Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প942 Mins Read0

    ৭৬-শেষ. অজস্র মালপত্র

    ৭৬.

    এস এস মহারাজায় নানা ধরনের অজস্র মালপত্র বিকেলে তুলে ফেলা হয়েছিল। তারপর সাধারণ যাত্রী এবং উদ্বাস্তুরা উঠেছে। সবার শেষে উঠেছে বিভাস, নিরঞ্জন, বিনয় এবং কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন বিভাগের আরও কয়েকজন কর্মচারী, একজন ডাক্তার, একজন নার্স। হিরন্ময়রা, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা কিছুক্ষণের জন্য জাহাজে উঠে উদ্বাস্তুদের। অঢেল ভরসা, প্রচুর আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিয়েছেন। আন্দামানে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এবং এখানকার সরকার সবসময় শরণার্থীদের পাশে থাকবে। শত শত ছিন্নমূল মানুষের স্থান তাদের হৃদয়ে। দ্বীপপুঞ্জে গিয়ে তারা যদি কোনওরকম অসুবিধে বা বিপদ আপদে পড়ে, খবর পাওয়ামাত্র হিরন্ময়রা দৌড়ে যাবেন। তৎক্ষণাৎ তাদের সমস্ত সমস্যার সুরাহা করে আসবেন। চোখের আড়ালে গেলেই যে পশ্চিমবঙ্গবাসীরা তাদের ভুলে যাবে, এমন চিন্তা কেউ যেন মাথায় না আনে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

    হিরন্ময় নেমে যাবার পর জাহাজের সিঁড়ি তুলে নেওয়া হয়েছিল। এখন কেউ আর উঠতে বা নামতে পারবে না।

    মহারাজার লোয়ার ডেকের তলায়, অর্থাৎ জাহাজের খোলের ভেতর চুরানব্বইটা ডি পি ফ্যামিলির থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা মেয়েপুরুষ নিয়ে মোট চার শ বিরাশি জন। লোয়ার ডেকের দুধারে পয়সাওলা প্যাসেঞ্জার এবং উঁচু পোস্টের সরকারি বে-সরকারি অফিসারদের জন্য বেশ কটা কেবিন। বাকি প্যাসেঞ্জাররা–যাদের অল্প দামের টিকেট তারা থাকবে ডেকে। লোয়ার ডেকের মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্জিন-ঘর। ধোঁয়া বার করে দেবার জন্য গোলাকার বিশাল চিমনি সোজা ওপর দিকে উঠে গেছে। চিমনির সামনে খানিকটা এলাকা খোলা। সেখানে অগুনতি ডেক চেয়ার পাতা। দীর্ঘ সুমদ্রযাত্রায় যাত্রীরা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে কখনও কখনও সময় কাটায়। জাহাজের দুই প্রান্ত বুক-সমান হাইটের মজবুত লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা। এই ডেকেরই পেছন দিকের অনেকটা অংশ জুড়ে কিচেন, মস্ত ডাইনিং হল এবং খালাসিদের থাকার জন্য ছোট ছোট কুঠুরি।

    লোয়ার ডেক থেকে তিরিশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে আপার ডেক। এখানেও বেশ কটা কেবিন রয়েছে। এগুলো জাহাজের ক্যাপ্টেন, ডেপুটি ক্যাপ্টেন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার, তার সহকারী, ওয়ারলেস অপারেটর, ডাক্তার এবং খুব বেশি দামের টিকেটওলা কিছু প্যাসেঞ্জারদের জন্য। এখানে রয়েছে অগুনতি লাইফ-বেল্ট। কোনও দুর্ঘটনায় জাহাজ ডুবি হলে সেগুলো আঁকড়ে সমুদ্রে ভেসে থাকা যায়। লোয়ার ডেকে যে চিমনিটা রয়েছে সেটাই এখানকার ছাদ ফুঁড়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। এই ডেকের চার ভাগের তিন ভাগ খোলা, লোয়ার ডেকের চাইতেও অনেক বেশি ডেক চেয়ার সামনের দিকে সাজিয়ে রাখা আছে। পেছনের অংশে জাহাজের অফিস।

    .

    এখন সাতটার মতো বাজে। গোটা জাহাজ জুড়ে সব আলো জ্বলে উঠেছে। আশেপাশে আরও কটা জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোতে তো বটেই, জেটিতে এবং ডকের যেখানে যতদূর চোখ যায়–শুধু আলো আর আলো।

    কেবিনের টিকেট বিনয়ের। লোয়ার ডেকের একটা ছোট কেবিন তার জন্য রিজার্ভ করা হয়েছে। তার তিনটে কেবিন পর একটা মাঝারি কেবিন বিভাস আর নিরঞ্জনের।

    মিনিট খানেক হল নিজের কেবিনে এসেছে বিনয়। বিভাস, নিরঞ্জন আর কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য কর্মচারীরা কেউ লোয়ার ডেকে আসেনি। সবাই উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আরও নিচে জাহাজের খোলে চলে গেছে।

    বিনয়েরও ওদের সঙ্গে যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হাতে লটবহর ঝুলিয়ে যাওয়াটা ঝাটের ব্যাপার। জাহাজে উঠে আঙুল বাড়িয়ে তার কেবিনটা দেখিয়ে দিয়েছিল নিরঞ্জন। তাই নিজের কেবিনে চলে আসতে তার অসুবিধে হয়নি।

    পৃথিবীর কোনও দিকেই এখন নজর নেই বিনয়ের। মাথার ভেতর অবিরল পাক খেয়ে চলেছে একটাই চিন্তা-ঝিনুক। চোখের সামনে স্থির দাঁড়িয়ে একটাই ছবি–ঝিনুক। সুটকেস নামিয়ে, ত্বরিত হাতে হোল্ড-অলটা খাঁটিয়া ধরনের একটা বেডে ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।

    বিনয় এর মধ্যে জেনে গেছে, লোয়ার ডেকে বিশাল ইঞ্জিন রুমের পেছন দিকে একজোড়া গোলাকার সুড়ঙ্গ রয়েছে। ওই দুটো দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে জাহাজের খোলে। সুমদ্রযাত্রায় সেটাই উদ্বাস্তুদের আস্তানা।

    বিনয় সিঁড়ি ভেঙে পাতালে নেমে এল। এখানে জাহাজের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি পুরু কাঠের পাটাতনে ঢাকা। একধারে উঁচু রেলিং-ঘেরা এলাকায় স্থূপাকার মালপত্র। বিকেলে জেটি থেকে কুলিদের এ-সব তুলে আনতে দেখেছিল সে। বাকি অংশটায় অনেকখানি জায়গা জুড়ে শোওয়ার জন্য সারি সারি বাঙ্ক। একটার ওপর একটা। রেলের কামরায় যেমনটা দেখা যায়। বাঙ্ক ছাড়াও প্রচুর ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। সেখানে উদ্বাস্তুরা তাদের লটবহর নিয়ে ঠাসাঠাসি করে বসে ছিল। জেটিতে লোকগুলোর চোখেমুখে যেটুকুও চাঙ্গা ভাবা ছিল, জাহাজে ওঠার পর সেটাও বুঝি বা লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ নিচু গলায় কথা বলছিল। তবে বেশির ভাগই ধন্দ-ধরা। বাচ্চাগুলো তাদের মায়েদের আঁকড়ে ধরে চুপচাপ হয়ে গেছে। আন্দামানে যাওয়াটা সমীচীন হল কি না, তারা যেন। বুঝে উঠতে পারছে না। তাদের ঘিরে অনিশ্চয়তা, ভয় এবং তীব্র দুর্ভাবনা।

    এদিকে নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা অবিরাম উদ্বাস্তুদের সজীব রাখতে চাইছে।

    নিরঞ্জন বলছিল, এই কি, আপনেরা একহানে দলা পাকাইয়া রইছেন ক্যান? হাত মুখ ধুইয়া লন। বাঙ্কে হগলের জাগা অইব না। নিচেও অনেকের হুইতে হইব। নেন, নেন, উইঠা, বিছানা পাইতা ছানের (চানের) ঘরে গিয়া হাতমুখ ধুইয়া লন। আটটায় রাইতের খাওন (খাবার) দেওয়া অইব।

    বিভাস বলছে, অত মনমরা অইয়া থাকলে চলে? য্যান শ্মশানযাত্রী। আরে বাবা, আন্দামানে গ্যালে জমিন পাইবেন, নিজেগো বাড়িঘর হইব। কত বড় লাভ কন দেখি। মনে ফুর্তি আনেন। আনন্দ করেন

    প্রথম থেকেই বিনয় দেখে আসছে পুনর্বাসন বিভাগের এই দুই যুবক, বিশেষ করে নিরঞ্জন শরণার্থীদের আন্দামানে নিয়ে যাবার ব্যাপারে উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটছে। যুগলের মুখটা নতুন করে মনে পড়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের উৎখাত হয়ে আসা মানুষজনকে তুলে এনে বিপুল পরিশ্রমে আর অসীম যত্নে মুকুন্দপুরে নতুন এক পূর্ববঙ্গ সৃজন করে চলেছে সে। অবিকল তারই মতো নিরঞ্জনও চাইছে বঙ্গোপসাগরের সুদূর দ্বীপমালায় হাজার বছরের অরণ্য নির্মূল করে গড়ে তুলবে পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূলদের জন্য নতুন বাসভূমি। পশ্চিম বাংলার বাইরে সমুদ্রের মাঝখানে আর-এক বাংলা। একান্তভাবেই বাঙালিদের জন্য। চকিতে নাড়া দিয়েই ভাবনাটা চকিতে মিলিয়ে গেল।

    বিনয় পায়ে পায়ে উদ্বাস্তুদের দিকে এগিয়ে যায়। নিরঞ্জনরা তাকে দেখতে পেয়েছিল। জিজ্ঞেস করে, আইয়া পড়ছেন?

    বিনয় আস্তে মাথা নাড়ে। নিরঞ্জনরা আর কোনও প্রশ্ন না করে বিপুল উদ্যমে ফের ম্রিয়মাণ উদ্বাস্তুদের সজীব করে তুলতে থাকে।

    হলধর কোত্থেকে যেন উঠে এসে বিনয়ের পাশে দাঁড়ায়। উৎকণ্ঠিত মুখ। বলে, ছুটোবাবু, এতক্ষণ কই আছিলেন? আপনেরে না দেইখা জবর ডরাইয়া গ্যাছিলাম

    বিনয় বলল, আমার টিকেট ওপরের তলায়। সেখানে বাক্স-বিছানা রেখে এলাম। তাই একটু সময় লাগল–

    ছুটোবাবু, আমাগো জাহাজের এই গাদে (গর্তে) হান্দাইয়া (ঢুকিয়ে) দিছে। ইন্দুরের লাখান ফান্দে আটকাইয়া থাকতে অইব। চাইর দিক বন্দ। দম বন্দ অইয়া হগলটি মরুম–

    না– জোরে জোরে মাথা নাড়ে বিনয়। সিলিংয়ে পুরু টিনের তৈরি বিরাট বিরাট উইন্ড ব্লোয়ার। সেগুলো দেখিয়ে বলে, এখানে বাতাসের অভাব হবে না। ওগুলো দিয়ে সারাক্ষণ হাওয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারও মারা যাবার ভয় নেই।

    এর মধ্যে উদ্বাস্তুদের জটলা থেকে আরও কয়েকজন উঠে এসেছিল। তাদের সবাইকে কাছাকাছি একটা ব্লোয়ারের ভোলা মুখ দেখিয়ে বলল, ওখানে গিয়ে দাঁড়ান। বুঝতে পারবেন, ওপর থেকে হাওয়া আসছে।

    হলধররা ব্লোয়ারটার দিকে এগিয়ে যায়। বিনয় ওদের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিকই, কিন্তু তার নজর খানিক দূরের বাকি উদ্বাস্তুদের দিকে। সে সোজা সেখানে চলে যায়। পুরুষ এবং বাচ্চাকাচ্চাদের সম্বন্ধে তার লেশমাত্র আগ্রহ নেই। বিনয়ের একমাত্র লক্ষ্য-মেয়েদের মুখ। বেশির ভাগেরই মুখ খোলা। তবে বেশ কয়েকজনের ঠোঁট অবধি ঘোমটা টানা।

    পুরো জমায়েতের চারপাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েগুলোকে দেখল বিনয়। কিন্তু না, ঝিনুককে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে যে সামান্য সংশয় থেকে গিয়েছিল সেটাকে প্রায় উড়িয়েই দিল সে। ঝিনুক ঘোমটা টেনে বসে আছে তা ভাবাই যায় না। সে অসূর্যস্পশ্যা নয়।

    বিনয়ের মনে হল, সে যে একটি মেয়ের মুখে ঝিনুকের আদল দেখেছিল সেটা তার নিজেরই চোখের ভ্ৰম, অস্থির মনের বিভ্রান্তি। সেই বিকেল থেকে যে প্রবল উৎকণ্ঠা তাকে ব্যাকুল করে রেখেছিল, এখন তার অবসান ঘটেছে।

    ভিড়ের ভেতর ঝিনুককে খোঁজাখুজি করতে অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। বিনয় নিরঞ্জনদের কাছে ফিরে এল।

    এদিকে নিরঞ্জনদের তাড়ায় এখানকার সারি সারি চানঘরগুলো থেকে উদ্বাস্তুরা হাত-পা মুখটুখ ধুয়ে এসেছিল। বিছানাও পেতে ফেলেছে। বাঙ্কে যাদের জায়গা হয়নি তারা মেঝের পাটাতনে শোওয়ার ব্যবস্থা করেছে।

    এখন নিরঞ্জন আর বিভাসের অ্যাসিস্টান্টরা এবং জাহাজের কিচেনের লোকজন উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে বসিয়ে সিলভারের থালা-বাটিতে রাতের খাবার দিচ্ছে। ভাত, ডাল আর ডিমের ঝোল। পরে একটা করে পানতুয়া।

    খাওয়াদাওয়া চুকতে নটা বেজে গেল।

    নিরঞ্জন তার ত্রাণবিভাগের সহকারীদের বলল, তুমরা ডাইনিং হলে গিয়া অহনই খাইয়া আসো। তোমাগো খাওন হইলে আমরা উপুরে খাইতে যামু। তুমরা রিফুজগো লগে রাইতে এইহানে থাকবা। আমরা থাকুম লোয়ার ডেকের ক্যাবিনে। কিছু দরকার অইলে লগে লগে (তক্ষুনি) আমাগো খবর দিবা। এতগুলান মাইনষের বাঁচা-মরার দায়িত্ব আমাগো। হগল দিকে নজর রাখবা।

    সহকারীরা খেয়ে এলে বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে নিরঞ্জন আর বিভাস খাবার ঘরে চলে গেল।

    .

    সেদিন দমদমের ত্রাণশিবিরগুলোতে যাবার পর থেকে মাঝখানের কটা দিন নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়নি বিনয়। জিনিসপত্র কেনাকাটা, গোছগাছ, দিদিদের বাড়ি যাওয়া, এমনি নানা ব্যাপারে প্রচুর ধকল গেছে। আজও খিদিরপুর ডকে এক লহমা বসে যে একটু জিরিয়ে নেবে, তেমন ফুরসত মেলেনি। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। ক্লান্তিতে সারা শরীর ভেঙে আসছে, ছিঁড়ে পড়ছে স্নায়ুমণ্ডলী। নিরঞ্জন আর বিভাসের হাল তার চেয়ে অনেক বেশি কাহিল। উদ্বাস্তুদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে চোখের সামনে রঙিন স্বপ্নের হাজারো ছবি টাঙিয়ে জাহাজে তোলা যে কী দুরূহ ব্যাপার, বিনয় তা ভাল করেই জানে। আন্দামানে গেলে অঢেল আরাম, অঢেল আনন্দ, অফুরান সুখ। এমনি কত কত রূপকথা যে নিরঞ্জনদের বানাতে হয়েছে।

    খাওয়া সেরে নিরঞ্জন বিনয়কে বলল, শরীলে আর দিতে আছে না। অহন বিছানায় কাইত অইয়া পড়ন লাগে। আপনেও যান –

    নিজের কেবিনে এসে ক্ষিপ্র হাতে উঁচু খাঁটিয়ায় বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে বিনয়। এস এস মহারাজা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। কখন সেটা ছাড়বে, কে জানে।

    শোবার সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে আসতে থাকে বিনয়ের। তারই মধ্যে কাঁচের জানালা দিয়ে সে দেখতে পায়, আলোয় আলোয় খিদিরপুর ডক যেন আশ্চর্য এক ইন্দ্রপুরী।

    .

    ৭৭.

    ঘুমটা আচমকাই ভেঙে গেল পাঁচমেশালি আওয়াজে। বহু মানুষের ত্রস্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। আসছে দুদ্দাড় ছোটাছুটির শব্দ। তার মধ্যেই কারা যেন হিন্দিতে তাড়া দিয়ে চলেছে। সাইক্লোন আতি হ্যায়। সব কোঈ নিচা হোলমে চলা যাও। জলদি কর–সেই সঙ্গে দশ দিগন্ত কাঁপিয়ে গাঁ গাঁ অবিরল আওয়াজ। লক্ষ কোটি দানব যেন অবিরাম গজরে চলেছে। তাছাড়া উঠে আসছে প্রবল ধকধকানির মতো শব্দ। একটানা, বিরতিহীন।

    ধড়মড় করে উঠে বসল বিনয়। শিয়রের দিকের জোড়া কাঁচের জানালা জাহাজের দেওয়ালের গায়ে আটকানো। তার বাইরে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। যতদূর চোখ যায়, কেউ যেন ঘন আলকাতরার পোঁচ লাগিয়ে দিয়েছে। যে-বেডটায় সে বসে আছে সেটা প্রচণ্ড দুলছে।

    প্রথমটা বিনয় খেয়াল করতে পারল না, এই মুহূর্তে সে কোথায় রয়েছে। নিজের অজান্তে তার মস্তিষ্কে স্বয়ংক্রিয় কোনও নিয়মে চিতা চলছিলই। চকিতে মনে পড়ে গেল এস এস মহারাজা জাহাজে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আন্দামান চলেছে। কিন্তু কাল রাতে শোবার সময় আলোকোজ্জ্বল খিদিরপুর ডক। চোখে পড়েছিল। এখন তার চিহ্নমাত্র নেই। জানালার বাইরে শুধুই অন্ধকার।

    এটা টের পাওয়া যাচ্ছে, বিশাল জলযান ঢেউ কেটে কেটে ছুটে চলেছে। সে যখন গভীর ঘুমে সেইসময় হয়তো জাহাজ রওনা হয়েছিল। একটানা ধকধকানি যেটা শোনা যাচ্ছে তা ইঞ্জিনের আওয়াজ। তাছাড়া জাহাজের বিশাল বিশাল চাকাগুলোর জল কাটার গম্ভীর ঘড়র ঘড়র আওয়াজটাও এখন বোঝা যাচ্ছে। এর সঙ্গে সাঁ সাঁ শব্দটা কীসের, আন্দাজ করা যাচ্ছে না।

    এখন কি রাত? কিন্তু আকাশে চাঁদ বা একটি নক্ষত্রও চোখে পড়ে না। জানালার বাইরে সমস্ত কিছুই আঁধারে বিলীন। সেদিকে দিশেহারার মতো তাকিয়ে কী করবে, বিনয় যখন ভাবছে, দরজায় দমাদ্দম ধাক্কা পড়ল।

    বিনয়বাবু-বিনয়বাবু

    নিরঞ্জনের গলা। বেড থেকে লাফিয়ে নেমে এসে দরজা খুলে দেয় বিনয়।

    নিরঞ্জন এস্তভাবে বলল, তরাতরি নিচে চলেন। সাইক্লোন অহনই আইয়া পড়ব

    সাইক্লোনের কথাটা আগেও আবছাভাবে কানে এসেছে। কারা যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যাত্রীদের সতর্ক করে দিয়ে নিচে যেতে বলছিল।

    কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে বিনয়। তক্ষুনি চোখে পড়ে আপার ডেক আর লোয়ার ডেকের আতঙ্কগ্রস্ত প্যাসেঞ্জাররা উদ্ভ্রান্তের মতো সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে, জাহাজের নিচে যেখানে উদ্বাস্তুরা রয়েছে সেখানে নেমে যাচ্ছে।

    কাল রাতে খিদিরপুরে জাহাজের কেবিনে বিনয় যখন শুয়ে পড়ে, দুর্যোগের আভাসমাত্র ছিল না। মেঘশূন্য আকাশ ছিল আশ্চর্য রকমের স্বচ্ছ। সেখানে স্ফটিক খণ্ডের মতো তারাগুলি জ্বল জ্বল করছিল। ঘুম ভাঙার পর যাকে আলকাতরার কালো পোচ মনে হয়েছিল তা হল স্তরে স্তরে ঘন মেঘ। সেই মেঘ চিরে ফেড়ে বিদ্যুৎ চমকে যাচ্ছে। বাজ পড়ছে মহুমূহু। কাল বাতাস বয়ে যাচ্ছিল ঝিরঝির করে। তার তেজ এখন কোটিগুণ বেড়ে গেছে। ঢেউ উত্তাল হয়ে উঠেছে।

    সুড়ঙ্গের মতো সেই পথ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে জাহাজের তলদেশে নামতে নামতে নিরঞ্জন জানায়, কাল মধ্য রাতে এস এস মহারাজা কলকাতা থেকে রওনা হয়েছিল। সমুদ্রের মোহানা পর্যন্ত নির্বিঘ্নেই চলে এসেছে। কিন্তু ভোর হতে না হতেই মেঘ জমতে শুরু করেছিল। বাতাসে দেখা দিয়েছিল খ্যাপামির লক্ষণ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের মাতামাতি বাড়তে লাগল।

    নিরঞ্জন বলতে থাকে, এই হালার বে অফ ব্যাঙ্গল পাগলাচণ্ডী সমুন্দর। হের মতিগতি বুঝন ভার। কহন যে চেইতা (ক্ষিপ্ত হয়ে উঠব, কেও জানে না।

    বিনয় জিজ্ঞেস করে, এখন কি দিন, না রাত্তির?

    দিন। দশটা সাড়ে-দশটা বাজে। ম্যাঘ কইরা আন্ধার হইছে বইলা দিন-রাইত ফারাক করা যায় না।

    জাহাজের খোলে ঢুকে দেখা গেল হুলস্থুল কাণ্ড। উদ্বাস্তুরা উন্মাদের মতো কপাল কি বুক চাপড়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। তাদের তুমুল আর্তনাদ সিলিং ভেদ করে ওপরে উঠে যাচ্ছে।

    কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে কয়েকজনের চিৎকার শোনা গেল। গরমেন আমাগেরে মারতি নিয়া যাতিছে। আমাগের আর রক্ষে নেই– কথা শুনে আঁচ করা যায় খুলনা কি যশোর অঞ্চলের লোজন।

    আর-একটি দল পাটাতনে উবু হয়ে বসে হাতজোড় করে সমস্বরে গেয়ে চলেছে, হরেকৃষ্ণ হরেরাম, হরেকৃষ্ণ হরেরাম। ভগমান আমাগো বাঁচাও

    অন্য একটা দলের কয়েকজন মেঝেতে মাথা ঠুকতে ঠুকতে ব্যাকুলভাবে বলে চলেছে, মা গঙ্গা, তুমার রোয় থামাও। আমাগো উপুর মুখ তুইলা তাকাও।

    এদিকে বেলা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডবও বেড়ে চলেছে। পাতালপুরীতে বসেও টের পাওয়া যাচ্ছে এক মাইল দুমাইল জুড়ে পর্বতপ্রমাণ এক-একটা ঢেউ বিশাল জলযানটাকে পলকে মোচার খোলার মত মহাশূন্যে তুলে নিয়ে পরক্ষণে আছড়ে নিচে নামিয়ে আনছে। জাহাজের পোর্টহোলগুলো জলের তলায়, তাই বাইরের কিছুই দেখা যচ্ছে না। তবু আঁচ করা যায়, ঝড় বইছে উদ্দাম গতিতে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে অঝোরে বৃষ্টি।

    ঝড়বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে চলছে রোলিং। জাহাজ কখনও ডাইনে হেলে পড়ছে, কখনও বাঁয়ে। কখনও সামনে, কখনও পেছনে। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, এই বুঝি ডুবে যায়।

    রেলিংয়ের ফল হয়েছে এই, প্রাণ বাঁচাতে যারা জাহাজের খোলে জড়ো হয়েছে তাদের অনেকেই হড়হড় করে বমি করে ফেলছে। বিশেষ করে উদ্বাস্তুরা। যে যা খেয়েছিল, পাকস্থলী তা ধরে রাখতে পারেনি। গলা দিয়ে ঠেলে সব বেরিয়ে এসেছে।

    তাণ্ডব কমতে দুপুর পেরিয়ে গেল।

    এখন আর উতরোল কান্না, চিৎকার বা অকূল প্রার্থনা, কিছুই শোনা যাচ্ছে না। উদ্বাস্তুরা বমিতে মাখামাখি হয়ে আচ্ছন্নের মতো এধারে ওধারে পড়ে আছে। উগ্র কটু গন্ধে ভরে গেছে জাহাজের খোল।

    কিন্তু রোলিং বা সাইক্লোন কিছুই যেন ছুঁতে পারেনি নিরঞ্জন আর বিভাসকে। দুর্যোগ কেটে গেলে তারা ডাক্তার ডেকে নিয়ে এল। তারপর তাদের সহকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে উদ্বাস্তুদের সারা গা ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে, ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিল।

    রোলিংয়ে ভীষণ কাবু হয়ে পড়েছিল বিনয়। তবু নিরঞ্জনদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোকে যতখানি পারল, শুশ্রূষা করল।

    ফের যখন নিরঞ্জনদের সঙ্গে বিনয় ওপরের ডেকে উঠে এল, বিকেল হয়ে গেছে। সারা গায়ে বমি লেগে আছে। এখন তার প্রথম কাজটি হল ভাল করে চান। তারপর টানা একটি ঘুম।

    .

    ৭৮.

    দুর্যোগের পর তিনটে দিন কেটে গেছে। বঙ্গোপসাগর আচমকা যেমন খেপে উঠেছিল, আচমকাই তেমনি শান্ত হয়ে গেছে। এই সমুদ্রের মেজাজ একেবারেই সৃষ্টিছাড়া। নিরঞ্জন বলেছিল, কখন যে তার মাথায় পাগলচণ্ডী ভর করবে, আর কখন যে সে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসবে, আগেভাগে তার হদিস মেলে না। সাইক্লোনের সময় কয়েকটা ঘণ্টা বঙ্গোপসাগর চোখের পলকে মহারাজা জাহাজটাকে আঙুলের ডগায় তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আকাশে, পরক্ষণে নামিয়ে আনছিল পাতালে। একবার আকাশ, একবার রসাতল। মনে হচ্ছিল, সমুদ্রের এই মারাত্মক খেলাটা চলতেই থাকবে, চলতেই থাকবে।

    প্রাণ বাঁচাতে যাদের জাহাজের খোলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের দুমড়ে মুচড়ে ঝাঁকিয়ে আর ক্রমাগত আছাড় মেরে মেরে সমুদ্র প্রায় সাবাড় করে এনেছিল। তবে সবচেয়ে কাবু হয়ে পড়েছিল উদ্বাস্তুরা। সাইক্লোনের পরও দুটো দিন ধন্দ-ধরা মানুষের মতো তারা হয় শুয়ে থেকেছে, নইলে ঝিম হয়ে বসে থেকেছে।

    তবে কাল থেকে এই মানুষগুলো খানিকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু কিছু খেলে পেটে রাখতে পারছে না। তক্ষুনি গলা দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। সি-সিকনেস।

    সাইক্লোনটা অবশ্য একদিক থেকে নিরঞ্জনদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। বিভাস দমদমের ক্যাম্পে গিয়ে আপেল আঙুর আর ডায়মণ্ডহারবারের পর থেকে চর পড়ার গল্প ফেঁদে এসেছিল, তাই নিয়ে উদ্বাস্তুরা নিশ্চয়ই ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করে দিত। কিন্তু সামুদ্রিক ঝড় তাদের মাথা থেকে সে-সব বার করে দিয়েছে।

    খবরের কাগজে চাকরি নেবার পর থেকে ভোরে ওঠাটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে বিনয়ের। আন্দামানের জাহাজেও তার হেরফের ঘটেনি।

    আজ সুর্যোদয়ের আগেই মুখটুখ ধুয়ে লোয়ার ডেকের সামনের দিকে একটা ডেকচেয়ারে বসে আছে সে।

    ভোরের দিকটায় বছরের এ-সময় বঙ্গোপসাগরে মিহি সিল্কের মতো অল্প অল্প কুয়াশা থাকে। তবে সেটা নজর আটকে দেবার মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য উঠবে। সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশার আবরণ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। কদিন ধরে তাই দেখছে সে।

    লোয়ার ডেকের এই ফাঁকা জায়গাটায় একাই রয়েছে বিনয়। জাহাজের লস্কর, স্টোকার, ইঞ্জিন অপারেটর–এরা ছাড়া এখনও কারও ঘুম ভাঙেনি। এমনকি সদাব্যস্ত, সারাক্ষণ তৎপর নিরঞ্জন এবং বিভাসও তাদের কেবিনে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

    বিনয়ের চোখের সামনে যতদূর চোখ যায়, সেই দিগন্ত অবধি, বিপুল জলরাশি। কোথাও এতটুকু মারমুখী ভাব নেই। সমুদ্র জুড়ে শুধু অপার প্রশান্তি। কে বলবে, এই বঙ্গোপসাগর কদিন আগে কী তাণ্ডবটাই না ঘটিয়ে দিয়েছিল!

    এস এস মহারাজা এগিয়ে চলেছে দূরন্ত গতিতে। ইঞ্জিনের ধকধকানি আর বিশাল বিশাল চাকার অবিশ্রান্ত জল কাটার আওয়াজ ছাড়া চরাচরের কোথাও কোনও শব্দ নেই।

    জাহাজের যাত্রীরা না জাগুক, পাখিদের কিন্তু এর মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেছে। এক ঝাক সি-গাল মহারাজা জাহাজের দুপাশে চক্কর দিতে দিতে চলেছে। আরও দূরে আকাশে উড়ছে অগুনতি পাখি। ওরাও কি সি-গাল? বিনয় বুঝতে পারল না।

    কলকাতায় থাকতেই বিনয় শুনেছিল, এস এস মহারাজা চারদিনে তাদের আন্দামানে পৌঁছে দেবে। কিন্তু আচমকা সাইক্লোনে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছনো সম্ভব নয়। একটা দিন বেশি লাগবে। জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এর ভেতর আলাপ হয়েছিল। ভদ্রলোক দক্ষিণ ভারতীয়। নাম ক্যাপ্টেন ওয়াই এস আইয়ার। দেরির কারণটা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাইক্লোনে যখন সমুদ্র জুড়ে বিরাট বিরাট আকাশছোঁয়া ঢেউ ওঠে তখন মুখোমুখি যুঝতে যুঝতে, কখনও পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগুতে হয়। ঢেউ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে গেলে মহা সর্বনাশ। বিশাল আকারের তরঙ্গগুলি চকিতে জাহাজকে। উলটে দেবে। নিশ্চিত ভরাডুবি ঠেকানো যাবে না। সমুদ্রের সঙ্গে লড়তে লড়তে সোজাসুজি আন্দামানের দিকে যেতে পারেনি এস এস মহারাজা। অনেকটা ঘুরপথে প্রায় বার্মার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। দুর্যোগ কাটলে পুরানো রুটে ফিরতে যথেষ্ট সময় লেগেছে।

    কাল ক্যাপ্টেন জানিয়েছিলেন, আজ দুপুরের আগেই এস এস মহারাজা আন্দামানে পৌঁছে যাবে। নিরঞ্জনের কাছে জানা গিয়েছিল, জাহাজ প্রথমে ভিড়বে পোর্টব্লেয়ারের মুখোমুখি একটা ছোট্ট দ্বীপ-রস আইল্যাণ্ড। সেখানে উদ্বাস্তুদের নামিয়ে অন্য যাত্রীদের নিয়ে সেটা চলে যাবে চ্যাথাম হারবারে।

    একটানা সমুদ্রযাত্রার পর ফি বারই শ্রান্ত শরণার্থীদের রস দ্বীপে নামানো হয়। সেখানে খাওয়া দাওয়া এবং বিশ্রামের পর তাদের পোর্টব্লেয়ারের আশেপাশে পুনর্বাসনের জন্য পাঠানো হয়।

    পোর্ট ব্লেয়ার হল দক্ষিণ আন্দামানে। আন্দামান এবং নিকোবার আইল্যাণ্ডসের হেড কোয়ার্টার্স। এই শহরে চল্লিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এতদিন উদ্বাস্তুদের জন্য জনপদ তৈরির কাজ চলছিল। কিন্তু এবার মহারাজা জাহাজে যে ডি পি ফ্যামিলিগুলোকে আনা হয়েছে তাদের দুভাগে ভাগ করে একটা দলকে পাঠানো হবে অন্য এক দ্বীপে–মধ্য আন্দামানে। দক্ষিণ আন্দামানের মতো সেখানেও জঙ্গল কেটে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

    দুপুরের আগে আগেই এস এস মহারাজার আন্দামানে পৌঁছে যাবার কথা। কোন ছেলেবেলা থেকে এই রহস্যময় দ্বীপপুঞ্জের নানা ভয়াবহ কাহিনি শুনে আসছে বিনয়। সেখানে যেতে হবে, কোনওদিন সে কি কল্পনা করতে পেরেছিল? জাহাজ যত এগিয়ে যায়, তার হাড়ে-মজ্জায় প্রবল উত্তেজনা চারিয়ে যেতে থাকে।

    একসময় দিগন্তের তলা থেকে সূর্য উঠে আসে। প্রথমে রক্তবর্ণ। তারপর দ্রুত রং পালটে যায়। লালটা আর লাল রইল না, ক্রমশ গনগনে আগুনের চেহারা নিতে থাকে। কুয়াশা আগেই ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছিল। রোদ তপ্ত হয়ে দিগন্তজোড়া নোনা জলের ওপর ছড়িয়ে পড়ছে। খানিক পরে আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। মনে হবে, জল ছুঁড়ে আগুনের হলকা উঠে আসছে।

    নিরঞ্জনের গলা কানে এল, আপনে এইহানে? সমুন্দুরে সূর্যোদয় দেখতে আছিলেন? একটা চেয়ার টেনে এনে সে পাশে বসে পড়ল।

    বিনয় একটু হাসল।–ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল। তখন সবাই ঘুমোচ্ছে। এক-একা কী আর করি। তাই এখানে এসে বসে আছি। বিভাসবাবু কোথায়? তাঁকে দেখছি না তো সেই যে শান্তিনিবাস মেসে নিরঞ্জন বিভাসকে নিয়ে এসেছিল, তারপর থেকে ওদের আলাদা আলাদা কখনও দেখা যায়নি। দমদমের ত্রাণশিবিরে, খিদিরপুর ডকে কিংবা জাহাজে, সর্বত্র দুজন ওরা একসঙ্গে কাজ করে গেছে। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে যেন ভাবা যায় না।

    নিরঞ্জন জানায়, আজ তাদের ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেছে। চটপট মুখটুখ ধুয়ে বিভাসকে নিয়ে দুজনে জাহাজের খোলে রিফউজিদের কাছে যাচ্ছিল। কেননা, উদ্বাস্তুদের তাড়া দিয়ে দিয়ে চান করাতে হবে, সকালের খাবার খাইয়ে রেডি করিয়ে রাখতে হবে। এ-সব করাতে দু-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণে জাহাজ আন্দামানে পৌঁছে যাবে। এস এস মহারাজা বেশিক্ষণ রস আইল্যাণ্ডে দাঁড়াবে না। উদ্বাস্তুদের নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে।

    জাহাজের তলায় ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ নিরঞ্জন বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল। বিভাসকে নিচে পাঠিয়ে সে তার কাছে চলে এসেছে।

    একটু চুপচাপ।

    তারপর বিনয় বলে, আপনি বললেন কিছুক্ষণের ভেতর আমরা আন্দামান পৌঁছে যাব। কিন্তু জল ছাড়া কোনও দিকে কিছুই তো চোখে পড়ছে না।

    নিরঞ্জন হাত-ঘড়ি দেখে বলল, অহন সাড়ে সাতটা। নয়টার আগেই আন্দামানের কোস্ট দেখতে পাইবেন।

    নিরঞ্জনের কথাই হয়তো ঠিক। সে তো প্রায়ই উদ্বাস্তু আনতে কলকাতায় পাড়ি দেয়। নিয়মিত এই রুটে যাতায়াতের কারণে প্রখর অনুমানশক্তিতে সে বলে দিতে পারে কোথায় কতদূরে রয়েছে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ, কিংবা কতক্ষণে তার দেখা পাওয়া যাবে।

    নিরঞ্জন বলল, বিনয়বাবু, জাহাজ আন্দামানের দিকে যত আউগাইতাছে (এগুচ্ছে) ততই আমার দুশ্চিন্তাহান বাড়তে আছে।

    বিনয় অবাক হল।–কীসের দুশ্চিন্তা?

    আপনে তো জানেনই, খিদিরপুর ডক থিকা ছয়টা ডি পি ফেমিলি ভাইগা গ্যাছে।

    হ্যাঁ। সে তো জানিই।

    এক শ ফেমিলি লইয়া যাওনের কথা। বাকি ছয়টা মেক-আপ করুম ক্যামনে?

    বিনয় বলল, পালিয়ে গেলে কী আর করা যাবে?

    নিরঞ্জন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, কী আর করন যাইব! আপনে তো কইয়াই খালাস। একহান কথা। ভাইবা দ্যাখছেন?

    বিনয় কোনও প্রশ্ন করে না। শুধু নিরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিরঞ্জন বলতে লাগল, এক-এক ফেমিলির একইশ বিঘা কইরা জমিন পাওনের কথা। হেইটা অইলে হিসাবটা কী খাড়াইল? ছয় ইনটু একইশ–এক শ ছাব্বিশ বিঘা চাষের জমিন হাত থিকা বাইর অইয়া যাইব। এতখানি জমিন সোজা কথা! একটু থেমে ফের বলে, আন্দামানের রিহ্যাবিলিটেশন স্কিম ইস্ট ব্যাঙ্গলের রিফুজিগগা লেইগা। কিন্তুক কেও না গ্যালে তাগো জমিনে সরকার অন্য প্রভিন্সের মানুষ আইনা বাইতে পারে। হেইটা কিছুতেই মাইনা নিমু না। উই জমিনটা যাতে রিফিউজিগো হাতেই থাকে হের একটা ফিকির বাইর করতেই অইব।

    কী ফিকির?

    হেইটা অহনও ভাইবা উঠতে পারি নাই। আগে আন্দামানে যাই। স্যান (সেন) সাহেব, মণ্ডল সাহেব, ব্যানার্জি সাহেব, রাহাদা-এনাগো লগে পরামশ কইরা দেখি। তেনারা কী কন হুনি। হের পর একটা ব্যবস্থা অইয়াই যাইব।

    নিরঞ্জনের রাহাদা যে বিশ্বজিৎ রাহা সেটা আগেই জেনে নিয়েছে বিনয়। বিশ্বজিৎ আবার জগদীশ গুহঠাকুরতার বন্ধুর ছেলে। বিনয় যে আন্দামানে যাচ্ছে, টেলিগ্রাম করে জগদীশ বন্ধুপুত্রকে তা জানিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া বিনয়ের সঙ্গে একটা পরিচয়-পত্রও লিখে দিয়েছেন।

    বিনয় বলল, আন্দামানে গিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিশ্বজিৎবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে। দেবেন।

    মনে আছে, মনে আছে। চিন্তা কইরেন না। ভরসা দেবার ভঙ্গিতে হাত তুলল নিরঞ্জন। জাহাজ থিকা রস আইল্যাণ্ডে নামনের লগে লগে রাহাদারে পাইয়া যাইবেন।

    উনি রস আইল্যাণ্ডে আসবেন? বিস্ময়ের সুরে জিজ্ঞেস করে বিনয়।

    নিরঞ্জন বলল, হুদা (শুধু) রাহাদা ক্যান, আন্দামানের ব্যাঙ্গলি সোসাইটির যত ক্রিম–য্যামন ধরেন হারবার মাস্টার স্যান সাহেব, চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট মণ্ডলসাহেব, চিফ ম্যাডিক্যাল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ–এই হগল বাছা বাছা মাইনষেরা যেইদিন রিফুজি আহে, রস আইল্যাণ্ড যাইবেনই। হেরা ছাড়া নানান ডিপার্টমেন্টের ছোট বড় অফিসারেরা, কেরানিরা, দোকানদার, ব্যবসাদাররা তো থাকেই। য্যান মেলা বইয়া যায়

    এত লোক যায় কেন?

    রিফুজিগো রিসিভ করতে। আন্দামানে এত বাঙ্গালি দেইখা উদ্বাস্তুরা বল-ভরসা পায়।

    এই খবরটা জানা ছিল না বিনয়ের। শুনে খুব ভাল লাগল। আন্দামানের মাটিতে পা দিয়েই উদ্বাস্তুরা বুঝতে পারবে নির্জন দ্বীপে তাদের চির-নির্বাসনে পাঠানো হয়নি। স্বচক্ষে দেখতে পাবে এখানে তাদের অজস্র শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছে। এতে তাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যাবে।

    খানিক নীরবতা।

    তারপর নিরঞ্জন বলে, আপনে এইহানে বহেন। আমি গিয়া দেখি রিফুজিরা কী করতে আছে—

    বিনয় বলল, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাই।

    না না, এই কয়দিন আমাগো লগে হাত মিলাইয়া রিফুজিগো ম্যালা স্যবা (সেবা) করছেন। এই পরথম এই দিকে আইলেন। এটু পরেই আন্দামানের আইল্যাণ্ডগুলান দেখতে পাইবেন। বিউটিফুল সিনারি। দেখতে দেখতে চামড় হইয়া যাইবেন।

    বিনয়কে ডেকে রেখে নিরঞ্জন চলে গেল। এদিকে লোয়ার ডেকের অন্য প্যাসেঞ্জারদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারা একে একে এসে বিনয়ের চারপাশের ডেক চেয়ারগুলোতে বসে পড়েছে।

    .

    আরও ঘণ্টাখানেক বাদে দূর দিগন্তে জলে সবুজ রঙের টুকরো টুকরো ঝাপসা কিছু ছবি ফুটে উঠল। ক্রমশ সেগুলো স্পষ্ট হতে হতে লম্বা গোলাকার তেকোনো চারকোনা নানা আকারের দ্বীপ হয়ে গেল। প্রতিটি দ্বীপ ঘন জঙ্গলে বোঝাই। শুধু গাছ আর গাছ। সেগুলোর যে-দিকটা সমুদ্রের ধার ঘেঁষে সেখানে ঠাসা ম্যানগ্রোভের ঝাড়। বিনয় ম্যানগ্রোভ আগেও দেখেছে। কিন্তু অন্য গাছগুলো একেবারেই অচেনা। দেখে মনে হল, এইসব দ্বীপে মানুষজন নেই। থাকলেও বনভূমির গভীর অন্তঃপুরে কোথায় রয়েছে, কে জানে। তবে অজস্র পাখি চোখে পড়ছে।

    ডাইনে বাঁয়ে কাছে দূরে–অগুনতি দ্বীপের ফাঁক দিয়ে ফাঁক দিয়ে এক সময় এস এস মহারাজা একটা মাঝারি দ্বীপের গায়ে এসে ভিড়ল। বিনয় আন্দাজ করল, এটাই রস আইল্যাণ্ড। দ্বীপটা অজস্র নারকেল গাছে ছয়লাপ। ঘাসে-ভরা সবুজ সমতল জমিও রয়েছে। আছে বিরাট বিরাট পাথরের চাঁই। দ্বীপটার গায়ে দুটো স্টিম লঞ্চ আর একটা মোটর বোট নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওখানে এখন প্রচুর লোকজন। অনেকগুলো বিরাট বিরাট লাল-নীল ছাতা দেখা যাচ্ছে। গার্ডে আমব্রেলা। লম্বা লম্বা তেরপলের বেশ কটা ছাউনিও খাটানো রয়েছে।

    জাহাজে ওঠার আগে আন্দামানের মানচিত্রটা যে কতবার দেখেছে বিনয় তার লেখাজোখা নেই। দেখতে দেখতে সেটা তার মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে ঢুকে গেছে। সে আঁচ করে নিল রস-এর সামনের উপসাগরটা সোসসাস্ট্রেস বে। সেটা কতখানি চওড়া হবে? খুব বেশি হলে আধ মাইল। তার ওপারে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পোর্টব্লেয়ার শহর। কোনাকুনি তাকাতেই একটা উঁচু টিলার মাথায় লালরঙের সুবিশাল ইমারতটা চিনতে লেশমাত্র অসুবিধে হল না। কুখ্যাত সেলুলার জেল। এই কারাগারের ছবি নানা বইয়ে কতবার যে দেখেছে! বিনয় নিজের অজান্তে অদ্ভুত শিহরন অনুভব করে।

    এদিকে জাহাজ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে তুমুল ব্যস্ততা। খালাসিরা জাহাজের ওপর থেকে হইহই করে লম্বা সিঁড়ি নামাচ্ছে। পুনর্বাসন বিভাগের কর্মী এবং উদ্বাস্তুরা এখানে নামবে, তারই তোড়জোড় চলছে।

    ডেক চেয়ার থেকে উঠে এল বিনয়। সোজা তার কেবিনে গিয়ে নিজের সুটকেস আর হোল্ড-অলটা নিয়ে বেরিয়ে আসতেই চোখে পড়ল নিরঞ্জনরা তাড়া দিয়ে দিয়ে জাহাজের খোল থেকে উদ্বাস্তুদের বার করে আনছে। পুরুষদের মাথায় এবং হাতে টিনের বাক্স, বোঁচকা বুচকি। বয়স্ক মেয়েমানুষগুলোর কাঁখে কাচ্চাবাচ্চা।

    নিরঞ্জন আর বিভাস একটানা হেঁকে যাচ্ছিল, আপনেরা আস্তে আস্তে লাইন দিয়া নিচে নাইমা যান- অবিকল এই কায়দায় খিদিরপুর ডকে তারা শরণার্থীদের জাহাজে তুলেছিল।

    উদ্বাস্তুরা কিন্তু ভীষণ চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছে।

    জবর ক্ষুদা বাবুরা। প্যাট জ্বলতে আছে– কিংবা কখন খাতি দেবান বাবারা? খিদির চোটে মরে যাতিচি

    আসলে জাহাজে ওঠার পর একটা রাত কাটতে না কাটতেই সাইক্লোন ধেয়ে এল। তার ধাক্কা সামাল দিতে না দিতে শুরু হল সি-সিকনেস। এই কদিন উদ্বাস্তুরা যা খেয়েছে, তক্ষুনি বমি হয়ে বেরিয়ে গেছে। এখন পেটে তাদের দাবানল জ্বলছে।

    নিরঞ্জন বলল, আপনেগো ভাত তরকারি মাছ ডাইল রেডি কইরা রাখা আছে। নিচে নামলেই খাইতে বহাইয়া দিমু।

    লোয়ার ডেক থেকে সমস্ত কিছু দেখতে পাচ্ছে বিনয়। দ্বীপে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা সবাই জাহাজের সিঁড়ির কাছে চলে এসেছেন। চেহারা এবং পোশাক আশাক দেখে আঁচ করা যায়, এঁরা উঁচু স্তরের অফিসার এবং অন্যান্য গণ্যমান্য লোক। চল্লিশ পঞ্চাশজন উদ্বাস্তু নামলেই তারা হাসিমুখে, আন্তরিক সুরে বলছিলেন, আসুন আসনুউদ্বাস্তুদের সঙ্গে করে ওঁরা তেরপলের ছাউনিগুলোর তলায় নিয়ে বসাচ্ছেন।

    উদ্বাস্তুদের নামাতে নামাতে বিনয়কে দেখতে পেয়েছিল নিরঞ্জন। হাত তুলে ইশারায় তাকে দাঁড়াতে বলল সে।

    আধ ঘণ্টার মধ্যে সব উদ্বাস্তু নেমে গেল। সবার শেষে নামল নিরঞ্জন, বিভাস, বিনয় এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের খালাসিরা সিঁড়ি টেনে তুলে ফেলল। তারপর গম্ভীর ভো বাজিয়ে বাকি প্যাসেঞ্জারদের নিয়ে এস এস মহারাজা ঢিমে চালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। খুব সম্ভব ওধারেই কোথাও চ্যাথাম হারবার।

    জাহাজ থেকে নেমে নিরঞ্জন বিনয়কে বলল, আপনে তো রাহাদার লেইগা অস্থির অইয়া আছেন। আহেন, আলাপ করাইয়া দেই- আন্দামানের সব অফিসার, ব্যবসাদার এবং নানা প্রোফেশনের লোকজন যেখানে ভিড় করে আছেন, বিনয়কে সেখানে নিয়ে গেল নিরঞ্জন। বিশ্বজিৎ রাহার সঙ্গে আলাপও করিয়ে দিল। বয়স বেশি নয়, পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ। বেশ সুপুরুষ, সপ্রতিভ। চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ আছে।

    বিশ্বজিৎ বললেন, জগদীশকাকার টেলিগ্রাম আমি পেয়েছি। আপনার সম্বন্ধে সব জানিয়ে দিয়েছেন। পোর্ট ব্লেয়ারে আপনি আমার কাছে থাকবেন। উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তো বটেই, আন্দামানের যে-কোনও বিষয়ে যা যা সাহায্য দরকার, সব পাবেন।

    প্রথম আলাপেই মানুষটিকে খুব ভাল লেগে গেল বিনয়ের। মনে হল, বেশ কাজের লোক, তা ছাড়া ভারি অমায়িক এবং সহৃদয়। বিনয় বলল, অনেক ধন্যবাদ

    বিশ্বজিৎ বিব্রতভাবে বললেন, ধন্যবাদ টন্যবাদ বললে লজ্জা পাব। নো ফর্মালিটি প্লিজ– বলে তিনিও কয়েকজনের সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। চিফ কনজারভেটর অফ ফরেস্ট ব্রজদুলাল মণ্ডল, চিফ মেডিকেল অফিসার ডাক্তার চট্টরাজ, হারবার মাস্টার সোমনাথ সেন, ইত্যাদি। এঁরা প্রবীণ মানুষ, পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স। সকলেই কথায়বার্তায় চমৎকার। এত উঁচু উঁচু পোস্টে আছেন, কিন্তু এতটুকু অহমিকা নেই। তারা জানালেন, কলকাতা থেকে আসা তরুণ সাংবাদিকটির সঙ্গে সমস্ত রকম সহযোগিতা করবেন।

    ওধারে তেরপলের চাদোয়াগুলোর তলায় সব উদ্বাস্তুদের নিয়ে বসানো হয়েছিল। তাদের চেঁচামেচি আরও বেড়ে গেছে।

    খাতি দ্যান বাবারা, তরাতরি খাতি দ্যান।

    বিশ্বজিৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল নিরঞ্জন। তাকে বললেন, ড্রাম বোঝাই করে জল এনে রাখা হয়েছে। রিফিউজিদের বলো, যেন চটপট হাতমুখ ধুয়ে নেয়। তারপর খেতে বসিয়ে দাও–

    দ্রুত চোখেমুখে জল ছিটিয়ে শরণার্থীরা কাতার দিয়ে বসে গেল। শালপাতার থালায় তাদের ভাত ডাল মাছ পরিবেশন করতে লাগল পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীরা। এদের সঙ্গে হাত মেলালেন সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, রাহাসাহেব, ডাক্তার চট্টরাজের মতো হোমরা চোমরারা।

    এত বড় বড় মাপের সব মানুষ যত্ন করে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। ফলে উদ্বাস্তুরা অভিভূত। উদ্দীপ্ত মুখে বলে, বাবারা, মনে ডর লইয়া কালাপানি আইছিলাম। ভাবি নাই আপনেগো লাখান মাইনষেগো কাছে পামু। অহন ভরসা পাইতে আছি।

    বিশ্বজিৎরা জানালেন, তারা সবসময় উদ্বাস্তুদের পাশে আছেন। এবং থাকবেনও।

    খাওয়া হয়ে গেলে শরণার্থীরা বেশির ভাগই চাঁদোয়ার তলায় শুয়ে পড়ল। কেউ কেউ নারকেলগাছের ছায়ায় বা বড় বড় পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিল।

    উদ্বাস্তুদের পর বিশ্বজিৎরা খেয়ে নিলেন। সেই একই খাদ্যবস্তু। ভাত ডাল মাছ, ইত্যাদি।

    চারদিকে অনেকগুলো বিশাল বিশাল রঙিন ছাতা দাঁড় করানো রয়েছে। সেগুলোর তলায় প্রচুর ফোল্ডিং চেয়ার এবং টেবল। অফিসাররা এবং অন্য সবাই যাঁরা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিলেন, খাওয়াদাওয়ার পর তারা এক-একটা ছাতার নিচে গিয়ে বসলেন। যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে, এখন একটু জিরিয়ে নেওয়া দরকার।

    একটা ছাতার তলায় বসে ছিল বিনয়, নিরঞ্জন, বিশ্বজিৎ এবং আরও দু-একজন অফিসার।

    এখন ভরদুপুর। সূর্য খাড়া মাথার ওপর উঠে এসেছে। রোদের তাপে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল গেজে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মনে হয়, চোখ ঝলসে যাবে।

    বিশ্বজিৎ ঘড়ি দেখে নিরঞ্জনকে বললেন, এখন বারোটা বেজে সাতান্ন। সাড়ে চারটেয় চলুঙ্গা জাহাজ আসবে। তোমরা যে রিফিউজিদের আজ নিয়ে এসেছ তার অর্ধেক নিয়ে চলুঙ্গা মিডল আন্দামানে যাবে

    এই খবরটা বিনয়ের জানা। সে নীরবে শুনতে থাকে।

    বিশ্বজিৎ বলছিলেন, তোমার কাছে তো রিফিউজিদের ফ্যামিলিগুলোর লিস্ট রয়েছে। দাও তো দেখি, কাদের ওখানে পাঠানো যায়।

    টাইপ-করা তালিকাটি পকেট থেকে বার করে বিশ্বজিৎকে দিল নিরঞ্জন। সেটা দেখতে দেখতে বিশ্বজিতের ভুরু কুঁচকে গেল, এ কী, ছটা ফ্যামিলি কম দেখছি!

    মলিন মুখে নিরঞ্জন জানালো, কীভাবে খিদিরপুর ডক থেকে ছটা উদ্বাস্তু পরিবার চুপিসারে পালিয়ে গেছে। তখন হাতে এমন সময় ছিল না যে নতুন করে কোনও ক্যাম্প থেকে নতুন ছয় ফ্যামিলি জোগাড় করে আনে।

    বিশ্বজিৎকে চিন্তিত দেখায়। বললেন, জাঙ্গল রিক্লেম হয়ে গেছে। গভর্নমেন্ট জমি ফেলে রাখতে চাইবে না। মোপলাদের নিয়ে আসবে। এখন উপায়?

    কী উত্তর দিতে গিয়ে আচমকা চোখেমুখে বিদ্যুৎ খেলে গেল নিরঞ্জনের। দ্যান তো লিস্টিহান বিশ্বজিতের হাত থেকে তালিকাটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পেন দিয়ে পটাপট কটা উদ্বাস্তুর নামের পাশে টিক মারতে মারতে প্রবল উত্তেজনার সুরে সে বলল, রাহাদা, আমার মাথায় একহান প্ল্যান আইছে। যদি আপনেরা হেল্প করেন, ছয়টা ডি পি ফেমিলির সমস্যা সৎ অইয়া যাইব।

    হতবাক বিশ্বজিৎ কয়েক পলক তাকিয়ে থাকেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, কীভাবে সৎ করবে?

    টেবলের ওপর হাতের তালিকাটা নামিয়ে রেখে বিশ্বজিৎ টিকমারা নামগুলো দেখিয়ে দেয়। সবসুদ্ধ বারোটা নাম। সেগুলোর পাশে বয়সও লেখা আছে। হরিপদ বিশ্বাস (২৪ বছর), জবা ভক্ত (১৬ বছর), গণেশ রুদ্রপাল (২১ বছর), ময়না দাস (১৭ বছর), গোপাল সূত্রধর (২৩ বছর ৬ মাস), সাগরী পাল (১৫ বছর), মাখন কর্মকার (২৬ বছর ৩ মাস), মিনতি দাস (১৫ বছর ৯ মাস), গগন বিশ্বাস (২০ বছর ১০ মাস), সুন্দরী কর্মকার (১৮ বছর), কার্তিক দাস (২২ বছর ৪ মাস), বাসমতী বিশ্বাস (১৯ বছর)।

    নামগুলো দেখা হলে বিশ্বজিৎ মুখ তোলেন। নিরঞ্জন বলে, কিছু নি বুঝতে পারলেন?

    বিশ্বজিৎকে কেমন যেন বিমূঢ় দেখায়। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, নো। নাথিং

    বিনয় পাশে বসে ছিল। এই বারোটা নাম কোন পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান করবে, সেটা তার আদৌ বোধগম্য হচ্ছে না।

    নিরঞ্জন এবার জলবৎ বুঝিয়ে দিল। এই ছজোড়া যুবক-যুবতী সবাই অবিবাহিত, ওদের নিজস্ব কোনও ফ্যামিলি নেই। ওরা এসেছে ওদের মা-বাবার সঙ্গে, কেউ বা দাদা-বউদির সঙ্গে। এদের যদি এখনই বিয়ে দেওয়া যায়, ছটা নতুন ফ্যামিলি বানিয়ে ঘাটতি পূরণ হয়ে যাবে। চুরানব্বই আর ছয় মিলিয়ে যোগফল পুরো এক শ। পাক্কা এক শ ছাব্বিশ বিঘে জমি বাঙালিদের হাতছাড়া হবে না।

    উৎসাহে বিশ্বজিতের চোখমুখ ঝকমক করতে থাকে। বললেন, তোমার ব্রেনখানা সোনা দিয়ে বাঁধানো। হাত মিলাও ভাই নিজেই নিরঞ্জনের একখানা হাত তুলে নিয়ে ঝাঁকাতে লাগলেন, এ বিয়ে হবে, নিশ্চয়ই হবে। কে, কখন, কাকে বিয়ে করে সেপারেট ফ্যামিলি বানাচ্ছে, কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এক শ ফ্যামিলি দরকার। সেটা পেলেই হল। তবে

    নিরঞ্জন জিজ্ঞেস করে, তবে কী?

    সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, ডাঃ চট্টরাজদের ব্যাপারটা জানানো দরকার। যদি কিছু গোলমাল হয় ওঁরা সামলে নেবেন।

    অন্য একটা ছাতার তলায় বসে সেনসাহেবরা বিশ্রাম করছিলেন। বিশ্বজিৎ উঠে গিয়ে তাদের ডেকে এনে নিরঞ্জনের পরিকল্পনার কথা জানাতে প্রথমটা সবাই থ। তারপর তুমুল হাসিতে ফেটে পড়লেন।

    সেনসাহেব বললেন, গ্র্যাণ্ড–

    মণ্ডলসাহেব বললেন, ওদের বিয়ের বয়েস হয়েছে। কদিন পরে তো বিয়ে করবেই। কদিন আগেই না হয় করল। একটু থেমে বললেন, যখন হোক সেপারেট ফ্যামিলি তো ওদের হবেই। রস আইল্যান্ডেই না হয় শুভ কাজটা হল।

    ডাক্তার চট্টরাজ সংশয়ের সুরে বললেন, এই সবে ওরা আন্দামানে পৌঁছেছে। এখনও নিজেদের কলোনিতে যায়নি। বিয়ে করতে কি রাজি হবে?

    অইব স্যার, অইব। এই ব্যাপারখান আমার হাতে ছাইড়া দ্যান লাফ দিয়ে উঠে গার্ডেন আমব্রেলার বাইরে গিয়ে দুই হাত চোঙার মতো মুখের কাছে তুলে নিরঞ্জন হাঁকতে থাকে, হরিপদ বিশ্বাস-হরিপদ বিশ্বাস–এইহানে আসো

    কাছাকাছি একটা পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে রোগা প্যাংলা গোছের এক যুবক খাওয়াদাওয়ার পর ঘুমোচ্ছিল। নামটা কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে আসে। ভীষণ ঘাবড়ে গেছে সে। সারা শরীর কাঁপছে। হাতজোড় করে ভয়ার্ত সুরে বলে, ছারেরা (স্যারেরা), এত রিফুজ থাকতি আমারি ডাকতিছেন কেন? আমি তো জেবনে অল্যায় কিছু করি নাই

    নিরঞ্জন সহৃদয় ভঙ্গিতে বলে, ডরাও ক্যান? তোমার লগে কামের কথা আছে

    না ছার, আমারে ছাড়ি দ্যান-আমারে ছাড়ি দ্যান।

    এইসময় ছুটতে ছুটতে একজন আধবয়সী রুণ চেহারার লোক এসে পড়ে। হতচকিত, শঙ্কাতুর। ব্যাকুলভাবে বলে, হরিপদ কী করিছে ছারেরা? কী করিছে?

    নিরঞ্জন তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনে ক্যাঠা (কে)? এহানে কী চাই?

    লোকটা জানালো তার নাম গদাধর বিশ্বাস। সে হরিপদর দাদা। নিরঞ্জন বলে, আপনে আইছেন, ভালই অইছে।

    এরপর কিছুক্ষণ কথা হল। কোথায় দেশ ছিল গদাধরদের? কতদিন আগে পাকিস্তান থেকে এসেছে? দেশে থাকতে তারা কী করত–চাষবাস, না অন্য কিছু? ইত্যাদি ইত্যাদি।

    লঘু চালে গল্প করে করে পরিবেশটা সহজ করে নিয়ে এবার হরিপদর দিকে তাকায় নিরঞ্জন, তোমারে ক্যান ডাকছি, এইবার হোননা। আমরা তোমার বিয়া দিতে চাই।

    বিভা (বিয়ে)! এমন বিস্ময়কর শব্দ আগে কখনও বুঝি বা শোনেনি হরিপদ। অনেকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর হাত-পা-মাথা ঝাঁকিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দেয়। মারি ফেলান ছার, মারি ফেলান। টাস করি বাড়ি মারি শ্যাষ করি ফেলান। গুলি করি হাগরের (সাগরের) জলে ভাসায়ে দ্যান। বিভা আমি করতি পারফ (পারব না।

    হরিপদর সঙ্গে তার দাদাও সুর মেলায়, মারি ফেলান ছারেরা, মারি ফেলান। মাথায় বাড়ি মারি–

    আচমকা বিয়ের প্রস্তাবে বেজায় ভড়কে গেছে ওরা। দুজনকে ধাতস্থ করতে বেশ সময় লাগল। হরিপদ যখন বুঝতে পারল, নিরঞ্জনদের কোনওরকম দুরভিসন্ধি নেই, তখন বলল, মনে তো বিভার বাসনা আছে, কিন্তুক মিয়া ছাওয়াল (মেয়ে) পাই কোয়ানে (কোথায়?

    গদাধরও জানায়, সমস্যা একটাই। পাত্রী কীভাবে পাওয়া যাবে?

    নিরঞ্জন হরিপদকে বলল, হেই চিন্তা আমাগো। মাইয়া আমরা ঠিকই জুটাইয়া দিমু। তুমি যে বিয়া করতে রাজি অইছ, এ আমাগো চৈদ্দ পুরুষের ভাগ্যি। এটু খাড়াও বলেই খানিক আগের মতো মুখের সামনে দুই হাতের চোঙা বানিয়ে হাঁক পাড়তে থাকে, যোগেন বিশ্বাস–যোগেন বিশ্বাস

    ডান পাশে একটু ঢালুমতো জায়গায় প্রচুর নারকেল গাছের জটলা। সেখানে শুয়ে ছিল যোগেন। লোকটা আধবুড়ো। মাথায় উষ্কখুষ্ক কাঁচাপাকা চুল। গালে সাত-আট দিনের খাড়া খাড়া দাড়ি। পরনে ময়লা খাটো ধুতির ওপর ফতুয়া। ডাক শুনে হরিপদদের মতোই হাই হাই করে চিকুর পাড়তে পাড়তে এসে হাজির। সে কী এমন অপরাধ করেছে যে এত এত রিফুজ থাকতে তাকে তলব করা হয়েছে? কেউ কি তার নামে ছারেদের কাছে কিছু লাগিয়েছে? সেইজন্য ছারেরা কি তার ওপর অসন্তুষ্ট? এক নাগাড়ে চেঁচিয়ে যেতে লাগল যোগেন।

    নিরঞ্জনের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে। হরিপদদের মতোই বুঝিয়ে সুঝিয়ে যোগেনকে ঠাণ্ডা করল। তারপর বলল, আপনের কি একহান ডাঙ্গর (ডাগর) মাইয়া আছে?

    যোগেন ঘাড় কাত করে জানায়, আছে তো। আপনি কেমন করি জানতি পারলেন?

    টেবল থেকে উদ্বাস্তুদের নামের তালিকা তুলে ধরে নিরঞ্জন বলল, এইর ভিতরে আপনেগো বেবাক রিফুজির নাম ধাম লিখা আছে। তা মাইয়ার বিয়া দিবেন না?

    দিতি তো চাই। কিন্তুক ছাওয়ালপান (পাত্র) পাই কোয়ানে (কোথায়)? হরিপদকে দেখিয়ে নিরঞ্জন বলল, দ্যাখেন তো ইয়ারে পছন্দ হয় কি না—

    যোগেন বিশ্বাস এখন আর পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাত উদ্বাস্তু নয়। সে এই মুহূর্তে একজন ভাবী শ্বশুর। লহমায় তার চেহারা বদলে যায়। বুকের ওপর আড়াআড়ি দুই হাত রেখে অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হরিপদকে পর্যবেক্ষণ করে। তারপর ভারিক্কি চালে শুরু করে, মশয়ের নাম?

    হরিপদ মাথা নিচু করে কেঁচোর মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মিন মিন করে উত্তর দেয়, শিরি (শ্ৰী) হরিপদ বিশ্বেস

    পিতা?

    ঈশ্বর জগন্নাথ বিশ্বেস

    নিবাস?

    খুইলনে (খুলনা) জিলা। পাকিস্থান—

    গেরাম?

    আছেরপুর।

    হরিপদর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল গদাধর। সে বলে, আমি হরিপদর বড় ভাই। যা জিগুবার (জিজ্ঞেস করার) আমারে জিগুতে পারেন। ও আমার ফেমিলির ছেলে।

    ঘাড় টেরা করে যোগেন বলে, যা জিবার ছেলিরি (ছেলেকে) জিগুব বলে ফের সওয়াল শুরু করে, শিউলি, না ধানী?

    ধানী।

    কোন গুরুর শিষ্য? হরিচান (হরিচাঁদ), গুরুচান, না পাগলচান?

    হরিচান।

    বিনয় একধারে বসে এই বিচিত্র সওয়াল-জবাব শুনে যাচ্ছিল। ওদের মধ্যেও যে আলাদা আলাদা শ্রেণী আছে, আছে আলাদা আলাদা গুরু, এ-সব জানা ছিল না তার।

    যোগেনের চোখমুখ দেখে মনে হল, সে খুশি। তারা যেমন পাত্র চায়, খাপে খাপে মিলে গেছে। এই ছেলেকে কন্যাদান করা যায়। সে এবার জিজ্ঞেস করে, মশয় তো আমার মেয়ারে (মেয়েকে) বিভা করতি চান, তা খাওয়াতি টাওয়াতি পারবেন?

    হরিপদ যতই কেঁচো হয়ে থাকুক, ভেতরে ভেতরে খুবই ধুরন্ধর। সে রাহাদের দেখিয়ে বলল, এই ছারেরা মাথার উপুরি আছেন। তেনিরা থাকতি কি আপনের মেয়া রুপুস (উপোস) দিয়ি মরবে? ভাবী ধর্মপত্নীর ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব সে রাহাসাহেব সেনসাহেবদের ওপর সঁপে দিল।

    কোটার এক শ ফ্যামিলি পূর্ণ করতে হবে, তাই রাহারা কেউ টু শব্দটি করলেন না।

    এদিকে যোগেনের প্রশ্নের শেষ নেই। সে বলল, মশয়, আমার জমিনে এটু লাঙ্গল টাঙ্গল দিয়া দিতে পারবেন তো?

    এখনও জমি পাওয়া যায়নি, কিন্তু আগে থেকেই ভাবী জামাইকে চাষ করে দেবার কড়ার করিয়ে নিচ্ছে যোগেন। হরিপদও একটি আস্ত ঘুঘু। সে বলে, বিদ্যাশি (বিদেশে) আত্মবান্ধবেরে দেখতি হবে না? বিয়ে হয়নি, কিন্তু এর মধ্যেই সে যোগেনদের নিজের পরমাত্মীয় বানিয়ে ফেলেছে।

    যোগেন রাহাদের দিকে ফিরে জানিয়ে দিল, পাত্র পছন্দ হয়েছে। এ বিয়েতে তার আপত্তি নেই।

    নিরঞ্জন খুবই তুখোড়। ভেলকির পর ভেলকি দেখিয়ে পরের পাঁচজোড়া যুবক-যুবতীর বিয়েও পাকা করে ফেলল। অবিকল একই প্রক্রিয়ায়।

    আন্দামানের মাটিতে নামতে না-নামতেই একসঙ্গে ছছটি বিয়ের মতো ঘটনা ঘটতে চলেছে। খবরটা অন্য উদ্বাস্তুদের কাছেও পৌঁছে গিয়েছিল। ঘুম টুম চোখ থেকে ঝেড়ে ফেলে তারা এসে নিরঞ্জনদের ছাতার সামনের দিকে ভিড় জমায়। তাদের চোখে একই সঙ্গে অপার কৌতূহল এবং উত্তেজনা।

    হঠাৎ জমায়েতের ভেতর থেকে একটা লোক উঠে আসে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। ভারী শরীর। সারা গায়ে প্রচুর পাকা লোম, কান এবং নাকের ভেতর থেকেও লোমের গোছা বেরিয়ে এসেছে। পরনে ধুতি আর তালি-মারা নিমা (এক জাতীয় জামা)। নিমায় বোম নেই। ফলে বুকের ওপর আড়াআড়ি লালচে পৈতার গোছা দেখা যাচ্ছে। সে হাতজোড় করে, মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, পন্নাম ছারেরা, আমার নাম রসিক জয়ধর। দ্যাশ আছিল পাকিস্থানের ফরিদপুর জিলায়। দ্যাশে থাকতে পূজা-পাব্বন-ছাদ্দ-বিয়া, এই হগল কিয়াকম্ম করতাম। চাষবাসের লগে লগে পুরৈতগিরি (পুরোহিত গিরি) আছিল আমাগো প্যাশা। (পেশা)। তা ছারেরা, যে বিয়াগুলান আপনেরা ঠিক করছেন, আমি হেইগুলান দিতে চাই

    ছজোড়া বর-কনে প্রস্তুত। একজন পুরুতও পাওয়া গেল। বিপুল উৎসাহে বিশ্বজিৎ রাহা বলে ওঠেন, নিশ্চয়ই দেবেন। কী কী করতে হবে বলুন

    রসিক জয়ধর একটা ফর্দ তৈরি করে দিল। বাসি ময়লা কাপড় চোপড় পরে তো বিয়ে হয় না। বর-কনের জন্য নতুন শাড়িজামাটামা চাই। চাই টোপর, ফুলের মালা, শাঁখা সিঁদুর, নোয়া, পাত্র পাত্রী এবং পুরোহিতের জন্য আসন, উপহারের জিনিসপত্র, ইত্যাদি।

    ফর্দে চোখ বুলিয়ে মোটামুটি হিসেব করে নিলেন বিশ্বজিৎ। মোটামুটি সাত শ টাকা দরকার। অফিসার এবং পোর্ট ব্লেয়ারের অন্য যে-সব বাঙালি বাসিন্দারা উদ্বাস্তুদের স্বাগত জানাতে এসেছিল তাদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হল। এমন একটা শুভ কাজ। সবাই হাসিমুখে টাকা দিলেন। বিনয় দিল কুড়ি টাকা। সাত শর জায়গায় সাড়ে আটশ উঠে গেল।

    চ্যাথাম বন্দরের যাবতীয় জাহাজ, স্টিমলঞ্চ, মোটর বোট«বার-মাস্টার সেনসাহেবের অধীনে। বস আইল্যাণ্ডে যে মোটর বোটটি রয়েছে, হারবার মাস্টার সেন সাহেবের অনুমতি নিয়ে পুনর্বাসন বিভাগের দুজন কর্মী, নিতাই কুণ্ডু আর রমেশ নাহাকে সেটায় করে পোর্টব্লেয়ারে এবারডিন মার্কেটে পাঠিয়ে দিলেন বিশ্বজিৎ। সঙ্গে দিলেন রসিকের ফর্দ এবং টাকা। নিতাইরা লিস্ট মিলিয়ে জিনিসপত্র তো আনবেই। শুভ বিবাহে মিষ্টিমুখ না হলে চলে? এবারডিন বাজারে কিছুদিন হল এক বাঙালি ময়রা মিঠাইয়ের দোকান খুলেছে। নিতাইদের বলে দেওয়া হল, সের দশেকের মতো রসগোল্লা যেন নিয়ে আসে।

    রস থেকে উপসাগর পেরিয়ে পোর্টব্লেয়ার যেতে দশ মিনিট, কেনাকাটা সারতে চল্লিশ মিনিট, ফিরে আসতে আরও দশ মিনিট। মোট ষাট মিনিট অর্থাৎ এক ঘণ্টা লাগল নিতাইদের। টাটকা ফুলের মালা পাওয়া যায়নি। তাই এক ডজন কাগজের ফুলের মালা এনেছে ওরা। আসলের বদলে নকল। কিন্তু কী আর করা যাবে? মন শুদ্ধ থাকলে ওতেই চলে যাবে।

    নিতাইরা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণোদ্যমে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। ছজোড়া বর-কনের সাজগোজ করতে সময় লাগল ঠিক সতেরো মিনিট।

    এখন দুটো বেজে আটান্ন। সূর্য একনাগাড়ে আগুন ঢেলে চলেছে। সমুদ্রের নোনা জল ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। ধারে কাছে সি-গাল বা অন্য কোনও পাখি নেই। এলাকা ছেড়ে সব উধাও হয়েছে।

    ঝলসানো আকাশের নিচে আন্দামানের এক সৃষ্টিছাড়া দ্বীপে বিয়ের আসর বসল।

    প্রথম বিয়েটা হবে হরিপদ আর বাসমতীর। চারখানা নতুন আসন পাতা হয়েছে। পাত্র-পাত্রী বসেছে মুখোমুখি। তাদের একপাশে পুরুত রসিক জয়ধর। আর-এক পাশে যোগেন বিশ্বাস। সে কন্যা সম্প্রদান করবে।

    আসরের চারপাশে ঠাসাঠাসি ভিড়। বিয়ে ব্যাপারটার ভেতর বুঝি বা কোনও ম্যাজিক থাকে। যে উদ্বাস্তুরা পাঁচটা দিন জাহাজে ভয়ে আতঙ্কে সিটিয়ে ছিল, তাদের এখন চেনাই যায় না। এধারে ওধারে চলছে অবিরল কলকলানি। সেই সঙ্গে হাসি। হা হা, হি হি। আর টুকরো টুকরো মজাদার সব মন্তব্য।

    বিশ্বজিৎ রসিক জয়ধরকে বললেন, ঠাকুর মশাই, হাতে সময় কিন্তু বেশি নেই। বিকেলের মধ্যে বিয়েগুলো সেরে ফেলতে হবে।

    রসিক বলল, চিন্তা কইরেন না ছার। এক-একহান বিয়া বারো চৈ মিনিটে নামাইয়া দিমু। বলেই হরিপদর একখানা হাত টেনে নিয়ে তার ওপর বাসমতীর হাত রাখে। বর-কনের হাতের ওপর যোগেনকে হাত রাখার নির্দেশ দিয়ে বলে, আমার লগে মন্তর পড়। কও ওঁ নারায়ণায় নমঃ।

    বাসমতীরা আউড়ে যায়,

    ওঁ নারায়ণায় নমঃ
    ওঁ গণেশায় নমঃ
    ওঁ গণেশায় নমঃ
    ওঁ মহাদেবায় নমঃ

    এরপর আরও কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ে যোগেনের হাতটা নামিয়ে দিয়ে উদ্বাস্তুদের ভিড়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলে, বিয়া অইতে আছে কিন্তুক শঙ্খ নাই। শঙ্খ না ফুয়াইলে (ফু দিলে) কি বিয়া হয়? হে আর কী করন? নাই তো নাই। মায়েরা, তোমরা হগলটি জোকার (উলু) দাও।

    চতুর্দিক থেকে মিষ্টি সুরে উলুর আওয়াজ উঠতে থাকে। আর তারই মধ্যে গলার স্বর উঁচুতে তুলে রসিক জয়ধর বলে যায়, অস্য ফাল্গুন মাসি, শুক্লপক্ষে, নিশাকালে বাসমতী বিশ্বেসের লগে

    বিনয় অবাক। বাংলা ক্যালেণ্ডারে এটা কার্তিক মাস, এখন ভর দুপুর। আর লোকটা বলছে কি না ফাল্গুন মাস, নিশাকাল, ইত্যাদি। খুব সম্ভব একটা মন্ত্রই শিখে রেখেছে রসিক। যে মাসেই বিয়ে হোক-বৈশাখ কি শ্রাবণ, মাঘ বা ফান, দিনে কি রাতে, তপক্ষে বা কৃষ্ণপক্ষেওই এক লাচাড়ি পড়ে যাবে সে।

    বঙ্গোপসাগরের এক নির্জন দ্বীপে, অদ্ভুত এই বিয়ে, মন্ত্রোচ্চারণ, উলুধ্বনি–সব কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হয় বিনয়ের। আবার মজাও লাগছে। এধারে ওধারে তাকাতে তাকাতে তার চোখ চলে যায় মেয়েদের জটলাটার দিকে। কুমারী মেয়েদের মুখ খোলা। তবে বিবাহিতাদের সবার মাথাতেই ঘোমটা। কারও নাক অবধি ঢাকা, কারও বা কপাল অবধি।

    হঠাৎ একটা মুখের ওপর নজর আটকে যায় বিনয়ের। পুরো মুখ নয়– একটা চোখ, কপাল চিবুক এবং নাকের খানিকটা অংশ। বাকিটা ঘোমটায় ঢাকা খুবই চেনা চেনা। এ কে? ঝিনুক কী? পাঁচদিন আগে খিদিরপুর ডকে মহারাজা জাহাজে উদ্বাস্তুরা যখন উঠছিল, ঝিনুকের মতোই একজনকে দেখেছিল সে। পরে জাহাজের খোলে আঁতিপাঁতি করে খুঁজেছে, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। এখন যাকে দেখা যাচ্ছে তার চোখে গালে চিবুকে ঝিনুকেরই আদল। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যেতে থাকে বিনয়ের।

    ওই মেয়েটির কাছে সোজাসুজি যাবার উপায় নেই। মাঝখানে বিয়ের আসর। সেটা ঘিরে উদ্বাস্তুরা বসে আছে বৃত্তাকারে। ভিড়ের পেছন দিয়ে পেছন দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো বিনয় যখন ওধারে পৌঁছল, মেয়েটাকে আর দেখা গেল না। সে কি এর মধ্যে সারা মুখে ঘোমটা টেনে দিয়েছে?

    সারি সারি অগুনতি ঘোমটা-ঢাকা মেয়েমানুষদের মধ্যে কে যে ঝিনুক (আদৌ যদি ঝিনুক হয়), জানার উপায় নেই। কারওকে তো বলা যায় না, তোমার মুখটা দেখব, ঘোমটা খোল। বিনয় চাপা, ব্যাকুল স্বরে ডাকতে লাগল, ঝিনুক-ঝিনুক- কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না।

    হতাশ বিনয় কিছুক্ষণ বাদে বিশ্বজিৎদের কাছে ফিরে আসে। এদিকে হরিপদ আর বাসমতীর মালাবদল, শুভদৃষ্টি ইত্যাদি শেষ হয়ে গেছে। এখন দুনম্বর বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কিন্তু কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না বিনয়। চারপাশে এত কলরোল, রসিক জয়ধরের তেজী গলার মন্ত্রপাঠ সে-সবের একটি শব্দও তার কানে ঢুকছে না।

    রসিক করিৎকর্মা লোক। এক ঘণ্টা সাত মিনিটের ভেতর ছটা বিয়ে চুকিয়ে ফেলল। এক শ ডি পি ফ্যামিলির কোটাও পূর্ণ হয়ে গেল।

    .

    কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে চারটেয় ইন্টার-আইল্যাণ্ড শিপ সারভিসের চলুঙ্গা নামের মাঝারি আকারের জাহাজটি এসে ভিড়ল রস আইল্যাণ্ডে। এই জাহাজটা আন্দামান ও নিকোবরের নানা দ্বীপে মালপত্র। এবং যাত্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। চলুঙ্গা পঞ্চাশটি উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে এখান থেকে আজ যাবে মধ্য আন্দামানে। কোন কোন পরিবার যাবে, বিশ্বজিৎ রাহা এবং পুনর্বাসন দপ্তরের অন্য অফিসাররা ঠিক করে দিয়েছেন।

    সুর্যের গনগনে, কাকে খাই কাকে খাই চোষা এখন অনেক বদলে গেছে। পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোর আড়ালে সেটা নেমে যাচ্ছে। রোদের তাপ জুড়িয়ে গেছে অনেকটাই। জাদুকলস উপুড় করে কারা যেন সমুদ্রে সোনা ঢেলে চলেছে অবিরল।

    চলুঙ্গা জাহাজ থেকে সিঁড়ি নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল দ্বীপে। নিরঞ্জন, বিভাস এবং পুনর্বাসন দপ্তরের কজন কর্মী তালিকা দেখে হেঁকে হেঁকে পঞ্চাশটি পরিবারকে জাহাজে তুলতে লাগল। খিদিরপুর ডকে যেভাবে ভোলা হয়েছিল, হুবহু সেই পদ্ধতিতে। উদ্বাস্তুরা সিঁড়ি বেয়ে একের পর এক উঠে যাচ্ছে।

    বিদায় জানাতে বিশ্বজিৎ, সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেবরা জাহাজের কাছে চলে এসেছেন। তাদের সঙ্গে বিনয়ও রয়েছে।

    আধঘণ্টাও লাগল না, পঞ্চাশটি ফ্যামিলির প্রায় আড়াই শটি মানুষ জাহাজে উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে কাঠের সিঁড়িও তুলে ফেলা হল।

    তারপর দশ দিগন্ত সচকিত করে গম্ভীর ভো বাজিয়ে এস এস চলুঙ্গা চলতে শুরু করে। জলযানটার আপার ডেকের রেলিং ধরে বেশ কিছু উদ্বাস্তু রস-এর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তাদের ভেতর ঝিনুককে দেখতে পেল বিনয়।

    খিদিরপুর ডকে মুখের একটা অংশ চোখে পড়েছিল। খানিক আগে হরিপদদের বিয়ের আসরে ঘোমটার খানিকটা আবরণ ছিল। এখন ঘোমটা টোমটা নেই। পরিপূর্ণ মুখখানাই দেখা যাচ্ছে। এ কদিন বিনয়ের মনে যে সংশয়টুকু ছিল তা মুহূর্তে উধাও। চিরদিনের চেনা সেই ঝিনুকই। মহারাজা জাহাজে কিংবা খানিক আগে রস দ্বীপে বিনয় তাকে এত খোঁজাখুঁজি করেছে। ডেকেছেও কিন্তু ঝিনুক সাড়া দেয়নি, কাছে আসেনি। নিশ্চয়ই ক্ষোভে, দুঃখে, নিদারুণ অভিমানে। কত আলোকবর্ষ পেরিয়ে এত স্পষ্ট করে বিনয় তাকে দেখল! বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, মজ্জা কুঁড়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কী যে তীব্র আকুলতা!

    ভবানীপুরে এক কুয়াশামলিন সন্ধ্যায় নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল ঝিনুক। এতকাল বাদে আন্দামানের এই বিকেলে, আকাশ থেকে যখন স্বর্ণধারা নেমে আসছে বঙ্গোপসাগরে, তাকে আবার এক ধাবমান জলযানে দেখা গেল। এত কাছে ঝিনুক, কিন্তু তার কাছে যাবার উপায় নেই।

    স্টিমশিপ চলুঙ্গা দূরে, আরও দূরে, পারাপারহীন গভীর সমুদ্রের দিকে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। আচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে থাকে বিনয়।

    [‘কেয়াপাতার নৌকো’-র পরবর্তী পর্ব সমাপ্ত]

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়
    Next Article কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.