তারা চারজন
তারা চারজন
চুয়ান্ন বছর আগে যখন আমি বম্বে যাই তখনও তার নাম মুম্বাই করা হয়নি। শহরটা আজকের মতো এমন বিশাল মহানগরী হয়ে ওঠেনি। আমি সেই পুরোনো বম্বের একটা গল্প বলব। তার আগে একটু ভণিতা করে নিই। তা হলে গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে। সব কিছুরই একটা চালচিত্র থাকে। নইলে ব্যাপারটা ন্যাড়া লাগে।
তখন বম্বের লোকজন আর কত? মেরেকেটে ষাট লাখ। এখনকার মতো দমবন্ধ—করা ভিড় নেই। ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন শহর।
মূল সিটির চার্চগেট স্টেশন, যাব ঠিক উলটোদিকে ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়াম, ডানপাশে কয়েক পা গেলেই বিখ্যাত মেরিন ড্রাইভ, তার ওধারে আদিগন্ত আরব সাগর—সেই স্টেশনটা থেকে সাবার্বন ট্রেন শহরটাকে ফুঁড়ে উত্তর দিকে অনেক দূর চলে যেত; আজকাল আরও, আরও দূরে যায়। এই লাইনে দু—চারটে মিনিট দৌড়ের পরই একেকটা স্টেশান। মেরিন লাইনস, গ্রান্ট রোড, চার্নি রোড, মহালদমী ইত্যাদি স্টেশন পেরুলেই মূল বম্বের সীমানা শেষ। তারপর শহরতলি শুরু।
শহরতলির স্টেশনগুলোর দুপাশটা মোটামুটি জমজমাট। উঁচু উঁচু নতুন পুরনো বিল্ডিং, ঝাঁ—চকচকে রাস্তা, বেশ কিছু অফিস, মাঝে মাঝে রাস্তার মোড়ে ইরানিদের রেস্তোরাঁ বা ছোটখাটো হোটেল। ব্যস, এটুকুই। নইলে ফাঁকা জায়গাই বেশি। সেগুলোতে হয় আগাছার জঙ্গল, ঝোপঝাড় বা সবজির চাষ, ছাড়া—ছাড়া ভাবে দু—চারটে টালির চালের বাড়িও চোখে পড়ে।
আমি একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে কাজ করতাম। না, পাকা চাকরি নয়। ফুরনের কাজ। তখনও এদেশে টিভি আসেনি। মিডিয়া বলতে খবরের কাগজ। আমাদের এজেন্সি বেশ কয়েকটা কনফেকশনারি, সুগন্ধি সাবান, হেয়ার অয়েল, ক্রিম, পারফিউম, সেন্ট ইত্যাদি জিনিসের বিজ্ঞাপন তৈরি করত দেশের নানান ভাষার কাগজগুলোর জন্য। আমি বাংলা ভাষায় কলকাতার পত্র—পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপনের কপি তৈরি করে দিতাম। না, রোজ অফিসে হাজিরা দিতে হত না। সপ্তাহে দু’দিন মাত্র যেতাম। যে টাকা পেতাম তাতে দিব্যি চলে যেত।
আমি থাকতাম শহরতলিতে। চার্চগেট থেকে তেরো—চোদ্দো মাইল দূরে বান্দ্রা নামে একটা জায়গায়। সাবার্বন ট্রেন থেকে স্টেশনে নেমে নাক বরাবর পশ্চিম দিকে মাইল খানেক গেলেই সমুদ্রের ধারে ব্যান্ডস্ট্যান্ড। পাপাজিদের অর্থাৎ সর্দারজিদের সাদামাঠা লম্বাটে ধরনের তেতলা একটা হোটেলের ফার্স্ট ফ্লোরে কোণের দিকের শেষ ঘরটা ছিল আমার। জানলা দিয়ে ওখান থেকে একশো গজ দূরের সমুদ্র দেখা যায়।
হোটেলের নাম ‘এভারগ্রিন লজ’। নিজের ঘরে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে এজেন্সির কাজ করতাম।
আমাদের হোটেলের বোর্ডাররা কেউ ত্রিবাঙ্কুরের লোক, কেউ ইউ. পি, কেউ মাদ্রাজ (তখনও তামিলনাড়ুু নাম হয়নি), কেউ বিহার, কেউ গোয়া, কেউ বা হায়দ্রাবাদ— সেকেন্দ্রাবাদের। বাঙালি আমি একজনই। বোর্ডাররা মানুষ ভালো, কিন্তু তাদের সঙ্গে বেশিক্ষণ গল্প করতে বা আড্ডা দিতে জুত লাগত না। আমি অবশ্য কিছু বাঙালি বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছিলাম। তারা থাকত বান্দ্রা থেকে আড়াই তিন মাইল দূরে খার—এর ডান্ডাস পয়েন্টে।
এই অঞ্চলটা সমুদ্রের পাড়ে। সব মিলিয়ে ওরা পাঁচজন। সুরেশ, দিবাকর, অরুণ, মনোজিৎ আর পূর্ণেন্দু। টেক্সটাইল মিল, ফার্মাসিউটিক্যালস, ইঞ্জিনিয়ারিং এমনি সব কোম্পানির অফিসে। ডান্ডাস পয়েন্টে ওরা থাকত পার্শিদের আদ্যিকালের একটা খোলামেলা দোতলা বাড়ির দু’খানা ঘর ভাড়া করে। খাওয়াদাওয়া বাইরের কোনও হোটেল—টোটেলে। থাকাটাই শুধু ওখানে। বম্বেতে হোটেল রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি। তবে চা—টা নিজেরাই করে নিত। পাঁচজনেই ভীষণ আমুদে, আড্ডাবাজ।
আমি মাঝে—মাঝেই সুরেশদের আস্তানায় আড্ডা দিতে যেতাম। বাংলার বাইরে বাঙালি ছাড়া বাঙালির গতি নেই। অন্তত তখনও তেমনটাই ছিল। ওরাও ‘এভারগ্রিন লজ’—এ আসত।
সমুদ্রের ধার দিয়ে তখন ডান্ডাস পয়েন্টে সোজাসুজি হেঁটে যাওয়া যেত। এখনও যায়। রাস্তাটার বাঁ—পাশে আরব সাগর, ডাইনে টানা পাহাড়, নাম পালি হিল। পাহাড়টা খুব উঁচু নয়, বড়জোর তিন—সাড়ে তিন হাজার ফিট হাইট। সেটার গায়ে জঙ্গল। তখন তাই ছিল। মাথায় বাংলো টাইপের কিছু বাড়ি। সমুদ্রের দিক থেকে সেখানে ওঠার পথ নেই। পাহাড়ের ওধার দিয়ে পাথর কেটে চুড়োয় ওঠার রাস্তা বানানো হয়েছে। যাদের দরকার তারা ওই রাস্তা দিয়েই ওঠানামা করে।
আমি হাঁটাহাঁটির মধ্যে নেই। বাসে পালি হিলের ওপাশ দিয়ে অনেকটা ঘুরে ডান্ডাস পয়েন্টে যেতাম। সুরেশ পূর্ণেন্দুরাও বাসে চেপেই আমার হোটেলে আসত।
সেদিন সন্ধেয় সুরেশদের আস্তানায় গেছি। চুয়ান্ন বছর আগে বম্বের শহরতলিতে যেমন দেখা যেত আশপাশে ছাড়া ছাড়া কিছু বাড়ি। ওদের ওখানেও তা—ই। এই বাড়িগুলো অনেক দিনের পুরোনো, সেকেলে আর্কিটেকচার।
যাই হোক, চা আর গাঠিয়া টাঠিয়া খেতে খেতে আড্ডা বেশ জমে উঠেছিল। সেদিন ভূতচর্চা চলছিল পুরোদমে। আমি ভূতপ্রেত পিশাচ—আত্মা এসব কিছুই বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যজীবনে সম্পূর্ণ দাঁড়ি পড়ে যায়। মরণের পরে আর কিছু নেই, থাকতে পারে না। বড় জোর কেউ মারা গেলে চিতায় পুড়ে তার দেহ ছাই হয়ে যায় কিংবা গোরস্থানের মাটিতে মিশে গিয়ে বায়ুমন্ডলে বাড়তি কিছু হাইড্রোজেন গ্যাস কি কার্বন ডাই—অক্সাইড তৈরি হতে পারে। পৃথিবীতে তার আর কোনও চিহ্নই থাকে না। অবশ্য আগেভাগে ফোটো তোলা থাকলে দেওয়ালে টাঙিয়ে বা অ্যালবামে সাজিয়ে রাখা যায়। মরণের ওপারে প্রেতলোক বলে যদি কিছু থেকে থাকে সেখানে তারা বহাল তবিয়তে থাকুক না। হঠাৎ জ্যান্ত মানুষদের সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে কি দাঁত খিঁচিয়ে তাদের ভয় দেখাতে বা গলা টিপে মারতে মর্তলোকে ভূতপ্রেতরা উদয় হবে কেন?
সুরেশ বলল, ‘তুমি তো বিশ্বাস করো না, আমার পিসেমশাইয়ের এক বন্ধু বর্ধমান ডিস্ট্রিক্টের কাটোয়ার লোক। একবার কয়েকজনের সঙ্গে শ্মশানে মড়া পোড়াতে গিয়েছিলেন কিন্তু পোড়াতে পারেননি। দশটা বিশাল বিশাল ছায়ামূর্তি হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে উঠে ডেডবডিটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। পিসেমশাই আর তাঁর বন্ধুরা মড়া ফেলে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। এটা সত্যি ঘটনা।’
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘তা ওই ছায়ামূর্তিগুলো তো ভূত—তাই না? তা তোমার পিসেমশাইরা পালালেন কেন? ওদের সঙ্গে দোস্তি করে পরলোকের ব্যাপার—স্যাপার একটু জেনে নিতে পারতেন!’
সুরেশ ভীষণ অসন্তুষ্ট হল,—’পিসেমশাই আমার গুরুজন। তাঁকে নিয়ে এরকম ঠাট্টাটাট্টা আমি লাইক করি না।’
বললাম,—’স্যরি—স্যরি—।’
অরুণ বলল ‘আমাদের বাড়ি পাইকপাড়ায়। সেই এরিয়ায় একটা পুরোনো পড়ো বিল্ডিং ছিল। কোনও লোক সেখানে থাকতে পারত না। ভাড়াটে এলে এক রাত্তির কাটতে—না—কাটতেই পালিয়ে যেত। ঠাকুরদার মুখে শুনেছি, মাঝরাত্তিরে সেখানে বহু মানুষের হইচই আর হাসির আওয়াজ শোনা যেত।’
‘জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেই বিল্ডিংটা কি এখনও আছে?’
‘না। স্বাধীনতার পর এক পাল রিফিউডি ইষ্ট পাকিস্তান থেকে এসে বাড়িটা দখল করে নেয়। তারপর প্রোমোটাররা মালিকের কাছে কিনে রিফিউজিদের কিছু টাকাপয়সা দিয়ে উঠিয়ে ক’বছর হল একটা বারোতলা হাইরাইজ বানিয়েছে।’
জিবে চুকচুক আওয়াজ করলাম, ‘প্রথমে রিফিউজিরা, তারপর প্রোমোটাররা সেই প্রেতাত্মাদের তাড়াল। তারা কোথায় গিয়ে কলোনি বসিয়েছে, খবর পেয়েছ? যদি পাও, আমাকে বলো। অফিস থেকে ক’দিনের ছুটি নিয়ে তাদের সঙ্গে মোলাকাত করে আসব।’
অরুণ ভীতু মানুষ। বলল, ‘ভূতপ্রেত নিয়ে এমন মজা করতে নেই।’
‘খালি বাড়িতে তারা যদি রাত—বিরেতে খামোকা হইচই করতে পারে, হাসতে পারে, কিন্তু রিফিউজি আর প্রোমোটার দেখলে ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। মজার ব্যাপার নয়?’
অরুণ চুপ করে গেল।
পূর্ণেন্দু বলল, ‘পলটারগেইস্টদের কথা জানো?
‘না। তারা আবার কারা?’
পূর্ণেন্দু ভূতপ্রেত পরলোক ইত্যাদি সম্পর্কে মহাবিশেষজ্ঞ। দেশ—বিদেশের নানা ভৌতিক কাহিনি তার ঝাড়া মুখস্থ। বলল, ‘পলটারগেইস্টরা হল্লাবাজ প্রেতাত্মা। ভীষণ উৎপাত করে। একটা সত্যি ঘটনা শোনাচ্ছি। আমার দিদিমার এক পিসতুতো দাদা বিহারের কাটিহারে থাকতেন। দিদিমার কাছে শুনেছি তাঁর এই দাদাটির বাড়ির কাছাকাছি অন্য একটা বাড়িতে পলটারগেইস্টরা মাঝরাতে হল্লা করতে করতে ভোর অব্দি অনবরত পাথর ছুড়ত।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘দিনের বেলায় ছোঁড়েনি কেন?’
পূর্ণেন্দু চটে উঠল, ‘অত তর্ক কোরো না তো। একেক গ্রুপের ভূতের একেক রকম স্টাইল। পলটারগেইস্টরা তাদের কাজের সময় হিসেবে রাতটাকেই সিলেক্ট করেছে।’
মনোজিৎ আর দিবাকরও ভূতের নানারকম লোমহর্ষক গল্প শোনাল। ওরাও ওদের বয়স্ক আত্মীয়স্বজনদের মুখে ওগুলো শুনেছে।
বললাম, ‘তোমরা ঠাকুরদা, দিদিমা বা অন্য রিলেটিভদের শোনা আজগুবি সব গপ্প শোনালে। ভালোই লাগল।’
পূর্ণেন্দু তেরিয়া হয়ে ওঠে। ভূতের ব্যাপারে ঠাট্টা—ইয়ার্কি সে একদম বরদাস্ত করে না। অন্যরা একটু মিনমিন করলেও ভূত যে আছে, সুযোগ পেলে সে বুঝিয়ে দিতে ছাড়ে না। এমন ভূতের অস্তিত্বে বিশ্বাসী মানুষ আর একজনও দেখিনি। বলল, ‘যাদের কাছে শোনা তারা কি মিথ্যে বলেছে?’ আর দে লায়ারস? এঁরা এজেড, রেসপনসিবল সব মানুষ। তোমার কি ধারণা, বানিয়ে বানিয়ে ওরা গল্প ফেঁদেছে!’ ওঁদের ইনসাল্ট করার কোনও রাইট তোমার নেই।’
আমি হকচকিয়ে যাই, ‘আরে ভাই রাগ কোরো না। তোমাদের ঠাকুরদা দিদিমাকে রেসপেক্ট জানিয়েই জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি বা সুরেশ অরুণরা কি নিজের চোখে তেনাদের দেখেছ?’
পূর্ণেন্দু গোঁ ধরেই থাকে। এঁড়ে তর্ক জুড়ে দেয়, ‘তুমি কি তোমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা কি তাঁরও ঠাকুরদাকে স্বচক্ষে দেখেছ?’
‘না দেখলেও তাঁরা ধরাধামে ছিল সেটা তো স্বয়ংসিদ্ধ। পূর্বপুরুষরা না থাকলে তুমি আমি জন্মালাম কী করে?’
একটু থতিয়ে গেল পূর্ণেন্দু। কিন্তু পিছু হটার বান্দা সে নয়। বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি কি কাশ্মীরের এক সময়ের রাজা দাহির কি ভাস্কো—ডা—গামা বা রাসপুটিন, আলেকজান্ডারকে দেখেছ?’
এমন একটা উদ্ভট প্রশ্নে আমি অবাক। তারপর হেসে ফেললাম, ‘তুমি শেষ পর্যন্ত কিনা দাহির আলেকজান্ডারদের নিয়ে টানাটানি শুরু করলে? আরে বাবা, তাঁরা ছিলেন কিনা এটাই তো জানতে চাও? ছিলেন, ছিলেন, নিশ্চয়ই ছিলেন। হিস্টোরিয়ানরা তাঁদের থাকার প্রমাণ, তাঁদের নানা কীর্তির কথা নানা বইতে লিখে রেখেছেন।’
‘এবার পথে এসো।’ পূর্ণেন্দু গলার স্বর চড়ায়, ‘ভূতেরা, আত্মারা যে এই পৃথিবীতে আছে এদেশের আর বিদেশের অনেকেই তা লিখেছেন। তাঁরা নিজের চোখে এদের দেখেছেন। হিস্টোরিয়ানদের লেখাগুলো যদি প্রমাণ বলে ধরো, এই লেখকদের লেখা প্রমাণ নয়? এঁরা বিরাট বিরাট পণ্ডিত। কেউ গাঁজা খেয়ে ধোঁকা দেবার জন্যে লেখেননি। এক আইরিশ আত্মা—বিশারদ—’
ওকে থামিয়ে দিয়ে আমিও কণ্ঠস্বর আরও উঁচুতে তুললাম, ‘আমি এরকম দু—চারটে বই পড়েছি। এগুলোকে প্রমাণ বলে? আটার রাবিশ।’
ভেবেছিলাম অন্য চারজনের কেউ হয়তো আমার পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু তারাও পূর্ণেন্দুর সঙ্গে কোরাসে সুর মেলাল। পাঁচজন ভূতবিশ্বাসীর মধ্যে আমি একমাত্র চরম অবিশ্বাসী। গলাবাজি করে ওদের বিরুদ্ধে ওয়ান—ম্যান আর্মির মতো লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলাম।
ভূতের টপিক এমন একটা ব্যাপার যে শুরু হলে কখন কোথায় গিয়ে থামবে তার ঠিক—ঠিকানা নেই। তুমুল তর্কাতর্কির মধ্যে হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ চলে যায়। এগারোটা বেজে সাতচল্লিশ। একটা চেয়ারে বসে ছিলাম। স্প্রিংয়ের মতো প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াই।
‘আরেব্বাস! এত রাত হয়ে গেছে, টেরই পায়নি। আজ চলি ভাই।’
পূর্ণেন্দু বলল, ‘বাসটাস বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এতটা রাস্তা যাবে কী করে? রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে উঠে চলে যেও। আমাদের জন্যে রুটি—তরকারি আনিয়ে রেখেছি। ভাগাভাগি করে খেয়ে নেব।’
‘ইমপসিবল। অ্যাডের আর্জেন্ট কিছু কাজ বাকি রেখে তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে এসেছিলাম। ঠিক করেছিলাম, ন’টা—সাড়ে ন’টায় উঠে পড়ব। কথায় কথায় এত রাত হবে, ভাবতে পারিনি। আজই হোটেলে ফিরে কাজটা কমপ্লিট করে সাড়ে দশটার ভেতর ফোর্টে এজেন্সির অফিসে জমা দিতে হবে। আচ্ছা চলি—’।
বেরিয়ে পড়লাম, লাস্ট বাস চলে গেছে ঘণ্টা দেড়েক আগে। যদি কপাল জোরে একটা ট্যাক্সি জুটে যায়।
পূর্ণেন্দু সুরেশরাও আমার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল। সবাই খোঁজাখুঁজি করল। না, ট্যাক্সির পাত্তা নেই। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসটাস সব উধাও।
সুরেশ বলল, ‘এবার?’
হাসলাম, ‘স্রেফ পায়দল। হেঁটেই চলে যাব।’
পালি হিলের পেছন দিয়ে গেলে মিনিমাম দু—ঘণ্টারও বেশি লেগে যাবে। তবে সমুদ্রের ধার দিয়ে যদি যাই, মিনিট চল্লিশের ভেতর হোটেলে পৌঁছে যাব। ঠিক করলাম ওই শর্টকাট রাস্তাটাই ধরব।
সুরেশ পূর্ণেন্দুরা বলল, ‘ওই রাস্তাটা ভালো না। বিশেষ করে রাত্তিরবেলাটা। গুণ্ডা ছিনতাইবাজরা ওত পেতে থাকে।’
তখন সাহস ছিল প্রচণ্ড। তা ছাড়া এজেন্সির জরুরি কাজটা মাথায় ঘুরছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে ফেরা দরকার। বললাম, ‘তোমরা টেনশন কোরো না। কিচ্ছু হবে না।’
ওরা উদ্বিগ্ন মুখে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে গেল। সমুদ্রের ধারের রাস্তাটা মধ্যরাতে একেবারে সুনসান। কোথাও জনপ্রাণী চোখে পড়ছে না। এখন পূর্ণিমাপক্ষ। আকাশে প্রকাণ্ড রুপোর থালার মতো চাঁদ অবিরল জ্যোৎস্না ঢেলে চলেছে। রাস্তার একধারে লাইন দিয়ে নারকেল গাছ। তারপর অজস্র ছোটবড় পাথরের চাঁই বা বোল্ডার। তারপর বীচ। বীচের পর থেকে আরব সাগর। সমুদ্র থেকে উঁচুউঁচু ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে; সাঁই সাঁই হাওয়া নারকেল গাছের ঝুঁটি ধরে ক্রমাগত ঝাঁকিয়ে চলেছে। বাঁ—ধারে পালিহিল। সেখানে এদিক থেকে একেবারে চুড়ো অবধি ঝোপঝাড় জঙ্গল। পাহাড়টার মাথায় যে দশ—বিশটা বাংলো টাইপের বাড়ি আছে, সেগুলোর বাসিন্দারা এতক্ষণে ঘুমের আরকে ডুবে গেছে। কোনও বাড়িতেই একফোঁটা আলো নেই।
পাহাড়ের নীচের দিকে মাঝে—মাঝেই অনেকটা জায়গা জুড়ে ভাঙাচোরা ধ্বংসস্তূপ চোখে পড়ছে। চারশো—সাড়ে চারশো বছর আগে যে পর্তুগিজ জলদস্যুরা ভারতবর্ষে হানা দিয়েছিল তারা কালিকটে এসেই থেমে থাকেনি। আরব সাগরের তীর ধরে ধরে বোম্বেতে এসেও হাজির হয়েছিল। এমনকি বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সুদূর বাংলাদেশেও অভিযান চালিয়েছিল। গড়ে তুলেছিল একের পর এক কেল্লা। বোম্বেটেরা কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! কিন্তু পালি হিলের তলার দিকে জঙ্গলে—ঘেরা যে ভগ্নস্তূপ চোখে পড়ে সেসব এই জলদস্যুদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।
চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল। নির্জন রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছি। মিনিট দশেক হাঁটার পর হঠাৎ পেছন দিকে পায়ের অস্পষ্ট আওয়াজ কানে এল। চমকে পেছন ফিরে দেখি, তিনটে কুড়ি—একুশ বছরের চোয়াড়ে চেহারার ছোকরা আমার দিকে আসছে। লক্ষণ ভালো মনে হল না। সমুদ্রের ধারের এই লম্বা রাস্তাটার দুর্নাম আগেই শুনেছি। রাতের দিকে একা কারওকে পেলে ছিনতাইবাজরা ছুরি দেখিয়ে সব লুটপাট করে নেয়। বাধা দিলে নির্ঘাত চাকু চালিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে দু—একটা ডেডবডি এখানে পড়ে থাকার কথা শুনেছি।
আমার হাতে একটা দামি ঘড়ি আছে। শখ করে কিনেছিলাম। তখনই দাম পড়েছিল এগারোশো টাকা। এ ছাড়া পকেটেও রয়েছে পাঁচ—ছ’শো। চুয়ান্ন বছর আগে এই টাকা অনেক টাকা।
নাঃ! সময় বাঁচাতে আসা ঠিক হয়নি। পালিহিলের ওধার দিয়ে গেলে সময় অনেকটা লাগত ঠিকই। কিন্তু ওধারে বাড়িঘর প্রচুর, বেশি রাত অবধি রাস্তায় লোকজন থাকে। ভয়ের কিছু নেই।
এতগুলো টাকা আর শখের ঘড়িটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারব না। মুখ ফিরিয়ে জোরে জোরে পা চালাতে লাগলাম। পায়ের আওয়াজে টের পাচ্ছি ছোকরা তিনটেও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। শিকার যখন পেয়ে গেছে, কিছুতেই তাকে ছাড়বে না।
আমিও স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছি। টের পাচ্ছি ওদের সঙ্গে দূরত্বটা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। বজ্জাত তিনটে অল্পবয়েসি ছোকরা। চিতার মতো ক্ষিপ্র। যত জোরেই পা চালাই, ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না। মুখ বুজে চুপচাপ টাকা ঘড়িটড়ি দিয়ে দিলে ওরা আর ঝঞ্ঝাট করবে না। কিন্তু কেন দেব? ভাবলাম দৌড় লাগাই, কিন্তু শেষ রক্ষা কি হবে? মূর্তিমান শয়তানের দলটার হাত থেকে টাকাপয়সা নিয়ে অক্ষত শরীরে শেষ পর্যন্ত কি হোটেলে পৌঁছতে পারব?
হেঁটে গেলে ‘এভারগ্রিন লজ’ আর আধঘণ্টার পথ। তবু মনে হচ্ছে যেন হাজার মাইল দূরে। তখন আমার বয়স পঁচিশ; শরীর বেশ টান টান, এক ফোঁটা বাড়তি মেদ নেই। মনে সাহস আর গায়ে জোরও ছিল। ওদের হাতে ছোরাছুরি না থাকলে রুখে দাঁড়াতে পারতাম। পয়লা ধাক্কায় ওরা কিছু করার আগে আচমকা একটার পেটে পা এবং আরেকটার পেটে হাত চালিয়ে রাস্তায় শুইয়ে ফেললে তিন নম্বরটাকে কায়দা করতে দু’মিনিটও লাগবে না।
কিন্তু ধারালো অস্ত্রের সঙ্গে খালি হাতে লড়তে যাওয়া নেহাতই গোঁয়ার্তুমি। ভাবলাম দৌড় লাগাব। কিন্তু তাতেও তো পার পাওয়া যাবে না।
তবু একটা চেষ্টা তো করা যাক। হোটেল অবধি না হোক, একবার ব্যাসস্ট্যান্ডের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়লে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে মানুষজন সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে বেড়ায়। ছিনতাইবাজদের দেখলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে; মেরে পুরোপুরি কিমা বানিয়ে ছাড়বে।
আমি দৌড়ের জন্য পুরোপুরি তৈরি হচ্ছি, ততক্ষণে পেছনে পায়ের শব্দ খুব কাছে এসে পড়েছে। তিন ছিনতাইবাজ আর আমার মধ্যে দূরত্ব এখন কুড়ি—বাইশ ফিটের বেশি হবে না বলেই আন্দাজ করছি। দুদ্দাড় করে ওরা ধেয়ে আসছে।
আচমকা পালিহিলের নীচের দিকের জঙ্গল ফুঁড়ে একজন বেরিয়ে এসে আমার ঠিক পেছনে প্রায় ঘাড়ের কাছে এসে খসখসে গলায় পুরোনো ধরনের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘নো ফিয়ার! হাঁটতে থাকো!’
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আরও একজন। সেও আমার ঠিক পেছনে। তারপর আরও দু’জন; তারা সমুদ্রের দিক থেকে হঠাৎ উঠে এসে আমার দু’পাশে দাঁড়িয়েছে। চেহারাগুলো ঝাপসা ঝাপসা। মুখচোখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। এমন চেহারা কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়?
চকিতে মনে পড়ে গেল। ইতিহাসের বইতে আর্টিস্টের আঁকা পর্তুগিজ জলদস্যুদের যে ছবি চোখে পড়েছে, অবিকল সেইরকম। পরনে তেমনই পোশাক। কাঁধ থেকে অদ্ভুত ধরনের সেকেলে বন্দুক ঝুলছে। সবাই মাথায় আমার চেয়ে আধ হাতেরও বেশি লম্বা। বুকের পাটা কম করে চল্লিশ ইঞ্চি তো হবেই।
উনিশশো উনষাট সালে সাড়ে তিনশো—চারশো বছর আগের সেই বোম্বেটেরা বম্বের সমুদ্রতীরে মধ্যরাতে কোন ম্যাজিকে এসে হাজির হল, কিছুতেই বুঝতে পারছি না! মাথার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
টের পাচ্ছি, শিরদাঁড়ার ভেতর দিকে বরফের মতো কনকনে স্রোত ওঠানামা করছে। পা—দু’টো একেবারে পাথর। হৃৎপিণ্ডে দমাদ্দম হাতুড়ি পেটার মতো কিছু একটা চলছে। মনে হল, বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। জীবনে কত জায়গায় গেছি, কত কী দেখেছি। কিন্তু এমন দৃশ্য আগে আর চোখে পড়েনি। ইতিহাসের পাতা থেকে পর্তুগিজ জলদস্যুরা প্রায় চার শতাব্দী পেরিয়ে সশরীরে যে বেরিয়ে আসতে পারে কে ভাবতে পেরেছিল। এত ভয় আগে কখনও পাইনি। আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।
সেই খসখসে গলাটা ফের কানে এল, ‘ম্যান! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ভাবছ! পা চালাও—।’
বোম্বেটেরা যে কতটা নিষ্ঠুর, কতটা নৃশংস ইতিহাসের পাতায় পাতায় তার বর্ণনা পড়তে পড়তে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। মাঝরাতে এই চারমূর্তি কী চায়, তাদের মতলবটা ঠিক কী, আঁচ করা যাচ্ছে না। ইচ্ছা করলে মুহূর্তে আমাকে শেষ করে ফেলতে পারে। তা হলে আমার মতো আগাগোড়া নিপাট নিরীহ বাঙালিকে ঘিরে ধরার কারণটা কী?
খসখসে গলায় যে কথা বলছিল, এবার সে যেন একটু বিরক্ত,—’কী হল তোমার? দাঁড়িয়েই থাকবে নাকি?’
আরেকজন বেশ নরম গলায় বলল, ‘হঠাৎ আমাদের দেখে ও ভড়কে গেছে। ধমকাচ্ছ কেন?’ আমাকে বলল, ‘চলো—।’
সামান্য হলেও সাহস ফিরে পাচ্ছি। ওরা যা বলেছে সেটাই করতে হবে। নইলে হয়তো খেপে গিয়ে—। আমি সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম।
চার বোম্বেটে আমাকে একরকম বেড় দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল। আমার গলা দিয়ে টুঁ শব্দটি বেরুচ্ছে না, ওরাও কিছু বলছে না। সমুদ্রের গর্জন ছাড়া চারজোড়া ভারী বুট আর আমার চটির আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ নেই।
সাহস আরও বাড়ছিল। না, ওরা আমার ক্ষতি করবে না বলেই মনে হচ্ছে। চকিতে সেই ছিনতাইবাজ ছোকরাগুলোর কথা মনে পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, চাঁদের আলোয় ঊর্ধ্বশ্বাসে তারা পালিয়ে যাচ্ছে।
একসময় বাস স্ট্যান্ডের কাছাকাছি চলে এলাম। চার বোম্বেটে দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন বলল, ‘তোমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলাম। ওই যে তোমার হোটেল।
খেয়াল করিনি, এবার নজরে পড়ল, মাত্র চারশো—সাড়ে চারশো ফিট দূরে আমাদের ‘এভারগ্রিন লজ’।
অন্য একজন বলল, ‘চলে যাও, ওই বদমাশ স্ট্রিট ডগগুলো তোমার ধারেকাছে আর ঘেঁষবে না।’
অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে পা বাড়াতে যাচ্ছি, তিন নম্বর বোম্বেটেটি আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে বন্ধুদের কাছে খুব গলাবাজি করছিলে না—আফটার ডেথ ঘোস্ট, স্পিরিট কিচ্ছু নেই, সব বোগাস! কিন্তু নিজের চোখেই দেখলে তো, আমরা দিব্যি আছি। বম্বের এই কোস্টে সাড়ে তিনশো বছর ধরে। আরও হাজার বছর থেকে যাব; বুঝলে হে। আচ্ছা গুড বাই—।’
খিকখিক করে একটু হাসির আওয়াজ। তারপর কোথায় কী! চারমূর্তি পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
__