Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শতধারায় বয়ে যায় – প্রফুল্ল রায়

    প্রফুল্ল রায় এক পাতা গল্প942 Mins Read0

    ৩৬-৪০. বড় রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে

    ৩৬.

    বড় রাস্তা থেকে বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিনয়। রাগে তার মাথায় আগুন ধরে গেছে ঠিকই, তবে তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক হয়েছে সে। তার ভাল একটা চাকরির জন্য শিশিরের এত আগ্রহের তো একটাই উদ্দেশ্য। প্রথমে তাকে দাঁড় করিয়ে দেবেন। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার পর ঝুমার সঙ্গে বিয়ের কথা পাড়বেন। এর পেছনে নিশ্চয়ই ঝুমার জোরালো চাপ রয়েছে। সে কী ধরনের মেয়ে, বিনয়ের চেয়ে কে আর ভাল জানে। ঝুমা যা চায়, পৃথিবীর সব বাধা চুরমার করে তা আদায় করে নেবার শক্তি তার আছে। হয়তো শিশিরকে তার ইচ্ছার কথা সরাসরি বলেনি। হাজার হোক তিনি বাবা। হয়তো স্মৃতিরেখা কিংবা সুনীতিকে বলেছে। তারা জানিয়েছে শিশিরকে। আনন্দদের সঙ্গে নিখুঁত পরিকল্পনা ছকে তিনি ছুটে এসেছেন টালিগঞ্জে। খান মঞ্জিল সারানোর ব্যবস্থা করা নিশ্চয়ই একটা কারণ, কিন্তু সেটা তো বংশী সিংকে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেই চলত। আসল কারণটা হল, আপাতত লোভনীয় চাকরির টোপ নাকের সামনে ঝুলিয়ে বিনয়কে মুঠোয় পুরে ফেলা। টোপটা গিললেই রূপকথার সেই গল্পের মতো ইহার পর ইহারা সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর-সংসার করিতে লাগিল গোছের পরম রমণীয় একটা পরিসমাপ্তির দিকে তাকে টেনে নিয়ে যাবেন শিশিররা।

    কিন্তু এরা ভেবেছে কী? পৃথিবী নামে গ্রহে ঝিনুক নামে যে একটি মেয়ে ছিল, মাত্র মাসখানেক হল সে নিরুদ্দেশ হয়েছে, সেটা কি এদের স্মৃতি থেকে একেবারেই মুছে গেছে? ঝিনুকের নামটা কারও মুখে একবারও তো শোনা গেল না! সবাই ভুললেও বিনয় কিন্তু তাকে মুহূর্তের জন্যও ভোলেনি। সে মিশে আছে তার শ্বাসবায়ুতে, আছে তার রক্তেমাংসে, তার হাডেমজ্জায়। কতভাবে যে মেয়েটা তাকে জড়িয়ে রয়েছে, একমাত্র সেই জানে। যখনই কোনও ধর্ষিত মেয়ের কথা কানে আসে কিংবা খবরের কাগজে তাদের মর্মান্তিক লাঞ্ছনার বিবরণ পড়ে, এই যেমন লাহোরের নীলম, কুমিল্লার দীপালি, তারপাশা স্টেশনে যে মাঝবয়সী জননীটি অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিল তার মেয়ে, মুকুন্দপুর কলোনির কটি তরুণী ছাড়াও সর্বস্বখোয়ানো শত সহস্র কিশোরী যুবতী–তখনই ঝিনুক হাজার দিক থেকে তাকে বেড়াজালের মতো ঘিরে ধরে।

    বিনয়ের বদ্ধমূল বিশ্বাস, নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও সে বেঁচে আছে। শুধু তাই না, একদিন না একদিন তার সঙ্গে দেখাও হয়ে যাবে। কেন এমনটা মনে হয়, যুক্তি দিয়ে বিনয় বোঝাতে পারবে না। বিশ্বাস বিশ্বাসই।

    সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার তা হল সুধা আর হিরণের আচরণ। হেমনলিনী যখন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঝিনুককে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিলেন, সুধারাই অফুরান মমতায় তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল। আগলে আগলে রেখেছিল দুহাত দিয়ে। অথচ শিশির কী কারণে এ-বাড়িতে এসেছিলেন, সব জেনেও ওরা কেউ আপত্তি করেনি। বরং মনে হয়েছে শিশিরের কথায় ওদের যথেষ্ট সায় রয়েছে।

    এটা ঠিক, প্রায় সারাদিন প্রচুর কথাবার্তা হয়েছে, অবিরল হাসিঠাট্টা, কিন্তু কুমার নাম একবারও কারও মুখে শোনা যায়নি। কিন্তু শিশির যখন চাকরির ব্যাপারটা টেনে আনলেন তখন থেকেই তার অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছিল। তাকে চোখে দেখা যাচ্ছিল না ঠিকই কিন্তু সে ছিল, প্রবলভাবেই ছিল।  তারই জন্য চাকরির সোনালি সুতোর ফাঁসে বিনয়কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়াতে চান শিশির, তা বুঝেও একটি বার ঝিনুকের কথা মনে পড়ল না সুধাদের? সুধারা কি জানে না, ঝিনুকের জন্য দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এমনকি শত আলোকবৰ্ষ সে অপেক্ষা করে থাকবে?

    ঘরের জানালাগুলো বন্ধ। সামনের দিকের দরজার একটা পাল্লা সামান্য খোলা। গলা পর্যন্ত ভারী লেপ টেনে সেই ফঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে বিনয়। অন্যমনস্কর মতো। দিনের শেষে আলোটুকু আরও মলিন হয়ে গেছে। কুয়াশা গাঢ় হতে শুরু করেছে। রাস্তায় মিউনিসিপ্যালিটির টিমটিমে বাতিগুলো এর মধ্যেই জ্বলে উঠেছে। সামান্য ম্যাড়মেড়ে আলো ছাড়া সেগুলোর কাছ থেকে আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। যতদূর নজর যায়, সেই ট্রাম রাস্তা অবধি, সবই ঘোলাটে, ঝাপসা। এখনও ভাল করে সন্ধে নামেনি, তবু চারপাশ ঠাণ্ডায় কেমন যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে।

    বিনয় তাকিয়ে ছিল ঠিকই কিন্তু কিছুই লক্ষ করছিল না। তার বুক ঝিনুকের জন্য নতুন করে উথালপাতাল হয়ে যাচ্ছিল।

    সুধা ঘরে ঢুকল। ভেতরটা বাইরের থেকে অনেক বেশি অন্ধকার। সে সুইচ টিপতেই সারা ঘর আলোয় ভরে গেল। অসময়ে বিনয়কে লেপ ঢাকা দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে সে যতটা অবাক, তার চেয়ে অনেক বেশি চিন্তিত। উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল, কি রে, এই সময় শুয়ে আছিস যে?

    বিনয় উত্তর দিল না।

    সুধা আপাতত আর কিছু বলল না। সন্ধেবেলায় ঘরে ঘরে ধূপ জ্বালানো তার দৈনন্দিন কর্মসূচির মধ্যে পড়ে। সংসারের কোনও কাজই সে হেলাফেলা করে সারে না। সমস্ত কিছুর মধ্যেই থাকে। তার যত্ন এবং নিষ্ঠা। ভাইয়ের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে ডানপাশের দেওয়ালের কাছে চলে গেল। দেওয়ালের গায়ে একটা সিমেন্টের চওড়া তাক। সেটার ওপর গঙ্গাজলের বোতল, ধুপকাঠির বাক্স, দেশলাই আর অজস্র ছিদ্রওলা পেতলের ধূপদানি সাজানো রয়েছে।

    সুধা গঙ্গাজলে হাত ধুয়ে বাক্স থেকে চারটে ধূপকাঠি বার করে, দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে নিচের ছুঁচোলো অংশগুলো ধূপদানির সরু সরু ফুটোয় গুঁজে দিল। জ্বলন্ত ধূপকাঠি থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে চন্দনের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিতে লাগল চারদিকে।

    এবার সুধা চলে আসে ভাইয়ের কাছে। অনেকখানি ঝুঁকে বলে, শরীর খারাপ লাগছে? আবার কি জ্বরটা এল?

    নীরস গলায় বিনয় বলল, না।

    কথাটা বুঝি বা বিশ্বাস হল না সুধার। ভাইয়ের পাশে বসে তার কপালে গালে গলায় হাত বুলিয়ে পরখ করে নিল। উৎকণ্ঠার কারণ নেই। মানুষের শরীরে স্বাভাবিক যেটুকু তাপ থাকা দরকার তার বেশি কিছু নয়। নিশ্চিন্ত হয়ে সুধা বলে, গা তো বেশ ঠাণ্ডাই। ভর সন্ধেবেলায়, কেউ শুয়ে থাকে? ওঠ ওঠ। উমার চা হয়ে গেছে। দাদু আর তোর হিরণদা বাইরের ঘরে তোর জন্যে অপেক্ষা করছে। চা খাবি চল–

    এক ঝটকায় গা থেকে লেপটা সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে বিনয়। ঝাঁঝালো গলায় বলে, এ-সবের মানে কী? তার মুখ কঠোর হয়ে উঠতে থাকে।

    বিনয় ছেলেবেলায় একটু আধটু দুষ্টুমি করত ঠিকই। সুধার সঙ্গে সারাক্ষণ তুমুল যুদ্ধ লেগেই থাকত। কিন্তু বড় হবার পর খুব শান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাকে এমন উগ্র মেজাজে দেখে হকচকিয়ে যায় সুধা। কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই গলার স্বর আরও চড়িয়ে দেয় বিনয়, আমার চাকরির জন্যে শিশিরবাবু কেন এত উঠে পড়ে লেগেছেন তা কি আমি বুঝতে পারিনি? আর তোরাও তা জানিস।

    সুধা ঘাবড়ে যায়। মানে–মানে–

    রোষে ফুঁসতে থাকে বিনয়, ঝিনুক বলে একটা মেয়ে যে ছিল তার কথা একবারও তোদের মনে পড়ল না? ওকে সুস্থ করে তুলতে, ওর মন থেকে ভয় সংকোচ লজ্জা ঘুচিয়ে দিতে কী না করেছিস তোরা? আর এই অল্প কটা দিনের ভেতর শেষের দিকে তার গলা বুজে আসে।

    পাংশু মুখে বসে থাকে সুধা।

    বিনয় আবার আগের মতো ঝাঁঝের সুরে বলে, ঝিনুকের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তোরা জানিস না?

    সুধা, সুনীতি বা জগৎ সংসারের আর কারও কাছেই এত সোজাসুজি, এমন স্পষ্ট করে আগে কখনও ঝিনুকের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলেনি বিনয়। প্রয়োজনও হয়নি। আত্মীয় পরিজন থেকে শুরু করে চেনাজানা সবাই জানত, ঝিনুক তার জীবনের কত বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে। সেই কোন ছেলেবেলা থেকে তার যাবতীয় আশা, যাবতীয় সুখদুঃখ, সমস্ত কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেয়েটা। তাকে বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবতেই পারে না বিনয়। তাকে যদি দুখণ্ড করা যায় তার একটা অংশ অবশ্যই ঝিনুক।

    সুধার উত্তর শোনার আগেই বিনয় ফের বলে ওঠে, তোরা যা মতলব করেছিস তা কখনই হবে না।

    সুধা ভাইয়ের পিঠে একটা হাত রেখে তাকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। নরম গলায় বোঝাতে থাকে, দ্যাখ, শিশিরদাদের অনেকদিন ধরেই হয়তো ইচ্ছে ছিল ঝুমার সঙ্গে তোর বিয়ে হোক। আমি সেটা জানতে পেরেছি এই সেদিন। ঝিনুক থাকলে নিশ্চয়ই ওরা এ ব্যাপারে এগুতো না। কিন্তু কত খোঁজাখুঁজি করা হল। এত দিনেও তার হদিস পাওয়া গেল না। নিজের থেকে যে হারিয়ে যায় তার সন্ধান কি আর মেলে? সে সবিস্তার বলে যায়, তাই শিশিরদা আর স্মৃতিরেখাদি যখন আনন্দদা আর দিদিকে তোর চাকরি আর ঝুমার সঙ্গে বিয়ের কথা বলল, আনন্দদারা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তা জানিয়ে দিয়েছে। আমরাও অনেক ভেবে দেখলাম, ছন্নছাড়ার মতো বাকি জীবন কাটিয়ে দিবি, তা তো আর হয় না। তাছাড়া, এক্সচেঞ্জ করে খান মঞ্জিল-এর মতো অত বড় একখানা বাড়ি পাওয়া গেছে। একতলা দোতলা তিনতলা মিলিয়ে কত ঘর–তোর বিয়ে হলে সবাই একসঙ্গে থাকা যাবে। বাড়ি জমজমাট হয়ে উঠবে।

    বিনয় থ হয়ে যায়। তাকে নিয়ে সুধারা এমন সুদূরপ্রসারী একটা পরিকল্পনা যে করেছে, আগে ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায়নি। চকিতে মনে পড়ে গেল, আজই দুপুরে তাকে আলাদাভাবে খান মঞ্জিল-এর দোতলায় পুব-দক্ষিণ ভোলা প্রশস্ত ঘরখানায় টেনে নিয়ে গিয়ে হিরণ বলেছিল, এই ঘরখানা তার। বিনয়ের যদি মনে হয়, ঘরটার কিছু অদলবদল করবে, করে নিতে পারে। তখন খেয়াল হয়নি, এখন হিরণের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঝুমার সঙ্গে বিয়ের বিয়ে হবে এবং পাকাপাকিভাবে তারা ওদের কাছে থেকে যাবে, এটাই ওদের একান্ত ইচ্ছা।

    অসহ্য রাগে ব্ৰহ্মরন্ধ্র জ্বলে যাচ্ছিল বিনয়ের। কিন্তু নিজেকে এবার আর ফেটে পড়তে দিল না। স্নায়ুমণ্ডলীকে প্রাণপণে নিয়ন্ত্রণে রাখল। খুব ঠাণ্ডা গলায় সে বলে, ছোটদি, একটা কথা তোকে স্পষ্ট করে বলছি।

    বিনয়ের কণ্ঠস্বর শান্ত হলেও তার মধ্যে এমন একটা দৃঢ়তা এবং জেদ মেশানো রয়েছে যাতে চমকে ওঠে সুধা। ভয়ে ভয়ে বলে, কী রে?

    শিশিরবাবু যে চাকরির কথা বলেছেন সেটা আমি কিছুতেই নেব না।

    বিমূঢ়ের মতো সুধা বলে, এত ভাল চাকরি। নিবি না!

    না। কিছুতেই না। তুই বা হিরণদা ভদ্রলোককে আমার কথাটা জানিয়ে দিস।

    সুধা কিছুক্ষণ মুখ চুন করে থাকে। তারপর স্নান সুরে বলে, শিশিরদা আমাদের চেয়ে বয়েসে কত বড়। গুরুজন। নিজে বাড়িতে এসে বলে গেছেন। হুট করে কি তাকে না করে দেওয়া যায়? ভীষণ অপমানিত বোধ করবেন।

    বিনয় বলল, ঠিক আছে, তোদর কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করব।

    শঙ্কাভরা চোখে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় সুধা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে দেখে। তারপর বলে, দেখিস বিনু, এমন কিছু করিস না, যাতে আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়। হাজার হোক, ওঁরা রাজদিয়ার লোক। দিদির দিক থেকেও ঘনিষ্ঠ কুটুম।

    চিন্তা করিস না। তোদের সম্পর্ক নষ্ট হবে না।

    একটু চুপচাপ।

    তারপর সুধা বলল, চল। চা করে বাইরের ঘরে রেখে এসেছি। বোধহয় এতক্ষণে জুড়িয়ে গেল।

    শীত পড়তেই এ-বাড়িতে দুপুরের পর দুবার চা হচ্ছে। একবার বিকেলে, একবার সন্ধের পরপর। আনন্দরা থাকতে বিকেলের চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন দ্বিতীয় প্রস্থ। বিনয় আস্তে আস্তে উঠে পড়ে। বলে, চল–

    খাট থেকে দুজনে নেমে পড়ে। আলনা থেকে একটা চাদর নামিয়ে সারা শরীরে জড়িয়ে নেয় বিনয়।

    বাইরের ঘরে এসে দেখা গেল দ্বারিক দত্ত কান-ঢাকা উলের টুপি এবং গায়ে শাল চাপিয়ে গুটিসুটি বসে আছেন। শীতকালটা বুড়ো মানুষদের ভীষণ কাবু করে ফেলে।

    দ্বারিক দত্তর মুখোমুখি বসে ছিল হিরণ। তার পরনে ঘরে পরার পোশাক। পাজামা-শার্টের ওপর ফুলহাতা গরম সোয়েটার। মাঝখানের সেন্টার টেবলটায় কাঠের ট্রেতে চার কাপ চা। যাতে ঠাণ্ডা হয়ে না যায়, তাই সেগুলোর ওপর প্লেট ঢাকা দেওয়া রয়েছে। আর আছে মস্ত একটা প্লেট বোঝাই স্থানীয় কোনও বেকারির এস বিস্কুট। সেগুলো এমনই কড়কড়ে যে দ্বারিক দত্তর পক্ষে বাঁধানো দাঁত দিয়ে চিবানো শক্ত। তাই তার জন্য থিন অ্যারারুট বিস্কুটও আছে খানকতক।

    বিনয় নিঃশব্দে হিরণের পাশে বসে পড়ে। সুধা বসল দ্বারিক দত্তর কাছাকাছি একটা চেয়ারে।

    দ্বারিক দত্ত বললেন, বিনু, কী করছিলি এতক্ষণ? আমরা তোর জন্যে বসে আছি।

    তার জন্য বুড়ো মানুষটির এখনও চা খাওয়া হয়নি, হিরণও হাত গুটিয়ে বসে আছে। বিনয় একটু লজ্জা পেল। কিছু একটা কৈফিয়ৎ দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুধা বলে ওঠে, কাল জ্বর হয়েছিল। তারওপর দুপুর অবধি খুব ছোটাছুটি গেছে। শরীরটা ভাল নয়। তাই শুয়ে পড়েছিল। বিনয় যে ক্ষোভে রাগে উত্তেজনায় সবার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সেটা আর জানালো না। পাছে চাকরির কথা, দাবার চতুর চালের মতো শিশিরের গোপন ফন্দির কথা উঠে পড়ে এবং তার ফলে খানিক আগের মতো বিনয় গনগনে ক্রোধে ফের একটা অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়ে বসে, সেই ভয়ে একেবারে উতলা হয়ে আছে সুধা।

    দ্বারিক দত্ত বললেন, নাও, সবাই চা খাও বলে একটা কাপ আর থিন বিস্কুট তুলে বিস্কুটটা চায়ে ভিজিয়ে নরম করে খেতে লাগলেন।

    বিনয়রাও হাতে হাতে কাপ তুলে নিয়েছিল। কিন্তু চা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। শীতের সন্ধ্যায় এমন পানীয়ে গা গরম হয় না।

    হিরণ সুধাকে বলল, ধুর, জুত হচ্ছে না। শীতকালে আগুন আগুন চা না হলে চলে! উমাকে আর-এক বার চা করতে বল।

    সুধা বলল, এখনও তো হাতের কাপটা শেষ হয়নি। ঘন্টাখানেক পর চায়ের জল চড়াতে বলব।

    ঠিক আছে। যখন হোক পেলেই হল।

    সুধার শঙ্কা বা দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। না, ওবেলার মতো খান মঞ্জিল, বিনয়ের চাকরি, এই সব নিয়ে কেউ একটি শব্দও মুখ থেকে বার করল না। বরং এ-বছরের শীত নিয়ে আলোচনাটা একই বৃত্তে পাক খেতে লাগল। অল ইণ্ডিয়া রেডিওর নিউজে জানিয়েছে, খবরের কাগজেও বেরিয়েছে, এমন শীত নাকি কলকাতায় গত দশ বছরের মধ্যে পড়েনি।

    দ্বারিক দত্ত বললেন, তোমাদের গরম রক্ত। ঠাণ্ডা সহ্য করার শক্তি আছে। আমার তিনকাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। রাতে লেপ-তোষকের ভেতর হিহি করে কপি। মনে হয়, বরফের মধ্যে শুয়ে আছি। আরও ঠাণ্ডা পড়লে বাঁচব না। এটাই হবে আমার জীবনের শেষ শীত।

    সুধা ধমকে ওঠে, কী বাজে কথা বলছেন দাদু! কলকাতা শহরে এক শ বছরের বেশি কত লোক বেঁচে আছে জানেন?

    দ্বারিক দত্ত হাসেন, তারা এক্সট্রা-অর্ডিনারি। ভগবানের বরে অক্ষয় পরমায়ু নিয়ে জন্মেছে।

    এই ধরনের লঘু চালের কথাবার্তা যখন চলছে, আচমকা বাইরে থেকে যুগলের উঁচু গলার ডাক ভেসে এল, ছুটো দিদি, জামাইবাবু, ছুটোবাবু, তরাতরি দুয়ার খোলেন। একেরে কালাইয়া (জমে) গ্যালাম। সে যখনই আসে দশ দিগন্ত কাঁপিয়ে হাঁক পাড়ে।

    সবাই অবাক। মাত্র একবার ছাড়া আগে আর কখনও যুগল সন্ধের পর এ-বাড়িতে আসেনি। আজ হঠাৎ কী এমন ঘটতে পারে যে তাকে এসময় আসতে হল!

    যুগলের হাঁকাহাঁকি চলছেই। সুধা আর বসে থাকল না। ত্বরিত পায়ে উঠে বাইরের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে উঁচু গলায় উমাকে ডেকে নিচে পাঠিয়ে দিল। তারপর ফিরে এসে নিজের চেয়ারটিতে বসে পড়ল।

    .

    ৩৭.

    একটু পরেই উমার সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে বাইরের ঘরে চলে এল যুগল। উমা অবশ্য দোতলার ভেতর দিকে গেল না, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। যুগল এসেছে, সুধা যদি তার জন্য কিছু এনে দিতে বলে, কিংবা অন্য কোনও দরকার হয়, সেই কারণে তার অপেক্ষা করা।

    যুগলের পোশাক আশাক দেখার মতো। মাথা এবং গলা কম্ফোর্টারে ঢাকা। পরনে পাজামা আর হাফ শার্টের ওপর পোকায়-কাটা সোয়েটার। তার ওপর চাদর। আষ্টেপৃষ্ঠে এত গরম জামাকাপড় প্যাচানো সত্ত্বেও সে ভীষণ কাঁপছিল। মেঝের ওপর থেবড়ে বসে পড়তে পড়তে বলল, আইজ জবর টালকি (শীত)। শীতটা দেখা যাচ্ছে, দ্বারিক দত্তর মতো যুগলকেও কাবু করে ফেলেছে। সিমেন্টের মেঝেটা ঠাণ্ডা বরফ হয়ে আছে। কিন্তু হাজার বললেও যুগল বিনয়দের সামনে চেয়ারে বসবে না।

    সুধা উমাকে বলল, যুগলের জন্যে আগে মোটা আসন দিয়ে যা–

    উমা দৌড়ে একটা কম্বল-কাটা পুরু আসন নিয়ে এল। সেটা পেতে তার উপর বসতে বসতে যুগল বলল, হুদা আসনে মানাইব না। জিভ্যায় (জিভে) ছ্যাকা লাগে, বড় গেলাস ভইরা এমুন চা কইরা দিতে কন উমা বুইনরে।

    খানিক আগেই আগুন আগুন চায়ের কথা হচ্ছিল। সুধা হিরণদের দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে একটু হাসল। অর্থাৎ এক ঘণ্টা পরে নয়, যুগলের কল্যাণে ঢের আগেই চাটা পাওয়া যাবে। সে উমাকে বলল, যুগল কী বলেছে, শুনলি তো? সবার জন্যে চা, আর যুগলের জন্যে চায়ের সঙ্গে কিছু খাবারও নিয়ে আসিস।

    উমা আর দাঁড়াল না।

    যুগল বলল, ছুটো দিদি, আইজ রাইতে আপনেগো এইহানে থাকুম। রান্ধন কি হইয়া গ্যাছে?

    সুধা জিজ্ঞেস করল, কেন বল তো?

    তাইলে আমার লেইগা চাউরগা (চাট্টি) চাউল লইয়েন।

    ওবেলার প্রচুর ডাল ভাত মাছ মাংস তরকারি বেঁচে গেছে। শীতকালে এত তাড়াতাড়ি রান্না জিনিস নষ্ট হয় না। সেগুলো গরম করে নিলেই চলবে। যুগল একা কেন, আরও পাঁচজন এলেও নতুন করে ভাতটাত চাপাতে হতো না। সুধা বলল, ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

    কাইল দুফারেও এইহানে খাইয়া যামু কিলাম (কিন্তু)।

    ঠিক আছে।

    একধারে বসে যুগলকে লক্ষ করছিল বিনয়।

    পৃথিবীতে এমন দুচারটে মানুষ আছে যাদের দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। যুগল তাদেরই একজন। কিছুক্ষণ আগেও যে ক্রোধ, ক্ষোভ এবং উত্তেজনা বিনয়ের মস্তিষ্কে টগবগ করে ফুটছিল, এখন সে-সব অনেকটাই জুড়িয়ে এসেছে। সে জিজ্ঞেস করল, এই রাত্রিবেলা হঠাৎ কোত্থেকে এলে?

    যুগল বলল, আইছি কি অহন? হেই দুফারে মুকুন্দুপর থিকা বাইর হইছিলাম।

    কলকাতায় কিছু দরকার ছিল?

    হ। কইলকাতা ছাড়া বাচনের পথ আছে নিকি?

    আশু দত্তর কথা মনে পড়ে গেল বিনয়ের। বেশ কয়েকদিন আগে যুগল তাদের কলোনিতে একটা স্কুল বসাবার জন্য একরকম জোর করেই তাকে মুকুন্দপুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কথা খেয়াল ছিল না। ব্যস্তভাবে বিনয় জিজ্ঞেস করল, আশু স্যার কেমন আছেন?

    উমা চা আর মিষ্টি নিয়ে এল। আয়েস করে গরম চায়ে চুমুক দিয়ে যুগল বলল, তেনিও তো আমার লগে আইছেন।

    এখানে নিয়ে এলে না কেন?

    তমস্ত দিন দুইজনে গরমেনের অপিসে ঘুরাঘুরি করছি। মাস্টর মশয় বুড়া মানুষ। হয়রান হইয়া পড়ছিলেন। কইলেন, আমারে সন্তোষের বাসায় দিয়া আয়। কালীঘাটে উনার মাউসাতো ভাইয়ের বাসায় রাইখা আপনেগো এইহানে চইলা আইছি। সন্তোষবাবুরা তেনাগো বাড়িতে থাকতে কইছিল। কিন্তু উইহানে জাগা কম। উনাগো অসুবিধা হইত। হের লেইগা আপনেগো কাছে চইলা আইলম। মাস্টর মশয় জানাইতে কইছেন পরে যেইদিন কইলকাতায় আইবেন, আপনের লগে দেখা করবেন। সোময় সুযুগ কইরা আপনেরে মুকুন্দুপুরে যাইতে কইছেন।

    বিনয় বলল, স্যার ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে এসেছেন। এত কাছে, আমার নিজেরই এখন একবার যাওয়া উচিত। কিন্তু শরীরটা আজ ভাল নেই। কাল সকালে গিয়ে যে দেখা করব, তাও হবে না। অফিসের দরকারি কাজে ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়তে হবে। এখন মাসখানেক ভীষণ ব্যস্ত থাকব। পরে এক ছুটির দিনে মুকুন্দপুরে চলে যাব। তা গভর্নমেন্ট অফিসের কথা বলছিলে না?

    যুগল বলল, হ।

    সেখানে এসেছিলে কেন?

    যুগল বিপুল উৎসাহে তড়বড় করে আগের ঘটনা পরে, পরের ঘটনা আগে সব জড়িয়ে মুড়িয়ে এলোমেলোভাবে যা বলল তা গুছিয়ে নিলে এইরকম দাঁড়ায়। তাদের কলোনিতে স্কুলের জন্য আপাতত মস্ত একখানা ঘর তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই নিয়ে ওখানে প্রচণ্ড উদ্দীপনা। মুকুন্দপুরবাসীরা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তাদের জীবন কষ্টেসৃষ্টে কোনওরকমে কেটে যাচ্ছে। কিন্তু পেটে কালির অক্ষর না ঢুকলে সীমান্তের এপারে তাদের সন্তানদের টিকে থাকাই মুশকিল। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখলে চাকরিবাকরি মিলবে। তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে।

    কিন্তু শুধুমাত্র উদ্দীপনা থাকলেই তো হয় না। যুগলরা না হয় ঘর বানিয়ে দিল। সেটাই তো সব নয়। স্কুল চালাতে গেলে বহু কিছু দরকার। আশু দত্তর যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তার একার পক্ষে কলোনির এতগুলো বাচ্চাকে মুখে ফেনা তুলে কতকাল পড়ানো সম্ভব? সেজন্য এখনই আর একজন টিচার না নিলেই নয়। কিন্তু নিলেই তো হল না। তাকে পয়সাকড়ি দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের বইপত্র খাতাপেন্সিল চাই।

    মা-বাপদের হাল তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। একবেলা ভাত জোটে তো আর-এক বেলা হরিমটর। স্কুল চালাতে গেলে আসল যেটা দরকার তা হল টাকা। তাছাড়া স্কুল খুললে সরকারি অনুমোদনও পেতে হবে।

    রাজদিয়া হাইস্কুলে আশু দত্তর একজন প্রাক্তন ছাত্র এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরে মস্ত বড় মাপের অফিসার। তাঁর কাছে গেলে মুকুন্দপুর স্কুলের সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে।

    যুগল বলতে লাগল, মাস্টর মশয় তেনির ছাত্রর.কথা জানতেন। ঠিক কইরা রাখছিলেন, ইস্কুলের ঘরখান বানাইনা (তৈরি) হইলে ছাত্রর লগে দ্যাখা করবেন। হেইমতো আইজ মাস্টর মশয় আমারে টানতে টানতে ডালৎসিতে একহান বাড়ি লইয়া আইলেন। তিনতালা বাড়ি। কুনহানে আগা, কুনহানে শ্যাষ ঠাহর পাই না। কাতার দিয়া ঘরের পর ঘর। সুখের দিকে চওড়া বারিন্দা। এরে-ওরে জিগাইয়া একতালা দুইলা তিনতালা ঘুইরা যহন হেই অফসররে বাইর করলাম, মাজা (কোমর) বেইকা (বেঁকে) গ্যাছে। আমারই যদি এই অবোস্তা হয়, মাস্টর মশয়ের কী হাল হইছে, বুইঝা দ্যাহেন।

    একটানা কথা বলে হাঁপিয়ে পড়েছিল যুগল। খানিকক্ষণ দম নিয়ে ফের শুরু করে, অফসরের নাম শিবনাথ স্যানগুপ্ত। পাও থিকা মাথার চুল তরি (অবধি) পুরা সাহেব। এত বড় অফসর কিন্তুক মাটির মানুষ। পুরানা মাস্টর মশয়রে ভুলে নাই। ম্যালা (অনেক) বচ্ছর পর আশু দত্তরে দেইখা পরথমে আটাস (অবাক) অইয়া গেল। হের পর তেনার পায়ে মাথা রাইখা স্যাবা দিল (প্রণাম করল)। হের পর মাস্টর মশয়রে গদি-আলা লম্বা চ্যারে (চেয়ারে) ধইরা ধইরা নিয়া বহাইল। চা আইল, বড় বড় সন্দেশ আইল, রসগুল্লা আইল। তরিজুত কইরা খাওয়ানের পর মাস্টর মশয়ের মুখে আমাগো ইস্কুলের কথা মন দিয়া হোনলেন।

    ঘরের সবাই গভীর আগ্রহে শুনে যাচ্ছিল। দ্বারিক দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, তারপর?

    হগল হুইন্যা তেনি ভরসা দিয়া কইলেন, কুনো চিন্তা নাই। আমাগো কুলোনির স্কুলের লেইগা যত ট্যাকা দরকার, সরকার থিকা পাওন যাইব। আমরা অহন নিচ্চিন্ত। মাস্টর মশয়রে জোর কইরা কুলোনিতে ধইরা নিয়া গ্যাছিলাম। নাইলে স্কুলটা করতে পারতাম না। আমাগো পোলাপানগুলানও মানুষ হইত না।

    দ্বারিক দত্ত বললেন, সেই কত বছর আগে ঢাকা থেকে এম এ পাস করে আসার পর হেমনাথ আর মোতাহার হোসেনের সঙ্গে আশু রাজদিয়ায় স্কুল বসিয়েছিল। এই বয়েসে কলোনিতে গিয়ে আবার বসাচ্ছে। বিয়েশাদি করে সংসার করল না। সারাটা জীবন স্কুল আর ছাত্রই ওর ধ্যানজ্ঞান। এমন মানুষ হয় না।

    একধারে বসে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। চকিতে একজনের কথা মনে পড়ে যায়। রামরতন গাঙ্গুলি। আশু দত্তর মতো তিনিও ইউনিভার্সিটিতে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট করার পর হেলায় নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পূর্ব বাংলার নগণ্য এক গ্রামে স্কুল বসিয়েছিলেন।

    রামরতন সীমান্তের এপারে পৌঁছাতে পারেননি। আসতে পারলে আশু দত্তর মতো তিনিও হয়তো কোনও নিরক্ষর উদ্বাস্তুদের কলোনিতে স্কুল বসাতেন।

    রামরতনের কথা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে সারি সারি কটি মুখ চোখের সামনে ফুটে ওঠে। তার বৃদ্ধা স্ত্রী, বাসন্তী, ছায়া, মায়া। মাঝখানে কটা দিন নিজেকে নিয়ে বিনয়কে এতই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে ছায়া-মায়াদের একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। অথচ ওরা তার মুখ চেয়ে বসে আছে। নিজেকে বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক মনে হয় বিনয়ের।

    অসহায় চার রমণীকে নিদারুণ একটা খবর দেবার ছিল। নিত্য দাস জানিয়ে গিয়েছিল, জামতলির নাসের আলি তাদের দেশের বিষয়আশয় বিক্রির ব্যবস্থা করতে গিয়ে খুন হয়ে গেছেন। ওপার থেকে কিছু টাকা পয়সা পাওয়ার যে ক্ষীণ আশাটুকু ছিল তা বিলীন হয়ে গেছে। এই খবরটা ওদের জানানো হয়নি। তাছাড়া ছায়া-মায়ার চাকরির জন্য তার কাছে কত যে কাকুতি মিনতি করেছেন রামরতনের স্ত্রী। তা নিয়েও কিছুই করা হয়নি। ভেবেছিল, আনন্দ আর হিরণকে দুজনের জন্য যে কোনও সম্মানজনক কাজ জোগাড় করে দিতে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাবে। দেওয়া হয়নি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছায়া-মায়াদের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

    এদিকে যুগল বলছিল, আইজ পুরা কাম হয় নাই। হেই অফসর কাইল দুফারে দুইটার সোময় ফির যাইতে কইছেন। আশু মাস্টর মশয়রে অনেকগুলান সরকারি চোতায় সই মই করতে অইব। হের পর আমরা মুকুন্দুপুর চইলা যামু।

    বিনয় জিজ্ঞেস করল স্যারের মা তো সন্তোষবাবুদের কাছে ছিলেন।

    হ। অহনও আছেন। সন্তোষবাবুরা তেনারে খুব যত্ন করেন।

    স্যার কি এর মধ্যে তাঁকে মুকুন্দপুর নিয়ে যাবেন?

    না না। বিলের কিনারে আমাগো কুলোনি। জবর টালকি (ঠান্ডা)। কইলকাতার থিকা পাঁচ সাতগুণ বেশি। এই সোময় বুড়া মানুষরে নিয়া গ্যালে বাঁচব না। শীতকালটা কাটুক, ফাগুন মাস পড়ক, রইদের (রোদের তাপ বাড়ুক, তহন উনি যাইবেন।

    কিছুক্ষণ নীরবতা।

    তারপর একটু ভেবে বিনয় জিজ্ঞেস করে, মাঝখানে বেশ কয়েকদিন আমার মুকুন্দপুরে যাওয়া হয়নি। এর ভেতর নতুন কোনও রিফিউজি সেখানে গেছে?

    যুগল বলল, গ্যাছে বিশ পঁচিশখান ফেমিলি। শিয়ালদহর ইস্টিশান থিকা আমিই তাগো লইয়া গ্যাছি।

    এরা সব কোন জেলার লোক?

    কুন জিলার আবার? ঢাকা বিক্রমপুরের। আমাগো রাইজদার চাইর পাশের গেরাম গুয়াখোলা, গিরিগঞ্জ, ডাকাইতা পাড়ায় তাগো ভিটামাটি আছিল।

    অর্থাৎ মুকুন্দপুর জবরদখল কলোনিতে পূর্ব বাংলায় ফেলে আসা প্রিয় ভূখণ্ডটিকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে যুগল। রিফিউজি স্পেশাল বোঝাই হয়ে সীমান্তের ওপারের যে উদ্বাস্তুদের ঢল রোজ শিয়ালদায় নামে তাদের ভেতর থেকে রাজদিয়া অঞ্চলের লোক বেছে বেছে সে কলোনিতে নিয়ে যায়।

    যুগল ফের বলে, মুকুন্দপুরে গ্যালেই দেখতে পাইবেন নয়া মানুষগুলান আপনের অচিনা (অচেনা) না। দ্যাশে থাকতে তাগো দ্যাখছেন।

    কথায় কথায় রাত বাড়ে। শীতে শহর ক্রমশ নিঝুম ও অসাড় হয়ে যেতে থাকে। দূরের বড় রাস্তা থেকে ক্কচিৎ দু-একটা ট্রাম, বাস কি ঘোড়ার গাড়ির ছুটে চলার আওয়াজ ভেসে আসে।

    এদিকে সুধা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কাল নটার ভেতর হিরণের অফিসের ভাত দিতে হবে। বিনয়ও বলে রেখেছে, সকাল সকাল বেরিয়ে পড়বে। তার জন্য তো বটেই, যুগল এসেছে, বাড়ির অন্য লোজন রয়েছে–এদের সবার জন্যও জলখাবার করতে হবে। খাওয়াদাওয়ার পর্ব চুকিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া দরকার। সুধার আর বসে থাকার উপায় নেই। সে উঠে পড়ে, অনেক রাত হয়েছে। আর গল্প নয়। উমা আর আমি খাবার গরম করে দশ মিনিটের ভেতর তোমাদের ডাকছি। হাত মুখ ধুয়ে নাও। বলে সে বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।

    .

    খাওয়ার পালা চুকতে ঢুকতে রাত দশটা বেজে গেল। যুগল থাকবে। তার জন্য বাইরের ঘরে বিছানা পেতে দিল উমা।

    .

    ৩৮.

    নতুন ভারত-এর চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ির সঙ্গে শান্তিনিবাস মেসে যেদিন বিনয় দেখা করতে যায় সেদিন তিনি রিফিউজি ক্যাম্প আর জবরদখল কলোনির লম্বা একটা লিস্ট তাকে দিয়েছিলেন। সেই তালিকার ভেতর থেকে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিটা বেছে রেখেছিল বিনয়। নামটা তার খুব ভাল লেগেছে। দেশ থেকে উৎখাত হওয়ার পর হাজার কষ্টেও এই কলোনির বাসিন্দাদের মন থেকে সোনার বাংলা মুছে যায়নি। যুগলের মতো তেমনই একটি কলোনি বঙ্গদেশ সীমান্তের এপারে তারাও বুঝিবা গড়ে তুলতে চায়। বিনয় ঠিক করেছে প্রসাদ যে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি দিয়েই সেটা শুরু করবে। কাল রাতেই সে ভেবে রেখেছিল ভোর ভোর উঠে বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। ধড়মড় করে বিছানা থেকে বাইরে আসতে বিনয়ের চোখে পড়ল, দুজন ছাড়া সারা বাড়ি জেগে গেছে। দ্বারিক দত্তর যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আর সরস্বতী সুস্থ হয়ে উঠলে এখনও বেশ দুর্বল। ওঁরা বেশ বেলা করে ওঠেন।

    রান্নাঘরে এর মধ্যেই ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। একই সঙ্গে চলছে রান্নাবান্না এবং জলখাবার তৈরির তোড়জোড়। সুধা আর উমার হাত চলছে নিপুণ যন্ত্রের মতো। কুটনো কোটা, চালধোয়া, জলখাবারের জন্য ময়দা মেখে লুচি বেলা–কাজ কি একটা দুটো? বিশ হাতে দুজনে তা সামলাচ্ছে।

    সুধাকে এক ডেকচি গরম জল করে চানঘরে পাঠিয়ে দিতে বলে বিনয় শেভ করে, মুখ ধুয়ে নিল। তার মধ্যেই গরম জল পৌঁছে গেছে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে পোশাক পালটে সে সোজা চলে এল বাইরের ঘরে। সেখানে খবরের কাগজে চোখ বুলোত বুলোতে যুগলের সঙ্গে কথা বলছিল হিরণ। বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, বেরুবার জন্যে একেবারে রেডি দেখছি।

    হ্যাঁ সামান্য হেসে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বিনয়।

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সুধা আর উমা বিনয় এবং যুগলের জন্য থালা বোঝাই করে লুচি তরকারি আর চা নিয়ে এল। হিরণের জন্য অবশ্য শুধুই চা আর একখানা বিস্কুট। ছুটির দিন বাদে সকালে চা-বিস্কুট ছাড়া আর কিছু খায় না সে।

    সুধা বিনয়কে জিজ্ঞেস করে, এখন তো বেরুচ্ছিস। কখন ফিরবি?

    যেখানে যাচ্ছে সেখানকার কাজ কখন শেষ হবে, কে জানে। বিনয় বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। দেরি হলে সোজা অফিসে চলে যাব।

    দুপুরে কোথায় খাবি?

    অফিসের কাছে নিশ্চয়ই হোটেল টোটেল আছে। সেখানে কোথাও খেয়ে নেব।

    সুধা একটু ভেবে লল, যদি তাড়াতাড়ি কাজ হয়ে যায় বাড়িতে এসে খেয়ে যাস।

    আচ্ছা—

    সুধা আর উমা চলে গেল।

    লুচি ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে পুরছিল ঠিকই কিন্তু মাথার ভেতর সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিটা ঘুরছিল। প্রসাদের লিস্টে কলোনিটার ঠিকানা দেওয়া আছে। গড়িয়ার মোড় থেকে রাজপুরের দিকে খানিকটা গেলে সেখানে পৌঁছনো যাবে।

    টালিগঞ্জ থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত যাবতীয় রাস্তা, অলি গলি, বাসের রুট, ট্রামের রুট সড়গড় হয়ে গেছে বিনয়ের। কিন্তু গড়িয়া উড়িয়া তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। সেখানে কীভাবে, কত নম্বর বাস ধরে যেতে হবে, খেতে খেতে হিরণের কাছে বিশদভাবে জেনে নিল।

    খাওয়া শেষ হলে সে বলল, হিরণদা, এবার বেরিয়ে পড়ি। যুগলকে বলল, পরে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। তারপর রান্নাঘরের দরজার সামনে গিয়ে বলল, চলি রে ছোটদি–

    সাবধানে যাস– সুধা কাটা আনাজ ধুচ্ছিল। আঁচলে ভেজা হাত মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে সিঁড়ির মুখ পর্যন্ত এল।

    .

    বিনয় বড় রাস্তায় এসে ছনম্বর রুটের বাস ধরল। এটা গড়িয়া পর্যন্ত যাবে। সেখানে নেমে হরিনাভি রাজপুরের দিকের বাস ধরতে হবে।

    কুয়াশা কেটে গিয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। এখন সোনালি রোদে ভরে গেছে সারা শহর। কিন্তু রোদটা এতটাই নিস্তেজ যে শরীরকে তপ্ত করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। শীতল বাতাস ধীর চালে বয়ে চলেছে।

    বাসে প্যাসেঞ্জারও বেশ কম। রোগাটে চেহারার কন্ডাক্টরটা–গায়ে ময়লা খাটো পাজামা আর হাফ শার্টের ওপর সস্তা সোয়েটার, মাথা আর গলা পেঁচিয়ে কম্ফোর্টার-পাদানিতে দাঁড়িয়ে খ্যানখেনে গলায় গিটকিরি খেলিয়ে চেঁচিয়ে চলেছে একটানা-টালিগঞ্জ টেরাম ডিপো, রানিকুঠি, বাঁশধানি, নাকতলা, গড়িয়া–চলে আসুন, চলে আসুন, খালি গাড়ি

    কলকাতায় আসার পর বিনয় যে বাসেই উঠেছে, সেটা যদি মুড়ির টিনের মতো বোঝাইও থাকে, সব কন্ডাক্টরের মুখে এক সুরে একই লজ, খালি গাড়ি, খালি গাড়ি– কথাটা মনে পড়তেই তার হাসি পায়।

    একটা জোড়া সিটের জানালার পাশে বসে ছিল বিনয়। টালিগঞ্জে তার দৌড় সুধাদের জাফর শা রোডের বাড়ি, খান মঞ্জিল-এর সামনের রাস্তা, আর আদি গঙ্গার ধারের বাজার অবধি। এ-দিকটায় আগে আর কখনও আসেনি সে। ট্রাম রাস্তার দুধারই ফাঁকা ফাঁকা। প্রচুর বড় বড় ঝাড়ালো। গাছ চোখে পড়ছে। এইসব বনস্পতির মাথায় উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। তাদের ডানার অজস্র রঙে। রোদ পড়ে একটা ঝলমলে মায়াবি নকশা তৈরি হচ্ছে।

    দুটো স্টপেজ পেরুবার পর একটা লোক বাসে উঠল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। ক্ষয়াটে, পাকানো চেহারা। কণ্ঠমণি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। খেলো ধুতি-শার্টের ওপর চাদর। চেহারা দেখেই টের পাওয়া যায় তার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝাঁপটা গেছে। এধারে ওধারে আট দশটা খালি সিট। চারদিকে তাকিয়ে কী ভেবে লোকটা বিনয়ের পাশে বসে পড়ল। তারপর গায়ের চাদরটা বেশ ঘন করে বুক পিঠ আর গলায় সাপটে জড়িয়ে নিল।

    এক পলক তাকে দেখে ফের জানালার বাইরে চোখ ফিরিয়ে নেয় বিনয়। কিন্তু কলকাতার এই অচেনা এলাকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যে দেখবে তার কি উপায় আছে? কেননা তার পাশের সহযাত্রীটি ভীষণ ছটফটে আর গায়ে-পড়া। চুপচাপ বসে থাকা তার ধাতে নেই। ঘাড় কাত করে দু-একবার বিনয়কে দেখে নেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে, কদূর যাইবেন বাবুমশয়?

    অগত্যা মুখ ফেরাতেই হয়। কোথায় চলেছে সেটা জানিয়ে দেয় বিনয়।

    লোকটা বলল, হে তো ম্যালা (অনেক) দূর। আমি অতখানি যামু না। বাশধানীতে লামুম। লন (চলুন), কথা কইতে কইতে যাই।

    ভাষা আর উচ্চারণ শুনে আগেই টের পাওয়া গেছে, লোকটা ওপার বাংলার। বিনয় বলল, বাশধানীটা কোথায়?

    লোকটা বেশ অবাক হল, বাশধানী কুনখানে জানেন না? জাগানের নামও বুঝিন হুনেন নাই?

    বাশধানীর নাম না-শোনা এবং এই শহরের কোথায় তার অবস্থান সেটা না-জানা কতটা অপরাধের, বোঝা যাচ্ছে না। বিনয় শুধু মাথা নাড়ে, না।

    কী একটু চিন্তা করে লোকটা বলল, আপনে কি কইলকাতার মানুষ না?

    খুব ছেলেবেলাটা অবশ্য কলকাতায় কেটেছে বিনয়ের। তারপর থেকে রাজদিয়াই তো তার সর্বস্ব। ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে সে, না। আমি এখানে নতুন এসেছি।

    লোকটা বিনয় সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে, আপনের দ্যাশ কুনখানে?

    ঢাকা ডিস্ট্রিক্টের রাজদিয়ায়।

    লোকটার দুচোখ প্রবল উৎসাহে চকচক করতে থাকে। কন কী! রাইজদা তো আমি চিনি। বিক্রমপুরে। আমাগো বাড়ি আছিল বজরযুগনিতে (বজ্রযোগিনীতে)। বজরযুগনির নাম নি শোনছেন?

    বিনয় ঘাড় কাত করল, শুনেছি। নাম-করা গ্রাম। দু-একবার সেখানে গেছিও।

    লোকটা বলল, আপনেও বিক্রমপুইরা, আমিও বিক্রমপুইরা। কী ভালা যে লাগতে আছে। তা কবে আইছেন কইলকাতায়?

    প্রথম দিকে বিরক্ত হচ্ছিল বিনয়। কিন্তু লোকটার কথাবার্তায়, স্বভাবে অদ্ভুত সারল্য মাখানো। তাছাড়া একই দেশে বাড়ি। তাকে এখন অসহনীয় মনে হচ্ছে না। বিনয় বলল, মাস দুই হবে। একটু বেশিও হতে পারে। আপনি কতদিন আগে এসেছেন?

    বচ্ছরখানেক আগে। পাকিস্থানে তো আর থাকন গ্যাল না। ভিটামাটি খুয়াইয়া শিয়ালদর ইস্টিশানে আইয়া মাস তিন চাইর পোলামাইয়া লইয়া পইড়া রইলাম। হাজারে হাজারে রিফুজ। জাগাখান (জায়গাটা) এক্কেরে থিকথিকা নরক। একদিন ঠিক কইরা ফালাইলাম, উইহানে আর থাকাথাকি নাই। থাকলে পথের কুত্তা বিলাইয়ের (বেড়ালের) লাখান গুষ্টিসুদ্ধা শ্যাষ হইয়া যামু। শুনাশুন কানে আইল, রানীকুঠি বাঁশধানীর দিকে রিফুজরা জবরদখল কুলোনি বহাইতে আছে। অ্যামনেও মরুম, ওমনেও মরুম। ভাবলাম বাচনের চ্যাষ্টা কইরা দেখি। শিয়ালদায় সরকারি অফসরগো কিছু না জানাইয়া একদিন। রইতে চইলা আইলাম বাশধানীতে। হেই থিকা উইহানেই ঘর তুইলা রইছি। শিয়ালদার তুলনায় এই কুলোনি স্বগ্ন।

    হুবহু যুগলদেরই কাহিনি। পশ্চিমবঙ্গের এক টুকরো ভূখণ্ড দখল করে তেমনি ঘরবাড়ি বানিয়ে নতুন করে বাঁচার অবিরল, প্রাণপণ প্রয়াস। বিনয় লোকটা সম্বন্ধে এবার রীতিমতো আগ্রহ বোধ করে। তাকে অফিস থেকে নানা রিফিউজি ক্যাম্প এবং কলোনিতে ঘুরে ঘুরে তথ্য জোগাড়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। লোকটা যেচে আলাপ করেছে, এ একরকম ভালই হল। ওদের কলোনিতেও যাবে। সে। হয়তো সেখানে চমকপ্রদ অনেক খবরাখবর পাওয়া যাবে। জিজ্ঞেস করে করে সে জেনে নিল, ওদের কলোনির নাম দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নগর। ভারতবর্ষের এক সর্বত্যাগী জননায়কের নামে নতুন এই উপনিবেশের নাম। বাশধানীতে নেমে বাঁ দিকে মিনিট পনেরো হাঁটলে তাদের কলোনিতে পৌঁছনো যাবে। আরও জানা গেল, তার নাম ধনঞ্জয় বণিক।

    প্রসাদ লাহিড়ির সেই লিস্টটায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নগর-এর নাম আছে কি না, বিনয় মনে করতে পারল না। বলল, একদিন আপনাদের কলোনিতে যাব।

    নিয্যস (নিশ্চয়ই) আইবেন। দেইখা যাইয়েন আমরা ক্যামন কইরা বাইচা আছি।

    একটু চুপচাপ।

    তারপর লোকটা, অর্থাৎ ধনঞ্জয় বণিক বলে ওঠে, তহন কইলেন কইলকাতার এই মাথায় আগে কুনোদিন আহেন নাই।

    হ্যাঁ– বিনয় ঘাড় কাত করে। তাইলে আপনের ম্যালা (অনেক) কিছু চিনন জানন (চেনা জানা) দরকার। বলে ডান পাশে, রাস্তার ওধারে আঙুল বাড়িয়ে একটা উঁচু পাঁচিল দেখিয়ে ধনঞ্জয়। বলল, এহানে কী হয় জানেন?

    জবরদখল কলোনি থেকে একেবারে আলাদা প্রসঙ্গে চলে গেছে লোকটা। বিনয় লক্ষ করল, পাঁচিলটা ফুটপাথের গা ঘেঁষে একটানা চলেছে তো চলেছেই। আন্দাজ করা যায়, ওটার ওপাশে অনেকখানি এলাকা রয়েছে। ভেতরে কী আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। যা চোখে পড়ছে তা হল উঁচু উঁচু সব বনস্পতি। বিনয় বলল, না, জানি না। ছুটির দিনে উইহানে সাহেব মেমগো মেলা বইয়া যায়। লম্বা লম্বা লোহার কাঠি আর সাদা বল দিয়া হেরা তমস্ত (সারা) দিন খেলে। এই খেলাটার কয়ে গলফো।

    বিনয় অনুমান করে নিল, ধনঞ্জয়ের গলফো হল গলফ। কলকাতায় একটা বিশাল গলফ ক্লাব আছে, সেটা আগেই শুনেছে সে। খেলাটা কী ধরনের, সে-সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তবে গলফ ক্লাবটা যে টালিগঞ্জেই, ধনঞ্জয়ের দৌলতে তা জানা গেল।

    গলফ ক্লাবের লম্বা পাঁচিল পেছনে ফেলে কিছুক্ষণের মধ্যে ছনম্বর বাস একটা মোড়ের মাথায় চলে আসে। ফাটা রেকর্ডের মতো একটানা এক সুরে কন্ডাক্টরের চিল্লানি চলছেই, রানিকুঠি, গাছতলা, নাকতলা, রথতলা, গড়িয়াখালি গাড়ি, খালি গাড়ি–

    মোড়ের মুখে মস্ত মস্ত শেডের তলায় কাতার দিয়ে ঝকঝকে অগুনতি ট্রাম দাঁড়িয়ে আছে। ধনঞ্জয় বলল, এইটা হইল গিয়া টালিগুঞ্জের টেরাম ডিপু। কইলকাতার টেরাম এই তরি (অবধি) আহে।

    ধনঞ্জয় উপযাচক হয়ে গাইডের ভূমিকাটি নিয়েছে। অনেকটা যুগলেরই মতো। ধনঞ্জয়ের ধারণা সে কলকাতায় এসেছে বিনয়ের অনেক আগে, এই শহর সম্পর্কে সে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। এখানকার পথঘাট, অন্ধিসন্ধি, সমস্ত কিছুই তার নখদর্পণে। কাজেই সদ্য-চেনা, তারই মতো বিক্রমপুইরা যুবকটিকে টালিগঞ্জ এলাকার যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গা চিনিয়ে দেওয়ার দায় যেন তারই। বিনয় মনে মনে একটু হাসে। উত্তর দেয় না।

    ধনঞ্জয় সোজা রাস্তাটার দিকে একবার আঙুল বাড়ায়, এবং একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য পেশ করে। উই যে পথহান দেখতে আছেন, উইটা সিধা কুঘাটে গিয়া ঠেকছে। তার দুই ধারে আলিসান আলিসান সিনেমা বানানের কারখানা

    কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না বিনয়ের। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সিনেমা বানানোর কারখানা মানে?

    বিনয়ের অজ্ঞতায় হয়তো করুণাই বোধ করে ধনঞ্জয়। তার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে, কাননবালা, অহীন্দ চধরি, রোবিন মজুমদার, বরুয়া, ভারতী, চন্দাবতী, জহর গাঙ্গুলি, রেণুকা রায়, ছবি বিশ্বাস, ফণী রায়-এনাগো নাম নি হোনছেন?

    বিনয় বলল, এঁদের নাম কে না জানে? ঢাকায় গিয়ে ওঁদের ছবিও দেখেছি। শেষ উত্তর, মানে না মানা, শহর থেকে দূরে, দেবদাস, উদয়ের পথে–এমনি অনেক।

    ধনঞ্জয় নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। দুই হাত ঝাড়া দিয়ে বলে, তাইলে তো আপনে বেবাইক জানেন। যেনাগো নাম কইলেন তেনারাই এইহানে সিনেমা বানায়।

    বাস বাঁয়ে ঘুরে একটা সরু রাস্তায়, খানিকটা পিচের, খানিকটা খোয়র, এবড়োখেবড়ো এসে পড়ে। মোড় থেকে দেড়শ দুশ ফিট যায়নি, হঠাৎ বাঁ পাশে হাত বাড়িয়ে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে ধনঞ্জয়। এই দ্যাহেন একখান সিনেমার কারখানা

    বিনয় মাথা ঝুঁকিয়ে লক্ষ করল, একটা মস্ত গেটের মাথায় আধখানা বৃত্তের আকারে সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ইন্দ্রপুরী স্টুডিও। গেট থেকে নুড়ি-বিছানো রাস্তা ভেতর দিকে যেখানে গিয়ে ঠেকেছে। সেই জায়গাটায় ফ্যাক্টরির শেডের মতো অ্যাসবেস্টসের ঢালু ছাদওলা উঁচু উঁচু অনেকগুলো বাড়ি।

    লহমায় স্টুডিও পেছনে ফেলে ভাঙাচোরা রাস্তায় টাল খেতে খেতে অনেকটা এগিয়ে এল বাসটা। এবার দুধারে প্রচুর গাছপালা, ডোবা, পানাপুকুর, মাঝেমধ্যে ছিরিছাঁদহীন আদ্যিকালের কিছু বাড়িঘর। ফাঁকা, পোড়ো জমিই বেশি।

    একসময় ধনঞ্জয় বলল, বাও (বাঁ দিকে নজর করেন বাবুমশয়। এইহান থিকা জবরদখল কুলোনি শুরু হইছে।

    বিনয় দেখল, কাঁচা বাঁশের বেড়া, টিন কি টালির চালের ছাউনি মাথায় নিয়ে কত যে ঘর এলোমেলো বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে আছে! ছিন্নমূল মানুষের ছন্নছাড়া উপনিবেশ। বিনয়ের মনে হল, সে যেন পূর্ব বাংলার কোনও হতদরিদ্র মানুষজনের গ্রামে চলে এসেছে।

    ধনঞ্জয় একের পর এক কলোনিগুলোর নাম বলে যাচ্ছিল। অনেকটা রেডিওতে ধারাবিবরণী দেবার সুরে। বিনয় ভাবল, সুধাদের বাড়ির এত কাছে সার দিয়ে কলোনি রয়েছে। আর সে কিনা চলেছে অনেক দূরের কোন এক সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে! টালিগঞ্জের এই এলাকাটা থেকে শুরু করলেই ভাল হতো। সে কি এখানেই কোথাও নেমে যাবে? পরক্ষণে মনে হল, না, থাক। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে যাওয়া যখন আগেই স্থির করে ফেলেছে তখন সেখানেই যাবে।

    একটা তেমাথায় এসে গোলাপি রঙের বিশাল তেতলা বাড়ির সামনে বাস থামল। ধনঞ্জয় বলল, এই জাগাখানের নাম রানিকুঠি। মস্ত বাড়িটা দেখিয়ে বলে, যুঝের (যুদ্ধের) সোময় এই দালানখান মিলিটারিরা দখল কইরা নিছিল। জুয়ান পোলারা এইখানে আইয়া যুঝে যাওনের লেইগা নাম লিখাইত।

    রানিকুঠি ছাড়িয়ে আরও খানিকটা যাবার পর একটা বাজার মতো জায়গায় বাস এসে দাঁড়ায়। ধনঞ্জয় বলে, এই অইল বাশধানী। আমারে অহন নামতে হইব বাবুমশয়। বলতে বলতে সে উঠে পড়ে।

    আগেই তার এবং নিজের টিকিট কেটে নিয়েছিল বিনয়। বলল, ঠিক আছে। আপনার সঙ্গে পরিচয় হয়ে ভলই হল। এ-দিককার অনেক কিছু জানতে পারলাম।

    মাথাটা বুকের ওপর অনেকখানি ঝুঁকিয়ে ধনঞ্জয় বলল, পন্নাম বাবুমশয়।

    বিনয় হাতজোড় করে, নমস্কার

    সোময় কইরা একদিন আমাগো কুলোনিতে আইবেন কিলাম—

    বললাম তো, যাব—

    ধনঞ্জয় নেমে গেল।

    বাস ফের চলতে শুরু করে। যতই এগুচ্ছে মানুষের বসতি ক্রমশ কমে আসছে। বাড়ছে ঝোপঝাড়, গাছগাছালি, পোড়ো জমি। ফাঁকে ফাঁকে উদ্বাস্তু কলোনি। অন্য দিকে রাস্তার ডান ধার ঘেঁষে পাশপাশি চলেছে একটা চওড়া খাল। এই শীতেও সেটা হেজেমেজে যায়নি। যথেষ্ট জল রয়েছে। এখন জোয়ারও নেই, ভাটাও না। স্থির জলে এখানে ওখানে থোক থোক কচুরি পানা।

    একসময় বাস গড়িয়ার মোড়ে পৌঁছে যায়। এখানে চারপাশে প্রচুর দোকান পাট। রকমারি দোকান। কোনওটা মিষ্টির, কোনওটা ওষুধের, কোনওটা মুদিখানা বা লন্ড্রি। তারই ফাঁকে ফাঁকে শীতের নানারকম আনাজ–তরতাজা ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, পালং, মেথিশাক, কালো কুচকুচে সুপুষ্ট বেগুন, টোমাটো, ঘন সবুজ ধনেপাতা, কলাই শাক ইত্যাদি নিয়ে বসেছে কাছাকাছি এলাকার চাষীরা। তাছাড়া অনেকেই রাস্তার কিনারে বড় বড় চ্যাপটা কানা-উঁচু টিনের পরাতের ওপর নানা ধরনের টাকটা মাছ সাজিয়ে বসেছে। সরপুঁটি, দিশি পাবদা, পাতি ট্যাংরা, খলসে, বাঁশপাতা, বাটা, কালবোস, এমনি কত কী। মনে হয় সবই আশেপাশের খাল বিল থেকে ধরে আনা।

    পুরোদমে কেনাবেচা চলছে। মানুষজনের ভিড়ে জায়গাটা দস্তুরমতো সরগরম।

    দু-একজনকে জিজ্ঞেস করে যে রাস্তাটা বাজারের পাশ দিয়ে পাক খেয়ে দক্ষিণে চলে গেছে সেখানে এসে রাজপুরের দিকের একটা বাস ধরল বিনয়। কলকাতায় যে ধরনের বাস চলে অবিকল তেমনি। লম্বা টিনের বাক্সের মতো বডি। কাঠের সিটে দু-আড়াই ইঞ্চি পুরু নারকেল ছোবড়ার শক্ত গদি।

    রাস্তার হাল বেজায় খারাপ। খানাখন্দে বোঝাই। বাস ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছে।

    গড়িয়ার বাসের মতো রাজপুরের এই বাসেও প্যাসেঞ্জার বেশ কম। অনেক সিট খালি পড়ে আছে।

    গডিয়া বাজারের জমজমাট এলাকাটা পেছনে ফেলে আসার পর একটা লোহার সরু মতো পুল পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ আগে গড়িয়ার বাসে বসে যে খালটা চোখে পড়েছিল সেটা পুলের তলা দিয়ে চলে গেছে। পুলের পর থেকে রাস্তা ক্রমশ সরু হচ্ছে। এধারে বাড়িঘর আরও কম। গাছপালা বেশি। ঝোপঝাড় বেশি। কত যে বট, অশ্বথ আর পাকুড়। শয়ে শয়ে নারকেলগাছ। আর আছে অজস্র ছোট ছোট খাল, এই শীতেও নিচু জমিতে জল জমে আছে। সব মিলিয়ে পূর্ব বাংলার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। প্রসাদ লাহিড়ির লিস্টে লেখা ছিল, সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে যেতে হলে কোন স্টপেজে নামতে হবে। টিকিট কাটার সময় বিনয় কন্ডাক্টরকে জানিয়ে রেখেছিল, ভুবনমোহিনী গার্লস হাইস্কুল-এর স্টপেজে যেন তাকে নামিয়ে দেয়। কন্ডাক্টরটার দায়িত্বজ্ঞান যথেষ্ট। মিনিট পনেরো কুড়ি পর এক জায়গায় বাস থামিয়ে সে হাঁকল, বাবু আপনার ইস্টপেজ এসে গেছে।

    জানালার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে ছিল বিনয়। মুখ ফিরিয়ে ধড় করে সে নেমে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে একটানা কলকলানি ভেসে আসে। অল্পবয়সী মেয়েদের মিলিত কণ্ঠস্বর।

    বিনয় লক্ষ করল একটু দূরে, রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে ইংরেজি এল হরফের আকারে সেকেলে ধাঁচের মস্ত একখানা দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে গেট। গেটের মাথায় কাঠের বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে স্কুলের নাম লেখা রয়েছে। পাঁচ ছয় থেকে ষোল সতেরো বছর অবধি, নানা বয়সের মেয়ে কাঁধে বইখাতা বোঝাই কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে কলর বলর করতে করতে স্রোতের মতো স্কুলে ঢুকছে।

    প্রসাদ লিখে দিয়েছেন, ভুবন মোহিনী গার্লস হাইস্কুল-এর উলটো দিকে একটা গেঁয়ো মাটির পথ রয়েছে। বাস রাস্তা পেরিয়ে ওধারে যেতেই তেমন একটা পথ পাওয়া গেল। সেটা ধরে বেশি দূর হাঁটতে হল না। বড় জোর মিনিট খানেক। তারপরেই মোটা বাঁশের একটা খুঁটি পোঁতা। সেটার সঙ্গে পেরেক দিয়ে আটকানো এক টুকরো লম্বা টিনের পাত। পাতটায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা: সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি।

    দূর থেকে পাঁচমেশালি শব্দ ভেসে আসছিল। ঠক ঠক, ঘসর ঘসর, দুম দাম। আরও খানিকটা এগোতেই কলোনিটা চোখে পড়ল। সেখানে এখন নতুন নতুন ঘর তোলার কাজ চলছে। কেউ টিন বা খড় দিয়ে ছাউনি দিচ্ছে। কেউ পেরেক ঠুকে বেড়া লাগাচ্ছে, কেউ বা খুঁটি পুঁতছে। তৈরি হচ্ছে নতুন বসতি। উৎখাত হয়ে আসা মানুষের উপনিবেশ।

    হঠাৎ পথের একধারে একটা দৃশ্য বিনয়কে অবাক করে দেয়। সেখানে পাহাড়প্রমাণ পোড়া কাঠ, বাঁশ, টিন, হোগলা, টালি আর ছন। এই ধ্বংসস্তূপের হেতুটা কী, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। \

    উত্তুরে হাওয়ায় পোড়া ছন আর হোগলার ছাই উড়ছিল। বিনয় আর দাঁড়ায় না। কয়েক পা যেতেই কলোনির দিক থেকে দশ বারো জন দৌড়ে আসে। তাদের মধ্যে দুচারটি যুবক ছাড়া বাকি সবাই বয়স্ক মানুষ। উদ্বাস্তু বলতে ত্রস্ত, শুষ্ক যে চেহারাগুলো চোখের সামনে ফুঠে ওঠে এরাও অবিকল তাই। বলা নেই কওয়া নেই, অচেনা একটা মানুষ কী উদ্দেশ্যে আচমকা তাদের কলোনিতে চলে এসেছে, বুঝতে না পেরে তাদের চোখেমুখে কত কী যে ফুটে ওঠে! সংশয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠা এবং সেই সঙ্গে কৌতূহলও।

    একটা আধবুড়ো লোক–পরনে ময়লা খাটো ধুতি আর নিমার ওপর জ্যালজেলে চাদর, হাতের এবং গলার শিরাগুলো প্রকট, ঘোলা ঘোলা চোখ, ভাঙা গালে খাপচা খাপচা কাঁচাপাকা দাড়ি, গলায় তিন ফের তুলসির মালা–ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনিরে তো চিনতি পাল্লেম না বাবু তার গলায় যশোর কি খুলনা জেলার টান। তবে এপারে আসার পর এখানকার ভাষা আর সীমান্তের ওপারের ভাষা মিলেমিশে তার কথাগুলো কিছুটা তেউড়ে গেছে।

    বিনয়ের উত্তর দেওয়া হয় না। তার আগেই জটলার ভেতর থেকে কেউ বলে ওঠে, উনারে আমি চিনি। বড় ভালা মানুষ। আমরা একলগে পাকিস্থান থিকা ইন্ডিয়ায় আইছি।

    এধারে ওধারে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে পেল বিনয়। শীর্ণ, দড়ি-পাকানো শরীর। দেখামাত্রই চেনা গেল। হরিদাস সাহা। তারপাশা স্টিমারঘাটে তাকে প্রথম দেখেছিল সে। কোন এক নয়া চিকন্দি গ্রামে ছিল হরিদাসের সাত পুরুষের ভিটেমাটি। হানাদার বাহিনী একদিন রাতে তার যুবতী মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তান ছেড়ে চলে যাবে।

    বিনয়ের মনে পড়ে, মেয়ে হারানোর শোকে সমস্ত রাত হরিদাস সাহার স্ত্রী নদীর পাড়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেছিল। সেই সঙ্গে বিরামহীন, সকরুণ, বুকফাটা বিলাপ। গোয়ালন্দের স্টিমারে ওঠার পরও সেই কান্না তার থামেনি। গোয়ালন্দ থেকে রিফিউজিদের জন্য স্পেশাল ট্রেনের গাদাগাদি ভিড়েও তার সেই অবিরল কান্না শোনা গেছে। আরও পরে শিয়ালদা স্টেশনে গাড়ি পৌঁছলে তার সঙ্গে আর দেখা হয়েছিল কি না, বিনয়ের মনে পড়ে না।

    তারপাশার স্টিমারঘাটে বা রিফিউজি স্পেশালে কাছাকাছি থাকলেও হরিদাস সাহার সঙ্গে একটি কথাও হয়নি বিনয়ের। লোকটার সঙ্গে কেউ আলাপও করিয়ে দেয়নি। ওদের সম্বন্ধে সে যেটুকু যা শুনেছে, সবই তেঁড়াদার হরিন্দর মুখে। আলাপ পরিচয় না হলেও শোকাতুর মানুষটা তার গতিবিধি লক্ষ করেছে এবং তাকে মনেও করে রেখেছে। হরিদাস সাহার সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে, ভাবতে পারেনি বিনয়। দেশভাগের পর চেনাজানা কত মানুষ কোথায় কত দিকে ছিটকে পড়েছে। কীভাবে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে মাথা গোঁজার মতো একটু জায়গা করে নেবে, কীভাবে দুটো পয়সা রোজগার করে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে, এমন হাজারটা চিন্তা সবার মাথায় পাষাণভারের মতো চেপে আছে। অন্যের কথা ভাববে, তেমন বাড়তি সময় কারও হাতে নেই। হরিদাস সাহাও একদিন বিনয়ের স্মৃতি থেকে নিশ্চয়ই বিলীন হয়ে যেত। কিন্তু হল না।

    সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে হরিদাসকে দেখে ভাল লাগল বিনয়ের। পরক্ষণে তীব্র ক্লেশে শতখান হয়ে যাওয়া তার স্ত্রীর কথা মনে পড়ল। সে কি এখনও তেমনি কাঁদে? ভাবতেই বুকে অদ্ভুত চাপা কষ্ট অনুভব করতে থাকে বিনয়।

    এদিকে আগন্তুকটি কলোনির বাসিন্দা হরিদাসের পরিচিত এবং সে তাকে ভালমানুষ বলে ঢালাও প্রশস্তি করেছে, ফলে যারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল তাদের সংশয় কেটে যায়। বিনয় সম্পর্কে আর ভয় নেই। তারা নিশ্চিত, এই যুবকটি তাদের কোনওরকম সংকট বা বিপদে ফেলবে না। মুখ চোখ দেখেই এখন টের পাওয়া যায়, লোকগুলো বেশ স্বস্তি বোধ করছে।

    বিনয় ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ আমাকে দেখে আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গেছেন।

    কেউ জবাব দিল না।

    বিনয় বলে, বিশেষ দরকারে আমাকে এই কলোনিতে আসতে হয়েছে। শুনলে বুঝতে পারবেন।

    গলায় যার তুলসীর মালা, সেই আধবয়সী লোকটা সসম্ভ্রমে বলল, সব শোনবো। মুখ দেখি মনে হতিচে, অনেক দূর থেকি আসতিচেন। খুব ধকল গেছে। আগে কলোনিতে যায়ে জিরোয়ে লেন। তারপর কথা হবে নে

    বিনয়কে সঙ্গে নিয়ে সবাই সামনের দিকে এগিয়ে চলে।

    .

    ৩৯.

    হরিদাস সাহা বিনয়ের গা ঘেঁষে হাঁটছিল। বাকি সবাই কেউ সামনে, কেউ পেছনে। হরিদাস একটানা বলে যাচ্ছিল, দ্যাশ থিকা আইয়া আপনেগো লগে শিয়ালদার ইস্টিশানে তো লামলাম। হের পর আপনেরা কুনখানে যে গ্যালেন দেখি নাই। আমরা এক্কেয়ে উথাল সমুপুরে পড়লাম খান। চাইর দিকে খালি রিফুজ আর রিফুজ। গু, মুতে, কফে, ছ্যাপে (থুতু) জাগাখান আস্তা নরককুণ্ডু। দুই ব্যালা (বেলা) সরকারি বাবুরা দুই দলা কইরা খিচোরি কি ডাইল-ভাত দ্যায়। হেই খাইয়া কুনোরকমে বাইচা থাকি। এইভাবে চিরকাল তো চলে না। কিন্তুক কী করুম, ভাইবা ভাইবা দিশা পাই না। শিয়ালদার পেলাটফরোমে মইরা ঝইরা শ্যাষ হইয়াই যাইতাম। আত (আচমকা) খবর পাইলাম গইরার (গড়িয়ার) এইদিকে রিফুজরা কুলোনি বহাইতে আছে। এই হানে আইলে জমিন মিলব। ভাবলাম দেহি একবার চ্যাষ্টা কইরা। বউ পোলাপানগো হাত ধইরা আরও কয় ঘর রিফুজের লগে রাতারাতি চইলা আইলাম। হেই থিকা এহানেই আছি।

    সব জবরদখল কলোনি তৈরির পেছনে প্রায় একই ইতিহাস। রিফিউজি ক্যাম্প বা শিয়ালদা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম কিংবা কলকাতার ফুটপাথ থেকে চলে এসে জলা জমি ভরাট করে, বনজঙ্গল কেটে ছিন্নমূল মানুষ ঘরবাড়ি তুলছে। বিনয় জিজ্ঞেস করে, কতদিন হল আপনি এখানে আছেন?

    দিন পনরো যুলো

    কথায় কথায় সবাই কলোনির ভেতর চলে আসে। বিনয় লক্ষ করল, অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রচুর ঘর। নতুন নতুন আরও অনেকগুলোর কাজ চলছে। এখানেও একধারে পোড়া কাঠ, টালি, ছন আর খড়ের ছাই ভঁই হয়ে আছে।

    কণ্ঠিধারী সেই লোকটা হাঁকডাক করে একটা বেতের মোড়া আনিয়ে বিনয়কে বসালো। আচমকা একজন এসে পড়েছে। হোক অনাহুত, তবু অতিথি তো। তাকে আপ্যায়ন করা দরকার। তাই চা এবং সস্তা লেড়ো বিস্কুটের ব্যবস্থাও হয়ে গেল।

    বিনয় বুঝতে পারছিল এই লোকটা সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পশ্লির মাতব্বর। এখানকার বাসিন্দারা তাকে যথেষ্ট মানে।

    এদিকে কলোনিতে বিনয়ের আসার খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে বাচ্চা কাচ্চা, ছেলেবুড়ো, যুবকযুবতী থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষজন তার সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়ায়।

    চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে বিনয় বলল, কেন এই কলোনিতে এসেছি, নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছে হচ্ছে–

    জনতা উত্তর দেয় না। সবার তরফ থেকে কঠিধারী বলে, হাঁ বাবু

    তার আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দেয় বিনয়। তারপর পকেট থেকে নোট-বুক আর পেন বার করে এই কলোনি সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানা তথ্য টুকে নিতে থাকে।

    সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ঠিক একবছর আগে। একসময় এখানে ছিল নাবাল জমি। পুরো ভূখণ্ডটি জুড়ে হাঁটু অবধি জলে উদ্দাম হোগলা বন। বন সাফ করে নিচু জমিতে মাটি ফেলে বসতি বানানো হল। মুকুন্দপুরে যুগলদের বাস্তুহারা কলোনিতে রাজদিয়া এবং তার চারপাশের বিশ পঁচিশটা গ্রামের মানুষই শুধু রয়েছে। কিন্তু এখানে এসেছে পূর্ব বাংলার নানা প্রান্তের লোজন। বরিশাল, খুলনা, যশোর, পাবনা, ফরিদপুর, ঢাকা-কোনও জেলাই বাদ নেই।

    হকারি, ছোটখাটো দোকানদারি, বেতের কাজ, বাঁশের কাজ, ছাড়াও নানা ধরনের উঞ্ছবৃত্তি করে এই কলোনির বাসিন্দারা পেটের ভাত জোটাচ্ছে। কতদিন এভাবে চালানো সম্ভব হবে, জানা নেই।

    মাথা গোঁজার মতো ঘর এরা তুলতে পেরেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানেও পদে পদে সংকট। বিপদ তাদের নিত্য সঙ্গী। যে হোগলাবন সাফ করে জলা বুজিয়ে এখানে কলোনি বসানো হয়েছে সেই জমির মালিক এই অঞ্চলের সামন্তরা। তারা লোক ভাল নয়। বছরের পর বছর এখানকার পরিত্যক্ত জমিতে হোগলা আর ঝোপঝাড় গজিয়েছে। সাপখোপ পোকামাকড় শিয়াল বাঘডাসা বংশ বাড়িয়েছে। এসব নিয়ে এতকাল মাথাব্যথা ছিল না তাদের। কিন্তু উদ্বাস্তুরা এসে যেই বসতি বানালো, অমনি সামন্তদের মস্তিষ্কে অধিকার বোধ চাগাড় দিয়ে উঠল। বিষাক্ত সরীসৃপেরা থাকলে আপত্তি নেই। কীটপতঙ্গ, বুনো পাখির ঝাক কিংবা হোগলা বন, ঝোপঝাড়–এ-সব অবাধে থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ এসে জনপদ বানিয়ে বসবাস করবে, সামন্তরা কিছুতেই তা মেনে নেবে না। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির বাসিন্দাদের উৎখাত করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কতবার যে সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়েছে তার হিসেব নেই। তিন তিনবার রাতের অন্ধকারে হানাদারেরা কলোনির ঘরের চালে, বাঁশের বেড়ায় পেট্রোল ঢেলে ছারখার করে দিতে চেয়েছে।

    কণ্ঠিওলা লোকটা বলতে লাগল, সামন্তরা ঘরবাড়ি পোড়ায়ে আমাগেরে ভাগায়ে দিতি চায়। আমরা দখল ছাড়ি না। মাটি কামড় দে পড়ি থাকি। ঘরপোড়া ছাই, আর দগ্ধ বাঁশ খুঁটির স্তূপ দেখিয়ে বলল, বিশ দিন আগে আমাগের কুলোনিতে ওরা আগুন ধরায়ে দেছে। আমরা ছাই ভস্ম সরায়ে ফের ঘর বাঁধতিচি। যতবার আগুন দেবা, ততবার ঘর তুলি নেবা নে। জমিন য্যাকন একবার দখল করিচি, ও আর ছাড়বা না।

    কলোনির সামনের দিকে এবং ভেতরে যে পোড়া টিন, টালি, বাঁশ টাশ স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে তার কারণ এতক্ষণ বুঝতে পারল বিনয়। অবিকল যুগলদের মুকুন্দপুর কলোনির মতোই ঘটনা। সেখানেও জমি মালিকের ঘাতকবাহিনী একই পদ্ধতিতে উদ্বাস্তুদের তাড়াতে চায়। এখানেও ঠিক তা-ই। বর্শা, রামদা, লাঠি ইত্যাদি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, নইলে ঘরে আগুন। কিন্তু সীমান্তের ওপারে সর্বস্ব খুইয়ে আসার পর ছিন্নমূল মানুষগুলোর পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বসুন্ধরার এক কোণে বনজঙ্গল সরীসৃপে বোঝাই পোড়ো জমি খুঁজে বার করে তারা নতুন নতুন লোকালয় গড়ে তুলছে। যত আক্রমণই আসুক, ভয়ে তারা পালিয়ে যাবে না। সব হানাদারির বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়াবে।

    বিনয় কথা বলছিল ঠিকই, সেই সঙ্গে দুরন্ত গতিতে তার কলম চলছিল।

    ভিড়ের ভেতর থেকে ঢ্যাঙা, কৃশ চেহারার একটা লোক জিজ্ঞেস করে, আমাগো কথা লেইখা লইতে আছেন, এ দিয়া কী করবেন বাবুমশয়?

    কথা শুনেই ধরা যায়, তার আদি বাড়ি খুলনা বা যশোরে নয়। ঢাকা কিংবা ফরিদপুরে। বিনয় বলল, লেখাটা আমাদের কাগজে ছাপা হবে।

    ছাপা হইলে গরমেনের নজরে পড়ব?

    বিনয় ধন্দে পড়ে যায়। তাদের কাগজ নতুন ভারত এখনও বাজারে বেরোয়নি। বেরুবার পর সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি সম্পর্কে তার রিপোর্টটা ছাপা হলে গরমেন অর্থাৎ সরকারের নজরে পড়বে কি না, জানা নেই। একটা প্রশ্ন বিনয়কে উৎসুক করে তোলে। গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য লোকটার এত আগ্রহ কেন? অনিশ্চিতভাবে সে বলল, পড়তে পারে। কেন বলুন তো?

    এবার ঢ্যাঙা লোকটা নয়, কষ্ঠিধারীটি বুঝিয়ে দিল। এই কলোনির বাসিন্দারা কী অসীম দুর্দশার মধ্যে রয়েছে, প্রতিটি মুহূর্তে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য তাদের কী নিদারুণ যুদ্ধ–খবরের কাগজে এ-সব বেরুলে সরকারি কর্তাদের নির্ঘাত টনক নড়বে। এর আগে কণ্ঠিধারীরা বেশ কয়েকবার সাহায্যের জন্য সরকারের কাছে দরবার করেছে কিন্তু এখন অবধি একটি ঘষা আধলাও মেলেনি। যা পাওয়া গেছে তা হল অঢেল প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কাগজ যদি সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি সম্পর্কে নাড়াচাড়া দেয়, সরকারের সাধ্য নেই তা অগ্রাহ্য করে।

    খবরের কাগজের ছাপার হরফ যে অলৌকিক শক্তিধর এবং সেগুলো যে আকাশ থেকে চন্দ্র সূর্য পেড়ে আনতে পারে, এটা জানা ছিল না বিনয়ের। কিন্তু এখানকার লোকজনের কাগজ সম্পর্কে অটুট বিশ্বাস, অনন্ত ভরসা। কেন এই নিরক্ষর মানুষগুলোর এমন ধারণা, কে জানে। এ নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না বিনয়।

    কণ্ঠিধারী বলল, আমাগের কথা ভাল করি গুছায়ে গাছায়ে লিখি দিবেন বাবু

    বিনয় ঘাড় কাত করে, হ্যাঁ, লিখব। একটু ভেবে বলল, আপনার নামটা কিন্তু জানা হয়নি।

    কণ্ঠধারী জানায় তার নাম রাধামাধব দাস। শুধু তাই না, অন্যদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয়। তাদের কেউ নিতাই কর্মকার, কেউ মথুরা করাতি, কেউ গণেশ শীল ইত্যাদি।

    বিনয় এবার বলে, আপনাদের কলোনিটা একটু ঘুরে দেখা যাবে?

    নিচ্চয় বাবু। আসেন,

    বিনয় উঠে পড়ে। কণ্ঠিধারী অর্থাৎ রাধামাধব দাস পথ দেখিয়ে তাকে নিয়ে যেতে থাকে। হরিদাস সাহা এবং অন্য সবাই তাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে।

    সামনের দিকে বসে যতটা মনে হয়েছিল, ভেতর দিকে যেতে যেতে বিনয় দেখতে পেল, কলোনিটা আয়তনে তার চেয়ে অনেক বড়। রাধামাধব বলেছিল হোগলাবন নির্মূল করে এখানে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। এখন চোখে পড়ল, দূরে এখনও প্রচুর হোগলা এবং নানা ধরনের বুনো ঝোপঝাড় রয়েছে। তার মানে পুরোটা সাফ হয়নি। ওগুলো কেটে ফেললে আরও বহু মানুষের বাসস্থানের বন্দোবস্ত হতে পারে। বিনয়ের আসার খবর পেয়ে কেউ কেউ তাকে দেখতে এলেও ভেতরের দিকে যারা ছিল তারা হয়তো জানতে পারেনি। এদের কেউ কেউ ঘর তুলছে। মেয়েরা রান্নাবান্না বা অন্য কাজে ব্যস্ত। প্রচুর বাচ্চাকাচ্চা সারি সারি ঘরের সামনে খোলা জায়গায় ছোটাছুটি হুটোপাটি করছে।

    যারা ঘর বানাচ্ছিল, রাধামাধবের সঙ্গে একটি নতুন লোককে দেখে তারা এগিয়ে আসে। মেয়েরা। ঘরকন্না স্থগিত রেখে মাথায় আধঘোমটা টেনে গভীর কৌতূহলে বিনয়কে লক্ষ করতে থাকে। বাচ্চাগুলো হুল্লোড় থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সবার চোখেমুখে অপার বিস্ময় ফুটে ওঠে।

    এখানে কোন বাড়িটা কার, তার দেশ পূর্ব পাকিস্তানের কোন জেলায় ছিল, পর পর বলে যাচ্ছে রাধামাধব। হঠাৎ ডান পাশের শেষ মাথা থেকে উঁচু গলায় কেউ ডেকে ওঠে, বাবুমশয় না? পরক্ষণে দেখা গেল, একটা লোক দৌড়তে দৌড়তে এদিকে আসছে।

    বিনয় দাঁড়িয়ে যায়। কাছাকাছি আসতে লোকটাকে চিনতে পারল। সেই অত্যন্ত চতুর, অতীব ফন্দিবাজ অধর ছুঁইমালী। তারপাশা থেকে গোয়ালন্দে আসার সময় স্টিমারে তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। লোকটা বাঁ পায়ের ঊরুতে পুরোনো কাপড়ের পুরু ব্যান্ডেজ বেঁধে তার ভেতর দেশের বিষয় আশয়ের যাবতীয় দলিল ভরে খোঁড়াতে খোঁড়তে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে। করুণ, কাতর মুখ করে তার পা টেনে টেনে চলার ভঙ্গিটা এমনই নিখুঁত ছিল যে বর্ডারের পাকিস্তানি অফিসাররা ধরতেই পারেনি লোকটা কত বড় ধোঁকাবাজ।

    অধর হাতজোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে শশব্যস্তে বলল, পন্নাম বাবুমশয়। আপনের লগে এই জনমে ফির যে দেখা অইব, ভাবতে পারি নাই।

    হরিদাস সাহার পর অধর ছুঁইমালীকে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে দেখে আরও একবার অবাক হল বিনয়। কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে বলল, আমিও ভাবিনি। তা সাহা মশাই আর আপনারা কি একসঙ্গে এই কলোনিতে এসেছেন?

    ঠিকই ধরছেন। শিয়ালদায় পইচা মরতে আছিলাম। মাইনষের লাখান বাচনের লেইগা অন্য রিফুজগো লগে আমরা দুই ঘর এইহানে চইলা আইলাম।

    রাধামাধব অধরকে বলল, মনে হতিচে বাবুর সঙ্গি তোমারও চেনাজানা আছে?

    অধর বলল, আছেই তো। আমরা এক লগে পাকিস্থান থিকা ইণ্ডিয়ায় আইছি। পিরথিমীতে বাবুমশয়ের লাখান মানুষ হয় না। য্যামন বিদ্বান, ত্যামন মাইষের লেইগা তেনার দয়ামায়া। পাকিস্থান থিকা আসার সোময় এক বুড়া মাস্টরমশয় আর তেনার ফেমিলির লেইগা উনি যা করছেন, নিজের চৌখে তো দেখছি ।

    জামতলির বৃদ্ধ হেড মাস্টার রামরতন গাঙ্গুলি এবং তার স্ত্রী আর মেয়েদের কথা ভোলেনি অধর। সেই কথাই বিশদভাবে রাধামাধবকে বলতে লাগল।

    বিনয় মনে করে, সে রামরতনদের জন্য যেটুকু করেছে তা ঢাক পিটিয়ে বলার মতো কোনও ঘটনাই নয়। অধর ভুইমালীকে থামাতে যাচ্ছিল, তার আগেই লোকটা একেবারে অন্য কথায় চলে যায়, জানেন বাবুমশয়, শিয়ালদার ইস্টিশানে হেই যে আমরা আইয়া নামছিলাম হের পর আপনেরে কত যে বিচারাইছি (খুঁজেছি), কিন্তুক ভিড়ের মইদ্যে কুনোহানে পাইলাম না। দিনের পর দিন ভগমানের কাছে কানছি (কেঁদেছি), আপনের লগে য্যান দ্যাখা করাইয়া দ্যায়। অ্যাদ্দিনে ভগমানের দয়া হইছে। আপনের দ্যাখ্যা পাইলাম। কী আনন্দ যে অইতে আছে, বুঝাইয়া কইতে পারুম না। উচ্ছ্বাসের ফেনা মরে এলে গলা নামিয়ে বলল, আপনের লগে আমার ম্যালা (অনেক) কামের কথা আছে।

    বিনয় অবাক হল, কী কথা?

    হেইটা আপনের আর আমার মইদ্যে অইব (হবে)। অন্য মাইনষের সুমখে (মানুষের সামনে) না। আমাগো কুলোনিখান পুরা দেইখা লন। হের (তার) পর গুপনে (গোপনে) কমু।

    ঘুরে ঘুরে একসময় কলোনি দেখা শেষ হল। এখানে ঢোকার পর কিছু লোকের সঙ্গে আগেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রাধামাধব। যারা অনেকটা ভেতরে দিকে ছিল তাদের সঙ্গেও পরিচয় হল। তাদের নাম, পূর্ব পাকিস্তানের কোন কোন জেলায় তাদের সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছিল, কেন তাদের দেশ ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে, সব নোটবুকে টুকে নিয়েছে বিনয়। লক্ষ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষের জন্মভূমি ফেলে আসার মূল কারণ দুটো। পাকিস্তানীদের গায়ের জোরে বিষয় সম্পত্তি দখল করার চেষ্টা, নইলে যুবতী মেয়েদের ছিনিয়ে নেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির বাসিন্দাদের বেলাতেও হেতুগুলো আলাদা কিছু নয়।

    সূর্য মাথার ওপর উঠে এসেছিল। হঠাৎ বিনয়ের খেয়াল হল, তার ডিউটি দুটো থেকে। এখান থেকে অফিসে পৌঁছতে কম করে ঘণ্টা দুই লেগে যাবে। সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, আরও কিছুক্ষণ আপনাদের সঙ্গে থাকতে পারলে ভাল লাগত কিন্তু এখন আমাকে যেতে হবে। সে যে-পথ দিয়ে কলোনিতে ঢুকেছিল সেদিকে হাঁটতে থাকে।

    জনতাও সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। রাধামাধব হাত কচলাতে কচলাতে কুণ্ঠিতভাবে বলে, বেইল (বেলা) দুফার হয়ে গিয়েলো। বুলতে সাহস হচ্ছে না। দুটি ভাত খায়ে গেলি মনে বড় শান্তি পাতাম। কিন্তুক আমাগের হাতে ভাত কি খাবেন?

    রাধামাধবের দ্বিধার কারণটা আন্দাজ করতে পারছিল বিনয়। স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়, সে জাতপাত মানে না। তবে আজ আর এক লহমাও এখানে থাকার উপায় নেই। যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। দুটোর ভেতর যেভাবেই হোক তাকে অফিসে হাজিরা দিতে হবে। পরে একদিন সময় করে এসে নিশ্চয়ই খেয়ে যাবে।

    দেখা হবার পর থেকে অধর ভুইমালী জোঁকের মতো বিয়ের গায়ে সেঁটে ছিল। কলোনির মুখে এসে রাধামাধবদের উদ্দেশে বলল, তুমাগো আর কষ্ট কইরা যাইতে অইব না। আমি বাবুমশয়রে বাসে তুইলা দিয়া আহি।

    রাধামাধবরা এর পরেও বড় রাস্তা পর্যন্ত যেতে চেয়েছিল কিন্তু একরকম কাকুতি মিনতি করে তাদের থামিয়ে দিয়ে অধর ভুইমালী বিনয়ের পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। আগেই অধর জানিয়ে রেখেছে, একান্ত গোপনে সে বিনয়কে কিছু বলতে চায়।

    বিনয় বলল, আমার কিন্তু ভীষণ তাড়া আছে। গড়িয়ার বাস এলেই উঠে পড়ব। কী বলবেন বলুন–

    অধর সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিল। যদিও আশপাশে কেউ নেই, তবু গলার স্বর অনেকখানি নামিয়ে বলল, আপনে তো জানেন বাবুমশয়, কত বুদ্ধি খাটাইয়া, কত কষ্ট কইরা দ্যাশ থিকা আমাগো দলিলপত্তরগুলান আনছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কইরা হেই কথা কেওরে (কাউকে) কইতে পারি না, যদিন হাতাইয়া লয়। শুনাশুন কানে আইছে, ম্যালা (অনেক) মাইষে দ্যাশের বিষয় আশয়ের লগে এহানকার মুসলমানগো জমিজমা এচ্চেঞ্জ করতে আছে। কথাটা কি ঠিক?

    ঠিক।

    যারা এচ্চেঞ্জ করায় ত্যামন কেওরে আপনে চিনেন?

    নিত্য দাসের মুখটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে বিনয়ের। সে বলে, চিনি। আপনি যদি চান তাকে পাঠিয়ে দিতে পারি।

    দ্বিধার সুরে অধর জিজ্ঞেস করে, আমার লগে বাটপারি করব না তো?

    নিত্য দাসের প্রচণ্ড টাকার লোভ। কিন্তু বিনয় জানে, দালালি পেলেই সে খুশি। কারও সঙ্গে জালিয়াতি জুয়াচুরি করেছে, এমন দুর্নাম তার নেই।

    বিনয় বলল, আমি যাকে পাঠাব সে আপনাকে ঠকাবে না।

    উৎসাহে চোখমুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে অধর ভুইমালীর। বলে, তাইলে পাঠাইয়া দিয়েন। তেনার লগে কথাবাত্রা কইয়া দেখি। হের পর আসল কামের সোময় আপনেরে কিন্তুক থাকতে অইব।

    থাকব।

    আপনের ঠিকানাখান দ্যান বাবুমশয়–

    পকেট থেকে নোট বই এবং কলম বার করে একটা কাগজ ছিঁড়ে সুধাদের বাড়ির ঠিকানা লিখে অধরকে দিল বিনয়।

    অধরের চোখেমুখে কৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে। হাতজোড় করে বলে, আমার কী উপকার যে অইব, কইয়া বুঝাইতে পারুম না।

    একটু চুপচাপ।

    বিনয়রা বড় রাস্তায় চলে এসেছিল। বেশ লোজন রয়েছে। দুচারটে গাড়িও চলছে। কিন্তু গড়িয়ার দিকের বাসের দেখা নেই।

    হঠাৎ কী মনে পড়ে যাওয়ায় ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ে অধর। ব্যগ্র সুরে বলে, আরে একহান কথা কইতেই তো ভুইলা গ্যাছি

    বিনয় একটু অবাক হল, কী কথা?

    দুই হপ্তা আগে আমরা যেইদিন এই কুলোনিতে আইলাম–হ, তারও তিন চাইর দিন আগে আতখা (হঠাৎ) বউ ঠাইরেন শিয়ালদার ইস্টিশানে দেখছি। কিন্তুক আপনে তেনার লগে আছিলেন না।

    কে বউ ঠাকরুন?

    আপনার ইস্তিরি।

    তার মানে ঝিনুক। রাজদিয়া থেকে কলকাতায় আসার সময় পথে যার সঙ্গেই আলাপ হয়েছে তারা সবাই ধরে নিয়েছে ঝিনুক তার স্ত্রী। ঝিনুকের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তড়িৎপ্রবাহ খেলে যায় বিনয়ের। টের পায় হৃৎপিণ্ডে দমাদম কেউ হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে অবিরল। অনেকক্ষণ পর কিছুটা সামলে নিয়ে রুদ্ধস্বরে বলল, আপনি ঠিক দেখেছেন?

    অধর সামান্য হাসে, ঠিকই দেখছি।

    তবু বিনয় অধীর গলায় বলে, আপনার কোনও ভুল হয়নি তো?

    কথা হোনো বাবুমশয়ের! আমার চৌখে অহনও চাইলশা ধরে নাই। আপনে, বউ ঠাইরেন, হেই বুড়া মাস্টরমশয়, তেনার বউ-মাইয়ারা, আমরা, আরও হাজারে হাজারে রিফুজ একলগে ইন্ডিয়ায়। আইলাম। আর আপনে কন আমার ভুল অইচে কি না। যেনারে একবার দেহি তেনারে কুনোদিন, ভুলি না বাবুমশয়–

    বিনয়ের মনে হল, সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার চারপাশে মহাবিশ্ব দুরন্ত গতিতে ঘুরে চলেছে। ঘুরেই চলেছে। ঘুরেই চলেছে।

    অধর ভুইমালী তীক্ষ্ণ নজরে বিনয়কে লক্ষ করছিল। খানিক আগে যে মানুষটিকে ধীর স্থির শান্ত মনে হচ্ছিল, মুহূর্তে সে আগাগোড়া বদলে গেছে। চোখেমুখে কেমন যেন অস্থির অস্থির, উতলা ভাব। ব্যস্তভাবে অধর জিজ্ঞেস করে, শরীল নি খারাপ লাগে বাবুমশয়?

    না না, আমি ঠিক আছি। ব্যাকুলভাবে বিনয় বলে, আপনার বউঠাকুরনকে শিয়ালদায় কী করছিল?

    অধর হতবাক। নিজের স্ত্রী সম্বন্ধে খবর রাখে না, বিনয়কে এতটা আলাভোলা বা দায়িত্বজ্ঞানহীন কখনও মনে হয়নি তার। পাকিস্তান থেকে আসার সময় তারপাশার স্টিমারে বা গোয়ালন্দের ট্রেনে সে তো দেখেছে বিনয় কীভাবে, কত যত্নে স্ত্রীকে বুকের ভেতর আগলে আগলে নিয়ে এসেছে। অসীম বিস্ময়ে অধর বলে, শিয়ালদায় ক্যান গ্যাছিল, আপনে জানেন না?

    প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে অধরের একটা হাত আঁকড়ে ধরে বিনয়, বলুন কী করছিল, বউঠাকুরণ? বলুন, বলুন–তার কণ্ঠস্বরে অধীরতা, তীব্র উত্তেজনা।

    পলকহীন বিনয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অধর। বলে, শিয়ালদায় মাইষে ক্যান যায়? টেরেন ধরনের লেইগা–

    ঝিনুক নিরুদ্দেশ হবার পর একটা চিন্তা প্রায়ই বিনয়কে উতলা করে রাখত। লাঞ্ছিত, চিরদুঃখী মেয়েটা হয়তো আবার পাকিস্তানেই ফিরে গেছে। পরে আশু দত্ত বা রামকেশবের সঙ্গে যখন দেখা হল তখন নিশ্চিতভাবে জানা গেল, সে অন্তত রাজদিয়ায় যায়নি। তারপরও বিনয়ের মাঝে মাঝে মনে হতো, এমনও তো হতে পারে, ঝিনুক পাকিস্তানের ট্রেনেই উঠেছিল কিন্তু রাজদিয়া অবধি পৌঁছতে পারেনি। পথেই ধর্ষক কিংবা ঘাতকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেছে। তারপর কী হতে পারে, ভাবতে সাহস হয়নি বিনয়ের। আতঙ্কে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।

    বিনয়ের ব্যাকুলতা হাজার গুণ বেড়ে যায়। সে বলে, আপনার বউঠাকুরনকে কি পাকিস্তানের ট্রেনে উঠতে দেখেছেন?

    না ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে অধর, আমি যহন তেনারে দেখছি, ইস্টিশানে পাকিস্থানের টেরেন আছিল না।

    বিমূঢ়ের মতো বিনয় জিজ্ঞেস করে, তা হলে?

    চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে অধর বলে, যদূর মনে লয়, কলকাতার আশেপাশে যেই হগল টেরেন যায় হের কুনো একটায় বউঠাইরেন উঠছিল।

    অধরের হাতটা ধরাই ছিল। জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বিনয় বলে, শিয়ালদা থেকে কত দিকেই তো লোকাল ট্রেন যায়। তার কোনটায়?

    এবার দিশেহারা হয়ে পড়ে অধর। আকাশপাতাল হাতড়াতে হাতড়াতে বলে,পনরো যুলো দিন আগের কথা। ঠিক ঠাওর পাইতে আছি না। কুনো টেরেন যায় বোনগার দিকে। কুনো টেরেন ধরেন গিয়া কাঁচরাপাড়া নৈহাটি লালগোলার দিকে। না বাবুমশয়, মনে পড়ে না।

    ঝিনুক নিখোঁজ হবার পর কেউ একজন তাকে স্বচক্ষে দেখেছে এবং কলকাতার কাছাকাছি কোথাও সে আছে, সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পশ্লিতে এসে এটুকু অন্তত জানা গেল। কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে ওধারে মুকুন্দপুর আর গড়িয়ার এধারে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি পর্যন্ত তার দৌড়। এ ছাড়া চারপাশে অজস্র নগণ্য শহর আর গ্রাম ছড়িয়ে আছে। সে-সব জায়গায় যাওয়া তো দুরের কথা, নাম পর্যন্ত জানা নেই। এই সমস্ত লোকালয়ের কোথায় ঝিনুক রয়েছে, কে তার সন্ধান দেবে?

    হঠাৎ অদম্য এক জেদ মাথায় ভর করে বিনয়ের। একবার যখন ঝিনুকের খবর পাওয়া গেছে, যেভাবে হোক তাকে খুঁজে বার করবে সে। কিন্তু এখানে ওখানে উদভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করলে তো তাকে পাওয়া যাবে না। আরও কিছু তথ্য দরকার যার খেই ধরে এগুলে কাজ হবে।

    বিনয় জিজ্ঞেস করে, শিয়ালদায় আপনার বউঠাকরুন কি একলাই ছিল?

    কোন ট্রেনে উঠেছে অধর তা সঠিক জানাতে না পারলেও, এই প্রশ্নের জবাবটা সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া গেল। না বাবুমশয়, লগে একজন আছিল। মনে লয় (হয়), আপনেগো কুনো আত্মজন (আত্মীয়)।

    আত্মীয়-পরিজন বলতে এই শহরে হিরণরা এবং আনন্দরা ছাড়া অন্য কেউ নেই বিনয়ের। তবে দেশভাগের পর রাজদিয়া আর তার চারপাশের কুড়ি-পঁচিশটা গ্রামগঞ্জের বহু মানুষ এখানে চলে। এসেছে। তাদের অনেকের সঙ্গেই সম্পর্ক আত্মীয়ের মতোই। তাদের কারও কারও সঙ্গে দেখাও হয়েছে বিনয়ের। ঝিনুকের নিরুদ্দেশ হবার খবরটা প্রায় সবাই জানে। এদের কেউ তাকে দেখলে তক্ষুনি বিনয়কে জানিয়ে দিত। সেদিক থেকে মনে হয়, শিয়ালদা স্টেশনে পনেরো কুড়িদিন আগে ঝিনুকের। সঙ্গে যে ছিল সে পরিচিত কেউ নয়।

    অনন্ত আগ্রহে বিনয় জিজ্ঞেস করে, যার কথা বললেন সে কি পুরুষ, না মেয়েলোক?

    অধর বলল, পুরুষ মানুষ।

    কেমন দেখতে?

    অধরের স্মৃতিশক্তি এবার কোনওরকম গোলমাল করল না। ঝিনুকের সঙ্গীর মোটামুটি নিখুঁত বর্ণনা দিল সে। লোকটি আধবুড়ো, চুল উষ্কখুষ্ক, গালে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি, রোগা পাকানো চেহারা, চোখে পুরু কাঁচওলা নিকেলের টেড়াবাকা আদ্যিকালের চশমা, গায়ে ময়লা ধুতি আর ফতুয়ার ওপর ধুসো চাদর।

    এমন সাদামাঠা, গরিব গরিব, কৃশ চেহারার প্রৌঢ় রাস্তায় বেরুলে প্রতি কুড়ি জনের ভেতর দু-একটা পাওয়া যাবেই। খানিকটা দমে যায় বিনয়। এরপর কী বলবে যখন ভাবছে, সেই সময় আচমকা কিছু মনে পড়ে যায় অধরের। উৎসাহের সুরে বলে, আমার কী মনে লয় জানেন?

    কী?

    বউ ঠাইরেনের লগে যেনি আছিল তেনি পাকিস্থানের মানুষ

    বিনয় উগ্রীব হয়ে ওঠে, কী করে বুঝলেন?

    অধর বলে, আধবুড়া মানুষটা বউঠাইরেনরে কিছু কইতে আছিল। দু-একহান কথা আমার কানে আইছে। পদ্মাপাইরারা ছাড়া অ্যামন কইরা কেও কয় না। ভাষা এবং উচ্চারণ শুনে তার ধারণা। হয়েছে প্রৌঢ়টির বাড়ি একসময় পদ্মার তীরবর্তী কোনও অঞ্চলে ছিল।

    অধর থামেনি, মনে লয়, মানুষটা বেশিদিন বডারের এই ধারে আহে নাই। আমাগো লাখান রিফুজও হইতে পারে।

    বিনয় জিজ্ঞেস করল, রিফিউজি যে, টের পেলেন কী করে?

    অধর বলে, দ্যাশের ভিটামাটি খুয়াইয়া যারা পশ্চিম বঙ্গে আইছে হেগো চোখেমুখে অন্য কিসিমের। ছাপ থাকে। ঠিক বুঝান যায় না। তয় দ্যাখলেই ট্যার পাওন যায়।

    অর্থাৎ উদ্বাস্তুদের সারা শরীরে, পোশাকে আশাকে এমন একটা মার্কামারা ব্যাপার থাকে যাতে হাজার মানুষের জটলাতেও তাদের চিনে নেওয়া যায়। বিনয় বলল, ভদ্রলোক আপনার বউঠাকরুনকে কী বলছিলেন, মনে আছে?

    ওই যে কইলাম দুই-একহান কথা—

    সেই কথাগুলোই শুনতে চাইছি।

    খাড়ন, ভাইবা লই। কপালে অগুনতি ভাঁজ ফেলে অধর ভুইমালী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, দূর থিকা তো হুনছি। তভু যেটুক মনে আছে, হোনেন। বুড়া মানুষটা কইতে আছিল, দ্যাড় ঘণ্টার ভিতরে আমরা পৌঁছাইয়া যামু। যেহানে গিয়া থাকবা তুমার কুনো কষ্ট হইব না। আমাগো সোমসারটা নিজেগো সোক্সর মনে কইরো। এইর পর আরও কিছু কইছিল। ভুইলা গ্যাছি।

    বিনয় বলল, বয়স্ক লোকটাকে দেখে আপনার রিফিউজি মনে হয়েছে। ওরা কি কোনও জবরদখল কলোনি বা ক্যাম্পে থাকতে পারে?

    অধর বলল, না জাইনা হেইটা ক্যামনে কই? থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। একটু থেমে ফের বলে, পাকিস্থান থিকা যারা চইলা আইছে হেরা বেবাকেই তো আর কেম্পে কুম্পে উঠে নাই। কেওর কেওর আত্মজন কইলকাতার চাইর কিনারে তো বটেই, পচ্চিমবঙ্গের নানাহানে রইছে। আত্মজনের বাড়িও ম্যালা (অনেক) মাইনষে উঠছে।

    এদিকটা ভেবে দেখেনি বিনয়। তার নিজের কথাই ধরা যাক। কিংবা রামকেশব বা আশু দত্তর কথাও। তারাও তো সীমান্তের ওপার থেকে চলে এসেছে। কিন্তু সরকারি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছে কি? কলকাতার চারপাশে এবড়ো খেবড়ো পোড়ো জমি চৌরস করে, জলাজমি ভরাট করে বা বনজঙ্গল সাফ করে জবরদখল কলোনিও বসায়নি। তাদের মতো আরও বহু মানুষ সীমান্তের এপারে আত্মীয়পরিজনের বাড়িতেই এসে উঠেছে।

    অফিস থেকে আপাতত তাকে যে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সেটা হল শরণার্থী শিবিরে শিবিরে আর কলোনিতে কলোনিতে ঘুরে নানা তথ্য জোগাড় করে সে-সবের ভিত্তিতে রোজ একটা করে প্রতিবেদন তৈরি করে রাখা। অধরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্ষীণ একটু আশা চকিতের জন্য দেখা দিয়েছিল। বিনয় ভেবেছিল, ক্যাম্প ট্যাম্পগুলোতে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো ঝিনুকের খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই অজানা প্রৌঢ়টির সঙ্গে সে যদি কলোনি টলোনির বাইরে অন্য কোথাও গিয়ে থাকে? হাজার বছর এখানে ওখানে ছোটাছুটি করলেও তার সন্ধান মিলবে না। আশাটুকু মুহূর্তে বিলীন হয়ে যায় বিনয়ের।

    অধর বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বলল, আধবুড়া মানুষটারে চিনতে নি পারলেন বাবুমশয়?

    অথৈ নৈরাশ্যে ডুবে যেতে যেতে ঝাপসা গলায় বিনয় উত্তর দেয়, না।

    অনেক আগেই অধরের মনে খটকা দেখা দিয়েছিল। সে জিজ্ঞেস করে, এইটা ক্যামন কথা হইল?

    দুরমনস্কর মতো বিনয় বলে, কোনটা?

    আপনের অচিনা মাইনষের লগে বউ ঠাইরেন কই গ্যাল আর আপনে সোয়ামী হইয়া হেয়া জানেন না?

    এ প্রশ্নের জবাব জানা নেই বিনয়ের। সে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে।

    যদিন অপরাধ না লন, একহান কথা কই

    কী?

    বউ ঠাইরেন কি আপনের লগে কাইজা (ঝগড়া) কইরা বাড়ি থিকা গ্যাছে গিয়া?

    কী কারণে, কতখানি অপমানিত হয়ে, কী নিদারুণ যন্ত্রণায় ঝিনুক নিরুদ্দেশ হয়েছে, অধর ভুইমালীকে তা জানানো যায় না। জড়ানো গলায় কিছু বলে বিনয়, তার একটি শব্দও বোঝা গেল না।

    অধর হয়তো ঝিনুক সম্বন্ধে অস্বস্তিকর আরও প্রশ্ন করত, এইসময় রাস্তার উলটো দিকে, একটা বাস থেকে নেমে একজন যুবক এবং একজন তরুণী এধারে চলে আসে। যুবকটির বয়স সাতাশ আটাশ। রোগা, লম্বা। বেশ ধারালো চেহারা। গালে খাপচা খাপচা, পাতলা দাড়ি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। পরনে আধময়লা পাজামা আর পাঞ্জাবির ওপর হাফ-হাতা সোয়েটার। পায়ে ভারী চঞ্চল। কাঁধ থেকে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। তার সঙ্গিনীটি বেশ সুশ্রী। চব্বিশ পচিশের মতো বয়স। একসময় গায়ের রং ছিল টকটকে। রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। মাথার ঘন চুল রুক্ষ, বোঝা যায়, অনেকদিন তেল পড়ে না। এরও চোখে চশমা। এর কাধ থেকে যে চটের ভারী ব্যাগটা ঝুলছে সেটার গায়ে নানারকম নকশা।

    দুজনে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির দিকে যাচ্ছিল, অধরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। যুবকটি বলল, অধরদা, আপনাদের ওখানে চলেছি। দরকারি কথা আছে।

    অধর বলল, যান। কুলোনির বেবাকেই (সকলেই) আছে। তাগো লগে কথাবারা আরম্ভ করেন।

    আপনারও থাকাটা জরুরি।

    আমি বাবুমশয়রে বাসে তুইলা দিয়া অহনই আইতে আছি বলে বিনয়কে দেখিয়ে দিল অধর।

    যুবকটি অধরের সঙ্গে কথা বলছিল ঠিকই, তবে বার বার তার চোখ চলে যাচ্ছিল বিনয়ের দিকে। তবে বিনয় সম্পর্কে অধরকে কোনও প্রশ্ন করল না। সঙ্গিনীকে নিয়ে সে কলোনির দিকে চলে গেল।

    বিনয়ও দুজনকে লক্ষ করেছে। তাদের দেখে শরণার্থী বলে মনে হয় না। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে তাদের যে যাতায়াত আছে সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। নইলে অমন অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে অধর ভুইমালীকে অধরদা বলত না। যুবক আর তরুণীটি সম্পর্কে কৌতূহল হচ্ছিল বিনয়ের। জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?

    অধর একটু চুপ করে থাকার পর বলল, পাট্টির লোক।

    পাট্টি অর্থাৎ পার্টি। বিনয় আবছাভাবে শুনেছে, নানা রাজনৈতিক দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কলোনিগুলোতে ঢুকে পড়ছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অধরের কাছ থেকে সে জেনে নেয় যুবকটির নাম ত্রিদিব সেন, তরুণীটি হল জয়ন্তী বসু। তারা সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে কলোনি কমিটি বানাতে চায়। সেইজন্য প্রায়ই এখানে আসছে।

    বিনয় বলে, কলোনি কমিটি কাদের দিয়ে গড়া হবে? তাদের কী কাজ?

    অধর জানায়, কমিটি তৈরি হবে, সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির বয়স্ক বুদ্ধিমান লোকজনদের নিয়ে। সে আরও জানালো, সামনে কলোনির মাতব্বররা থাকলেও, ত্রিদিব সেনরাই আসল। তাদের পরামর্শ মতো চলতে হবে। উদ্বাস্তুরা সীমান্তের এপারে এসে পশুর মতো জীবনযাপন করছে অথচ সরকার তারা যাতে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে পারে তার কোনও ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। সহজ কথায় কাজ হবে না। শরণার্থীদের দাবি দাওয়া যাতে সরকার মেনে নেয় সেজন্য ত্রিদিব সেনরা তাদের নিয়ে মিটিং মিছিল করবে, নানা ধরনের আন্দোলনের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কমিটি গড়া হচ্ছে সেই কারণে।

    বিনয় জিজ্ঞেস করে, ত্রিদিব সেনরা কোন পার্টির লোক?

    কমিনিস (কমিউনিস্ট)। তয় শুনাশুন শোনছি চাইর পাশে আর যে হগল কুলোনি আছে হেই সব জাগার বেশির ভাগ কেমিটিই কংগ্রেসের।

    দেশে থাকতে সুদূর তালসোনাপুরের এই অক্ষরপরিচয়হীন অধর ভুইমালী কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টির বা অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের নাম শুনেছে কি না, যথেষ্ট সংশয় আছে। কিন্তু সীমান্তের এপারে আসার পর তারা অনেক কিছুই জানছে, শুনছে, শুধু তাই না, সে-সবের মধ্যে জড়িয়েও পড়ছে।

    গড়িয়ার দিকের একটা বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ায়। নানা কথায় অনেকটা সময় কেটে গেছে। না, আর দেরি করা ঠিক নয়। আচ্ছা, আজ যাই বলে বাসটায় উঠে পড়ল বিনয়।

    .

    গড়িয়ায় এসে রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে পাঁচ নম্বর রুটের বাস ধরল বিনয়। এটা তাকে ধর্মতলায় নিয়ে যাবে। ধর্মতলা তার চেনা জায়গা। সেখান থেকে কোন কোন নম্বরের বাস তাদের অফিসের সামনে দিয়ে যায়, সব বিনয়ের মুখস্থ।

    পাঁচ নম্বর বাসটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা। বসার জায়গা পেয়ে গেল বিনয়। এ-দিকটায় আগে আসেনি সে। শহর এখানে সেভাবে জমে ওঠেনি। চারপাশে প্রচুর ঝোপঝাড়, প্রচুর গাছপালা। কত যে ডোবা আর পানাপুকুর তার লেখাজোখা নেই। যেভাবে কলকাতায় মানুষ বাড়ছে, সীমান্তের ওপার থেকে শরণার্থীদের ঢল নামছে প্রতিদিন, কয়েক বছরের মধ্যে গড়িয়ার এই এলাকায় ফাঁকা জায়গা বলে কিছু থাকবে না।

    ছোকরা কন্ডাক্টরটা পাদানিতে দাঁড়িয়ে একটানা চেঁচিয়ে যাচ্ছে, রামগড় যাদবপুর, ঢাকুরিয়া– খালি গাড়ি, খালি গাড়ি–। বাইরের দৃশ্যাবলী, লোকজন, পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া যানবাহন কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না বিনয়। ঝিনুকের চিন্তাটা তার মাথায় উলটো পালটা স্রোতের মতো চারদিক থেকে ঢুকে যাচ্ছে। কলকাতার কাছাকাছি, হয়তো চল্লিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে কোথাও সে আছে। বনগাঁ বা নৈহাটি-কাঁচরাপাড়া লাইনের কোনও স্টেশনে নেমে সেখানে যেতে হয়। কিন্তু সেটা কোন স্টেশন? আর সেই স্টেশন থেকে কতদূরে গেলে কোন সে শহর বা গ্রাম যেখানে ঝিনুকের হদিস মিলবে? না, কিছুই জানা নেই। মেয়েটা এত কাছে রয়েছে, অথচ কত দূরে! মনে হয়, পৃথিবীর বাইরের কোনও গ্রহে যেখানে কোনও দিন পৌঁছানো যাবে না।

    নিজের মস্তিষ্কের অন্তঃপুর যেন দেখতে পাচ্ছিল বিনয়। সেখানে শুধুই হতাশা।

    ধর্মতলায় বাস বদলে অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে আড়াইটা বেজে গেল। দুপুরের শিফট দুটোয় চালু হয়। তার মানে আধঘণ্টা লেট হয়ে গেছে।

    .

    ৪০.

    নিউজ ডিপার্টমেন্টে এসে দেখা গেল, চারদিক গমগম করছে। প্রফ-রিডার আর সব-এডিটরদের টেবলগুলোর ফাঁক দিয়ে রিপোর্টিং সেকশনে চলে এল বিনয়। চিফ রিপোর্টার প্রসাদ লাহিড়ি নেই। তার চেয়ারটা ফাঁকা। মণিলালও নেই। তবে সুধেন্দু আর রমেন তাদের টেবলে বসে আছে।

    অ্যাটেনডান্স রেজিস্টারটা থাকে প্রসাদের টেবলে। দেরিতে আসার জন্য অস্বস্তি হচ্ছিল বিনয়ের। ভয়ে ভয়ে সে হাজিরা খাতায় সই করল। ভাবল, প্রসাদের সঙ্গে দেখা হলে লেটের কারণটা জানিয়ে দেবে।

    সইয়ের পর সুধেন্দুদের পাশে নিজের টেবলে গিয়ে বসল বিনয়। সেই সকালে বেরিয়ে বাসে অনেকটা রাস্তা ছোটাছুটি করতে হয়েছে। ভীষণ ক্লান্তি বোধ করছিল সে। খিদেও পেয়েছে প্রচণ্ড। অফিসে ক্যানটিন খোলা হলেও পুরোপুরি সেটা চালু হয়নি। শুধু চা, অমলেট, ডিম সেদ্ধ আর টোস্ট পাওয়া যায়। বাজারে কাগজ বেরুবার পর দুপুর আর রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।

    কাছাকাছি নিশ্চয়ই হোটেল টোটেল আছে। কারওকে জিজ্ঞেস করলে তার হদিস পাওয়া যাবে। সেখানে গিয়ে খেয়ে আসা যায় কিন্তু এই মুহূর্তে আর বেরুতে ইচ্ছা করছে না। একটা বেয়ারাকে ডেকে টোস্ট, ডিম সেদ্ধ আর চা আনতে বলে সুধেন্দুকে জিজ্ঞেস করে, প্রসাদদা এখনও আসেননি?

    সুধেন্দু বলল, এসেছেন। নিউজ এডিটরের ঘরে মিটিং করছেন।

    মণিলালদাকেও দেখছি না

    প্রসাদদা ওকে কী একটা কাজে কংগ্রেস অফিসে পাঠিয়েছেন। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। বলতে বলতে উঠে পড়ল সুধেন্দু, আমাকেও একটু বেরুতে হবে।

    বিনয় বলল, কখন আসছেন?

    সন্ধের আগে তো নয়ই।

    সুধেন্দু চলে যাবার পর চোখের কোণ দিয়ে একবার রমেনকে দেখল বিনয়। সেদিনের সেই ঘটনার পর খুব সতর্ক হয়ে গেছে সে। এই স্বার্থপর, কুচুটে লোকটাকে মোটেই তার পছন্দ নয়।

    রমেন টেবলের ওপর ঝুঁকে কিছু লিখছিল। তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে পকেট থেকে নোট বুক, পেন বার করে টেবলের ওপর রাখল বিনয়। তারপর শরীরটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। একটু জিরিয়ে খাওয়া দাওয়া চুকিয়ে সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লি সম্পর্কে প্রতিবেদনটা লিখে ফেলতে হবে।

    কিছুক্ষণের মধ্যে টোস্ট, ডিম, চা এসে গেল। লেখাটা কোথায় শুরু করে কীভাবে তথ্যগুলো সাজাবে, খেতে খেতে যত ভাবছিল ততই মনটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে বিনয়ের। বার বার ঝিনুকের মুখ চোখের সামনে ফুটে উঠছে।

    হঠাৎ পাশ থেকে রমেনের গলা কানে এল, বিনয়

    বিনয় আনমনা হয়ে ছিল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রমেন বলল, তোমার লগে একখান কথা আছে।

    বিনয় জিজ্ঞেস করে, কী কথা?

    তোমার মতো ভাইগ্যবান কইলকাতায় খুব বেশি নাই।

    কী করে বুঝলেন আমি ভাগ্যবান?

    রমেন হেসে হেসে বলে, আরে ভাই তোমার কতবড় একখান উচা (উঁচু) চঙ্গ আছে ভাইরা দেখ।

    বিনয় বলল, চঙ্গ!

    হ-চঙ্গ। ল্যাডারল্যাডার, পশ্চিমবঙ্গে যারে কয় মই।

    রমেনের কথা বলার ধরনটা ভাল লাগল না বিনয়ের। কোথায় যেন একটা নোংরা সংকেত রয়েছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে।

    রমেন এবার বলে, ক্লিয়ার কইরা বলি। তোমার ভগ্নীপতি আনন্দবাবু হইলেন তোমার ল্যাডার। যার এমুন চঙ্গ আছে সে ভাইগ্যবান না? তার মুখের হাসিটা আরও ছড়িয়ে পড়ে।

    এবারও জবাব দেয় না বিনয়। দেখাই যাক, আনন্দকে নিয়ে লোকটা কতদূর যায়।

    কণ্ঠস্বর ঝপ করে অনেকখানি নামিয়ে দিয়ে রমেন এবার বলল, একখান সুখবর শোনলাম।

    কী সুখবর?

    বিনয়ের দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় রমেন বলে, মার্কেটে আমাগো কাগজ বাইর হওনের একমাসের মইধ্যে তোমার নিকি পোমোশন হইব।

    প্রোমোশন? মানে?

    নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে রমেন বিশ্বাস বলল, সোজা কথাখান বোঝো না? তোমোশন হইল পদোন্নতি।

    কী বলছে লোকটা! মাত্র কদিন হল হল নতুন ভারত-এ চাকরি পেয়েছে সে। এর ভেতর খোমোশন। মাথার ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে যায় বিনয়ের। কী উত্তর দিতে যাচ্ছিল তার আগেই রমেন ফের বলে ওঠে, শুনতে আছি ডেপুটি চিফ রিপোর্টার হইয়া তুমি আমাগো মাথার উপুর । বসবা (বসবে)।

    শিরদাঁড়া টান টান হয়ে গিয়েছিল বিনয়ের। লোকটার মতলব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দাঁতে দাঁত চেপে বিনয় জিজ্ঞেস করে, আপনাকে কথাটা কে বলেছে?

    খুব শান্ত গলায় রমেন বলে, কইছে কেউ?

    কে সে?

    তার নাম কওনটা (বলাটা ঠিক না। বিশ্বাসভঙ্গ হইব। ভাই তোমার ভগ্নীপতির লগে আমাগো কাগজের মালিক জগদীশ গুহঠাকুরতার এত কাতির। তিনি রেম্যান্স করলে একটা প্রোমোশন হইব না, হেই কখনও হয়! তোমারে অ্যাডভান্স অভিনন্দন জানাইয়া রাখি।– এই লোকটারমেন বিশ্বাস–বিষপোকার মতো আবার হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল বিনয়। ক্রোধে, উত্তেজনায় মাথার ভেতরটা যেন ফুটতে থাকে। শিরায়ু বুঝিবা ছিঁড়ে পড়বে। নিজের অজান্তেই সে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেয়। –উঠুন উঠুন, তারাপদদার ঘরে নিয়ে যাই। দরকার হলে জগদীশবাবুর চেম্বারেও টানতে টানতে নিয়ে যাব। আমি জানি কেউ আপনাকে এ-সব বলে নি। ইউ আর এ ডার্টি পার্সন। প্রথম দিন থেকে আপনি আমার পেছনে লেগে আছেন। এই ইতরামোর শেষ আমি দেখতে চাই।

    বিনয়ের মতো নম্র ভদ্র বিনয়ী ছেলে যে এমন তুলকালাম কান্ড ঘটাতে পারে, রমেন ভাবতে পারে নি। সে ভয়ে কেঁচোর মতো গুটিয়ে যায়। মিন মিন করে বলে, আরে ভাইটি, বসো বসো। চেইতা (রেগে) যাও ক্যান? ঠিক আছে, যা কইছি উইদড্র করলাম। ইহল তো? এইটা মনে করে রাইখো না।

    রমেনের গলায় রীতিমতো তোয়াজের সুর। রাগের মাথায় বিনয় তারাপদ ভৌমিক এবং জগদীশ গুহঠাকুরতার ঘরে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল ঠিকই কিন্তু রমেন যখন কুঁকড়ে গেছে তখন এই নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া করল না। আসলে ঝামেলা ঝাট, তর্ক বিতর্ক, উত্তেজনা, এ-সব আদৌ পছন্দ নয় তার। কেউ গায়ে পড়ে অপমান করলে বা অকারণে নোংরা কথা বললে তক্ষুনি তক্ষুনি হেস্তনেস্ত করার কথা হয়তো সে ভাবে, কিন্তু লোকটা পিছু হটলে সে-সব আর মনে রাখে না।  ঝগড়াঝাটির জের টেনে চলা তার ধাতে নেই।

    বিরক্ত চোখে একবার রমেনের দিকে তাকিয়ে বসে পড়ে বিনয়। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের উত্তপ্ত বাষ্প জুড়িয়ে আসে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সেটা শান্ত হলে একসময় লেখা শুরু করল সে। সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে প্রচুর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল। মনে হচ্ছে, প্রতিবেদনটা ভালই দাঁড়িয়ে যাবে।

    নিউজ এডিটরের ঘরে মিটিং-এর পর প্রসাদ লাহিড়ি ফিরে এসেছিলেন। লেখাটা শেষ করে বিনয় তাঁর টেবলের সামনে এসে দাঁড়াল। তাকে বসতে বলে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে যে অ্যাসাইমেন্ট দেওয়া হয়েছে সেটা কি আরম্ভ করতে পেরেছ?

    টেবলের এধারে বসতে বসতে মাথা নাড়ল বিনয়, হ্যাঁ—

    জবরদখল কলোনি না ক্যাম্প, কী দিয়ে স্টার্ট করলে?

    গড়িয়ার ওধারের সেই কলোনিটার নাম জানিয়ে দিয়ে বিনয় বলল, ওটা সম্পর্কে লিখেও ফেলেছি। এই যে

    হাত বাড়িয়ে বিনয়ের হাত থেকে লেখাটা নিয়ে টেবলের ওপর পেপার-ওয়েট চাপা দিয়ে রাখতে রাখতে তারিফের সুরে প্রসাদ বললেন, ভেরি গুড। রোজই কিন্তু এরকম একটা করে লেখা চাই।

    আপনি তো সেদিনই বলে দিয়েছিলেন। আমার তা মনে আছে। রোজই দেব। টেবলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বিনয় বলল, লেখাটা তো পড়লেন না প্রসাদদা? তার গলায় মৃদু উদ্বেগ। প্রতিবেদনটা প্রসাদের পছন্দ হল কি না সেটা শোনার জন্য উগ্রীব হয়ে আছে সে।

    প্রসাদ হাসলেন, পড়ার দরকার নেই। আমি জানি খুব যত্ন করে লিখেছ আর ওটা খুব ভাল হয়েছে।

    তার লেখার ওপর চিফ রিপোর্টারের বিপুল আস্থা আছে জেনে ভীষণ খুশি হল বিনয়। আর তখনই অদৃশ্য কোনও আঙুল যেন ঠেলা দিয়ে তার মাথাটা বাঁ পাশে ঘুরিয়ে দিল। দেখা গেল, একদৃষ্টে এদিকে তাকিয়ে আছে রমেন। প্রসাদের শেষ কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে সে। আগেও যেমন হয়েছে আজও হিংসেয় কালো হয়ে গেছে তার মুখ। চোখাচোখি হতেই ঝপ করে মাথা নামিয়ে প্যাডের পাতায় ঘস ঘস করে কী লিখতে লাগল।

    কয়েক পলক রমেনকে দেখে প্রসাদের দিকে তাকায় বিনয়। তার মতো আনকোরা এক প্রতিবেদকের লেখা সম্পর্কে চিফ রিপোর্টারের ধারণা এত উঁচু যে লেখা পড়ারও দরকার মনে করেননি। এটা বিনয়কে এমনই চনমনে করে তুলেছে যে তার মনে হল, রমেনের মতো একটা বাজে, হিংসুটে লোকের চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবার মানে হয় না। তার কথা যত ভাববে ততই রাগ চড়ে যাবে। উত্তেজনা বাড়বে। কাজকর্মে মন বসবে না। এই পৃথিবীতে বিষাক্ত কীটের অভাব নেই। তারা সুযোগ পেলেই হুল ফোঁটায়, বিষ ঢালে। কিন্তু কী আর করা যাবে? এই নিয়েই থাকতে হবে।

    ঝিনুকের ভাবনাটা কিছুক্ষণের জন্য চাপা পড়ে ছিল। সেটা আবার মস্তিষ্কের গোপন কুঠুরি থেকে বেরিয়ে এল। অধর ভুইমালী যা ইঙ্গিত দিয়েছে, তাতে বনগাঁ কি নৈহাটি-কাঁচরাপাড়া লাইনে, কলকাতা থেকে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মাইলের মধ্যে ঝিনুকের থাকার সম্ভাবনা। ওই সব এলাকার রিফিউজি ক্যাম্প টম্পে সে আছেই, এমন কথা জোর দিয়ে বলতে পারেনি অধর। তবু ওই জায়গাগুলোতে খোঁজ নেওয়া ভীষণ জরুরি। কিন্তু ওই অঞ্চলের ক্যাম্প আর কলোনিগুলোর ঠিকানা বিনয়ের জানা নেই।

    লেখা জমা দেওয়া হয়ে গেছে। তারপরও বিনয়কে বসে থাকতে দেখে প্রসাদ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আর কিছু বলবে?

    বিনয় ঘাড় কাত করে, হা–

    বল না—

    আপনি আমাকে যে লিস্টটা দিয়েছেন তাতে যাদবপুর নাকতলা গড়িয়া নিউ আলিপুর, এই এলাকাগুলোর ক্যাম্প আর কলোনির নাম, অ্যাড্রেস রয়েছে। কিন্তু শিয়ালদা নর্থ আর মেন লাইনেও অনেক কলোনি রয়েছে। আপনি কিন্তু সেগুলোর নাম-ঠিকানা দেননি।

    প্রসাদ বললেন, যা দিয়েছি সে-সব কভার করতেই অনেকদিন লেগে যাবে। আগে সাউথটা শেষ কর। তারপর শিয়ালদা মেন আর নর্থ ধরবে

    কিন্তু

    না না। যা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে তার বাইরে এখন অন্যদিকে ছোটাছুটির দরকার নেই।

    প্রয়োজনটা কী কারণে, সেটা প্রসাদকে জানানো যায় না। তবু মরিয়া হয়ে বিনয় বলল, আমি ওই দিকের মুকুন্দপুর বাস্তুহারা কলোনি বলে একটা কলোনিতে মাঝে মাঝে যাই। অন্যগুলোর নাম জানা থাকলে

    প্রসাদ একটু বিরক্তই হলেন, তা যেতে পার, কিন্তু ওদিকে আর কোথাও আপাতত যেতে হবে না।

    ফের কিছু বলতে সাহস হল না বিনয়ের। হতাশ ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়িয়েছিল, হঠাৎ হাজিরার কথা মনে পড়ায় আবার বসে পড়ে। কাচুমাচু মুখে বলে, আমার একটা অন্যায় হয়ে গেছে প্রসাদদা

    প্রসাদ অবাক হলেন, কী অন্যায়?

    সকালে আমি সোনার বাংলা উদ্বাস্তু পল্লিতে গিয়েছিলাম। সেখানে কাজ সেরে অফিসে আসতে আধ ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি অ্যাটেনডান্স রেজিস্টারে সই করে ফেলেছি।

    বেশ করেছ। তুমি তো অফিসের কাজেই গিয়েছিলে। তখন থেকেই তোমার ডিউটি আওয়ার্স শুরু হয়েছে। কাজ কমপ্লিট করে অফিসে পৌঁছতে যদি দু-এক ঘণ্টা দেরিও হয়, কোনও সমস্যা নেই। যেদিন অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করতে আরও দেরি হবে সেদিন অফিসে আসবে না। পরদিন এসে সই করবে। ঠিক আছে?

    আচ্ছা

    একটু ভেবে প্রসাদ ব্যস্তভাবে বললেন, সেই সকালে বেরিয়েছ, বললে না?

    বিনয় মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

    দুপুরে ভাতটাত খাওয়া হয়েছে?

    না। অফিসে এসে ডিম টোস্ট খেয়েছি। রাত্তিরে ফিরে ভাত খাব।

    না না, এটা কোনও কাজের কথা নয়। যদ্দিন না অফিসের ক্যানটিন পুরো চালু হচ্ছে, সকালে বাড়িতে সব রান্না না হয়ে উঠলেও দুটি ভাতে ভাত অন্তত খেয়ে বেরিয়ো। মনে থাকবে?

    হ্যাঁ।

    সারাদিন পেটে ভাত পড়বে না, ছাতা মাতা খেয়ে কাটাবে। তার ওপর এত পরিশ্রম। এভাবে বেশিদিন টানতে পারবে না। শরীর ভেঙে যাবে। আজ আর তোমার অফিসে থাকার দরকার নেই। বাড়ি চলে যাও।

    প্রসাদ লাহিড়িকে কী আশ্চর্য স্নেহময়, সহৃদয় মানুষই না মনে হচ্ছে বিনয়ের। তার সব দিকে নজর। শরীর খারাপ হবে বলে কত চিন্তা! অথচ শিয়ালদা নর্থ আর মেন লাইনের রিফিউজি ক্যাম্প আর কলোনির নাম-ঠিকানাগুলো কিছুতেই দিলেন না। একদিকে যেমন ভালও লাগছে, অন্যদিকে ক্যাম্প-কলোনির ঠিকানা না পাওয়ায় অভিমানও হচ্ছে। বিনয় আর বসে না, ধীরে ধীরে উঠে পড়ে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleউত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়
    Next Article কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    Related Articles

    প্রফুল্ল রায়

    আলোর ময়ুর – উপন্যাস – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    উত্তাল সময়ের ইতিকথা – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    গহনগোপন – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    নিজেই নায়ক – প্রফুল্ল রায়ভ

    September 20, 2025
    প্রফুল্ল রায়

    ছোটগল্প – প্রফুল্ল রায়

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.