সব রক্ত মাথায় উঠে এল যেন। বাঘের মতো গর্জে উঠলেন, ‘এই ব্যাটা চোর, কী চাই এখানে?’
ফটিক দাঁত বের করে, মাথা ঝুঁকিয়ে, হাতজোড় করে বলল, ‘পেন্নাম স্যার—’
ধনঞ্জয় একটা কনস্টেবলকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ঘাড় ধাক্কা দিয়ে উল্লুকটাকে বার করে দাও তো—’
কনস্টেবলটা হুকুম পাওয়া মাত্র এগিয়ে আসছিল, ত্রস্তভাবে ফটিক বলল, ‘আপনার কাছে একটা জরুরি কাজে এসেছি স্যার। ওই সোনার নটরাজের ব্যাপারে—’
হুমকে উঠতে গিয়ে থেমে গেলেন ধনঞ্জয়। কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘কী বলবি বল—’
ফটিক বলল, ‘সবার সামনে আমি মুখ খুলব না স্যার। যা বলার স্রেফ আপনাকেই বলব।’
কী ভেবে অফিসার আর কনস্টেবলদের হাতের ইশারায় বাইরে যেতে বলে ফটিককে ভেতরে ডাকলেন ধনঞ্জয়। তারপর নিজের চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সোনার মূর্তি সম্বন্ধে কী জানিস তুই?’
ফটিক তাড়াহুড়ো করল না। ধনঞ্জয়ের টেবলের সামনে অনেকগুলো চেয়ার সাজানো রয়েছে কিন্তু দারোগার সামনে ছিঁচকে চোর তো আর চেয়ারে বসতে পারে না। সে মেঝেতে থেবড়ে বসে ট্যারাব্যাঁকা, পোকা—খাওয়া দাঁত বার করে হাসল। তারপর বলল, ‘কিছু কিছু জানি। সেটা আপনাকে এক্ষুনি বলতে পারছি না। ওটা আমার গোপন কথা। তবে—’
রাগে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল ধনঞ্জয়ের। দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘তবে কী?’
প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে ফটিক বলল, ‘স্যার, খবরের কাগজে নাকি বেরিয়েছে সোনার মূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারলে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার মিলবে?’
‘হ্যাঁ, সত্যি। তাতে কী হল?’
‘টাকাটা পেলে বড্ড উপকার হত। লোকের বাড়ি থেকে ছোটোখাটো মাল সরিয়ে, পুলিশ আর পাবলিকের পেটানি খেয়ে ঘেন্না ধরে গেছে। ওই টাকাটা পেলে চুরি—ছ্যাঁচড়ামো ছেড়ে ভদ্দরলোক হয়ে বসতাম।’
ফটিকের সঙ্কল্পটা মহৎ। কেউ যদি নিজের দোষত্রুটি শুধরে ভালো হতে চায়, তাকে সাহায্য করাই উচিত। একটু নরম হয়ে ধনঞ্জয় বললেন, ‘পুরস্কারটা তোমার ওই চাঁদ মুখ দেখে দেবে?’
ফটিক চোখ নামিয়ে বলল, ‘তাই কখনও দেয় স্যার! ডাকাতদের হাত থেকে মূর্তি ফেরত আনলে তবে না পুরস্কারটা মিলবে! একটা কথা জানার আছে। যদি রাগারাগি না করেন—’ বলতে বলতে থেমে গেল।
ফটিকের দাঁত—খিঁচানো চেহারার মধ্যে কোথায় যেন একটা ছেলেমানুষি সারল্য রয়েছে। সেই কারণে ধনঞ্জয় হয়তো তাকে একটু পছন্দও করেন। বললেন, ‘কী জানতে চাস?’
ফটিক বলল, ‘ধরুন, মূর্তিটা ডাকাতদের হাত থেকে বাগিয়ে আনলাম। পুরস্কারটা পাবো তো?’
টেবলের ওপর প্রচণ্ড ঘুষি মেরে ধনঞ্জয় বলেন, ‘আলবাত পাবি। কিন্তু—’
‘কী স্যার?’
‘তিনদিন ধরে খুঁজে খুঁজে আমাদের জিভ বেরিয়ে গেল। তুই কি পারবি রে ফটিক?’
ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে ফটিক বলল, ‘আমার ওপর ভরসা রাখুন স্যার। পুরস্কার তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে আপনার আর মহেশপুরের মান—ইজ্জতও রয়েছে। সেটা তো রাখতে হবে।’
ধনঞ্জয় খুশি হলেন। মূর্তি উদ্ধার আর খুনিদের পাকড়াও—কোনোটাই করতে না পেরে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তা ছাড়া ওপরওলাদের ধাতানিতে একেবারে নাজেহাল অবস্থা তাঁর। এই প্রথম একটু যেন আশার আলো দেখতে পেলেন। অবশ্য ফটিক পুরস্কার—টুরস্কারের ব্যাপারে যেভাবে খোঁজখবর নিচ্ছে তাকে মনে হয় দুর্ধর্ষ খুনিগুলোর হাত থেকে নটরাজ মূর্তি ছিনিয়ে আনতে পারবে। তবু একটু সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। আদৌ কি তার পক্ষে কাজটা সম্ভব? টেবলের ওপর অনেকটা ঝুঁকে ধনঞ্জয় জিজ্ঞেস করলেন, ‘একটু বুঝিয়ে বল মূর্তিটা কীভাবে আনবি?’
মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ফটিক বলল, ‘সেটা জানতে চাইবেন না স্যার। আগে থেকে জানাজানি হয়ে গেলে সব কেঁচে যাবে। মাঝখান থেকে পুরস্কারটা পাবো না।’
পঞ্চাশ হাজার টাকা বেহাত হওয়ার জন্য ফটিক মূর্তি উদ্ধারের কৌশলটা যে গোপন রাখতে চায় সেটা বোঝা যাচ্ছে। ওর ওপর জোর করলে যেটুকুও আশা আছে তা আর থাকবে না। ধনঞ্জয় বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোকে বলতে হবে না।’ একটু চিন্তাও হল তাঁর। এবার বললেন, ‘খুব সাবধান ফটকে। ডাকাতগুলোর সঙ্গে বন্দুক আছে কিন্তু—’
‘সে আপনাকে বলতে হবে না স্যার। আশীর্বাদ করুন, কাজটা যেন ভালোয় ভালোয় করে ফেলতে পারি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আশীর্বাদ করছি। তা কবে থেকে লাগবি?’
‘লেগে গেছি স্যার।’
কথাবার্তা পাকা হওয়ার পরও ওঠার নাম নেই ফটিকের। ধনঞ্জয় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি রে, আর কিছু বলবি?’
আস্তে ঘাড়টা হেলিয়ে দিল ফটিক।
ধনঞ্জয় বললেন, ‘বলে ফেল—’
হাত কচলাতে কচলাতে ফটিক বলল, ‘স্যার, একটা ঝামেলা হয়ে গেল যে।’
‘কীসের ঝামেলা?’
‘যদ্দিন না সোনার নটরাজ ফেরত আনতে পারছি, অন্যদিকে তো নজর দিতে পারব না। নিজের কাজকম্ম বন্ধ থাকবে। হাতে পয়সাকড়ি নেই। এখন খাব কী?’
ধনঞ্জয় একটু ভেবে বললেন, ‘তোর কাজকর্ম মানে চুরি তো?’
ফটিক দাঁত বার করে হাসল।
ধনঞ্জয় ভুরু ঝুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা আমাকে কী করতে হবে?’
ফটিক মাথাটা যতখানি পারে নীচু করে বলল, ‘স্যার, যদি আমাকে পঞ্চাশটা টাকা ধার দ্যান—পরে তো পুরস্কারটা পাচ্ছিই, তখন শোধ করে দেবো।’
‘হতচ্ছাড়া তোমার পেটে পেটে মহা শয়তানি—’ পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ফটিককে দিতে দিতে ধনঞ্জয় বললেন, ‘ওটা আর দিতে হবে না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখিস, নটরাজ যদি ফিরিয়ে আনতে না পারিস, মারের চোটে তোর হাড় আর মাংস আলাদা করে ফেলব।’
ফটিক থানায় এসেছিল বিকেলে, ধনঞ্জয় চাকলাদারকে ‘পেন্নাম’ ঠুকে যখন বেরুল, সন্ধে নামতে শুরু করেছে। এখন আর অন্য কোথাও নয়, সোজা গঙ্গার ধারে চলে যাবে। সেদিকে যেতে যেতে আচমকা দারুণ একটা ফন্দি মাথায় এসে গেল তার। ফটিকের মনে হল ডাকাতগুলোর আর নিস্তার নেই। নিশ্চয়ই বাছাধনেরা এবার ফাঁদে পড়ে যাবে। খুশিতে কয়েক পাক নেচে উঠতে ইচ্ছা করল তার। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল সে। না, এখন নয়। আগে মূর্তি উদ্ধার হোক, খুনিগুলো ধরা পড়ুুক, তারপর নাচার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আজকের রাতটা মাথা ঠান্ডা রেখে ডাকাতদের ওপর শুধু নজর রেখে যেতে হবে। ফটিকের আশা কালই হেস্তনেস্ত যা হওয়ার হয়ে যাবে।
নদীর পাড়ে আসতে আসতে অন্ধকার আর কুয়াশা গাঢ় হয়ে নেমে গিয়েছিল। ফটিক তার সেই রেনট্রিটার ডালে চড়ে চোখ—কান সজাগ রেখে পাল্লাভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে তেতলার ঘরের দিকে তাকিয়ে রইল।
অন্য দিনের মতো আজও একটা মোমবাতির আলোর চারপাশে বসে ডাকাতেরা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছিল। তাদের খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। ওদের কথাবার্তা থেকে মনে হল, আজ দুপুরেই খাবার ফুরিয়ে গেছে। রাতটা উপোস দিয়ে কাটাতে হবে। কাল যেভাবেই হোক, ওরা খাবার জোগাড় করবে, নইলে যত বিপদই ঘটুক এখান থেকে পালিয়ে যাবে।
গোঁফওলা বলল, ‘নিশ্চয়ই চারদিকে পুলিশ গিজগিজ করছে। তাদের চোখে ধুলো ছিটিয়ে পালাবে কী করে?’
গাল—কাটা বলল, ‘সেটা আমি ভেবে রেখেছি। কাল মাঝরাতে এখান থেকে মাইলখানেক দূরে যে নৌকোঘাটাটা রয়েছে, সেখানে গিয়ে একটা নৌকো কেড়ে নদীর ওপারে চলে যাব। একবার গঙ্গা পেরুতে পারলে আর চিন্তা নেই।’
‘কিন্তু এখানে আসার পর পালাবার ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অনেক ভাবনাচিন্তা করেছিলাম। দু’দিক দিয়ে মহেশপুর থেকে সরে পড়া যায়। রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে, নইলে নদী পেরিয়ে। স্টেশনে সারাক্ষণ পাহারা থাকবে। নৌকোঘাটার যে খবর নিয়ে এসেছিলাম সেটা বোধহয় তোমার মনে নেই। চুরি যাবার ভয়ে প্রত্যেকটা নৌকোয় রাত্তিরে লোক থাকে। নৌকো কাড়তে গেলে ওরা হল্লা বাধাবে না?’
‘আমাদের সঙ্গে বন্দুক আছে কী করতে?’
ঝাঁকড়া চুলের লোকটা বলল, ‘তোমরা তো জানো আমি একদম খিদে সহ্য করতে পারি না। আজ রাত্তিরে উপোস দিতে হবে, কালও মাঝরাত পর্যন্ত পেটে কিছু পড়বে না। স্রেফ মরে যাব।’
গাল—কাটা তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, ‘বললাম তো, খাবার জোগাড় করতে চেষ্টা করব। না পারলে একটু কষ্ট কর। মূর্তিটা আমেরিকান সাহেবের হাতে তুলে দেবার পর কত টাকা পাবি একবার ভেবে দ্যাখ।’
রেনট্রির ডালে আর ঝুলে রইল না ফটিক। চুপচাপ নেমে এসে সোজা শহরের মাঝখানে ‘মা দুর্গা মেডিক্যাল স্টোর্স’—এ চলে এল। এখানকার সেলসম্যান নিকুঞ্জ হালদার, যার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, গোলগাল হাসিখুশি মানুষ। ফটিক ছিঁচকে চোর হলেও এ শহরের অনেকেই তাকে ভালোবাসে। নিকুঞ্জ হালদারও। আসলে যে যখন কোনো কাজে তাকে ডাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে হাজির হয়ে যায়। মড়া পোড়ানো, মাল বওয়া, ছোটোখাটো ফরমাশ খাটা—কোনো ব্যাপারেই তার ‘না’ নেই।
নিকুঞ্জকে বাইরে ডেকে এনে ফটিক বলল, ‘দাদা, আমার একটা উপকার করতে হবে।’
নিকুঞ্জ জানতে চাইল, ‘কী উপকার?’
ফটিক তার কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলতেই নিকুঞ্জ আঁতকে উঠল, ‘না, না, ও আমি পারব না।’
ফটিক বোঝাল, ‘তোমার কোনও ভয় নেই। কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না। তা ছাড়া পরে তোমাকে আমি দু’হাজার টাকা দেব।’
নিকুঞ্জ চমকে উঠে বলল, ‘অত টাকা তুই পাবি কোথায়?’
‘এখন জানতে চেয়ো না, পরে তোমাকে সব বলব।’ ফটিক বলল।
নিকুঞ্জর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না কিন্তু দু’হাজার টাকা পাওয়া যাবে। সেই লোভে বলল, ‘ঠিক আছে।’
পরদিন সকালে তখন ন’টাও বাজেনি, দেখা গেল পলিথিনের বিরাট একটা ব্যাগে পাউরুটি আর কেক—টেক বোঝাই করে গঙ্গার ধারে সারি সারি গুদামগুলোর পাশ দিয়ে পোড়ো বাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে চলেছে ফটিক।
এর মধ্যে সব গুদাম খুলে গেছে। চারদিকে প্রচুর লোকজন। তাদের কেউ কেউ পাউরুটি কিনতে চাইলে ফটিক জানাল, বেচা যাবে না, অন্য লোকের অর্ডার আছে।
গুদামের লাইন পেরিয়ে পোড়ো বাড়িগুলোর কাছে এসে গলা চড়িয়ে ফটিক হাঁকতে লাগল, ‘রুটি চাই, রুটি। টাটকা কেক—’
সেই তেতলাটা পর্যন্ত যায়নি সে, তবে তার চোখ সেদিকেই রয়েছে। হঠাৎ মনে হল, ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে একটা মুখ পলকের জন্য দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। ফটিক আর এগুলো না, যেন ফিরে যাচ্ছে এমন একটা ভাব করে আড়চোখে বাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে ঘুরে দাঁড়াল।
আর তখনই পেছন থেকে একটা চাপা গলা কানে এল ফটিকের, ‘এই শোন—’ মুখ ফেরাতে দেখতে পেল, সেই লম্বা চুলওলাটা একতলার দেওয়ালের আড়াল থেকে হাতছানি দিচ্ছে। কখন সে নীচে নেমে এসেছে, টের পাওয়া যায়নি। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল ফটিকের। একবার ভাবল, দৌড়ে পালিয়ে যাবে কি না। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। পরক্ষণে মনে হল, এমন সুযোগ জীবনে দু’বার আসবে না। পায়ে পায়ে, খুব সতর্কভাবে এগিয়ে গেল সে।
কাছাকাছি যেতেই লম্বা চুলওলা বলল, ‘ক’টা রুটি আছে?’
‘কুড়িটা।’
‘আর কী আছে?’
‘কেক—’
‘সব কিনে নেব। আমার সঙ্গে ভেতরে এস।’
‘ভেতরে যাব কেন? এখানেই দাম দিয়ে নিয়ে যাও।’
লম্বা চুলওলা পেছনে যে বন্দুক লুকিয়ে রেখেছিল, টের পাওয়া যায়নি। ঝট করে সেটা সামনের দিকে নিয়ে এসে কড়া গলায় বলল, ‘এটা চিনিস? যা বলছি তাই কর।’
এমনটা যে হতে পারে, আঁচ করতে পারেনি ফটিক। আতঙ্কে তার দম বন্ধ হয়ে এল। সেই অবস্থায় লম্বা চুলওলার সঙ্গে তেতলার সেই ঘরটায় আসতেই হল তাকে। অন্য চার ডাকাত সেখানে বসে আছে।
গাল—কাটা হেসে হেসে ফটিককে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী নাম রে?’
ফটিক নাম বলল।
‘বড্ড উপকার করেছিস আমাদের। কাল সারারাত কিচ্ছু খাইনি। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই করছে।’
ভয়ে ভয়ে ফটিক বলল, ‘যা নেবার নিয়ে দামটা দাও। আমি চলে যাই।’
‘অত তাড়া কীসের? বোস বোস। তোর যা দাম তার থেকে অনেক বেশিই পাবি। আর একটা কথা। মাঝরাত পর্যন্ত আমরা এখানে আছি। ততক্ষণ আমাদের সঙ্গে তোকে থাকতে হবে।’ একটা বন্দুক তুলে ফটিকের দিকে তাক করে গাল—কাটা বলল, ‘যদি মুখ বুজে গুড বয় হয়ে বসে থাকিস, কিচ্ছু হবে না। আর ট্যাঁ—ফোঁ করলে গুলিতে স্রেফ ঝাঁঝরা হয়ে যাবি।’
হাত—পা আলগা হয়ে আসছিল ফটিকের। চোখে অন্ধকার দেখছিল। তারই মধ্যে কোনও রকমে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল।
এদিকে পলিথিনের ব্যাগটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে ডাকাতেরা। কয়েক মিনিটের ভেতর দশ—বারোটা রুটি আর ডজন দেড়েক কেক সাবাড় করে সবাই গল্প করতে লাগল। ফটিকের দিকে কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।
ফটিক শুধু ভাবছিল, যে ফন্দিটা সে করেছে, শেষ পর্যন্ত সেটা যদি কাজে না লাগে? এই ঠান্ডার সময়েও ঘেমে নেয়ে যাচ্ছিল সে।
কিন্তু আধঘণ্টাও পেরুল না, তার আগেই চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে আসতে লাগল ডাকাতদের, কথা জড়িয়ে এল। তারপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে নাক ডাকা শুরু হল। নিকুঞ্জ হালদার কড়া ডোজের যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিল সেগুলো গুলে পাউরুটি আর কেকে মাখিয়ে দিয়েছে ফটিক। তার ফল হয়েছে চমৎকার। আর দুশ্চিন্তা নেই।
ডাকাতরা ঘুমিয়ে পড়ার পরও খানিকক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল ফটিক। তারপর আস্তে আস্তে ডাকল, ‘এই যে দাদারা—’
কোনও সাড়া নেই। আরও কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর ফটিক নিশ্চিন্ত হয়ে গেল যে ওদের ঘুম সাত—আট ঘণ্টার মধ্যেও ভাঙবে না। এবার উঠে ঘরময় খোঁজাখুঁজি করতে করতে একটা বড় কাঠের বাক্সের ভেতর নটরাজ মূর্তিটা পেয়ে গেল। বাক্সসুদ্ধু মূর্তিটা বুকে জড়িয়ে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের শেকলটা তুলে দিল। তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে থানার দিকে দৌড়।
ওসি ধনঞ্জয় চাকলাদার থানাতেই ছিলেন। বাক্সটা তাঁর হাতে দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘এই নিন আপনার সোনার নটরাজ। খুনিদের ধরতে হলে এক্ষুনি পুলিশ নিয়ে চলুন।’
কিছুক্ষণের মধ্যে পাঁচ ডাকাত ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ল।
এরপর পুরস্কারের পঞ্চাশ হাজার টাকা পেয়ে গেল ফটিক। কথামতো তার থেকে দু’ হাজার নিকুঞ্জকে দিয়ে দিল সে।
এখন আর চুরিচামারি করে না ফটিক। মহেশপুরের বাজারে একটা মনোহারি জিনিসের দোকান খুলে বেশ সুখেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছে।
—