Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    লৌকিক এবং অলৌকিক গল্প – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প238 Mins Read0

    আমার হিরের টুকরো ছাত্র

    আমার হিরের টুকরো ছাত্র

    পঁয়ষট্টি বছর আগের কথা।

    আমার বয়স তখন উনিশ টুনিশ হবে। তারও কয়েক বছর আগে ভারত স্বাধীন হল, সেই সঙ্গে দেশভাগও। তখনকার পূর্ববাংলা রাতারাতি পূর্ব পাকিস্তান (এখন বাংলাদেশ) হয়ে গেল।

    আমরা পদ্মাপারের আকাট বাঙাল এবং রিফিউজি। আমাদের পক্ষে আর পাকিস্তানে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। সেখানে যা চলছিল তাতে আতঙ্কে দেশ ছাড়তে হয়েছে।

    একজন মহা মহা পণ্ডিত এবং মহা মহা রসিক লেখক, শুনেছিলাম তাঁদের অঢেল টাকাপয়সা, মজা করে তাঁর জাদু—কলমে কোথায় যেন লিখেছিলেন খুবই ‘কষ্টেস্রষ্টে’ তাঁর নাকি দিন কাটছে। তা হলে আমরা যারা সীমান্তের ওপারে বাড়িঘর, জমিজমা ফেলে চলে এসেছি তাদের হাল সেইসময় কীরকম তা কি আর বুঝিয়ে বলতে হবে? কোনও রকমে টিকে আছি।

    আমার ঘাড়ে তখন লেখালেখির ভূত চেপেছে। এ—পত্রিকায় সে—পত্রিকায় গল্প—টল্প লিখে মাসে কুড়ি—পঁচিশ টাকার বেশি আমদানি হয়। পকেট প্রায় সবসময়ই ফাঁকা।

    পাকিস্তান থেকে এপারে এসে আমরা উঠেছিলাম ভবানীপুরের এক পুরোনো পাড়ায় আধাবস্তি টাইপের লম্বা ব্যারাকের মতো একটা বাড়িতে। সেখানে ছিল আমাদের মতোই আরও ছ’টা রিফিউজি ফ্যামিলি।

    এই পাড়াতেই থাকতেন সুধাকরবাবুরা। সুধাকর লাহা। তাঁদের বনেদি বংশ, মোটা মোটা থামওয়ালা মস্ত তেতলা বাড়ি। আশুতোষ না মুরলীধর কোনও একটা কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। চমৎকার মানুষ। সারাক্ষণ মুখে হাসি। কেন যেন আমাকে ভীষণ পছন্দ করতেন। আমাদের সব খবর রাখতেন। একদিন সন্ধেবেলায় লোক পাঠিয়ে তাঁদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘টুইশনি করবি? ক্লাস সেভেনের ছাত্র। সপ্তাহে চারদিন পড়াতে হবে। পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনে—’

    পঁয়ত্রিশ টাকা তখন অনেক টাকা, বিশেষ করে আমাদের মতো সেই সময়ের উদ্বাস্তুদের কাছে। আচমকা টুপ করে আকাশের চাঁদ যেন হাতে এসে পড়ল। আহ্লাদে আটখানা নয়, ষোলোখানা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় গিয়ে পড়াতে হবে?’

    সুধাকরবাবু বললেন, ‘বেশি দূর নয়। আমাদের এই পাড়ার রাস্তাটা সোজা গিয়ে যেখানে ডান দিকে বেঁকেছে সেই মোড়ের মাথায় ”জয়হরি স্টোর”। নিশ্চয়ই তোর চোখে পড়েছে—’

    ‘পড়বে না? ওটার পাশ দিয়েই তো ট্রাম রাস্তায় যাই।’

    ‘ওই দোকানের মালিক হল দোলগোবিন্দ সামন্ত। তার ছেলেকেই পড়াতে হবে। দোলগোবিন্দকে তোর কথা বলে রেখেছি। কাল একটু বেলার দিকে, এই ধর এগারোটা নাগাদ তার সঙ্গে দেখা করবি। ভুলে যাস না।’

    উত্তেজনায় সারা রাত ভালো ঘুম হল না। সুধাকরবাবু বলে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজটা যদি না পাই? এই চিন্তাটা মাথার ভেতর কুটুর কুটুর করে পোকার মতো কামড় বসিয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙার পরও অস্থির—অস্থির ভাবটা কাটছে না।

    আমাদের ঘড়ি—টড়ি নেই। তবে পাশের ভাড়াটেদের মান্ধাতার ঠাকুরদার আমলের একটা ওয়ালক্লক আছে। দেশের ভিটেমাটি খুইয়ে এপারে আসার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে টুকিটাকি যে দু’চারটে জিনিস ওরা আনতে পেরেছে তার মধ্যে এই ঘড়িটাও ছিল। কিছুক্ষণ পর পর ঘড়িটা দেখে আসছি। এগারোটায় ‘জয়হরি স্টোর’—এ যাবার কথা। আমি চাই ঘড়ির কাঁটাদুটো বাঁই বাঁই করে পাক খেয়ে যত তাড়াতাড়ি পারে এগারোটা বাজিয়ে দিক। আসলে আমার তর সইছিল না। কিন্তু ঘড়িটা বেজায় ঠ্যাঁটা। নিজের মেজাজে টিক টিক করে চলতে লাগল।

    সেই সময় প্যান্ট—শার্টের তেমন চল ছিল না। বেশির ভাগ বাঙালিই ধুতি আর ফুলশার্ট কি পাঞ্জাবি পরত। এগারোটা বাজার একটু আগে আগেই চান টান করে বাড়িতে কাচা পরিষ্কার একটা ধুতি আর হাফশার্ট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

    ‘জয়হরি স্টোর’—এর সামনে দিয়ে রোজ দু’চার বার যাতায়াত করলেও আগে সেভাবে লক্ষ করিনি। আজ চোখে পড়ল দোকানটা বেশ বড়, অনেকটা জায়গা জুড়ে। মুদিখানার সঙ্গে মনিহারি দোকান মিলিয়ে যেমনটা হয় সেইরকম। মালপত্রে ঠাসা। রাস্তার দিকে মাথার ওপর মস্ত সাইনবোর্ডে ‘জয়হরি স্টোর’ নামটা জ্বলজ্বল করছে। তার তলায় লেখা—প্রোঃ শ্রীযুক্ত দোলগোবিন্দ সামন্ত। তার নীচে—স্থাপিতঃ বাং ১৩২৮ সাল।

    কারবারটা যে বেশ জমজমাট, বলে না দিলেও চলে। পাঁচ—ছ’টা কর্মচারী খদ্দেরদের ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। ভেতর দিকে তক্তপোশের ওপর তেলচিটে, আধময়লা গদিতে কোলের কাছে ক্যাশবাক্স আগলে যে নাড়ুুগোপাল—মার্কা ব্যক্তিটি থেবড়ে বসে আছেন তাঁর পরনে খাটো ধুতি আর ফতুয়া। কপালে চন্দনের ছাপে লেখা ‘জয়হরি’ গলায় তিন কণ্ঠি তুলসির মালা এবং কালো সুতোয় বাঁধা ছোটখাটো ঢোলের সাইজের রুপোয় বাঁধানো মাদুলি। মাথার পেছন দিকে একগোছা পুরুষ্টু টিকির ডগায় ক্লিপ দিয়ে সাদা ফুল আটকানো। বয়স পঞ্চান্ন—ছাপ্পান্ন হবে। এই আগাগোড়া পরম বৈষ্ণবটি যে শ্রীযুক্ত দোলগোবিন্দ সামন্ত, ঠিকই আন্দাজ করে ফেললাম।

    গদিতে বসেই তিনি অনবরত কর্মচারীদের হুকুম দিয়ে যাচ্ছেন।—’এই ভবা, লিস্টি মিলিয়ে রমেনবাবুর মালগুলো গুছিয়ে দে।’ ‘এই গজু, নিবারণবাবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। দ্যাখ তাঁর কী কী দরকার—’

    খদ্দেরদের মাল বুঝিয়ে দিয়ে কর্মচারীরা হিসেব করে টাকাপয়সা নিয়ে আসছে। দোলগোবিন্দ তিন চার বার গুনে সেসব ক্যাশবাক্সে ঢোকাচ্ছেন।

    এইভাবেই দোকানদারি চলছে। খদ্দেরদের ভিড় ভেদ করে দোলগোবিন্দর কাছে কখন পৌঁছুতে পারব, বুঝতে পারছি না। দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছি।

    কর্মচারী আর খদ্দেরদের দিকে নজর থাকলেও তিনি কিন্তু আমাকে লক্ষ করেছিলেন। গদি থেকে উঠে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুধাকরবাবু পাঠিয়েছেন তো?’

    আমি ঘাড় কাত করলাম, ‘হ্যাঁ—’

    মাথা ঝুঁকিয়ে গদগদ হয়ে হাতজোড় করলেন দোলগোবিন্দ, ‘কী সৌভাগ্যি, আসুন মাস্টারমশাই, আসুন—’

    দোলগোবিন্দকে বেশ ভালো লেগে গেল। খুবই বিনয়ী। আমিও হাতজোড় করলাম।

    দোকানটার বাঁ দিকের দেওয়াল ঘেঁষে সরু একটা প্যাসেজ। সুড়ঙ্গের মতো সেই ফালি পথটা দিয়ে দোলগোবিন্দ আমাকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সেই গদিটার পাশে একটা বেতের চেয়ারে বসিয়ে গদিতে উঠে ঠিক আগের কায়দায় ক্যাশবাক্স আঁকড়ে ধরে থেবড়ে বসে পড়লেন। সারা মুখ জুড়ে হাসি যেন ছলাৎ ছলাৎ করছে। বললেন, ‘সুধাকরবাবুকে এই তল্লাটের সব্বাই শেদ্ধাভক্তি করে। বড্ড মান্যিগাণ্যি, পণ্ডিত মানুষ। এমনটা আর দেখিনি এজন্মে। তেনার কাছ থেকে যখন আসচেন; আমি নিশ্চিন্তি। জয় হরি।—এই কাত্তিক, তুই তো তালকানা, খদ্দেরদের মালপত্তর ঠিক করে মাপবি। কম দেওয়া হয়েছে বলে আমাদের যেন বদনাম না হয়। জয় হরি—’

    বুঝতে পারছি প্রায় প্রতিটি বাক্যের শেষে একটা করে ‘জয় হরি’ থাকবে। আরও বোঝা গেল দোকানদারির ফাঁকে ফাঁকে দোলগোবিন্দ আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অপেক্ষা করতে লাগলাম।

    হরিভক্ত বৈষ্ণবটি আচমকা উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর গদির ঠিক পেছনের দেওয়ালে পাশাপাশি দুটো কাচ—বসানো বড় ছবি। একটা শ্রীকৃষ্ণের, অন্যটা শ্রীগৌরাঙ্গের। দুটো ছবির ওপর রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে গাঁথা টাটকা মালা ঝুলছে। ছবির তলায় কাঠের তাকেও প্রচুর ফুল। একগোছা ধূপকাঠিও জ্বলছে। ফুল আর ধূপের গন্ধে চারিদিক ম ম।

    তাক থেকে পেতলের একটা রেকাবি নামিয়ে আনলেন দোলগোবিন্দ। রেকাবিতে গোটাচারেক গোদা সাইজের তালশাঁস সন্দেশ রয়েছে সেগুলোর ওপর কয়েকটা ফুলের পাপড়ি। রেকাবিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি বসে পড়লেন, ‘এটুকু খান—’

    ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, ‘এত সব মিষ্টি টিষ্টি কী ব্যাপার? না—না’ জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগলাম।

    দোলগোবিন্দ নাছোড়। হাতজোড় করে, জিব কেটে বললেন, ‘শুধু মিষ্টি না, মিষ্টি না, শ্রীকৃষ্ণ আর গৌরাঙ্গদেবের পেসাদ। আপনার জন্যে পুজো দিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। দেখছেন না, ওগুলোর ওপর ফুলের পাপড়ি আর দুব্বো পড়ে আছে। একটা বড় কাজ করতে এসেছেন, সেটা যাতে বরাব্বর চালাতে পারেন সেইজন্যেই তো পুজো টুজো। পেসাদটা খেলে মনে বল পাবেন। দিন, দিন, মুখে দিন। জয় হরি—’

    বড় কাজটা যে টুইশনি, আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু সেটা চালিয়ে যাবার জন্য দোলগোবিন্দকে পুজো দিতে হয়েছে, মনের জোর বাড়াতে প্রসাদ খেতে হবে, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। আবার খটকাও লাগছে। লোকটার মাথায় গোলমাল টোলমাল নেই তো। প্রসাদ না খেলে দোলগোবিন্দ যদি বিগড়ে যান? তার ফলটা হবে এই—মাসে মাসে পঁয়তিরিশটা টাকার দফা রফা।

    মিষ্টি—টিষ্টি খুব একটা পছন্দ করি না। তবু সন্দেশগুলো গলার ভেতর দিয়ে নীচের দিকে নামিয়ে দিলাম।

    দোলগোবিন্দর মুখে মিটি মিটি স্বর্গীয় হাসি। বিগলিত হয়ে বললেন, ‘কী আনন্দ যে পেলাম। দেখবেন এই প্রসাদ মনের শক্তি কতটা বাড়িয়ে দেয়। এখন তা হলে কাজের কথাটা আরম্ভ করি—’

    যা কাণ্ডকারখানা চলছিল, ভেতরে ভেতরে বেশ মিইয়ে গেছি। এবার চনমনে হয়ে উঠলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, করুন, করুন।’

    ‘বুঝলেন মাস্টারমশাই, আমাদের দেশ ছিল হাওড়া জেলার একটা গাঁয়ে। কিন্তু দেশের সঙ্গে সম্পক্ক আর নেই। তিন পুরুষ ধরে আমরা এই ভবানীপুরেই আছি। আমাদের বংশটা একটু ছিষ্টিছাড়া গোছের। অন্য কারুর সঙ্গে মিল পাবেন না। জয় হরি—!’

    আমি হাঁ। কাজের কথা বলতে গিয়ে পরম বৈষ্ণবটি তাঁদের বংশের ইতিহাস—ভূগোল শোনাবেন নাকি? কী জাঁতাকলেই না পড়েছি। ঢোক গিলে বললাম, ‘টুইশনির ব্যাপারটা—’

    ‘হবে, হবে। আমরা সেদিকেই তো চলেছি। বংশের কথাটা পুরো না বললে বুঝবেন কী করে? আমার বাবারা একুনে ছিল পাঁচ ভাই। আগে দুই জ্যাঠা, মাঝখানে বাবা, তারপর দুই কাকা। এবার ধরুন, আমরা জেঠতুতো খুড়তুতো ভাই মিলিয়ে তা হব কুড়ি—পঁচিশ জনা। আমাদের ছেলেরা কম করে সত্তর—আশি। মহাভারতের কুরুবংশ আছে না, তার কাছাকাছি। অবিশ্যি একসঙ্গে থাকি না। সব আলাদা আলাদা।’

    মহাভারত অবধি পৌঁছে গেছেন দোলগোবিন্দ। আমি আঁতকে উঠি, ‘কিন্তু সামন্ত মশাই, টুইশনি নিয়ে—’

    আমাকে থামিয়ে দিয়ে দোলগোবিন্দ বললেন, ‘ঘাবড়াবেন না। সেখানেই চলে এসেছি। বাবা, কাকা, জ্যাঠা, তারপর আমরা, আমাদের পর আমাদের ছেলেরা—এতসব পঙ্গপালের ভেতর থেকে একজনাও ইস্কুলের চৌকাট পেরুতে পারেনি, কেউ কেলাস থিরি পাশ, কেউ ফোর, কেউ ফাইভ কি সিক্স। দৌড় ওই অব্দি। ভন্টে মানে আমার বড় ছেলে যাকে আপনি পড়াবেন বলে এসেছেন, একমাত্তর সে—ই ই কেলাস সেভেনে উটেচে। নিজের ক্ষ্যামতায় নয়, ঠেলে—ঠেলে তুলতে হয়েছে। ফাইভের শেষ পরীক্ষেয় অঙ্কে পেয়েছিল দশ, বাংলায় সতেরো, ইংরিজিতে নয়—এই রকম সব নম্বরের ছিরি। ওদের ইস্কুলের হেডমাস্টার অনুকূলবাবুর দয়ার শরীর। আমি দোকানে তালা ঝুলিয়ে, ব্যবসাপত্তর শিকেয় তুলে ঝাড়া দু’ দুটো দিন তেনার বাড়িতে হত্যে দিয়ে পড়ে রইলাম। হেডমাস্টারের মন গলল। ভন্টে ফাইভ থেকে সিক্সে উঠল। সিক্সের শেষ পরীক্ষেয় সেই একইরকম নম্বর। ফের দু’দিন দু’রাত্তির হত্যে দিতে হল। ভন্টে সেভেনে উঠল। ব্যস। সেখেনেই শেষ অনুকুলবাবু বলে দিয়েচেন, এটাই লাস্ট।’

    দোলগোবিন্দ আমাকে মুহুর্মুহু চমকে দিচ্ছেন। এতক্ষণ তেমন খেয়াল করিনি, হঠাৎ মনে হল কথা বলতে বলতে বার বার আমার পা থেকে মাথা অবধি নিরীক্ষণ করে চলেছেন। কী দেখছেন এত! আমি কি একটি দর্শনীয় প্রাণী? উশখুশ করতে লাগলাম।

    দোলগোবিন্দ আমার অস্বস্তিটা টের পাচ্ছিলেন। বললেন, ‘থির হয়ে বসুন মাস্টারমশাই। আরও কিছু কথা আচে। মন দিয়ে শুনুন। জরুরি কথা। ঠেলে গুঁতিয়ে যেমন করে পারি ভন্টেকে সেভেনে তুলিচি। আমাদের বংশের ও হল সব চেয়ে বড় বিদ্বান লোক। আমি ভন্টেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। মেরেকেটে ছোকরাকে যদি ম্যাট্টিকটা পার করিয়ে দিতে পারেন আমাদের বংশের মুখে ঝাড়বাতি জ্বলবে—’

    বলেই আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে লাগলেন, ‘না। কাজটা অত সোজা না। আগে আপনি ভন্টেকে সেভেন থেকে এইটে তুলুন। ঝাড়বাতি না হোক, পিদিম তো জ্বলবে। আপনাকে সোনার কলম আর সোনার ফিতেওলা ঘড়ি দেব। ভবানীপুরে দু’দিন মোচ্ছব লাগাব।’

    বলেই কেমন যেন মিইয়ে গেলেন। ‘কিন্তু সমিস্যেটা হল—’

    ‘কীসের সমস্যা?’

    হঠাৎ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দোলগোবিন্দ, ‘উঠুন তো মাস্টারমশাই, উঠে দাঁড়ান—!’

    ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে পড়লাম। লোকটা আমাকে নিয়ে কী করতে চায়? পাগল করে ছাড়বে নাকি?

    ‘আসুন, আসুন আমার কাচে—।’ দোলগোবিন্দ হাতছানির মতো করে আঙুল নাড়তে লাগলেন।

    আমি অবাক।—’আপনার কাছেই তো আছি—।’

    ‘আরও কাচে, আরও কাচে।’

    একবার ভাবলাম, সরে পড়ি। তারপরেই ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত না দেখে ছাড়ছি না। গদির গা ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালাম।

    দোলগোবিন্দ বললেন, ‘আপনার দু’হাতের গুল দেখান তো!’

    গুল মানে মাসল, পেশি। আস্তে আস্তে জামার হাতা গুটিয়ে হাতের মুঠো পাকিয়ে মাসল ফোলাবার চেষ্টা করলাম। একটু বড় সাইজের মার্বেলগুলির মতো মাসল দেখা দিল। দোলগোবিন্দ সেটা টিপে বললেন, ‘গুল কোথায়? এ তো একদম নেতিয়ে আছে।’ তারপর বুকে পিঠে ডাক্তারদের মতো আঙুল ঠুকে ঠুকে, কখনও জোরে চেপে চেপে কিছু বুঝতে চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ‘শরীরে শাঁস বড্ড কম। হাড়ই বেশি। দেখা হয়ে গেচে। যান মাস্টারমশাই, বসুন। বলতে বলতে ঝপ করে গলা নামিয়ে দিলেন, ‘বড্ড রোগা পটকা। হাতদু’টো কাঠি কাঠি, বুকের খাঁচায় মাংস নেই বললেই হয়।’ বলে গলা নামিয়ে বিড় বিড় করতে লাগলেন, ‘ক’দ্দিন যে টিকে থাকবে—।’

    আমি গিয়ে চেয়ারে বসে পড়েছিলাম। কিন্তু দোলগোবিন্দর বিড়বিড়ানি কানে এসেছে। কীসের টিকে থাকা? আমরা দু’জন ছাড়া এখানে আর তো কেউ নেই। কার সম্বন্ধে ওই কথাগুলো বলছে?

    দোলগোবিন্দ হঠাৎ গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন, ‘গণশা! দাঁড়িপাল্লা ভজাকে দিয়ে এখানে আয়—।’

    একটা তাগড়াই চেহারার কর্মচারী সামনে এসে দাঁড়াল। দোলগোবিন্দ তাকে বললেন, ‘ভন্টেকে এখানে নিয়ে আয়। বলবি আমি ডেকিচি। ব্যাগড়বাই করলে ঘাড়ে কষে তিনটে থাপ্পড় মারবি।’

    গণশা অর্থাৎ গণেশ চলে গেল। ভন্টে যে দোলগোবিন্দর ছেলে, আগেই জানা গেছে। যেভাবে পরম সমাদরে তাকে নিয়ে আসার কথা বলা হল তাতে কেমন যেন একটা অশান্তি হচ্ছে।

    দোলগোবিন্দর সেই চড়া মেজাজটা আর নেই। হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘এটা নিন মাস্টারমশাই।—’ তাঁর হাতে একটা ব্রাউন রংয়ের পুরু খাম। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।

    আমি অবাক, ‘কী আছে এর ভেতর?’

    ‘আপনার একমাসের মাইনে।’

    ‘আমি তো এখনও পড়াতেই শুরু করিনি। না না, দয়া করে ওটা দেবেন না। মাস কাবার হলে—’

    আমাকে শেষ করতে দিলেন না দোলগোবিন্দ, ‘ধরুন তো, ধরুন। মাস যখন কাবার হবার তখন হবে। এমনটাও হতে পারে, পাঁচ—সাত দিন পড়িয়ে আর এলেনই না। তখন সারা জন্মের জন্যে ঋণ থেকে যাবে। গুরুকে দক্ষিণে না দেওয়াটা মহাপাপ।’ বলে নিজেই আমার বুক পকেটে খামটা গুঁজে দিলেন।

    বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, পারা গেল না। গণেশ এর মধ্যে ফিরে এল। তার সঙ্গে বৃহৎ সাইজের একটি গোরিলা। গোরিলা ছাড়া আর কোনও লাগসই উপমা মাথায় এল না। বয়স ষোলো—সতেরো। পরনের হাফপ্যান্ট আর টাইট গেঞ্জি ফাটিয়ে তার মাসল যেন বেরিয়ে আসবে। গামা পালোয়ান বা জো লুই হতে এই ছোকরার যে খুব বেশিদিন লাগবে না, দিব্যদৃষ্টিতে তা এখনই দেখতে পাচ্ছি।

    ইনি কে হতে পারেন সেটা কি আর বুঝতে পারিনি। তবু দোলগোবিন্দ পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘মাস্টারমশাই, এই আমার ছেলে ভন্টে, আপনার ছাত্তর। আর ভন্টে, ইনি তোর নতুন মাস্টারমশাই, গড় কর—।’

    শ্রীমান ভন্টে যে আনন্দে গলে গিয়ে নাচতে নাচতে এখানে আসেনি, তার বেজায় বিরক্ত মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে। চেহারা টেহারা, ভাবগতিক দেখে রীতিমতো দমেই গেলাম।

    ভন্টে ঝুঁকে আমার পায়ের দিকে হাত বাড়াল। কিন্তু পায়ের পাতার চামড়া জ্বালা করছে কেন? চিমটি কাটল নাকি? হঠাৎ কেমন একটা জেদ চেপে গেল, বেয়াড়া ছোকরাটাকে টিট করতেই হবে।

    দোলগোবিন্দ বললেন, ‘মাস্টারমশাই, একটা কথা বলতে ভুলে গেচি। ভন্টে কিন্তু এই নিয়ে দু’বচ্ছর কেলাস সেভেনে শেকড় গজিয়ে পড়ে আচে। হেডমাস্টার অনুকূলবাবু বলেছেন, এবার যদি ফেল করে ইস্কুল থেকে লাথি মেরে বের করে দেবেন। এখন সবে গরমের ছুটি পড়েছে, হাতে অনেকটা সময় আচে। সেই পুজোর ছুটিরও মাস দেড়—দুই বাদে শেষ পরীক্ষে। এমনভাবে তৈরি করে দিন, যাতে এইটে উঠতে পারে। আপনার ওপর খুব ভরসা করে থাকব। আমাদের বাড়িটা খুব কাচেই। পাশের গলিতে।…গণশা, তুই এঁদের পড়ার ঘরে পৌঁছে দিয়ে আয়। বাড়িতে বলবি ভন্টের ওপর যেন চোখ রাখে। ঝঞ্ঝাট টঞ্ঝাট বাধালে তক্ষুনি দোকানে খবর পাঠায়।—’

    এতক্ষণ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঠান্ডা, হিংস্র চোখে আমাকে দেখছিল ভন্টে। এবার মুখ খুলল, ‘আমি আজ পড়ব না।’

    দোলগোবিন্দ হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘হারামজাদা! তুই পড়বি না কী রে, তোর বাপ পড়বে। যা—’

    গণেশ আমাদের একটা সেকেলে দোতলা বাড়ির নীচের তলায় পড়ার ঘরে পৌঁছে দিয়ে বলল, ‘মাস্টারমশাই, আপনি পড়ানো শুরু করুন। বউদিদির সঙ্গে দেখা করে তাড়াতাড়ি দোকানে ফিরতে হবে।’ সে চলে গেল।

    বউদিদি যে দোলগোবিন্দ সামন্তর স্ত্রী, বোঝা গেল।

    পড়ার ঘরে চেয়ার—টেবিল পাতা। বইটই রাখার জন্য একটা ছোট আলমারিও রয়েছে।

    আমি একটা চেয়ারে বসলাম। ভন্টে মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, ‘তোমার বই—টই সব নিয়ে এসো—।’

    ঘোর অনিচ্ছায় আলমারি থেকে এক গাদা বই আর খাতা বের করে এনে টেবিলের ওপর রেখে ভন্টে আমার মুখোমুখি বসল।

    জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের সেভেনের সিলেবাসে কী—কী আছে?’

    ভন্টে জানিয়ে দিল।

    ‘কোন সাবজেক্টের কী কী পড়ানো হয়েছে?’

    ‘জানি না।’

    চমকে উঠি, ‘তুমি স্কুলে যাও না?’

    ভন্টে বলল, ‘যাব না কেন? লাস্ট বেঞ্চিতে বসে খগেন, বাসব আর শচীনের সঙ্গে গল্প করি। মাস্টাররা কী বকর বকর করে, কে শুনচে—’

    এমন একটি উৎকৃষ্ট ছাত্র জুটবে, কে জানত! বললাম, ‘স্কুলে যা পড়ানো হয়েছে, তুমি তো বলতে পারছ না। গোড়া থেকে শুরু করে আমি সিলেবাসটা শেষ করে দেব। তুমি শুধু আমাকে একটু হেল্প করবে।’

    কপাল কুঁচকে গেল ভন্টের, ‘কীসের হেল্প?’

    ‘আমি যেমন—যেমন বলব সেইমতো পড়বে। হোম টাস্ক করে রাখবে। ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলে দেখবে তর তর করে এইটে উঠে গেছ। আজ বাংলা, অঙ্ক, ইতিহাস দিয়েই শুরু করা যাক। পাটিগণিতের বইটা দাও।’

    চিরতা গেলার মতো মুখ করে ভন্টে বলল, ‘ওইসব সিঁড়িভাঙা অঙ্ক, লাভক্ষতি, বাঁদরের খুঁটি বেয়ে ওঠা আমার মাথায় ঢোকে না—’

    ‘তা হলে জ্যামিতিই হোক।—’

    ‘আরও খারাপ।—’

    ‘তবে কি অ্যালজেব্রা? ওটা কিন্তু খুব সহজ।’

    কী ভেবে কে পি বোসের অ্যালজেব্রা বইটা এগিয়ে দিল ভন্টে। সেটা থেকে এ প্লাস বি স্কোয়ার গোছের দু’চারটে অঙ্ক কষিয়ে শুভারম্ভটা হল।

    অ্যালজেব্রার পর বাংলা। রবীন্দ্রনাথের ”দুর্ভাগা দেশ’টা বুঝিয়ে টুঝিয়ে দিলাম।

    বাংলার পর ইতিহাস। সিলেবাসে সম্রাট আকবর আছেন। বইটা খুলে পড়ে পড়ে তাঁর রাজত্বকালে দেশের অবস্থা, তাঁর সুশাসন ইত্যাদি সম্বন্ধে বলে গেলাম।

    আকবরের চ্যাপ্টারটা শেষ হলে বললাম, ‘এবার হোম টাস্ক। অ্যালজেব্রার মাত্র পাঁচ—ছ’টা অঙ্ক কষিয়েছি। ওইরকম আরও কয়েকটা অঙ্ক আছে, সেগুলো করে রাখবে। ”দুর্ভাগা দেশ”—এর সারাংশ আর শেষ চার লাইনের ব্যাখ্যা লিখবে। একটা রচনাও লিখতে হবে। তুমি কলকাতার বাইরে কোথায়ও বেড়াতে গেছ?’

    বিশেষ সাড়াশব্দ করছিল না ভন্টে। মৌনীবাবাদের মতো চুপচাপ বসে বসে আমার আগাপাশতলা দেখে যাচ্ছে। বলল, ‘বাবা কোত্থাও নিয়ে যায় নাকি? ”জয়হরি স্টোর” নিয়েই তো দিন রাত পড়ে থাকে। শুধু তিন—চারবার কাটোয়ায় মামাবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল।’

    ‘কাটোয়াই চলবে। শহরটার পাশ দিয়ে দু’ দুটো নদী চলে গেছে—গঙ্গা আর অজয়। রচনায় এই দুই নদী, সেখানকার মানুষজন, পাখি, গাছপালা—যা যা দেখেছ, সব গুছিয়ে লিখে ফেলবে।’

    প্রায় ঘণ্টাদুয়েক শ্রীমান ভন্টের সঙ্গে কাটিয়ে দিলাম। আমার একটু—আধটু ভয়—টয় যে ছিল না তা নয়। তবে ভন্টে এখন পর্যন্ত কোনও ঝামেলা টামেলা পাকায়নি। বেশ শান্তশিষ্ট হয়েই আছে। শ্রীকৃষ্ণ আর শ্রীগৌরাঙ্গর প্রসাদের জোর আছে। যাই হোক, সবসময় মনে হচ্ছে, বেশ কয়েকজন আড়ালে থেকে আমাদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। চালানোরই তো কথা। দোলগোবিন্দ গণেশকে দিয়ে তেমনটাই করতে বলে দিয়েছেন। নজরদারদের না দেখলেও মাঝে মাঝে তাদের ফিসফিসানি কানে এসেছে।

    ভন্টের দিকে তাকালাম, ‘যা—যা বললাম সব মন দিয়ে করবে। আজ আমি যাচ্ছি। কাল সকাল ন’টায় আসব, একটা পর্যন্ত থাকব।’

    ভন্টের মুখচোখের চেহারাই পালটে গেল। কেমন যেন বুনো, হিংস্র। কিন্তু খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কাল আপনি আসবেন না মাস্টারমশাই—’

    ‘কেন?’

    ‘কাল মোহনবাগান—ইস্টবেঙ্গলের খেলা আছে। ভোরবেলা গিয়ে টিকিটের জন্যে লাইন দিতে হবে। সন্ধেবেলায় ফিরে ”বিজলি”তে সিনেমা দেখব। ”কালোছায়া”, ডিটেকটিভ গল্প—।’

    বলে কী ছোকরা! জানি আমার বুকের মাপ সাড়ে সাতাশ ইঞ্চি, হাত—পা ফড়িংয়ের মতো কাঠি কাঠি, ওজন মেরেকেটে চল্লিশ কি একচল্লিশ সের। কিন্তু পদ্মাপারের বাঙালদের মাথায় মাঝে মাঝে গোঁ চাপে। আমারও চাপল। ঠিক করে ফেললাম, হাড়—বজ্জাত ছোকরাটাকে বাগে আনবই।

    গুরুগম্ভীর গলায় বললাম, ‘ডিসেম্বর মাসে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত খেলা, সিনেমা, বাঁদরামো, সব বন্ধ। কাল ন’টায় এসে যেন দেখি তুমি এখানে বসে আছ। পড়া, হোমটাস্ক, সব করে রাখবে।’

    তেরিয়া হয়ে ভন্টে বলল, ‘আপনাকে কাল আসতে বারণ করেছি। আসবেন না।—’

    গলার স্বর অনেকটা উঁচুতে তুললাম, ‘আসব।’

    ‘মাস্টারমশাই, আপনার আগে বাবা তেরোজন মাস্টার রেখেছিল। তারা কেউ দু’দিনের বেশি টেকেনি। স্রেফ ভাগলবা। এরা সব্বাই পড়া—পড়া করে পাগল বানিয়ে দিচ্ছিল। আপনিও তাই করছেন কিন্তু। কী হবে জানেন?’

    দোলগোবিন্দ সামন্ত কেন টিকে থাকার কথা বলেছিলেন, এতক্ষণে বুঝতে পারছি। ছোকরা আমাকে শাসাচ্ছে। মাথায় টগবগ করে রক্ত ফুটছে। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘অসভ্য, বজ্জাত, পাজির পা ঝাড়া একটি চড়ে—’

    বাকিটা শেষ হবার আগেই লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে ভন্টে, ‘চড় মারবে, ধুর শালা—’

    আমার নাকের ওপর গদাম করে পেল্লায় হাতুড়ির ঘা এসে পড়ল যেন। আসলে ভন্টে ঘুসি চালিয়েছে। আমার গলা থেকে ‘আঁক’ করে একটা আওয়াজ বেরুল। আমি চেয়ার থেকে ছিটকে মেঝেতে চিতপাত হয়ে পড়লাম। বাইরে প্রচণ্ড চেচামেচি, ‘ওরে, ভন্টে মাস্টারকে খুন করে ফেললে রে, শিগগির দোকানে গিয়ে খবর দে।’ টের পেলাম নাকের ফুটো দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এরপর চারপাশ ঝাপসা হতে হতে অন্ধকার হয়ে গেল।

    জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। নাকটা ফুলে টেনিস বল, তার ওপর ব্যান্ডেজ।

    বেডটা ঘিরে সুধাকরবাবু, আমার বাবা, মা, দোলগোবিন্দ সামন্ত, ডাক্তার, নার্স দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আমাকে চোখ মেলতে দেখে দোলগোবিন্দ হাতজোড় করে বললেন, ‘আমার জন্যে আপনার এত বড় ক্ষেতি হয়ে গেল। ক্ষমা করে দিন। ভন্টে পালিয়েছে। কিন্তু কোথায় যাবে? হাতে যখন পাব, গা থেকে চামড়া তুলে ফেলব। আর হ্যাঁ, আপনার সব চিক্কিচ্ছের ভার আমার।’

    তিন দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। নাকটা আগের চেহারায় ফিরতে মাসখানেক সময় লাগল। দোলগোবিন্দ সামন্তের বাড়িতে আমার প্রথম এবং শেষ টুইশনি। ভন্টে আমার প্রথম এবং শেষ ছাত্র।

    ভবানীপুরে আমরা খুব বেশিদিন থাকিনি। দক্ষিণ কলকাতার অন্য এলাকায় চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম টুইশনির স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দোলগোবিন্দর দেওয়া পঁয়তিরিশটা টাকা অনেক দিন আমার কাছে ছিল।

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপাগল মামার চার ছেলে – প্রফুল্ল রায়
    Next Article সিন্ধুপারের পাখি – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }