Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প18 Mins Read0

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    এপ্রিল ৭

    নৃতত্ত্ববিদ্‌ ডাঃ ক্লাইনের আশ্চর্য কীর্তি সম্বন্ধে কাগজে আগেই বেরিয়েছে। ইনি দক্ষিণ আমেরিকায় আমাজনের জঙ্গলে ভ্রমণকালে এক উপজাতির সন্ধান পান, যারা নাকি ত্রিশ লক্ষ বছর আগে মানুষ যে অবস্থায় ছিল আজও সেই অবস্থাতেই রয়েছে। এটা একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার। শুধু তাই নয়; সাকার্স বা চিড়িয়াখানার জন্য যে ভাবে জানোয়ার ধরা হয়, সেই ভাবেই এই উপজাতির একটি নমুনাকে ধরে খাঁচায় পুরে ক্লাইন নিয়ে আসেন তাঁর বাসস্থান পশ্চিম জার্মানির হামবুর্গ শহরে। খবরের কাগজে এই মানুষের ছবি আমি দেখেছি। বানরের সঙ্গে তফাত করা খুব কঠিন, যদিও দুই পায়ে হাঁটে। তারপর থেকে ক্লাইনের বিশ্বজোড়া খ্যাতি। এই আদিম মানুষটি এখনও ক্লাইনের বাড়িতে খাঁচার মধ্যেই রয়েছে। কাঁচা মাংস খায়, মুখ দিয়ে জান্তব শব্দ করে, স্বভাবতই কোনো ভাষা ব্যবহার করে না, আর অধিকাংশ সময় ঘুমায়। আমার ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছিল একবার এই আদিমতম মানবের নমুনাটিকে দেখার; সে ইচ্ছা যে পূরণ হবার সম্ভাবনা আছে তা ভাবিনি। কিন্তু সে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কাল ক্লাইনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। ক্লাইন লিখছে—

    প্রিয় প্রোফেসর শঙ্কু,

    ইনভেন্টর হিসেবে তোমার খ্যাতি আজ বিশ্বজোড়া। সব দেশের বিজ্ঞানীরাই তোমাকে সম্মান করে। আমি যে আদিমতম মানুষের—যাকে বলা হয় হোমো অ্যাফারেনসিস—একটি নমুনা সংগ্রহ করেছি সে-খবর হয়তো তুমি কাগজে পড়েছ। আমি চাই তুমি একবার আশ্চর্য মানুষটিকে এসে দেখে যাও। আমি জানি তুমি বছরে অন্তত একবার ইউরোপে আসো। এ বছর কি তোমার আসার সম্ভাবনা আছে? যদি থাকে তো আমাকে জানিও। যেখানেই থাকো না কেন, সেখান থেকে তোমাকে আমি হামবুর্গ আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সব খরচ আমার। যে-সময় তুমি আসবে, সে-সময় আমি আরও কয়েকজন বৈজ্ঞানিককে ডাকতে চাই। এমন আশ্চর্য আদিম প্রাণী দেখার সুযোগ তোমাদের আর হবে না। আমরা যখন যাই, তখন এই প্রাণীর আর মাত্র বারোজন অবশিষ্ট ছিল। তারাও আর বেশিদিন বাঁচবে না। আর অন্য কোনো দলও যে সেখানে গিয়ে তাদের দেখা পাবে, এ-সম্ভাবনাও কম, কারণ পথ অত্যন্ত দুর্গম আর নানারকম হিংস্র প্রাণীতে ভর্তি। আমার তরুণ বন্ধু বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক হেরমান বুশ তো নৌকা থেকে নদীর জলে পড়ে কুমিরের খাদ্যে পরিণত হয়। আমাদের নেহাত ভাগ্য যে আমরা প্রাণ নিয়ে ফিরেছি।

    যাই হোক, তুমি কী স্থির করো আমাকে অবিলম্বে জানিও।

    হাইনরিখ ক্লাইন

    আগামী সেপ্টেম্বর আমার জিনিভাতে একটা কনফারেন্সে নেমন্তন্ন আছে। যাওয়া নিয়ে দ্বিধা করেছিলাম—বয়স হয়ে গেছে—জেটে ঘোরাঘুরির ধকল আর সয় না—কিন্তু ক্লাইনের এই আমন্ত্রণের জন্য জিনিভাতে যাব বলে স্থির করেছি। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। অ্যাদ্দিন যে-সমস্ত মানুষের শুধু হাড়গোড়ের জীবাশ্ম বা ফসিল পাওয়া গিয়েছিল, সেই মানুষ জ্যান্ত দেখতে পাব এ কি কম সৌভাগ্য!

    এখানে বলে রাখি ক্লাইনের তরুণ সহকর্মী হেরমান বুশের সঙ্গে আমার বছর পাঁচেক আগে ব্রেমেন শহরে আলাপ হয়। ছেলেটি ছিল এক অসাধারণ মেধাবী জীবতাত্ত্বিক। তা এ-হেন মৃত্যু আমাকে মর্মাহত করেছিল। ক্লাইনের সঙ্গে আমার আলাপ হবার সুযোগ হয়নি। শুনেছি সে অতি সজ্জন ব্যক্তি। নৃতত্ত্ব নিয়ে তার অনেক মৌলিক গবেষণা আছে।

    মুশকিল হচ্ছে আমাকে সেপ্টেম্বরে বাইরে যেতে হলে আমার একটা কাজ হয়তো আমি শেষ করে যেতে পারব না। অবিশ্যি এলিক্সিরামের অভাবে এমনিও আমি আর খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারব বলে মনে হয় না। আসলে আমি একটা ড্রাগ প্রস্তুতের ব্যাপারে একটা পরীক্ষা চালাচ্ছিলাম। এই ড্রাগ তৈরি হলে চতুর্দিকে সাড়া পড়ে যেত। এর সাহায্যে একজন মানুষের ক্রমবিবর্তনের মাত্রা লক্ষগুণ বাড়িয়ে দেওয়া যায়। অর্থাৎ একজন মানুষকে এই ড্রাগ ইনজেক্ট করলে পাঁচ মিনিটের ভিতর তার মধ্যে দশ হাজার বছর বিবর্তনের চেহারা দেখা যেত। ওষুধ আমি তৈরি করেছি। প্রথমবার আমার চাকর প্রহ্লাদের উপর প্রয়োগ করে কোনো ফল পাইনি। তারপর এলিক্সিরামের মাত্রা একটু বাড়িয়ে দিয়ে আবার ইনজেক্ট করাতে দেখি প্রহ্লাদ অত্যন্ত জটিল গাণিতিক বিষয় নিয়ে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করেছে।

    কিন্তু এই অবস্থা বেশিক্ষণ টেকেনি। দশ মিনিটের মধ্যে প্রহ্লাদ ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ঘুম যখন ভাঙে তখন দেখি সে আবার যেই কে সেই অবস্থায় ফিরে এসেছে। বলল, ‘আপনি সুই দেবার পর মাথাটা ভোঁভোঁ করছিল। আমি বোধহয় ভুল বকছিলাম, তাই না?’

    আমার কাছে এলিক্সিরাম আর নেই। গত বছর জাপান থেকে এক শিশি এনেছিলাম। এই ড্রাগটিও মাত্র বছর তিনেক আবিষ্কার হয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী ড্রাগ এবং দামও অনেক। তবে প্রহ্লাদের উপর প্রয়োগের ফলে যেটুকু ফল পেয়েছিলাম তাতেই যথেষ্ট উৎসাহিত বোধ করেছিলাম। ভবিষ্যতের মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন বাড়বে তাতে আমার সন্দেহ নেই। তার পরের অবস্থায় হয়তো দীর্ঘকাল যন্ত্রের উপর নির্ভরের ফলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে আসবে, কিন্তু নতুন নতুন যন্ত্র উদ্ভাবনের তাগিদে মস্তিষ্ক বেড়েই চলবে। অবিশ্যি এসব ঘটতে সময় লাগবে অনেক। বিবর্তনের ফলে রূপান্তরের চেহারা ধরা পড়তে পড়তে বিশ-পঁচিশ হাজার বছর পেরিয়ে যায়।

    আমার ওষুধটা তৈরি হলে ভবিষ্যৎ মানুষ সম্বন্ধে আর অনুমান করতে হবে না; চোখের সামনে দেখতে পাব মানুষ কী ভাবে বদলাবে।

    ক্লাইনের চিঠির জবাব আমি দিয়ে দিয়েছি। তাতে এও লিখেছি যে, আমার দুই বন্ধু ক্রোল আর সন্ডার্সকে সে যদি আমন্ত্রণ জানায় তাহলে খুব ভাল হয়, কারণ এদের দু’জনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ক্রোল হল নৃতাত্ত্বিক আর সন্ডার্স জীববিদ্যা-বিশারদ। আমার যাওয়া সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। প্রথমে জিনিভা, তারপর হামবুর্গ।

    সেপ্টেম্বর ১০

    আজ আমি জিনিভা রওনা দিচ্ছি। ক্রোল আর সন্ডার্স দু’জনেরই চিঠি বেশ কিছুদিন হল পেয়েছি। দু’জনকেই ক্লাইন আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ক্রোলকে আমার ড্রাগের কথা লিখেছিলাম। সে উত্তরে লিখেছে,

    ‘তোমার ওষুধ যে অবস্থায় রয়েছে সে অবস্থায়ই সঙ্গে করে নিয়ে এসো। ইউরোপের যে-কোনো বড় শহরে এলিক্সিরাম পাওয়া যায়। হয়তো ক্লাইনের কাছেই থাকতে পারে। একই সঙ্গে অতীত ও ভবিষ্যতের মানুষকে দেখতে পারলে একটা দারুণ ব্যাপার হবে। ক্লাইন লোকটাকে আমার বেশ ভাল লাগে। আমার বিশ্বাস, সে নিশ্চয়ই তোমাকে তার ল্যবরেটরিটা ব্যবহার করতে দেবে।’

    আমি তাই সঙ্গে করে আমার ওষুধ এভলিউটিন-এর শিশিটা নিয়ে যাচ্ছি। সুযোগ পেলে প্রস্তাবটা ক্লাইনকে দেব।

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    সেপ্টেম্বর ১৬, হামবুর্গ

    জিনিভার কাজ শেষ করে কাল হামবুর্গ পৌঁছেছি। অন্য অতিথিরাও একই দিনে এসেছে। ক্রোল আর সন্ডার্স ছাড়া আছে ফরাসি ভূতাত্ত্বিক মিশেল রামো, ইটালিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী মার্কো বার্তেল্লি আর রুশ স্নায়ু-বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইলিয়া পেট্রফ।

    আমি পৌঁছেছি রাত্রে। ক্লাইন আমাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘আমার সে মানুষ সন্ধ্যা থেকেই ঘুমায়। ত্রিশ লক্ষ বছর আগে আদিম মানুষও তা-ই করত বলে আমার বিশ্বাস। আমি তাই কাল সকালে তোমাদের সকলকে তার কাছে নিয়ে যাব।’

    আমি আর ল্যাবরেটরির কথাটা তুললাম না। দু’একদিন এখানে থাকি, তারপর বলব। তবে তার সহকর্মীর মৃত্যুতে সমবেদনা জানানোর কথাটা ভুলিনি। তাকে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, সে-কথাও বললাম। ক্লাইন বলল যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর এক স্প্যানিশ পর্যটকের লেখা একটা অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য ভ্রমণকাহিনীতে নাকি ব্রেজিলের এই উপজাতির উল্লেখ আছে। লেখক বলেছেন, তারা বাঁদর ও মানুষের ঠিক মাঝের অবস্থায় রয়েছে। এতদিন আগের এই আশ্চর্য সিদ্ধান্ত ক্লাইনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। এই বিবরণই ক্লাইনকে টেনে নিয়ে যায় আমাজনের গভীর জঙ্গলে। সেটা যে সফল হবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

    নৈশভোজের কোনো ত্রুটি হল না। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া ছাড়াও তিনজন অচেনা বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে আলাপ করেও খুব ভাল লাগল। বার্তেল্লি, রামো আর পেট্রফ তিনজনেই আদিমতম মানুষটিকে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে। সকলেই স্বীকার করল যে, এ একটি আশ্চর্য আবিষ্কার, আর আমাজনের জঙ্গল এক অতি আশ্চর্য জায়গা।

    পেট্রফ ক্লাইনকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি এই মানুষটিকে সভ্যতার পথে খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যাবার কোনো চেষ্টা করছ?’

    ক্লাইন বলল, ‘যে মানুষ প্রায় ত্রিশ লক্ষ বছর আগের অবস্থায় রয়েছে, তাকে কিছু শেখানো যাবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, এতদিন এসব মানুষের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়, আর আসল মানুষটি পাওয়া গেল দক্ষিণ আমেরিকায়।’

    ‘ওকে রেখেছ কীভাবে?’ বার্তেল্লি জিগ্যেস করল।

    ‘আমারই কম্পাউন্ডে একশো গজ ব্যাসের একটি শিক দিয়ে ঘেরা জায়গা করে তার মধ্যে রেখেছি। ঘরের মধ্যে খাঁচার ভিতর রাখার ইচ্ছে আমার আদৌ ছিল না। প্রাকৃতিক পরিবেশেও দিব্যি আছে। ওর দলের লোকের অভাব বোধ করার কোনো লক্ষণ এখনও দেখিনি। ওর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি সশস্ত্র লোক রাখতে হয়েছে। এমনিতে ও কোনো হিংস্র ভাব দেখায় না, কিন্তু আমি জানি ওর শারীরিক শক্তি প্রচণ্ড। একটা গাছের মোটা ডাল সে হাত দিয়ে মট্‌ করে ভেঙে দিয়েছিল।’

    ‘ওর মধ্যে সুখ-দুঃখ জাতীয় অভিব্যক্তির কোনো লক্ষণ দেখেছ?’ আমি প্রশ্ন করলাম।

    ‘না,’ বলল ক্লাইন। ‘ও শুধু মাঝে-মাঝে মুখ দিয়ে একরকম শব্দ করে যার সঙ্গে গোরিলার হুঙ্কারের কিছুটা মিল আছে।’

    ‘চার পায়ে আদৌ হাঁটে কি?’

    ‘না। এ যে মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সব সময় দু’ পায়েই হাঁটে। ফলমূলও খায়, মাংসও খায়। তবে মাংসটা খায় কাঁচা, ঝলসে নয়। এ মানুষ এখনও আগুনের ব্যবহার শেখেনি। একদিন ওর সামনে আগুন জ্বালিয়ে দেখেছি, ও চিৎকার করে দূরে পালিয়ে যায়।’

    সাড়ে দশটা নাগাদ আমরা যে যার ঘরে চলে গেলাম। অতিথি-সৎকারের কোনো ত্রুটি করেনি ক্লাইন, এটা স্বীকার করতেই হবে।

    সেপ্টেম্বর ১৭, রাত ১১টা

    আজ বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমরা ছয়জন বৈজ্ঞানিক আজ একটি জ্যান্ত ‘হোমো অ্যাফারেনসিস’-কে দেখলাম। দু’ পায়ে না হাঁটলে ওকে বাঁদর বলেই মনে হত। সর্বাঙ্গ খয়েরি লোমে ঢাকা। ক্লাইন মানুষটাকে একটা হাফপ্যাণ্ট পরিয়ে তার মধ্যে খানিকটা সভ্য ভাব আনবার চেষ্টা করেছে, আর কাছেই ফেলে রেখেছে একটা ভাল্লুকের লোম—শীত লাগলে গায়ে জড়াবার জন্য। সেটা নাকি এখনও পর্যন্ত ব্যবহার করার কোনো দরকার হয়নি। মাটিতে একটা সিমেন্ট করা গর্তে জল রাখা রয়েছে, সেটা তৃষ্ণা নিবারণের জন্য। আমাদের সামনেই প্রাণীটা তার থেকে জল খেল জানোয়ারের মতো করে। তারপর আমাদের এতজনকে একসঙ্গে দেখেই বোধ হয় একটা চেস্টনাট গাছের পিছনে গিয়ে কিছুক্ষণ লুকিয়ে থেকে তারপর অতি সন্তর্পণে আবার বেরিয়ে এল।

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    ক্লাইন বোধহয় ইচ্ছা করেই চারিদিকে ছোটবড় পাথরের টুকরো ছড়িয়ে রেখেছে। মানুষটা এবার তারই একটা হাতে নিয়ে এদিকে ওদিকে ছুঁড়ে যেন খেলা করতে লাগল।

    সত্যি, এমন দৃশ্য কোনোদিন দেখব তা স্বপ্নেও ভাবিনি। পেট্রফ তার ক্যামেরা দিয়ে কিছু ছবি তুলল। যদিও লোকটা বিশ গজের বেশি কাছে আসছে না।

    আমরা থাকতে-থাকতেই সশস্ত্র প্রহরী একটা প্লাস্টিকের বালতিতে কাঁচা গোরুর মাংস নিয়ে গিয়ে মানুষটাকে খেতে দিল। তার চোয়ালের জোর সাংঘাতিক, সেটা চোখের সামনেই দেখতে পেলাম।

    দুপুরে লাঞ্চ খেতে খেতে ক্রোল একটা কথা বলল ক্লাইনকে।

    ‘তোমার এই মানুষটি যে নেটা বা লেফ্‌ট-হ্যাণ্ডেড, সেটা লক্ষ করেছ বোধহয়।’

    সেটা আমিও লক্ষ করেছিলাম। সে পাথরগুলো বাঁ হাত দিয়ে তুলছিল। ক্লাইন বলল, ‘জানি। ওটা আমি প্রথম দিনই লক্ষ করেছি।’

    রামো বলল, ‘তোমার এই আদিম মানুষের চাহনিতে কিন্তু একটা বুদ্ধির আভাস আছে; যেভাবে সে আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল—’

    ক্লাইন কথার পিঠে কথা চাপিয়ে বলল, ‘তার মানেই বুঝতে হবে হোমো অ্যাফারেনসিসকে আমরা যত বোকা ভাবতাম, আসলে সে তত বোকা নয়। চার পা থেকে দু’পায়ে হাঁটবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মস্তিষ্কের আয়তনও নিশ্চয়ই বেড়ে গিয়েছিল।’

    আমি এইবার ক্লাইনকে অনুরোধ করলাম তার ল্যাবরেটরিটা দেখবার জন্য। ক্লাইন খুশি হয়েই সম্মত হল। বলল, ‘বেশ তো, খাবার পরেই না হয় যাওয়া যাবে।’

    লাঞ্চের শেষে চমৎকার ব্রেজিলিয়ান কফি খাইয়ে ক্লাইন আমাদের নিয়ে গেল তার গবেষণাগার দেখাতে। যন্ত্রপাতি ওষুধপত্রে পরিপূর্ণ ল্যাবরেটরি, দেখে মনে হল সেখানে যে-কোনো রকম একসপেরিমেন্ট চালানো যায়। সবচেয়ে ভাল লাগল দেখে যে, ল্যাবরেটরির একপাশে একটা সেল্‌ফে অনেকগুলি শিশি-বোতলের মধ্যে তিনটে পাশাপাশি শিশিতে এলিক্সিরাম রয়েছে। অবিশ্যি আমার ড্রাগের কথা এখনও ক্লাইনকে বলিনি।

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    রাত্রে ডিনার খেয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে পরস্পরকে গুড নাইট জানিয়ে যে যার ঘরে চলে গেলাম। আমার মনে কিসের জন্য জানি একটা খটকা লাগছে, অনেক ভেবেও তার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। ঘড়িতে দেখি পৌনে এগারোটা। এত রাত্রে কে?

    দরজা খুলে দেখি ক্রোল আর সন্ডার্স। ব্যাপার কী?

    ক্রোল বলল, ‘আমি যে ঘরে রয়েছি সে ঘরে নিশ্চয়ই কোনো সময় হেরমান বুশ ছিল। কারণ তার একটা খাতা একটা দেরাজের মধ্যে পেলাম।’

    ‘কী আছে সে খাতায়?’

    ‘যা আছে তা পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। আমাজনের জঙ্গলে নদীপথে সাড়ে তিন শ মাইল যাবার পরেও আদিম মানুষের দেখা না পেয়ে ক্লাইন নাকি হাল ছেড়ে দিয়েছিল। বুশই তাকে উৎসাহ দিয়ে নিয়ে যায়। সে বলে যে, স্প্যানিশ পর্যটকের বিবরণ কখনও ভুল হতে পারে না। কিন্তু—’

    ‘কিন্তু কী?’

    ‘বুশের মনে একটা সংশয় দেখা দিয়েছিল। তার মন বলছিল যে, সে এই অভিযানের শেষ দেখে যেতে পারবে না। সে বলছে যে, তার মধ্যে যে একটা ভবিষ্যৎ দর্শনের অলৌকিক ক্ষমতা আছে সেটা সে অনেক সময় লক্ষ করেছে। ক্লাইনের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না; প্রাণের ভয় সে কখনই করেনি। সে অত্যন্ত সাহসী ছিল। জাহাজে যেতে যেতেও সে একাগ্রমনে একটা এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছিল।’

    ‘কী এক্সপেরিমেন্ট?’

    ‘সেটা বুশ বলেনি। বুশ নিজেও জানত বলে মনে হয় না।’

    ‘বেচারি বুশ!’

    বুশের মৃত্যুতে এমনিই আমি আঘাত পেয়েছিলাম, এ খবরে মনটা আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল।

    ‘শুধু তাই নয়,’ বলল ক্রোল। ‘ক্লাইন যে একটা যুগান্তকারী আবিষ্কার করে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাবে সেটাও বুশ বুঝতে পেরেছিল। তাই সে আরও চাইছিল যাতে ক্লাইন না পিছু হটে।’

    সন্ডার্স কিছুক্ষণ থেকে একটু অন্যমনস্ক ছিল। আমি তাকে জিগ্যেস করলাম সে কী ভাবছে। সে বলল, ‘কিছুই না। একটা সামান্য খট্‌কা। আমার ধারণা ছিল আদিম মানুষ বুঝি বেঁটে হয়, কিন্তু এ দেখছি প্রায় পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চির কাছাকাছি।’

    আমি বললাম, ‘তার কারণ আর কিছুই নয়; এ মানুষ আদিম হলেও আসলে সে বিংশ শতাব্দীর প্রাণী। এর সব লক্ষণ হোমো অ্যাফারেনসিসের সঙ্গে মিলবে এটা মনে করা ভুল।’

    ‘তা বটে।’

    রাত হয়েছিল। তাই আমাদের কথা বেশিদূর এগোল না। ক্রোল বিদায় নেবার সময় বলে গেল, ‘এবার তোমার ড্রাগের কথাটা ক্লাইনকে বলো। ওর এলিক্সিরাম তো তোমার লাগবে। সে-ব্যাপারে আশা করি ও কোনো আপত্তি করবে না।’

    পণিনামে কী আছে জানি না, কিন্তু কাল সকালেই ক্লাইনকে আমার ড্রাগটা সম্বন্ধে বলতে হবে।

    সেপ্টেম্বর ১৮

    আজ সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে সকলের সামনে আমার এভলিউটিন-এর কথাটা বললাম। আমার চাকরের উপর পরীক্ষা করে কী ফল হয়েছে সেটাও জানালাম, আর সব-শেষে ক্লাইনের কাছে আমার আর্জি পেশ করলাম। —‘তোমার এলিক্সিরামের এক চামচ পেলেই মনে হয় আমার কাজটা সফল হবে। তার জন্য যা দাম লাগে, আমি দিতে রাজি।’

    ক্লাইন দেখলাম রীতিমত অবাক হল আমার ওষুধটার কথা শুনে। বলল, ‘এক চামচ এলিক্সিরামের জন্য দাম দেবার কথা বলছ? কী-রকম মানুষ তুমি? কিন্তু এই ওষুধ তৈরি হলে তুমি কার উপর পরীক্ষা করবে? সে লোক কোথায়?’

    আমি হেসে বললাম, ‘কেন, তোমার হোমো অ্যাফারেনসিস তো রয়েছে। তার উপর পরীক্ষা করলে সে আধ ঘণ্টার মধ্যে আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েনসে পরিণত হবে।’

    আমি ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল আমার কথাটা শুনে ক্লাইনের চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল। সে বলল, ‘এর অ্যান্টিডোট তুমি তৈরি করেছ, যাতে সেটা খাইয়ে মানুষকে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়?’

    আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘সে ব্যবস্থাও আছে।’

    ‘তুমি দেখছি খুব থরো,’ বলল ক্লাইন। ‘যাই হোক, আমার একটা ব্যাপার আছে, সেটা আমি বলিনি—আমি জ্যোতিষে বিশ্বাস করি। আজকের দিনটা এই জাতীয় পরীক্ষার পক্ষে ভাল নয়। তোমাকে আমি এলিক্সিরাম দেব কাল। কাল সকালে।’

    ব্রেকফাস্টের পর আমরা আবার আদিম মানুষটিকে দেখতে গেলাম। আজ দেখলাম তার ভয় অনেকটা কমে গেছে। সে আমাদের দশ হাতের মধ্যে এগিয়ে এসে আমাদের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। আমার উপর দৃষ্টি রাখল প্রায় দু’মিনিট। তারপর মুখ দিয়ে একটা রুক্ষ শব্দ করল, যদিও তার মধ্যে রাগের কোনো চিহ্ন ছিল না।

    আমার মন থেকে কিন্তু খট্‌কা যাচ্ছে না। অ্যাফারেনসিসের এই বিশেষ নমুনাটিকে দেখলেই আমি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। কেন তা বলতে পারব না। হয়তো বয়সের সঙ্গে আমার চিন্তাশক্তিও কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।

    সেপ্টেম্বর ১৮, রাত দশটা

    আজ ডিনার খাবার পর থেকে গা-টা কেমন গুলোচ্ছিল। শুধু গা গুলোচ্ছিল বললে ভুল হবে, সেইসঙ্গে মাথাটাও কেমন জানি গোলমাল লাগছিল, চিন্তা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। আমার সঙ্গে আমারই তৈরি আশ্চর্য ওষুধ মিরাকিউরল ছিল। তার এক ডোজ খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলাম। এরকম আমার কখনও হয় না। আজ কেন হল?

    দশ মিনিটের মধ্যে দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখি সন্ডার্স আর ক্রোল। ক্রোল বলল, ‘আজ ডিনারে আমাদের পানীয়তে বোধহয় কিছু মেশানো ছিল। মাথাটা ঘুরছে, চিন্তা সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।’

    সন্ডার্স বলল, ‘আমারও সেই অবস্থা।’

    আমি দু’জনকেই মিরাকিউরল খাইয়ে সুস্থ করলাম।

    কিন্তু অন্য তিনজনের কী হবে?

    আমরা তিনজন ওষুধ নিয়ে ছুটলাম। ওদের ঘর জানা ছিল, দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলিয়ে সকলকেই ওষুধ দিলাম। সকলেরই একই অবস্থা। পেট্রফ ভাল ইংরিজি জানে, আমাদের সঙ্গে ইংরিজিতেই কথা বলে, কিন্তু এখন সে রাশিয়ান ছাড়া কিছুই বলছে না—তাও আবার ব্যাকরণে ভুল। বার্তেল্লি তার ভাষায় কেবল ‘মাম্মা মিয়া, মাম্মা মিয়া’ অর্থাৎ ‘মাগো, মাগো’ বলছে, আর আমাদের ফরাসি বন্ধু কোনো কথাই বলছে না, কেবল ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে সামনের দিকে চেয়ে আছে। যাই হোক, আমার আশ্চর্য ওষুধের গুণে সকলেই সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল।

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    প্রশ্ন হল—এখন কী কর্তব্য। ক্লাইন কি কোনো কারণে আমাদের পিছনে লেগেছে? কিন্তু কেন? আমায় বাধা দেওয়ায় তার আগ্রহ হবে কেন, আর সেইসঙ্গে অন্য সকলের উপরেও আক্রোশ কেন?

    এ নিয়ে এখন ভেবে লাভ নেই। আমরা পরস্পরের কাছে বিদায় নিয়ে যে যার ঘরে ফিরে এলাম।

    আর তার পরেই আমার মনের খটকার কারণটা বুঝতে পারলাম, আর সেইসঙ্গে বুঝলাম যে, আমার এভলিউটিন ওষুধ যথাশীঘ্র সম্ভব তৈরি করা দরকার।

    কিন্তু ক্লাইনের সঙ্গে আমাদের যা সম্পর্ক, সে কি আমাদের কোনো রকমে সাহায্য করবে?

    সেটা কাল সকালের আগে জানা যাবে না।

    সেপ্টেম্বর ১৯

    আজ সকালে ব্রেকফাস্টে নামতেই ক্লাইন জিগ্যেস করল, ‘কাল তোমরা সুস্থ ছিলে? আমার শরীরটা কিন্তু খুব খারাপ হয়েছিল। মনে হয় কোনো খাবারে কোনো গোলমাল ছিল।’

    আমরা অবিশ্যি সকলেই স্বীকার করলাম যে, আমাদেরও শরীরটা খারাপ হয়েছিল এবং ওষুধ খেয়ে তবে সুস্থ হয়েছি।

    ‘কী ওষুধ খেলে?’ জিগ্যেস করল ক্লাইন।

    ‘প্রোফেসর শঙ্কুর তৈরি একটা ওষুধ,’ বলল সন্ডার্স।

    ‘আহা, আমি জানলে তো আমিও খেতাম,’ বলল ক্লাইন। ‘আমাকে সারা রাত ছটফট করতে হয়েছে। আজ সকালে ছ’টার পরে অনুভব করলাম উদ্বেগটা কেটে গেছে।’

    আমি বললাম, ‘ভাল কথা, আজ যদি এলিক্সিরামটা পাই তাহলে খুব কাজ হয়।’

    ‘বেশ তো, ব্রেকফাস্টের পরই দেব তোমায়।’

    ব্রেকফাস্টের পর ক্রোল, সন্ডার্স আর পেট্রফ একটু বেড়াতে বেরোল।

    বার্তেল্লি আর রামো বলল যে, তারা আজ আদিম মানুষের কয়েকটা ছবি তুলবে। মানুষটা যখন ভয় কাটিয়ে উঠে কাছে আসতে শুরু করেছে, তখন ভাল ছবি উঠবে।

    ক্লাইনের সঙ্গে আমি গেলাম ল্যাবরেটরিতে। ক্লাইন তাক থেকে একটা এলিক্সিরামের শিশি নামাতেই দেখলাম ওষুধ পালটানো হয়েছে। এর চেহারা এবং গন্ধ এলিক্সিরামের নয়। এলিক্সিরামে একটা খুব হালকা নীলের আভাস পাওয়া যায়; এটা একেবারে জলের মতো দেখতে। আমার চোখে ধূলো দেওয়া অত সহজ নয়।

    তবে বাইরে আমি কিছু প্রকাশ করলাম না। একটা ঢাকনাওয়ালা পাত্রে তরল পদার্থটার এক চামচ নিয়ে ঢাকনা বন্ধ করে দিলাম।

    ব্যর্থমনোরথ হওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই নিজের ঘরে চলে এলাম। আজ আর আদিম প্রাণীটাকে দেখতে ইচ্ছা করছিল না। আমার গবেষণা সার্থক হতে হতে হল না। এর চেয়ে আপসোসের আর কী হতে পারে? অবিশ্যি শহরে খোঁজ করলে ড্রাগিস্টের দোকানে নিশ্চয়ই এলিক্সিরাম পাওয়া যাবে, কিন্তু সে-ব্যাপারে যে ক্লাইন ব্যাগড়া দেবে না তার কী স্থিরতা?

    সাড়ে দশটায় দরজায় টোকা পড়ল। খুলে দেখি সন্ডার্স আর ক্রোল।

    ‘ড্রাগ নিয়েছ?’ প্রশ্ন করল ক্রোল।

    বললাম, ‘নিয়েছি, কিন্তু সেটা আসল জিনিস নয়। ভেজাল।’

    ‘সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম। এই নাও তোমার এলিক্সিরাম।’

    ক্রোল পকেট থেকে একটা শিশি বার করে আমাকে দিল।

    আমার ধড়ে প্রাণ এল। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ওষুধের সঙ্গে এক চামচ এলিক্সিরাম মিশিয়ে দিলাম।

    ‘কিন্তু এটা তুমি কার উপর প্রয়োগ করতে চাও?’ জিগ্যেস করল সন্ডার্স।

    আমি বললাম, ‘যার উপর করলে একটা বিরাট রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। কিন্তু এখন নয়। রাত্রে।’

    ক্রোল আর সন্ডার্সের অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও আমি কী করতে যাচ্ছি সেটা বললাম না।

    দুপুরে লাঞ্চের সময় ক্লাইন বলে পাঠাল যে, তার শরীরটা আবার খারাপ হয়েছে, তাকে যেন আমরা ক্ষমা করি এবং তাকে ছাড়াই খেয়ে নিই।

    বিকেলে আমরা সকলে হামবুর্গ শহর দেখতে বেরোলাম। সন্ধ্যা সাতটায় ফিরে এসে জানলাম যে, ক্লাইন সুস্থ, একটু বেরিয়েছেন এবং ডিনারের আগেই ফিরবেন।

    আমার কেন জানি বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। ক্লাইন বেরিয়েছে? সে একা, না তার সঙ্গে আর কেউ গেছে?

    আমি বাকি পাঁচজনের দিকে চেয়ে বললাম, ‘আমি একটা গোলমালের আশঙ্কা করছি। আমাদের একবার দেখা দরকার আদিম মানুষটা তার খাঁচায় আছে কি না। তোমরা এক মিনিট অপেক্ষা করো, আমি আমার অস্ত্রটা নিয়ে নিই, কারণ কী ঘটবে কিছুই বলা যায় না।’

    আমার অ্যানাইহিলিন পিস্তলটা যে আমি সব সময় সঙ্গে নিয়ে সফরে যাই তা নয়, কিন্তু এবার কেন জানি নিয়ে এসেছিলাম। বাক্স থেকে সেটা বার করে নিয়ে বাকি পাঁচজনকে নিয়ে ছুটলাম বাড়ির উত্তর দিকে লোহার শিকে ঘেরা অ্যাফারেনসিসের খাঁচার উদ্দেশে।

    শিকের এক জায়গায় একটা লোহার গেট, সেখান দিয়েই ভিতরে ঢুকতে হয়। গেটের সমানে সশস্ত্র প্রহরী দাঁড়িয়ে রয়েছে—ক্লাইনের বিশ্বস্ত রুডলফ। আমাদের দেখে সে রিভলভার বার করল। কী আর করি—আমার অ্যানাইহিলিনের সাহায্যে তাকে অস্ত্রসমেত নিশ্চিহ্ন করে দিতে হল।

    এখন পথ খোলা। আমরা ছয়জন ঢুকলাম খাঁচার মধ্যে। কিন্তু মিনিটখানেক এদিক ওদিক দেখেই বুঝলাম যে, আদিম মানুষ নেই। অর্থাৎ ক্লাইন তাকে নিয়েই বেরিয়েছে।

    এবারে ক্রোল তার তৎপরতা দেখাল। সে বাড়ির ভিতর গিয়ে সোজা পুলিশ স্টেশনে ফোন করল। ক্লাইনের ডেমলার গাড়ির নম্বরটা আমার মনে ছিল। সেটা ক্রোল পুলিশকে জানিয়ে দিয়ে বলল, এ-গাড়ির জন্য এক্ষুনি যেন অনুসন্ধান করা হয়।

    বিশ মিনিট লাগল পুলিশের কাছ থেকে উত্তর আসতে। কোনিগস্ট্রাসে আর গ্রুনবার্গস্ট্রাসের সঙ্গমস্থলে গাড়িটা ধরা পড়েছে, ক্লাইন রিভলভার দিয়ে একটি পুলিশকে জখমও করেছে। ক্লাইনের সঙ্গে একটি বুনো লোক রয়েছে, দু’জনকেই পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছে, আমরা যেন সেখানে যাই।

    ফোন করে দুটো ট্যাক্সি আনিয়ে আমরা ক’জন পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। ক্লাইনকে জেরা করা হচ্ছে, আমরা দেখতে চাইলাম বুনো মানুষটিকে। একটি কনস্টেবল আমাদের একটা ভিতরের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে আসবাব বলতে একটিমাত্র টেবিল আর একটি চেয়ার। মেঝের এক কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে আমাদের পরিচিত হোমো অ্যাফারেনসিস ঘুমোচ্ছে।

    আমি আমার পকেট থেকে একটা বাক্স বার করে ঘুমন্ত মানুষটির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাক্সে ইনজেকশনের সব সরঞ্জাম আর আমার এভলিউটিন ড্রাগ ছিল। ড্রাগটা সিরিঞ্জে ভরে ঘুমন্ত মানুষটির লোমশ হাতে একটা ইনজেকশন দিয়ে দিলাম।

    তারপর গভীর উৎকণ্ঠায় আমরা ছয়জন বৈজ্ঞানিক ইনজেকশনের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

    পাঁচ মিনিটের মধ্যেই রূপান্তর শুরু হল। গায়ের লোম মিলিয়ে এল, কপাল প্রশস্ত হল, চোয়াল বসে গেল, চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এল, শরীরের মাংসপেশী কমে এল।

    পনের মিনিটের মাথায় বোঝা গেল, আমরা যাকে দেখছি সে ব্রেজিলের কোনো উপজাতির অন্তর্গত নয়; সে ইউরোপের অধিবাসী, তার গায়ের রং আমার বন্ধুদেরই মতো। তার মাথার চুল সোনালি, তার শরীর দেখলে মনে হয় না তার বয়স ত্রিশের বেশি, তার নাক-চোখে বোঝা যায় সে সুপুরুষ।

    ‘মাইন গট্‌!’ বলে উঠল ক্রোল। ‘এ যে হেরমান বুশ!’

    আমি এবার আরেকটা ইনজেকশন দিয়ে বিবর্তন বন্ধ করে দিলাম। তারপর হাত দিয়ে ঠেলা দিতেই বুশ ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চোখ কচলে জার্মান ভাষায় প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কে? আমি কোথায়?’

    আমি বললাম, ‘আমরা তোমার বন্ধু। তোমার যে শত্ৰু সে এখন পুলিশের জিম্মায়। এবার বলো তো ক্লাইন কী এক্সপেরিমেন্ট করছিল?’

    ‘ওঃ!’ বুশ কপাল চাপড়াল। ‘হি ওয়াজ প্রিপেয়ারিং দ্য ড্রাগ অব সেটান।’ অর্থাৎ সে শয়তানের দাওয়াই তৈরি করছিল। ওটা ইনজেক্ট করলে মানুষ বিবর্তনের পথে পিছিয়ে যেত। ক্লাইন সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে আমাকে ব্রেজিলে নিয়ে যায়। তারপর একদিন সুযোগ পেয়ে আমাজন নদীতে আমাদের জাহাজের একটা ঘরে আমাকে রিভলভার দেখিয়ে জোর করে ইনজেকশনটা দেয়। তারপর কী হয়েছে আমি জানি না। —কিন্তু তোমরা…তোমাদের তো অনেককেই চিনি দেখছি। ইউ আর প্রোফেসর শঙ্কু, তাই না?’

    শঙ্কু ও আদিম মানুষ

    ‘তাই। এবার আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।’

    ‘কী?’

    ‘তুমি তো লেফ্‌ট-হ্যাণ্ডেড—তাই না? আমার ডায়রিতে তুমি তো তোমার নামঠিকানা লিখে দিয়েছিলে। তখন থেকেই আমার মনে আছে।’

    ‘ইয়েস—আই অ্যাম লেফ্‌ট-হ্যাণ্ডেড।’

    আমার খটকার কারণ ছিল এটাই। আশ্চর্য এই যে, আমরা দু’জন বৈজ্ঞানিক প্রায় একই গবেষণায় লিপ্ত ছিলাম, ও যাচ্ছিল পিছন দিকে, আমি যাচ্ছিলাম ভবিষ্যতের দিকে। এখন দেখছি যে, বিবর্তন নিয়ে বেশি কৌতূহল প্রকাশ না করাই ভাল। যা হচ্ছে তা আপনা থেকেই হোক। আমার এভলিউটিনের শিশি আমার গিরিডির তাকেই শোভা পাবে—ওটা আর ব্যবহার করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে বর্তমান ক্ষেত্রে এটা কাজ দিয়েছে আশ্চর্যভাবে।

    ক্লাইনের নিস্তার নেই, কারণ তার গুলিতে যে পুলিশটি জখম হয়েছিল, সে এইমাত্র মারা গেছে।

     

    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপুনশ্চ প্রোফেসর শঙ্কু – সত্যজিৎ রায়
    Next Article শঙ্কুর পরলোকচর্চা

    Related Articles

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    ফেলুদা এণ্ড কোং – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বাক্স রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }