Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – জুবায়ের আলম

    জুবায়ের আলম এক পাতা গল্প333 Mins Read0

    শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – ১৪

    হঠাৎ পাওয়া ধাক্কা

    পিক্সেল রিফরমেশন অনেক ধৈর্যের কাজ। ছবি জুম করে একটা একটা পিক্সেল দিয়ে একটা অবকাঠামো দাঁড় করাতে হয়। সময় নিয়ে একটা একটা করে ব্লকগুলো সাজাতে হয়। অনেকটা জিগ-স পাজলের মত।

    সেটাই আরাফ, সাইদুর আর আতিক দ্বীপ্ত মিলে করছে। আতিক দ্বীপ্ত সাইদুরের বন্ধু। সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বাড্ডায় ওদের একটা সফটওয়ার ফার্ম আছে, নাম এক্স-বিট। সে-ই বেশির ভাগ করছে। সকাল থেকে কাজ শুরু হয়েছে, প্রায় শেষের পথে।

    বন বন করে পাখা ঘুরছে মাথার ওপরে। তারপরও গরম। তিনজনেই খালি গায়ে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে মূর্তির মত কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে আছে। আর একটু একটু করে একটা আবছা মানুষের মুখ ফুটে উঠছে। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি আরাফেরও যেমন বাড়ছে তেমন বাড়ছে সাইদুরের। যত স্পষ্ট হচ্ছে অবকাঠামোটা, ততই ধুকপুকানি বাড়ছে। একটা চাপা কৌতূহল যেন ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে একটা যন্ত্রণাদায়ক আতঙ্কে। ঠিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করার আগে যেমন লাগে, ঠিক তেমন।

    এক এক লেয়ার কাজ করার পরে সেটা আবার শার্প করতে হচ্ছে যাতে অবকাঠামোটা একটু পরিষ্কার হয়। বেশ কয়েকবার শার্প করার পরে যখন মোটামুটি মানুষটার চেহারা বোঝা গেল, সাইদুর আর আরাফ বজ্রাহতের মত বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল স্ক্রিনে ফুটে ওঠা মানুষটার চেহারার দিকে।

    ****

    লাইটিং? ওকে। কার্টেইন? ওকে। সাউন্ড সিস্টেম? ওকে।

    শিল্পকলা একাডেমির অডিটোরিয়ামের মূল মঞ্চে শোভা পাচ্ছে ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের বিরাট ব্যানার। খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে পুরো মঞ্চটা। সাউন্ড সিস্টেমটা বেশ কয়েকবার চেক করাও হয়ে গিয়েছে। অপরেশ পাল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সাউন্ড সিসটেমটা চেক করিয়েছেন। অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি। এখন শুধু লাইটটা ঠিক ঠাক মত সেট করলেই হয়ে যাবে।

    কিন্তু হিরণের ফোন বন্ধ। বেশ কয়েকবার হিরণের বাসায় লোক পাঠিয়েছেন গত পরশুদিন থেকে। বাসায় কেউ নেই। তালাবদ্ধ। বাড়িওয়ালাও কিছু বলতে পারছে না। সে না আসলেও কোন ব্যাপার না। হিরণের অনুপস্থিতির কোন একটা কারণ বলে দেওয়া যাবে। কিন্তু ছেলেটা গেল কোথায়? নাহ, দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। বড় বড় অতিথিরা আসছেন, পুরো ফোকাস এখন এই অনুষ্ঠানটার ওপরে দিতে হবে।

    আনমনেই ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলেন হিরণকে।

    ‘দুঃখিত, কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…’

    কিছুক্ষণ পরে অফিস সহকারী মহিলাটি অপরেশকে ডেকে বলল, “স্যার, হিরণ পাশার লাশ পাওয়া গিয়েছে, সাভারের নাজমা বাজারের একটা আড়তে।”

    ****

    শুক্রবার।

    ঝিম ধরা দুপুর। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিজের কেবিনে বসে চিন্তায় ডুবে আছে এজেন্ট এলিন।

    কীভাবে নীরুকে মুক্ত করব আমি?- নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল এলিন। মাথার ভেতরে ঝড় শুরু হয়েছে। একটা না একটা উপায় তো বের করতে হবে। বইটা দরকার। বইটার খুব দরকার। হাতে সময় বেশি নেই। আসামীটার মৃত্যুর খবর এখনও জানাজানি হয়নি। কিন্তু যখন হবে, তখন এটার চূড়ান্ত তদন্ত হবে। তার আগেই কাজ শেষ করতে হবে। একটা অসহ্য মানসিক চাপ পাক খেতে লাগল তার ভেতরে।

    নীরুর কেসের ফাইলটা সামনে খোলা। ফ্যানের বাতাসে ফর ফর করে পাতাগুলো উল্টে পাল্টে যাচ্ছে। ফাইলটা বেশ কয়েকবার পড়া হয়ে গিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত এমন কোন ফাঁকফোকর পায়নি যেটা দিয়ে নীরুকে বের করে আনা যায়।

    ধূর! সাইদুর যে কেন ওই অডিও ক্লিপটা দেওয়ার বুদ্ধিটা দিল। ওটা না দিলে আর এমন হত না। ওটাই সব থেকে বড় প্রমাণ। এছাড়া শাঁখারীবাজারে যে বন্দুকটা পাওয়া গিয়েছে সেটাতে নীরুর হাতের ছাপ নেই, আবার ওখানে যে নীরু ছিল তারও কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু ক্লিপটাই যত সর্বনাশটা করল। ওটা শুনলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে নীরু সেদিন শাঁখারীবাজারে ছিল।

    হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। সাইদুর ফোন দিয়েছে।

    “হ্যালো এলিন?”

    “হ্যাঁ বল। তুই আর আরাফ কোথায়? ফোন বন্ধ কেন তোদের? আর জানিস আমি বইটা…”

    “থাম থাম। খুব তাড়াতাড়ি মল্লিকাকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আয়। খুব তাড়াতাড়ি।”

    “কেন কি হয়েছে? এই?

    লাইনটা কেটে গেল।

    পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বের হওয়ার সময় দেখল, তুমুল হৈ চৈ, ছুটাছুটি। একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই জানালো, হিরণ পাশার লাশ পাওয়া গিয়েছে সাভারে। এক্ষুনি বের হতে হবে। এলিন কোন কথা না বলে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। উদ্দেশ্য জয়েনুদ্দীনের বাসা।

    এসির টেম্পারেচারটা কমিয়ে দিয়ে ঘড়িটা দেখে নিল এলিন। বাইরে প্রচণ্ড গরম।

    শুক্রবারের ফাঁকা রাস্তা। তাই কালিদাস সরণী পর্যন্ত যেতে খুব বেশি বেগ পোহাতে হল না। সাইদুর আর আরাফ কী হিরণ পাশার মৃত্যুর খবরটা পেয়েছে? না পেয়ে থাকলে দেওয়া উচিৎ। জানিয়ে দিলে ওরা ওখান থেকেই বেরিয়ে পড়বে। আর মল্লিকা? মল্লিকাকেও সংবাদ দিতে হবে। ওকে ম্যাসেঞ্জারে একবার জানিয়ে দিলেই হবে। ও সারাদিন ম্যাসেঞ্জারেই থাকে।

    সেলফোনটা বের করেই এলিন প্রথমে ফোন করল মল্লিকাকে। মল্লিকা ফোন ধরল। “মল্লিকা? খুব তাড়াতাড়ি তোর বাসার সামনে চলে আয়। আমি তোকে নিয়ে বের হব।” এলিন বলল।

    ওপাশে মল্লিকার ভাঙা ভাঙা কণ্ঠ শোনা গেল, “দোস্ত, আজকে তো আমার একটা ইনভাইটেশান আছে বিকালে। শিল… কয়ে……তা……কী……য়েছে?”

    দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে কথাগুলো কাটা কাটা শোনা গেল। এলিন বুঝতে পারল না কিছু। সে কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ বলতেই লাইনটা কেটে গেল। এলিন আরেকবার ফোন করতে যাবে ঠিক তখনই এক রিক্সাওয়ালা গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিল। মেজাজটা চড়ে গেল এলিনের জানালার কাঁচ নামিয়ে ঝাড়ি দিতে যাবে ঠিক এমন সময়েই হাত থেকে পড়ে গেল ফোনটা। শক্ত পিচের ওপরে ফোনটা পড়তেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেল। কোনভাবেই আর ওপেন হল না ফোনটা।

    এলিনের জানা হল না, একটা অচেনা নাম্বার থেকে প্রায় দশবার ফোন এসেছে। মিসড কল হয়ে আছে।

    একরাশ বিরক্তি নিয়ে এলিন কালিদাস সরণীতে পৌঁছাল। গাড়িটা সোজা ঢুকিয়ে দিল জয়েনুদ্দীনের বাড়ির গলিতে। খুব দ্রুত তাকে নিয়ে সাভার পৌঁছাতে হবে। একবার ব্যাটারি খুলে ফোনটা অন করার চেষ্টা করা দরকার। কিন্তু হাতে সময় নেই, একেবারেই সময় নেই। তৌফিক এলাহীর আগে পৌঁছাতে হবে যেভাবেই হোক।

    শক্ত একটা ব্রেক করে গাড়িটা জয়েনুদ্দীনের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।

    গাড়ির দরজা খুলে বের হতেই গরম বাতাসের হলকা এসে এলিনের গালে চড় বসিয়ে দিল। তাড়তাড়ি কাঠের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল এলিন।

    জয়েনুদ্দীনের ঘরে তালা মারা।

    সৰ্বনাশ!

    দরজা খোলার শব্দ শুনে ওপরতলা থেকে একজন মেয়ে উঁকি মেরে বলল, “কিডা রে? কিডা আইচে?”

    “আমি। জয়েনুদ্দীন সাহেব কোথায় গিয়েছে বলতে পারেন?” এলিন বলল।

    “বুড়া মিয়ার কোন আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি রইছে সেকেনে গিইচে। মাত্র বেরোইলু।” বিদ্যুৎ গতিতে বের হয়ে গেল এলিন। কোন দিকে গিয়েছে? নাহ, হাসপাতালে খোঁজার সময় নেই।

    এলিন একাই যাবে। কাউকে দরকার নেই এলিনের। সিটের নিচে স্ট্র্যাপ দিয়ে আটাকানো রিভলভারটা চেক করে নিল একবার। এক্সট্রা একটা ম্যাগাজিনও আছে। ব্যাপার না, এতেই হবে। সে অন্যদের থেকে কম কিসে? অন্যদের মত হয়ত কারাটে জানে না, তাতে কি? হোক সে ফরেনসিক স্পেশালিষ্ট, কিন্তু সে সব পারে।

    গাড়ি ঘুরিয়ে কালীদাস সরণীর দিকে গেল এলিন। এখান থেকে সোজা সাভারে যাবে।

    কিন্তু কালীদাস সরণীতে এসেই রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির সামনে পড়ল একটা লোক। হাতে ব্যাগ। মুখ ভর্তি দাড়ি।

    “জয়েনুদ্দীন আপনি!” চিৎকার করে উঠে দরজা খুলে বের হয়ে আসলো এলিন।

    “তুমি এইখানে?” জয়েনুদ্দীনও অবাক, “আজ তো শুক্রবার? তুমি এইখানে কেন? বাকিরা কই?”

    “সব বলব, আগে গাড়িতে ওঠেন। তাড়াতাড়ি ওঠেন।”

    “আমার এক আত্মীয় মিটফোর্ডে ভর্তি হয়েছে। আত্মীয় বলতে আমার এক বন্ধুর ছেলে, আত্মীয়ের মতই।”

    “পরে যাইয়েন, প্লিজ গাড়িতে ওঠেন। সাভারে খুন হয়েছে।”

    “কে?”

    “আরে ওই যে, কী যেন, হিরণ পাশা।”

    “দেখ আমি এখন যেতে পারব না। আমার খুব জরুরী কাজ আছে বললামই তো তোমাকে।”

    পেছনে জ্যাম বেঁধে গিয়েছে। লোকজন পাগলের মত হর্ণ বাজাচ্ছে। কেউ কেউ চিৎকার করছে, “সাইডে খাড়ায়ে পিরিত করেন রাস্তার মাজ দিয়া কি লাগাইছেন ঐ ম্যাডাম।”

    এলিন শেষবারের মত চেষ্টা করল; কড়া গলায়, “আপনি যাবেন, না আমি রিভলবার বের করব?”

    বাধ্য হয়ে জয়েনুদ্দীন গাড়িতে উঠলেন তার হাতের পোটলাটা সমেত। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, “আরেহ, এত জোরে কেউ গাড়ি চালায়?”

    জয়েনুদ্দীন পেছনের সিটে বসতে যাচ্ছিলেন, এলিন সামনের সিটে বসতে বলল।

    পনেরো মিনিটের ভেতরে গাড়ি পল্টনের মোড় পার হয়ে গেল। জয়েনুদ্দীন জিজ্ঞাসা করলেন,

    “কীভাবে খুন হয়েছে কিছু জানা গিয়েছে?”

    “নাহ। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তৌফিক এলাহীর আগে পৌঁছাতে হবে আমদেরকে। না হলে বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে। আমি আর আপনি গিয়ে পুরো ক্রাইম সিনটা আগে দেখব।”

    “বাকিরা কোথায়?”

    “ওরা ব্যস্ত। আপনার তো ফোন ও নাই যে কল করে জানাবো। এই যুগে ফোন ছাড়া কেউ থাকে? আপনাকে যে একটা ফোন দেব তারও উপায় নাই।”

    “কিসে ব্যস্ত?”

    “ওই যে ভিডিও ফুটেজটা নিয়ে ব্যস্ত।”

    “কিসে?”

    “ওই যে ড্রোনের ভিডিও ফুটেজটা।”

    সাথে সাথে এলিনের মনে হল, এটা তো জয়েনুদ্দীনকে বলার কথা ছিল না। এটা সারপ্রাইজ ছিল। যাই হোক, বলেই যখন ফেলেছে তখন বাকিটা বলেই ফেলা ভালো। জয়েনুদ্দীন কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না যে আমাকে এটা বলোনি কেন হ্যান ত্যান। মূর্তির মত বসে থাকলেন। তার নিঃশ্বাস ছোট থেকে আরো ছোট হয়ে আসলো।

    বাকিটা সময় কেউ কথা বলল না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আত্মীয়ের জন্য কিছুক্ষণ আস্ফালন করে ঘুমিয়ে পড়লেন জয়েনুদ্দীন।

    সোয়া এক ঘণ্টার ভেতরে গাড়ি সাভার বাজারের মোড়ে পৌঁছে গেল। এখন সোজা বাম দিকে গেলেই নাজমা বাজার। দুজনের কেউই জানে না, কি ভয়ানক বিপদের ভেতরে পড়তে যাচ্ছে তারা।

    স্বাগতম

    নাজমা বাজার জায়গাটা আড়তে ভর্তি। সাভার বাজার থেকে সোজা পশ্চিমে, গ্রামের ভেতর দিয়ে একেবারে ধলেশ্বরীর তীরে বাজার। রাস্তা বললে ভুল হবে। গলি এক একটা। সরু সরু গলিগুলো এদিক ওদিক দিয়ে একেবারে ধলেশ্বরীতে গিয়ে মিশেছে। বেশ কয়েকটা ঘাট আছে। সবজি বেশি আনা নেওয়া করা হয়।

    খুনটা হয়েছে একেবারে ঘাটের কাছেই একটা বাড়িতে। নিচে আড়ত। ওপরে একটা পলেস্তারাহীন ঘর। আশেপাশে লোক জড়ো হয়েছে। এলিন আর জয়েনুদ্দীন আসতেই সাভার থানার ওসি বললেন, “খুনটা সম্ভবত কাল রাতে হয়েছে। সকালে আড়ত খুলে লাশটা আবিষ্কার করে এখানকার একজন কর্মচারী।”

    তিনজনে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে লাগলেন। নিচে হাবিলদাররা লোকজন ঠেকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এলিন প্রশ্ন করল, “সেই কর্মচারী কি আছে এখন?”

    “হ্যাঁ আছে কিন্তু ওকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কথা বলবেন?” ওসি বললেন।

    এলিন মাথা নেড়ে জানালো যে সে কথা বলতে চায়। “ঠিক আছে। এখানকার কাজ শেষ করে থানায় গেলেই হবে নাকি?”

    ওসি সাহেব আড়চোখে এলিনের ব্যাজের দিকে তাকাচ্ছেন। কোন মেয়েকে তিনি এর আগে ডিবিতে দেখেননি। প্রথমে ভেবেছিলেন হিরণের গার্লফ্রেন্ড হবে। ব্যাজটা না দেখলে উল্টাপাল্টা কিছু একটা বলে দিতেন। তার অবশ্য এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে তিনি একজন ডিবির জুনিয়র ফিল্ড এজেন্টের সাথে আছেন আর সেটা একজন মেয়ে। কিন্তু এই বুড়োটা কে? জিজ্ঞাসা করাটা কি উচিৎ হবে?

    পুরো ঘরটাতে বেশ কিছু চটের বস্তার স্তূপ আছে। কয়েকটা বালতি, এক কোণায় একটা বস্তা মাপার বিশাল দাড়িপাল্লা। মেঝেতে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে ধান আর গম। একটা ভ্যাপসা গন্ধ মিশেছে রক্তের গন্ধের সাথে।

    লাশটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। ঠিক এভাবেই ইমন মোস্তাফিজের লাশটা পড়ে ছিল হোটেলের বারান্দায়। মগজ আর মাথার খুলি ছিটকে পড়ে আছে এখানে সেখানে। বিভৎস আঁশটে একটা গন্ধে দম আটকে আসল এলিনের। পকেট থেকে একটা ক্লিনিকাল মাস্ক বের করল। জয়েনুদ্দীনের দিকে ইশারা করতেই জয়েনুদ্দীন এগিয়ে গেল লাশটার দিকে। ওসি সাহেবের কাছ থেকে একটা টর্চ চেয়ে নিল সে।

    জ্বল জ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে হিরণ পাশার লাশটা। বাম পাশের চোখটা খোলা থাকলেও ডান পাশের চোখটার জায়গায় একটা চুপসে যাওয়া গর্ত। পাশের দেয়ালে আর চটের বস্তায় ঘন টমেটো কেচাপের মত রক্ত জমাট বেছে আছে। চোখের মনি বের হয়ে গিয়েছে। মাথার ডান পাশের এবড়ো থেবড়ো গর্তটাতে মাছি বসছে ভন ভন করে।

    “মার্ডার ওয়েপন কি পাওয়া গিয়েছে?” জয়েনুদ্দীন প্রশ্ন করলেন।

    ওসি সাহেব মাথা নাড়লেন; কোন অস্ত্র পাওয়া যায়নি। জয়েনুদ্দীন ডানে তাকালেন। গুলিটা তাহলে ডান দিক থেকেই আসার কথা।

    মৃত্যুর আগে কি ভেবেছিল ছেলেটা? প্রথমে হয়ত এড্রেনালিন নামের হরমোনটা ক্ষরন শুরু হয়েছিল। বাঁচার জন্য লড়বে? নাকি পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করবে? কোন সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল? হয়ত মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে নিজের নিশ্চিত নিয়তির কথা জানতে পেরেছিল সে। তখন রক্তে ডাইমেথিল ট্রিপট্যামিন নামক হরমোনের ঢল নেমেছিল হয়ত। হৃৎপিণ্ড শেষবারের মত রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দেওয়ার আগে ছেলেটার চোখে ভেসে উঠেছিল জ্যামিতিক কিছু আকৃতি হয়ত ফুটে এসেছিল। যেটাকে বলে হলোফ্র্যাক্টিক জিয়োমেট্রিক ভিজুয়াল। তারপর সব অন্ধকার। একটা অন্ধকারের জগৎ। যেখানে জীবনের হাসি কান্না আর প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির সবটাই মিথ্যে হয়ে যায়।

    ডান দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘরটার মেঝেতে প্রচুর ধূলো আছে। কিন্তু সেই ধুলোতে কোন পায়ের ছাপ নেই। না থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ খুন হয়েছে প্রায় বারো ঘণ্টা আগে। পায়ের ছাপ যদি এর মধ্যে থেকেও থাকত তাহলে এতক্ষণে ঢেকে গিয়েছে। কিন্তু ডান দিক থেকে গুলি করার কোন চিহ্নই দেখতে পেলেন না জয়েনুদ্দীন। কোন গুলির খোসা পড়ে নেই। মেঝেতে গানপাউডার বা বারুদের ছিটে ফোঁটাও নেই। যেন জ্বিন ভূতে এসে মেরেছে হিরণকে।

    “কিছু বুঝছেন? তাড়াতাড়ি করেন একটু। তৌফিক এলাহী আসলে কাজ শেষ করতে পারবেন না,” এলিন বলল। ঘড়ি দেখলেন ওসি সাহেবও।

    কি মনে করে জয়েনুদ্দীন ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেলেন আবার। ডান হাতটা ধরতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল তার চোখে। হাতের মাংসপেশী পাথরের মত শক্ত; প্রি-ট্রমাটিক মাসল স্প্যাজম। মৃত্যুর আগে এই হাতেই পিস্তল ধরেছিল হয়ত। কিন্তু পিস্তলটা কোথায়? পুরো ব্যাপারটা বুঝতে মুহূর্তও লাগল না। এটা খুন না, এটা আত্মহত্যা! আর…আর এটা তাকে ধরার জন্য একটা ফাঁদ!

    চোখের পলকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ওসি সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলেন জয়েনুদ্দীন। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বের করে আনলেন একটা ধারালো ফলাওয়ালা কলম। বসিয়ে দিলেন ওসি সাহেবের গলায়, একেবারে কণ্ঠনালী বরাবর। ছট ফট করতে করতে ধুলো ধূসরিত মেঝের ওপরে পড়ে গেলেন ওসি।

    রিভলবারটা হাতে নিতে এলিনের এক সেকেন্ড দেরি হয়ে গেল। এলিনের হাতে বসে গেল জয়েনুদ্দীনের ধারালো ফলা। এলিন কঁকিয়ে উঠল। তীব্র আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সে।

    বিস্ফোরিত চোখে উন্মত্ত হাসি নিয়ে জয়েনুদ্দীন তাকিয়ে থাকল এলিনের দিকে। শান্ত সৌম্য চেহারাটা পরিণত হয়েছে উন্মাদের চেহারায়। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের ফলে চোখ দুটো রক্ত জবার মত লাল। চাপা গোঙানীর শব্দ আসছে কিছুক্ষণ পর পর। এই জয়েনুদ্দীনকে এলিন চেনে না। কেউ চেনে না।

    চোখের সামনে মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখল এলিন। কিছুক্ষণের জন্য রুদ্ধশ্বাসের অপেক্ষা। তারপরেই মৃত্যু।

    নিচের পুলিশগুলোর উদ্দেশ্যে একটা চিৎকার দিতে গেল এলিন। ঠিক সেই মুহূর্তেই সিলিং-এর একটা টিন খুলে কেউ একজন লাফিয়ে পড়ল। জয়েনুদ্দীন কিছু বুঝে ওঠার আগেই সপাটে একটা ঘুষি চালাল ছায়ামূর্তিটা। তারপর সেকেন্ডেরও কম সময়ে বাম পাঁজর বরাবর আর একটা। কিন্তু কৃষ্ণ পদার্থের শক্তি শুষে নেওয়ার মত সব গুলো আঘাত শুষে নিল জয়েনুদ্দীন। অবলীলায় লাথি কষে দিল ছায়ামূর্তিটার ডান হাঁটু বরাবর।

    অনেক পুরোনো চাল এটা। হাঁটু সরিয়ে নিল ছায়ামূর্তি। একটুর জন্য হাঁটুতে লাগল না আঘাতটা। বাম পা টা কাজে লাগাল সে, জয়েনুদ্দীনের বাম পা বরাবর চালাল লাথি। জয়েনুদ্দীন প্রস্তুত ছিলেন, সরিয়ে নিলেন পা। আঙুলের গাঁটগুলো শক্ত করে ছায়ামূর্তিটার গলা বরাবর চালালেন।

    এই আঘাতটা ছায়ামূর্তি এড়াতে পারল না। একেবারে শ্বাসনালীতে আঘাত লাগায় খক খক করে কাশতে কাশতে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। বস্তার স্তূপে ভর দিয়ে লড়াই করতে থাকল এক ফোঁটা অক্সিজেনের জন্য।

    সুযোগটা কাজে লাগালো জয়েনুদ্দীনে। কোমরের হাড় ইলিয়াম বরাবর সজোরে একটা লাথি চালালো। থ্যাক করে একটা ভোঁতা শব্দ হল। ছায়ামূর্তিটা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল, একটা তীব্র আর্তনাদ বের হয়ে আসলো মুখ দিয়ে।

    নিচে তখন তীব্ৰ হৈ চৈ।

    জয়েনুদ্দীন পর কয়েকটা ঘুষি চালাল। একটা ঘুষি কানের ওপরে লাগতেই ভোঁ ভোঁ করে উঠল ছায়ামূর্তির কান। চোখে মুখে সর্ষের ফুল ফুটে উঠল। জয়েনুদ্দীন সুযোগটা ছাড়ল? না। সপাটে গলা বরাবর লাথি চালালো। ধরাশয়ী হয়ে গেল ছায়ামূর্তিটা।

    এর পরের লক্ষ্য হচ্ছে চোখ। আঙুলদুটো ‘ভি’ আকৃতির করে প্রস্তুত হয়ে থাকল আঘাতের জন্য। ছায়ামূর্তিটা উঠে দাঁড়ালেই এই শেষ আঘাতটা চলবে। তাহলেই খেলা শেষ।

    বুকের সমস্ত সাহস এক করে এলিন উঠে দাঁড়ালো। কলমের মত ফলাটা হাতে বিঁধে আছে। অবশ হয়ে গিয়েছে হাতটা। যেভাবেই হোক, তাকে নিচের পুলিশগুলোকে ডাকতে হবে। জয়েনুদ্দীন ছায়াটাকে নিয়ে ব্যস্ত। এই সুযোগ। দরজার দিকে দৌড় দিল এলিন। ঠিক তখনই জয়েনুদ্দীন এলিনের চুল চেপে ধরল, হেঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝের ওপরে।

    কিন্তু এটা ছায়ামূর্তিটাকে এক টুকরো সময় দিল নিজেকে সামলে নেওয়ার। বস্তার স্তূপের নিচে একটা রডের তৈরি হুক বাঁধল হাতে। এই হুক দিয়ে বস্তা কাঁধে তোলে মজুররা। ব্যস, হুকটা বসিয়ে দিল জয়েনুদ্দীনের কাঁধে। আর সাথে মেরুদণ্ড বরাবর একটা লাথি।

    কড়াক করে একটা শব্দ হল।

    জয়েনুদ্দীন আছড়ে পড়লেন মেঝেতে।

    ওপরে ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে দুজন পুলিশ ছুটে আসল। দরজার মুখেই ওসি সাহেবের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে গেল। একজন পি পিঁ করে বাঁশি ফুকতে লাগল। আর একজন কাঁধের সস্তা রাইফেলটা কাঁপা হাতে বলতে লাগল, “হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ, সরকারি বন্দুক তারপরও কিন্তু গুলি আছে। একদম নড়াচড়া করবি না।”

    ছায়ামূর্তিটা দুই হাত উপরে তুলে কাশতে কাশতে বলল, “আমি আমানুল্লাহ, ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ডোমেস্টিক হোমিসাইড সেকশনের এক্স-চীফ এজেন্ট। আপনাদের কাছে ফার্স্ট এইডের বক্স আছে? মেয়েটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।”

    আহত জয়েনুদ্দীন ওঠার চেষ্টা করতেই এক পুলিশ চিৎকার করে উঠল, “বাড়ি দে, বন্দুকের কুঁদা দিয়া বাড়ি দে।”

    জয়েনুদ্দীনের দুই হাতে ভর দিয়ে উঠে পড়েছে প্রায়। আমানুল্লাহ এক এক পা করে এগোচ্ছেন। এই জানোয়ারটাকে বিশ্বাস নেই।

    হতচকিত পুলিশটাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার পুলিশকে খেঁকিয়ে উঠল, “দে ব্যাটা বাড়ি দে।”

    মেরুদণ্ড বরাবর জোরে একটা বাড়ি দিল পুলিশটা। ধপ করে আবার জয়েনুদ্দীন পড়ে গেল।

    ****

    সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে।

    দুই হাত বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে জয়েনুদ্দীনকে। মাথা নিচু করে বসে আছে। আমানুল্লাহ একটা বস্তার ওপরে বসে আছেন। চট করে তাকে দেখে চেনার উপায় নেই। বেশ শুকিয়ে গিয়েছেন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ছোট ছোট করে কাটা চুলের এক পাশে শুকিয়ে যাওয়া গভীর ক্ষত। চোখ দুটো কোটরের আরো গভীরে ঢুকে গিয়েছে। সারা শরীরে ছোট বড় ক্ষত। পিঠে দুটো বড় বড় ক্ষত। নার্স একটু আগে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ পরিয়ে দিয়েছে। বার বার বলেছে, “স্ট্রেঞ্জ! এতগুলো ক্ষত নিয়ে হ্যান্ড টু হ্যান্ড মারপিট করতে এই প্রথম কাউকে দেখলাম!” এম্বুলেন্সে করে তাকে কাছেই একটা বেসরকারী মেডিকেলে পাঠানোর কথা বলা হয়েছিল, তিনি শোনেননি। এলিনকে রেখে যেতে চাননি।

    হাতে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে এলিন ঝিম ধরে বসে আছে। চোখে মুখে একটু আগে শেষ হওয়া কান্নার ছাপ। নাকটা গোলাপী হয়ে আছে।

    ওসি সাহেবের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুলিশ কমিশনার রওনা হয়েছেন। কিছুক্ষণের ভেতরেই চলে আসবেন। পুরো আড়তটা পুলিশ ঘিরে রেখেছে।

    “এই কেসের সমাধান জয়েনুদ্দীন করতে পারত না। কারণ এই খুনটা সে কিংবা তার লোকজন করেনি। সে যে খুনগুলো করেনি, সেই খুনগুলো ছাড়া অন্য খুনের সুরাহা সে করতে পারে না। সে একটা ভণ্ড ছাড়া আর কিছুই না। একটা চালবাজ, একটা খুনি।” ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেন আমানুল্লাহ। এলিন তাকালো। দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা।

    “সব বলব, কমিশনার স্যার আসুক। সব বলব।” আমানুল্লাহ বললেন। “আপনাকে বেঁচে থাকতে দেখে কি যে ভালো লাগছে স্যার। আমি এত খুশি আর এতো অবাক আমার সারা জীবনে হইনি। আপনি কোথায় ছিলেন স্যার? আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি কেন?”

    “জীবন কি ফুরিয়ে গিয়েছে? এই লাইনে থাকলে আরো কত অবাক হতে হবে। তোমাদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগই তো পাইনি। পেলে তো অনেক আগেই যোগাযোগ করতাম। আলতো হেসে বললেন আমানুল্লাহ। সেই হাসিতে পুরনো ক্লান্তি আর নতুন মুক্তির মিশ্র স্বাদ।”

    “আপনি কিভাবে সংবাদ পেলেন যে হিরণ পাশা খুন হয়েছে? আর আমিও এখানে আসবো?”

    “বলব, সব বলব, শুধু তুমি আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। আমি তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম, তুমি ফোন ধরছিলে না কেন?”

    “আপনি ফোন দিয়েছিলেন? কেন? আমার ফোনটা হঠাৎ করে পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। আর অন করা হয়নি।”

    “আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম যেন তুমি সবাইকে নিয়ে এখানে চলে আসতে পারো। আর সাথে জয়েনুদ্দীনকেও আনতে বলছিলাম। কারণ, ততক্ষণে আমার জানতে বাকি নেই আসল কালপ্রিট সে-ই। কিন্তু তুমি একা এসেছ দেখে অবাক হয়েছি। খুব বড় একটা বিপদে পড়তে পারতে…”

    “…যদি আপনি ঠিক সময়ে না আসতেন।”

    দুইজনেই মুচকি হাসল। আমানুল্লাহ বললেন, “হিরণ আমাকে খুঁজছিল। শুধু হিরণ না, হিরণের আশেপাশের অনেক মানুষই আমাকে খুঁজছিল। আমাকে খুন করার জন্য। কারণ আমি ওদের সব গোপন ব্যাপারগুলো জেনে ফেলেছিলাম। আর যতগুলো খুন হয়েছে তার নাটের গুরু জয়েনুদ্দীন। হিরণকে আমি একা এইখানে দেখা করতে বলি। আজ ভোরে এইখানে ও আমার সাথে দেখা করে। ওর হাতে একটা দেশী সস্তা পিস্তল ছিল। ওটা দিয়ে ও আমাকে খুন করত। আমি বললাম যে আমাকে যদি খুন কর তাহলে তোমাদের সবার যত নোংরামির তথ্য আছে প্রতিটা চ্যানেলে পাবলিশ হয়ে যাবে। আর যদি আত্মসমর্পন করে বাকিদের বিরুদ্ধে সত্যি সাক্ষ্য দাও, তাহলে আমি আমানুল্লাহ নিজে তোমার শাস্তি মওকুফ করব। এখন বল, তুমি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পন করবা নাকি আমাকে খুন করবা? ছেলেটা খুব সহজ সরল ছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, সে সত্যি সাক্ষ্য দিলে ওরা নাকি ওকে জ্যান্ত কবর দেবে। আমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তার আগেই ও মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে নিজেকে শেষ করে দিল।”

    “আমি যখন আসছিলাম, তখন জয়েনুদ্দীন বারবার বলছিল মিটফোর্ডে নাকি ওর এক আত্মীয় না কে জানি ভর্তি হয়েছে।”

    “মিথ্যা কথা বলেছে। ও এইখানে একা আসছিল কী হয়েছে দেখার জন্য। অথবা, হতে পারে ও পালিয়ে যাচ্ছিল।”

    দুজনেই জয়েনুদ্দীনের দিকে একবার তাকালো। মাথা নিচু করে সে বসে আছে। নকল দাড়িটা অনেকক্ষণ আগেই খুলে গিয়েছে। আমানুল্লাহ বললেন, “ছেলেটার কাছে আমি ঋণী, বুঝলে?”

    “কার কাছে স্যার?”

    “সুকান্ত।”

    “কিক- কি বলছেন স্যার? ও না এদের সাথে জড়িত?”

    “নাহ। সুকান্ত জড়িত না। সুকান্ত আমার জীবন বাঁচিয়েছে।”

    “আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না স্যার। মাথার ভেতরে কেমন সব প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে।”

    “চল বুঝিয়ে বলছি।”

    কমিশনারের গাড়ির সাইরেন শুনতেই দুজনে উঠে দাঁড়ালো। কমিশনার মহোদয় এসেই আমানুল্লাহকে জড়িয়ে ধরলেন। সেই পুরনো সহজ সরল হাসিটা হেসে আমানুল্লাহ বললেন, “স্যার, চলেন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতেই সবটা খুলে বলি।”

    কমিশনার মহোদয় জয়েনুদ্দীনের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা বলতে গেলেন, আমানুল্লাহ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ওকে এই মুহূর্তে একটা বিকল্প পথে শিল্পকলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন স্যার। সাথে দুইটা পুলিশ ভ্যান দিয়েন। আমাদের দুজনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিল্পকলা একাডেমীতে পৌঁছাতে হবে।”

    একসাথে এতগুলো কথা শুনে কমিশনার সাহেব নিজেই থতমত খেয়ে গেলেন। একসাথে অনেক কথা বলতে গিয়ে শুধু বললেন, “চল চল।”

    হঠাৎ এলিন প্রশ্ন করল, “স্যার, তৌফিক স্যার আসলেন না?”

    কমিশনার বললেন, “তৌফিকের আন্ডারে থাকা একজন সাসপেক্ট মারা গিয়েছে গতকাল রাতে। এই নিয়ে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের ইনভেস্টিগেশন শেষ না করা পর্যন্ত তাকে হেডকোয়ার্টার থেকে বের হতে দেওয়া হবে না।”

    এলিনের বুকের ওপরের পাথরটা যেন তুলোর মেঘ হয়ে বাতাসে হারিয়ে গেল। প্রশ্ন করল, “কীভাবে মরল স্যার? খুন হয়েছে?”

    “এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, লাংগস রাপচার। অতিরিক্ত পিটুনীর কারণে ফুসফুস থেঁতলে গিয়েছে। এছাড়া প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ইন্টার্নাল হেমোরেজের কারণে ফুসফুসে রক্ত ঢুকে গিয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলে পুরোটা জানা যাবে।”

    মাথা নাড়ল এলিন। তারমানে গার্ড দুজন তার নামে কোন সাক্ষ্য দেয়নি! কেন দেয়নি? প্রশ্নটা মাথার ভেতরে ঘুরতে লাগল।

    এলিনের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে কাছেই এক বিখ্যাত বেসরকারী মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আমানুল্লাহ আর কমিশনার রওনা হলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। আর জয়েনুদ্দীনকে নিয়ে তিনটা ভ্যান রওনা হল একটা ফুলস্টপ বিন্দুর দিকে।

    মস্ত বড় ভুল

    তুরাগ নদীকে ডান পাশে রেখে, এক অখ্যাত সরু রাস্তা দিয়ে তিনটা কাভার্ড ভ্যান যাচ্ছে। তিনটা কাভার্ড ভ্যানে তিনটা আলাদা আলাদা কোম্পানীর ব্যানার ঝুলছে। একটাতে আইসক্রিমের ব্যানার। আরেকটাতে ফার্নিচার কোম্পানীর ব্যানার আর একটাতে অখ্যাত এক ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর ব্যনার। কিন্তু তিনটা ভ্যানই পুলিশ বহন করছে। মাঝখানের ভ্যানটাতে আছে জয়েনুদ্দীন। যেকোন ধরণের অকস্মাৎ আক্রমণ এড়াতেই এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া।

    ভ্যানের ঢুলুনিতে তারেকের তন্দ্রা মত এসেছে। হাতের শটগানটা আলগোছে ধরে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে সে। তার পাশেই বসে আছে ফারহান। তারেকের মত তাকে ঢুলুনিতে পায়নি। এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে সামনে বসে থাকা লোকটার দিকে। এই লোকটা মানুষ খুন করেছে? এই যে দুই হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ বেঁধে রাখা হয়েছে, আঘাতে আঘাতে মুখের এখানে ওখানে ফেটে ফুলে গিয়েছে, এই লোকটা খুনি? একটা চাপা বিস্ময় কাজ করছে ফারহানের ভেতরে। এর আগে চোখের সামনে এত বড় কোন খুনিকে সে দেখেনি। খুচরো পকেটমার দেখেছে, কিন্তু তাদের প্রতি কৌতূহল কাজ করেনি কখনও।

    জয়েনুদ্দীন আসলে ‘আসন ঘিরে’ বসে নেই। সে পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে আছে। ফেটে যাওয়া জায়গাগুলোতে রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। একটা মাছি মাঝে মাঝে বসছে সেখানে। কিন্তু মাইকেল এঞ্জেলোর কোন এক ভাস্কর্যের মত সে ও বসে আছে নিষ্প্রাণ, নিস্পন্দিত।

    হঠাৎ চোখ খুলল জয়েনুদ্দীন। ফারহানের চোখে চোখ পড়তেই কি যেন হল ফারহানের। একটা ভীষণ ভয়, একটা কৌতূহল, সব মিলে মিশে কেমন যেন একাকার হয়ে গেল। এই দৃষ্টি যেন বহুদূর থেকে কোন নক্ষত্র থেকে আসছে। ফারহানের ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা হয়ে গেল। যেন এক অসীম কৃষ্ণগহ্বরের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, একা।

    কাভার্ড ভ্যানের ঝাঁকুনিতে তারেকের ঝিমুনি ছুটে গেল। ঝিমুনি কাটতেই চোখ পড়ল জয়েনুদ্দীনের চোখের দিকে। লোকটা ফারহানের দিকে তাকিয়ে কি দেখে? “ওই, কি দেখিস? সৃষ্টিকত্তার নাম নে শালার ব্যাটা শালা। এত্তগুলা মানুষরে খুন করলি ক্যামনে? বুক কাঁপল না একবারও!”

    একটা কাষ্ঠল হাসি ফুটে উঠল জয়েনুদ্দীনের মুখে। হাসির ভাঁজে চড় চড় করে ফেটে গেল প্রায় শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতস্থানগুলো। ফারহানের দিকে তাকিয়ে বলল, “সৃষ্টিকর্তাকে আমার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ আমি এই জীবন চাইনি। সে আমার অনুমতি ছাড়া কেন আমার ওপরে এই জীবন চাপিয়ে দিয়েছেন? জবাবদিহিতা তখনই থাকে যখন স্বেচ্ছায় কোন দায়িত্ব গ্রহন করা হয়। দাসত্বে কখনও জবাবদিহিতা থাকে না। নাকি?” ফারহানের দিকে একটা অদ্ভুত শূন্যতায় ভরা দৃষ্টি দিয়ে জয়েনুদ্দীন তার হাসিটা আরো একটু বিস্তৃত করলেন।

    “শালার পুত, তুই তো খুনিই না, নিমকহারামও।” তারেক বলল, সাথে জুড়ে দিল নোংরা একটা গালি।

    জয়েনুদ্দীন তার ঘন ভ্রু দিয়ে ঢাকা চোখে তারেকের দিকে তাকালেন। বললেন, “শোন তাহলে, প্রতিটা মানুষের জীবনে অনেক ধরণের লক্ষ্য থাকে। বেশিরভাগ লক্ষ্যই তাকে হয় ভালো হতে উৎসাহিত করে, অথবা খারাপ হতে। ভালো খারাপের কোন সঠিক সংজ্ঞা নেই। ঠিক যেমন সুখ দুঃখের সংজ্ঞা নেই। এগুলো আপেক্ষিক। কিন্তু এই আপেক্ষিকতার হিসাবটা পাশে সরিয়ে রাখলে এটুকু বলা যায়, ভালো মানুষরা সাধারণত জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে না। খারাপ মানুষরা পারে। তাদের জীবনে কোন বাউন্ডারি নেই। তাদের কাছে সামাজিক নিয়ম বা আইন খাটে না। তারা এই মহাবিশ্বের ‘ডার্ক ম্যাটার’ এর মত- মানে যেই সব বস্তুর ওপরে চিরাচরিত পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র খাটে না। তাদের স্বর্গের লোভ নেই, নরকের ভয়ও নেই। তাদেরকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাদেরকে কেউ ব্যবহার করতে পারে না। যখন ভালো মানুষেরা অন্যের জীবনের কাহিনী লিখতে ব্যস্ত, তখন খারাপ মানুষেরা নিজেরাই নিজেদের জীবনের গল্প লেখে, আর পরে তাদের সেই জীবন অনুসরণ করে তথাকথিত ভালো মানুষেরা।”

    তারেকের চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। একটা কঠিন দৃষ্টি দিয়ে বলল, “তোর মুখে পিশাব করে দিতে ইচ্ছা করতেছে জানোস? ভালো মানুষরা স্বর্গে যায়, আর তোর মতন কীটগুলা নরকে যায়। হিসাব বুঝলি?”

    ফারহানের চোখে মুখে তখন শূন্য চাহনি। যেন অনেক দূরে তাকিয়ে আছে। জয়েনুদ্দীন মাথা উঁচু করে বলল, “সামাজিক নিয়ম টিয়ম মেনে ভালো মানুষি করে, সামাজিক দাস হয়ে স্বর্গে যাওয়ার চাইতে নিজের ইচ্ছা মত, রাজার মত চলে নরকে যাওয়াও ভালো।” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “স্বর্গে তো সবাই যেতে চায়, কিন্তু নরকে গিয়ে সেখানেই এক টুকরো স্বর্গ বানিয়ে নেওয়ার সাহস আর কয়জনের আছে বল?”

    এক সর্বগ্রাসী দৃষ্টি যেন ফারহানকে গ্রাস করে ফেলতে লাগল। তার এতদিনের ভীরুতা, উচ্চপদস্থ কর্তাদের ঝাড়ি, রোজ রাতে ব্যারাকের টয়লেটে বসে কান্না আর দেয়ালে ঘুষি মারার ফলে আঙুলের গাঁটে তৈরি হওয়া ক্ষত, সব সময় একটা নিয়মের শেকল পেঁচিয়ে থাকা গলায়- সব যেন ফুটন্ত লাভার মত উদ্গরিত হতে শুরু করল।

    “তুই জানোস? তোরে এইখানে পিটাইলে কেউ জানতে পারব না? বুঝতেও পারব না?” তারেক বলল। তার চোখে মুখে তীব্র ঘৃণা। তীব্র ক্রোধ। রাগে থর থর করে কাঁপছে সে, “শালা নাস্তেক, খুনি। এই বন্দুকের নল দেখতেছস? এইটা তোর পুটকির ভিত্রে হান্দায়ে এমন একটা দিব না, বুঝবার পারবি তহন। তুই তো জানস না। তোরে একটা গোপন কথা বলি। আমিন বাজারের ভাগাড় চিনস? ওইহানে তোরে নিয়া কুত্তার মত গুলি করা হবে। এনকাউন্টারের নাম শুনছস? ক্রসফায়ার শুনছস? মরার জন্য রেডি হ নাস্তেক কুনহানের।”

    একটা শীতল হাসি ফুটে উঠল জয়েনুদ্দীনের ঠোঁটে। নিষ্ঠুর একটা হাসি হেসে বলল, “কে বলেছে আমি নাস্তিক? আমি তো ঈশ্বরে বিশ্বাসী, আর আমি বিশ্বাস করি, মানুষের ঈশ্বর মানুষ স্বয়ং। মানুষের হাতেই নির্ধারিত হয় মানুষের ভাগ্য, মানুষের হাতেই নির্ধারিত হয় মানুষের সুখ-দুঃখ এমনকি মৃত্যু। এই যেমন এই মুহূর্তে আমি তোমার মৃত্যু নির্ধারণ করতে পারি, দেখতে চাও। আমি কিন্তু প্রমাণ দিতে পারি?”

    “শালা কুত্তার বাচ্চা” তারেকের শটগানের কুঁদোটা তখন জয়েনুদ্দীনের কপাল স্পর্শ করেনি, তার আগেই বজ্রপাতের মত বেজে উঠল ফারহানের শটগান। বদ্ধ ভ্যানটার ভেতরে এই তীব্র শব্দে কানে তালা লেগে গেল জয়েনুদ্দীনের। ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনতে পেলেন তিনি। আর চোখের সামনে দেখতে পেলেন, ছিন্ন ভিন্ন তারেকের লাশটা কিভাবে ছিটকে ভ্যানের দেয়ালে ধাক্কা খেল। ফারহানের চোখজোড়া ততক্ষণে লাল হয়ে গিয়েছে। থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে পুরো শরীর। গাছের শেকড়ের মত শিরা ফুলে ওঠা হাতজোড়া পেঁচিয়ে ধরেছে শটগানের ইবোনাইটে মোড়া হাতল।

    “মানুষের সব থেকে প্রিয় জিনিসটাই তার সব থেকে বড় দুর্বলতা। এইটা বুঝলে এইভাবে মরতে হত না।”

    কড়া ব্রেক কষে থেমে গেল ভ্যানটা। গুলির শব্দ বাকিরা শুনতে পেয়েছে। বাইরে কোলাহল।

    ততক্ষনে জয়েনুদ্দীনের হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়েছে ফারহান। তার ভেতরের লাভাটুকু ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে তার চোখ মুখ দিয়ে। এ যেন এক মুক্তির স্বাদ। এক অদ্ভুত অনুভূতি, শেকল ভেঙে যাওয়ার শব্দ। মন্ত্রমুগ্ধের মত তারেকের রক্তমাখা শটগানটা বাড়িয়ে দিল জয়েনুদ্দীনের দিকে।

    জয়েনুদ্দীন কোন কথা বললেন না। শুধু তার চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠল অনেক পুরনো একটা ভরসা। তুমি এগিয়ে যাও। তুমি কারো দাস না। ঝাড়ি খাওয়ার জন্য তোমার জন্ম হয়নি। এই পৃথিবী তাকেই সমীহ করে, যে চিরাচরিত নিয়মকে কখনও সমীহ করেনি। যাও, আমি আছি।

    ঘটাং!

    ভ্যানের পেছনের দরজাটা খুলে গেল। সাথে গর্জে উঠল ফারহান আর জয়েনুদ্দীনের শটগান। ধাঁই ধাঁই করে গুলি চলল। ভ্যানের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো একেবারে মুহূর্তের ভেতরে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল।

    সচল হয়ে উঠল ওয়াকিটকিগুলো। খড় খড় করে বাজতে লাগল। জয়েনুদ্দীনের সতর্ক দৃষ্টি বাইরেটা একবার দেখে নিল। তারপর ফারহানের দিকে ইশারা করলেন। ভ্যান থেকে লাফিয়ে ফারহান ডাইভ দিল। নিজেকে গড়িয়ে নিয়ে গেল পেছনের গাড়িটার সামনে।

    একটা বিকট দূর্গন্ধ একে ধাক্কা দিল নাকে। পচা বাসি গন্ধ তার সাথে মিশেছে ময়লা পোড়া ধোঁয়ার দম আটকানো গন্ধ। গাড়ি কি তাহলে আমিন বাজারের ভাগাড়ে চলে এসেছে?

    গাড়িটার ভেতরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জয়েনুদ্দীন তারপরও আন্দাজে দুটো গুলি করলেন পেছনের গাড়ি বরাবর। ঝন ঝনাৎ ঝন ঝন করে উইন্ডশিল্ড ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ফারহান গাড়িটার টায়ার বরাবর গুলি করতে যাচ্ছিল, জয়েনুদ্দীন নিষেধ করলেন। গাড়িটা লাগবে।

    জয়েনুদ্দীন নেমে আসলেন ভ্যান থেকে। পেছনের গাড়িটার হেডলাইটে তার রক্তমাখা অবয়বটা ঝলসে উঠল। রক্তমাখা হাতটা প্যান্টে মুছে নিয়ে শটগানের হাতলটা ধরলেন আবার। তা না হলে পিছলে যেতে পারে।

    ভ্যানের সামনে থাকা গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল দুইজন। প্রতিটা পদক্ষেপ উদ্দীপিত। সেই পদক্ষেপে এতটুকু দ্বিধা নেই। বিভ্রান্তি নেই। ভয় নেই।

    ঠং করে একটা গুলি এসে লাগল ভ্যানের গায়ে। সাথে সাথে জয়েনুদ্দীন আর ফারহান নিচু হয়ে ভ্যানের আড়ালে লুকাল। জয়েনুদ্দীন ফারহানকে ইশারা করলেন। ফারহান ঘুরে ভ্যানের উল্টো দিকে গেল। আস্তে আস্তে শিকারি পশুর মত এগিয়ে গেল গাড়িটার দিকে। দেখল, গাড়িটার সামনে একজন পুলিশ কুঁজো হয়ে বসে আছে। হেডলাইটের হলুদ আলোতে তার শার্টটা বোঝা যাচ্ছে।

    ধ্রাম!

    দ্বিধাহীন শটগানটা গর্জে উঠল। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল লোকটার লাশ।

    ঘন মেঘে আকাশ ঢেকে গিয়েছে। মুহুর্মুহু চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। আজ আকাশে সন্ধ্যার শুকতারা নেই। নেই সূর্যের ফেলে যাওয়া একটু আবির রঙা গোধুলী। আজ শুধুই অন্ধকার।

    জয়েনুদ্দীন বের হয়ে এলেন ভ্যানের আড়াল থেকে। রক্ত আর ঘামে ফারহানকে চকচকে সসেজ বলে মনে হচ্ছে। “তোমার সেলফোনটা দাও তো।” জয়েনুদ্দীন বললেন। পকেট থেকে সেলফোনটা বের করে বাড়িয়ে ধরল ফারহান। জয়েনুদ্দীন গুনে গুনে এগারটা নাম্বার ডায়েল করে কল করলেন।

    “হ্যালো? হ্যাঁ, সময় হয়ে গিয়েছে। আমানুল্লাহ রওনা হয়ে গিয়েছে। যেভাবে বলছি সেভাবে কর…”

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅন্যমনস্ক – জুনায়েদ ইভান
    Next Article প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প – জুবায়ের আলম

    Related Articles

    জুবায়ের আলম

    প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প – জুবায়ের আলম

    August 14, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.