Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌকিক এবং অলৌকিক গল্প – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প238 Mins Read0

    জের

    জের

    রোজই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়। না হলেই বুঝি ভালো হত।

    অন্ধকার থাকতে থাকতে আমি হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। হোটেলের কাছেই অবজারভেটরি। অবজারভেটরিটা আমার স্টার্টিং পয়েন্ট। ওখান থেকে সমুদ্রতীরের বালি ভাঙতে ভাঙতে চলে যাই স্বর্গদ্বারের দিকে। ভদ্রলোক আসেন স্বর্গদ্বারের দিক থেকে।

    দুই বিপরীত দিক থেকে এসে মাঝামাঝি একটা জায়গায় আমরা মিলি। মুহূর্তমাত্র, তারপরেই পরস্পরকে পার হয়ে চলে যাই। লক্ষ করেছি, ভদ্রলোকের দৌড় অবজারভেটরি পর্যন্ত।

    স্বর্গদ্বারের বুড়ি ছুঁয়ে আবার যখন সেই মাঝামাঝি জায়গাটায় ফিরি, ততক্ষণে ভদ্রলোক ওদিক থেকে চলে এসেছেন।

    এধারে অবজারভেটরি, ওধারে স্বর্গদ্বার। সারা সকালবেলাটা এই দুই প্রান্ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমাদের কেটে যায়।

    অন্য সময় হলে টুরিস্ট আর স্বাস্থ্যান্বেষীদের ভিড়ে ভদ্রলোককে হয়তো লক্ষ করতাম না। কিন্তু পুরীতে এখন মানুজন কম। কম হবার কথাই। আশি ঘণ্টা আগেও মনসুন ছিল সিলোনের কাছে; কোনাকুনি কয়েক শো মাইল পাড়ি দিয়ে এর মধ্যে এখানে এসে পড়েছে।

    পুরীর আকাশ আজকাল সারাদিনই মেঘে ঢাকা; মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হচ্ছে। দিন পাঁচেক হল এখানে এসেছি। তার ভেতর দু—দিন মোটে রোদ দেখা গেছে। তাও অল্প সময়ের জন্য; তারপরেই ঘন মেঘ তার মুখে ঘোমটা টেনে দিয়েছে। বর্ষা মাথায় নিয়ে এই মরশুমে কেউ এখানে আসতে চায় না। না টুরিস্ট, না স্বাস্থ্যান্বেষী, না পুণ্যলোভী। তবু যারা আসে তারা বিশেষ বেরোয় টেরোয় না, ঘরেই বসে থাকে। বেরুলেও ভোরের দিকে অন্তত না।

    কাজেই সোনালি বালির নির্জন সৈকতে ভদ্রলোক আমার চোখে পড়েছিলেন; সম্ভবত তিনিও আমাকে লক্ষ করে থাকবেন।

    অন্য দিন আমার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে অবজারভেটরির দিকে চলে যান ভদ্রলোক। আজ কিন্তু গেলেন না; কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অগত্যা আমাকেও দাঁড়াতে হল।

    হাতজোড় করে ভদ্রলোক বললেন, ‘নমস্কার। রোজই আপনাকে সমুদ্রের পারে দেখি। ভাবি আলাপ করব।’

    প্রতি—নমস্কার জানিয়ে বললাম, ‘আমিও আপনাকে দেখি। আলাপ করবার ইচ্ছে আমারও।’

    ‘ইচ্ছেটা দু’পক্ষেই ছিল। অথচ দেখুন, সেটা প্রকাশ করতে আমাদের চার পাঁচ দিন লেগে গেল। ব্যাপারটা কী জানেন?’

    আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।

    ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ‘আমরা বড্ড বেশি ফরম্যাল হয়ে গেছি। না কি পরনির্ভর? তৃতীয় একজন পরিচয় করিয়ে না দিলে নিজের থেকে কেউ এগিয়ে যেতে পারি না।

    কথাটা মোটামুটি সত্যি। হাসতে হাসতে বললাম, ‘তা যা বলেছেন।’

    ভদ্রলোক বললেন, ‘দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, চলুন হাঁটতে হাঁটতে গল্প করা যাক।’

    ‘চলুন।’

    অন্যদিন আমরা উল্টো দিকে চলে যাই। আজ কিন্তু ভদ্রলোক আমার সঙ্গে সঙ্গে ফের স্বর্গদ্বারের দিকে চললেন।

    আজকের দিনটা বেশ ভালোই। মেঘ অবশ্য আছে, তবে অন্য সব দিনের মতো ভারী আর অনড় না, টুকরো টুকরো, ভবঘুরে ধরনের। আকাশের এ—কোণে ও—কোণে তারা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর কি আশ্চর্য, সমুদ্রের তলা থেকে কাটা তরমুজের মতন লাল টুকটুকে সূর্য মাথা তুলেছে। পাঁচ দিনের ভেতর আজই প্রথম সূর্যোদয় দেখতে পেলাম।

    পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভদ্রলোক বললেন, ‘আলাপ হয়েছে; পরিচয়টা সেরে ফেলা যাক। অধীনের নাম সোমনাথ চক্রবর্তী। পাটনায় থাকি, কন্ট্রাক্টরি করে পেট চালাই। এবার আপনি বলুন।’

    প্রথমে নাম বললাম। তারপর জানালাম, ‘আমি কলকাতাবাসী। নাম—করা মার্চেন্ট অফিসে মোটামুটি ভালোই চাকরি করি; মাঝারি ধরনের অফিসার।

    পরিচয়—পর্ব চুকলে সোমনাথ বললেন, ‘জানেন অরবিন্দবাবু, সী—বীচে প্রথম দিন আপনাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’

    ‘কেন?’

    ‘এই অফ—সিজনে পুরীতে লোকজন আসে না। আমি কিন্তু এ সময়টা প্রতি বছর আসি। এবার এসে দেখলাম, আমার মতো বাতিকগ্রস্ত আরো এক—আধজন আছে।’

    উত্তর আর কী দেব, হাসলাম।

    সোমনাথ আমার চাইতে পাঁচ—সাত বছরের বড়ই হবেন; মাথায় অবশ্য ইঞ্চি কয়েক খাটো। গোলগাল ভারী চেহারা, হাড় আর মাংসের চাইতে চর্বির ভাগ বেশি। লম্বা ধাঁচের ভরাট মুখ। চওড়া কপালের ওপর চুল পাতলা হয়ে এসেছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।

    আলাপ হবার পর অবজারভেটরি থেকে স্বর্গদ্বার পর্যন্ত বার তিনেক আমাদের টহল দেওয়া হয়ে গেছে। সোমনাথের মুখ কিন্তু মুহূর্তের জন্যও থামেনি। ভদ্রলোক সব সময় বকবকায়মান।

    এদিকে সূর্যটা লাফ দিয়ে সমুদ্রের তলা থেকে উঠে এসেছে। খানিক আগে ওটা ছিল কাটা তরমুজ; এখন সোনার ঘট।

    হঠাৎ কী মনে পড়তে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সোমনাথ, ‘ভালো কথা, এতক্ষণ ধরে গল্প—টল্প করছি, অথচ আপনি কোথায় উঠেছেন জানাই হয়নি।’

    ‘ওসেন—ভিউ হোটেলে। আপনি?’

    ‘আমি পুরী ইণ্টারন্যাশনালে।’

    একটু ভেবে সোমনাথ এবার শুধোলেন, ‘একাই এসেছেন?’

    মাথা নাড়লাম, ‘না, সস্ত্রীক।’

    উৎসুক চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে সোমনাথ বললেন, ‘মিসেস সঙ্গে রয়েছেন?’ তবে একা একা বেড়াতে আসেন যে?’

    ‘আর বলবেন না; আমার স্ত্রী প্রাতরুত্থানটা তেমন পছন্দ করেন না। ভোরবেলা বেড়াবার কথা বললে বলেন; খামোখা হেঁটে হেঁটে পায়ে খিল ধরাব কেন?’ তিনি হোটেলেই থাকেন, আমি বেরিয়ে পড়ি।’

    সোমনাথের চোখ চকচক করতে লাগল, ‘অদ্ভুত ব্যাপার তো মশায়—’

    ভদ্রলোক ঠিক কি বলতে চান বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল?’

    ‘স্ত্রীভাগ্য দেখছি, আমাদের দু’জনেরই এক।’

    এবার আমার কৌতুহলী হবার পালা, ‘কী রকম?’

    সোমনাথ বলতে লাগলেন, ‘আমার মিসেসও সঙ্গে এসেছেন। প্রাতর্ভ্রমণে তাঁরও ঘোরতর অরুচি।’

    কয়েক পলক দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর গলা মিলিয়ে জোরে জোরে হেসে উঠলাম।

    দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল। তরল সোনার মতন উজ্জ্বল ঝলমলে রোদ। চার পাঁচ দিন পর অনেক কালের পুরনো সূর্যকে তার আপন মহিমায় দেখে বড় ভালো লাগছে।

    বেলা বেড়ে যাচ্ছিল। বললাম, ‘আজ এই পর্যন্ত। অনুমতি করুন, এবার হোটেলে ফিরি।’

    ‘উঁহু—’ দু’ধারে মাথা নাড়লেন সোমনাথ, ‘তা হবে না মশাই।’

    ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য কী? সারা দিনই ‘বীচে’ ঘুরবেন নাকি? কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই সোমনাথ তাঁর মনের ইচ্ছাটা পরিস্কার করে দিলেন, ‘হোটেলে পরে ফিরবেন। এখন আমার সঙ্গে চলুন।’

    ‘আপনার সঙ্গে কোথায় যাব?’

    ‘আমার হোটেলে। প্রথম আলাপ হল, একটু চা—টা না খাইয়ে ছাড়তে পারি? তা ছাড়া—’

    ‘কী?’

    ‘মিসেসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব।’

    ‘এখন থাক, পরে না হয়—’

    মাঝপথেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে সোমনাথ চেঁচামেচি জুড়ে দিলেন, ‘না—না মশাই, পরে—টরে না। টাটকা—টাটকাই হয়ে যাওয়া ভালো। আসুন।’

    আচ্ছা পাল্লায় পড়া গেছে। ভদ্রলোকের আন্তরিকতা, ইনফরম্যাল ভাব আমাকে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু এখন সেটা প্রায় জুলুমের পর্যায়ে গিয়ে পড়ছে। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলাম। তবু হাসিমুখে বিনীতভাবে বললাম, ‘আমর স্ত্রী একা একা আছেন। ফিরতে দেরি হলে চিন্তা করবেন।’

    ‘করুন একটু চিন্তা; তাতে সাঙ্ঘাতিক কিছু ক্ষতি হবে না। ম্যাক্সিমাম হাফ এ্যান আওয়ার; তার মধ্যেই আপনাকে ছেড়ে দেব।’

    একরকম জোর করেই সোমনাথ আমাকে তাঁর হোটেলে টেনে নিয়ে চললেন। যেতে যেতে সৎ পরামর্শ দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘মনে হচ্ছে আপনি মশাই গুডি—গুডি হাজব্যাণ্ড। স্ত্রীর গায়ে আঁচটি লাগতে দ্যান না, এটা ঠিক না। মাঝে মাঝে মহাশয়াকে একটু আধটু ভাবাবেন। সব সময় নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় রাখলে লাইফে আর চার্ম থাকবে না, একেবারে আলুনি হয়ে যাবে।’

    উপদেশ শিরোধার্য করে পায়ে পায়ে এগুতে লাগলাম।

    সোমনাথের হোটেল স্বর্গদ্বারের কাছে। দোতলায় একটা সুইট নিয়ে ওঁরা আছেন।

    অল্পক্ষণের পরিচয়েই বুঝেছি, সোমনাথ মানুষটি উচ্ছ্বাসপ্রবণ, কারণে—অকারণে মেতে উঠতে পারেন। স্যুইটের দরজায় এসে তিনি প্রায় হৈ—চৈ জুড়ে দিলেন, ‘কোথায় গেলে; দরজা খোল, দরজা খোল। দেখ, কাকে ধরে এনেছি—’

    ভেতর থেকে মেয়ে—গলা ভেসে এল, ‘খুলছি, খুলছি। সব সময় হুলস্থূল কাণ্ড! এক মিনিট তর সয় না!’ বলতে বলতে খুট করে শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল।

    তারপরেই দেখলাম, আমার মুখোমুখি অলকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাঁচ বছর আগে যেমন দেখেছি প্রায় সেই রকমই রয়েছে অলকা। ডিমের মতন লম্বাটে সেই মুখ, কচি পাতার শ্যামল আভার মতো সেই রং, সেই ভুরু, মসৃণ সেই গ্রীবা, কালো কুচকুচে সেই চোখের তারা। তফাতের মধ্যে বয়সের সামান্য একটু ভার পড়েছে শরীরে। ফাঁকা আকাশে সূর্যোদয়ের মতো অলকার কপালে মস্ত সিঁদুরের টিপ।

    সমস্ত ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য। এতকাল পর এখানে এভাবে পাটনার কোন এক কন্ট্রাক্টর সোমনাথ চক্রবর্তীর ঘরণীরূপে অলকাকে দেখব, কে ভাবতে পেরেছিল?

    পলকের জন্য মনে হল, আমার হৃৎপিণ্ডের ওঠা—নামা বন্ধ হয়ে গেছে। পরক্ষণেই অসহ্য শীতের মতো কিছু একটা চামড়ার তলা দিয়ে চোরা বানের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল। টের পেলাম, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

    অলকাও এই মুহূর্তে এখানে আমাকে দেখবে, ভাবেনি। চোখের তারা তার স্থির, কণ্ঠার কাছটা এবং ঠোঁট দুটো অসহনীয় কোন আবেগে থর থর কাঁপছে। লক্ষ করলাম, তার মুখ থেকে পরতে পরতে রক্ত নেমে যাচ্ছে।

    সোমনাথ চক্রবর্তী চেঁচামেচি করে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে লাগলেন, ‘ইনি অরবিন্দ লাহিড়ী; কলকাতায় স্যাণ্ডারসন কোম্পানির মস্ত অফিসার। আজই ‘বীচে’ আলাপ হয়েছে, একেবারে পাকড়াও করে নিয়েই এলাম। সহজে কি আসতে চান? আর উনি আমার সহধর্মিনী—অলকা।’

    কাঁপা আধফোটা গলায় বললাম, ‘নমস্কার।’

    অলকার শিথিল দুই হাত যুক্ত হয়ে খানিক উঠেই নেমে গেল। ঝাপসা গলায় কিছু একটা বলল সে, কিন্তু বোঝা গেল না।

    সোমনাথের উঁচু গলা আবার শোনা গেল, ‘অরবিন্দবাবুকে দেখে তুমি যে ‘একেবারে বোবা হয়ে গেলে! ভদ্রলোককে ভেতরে নিয়ে যাও।’ আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আসুন মশাই—’

    ইচ্ছে করছিল ছুটে পালিয়ে যাই। যাব তো, কিন্তু কোথায়? পেছন দিকে একটা নিরেট দেওয়াল যেন কেউ তুলে দিয়েছে। অগত্যা সামনের দিকে পা বাড়াতে হল।

    ভেতরে গিয়ে সোজা আমাকে বিছানায় বসালেন সোমনাথ। একটু পর চা এল, আনুষঙ্গিক খাবার—দাবার এল। সোমনাথ বললেন, ‘খান মশাই—’

    খেতে খেতে একাই জমিয়ে তুললেন সোমনাথ। মুখ নীচু করে মাঝে—মধ্যে আমি এক—আধটা ‘হুঁ’ ‘হাঁ’ যুগিয়ে যেতে লাগলাম। অলকা ঘরেই আছে, আমারই মতো তারও মুখ মাটির দিকে অবনত।

    একটানা অনেকক্ষণ গলা সাধার পর হঠাৎ যেন সোমনাথের খেয়াল হল, ঘরের আর দু’টি মানুষ একেবারে পুতুল হয়ে বসে আছে। একবার অলকা, আরেকবার আমাকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘কী মশাই, আমার স্ত্রীর কাছে অত সঙ্কোচটা কিসের আপনার? বী এ্যাট হোম—’

    বিব্রতভাবে বললা, ‘না, মানে—’

    সোমনাথ অলকাকে বললেন, ‘তোমার আজ হল কী? একেবারে লজ্জাবতী লতা বনে গেলে দেখছি। অরবিন্দবাবুর কাছে লজ্জা কী, উনি আমাদের ঘরের লোক। মুখ বুজে বসে থাকলে উনি কী ভাববেন?’

    আমার চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘অনেক বেলা হয়ে গেল। এবার আমি যাব সোমনাথবাবু।’

    ‘সেকি! আধ ঘণ্টা তো এখনও হয়নি। তাছাড়া আমার স্ত্রীর সঙ্গে তো ভালো করে আলাপই হল না। জানেন, স্ত্রী বলে বলছি না, ও খুব ভালো গাইতে পারে।’

    অলকা যে অসাধারণ গায়িকা, চর্চা এবং চেষ্টা করলে প্রচুর নাম করতে পারত, আমার চাইতে কে আর ভালো জানে। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘পরে আরেক দিন এসে মিসেসের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করে যাব; তখন গানও শুনব।’

    সোমনাথ এবার সদয় হলেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ‘তাহলে তাই। আবার করে আসছেন বলুন। কবে কি, ওবেলাই আসুন না। ভালো কথা, আপনি একলা না, মিসেসকেও সঙ্গে আনবেন।’ অলকাকে বললেন, ‘সস্ত্রীক আসবার জন্যে অরবিন্দবাবুকে নেমতন্ন করে দাও।’

    চকিতের জন্য একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ নামাল অলকা। এবারও অস্ফুট স্বরে যা বলল বোঝা গেল না।

    সোমনাথের স্যুইট থেকে বেরিয়ে দু—তিনটে সিঁড়ি এক—এক বারে টপকে শ্বাসরুদ্ধের মতো নীচে নেমে এলাম। সোমনাথও আমার সঙ্গে সঙ্গে আসছিলেন। আমার মতো এত তাড়াতাড়ি তিনি সিঁড়ি ভাঙতে পারছিলেন না। কিছু পরে নীচে নেমে তিনি বললেন, ‘কী মশাই, অমন লাফিয়ে লাফিয়ে নামছিলেন! হয়েছিল কী আপনার? বাঘে তাড়া করলেও তো কেউ এমন করে ছোটে না।’

    উত্তর দিলাম না, বিপন্ন মুখে একটু হাসলাম শুধু।

    সোমনাথ বললেন, ‘এই বয়েসে এত লাফ—ঝাঁপ ভালো না, একবার পা ফসকালে দেখতে হত না, দু’টি মাসের জন্যে বিছানা নিতে হত।’

    সোমনাথ একাই কথা বলে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যেই লম্বা লম্বা পা ফেলে রাস্তায় এসে একটা সাইকেল—রিক্সা থামিয়ে উঠে বসলাম।

    সোমনাথ সঙ্গ ছাড়েননি। কাছে এসে বললেন, ‘চলুন, আপনাকে আপনার হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। সেই সঙ্গে মিসেসকেও নেমতন্ন করে আসা যাবে।’

    জোরে জোরে দু’ হাত নেড়ে বললাম, ‘না—না, আপনি আবার কষ্ট করে যাবেন কেন? আমাকেই তো বলে দিয়েছেন, তাতেই হবে। মিসেসকে আর নেমতন্ন করতে হবে না।’

    ‘তা হলে বিকেলে আসছেন? আমরা কিন্তু খুব আশা করব!’

    আসব যে না, আগেই স্থির করে ফেলেছি। পাছে সোমনাথ আবার ঝঞ্ঝাট বাধান, তাই কোনোরকমে মাথাটা হেলিয়ে রিক্সাওলাকে বললাম, ‘চালাও—’ সমুদ্রের পাড় দিয়ে রাস্তা, রিক্সা উর্ধ্বশ্বাসে আমার হোটেলের দিকে ছুটতে লাগল। কিছুক্ষণ আগে সূর্যোদয় দেখে গেছি। সারা গায়ে রোদের আদর মেখে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউগুলো তরল সোনার মতো টলমল করছিল। এখন কোথায়ই বা সূর্য, কোথায়ই বা রোদ, টুকরে টুকরো ছন্নছাড়া সেই মেঘগুলো কখন যে কাছাকাছি এসে জমাটা বেঁধে সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে, কে বলবে। জেলেরা ভোরবেলার তিন কাঠের ডিঙিতে গভীর সমুদ্রের দিকে চলে গিয়েছিল। এখন তারা ফিরে আসছে। পাহাডের মতো বড় বড় উঁচু উঁচু ঢেউগুলোর ওপর ডানা মেলে বাতাস কেটে কেটে অসংখ্য সাগরপাখি উড়ছে।

    মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, সাগরপাখি কিংবা কালো কালো বিন্দুর মতো কাছে—দূরে অগণিত জেলেডিঙি—কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম না। বার বার ঘুরে ফিরে অলকার মুখটাই আমার চোখের ওপর ভেসে উঠছে। এই মুখটাই সময়ের উজান ঠেলে আমাকে সাত—আট বছর পেছনে টেনে নিয়ে গেল।

    একদিন ভালোবেসেই অলকাকে বিয়ে করেছিলাম। বাবা—মা, আত্মীয়—স্বজন, এ ব্যাপারে কারো সমর্থন ছিল না। অলকার জন্য সেদিন সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এত করেও ভালোবাসার সেই বিয়েটাকে দীর্ঘায়ু করা যায়নি। তার জন্য দায়ী আমরাই।

    স্বভাবের দিক থেকে আমরা ছিলাম দুই বিপরীত মেরুর, আমাদের মধ্যেই বিরোধের বীজ লুকনো ছিল। বিয়ের আগে সেটা টের পাওয়া যায়নি। তখন আমাদের চোখে অন্য রং, তখন আমরা আবেগের জোয়ারে ভাসছি।

    বিয়ের কয়েক মাস পর বুঝতে পারলাম, অলকা আর আমি খুব কাছাকাছি নেই। একই ঘরে থাকি, একই টেবিলে মুখোমুখি খেতে বসি, এমন কি একই বিছানায় পাশাপাশি শুই, তবু আমাদের মাঝখানে অনেক দূরত্ব। সেই দূরত্ব দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল।

    তখন আমি মার্চেণ্ট অফিসে মাঝারি মাপের কেরানি। কিন্তু তার মধ্যেই চিরদিন সীমাবদ্ধ থাকব, আমার উচ্চাশা এত সামান্য নয়। কোনোদিনই আমি নীচের দিকে তাকাতে জানি না, আমার দৃষ্টি সবসময় উঁচুতে। যে ভাবেই হোক, যে পথেই হোক, চূড়ায় আমাকে উঠতেই হবে। কেরানি থেকে অফিসার হব, অফিসার থেকে ম্যানেজার, ম্যানেজার থেকে ডাইরেক্টর—আমার দাবীর এবং লোভের কোথাও শেষ নেই।

    কিন্তু উঠব বললেই তো ওঠা যায় না। ওপরে যাবার পথ বড় দুর্গম। কিন্তু উচ্চাশা যার আকাশ—সমান সে একটা না একটা কৌশল বার করবেই। আমিও করেছিলাম। পোষা কুকুরের মতো বড়কর্তাদের পায়ে পায়ে ঘুরতাম, দু—চার টুকরো মাংসের জন্য না পারি কী? দরকার হলে জিভ দিয়ে ওদের জুতো পর্যন্ত সাফ করে দিতে পারতাম। আজও পারি।

    শুধু চাটুকারিতা বা তোষামোদ না, মাঝে মাঝে ধার—টার করে দামি হোটেলে পার্টি পর্যন্ত দিয়েছি। কর্তাদের মনোরঞ্জনের জন্য চড়াদামে মেয়েমানুষের শরীর কিনে ঘুষ দিয়েছি। নগদ নগদ তার ফলও পেয়েছি। একদিন আবিষ্কার করেছিলাম, কেরানিত্বের গণ্ডী পেরিয়ে ছোটখাটো অফিসার হয়ে গেছি। ছোট অফিসার থেকে ক্রমশ আরো ওপরে উঠতে লাগলাম, এক—আধ বছরের মধ্যে ডিপার্টমেন্টাল ম্যানেজার হয়ে যাব।

    অফিসার হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার চালচলন, ধরন—ধারণ পুরোপুরি বদলে গিয়েছিল। পার্টি—ক্লাব—ড্রিঙ্ক নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। সকালবেলা স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যেতাম, লাঞ্চ অফিসেই সারতাম। ছুটির পর ক্লাব। মাঝেরাতে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন আমার ভেতর আমি থাকতাম না। কোনোদিনই ঘাড়ের ওপর মাথা সিধে রেখে স্বাভাবিক পায়ে ফিরতে পারতাম না। কোনোদিন হামাগুড়ি দিয়ে, কোনোদিন টলতে টলতে সিঁড়ির রেলিং ধরে ধরে আমাকে উঠতে হত। বেশির ভাগ দিনই দরজা পর্যন্ত এসে বমি করে ফেলতাম।

    আমার উচ্চাশা যেখানে বাঁধা, অলকার নজর ততদূর পৌঁছোয় না। আমার সুখের ধারণার সঙ্গে তার সুখের ধারণার কোনো মিল নেই। আমাকে ঘিরে শান্ত স্তিমিত নিস্তরঙ্গ উত্তেজনাহীন একটি জীবনকে সে সুখের চরম ধরে নিয়েছিল। অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে সারাদিন তার কাছে থাকি, ছুটির দিনে দু’জনে সিনেমায় যাই কিংবা শহর থেকে দূরে কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসি, এই ছিল তার কাম্য। বেশি টাকা, বেশি প্রতিষ্ঠার পেছনে উদভ্রান্তের মতো ছোটা সে পছন্দ করত না।

    অলকা বলত, ‘এ তুমি কী করছ?’

    আমি পাল্টা প্রশ্ন করতাম, ‘কী করছি?’

    ‘টাকা টাকা আর প্রমোশন করে এমন পাগল হয়ে উঠেছ কেন?’

    হেসে বলতাম, ‘অল্পে আমার সুখ নেই, তাই—’

    ভীরু গলায় অলকা বলত, ‘কিন্তু আমরা তো বেশ আছি। তুমি যা মাইনে পাও তাতেই আমাদের ভালোভাবে চলে যাবে। আর টাকার দরকার নেই।’

    ‘আছে।’

    ‘কী হবে আরো টাকা দিয়ে?’

    ‘ওটার খুব প্রয়োজন। বেশি টাকা মানেই বিরাট স্টেটাস।’

    ‘বেশি টাকা থাকলে অনেক আরাম হয়তো হয়, কিন্তু—’

    ‘কিন্তু কী?’

    ‘টাকায় কি সুখ কেনা যায়?’

    শরীরের সবটুকু শক্তি গলায় ঢেলে বলতাম, ‘নিশ্চয়।’

    একেক দিন অলকা বলত, ‘টাকা চাও, প্রমোশন চাও, তার না হয় একটা মানে বুঝলাম। কিন্তু রোজ রোজ মদ খাও কেন?

    ‘আরে বাপু, মদই তো ওপরে ওঠবার সিঁড়ি।’

    ‘কিন্তু—’

    ‘আবার কী?’

    ‘রোজ মাঝরাত্তিরে কোন অবস্থায় টলতে টলতে বাড়ি ফেরো তুমি তা তো বুঝতে পারো না। বুঝবে কি, তোমার তখন কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, মনুষ্যত্ব থাকে না। চারধারের লোক তোমার কাণ্ড দেখে মুখ টিপে টিপে হাসে। তখন আমার কী ইচ্ছে হয় জানো?’

    ‘কী?’

    ‘ইচ্ছে হয় গলায় দড়ি দিই।’

    আবহাওয়াটা হাল্কা করবার জন্য বলতাম, ‘ইচ্ছেটা মোটেই সদিচ্ছা নয়।’

    অলকা বলত, ‘তুমি যাই বল, একদিন দেখবে আমি ঠিক আত্মহত্যা করে বসেছি।’

    অলকা যা খুশি বলুক, আমি গ্রাহ্য করতাম না। আমি আমার পথেই চলতে লাগলাম। দু’জনের মাঝখানে দূরত্ব বাড়তেই লাগল।

    অবস্থা যখন এইরকম, সেই সময় চরম ঘটনাটি ঘটল।

    আমাদের অফিস থেকে কোম্পানির ‘গেল্ডেন—জুবলি’ বছর উপলক্ষে একটা পার্টি দেওয়া হয়েছিল। অফিসার র‌্যাঙ্কের কর্মচারীদেরই শুধু তাতে প্রবেশাধিকার। সবাইকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল।

    সে বছর আমার একটা প্রমোশনের ব্যাপার ছিল। কাজেই পার্টি সম্বন্ধে আমার উৎসাহই ছিল সব চাইতে বেশি।

    আগে কখনও কোনো পার্টিতে অলকাকে নিয়ে যেতে পারিনি। মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মদ খাবে, এর স্ত্রী ওর স্বামীর গা জড়াজড়ি করে নাচবে—আধুনিক নাগরিক জীবনের এই সব স্বাভাবিক ঘটনাকে বেলেল্লাপনা মনে করত অলকা এবং তীব্রভাবে ঘৃণাও করত। অলকার যখন এত বিতৃষ্ণা, এত অনিচ্ছা তখন আর তাকে টানাটানি করতাম না।

    কিন্তু গোল্ডেন—জুবলি ইয়ারে কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন প্রত্যেকেই যেন নিজের নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আসেন। ‘আওয়ার্স ইজ এ হ্যাপি ফ্যামিলি। আমরা চাই, শুধু সহকর্মী না, তাঁদের স্ত্রীরাও ফর বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হোন, ঘনিষ্ঠ হোন। এতে ফেলো—ফিলিং বাড়বে।’

    আমি অলকাকে ধরেছিলাম, ‘এ পার্টিতে তোমাকে যেতেই হবে।’

    অলকা প্রবলভাবে মাথা এবং দু হাত নেড়ে বলেছিল, ‘না—না, কিছুতেই না।’

    ‘আরে বাপু, তুমি একাই যাচ্ছ না, সব অফিসারের স্ত্রীরাই যাচ্ছেন। অমন যে এ্যাকাউন্টস অফিসার মিস্টার ভাদুড়ির স্ত্রী, যাঁকে সবাই বলে অসূর্যম্পশ্যা, তিনি পর্যন্ত যাচ্ছেন। তোমাকে যেতেই হবে। নইলে আমার মান—ইজ্জৎ থাকবে না।’

    অনেক বলে—কয়ে, অনুনয়—বিনয় করে অলকাকে রাজি করিয়েছিলাম। সে রাজি না হলেই বুঝি ভালো হত।

    বিরাট হোটেলের সুবিশাল ব্যাঙ্কুয়েট হলে পার্টি দেওয়া হয়েছিল। ছোট ছোট একেকটা টেবিলে সস্ত্রীক এককে জন অফিসার বসে ছিলেন। অলকা আর আমিও একটা টেবিল দখল করেছিলাম। সামনের দিকে উঁচু ডায়াসে গোয়াঞ্চি অর্কেস্ট্রা পার্টি খুব ধীরে ধীরে বিদেশি গৎ বাজাচ্ছিল। ধবধবে উর্দিপরা বয়রা ব্যস্ত পায়ে ঘুরে ঘুরে সফট এবং হট ড্রিঙ্ক টেবিলে টেবিলে দিয়ে যাচ্ছিল।

    ব্যাঙ্কুয়েট হলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অলকা বলতে শুরু করেছিল, ‘এখানে আমার ভালো লাগছে না। আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।’

    বলেছিলাম, ‘কী পাগলের মতো বকছ! এখন বাড়ি ফেরা যায় নাকি? ডিসেন্সি বলেও তো একটা কথা আছে।’

    তবু অলকা ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছিল। শেষ দিকে তার কথায় আমি আর কান দিই নি।

    এদিকে আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মগনলালজী এসে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এ কি, আপনারা আলাদা আলাদা ছড়িয়ে রয়েছেন কেন? মাঝখানে এসে আলাপ—পরিচয় করুন।’

    বলামাত্র নিজের নিজের স্ত্রীকে নিয়ে সবাই হলের মাঝখানে চলে গিয়েছিল। অলকাকে নিয়ে আমিও গিয়েছিলাম। তারপর স্ত্রীদের মধ্যে পরিচয়ের পালা শুরু হয়েছিল। অন্য অফিসারদের স্ত্রীরা চড়াও হয়ে আলাপ—টালাপ করছিল, কিন্তু অলকা ওসবে নেই; আড়ষ্টের মতন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। অলকার জন্য আমি খুবই অস্বস্থি বোধ করছিলাম।

    মগনলালজী আসবার পরই অর্কেস্ট্রায় চড়া সুর বাজতে শুরু করেছিল। এখন যেন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আর কি আশ্চর্য, কখন যে একটা ক্যাবারে ড্যান্সার ডায়াসে এসে গিয়েছিল, কে বলবে। মেয়েটার বয়েস কুড়ি—বাইশের মধ্যে। তার শরীরে সৌন্দর্যের চাইতে বন্যতা বেশি। উদ্দাম বেপরোয়া স্বাস্থ্যের প্রতিটি রেখা থেকে বিদ্যুৎ—তরঙ্গ ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল।

    মেয়েটার বুকের কাছে এক টুকরো পাতলা কাপড়ের আবরণ, কোমরের তলায় আঁটো—সাঁটো জাঙ্গিয়া। এই পোশাক তার শরীরের অদৃশ্য রহস্য যেন আরো বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছিল। বাজনার তালে তালে নানারকম মুদ্রায় সে হাত—পা ছুঁড়ছিল আর ব্যাঙ্কুয়েট হলের প্রতিটি মানুষের বুকে রক্ত ছলকাচ্ছিল।

    ক্যাবারে নাচিয়ের দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ বুজে ফেলেছিল অলকা। তার মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। চাপা গলায় সে বলেছিল, ‘এক সেকেণ্ডও আমি আর এখানে থাকব না। কোনো ভদ্র রুচির মানুষ এখানে আসতে পারে, এ আমি কল্পনাই করতে পারি না।’

    অলকাকে ওখানে নিয়ে যাওয়া যে ঠিক হয়নি, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। বলেছিলাম, ‘চুপ কর, চুপ কর। কেউ শুনতে পেলে কী ভাববে!’

    অলকা আমার কথা যেন শুনতে পাচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ওই অসভ্য ছুঁড়িটা কী করছে?’

    ‘দেখতেই তো পাচ্ছ। নাচছে।’

    ‘ওই রকম ইতরামি আর বেলেল্লাপনার নাম নাচ?’

    ‘যে নাচের যে ধরন।’

    ‘বুঝলাম না হয় ওটাই ধরন। তাই বলে ন্যাংটো হয়ে লোকের সামনে আসতে হবে? লজ্জাসরম বলে কি ওর কিছুই নেই!’

    ‘ওই রকম ড্রেস ছাড়া এ নাচ জমে না।’

    ‘নাচ মাথায় থাক; তুমি আমায় বাডিতে দিয়ে এস।’

    আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, সেই সময় মগনলালজীর গলা আবার শোনা গিয়েছিল। আমাদের মধ্যে এসে তিনি বলছিলেন, ‘হ্যালো মিস্টার দাশগুপ্ত, মিস্টার ভাদুড়ি, মিস্টার মাথুর, প্লীজ ইন্ট্রোডিউস মী টু ইওর ওয়াইভস—’

    দাশগুপ্ত, ভাদুড়ি, মাথুর মালহোত্রা, চ্যাটার্জি বাবুর দল মগনলালজীর সঙ্গে নিজেদের স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। ‘হিয়ার ইজ যাওয়ার অনারেবল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অ্যান্ডস্যার শী ইজ মাই ওয়াইফ রীতা—’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আলাপ—পরিচয় করতে করতে মগনলালজী আমাদের কাছে চলে এসেছিলেন, ‘নাউ মিস্টার লাহিড়ী, ইন্ট্রোডিউস মী—’

    অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে গদগদ স্বরে বলেছিলাম, ‘ইয়েস স্যার, এই আমার স্ত্রী—অলকা। আর ইনি—’

    মগনলালজী হাতজোড় করে অলকার দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর দৃষ্টি স্থির, পলকহীন। বেশ কিছুক্ষণ পর মুগ্ধ গলায় বলেছিলেন, ‘শী ইজ সো নাইস; এক্সকুইজিটলি বিউটিফুল। আপনার মতো সুন্দরী মহিলা আমি খুব বেশি দেখিনি।’

    অলকার কানের কাছে মুখ নিয়ে নীচু গলায় বলেছিলাম, ‘এমন কমপ্লিমেন্টস দিলেন; ওঁকে ধন্যবাদ দাও।’

    অলকা চুপ। তার মুখে পলকে পলকে দুরন্ত বেগে রক্তোচ্ছ্বাস খেলে যাচ্ছিল। ঠোঁটের প্রান্ত থরথর কাঁপছিল।

    মগনলালজী এবার আমার দিকে ফিরেছিলেন, ‘আপনার ভাগ্যকে আমি ঈর্ষা করি মিস্টার লাহিড়ী। এমন রূপসী মহিলার স্বামী আপনি!’

    আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার; মেনি থ্যাঙ্কস—’

    আমাকে ছেড়ে মগনলালজী আবার অলকার দিকে ঝুঁকেছিলেন, ‘মিসেস লাহিড়ী, আমার খুব ইচ্ছে আসছে শনিবার মিস্টার লাহিড়ী আর আপনি আমার সঙ্গে চা খান। এই অনুরোধটা রাখলে খুব আনন্দিত হব।’

    পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, ‘মোস্ট গ্ল্যাডলি স্যার, এ তো আমাদের সৌভাগ্য।’ মগনলালজী চা খেতে ডেকেছেন; আমার পক্ষে এ আশাতীত। আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম, ভাগ্যের দরজা খুলে গেছে।

    অলকা কিন্তু কোনো কথা বলছিল না। তার একটা ঠোঁটের ওপর আরেকটা ঠোঁট চেপে বসেছে, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছিল। অলকার কানের ভেতর মুখ ঢুকিয়ে অত্যন্ত উদ্বেগের সুরে বলেছিলাম, ‘কী হচ্ছে এসব, সাধারণ ভদ্রতাটুকু পর্যন্ত তোমার নেই। প্লীজ অলকা, প্লীজ, মগনলালজীকে বল, আমরা চা খেতে যাব। ওঁকে ধন্যবাদ দাও।’

    অলকা চুপ। মনে হচ্ছিল আমাকে অপদস্থ করার জন্য যেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে সে। এর চাইতে ওকে না আনলেই যেন ভালো হত।

    এদিকে মগনলালজী আবার অলকার দিকে তাকিয়েছিলেন, ‘আপনি কিন্তু কিছুই বলছেন না মিসেস লাহিড়ী। ডু ইউ ডিসলাইক মাই কম্পানি?’

    ভয়ে উদ্বেগে হৃৎপিণ্ড যেন লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এসেছিল। বুকের ভেতর অসহ্য রক্তের চাপ অনুভব করেছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম, সৌভাগ্যটা হাতের মুঠোয় এসেও বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠেছিলাম, ‘সে কি স্যার, না—না, আপনার সঙ্গ ও যথেষ্ট পছন্দ করছে। ব্যাপারটা হল, আমার স্ত্রী ভারি লাজুক, তাই—’

    মগনলালজী কী বুঝেছিলেন তিনিই জানেন। উত্তর না দিয়ে সামান্য হেসেছিলেন।

    নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছিল আমার। মনে হচ্ছিল আঁচড়ে কামড়ে নিজেকে ক্ষত—বিক্ষত করে ফেলি। কিন্তু ব্যাঙ্কুয়েট হলে দাঁড়িয়ে কিছুই করা যাচ্ছিল না। আমি অলকার কানের কাছে মুখ এনে করুণ মিনতিপূর্ণ সুরে শুধু বলতে পেরেছিলাম, ‘অলকা, বুঝতে পারছ না, আমার কত বড় ক্ষতি করছ। আমাকে একটু দয়া কর, মগনলালজীর সঙ্গে কথা—টথা বল।’

    কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। জেদী একগুঁয়ে মেয়ের মতো ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েই ছিল অলকা।

    এই সময় মগনলালজী আমাদের ছেড়ে সমস্ত ব্যাঙ্কুয়েট হলের ওপর দিয়ে দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিলেন, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, আপনারা অনুমতি দিলে আমার একটা প্রস্তাব আছে।’

    সবাই সমস্বরে সাগ্রহে বলে উঠেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই; আপনি বলুন স্যার।’

    ‘আমার ইচ্ছা, এক মিনিটের জন্যে ব্যাঙ্কুয়েট হলের সব লাইট নিভিয়ে দেওয়া হবে। অ্যান্ড উই শ্যাল হ্যাভ মেরিমেন্ট ইন ইট।’

    ‘অবশ্যই স্যার, অবশ্যই।’

    একটু পরেই হলের আলোগুলো নিভে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ডায়াসের ওপর অর্কেস্ট্রায় ঝড়ের গতি নেমে এসেছিল। প্রবল উদ্দাম শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছিল যেন। তার মধ্যেই আমার চারপাশে চুম্বনের নানারকম শব্দ হচ্ছিল।

    আমাদের ডান দিকে মিস্টার ঘোষের স্ত্রী সুনীতা ঘোষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক মিনিট মোটে সময়। তার ভেতর যে যতটুকু মজা লুটে নিতে পারে। অন্ধকারে সুনীতা ঘোষকে আমি খুঁজছিলাম।

    হঠাৎ ব্যাঙ্কুয়েট হলের সব শব্দ ছাপিয়ে অলকার তীক্ষ্ন চিৎকার শোনা গিয়েছিল। আমি চমকে উঠেছিলাম। ভয়, দুশ্চিন্তা এবং উৎকণ্ঠা, সব একাকার হয়ে আমাকে বিমূঢ় করে ফেলছিল। কী করব, কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না।

    এই সময় আবার হলের আলোগুলো দপ করে জ্বলে উঠেছে। অলকা তখনও চিৎকার করছে। ‘জানোয়ার, পশু, ইতরামো করার আর জায়গা পাও নি।’ তার দুই হাত মগনলালজীর ঘাড়ের কাছটা খামচে ধরেছিল। ধারাল নখগুলো মগনলালজীর লালচে মসৃণ চামড়ায় গেঁথে যাচ্ছিল।

    সেই মুহূর্তে অলকাকে বাঘিনীর মতো লাগছিল। ভরাট গ্রীবার তলা থেকে দুটো হাড় পেরেকের মতন ফুটে বেরিয়েছিল। গলার শিরগুলো নারকেল দড়ির মতো ফুলে ফুলে উঠেছিল। চোখ দুটো যেন দু’টো রক্তের ডেলা।

    হলের সবগুলো চোখ তখন অলকা আর মগনলালজীর ওপর স্থির। ডায়াসের বাজনা থেমে গেছে। কোথাও এতটুকু শব্দ নেই। সবাই শ্বাসরুদ্ধের মতন দাঁড়িয়ে আছে।

    অলকাকে মগনলালজীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে যাব, তার আগেই অঘটন ঘটে গিয়েছিল। অলকা পা থেকে জুতো খুলে মগনলালজীর গালে কষিয়ে দিয়েছিল, ‘নাউ ইউ হ্যাভ লেসন। আই থিঙ্ক, ইউ উইল নেভার ফরগেট ইন ইওর লাইফটাইম।’ বলে আর দাঁড়ায়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

    আমি যে কীভাবে ফিরে এসেছিলাম, আজ আর মনে নেই।

    বাড়ি ফিরে ক্রুদ্ধ—হিংস্র—চাপা গলায় বলেছিলাম, ‘এর মানে কী?’

    অলকা সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘তার আগে আমার একটা কথার জবাব দাও।’

    ‘কোনো কথার জবাব দেব না। কেন—কেন তুমি আমার এতবড় সর্বনাশ করলে?’

    ‘কীসের সর্বনাশ?’

    ‘বুঝতে পারছ না?’ অলকার চোখে আগুন জ্বলছিল।

    ‘আমার প্রমোশন, আমার প্রমোশন।’ ক্ষিপ্তের মতো, হিতাহিতজ্ঞানশূন্যর মতো আমি হাত—পা ছুড়েছিলাম, আমার মাথা থেকে আগুন ছুটছিল, ‘ওপরে ওঠবার সুযোগ চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল।’ কথাগুলো সীসের ডেলার মতো ভারী হয়ে আমার গলার কাছে আটকে আটকে যাচ্ছিল।

    ‘তুমি প্রমোশনের কথা ভাবছ আর ওই লোকটা, তোমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, অন্ধকারে আমাকে জড়িয়ে ধরে—’

    অলকার কথা শেষ হবার আগেই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম। টেনে টেনে বলেছিলাম, ‘সতী!’ একটু জড়িয়ে ধরলে গায়ে ফোস্কা পড়ে যায়।’

    ‘কী বলছ তুমি! আমি তোমার স্ত্রী!’

    ‘চোপ মাগী, আজ তোকে খুনই করে ফেলব।’ হিতাহিতজ্ঞানশূন্যের মতো অলকার গলা টিপে ধরেছিলাম। তারপর ঘরের এককোণে তাকে ছুঁড়ে দিয়ে কিল—চড়—লাথি চালিয়ে যাচ্ছিলাম।

    দু’হাতে মার আটকাতে আটকাতে অলকা বলে যাচ্ছিল, ‘তুমি আমাকে মারলে, তুমি আমাকে মারলে—’

    ‘তুই আমার এতবড় ক্ষতি করলি, তোকে শেষ করে ফেলাই উচিত।’

    পরের দিনই অলকা তার বাবার কাছে চলে গিয়েছিল। তারপর কোর্টকাছারি, উকিল—মুহূরি, ছোটাছুটি। মাঝখানে হিতাকাঙ্ক্ষী দু’একজন বন্ধু সন্ধির চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কিছুই হয়নি, একদিন কোর্টের রায়ে পাকাপাকি বিচ্ছেদ ঘটে গেল।

    খবর পেয়েছিলাম, রায় বেরুবার পর মাস্টারি নিয়ে অলকা পাটনা চলে গেছে।

    তারপর আর কিছুই জানি না।

    এদিকে আমি পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে আরো সাউথে চলে গিয়েছিলাম, আবার বিয়েও করেছি। আমার এবারকার স্ত্রীর নাম সাধনা।

    তারপর এতকাল বাদে পুরীর সমুদ্রতীরে আবার অলকাকে দেখলাম।

    হোটেলে ফিরে দেখলাম, সাধনা মুখ—টুখ ধুয়ে হাল্কা প্রসাধন সেরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে কিছুটা চিন্তিত দেখাচ্ছে।

    সাধনা বলল, ‘কী ব্যাপার, আজ তোমার ফিরতে এত দেরি?’

    চট করে উত্তর দিলাম না। একটু ভেবে আস্তে আস্তে বললাম, ‘আর বোলো না, ‘বীচে’ এক ভদ্রলোকের পাল্লায় পড়েছিলাম। একেবারে নাছোড়বান্দা। আমাকে টানতে টানতে ওঁদের হোটেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।’

    ‘আমি কিন্তু খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আরেকটু দেখে তোমাকে খুঁজতে ‘বীচে’ যেতাম। যাক গে, এখন এসো তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিই। মনে আছে তো, আজ ন’টার সময় হরিণের চামড়ার চটি ডেলিভারি আনতে যেতে হবে?’

    আমি যে খানিক আগে চা খেয়েছি, সে কথা বলতে সাহস হল না। অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর হোটেলে গিয়ে কী কথাবার্তা হল কাকে কাকে দেখলাম, এসব জানতে চায়নি সাধনা। ফলে কিছুটা আরাম বোধ করলাম। দ্রুত শ্বাস টানার মতো করে বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে বৈকি। চটি নিয়ে চল একবার মন্দিরের ওধারের বাজারটায় ঘুরে আসি।’

    ‘বাজারে কেন?’

    ‘কিছু হাড়ের জিনিস কিনব। তুমিও সেদিন বলছিলে না, শাঁখ—টাখ কড়ি—ফড়ি কী কিনবে—’

    ‘তাড়াহুড়োর কী আছে, আমরা তো আছিই কিছুদিন। পরে ধীরে—সুস্থে কিনব।’

    খানিক ইতস্তত করে বললাম, ‘ভাবছিলাম—’

    সাধনা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, ‘কী’?

    ‘পুরীতে আর ভালো লাগছে না। ভাবছি কেনাকাটা যা সারবার আজই সেরে রাত্তিরের ট্রেনে চলে যাব।’ বার বার অলকার মুখ মনে পড়ে যাচ্ছিল। এখানে বেশিদিন থাকলে আর সোমনাথ চক্রবর্তী যেরকম নাছোড়বান্দা তাতে অলকার সঙ্গে আবার দেখা হবেই। আমার বুকের ভেতর থেকে ফিসফিসিয়ে কেউ যেন বলতে লাগল, অলকার সঙ্গে আর দেখা না হওয়াই ভালো।

    সাধনা বলল, ‘পুরী হঠাৎ খারাপ হয়ে উঠল যে? কাল রাত্তিরেও তো এই জায়গাটার কত গুণগান করছিলে।’

    মনে মনে থতিয়ে গেলাম। রাতারাতি পুরীকে ভালো না লাগার কারণ—স্বরূপ বললাম, ‘এখন অফ—সীজন, বড্ড বৃষ্টি হচ্ছে।’ বলেই মনে হল, যুক্তিটা তেমন জোরালো হয়নি।

    ‘বাঃ।’

    ‘কী হল?’

    ‘অফ সীজন আর বৃষ্টি হবে জেনেই তো পুরী এসেছ।’

    আমি চুপ।

    সাধনা বলতে লাগল, ‘আগে আর কখনও আমি সমুদ্রের ধারে আসিনি। আসা যখন হয়েছেই, তাড়াতাড়ি কলকাতায় ফিরছি না।’

    হঠাৎ যেন হাতের কাছে একটা অবলম্বন পেয়ে গেলাম, ‘সমুদ্র দেখতে চাও, এই তো? চল গোপালপুর—অন—সী—তেই যাই। পুরীর চাইতে গোপালপুরের ‘বীচ’ ফার—ফার বেটার। ওখানকার ব্রেকার দেখলে অবাক হয়ে যাবে।’

    পলকহীন কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল সাধনা। তারপর বলল, ‘গোপালপুর তো আরো সাউথে, সেখানে এখন অফ সীজন আর বৃষ্টি হবে না? তা ছাড়া পুরী এসে ক’দিন তো হোটেলেই আটকে আছি। ভুবনেশ্বর দেখা হল না, উদয়গিরি খণ্ডগিরি দেখা হল না। কোনারক যাওয়া হল না। এসব না দেখে আমি নড়ছি না।’

    একটা ফাঁদের মধ্যে আমি যেন জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। শিথিল গলায় বললাম,

    ‘না, মানে—’

    একটুক্ষণ কী ভাবল সাধান। তারপর বলল, ‘তোমার কী হয়েছে বল তো?’

    চমকে উঠে বললাম, ‘কই, কিছু না।’

    ব্রেকফাস্টের পর জুতোপট্টিতে গেলাম। কিন্তু চটি ডেলিভারি নেবার পরই বৃষ্টি নেমে গেল। অগত্যা আবার হোটেলে ফিরে আসতে হল।

    রোজই সকালে ‘বীচে’ বেড়িয়ে হোটেলে ফিরি। তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে সাধনাকে নিয়ে আবার বেরুই। এদিক সেদিকে ঘুরে দুপুরবেলা ফিরে আসি। আজ আর দ্বিতীয়বার বেড়ানোটা হল না।

    সেই সে জুতোপট্টি থেকে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরেছিলাম, তারপর সারাদিন এক মিনিটের জন্য আর কামাই নেই। বৃষ্টি ঝরছে তো ঝরছেই।

    দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটায় বিকেল হয়ে গেল। আচমকা, আমার মনে পড়ে গেল সোমনাথ চক্রবর্তী সাধনাকে আর আমাকে এবেলা চা খাবার নেমন্তন্ন করেছেন। নেমন্তন্নর কথাটা সাধনাকে বলিনি।

    হোটেলের বিছানায় শুয়ে জানলার বাইরে ঝাপসা বৃষ্টিবিলীন আকাশ দেখতে দেখতে একটা ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া গেল, এই দুর্যোগে অন্তত সোমনাথ চক্রবর্তীর নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতে হচ্ছে না। এক সমস্যা মিটল, শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, কেমন করে সাধনাকে নিয়ে পুরী থেকে চলে যাওয়া যায়।

    কিন্তু সমস্যা কাটল বলে যখন আমি নিশ্চিত, সেইসময় দেখা গেল ওয়াটারপ্রুফ আর গাম বুট চড়িয়ে এই বর্ষার মধ্যে সোমনাথ এসে হাজির। সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, সোমনাথ চক্রবর্তীকে চিনতে আমার অনেক বাকি ছিল। ভদ্রলোক পরিচয় করিয়ে দেবার অপেক্ষায় থাকলেন না। গাম—বুট আর ওয়াটারপ্রুফ বাইরে রেখে মুহূর্তে সাধনার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললেন। তারপর আমার দিকে আড়ে আড়ে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার স্বামীটিকে দায়রায় সোপর্দ করা উচিত।’

    সামান্য আলাপেই সোমনাথের আমুদে স্বভাবটা মোটামুটি ধরতে পেরেছিল সাধনা। হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন বলুন তো?’

    ‘এই দেখুন না ওবেলা মিস্টার লাহিড়ীকে বলে দিয়েছিলাম, আপনাকে নিয়ে যেন এবেলা আমার ওখানে চা খান। সেই বেলা তিনটে থেকে ঘড়ি দেখছি তো ঘড়িই দেখছি। কিন্তু আপনাদের পাত্তাই নেই।’

    ‘আপনার ওখানে এবেলা চা খাবার কথা তো ও কিছু বলেনি।’

    সোমনাথকে দেখেই আমার বুকের ভেতরটা অজানা উদ্বেগে ঢিব ঢিব করছিল। ব্যস্তভাবে সাধনাকে বললাম, ‘ওবেলা বলিনি, ভেবেছিলাম, এবেলা তোমাকে একটা সারাপ্রাইজ দেব। কিন্তু এমন বৃষ্টি নামল ‘যাব কী করে?’

    সোমনাথ বললেন, ‘ইচ্ছা থাকলে কি আর উপায় হয় না? আমি এলাম কেমন করে?’ একটু থেমে আবার, ‘কেউ আসবার কথা থাকলে, যদি না আসে, কী খারাপ যে লাগে!’

    সাধনা বলল, ‘আমারও খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, বাকি দিনটাই মাটি।’

    সোমনাথ বললেন, ‘নিন, এবার চলুন—’

    আমি চমকে উঠলাম, ‘কোথায়?’

    ‘কোথায় আবার, আমার হোটেলে—’

    ‘এই বৃষ্টিতে কেমন করে যাব? আমাদের আবার ছাতা—টাতা নেই।’

    ‘আপনাদের জন্য দুটো রেনকোট জোগাড় করে এনেছি, আর দুটো সাইকেল রিক্সা। কিচ্ছু অসুবিধে হবে না।’

    গলে যাবার মতো কোনো ছিদ্রই রাখেন নি সোমনাথ চক্রবর্তী, সুচারুরুপে সব ফাঁক বুজিয়ে তবেই এখানে হানা দিয়েছেন। বুঝতে পারছিলাম, গলায় ফাঁস আটকে আসছে। শেষ চেষ্টা করে করুণ মুখে তবু বললাম, ‘আজ না হয় থাক, এত বৃষ্টি নিয়ে—’

    ‘আরে মশাই, এমন ভাবে মুড়ে আপনাকে নিয়ে যাব যে গায়ে একটি ফোঁটা পড়বে না। উঠুন—উঠুন—’

    সাধনাও ওদিক থেকে ধমকের গলায় বলল, ‘তুমি কী বল তো! ভদ্রলোক এত কষ্ট করে এলেন আর তুমি যেতে পারবে না? ওঠ—ওঠ—’

    দেখা গেল, আমার গলায় ফাঁস আটকাবার ব্যাপারে সোমনাথ আর সাধনার মধ্যে প্রচুর মিল।

    শেষ পর্যন্ত যেতেই হল। সোমনাথের হোটেলে গিয়ে খুব খাওয়া দাওয়া হল। সোমনাথ আর সাধনা প্রচুর কথা বলল, হাসাহাসি করল। অলকা আর আমি কিন্তু আড়ষ্টের মতো বসে থাকলাম।

    সোমনাথের সুইটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ করেছি, একদৃষ্টে প্রায় পলকহীন সাধনার দিকে তাকিয়ে আছে অলকা।

    অনেক রাত্তিরে ছাড়া পাবার পর বিদায় নিলাম। আসবার সময় সাধনা ওদের পাল্টা নেমন্তন্ন করল। আমার গলায় সেই ফাঁসটা আরেক পাক জড়িয়ে গেল।

    এরপর থেকে এবেলা সোমনাথের হোটেলে আড্ডা জমলে ওবেলা বসে আমাদের হোটেলে। ওই নেমন্তন্নর ব্যাপারে আমার বা অলকার দিক থেকে উৎসাহ নেই। কিন্তু সাধনা আর সোমনাথের যেন ক্লান্তি নেই। শুধু পুরীর হোটেলেই নাকি, সাধনা আমাদের কলকাতার ঠিকানা দিয়ে বার বার অনুরোধ করেছে, ‘কলকাতায় এলে আমাদের ওখানেই উঠবেন।’ সোমনাথও পাটনার যাবার নেমন্তন্ন আগেভাগেই সেরে রেখেছেন। শুনতে শুনতে আমার শ্বাস আটকে এসেছে।

    আড্ডাই শুধু দিই না, একেক দিন তাসের আসরও বসে। তাস খেলতে বসলেই অলকাকে আমার পার্টনার করে দ্যান সোমনাথ। অসহায়ের মতন আমি বলি, ‘তার চাইতে আপনি আর আমি পার্টনার হই। মেয়েদের সঙ্গে লড়ে দেখাই যাক, কারা জেতে।’

    ‘উঁহু,—’সোমনাথ জোরে জোরে মাথা নাড়েন।

    ‘কী।’

    ‘মিক্সড ডাবলস হবে।’

    একটু ভেবে বলি, ‘আচ্ছা এক কাজ করা যাক।’

    ‘আবার কী?’

    ‘আমি আর সাধনা পার্টনার হই, আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে জুটি বাঁধুন।’

    সোমনাথ হাসতে হাসতে বলেন, ‘আরে মশাই, নিজের স্ত্রীর সঙ্গে চিরকালই তো জুটি বেঁধে থাকতে হবে। অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে জুটি বাঁধলে কেমন লাগে দেখুন না—’

    নিতান্ত হালকা গলায় পরিহাসের ছলে বলেন সোমনাথ, তবু ভীষণভাবে চমকে উঠে নিজের অজান্তেই অলকার দিকে তাকাই। তক্ষুনি চোখাচোখি হয়ে যায়। অলকাও আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

    সোমনাথ আবার বলেন, ‘আরে মশাই, খেলুন খেলুন তো আপনি তো আর আমার স্ত্রীর ভাসুরঠাকুর নন।’

    খেলে যাই ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই যেন জমে না।

    অলকা অথবা আমি যে সহজ স্বচ্ছন্দ হতে পারি না, সেটা সাধনার চোখে পড়েছে। একদিন সে বলল, ‘কী ব্যাপার, মিসেস চক্রবর্তীর কাছে তুমি অমন কাঠ হয়ে থাক কেন? তোমার যে এত লজ্জা, আগে তো জানতাম না।’

    জড়ানো গলায় বললাম, ‘কই, লজ্জা আবার কোথায়?’

    দশ দিন হল আমরা পুরী এসেছি। এর মধ্যে এমন একটা দিনও কাটেনি যেদিন বৃষ্টি হয়নি।

    দশ দিন পর আজই প্রথম নির্মেঘ আকাশ চোখে পড়ল। সকাল থেকে সারাটা দিন ঝলমলে সোনালি রোদ পুরীর গায়ে আদরের মতো লেগে রয়েছে।

    সন্ধের পর নীলাকাশে চন্দনের পাটার মতো গোল একটি চাঁদ উঠল। তারায় তারায় আকাশটা ছেয়ে গেল।

    এবেলা আমার হোটেলে আড্ডা বসবার কথা। একটু রাত হলে সোমনাথরা এলেন। এসেই বললেন, ‘এবার পুরী এসে আজই প্রথম চাঁদ দেখলাম।’

    সাধনা বলল, ‘আকাশের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, দিনকয়েকের জন্যে বৃষ্টিটা বুঝি ধরল।’

    আমি সায় দিলাম, ‘তাই মনে হচ্ছে।’

    হঠাৎ কিছু মনে পড়তে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে উঠলেন সোমনাথ, ‘বৃষ্টি যখন ধরেছে তখন চলুন না, এই ফাঁকে উদয়গিরি খণ্ডগিরি আর কোনারকটা দেখে আসি।’

    আমি কিছু বলবার আগেই সাধনা লাফিয়ে উঠল, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ, আপনি সব ব্যবস্থা করে ফেলুন। এই সুযোগ ছাড়লে আবার কখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামবে।

    পরের দিনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। উদয়গিরি খণ্ডগিরি আর ওড়িশার নতুন ক্যাপিটাল দেখে দিন দুই পর ফিরলাম। মাঝখানে একটা দিন বিশ্রাম নিয়ে এবার কোনারকে।

    একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, হাজার আড়ষ্টতার মধ্যেও অলকা আমাকে কিছু বলতে চেয়েছে, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য আমাকে আলাদা পায়নি। সব সময় সাধনা আর সোমনাথ আমাদের কাছে কাছেই ছিলেন।

    কোনারকে এসে সূর্য—মন্দিরে ঘুরতে ঘুরতে পাথরের দেওয়ালে নানারকম কারুকার্য দেখার ছলে অলকা পিছিয়ে পড়তে লাগল। সোমনাথ আর সাধনা বক বক করতে করতে এগিয়ে গেছে।

    একটুক্ষণ ইতস্তত করলাম। তারপর সব দ্বিধা দু’হাতে ঠেলে আমিও পিছোতে পিছোতে যেখানে অলকা দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে চলে এলাম।

    অলকা দেওয়ালের গায়ে ঝুঁকে একটা পাথরের মূর্তি দেখছিল। আমি তার পেছনে গিয়ে খুব আস্তে ডাকলাম।

    আমি যে আসব, অলকা যেন জানত। অনেকক্ষণ সেই ভাবেই ঝুঁকে থাকল সে, তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।

    অনেকক্ষণ পর আমিই প্রথম বললাম, ‘চল, ওই বেদীটায় গিয়ে বসি।’

    নিঃশব্দে আমার পিছু পিছু চলে এল অলকা। দু’জনে পাশাপাশি বসলাম।

    একটু ভেবে বললাম, ‘এভাবে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভাবতে পারিনি।’

    অলকা উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর আধফোটা শিথিল স্বরে বলল, ‘আমার একটা কথা ছিল।’

    ‘বল—’ আমি উন্মুখ হলাম।

    ‘আমি আবার বিয়ে করেছি—’ বলতে বলতে অলকার ঘাড় ভেঙে যেন ঝুলে পড়ল।

    ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ অদ্ভুত হাসলাম আমি।

    ‘আমার যে আগে বিয়ে হয়েছিল, মিস্টার চক্রবর্তীকে জানাই নি। এ কথাটা চিরকাল গোপন রাখতে হবে।’

    লম্বা শ্বাস টেনে বললাম, ‘রাখব। তোমাকেও একটা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।’

    ‘কী?’

    ‘সাধনাকেও আমি জানাইনি, আগে বিয়ে করেছিলাম। তুমি তো জানোই, বাবা মা, আত্মীয়স্বজন, কারো সঙ্গেই আমার সম্পর্ক নেই। সাধনাকে যে বিয়ে করেছি কেউ জানে না। জানলে আমার আগের বিয়ের খবর নিশ্চয়ই পেয়ে যেত। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ওকে কোনোদিন জানাবে না।’

    ‘না।’

    আমরা যেন পরস্পরের স্বার্থে অলিখিত এক চুক্তিপত্রে সই করলাম।

    তারপর অনেকক্ষণ কাটল। হঠাৎ এক সময় অলকা খুব মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

    ‘কী?’

    ‘সাধনাকে বিয়ে করে নিশ্চয়ই তুমি খুব সুখী হয়েছ?’

    ‘তার আগে আমার একটা কথার উত্তর দাও।’

    ‘কী?’

    ‘মিস্টার চক্রবর্তীকে বিয়ে করে তুমি নিশ্চয়ই সুখী হয়েছ?’

    অলকার উত্তর শোনা হল না, আমার উত্তর সে জানতে পারল না। তার আগেই সোমনাথ আর সাধনা হৈ হৈ করতে করতে এসে পড়ল।

    সোমনাথ বললেন, ‘আরে মশাই, আপনারা এখানে বসে আছেন। ওদিকে আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান।’

    কোনোরকমে জড়ানো জড়ানো গলায় উচ্চারণ করলাম, ‘বড্ড টায়ার্ড হয়ে পড়েছিলাম।’

    ‘একটু হেঁটেই টায়ার্ড! উঠুন—উঠুন—’

    অলকা আর আমি উঠে পড়লাম। সোমনাথদের সঙ্গে যেতে যেতে একটা কথা বার বার মনে হতে লাগল। আদালতের রায়ে সেদিন যা শেষ হয়ে গেছে ভেবেছিলাম, আজ মনে হচ্ছে মৃত্যু পর্যন্ত তার জের টেনে যেতে হবে।

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়
    Next Article সিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }